৩. মমির গল্প (প্রথম পর্ব)

মমির গল্প (প্রথম পর্ব)

ডাক্তারির প্রথম বছরে অ্যানাটমিটা খুব ভয়ের জিনিস। ভয়টা যত না জীবনে প্রথমবার মৃতদেহ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার জন্য, তার চেয়ে বেশি শরীরের প্রতিটা পেশি, শিরা, ধমনী, তাদের উৎস, গতিপথ মুখস্থ রাখাকে। আমার কিন্তু অ্যানাটমি দিব্যি লাগত। গোল্ড মেডেলও পেয়েছিলাম। তাই এখনও মাঝে মাঝে বিকেলে কলেজ ছুটির পরে অ্যানাটমির বিল্ডিংয়ে ঢুকি। ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েগুলোকে পড়াই কয়েক ঘণ্টা।

আজকেও সেরকমই একটা দিন ছিল। ছুটির পরে এক ঘণ্টা মতন পড়ালাম, তারপরে হোস্টেলমুখো। ঘরে ঢুকে দেখি পিজি খাটে আধশোয়া হয়ে ভুঁড়িতে হাত বোলাচ্ছে। খাটের পাশে টুলে একটা বড়ো বাটিতে মুড়ি মাখা। আর তার পাশের চেয়ারটায় বসে আছেন, নান আদার দ্যান…

‘আরে ভবেশদা যে! এখানে? কী…’

আমার কথাটা শেষ করতে দিল না পিজি। নাক সিটকে খাট থেকে উঠে বসে বলল, ‘তুই আবার বাচ্চাগুলোকে পড়াতে গেছিলি? ইস, গায়ে সেই ফর্মালিনের গন্ধ। একদম ঘরে ঢুকবি না এখন, যা আগে চান করে আয়।’

বলে ঘরে ঝুলিয়ে রাখা দড়ি থেকে গামছা টেনে নিয়ে আমার দিকে ছুড়ে দিল।

অগত্যা!

image26.jpg

চান করে যখন ঘরে ঢুকছি ততক্ষণে দেখি তিন কাপ চা-ও এসে গেছে। এবারে পিজি নিজেই আমার আগের প্রশ্নের জবাব দিল,

‘আরে, আজকে ক্লাসের পরে বাইরে বেরিয়ে দেখি হাসপাতালের মধ্যে ভবেশদা ঘোরাঘুরি করছেন। জিজ্ঞাসা করতে বললেন কোন এক ভাইঝিকে দেখতে এসেছিলেন। আমিও দুম করে ধরে নিয়ে চলে এলুম।’

বুঝতেই পারলাম পিজি এখন গল্প শোনার মুডে আছে।

‘কিন্তু পিজি, কালকে ফার্মার ক্লাস টেস্ট, ভুলে গেলি?’

‘আরে ধুর, নিকুচি করেছে তোর ক্লাস টেস্টের, অমন অনেক আসবে যাবে। তুই চুপ করে বোস তো। নে, চা খা।’

সত্যি বলতে কী, মাসে তিনটে করে ক্লাস টেস্ট দিতে আমারও ভালো লাগে না। তবে একটু বেশি রাত অবদি পড়লেই ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। এই ভেবে আমিও এবারে বারমুডার ওপরে একটা গেঞ্জি গলিয়ে পিজির খাটেতেই হাঁটু মুড়ে বেশ জমিয়ে বসলাম।

‘তা ভবেশদা, আজকে হাতে সময় আছে তো?’

‘আমার হাতে তো সময়ই সময়, আগে একটা কথা বলো তো, তোমার গা থেকে ফর্মালিনের গন্ধ ছাড়ছিল কেন?’

‘ওহ, জুনিয়রদের একটু অ্যানাটমি পড়াচ্ছিলাম, ওখানে ডেডবডিগুলোতে ফৰ্মালিন দেওয়া থাকে তো…’

‘জানি, যাতে না পচে যায়। একে কী বলে বলো তো?’

‘এমবামিং।’

বুঝতেই পারছি ভবেশদা কোনদিকে যেতে চাইছেন।

‘আজকে কি মমি নিয়ে কিছু হবে নাকি?’

ভবেশদা এবারে একটু হেসে বললেন,

‘হতেই পারে, মমির রহস্য নিয়ে তো সবার মনেই প্রশ্ন, কী করে একটা মানুষকে হাজার হাজার বছর ধরে প্রায় অবিকৃত রেখে দিত ওরা? তার চেয়েও বড়ো প্রশ্ন এত খাটনি খাটার কী দরকার ছিল?’

‘ঠিক, শরীরটাকে প্রিজার্ভ করে লাভ কী হত?’

‘হুঁ হুঁ বাবা, কারণ তো আছেই, মিশরের প্রথম মমি কার হয়েছিল জানো?’

‘নাহ, সেটা ঠিক জানা নেই।’

‘শুনলে অবাক হয়ে যাবে। প্রথম মমি একজন দেবতা নিজেই, স্বয়ং ওসাইরিস!’

‘বলেন কী!’

ভবেশদা এবারে একমুঠো মুড়ি গালে ফেলে চিবোতে চিবোতে বললেন,

‘আগে সেই গল্পটা শুনে নাও তাহলে। ওসাইরিস, সেথ আর আইসিস তিন ভাইবোন। আবার আইসিস ওসাইরিসের স্ত্রীও।’

‘অ্যাঁ! বোনই স্ত্রী?’

‘হ্যাঁ, মিশরের পুরাণে এরকম উদাহরণ অনেক আছে। অনেক ফারাওরাও তাঁরদের বোনকে বিয়ে করতেন। তো যেটা বলছিলাম, ওসাইরিস তখন মিশরের রাজা। সিংহাসনে বসে আছেন। কিন্তু ওসাইরিসের ভাই সেথের খুব রাগ ওঁর ওপরে। সেই সেথই একদিন ওসাইরিসকে বুদ্ধি করে খুন করলেন। তারপরে ওসাইরিসের দেহটাকে বিয়াল্লিশটা টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন মিশরের দিকে দিকে। ওসাইরিসের স্ত্রী আইসিস এবারে একটা চিলের রূপ নিয়ে খুঁজতে বেরোলেন স্বামীর শরীরের অংশগুলো। লিঙ্গ বাদে সবকটা টুকরোই পাওয়া গেল। মৃত ওসাইরিসের এক একটা টুকরোকে জোড়া লাগালেন আইসিস। লিঙ্গটা তৈরি হল সোনা দিয়ে। তারপরে সেই ওসাইরিসের দেহের সংরক্ষণ করল আনুবিস।’

‘আনুবিস?!’

‘হ্যাঁ, আনুবিস মানে শেয়ালদেবতাই ওসাইরিসের মমি বানালেন। সেই প্রথম মমি বানানো। তারপরে ওসাইরিসের শরীরে প্রাণ এল। পুনর্জন্মের পরে ওসাইরিস আর আইসিসের একটা সন্তান হল, তার নাম হোরাস। সে-ই পরে সেথকে যুদ্ধে হারিয়ে বাবার হত্যার বদলা নেবে।’

image35.jpg

ফেলুদার ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’-তে আনুবিস। সৌজন্যে : সন্দীপ রায়

‘আচ্ছা, সেইজন্যই গতবারে বলেছিলেন আনুবিস মামিফিকেশনের দেবতা।’

‘একদম ঠিক। অন্যদিকে ওসাইরিস তাঁরর পুনর্জন্মের পরে পাতালে চলে যান। সেই থেকে তিনি মৃত্যুর পরের জগতের দেবতা, এই জগতের নামই দুয়াত।’

‘হ্যাঁ, বলেছিলেন তো।’

image36.jpg

ওসাইরিসের মমি বানাচ্ছেন আনুবিস

‘হ্যাঁ, তাই দেখবে ওসাইরিসের যেকোনো ছবি মমিরই মতো। হাত দুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখা, সোজা মাথা। পা দুটোও জোড়া। যেন গোটা শরীরটাই কিছু দিয়ে মোড়ানো আছে।’

এতক্ষণে পিজি মুখ খুলল, ‘হুম, ওসাইরিসকে কপি করেই তাহলে মমি বানানোর শুরু।’

‘না, ঠিক কপি করে নয়। মিথোলজি তো মানুষেরই তৈরি। মানুষের জীবনের গল্পই তাতে থাকে। এই গল্প ছাড়াও মমি বানানোর পিছনে আরেকটা ফিলোজফিকাল কারণ আছে, বুঝলে।’

‘আরেকটা কারণ!’

‘হ্যাঁ, আর এটাই মুখ্য কারণ। ইজিপশিয়ানরা বিশ্বাস করত একজন মানুষের তিন রকমের আত্মা আছে, তাদের মধ্যে একজন হল ‘‘আখ’’।’

‘হ্যাঁ, যেটা সেই ওসাইরিসের সামনে পরীক্ষায় পাশ করলে স্বর্গের দিকে যেতে পারে।’

‘ঠিক, আরেক রকমের আত্মা হল ‘‘বা’’, যে আত্মার ডানা আছে, পাখির রূপ ধরে সে দিনের বেলায় কবর থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে ঘুরতে পারে। রাতের বেলায় আবার কবরে ফিরে আসে।’

‘আর তিন নম্বর আত্মা?’

‘তার কথাই এখানে আসল, সেই আত্মার নাম হল ‘‘কা’’, কা-ই হল শরীরের মূল জীবনীশক্তি। অন্য দুটো আত্মা মৃত্যুর পরে তৈরি হলেও কা মানুষ জন্মাবার সময়তেই সৃষ্টি হয়। তাই কা-কে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হল শরীরটাকে টিকিয়ে রাখা।’

আমি বললাম, ‘এবারে বুঝলাম, এই কা-কে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই মৃতদেহের সংরক্ষণ করার দরকার পড়ে। তাই থেকেই মমি বানানোর শুরু।’

image37.jpg

মিশরীয় চিহ্ন

‘ঠিক ধরেছ, এই কা-কে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই মমির সঙ্গে কবরে রাখা হত খাবারদাবার, জল, সাজগোজের জিনিস, এমনকী টয়লেট পর্যন্ত। ইজিপ্ট এমনিতেই খুব শুকনো দেশ। প্রথম দিকে মৃতদেহদের কবর দেওয়া হত বালিতে গর্ত খুঁড়ে। খুব কম আর্দ্রতা থাকার জন্য গরম বালির নীচে সেই দেহগুলো শুকিয়ে গেলেও পচত না একেবারেই। কিন্তু ফারাওরাই প্রথম ভাবতে লাগলেন যে, আমাদের কবর বাকিদের সঙ্গে হবে কেন? আমরা রাজা, আমাদের সমাধি হবে অন্যদের থেকে আলাদা, চোখ ধাঁধানো। কিন্তু তাহলে তো কফিনের মধ্যেই একটা মাইক্রো ক্লাইমেট তৈরি করতে হবে, যেটা হবে বালির কবরের মতোই। শুকনো, আবার ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলেও চলবে না। এই চিন্তা থেকেই শুরু হল মমি বানানোর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে উন্নত করতে সময় লেগেছিল কয়েক হাজার বছর। শুধুমাত্র হাতে-গোনা কয়েকজন এই কাজটা জানত। তাই এদের মূল্য ছিল অপরিসীম। প্রথমদিকে শুধু ফারাওদের মমি তৈরি হলেও পরে ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। তখন পকেট গরম থাকলেই নিজের মমি বানিয়ে নেওয়াটা কোনো ব্যাপার নয়। তাই এখন ফারাওদের মমি ছাড়াও অনেক ধনী পরিবারের লোক কিংবা তাদের স্ত্রী, কন্যাদেরও মমি পাওয়া যায়। আদরের পোষ্যদেরও মমি বানিয়ে রাখার চল ছিল।’

পিজি অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল, এবারে বলল, ‘সবই তো বুঝলাম, কিন্তু মমিটা ওরা বানাত কী করে?’

ভবেশদার চা-টা হাতের কাপেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল কথা বলতে বলতে, একটা লম্বা চুমুক দিয়ে সেটাকে শেষ করে বললেন,

‘মমি তৈরির রেসিপিটা বুঝলে অনেকটা সুক্তো রান্না করার মতো, মোটামুটি উপকরণগুলো সবার চেনা। কিন্তু ভালো রাঁধতে খুব কম লোক পারত।’

‘কিছু তো একটা রহস্য ছিলই।’

‘হ্যাঁ, সে তো থাকবেই। কীভাবে মমি বানাতে হবে সেটা তো শুধু কিছু সংখ্যক লোক জানত। তারা সেই সিক্রেট কারোর কাছে বলত না। হেরোডটাসের নাম শুনেছ তো?’

‘শুনব না আবার? স্কুলের ইতিহাস বইতে পড়েছিলাম তো।’

‘ঠিক, গ্রিক ইতিহাসবিদ, ফাদার অফ হিস্ট্রি বলা হয় এঁকে, যিশুর জন্মের দেড় হাজার বছর আগে হেরোডটাস ইজিপ্ট ঘুরে গেছিলেন। ওঁর লেখাতেই মমি কীভাবে বানানো হত তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। মমি বানানোর ওয়ার্কশপগুলো ছিল শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, মরুভূমির কাছাকাছি। সেখানে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার পরে বাড়ির লোকেদের প্রথমে কাঠ দিয়ে বানানো মমির ছোটো ছোটো রেপ্লিকা দেখানো হত। এক একরকম মমির এক একরকম দাম। দাম ঠিক হওয়ার পরে মৃতদেহকে নিয়ে আসা হত একটা ঘরে, তার নাম ইব। সেখানে তাকে তিনদিন ধরে ভালো করে জল দিয়ে ধোয়া হত। ইবের পরে মৃতদেহের গন্তব্য ছিল আরেকটা ঘর, নাম ওয়াবেত। ওয়াবেত মানে পবিত্র স্থান। এখানেই তারপরে শুরু হত মমি বানানো। প্রথমেই একটা তামার তৈরি সরু আঁকশি মৃতের নাকের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হত খুলিতে। তাই দিয়ে কুরে কুরে মস্তিষ্কটাকে বের করে নেওয়া হত।

image38.jpg

তামার আঁকশি দিয়ে মাথার ঘিলু বের করে নেওয়া হত

যেটুকু বেরোত না সেটুকু জল স্প্রে করে বের করা হত। এরপরের কাজ হল শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলো বের করা। ধারালো ইথিয়োপিয়ান ব্লেড দিয়ে পেটের বাঁ-দিকে লম্বালম্বিভাবে চিরে বের করে নেওয়া হত নাড়িভুঁড়ি, লিভার, কিডনি, স্প্লিন আর ফুসফুস। আগেই বলেছি হৃৎপিণ্ড ওদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় জিনিস ছিল, তাই ওটিকে ছোঁয়া হত না। এই বের করে নেওয়া অঙ্গগুলোও আবার শুকিয়ে রাখা হত অ্যালবাস্টার পাথরের জারে। সেগুলো মমির সঙ্গেই কফিনে যেত। ভিসেরাগুলো বের করে নেওয়ার পরের কাজ হল শরীরটা থেকে জল একদম টেনে বের করে নেওয়া। কারণ জল থাকলেই শরীর পচতে শুরু করবে। এইজন্য ব্যবহার করা হত ন্যাট্রন। এই ন্যাট্রনের গুঁড়ো ঢুকিয়ে দেওয়া হত ফাঁপা পেটের মধ্যে। তারপর গোটা শরীরটাকে চুবিয়ে রাখা হত ন্যাট্রন ভরতি চৌবাচ্চায়, চল্লিশ দিনের জন্য! একটা শরীরকে একদম শুকিয়ে খটখটে করার জন্য লাগত প্রায় আড়াইশো কিলো ন্যাট্রন।’

‘এই ন্যাট্রন জিনিসটা কী?’

image39.jpg

ন্যাট্রন 

‘এটা হল বুঝলে, একরকমের পাথরের গুঁড়ো, হাইড্রেটেড সোডিয়াম কার্বোনেট। রং হত সাদা বা স্বচ্ছ। পাওয়া যেত নুনের লেকগুলোতে। যেটা বলছিলাম, চল্লিশ দিন পরে সেই দেহকে তুলে নিয়ে আসা হত। তারপরে তার চামড়ায় লাগানো হত সিডার অয়েল আর তরল রেজিন, তাতে মেশানো থাকত নানান রকমের মশলা, সেই মশলাগুলোর একটা ছিল দারচিনি, যেটা নিয়ে আসা হত ভারতবর্ষ থেকেই!’

‘বাপ রে! মমি বানানোর জন্য তাহলে আমাদের দেশের একটু হলেও অবদান আছে, কিন্তু মড়ার শরীরে এরকম করে তেল ঘষার কারণটা কী?’

image40.jpg

অ্যালাবাস্টারের জার

‘কারণটা দুটো, প্রথমত পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, আর দ্বিতীয়ত এর জন্য শরীর থেকে একটা সুগন্ধও বেরোত। এই তেল লাগানোর পরে মৃতের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত খড়, কাঠের গুঁড়ো, বালির মিশ্রণ। মুখ, নাকের ফুটো বুজিয়ে দেওয়া হত মোম দিয়ে। চোখ দুটোও সরিয়ে নেওয়া হত, তার জায়গায় আসত সাদা পাথরের ওপরে আঁকা চোখ। এইসব কাজ কিন্তু করত মূল পুরোহিত, সে পরে থাকত আনুবিসের মুখোশ। একে বলা হত ‘‘হেরি সেশেতা’’, ইংরেজিতে যার মানে দাঁড়ায় ‘‘লর্ড অফ দ্য সিক্রেটস’’।’

‘কিন্তু মমির ছবিগুলো যে দেখি কাপড় দিয়ে মোড়ানো।’

‘হ্যাঁ, এখানেই আসছিলাম, এটাই লাস্ট স্টেপ। কিন্তু এই জায়গাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই বিজ্ঞানের সঙ্গে মিশে যায় বিশ্বাস। হেরি সেশেতা বেশ কয়েকদিন ধরে মৃতের শরীরটাকে কাপড় দিয়ে মুড়ে ফেলত। মাথা থেকে শুরু করে পায়ের পাতা অবধি। এটা করার সময় পাশে দাঁড়িয়ে জাদুমন্ত্র পড়ত আরেকজন পুরোহিত, যাকে বলা হত ‘‘হেরি হেব’’। কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজেও রেখে দেওয়া হত মন্ত্রপূত অ্যামুলেট বা প্যাপিরাসের পাতা। এই কাপড় দিয়ে মোড়ানোর কাজটা হলেই মমি তৈরি শেষ।’

image41.jpg

পিজি এবারে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল,

‘বাপ রে! এ তো হেবি ফ্যাচাংয়ের ব্যাপার!’

‘এখানেই শেষ, ভাই প্রদীপ্ত? মমি বানানো হয়ে গেলে তাকে দিয়ে দেওয়া হত বাড়ির লোকের হাতে। তারা তাকে ঢোকাত কাঠের কফিনে। সেই কফিনের গায়ে বা ভেতরের দেওয়ালে লেখা থাকত বুক অফ দ্য ডেড-এর মন্ত্রগুলো, আগের দিন যেটা বললাম। তারপরে সেই কাঠের কফিনের জায়গা হত পাথরের কফিনের মধ্যে।

‘হ্যাঁ জানি, ওগুলোকেই সারকোফেগাস বলা হত তো?’

‘একদম তাই। কিন্তু সারকোফেগাস নামটার মানে জানো?’

‘তা তো জানি না।’

‘ইজিপশিয়ানরা কিন্তু এই শব্দ ব্যবহার করত না। এই যে আমরা এত রকমের ইজিপশিয়ান দেবদেবীর নাম বলছি সেগুলোর অনেকটাই কিন্তু গ্রিক আর রোমান উচ্চারণ। ওরা প্রায় সাতশো বছর দেশটাকে শাসন করেছিল। তেমনই সারকোফেগাস শব্দটাও গ্রিক। সারকো মানে মাংস, আর ফেগাই মানে খাওয়া। সারকোফেগাস মানে তাহলে মাংস খাওয়া।’

‘এরকম অদ্ভুত নাম কেন!’

image42.jpg

সারকোফেগাস

‘কফিনগুলো তৈরি হত লাইমস্টোন দিয়ে। এই কফিনের ভেতরে যে আবহাওয়ার সৃষ্টি হত তাতে মৃতদেহের মাংসপেশিগুলো শুকিয়ে প্রায় ভ্যানিশ হয়ে যেত। কিন্তু পচন ধরত না। তাই নাম সারকোফেগাস।’

আমি এই সময় ভাবছিলাম বাপ রে, সত্যিই কত কিছু জানি না। শব্দটা সেই মমি সিনেমা দেখার সময় থেকে শুনে আসছি, কিন্তু কখনো মনে হয়নি যে নামটার এরকম অদ্ভুত একটা মানে আছে। তবে একটা জায়গায় খটকা থেকেই যাচ্ছিল। তাই ভবেশদার কাছেই জানতে চাইলাম,

‘তাহলে আমাদের কলকাতা মিউজিয়ামের মমিটার এমন খারাপ অবস্থা কেন?’

‘ভালো কথা বলেছ, কলকাতায় মমিটা কবে এসেছিল জানো?’

‘না তো।’

image43.jpg

কলকাতার মমি

‘ঠিক কবে এসেছিল সেটা জানা যায় না, তবে ৫ জুলাই, ১৮৩৪-এর তারিখে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রসিডিংসের একটা নোট পাওয়া গেছে। ওইদিন সোসাইটি একটা চিঠি পায় বেঙ্গল লাইট ক্যাভালরির জনৈক লেফটেন্যান্ট আর্চিবল্ডের কাছ থেকে। তিনি নাকি সোসাইটিকে একটি মমি গিফট করতে চান, যেটা পাওয়া গিয়েছিল ইজিপ্টের গৌরভা নামের একটা জায়গায় ফারাওদের সমাধি থেকে। আর্চবল্ডের জাহাজের লোকজন ভয় পেয়ে ওই মমিকে নিতে চায়নি। তাই তাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রণতরীতে করে আনা হয় মুম্বইতে, সেখান থেকে কলকাতায়। এটা সত্যি যে সেই মমির হালত এখন খুব খারাপ, মাথার খুলি বেরিয়ে গেছে। ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। তবে খোদ ইজিপ্টেই মমিদের যা হাল হয়েছিল শুনলে চমকে যাবে।’

‘ওরা মমির ক্ষতি করবে কেন? ওরা তো এই কাল্টে বিশ্বাস করত।’

‘সে তো মাত্র কয়েক হাজার বছরের জন্য, ভায়া। মানুষের মন থেকে একসময় সেই বিশ্বাস কর্পূরের মতো হাওয়া হয়ে যেতে থাকে। ফারাওদের সমাধিগুলোতে বার বার ডাকাতি হত, শক্ত পাথরের দেওয়ালে গর্ত খুঁড়ে ডাকাতরা ঢুকে পড়ত। লক্ষ্য ছিল মমির সঙ্গে সাজিয়ে রাখা সোনার গয়না আর আসবাবপত্র। সেসব কিছু লুঠ করে নেওয়ার পরে মমির শরীরটাকেও ছাড়েনি ওরা। ফারাও তৃতীয় তুতমোসিসের মমি যখন পাওয়া যায় তখন তার বুকে একটা বড়ো ফুটো। ডাকাতেরা কাপড় কেটে বুকের কাছে বসানো সোনার অ্যামুলেট খুলে নিয়েছিল। কত মমি পাওয়া গেছে হাত, পা, গর্দান ছাড়া। সমাধি লুঠ করার সময় ডাকাতরা ছোটো ছোটো বাচ্চাদের মমিগুলোকে জ্বালিয়ে মশালের মতো ব্যবহার করত। এমনকী কাঠের কফিনেও আগুন লাগিয়ে দিত, যাতে তাতে লেগে থাকা সোনা গলিয়ে বের করে নেওয়া যায়।’

‘তাহলে ভাগ্যিস ইউরোপের লোকজন গিয়ে পড়েছিল মিশরে! তাই যতটুকু রিস্টোরেশন…’

‘কীসের রিস্টোরেশন? ইউরোপের লোকজন মিশরের খবর পায় কার জন্য জানো?’

‘না তো।’

‘নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জন্য। সে আরেক গল্প, অন্য আরেকদিন বলা যাবে ’খন। কিন্তু আমার এখানে বক্তব্য হল যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানির লোকেরাও মমিদের নিয়ে খুব একটা ভালো ব্যবহার করেনি।’

‘মানে? ওরাও লুঠ করত?’

‘লুঠ আর করবে কী? ততদিনে প্রায় সব সমাধি লুঠ হয়েই গেছে। ওরা মমিগুলোকে জাহাজে বোঝাই করে দেশে আনত। ফ্রান্সে আর লন্ডনে বিত্তশালীদের বাড়িতে লোকজন ডেকে তামাশা চলত। কখনো সেটা দেখানোর জন্য টিকিটও বিলি করা হত।’

‘কীসের তামাশা?’

‘মমি খোলার। টেবিলে মমিটাকে শুইয়ে দামড়া দামড়া যন্ত্রপাতি দিয়ে তার কাপড়ের আচ্ছাদন খোলা হত। তাতে কোনোরকম বৈজ্ঞানিক ভাবনা ছিল না। শুধুমাত্র সস্তার থ্রিল আর কৌতূহলের জন্য কত শত মমি যে নষ্ট হয়ে গেছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।’

image44.jpg

মমির কাপড়ের আচ্ছাদন খোলা

‘ছি ছি। একটা এমন দারুণ শিল্প এভাবে নষ্ট করেছে!’

‘এ তো কিছুই নয়, মমি খাওয়ার কথা কখনো ভাবতে পারো?’

কথাটা শুনেই আমার গা গুলিয়ে উঠল। পিজিও দেখলাম একবার ওয়াক করল। মমি আবার খাবে? ভবেশদা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন এবারে, তারপরে বললেন,

‘ঠিকই শুনেছ। পারসিয়ান পাহাড়গুলোতে একরকমের বিটুমেন পাওয়া যেত, তার নাম মামিয়া। গ্রিক ফিজিশিয়ান ডায়োস্কোরিডেস তাঁরর বইতে এই মামিয়াকে মমি বলে ভুল করেন। সেই বইটাকেই ফলো করে ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে এই অদ্ভুত ওষুধ ব্যবহারের ধুম পড়ে যায়। ১৫৮৬ সালে ব্রিটিশ মার্চেন্ট জন স্যানডারসন জাহাজে করে ৫০০ কিলো মমি নিয়ে আসেন লন্ডনে। সেগুলোকে গুঁড়ো করে সেই পাউডারের সঙ্গে আরও কিছু মশলা আর হার্বস মিশিয়ে আজগুবি ওষুধ তৈরি হত। সেই ওষুধ নাকি ফোঁড়া থেকে শুরু করে প্যারালিসিস পর্যন্ত সারিয়ে দেয়। কে এই ওষুধের বিজ্ঞাপন করেছিল জানো? নামটা শুনলে চমকে উঠবে, ফ্রান্সিস বেকন, সেই সময়কার বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক।’

‘বলেন কী!’

‘হুম, মানুষ চড়া দামে পাগলের মতো ওই ওষুধ কিনত। একসময় চাহিদা এত বেড়ে গিয়েছিল যে শেষের দিকে বেওয়ারিশ মৃতদেহ তুলে এনে ব্যান্ডেজ করে আবার মাটিতে পুঁতে কিংবা রোদে শুকিয়ে গুঁড়িয়ে বিক্রি করত। এইসব চলতে থাকে আরও দু-শো বছর ধরে। শেষ হয় এইটিন্থ সেঞ্চুরির শেষের দিকে, যখন ইজিপ্টের ওটোমান সম্রাটরা বে-আইনি মমি পাচার নিষিদ্ধ করে দেয়। তারপরে প্রথম যে মমিটা গোটা দেহে লন্ডনে ঢোকে সেটাকে রাজা দ্বিতীয় চার্লস আনিয়েছিলেন নিজের রক্ষিতার মন জয় করার জন্য। সেটা এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে।’

‘তাহলে মমির ঠিকঠাক অ্যানাটমিকাল ডিসেকশন কখনো হয়ইনি?’

‘কে বলেছে হয়নি? হয়েছে তো। কিন্তু আজকে আর সে-গল্প নয়। একদিনে আর কত হজম করবে?’

বলেই হাতের ঘড়ি দেখল ভবেশদা।

‘ইস, সাড়ে দশটা বেজে গেল। আমার ট্রেনটা না মিস হয়ে যায়। উঠি আজকে। কাল সন্ধেবেলায় দোকানে এসো। তখন না হয় বাকিটা বলে দেব। খুব কৌতূহল হলে গুগল করেও দেখতে পারো। তবে বেশি কিছু পাবে বলে মনে হয় না। এই ভবেশ সামন্তর কাছেই আসতে হবে, জানি।’

বলেই ভবেশদা উঠে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। অদ্ভুত মানুষ বটে একটা!

image45.jpg

ন্যাট্রনের চৌবাচ্চায় মৃতের শরীর। ছবি : সৌমক পাল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *