২. টোপ সুদ্ধ সুতোটা

ছিপটা তুলে, টোপ সুদ্ধ সুতোটা, ছ-সাত হাত দুরের জলে আলতো করে ছুঁড়ে দিলাম: ফাতনাটা প্রথমে চিত, তারপরে আস্তে আস্তে কাত হয়ে জলের মধ্যে ডুব দিল, অর্ধেকের কিছু কম জলের ওপর জেগে রইল। একটা ছোট ফড়িং কোথা থেকে ফাতনাটার কাছে এসে উড়তে লাগল। কত রকমের যন্ত্রণা। ফড়িংটার এখন জেগে থাকা ফাতনার ওপরে বসবার তাল। বসলেই ফাতনাটা কাঁপতে থাকবে। অনেকটা মিরগেলের বাঁদরামির মতোই। তবু বলা যায় না, হয়তো জলের তলায় পাঁচশ-আটশো গ্রাম ওজনের আসল কেউ এসে ঠোকাবে। অবশ্যি ফাতনা একেবারে ডুবলে ফড়িঙের ফড়ফড়ানিতেও কিছু যাবে আসবে না।

অনাথদার বউ আর মিনতি ঘাটের ধাপে জলে পা ডুবিয়ে বসেছে। দুজনের মধ্যে নিচু গলায় কথাবার্তা হচ্ছে। কী কথা হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছি না, তবে বুঝতে পারি আমাকে আমার বিষয়েই কোনও কথা হচ্ছে। বড় রাস্তা দিয়ে ডাইনের বাসটা গড়িয়ার দিকে চলে যাচ্ছে, তার পিছনে পিছনে গোটা দুয়েক মাল বোঝাই ভারী লরি। মাল বোঝাই আর খালি লরির শব্দ শুনলেই বোঝা যায়। শুয়োরের মরণডাক-হর্ন বেজে যাচ্ছে ঠিক। লরিগুলো কলকাতা-মুখো না ক্যানিং-মুখো ধরতে পারছি না।

আমি সোজাসুজি ঘাটের দিকে তাকাতে পারছি না। নজর রেখেছি ফাতনার দিকেই, তার মধ্যেই চোখ তুলে, এদিকে ওদিকে এক বার দেখে নিচ্ছি। মাছরাঙাটা একটা ধনুকের মতো বাঁকা সরু বাঁশের ডগায় দোল খাচ্ছে। ঘাটের ওপর জামরুল গাছের ছায়া এগিয়ে এসেছে অনেকখানি। কিন্তু অনাথদার বউ বা মিনতির গায়ে এখনও রোদ। কেবল একটা নারকেল গাছের লম্বা শরীরের ছায়া দুজনের গায়ে একটা কালো দাগের মতো দেখাচ্ছে। অনাথদার বউয়ের নাম নীলা। নীলা বউদি বলে আমি ডাকি। আমাদের গোটা চাটুয্যে বাড়ির চৌহদ্দি আর কাছেপিঠে এত জ্ঞাতি-আত্মীয়দের বাড়ি, দাদা বউদির সংখ্যা এত, নাম না জুড়ে কারোকে ডাকা সম্ভব না। মিনতি অবিশ্যি পাড়ার এক সদগোপ বাড়ির মেয়ে। দেখতে তেমন একটা কিছু না, কিন্তু মেয়েটা ভাল। সুরেন্দ্রনাথ থেকে ডিগ্রি কোর্সে বি-এ পাশ করেছে। পুকুরঘাটের জলে পা ডুবিয়ে এখন যেমন গামছা জলে ভিজিয়ে ঘাড় গলা ঘষছে, দেখলে মনে হবে না কলেজে পড়া মেয়ে। আমাদের এদিকে সবই এ রকম। নীলা বউদিও বিদ্যাসাগর থেকে পাশ করা মেয়ে। গামছা ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে যে ভাবে জলের তলার সিঁড়িতে গোড়ালি ঘষছে, মাথায় আধখানা ঘোমটা, কপালে সিঁদুরের বাসি দাগটা এক দিকে বেঁকে গিয়েছে, দেখলে কেউ বলবে, এইনীলা বউদিই বেণী দুলিয়ে দশ বারো বছর আগে কলেজে যেত? নীলা বউদি যে জলে পা ডুবিয়ে সিঁড়িতে গোড়ালি ঘষছে সেটা বুঝতে পারছি তার শরীরের দোলানি দেখে। গোড়ালি ঘষার সঙ্গে সঙ্গে বুক পিঠ কোমর নাড়া খাচ্ছে। নীলা বউদির দুই মেয়ে। একটির বয়স ছয় আর একটির বছর দুয়েক হবে। পর পর দুই মেয়ে, অনাথদার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার আশা ছিল মেয়ের পরে একটি ছেলে হবে, তারপরে আর না। আশা! এক কথায় মারাত্মক! করেছ কি মরেছ। আশা-টাশা না করে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দাও। যা হবার তা হবে। অন্তত মনের জ্বালায় জ্বলতে হবে না। এই যেমন আমি বঁড়শি ডুবিয়ে ছিপ নিয়ে বসে আছি। চার করিনি বটে। যদি করতামও আর আশা করে বসে থাকতাম একখানি দু-তিন কেজির কাতলা বা রুই উঠবেই, তা হলেই সব ভণ্ডুল। জানি, পুকুরে রুই কাতলা সবই আছে। তবু জলের তলার ব্যাপার, চোখে দেখতে পাচ্ছি না কিছুই। চারে কেউ আসবে কি না-আসবে, টোপ কেউ গিলবে কিনা-গিলবে কিবলা যায়?কালবোস বা মিরগেলের কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি। বড় মাছের টোপে কয়েক বার মার সিঙ্গিও ধরেছি। ভাবা যায়?

তবু হা, ভাবছি বটে, আশা কিন্তু যেতে চায় না। ভাগ্যের কথা মেনেও কোনও ব্যাপারেই কি আজ অবধি চুপচাপ বসে থাকতে পেরেছি? তা হলে তো আমিও সব জ্বালা যন্ত্রণার হাত থেকে বেঁচে যেতাম। পারছি না তো। আশাও সেই আচমকা তাড়া খাওয়া পাগলা ঘোড়ার মতো। কোথায় কোন দিকে ছিটকে দৌড় লাগাবে বোঝা যায় না। অবিশ্যি অনাথদা বা নীলা বউদির মনে ছেলে না হওয়ার জন্য এখন আর কোনও আফসোস নেই। অনাথদা আর বলেনা, যাহশালা, চাইলাম একটা ছেলে,হল আর একটা মেয়ে।.নীলা বউদিকেও মোটেই অসুখী মনে হয় না। আমি অবিশ্যি আজকাল আর অনাথদারবাড়ি যাইনা। কেউ বারণ করেনি কিন্তু যাইনা বলেঅনাথদার সঙ্গে দেখা হলেও যেতে বলে না বা জিজ্ঞেস করে না, কেন যাই না। বউদিও যেতে বলে না। এই নাবলা থেকেই বুঝতে পারি অনাথদার ইচ্ছা নেই, আমি তাদের বাড়ি যাই। অথচ এক সময়ে অনাথদার বাড়িতে কত আড্ডা দিয়েছি। সময় নেই, অসময় নেই, যখন খুশি গিয়েছি, খেয়েছিবসেছি শুয়েছি। এখন সব কিছুই বদলিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এমন না যে, অনাথদার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গিয়েছে। কত বছর হল, খুকুও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে? একটু হিসাব করতে হবে। খুকু চলে যাবার কিছুকাল-মাস কয়েক পর থেকেই অনাথদা কেমন যেন আস্তে আস্তে আমার কাছ থেকেই সরে যাচ্ছিল। অনাথদা আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করেছিল। তার আগে আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করেছিল নীলা বউদি। সেও তো এক সময়ে আমাদের বাড়িতে এবেলা ওবেলা আসত। এখন আসে না। বাড়ির পিছন দিয়ে এই পুকুরঘাটে স্নান করতে আসে। মাঝে মধ্যে হঠাৎ এ রকম দেখা হয়ে যায়। পাড়ার চেনাশোনা অন্য কেউ থাকলে নীলা বউদি কথা বলে না। মিনতি থাকলে, দু-চার কথা হয়। মিনতির সঙ্গে তার খুব ভাব। দুই মেয়ের মা, ব্রিাহিতা একটি মেয়ের সঙ্গে, বয়সে কম করে দশ বছরের ছোট আইবুড়ো একটি মেয়ের এত ভাব কীসের?

