পরিশিষ্ট – চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও তেভাগা আন্দোলন প্রসঙ্গে

পরিশিষ্ট – চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও তেভাগা আন্দোলন প্রসঙ্গে

এ বৎসর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (CPI) পশ্চিমবঙ্গ শাখার উদ্যোগে ‘তেভাগা’ রজত জয়ন্তী উদযাপন করা হয় এবং বিগত মে মাসে উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে ‘তেভাগা সংগ্রাম’ নামে একটি স্মারক গ্রন্থ তাঁরা প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটিতে পশ্চিম বাঙলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের কতকগুলি প্রবন্ধের সাথে বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির শ্রী মণি সিংহ, শ্রী গুরুদাস তালুকদার এবং শ্রী মণিকৃষ্ণ সেনের তিনটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। শেষোক্ত এই প্রবন্ধ তিনটির মধ্যে শ্রী মণি সিংহ-এর ‘তেভাগা সংগ্রামের স্মৃতিকথা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সম্পর্কেই আমি বিশেষভাবে এখানে কিছু আলোচনা করবো।

শ্রী মণি সিংহ-এর এই প্রবন্ধটির প্রতি আমার পক্ষপাতিত্বের কারণ একটু ব্যক্তিগত হলেও কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ব্যাপারের মধ্যেই তার গুরুত্ব সীমাবদ্ধ নেই। সেটা থাকলে প্রবন্ধটি নিয়ে এভাবে আলোচনার কোন প্রয়োজন হতো না। এ প্রয়োজন বোধ করছি এ কারণে যে, ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে গিয়ে শ্রী মণি সিংহ তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণভাবে যে সমস্ত বক্তব্য উপস্থিত করেছেন তা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর, মারাত্মক এবং বিপজ্জনক!

একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর উপরোক্ত প্রবন্ধটিকে আন্দোলনের সূচনা, জোতদার-পুলিশের মিলিত হামলা, তেভাগা সংগ্রামের বৈশিষ্ট্য, সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং ছিদ্রান্বেষীদের কুৎসার জবাবে এই পাঁচটি শীর্ষে বিভক্ত করা হয়েছে। ‘ছিদ্রান্বেষীদের কুৎসার জবাবে’ শীর্ষক অংশটির আরম্ভ নিম্নরূপ:

আমার মূল কথা হইল যে, অবিভক্ত বাঙলায় ১৯৪৬-৪৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভা যে তেভাগা সংগ্রাম পরিচালনা করিয়াছিল সে সংগ্রাম যুগ যুগ পশ্চাৎপদ ও শোষিত কৃষকদের, এমনকি কৃষক নারীদের মধ্যে এক নতুন জীবনের সঞ্চার করিয়াছিল।
কিন্তু বাঙলাদেশে এমন লোকও আছেন যাঁহারা কমিউনিস্ট পার্টির ঐ অবদান স্বীকার করার চাইতে পার্টির ত্রুটি খুঁজিতেই ব্যস্ত। উদাহরণ-স্বরূপ, জনাব বদরুদ্দীন উমরের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক’ বইটির কয়েকটি মন্তব্যের উল্লেখ করা যায়।[১]

কমিউনিস্ট পার্টির ‘ত্রুটি খুঁজিতে’ আমি কিভাবে ব্যস্ত হয়েছি তার বিবরণের পূর্বে শ্রী মণি সিংহ যেমন এই সাধারণ মন্তব্য করেছেন, তেমনি আমিও তাঁর অপরাপর কতগুলি বিশেষ মন্তব্য সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে সাধারণভাবে তেভাগা আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে আমার বইটির মুখবন্ধে যা বলেছি সেটা প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই। কংগ্রেস, কৃষক-প্রজা পার্টি, মুসলিম লীগ ইত্যাদি সংগঠনগুলি বাঙলাদেশের কৃষক সমাজকে কি দৃষ্টিতে দেখতো এবং আন্দোলন করার নামে কৃষকদের কিভাবে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে তারা ব্যবহার করতো অতি সংক্ষিপ্তভাবে সে কথা বলার পর কৃষকসভা ও তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে আমি মুখবন্ধটিতে বলেছি:

এসব সত্ত্বেও বাঙলাদেশে কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা মস্ত ব্যতিক্রম এনেছিলো কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন কৃষকসভা। এই সংগঠনটির মাধ্যমে এদেশের কৃষক সমাজের এক ব্যাপক অংশ শ্রেণীগতভাবে সংগঠিত হয়েছিলেন। কৃষকসভা নেতারা নির্বাচন জয়ের মতলবে কৃষক রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করেননি। তাঁরা কৃষক রাজনীতির মাধ্যমে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কৃষক-শ্রমিক ঐক্য, এর মাধ্যমে তাঁরা চেয়েছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনীতির প্রধান মিত্র এবং মূল শক্তি হিসেবে কৃষকদের সংগঠিত করতে। এ জন্যেই তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে সত্যিকার কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করা, তেভাগাকে একটি জঙ্গী আন্দোলন হিসেবে এগিয়ে নিয়ে বাঙলাদেশের সামন্ত স্বার্থের বিরুদ্ধে পরিচালনা করা। এ আন্দোলনের অনেক ভুল-ত্রুটি থাকলেও এই আন্দোলনই আজ পর্যন্ত বাঙালাদেশের সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবময়।

উপরোক্ত ভাষায় তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির ও কৃষক সভার বিরুদ্ধে ‘কুৎসা রটনা’ এবং তেভাগা আন্দোলনের ‘ছিদ্রান্বেষণের’ পর আমি কি কি বক্তব্য উপস্থিত করার ফলে শ্রী মণি সিংহ-এর বিরাগভাজন হয়ে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক’ বইটি লেখার জন্যে ধিকৃত হয়েছি এবার সেটা দেখা দরকার।

শ্রী মণি সিংহ আমার বই থেকে যে বক্তব্যটি উল্লেখ করেছেন তা হলো এই:

কৃষকসভা কর্তৃক অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আহ্বান দেওয়া সত্ত্বেও তেভাগা আন্দোলনকে সত্যিকার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণ-আন্দোলনের পথে চালনা করা তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। এর ফলে অনেক সময় বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কৃষকরা যেখানে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত, যেখানে মধ্যশ্রেণী থেকে আগত অনেক নেতা ও কর্মী কৃষকদের সংগ্রামের পথ থেকে সুকৌশলে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় নিযুক্ত থেকেছেন।

