২১শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ বৃহস্পতিবার
জেল-হাসপাতাল থেকে আজ রাশেদ মোশাররফ ও শাহাবুদ্দিন চৌধুরীকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। তাদের শরীর একটু ভাল। তাদের দশ নং সেলে পাঠান হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা আছে। দোতলা থেকে আমাকে ইশারা করে জানাল তারা আজ চলে যাবে হাসপাতাল থেকে। আমি ওদের দিকে একটু এগিয়ে যেয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম। যখন রওয়ানা হলো আমি একটু এগিয়ে গিয়ে ওদের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটু চিৎকার করে বললাম চিন্তা করিও না, ত্যাগ বৃথা যাবে না। জনগণের দাবি জনগণই আদায় করবে।
তারা আমার কাছে থাকার জন্য কত ব্যস্ত। অন্তত দূর থেকে হলেও আমাকে দেখতে পেত, এখন আর তা-ও হবে না। তাদের চোখে মুখে বেদনার ছাপ আমি দেখতে পেলাম। হাফেজ মুছা এখনও হাসপাতালে আছে। তার শরীরও ভাল না।
ভেবেছিলাম আজ রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখতে আসবে আমাকে। হিসাবে পাওয়া যায় আর রেণুও গত তারিখে দেখা করার সময় বলেছিল, ২০ বা ২১ তারিখে আবার আসব। চারটা থেকে চেয়েছিলাম রাস্তার দিকে। মনে হতেছিল এই বোধহয় আসে খবর। যখন ৫টা বেজে গেল তখন ভাবলাম, না অনুমতি পায় নাই। আমিও ঘর থেকে বের হয়ে স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য হাঁটতে শুরু করলাম। ভীষণ গরমও পড়েছে। কিছু কিছু ব্যায়ামও করা শুরু করেছি। কারণ, রাতে ঘুম হয় না ভালভাবে। সন্ধ্যার পূর্বে কিছু বেগুন গাছ লাগালাম নিজের হাতে।
সৈয়দ শরীফুদ্দিন পীরজাদা নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। ইনি পাকিস্তানের এটর্নি জেনারেল ছিলেন। এডভোকেট হিসেবে যথেষ্ট নাম করেছেন। এই তো শাসনতন্ত্র ! যখন ইচ্ছা মন্ত্রী, যখন ইচ্ছা বিদায়-প্রায় বাদশাহি কায়দায়। অনেক খেলা দেখলাম, আরও কত দেখতে হবে খোদাই জানে।
উত্তর ভিয়েতনাম ঘোষণা করেছে মার্কিন পাইলটদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে বিচার করা হবে না, বিচার করা হবে যুদ্ধ-অপরাধী হিসেবে। অন্যায়ভাবে অন্যের দেশে বোমাবর্ষণ করা-যুদ্ধ ঘোষণা না করে, এর চেয়ে ভাল ব্যবহার আশা করতে পারে কি করে?
বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ঢাকা হাইকোর্টের এক বিশেষ বেঞ্চ সমীপে বিচারাধীন জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও আমার হেবিয়াস করপাস মামলার শুনানি গতকাল শেষ হয়ে গেছে। বিচারপতি উপরোক্ত মামলাগুলির রায় দান স্থগিত রেখেছেন। আবদুস সালাম খান সাহেব ও অন্যান্য এডভোকেটগণ মামলা পরিচালনা করেন।
২২শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ শুক্রবার
