১লা আগস্ট ১৯৬৬ ॥ সোমবার
বড় আশ্চর্য লাগছে। মোনায়েম খান সাহেব কিছুদিন একেবারেই চুপচাপ। একটাও হুমকি ছাড়েন নাই, পিন্ডি থেকে এসে। সর্বদলীয় সভা জনাব নূরুল আমীন সাহেবের বাড়িতে হয়েছে। নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলনে আমার আপত্তি থাকার কোনো কারণ নাই। কিন্তু আন্দোলন করার নেতা কেউই নন। ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং রাজবন্দিদের মুক্তি, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত করার আদেশ প্রত্যাহার, কৃষক শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হতে পারে। আমার মনে হয়, এনডিএফ নেতারা তাদের সেই গাধা নীতি ধরে বসে আছেন: ‘গণতন্ত্রের দাবি’। আর কোনো দাবির প্রয়োজন নাই, দলও থাকবে না, এক কমান্ড’ বলে বেড়ান। এতে আন্দোলন হয় না, আর দাবি আদায়ও হয় না। ঘরে বসে গুজগুজ রাজনীতি চলে, আর কোনো মতে একটা আপোস করা যায় কিনা সেই ফন্দি। ন্যাপ আলাদের অন্য পথ, সকলের সাথে মিশে কাজ করতে রাজি, তবে তাদের দাবিগুলি নিম্নতম কর্মসূচির মধ্যে গ্রহণ করতে হবে।
এদেশে এসব হবে না। আন্দোলন যে দল করবে, ত্যাগ যে দল করবে, তারাই জনগণের সমর্থন পাবে এবং শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় হবে। আওয়ামী লীগের যারা এখনও জেলের বাইরে আছে তারাই কাজ করে চলুক। দেখা যাক কি হয়। জনসমর্থন ছয় দফার আছে, শুধু নেতৃত্ব দিতে পারলেই হয়। ৭ তারিখে নেতৃত্ব যে ভুল করেছে তা এখানে লেখলাম না।
ভেবেছিলাম এডভোকেট ও আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ মিলবে, কারণ মামলা আরম্ভ হবে জেলগেটে, ৮ই আগস্ট থেকে। কোর্ট তো জেলগেটেই বসবে। মাত্র ছয়দিন আছে, কখন কাগজপত্র নিবে, নকল নিতে সময় লাগবে কোর্ট থেকে। কোন কোন এডভোকেট থাকবে? এরা বিচারের নামে প্রহসন করতে চায়। মার্শাল ল’ যখন চলছিল তখনও বিচার পেয়েছিলাম, আজকাল জামিনের কথা উঠলেই টেলিফোন বেজে উঠে।
২রা আগস্ট ১৯৬৬ ॥ মঙ্গলবার
মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের সঠিক খবর জানার জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছিলাম। এক্স-রে কি পাওয়া গেছে? ডাক্তার সাহেব আমাকে দেখতে আসলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের কি অবস্থা? তিনি বললেন, এক্স-রেতে ধরা পড়েছে এখনও তিনি ভুগছেন যক্ষ্মা রোগে। একে জেলে ধরে আনার যে কি অর্থ হতে পারে বুঝি না। এ রকম নিরীহ লোক আমার জীবনে দেখিনি। তিনি অফিসের কাজ করেন। কোনোদিন সভায় বক্তৃতা করেন। নাই। কোথাও পার্টি গঠন করতে যান নাই। অফিসের কাজগুলি দেখতেন এইমাত্র। বোধহয় সরকারের কাছে দরখাস্ত করেছেন তার ভাল চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার জন্য, নতুবা মুক্তি দিতে। জানি না কি হবে, তবে তার শরীর যদি আরও খারাপ হয় আর কোনো অঘটন ঘটে তবে সরকারই দায়ী হবে।