এ কথা ভেবে কোনও লাভ নেই। পাকা-চুল-মাথা থেকে পাকা চুল বাছার মতো ব্যাপার। কারণ, এর কোনও কূলকিনারা পাওয়া যায় না। দেখেছি মেয়েরা একটা বয়সে পৌঁছে গেলে, তাদের মধ্যে আর বয়সের ফারাকটা থাকে না। কেন থাকে না, কী কথা তারা বলাবলি করে, কার সঙ্গে তাদের কী জন্য ভাব হয়, এ সব ভেবে কোনও কুলকিনারা পাওয়া যায় না। ইদানীং দেখি নীলা বউদির সঙ্গে প্রায় সময়েই মিনতি থাকে। কুরঘাটে মান করতে আসা ছাড়াও রিকশায় করে বা বাসেও সেজেগুজে দুজনকে চলাফেরা করতে দেখি। হয়তো আশেপাশে সিনেমায় যায়, কিংবা কলকাতায় যায়। যেখানেই যাক দুজনকে প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যায়।

যাই হোক, নীলা বউদি যে দুই মেয়ে নিয়েই এখন সুখী বুঝতে পারি, দুই মেয়েকেই যখন সাজিয়ে গুজিয়ে খেলতে পাঠায়। মেয়ে দুটি দেখতেও সুন্দর হয়েছে। ছোটটি একটু বেশি সুন্দর, পুতুলের মত। অবিশ্যি নীলা বউদিও সুন্দরী। প্রথম বউ হয়ে যখন এসেছিল তখন ছিল ছিপছিপে। এখন—এখন কী বলা যায়? মোটা তো কিছুতেই বলা যাবেনা। এমনও না যে, দুটি মেয়ে হয়েইরীরটা ধ্বসে গিয়েছে। বরং আরও যেন সুন্দরীই হয়েছে। যেমন একটা কচি ছিপছিপে গাছ, ডালপালা ছড়িয়ে ফুলে ফলে ভরে ওঠে, অনেকটা তেমনি। বোধ হয় এক কথায় বলতে হয় ঢলঢলে। তাঁ, ফরসা রং, কালো বড় বড় চোখ আর ঢলঢলে। হাসি তো লেগেই আছে। নীলা বউদিকে আমি কখনও তেমন মুখ ভার করে থাকতে দেখিনি।

কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার,নীলা বউদি মিনতিকে নিয়ে ঘাটে আসার পর থেকেই আমি আমার খাটো হাফ প্যান্টটার তলা ধরে, আমার ভোলা উরতটাকে ঢাকবার চেষ্টা করছি। অস্বস্তি বোধ করছি, আর নিজেকে সত্যি কেমন অসভ্য মনে হচ্ছে। রোজ রোজ তো আর এই সময়ে পুকুরে ছিপ ফেলে বসি না। এক একদিন হঠাৎ খেয়াল হয়। আর এলেই যে নীলা বউদির সঙ্গে দেখা হবেই তার কোনও ঠিক নেই। তবু, এমন একটা অস্বস্তি হয়–এখন যেমন হচ্ছে, আমি থেকে থেকেই প্যান্টের তলাটা টেনে নামাবার চেষ্টা করছি। অসম্ভব ব্যাপার। নাভির নীচে জাঙিয়াটা বেরিয়ে পড়ার দাখিল। সেটা আরও খারাপ। কোমরের কাছে জাঙিয়ার খানিকটা বেরিয়ে পড়ল আর খাটো প্যান্টের তলাটা এক-আধ ইঞ্চি নামল, আসলে, বলতে গেলে, যেমনটা দেখাচ্ছিল তেমনটাই দেখাচ্ছে।

নীলা বউদি আর এ রকম আরও কয়েকজন ছাড়া, এ রকম খালি গায়ে খাটো আঁটো প্যান্ট পরে অন্য কারও সামনে ঘুরে বেড়াতে আমার মনে কোনও রকম খচখচ করে না। হয়তো নীলা বউদি বা আর কয়েকজনের সামনেও করত না। আসলে আমার মনে খচখচানিটা ধরিয়েছিল বাবা। তার আগে তো আমার কিছু মনেই হত না। মনে হওয়া শুরু হয়েছিল, বাবার সঙ্গে ঝগড়ার পর থেকেই। ওপরে আমার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এ বেশে নিজেকে দেখেছি। আশ্চর্য, বাবা যে কথাটা একেবারে মিথ্যা বলেছিল মনে হয়নি। বাবা কিছু না বললে আমি কোনওকালেই এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতাম না। আগে ভাবিওনি। বাবার সঙ্গে ঝগড়ার পরে এক দিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে মনে হয়েছিল, আমার প্রায় ছ ফুট লম্বা চেহারা এ রকম একটা আঁটো খাটো প্যান্ট–প্রায় একটা বড় জাঙ্গিয়ার মতোই বলা যায়, সত্যি বিচ্ছিরি। কী করে যে বোধশোধগুলো হারিয়ে গিয়েছিল, জানি না। বা ও রকম কোনও বোধশোধই আমার হয়তো ছিল না। খুকু এ বাড়িতে থাকতে কি আমি কখনও এ রকম ভাবে বাড়িতে ঘুরে বেড়াতাম? মনে পড়ে না। হয়তো বেড়াতাম না। কিংবা হয়তো কেবল খুকুর সামনেই এ রকম থাকতাম, যখন আর কেউ কাছে থাকত না। কারণ, একমাত্র খুকুর সামনেই এ রকম থাকা যায় বা যেত।

কিন্তু ঘটনা যা-ই ঘটুক, আমি যখন থেকে এ বেশে বাড়ির সীমানার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি, তা নিয়ে আমার কখনও কিছু মনে হয়নি। হতও না, বাবা হঠাৎ আমার ওপর ওইরকম খগহস্ত হয়ে না উঠলে। তারপরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল বাবা খুব মিথ্যে বলেনি। এখন এই নীলা। বউদির সামনে সে কথাটা আরও ভাল ভাবে বুঝতে পারছি। তা বলে, বাবার কাছে আমি নতি স্বীকার করিনি। বরং আরও বেপরোয়া হয়ে ঘুরে বেড়াই। বিশেষ করে তার সেই কারখানার মেয়েগুলোর সামনে। কারণ, মেয়েগুলো আমার অচেনা না। বাবাকেও আমি চিনি, আর সেই চেনাটা আমার একলার না, অনেকেই বাবাকে চেনে। অবিশ্যি মেয়েদের আগের দলটাকে আমি বাড়ি-ছাড়া করেছিলাম আরও অনেক আগে। তখন এ রকম একটা বিদঘুঁটে চেহারা নিয়ে আমি ঘুরতাম না। আসলে বাড়িতে একদল জোয়ান মেয়ে জড়ো করে, কাজ চালানোটাই আমার সহ্য হয়নি। মা তো মনে মনে রেগেই ছিল। তবে আমি একলা বললে ভুল হবে, আমরা। পাড়ার কয়েকজন মিলে, আমরা বেশ একটা ভাল দল পাকিয়েছিলাম। বাবা বলে, আমরা একটা ষড়যন্ত্র করেছিলাম। তা যা খুশি তা বলতে পারে। তা বলে, পাড়ার মধ্যে বাড়িতে বসে বাবা যা খুশি তা-ই করে যাবে, এটাও সহ্য করা হবে কেন? নতুন তো কিছু না। বাবার জীবনের যে অনেক কীর্তি তা পাড়ার সকলেরই জানা ছিল। তবে বাবা তো কারোর ক্ষতি করেনি, তাই কেউ কিছু বলত না। বাবা ভেবেছিল, চিরকাল এ রকমই চালিয়ে যাবে।

বাইরের ঘরে কারখানা হলেও, বাবাকে, কারখানার মেয়েদের বাড়ির ভিতরে বাথরুমে আসতেই হত। বাড়ির থাম আর ছাদ আঁটা বারান্দার ধারে ধারেই সারি সারি ঘর। সেই সব ঘরের একটিতে কারখানার মেয়েদের রান্না হয়। মেয়েদের পুকুরে যাতায়াতও সেই বারান্দা দিয়েই। সব বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

আমি একলা হলে হয়তো পারতাম না। আসলে বাবা যেমন সব দিক ভেবে রেখেছিল সেই ভাবনাগুলোও আচমকা চাবুক খাওয়া পাগলা ঘোড়ার মতো উলটোপালটা ছুট লাগিয়েছিল। সেই সময়টা প্রথম যুক্তফ্রন্ট আমলের। আমি তখন চাকরি করি একটা কারখানায়। নিজে কোনও কালেই রাজনীতি করিনি, তবে কারখানার ইউনিয়নে থাকতেই হত। না থাকলেই গোলমাল। আমাদের অঞ্চলের ফ্রন্টের বন্ধুদের দৌলতেই আমি চাকরিটা পেয়েছিলাম। যারা যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন সবকিছুই তাদের হাতে। মরা ইউনিয়ন রাতারাতি চাঙা হয়ে যায়। আমি যে কারখানায় কাজ করতাম ফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার আগে ফ্রন্টের শরিক দলের ইউনিয়নটা মরেইছিল। আর জ্যান্ত ইউনিয়নটা ছিল, আগের শাসক দলের হাতে। তার লিডার ছিল গৌর সেন। আমাদের অঞ্চলেই বাড়ি। অনেক দিন লোকটির কাছে হাঁটাহাঁটি করেছি। দেব দেব করেও চাকরি দেয়নি, বরং আমাকে দলের কাজে লাগাতে চেয়েছিল। মুখ ফুটে কোনওদিন বলিনি, আমি কোনও দলের কাজ করতে পারব না। যদিও আমার বোঝা উচিত ছিল, আমাদের মতো ছেলেদের দলে না ভিড়লে আর কোনও দিনই চাকরি জুটবে না। তেমন লেখাপড়া শিখলে বা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে খুঁটির জোর থাকলে দলে না ভিড়েও চাকরি জোটা সম্ভব ছিল। তার কোনওটাই আমার ছিল না।

