তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মুসলিম লীগ সরকারের জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ বিল
১. জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ প্রশ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ
বাঙলাদেশের মধ্যবিত্তের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু সৃষ্ট জমিদারী প্রথার যোগ খুব ঘনিষ্ঠ। এর কারণ জমিদারী প্রথাই তাদের আর্থিক জীবনের প্রধান ভিত্তি। চাকরী এবং নানা পেশাগত ব্যাপারের ওপর যাদের জীবন মূলতঃ নির্ভরশীল তাদের সাথেও এই প্রথার যোগ কোনদিন বিনষ্ট হয়নি। উপরন্তু অন্যান্য উপায়ে উপার্জিত উদ্বৃত্ত মূলধন বাঙলাদেশের মধ্যবিত্তেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমি ও জমিদারী ক্রয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করেছে। বৃটিশ আমলে আমাদের দেশে শিল্পোন্নয়ন নীতিগতভাবে অবহেলিত হওয়ার ফলে এছাড়া তাদের কোন উপায়ও ছিলো না। এ জন্যেই দেখা যায় যে, বাঙলাদেশে ঊনিশ ও বিশ শতকে মধ্যশ্রেণীর উত্থান ঘটলেও এই মধ্যশ্রেণীর সাথে সামন্ত শোষণ ও সামন্ত অর্থনীতির নাড়ীর যোগ শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থেকেছে।
বাঙলাদেশে জমিদার শ্রেণী এবং অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী মধ্যবিত্তের মধ্যে কতকগুলি ঐতিহাসিক কারণে মুসলমানদের থেকে হিন্দুদের প্রাধান্য অনেক বেশী ছিলো। এর ফলে এখানে জনসংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জমিদার, জোতদার, মহাজনদের মধ্যে এবং বিভিন্ন চাকরী ও ব্যবসা ক্ষেত্রে হিন্দুরাই ছিলো বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ আনুপাতিকভাবে শোষক শ্রেণীর মধ্যে হিন্দুদের এবং শোষিত শ্রেণীর মধ্যে মুসলমানদের ছিলো সম্প্রদায়গত প্রাধান্য। এ জন্যেই বাঙলাদেশের সামন্ত-বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত হিন্দুদের রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেস এবং সেই শ্রেণীর মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের মধ্যে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের প্রশ্নে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। এই পার্থক্যের দরুণ কংগ্রেস জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের থেকে সাধারণভাবে অনেক বেশী বিরোধিতা করে। এ জন্যেই বাঙলাদেশে কংগ্রেসের কর্মসূচীর মধ্যে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের কথা কোনদিনই স্থান পায়নি। তাদের মধ্যে যারা বামপন্থী নামে বিখ্যাত তারাও কোনদিন জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের কোন রকম প্রস্তাব আনেনি। উপরন্তু জমিদারী প্রথা টিকিয়ে রাখা এবং বর্গাচাষীদের ওপর জোতদারী-মহাজনী শোষণকে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগে নেতৃত্বই দিয়েছে। ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনের সময় বিধান পরিষদের কংগ্রেস সদস্যেরা সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বেই কৃষক স্বার্থের বিপক্ষে এবং জমিদারদের স্বার্থের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এ জন্যেই দেখা যায় বাঙলাদেশে কংগ্রেসের প্রভাব ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যেই এক রকম সীমাবদ্ধ ছিলো। নীচু বর্ণের হিন্দু এবং মুসলমানদের সাথে কংগ্রেসের তেমন ঘনিষ্ঠ যোগ কোনদিনই স্থাপিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদ বলেন:
কংগ্রেস যাঁহাদের হাতে আছে তাঁহাদের অধিকাংশই কৃষকদের শোষণের সহিত সংশ্লিষ্ট রহিয়াছেন। এই কারণে কৃষকেরা সর্বদাই কংগ্রেসের লোকদিগকে সন্দেহের চোখে দেখিয়া থাকে। যাহারা ভক্ষক তাহারা যে সহজে রক্ষকও হইয়া উঠিতে পারে একথা কৃষকেরা বিশ্বাস করিতে পারে না। ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনের সময় কংগ্রেসের মনোনীত সভ্যেরা কৃষকের স্বার্থের পক্ষে ভোট না দিয়া জমিদারদের পক্ষে ভোট দিয়াছিলেন। ইহাতে কৃষকেরা কংগ্রেসের উপরে সকল বিশ্বাস হারাইয়া ফেলিয়াছেন। গত নির্বাচনের* ফলাফল হইতে আমরা একথার সত্যতা উপলব্ধি করিতে পারিতেছি। বাংলার কৃষকগণের মধ্যে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরই বিপুল সংখ্যাধিক্য রহিয়াছে। অথচ, কংগ্রেসের নামে একজনও মুসলমান বাংলার আইনসভায় (লেজিসলেটিভ এসেমরীতে) নির্বাচিত হইতে পারেন নাই। যাঁহারা কংগ্রেসী মুসলমান, কিংবা কংগ্রেস ভাবাপন্ন মুসলমান তাঁহারাও কংগ্রেসের নামে নির্বাচিত-প্রার্থী হইতে সাহস করেন নাই। হিন্দুদের মধ্যে অবর্ণ-হিন্দুরাই কৃষক, বর্ণ-হিন্দুরা নয়। এই অবর্ণ-হিন্দুদের মধ্য হইতেও মাত্র চারিজন লোক কংগ্রেসের পক্ষ হইতে বাঙলার লেজিসলেটিভ এসেমরীতে নির্বাচিত হইতে পারিয়াছেন। ইহা হইতে আমরা পরিষ্কার বুঝিতে পারিতেছি যে, বাঙলার কৃষকগণের সহিত কংগ্রেসের যোগাযোগ কত কম।[১]
[* ১৯৩৭ সালের নির্বাণ। –ব. উ.]
কিন্তু কংগ্রেসের মতো মুসলিম লীগও প্রধানতঃ সামন্ত-বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান হলেও কৃষকদের সমর্থনই ছিলো তার রাজনৈতিক শক্তির মূল ভিত্তি। কাজেই কৃষকদের ওপর জমিদারী শোষণ সম্পর্কে কংগ্রেসের মতো উদাসীন থাকা অথবা তার বিরোধিতা করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই নিজেদের শ্রেণীস্বার্থের সাথে কৃষকদের স্বার্থের একটা আপাত সমন্বয় সাধনই ছিলো বাঙলাদেশে মুসলিম লীগ নীতির সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
এই লক্ষ্য অর্জনের দিক থেকে মুসলিম লীগকে খুব বেশী অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি। জমিদার-জোতদার, মহাজনদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের ফলে জোতদার, মহাজন-কৃষক, খাতক শ্রেণী বিরোধকে তারা হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিরোধ হিসেবে উপস্থিত করেছিলো এবং বাঙলাদেশে মুসলমান কৃষকরা মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সর্বত্র সংগঠিত হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো পাঁচ লক্ষে।[২]
মুসলিম রাজনীতির মধ্যে কৃষকদের এই ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে কৃষক স্বার্থকে বাহ্যত কংগ্রেসের মতো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা মুসলিম লীগের দ্বারা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া মুসলিম লীগভুক্ত মুসলমান ছাত্রসমাজ এবং নেতৃত্বের এক অংশের মধ্যে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের স্বপক্ষে যথেষ্ট সমর্থন থাকায় জমিদার-জোতদারদের বিরোধিতা সত্ত্বেও কৃষক সমস্যার আলোচনা কর্মী মহলে ও সভা-সমিতিতে অনেকখানি প্রাধান্য লাভ করতো।
১৯৪০-এর গোড়া থেকেই বাঙলাদেশে মুসলমান যুবকদের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা কিছুটা বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৪৩-এর শেষের দিকে আবুল হাশিম প্রাদেশিক সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় আন্দোলন ক্রমশঃ দানা বাঁধতে থাকে। এর ফলে নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন এই রক্ষণশীল অংশ অল্পদিনের মধ্যেই তাদের পূর্ব কর্তৃত্ব হারায় এবং ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার মধ্যে তারা প্রভাবহীন হয়ে পড়ে।
মুসলিম লীগের মধ্যে এই অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশের উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের জানুয়ারীতে ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল’ (১৯৪৭) এবং ঐ বৎসরই ২১শে এপ্রিল ‘বঙ্গীয় জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’ তৈরী হয়।
২. জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ ও মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের মুখপাত্র প্রাদেশিক সম্পাদক আবুল হাশিম মুসলিম লীগ কাউন্সিলে পেশ করার উদ্দেশ্যে যে খসড়া ম্যানিফেস্টোটি প্রকাশ ও প্রচার করেন তাতে কৃষকদের স্বার্থ সম্পর্কে একটিমাত্র অনুচ্ছেদে বলা হয়:
কৃষকদের অধিকার: কৃষকদের স্বার্থরক্ষা ও সর্বপ্রকার খাজনার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। সর্বপ্রকার অন্যায়মূলক কর উচ্ছেদ করা হবে। রাষ্ট্র সমবায় পদ্ধতিতে চাষ আবাদ করবে এবং কৃষকেরা যাতে তাদের কৃষিজাত দ্রব্যসমূহের ন্যায্যমূল্য লাভ করিতে পারে সেজন্য সমবায় বিক্রয় ব্যবস্থার প্রতি উৎসাহ দান করবে। রাষ্ট্র বিশাল আকারে সেচ পরিকল্পনা গ্রহণ করবে যাতে করে দেশের কোন অঞ্চলে কৃষকেরা চাষ আবাদের উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়।[৩]
এর মধ্যে খাজনা সম্পর্কে ‘সামঞ্জস্য বিধান’ সর্বপ্রকার অন্যায়মূলক কর উচ্ছেদ ইত্যাদির কথা বলা হলেও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু তার কোন উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও এই ম্যানিফেস্টোটি মুসলিম লীগ কাউন্সিলে আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করা সম্ভবপর হয়নি। যাঁরা এর বিরোধিতা করেন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সুহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁদের অন্যতম।[৪]
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশেরও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কে এই অবহেলার মনোভাব সত্ত্বেও ১৯৪৬ সালের পূর্বে বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় মুসলিম লীগকে বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কে প্রতিশ্রুতি দান ও প্রস্তাব পাশ করতে হয়। দক্ষিণপন্থীরা অনেক সময় এই সমস্ত সম্মেলন ও সভা-সমিতিতে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এই প্রস্তাবের কোন খোলাখুলি বিরোধিতা করা সে সময় তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ জেলা লীগ সম্মেলনের প্রস্তাবটি উল্লেখযোগ্য।
১২ই জানুয়ারী, ১৯৪৬, ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ে জেলা লীগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নাজিমুদ্দীন, সুহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানও উপস্থিত ছিলেন। ময়মনসিংহ লীগের এই জেলা সম্মেলন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রচার অভিযানও ছিলো। কারণ এই কেন্দ্রে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করছিলেন মৌলানা শামসুল হক। যে সামান্য কয়েকজন প্রার্থী ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীদেরকে পরাজিত করেন তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন।
এই সম্মেলনে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কে নিম্নলিখিত প্রস্তাব গৃহীত হয়:
এই সম্মিলনীর সুচিন্তিত অভিমত এই যে, যতদিন চিরস্থায়ী জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ না হইবে, ততদিন মুসলিম জনসাধারণের অর্থনৈতিক আজাদী হাসিল হইবে না। বাংলা সরকার পঁচিশ বৎসরের কিস্তিবন্দী অতিরিক্ত ক্ষতি-পূরণ দিয়া জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের যে পরিকল্পনা করিয়াছেন, এই সম্মেলন তার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছে। এই সম্মিলনীর অভিমত এই যে, কিস্তিবন্দীতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ না করিয়া অনতিবিলম্বে সমগ্রভাবে বিনা ক্ষতিপূরণে এই কুপ্রথার উচ্ছেদ সাধন জনসাধারণের স্বার্থের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন।[৫]
এই প্রস্তাব সত্ত্বেও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর গদিনসীন মুসলিম লীগ সরকার তেভাগা আন্দোলনের চাপের মুখে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কে যে বিল প্রণয়ন করে তাতে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পরিবর্তে প্রকৃতপক্ষে প্রচুর ক্ষতিপূরণসহ সরকার কর্তৃক জমিদারী ক্রয়ের বন্দোবস্তই করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বিলটি বঙ্গীয় বিধানসভায় পেশ করার পূর্বেই মুসলিম লীগের প্রগতিশীল মহল তার বিরুদ্ধে সমালোচনায় সোচ্চার হন এবং আবুল হাশিম পরিচালিত ও কাজী মুহম্মদ ইদরিস সম্পাদিত সাপ্তাহিক মিল্লাত-এ এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু লেখালেখি হয়।