আমার কাছেই একজন কয়েদি পাহারা থাকে, নাম ফয়েজ, বাড়ি মানিকগঞ্জ। বাড়ি থেকে তার ললাকেরা দেখা করতে এসে কিছু লেবু দিয়ে গিয়েছিল। সেই লেবুর থেকে চারটা লেবু এনে আমার সেলের কাছে দিয়ে গিয়াছে, বলেছে আমাকে খেতে। আমি ডেকে বললাম, ফয়েজ আমার তো রোজই লেবু আসে। তোমরা খাও। বলে কিনা, স্যার, খুব দুঃখ পাব যদি আপনি না খান। আমার সঙ্গে আর কোনো কথা হলো না। শুধু ভাবলাম, এদের কত বড় মন, থাকলে সবই দিয়ে দিতে পারত। তার বাড়ির থেকে লেবু এসেছে, আমাকেও খেতেই হবে।
পাঁচটা কাগজ রাখি, কোনো সংবাদই নাই। কাগজগুলিকে প্যামফ্রেট করে ফেলেছে। আইয়ুব সাহেবের মাস পহেলা বক্তৃতা ভালভাবে পড়লাম, তবে ভারতের সাথে আলোচনা ও ফয়সালা হতে হলে কাশ্মীরের একটা সন্তোষজনক মীমাংসা হওয়া উচিত। ভালই বলেছেন তিনি। পত্রিকায় লিখেছে : ‘President Ayub Khan said today, without meaningful talks on the problem of Jammu and Kashmir, any treaty between India and Pakistan to resolve basic disputes would be futile.’ আমি ‘meaningful অর্থটা বুঝলাম না। পূর্বেও প্রেসিডেন্ট সাহেবের মুখ থেকে একথা শুনেছি। এর অর্থ কি এই হয় না যে আমাদের আর গণভোটের দাবি নাই। যদি না থাকে, তাহাও পরিষ্কার করে বলা উচিত। ভারতও তার মতের কোনো পরিবর্তন করতে রাজি নয়। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ভারত, গণতন্ত্রের পথে যেতে রাজি হয় না কেন? কারণ, তারা জানে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের মতামত নিলে ভারতের পক্ষে কাশ্মীরের লোক ভোট দিবে না। তাই জুলুম করেই দখল রাখতে হবে।
দুই দেশের সরকার কাশ্মীরের একটা শান্তিপূর্ণ ফয়সালা না করে দুই দেশের জনগণের ক্ষতিই করছেন। দুই দেশের মধ্যে শান্তি কায়েম হলে, সামরিক বিভাগে বেশি টাকা খরচ না করে দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা যেত। তাতে দুই দেশের জনগণই উপকৃত হতো। আমার মনে হয়, ভারতের একগুয়েমিই দায়ী শান্তি না হওয়ার জন্য।
নাইজেরিয়ার খবর দেখলাম, আবার হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। নাইজেরিয়ার লৌহমানব সামরিক রাষ্ট্রপ্রধান জনসন সান্ডন সারনমি নিহত হয়েছেন। একজন কর্নেল ইয়াকুবু নাইজেরিয়ার সর্বময় ক্ষমতা দখল করেছেন।
জনাব আইয়ুব খান সাহেব আজকাল আল্লা ও রসুলের নাম নিতে শুরু করেছেন। খুব ভাল কথা। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বলেন, দেশের দুই অংশকে যুক্ত করার সূত্র আমাদের পয়গম্বর হজরত মহম্মদ (দ.)-এর মহান ব্যক্তিত্বেই পরিলক্ষিত হইয়াছে। যতদিন এই যোগসূত্রের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন জাতীয় একতা অক্ষুন্ন থাকিবে। মহান আদর্শের নামে নিশ্চয়ই হজরত মহম্মদ (দ.) দেশের একটা অংশ অন্য অংশকে শোষণ করবে এ কথা বলে যান নাই। তিনি তো ইনসাফ করতে বলেছিলেন। শোষক ও শোষিতের মধ্যে সংগ্রাম হয়েই থাকে এবং হবেও। শোষকদের কোনো জাত নাই, ধর্ম নাই। একই ধর্মের বিশ্বাসী লোকদেরও শোষণ করে চলেছে ছলে বলে কৌশলে। প্রেসিডেন্ট আজও ছয় দফা দাবির উপর ইঙ্গিত দিয়েছেন। জনাব সবুর তো প্রকাশ্যভাবেই বলে চলেছেন, পাকিস্তানকে দুই ভাগ করার অভিসন্ধি নাকি ৬ দফার মধ্যে আছে? কোথায় পেলেন? কিভাবে পেলেন? পাকিস্তান এক না থাকলে এই দাবিগুলি আদায় হয় কি করে? এই সমস্ত কথা বলে আর মানুষকে ধোঁকা দেওয়া চলবে না। জনগণ বুঝতে শিখেছে।
৩রা আগস্ট ১৯৬৬ ॥ বুধবার
সকালে দেখতে আসলেন সিভিল সার্জন সাহেব। আমার শরীর ভাল না তাই। শরীর কি ভাল থাকে, একলা থাকলে জেলখানায়? প্রায়ই শরীর খারাপ হয়। আমার স্ত্রীকে কিছুই বলি নাই। কারণ, চিন্তা করে শরীর নষ্ট করবে।
আজ অনেকক্ষণ হাঁটাচলা করলাম। বিকালে চা খেতে বসেছি, দেখি সিকিউরিটি ব্রাঞ্চের সিপাহি সাহেব এসেছে আমাকে জেলগেটে নিতে। ‘দেখা’ এসেছে-জহিরুদ্দিন সাহেব, আবুল সাহেব ও আমার স্ত্রী। ছোট তিনটা বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। মামলা সম্বন্ধে আলোচনা হলো কিছুটা। আইবি অফিসারদের সামনেই আলোচনা করতে হবে। দুইজন ইন্সপেক্টর দিয়েছে। সামনেই বসে থাকে কোনো কিছু আলাপ করার উপায় নাই। কিভাবে মামলা চালাব তাহাই আইবি জানতে চায়। আর আমরা তা বলব কেন? বললাম, নকল (certified copy) নিতে। নকল না দিলে মামলা করব না। বলে দিব, যাহা ইচ্ছা করুক। কাগজপত্র না পেলে মামলা চালাইব কি করে? সালাম সাহেবও আসবেন। শুনলাম অনেক উকিল আসবেন ৮ তারিখে জেল গেটে মামলা করার জন্য। রেণুকে বললাম, কিছু টাকা দিতে নকল নেওয়ার জন্য। ছোট্ট ছেলেটা আমার কানে কানে কথা বলে। একুশ মাস বয়স। বললাম, আমার কানে কানে কথা বললে আইবি নারাজ হবে, ভাববে একুশ মাসের ছেলের সাথে রাজনীতি নিয়ে কানে কানে কথা বলছি। সকলেই হেসে উঠল। এটা রাসেলের একটা খেলা, কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপ করে থাকে আর হাসে। আজ আমার কাছ থেকে ফিরে যাবার চায় না। ওর মায়ের কাছে দিয়ে ভিতরে চলে আসলাম। ছোট্ট মেয়েটা রেহানা আমার কাছ থেকে সরতে চায় না, তাই তাকে একটু আদর করলাম। মামলায় যে কি হবে জানি না। তবে সরকারের উৎসাহ একটু বেশি মনে হয়। অনেকগুলি মামলাই তো আছে। জেল থেকে কবে যে বের হতে পারব জানি না। সন্ধ্যার একটু পূর্বে আসলাম, আমার সেই পুরানা বাড়িতে।
বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিল। একজন সিপাহি আমাকে জিজ্ঞাসা করল, স্যার আপনাকে নাকি আপনার বাবা ত্যাজ্য পুত্র করে দিয়েছে, রাজনীতি করার জন্য আর বারবার জেলখাটার জন্য?’ বললাম, এরকম কথা জীবনে আমি অনেক শুনেছি। আমার বাবা আজও আমাকে যে স্নেহ করেন বোধহয় অনেক পুত্রের কপালেই তা জোটে না জীবনে। আমার আব্বা কখনও আমার সাথে মুখ কালো করে কথা বলেন নাই। এখনও কাছে গেলে ছোট ছেলের মতো আদর করেন। আর কোনোদিন আমাকে কোনো কিছুর জন্য নিরাশ করেন নাই। আমার বাবা কখনও বড়লোক ছিলেন না। অনেক কষ্ট করেছেন, কিন্তু আমার প্রয়োজন তিনি মিটাইয়াছেন। এমনকি আমি জেলে থাকলেও আমার ছেলেমেয়ের দরকার হলে ধান, পাট বিক্রি করে টাকা পাঠাতে কৃপণতা করেন নাই। সিপাহিকে দেখালাম কয়েকদিন পূর্বের চিঠি। তাতে লিখেছেন ‘তাঁর (আমার বাবার) মতো সুখী এ জগতে কয়জন আছে।‘
মনে মনে বললাম, ওরে আমার রাজনীতি, তোমার জন্য জীবনে কত কথাই আমাকে শুনতে হলো। এগার মাস মন্ত্রীত্ব করেছিলাম। ‘চোর’ বলতে কারও বাঁধলো না। আমি নাকি সিনেমা হল করেছিলাম! একজন সিপাহি জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনার বলাকা সিনেমা হলটা সরকার নিয়ে গিয়াছিল, ফেরত দেয় নাই, না!’ হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম, আমার সিনেমা হল বলাকা, নিশ্চয়ই বলাকা সিনেমার মালিক এ খবর পেলে হার্টফেল করে মারা