আসলে গৌর সেন লোকটিকে আমার ভাল লাগত না। ইউনিয়নের লিডার না হয়ে লোকটার কারখানার মালিক হওয়াই উচিত ছিল। কথাবার্তা ছিল সেই রকম। বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে হুকুমের সুরে কথা বলত। বেশি কিছু বলতে গেলে, রেগে ফেঁজে রীতিমতো খিস্তি করত। ভয়েই বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হত, অথবা চলে আসতে হত। লোকটাকে অধিকাংশ সময়েই রেগে থাকতে দেখতাম। অস্থির অস্থির দেখাত। মনে হত, লোকটার মনে এক ফোঁটা শান্তি নেই, সবসময়েই যেন কেউটে সাপের মতো ফণা উঁচিয়ে তেড়ে আছে। অবিশ্যি একটা কথা সত্যি, গৌর সেন আমার সঙ্গেই কেবল ওই রকম করে কথা বলত না। আমার মতো বাইরের সকলের সঙ্গে তো বটেই, তাকে ঘিরে দলের যারা থাকত, তাদের সঙ্গেও সে ওই রকম ভাবেই প্রায় কথা বলত। আমার মনে হত, লোকটা কারোকে বিশ্বাস করে না। ভিতরে কোথায় একটা কী গোলমাল আছে।

ঝাড়া দেড় বছর লোকটার পিছনে ঘুরতে ঘুরতে এক দিন গৌর সেন আমাকে একেবারে একলা দুপুরে বাড়িতে দেখা করতে বলেছিল। আমি খুব আশা নিয়ে গিয়েছিলাম, মনে আছে মাকে বলে বেরিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে গৌর সেন আজ আমার একটা গতি করে দেবে।’…মা জবাবে বলেছিল, দ্যাখ, তোর কপালে কী আছে।..আমার কপাল, এক দিক থেকে মায়ের কপালও বটে। বাবা তো মাকে নেহাত খেতে দিতে হবে, তাই দিত। আমাকে সেই সময়ে উঞ্ছবৃত্তি করেই চলতে হত। জ্যাঠতুতো দাদাদের কাছে হাত পেতে, বাড়ি আর বাগানের নারকেল, সুপুরি, কলা কখনও কখনও পুকুরের মাছও বিক্রি করে দিতাম। তবে সেগুলোও সেই সময় আমাকে লুকিয়ে করতে হত। বাবার সঙ্গে আমার প্রথম ঝগড়ার পরে বড়দা-জ্যাঠামশাইয়ের বড় ছেলে হীরক, এ বাড়ি ছেড়ে, গড়িয়ার বাড়িতে চলে গিয়েছিল। বড়দা বা মেজদা পান্নালাল, কী ভেবেছিল জানি না, ঠাকুরদা আর ঠাকমা মারা যাবার পরেই, তাদের ভাগের বেশ কিছু ধান জমি আর একটা বাগান বিক্রির টাকা দিয়ে আগেই গড়িয়ায় একটা বাড়ি করেছিল। মেজদা চলে গিয়েছিল বড়দার আগেই। আমার জ্যাঠামশাই খুন হয়েছিলেন।

জ্যাঠামশাইয়ের খুনের ব্যাপারটা পরে ভাবা যাবে। আমি তো খুব আশা নিয়ে গৌর সেনের বাড়ি গিয়েছিলাম। ঘোর দুপুর হলেও, খেয়ে যাইনি। ভেবেছিলাম সুসংবাদটা নিয়ে বাড়ি ফিরে খাব। গৌর সেন বোধ হয় কিছু বলে রেখেছিল। আমি যেতেই বাইরের ঘরে যে লোকটা টেবিলের ওপর পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিল, আমাকে দেখা মাত্রই বলেছিল, স্বর্ণকমল চ্যাটার্যি?

ওইটাই আমার ভাল নাম। হীরকলাল, পান্নালাল, তাদের ভাই স্বর্ণকমল। যাকে বলে জড়োয়া ব্রাদার্স। কথাটা মেজদাই ঠাট্টা করে মাঝে মাঝে বলত। আমি লোকটিকে বলেছিলাম, হ্যাঁ।

ওই দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চলে যাও। লোকটা চেয়ার থেকে একটুও না নড়ে আমাকে প্রায় হুকুমের সুরে বলেছিল।

গৌর সেন আর তার সব চেলারাই কথাবার্তা আচার আচরণে সমান। অবিশ্যি গৌর সেনের সামনে সবাই এক রকম। হবেই বা না কেন? কলকাতার দক্ষিণ আর ট্যাংরা অঞ্চলের যত কলকারখানা সমস্তগুলো ইউনিয়নের একচ্ছত্র নেতা গৌর সেন। তার প্রতাপই আলাদা। সবাই বলাবলি করত, কারখানার মালিকও যা, গৌর সেনও তা-ই। তার কথাতেই সব। সে হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, না বললে, না। কারখানার মালিকদের সঙ্গেও নাকি তার নিয়মিত ওঠাবসা ছিল। থানার পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে চলাফেরা ওঠা বসা তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি। কী করে একটা লোক এ রকম পজিশনে আসে? আমি তো কোনওকালে ভেবেই উঠতে পারলাম না।

আমি লোকটার কথামতো, দেখিয়ে দেওয়া দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দরজাটা খোলাই ছিল। আমি উঁকি দিয়ে আগে ভিতরে দেখেছিলাম। গৌর সেন একেবারে একলা, একটা খাটের ওপর চিত হয়ে শুয়ে ছিল। পরনে ছিল একটা লুঙ্গি, গায়ে একটা গেঞ্জি। আমি উঁকি দিতেই তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়েছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করছিল। হাত তুলে আঙুলের ইশারায় আমাকে ডেকেছিল। আমি ভিতরে গিয়েছিলাম। বসবার কোনও চেয়ার বা টুল কিছুই ছিল না। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে আমাকে সেই প্রথম বেশ মিহি মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি বলরাম মিত্তিরকে চেনো তো?

কোন বলরাম মিত্তির? আমার মুখ ফসকিয়ে কথাটা বেরিয়ে পড়েছিল, অথচ আমাদের গোটা এলাকায় বলরাম মিত্তির বলতে একজনকেই বোঝায়।

গৌর সেনের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছিল, আর চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠেছিল। আমি তাড়াতাড়ি থতমত খেয়ে বলেছিলাম, বলরাম মিত্তির মানে, আপনি বলরাম মিত্তিরের কথা বলছেন?

ভয় এমন জঘন্য জিনিস, মানুষকে বেমালুম পাঁঠা বানিয়ে দিতে পারে। আমার নিজেকে অন্তত তখন তাই মনে হয়েছিল। গৌর সেন জ্বলজ্বলে চোখে, আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। আর গৌর সেনের মতো লোকেরা যা করতে চায়, সবই ভয় দেখিয়ে। মানুষকে কিছুতেই স্বস্তিতে কথা বলতে দেবে না। আমি আবার তাড়াতাড়ি বলেছিলাম, আপনি রায়পাড়ার বলরাম মিত্তিরের কথা বলছেন তো?

একটা তেতে ওঠা লোহা যেমন আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে রং বদলায়, গৌর সেনের মুখটা সেইভাবে স্বাভাবিক হয়েছিল। আমার চোখ থেকে সে চোখ এক বারও সরায়নি, আর তার চোখে শেষপর্যন্ত সন্দেহ লেগেছিল। কোনও রকম রাগ না করে বলেছিল, হ্যাঁ, রায়পাড়ার বলরামের কথাই বলছি। সে কে জানো তো?