৫ই জুলাই, ১৯৪৬, তারিখে ‘জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি’ নামে মিল্লাত-এ একটি সম্পাদকীয়তে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলা হয় :
বাঙলা পল্লীপ্রধান দেশ। নির্মম দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে বাঙলার পল্লীর শিরদাঁড়া ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, তার জীবনীশক্তি নিঃশেষিত হইয়াছে। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ বাঙলার জমিদারী প্রথা। কৃষি-প্রধান দেশের অর্থনৈতিক জীবনে সামন্ত প্রথা যে কি ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করে তাহা কাহারো অজানা নাই। বাঙলার অর্থনৈতিক জীবন হইতে জমিদারী প্রথার এই জগদ্দল পাথর যতদিন না অপসারিত হইবে ততদিন বাঙলার দারিদ্র্যের সমস্যা কিছুতেই মিটিবে না। কারণ কৃষিপ্রধান দেশের দারিদ্র্যের সমস্যা মোটেই শহুরে সমস্যা নয়, ইহা সর্বতোভাবে গ্রাম্য সমস্যা। আর বাঙলার গ্রামের সমস্যা বলিতে তাহাদেরই সমস্যা বুঝায়, যাহাদের মাংসশূন্য, অস্থিচর্মসার ও অনাহারক্লীষ্ট দেহের উপর দিয়া জমিদারী প্রথার নিষ্ঠুর রথচক্র সুদীর্ঘদিন হইতে অত্যন্ত দাপটের সহিত ছুটিয়া চলিয়াছে, যাহারা বুকের রক্ত পানি করিয়াও খাজনার দায় মিটাইতে না পারিয়া পথে পথে হাহাকার করিয়া ফিরিতেছে। সুতরাং বাঙলার মৃতপ্রায় পল্লীকে পুনরায় নবজীবনে উজ্জীবিত করিতে হইলে জমিদারী প্রথার বিলোপ সাধন অপরিহার্য।
জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কে এই বক্তব্যের পর খেসারতের প্রশ্নে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়:
সুতরাং জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির আবশ্যকতা অপরিহার্য কি-না, এ প্রশ্নের শেষ সমাধান হইয়া গিয়াছে। আজ আর এক নূতন প্রশ্ন উঠিয়া-ে জমিদারকে ক্ষতিপূরণ দানের প্রশ্ন। সরকারী দফতরখানা হইতে প্রাপ্ত উপরোক্ত সংবাদ হইতে জানা গেল, বাঙলা সরকার জমিদারকে খেসারত দিয়া জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির চেষ্টায় আছেন। কিন্তু কে কাহাকে ক্ষতিপূরণ দিতেছে, আর কোন্ যুক্তিবলেই বা এই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হইতেছে? বাঙলার জনসাধারণ দীর্ঘদিন হইতে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ দাবী করিয়া আসিতেছে। তাহারা বাঙলার জমিদারী ক্রয় করিবার দাবী কোন দিনেই জানায় নাই। আর উহা ক্রয় করিবার সামর্থও তাহাদের নাই।
বাঙলা সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়া জমিদারী প্রথা বিলোপ সাধনের পরিকল্পনা করিয়া কার্যত বাঙলার মাটির উপর জমিদারদের সার্বভৌম স্বত্ত্ব স্বীকার করিয়া লইয়াছেন।
ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগের প্রগতিশীল মহল এবং সাধারণ কর্মীদের মধ্যে যে কতখানি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো তার প্রমাণ এর ঠিক পরবর্তী সংখ্যা অর্থাৎ ১২ই জুলাইয়ের মিল্লাতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ওপর আর একটি সম্পাদকীয়। ‘জমিদারীর ক্ষতিপূরণ’ শীর্ষক এই সম্পাদকীয়টিতে খেসারত সম্পর্কে বলা হয়:
ফ্লাউড সাহেবের সুপারিশ অনুযায়ী জমিদারের প্রাপ্য নীট আয়ের দশ গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরিকল্পনা যদি বাঙলা সরকার করিয়া থাকেন, তাহা হইলে, বাঙলার জমিদারী প্রথা বিলুপ্তি করার বিনিময়ে সরকারকে অন্যূন ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হইবে। বাঙলার জমিদারদের মোট বাৎসরিক আয় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা, আর তাঁহাদের নীট আয় প্রায় ৮ কোটি টাকা। এই আট কোটি টাকার দশ গুণ তো দিতে হইবেই, উপরন্তু জরীপের জন্য সরকারের তহবিল হইতে প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ করিতে হইবে। এসব ছাড়া সরকারী তহশীল অফিস, কর্মচারীদের বাসস্থান ইত্যাদি তৈরী করিতেও প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়িত হইবে। জমিদারদের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া সরকার এই পরিকল্পনা তৈরী করিয়াছেন বলিয়া জমির উপর জমিদারের সার্বভৌম স্বত্ব স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে। সুতরাং স্বত্ব স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে বলিয়াই জমিদারকে বকেয়া খাজনাও মিটাইয়া দিতে হইবে। অতএব বকেয়া খাজনার খাতে সরকারকে আরো ১৩ কোটি টাকা ব্যয় করিতে হইবে।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত অনিশ্চিত। এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সুদসহ ১০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব সরকার কোন্ সাহসে যে মাথায় তুলিয়া লাইতেছেন, তাহা বাস্তবিকই আমাদের বুদ্ধির অগম্য।
মুসলিম লীগ সরকার প্রস্তাবিত জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ বিল যে কৃষকদের কোনই উপকারে আসবে না, উপরন্তু তাদের দুরবস্থাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে সে সম্পর্কে এতে বলা হয়:
এ দেশের স্বাস্থ্য, সম্পদ ও উন্নতির সহিত কৃষিসমস্যা ও কৃষকের জীবন অবিচ্ছেদ্যরূপে বাঁধা। কৃষি-সমস্যার সমাধান না হইলে বাঙলাদেশ ধ্বংস হইবে। বিনা ক্ষতিপূরণে জমি বাজেয়াফ্ত্ করিয়া কৃষকদের মধ্যে সেই জমি বিলি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা সরকার যতদিন না করিবেন ততদিন সরকারের পক্ষে দেশের গঠনমূলক কাজে হাত দেওয়া ও কৃষি-সমস্যার সমাধান করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ, সরকারের যত বড় হিম্মতই থাকুক না কেন, অর্থ সংগ্রহের ক্ষমতার একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। সুদসহ একশত কোটি টাকা ঋণের পাহাড় মাথায় লইয়া বাঙলা সরকার কৃষকের মঙ্গলের জন্য মাথা ঘামাইবার অবসর পাইবেন, অথবা মাথা ঘামাইবার মত সামর্থ্য তাঁহাদের থাকিবে, এ কথা সুস্থ মস্তিষ্কে যে ব্যক্তি বিশ্বাস করিবে তাহাকে ঠকিতে হইবে।
১০ই জানুয়ারী, ১৯৪৭ ‘জনগণের দাবী’ নামে মিল্লাত-এর অন্য একটি সম্পাদকীয়তে জমিদারদের প্রতি মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে বলা হয়:
সুতরাং খেসারত দেওয়া সম্পর্কে আজ আর নূতন কিছু না বলিয়া শুধু এই কথাটা বলিতে চাই যে, খেসারত দিয়া সরকার জমিদারগণকে শিল্পপতিতে রূপান্তরিত করার যে মতলব করিতেছেন দেশবাসী তাহা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য বলিয়া মনে করে না।
পরবর্তী ৩রা ফেব্রুয়ারীতে যে বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা সেই অধিবেশনেই জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ বিলকে আইনে পরিণত না করে সেটিকে পরীক্ষার জন্যে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর সম্ভাব্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও সম্পাদকীয়টিতে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
শুধু সম্পাদকীয় স্তম্ভেই নয়, মিল্লাত-এ প্রকাশিত অন্যান্য প্রবন্ধের মাধ্যমেও বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের যৌক্তিকতা দিয়ে নানা বক্তব্য উপস্থিত করা হয়। এই সমস্ত প্ৰবন্ধ লেখকদের মধ্যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তৎকালীন প্রচার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ অন্যতম। ‘জমিদারী প্রথা তুলিয়া দিতে আবার ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন কেন?’ নামক প্রবন্ধে খেসারতের অযৌক্তিকতা সম্পর্কে তিনি একটা তথ্যপূর্ণ আলোচনা করেন। *
[* এই প্রবন্ধটি শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরিচালিত এবং আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদ থেকে মিল্লাত-এ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিলো।]
৩. মুসলিম লীগ সরকারের ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’
জমিদারী প্রথা বিলোপের উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমান ২১শে এপ্রিল, ১৯৪৭, ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’ নামে একটি বিল পেশ করেন। তার পূর্বে এ সম্পর্কে মূল প্রস্তাবটি কলকাতা গেজেটে প্রকাশিত হয়। সেই প্রস্তাবে ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে সরকার বলেন:
সরকার কর্তৃক অধিকৃত জমির জন্য জমির মালিকদিগকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে। কৃষকদের মধ্যে জমি বিলি করার উদ্দেশ্যে যাহারা খাজনা পাইয়া থাকেন এরূপ সকল শ্রেণীর লোকের জমি সরকার ক্রয় করিবেন। এতদ্ব্যতীত হাট-বাজার, বেসরকারী বনজঙ্গল, জলাভূমি, মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্র (জলকর) ও বালুচর প্রভৃতি সমস্ত কিছুর স্বত্বই গভর্ণমেন্ট ক্রয় করিবেন। রায়তদের হাতে নির্দিষ্ট পরিমাণের অধিক আবাদী জমি থাকিলে তাহাও সরকার কর্তৃক অধিকৃত হইবে।
ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে কি পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে এবং ক্ষতিপূরণের হার কি হবে সে সম্পর্কে প্রস্তাবে বলা হয়:
(ক) যেখানে নীট আয় ২০০০ টাকার অধিক নহে, সেখানে নীট আয়ের ১৫ গুণ ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদান করা হইবে। (খ) যে ক্ষেত্রে নীট আয় ২০০০ টাকা এর অধিক কিন্তু ৫,০০০ টাকা এর অধিক নহে সে ক্ষেত্রে নীট আয়ের ১২ গুণ ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদান করা হইবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসাবে যাহা প্রদান করা হইবে তাহা ‘ক’-এ বর্ণিত সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অপেক্ষা কোন ক্ষেত্রে কম হইবে না। (গ) যে ক্ষেত্রে নীট আয় ৫,০০০ টাকা এর বেশী, কিন্তু ১০,০০০ টাকা এর অধিক নহে, সে ক্ষেত্রে নীট আয়ের দশ গুণ ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদত্ত হইবে। ‘গ’-এ বর্ণিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ‘খ’-এ বর্ণিত সর্বোচ্চ পূরণের পরিমাণ অপেক্ষা কোন ক্ষেত্রে কম হইবে না। (ঘ) যেখানে নীট আয়ের পরিমাণ ১০,০০০ এর অধিক সেখানে নীট আয় ৮ গুণ ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদত্ত হইবে। এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ‘গ’-এ বর্ণিত সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অপেক্ষা কম হইবে না। অন্যান্য শ্রেণীর সম্পত্তির জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বিত হইবে। হাট ও বাজার, জলকর ও বেসরকারী বনের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আয়ের দশ গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে।
ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে এই প্রস্তাবটিতে আরও বলা হয় যে, নীট আয়ের অর্থ হলো খাজনা, বাঁধবন্দী ও জমি রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে এবং খাজনা আদায়ের জন্যে যে ব্যয় হয় সেই খরচ বাদে আদায়ের যে অংশ থাকে তাই। খাজনা আদায়ের ব্যয় সম্পর্কে রেভিনিউ অফিসারের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে এ কথাও প্রস্তাবটিতে উল্লেখ করা হয়। বর্গাদারের দ্বারা জমি চাষ করার প্রথা উচ্ছেদের ব্যবস্থা অবলম্বন সম্পর্কে বলা হয় যে, বিলটি আইনে পরিণত হলে আইন পাসের পূর্বে যে চাষী কোন নির্দিষ্ট জমি চাষ করে নাই, তার সাথে উক্ত জমির মালিক সেই জমি চাষের জন্যে কোন নোতুন চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে না।
বিলটিতে প্রস্তাবিত সামগ্রিক বিলি-ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়:
জমিদার ও রায়তদের হাতে বিশেষভাবে নির্ধারিত পরিমাণের অতিরিক্ত যে আবাদী জমি আছে, সরকার তাহাও অধিকার করিয়া উহা দরিদ্র কৃষক, জমিহীন শ্রমিক ও বর্গাদারদের মধ্যে বিলি করিবেন। সরকার কর্তৃক জমি ও অন্যান্য জিনিসের স্বত্ব অধিকৃত হইবার পর প্রজারা জমির একমাত্র মালিক হিসাবে সরকারের সহিত সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসিবে। উক্ত প্রজাদের অধিকার ও স্বত্ব সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিতে হইবে। কেবলমাত্র এক শ্রেণীর প্রজা থাকিবে। উক্ত রায়তদের জমির উপর পূর্ণ অধিকার থাকিবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি অপেক্ষা কম পরিমাণ জমির মালিক আসল কৃষকের নিকট একজন রায়ত জমি বিক্রয় করিতে পারিবে। কিন্তু প্রকৃত কৃষক নহে এরূপ লোকের নিকট জমি বিক্রি করা নিষিদ্ধ হইবে। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ভিন্ন অপরের নিকট জমি বিলি করা একেবারে নিষিদ্ধ হইবে। জমি খণ্ড খণ্ড করা সম্পর্কে একটি বিশেষ সীমা নিষিদ্ধ থাকিবে। সমবায় ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকার্য পরিচালনা করিবার জন্য ছোট ছোট জমি খণ্ড একত্রিত করার ব্যবস্থা করা হইবে।
৪. রাজস্ব সচিব ফজলুর রহমানের পরিষদ বক্তৃতা
১৯৪৭ সালের ২১শে এপ্রিল বঙ্গীয় বিধান পরিষদে মুসলিম লীগ সরকারের রাজস্ব সচিব ফজলুল রহমান ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’ পেশ করেন এবং সেই উপলক্ষ্যে বিলটির ওপর একটি ব্যাখ্যামূলক বক্তৃতা দেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং তার বিভিন্ন সংস্কার প্রচেষ্টা সম্পর্কে কতকগুলি সাধারণ মন্তব্যের পর ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে তিনি বলেন:
আমি জানি, কোন কোন মহলে এই বিল সুবিবেচনাপ্রসূত নহে বলিয়া ধারণা করা হইয়াছে। এ সম্পর্কে দুই প্রকার মনোভাব দেখা যায়। একজন এইরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঐতিহাসিক পটভূমিকা ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় জমিদারদের কোনরূপ ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত নহে। অপরপক্ষ বলেন, জমিদারদিগকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। একথা সত্য যে, বৈদেশিক শাসন দৃঢ় করিবার জন্যই জমিদারী প্রথার সৃষ্টি হইয়াছিল, আজ যদি জাতীয় স্বার্থের জন্য ইহার লোপ করিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে ক্ষতিপূরণের জন্য আপত্তি করিবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকিতে পারে না। একথাও বলা হয় যে, জমিদারগণ জমি ও চাষবাসের উন্নতিকল্পে তাঁহাদের দায়িত্ব পালন করেন না। সুতরাং বিনা পরিশ্রমে জমির সম্পদ ভোগ করিবার অধিকারও তাঁদের নাই। কয়েকটি দেশে বিনা ক্ষতিপূরণে সরাসরি জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। আবার কোথাও কোথাও ক্ষতিপূরণের নীতি গৃহীত হইলেও ইহা চলতি বাজারমূল্যের অনেক কম নির্ধারণ করা হইয়াছে। চরমপন্থীগণ মোটামুটি এই সকল যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হন। পক্ষান্তরে জমিদারী প্রথা সমর্থকগণ বলিয়া থাকেন যে, জমীদারী প্রথার মূলে যাহাই থাকুক না কেন, আইনে জমিদারদের এমন কতকগুলি মৌলিক অধিকার দেওয়া হইয়াছে যাহার বলে এতদিন ধরিয়া ভূমিস্বত্ব হস্তান্তরিত হইয়াছে। ফলে মূল মালিকের সহিত সম্পর্ক নির্ধারণ করিতে পারে এরূপ পরিবার খুব কমই আছে। অধিকাংশ জমিদারই পূর্ণ বাজারমূল্যে নিলাম অথবা ব্যক্তিগতভাবে খরিদ করিয়া স্বত্ব পাইয়াছেন। সুতরাং বর্তমান জমিদারগণকে সম্পত্তির পূর্ণ মূল্য না দিয়া জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের আইন করিলে উহা নিতান্ত অন্যায় ও পক্ষপাতমূলক হইবে। আমি পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি, এ সম্পর্কে উভয় পক্ষের চরম মনোভাব কি। কমিশনের অধিকাংশ সভ্যই সাধারণভাবে মোট লাভের দশ গুণ ক্ষতিপূরণ দিবার সুপারিশ করিয়াছেন। সর্বক্ষেত্রে দশ গুণ ক্ষতিপূরণে কাহারও প্রতি অন্যায় হইতে পারে মনে করিয়া স্যার ওয়াল্টার গার্নার ক্ষেত্রবিশেষে উহা শিখিল করিবার কথা বলিয়াছেন। সর্বক্ষেত্রে দশ গুণ ক্ষতিপূরণে শাসনব্যবস্থায় সুবিধা হইতে পারে। কিন্তু ইহাতে সর্বক্ষেত্রে ন্যায় বিচার করা হইবে না। আমি ইহাও বলিতে চাহি যে. গভর্ণমেন্ট সর্বদিক বিবেচনা করিয়া ক্ষতিপূরণের একটি ক্রমিক হারের তালিকা নির্ধারণ করিয়াছেন।[৭]
রাজস্বমন্ত্রী ফজলুর রহমান ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং না দেওয়া এই দুই পক্ষের যুক্তির উল্লেখ করে নিরপেক্ষ ভূমিকার যে ধারণা তাঁর বক্তৃতায় দিতে চেয়েছেন তা রক্ষা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁদের আনীত বিল যে জমিদারদের প্রতিই প্রায় ষোলোআনা পক্ষপাতমূলক সেটা ক্ষয়িষ্ণু জমিদারদেরকে নোতুন আর্থিক জীবন দানের পরিকল্পনার মধ্যেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
ক্ষতিপূরণের টাকা যদি প্রদেশের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধির জন্য লাভজনক পরিকল্পনা কার্যকরী করিবার উদ্দেশ্যে ব্যয় না হয়, তবে দেশে যে আর্থিক দৈন্য আসিয়া পড়িবে তাহাও সরকার বিবেচনা করিয়াছেন। এই বিপদের প্রতি সজাগ হইয়াই গভর্ণমেন্ট জমিদারদের এই ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়াই তাঁহাদের দ্বারা দেশের শিল্প সম্পদ বৃদ্ধির ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বিবেচনা করিতেছেন। এই ব্যাপারে গভর্ণমেন্ট এই সকল শিল্প সংগঠনে জমিদারদিগকে সাহায্য করিবেন মাত্র।[৮]
কাজেই এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, মুসলিম লীগ সরকার কেন্দ্রের থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে জমিদারদেরকে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই ক্ষান্ত না হয়ে তাদের জন্যে শোষণের নোতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। যুক্তিস্বরপ তাঁরা অবশ্য একথা বলতে চেয়েছিলেন যে, জমিদারদের মাধ্যমে এইভাবে ১০০ কোটি টাকা শিল্প খাতে নিয়োগ করা হলে শিল্পোন্নতির দ্বারা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অনেক অগ্রগতি সাধিত হবে। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য যাই হোক এর আসল উদ্দেশ্য ছিলো কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্তদের দেওয়া কর থেকে ১০০ কোটি টাকা খরচ করে বাঙলাদেশের অপদার্থ জমিদারদেরকে শিল্পপতি হিসেবে নোতুন জীবন দান করা। কাজেই বিলটিকে জমীদারী উচ্ছেদ বিল হিসেবে না দেখে ‘জমিদার পুনর্বাসন বিল’ হিসেবে তাকে দেখাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
৫. বিল-এর পরিণতি
২১শে এপ্রিল প্রাদেশিক পরিষদে বিলটি পেশ করার পর অন্যান্যদেরসহ মুসলিম লীগের একাংশের আপত্তি সত্ত্বেও সরকার সেটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠান এবং ১৫ই জুলাই-এর মধ্যে তাঁদেরকে রিপোর্ট দানের নির্দেশ দেওয়া হয়। সিলেক্ট কমিটির এই রিপোর্ট তৈরীর পূর্বেই ৩রা জুন তারিখে ভারতের সর্বশেষ গভর্ণর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ও বাঙলা বিভাগ সম্পর্কে তাঁর রোয়েদাদ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পর ‘বঙ্গীয় জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ত্ব বিল’কে বঙ্গীয় বিধান পরিষদ কর্তৃক আইনে পরিণত করার প্রশ্ন ওঠে না। দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাঙলার নোতুন প্রাদেশিক সরকার পূর্ব বাঙলা বিধান পরিষদে এই সংক্রান্ত একটা নোতুন বিল ১৯৪৮-এর এপ্রিল মাসে পেশ করেন এবং পরে ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারীতে তা আইনে পরিণত হয়।
তথ্যসূত্র
১ মুজফ্ফর আহমদ, কৃষক সমস্যা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী লিমিটেড, ৩য় সংস্করণ, অক্টোবর, ১৯৫৪, পৃ ৩৯।
২ Inside Bengal Muslim League, People’s War, October ২৪, 1945.
৩ Draft Manifesto of the Bengal Provincial Muslim League by Abul asim. P 7.
৪ আবুল হাশিম।
৫ মিল্লাত, ১ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা, ২৫শে জানুয়ারী, ১৯৪৬।
৬ মিল্লাত, ২য় বর্ষ, ১৮তম সংখ্যা, ২৫শে এপ্রিল, ১৯৪৭।
৭ মিল্লাত, ২৫শে এপ্রিল, ১৯৪৭।
৮ পূর্বোক্ত।
৯ মিল্লাত, ৯ই মে, ১৯৪৭।