যাবে। কারণ বেচারা বহু টাকা খরচ করে ইস্টার্ন ফেডারেল ইস্যুরেন্স কোম্পানীর কাছ থেকে হলটা কিনেছে। আমার একআনা শেয়ারও যদি থাকত তবে আর কষ্ট করতে হতো না। বেচারা অবাক হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। বলেন কি স্যার, আজও তো অনেকে বলে।’ বললাম, বলতে দিন, ওটা তো আমাদের কিসমত-যাদের জন্য আমি রাজনীতি করি তাদের কেউ কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না। অনেকক্ষণ ভাবলাম, এই তো দুনিয়া! জনাব সোহরাওয়ার্দীকে ‘চোর’ বলেছে, হক সাহেবকে ‘চোর’ বলেছে, নেতাজি সুভাষ বসুকে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে এই বাঙালিরা ‘চোর’ বলেছে, দুঃখ করার কি আছে!
৪ঠা আগস্ট ১৯৬৬ ॥ বৃহস্পতিবার
রেণু কিছু খাবার দিয়ে গেছে-কি করে একলা খেতে পারি? কই মাছ খেতে আমি ভালবাসতাম, তাই ভেজে দিয়েছে। কয়েকটা মাছ পাকিয়ে দিয়েছে, মুরগির রোস্ট, এগুলি খাবে কে? কিছু কিছু খেয়ে বিলিয়ে দিলাম কয়েদিদের মধ্যে। তারা কত খুশি এই জিনিস খেয়ে! কেহ বলে, সাত বৎসর কেহ বা পাঁচ বৎসর, কেহ বা তিন বৎসর এই জেলে একঘেয়ে খাওয়া খেয়ে বেঁচে আছে। যখন মিঠা কুমড়া শুরু হয় কয়েক মাস মিঠা কুমড়াই চলে, আবার যখন ক্ষেতে উঁটা জন্মায় আবার শুরু হয়ে কিছুদিন চলে, আবার কিছুদিন পুঁইশাক। ডাল তো আছেই। আমার এক ছাফাইয়া ছিল একটু রসিক, সাত বৎসর জেল হয়েছে, প্রায় পাঁচ বৎসর খেটেছে বলে খালাসের সময় হয়ে এসেছে। বলে, এই রকম মজার খাবার পেলে আর কিছুদিন জেলে থাকতে রাজি আছি? মেট বলে, “পেটে ডালের চর পড়ে গিয়াছিল। বিশ বৎসর সাজা, সাত বৎসর খেটেছি এখন আর ডাল খেতে হয় না।’
আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম। জেলখানায় আমার জন্য কাজ করবে, আমার জন্য পাক করবে, আমার সাথে এক পাক হবে না! আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, চাকরদের জন্য আলাদা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সামন্তবাদ ছিল, তখনও জমিদার তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ যখন সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর শিল্প ও বাণিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখনই এই রকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে, সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ।
আমি তো অনেক আরামেই থাকি; কিন্তু সাধারণ কয়েদিদের জীবন তো দুর্বিষহ। কয়েদিরা যেন মেশিন হয়ে গেছে। আমার জন্য যারা কাজ করে তারা ছাড়াও আমার এরিয়ায় যারা কাজ করে তাদের প্রত্যেককেই আমি মাঝে মাঝে কিছু কিছু খেতে দিতে চেষ্টা করি। কিছু কিছু করে জমাই আমার খাবার থেকে, তারপর ডাকাইয়া ওদের মধ্যে বিলি করি। কত আনন্দ দেখি ওদের মুখে। ২৬ সেলে যারা সিকিউরিটি আইনে বন্দি আছেন, বহুদিন ধরেই আছেন। ধীরেন বাবু ওখানে ফুলের বাগান করেন। আমি শুনেছি এত সুন্দর বাগান নাকি ঢাকা শহরেও নাই। ঐ বাগানটা আমি ১৯৬২ সালে শুরু করি, তখন ওখানে টমেটোর বাগান ছিল। কিছুদিন পরে আমি খালাস হয়ে যাই তখন থেকে তাঁহারা ওখানেই আছেন। আমি খবর দিয়েছিলাম কয়েকটা গোলাপ ফুলের চারা দিতে। আজ বিকালে তিনটা লাল গোলাপের চারা পাঠাইয়া দিয়েছেন। আমি লেগে পড়লাম বাগানে, তাড়াতাড়ি গর্ত করে, সার দিয়ে লাগাইয়া দিলাম। এত ইটের টুকরা পরিষ্কার করতে জান শেষ হয়ে যায়। আমার বাগানটাও এখন সুন্দর হয়ে উঠেছে। দেখতে বেশ লাগে। এইত আমার কাজ। বই পড়া ও বাগান করা।
ওকালতনামা আইবির কাছ থেকে সেন্সর হয়ে এসেছে আমার সই নেবার জন্য। দেখলাম, দুইটা ওকালতনামায় না হলেও প্রায় ৪০ জন এডভোকেট দস্তখত করেছেন। জেলগেটে কোর্ট করে বিচার হবে, কি চমৎকার ব্যবস্থা। আমাকে নাকি বাইরের কোর্টে নিলে, ভয়ানক গোলমাল হবে। এতই যদি ভয় হয়, তবে ছেড়ে দেও এবং ৬ দফার দাবি মেনে নেও।
আমি নাকি ভয়ানক প্রকৃতির লোক? আমাকে নাকি জেলগেট থেকে কেড়ে নিবে? তাই চারজন করে বন্দুকধারী সিপাহি রাখা হয়েছে-জেল দরজার কাছে। ইংরেজ আমল থেকে আমার এবার জেলে আসা পর্যন্ত একজন বন্দুকধারী পাহারা থাকত। ইংরেজ আমলে যখন বিপ্লবীরা গুলি চালায়ে সাদা চামড়াদের হত্যা করত তখনও একজন সিপাহি বন্দুক নিয়ে থাকত, এখন। জেল সিপাহি একজন, আর্ম পুলিশ থেকে দুইজন, আর আনছার দুইজন। বন্দুক নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা গেটের কাছে দাঁড়াইয়া পাহারা দেয়। ভয় নাই, ভয় নাই এ রাজনীতি এখনও আমরা করছি না। পালাব না, আর জেলগেট ভাঙতেও কেহ আসবে না।
আজ ডিপুটি জেলার সাহেব একবার এসেছিলেন।
আমার মুড়ি ফুরাইয়া গিয়াছিল, জমাদার সাহেব আজ মুড়ি কিনে দিয়েছেন।
আমার মুড়ি জেলখানায় খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সিপাহি, জমাদার ও কয়েদিদের মধ্যে থেকে অনেকে পালিয়ে মুড়ি খেতে আসে।
সুপ্রীম সোভিয়েত আলেক্সী কোসিগিনকে দ্বিতীয়বারের জন্য সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছে। মি. কোসিগিন অভিযোগ করেছেন, চীন সরকার সোভিয়েট নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাইয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ব্যাপক সাহায্য করিতেছে। আমার মনে হয় কথাটার মধ্যে কিছুটা সত্য নিহিত আছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বিভেদকে আমেরিকা পুরাপুরি ব্যবহার করতে ছাড়বে না।
৫ই আগস্ট ১৯৬৬ ॥ শুক্রবার
কয়েদিদের ধারণা, আমি ছাড়া পেলে ওদের মুক্তিরও একটা সম্ভাবনা আছে। একজন কয়েদি কিছুদিন পূর্বে ২০ বৎসর সাজা খেটে মুক্তি পেয়েছিল, তিন বৎসরের মধ্যেই আবার ২৫ বছর জেল নিয়ে ফিরে এসেছে। খবর নিয়ে জানলাম, যারা তাকে খুনের মামলায় সাক্ষী দিয়ে জেল দিয়েছিল তারা খুব প্রভাবশালী লোক। কোথায় একটা ডাকাতি ও খুন হলো আর তাকে আসামি করে সাক্ষী দিয়ে আবার সাজা দিয়ে দিয়েছে। শপথ করে বলল, এ ঘটনা সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না। বাড়ি যেয়ে বিবাহ করেছিল। ঠিক করেছিল যে কয়দিন বেঁচে আছে, সংসার করবে আর কোনো গোলমালের মধ্যে যাবে না। প্রথম যখন জেলে এসেছিল তখন যে স্ত্রীকে রেখে এসেছিল সে তারই এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে পরে বিবাহ বসে। চাচাতো ভাইয়ের ভয় হয়েছে, যদি প্রতিশোধ নেয়। তাই সেও তার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। আর একজন বরিশাল থেকে এসেছে। পূর্বে ২০ বছর জেল খেটে গেছে। এবার ২৫ বছর জেল নিয়ে এসেছে। ৪০-৫০ বছর এমনকি ৭০ বৎসর জেল হয়েছে বিভিন্ন ডাকাতি ও খুন মামলায় এরকম কয়েদিও ঢাকা জেলে আছে। জেল খাটছে, হাসছে, খেলছে। অল্প দুঃখে কাতর, অতি দুঃখে পাথর’, অনেকেই পাথর হয়ে গেছে। মনে করে এই জেলেই তাদের বাড়ি। জীবনে আর যাওয়া হবে না বাইরে। এতদিন জেল খাটলে কি আর বাঁচবে। তবুও আশা করে আর সুযোেগ পাইলেই বলে, স্যার, আপনি নিশ্চয়ই আমাদের ছাড়বেন, আপনি যদি ক্ষমতায় যান-জেল কি জিনিস আপনিই বোঝেন, তাই আমাদের ছেড়ে দিবেন। মনে মনে বললাম, আমাকে এরা ছাড়বে না আর.. তোমাদের আশা এ জীবনে আর পূরণ হবে না।
৬ই আগস্ট ১৯৬৬ ॥ শনিবার
আজ জনাব আইয়ুব সাহেব তার কলোনি পূর্ব পাকিস্তান দেখতে আসবেন। মাঝে মাঝে মাইকের শব্দ আসে, হাওয়াই আড্ডায় যেয়ে পাকিস্তানের লৌহ মানবকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবার অনুরোধ। জনসাধারণ স্বইচ্ছায় যাবে কিনা এ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে! তবে ছোট খা সাহেব টাকায় ভাড়া করে কিছু লোক নেবার চেষ্টা করবেন। যদি এক দেশই হবে তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসলেই তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এই অভ্যর্থনার প্রহসন কেন? আইয়ুব সাহেব সবই বোঝেন। মোনায়েম খান সাহেব তার চাকরি রক্ষা করার জন্য এসমস্ত করে থাকেন, আর দুনিয়াকে দেখাতে চান, দেখ কত জনপ্রিয়তা! একবার যদি গণভোটের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা যাচাই করতেন তাহলে বুঝতে পারতেন তার শোচনীয় অবস্থা। আশা করি তিনি নিজে ভাল করে বুঝে নিবেন অবস্থাটা। কারণ, এরপরও যদি এই জুলুম, অত্যাচার ও ধরপাকড় চলতে থাকে পরিণতি বোধহয় ভাল হবে না। ইত্তেফাক কাগজ সম্বন্ধে তিনি কিছু একটা করবেন অনেকেই আশা করেন। তবে আমার নিজের মতে, মোনেম খান তার অনুমতি না নিয়ে এতবড় কাজ করতে সাহস পান নাই।
আজই দুইজন ছাত্রলীগের নেতাকে ডিপিআরএ গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছে। একজনের নাম নূরে আলম সিদ্দিকী, আর একজন খুলনার কামরুজ্জামান। এদের পুরানা ২০ সেলে রাখা হয়েছে, ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। নূরে আলম এম এ পরীক্ষার্থী, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে পরীক্ষা।
সন্ধ্যায় আরও দুই ভদ্রলোককে জেলে আনল, একজন সন্ধ্যার পূর্বে, আর একজন তালাবন্ধ করার পরে। তাদেরও পুরানা ২০ সেলের ৪ নম্বর ব্লকে রাখা হয়েছে। খবর নিয়ে জানলাম একজনের নাম ফজলে আলী, তিন মাস পূর্বে চার্টার্ড একাউনটেন্ট হয়ে বিলাত থেকে এসেছেন। আর-একজন আলমগীর কবির, ন’মাস পূর্বে বিলাত থেকে এসেছেন-সাংবাদিক। কি করেছে জানি না, পূর্ব বাংলায় রাজনীতি করে নাই। কোনোদিন করলে নিশ্চয়ই আমি জানতাম। বিলাতে বসে কোনো কিছু করেছেন কি না জানি না। বিলাতি কায়দায় কাপড়-চোপড় পরে এসেছে। ভাবলাম, বেচারা কোথায় এসেছে একটু পরেই বুঝতে পারবে। দুনিয়ার দোজখ, পাকিস্তানি জেল। দেড় টাকা খোরাক বাবদ সারাদিন ভরে। এদের ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে ওদের জায়গাটা দেখা যায়। ঐ ঘরে আমিও একদিন ছিলাম জাকির হোসেন সাহেবের বদৌলতে। কাপড়, জামা, বিছানা কিছুই আনে নাই। একেবারে নতুন লোক। বেশ কষ্ট হবে। বোধহয় বিলাত থাকতে পূর্ব বাংলার দাবি-দাওয়ার কথা একটু একটু বলে থাকবে। ইংরেজের গণতন্ত্র দেখে এসেছে। এইবার পাকিস্তানি গণতন্ত্র দেখবে।
এদের জন্য দুঃখ হলো কিছুটা।
আইয়ুব সাহেব পৌঁছে গেছেন। আজ একজন সিপাহির কাছ থেকে শুনলাম। নিশ্চয়ই হুঙ্কার ছেড়েছেন।
৭ই আগস্ট ১৯৬৬ ॥ রবিবার
প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান ছয় দিনব্যাপী সফরের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেছেন। আমি আশ্চর্য হলাম, প্রেসিডেন্ট কিভাবে এসব কথা বলতে পারেন। নিশ্চয়ই তিনি সরকার সমর্থকদের সম্বন্ধে বলেছে। তিনি বলেছেন, বিভেদ সৃষ্টিকারীদের কার্যকলাপ যদি সকল সীমা অতিক্রম করে তাহা হইলে তাহাদের রোধ করিবার জন্য অন্য পন্থা অবশ্যই গ্রহণ করিতে হইবে।’ তিনি আরও বলেন, যে সকল বিভেদ সৃষ্টিকারী জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধাচরণ করিতেছে তাহাদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইবার জন্য জনগণের কাছে আবেদন করেন।
সরকার পক্ষে মি. আফসার উদ্দিন, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, বিচার করছেন। ২টা পর্যন্ত মামলা চলল। ৫ জন সরকার পক্ষের সাক্ষী হাজির হয়েছিল। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে মামলার তারিখ ঠিক হলো। বাকি সাক্ষ্য সেই দিন হবে। গতকাল তেজগাঁ থেকে আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। ফজলে আলী ও আলমগীর কবিরকে ডিপিআর-এ ধরে এনেছিল। ২০ সেলের সামনে রেখেছিল, আজ তাদের অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে গেল। যারা তাদের দিতে গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে খবর পেলাম পুরানা হাজতে নিয়ে গেছে। ভালই হয়েছে, নূতন লোক সেলে কষ্ট হতেছিল।
আজ আমার তিন মাস পূরণ হলো। ডাইরি লেখাও শেষ করলাম। আগামীকাল থেকে ছোটখাট ঘটনাগুলো লিখবো।
নোটিশ পেয়েছি আর একটা মামলা জেল গেটে হবে সে মামলাটাও বক্তৃতা করার জন্য। আব্দুল মালেক, ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণী, নোটিশ দিয়েছে। আগামী ১৭ই সেপ্টেম্বর জেলগেটে মামলা আরম্ভ হবে।
সিলেট আওয়ামী লীগ সম্পাদক আবদুর রহীম ও সহ-সভাপতি জালাল উদ্দিন আহম্মদ এডভোকেটকে পূর্ব পাকিস্তান ডিপিআর-এ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইয়ুব খান সাহেবের সফর উপলক্ষ্যে গোলমাল নাকি হয়েছিল তার সভায়। ছাত্র ও ন্যাপ কর্মীদের কয়েকজনকেও গ্রেপ্তার করেছে।