দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – তেভাগার লড়াই
১. ভাগচাষী
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে সারা ভারতব্যাপী জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের জন্যে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে এবং সরকারী মহলেও এ বিষয়ে গুরুতর চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। এর ফলে বাঙলাদেশের ভাগচাষীদের বিরুদ্ধে জমিদার শ্রেণীর আক্রমণ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সম্ভাবনা থাকায় জমিদাররা যত বেশী সম্ভব জমি খাস দখলে রাখার জন্যে সচেষ্ট হয়। কারণ তাদের খাস দখলে যত বেশী জমি থাকবে ততই তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থপ্রাপ্তির অংক বৃদ্ধি পাবে। এই পর্যায়ে জমি খাস দখলে রাখার জন্য জমিদারদের প্রচেষ্টার দ্বিতীয় কারণ এই ছিলো যে, মজুত করা ফসল চড়া দামে বিক্রি করে যে লাভের সম্ভাবনা সেটা খাজনার মুনাফা থেকে ছিলো বহুগুণে বেশী। কাজেই যত বেশী জমি খাস দখলে থাকবে ততই বেশী ফসল মজুত হবে এবং লাভের অংকও স্ফীত হবে সেই পরিমাণে।
এইভাবে জমিদাররা খাস করার জোর প্রচেষ্টা চালানোর ফলে সারা বাঙলাদেশে ১৯৪৫- ৪৬ সালের দিকে খাজনা ও খাস দখলের মামলা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। কৃষকদের আর্থিক অনটনের সুযোগে অল্প মূল্যে দখলীস্বত্ব কেনার জন্যেও এই সময়ে জমিদাররা তৎপর হয়। বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কৃষকরা জমিতে যে দখলীস্বত্ব লাভ করেছিলো সে স্বত্বও এইভাবে ধীরে ধীরে জমিদারদের কাছে হস্তান্তরিত হতে থাকে।[১]
এ সময় জমিদার-জোতদাররা অনেক খাস জমি পতিত ফেলে রাখছিলো তবু বন্দোবস্ত দিচ্ছিল না। যুদ্ধের সময় পতিত জমিতে ফসল উৎপন্নের অধিকার দিয়ে যে আইন করা হয়েছিলো সে আইনও রদ করা হয়েছিলো। অন্যদিকে যে সমস্ত জমি দুর্ভিক্ষের বছরে কৃষকদের থেকে জোতদারদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছিলো তার কতকাংশ ফেরত দেওয়ার জন্যে অস্থায়ী আইনটিও সরকার তুলে নিয়েছিলেন।[২] এর ফলে জমিদার-জোতদারদেরই ষোল আনা লাভ হয়েছিলো, খাজনা ইচ্ছেমতো বৃদ্ধির ক্ষমতা ও তাদের খাস জমির পরিমাণ দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছিলো এবং কৃষকরা দলে দলে জমির দখলীস্বত্ব হারিয়ে পরিণত হয়েছিলেন অন্যের জমিতে ‘নিছক চাষের মালিক’ ও ক্ষেতমজুরে।
সে সময় বাঙলাদেশে ২০০০ জমিদারের মধ্যে ২১২টি ছিলো খুব বড়ো জমিদার পরিবার। এ ছাড়া সারা প্রদেশে বড় জোতদারদের সংখ্যা ছিলো প্রায় এক লক্ষ।[৩] কিন্তু যারা নিজেরা চাষ আবাদ করে সেই ভাগচাষী, গুলাপ্রজা, ক্ষেতমজুর, ঠিকা বা উঠবন্দী প্রজাদের জমির উপর কোন স্বত্বই ছিলো না। তারা প্রকৃতপক্ষে ছিলো ভূমিহীন। ভারতীয় সংখ্যাতত্ত্ব গবেষণাগারের শ্রীযুক্ত অম্বিকাচরণ ঘোষের হিসাবমতো ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা ১৯৪৪ সালের শেষভাগে শতকরা চল্লিশের ওপর[৪] হলেও তার সত্যিকার সংখ্যা ছিলো শতকরা পঞ্চাশেরও অনেক বেশী।
যে সমস্ত ভূমিহীন কৃষক জোতদারদের জমি চাষ আবাদ করেন তারা মোটামুটি দুই প্রথায় জমির মালিককে খাজনা দেন। এক প্রথা অনুসারে কৃষককে মোট উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক হিসেবে এবং অন্য প্রথা অনুসারে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত পরিমাণ ফসলে জমির খাজনা দিতে হয়। প্রথম নাম আধি, বর্গা বা ভাগচাষ এবং দ্বিতীয় প্রথার নাম টংক, গুলা, সাঁজাভাগ, খাড়াফাগ, মকরাবাগ ইত্যাদি।
এই সমস্ত ভাগচাষী অথবা গুলা প্রজাদের জমিতে কোন দখলী স্বত্ব তো থাকেই না উপরন্তু বহু বৎসর ধরে ক্রমাগত একই জমিতে চাষ আবাদ করে এলেও জোতদার-জমিদাররা তাদেরকে এক বৎসরের বেশি মেয়াদে একসঙ্গে কখনোই জমি চাষের অনুমতি দেয় না। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কৃষককে তারা শুধুমাত্র মৌখিকভাবে চলতি বৎসরের জন্যেই চাষ আবাদের অনুমতি দেয়। সেন্সাস রিপোর্টে এই কৃষকদেরকে প্রজা হিসেবে বর্ণনা করলেও প্রকৃতপক্ষে এবং আইন অনুসারেও তারা কৃষি শ্রমিক ব্যতীত আর কিছুই ছিলো না।
বিঘা প্রতি দু-তিন টাকা খাজনা দিয়ে জমিতে যে ফসল হয় তার অর্ধেক পায় জোতদার। এই অর্ধেক ফসলের জন্যে সে এক পয়সাও খরচা করে না, চাষের সমস্ত খরচই ভাগচাষীর I গড়ে একজন ভাগচাষী প্রায় দশ বিঘা জমি চাষ করে। কাজেই সেই অনুসারে দশ বিঘাকে একটা ইউনিট ধরে ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়ি জেলা কৃষক সমিতির হিসেব[৪] মতো আধিয়ার বা ভাগচাষীর আয়-ব্যয়ের একটা হিসেব নীচে উদাহরণস্বরূপ দেওয়া গেল:
এছাড়া ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর সাপ্তাহিক মিল্লাত-এ প্রকাশিত একটি লেখায় যে হিসাব দেওয়া হয় সেটিও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
ভাগ চাষীরা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জমিওয়ালা কি পরিমাণ লাভ করে, তার একটা মোটামুটি হিসাব এখানে দিতেছি। এক বিঘা জমির ধান্যোৎপাদনের উপযোগী চাষের খরচ বর্তমান অবস্থায় ১৫ টাকা। বীজ ধান্য ৫ টাকা। বাঁধা বন্দীর খরচ ৫ টাকা। ঘাস ইত্যাদি বাছাই ৩ টাকা। কাটাই-মাড়াই ইত্যাদি খরচ ৮ টাকা। সুতরাং এক বিঘা জমির জন্য চাষীকে অন্যূন ৩৫ টাকার মতো খরচ করিতে হয়। অবশ্য ইহা আমাদেরই জেলার হিসাব।*
আমাদের দেশে এক বিঘা জমিতে ৮-১০ মণের বেশী ধান্য ফসল হয় না। ভাগ চাষীরা পায় অর্ধেক ৪-৫ মণ। এর জন্য ৩৫, ৩৬ এমনকি ৪০ টাকা খরচ করিলে সে কি লাভবান হইল? তার উপর গতর খাটুনি ত’ ফাউ। প্রতিপক্ষ জমিওয়ালার কি লাভ হইতেছে এক্ষণে তাহাই দেখা যাক। ভাগরা জমির খাজনা জমিওয়ালা দিয়া থাকে, এক বিঘা জমির খাজনা দুই টাকা তিন টাকার বেশী নহে। সুতরাং জমিওয়ালা ২-৩ টাকা খরচ করিয়া পাইতেছে যেখানে আধা ভাগের বদৌলতে ৪-৫ মণ ধান অর্থাৎ ৪০ টাকার মত সেখানে ভাগরাদার ৩৬ টাকা খরচ করিয়া পাইতেছে তাহাই।[৬]
[* কোন্ জেলা সম্পর্কে বলা হচ্ছে তার কোন উল্লেখ লেখাটির মধ্যে নেই।]
এই সব হিসাব থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, সাধারণ অবস্থায় জমি খাস আবাদ করার থেকে বর্গা দেওয়া জোতদারদের পক্ষে অনেক বেশি লাভজনক। অন্যপক্ষ ভাগচাষীদের অবস্থা কৃষি শ্রমিকদের থেকেও অনেক বেশী খারাপ। এই খারাপ অবস্থা সত্ত্বেও তারা জোতদারের জমিতে ভাগচাষ করতে বাধ্য হয় এজন্যে যে গ্রামে নিজের শ্রম কৃষিকার্যের জন্যে বিক্রি করার বিশেষ কোন সুবিধে নেই। তাছাড়া যেটুকু সুযোগ আছে তার মধ্যেও অনিশ্চয়তা অনেক বেশী। কাজেই জোতদারের শর্তেই জমি চাষ করা ব্যতীত তার কোন উপায় থাকে না, জমির খুঁটিতেই সে ভূমিদাসের মতো বাঁধা। এজন্যেই ফ্লাউড কমিশনের কাছে কৃষকসভা প্রদত্ত মেমোরেন্ডামে বলা হয় যে, জমির মালিকেরা কৃষি শ্রমিক নিযুক্ত করে নিজেদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চাষ আবাদ করার থেকে জমি বর্গা দেওয়াকেই অধিকতর লাভজনক মনে করে।[৭]
গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জোতদাররা মহাজনী কারবার করে এবং মহাজন দুস্থ কৃষকদেরকে ঋণদানের মাধ্যমে তাদের জোতজমি হস্তগত করে চলে। এইভাবে জোতদারী ও মহাজনী কারবার ক্রমাগতভাবে একই লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং তার ফলে কৃষকদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়।
তৎকালীন কৃষকসভা নেতা কৃষ্ণবিনোদ রায় বাঙলাদেশের কয়েকটি এলাকা সফর করে যে রিপোর্ট দেন তাতে সেই সময়কার কৃষক জীবনের একটা চিত্র পাওয়া যায়। জলপাইগুড়ি জেলার একটি এলাকা সম্পর্কে তিনি বলেন:
সরকারী হিসাবে জলপাইগুড়ি একটি বাড়তি জেলা, কাজেই এখানে কৃষকদের অবস্থা সাধারণ নিয়মে ভালো হওয়ারই কথা। গত জুলাই মাসে (১৯৪৬ সাল ব. উ.) জলপাইগুড়িতে গিয়াছিলাম; তখন কিন্তু সেখানকার গরীব কৃষক ও ভাগচাষীরা উপবাসে দিন কাটাইতেছিল। কারণ দেখিবার জন্যে বোদা ও পঞ্চগড় এই দুইটি বাড়তি থানার কয়েকটি গ্রামে যাই। প্রতি গ্রামে গড়ে দুইশত পরিবার। তাহার মধ্যে চার-পাঁচটি পরিবার জোতদার, বারো হইতে পনেরোটি পরিবার স্বচ্ছল চুকানদার (এখানে রায়তকে চুকানদার বলে, ইহাদের পনেরো হইতে বিশ বিঘা জমি আছে)। আর সকলেই গরীব চুকানদার, আধিয়ার ও মজুর। পচাগড় থানায় পানিমাছ পুকরিয়া গ্রামে ঘরে ঘরে গেলাম, প্ৰায় সকলেরই এক অবস্থা। একজনের বাড়ীতে গেলাম। আগে তার অবস্থা মন্দ ছিল না, কিন্তু তেরশ পঞ্চাশ সালের মন্বন্তরের বছরে জমি বেচিয়া তাহাকে পেট চালাইতে হইল; সে ছিল চুকানদার হইল আধিয়ার। আধা ভাগে সংসার চলে না। গত বছর দেড়াবাড়িতে (আষাঢ় মাসে এক মণ ধান কর্জ লইলে পৌষ মাসে দেঢ় মণ শোধ দিতে হয়) কর্জ মিলিয়াছিল। এবার কিন্তু জোতদার মিয়া বিনা বন্ধকে বা কোন সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া না দিলে কর্জ দিতে অস্বীকার করিয়াছে। প্রথমে দুই-একটা পিতল-কাঁসা বন্ধক দিয়া কর্জ মিলিয়াছে; তারপর বন্ধকের নামে আফি মিয়া গরু তিনটি হস্তগত করিয়া বলিয়াছে: ১২ মণ ধান কর্জ দিতে পারি, তবে এক মণ ধানের দাম ১২ টাকা ধরিতে হইবে; ধান শোধের সময় পৌষ মাসে ধানের দর নামিয়া যাইবে, কিন্তু পৌষ মাসের দরে যত ধানের দর ১২ টাকা হয় সেই পরিমাণ ধান দিয়া ঐ ঋণ সুদসহ পরিশোধ করিতে হইবে। নিরুপায় আধিয়ার তাহাতেই রাজী হয়, আফি সিয়া তখনকার মতো তাহাকে তিন মণ ধান দিয়া বিদায় করিয়াছে; সে ধান ফুরাইয়াছে, আর ধান আনিতে গেলে জোতদার টালবাহানা করিয়া বারবার ফিরাইয়া দিয়াছে; আর কোথাও ধান মিলে নাই। সাত দিন সমস্ত পরিবার উপবাসী আছে, তাহার উপর আবার না খাইতে পাইয়া তাহার বোন তিনটি ছেলেমেয়ে লইয়া আসিয়াছে। সে দেখিলাম, নয় জন মানুষ একটি কাঁঠাল কোলে করিয়া বসিয়া আছে – সন্ধ্যার সময় ভুসড়া সমেত সিদ্ধ করিয়া খাইবে আজ সাত দিন পরে। পাশের বাড়ীতে গেলাম। তাহারা খাইতে দিতে না পারিয়া বড় মেয়েটিকে বিক্রয় করিয়াছে; ছেলের মধ্যে বড়টিকে অন্য এক বাড়ীতে পোষাণি দিয়েছে, ছোট দুটি বাচ্চা মায়ের শুকনো বুক চুষিতেছে। কৃষক ও তাহার স্ত্রী সারাদিন অভুক্ত আছে, আগের দিনও তাহারা উপবাস করিয়াছে।[৮]
খুলনা ও চব্বিশ পরগণা সম্পর্কে কৃষ্ণবিনোদ রায় তাঁর রিপোর্টটিতে বলেন:
খুলনা ও চব্বিশ পরগণা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলের আর একটি কাহিনী বলি। এই অঞ্চলে ভাগচাষী ও ক্ষেতমজুরের অবস্থা একেবারে ক্রীতদাসের পর্যায়ে দাঁড়াইয়াছে; জমি খাস করার প্রথা অন্যান্য জায়গা অপেক্ষা এখানে অনেক জঘন্য। খুলনা জেলার কামারখোলা ইউনিয়নের বড় বড় জোতদারের বাড়ীতে প্রকাণ্ড চালাঘর দেখা যায়। কোনো ঘরে ৫০ জন, অন্য কোনো জোতদারের চালাঘরে ১০০ জন লোককে পড়িয়া থাকিতে দেখা যায়। ইহাদের সব জমি, বাড়ী-ঘর পর্যন্ত জোতদারের পেটে গিয়াছে। জোতদারই তখন বলিয়াছে: ‘আপাততঃ আমার বাড়ীতে সপরিবারে আশ্রয় লও।’ তাহারা তেমনই থাকে; সপরিবারে জোতদারের বাড়ীতে তাহারা খাটে, নিজেদের প্রাপ্য ধানে বা কর্জ লইয়া, গাছতলায় বা তালপাতার ঘর বাঁধিয়া সেখানে রাঁধিয়া খায়। তার পরের ইতিহাস খুব ছোট; পারিবারিক জীবনও ভাঙিয়া যায় – লক্ষ্মীশ্রীসম্পন্ন সুখী কৃষকের জীবন ভস্মলোচন জোতদারের চাহনিতে পুড়িয়া ছারখার হইয়া যায় – চালা ঘরে পড়িয়া থাকে ভস্মাবশেষ, ছন্নছাড়া মজুর।
এগুলি বাছাই করা দু-একটি কাহিনী নয়, কোটি কোটি কৃষকের জীবনের ইহাই নিত্যকার ছবি।[৯]
সারা বাঙলাদেশের মধ্যে উত্তর বাঙলাতে জোতদারের অত্যাচার ছিলো সব থেকে নিষ্ঠুর ও সংগঠিত। এই অঞ্চলে একজন জোতদার হাজার হাজার বিঘা জমির মালিক এবং শতকরা ৬০-৭০ জন কৃষক ভূমিহীন কৃষিমজুর অথবা আধিয়ার। এই ভূমিহীন কৃষকরা তাদের জীবিকার জন্যে জোতদারদের ওপরেই সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। চাষের জন্যে জমি জোতদারদের থেকে পেতে হয় এবং প্রয়োজনের সময় ধার-কর্জও তারাই দেয়। চাষের সমস্ত খরচ নিজে বহন করে আধা ভাগে চাষ করে স্বচ্ছলভাবে সংসার চালানো তো দূরের কথা জীবন টিকিয়ে রাখাই কৃষকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাজেই তাকে সারা বৎসরই ঋণের জন্য জোতদারের দ্বারস্থ হতে হয়। জোতদার আধিয়ারদেরকে কোনমতে প্ৰাণে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে অল্প অল্প ধান ঋণ হিসাব দেয় এবং প্রায় ক্ষেত্রেই ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে খাতায় আধিয়ারের নামে হিসাব টুকে রাখে। এইভাবে বৎসরের শেষে ফসল তোলার সময় এলে হিসাব মিলিয়ে দেখা যায় যে, আধিয়ারের আধা ভাগের প্রায় সবটাই ঋণের দায়ে জোতদারের কুক্ষিগত। কাজেই আধিয়ারের শূন্য হাত।
ফসল তোলার মৌসুমে পাওনা আদায়ের উদ্দেশ্যে নিজের খামারে ফসল তুলতে জোতদার তার অধীনস্থ আধিয়ারকে বাধ্য করে। ঋণের বোঝা ছাড়াও আধিয়ারকে জোতদারের খামারে মাড়াই খরচসহ অন্যান্য নানা প্রকার উপরি খরচের বোঝা বইতে হয়। এইসব পাওনার কোন প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতাও আধিয়ারের থাকে না।
এইভাবে সারা বৎসরের হাড় ভাঙ্গা খাটুনীর পরও ফসলের মৌসুমে ভাগ চাষীর হাত শূন্যই থাকে এবং তখনো তারা পূর্বের মতোই ঋণের জন্যে জোতদারের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়। এই সমস্ত সুযোগ নিয়ে জোতদাররা কৃষকদের মেয়েদের ওপরও হামলা করতে ছাড়ে না। শেষে ঋণের বোঝা বাড়তে বাড়তে আধিয়ারের অবস্থা এতই শোচনীয় হয় যে, ভাগচাষ করে পরিবার নিয়ে টিকে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে বাধ্য হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাকে গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র কাজের খোঁজে বের হতে হয়। কিন্তু বাঙলাদেশের কোন অঞ্চলেই রুজি-রোজগারের সে রকম ব্যবস্থা না থাকায় তারা প্রায়ই ভিক্ষুকে পরিণত হয়, তাদের পারিবারিক জীবনও ভেঙে পড়ে।
রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে গ্রাম ছেড়ে এইভাবে নিরুদ্দেশ হওয়াকে বলা হতো ‘ভোটান যাওয়া’। উত্তরাঞ্চলের ভূটান দেশ সম্পর্কে উত্তর বাঙলার কৃষকদের মধ্যে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত ছিলো। এইসব কাহিনীর উপর ভিত্তি করেই তারা ধারণা করত যে, নিরুদ্দেশ ব্যক্তি অথবা পরিবার ভূটানে গিয়েই আশ্রয় নিয়েছে এবং নোতুনভাবে কাজকর্ম ও জীবনযাত্রা শুরু করেছে।[১০]
দিনাজপুর অঞ্চলে এই ধরনের নিরুদ্ধেশ যাত্রার একটা ঘটনা বিবৃত করতে গিয়ে সত্যেন সেন তাঁর ‘গ্রামবাংলার পথে পথে’ নামক বইয়ে উল্লেখ করেছেন:
একজন কৃষক কর্মীর মুখে শুনলাম, তিনি একজন আধিয়ারের চরম দুরবস্থার কথা শুনে তার বাড়ীতে খোঁজ করতে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন, তার কুঁড়ে ঘরটা পড়ে আছে। কিন্তু ঘরে মানুষ নেই। পাড়া-প্রতিবেশীরা বললো, ‘আধাবল্লভ তো নাই, সে আত্রিবেলা কান্তাই মাথাত দিয়ে বনুসের হাত ধরে ভোটান গেছে।’ স্থানীয় কথ্য ভাষায় ‘কান্তাই’ মানে কড়াই, আর “বনুস’ মানে বউ। তার বক্তব্যটা হচ্ছে ‘রাধাবল্লভ কাল রাত্রিবেলা তার কড়াইটা মাথায় নিয়ে বউর হাত ধরে ভূটান চলে গেছে।[১১]
দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের আধিয়ার ও গরীব চাষীদের বিয়ে সম্পর্কেও সত্যেন সেন কয়েকটি জিনিস উল্লেখ করেছেন। অর্থনৈতিক কারণে জোতদার ও সম্পন্ন গৃহস্থদের ঘরের নানান কাজকর্মের জন্যে তারা অনেকেই কয়েকটি করে বিয়ে করে। এতে একাধিক বউয়ের সাথে ঘর করা ছাড়াও অপেক্ষাকৃত অল্প খরচায় সমস্ত কাজকর্ম দেখাশোনার কাজ সম্পন্ন হয়। এজন্য মেয়েদের চাহিদা এই সব অঞ্চলে বেশী। ছেলেদেরকেও তাই বিয়ের সময় অন্যান্য জায়গার তুলনায় উঁচু পণ দিতে হয়। এর ফলে বহু কৃষি শ্রমিক ও যুবক আধিয়ারের পক্ষেই আর বিয়ে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্থানীয় ভাষায় বিবাহে অকৃতকার্য এই যুবকদেরকে বলে ‘ঢ্যানা’।[১২] এদের মধ্যে অনেকেই জোতদারদের বাড়ীতে থেকে ক্ষেতখামারে কাজ করে। বউয়ের অভাবে এই সমস্ত ঢ্যানাদের মন-মেজাজ প্রায়ই বিগড়ে থেকে যাতে কাজের ক্ষতি না হয় তার জন্যে জোতদাররা নিজেদের ঘরে ঘরে দু-একজন করে ‘আন্ধুনী বেটী ছাওয়া’ অর্থাৎ রাধুনী মেয়ে রাখে। বাহ্যতঃ চাকরদের জন্যে খাদ্য পরিবেশন করার কাজে নিযুক্ত হলেও তাদের আসল কাজ হলো তাদের ঢ্যানা চাকরদের কাছে দেহদান করা।[১৩] হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ‘আন্ধুনী বেটী ছাওয়া’ রাখার এই প্রথা রংপুর, দিনাজপুরের জোতদারদের মধ্যে ছিলো খুবই সাধারণ।
১৯৪৬ সালে বাংলাদেশেরই ১৯টি জেলায় যখন তেভাগা, টংক প্রভৃতি আন্দোলন শুরু হয় তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার-জোতদারদের শোষণে এই ছিলো বাঙলাদেশের কৃষকদের, বাঙলাদেশের অন্নদাতাদের, আর্থিক জীবন ও সমাজচিত্র।
২. ভাগচাষীর দাবী
তেভাগা আন্দোলন মূলতঃ ভাগচাষীদের তিন ভাগ ফসলের দুই ভাগ দাবীর আন্দোলন হলেও এই একটি মাত্র ক্ষেত্রেই তাদের দাবী সীমাবদ্ধ ছিলো না। ভাগচাষীদের ওপর জোতদার মহাজনদের শোষণের অন্যান্য দিকগুলিও এই আন্দোলনের আওতাভুক্ত ছিলো এবং সেই সমস্ত শোষণের অবসানের জন্যেও ভাগচাষীরা একই সাথে দাবী তোলেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনে যে দাবীগুলি মূল দাবী হিসেবে উত্থাপিত হয়েছিলো সেগুলি হলো – ১. উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ চাই, ২. জমিতে ভাগচাষীকে দখলীস্বত্ব দিতে হবে, ৩. শতকরা সাড়ে বারো ভাগের বেশী অর্থাৎ মণকরা ধানে পাঁচ সেরের বেশী সুদ নেই, ৪. হরেক রকম আবওয়াবসহ বাজে কোন আদায় নেই, ৫. রসিদ ব্যতীত কোন ভাগ দেওয়া নেই, ৬. আবাদযোগ্য পতিত জমিতে ফসল করতে হবে এবং ৭. জোতদারের পরিবর্তে ভাগচাষীর খামারে ধান তুলতে হবে।[১৪]
এই দাবীগুলির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এই যে, তার মধ্যে জোতদার কর্তৃক চাষে আংশিক ভার বহনের কোন কথা নেই। ভাগচাষী কর্তৃক চাষের ব্যয়ভার বহনের জোতদারী শর্ত উচ্ছেদের প্রশ্ন এইভাবে বস্তুতঃ তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্বের দ্বারা উপেক্ষিত হয়।
(এক) তেভাগার দাবী ১৯৪৬ সালে হঠাৎ উত্থাপিত হয়নি। তারও একটি পূর্ব ইতিহাস আছে। এই দাবী সম্পর্কে নানা আলাপ-আলোচনা প্রস্তাব ইতিপূর্বে হয়েছিলো। কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে ফ্লাউড কমিশনের কাছে যে মেমোরেন্ডাম পেশ করা হয়েছিলো তাতেও জমির ওপর ভাগচাষীর দখলীস্বত্ব এবং উৎপন্ন ফসলের দুইভাগ পাওনার দাবী উত্থাপন করা হয়।[১৫ ফ্লাউড কমিশন এই দাবীকে স্বীকৃতি দিয়ে বাঙলা সরকারের কাছে নিম্নোক্ত মর্মে সুপারিশ পেশ করেন:
১৯২৮ সালের আইনে বর্গাদার সম্পর্কে ঐরূপ বিধান করা ভুল হইয়াছে। … বর্গাদারকে প্রজা বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে; অর্ধেক ভাগের বদলে মালিক তিন ভাগের এক ভাগের বেশী আইনতঃ বর্গাদারদের নিকট হইতে আদায় করিতে পারিবেন না।[১৬]
সুপারিশটি ফজলুল হক মন্ত্রীসভার কাছে পেশ করা হলেও এই ‘কৃষকদরদী নেতা’ তাঁদের নিয়োজিত কমিশনের সুপারিশকে কার্যকর করার কোন ব্যবস্থা না করে বাঙলাদেশের বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে বর্গাপ্রথাকে আধা ভাগের ভিত্তিতেই টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেন। কৃষকদের শ্রেণী শত্রুরা কৃষক উদ্ধারের নামে তাদেরকে রাজনীতিগতভাবে কী প্রকারে বিভ্রান্ত ও শোষণ করে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা পার্টির রাজনীতি তারই একটা উত্তম দৃষ্টান্ত।
কিন্তু সামন্ত-বুর্জোয়া নেতৃত্বের দ্বারা এইভাবে প্রবঞ্চিত হলেও বাঙলাদেশের ভাগচাষী এবং অন্যান্য শোষিত কৃষকরা নিজেদের দাবী-দাওয়া সম্পর্কে নিশ্চেষ্ট না থেকে নোতুনভাবে কৃষকসভার নেতৃত্বে তেভাগার লড়াইকে সংগঠিত করেন। তাঁরা আওয়াজ তোলেন, ‘আধি নাই, তেভাগা চাই’।
(দুই) চাষের জমিতে দখলীস্বত্বের দাবীও কোন নোতুন দাবী ছিলো না। কৃষক সমিতির মেমেরারেন্ডামে ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে বলা হয়:
এই শ্রেণীটির ক্ষেত্রে (ভাগচাষী অথবা বর্গাদার শ্রেণী – ব. উ.) আইন প্রণয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জমির ওপর তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট আইনগত মর্যাদা দান। এটা খুব স্পষ্ট যে, বিপুলসংখ্যক কৃষকদের জমির ওপর ‘কৃষক-স্বত্বাধিকারের’ মর্যাদা দেওয়াও হচ্ছে আসল কাজ এবং সাম্প্রতিককালে যেখানেই কোন চাষী আর্থিক চাপের ফলে জমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বর্গাদারে পরিণত হয়েছেন সেখানেই তাঁকে পূর্ব মর্যাদা ফিরে পাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।[১৭]
পঞ্চাশের মন্বন্তরের পরে লক্ষ লক্ষ কৃষক নিজেদের জমি থেকে দেনার দায়ে উৎখাত হয়ে গিয়েছিলেন এবং ক্রমাগত বহু বৎসর ধরে একই জমিতে একটানা চাষ করা সত্ত্বেও ভাগচাষীদের কোন দখলীস্বত্ব জমির ওপর ছিলো না। প্রতি বৎসর মৌখিকভাবে জোতদার মাত্র চলতি বৎসরের জন্যেই তার জমিতে চাষের অনুমতি দিতো। এর ফলে বহুদিন একই জমিতে চাষ আবাদ করলেও ভাগচাষীর জীবনে কোন নিশ্চয়তা ছিলো না। জোতদার তার ওপর যে হাজারো রকম নির্যাতন চালাতো এবং হাজারো রকম বাজে দাবী ওঠাতো তার প্রতিবাদ করলে বা দিতে রাজী না হলে জমি থেকে তাকে সঙ্গে সঙ্গে উৎখাত করে দেওয়া হতো।
তেভাগা আন্দোলনের সময় এর বিরুদ্ধেও আওয়াজ ওঠে এবং ভাগচাষীরা জমিতে ভাগচাষীকে দখলীস্বত্বদানের দাবী তোলেন।
(তিন) কৃষকদের ওপর মহাজনী অত্যাচারের সীমা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ১৯১৮, ১৯৩৪, ১৯৩৬ এবং ১৯৪০ সালে আইন প্রণীত হয়। ১৯১৮ সালের সুদী কর্জ আইন (Usurious Loans Act) অনুসারে আদালতকে ক্ষমতা দেওয়া হয় যে কোন ক্ষেত্রে মহাজনের সুদের দাবী অন্যায় ও অতিরিক্ত মনে হলে তারা তা কমিয়ে দিতে পারবেন। ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় মহাজনী আইনে (Bengal Money Lenders Act) সুদের হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং স্থির হয় যে, আসলের থেকে বেশী পরিমাণ সুদ আদালতের মাধ্যমে আদায় করা চলবে না। ১৯৩৬ সালের বঙ্গীয় চাষী খাতক আইন (Bengal Agricultiral Debtors Act) অনুসারে সরকারের মনোনীত স্থানীয় মাতব্বরদের ওপর ঋণ সম্পর্কে সালিশ করার ভার দেওয়া হয় এবং আদালতের মামলা-মোকদ্দমার ডিক্রী জারী মুলতুবী রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয় ঋণ সালিশী বোর্ডকে। ডিক্রীর টাকা কমাবার অথবা নিলাম রদ করার কোন ক্ষমতা এই আইনের ছিল না। ১৯৪০ সালের বঙ্গীয় মহাজনী আইন ( Bengal Money Lenders Act) এবং ১৯৪২ সালে চাষী খাতক আইন সংশোধনের মাধ্যমে কৃষকদেরকে কয়েকটি সুবিধা ও অধিকার দেওয়া হয়। এই সব আইনগুলি পাস হওয়ার পর মহাজনের সুদের হার অনেকখানি কমানোর ব্যবস্থা হয়, টাকা আদায়ের ব্যবস্থা সম্পর্কে মহাজনের অবাধ অধিকার কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয় এবং টাকা পরিশোধের সুবিধা আগের থেকে বেশী দেওয়া হয়।[১৮]
কিন্তু এসব আইনগত অধিকার বাস্তবক্ষেত্রে ভাগচাষীসহ বৃহত্তর কৃষক সমাজের অবস্থার মধ্যে বিশেষ কোন পরিবর্তন আনতে পারে না। এর প্রধান কারণ ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে জোতদার মহাজন এবং কৃষকদের অবস্থান। মহাজনরা ঋণ না দিয়ে কিছুকাল বসে থাকতে পারে কিন্তু ভাগচাষীর ঋণ ব্যতীত চলার উপায় নেই এবং এই ঋণের জন্যে জোতদার-মহাজনের ওপর তারা পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। কাজেই আইনের ক্ষেত্রে কাগজপত্রে যাই থাকে বাস্তব ক্ষেত্রে লেনদেনের সময় কৃষকরা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই জোতদার মহাজনের কব্জাগত।
ভাগচাষীরা যে ঋণ নেন বিপুল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হলো ‘ধান কর্জ’ অর্থাৎ নিজেদের পরিশ্রমে উৎপন্ন ফসল চড়া সুদে জোতদার মহাজনের থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া। এই ঋণ ব্যতীত কৃষকদের আর কোন পথ নেই। ফ্লাউড কমিশনের কাছে কৃষকসভা স্বল্প মেয়াদী সরকারী এজেন্সী মারফত ঋণদানের প্রস্তাব[১৯] করলেও সেই ধরনের ঋণদানের কোন ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। যেটুকু ব্যবস্থা তারা পূর্বে সমবায় সমিতি আইন এবং গ্রাম উন্নতি আইনের মাধ্যমে করেছিলেন তাও যুদ্ধোত্তর অর্থ সংকটের ফলে সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। সমবায় ব্যাংকগুলি ভেঙ্গে পড়ার ফলে একদিকে সেখান থেকে সামান্যতম ঋণ লাভেরও কোন সুবিধা থাকে না, অন্যদিকে সমবায় সমিতির পূর্বের ঋণ কৃষকদেরকে ঠিকমতোই পরিশোধ করতে হয়। এই ঋণ শোধের তাগিদে কৃষকের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়ে, কারণ সমবায় ঋণ, ঋণ সালিসী বোর্ড এবং মহাজনী আইনের আওতাভুক্ত ছিলো না। পঞ্চাশের মন্বন্তরের পর সরকার কিছু কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিলো নিতান্তই সামান্য।[২০]
এসব কারণেই জোতদার মহাজনদের মহাজনী ব্যবসার শিকার না হয়ে কৃষকদের কোন গত্যন্তর ছিলো না এবং কৃষকদের এই দুর্বলতার সুযোগে নিজেদের বন্ধকী ব্যবস্থা ও কৃষকের জমি আত্মসাৎ অবাধ রাখার কোন অসুবিধে তাদের হতো না।
দান কর্জায় যে কয়েকটি প্রথায় জোতদার-মহাজনেরা সুদ আদায় করতো তার মধ্যে দেড়া বাড়ি, দুনো বাড়ি, এবং দর কাটা বা করালী প্রথা প্রধান। দেড়া বাড়ি অনুসারে আষাঢ় মাসে এক মণ ধান কর্জা নিলে পৌষ মাসে দেড় মণ দিয়ে তা শোধ করতে হয়। দুনো বাড়ি অনুসারে দেড় মণের স্থানে দিতে হয় দ্বিগুণ অর্থাৎ দুই মণ। দরকাটা প্রথায় কর্জ দেওয়ার সময় ধানের খুব বেশী দাম ধরা হয় এবং ঐ দামের যত টাকা পাওনা হয় তত টাকার ধান ঋণ পরিশোধ করার সময় ভাগচাষীকে দিতে হয়।[২১]
এইভাবে ভাগচাষী আধি এবং ঋণের ভারে একদিকে যেমন নিঃস্ব ও জর্জরিত হয় তেমনি অন্যদিকে জোতদার-মহাজনেরা জমি বর্গা দিয়ে এবং বন্ধকী ও সুদী কারবারের মাধ্যমে ভাগচাষীদেরকে নিষ্ঠুরভাবে শোষণ করে নিজের আর্থিক সঙ্গতি ও জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
ভাগচাষীদের ওপর এই সংগঠিত শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তেভাগা আন্দোলনের দাবী ছিলো প্রতি ইউনিয়নে সরকারী ধানের গোলা ( Grain Bank) স্থাপন এবং শতকরা সাড়ে বারো অর্থাৎ মণপ্রতি পাঁচ সের ধানের বেশী সুদ বেআইনী করা।
(চার) আধি এবং সুদের নির্যাতন ছাড়া বেআইনী আদায় বা নানা ধরনের আবওয়াবের মাধ্যমে জোতদাররা ভাগচাষীদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত নিঙড়ে নিতো। কোন আইন-কানুনের মধ্যেই এ ধরনের আদায়ের কোন ব্যবস্থা না থাকায় তা পুরোদস্তুর জোরজবরদস্তির মাধ্যমেই ভাগচাষীদের থেকে আদায় হতো। এই বেআইনী আদায় পুরুষানুক্রমে ঊনিশ শতকের গোড়া থেকেই চলে আসার ফলে জোতদার-জমিদাররা একে তাদের অধিকার হিসেবেই বিবেচনা করে এবং নিত্যনোতুন আদায়ের দ্বারা নিজেদের উদর পূর্তি করে। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় বিধান পরিষদে ও তার পর ফ্লাউড কমিশনের কাছে এ বিষয়ে অনেক বিতর্ক এবং আলোচনা হয় কিন্তু জমিদার-জোতদারদের এই বেআইনী আদায় বন্ধ করা কোনক্রইে সম্ভব হয় না।
কৃষ্ণবিনোদ রায় ১৯৪৬ সালে প্রচলিত আবওয়াবের মধ্যে এগারোটির কথা উল্লেখ করেছেন।[২২] জোতদার গদীতে বসলে তাকে গদী সেলামী দিতে হবে, জোতদারের ছেলের পড়ার খরচ বাবদ তাকে ধান দিতে হবে, অগ্রহায়ণ মাসে নোতুন ধান উঠলে জোতদার নিজের আত্মীয়স্বজনকে বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করবে তার জন্যে ধান দিতে হবে। আধাভাগ ও ঋণ শোধের ওপর এইভাবে গদী সেলামী, ছেলে পড়ানী, মাছ খাওয়ানী, করালী, খলিয়ান বাড়ানি ইত্যাদি আবওয়াব দেওয়ার পর কৃষক হয় নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত।
এই জন্যেই আবওয়াবের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তারা আওয়াজ তোলেন আবওয়াবকে বেআইনী ঘোষণা ও অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে, কোন রকম বাজে আদায় করতে জোতদারকে আর দেওয়া হবে না।
(পাঁচ) ভাগচাষীদের আর এক বিপদ এই যে ফসল ভাগের সময় আধা ভাগ জোতদারকে দেওয়ার পরও তারা ভাগচাষীকে কোন রসিদ দিতো না। কোন লিখিত কাগজপত্র বা রেকর্ডের অভাবে জোতদাররা অনেক সময় অধীনস্থ ভাগচাষীদের থেকে অতিরিক্ত আদায়ের চেষ্টা করতো। সেজন্যে তেভাগা আন্দোলনের সময়ে তারা দাবী তোলেন যে, লিখিত রসিদ না দিলে জোতদারকে তার আধা ভাগ দেওয়া হবে না। ভাগ নিয়ে তাদেরকে পাকা রসিদ দিতে হবে।
(ছয়) জমিদাররা নিজের পয়সা খরচ করে জমির কোন উন্নতি কোন সময়ে করতে চায় না একথা বৃটিশ ভারতীয় সরকারের ঊনিশ শতকীয় মুখপাত্রেরা থেকে কৃষক আন্দোলনের কর্মীরা সকলেই স্বীকার করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অপদার্থ জমিদার-জোতদাররা শুধু কৃষকের শ্রমের ফল ভোগ করারই মালিক, জমির উন্নতির কোন দায়দায়িত্ব তাদের নেই। কাজেই বাঙলাদেশের মতো জমির অভাবগ্রস্ত এলাকাতেও পতিত জমির উন্নতি ও আবাদের দিকে তাদের কোন লক্ষ্য কোনদিন থাকেনি। অথচ তেভাগা আন্দোলনের সময় বাঙলাদেশে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ছিলো ৪২ লক্ষ একর।[২৩] এজন্যেই তেভাগা আন্দোলনে কৃষকদের অন্যতম দাবী ছিলো পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করে তাতে ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা।
(সাত) ফসল তোলার মৌসুমে জোতদাররা সব সময়েই ভাগচাষীদেরকে উৎপন্ন ফসল তাদের নিজেদের খামারে তুলতে বাধ্য করতো। এই ব্যবস্থার ফলে ভাগচাষীদের থেকে অনেক অন্যায় আদায় এবং গোলমাল করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো। এজন্যেই তেভাগা আন্দোলনে ভাগচাষীদের অন্যতম প্রধান দাবী ছিলো জোতদারদের খামারের পরিবর্তে ফসল তাদের নিজের খামারে তুলতে হবে।
এই সাতটি দাবী ছাড়া ভাগচাষীদের যে অন্য কোন দাবী ছিল না তা নয়। স্থানীয় অবস্থা ভেদে অনেক রকমের দাবীই সে সময় ভাগচাষী এবং তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে অন্যান্য কৃষকরাও তুলেছিলেন।
উপরে উল্লিখিত দাবীগুলোর ভিত্তিতে কৃষকরা সে সময় যে ধ্বনি তুলেছিলেন তা হলো : ‘নিজ খামারে ধান তোল’, ‘আধি নাই তেভাগা চাই’, ‘রশিদ বিনা ভাগ নাই’, ‘পাঁচ সেরের বেশী সুদ নাই’, ‘বাজে কোন আদায় নাই’, ‘দখল রেখে চাষ করো’, ‘পতিত জমিতে ফসল করো’।[২৪]
বাঙলাদেশের ঊনিশটি জেলাতে এই ধ্বনি তুলে ভাগচাষীসহ অন্যান্য নির্যাতিত কৃষকরা তেভাগার লড়াই সংগঠিত ও পরিচালনা করেন।
আধি ছাড়াও ফসলের খাজনা দেওয়ার অন্য একটা প্রথা বাঙলাদেশের অনেক জেলায় প্রচলিত ছিলো। এই প্রথা অনুসারে ফসল হোক অথবা না হোক কৃষককে বিঘা প্রতি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল জোতদারের ঘরে পৌছে দিতে হবে। ময়মনসিংহ জেলায় এই প্রথার নাম ছিলো টংক। কিন্তু অন্যান্য জেলায়ও তা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিলো। মেদিনীপুরে এর নাম সাঁজা, চট্টগ্রামে এর নাম মকরা বাগা। কোথাও এর নাম সইয়া, ধানী খাজনা, চুক্তি বর্গা, খাড়াভাগ অথবা গুলা।
১৯৪০ সালের পূর্বে ময়মনসিংহে টংক প্রথা অনুসারে একর প্রতি ৭ মণ থেকে ১৫ মণ ধান দিতে হতো। কিন্তু ১৯৪০-এ নেত্রকোণায় কয়েকটি থানায় এই প্রথার বিরুদ্ধে কৃষক সংগ্রামের ফলে পরিমাণ একর প্রতি ৯ মণ নির্দিষ্ট হয়।[২৫
আধি প্রথায় যে সমস্ত দোষ আছে তার সবগুলিই টংক, গুলা, মকরাবাগা ইত্যাদি প্ৰথায় বর্তমান। উপরন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল খাজনা দেওয়ার শর্ত থাকায় ফসল না হলেও কৃষক তা জোতদারকে দিতে বাধ্য। যদি কোন বৎসর একেবারে ফসল না হওয়ার জন্যে কৃষক খাজনা দিতে না পারেন, তা হলে সেই ফসল উচ্চহারে সুদসহ পরের বৎসর পরিশোধ করতে হয়। এদিক দিয়ে টংক, গুলা প্রভৃতি প্রথা আধির থেকেও অনেক বেশী নির্যাতনমূলক।
এজন্যে তেভাগা আন্দোলনের সময়ই ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নদীয়া এবং মেদিনীপুর জেলায় টংক, গুলা, সাঁজা, খাড়াভাগ, মকরবাগা ইত্যাদি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের সময় কৃষকরা ধ্বনি তোলেন: ধানী খাজনা দেবো না, চলতি হারে টাকায় খাজনা দেবো; জমি থেকে উচ্ছেদ করা চলবে না; সেলামীসহ অন্যান্য বাজে আদায় বন্ধ করতে হবে।[২৬]
৩. তেভাগার লড়াইয়ের সাংগঠনিক চরিত্র
বাঙলাদেশে আধিয়ার, ভাগচাষী অথবা বর্গাদারের তেভাগা আন্দোলন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার নেতৃত্বেই সংগঠিত ও পরিচালিত হয়। আধা ভাগের পরিবর্তে তেভাগার দাবীতে কৃষকদের এই আন্দোলন শুরু হলেও অগ্রগতির সাথে সাথে দাবীর বৈচিত্র এবং সর্বস্তরের কৃষকদের মধ্যে বিস্তৃতির দিক থেকে তা অনেকখানি ব্যাপক আকার ধারণ করে। আধি, টংক প্রভৃতি প্রথা থেকে হাট তোলা, ইজারাদারী প্রভৃতি সব রকম নির্যাতনের বিরুদ্ধেই কৃষকরা সর্বত্র সংগঠিত হতে থাকেন। নিছক অর্থনৈতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এই আন্দোলনকে একটা রাজনৈতিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কৃষকসভার পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয়। আন্দোলনের পুরোগামী কৃষক কর্মীরাও একথা ভালোভাবেই বোঝেন যে, তাঁদের সব রকম আন্দোলনের মূল কথা হলো জমি দখলের লড়াই। জমির ওপর যতদিন পর্যন্ত না তাঁরা নিজেদের একটা স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তাঁদের ওপর জমিদারী-জোতদারী-মহাজনী অত্যাচারের শেষ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সেই জন্যেই তেভাগা আন্দোলনের সময় তাঁরা উচ্চকণ্ঠে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের দাবী তোলেন। কৃষকসভার পক্ষ থেকেও এই আন্দোলনের সময় বলা হয় যে, কৃষকের জমির লড়াইয়ের সাথে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কাজেই কৃষকের জমির লড়াই বস্তুতঃপক্ষে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, যে সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষে নিজের অবস্থানকে নিশ্চিত করার জন্যেই কৃষকদের থেকে জমি কেড়ে জমিদারদেরকে তা দান করেছিলো। কাজেই জমিদারদের হাত থেকে জমি কেড়ে নিজেদের হাতে আনার জন্যে কৃষকদের সংগ্রাম সামন্তবাদ এবং তার রক্ষক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এ সংগ্রাম বস্তুতঃপক্ষে স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ মর্মে আহ্বান জানিয়ে কৃষকসভার পক্ষ থেকে বলা হয়:
সুতরাং গ্রামের সমাজজীবনে ও অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ যে শিকড় গাড়িয়াছে তাহা উপড়াইয়া ফেলিতে হইবে। গ্রামের জমিদার-জোতদার ও সাম্রাজ্যবাদী প্রতিনিধিদের দুর্নীতির রাজত্বের অবসান করিতে হইবে। তাহারই জন্য যে সংগ্রাম, তাহাই সামন্ততান্ত্রিক শোষণ হইতে কৃষককে মুক্ত করিবে, জমিদারী প্রথা ধ্বংস করিয়া কৃষককে জমি দিবে, সাম্রাজ্যবাদী শাসন ধ্বংস করিয়া সমগ্র দেশবাসীকে দিবে মুক্তি ও নবজীবন, গড়িয়া উঠিবে মিলিত হিন্দু-মুসলমান বাঙালীর স্বাধীন সুখী নোতুন বাঙলাদেশ। হাজার হাজার গ্রামে ধানের ক্ষেতে তেভাগার যে অপূর্ব লড়াই চলিয়াছে, টংক ও জমি হইতে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হইয়াছে, জমিদারী ধ্বংস করার জন্য যে গণ-অভ্যুত্থান জাগিয়ে উঠিতেছে, তাহা কৃষি বিপ্লবেরই সূচনা, স্বাধীনতার চরম সংগ্রামের প্রারম্ভ মাত্র![২৭]
‘আগে স্বাধীনতা লাভ কর, তারপর জমিদারী উচ্ছেদ’ এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে বলা হয়:
আমলাতন্ত্র ও জমিদারী – একটিকে অপর হইতে বিচ্ছিন্ন করা যায় না; জমিদারী মজুতদারী বাঁচাইয়া রাখিয়া সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করা যায় না।
আজ বাংলার গ্রামে গ্রামে ফসল রক্ষার লড়াইতে কৃষকরা যে চেতনা লইয়া পুলিশের সহিত লড়িতেছে, মিলিটারীর আঘাত প্রতিহত করার কথা ভাবিতেছে, – সে চেতনা স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ লড়াইয়ের দৃঢ় প্রেরণা। কৃষক-মজুর মধ্যবিত্তের ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতার লড়াই গ্রামে জমিদার-জোতদার-মজুতদারের বিরুদ্ধে, শহরে বিদেশী মূলধনের বিরুদ্ধে ও ধনিকের অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে![২৮]
দিল্লীতে ১৯৪৭-এর প্রথম দিকে যখন কংগ্রেস লীগ সরকার বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোষ আলোচনায় ব্যস্ত তখন ভারতবর্ষের শ্রমিক কৃষক ও বিপ্লবী মধ্যবিত্তের সাম্রাজ্যবাদের আর্থিক বুনিয়াদের ওপর আঘাতের পর আঘাত হেনে দেশময় ধর্মঘট ও জমি দখলের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এই লড়াইকে মিলিতভাবে তার পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কৃষক সভার আহ্বান ছিল:
তাই গ্রামে যে লড়াই চলিতেছে তাহা চরম কৃষিবিপ্লবের সূচনা, কারখানায় ও অফিসে যে ধর্মঘট চলিয়াছে তাহা চূড়ান্ত সাধারণ ধর্মঘটের প্রস্তুতি, সারা দেশে যে বিপ্লবের বান ডাকিয়াছে তাহা স্বাধীনতার শেষ সংগ্রামের আহ্বান।
সাম্রাজ্যবাদ যখন রাষ্ট্রগঠন-পরিষদের মায়াজাল রচনা করিয়া দিল্লীতে বসিয়া এদেশে সাম্রাজ্য কায়েম করিবার সুখস্বপ্ন দেখিতেছে এবং নেতৃবৃন্দ যখন আপোষ ও বিভেদের পথে চলিতেছে, কৃষক-মজুর ও মধ্যবিত্ত জনসাধারণ তখন সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুর পরোয়ানা স্বাক্ষর করিতেছে। বিপ্লবী ছাত্র ও মহিলারাও মজুর শ্রেণীর সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের এই লড়াইয়ের সমর্থনে আগাইয়া আসিয়াছেন। আসুন সকলে মিলিয়া শেষবারের মতো সাম্রাজ্যবাদের বুকে চরম আঘাত হানি, সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসস্তূপের উপর কৃষক-মজুর- মধ্যবিত্তের নোতুন বাঙলা গড়িয়া তুলি।[২৯]
তেভাগা আন্দোলন ছিলো জোতদার এবং তাদের সহায়ক ও রক্ষক পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কৃষকদের সশস্ত্র লড়াই। আধির পরিবর্তে তেভাগা যতই যুক্তিপূর্ণ হোক জোতদাররা তাদের স্বার্থ ছেড়ে দিতে মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। উপরন্তু নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে তারা কৃষকদের ওপর সশস্ত্র হামলার পথই সর্বক্ষেত্রে বেছে নেয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে কৃষকরাও লাঠি, কাস্তে, হাতুড়ি, কুড়াল, শাবল ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য জিনিসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে তাঁদের বিরুদ্ধে জোতদারদের হামলাকে সংগঠিত এবং সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধের জন্যে এগিয়ে যান। এর জন্যে তাঁরা কৃষকদের সশস্ত্র ভলান্টিয়ার বাহিনীও গড়ে তোলেন।
ধান কাটার মৌসুমে সংগঠিত ও সশস্ত্র থাকার প্রয়োজনীয়তা সব থেকে বেশী দেখা দেয়। এজন্য কৃষকসভা নির্দেশ দেয় যে, কোন ভাগচাষী যেন পৃথকভাবে নিজের ধান না কাটেন। প্রত্যেক জমিতেই দলবদ্ধভাবে ও শৃঙ্খলার সাথে অল্প সময়ের মধ্যে তাদেরকে ধান কেটে নিজ নিজ খামারে তোলার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। এই সঙ্ঘবদ্ধতার জন্যে জোতদারের ইচ্ছে ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষকদের ওপর হামলা করা তাদের পক্ষে খুবই কঠিন হতো।
এ ক্ষেত্রে কৃষকসভার আর একটি নির্দেশ ছিলো এই যে, কোথাও কোন বিপদের আভাস পেলে যে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাছে যা অস্ত্র পাওয়া যায় তাই নিয়ে তারা যেন ঘটনাস্থলে হাজির হন।[৩০]
কৃষকদেরকে কৃষক আন্দোলন ও সাংগঠনিক ধারা এবং পদ্ধতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কৃষকসভা ব্যাপকভাবে ছোট ছোট ঘরোয়া আলোচনার ব্যবস্থা করতো। যেখানেই কৃষকসভা বা কৃষক সমিতির সংগঠন গড়ে উঠতো সেখানেই তাদেরকে নিজেদের শ্রেণীগত চরিত্র ও দাবী এবং সাধারণভাবে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলার চেষ্টা হতো। ‘সংগঠন ও সংগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষা আর শিক্ষার মাধ্যমে সংগঠন ও সংগ্রাম’ এই ছিল সেদিন কৃষকসভার ধ্বনি।[৩১]
৪. লড়াইয়ের কয়েকটি খণ্ডচিত্র
(ক) তেভাগা আন্দোলনের গোড়ার দিকে রংপুর জেলার ডিমলা থানার খগাখড়িবাড়ী গ্রামে কৃষকদের সাথে জোতদারদের যে সংঘর্ষ হয় তার মধ্যে জোতদার-পুলিশ আঁতাত এবং কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের এক সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে।[৩০]
এই এলাকায় কৃষক সমিতির মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিলো যে, এর পর থেকে জোতদারের খামারে ভাগচাষীরা আর ধান তুলবেন না। সে ধান তারা নিজেদের খামারে তুলবেন এবং জোতদারকে আধির বদলে দেবেন তেভাগা। জোতদাররা এ খবর জানলেও কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মুখে সরাসরি কোন হামলা করার ক্ষমতা তাদের ছিলো না। তাই ফসল কাটার মৌসুমে যখন কৃষকরা দলবদ্ধভাবে ধান কাটা শুরু করলো তখন তারা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখলো কিন্তু সরাসরি হামলার পথে এলো না। এই সময় স্থানীয় কৃষকসভার কর্মীদের অনেকের নামেই হুলিয়া ছিলো। তাঁরা একদিকে গ্রেফতার এবং অন্যদিকে জোতদারদের পোষা গুণ্ডাদের হামলা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আত্মগোপন করে থাকছিলেন। কিন্তু সেই অবস্থাতেও কৃষকদের সাথে মেলামেশা এবং আলাপ-আলোচনার কোন বাধা তাঁদের ছিলো না। স্থানীয় কৃষকরা নিজেদের নেতাদেরকে আপনজনের মতোই রক্ষা করে চলতেন। তাঁদের বিপদ-আপদ সম্পর্কে সর্বদাই হুঁশিয়ার থাকতেন।
এই সমস্ত কারণে জোতদাররা* কৃষকদের দলবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা না করলেও অন্যান্য উপায়ে আক্রমণের জন্য তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো। এভাবেই তারা একদিন কৃষকদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে বসলো।
[* এই জোতদারদের নেতা ছিলো মশিউর রহমান (যাদু)। তার সরাসরি নেতৃত্বেই জোতদাররা]
কৃষকদের ওপর এই হামলা চালায়। কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত স্বাধীনতা পত্রিকায় এই ঘটনার পূর্ণ বিবরণ প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। – ব. উ.।
সেদিন সন্ধ্যের একটু আগে জোতদাররা পাঁচটা বন্দুকসহ তাদের দালাল ও গুণ্ডাদেরকে নিয়ে কৃষকদের পাড়ার মধ্যে ঢুকে অতর্কিতে এলোপাথাড়িভাবে গুলী চালাতে শুরু করলো। তাঁদের এই অতর্কিত আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো পাল্টা আক্রমণের থেকে রক্ষা পাওয়া এবং কৃষকদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করে তাদের মনোবল সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দেওয়া।
বন্দুকের গুলিতে প্রথমেই নিহত হন স্থানীয় কৃষক কর্মী তগনারায়ণ।* গুলি খেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে যান। জোতদাররা মনে করেছিলো একজন কৃষক এইভাবে নিহত হওয়ার পর কৃষকদের মনোবল ভেঙে পড়বে, তারা পিছু হটে চতুর্দিকে ছুটে পালাবে। কিন্তু তা হলো না। তগনারায়ণের মৃত্যু তার অন্যান্য কৃষকভাইদের মধ্যে জ্বালিয়ে দিলো প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধের আগুন। তাঁরা সকলে বন্দুকের গুলী উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বন্ধুকধারী জোতদার এবং তাদের দালাল ও গুণ্ডাদের ওপর। এদের সকলের সামনে ছিলেন বাচ্চাই মামুদ। অনেকগুলি গুলী এসে তার দেহে বিদ্ধ হলো। তাঁর সাথে আরো দশ-পনেরোজন কৃষক জখম হয়ে পড়ে গেলেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও কৃষকদের মনোবল ভাঙলো না, তাঁদেরকে তারা হটাতে পারলো না। গুলীর মুখেও কৃষকদের বেপরোয়া অগ্রগতি দেখে জোতদাররা ভয় পেয়ে গেলো, প্রমাদ গুণলো। এবার শুরু হলো তাদের পশ্চাদপসরণ এবং পালানোর পালা। বিদ্যুৎগতিতে তারা পিছন ফিরে উধাও হলো। জোতদাররা পালিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পৌছালো। পুলিশের এই দ্রুত উপস্থিতি সকলের মধ্যেই বিস্ময়ের সৃষ্টি করলো কারণ থানা গ্রাম থেকে অনেক দূরে। এত তাড়াতাড়ি তাদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া সাধারণ অবস্থায় সম্ভব ছিলো না। কিন্তু বিস্ময় তাদের কেটে গেল। তারা বুঝলেন যে, থানার সাথে যোগসাজশ করেই জোতদাররা কৃষকদের ওপর এই অতর্কিত এবং নৃশংস হামলা চালিয়েছিলো। যোগসাজশের পরিচয় পুলিশরা নিজেরাই দিলো। কৃষকদের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও তারা শহীদ তগনারায়ণের মৃতদেহ তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও কমরেডদের থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো।
[* সত্যেন সেন, গ্রাম বাঙলার পথে পথে, বইয়ে তগনারায়ণের নাম ভুলবশতঃ তন্নারায়ণ লিখেছেন। – ব. উ.]
তগনারায়ণের হত্যা এবং কৃষকদের ওপর জোতদার ও পুলিশের মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে সারা অঞ্চলে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো এবং গ্রামে গ্রামে আওয়াজ উঠলো: ‘তগনারায়ণ হত্যার প্রতিশোধ চাই’। কৃষকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে মনোবল ভেঙে দেওয়ার যে চক্রান্ত জোতদাররা করেছিলো তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। শ্রেণীশত্রুদের বিরুদ্ধে কৃষকরা নোতুন চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হলেন।
ঘটনার পরদিন তগনারায়ণ হত্যার প্রতিবাদে সমগ্র এলাকা জুড়ে এক মিছিল বের করা হলো। এই মিছিলে কৃষকদের সাথে সকল শ্রেণীর শ্রমজীবী – কামার, কুমার, জেলে, মুচী, জোলা সকলে যোগদান করে তাকে পরিণত করলেন ঐ অঞ্চলের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ মিছিলে। মিছিল নানা জায়গা ঘুরে শহীদ তগনারায়ণের গ্রাম খগাখড়িবাড়ীতে এসে থামলো। জোতদারদের বাড়ীর সামনে সভা করে তারা আওয়াজ তুললেন: তগনারায়ণ হত্যার প্রতিশোধ চাই, আধির বদলে তেভাগা চাই, জোতদারী প্রথা ধ্বংস হোক।
সভায় শহীদ তগনারায়ণের নামে সকলে শপথ গ্রহণ করলেন যে, তাঁদের শ্রেণীশত্রু জোতদারদের কাছে তাঁরা কেউ কোন জিনিস বিক্রি করবেন না, তাদেরকে সবাই একঘরে এবং কোণঠাসা করবেন। সভায় এইমর্মে তারা অপর একটি প্রস্তাব নিলেন যে, খুনী জোতদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকে তারা শুধু খগাখড়িবাড়ী বা ডিমলা থানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে ছড়িয়ে দিবেন সারা নীলফামারী মহকুমায়, রংপুর জেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।
এই সভার পরদিন স্থানীয় কৃষকসভার উদ্যোগে তাঁরা একটি বিরাট মিছিল নিয়ে আটাশ মাইল দূরে নীলফামারী শহরে যান এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ অন্যান্য বিপত্তিকে কাটিয়ে উঠে সেখানকার অধিবাসীদের কাছে জোতদারদের নির্যাতন ও কৃষক প্রতিরোধের কথা ছড়িয়ে দেন।
(খ) খাঁপুর দিনাজপুর জেলার পতিরাম থানার অন্তর্গত। অন্যান্য জেলার মতো ১৯৪৬ সালে খাঁপুরের ভাগচাষীরাও আধা বর্গার পরিবর্তে নিজেদের এলাকায় তেভাগা চালু করেন। জোতদাররা এর বিরুদ্ধে হামলার উদ্যোগ নিলেও কৃষকসভার লাঠিয়াল ভলান্টিয়ারদের সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত শক্তির সামনে তারা সরাসরি কোন আক্রমণ কৃষকদের ওপর চালাতে পারে নাই। কৃষকরা মিলিতভাবে ধান কাটার সময় আওয়াজ তোলেন: জান দেবো তো ধান দেবো না।
খাঁপুর তেভাগা আন্দোলনের একটা শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার ফলে জোতদাররা তো বটেই এমনকি তাদের রক্ষক সরকারী পুলিশ বাহিনীও প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের সেই এলাকায় ঢুকে কৃষকদের ওপর কোন নির্যাতন চালাতে সাহস করতো না।
এই অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন কৃষ্ণদাস সামন্ত। কিন্তু তিনি ছাড়া অন্যান্য অনেকেই এই এলাকায় কৃষকসভার পক্ষ থেকে কৃষকদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাদের সকলকেই সে সময় পুলিশ ও জোতদারদের আক্রমণ এড়িয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ চালাতে হচ্ছিলো। এলাকাটিতে পুলিশ প্রকাশ্যভাবে প্রবেশ করতে না পারলেও তাদের গোয়েন্দারা সর্বদাই এই আত্মগোপনকারী নেতাদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করতো।
একদিন এই গোয়েন্দাদের খবরের ওপর ভিত্তি করে একদল পুলিশ রাত্রিকালে নিজেদের ভ্যানে চড়ে খাঁপুরে এসে হাজির হলো এবং গাড়ীটি দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে অতি সন্তর্পণে তারা স্থানীয় প্রভাবশালী কৃষকনেতা নীলকণ্ঠ দাসের বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নীলকণ্ঠকে পুলিশ অনেকদিন থেকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছিলো কিন্তু তিনি সুকৌশলে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলছিলেন। নীলকণ্ঠ ছিলেন দরিদ্র চাষী। তার কুঁড়ে ঘরের দরজায় বুটের লাথি মেরে পুলিশ বন্ধ দরজা ভেঙে ফেললো। কিন্তু ঘরের মধ্যে ঢুকে তারা নীলকণ্ঠকে পেলো না। নীলকণ্ঠ রাত্রিতে নিজের ঘরে ছিলেন না। কিন্তু গৃহস্বামীর এই অনুপস্থিতি তাঁর স্ত্রী ও মাকে পুলিশী নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলো না। নীলকণ্ঠের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাঁকে প্রবলভাবে মারধোর করা সত্ত্বেও নীলকণ্ঠের খবর তাঁর থেকে বের করা গেলো না। এই ব্যর্থতায় মরীয়া হয়ে এবং নলীকণ্ঠের মায়ের চীৎকারে কৃষকদের জেগে ওঠা এবং প্রতিশোধের আশংকায় তারা নীলকণ্ঠের স্ত্রীকে চুলের মুঠি ধরে মাটির ওপর দিয়ে টানতে টানতে নিজেদের গাড়ীর দিকে নিয়ে যেতে থাকলো। তার চীৎকার বন্ধ করার জন্য পুলিশরা তাঁকে বুটের লাথি মারতে মারতে অজ্ঞান করে দিলে, তাঁর পরনের শাড়ীও খুলে পড়লো।
ইতিমধ্যে নীলকণ্ঠের মায়ের চীৎকারে গ্রামের অনেকেরই ঘুম ভেঙে গেল। নগেন বৰ্মণ নামে স্থানীয় কৃষকসভার একজন জঙ্গী কর্মীও এই সময় বাইরে বেরিয়ে এলেন এবং নলীকণ্ঠের স্ত্রীকে পুলিশ এইভাবে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তুলে কৃষকদেরকে আহ্বান জানালেন।* তার এই সংকেত ধ্বনিতে ঘুমন্ত কৃষকরা জেগে উঠে দলে দলে বেরিয়ে এলেন এবং অতি দ্রুতগতিতে সমস্ত এলাকাটি এক রণক্ষেত্রের আকার ধারণ করলো। চারিদিকে জ্বলে উঠলো অসংখ্য মশাল।
[* ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-এর অর্থ বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। – ব. উ.]
এই অবস্থায় নীলকণ্ঠের স্ত্রীর মৃতপ্রায় নগ্নদেহটিকে টানতে টানতে দৌড় দিয়ে পুলিশ নিজেদের গাড়ীর কাছে হাজির হলো। কৃষকরা তাদের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে তীর বর্ষণ করতে শুরু করলেন। তীরের ভয়ে তারা অনেকেই গাড়ীর মধ্যে ঢুকে পড়লো কিন্তু পুলিশ ইন্সপেক্টর ভেতরে ঢোকার পূর্বেই একটি তীর গিয়ে তার কুঁচকিতে বিদ্ধ হলো। এই গুরুতর আঘাতের ফলে বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে তার উপায় রইলো না। মরীয়া হয়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্যে সে পুলিশদেরকে নির্দেশ দিলো বাইরে এসে কৃষকদের ওপর গুলীবর্ষণ করতে। সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলধারী পুলিশরা গাড়ী থেকে বের হয়ে এসে সারিবদ্ধভাবে বসে কৃষকদের ওপর শুরু করলো অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ। এর ফলে বহু কৃষক হতাহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। কিন্তু তবু পুলিসের ওপর আক্রমণ তাঁদের থামলো না।
এই সময় চেয়ার সাই নামক একজন মধ্যবয়স্ক কৃষক অসীম বীরত্বের সাথে গুলিকে উপেক্ষা করে এসে পুলিশ-ভ্যানের চাকা অকেজো করে দেওয়ার জন্যে শাবল দিয়ে তাতে আঘাত শুরু করেন। এই শব্দ শুনে তাঁকে তারা গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে কাছেই নিজের বাড়ীর উঠোনে পড়ে যান। ‘পানি পানি’ বলে চীৎকার করায় তাঁর ছোট মেয়ে তাড়াতাড়ি বাটিতে করে তার জন্যে পানি আনে কিন্তু সে পানি মুখে দেওয়ার পূর্বেই পুলিশ এসে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চেয়ার সাইকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পানি খাওয়া তাঁর পক্ষে আর হয়ে ওঠে না।
অন্যান্য আহতরাও ‘পানি পানি’ বলে চীৎকার করছিলেন কিন্তু গুলির জন্যে কৃষকরা তাঁদের দিকে আর এগিয়ে যেতে সাহস করছিলেন না। পুলিশ সেদিনকার হতাহতদেরকে সেখানে ফেলে না রেখে তাদের সকলকেই নিজেদের গাড়ীতে তুলে নিয়ে উধাও হয়।
সরকারী হিসেব মতে খাঁপুরের লড়াইয়ের নিহতের সংখ্যা ছিলো এগারোজন। কিন্তু খাঁপুরের জনগণের হিসেবে সেদিন পুলিশের গুলী এবং পরবর্তী নির্যাতনে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা ছিলো ছাব্বিশ। গ্রামের এই ছাব্বিশজন মানুষ আর কোনদিন গ্রামে ফিরে আসেননি। তাঁদের মধ্যে অনেকে ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং অন্যান্য আহতদেরকে তারা হাসপাতালে না দিয়ে পুলিশ ভ্যানের মধ্যেই পিটিয়ে মেরে ফেলে।[৩৩]
(গ) শৈলেন ঘোষ ও ধীরেন ভট্টাচার্য ছিলো খুলনা জেলার শোভনা ইউনিয়নের দু’জন বড়ো জমিদার। সেখানকার বিল অঞ্চলের জমিগুলিকে খাস দখলে আনার জন্যে তারা বেশ কিছুদিন থেকে চেষ্টা চালাচ্ছিলো। এই উদ্দেশ্যে তারা অবলম্বন করেছিলো একটা নোতুন কৌশল।
শোভনার বিল অঞ্চলে সমুদ্রের লোনাপানি ঢোকার জন্যে ধান জন্মাতো না। এর ফলে বিস্তৃত এলাকার জমি অনাবাদী পড়ে থাকতো। কৃষকরা নিজেদের পরিশ্রমে বাঁধ দিয়ে লোনাপানি আটকাবার উদ্যোগ কয়েকবার নিয়েছিলেন কিন্তু জমিদারদের প্রবল বিরোধিতায় সেটা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে জমিদারদের বিরোধিতার কোন আইনসঙ্গত অধিকার ছিলো না, কিন্তু তবু নিজেদের লাঠিয়ালদের জোরে তারা এ ব্যাপারে নিজেদের হুকুম রাখতে সমর্থ হয়েছিলো।
লোনা পানির কবল থেকে জমিকে রক্ষা করে তাতে আবাদ করা এবং ফসল ফলানোর বিরুদ্ধে জমিদারদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো সেই বিল এলাকার সমস্ত জমি কৃষকদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে নিজেদের খাস দখলভুক্ত করা। লোনা পানির জন্যে জমিতে ফসল না হলে কৃষকরা জমিদারকে খাজনা দিতে পারবে না এবং বাকী খাজনার মামলা জিতে জমিদার তাঁদের জমি সহজেই হাত করতে পারবে, এই ছিলো তাদের কৌশল। এই কৌশল অবলম্বন করে তারা সত্যি সত্যিই বহু কৃষকের জমি খাস দখলে আনার জন্যে আদালতের ডিক্রী পেয়েছিলো।
এই কৃষকদেরই একজন ছিলেন স্থানীয় কৃষক সমিতির কর্মী ফেরেজতুল্লাহ। জমিদার ধীরেন ভট্টাচার্য তার বিরুদ্ধে বাকী খাজনার মামলা জিতে আদালত থেকে জমি খাস দখলে আনার ডিক্রী পেয়েছিলো কিন্তু কৃষক সমিতির নির্দেশে ফেরেজতুল্লাহ জমি নিজের হাতছাড়া করেননি। উপরন্তু জমির দখল হস্তান্তরের ব্যাপারে কিছুই হয়নি এমনি ভাব ধারণ করে অন্যান্য বৎসরের মতো সেবারও জমিতে চাষ করেছিলেন। এর ঠিক পূর্বে কৃষক সমিতির উদ্যোগে স্থানীয় কৃষকরা জমিদারদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে বরাবুনিয়ার বাঁধ তৈরীর ফলে ঐ সব জমির উৎপাদন শক্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। কাজেই ফেরেজতুল্লাহর জমিতে ধান এসেছিলো প্রচুর।
নিজের খাস জমিতে এইভাবে ফেরেজতুল্লাহকে জমি আবাদ করতে দেখেও জমিদার কিছু করার সাহস পায়নি কিন্তু ফসলের রূপ দেখে তারা আর স্থির থাকতে পারলো না। তারা স্থির করলো গোপনে লাঠিয়ালসহ জমির ওপর হামলা করে রাত্রির অন্ধকারে তারা সে জমির ধান কেটে নিয়ে যাবে।
এই হামলার ষড়যন্ত্রের খবর সেদিন সন্ধ্যের দিকেই কৃষক সমিতির একজন গুপ্তচরের মাধ্যমে সমিতির স্থানীয় কৃষক নেতা বিষ্ণু চ্যাটার্জী এবং অন্যান্যেরা জানতে পারলেন। জমিদার ধীরেন ভট্টাচার্যের এই হামলাকে প্রতিরোধ করার জন্য তারা সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। গ্রামে গ্রামে তারা খবর পাঠালেন সকলকে তৈরী থাকার জন্যে, বিপদসংকেত শোনামাত্র ফেরেজতুল্লাহর জমির দিকে লাঠি, সড়কি নিয়ে এগিয়ে যেতে।
এ ব্যাপারে একটা অসুবিধা দাঁড়াল এই যে, সেই অঞ্চলের কৃষক সমিতি নিজেদের কোন লাঠিয়াল বাহিনী অথবা শক্তিশালী ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি, অথচ জমিদারদের কর্তৃত্বে একদল লাঠিয়াল সর্বদাই হামলার জন্যে প্রস্তুত ছিলো। তাছাড়া জমিদারদের হাতে বন্দুকও ছিলো।
যাই হোক, এই সব অসুবিধা সত্ত্বেও জমিদারের আক্রমণের বিরুদ্ধে কৃষক সমিতির কর্মীরা যতদূর সম্ভব কৃষকদেরকে সংগঠিত করার চেষ্টা করতে নিযুক্ত হলেন। এছাড়া তাঁরা তাঁদের একজন কর্মীর মাধ্যমে সাহায্য-সহযোগিতার জন্যে খবর পাঠালেন নিকটবর্তী গ্রাম ধানীবুনিয়ার হীরালাল বাইনের কাছে। হীরালাল বাইনের একটি লাঠিয়াল বাহিনী ছিলো কিন্তু কৃষক সমিতির সাথে তাদের কোনরকম যোগাযোগই ছিলো না। সোনা নামে উপরোক্ত কর্মীটির সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় এবং সামান্য যোগাযোগের ভিত্তিতেই হীরালাল বাইনের কাছে এই সাহায্যের জন্যে তাঁরা আবেদন জানান।
একেবারে শেষ রাত্রের দিকে ফেরেজতুল্লাহর গ্রাম থেকে দুই মাইল দূরবর্তী বিষ্ণু চ্যাটার্জীদের গ্রাম শিংগা ও ঢোলের শব্দে চঞ্চল হয়ে উঠলো। বিপদসংকেত গ্রাম থেকে গ্রাম হয়ে চারিদিকের কয়েকটি গ্রামেই ছড়িয়ে পড়লো। এরপর সকলেই লাঠি, দা, সড়কি যে যা হাতের কাছে পেলো তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ফেরেজতুল্লাহর গ্রামের দিকে। দেখতে দেখতে কয়েক হাজার কৃষক এসে জড়ো হয়ে গেলেন ফেরেজতুল্লাহর জমির কাছে।
ঘটনাস্থলে কৃষকদের সংখ্যা জমিদারদের লোকজনের থেকে অনেক বেশী হলেও উপযুক্তভাবে সংগঠিত না থাকার ফলে এবং সাহসী নেতৃত্বের অভাবে তারা শত্রুপক্ষের লাঠিয়ালদের হুংকার ও আস্ফালনের মুখে তাদেরকে বাধা দিতে অথবা তাদের থেকে কাটা ধান ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হলেন না। জমিদারের নায়েব চটপট ধান কেটে নৌকা বোঝাই করে নিজেদের খামারের উদ্দেশ্যে অন্ধকারের মধ্যে পাড়ি জমালো।
এ সময় জমিদারের লাঠিয়ালদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হাত থেকে ফসল ছিনিয়ে নেওয়ার বদলে অসংগঠিত ও হতচকিত কৃষকরা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে চীৎকার ও পরস্পরকে গালাগালি করতে প্রবৃত্ত হলেন। বিষ্ণু চ্যাটার্জীও তাদেরকে আর কিছুতেই সামাল দিতে পারলেন না। এদিকে জমিদারের নায়েবের ধান বোঝাই নৌকো ক্রমশঃই দূরে সরে যেতে লাগলো।
এই অবস্থায় সামনে এগিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি কুৎসিৎ ও অশ্লীল গালাগালি দিয়ে তারপর বললেন, “কুত্তার বাচ্চারা, ধান নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ওরা, আর তোরা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? ছোট্, ব্যাটারা ছোট্, ওই শালার ধান চোরদের কান ধরে টেনে নিয়ে আসতে হবে।’ এই কথার পর রসজমা প্রায় পঙ্গু পা নিয়েই তিনি কাঁধে লাঠি ফেলে নৌকোর দিকে লক্ষ্য রেখে শাখা নদীটির পাড় ধরে দৌড়ুতে শুরু করলেন।
নেতৃত্বের এই আকস্মিক আবির্ভাবে সমবেত হতবুদ্ধি কৃষকেরা পরস্পরকে গালাগালি বাদ দিয়ে সংগ্রামের জন্যে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন। বিষ্ণু চ্যাটার্জীর মতো বিখ্যাত নেতাও এই বৃদ্ধ অশিক্ষিত কৃষকের কাছে লড়াইয়ের মাঠে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে হার মানলেন। কিন্তু তবু তিনি পিছিয়ে পড়লেন না। নতুন উৎসাহে তিনি প্রকৃত কৃষক নেতার মতোই অন্যান্য কৃষকদের সাথে সেই বৃদ্ধের পেছনে দৌড়ুতে থাকলেন। এবারে তাঁর মধ্যেও শক্তি এলো, নেতৃত্বের ক্ষমতা তিনি ফিরে পেলেন। জমিদারের লাঠিয়ালদের পরোয়া না করে ধান বোঝাই নৌকো দখল করার সংগ্রাম সকলকেই চাঙ্গা এবং জঙ্গী করে তুললো।
এই অবস্থায় দৌড়ুতে দৌড়ুতে কৃষকরা নৌকোর খুব কাছাকাছি এসে পড়লেও সেখানে একটা সম্ভবনা লক্ষ্য করে সকলেই কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। সামনেই ভদ্রা নদী। জমিদারের নৌকো সেই বড় নদীতে গিয়ে পড়লে তখন তাদেরকে ধরা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। জোর বৈঠা টেনে তারা নাগালের বাইরে চলে যাবে।
ঠিক এই সংকটমুহূর্তে দেখা গেলো যে, জমিদারের নৌকোগুলো হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কৃষকরা আবার জোর দৌড় শুরু করে আরও কিছুটা কাছাকাছি এসে দেখলেন যে, জমিদারের নৌকোগুলো দাঁড়িয়ে পড়ার কারণ তাদের সামনে পাশের এক খাল থেকে গোটা দশের নৌকো তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। এই নৌকোগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যে চার-পাঁচজন করে লোক এবং তাঁদের প্রত্যেকেরই হাতে ঢাল এবং সড়কি। হঠাৎ পরিস্থিতির এই পরিবর্তনের কারণ বুঝতে না পেরে সকলেই যখন কিছুটা হতভম্ব তখন সোনা নামে যে কৃষক কর্মীটিকে হীরালাল বাইনের কাছে পাঠানো হয়েছিলো তাকে সেই নৌকাগুলোর একটার মধ্যে দেখে সকলে চীৎকার করে উঠলেন। তাঁরা বুঝলেন হীরালাল বাইনের দল জমিদারের নৌকো আটক করেছে।
এইভাবে চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে জমিদারের নায়েব কাঁপতে কাঁপতে কৃষকদের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। জমিদারের লাঠিয়ালদের লাঠি, সড়কি সবই তাদের থেকে কেড়ে কৃষকরা দখল করে নিলেন। যারা ফেরেজতুল্লাহর ধান চুরি করেছিলো তারা নিজেরাই সেই ধান তাঁর বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে গেলো।
এই ঘটনার পর হীরালাল বাইন তো বটেই, এমনকি জমিদারের লাঠিয়ালরা পর্যন্ত কৃষক সমিতির সভ্য এবং কর্মীতে পরিণত হলেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে তারা গড়ে তুললেন কৃষক সমিতি।
এর পরবর্তী পর্যায়ে হীরালাল বাইন সার্বক্ষণিক কৃষক কর্মী হিসেবে কৃষক সমিতির আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে অনেকদিন রাজবন্দী হিসেবে থাকতে হয়। একবার পুলিশ তাদের গ্রাম ঘিরে ফেলার পর যখন তারা পাল্টা আক্রমণ চালান তখন পুলিশের গুলিতে তাঁর ছেলে রামকান্ত বাইন এবং ভাই সতীশ বাইন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এই ঘটনার পরও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং আস্থা রেখেই তিনি বলেছিলেন, ‘ওরা এক ছেলেকে মেরে ফেলেছে সেজন্য হীরালাল বাইন দমে যাবে না। আমার এক ছেলে গেছে, আরও ছেলে আছে। আর আমার সব ছেলেও যদি যায়, দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষকের ছেলেরা থাকবে। ওরা তাদের সবাইকে মেরে ফেলতে পারবে না।’[৩৪]
(ঘ) ১৯৪৬ সালে যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার বাকড়ি ছিলো কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। এই অঞ্চলের বাকড়ি, দোগাছা, কমলাপুর, ঘোড়ানাছ, হাতিয়ারা, গুয়াখালা, বেনাহাটি ইত্যাদি গ্রামগুলিকে নিয়ে যে ব্যাপক তেভাগা আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো বাকড়ি ছিলো তারই প্রাণকেন্দ্র। গুয়াখালার সরলাবালা পাল (সরলাদি) এই সময় কৃষক সমিতির পাশাপাশি এই সব এলাকায় মহিলা সমিতি এবং নারী বাহিনী গড়ে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে সরলাদির নেতৃত্বে মহিলা কৃষকদের এই সংগঠন সারা বাঙলায় মহিলা সংগঠনের মধ্যে ছিলো সব থেকে শক্তিশালী, সংগ্রামী এবং তৎপর। এই মহিলা সমিতির মধ্যে অন্যান্য যাঁরা নেতৃত্বের স্থানে ছিলেন তাঁরা হলেন বাকলির অনিমা, মহারানী, ফুলমতী, বাগলা প্রভৃতি। সরলাদি লেখাপড়া কিছুই জানতেন না কিন্তু তাঁর সাহস এবং সাংগঠনিক শক্তি ছিলো অসাধারণ। এই সাহস ও সাংগঠনিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই নড়াইল মহকুমার এই অঞ্চলটিতে জোতদার ও পুলিশদের সরাসরি এবং সশস্ত্র মোকাবিলার ক্ষেত্রে মহিলারা অনেক সময় পুরুষদের থেকেও অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন।
এই অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় বর্ষাকালে আউশ ধান কাটার সময়। কৃষক সমিতির নেতৃত্বে কৃষকরা জমির ধান কেটে নিজেদের খামারে তোলার পর তাঁদের বিরুদ্ধে জোতদাররা প্রথমে মামলা করে এবং পরে পুলিশ ডেকে এনে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এই সময়ে সরলাদির নেতৃত্বে স্থানীয় নারী বাহিনীর মহিলারা প্রত্যেকে ঝাঁটা হাতে নিয়ে পুলিশের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং জোর করে তাদের নৌকো টেনে এনে ডাঙ্গার ওপর তুলেছিলেন। মহিলা সমিতির এই বাহিনীতে তখন মহিলার সংখ্যা ছিলো আড়াইশো- তিনশো। সেদিন এইভাবে মহিলাদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পুলিশরা ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় নেয়। কিন্তু তারপর আরও দুইবার তারা গ্রামের ওপর হামলা চালায় এবং দুইবার নারী বাহিনী তা প্রতিরোধ করে। পুলিশরা এই অঞ্চলে নিজেদের ক্যাম্প বসিয়ে সেখান থেকে আরও অনেকবার নিয়মিতভাবে হামলা চালায়। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে মহিলাদেরকে পেছনে রেখে পুরুষরা ঢাল-সড়কি নিয়ে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সেই সব হামলাকে প্রতিহত করেন।[৩৫]
(ঙ) ১৯৪৬ সালে যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার ডুমুরতলা, চাঁদপুর, বড়ন্দর, নড়াইল; সদর মহকুমার এগারোখান, পাজিয়া, গড়ভাঙ্গা; মাগুরা মহকুমার আসবা, বরইচরা প্রভৃতি এলাকায় শক্তিশালী তেভাগা আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর মধ্যে আবার নড়াইল, পাজিয়া ও গড়ভাঙ্গা এলাকায় আন্দোলন সব থেকে বেশী জঙ্গীরূপ পরিগ্রহ করে।
এই সমস্ত এলাকায় কৃষকরা বিপ্লবী কৃষক কমিটি এবং কৃষক আদালত গঠন করেন এবং গ্রামের শাসনকার্য নিজেদের হাতে নিয়ে আসেন। পুলিশ ও সরকারী আমলারা এই গ্রামগুলিতে ঢুকতে সাহস করতো না। একবার পাঁচ-সাতজন পুলিশ আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করার উদ্দেশ্যে বড়ন্দর গ্রামে যায়। গ্রামে পুলিশ ঢোকার খরব পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে শত শত কৃষক রামদা, সড়কি ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং পুলিশকে ঘিরে ফেলেন। পুলিশ এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে না পেরে কৃষকদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কৃষকরা তখন দারোগার মাথার টুপি কেড়ে সেই টুপি নিয়ে ফুটবল খেলেন।
আর একবার নড়াইলের মহকুমা হাকিম পুলিশ নিয়ে কয়েকজন আত্মগোপনকারী নেতাকে গ্রেফতারের জন্যে এই এলাকার দুর্গাপুর গ্রামে ঢোকেন। পুলিশ গ্রামে ঢোকার পরই সেই সংবাদ জানিয়ে চারদিকে জয়ঢাক বেজে ওঠে। শত শত সশস্ত্র কৃষক মহকুমা হাকিম ও পুলিশ বাহিনীকে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘেরাও করে ফেলেন। নড়াইল থেকে দুর্গাপুর আসার রাস্তার বিভিন্ন স্থান তাঁরা কেটে দেন এবং রাস্তার মাঝে মাঝে ব্যারিকেড তৈরী করেন। এইভাবে কৃষকদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে এবং গ্রাম পরিত্যাগ করার পথ বন্ধ থাকায় পুলিশ ও কৃষক বাহিনী সমস্ত দিন পরস্পরের মুখোমুখি সশস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। অবশেষে মহকুমা হাকিম পুলিশ নিয়ে গ্রামে ঢোকার জন্যে কৃষকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আর কোনদিন গ্রামে ঐভাবে ঢুকবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এর পর তাঁদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।[৩৬]
(চ) কুকুটিয়া ঢাকা জেলার পশ্চিম বিক্রমপুর অঞ্চলের একটি ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে কৃষকসভার নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে ‘তেভাগা সংগ্রাম কমিটি’ গড়ে ওঠে। এই সংগ্রাম কমিটির পরিচালনায় সর্বত্র কৃষকদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও গঠিত হয়। মাথায় লাল টুপি এবং হাতে লাঠি নিয়ে এই স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিদিন নিয়মিতভাবে প্যারেড করতেন। মিছিল, সভাসমিতিও তাঁরা সংগঠিত করতেন। এই সব সভা-সমিতি এবং মিছিল থেকে ধ্বনি উঠতো: নিজ নিজ খামারে ধান তোলো, কৃষক কারো গোলাম নয়, তেভাগা চালু করো, কৃষকদের দাবী মানতে হবে, কৃষক ঐক্য গড়ে তোলো।
কুকুটিয়া ইউনিয়নের মহিলারাও মহিলা সমিতির মাধ্যমে তেভাগা আন্দোলনে শরিক হন। গ্রামে গ্রামে তাঁরা কৃষক মহিলাদেরকে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে টেনে আনেন।
তেভাগা আন্দোলনের এই অবস্থায় স্থানীয় জোতদার তালুকদাররা কৃষকদের অগ্রগতিকে রোধ করার উদ্দেশ্যে নিজেরা এক সভায় মিলিত হয় এবং পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
এর বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরোধকে জোরদার করার জন্যে কৃষকরাও এক জনসভার ব্যবস্থা করেন। জমিদারদের বিরুদ্ধতা এই জনসভার স্বপক্ষে কৃষকদেরকে আরও বেশী করে উৎসাহিত করলো। কৃষকরা নির্বিঘ্নে সভা করলেন এবং তেভাগার লড়াইকে সকল বাধা- বিপত্তির মুখে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানী দিয়ে কোন ফল না পেয়ে জমিদাররা একুশজন বাছাই করা কৃষক কর্মীকে ১০৭ ধারার এক মামলায় জড়িয়ে দিলো। তারা ভাবলো জেলের ভয়ে তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে আন্দোলনের পথে আর পা বাড়াবেন না। কিন্তু জমিদার-জোতদারদের এই হামলা কৃষকদেরকে আন্দোলনে নিরুৎসাহী ও হতাশাগ্রস্ত না করে তাঁদের উৎসাহ- উদ্দীপনা এবং সংগ্রামী উদ্যমকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো।
কৃষক কর্মীরা সাত দিন পর জামিনে মুক্তিলাভ করে আসার পর তাঁদেরকে নিয়ে বিরাট মিছিল এবং জনসভা করা হলো। সেই জনসভায় বিভিন্ন বক্তা তেভাগার লড়াই চালিয়ে গিয়ে নিজেদের সমস্ত ন্যায়সঙ্গত দাবী আদায় করার দৃঢ়সংকল্প ঘোষণা করলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন যে, তেভাগার দাবী মেনে না নিলে তাঁরা জোতদারদের ঘরে একগোটা ধানও পৌঁছে দেবেন না।
কৃষকদের এই জঙ্গী আন্দোলনের মুখে জোতদাররা তাঁদের বিরুদ্ধে কোন হামলার সাহস করলো না। ফসলের মৌসুমে লালটুপি পরিহিত লাঠিধারী কৃষক স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পাহারারত অবস্থায় ভাগচাষীরা মিলিতভাবে ধান কাটলেন। গ্রামের কৃষক মহিলারাও অনেকে এই সময় ক্ষেতের কাছে দাঁড়িয়ে শত্রুপক্ষের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতেন। কৃষকসভার কর্মীরা গায়ে পড়ে জমিদারদের সাথে কোন সংঘর্ষ বাধাবার চেষ্টা করতেন না। এমনকি প্রতিপক্ষের নানা উস্কানীর মুখে তাঁরা ধৈর্য ধারণ করে থাকতেন। কিন্তু কথা ছিলো যে, তাঁদের ওপর কোন আক্রমণ এলে সে আক্রমণকে সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে।
কুকুটিয়া ইউনিয়নের জোতদার-জমিদাররা অবশ্য কৃষকদের বিরুদ্ধ কোন ব্যাপক ও তীব্র আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়নি। নিজেদের পাইকবরকন্দাজরা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলো। কিন্তু একদিকে কৃষকদের মধ্যে উত্তেজনার অভাব দেখে এবং অন্যদিকে তাদের সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তারা ঐ অঞ্চলে কোন হাঙ্গামা সৃষ্টি না করে জোতদারদেরকে দেওয়ানী মামলা করার পরামর্শ দিয়ে সরে পড়ে।
পুলিশদের পরামর্শ মতো দেওয়ানী মামলা করেও জমিদারদের সুবিধে হলো না, কারণ কৃষকদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে একজন স্থানীয় লোকও তারা পেলো না। এই অবস্থায় জমিদার-জোতদারদের মধ্যে ভাঙন এলো এবং তাদের মধ্যে অনেকেই তেভাগার ভিত্তিতে কৃষকদের সাথে আপোষ করে ফেললো।[৩৭
৫. কৃষক-শ্রমিক ঐক্যজোট
কৃষকসভার নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন চলাকালে কৃষক কর্মীদের যে রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা হয় তার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিলো এই যে, কৃষকদের জমির লড়াই, তার তেভাগার সংগ্রাম কখনো সমাজের অন্যান্য নির্যাতিত শ্রেণী, বিশেষতঃ শ্রমিক শ্রেণীর সক্রিয় সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়। এ জন্যে শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া, তাঁদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং সহযোগিতাও ছিলো কৃষকসভার একটা মৌলিক নীতি। এ জন্যেই দেখা গেছে যে, তেভাগা আন্দোলনে শুধু যে গ্রামের ভাগচাষীরাই শরিক হয়েছেন তাই নয়। গ্রাম্য তাঁতী, কামার, কুমোর, ছুতোর ইত্যাদি কারিগর এবং শ্রমিকরাও ব্যাপকভাবে এগিয়ে এসে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে শরিক হয়েছেন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইকে জোরদার করতে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যে সমস্ত শ্রমিক ইউনিয়ন ছিলো সেগুলিতে শ্রমিকদের মধ্যেও কৃষক-শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কথা বলা হতো। নারায়ণগঞ্জ সূতাকল শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সময় শ্রমিকরা পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষকদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। তাঁরা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সেই সমস্ত এলাকায় নিজেরা সাধ্যমতো চাঁদা তুলে গ্রামবাসীদের জন্য লঙ্গরখানাও চালিয়েছিলেন।[৩৮] কৃষকরাও নারায়ণগঞ্জের মিল এলাকায় ১৯৪৬ সালের বিখ্যাত সূতাকল ধর্মঘটের সময় গ্রাম থেকে চাল-ডাল তুলে ধর্মঘটকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। গ্রামে গ্রামে সে সময় সভা করে তাঁরা ধর্মঘটের সমর্থনে জনমত গড়ে তুলতেন।[৩৯] ধর্মঘটের সময় শ্রমিক ছাড়া অন্যান্য লোকেরা যাতে নোতুন শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিয়ে মালিকপক্ষের দালালী করতে না পারে সেদিকেও তাঁরা সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন।[৪০]
বাঙলাদেশের যে সমস্ত এলাকায় তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিলো এবং কৃষকরা জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে নিজেদের জমি ও ফসলের লড়াই শুরু করেছিলেন সেই সব জায়গায় ১৯৪৬ সালে তেমন কোন বৃহৎ শিল্প কারখানার অবস্থান না থাকার ফলে ব্যাপক শ্রমিক-কৃষক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সম্ভব হয়নি। তবে যে সমস্ত এলাকায় শ্রমিক সংগঠন ছিলো তার পার্শ্ববর্তী জায়গার কৃষকরা নিজেদের আন্দোলন চালাতে গিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনকেও যে ক্ষেত্রবিশেষে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন তারও উদাহরণ আছে। এই রকম একটি উদাহরণ হলো রংপুর জেলার লালমনিরহাট রেল শ্রমিকদের সাথে তেভাগা আন্দোলনে শরিক কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধের সময় শ্রমিকরা যে সামান্য মাগগিভাতা পেতেন তাতে এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে তাল রেখে সংসার চালানো তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন করেও কোন ফল না হওয়ার পর শ্রমিকরা ধর্মঘটের চিন্তা শুরু করেন।
এ সময় রেল শ্রমিকদের ইউনিয়ন সর্বত্র খুব শক্তিশালী ছিলো না। কোন কোন এলাকায় তার শক্তি বেশী হলেও অন্য এলাকায় তা ছিলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল। কাজেই সকল শ্রমিককে ধর্মঘটের আহ্বানে কতদূর সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সে বিষয়ে যথেষ্ট দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো। তাছাড়া কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত দালাল ইউনিয়নগুলিও এই সময় ধর্মঘট বানচালের নানা চক্রান্তে নিযুক্ত ছিলো।
ধর্মঘট প্রশ্ন আলোচনা এবং সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্যে উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলার লালমনিরহাট জংশনে রেল শ্রমিকদের এক আঞ্চলিক সম্মেলন ডাকা হয়। রেল শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই এলাকার ইউনিয়নের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিলো। কাজেই লালমনিরহাট শ্রমিকদের সিদ্ধান্তের ওপর রেল ধর্মঘটের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করেছিলো।
লালমনিরহাটে যেদিন এই শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো সেদিনটি ছিলো শ্রমিক-কৃষক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের এক উজ্জ্বল ও গৌরবময় দিন। সেদিন গ্রামাঞ্চল থেকে তেভাগা আন্দোলনের বীর কৃষকরা লাল ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে মিছিল করে দলে দলে এসে হাজির হতে লাগলেন রেল শ্রমিকদের সম্মেলনে। তাঁরা আওয়াজ তুললেন, ‘রেল শ্রমিকদের দাবী মানতে হবে’, ‘দুনিয়ার মজুর-চাষী এক হও’। কৃষকদের এই আহ্বানে রেল শ্রমিকরাও পিছিয়ে থাকলেন না। তাঁরাও বলিষ্ঠকণ্ঠে আওয়াজ তুললেন, ‘তেভাগার দাবী মানতে হবে’, ‘দুনিয়ার মজুর-চাষী এক হও’।
সেদিনকার রেল শ্রমিক সম্মেলনে শ্রমিকদের সংখ্যা ছিলো পাঁচ হাজার, কিন্তু কৃষকদের সংখ্যা ছিলো পনেরো হাজার অর্থাৎ শ্রমিকদের তিনগুণ। কৃষকদের এই শরীকানায় সারা সম্মেলনে এক অভূতপূর্ব সাড়া জেগেছিলো।
সম্মেলনের কাজ শুরু হওয়ার পর একজন শ্রমিক নেতা ধর্মঘটের স্বপক্ষে বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু শ্রমিকরা তাঁর বক্তৃতায় বিশেষ সাড়া দিলেন না। এরপর বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন তৎকালীন বিখ্যাত শ্রমিক নেতা জ্যোতি বসু।* জ্যোতি বসুর বক্তৃতার সময় পাঁচ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ধর্মঘটের স্বপক্ষে অনেকখানি সমর্থন দেখা গেলো। তাঁরা ঘন ঘন হাততালি দিয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানালেন।
[* রেল শ্রমিকদের দলের এলাকা থেকেই ১৯৪৬ সালে জ্যোতি বসু বঙ্গীয় প্রাদেশিক বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন।[
কিন্তু বক্তৃতা শেষ করে জ্যোতি বসু যখন শ্রমিকদের মতামত জানতে চেয়ে তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁরা ধর্মঘটে যেতে প্রস্তুত আছেন কিনা, তখন কেউ তার কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু চারদিকে শোনা যেতে লাগলো অস্ফুট গুঞ্জনধ্বনি চাপা আলোচনা।
লালমনিরহাটের এই রেলশ্রমিকদের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন উর্দু ভাষী বিহারী। দেশের সাথে সম্পর্ক একপ্রকার চুকিয়ে দিয়েই তাঁরা এই অঞ্চলে কাজে এসেছিলেন। চাকরী গেলে অথবা ধর্মঘট বেশীদিন চললে তাঁদের দাঁড়াবার কোন জায়গা থাকবে না। কাজেই ধর্মঘটের প্রতি সম্পূর্ণ নৈতিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এই সব বাস্তব অসুবিধার জন্যে তাঁরা মনস্থির করে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না। শ্রমিকদের এই অবস্থা দেখে নেতাদের মধ্যে ও নৈরাশ্য এবং বিভ্রান্তি দেখা দিলো।
এমন সময় সেখানে উপস্থিত সারা ভারত কৃষকসভার সভাপতি বঙ্কিম মুখার্জী সমবেত শ্রমিকদেরকে উদ্দেশ্য করে যা বললেন তার সারমর্ম হলো : ‘আমি জানি, আপনারা সবাই ধর্মঘটের পক্ষে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনারা ধর্মঘটে যোগ দিতে ইতস্ততঃ করছেন। তার কারণটাও আমরা জানি। আপনারা বাঙলার বাইরের লোক, এখানে আপনাদের এমন কোন আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব নেই যাঁরা ধর্মঘট চলার সময় আপনাদের আশ্রয় দিতে পারে বা কোন রকম সাহায্য করতে পারে। ধর্মঘটের সময় আপনাদের খাওয়া-দাওয়া কেমন করে চলবে, এই নিয়েই তো আপনাদের দুশ্চিন্তা? আপনারা বলুন আমি ঠিক বলছি কিনা।’
বঙ্কিম মুখার্জীর এই কথার পর শ্রমিকদের পক্ষে থেকে একজন তাঁর বক্তব্য সমর্থন করে বললেন যে, ধর্মঘট তাঁরা চান। তবে তাঁরা বাইরের মানুষ বলে তাঁদের মস্ত অসুবিধা। অন্যান্য শ্রমিকরাও এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করলেন।
এর পর বঙ্কিম মুখার্জী তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেন যে, ধর্মঘট চলাকালে তাঁরা যদি শ্রমিকদের খাওয়া-দাওয়ার ভার নেন তাহলে তাঁরা ধর্মঘটে রাজী আছেন কিনা। উত্তরে শ্রমিকরা নিজেদের রিজার্ভ ফান্ডের স্বল্পতা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করে সেই প্রস্তাবের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলেও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হলে ধর্মঘটে তাঁরা যাবেন বলে জানিয়ে দিলেন।
শ্রমিকদের এই সিদ্ধান্তের পর বঙ্কিম মুখার্জী সমবেত পনেরো হাজার কৃষকদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কৃষক ভাইসব, আমি আপনাদের পক্ষ থেকে শ্রমিক ভাইদের ওয়াদা দিচ্ছি যে, রেল ধর্মঘট যতদিন চলবে ততদিন আমরা আমাদের ধর্মঘটী শ্রমিক ভাইদের ডাল- ভাত যুগিয়ে চলবো। বলুন, আপনারা এই ওয়াদা রক্ষা করে চলতে প্রস্তুত আছেন তো?’ নিজেদের নেতার এই আহ্বানে জঙ্গী কৃষকরা সঙ্গে সঙ্গে বিপুল উৎসাহে সাড়া দিলেন তাঁরা ঘোষণা করলেন যতদিন তাঁরা নিজেরা খেতে পাবেন ততদিন ধর্মঘটী শ্রমিক ভাইদের খাওয়া-দাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না।
এরপর কৃষক-শ্রমিকদের মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ উঠলো – ‘দুনিয়ার মজুর-চাষী এক হও’। রেল শ্রমিকরা ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সম্মেলন সাফল্যমণ্ডিত হলো।
এভাবেই তেভাগার লড়াইয়ের বীর বাঙলাভাষী কৃষকরা নিজেদের সংগ্রামের সাথে এক করে দিলেন উর্দুভাষী বিহারী শ্রমিকদের ধর্মঘট আন্দোলনকে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং ভাষার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাঁরা এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করলেন সত্যিকার কৃষক-শ্রমিক ঐক্যের, তাঁদের আন্তর্জাতিকতাবাদের।[৪১]
৬. তেভাগার লড়াইয়ে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন
তেভাগার লড়াই ছিলো হিন্দু-মুসলমান জমিদার-জোতদারের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান ভাগচাষী এবং অন্যান্য নিপীড়িত কৃষকদের মিলিত সংগ্রাম। কিন্তু কৃষকদের এই মিলিত সংগ্রামের যারা শত্রু সেই জমিদার-জোতদাররা কৃষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির নানা চক্রান্তের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাকে একটা প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছিলো। বাঙলাদেশে কৃষক সমাজের সামাজিক বিন্যাসই জমিদার, জোতদার, পুলিশ, আমলা প্রভৃতিকে এই অস্ত্র ব্যবহারের অনেকখানি সুযোগ করে দিয়েছিলো।
এ সম্পর্কে ‘কৃষকসভার গতি ও বিকাশ’ নামে ১৯৪৩ সালের একটি লেখায় কৃষকসভার অন্যতম নেতা মনসুর হাবিব বলেন:
বাংলায় শ্রেণীবিরোধের প্রধান ক্ষেত্র জমিদার ও কৃষক, মহাজন ও খাতক। অনেক ক্ষেত্রে জমিদার-মহাজন এবং কৃষক-খাতক মিলে গিয়ে দুটি মাত্র বিরোধী শ্রেণী হয়ে পড়ে। জমিদার ও মহাজনদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা খুব বেশী, কৃষক ও খাতকের মধ্যে মুসলমান খুব বেশী। তার ফলে শ্রেণীবিরোধের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রূপ ফুটে বেরোয়। তাই ‘শ্রেণীবিরোধ ও শ্রেণী দাবীকে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও সাম্প্রদায়িক দাবী বলে’ প্রচার করা হয়।
ইংরাজী শিক্ষা ও চাকরীর বিষয় নিয়ে হিন্দু ও মুসলমান মধ্য শ্রেণীর ভিতরও সাম্প্রদায়িকতা খুব ছড়িয়ে গেছে।
হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার প্রধান ক্ষেত্র মধ্যশ্রেণী। প্রধান কারণ:
১. কালচার বা কৃষ্টির দিক দিয়ে মুসলমান মধ্যশ্রেণী এখনো অনেকটা ফিউডাল অবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে, হিন্দু মধ্যশ্রেণী (বর্ণ হিন্দু) অনেকটা বুর্জোয়া অবস্থার মধ্যে এসে পড়েছে। তাই তাদের মধ্যে কৃষ্টিগত বিরোধ।
২. শিক্ষা ও আর্থিক অবস্থার (চাকরি, পেশা ও বৃত্তি) দিক থেকে এবং ক্রমে রাজনীতিক ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে হিন্দু ও মুসলমান মধ্যশ্রেণীর ভিতর তফাৎ ও বিরোধ আছে। এই বিরোধ অশিক্ষিত মুসলমান কৃষক ও অশিক্ষিত নিচু বর্ণের হিন্দু কৃষকদের মধ্যে নাই। জমিদার-কৃষক বা মহাজন-খাতক বিরোধ নিতান্তই শ্রেণীবিরোধ। এই বিরোধকে ধর্মের নামে কাজে লাগানো সহজ। মধ্যশ্রেণী তাকে কাজে লাগায়।[৪২]
বাঙলাদেশে তেভাগা আন্দোলনের সূচনা থেকে শেষ পর্যায় পর্যন্ত কয়েক বৎসরই ছিলো মধ্যবিত্ত হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা, বিদ্বেষ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার এক চরম পর্যায়। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, তেভাগা আন্দোলন দমনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান মধ্যশ্রেণী মিলিতভাবে পরস্পরের সাথে একজোট হয়ে চক্রান্তে নেমেছিলো। সাম্প্রদায়িক ভেদনীতিকে তারা কৃষক আন্দোলন দমনের মাধ্যমে যৌথভাবে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো।
এই উদ্দেশ্যে কংগ্রেস-লীগ উভয় প্রতিষ্ঠানের দক্ষিণপন্থী মুখপাত্রেরা তেভাগা দাবীকে সাম্প্রদায়িক দাবী বলে সুবিধেমতো চিহ্নিত করছিলেন। মুসলমান জোতদাররা হিন্দু কৃষকদের বিরুদ্ধে মুসলমান কৃষকদের এবং হিন্দু জোতদাররা মুসলমান কৃষকদের বিরুদ্ধে হিন্দু কৃষকদের উত্তেজিত করে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও দাঙ্গার পথে চালনা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষকরা শহরাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হানাহানির সেই শীর্ষ পর্যায়েও নিজেদের সাম্প্রদায়িক ঐক্য বজায় রাখতে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই সমর্থ হয়েছিলেন। তেভাগা আন্দোলনে জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমেই তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন বাঙলাদেশের বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে। এই সম্পর্কে তৎকালীন কৃষক নেতা কৃষ্ণবিনোদ রায় বলেছেন:
কথা উঠিয়াছে, তে-ভাগার দাবী সাম্প্রদায়িক দাবী; তে-ভাগার বা অন্যান্য লড়াই চালাইলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিবে। ঘটনা ও ইতিহাস ইহাকে একেবারে মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছে 1 তিন মাস দাঙ্গার আতংক অক্টোপাসের মতো বাংলাকে ঘিরিয়া রাখিয়াছিল, আজ তে- ভাগা লড়াই দাঙ্গাকে ঝাঁটাইয়া বিদায় করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান জোতদার হিন্দু-মুসলিম চাষীর বিরুদ্ধে মিলিয়াছে, হিন্দু-মুসলমান পুলিশ ও আমলারা একযোগে হিন্দু-মুসলমান কৃষককে গ্রেফতার করিতেছে। লীগ নেতা মাওলানা আব্দুল্লাহিল বাকী ও কংগ্রেস নেতা শ্রীযুক্ত নিশীথনাথ কুণ্ডু দিনাজপুরে, লীগ নেতা মওলভী গিয়াসউদ্দীন পাঠান ও কংগ্রেস নেতা শ্রীযুক্ত মনোরঞ্জন ধর ময়মনসিংহে, লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও কংগ্রেস নেতা শ্রীযুক্ত জ্যোতিষ চক্রবর্তী যশোহরে একেযোগে তে-ভাগার বিরোধিতা করিতেছেন, লীগ ও কংগ্রেসের নওজোয়ানের দল অনেক হিন্দু-মুসলমান কৃষকের পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। তেভাগার লড়াই এবং কৃষকের অন্যান্য সংগ্রাম দুর্ভিক্ষ বিধ্বস্ত দাঙ্গা জর্জরিত মৃতপ্রায় বাংলাদেশে নূতন বাংলার বুনিয়াদ রচনা করিতেছে।[৪৩]
কৃষ্ণবিনোদ রায়ের এই দাবী মিথ্যা ছিলো না। তেভাগার লড়াইয়ের সময় কৃষকদের দাঙ্গা প্রতিরোধের অসংখ্য ঘটনাই তার প্রমাণ
তেভাগা লড়াইয়ের শহীদ তগনারায়ণের হত্যার প্রতিবাদে ডিমলা ইউনিয়ন থেকে কৃষকদের যে মিছিল নীলফামারী শহরে উপস্থিত হয়েছিলো সেটি সেদিন যেভাবে হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা প্রতিরোধ করে গ্রামের কৃষক এবং শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে নোতুন চেতনার সৃষ্টি করেছিলো তা বাঙলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা।[৪৪]
কৃষকদের প্রতিবাদ মিছিল যখন নীলফামারীর পথে ডোমারে গিয়ে পৌছালো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিন্তু কোন অসুবিধা হলো না। কারণ কৃষকের বিরাট মিছিলটি সারা অঞ্চলে এতো উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলো যে, স্থানীয় লোকেরাই এগিয়ে এসে কৃষকদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ডোমারে মিছিলটি অবস্থানকালেই সেখানে খবর এসে পৌঁছালো যে, সৈয়দপুরে হিন্দু- মুসলমানদের দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে, অনেকে হতাহত হয়েছে এবং দাঙ্গা নীলফামারীসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার প্রবল আশংকা দেখা দিয়েছে। হিন্দু-মুসলমান কৃষকের সেই মিলিত সংগ্রাম এবং শহীদ তগনারায়ণের হত্যার প্রতিবাদে তাঁদের সেই জঙ্গী মিছিলের উদ্দেশ্য দাঙ্গার মুখে পড়ে ব্যাহত ও ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। কিন্তু কৃষক কর্মীরা সেই জটিল পরিস্থিতির সামনে ভেঙ্গে পড়লেন না। তাঁরা তৎক্ষণাৎ দাঙ্গাকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে গেলেন। সমবেত কৃষকদের তাঁরা বোঝালেন দাঙ্গার অর্থ কৃষকসভা ধ্বংস হওয়া, তেভাগা আন্দোলন ধ্বংস হওয়া, কৃষকদের ওপর জোতদারী-মহাজনী নির্যাতন টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা। কৃষকরাও অনেক রাত্রি পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা করে স্থির করলেন যে, নীলফামারী গিয়ে দাঙ্গাকে তাঁরা প্রতিরোধ করবেনই। পরদিন সকাল থেকে মিছিলটি এগিয়ে চললো নীলফামারীর দিকে।
এই সময় নীলফামারীতে দারুণ ভয়, আতংক এবং উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। বিশেষ করে সৈয়দপুরে নিহত ব্যক্তিদের লাশ যখন সেখানকার হাতপাতালে ট্রাকে করে নিয়ে আসা হলো তখন সেই উত্তেজনা আরও বেড়ে উঠলো। যারা দাঙ্গা বাধাবার চেষ্টা করছিলো তারাও অধিকতর উৎসাহের সাথে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ত্রুটি রাখলো না।
কিন্তু দাঙ্গার এই অবস্থা বিকেলের দিকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। দূর থেকে কৃষকদের মিছিলটি দেখে প্রথমে শহরের লোকে ঐ এলো, ঐ এলো রব তুলে আতংকে দিশাহারা হওয়ার উপক্রম করলো। হিন্দুরা মনে করলো মুসলমানরা আসছে, মুসলমানরা মনে করলো হিন্দুরা আসছে! চারদিকে ছুটোছুটি পড়ে দোকানপাট সমস্ত বন্ধ হয়ে গেলো! এমন সময় কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী দৌড়ে এসে শহরে খরব দিলো যে, যারা আসছে তারা দাঙ্গাবাজ নয়। তারা কৃষক সমিতির লোক, লাল ঝাণ্ডা তাদের হাতে। লাল ঝাণ্ডার যারা ঘোর শত্রু তারাও জানতো যে, লাল ঝাণ্ডাধারীরা আর যাই করুক দাঙ্গা বাধায় না। কাজেই নীলফামারী শহরের শান্তিপ্রিয় হিন্দু-মুসলমান জনগণ তৎক্ষণাৎ আশ্বস্ত হলেন। মিছিল ধীরে ধীরে শহরে প্রবেশ করলো। তেভাগার সৈনিক তগনারায়ণ হত্যার প্রতিবাদ মিছিল থেকে আওয়াজ উঠলো, ‘দাঙ্গাবাজরা নিপাত পাক’, ‘কৃষক সমিতি জিন্দাবাদ।’
মিছিলটি শহরে পৌঁছনোর পর নীলফামারীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হলো। শহরের লোকেরা দলে দলে এগিয়ে এসে তাঁদেকে অভ্যর্থনা জানালেন।
শহরের লোকদের থেকেই কৃষক কর্মীরা জানতে পারলেন যে, ডিমলা থানা এলাকায় কোন কোন নামজাদা জোতদারদের মধ্যে অনেকে গ্রাম পরিত্যাগ করে সৈয়দপুরের কাছেই আশ্ৰয় নিয়েছে এবং দাঙ্গা বাধানোর ক্ষেত্রে তাদেরও কিছুটা হাত আছে।
কৃষকদের মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করার পর তাঁরা কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে এক জনসভার আহ্বান দিলেন। সেই জনসভায় শহরবাসীরা যোগ দিলেন দারুণ উৎসাহের সাথে। গ্রাম ও শহরবাসী কৃষক ও মধ্যবিত্তের সেই মিলিত সভায় কৃষক নেতা দীনেশ লাহিড়ী বক্তৃতা দিয়ে তেভাগা আন্দোলনের উদ্দেশ্য, জোতদারদের নির্যাতন এবং তগনারায়ণ হত্যার কাহিনী বর্ণনা করলেন। জোতদাররা নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থ রক্ষার জন্যে কিভাবে কৃষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য বিভেদ সৃষ্টি করতে অহরহ চেষ্টা চালাচ্ছে সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিতভাবে বললেন। এরপর তিনি আহ্বান জানালেন শোষক শ্রেণীর দ্বারা প্ররোচিত সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ করে তাদের ওপর চরম আঘাত হানতে। কৃষকরা নিজেদের লাঠি উঁচু করে শপথ নিলেন দাঙ্গাবাজ জোতদারদের চক্রান্তের ফলে একজনের প্রাণহানি হলেও তাঁরা জোতদারদের মাথা নেবেন।
ঢাকা জেলার বিক্রমপুর এলাকায় কুকুটিয়া ইউনিয়ন কৃষক সমিতির দাঙ্গা প্রতিরোধও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। কুকুটিয়ার পার্শ্ববর্তী তন্তর ও শিংপাড়া এই দুই ইউনিয়নের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির খুবই অবনতি ঘটে। সেখানে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোকরাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। শুধু তাই নয়, এই দুটি গ্রাম থেকে লোকজন গিয়ে কুকুটিয়ার কৃষকদেরকেও দাঙ্গায় প্ররোচিত করতে উদ্যোগ নেয়।
এই অবস্থায় স্থানীয় কৃষক নেতা শাহেদ আলী গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক কর্মীদের সাথে আলাপ- আলোচনা করেন এবং তাদেরকে নিয়ে একটা বড় বৈঠক ডাকেন। এই বৈঠকে সাধারণ কৃষক কর্মীরা সিদ্ধান্ত করেন যে, দাঙ্গা তেভাগার ক্ষতি করবে। তেভাগার শত্রুরাই দাঙ্গা সৃষ্টি করছে। দাঙ্গায় গরীবেরই সর্বনাশ হবে। এ দাঙ্গা কিছুতেই ঘটতে দেওয়া যায় না।
গ্রামে গ্রামে ঘুরে এই ধরনের সভা বৈঠকের মাধ্যমে সেখানকার স্থানীয় কৃষক নেতা ও কর্মীরা কৃষকদের মধ্যে দাঙ্গা-বিরোধী মনোভাবকে জোরদার করেন এবং শেষ পর্যন্ত দাঙ্গা রোধ করতে তাঁরা সমর্থ হন। শিংপাড়া খালের দুই পাড়ে শত শত হিন্দু-মুসলমান যখন দাঙ্গার জন্যে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ করছিলেন তখন কৃষক কর্মীরা দুর্দান্ত সাহসের সাথে তাদের মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হন এবং নিজেদের জীবন বিপন্ন করে আলোপ- আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষকেই নিরস্ত্র ও নিরস্ত করেন।[৪৫]
১৯৪৬ সালে নোয়াখালী দাঙ্গার সময় পার্শ্ববর্তী এলাকা কুমিল্লার গ্রামাঞ্চলে দাঙ্গা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কৃষক নেতা এরাদাতউল্লাহর নেতৃত্বে কৃষকরা যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সেটা ছিলো ঐ অঞ্চলের বৃহত্তর কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন এবং কৃষক সভার সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় অধ্যায়।
ঢাকা জেলার রায়পুরা থানার রহিমাবাদ গ্রামে একবার দাঙ্গা বন্ধ করতে গিয়ে কৃষকরা যে প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন প্রকৃতপক্ষে তার ফলেই সেখানে কৃষকসভা গড়ে ওঠে এবং তার নেতৃত্বেই কৃষকরা সংগঠিতভাবে অনেক আন্দোলন চালান।[৪৬]
শুধু এই দুই ক্ষেত্রেই নয়। অসংখ্য জায়গায় কৃষকদের দাঙ্গা প্রতিরোধ বাঙলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে।
৭. তেভাগা ও মধ্যবিত্ত
তেভাগা আন্দোলনের সময় জমিদার-জোতদাররা মধ্যশ্রেণীর সাথে কৃষকদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাকে বাড়িয়ে তোলার অনেক চেষ্টা করে। মধ্যবিত্তের স্বার্থ তেভাগার দ্বারা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনার ফলে জোতদারদের এই প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়।
কৃষক ও মধ্যবিত্তের সম্পর্ককে তিক্ত ও শত্রুতামূলক করার জোতদারী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কৃষকসভার কর্মীরাও উদ্যোগ নেন। তাঁরা দেখাতে চেষ্টা করেন যে, আধির পরিবর্তে তেভাগা হলে বিঘা প্রতি প্রায় এক মণ ধান তাঁরা কম পাবেন, কিন্তু তাতে তাঁদের তেমন আর্থিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। অন্যান্য পেশা ও কাজকর্মে রত অধিকাংশ মধ্যবিত্তের জমির পরিমাণ দশ বিঘার বেশী হয় না। কাজেই তেভাগার ফলে বৎসরে তাঁদের ক্ষতি মাত্র দশ মণ অর্থাৎ তৎকালীন বাজার দর অনুসারে ৬০ অথবা ৬৫ টাকা। এতে তাঁদের তেমন কিছু এসে যায় না। কিন্তু জোতদারদের জমিসহ মধ্যবিত্তের জমিগুলি যদি তেভাগার আওতার মধ্যে আসে তাহলে জোতদারদের-চোরাকারবারীদের কুক্ষিমুক্ত হয়ে বাজারে অবাধ ধান- চাল সরবরাহের ফলে চালের মূল্যসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের মূল্যহ্রাস পেতে বাধ্য। এই মূল্য হ্রাসের ফলে বৎসরে ৬৫ টাকার ক্ষতির তুলনায় তাঁদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।
মধ্যশ্রেণীর মধ্যে যাঁরা জীবিকার জন্যে জমির ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল তাঁদের ক্ষেত্রে কৃষকরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে তেভাগার পরিবর্তে আধির ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এসেছেন এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। বিধবা মহিলাদের ক্ষেত্রে তাদের নিজেদেরকেই বিশেষভাবে এই সমস্ত বিবেচনা করতে প্রায়ই দেখা গেছে।[৪৭]
এ প্রসঙ্গে কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ একটা বিশেষ উদাহরণ উল্লেখ করেছেন:
কৃষক কর্মীদের বৈঠকে তেভাগা নিয়ে আলোচনার সময় ‘সর্বস্তরে তে-ভাগা চালু করো কৃষক সভার এই প্রস্তাবে স্থানীয় কৃষক নেতৃবৃন্দ ঘোর আপত্তি জানালেন। তারা বললেন, ‘এ হয় না। এই ইউনিয়নে এমন কয়েকজন বিধবা আছেন যাঁদের এই জমির ফসলের উপরই জীবিকা নির্ভর করে। জমি বর্গা দিয়েই তাঁরা খেয়ে আছেন। তাঁদের জমিতে তে- ভাগা অর্থ তাদের ভাতে মারা। এ অসম্ভব। এ হয় না। এ কৃষকসভার নীতি হতে পারে না। তাঁদেরকে অর্ধেক দিতে হবে।’ অনেক আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর স্থানীয় কৃষক নেতৃবর্গের প্রস্তাবই সভায় গৃহীত হলো।
কৃষকরা মাথায় বসে ঐ তিনজন বিধবার প্রাপ্য ধান তাঁদের বাড়ি পৌছিয়ে দিলেন। এ কাজের ফলে আশাতীত মঙ্গল হলো।
কেবল ঐ বিধবা পরিবার তিনটিই নয়, তাঁদের কয়েক ঘর আত্মীয়-স্বজনও কৃষকসভার সমর্থক হয়ে তার দাবীর স্বীকৃতি দিলেন। জমিদারদের অনেক ষড়যন্ত্রই তাঁরা ফাঁস করে দিলেন। কৃষকদের এই কাজ জমিদারদের মধ্যে শুরুতেই ভাঙ্গন এনে দিয়েছিলো।[৪৮]
মধ্যবিত্তদের সাথে কৃষকদের যে কোন মৌলিক স্বার্থগত বিরোধ নেই উপরন্তু তারা উভয়েই যে জোতদার, মহাজন, সরকারী আমলা এবং সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা সমানভাবে শোষিত, এ কথা কৃষকসভার পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়। অফিসের কেরানী, ছোট দোকানদার, এমনকি জমিদারদের অল্প বেতনভোগী নায়েব— গোমস্তারা পর্যন্ত কিভাবে এই শোষণের দ্বারা অহরহ জর্জরিত হচ্ছে কৃষকসভার কর্মীরা তারও অনেক দৃষ্টান্ত দিয়ে মধ্যবিত্তের তেভাগা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন করে তোলার চেষ্টা করেন এবং তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে আন্দোলনের পথে টেনে আনতেও সক্ষম হন।
বস্তুতঃপক্ষে বাঙলাদেশের বিশ লক্ষ একর আবাদী জমি এই সময় ছিলো পাঁচ লক্ষ সত্তর হাজার মধ্যবিত্ত পরিবারের হাতে। কিন্তু সেই জায়গায় মুষ্টিমেয় জমিদার-জোতদারদের হাতে ছিলো প্রায় এক কোটি একর।[৪৯] সেই হিসেবে কৃষকদের প্রকৃত শত্রু ছিলো মুষ্টিমেয় জমিদার, জোতদার লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত পরিবার নয়। এ জন্যেই কৃষকসভা ধ্বনি তুলেছিলো: মধ্যবিত্তের প্রকৃত শত্রু কৃষক নয়, শত্রু হলো বড় জমিদার-জোতদার, আমলাতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ।[৫০]
৮. মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল] (১৯৪৭)-এর খসড়া প্ৰকাশ
কৃষকসভার নেতৃত্বে বাঙলাদেশে তেভাগা আন্দোলন বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে যখন এক নোতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে শুরু করেছে, তেভাগার আন্দোলন যখন প্রকৃতপক্ষে পরিণত হয়েছে জমিদার-জোতদার, সরকারী আমলা ও পুলিশের সশস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে কৃষকদের সশস্ত্র প্রতিরোধ, তেভাগা সংগ্রাম যখন তার সর্বোচ্চ শিখরে তখন মুসলিম লীগ সরকার ১৯৪৭-এর ২১শে জানুয়ারী তারিখে জনসাধারণের অবগতির জন্যে ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ ‘বিল’ (১৯৪৭) নামে একটি বিল প্রকাশ করেন। বিলটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ[৫১] নীচে দেওয়া গেল :
১. বাংলার বর্গাদার দ্বারা জমি চাষ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে আইন করা হইতেছে। ইহা বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৪৭ সাল) নামে অভিহিত হইবে।[১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন বাংলার যে সকল অঞ্চলে প্রযোজ্য, ইহাও সেই সকল অঞ্চলে প্রযোজ্য হইবে এবং আগামী ১৯৪৯ সালের ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত ইহা বলবৎ থাকিবে।
২. এই আইনে ‘কৃষি বৎসর’ বলিতে ১লা বৈশাখ হইতে যে বাঙলা বৎসর আরম্ভ হয়, তাহাই বুঝাইবে।
শস্যের একটা অংশ দিবার শর্তে যে ব্যক্তি ‘আধি’, ‘বর্গা’ বা ভাগ’ নামে সাধারণতঃ পরিচিত ব্যবস্থায় অপরের জমি চাষ করে, তাহাকে ‘বর্গাদার’ বলা হইবে। ‘কালেক্টর’ বলিতে আইনানুযায়ী কালেক্টরের সমস্ত বা কোন কাজ করিবার জন্য প্রাদেশিক গভর্ণমেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত যে কোন অফিসারও বুঝাইবে।
‘মালিক’ বলিতে বর্গাদার যাহার জমি চাষ করে তাহাকে বুঝাইবে।
৩. ১৯৪৭ সালের ২২শে জানুয়ারী তারিখে বা ঐ তারিখের অব্যবহিত পূর্বেকার চাষের মরশুমে কোন ব্যক্তি যদি বর্গাদার হিসাবে কোন জমি চাষ করিয়া থাকে, তাহা হইলে লিখিত বা অলিখিত অন্যরূপ কোন চুক্তি থাকা সত্ত্বেও আগামী ১৯৪৭ সালের ১৭ই এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত ঐ জমি চাষ করার অধিকার তাহার থাকিবে এবং ঐ তারিখের পূর্বে জমির মালিক ৫ ধারায় বর্ণিত কারণ ব্যতীত নিজে জমির চাষ করিতে বা অন্যভাবে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবেন না।
৪. ১৯৪৭ সালের ২২শে জানুয়ারী তারিখে বা তাহার অব্যবহিত পূর্ববর্তী চাষের মরশুমে বর্গাদার হিসাবে জমির চাষ করিয়াছে, এইরূপ কোন ব্যক্তিকে যদি জমির মালিক চাষে বাধা দেয়, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি কালেক্টরের নিকট আবেদন করিতে পারিবে এবং কালেক্টর আবশ্যক মতো তদন্ত করিয়া যদি দেখেন যে, এই ব্যক্তি বর্গাদার হিসেবে ঐ তারিখে বা তাহার অব্যবহিত পূর্ববর্তী চাষের মরশুমে চাষ করিয়াছে তাহা হইলে বর্গাদারকে জমি চাষ করিতে দিবার জন্য তিনি মালিকের ওপর নোটিশ জারি করিতে পারিবেন।
মালিকের উপর নোটিশ জারির পরও বর্গাদার যদি কালেক্টরকে জানায় যে, মালিক তাহাকে জমি চাষ করিতে দিতেছে না, তাহা হইলে কালেক্টর আবশ্যক হইলে আরও তদন্ত করিবেন এবং যদি দেখেন যে, মালিক বর্গাদারকে চাষ করিতে দেন নাই, তাহা হইলে তিনি বর্গাদারকে নগদ ক্ষতিপূরণ দিবার জন্য মালিকের ওপর লিখিত আদেশ জারি করিতে পারিবেন, তবে জমি চাষে বাধাপ্রাপ্ত না হইলে বর্গাদার এই আইন অনুসারে ফসলের যে অংশ পাইত, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ তাহার মূল্যের দ্বিগুণের অধিক হইবে না।
৫. জমির মালিকের লিখিত আবেদনক্রমে কালেক্টর নিম্নলিখিত কারণসমূহের যে কোন কারণে আবশ্যক তদন্তের পর বর্গাদারকে জমি চাষ বন্ধ করিবার জন্য আদেশ দিতে পারিবেন, –
ক) জমির মালিক নিজে বা তাহার পরিবারের লোকদের সাহায্যে জমি চাষ করিতে চাহেন;
(খ) বর্গাদার জমির অপব্যবহার করিয়াছে;
(গ) বর্গাদার উপযুক্তভাবে জমি চাষ করে নাই অথবা
(ঘ) বর্গাদার এই আইন অনুযায়ী জমিতে উৎপন্ন ফসলের অংশ মালিককে দেয় নাই। জমি ছাড়িয়া দিবার জন্য নোটিশ জারি হইবার পর বর্গাদার যদি সঙ্গে সঙ্গে তদনুযায়ী কাজ না করে, তাহা হইলে মালিকের আবেদনক্রমে কালেক্টর নোটিশ কার্যকরী করার জন্য যেরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন উপযুক্ত বিবেচনা করিবেন, সেইরূপ ব্যবস্থা অবলম্বনের আদেশ দিবেন। ফসলের অংশ না দেওয়ার জন্য জমি ছাড়িয়া দেওয়ার আদেশ দেওয়া হইলে আদেশের তারিখ হইতে ৩০ দিনের মধ্যে বর্গাদার যদি মালিককে ফসলের প্রাপ্য অংশ বা কালেক্টরের নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ দেয়, তাহা হইলে বর্গাদারের বিরুদ্ধে এই ধারা অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা অবলম্বিত হইবে না।
৬. যেরূপ আইন বা যুক্তিই থাকুক না কেন; বর্গাদার জমিতে উৎপন্ন ফসলের নিম্নলিখিত অংশ নিজের জন্য রাখিতে পারিবে, –
(ক) যেখানে মালিক চাষের লাঙ্গল, চাষের জন্য যন্ত্রপাতি ও সার দিবে, সেখানে ফসলের অর্ধাংশ;
(খ) মালিক যেখানে চাষের বলদ, লাঙ্গল, চাষের অন্য যন্ত্রপাতি ও সার দিবে না, সেই ক্ষেত্রে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ।
উপরোক্ত বিলটির মধ্যে তেভাগা আন্দোলনের দুটি প্রধান দাবী চাষের জমিতে ভাগচাষীর দখলীস্বত্ব এবং ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু জোতদার কর্তৃক বাজে আদায় বন্ধ, বর্গাদারের নিজের খামারে ফসল তোলার অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে বিলটির মধ্যে কোন উল্লেখ নেই। অবশ্য সে উল্লেখ না থাকলেও বিলটিতে প্রধান দুটি দাবীর স্বীকৃতির মাধ্যমে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার খোলাখুলিভাবে ভাগচাষীদের দাবীর ন্যায্যতাই স্বীকার করেন।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তেভাগা আন্দোলনের সময় বাঙলাদেশের ঊনিশটি জেলাতে কৃষকরা ব্যাপকভাবে যে সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন এবং তাদের ওপর সুহরাওয়ার্দীর মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশ যে দারুণ অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিলো সে সম্পর্কে প্রতিবাদ তো দূরের কথা কোন মন্তব্য পর্যন্ত মুসলিম লীগ নেতারা প্রকাশ্যভাবে করেননি। মুসলিম লীগে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশের মুখপাত্র প্রাদেশিক সম্পাদক আবুল হাশিম পরিচালিত সাপ্তাহিক মিল্লাতে’ ১৯৪৬-এর ২৭শে ডিসেম্বরের সংখ্যায় প্রকাশিত ‘চাষীদের তে-ভাগা দাবী রোধ করা যাইবে না’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ ব্যতীত তে-ভাগা সম্পর্কে অন্য কোন প্রবন্ধ, বিবৃতি, বক্তৃতার বিবরণ, সংবাদ অথবা সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়নি।
এই প্রবন্ধটিতেও তেভাগার দাবীকে সমর্থন করলেও তেভাগা আন্দোলনে সরকারী আমলা ও পুলিশের নির্যাতন সম্পর্কে একটি অক্ষরও লেখা হয়নি। বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের স্বপক্ষে ‘মিল্লাতে একাধিক জোরালো সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হলেও তেভাগা দাবীর সমর্থনে অথবা অসংখ্য কৃষকের নির্মম হত্যার প্রতিবাদে কোন সম্পাদকীয় সেই পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়নি |
উপরোল্লিখিত বিলটি সর্বসাধারণের অবগতির জন্যে তৎকালীন সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে প্রকাশিত হলেও সেটি আইনে পরিণত হয়নি। উত্তর বাঙলার প্রভাবশালী মুসলমান জোতদাররা বিলটির বিরুদ্ধে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলো এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির মধ্যে জোতদার শ্রেণীভুক্ত সদস্যদের প্রবল বিরোধিতার ফলে সেটিকে পরিষদে পেশ করা আর লীগ মন্ত্রিসভার দ্বারা সম্ভব হয়নি।[৫২] সারা বাঙলাদেশ ব্যাপী প্রবল কৃষক আন্দোলনের মুখে মুসলিম লীগের যে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশের প্রভাবে বিলটি প্রণীত ও প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁরাও মুসলমান জোতদারদের বিরোধিতার মুখে সেটা আইনে পরিণত করার ব্যাপারে কোন জোর উদ্যোগ নিতে উৎসাহী হলেন না। কাজেই বিলটি মুসলমান সামন্ত-বুর্জোয়া শ্রেণীর সংগঠন মুসলিম লীগের একটি অংশের ‘সদিচ্ছার’ বাহন হয়েই মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় কবরস্থ হলো।
৯. তেভাগার লড়াইয়ের সফলতা ও দুর্বলতা
দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, যশোহর, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি, রংপুর, চব্বিশ পরগণা, খুলনা, হাওড়া, হুগলী, বাঁকুড়া, বীরভূম, মালদা, পাবনা, বগুড়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নদীয়া এবং ফরিদপুরে।[৫৩] এই জেলাগুলির প্রত্যেকটিতে অবশ্য একই সঙ্গে এবং একইভাবে তেভাগা সংগ্রাম গড়ে ওঠেনি। প্রত্যেক জায়গাতেই প্রথম পর্যায়ে কৃষকসভার নেতৃত্বে নিজেদের দাবীতে কৃষকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার কাহিনী অনেকাংশে স্বতন্ত্র। তাঁদের দাবীর মধ্যেও ক্ষেত্রবিশেষে অনেক তারতম্য ছিলো। তেভাগা এবং টংক প্রথার পার্থক্যই এক্ষেত্রে সব থেকে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু এই সব পার্থক্য সত্ত্বেও ১৯৪৬-৪৭-এর ব্যাপক কৃষক আন্দোলন সারা বাঙলাদেশে কৃষকদের মধ্যে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিলো। ‘জান দেবো, তবু ধান দেবো না’ এই প্রতিজ্ঞা তাঁদের মনে যে সংগ্রামের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করেছিলো সেটা পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের চেতনার স্তরকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছিলো।
নির্যাতিত-নিপীড়িত কৃষকরা তেভাগার লড়াইয়ের ময়দানে নিজেদের শত্রু-মিত্রের ভেদাভেদ, সংগ্রামের সার্বিক চরিত্র এবং স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমেই যে কৃষক আন্দোলনের সাফল্য সম্ভব এ কথা অনেক ভালোভাবে বুঝতে শিখেছিলেন। এ জন্যে তাঁদের ওপর জমিদারী-জোতদারী নির্যাতন এবং পুলিশ ও সরকারী আমলার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী হামলা যত বৃদ্ধি পাচ্ছিলো ততই তাঁরা বেশী করে উদ্দীপ্ত এবং উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে।
এ প্রসঙ্গে কৃষ্ণবিনোদ রায় নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:
রংপুর জেলার বড়গাছা গ্রামে যাইতেছি। আমাদের দেখিয়া সমিতির লোক বুঝিয়া কৃষক মেয়ে-পুরুষ ভীড় করিয়া আসিল। একটি মেয়ে বলিলেন: ‘পরশু আমরা সফলভাবে হাট হরতাল করিয়াছি।’ আর একজন বলিলেন: ‘ভলান্টিয়ার দল ধান কটিয়া ঘরে তুলিতেছে।’ জিজ্ঞাসা করিলাম: এই সংগ্রাম তোমরা শুরু করিয়াছ কেন? জবাব দিল নন্দ বর্মন: ‘এবার গোটা রংপুর স্বাধীন করিব।’ নিরক্ষর চাষী যে, রংপুরের বাইরে কোনো জায়গার নাম সে শোনে নাই। অপর কৃষক কর্মী গোলাম আজিজ আহমদ সংশোধন করিয়া তাড়াতাড়ি বলিলেন: “শুধু রংপুর নয়, গোটা বাংলা এবার স্বাধীন হইবে।’
এই অপূর্ব চেতনাই এবার বাংলার দুর্ভিক্ষ-বিধ্বস্ত কৃষকদের সাম্রাজ্যবাদের আমলা ও পুলিশের সামনে মুখোমুখি দাঁড় করাইয়া দিয়াছে। শত্রুর দল পিছু হটিতে শুরু করিয়াছে।[৫৪]
তেভাগা আন্দোলন মূলতঃ ছিলো ভাগচাষীদের আন্দোলন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আন্দোলন যখন কৃষকের সাথে জমিদার, জোতদার ও আমলা পুলিশের লড়াইয়ে পরিণত হলো তখন ভূমিহীন ক্ষেতমজুররাও সেই লড়াইয়ে এগিয়ে এলেন, হাজির হলেন সামনের সারিতে। এই সামনের সারিতে দাঁড়িয়েই দিনাজপুরের ক্ষেতমজুর সমিরউদ্দিন ও শিবরাম ১৯৪৭- এর ৪ঠা জানুয়ারী বিসর্জন দিলেন নিজেদের জীবন।[৫৫] ফসল ভাগের লড়াই দ্রুতগতিতে পরিণত হলো সকল স্তরের নির্যাতিত কৃষকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিরোধী, জমিদারী প্রথা- বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তি সংগ্রামে। তেভাগার লড়াই এভাবেই একত্রিত, উদ্বুদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হলো বাঙলাদেশের কৃষক সমাজের বিরাট এক অংশকে।
কিন্তু তেভাগা আন্দোলনের এই সবলতা সত্ত্বেও তার কয়েকটি দুর্বলতাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
কৃষকদের তেভাগার লড়াই মূলতঃ কৃষকসভার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়। বাঙলাদেশের এই কৃষকসভা প্রকৃতপক্ষে ছিলো কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রকাশ্য শ্রেণী সংগঠন। সেই হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন রণনীতিগত কাঠামোর মধ্যেই তেভাগার লড়াইকেও তাঁরা সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি তখন সাধারণ সম্পাদক পূরণচন্দ্র যোশীর নেতৃত্বে কংগ্রেস লীগের সাথে আপোষমূলক রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরেছিলো। সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোষ ও চক্রান্তে লিপ্ত কংগ্রেসে লীগ নেতৃত্বের প্রতি এ দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি কোন স্বাধীন ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি। সামন্ত-মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান কংগ্রেস লীগকে পুরোপুরিভাবে জাতীয় বুর্জোয়া পার্টি আখ্যায় ভূষিত করে তারা সেই পর্যায়ে তাদের নেতৃত্ব স্বীকার করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে জোরদার করার নীতি অবলম্বন করেছিলো। এই উদ্দেশ্যে যোশী ধ্বনি তুলেছিলেন, ‘কংগ্রেস লীগ এক হও হাতে হাত বেঁধে লও’; এই উদ্দেশ্যেই তাঁরা নিযুক্ত ছিলেন গান্ধী-জিন্নাহর মিলন ঘটাতে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির এই রণনীতির ফলে তার প্রকাশ্য শ্রেণী সংগঠন
কৃষক সভা কর্তৃক অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আহ্বান দেওয়া সত্ত্বেও তেভাগা আন্দোলনকে সত্যিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণআন্দোলনের পথে চালনা করা তাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি এর ফলে অনেক সময় বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, কৃষকরা যেখানে সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত সেখানে মধ্যশ্রেণী থেকে আগত নেতা ও কর্মীরা কৃষকদেরকে সংগ্রামের পথ থেকে সুকৌশলে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় নিযুক্ত থেকেছেন।
এঁদের মধ্যে অনেকে সে সময় তেভাগা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বক্তব্য উপস্থিত করতে গিয়ে বলেন যে, কৃষকরা অবিপ্লবী শ্রেণী, শ্রমিকরাই হলো আসল বিপ্লবী। কাজেই কৃষক আন্দোলনের পরিবর্তে পার্টির উচিত শ্রমিক আন্দোলনেই সর্বশক্তি নিয়োগ করা।[৫৬]
আসলে এই সমস্ত কৃষকসভা কর্মীরা কৃষকের প্রতিনিধি ছিলেন না, তারা ছিলেন নিজেদের মধ্যশ্রেণীর প্রতিনিধি। শ্রমিক আন্দোলনের দ্বারা সেই পর্যায়ে তাঁদের শ্রেণীগত স্বার্থ কোন প্রকারে ক্ষুণ্ন হতো না, কিন্তু তেভাগার আঘাত তাঁদের ওপর সরাসরিভাবে এসে পড়তো। কাজেই কৃষকদেরকে অবিপ্লবী আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন গঠনের প্রস্তাব!
বাস্তব সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই ধরনের কৃষক নেতাদের প্রভাব অনেক সময় অনেকভাবে কার্যকর হতো। পার্টির মধ্যে আপোষমূলক রাজনীতির প্রভাব, তার মধ্যে মধ্যবিত্তের অবাধ অনুপ্রবেশ এবং শুধু অনুপ্রবেশই নয়, তাদের নেতৃত্বই বস্তুতঃপক্ষে তেভাগার আন্দোলনকে অধিকতর জঙ্গী এবং ব্যাপক আন্দোলনে পরিণত করার ক্ষেত্রে ছিলো এক মস্ত ও দুরতিক্রম্য বাধা।
১০. তেভাগার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা
তেভাগার লড়াইয়ের ফলে বাঙলাদেশের ঊনিশটি জেলার অনেকগুলি অঞ্চলে বাস্তবক্ষেত্রে তেভাগার দাবী স্বীকৃত হয়। আন্দোলনের জোয়ার ডাকিয়ে, জমিদার-জোতদারদের বুকে কাঁপন তুলে, কৃষকেরা সরকারী আইনের অপেক্ষা না রেখেই শ্রেণীশত্রুদের থেকে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে সমর্থ হন। কিন্তু তাঁদের এই সাফল্য বেশীদিন তাঁরা ধরে রাখতে পারেননি। মুসলিম লীগের তেভাগা বিলের আশ্বাস, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের আশ্বাস ইত্যাদির ওপর আস্থা রেখে তাদের সাথে একটা আপোষ করার চেষ্টায় কৃষকসভাও শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনকে চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প থেকে বিচ্যুত হয়। এর ফলে কৃষকরা নিজেদের রক্তের বিনিময়ে ফসল ভাগের লড়াইয়ে যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন জমিদার- জোতদাররা তা আবার তাঁদের থেকে সম্পূর্ণভাবে ছিনিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে কংগ্রেস লীগ নেতৃত্ব এবং সরকারী আমলা পুলিশ হয় তাদের নিশ্চিত এবং নির্ভরযোগ্য সহায়ক। তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস এবং তৎকালীন কৃষকসভা নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে দেখা যায় তেভাগা আন্দোলন অর্থনীতিবাদী আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও জমিদার, জোতদার ও সরকারী প্রতিরোধের মুখে তা ক্রমশঃই অধিকতর জঙ্গী আকার ধারণ করেছিলো, ক্রমশঃই তা পরিগ্রহ করছিলো একটা রাজনৈতিক চরিত্র।
তেভাগার লড়াইকে রাজনৈতিক লড়াইয়ে পরিণত করার ক্ষেত্রে কৃষকরা নিজেরা যে পিছিয়ে ছিলেন না এবং উপযুক্ত নেতৃত্ব যে তাঁদেরকে আরও কঠোর সংগ্রামের পথে চালনা করতে সমর্থ হতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষকসভা কৃষকদের এই আন্দোলনকে সংস্কারবাদী রাজনীতির গণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে সচেষ্ট ছিলো। এজন্যেই তেভাগার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বৈপ্লবিক রাজনীতিক আন্দোলন হিসেবেই ১৯৪৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত কোন প্রকারে টিকে থাকে। তারপর শুরু হয় কৃষকদের ওপর জমিদার-জোতদারদের নোতুন হামলা।
তেভাগার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, সংস্কারবাদী আন্দোলন এক পর্যায়ে যতই জঙ্গী হোক কৃষকের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যতীত তার সাফল্যকে কোন রকমে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। আন্দোলনের সময় কৃষকরা তেভাগার অধিকারে কিছুদিন নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত রেখেছিলেন তাঁদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে। যে মুহূর্তে সেই শক্তি নিশ্চিহ্ন হলো সেই মুহূর্তে তাঁদের সাফল্যটুকু হারিয়ে গেলো, সরকারী শাসনযন্ত্রের সহায়তায় জোতদাররা নিজেদের আধির অধিকার আবার প্রতিষ্ঠা করলো।
শুধু এলাকাগত রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য নয়। একথা প্রযোজ্য সামগ্রিকভাবে শ্রমিক, কৃষকের শক্তিশালী সংগঠন এবং তাদের দ্বারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রেও। জমিদার-জোতদাররা তাদের অধিকারে জমির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত, কারণ রাষ্ট্র তাদের। কৃষকরা যতই জঙ্গী অর্থনীতিবাদী আন্দোলন করুন যে পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁদের শ্রেণীশত্রুদের হাতে সে পর্যন্ত তাঁরা কোন ক্ষেত্রেই নিরাপদ নন। তাই শ্রমিক-কৃষকদের শ্রেণীস্বার্থ নিরাপদ হতে পারে একমাত্র তখনই যখন রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁদের আয়ত্তাধীন। এই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াই ব্যতীত কৃষক-শ্রমিকের শ্রেণীগত প্ৰতিষ্ঠা এবং স্বার্থরক্ষার অন্য কোন পথ নেই।
তথ্যসূত্র
১ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষীর লড়াই, পৃ ১৩; বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার পক্ষে বগলা গুহ কর্তৃক ২৪৯, বহুবাজার স্ট্রীট, কলিকাতা থেকে প্রকাশিত।
২ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩-১৪।
৩। পূর্বোক্ত, পৃ ১৫।
৪ পূর্বোক্ত, পৃ ২০।
৫ পূর্বোক্ত, পৃ ২২।
৬ (কারী) মাহমুদ আলী, চাষীদের ‘তেভাগা’ দাবী রোধ করা যাইবে না, সাপ্তাহিক মিল্লাত, ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ২৭শে ডিসেম্বর, ১৯৪৬।
৭ Memorandum, P70.
৮ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষীর লড়াই, পূর্বোক্ত পৃ ১৭-১৮।
৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১৮-১৯।
১০ সত্যেন সেন, গ্রাম বাঙলার পথে পথে, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭০, কালি-কলম প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ ৮।
১১ পূর্বোক্ত।
১২ পূর্বোক্ত, পৃ ১০।
১৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১১-১২।
১৪ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষীর লড়াই, পূর্বোক্ত পৃ ২৩-২৫।
১৫ পূর্বোক্ত, পৃ ২৩।
১৬ কৃষ্ণবিনোদ রায়, পূর্বোক্ত, পৃ ২৩
১৭ Memorandum, P 70-71.
১৮ কৃষক কর্মীদের শিক্ষা কোর্স, পূর্বোক্ত, পৃ ৭১-৭২’, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ রসুল কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৪৩।
১৯ Memorandum, P ৪9.
২০ কৃষক কর্মীদের শিক্ষা কোর্স, পূর্বোক্ত, পৃ ৭৫
২১ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষীর লড়াই, পৃ ২৩-২৪।
২২ পূর্বোক্ত, পৃ ২৪।
২৩ পূর্বোক্ত, পৃ ২৫।
২৪ পূর্বোক্ত।
২৫ পূর্বোক্ত, পৃ ২৬।
২৬ পূর্বোক্ত, পৃ ২৭।
২৭ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষীর লড়াই, পূর্বোক্ত পৃ ২৮-২৯।
২৮ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭।
২৯ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৯।
৩০ সত্যেন সেন, গ্রাম বাঙলার পথে পথে, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭০, পৃ ১৭।
৩১ জিতেন ঘোষ, গরাদের আড়াল থেকে, প্রথম সংস্কারণ, সেপ্টেম্বর, ১৯৭০, পৃ ৪১।
৩২ সত্যেন সেন, গ্রাম বাঙলার পথে পথে, পৃ ১৪-৩০।
৩৩ সত্যেন সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ৯৮-১০৯।
৩৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১২৪-১৩৫।
৩৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৪-১৫৯।
৩৬ (ঙ)-এর বিবরণ : আবদুল হক, অমল সেন।
৩৭ জিতেন ঘোষ, গরাদের আড়াল থেকে, পূর্বোক্ত, পৃ ৯৮-১০৫।
৩৮ সত্যেন সেন, ঢাকা জেলার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি রক্ত-রাঙ্গা অধ্যায়, মেহনতী মানুষ, সত্যেন সেন ও বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, ১৯৭৬, পৃ ১০-১১।
৩৯ জিতেন ঘোষ, গরাদের আড়াল থেকে, পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৫।
৪০ সত্যেন সেন, মেহনতী মানুষ, পৃ ৯।
৪১ সত্যেন সেন, গ্রাম বাঙলার পথে পথে, পূর্বোক্ত, পৃ ৪৪-৪৯ এবং জিতে ঘোষ, গরাদের আড়াল থেকে, পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৫।
৪২. কৃষক কর্মীদের শিক্ষা কোর্স, পূর্বোক্ত, পৃ ১১-১২।
৪৩ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষীর লড়াই, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৫-৩৬।
৪৪ সত্যেন সেন, গ্রাম বাঙলার পথে পথে, পূর্বোক্ত, পৃ ২৪-২৮।
৪৫ জিতেন ঘোষ, গরাদের আড়াল থেকে, পূর্বোক্ত, পৃ ১০৮-৯।
৪৬ পূর্বোক্ত, পৃ ৬২।
৪৭ শান্তি সেন।
৪৮ জিতেন ঘোষ, গরাদের আড়াল থেকে, পূর্বোক্ত, পৃ ১০৭।
৪৯ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষীর লড়াই, পূর্বোক্ত, পৃ ২৯-৩০।
৫০ পূর্বোক্ত, পৃ ৩০।
৫১ বিবরণ সাপ্তাহিক মিল্লাত, ৩১শে জানুয়ারী, ১৯৪৭, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা থেকে গৃহীত।
৫২ আবুল হাশিম।
৫৩ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষীর লড়াই, পূর্বোক্ত, পৃ ২।
৫৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৯-১০।
৫৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৮।
৫৬ জিতেন ঘোষ, গরাদের আড়াল থেকে, পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৩।