এঁদের মধ্যে অনেকে সে সময় তেভাগা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বক্তব্য উপস্থিত করতে গিয়ে বলেন যে, কৃষকরা অবিপ্লবী শ্রেণী, শ্রমিকরা হলো আসল বিপ্লবী। কাজেই কৃষক আন্দোলনের পরিবর্তে পার্টির উচিত শ্রমিক আন্দোলনেই সর্বশক্তি নিয়োগ করা।[২]

আমার এই বক্তব্য উল্লেখ করে মণি বাবু তাঁর প্রবন্ধটিতে বলছেন:

কিন্তু উমর সাহেবের এই সমালোচনার মূলেই ভুল। তেভাগা সংগ্রাম ছিল সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থার সংস্কারের সংগ্রাম। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভা সে দৃষ্টি নিয়াই সে সংগ্রাম পরিচালনা করিয়াছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভার নেতৃত্ব সে সংগ্রামকে ‘সাম্রাজ্যবাদ- বিরোধী বিপ্লব’ বা ‘ক্ষমতা দখলের’ সংগ্রাম হিসাবে দেখে নাই এবং সে পথে পরিচালনা করার ব্যর্থ প্রয়াসও করে নাই। তখন ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অবস্থা ছিল, জনগণের উপর কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যে প্রভাব ছিল, সেই বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তেভাগা সংগ্রামকে ‘ক্ষমতা দখলের’ সংগ্রামের পথে চালনা করার চিন্তাও হইত বাতুলতা মাত্র। এই কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভা সে পাগলামির পথে যায় নাই। তাহারা সঠিকভাবে তেভাগা সংগ্রামকে মূলত সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রামরূপেই পরিচালিত করিয়াছিল।
কিন্তু উমর সাহেব তেভাগা সংগ্রামের মূল দাবি, তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভৃতি বাস্তব অবস্থা বিচার না করিয়াই কৃষকসভা তেভাগা সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণ- আন্দোলনের পথে চালনা করিতে ব্যর্থ হইয়াছে বলিয়া সমালোচনা করিয়া তাঁহার বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে চাহিয়াছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহাতে তেভাগা সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁহার অজ্ঞতাই প্রমাণ পাইয়াছে।[৩]

যে কোন ঔপনিবেশিক এবং আধা-ঔপনিবেশিক দেশে সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রাম এবং তার সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সম্পর্ক সম্বন্ধে শ্রী মণি সিংহ যে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং গভীর জ্ঞানের পরিচয় এখানে দিয়েছেন সেটা নিশ্চয়ই নিম্নতম রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীদের এবং মার্কস লেনিনের অন্ততঃ দুই একটি মূল গ্রন্থ পাঠ করেছেন এমন ব্যক্তিদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না। কারণ তাঁরা সকলেই জানেন যে, যে কোন ঔপনিবেশিক এবং আধা-ঔপনিবেশিক দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ সুকঠিন গাঁটছড়ায় পরস্পরের সাথে আবদ্ধ থাকে। সামন্তবাদকে নানাভাবে টিকিয়ে রেখে, তাকে নবজীবনদানের বিবিধ রকম চেষ্টার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ একদিকে যেমন দেশীয় পুঁজিবাদের বিকাশকে বাধা দেয়, অন্যদিকে তেমনি তারা সামন্তবাদী শক্তিসমূহকে ভিত্তি করেই গড়ে তোলে নিজেদের দেশীয় সমর্থনের বুনিয়াদ। সারা ভারতবর্ষ এবং বিশেষত বাঙলাদেশেও, ঠিক সে রকমটিই ঘটেছিলো। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বৃটিশ শাসন এদেশে সামন্তবাদকে নবজীবন দান করে একদিকে যেমন দেশীয় পুঁজির বিকাশকে রোধ করেছিলো এবং অন্যদিকে তেমনি নিজেদের শাসনের স্বপক্ষে একটি শক্তিশালী দেশীয় শ্রেণী স্বার্থকে নিজেদের স্বার্থের গাঁটছড়ায় আবদ্ধ করেছিলো একথা শ্রী মণি সিংহ-এর কাছে অজ্ঞাত থাকলেও এদেশের অতি সাধারণ প্রগতিশীল কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে সুবিদিত। সামন্তবাদের সাথে সাম্রাজ্যবাদের এই সম্পর্কের জন্যই আমাদের দেশের কোন সামন্ত-বিরোধী সংগ্রামই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চরিত্র পরিগ্রহ না করে পারেনি। ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে কৃষকদের যে সমস্ত খণ্ডযুদ্ধ ও জঙ্গী অর্থনৈতিক সংগ্রাম ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত হয়েছে তার প্রত্যেকটিই সেজন্য অনিবার্যভাবে পরিচালিত হয়েছে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় পরিণত না হয়ে পারেনি। এ জন্যেই কমিউনিস্ট পার্টি ইংরেজী মাসিক পত্র ‘কমিউনিস্ট’- এর সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সংখ্যায় তেভাগা সংগ্রাম সম্পর্কে তৎকালীন বাঙলাদেশের বিখ্যাত ও প্রভাবশালী নেতা ভবানী সেন বলেন, ‘এই আন্দোলন জনগণের গণতন্ত্রের উত্তাল তরঙ্গের প্রতীক, যে গণতন্ত্র ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী ব্যবস্থার সকল অবশেষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করবে।’

এবার তেভাগা আন্দোলন ও তার সাথে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের সম্পর্ক সম্বন্ধে তৎকালীন কৃষকসভার বক্তব্য কি ছিলো সেটা দেখা যাক। কৃষকদের তেভাগা সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে বর্ণনা করে ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা কর্তৃক প্রকাশিত এবং কৃষকসভার নেতা শ্রী কৃষ্ণবিনোদ রায়* কর্তৃক লিখিত ‘চাষীর লড়াই’ নামক একটি পুস্তিকাতে বলা হয়:

