বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা ১৮০০-১৯০০
‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ গ্রন্থমালার শেষ (সমাপ্ত) খণ্ড – বিনয় ঘোষ
প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ১৯৬৮
পরিমার্জিত সংস্করণ প্রসঙ্গে প্রকাশকের কথা
‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা’—র প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ১৯৬৮—তে গ্রন্থকার কর্তৃক ৪৭/৩ যাদবপুর সেন্ট্রাল রোড কলিকাতা—৩২ থেকে প্রকাশিত হয়। ঐ বইটিতে লেখা হয়েছিল—’ভারত সরকারের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্তর্গত আঞ্চলিক ভাষা উন্নয়ন উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আনুকুল্যে প্রাপ্ত আর্থিক সাহায্যের জন্য এই গ্রন্থের সুলভ মূল্য সম্ভব হয়েছে।’ বইয়ের দাম ধার্য হয়েছিল সতেরো টাকা। পরবর্তীকালে বইটি পৃথকভাবে আর ছাপা হয়নি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন প্রকাশ ভবন।
নতুন করে প্রকাশ করার সময় আমাদের অবলম্বন করতে হয়েছে পূর্ব প্রকাশের মুদ্রণ। কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ লক্ষ করা যায়। সে-সব সাধ্যমতো সংশোধন করা হয়েছে। এবং লেখক ও তাঁর লেখাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে আমরা যত্ন নিয়েছি ছাপা ও সামগ্রিক প্রকাশনার বিষয়ে। নির্ঘণ্ট প্রস্তুত করেছেন শ্রী সত্যব্রত ঘোষাল। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
গ্রন্থপ্রসঙ্গে
‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ গ্রন্থমালার পরিকল্পনা করা হয় ১৯৫৯ সালে। প্রথম সংগ্রহের কাজ আরম্ভ হয় ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা নিয়ে, এবং প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ১৯৬২ সালে। তারপর ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ ‘সম্বাদ ভাস্কর’ ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ ‘বিদ্যাদর্শন’ ‘সর্বশুভকরী পত্রিকা’ ‘সোমপ্রকাশ’ প্রভৃতি দুষ্প্রাপ্য পত্রিকার সংকলন দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। বহু গ্রন্থাগার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পত্রিকাগুলি সন্ধান করে, তার ভিতর থেকে উপকরণ—নির্বাচন করে, কপি করে, সম্পাদনা করে এক—একটি খণ্ডের কাজ শেষ করতে অনেক সময় লেগেছে। প্রায় দশ বছর লাগল কাজটি শেষ করতে। আত্মজীবনী, জীবনস্মৃতি, চরিতকথা, বংশবৃত্তান্ত ও পারিবারিক বৃত্তান্ত প্রভৃতি সামাজিক ইতিহাসের উপাদান আমাদের দেশে অত্যল্প বলে পুরাতন সাময়িকপত্রের এই উপাদানের মূল্য ও গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।
‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা’ (১৮০০—১৯০০) এই গ্রন্থমালার শেষ (সমাপ্ত) বা উপসংহার—খণ্ড। এখানে উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাসের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, প্রধানত সমাজতাত্ত্বিক (Sociological) দৃষ্টিতে। পূর্বের চার খণ্ডের ‘সম্পাদকীয়’ প্রবন্ধে ও ‘প্রাসঙ্গিক তথ্যে’ উনিশ শতকের বাংলার বিভিন্ন দিক নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। আমার লেখা ‘বাংলার নবজাগৃতি’ ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ (তিন খণ্ড) ‘বিদ্রোহী ডিরোজিও’ ‘কলকাতা কালচার’ প্রভৃতি গ্রন্থেও উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিবৃত্ত আলোচিত হয়েছে। কাজেই বর্তমান গ্রন্থে তার পুনরাবৃত্তি করিনি, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টি দিয়ে বাঙালি সমাজের পরিবর্তনের মৌল ধারা ও প্রকৃতি বিচারের প্রয়াস পেয়েছি। দুঃসাহসিক প্রয়াস সন্দেহ নেই, কিন্তু ইতিহাসের গতিধারা বিশ্লেষণে অন্তত কিছুটা দুঃসাহসিক না হলে হয়ত নতুন চিন্তা ও দিঙ্নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
বিনয় ঘোষ
নিবেদন
পৃথক Bibliogrphy অনাবশ্যকবোধে দেওয়া হল না, কারণ প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে বিস্তৃত ‘নির্দেশিকা’ দেওয়া হয়েছে।
গ্রন্থে সন্নিবেশিত চিত্রাবলি সংগ্রহ করেছি বিভিন্ন পুরাতন চিত্রসংকলন থেকে। যেমন :
B. Solvyns : A Collection of Two Hundred and Fifty Coloured Etchings, Descriptive of the Manners, Customs and Dresses of the Hindoos : Calcutta 1799
Charles Doyley : The European in India, London 1813.
Colesworthy Grant : Rural Life in Bengal, London 1860
বসন্তক ১২৭৯—৮০ : বাংলা ব্যঙ্গপত্র। প্রাণনাথ দত্ত সম্পাদিত।
শ্রীরাধাপ্রসাদ গুপ্ত W. Taylor অঙ্কিত দুষ্প্রাপ্য চিত্রটি (পৃষ্ঠা ১৬) তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে দিয়েছেন। এজন্য তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। গ্রন্থে মুদ্রিত চিত্রটি আসল চিত্রের অংশবিশেষ। মূল চিত্রটি কলকাতার লাটভবনে হার্ডিঞ্জের আমলে শিখ যুদ্ধে বিজয়োৎসবের চিত্র।
বিনয় ঘোষ
১. গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তনের গতি
পরিবর্তনের স্রোত যত দ্রুত নাগরিক সমাজে প্রবাহিত হয়, গ্রাম্য সমাজে তা হয় না। নাগরিক সমাজ গতিশীল জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতে, দ্বন্দ্ব—বিরোধের শব্দ—প্রতিশব্দে মুখর, কিন্তু গ্রাম্য সমাজ গ্রাম্য রাত্রির মতো স্থির শান্ত ও অচঞ্চল। ভারতের ও বাংলা দেশের গ্রাম্য সমাজের এই শান্ত—স্থির অচঞ্চলতা শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্ষুণ্ণ ছিল। হিন্দু যুগে ও মুসলমান যুগে রাজনৈতিক তরঙ্গের আঘাতে অথবা রাষ্ট্রিক বিপর্যয়ের ঝড়ঝঞ্ঝায় এই গ্রাম্য সমাজের শান্তিভঙ্গ হয়নি, অথবা তার একটানা সুস্থির প্রবাহে কোনও তীরভাঙা নতুন স্রোত সঞ্চারিত হয়নি। গ্রামের কৃষক কারিগর ব্রাহ্মণ—বৈদ্য—কায়স্থ ও অন্যান্য বর্ণের লোকেরা বংশপরম্পরায় কৌলিকবৃত্তি পালন করত, কদাচ তার ব্যতিক্রম ঘটত না। খাদ্য উৎপাদন অথবা ব্যবহার্য দ্রব্য উৎপাদনের সঙ্গে যাঁদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকত না—যেমন ব্রাহ্মণ—বৈদ্য—কায়স্থদের—তাঁরা নানাবিধ সমাজকর্মের জন্য গ্রাম্য সমাজে উৎপন্ন খাদ্য ও দ্রব্যের প্রয়োজনীয় ভাগ পেতেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গ্রাম্য মানুষদের জীবন কয়েকটি নির্দিষ্ট ছন্দে ও সুরে বাঁধা থাকত। এই ছন্দ ও সুর হল ‘কাস্টম’ বা সামাজিক প্রথা ও ‘ট্র্যাডিশন’ বা ঐতিহ্য, পুরুষানুক্রমিক ধারা। প্রথা ও ঐতিহ্যের শৃঙ্খলে গ্রাম্য সমাজের অর্থনীতি—সমাজনীতি—রাষ্ট্রনীতি এমনভাবে বাঁধা থাকত যে হঠাৎ কোনও পরিবর্তনের ঢেউ সজোরে আঘাত করলেও সেই বন্ধন সহজে ছিন্ন হত না। প্রথা ও ঐতিহ্যের তটে দৃঢ়—নোঙরিত জীবনতরি হয়তো গ্রাম্য সমাজের মৃদু তরঙ্গে সামান্য একটু দোলায়িত হত, কিন্তু নোঙর ছিঁড়ে সমাজের বুকে দিশাহারা হত না। জীবন ও সমাজের ভিত হল অর্থনীতি। সেই আর্থব্যবস্থায় কোনও ভাঙন ও পরিবর্তন ঘটলে সমাজজীবনের অন্যান্য স্তরেও আবর্তের সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে নতুন স্রোতও সঞ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু গ্রাম্য সমাজে এই পরিবর্তন দ্রুত হয় না, অত্যন্ত ধীরে ধীরে হয় এবং তার মন্থরগতিও কালিক ও দৈশিক বিশেষ অবস্থার উপর অনেকটা নির্ভর করে।
সেকালের গ্রাম্য সমাজের সামাজিক শ্রেণি রূপও ছিল পিরামিডের মতো অচল স্তরবদ্ধ। সবার উপরে দেশের রাজা। রাজা ও প্রজার মধ্যে দূরত্ব এত বেশি ছিল যে কেউ কাউকে চোখের দেখাও দেখতে পেত না। বহু দূর দিগন্তের ওপারে, প্রজাদের কল্পনার এক বিচিত্র আলোকরাজ্যে, অদৃশ্য দেবতার মতো, রাজা তাঁর মণিমুক্তার সিংহাসনে বসে থাকতেন, রক্ষীবেষ্টিত বিশাল গড়বন্দি রাজপ্রাসাদে। প্রজারা থাকত ছোট ছোট নিস্তব্ধ নিঝুম গ্রামে, খড়পাতার কুটিরে। তারা হাল চষত, মাছ ধরত, জাল বুনত, লোহা পিটত, তাঁত বুনত, যাজন—ভজন করত, গ্রাম্য মেলায় উৎসব—পার্বণে আনন্দ করত, রাজার সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময়ও হত না। দেশের রাজার প্রতিনিধিরূপে গ্রাম্য সমাজসমষ্টির শীর্ষস্থানে যিনি বিরাজ করতেন, তিনি স্থানীয় রাজা ও জমিদার। গ্রাম্যের প্রজাদের থেকে তিনিও অনেক দূরে বাস করতেন এবং দেশের রাজার মতো প্রহরীবেষ্টিত গড়বন্দি রাজপ্রাসাদে। এই স্থানীয় রাজা—জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে দূরত্ব যথেষ্ট ছিল, কিন্তু একেবারে দিগন্তপারের অদৃশ্য দূরত্ব নয়। মধ্যে মধ্যে খাজনার দায়ে, অথবা রাজবাড়ির কোনও মহোৎসবে স্থানীয় রাজা—প্রজার মধ্যে ‘দৈশিক—অপরত্ব’ বা ‘নিকটত্ব’—যোগ ঘটত, হয়তো দৃষ্টিরও বিনিময় হত—রাজা—জমিদারের মহামানবসুলভ উদার—উদাস দৃষ্টির সঙ্গে প্রজার ভয়বিহ্বল নিরীহ ভক্তসুলভ দৃষ্টির বিনিময়। কানুনগো—পাটোয়ারি, নায়েব—গোমস্তা, সেপাই—বরকন্দাজ প্রভৃতি জমিদারের রাজস্ব—আদায়কারী কর্মচারী প্রজাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন করতেন। কিন্তু এঁদের ঠিক গ্রাম্য সমাজের মধ্যশ্রেণিভুক্ত করা যায় না। বিত্তের দিক থেকে, অথবা প্রতিপত্তির দিক থেকে গ্রাম্য সমাজে আগেকার কালে মধ্যশ্রেণি একটা ছিল, কিন্তু তাদের শ্রেণিগত প্রভাব সমাজে তেমন ছিল না। সংগতিপন্ন খোদকস্ত কৃষকরা ও কারিগররা বিত্তের দিক থেকে মধ্য—শ্রেণিভুক্ত হলেও, সামাজিক প্রভাব ছিল তাদের চিরন্তন প্রথানুগত, বিত্তগত নয়। আসলে গ্রাম্য সমাজের প্রভাব—প্রতিপত্তি বিত্তনির্ভর ছিল না, কুলবৃত্তিগত ছিল। ব্রাহ্মণ তাঁর কুলবৃত্তির জন্যই গ্রাম্য সমাজে অখণ্ড প্রতিপত্তিশালী ছিলেন, বিত্তের জন্য নয়। বিত্তহীন দরিদ্র ব্রাহ্মণের সামাজিক প্রভাব বিত্তবান বণিক—কারিগর ও কৃষকের চেয়ে শতগুণ বেশি ছিল গ্রাম্য সমাজে। কাজেই বিত্তের দিক থেকে মধ্যশ্রেণি সেকালের গ্রাম্য সমাজে থাকলেও, যেহেতু সমাজে প্রথানুগ কৌলিক প্রভাব ছাড়া আর্থপ্রভাব কার্যকর ছিল না, সেইজন্য আধুনিক অর্থে মধ্যবিত্তশ্রেণি সেকালের গ্রাম্য সমাজে ছিল এমন কথা বলা যায় না। গ্রাম্য সমাজের অচল পিরামিডের ভিত্তিভূমি শতকরা নব্বুইজন স্বল্পবিত্ত দরিদ্র কৃষক নিয়ে গঠিত ছিল। বাকি দশজন বা পনেরোজনের মধ্যে জমিদারদের আমলাবর্গ ছাড়া রাজকর্মচারীরা ছিলেন, কারুশিল্পীরা ছিলেন, অবস্থাপন্ন কৃষকরা ছিলেন এবং ব্রাহ্মণ প্রভৃতি বিভিন্ন কুলবৃত্তিজীবীরা ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে গ্রাম্য সমাজের এই নিরেট পিরামিডের মূলে আঘাত লেগেছিল—রাজস্ববৃদ্ধির নানা রকমের পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা করার ফলে। গ্রাম্য সমাজের শ্রেণিগত রূপের খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, পিরামিডটা একটু টলে উঠেছিল, কিন্তু সেটা ধূলিসাৎ হয়ে যায়নি অথবা গ্রাম্য সমাজের কোনও মৌল রূপান্তর হয়নি। অথচ গ্রামসমাজজীবনে বিত্তপ্রাধান্যের জন্য পরস্পরবিরোধী অনেক স্রোত সঞ্চারিত হয়েছিল, এবং তার ফলে ঘূর্ণাবর্তেরও সৃষ্টি হয়েছিল অনেক। সাধারণ গ্রাম্য মানুষের জীবন পুরাতন ও নতুন স্রোতের টানাটানির মধ্যে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
জমিদারশ্রেণির রূপান্তর
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলা দেশে একশ্রেণির নতুন জমিদার সৃষ্টি করে তাঁদের ভূসম্পত্তিতে চিরস্থায়ী স্বত্ব স্বীকার করে নেয়। ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তিত হবার আগে এ দেশের বনেদি জমিদাররা বাস্তবিক ভূসম্পত্তির কোনও বংশানুক্রমিক স্বত্ব ভোগ করতেন কি না, এবং যদি না করে থাকেন তাহলে তাঁদের সামাজিক আর্থনীতিক সঠিক ভূমিকা বা রূপ কী ছিল, তা—ই নিয়ে ইংরেজ পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়। হেস্টিংস, গ্রান্ট, শোর, কোলব্রুক, হ্যারিংটন, ফিলিপ ফ্রান্সিস এবং আরও অনেকে এই আলোচনায় যোগদান করেন। ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা যখন বাংলা—বিহার—উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন, তখন থেকে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন পর্যন্ত, প্রায় ২৮ বছর ধরে, শুধু আলোচনা নয়, রাজস্ব—সংগ্রহের নানারকম কৌশলের ভিতর দিয়ে এ দেশের জমিদারদের সামাজিক রূপ বিদেশি শাসকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক বা প্রথানুগ রূপ যতটা নয়, জমিদার সম্বন্ধে তাঁদের নিজস্ব ধারণাগত রূপই তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁদের কাছে বাস্তব সত্যরূপে প্রতিভাত হতে থাকে। এই ধারণাগত রূপ অবশ্য ইংরেজদের প্রশাসনিক স্বার্থগত রূপ।
জমিদারদের রূপ বা সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে হ্যারিংটন বলেছেন :১ ”এ দেশের জমিদাররা এমন একশ্রেণির জীব যাঁদের এককথায় আমাদের ইংরেজি ভাষায় কোনও পরিচয় দেওয়া যায় না। রাষ্ট্রের পক্ষে রায়ত ও জমির উপস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে আঞ্চলিক রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করেন জমিদার। জমিদারির উত্তরাধিকার তিনি লাভ করেন বটে, কিন্তু নতুন করে দেশের সম্রাটের কাছ থেকে তার জন্য সনদ নিতে হয় এবং সম্রাটকে পেশকশ ও প্রাদেশিক নাজিমকে নজরানা দিতে হয়। জমিদারি তিনি কিনতে পারেন, তবে তার জন্য সম্রাট ও নাজিমের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া বিধেয়। একদিক থেকে তাঁকে তাঁর জমিদারির নির্দিষ্ট রাজস্বের বাৎসরিক কন্ট্রাক্টার বা ইজারাদার বলা যায়। অন্য কোনও কর্মচারী বা ইজারাদার দিয়ে গভর্নমেন্ট যদি বিশেষ কোনও কারণে সেই রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা করেন, তাহলে জমিদারকে সাধারণত তার জন্য উচ্ছেদ করা হয় না, আলাদা ভাতা ও কিছু সম্পত্তি দিয়ে তাঁকে পোষণ করা হয়। অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকে দেখা যায় যে নিজস্ব এলাকার মধ্যে জমিদার ‘আবওয়াব’ ও ‘কর’ আদায়ের অধিকার ভোগ করছেন। এই অধিকারও নিরঙ্কুশ নয়, দেশীয় সরকার যখন খুশি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। নিজের জমিদারির কাজকর্মের সুবিধার জন্য প্রজাদের কাছ থেকে জমিদার নানা রকমের উপঢৌকনও আদায় করতে পারেন। তাঁর নিজস্ব অঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত থাকে, অথচ এক্ষেত্রেও তাঁর সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বীকার করা হয় না।”
হ্যারিংটন সাহেব ১৭৮০ থেকে ১৮২৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানির অধীনে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তাঁর মতামতের গুরুত্ব আছে। জমিদারের স্বরূপ—নির্ণয়ের এই প্রকাশভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যে অস্পষ্টতা এর মধ্যে কতখানি ছিল, অথচ একেবারে যে অস্পষ্ট বা ধরাছোঁয়ার বাইরে, তা—ও নয়। আসল ব্যাপার হল, দীর্ঘকালের সামাজিক প্রথার বেড়াজালের মধ্যে এ দেশের জমিদাররা অধিকাংশই অঙ্কুর থেকে মহীরুহে পরিণত হয়েছিলেন, রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনের বাঁধা সড়ক ধরে হননি। কাজেই ইংরেজদের পক্ষে ইংরেজি ভাষায় তাঁদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা সহজ হয়নি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর তা প্রায় জলের মতো সহজ হয়ে যায়। হ্যারিংটনের বন্দোবস্ত—পরবর্তী জমিদারের সংজ্ঞা থেকে তা বোঝা যায় : ২ ”জমিদার তাঁর জমিদারির মালিক—উত্তরাধিকার, দান বা কেনা বেচা থেকে তিনি এই মালিকানাস্বত্ব লাভ করতে পারেন—তাঁর দায়িত্ব হল—তাঁর জমিদারির নির্দিষ্ট স্থায়ী রাজস্ব যথাসময়ে গভর্ণমেন্টকে পরিশোধ করা। তাঁর দেয় রাজস্ব চুকিয়ে দিয়ে তিনি আইনসংগতভাবে উপস্বত্বভোগী ও প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মুনাফা ও খাজনা যতটা সম্ভব আদায় করতে পারেন এবং তা ভোগও করতে পারেন। পতিত জমি বা বনজঙ্গল হাসিল করা জমি প্রজাদের বিলি করতে পারলে তার খাজনাও তাঁর প্রাপ্য ও ভোগ্য হবে।”
একজন ইংরেজ লেখক বলেছেন : “Lord Cornwallis modelled his scheme of Zemindary proprietors on the English system of large landed estates.” ৩ কর্নওয়ালিস যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আদি—পরিকল্পক ছিলেন তা নয়, তাঁর আগে ফিলিপ ফ্রান্সিস ও আরও কেউ কেউ এ দেশের জমিদারদের সঙ্গে এই ধরনের একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। কর্নওয়ালিস তার বিধিসম্মত রূপ দিয়েছিলেন মাত্র। তা ছাড়া ইউরোপ বা ইংলন্ডের কোনও—একটা বিশিষ্ট মডেল যে এ দেশের জমিদারি বন্দোবস্তের সময় তাঁদের মনের মধ্যে স্পষ্টভাবে ছিল, তা—ও মনে হয় না। বরং এ কথা বলা যায়, বাংলা দেশে নবাবি আমলে মুর্শিদকুলি খাঁ—র দেওয়ানির সময় যে রাজস্বব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, ব্রিটিশ শাসকরা বাংলা—বিহার—উড়িষ্যার দেওয়ানি পাবার পর নানাবিধ পরীক্ষান্তে শেষ পর্যন্ত তাকেই অনুসরণ করেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার এ সম্বন্ধে লিখেছেন : ”ইংরেজদের ভূমিরাজস্বনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির আসল উৎস হলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। সেই বৈশিষ্ট্যগুলির পরিচ্ছন্ন ও কঠোর রূপ দিয়েছিলেন কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে।” ৪
অষ্টাদশ শতকের প্রথম পর্ব (১৭০০—২৭) মুর্শিদকুলি খাঁ—র দেওয়ানি ও সুবাদারির কাল। ঢাকার বদলে ‘মখসুদাবাদ’ তাঁর শাসনকেন্দ্র হয় এবং সেইজন্য পরে তার নাম হয়, তাঁরই নামে, ‘মুর্শিদ—আবাদ’। কলকাতার আগে, এবং ঢাকার পরে, এই মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলার অন্যতম শহর ও রাজধানী। মুর্শিদ বাংলা দেশে এসে দেখেন যে অধিকাংশ ভূ—সম্পত্তি বড় বড় সরকারি কর্মচারীদের জায়গির দেওয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় আয়ের অন্যতম উৎস হল বাণিজ্যশুল্ক। এই অবস্থায় রাজস্ববৃদ্ধির দুটি উপায় তিনি স্থির করলেন। প্রথম উপায় হল, বাংলা দেশের জায়গিরগুলিকে খালসা জমিতে পরিণত করা এবং জায়গিরদারদের বাংলার বদলে উড়িষ্যার বিভিন্ন বনময় অঞ্চলে জায়গির দেওয়া। দ্বিতীয় উপায় হল, রাজস্ব আদায়ের জন্য ‘কন্ট্রাক্ট’ বা ‘ইজারা’ দেওয়া। হিন্দু ও পাঠান রাজত্বকাল থেকে যাঁদের প্রতিষ্ঠা, সেই বাংলা দেশের বনেদি জমিদারদের মুর্শিদের সময় যথেষ্ট অধঃপতন হয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত রাজস্ব আদায় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠার ফলে মুর্শিদ রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারাদার নিয়োগ করেন। তাঁর এই ব্যবস্থাকে ‘মাল জামিনি’ ব্যবস্থা বলা হয়। বনেদি জমিদাররা রইলেন, কিন্তু ইজারাদারদের আওতায়। ক্রমে অবশ্য তাঁরা অনেকে লোপ পেয়ে গেলেন। দু—তিন পুরুষের মধ্যে দেখা গেল, মুর্শিদের এই ইজারাদাররা রাজ—মহারাজ উপাধিতে ভূষিত হয়ে বেশ বড় বড় জমিদারে গোত্রান্তরিত হয়েছেন। এঁরা কেউ—“though not of princely birth, but merely glorified civil servants, paid by percentage on their collections.”—তাহলেও এঁরাই ছিলেন মুর্শিদের আমলের কলিকাতা—গোবিন্দপুর—সুতানুটিতে ইংরেজদের জমিদারি ভোগ করার সময়কার বাংলার প্রতাপশালী জমিদারশ্রেণি। “Indeed, under Murshid Quli and the Permanent Settlement of Cornwallis, our hereditary landed families of historical origin (except a few small fry) were extinguished and their places were taken by new men of the official and capitialist classes.” ৫
মুর্শিদ হিন্দুদের ভিতর থেকে ইজারাদার নিয়োগ করতেন বেশি, তার কারণ সেই সময় মুসলমান ইজারাদাররা রাজস্বের টাকা তছরুপ করে পরে আর তা পরিশোধ করতে পারতেন না। হিন্দু ইজারাদাররা এ ব্যাপারে একটু বেশি রাজভক্তি দেখাতেন, বোধহয় দেওয়ান ও নবাবের কাছ থেকে অনুগ্রহলাভের প্রত্যাশায়। সেই অনুগ্রহ হল জমিদারি ও তার সনদ। মুর্শিদের সময় উত্তর—পূর্ববাংলার ময়মনসিংহ ও আলপসিংহ, দক্ষিণবাংলার যশোহর—খুলনা প্রভৃতি অঞ্চল নিয়মিত সরকারি রাজস্ব আদায়ের অঞ্চলে পরিণত হয়। ভাগ্যবান যাঁরা মুর্শিদের পোষকতায় বড় বড় জমিদারে পরিণত হন, তাঁদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ রঘুনন্দন অন্যতম। প্রথমে তিনি মুর্শিদাবাদে রাজস্ববিভাগে একজন সামান্য কর্মচারী ছিলেন মাত্র। সেখানে তাঁর বৈষয়িক ব্যাপারে তীক্ষ্ন বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির পরিচয় পেয়ে মুর্শিদ তাঁকে রাজস্ববিভাগের অন্যতম উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। এইসময় ধীরে ধীরে, নিজের ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে, তিনি অনেক জমিদারি তাঁর ভাই রামজীবনের নামে হস্তান্তরিত করেন। তার মধ্যে, সীতারামের পতনের পর (১৭১৪ সাল), ভূষণা পরগনার জমিদারি অন্যতম। রামজীবনের মৃত্যুর পর তাঁর পোষ্যপুত্র রামকান্ত জমিদারির সনদ পান (১৭৩৩ সাল)। প্রসিদ্ধ রানি ভবানী রামকান্তর স্ত্রী। এইভাবে উত্তরবঙ্গের নাটোর রাজবংশ ক্রমে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান রাজবংশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। তিলি জাতির দয়ারাম রায় রঘুনন্দনের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন এবং রাজা সীতারামকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন চক্রান্তের অধিনায়ক। দয়ারাম পুরস্কৃত হন এবং রাজানুগ্রহে দিঘাপতিয়া রাজবংশ (রাজশাহি জেলা) প্রতিষ্ঠা করেন। রানি ভবানীর পর নাটোরের জমিদারি যখন তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীর হাতে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, তখন তাঁর একজন দক্ষিণরাঢ়ি কায়স্থ কর্মচারী যশোহরে নড়াইল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
রাজশাহি জেলার তাহিরপুর ও পুটিয়ার দুটি জমিদার বংশ নাটোরের চেয়ে পুরাতন, কিন্তু পরে তাঁদের অবস্থা অনেক পড়ে যায়। এই দুটি বংশই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বংশ। আরও দু—জন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার মুর্শিদকুলির কাছে তাঁদের উন্নত পদমর্যাদার জন্য কৃতজ্ঞ—একজন বগুড়ার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী। মুর্শিদকুলির পূর্বেকার জমিদারদের মধ্যে বিষ্ণুপুরের (বাঁকুড়া) মল্লবংশ, বীরভূমের আসাদউল্লার বংশ, পঞ্চকোটের রাজবংশ প্রভৃতি কয়েকটি বড় জমিদার বংশ হস্তান্তরিত হয়নি। কিন্তু রাজশাহির (পরবর্তী রাজশাহি জেলার প্রায় তিনগুণ বড়) পুরাতন বনেদি জমিদার বংশ—যাঁদের জমিদারি প্রায় ১৩০০০ বর্গমাইল বিস্তৃত ছিল এবং রাজস্ব ছিল ২৭ লক্ষ টাকা—মুর্শিদকুলির আমলে খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়ে নাটোর প্রভৃতি রাজবংশের উৎপত্তি হয়।৬
জন শোর তাঁর একটি ‘মিনিট’—এ (১৭৮৮) বলেন। “most of the considerable Zamindars in Bengal may be traced to an origin within the last century and a half.”৭ জেমস গ্র্যান্ট বাংলার জমিদারদের আভিজাত্য আরও বেশি খর্ব করে বলেছেন : “the universally new creation of the necessary class and officers denominated Zamindars in the course of Jafer Khan’s (Murshid Quli Khan’s) viceroyalty.”৮ জন শোর ও জেমস গ্র্যান্টের কথা অনেকটা সত্য হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। মুর্শিদকুলি যে অনেক পুরাতন বনেদি জমিদার বংশ ভেঙে নতুন জমিদার বংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইজারাদারদের জমিদারে রূপায়িত করেছিলেন, সে কথা আমরা আগে বলেছি। বাস্তবিক মুর্শিদকুলি বাংলা দেশে যে নতুন জমিদারশ্রেণি পত্তন করেন, ইংরেজ শাসকরা পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে তাঁদের পদমর্যাদা ও বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের ভিত্তি পোক্ত করে দেন।৯ শুধু তা—ই নয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইংরেজ আমলের আরও অনেক বিত্তশালী অর্বাচীনের সামনে অভিজাত জমিদারশ্রেণির মর্যাদালাভের পথ প্রশস্ত করে দেয়। দিনাজপুর, বর্ধমান, নদিয়া, নলডাঙা প্রভৃতি জমিদার বংশ মুর্শিদকুলির আগে প্রতিষ্ঠিত। মুর্শিদের দেওয়ানিকালে এই জমিদাররা সকলে মর্যাদাচ্যুত হননি, জমিদারিও তাঁদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়নি। দৃষ্টান্ত হিসাবে বর্ধমান ও নদিয়ার রাজাদের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর, এঁদের দ্রুত পতন হতে থাকে এবং নানা রকমের উপস্বত্বের সংঘাতে জমিদারি শতখণ্ড হয়ে যায়। কত যে ফাটল ধরে এক—একটা জমিদারির মধ্যে তার ঠিক নেই। সে কথা আমরা পরে বলব।
ফিলিপ ফ্রান্সিস ১৯ অক্টোবর ১৭৭৪ ভারতবর্ষে আসেন। ২২ জানুয়ারি ১৭৭৬ তিনি একটি মিনিটে বাংলা দেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাব পেশ করেন। ১৭৮৯—৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় এবং ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করা হয়। এই বন্দোবস্তের প্রবর্তক যাঁরা তাঁদের ধারণা ছিল, জমিদারদের দেয় রাজস্ব স্থায়ীভাবে সুনির্দিষ্ট করে দিলে নিজেদের জমিদারি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ব্যাপারে তাঁরা অনেক বেশি উৎসাহিত হবেন। জমিদারি যদি তাঁদের কাছে লাভবান হয়, তাহলে স্বার্থের দিক থেকেও তাঁরা নিজেদের জমিদারির উন্নতিসাধনে তৎপর হবেন। প্রচলিত পরগনা—হারে কৃষকদের কাছ থেকে তাঁরা খাজনা আদায় করবেন, কোনওরকম লোভের বশবর্তী হয়ে তাদের খাজনা বৃদ্ধি করবেন না। সুতরাং কর্নওয়ালিস ও তাঁর সমর্থকরা জমিদারদের ভূসম্পত্তিতে স্থায়ী স্বত্ব দান করে ভাবলেন যে তাতে চাষবাসের উন্নতি হবে, গ্রাম্য সমাজের উন্নতি হবে এবং দেশের শ্রীবৃদ্ধি হবে। কিন্তু তাঁদের ধারণার ঠিক বিপরীত ফল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য বাংলা দেশে ফলল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষিত হবার আঠারো—উনিশ বছর পরে, ১৮১২ সালের ‘সিলেট কমিটি’—বিখ্যাত Fifth Report—এর লেখকরা—সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলেন যে বাংলা দেশের জমিদাররা জমির বা সম্পত্তির মালিক নন। ‘জমিদার’ হল একটা ‘Office’, অর্থাৎ রাজকীয় দায়িত্ব—নির্দিষ্ট একটি ‘পদ’ মাত্র, তার সঙ্গে জমিদারির মালিকানাস্বত্বের কোনও সম্বন্ধ নেই। পঞ্চম রিপোর্টে বলা হয় যে এই বিশেষ রাজপদের দায়িত্ব হিসেবে জমিদারদের কর্তব্য হল—“to superintendant that portion of the country committed to his charge, to do justice to the ryots or peasants, to furnish them with the necessary advances for cultivation, to furnish them with the necessary advances of cultivation.” এই রাজকর্তব্য পালনের জন্য জমিদাররা কতকগুলি সুযোগ—সুবিধা পেতেন, যেমন বিনা খাজনায় কিছু সম্পত্তি তাঁরা ভোগ করতেন এবং তার সঙ্গে অন্যান্য কিছু পাওনা তাঁদের থাকত, যা তাঁদের সংগৃহীত রাজস্বের শতকরা দশ ভাগের বেশি নয়। জমিদারের আয় হিসেবে এটা যে খুব কম তা নয়। এই রাজপদের উৎপত্তি হিন্দু রাজাদের সময় থেকে সন্ধান করা যায়। গোড়াতে এঁরা ‘চৌধুরী’ বলে পরিচিত ছিলেন, পরে মুসলমান রাজত্বকালে ‘ক্রোড়ী’ নামে পরিচিত হন। এক ক্রোড় বা কোটি ‘দাম’ (Dam)—প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা—রাজস্বের এক—একটি অঞ্চলে এঁদের কালেক্টর নিযুক্ত করা হত বলে বোধহয় এঁদের ‘ক্রোড়ী’ বলত। মুসলমান আমলের শেষদিকে ‘জমিদার’ কথাটি বেশি প্রচলিত হয়—“which, literally signifying a possessor of land, gave a colour to that misconstruction of their tenure which assigned to them and hereditary right to the soil.” অতএব সিলেক্ট কমিটি তাঁদের Fifth Report—এ বলেন যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে জমিদারদের এমন অধিকার দিয়েছেন বাংলা দেশে যা তাঁরা কোনওকালে ভোগ করেননি (“rights hitherto unknown and unenjoyed in Bengal”)। এই কথা বলে তাঁরা মন্তব্য করেন যে বাংলা দেশে স্থায়ী জমিদারিস্বত্ব এমন লোকদের দেওয়া হয়েছে যাঁদের কোনওরকম দায়িত্ব পালন করবার যোগ্যতা নেই। এই জমিদারদের Fifth Report—এ যে সমস্ত বিশেষণে ভূষিত করা হয় তার মধ্যে কয়েকটি হল এই :
“idiots or of weak understanding; poor creatures sunk in sloth and debauchery; extravagant, necessitous, and therefore exacting; ignorant and rapacious; harbourers of dacoits; obstructive zemindars, more plague than profit.”
ইডিয়ট নির্বোধ উচ্ছৃঙ্খল বিলাসী অমিতব্যয়ী স্বেচ্ছাচারী নিষ্ঠুর স্বার্থপর ডাকাতপোষক—এগুলি হল জমিদারদের বিশেষণ। এই জমিদারশ্রেণির হাতে ইংরেজ শাসকরা বাংলার গ্রামসমাজের সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হলেন।
১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে যখন এই গুরুদায়িত্ব জমিদারদের দেওয়া হল, তখন বাংলা দেশের অবস্থা কী? এই বন্দোবস্তের আগেই ইংরেজদের রাজস্ব সংগ্রহের নানারকম কৌশল প্রয়োগের ফলে বাংলা দেশের বনেদি জমিদার ও কৃষক উভয় শ্রেণিই চরম দুরবস্থায় পৌঁছেছিল। তার উপর ১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ফলে বাংলার গ্রাম প্রায় শ্মশানে পরিণত হয়েছিল বলা চলে। এই ঐতিহাসিক দুর্ভিক্ষের চিত্র জন শোর তাঁর একটি কবিতায় জীবন্তরূপে এঁকেছেন :১০
“Still fresh in memory’s eye the scene I view,
The shrivelled limbs, sunk eyes, and lifeless hue;
Still hear the mother’s shrieks and infant’s moans
Cries of despair and agonising moans.
In wild confusion dead and dying lie;–
Hark to the jackal’s yell and vulture’s cry,
The dog’s fell howl, amidst the glare of day
They riot unmolested on their prey!
Dire scenes of horror, which no pen can trace,
Nor rolling years from memory’s page efface.”
দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরে দেখা যায় যে বাংলা দেশের কৃষকদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে এবং প্রাচীন জমিদারদের মধ্যে অনেকে দারুণ দুরবস্থায় পড়েছেন। হান্টার লিখেছেন যে ১৭৭০ সাল থেকে বাংলা দেশের পুরাতন অভিজাতশ্রেণির ধ্বংসের কারণ সন্ধান করা যায়।১১ বাংলার গ্রাম্য সমাজের এই চরম দুর্দিনে জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয় এবং তাঁদের এমন কতকগুলি ক্ষমতা দেওয়া হয় যাতে তাঁরা অন্তত নিজেদের সুদিনের ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু তা—ও অনেকে করতে পারেননি। চিরদিনের বিলাসিতার অভ্যাস ও স্বভাবশৈথিল্যের জন্য জমিদারদের মধ্যে অনেকেই নির্দিষ্ট দিনক্ষণের মধ্যে তাঁদের দেয় রাজস্ব সরকারকে দিতে পারেননি। নানারকম অজুহাত দেখিয়ে তাঁরা রাজস্ব বাকি ফেলেছেন এবং প্রজাদের দুরবস্থা ও খাজনা অনাদায় তার প্রধান কারণ বলে নির্দেশ করেছেন। কিন্তু আসল কারণ হল, এ দেশের জমিদাররা রাজস্ব পরিশোধের ব্যাপারে সূর্যাস্ত আইনের মতো কোনও কঠোর আইনকানুনের বন্ধন মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিলেন না। তার ফলে অনেকেরই জমিদারি ‘লাটে’ ওঠে এবং নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। নিলামে এইসব জমিদারি যাঁরা কেনেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ হলেন কলকাতার মতো শহরের একশ্রেণির একপুরুষের ধনিক—যাঁরা ইংরেজ আমলে কলকাতা শহরে দেওয়ানি—বেনিয়ানি—মুতসুদ্দিগিরি করে, হাটবাজারের ইজারা নিয়ে, প্রচুর ধন উপার্জন করেছিলেন। কর্নওয়ালিস কোম্পানির ডিরেক্টরদের একটি চিঠিতে (৬ মার্চ ১৯৭৩) পরিষ্কার লিখেছিলেন : “The large capitals possessed by many of the natives, which they will have no means of employing… will be applied to the purchase of the landed property as soon as the tenure is declared to be secured.”১২
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কর্নওয়ালিসের এই উদ্দেশ্যই সফল হয়েছিল। এ দেশের যে ধনিকদের কথা কর্নওয়ালিস এই চিঠিতে ইঙ্গিত করেছেন, তাঁরা অধিকাংশই কলকাতা শহরের দেওয়ান—বেনিয়ান—মুতসুদ্দি। দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিও*—যাঁর স্বাধীন ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রতি যথেষ্ট উৎসাহ ছিল—শেষ পর্যন্ত তাঁর সঞ্চিত ধন বাণিজ্য থেকে জমিদারি ও ভূসম্পত্তিতে নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।১৩ অন্যান্য বেনিয়ান বা মুতসুদ্দিদের কথা বলাই বাহুল্য। রামদুলাল দে, মতিলাল শীল, লাহা ও মল্লিকরা, পাইকপাড়ার রাজা সিংহরা, হাটখোলার ও রামবাগানের দত্তরা, সকলেই প্রায় সঞ্চিত ধনদৌলতে শহরের ও গ্রামের জমিদার হন। অর্থাৎ তাঁরা শহরেও সম্পত্তি কেনেন, গ্রামেও সম্পত্তি কেনেন। এককথায় বলা যায়, তাঁরা নাগরিক ও গ্রাম্য ভূসম্পত্তির মালিক হয়ে অনায়াসলব্ধ উপার্জন ও মুনাফা (unearned income ও profit) লাভের জন্য লালায়িত হয়ে ওঠেন। শহরের স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসিতার দিকে সবসময় তাঁদের নজর বেশি থাকত বলে, বেশির ভাগ সময়ে শহরেই তাঁরা থাকতেন। শুধু বিলাসিতার জন্য নয়, নাগরিক সমাজে তাঁদের আভিজাত্য প্রদর্শনের পথ অনেক বেশি উন্মুক্ত ও প্রশস্ত বলেও তাঁরা শহুরে হয়ে গিয়েছিলেন।
হান্টার এইসময়কার হাতে লেখা নথিপত্র সন্ধান করে চারটি খণ্ডে সংকলন করেছেন। ভূমিকায় লিখেছেন : “In these four volumes of Bengal Records, I cite many hundred letters written at that disastrous period, and showing how the disintegration of estates went on in every district of Bengal.”১৪ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর তেরো—চোদ্দো বছরের মধ্যেই অনেক জমিদারি খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে যেতে থাকে। ভাঙনের সুযোগে যাঁরা এইসব জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হতে থাকেন, তাঁরা হলেন শহরের ধনিকশ্রেণি। কার্ল মাকর্স তাঁর ভারতীয় ইতিহাসের খসড়ায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল প্রসঙ্গে লিখেছেন : “greater part of the province’s landholdings fell rapidly into the hands of the few city-capitalists who had spare capital and readily invested it in land.”১৫ বাস্তবিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারি কেনা—বেচার ইতিবৃত্ত যদি সরকারি দলিল—দস্তাবেজ থেকে ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করা যেত, তাহলে কার্ল মার্কসের কথা যে কতখানি সত্য তা প্রমাণ করা সম্ভব হত। তবে দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো কয়েকজনের জীবনবৃত্তান্ত থেকে যেটুকু জানা যায় তাতে এর সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ করার কিছু থাকে না।
প্রত্যাশা ও বাস্তব ফলাফলের মধ্যে যে কতখানি পার্থক্য ঘটেছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর, তা এই উক্তি ও আলোচনা থেকে বোঝা যায়। জাস্টিস জর্জ ক্যাম্বেল বলেন (১ জুন ১৮৬৪) : ”বড় বড় জমিদাররা, কদাচিৎ দুই—একজন ছাড়া, নিজেদের জমিদারির উন্নতির জন্য একটি কপর্দকও খরচ করেন না। তিনি নিজে চাষ তো করেনই না, চাষের উন্নতির জন্য কোনও নতুন উন্নত কলাকৌশলও প্রয়োগ করতে প্রয়াসী হন না। ইংরেজ জমিদারদের মতো ‘ফার্ম’ বা ‘ফার্ম—হাউস’ কিছুই তৈরি করেন না। চাষের জমি ঘিরে দেওয়া, গাছগাছড়া ও বীজের ব্যবস্থা করা, নালা—নর্দমা বা সেচের ব্যবস্থা করা—এসব কিছুই তিনি কর্তব্য বলে মনে করেন না। তিনি শুধু চাষিদের নিজেদের খরচে চাষ করার অনুমতি দেন এবং খাজনা ও অন্যান্য যা—কিছু তাঁর নিজের পাওনা তা কড়ায়—গন্ডায় আদায় করেন, যতটা পারেন বেশি করে আদায় করার চেষ্টা করেন।” জাস্টিস শম্ভুনাথ পণ্ডিত বলেন (১৯জুন ১৮৬৫) : ”বাংলা দেশের জমিদাররা মূলধন নিয়োগ করে তাঁদের জমিদারি উন্নতি করেছেন, এরকম বড়—একটা দেখা যায় না। জমিদাররা একাজ করবেন, একথা আইনে লেখা আছে বটে, কিন্তু জমিদাররা তা কাজে বিশেষ পরিণত করেননি।” জাস্টিস সিটনকার বলেন (১৯ জুন ১৮৬৫) : ”কৃষিকাজের উন্নতির জন্য জমিদাররা কোনওরকম দায়িত্ব পালন করেননি। চাষিদের মূলধন বা বীজ দিয়ে সাহায্য করা, সেচের ব্যবস্থা করা, পথঘাটের উন্নতি করা, এসব কর্তব্য তাঁরা পালন করেননি। কিছু পুকুর, এখানে—ওখানে কিছু পথঘাট, হাট ও গঞ্জ তাঁরা করেছেন বটে, কিন্তু যা করা উচিত ছিল তার তুলনায় এগুলি কিছুই নয়। বরং অধিকাংশ জায়গায় বনজঙ্গল হাসিল করে চাষিরাই নিজেরাই আবাদের জমি বৃদ্ধি করেছে এবং জোতদার ও অবস্থাপন্ন চাষিদের জন্যই খেজুর, আখ, তামাক প্রভৃতির চাষ উন্নত হয়েছে। জমিদারদের জন্য এসব উন্নতি কিছু হয়নি, তাঁরা শুধু উন্নতির ফলটুকু ভোগ করেছেন।” রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফ ও আরও ২০ জন মিশনারি বলেন (এপ্রিল ১৮৭৫) : ”জমিদাররা চাষিদের সঙ্গে ব্যবহার করেন ঠিক প্রজাদের মতো নয়, কতকটা ক্রীতদাসের মতো। তাঁরা নিজেদের রাজা—মহারাজাদের মতো মনে করেন। প্রজাদের কাছে খাজনাদি যা তাঁদের ন্যায্য পাওনা, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁরা নানা কৌশলে আদায় করেন এবং বিনা পারিশ্রমিকে, নিজের নানা রকমের কাজে প্রজাদের খাটিয়ে নেন। তা ছাড়া অত্যাচার যে কত রকমের করেন তা বলে শেষ করা যায় না।”১৬
এরকম আরও অনেকের উক্তি উদ্ধৃত করা যায়, বক্তব্য সকলেরই এক—চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে চাষির সর্বনাশ হয়েছে, চাষের অবনতি হয়েছে, গ্রাম ও গ্রাম্য সমাজ ধ্বংসের পথে এগিয়ে গিয়েছে। কয়েকজন জমিদার নিজেদের অযোগ্যতা ও স্বভাবশৈথিল্যের জন্য উচ্ছন্নে গেলেও, অধিকাংশ জমিদার যাঁরা শেষ পর্যন্ত জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন, তাঁরাই শেষ পর্যন্ত বন্দোবস্তের ফলে উপকৃত ও লাভবান হয়েছেন। উনিশ শতকের সাময়িকপত্রের আলোচনা থেকেও বাংলা দেশের এই জমিদার সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়। কয়েকটি আলোচনার কথা আমরা এখানে উল্লেখ করছি। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ জমিদারদের রাজস্বসংগ্রহ প্রসঙ্গে লিখেছেন (শ্রাবণ ১৩৭২ শক) :
”রাজস্ব সংগ্রহার্থে কি অপূর্ব্ব কৌশল, কি পরিপাটি নিয়ম, কি অদ্ভুত নৈপুণ্যই প্রকাশ করিয়াছেন। প্রজারা নিঃস্ব ও নিরন্ন হউক, তথাপি তাহারদিগকে নিরূপিত রাজস্ব দিতেই হইবে, ভূস্বামীর সর্ব্বস্বান্ত হউক, তথাপি তিনি ত্রি মাসের পর কপর্দ্দক মাত্র রাজস্বও অনাদায়ি রাখিতে পারেন না। অনাবৃষ্টি হইয়া সমুদায় শস্য শুষ্ক হউক, জল প্লাবন হইয়া দেশ উচ্ছিন্ন যাউক, রাজস্বদানে অক্ষম হইয়া প্রজারা পলায়ন করুক, তথাপি নির্দ্দিষ্ট দিবসে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে তাঁহাকে সমস্ত রাজস্ব নিঃশেষে পরিশোধ করিতে হইবে।”
‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ লিখেছেন যে ভিন্ন ভিন্ন ভূস্বামী কত রকমের ছল—বল—কৌশল প্রয়োগ করে যে প্রজাদের উপর অত্যাচার করেন তা গণনা করা যায় না। তাঁদের অধীন সমস্ত প্রজার যা—কিছু সম্পত্তি বা ভোগ্যবস্তু সবই তাঁরা নিজেদের মনে করেন। প্রজাদের ফলমূল, গাছ পর্যন্ত ভূস্বামীদের সর্বগ্রাসী লোভের কাছে রক্ষা পায় না। কোনও দরিদ্র প্রজা ফলের গাছ রোপণ করে, অনেক যত্ন ও পরিশ্রম করে, বহুদিন পরে হয়তো ফল ফলাল, কিন্তু তাতেও ভূস্বামীর প্রলুব্ধ দৃষ্টি পড়ল। গাছের ফল তিনি আগে ভোগ করবেন, তারপর প্রজা করবে। নিজের কোনও প্রয়োজনসাধনের জন্য যদি কোনও প্রজাকে তিনি আম, জাম বা কাঁঠাল গাছ ছেদন করতে বলেন, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই গাছ ছেদন করে প্রদান করতে হয়। ছেদন করার পরেও সেই গাছের জন্য প্রজাকে কর দিতে হয় জমিদারকে। জমিদার ফলবান বড় গাছটির বদলে অন্য একটি ছোট গাছ রোপণ করার অনুমতি দিয়ে প্রজার কাছ থেকে কর গ্রহণ করতে থাকেন। প্রজাদের স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি দূরে থাকুক, তাদের দেহ ও দৈহিক পরিশ্রমও জমিদাররা নিজেদের কেনা বস্তু বলে মনে করেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে কৃষ্ণনগরের জমিদারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জমিদারের হুকুম যে বিনামূল্যে ও বিনাবেতনে গোপরা তাঁকে দুধ দেবে, জেলেরা মাছ দেবে, নাপিতরা ক্ষৌরকর্ম করবে, যানবাহকরা বহন করবে, চর্মকাররা পাদুকাদি দেবে, ”ইত্যাদি সকলেই স্ব স্ব উপজীব্যোচিত অনুষ্ঠান দ্বারা তাঁহারদিগের সেবা করিবেক।” জমিদার যখন নিজের গ্রামে থাকেন, ”তখন তাঁহাকেও নিজধনে বাসার ব্যয় সম্পাদন করিতে হয় না। তদ্ভিন্ন তাঁহার বাটীতে কোন ক্রিয়া উপস্থিত হইলে চতুর্দ্দিক হইতে নানাপ্রকার সামগ্রীপত্র আসিতে থাকে।” ”ক্রীতদাসকেও এরূপ দাসত্ব করিতে হয় না।” তাঁর জমিদারি এলাকায় যাঁরা ব্যাবসাবাণিজ্য করেন, তাঁদেরও জমিদারের ইচ্ছাধীন মূল্যে পণ্যদ্রব্য দিতে হবে, তার নাম ‘সরকারি মূল্য।’ যে জিনিসের দাম বাজারে দুটাকা, জমিদারের কাছে হয়তো তা চার আনায় বেচতে হবে। জমিদারের শোষণের লোভ যেন সীমাহীন।
ভূস্বামীরা তাঁদের দুর্নিবার ধনতৃষ্ণা চরিতার্থ করার আরও একটি প্রশস্ত পথ প্রস্তুত করেন। প্রজায় প্রজায় বিবাদ—বিসংবাদ হলে ভূস্বামীর কাছে বিচারের জন্য যেতে হয়। ভূস্বামী তখন কী করেন? ”তিনি বিচারক নাম গ্রহণ করিয়া সর্বতোভাবে অবিচার করেন—ধর্মাবতার নাম ধারণ করিয়া সম্পূর্ণরূপ অধর্মাচরণেই প্রবৃত্ত থাকেন।… উৎকোচের তারতম্যানুসারে তাঁহার বিচারক্রিয়ার তারতম্য হয়…।” কোনও কোনও ভূস্বামী ব্রাহ্মণের ব্রহ্মোত্তর, দেবতার দেবোত্তর সম্পত্তি পর্যন্ত গ্রাস করতে কুণ্ঠিত হন না। ডাকাত, লেঠেল ও গুণ্ডা ভূস্বামীরা পোষণ করেন প্রজাদের পীড়ন করার জন্য। অবাধ্য ও বিদ্রোহী প্রজাদের ধান লুঠ করা, গোহরণ করা, প্রজাদের জলমগ্ন করা ও প্রহার করা তাঁদের প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গ্রামের জমিদাররা প্রজাদের উপর শুধু শারীরিক অত্যাচার যে কত রকমের করেন, কলকাতার মতো শহরের অধিবাসীরা তা ঠিক জানেন না বলে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ তার একটি ১৮—দফা তালিকা প্রকাশ করেন :
১। দণ্ডাঘাত ও বেত্রাঘাত।
২। চর্মপাদুকা প্রহার।
৩। বংশকাষ্ঠাদি দ্বারা বক্ষঃস্থল দলন।
৪। খাপরা দিয়ে কর্ণ ও নাসিকা মর্দন।
৫। ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ।
৬। পিঠে দুই হাত মোড়া দিয়ে বেঁধে বংশদণ্ড দিয়ে মোচড় দেওয়া।
৭। গায়ে বিছুটি দেওয়া।
৮। হাত—পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা।
৯। কান ধরে দৌড় করানো।
১০। কাঁটা দিয়ে হাত দলন করা। দু—খানা কাঠের বাখারির একদিক বেঁধে তার মধ্যে হাত রেখে মর্দন করা। এই যন্ত্রটির নাম ‘কাটা’!
১১। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রোদে ইটের উপর পা ফাঁক করে দু—হাতে ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা।
১২। প্রবল শীতের সময় জলে চোবানো।
১৩। গোনীবদ্ধ করে জলমগ্ন করা।
১৪। গাছে বা অন্যত্র বেঁধে টান দেওয়া।
১৫। ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে ধানের গোলায় পুরে রাখা।
১৬। চুনের ঘরে বন্ধ করে রাখা।
১৭। কারারুদ্ধ করে উপবাসী রাখা।
১৮। ঘরের মধ্যে বন্ধ করে লঙ্কা—মরিচের ধোঁয়া দেওয়া।১৭
প্রজাপীড়নের এই ১৮—দফা ক্যাটালগও যথেষ্ট নয়, জমিদারদের যথেচ্ছাচারিতার সম্পূর্ণ চিত্র এর মধ্যে ফুটে ওঠে না। উনিশ শতকের বাংলা সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় জমিদারদের এই অত্যাচারের আরও অনেক মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে।১৮ তার একঘেয়ে পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই এখানে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের গোত্রান্তরিত করেছিল। পূর্বের ফিউডাল বদান্যতা এই হঠাৎ—জমিদারদের ছিল না। তাঁরা স্বার্থপর অর্থপিশাচ হৃদয়হীন ঠিকাদারে পরিণত হয়েছিলেন—ইংরেজদের রাজস্বের ঠিকাদার। তার উপর বাংলা দেশে, মার্ক্স—এর ভাষায়, শহরের পুঁজিপতিরাই নিলামে জমিদারি কিনে গ্রামাঞ্চলে জমিদারে পরিণত হয়েছিলেন। গ্রাম্য সমাজের সঙ্গে তাঁদের কোনও অন্তরের যোগ, নাড়ির যোগ ছিল না। ইংরেজ আমলে বাংলার জমিদারশ্রেণির এই গোত্রান্তর একটা বড় রকমের সামাজিক পরিবর্তন, যা গ্রাম্য সমাজকে অনিবার্য ধ্বংসের মুখে এগিয়ে দিয়েছিল।
গ্রাম্য মধ্যশ্রেণির বিকাশ ও বিস্তার
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর বাংলার জমিদাররা যখন সরকারি রাজস্বের কনট্রাক্টারে পরিণত হলেন, তখন দেখতে দেখতে তাঁদের অধীনে নানাশ্রেণির সাব—কনট্রাক্টার গজিয়ে উঠতে লাগল। উপরের জমিদার ও নিচের কৃষকদের মধ্যে একটা বিশাল মধ্যস্বত্বভোগীর দল বা উপশ্রেণির সৃষ্টি হল। বাংলার গ্রাম্য সমাজের মধ্যস্তর বা গ্রাম্য মধ্যবিত্তশ্রেণি এঁদের বলা যায়, যদিও নাগরিক জীবনের আকর্ষণে গ্রামের সঙ্গে এঁদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক (আর্থিক শোষণের সম্পর্ক ছাড়া) অত্যন্ত ক্ষীণ ছিল। ব্রিটিশ আমলে বাংলার গ্রাম্য সমাজের আর—একটি বড় পরিবর্তন হল এই বিভিন্ন স্তরভুক্ত মধ্যস্বত্বভোগী মধ্যশ্রেণির বিকাশ। একজন ইংরেজ লেখক লিখেছেন :১৯
“The creation of middlemen, on permanent tenures, down to the third and fourth degrees, and lower, was permitted without stint… the permission of numerous grades of middlemen between zemindar and ryot, on old estates, all of whom, as well as zemindar, derived their income out of the ryot’s payments, only set in train so many agencies for repeated illegal enhancements of rent, beyond the amount warranted by established custom. These middlemen, or farmers of rents have proved a scourge of the country.”
সেকালের সাময়িকপত্রে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে অনেক আলোচনা করা হয়েছে। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছেন (ভাদ্র ১২৫৯) :২০
”কোন বৎসর শস্য হউক বা না হউক তাঁহারা নিয়মিত রাজস্বের একটি পয়সাও পরিত্যাগ করেন না, এতদ্ভিন্ন ইজারাদার পত্তনিয়াদার ও দরপত্তনিয়াদার ইত্যাদি বহুলোকে কৃষকের পরিশ্রমার্জিত বস্তুর অংশ গ্রহণপূর্বক আপনাপন উপার্জনে তৎপর থাকাতে কৃষকের অবস্থা অতিশয় ক্লেশদায়ক হইয়াছে…।”
”পল্লীগ্রামের ক্ষুদ্র ২ জমীদার ও ইজারাদার ও বাড়ীদারদিগের অত্যাচারের ব্যাপার আমরা পুনঃ ২ প্রভাকরে প্রকাশ করিয়া থাকি, ঐ সকল দৌরাত্ম্য কোনকালে নিবারণ হয় এমত বোধ করি না, দীনদুঃখিদিগের দুঃখ বিবরণ বর্ণন করিতে আমাদিগের কাষ্ঠের লেখনী করুণা রসে আর্দ্রা হইতেছে, জমীদার, ইজারাদার, যোৎদার প্রভৃতি দ্বার হইতে মুক্ত হইলেও বাড়ীদারের বাড়ীর প্রহার হইতে রক্ষা পাওয়া কখনই সম্ভবে না…” (আষাঢ় ১২৫৮)।
”গবর্ণমেণ্টের নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করিয়া কেবল জমীদারেরাই ভূমির উৎপন্নের লাভাংশ ভোগ করিয়া থাকেন এমত নহে, জমীদারদিগের অধীনে যে সমস্ত তালুকদার ও পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, ইজারাদার প্রভৃতি আছেন, তাঁহারা কৃষকদের শ্রমোৎপাদিত দ্রব্যাদির প্রতি আপনাপন সুখসেবা ও সংসারযাত্রা নির্বাহ করণের সম্যকনির্ভর করিয়া থাকেন অর্থাৎ কৃষকদিগকে আপনাপন শ্রমার্জিত ধন দিয়া এই সকল লোকেরও পুষ্টিবর্ধন করিতে হয়।” (অগ্রহায়ণ ১২৯৯)
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল সম্পর্কে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকাতেও একাধিক আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে।২১ যেমন :
”চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়া অবধি এ পর্যন্ত ঐ প্রদেশে ভূমিজরিপ বা প্রজার কর বৃদ্ধি হয় নাই। কিন্তু জমিদারকে ঐ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সময়ে যে মালিকানী শরঞ্জামী দেওয়া হয়, জমিদার তদপেক্ষা প্রচুর লভ্য ভোগ করিতেছেন। তাহার উক্ত অবধারিত সদর জমা ও মালিকানী শরঞ্জামীর অন্যথা হয় নাই, ভূমির বা প্রজার উন্নতির নিমিত্ত অর্থ ব্যয় করিতেও হয় নাই, তবে এক্ষণে প্রজার কর কি জন্য বৃদ্ধি হইবে?… যখন জমিদারের প্রচুরলভ্য থাকা দৃষ্ট হইতেছে, তখন তাহার অধীন পত্তনিদারের স্বীয় লভ্যের নিমিত্ত প্রজার উপরে কর বৃদ্ধি করা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত হইতে পারে না।” (৯ মাঘ ১২৭৮)।
”১৮৯১ সালের ৮ আইনের বিধান মতে পত্তনি দিবার যেরূপ বন্দোবস্ত আছে, তাহা প্রজাগণের অধিকতর অনিষ্টের কারণ। সুচতুর জমিদারগণ স্বীয় অধিকারস্থ জমিদারী জরীপ ও নিরিখ ধার্য্য করিয়া পত্তনি দিবার ঘোষণা করিয়া দেন, নীলামের ডাকের ন্যায় উহার ডাক বাড়িতে থাকে, যে ব্যক্তি অধিক পণ জমা দিতে সম্মত হয়, তাহার সহিত পত্তনির বন্দোবস্ত হইয়া থাকে। পত্তনিদার মহলে উপস্থিত হইয়া খাজনা আদায় করিবার পূর্বে এই কথা প্রচার করিয়া দেয় যে যে প্রজা টাকায় সিকি বৃদ্ধি স্বীকার না করিবে তাহার সহিত বন্দোবস্ত হইবে না। এই নিমিত্তই প্রজারা ভূমিতে জমিদারের জরীপের রজ্জুপাতকে হৃদয়শল্য জ্ঞান করে… ভূমি মাপিবার রসি স্থির না থাকাতে সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় পত্তনিদারের লোকেরা ১৮ কাঠায় বিঘা হয়, এমত রসি লইয়া মাপ আরম্ভ করে, এবং ১০ বিঘার বন্দকে জরীপ মুখে ১২ বিঘা করিয়া তুলে, যখন প্রজারা মাঞ্চেষ্টারের মজুরদিগের ন্যায় নিতান্ত নিরুপায় হইয়া পত্তনিদারের দুরাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিতে বাধ্য হয়। এই প্রকার দর—পত্তনিদার, ছে—পত্তনিদার, ইজারাদার, ছে—ইজারাদারের হস্তে নিত্য নূতন যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়, ইহাতে কি প্রজাদিগের সুখ—সৌভাগ্যের প্রত্যাশা আছে।” (১৪ ভাদ্র ১২৭০)
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’তেও বাংলার এই মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রজাশোষণের বিচিত্র কলাকৌশল সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।২২ ইজারাদার সম্পর্কে লেখা হয়েছে :
” তিনি সেই লোভাগ্নির উপভোগ আহরণার্থে ভূ—স্বামী—সংস্থাপিত নানাপ্রকার নিষ্পীড়ন প্রণালীর কোন ভাগই পরিত্যাগ করেন না, বরঞ্চ সর্ব—প্রযত্নে তাহার বৃদ্ধিরই চেষ্টা পায়েন। বিশেষতঃ প্রজারা ভূ—স্বামীর চিরন্তন ধন, তাহারা এককালে উচ্ছিন্ন না যায় ও অধিকার পরিত্যাগ না করে, তাহার এমত বাসনা অবশ্যই থাকিতে পারে। কিন্তু ইজারার নিরূপিত সময় অতীত হইলেই ইজারাদারদের স্বত্ব লোপ হয়, সুতরাং প্রজাদের প্রতি তাঁহার সঞ্চারের সম্ভাবনা কি? নিঃশেষে ধন শোষণ করিতে পারিলেই তাঁহার মঙ্গল। বিশেষতঃ ভূস্বামী তাঁহার নিকট যাদৃশ নিষ্কর্ষণ করিয়া কর গ্রহণ করেন, তাহাতে তাঁহার লাভভাবের তাদৃশ সম্ভাবনা থাকে না। অতএব তিনি স্বীয়লাভ প্রত্যাশায় উপায়ান্তর চেষ্টা করেন, বিবিধপ্রকার কুটিল কৌশল কল্পনা করিতে থাকেন। প্রজার সর্বনাশই সেই সকল বিষম যন্ত্রণার একমাত্র তাৎপর্য্য। তাহারা ভূস্বামীকে যত রাজস্ব প্রদান করিত, ইজারাদারকে তদপেক্ষায় চতুর্থাংশ অধিক দিতে হইবেক।”
”কল্য যে ভূম্যধিকারীর লক্ষ মুদ্রা রাজস্ব ছিল, অদ্য তাহাতে আর পঞ্চবিংশতি সহস্র যুক্ত হইল। অতএব ইজারার নাম শুনিলে প্রজাদের হৃৎকম্প না হইবে কেন?”
”এক্ষণে যাহারদিগকে উপর্যুপরি জমীদার, ইজারাদার ও দরইজারাদার এই চারি প্রভুর লোভানলে আহুতি দান করিতে হয়, তাহারা যে কি প্রকারে প্রাণধারণ করে, তাহা ভাবিয়া স্থির করা যায় না। তাহারদের দারুণ দুর্দ্দশা বাক্যপথের অতীত!” (বৈশাখ ১৭৭২ শক)।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগেও মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু তখন এই সামাজিক উপশ্রেণি বা মধ্যশ্রেণি এরকম ব্যাপক ভয়াবহ মূর্তি ধারণ করেনি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে, নতুন জমিদারশ্রেণির অধীনে যে নতুন মধ্যস্বত্বভোগীর উদ্ভব হতে থাকে, তাদের চরিত্রই আলাদা। ১৮১৯ সালের অষ্টম রেগুলেশন অনুযায়ী (Regulation VIII, 1819 ) যখন মধ্যস্বত্বগুলিকেও জমিদারিস্বত্বের মতো পাকাপোক্ত বিধিসম্মত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তখন থেকে মধ্যস্বত্বের দ্রুত সম্প্রসারণ হতে থাকে।২৩ জর্জ ক্যাম্বেলের আমলে বাংলা সরকার তাঁদের প্রশাসনিক রিপোর্টে (১৮৭২—৭৩) মধ্যস্বত্বের বিস্তার সম্বন্ধে লেখেন :
“The practice of granting such undertenures has steadily continued until, at the present day, with the putnee and subordinate tenures in Bengal proper…, but a small proportion of the whole permanently-settled area remains in the direct possession of the zemindars.”
অর্থাৎ ১৮৭২—৭৩ সালের মধ্যেই—চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর ৮০ বছরের মধ্যে—বাংলা দেশের প্রত্যেক জমিদারিতে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ইজারার স্তরবিন্যাসের ফলে জমিদারি এত দূর খণ্ডিত হয়েছিল যে প্রকৃত জমিদারের অধীনে খুব সামান্য জমিদারি ছিল। এই রিপোর্টেই দেখা যায় যে বাংলা দেশে মধ্যস্বত্বের বিস্তারের ফলে ১৮৭২ সালের মধ্যে জমিদারির সংখ্যা বেড়ে দেড় লক্ষের বেশি হয়। তার মধ্যে ৫৩৩টি হল বড় জমিদারি—২০ হাজার একরের উপরে, ১৫৪৭টি হল ছোট জমিদারি—২০ হাজার থেকে ৫০০ একরের মধ্যে, এবং ১৩৭৯২০৩টি হল ছোট জমিদারি—৫০০ একর ও কম।২৪ ১৮৭১—৭২ সালের বেভারলের সেন্সাস রিপোর্ট থেকে কৃষক ও জমিদারের মধ্যবর্তী বিভিন্ন স্তরের উপস্বত্বভোগী ও কর্মচারীদের একটা পরিচয় পাওয়া যায় :২৫
কৃষক ৬৩৯১০৭৪ জোতদার ১৯৫৬৪
জমিদার ৪২৬১৮ গাঁতিদার ৩৮২৪
ইতমামদার ৫৮৬ হাওলাদার ৯৩৪৩
ঠিকাদার ৩০৩ গোমস্তা ১৮,৪৭২
ইজারাদার ৩৩৫৪ তহসিলদার ১০,৫৪৬
লাখেরাজদার ২৩০৭০ পাটোয়ারী ১৩৭৬
জায়গীরদার ৩৬৫ পাইক ১৪,৭৯৭
ঘাটোয়াল ৬৬৮ জমিদারের ভৃত্য ১১,০৩০
আয়মাদার ২০০৪ দফাদার ২০২
মকরারিদার ৯৯৩৩ দেওয়ান ১০৪
তালুকদার ৯৬০৫০ মণ্ডল ১৬২০
পত্তনিদার ৩৩৭২ নায়েব ৫৮১
খোদকস্তপ্রজা ৭৫৫২ এস্টেট-ম্যানেজার ২১
মহলদার ১১২৮
একমাত্র কৃষকদের বাদ দিলে সকলকেই প্রায়—জমিদারের বেতনভুক ভৃত্য ও পাইক—বরকন্দাজেরও—গ্রাম্য মধ্যশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এই গ্রাম্য মধ্যশ্রেণির আকৃতি ও প্রকৃতি সেন্সাসের সংখ্যা থেকে অনেকটা পরিষ্কার বোঝা যায়! প্রকৃতি সম্বন্ধে সুন্দর বিস্তারিত একটি বিবরণ ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য়, বেভারলে’র সেন্সাসের আরও প্রায় কুড়ি বছর আগে ১৮৫০—৫১ সালে, প্রকাশিত হয়।২৬ ভূস্বামীদের নিযুক্ত ”ব্যাঘ্রসম নিষ্ঠুর—স্বভাব” কর্মচারীদের কথাপ্রসঙ্গে তত্ত্ববোধিনী প্রথমে গোমস্তা ও নায়েবদের কথা বলেছেন। প্রজাদের ”কর্ণকুহরে গোমস্তা ও নায়েব শব্দ বজ্রনির্ঘোষের ন্যায় ভয়ানক বোধ হয়।” নায়েব ও গোমস্তা ”নিতান্ত নির্মায়িক” (অমায়িকের বিপরীত) হয়ে প্রজাদের উপর নানারকম উপদ্রব করেন। ”ভূস্বামির নিরূপিত ভাগ—আহরণের পূর্বেই আপনাপন ভাগ গ্রহণ করে, এবং সূচ্যগ্রবৎ সূক্ষ্মছল পাইলেই প্রজার ধন হরণ করিতে থাকে। বনচর ব্যাঘ্র বরাহ তাহারদের অপেক্ষায় কত অনিষ্ট করিতে পারে?” শুধু নায়েব—গোমস্তা নন, জমিদারের সংসার—সংক্রান্ত সামান্য কাজেও যাঁরা নিযুক্ত থাকেন, গ্রামাঞ্চলে তাঁদের প্রতাপও কম নয়। ”ভূ—স্বামীর সংসার—সংক্রান্ত কোন ক্ষুদ্র কর্মেও যিনি নিযুক্ত থাকেন, তাঁহার প্রভাবের আর পরিসীমা থাকে না, বাজার—সরকারও রাজার তুল্য প্রভুত্ব ও পরাক্রম প্রকাশ করে।” এরপর আছেন গ্রামের কুখ্যাত দারোগাবাবু—”দারোগা ও তৎসংক্রান্ত কর্মচারিদের প্রসিদ্ধ দুর্ব্যবহার স্মরণ করিলে হৃদয়ের শোণিত শুষ্ক হইতে থাকে।” ”দারোগার দীর্ঘোদর পূরণার্থে” প্রজাদের যে কত কী উৎসর্গ করতে হয় তা বলে শেষ করা যায় না। দারোগাবাবুর পরে আছেন গ্রামের মহাজন। দেনা ও দৈন্যের দায়ে মুমূর্ষু কৃষকদের যাঁরা ঋণ দিয়ে চিকিৎসা করেন তাঁরাই হলেন ‘মহাজন’। ”এই সমস্ত মহাজন সংজ্ঞক বিষদ বৈদ্যের হস্তে পতিত হইলে নিষ্কৃতির পথ এককালে রুদ্ধ হয়। মহাজন মূলধনের অর্ধ বা তদনুরূপ সমধিক বৃদ্ধিলাভ ব্যতীত ঋণদান স্বীকার করেন না, কারণ তদ্ভিন্ন তাঁহার অর্থপিপাসা সম্যক চরিতার্থ হয় না।”
ইংরেজ আমলের আদালত ও নতুন বিচারব্যবস্থার ফলেও গ্রাম্য সমাজে নতুন একশ্রেণির লোকের উৎপত্তি হয়, যাঁদের তথাকথিত মামলাবিশারদ (আসলে দালাল) বলা যায়। এঁরাও এই গ্রাম্য মধ্যবিত্তের অন্তর্ভুক্ত। ”পূর্বে লোকের বিবাদ বিসম্বাদ ঘটিলে দেশের দশজনকে ডাকিয়া মীমাংসা করিয়া লইত। এক্ষণে অর্ধ হস্ত ভূমির জন্য লোকে চতুর্দশবার আদালতে ছুটাছুটি আরম্ভ করিয়াছে। এই ছুটাছুটি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় প্রত্যেক গ্রামে একশ্রেণীর নূতন লোক দেখা দিয়াছে। লোকের বিবাদে সাহায্য করা উহাদের কাজ। ঐ সকল অলস পরশ্রীকাতর লোকের হয়ত অন্নের সংস্থান আছে, পরের কাজ পাইলে ইহাদের সময়টা একটু সুখে যায়। ইহাদের অনেকে হয়ত দুই দশবার আদালতে যাতায়াত করিয়া আদালতের কার্যপ্রণালীর সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছে। ইহারা তীর্থের কাকের ন্যায় আদালতের পার্শ্বে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং নির্বোধ লোক দেখিলেই কিঞ্চিৎ লাভ করিবার চেষ্টায় থাকে। মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে, জাল মকদ্দমা প্রস্তুত করিতে উকিল, সাক্ষী প্রভৃতির বন্দোবস্ত করিতে ইহারা বড় পটু। ইহারা একজনের পক্ষ হইয়া অপরের সর্বনাশ করে, আবার সুযোগ পাইলে প্রথম ব্যক্তির সর্বনাশের চেষ্টা পায়।” (সোমপ্রকাশ, ১৯ আশ্বিন ১২৮৯)।২৭ এই শ্রেণির লোকের সংখ্যা আজও গ্রামাঞ্চলে কম নয়।
পত্তনিদার দরপত্তনিদার ছে—পত্তনিদার ইজারাদার গাঁতিদার তালুকদার জোতদার প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী, নায়েব গোমস্তা দেওয়ান ম্যানেজার তহসিলদার থেকে আরম্ভ করে পাইক—বরকন্দাজ, এমনকী জমিদারের বাজার—সরকার পর্যন্ত আমলাবর্গ, নতুন পুলিশের দারোগা কনস্টেবল, মহাজন এবং আইন—আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দালাল থেকে উকিল পর্যন্ত নানা রকমের লোক নিয়ে বাংলার গ্রাম্য সমাজে যে বিপুল—কলেবর এক মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশ হল, অর্থনীতিক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদনের (production) সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক রইল না। পরনির্ভর স্বার্থপর অর্থপিশাচ বেতনভুক এই গ্রাম্য মধ্যবিত্তশ্রেণির হাজার নখদন্ত বাংলার কৃষকদের দিকে ধাবিত হল। বাংলার কৃষকরা, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র ভাষায় : ”রজনীতে নায়েব, দারোগা, গোমস্তা, নালিশ, দণ্ড এই সকলই স্বপ্ন দেখে! সর্ব—সন্তাপ—নাশিনী নিদ্রাও তাহাদের উদ্বেগ দূরীকরণের সমর্থ নহে!” সহস্রমুখী জোঁকের মতো কৃষকদের শ্রম ও শ্রমার্জিত অর্থ শোষণ করা ছাড়া গ্রাম্য মধ্যশ্রেণির আর কোনও উপায় রইল না। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছেন : ”পত্তনিয়াদার তালুকদার দরপত্তনিয়াদার ইত্যাদি ভূমির উৎপন্ন ভোগীর সংখ্যা রাজনিয়মবলে যত বৃদ্ধি হইয়া আসিয়াছে ততই কৃষকের ক্লেশ বৃদ্ধি হইয়াছে, এতদ্ভিন্ন খোদকস্তা, পাইকস্তা, জোতদার, বীজধানদাতা ইত্যাদিও ভূমির উৎপন্ন গ্রহণকারী বিস্তর আছে, তাহারা স্বহস্তে ক্ষেত্র কর্ষণ বীজবপন ইত্যাদি ক্ষেত্রের কার্য কিছুই করে না, অথচ কৃষকের উপর কর্তৃত্ব করে।” (৫ ভাদ্র ১২৬৪)।২৮ কৃষকের শ্রমোৎপন্নভোগীর সংখ্যা গ্রাম্য সমাজে বেড়েছে, ব্রিটিশ শাসকরা আইনবলে তাঁদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি করেছেন। উৎপাদনকর্ম থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন এরকম শোষণমুখী অর্থলোভী বিপুলাকার মধ্যশ্রেণি বাংলার গ্রাম্য সমাজে ব্রিটিশ পূর্ব যুগে, মুসলমান বা হিন্দু রাজত্বকালে, ছিল না। বাংলা দেশের গ্রাম্য সমাজের এই পরিবর্তন একদিক থেকে যুগান্তকারী বললেও অত্যুক্তি হয় না।
নীলকর ও নীলচাষ—গ্রাম্য জীবনের অভিশাপ
ইংরেজরা এ দেশে বাণিজ্য করতে এসে শাসক হয়েছিলেন। ব্যবসায়ী বুদ্ধি তাঁদের খুব সজাগ ছিল। এই সজাগ বণিকবুদ্ধি যখন বাংলার উর্বর ফসলখেতে প্রযুক্ত হল, তখন সেখানে খাদ্যফসলের (food crops) পরিবর্তে বাণিজ্য—ফসল (commercial) উৎপাদনে তাঁরা উৎসাহী হলেন। ইংরেজ পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীরা জানতেন যে নীল (indigo), পাট (jute) ইত্যাদি বাণিজ্য—ফসল এ দেশের মাটিতে প্রচুর ফলাতে পারলে সোনা ফলানোর মতো হবে। এ দেশের মাটিতে, এ দেশের দরিদ্র চাষি—মজুরের সুলভ মজুরিতে বাণিজ্য—ফসল ফলিয়ে, নিজেদের দেশ ইংলন্ড ও অন্যত্র রপ্তানি করতে পারলে তাঁরা পর্যাপ্ত মুনাফা করতে পারবেন, যা অন্য কোনও সাধারণ ব্যাবসাবাণিজ্যে সহজে করা সম্ভব হবে না। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর মূলধন তাই বাণিজ্য—ফসল উৎপাদনে বিনিয়োগ করা হল। নীলের কথা বলি। বাংলা দেশে বিদেশি মূলধন ও বাণিজ্য—ফসলের ইতিহাসে নীল ও পাট দুটি স্বতন্ত্র অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। বাংলার গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে নীলকর ও নীলচাষের সম্পর্ক অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। কারণ নীলচাষের ব্যাপারে (পাটের ব্যাপারে নয়) নীলকর সাহেবরা বাংলার গ্রামাঞ্চলে শুধু ব্যবসায়ীরূপে নয়, এক অভিনব অত্যাচারী জমিদাররূপেও বিরাজ করতেন। চাষের খেত থেকে আরম্ভ করে তাঁদের নীলকুঠি (indigo factory) পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে তাঁরা এক বিচিত্র রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসেছিলেন। নীলকর সাহেবরা ছিলেন বিদেশি শাসকদের প্রতিভূ, কাজেই স্থানীয় এদেশি জমিদার—তালুকদার—পত্তনিদারদের চেয়ে তাঁদের প্রতাপ—প্রতিপত্তি শতগুণ বেশি ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদাররাও তাঁদের অধীন নীলকর সাহেবদের যথেষ্ট সমীহ ও ভয় করে চলতেন।
১৭৭০ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইংরেজ আমলে বাংলা দেশে নীলচাষ আরম্ভ হয়। কোন ব্যক্তি প্রথমে নীলচাষ আরম্ভ করেন, তা—ই নিয়ে মতভেদ থাকলেও, মোটামুটি জানা যায় যে ল্যুই বোনদ (Louis Bonnaud) নামে এক ব্যক্তি মরিশাসে নীলচাষ করে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশে আসেন। ১৭৭২ সালে তিনি চন্দননগরের কাছে গোঁদলপাড়া গ্রামে দুটি মাত্র ভ্যাট নিয়ে একটি ছোট নীলকুঠি স্থাপন করেন। এটাই বাংলার প্রথম নীলকুঠি। পরে বোনদ চন্দননগর ও চুঁচুড়ার মাঝামাঝি একটি জায়গায় আর—একটি নীলকুঠি ১৭৭৩ সালে করেন। হাওড়ায় শ্যামপুকুরে দু—জন ফরাসি চিকিৎসক এই সময়ে একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। ১৭৮৩ সালের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি নীলকুঠি স্থাপিত হয় এবং বাংলাদেশ থেকে ইংলন্ডে ওই বছরে ১২০০/১৩০০ মন নীল রপ্তানি হয়। ১৭৯৫—৯৬ থেকে ১৮০৪—০৫ সালের মধ্যে বছরে ২৪,০০০ থেকে ৬২,০০০ মন নীল বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়। ১৮১৪—১৫ সালে ৮৫,৪০৮ মন নীল কলকাতা থেকে লন্ডনে চালান দেওয়া হয়। বাংলাদেশের নীলের জন্য কোম্পানি ও ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী উভয়েই মূলধন খাটাতেন। যে দামে বাংলাদেশে নীল তাঁরা কিনতেন (গড়ে ১৬০ টাকা থেকে ২০০ টাকা মন), তার তিন—চারগুণ বেশি মূল্যে লন্ডনের বাজারে বিক্রি করতেন। নীলকরদের দাদন নিয়ে নীল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হত। ১৮১৯—২০ থেকে ১৮২৬—২৭ সালের মধ্যে কোম্পানি মোট যত মূলধন বাংলার নীলের জন্য বিনিয়োগ করেন, তাতে তাঁদের মুনাফা হয় ৩৪৯,০৪০ পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা।২৯ পার্লামেন্টে দাখিল করা হিসেব থেকে মুনাফার এই অঙ্ক গৃহীত, কাজেই হিসেবে যে যথেষ্ট গোঁজামিল ছিল তাতে সন্দেহ নেই। মুনাফার অঙ্ক অন্তত দ্বিগুণ হওয়া স্বাভাবিক, অর্থাৎ ১৮১৯—২০ থেকে ১৮২৬—২৭ সালের মধ্যে শুধু কোম্পানির বাৎসরিক মুনাফা হত বাংলার নীল থেকে প্রায় ১০/১২ লক্ষ টাকা। এ ছাড়া ‘প্রাইভেট মার্চেন্ট’ সংখ্যায় যথেষ্ট ছিলেন, তাঁদের মূলধন ও মুনাফার পরিমাণ কোম্পানির চেয়ে বেশি ছাড়া কম ছিল না। এ দেশি জমিদাররাও অনেকে নীলচাষের মুনাফায় প্রলুব্ধ হয়ে নীলকর হয়েছিলেন এবং নীলকুঠি স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের কথাও এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয়।
নীলচাষের এই প্রথম পর্বের ইতিহাস থেকে বোঝা যায় যে বাংলাদেশে অষ্টাদশ শতকের শেষ দশক থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথম চতুর্থাংশের মধ্যে বাণিজ্য—ফসল নীল বাংলার উর্বর ফসলখেত কত দূর পর্যন্ত জবরদখল করেছিল এবং নীলকর ও নীলকুঠির প্রভাব বাংলার গ্রামে কত দূর বিস্তৃত হয়েছিল। বাংলাদেশে এমন কোনও জেলা নেই যেখানে নীলকর সাহেবের কথা রোমাঞ্চকর জনকাহিনিতে পরিণত হয়নি। হাওড়া—হুগলি, ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া, যশোহর প্রভৃতি জেলায় গ্রামে গ্রামে নীলকুঠির ভগ্নস্তূপ এখনও দেখা যায়, স্থানীয় গ্রাম্য লোক ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে সেগুলি দেখিয়ে দেন এবং গল্প বলেন যে নীলকর সাহেবের প্রেতাত্মা এখনও নাকি ঘোড়ায় চড়ে বেত হাতে নিয়ে, পরিত্যক্ত নীলকুঠির আশপাশের জঙ্গলে অন্ধকার রাতে ঘুরে বেড়ায়। প্রবল শীতের শিহরনের মতো এখনও সেই নীলকর সাহেবের অত্যাচারের কাহিনি শুনলে গ্রামের লোকের শরীর শিউরে ওঠে।
উনিশ শতকের বাংলা ও ইংরেজি সাময়িকপত্রে নীলকরদের দৌরাত্ম্য ও দুর্বিনীত আচরণের কাহিনি এত প্রকাশিত হয়েছে যে শুধু বাংলা পত্রিকার রচনাগুলি সংকলন করলে একটি হাজার পৃষ্ঠার বড় বই হতে পারে। আমরা কয়েকটি রচনার বক্তব্য উল্লেখ করছি।৩০ ‘সংবাদ প্রভাকর’ (৩ আষাঢ় ১২৫৫) লিখেছেন, নীলকরদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বা মামলা—মকদ্দমা কিছু করা যায় না, কারণ ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকে এবং তাঁরা প্রায় নীলকরদের আতিথ্য গ্রহণ করেন। জেলার কর্তা যদি শিকারে যান, বিলাসে যান, তাহলে স্থানীয় কোনও নীলকর সাহেবেরই অতিথি হয়ে নীলকুঠিতে অবস্থান করেন। ”এই নীলকুঠি সংক্রান্ত নিষ্ঠুরতা ও হত্যাঘটিত মোকদ্দমা কতবার সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত হইল, সদর নিজামতের ঘর এ বিষয়ে নথিতে পরিপূর্ণ হইয়াছে কিন্তু তাহাতে এ পর্যন্ত কোন উপকার হইল না।… কয়েক জিলায় কয়েকজন জাইণ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হইলেন, অথচ অত্যাচারের কিছুমাত্র খর্বতা হইল না, ইহার তাৎপর্য এক সাদা বর্ণের সর্বনাশ করিয়াছে, সাহেবরা ম্যাজিষ্ট্রেট হইলে কি হইবে, ঝাঁকের পায়রা ঝাঁকে মিশিয়া যান। তাহার উপর আবার ‘শাদা মুল্লুক জাদা’…” (সংবাদ প্রভাকর, ১ মাঘ ১২৬৫)। নদিয়া জেলায় নীলকরদের অত্যাচার প্রসঙ্গে প্রভাকর লিখেছেন (৬ মাঘ ১২৬৬) : ”প্রদেশ মধ্যে রাজশাসন প্রণালী নাই বলিলেই হয়। নীলকরেরাই রাজা এবং হর্তা কর্তা যাহা মনে করেন তাহাই করিতে পারেন?” মরে সাহেব বিখ্যাত নীলকর ছিলেন, সুন্দরবনে তাঁর নীলের আবাদও ছিল। তাঁর নামেই ‘মরেলগঞ্জ’। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় (২ বৈশাখ ১২৬৯) এই নীলকর মরে সাহেবের স্বেচ্ছাচারিতার একটি বিস্তারিত বিবরণ—’সুসভ্য ইংরাজবংশাবতসং নীলকর শ্রীযুক্ত মরে হইতে প্রজাদিগের নির্বাসন, ভ্রূণহত্যা, স্ত্রীহত্যা, বালহত্যা, বলাৎকার, জালকারিতা প্রভৃতি’—শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বর্ণনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করা হয় : ”ইংরাজ জাতির মধ্যে যে এতদূর দুরাত্মা, এতদূর নির্দয়, এতদূর নিষ্ঠুর আছে, তাহা আমরা পূর্বে জ্ঞাত ছিলাম না। মরে সাহেব অধুনা যাদৃশ দুষ্কর্ম করিতেছেন তাহাতে বোধ হয়, কি অসভ্য বাঙ্গালি, কি প্রসিদ্ধ নিষ্ঠুর মুসলমান কেহ কখন এতদ্দেশে তাদৃশ ঘৃণিত কার্যে প্রবৃত্ত হন নাই।” নীলকরের অত্যাচারে কাতর একজন মুসলমান চাষির একটি চিঠির অবিকল প্রতিলিপি ‘সোমপ্রকাশ’ প্রকাশ করেছিলেন (১৬ চৈত্র ১২৭০)। তার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা হল :
”হা খোদা! তোর মনে এই ছিল! এই রকম কত করছে। থানার দারোগা ৭০০ টাকা ফুরণ করিয়া নিয়েছে সকল গাঁয় নীল বুনিয়ে দেবে, মেজেষ্টরের নিকট দরখাস্ত করিলে লা মঞ্জুর, সারা বছর না খেয়ে মজুরি করে জমিগুলি চাষ করিয়া রাখিয়াছি, আশমান পানি দিলিই ধান বুনবো তাবে বাল বাচ্চা সমেত খেয়ে জান বাঁচাবো। তাই নীল বুনে নেবে, চুক্তি ভঙ্গ বলে সকলে বেচে কিনে নিল, জমায় তিনচারগুণ বেশী করলো, খোদা বান্দা ফাটকে মলো। আরো কত মরে তার ঠেকনা কি? আয়েন্দা ভাত পানির দফা যায়। আল্লা এমন করে মারিস ক্যান? তুই তো সকলই পারিস। একদিন কেন সব রাইয়ত গুষ্টি সমেত মেরে ফেলে সাহেবগারে সব দে না? আর তো বরদাস্ত হয় না। দোহাই আল্লা! এই দরখাস্ত করছি তুই আমাদের মেরে ফেল।”
—আবদুল মতলবে মণ্ডল
দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার একজন গ্রাহক লিখেছেন (২৪ ভাদ্র ১২৬৯) : ”নীলদর্পণের বর্ণনায় যদি কোন মহাত্মার সন্দেহ থাকে, তবে বারেক এ প্রদেশে আগমন করিয়া নীলকরের অত্যাচার ও বিচার প্রণালী ও অস্মদের অবস্থা ক্ষণকাল অবলোকন করিলেই বর্ণিত পুস্তকের একটি কথার প্রতিও অবিশ্বাস করিবার অনুমাত্র কারণ থাকিবে না।”
একজন বিদেশি শিল্পী বাংলা দেশের নীলচাষ ও নীলকুঠির বিস্তারিত সচিত্র বিবরণ দিয়েছেন।৩১ এই বিবরণ থেকে নীলকুঠিতে গড়ে কতজন লোক কী কাজ করত তার একটা হিসেব পাওয়া যায় :
মোট কুলির সংখ্যা ৩৯৫ জন। লেখক বলেছেন, যে বছর চাষ ভালো হয় না, সেই বছর কুলির সংখ্যা সাধারণত এইরকমই থাকে, চাষ ভালো হলে কুলির সংখ্যা এর দ্বিগুণ হয়। এ ছাড়া ভদ্রলোক কর্মচারী—নায়েব গোমস্তা সরকার প্রভৃতি—সংখ্যায় কম থাকেন না।
নীলকররা কীভাবে জোর করে চাষিদের দিয়ে নীলচাষ করান তার একটি নিখুঁত মর্মস্পর্শী বিবরণ ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়েছে (অগ্রহায়ণ ১৭৭২ শক, ৮৮ সংখ্যা)। তত্ত্ববোধিনী লিখেছেন :
”নীল প্রস্তুত করা প্রজাদিগের মানস নহে; নীলকর তাহারদিগকে বলদ্বারা তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত করেন, ও নীলবীজ বপনার্থে তাহারদিগকে উত্তমমোত্তম ভূমি নির্দিষ্ট করিয়া দেন। দ্রব্যের উচিৎ পণ প্রদান করা তাহার রীতি নহে, অতএব তিনি প্রজাদিগের নীলের অত্যল্প অনুচিত মূল্য ধার্য করেন… কখন কখন এপ্রকারও ঘটে যে কোন কৃষক শস্য বপনার্থে কোন উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র সুচারুরূপে কর্ষণপূর্বক অতি পরিপাটিরূপে পরিষ্কৃত করিয়া রাখিয়াছে, ইতিমধ্যে নির্দয় নীলকরের প্রেরিত নিদারুণ লোকেরা তাহার অজ্ঞাতসারে তথায় উপস্থিত হইয়া নীলের বীজ বপন করিয়া যায়—তাহার আশাবৃক্ষ সমূলে নির্মূল করিয়া প্রস্থান করে।’
নীল উৎপাদন করার পরে চাষিদের নিস্তার নেই। নীল কেটে যখন তারা কুঠিতে উপস্থিত করে তখন তাদের ”বিষম বিপত্তির কাল।” ”হিংস্র জন্তুবৎ নৃশংস—স্বভাব আমলারা” দাদন দেবার সময় চাষিদের কাছ থেকে টাকা নেয়, তারপরেও নানারকম ছুতোনাতায় চাষিদের কাছ থেকে তারা টাকা আদায় করে, এবং অবশেষে কুঠিতে যখন চাষিরা নীল নিয়ে আসে তখনও তাদের পীড়ন করা হয়। পঁচিশ মন নীল খাতায় পাঁচ মন লেখা হল এই ভয় দেখিয়ে কুঠির ভদ্রলোক আমলারা টাকা আদায় করতে ছাড়ে না। ”একে নীলকর সাহেব তাহারদিগকে উচিত মূল্যের অর্ধমাত্রও প্রদানে স্বীকৃত হন না, তাহাতে আবার আমলারা তাহারদের উপর ছলে বলে কৌশলে নানাপ্রকার অত্যাচার করে। ইহাতে শত শত ব্যক্তি বর্ষে বর্ষে নীলকর সাহেবদের সন্নিধানে নীলের দাদন গ্রহণ করিয়া ক্রমে এপ্রকার ঋণগ্রস্ত হইতে থাকে, যে তাহাদের পুত্র পৌত্র প্রপৌত্র প্রভৃতিও তৎপরিশোধে সমর্থ হয় না।”
নীলকর ও তাদের অনুচররা কেবল যে চাষিদের উপরই এরকম অত্যাচার করেন তা নয়। ”যাহারা গাড়ি নৌকা বা মস্তকে করিয়া নীলপত্র বহন করে, ও তৎসম্বন্ধীয় অন্যান্য কার্য করে, তাহারদিগেরও প্রতি এই প্রকার ব্যবহার।” চাষিরা যেমন নীলের ন্যায্য মূল্য পায় না, কুঠির কুলিরাও তেমনই উচিত বেতন পায় না, তার জন্য নীলকরের কাছে তারা কাজ করতে চায় না। কিন্তু না চাইলে কী হবে, ”সাহেবের অনিবার্য অনুমতি অবশ্যই অবশ্য পালন করিতে হয়।” নীলকুঠির ভদ্রলোক কর্মচারীদের চরিত্র বর্ণনা করে তত্ত্ববোধিনী লিখেছেন : ”তাহারা ভদ্রলোক বলিয়া বিখ্যাত বটেন, কিন্তু ব্যবহারানুসারে ভদ্রাভদ্র বিবেচনা করিতে হইলে তাঁহারদিগকে এ অ্যাখা প্রদান করা কোনক্রমেই উচিত নহে। যৎকিঞ্চিৎ অঙ্কশিক্ষা মাত্র তাঁহারদের বিদ্যার সীমা; তাঁহারা বিদ্যারসের স্বাদ গ্রহণও করেন না, নীতিশাস্ত্রেও শিক্ষিত হয়েন না। বিদ্যা ও ধর্মবিহীন লোকের যে প্রকার আচরণ হওয়া সম্ভব, তাহা কাহার অগোচর আছে? তাঁহারদের মুখশ্রীতে কেবল লোভ আর নির্দয়তার নিদর্শনই স্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়, জ্ঞান ও ধর্মের চিহ্নমাত্রও দৃষ্টি করা যায় না।” এদের ছেলেপিলেরাও পাঠশালায় কিছু লেখাপড়া শিখে নীলকুঠির যে—কোনও কাজে ঢুকে পড়ে, এবং তারপর বাবা—খুড়োর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নানারকম কদাচার ও অবিচারে প্রবৃত্ত হয়। অনেক পল্লিগ্রামে নীলকুঠির সংশ্লিষ্ট ভদ্রলোক আমলাদের এক—একটা অত্যাচারী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, গ্রামের শান্ত ও নিরীহ লোকজন তাদের সাক্ষাৎ যমদূত মনে করে।৩২
নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনির শেষ নেই। মনে হয় সারা পৃথিবীর স্বেচ্ছাচারিতার ইতিহাসে বাংলা দেশের নীলকর সাহেবরা যেন শীর্ষস্থান অধিকার করে আছেন। তাঁদের জীবনের জপতপধ্যান হল টাকা আর টাকা, মুনাফা আর মুনাফা। খাদ্যফসলের প্রয়োজন নেই, নীলের মতো টাকার ফসল চাই। তার জন্য চাষিদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করা, তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা, ধানি জমিতে জোর করে নীলচাষ করা, এবং তার জন্য থানার দারোগা থেকে যে—কোনও দুর্বৃত্তের সঙ্গে টাকার চুক্তি করা—এসব যেন নীলকরদের জন্মগত অধিকারে পরিণত হয়েছিল মগের মুল্লুক বাংলা দেশে। এই চরম অত্যাচারের ফলেই বাংলা দেশে নীল বিদ্রোহ (১৮৬০) হয়।৩৩ এ দেশের চিরস্থায়ী জমিদার—পত্তনিদার—তালুকদার এবং বিদেশের নীলকররা বাংলার গ্রাম্য সমাজের শান্তি—শৃঙ্খলা ধ্বংস করে, তার যুগযুগান্তের স্থৈর্য ও আত্মসমাহিত রূপ বিকৃত করে, গ্রামের দীনদরিদ্র সাধারণ মানুষকে এই সত্যই উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছিলেন যে সবার উপর টাকা সত্য, তার উপরে আর কিছু নেই। বর্তমান যুগের ‘money economy’ বা টাকাপ্রধান আর্থনীতিক ব্যবস্থার স্বরূপ যে কত দূর হৃদয়হীন ও বিবেকহীন হতে পারে, বাংলার নীলচাষ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এবং নীলকররা তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। নীলকররা কেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী বাংলার জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরাও তার ঐতিহাসিক সাক্ষী।
গ্রাম্য কারুশিল্প ও কারিগরদের অবনতি
প্রধানত ব্যবহার বা ভোগপ্রধান অর্থনীতির (use economy) উপর প্রাচীন কারুশিল্প ও কারিগরশ্রেণির প্রতিষ্ঠা ছিল। কিছুটা বহির্বাণিজ্যও তার সমৃদ্ধির কারণ ছিল। কিন্তু বিনিময়প্রধান অর্থনীতির (exchange economy) যুগে এইসব কারুশিল্প সম্বন্ধে মানুষের মনোভাবই বদলে গেল। কারখানার যন্ত্রপাতি আর কর্মকারের হাতে—গড়া যন্ত্রপাতির মধ্যে প্রভেদ অনেক। কারখানার কলে তৈরি বস্ত্র আর তন্তুবায়ের হাতে তাঁতে তৈরি বস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য যথেষ্ট। ভোগ্য ও ব্যবহার্য জিনিসের প্রতি কলকারখানা ও বিনিময়প্রধান অর্থনীতির যুগে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুতপরিবর্তনশীল। ব্যক্তিগত রুচি, শখ ও বিলাসিতা চরিতার্থ করার জন্য বাংলার গ্রাম্য অভিজাতশ্রেণি একদা বাঙালি কারুশিল্পীর উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, ইংরেজ শাসকদের নতুন রাজস্ববন্দোবস্তের ফলে তাঁরা একেএকে ধ্বংস হয়ে গেলেন। তাঁদের পরিবর্তে যে নতুন গ্রাম্য অভিজাত ও ধনিকশ্রেণির উদ্ভব হল, তাঁরা অধিকাংশই একপুরুষের হঠাৎ—ধনী, প্রধানত শহরে দালালি—বেনিয়ানি—দেওয়ানি করে অর্থ রোজগার করেছেন এবং নিশ্চিন্ত—নিষ্ক্রিয় আয়ের (unearned income) নিষ্কণ্টক পথ অন্বেষণ করে জমিদারি কিনে ‘চিরস্থায়ী’ জমিদার হয়েছেন। বড়—মাঝারি—ছোট নির্বিশেষে এই শ্রেণির ‘city-capitalist’ (কার্ল মার্কসের ভাষায়) জমিদাররা ‘বিলাতি’ বা বিদেশি ভোগ্যবস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হলেন বেশি, এমনকী বিলাতি দ্রব্য ব্যবহারের সঙ্গে তাঁদের নতুন সামাজিক পদমর্যাদার (social status) যোগসূত্রও স্থাপন করলেন, এবং অনাদরে ও উপেক্ষায়, পোষকতার অভাবে, সেকালের বংশানুক্রমিক কারুশিল্পজীবীরা উৎসন্নে গেলেন। তা ছাড়া বিনিময়—যুগের বাজার (market) হল প্রতিযোগিতার বাজার। কারখানাজাত বিলাতি দ্রব্যের কাছে বিনিময়—মূল্যের প্রতিযোগিতায় পরাজয় স্বীকার করে দেশীয় কারুশিল্পকে বাজার থেকে বিদায় নিতে হল। দুটি কারণে দেশীয় শিল্পের অবনতি হল—দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্যের প্রতি এ দেশের ব্যবহারকদের (consumers) মনোভাবের পরিবর্তন, নতুন উপযোগ—বোধ (utility) এবং কলে তৈরি বিলাতি দ্রব্যের সুলভ মূল্য। ‘সোমপ্রকাশ’ এসম্বন্ধে লিখেছেন (২৬ চৈত্র ১২৯০) : ৩৪
”এক্ষণে বঙ্গদেশের মধ্যে যে কিছু শিল্পদ্রব্য উৎপন্ন হয় তাহা বঙ্গদেশ ছাড়িয়া বাহিরের মুখ দেখিতে পায় না। পূর্বে যে যে শিল্পের সদ্ভাব ছিল, পাশ্চাত্ত্য বাণিজ্য সংস্রবে তাহার যে মহত্তর অনিষ্ট ঘটিয়াছে, চিন্তাশীল লোকমাত্রেই তাহা অনুভব করিয়াছেন। ১৮৮২—৮৩—এর বঙ্গদেশীয় শাসন সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনীতে স্পষ্ট লিখিত হইয়াছে যে ‘ইংলণ্ড হইতে বাহুল্যরূপে বস্ত্রের আমদানী হওয়াতে দেশীয় উৎকৃষ্ট শিল্প ও যন্ত্রসকল বিনষ্ট হইতেছে।’ পূর্বের ন্যায় আর ঢাকায় মসলিন প্রস্তুত হয় না, এখনকার ঢাকাই তন্তুবায়গণ আর সে প্রকার সূতা প্রস্তুত করিতে পারে না। তাহারাও সম্পূর্ণরূপে ম্যাঞ্চেষ্টারের অধীন হইয়া পড়িয়াছে। দেশীয় তন্তুবায়েরা সুতার কাজ প্রায় পরিত্যাগ করিয়াছে। বিলাত হইতে যে সকল সুতার আমদানী হয়, এখানকার তাঁতিরা তাহারই ব্যবহার করে। বস্ত্রবয়ন কার্য প্রায় উঠিয়া গেল। এক্ষণে চটের খোলের ব্যবসায় তৎস্থান অধিকার করিয়াছে। কলিকাতা ও অন্যান্য স্থানাদিতে চটের কলে খাটিয়া অধিকাংশ লোক জীবিকা উৎপাদন করে। এক্ষণে যে যে স্থানে যে যে সামান্য প্রকার দ্রব্য উৎপন্ন হয় তদ্বৃত্তান্ত লিখিত হইতেছে। বর্ধমান বিভাগে কালনায় লালবাগানে যে সকল ধুতি ও শাড়ী প্রস্তুত হইয়া থাকে, তাহা এখনও উৎকৃষ্ট বলিয়া প্রসিদ্ধ। বিলাতের বস্ত্রের আমদানিতে ইহারও ক্রমশঃ অবনতি হইতেছে। বর্ধমান জেলায় ৯টা পাটের কল ৩টা কাপড়ের কল আছে এই সকল কলে চট ও বস্ত্র উৎপন্ন হইয়া থাকে। রামপুর উপরিভাগে পাটের দড়ি অধিক হইয়া থাকে। গত বৎসর পাটের কলে ৭১৪৭৫৭ মণ দ্রব্য প্রস্তুত হইয়াছিল। হাবড়ায় তুলার কলের কার্যের ক্রমশই হ্রাস হইয়া আসিতেছে। পশ্চিম অঞ্চলে তুলার কলে যেরূপ লাভ হইতেছে, হাবড়ার কলে সেরূপ হইতেছে না কিন্তু চটের কলে উত্তমরূপ লাভ হইতেছে, পাটের গাঁইট কষার জন্য ৩টি কোম্পানী হইয়াছে। বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলায় কতকগুলি লাক্ষার কারখানা আছে। এক বাঁকুড়ায় ৩৪টা লাক্ষার কল হইয়াছে। উক্ত জেলায় লাক্ষার ব্যবসায়ই প্রধান। বীরভূমে ইসলামবাজার নামক স্থানে এদেশীয়দিগের ৮টি লাক্ষার কারখানা আছে। এস্থলে বলা বাহুল্য যে বহির্বাণিজ্য সম্বন্ধে ঐ একটি পদার্থ এদেশের প্রধান দ্রব্য। বর্ধমানে, হুগলী ও মেদিনীপুর অঞ্চলে ধাতু পাত অধিকাংশ প্রস্তুত হয়, তাহাও বিদেশে রপ্তানি হইয়া থাকে। ১৮৮২।৮৩ অব্দে বর্ধমান জেলা হইতে আট লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার টাকার কাঁসা বিলাতে প্রেরিত হইয়াছিল। ঐ অব্দে হুগলি হইতে ছয় লক্ষ সাঁইত্রিশ হাজার ও মেদিনীপুর হইতে আটাশ লক্ষ ঊনষাট হাজার টাকার পিত্তল বিলাতে রপ্তানি হয়। বর্ধমান জেলার মধ্যে কাঞ্চননগর শিল্পের একটি প্রসিদ্ধ স্থান। তথায় ছুরি কাঁচি প্রভৃতি অস্ত্রসকল অতি উত্তমরূপে প্রস্তুত হইয়া থাকে। রানীগঞ্জ ও বর্ধমানের কাটরা (কাটোয়া?) বিভাগে কুম্ভকারের কার্যের কিছু কিছু উন্নতি আছে। বর্ধমানের মধ্যে রঘুনাথচক নামক স্থানে পোর্ট সিমেণ্ট প্রস্তুত করিবার একটি কারখানা হইয়াছে। উহার বাণিজ্যে কিছু কিছু লাভ হইতেছে। রানীগঞ্জে উক্ত সিমেণ্ট করিবার জন্য একটি বৃহৎ কারখানা প্রস্তুত হইতেছে। ইহার কার্য অদ্যাপি আরম্ভ হয় নাই। বালির কাগজের কার্য উত্তমরূপ চলিতেছে। ২৪—পরগণার মধ্যে ৩৪টি কল আছে। ঐ সকল কলে সাতাইশ হাজার লোক খাটিয়া থাকে। ঐ সকল কলে থোলে, কাপড়, সূতা, ইট, চাউল, তৈল, লাক্ষা প্রস্তুত হয়। কেরোসিন তৈলের আমদানি নিবন্ধন রেড়ি তৈলের আমদানি কলের কার্য মন্দ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। উক্ত বিভাগে মৃৎপাত্র লৌহ ও পিত্তল পাত্র, অস্ত্রাদি ও শৃঙ্গের কার্য বহুল পরিমাণে হইতেছে। শান্তিপুরের উৎকৃষ্ট বস্ত্র ব্যবসায় বিলাতি যন্ত্রের আমদানি নিবন্ধন ক্রমেই অবনতি হইতেছে। রেশম প্রস্তুত করিবার প্রধান স্থান মুর্শিদাবাদ। এই ব্যবসারও ক্রমে লোপ হইবার সূচনা হইয়াছে। নদীয়াতে রেশমের একটি কুঠি আছে। বিলাতি সার্টিন ও অন্যান্য বস্ত্রের আমদানি হেতু এ ব্যবসায়টিও লোপ পাইতে বসিয়াছে। খুলনা জেলাতে মৃত্তিকাপাত্র পাটও অধিক জন্মে। কোন কোন স্থানে লবণও প্রস্তুত হইয়া থাকে। …রাজসাহী ও রঙ্গপুরের পিত্তলের বাসন বিদেশে অধিক রপ্তানি হইয়া থাকে। দিনাজপুর বগুড়া জলপাইগুড়ি পাবনা প্রভৃতি জেলাতে নানাপ্রকার মাদুরের ব্যবসা আছে… ঢাকা বিভাগে শঙ্খের কাজ, নারিকেল তৈল, চিনি, পিত্তল পাত্র, স্বর্ণ ও রৌপ্যের দ্রব্যাদি, মাদুর, সাবান, পনির ইত্যাদি অনেক দ্রব্য উৎপন্ন হয়। ইহা ভিন্ন নৌকা নির্মাণ প্রভৃতি সূত্রধরের কার্য ও কুম্ভকারের কার্যও অধিক হয়।”
কারুশিল্পের এই বিবরণ পর্যাপ্ত ও বিস্তারিত নয়। বিস্তারিত বিবরণ দেবার প্রয়োজন নেই এখানে। কী কারণে কারুশিল্পের অবনতি হয়েছে বাংলাদেশে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছেন ‘সোমপ্রকাশ’। অনেক দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্যের বাইরে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দেশের মধ্যেও কিছু কিছু কলকারখানা গড়ে ওঠাতে দেশীয় শিল্পের লোপ পেয়েছে। বিদেশের শিল্পদ্রব্যের আমদানির ফলেও দেশীয় কারুশিল্পের অবনতি হয়েছে। ‘সোমপ্রকাশ’ কথিত এই কারণগুলি ছাড়াও দেশীয় শিল্পের অবনতির আর একটি বড় কারণ হল—ব্রিটিশ আমলে নাগরিক ধনিক ও মধ্যবিত্তশ্রেণির ভোগ্যবস্তুর প্রতি মনোভাবের পরিবর্তন, বিদেশি দ্রব্যের চাকচিক্যের প্রতি অনুরাগ ও সাধারণভাবে খানিকটা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পদ্ধতি—বদল।
দেশীয় শিল্প ও তৎসংক্রান্ত বাণিজ্যের ক্রমাবনতির ফলে বাংলাদেশে পুরাতন শিল্পনগরগুলিরও (সেন্সাসে এই নগরগুলিকে ‘Country towns’ এবং পরে ‘Residential towns’ বলা হয়েছে) অবনতি হয়েছে। এইসব নগরে লোকসংখ্যার ক্রমিক হ্রাস থেকে তা বোঝা যায় :৩৫
কালনা দাঁইহাট খড়ার রামজীবনপুর চন্দ্রকোনা মুর্শিদাবাদ—এগুলি বাংলাদেশের প্রাচীন শিল্পনগর। এই নগরগুলির ক্রমিক অবনতির কারণ টমসন তাঁর ১৯২১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে যা নির্দেশ করেছেন তা এই : (১) এইসব নগরে যাঁরা নতুন চাকরিজীবী ও বৃত্তিজীবী—শিক্ষক কেরানি উকিল—মোক্তার প্রভৃতি—তাঁরা শহরে সপরিবারে বাস করেন না। গ্রামে তাঁদের পরিবার থাকে, শহরে তাঁরা একলা থাকেন অর্থ রোজগারের ধান্দায়; (২) নতুন শাসনকেন্দ্র বা শিল্পকেন্দ্র যেসব নগরে স্থাপিত হয়নি, তাদের অবনতি হয়েছে; (৩) যুবকরা স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। এই কারণগুলিকে এককথায় টমসন সাহেব নাগরিক জীবনের প্রতি বাঙালির বিরাগ—“unpopularity of town life among the people of Bengal”—বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এ কথা যে সত্য নয় তা বাংলাদেশে কলকাতা শহর তো বটেই, বর্ধমান কৃষ্ণনগর বহরমপুর প্রভৃতি জেলাশহর, মহকুমাশহর ও নতুন শিল্পনগরের প্রসার ও লোকসংখ্যাবৃদ্ধির ইতিহাস থেকে বোঝা যায়। বাঙালির, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালির, মন গ্রামমুখী নয়, শহর—নগরমুখী।
পুরাতন শিল্পনগরের অবনতির প্রধান কারণ হল—দেশীয় শিল্পের পোষকতার অভাব, বিদেশি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তার পরাজয়, এবং নতুন কারখানা শিল্পের বিস্তার। দ্বিতীয় কারণ হল—নতুন রাজধানী—শহর (যেমন কলকাতা), নতুন জেলাশহর (যেমন বর্ধমান কৃষ্ণনগর বহরমপুর প্রভৃতি) ও নতুন শিল্পনগরের (যেমন টিটাগড় নৈহাটি ও অন্যান্য পাটকল অঞ্চল, বা নতুন শিল্পকেন্দ্র) লোকাকর্ষণশক্তির (‘pull’) প্রাবল্য। পুরাতন কারুশিল্পীশ্রেণির একটা বড় অংশ, আর্থিক কারণে, নতুন কারখানা শিল্পে মজুর হয়েছেন, অথবা শহরে—নগরে নতুন বৃত্তি অবলম্বন করেছেন বংশগত বৃত্তি ছেড়ে, জীবনধারণের তাগিদে। পূর্বোদ্ধৃত ‘সোমপ্রকাশ’—এর বিবরণের মধ্যে এই ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট। তন্তুবায়, কর্মকার প্রভৃতি বৃত্তিজীবীদের মধ্যে একটা বড় অংশ তো বটেই, পটুয়াশিল্পী, কথক প্রভৃতি চারুশিল্পীদের মধ্যেও অনেকে নতুন শহরে—নগরে এসে বৃত্তিবদল করেছেন। যেমন বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলের পটুয়াশিল্পীরা অনেকে কলকাতা শহরে, অথবা কোনও জেলাশহরে, গৃহনির্মাণশিল্পী, রাজমিস্ত্রি বা প্রতিমানির্মাণের কাজে নিযুক্ত হয়েছেন।৩৬ যেমন ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়াম কেরির বাংলা টাইপ—কাস্টিং—এর কাজে পঞ্চানন কর্মকার নিযুক্ত হয়েছিলেন, তেমনি অনেক বাঙালি কর্মকার হয়তো ছুরি—কাঁচি—বঁটি—কাটারি তৈরির পরিবর্তে নতুন মুদ্রণশিল্পের যুগে ‘টাইপ—কাস্টার’ বা অক্ষর—খোদাইশিল্পী হয়েছিলেন। এরকম দৃষ্টান্ত আরও অনেক দেওয়া যায়। কিন্তু এর ভিতর থেকে সামাজিক গতির (social trend) দিঙনির্ণয় করাই হল আসল সমস্যা। আমরা দেখেছি ইংরেজ শাসকদের রাজস্ব সংগ্রহনীতির নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষার পরে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়েছে, নতুন জমিদারশ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, তাঁদের অধীন পত্তনিদার—দরপত্তনিদার প্রভৃতি অসংখ্য খুদে জমিদারকে একই আইনসঙ্গত অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, বাণিজ্য—ফসল নীলচাষের ফলে গ্রামের পর গ্রাম প্রায় শ্মশানে পরিণত হয়েছে, গ্রাম্য সমাজের কারুশিল্পীশ্রেণিকে উৎখাত করা হয়েছে, চাকরাজ—লাখেরাজ প্রভৃতি সম্পত্তিভোগ থেকে ঘাটোয়াল—পাইক—চৌকিদার ও অন্যান্য বৃত্তিজীবীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। ৩৭
নতুন জমিদারশ্রেণির স্থায়ী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে পুরাতন সমাজব্যবস্থা (ফিউডাল) বজায় রাখার চেষ্টা করলেন ব্রিটিশ শাসকরা, কিন্তু জমিদারদের কাছ থেকে সেকালের সামন্ত যুগের একটা বড় ক্ষমতা অপহরণ করে নিলেন। গ্রাম্য সমাজ রক্ষা করার বা শাসন করার কোনও অধিকার বা দায়িত্ব জমিদারদের রইল না, অথচ তাঁরা যাতে স্থায়ীভাবে নিরাপদে জমিদারি ভোগ করতে পারেন, এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যেভাবে খুশি ইজারা দিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করা হল। এ নীতি স্ববিরোধী (contradictory)। একদিকে সেকালের সমান্তব্যবস্থা কায়েম করার ব্যবস্থা করা হল, আবার অন্যদিকে তার ভিতটিও ভেঙে দেওয়া হল। ঠিক এইরকম আত্মবিরোধী নীতি অনুসরণ করেই আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসকরা, তাঁদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও, একটা যুগান্তকারী সামাজিক পরিবর্তনের ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। সেকালের সামন্ত যুগের যথেষ্ট উচ্ছিষ্ট থাকা সত্ত্বেও, এবং ব্রিটিশ শাসকদের ইচ্ছা, চিন্তা ও নীতির বিরুদ্ধেও তাঁরা যে বাংলার সেকালের গ্রাম্য সমাজের ভিতটি ভেঙে দিয়েছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। বণিকসুলভ মনোভাব, বিনিময়প্রধান অর্থনীতি, অবাধ বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতার ‘মার্কেট’ বা বাজার, টাকার মানদণ্ডে জমিদারের প্রভাব—বিচার ও মর্যাদার তারতম্য—এতসব ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া থেকে বাংলার গ্রাম্যসমাজ নিষ্কৃতি পায়নি। সেকালের বাংলার গ্রাম্যসমাজের ভিত পর্যন্ত নাড়া দিয়ে তাঁরা যে সামাজিক পরিবর্তনের (social change) প্রেরণা (stimulus) সঞ্চার করেছিলেন তা মিথ্যা নয়। ঐতিহাসিক ঘটনার লৌহবর্ম ভেদ করে যদি অন্তরে প্রবেশ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে ব্রিটিশ শাসকরা একটা বড় রকমের সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন এ দেশে, অনেকটা তাঁদের অজ্ঞাতসারে।
গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তনের রূপ ও ধারা
সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস (Karl Marx) ব্রিটিশ শাসন—শোষণনীতির ফলে ভারতীয় সমাজের পরিবর্তন প্রসঙ্গে এই কথাই বলেছেন। তিনি লিখেছেন, অতীতে ভারতের রাজনৈতিক জীবনে যত পরিবর্তনই হোক—না কেন, সেই সুদূর অতীত থেকে প্রায় উনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত তার সামাজিক জীবনের বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি। তাঁত ও চরকা চিরকাল ভারতের অসংখ্য তাঁতি ও সুতাকাটনির জীবিকা ছিল এবং ভারতের স্থিতিশীল সমাজের প্রধান স্তম্ভ ছিল কারুশিল্প। ভারতের সমাজজীবনে অনধিকার প্রবেশ করে ব্রিটিশ শাসকরা চরকা ও তাঁত ধ্বংস করেছেন—“It was the British intruder who broke up the Indian handloom and destroyed the spinning wheel.” ভারতের গ্রাম্য সমাজ ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবারকেন্দ্রিক সমাজ। তাঁত, চরকা ও কৃষিকাজ ছিল এই পরিবারনির্ভর সমাজের স্তম্ভ এবং পরস্পরনির্ভর গৃহশিল্প ও কৃষিকাজ থেকে তার আর্থনীতিক প্রয়োজন মিটে যেত। এই সুস্থির সমাজজীবনে হস্তক্ষেপ করে ইংরেজরা হয় সুতাকাটনিকে নিয়ে গেলেন ল্যাঙ্কাশায়ারে, আর তাঁতিকে রাখলেন বাংলা.দশে, না হয় তাঁতি ও কাটনি উভয়কেই ধ্বংস করে ছোট ছোট স্বাবলম্বী সমাজকেন্দ্রগুলির আর্থিক ভিত ভেঙে দিলেন। তার ফলে এশিয়ায় যে সামাজিক বিপ্লব ঘটল, সত্য কথা বলতে কী, তা এই প্রথম, পূর্বে কখনো ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। মার্কস বলেছেন :
“Those family communities were based on domestic industry, in that peculiar combination of hand-weaving, hand-spinning and hand-tilling agriculture which gave them self-supporting power. English interference having placed the spinner in Lancashire and the weaver in Bengal, or sweeping away both Hindu spinner and weaver, dissolved these small…communities, by blowing up their economical basis and thus produced the greatest, and to speak the truth the only social revolution ever heard of in Asia.”
এ কথা সত্য, মার্কস বলেছেন যে, কোনও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ইংরেজরা হিন্দুস্থানে এই সামাজিক বিপ্লবের সূত্রপাত করেননি, বরং অত্যন্ত কুৎসিত মনোভাব ও স্বার্থের বশবর্তী হয়ে করেছিলেন এবং তা কার্যকর করতে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয়ও দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্নটা তা নয়। প্রশ্ন হল, মানবজাতির ভবিষ্যৎ কি সুন্দর হতে পারে যদি এশিয়ায় এই ধরনের কোনও মৌল সামাজিক বিপ্লব না ঘটে? হতে পারে না, এবং তা যদি না হয় তাহলে ইংলন্ড যত অন্যায়—অপরাধই করুক—না কেন, তার অজ্ঞাতসারেই সে এই বিপ্লব সংঘটনে ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছে—
“England, it is true, in causing a social revolution in Hindusthan was actuated only by the vilest interests, and was stupid in her manner of enforcing them. But that is not the question. The question is, can mankind fulfil its destiny without a fundamental revolution in the social state of Asia? If not, whatever may have been the crime of England she was the unconscious tool of history in bringing about that revolution.”৩৮
মার্কসের এই বিশ্লেষণের তাৎপর্য গভীর। ব্রিটিশ শাসন ও শোষণনীতির কঠোর সমালোচনা করা এক জিনিস, এবং সেই নীতির ফলে আমাদের দেশের সমাজজীবনে প্রচণ্ড বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল তার স্বরূপ ও গতিধারা পর্যালোচনা করা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। সামন্ততন্ত্র (Feudalism) থেকে ধনতন্ত্রের (Capitalism) স্তরে যাত্রাপথে সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তিতে একটা বড় রকমের রূপান্তর ঘটেছিল। গৃহশিল্প—কারুশিল্প থেকে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রশিল্পের পথে অগ্রগতি এই রূপান্তরের অন্যতম কারণ সন্দেহ নেই, কিন্তু তার সঙ্গে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল—যাকে এককথায় বলা যায় মানুষের মধ্যে টাকাসর্বস্ব মানসতার (money-oriented mentality) বিকাশ। এই মানসতার বিকাশ হয়েছিল আর্থনীতিক ক্ষেত্রে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তনের জন্য। সেই পরিবর্তন হল, ‘স্বাভাবিক অর্থনীতি’র (natural economy) স্তর থেকে ‘টাকার অর্থনীতি’র (money economy) স্তরে উত্তরণ। আধুনিক অর্থবিজ্ঞানীরা ‘natural economy’ ও ‘money economy’ কথা দুটি আর বিশেষ ব্যবহার করেন না, তার পরিবর্তে ‘use economy’ ও ‘exchange economy’ কথা দুটি ব্যবহার করেন। আত্মনির্ভর গ্রাম্য সমাজের স্বল্পপরিসর বাজারে কৃষক ও কারুশিল্পীরা পরস্পরের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের আদানপ্রদান করত। ব্যাবসাবাণিজ্য হত বটে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনাতিরিক্ত উৎপাদন (surplus production) করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ব্রিটিশ আমলে নতুন স্বাধীন বাণিজ্যের ফলে, এবং বাজারে বিদেশি জিনিসের আমদানির জন্য, পুরাতন কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যাদির চাহিদা কমতে থাকে। পুরাতন পরিবার—আবদ্ধ শ্রমবিভাগের (division of labour) সংকীর্ণতাও নতুন প্রসার্যমাণ প্রতিযোগিতার বাজারে (expanding competitive market) অচল হয়ে ওঠে। টাকা—পণ্য—বিনিময়প্রধান অর্থনীতির প্রভাবে সেকালের গ্রাম্য সমাজের প্রয়োজনমুখী অর্থনীতির ভিত ভেঙে যায়। এই হল প্রয়োজনপ্রধান অর্থনীতির উপর বিনিময়প্রধান অর্থনীতির সংঘাতের প্রথম ফল।
দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হল—টাকা বিনিময়—মাধ্যম (medium of exchange) হওয়ার ফলে উৎপাদনের প্রতি উৎপাদকের মনোভাবের পরিবর্তন হল। স্থাবর সম্পত্তি ও বিনাশশীল দ্রব্যাদি স্তূপাকার করে ধনসঞ্চয় করার আর প্রয়োজন রইল না। চরম সীমা পর্যন্ত ধনসঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা গতিশীল ও ঘূর্ণায়মান টাকার দ্বারা পরিতৃপ্ত করা সম্ভব হল। দৃশ্যমান জড়বস্তুর বদলে যখন অদৃশ্য টাকার পুঁজি পর্বতপ্রমাণ করার পথেও আর কোনও বাধা রইল না, তখন মানুষের মনোভাবের একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে গেল। কেবল যারা টাকা লেনদেনের কাজকর্মে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ল তারা নয়, সাধারণ লোক যারা খুব বেশি জড়িত হতে পারল না, তারাও এই টাকাপ্রধান অর্থনীতির জাদুস্পর্শ থেকে মুক্তি পেল না। সুতরাং শুধু নতুন যুগের বণিক—ব্যবসায়ীরা নয়, সেকালের রাজা—মহারাজা—জমিদাররাও টাকার দৃষ্টি দিয়ে তাঁদের স্থাবর—অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির মূল্যায়ন করতে আরম্ভ করলেন। মার্কসীয় অর্থবিজ্ঞানী পল সুইজি (Paul M. Sweezy) সুন্দর করে এই বিষয়টি বুঝিয়েছেন : ৩৯
“…the very existence of exchange value as a massive economic fact tends to transform the attitude of producers. it now becomes possible to seek riches, not in the absurd form of a heap of perishable goods but in the very convenient and mobile form of money or claims to money. The possession of wealth soon becomes an end in itself in an exchange economy, and this psychological transformation affects not only those who are immediately involved but also… those who come into contact with the exchange economy. Hence not only merchants and traders but also members of the old feudal society acquire what we should call today a business-like attitude toward economic affairs.”
এই প্রতিক্রিয়ার স্বাভাবিক পরিণতি হল সমাজের বিত্তবান অভিজাতশ্রেণির ভোগবিলাসের রুচির পরিবর্তন। ঐতিহাসিক পিরেনি (Henri Pirenne) এ সম্বন্ধে বলেছেন :৪০
“…in every direction where commerce spread, it created the desire for the new articles of consumption, which it brought with it. As always happens, the aristocracy wished to surround themselves with the luxury, or at least the comfort befitting their social rank.”
বাংলাদেশের নাগরিক ও গ্রাম্য অভিজাতশ্রেণির ভোগবিলাস চরিতার্থতার দিক থেকে এ কথা যে কতখানি সত্য তা আমরা জানি।
বিনিময়প্রধান অর্থনীতির আর—একটি ঐতিহাসিক ফল হল, নতুন শহর—নগরের বিকাশ। গ্রাম্যজীবনের গড্ডলপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শতসহস্র বিধিনিষেধের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ নতুন শহরে ও নগরে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচতে চাইল। সুইজির ভাষায় :—“the rise of the towns, which were the centers and breeders of exchange economy, opened up to the servile population of the countryside, the prospect of a freer and better life.”৪১
কার্ল মার্কস তাঁর ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে ভারতীয় সমাজে নতুন বিনিময়প্রধান অর্থনীতির প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে বলেছেন :
“The greater part of the products is destined for direct use by the community itslef, and does not take the form of commodities. Hence production here is independent of that division of labour brought about, in Indian society as a whole, by means of the exchange of commodities.”
মার্কস বলেছেন যে ভারতীয় সমাজে কুলানুগামী শ্রমবিভাগ অনেকটাপ্রাকৃতিক বিধানের (Law of Nature) মতো কার্যকর ছিল। কর্মকার সূত্রধর তন্তুবায় সকলে স্বাধীনভাবে, কিন্তু বংশগত ধারা অনুযায়ী, নিজেদের কাজকর্ম করত, অর্থাৎ শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করত। এই সহজ—সরল উৎপাদনরীতি এত দূর কুলানুবর্তী ছিল যে কোনওদিন তা ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। যদি দৈবাৎ কোনওদিন ধ্বংস হত, তাহলে পুনরায় সেই এক স্থানে, একই পদ্ধতিতে আবার তার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা সম্ভব হত। কুলানুগামী উৎপাদনরীতির এই স্বাভাবিক সারল্যই, মার্কস বলেছেন : “supplies the key to the secret of the unchangeableness of Asiatic society” এবং রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও ভারতীয় সমাজের আর্থ ভিত্তি অচল—অটল ছিল এই কারণে—“The structure of the economic elements of society remains untouched by the storm-clouds of policital sky.”৪২
এশিয়ার তথা ভারতীয় ও বাংলার সমাজের এই অচলতা ও স্থিতিশীলতা ব্রিটিশ শাসন—শোষণনীতির ফলে ধ্বংস হয়ে গেল। ধ্বংসস্তূপের উপর হয়তো নবযুগের প্রয়োজন অনুযায়ী কোনও নতুন সমাজের ভিত সেখানে স্থাপিত হল না, অথবা তার কোনও নতুন কাঠাম বা ‘structure’ গড়ে উঠল না, ব্রিটিশ স্বার্থের প্রতিবন্ধকতার জন্য। বিনিময়প্রধান অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি হল যন্ত্রশিল্পায়নের (industrialisation) দিকে, এবং একাধিক শিল্পনগরের (industrial towns) বিকাশের দিকে। এই গতিও ব্রিটিশ শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে প্রতিরুদ্ধ হল। বাণিজ্য নীতিগতভাবে কুলবন্ধনমুক্ত হলেও, বিদেশি শাসকরা শতবন্ধনে তার স্বচ্ছন্দ গতিতে বাধা সৃষ্টি করলেন। তার ফলে বাংলার গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তনের রূপ কালোপযোগী হল না এবং পরিবর্তনের গতিও ইতিহাস—নির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত হল না। কিন্তু তা না হলেও, ব্রিটিশ আমলের ‘exchange economy’—র ঘাতপ্রতিঘাত থেকে বাংলার গ্রাম্যসমাজ ও গ্রাম্য মানুষ রক্ষা পেল না। তার বৈদ্যুতিক ‘শক’ তার ভিত পর্যন্ত সজোরে নাড়া দিল। তার দৃষ্টিভঙ্গি ও মনের পরিবর্তন হল। প্রাচীন সমাজের পিঞ্জর জীর্ণ অবস্থাতেই রইল, একেবারে ভাঙল না। তা সত্ত্বেও নতুন দৃষ্টি ও মন সেই জীর্ণ পিঞ্জরের বাইরে ভবিষ্যৎ সমাজের রূপরেখা দেখতে পেল। বাংলার গ্রাম্যজীবনে নতুন গতি সঞ্চারিত হল, এবং সেই গতির স্বাচ্ছন্দ্য—স্বাধীনতা পদে পদে ব্যাহত হলেও, গতিটা মিথ্যা নয়।
গ্রাম্য সমাজের গতিশীলতা (social mobility) এমনিতেই নাগরিক সমাজের মতো বেশি সচল নয়, কিছুটা মন্থর। কারণ প্রাচীন ঐতিহ্য (tradition), আমাদের দেশে জাতিভেদ ও কুলবর্ণগত সংস্কার, ধর্ম ও শাস্ত্রগত সংস্কার—প্রভৃতির প্রভাব গ্রাম্যসমাজে অনেক বেশি গভীর। এগুলি সামাজিক অচলতা ও কূপমণ্ডূকতা সহজে ভাঙতে দেয় না এবং নতুন কোনও গতির সচলতাও বৃদ্ধি করে না।৪৩ তা সত্ত্বেও বাংলার গ্রামে সামাজিক গতিশীলতার একটা ‘প্যাটার্ন’ উনিশ শতকে দেখা যায়, যার রেখাচিত্র মোটামুটি এইরকম :
কৃষক—খেতমজুররা অনেকে শহরে—নগরে গিয়ে জীবিকার তাগিদে দিনমজুর বা গৃহভৃত্য হয়েছেন, কারুশিল্পীরা কারখানার মজুর ও দক্ষ শ্রমিক হয়েছেন এবং এই উভয় শ্রেণির মধ্যে কেউ কেউ জীবনসংগ্রামে জয়ী হয়ে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীর স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন। জমিদারির মধ্যস্বত্বভোগীদের মধ্যে একটা অংশ শহরে চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী মধ্যবিত্তের জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় হল, এই তিন শ্রেণির মধ্যে যাঁরা শহরমুখী হয়েছেন, তাঁদের সম্পূর্ণ urbanisation সম্ভব হয়নি, অর্থাৎ তাঁরা পুরোপুরি শহুরে বা শহরবাসী হতে পারেননি। যেমন গ্রাম থেকে শহরে এসে যাঁরা মজুর হয়েছেন তাঁরা সম্পূর্ণ ‘proletarianised’ হননি, তেমনি গ্রামের জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী যাঁরা শহরমুখী হয়েছেন এবং শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তশ্রেণিতে গৃহীত হয়েছেন, তাঁরাও সম্পূর্ণরূপে ‘urbanised’ হননি। শহরমুখী প্রায় সকল শ্রেণির লোকের এক—পা ছিল গ্রামে, এক—পা ছিল শহরে। ১৯২১ সালের সেন্সাস অধিকর্তা টমসন সাহেব বাঙালির নগরজীবনের যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, তা হল এই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ বৈশিষ্ট্যের কারণ হল আর্থনীতিক। গ্রামের জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী শহুরে জীবন বা চাকরি—ব্যাবসার জন্য তাঁদের জমিদারি বা তার উপস্বত্বের আয় ছাড়তে পারেননি, এবং নাগরিক জীবনের প্রতিষ্ঠা, বিলাসিতা, শিক্ষাদীক্ষা ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য গ্রাম্য আয়ের উপর (যার সবটুকু প্রায় অনুপার্জিত আয়) নির্ভর করেছেন বেশি। আর কৃষক—কারুবর্গ যাঁরা শহরে দিনমজুর, গৃহভৃত্য, কারখানার মজুর, অথবা ছোট ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবী হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে সপরিবারে সম্পূর্ণ শহরবাসী হওয়া আর্থিক কারণেই সম্ভব ছিল না। এইভাবে নাগরিক জীবনের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলার গ্রাম্য সমাজে। বাংলার জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী বিরাট খুদে জমিদারগোষ্ঠী, বাংলার কৃষক ও কারুশিল্পী শহরের বার্তা গ্রামে বহন করে নিয়ে গিয়েছেন। এমনকী গ্রামের দরিদ্র কৃষক—খেতমজুর যাঁরা শহরে এসে দিনমজুর বা গৃহভৃত্য হয়েছেন, তাঁরাও গ্রামে ফিরে গিয়ে শহুরে জীবনের কত রূপকথাই না গ্রামবাসীর কাছে বর্ণনা করেছেন!৪৪ শহরে সাহেবের খানসামা—খিদমতগার, নাগরিক অভিজাত—পরিবারের ভৃত্য গ্রামে গেলে মনিবের প্রতিনিধির মতো ব্যবহার করে গ্রাম্য সমাজে বিশেষ মর্যাদা পায়, গ্রামের লোক পুরোনো রামায়ণগান ও কথকতার মতো নগরজীবনের নতুন রূপকথা ও কথকতা শোনে। শহরের জীবনযাত্রার হাওয়া নানা পথে, নানা রকমের লোকের মুখে মুখে গ্রামে বয়ে যায়। শহরের মন গ্রামের মনের উপর ভর করে। বাংলার গ্রাম শহরের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।
বাংলার শহর—গ্রামের এই ঘাতপ্রতিঘাতের (urban-rural-interaction) ফলে গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন (২০ জৈষ্ঠ, ১২৭৫) :৪৫ ”বিদ্যাদান কার্যের প্রাচুর্য, বাণিজ্যের উন্নতি ও রেলওয়ের সৃষ্টি এই তিনটিই পল্লীগ্রামের অবস্থা পরিবর্তনের প্রধান কারণ।” দুটি পরিবর্তনের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হল মাদকদ্রব্য। ”মাদকদ্রব্য সেবনের সমধিক প্রাদুর্ভাব”, আর—একটি হল ”অনেকে যথেচ্ছাচারী হইয়া পড়িয়াছে।” এখন আর গ্রামে ”ত্রিকালীন সন্ধ্যাবন্দন ও জপহোমাদি” প্রায় দেখা যায় না। ”কোশাকুশি ও শালগ্রামশিলা অনেকের বাটী পরিত্যাগ করিয়াছেন।” একেও এক্সচেঞ্জ ইকনমি’র মাহাত্ম্য বলা চলে।
গ্রামের উপর শহরের প্রভাব নির্ভর করে শহর থেকে গ্রামের দূরত্বের উপর। উনিশ শতকে এই দূরত্বের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট, এমনকী রেলপথে বাষ্পীয় রেলগাড়ি চলাচলের পরেও। শহরের কাছাকাছি গ্রাম এবং শহর থেকে বহু দূরের গ্রামের মধ্যে নাগরিক প্রভাবের ও সামাজিক পরিবর্তন—গতির পার্থক্য ছিল। এই প্রসঙ্গে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছেন :৪৬
”সহরের নিকটে থাকাতে নানাপ্রকার সামাজিক বিপ্লবও ঘটিয়াছে। সমাজের প্রাচীন শৃঙ্খলা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। পূর্বে যখন গ্রামের মধ্যে দুইচারিজন ধনী ও ক্ষমতাশালী লোক থাকিত এবং অপর সকলে সাক্ষাৎ বা পরম্পরাভাবে তাহাদের অধীন থাকিত তখন সমাজের একপ্রকার শৃঙ্খলা দৃষ্ট হইত, উক্ত ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদিগের দ্বারা অনেক সময়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হইত। এক্ষণে সকলেই স্বাধীনভাবে কিছু কিছু উপার্জন করিয়া থাকে, কেহ কাহারও অধীন বা বশবর্তী নয়। সুতরাং কেহ কাহারও শাসনানুগত নহে। এই কারণে সমাজের অনেক লোক রীতিনীতি সম্বন্ধে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিয়াছে। ধর্মশাস্ত্রের যে শাসন ছিল তাহাও ইংরাজী শিক্ষার গুণে ও সহরের বাতাসে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, এখন শাস্ত্র ও সমাজবিরুদ্ধ পাপ সকল সমাজ মধ্যে অবারিত হইতেছে। নিবারণের উপযুক্ত শাসনশক্তি কাহারও নাই।
শহরের কাছাকাছি গ্রাম্য সমাজের ভিতরের শাসনশৃঙ্খলার ভিত ভেঙে গিয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠ ও সম্ভ্রান্ত বা গুণীমানী ব্যক্তির শাসন কেউ আর মান্য করেন না। অর্থাৎ নাগরিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ গ্রাম্য সমাজেও প্রবেশ করেছে এবং তার তীব্রতা বেড়েছে আর্থিক আত্মনির্ভরতার জন্য। ‘সোমপ্রকাশ’ দুঃখ করে বলেছেন যে যাঁরা শহরে থাকেন তাঁরা শহরের দোষের সঙ্গে গুণগুলিরও অংশীদার হন, কিন্তু যাঁরা শহরের কাছাকাছি গ্রামে থাকেন তাঁরা শহরের ”গুণভাগ না পাইয়া দোষভাগই অধিক ভোগ” করে থাকেন। আরও একটি বিষয়ের প্রতি ‘সোমপ্রকাশ’ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যে সমস্ত গ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে, সেখানকার শিক্ষিত বা শহরবাসী লোকরা যখন ছ—মাস—ন—মাস অন্তর একবার করে গ্রামে যান, তখন দীর্ঘকাল গ্রামে থাকেন এবং গ্রামের উন্নতির জন্য কিছু করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু শহরের কাছাকাছি গ্রামের লোক ”সপ্তাহের মধ্যে যে একদিন গ্রামে আগমন করেন তাহাও বিশ্রাম ও আমোদ প্রমোদের জন্য।”
শহরের কাছাকাছি গ্রাম্য জীবনে আরও একটি নাগরিক প্রতিক্রিয়ার নির্দেশ করেছেন ”সোমপ্রকাশ’। ”দূরস্থিত জনপদ সকলের লোকদিগের বিলাস বাসনা অল্প। সামান্য আহার, সামান্য পরিচ্ছদে সন্তুষ্ট হইয়া তাহারা সুখে দিন যাপন করে। কিন্তু সহরের নিকটবর্তী স্থানে নিত্য নূতন নূতন বিলাস সামগ্রী দেখিতে পাওয়া যায়। তাহাতে লোকের ব্যয় বৃদ্ধি হইয়া থাকে।” ‘সোমপ্রকাশ’—এর ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। বক্তব্য হল, নাগরিক জীবনযাত্রার মান ও ধরন (consumption-pattern) শহরের কাছাকাছি গ্রামে প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করে এবং তার ফলে নিত্যনূতন ভোগ্যবস্তুর প্রতি গ্রামের আকর্ষণ বেড়ে যায়। শহুরে জীবনের পরিবর্তনশীল ফ্যাশনের সঙ্গে গ্রামের লোকও তাল দিয়ে চলতে চায়। তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয় ব্যয়বৃদ্ধি। এই দৃষ্টান্তটিকেও গ্রাম্য সমাজে ‘এক্সচেঞ্জ ইকনমি’—র সংঘাতের ফলাফলরূপে উল্লেখ করা যায়।
ইতিহাসের দূত হয়ে, মার্কসের ভাষায়, ইংরেজরা তাঁদের অজ্ঞাতসারে হিন্দুস্থানের তথা বাংলার সমাজে যে যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, তার আভাস ‘সোমপ্রকাশ’—এর এই গ্রাম্য জীবনের পরিবর্তন—গতির বিশ্লেষণ থেকে অনেকটা পাওয়া যায়। সামাজিক বিপ্লবের ইন্ধন ইংরেজরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও জোগাতে বাধ্য হয়েছিলেন, নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থতার জন্য। বিপ্লবের ঐতিহাসিক পরিণতির—অর্থাৎ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে ধনতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণের উপযোগী বাস্তব আর্থভিত্তিক স্থাপন ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা সম্ভব হয়নি বটে, কিন্তু তার এমন কয়েকটি অনুপ্রাণনশক্তি শহরে—নগরে এবং শহর—নগর থেকে গ্রামে তাঁরা সঞ্চারিত করেছিলেন যাতে গ্রামের ব্যক্তিমানস ও সমাজমানসের মূল গড়নটাই বদলে গিয়েছিল। গ্রামের গতানুগতিক জীবনযাত্রার নীতি ও আদর্শ, কাজকর্মের রীতি ও পদ্ধতি, আচার—ব্যবহার আগের মতো আর ছিল না। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ লিখেছেন (শ্রাবণ ১৭৭৮ শক) :৪৭
”বঙ্গসমাজে দিন দিন যত ইংরাজ জাতির আচার ব্যবহার ও রীতিনীতি প্রবিষ্ট হইতেছে, ততই আরও দেশের দরিদ্রতা বৃদ্ধি হইতেছে। ইহারা ইংরাজ প্রভৃতি সভ্যজাতির নিকট হইতে যত নানাপ্রকার অভিনব সভ্যতার শিক্ষা পাইতেছে, ততই নানাপ্রকারে ইহাদিগের প্রয়োজন বৃদ্ধি হইতেছে। ইহারা আর সামান্য দ্রব্য আহার করিয়া তৃপ্ত হইতে পারে না, সামান্য প্রকার বেশভূষায় তুষ্ট হয় না এবং সামান্যরূপ গৃহাদিতে বাস করিয়াও সুখী হয় না, অথচ অতি সামান্য অবস্থায় কাল যাপন করিয়া জীবনধারণ করিবারও ইহাদিগের কোন সাধ্য নাই। জলশূন্য মরুদেশীয় লোকের জলতৃষ্ণা অধিক হইলে যে প্রকার অবস্থা হয়, এক্ষণে এদেশীয় লোকেরও অবিকল তদ্রূপ অবস্থা হইয়াছে।”
এখানেও গ্রাম্য সমাজের উপর টাকার বিনিময়প্রধান অর্থনীতি ও শহরের প্রভাব প্রতিক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবী ফলাফলের কথা বলা হয়েছে। এ কথা ‘সোমপ্রকাশ’ও বলেছেন। গ্রামের সাধারণ লোকের যখন মরুভূমির মধ্যে তৃষ্ণার্তের মতো অবস্থা, তখন গ্রামের জমিদাররা কী করেছেন? কালীপ্রসন্ন সিংহ জমিদারদের কলকাতা শহরে বসবাস প্রসঙ্গে লিখেছেন :
”পাড়াগেঁয়ে দুই—একজন জমিদার প্রায় বারোমাস এখানেই কাটান। দুকুরব্যালা ফেটিং গাড়ি চড়া, পাঁচালি বা চণ্ডীর গানের পেলেদের মতন চেহারা, মাথায় ক্রেপের চাদর জড়ানো, জনদশ বারো মোসাহেব সঙ্গে, বাইজানের ভেড়ুয়ার মত পোশাক, গলায় মুক্তার মালা—দেখলেই চেনা যায় যে ইনি একজন বনগাঁর শেয়াল রাজা, বুদ্ধিতে কাশ্মীরী গাধার বেহদ্দ—বিদ্যায় মূর্তিমান মা! বিসর্জন, বারোইয়ারি, খ্যামটা নাচ আর ঝুমুরের প্রধান ভক্ত, মধ্যে মধ্যে খুনী মামলার গ্রেপ্তারী ও মহাজনের ডিক্রীর দরুণ গা ঢাকা দেন। রবিবার, পালাপার্ব্বণ বিসর্জন আর স্নানযাত্রায় সেজে গুজে গাড়ি চড়ে বেরোন।
”পাড়াগেঁয়ে হলেই যে এই রকম উনপাঁজুরে হবে, এমন কোন কথা নাই। কারণ, দুই একজন জমিদার মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় এসে বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠা ও প্রশংসা নিয়ে যান। তাঁরা সোনাগাজীতে বাসা করেও সে রঙ্গে বিব্রত হন না; বরং তাঁদের চালচুল দেখে অনেক সহুরে তাক হয়ে থাকেন। আবার কেউ কাশীপুর, বোড়স্যা, ভবানীপুর ও কালীঘাটে বাসা করে, চব্বিশ ঘণ্টা সোনাগাজীতেই কাটান, লোকের বাড়ির চড়োয়া হয়ে দাঙ্গা করেন; তার পরদিন প্রিয়তমার হাত ধরে যুগল বেশে জ্যাঠা খুড়া বাবার সঙ্গে পুলিশে হাজির হন, ধারে হাতী কেনেন। পেমেণ্টের সময় ঠ্যাঙ্গাঠেঙ্গি উপস্থিত হয়—পেড়াপিড়ি হলে দেশে সরে পড়ে,—সেথায় রামরাজ্য!”
পল্লিগ্রাম জমিদারদের রামরাজ্য, এবং শহর ঠিক রামরাজ্য না হলেও কতকটা অ্যালিসের আজবপুরীর মতো। গ্রাম্য জমিদারদের শহুরে জীবনযাত্রার এই বর্ণনায় কিছুটা শ্লেষ—ব্যঙ্গের তীক্ষ্নতা থাকলেও, এর অনেকটাই সত্য। এই জমিদাররা তাঁদের গ্রাম্য রামরাজ্যে নাগরিক প্রভাব বিস্তারের সবচেয়ে বড় এজেন্ট হয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে তাঁদের নিজেদেরও শ্রেণিগত চরিত্রের যে কত দূর পরিবর্তন হয়েছিল তা পূর্বোক্ত বিবরণ থেকে বোঝা যায়। ধনতান্ত্রিক জীবনাদর্শের প্রভাব এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ।৪৮
সেকালের গ্রাম্য সমাজে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন চারিত্রিক গুণের জন্য। লোভ হিংসা অহংকার মিথ্যাচরণ তাঁদের চরিত্র দারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেও স্পর্শ করতে পারেনি। নতুন সামাজিক পরিবেশে এই ব্রাহ্মণদের চরিত্রে কী পরিবর্তন হল? ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ লিখেছেন (১ শ্রাবণ ১৭৬৮ শক) :৪৯
”ইহা কি ব্রাহ্মণদিগের সামান্য লজ্জার বিষয় যে যে শূদ্রেরা পূর্বে তাঁহারদিগের আজ্ঞাকারী দাস ছিল, এইক্ষণে তাঁহারা সেই শূদ্রদিগের আজ্ঞানুবর্তী হইয়াছেন—ধনসেবার জন্য তাঁহারদিগের সেবাতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন? যাঁহারা ব্রাহ্মণত্ব ও পণ্ডিতত্ব লইয়া দম্ভ করেন, অনাহূত অনাদৃত তিরস্কৃত হইলেও ধনিদিগের দ্বারে দ্বারে ভ্রমণ করা তাঁহারদিগের প্রাতঃকৃত্য হইয়াছে, এবং ধনিদিগের উপাসনা আন্তরিক ধর্মানুষ্ঠান হইয়াছে।… এবম্প্রকার অযোগ্য আচরণ প্রযুক্ত ক্রমে তাঁহারা সংসারে অধোগামী হইতেছেন, তদ্বিপরীতে অনেক শূদ্র জ্ঞান ও যোগ্যতা দ্বারা উচ্চপদে আরোহণ করিতেছেন।”
ব্রাহ্মণত্বের দুর্ভেদ্য দুর্গ পর্যন্ত টাকাসর্বস্ব মানসতার অভিযান এবং অভিযানের ফলে সেই দুর্গের পতনের এই দৃষ্টান্তটি থেকে বোঝা যায়, গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তনের রূপ কী এবং তার গতি কোনদিকে! গ্রাম ও শহরে যে সমাজের দু’টি স্বতন্ত্র, পরস্পরবিচ্ছিন্ন খণ্ডরূপ, বাংলার সমাজ সম্বন্ধে এ ধারণা উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসননীতির সংঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীরা অবশ্য গ্রাম ও শহর সম্বন্ধে এই দ্বিখণ্ডিত দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন প্রত্যয় (dichotomous concept) সমর্থন করেন না, বরং প্রত্যক্ষ অনুসন্ধান ও অভিজ্ঞতার আলোকে উভয়ের মধ্যে প্রবহমান প্রভাবের কথা (rural-urban continuum) বেশি সত্য বলে স্বীকার করেন।৫০ এ কথা শুধু ইয়োরোপীয় সমাজে সত্য নয়, এশিয়ার সমাজেও সত্য—“clearly… the notion that there is an ‘urban-rural dichotomy’ in Asian countries was hardly tenable… both for the process and the analysis of the development.’’৫১ বাংলার গ্রাম্য সমাজের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন গ্রাম যে নেই তা নয়, বিশেষ করে উনিশ শতকের যানবাহন—যোগাযোগের (রেলওয়ের পরেও) স্বল্পতার দিনে নিশ্চয় ছিল। আসলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে মেরু—ব্যবধান রচনা না করে এ কথা বলা যায় যে উভয়ের মধ্যে দৈশিক দূরত্বের উপর নির্ভরশীল প্রভাব—প্রবাহের তারতম্য থাকলেও, কালিক সহাবস্থানের জন্য একেবারে নাগরিক প্রভাববর্জিত গ্রামের কথা প্রায় ভাবা যায় না, এবং ভাবলেও সমাজজীবনের দিক দিয়ে তা অবাস্তব বলে মনে হয়। বস্তুত টাকা—বিনিময় প্রধান অর্থনীতির বৈদ্যুতিক প্রবাহ, উনিশ শতকেও, বাংলা দেশের সুদূর পল্লিগ্রামের মানুষের মর্মস্থল পর্যন্ত যে আঘাত করেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বাস্তবিক ব্রিটিশ শাসকরা অজ্ঞাতসারে বাংলার সমাজজীবনে বৈপ্লবিক দূতের কাজ করেছিলেন। প্রাচীন বনেদি জমিদারশ্রেণির ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করে—City capitalist, দেওয়ান বেনিয়ান মুতসুদ্দি প্রভৃতিকে নতুন চিরস্থায়ী স্বত্বের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত জমিদারশ্রেণিতে পরিণত করে—মধ্যস্বত্বভোগীদেরও নতুন জমিদারদের মতো কৃষকদের শোষণ ও পীড়নের অধিকার দিয়ে—ভূমিরাজস্বকে বাণিজ্যের পণ্যের মতো ‘স্পেকুলেশন’ ও মুনাফার বস্তুতে পরিণত করে—পণ্যফসল নীলের আবাদে যথেচ্ছাচারী নীলকরদের উৎসাহিত করে—বিনিময়ের বাজারে বিদেশি ব্রিটিশ পণ্যের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় স্বদেশি শিল্প ও কারুবর্গকে উৎখাত ও বৃত্তিচ্যুত করে—নবযুগের নতুন বিনিময়—মাধ্যম টাকার আর্থনীতিক একাধিপত্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে, গ্রাম ও শহর নির্বিশেষে, প্রতিষ্ঠিত করে—বিদ্যা, বাণিজ্য, সামাজিক ক্ষমতা ও মর্যাদা, সমস্ত কিছু নতুন টাকার মানদণ্ডে পরিমাপ করার আদর্শ প্রচার করে, ব্রিটিশ শাসকরা বাংলার পল্লিসমাজের অস্থিমজ্জায় যে প্রচণ্ড আঘাত করেছিলেন, তার প্রতিক্রিয়ায় সেকালের জীবনধারার গতির অবশ্যই পরিবর্তন হয়েছিল। এরকম বহুমুখী নির্বিচার আঘাতের ফলে যদি পরিবর্তন না হয়, বা না হত, তাহলে বুঝতে হবে যে ইংরেজদের আগমনের আগে বাংলার জনসমাজের কোনও জীবন্ত অস্তিত্ব বলে কিছু ছিল না, শুধু সেটা একটা মৃতের কঙ্কালের মতো ছিল। কিন্তু তা মনে করার যখন কোনও যুক্তি নেই, তখন ব্রিটিশ শাসনের আঘাতে তার পরিবর্তনমুখী গতির কথা ভাবতেও কোনও বাধা নেই। সেই গতির রূপ ও দিক নির্ণয় করার চেষ্টা আমরা কিছুটা করেছি। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে সামাজিক গতিশীলতার (social mobility) উত্থান—পতন, জোয়ারভাঁটা আছে, এবং উনিশ শতকের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলার গ্রাম্য সমাজজীবনের পরিবর্তনশীল গতির মধ্যেও এই উত্থান—পতনের তরঙ্গায়িত রূপ দেখা যায়।
নির্দেশিকা
বন্ধনীর মধ্যে সূচকসংখ্যা
(১) J. H. Harington : An Elementary Analysis of Law and Regulations, Calcutta 1814-15, III, 398-400
(২) Harington, op. cit, ibid
(৩) The Zemindary Settlement of Bengal, (Z. S. B), Calcutta 1879, I, 64.
(৪) “The land revenue system taken over by the English was in its main features the creation of Murshid Quil Khan, and it was continued in a more refined but more rigid form under Cornwallis’s Permanent Settlement.”
—Majumdar, R.C. History of Bengal (H.B) (Dacca Univ. 1943), II, Ch XXI, 397
(৫) H. B, II, 409
(৬) H. B, II, 414-15Watte Kelly Firminger : Fifth Report, 1917-18 Introduction
(৭) John Shore : Minute of April 1786 in Harington’s Analysis, II, 233-34
(৮) James Grant : Analysis fo the Finances of Bengal, Fifth Report 1812
(৯) “He thus created a new landed aristocracy in Bengal whose position was confirmed and made hereditary by Lord Cornwallis”.—H. B, II. 409-10.
(১০) Memories of the Life and Correspondence of John Lord Teignmouth, I, 25-26 (London 1843)
(১১) W. W. Hunter : The Annals of Rural Bengal (Third ed. London 1886), 56-57 “Before the commencement of 1771, one-third of a generation of once rich families had been reduced to indigence.”“From the year 1770 the ruin of two-thirds of the old aristocracy of Lower Bengal dates.”—56-57.
(১২) Second Report of Select Committee, 1808-12, app IX, 103
(১৩) দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে তৃতীয় অধ্যায়ের নির্দেশিকা দ্রষ্টব্য।
(১৪) W. W. Hunter : Bengal M. S. Records, 1782-1807 (London 1894), I, 24-25
(১৫) Karl Marx : Notes on Indian History (Moscow, n.d.) 101
(১৬) Z. S. B., app. IV
(১৭) বিনয় ঘোষ : সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য়, ১১৭
(১৮) বিনয় ঘোষ : সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ খণ্ড দ্রষ্টব্য।
(১৯) Z. S. B., I, 60
(২০) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ১ম, ৮৪—৮৫, ৭৭, ১৩৫
(২১) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ৪র্থ, ১০৯—১২, ৮৫—৮৮
(২২) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ২য়, ১১৩—১৪
(২৩) “The tenures known by the name of Putnee talooks,… shall be deemed to which they are held. They are heritable by their conditions; and it is hereby further declared that they are capable of being transferred by sale, gift, or otherwise, at the discretion of the holder…”“Putnee talookdars are hereby declared to possess the right of letting out the lands composing their talooks in any manner they may deem most conducive to their interests…’’“If the holder of a Putnee talook shall have underlet in such manner as to have conveyed a similar interest to that enjoyed by himself… the holder of such a tenure shall be deemed to have acquired all the rights and immunities declared in the preceding section to attach to Putnee talooks… the same construction shall also apply in the case of Putnee talooks of the third or fourth degree.”
(২৪) Bengal Administration Report, 1872-73, 73
(২৫) H. Beverley : Census Report 1871-72, Calcutta, 1872
(২৬) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ২য়, ১০৮—১৩২
(২৭) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, ২৯৭—৯৮
(২৮) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১ম, ১০২
(২৯) John Phipps : A Series of the Principal Products of Bengal : No. I. Indigo : Calcutta 1832, Ch. II. Table XXIV, 59 ‘নীলচাষের ও নীল ব্যবসায়ের গোড়ার ইতিহাস’ এই গ্রন্থ থেকে গৃহীত।
(৩০) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য়, ১২৫—১৩২
(৩১) Colesworthy Grant : Rural Life in Bengal, London 1866, Letter VIII, 114-36
(৩২) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য়, ১২৫—৩২
(৩৩) Indigo Papers, Bengal Government Records
(৩৪) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, ১৬৮—৭০
(৩৫) W. H. Thompson : Census Report of Bengal 1921 CalcuttaA. Mitra : Census Report 1951, Delhi, 1953; Vol. V, Part IA–Report, 412-14
(৩৬) বিনয় ঘোষ : পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, কলিকাতা ১৯৫৭Benoy Ghosh : Traditional Arts. etc (UNESCO Seminar monograph, R. K. Mission Cult. Inst.) Calcutta 1981
(৩৭) D. J. McNeile : Report on the Village Watch of the Lower Provinces of Bengal : Calcutta 1866, 13এই রিপোর্ট ম্যাকনিল সাহেব সেকালের ঘাটোয়াল পাইক প্রভৃতি নানা রকমের গ্রাম রক্ষীদের নিষ্কর ভূসম্পত্তি থেকে উচ্ছেদের ফলে এবং তার পরিবর্তে নতুন পুলিশ—শাসন প্রবর্তনের ফলে বাংলার গ্রাম্য সমাজে যে বিপর্যয় ঘটেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
(৩৮) Karl Marx : ‘British Rule in India’–New York Daily Tribune, June 25, 1853-মার্কসের উদ্ধৃতিগুলি এই প্রবন্ধ থেকে গৃহীত।
(৩৯) Maurice Dobb-এর Studies in the Development of Capitalism গ্রন্থের Paul M. Sweezy কর্তৃক আলোচনা : Science and Society : New York, Spring 1950
(৪০) Henri Pirenni : Economic and Social History of Medieval Europe (N. Y. 1937), 82.
(৪১) Paul M. Sweezy : পূর্বোদ্ধৃত প্রবন্ধ।Maurice Dobb : Studies in the Development of Capitalism : London 1947
(৪২) Karl Marx : Selected Writings in Sociology and Social Philosophy : ed. by T. B. Bottomore and M. Rubel, London 1961, 110-12 : উদ্ধৃতিগুলি Capital. Vol. I থেকে গৃহীত, Moore & Aveling অনূদিত (১৮৮৭)।
(৪৩) P. Sorokin and C. C. Zimmerman : Principles of Rural-Urban Sociology (N.Y. 1929), 41-48
(৪৪) J. J. Hecht : The Domestic Servant Class in Eighteenth-Century England (Lond 1956)
(৪৫) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, ২১৩
(৪৬) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪র্থ, ২৯৭—৯৯
(৪৭) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য়, ১৮৪
(৪৮) কালীপ্রসন্ন সিংহ : হুতোম প্যাঁচার নকশা : কলিকাতা ১৩৪৪, ১১—১২
(৪৯) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২য়, ৯৮
(৫০) John L. Haer : ‘Conservatism, Radicalism and the Rural-Urban Continuum’ in Cities and Society, ed. Hatt and Reiss (N. Y. 1963) 692-97P. H. Landis : Rural Life in Process (N.Y. 1948) 127-28
(৫১) Urban-Rural Differences in Southern Asia : UNESCO Research Centre, Delhi, 1964, 24-27
* তৃতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।