রাত্রে এমনিই একটু ঘুম কম হয়। তারপর আজ আবার দুইটা পাগল একসাথে চিষ্কার করতে শুরু করে। একজন পাগল ৪০ সেল থেকে চিৎকার করতে থাকে। সে একটু চুপ করলে আর একজন ঠিক কুকুর, বিড়ালের মতো ডাকতে থাকে। এইভাবে চলতে থাকে। প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল। পরে মশারির ভিতর থেকে হেসে উঠি। কারণ, একজন পাগল সত্য সত্যই একদম কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে পারে। ভোররাতে একটু ঘুম লাগলে আবার শুরু হয় গণনা। জমাদার সাহেবরা গণনা করে দেখে রাত্রে কয়েদিরা ঠিক আছে কিনা। উঠেই পড়লাম বিছানা থেকে উঠেই দেখি, আমার তিনটা মুরগির মধ্যে একটা মুরগির ব্যারাম হয়েছে। দুইটা ডিম দেয়। যে মুরগিটার ব্যারাম হয়েছে, সেটা দুই-চারদিনের মধ্যেই ডিম দিবে। মুরগিটা দেখতে খুব সুন্দর। ওকে ডেকে আমি নিজেই খাবার দিতাম। ওষুধ দেওয়া দরকার। প্রথমে পিঁয়াজের রস, তারপর রসুনের, যে যাহা বলে তাহাই খাওয়াইতে থাকি। দেখলাম, এত অত্যাচার করলে ও শেষ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে পানি, কিছু খাবার খেতে দেই ও মাথা বোয়াইয়া দেই। বিকালের দিকে অবস্থা বেশি ভাল লাগে নাই। কি হয়, বলা যায় না।
মনটা খারাপ করে ছয় সেলের কাছে যেয়ে দাঁড়াই। হঠাৎ দেখি পায়ে ডান্ডাবেড়ি দিয়ে একজন হাঁটাচলা করছে। বললাম, ‘ব্যাপার কি?’ জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে ডান্ডাবেড়ি দিয়েছে কেন?’ বলল, স্যার কোর্টে যেতে হবে, ৫৩ বৎসর জেল দিয়ে দিয়েছে, খাটতে হবে ২৫ বৎসর। আরও ১৯৩টা কেস চলছে। যাকে বলা হয় মুন্সীগঞ্জ ‘গ্যাং কেস। কতদিন জেল হয় খোদায় জানে! জেল থেকে একবার পালাইয়া ছিলাম। তারপর আবার এত বছর জেল, তাই ডান্ডাবেড়ি লাগাইয়া কোর্টে যেতে হয়। বললাম, কেন ডাকাতি করে জীবনটা নষ্ট করলেন? আপনার কে আছে?’ তখন তিনি বলতে শুরু করলেন, মা-বাবা ছোট বয়সে মারা যায়। এক ফুপাতো ভাই ডাকাত ছিলেন। বোধহয় নাম শুনেছেন, মুন্সীগঞ্জের ফেলু ময়াল। আমাকে ফুসলাইয়া ডাকাতি করতে নিয়ে যায়। তখন আমার বয়স অল্প, কিছু টাকাও আমাকে দেয় ডাকাতি করে এনে। তারপর লোভ হয়, তার সাথেই ডাকাতি করা শুরু করি। তাকে ছাড়াও দু’একবার করেছি। মোট ১০-১২টা ডাকাতি করেছি সত্য, আজ বুঝতে পেরেছি কি ভুলই না জীবনে করেছি! আজ সেই ফেলু ময়াল, আমার ফুপাতো ভাই সরকারি সাক্ষী (একরারী) হয়েছে। সাত বৎসর মামলা চলেছে আরও কতকাল চলবে খোদাই জানে। তবে আমার জীবনের আর কি আছে? ৫৩ বৎসর জেল! কনফার্ম করে ২৫ বৎসর খাটতে হবে। এ মামলায়ও কয়েক বৎসর জেল হবে। মানে, জীবন এই জেলের সেলের মধ্যেই কাটাতেই হবে। আমার একটা মেয়ে আছে ও স্ত্রী আছে। আর কি কোনোদিন ওদের কাছে থাকতে পারব। মা-বাবা না মরে গেলে বোধহয় এ পথে আসতে হতো না। জীবনে বহু অন্যায় ও পাপ করেছি। খোদা কি মাফ করবে? চুপ করে আবার বলল, ‘মেয়েটা ও স্ত্রীর কি হবে? কিছু তো আর রেখে আসতে পারি নাই। বাহিরে গেলেও আর উপায় নাই। ডাকাতি না করলেও জেলে আসতে হবে। কারণ, দাগী খাতায় নাম উঠেছে। ডাকাতি হলেই পুলিশ আমাদেরই ধরে আনবে। লোকটির নাম ছোটন। সুগঠিত শরীর, ছোটখাটো লোকটা। অটুট স্বাস্থ্য। মনে হয়, বুলেটও ঢুকবে না ওর শরীরে। কারাগারের এই নিষ্ঠুর ইটের ঘরেই জীবনটা দিতে হবে। তবুও আশা করে পঁচিশ বৎসর খেটে বের হতে পারবে। আবার মুক্ত বাতাস, মুক্ত হাওয়ায় বেড়াতে পারবে। ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করবে। মানুষের আশার শেষ নাই। অনেকে বিশ বৎসর জেল খেটে বের হয়ে যায়। কিন্তু বাইরে যেয়ে বেশিদিন বাঁচে না। এখানে বেশিদিন থাকলে ভিতরে কিছুই থাকে না, শুধু থাকে মানুষের রূপটা।
আজকাল রীতিমত বিকালে বেড়াই। হিসাব করে এক মাইল থেকে দুই মাইল হাঁটি। অল্প জায়গা কত বার হাঁটলে এক মাইল হয় হিসাব করে নিয়েছি, তাই ঘুরে ঘুরে হাঁটি।
২৩শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ শনিবার
সকালে বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিলাম। একজন কয়েদি সেলের দরজায় দাঁড়ায়ে আছে। কি যেন বলতে চায়। সাধারণ কয়েদিদের মধ্যে অনেক বিচক্ষণ লোকও আছে। রাজনীতি সম্বন্ধে সাধারণ জ্ঞানও আছে। এই কয়েদিটি সাংঘাতিক প্রকৃতির। জেলের আইন-টাইন বেশি মানে না। অনেক মারধোর খেয়েছে জীবনে। লেখাপড়া কিছুটা জানে। দু’একটা ইংরেজিও মাঝে মাঝে বলে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলতে চাও? বয়স বেশি না, ২৫-২৬ হবে, তাই ‘তুমি’ বললাম। বলল, আপনি পূর্ব বাংলার কথা বলেন, আর আমাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও বলে থাকেন কিন্তু শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারাই দায়ী না, পূর্ব পাকিস্তানিরাও দায়ী আছে। আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। বললাম, আরও কিছু বলবে? উত্তর দিল, না। বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হলো, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমাদের এই সংগ্রাম নয়; পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ সুখে থাকুক, আমরাও সেটা চাই। তবে, পশ্চিম পাকিস্তানে একদিকে শক্তিশালী শোষক শ্ৰেণী আছে, তাদের সাথে আছে একশ্রেণীর সরকারি কর্মচারী তাহারাই দায়ী। তারাই প্রথম থেকে ষড়যন্ত্র করেছে, ছলে বলে কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে হবে। তাদের সূক্ষ্ম বুদ্ধিও আছে। পূর্ব বাংলার নেতারাও দায়ী অনেকখানি। আমাদের নেতারা ১৯৪৭ সাল থেকে বুঝেও স্বার্থের লোভে সুযোগ দিয়েছে শোষণ করতে বাধা দেয় নাই, প্রতিবাদ করে নাই, যদি বড়কর্তারা বেজার হন! মন্ত্রীত্ব ও চাকরি যদি না থাকে! ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত যারাই এই শোষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকদের খুশি করার জন্য, তাহাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। এদের দিয়েই স্বায়ত্তশাসনের দাবি, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগে বাধা সৃষ্টি করেছে। এরা বুঝেও বুঝতে চাইতো না। এমনকি দু’একজন উর্দু হরফে বাংলা লেখার জন্য প্রচার করে বেড়াতো। যখন নৌ-ঘাটি চট্টগ্রামে চেয়েছি তখন কেবলমাত্র মন্ত্রীত্ব রক্ষা করার জন্যই এরাই বাধা দিয়েছে বেশি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্ৰেণী বুঝলো এবার বোধহয় আর শোষণ করা চলবে না, তখন আবার ষড়যন্ত্র করল সেই লোকগুলিকে দিয়ে-যারা ইলেকশনের পূর্বে হক সাহেবের মাথায় চেপে, আওয়ামী লীগের কাঁধে পা রেখে ইলেকশনে পার হয়ে এসেছে। বৃদ্ধ হক সাহেবকে ব্যবহার করল এরা। যখন দ্বিতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলী শাসনতন্ত্র তৈয়ার করতে শুরু করল, আওয়ামী লীগের সদস্যরা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে ভিতর ও বাহিরে স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে সংগ্রাম শুরু করল, তখন এই বাঙালিদের ভোট দিয়ে আমাদের দাবিকে ভোটে পরাজিত করে নতুন শাসনতন্ত্র গঠন করল। তখনও যদি বাঙালিরা এক হতে পারতাম তাহলে নিশ্চয়ই স্বায়ত্তশাসন দাবি আদায় করতে পারতাম। আজও যে আমাদের ওপর জুলুম হচ্ছে-মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) সাহেব যদি আইয়ুব সাহেবের হাতে মন্ত্রীত্বের লোভে ধরা না দিতেন, তবে অনেকগুলি দাবি আদায় হতো। আজও দেখুন, আওয়ামী লীগ যখন ৬ দফার দাবি তুলল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য তখন এই বাঙালিরাই বেশি বাধা দিতেছে। মোনায়েম খাঁ সাহেব গভর্নর আছেন, কে তাকে তাড়াচ্ছে? তিনি চরম অত্যাচার করে চলেছেন। আমাদের গ্রেপ্তার, ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ, নিউনেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত, তার মালিককে গ্রেপ্তার, নারায়ণগঞ্জ ও তেজগায় গুলি করতে একটুও মনে বাধলো না তার। কাদের গ্রেপ্তার করছে? কাদের গুলি করে হত্যা করা হলো? কে বা কারা শত শত ছাত্রের জীবন নষ্ট করল? তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিশ্চয়ই আসে নাই। যদি এই স্বায়ত্তশাসনের দাবি কৃতকার্যতা লাভ করে, তবে যারা অত্যাচার করল, তাদের ছেলেমেয়ে বংশধররা তার সুবিধা ভোগ করবে কিনা? যারা জীবন দিল তাদের বংশধররাই কি শুধু ভোগ করবে? আমাদের দুঃখের জন্য আমরাই দায়ী বেশি। আমার ঘর থেকে যদি চুরি করতে আমিই সাহায্য করি সামান্য ভাগ পাওয়ার লোভে তবে চোরকে দায়ী করে লাভ কি?
এই সব কথা বলতে বলতে জমাদার চলে এল, আর সিপাহিও এগিয়ে এল। কয়েদিটা তাড়াতাড়ি সেলে চলে গেল। আমি চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থেকে আবার খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলাম।
বিকালে জেলার সাহেব এলে তাকে বললাম, তিনি যেন ১০ সেলের আওয়ামী লীগের লোকদের জন্য এক জায়গায় পাক করার ব্যবস্থা করেন। ১/২ ওয়ার্ডে, সেখানে আরও ডিপিআর আসামি আছে তাদের পাকের বন্দোবস্ত আলাদা করেছে। তারা ডিপিআর-এর বন্দি। ১/২ ওয়ার্ডের রাজবন্দিরা মনে করবে কি? পূর্বে এক জায়গায় পাক হতো। যদি আলাদা পাকের বন্দোবস্ত করতে হয়, তবে যেখানে তাদের রাখা হয়েছে সেখানেই করুন, সেটাই তো আওয়ামী লীগের রাজবন্দিদের দাবি ছিল। তারা তো এক জায়গায় দুই পাক করতে বলে নাই। ১/২ খাতার রাজবন্দিরা নিশ্চয়ই দুঃখ পেয়েছে। মনে করবে, সহকর্মীদের কি করে আলাদা পাক করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে?
জেলার সাহেব বললেন, এটা তো আমি চিন্তা করি নাই। নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। কিন্তু করব কি? জায়গা তো নাই। আপনাদের তো জেল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় রাখা হয় না। ১০ সেলের কাছেও কোনো পাকের বন্দোবস্ত নাই। বললাম, আমাদের কপাল! সকলের চেয়ে খারাপ জায়গায় আওয়ামী লীগারদের রাখা হবে, যেমন আমাকে একলাই থাকতে হবে। কাহাকেও দিবেন না আমার কাছে। জেলার সাহেব চুপ করে থাকলেন। আমি জানি, এদের বলে কোনো লাভ নাই। নীচতার সাথে যুদ্ধ করতে হলে নীচতা দিয়েই করতে হয়, তাহা যখন পারব না তখন নীরবে খোদার ওপর নির্ভর করেই জেলখাটতে হবে। বিদায় নিয়ে জেলার সাহেব চলে গেলেন।
আমার মুরগিটা মারা গেছে। অনেক ওষুধ খাইয়েছি। বেচারার খুব কষ্ট হতেছিল, ভালই হলো। আমার একটু কষ্ট হলো। মুরগিটাকে আমার খুব ভাল লাগত। ওর হাঁটাচলার মধ্যে একটা গাম্ভীর্য ছিল।
২৪শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ রবিবার
আব্বার চিঠি পেলাম আজ সকালে। আমি যখন চিঠি পড়ি একজন কয়েদি পাহারার, লেখাপড়া জানে, জিজ্ঞাসা করল, ‘চিঠি কি আপনার আব্বা লিখেছেন?’ বললাম, হ্যা, তুমি বুঝলে কেমন করে?’ বলল, “দেখলাম লিখেছেন, ‘বাবা খোকা’। বাবা ছাড়া একথা আর কে আপনাকে লেখতে পারে!’ আমি হেসে উঠলাম এবং বললাম, বাবা-মায়ের কাছে আজও আমি ‘খোকা’ই আছি। যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন ততদিনই আমাকে এই বলেই ডাকবেন। যেদিন এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন আর কেহই এ স্নেহের ডাকে আমাকে ডাকবে না। কারণ এ অধিকারই বা কয়জনের আছে! আমার ৪৫ বৎসর বয়স, চুলেও পাক ধরেছে। পাঁচটি ছেলেমেয়ের বাবা আমি, তথাপি আজও আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে বোধহয় সেই ছোট্ট খোকাটি’–এখনও মায়ের ও আব্বার গলা ধরে আদর করি, আমার সাথে যখন দেখা হয়।
আমার বাবা খুব শান্ত প্রকৃতির লোক। সকল সময়ই গাম্ভীর্য নিয়ে থাকেন। তাকে আমরা ভাইবোনরা ছোট্টকালে ভালবাসতাম এবং ভয়ও পেতাম। আমার মা আমাদের না দেখলেই কাঁদতেন। তাঁর মধ্যে আবেগ খুব বেশি। কিন্তু আমার বাবার সহ্যশক্তি অসম্ভব। জীবনে মুখ কালো করতে আমি দেখি নাই। বোধহয় একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম বলে বাবা আমাকেই খুব বেশি স্নেহ করতেন। আব্বা এক জায়গায় লিখেছেন, তোমার গত ১৯/৬/৬৬ এবং ১/৭/৬৬ তারিখের চিঠি দুইখানা গতকাল পাইয়া তোমার কুশল জানিতে পারিলাম। তবে আমাদের জন্য যে সব সময় চিন্তিত থাক তাহাও বেশ বুঝিলাম। কখনও আমাদের জন্য চিন্তা করিবা না, খোদার মর্জিতে আমাদের মতন সুখী লোক বোধহয় নাই; থাকিলেও খুব কম। আমার সহ্যশক্তিও আছে, বিপদে আপদে কখনও বিচলিত হই না, তাহা তোমার ভালভাবে জানা আছে।
বারবার আমার আব্বা ও মা’র কথা মনে পড়তে থাকে। মায়ের সাথে কি আবার দেখা হবে? অনেকক্ষণ খবরের কাগজ ও বই নিয়ে থাকলাম কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারি না, ভালও লাগছে না। অনেকক্ষণ ফুলের বাগানেও কাজ করেছি আজ। মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলি স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম।
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো।
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।‘
দিনের আলো নিভে গেল, আমিও আমার সেই অতি পরিচিত আস্তানায় চলে গেলাম।
২৫শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ সোমবার
শরীরটা খারাপই হয়ে চলেছে। বসে থাকার জন্যই বোধহয় খুবই দুর্বল লাগে। আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাতে জনগণকে অনুরোধ করেছে-যে পর্যন্ত ৬ দফার দাবি আদায় না হয়। যদিও শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে চলেছে আওয়ামী লীগ, তথাপি সরকার অত্যাচার করে চলেছে। গুলি হলো, গ্যাস মারল, শত শত কর্মীকে জেলে দিল, বিচারের নামে প্রহসন করল, কত লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে কে তা বলতে পারে? সরকার নিজেই স্বীকার করেছে ১১ জন মারা গেছে ৭ই জুনের গুলিতে। আমরা পাকিস্তানকে দুইভাগ করতে চাই বলে যারা চিৎকার করছে তারাই পাকিস্তানের ক্ষতি করছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া উচিত। তারা আলাদা হতে চায় না। পাকিস্তান একই থাকবে, যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া হয়। ইংরেজ কত লোককে হত্যা করেছিল কিন্তু দাবাইয়া রাখতে পারে নাই। এই দেশে কত ছেলেকে ফাঁসি দিয়েছিল। অনেকেরই সে কথা মনে আছে-গোপীনাথ সাহা, নির্মল, জীবন ঘোষ, রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, তারকেশ্বর আরও কত লোককে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছিল। তবু আন্দোলন দাবাতে পারে নাই। আন্দোলন আরও জোরে চলেছিল। আমরা যদিও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, তথাপি ইংরেজের অত্যাচারের বিরুদ্ধেই শুরু হয়েছিল ঐ পথ। এমন দিন এসেছিল ইংরেজ সাহেবরা ঘর থেকে বের হতেও ভয় পেত।
আমি জানি আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করে, তাদের উপর অত্যাচার করা কোনো মতেই উচিত হতেছে না। সরকার বলে দিলেই তো পারে, তোমরা রাজনীতি করতে পারবা না। আমরা চিন্তা করে দেখতাম রাজনীতি করব, কি করব না? মার্শাল ল’-এর সময় তো আমরা রাজনীতি করি নাই। চুপচাপ ছিলাম, কারণ রাজনীতি তখন বেআইনী ছিল। আজ দিন যে কিভাবে কেটে গেল আমি জানি না।
২৬শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ মঙ্গলবার
আজ নিশ্চয়ই দেখা। ছেলেমেয়ে নিয়ে রেণু আসবে যদি দয়া করে অনুমতি দেয়। পনের দিনতো হতে চলল, দিন কি কাটতে চায়, বার বার ঘড়ি দেখি কখন চারটা বাজবে। দুপুরটা তো কোনোমতে কাগজ নিয়ে চলে যায়। এত দুর্বল হয়ে পড়েছি যে, হাঁটতে ইচ্ছা আজ আর হয় না। সাড়ে চারটায় আমাকে নিতে আসল সিপাহি সাহেব। একসাথে দুইটা দেখার অনুমতি, আমার কোম্পানির ম্যানেজার ও একাউনটেন্টও এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কিছু আলোচনা করার জন্য। দূর থেকেই ছোট্ট বাচ্চাটা ‘আব্বা, আব্বা করে ডাকতে শুরু করে। এইটাই আমাকে বেশি আঘাত দেয়। দুইজন করে অফিসার পাঠায়। এরা জানে আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা রাজনীতির ধার ধারে না। এদের সাথে আলোচনা ঘর-সংসারের। মা কিছুটা ভাল আছেন, আব্বা খুলনায় গেছেন, আমার ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা কেমন, সংসার কেমন চলছে—অর্থাভাব হবে কি না? উপার্জন কম করি নাই, তবে খরচ করে ফেলেছি। এই সমস্ত ঘরোয়া কথাবার্তা। বেচারা কর্মচারীরা বোধহয় লজ্জাও পায়। কি শুনবে বসে বসে। রেণুকে বললাম, মোটা হয়ে চলেছি, কি যে করি! অনেক খাবার নিয়ে আসে। কি যে করব বুঝি না। রেণু আমার বড় মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব এনেছে, তাই বলতে শুরু করল। আমার মতামত চায়। বললাম, জেল থেকে কি মতামত দেব; আর ও পড়তেছে পড়ক, আইএ, বিএ পাশ করুক। তারপরে দেখা যাবে।’ রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কতদিন যে আমাকে রাখবে কি করে বলব! মনে হয় অনেকদিন এরা আমায় রাখবে। আর আমিও প্রস্তুত হয়ে আছি। বড় কারাগার থেকে ছোট কারাগার, এই তো পার্থক্য।
২৭শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ বুধবার
ছেলেমেয়েরা চলে যাবার পরই আমাকে একটা নোটিশ দেয়া হলো। নোটিশ পাঠাইয়াছেন, এ আহমদ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট-আমার বিচার হবে জেলগেটে। কোর্টে নেওয়া হবে না। এই মামলাটা রমনা থানার ৮০(৪)/৬৬ নম্বরের মামলা। জি. আর, নম্বর ১৮৯৩/৬৬ ইউ. আর, ৪৭ ডিপিআর ১৯৬৫। এই মামলাটা ঢাকায় আমার গ্রেপ্তারের কিছুদিন পূর্বে দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলায় আমাকে জেলা জজ বাহাদুর জামিন দিলে আবার রাতে আমার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে সিলেট পাঠাইয়া দেয়। ডিপিআর-এ গ্রেপ্তার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিনাবিচারে বন্দি করে রেখেও এদের শান্তি নাই। অত্যাচারেরও একটা সীমা থাকে! আটটা মামলা সমানে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করেছে। একজন লোকেরই এই বুদ্ধি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পিছন দরজার রাজনীতিতে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। এই সকল নীচতা দেখে মনটা আমার বিষিয়ে ওঠে। যে জাতের ভিতর এইরকম নীচ প্রকৃতির লোক জন্ম নিতে পারে, তাদের মুক্তি কি কোনোদিন আশা করা যায়!
নোটিশটা আর ২০/২৫ মিনিট পূর্বে পেলে সুবিধা হতো। আমার স্ত্রীর কাছে বলে দিতে পারতাম জহিরুদ্দিন ও অন্যান্য উকিল সাহেবদের আসতে। কাগজপত্র, নকল কত কি প্রয়োজন। এমনি আইবি আজকাল খুবই কৃপণতা করে, দেখা করতে অনুমতি দিতে। মনে করে, জেলে বসে রাজনীতি করি। তাদের বোঝা উচিত আমরা ও ধরনের রাজনীতি করি না। তাহলে তো প্রকাশ্যে ৬ দফার কথা না বলে গোপনে গোপনে কাজ করে যেতাম। আমি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। যদি ঐ পথে কাজ করতে না পারি ছেড়ে দিব রাজনীতি। প্রয়োজন কি! আমরা একলা দেশসেবার মনোপলি নেই নাই। যারা সন্ত্রাসবাদীতে বিশ্বাস করে তারাই একমাত্র রাজনীতি করবে, মাটির তলা থেকে ধাক্কা দেবে সুযোগ পেলেই। আমার কি আসে যায়? বহুদিন রাজনীতি করলাম। এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে আরাম করব। তবে সরকার যেভাবে জুলুম চালাচ্ছে তাতে রাজনীতি কোনদিকে মোড় নেয় বোঝা কষ্টকর।
আজ দিনভরে শুয়েই কাটালাম বেশি। নিজের জন্য আমার বেশি ভাবনা নেই। শুধু দুঃখ হয় এদের অত্যাচারের ধরনটা দেখে। আমার উপর এতো অত্যাচার না করে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেললে সব ল্যাঠা মিটে যেত। শুনলাম, আমার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা সব জায়গাতেই মামলা দায়ের করছে। আমি একা এত মামলা সামলাব কেমন করে? আমি ভাসাইয়া দিয়াছি নিজেকে যাহা হবার হবে। খোদাই আমাকে রক্ষা করেছে জালেমদের হাত থেকে, আর ভবিষ্যতেও করবে।
২৮শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ বৃহস্পতিবার
ভীষণভাবে ব্যাথা শুরু হয়েছে, পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত। বুঝতে পারলাম না, কেন এই ব্যথা। বসতেই পারি না। শুয়ে থাকলে একটু আরাম লাগে। হাঁটতে পারি। হাঁটলে বেশি ব্যথা লাগে না, তবে সোজাভাবে হাঁটতে হয়। দিনভরই শুয়ে থাকতে হয়। সরিষার তেল গরম করে মালিশ করালাম দুইবার। রফিক ছাফাইয়াটা মালিশ ভাল করে। রাতে ঘুমাতে পারি নাই।
২৯শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ শুক্রবার
সারাদিন ব্যথায় কাতর। ডাক্তার ক্যাপ্টেন সামাদ সাহেব এলেন আমাকে দেখতে। খাবার ঔষধ দিলেন, আরও দিলেন মালিশ। বিছানায় পড়ে রইলাম। সন্ধ্যার দিকে কষ্ট করে বের হয়ে বাগানের ভেতর আরাম কেদারায় কিছু সময় বসে আবার শুয়ে পড়লাম। খুবই কষ্ট পেতেছি।
৩০শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ শনিবার
আজ সিভিল সার্জন সাহেব এলেন, ঔষধও দিলেন। ব্যথা একটু কমেছে তবে উঠতে বসতে কষ্ট হয়। সারাদিন তো একলাই আমাকে থাকতে হয়। তারপর আবার শরীর খারাপ। বিকালে বাইরে বসে আছি, দেখি আমাদের অফিস সেক্রেটারি এডভোকেট মোহাম্মদউল্লাহকে নিয়ে চলেছে পুরানা ২০ সেলের এক নম্বর ব্লকে। আমি যেখানে থাকি তার সামনে দিয়েই রাস্তা। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? বুঝতে আমার বাকি রইল না। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের ১৯৫৫ সালে একবার যক্ষ্মা হয়ে মহাখালী টিবি হাসপাতালে ছিলেন প্রায় ৭/৮ মাস। চিকিৎসা করে ভাল হয়েছিলেন। বোধহয় আবার আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এক্স-রে করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে নেওয়া হয়েছিল। রিপোর্ট বোধহয় খারাপ। তাই তাকে ১০ সেল থেকে টিবি ওয়ার্ডে নিয়ে এসেছে। জেলখানার টিবি ওয়ার্ড মানে সেল। ভাল লোকের মাথা খারাপ হয়ে যায় সেলে থাকলে। আর অসুস্থ মানুষের কি হবে সহজেই বুঝতে পারা যায়। কথা বলতে না পারলেও দেখতে পারব, খোঁজখবর নিতে পারব। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের আর্থিক অবস্থা আমার জানা আছে। মহাখালী হাসপাতালে কেবিন নিয়ে থাকতে বহু খরচ। তারপর আবার বাড়ির খরচ। জানি না সরকার মুক্তি দিবে কিনা তাকে! দিন কেটে যায়, আর যাবেও। কোনো কাজেই লাগছি না।
৩১শে জুলাই ১৯৬৬ ॥ রবিবার
সোনার খাঁচায়ও পাখি থাকতে চায় না। বন্দি জীবন পশুপাখিও মানতে চায় না। আমরা মানুষ, আমাদের মানতে কি ইচ্ছা হয়! মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের কথা ভাবতে ভাবতে অনেক কথা আজ মনে পড়ল। যুগে যুগে যারা আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই ক্ষমতা দখলের জন্য করে নাই। একটা নীতি ও আদর্শের জন্যই ত্যাগ স্বীকার করে গেছে। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত বোনকে বিধবা করেছে, কত লোককে হত্যা করা হয়েছে, কত সংসার ধ্বংস হয়েছে। কারণ তো নিশ্চয়ই আছে, যারা এই অত্যাচার করে তারা কিন্তু নিজ স্বার্থের বা গোষ্ঠী স্বার্থের জন্যই করে থাকে। সকলেই তো জানে একদিন মরতে হবে। তবুও মানুষ অন্ধ হয়ে যায় স্বার্থের জন্য। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। পরের ছেলেকে যখন হত্যা করে, নিজের ছেলের কথাটি মনে পড়ে না। মানুষ জাতি স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।
পাকিস্তানের ১৯ বৎসরে যা দেখলাম তা ভাবতেও শিহরিয়া উঠতে হয়। যেই ক্ষমতায় আসে সেই মনে করে সে একলাই দেশের কথা চিন্তা করে, আর সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী আরও কত কি! মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি রেখে অনেক দেশনেতাকে শেষ করে দিয়েছে। তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে, সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কতকাল এই অত্যাচার চলবে কেই বা জানে! এই তো স্বাধীনতা, এই তো মানবাধিকার!
অনেকক্ষণ চিন্তা করলাম বসে বসে। মনে হয়, এ পথ ছেড়ে দেই, এত অত্যাচার নীরবে সহ্য করব কি করে? বিবেক যে দংশন করে। বয়স হয়েছে, শরীর তো খারাপই হতে থাকবে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পারব কি না? মনকে সান্ত্বনা দেই এই কথা ভেবে, আর কতদিনই বা বাঁচব? চলুক না। এই দেশের মানুষের জন্য কিছু যদি নাও করতে পারি, ত্যাগ যে করতে পারলাম এটাই তো শান্তি।
ব্যথাটা অনেক সেরে গেছে। আস্তে আস্তে হাঁটাচলা করতেও আরম্ভ করেছি।