৩. পুকুর ঘাটের কাছে

পুকুর ঘাটের কাছে একটা জোর শব্দের সঙ্গে জল ছিটকিয়ে এল অনেক দূর পর্যন্ত। আমার মন যেখানেই থাক নজর ছিল ফাতনার দিকেই। কোমরের কাছে খাটো হাফ প্যান্টটা টানাটানি করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি রীতিমতো রেগে ভুরু কুঁচকে ঘাটের দিকে তাকালাম। নীলা বউদি তখনই জলের থেকে মাথা, আর প্রায় নাভি পর্যন্ত জলের ওপরে শরীরটা তুলে টালমাটাল অবস্থায় উঠে দাঁড়াল। মাথার চুল খোলা। এক গোছা ভেজা চুলে মুখের অর্ধেক ঢাকা পড়েছে।

এখন আর গায়ে গামছা জড়ানো নেই, সেটা হাতে ধরা। নাভির কাছ থেকে কাপড়টা সরে গিয়েছে, বুকের আঁচল কাঁধের এক পাশে দড়ির মতো জড়িয়ে গিয়েছে। ভরাট বুকে লেপটানো জামা। ভুরু, চোখের পাতা থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। হাসতে হাসতে আমার দিকে ফিরে বলল, প্লিজ ঠাকুরপো, রাগ কোরো না। তোমাদের ঘাটের সিঁড়ি এত পেছল একদম হড়কে গেছি। আর একটু হলে আমার কোমর ভেঙে যেত।

আমার ফাতনায় তখন ঢেউ লেগেছে। আমি জানি, অনাথদা বা নীলা বউদির বাড়ির কেউ থাকলে সে আমার সঙ্গে কথা বলত না। তার মুখে প্লিজ’ শব্দটা আমার মনে অনেক দিনের অনেক কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। নীলা বউদি ভালই জানে তার ওপরে আমি কখনওই রাগ করব না। আমি হেসেই জিজ্ঞেস করলাম, লাগেনি তো?

না। আসলে ডান দিক ঘেঁষে নামলে সিঁড়ির লাল হড়হড়ে শ্যাওলায় পা পড়ত না। নীলা বউদি বলল, এই মিনুটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে খেয়াল ছিল না, সোজা নেমে পড়েছি, আর, একেবারে চিত্তির।’ বলে খিলখিল করে হেসে উঠল।

এই হল আসল নীলা বউদি। হেসেই আছে, হাসিটাও মিষ্টি। নীলা বউদিকে আমি কখনও রাগ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বরং হাসির জন্যই নীলা বউদিকে সব সময়ে শ্বশুরবাড়িতে সাবধানে থাকতে হয়। কখন কী কারণে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠবে, নিজেও জানে না, আর হেসে উঠলেই বিপাকে পড়তে হয়, কারণ ও রকম হঠাৎ হঠাৎ হেসে ওঠা বাড়ির সকলের পছন্দ না। অনাথদাকে কত দিন বিরক্ত হয়ে বলতে শুনেছি, কী যে খ্যাখ্যাল করে হাসো বুঝিনে।

বউদির হাসি তার জন্য বন্ধ হয় না। আসলে, আমি জানি, অনাথদা বউদির হাসি পছন্দ করে, কিন্তু স্বামী হিসাবে ওটুকু না বললে নয়, তা-ই বলা। হু, মনটা কেমন হুহু করে উঠছে। নীলা বউদির দিক থেকে চোখ সরিয়ে, আমি জলের ঢেউয়ে দোল খাওয়া ফাতনাটার দিকে তাকালাম। ফড়িংটা অনেকক্ষণ উড়ে গিয়েছে। টোপ কি আর বঁড়শিতে গাঁথা আছে? না, খসে পড়েছে? আমি আবার তাকালাম ঘাটের দিকে। মিনতি প্রথমটা ঘাবড়িয়ে মুখ চুন করে আমার দিকে তাকিয়েছিল, ভেবেছিল, আমি নিশ্চয় খেঁকিয়ে চিৎকার করে কিছু বলে উঠব। অবিশ্যি মিনতি ও রকম পড়ে গেলে, আমি ভাল কথা হয়তো কিছু বলতাম না। সবাই জানে, আমি আজকাল একরকমের উগ্র চণ্ডাল হয়ে উঠেছি। কখন কাকে কী বলে বসব, কিছু বলা যায় না। সেজন্য আমাকে সহজে কেউ ঘাঁটায় না।

কিন্তু সত্যি কি আমি সেই রকম হয়ে গিয়েছি? বুকটার কাছে কী রকম করছে। এখন আর আমি কারোকে কিছু বোঝাতে পারি না। এই যে আমি এ সময়ে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে বসেছি, সত্যি কি মাছ ধরতেই বসেছি? আমি জানি, আশেপাশে অনেকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, বিশেষ করে মেয়েরা, আমি ইচ্ছা করেই, মতলব করেই এ সময়ে পুকুরধারে ছিপ ফেলে বসি। এ সময়ে ঘাটে মেয়েরা স্নান করতে আসে, আমি তাদের স্নান করা দেখবার জন্যই পুকুরে ছিপ ফেলে, গাছের ছায়ায় বসে থাকি, আমার নামে এ সব কথা বলাবলি হয়। এও জানি, এ সব বলাবলির মধ্যে, আমার বাবাও একজন।

আমার অবিশ্যি কিছু যায় আসে না, আমার নামে যে যা খুশি বলতে পারে। কিন্তু আমি তো জানি, কেন এ সময়ে পুকুরপাড়ের ছায়ায় এসে বসে থাকি। গোটা বাড়িতে, ঘরের মধ্যে, বাগানে, রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে কোথাও যখন ভাল লাগে না, অথচ মনের মধ্যে ছটফট করতে থাকে, কোথাও নিরিবিলিতে গিয়ে একলা কিছুক্ষণ বসে থাকি, তখনই এ রকম হঠাৎ কোনও কোনও দিন ছিপ নিয়ে পুকুরধারে এসে বসি। হয়তো দোতলায়, আমার ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতে পারলেই ভাল হয়। পারি না। আমাকে যেন এক এক দিন কেমন ভূতে পায়, অথবা কোনও প্রেতাত্মা তাড়া করে। আমি লোকজনের সঙ্গে থাকতে পারি না। কারও সঙ্গে কথা বলা ভাল লাগে না। এমনকী মায়ের সঙ্গেও না। বিতির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাতে কিছু যায় আসে না। ও থাকলে, ওর সঙ্গে কথা বলতেও আমার ভাল লাগত না।

কেবল যে পুকুরধারে ছিপ ফেলে বসে থাকি, এমন না। এক একদিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, কোনও কিছু না ভেবেই এক দিকে চলতে আরম্ভ করি। কোথায় যাচ্ছি, কত দূরে যাচ্ছি, কখন ফিরব, কিছুই খেয়াল থাকে না। খেয়াল অবিশ্যি এক সময়ে হয় নিশ্চয়। তখন হয়তো বেলা গড়িয়ে যাবার মুখে। তখন মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়, মা আমার জন্য না খেয়ে বসে আছে। কারখানাটায় লকআউট না থাকলে, এ রকম অবস্থায় পড়তে হত না। এখন সেভেনটি সিক্স চলছে। লকআউট চলছে ঠিক দশ মাস। এমারজেন্সিতেও কিছু করা যাচ্ছে না, কারখানার গেট যেমন বন্ধ, তেমনিই আছে। অথচ সবই নাকি ঠিক চলছে। তাই যদি মেনে নিতে হয়, তা হলে আমাদের কারখানার মালিক নিশ্চয় এমারজেন্সিরও ওপরে। এখন তো নির্মল নেই। নির্মল তো এই পৃথিবীতেই নেই। গৌর সেনের একলা রাজত্ব। সে তো এমারজেন্সিওয়ালাদেরই একজন। কারখানাটা খুলতে পারছে না কেন? তবে হ্যাঁ, একটা কাজ সে করেছে। সেভেনটি থ্রি-তে বলরাম মিত্তিরকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। না, তার জন্য কেউ ধরা পড়েনি। গৌর সেন তো নয়-ই, আমি তো গৌর সেনের বাড়ির সেই দুপুরের ঘটনাটা ভুলতেই বসেছিলাম। সেভেনটি থ্রিতে, তখন আমার সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল, বোধ হয় আমার জীবনের সব থেকে খারাপ সময়, হঠাৎ এক দিন সকালে শুনলাম, রায়পাড়ার বলরাম মিত্তিরকে কে গুলি করে খুন করেছে। আর ডেডবডিটা নাকি পাওয়া গিয়েছে, তার বাড়ির সামনেই। খবরটা শোনা মাত্রই আমার চোখের সামনে গৌর সেনের মুখটা ভেসে উঠেছিল। বাইরের ঘরের পাশের ঘরে, খাটে শোয়া তার সেই শক্ত চোয়াল, জ্বলজ্বলে চোখ, চেহারাটা। আর বাইরের ঘরে, টেবিলের ওপর পা তুলে বসে থাকা সন্টু। অথচ, আমি জানতাম, বলরামকে শিক্ষা দেবার জন্য, কেবল ঝাড় দেবার কথা হয়েছিল, অবিশ্যি সেটা ছিল, সিক্সটি সিক্স-এর শেষের দিকে। তারপরে রাজনৈতিক জগতের চেহারা বেমালুম বদলিয়ে গিয়েছিল। তবে, নিজের দলের লোককে একেবারে নিকেশ করে দেওয়া, এ রকমটা আমি আগে কখনও দেখিনি। সেই প্রথম জেনেছিলাম। অন্য দলের লোককে খুন করাটা তো একটা আকচার ঘটনায় দাঁড়িয়েছে, এক দলের তোক আর এক দলের লোককে খুন করছে, না হয় তো পুলিশ দল নিজেরা খুন করে, দলের নামে চালাচ্ছে। কিন্তু নিজের দলের লোককে নিজেরাই খুন করছে, এটা আমি বলরাম মিত্তিরের বেলাতেই দেখেছি। হয়তো আরও এ রকম ঘটেছে বা ঘটছে, আমার জানা নেই।

বলরাম মিত্তিরের খুনের খবর শুনে আমার মনটা কেমন চমকে চমকে উঠেছিল। আমি কারও কাছে মুখ খুলিনি, কিন্তু আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না, খুনটা গৌর সেন করিয়েছে। পাটির খুনোখুনি দেখে এমন হয়েছে, আমার ভয় হয়েছিল, আমিও না আবার গৌর সেনের টারগেট হয়ে যাই। বলা যায় না। অন্তত এক বার তো সে আমার কাছে মুখ খুলে ফেলেছিল। ভাবতে পারত, আমি একটা সাক্ষী। রয়ে গিয়েছি। সন্টুকে বলে দিলেই হত। কারখানায় যাবার বা ফেরবার পথে, কোনও এক জায়গায় ঝেড়ে দিলেই হত। বোধ হয় আমার কথা গৌর সেনের মনে ছিল না। থাকলেও, আমাকে নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না।

সন্টুকে আজকাল দেখলেই বুঝতে পারি, তার কোমরে রিভলবার গোঁজা আছে। আগের তুলনায় ওর চেহারাটা বদলিয়েছে। প্রথম যখন দেখেছিলাম, তখন ছিল রোগা ছিপছিপে, এখন বেশ শাঁসে জলে। চোখ দুটো সবসময়েই প্রায় লাল আর প্রায়ই পুলিশের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখি। কিন্তু আমার একটু অবাক লাগে, ও কি আমাকে চিনতে পারে না? রাস্তাঘাটে, রেল ইস্টিশনে, যেখানেই দেখি, ও যেন আমাকে দেখেও দেখতে পায় না। অথবা চিনেও চিনতে চায় না। অবিশ্যি যদি চিনতে না চায়, বা না পারে, তা হলেই আমি বেঁচে যাই। আমি এদের ধারেকাছে থাকতে চাই না।

এ রকম অবস্থা হয়েছিল দুটো যুক্তফ্রন্টের আমলে। এখন আমি সন্টুর দোষ দেখছি। সেভেনটির আগে, নকুল পঞ্চাননরাও কম কিছু করেনি। ওদের হাতেও তখন মাল থাকত, যাকে ওরা বলত চেম্বার। তা ছাড়া পাইপগান তো ছিলই, আর আমাদের বাড়ির দোতলার খালি ঘরে বসেই ওরা নানা রকম শলাপরামর্শ করত, কিন্তু আমাকে কাছে থাকতে দিত না। আমিও কাছে থাকতে চাইতাম না। ও সব আমার কোনওকালেই ভাল লাগত না। দলাদলি, মারামারি, খুনোখুনি এ সব আমি চিরকাল এড়িয়ে চলেছি। সত্যি কথা বলতে কী, আমি তো একটা সাধারণ জীবন চেয়েছিলাম। যে জীবনে আমি কাজ করব, কাজ করে বাড়ি ফিরব, আর বাড়িতে থাকবে।

কোনও লাভ নেই ও সব কথা ভেবে। এখন, এই দশটা মাসের বেকার জীবন, বড় খারাপ কাটছে। এই বেকার জীবন না হলে, আমার ভূতে পাওয়া অবস্থাটার একটা গতি হত। কিছু না হোক কারখানায় যেতেই হত। কাজ করি বা না করি, কারখানার মধ্যেই কোনওভাবে সময় কাটাতেই হত। কিন্তু এখন যেমন, শুধু সাইকেলে বেরিয়ে পড়ি না, এক একদিন ট্রেনে করে চলে যাই ক্যানিং। বাজারের ভিতর দিয়ে, বেশ্যাপাড়াটা পেরিয়ে চলে যাই লঞ্চ ঘাটে। ইচ্ছা করে, লঞ্চে ভেসে যাই বাসন্তী, মোল্লাখালি, না হয় তো গোসাবা। তা যাওয়া হয় না। ঘাট ছাড়িয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে বাঁধের ওপর চুপচাপ বসে থাকি, তাকিয়ে থাকি নদীর দিকে।

আচ্ছা, মানুষের জীবনে আমার মতো মানুষের জীবনে, নদীর কি একটা ম্যাজিক আছে? নদীর ধারে বসলে, নদীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সময়টা এমনভাবে কেটে যায়, যেন অনেকটা স্বপ্নের মতো। কেন? জলের জোয়ার ভাটা, আসা যাওয়ার জন্য? সত্যি কথা বলতে কী, নদীকে আমার নদী বলে মনে হয় না। মনে হয়, স্রোতের যাওয়া আসার মধ্যে নদীর জলে, তার নীচে, কী যেন একটা ঘটে চলেছে। কেন এ রকম মনে হয়? যেন নদী জীবন্ত কোনও প্রাণীর মতো, মনে হয়, চোখে না দেখা একটা কী রহস্য নদীর বুকে লুকিয়ে রয়েছে।

খুব ইচ্ছা করে, সারা দিন কোনও নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকি। কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো হয় না। যে আমাকে ভিতর থেকে তাড়া করে, আমাকে কোথাও ছুটিয়ে নিয়ে যেতে চায়, সে সবসময় আমার ইচ্ছাপূরণের কথা ভাবে না। তবুনদীর ধারে আমি যাই। যেমন কলকাতায় আউটরাম ঘাটে গিয়েও বসে থাকি। তবে ও জায়গাটাকে আমার ভয় লাগে। একটা বিশেষ কারণে ভয় লাগে। বিশেষ একজন কারও সঙ্গে যদি আমার দেখা হয়ে যায়, এই ভয়। তার থেকে ক্যানিং-এর বাঁধে আমার ভাল লাগে। জানি না, কোনও দিন কেউ সেখানে বসে থাকতে দেখলেও হয়তো ভাববে, আমি মেয়েদের স্নান দেখবার জন্য বাঁধের ওপর বসে আছি।

না, সেটা কোনও দিন কেউ ভাবতে পারবে না, কারণ ক্যানিং-এর নদীতে কেউ স্নান করে না। এক বলতে পারে, লঞ্চঘাটের যাত্রী মেয়েদের দেখবার জন্য আমি ওখানে গিয়ে বসে থাকি। কিন্তু তা-ই বা বলবে কেমন করে? আমি তো ঘাট থেকে অনেক দূরে গিয়ে বসি। হুম, ঘাট থেকে দূরে? তবে শালা নিশ্চয়ই ক্যানিং-এর বাজারের কাছে বেশ্যাপাড়ার মেয়েদের ঘরে যাবার ফিকিরেই ওখানে তুমি যাও। বলতে পারে। লোকে কী না বলতে পারে। তা, তাই যদি হবে, আমাদের এ অঞ্চলের আশেপাশে এ সবের অভাব কী? তিন মাইলের মধ্যে দুটো বাজার আর প্রত্যেকটা বাজারের লাগোয়া বেশ্যাবাড়ি

আসলে, সব কথা মানুষকে বোঝানো যায় না। আমার যদি মেয়েমানুষ দেখবার ইচ্ছা হত, বিশেষ করে স্নানের ঘাটে ভেজা-গা মেয়েদের, তার জন্য নিজেদের পুকুরধারে ছিপ ফেলে বসারই বা দরকার কী? একটু হেঁটে, রায়পুকুরের ধারে চলে গেলেই তো হয়। রায়পুকুর হল বিরাট এক দিঘির মতো। ভোরবেলা থেকে সেখানে স্নান শুরু হয়, রাত্রেও শেষ হয় না। বাঁধানো ঘাট নেই বটে, কিন্তু বিরাট পুকুরের ধারেই বেশ কয়েকটা ঝাড়ালো বট অশ্বত্থ গাছ আছে। আমার মতো অনেক বেকার ছেলেই, সকালে বিকালে গাছতলায় বসে আড্ডা মারে, না হয় তো তাস খেলে। আমি তো সেখানে গিয়েও বসতে পারি। সারা দিন কম করে শ’খানেক যুবতী মেয়ের স্নান করা দেখতে পারি। আর ও সব দেখার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য তো একটাই। চোখের দেখার সাধ না মিটিয়ে, আমি তো অন্য ভাবেও সাধ মেটাতে পারি। অভাব আছে নাকি কিছু?

মিনু তুই পাশ দিয়ে নেমে এসে আমাকে একটু ধর। ঘাটের সিঁড়ি থেকে নীলা বউদির গলা শোনা গেল, আমি ভয়ে নড়তে পারছিনে। আবার যদি পড়ে যাই?

আমি ঘাটের দিকে এক বার তাকালাম। দেখলাম, মিনতি ঘাটের একপাশ দিয়ে পা টিপে টিপে সাবধানে জলে নামছে, মুখে হাসি। আচ্ছা, নীলা বউদিও কি আমার সম্পর্কে ওইরকম ভাবে? না, নীলা বউদি এক সময়ে, রোজ অন্তত এক বারের জন্য হলেও, আমাদের বাড়িতে আসত। নিজেই বলত, এক বারটি না এলে কিছুতেই মন মানে না। অনাথদাও তখন রোজ আসত। তারপরে কবে থেকে আসা বন্ধ হল? খুকু কবে চলে গিয়েছে এই বাড়ি ছেড়ে? কিন্তু তারপরও কি নীলা বউদি আমাদের বাড়িতে আসেনি?

ঠাকুরপো, ওদিককার খবর কী?’ নীলা বউদি ঘাট থেকে জিজ্ঞেস করল।

আমার বুকের মধ্যে একটা কাঁপুনি লেগে কুমোরের চাকের মতো বনবন পাক খেতে লাগল। আমি জানি, বঁড়শির টোপ খসে গিয়েছে, ফাতনা এখনও একটু একটু দোল খাচ্ছে। আমি যদি জানতাম, নীলা বউদি আজ ঘাটে আসবে, তা হলে আসতাম না। নীলা বউদি অন্য সময় অন্যখানে আমাকে দেখলে কথা বলে না। কিন্তু এই ঘাটে নিরিবিলিতে দেখা হলেই, এক বার অন্তত ওই কথাটি জিজ্ঞেস করবে। আমি পাশে রাখা সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই তুলে নিয়ে হাসবার চেষ্টা করে, ঘাটের দিকে ফিরে তাকালাম, কোন দিককার কথা বলছ, পুব পশ্চিম না উত্তর দক্ষিণ?

ধরে নাও, উত্তর দিকের কথাই জিজ্ঞেস করছি।নীলা বউদি বলল, কলকাতা তো উত্তর দিকেই।

আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে, ধোঁয়াটা টানতে গিয়েও ভিতরে নিতে পারলাম না, ভক করে ছেড়ে দিলাম। খুকু প্রায় নীলা বউদির সমবয়সিই ছিল। খুকু হয়তো মাস কয়েকের ছোট, তবু দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। আর নীলা বউদি স্পষ্টই বলত, দ্যাখ খুকু, তুই এত সুন্দরী আর রূপসী, আমি যদি ছেলে হতাম, তা হলে দুদে ঠাকুরপোর সঙ্গে এক হাত লড়ে যেতাম।

নীলা বউদি কথাটা অবিশ্যি মিথ্যা বলত না। খুকু সত্যি রূপসী ছিল। তবে, নীলা বউদির ওই রকম ঠাট্টা ছিল সামান্য ব্যাপার। সে যেমন খিলখিল করে হাসতে পারে, দুমদাম করে ভয়ংকর সব কথাও বলতে পারে। অন্তত আগে পারত। ভয়ংকর মানে কী বলব, আমার মতো লোকেরই লজ্জায় কানে তালা লেগে যেত। ওই যাকে বলে ইয়ে, ওই দাম্পত্য জীবন না কি, ওইসব স্বামী স্ত্রীর শোয়া বসা নিয়ে, কান গরম করা সব কথা। আমি তো সামনে থেকে পালিয়েই যেতাম। তবে, আমি বুঝতে পারতাম, নীলা বউদির ওইসব কথা, খুকু বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত। নীলা বউদি যে সত্যি খুকুর রূপে মুগ্ধ ছিল, বুঝতে পারতাম, সে রোজ নিজের হাতে খুকুকে সাজাত। সাজিয়ে সাজিয়েও তার মন যেন ভরত না। তারপরে আমার সামনে খুকুকে নিয়ে এসে বলত, এই নাও, সাজিয়ে দিয়ে গেলাম, আজ রাতটা ভাল ভাবে কাটানো চাই।

ও সব কথার জবাব আমার জানা ছিল না। অবিশ্যি, কে না মুগ্ধ ছিল খুকুর রূপে? কিন্তু, সকলের বা অনেকের ধারণা, খুকুর রূপই কাল করেছিল। কথাটা যে মিথ্যা, সেটা আমার থেকে আর কে ভাল জানে? রূপ তো নীলা বউদিরও কম না। যদিও তার বিনয়ের অভাব নেই। বিনয়ের অভাব কি খুকুরও ছিল? সে যাই হোক গিয়ে, নীলা বউদি নিরিবিলিতে দেখা হলেই, ওই কথাটা আমাকে জিজ্ঞেস করে কেন? সে কি বোঝে না, আমি এক রকম শ্মশানের চিতায় শুয়ে আছি! তার কথায় আমার সেই চিতাকেই খুঁচিয়ে দেওয়া হয়, আগুন জ্বলে ওঠে দাউ দাউ।

আমি কয়েক বার সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, আবার ঘাটের দিকে তাকালাম। ছিপ ফাতনা, টোপ, ও সব কোনও কিছুই এখন আর আমার মাথায় নেই। দেখছি, নীলা বউদি ঘাটের এক পাশে সরে গিয়ে আমার দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে, আর মিনতি তার পিছনের জামাটা তুলে, গামছা দিয়ে ঘষে দিচ্ছে। বললাম, খবর কিছু নেই।

কিন্তু খবর তো একটা কিছু চাই। এ ভাবে আর কতকাল চলবে?’ নীলা বউদি বলল, এক বার মুখ ফিরিয়ে ঘাটের ওপর দিকে দেখে নিল, কেউ এসেছে কি না। মিনতি তার পিঠ ঘষছে, শরীরটা সামনে ঢেউ দিয়ে দিয়ে উঠছে।

বললাম, যত কাল চলে, চলুক।

তা বললে হয় না দুদে ঠাকুরপো।নীলা বউদি পিছনে হাত দিয়ে মিনতির হাত থেকে গামছাটা নিয়ে তাকে বলল, নে মিনু, তুই এবার ডুব দিয়ে নে। আর দেরি করব না।’ বলেই আবার আমার দিকে ফিরে বলল, যার যেখানে খুশি গিয়ে থাকুক, আমি কিছু বলতে চাই না, কিন্তু তোমার জীবনটার কথা এক বার ভাববা।

কী করে বোঝাব, আমার বুকের কাছে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একেই বোধ হয় বলে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। কোথায় ভিতরের তাড়া খেয়ে, বাগানে আগেই দেখে রাখা ডিম ভরা পিঁপড়ের বাসাটা এক খামচায় তুলে এনে, ছিপ নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। পুকুরের জলে নদীর স্রোত নেই বটে, নদীর মতো মস্ত বড়ও না, তবু ভিতরের তাড়া আমাকে জলের কাছেই বেশি নিয়ে আসে, বা আমার আসতে ইচ্ছা করে। সত্যি তো আমি আর মাছ ধরতে আসিনি। জলে বঁড়শি ডুবিয়ে ছিপ নিয়ে বসে বসে শুধু কতগুলো পুরনো কথা ভাবা, কতগুলো পুরনো ছবি দেখা। কিন্তু নীলা বউদির শেষের কথার কী জবাব দেব? আমি জানি, সে কী বলতে চায়। আমার জীবনটা নিয়ে নতুন করে ভাববার আর কি কিছু আছে? আমার জীবনের কথা ভাবার একটিই অর্থ, আমার খালি ঘরে আবার এক খুকুকে নিয়ে আসা। বুঝতে পারি, নীলা বউদির কথার মধ্যে একটা প্রতিশোধের সুর। একজন চলে গিয়েছে, যাক, যেখানে খুশি গিয়ে যেমন ইচ্ছা থাকুক, আমি কেন আমার জীবনটা নষ্ট করছি। এই হল নীলা বউদির আসল কথা।

নষ্ট? নষ্ট করছি? নষ্ট আমি কিছুই করছি না, কেবল মনে হয়, নষ্ট হতে আর বাকি কী আছে? সত্যি কি, একজনকে দিয়ে আর একজনের জায়গা ভরাট করা যায়? এক জায়গার গর্ত আর এক জায়গা থেকে মাটি কেটে এনে ভরতি করার মতো? মানুষ–একটা বিশেষ মানুষ কি সেই রকম গর্ত? আমি তোতা ভাবতে পারি না। হ্যাঁ, আমার বুকের কাছে নিশ্বাস আটকে থাকছে, জঘন্য একটা কষ্ট–যেটা রক্তে মাংসে ঠিক বোঝা যায় না, সেই রকম একটা কষ্ট লাগছে। নীলা বউদিকে আমি কী জবাব দেব? কী বোঝাব? মন্দির থেকে সেই ইয়ে কী ওটা? হ্যাঁ, বিগ্রহ, যাকে বলে বিগ্রহ, সে যদি চুরি হয়ে যায়, আর একটা সেই রকম বিগ্রহ এনে আবার প্রতিষ্ঠা করার মতো নাকি ব্যাপারটা?

নীলা বউদি, তুমি তো ওকে অনেক আগে থেকেই দেখেছিলে, যত কাল আমার সঙ্গে ছিল, তত কাল প্রায় রোজ এক বার দেখেছ, ওর সঙ্গে আমাকে দেখেছ, আমাদের এক ঘরে দেখেছ, তারপরেও কি তোমার মনে হয়, মন্দিরের চুরি যাওয়া বিগ্রহের বদলে, আর একটা বিগ্রহ দিয়ে, ওর জায়গা পূরণ করা যায়? আমি জানি না, নীলা বউদি, অনাথদা তোমাকে ছেড়ে গেলে, বা তুমি অনাথদাকে ছেড়ে গেলে, তোমাদের কারও জায়গাই কি অন্য কারোকে দিয়ে পূরণ করা যাবে? অবিশ্যি, আমি জানি তোমাদের কোনও কালেই ছাড়াছাড়ি হবে না। কথাটা একটু বেশি জোর দিয়ে বললুম, অথবা বলতে পারো, ওই যে কী বলে কী বাণী? দৈববাণী হা, কথাটা দৈববাণীর মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু তোমাদের প্রথম থেকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল, সংসারে তোমাদের একটা আলাদা রূপ আছে। আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না, সবসময় সব কথা তো আমার মতো লোকের পক্ষে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না, তবু প্রথম থেকেই তোমাদের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল, তোমরা–তুমি আর অনাথদা, দুজনের জন্য গড়া।

জানি জানি, এ সব কথা শুনলে আজকাল লোকে হাসে। তা হলে, আগে আমি নিজেকে গালাগালটা দিয়ে নিই। আমি একটা পাঁঠা, কিন্তু আমাদের চারপাশে এত অসংখ্য পাঁঠার ভিড়, এক এক সময় মনে। হয় না, গোটা দেশটাই পাঁঠার দেশ? শোন, বুঝিয়ে বলছি না, কিন্তু তোমার আর অনাথদার মধ্যে আমি কখনও প্রেমের বাড়াবাড়ি দেখিনি, যাকে আমার আদিখ্যেতা বলে মনে হয়। তুমিই ভেবে দ্যাখো, অনাথদার মুখটা যেন সবসময়েই গম্ভীর, সবসময়েই যেন কী চিন্তা করছে। তুমি পাশে বসে চুল বাঁধছ, কিংবা কাজল টানছ, অথবা ধরো, বিশেষ কোথাও যাবার জন্য ভাল শাড়ি জামা পরে, ঠোঁটে লিপস্টিক লেপছ, অনাথদার যেন সে সব চোখেই পড়ছে না। অথচ, তুমি কি তার দৃষ্টি কাড়বার চেষ্টা করছ? মোটেই না। তুমি কি মুখ ভার করছ? মোটেই না। কেন, আমি জানি। আসলে, তোমাদের নিজেদের মধ্যে একটা জানাজানি আছে। আমি জানি, অনাথদা সবই দেখছে, তার ভিতরটা ভরে উঠছে, তোমার ভিতরটা ভরে উঠছে। দাঁড়াও, দাঁড়াও, বিনতি প্রায়ই একটা গান করত, তার একটা কলি আমার মনে। আসছে। আহা, কী যেন সেই গানের কলিটা? রবি ঠাকুরেরই নিশ্চয়, না হলে ওই রকমই গানের কলিতাঁ, মনে পড়েছে, না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা, আমার বাঁশীটি বাজানো, সেই ভালো সেই ভালো। আমারে না হয় না জানো। না, আর মনে করতে পারছি না, দরকারও নেই, এইটুকু দিয়েই আমার কথাটা বোঝাতে পারছি। তোমাকে না, নিজেকে বোঝাতে পারছি।

বিনতিযখন গানটা গাইত–পুকুরধারে বা বাগানের নিরিবিলিতে, আমার মনে হত, ও ওর ভাবী বরের সঙ্গে ওই গানটা গেয়ে গেয়ে কথা বলত। আরও, কেন জানি না, আমার মনে হত গান গাইবার সময় ওর ঠোঁট দুটো যেন অভিমানে ফুলে উঠত, স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক। আমাকে আর বাবাকে নিয়ে সবসময়ে সংসারে যা অশান্তি, ও মনে মনে অস্থির হয়ে উঠত, আর ভাবত, ওর জীবনটাই আমি। আর বাবা নষ্ট করে দেব। সে-ভাবাটা ওর দোষ না। যেখানে বাবা আর একমাত্র দাদা সংসারে সবসময়। বিবাদে মত্ত, ওর ভয় পাওয়া, নিরাশ হওয়া তো স্বাভাবিক।

যাই হোক, তোমার কথাই বলি নীলা বউদি। আমি মোটা দাগের মানুষ, তবু, তোমাকে আর অনাথদাকে দেখলে, আমার সেই গানের কলিটার কথাই মনে পড়ে। আসলে, তোমরা কেউ কারোকে দেখছ না, তবু যে কথা তোমাদের মধ্যে বলাবলি হয় না, সেই কথারই ব্যাকুলতায়, তোমাদের মনের বাঁশি বাজানো। আসলে, তোমরা দুজনে দুজনকে খুব ভাল জানো বলেই তো, আমারে না হয় না জানো’। পাগলের মতো ভাবছি, নেহাত, ভাগ্যিস তুমি শুনতে পাচ্ছ না আমার মনের কথা। আমি আসলে কী বলছি জানো? এটাই সংসারের সবথেকে সুন্দর আর স্বাভাবিক রূপ। যেন অনেকটা সেই মহাদেবের মতো, শ্মশানে শ্মশানে ছাই ভস্ম মেখে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যেন এ সংসারের প্রতি তাঁর কোনও লক্ষ নেই, টান নেই। কিন্তু উমা তাকে ঘিরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনাথদার তো ওই রকমই একটা আত্মভোলা ভাব। আর তুমি সবকিছু নিয়ে জড়িয়ে আছ। হঠাৎ মনে হবে, দুজনে দুজনের কাছ থেকে অনেক দূরে, আসলে তোমরা দুজনে দুজনের মধ্যে জড়িয়ে আছে। তোমরা বাইরে থেকে যা-ই হও, যেমনই তোমাদের দেখাক, তোমাদের চেহারা, তোমাদের বয়স, তবু তোমরা আমার দাদু দিদিমা, ঠাকুরদা ঠামার মতো প্রাচীন। তাঁরা যেন তাদের নিজেদের জন্যই গড়া ছিলেন। কেন আমার এ রকম মনে হয় জানি না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তাঁদের ভালবাসাবাসি ছিল অন্য এক জগতের। তাঁদের একজনের জন্য আর একজনের প্রাণের টান কতখানি, বাইরে থেকে কোনও কালেই বোঝা যেত না। অথচ সংসারের ভিতরে আর বাইরে, নানা কাজের মধ্যে, তাঁরা ছিলেন দুটো চুম্বকের মতো। তারা আসলে কেউ কারোকে কখনও ছেড়ে থাকতেন না।

তোমাকে বসিরহাটের দাদুর কথা একটু বলি। দিদিমা যখন মারা গেলেন, তখন আমার বয়স আর কত? তেরো-চৌদ্দর বেশি না। আমি ভেবেছিলাম, দাদু নিশ্চয় কাদবেন। কারণ আমি নিজে কেঁদেছিলাম। বউ মরে গেলে, স্বামী কখনও না কেঁদে পারে? কিন্তু আশ্চর্য, দিদিমার হাত তুলে নাড়ি দেখে, বুকে হাত দিয়ে, মাথা নিচু করে দিদিমার বুকে আর নাকে ঠেকিয়ে, দাদু মুখ তুলে যেন সংসারের আর দশটা কথার মতোই বলেছিলেন, ওর স্বর্গপ্রাপ্তি হল। দিদিমা তো হঠাৎ, একেবারে বিনা নোটিসেই মারা গিয়েছিলেন। অসুখে বিসুখে ভোগেননি। আমাকে বলেছিলেন, ঘর থেকে তাড়াতাড়ি গঙ্গাজলের ঘটিটা নিয়ে এসো।

আমি ছুটে গঙ্গাজলের ঘটি এনে দিয়েছিলাম। দিদিমা যে উঠোন থেকে ঘরে যেতে গিয়ে, পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন, আমি তখনও তা বুঝতেই পারিনি। দাদু দিদিমার মুখ ফাঁক করে একটু গঙ্গাজল ঢেলে দিয়েছিলেন, আর কয়েক ফোঁটা কানে কানে জল দেওয়া কি উচিত? আমার মনে হয়েছিল দাদু নিচু হয়ে, দিদিমার কানে কানে কী বলেছিলেন। অস্পষ্ট, ফিসফিস করে বলেছিলেন, কথাগুলো মন্ত্র বা আর কিছু, আমি বুঝতে পারিনি। তারপরে দাদুর জ্ঞাতি গোষ্ঠীর লোকজন সবাই আশেপাশের বাড়ি থেকে এসেছিল। দিদিমাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দাদু কাঁধ দেননি বটে, তবে ইছামতীর ধারে, কাছেই শ্মশানে, সকলের সঙ্গে, ঠিক আর দশজনের মতোই গিয়েছিলেন। আমি দাদুর চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আশ্চর্য, দাদুর চোখে এক ফোঁটা জলও দেখিনি। রাত্রে লুকিয়ে কেঁদে থাকলে আলাদা কথা। কিন্তু আমি যত রাত্রি অবধি জেগে থাকতাম, কখনও কাঁদতে দেখিনি। দাদুর কাছেই তো আমি শুতাম। তবে একটা জিনিস লক্ষ করতাম, দাদুর চোখের দৃষ্টি বদলিয়ে গিয়েছিল। আমি যখন ভাবতাম, দাদু আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে, আমি অস্বস্তি বোধ করে জিজ্ঞেস করতাম, দাদু, কিছু বলছ?

দাদু অবাক হয়ে বলতেন, কই, না তো? দাদু যেদিকে তাকিয়ে থাকতেন, সেদিকে কিছু দেখতেন না। যেদিকে যাবেন ভাবতেন, তার উলটো দিকে যেতেন, আবার ঠিক পথে ফিরে আসতেন। এখন, পরে বড় হয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, দাদু কাঁদেননি, হা হুতাশ করেননি, পুজোপাট যেমন করতেন, সবই বজায় ছিল, কিন্তু তিনি দিদিমার সঙ্গে কাটানো সারা জীবনটার কথা ভাবতেন। তাঁর আনমনা হয়ে যাওয়া, ডাকলে চমকিয়ে ওঠা, ওইসব কথা এখন মনে পড়লেই বুঝতে পারি, দাদু দিদিমার পায়ে পায়ে ফিরতেন। তখন বুঝতে পারতাম না, এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি, এক বৃদ্ধ অতি গোপনে, কেবল আপন মনে নিজের স্ত্রীর কথা ভাবতেন, তার সঙ্গে চুপিচুপি কথা বলতেন, তাঁদের সারাটা জীবনের কথা ভাবতেন। বাইরে থেকে কেউই টের পেত না।

আমি জানি, আজকাল ও সব কথা কেউ বিশ্বাস করে না, বিশেষ এক জনের জন্য আর একজন গড়া। যেন তা হলেই ভগবানের নির্দেশের কথা এসে পড়বে। নিয়তির কথাটা কেউ কি ভাববে না? আচ্ছা, নীলা বউদি, একটা খারাপ কথা বলছি। ধরো, তোমার সঙ্গে যদি আমার কিছু ঘটে যায় কী বলছি, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, যে কথাটা ভাবাই যায় না, তোমার সঙ্গে আমার–তবু, ধরো তোমার সঙ্গে হঠাৎ যদি আমার কিছু একটা ঘটে যায়, তা হলেও কি অনাথদার জায়গা কখনও আমাকে দিয়ে পূরণ করা যাবে? তোমাকে দিয়ে কি কখনও খুকুর জায়গা পূরণ করা যাবে? নীলা বউদি, আমি জীবনের অনেক কিছুই বুঝি না, অনেকেই আমাকে উল্লুক, বোকা বুন্ধু পাঁঠা গোঁয়ারও ভাবে, তবু কিছু কিছু ব্যাপার বুঝতে পারি। আমি জানি, যে কথাটা বললাম, মানুষের জীবনে এ রকম ঘটতে পারে। ঘটতেও দেখেছি। আর তার জন্য মানুষকে খুন করতে পর্যন্ত দেখেছি, তবু কিন্তু একজনের জায়গা আর একজনকে দিয়ে কখনও পূরণ করা যায় না। সেই জন্যই কি মানুষ খুন করে? পূরণ করা যায় না বলেই, বুকের সেই খাঁ-খাঁ জায়গাটা তখন একজনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে শান্তি পায়? আমি অবিশ্যি সব খুনকে এক রকম বলি না, অথবা কী জানি, সব খুনেরই শেষ কারণ হয়তো একটাই। যাকে বলে জিঘাংসা, খুনের প্রথম ধাপটা বোধ হয় তাই। কিন্তু আসলে কি কষ্ট থেকেই!

নীলা বউদি, আমি অন্য দিকে চলে যাচ্ছি। তবে যাই বলল, এক এক সময় খুন করাটাকে আমার মহৌষধ বলে মনে হয়। সকল ব্যাধির আরাম, প্রাণের শান্তি। না, আবার আমি অন্য দিকে চলে যাচ্ছি। তোমার কথাতেই আবার ফিরে আসছি। নিজের কথা ভেবেও আমি একটা কথা বুঝেছি, কারও জায়গাই কারোকে দিয়ে পূরণ করা যায় না।

আমার বাবা মার কথাই ভাবো না। এদের কারও জায়গা কি কারোকে দিয়ে পূরণ করা যায়? অথচ বাবার কথা তো তুমি ভালই জানো৷ তবু আমার মনে হয়, এরা একজনের জন্য আর একজন গড়া। ভাবতে খারাপ লাগে, যন্ত্রণাও হতে পারে। কারণ, এ পৃথিবীতে আমাদের সকলের সঙ্গে সকলের মেলে না। আমরা কেউ এক ছাঁচে গড়া নই, তবু যেন কোনও এক দেখতে না পাওয়া জগৎ থেকে, কেউ আমাদের একজনের সঙ্গে আর একজনকে জুড়ে দিয়েছে। তাদের কারও সঙ্গে কারও মিল না থাকুক, তবু তারা একজনের জন্য আর একজন গড়া। বাবার জীবনটা হল নির্বিচারে ভোগ করা, যখন যা পাওয়া যায়, তখন তাই নিজের কাছে টেনে নেওয়া। তার জন্যে কোনও দিকে, সমাজ সংসার, যশ অপযশ, যা নিয়ে মানুষ ভাবে বলে আমাদের ধারণা, বাবার সে সব কিছুই নেই। সুযোগ পেলেই থাবা দিয়ে তুলে নেওয়া, এই হল বাবার জীবন। আর মা? প্রতিবাদ নেই, বিবাদ নেই, কোনও কিছু আঁকড়ে নিজের জন্য রেখে দেওয়ার ব্যাপার নেই, কলুষ-অকলুষের বিচার নেই, বাবা যখন যা চেয়েছে, যেমন করে চেয়েছে তাই দিয়েছে। মনে হয় না কি, যেন একটা অভিশাপ? অন্তত আমার মায়ের জীবনে? একটা বাড়ির মধ্যে, সারাটা জীবন একভাবে কেটে যাচ্ছে, আমাদের ভাইবোনদের প্রসব করেছে, তারপরে ঠাকমা। মারা যাবার পরে, একদিন দোতলার ঘর থেকে, একতলার ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমার মাকে যদি কেউ বিশ-পঁচিশ কিংবা আরও বেশি, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেও বলত, নিজের জীবনটার কথা এক বার ভাবো, তা হলেও কি কিছু হত? সমাজের বিধান, আইনের নির্দেশের কথা ছেড়েই দাও, মা কি বাবার জায়গা কারোকে দিয়ে পূরণ করতে পারত?

জানি, তুমি কী বলবে। নতুন করে জীবন শুরু করা। কথাটা আজকাল খুব চালু হয়েছে। কিন্তু কী তার অর্থ? সত্যি বিশ্বাস করো, আমি অনেক ভেবেও, কথাটাকে জীবনে কী ভাবে কাজে লাগানো যায়, তার কোনও পথ খুঁজে পাইনি। নতুন করে শুরু করা মানে কী? কোনও গ্যারান্টি আছে? নাকি, নতুন মানে থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়, বিশেষ একজন মানুষের কথাই কেবল বলছি না, সব দিকের কথাই বলছি। চারদিকে এই যে চিৎকার, নতুন, নতুন করে শুরু করো, কী তার আসল ভিত্তি? কী তার আসল চেহারা? জীবনের কোনও দিকে তাকিয়ে কি কথাটার অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়? আমার তো মনে হয়, পুরনো ভিতের গ্রাসের মধ্যে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আমরা রয়েছি, আর সেখান থেকে মাঝে মাঝে চিৎকার করছি, নতুন, নতুন, নতুন করে শুরু কর। এ কি এক ধরনের মতলববাজদের চিৎকার! না না, তোমাকে সেই চিৎকার করা দলের মধ্যে ফেলছি না। আসলে আমি বলতে চাইছি, যদি সত্যি নতুন করে শুরু করা যেত, তার কোনও কী বলব কথাটা–তার কোনও রিয়্যাল বস্তু যদি আমাদের জীবনে। নিহিত থাকত, তা হলে নতুন শুরুর একটা অর্থ থাকত।

নীলা বউদি, আমি সত্যি জানি না, নিজের জীবনের কথা কী ভাবব। অনাথদা, তুমি, ঠাকুরদা, ঠা, দাদু, দিদিমা, মা, বাবা সকলের কথাই তো বললাম। আমি কাকে দিয়ে কার জায়গা পূরণ করব? মাঝে মাঝে কেবল একটা কথাই আমার মনে হয়, পূরণ করা যায় না, নাশ করা যায়। নাশ–মানে, সেই মহৌষধ, সেই পরমা শান্তি, সেই প্রাণের আরাম। তবু তো একটা কথা থেকেই যাবে। বিধাতা? বিধু যার নাম, ওর জায়গা কাকে দিয়ে পূরণ করব? জানি না, মা কী ভেবে আমার ছেলের নাম রেখেছিল। বিধাতা। ভাগ্যিস, ওটাই পোশাকি নাম হয়ে ওঠেনি। বিধাতা থেকে ডাক নাম বিধু হয়েছে।

মনে রেখো ঠাকুরপো, বয়স কমে না, সে বেড়েই যায়। নীলা বউদির গলা ভেসে এল ঘাটের কাছ থেকে।

আমি ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, নীলা বউদি ভেজা শাড়ি জামার ওপরে, বুকে পিঠে গামছাও জড়িয়েছে। মিনতির ঘাড়ে হাত দিয়ে, সিঁড়ির পিছল বাঁচিয়ে সাবধানে উঠতে উঠতে আমার দিকে দেখছে। না, নীলা বউদি হাসছে না। কিন্তু আমি সিগারেটে শেষ টান দিয়ে হাসলাম। নীলা বউদি মুখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে উঠতে লাগল।

হাসলাম এই কারণে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে, কমছে না, এটাও কি আর আমার জানবার মতো কথা? এই তো, একটু আগেই, বয়সের হিসাব কষছিলাম, এখন আমার বয়স বিয়াল্লিশ বছর তিন মাস। আমি জানি, এ বয়সটাকে, অনেকে পুরুষের পক্ষে অমাবস্যার তুলনা দেয়। বিশেষ করে আমার বাবা। আমার বাবার পক্ষে ও তুলনাটা একটা বেশ মজার কৈফিয়তের মতো লাগে। চল্লিশ বছর বয়সের পরে, পুরুষের জীবনে আর কী থাকে? যেন, চল্লিশ বছর বয়সটাই বানপ্রস্থের বয়স। বাবার পক্ষে এ কৈফিয়তটা বেশ কাজে লাগাবার মতো। কারণ, এটা আমাদের সমাজে সংসারেও বেশ মেনে নেওয়ার ব্যাপার, চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেলে, আর কিছুই রইল না। বাকিটা সবটাই ফাঁকি, অথবা–অথবা কী বলব, অক্ষম ভোগের নির্লজ্জতা। কিন্তু আমি ভালই জানি ও কথাটা আমার ঠাকুরদার আমল পর্যন্ত যদিও কোনও রকমে মানা যেত, এখন কিছুতেই মানা যায় না।

না, বাবাকে দিয়ে আমি কিছু প্রমাণ করতে চাই না। বাবা ষাট পেরিয়েও চল্লিশের বাঁধকে দিব্যি কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে মূর্খ, গাড়ল, যা-ই ভাবা হোক, আমি জানি বয়সটা কিছু না। অন্তত চল্লিশ বছর বয়সটা কিছু না। বরং শরীরের ক্ষয়কে মেনে নিয়েও মনের জোয়ারকে বেমালুম উড়িয়ে দেওয়া কোনও কাজের কথা না। আসলে মনটা বাড়ে বই কমে না। ছেলেবেলায় বসিরহাট ইস্কুলে একটা ধাঁধার কথা মনে পড়লে এখনও বেশ মজা লাগে। ধাঁধাটা ছিল, কাটলে তো সবই কমে, বাড়ে কী? ছেলেবেলার একটা মন ছিল, তা-ই জবাবও একটা ছিল। কেন, চুল কাটলেই বাড়ে। কিন্তু প্রশ্নটা ছিল না। প্রশ্নটা ছিল, যতই কাটা হচ্ছে, ততই বেড়ে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ সঙ্গে সঙ্গে। কী বেজায় কঠিন ধাঁধা। কাটছে আর বাড়ছে, সে আবার কী বস্তু?

জবাব ছিল, পুকুর। এক একটা কোদালের কোপ পড়ছে, থান থান মাটি কাটা হচ্ছে, আর পুকুর বেড়ে যাচ্ছে। ধাঁধার জবাব এ রকমই হয়ে থাকে। আর আমি দেখছি, জীবনটা কাটছে আর বাড়ছে। বাড়তে বাড়তেই শেষ হয়। আমি বুঝি না, পণ্ডিত চালাক এমনকী মূর্খরাও, চল্লিশ বছর বয়সটাকে নিয়ে খুবই হেনস্থা করে। যেন শরীরের সঙ্গে মনের কোনও ব্যাপার নেই। তা ছাড়া সময় আর যুগটাও কি বদলায়নি? আগে তো মেয়েদের সম্পর্কে বলা হত, মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি। এখন তো কুড়িতে খুকি, চল্লিশে যুবতী। অবিশ্যি নীলা বউদির কোনও দোষ দেখি না আমি। কেননা, সে আমাকে উপদেশ দিচ্ছে।, ওটা তার ক্ষোভের কথা। নিরিবিলিতে দেখা হলে, আরও অনেক বারই সে ওই কথাটা আমাকে। বলেছে। কিন্তু আমি তাকে বোঝাতে পারব না, কয়সের কথাটা আমার সেভাবে কোনও দিনই মনে। হয়নি। আজ যে কিছুক্ষণ আগে মনে হচ্ছিল, তার কারণ, একটাই হিসাব খুঁজে বের করার চেষ্টা, খুকু কবে এ বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে? বিধাতা কবে এ বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে? বিধাতা চলে যায়নি, ওকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার হিসেবের মূলটা ছিল, ওদের ছেড়ে কত কাল আছি?

এমন তো নয়, তুমি কেবল ঠকবার জন্যই জন্মেছ?’ নীলা বউদির রুষ্ট গলা আবার ঘাটের দিক থেকে ভেসে এল।

আমি মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। নীলা বউদি মিনতিকে নিয়ে সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ আমার দিকে ফেরানো। না, একটুও হাসি নেই তার মুখে, বরং গম্ভীর রাগ রাগ ভাব। মানুষ কত বদলিয়ে যায়। এই বউদিকে অনাথদা আমার সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছে। অবাক কাণ্ড। অথচ, বউদি যে কেন এ রকম করে বলছে, তা তো জানি। জ্ঞাতি সম্পর্কে দেবর হতে পারি, আসলে তো আমরা বন্ধুই। নীলা বউদির কথার সঙ্গে মায়ের কথার কিছু কিছু মিল আছে। অবিশ্যি মা মায়ের মতো বলে। বউদি বউদির মতো। নীলা বউদি আবার বলল, আমি যদি আগে বুঝতে পারতাম, তা হলে মুখপুড়িটাকে একদিন দোতলা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতাম।বলেই সে পিছন ফিরে, ভেজা শাড়ি ছপছপিয়ে চলে গেল।

মুহূর্তেই মনে হল, গোটা পুকুরঘাট, গাছপালা, জঙ্গল বাঁশঝাড় সবই যেন কেমন স্থির আর চুপচাপ হয়ে গেল। আর আমার এত বড় চওড়া বুকটার ভিতরে যেন হৃৎপিণ্ড বলে কিছু নেই, সেটাও পাথর হয়ে গিয়েছে। অথচ, পাথরেও কী রকম অদ্ভুত টনটন করে।

হঠাৎ বাঁশঝাড় থেকে মাছরাঙাটা যেন কেঁদে ওঠার মতো ডেকে উঠল। কেন? পুকুরটা তো শুকিয়ে যায়নি। এখনও অনেক জল। এখন সবে চৈত্র মাস। একমাত্র জলের অভাবেই মাছরাঙা এ রকম করে। ডেকে ওঠে। এ সব ছেলেবেলার শোনা কথা। জলের জন্য মাছরাঙা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকে। আর চাতকের তো নাকি জলের জন্য ডাকতে ডাকতে, গলা চিরে রক্ত বেরিয়ে যায়। কিন্তু মাছরাঙাটা এখন এমন করে ডেকে উঠল কেন? আশেপাশের গাছপালায় অন্যান্য পাখিও ডাকছে। এই সব মানে, যে সব পাখিরা ডাকে, যাদের ডাকাডাকি নিয়ে অনেক গান কবিতাও লেখা হয়। জানি না, বুঝিও না এ সব ডাকের মধ্যে কী মধু আছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, এ সবও নাকি নিজেদের মধ্যে ডাকাডাকি। কিন্তু সেই তুলনায়, মাছরাঙাটার ডাক শুনতে খুবই বিশ্রী, অথচ চিৎকারটা প্রায় সত্যিকারের কান্নার মতোই শোনায়।

আমি বাঁশঝাড়ের দিকে তাকালাম। মাছরাঙাটা নিশ্চয় জায়গা বদলিয়েছে, ওকে দেখতে পেলাম না। আসলে আমার মাথায় বিধে আছে নীলা বউদির কথাগুলোই। আর আমার মনটা চলে গিয়েছে বসিরহাটে দাদুর বাড়ি। হ্যাঁ, মজা আর–আর কী বলে ওটাকে? কৌতুক। কৌতুক মজা যন্ত্রণা, সবকিছু মিলে মনের মধ্যে একটা ঝাঁকুনি লাগছে, প্রায় হাসতে হাসতেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি জোরে টান দিয়ে জলের তলা থেকে বঁড়শিটা তুলে নিলাম। ইচ্ছা করল, নাইলনের সুতো দিয়ে, জলের বুকে প্রাণভরে চাবকাই।

কিন্তু সে সব কিছুই করলাম না। পিঁপড়ের ডিমের ঠোঙা থেকে ডিম বের করে বঁড়শিতে গেঁথে আস্তে আস্তে সুতোটাকে দূরে ছুঁড়ে জলের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম। আমার চোখের সামনে। জোড়াদিঘিপাড়ার খুকুদের বাড়িটা ভাসছে। সময়টা সিক্সটি সিক্স-এর গোড়ায়। বসিরহাটের দাদু তখন প্রায় শয্যাশায়ী। খুব একটা অসুখ-বিসুখ কিছু ছিল না। বয়সের ভারে, দাদু বেশির ভাগ সময় শুয়েই কাটাতেন। আমি প্রায় প্রত্যেক মাসেই দাদুকে এক বার দেখতে যেতাম। দাদুই বলতেন, তুমি মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখে যেয়ো। তুমি ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই।

আমি জানতাম, দাদু কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। আমি দাদুকে দেখতে যেতাম, আর বেশ ভালই বুঝতে পারতাম, দাদু দিদিমার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখলেই বলতেন, তুমি বেশ বড় হয়ে উঠছ। তোমার দিদিমা তোমার এই চেহারাটা দেখতে পেলেন না। আসলে, আমার বড় হয়ে ওঠা চেহারাটার দিকে তাকিয়ে, দাদুর নিজের প্রসন্নতার মধ্যে, প্রথমেই ভেসে উঠতেন দিদিমা। কারণ, তিনি তো আর কারও সঙ্গে ছিলেন না। কিন্তু দাদুকে আমি কখনও জোড়াদিঘি পাড়ার জ্যোৎস্নার কথা বলিনি। বরং দাদু বলতেন, তোমার বাবা মায়ের উচিত, এ বার তোমার একটি বিয়ে দেওয়া।

কথাটা শুনলে, আমার মনে একটা সুখের স্বপ্নের ছবি ভেসে উঠত, মোটামুটি ঠিকই হয়ে গিয়েছিল, খুকুকে আমি বিয়ে করব। কবে থেকে যেন জোড়াদিঘি পাড়ার মজুমদার বাড়ি যেতে আরম্ভ করেছিলাম? বোধ হয় সিক্সটি ফোর-এ শেষ দিকে। কার সঙ্গে গিয়েছিলাম? কানু, হা কানুর সঙ্গে প্রথম গিয়েছিলাম। দেশ বিভাগের পরে এলে, কলোনি বা নতুন বাঙাল পাড়ায়। মজুমদাররা হয়তো বাড়ি করত কিন্তু জোড়াদিঘি পাড়ার মজুমদাররা দেশ বিভাগের প্রায় বারো-চোদ্দো বছর আগেই আমাদের এলাকায় এসেছিল, শুনেছি, খুকুর ঠাকুরদা প্রথম এ অঞ্চলে এসে জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন। সুন্দরবনের দিকে, আবাদ অঞ্চলে কোথায় বেশ কিছু চাষের জমিও কিনেছিলেন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, কলোনি জীবনের যে-একটা ছাপ আছে, খুকুদের বাড়িতে সে ছাপটা পড়েনি। তবু, আমাদের অঞ্চলের লোকেরা বাঙাল বলে ওদের সঙ্গে মেলামেশা কমই করত।

আমার ধারণা ছিল, কানু জ্যোৎস্নার সঙ্গে প্রেম করে। কথাটা কি একেবারে মিথ্যা? কানুর ভাল নাম, কানাইলাল অধিকারী। খাঁটি ঘটি বলতে যা বোঝায়, তাই। আমাদের বাড়িতে ওর যাতায়াত ছিল, আর ওর মুখেই প্রথম আমি মজুমদার বাড়ির কথা শুনেছিলাম। শোনার আগে অবিশ্যি, নারকেল আর সুপুরি বাগানে ঢাকা, টিনের চাল, বড় বাড়িটা অনেক দিনই দেখেছি। নারকেল সুপুরি ছাড়াও, মজুমদারদের ছোটখাটো একটা বাগান, আর প্রায় ডোবার মতো ছোট একটা পুকুর ছিল, গোটা বাস্তু জমির সীমানার মধ্যে। কানু জোড়াদিঘি পাড়ার ছেলে। জোড়াদিঘি পাড়া, মানে সত্যি সত্যি ওদের পাড়ায় মস্ত বড় বড় দুটি পাশাপাশি দিঘি আছে। আমি মজুমদারদের বাড়ি চিনতাম, জানতামও ঢাকা না বরিশাল, কোথাকার এক বদ্যি পরিবার ও বাড়িতে আছে। কিন্তু মজুমদারদের বাড়ি যাওয়া, বা মেলামেশা করার কথা কখনও ভাবিনি। কানুই আমাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিল।

না, এমন না যে, আমাকে ও ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। ওর ও বাড়িতে যাতায়াত আছে শুনেছিলাম, আরও একটা কথা শুনেছিলাম কানুর মুখেই। ও গোঁফের কোণ দাঁত দিয়ে কেটে চোখের তারা ঘুরিয়ে আমাকে বলছিল, মজুমদার বাড়ির গিন্নি থেকে প্রত্যেকটা মেয়েই দারুণ।

ওই রকম কথা আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এত বলাবলি হত, তা নিয়ে সিরিয়াসলি কেউ কোনও দিন কিছুই ভাবিনি। আমি বরং হেসে কানুকে বলতাম, তুই কি, গাছের খাবি, তলারও খাবি কুড়োবি, এ রকম ভেবেছিস নাকি?

ধ্যেসস সালা। কানু হেসে উঠত। মজুমদার গিন্নিকে আমি মাসিমা বলে ডাকি।

আমি বলতাম, তা হলে মাসিমাকে মাসিমার চোখেই দেখিস, ও সব বাজে কথা বলার দরকার কী?

অনেক সময় মনেই থাকত না, কানু মজুমদার বাড়ি সম্পর্কে কখন কী বলত, কেন বলত। ও বলত, আমি শুনে যেতাম, আর এটা বুঝেছিলাম, মজুমদার বাড়ির গিন্নি সুন্দরী, তাঁর দুই কন্যাও সুন্দরী। তারপরে সিক্সটি ফোর-এর শেষ দিকে, মনে হয় সেটা ছিল অগ্রহায়ণ মাস, আমরা যাকে হেমন্তকাল বলি, একদিন প্রায় পড়ন্তবেলায়, কানুদের বাড়ি থেকে আমি আর কানু দুজনে দুটো সাইকেলে চেপে আমাদের বাড়ি ফিরছিলাম। জোড়াদিঘি পাড়ার বড় মাঠে, আমাদের আঞ্চলিক ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। বেলা এগারোটাতেই ভাত খেয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। খেলার পরে, কানুদের বাড়ি চা খেয়ে, দুজনে একসঙ্গে আমাদের বাড়ি ফিরছিলাম। অগ্রহায়ণ মাসের সেই পড়ন্ত বেলায়, ঘন সুপুরি গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, একটি মেয়ে ডেকে উঠেছিল, কোথায় যাচ্ছ কানুদা?

কানুর সঙ্গে সঙ্গে আমিও সাইকেলের ব্রেক কষেছিলাম। কানু সাইকেল থেকে না নেমেই, পিচের রাস্তায় পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, যাচ্ছি একটু দুদেদের বাড়ি।

আমাদের বাড়ি আসবে না? মেয়েটি ঘাড় কাত করে, এমনভাবে হেসে বলেছিল, যেন কানু ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে, অথচ ওদের বাড়ি না যাওয়াটা একটা অবাস্তব ব্যাপার।

কানু আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিলাম। পড়ন্তবেলার লাল রোদ মেয়েটির পিছন থেকে, ঠিক যেন থিয়েটারের উইংস-এর পাশ থেকে সুইচ টিপে জ্বালানো আলোর মতো দেখাচ্ছিল। মেয়েটির কত বয়স হবে? আমি বুঝতে পারিনি। তখনও তার চুল খোলা। গায়ে লাল জামা, আর লাল ডোরা সাদা একটা শাড়ি। আটপৌরে ধরনে না, যাকে বলে চলতি কথায় ড্রেস দিয়ে পরা অর্থাৎ সামনে কুঁচিয়ে ঘুরিয়ে ফেত্তা দিয়ে পরা ছিল। চলে যাওয়া বেলার লাল রোদ তো মেয়েটির পিছনে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে এসে পড়েছিল, তবু ওর গাল দুটো লাল দেখাচ্ছিল কেন? না না, শুধু গাল কেন, ওর মুখ গলা হাত জামা কাপড়ের বাইরে গোটা শরীরটাই যেন লাল রোদে মাখামাখি দেখাচ্ছিল। অথবা এত ফরসা, লালচে ফরসা যাকে বলে, সেই রকম আর তার সঙ্গে চোখ দুটো এত কালো আর টানা, তারা দুটো এত চকচকে, যেন এঁকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চুড়ি হার দুল, কিছু ছিল কি না, আমি দেখিনি, আমার চোখে পড়েনি, অথবা আমি ও সব মোটে খেয়ালই করিনি। ছিপছিপে বলেই বোধ হয়, মেয়েটিকে লম্বা দেখাচ্ছিল, কিন্তু সেটা কোনও রকম বেমানান লম্বা না। বরং এমন মানানসই, মনে হয়েছিল, ওই রকমটি ছাড়া, আর কোনও রকমই, ওর পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিল না। আরও কি কিছু ছিল, যা আমার দৃষ্টিকে নির্লজ্জের মতো যেন চুম্বকের টানে ধরে রেখেছিল? ওর খোলা কালো চুল? স্বাভাবিকের থেকেও একটু বেশি লাল ঠোঁট, ফাঁক করা ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসি? ওর ঘাড় কাত করে তাকানো? ওর–ওর সেই আশ্চর্য বুক, অর্ধেক ঢাকা আঁচলের বাইরে যা লাল জামায় ঢাকা, অথচ যেন পায়রার বুকের মতো নরম আর ঢলঢলে? ঢলঢলে! কী বলা যায় বুকের ওই আকারকে? না কি আরও কিছু ছিল, যা মেয়েটির রূপ ছাড়িয়েও বেশি কিছু?

মেয়েটি কেবল কানুর দিকে না, আমার দিকেও তাকাচ্ছিল। আর–আর, হ্যাঁ, ওর ঠোঁট দুটো কি কোনও ভঙ্গি করছিল? কানু জিজ্ঞেস করেছিল, কলেজে গেছলে?

না, আজ যাইনি। মেয়েটি বলেছিল, পড়াটড়া হবে কি না বুঝতে পারছি না। হয়তো স্কুল ফাইন্যাল পর্যন্ত হয়ে রইল। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলবেন নাকি? ভেতরে আসবেন না?

কানু আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি কানুর দিকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেবার আগেই, ও বলে উঠেছিল, দুদে, এর নাম জ্যোৎস্না। ডাক নাম খুঁকি।

মোটেই না কানুদা, আমার ডাকনাম খুকু। জ্যোৎস্না বলেছিল।

আমি–আশ্চর্য, কী করে কথাটা আমার মনে এসেছিল, জানি না, আমি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, এই মেয়ের নাম জ্যোৎস্না কেন? জ্যোৎস্না বললেই, ঢলঢলে যে চাঁদের আলোর কথা আমাদের মনে পড়ে যায়, এই জ্যোৎস্না তো সে রকম ছিল না। জ্যোৎস্নার মধ্যে কেমন একটা মিষ্টি আর ঠাণ্ডা দুধের স্বাদ আছে। কথাটা পরে আমি অনেক বার বলেছি, বিশেষ করে নীলা বউদির সামনে। জবাবে নীলা বউদি বলেছে, আহা, জ্যোৎস্না মানে তো তোমার কাছে ঠাণ্ডা আর মিষ্টি দুধই মনে হবে। তুমি যে ঠাণ্ডা মিষ্টি দুধই চুমুক দিয়ে খেতে ভালবাসো।

কথাটা অবিশ্যি মিথ্যা না, আমিষের থেকে নিরামিষ, মাংসের থেকে দুধ আমি ভালবাসি। বসিরহাটে দাদুর কাছে থেকে, ছেলেবেলাতেই ওই অভ্যাস আমার হয়েছিল। হ্যাঁ, গরম না, ঠাণ্ডা, একটু ঠাণ্ডা দুধ আমি ভালবাসি। কিন্তু অগ্রহায়ণের সেই পড়ন্ত বেলায়, জোড়াদিঘি পাড়ার মজুমদার বাড়ির সুপুরি গাছের ফাঁকে জ্যোৎস্নাকে দেখে, আমি আমার প্রিয় খাবারের কথা ভাবিনি। আমার হঠাৎই মনে হয়েছিল, ওই মেয়ের নাম জ্যোৎস্না কেন? জ্যোৎস্না ঢলঢলে, নরম, সারা শরীরে যেন ঠাণ্ডা জলে ডুব দিয়ে, সাঁতার কেটে স্নানের আরাম আর আনন্দ এনে দেয়। আমার তো অনেকদিন জ্যোৎস্না রাত্রে, আমাদের বাগানে, পুকুর ধারে, ছাদে, মনে হয়েছে, আমাকে যেন জ্যোৎস্না দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে, আমি যেন জ্যোৎস্নায় সাঁতার কাটছি।

কিন্তু মজুমদার বাড়ির জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল, ওর নাম রাখা উচিত রোদ। কিরণ বললে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। কার কিরণ? সূর্যের না চাঁদের? জ্যোৎস্নার নাম রাখা উচিত ছিল রৌদ্রকিরণ। অন্তত সূর্যমুখী নাম রাখা যেত। কারণ, ওকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, ওর গায়ের রং, চোখের কালো রং এতই ঝকঝকে, যেন গায়ে উত্তাপ লাগছিল। শুধু গায়ে? মনে না? কানু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, যাবি নাকি দুদে?

অ্যাঁ?’ আমি নিরেট বোকার মতে, প্রায় চমকিয়ে একটা জিজ্ঞাসার শব্দ করেছিলাম।

কানু খুকুকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি আমার এ বন্ধুকে চেনো?

দেখেছি’, খুকু বলেছিল, তারপরে ঠোঁট টিপে একটু হেসে, আমার মুখের দিকে এক বার দেখে, আবার বলেছিল, চিনি। রাঢ়িপাড়ার চাটুয্যাবাড়ি। কথাটা ও শেষ করেনি, আমার দিকে আবার এক বার দেখে, কানুর দিকে তাকিয়েছিল।

জ্যোৎস্না ভুল বলেনি। প্রথমে বোধ হয় ইচ্ছা করেই চেপে যেতে চেয়েছিল। কত ওর বয়স ছিল সেই সময়? যতই হোক, ওই বয়সের একটি মেয়ে, যত্ত ছেলেদেরই চিনুক, কিন্তু সে কথা তৎক্ষণাৎ বলে ফেলতে নেই। একটু থেমে গিয়ে তারপরে বলে ফেলেছিল। আমাদের পাড়াটার নাম রাঢ়িপাড়াই বটে। রাঢ়ীয় শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের বেশির ভাগের বাসস্থান বলেই, ওই নাম ছিল। কিন্তু খুকু যখন বলেছিল, তখন পৌরসভার খাতাপত্রে আমাদের পাড়ার নাম হয়ে গিয়েছিল গঙ্গাধর চ্যাটার্যি রোড।

জ্যোৎস্নাবা খুকু–যা-ই বলা যাক, ও আমাকে চিনত শুনে আমি কি মনে মনে খুশি হইনি? স্বর্ণকমল চাটুয্যে, তুমি একটি উত্তম গর্দভ। খুশি? বলল, তোমার বুক ফুলে উঠেছিল! খুকু নিজেই আমাকে ডেকে উঠেছিল, আসুন না।

আমি কানুর দিকে তাকিয়েছিলাম। কানু সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকেছিল, আয়, পাঁচ মিনিট বসে যাই।

ইতিমধ্যে আমিও পা নামিয়ে রাস্তায় ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সাইকেল থেকে নেমে, কানুর পিছনে পিছনে কাঠ দিয়ে তৈরি আগল ঠেলে সামনের উঠোনে ঢুকেছিলাম। দেখেছিলাম। থাক, এ সব কথা এখন ভাববার কোনও দরকার নেই। বসিরহাটে দাদুর বাড়ি যাওয়ার কথাই বলা যাক। নীলা বউদির ওই কথাটা, এমন না যে, তুমি কেবল ঠকতেই এসেছ’ হঠাৎ আমাকে বসিরহাটে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে খুকুর কথাটা এসে পড়ল, কারণ, তার সঙ্গেও আমার জীবনে চাবুক খাওয়া চমকানো ছুটন্ত ঘোড়ার দলের মতো ঘটনা জড়িয়েছিল। আমি প্রতি মাসেই অন্তত এক বার বসিরহাটে দাদুকে দেখতে যেতাম। দাদুর ওপর আমার নিজের টান থেকেই যেতাম। তা ছাড়া, মা আমাকে মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিত, এ মাসে কিন্তু দাদুকে দেখতে যাসনি। কবে যাবি?..মনে করিয়ে দেবার কোনও কারণ ছিল না, আমার মনেই থাকত। আসলে মা আমার মাথায় একটা কথা এমনভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছিল যেটাকে আমি বিশ্বাসের থেকেও বেশি অনিবার্য বলে জানতাম। মা বলত, আমার বাবার তুই ছাড়া আর কেউ তো নেই। বাবা তার যাবতীয় সম্পত্তি, জমি বাড়ি নগদ টাকা গয়না, সবই তোর নামে লিখে রেখেছে। নেহাত ওখানে থাকলে তোর অযত্ন হবে, নইলে আমিই তোকে বাবার কাছে গিয়ে থাকতে বলতাম।

মায়ের মুখ থেকে নিছক সত্যি কথাগুলো শুনতে আমার ভাল লাগত না। একটা কথা মা ভুল বলত। বসিরহাট থেকে দাদুই আমাকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। দিদিমা মারা যাবার পরে তিনি আর আমাকে তার কাছে রাখতে চাননি। সেটা আমার অযত্নের জন্য, এ কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস কখনও করতে পারিনি। আসলে দিদিমা ছিলেন, দাদুর সাহস ভরসা আত্মবিশ্বাস। তা-ই দিদিমা মারা যাবার পরেই যে দৌহিত্রটিকে ছেড়ে তিনি থাকতে পারতেন না তার দায়িত্ব নিতে আর সাহস পাননি। তাড়াতাড়ি আমাকে আমার বাবা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আরও একটা বিষয়, যে কথাটা আমি আগেই বলেছি, দাদু দিদিমার সঙ্গে তার পুরনো জগতে ডুবে যাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি একলা থাকতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে সিক্সটি ফোর-এ আমার এ জ্ঞান ছিল, দাদু তার সবকিছু আমাকেই দিয়ে যাবেন। দিদিমা মারা যাবার পরে বসিরহাট থেকে যখন নিয়ে এসেছিলেন, জ্যাঠাইমা, মা, ঠাকমা সকলের মুখেই কথাটা শুনতাম। দাদু যে আমাকেই তাঁর সব কিছু দিয়ে যাবেন সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।

কিন্তু, এক নম্বর: আরও একটু বয়স হবার পরে, জ্যাঠাইমার মুখে ওকথা শুনতে আমার ভাল লাগত না। দু নম্বর: বাবা বা আমার বন্ধুরা যখন কেউ ঠারেঠোরে বোঝাবার চেষ্টা করে বলত দাদুকে মাসে এক বার দেখতে যাওয়ার মূলে দাদুর সম্পত্তির ওপর আমার দাবিকে নাকি বজায় রাখারই উদ্দেশ্য। কথাটা যে কত বড় মিথ্যা সেটা আমার থেকে বেশি কেউ জানত না। বড় হয়েও বসিরহাটে দাদুকে দেখতে গিয়ে তাঁর সেই বুড়ো বুড়ো তেলতেলে গন্ধ গায়ে একটু হাত না দিতে পারলে ভাল লাগত না। তাঁর কাপড়ের কোঁচা মুখে পুরতাম না বটে, কিন্তু হাতে ধরে ঘাঁটতাম। দাদুও এদিকে ওদিকে হাতড়িয়ে আমার একটা হাত খুঁজে নিয়ে ধরে রাখতেন, আর সেখান থেকে একটু একটু করে আমার কোমর পিঠ বেয়ে মাথায় তার হাত উঠে আসত। আর হঠাৎ বলে উঠতেন, তোমার দিদিমাই নেই। কে আর তোমাকে দেখবে।

যেন আমার তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স অবধি দিদিমাই আমাকে দেখে এসেছিলেন। আসলে আমার গায়ে হাত দিয়েও দাদুর দিদিমাকেই মনে পড়ত। আর আমার বুকের মধ্যে কেন টনটন করত? ঠিক মনে হত আমার বুকে ঝরনার মতো জলের ধারা নেমে যাচ্ছে। আসলে আমি আমার ছেলেবেলায় ফিরে যেতাম, যেটা ছিল খুব কঠিন। আমাদের বাড়িতে এক বার ঢোকার পরে, যে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম, বলতে গেলে রাতারাতিই আমার ছেলেবেলাটা হারিয়ে গিয়েছিল। সেই জন্যই ছেলেবেলায় ফিরে যাওয়া কঠিন ছিল।

দাদু আমার গায়ে হাত রেখে দুঃখ করে বলতেন, লেখাপড়া তত বেশি হল না। একটা চাকরিও পাচ্ছ না। আর তোমরা আজকালকার ছেলে, পুজোপাজা আহ্নিক মন্ত্রদান দীক্ষা যজমানি এ সব নিয়েও থাকতে পারবে না। পারলে কিন্তু খুবই ভাল হত। তোমাদের মতন ছেলেপিলেরা ভাবে ও সব আজকাল অচল, আয়পয়ও তেমন নেই। সেটা কিন্তু একবারেই ভুল। অচল তো আদৌ নয়। বরং এ সব নিয়ে থাকলে দেখতে মানুষের বিশ্বাস কিছুমাত্র কমেনি। আর জীবিকা হিসাবেও যদি দ্যাখো, তা হলেও তোমাদের আজকালকার অনেক কাজের থেকে এটা অনেক বেশি সম্মানের। কী, মনে মনে হাসছো তো? তবে শোনো বলি, আমার যজমানদের মধ্যে তোমাদের ওইসব কংগ্রেস কমিনিস্ট সবাই আছে, অনেক বড় বড় নেতা আমাদের যজমান, একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবে। সবাইকেই শান্তি স্বস্ত্যয়ন ইত্যাদি করতে হয়…।

আমি দাদুর কথাগুলো শুনে যেতাম। তাঁর অধিকাংশ কথাই যে সত্যি, তা আমি জানতাম। কিন্তু আমার পক্ষে দাদুর মতো জীবনযাপন করা অসম্ভব ছিল। আমি ভাবতেই পারতাম না। তিনিও বুঝতেন আর পরে বলতেন, আমি নেহাত কথার কথা বলছি, তোমাকে ও সব করতেই হবে, তা বলছি না। আমি জানি আমার সঙ্গেই আমাদের বংশের এ সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।’…দাদু কখনও ভুলেও মামার নাম করতেন না। মামার বিষয়ে যা কিছু ভাবনা চিন্তা সে সব মনে মনে দিদিমার সঙ্গেই আদানপ্রদান হত, আমার ধারণা। আমাকে বলতেন, দু বেলা গায়ত্রী জপো তো? ওটা অবিশ্যি কর্তব্য।

আমি ভাল ছেলের মতো ঘাড় কাত করে মিথ্যা বলতাম, গায়ত্রী জপ করি। আসলে আমার পৈতাই ছিল না, ও সব খেয়ালও থাকত না। সত্যি কথা বলতে কী, কোনও বাহাদুরি করার জন্য আমি পৈতা ফেলে দিইনি। আমার বাবার জন্যই আমি পৈতা পরা ছেড়েছি। বাবার গলায় বেশ মোটা পৈতা দেখে, আমার পৈতার ওপরেই ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। ওই লোক, যে জীবনে কোনও অন্যায় করতেই বাকি রাখেনি, সে যদি পৈতা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় তা হলে আমার পক্ষে ও বস্তু গলায় না ঝোলানোই ভাল। কিন্তু দাদুকে তো সে কথা বলতে পারতাম না। অবিশ্যি দাদু অবিশ্বাস করে কোনও দিন আমার পৈতা দেখতেও চাননি।

যাই হোক, আমাকে প্রতি মাসে এক দিন বসিরহাটে যেতে দেখে খুকুরও ইচ্ছা হয়েছিল আমার সঙ্গে এক দিন যাবে। সিক্সটি ফাইভ থেকেই খুকুর সঙ্গে আমার মাখামাখি এতটা এগিয়ে গিয়েছিল আমরা দুজনে প্রায়ই কলকাতায় যেতাম। কয়েকটা ইস্টিশনের ব্যাপার। বালিগঞ্জ ইস্টিশনে নেমে লেকের ধারে, কোনও দিন ভিক্টোরিয়া অথবা গঙ্গার ধারে না হয় তো এমনিই দুজনে কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। কানু আর আমার সঙ্গে বা খুকুর সঙ্গে কথা বলত না, ওদের বাড়ি বা আমাদের বাড়ি আসত না।

কিন্তু ও সব কথা পরেও ভাবা যাবে। আমি তো আগেই বলেছি, খুকুর নাম জ্যোৎস্না না রেখে রাখা উচিত ছিল রোদ। সূর্যমুখী বললে, ওর আগুনের মতো রূপের কথা কম বলা হয়। আমার মনে হয়, সূর্যমুখীরও একটা ইয়ে আছে, কী বলে ওটাকে? সফটনেস? মাঝে মাঝে ইংরেজি বলার খুব ঝোঁক হয় আমার। প্রায়ই বিশেষ করে কোনও কারণে মেতে গেলে, বা তেতে গেলে ইংরেজি বেরিয়ে পড়ে আমার মুখ দিয়ে। আসলে সূর্যমুখীর মধ্যেও একটা কোমলতা যেন আছে, যা ছিল না খুকুর রূপের মধ্যে। ও যেন আগুন দিয়ে তৈরি আর দাহ ছিল ওকে ঘিরে। আমি সে কথা ওকে বলেছিলাম। ও হাসত, বলত, আমাকে সহ্য না হলে ছেড়ে দাও।

ছেড়ে দেব কি, আমি তো ওর মধ্যে ভিতরে বাইরে একেবারে আগুনে রাখা মাখনের মতো গলেই গিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী, খুকুর যে কেবল রূপের আকর্ষণ ছিল, যার সঙ্গে ওর শরীরটাও অনেকখানি, তার থেকেও বেশি আকর্ষণ ছিল ওর চোখের তারা ঘোরানোয়, ঠোঁটের নানা ভঙ্গিতে, কথা বলার বিশেষ কতগুলো ইঙ্গিতে আর চলার গতিতে। কী ভাবে যে ও চলত, মনে হত ওর কোমরের নীচে একটা ভঙ্গি, কোমরের ওপরে আর একটা ভঙ্গি। ওকে নিয়ে রাস্তায় বেরোলে আমি রীতিমতো অস্বস্তি বোধ করতাম, কিন্তু ও খুব সহজ আর অনায়াস ছিল। রাস্তার লোকজনকে যেন দেখতেই পেত না। আর আমার নজর কেবলই রাস্তার লোকগুলোর দিকে যেত, খুকুর ওপর তাদের দৃষ্টি দেখলে শ্মশানের কুকুরের জ্বলজ্বলে চোখের কথা আমার মনে পড়ত আর বুকের মধ্যে জ্বালা ধরে যেত। রাস্তার লোকগুলোকেও আমার হিংসে হত। খুকুর অবিশ্যি কিছুই যেত আসত না, বরং দেখতাম প্রায়ই ওর চেনাশোনা কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। হয় ওর আত্মীয় কোনও ছেলে, না হয় তো, যেকদিন কলেজে গিয়েছিল, প্রি ইউ পড়তে, তার মধ্যেই জানাশোনা কোনও ছেলে। খুকু তাদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলত। আর আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠত। শালারা কোথা থেকে এসে জোটে। আর জুটলে সহজে ছেড়ে যাবার পাত্রও না। খুকুও যে বলবে, বা তাড়াতাড়ি কাটিয়ে দেবে, সে সব লক্ষণ দেখা যেত না। এক এক সময় ও যেন আমার কথা ভুলেই যেত। তা নিয়ে আবার আমি মন খারাপ করতাম, মান-অভিমান, যাকে বলে নাকি গোঁসা।

খুকু প্রায়ই বসিরহাটে যেতে চাইত, আমাকে একদিন তোমার দাদুর কাছে নিয়ে চলো না। বেশ একটু বেড়ানোও হবে। তুমি তো বলো ইছামতীর ধারে দাদুর বাড়িটা খুব সুন্দর।

না নিয়ে যাবার কোনও কারণ ছিল না। খুকু যেতে চাইলে আমি নিয়ে যাব না, তা হতেই পারে না।

সময়টা ছিল সিক্সটি সিক্স-এর গোড়ায়। তা-ই বা কেন, সিক্সটি সিক্স-এর জানুয়ারি, আর তাও জানুয়ারি মাসেরও দশ বারো তারিখ নাগাদ। মোট কথা তখনও পৌষ মাস। কথায় বলে কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। তার মানে পৌষ মাসটা সময় ভালই। পূজাপাট বা বিয়ে থা র ব্যাপারে না, খাওয়ার সুখ, লেপ মুড়ি দিয়ে শোবার সুখ। নতুন ধান নতুন চাল, এ সব কারণেই বোধ হয় পৌষ মাস সকলের প্রিয়। অথচ হিন্দুদের পৌষ মাসে কোথাও বাইরে গিয়ে কাটাতে নেই।

আমি একদিন সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে জোড়াদিঘি পাড়ার খুকুদের বাড়ি গিয়ে ওকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। আমি মাকে কিছু বলিনি, কিন্তু খুকু ওর মাকে বলেছিল আমার সঙ্গে বসিরহাটে যাচ্ছে দাদুর বাড়ি। খুকু সবই লাল পোশাক পরেছিল। লাল শাড়ি লাল জামা লাল উলের কার্ডিগান। কার্ডিগানটা অবিশ্যি ওর এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করতে হয়েছিল। ওর গরমের পোশাক তেমন কিছু ছিলই না। আমারও ছিল না, তবু ওর থেকে কিছু বেশি ছিল। তবে খুকুর মতো মেয়ের লাল পোশাক পরা মানেই জ্বলন্ত মশাল নিয়ে চলা। ও ছিল এমনিতেই টকটকে ফরস। কাঁচা সোনার রং একরকম, সেটাও ফরসা, যেমন আমার মা। খুকুকে বলতে হয় গিনি মোহরের মতো। তার সঙ্গে লাল পোশাক, চুলের দু পাশে দুটো আলগা খোঁপায় লাল ফিতের ফুল রাজ্যের দৃষ্টিকে ঝেটিয়ে নিয়ে বেড়ানো যাকে বলে।

আমি রেলপথটা অ্যাভয়েড করেছিলাম। সাধারণত শিয়ালদহ সাউথ থেকে নর্থে গিয়ে বারাসাতের ট্রেন ধরতাম। বারাসাত থেকে বাসে। ট্রেনও আছে হাসনাবাদ পর্যন্ত কিন্তু সেই ট্রেনে উঠলে গা ঘুলোত। যদিও ইলেকট্রিক ট্রেনের অবস্থাও এমন কিছু ভাল ছিল না। পাইখানা পেচ্ছাপের দৌরাত্ম্য সেই সব ট্রেনেও ছিল। কিন্তু বসিরহাট হয়ে হাসনাবাদ পর্যন্ত যে যে গাড়ি যায় সেগুলো চলন্ত ভিখিরির আস্তানা। পাইখানা পেচ্ছাব বমি রক্ত রান্না হাঁড়িকুড়ি, মেঝেতে বিস্তর সংসার–ভাবাই যায় না। তবে বারাসাত থেকে বাসে জায়গা পাওয়া একটু মুশকিল ছিল। খুকুকে নিয়ে আমি সেই রিসক নিইনি। শিয়ালদহ সাউথ থেকে শ্যামবাজারে গিয়ে একেবারে বসিরহাটের বাস ধরেছিলাম। দুজনে পাশাপাশি বসেছিলাম। জানলার ধারে বসে খুকু খুব খুশি হয়েছিল।

বেলা তিনটের মধ্যেই আমরা বসিরহাটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। দাদুর বাড়ির দরজা খোলাই ছিল। তাঁর সম্পর্কে অনাথিনী আত্মীয়া, বয়স বোধ হয় ষাটের মতো, খুকুকেই হাঁ করে দেখছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদু কোথায়?

কে?’ দাদুই ঘরের ভিতর থেকে বলে উঠেছিলেন, দুদে এসেছে মনে হচ্ছে? এসো, ভেতরে এসো, আমি শুয়ে আছি।

আমি খুকুকে নিয়ে দাদুর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ওকে কানে কানে বলেছিলাম, দাদুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করো।

ওটা আবার শেখাতে হয় নাকি, বোকা! খুকু আমার গায়ে আঙুলের খোঁচা দিয়েছিল।

আহা, খুকুর মুখে বোকা’ শুনতে কী ভালই লেগেছিল। বোকা, বোকা, আমি বোকা। দাদুর ঘরের দক্ষিণ আর পুবের দরজা জানালা খোলা ছিল। না হলে অন্ধকার হত। আমি আর খুকু জুতো আর স্যান্ডেল খুলে ভিতরে ঢুকেছিলাম। দাদু বিছানায়। দাদু বিছানায় মাথা রেখে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়েছিলেন। আমি কাছে গিয়ে বলেছিলাম, শরীর খারাপ মানে কী, জ্বর-টর হয়েছে নাকি?

না, জ্বর ঠিক নয়, তবে জ্বর-জ্বর ভাব! দাদুর গলাটা একটু কাহিল শুনিয়েছিল, বয়স তো হয়েছে, তার ওপরে শীত। এখন বেশি গরম শীত বর্ষা কিছুই আর সহ্য হয় না। কীসের একটা গন্ধ পাচ্ছি বলে তো, তুমি কি আতর এসেন্স মেখে এসেছো নাকি?

আমি খুকুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম। দাদু খুকুকে দেখতে পাননি, কিন্তু ওর মেখে আসা সেন্ট ক্রিম ইত্যাদির গন্ধ পেয়েছিলেন। চোখের দৃষ্টি কমে এসেছিল, যদিও ছানি পড়েনি। আমি বলেছিলাম, না, আমি কিছু মেখে আসিনি। আমার সঙ্গে একজন এসেছে তোমাকে দেখতে। আমি খুকুর দিকে তাকিয়ে দাদুর পায়ের দিকে ইশারা করেছিলাম।

খুকু দাদুর পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দাদু ওকে দেখতে পেয়েছিলেন, বলে উঠেছিলেন, দাঁড়াও দাঁড়াও, মাথাটা তুলি, তারপরে প্রণাম করো।

দাদু বালিশ থেকে কেবল মাথা তোলেননি, উঠে বসেছিলেন। খুকু দাদুকে প্রণাম করেছিল। এটা আমাদের একটা সংস্কার, শোয়া অবস্থায় প্রণাম করতে নেই। শোয়া অবস্থায় একমাত্র মরা মানুষকেই। প্রণাম করা যায়। সেই জন্য শোয়া মানুষকে মাথা তুলে, প্রণাম নিতে হয়।

আমি প্রতি মাসেই দাদুর কাছে যেতাম, কিন্তু প্রণাম করতাম না। আমাদের সম্পর্কটাই এমন ছিল, প্রণাম করাটা এক রকমের ইয়ে বাহুল্য যাকে বলে। কিন্তু সে বার খুকু প্রণাম করার পরেই আমিও দাদুকে প্রণাম করেছিলাম। দাদু অবাক হয়ে শব্দ করে উঠেছিলেন, অ্যাঁ?’..তারপরে আরও ছোট একটি শব্দ করেছিলেন, অ!’ তিনি ভুরু কুঁচকে খুকুর দিকে তাকিয়েছিলেন। চোখের কম নজরের জন্যই, তাঁর ভুরু কুঁচকে তাকাতে হত। খুকুর দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ মেয়েটি কে?

আমাদের ওখানে জোড়াদিঘি পাড়ায় এদের বাড়ি।আমি বলেছিলাম, এর নাম জ্যোৎস্না।

দাদুর মুখের চামড়ার রেখাগুলো দুমড়ে মুচড়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। বলেছিলেন, অ। তা, এ তোমার সঙ্গে চলে এল, এর বাড়িতে বাবা মা কিছু বলবেন না?

আমি বলেছিলাম, না, ও ওর বাবা মাকে বলেই এসেছে। তোমাকে দেখবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ওর। আমার কাছে তোমার কথা শুনেছে তো, তাই।

অ! দাদু যেন কেমন একটু দিশাহারা চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, আমি বুড়োমানুষ, আমাকে আর দেখবার কী আছে?

খুকু বলে উঠেছিল, বারে, বুড়োমানুষ হলে দাদুকে বুঝি দেখতে আসে না কেউ?

 অ্যাঁ? হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা আসে। দাদু বলেছিলেন, আর আস্তে আস্তে তাঁর মুখের রেখাগুলো স্থির হয়ে আসছিল, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, একে নিয়ে আসার কথা তোমার মা জানেন?

আমি মিথ্যা বলেছিলাম, হ্যাঁ, মাকে বলেই এসেছি।

স্নেহদিদিকে তুমি গিয়ে এক বার খবর দাও, তোমার আসার কথা। দাদু বলেছিলেন তাঁর সেই আত্মীয়া মহিলার কথা, ঘরে কিছু খাবার-দাবার আছে কি না।

আমি পুরনো খাটের বিছানায়, দাদুর পাশে বসে বলেছিলাম, মেহদিদি আমাদের দেখেছেন, খাবার-টাবারের জন্য তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

হুমম!’ দাদু লম্বা একটা শব্দ করেছিলেন, তারপরে যেন আনমনে বলেছিলেন, কী যেন নাম বললে এর?’

আমি বলেছিলাম, জ্যোৎস্না।

 পদবি? দাদু জিজ্ঞেস করেছিলেন।

আমি আর খুকু দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়েছিলাম, হেসেছিলাম, বলেছিলাম, মজুমদার, জ্যোৎস্না মজুমদার।

মজুমদার থেকে কিছুই বোঝা যায় না। দাদু তার সেই চিরকালের শান্ত স্বরে বলেছিলেন, রাঢ়ি, বৈদিক, বারেন্দ্র এমনকী কায়স্থও হতে পারে।’

আমি সহজভাবেই বলেছিলাম, ওরা বৈদ্য।

বদ্যি?’ দাদু জিজ্ঞেস করেই হঠাৎ কাশতে আরম্ভ করেছিলেন।

দাদুর কোলের ওপর রাখা হাতের ওপর আমার হাত রেখে বলেছিলাম, কাশিও তো করেছে দেখছি। হাতটাও গরমই লাগছে।’

দাদু মাথা নেড়ে একটু যেন নিশ্বাসের টানের সঙ্গে বলেছিলেন, না, তেমন কিছু না। ও রকম একটু-আধটু কাশি তো আছেই।

আমি আশা করেছিলাম, দাদু আমার গায়ে হাত দেবেন। দেননি। নিজের গায়ের মোটা কথাটা আর একটু ভাল করে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, বলেছিলেন, তোমাদের বাড়ি থেকে তো জোড়াদিঘি পাড়া বেশি দূরে নয়। সে পাড়ায় কোনও বদ্যিদের ঘর ছিল, মনে করতে পারছিনে তো!

আমি আবার খুকুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম, বলেছিলাম, তুমি তো অনেক কাল আমাদের। ওদিকে যাওনি। ওরা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছে, জ্যোৎস্নার দাদু আমাদের ওখানে দেশ বিভাগের আগেই এসে বাড়ি করেছিলেন।

অ’ দাদু আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকিয়েছিলেন।

আমি বুঝতে পারছিলাম, খুকু যে দাঁড়িয়ে ছিল, দাদুর খেয়ালই ছিল না, তা-ই বসতে বলেননি। আমিই বলেছিলাম, খুকু, তুমি ওখানে বসোনা, দাদুর পায়ের কাছে।

অ্যাঁ’, দাদুর আবার সেই জিজ্ঞাসার শব্দ, তারপরে বলেছিলেন, ঘরে তো এখুনি অন্ধকার নেমে আসবে। ওকে এখানে বেড়াতে নিয়ে এসেছে, এক বার নদীর ধারটায় বেড়িয়ে এসো। এরপরে তো কিছুই দেখতে পাবে না, দেখতে দেখতেই পোষের বেলা চলে যাবে।

দাদু কথাটা কিছু ভুল বলেননি। অথচ অশ্চর্য, শীতের বেলার কথাটা আমারই মনে রাখা উচিত ছিল। খুকুকে নিয়ে, রিকশায় করে ইটিণ্ডার দিকে বেড়াতে যাবার কথাটা আমিই ভেবে রেখেছিলাম, খুকুকেও আগে বলেছিলাম। দাদুর কথা শুনে, আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ঠিক বলেছো দাদু, সন্ধে তো নামতেই চলল। আমি ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।

আমি খুকুকে ইশারা করেছিলাম। খুকু বলেছিল, দাদু, তা হলে একটু বেড়িয়ে আসি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, এসো৷ দাদু বলেছিলেন।

আমি খুকুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আহ, নিকুচি করেছে বেরিয়ে পড়ার। এ সব ভাবার আর কোনও অর্থই হয় না। আমি জানতাম না, আমার পায়ে কুড়োল মেরে বসে আছি, কী কুক্ষণে যে খুকুকে নিয়ে বসিরহাটে গিয়েছিলাম। তবু তো দাদুকে বলিনি, ওকে বিয়ে করব, ঠিক করেছি। এর পরে আমার নিজেকে কী বলা উচিত? গাধা? পাঁঠা? উল্লুক? কোনও কিছু বলেই, নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা কোনও দিন আর বোঝানো যাবে না। আসলে আমি দাদুকে কোনও কালে চিনতেই পারিনি। যে দাদুর কোলে পিঠে চড়ে মানুষ হয়েছি, বাছুরের গাইয়ের বাঁট চোষার মতো তাঁর কোঁচা পাকিয়ে মুখে পুরে ঘুরেছি, যে দাদুর আমি চোখের মণি ছিলাম, যার কাছ থেকে চলে আসার পরে প্রতি মাসে এক বার যাঁকে দেখতে যেতাম, যিনি আমার গায়ে হাত না দিয়ে থাকতে পারতেন না, যাঁর বহু কথা বহু দিন শুনেছি, যা থেকে তাকে আমার বুঝতে পারা উচিত ছিল, কিন্তু তাঁকে আমি কোনও কালেই বুঝতে পারিনি, চিনতেও পারিনি। আমি এক বারও ভাবিনি, পৃথিবীতে যত পরিবর্তনই হোক, আমাদের দেশে সমাজে সংসারে যত ওলটপালটই হোক, আমার দাদুর কিছুই যায় আসেনি। তিনি চিরকাল তার নিজের বিশ্বাস, ধারণা নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন না যে, সেই ওলটপালটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি লড়াই করেছিলেন। নির্মল, নকুলরা বা গৌর সেনরা যে রকম বলে, আদর্শ আর মতবাদের লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।

না না, দাদু সে রকম লড়াইয়ে কোনও দিনই নামেননি। আদর্শ, মতবাদ, বিশ্বাস, ওইসব ব্যাপারগুলো ছিল তাঁর ভিতরের বিষয়। তিনি সবই দেখেছিলেন, সবই বুঝেছিলেন, দেশ সমাজ কোথায় যাচ্ছে। কী ঘটছে, আর সবই কীরকম বদলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁর কিছুই যায় আসেনি। তিনি জানতেন, সবাই হাওয়ায় আর টানে ভেসে যাচ্ছে, যাক। তাঁকে কোনও কিছুই টলাতে পারেনি। যুদ্ধের সময়ের কথা আমার ভাল মনে নেই। কত আর আমার বয়স তখন? ছ-সাত-আট ছিল হয়তো। বড় হয়ে অনেক কথাই শুনেছি, কিন্তু আমার দাদুকে কখনও যুদ্ধের সম্পর্কে কিছু বলতে বা হায় হায় করতে শুনিনি। তারপরে দেশ স্বাধীন, দেশ বিভাগ, কত কাণ্ডকারখানা, যাকে সত্যি ওলটপালট বলা যায়, দাদুর সে সবে কিছুই যায় আসেনি। তাঁর জীবনের, মনের কোথাও কিছু বদলায়নি। তাঁর সেই পুরনো ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা, কিছুই বদলায়নি। অথচ আমি দাদুকে একটুও বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি, তিনি খুকুকে আমার সঙ্গে দেখা মাত্র, সজাগ হয়ে উঠেছিলেন, আর সেই জন্যই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রাঢ়ী, পাশ্চাত্য না বারেন্দ্র?

তিনটিই ব্রাহ্মণদের গোষ্ঠীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি তখনও বুঝতে পারিনি, যাকে বলে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে, মনের দিক থেকে উদার হওয়া, দাদু সেই পর্যন্ত হয়েছিলেন, অর্থাৎ খুকু কোন শ্রেণীর ব্রাহ্মণ কন্যা, তিনি জানতে চেয়েছিলেন। বুঝতে পারিনি, যে কোনও একটি ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হলেই, তিনি মনে মনে আমাদের মেনে নিতেন। আমি নিতান্ত উল্লুক, অথচ নিজেকে খুব চালাক ভেবে, দাদুকে এক বারও জানাইনি, আমি খুকুকে বিয়ে করব। কিন্তু দাদু আমাদের দেখা মাত্র বুঝে নিয়েছিলেন। খুব খারাপ কথায় বলতে গেলে, বলতে হয়, ভাদ্র মাসের দুটো মাদি মদ্দা কুকুরকে দেখলে যেমন কারও কিছু বুঝতে বাকি থাকে না, দাদু আমাদের ঠিক তেমনি করেই বুঝে নিয়েছিলেন। অথচ একটুও রাগ করেননি, উত্তেজিত হননি, তার আপত্তির কথা বলেননি, কেবল এক বার কেশে। উঠেছিলেন, যখন শুনেছিলেন, খুকু বদ্যিদের মেয়ে। তারপরেও বুড়ো কীরকম নিরীহভাবে খোঁজ নিয়েছিলেন, জোড়াদিঘি পাড়ায় কোনও বদ্যি পরিবারের বাস আছে বলে শোনেননি।

দাদু যখন ওইসব খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন, তখনই মনে মনে নিজের মন তৈরি করে ফেলেছিলেন। হি টুক দ্য ডিসিশন। ইংরেজিতে বললে বোধ হয়, এ কথা বলতে হয়। কিন্তু দাদু যে নিঃশব্দে, সামান্য একটুও আওয়াজ না দিয়ে, আমার ভয়ংকর সর্বনাশ করেছিলেন সে কথা ভাবলে, এখনও দাঁতে দাতে পিষতে গিয়ে আমি হাসি চাপতে পারি না। আসলে এখন আর রেগে হেসে কেঁদে, কোনওটাতেই লাভ নেই। যত দূর জানতাম, আমার বাবার ওপর তিনি প্রসন্ন ছিলেন না। দু-একবার কথায় কথায় আমাকে বলেওছিলেন, ত্রিলোচন যদি একটু বুঝে চলত, ভাল হত। কখনও বলতেন, আসলে এটাই ওর এ জন্মের কর্ম, করেও যেতে হবে। তার মানে, বাবা গত জন্মের ফল এ জন্মে ভোগ করছিলেন। এ কথা কেউ বিশ্বাস করলে, আর তো কিছুই বলার থাকে না। কিছু করারও থাকে না। আমার নিজের বিষয়ে যদি এ রকম ভাবতে পারতাম, তা হলে কোনও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভাবনা-চিন্তাই করতাম না। কিন্তু তা পারিনি। নিজের বেলায় পারিনি, বাবার বেলায়ও পারিনি।

তবু আমি কখনও ভাবতে পারিনি, খুকুকে নিয়ে দাদুর ওখান থেকে চলে আসার পরদিনই, তিনি বাবাকে চিঠি লিখে ডেকে পাঠাবেন। সে সব কথা আমি পরে জানতে পেরেছিলাম। কখন? যখন, সব ভেবে চিন্তা করে রাখা বিষয়গুলো, চাবুক খাওয়া পাগলা ঘোড়ার মতো ছিটকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্য, দাদু তো মাকেও চিঠি লিখে ডেকে পাঠিয়ে সব জিজ্ঞেস করতে পারতেন? তিনি তো জানতেন, বাবা কখনওই আমার বিষয়ে একটি ভাল কথাও বলবে না। তবু দাদু বাবাকেই ডেকে পাঠিয়েছিলেন, আর আমার আর খুকুর বিষয় সব জানতে চেয়েছিলেন। আর আমার বাবা? গভীর জলের অতি ধূর্ত মিরগেল মাছ। অবিশ্যি আমাদের বাড়িতে খুকুর বিষয় আর গোপন ছিল না। মা সবই জানত। খুকু আমাদের বাড়ি গিয়েছিল, মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। বাবার সঙ্গেও। ওটাই খুকুর বিশেষত্ব, যা কোনওকালেই আমি ভাল চোখে দেখতে পারিনি। ও জানত, বাবার সঙ্গে আমার মোটেই সদ্ভাব নেই। আগেই ওকে বলেছিলাম, বাবা সংসারে কী বিপর্যয় ডেকে এনেছে, আমাদের সকলের কী সর্বনাশ করেছে। তবু, খুকুর এমনই প্রাণ, ভাবী শ্বশুরমশাইকে একটি প্রণাম না করে পারেনি। আর বাবা তো কী মুগ্ধ। হলই বা বদ্যির মেয়ে, তায় বাঙাল? ও সব আজকাল আবার কেউ ভাবে নাকি? বাবা প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিল, ছেলের বউ হিসাবে খুকুকে তার খুবই পছন্দ।

আহা, যেন কেউ তার কাছে জানতে চেয়েছিল! আর বাবা অপছন্দ করলেই যেন আমি একেবারে তার পায়ে মাথা কুটে মরতাম। আমার রাগ হয়েছিল খুকুর ওপর। কী দরকার ছিল বাইরের ঘরে গিয়ে বাবাকে প্রণাম করার, আলাপ করার? খুকু আমাকে বলেছিল, আহ্, তুমি বোঝ না, ওটুকু করতে হয়। আমাকে তো বললেন, দুদের সঙ্গে তোমাকে আমাদের বাড়ি আসতে দেখেই বুঝেছি, একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমার তো বেশ ভালই লাগছে তোমাকে। বসো বসো। আমাকে খুব খাতির করলেন।..

সেই সময় অবিশ্যি বাবার প্লাস্টিকের ঝুড়ি ব্যাগ বোনার কারখানাটা সবে মাত্র শুরুর মুখে। গোটা দুয়েক মাত্র মেয়ে কাজ করত। বাবা নিজেও তখন হাতে কাজ করত। কারখানা নিয়ে তখনও আমার সঙ্গে গোলমাল লাগেনি, যদিও মেয়ে দুটোকে দেখেই আমার মেজাজ খারাপ হতে আরম্ভ করেছিল। কারণ মেয়ে দুটোকে আমার চিনতে বাকি ছিল না। বেড়ালের যেমন আঁশটে গন্ধ ছাড়া ভাল লাগে না, বাবারও তেমনি মেয়ে না হলে কোনও কাজ হয় না। যেন সংসারে ছেলেদের দিয়ে কোনও কাজ হয় না।

যাই হোক, বাবা দাদুর চিঠিটি পেয়েই, আমাদের কারোকে কিছু না বলে সোজা বসিরহাট চলে গিয়েছিলেন। যে জামাই-শ্বশুরে দীর্ঘকাল দেখাশোনা ছিল না, পত্রালাপ ছিল না, বলতে গেলে দুজনের মধ্যে কোনও সম্পর্কই ছিল না, তাদের মধ্যে হঠাৎ আমে দুধে মেশামিশি হয়েছিল কেমন করে, আজও বুঝতে পারি না। পরে জানতে পেরেছিলাম, বাবা দাদুর কাছে খুকুকে কী চেহারায় তুলে ধরেছিল। বদ্যি বাঙাল হলেও কথা ছিল, খুকু যে একটা জঘন্য চরিত্রের মেয়ে, গোটা এলাকায় নামকরা, সে সব কথাও বেশ তৈরি করে বলেছিল। সে সব কথা আমি স্নেহদিদির মুখ থেকে শুনেছিলাম।

বাবার কথা শুনে দাদু বলেছিলেন, যা বোঝবার, আমি এক বার দেখেই বুঝে নিয়েছি। আমার উকিল সদানন্দ ভটচাজকে ডেকেছিলাম। নতুন করে উইল করা হয়ে গেছে। সবই দুদের নামে ছিল, এখন সবই আমার মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি। আমার যাবতীয় সম্পত্তি সবই দুদের ছেলে আর ওর মাকে লিখে দিয়েছি। তারপরে জ্যোতু (আমার মায়ের নাম জ্যোতির্ময়ী–ডাক নাম জ্যোতু) যা ভাল বুঝবে, তাই করবে। তুমি এ কথাটা জ্যোতুকে গিয়ে বলবে, যেন আবার আমাকে ভুল না বোঝে। দুদে অব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে করবে, আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমার–আমার পিতৃপুরুষের বিষয় সম্পত্তি ওকে দিয়ে যাই। এ সবই হচ্ছে গত জন্মের ফল–আমার, দুদের, জ্যোতুর–সকলেরই। এই দেখে রাখো দলিল, থাকবে আমার মাথার কাছে সিন্দুকে। মরেও যদি যাই, চাবি থাকবে আমার কোমরের ঘুনসিতে। জ্যোতু যেন খুলে নেয়।

বাবা আমার শাহেনশা ব্যক্তি। দলিল দেখেছিল। জেনেছিল, দাদুর কোমরের ঘুনসিতে চাবি ছিল। সেটা আমিও জানতাম। দাদু তো প্রায় আমার সামনে কাপড় ছাড়তে গিয়ে ল্যাংটোই হয়ে পড়তেন। কোমরে সুতোয় বাঁধা চাবি আর দুটো মাদুলি দেখেছিলাম। বাবা একটানা সাত দিন বসিরহাটে ছিল। স্নেহদিদির মুখে শুনেছি, দাদু বাবাকে বার বার চলে যেতে বলেছিলেন। বাবা বলেছিল, আপনার শরীর তো বিশেষ ভাল নেই, কয়েকটা দিন থেকেই যাই।দাদু বলেছিলেন, আমার শরীরের জন্য আর ভেবে কী হবে? আমি আর কদিন? তুমি তোমার নিজের কাজকর্ম দ্যাখ গিয়ে।

বাবা সে পাত্র ছিল না। সাত দিন থেকে, প্রতিটি বিষয়ের খোঁজ খবর নিয়েছিল। খোঁজ খবর বলতে, দাদুর নগদ টাকা পয়সা, গহনা। আরও একটা কারণ বোধ হয় ছিল। বাবা বসিরহাট থাকতে থাকতেই, দাদু যেভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, প্রায় বিছানা থেকে উঠতেই পারতেন না, স্বভাবতই আমার মনে এখনও একটা সন্দেহ খচখচ করে, বাবা দাদুকে খাবারের সঙ্গে বা কবিরাজি ওষুধের সঙ্গে কোনও বিষ, একটু একটু করে খাওয়াচ্ছিল। বাবার দ্বারা কিছুই অসম্ভব না। তবু সাত দিন বাদে বাবাকে ফিরে আসতে হয়েছিল, কিন্তু মাকে একটি কথাও ফাস করেনি। আর, আমি আর মা ভেবেছিলাম, বাবা যে রকম করে থাকে, তাই করেছিল। কোথাও হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল, হয়তো কোথাও কিছু জুটেছিল, কিছু টাকা পয়সা কোনও রকমে হাতে এসে গিয়েছিল। সে টাকা না ফুরানো পর্যন্ত বাবার আর পাত্তা মিলবে না। কারখানার মেয়ে দুটোও আসা বন্ধ করেছিল। ফিরে এসেও বাবা কারখানার কাজে বিশেষ মন দেয়নি। স্বাভাবিক। বাবা তখন একটা দানপত্র লেখানো নিয়ে ব্যস্ত ছিল। যেটা পরে মাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছিল।

মা আমাকে একটা কথাও বলেনি। কেন? না, আমাকে বলেছিল, দাদু তাকে তার যাবতীয় সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন। তাই একটা কাগজে সই করে দিতে হবে। মা চিরদিনের মতোই সরল বিশ্বাসে, কাগজে সই করে দিয়েছিল। কীসে সই করছে, কী লেখা আছে, কিছুই জানার দরকার বোধ করেনি। কেবল এক বার বাবাকে বলেছিল, সে কী, আমি তো জানতাম, বাবা তার সব কিছু দুদেকে দিয়ে গেছেন।

বাবা বলেছিল, না, এই নাও দলিল, তোমার বাবা তোমাকেই সব দিয়ে গেছেন।

আর মায়ের ধারণা ছিল, আমাকেই সব দিয়ে যাবে। একেই বলে, ভাবনা চিন্তাগুলো সব চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মতো পাগলা হয়ে ছুটে চলে যায়! না, তার পরের মাসে দাদুকে দেখবার জন্য আমাকে আর বসিরহাটে যেতে হয়নি। সিক্সটি সিক্স-এর ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, এক সকালেই, দাদুর এক জ্ঞাতি, সম্পর্কে ভাইপো, খবর নিয়ে এসেছিল, দাদু আগের দিন মাঝরাত্রে চিত্তির উলটেছেন, আমাদের সবাইকে যেতে হবে। মা কেঁদে উঠেছিল। কেন, তা জানি না। দাদু বেঁচে থাকতে কদিনই বা তাকে দেখতে গিয়েছিল? বাবাই বা এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল কেন? মায়ের কান্নার মানে যদি বা বুঝতে পারছিলাম বাবা বলে কথা, কিন্তু বাবার ব্যস্ততা কীসের? যেন বাবাই আমাদের তাড়াহুড়ো দিয়ে বসিরহাটে নিয়ে গিয়েছিল। কোন ফাঁকে যে বাবা দাদুর কোমরের ঘুনসি থেকে চাবিটা খুলে নিয়েছিল; কিছুই টের পাইনি। দাদুর উইলপত্রও সরিয়ে নিয়েছিল। আমরা দাদুর শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত বসিরহাটেই ছিলাম। তার মধ্যে বাবা মাকে দিয়ে, দাদুর দিয়ে যাওয়া সব সম্পত্তি, মায়ের কাছ থেকে নিজের নামে দানপত্র লেখানো কাগজ সই করিয়ে নিয়েছিল, আর মায়ের হাতে মূল্যহীন দলিলটা তুলে দিয়েছিল।

দাদু মাকে তার সবকিছু দিয়ে গিয়েছেন, কথাটা মায়ের মুখ থেকে প্রথম যখন শুনেছিলাম, আর দলিলটা দেখেছিলাম, তখন হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। দাদু কেন তার নিজের পুত্রকে কিছু দিয়ে যাননি, আর আমাকেই বা কেন দিয়ে যাননি, তাও দলিলে লেখা ছিল। সেই প্রথম আমি জেনেছিলাম, খুকুকে নিয়ে গিয়ে আমি কী সর্বনাশ করেছিলাম। তবু মনে একটাই সান্ত্বনা ছিল, দাদু সবই মাকে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু দাদুর মুখটা আমার বারে বারে মনে পড়ছিল। আর মনে হচ্ছিল, কী মারাত্মক মানুষ! ছেলেবেলার দিনগুলো মনে করে বুকের মধ্যে রীতিমতো টনটন করেছিল।

টনটন! তবু তো বুকে তখন দাউ দাউ আগুন জ্বলেনি। জ্বলেছিল মাসখানেক পরেই। বাবা বসিরহাট থেকে ফিরে, দু দিন বাদেই আবার বাড়ি থেকে হাওয়া! প্লাস্টিকের ঝুড়ি ব্যাগের কারখানা উঠেই গিয়েছিল। অথচ কোনও সন্দেহই করতে পারিনি, বরং মনে মনে স্বস্তি বোধ করছিলাম, মায়ের হাতে অনেক কিছু আছে। কিন্তু খবর এসেছিল, দাদুর সর্বস্ব বাবা নিয়ে যাচ্ছে, এমনকী সুন্দরবনের পাট বিক্রিও করছে। আমি প্রায় পাগলের মতোই বসিরহাটে ছুটে গিয়েছিলাম। মাকেও সঙ্গে নিয়েছিলাম, কারণ দাদুর সিন্দুকের চাবি বাবা মাকেই পরে ফেরত দিয়েছিল। মা সিন্দুক খুলে দেখেছিল, টাকা পয়সা গহনাগাঁটি কিছুই নেই।

আমাকে আর মাকে দেখে দাদুর জ্ঞাতি আত্মীয়রা ভিড় করে এসেছিল। স্নেহদিদিও ছিল। তার মুখেই শোনা গিয়েছিল, দাদুর সিন্দুক বাবা খুলেছিল। তার মানে চুরি? কিন্তু চুরি করে জমিজমা বিক্রি করা যায় কেমন করে? দাদুর সেই জ্ঞাতি সম্পর্কে ভাইপো, যে তার মরার খবর আমাদের দিতে গিয়েছিল, সে বলেছিল, চুরি করবে কেন? ত্রিলোচনকে তো জ্যোতুই ওর বাপের সব সম্পত্তি দানপত্র লিখে দিয়েছে।

আমি ক্ষ্যাপা বাঘের মতো মায়ের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলাম। মা সাপের ছোবল খাওয়ার মতো আর্তনাদ করে উঠেছিল, না না, আমি তো ওকে দানপত্র লিখে দিইনি?

দাদুর সেই জ্ঞাতি ভাইপো বলেছিল, জ্যোতু, আমি তো আসল নকল কিছু বলতে পারব না, তবে ত্রিলোচন তোমার সই করা দানপত্রের দলিল আমাকে দেখিয়েছে। তারিখ দেখেছি, কাকা মারা যাবার দু দিন পরে তুমি সই করেছ। এ বার মনে করে দ্যাখো, তুমি কোনও কাগজে দলিলে সই করেছিলে কি না।

মায়ের ফরসা মুখ যেন বিষের ছোবলের মতোই নীল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু আর চিৎকার করেনি। মরে গেলেও কোনও কোনও মানুষের চোখ যেমন খোলা থাকে, মায়ের চোখ দুটো সেই রকম দেখাচ্ছিল। আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। মা ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়েছিল। দেখেই আমার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠেছিল, আর চিৎকার করে উঠেছিলাম, কী, দিয়েছ কোনও কাগজপত্র সই করে?

মা কথা বলেনি, কাঁদেনি, চিৎকার করেনি, কেবল আস্তে আস্তে মাথা কাত করে কঁকিয়েছিল, যার একটাই অর্থ, সই করে দিয়েছে। আমি সকলের সামনে হুংকার দিয়ে উঠেছিলাম, সই দেবার আগে, তুমি এক বার আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারলে না? তুমি তোমার স্বামীকে চিনতে না?

মা মরার মতো চোখ নিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়েছিল। আমার ইচ্ছা করেছিল, মাকে টেনে নিয়ে যাই নদীর ধারে, গলা টিপে জলের মধ্যে ডুবিয়ে মারি। মাথার মধ্যে কেমন করছিল, মনে হচ্ছিল, আমি পাগল হয়ে যাব। যদিও আজকাল আমাকে অনেকে পাগল গাধা উল্লুক, যা খুশি তা-ই ভাবে, কিন্তু আমি কখনও পাগল হতে পারিনি। দাদুর জ্ঞাতি ভাইপোর দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, কী করা যায় বলুন তো? মাকে তো ঠকিয়ে সই করে নিয়েছে, এর জন্যে কী করা যায়?

দাদুর জ্ঞাতি ভাইপো ঠোঁট বঁকিয়ে হেসে বলেছিল, মনে তো হয় না, এখন আর কিছু করার আছে। স্ত্রী যদি স্বামীকে সজ্ঞানে, সন্তোষের সঙ্গে তার সম্পত্তি দিয়ে দেয়, তা হলে বলার কিছুই থাকে না। এমনকী দুজন সাক্ষীর সইও আমি দেখেছি। তার মধ্যে এক জন বসিরহাটেরই এক উকিল আছে, আর এক জনকে আমি চিনিনে।

সেই সাক্ষীদের ধরে কিছু করা যায় না? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

দাদুর জ্ঞাতি ভাইপো বলেছিল, না, তারা তো সাক্ষী মাত্র। অবিশ্যি জ্যোতু যদি জাল-জুয়াচুরির মামলা করে, তা হলে আলাদা কথা। কারণ সাক্ষীরা নিশ্চয় ওর সামনে সই করেনি। ত্রিলোচন নিশ্চয়ই। টাকা পয়সা দিয়ে সাক্ষীদের সই করিয়েছিল।

আমি আবার মায়ের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী, মামলা করবে তো? আমিই সব ব্যবস্থা করব।

মা পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিল, আর আমার ভিতরেই যেন কেউ বলে উঠেছিল মা কোনও দিনই বাবার বিরুদ্ধে মামলা করবে না। আমার ভিতরে না না না, তবু আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, এ বার আমি তোমাকে রেহাই দেব না মা, মামলা তোমাকে করতেই হবে। ত্রিলোচন চাটুয্যে কত চালাক আর ধূর্ত দেখে নেব।

বলেও আমি মাকে বসিরহাটে ফেলে রেখে কলকাতায় ছুটে গিয়েছিলাম। বাবার কয়েকটা আস্তানা আমার চেনা ছিল। তার চেনাশোনা পরিচিত কয়েকজনকেও চিনতাম। সব জায়গায় গিয়েছিলাম, খুঁজেছিলাম, সকলের কাছেই গিয়েছিলাম, বাবাকে কোথাও পাইনি।