আপনার বন্ধু মানে উনিও আপনার সঙ্গে–

গৌর সেন হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল, আর সেই বোধ হয় প্রথম আমি গৌর সেনের মুখে। হাসি ফুটতে দেখেছিলাম। অন্তত আমার সঙ্গে কথা বলার সময়। বলেছিল, হ্যাঁ, আমার সঙ্গে পার্টি আর ইউনিয়ন করে। ওটাও ঠিক বলেছ, সে আমার বন্ধু, কিন্তু সে তোমাকে চাকরি দিতে চাইছে না। এ নিয়ে তো আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করতে পারি না। আমি অবিশ্যি বলরামকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি, চাকরিটা তোমাকে পাইয়ে দিলে, তারপরে তুমি ঠিক আমাদের দলের হয়ে কাজ করবে। কিন্তু কী জানো, বলরামের ঘাড়ের রগ বড় শক্ত, আমি একদম পছন্দ করিনে। ওর জন্যেই তোমার মতো আরও কয়েকজনকে আমি কাজে ঢোকাতে পারছিনে। বোঝে না, এটা আমাদের দলের পক্ষেই খারাপ।

গৌর সেন কথা থামিয়ে আর-সি-ঢালাই ছাদের দিকে তাকিয়েছিল। আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, গৌর সেনের মতো লোক আমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলছে। আমি যেন তার নিজের লোক, নিজেদের ভিতরের কথা বলার মতো লোক। সে না বললে তো আমি কোনওদিন জানতেই পারতাম না, বলরাম মিত্তিরের সঙ্গে গৌর সেনের মতের অমিল থাকতে পারে। সবাই জানত, গৌর সেন এক নম্বর নেতা, বলরাম মিত্তির দু নম্বর। কিন্তু দুজনে হরিহর আত্মা। অথচ গৌর সেন নাকি বলরামকে পছন্দ করে না। অন্য কারও মুখ থেকে শুনলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না। গৌর সেনের কথার জবাবে আমি কী বলব, কিছুই বুঝতে পারিনি, অবাক বোকার মতো তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।

গৌর সেন ছাদের দিকে চোখ রেখেই বলেছিল, তোমাকে খোলাখুলিই বলছি, বলরামের সঙ্গে আমার বনছে না, আর সেটা তোমাদের কয়েকজনের জন্যই। হ্যাঁ, যদি বুঝতাম তোমরা আমাদের অ্যান্টি পার্টির ছেলে, তা হলে একটা কথা ছিল। তা তোমরা নও। তবু বলরামের এ গোঁয়ার্তুমির মানে কী? নিজেদের ভেতরের সব কথা তোমাকে খুলে বলতে পারছিনে। তবে শুধু তোমাদের ব্যাপারে না, বলরাম খুব খারাপ রাস্তা নিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন করব, মালিকের গোলামি তো করতে পারিনে। তাই বলছি, বলরামের একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। সেটা তোমাদের হাত দিয়ে হলেই ভাল হয়।

সর্বনাশ! বলরাম মিত্তিরের শিক্ষা, তাও আবার আমাদের হাত দিয়ে? আমাদের বলতে আর কাদের কথা গৌর সেন বলছিল, তখনও বুঝতে পারিনি, শিক্ষাটাই বা কী তাও বুঝতে পারছিলাম না। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, শিক্ষা?

বাইরের ঘরে যে ছেলেটা বসে আছে, ওকে চেনো?’ গৌর সেন আমার কথার জবাবে পালটা জিজ্ঞেস করেছিল।

আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, চিনি না, তবে আপনাদের পার্টি অফিসে দেখেছি।

ওর নাম সন্টু, তোমার মতোই বলরামের একজন ভিকটিম৷’ গৌর সেন বলেছিল, বলরামের জন্যই ওরও কিছু হচ্ছে না। বাকিদের সন্টুই তোমাকে চিনিয়ে দেবে। তোমরা বলরামকে কিছুকালের জন্য শুইয়ে রেখে দাও।

কথাটার সঠিক অর্থ না বুঝলেও বুকটা কেমন কেঁপে উঠেছিল, বলেছিলাম, শুইয়ে রেখে দেব?

হ্যাঁ, একেবারে হাপিস করে দিতে বলছি না। ভাল করে ঝাড় দিয়ে দাও, যেন বলরাম কিছুকাল হাসপাতালে পড়ে থাকে। গৌর সেন এমনভাবে কথাগুলো বলেছিল, যেন বাগানের গাছ থেকে কলার কাঁদি কেটে আনতে বলার মতো একটা সহজ কথা, সেই ফাঁকে আমি তোমাদের কয়েকজনকে একটা ভাল জায়গায় কাজে ঢুকিয়ে দেব।

আমার মনে অবিশ্বাস আর সন্দেহ, আমি কোনও কথা না বলে গৌর সেনের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। সে আঙুল দিয়ে দাঁত খুঁটে আমার দিকে তাকিয়েছিল, পারবে না?

আজ্ঞে? কী বলব, কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। লোকটা ঠাট্টা করছিল, নাকি সত্যি নিজের দলের লোককে মারতে বলছিল, আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

গৌর সেন বলেছিল, তোমার শরীরটরির তো বেশ লম্বা চওড়া আছে। সঙ্গে যারা থাকবে, তারাও কেউ কম যায় না। কবে কখন কোথায় ঝাড় হবে, সন্টুই সব বলে দেবে। যাও, পাশের ঘরে সন্টু কী বলে, শুনে নাও।

বাড়ি থেকে না খেয়ে বেরোবার সময়, মাকে কী বলে বেরিয়েছিলাম, সে কথা আমার মনে পড়ছিল। আর আচমকা চাবুক খাওয়া ঘোড়ার দল আমার মাথার মধ্যে পাগলের মতো ছুটোছুটি করছিল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে, আমি বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। গৌর সেন ডেকেছিল, শোনো৷

আমি ফিরে তাকিয়েছিলাম। গৌর সেনের চোখ দুটো শুয়ে থাকা শান্ত বাঘের মতো আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, সে আমার বুকের ভিতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। বলেছিল, আমার যা বলার বলে দিলাম। তুমি যদি পারো তো ভাল, না পারলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু কথাটা জানাজানি হলে।হঠাৎ একটু থেমে সে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার বাবা মা বেঁচে আছে?

হ্যাঁ। আমি ঘাড় কাত করে বলেছিলাম।

গৌর সেন আবার জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়ে করেছ?

আমি মাথা নেড়েছিলাম। গৌর সেন বলেছিল, ঠিক আছে। সে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পাশ ফিরে শুয়েছিল।

আমি গৌর সেনের প্রত্যেকটা কথার মানেই বুঝতে পেরেছিলাম। সময়টা প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের ঠিক আগেই। তখনও, এখন যেমন কথায় কথায় খুনোখুনি হয়, ও রকম ছিল না। কিন্তু গৌর সেনের কথায় আমি সেই সময়েই বুঝে নিয়েছিলাম, রাজনীতির নিয়ম আলাদা। তবে এটা ভাবতে পারিনি, দরকার হলে নিজের দলের লোককেও ঝাড় দেওয়ার দরকার হয়। সেই সময় অবিশ্যি ঝাড় ছিল হাপিস বা খতম না। আমি বাইরের ঘরে গিয়েছিলাম। সন্টু এক ভাবেই চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে রেখেছিল। আমি কিছু বলবার আগেই সে জিজ্ঞেস করেছিল, গৌরদার সঙ্গে কথা হল?

হয়েছে।

 ঠিক আছে তো সব?

উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে বললেন।

হ্যাঁ, এক জায়গায় বসে প্ল্যানটা ছকে নিতে হবে। বাজারের পেছনে ভুতোর দোকানটা চেনা আছে?

দোকানটা চেনা ছিল। বাজারের পিছনে ভুতোর দোকানটা বাইরে থেকে চায়ের দোকান। আসলে, সকাল থেকেই ওখানে চোলাই মদ বিক্রি হয়। বাজারের ফড়িয়া থেকে সকলেরই জানা ব্যাপার। আর একটু ভিতরে ঢুকলেই বেশ্যাপল্লী। জানা ব্যাপার হলেও, বাজারের পিছন দিকে কোনওকালেই আমার যাতায়াত ছিল না। ভুতোর দোকানেও কোনও দিন যাইনি। তবে ভুতোর দোকানে যাতায়াত করে, এমন অনেকের সঙ্গেই চেনা জানা ছিল। সন্টুকে বলেছিলাম, চিনি, কোনও দিন যাইনি।’

ভেতরে বসবার ঘর আছে’, সন্টু বলেছিল, আজই সন্ধের পরে চলে এসো, আমি দোকানের বাইরে থাকব। মালটাল চলে?

আমি মাথা নেড়েছিলাম, আর সেটা মিথ্যা না। সন্টুর মালটাল মানে চোলাই মদ। সেই সময়ে কোনও মদই আমি চেখেও দেখিনি। পরে চেখে দেখেছি, কিন্তু আমার কোনও দিনই ভাল লাগেনি। যদিও আমার বাবার ধারণা, আমি একটা পাঁড় মাতাল। আমাকে সোজাসুজি বলে না, মাকে শোনায়। আরও কারো কারোকে বলে। কেন বলে তাও জানি। আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ কেউ মদ খায়। অবিশ্যি যখন আমার বন্ধুবান্ধব ছিল, বিশেষ করে বাবাকে শায়েস্তা করার জন্য যারা আমাকে মদত দিয়েছিল। এমনকী তারা আমাদের বিরাট বাড়িটার দোতলায় বসেই অনেক সময় বোতল গেলাস নিয়ে বসত। বাবা ঠিক টের পেত, আর মনে করত আমিও চালাচ্ছি।

আমি সন্টুকে বলেছিলাম, না, ও সব আমার চলে না।

 চলবে চলবে। সন্টু ওর ছোপ ধরা দাঁতগুলো দেখিয়ে হেসেছিল, আমার সঙ্গে দু দিন বসলেই চলবে। ও সব একটু দরকার, বুঝলে? নইলে শালা মেজাজ আসে না, প্ল্যানট্যান করা যায় না। থাক গে, ও সব নিয়ে ভাবতে হবে না, তুমি ঠিক সন্ধের পরে ভুতোর দোকানে চলে এসো।

আমি কোনও জবাব না দিয়ে দরজার দিকে এগিয়েছিলাম। সন্টু পিছন থেকে বলে উঠেছিল, কী হল, কিছু বললে না?

কী আর বলব, ঠিক আছে। আমি মুখ ফিরিয়ে বলেছিলাম, তারপরে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। মনে মনে কেবল একটা কথাই বলেছিলাম, শালা!..সত্যি কথা বলতে কী, সেই বেলা প্রায় আড়াইটা-পৌনে তিনটায় আমি বাসের জন্য অপেক্ষা করিনি। সাইকেল রিকশায় চাপার মতো পয়সাও পকেটে ছিল না। দু মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। মা আমার জন্য বাড়ির বাগানের দিকে, রাস্তার ধারে বড় দরজাটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, মা তখনও খায়নি। চাকরির সুসংবাদটা শুনে একেবারে দুজনের খাবার বেড়ে নিয়ে বসবে এ রকম একটা ইচ্ছা ছিল।

মায়ের দিকে তাকিয়ে সত্যি আমার কেমন কষ্ট হয়েছিল। লাল পাড় সামান্য একটা শাড়ি, সাদা একটা জামা, মাথায় ঘোমটা টানা। হাতে দু গাছি শাঁখা আর এক হাতে সোনা বাঁধানো একটি নোয়া ছাড়া কিছুই ছিল না। অথচ ছিল সবই ছিল সবই, কথাটা মনে হওয়া মাত্রই আমার চোখ পড়েছিল বৈঠকখানা ঘরের বন্ধ দরজার দিকে। বৈঠকখানা ঘরের বাইরে থাম আর ছাদ আঁটা চওড়া গোল বারান্দায় একটা কুকুর শুয়ে ছিল। আর থামের মাথায় পায়রারা বকবকম করছিল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, বৈশাখের সেই ভূতে ঠেলা মারা দুপুরে বৈঠকখানা ঘরে বন বন করে পাখা ঘুরছে। বাবা নিশ্চয় তক্তপোশের ওপর বসে হাওয়া খাচ্ছে, না হয়তো আধশোয়া হয়ে সিগারেট টানছে আর মেঝে জুড়ে বসে মেয়েরা প্লাস্টিকের ঝুড়ি ব্যাগ বুনছে, ফাঁকে ফাঁকে হাসি মশকরা মজার গল্প চলছে। বাইরের ঘরের পাশেই একটা ছোট ঘর আছে, সেই ঘরেই বাবার আলাদা রান্না হয়। কারখানারই বিশেষ একটি মেয়ে রান্না করে দেয়। আমি আর মা আলাদা।

মায়ের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হলেও, বাইরের ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আমার বুকের মধ্যে যেন কেউ ধারালো নখে খামচিয়ে ফালা ফালা করে দিয়েছিল। মায়ের গলার এক ছড়া সোনার সরু হার ছাড়া, বাবা সব নিয়ে নিয়েছে। বাবা চেয়েছে, মা দিয়ে দিয়েছে। এক সময়ে মায়ের ওপরেও রাগ হত। যদিও রাগ করে কোনও লাভ ছিল না। তবু মন মানত না। আর সেই মাকেই বাবা একই বাড়ির মধ্যে আলাদা করে দিয়েছিল। মায়ের অপরাধ, সে তার ছেলেকে কেন, স্বামীর কথামতো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়নি।

মা আমার দিকে তাকিয়ে, উপবাসী শুকনো মুখে হেসেছিল, বড় দেরি করে এলি রে দুদে, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। এক একটা বাস যায়, রিকশা ভেঁপু ফোঁকে, আর ভাবি, এই বুঝি তুই এলি৷

চলো চলো, ভেতরে চলল। আমি মায়ের পাশ দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলাম।

মা দরজাটা একটু ঠেলে দিয়ে আমার পিছনে পিছনে এসেছিল। আমি বাইরের ঘরের পাশের ছোট ঘরটার পাশ দিয়ে, ভিতরের বারান্দায় ঢুকে, চোখের কোণ দিয়ে এক বার বাইরের ঘরের খোলা দরজার দিকে তাকিয়েছিলাম। একটুও ভুল ভাবিনি। ভাল করে না তাকিয়েই, নীচে মায়ের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে, কথাবার্তা হাসির টুকরো শুনতে পেয়েছিলাম। আমার দাঁতে দাঁত চেপে বসছিল। এক টানে গায়ের জামাটা খুলে মায়ের খাটে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। মা ঘরে ঢুকে পাখার সুইচটা টিপে দিয়েছিল। বলেছিল, এখন আর ওপরে যাসনে। খেয়ে নিয়ে ওপরে গিয়ে প্যান্ট ছাড়িস। আমি এ ঘরেই ভাত তরকারি এনে রেখেছি। তোকে আর বাইরে গিয়ে হাত মুখ ধুতে হবে না, ঘরেই নালির মুখের কাছে জলের বালতি আর ঘটি রেখে দিয়েছি। হাত মুখ ধুয়ে নে।

আমি মায়ের ঘরের বড় আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আজকালকার ড্রেসিং টেবিল বলতে যে রকম বোঝায়, মায়ের আয়না বসানো টেবিলটা ঠিক সে রকম না। নীচের দিকটা চওড়া জলচৌকির মতে, তার গায়ে দুটো বড় বড় দেরাজ, যার মধ্যে জামাকাপড় রাখা যায়। সেই জলচৌকিটার দু পাশে দুটো কাঠের স্ট্যান্ড, মাঝখানে লম্বা চওড়া একটা আয়না। আসলে এ সম্পত্তিটা ছিল আমার ঠাকমার। এ ঘরে ঠাকুরদা আর ঠাকমা থাকত। বেশি বয়সে দুজনের কেউ-ই আর দোতলায় ওঠানামা করত না।

আমি মাকে আয়নায় দেখতে পাচ্ছিলাম, বন্ধ জানালার কাছে সরিয়ে রাখা জলের বালতিটা মা নালিমুখের কাছে রাখছিল। আশ্চর্য, মা এমন নির্বিকার থাকত কেমন করে? রাগ, তেজ, চিৎকার, মেয়েদের এত কথা যে শুনি, মাকে কোনও দিনও সেই রকম কিছু করতে দেখিনি। অপমানবোধও কি ছিল না? ঘৃণা ছিল না? সারাটা জীবন বাবার মতো লোককে সহ্য করে আসছে কেমন করে? তাও যদি বুঝতাম, স্বামী হিসাবে বাবা একেবারে খাঁটি মানুষ। সব জেনে-শুনেও, সেই বাবা যখন যা চেয়েছে, মা হাতে করে তুলে দিয়েছে। যখন যা বলেছে, তা-ই শুনেছে। সেই কী বলে কথাটা–হিপনোটাইজ, বাবা কি সে রকম কিছু জানত নাকি? নাকি, মায়ের কোনও দুর্বল ব্যাপার ছিল? মা বাবাকে কি বিশেষ কোনও কারণে ভয় পেত?

না,নতুন করে ওইসব কথা ভাবার কোনও মানে ছিল না। মাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, অনেক ধাতিয়েছি রেগে ফেঁজে, এমনকী কেঁদেও মাকে অনেক কথা বলেছি, মাকে ছিঁড়ে খেয়েছি। মায়ের চিরকালের সেই ঠাণ্ডা শান্ত ছোট ছোট জবাব, ও চাইলে, আমি কী করব।’..ও বললে, আমি কী করব?’…ও করলে, আমি কী করব?’…ও ও ও! শুনতে শুনতে মনে হত, মায়ের গলা টিপে ধরে, চিরদিনের জন্য চুপ করিয়ে দিই। ও-ই সব, ওর কথার কোনও অবাধ্যতা করা চলে না অথচ তোমার ও তোমাকে, আমাকে, আমাদের বোনেদের সবাইকে পথের ভিখিরি করে ছেড়ে দিয়েছে। তারপরেও ও চোখের সামনে ওই জীবন চালিয়ে যাচ্ছিল। মা নির্বিকার। কেন?

আমি গায়ের ঘামে ভেজা গেঞ্জিটা খুলে, মায়ের খাটের ওপরে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। নতুন করে ও সব কথা ভাবার কোনও মানে ছিল না। ও সব ভাবনা অনেক দিন আগেই, চাবুক খাওয়া চমকানো ঘোড়ার মতো ছুটে গিয়েছিল। তাই ঠিক করেছিলাম, বাবার সঙ্গে আমাকেই লাগতে হবে। কিন্তু কীভাবে, সেটা ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। মা খাটের পাশে, পাখার নীচেই, আমাকে খেতে দেবার জন্য আসন পেতে দিয়েছিল। গেলাসে জল গড়িয়ে দিয়েছিল। বিতির জন্য অপেক্ষা করার দরকার ছিল না। বিনতি আমার ছোট বোন, সেই সময়ে সুরেন্দ্রনাথে পড়ত। বিনতির ওপরে আমার আর এক ছোট বোন পানতু, বছর তিনেক আগে, ছোট পিসিমা আর বড়দা নিজেদের খরচে বিয়ে দিয়েছিল। পানতুর শ্বশুরবাড়ি কালীঘাটে। বিনতি গরমের ছুটি পড়বার আগেই, পানতুর বাড়ি চলে গিয়েছিল। গোটা ছুটি কাটাবার জন্য না, কয়েক দিন থাকবার জন্য। পানতুর বর মহাদেবের সরকারি চাকরিটা ভালই। বিতিটা সেখানে গেলে ভালই থাকে। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম। আমার অবিশ্যি অন্য মতলব ছিল। পানতুর কাছ থেকে দু-চারটে টাকার ক্যাশ জোগাড় করার ফিকির।

আমি আয়নায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। মা খাটের নীচে থেকে ভাতের হাঁড়ি এগিয়ে এনে আমার জন্য থালায় বাড়ছিল। মায়ের উপোসি শুকনো মুখ, শুকনো ঠোঁটে পানের লাল দাগ। বোধ হয় আমি আসার একটু আগেই পান চিবিয়েছিল। নেশায় না খিদের জন্য, জানি না। বোধ হয় খিদেই পেয়েছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, মায়ের শুকনো মুখে, কেমন একটা খুশির ভাব। এমনিতে দেখলে, মনে হত নির্বিকার, নিজের মনে কাজ করছে। আসলে তা না। মন ভাল থাকলে, মুখে যেমন একটা ছাপ পড়ে মায়ের মুখে সেই রকম একটা ছাপ পড়েছিল। কেন, আমি তা জানতাম।

আমি একটা দমকা নিশ্বাস চেপেছিলাম। কে যে বেচারি, আমি না মা, নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। পাখার বাতাসে গা-টা ঠাণ্ডা হলেও গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল। আমি আয়নার কাছ থেকে সরে, খাটের কাছে গিয়ে নিচু হয়ে জলের গেলাসটা তুলে নিয়েছিলাম। মুখে ছোঁয়াবার আগেই মা বলে উঠেছিল, কী করছিস? এই রোদ থেকে এসেই জল খাসনে। আগে হাতে মুখে একটু জল দে। দু গরাস ভাত মুখে দিয়ে জল খাস।

আমি ঠোঁটের কাছ থেকে গেলাসটা নামিয়ে রাখছিলাম। নালিমুখের কাছে গিয়ে ঘটি করে বালতি থেকে জল তুলে নিচু হয়ে মুখটা ধুয়েছিলাম। হাত ধুয়েছিলাম। মা তার লাল পাড় শাড়ির আঁচলটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, নে, এটা দিয়ে মুছে নে, এখন আর উঠে গামছা হাটকাতে হবে না।

আমি আসনের ওপর আঁটসাঁট ট্রাউজার পরে, এক পা মুড়ে, আর এক পা ছড়িয়ে বসেছিলাম। পাখার বাতাসে আরাম লাগছিল। মায়ের আঁচলটা নিয়ে মুখ মুছেছিলাম। পুকুরের জলে কাপড় কেচে শুকোবার পরে যে রকম গন্ধ হয়, মায়ের আঁচলের গন্ধ অনেকটা সেই রকম। ভাতের পাতে কাঁচা পোস্ত পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা দিয়ে বাটা দিয়েছিল। আমি ভাত মাখতে মাখতে, গৌর সেন আর সন্টুর কথা ভাবছিলাম। মায়ের মুখের দিকে আমি তাকাচ্ছিলাম না, কিন্তু তার নিশ্চিন্ত খুশির ছাপটা চোখে। ভাসছিল। আমি জানতাম, আমার খাওয়া না হলে মা আমাকে চাকরির কথা জিজ্ঞেস করবে না। অথচ, মা ধরেই নিয়েছিল, চাকরিটা আমি নিশ্চয়ই পেয়েছি। কাঁচা পোস্ত বাটা, পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা দিয়ে ভাত খেতে বরাবরই ভালবাসি। বসিরহাটের দাদুর কাছে ছেলেবেলাতেই ও সব খেতে শিখেছিলাম। মুখে ভাতের গরাস তুলতেই, মুখের ভিতরটা ভিজে উঠেছিল। অথচ মাকে কথাটা বলা হচ্ছিল না। আমার খাবার পরে মা জিজ্ঞেস করবে, জানতাম। তারপরে মায়ের অবস্থাটা কী হবে? ভাবতে ভাবতেই, জলের গেলাস তুলে চুমুক দিয়েছিলাম। কোনও ব্যাপারই আমার পক্ষে বেশিক্ষণ চেপে রাখা সম্ভব হত না। কাঁচা পোস্ত বাটা দিয়ে ভাত খেতে যথেষ্ট ভাল লাগা সত্ত্বেও আমি মিথ্যা কথা বলছিলাম, মা খেতে ভাল লাগছে না।

মা তখন আমার জন্য বাটিতে ডাল ঢালছিল। চোখ তুলে এক বার আমার দিকে দেখেই, ডালের পাত্র রেখে যেন ভয় পেয়ে বলেছিল, কেন রে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

না শরীর, আর কী খারাপ হবে। আমি বলেছিলাম, চাকরিটা হল না মা।

মায়ের পান খাওয়া শুকনো ঠোঁটে হাসি না ফুটলে বোঝা যেত না মনটা তার কত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, চাকরি হওয়া না-হওয়ার কথা কেউ বলতে পারে না। ও নিয়ে মন খারাপ করে লাভ কী, খেয়ে নে। মা আমার পাতে মোচার চচ্চড়ি তুলে দিয়েছিল।

অথচ মাকে আমিই বিশেষ করে আশা দিয়ে গিয়েছিলাম, জবাবে মা বলেছিল, দ্যাখ তোর কপালে কী আছে। বলেছিলাম, সত্যি, আজ খুব আশা নিয়ে গেছলাম, শালা– কথাটা আর শেষ করিনি, কারণ, মাকে আমি গৌর সেনের ঘটনা বলতে চাইনি। কয়েক গ্রাস খেয়ে বলেছিলাম, অনেক তো বেলা হয়ে গেছে, তুমিও নিয়ে বসে পড়ো না।

বসব, তোর হোক। মা বলেছিল, কিন্তু তার মুখে আর সেই নিশ্চিন্ত খুশির ভাব ছিল না।

গৌর সেনের কথা কেবল মাকে না, কারোকেই বলিনি, আর যাইওনি। কয়েকটা দিন সবসময়েই মনে হত, এই বুঝি সন্টু এসে পড়ল। রাস্তাঘাটের দিকে নজর রেখে চলতাম। ভাবতাম কোনদিন শুনব, বলরাম মিত্তির মার খেয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। কিন্তু শুনিনি। বরং উলটো খবর অবিশ্যি আমাদের পাড়ার ছেলেদের কাছেই পেতাম, যারা গৌর সেন বা বলরাম মিত্তিরদের অ্যান্টি পার্টি। ওদের মুখেই শুনেছিলাম, বলরাম মিত্তির তার এলাকা ছেড়ে কসবার দিকে কোথায় আস্তানা নিয়েছিল আর গৌর সেনের সঙ্গে নিজেদের ইউনিয়নগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। তার মানে, আপসে মিটিয়ে নিয়েছিল।

তারপরেই এসেছিল প্রথম যুক্তফ্রন্টের আমল। ভোটের সময় থেকেই আমি আমাদের এলাকায় কাজে নেমে পড়েছিলাম। আসলে আমাদের গোটা এলাকাটাই প্রায় গৌর সেনদের বিরোধী ছিল। অন্তত আমার বয়সি বা আমার থেকে ছোট ছেলেরা সকলেই প্রায় ওদের বিরুদ্ধে ছিল। কে আদর্শবাদী, আর কে না, আমিই কিছুই বুঝতাম না। শাসক দলের ওপর, আর সকলের মতোই আমারও রাগ ছিল। তা ছাড়া, গৌর সেনের ব্যাপারটা আমি ভুলতে পারিনি। লোকটাকে মনে মনে ভীষণ ঘৃণা করতাম। লোকটার সেই চোয়াল শক্ত, জ্বলজ্বলে চোখ, হুকুমের স্বরে কথাবার্তা মনে পড়লেই আমার মাথার রক্ত চড়ে উঠত। আর ওই সেই চ্যালা চামুণ্ডাগুলো যারা ওকে পার্টি অফিসে ঘিরে থাকত, দু-একজন ছাড়া কারোকে আমার সহ্য হত না, সবগুলোকেই খুদে গৌর সেনের মতোই শয়তান মনে হত। অথচ ওরাই ইউনিয়নের লিডার গৌর সেন তার ওপরে বলতে গেলে কারখানাগুলোর মালিক। আসল মালিককে কে আর কবে চোখে দেখতে পায়। বরং রায়পাড়ার বলরাম মিত্তির লোকটাকে আমার একটু ভাল মনে হত। লোকটার কথাবার্তা কিছুটা ভদ্রগোছের ছিল। যদিও আমার সঙ্গে কথা কোনও দিনই হয়নি। লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখেছি। রোখোক হুকুমের ভাব ছিল না।

ভোটের কাজের সময়, আমি বাবাকে লক্ষ করেছিলাম। আমার কাজকর্ম যে বাবার ভাল লাগছিল না, বুঝতে পেরেছিলাম। আর আমাদের এলাকার যে দু-চারজন শাসক দলের লোক ছিল, তাদের প্রায়ই বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেখা যেত। আমাদের বন্ধুরা বলত, কী রে দুদে, ত্রিলোচন কাকার ব্যাপারটা কী?

একে মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ। আমি ব্যাপারটা তৎক্ষণাৎ ক্যাচ করেছিলাম, ব্যাপার আবার কী, যা বোঝবার বুঝে নাও।

বোঝবার কিছু নেই, যা দেখবার, তা দেখে রাখছি! বন্ধুরা বলেছিল, ইলেকশনটা মিটে যাক, রেজাল্টটা দেখা যাক তারপরে সব বোঝাবুঝির পালা।

আমিও মনে মনে, দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলাম, হ্যাঁ, তারপরে সব বোঝাবুঝির পালা।

তখন কি জানতাম, সব খেলারই দান আছে, আর ওটাকে কী বলে? প্রতিদান, হ্যাঁ, প্রতিদানও আছে। চলতি কথায় যাকে বলে পালটা দান। কিন্তু আমার তখন ও সব মাথায় ছিল না। আমি প্রথম দান নিয়েই ভাবছিলাম। আমাদের বাড়ির দোতলায় ইলেকশনের পোস্টার লেখা, বৈঠকও বসত। বাবা সহ্য করতে পারছিল না। মা আমাকে বলেছিল, বাড়িতে এ সব কী করছিস? ও কিন্তু খুব রাগ করছে। চোখ পাকিয়ে দেখছে, আর ফুঁসছে। জানিসই তো এ সব দলের ছেলেদের ও মোটে দেখতে পারে না।

তা আর জানতাম না? খুবই ভাল জানতাম। জ্যাঠামশাইয়ের খুনের দায়টাও বাবা কমিউনিস্টদের ঘাড়ে চাপিয়েছিল। না, এ অঞ্চলে না। খুন হয়েছিলেন কাঁচরাপাড়ার কাছে। ডেডবডি পড়ে ছিল রেল লাইনের ধারে, যদিও রেলে কাটা পড়ার কোনও চিহ্ন ছিল না। ভারী লোহার হাতুড়ি বা ডাণ্ডা দিয়ে মাথার পিছন দিকটা একেবারে ফাঁক করে দেওয়া হয়েছিল। তার মানে, জ্যাঠামশাই নিশ্চয় তাঁর খুনিকে দেখতে পাননি। বাবা যুক্তি দিয়েছিল, উনিশশো উনপঞ্চাশে, ইস্টার্ন রেলের বড় ইঞ্জিনিয়ার জ্যাঠামশাইকে কমিউনিস্টরা খুন করেছে। পুলিশ কোনও কু খুঁজে পায়নি। কিন্তু আমি জানি, বাবা নেহাত দোষ চাপাবার জন্যই, একটা মিথ্যা কথা বলেছিল।

যাই হোক, সে কথা পরে হবে। কথাটা বাবা-ই মাকে বলেছিল, যারা তার দাদাকে খুন করেছে, তারা আমাদের বাড়িতে বসে ইলেকশনের বৈঠক মিটিং করবে, পোস্টার লিখবে? এটা মায়ের ওর পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। আমি মাকে বলে দিয়েছিলাম, বাবাকে বলে দিয়ে, তার যা করবার আছে, যেন করে। আমার যা করবার, আমি করে যাব।

করেছিলাম। আসলে বাবাও অপেক্ষা করছিল, ইলেকশনের রেজাল্টের জন্য। বাবাও কখনও রাজনীতি করত না, কিন্তু বরাবরই শাসক দলের প্রতি সমর্থন ছিল। আর আমাকে শাসক দলের বিরুদ্ধে যেতে দেখে, বিশেষ করে ইলেকশন নিয়ে মাতামাতি করতে দেখে, মেজাজ খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কী একটা কথা যেন আছে? লেখাপড়া না শিখলে যা হয়, কিছুতেই ভাল ভাল কথাগুলো মনে থাকে না। কথাটাকথাটা ভবিতব্য। হ্যাঁ, ভবিতব্য। তা না হলে আমার মতো ছেলে, যে কোনও দিন রাজনীতির কথা ভাবেনি, মাথা ঘামায়নি, সেই আমি কেন যুক্তফ্রন্টের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী বাবাকেও তো কখনও রাজনীতি করতে দেখিনি, মাথা ঘামাতেও দেখিনি, একমাত্র জ্যাঠামশাইয়ের খুনের ব্যাপারে, উনপঞ্চাশ সালে কমিউনিস্টদের দায়ী করা ছাড়া। ওই সময়ে নাকি কমিউনিস্টরা সশস্ত্র বিপ্লব করছিল, আর জ্যাঠামশাইয়ের ওপর তাদের রাগ ছিল, বাবার ও কথায় কতটা রাজনীতি ছিল, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভবিতব্য বলতে আমি বোঝাতে চাইছিলাম, আমরা বাবা ছেলে, কী রকম আশ্চর্যভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিলাম। আমি যতই যুক্তফ্রন্টের আন্দোলনে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম, বাবা ততই আমাদের কুৎসা গাইতে আরম্ভ করেছিল। বাবা যদি শুধু আমাকে গালাগাল দিত, তা হলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু বাবা আমাদের সব দলগুলোর নামেই কুৎসা রটাতে আরম্ভ করেছিল। বাবার ধারণা ছিল, শাসক দল জিতবেই। একেই বলে ভবিতব্য! পাশা ওলটাবার খেলা।

সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনেই কি যুক্তফ্রন্ট নিয়ে কোনও আশা ছিল? বরং সন্দেহই ছিল। তবু আমি শাসক দলের বিরুদ্ধে ছিলাম। কারণ, আমি জানতাম, শাসক দলে আমার কোনও বন্ধু ছিল না। ওদের কাছ থেকে আমি জীবনে কিছুই পাব না। গৌর সেনদের মতো শক্ত চোয়াল আর জ্বলজ্বলে চোখের চাউনি ছাড়া। আর ফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মধ্যে অনেকেই আমার বন্ধু ছিল। তারা আমার কাছে আর যা-ই হোক, কেউ গৌর সেন ছিল না। অবিশ্যি আমার প্রায় চোদ্দো বছর বয়স অবধি বসিরহাটেই কেটে গিয়েছিল, নিজের গ্রাম বা এলাকায় ছেলেবেলা থেকে কারও সঙ্গে আমার মেলামেশা ছিল না। তারপর থেকে তো ওরাই আমার বন্ধু। ওদের সঙ্গেই ইস্কুলে পড়েছি, সিগারেট টানতে শিখেছি, চায়ের দোকানে আড্ডা মেরেছি।

আহ্, এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার সারাটা জীবন যদি বসিরহাটে, দাদুর বাড়িতেই কেটে যেত তা হলে আজকের এ জীবনটার মুখোমুখি হতে হত না। দিদিমা মারা গিয়েছিল, তাতে কী? আমি কেন জোর করে দাদুর কাছে থাকতে চাইনি? এমন তো ছিল না, দাদু না খেয়ে থাকবেন, তা-ই আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল? আসলে, দিদিমা মারা যাবার পরে দাদু আর আমাকে কাছে রাখতে ভরসা পাননি। আমার মনে আছে, দাদু বলেছিলেন, তোর দিদিমা চলে গেল, এ বার আমিও কবে চলে যাব। অনেক কাল তো তোকে নিজের কাছে পেলাম ভাই, এ বার নিজের বাবা মা ঠাকমা ঠাকুরদার কাছে গিয়ে থাক। তাঁদেরও তো তোকে কাছে রাখতে ইচ্ছে করে।