সুতরাং গ্রামের সমাজ জীবনে ও অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ যে শিকড় গাড়িয়াছে তাহা উপড়াইয়া ফেলিতে হইবে। গ্রামের জমিদার-জোতদার ও সাম্রাজ্যবাদী প্রতিনিধিদের দুর্নীতির রাজত্বের অবসান করিতে হইবে। তাহারই জন্য যে সংগ্রাম, তাহাই সামন্ততান্ত্রিক শোষণ হইতে কৃষককে মুক্ত করিবে, জমিদারী প্রথা ধ্বংস করিয়া কৃষককে জমি দিবে, সাম্রাজ্যবাদী শাসন ধ্বংস করিয়া সমগ্র দেশবাসীকে দিবে মুক্তি ও নবজীবন, গড়িয়া উঠিবে মিলিত হিন্দু-মুসলমান-বাঙ্গালীর স্বাধীন, সুখী নূতন বাঙলাদেশ। হাজার হাজার গ্রামে ধানের ক্ষেতে তেভাগার যে অপূর্ব লড়াই চালিয়াছে, টংক ও জমি হইতে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হইয়াছে, জমিদারী ধ্বংস করার জন্য যে গণ-অভ্যুত্থান জাগিয়া উঠিতেছে তাহা কৃষি বিপ্লবেরই সূচনা, স্বাধীনতার চরম সংগ্রামের প্রারম্ভ মাত্র।[৪]

[* কৃষ্ণবিনোদ রায় ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপরা ওয়ার্ডে গুলিবর্ষণের সময় সেখানে ছিলেন পরবর্তীকালে ভারতীয় ইউনিয়নে চলে যান। এখন তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (CPI) একজন নেতা। তেভাগা সংগ্রাম নামক স্মারক গ্রন্থটিতে এঁরও একটি প্রবন্ধ আছে।]

‘আগে স্বাধীনতা লাভ কর, তারপর জমিদারী উচ্ছেদ’ এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে উপরোক্ত পুস্তিকাটিতে বলা হয়:

আমলাতন্ত্র ও জমিদারী একটিকে অপর হইতে বিচ্ছিন্ন করা যায় না; জমিদারী, মজুতদারী বাঁচাইয়া রাখিয়া সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করা যায় না।
‘আজ বাঙলার গ্রামে গ্রামে ফসল রক্ষার লড়াইতে কৃষকরা যে চেতনা লইয়া পুলিশের সহিত লড়িতেছে, মিলিটারীর আঘাত প্রতিহত করার কথা ভাবিতেছে – সে চেতনা স্বাধীনতা- যুদ্ধের শেষ লড়াইয়ের দৃঢ় প্রেরণা। কৃষক, মজুর, মধ্যবিত্তের ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতার লড়াই গ্রামে জমিদার-জোতদার, মজুতদারের বিরুদ্ধে, শহরে বিদেশী মূলধনের বিরুদ্ধে ও ধনিকের অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে।[৫]

মণিবাবু বলেছেন, “তখন ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অবস্থা ছিল, জনগণের উপর কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যে প্রভাব ছিল, সেই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তেভাগার সংগ্রামকে ‘ক্ষমতা দখলের’ সংগ্রামের পথে চালনা করার চিন্তাও হইত বাতুলতা মাত্র।”৬ আমার ‘বাতুলতার’ উল্লেখ করে মণিবাবু আমার প্রতি যেভাবে তাঁর অদ্ভুত বিদ্রূপ নিক্ষেপ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখে এবার দেখা দরকার তৎকালীন কৃষকসভা ‘বাতুলতা’ প্রকাশের ক্ষেত্রে আমার থেকে পিছিয়ে ছিলো কিনা। ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস লীগ সরকার যখন দিল্লীতে বৃটিশ সরকারের সাথে আপোষ আলোচনায় ব্যস্ত তখন ভারতবর্ষের শ্রমিক-কৃষকরা ব্যাপকভাবে সাম্রাজ্যবাদের আর্থিক বুনিয়াদের ওপর আঘাত হানছিলেন, ধর্মঘট ও জমি দখলের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই লড়াইকে সম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা নিম্নোক্ত ভাষায় কৃষক-শ্রমিকের প্রতি আহ্বান জানান:

তাই গ্রামে যে লড়াই চলিতেছে তাহা চরম কৃষি বিপ্লবের সূচনা, কারখানায় ও অফিসে যে ধর্মঘট চলিয়াছে তাহা চূড়ান্ত সাধারণ ধর্মঘটের প্রস্তুতি, সারা দেশে যে বিপ্লবের বান ডাকিয়াছে তাহা স্বাধীনতার শেষ সংগ্রামের আহ্বান। সাম্রাজ্যবাদ যখন রাষ্ট্রগঠন পরিষদের মায়াজাল রচনা করিয়া দিল্লীতে বসিয়া এ দেশে সাম্রাজ্য কায়েম করিবার সুখস্বপ্ন দেখিতেছে, এবং নেতৃবৃন্দ যখন আপোষ ও বিভেদের পথে চলিতেছে, কৃষক-মজুর ও মধ্যবিত্ত জনসাধারণ তখন সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুর পরোয়ানা স্বাক্ষর করিতেছে। বিপ্লবী ছাত্র ও মহিলারাও মজুর শ্রেণীর সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের এই লড়াইয়ের সমর্থনে আগাইয়া আসিয়াছে। আসুন সকলে মিলিয়া শেষবারের মতো সাম্রাজ্যবাদের বুকে চরম আঘাত হানি, সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস স্তূপের উপর কৃষক-মজুর-মধ্যবিত্তের নূতন বাংলা গড়িয়া তুলি।[৭]

এ কৃষকসভা যে তেভাগা আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের পথে চালনা করার রাজনৈতিক আহ্বানও অনেক ক্ষেত্রে জানিয়েছিলেন এ কথা লিখে আমি ‘বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে গিয়ে যে তেভাগা সংগ্রাম সম্পর্কে কোন ‘অবিজ্ঞতার’ পরিচয় দান করি নাই কৃষকসভা কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে উপরোক্ত তিনটি উদ্ধৃতিই তার চূড়ান্ত প্রমাণ। এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্যকে বাতুলতা বলে বর্ণনা করার ফলে শ্রী মণি সিংহ সম্পর্কে কয়েকটি ধারণা যে কোন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির মনে স্বভাবতঃই দেখা দিতে পারে এবং আমার মনেও সেগুলি দেখা দিয়েছে। ধারণাগুলি হলো এইঃ (ক) শ্রী মণি সিংহ চল্লিশের দশকের একজন নামজাদা কৃষক নেতা এবং হাজং আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বলে পরিচিত হলেও কৃষকসভার তৎকালীন নীতি এবং যে সমস্ত পত্র-পত্রিকা ও পুস্তক-পুস্তিকার মাধ্যমে সেইসব নীতি প্রচারিত হতো সেগুলির সাথে তাঁর কোন পরিচয় ছিল না। অর্থাৎ কৃষক নেতা হিসেবে তিনি যে শুধু মার্কস, লেলিন, মাও-সে-তুঙ পড়ার কোন প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন না তাই নয়। নিজেদের সংগঠন কর্তৃক প্রচারিত বইপত্র পাঠের কোন তোয়াক্কাও তিনি রাখতেন না। সেটা রাখলে শুধু উপরোক্ত পুস্তিকাটি নয়, অন্যান্য পুস্তক-পুস্তিকা, দৈনিক স্বাধীনতা, সাপ্তাহিক জনযুগ ও Peoples Age, মাসিক কমিউনিস্ট ইত্যাদিতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে যেসব বক্তব্য তখন অহরহ প্রচার করা হতো সেগুলির সাথেও তাঁর ক্ষীণতম পরিচয় থাকতো। কৃষক সংগ্রামের বিশেষতঃ তেভাগা সংগ্রামের, সাম্রাজ্যবাদ- বিরোধী চরিত্রের উল্লেখ করাতে আমার ওপর তিনি ‘মার মার কাট কাট রব তুলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তার থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সে পরিচয় তাঁর বিন্দুমাত্র ছিল না, অথবা দৈবক্রমে থাকলেও তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সে পরিচয় আজ গোপন করছেন। (খ) কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভয়ে কম্পমান* শ্রী মণি সিংহ কংগ্রেস-লীগের তৎকালীন প্রভাব ও জনপ্রিয়তার যুগে তেভাগা সংগ্রামকে ‘ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের পথে চালনা করার চিন্তাকে পর্যন্ত বাতুলতা আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, ‘কৃষকসভা সে পাগলামির পথে যায় নাই।’ শ্ৰী মণি সিংহ-এর মতে ‘বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি সে ‘পাগলামির পথে’ যায়নি তা শ্ৰী সিংহ-এর নিজের উক্তি থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু কৃষকসভা যে সে পাগলামির পথ ধরার জন্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন সেটা পূর্বেও উল্লেখ করেছি। কংগ্রেস-লীগের প্রভাব, জনপ্রিয়তা ও বিরোধিতার মুখে কৃষকসভা শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের কাছে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুদ্ধকে নিজেদের অর্থনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাকে উত্তীর্ণ হয়েও জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে যে বাস্তব জ্ঞান ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলো তাকে সরাসরি অস্বীকার করে, তাকে ‘বাতুলতা’ ‘পাগলামি’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে কৃষকসভার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে তার কৃতিত্বকে খর্ব করেছে কে, আমি না শ্রী মণি সিংহ-এর মত জমিদার শ্রেণী থেকে আগত ‘বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন’ কৃষক নেতা, সেটা এক্ষেত্রে অবশ্যই একটা বিচার্য বিষয় (গ) শ্রী মণি সিংহ বলছেন, কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভা ‘তেভাগা আন্দোলনকে মূলতঃ সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রামরূপেই পরিচালিত করিয়াছিল। কোন ঔপনিবেশিক অথবা আধা-ঔপনিবেশিক দেশে কোন আন্দোলনকে ‘মূলতঃ’ সামন্তবাদ- বিরোধী সংগ্রাম হিসেবে পরিচালনা করে যে, তার দ্বারা সামন্তবাদকে উচ্ছেদ করা যায় না, সে উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে প্রাথমিক সংগ্রাম যে শ্রেণী সংগ্রামকে বিস্মৃত না হয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই করতে হয়, একথা পণ্ডিতপ্রবর শ্রী মণি সিংহ যে মোটেই জানেন না অথবা জানতে চান না একথা বলাই বাহুল্য। তাঁর নিজের বক্তব্য এবং স্বীকৃতি থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তিনি নিজের এলাকায় কৃষক সংগ্রামকে কিভাবে পরিচালনা করেছিলেন। কৃষক সংগ্রামকে, হাজংদের সংগ্রামকে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিতে তৎকালীন কৃষকসভার ব্যর্থতার জন্যে শ্রী মণি সিংহ-এর মতো জমিদার শ্রেণী থেকে আগত নেতাদের ‘বাস্তববাদী কৌশল’ (সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রচেষ্টার মধ্যে যে কৌশলের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি) যে কতখানি দায়ী ছিলো শ্রী মণি সিংহ-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য তারই একটি অভ্রান্ত প্রমাণ। সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রামের বিকাশ একমাত্র সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের মধ্যেই সম্ভব। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ- বিরোধী সংগ্রামের বাস্তব প্রয়োজনীয়তা এবং সম্ভাব্যতাকে কার্যক্ষেত্রে অস্বীকার করে এই ধরনের কৃষক নেতারা যে কৃষক সংগ্রামের বিকাশের ক্ষেত্রে কি ধরনের বাধা সৃষ্টি করেছিলেন, জমিদার ও মধ্যশ্রেণীর প্রতিনিধিরূপে অতিশয় চাতুর্যের সাথে কিভাগে কৃষক আন্দোলনের পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাত করেছিলেন, সে কথার উল্লেখ যে শ্রী মণি সিংহ-এর মতো বিপ্লবীর বিরুদ্ধে ‘কুৎসা রটনা’ অথবা তাঁর ‘ছিদ্রান্বেষণ’ নয়, তার প্রমাণ মণিবাবু নিজেই হাজির করেছেন।

[* শ্রী মণি সিং এবং তাঁর দলভুক্ত লোকদের এই ধরনের কাঁপুনি আজ পর্যন্ত থামেনি। এখনো আওয়ামী লীগকে কংগ্রেস লীগের স্থলাভিষিক্ত করে তাঁরা বলছেন জনগণের ওপর আওয়ামী লীগের যে প্রভাব তাতে করে এই বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক-কৃষকদেরকে ‘ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের পথে চালনা করার চিন্তাও বাতুলতা মাত্র। সে পথে পা বাড়ানো পাগলামিরই নামান্তর!]

আমার উপরোক্ত ধারণাগুলি ব্যক্ত করার পর এবার উল্লেখ করা দরকার যে, ‘তেভাগা সংগ্ৰাম নামে স্মারক গ্রন্থটির মুখবন্ধে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বাঙলা রাজ্য কমিটির সম্পাদক শ্রী গোপাল বন্দোপাধ্যায় তেভাগা সংগ্রামের মূল চরিত্র নিম্নলিখিত ভাষায় বর্ণনা করেছেন : ‘১৯৪৬-৪৭ সালে অবিভক্ত বাঙলাদেশে তেভাগার লড়াই হয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সেই লড়াই ছিল একদিকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং তারই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ-সৃষ্ট জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে গ্রামের গরীবদের সামন্ততন্ত্র-বিরোধী প্রচণ্ড অভিযান’। এ বর্ণনা যে শ্রী মণি সিংহ-এর বক্তব্যের ক্ষেত্রে আদৌ সহায়ক নয়, উপরন্তু সে বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধী সে কথা বলাই বাহুল্য! এবার শ্রীমণি সিংহ-এর নিজের প্রবন্ধটির নীচে উদ্ধৃত অংশটি বিচার করা যাক :

ময়মনসিংহ জেলার কৃষক আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিলো টংক আন্দোলন, যার লক্ষ্য ছিল টংক প্রথার উচ্ছেদ। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে পূর্বে ও পশ্চিমে ইহার বিস্তার ছিল ৭০ মাইল। মুসলিম গ্রাম দশাল হইতে ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই আন্দোলন শুরু হয়। কয়েকটি পর্যায়ে এই আন্দোলন চলিয়া অবশেষে ১৯৫০ সালে জমিদারী দখল আইনের মাধ্যমে টংক প্রথা উচ্ছেদ হয় – আন্দোলনের হয় সমাপ্তি। এই সংগ্রামে ৬০ জন মেয়ে-পুরুষ হাজং, ডালু কৃষক শহীদ হন। বিচিত্র এই আন্দোলন, মহান তার আবেগ। সাম্রাজ্যবাদ আর সামন্তবাদ উচ্ছেদের দৃঢ় সংকল্প লইয়া কৃষক বধূ-মাতা- কন্যা ও সন্তানেরা সংগ্রামে আগাইয়া আসেন। এই আন্দোলনে যাঁহারা শহীদ হইয়াছেন তাঁহাদের অধিকাংশেরই কোন টংক জমি ছিল না। দেশপ্রেমের এই অমর কাহিনী আজ দেশবাসী অধিকাংশেরই অজানা।[৮]

শ্রী মণি সিংহ-এর নিজের লেখা থেকেই এখানে দেখা যাচ্ছে যে, তাঁর এলাকার টংক আন্দোলনে কৃষক বধূ-মাতা-কন্যা ও সন্তানেরা ‘সাম্রাজ্যবাদ আর সামন্তবাদ’ উচ্ছেদের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং যাঁরা শহীদ হন তাঁদের অধিকাংশেরই কোন টংক জমি ছিল না অর্থাৎ তাঁরা দেশপ্রেম ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে, অর্থনৈতিক সংগ্রামের পরিধি উত্তীর্ণ হয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। সামন্তবাদ-বিরোধী কৃষক আন্দোলনে এটাই ঘটে থাকে। সামন্তবাদ- বিরোধী অর্থনৈতিক সংগ্রাম বিকাশ লাভ করে এভাবেই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্মদান করে এবং তার সাথে একাত্ম হয়ে যায়।

শ্রী মণি সিংহ-এর এলাকাতেও অনিবার্য ঐতিহাসিক নিয়মে যে তাই ঘটেছিলো সে কথা তিনি নিজের স্মৃতিকথায় অস্বীকার করতে তো পারেননি, উপরন্তু তার আবেগকে ‘মহান’ আখ্যা দিয়ে শহীদ কৃষকদের দেশপ্রেমের প্রশংসা করেছেন!

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এই বর্ণনা এবং আমার ওপর তাঁর উপরোল্লিখিত আক্রমণ, এই দুই যে একটু বেসুরো তা যে কোন সচেতন ব্যক্তির কাছেই ধরা পড়বে। কারণ তেভাগা আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চরিত্রের উল্লেখের জন্যে আমাকে ‘বাতুল’, ‘পাগল’, ‘অজ্ঞ’ ইত্যাদি আখ্যায় যিনি ভূষিত করছেন, টংক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে একই প্রবন্ধে সেই তিনি যখন আবার ‘মহান’ ও ‘দেশপ্রেমমূলক’ বলে বর্ণনা করছেন তখন এই দুই ধরনের উক্তির অসামঞ্জস্য সহজেই চোখে পড়ার কথা। আসল কথা হলো, তেভাগা আন্দোলনের চরিত্র বর্ণনার ক্ষেত্রে মণিবাবুর বিজ্ঞতা ও বিদ্যের দৌড় দেখা গেল। এতখানি চিন্তাশীল না হলে একই প্রবন্ধে কৃষক আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সম্পর্কে এ দুই ধরনের পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য উপস্থিত করা সত্যিই অসম্ভব! এজন্যে পুরো প্রবন্ধটিতেই ‘তত্ত্বগতভাবে’ যা কিছু তিনি বলতে গেছেন সেগুলি আবোলতাবোল ব্যতীত আর কিছু নয়। তার মধ্যে না আছে কোন সামঞ্জস্য, না আছে কোন বিদ্যেবুদ্ধির পরিচয়।

এতক্ষণ তো গেল তেভাগা আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা। এবার মধ্যশ্রেণী থেকে আগত কিছু কর্মীদের সম্পর্কে আমার মন্তব্যের যে সমালোচনা শ্রী মণি সিংহ তাঁর প্রবন্ধটিতে করেছেন সে প্রসঙ্গে আসা যাক।

‘অনেক সময় বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কৃষকরা যেখানে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত, সেখানে মধ্যশ্রেণী থেকে আগত অনেক নেতা ও কর্মী কৃষকদেরকে সংগ্রামের পথ থেকে সুকৌশলে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় নিযুক্ত থেকেছেন। এঁদের মধ্যে অনেকে সে সময় তেভাগা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বক্তব্য উপস্থিত করতে গিয়ে বলেন যে, কৃষকরা অবিপ্লবী শ্রেণী, শ্রমিকরা হলো আসল বিপ্লবী। কাজেই কৃষক আন্দোলনের পরিবর্তে পার্টির উচিত শ্রমিক আন্দোলনেই সর্বশক্তি নিয়োগ করা।’- আমার এই বক্তব্য সম্পর্কে মণিবাবু যা বলেছেন তা হলো এই: … মধ্যশ্রেণী হইতে আগত অনেক নেতা ও কর্মী সুকৌশলে কৃষকদের সংগ্রামের পথ হইতে সরাইয়া নেওয়ার চেষ্টা করিয়াছে, প্রভৃতি যেসব মন্তব্য উমর সাহেব করিয়াছে সেগুলি হইল উদ্ভট, মনগড়া ও কুৎসা। তেভাগা সংগ্রামের নেতা ও কর্মীরা ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী কর্মী ও নেতা। তাঁহারা ব্যক্তিগত স্বার্থ তুচ্ছ করিয়া কৃষকদের সাথে থাকিয়া সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন ও বহু নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন। এই সব দেশপ্রেমিকের বিরুদ্ধে উমর সাহেবের ঐসব কুৎসা তাঁহার অন্ধ কমিউনিষ্ট-বিদ্বেষের পরিচায়ক’।[৯]

এমনভাবে শ্রী সিংহ এখানে তাঁর সমালোচনা উপস্থিত করেছেন যেন কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভার সমস্ত কর্মী ও নেতাদেরকে এমন কি অধিকাংশকে আমি সমালোচনার উপলক্ষ্য করেছি। পশ্চিম বাঙলায় প্রকাশিত তাঁর এই প্রবন্ধটিতে তিনি অতি নিলজ্জভাবে একটি সুযোগ গ্রহণ করেছেন। পশ্চিম বাঙলায় বইটি প্রকাশিত হয়নি এবং পশ্চিম বাঙলার পাঠকরা বইটি পড়ার সুযোগ আজ পর্যন্ত পাননি। কাজেই এ ধরনের বানোয়াট বক্তব্যের মাধ্যমে আমার বক্তব্যসমূহকে বিকৃত করে তাঁদের কাছে আমার চরিত্র হননের অপচেষ্টাই তিনি করেছেন।

যাই হোক, আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, মধ্যশ্রেণী থেকে আগত কর্মী ও নেতাদের সম্পর্কে সাধারণভাবে যে উপরোক্ত সমালোচনামূলক মন্তব্য আমি করিনি তা আমার বইয়ে যে কোন পাঠকের কাছে সুস্পষ্ট হবে। তাছাড়া কিছুসংখ্যক মধ্যশ্রেণী থেকে আগত কর্মীদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছি সেটাও ‘উদ্ভট’, ‘মনগড়া কথা’ অথবা ‘কুৎসা’ নয়। উপরন্তু তা বহু কৃষক নেতা ও কর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ আলোচনার ফল। শুধু তাই নয় আমার উপরোক্ত বক্তব্যটি যে প্রকাশিত তথ্য থেকে নেওয়া হয়েছে সে তথ্যও আমি আমার মন্তব্যের পাশেই একটি পশ্চাদটিকার দ্বারা নির্দেশ করেছি। মণিবাবু যদি একটু বুদ্ধির ব্যবহার করে সেই পশ্চাদটিকাটিকে লক্ষ্য করতেন তাহলে দেখতেন যে, সেই তথ্য শ্রী জিতেন ঘোষের ‘গরাদের আড়াল থেকে’ নামক পুস্তকের ১৩৩ পৃষ্ঠা থেকে সংগৃহীত। জিতেনবাবু সেখানে যা বলেছেন তা নীচে উদ্ধৃত হলো :

কৃষকের তেভাগা আন্দোলনের সময় কৃষকসভারই কতিপয় কর্মী আপত্তি তুলেছিলেন এই বলে যে, কৃষকরা অবিপ্লবী শ্রেণী, শ্রমিকরাই বিপ্লবী শ্রেণী। কাজেই কৃষক আন্দোলন নয়, মজুর সংগঠন এবং আন্দোলনই গড়ে তোলা উচিত।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের সাথে কৃষক শ্রেণীর রয়েছে এক চিরসংঘাত। কৃষক আন্দোলন জমিদার-জোতদার শ্রেণীর স্বার্থে যেমন আঘাত করে, তেমনি তা আবার আঘাত হানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থেও। কৃষকের তেভাগা আন্দোলন তাঁদেরই স্বার্থে আঘাত হেনেছে, শ্রমিক আন্দোলন তা এখনও করেনি বলেই ঐ সমস্ত মধ্যবিত্ত কর্মীরা কৃষক আন্দোলনের পরিবর্তে শুধুমাত্র মজুর আন্দোলনের জিগির তুলেছিলেন। বড় বড় কথার আড়ালে নিজেদের দুর্বলতাই ঢেকে রাখতে চেয়েছিলেন, তা না হলে, তাঁরা যদি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও বিপ্লবী ধারা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতেন, তাহলে কৃষক সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কৃষক শ্রেণীর যে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এবং প্রয়োজন রয়েছে তাঁদের সংগঠিত শ্রেণী আন্দোলনের, তা বুঝতে তো কোন কষ্ট হবারই কথা ছিল না।[১০]

আমি যাদের সাথে সাক্ষাৎ আলাপ করেছি তাদের কথা বাদ দিয়েও এবার পাঠকরা (এবং মনিবাবু নিজেও) শ্রী জিতেন ঘোষের উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে আমার বক্তব্য মিলিয়ে দেখতে পারেন। সেটা করলে তাঁরা দেখবেন যে, দুই বক্তব্যই প্রায় হুবহু এক। আমরা সকলেই জানি জিতেনবাবু বাঙলাদেশের একজন বিখ্যাত কৃষক নেতা এবং এখন তিনি বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিতেই আছেন। যে বক্তব্য উপস্থিত করার জন্য আমি মনগড়া কথা বোলনেওয়ালা, কুৎসাকার, অন্ধ কমিউনিস্ট বিদ্বেষী ইত্যাদি আখ্যায় মণিবাবুর দ্বারা ভূষিত হলাম সেই একই বক্তব্য ১৯৭০ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তকে লিপিবদ্ধ করার পরও শ্রী জিতেন ঘোষ কিভাবে একজন কমিউনিস্ট ও দেশপ্রেমিক হিসেবে এখনো তাঁদের পার্টিতে অবস্থান করছেন? বুদ্ধির ব্যবহারে অসমর্থ হয়ে একদিকে যেমন শ্রীমণি সিংহ আমার পশ্চাদটিকাটি লক্ষ্য করেননি তেমনি পড়াশোনার প্রতি সাধারণভাবে আগ্রহের নিতান্ত অভাবের জন্যে তাঁদের নিজেদের পার্টির মানুষ জিতেনবাবুর লেখা বইটিও তিনি পড়ে দেখেননি। বইটি যদি তিনি পড়তেন, তাহলে আমার প্রতি বিশেষণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে হয় তিনি কিছুটা সংযত হতেন, নতুবা বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির ক্ষমতাবলে জিতেনবাবুকে ‘অন্ধ কমিউনিস্ট বিদ্বেষী’ হিসেবে পার্টি থেকে বহিষ্কার করতেন।

মধ্যশ্রেণী থেকে আগত কর্মী ও নেতাদের সম্পর্কে নানা সমালোচনামূলক মন্তব্য অনেকেই করছেন এবং তার যথেষ্ট সংগত কারণও ছিলো। এ প্রশ্নটির আলোচনা বর্তমান পরিস্থিতিতেও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে তেভাগা আন্দোলনে মধ্যবিত্তের অবস্থান সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা দরকার। এক্ষেত্রে শ্রী মণি সিংহ-এর সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন অবিভক্ত বাঙলার কমিউনিস্ট পার্টি সম্পাদক ভবানী সেন এবং কৃষক নেতা কৃষ্ণবিনোদ রায়ের বক্তব্যই উদ্ধৃত করছি। কারণ তাঁরা যে শুধু তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন তা নয়, তাঁরা পরবর্তীকালে পার্টি ভাগের পর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিরও (CPI) নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থেকেছেন।*

[* শ্রীভবানী সেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত CPI-এর নেতৃস্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণবিনোদ রায় এখনো CPI-এর সাথে যুক্ত।]

কমিউনিস্ট পার্টির ইংরেজী মাসিকপত্র কমিউনিস্ট- এ ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘বাঙলায় তেভাগা আন্দোলন’ নামক একটি প্রবন্ধে তেভাগা আন্দোলনের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে সাধারণ মধ্যশ্রেণীর অবস্থান সম্পর্কে ভবানী সেন বলেন:

কৃষকদের পক্ষে গণতান্ত্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীগুলির সমর্থন আদায় করে আনা ছিল আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু মধ্যবিত্তরা আন্দোলনে আতংকিত হয়ে পড়ল; কারণ এদের অনেকেই গরীব ও ক্ষুদ্র জোতদার, যারা এই ব্যবস্থাটা উচ্ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কর্মসংস্থানের নূতন পথ উন্মুক্ত করা না হলে তারা শেষ হয়ে যাবে। …. মধ্যবিত্ত শ্রেণী আন্দোলনটাকে ভুলভাবে দেখেছিল তার নিজের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক কৃষক যুদ্ধ হিসেবে। এটাই আমলাতন্ত্রকে গ্রামে গ্রামে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের সুযোগ করে দিয়েছিল। নির্দয় পুলিশী নিপীড়ন সম্ভব করে তোলার পেছনে বৃহত্তর একক কারণ ছিল আন্দোলন থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিচ্ছিন্নতা।[১১]

সাধারণভাবে মধ্যশ্রেণীর এই অবস্থানের জন্যে মধ্যশ্রেণী থেকে আগত কৃষকসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি কর্মীদের এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে নেতাদের মধ্যেও তার প্রভাব প্রতিফলিত হবে না এটা স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেওয়া যে, মধ্যশ্রেণীর চরিত্র ও তৎকালীন পার্টি সংগঠন সম্পর্কে একটা চরম অজ্ঞতার পরিচায়ক একথা শ্রী মণি সিংহ-এর একেবারেই মনে না হওয়ায় তিনি জমিদার ও মধ্যশ্রেণী থেকে আগত সমস্ত কৃষকসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যকে মধ্যশ্রেণী ও সামন্ত প্রভাবমুক্ত বলে ধরে নিয়ে যে সরলতার পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে পাণ্ডিত্যের বিপরীত। এজন্যে ‘বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন’ মণি সিংহ মধ্যবিত্ত পরিবারসমূহ থেকে আগত কর্মী ও নেতাদের বিচ্যুতির সম্ভাবনাকে যেভাবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন অন্যদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। কাজেই আন্দোলনের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই মধ্যশ্রেণীর অবস্থানের এই প্রশ্নটি আলোচনা করেছেন।

শ্রী কৃষ্ণবিনোদ রায় তেভাগা আন্দোলনের ব্যর্থতার প্রশ্নটিকে সাধারণভাবে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তেভাগার লড়াইয়ের ব্যর্থতাও কম নয়। তখন আমরা তেভাগার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। কিন্তু এখানে আমার মনে হয়, আমাদের কৃষকসভার সংগঠন আরও প্রসারিত ও ব্যপ্ত করতে পারিনি, কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় বৃহৎ পার্টির শক্তি অর্জন করতে পারেনি এটাই তেভাগা আন্দোলনের ব্যর্থতার প্রধান কারণ। এই দুর্বলতাই পরিস্ফুট হয়েছে দুদিক থেকে: (ক) শ্রমিকশ্রেণী প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব এই আন্দোলনে দিতে পারেনি। (খ) নিম্ন-মধ্যবিত্তরা গণ-রাজনৈতিক প্রগতিশীল ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে খুব সক্রিয় হলেও তেভাগা সংগ্রামে তাঁরা বিরুদ্ধে বা বড়জোর দ্বিধাগ্রস্তদের দলে ছিলেন।[১২] শ্রী কৃষ্ণবিনোদ রায়ের এই সব বক্তব্য যে আমার সমালোচনারই অনুরূপ তা সহজেই লক্ষণীয়। মধ্যবিত্তদের প্রশ্নটিকে আরও একটু বিশদভাবে উল্লেখ করে তিনি বলছেন, “গরীব মধ্যবিত্ত জনগণ অকৃষক। তাঁরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নিৰ্ভীক যোদ্ধা। কিন্তু এঁদের গণতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনা থাকলেও সামন্তবাদ-বিরোধী চেতনা দুর্বল ছিল। পক্ষান্তরে তেভাগা আন্দোলনের নেতাদের অবশ্য করণীয় কাজ ছিল এই গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষদের সমর্থন ও সহযোগিতা যাতে পাওয়া যায় তার জন্য প্রচেষ্টা করা, একটা পারস্পরিক সমঝোতায় আসবার চেষ্টা করা। এই প্রচেষ্টায় ঘাটতি ছিল। ‘তেভাগার লড়াই’ পুস্তিকায় অবশ্য এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া ছিল। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের ক্ষেত্রে কর্মী ও নেতাদের মধ্যে এই নীতিটি দৃঢ়ভাবে প্রয়োগের ব্যাপারে একটা দ্বিধা ও ভীরুতা ছিল।’[১৩] শুধু মধ্যশ্রেণী নয়, মধ্যশ্রেণী থেকে আগত নেতা ও কর্মীদের শ্রেণীগত দুর্বলতা সম্পর্কে শ্রী কৃষ্ণ বিনোদ রায়ের এই মন্তব্যও যে আমারই মন্তব্যের অনুরূপ এবং শ্রীমণি সিংহ-এর ধারণাও মন্তব্যের বিপরীত সে কথা বলাই বাহুল্য।

মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আগত কিছুসংখ্যক কর্মীদের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সমালোচনা করলেও সাধারণভাবে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে আমি আমার বইটিতে যা বলেছি তা হলো এই, ‘তেভাগা আন্দোলনের সময় জোতদাররা মধ্যশ্রেণীর সাথে কৃষকদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাকে বাড়িয়ে তোলার অনেক চেষ্টা করে। মধ্যবিত্তের স্বার্থ তেভাগা দ্বারা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনার ফলে জোতদারদের এই প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়।[১৪]

মধ্যবিত্তদের সাথে কৃষকদের যে কোন মৌলিক স্বার্থগত বিরোধ নেই, উপরন্তু তারা উভয়েই যে জোতদার, মহাজন, সরকারী আমলা এবং সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা সমানভাবে শোষিত, এ কথা কৃষকসভার পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়। অফিসের কেরানী, ছোট দোকানদার, এমনকি জমিদারদের অল্প বেতনভোগী নায়েব-গোমস্তারা পর্যন্ত কিভাবে এই শোষণের দ্বারা অহরহ জর্জরিত হচ্ছে কৃষকসভার কর্মীরা তারও অনেক দৃষ্টান্ত দিয়ে মধ্যবিত্তদেরকে তেভাগা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন করে তোলার চেষ্টা করেন এবং তাঁদেরকে অনেক ক্ষেত্রে আন্দোলনের পথে টেনে আনতেও সক্ষম হন।[১৫]

তেভাগা আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রত্যেকই তার সাফল্য ও ব্যর্থতা এই দুই দিকই, অন্যত্র তো বটেই, এমন কি উল্লেখিত স্মারক গ্রন্থটিতেও আলোচনা করেছেন। শুধু তাই নয়, শ্রী মণি সিংহ নিজেও আপন যোগ্যতা অনুযায়ী সে কাজ করতে চেষ্টা করেছেন। আমিও বিস্তারিতভাবে তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনার পর অতি সংক্ষিপ্তভাবে তার কতকগুলি ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতার কারণ সঙ্গতভাবেই আলোচনা করেছি। ‘কিন্তু বাঙলাদেশে এমন লোকও আছেন যাঁহারা কমিউনিস্ট পার্টির ঐ অবদান স্বীকার করার চাইতে পার্টির ত্রুটি খুঁজিতে ব্যস্ত’ আমার এই আলোচনা সম্পর্কে এই ধরনের উক্তি যে কত বড় নির্লজ্জ অসাধুতা তা আমার বইটির যে কোন পাঠকই উপলব্ধি করবেন। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে কুৎসার আশ্রয় কে নিয়েছে আমি না মণিবাবুর মতো কৃষক দরদী বিপ্লবী সেটাও বোঝার কোন অসুবিধে হবে না।

শ্রী মণি সিংহ-এর লিখিত প্রবন্ধটি সম্পর্কে আরও অনেক গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করে আম র বইটি সম্পর্কে মণিবাবুর ‘জ্ঞানগর্ভ সমালোচনার জবাব এখানেই শেষ করবো। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলা ভাষার ‘অভিভাবক’ শাস্ত্রানুগত পণ্ডিতদের সাথে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, গ্রাম্য পাণ্ডিত্য এবং গ্রাম্য বর্বরতা, উভয়ের হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া তিনি ইহাকে (অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে – ব. উ.) পৃথিবীর ভদ্রসভার উপযোগী আর্য ভাষারূপে গঠিত করিয়া গিয়াছেন।[১৬ শ্রী মণি সিংহ-এর মতো ‘মার্কসবাদী পণ্ডিত ও কৃষক নেতাদের সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এ কথা বলা চলে যে, এই ধরনের লোকদের গ্রাম্য পাণ্ডিত্য ও গ্রাম্য বর্বরতার হাত থেকে কমিউনিস্ট তত্ত্ব এবং কর্মপদ্ধতি এই উভয়কেই যতদিন পর্যন্ত না সম্পূর্ণভাবে উদ্ধার করা হচ্ছে ততদিন এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল প্রতিবন্ধকতাগুলি নির্মূল ও দূরীভূত করে এদেশে কোন সত্যিকার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করা কোনমতেই সম্ভব নয়।

তথ্যসূত্র

১ তেভাগা সংগ্রাম: রজত-জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ, ‘তেভাগা’ রজত-জয়ন্তী উদযাপন কমিটির পক্ষে সুমিত চক্রবর্তী-কর্তৃক কালান্তর কার্যালয়, ৩০/৬ ঝাউতলা রোড, কলকাতা-১৭ থেকে প্রকাশিত, পৃ ৫০।

২ তেভাগা সংগ্রাম, পৃ ৫০-৫১; চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক, পৃ ৪১৯।

৩ তেভাগা সংগ্রাম, পৃ ৫১।

৪ কৃষ্ণবিনোদ রায়, চাষী লড়াই, পূর্বোক্ত, পৃ ২৮-২৯।

৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭।

৬ তেভাগা সংগ্রাম, পৃ ৫১।

৭ চাষী লড়াই, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৯।

৮ তেভাগা সংগ্রাম, পৃ ৪৮-৪৯।

৯ পূর্বোক্ত, পৃ ৫১।

১০ জিতেন ঘোষ, গরাদের আড়াল থেকে, পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৩।

১১ The Tebhaga Movement in Bengal, Communist vol. No. 3, Sept. 1947. বঙ্গানুবাদ : তেভাগা সংগ্রাম, পৃ ১৬-১৭।

১২ কৃষ্ণবিনোদ রায়, তেভাগা সংগ্রাম, পৃ ২৮।

১৩ পূর্বোক্ত।

১৪ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক, পৃ ১১৩।

১৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১১৫।

১৬ রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর চরিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *