৩. বাঙালির শিল্পোদ্যম

৩. বাঙালির শিল্পোদ্যম

আধুনিক কারখানা শিল্পের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠা আমাদের দেশে যে ব্রিটিশ আমলে হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। বাংলা দেশ ইংরেজদের অন্যতম বাণিজ্যিক কর্মকেন্দ্র, এবং কলকাতা শহর ইংরেজদের প্রথম রাজধানী ও অন্যতম বন্দর ছিল বলে শিল্প—বাণিজ্যের উৎসাহ ও সুযোগ বাঙালিদের বেশি পাওয়াও স্বাভাবিক। খনিজ ও অন্যান্য শিল্পসম্পদের দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশে শিল্পায়নের বাস্তব অবস্থা যথেষ্ট অনুকূলও বলা যায়। উনিশ শতকে একশ্রেণির ধনিক বাঙালির হাতে পর্যাপ্ত মূলধনও ছিল। এই ধনিক বাঙালিরা ইংরেজদের সংস্পর্শে নানাবিধ কাজকর্ম করে আঠারো শতকের মধ্যেই প্রভূত ধনসঞ্চয় করেছিলেন। এরকম বাস্তব ঐতিহাসিক পরিবেশ অন্তত কিছুটা রচিত হওয়া সত্ত্বেও কেন বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীন শিল্পোদ্যমের আশানুরূপ প্রকাশ হয়নি তা ভাববার বিষয় বলে মনে হয়।

বাঙালির শিল্পোদ্যম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সংঘাতে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশের ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়নি, বহুকথিত এ যুক্তি অভ্রান্ত হলেও, তার স্বপূর্ণতা কতখানি তা বিচার করা উচিত। আঠারো শতকে এবং উনিশ শতকেও খানিকটা, দেওয়ানি বেনিয়ানি ও নানা রকমের ইজারাদারি করে একশ্রেণির বাঙালি অর্থান্বেষী একপুরুষেই যে বিপুল ধনসঞ্চয় করেছিলেন, তা স্বাধীন শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার পথে ব্রিটিশ শিল্পনীতি কতখানি অনতিক্রম্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং সেই শিল্পক্ষেত্রের সীমানাই বা কত দূর বিস্তৃত? অথবা এ ছাড়া আরও অন্যান্য অনার্থনীতিক (non-economic) কারণও ছিল? একপুরুষের অর্জিত ও সঞ্চিত ধন দু—তিন পুরুষের মধ্যে ক্ষয় হয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল কেন? ব্রিটিশ আমলে স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের ক্ষেত্র যেটুকু প্রস্তুত হয়েছিল, তার মধ্যে কি বাঙালির মূলধন যাবতীয় বাধাবিপত্তি ঠেলে, সর্বক্ষেত্রে না হলেও, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিচরণ করতে পারত না? বাঙালির জাতীয় চরিত্রের, অথবা বাঙালি সমাজের কোনও বৈশিষ্ট্য কি বাঙালির আর্থনিতিক জীবনে কোনও প্রভাব বিস্তার করেনি? বাংলার সামাজিক গড়ন, সংস্কারপ্রথা—রীতিনীতি কত দূর বাঙালির কর্মজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল, তা গভীরভাবে ভাববার বিষয়। বিদ্যাবুদ্ধি ও চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে বাঙালির দুঃসাহসিক অভিযান অর্থনীতিক্ষেত্রে কেন প্রতিফলিত হয়নি, অথবা অর্থনীতিক্ষেত্রের রক্ষণশীলতা কেন বাঙালির মননশীলতার প্রতিবন্ধক হয়নি, তা—ও বিচার করে দেখা কর্তব্য।

আধুনিক যন্ত্রপাতি, শিল্প—বাণিজ্য, বিজ্ঞানচর্চা ইত্যাদির প্রতি বাঙালির মনোভাব কোনওদিনই বিরূপ ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত উনিশ শতকের সাময়িকপত্রে বাঙালির যন্ত্রবিদ্বেষের, অথবা কারখানা শিল্পের প্রতি বীতরাগের কোনও নজির বিশেষ পাওয়া যায় না। বরং দেখা যায়, সামাজিক ব্যাপারে কিছুটা রক্ষণশীল পত্রিকাও (যেমন ‘সংবাদ প্রভাকর’) যন্ত্র, কলকারখানা, শিল্প ও বাণিজ্যবিদ্যা ইত্যাদি ব্যাপারে আধুনিক যুগোপযোগী প্রগতিশীল মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। সামান্য ধানভানা কল, গমপেষাই কল বা সেলাইয়ের কলের মতো ছোট ছোট কলও যখন এ দেশে এসেছে, তখন বাংলা পত্রিকায় সানন্দে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে এবং তার উপযোগিতা সাধারণের কাছে সোৎসাহে প্রচার করা হয়েছে। বহুবাজার—মলঙ্গা নিবাসী রাজেন্দ্র দত্ত মহাশয়ের হৌসে যখন আমেরিকা থেকে সেলাইয়ের কল আসে ( বাংলা ১২৬০ সাল), তখন ‘সংবাদ প্রভাকর’ লেখেন :

”বধূবাজার নিবাসী ধনরাশি শ্রীযূত বাবু রাজেন্দ্র দত্ত মহাশয়ের হৌসে আমেরিকা হইতে ছয়টা অত্যাশ্চর্য নূতন কল আসিয়াছে, তদ্দ্বারা অল্প সময়ের মধ্যে জামা, চাপকান, ইজার, পেণ্টলন প্রভৃতি নানাপ্রকার পোশাক ও গড়িচটের থলে পর্যন্ত সেলাই হইয়া থাকে। ঐ যন্ত্রগত সূচের এমত দ্রুতগতি ও চমৎকার কার্যস্থিরতা যে তাহা একভাবে গমন করিয়া এমত সেলাই করে যে বড় বড় দর্জিরাও সেইরূপ করিতে পারে না, ইংরাজ ও ফ্রেঞ্চ জাতিরা অসামান্য বুদ্ধির দ্বারা যদিও অনেকপ্রকার কল প্রস্তুত করিয়াছেন, তথাচ তাঁহারা এ প্রকার প্রয়োজনীয় আশ্চর্য যন্ত্র নির্মাণ করিয়া প্রতিষ্ঠাভাজন হইতে পারেন নাই, যে ব্যক্তির বুদ্ধির প্রাখর্য দ্বারা আশ্চর্য যন্ত্র নির্মিত হইয়াছে, তিনি কিরূপ অদ্বিতীয় লোক বিজ্ঞমণ্ডলী বিবেচনা করিবেন। এই যন্ত্র সাধারণের পক্ষে সামান্য প্রয়োজনীয় নহে, এক দিবসে এককালে ৬০০০ থলিয়া সেলাই হইয়া থাকে, অতএব ঐ কলের সংখ্যা বৃদ্ধি হইলে মনুষ্যের কত উপকার হইবেক তাহার সংখ্যা করা দুঃসাধ্য, ঐ যন্ত্রের দর্শনার্থ অনেকেই গমন করিতেছেন, আমারদিগের কোন বন্ধু তদ্দ্বারা কাপড় সেলাই করিয়া লইয়া সেলাই দৃষ্টে চমৎকৃত হইয়াছেন।”

এরকম ধানভানা—গমপেষা কলের কথাও সানন্দে প্রকাশ করা হয়েছে। ‘সমাচার দর্পণ’ (৮ আগস্ট ১৮২৯) এ সম্বন্ধে লিখেছেন যে কলকাতার গঙ্গাতীরে এমন একটি নতুন কল বসেছে যা কলকাতার লোকদের সুজি জোগাতে আরম্ভ করেছে। ”এই কলের দ্বারা গমপেষা যাইবে ও ধানভানা যাইবে ও মর্দনের দ্বারা তৈলাদি প্রস্তুত হইবে এবং এই সকল কার্য ত্রিশ অশ্বের বলধারী বাষ্পের দুইটা যন্ত্রের দ্বারা সম্পন্ন হইবে। এতদ্দেশীয় অনেক লোক এই আশ্চর্যের বিষয় দর্শনার্থে যাইতেছেন।” ‘দর্পণ’—সম্পাদক তাঁর বন্ধুদের পরামর্শ দিয়েছেন, যে অদ্ভুত যন্ত্র বাষ্পের দ্বারা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দু—হাজার মন গম পিষতে পারে, তা প্রত্যেকের উচিত একবার স্বচক্ষে দেখা।

শিল্পবিপ্লবের পর ইংলন্ডে ‘মেকানিকস ইনস্টিটিউট’—এর প্রতিষ্ঠা ও প্রসার হতে থাকে। প্রধানত ইংলন্ডের সুদক্ষ কারিগর ও ইঞ্জিনিয়াররা বৈজ্ঞানিক শিল্পবিদ্যা আয়ত্ত করার জন্য ওই ইনস্টিটিউট স্থাপনে উৎসাহী হন। এঁদের শিল্পবিপ্লবকালের ‘এলিট’—শ্রেণি বলা হয়—“The men who made and mended the machines were the elite of the Industrial Revolution”—(Trevelyan)। ইংলন্ডে বয়স্কদের শিক্ষার আন্দোলনও আরম্ভ হয় শিল্পবিপ্লবের পর থেকে, কারিগর ও ইঞ্জিনিয়ারদের বৈজ্ঞানিক বিদ্যাশিক্ষার চাহিদা থেকে বাংলাদেশে ১৮৩৯ সালে ‘মেকানিকস ইনস্টিটিউট’ কলকাতা শহরে স্থাপিত হয়। বিজ্ঞান ও যন্ত্রপাতির নতুন নতুন আবিষ্কারের সাহায্যে এ দেশে কীভাবে কারিগরি বিদ্যা ও শ্রমশিল্পের উন্নতি করা যায়, তারই উপায় নির্ধারণ করার জন্য এই সভা স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু এ দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটেনি এবং সমাজে ইঞ্জিনিয়ার—কারিগরদের আবির্ভাবও হয়নি, তাই নব্য—ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই ‘মেকানিকস ইনস্টিটিউট’—এর উৎসাহী প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। স্বভাবতই অল্পদিনের মধ্যে মধ্যবিত্তদের এই উৎসাহে ভাটা পড়েছিল। ‘সংবাদ প্রভাকর’ তার জন্য দুঃখ করে লিখেছেন :

”এই নগর মধ্যে শিল্পবিদ্যার উপদেশ প্রদানার্থ মিকানিক ইনস্টিটিউশন নামক এক সভা হইয়াছিল, অনেকানেক সম্ভ্রান্ত বিজ্ঞব্যক্তি তাহাতে নিযুক্ত ছিলেন, ও প্রধান ২ বিদ্বান ব্যক্তিরা তথায় উপস্থিত হইয়া বিনাবেতনে সাধারণের প্রতি উপদেশ প্রদান করিতেন, কিছুদিন পরে ঐ মহৎ সভা সাধারণের অনুরাগ বিরহে একেবারে লয়প্রাপ্ত হইয়াছে, কি আশ্চর্য পৃথিবীস্থ তাবজ্জাতি যে বিদ্যার দ্বারা অসাধ্য সাধনায় কৃতকার্য হইতেছেন কলিকাতাস্থ লোকেরা কি কারণ সেই মহাবিদ্যা প্রকাশিকা সভার প্রতি অনুরাগশূন্য হইলেন আমরা বুদ্ধির দ্বারা তাহার মর্মোদ্ধারণে নিতান্ত অক্ষম হইতেছি…।”

কেবল ক্ষোভ প্রকাশ করেই প্রভাকর ক্ষান্ত হননি, বাঙালি চরিত্রের কিঞ্চিৎ সমালোচনাও করেছেন। লিখেছেন :

”অস্মদ্দেশীয় লোকদিগের এই এক চমৎকার স্বভাব যে তাঁহারা অল্প অর্থের মুখ দেখিতে পাইলেই বাবু হইয়া পড়েন এবং সর্বদা গোলবালিসে ঠেস দিয়া আলস্যের সহিত গলাগলি প্রেম করিতে থাকেন, তাঁহারা যদি অর্থ পাইলেই পরিশ্রমের কার্যে অনুরাগী হন তবে এই দেশ পৃথিবী মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত ও প্রধান হইতে পারে… তাঁহারা শিল্পবিদ্যায় লিপ্ত হওয়া অপমানবোধ করেন, কি আশ্চর্য, যে বিদ্যার জন্যে মনুষ্য সাংসারিক কার্যের পরমোপকারক হন, তাঁহারা সেই বিদ্যার অনুশীলনকে অপমানের কর্ম বলিয়া গণ্য করিয়া থাকেন…।”

এ দেশের সামাজিক ব্যাপারে পাশ্চাত্য ভাবধারা অনুকরণের ঘোর বিরোধী ছিলেন ‘সংবাদ প্রভাকর’, কিন্তু শিল্প—বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ছিলেন পাশ্চাত্যপন্থী। সামাজিক প্রগতিবাদীদের মধ্যে মধ্যে বেশ তীক্ষ্ন ব্যঙ্গবিদ্রুপবাণে বিদ্ধ করেছেন প্রভাকর, কিন্তু শিল্প—বাণিজ্যের প্রতি ইংরেজদের মতো অনুরাগী না—হওয়ার জন্যই বাঙালিদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। প্রভাকরের মতামত বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল, তার সামাজিক দৃষ্টির সঙ্গে আর্থনীতিক দৃষ্টির সামঞ্জস্য ছিল না। অর্থনীতিক্ষেত্রে প্রভাকরের আধুনিকতা বাস্তবিক বিস্ময়কর। এই একটি দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, শিল্প—বাণিজ্যক্ষেত্রে বাঙালির উৎসাহের অভাব অন্তত উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে ছিল না। এমন কথা কেউ বলেননি যে সেকালের গ্রাম্য সমাজ ও কুটিরশিল্পই ভালো ছিল, আধুনিক শিল্প—বাণিজ্যের প্রয়োজন নেই, অথবা তাতে সমাজের অকল্যাণ হবার কোনও সম্ভাবনা আছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের প্রতি বিত্তশালী বাঙালিদের অনুরাগ কেন ব্যাপক ও গভীর হল না, তার কারণগুলি অনুসন্ধান করার একটা গুরুদায়িত্ব থেকে যায়।

ব্রিটিশ শিল্পনীতির অন্তরায়

ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় শিল্পনীতি রূপায়িত হয়েছে মূলত ব্রিটিশ স্বার্থে। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের অধীন উপনিবেশের শিল্পায়ন—নীতি কখনো উপনিবেশের স্বার্থে পরিচালিত হতে পারে না। শাসকের স্বার্থে যতটুকু শিল্পায়ন সম্ভব হয় সেইটুকুই উপনিবেশের লাভ। পরাধীন দেশের শিল্পোদযোগী ধনিকশ্রেণিরও আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ—সুবিধা বিদেশি শাসকের স্বার্থসিদ্ধির এই রন্ধ্রপথে অনুসন্ধান করতে হয়। ভারতে ব্রিটিশ শিল্পনীতির উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করে মাইকেল কিড্রন বলেছেন :

“From the 1850’s public works were financed out of current revenues–sparingly; request for subsidies for heavy industry were repeatedly denied; several attempts to set up investment banks were blocked and the field left clear for orthodox British banking which was then, as now, totally unsuited for the purpose. Railways converged on the ports with little regard for internal economic logic and none for uniformity of gauges and rates Railway building had little ‘spread effect’ : permission to buy government stores in India came only in 1928 and preference for local manufactures in 1931. Recommendations of the Famine Enquiry Commission, 1880, to encourage industry and sponsor technical training officially were ignored for nearly forty years.”

খুব অল্পকথায় কিড্রন এখানে ব্রিটিশ শিল্পনীতির ইতিহাস ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করেছেন। সার কথাটুকু তিনি বলেছেন এবং তার ভিতর থেকে বোঝা যায় ব্রিটিশ শিল্পনীতি কত দূর ভারতীয় শিল্পায়নের পরিপন্থী ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আধুনিক শিল্পপ্রতিষ্ঠা ভারতবর্ষে কিছু কিছু হয়েছে, বাংলা দেশেও হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলা দেশে শ্রীরামপুরে (হুগলি) প্রথম কাগজের কল স্থাপিত হয়। ১৮২০ সালের রানিগঞ্জে (বর্ধমান) প্রথম কয়লাখনি খোঁড়ার পর প্রায় কুড়ি বছরের মধ্যে আর কোনও নতুন খনি খোঁড়া হয়নি। উনিশ শতকের মধ্যভাগে রেলপথ নির্মাণের সময় থেকে কয়লাখনির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮৭৯—৮০ সালের মধ্যে রানিগঞ্জ ও তার পাশাপাশি অঞ্চলে প্রায় ৫৬টি কয়লাখনিতে কাজ আরম্ভ হয়। ১৮৭২—৭৩ সালের মধ্যে কয়েকটি কাপড়ের কল স্থাপিত হয়, তার মধ্যে ১৮টি বোম্বাই প্রদেশে এবং ২টি বাংলাদেশে। পাটচাষ ও পাটকল প্রধানত বাংলা দেশেই কেন্দ্রীভূত ছিল। *১৮৫৪ সালের অকল্যান্ড প্রথম পাটকল শ্রীরামপুরে স্থাপন করেন। ১৮৮২ সালের মধ্যে ভারতবর্ষে ২০টি পাটকল স্থাপিত হয়, তার মধ্যে ১৮টি বাংলা দেশে এবং এই ১৮টির মধ্যে ১৭টি কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে।

লোহা—ইস্পাতশিল্পের ইতিহাস থেকে ব্রিটিশ শিল্পনীতির স্বরূপ আরও পরিষ্কার বোঝা যায়। ১৮০৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মি : ডানকান ভারতে প্রথম লৌহ—ইস্পাত কারখানা নির্মাণে উদযোগী হন, কিন্তু সফল হননি। তারপরে ১৮৩০ সালে জোসিয়া মার্শাল হিদ তৎকালীন মাদ্রাজের পোর্টে নোভোতে লৌহ—ইস্পাত কারখানা স্থাপন করেন। মাদ্রাজ সরকারের সহযোগিতা থাকা সত্ত্বেও ১৮৬০ সালে উঠে যায়।

১৮৭০ সালে জোমস ইরসকাইন কুলটির জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে ব্লাস্ট ফার্নেস স্থাপন করেন। বেঙ্গল আয়রন ওয়ার্কস পরবর্তীকালে বরাকর আয়রন ওয়ার্কস নামে উৎপাদন শুরু করে। নিম্নমানের লোহা উৎপাদনের জন্য বন্ধ হয় যায়। ৮বছর পরে বেঙ্গল আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল কোম্পানি কারখানা অধিগ্রহণ করে উৎপাদন শুরু করে। উনিশ শতকের মধ্যেই এই কোম্পানি শুধু লোহা তৈরি করেছিল, তা—ও অল্প পরিমাণে, ইস্পাত তৈরি করতে পারেনি। লোভাট ফ্রেজার (Lovat Fraser) বলেছেন যে উনিশ শতকের মাঝামাঝির পর থেকে ভারতের শিল্পায়নের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের বিরাগ আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে এবং তার ফলে ভারতের শিল্পপ্রসার যথেষ্ট ব্যাহত হয়। আশ্চর্য হল, রেলপথ স্থাপিত হবার পরে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, ইস্পাতের যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ভারতে কোনও ইস্পাত তৈরির কারখানা স্থাপিত হয়নি। জামসেদজি টাটা ১৮৮০ সালে মধ্যপ্রদেশে লোহা—ইস্পাতের কারখানা স্থাপনের জন্য ভারত সরকারের কাছে রেলওয়ের কিছু সুযোগ—সুবিধা চেয়েছিলেন, কিন্তু মধ্যপ্রদেশের চিফ কমিশনার তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। বিশ শতকের গোড়ায়, কার্জনের শাসনকালে, লোহা—ইস্পাতের কারখানা স্থাপনের সুযোগ—সুবিধা দেওয়া হয় এবং ইস্পাত তৈরিও এই সময় থেকে আরম্ভ হয়। ভারতবর্ষে আধুনিক কারখানায় প্রথম ইস্পাত তৈরি হয় ১৯১৩ সালে।১০

প্রশ্ন হল, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ দেশের লোহা—ইস্পাতশিল্পের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের যে প্রতিকূল মনোভাব ছিল, বিশ শতকের গোড়ায় তা অনুকূল হবার কারণ কী? অর্থাৎ প্রথমে কেন প্রতিকূল ছিল, পরে কেন অনুকূল হল? প্রথমে প্রতিকূল ছিল কারণ ভারতে রেলপথ প্রতিষ্ঠার পর লোহা—ইস্পাতের যে বিপুল চাহিদা হয়েছিল তা ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের দেশের ইস্পাতশিল্পের প্রসারের জন্য ইংলন্ড থেকে আমদানি লোহা—ইস্পাত দিয়ে মেটাতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ ভারতীয় রেলওয়ের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার প্রায় অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত ইংলন্ডের লোহা—ইস্পাত শিল্পের প্রসারে সাহায্য করেছে। পরে বিশ শতকের গোড়ায় এই মনোভাব পরিবর্তনের কারণ হল উনিশ শতকের শেষ দশকের দিকে ভারতের লোহা—ইস্পাতের বাজারে ইংলন্ডের একচেটিয়া প্রতিপত্তি ‘চ্যালেঞ্জ’ করে বেলজিয়াম অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাজেই নানাদিক বিচার করে ব্রিটিশ সরকার এই সময় ভারতে লোহা—ইস্পাত তৈরির কিছু সুযোগ—সুবিধা ভারতীয় পুঁজিপতিদের দিয়েছিলেন। ‘টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’ ১৯০৭ সালে স্থাপিত হয়, ১৯০৮ সালে টাটার কারখানা নির্মাণ আরম্ভ হয়, ১৯১১ সালে প্রথম লোহা তৈরি হয় এই কারখানায় এবং ১৯১৩ সালে হয় ইস্পাত।১১ দেশীয় লোহাশিল্প সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন : ১২

”এতদ্দেশে বিস্তর লৌহের আকর আছে। সেই আকরোত্তোলিত লৌহের যথোপযুক্ত ব্যবহার হইলে ভারতবর্ষে আর বৈদেশিক লৌহের আমদানী করিবার প্রয়োজন হইবে না। পূর্বে আমাদের মহামান্য ষ্টেট সেক্রেটারি মহোদয় এদেশে শিল্পবিস্তারের উদ্দেশ্যে স্থানে স্থানে লৌহের কারখানা খুলাইবার প্রস্তাব করেন, পরে লোকহিতৈষী মহাত্মা লার্ড রিপন সেই প্রস্তাবের কার্যকারিতা হৃদয়ঙ্গম করিয়া যাহাতে শীঘ্র নানাস্থানে লৌহের কারখানা স্থাপিত হয়, তদ্বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হইয়াছেন… এক্ষণে যে সমস্ত স্থানে লৌহের আকর আছে, তত্তৎস্থলে এক একটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হইবে, সেই সমস্ত কারখানা রেলওয়ের লৌহময় দ্রব্যসামগ্রীর আঞ্জাম করিবেন, ফলতঃ এবিষয়ে গবর্ণমেণ্ট অনেকটা আনুকূল্য করিতে সম্মত হইয়াছেন, আমরা ভরসা করি এতদ্দেশীয় ধনবান ব্যক্তিরা যেন বিলাতের দিকে দৃষ্টিপাত না করেন, অবশ্য আমরা স্বীকার করি এই বৃহৎ কার্যে বিস্তর ধন আবশ্যক, কিন্তু ঐ মূলধন যে এদেশ হইতে সংগৃহীত হইতে পারিবে না তাহার কোন কারণ নাই… গবর্ণমেণ্ট লৌহের ব্যবসায়ে কিছু আনুকূল্য করিবেন শুনিয়া ভারতবর্ষের চিরন্তন ছিদ্রান্বেষী ইংলিসম্যান দুশ্চিন্তায় গলদঘর্ম হইয়া পড়িয়াছেন, মূর্ছিত হন নাই, হইতে হইতে চৈতন্য পাইয়াছেন…।”

উনিশ শতকের শেষদিক থেকে এ দেশের লোহা—ইস্পাতশিল্পের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মনোভাবের যে পরিবর্তন হচ্ছিল, ‘সোমপ্রকাশ’ তারই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এই আনুকূল্যটুকুও যে স্থানীয় ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভালো চোখে দেখছিলেন না তা ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার মতামত সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’—এর মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। যা—ই হোক, ভারতের শিল্পায়নের পথে ব্রিটিশ শিল্পস্বার্থ যে বেশ বড় একটা অন্তরায় ছিল, আমাদের লোহা—ইস্পাতশিল্পের প্রতিষ্ঠাকালের (এবং পরবর্তী অগ্রগতিরও) এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কয়লাখনির ইতিহাস অন্য এক রকমের দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যায়। বাংলা দেশে রানিগঞ্জ অঞ্চলে ১৭৭৪ সাল থেকেই কয়লার খাদ খোঁড়ার চেষ্টা হয়।১৩ কিন্তু সেই সময় কোনওদিক থেকে কোনওরকম উৎসাহ ও সহযোগিতা না পেয়ে এক্ষেত্রে প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের সমস্ত উদ্যম ব্যর্থ হয়। তারপর প্রায় চল্লিশ বছরের মধ্যে আর কোনও প্রচেষ্টা দেখা যায় না। ১৮২০ সালে রানিগঞ্জে আবার কয়লাখনি খোঁড়া হয়, কিন্তু তার কাজকর্মও নানারকম অসুবিধার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৪৫—৪৬ ও ১৮৫৮—৬০ সালে কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের জন্য এই অঞ্চল জরিপ করা হয়। এই সময় রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা ও তার কাজকর্ম চলতে থাকে। বিদেশ থেকে আমদানি কয়লা দিয়ে সেই কাজ চালানোর অসুবিধা হয়। তখন থেকে কয়লাখনির ধারাবাহিক প্রসার হতে থাকে। ১৮৬০ সালে দেখা যায় রানিগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় পঞ্চাশটি কয়লাখনি থেকে বছরে ২৮২০০০ টন কয়লা উৎপন্ন হচ্ছে।১৪ কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলের খনিজ সম্পদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অধিকার কায়েম করতে টালবাহানা করেছেন। তার ফলে স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে বিরোধ ও মামলা—মকদ্দমায় অনেক খনির কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ‘কোল ফিল্ড কমিটি’ তাঁদের রিপোর্টে বলেছেন : “A notable feature of this development was the failure of Government to assert their rights to the mineral wealth in the permanently settled areas. The early entrepreneurs had, therefore, to conclude agreements with the local land-owners and the inevitable complexities and resultant expensive legal disputes caused many failures.” ১৫

বাঙালির প্রাথমিক শিল্পোদ্যমের ইতিহাসে কয়লার একটি বিশেষ স্থান আছে। উনিশ শতকের মধ্যে ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’ বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং প্রচুর মুনাফাও করতে থাকে। কিন্তু এই মুনাফার সবটুকুই বিদেশি পুঁজিপতিরা গ্রাস করতেন। শুধু তা—ই নয়, এই অঞ্চলে তাঁদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় থাকুক এবং অন্য কোনও কয়লাখনি স্থাপিত না হোক, এই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। ব্রিটিশ শাসকরাও কোম্পানির মালিকদের এই উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৮৫৭ সালে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা এই কোম্পানি সম্বন্ধে লেখেন :১৬

“The company has been about half a century in existence, having succeeded government in the possession of the splendid concern which Government at an immense loss had raised for the purpose of unlocking the coal resources of Bengal. The resources, moral and material, at the command of the Company’s Agent are immense. This Company has always considered itself the sole rightful owner of the extensive coal fields which stretch westward from Burdwan, and resented any infringment of or tresspass upon its monopoly. For many years, Government and the local authorities seemed to acquiesce in its claims, and afforded no countenance or protection to any other speculator who dared to set up in rivalry to the Company… Great has become the Bengal Coal company, great its prestige and great the fame of its manager. The present Governor-General has, we understand, paid the tribute of his admiration, to the great company and its concerns. In competition with this company, in the face of difficulites which have scared away or ruined rival British speculations, a native gentleman, thirteen years ago, opened a mine in the vicinity of the Bengal Coal Company’s fields. In thirteen years, the Searsole colliery has become the second great colliery in Bengal, and bids fair to outgrow the old company’s works.”

বাংলাদেশে কয়লাখনির এই ইতিহাস থেকেও বোঝা যায় ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের স্বার্থ কতখানি এ দেশীয় ধনিকদের শিল্পোদ্যমের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সম্বন্ধে কোনও সংশয় নেই, কিন্তু প্রশ্ন হল এই প্রতিবন্ধকতাই কি বাঙালির শিল্পোদ্যমের ব্যর্থতার একমাত্র কারণ?

কার-ট্যাগোর অ্যান্ড কোম্পানি

উনিশ শতকে বাঙালিদের মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহ ও অনুরাগ দ্বিতীয় আর কারও ছিল কি না সন্দেহ। ১৮৩৪ সালে দ্বারকানাথ গভর্নমেন্টের দেওয়ানের কাজ ছেড়ে (Customs, Salt and Opium Board) স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের জন্য ‘কার—ট্যাগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ স্থাপন করেন (১৮৩৫—৩৬)। প্রথমে এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ছিলেন কার সাহেব (Willam Carr), প্রিন্সেপ সাহেব (William Prinsep) ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। কোম্পানির মূলধন বেশির ভাগই দ্বারকানাথ জোগান দিতেন। এই কোম্পানি রানিগঞ্জের কয়লাখনির ব্যবসায়ে উৎসাহী হয়ে অনেক মূলধন নিয়োগ করেন। ১৮৩৬ সালে একটি বিদেশি কোম্পানির খনি নিয়ে এই কাজ আরম্ভ করা হয়। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা লেখেন (৯ জানুয়ারি ১৮৩৬) :১৭ ”আলেকজান্দার কোম্পানির ইষ্টেটসম্পর্কীয় রানীগঞ্জের কয়লার আকর গত শনিবারে নীলাম হওয়াতে বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর ৭০০০ টাকাতে তাহা ক্রয় করিয়াছেন। ঐ আকর পূর্বে অত্যুৎসাহী জোন্স সাহেবের ছিল। ঐ সাহেব প্রথমেই এতদ্দেশে কয়লা বাহির করাতে ভারতবর্ষীয় লোকেরা তাঁহার অত্যন্ত বাধ্য হইয়াছেন।”

দ্বারকানাথ ঠাকুরই কার—ট্যাগোর কোম্পানির প্রাণস্বরূপ ছিলেন। তিনি টাকা জোগাতেন এবং দায়িত্বপূর্ণ কাজকর্ম নিজেই পরিচালনা করতেন। কোম্পানির আর্থিক ব্যাপারে, মূলধনের প্রধান নিয়োগকর্তা বলে, তিনি প্রায় সর্বময় কর্তা ছিলেন, অন্য কোনও অংশীদারকে হস্তক্ষেপ করতে দিতেন না। কার ও প্রিন্সেপ সাহেব ছাড়া পরে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হেন্ডারসন, প্লাউডেন, ম্যাকফার্সন ও টেলার সাহেব অংশীদার হন এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও দ্বারকানাথ অংশীদার করে নেন। ব্যাবসাবাণিজ্যের জন্য যাতে টাকা ধার পেতে অসুবিধা না হয় সেই উদ্দেশ্যে, প্রধানত দ্বারকানাথের উদ্যোগে, ১৮২৯ সালে ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’ স্থাপিত হয়। প্রায় ১৬ লক্ষ টাকা মূলধন নিয়ে ব্যাঙ্কের কাজ আরম্ভ হয় ১৭ আগস্ট ১৮২৯। এই মূলধনে দ্বারকানাথের অংশ ছিল অনেকটা, এ ছাড়াও মধ্যে মধ্যে ব্যাঙ্কে অনেক টাকা তিনি দিয়েছেন। কার—ট্যাগোর কোম্পানির সঙ্গে স্বভাবতই ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৮৪০ সালের পর থেকে ইংলন্ডে ও ভারতবর্ষে আর্থিক সংকটের ফলে অনেক ব্যাঙ্ক ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ফেল হয়ে যায়। দ্বারকানাথ এই সংকটের ভিতর দিয়েও তাঁর ব্যাঙ্ক ও কোম্পানির কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় হঠাৎ ১৮৪৬ সালের ১ আগস্ট ইংলন্ডে দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয়। তার প্রায় দেড় বছরের মধ্যে ব্যাঙ্ক ও কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়। ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের পতন হয় ১৮৪৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর, এবং কার—ট্যাগোর কোম্পানি উঠে যায় ১৮৪৮ সালের ১২ জানুয়ারি।১৮

১৮৪৮ সালের ৪ এপ্রিল কার—ট্যাগোর কোম্পানির পাওনাদারদের একটি সভা হয়। সভায় কোম্পানির যে হিসেব দেওয়া হয়েছিল তাতে দেখা যায় যে তার মোট দেনা ছিল তখন প্রায় ২৫ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা। কোম্পানির সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি হলে এবং অনাদায়ি টাকা আদায় হলে প্রায় ২৯ লক্ষ ২ হাজার ৯৫০ টাকা পাওয়া যেত এবং তা দিয়ে দেনা পরিশোধ করাও হয়তো সম্ভব হত। কিন্তু যে—কোন—একজন পাওনাদারের দাবি উপস্থিত হওয়ামাত্র তৎক্ষণাৎ তা মেটাতে না পারলে ব্যাঙ্কের মতো বাণিজ্য—হাউসেরও পতন হয়। কার—ট্যাগোর কোম্পানির ক্ষেত্রে তা—ই হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আত্মজীবনী’তে মোট দেনা ১ কোটি টাকা ও মোট পাওনা ৭০ লক্ষ টাকা বলে লিখেছেন। আগের হিসেবের সঙ্গে এই হিসেবের মিল নেই। মনে হয় দেবেন্দ্রনাথের হিসেব দ্বারকানাথের ব্যক্তিগত দেনাপাওনার সঙ্গে কোম্পানির দেনাপাওনার মিলিত হিসেব।

* দ্বারকানাথের কয়লার ব্যাবসার কথা বলি। ৭০,০০০ টাকা দিয়ে ১৮৩৫ সালে দ্বারকানাথ আলেকজান্ডার কোম্পানির কাছ থেকে রানিগঞ্জে কয়লাখনি কেনেন। এ সংবাদ আমরা তৎকালের সাময়িকপত্র থেকে পাই। এই কয়লাখনি ব্যবসায়ও দ্বারকানাথের কার—ট্যাগোর কোম্পানির কাছে যে বিশেষ লাভজনক হয়নি, তা সরকারি রাজস্ববিভাগের নথিপত্রে রক্ষিত কোম্পানির কয়েকটি চিঠি থেকে বোঝা যায়। বর্ধমানের ডেপুটি কালেক্টর ও খাসমহলের সুপারিনটেনডেন্ট টেলর (W. Taylor) সাহেবের কাছে ২৭ মার্চ ১৮৩৯ সালে লিখিত কার—ট্যাগোর কোম্পানির একখানি চিঠি থেকে রানিগঞ্জের কয়লাখনির ব্যবসায়ের কথা কিছুটা অনুমান করা যায়। চিঠিতে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ যা লেখেন তার মর্ম এই : ১৯

”১৮১৫ সালে জনৈক উইলিয়াম জোন্স (Willam Jones) এই কয়লাখনি প্রথম খনন করেন এবং গভর্নমেন্ট তাঁকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ দিয়ে সাহায্য করেন।

বর্ধমানের মহারানি জয়কুমারীর কাছ থেকে বাৎসরিক ৫৫।। ৩ পাই খাজনাতে জমি নিয়ে জোন্স কয়লার খাদ খোঁড়েন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৭১ তারিখের এই পাট্টা আপনাদের রাজস্ববিভাগের দপ্তরে আছে।

গভর্নমেন্ট নতুন একটি শিল্পপ্রচেষ্টাকে উৎসাহ দেবার জন্য যে ঋণ দিয়েছিলেন, তার জন্য জামিন ছিলেন আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানি। ১৮২২ সালে জোন্স সাহেবের মৃত্যুর পর এই আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানি কয়লাখনির মালিক হন।

যদিও আগের জমিতে উক্ত কোম্পানি খাদের কাজ করছিলেন, তাহলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে এবং খানিকটা নিরাপত্তার জন্যও, তাঁরা রানিগঞ্জ ও তার পাশাপাশি আরও চারটি গ্রামের (যা বর্ধমানরাজের দেবোত্তর সম্পত্তি ছিল) পত্তনি তাঁদের একজন কর্মচারী গোবিন্দপ্রসাদ পণ্ডিতের নামে গ্রহণ করেন।

রানিগঞ্জের কয়লাখনি এবং এই গ্রামগুলি ১৮৩৫ সালে আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানির ওয়ারিশরা আমাদের কাছে বিক্রি করে দেন।

রাণিগঞ্জ ও অন্যান্য গ্রামের জন্য আমাদের ১৫০০ টাকা সেলামি দিতে হয়, এবং ৯৫৯ টাকা বাৎসরিক খাজনা দিতে হয়। এইসব সম্পত্তি ও জমিজমার দলিলপত্র আপনাদের অফিসেই রক্ষিত আছে।

রানিগঞ্জ অঞ্চল আপনাদের যথেষ্ট পরিচিত। এরকম শুকনো অনুর্বর অঞ্চল যে চাষবাসের আদৌ অনুকূল নয় তা আপনি জানেন। সুতরাং কয়লাখনি ছাড়া অন্য উপায়ে এখান থেকে কিছু উপার্জন করা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও আমরা যে এখানে পাশাপাশি কতকগুলি গ্রাম পত্তনি নিয়েছি তা কেবল আমাদের কয়লাখনির ভবিষ্যৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে এবং খানিকটা খনিমজুরের সমস্যা সমাধানের জন্যও বটে। এইসব অঞ্চলের যেটুকু উন্নতি হয়েছে তা আমাদের কয়লাশিল্পের কাজের জন্য। কয়লাখনি না থাকলে এই সমস্ত গ্রামের অবস্থা যেমন শোচনীয় ছিল তেমনি থাকবে। আমরা ভাবতেই পারি না যে এই উন্নতির জন্য গভর্নমেন্ট আমাদের কাছ থেকে বেশি করে ট্যাক্স ধার্য করবেন। আমাদের স্বার্থের জন্য আমরা গভর্নমেন্টের কাছ থেকে কতকগুলি সুযোগ—সুবিধা দাবি করেছি এবং আমরা মনে করি যে এরকম জনকল্যাণকর শিল্পকর্মের শ্রীবৃদ্ধির জন্য গভর্নমেন্টের উচিত আমাদের কাজকর্মে কোনও বাধা সৃষ্টি বা হস্তক্ষেপ না—করা। কয়লাশিল্প এমন একটি শিল্প যা আমাদের দেশে একেবারে নতুন এবং সবেমাত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে বলা চলে। দেশের ও জাতির কল্যাণ ও উন্নতি যে কতখানি এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল, তা—ও বুঝিয়ে বলার দরকার করে না।”

”এই কারণে গভর্নমেন্টের কাছে আমাদের অনুরোধ, তাঁরা যেন খাজনাবৃদ্ধি করে, অথবা সেলামি চেয়ে অযথা আমাদের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করেন। খাজনাবৃদ্ধির অর্থ হল আমাদের কয়লার উপর ট্যাক্স ধার্য করা। এখনও যখন আমাদের দেশে ইংলন্ড থেকে আমদানি কয়লা দিয়ে বেশির ভাগ চাহিদা মেটাতে হয়, তখন প্রতিযোগিতায় আমাদের কয়লার মূল্য বেশি হলে ব্যবসায়ের যথেষ্ট ক্ষতি হবে, এবং হয়তো কয়লাখনি বন্ধ করে দিতে হবে।” চিঠির শেষ অংশটুকু এই :

“…We deem it our duty most strongly to appeal against an increased rate of assessment which operating exclusively as a direct tax upon our coal would, during the present competition and while so large a proportion of the entire quality consumed in India is imported from England, oblige us probably at once to close our mines and save ourselves from certain loss only by disposing of stock that we have already collected while we should throw out of employment some thousands of persons who depend upon our colliery for employment in mining and in conveying the coal from Raneegunge to Calcutta.

We have etc.

sd/Carr Tagore & Co.”

ব্রিটিশ শাসকরা যে ‘কার—ট্যাগোর অ্যান্ড কোম্পানি’র কয়লাখনি শিল্পের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন না, তা এই চিঠির মূল বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। যদি এ দেশের স্বাধীন শিল্পোদ্যম ও শিল্পোন্নতির প্রতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের এতটুকু অনুকূল মনোভাব থাকত তাহলে কয়লাশিল্পের শৈশবকালে এ দেশের শিল্পোদযোগীদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করতে তাঁরা দ্বিধা করতেন না। অবশ্য ‘কার—ট্যাগোর কোম্পানি’ এই চিঠিখানা যখন লিখেছিলেন (১৮৩৯) তখন আমাদের দেশে রেলপথ স্থাপিত হয়নি। এমনকী এই কোম্পানি যখন উঠে যায় (১৮৪৮) তখনও রেলপথ পরিকল্পনা ঠিক বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। ‘কার—ট্যাগোর কোম্পানি’র শিল্পোদ্যম তার আগেই নিঃশেষ হয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসকদের শিল্পানুকূল্যের অভাব তার পতনের একটি অন্যতম কারণ। রানিগঞ্জের কয়লাখনির প্রসার অন্যান্য অঞ্চলের রেলপথ স্থাপিত হবার পর দ্রুতগতিতে হয়। কিন্তু তার সঙ্গে দ্বারকানাথ ঠাকুর বা ‘কার—ট্যাগোর কোম্পানি’র কোনও সম্পর্ক ছিল না।

আমাদের প্রশ্ন হল, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো একজন অসাধারণ শিল্পোদযোগী বাঙালির স্বাধীন শিল্পোদ্যম ব্যর্থ হল কেন, এবং তাঁর চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ইয়োরোপীয় মডেলের বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান কার—ট্যাগোর কোম্পানির কেনই বা মাত্র বারো বছরের মধ্যে পতন হল?

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের শিল্পানূকুল্যের অভাব দ্বারকানাথের এই শিল্পোদ্যমের ব্যর্থতা ও বাণিজ্যিক অবনতির একটি কারণ, এবং অবশ্যই বড় কারণ যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ছাড়াও আরও অন্যান্য কারণ ছিল এবং সেই কারণগুলির গুরুত্ব কম বলে মনে হয় না। সেই কারণগুলি হল :২০

১. ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, কার—ট্যাগোর কোম্পানি এবং নিজের বিষয়সম্পত্তি—এই ত্রিমুখী অভিযানের ফলে দ্বারকানাথের মূলধন কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে, তার গুরুত্ব অনুযায়ী, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কেন্দ্রীভূত হতে পারেনি। বহু ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে দ্বারকানাথের মূলধন শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কেবল ভূসম্পত্তিতে বিনিযুক্ত মূলধনটুকু ছাড়া। ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ও কার—ট্যাগোর কোম্পানির যুগপৎ দেউলিয়া হওয়া থেকে এবং কোম্পানির দেনাপাওনার হিসেব থেকে তা বোঝা যায়।

২. তখনকার ইংরেজ ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই মূলধন সংগ্রহ করতেন এ দেশের ধনী বেনিয়ানদের কাছ থেকে। বড় বড় ইংরেজরা নিঃসংকোচে হাজার হাজার টাকা ঋণ করতেন ধনিক বাঙালিদের কাছ থেকে এবং সে টাকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা বাণিজ্যিক স্পেকুলেশনে উড়িয়ে দিতেন, পরিশোধ করতে পারতেন না। দ্বারকানাথের ইংরেজ অংশীদাররা হয়তো ইংরেজ বলে তাঁর কোম্পানির ‘স্টেটাস’ বাড়িয়েছেন, কিন্তু ঐ ‘স্টেটাস’টুকু ছাড়া আর কোনও লাভ দ্বারকানাথের হয়নি। বিশেষ করে মূলধনের দিক থেকে বরং তাঁরা গলগ্রহ হয়েছেন, প্রকৃত সহযোগী হতে পারেননি। অর্থাৎ দ্বারকানাথকে তাঁদের টাকাও জোগান দিতে হয়েছে, কোম্পানিকে তো দিতে হয়েছেই। কী উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য দ্বারকানাথ ইংরেজ অংশীদার নিয়েছিলেন তা জানা নেই। ম্যাকিনটোশ কোম্পানির দু—জন অংশীদার গর্ডন (J. G. Gordon) ও ক্যালডর (James Calder) দ্বারকানাথের বাল্যবন্ধু ছিলেন বলে তাঁরা তাকে কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের একজন ডিরেক্টর করে নেন। এক্ষেত্রে তাঁর ইংরেজ বন্ধুদের স্বার্থ পরিষ্কার বোঝা যায়। সেই স্বার্থ হল দ্বারকানাথের টাকা। কিন্তু দ্বারকানাথ কী স্বার্থে (একমাত্র সামাজিক স্টেটাসের স্বার্থ ছাড়া) কার—ট্যাগোর কোম্পানিতে ইংরেজ অংশীদার নিয়েছিলেন, তার রহস্য ভেদ করা সত্যই কঠিন। তা না নিয়ে যদি তিনি তাঁর সমসাময়িক কয়েকজন বাঙালি ধনিককে (যথেষ্ট বাঙালি ধনিক বন্ধু তাঁর ছিলেন) ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অংশীদার করে নিতেন এবং তাঁদের কয়েকজনকেও যদি স্বাধীন শিল্পকর্মে উৎসাহী করতে পারতেন, তাহলে হয়তো তাঁর কোম্পানির ইতিহাস অন্যরকম হত। বাঙালির শিল্পোদ্যমের ইতিহাসেও একটা নতুন ধারা তিনি প্রবর্তন করতে পারতেন। নিজেও হয়তো বিস্তর দেনার দায়ে ভরাডুবি হতেন না। আর যদি গভর্নমেন্টের সহানুভূতি পাবেন বলে তিনি ইংরেজ অংশীদার নিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা তাঁর কল্পনাবিলাস বলতে হয়। জোন্স সাহেব ৪০ হাজার টাকা ঋণ পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়লার ব্যবসা তিনি করতে পারেননি। গভর্নমেন্ট অনুকূল হলে নিশ্চয় তাঁর অবস্থা শোচনীয় হত না। আলেকজান্ডার কোম্পানিও সরকারি আনুকূল্য পেলে এবং কয়লাশিল্পে লাভবান হলে নিশ্চয় দ্বারকানাথের কাছে ৭০ হাজার টাকায় তা বিক্রি করে দিতেন না। সুতরাং ইংরেজ অংশীদার হলে ব্রিটিশ সরকার তাঁর শিল্পোদ্যমে সহযোগিতা করবেন, এরকম কোনও ধারণা করার কোনও যুক্তিসংগত কারণ ছিল না। ব্রিটিশ শিল্পনীতি এ দেশে এরকম কোনও মানদণ্ড দ্বারা পরিচালিত হয়নি। তাহলে হিদ সাহেবের লোহার কারখানা উঠে যেত না এবং জামসেদজি টাটা না হয়ে কোনও ইংরেজ যদি তখন লোহা—ইস্পাতের কারখানা করতে চাইতেন তাহলেই যে ভারতের ব্রিটিশ শিল্পনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন হত, এমন কথা ভাববার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। কাজেই শিল্পস্বার্থের দিক থেকে ইংরেজ অংশীদার নেওয়া দ্বারকানাথের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল বলে মনে হয়।

৩. নীলের ব্যবসায়ে কার—ট্যাগোর কোম্পানিকে এবং ইউনিয়ন ব্যাঙ্ককে জড়িত করা অথবা তাঁর নিজের দিক থেকেও জড়িত হওয়া উচিত হয়নি। নীলচাষ ও নীলকুঠির ব্যবসা কোনওমতেই স্বাধীন শিল্পপদবাচ্য হতে পারে না, অথচ এই নীলকুঠিতে কার—ট্যাগোর, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ও দ্বারকানাথের অনেক টাকা নষ্ট হয়েছিল।

৪. শিল্প—বাণিজ্যের পরিবর্তে বিষয়সম্পত্তি ও জমিদারি কিনে দ্বারকানাথ লক্ষ লক্ষ টাকা ভূগর্ভে সমাধিস্থ করেছিলেন। ‘বোর্ড অফ রেভিনিউ’—এর দলিল—দস্তাবেজের মধ্যে দ্বারকানাথের এই জমিদারি কেনার ও জমিদারে পরিণত হওয়ার ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত খুঁজে পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা পর্যন্ত বহু ভূসম্পত্তি কিনে শেষ পর্যন্ত তিনি বেশ বড় একজন জমিদার হয়েছিলেন। দ্বারকানাথ বুঝতে পারেননি যে জমিদার ও শিল্পপতি একসঙ্গে হওয়া যায় না, হয় পুরোপুরি জমিদার হতে হয়, না হয় পুরোপুরি শিল্পপতি হতে হয়। দুটি একসঙ্গে হতে গেলে শেষ পর্যন্ত অচল—অটল জমিদারিটুকুই থাকে, কিন্তু সচল শিল্প—বাণিজ্য থাকে না। দ্বারকানাথের ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। এককথায় বলা যায়, দ্বারকানাথের মধ্যে স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের যথেষ্ট উৎসাহ থাকলেও, নতুন কালোপযোগী আদর্শ শিল্পপতির মনোভাব বা চরিত্র তাঁর ছিল না। সামন্ত্রতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক মনোভাবের এক বিচিত্র বিসদৃশ সংমিশ্রণ তাঁর চরিত্রে ঘটেছিল। এই দু—কূলমুখী মন তাঁর বাণিজ্যিক ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

৫. দ্বারকানাথের বেহিসেবি ভোগবিলাসিতা ও বদান্যতা যে তাঁর বাণিজ্যিক ব্যর্থতার আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সে কথা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়। উৎসব—পার্বণে, সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অজস্র টাকা ব্যয় করতে একটুও কুণ্ঠিত হতেন না। দানধ্যানও তিনি প্রকৃত দানবীরের মতো করতেন। তাঁর বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে যাননি এবং তাঁর বাদশাহি ভোজনৃত্যের অনুষ্ঠানে যোগদান করেননি, এরকম সম্ভ্রান্ত ইংরেজ, ভারতীয় ও বাঙালি তখন কেউ ছিলেন কি না সন্দেহ। দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির অনুষ্ঠানে যাওয়াটা তখনকার দিনে ইংরেজরাও সামাজিক ‘স্টেটাস’ প্রতিষ্ঠার দিক থেকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন। কত লক্ষ লক্ষ টাকা যে এই বাগানবাড়ির ভোজনৃত্যের উৎসবে, আতশবাজি ও আলোর বিচিত্র খেলায়, আমোদপ্রমোদে, বিলাসে ঠিক কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে তার হিসেব নেই। ১৮৫৬ সালে এই বাগানবাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। ”হা, যে উপবন প্রস্তুত করণে দ্বারকানাথবাবু দুইলক্ষ টাকার অধিক ধন বিসর্জন করিয়া ছিলেন এবং যে কাননে এক ২ রজনীতে ইংরাজাদি ভোজনে দশ বিশ সহস্র উড়িয়া গিয়াছিল, গত শনিবারে সেই বাগান বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। শ্রীযুক্ত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুর ও শ্রীযুক্ত রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বাহাদুর ৫৪ চুয়ান্ন সহস্র মুদ্রায় তাহা ক্রয় করিয়াছেন।” (সম্বাদ ভাস্কর, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৫৬)। জামসেদজি টাটার প্রথম লোহা—ইস্পাতের কারখানার মতো অন্তত একটি কারখানার মূলধনও সেই টাকা দিয়ে জোগান দেওয়া সম্ভব হত মনে হয়। আর তার অর্ধেক টাকাও যদি অপব্যয় না হত তাহলে বিলেতে তাঁর মৃত্যুর পরে ‘কার—ট্যাগোর কোম্পানি’ কখনো দেউলিয়া হত না এবং দেবেন্দ্রনাথকেও পিতৃঋণের দায়ে বিপন্ন হতে হত না। বিলেতে থাকার সময় যে বিলাসিতার বহর তিনি দেখিয়েছিলেন তা তাঁর মৃত্যুর পরে লোককাহিনিতে পরিণত হয়েছিল। বিলেতের লর্ডরাও দ্বারকানাথের বিলাসিতা ও ব্যয়ের বহর দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন। এই বিলাসিতা মধ্যযুগের রাজা—বাদশাহের বিলাসিতা, আধুনিক যুগের শিল্পপতির বিলাসিতা নয়। আধুনিক যুগের শিল্পপতির মন হিসেবি মন। দ্বারকানাথের যেমন ছিল সেকালের রাজা—বাদশাহের মন, বেহিসাবি মন। বেহিসাবি মন নিয়ে স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কৃতকার্য হওয়া যায় না, দ্বারকানাথও তাই হতে পারেননি।

রামদুলাল দে সরকার (দেব) : ‘আশুতোষ দে (দেব) অ্যান্ড নেফিউজ’

কুঁড়েঘর থকে রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলেছেন, এবং কানাকড়ি থেকে কোটিপতি হয়েছেন ব্যাবসা করে, এরকম দৃষ্টান্ত বাঙালি সমাজে বিরল। দ্বারকানাথের একপুরুষ আগে এই বিরল দৃষ্টান্তের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হলেন রামদুলাল দে সরকার। শেষজীবনে রামদুলাল কোটিপতি নামে পরিচিত হয়েছিলেন এবং বিলেতের ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকা তাঁর পুত্রদের ‘Rothschilds of Bengal’ বলে সম্বোধন করতে কুণ্ঠিত হননি। ইংরেজ আমলের আদিপর্বের বাঙালি ধনপতিদের ধনার্জনের কীর্তি সম্বন্ধে অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনা যায়। রামদুলাল সম্বন্ধেও এরকম কাহিনির অভাব নেই। কলকাতার কাছে দমদম অঞ্চলে একটি গ্রামে রামদুলাল অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দিদিমা কলকাতা শহরের বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী মদন দত্তর পরিবারে রাঁধুনির কাজ করতেন। রামদুলাল ছেলেবেলায় কলকাতায় এসে এই দত্ত পরিবারের আশ্রয়ে সামান্য কিছু লেখাপড়া শেখেন এবং খেয়ে—পরে মানুষ হন। মদন দত্তর সান্নিধ্যে ব্যবসায়ের প্রেরণা ছেলেবেলা থেকে তাঁর মনে জাগা অস্বাভাবিক নয়। প্রথমে মদন দত্তর কাছে তিনি বিল—সরকারের কাজ করেন (বেতন মাসিক ৫ টাকা), পরে শিপ—সরকারের কাজে নিযুক্ত হন (বেতন মাসিক ১০ টাকা)। এই সময় মালিকের নামে একখানি ডুবোজাহাজ কিনে তিনি যে ব্যবসায়ী বুদ্ধির পরিচয় দেন তাতে মদন দত্ত খুশি হয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করেন। এই পুরস্কারের টাকা নিয়ে রামদুলাল স্বাধীন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। তারপর তাঁর জীবনের ইতিহাস কেবল ভাগ্য, সাফল্য ও টাকার ইতিহাস। রামদুলালের শেষজীবন পর্যন্ত এই ইতিহাস কেবল অবিরাম অগ্রগতির ইতিহাস। তাঁর মৃত্যুর পর বাকি ইতিহাস ক্রমিক অবনতির ইতিহাস, যে ক্রমাবনতির সঙ্গে তাঁর মতো আরও অনেক বাঙালি ধনিক পরিবারের ইতিহাসের সাদৃশ্য আছে।২১

রামদুলাল Fairlie Fergusson & Co—র বেনিয়ান ছিলেন। ব্রিটিশ এজেন্সি হৌসের মধ্যে বোধহয় বৃহত্তম ছিল এই কোম্পানি। “The transactions of that House would strike the merchant of the present day as mythical”—(গিরিশচন্দ্র ঘোষ)। বাজারে এই কোম্পানির এমন প্রতিপত্তি ছিল যে এর দালালরা কোনও জিনিস চাইলে তা আর অন্য কেউ পেত না। এই কোম্পানির বেনিয়ান হিসেবে রামদুলালের সুনাম, প্রতিপত্তি ও ‘ক্রেডিট’ বাজারে অদ্বিতীয় ছিল। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টাকার কাজকর্ম রামদুলালের কথায় এবং সামান্য ইশারায় চলত। পামার কোম্পানি, আলেকজান্ডার কোম্পানি, ম্যাকিনটস কোম্পানি ছিল তখনকার বড় বড় ব্যবসায়—প্রতিষ্ঠান, এবং পরবর্তীকালে পঞ্চাশটি প্রতিষ্ঠানের কাজ এরা একাই তখন করত। তার মধ্যে রামদুলাল যে কোম্পানির বেনিয়ান ছিলেন তার সমকক্ষ আর কেউ ছিল না। টাকা দু—পয়সা—চার পয়সা দস্তুরি পেয়ে রামদুলাল এই বেনিয়ানির কাজ থেকেই লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেছেন।

‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেছেন : “Ramdoolal may justly be said to be the pioneer of American commerce in Bengal.” আঠারো শতকের শেষে আমেরিকা স্বাধীন দেশ হবার পর থেকেই বাংলা দেশের সঙ্গে তার বহির্বাণিজ্যের যোগাযোগ ঘটে প্রধানত রামদুলাল দে—র মাধ্যমে। রামদুলাল তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী, বিদেশে চীন থেকে ইংলন্ড—আমেরিকা পর্যন্ত বণিকমহলে তাঁর খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত। তাঁর মৃত্যুর পরে ব্যবসায়ের খাতাপত্র থেকে যে সমস্ত আমেরিকান বাণিজ্য—প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গিয়েছে, তা থেকেই বোঝা যায় আমেরিকার সঙ্গে রামদুলালের ব্যাবসা কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল :

বস্টন

G. R. Minot, G. Warren, J. Young, J. S. Amory, T. Wigglessworth, J. T. Coleridge, H. Irving, J. J. Bowditch, B. Rich and Son, E. Rhodes, F. W. Everitt, W. Godard, Mackie and Coleridge, H. Lee, O. Godwin, Theuring and Perkins.

নিউ ইয়র্ক

Messrs. Lennov & Son, G. S. Higginson, Messrs, C. & D. Skinner, Messrs, Singleton & Mezick, S. Austin Junior, W. C. Appleton, E. B. Crooker, E. Davies, J. J. Dixwell, W. A. Brown, A. Baker Junior, G. Brown, T. C. Bacon, M, Curtis, Baring Brothers.

ফিলাডেলফিয়া

Messrs. Grant & Stone

সালেন

Pickering Dodge, W. Landor.

নিউবেরি পোর্ট

The Hon’ble E. S. Rant, J. H. Telcombe.

মারভেলহেড

J. Hooper.

আমেরিকার ব্যবসায়ীরা রামদুলালকে এমন শ্রদ্ধা করতেন যে একটি আমেরিকান জাহাজের নামকরণ তাঁরা করেছিলেন রামদুলালের নামে। তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের একটি পোর্ট্রেট (৯ ফুট৬ ফুট) তাঁরা রামদুলালকে উপহার পাঠিয়েছিলেন। এই পোর্ট্রেটটি রামদুলালের পুত্র ও নাতিরা (আশুতোষ দে অ্যান্ড নেফিউজ) তাঁদের প্রতিষ্ঠানের আপিসে সযত্নে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। রামদুলালের বাণিজ্যের পণ্য তাঁর নিজের চারখানি জাহাজে বিদেশে যাতায়াত করত—তার মধ্যে একটি জাহাজের নাম ‘রামদুলাল দে’, একটির নাম ‘বিমলা’ (তাঁর বড়মেয়ের নামে), একটির নাম ‘ডেভিড ক্লার্ক’ (ফার্গুসন কোম্পানির একজন অংশীদার)। তখনকার দিনে (১৮০২—২৫) রামদুলাল তাঁর কর্মচারীদের মাসিক বেতন দিতেন পনেরো হাজার টাকা, আজকালকার দেড় লক্ষ টাকারও বেশি।

রামদুলালের মৃত্যুর (১ এপ্রিল ১৮২৫) প্রায় ৪৩ বছর পরে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেন : “The house established by Ramdoolal still flourishes amongst us, being carried on by the grandsons of the millionaire on the daughter’s side under the style of Ashootosh Deb and Nephews… The fame for honesty and capacity established by Ramdoolal is still maintained by this house, which continues to transact direct with the merchants of Boston, NewYork and Philadelphia, without the intervention of any English or American Agents.” কিন্তু উনিশ শতকের শেষ পর্বের মধ্যেই এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও প্রতিপত্তি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। রামদুলালের বর্তমান বংশধররা সাতুবাবু—লাটুবাবুর (রামদুলালের দুই পুত্র আশুতোষ দেব ও প্রমথনাথ দেব) বাবুগিরির জরাজীর্ণ ঐতিহ্যের অনুরাগী, না পূর্বপুরুষ রামদুলালের বাণিজ্যকীর্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বলা কঠিন।

রামদুলাল, তাঁর দুই পুত্র ও নাতিদের সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল—লক্ষ লক্ষ টাকার বাণিজ্য (Commerce) করেছেন তাঁরা, কিন্তু কখনো স্বাধীন শিল্পোদ্যমের (Industrial Enterprise) দিকে আকৃষ্ট হননি। কেন হননি? ব্রিটিশ শিল্পনীতির প্রতিকূলতার জন্য? মনে হয় না। রামদুলাল ও তাঁর বংশধরদের মনোভাব আধুনিক যুগোপযোগী ছিল না। ঠাকুর পরিবারে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা ছিল, দৃষ্টিভঙ্গিও তাঁদের আধুনিক ছিল, যদিও জমিদারির স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত তাঁরা আত্মরক্ষা করা বাঞ্ছনীয় মনে করেছিলেন। রামদুলাল দে—র পরিবারে তা—ও ছিল না। রামদুলাল নিজে গোঁড়া হিন্দু ছিলেন এবং এই গোঁড়ামির জন্য বহু লক্ষ টাকা তিনি অপব্যয় করেছেন, অবশ্য দ্বারকানাথের মতো ব্যক্তিগত বিলাসিতার দিকে রামদুলালের আদৌ কোনও নজর ছিল না। বরং সেদিক থেকে তিনি অত্যন্ত মিতব্যয়ী ছিলেন। পিতার সরল জীবনযাত্রার বিপরীত প্রতিক্রিয়া দুই পুত্র সাতুবাবু ও লাটুবাবুর চরম অসংযত বিলাসিতার মধ্যে দেখা দিয়েছিল। নাচ—গান—হল্লায়, কবিগানে—আখড়াই গানে, বুলবুলির লড়াইয়ে, শখের পায়রা ও বাঁদরের বিয়েতে, বাইনাচ ও খেমটানাচে—এই দুই বাবু—ভাই পিতার লক্ষ লক্ষ টাকা তামাকের ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়া আশুতোষ দেব গোঁড়া হিন্দুসমাজের পোষকতার জন্যও (ধর্মসভা) কম টাকা নষ্ট করেননি। জাতরক্ষা, সমন্বয়, কৌলীন্যরক্ষা ইত্যাদির জন্য তাঁর পিতার মতো তিনি হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন। দ্বারকানাথের মতো সাতুবাবুদের শখের বাগানবাড়ি ছিল বেলগাছিয়ায়। সেখানেও কয়েক লক্ষ টাকা অনুষ্ঠান—আপ্যায়নের বিলাসিতায় তাঁরা ব্যয় করেছেন।

মৃত্যুর সময় রামদুলাল প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা রেখে গিয়েছিলেন। এই টাকায় তাঁর পুত্র ও নাতিরা একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য—প্রতিষ্ঠানকে বৃহত্তর করতে পারেননি, বরং তার অবনতির পথই ধীরে ধীরে প্রশস্ত করেছিলেন। বাণিজ্যের বদলে স্বাধীন শিল্পোদ্যমের কথা তাঁরা চিন্তাও করেননি। অথচ রামদুলালের সারাজীবনের সঞ্চিত যে বিপুল মূলধন তাঁরা পেয়েছিলেন তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে বাংলা দেশের টাটা বা বোম্বায়ের মিল মালিকদের মতো বড় বড় কলকারখানার মালিক তাঁরা হতে পারতেন। কিন্তু সেদিকে কোনও উদ্যোগের আভাস পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে পাওয়া যায়নি। উত্তরাধিকারসূত্রে লব্ধ মূলধন তাঁরা একটুও বাড়াতে পারেননি, বরং দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, ভোগবিলাসিতায় ও নানা রকমের আনুষ্ঠানিক বাহ্যাড়ম্বরে তা ক্ষয় করেছেন। এই ক্ষয়ের জন্য ব্রিটিশ শিল্পনীতি কতটুকু দায়ী?

রামদুলাল দে তাঁর দুই পুত্রের বিবাহের জন্য প্রায় ৬ লক্ষ টাকা খরচ করেন—“He spent three lacs of rupees on the marriage each one of his sons”—(গিরিশচন্দ্র)। গভর্নমেন্ট গেজেটে রামদুলাল বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর দুই পুত্রের বিবাহের আমন্ত্রণ সকলকে জানান (৭ ও ১১ ফাল্গুন ১২২৬)। বিবাহ উপলক্ষে দু—দিন শুধু ইংরেজদের খানাপিনা ও আপ্যায়নের জন্য নির্ধারিত হয় আর চার দিন মুসলমান ও হিন্দুদের জন্য পৃথকভাবে ঠিক করা হয়। বলা বাহুল্য, নিমন্ত্রিতদের ভোজের জন্য ইংরেজি খানা, আরবি ও মোগলাই খানা এবং হিন্দু খানার ব্যবস্থা করা হয়। বাকি অনুষ্ঠান যা হয় তা কল্পনা করাই ভালো।২২  ১৮২০ সালে ৬ লক্ষ টাকা বিবাহের খরচ আজকের দিনে ১ কোটি টাকা। যাঁরা খরচ করতে পারেন তাঁরা বুঝতে পারবেন।

রামদুলালের জীবদ্দশায় তাঁর দুই পুত্র সাতুবাবু—লাটুবাবু মধ্যে মধ্যে বাড়িতে নাচগানের আসর বসাতেন। বাইজির নূপুরের আওয়াজ ও কণ্ঠস্বর রামদুলালের কানে পৌঁছোত, তাতে তাঁর হিসেবের খাতা লেখার অসুবিধা হত। পুত্রদের ডেকে তিনি বলতেন, ‘এটা একজন ব্যবসায়ীর বাড়ি, সেকালের আমির—ওমরাহের বাড়ি নয়। নাচগানটা যত কম হয় তত ভালো।’ রামদুলাল তখন ভাবতে পারেননি যে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সিন্দুকের টাকা সাতু—লাটুবাবুদের বাইজির নৃত্যরত পায়ের তলা দিয়ে অনর্গল ধারায় বয়ে যাবে। ধর্মভীরু রামদুলাল বাইজি নাচাননি, কিন্তু বারাণসীতে তেরোটি শিব মন্দির তৈরি করে দিয়েছিলেন। এই মন্দির আজও বারাণসীতে আছে। তার জন্য তখন তিনি খরচ করেছিলেন ২ লক্ষ ২২ হাজার টাকা। পাঁচ দিন ধরে বারাণসীতে তার জন্য গরিব—দুঃখীদের অন্নবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছিল। তার জন্য কত হাজার টাকা খরচ হয়েছিল তার হিসেব নেই। এই উপলক্ষে রামদুলালের সাধ্বী স্ত্রী—কে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হয়েছিল সোনা—জহরত দিয়ে এবং তার মূল্য হয়েছিল লক্ষ টাকার ওপর। এই টাকা বারাণসীর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দান করা হয়েছিল।

রামদুলালের মৃত্যুর পর তাঁর সঞ্চিত টাকা দিয়ে তাঁর যে শ্রাদ্ধ করা হয়েছিল তার কাহিনিও রূপকথার মতো রোমঞ্চকর। শ্রাদ্ধসভায় বাংলা দেশ ও কাশী কাশ্মীর সৌরাষ্ট্র মহারাষ্ট্র কাঞ্চী কান্যকুব্জ প্রভৃতি প্রদেশ থেকে শুধু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এসেছিলেন সাত—আট হাজার। আমন্ত্রিতদের বাদ দিয়ে প্রায় এক লক্ষ কাঙালিভোজন করানো হয়েছিল। গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেন, “The entire expense of this Shard amounted to five lacs of rupees.”—কিন্তু ‘সমাচার দর্পণ’ লিখেছেন : ”ইহাতে কত লক্ষ টাকা ব্যয় হইয়াছে তাহা অনুমান করা যাইতে পারে নাই।”২৩ রামদুলালের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী—র শ্রাদ্ধে, অর্থাৎ আশুতোষ দেবের মাতৃশ্রাদ্ধে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়।২৪  এই কয়েকটি অনুষ্ঠানের হিসেব থেকে সহজেই অনুমান করা যায় রামদুলালের সময় থেকে দুই পুরুষের মধ্যে তাঁর পরিবারে শুধু বিবাহ ও শ্রাদ্ধ উপলক্ষে কত লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। তাঁর মোট মূলধনের (১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা) অন্তত চার ভাগের এক ভাগ হবে বলে মনে হয়। আর এক ভাগ অন্তত তাঁর পুত্র ও নাতিরা যে ভোগবিলাসিতার খাতে ব্যয় করেছিলেন তা—ও অনুমান করতে বাধা নেই। বাকি অর্ধেকের বেশ কিছুটা গোঁড়া হিন্দুয়ানির দানধ্যানে ও ধর্মেকর্মে যে গিয়েছে তা—ও বোঝা যায়। বংশধররা যে মূলধন একেবারে বাড়াতে পারেননি, তা এইভাবে অতিদ্রুত দু—তিন পুরুষের মধ্যে ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। রামদুলালের বাণিজ্য—প্রতিষ্ঠান লোপ পেয়েছে। তাঁর বংশধররা কলকাতার ও গ্রামাঞ্চলের জমিদারির নিষ্ক্রিয় স্বত্বভোগীতে পরিণত হয়েছেন। এই পরিণতির কারণগুলি নিশ্চয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শিল্পনীতি জোগান দেয়নি। দ্বারকানাথের ক্ষেত্রে খানিকটা দিয়েছিল, কিন্তু রামদুলালের ক্ষেত্রে বোধহয় একেবারেই নয়। তাহলে কারণটা অন্যত্র অনুসন্ধান করতে হয়।

১৮৪৬ সালের Bengal Directory—তে ৯২টি ব্রিটিশ বাণিজ্য—প্রতিষ্ঠানের এজেন্টদের নাম আছে, তার মধ্যে ৪টিতে বাঙালি অংশীদার আছেন।

 Carr, Tagore & Co.–Colvin’s Ghaut

 দ্বারকানাথ ঠাকুর

 দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 Aylwin & Co.–no. 17. Strand

 শম্ভুচন্দ্র দাস

 Kelsalls & Ghosh–no. 5. Bankshall Street

 রামগোপাল ঘোষ

 Oswald, Seal & Co.

 হীরালাল শীল

বাকি ৮৮টি এজেন্সি হাউসের মধ্যে কোনও বাঙালি অংশীদার নেই।

১৮৪৬ সালের সুপ্রিম কোর্টের জুরিদের নামের তালিকাতে দেখা যায়, মোট ২৫১ জনের মধ্যে ৪০ জন ভারতীয়, বাকি সকলে ইংরেজ, এবং ৪০ জন ভারতীয়র মধ্যে ৩৭ জন বাঙালি, ৩ জন পারসি। পারসি তিনজনই বণিক।

বাঙালিদের মধ্যে—

 বেনিয়ান—১৯ বণিক—২

 জমিদার—১২ খাজাঞ্চি—১

 সরকার—২ দেওয়ান—১

দু—জন বণিক হলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামগোপাল ঘোষ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও আছে, কিন্তু তাঁর নামের পাশে লেখা আছে ‘জমিদার’। এই ৩৭ জন বাঙালি নিঃসন্দেহে কলকাতার নাগরিক সমাজের, এবং বাঙালি সমাজেরও, শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। কিন্তু বেনিয়ানি, জমিদারি ও চাকরি ছাড়া বাণিজ্যের পেশা মাত্র দু—জনের। এই দু—জনের মধ্যে দ্বারকানাথের বাণিজ্যের কথা আমরা আগে সংক্ষেপে বলেছি। তার সঙ্গে রামদুলাল দে—র কথাও বলা হয়েছে।

বাঙালির শিল্প—বাণিজ্যের প্রতি বিরাগের সমালোচনা

উনিশ শতকের বংলা সাময়িকপত্রে শিল্প—বাণিজ্যের প্রতি বাঙালির নিস্পৃহতা ও উদাসীনতার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। সর্বত্রই সমালোচনার যুক্তি প্রায় একরকম এবং তার তীব্রতা ও কঠোরতার মধ্যেও বিশেষ পার্থক্য দেখা যায় না। এই সমালোচনার যথেষ্ট সামাজিক তাৎপর্য আছে বলে মনে হয়। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছেন (১২৬০) :২৫

”এই বঙ্গদেশ মধ্যে অনেক ধনাঢ্য লোক আছেন, তাঁহারা যদ্যপি আপনাপন ধন দ্বারা ইংরাজদিগের ন্যায় বাণিজ্য করেন তবে অন্যান্য লোকসকল তাঁহারদিগের দৃষ্টান্তে অনুগামী হইতে পারেন, সুতরাং এই রাজ মধ্যে বাণিজ্যের আতিশয্য হয়, একথা অতি যথার্থ বটে, ফলতঃ যাঁহারা অতুল ধনের অধিকারী হইয়াছেন, তাঁহারদিগের আবার সেই প্রকার সাহস নাই, তাঁহারা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়া সাহেব বিশেষের অধীনে মুচ্ছুদ্দিগিরি কর্ম করিতে পারেন, তথাচ স্বাধীনরূপে বাণিজ্য করিতে পারেন না… অনেকে কোম্পানির কাগজকেই ভাল জানিয়েছেন। আমারদিগের রাজপুরুষেরা কোম্পানির কাগজের সুদ এত ন্যূন করিতেছেন, তথাচ সকলে কাগজ রাখিবার ইচ্ছা করিতেছেন।”

প্রভাকর বলছেন যে বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা অতুল ধনের অধিকারী হয়েছেন তাঁদের আবার স্বাধীন বাণিজ্য করবার মতো সাহস নেই। তাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহেবের অধীনে মুতসুদ্দির কাজ করতে পারেন, অল্প সুদে কোম্পানির কাগজও কিনতে পারেন, কিন্তু স্বাধীনভাবে ব্যাবসাবাণিজ্য করতে পারেন না। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছেন (১২৫৪) :২৬

”অস্মদ্দেশীয় লোকেরা মনের মধ্যে এমত ঠিক দিয়া রাখিয়াছেন যে, পরিশ্রমের নাম দুঃখ এবং আলস্যের নাম সুখ, সুতরাং যাঁহারা বিনা পরিশ্রমে অন্নদাস হইয়া অথবা যৎকিঞ্চিৎ উপস্বত্ব পাইয়া ঘরে বসিয়া কেবল বংশবৃদ্ধি করিতে পারিলেই সুখ জ্ঞান করেন আমরা তাহারদিগ্যে কি কথা উল্লেখ করিব বিবেচনা করিতে পারি না, দেশের লোক এরূপ না হইলে দেশের অবস্থাই বা কিরূপে এমত কদর্য হইবেক, বিদেশের বাণিজ্য দূরে থাকুক, দেশের বাণিজ্যে মনোযোগী হইলেই রক্ষা পাই, জাহাজে চড়া (বাপ রে) অনেক দূরের কথা, কালনা, মুর্শিদাবাদ, রামপুর ইত্যাদি স্থানে দেশজাত দ্রব্যের বাণিজ্য কয়জন ভদ্রসন্তান করিয়া থাকেন? যাহাদের কিঞ্চিৎ অর্থ আছে সাহেব কেনা রোগেই তাঁহারদিগের সর্বনাশ হয়, সেই টাকায় যদি আপনারা স্বাধীনরূপে ব্যবসা করেন তবে কত সম্মান কত সৌভাগ্য হইতে পারে, তাহা না করিয়া বাবুজিরা এক ২টা সাহেব কিনিয়া বসেন…”

এই কথা বলে প্রভাকর মন্তব্য করেছেন যে সাহেবরা যখন এ দেশে আসেন তখন তাঁদের ঐশ্বর্য বলতে থাকে শুধু একটা ছেঁড়া টুপি, পচা কাপড়ের জ্যাকেট—পাতলুন এবং একটা কাচের টম্বল। কৌশল করে কোনও ব্যাবসা ফেঁদে বসে একজন বাবু কাড়তে পারলেই কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের আর আধিপত্যের সীমা থাকে না, তখন তাঁরা একজন কেষ্টবিষ্টু হয়ে ওঠেন, ঘোড়া—গাড়ি সহিস বেয়ারা খানসামা ইত্যাদির ধুম পড়ে যায়। ”আমরা কি মূর্খ আর সাহেবরা কি চতুর আমারদিগের টাকায় ও আমারদিগের পরিশ্রমে সৌভাগ্য করিয়া আবার কথায় কথায় আমারদিগ্যেই রাস্কেল বলে, ঘুষি মারে, চক্ষু রাঙায়।” ধনিক বাঙালিবাবুদের ‘সাহেব—কেনা’ একটা রোগ এবং নিঃসম্বল চতুর ইংরেজদের ‘বাবু—কাড়া’ একটা কৌশল বলেছেন প্রভাকর। প্রভাকর লিখেছেন (১২৬১) :২৭

”বাঙ্গালিদিগের মধ্যে যাঁহারা পরমেশ্বরের প্রসাদে বিলক্ষণ ঐশ্বর্যশালী হইয়াছেন তাঁহারা সুদ অর্থাৎ বৃদ্ধির দ্বারা উপার্জন করণেই অধিক যত্নশীল, সুতরাং স্বাধীনরূপে বাণিজ্য করণের নিয়ম এদেশে একেবারে রহিত হইয়াছে…”

প্রভাকর দুঃখ করে লিখেছেন (১২৯৯) যে বাংলা দেশ মুটে ও চাকরের দেশে পরিণত হয়েছে : ২৮

”তাঁহাদের ধনে বিদেশের লোক বড়মানুষ হইতেছে, রঙ্গে রত্নে অনঙ্গ দেশ ঐশ্বর্যশালী হইতেছে, বঙ্গমাতা এক্ষণে কেবল কতকগুলি মুটে ও চাকর প্রসব করিতেছেন। মুটেরা তাহাদিগের মাতৃগর্ভজাত মহামূল্য রত্নজাত মাথায় করিয়া বিদেশী বাণিজ্যপোতে তুলিয়া দিতেছে, চাকরেরা সহাস্যবদনে বৈদেশিক সওদাগরি হাউসে সেইসকল রপ্তানী রত্নের তেরিজ জমাখরচাদি শুদ্ধ রোকড় সই হিসাব রাখিতেছে।”

বাঙালির আলস্য প্রসঙ্গে প্রভাকর লিখেছেন (১২৫৪ ব.) : ২৯

”যে দেশের লোকেরা আলস্যকে আলিঙ্গন প্রদান—পূর্বক অহরহ বিনা পরিশ্রমে কালক্ষয় করেন, তাঁহারা আপন দেশকে পরের অধীন করিয়া চিরকাল দুঃখ ভোগ করিতে থাকেন… এতদ্দেশীয় ব্যক্তিরা যদি আলস্য পরিত্যাগপূর্বক ইংলণ্ডবাসী লোকদিগের মত শিল্পবিদ্যায় অনুরাগী হওত বিভিন্নরূপ দ্রব্য প্রস্তুত করেন এবং জাত্যভিমান পরিহার করিয়া বিদেশীয় বাণিজ্যে উৎসুক হয়েন তবে দুঃখের লেশমাত্র থাকিতে পারে না…অধুনা অত্যল্প মনুষ্যের অন্নের সঙ্গতি আছে, নচেৎ প্রায় সকলেই নির্ধন হইয়াছে, কলিকাতাস্থ ধনিদিগের মধ্যে অনেকেরি শুদ্ধ কোম্পানির কাগজ সম্বলমাত্র।”

‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ লিখেছেন (১৭৭৮ শক) :৩০

”এক্ষণে যে সমস্ত বৃত্তি দ্বারা সমধিক অর্থাগম হইতে পারে, প্রায় তার অধিকাংশই এদেশীয় লোকের পক্ষে অবলম্বন করা অসাধ্য ও অনায়ত্ত। ইহারা যেমন কোন বিস্তীর্ণ বাণিজ্য ব্যবসায় অবলম্বন করিয়া অবস্থার উন্নতি করিতে অপটু এবং উৎকৃষ্ট শিল্পকর্মের অনুষ্ঠান করিয়া সমধিক—ধন উপার্জন করিতে সক্ষম, সেইরূপ কোন উৎকৃষ্ট রাজকীয় উচ্চপদ প্রাপ্ত হইতেও অসমর্থ… অধুনা বঙ্গদেশীয় লোকে যে প্রকার অবস্থায় অবস্থান করিতেছে, এবং এক্ষণে বঙ্গদেশ মধ্যে যে প্রকার বাণিজ্য প্রচলিত হইয়াছে তাহাতে করিয়া এদেশীয় সর্বসাধারণ লোকের দুঃখ দূর হওয়া কোন মতেই সম্ভব নহে। বাণিজ্য বিস্তার দ্বারা কৃষি ও বণিক লোকেরই উন্নতি হওয়া সম্ভব, কিন্তু এ বঙ্গদেশে উক্ত দুইপ্রকার লোকের অপেক্ষা বেতনভুক কর্মচারি লোকের সংখ্যাই অধিক। এদেশীয় অধিকাংশ মনুষ্যই নির্দিষ্ট বেতনে শ্রম করিয়া দিনপাত করিয়া থাকে।”

বাংলাদেশে যে ব্যবসায়ীর চেয়ে বেতনভুক চাকুরিজিবীর সংখ্যা অনেক বেশি সে কথা ১৮৫৬ সালেই ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ পরিষ্কার উল্লেখ করেছেন। পরে এ বিষয়ে লিখেছেন (১৭৯২ শকাব্দ) :৩১

”এক্ষণে আমাদের দেশে আর সকল বিষয়ে উৎসাহ লক্ষিত হইতেছে। আমাদের যুবকেরা আর সকল বিষয়েই যশোলাভ করিতেছেন; কি রাজনীতি, কি বিদ্যাশিক্ষা, কি ওকালতি, কি চিকিৎসা, সকল বিষয়েই জয়লাভ করিতেছেন; কেবল এই এক বিষয়ে—বাণিজ্য ব্যবসায়ে এখনও তাঁহারা নিরুদ্যম রহিয়াছেন। এ বিষয়ে বোম্বাই—এর ভ্রাতৃগণ আমাদের অপেক্ষা অনেক অগ্রসর। বোধ হয় সকলেই অবগত আছেন, সম্প্রতি দুইজন বোম্বাই প্রদেশস্থ হিন্দু, মারকিন দেশের সহিত বাণিজ্য সম্বন্ধ সংস্থাপন করিবার নিমিত্ত ও তত্রত্য কারখানা প্রভৃতির কার্য—প্রণালী স্বচক্ষে সন্দর্শন করিবার নিমিত্ত কথায় অবস্থিতি করিতেছেন। বঙ্গীয় যুবকেরা তাঁহাদের এই প্রশংসিত দৃষ্টান্ত কেন না অনুসরণ করেন?”

‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ বাঙালি যুবকদের বোম্বাইবাসীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে অনুরোধ করেছেন এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতি মনোযোগী হতে বলেছেন। ১৮৭০ সালের কথা।

‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকার সম্পাদক বাংলা দেশের এক ধনী ব্যক্তির একখানি চিঠি প্রকাশ করেছেন (১৮৪৯)। চিঠিখানি একাধিক কারণে উল্লেখযোগ্য : ৩২

”…সম্পাদক মহাশয়, আমি বিলাতীয় হুণ্ডী, কোম্পানির কাগজ ক্রয় বিক্রয় করিতাম, এবং প্রজালোককে ধান্যের বাড়ি নিয়মে ধান্য দিতাম, আর অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে ধান্য কাটা হইলে জমীদারেরা রাজস্বের জন্য ধান্যক্ষেত্রে আটক করিতে আমি অধিক সুদি খত লেখাইয়া লইয়া প্রজাদিগকে রাজস্বের টাকা দিতাম, এবং সোনারূপা হীরকাদি বন্ধক রাখিয়া ভদ্রলোকদিগকে গত পাঁচ বৎসরে অনেক টাকা দিয়াছি, এইক্ষণে বাজার এমত মন্দ হইয়া উঠিয়াছে আসল টাকা দূরে মরুক তাহার পাঁচ আনা বাদ দিয়াও মূলধন উঠাইবার উপায় দেখিতেছি না, কোম্পানির কাগজ বিক্রয় বন্ধ করিয়া দিয়াছি, কিঞ্চিৎ লাভের জন্য চারি টাকা সুদি এক লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ ক্রয় করিয়াছিলাম। কোম্পানি বাহাদুর পাঁচ টাকার কাগজ বাহির করিয়া দিলেন অমনি চারি টাকার কাগজের দর কম হইয়া পড়িল, তখন যদি হাজারে কিছু টাকা নোকশান করিয়া ছাড়িয়া দিতাম তবে এখন এত দুঃখ হইত না। তৎকালে কুবুদ্ধি হইয়াছিল কিছুকাল পরে কাগজের মূল্য বৃদ্ধি হইবে কিন্তু এইক্ষণে সেই কাগজ মাটী হইয়া গিয়াছে, অতএব আশী হাজার টাকার কাগজ পড়িয়া রহিয়াছে, এবং বিলাতি হণ্ডীর প্রতি আর কেহ বিশ্বাস করেন না, বাণিজ্য হৌসের মহামারীর পূর্বে অনেক টাকার হুণ্ডী ক্রয় করিয়া সে টাকা জলে দিয়াছি…।”

এই চিঠিখানি থেকে বিত্তশালী বাঙালির টাকার কর্মলোকের সন্ধান পাওয়া যায়। বিলেতি হুন্ডি ও কোম্পানির কাগজ কেনা—বেচা করা, এবং অত্যধিক সুদে টাকা খাটানো, এই ছিল বড়লোক বাঙালির প্রধান কাজ।

অর্থনীতিক্ষেত্রে ধনিক বাঙালির এই রক্ষণশীল মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেছেন ‘সোমপ্রকাশ’ একাধিক রচনায়। ইংরেজদের বিনা মূলধনে ব্যাবসা প্রসঙ্গে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন (১২৭১) :৩৩

”আমরা প্রায়ই শুনিতে পাই, অমুক ইউরোপীয় অমুক ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। অমূক বাবু মুচ্ছুদ্দি হইলেন (পাদটীকা : ‘ধনী বাবুদিগের অনেকে স্বয়ং ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইয়া বড় কষ্টস্বীকারে অগ্রসর হন না, বসিয়া যা কিছু লাভ করিতে পারেন সেই চেষ্টায় যান, শেষে লাভের মূলে জল দিয়া নিশ্চিন্ত হন।’) দিনকয় পরে শুনিতে পাই, তিনি ফেইল হইয়াছেন। বাবু টাকার নিমিত্ত ছটফট করিয়া বেড়াইতেছেন। বাজারের লোকেরা বাবুকে ধরিয়া পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিয়াছে। ওদিকে সেই ইউরোপীয় নাম ফিরাইয়া আর দোকান খুলিয়া বসিয়াছে। নীলপ্রধান প্রদেশে যে এত অত্যাচার হয়, অধিকসংখ্য মূলধনশূন্য ব্যক্তির ব্যবসায়ে প্রবৃত্তিই তাহার প্রধান কারণ। যাহারা এইরূপ নীল ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হয়, তাহাদিগের মূলধন থাকে না। সুতরাং প্রজার শোণিত আকর্ষণ পূর্বক অবয়ব পুষ্ট করিতে হয়। আমরা জানি অনেকে এই প্রকারে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিয়াছে। ইহাদিগের নিজের এক পয়সাও ছিল না। ঋণ ইহাদিগের ব্যবসায়ের মূলধন, দেউলিয়া আদালত ইহাদিগের পলাইবার পথ।”

ধনিক বাঙালির মুতসুদ্দিগিরি প্রসঙ্গে ‘সোমপ্রকাশ’ যে মন্তব্য করেছেন তা লক্ষণীয়। তাঁরা নিজেরা ব্যাবসাবাণিজ্যে প্রবৃত্ত হয়ে বড়—একটা কষ্ট স্বীকার করতে চান না, বসে বসে বিনা আয়াসে কী উপায়ে সেই টাকা খাটিয়ে কিছু লাভ করতে পারেন সেই চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত লাভের মূলে জল ঢেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন, অর্থাৎ টাকাটি জলে দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা যে অধিকাংশই বড়লোক বাঙালি মুতসুদ্দি—বেনিয়ানের টাকায় ব্যাবসা করতেন, এমনকী নীলকররা পর্যন্ত, সে কথা এখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে। ধনিক বাঙালির মূলধন প্রধানত দেউলিয়া ইংরেজ ব্যবসায়ীর মারফত ভস্মে গিয়েছে। অন্তত তার অনেকটা অংশ যে গিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাকি অংশের অনেকটা বিবাহ, শ্রাদ্ধ, ধর্মকর্ম, উৎসব—পার্বণ ও বিলাসব্যসনে ব্যয় হয়েছে, আর খানিকটা সমাধিস্থ হয়েছে শহর ও গ্রামের বাড়িঘরে ও ভূসম্পত্তিতে।

ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাঙালিদের তুলনা করে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন (১২৮৫) :৩৪

”মেষেরা যেমন দলপতিকে কোনদিকে গমন করিতে দেখিলে অন্যেও নির্বিকারচিত্তে ও অবলীলাক্রমে সেই দিকে দলে দলে গমন করিতে থাকে, আমাদিগের মধ্যে যদি কেহ, অমুক ব্যক্তি দ্রব্যের বাণিজ্য করিয়া এত লাভ করিলেন শুনিতে পাইলেন অমনি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া যত পারিলেন খরিদ করিলেন এবং যদি একবার মূলধনচ্যূত হইলেন ও চিরকালের জন্য বাণিজ্যকে প্রণাম করিয়া চাকুরির অনুসন্ধানে দ্বারে দ্বারে ফিরিতে লাগিলেন। কিন্তু বোম্বাইবাসীরা সেরূপ নহে। দুর্ভাগ্যক্রমে একবার ক্ষতিগ্রস্থ হইলেও বসিয়া না পড়িয়া কপাল ঠুকিয়া আবার দ্বিগুণ উৎসাহে কাহারও সাহায্য ভাগী হইয়া বাণিজ্য কার্যে রত হয় এবং অসাধারণ অধ্যবসায় বলে অল্প দিনেই ক্ষতিপূরণ করিয়া লয়। ফল কথা তাহারা আর বাঙ্গালিদিগের ন্যায় সামান্য একটি সুঁচ হইতে প্রয়োজনীয় যাবতীয় দ্রব্যের জন্য পরমুখ প্রত্যাশী থাকিতে ভালবাসে না। তাহারা সাবান, দেশলাই, কাপড়, সূতা প্রভৃতির কল বিলাত হইতে আনয়ন করিয়া এক্ষণে তাহার কতদূর উন্নতি করিয়া তুলিয়াছে। তাঁহাদের কাছে কি কলিকাতার বাণিজ্য—ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ী নামে অভিহিত হইতে পারেন; ব্যবসায়ী বোম্বাইবাসী প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ যাঁহাদের নামে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্টসি পরীক্ষোত্তীর্ণ দুই জন ছাত্রের ১০০০০ টাকা বৃত্তি নির্ধারিত আছে। আনুমানিক কোটি টাকা তাঁহাদের আয় ও পুণ্য কার্যেও অসংখ্য টাকা ব্যয়। ব্যবসায়ী আহম্মদাবাদে জলশত ভাই মন্নু ভাই। যাঁহাদের প্রথমে এক কপর্দকও সংস্থান ছিল না কিন্তু এক্ষণে কুবের তুল্য ঐশ্বর্য। ব্যবসায়ীরা মুরার জি গোকুল দাস ও সর মঙ্গল দাস খান্নু ভাই। যাঁহাদিগের কলে কাপড় ও সূতা বপন করিয়া কুলান করিতে পারিতেছে না। বাণিজ্য ব্যবসায়ী নারসী কেশব জী কোং। যাহাদিগের আফিঙ্গের ব্যবসায়ে কলিকাতাওয়ালা বড় বড় চতুর ব্যবসায়ীরাও সর্বদা শঙ্কিত ইত্যাদি। বাস্তবিক প্রকৃতরূপে ইঁহারাই মহাজন ও সওদাগর প্রভৃতি নামে অভিহিত হইতে পারেন।”

এরপর ‘সোমপ্রকাশ’ বলেছেন যে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন যে বাঙালিরা কোথায় মূলধন পাবেন এবং কে—ই বা তাঁদের সাহস দান করবে, তাহলে তার উত্তরে প্রথমেই আমরা বাঙালি জমিদার ও ধনীদের কথা বলব। তাঁদের হাত ধরে অনুরোধ করব, ”ও ভ্রাতঃ কলিকাতা ও মফস্বলবাসী জমিদার ও ধনিগণ! আপনারা অতঃপর ৩ পার্শেণ্ট ও ৪ পার্শেণ্ট সুদে গবর্ণমেন্টে টাকা জমা না দিয়া ৪।৫।৬ জনে একত্রিত ও প্রণয়সূত্রে বদ্ধ হইয়া মূলধন সংগ্রহ করিয়া বিদেশ হইতে বাণিজ্যোপযোগী দ্রব্যাদি আনয়ন ও স্বদেশোৎপন্ন দ্রব্যে বাণিজ্য জাহাজ পরিপূরণ করিয়া সমুদ্রপথে দূর দেশে চালান দিয়া বহির্বাণিজ্যে নিযুক্ত হও।” দুঃখের বিষয় এ আবেদনে কোনও ফল হয়নি।

পাটকল ও পাটের ব্যাবসার জন্য বাংলাদেশ বিখ্যাত। এই পাটের ব্যাবসার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন (১২৮৭) :৩৫

”চটের ব্যবসায়—সংঘর্ষে বঙ্গদেশ স্কটলণ্ডকে পরাজয় করিয়াছে সত্য, কিন্তু তাহাতে বঙ্গবাসীর কি লাভ হইয়াছে? বাঙ্গালীরা ঐ ব্যবসায়ের লাভের কত অংশ পাইতেছেন? প্রণিধানপূর্বক, যদি বিবেচনা করিয়া দেখা যায় দৃষ্ট হইবে, লাভ অতি অল্পই হইয়াছে। বঙ্গীয় কৃষকেরা পাটের চাষ করিয়া লাভবান হইয়াছে সত্য, এবং কতকগুলি বঙ্গীয় শ্রমজীবী কলে কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেছে সত্য, কিন্তু উক্ত শ্রমজীবীদিগের সংখ্যা পূর্বকার শিল্পজীবীদিগের সংখ্যা অপেক্ষা অনেক অল্প। কলের সমস্ত টাকাই ইংরাজের, উহাতে বাঙ্গালী অংশী অতি অল্পই আছেন। সুতরাং লাভের অংশ সমুদয়ই ইংরাজের, বাঙ্গালীর কিছুই নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না। বাঙ্গালীরা যে থলিয়া ও চটের কার্যে আর অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে, তাহার যো নাই। আর অধিক কল চলিলে ব্যবসায় মন্দা হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। হস্তে প্রস্তুত করিয়া গুণের কারবার করিলেও কলের সহিত যুঝিয়া উঠা যাইবে না।… যদি বাঙ্গালী ধনিগণ অধিক পরিমাণে চটের কলে অর্থ ব্যয় করিতেন, তাহা হইলে তাঁহারা পরিণামে বিলক্ষণ লাভবান হইতে পারিতেন। কারণ বাঙ্গালায় অনেক সুবিধা আছে। যেখানে পাট জন্মে সেইখানেই কল, পৃথিবীর আর কুত্রাপি এমন সুবিধা নাই। এই সুবিধা থাকাতেই বাঙ্গালায় পাটের কলের এত সমৃদ্ধি ও উন্নতি হইয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, অনুদ্যম ও অনুৎসাহশীলতা ধনী বাঙ্গালীদিগের একটি প্রশস্ত আয়দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে।”

বাংলাদেশে আগে হাতে তৈরি চট অন্যতম গৃহশিল্প ছিল। চব্বিশ পরগনা ও হুগলি অঞ্চল এই গৃহশিল্পের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। পাটকল হবার পর এই হাতের চটশিল্প বাজারের প্রতিযোগিতায় ক্রমে লোপ পেয়ে যায়। পাটকল প্রধানত ব্রিটিশ মূলধনেই গড়ে ওঠে, তাই বাঙালিরা তাতে কিছুই লাভবান হন না। পাটচাষ করে চাষিদের কিছু লাভ হয় এবং কৃষিকর্ম ও গৃহশিল্প থেকে উৎখাত কিছু লোক পাটকলের মজুরে পরিণত হয়। ‘সোমপ্রকাশ’ বলেছেন যে ধনিক বাঙালিরা উদ্যম ও উৎসাহের অভাবে পাট ব্যবসায়ে যতটুকু অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল তা করতে পারেননি।

আজকাল আমরা দেখতে পাই যে সরকারি অফিসে একটি কেরানির চাকরি খালি হলে তার জন্য দশ হাজারের কাছাকাছি পর্যন্ত দরখাস্ত পড়ে। এ উপসর্গ মধ্যবিত্ত বাঙালি চরিত্রে নতুন নয়। পুরো উনিশ শতক ধরে (আঠারো শতকও বলা চলে) এই চাকরিপ্রিয় বাঙালি চরিত্রের বিকাশ হয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না। ক্রমে যত বাঙালি মধ্যবিত্তের কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে, শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে, তত চাকরি বাড়েনি এবং অল্প চাকরির জন্য তাই অত্যধিক লোক প্রার্থী হয়েছে। এই সমস্যা সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন (১২৮৮) :৩৬

”চাকুরীর মান বেশি হওয়াতে সেই লোভে অন্য কোন স্বাধীন চিন্তাশীল ও শ্রমের কার্যে প্রবৃত্ত হইতে ইচ্ছাও করে না। কাজেই ক্রমে ক্রমে ঐ প্রকার কার্য হতাদৃত হইতেছে। প্রকৃতপক্ষে চাকুরীর এখন যেরূপ দুরবস্থা তাহার অপেক্ষা সামান্য মুদির দোকান করিয়া দিনাতিপাত করা ভাল। আমাদিগের সমাজে অলস অপদার্থ ও অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা অধিক বলিয়াই এরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে, তাই শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ধনী ও দরিদ্র সকলেই ইউরোপীয়দের পদলেহনে প্রস্তুত। এখন কৃষিকার্য করা ভদ্রলোকের কর্ম নহে, তাহাতে লোক চাষা বলিবে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভিতরও এ সংস্কার হওয়াতে ক্রমে লোকের চাকুরীপ্রিয়তা বৃদ্ধি হইতেছে এবং সেই কারণে কৃষকেরা পর্যন্ত ভদ্র হইবার প্রত্যাশায় জাতিব্যবসায় পরিত্যাগ করিয়া এখন চাকুরীর চেষ্টা করিতেছে। কর্ম অপেক্ষা প্রার্থী অধিক সুতরাং কর্মের মূল্য বাড়িতেছে, কাজেই দশ পনর টাকা বেতনের চাকুরীর জন্য দশহাজার প্রার্থী পাওয়া যাইতেছে।… যাবৎ লোকের মন হইতে চাকুরী প্রবৃত্তি বিদূরিত হইয়া দেশের উন্নতির চেষ্টা ও স্বাধীন কার্যে প্রবৃত্তি না জন্মিবে তাবৎ প্রকৃত উন্নতির সম্ভাবনা নাই…।”

১৮৮১—৮২ সালের লেখা, কিন্তু মনে হয় যেন ১৯৬৭—৬৮ সালে বাঙালির চাকরির সমস্যা নিয়ে লেখা।

বিদেশি মূলধন বিনিয়োগ করে দেশের শিল্পোন্নতি হলে তাতে লাভ কী? এই প্রশ্নের উত্তরে নীলকর ও চা—করদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে ‘সোমপ্রকাশ’ বলেছেন যে এ দেশের লোক নিয়ে এ দেশের লোকের উপর অত্যাচার করানো এবং সেই মূলধন থেকে নিজেরা দশ টাকা উপার্জন করা, এই হল আমাদের লাভ। রেলওয়ে প্রসঙ্গে ‘সোমপ্রকাশ’ বলেছেন যে তার যে প্রকৃত লাভ তার আসল ভাগী ইংরেজরা, এ দেশীয়দের লাভ দাসত্ব ও মজুরি। পাটকল বা অন্যান্য শিল্প কারখানায় ইংরেজরা যে মূলধন বিনিয়োগ করেছেন, তাতেও এ দেশীয়দের চাকরি ও মজুরি ছাড়া আর বিশেষ লাভ হয়নি।৩৭

ইয়াং বেঙ্গল বা ডিরোজিয়ানরাও ধনিক বাঙালিদের মুতসুদ্দিকর্ম ও আলস্যবিলাসের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং শিল্প বাণিজ্যের প্রতি অনুরাগী হতে বলেছেন। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর মুখপত্র ‘জ্ঞানান্বেষণ’ লিখেছেন (১৮৩৯) :৩৮

”ইংলণ্ডীয়দিগের মূলধনের উত্তমরূপে ব্যবহার্যতা হেতু যে ধনাঢ্যতা ইহা সর্বসাধারণজনকে অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে কেবল বিদ্যা দ্বারা যে জনদিগের ধনাঢ্যতা সৌভাগ্য হয় এমত তাঁহারা বলেন না বাণিজ্যাদি সহকারে সৌভাগ্যাদি হয়। তন্নিমিত্ত আমরা বলি যে এতদ্দেশীয় জনগণ স্বাভাবিক অলস ও নিদ্রা প্রভৃতি যে দোষবর্গ তাহা পরিত্যাগ করিয়া উক্ত বাণিজ্যাদিরূপ অস্ত্রশস্ত্র ধারণপূর্বক সৌভাগ্যের বিরোধী যে কুস্বভাব তাহাকে জয় করিয়া সৌভাগ্যকে প্রবল করুন।…

”আমরা জানি এতদ্দেশীয় যাঁহারা পৈতৃক ধন পাইয়াছেন তাঁহারা সেই ধনের উত্তমরূপে ব্যবহার ত্যাগ করিয়া গবর্ণমেণ্টে অতিক্ষুদ্র কার্যের ভার লইয়া তাহাতেই স্বচ্ছন্দবোধ করিয়া গৃহে বসিয়া বৃথা জল্পনায় বৃথা কালক্ষেপ করেন ইহাতে ইহাদিগের সেই সকল ধনের বৃদ্ধি হইতে পারে না আর ক্রমে ২ নানা কার্যে মূলধন বিনাশ পায় আর কিছুদিন পরে আমরা দেখি যে ঐ ব্যক্তি হয় কারাগারে আছেন অথবা কোন আত্মীয়ের বাটীতে পাতড়ায় নিযুক্ত হইয়াছেন…”

রক্ষণশীল প্রগতিশীল নির্বিশেষে উনিশ শতকের বাংলা সাময়িকপত্রের বাঙালির বাণিজ্যবিমুখতা সম্বন্ধে যে একসুরের সমালোচনা দেখা যায়, তার কারণ কী? কারণ হল, ব্রিটিশ আমলে নতুন মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে যতটুকু স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের প্রতি অনুরাগ জাগ্রত হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি, এবং যে কারণে হয়নি সেটা শুধু বৈদেশিক শাসকদের নীতিগত বাধাবিপত্তি ও স্বার্থগত বিরোধের কারণ দেখিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সাময়িকপত্রে শতকরা পাঁচটি সমালোচনার মধ্যে ব্রিটিশ শিল্পনীতির অন্তরায়ের গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়েও তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কি না সন্দেহ। প্রধানত নতুন মধ্যবিত্ত বাঙালির এবং ধনিক বাঙালির এমন কতকগুলি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে যা তাঁদের স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের উদ্যমের পথে প্রকাণ্ড অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কয়েকটি সমালোচনা আমরা পূর্বে উদ্ধৃত করেছি তার মধ্যে ধনিক ও মধ্যবিত্ত বাঙালির এই কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায় :

ক। যাঁরা ধনিক তাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহেবদের অধীনে বেনিয়ানি ও মুতসুদ্দিগিরি করতে পারেন, কিন্তু তাঁদের স্বাধীনভাবে বাণিজ্য করার সাহস নেই। এটা বড়লোক বাঙালিদের ‘সাহেব—কেনা’ রোগ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

খ। কোম্পানির কাগজ কিনে অথবা অন্য কোনও উপায়ে সুদ উপভোগ করা, জমিদারির উপস্বত্ব থেকে আয় করা অথবা বাঁধা মাইনের চাকরি করা, এই তিনটে হল ধনিক ও মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্যতম পেশা। এই পেশা বা বৃত্তি অবলম্বনের কারণ হল, বাঙালিরা শ্রমবিমুখ ও আলস্যকাতর। কোনও দুঃসাহসিক দায়িত্বগ্রহণে তাই তাঁরা বিমুখ।

গ। বাণিজ্যিক বুদ্ধিও বাঙালির তীক্ষ্ন নয়। হঠাৎ কোনও বাণিজ্য লাভবান হবে মনে হলে দু—চারজন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হয়তোসেইদিকে ছুটে যান, তারপর একটু আঘাত পেলে, অর্থাৎ লোকসান হলে সমস্ত গুটিয়ে নিয়ে ঘরে ফিরে আসেন, আর কোনওদিন বাণিজ্যের পথে যেতে চান না। বোম্বাই—পশ্চিম ভারত প্রভৃতি অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের মতো বাঙালিদের একাগ্রতা বা দৃঢ়তা বলে কিছু নেই।

বিভিন্ন সাময়িকপত্রের সমালোচনার এই হল মর্ম। ধনিক বাঙলিদের মুতসুদ্দিগিরির ও সুদখোর প্রবৃত্তির কঠোর সমালোচনা সকলে করেছেন। ইয়াং বেঙ্গল গোষ্ঠীর মুখপত্র ‘জ্ঞানান্বেষণ’ মাধব দত্তর কথা উল্লেখ করে তাঁর মুতসুদ্দিগিরি কর্মগ্রহণকে ‘অতি কুৎসিত’ ও ‘অতি নিন্দনীয়’ আচরণ বলেছেন। যাঁরা পৈতৃক ধনের উত্তরাধিকারী হন তাঁরা, ‘জ্ঞানান্বেষণ’ বলেছেন, গভর্নমেন্টের অতি ক্ষুদ্র কাজের ভার নিয়ে ঘরে বসে বৃথা কালক্ষেপ করেন এবং দু—এক পুরুষের মধ্যে তাঁদের সঞ্চিত ধনভাণ্ডার শূন্য হয়ে যায়। দেনার দায়ে হয় তাঁরা কারাবাসী অথবা আত্মীয়ের গলগ্রহ হন।

ঔপনিবেশিক অর্থনীতির বিশেষত্ব হল বিদেশি শাসকরা পরাধীন দেশটিকে বা উপনিবেশকে—

১) তাঁদের নিজেদের দেশের শিল্পজাত দ্রব্যের একচেটে বাজারে পরিণত করতে চান (“using the dependent country as a market for the products of its own manufacturing industry”—Gunnar Myrdal)

২) প্রাথমিক দ্রব্য বা কাঁচামালের প্রধান উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত করেন (“procuring primary goods from its dependent territory, and even in investing so as to produce them in plenty and at low cost”—Myrdal)৩৯

৩) রপ্তানি ও আমদানি দু—রকমেরই বাজার করে তোলেন (“monopolising the dependent country as far as possible for its own business interests, both as an export and import market”—Myrdal)।৪০

ভারতবর্ষকেও এইভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা তাঁদের শিল্পজাত দ্রব্যের রপ্তানি—আমদানি বাজার এবং কাঁচামালের উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। স্বভাবতই তাঁরা নিজেদের দেশের শিল্পোন্নতির স্বার্থে পরাধীন ভারতের শিল্পোন্নতি কাম্য বলে মনে করেননি। এ বিষয়ে কারও কোনও দ্বিমত নেই, থাকতেও পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন যুগের শিল্প—বাণিজ্যের স্বাধীন পরিবেশে (এই স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হলেও) ব্যাবসাবাণিজ্যের ও শিল্পোদ্যমের যেটুকু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, মূলধন থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য প্রদেশের ব্যবসায়ীদের মতো ধনিক ও মধ্যবিত্ত বাঙালিরা তার সামান্য সদব্যবহারও করতে পারেননি। এই অক্ষমতার আর্থনীতিক (economic) কারণের যত গুরুত্বই থাক, অনার্থনীতিক (non-economic) ও সমাজতাত্ত্বিক (Sociological) কারণের গুরুত্বও কম নয়।

বাঙালির বাণিজ্যবিমুখতার সমাজতাত্ত্বিক কারণ

ব্রিটিশ আমলে বাঙালি সমাজে যে নতুন ধনিকশ্রেণি ও মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশ হয় তাঁদের চরিত্র কতকগুলি বিশেষ উপাদানে গঠিত। ইংরেজ শাসক ও বণিকদের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ তাঁরা নানাদিক থেকে পেয়েছিলেন। এই সান্নিধ্য বিচিত্র কর্মক্ষেত্রে নানা উপায়ে তাঁদের অর্থোপার্জনের পথ খুলে দিয়েছিল। অধিকাংশ পথই সত্যকার ‘enterprise’—এর পথ নয়, অনুগ্রহজীবীর মসৃণ পথ। এ পথে চলতে হলে প্রকৃত বুদ্ধিমান না হলেও ধূর্ত ও শঠ হওয়া প্রয়োজন, এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যক্তিগণ (জাতিগত বা সমষ্টিগত নয়) উগ্র স্বার্থচেতনা। মহারাজা নবকৃষ্ণ, মদন দত্ত, রামদুলাল দে, মতিলাল শীল অন্যান্য ধনিক বাঙালি যাঁরা আঠারো শতকেই প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন, তাঁরা এই উগ্র ব্যক্তিস্বার্থচেতনা থেকে পরস্পরের সঙ্গে অবিরাম দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত থেকেছেন এবং শুধু নিজেদের আর্থিক আত্মপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সার্থক করার জন্য যে—কোনও পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করেননি। ন্যায়বোধ ও নীতিবোধ তাঁরা একেবারে বিসর্জন দিয়েছিলেন। ইংরেজতোষণ তাঁদের প্রতিষ্ঠালাভের অন্যতম কৌশল ছিল। কলকাতার হাটবাজারের ইজারাদারি, লবণ ও অন্যান্য বাণিজ্যপণ্যের দালালি, বেনিয়ান ও মুতসুদ্দিরূপে ইংরেজপোষণ, দেওয়ান—সরকার—গোমস্তা—মুনশি প্রভৃতি বিচিত্ররূপ ধারণ করে ইংরেজতোষণ ও প্রধানত দস্তুরিগত অর্থপ্রাপ্তি—এইগুলি ছিল একেবারে ইংরেজ আমলের গোড়া থেকে ধনিক বাঙালির অর্থ উপার্জনের অন্যতম পথ। এ পথ নিশ্চয় সৎসাহস, উদ্যম ও স্বাধীনতার বিপদসংকুল অথচ প্রশস্ত পথ নয়। যে পথে ধনিক বাঙালিরা ধনসঞ্চয় করেছেন (অবশ্য শুধু বাঙালিরা নন, এই সময় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ধনিকরাও অনেকে এই উপায়েই ধন সঞ্চয় করেছেন), সে পথ নোংরা অলিগলিপথ, চোরাগলিপথ, সর্পিল ও সংকীর্ণ পথ। এই পথে যে কর্মে রত থেকে তাঁরা মুঠো মুঠো ধুলো তাল তাল সোনায় পরিণত করেছেন, তাতে হয়তো ম্যাজিশিয়ানের কৌশল আছে, কিন্তু পুরুষের পৌরুষ নেই, সাহস বা উদ্যমও নেই।

যদি এ কথা সত্য হয় যে—“Enterprise is action of relatively high order of vigor, inspired by the vision of achievement of some desirable and ambitious objective.” ৪১—এন্টারপ্রাইজ বা শিল্পোদ্যম হল উচ্চস্তরের সাহস ও উৎসাহযুক্ত কোনও কর্ম, যা কোনও অভিপ্রেত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্দেশ্যের সাফল্যের দূরদৃষ্টিতে সমুজ্জ্বল ও অনুপ্রাণিত। তাহলে এ কথাও মনে হয় যে অর্থনীতিক্ষেত্রে ধনিক ও মধ্যবিত্ত বাঙালিদের কোনও ‘ambitious objective’—এর ‘vision of achievement’ ছিল না এবং তার দ্বারা অনুপ্রাণিত এমন কোনও কর্মে তাঁরা প্রবৃত্ত হননি যাতে ‘high order of vigor’ প্রয়োজন হয়। দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামদুলাল দে—র মতো দু—একজন যাঁরা স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যকর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তাঁদের ‘action’ ও ‘vision’ দুইই অনেকটা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিবন্ধকতার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দ্বারকানাথের মতো কেউ কেউ অমিতব্যয় ও অতিবিলাসে অনেক মূলধন ক্ষয় করেছিলেন, জমিদারির নিশ্চিন্ত আয়ের প্রতি প্রলুব্ধ হয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ রামদুলালের মতো যথেষ্ট বণিক—বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথার পাদমূলে অনেক ‘মূলধন’ উৎসর্গ করেছিলেন।

সমাজের মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক যে—কোনও প্রকারে প্রচুর ধনসঞ্চয় করলে যে দেশের উন্নতির জন্য ‘মূলধন’ সৃষ্টি হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। দেশের তিনজন লোক যদি কোটিপতি হন এবং বাকি সাতানব্বুইজন দারিদ্র্যের এমন স্তরে জীবনধারণ করেন যে এক পয়সাও সঞ্চয় (Saving) করা তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয় না, তাহলে জাতীয় উন্নতির জন্য প্রকৃত মূলধনও সৃষ্টি হয় না। বাংলাদেশে অতিসংকীর্ণ একটি ধনিকশ্রেণি ব্রিটিশ আমলে সৃষ্টি হয়েছিল বটে। কিন্তু সমাজের বেশির ভাগ লোকের কিছু কিছু অর্থাগমের সুযোগ হলেও দারিদ্র্যই বেড়েছিল নানাকারণে। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় এই ধারণাগুলি সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।৪২  ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন যে বাংলা দেশে সাধারণ লোকের দুঃখকষ্ট আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এমনকী যাঁরা যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেন তাঁরাও একদিকে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং অন্যদিকে পুরাতন সামাজিক প্রথার প্রতি আনুগত্যের জন্য বিশেষ সঞ্চয় করতে পারেন না। প্রথম কারণ, আগের চেয়ে জিনিসপত্রের মূল্য বেড়েছে, কিন্তু সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি। আয় যেটুকু বেড়েছে তা মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় কম। দ্বিতীয় কারণ, ”সভ্যতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনের সংস্কার ও হৃদয়ের ইচ্ছার ব্যতিক্রম ঘটাতে, অনেক নূতন—বিধ ভোগ্যবস্তু, নূতন—বিধ সামগ্রী অত্যাবশ্যক হইয়া উঠিয়াছে। সেগুলি না হইলে সমাজে হেয় ও অবগণিত হইতে হয়, সুতরাং সেগুলির আহরণের জন্য লোকে ব্যয় স্বীকার করিয়া থাকে।৪৩  ‘সোমপ্রকাশ’ এখানে যে সমস্যার ইঙ্গিত করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজ আমলে লোকের জীবনযাত্রার (pattern of living) খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। বাজারে নতুন নতুন ভোগ্যবস্তু আমদানির ফলে মানুষের ‘consumption-pattern’—এরও পরিবর্তন হয়েছে। তার ফলে সকলের ব্যয় বেড়েছে কিন্তু আয় বাড়েনি। দুঃখকষ্ট ও অভাববৃদ্ধির এ—ও একটা বড় কারণ। এ ছাড়া আরও একটি কারণ ‘সোমপ্রকাশ’ উল্লেখ করেছেন যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘হিন্দুসমাজের পুরাতন রীতিনীতি ও প্রথা প্রচলিত থাকতে, যে যৎকিঞ্চিৎ অর্থাগম হইতেছে, তাহাতে বিশেষ সাহায্য বোধ হইতেছে না।’ এই সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথাগুলি ‘সোমপ্রকাশ’ এইভাবে নির্দেশিত করেছেন :

প্রথম হল ‘একান্নবর্তিতা’। ”ইহা যে লোকের দারিদ্র্যতাবৃদ্ধির অন্যতম কারণ তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এই প্রথা প্রচলিত থাকাতে একদিকে দশজন নিষ্কর্মা, অথবা অন্নোপার্জক, একজন উপার্জনশীল ও পরিশ্রমী ব্যক্তির গলগ্রহ হইয়া থাকে।” এই একান্নবর্তিতার ফলে পরিবারের (এবং সমাজের) অনেক লোক যৌবনকাল থেকেই শ্রমবিমুখ ও অলস হয়ে যায়। বহু নিষ্কর্মা লোক পোষণের ফলে যিনি পরিশ্রম করে উপার্জন করেন, তিনিও অর্থের সদগতি করতে পারেন না এবং ক্রমে শ্রম ও উপার্জন উভয় সম্পর্কেই তিনি উদাসীন হয়ে পড়েন। অর্থাৎ একজন পরিশ্রমী ও উদযোগী পুরুষও একান্নবর্তী পরিবারের নিষ্পেষণে ক্রমে শ্রমবিমুখ ও অকর্মণ্য হয়ে যান। জাস্টিস ফিয়ার (Justice Phear) বেথুন সোসাইটিতে ‘হিন্দু যৌথ পরিবার’ সম্বন্ধে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন (১৮ মার্চ ১৮৬৭)। বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

‘But while your system is admirable to look at on its affectionate and charitable side, it has a reverse. it takes away from the individual that stimulus to exertion which the sense of self-dependence alone can give. I have been often grieved, during the short time I have been among you, to see men of the middle ranks, in the prime of life, residing at the family house with their wives and children about them, in a state of perfect idleness. …Clearly it is antagonistic to any exhibition of energy. It is fatal to the development of any true spirit of enterprise, and in some sense affects the common appreciation of honesty.” (emphasis added)

জাস্টিস ফিয়ারের এই বক্তৃতা প্রসঙ্গে গিরিশ ঘোষ The Bengalee পত্রিকায় লেখেন (এপ্রিল ১৮৬৭) ৪৪

‘‘Not one in a thousand, not one in ten thousand can talk of the joint Hindoo Family without a shudder. Not a boy in his teens, not a youngman above 20, not a middle-aged man of forty, not an old man of sixty can contemplate the accursed Joint Family without a cold tremor convulsing this entire frame. The men are friends, the women are furies in that same Joint Hindoo Family. It is well Mr. Justice Phear has raised the veil.”

বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা দেশে এই একান্নবর্তী পরিবারের যে কত দূর আধিপত্য ছিল তা ১৯৫১ সালের সেন্সাসের সার্ভে থেকে বোঝা যায়—“The survey indicates that the joints Family system, far from disintegrating as is loosely imagined, is still quite strong both in the north and the south-west and even in the surroundings of the metropolitan industrial area of 24-Parganas.”৪৫ বাঙালির আর্থনীতিক নিরুৎসাহ ও নৈষ্কর্ম্যের একটা বড় কারণ একান্নবর্তী পরিবারের সামাজিক প্রথা।

দ্বিতীয় কারণ হল ‘বাল্যবিবাহ’। ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন যে এই প্রথা প্রচলিত থাকার ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে দুটি অপকার হয় : (১) পুত্রকন্যাদের উপার্জনের উপযোগী শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না, (২) ব্যয় ক্রমে বাড়তে থাকে। যেমন এক ব্যক্তির একটি পুত্র আছে। তিনি নিজে মাসে ৩০ টাকা উপার্জন করেন, তাতে কোনওরকমে তাঁর পরিবারের ভরণপোষণ চলে যায়। পুত্রটির ১৪/১৫ বছর বয়সে বিবাহ দেওয়া হল, তাতে একটি পরিবার বৃদ্ধি হল। পরে ১৮/১৯ বছর থেকে পুত্রটি সন্তানের জন্ম দিতে আরম্ভ করল। তখন তাঁর ৩০ টাকাতে আর সংসার চলে না। কাজেই তিনি পুত্রকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য কাজে নিযুক্ত করে দিলেন। ”শিক্ষা অসম্পূর্ণ সুতরাং তাহারও উপার্জন অল্প হইতে লাগিল, কিন্তু সন্তানের স্রোত অপ্রতিহত রহিল।” এদিকে বৃদ্ধ পিতা অক্ষম হয়ে পড়লেন, তাঁর উপার্জনের ক্ষমতা রইল না। পরিবারের অবস্থা তখন কী হল? দারিদ্র্য ও অর্থকষ্ট এক্ষেত্রে স্বাভাবিক। তার উপর পুত্রটি চিরদিনের জন্য সমাজে একটি অপদার্থ হয়ে রইল, তার কোনও আর্থিক ক্ষমতা বা যোগ্যতা থাকল না।

তৃতীয় হল—পিতা—মাতার শ্রাদ্ধ, পুত্রকন্যার বিবাহ প্রভৃতি ব্যয়বহুল সামাজিক প্রথা। এই প্রথাগুলির জন্য ধনী—মধ্যবিত্ত—দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেরই বহু টাকা অপব্যয় হয়। তার জন্য টাকা সঞ্চয় করা সম্ভব হয় না এবং দেশের মূলধন বাড়ে না।

চতুর্থ হল—’চিরবৈধব্য’। এই প্রথার জন্য বহু নিরুপায় স্ত্রীলোকের ভরণপোষণের ভার বহন করতে হয় আত্মীয়স্বজনকে। তাতেও আর্থিক অপচয় কম হয় না।

পঞ্চম হল—’জাতিভেদ ও জাত্যভিমান’। ”যদিও ইংরাজীশিক্ষা বহুল প্রচার হওয়াতে ক্রমেই ভিন্ন ভিন্ন জাতির সমতা হইয়া আসিতেছে এবং অনেক উচ্চজাতির লোক জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য শাস্ত্রবিরুদ্ধ ও হীন জাতিদিগের চিরাবলম্বিত অনেক কার্য অবলম্বন করিতেছেন, তথাপি এখনও অনেকে জাত্যভিমান নিবন্ধন অশেষ কষ্ট ও সাংসারিক অসচ্ছল সহ্য করেন, কিন্তু কষ্ট নিবারণের উপায় থাকিতে। নীচ ও হেয় বলিয়া তাহাতে প্রবৃত্ত হইতে পারেন না।” ‘সোমপ্রকাশ’—এর এই উক্তি থেকে বোঝা যায় যে ব্রিটিশ আমলে সামাজিক গতিশীলতা (social mobility) খানিকটা সঞ্চারিত হলেও তা নানা কারণে প্রতিহত হয়েছে। প্রথম ও প্রধান কারণ জাতিভেদ ও জাত্যাভিমান। জাতিভেদপ্রথা ব্রিটিশ আমলে আদৌ শিথিল হয়েছে কিনা সন্দেহ। ইংরেজি শিক্ষা, সমাজসংস্কার আন্দোলন ইত্যাদির তরঙ্গাঘাতে জাতিভেদের বন্ধন আলগা হয়নি, অথবা তার লৌহপ্রাচীরে বড় রকমের কোনো ফাটল ধরেনি। সামান্য একটু—আধটু ছিদ্র যদি কোথাও হয়ে থাকে তাহলে তাকে ‘intercaste mobility’ বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। টাকার জোরে শ্রেণিরেখা (class-line) অতিক্রম করা যত সহজ, আমাদের জাতিবর্ণের স্তরবিন্যস্ত সমাজে জাতিরেখা (caste-line) অতিক্রম করা তত সহজ নয়। টাকার প্রচণ্ড চাপেও জাতির গণ্ডি যে অতিক্রম করা যায় না, তার অজস্র দৃষ্টান্ত আঠারো ও উনিশ শতকের সমীকরণ ও জাতিসভার (caste-counsil) ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে। বিশ শতকের বৈজ্ঞানিক দ্বিপ্রহরকালেও দেখা যায়, বাঙালি সমাজে, এমনকী ভারতীয় সমাজেও, জাতিভেদের বন্ধন বিশেষ শিথিল হয়নি। বৃত্তিগত গতিশীলতা (occupational mobility) উনিশ শতকের তুলনায় বিশ শতকে অনেক বেড়েছে এবং সেই অনুপাতে কুলবৃত্তির বন্ধনও শিথিল হয়েছে, কিন্তু সামাজিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই জাতিগত গোঁড়ামি এখনও প্রবল আছে। ‘সোমপ্রকাশ’—এর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে কুলবৃত্তির বন্ধন অনেক বেশি দৃঢ় ছিল এবং তার জন্য বাঙালিদের পক্ষে আর্থিক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিচরণ করা সম্ভব হয়নি। ব্রাহ্মণের ছেলে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য কোনওরকম পারিবারিক ও সামাজিক প্রেরণা পাননি, বরং বাধাই পেয়েছেন। সামাজিক প্রথানুগত্যের জন্য তাঁদের মানসিক গড়ন (mental orientation) ছেলেবেলা থেকেই তাই বাণিজ্যবিমুখ হয়ে ওঠে। তার ফলে কর্মজীবনে শিল্প—বাণিজ্যের নতুন রাজ্যে তাঁদের পক্ষে অভিযান করা সম্ভব হয় না।

‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় যে রচনা নিয়ে আলোচনা করা হল তা ১২৮০ সালে (ইংরেজি ১৮৭৩—৭৪ সালে) লেখা। আরও বারো বছর পরে ১২৯২ সালে (১৮৮৫—৮৬) ‘বাঙ্গালীর দারিদ্র্য’ নামে দীর্ঘ রচনায় এ বিষয়ে ‘সোমপ্রকাশ’ বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। প্রথমে বাঙালির উপজীবিকা (occupation) মোট সাতটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে :৪৬

প্রথম শ্রেণি : সামান্য ব্যাবসাবাণিজ্য

এই শ্রেণিতে আড়তদার গোলাদার দোকানদার থেকে সামান্য মুদি ও ফেরিয়ালা পর্যন্ত এবং যাঁরা নগদ টাকা ও ধান ইত্যাদির তেজারতি করেন তাঁদের সকলকেই ধরা হয়েছে। এঁদের সকলের কাজেই কিছু মূলধন দরকার এবং লাভ—লোকসানের ব্যাপার আছে বলে কাজটিকে ব্যাবসাবাণিজ্য বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় শ্রেণি : ভূসম্পত্তির উপস্বত্বভোগ

এই শ্রেণিতে জমিদার পত্তনিদার তালুকদার জোতদার গাঁতিদার ব্রহ্মোত্তর প্রভৃতি বৃত্তিভোগী ও কৃষকদের ধরা হয়েছে।

তৃতীয় শ্রেণি : দৈহিক ও মানসিক শ্রম বিক্রয়

এই শ্রেণিতে চাকরিজীবী হাইকোর্টের জজ থেকে সামান্য মুটেমজুর, চা—বাগান, রেলওয়ে প্রভৃতির কুলি সকলকেই ধরা হয়েছে। উকিল মোক্তার ডাক্তাররাও এই শ্রেণিভুক্ত। এঁরা সকলেই অপরের জন্য দৈহিক বা মানসিক পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন।

চতুর্থ শ্রেণি : জাতীয় ব্যাবসাযোগে জীবিকাশিল্পী

পুরোহিত ধোপা নাপিত তন্তুবায় কর্মকার সূত্রধর কাংসকার গন্ধবণিক সুবর্ণবণিক প্রভৃতি সকলে এই শ্রেণিভুক্ত। কারণ এঁরা সেই প্রাচীনকাল থেকে বৃত্তি অনুযায়ী জাতিভুক্ত হয়েছেন এবং নিজেদের কুলবৃত্তি অবলম্বন করেই জীবিকানির্বাহ করেন।

পঞ্চম শ্রেণি : পরমুখাপেক্ষী ও পরভোগ্যোপজীবী

তোষামোদ ভিক্ষা উঞ্ছবৃত্তি ইত্যাদির দ্বারা জীবিকানির্বাহ করেন তাঁদেরও একটি স্বতন্ত্র শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। এই বৃত্তিকে অবশ্য ‘ঘৃণিত বৃত্তি’ বলা হয়েছে।

এই পাঁচটি বৃত্তি সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ বলেছেন যে এগুলি সমাজে ব্রিটিশ—পূর্ব যুগেও ছিল, নতুন বৃত্তি নয়। ব্রিটিশ আমলে যে দুটি নতুন বৃত্তির কথা ‘সোমপ্রকাশ’ উল্লেখ করেছেন তা যে—কোনও আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীকেও চমৎকৃত করবে। এই নতুন বৃত্তি দুটি হল :

(১) আত্মবিক্রয় ও ধর্মবিক্রয়

(২) প্রতিভা বিক্রয়

আত্মবিক্রয় ও ধর্মবিক্রয় প্রসঙ্গে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন : ”বেশ্যাবৃত্তি, বিবাহের কন্যা বিক্রয় ও বি.এ., এম.এ. পাশযুক্ত পুত্রের প্রভূত পণগ্রহণ, শিষ্যের নিকট গুরুর অর্থগ্রহণ, এ সকল বৃত্তি প্রাচীন সমাজে বড় প্রচলিত ছিল না। হিন্দুশাস্ত্রে ঐরূপ বৃত্তি অবলম্বনে বিশেষ নিষেধ আছে ও ঘোর অধর্ম বলিয়া দণ্ডের বিধান আছে।” কিন্তু ব্রিটিশ আমলে টাকার দোর্দণ্ড প্রতাপে শাস্ত্রের এই বিধান ও নিষেধ স্বচ্ছন্দে লঙ্ঘন করতে অনেকেই কুণ্ঠিত হননি।

‘প্রতিভাবিক্রয়’ সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন : ”এই বিভাগে প্রতিভা সম্ভূত কাব্য নাটক নভেল বিক্রয়, বিজ্ঞান রসায়নশাস্ত্র ধর্মশাস্ত্র অথবা উপদেশ পূর্ণ কোনরূপ সাময়িকপত্রাদি বিক্রয় দ্বারা আবিষ্কর্তা, প্রণেতা রচয়িতা যে স্বত্ব ভোগ করেন, সেই স্বত্বাধিকারীগণকে ‘প্রতিভাবিক্রেতা’ বলা যায়। পুরাকালে এ প্রথাটি প্রচলিত ছিল না।” লক্ষণীয় হল, আত্মবিক্রয় ও ধর্মবিক্রয়কে ‘সোমপ্রকাশ’ ‘নিতান্ত ঘৃণ্য’ বলে নিন্দা করেছেন, কিন্তু ‘প্রতিভাবিক্রয়’কে নিন্দা করেননি। প্রতিভাবিক্রয় সম্বন্ধে বলেছেন যে এই ”উপজীবিকা যদিও পূর্বকালে হিন্দুসমাজে প্রচলিত ছিল না, কিন্তু এইরূপ বৃত্তি অবলম্বনে কোন দোষ দেখা যায় না বরং প্রার্থনীয় বলা যাইতে পারে।” ‘সোমপ্রকাশ’ মধ্যবিত্তশ্রেণির মুখপত্র, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের। ‘Commercialisation’ ও ‘Vulgarisation of talent’ ধনতান্ত্রিক যুগের বিশিষ্ট সামাজিক উপসর্গ। ব্রিটিশ আমলে স্বভাবতই এই উপসর্গের আমদানি ও প্রসার হয়েছে বাংলা দেশে, এবং ভারতবর্ষেও। প্রতিভা বাজারের অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের মতো, টাকার বিনিময়ে কেনা—বেচার পণ্যে পরিণত হয়েছে। নতুন মধ্যবিত্তের, বিশেষ করে বাংলা দেশের, অন্যতম উপজীবিকা হয়েছে প্রতিভাবিক্রয়।

‘একান্নবর্তী যৌথ পরিবার’ (Joint Family) বাঙালির (হিন্দুর) স্বাধীন কর্মোদ্যম ও শিল্পোদ্যম কীভাবে নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় করেছে, আগে তার উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বাঙালির উপজীবিকার মধ্যে যে ‘ভূসম্পত্তির উপস্বত্বভোগ’—এর কথা বলা হয়েছে, তার গুরুত্বও বাঙালির শিল্পোদ্যমের অভাবের কারণ হিসেবে কম নয়, বরং আরও বেশি বলা চলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও নানা স্তরের মধ্যস্বত্বের প্রবর্তন বাংলার সঞ্চিত মূলধনকে যেভাবে ভূসম্পত্তিভোগের দিকে চালিত করেছে, সেরকম বোধহয় ভারতের আর অন্য কোনও প্রদেশে করেনি। বাঙালির আর্থনীতিক অপমৃত্যুর প্রধান কারণ হয়েছে ভূসম্পত্তির অনার্জিত, অনায়াসলব্ধ আয় (প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। ‘ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশন’ বলেছেন :

“The limitation of the revenue payable by the Zamindars, coupled with their exemption from any income-tax on agricultural incomes throws an undue burden on other classes of tax-payers. The discrimination in favour of land has had the effect of creating a bias in favour of investment in land rather than in industrial enterprise, and has contributed to the over-capitalisation of rent-receiving as opposed to productive purposes either in agriculture or industriy.”

বাঙালির সঙ্গে বোম্বাইবাসীর শিল্প বাণিজ্যোদ্যমের তুলনা করে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বোম্বাই চিত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন : ”বোম্বায়ের লোকেরা বাঙালীদের অপেক্ষা বাণিজ্য ব্যবসা কার্যে সুদক্ষ। বাঙলার ধন সম্পত্তি ভূমিতে আবদ্ধ। বোম্বাই অঞ্চলে ভূমির তেমন মূল্য নাই কেন না এ প্রদেশে ভূমি সম্পর্কীয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলিত নাই।”৪৭ একদিকে একান্নবর্তী যৌথ পরিবার, অন্যদিকে চিরস্থায়ী ভূস্বত্ব—উপস্বত্ব, এই দুয়ের আকর্ষণে বাঙালির স্বাধীন কর্মোদ্যম ও শিল্পোদ্যম নিষ্পেষিত হয়েছে।

বাংলার আর্থিক অবনতির আরও কয়েকটি কারণ ‘সোমপ্রকাশ’ উল্লেখ করেছেন। বাঙালির আর্থিক অবনতিকে ‘ব্যাধি’ মনে করে কারণগুলিকে বলা হয়েছে এক একটি ভয়ানক ‘উপসর্গ’। কারণগুলি এই :

প্রথম কারণ—লোকসংখ্যাবৃদ্ধি ও ঘরমুখো মন। বাংলাদেশের লোকসংখ্যা বেড়েছে কিন্তু সেই অনুপাতে আয়ের পথ বাড়েনি। তা ছাড়া বাঙালিরা অত্যন্ত বেশি ঘরমুখো ও ঘরকুনো। ”বাঙ্গালী ঘরে পড়িয়া অনাহারে মরিবে, তথাপি বাহিরে যাইয়া আহারান্বেষণ করিবে না।” অর্থনীতিক্ষেত্রে শিল্প—বাণিজ্যে বাঙালির উদ্যমের অভাবের একটা বড় কারণ এই ঘরমুখো স্বভাব।

দ্বিতীয় কারণ—বাঙালির বিবাহপ্রিয়তা ও বিবাহবাধ্যতা। ”বাঙ্গালীর বিবাহপ্রিয়তা ও বাধ্যতা বাঙ্গালীর দারিদ্র্যের প্রধান সহায়।” এই বিবাহপ্রিয়তা ও বাধ্যতা থেকে বাংলা দেশে বহুবিবাহে ও বাল্যবিবাহের এত বেশি প্রচলন হয়েছে। এই সামাজিক কুপ্রথা বাঙালির স্বাধীন কর্মপ্রবৃত্তি অনেক পরিমাণে খর্ব করেছে।

তৃতীয় কারণ—কৌলীণ্যপ্রথা। এই প্রথার জন্য বিবাহে পুত্রকন্যার পণগ্রহণের নিয়ম প্রচলিত হয়েছে এবং ব্রাহ্মণদের অনুকরণে ব্রাহ্মণেতর জাতের মধ্যেও এই প্রথার প্রভাব পড়েছে। ”এই সামাজিক নিয়মে বাধ্য হইয়া অনেককে প্রভূত ব্যয় স্বীকার করিতে হয়, দুরপনেয় ঋণপঙ্কে লিপ্ত হইতে হয়, এমনকি অনেক সময়ে ভিক্ষাবৃত্তিও অবলম্বন করিতে হয়।” কাজেই কৌলীন্যপ্রথা যে বাঙালির আর্থিক মেরুদণ্ড ভাঙতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

চতুর্থ কারণ—একান্নবর্তিতা সম্বন্ধে আগে বলা হয়েছে।

পঞ্চম কারণ—সামাজিক প্রথা অনুযায়ী কতকগুলি কাজ করতে বাধ্য হওয়া—যেমন পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধ, পুত্রকন্যার বিবাহ, ঠাকুরসেবা, উৎসব—পার্বণ ইত্যাদি। ”আমাদের দেশে ক্রিয়াকর্মে যাগযজ্ঞে ও মহোৎসবে অধিক টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু ইহাতে সাধারণকে আলস্য পরবশ করে। কেহ অতিথিশালা স্থাপন করিলেন বা অন্নসত্র দিলেন, কতকগুলি লোক তথায় পরপিণ্ডে পেট পুরিয়া আলস্য ও পাপের আশ্রয় নিতে লাগিল ও অকর্মণ্য হইয়া সমাজের অব্যবহার্য জীব হইতে চলিল। ধনীর ধন বিতরণের এরূপ পন্থা প্রশস্ত নহে। ইহাতে দারিদ্র্য আনয়ন করে।” সামাজিক প্রথা দেশের অর্থনীতিক্ষেত্রে যে কীভাবে নানা ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়ার ভিতর দিয়ে জাল বিস্তার করতে পারে, এটি তার একটি বড় দৃষ্টান্ত। এ দেশের ধনিকরা নানারকম অসাধু উপায়ে স্বচ্ছন্দে অর্থ উপার্জন করতে পারেন, কিন্তু শেষে সেই সনাতন পাপ—পুণ্যবোধ থেকে যখন তাঁদের বিবেকদংশন আরম্ভ হয়, তখন পাপকর্ম থেকে মুক্তির আশায় তাঁরা ধর্মশালা, অতিথিশালা, দেবালয় ইত্যাদি স্থাপন করেন এবং তার ফলে দেশের লোককে অলস ও নিষ্কর্মা হবার সুযোগ দেন। উনিশ শতকে বাঙালি ধনিকরা এরকম যে কত করেছেন এবং তার জন্য যে কত লক্ষ লক্ষ টাকা অপব্যয় হয়েছে তা ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়।

ষষ্ঠ কারণ—”বংশগত মর্যাদা ও শাস্ত্রোক্ত নিষেধ।” এ সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। কোনও জমিদার সন্তানের প্রপিতামহ সুপ্রসিদ্ধ মান্যগণ্য জমিদার ছিলেন। তাঁর বার্ষিক আয় ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। সরকার তাঁকে রাজোপাধি দিয়েছিলেন। পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা রেখে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর সম্পত্তি পুত্রকন্যাদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। আবার তাঁদের বংশবৃদ্ধি হওয়ায় চারপুরুষের মধ্যে ওই সম্পত্তি কড়ায়—গন্ডায় ভাগ হয়। বর্তমান জমিদার বা রাজসন্তান নয় গন্ডা তিন কড়ার মালিক, তাতে যে আয় হয় তা দিয়ে তাঁর সংসার চলে না। তিনি হয়তো একশো টাকার মাইনের একটা চাকরি করতে পারেন, কিন্তু রাজসন্তান ও জমিদার হয়ে তাঁর চেয়ে পদমর্যাদায় ছোট এমন লোকের কাছে চাকরি করতে তিনি রাজি নন। ”তাঁহার প্রপিতামহ রাজা ছিলেন, এই অভিমানে ফাটিয়া ঘরে বসিয়া বসিয়া উপবাস করিতে লাগিলেন, ক্রমে বৃথা অভিমানে, চিন্তায়, দারিদ্র্যে অকালে কালগ্রাসে পতিত হইলেন… ইহাকে বলে বংশগত অভিমানের অত্যাচার।” ব্রিটিশ আমলে আর কিছু হোক না হোক, একশ্রেণির অজ্ঞাতকুলশীল নানাপ্রকার কৌশলে এ দেশে ধনিক বংশের প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলেন এবং ধনজাত একটা অভিমান ও মর্যাদাবোধ তাঁদের মধ্যে জেগেছিল। বাংলা দেশের হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী তাঁদের ধনসম্পত্তি তিন—চার পুরুষের মধ্যে উৎসন্নে গেলেও, এই বিত্তজাত বংশমর্যাদাবোধ উত্তরপুরুষের মন থেকে লোপ পায়নি।*

শাস্ত্রোক্ত নিষেধ সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন : ”তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান, তুমি স্বহস্তে হলচালন করিতে, যবন বা ম্লেচ্ছের দাসত্ব করিতে পারিবে না। সংক্ষেপতঃ শাস্ত্রোক্ত নিষেধ মানিলে ব্রাহ্মণের ভিক্ষাবৃত্তি ভিন্ন অন্য উপায় নাই। ব্রাহ্মণেতর জাতির সম্বন্ধেও অনেক প্রকার নিষেধ আছে। সে সকলের বিস্তৃত বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। মনু প্রভৃতির সংহিতা পাঠে পাঠক জানিতে পারিবেন। সুখের বিষয় যে, অধুনা অনেকে ঐ সকল সংহিতার নিষেধ—বিধি মানেন না। তথাপি যেটুকু পালন করেন, তাহাতে অবনতির আশঙ্কা আছে।”

সপ্তম কারণ—জাতিভেদ ও কর্মভেদ। ”জাতিভেদ ও কর্মভেদ জাতীয় অবনতির দুইটি প্রধান সহায়। জাতি ও কর্মভেদে পরস্পরের সহিত ঐক্য থাকে না, কোন সভাসমিতি সংগঠিত হয় না। কেহ কাহারো জন্য চিন্তা করে না, সহানুভূতিও থাকে না। কেহ কাহাকে বিশ্বাস করে না। কোন সাধারণে দেশহিতকার্যে সকলে একত্র হইয়া বদ্ধপরিকর হয় না। দুরূহ কার্যে একাগ্রতা ও একতার বলপ্রয়োগ আবশ্যক হইলে তাহা পাওয়া যায় না। তখন কেহ উজান কেহ বা ভাটা বাহিতে আরম্ভ করে, কেমন চাঁ ভাঁ লাগিয়া যায়।” জাতিগত কর্মভেদ অবশ্য শুধু বাংলা দেশের নয়, সারা ভারতবর্ষের আর্থিক অনুন্নতি ও অবনতির অন্যতম কারণ।

অষ্টম কারণ বলা হয়েছে শিক্ষার বিভ্রাট। ব্রিটিশ আমলে যে শিক্ষার প্রাধান্য বেড়েছে তা মানুষকে কর্মক্ষম করে না। শিল্পকৌশল, বিজ্ঞান এবং অন্যান্য অর্থকরী ও কার্যকরী শিক্ষার ব্যবস্থা এ দেশে নেই বললেই হয়। ”যে ভাবের শিক্ষা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাতে কেবল শূন্যে কেল্লা নির্মাণের বৃদ্ধি হয়, বচনে খৈ ফুটাইবার ক্ষমতা হয়, শিমূল ফুলের মত অল্প বাতাসে ফাটিয়া চাটিয়া দেশময় হওয়ার সুবিধা হয়, এরূপ নিষ্ফল শিক্ষায় দারিদ্র্য ও দুঃখের স্রোত প্রবলবেগে বহিবে তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।”

নবম কারণ—কার্যক্ষেত্রের অভাব। ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন যে দেশের লোকসংখ্যা ক্রমে বাড়ছে, কিছু লোক শিক্ষাও পাচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার যোগ্যতা ও লোকসংখ্যার অনুপাতে কাজকর্মের সংস্থান হচ্ছে না। ”রেলওয়ে, ট্রামওয়ে, চা—বাগানে, সওদাগরের বাটিতে অনেক লোক প্রতিপালন হয়। বিদেশীয় বণিকদিগকে আশীর্বাদ করি। তাঁহাদের দ্বারে খাটিয়া বিস্তর লোক জীবিকা নির্বাহ করিতেছে। দেশীয় ধনী গুণপুরুষদিগের এসকল বিষয়ে আদৌ দৃষ্টি নাই। দেশের কিসে উন্নতি হয়, অবনতি হয়, দারিদ্র্য দূর হয়, এরূপ চিন্তায় কোনদিন কোন মুহূর্তের জন্যও তাঁহাদের অসার মস্তিষ্ক আলোড়িত হয় না। যদি আজ বিদেশীয় বণিকগণ তাঁহাদের কাজ কারবার কলকারখানা ভারত হইতে উঠাইয়া লয়, তবে এই অগণ্য দরিদ্র ভারতবাসীর দশা কতদূর শোচনীয় হয় তাহা ভাবিতেও হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। সেইজন্য এই বলি, কেবল বিদেশের মুখাপেক্ষী ও বিদেশীয়ের ভাগ্যোপজীবী হইলে দেশের দারিদ্র্য কখন ঘুচে না।” এ দেশের ধনিকদের বিরুদ্ধে দেশের আর্থিক উন্নতিচিন্তা সম্বন্ধে ঔদাস্যের এই অভিযোগ কেবল ‘সোমপ্রকাশ’—এর নয়, সেকালের অধিকাংশ সাময়িকপত্রের।

দশম কারণ—”গবর্ণমেণ্টের বিদেশপ্রিয়তা, বিজাতীয়তা ও ধর্মান্ধতা।” বিদেশি শাসকরা এ দেশের শিল্পোন্নতি ও আর্থিক সমৃদ্ধি সম্বন্ধে যথেষ্ট উদাসীন বলেও দেশের দারিদ্র্য দূর হয় না। এ যুক্তি অকাট্য এবং খুব সাধারণ যুক্তি। কিন্তু বাংলা দেশে শিল্পোন্নতির অন্তরায় হিসেবে এখানে যে সমাজতাত্ত্বিক কারণগুলির উল্লেখ করা হয়েছে তার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

বিদেশি ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থবুদ্ধিজাত শিল্পনীতি যে এ দেশে শিল্পপ্রসারের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক ছিল, এ কথার পুনরাবৃত্তি অনেক অর্থনীতির ইতিহাসগ্রন্থে করা হয়েছে। এরকম স্বতঃসিদ্ধ সত্যের অবতারণা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, সে কথা গোড়াতেই বলেছি। আমাদের লক্ষ্য হল আর্থনীতিক কারণ ছাড়াও আরও অন্যান্য ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ বাংলাদেশে বাঙালির শিল্পোদ্যমের পথে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেছিল কি না সন্ধান করা। এই ধরনের কয়েকটি সামাজিক কারণের উল্লেখ আমরা আগে করেছি। আরও একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করব—সমুদ্রযাত্রার দৃষ্টান্ত। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাঙালিরা যখন শিক্ষা ও অন্যান্য কাজকর্মের জন্য সমুদ্রপথে, প্রধানত ইংলন্ডে, যাত্রা করতে আরম্ভ করেন, তখন স্বদেশে ফিরে আসার পর তাঁদের হিন্দুসমাজে গ্রহণ করার ব্যাপার নিয়ে এক সমস্যা দেখা দেয়। যাঁরা হিন্দুসমাজের কর্ণধার তাঁরা অনেকেই বিদেশ—প্রত্যাগতদের সমাজচ্যুত করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তা—ই নিয়ে বাংলার হিন্দুসমাজে বেশ প্রবল আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। উনিশ শতকের শেষ দশকের কথা। ‘সোমপ্রকাশ’ লেখেন :৪৮

”বাণিজ্যবিস্তার করিতে হইলেও বিদেশ গমন নিতান্ত অবশ্যক। কেবল পল্লীর ভিতরে বসিয়া তৈল লবণ বেচিলে বাণিজ্য করা হয় না। যখন এখানকার শিল্পোন্নতি হইবে তখন নানাদেশে এজেণ্ট রাখিতে হইবে, নচেৎ দ্রব্যাদি বিক্রয় হইবে না। বাণিজ্যের জন্য পণ্যদ্রব্যও জাহাজে করিয়া দেশে—বিদেশে লইয়া যাইতে হইবে। পার্সীরা বোম্বাইয়ের বস্ত্র অনেক দূরদেশে লইয়া যাইতেছেন, তাই তাহাদের যত্ন নিষ্ফল হয় না। নতুবা লিটনের রাজবুদ্ধির প্রসারে বস্ত্রের শুল্ক রহিত হওয়াতে বোম্বাইয়ের বণিক সম্প্রদায়কে আজি চক্ষের জলে ভাসিতে হইত।… ব্যবসায়ীরা ইউরোপে এজেণ্ট রাখিতে পারিলে তবে সম্পূর্ণ উপকারের সম্ভাবনা। এখন আমাদের বক্তব্য এই, বিশুদ্ধ হিন্দুধর্মকে মাথায় করিয়া থাকিলে এই সকল উদ্দেশ্য সিদ্ধি ঘটিবে না, তাহা নিশ্চিত। সেজন্য বলিতেছি, হিন্দুধর্ম যদি পুনর্জীবিত হয়, তবে উহার অনেক লেজামুড়া বাদ দিতে হইবে।”

ইংলন্ডে যখন ভারত ও অন্যান্য উপনিবেশের বাণিজ্যশিল্পের প্রদর্শনী হয় তখন হিন্দুরা যাতে অবাধে বিলাতযাত্রা করতে পারেন তা—ই নিয়ে আন্দোলন হয়। শিক্ষিত হিন্দুদের তরফ থেকে এরকম হাস্যকর প্রস্তাবও করা হয় যে গভর্নমেন্ট যদি সমুদ্রগামী জাহাজে ব্রাহ্মণ পাচক, গঙ্গাজল ও পূজার্চনার ব্যবস্থা করেন, তাহলে সমস্যার খানিকটা সমাধান হতে পারে। এই প্রস্তাব সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ মন্তব্য করেন : ”সহযোগীদিগের এইরূপ প্রস্তাবে আমরা কোনরূপেই হাস্যসম্বরণ করিতে পারিলাম না। আকাশে উড়িবার সাধ আছে অথচ ব্যোমযানে উঠিব না—যেমন মৃত্তিকায় বেড়াইতেছি তেমনি বেড়াইব অথচ আকাশে উড্ডয়ন করা হইবে এরূপ আশা যেমন হাস্যজনক, ইংলণ্ড আমেরিকা যাইব, নানাভাবে ভাবুক হইব অথচ দেশীয় মূর্খমণ্ডলীর কুসংস্কার বজায় রাখিব ইত্যাদির চিন্তা কি তদ্রূপ নহে?”৪৯  ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ লেখেন :

”অনেকেই জানেন বিলাত প্রত্যাগতদিগকে লইয়া এখানে ঘোরতর দলাদলি চলিতেছে। তন্মধ্যে অনেকেই তাহাদিগকে সংগ্রহ করিবার পক্ষপাতী এবং অনেকেই বিপক্ষ। প্রতিপক্ষরা বলেন উহাদিগকে সংগ্রহ করিলে ধর্মলোপ ও জাতিলোপ হইবে। যাই হউক এইরূপ মতভেদ হইয়া দুইটি দলের সৃষ্টি হইয়াছে এবং ইহার সংস্পর্শ অনেক পল্লীগ্রামেও পৌঁছিয়াছে। যাঁহারা সংগ্রহের পক্ষপাতী তাঁহারা অসংগ্রহে সমাজের অন্তর্বাদ কমিবে এই আশঙ্কা করেন। কারণ আজকার উচ্চশিক্ষা উচ্চপদ ব্যবসায় বাণিজ্য সূত্রে লোক বিলাত যাইতেছে। এই স্রোত রোধ করাও কঠিন।”৫০

আন্দোলন বেশ প্রবল হয়। হিন্দুদের সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধের উপযোগিতা বিচার করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি হন রমেশচন্দ্র মিত্র। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশচন্দ্র চন্দ, মন্মথনাথ মিত্র, পণ্ডিত মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, পণ্ডিত নীলমণি ন্যায়ালংকার প্রমুখ ষোলোজনকে নিয়ে কমিটি গঠিত হয়। বিচার—বিবেচনার পর পণ্ডিতরা রায় দেন যে সমুদ্রযাত্রা বা বিদেশযাত্রার ফলে প্রায়শ্চিত্তের অথবা হিন্দুসমাজ থেকে বহিষ্কারের কোনও কারণ ঘটে না। তাঁরা যে ‘ব্যবস্থা’ দেন তা এই : ৫১

Vyavastha I—As sea voyage does not come within the category of heinous transgressions, involving degradation (patitya), and heavy penances are not provided for it, and there is nothing even by parity of reasoning to consider it a heinous transgression, a person who makes a seavoyage without committing any heinous transgressions, should not be cosidered fallen (patita).

Vyavastha II—As residence in England and other foreign countries does not come within the category of heinous transgression, involving degradation (patitya) and heavy penances are not provided for it, and there is nothing even by parity of reasoning to consider it a heinous transgression, a person, who resides in England and other foreign countries, without committing any heinous transgressions should not be considered fallen (patita).

উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত যদি সমুদ্রযাত্রা ও বিদেশযাত্রা নিয়ে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে একরকম আন্দোলন সম্ভব হতে পারে, তাহলে বাঙালির আর্থিক উন্নতি ও স্বাধীন শিল্পোদ্যমের পথে কেবল বিদেশি শাসকের শোষণনীতির প্রতিবন্ধক ছাড়া এ দেশীয় লোকের সামাজিক মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির কোনও সক্রিয় প্রতিকূল ভূমিকা ছিল না, এমন সিদ্ধান্ত করা যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না।

প্রাচীন যুগ থেকে প্রায় মধ্যযুগের প্রান্ত পর্যন্ত ইতিহাসে বাঙালির বাণিজ্যিক কৃতিত্বের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা প্রধানত কুলবৃত্তিগত বাণিজ্য। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কয়েকটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের মধ্যে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। বর্ধমান জেলার গলসিথানার অধীন মল্লসারুল গ্রামে ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দের, অর্থাৎ প্রাচীন গুপ্ত যুগের, একটি তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছে। এই তাম্রশাসনে এই অঞ্চলের তদানীন্তন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নাম পাওয়া যায়। যেমন বক্কতক বা বাকতার হিম দত্ত, বটবল্লকের ষষ্ঠী দত্ত, শ্রী দত্ত, গোধগ্রামের মহি দত্ত ও রাজ্য দত্ত। এই দত্তরা কারা? পশ্চিমবঙ্গের গন্ধবণিক, তাম্বুলীবণিক প্রভৃতি বণিকসম্প্রদায়ের মধ্যে ‘দত্ত’—রা অন্যতম। এঁরা মনে হয় এই বণিক দত্তদেরই প্রাচীন পূর্বপুরুষ। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এঁরা এক—একটি অঞ্চলের বিশেষ অগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন, প্রধানত তাঁদের বাণিজ্যিক প্রতিপত্তির জন্য। বাংলা দেশের এই বণিকসম্প্রদায় বংশপরম্পরায় বাণিজ্য করে প্রচুর বিত্ত ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। হাজার—বারোশো বছর পরেও এই বণিকদের প্রতিপত্তির পরিচয় পাওয়া যায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল প্রভৃতি মঙ্গলকাব্যে। উজানির ধনপতি সদাগর ‘গন্ধবণিক জাতি বিদিত অবনী’। ‘বিদিত অবনী’ কথা থেকে বোঝা যায়, বাঙালি বণিকরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশেও বাণিজ্য করতে যেতেন। উজানি নগরে ছিল ধনপতির বাস। অজয় নদের তীরে, বর্ধমানের উজানি—কোগ্রাম এই উজানি নগর। কেবল ধনপতি সদাগরের উজানি নয়, চাঁদ সদাগরের চম্পকনগরও এই অঞ্চলে। খুল্লনার পাত্র নির্বাচন প্রসঙ্গে বণিকদের যেসব নাম ও বসতির উল্লেখ আছে তা এই—চম্পকনগরের চাঁদ সদাগর, বর্ধমানের ধুস দত্ত ও সোম দত্ত, সাতগাঁর বা সপ্তগ্রামের রাম দাঁ, বড়সূলের হরি দত্ত, ফতেপুরের রাম কুণ্ডু, কর্জনার হরি লাহা, ভাল্লকির সোম চন্দ। ধনপতি সদাগরের পিতার শ্রাদ্ধ উপলক্ষে উজানিতে বিভিন্ন অঞ্চলের বহু বণিকের সমাগম হয়েছিল। তাঁদের নামধামের তালিকা আরও বিস্তৃত—যেমন বর্ধমানের ধুস দত্ত, চম্পাইনগরের চাঁদ সদাগর, লক্ষ্মী সদাগর, কর্জনার নীলাম্বর বণিক ও তাঁর সাত ভাই, গণেশপুরের সনাতন চন্দ, তাঁর ভাই গোপাল ও গোবিন্দ চন্দ, সপ্তগ্রামের শ্রীধর হাজরা ও রাম দাঁ, সাকোঁর শঙ্খদত্ত, বিষ্ণুদত্ত ও তাঁর সাত ভাই, কাইতির যাদবেন্দ্র দাস, জাড়গ্রামের রঘুদত্ত, তেঘরার গোপাল দত্ত, ত্রিবেণীর রাম রায় ও তাঁর দশ ভাই, লাউগাঁর রামদত্ত, পাঁচড়ার চণ্ডীদাস খাঁ, খণ্ডঘোষের বাসু দত্ত, গোতানের রামদত্ত প্রভৃতি—

একে একে বণিকের কত কব নাম

সাতশত বেণে আইসে ধনপতিধাম।

সাতশত বণিকের সমাগম হয়েছিল ধনপতি সদাগরের গৃহে। যে সমস্ত গ্রাম থেকে তাঁরা এসেছিলেন তার প্রায় প্রত্যেকটি গ্রাম আজও স্বনামে বর্তমান রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে দামোদর অজয় দ্বারকেশ্বর সরস্বতী প্রভৃতি নদনদীর তীরে গ্রামগুলি প্রতিষ্ঠিত। আশ্চর্য হল, এইসব অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজে আজও দেখা যায় বণিকসম্প্রদায়ের সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তি সর্বাধিক। গ্রামে পা দিলেই এই অঞ্চলে আজও সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী, বড় বড় অট্টালিকাবহুল যেসব পাড়া দেখা যায়, সেগুলি প্রধানত বণিকসম্প্রদায়ের পাড়া।

বাণিজ্য বাংলার বণিকদের কুলবৃত্তি। এই কুলবৃত্তির ঐতিহ্য বর্তমানকাল পর্যন্ত বাঙালি বণিকরা অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছেন। বর্ধমান বাঁকুড়া হুগলি প্রভৃতি জেলায় নয় শুধু, কলকাতা শহরেও আঠারো শতক থেকে বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত ব্যাবসাবাণিজ্যক্ষেত্রে (trade and commerce) বাঙালি বণিকসম্প্রদায়ের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে দেখা যায়। কলকাতা শহরে বাঙালি শেঠ—বসাক প্রভৃতি তন্তুবণিকদের ইতিহাস এবং তাম্বূলী প্রভৃতি অন্যান্য বণিকসম্প্রদায়ের ইতিহাস থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।৫২  কিন্তু আশ্চর্য হল, উনিশ শতকে তো নয়ই, বিশ শতকেও বর্তমানকাল পর্যন্ত বাঙালি বণিকসম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাধীন শিল্প—প্রতিষ্ঠার পথে বিশেষ কেউ দুঃসাহসিক অভিযান করেছেন বলে জানা যায় না। কুলবৃত্তিগত বাণিজ্যের (commerce) সীমা তাঁরা হয়তো শাখাপ্রশাখায় বহু দূর পর্যন্ত প্রসারিত করেছেন, কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করে ধনতান্ত্রিক যুগের প্রকৃত শিল্পোদযোগীর মতো আধুনিক শিল্প—প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হননি। কেন হননি তা বাস্তবিকই ভাববার বিষয়। স্বাধীন শিল্প—প্রতিষ্ঠার উপযোগী পর্যাপ্ত মূলধন সঞ্চয় করেছেন এরকম ব্যবসায়ীর অভাব নেই এঁদের মধ্যে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন এঁরা বাণিজ্যমুখী হলেও স্বাধীন শিল্পমুখী হননি? কেন এঁরা প্রসিদ্ধ ‘ব্যবসায়ী’ হতে চান, ‘শিল্পপতি’ হতে চান না? তার অন্যতম কারণ মনে হয়, বেচা—কেনার বাণিজ্যে মুনাফার যে নিশ্চিন্ততা আছে, শিল্পোদমে তা নেই। রক্ষণশীল মন নিশ্চিন্ততার আশ্রয়ে ডানা গুটিয়ে থাকতে চায়, গতিশীল মনের মতো অবাধে ডানা বিস্তার করতে চায় না অনিশ্চিতের সন্ধানে। শিল্পোদযোগী পুরুষের (entrepreneur) মন দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর মতো বন্ধনমুক্ত, স্বাধীন ও কৃতিত্বকামী। বাঙালি বণিকসম্প্রদায় যেমন কুলবৃত্তিগত রক্ষণশীলতা শেষ পর্যন্ত ছাড়তে পারেননি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণের বাঙালি যাঁরা বাণিজ্যক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমলে পদার্পণ করেছিলেন, তাঁরাও বেশি দূর পর্যন্ত স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারেননি।

আর্থনীতিক ব্যবস্থা যদি ধনতান্ত্রিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্র ছাড়া যদি ব্যক্তির উপর শিল্প—বাণিজ্যের জন্য নির্ভর করতে হয়, তাহলে যে—কোনও দেশের শিল্পোন্নতির মূলে যে শিল্পোদ্যোগী পুরুষের দূরদর্শী অভিযানের প্রয়োজন আছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না, অথবা অর্থতত্ত্বের সূত্র ধরে বিচার করার প্রয়োজন হয় না। অর্থনীতিবিদরা অনেকে ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যমের গুরুত্বের কথা স্বীকার করেছেন এবং শুম্পিটারের মতো কয়েকজন শিল্পোন্নতির মূলে ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যমের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন।৫৩ শুম্পিটার বলেছেন যে, কোনও দেশের আর্থনীতিক বিকাশ প্রাকৃতিক নিয়মে স্বচ্ছন্দে অবলীলাক্রমে হয় না। হঠাৎ এক—একটা ঝাঁকুনি ও উল্লম্ফের শক্তি জোগান দেন প্রত্যেক দেশের শিল্পোদ্যোগী পুরুষরা, যাঁরা বলিষ্ঠ কল্পনা ও একাগ্রতা নিয়ে স্বাধীন শিল্পক্ষেত্রে অগ্রগতির নতুন নতুন পথের সন্ধানে যাত্রা করেন। ইংলন্ড—আমেরিকা, এমনকী জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশের ইতিহাস আলোচনা করলেও দেখা যায় যে শিল্পোন্নতির মূলে ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যমের ভূমিকা (role) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রথমেই আমরা যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছি তা হল, বাংলা দেশের আর্থিক জীবনে বা বাঙালিদের মধ্যে, এমনকী যাঁরা বংশানুক্রমে বাণিজ্যবৃত্তিজীবী তাঁদের মধ্যেও, ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যমের প্রকাশ তেমন হয়নি কেন?

এই প্রশ্নের বহুকথিত সহজ উত্তর হল—ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিকূলতা। এ উত্তরের যাথার্থ্য সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ আমরা প্রকাশ করিনি, কিন্তু সম্পূর্ণতা সম্বন্ধে সন্দেহ করেছি। রামদুলাল দে—র মতো কৃতী বণিক, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো উদ্যোগী শিল্পানুরাগী, এবং আরও অনেক বাঙালি যাঁরা ব্রিটিশ আমলের প্রথম পর্বে অর্থোপার্জনের নানারকমের সুযোগের যথেষ্ট সদব্যবহার করেছিলেন, এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন ও সঞ্চয় করেছিলেন, তাঁরা অন্তত স্বাধীনভাবে ছোটখাটো শিল্প—প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তৎপর হতে পারতেন। একমাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে এই তৎপরতা উনিশ শতকের প্রথম পর্বের মধ্যেই কিছুটা দেখা গিয়েছিল, কিন্তু তা—ও সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। তা না হলে নীলকুঠির ব্যবসায়ে কার—ট্যাগোর কোম্পানির প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করা কখনোই তিনি যুক্তিসংগত মনে করতেন না। কাজেই বাঙালিদের মধ্যে শিল্পোদ্যমের খানিকটা যে অভাব ছিল, এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই।

আমরা বাঙালি হিন্দুদের কথা বলছি, বাঙালি মুসলমানদের কথা নয়। তার কারণ বাঙালি মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষা ও শিল্প—বাণিজ্যের ব্যাপারে ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদের অনেক পরে উৎসাহী হয়েছিলেন। সম্পূর্ণ আঠারো শতক এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত শিক্ষাদীক্ষা ও ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঙালি হিন্দুরাই ছিলেন প্রধান ও অগ্রগণ্য। উনিশ শতকে অন্তত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যমের প্রকাশ কিছুটা পরিমাণে হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি এবং তা না—হওয়ার জন্য ব্রিটিশ নীতির যত গুরুত্বই থাক, বাঙালি হিন্দুদের নিজস্ব সমাজনীতির গুরুত্বও কম ছিল না। এইটাই আমাদের প্রতিপাদ্য।

যে—কোনও জাতির জাতীয় উন্নতি, বিশেষ করে আর্থিক জীবনের অগ্রগতির জন্য, সেই জাতির জনমানসে যে বেশ কিছুটা ব্যক্তিগত কৃতিত্বপ্রবণতা (achievement motive) থাকা দরকার, সমাজবিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক অনুসন্ধানের ফলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। সমাজের মধ্যে যদি ‘need for achievement’ (N- Ach বলা হয়েছে) বা কৃতিত্ব প্রদর্শনের প্রয়োজনবোধ রীতিমতো সজাগ না থাকে, তাহলে ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যমের অথবা কৃতকর্মা পুরুষের বিকাশ সেই সমাজে হয় না, এবং তা না হলে তার আর্থিক ক্রমোন্নতিতে নিশ্চিত ব্যাঘাত ঘটে। ম্যাকক্লেল্যান্ড বলেন :৫৪

“…a society with a generally high level of nAchievement will produce more energetic entrepreneurs who, in turn, produce more rapid economic development.”

অবশ্য বর্তমান শতকের গোড়াতেই ১৯০৪ সালে প্রখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স হেবার (Max Weber) বলেন যে আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগের হিসেবি যুক্তিবাদী উদযোগী দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ একটা ধর্মীয় মনোভাব থেকে উদ্ভূত। সেই ধর্মীয় মনোভাব হল Protestaintism—এর মনোভাব। আমেরিকা, ইংলন্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলিতে অনুসন্ধান করে ম্যাকক্লেল্যান্ড দেখেছেন যে বিভিন্ন দেশের প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যেই বেশির ভাগ শিল্পোদযোগী কৃতকর্মা ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে। ম্যাকক্লেল্যান্ডের আগে উইন্টারবটম প্রথমে (১৯৫৩ সালে) বিভিন্ন সমাজে মায়েদের শিশুপালনের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে কৃতিত্বপ্রবণতার সঙ্গে আর্থিক অগ্রগতির সম্পর্ক বিষয়ে ইঙ্গিত করেন। তিনি দেখেন যে যাঁরা জীবনে কৃতকর্মা পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, ছেলেবেলা থেকে তাঁদের মায়েরা সর্বাগ্রে তাঁদের সর্বক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হতে শিক্ষা দিয়েছেন। মায়েরা ছেলেদের বলেছেন :

“Know his way around the city

Be active and energetic

Try hard for things for himself

Wake his own friends

Do well in competition.”

 যে—ছেলেরা বাল্যকাল থেকে মায়েদের কাছে আত্মনির্ভরতার এই শিক্ষা পেয়েছে তাদেরই আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির বিকাশ হয়েছে এবং কর্মজীবনে তারাই হয়েছে কীর্তিমান পুরুষ। তাদের মধ্যেই সারাজীবন অত্যন্ত সজাগ কৃতিত্ববাসনা সক্রিয় থাকে দেখা যায়। কিন্তু যাঁদের মধ্যে এই বাসনা নিষ্ক্রিয় ও নির্জীব থাকে তাঁদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ছেলেবেলায় তাঁদের বাপ—মা অতিরিক্ত স্নেহের পক্ষপুটে তাঁদের লালনপালন করেছেন, কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে দেননি এবং স্বাধীনভাবে কোনও মতামত প্রকাশ করতে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পদে পদে বাধা দিয়েছেন।৫৫ অর্থাৎ আলালের ঘরের দুলালের মতো ছেলেবেলা থেকে তাঁরা প্রতিপালিত হয়েছেন। স্বভাবতই শৈশব উত্তীর্ণ হয়ে যখন তাঁরা যৌবনে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করেছেন, তখনও তাঁরা বাল্যকালের দুলালসুলভ পরনির্ভরতা ছাড়তে পারেননি। তাঁদের মধ্যে কৃতকর্মা উদযোগী পুরুষের বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়, সাধারণ কেরানি ও চাকুরিজীবীর বংশবৃদ্ধি হওয়াই সম্ভব। বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে অনেকটা তা—ই হয়েছে।

বাংলাদেশের মায়েরা অত্যধিক স্নেহকাতর ও কোমলস্বভাব। সন্তানদের প্রতি তাঁরা প্রায় স্নেহান্ধ বলা চলে। অধিকাংশ মায়েরাই তা—ই, যদিও বিদ্যাসাগরের মায়ের মতো দু—একটি ব্যতিক্রমও আছে। যেখানে ব্যতিক্রম, অর্থাৎ যেখানে কোমলতা ও কঠোরতার অদ্ভুত সমন্বয় ঘটে মাতৃচরিত্রে, সেখানে দেখা যায় বিদ্যাসাগরের মতো কৃতকর্মা সন্তানের আবির্ভাব হয়। কিন্তু সাধারণত দেখা যায়, বাঙালি পরিবারে বাবা—মা—র, বিশেষ করে মায়েদের স্নেহান্ধতার জন্য ছেলেদের ব্যক্তিত্ব ও পৌরুষের বিকাশ হয় না। অধিকাংশ বাঙালি যুবক একটা নিস্তেজ ও বিকলাঙ্গ ব্যক্তিত্ব নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে, কাজেই ‘কর্ম’ বলতে একটি কর্মই তাদের চোখের সামনে জ্যোতির কনকপদ্মের মতো ভেসে ওঠে, সেটি হল নিশ্চিন্ত দাসত্বকর্ম। আজও সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে কেরানিগিরি হল কর্মজীবনের সর্বাধিক কাম্য কর্ম, এবং তা—ও স্বদেশের, বিশেষ করে কলকাতা শহরের, গণ্ডির মধ্যে বাঞ্ছনীয়।

সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, সেই সমস্ত সমাজের দ্রুত আর্থনীতিক বিকাশ হয়েছে যেখানে সামাজিক শক্তির মূল নৈর্ব্যক্তিক ইনস্টিউশন—গত প্রথা—ঐতিহ্য থেকে আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কের ভিত্তিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ যে সমাজ যত বেশি ব্যক্তিমুখী এবং ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বীমুখী, পুরাতন সামাজিক প্রথা—ঐতিহ্যমুখী নয়, সেই সমাজ স্বভাবতই আন্তর্ব্যক্তিক কর্মপ্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে তত বেশি মানুষের কৃতিত্বপ্রবণতা জাগিয়ে তোলে। ঐতিহ্যমুখী সমাজকে অন্তর্মুখী (inner-directed) এবং ব্যক্তিমুখী সমাজকে বহির্মুখী বলা যায়। এই অনুসন্ধানের ফলাফল সম্বন্ধে ম্যাকক্লেল্যান্ড লিখেছেন :৫৬

‘The major proposition supported by these findings is that in societies which subsequently develop rapidly economically, the force which holds society together has shifted from tradition, particularly impersonal institutional tradition, to public opinion which helps define changing and functionally specific interpersonal relationship.৫৭

“…an other-directed society should be one in which ego is not motivated to interact by traditional institutional pressures but by pressures from others, particularly peers…”

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স হ্বেবার (Max Weber) ধর্মগত মনোভাবের সঙ্গে আর্থনীতিক মনোভাবের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে খ্রিস্টধর্মের মধ্যে প্রোটেস্ট্যান্টিজম ও তার বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা “helped to deliver the ‘spirit’ of modern capitalism, its specific ethos : the ethos of the modern bourgeois middle classes.”৫৮

প্রোটেস্ট্যান্টিজম ধর্মজীবনে ব্যক্তিগত কঠোরতা ও বিশুদ্ধতা এবং দেবতার সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করে জাগতিক জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতে সাহায্য করেছিল। এ বিষয়ে এরিখ ফ্রম (Erich Fromm) তাঁর The Fear of Freedom গ্রন্থে সুন্দর আলোচনা করেছেন। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের পার্থক্য সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন :

“In the Catholic Church the relationship of the individual to God had been based on membership in the Church. The Church was the link between him and God, thus on the one hand restricting his individuality, but on the other hand letting him face God as an integral part of a group. Protestantism made the individual face God alone… Psychologically this spiritual individulalism is not too different from the economic individualism. In both instances the individual is completely alone and in his isolation faces the superior power, be it of God, of competitors, or of impersonal economic force. The individualistic relationship to God was the psychological preparation for the individualistic character of man’s secular activites.”

ভারতীয় ধর্ম (হিন্দুধর্ম) সম্বন্ধে ম্যাক্স হ্বেবার বলেছেন যে—“Indian religiosity… is the cradle of those religious ethics which have abnegated the world, theoretically, practically, and to the greatest extent. It is also in India that the ‘technique’ which corresponds to such abnegation has been most highly developed.”৫৯ এই ধরনের আধ্যাত্মিক ধর্মভাবাপন্ন সমাজে ইহজাগতিক বুদ্ধির প্রাখর্য প্রত্যাশা করা যায় না। ম্যাক্স হ্বেবারের এই অভিমত প্রত্যক্ষ সামাজিক অনুসন্ধানলব্ধ তথ্যের দ্বারা যাচাই করে ম্যাক্লেল্যান্ডও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন—“that other-worldly religions like Hinduism and Buddhism stress values that would hardly be expected to lead parents to behave in ways that would induce high n Achievement in their sons.”৬০

যে দেশের প্রধান ধর্ম মানুষের মন পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও বৈষয়িক ভোগলালসার প্রতি বিমুখ করে তোলে, সে দেশ অর্থনীতিক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কৃতিত্বকামী উদ্যোগী পুরুষের সংখ্যা কম হওয়াই স্বাভাবিক। ভারতবর্ষে প্রধানত ব্রাহ্মণ্যধর্মবিরোধী বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে—যেমন জৈন, বৈষ্ণব, পারসি প্রভৃতি—শিল্পোদযোগী ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি দেখা যায়। তার কারণ এইসব ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ছোট ছোট প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মগোষ্ঠীর মনোভাবের সাদৃশ্য আছে।৬১  জাপানেও দেখা যায় উনিশ শতকে শিল্পোদযোগী ব্যবসায়ীশ্রেণির বিকাশ বৌদ্ধধর্মের একটি বিশেষ রূপের (Zen) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং ধর্মের ক্ষেত্রে Zen—ধর্ম ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যপন্থী, বাহ্য আচার—অনুষ্ঠানপন্থী নয়।৬২

বাংলাদেশে প্রচলিত আচারপ্রথাসর্বস্ব হিন্দুধর্মের প্রতিবাদে যে ব্রাহ্মধর্মের বিকাশ হয়েছিল, পাশ্চাত্য প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মান্দোলনের সঙ্গে অনেক দিক থেকে তার একটা আত্মিক সাদৃশ্য আছে দেখা যায়। ব্রাহ্মধর্মের বিদ্রোহ ছিল মূলত হিন্দুধর্মের বাহ্য অনুষ্ঠানবাহুল্য, পুরোহিতশাসন, পৌত্তলিকতা, অন্ধপ্রথানুগত্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে। অর্থাৎ ঠিক প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের মতো ব্রাহ্মধর্মেরও লক্ষ্য ছিল লোকচিত্তকে ধর্মের ক্ষেত্রে বহির্মুখী (objective) না করে অন্তর্মুখী (subjective) করা। ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে ধর্মের সঙ্গে বৈষয়িক জীবনের কোনও মৌল বিরোধ ছিল না, উভয়ের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সেতুবন্ধন বেশ দৃঢ় ছিল।৬৩ ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক রামমোহন রায়ের জীবনে এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো তাঁর প্রধান অনুগামীদের জীবনে ধর্ম ও বৈষয়িক চিন্তার অদ্ভুত সামঞ্জস্য দেখা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রাহ্মধর্মের উৎপত্তিকেন্দ্র বাংলা দেশে, অন্তত ব্রাহ্মধর্মপন্থীদের মধ্যে, অর্থনীতিক্ষেত্রে বেশ কিছু ‘achievement-oriented’ শিল্পোদযোগী ব্যক্তির বিকাশ হল না কেন, তা বাস্তবিক অনুধাবনযোগ্য। তা না—হবার একাধিক কারণ আছে বলে মনে হয়। প্রথম কারণ, হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মধর্মের অনুভূমিক বিস্তার ব্যাপক নয়, খুবই সীমাবদ্ধ। ব্রাহ্মধর্মের ethos বা মূলতত্ত্ব হিন্দুধর্মের ethos-এর স্থলাভিষিক্ত হওয়া তো দূরের কথা, তার গায়ে সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারেনি। কাজেই বাংলার হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মধর্মের আত্মিক প্রভাব খুব উপরের একটি সংকীর্ণ স্তর ছাড়িয়ে সমাজের গভীরে একেবারে প্রবেশ করতে পারেনি। রামমোহন রায় অথবা তাঁর অনুগামীরা কেউ Luther বা Calvin—এর মতো ব্যাপক ধর্মান্দোলনও গড়ে তুলতে পারেননি। ধর্ম ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রেই তাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অগ্রদূত হয়েও ব্রাহ্মধর্ম হিন্দুসমাজের সর্বস্তরে সেই মনোভাব সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হল, হিন্দুসমাজে নতুন প্রেরণা সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়ে ব্রাহ্মধর্মীরা ক্রমেই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে একটা sectarian মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। হিন্দুসমাজ চিরদিনই বিভিন্ন ধর্মীয় sect—এর প্রতি যেমন সহনশীল, তেমনই উদাসীন। সুতরাং পরবর্তীকালেও ব্রাহ্মধর্মের ethos হিন্দুসমাজে বিশেষ কোনও প্রেরণা সঞ্চার করতে পারেনি। তৃতীয় কারণ, রামমোহন—দ্বারকানাথের যুগে ব্রাহ্মধর্মের অনুযায়ী যাঁরা হয়েছিলেন তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন জমিদারশ্রেণিভুক্ত। প্রাচীন হিন্দুধর্মের ঐতিহ্যের প্রতি আসক্তি তাঁদের এত প্রবল ছিল যে রামমোহনের সান্নিধ্য অথবা ব্রহ্মোপাসনার ফলে তার মূল বিশেষ শিথিল হয়নি। হিন্দুসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে তাঁরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণে পুরো হিন্দুত্ব বজায় রেখে চলতেন। রামমোহনের পরে অন্তর্বিরোধের ফলে ব্রাহ্মধর্মান্দোলন ক্রমে আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উনিশ শতকের শেষ পর্বে হিন্দুধর্মের পুনরুভ্যুত্থানের আবর্তে সেই দৌর্বল্য কাটিয়ে ওঠাও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই কারণে ব্রাহ্মধর্মের “individualistic relationship to God” আমাদের সমাজে “individualistic character of man’s secular activities”—এর জন্য (Erich Fromm) উপযুক্ত মানসিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেনি। তাই ব্রাহ্মদের মধ্যেও, একমাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর ছাড়া, উনিশ শতকে আর কারও কর্মজীবনে শিল্পোদ্যমের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না।

ব্রাহ্মদের মতো ‘ইয়াং বেঙ্গল’—এর কথাও উল্লেখ করা যায়। ‘ইয়াং বেঙ্গল’ ধনিক বাঙালিদের মুতসুদ্দিগিরি ও বেনিয়ানিকর্মের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের পথে তাঁদের নির্ভয়ে অগ্রসর হতে বলেছেন অথচ তাঁদের নিজেদের মধ্যে কেউ, একমাত্র রামগোপাল ঘোষ ছাড়া, নিশ্চিন্ত চাকরি ভিন্ন স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্য পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় আসার পরে, উনিশ শতকের তৃতীয়—চতুর্থ দশকে, বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মধ্যে যখন খ্রিস্টধর্মের প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কয়েকজন খ্রিস্টধর্মের দীক্ষা নিতে থাকেন, তখন ‘প্রোটেস্ট্যান্ট’ স্বাতন্ত্র্যবাদের আদর্শ তাঁদের কারও জীবনে মানসক্ষেত্র ছাড়া অর্থনীতিক্ষেত্রে সঞ্চারিত হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত বিশেষ দেখা যায় না। অথচ বাঙালি খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট উভয় সম্প্রদায়ের প্রভাব প্রায় সমান। এক্ষেত্রেও দেখা যায়, হিন্দুসমাজের তথাকথিত অনুচ্চশ্রেণির মধ্যে তো বটেই, বহুকথিত উচ্চশ্রেণির মধ্যেও যাঁরা খ্রিস্টান হয়েছেন, তাঁরা অনেকেই পুরো খ্রিস্টান হতে পারেননি, ‘হিন্দু—খ্রিস্টান’ হয়েছেন। কাজেই খ্রিস্টধর্ম, এমনকী প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টধর্মও, প্রত্যক্ষভাবে হিন্দুসমাজে প্রবেশ করেও স্বাতন্ত্র্যের আদর্শে আর্থনীতিক কর্মজীবনে অনুপ্রাণিত করতে পারেনি।

বংশগত বৃত্তির সঙ্গে এবং পিতা—মাতার বৃত্তির সঙ্গে যে—কোনও ব্যক্তির কর্মজীবনের বাস্তব রূপের একটা সম্পর্ক আছে দেখা যায়। আমাদের দেশে এটা আরও বিশেষভাবে দেখা যায় তার কারণ কুলগত বৃত্তির বন্ধন আমাদের সমাজে যথেষ্ট দৃঢ়। ব্রিটিশ আমলে নানাবিধ শক্তির ঘাতপ্রতিঘাতে এই বন্ধন খানিকটা শিথিল হলেও একেবারে ভেঙে যায়নি। উত্তরপুরুষের মধ্যে বাল্যকাল থেকেই যে বংশগত বৃত্তির একটা প্রবণতা সঞ্চারিত হয় তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কর্মকার স্বর্ণকার তন্তুবায় বণিক প্রভৃতির কুলবৃত্তি তাঁদের বংশধরদের স্বভাবতই কুলবৃত্তিমুখী করে তোলে। সাধারণভাবে ভারতীয় সমাজে এই কুলবৃত্তিপ্রবণতা আজও সমাজের বিভিন্ন স্তরে বেশ সজাগ রয়েছে দেখা যায়। সমাজবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কিছু প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের কাজও করেছেন। ফ্রেজার (T. M. Fraser) পশ্চিম উড়িষ্যার কয়েকটি গ্রামে এ বিষয়ে বিশেষ অনুসন্ধান করে দেখেছেন যে তেলি জাতির (ফ্রেজারের মতে “the only real ‘entrepreneurial’ caste in this section of rural India”) বংশধরদের মধ্যে achievement—বোধ অনেক বেশি জাগ্রত, বংশানুক্রমিক কৃষিজীবীদের তুলনায়। ফ্রেজারের এই অনুসন্ধানের ফলাফল সম্বন্ধে আলোচনা করে ম্যাকক্লেল্যান্ড মন্তব্য করেছেন :৬৪

“One would have to predict on the basis of our theory, that fathers engaged in the produciton and sale of commodities would have higher n Achievement than those engaged exclusively in traditional agriculture. And the fact that their children have higher n Achievement tends to confirm the prediction that the parents do and also the inference that the parents have managed to bring up their children in a way to give them the same higher level of n Achievement that they have.”

বাংলাদেশেও সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করলে প্রায় অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে হয়। উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসক ও বণিকদের প্রধান অর্থনীতিক কর্মক্ষেত্র ছিল বাংলা দেশ এবং সকল জাতিবর্ণের বাঙালিরা (প্রধানত হিন্দু) নতুন কর্মবৈচিত্র্যের সুযোগ গ্রহণ করে যথেষ্ট লাভবানও হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ—কায়স্থ—বৈদ্য থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য বর্ণের বাঙালি হিন্দুরা, বেশ খানিকটা কুলবৃত্তির বন্ধন আলগা করে, সর্বতোভাবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিশেষ কুণ্ঠিত হননি। এদিক থেকে সামাজিক গতিশীলতা (social mobility) কিছুটা যে বাংলাদেশে কলকাতার নাগরিক সমাজে অন্তত সঞ্চারিত হয়েছিল তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে সামাজিক জীবনের এই সাময়িক উত্তেজনা ও কর্মচাঞ্চল্য কিছুটা থিতিয়ে আসার পর পেশা বা বৃত্তি ক্রমেই কুলানুগামী হয়ে উঠছে। বিভিন্ন বর্ণস্তর থেকে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার গুণে যাঁরা সামাজিক সোপান অতিক্রম করে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করেছিলেন, তাঁদের বংশধরদের মধ্যে অবশ্য কেউ কেউ পুরাতন কুলবৃত্তি গ্রহণ করেননি, সামাজিক মর্যাদাহানি হবে মনে করে, কিন্তু সমাজের সাধারণ কর্মজীবনের ঝোঁক যে পুরাতন বংশানুক্রমিক বৃত্তিমুখী হয়েছে তা—ও বোঝা যায়। যেমন হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণের গণ্ডির বাইরে যাঁরা ব্রিটিশ আমলে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে নতুন সামাজিক মর্যাদা (social status) লাভ করেছেন, তাঁরা তাঁদের বংশধরদের মানসিক গতি ছেলেবেলা থেকে চাকরি বা শিক্ষাভিমুখী করে তুলেছেন। উনিশ শতকের উচ্চশিক্ষিত বাঙালির পারিবারিক ইতিহাস থেকে তার পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। ইংরেজ আমলে এইভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে জাতিবর্ণ নির্বিশেষে একটা নতুন কুলবৃত্তির প্রচলন হয়েছে দেখা যায়। কাজেই নতুন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণি তাঁদের বংশধরদের মধ্যে ‘n Achievement’—বোধ জাগিয়ে তোলেন বটে, কিন্তু সেই বোধ প্রধানত service-education-oriented হয়ে থিতিয়ে যায়।

উনিশ শতকের প্রতিষ্ঠিত বাঙালিদের পারিবারিক ইতিহাস অনুশীলন করলে আরও একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। ব্রাহ্মণ—কায়স্থ—বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে আঠারো ও উনিশ শতকে যাঁরা ব্যাবসাবাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন, তাঁদের বংশধররা পরবর্তীকালে পূর্বপুরুষের বাণিজ্যবৃত্তির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ক্রমে চাকরি ও শিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছেন। ব্রাহ্মণ—কায়স্থ—বৈদ্যের ছেলেদের লেখাপড়া না শিখলে যে কোনও উপায় নেই এ কথা প্রায় প্রত্যেক উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু পরিবারের মা—পিসিমা—ঠাকুমাদের মুখ থেকে শোনা যায়। রামদুলাল দে (সরকার), মদন দত্ত প্রমুখ বিখ্যাত ব্যবসায়ীদের পারিবারিক ইতিহাস তার সাক্ষী।৬৫ পরিষ্কার বোঝা যায়, উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে ঘটনাচক্রে কেউ উদযোগী ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও, তাঁদের বংশধররা ক্রমে ব্যাবসাবাণিজ্যকে তাঁদের কুলমর্যাদার উপযোগী বৃত্তি বলে মনে করেননি।

পশ্চিম উড়িষ্যার তেলিজাতির মধ্যে ফ্রেজার ও ম্যাকক্লেল্যান্ড যে বংশগত বাণিজ্যপ্রবাহ লক্ষ করেছেন, বাংলা দেশে বিভিন্ন বণিকজাতির মধ্যেও তা—ই লক্ষ করা যায়। সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তাম্বূলীবণিক, তন্তুবণিক প্রভৃতি বিভিন্ন বাঙালি বণিকজাতির মধ্যে বংশগত বাণিজ্যপ্রবণতা বেশ প্রবল। বাংলা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে ভৌগোলিক পশ্চিমবঙ্গে—বর্ধমান বাঁকুড়া মেদিনীপুর হাওড়া হুগলি চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি জেলায় দেখা যায়, ব্যাবসাবাণিজ্যক্ষেত্রে বিভিন্ন বাঙালি বণিকজাতির আধিপত্য অন্যান্য জাতিবর্ণের তুলনায় অনেক বেশি।৬৬ এমনকী কলকাতা শহরেও দেখা যায় যে শেঠ বসাক রক্ষিত লাহা পাল দত্ত মল্লিক দাঁ কুণ্ডু সাহা প্রভৃতি বিভিন্ন বণিকজাতির মধ্যে শুধু ব্যাবসাবাণিজ্য (trade and commerce) নয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যম পর্যন্ত অনেকাংশে সীমাবদ্ধ। ৬৭ এইসব বণিক—পরিবারের বংশধরদের মধ্যে ম্যাকক্লেল্যান্ড বর্ণিত ‘n Achievement’ অনেক বেশি সজাগ। বাঙালি ব্রাহ্মণ—কায়স্থ—বৈদ্য পরিবারের বংশধরদের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর বা রামদুলাল দে—র বংশধরদের মধ্যে দেখা যায় যে দ্বারকানাথের শিল্পোদ্যম অথবা রামদুলালের বাণিজ্যস্পৃহা তেমনভাবে সঞ্চারিত হয়নি। কিন্তু বাঙালি বণিক বংশের মধ্যে যদিও তা সঞ্চারিত হয়েছে, তাহলেও তাঁদের পুরুষানুক্রমিক রক্ষণশীল, অতিসাবধানি অনুদার ঐতিহ্যাবদ্ধ মনোভাব যেহেতু আধুনিক শিল্পযুগের উপযোগী নয়, সেইহেতু বাংলাদেশে প্রকৃত ধনতান্ত্রিক শিল্পোদযোগী বিচিত্রকীর্তি পুরুষের আবির্ভাব তাঁদের মধ্যেও হয়নি।

নির্দেশিকা

প্রথমে পৃষ্ঠাসংখ্যা, পরে বন্ধনীর মধ্যে সূচকসংখ্যা

 (১)  সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ১ম, পৃষ্ঠা ৯১

 (২) ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় : সংবাদপত্রে সেকালের কথা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ১৯৩২

 (৩) G. M. trevelyan : English Social History, London, May 1948, pp. 478-81

 (৪) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, প্রাসঙ্গিক তথ্য, পৃষ্ঠা ৮৯২—৯৩

 (৫) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, পৃষ্ঠা ৬৮—৬৯

 (৬) Michel Kidron : Foreign Investments in India, London 1965, p 14

 (৭) D. R. Gadgil : Industrial Evolution of India, London 4th ed. Reprint 1946 pp. 48-62, 76-80P.P Pillai : Economic Conditions in India, Econimic Journal, 1925pp. 9-14Vera Anstey : The Economic Development of India; Longmans, 1923D. H. Buchanan : The Development of Capitalistic Enterprise in India, N.Y. 1934

 (৮) Lovat Fraser : Iron and Steel in India, Bombay 1919, p. 6

 (৯) Fraser : op. cit. pp. 11-12Frank Harris : Life of Jamsedji Tata, Blackie, 1958 pp. 151-52

(১০) D. R. Gadgil : op. cit. pp. 270-279

 (১১) D. R. Gadgil : op. cit. p. 271.

 (১২) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ৪র্থ, পৃষ্ঠা ১৫৫

 (১৩) “…the first published reference to the mining of coal dates back to the year 1774 when shallow mines are reported to have been developed in the Raniganj field.”–Report of the Indian Coalfields’ Committee, 1947, I.P. 19

 (১৪) Report of the Indian Coalfield’s Committee, 1946 I.P. 19

 (১৫) op. cit. Ch. III

 (১৬) The Hindu Patriot, 16 April, 1857

 (১৭) ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় : সংবাদপত্রে সেকালের কথা ২য়, পৃষ্ঠা ৩৫৭

 (১৮) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১৮৪৮ শক, কার্তিক—অগ্রহায়ণ—’দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিষয়সম্পত্তি’ সম্বন্ধে সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর আলোচনা। Kissory Chandra Mitra : Memoir of Dwarkanath Tagore (Originally read at the 27th Hare Anniversary Meeting Held at the Town Hall on the 1st June 1870) Calcutta 1870
 The Calcutta Gazette, 15 January 1848 The Bengal Hurkaru, 5 April 1848 : কার—ট্যাগোর কোম্পানির পাওনাদারদের সভার বিবরণ আছে।

 (১৯) Board of Revenue of Sadar, Misc. Proceedings 1839, No. 210

 (২০) দ্বারকানাথ ঠাকুর ও ‘কার—ট্যাগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ সম্বন্ধে পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক উপকরণ Board of Revenue Proceedings, 1821-50 এবং Board of Custom, Salt and Opium Proceedings, 1821-34—এর মধ্যে পাওয়া যায়। উনিশ শতকের ব্যাঙ্কিং—এর আদিপর্বের ইতিহাসে, বিশেষ করে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ইতিহাসে অনেক উপকরণ আছে। 

 (২১) Girish Chunder Ghose : Ramdoolal Dey the Bengalee Millionaire– A lecture delivered at the hall of the Hoogly College on 14 March 1868. রামদুলাল সম্বন্ধে অধিকাংশ বৃত্তান্ত ও তথ্য এই রচনা থেকে গৃহীত।Lokenath Ghose : The Modern History of Indian Chiefs etc. Part II, The Native Aristocracy and Gentry, Calcutta, 1881

 (২২) সমাচার দর্পণ, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২০ব্রজেন্দ্রনাথ : সংবাদপত্রে সেকালের কথা ১ম, পৃষ্ঠা ২৬৯।

 (২৩) সমাচার দর্পণ, ১৪ মে ১৮২৫সংবাদপত্রে সেকালের কথা ১ম, পৃষ্ঠা ২৯৭

 (২৪) সমাচার দর্পণ, ২০ অক্টোবর ১৮৩৮সংবাদপত্রে সেকালের কথা ২য়, পৃষ্ঠা ৫৪৩

 (২৫) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, পৃষ্ঠা ৯২—৯৩

 (২৬) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, পৃষ্ঠা ৬৭—৭০

 (২৭) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, পৃষ্ঠা ৯৭

 (২৮) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, পৃষ্ঠা ১৩৩

 (২৯) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, পৃষ্ঠা ৪০৮—৯

 (৩০) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য়, পৃষ্ঠা ১৮২

 (৩১) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য়, পৃষ্ঠা ২৪৮

 (৩২) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৩য়, পৃষ্ঠা ২৭৫—৭৬

 (৩৩) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ৯৩—৯৪

 (৩৪) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ১৫৪—১৫৮

 (৩৫) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ১৩০—৩৪

 (৩৬) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ১৪১—৪৩

 (৩৭) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ১৫৬—৬০

 (৩৮) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ৮০৭—৮

 (৩৯) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ৮০৮—১০

 (৪০) Gunnar Myrdal : Economic Theory Underdeveloped Regions, London 1959, pp. 57-60

 (৪১) Douglas Hall : Ideas and Illustration in Economic History, U.S.A. 1964 : p.15

 (৪২) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ১২০—২২

 (৪৩) The Proceedings and Transactions of the Bethune Society, November 1859 to April 1869, Calcutta 1870

 (৪৪) A. Mitra ed : Census of India 1951, Vol. V, West Bengal etc. Part–1-A-Report, p. 152

 (৪৫) Vol. V, West Bengal etc. Part–1-A-Report, p. 152

 (৪৬) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ১৮০—৮৯

 (৪৭) Report of the Land Revenue Commission of Bengal, Vol. I, pp. 35-39সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর : বোম্বাই চিত্র, কলকাতা ১২৯৫, পৃষ্ঠা ৪৪৭—৪৮

 (৪৮) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ৩১৮—২২

 (৪৯) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, পৃষ্ঠা ৩৪৮—৪৯

 (৫০) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য়, পৃষ্ঠা ৩৭৫—৭৭

 (৫১) The Hindu sea-Voyage Movement in Bengal : Published by the Standing Committee on the Hindu-Sea-Voyage Question, Cacutta 1894

 (৫২) দুর্গাচরণ রক্ষিত : কুশদ্বীপ কাহিনী, ১৩০৮বিনয় ঘোষ : পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি

 (৫৩) J. A. Schumpeter : The Theory of Economic Development, Harvard 1934

 (৫৪) David C. McClelland : The Achieving Society (Princeton 1961), Chapter 6, p. 205

 (৫৫) MClelland : op. cit. p. 46

 (৫৬) MClelland : op. cit. p. 198

 (৫৭) Max Weber : “The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism’From Max Weber, Essay in Sociology, London 1947, p. 321

 (৫৮) Erich Fromm : The Fear of Freedom, London 1955, pp. 93-94

 (৫৯) Max Weber : op. cit. p. 323

 (৬০) McClelland : op. cit. p. 357

 (৬১) H.B. Lamb : The Indian Merchant’ in Journal of American Folklore, 1958 McClelland : op. cit. p. 364

 (৬২) D.T. Suzuki : Zen and Japanese Culture, New York 1959McClelland : op. cit. pp. 380-381

 (৬৩) বিনয় ঘোষ : সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য় সম্পাদকীয়, পৃষ্ঠা ২৭—৩০

 (৬৪) McClelland : op. cit. pp. 380-81 (T. M. Fraser; ‘Achievement Motivation as a factor in rural development : A report on research in Western Orissa’– Unpublished paper, Haverford College 1961)

 (৬৫) Lokenath Ghosh : op. cit

 (৬৬) বিনয় ঘোষ : পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি

 (৬৭) দুর্গাচরণ রক্ষিত : কুশদ্বীপ কাহিনী, কলকাতা ১৩০৮ ব.

 মদনমোহন হালদারস্য : বসুক অর্থাৎ বসাকাদি উপাধিবিশিষ্ট জাতির পরিচয়, কলকাতা ১৮৯৫

 নগেন্দ্রনাথ শেঠ : কলিকাতাস্থ তন্তুবণিক জাতির ইতিহাস কলকাতা, অজিতকুমার বসাক, ১৯৫০

 নগেন্দ্রনাথ বসু : বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, কলিকাতা, বিশ্বকোষ, ১৯০০—১১

 নগেন্দ্রনাথ বসু : বিশ্বকোষ

 পণ্ডিত শিবেন্দ্রনারায়ণ শাস্ত্রী : বাঙ্গালার পারিবারিক ইতিহাস, কলিকাতা ১৯৩৪—৪০

 নরেন্দ্রনাথ লাহা : সুবর্ণবণিক কথা ও কীর্তি, তিন খণ্ড, ১৯৪০—৪২

 পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জেলায়—বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ—বহু প্রাচীন ‘বণিক’ পরিবারের (তাম্বূলিবণিক, গন্ধবণিক প্রভৃতি) বাস আছে। তাঁদের পারিবারিক ইতিহাস থেকে এ বিষয়ে আলোকপাত করার মতো অনেক তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। বাংলার আর্থনীতিক ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ আলোচনার জন্য সরেজমিনে এই ইতিহাস সংগ্রহ করা একান্ত আবশ্যক।—লেখক

* ১৮৫৫ সালে জর্জ অ্যাকল্যাণ্ড বাঙালি ব্যবসায়ি বৈশ্বম্ভর সেন—এর সহযোগিতায় হুগলি জেলার রিষড়ায় প্রথম জুটমিল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৮ সালে মিল আগুনে পুড়ে যায়।

* ১৭৭৪ সালে রানিগঞ্জে কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮২০ সালে আলেকজান্ডার অ্যাণ্ড কোম্পানির তত্ত্বাবধানে খননকার্য শুরু হয়।

* কলকাতা শহরের একাধিক প্রাচীন বাঙালি ধনিক পরিবারের বর্তমান বংশধরদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি, পূর্বপুরুষদের কীর্তিকথা তাঁরা সবিস্তারে না জানলেও, ১৫০/২০০ বছর আগেকার বংশমর্যাদাবোধ আজও তাঁরা ছাড়তে পারেননি। এঁরা অধিকাংশ চাকরি ও ব্যাবসাবাণিজ্য করতে অনিচ্ছুক, কারণ তাতে বংশমর্যাদার হানি হবে এই তাঁদের ধারণা। বাড়িভাড়া এঁদের অন্যতম আয়—লেখক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *