জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই—তারা জানে না জেল কি জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে ভিতরে তার একদম উল্টা। জনসাধারণ মনে করে চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে সমস্ত কয়েদি এক সাথে থাকে, তাহা নয়। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে।
কারাগার যার একটা আলাদা দুনিয়া। এখানে আইনের বইতে যত রকম শাস্তি আছে সকল রকম শাস্তিপ্রাপ্ত লোকই পাওয়া যায়। খুনি, ডাকাত, চোর, বদমায়েশ, পাগল—নানা রকম লোক এক জায়গায় থাকে। রাজবন্দিও আছে। আর আছে হাজতি—যাদের বিচার হয় নাই বা হতেছে, এখনও জামিন পায় নাই। এই বিচিত্র দুনিয়ায় গেলে মানুষ বুঝতে পারে কত রকম লোক দুনিয়ায় আছে। বেশিদিন না থাকলে বোঝা যায় না। তিন রকম জেল আছে। কেন্দ্রীয় কারাগার, জেলা জেল, আর সাবজেল—যেগুলি মহকুমায় আছে। জেলখানায় মানুষ, মানুষ থাকে না—মেশিন হয়ে যায়। অনেক দোষী লোক আছে; আর অনেক নির্দোষ লোকও সাজা পেয়ে আজীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে। সাবজেল দুইতিন মাসের সাজাপ্রাপ্ত লোক ছাড়া রাখে না। ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় তিন বছরের উপর জেল হলে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাইয়া দেয়।
আমি পাঁচবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি। আমার জীবনে কি ঘটেছে তা লিখতে চাই না, তবে জেলে কয়েদিরা কিভাবে তাদের দিন কাটায়, সেইটাই আলোচনা করব। পূর্বেই বলেছি, ‘জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে। জেলের কাজ কয়েদিরাই বেশি করে; অফিসারদের সাহায্য করে, আলাদা আলাদা এরিয়া আছে। হাজতিরা এক জায়গায় থাকে। সেখান থেকে তারা বের হতে পারে না। রাজবন্দিরা আলাদা আলাদা জায়গায় থাকে। সেখান থেকে তারা বের হতে পারে না। কয়েদিদের জন্য আলাদা জায়গা আছে, ছোট ছোট দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যেই থাকতে হয়। আর একটা এরিয়া আছে যাকে বলা হয় সেল এরিয়া। যেখানে জেলের মধ্যে অন্যায় করলে সাজা দিয়ে সেলে বন্ধ করে রাখা হয়। আবার অনেক সেলে একরারীদের রাখা হয়। সেল অনেক রকমের আছে—পরে আলোচনা করব।
কয়েদিদের গুনতি দিতে দিতে অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। সকালে একবার গণনা করা হয়, লাইন বেঁধে বসিয়ে গণনা করে। জমাদাররা যখন সকালে দরজা খোলে তখন একবার, আবার দরজা খোলার পরে একবার, ১১টার সময় একবার, সাড়ে ১২টায় একবার, বিকালে একবার; আবার সন্ধ্যায় তালাবন্ধ করার সময় একবার। প্রত্যেকবারই কয়েদিদের জোড়া জোড়া করে বসতে হয়। কয়েদিদের জন্য আলাদা আলাদা ওয়ার্ড আছে। কোনো ওয়ার্ডে একশত, কোনোটায় পঞ্চাশ, কোনোটায় পঁচিশ, আবার এক এক সেলে এক একজন, কোনো সেলে তিনজন, চারজন, পাঁচজনকেও বন্ধ করা হয়। তবে এক সেলে কোনোদিন দুইজনকে রাখা হয় না। কারণ, দুইজন থাকলে ব্যভিচার করতে পারে, আর করেও থাকে।
জেলের ভিতর হাসপাতাল আছে, ডাক্তারও আছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসাও পায়। কাজ করতে হয়। যার যা কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। যারা লেখাপড়া জানে, তারা অফিসে রাইটারের কাজ করে। কেহ বাগানে, কেহ গুদামে, কেহ ফ্যাক্টরিতে, কেহ সুতা কাটে, কেহ পাক করে, কেহ ঝাড় দেয়, আর কেহ মেথরের কাজও করে। যত রকম কাজ সবই কয়েদিদের করতে হয়। সন্ধ্যার পরে কেউই বাইরে থাকতে পারে না। সন্ধ্যায় সকলকেই তালা বন্ধ করে দেওয়া হয় বাইরে থেকে। ভিতরেই পায়খানা-প্রস্রাবখানা আছে। সন্ধ্যার পূর্বেই লাইন ধরে বসে খানা শেষ করতে হয়। তালা বন্ধ করে সিপাহিরা বাইরে পাহারা দেয়। ভিতরে থাকে কয়েদিরা। কয়েদিরা যত দিন জেলে থাকে—সন্ধ্যার পরে অন্ধকার হলো, কি চাঁদের আলো, এ খবর খুব কম রাখে।
কয়েদিদের ভিতর আবার প্রমোশনও হয়। কালো পাগড়ি নাইটগার্ড, গেট-পাহারা ইত্যাদি। যে সাজা তাদের দেয়া হয় তার অর্ধেক জেলখাটা হয়ে গেলে তাদের পাহারার কাজ দেয়া হয়। পাহারাদের কালো ব্যাচ পরতে হয়। এরা দরজায় দরজায়, দেয়ালে দেয়ালে, পাহারা দেয়। আবার কেউ কয়েকজন কয়েদির মালিক হয়, এই কয়েদিদের কাজ করায়। সেলে ব্যাজের ‘পাহারা’ জেলের সকল জায়গায় যেতে পারে। কাউকে ডাকতে হলে, কোনো কয়েদিকে আনার দরকার হলে জমাদার সিপাহিরা এদের পাঠায়। এদের উপর থাকে, কিনভিক্ট ওভারসিয়ার’-যাদের ‘মেট’ বলা হয়, এদের কোমরে চামড়ার বেল্ট থাকে। এরাও ‘পাহারা’দের মতো কাজ করায়। কয়েকজন কয়েদি-তাদের উপর যে যার মেট থাকে—এদের দেখাশোনা করে। তিনভাগের দুইভাগ সাজা খাটা হলে ‘মেট’ হতে পারে। এর উপর নাইটগার্ড করা হয়। এরা কোমরে বেল্ট ও সিপাহিদের মতো বাঁশি পায়। দরকার হলে এরা বাঁশি বাজাতে পারে এবং পাগলা ঘণ্টা দেওয়াতে পারে। যারা রাতে সিপাহিদের সাথে ডিউটি দেয় তাদের খাট-মশারি-বালিশ দেয়া হয়। তারা জেলের ভিতরে সকল জায়গায় ঘুরতে পারে। এর উপরে থাকে কালা পাগড়ি, তাদের কালা পাগড়ি পরতে হয়, এরা কোমরে বেল্ট ও বাঁশি পায়। এদের ক্ষমতা প্রায়ই সিপাহিদের সমান। এরা এক একটা এরিয়ার চার্জে থাকে এবং সেপাই জমাদারদের সাহায্য করে।
যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড খাটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তাদেরই এই ‘পাওয়ার দেয়া হয়। সকলকেই নাইটগার্ড করা বা কালা পাগড়ি দেয়া হয় না। যারা জেলের মধ্যে ভালভাবে থেকেছে, স্বভাব চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হয়, তাদেরই নাইটগার্ড করা হয়। কালা পাগড়ি ও নাইটগার্ডদের বাইরে ডিউটি দেয়া হয়। ‘মেট’ পাহারা ভেতরে পাহারা দেয়। যেখানে কয়েদিদের বন্ধ করে রাখা হয় সেখানে পাঁচজন করে মেট পাহারা থাকে। তারা দুই ঘণ্টা করে রাতে পাহারা দেয়। বাইরের থেকে সিপাহিরা জিজ্ঞাসা করে ভেতর থেকে উত্তর দেয়। প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে নাম্বার আছে। সিপাহিরা জিজ্ঞাসা করে আর নম্বর বলে ভেতর থেকে উত্তর দিতে হয়।
যেমন একজন সিপাহি বলল, “পাঁচ নাম্বার সাথে সাথে ভেতর থেকে বলতে হবে, ঠিক আছে, পঞ্চাশ জানালা বাড়ি ঠিক। মানে হলো কয়েদি ৫০ জন, আর বাড়ি ঠিক আছে। আবার জানালাও ঠিক আছে। এমনি এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর—এমনি করে রাতভর সিপাহিরা ডাকতে থাকে, যার উত্তর কয়েদি পাহারা ও মেটেরা ভিতর থেকে দিতে থাকে। রাতে দুইঘণ্টা পর পর সিপাহি বদলি হয়ে যখন নতুন সিপাহি আসে, তারা এসে তালা ভালভাবে চারিদিক পরীক্ষা করে দেখে, পূর্বের সিপাহির কাছ থেকে কাজ বুঝে নিতে হয়। সিপাহি বদলির সাথে সাথে আবার ভিতরে পাহারাও বদলি হয়ে পূর্বের পাহারার থেকে কাজ বুঝে নেয়।
কয়েদিরাই কয়েদিদের চালনা করে ও কাজ করায়। কাজ বুঝিয়ে দিতে হয় আবার কাজ বুঝে নিতে হয়। কয়েদিদের ওপর যে অত্যাচার হয় বা মারপিট হয়, তাও কয়েদিরাই করে। ইংরেজের কায়দা, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলা হয়। একটা সত্য ঘটনা না লিখে পারছি না। ঘটনাটা ঢাকা জেলে ঘটেছিল। একজন কয়েদির কয়েকটা চুরি মামলায় কয়েক বছর জেল হয়। চোর বলে গ্রামের লোক ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় এবং জেল দেওয়াইয়া দেয়। গ্রামের লোক কেউই ওকে দেখতে পারতো না। যারা জেল খাটার পরে পাহারা হয় এবং পরে কনভিক্ট ওভারসিয়ার হয়—যাকে মেট বলা হয়, তারা বেল্ট পরতে পারে। মেট হয়ে যখন কয়েকজন কয়েদির ভার পড়ল ওর ওপরে কাজ করাবার জন্য তখন ওর কথামতো তাদের চলতে হতো। তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে তার স্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লিখলো। তাতে লিখেছে, ‘গ্রামে আমার কথা কেহই শুনতো না, আমাকে সকলে ঘৃণা করত, কিন্তু খোদার মেহেরবানিতে জেলখানায় আমার এত প্রতিপত্তি হয়েছে যে, আমার কথামতো কতগুলি লোককে কাজ করতে হয়। বসতে বললে বসতে হয়, দাঁড়াতে বললে দাঁড়াতে হয়, কথা না শুনলে কোমরের বেল্ট খুলে খুব মার দেই। কারও প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নাই। আল্লাহ আমাকে খুব সম্মান দিয়েছে। এত বড়ো সম্মান সকলের কিসমতে হয় না। গ্রামের লোক আমাকে চোর বললে কি হবে, জেলে আমি একটা মাতুব্বার শ্রেণীর লোক। চুরি না করলে আর জেলে না আসলে এ সম্মান আমাকে কেউই দিত না। তুমি ভেবো না। এখানে খুব সম্মানের সাথে আছি।’ সত্যিই এত বড় সম্মান ও কোনোদিন আশা করতে পারে নাই।
কয়েদিরা চিঠি যখন পাঠায় তখন পরীক্ষা করে দেখা হয় জেল অফিসে। যখন এই চিঠি পরীক্ষা করার জন্য খোলা হলো তখন তো সকলে চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে সারা। চিঠি জেলার সাহেব, সুপার সাহেব সকলেই পড়লেন। পরের দিন তাকে হাজির করে তার বেল্টটা কেড়ে নেয়া হলো। তার মাতব্বরী শেষ। এই গল্পটা কোনো এক জেলার সাহেব আমাকে বলেছিলেন।
জেলে কতগুলি কথা ব্যবহার হয় যা বাইরের লোক সহজে বুঝতে পারবে না। আমি যখন প্রথম জেলে আসি তার পরদিন সকালে একজন কয়েদি ‘পাহারা এসে আমার ও আমার সাথী কয়েকজনকে বলল আপনাদের কেসটাকোলে যেতে হবে। আমরা তো ভেবেই অস্থির। বাবা ‘কেসটাকোল’ কি জিনিস? কোথায় যেতে হবে? বললো ওখানে কেসটাকোল হয়। আমরা একে অন্যের মুখের দিকে চাই। বললাম চলো, আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো এক জায়গায়। সেখানে জেলসুপার সাহেব এসে নতুন কয়েদিদের সকল কিছু জেনে টিকিটে লিখে নেয়। কয়েদিরা অন্যায় করলে বিচার হয়। আমরা যখন পৌছলাম, তখন সুপার সাহেব বললেন, আপনারা চলে যান আপনাদের রুমে। আপনাদের ওজন, নামধাম আপনাদের ওখানে যেয়ে লিখে আনবে। সিপাহি একজন আমাদের পৌঁছাইয়া দিল।
আমাদের সাথে কয়েকজন ডিভিশন কয়েদি ছিল তার মধ্যে শাহাবুদ্দিনকে আমি জানতাম, বাড়ি সিলেট। সিলেট গণভোটে কাজ করত, মুসলিম লীগের একজন নামকরা কর্মী ছিল। বিখ্যাত কালাবাড়ী খুন মামলায় ২০ বছরের সাজা হয়েছে। শাহাবুদ্দিনের নাম ছিল পি এম শাহাবুদ্দিন। সকলে ঠাট্টা করে বলতো, পলেটিক্যাল মারদাঙ্গার শাহাবুদ্দিন। জেলখানায় অনেকের পিছনে সে লাগতো, কারও ভাল দেখতে পারতো না। তবে লেখাপড়া জানতো। কয়েদিদের কাজ করে দিতে বলে কেহ কিছু বলতো না। শাহাবুদ্দিনকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেসটাকোল কিরে ভাই? ওতো হেসেই অস্থির। আমাকে বলল দেখেনতো, ইংরেজি ডিকশনারিতে আছে নাকি? আমি বললাম জীবনে তো শুনি নাই, থাকতেও পারে। ইংরেজি তো খুব ভাল জানি না। পুরনো ডিভিশন কয়েদিরা সকলেই হাসে। আমি তো আহাম্মক বনে গেলাম, ব্যাপার কী? পরে হাসতে হাসতে বললো, কেস ফাইল, কেস টেবিল, ‘কেসটাকোল’ না। কয়েদিরা একে এই নাম বলে ডাকে। কেস টেবিলে বিচার হয়। কয়েদিরা অন্যায় করলে শাস্তি পায়। কয়েদিদের অনুরোধ, দাবির কথা শোনে। চিঠিপত্র লেখে। নিজেকে আমি আহাম্মক মনে করেছিলাম। কেস টেবিল থেকে কেসটাকোল’ নতুন একটা ইংরেজি শব্দ কয়েদিরা জন্ম দিয়েছে। এরকম অনেক শব্দ ও নাম জেলখানায় আছে। পরে লিখব। সেন্ট্রাল জেলে অনেক রকম ডিপার্টমেন্ট আছে। কয়েদিদের ভাগ করে দেয়া হয়। এই ডিপার্টমেন্টকে ‘দফা বলা হয়।
জেলে শব্দকোষের কয়েকটি এ রকম :
রাইটার দফা-যারা লেখাপড়া জানে, অফিসের কাজ করে, চিঠিপত্র লিখে দেয়, হিসাব রাখে, আপীল লিখে দেয়, দরখাস্ত লিখে দেয়, চিঠিপত্র বিলি করে। কয়েদিদের খালাসের সময় হিসেব করে। কতদিন জেলখাটা হলো। হাসপাতালে কাজ করে, ঔষধপত্র হিসেব রাখে। একজন কর্মচারীকে কাজে সাহায্য করার জন্য একজন দুইজন অথবা বেশি রাইটার থাকে। এরা কর্মচারীদের কাজে সাহায্য করে। মাল গুদামের হিসেব রাখে, কয়েদিদের বেতন ভাগ করে দেয়, বাজার থেকে কি কি কিনতে হবে—তাহাও লিখে কর্মচারীদের দস্তখত নিয়ে কন্ট্রাক্টরদের কাছে পাঠায়। যত গোলমাল, এই রাইটারই বেশি করে।
চৌকি দফা—যেখানে কয়েদিদের পাক (রান্না) হয়। হিন্দু এবং মুসলমানদের আলাদা আলাদাভাবে পাক হয়ে থাকে। এখানে বহু কয়েদি কাজ করে। পানি আনে, মাছ ও তরকারি কোটে, মরিচ বাটে, খাওয়া বিলি করে, যাবতীয় খাওয়ার ব্যাপার এই চৌকি থেকে হয়। বহু লোকের পাক হয়। ডিভিশন চৌকি আলাদা হয়ে থাকে। ডিভিশন অর্থ হলো যে সমস্ত কয়েদিদের বাইরে অবস্থা ভাল, শিক্ষিত, সম্মানিত জেলে এসে পড়েছে তাদের ডিভিশন দেওয়া হয়। এক কথায় বলতে গেলে এদের উচ্চ শ্ৰেণী বলা চলে। এদের কনভিক্ট ডিভিশন-২ বলা হয়; ডিভিশন-১ও আছে। যারা হাজতি তারা ডিভিশন-১ পায়। যারা কনভিক্ট তাদের ডিভিশন-২ বলা হয়। আর আছে সাধারণ শ্রেণী যাদের তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি বলা হয়। ডিভিশন কয়েদিরা জুতা, জামা, খাট, মশারি পায়। আর জেলখানায় একটু মাতব্বরীও বেশি করতে চেষ্টা করে। আর করেও। কারণ প্রায়ই লেখাপড়া জানা ও অবস্থাসম্পন্ন লোক অথবা সরকারি কর্মচারী ঘুষ খেয়ে সাজা পেয়ে জেলে এসেছে। এদের পাকও আলাদা হয়। কারণ এরা রোজই মাছ, তরকারি, অন্যান্য জিনিস সাধারণ কয়েদিদের থেকে বেশি পায়। এদেরই এক কথায় সুখী কয়েদি বলা চলে। চৌকি দফায় যারা কাজ করে ও মেট পাহারা যারা থাকে, পরিশ্রম করতে হয় তাদের বেশি। খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হয় না। অনেক কিছু তৈয়ার করে পালাইয়া পালাইয়া খেয়ে থাকে, আর বিক্রিও করে। আশ্চর্য হবেন, বিক্রির ইতিহাস পরে আলোচনা করা যাবে। জেলখানায় পাওয়া যায় না এমন জিনিস খুব অল্পই আছে। তবে মেয়েলোক শুধু পাওয়া যায় না।
জলভরি দফা-বুঝতে বোধহয় কষ্ট হবে না, জলভরি কাকে বলে। কয়েদিদের মধ্যে একটা দফা আছে যারা পানি টানে ও ওয়ার্ডে পানি দেয়। বেশ শক্তিশালী লোক দেখে এই দফা পূরণ করা হয়। সকালে বাঁশের ভিতর দুইটা করে বড় বালতিতে পানি ভরে প্রত্যেক ওয়ার্ডে হাউজ আছে তাতে ভর্তি রাখতে হয়। এদের কষ্ট একটু বেশি, কারণ তিন তলা পর্যন্ত হাউজে পানি তুলতে হয়, সকালে ও বিকালে। যদি কোনো ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, দারোগা, পুলিশ, দফাদার কয়েদি হিসাবে জেলে আসে তখন কয়েদিরা এক হয়ে তাদের দিয়ে পানি টানায় এবং নিচের থেকে তিন তলায় পানি টানায়।
ঝাড়ু দফা-এদের কাজ ঝাড় দেওয়া, ময়লা পরিষ্কার করা। বুড়া বুড়া, অসুস্থ লোক দেখে এখানে দেওয়া হয়। দিনভর গাছের পাতা, সামান্য ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে হয়। এরাই সুখী বেশি কারণ কাজ নাই তবে ইদানীং নতুন সুপারেনটেনডেন্ট ঢাকা জেলে আসাতে এদের উপর কাজের চাপ একটু বেশি পড়েছে। কারণ তিনি গাছের পাতা দেখলে কয়েদিদের মেট পাহারাদের দিয়ে সেল বন্ধ করে শাস্তি দেন। তবে কয়েদিরাও চালাক কম না। একদিন বসে আছি হঠাৎ শুনতে পেলাম একজন কয়েদি আর একজন কয়েদিকে বলছে আরে ভাই, ঝাড় মার ঝাড় মার বড় সাহেব আসছে। আমি সহজে বুঝতে পারলাম না কেন বড় সাহেবকে ঝাড় মারতে চায়। পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে, ইনি খুব কড়া লোক। তাই কয়েদিরা ঝাড় মারে মাটিতে, বলে সুপার সাহেবের নামে। পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
বন্দুক দফা-একটা বিখ্যাত দফা আছে যার নাম কেহই বুঝবেন না, একে বন্দুক দফা বলা হয়। একদল কয়েদি আছে যারা মেথরের কাজ করে। মেথর হলে রোজ মাছ পাওয়া যায়। তেল পাওয়া যায়। আঁটি করে বিড়ি পাওয়া যায়, সাবানও পাওয়া যায়। লোভে পরে অনেকে মেথর দফায় কাজ করে, পায়খানা পরিষ্কার করে। আগে জুলুম করে, মারপিট করে মেথর করতে হতো। সহজে কেহ মেথর হতে চায় না। তাই অত্যাচার করার জন্য কয়েদিদের মধ্য থেকে দালাল ঠিক করে দেওয়া হতো। আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, বন্দুক দফা কেন বলা হয়? একটা গল্প আছে এর পেছনে। বাঁশ দিয়ে কাঁধে নিয়ে টিনে করে পায়খানার ময়লা দূরে নিয়ে লাল গাড়িতে ফেলতে হয়। তাই টিন ঘাড়ে করে টানতে টানতে দাগ হয়ে যায়। একজন কয়েদি মেথর দফায় কাজ করতে করতে তার কাঁধে দাগ হয়ে যায়। একবার তার ভাইরা তাকে দেখতে এসে কাঁধের দাগ দেখে জিজ্ঞাসা করে দাগ কিসের, তার উত্তরে মেথর কয়েদিটা বলে আমি বন্দুক দফায় জেলখানায় কাজ করি, সিপাহি সাহেবদের বন্দুক আমার বহন করে বেড়াতে হয়। তাই দাগ পড়ে গেছে। সেই হতে এই দফার নাম বন্দুক দফা।
পাগল দফা-জেলখানায় আরেকটা দফার নাম পাগল দফা। জেলখানায় বহু পাগল আছে। এদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা আছে, এদের জন্য সকালে একজন সিপাহি, বিকেলে একজন। কয়েদিদের মধ্য থেকে মেট পাহারা কয়েকজন রাখা হয় এদের দেখাশোনা করার জন্য। অনেক কয়েদি পাগল হয়ে যায়, বেশি দিন জেল জীবন সহ্য করতে পারে না বলে। অনেক কয়েদি আপনজনকে হত্যা করে পাগল হয়ে যায়। এরা ভাল না হওয়া পর্যন্ত বিচার বন্ধ থাকে। ফরিদপুরের এক পুলিশের হাওলাদার তার স্ত্রীর চরিত্রের উপর সন্দেহ করে স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করে। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তারপর সে পাগল হয়ে যায়। আবার অনেকে বাইরে পাগল হয়, আত্মীয় স্বজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অনুমতি নিয়ে জেলে পাঠাইয়া দেয়। অনেকে ভাল হয়, আবার অনেকে বেশি পাগল হয়ে যায়। দুনিয়ায় কত রকমের পাগল আছে জেলে আসলে বোঝা যায়। আমার কপাল ভাল কি মন্দ বলতে পারি না। তবে যেখানে পাগলদের রাখা হয় তার কাছেই আমাকে রাখা হয়েছিল। রাত হলে পাগলের পাগলামি বাড়ে। ৪০ সেলে পাগল রাখা হয়। এক এক সেলে এক এক জনকে বন্ধ করা হয়। অনেকে চুপচাপ থাকে, আবার অনেকে সারারাত গান গায়—কত রকমের গান ঠিক নাই। যাকে এক কথায় পাগলের গান বলা যায়। মাঝে মাঝে থালা পিটায়, মাঝে মাঝে দরজা ধরে ধাক্কা শুরু করে। আর মাঝে মাঝে দু’একজন রাতভরে গালাগালি করে। কাকে করে বুঝতে পারি না—তবে গালাগালি চালিয়ে যায়।
বহু রাত্রে ঘুমাতে না পেরে ওদের চিৎকারে বিছানায় শুয়ে রাত কাটাতে হয়েছে আমার। পাগলের উকট চিৎকারে কে ঘুমাতে পারে! এক পাগল ছিল, মাঝে মাঝে ক্ষেপে যেত। যখন ক্ষেপত রাতভর, আল্লাহু আকবার’ ‘জিন্দাবাদ’ এই দুই কথাই বলে রাত কাটিয়ে দিত। কেউ কেউ সিপাহিদের ডাকত বিড়ি খেতে, বলত “বাবু ও বাবু এদিকে আসেন”–ডাকতেই থাকত, কিছুক্ষণ ডাকার পরে যদি না আসে তাহলে বাবুর পরিবর্তে মা বোন তুলে গালি দিত। চল্লিশ সেলের দুই ধারে ছোট ছোট কামরা, সিপাহিদের বলে কয়ে ক্ষেপা পাগলদের অন্য পাশে বন্ধ করতে অনুরোধ করতাম। কিন্তু কখন যে কোনোদিকের কে ক্ষেপে উঠে কি করে বসবে তার ঠিক নেই। আজ একজন ঘুমাইয়া ছিল, রাতে আর একজন শুরু করল। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে সবগুলিকে এক এক করে নিয়ে যায়, পানির হাউজে গোসল করায়। পাগল সহজে গোসল করতে চায় না, তাই জোর করে পানির ভিতর ফেলে দেয় আর চেপে ধরে। অনেক পাগল আবার চালাক, চুবানোর ভয়ে তাড়াতাড়ি কলের নিচে বসে নিজেই গোসল করে নেয়।
একদিন দাঁড়াইয়া পাগলের গোসল দেখছি। এক পাগলের গোসল হয়ে গেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াইয়া রোদ পোহাচ্ছে। আর একজন পাগলকে কয়েকজন কয়েদি ধরে এনে গোসল করাচ্ছে। যে পাগলটা আমাদের কাছে দাঁড়াইয়া রোদ পোহাচ্ছে সে আমাকে বলে, কি দেখেন, এগুলি সব পাগল, খুব পাগলামি করে। আমি তো হেসেই অস্থির। নিজে যে পাগল তা ভুলে গেছে।
১৯৫৪ সালে জেলে গিয়ে এক পুরানা পাগলের সাথে দেখা হলো। ওকে আমি চিনতাম, কারণ বছরের মধ্যে প্রায় ১১ মাস ভাল থাকে, মাঝে মাঝে ক্ষেপে যায়। যখন ভাল থাকে তখন খুব ভাল ভাল কথা বলে। ওদের যখন নিয়ে যাচ্ছে আমি দাঁড়াইয়া দেখছি, দেখি সেই পুরান পাগল। নাম তার কফিলউদ্দিন। জিজ্ঞাসা করলাম কি কফিলউদ্দিন কেমন আছো?’ বললো, ভাল তো আছি, ছাড়ে তো না। আপনারা তো ছাড়ালেন না। আবার বুঝি আসছেন। আর কিছু বললাম না। সে চলে গেল। রোজ যখন আমার সামনে দিয়ে নিয়ে যেতো তখন আমাকে দূর থেকে একটা আদাব করত। কফিলউদ্দিন আজও জেলে আছে—কতকাল থাকতে হয় জানি না। আর একজন ছিল আমাকে দেখলেই ইংরেজি বলতো। পরে খবর নিয়ে জানলাম, স্কুলের মাস্টার ছিল। পাগল হয়ে গেছে।
একদিন জেল গেটে যাচ্ছি আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে। যাবার পথেই ওদের দরজা। এক পাগল দাঁড়াইয়া আছে ওদের দরজায়। আমাকে দেখে বলে, কি খবর! সিগারেটগুলি একলাই খান আমাদের দিতে হয় না। বললাম সিগারেট খাবা, এসে দিব। ফিরে এসে দেখলাম ওদের তালাবন্ধ করে দিয়েছে। ওকে সহজে সেলের বাইরে করে না কারণ খুব শক্তিশালী। ক্ষেপে গেলে মেরে ধরে অস্থির করে দেয়। এক সিপাহি বসে বসে ডিউটি দিতে ছিল। ও আস্তে আস্তে এসে কাছে বসেছে, হঠাৎ সিপাহির হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে সিপাহিকে মারতে শুরু করল। সিপাহির মাথা ফেটে গেল। সিপাহি দৌড় দিয়ে কোনো মতে নিজেকে রক্ষা করল। পরে অনেক সিপাহি ও কয়েদি এসে ওর কাছ থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। এক ঘণ্টা পর্যন্ত ওর কাছে কেউ যেতে পারে নাই। দুই একজন সিপাহি আছে যাদের দেখলে পাগলরা ক্ষেপে যায়। তাই তাদের ডিউটি পাগল খাতায় দেয়া হয় না। পাগলের সঙ্গে রাগ করলে, গালাগালি করলে তারা আরও ক্ষেপে যায়। একমাত্র ঔষধ পানি। যদি বলা যায়, কাল সকালে তোকে পানির ভিতর ফেলে দেব তখনই ভয় পায়। আমি মাঝে মাঝে বিড়ি কিনে পাগলদের দিতাম, বড় খুশি হতো বিড়ি পেলে। এবার দিতে পারি নাই, কারণ আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে বের হওয়া বা কারও সাথে কথা বলা নিষেধ।
শয়তানের কল-আর একটা দফার নাম শয়তানের কল জিজ্ঞাসা করলাম, শয়তানের কল কি? কম্বল ফ্যাক্টরী। ঢাকা জেলে একটা কম্বল ফ্যাক্টরী আছে, ভাল ভাল কম্বল তৈয়ার হয়। বিশেষ করে জেলখানায় কয়েদিদের তিনটা করে কম্বল শীতের দিনে দেওয়া হয়, আর গরমের দিন দুইটা। ঢাকা জেলের কম্বল ফ্যাক্টরী সমস্ত জেলের কয়েদিদের কম্বল সাপ্লাই করে। এখানে কয়েদিদের কাজ করতে হয়। উল, তুলা বাইরে থেকে কিনে আনা হয়। যারা বেশিদিন জেলে আছে তাদেরই এখানে কাজ শেখানো হয়। এরা কম্বল তৈয়ার করে বাইরেও বিক্রি করে। আমি এক কয়েদিকে জিজ্ঞেস করলাম, শয়তানের কল বলো কেন? বলে, হুজুর তুলা যখন ওড়ে তখন আমাদের দিকে চাইলে চিনতে পারবেন না; সমস্ত চুল, মুখ, কাপড় তুলার কণায় ও
ধুলায় ভরে যায়। সন্ধ্যায় গোসল করে তবে আমরা খেতে পারি। সাফ সুতরা হয়ে গোসল না করলে আমাদের চিনতে পারবেন না, মাথা, মুখ, সারা শরীরে তুলা লেগে আমাদের চেহারা শয়তানের মতো হয়ে যায় বলে, শয়তানের কল নাম দেওয়া হয়েছে।
দরজি খাতা-ঢাকা জেলে চাদর, কয়েদিদের কাপড়, মোড়া, টেবিল, চেয়ার, খাট, গদি অনেক কিছুই এখানে তৈয়ার হয়। একজন ডেপুটি সুপারেনটেনডেন্ট এর চার্জে থাকে। একে কয়েদিরা ডিপটি বলে। দরজি খাতা খুব বড়ো এখান থেকে পুলিশ লাইনেরও পোশাক বানাইয়া দেওয়া হয়।
মুচি খাতা-মুচি খাতা আছে যেখানে জুতা তৈয়ার হয়। তবে একে আরও উন্নত ধরনের করা যায় যদি ভাল মেশিন সাপ্লাই করা হয় এবং কয়েদিদের কিছু বেতন দেয়ার বন্দোবস্ত করা যায়। কয়েদিরা কাজ করতে চায় না, ফাঁকি দেয়—শুধু দিন গোনে। আজ একদিন গেল, কাল দুই দিন—এমনি। যদি এরা বুঝতে পারে বেশি কাজ করলে টাকা পাওয়া যাবে তাহলে বেশি কাজ করত।
অনেক সত্য ঘটনা আমি দিবার চেষ্টা করব—যাতে বুঝতে পারা যাবে, কেমন করে জেলে আসার পরে খাবারের অভাবে স্ত্রী তালাক দেয়া হয়। একটা না, বহু ঘটনা আছে। প্রথম প্রথম জেলে এসে অনেক কথা বুঝতেই আমার কষ্ট হতো, যেমন একদিন এক, ‘পাহারা এসে বলল তার সিকম্যান’ যেতে হবে। আমি তার মুখের দিকে চেয়ে আছি, কিছুই বুঝতে পারি না। জিজ্ঞাসা করলাম, সিকম্যান’ কিরে? বলে হুজুর ‘সিকম্যান’ জানেন না, যেখানে ওষুধ পাওয়া যায়, আমার যেতে হবে ওষুধ আনতে। আর কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম। বুঝলাম, এসব জেলের নিজস্ব ভাষা, আমি বুঝতে পারবো না।
ডিভিশন কয়েদি ছিল বরিশালের বারী সাহেব ও ওহাব সাহেব। আমরা এক সাথেই থাকতাম। বারী সাহেব হাসপাতালে রাইটারের কাজ করতেন আর ওহাব সাহেব ফ্যাক্টরীতে রাইটারের কাজ করতেন। দুইজন খালাতো ভাই। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। প্রায় আট বছর জেলে আছে। জমিজমার ব্যাপারে একটা খুন হয়ে যায়। তার দণ্ড এই জেল। ওহাব সাহেব একটা ছেলে রেখে এসেছে। জোয়ান সুপুরুষ। বিধবা মা ছিলেন, মারা গেছেন জেলে আসার পর। মাত্র স্ত্রী আর ছেলেটা, এক বছরের রেখে আসছে আর দেখা হয় নাই। বারী সাহেবের ছেলেমেয়ে আছে, মেয়েটার বিবাহ হয়েছে জেলে আসার পরে। খুব চিন্তিত থাকেন সকল সময়। কোনো রকমের কথাবার্তায় উত্তর নাই, গোলমালের ভিতর নাই। চুপচাপ থাকেন। ওহাব সাহেব ভীষণ গোয়ার লোক, রাগ হয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। এরা যখন কাজ করে ফিরে এলেন তখন, সিকম্যানের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বারী সাহেব বললেন, ‘সিকম্যান’ মানে হাসপাতাল, কয়েদিরা সিকম্যান বলে। বুঝলাম ব্যাপারটা।
জেলখানায় হাসপাতাল আছে, পূর্বেই বলেছি। সেন্ট্রাল জেলে, বিশেষ করে ঢাকা জেলে ভাল হাসপাতাল। দোতলা দালান, প্রায় একশ’ রোগীর স্থান হতে পারে, তিনজন ডাক্তার আছে, একজন কম্পাউন্ডার, সপ্তাহে দুইবার সিভিল সার্জন আসেন। তারই চার্জে জেল হাসপাতাল। ঔষধ যথেষ্ট থাকে, ডাক্তারের হুকুম মতো যে কোনো খাদ্য কয়েদিদের দিতে বাধ্য। একে ‘মেডিকেল ডাইট’ বলা হয়। কয়েদিদের ওজন কম হয়ে গেলে ডাক্তাররা ‘ডাইট’ দিয়ে থাকেন, তবে সকল ডাক্তার না। হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রাপ্ত হয়ে যদি রোগ ভাল না হয়, তবে জেলের মেডিকেল অফিসার ইচ্ছা করলে মেডিকেল কলেজে পাঠাতে পারে। দুঃখের বিষয় কয়েদিদের কপালে ভাল ঔষধ কম জোটে। কারণ ভাল ব্যবহারের ডাক্তার যারা—যারা কয়েদিদেরও মানুষ ভাবে, আর রোগী ভেবে চিকিৎসা করে, তারা বেশিদিন জেলখানায় থাকতে পারে না।
অনেক ডাক্তার দেখেছি এই জেলখানায় যারা কয়েদিদের ‘ডাইট’ দিতে কৃপণতা করে না, অসুস্থ হলে ভাল ঔষধ দেয়। আবার অনেক ডাক্তার দেখেছি যারা কয়েদিদের কয়েদিই ভাবে, মানুষ ভাবে না, রোগ হলে ঔষধ দিতে চায় না। পকেটে করে ঔষধ বাইরে নিয়ে বিক্রি করে। ঘুষ খায়, চিকিৎসা করার নামে। আবার টাকা পেলে হাজতিদের মাসের পর মাস হাসপাতালে ভর্তি করে রাখে, ব্যারাম নাই যদিও। এভাবে বাইরের থেকে জামিনের চেষ্টা করা যায়। ম্যাজিষ্ট্রেট যখন জেলখানায় দেখতে যায় কয়েদিদের অবস্থা, তখন হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি দেখায়ে দেয়। এতে জামিন পেয়ে যায়। বাইরে থেকে বিচারাধীন আসামীর কেউ হয়তো কোনো ডাক্তারের সাথে দেখা করে টাকা পয়সা দিয়ে গেছে, বলে গেছে জামিন হলে আরও দেব। যার অসুখ নাই তাকে মাসের পর মাস হাসপাতালে সিট দিয়ে রেখে দিয়েছে, আর যে সত্যিই রোগী তার স্থান নাই। এটা বাইরেও হয়ে থাকে, শুধু জেলে না, তবে এখানে একটু বেশি হয়।
আবার এমন ডাক্তার দেখেছি যারা জেলখানায় পানিও মুখে দেয় না, ঘুষ তো দূরের কথা। রোগীদের ভালভাবে চিকিৎসা করে, রাতদিন পরিশ্রম করে। আবার এমন ডাক্তার জেলে দেখেছি, সুন্দর চেহারা, মুখে দাড়ি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে-দেখলে মনে হয় একজন ফেরেস্তা। হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে কয়েদিরোগীদের ডাইট থেকে ডিম, গোস্ত, রুটি খুব পেট ভরে খান, আর ঔষধও মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে বিক্রি করেন।
হাসপাতালে রোগীদের জন্য আলাদা পাক হয়। এখানটায় হলো খাওয়ার আড্ডা। কয়েদিরা কথা বলতে সাহস পায় না, তাই তাদের মুখের গ্রাস অনেকেই খেয়ে থাকেন। একজন ডাক্তারকে আমি জানতাম, মুখে খুব ভদ্রলোক। আসতে সালাম, যাইতে সালাম, খবর নিয়ে জানলাম তিনি এক প্যাকেট সিগারেটও ঘুষ খান।
জেলে কোনো ঘটনা চাপা থাকে না। যে কোনো ঘটনা জেলখানায় আধা ঘণ্টার ভিতর আড়াইহাজার কয়েদির কানে চলে যাবে।
আমাকে ও মওলানা সাহেবকে মেডিকেল ডাইট’ বাঁচাইয়া রেখেছিল দ্বিতীয়বার। পরে খবর নিয়ে শুনলাম, নুরুল আমিন সাহেব নাকি জেল সুপারেনটেনডেন্ট সাহেবকে বলে রেখেছিলেন যে আমাদের যেন কোনো খাওয়ার, থাকার কষ্ট না হয়। সেজন্য বোধহয় একটু যত্ন পেয়েছিলাম।
পাকিস্তান হওয়ার পরে রাজবন্দিদের যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা ইংরেজ আমলে ছিল তাহা উঠাইয়া দেওয়া হয়। রাজবন্দিদের কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতো না। তাদের ব্যবহার করা হতো সাধারণ কয়েদিদের মতো। কাহাকেও তৃতীয় শ্রেণীর মতো ব্যবহার করত, আবার কাহাকেও প্রথম শ্রেণীর মতো ব্যবহার করত। আইবিদের ইচ্ছা। আমার মনে আছে, এক এমবিবিএস ভদ্রলোক ডাক্তারকে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি করে দুই বৎসর রাখা হয়েছিল। আমার এক ভাগ্নে মেডিকেল কলেজে পড়তে যাকে গ্রেপ্তার করে তৃতীয় শ্ৰেণীর কয়েদি করে জেলে রাখা হয়েছিল আমার চোখের সামনে। ওর দিকে আমি চাইতে পারতাম না। দু’একবার জেল পালানো বা জেলের আইন মানে , মারপিট করে-ডেঞ্জারাস কয়েদিদের রাখা হতো যেখানে সেই জেলে তাকেও রাখা হয়েছিল। আমাকেও দুই-চারবার এই সমস্ত সেলে থাকতে হয়েছে। তাই রাজবন্দিরা মেডিকেল ডাইট না পেলে তাদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু সকল সময় তাদের কপালে তা জুটতো না। হাসপাতালে রাজবন্দিদের ভর্তি করলে তাড়াতাড়ি রোগ ভাল হোক আর খারাপ হোক, সেদিকে খেয়াল না করে তাড়াইয়া দেওয়া হতো। ডাক্তাররা ইচ্ছা করলে কয়েদিদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। যত রকম রোগ আমরা সাধারণ মানুষ জানি তা জেলখানায় আছে। টিবি রোগীকেও রাখার ও চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত জেলের ভেতর করা আছে।
ডাক্তারদের থেকেও বেশি চুরি করে একশ্রেণীর কয়েদি-যারা ডাক্তারদের রাইটার। এরা কম্পাউন্ডারের কাজও করে। জেলখানায় ডাক্তাররা ইনজেকশন দেওয়া ভুলে যায়। কারণ কয়েদিদের দিয়েই অধিকাংশ কাজ করাইয়া থাকে। তবে সকল ডাক্তার না। অনেকে আবার খুব পরিশ্রমও করে রোগীদের ভাল চিকিৎসার জন্য।
রাজবন্দিদের সাধারণ কয়েদিদের সাথে রাখা হতো না। এদের জন্য ছোট ছোট জেল আছে ঢাকা ও অন্যান্য জেলে। আবার সকল রাজবন্দিকে এক জায়গায় রাখা হতো না, কোথাও দুইজন, কোথাও একজন, কোথাও পঞ্চাশ জন, কোথাও একশ’ জন এইভাবে রাখা হতো। এক স্থানের রাজনৈতিক বন্দিদের সাথে অন্য স্থানের রাজনৈতিক বন্দিদের এক জেলে থেকেও পাঁচ বছরে একবার দেখা হয় নাই এমন ঘটনাও আছে। পূর্বেই বলেছি, অধিকাংশ রাজনৈতিক বন্দিদের ডিভিশন দেয়ায় সাধারণ কয়েদিদের যা দেয়া হতো, এদেরও তাই দেয়া হতো।
১৯৫০ সালে সমস্ত রাজবন্দি প্রায় ৬০ দিন অনশন ধর্মঘট করে সরকারের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে। ১৯৫১ কি ৫২ সালেও হতে পারে ঠিক বলতে পারি না। জেল কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক বন্দিদের উপর বিশেষ করে ক্ষমতা দেখাতে পারে না, কারণ আইবি-এর হুকুম নিয়ে চলতে হয়। কোথায় কাকে কিভাবে রাখতে হবে তাহাও আইবি বলে দেয়। সেই মতো কাজ করতে হবে জেল কর্তৃপক্ষের। যদি কেউ কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে হঠাৎ দেখবেন তাকে অন্য জেলে পাঠাইয়া দেয়া হইয়াছে।
রাজনৈতিক বন্দিদের সচরাচর এক জেল থেকে অন্য জেলে চালান দেওয়া হয়। ইংরেজ আমলে খাবার ও থাকার বন্দোবস্ত অনেক ভাল ছিল। এমনকি ফ্যামিলি এলাউন্সও দেওয়া হতো। মাসে টাকা বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিতো সরকার। জেলবন্দির স্ত্রী বা ছেলেমেয়েদের অথবা তাদের বৃদ্ধ পিতা মাতাদের এখন তো জান বাঁচানোই কষ্টকর। এ নিয়ে জেলখানায় অনেক গোলমাল করার পরে সরকার এদের দুইটা গ্রেড করে দেন। প্রথম দেওয়া হয় গ্রেড ওয়ান, গ্রেড টু। গ্রেড ওয়ান যারা তাদের রোজ ২ ছটাক মাছ, সকালে ২ টুকরা রুটি আর চা ! মাখন, ডিম কিছুই দেওয়া হতো না।
এখানে আমি বলছি ১৯৫২ সালের কথা। ভাল তরকারিও কিছু দেওয়া হতো। যারা ডিভিশন কয়েদি তারাও সকালে রুটির সাথে মাখন পেত, কিন্তু আমাদের দেওয়া হতো না। ১৫ দিনে একদিন সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। সপ্তাহে একটা চিঠি লিখতে দিত। তা আবার আইবি অফিস হয়ে যেত। স্ত্রীর কাছে চিঠি লিখলে আইবি কর্মচারীরা পড়তেন। প্রেমের চিঠিও তারা পড়ে আনন্দ পেতেন। জেলে থেকে যদি কাউকে কিছু আনন্দ দেওয়া যায় ক্ষতি কি! জেলবন্দির কাছে লেখা চিঠিতে যদি কিছু রাজনীতি বা ঐ ধরনের কথা থাকত তবে সে চিঠি রাজবন্দিদের দেওয়া হতো না; যদি দেওয়া হতো মাঝে মাঝে কালো কালি দিয়ে এমনভাবে মাখাইয়া দেওয়া হতো, তা আর পড়ার উপায় থাকত না। এমন কি আমার স্ত্রীর ও বাবার চিঠি অনেকগুলি আছে যার অর্ধেক কালো কালি দিয়ে মুছে দেওয়া, বোধ হয় বাবা সান্ত্বনা দিয়েছেন অথবা বলেছেন, চিন্তা করিও না।
আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় একজন আইবি কর্মচারী বসে থাকত, আর জেলের পক্ষ থেকেও একজন ডিপুটি জেলার উপস্থিত থাকতেন। মাত্র ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়। এর মধ্যে যাবতীয় আলাপ করতে হবে। কথা আরম্ভ করতেই ২০ মিনিট কেটে যায়। নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছা হয়, কিন্তু উপায় কি? আমরা তো পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ হই নাই। তারা তো চুমুটাকে দোষণীয় মনে করে না। স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে কিন্তু বলার উপায় নাই। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো স্ত্রীকে নিষেধ করে দেই যাতে না আসে। ১৯৪৯ সাল থেকে ৫২ সাল পর্যন্ত আমার স্ত্রীকে নিষেধ করে দিয়েছিলেম, ঢাকায় আসতে, কারণ ও তখন তার দুইটা ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশের বাড়ি থাকত।
১৯৪৯ সাল থেকে ৫০ সালে ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য একটা মামলা চলে। আমার, শামসুল হক সাহেব, মওলানা সাহেব, ফজলুল হক ও আব্দুর রউফের বিরুদ্ধে। মামলাটা হয় লিয়াকত আলী খান ঢাকা আসলে আমরা একটা সভা করে শোভাযাত্রা বের করি। শোভাযাত্রা লাঠি চার্জ করে ভেঙে দেওয়া হয়, আর শামসুল হক সাহেব ও আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। কয়েকদিন পরে মওলানা সাহেবকে আর দেড়মাস পরে আমাকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদের জামিন দেওয়া হয়, কিন্তু আমাদের তিনজনকে রাজনৈতিক বন্দি করা হয়। তাই আমাদের জামিন হয় না। আমরা নিরাপত্তা বন্দি হয়ে যাই। যখন সরকারের ইচ্ছা ছাড়বে। বিনা বিচারে বন্দি। মুক্তি পাওয়াটা সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। এক বৎসর মামলা চলল। মওলানা সাহেব ও হক সাহেবকে মুক্তি দেওয়া হলো। আর আমাদের বাকি তিনজনকে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো তিন মাস করে। নিরাপত্তা বন্দিও রইলাম, সাথে সাথে সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করতে লাগলাম। আপীল করা হলো। আমাকে ফরিদপুর পাঠাইয়া দেওয়া হলো। হক সাহেব ৭/৮ মাস পরে মুক্তি পান। মওলানা সাহেব ও আমি ছিলাম এক জেলে। আমাদের অন্য রাজবন্দিদের সাথে রাখা হতো না। আমরা যদি ওদের সাথে থাকি তবে কম্যুনিস্ট হয়ে যাবো-এই হলো ভয়। ক্যুনিস্ট রাজবন্দি ছিল বেশি। আমাকে পাঠাইয়া দেওয়া হলো। মওলানা সাহেব একলা রইলেন, যখন বিদায়ের সময় হলো মওলানা সাহেব কেঁদে দিলেন। বুঝলাম, বুড়ার মনে ব্যথা।
আমাকে গোপালগঞ্জ চালান দেওয়া হলো, কারণ সেখানে আর একটা মামলার আসামী—সেটা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের। গোপালগঞ্জ পৌঁছে খবর পেলাম, আমার মা-বাবা ও স্ত্রী ঢাকায় আমাকে দেখতে গেছেন। সাবজেলে আমাকে রাখা হলো না, কারণ জায়গা নাই; পাঠাইয়া দেওয়া হলো ফরিদপুর জেলে। মামলার তারিখ পড়ে গেছে। ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাকে ভাড়া দেওয়া হতো ইন্টারক্লাসের, নিজের টাকা দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস করে নিলাম। সিপাহি বেচারারা কোনোদিন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নাই, খুবই আদর করেছে ও ভদ্র ব্যবহার করেছে। যে টাকা পথ খরচ সরকার দিতেন তাতে একবেলা খাওয়া হয়, স্টীমারে আর এক বেলা খাওয়া হতো না। তাই নিজের টাকা দিয়ে খেয়ে নিতে হতো।
ফরিদপুর জেলে এসে একলা পড়লাম। রাজবন্দিরা আছে। তাদের আলাদা জায়গায় রাখা হয়েছে। আর আমাকে রাখা হয়েছে একলা এক জায়গায়। হাসপাতালের একটা রুম ছেড়ে দিল, সেখানেই থাকলাম। প্রথমে হাসপাতাল থেকে খাবার দিত, পরে অন্য নিরাপত্তা বন্দিরা চার পাঁচজন এক জায়গায় থাকত, তারা নিজেদের পাক দেখাশোনা করত। আমাকে পরে সেখান থেকে খাবার আনাইয়া দেওয়া হতো। আমাকে ফরিদপুর জেলায় আনার পরে কাজ দেওয়া হলো, সুতা কাটা, কারণ এখন আর আমি রাজবন্দি নই, কয়েদি। সুতা কাটতে হতো। আর কয়েদির কাপড় পরতে হতো। তিন মাস খেটে ফেললাম, আমারও সাজা খাটা হয়ে গেল। আবার রাজনৈতিক বন্দি হয়ে গেলাম।
কিছুদিন পরে খবর পেলাম আমি আপীলে খালাস হয়ে গেছি। সাজাও খাটা হয়ে গেছে, আবার আপীলেও খালাস হলাম। এত কথা লেখা দরকার হতো না। একই জেলে আরও রাজবন্দি আছে, তারা এক ঘরে থাকে, তাদের সামনেই পাক হয়। আর আমাকে সেই একই জেলে একাকী থাকতে হচ্ছে। দোষ কি জানি না। জেলের আইন ভঙ্গ করি নাই, তবুও একাকী থাকতে হচ্ছে। তবে মাসে শুধু একবার গোপালগঞ্জ যেতে হয় ফরিদপুর থেকে। স্টিমার, নৌকা, গাড়িতে বেশ একটু ভোলা বাতাস খাইতাম। যদিও কথা বলা নিষেধ, তবু আস্সালামুআলাইকুম তো নিষেধ না। আমাকে কিছু কিছু মানুষ চিনতো। তাই সকল জায়গায়ই কিছু চেনাশোনা মানুষ পাওয়া যেতো, আস্সালামুআলাইকুম করেই শেষ করতাম, তা না হলে সিপাহিদের চাকরি যাবে। কারণ আইবি কর্মচারীও আছে। একবার আমাকে কে যেন মিষ্টি দিয়েছিল মাদারীপুর স্টেশনে। সেই মিষ্টি কেন আমি খেলাম তাতে সিপাহিদের কৈফিয়ত দিতে দিতে জান সারা হয়ে গেছে। একজন নাকি সাসপেন্ড হতে যাচ্ছিল, হাত পাও ধরে বেঁচে গেছে তাই ওদের জন্য কারও সাথে আলাপও করতাম না। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করত বলতাম, আমি কয়েদি, কথা বলা নিষেধ। আমার জন্য ওদের ক্ষতি হবে কেন!
‘আইন দফা’-জেলে একটা আইন দফা ছিল। এইটাই হলো সকলের চেয়ে কষ্টকর দফা। একটু মেজাজ দেখানো কয়েদি হলেই, সাজা দেওয়ার জন্য আইন দফা পাশ করা হতো। এদের গরুর মতো ঘানিতে ঘুরতে হতো। আর একটা পরিমাণ ঠিক ছিল, সেই পরিমাণ তেল ভেঙে বের করতে হতো। পিছনে আবার পাহারা থাকত, যদি আস্তে হাঁটতে অমনি পিটান। এটা ইংরেজ আমলেই বেশি ছিল, তবে পাকিস্তান হওয়ার পরে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে। সেন্ট্রাল জেলে এটা বন্ধ হয়ে যায় ১৯৪৯ সালে; তবে জেলা ও সাবজেলে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত চলে। শক্তিশালী লোকগুলি ঘানি টেনে এক বছরের ভিতর এত দুর্বল হয়ে পড়তো যে সে কথা কি বলব!
আমি যখন ফরিদপুর জেলে যাই তখন দেখতে পেলাম মানুষ দিয়ে ঘানি ঘুরাইয়া তেল বাহির করা হয়। একদিন জেলার সাহেবকে আমি বললাম, ‘সরকার হুকুম দিয়েছে কয়েদি দিয়ে ঘানি ঘুরানো চলবে না, আপনার জেলে এখনও চলছে কেন? তিনি বললেন ‘২/১ দিনের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে, গরু কিনতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। উপরে লিখেছি, অনুমতি এলেই কয়েদিদের পরিবর্তে গরু দিয়ে করা হবে। সত্যই জেলার সাহেব আমি থাকতেই বন্ধ করে দিলেন। না দিলে হয়তো আমার প্রতিবাদ করতে হতো অথবা সরকারের কাছে দরখাস্ত করতে হতো। একটা লোক ঘানি ঘুরাতে ঘুরাতে অসুস্থ হয়ে একবার হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে কষ্টের কথা আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে বলেছিল, হুজুর দিনভরে গরুর মতো ঘুরে রাতে যখন শুতে যাইতাম তখনও মনে হতো ঘুরছি, ঘুমাতে পারতাম না, দেখেন সেই যে শরীর নষ্ট হয়ে গেছে আর ভাল হয় নাই। খোদা আপনাকে বাঁচাইয়া রাখুক, আপনি জেলে না আসলে আর কতদিন যে গরুর মতো ঘুরতে হতো বলতে পারি না।
জেলখানায় কথা এক মিনিটে প্রচার হয়ে যেতো।
ডালচাকি দফা-ডালচাকি নামে একটা দফা আছে। এদের ডাল ও গম ভাঙতে হয়। আজও আছে এটা। ডাক্তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেয়। যাদের ‘good’ মার্কা স্বাস্থ্য তাদের রোজ একমন করে ডাল ভাঙতে হয়, আর যাদের স্বাস্থ্য মিডিয়াম’ তাদের আধামন ডাল রোজ ভাঙতে হয়। গমও ভাঙতে হয়। প্রত্যেকের রোজ দশ সের করে গম ভাঙতে হয়।
হাজতি দফা-এখানে হাজতিদের রাখা হয়—যাদের জামিন হয় নাই, মামলা চলছে। ঢাকা জেলে তিনতালা একটা দালানে এদের রাখা হয়। ছয়টা রুম আছে। কোনো লোক যখন হাজতে থাকে-যার মামলা চলতে থাকে, তখন সমস্ত রাত কারও ঘুমাবার উপায় থাকে না। রাত ভরে নামাজ, জেকের, মিলাদ। তজবি জপে ‘আল্লাহু আল্লাহু’ করতে থাকে।
১৯৪৯ সালে আমাকে গ্রেপ্তার করে সকালে জেলে এনে হাজতে রাখলো; কারণ আমাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। আরও কয়েকজন রাজবন্দি ছিল নিচের একটা রুমে। তাদের কাছে আমাকে রাখা হলো। আরও হাজতিও ছিল সেই রুমে। খাবার দিল ডাল, একটা তরকারী, আর ভাত—কি আর করা যাবে, খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম—খেয়ে নিলাম। যা পাক করেছে, তেলের গন্ধ, ময়লা–বিশেষ করে চাউলের ভিতর কাঁকর, ডাল দিয়ে চারটা মুখে দিলাম। জান তো বাঁচাতে হবে।
দুপুর বেলা দেখা এক মওলানা সাহেবের সঙ্গে, কোরানে হাফেজ, তাঁর বাবাও খুব বড় পীর ছিলেন, কুমিল্লায় বাড়ি। হাজতিদের মধ্যে নামাজ পড়বার আগে বক্তৃতা করছেন, ওয়াজ করছেন, হাজতিরা বসে শুনছে। আমি দূরে দাঁড়াইয়া তার বক্তৃতা শুনছি। তিনি বলছেন খুব জোরে দরুদ শরীফ পড়। শয়তান দূর হয়ে যাবে। জোরে পড়। অনেকক্ষণ বক্তৃতা করলেন; সুন্দর চেহারা, অল্প বয়স, চমৎকার বলার কায়দা। তবে জামাটা খুব বড়। ঐটা দেখেই মনে সন্দেহ হলো। একদম পা পর্যন্ত জামা। বোধ হয় ছয় সাত গজ হবে কমপক্ষে। তজবি হাতেই আছে। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে কথা বলেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, এই মওলানা সাহেব কি মামলায় এসেছেন। আমাকে এক ‘পাহারা’ বললো, জানেন না, ‘রেপ কেস’; একটা ছাত্রীকে পড়াতো তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মসজিদের ভিতর। মেয়েটার ১২/১৩ বৎসর বয়স, চিৎকার করে উঠলে লোক এসে দেখে ফেলে। তারপর ধরে আচ্ছামত মারধর করে। জেলে এসে কয়দিন তো হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। আমি বললাম হাজতে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেছে। বেটা তো খুব ভণ্ড। জমাইছে তো বেশ।
‘সন্ধ্যার পরে আমাদের তালাবন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের উপরের কোঠায় সেই হাফেজ সাহেব থাকতেন। মগরবের নামাজের পর চলল তার ‘মিলাদ অনেকক্ষণ, তারপর দরুদ, তারপর চলল কোরান তেলাওয়াৎ। তিনি যে কোরানে হাফেজ সেইটাই দেখাতে ব্যস্ত আছেন, বলে আমার মনে হলো। মামলায় তাঁর চার বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তিনি দরখাস্ত করেছিলেন ডিভিশন পাওয়ার জন্য। যদিও তার গ্রামের রিপোর্টে জানা গিয়েছিল তিনি সম্মানী ঘরের থেকে এসেছেন। তবে তাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই, কারণ তিনি পাশবিক অত্যাচারের অপরাধে অপরাধী।
ফরিদপুর জেল থেকে ফিরে এসে দেখলাম হাফেজ সাহেবকে ডিভিশনের কয়েদিরা এনেছেন তার কাছে কোরান পড়তে। আমার সাথে আলাপ হলো। জিজ্ঞাসা করলাম ‘এমন কাজটা করলেন ছাত্রীর সাথে, তাও আল্লাহর ঘর মসজিদের ভিতর।’ তিনি বললেন “মিথ্যা মামলা, এ কাজ আমি কোনো দিন করতে পারি?” তবে নিজকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বেশি কথা বলে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন আমাদের কাছে। অনেক মওলানা সাহেব মুরিদানদের বাড়িতে বেশি মুরগির গোশত খান। তাই শক্তিও বেশি, এজন্য এক বিবাহতে হয় না, তিনটা চারটা বিবাহ করেন। এটা এদের অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক। কারণ কাজ কর্ম করতে হয় না, ভিক্ষার টাকাতেই সংসার করেন, তাই তাকত বেশি। আবার অনেক মওলানা মৌলবী সাহেবরা আছেন যারা কাজ করেন, পরের জন্যে দেওয়া অর্থ কড়ি নেন না, আর বিবাহও একটা করেন। কারণ তাদের মন পবিত্র।
ছোকরা দফা-জেলখানায় আর একটা দফা বড় ভয়ানক ব্যাপার। সেটা হলো ছোকরা দফা। অল্প বয়সের কয়েদি ও হাজতিদের এক জায়গায় রাখা হয়, আলাদা করে। সাধারণ কয়েদিদের কাছে রাখতে দেওয়া হয় না। খুব কড়াকড়ি করা হয়। ছোকরাবাজি জেলে বেশি হয়। অনেকে ২০, ১০, ১২.. ৫… ৭… ৪.. ৩ বৎসর জেল নিয়ে আসে। নওজোয়ান অনেক থাকে, নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে এই সমস্ত কুকর্ম করে বেড়ায়। রীতিমত টাকা পয়সা খরচও করে এবং ছোকরা রাখে। জোগাড় করে ছোকরাদের ভাল ভাল জিনিস খাওয়ায়। ছোকরাবাজিতে ধরা পড়লে খুব অপমানও করা হয়। একবার একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে। একটা লোক ছোকরাবাজিতে ধরা পড়ে। তাকে কয়েদিরা মুখে কালি, গলায় জুতার মালা আর একজন লাঠি নিয়ে মারতে মারতে সারা জেল ঘুরায়। আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে নিয়ে আসে। লোকটা উপরের দিকে চাইছে না, আমি তো প্রথমে বুঝতে পারি নাই-পরে জিজ্ঞাসা করলে একজনে বলল সমস্ত ঘটনা। বলল এতো কিছুই না, আরও অনেক মার ওর কপালে আছে। এ বিষয়ে কড়াকড়িও খুব বেশি, এ কাজ তা সত্ত্বেও চলে বেশি। তাই ছোকরা চাইলে সহজে কাউকে দেওয়া হয় না। মেট পাহারা সিপাহিরা কড়া নজরে রাখে।
আমরা যেখানে থাকতাম কিছুদিন আমাদের ঘরের পাশের ঘরে ছোকরাদের রাখা হতো। দিনে আমরা যেখানে বেড়াতাম সেখানেই ওরা বেড়াতো। ৬ বৎসর বয়স থেকে ১৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত অন্তত পক্ষে তখন প্রায় ৫০ জন হাজতি কয়েদি ছিল। ছোট ছোট ছেলে ডাকাত বা চোরের দলে ‘খোজারু’ ছিল। এরা কারও বাড়িতে যেয়ে খোঁজ নিয়ে আসত। এদের ট্রেনিং দেওয়া হতো। কারও বাড়িতে চাকর থাকত, কয়েকদিন পরে পালাইয়া যেয়ে সমস্ত খোঁজ খবর দিত চোরের দলকে। আবার অনেকগুলি আছে পকেট মার। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। একটা ৮ বৎসরের ছেলে পকেট মারার জন্য তিনবার জেলে এসেছে। কিছুদিন জেল দেয়, ছোট ছেলে বলে ছাড়া পায়, তারপর আবার বাইরে যেয়ে পকেট মারে। পকেট মারের বড় দল আছে। ভাল ভাল শিক্ষিত অর্থশালী সর্দারও আছে। পকেট মেরে নিয়ে এক জায়াগায় ভাগ হয়। আবার কেহ কেহ একলাই করে।
একটা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলে সে বললো, হুজুর কি যে বলেন, একদিনে আমার ব্যয় হয় ১০/১৫ টাকা, আমি কেন আর একজনের বাড়িতে কাজ করব। তার চাইতে ভাল একটা দান মারবো, থানায় কিছু দিব, চুপ হয়ে যাবে। যদি হাতেনাতে ধরা পড়ি তবেই তো বিপদ। পকেটমারের আর কয়দিন জেল হয়? এই সমস্ত ছেলেরা একবার জেলে আসলে এদের জেলের ভয় ভেঙে যায়। অনেক বুড়ালোক বহুদিন জেলে আছে, ছোট ছোট ছেলেদের দেখলে বোধ হয় তাদের নিজের ছেলেদের কথা মনে পড়ে, তাই এদের অনেককে খুব আদর করে, না খাইয়া খাওয়ায়। এদের স্নেহ পিতৃস্নেহ।
জেলে আসলে অন্য পকেটমারদের বা ডাকাতদের কাছে থেকে বেশ ট্রেনিং পায়, বাইরে যেয়ে আরও বড় ডাকাত হয়। জেল দিয়ে লোকের চরিত্র ভাল হয়েছে বলে আমি জানি না।
একবার জেলে আমি শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছি। আমি একলা থাকতাম, অন্য রাজবন্দিদের আমার সাথে রাখা হতো না। একটা ঘরে যাকে দেওয়ানী বলা হয়-সেখানে আমি থাকতাম। আমার দেখাশুনা ও পাক করার জন্য দুইজন কয়েদি ছিল। একজনের নাম নবাব আলি, গ্রাম-শংকর, পোঃ-বোয়াইল, থানা-ধামরাই, জিলা-ঢাকা। আর একজনের নাম হোসেন খা, গ্রাম-সরাকাঠি, পোঃ-শ্যামপুর, জিলা-বরিশাল। প্রথমজনের ১০ বৎসরের আর দ্বিতীয়র ৭ বৎসরের জেল হয়েছে খুনের মামলায়। বাইরে কাজ করছে। সিপাহি বলে পাহারা দিচ্ছে বাইরে।
এটা ১৯৪৮ সালের ঘটনা, বোধ হয় ডিসেম্বর মাস। হঠাৎ একজন কয়েদি পাহারা আমার পা জড়াইয়া ধরে শুধু বলছে আমাকে বাঁচান। আমাকে মেরে ফেললো। আমার কাছে কোনো কয়েদির রাখার বা কথা বলার হুকুম নাই। আমি হঠাৎ চমকাইয়া উঠে জিজ্ঞাসা করলাম “কি ব্যাপার! তুমি এখানে কি করে এলে? কি হয়েছে বলো। সে কাঁপছে আর বলছে ‘একজনকে মেরেছি, এখন আমাকে ধরে নিয়ে মারবে। বিচারে যে শাস্তি হয় তাতে আমার আপত্তি নাই, তবে আমাকে না মারে। এর মধ্যে সিপাহি ছুটে এসে একে ধরে ফেলেছে। মেট, পাহারা, জমাদার সকলে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথায় পালালো। পরে ওকে ধরে নিয়ে গেল কেস টেবিলে। সেখানে সুবেদার আছে, আমি বলে দিলাম জমাদারকে ওকে যেন না মারা হয়। কারণ ও যখন চলে এসেছে আমার কাছে আশ্রয় নিতে, ওকে মারবেন না। জমাদার, সিপাহি, মেট ‘পাহারা আমার কথা শুনলো। এর মধ্যে দেখি একজন কয়েদিকে ৫/৬ জন কয়েদি ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ভীষণভাবে জখম হয়েছে। কয়েদিটা ঘুমাইয়া ছিল। সে অন্য জায়গায় কাজ করত তাকে লোহার একটা লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায়ই মুখে আঘাত করে, একটা দাঁত পড়ে যায়, আর কতগুলি নড়ে যায়। আর যে এসে আমার পা ধরেছে, যে মারলো তার নাম হলো আলি হোসেন। বিশ বৎসর সাজা, যাকে বলা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায় আর যাকে মেরেছে তার নাম হলো মাহতাব, বাড়ি ঢাকা।
এদের মধ্যে গোলমাল চলেছে বহুদিন থেকে, কারণ দুইজনই একজন ছোকরা কয়েদিকে পছন্দ করত। আলি হোসেন ছোকরাটাকে সকল সময় যত্ন করত, খাওয়াতো। বিড়ি দিত, কিন্তু ছোকরাটা মাহতাবের কাছেই থাকত। ওর কাছে বেশি যেতো, খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলেই চলে যেত মাহতাবের কাছে। রাতেও মাহতাব যেখানে পাহারা দিত সেখানেই ও থাকত। তাই রাগ হয়ে মাহতাব যখন ভাত খেয়ে ঘুমায়েছিল ওর নিজের জায়গায় তখন অন্য জায়গা থেকে আলি হোসেন সিপাহি জমাদারদের ফাকি দিয়ে সেখানে যেয়ে মেরে এক দৌড়ে পালাইয়া আমার কাছে চলে আসে। ধরা পড়লে বেশ ‘ধোলাই করা হতো। ধোলাই কথা ব্যবহার হয় জেলখানায়; বেশ মতো যাকে মারা হয় তাকে এককথায় ‘ধোলাই’ করা বলে। এই রকম অনেক ঘটনাই জেলে ঘটে থাকে।
ঢাকা জেলে প্রায় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার কয়েদি ও হাজতি আছে।
১৯৫০ সালে যখন জেলে ছিলাম তখন একজন কয়েদির সাথে আলাপ হয়। নাম তার লুদু ওরফে লুঙ্কর রহমান। ঢাকা শহরের লুঙ্কর রহমান লেনে তার বাড়ি। আমি তাকে ১৯৫৪ সালে দেখে যাই, আবার যখন ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হয় এবং আমাকে গ্রেপ্তার করে-জেলে এসে দেখি লুদু আছে। সে নিজকে সকলের চেয়ে সিনিয়র কয়েদি হিসেবে জাহির করত এবং দাবিও করত। জেলের সাধারণ আইন কানুন তার কণ্ঠস্থ ছিল। কথায় কথায় আইন ঝাড়তো। তার মতের বিরুদ্ধে কিছু হলেই সে সুপার ও জেলার সাহেবের কাছে নালিশ করত। সে বি-ক্লাস’ কয়েদি ছিল। সাধারণ কয়েদিরা তাকে ভয় করে চলত। কারণ সে খুব সাহসী, সহজে কাউকে মানতো না। আমি যেখানে থাকতাম সেখানে সে পানি দিত ও ঝাড় খাতায় কাজ করত। একজন জেল ওয়ার্ডার আমার ওখানে ডিউটি দিত। লোকটা অমায়িক ও ভদ্র, নাম তার কাদের মিয়া। সে লুদুকে বলতো, লুদু ভাল হও, আর চুরি করো না। আমি ঘরে বসে বই পড়তাম, তাদের কথা ভেসে ভেসে আমার কানে আসত। আমি তাদের আলাপ চুপচাপ করে শুনতাম।
লুদুকে আমি ডেকে বললাম, লুদু তোমার জীবনের ঘটনাগুলি আমাকে বলবা। লুদু বললো, “হুজুর আমার জীবনের কথা নাই বা শুনলেন, বড় দুঃখের জীবন। প্রায় ২০ বৎসর আমার জেলখানাতে হয়েছে। ১৩ বৎসর বয়স থেকে চুরি ও পকেট মারতে শুরু করেছি। কেন যে করেছিলাম আজও জানি না। তবে মাঝে মাঝে ভাবি কেন এই পথ নিয়েছিলাম। জীবনটা দুঃখেই গেল। বোধ হয় জীবনে আর শান্তি হবে না। চোর ও পকেটমারের জীবনে শান্তি হয় না। লুদু বলতে বলতে চোখের পানি ফেলেছিল, বোধহয় অনেক দুঃখের কথা তার মনে ভেসে এসেছিল।
লুদু বলতে লাগল, আর আমি ঘটনাগুলি লিখতে শুরু করলাম। একটা সামান্য চোরের জীবন আমি কেন লিখছি—এ প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করতে পারেন। আমি লিখছি এর জীবনের ঘটনা থেকে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার চিত্র। মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে, যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন, তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর ডাকাত পকেটমার হয়। আল্লাহ কোনো মানুষকে চোর ডাকাত করে সৃষ্টি করে না। জন্ম গ্রহণের সময় সকল মানুষের দেল একভাবেই গড়া থাকে। বড় লোকের ছেলে ও গরিবের ছেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না, যেদিন জন্মগ্রহণ করে। আস্তে আস্তে এক একটা ব্যবস্থায় এক একজনের জীবন গড়ে ওঠে। বড়লোক বা অর্থশালীর ছেলেরা ভাল খায়, ভাল পরে, ভাল শিক্ষা পায়। আর গরিবের ছেলেরা জন্মের পরে যে অবস্থা বা পরিবেশে বেড়ে উঠে এবং যাদের সাথে মেলামেশা করে তাদের স্বভাব চরিত্রই তারা পায়। লুদুর বাবার অবস্থা নেহাত খারাপ ছিল না। খেয়ে পরে সুখেই ছিল। কিন্তু সাতটা বিবাহ করে এবং বহু ছেলেমেয়ে জন্ম দেয়। সাথে সাথে কিছু বদ অভ্যাসও ছিল-মদ, তাড়ি খেয়ে টাকা উড়াইতো। তারপরে যাহা বাচতো রবিবার পকেটে করে ঘোড় দৌড় খেলায় তাহাও শেষ করে ফতুর হয়ে আসত। এইভাবে আস্তে আস্তে সংসার ভেঙে পড়তে লাগল। অভাব অভিযোগ দেখা দিল। লুদুর মা ছিল তার বাবার প্রথম স্ত্রী। এরা চার ভাইবোন ছিল। অন্য পক্ষেরও আরও নয়জন ছেলেমেয়ে ছিল। ফলে সংসারে ভীষণভাবে অভাব দেখা দিল।
লুদুর বড় ছিল এক ভাই, সে রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়েছিল। যা কিছু উপার্জন করত নিজেই ব্যয় করত, আর বাবার কিছু গুণও পেয়েছিল। ঘোড় দৌড়, জুয়াও শুরু করল।
লুদুর বাবা অন্য বিবাহ করার জন্য তার মাকে দেখতে পারতো না। তাই বাধ্য হয়ে লুদু মাকে নিয়ে আলাদাভাবে বাস করতে লাগল। সেই সময় লুদুকে দর্জির কাজ শিক্ষা করার জন্য ওর বড় ভাই এক দর্জির দোকানে দিল। প্রায় এক বছর থাকার পর ওর বাবা তাকে ফিরাইয়া আবার রাজমিস্ত্রির সাথে জোগালির কাজ করতে দিল। একাজে যা কিছু পেত তাতে সংসার চলত না।
এই সময় ওর বাবার মৃত্যু হলো, বড়ভাই সংসারের মালিক হলো। লুদু লেখাপড়া শিখতে চায়। তাই বড় ভাইকে বলল তাকে স্কুলে দিতে। কিন্তু বড় ভাইয়ের সংসারে টানাটানি, তার টাকার প্রয়োজন। ওদের ওপর অত্যাচার করতে লাগল। বাধ্য হয়ে একদিন লুদু ও তার ছোট ভাই বাড়ি ত্যাগ করে নানার বাড়ি চলে গেল। নানাবাড়িও ঢাকা শহরে। নানার বাড়িতে খায় আর ঘুরে বেড়ায়। এই সময় সে দেখতে একদল যুবক চাখানায় চা খায়, আড্ডা মারে, জুয়া খেলে, দুই হাতে টাকা উড়ায়।
ওর নানার বাড়ির পাশেরই একটা যুবক চুরি করত। তার নাম গোপাল। গোপালের সাথে লুদুর পরিচয় হয়। তার সাথে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতো। সে লুদুকে বলল, কি করিস, তুই আমার সাথে কাজ করলে তোর বেশ কিছু টাকা পয়সা হবে। লুদুকে সকল কথা গোপাল খুলে বলল। একদিন ঠিক হলো গোপাল ওকে নিয়ে রাতে চুরি করতে যাবে। ভয় পেলে চলবে না। যা বলবে তাই করতে হবে। এইভাবে মাঝে মাঝে গোপালের সাথে চুরি করত। গোপাল ওকে কিছু কিছু টাকা দিতো। তার হাতে টাকা আসাতে তার খুব ফুর্তি হলো। বেশ ব্যয় ট্যয় করত চা সিগারেট খাইতে, দু’একখানা ভাল কাপড়ও পরতো। কিছুদিন গোপালের সঙ্গে চুরি করার পরে বোধহয় ১৩/১৪ বৎসর বয়সে নিজেই একদিন চুরি করতে লোভ হলো। একলাই চুরি করবো, তবে সকল টাকা একারই হবে। প্রথমে চুরি বেশ সুন্দরভাবে করে আসতে লাগল। সাহস বেড়ে গেল। এইভাবে তিন মাস পর্যন্ত মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে একলাই চুরি করত। কিছু টাকা যখন লুদুর হাতে এল তখন সে তার ছোট ভাইকে স্কুলে দিল।
এই সময় একবার একা চুরি করতে যেয়ে ধরা পড়ল। বেশ কিছু উত্তম মধ্যম দিয়ে থানায় দেওয়া হলো। দারোগা সাহেব হাজতে পাঠাইয়া দিয়া একটা মামলা দায়ের করলেন। প্রায় তিন মাস হাজত খাটতে হলো। এই সময় লুদুর সাথে অনেক পুরানো চোরের পরিচয় হয় এবং তাদের কাছ থেকে চুরির নতুন নতুন ফন্দিও কিছু শেখে। ম্যাজিস্ট্রেট লুদুর অল্প বয়স বিবেচনা করে তাকে মুক্তি দিতে রাজি হলেন। শর্ত হলো, যদি লুদুর বড় ভাই একশ’ টাকার জামিন হয়, এক বছরের মধ্যে যদি আর কোনো চুরি বা খারাপ কাজ না করে তবে তাকে ক্ষমা করা হবে। সুদুর বড় ভাই তার মায়ের কান্নাকাটিতে রাজি হয়ে একটা বন্ড লিখে দিয়ে ওকে খালাস করে নিয়ে যায়।
কয়েক মাস ভাল থাকার পরে আবার চুরি করতে আরম্ভ করে। কারণ, টাকার তার প্রয়োজন। দুই তিন মাস পর আবার চুরি করতে যায়। জেলের এক চোরের সাথে তার আলাপ হয়েছিল, সে খালাস পেয়ে লুদুকে নিয়ে চুরি করতে যেয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। এইবার লুদুর নয় মাস কারাদণ্ড হয়। জেলখানায় ছোট ছোট ছেলেদের কয়েদিরা খুব ভালবাসে। অনেকে নিজের ছেলেমেয়েকে ফেলে আসে তাই পিতৃবাৎসল্য জেগে ওঠে। ছোট ছোট ছেলেদের দেখলে এরা না খাইয়া সেই বাচ্চাদের খাওয়ায়।
আর একদল-যারা ছোকরাবাজ তারাও এদের পিছনে লাগে। ভাল ভাল জিনিস জোগাড় করে খাওয়ায়। বিড়ি তামাকের অভাব হয় না। জঘন্য লোকগুলো এই ছেলেগুলিকে খারাপ করে ফেলে।
জেলে নয়মাস লুদুর কোনো কষ্ট না হওয়াতে তার মনে ধারণা হলো যে, জেল তো কিছুই না। এখানে আসলে আরামই পাওয়া যায়। সাথে সাথে পেশাদার চোরদের কাছ থেকে অনেক রকমের চুরির ফন্দি সে শিখে নেয় এবং দল সৃষ্টি করে। বাইরে এসে সকলে এক হয়ে চুরি করে। যখন নয় মাস পরে খালাস হলো, তাকে পুলিশের নজরে রাখার জন্য এক বৎসরের হুকুম হলো। প্রতি রাতে ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পুলিশ তাকে ডেকে দেখতো সে ঘরে আছে কিনা।
জেলখানায় আসার আগে কি করে পকেট মারতে হয়, তা সে শিখে এসেছিল। রাতে যখন পুলিশ তার ঘরে পাহারা দেয়, তখন দিনেই পকেট মারা ভাল মনে করলো সে। লুদু পকেট কাটতে শুরু করলো। প্রায় পাঁচ মাস এইভাবে চলল। এই সময় একদিন পুলিশ এসে তাকে থানায় ডেকে নিয়ে বলল, তুই কি করিস সে খবর রাখি; তোকে এবার ধরতে পারলে জেল দেওয়াব তিন বছরের জন্য আর বেতের বাড়ি তোর খেতে হবে। তুই কেন আমার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করিস না। তখন লুদু ভাবল যে থানার সাথে বন্দোবস্ত করলে বিপদ হবে। যখন দারোগা সাহেব বললেন দেখা সাক্ষাৎ কেন করিস না, তখন বুঝতে পারলো যে কিছু দিতে হবে।
একদিন পকেট মেরে বেশ কিছু টাকা পেয়ে লুদু ভাবলো দেখা যাক দারোগা সাহেব কি করেন। বাজার থেকে বড় একটা মাছ, কিছু পটল, কিছু আলু, আর দশটা টাকা নিয়ে দারোগা সাহেবের বাসায় গিয়ে চাকরকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সাহেব বাড়ি আছে কি না? সে উত্তর দিল ঘরে আছে। তাকে বল যে লুদু আসছে দেখা করতে। লুদু-সেই লুফর রহমান লেনের পকেটমার। দারোগা সাহেব বেরিয়ে এসে বললেন, কি জন্য আসছিস, এইগুলি আবার কি? লুদু দেখল, দারোগা সাহেব খুব খুশি হয়েছেন। লুদু বলল, হুজুর সামান্য জিনিস এনেছি, গরিব মানুষ কোথায় পাবো! দারোগা তার চাকরকে বললো এগুলো ভেতরে নিয়ে যাও। দশটা টাকাও লুদু দিল। টাকা পকেটে রেখে দারোগা বললেন, ‘বোধহয় ভাল দান মেরেছ, তা মাত্র দশ টাকা কেন? বেশি কিছু দেও। লুদু বলল, সামান্যই পেয়েছিলাম, আমার দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। মাঝে মাঝে কিছু দেবার চেষ্টা করব। দারোগা সাহেব বললেন, সপ্তাহে কত দিবি বল?’ লুদু বলল, “তা কেমন করে বলব, কিছু মারতে পারলেই আপনার জন্য নিয়ে আসব। দারোগা সাহেব বললেন, “ঠিক আছে, তবে হাওয়ালদার, সিপাহিদের দেওয়ার জন্য সপ্তাহে ১০ টাকা দিবি। আর চুরি করলে, তার কিছু ভাগ আমাকে দিয়ে যাবি। কারণ খবর আমার কাছে আসবে। তোকে আর রাতে ডাকা হবে না, কাজ চালাইয়া যা। দারোগা হাওয়ালদারদেরকে বলে দিল আমাকে আর রাতে ডাকাডাকি না করতে। আমি রাতে চুরি করতাম, আর দিনে পকেট মারতাম। বেশ টাকা পয়সা আমার হাতে আসতে লাগল। জুয়া খেলা, তাড়ি খাওয়াও শুরু করলাম।
‘এইভাবে মাত্র পাঁচ মাস কাটালাম। হঠাৎ একদিন পকেট মারতে যাই রেলওয়ে স্টেশনে। রেলওয়ে যে জিআরপি পুলিশের আন্ডারে একথা আমি তখন জানতাম না। এদেরও যে হাত করতে হয় এ ধারণা আমার ছিল না। আমি পকেট মারতে যেয়ে ধরা পড়ে গেলাম টাকা সমেত। আমাকে জিআরপি অফিসে নিয়ে খুব বানানো হলো। তারপরে বলল, নতুন বুঝি পকেট মারিস, কোনো খবর টবর রাখিস না। একজন পুলিশ এসে আমাকে বলল, “তোর বাড়ি কোথায়? টাকা খরচ করতে পারবি?’ লুদু বলল, কিছু তো পারি। যদি ব্যয় করতে রাজি হইস, তবে তোকে ছাড়াইয়া দিতে পারি দারোগা সাহেবকে বলে। পুলিশটা ১০০ টাকা চাইলো দারোগা সাহেবের জন্য, আর নিজের জন্য পঁচিশ টাকা। লুদু তাকে বললো, “অত টাকা তো ঘরে নাই, তবে ৭০ টাকা দারোগা সাহেবকে দেন, আর আপনি ২০ টাকা নেন। রাজি হলো, আমি আমার ছোট ভাইয়ের ঠিকানা দিয়ে থানার ঐ সিপাহিকে পাঠালাম। সিপাহি আমার ভাইকে নিয়ে হাজির হলো। দারোগা সাহেবকে টাকা দিলে তিনি সিপাহিকে কি যেন বলে বিদায় দিলেন। একটু পরে আমাকে ছেড়ে দিলেন।
এইভাবে জিআরপি পুলিশকে হাত করলাম। রোজ পকেট মারতাম। সকালে স্টেশনে, জিআরপিকে ভাগ দিতাম। আর বিকালে পকেট মারতাম সদরঘাট, তার ভাগ দিতাম কোতওয়ালী থানায়। এইভাবে দুই বৎসর চলল।
এর মধ্যে একটা বাসে পকেট মারতে চেষ্টা করেছি, দেখি এক ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি হাত টান দিয়ে নিয়ে এলাম। ভদ্রলোক আমাকে চোখ ইশারা দিল পকেট মারতে। প্রথম ধকল যখন কেটে গেল তখন আবার পকেট মারলাম। আমি যখন নামলাম ঐ ভদ্রলোকও দুইজন লোক নিয়ে নামল। আমি তাদের নিয়ে এক রেস্টুরেন্টে গেলাম। পকেট মেরে খামের মধ্যে ৭০০ টাকা রেখেছিলাম, আমি হাত সাফাই করে সরাইয়া ছিলাম ৪০০ টাকা, খামের মধ্যে থাকলো ৩০০ শ’ টাকা। লুদু বললো, এই দুই ভদ্রলোক তাকে বলেছিল, এরা সিআইডি। টাকা ভাগ হলো, লুদুর ১০০, আর ওদের ২০০। কথা ঠিক হলো এইভাবে বাসে গাড়িতে পকেট মারবে, আর এরা লুদুকে বাঁচাইয়া দিবে। লুদু যখন পকেট মারত এরা প্রায়ই তার সাথে থাকত। কয়েকবার ধরা পড়েছে, এরা বলে কয়ে ছাড়াইয়া দিয়াছে। মাইরের হাত থেকেও আমাকে অনেকবার রক্ষা করেছে। এভাবে সিআইডি অফিসও আমার হাতে হয়ে গেল। আমি বেপরোয়াভাবে পকেট মারা ও চুরি করা শুরু করলাম। লুদু বলল, এই সময় আমি লোহারপুলের কাছে সূত্রাপুর বাজারে পকেট মারতে চেষ্টা করায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হই। সূত্রাপুর থানায় আমি কিছু দেই নাই, দিলেও বোধহয় উপায় ছিল না। কারণ যাদের হাতে ধরা পড়েছি তারা বাইরের লোক। এই কেসে তিন মাস হাজতখানায় খাটার পর আমার দেড় বছরের জেল হয়।
আমি জেলে এসে এবার ভালই পাকা হলাম। গলার ভিতর ‘খোকড় বা ভাণ্ডার করা শিখলাম। পেশাদার ডাকাত, চোরদের গলায় একপ্রকার গর্ত করা থাকে; এরা গলার ভিতর ডাক্তার দিয়ে অপারেশন করে থােকড় করে। এই খোকড়ে ৫/৭টা মোহর অথবা ৮ থেকে ১০টা গিনি একসাথে রাখা যায়। কাঁচা টাকা প্রায় ৭-৮টা এক সাথে রাখা যায়। এমনকি ১০০ টাকার নোট সিগারেটের কাগজ দিয়ে মুড়ে দুই তিনখানা একসাথে রাখা যায়। না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। এরা টাকা রাখে কারণ, জেলে এসে সিপাহি জমাদারদের টাকা দিয়ে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। এরা গাঁজা, আফিম, চরস সরাব সবকিছু কিনে এনে খায়। এই টাকা খরচ করে জেল কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদেরও মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়।
চোর-ডাকাতকে যখন থানায় থানায় মারপিট করে তখন একখানা গিনি বের করে দিলে আর মার খেতে হয় না। জামিনও পাওয়া যায়। লুদু এই সময় ‘খোকড়’ তৈয়ার করার চেষ্টা করতে লাগল। ‘খোকড়’ দুই রকমের; কাঁচা ও পাকা। কাচা খোকড় বন্ধ হয়, বেশি কিছু রাখা যায় না। গলা টিপলে মাথায় মারলে হঠাৎ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু পাকা খোকড় থেকে চেষ্টা করলেও টাকা বা গিনি বের করা যায় না—যে পর্যন্ত নিজে থেকে বের করে দেয়। লুদু কাঁচা খোকড় করার জন্য গলার ভিতর সীসা গোল করে সুতা বেঁধে গলার মধ্যে রেখে দিত। সুতা দাঁতের সাথে বাধা থাকে, যাতে ভেতরে না চলে যায়। এইভাবে অনেকদিন রাখলে একটা গর্ত হয়। এই গর্তের উপর সোনা রাখতে পারলে আস্তে আস্তে পাকা হয়ে যায়। তা না হলে বাইরে যেয়ে ডাক্তার দ্বারা অপারেশন করে পাকা করা হয়। লুদু কাঁচা খোকড় তৈয়ার করল। এই সময় জেলে ছোকরা নিয়ে ছোরা-মারামারি করায় দশজনকে বদলি করল। এই জেলেই লুদুকে বাকি দিনগুলি খাটতে হলো।
লুদু বলে, এই বার জেল থেকে একবারে পাকা চোর হয়ে ফিরে এলাম। পাকা ‘খোকড়’ করলাম, দলবল খোঁজ করে তিনজন একসাথে হলাম। ঠিক করলাম, ঢাকা শহরে পকেট কেটে বেশি দিন বাইরে থাকা যাবে না। বিদেশেই যেতে হবে। তিনজন এক সাথে হয়ে সিলেট জেলায় গেলাম। সিলেট তখন আসামের ভিতর। লুদু বলল, তারা চামড়ার ব্যাপারী সেজে শ্রীমঙ্গলে এক বাড়িতে আশ্রয় নিল। দুই একটা চামড়া কিনতো, লবণ লাগাতো আর পকেট মারতো। এখানে সেই বাড়িওয়ালার এক মেয়েকে সে বিবাহ করে। কয়েকদিন পরে আবার ধরা পড়ে মৌলভীবাজার জেলে যেতে হলো। মেয়েপক্ষ যখন খবর পেল লুদু একটা দাগী চোর, তখন জেলে গিয়ে তার কাছ থেকে মেয়েটার তালাক নেওয়াইল। এখানে লুদুর ৯ মাস জেল হলো। এরপর আরও কয়েকবার জেল হয়।
১৯৪৯ সালে যখন আমি জেলে তখন লুদুর সাথে আমার পরিচয় হয়। ১৯৫২ সালে লুদু মুক্তি পায়, আবার ১৯৫৩ সালে গ্রেপ্তার হয়। এইবার ওর নয় বৎসর জেল হয়, তিনটা মামলা মিলে। ভালভাবে জেলে থাকলে ৬ বৎসর খেটে বের হতে পারতো।
কিন্তু তার স্বভাব মোটেই পরিবর্তন হয় নাই। খোকড় তার করতেই হবে। বি ক্লাস কয়েদি সকলেই তাকে সমীহ করে চলে। মার যে সে কত খেয়েছে তার সীমা নাই। একদিন বললো, কানে একটু কম শুনি, কারণ অনেক চড় কানে পড়েছে। শরীরের কোনো জায়গাই বাদ নাই মার খেতে।
আমার মনে হতো মার না খেলে লুদুর ভাল লাগে না। কাউকেও সে ভয় করে না, জেলে তাকে সকলেই সমীহ করে চলে। সুপারেনটেনডেন্ট যখন সাত দিনে একদিন ফাইল দেখতে আসে, লুদু সালাম করে দাঁড়াইয়া বলে, আমার নালিশ আছে হুজুর। পূর্বের সুপাররা নাকি বি ক্লাস কয়েদির কথা বেশি শুনতো না। নিয়ামতুল্লা সাহেব সকলের কথা মনযোগ দিয়ে শোনেন। আমি যখন জেলে, একদিন সুপার সাহেবকে আধাঘণ্টা দাঁড়া করে লুদু নালিশ করল। জেলার থেকে শুরু করে সুবেদার, ডাক্তার সকলের বিরুদ্ধেই সে বলল। কিছু কিছু সত্য কথাও বলেছিল। সে জানতো এই নালিশ করার পর তার বিপদ হবে। কিন্তু পরোয়া নাই। কারণ, তাকে রাতে সেলে থাকবার হুকুম দিয়েছে। দিনে সেল এরিয়ার বাইরে যাওয়ার হুকুম নাই। পানি টানে, ঝাড় দেয়, কাজ সে বেশি করে না। তার ইচ্ছা মতো চলে।
আমার বাগানে সে ঝাড় দিতে মাঝে মাঝে; গাছেও মাঝে মাঝে পানি দিত। আমি বললে আপত্তি করত না।
এবার লুদুর কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। সে বলে, ‘আর পকেট মারবো না, ভালভাবে থাকবো’। জেল হলে এখন তার আর ভাল লাগে না। তার স্ত্রীর কথা বলে মাঝে মাঝে দুঃখ করত। কারণ, শাশুড়ি নাকি তার স্ত্রীকে নিয়ে দুইবার তালাকের জন্য এসেছে। লুদু রাজি ছিল, তার স্ত্রী শোনে না, সে তার মাকে বলে দেখেই তো বিয়ে দিয়েছিলে যে ও চোর। তবে এখন কেন তালাক নিতে বল। আমার কপালে যা আছে তাই হবে। ও কতদূর যায় শেষ না দেখে ওকে ছাড়ব না। এই কথা লুদু বলে দুঃখ করে, আর বলে নিজের জন্য দুঃখ নাই, দুঃখ হলো ওর জীবনটা শেষ করে দিলাম। একটা ছেলে ছিল তাও মারা গেছে, ও কী করে থাকবে জানি না।
লুদু জেলের বাহির হয়ে কি করবে জানি না, তবে কথায় বার্তায় মনে হয়, ওর জীবনের উপর একটা ধিক্কার এসেছে।