ইচ্ছা! কোন ইচ্ছার সামনে এসে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। আমার চিরকালের অচেনা, অথচ অনেক সাধ আর আশা নিয়ে, দাদুর সঙ্গেই এসে এ বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম। বাগানের দিকে অন্দর মহলে যাবার খোলা দেউড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে, বিরাট বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিলাম। তখন জানতাম না, কী ভবিষ্যৎ নিয়ে এ বাড়িটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

কিন্তু এখন থাক সে সব কথা। ইলেকশনের ফলাফলের ব্যাপারটা, আমার মতোই গোটা দেশ, আশ্চর্য এক ভেলকি দেখেছিল। একে তো আমার মনে সন্দেহ ছিল। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা যে রাতারাতি এই রকম পালটে যাবে, আমি একটুও ভাবতে পারিনি। ভাবতে পারেনি আমার বন্ধুরাও। আমি যখন শুয়েছিলাম, এমনকী অতুল্য ঘোষও একজন প্রায় অচেনা লোকের কাছে হেরে গিয়েছেন, নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারিনি। আহ, বিজয় উৎসব কাকে বলে!

আমার মনে আছে, আমাদের গলির মোড়ে, চায়ের দোকানের কাছে, বড় রাস্তার ওপরে আমরা কিছু বন্ধু মিলে, নাচতে নাচতে কেবল চিৎকার করছিলাম, লাগ ভেলকি লাগ’, তখন আমাদের লোকাল লিডার জলধরদা সাইকেলের সামনে একটা ঝান্ডা লাগিয়ে এসে নেমেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েক জন ছিল। জলধরদা বেশ বিরক্ত হয়ে, আমাদের সবাইকে ধমক দিয়েছিলেন, এ আবার কী ধরনের শ্লোগান? লাগ ভেলকি লাগ? এটাকে তোমরা ভেলকি বলছ? ছি ছি ছি! আমাদের এই বিরাট জয়কে ভেলকি বলে চালাবার চেষ্টা করবে কারা? কায়েমি স্বার্থবাদীরা। মনে রাখবে, এটা মোটেই ভেলকি নয়। আমাদের কমরেডদের দীর্ঘকালের দুঃখ কষ্ট ত্যাগ জেল খাটা আর প্রচণ্ড পরিশ্রমের বাস্তব ফল। এটা হচ্ছে জনগণের রায়। জনগণের রায় ভেলকি নয়।

আমরা পাড়ার বন্ধুরা খুবই দমে গিয়েছিলাম। জলধরার কথা শুনে, নিজেদের অপরাধীও মনে হয়েছিল। তবে সেই সামান্য বকুনি ভুলে যেতে বেশি সময় লাগেনি। কয়েক দিন ধরে আমাদের সারা এলাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত, আমরা বিজয়োৎসব আর মিছিল নিয়ে মেতেছিলাম। আমার সমবয়সি নির্মলের সঙ্গেই আমি বেশি থাকবার চেষ্টা করতাম। নির্মল ছিল দক্ষিণ আর পূর্ব-কলকাতা ট্রেড ইউনিয়ন লিডার। ও আমাকে আশা দিয়ে রেখেছিল, ফ্রন্ট জিততে পারলে, ও আমার চাকরির চেষ্টা করবে। আমাদের জয়ের পরেই, নির্মল বলেছিল, এ বার গৌর সেন আর বলরাম মিত্তিরকে এক বার দেখে নেব। গৌর সেন আমাকে শাসিয়ে রেখেছে, এ বারের ইলেকশনের পরেই, ও আমাকেও কারখানা থেকে হটাবে।

নির্মলও কারখানায় চাকরি করত। গৌর সেনের কাছে, যে কারখানায় আমি চাকরির উমেদারি করতে যেতাম, নির্মল সে কারখানারই একটা ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র সুপারভাইজার ছিল। গৌর সেন পিছনে না লাগলে, হয়তো অনেক আগেই চার্জম্যান হয়ে যেতে পারত। নির্মল আমাকে বলেছিল, দরখাস্ত দিয়ে রাখ, মিনিস্ট্রিটা ফর্ম হতে দে, তারপরেই আশা করি, ইন্টারভিউ পেয়ে যাবি। ইন্টারভিউ পাওয়া মানেই চাকরি।

এর পরে গৌর সেনের সেই বলরাম মিত্তিরকে মারার প্ল্যানটা নির্মলকে আমার বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি বলতে পারিনি। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, ঘটনাটা জানাজানি হলে, ঝামেলা বাড়বে ছাড়া কমবে না। অবিশ্যি নির্মল যে একেবারে কিছুই জানত না, তা না। ও আমাকে বলেছিল, গৌর সেন আর বলরাম মিত্তিরের সঙ্গে লিডারশিপ নিয়ে হিচ আছে। কিন্তু গৌর সেন যে বলরামকে মেরে হাসপাতালে পাঠাতে চেয়েছিল, তা জানত না।

নির্মলের কথামতো আমি দরখাস্ত করেছিলাম। মিনিস্ট্রি ফর্ম করেছিল। সারা দেশে একটা নতুন উত্তেজনা। আমি নির্মলের সঙ্গে, কারখানার সামনের মাঠে মিটিং-এ গিয়েছিলাম। সবসময়েই প্রায় নির্মলের সঙ্গে ঘুরতাম। সেই সময়েই, চাকরিটা তখনও হয়নি, পাড়ার বন্ধুরা আমাকে বলেছিল, দুদে, তোদের এত বড় বাড়িটা পড়ে আছে, আমরা এক দিন পিকনিক করব।

আমি তো দরজা খুলেই রেখেছিলাম। মায়ের মনে বাবাকে নিয়ে একটু ভয় থাকলেও রাজি হয়েছিল। বিনতিও মনে মনে খুশিই ছিল। অচেনা তো কেউ না। সবাই পাড়ার ছেলে। একটা রবিবারে সকাল থেকেই বাড়ির মধ্যে হই-হুঁল্লোড় লেগে গিয়েছিল। মেনু ছিল মাংস ভাত আর দই। চাদা দিয়েছিল সবাই, আমি ছাড়া। আমি কেবল বেকার বলে না, আমাদের বাড়িতেই পিকনিকটা হয়েছিল, আমাদের গায়ে গতরে খাটাই যথেষ্ট ছিল।

কিন্তু মেঘ জমছিল অন্য দিকে। সেটা আমি প্রথমে তেমন আন্দাজ করতে পারিনি। আমাদের বিশাল লম্বা থামওয়ালা বারান্দায়, বন্ধুরা এলোমেলো বসে গিয়েছিল। সারি সারি অনেকগুলো ঘরের মধ্যে একেবারে শেষের দিকে ছিল বড় একটা বাথরুম। টিউবওয়েল আর চৌবাচ্চা ছাড়াও, গায়েই ছিল। পায়খানা। আবার বাইরের দিকেও একটা পায়খানা আর ছোট চৌবাচ্চা ছিল। দুটো রান্নাঘর ছিল, দোতলার সিঁড়ির পাশেই, পাশাপাশি। আসলে, জ্যাঠামশাইয়ের পরামর্শে ঠাকুরদা ঘর দুটো পাশাপাশি করেছিলেন, একটা রান্না ঘর আর একটা খাবার ঘর হিসাবে। তা ছাড়াও, বাগানের দিকে, বাথরুমের বিপরীতে, আর একটি ঘর ছিল। বিশেষভাবে পেঁয়াজ রসুন দিয়ে কিছু রান্না হলে, সেখানে হত। অবিশ্যি সে সব নিয়ম করতে হয়েছিল, ঠাকুরদা আর ঠামার আমলে। তাঁরা কেউ পেঁয়াজ রসুন খেতেন না। কিন্তু মাংস খেতেন, আর সে মাংসে পেঁয়াজ রসুন চলত না। বরং মাংসে একটু হিং দেওয়া চলত। বসিরহাটে দাদুর কাছে থেকে, আমিও সেই রকম খেতে শিখেছিলাম। আমার ভালই লাগত, এখনও লাগে। অনেকে জানে না, পেঁয়াজ রসুন ছাড়াও মাংসের আর একটা স্বাদ আছে।

অবিশ্যি আমার বন্ধুরা লম্বা বারান্দার এখানে ওখানে পেঁয়াজ রসুন ছাড়াতে বসে গিয়েছিল। কেউ কেউ কলাপাতায় মাংস বাছাবাছি করছিল। বিনতি মাটির ভাঁড়ে চা আর কলাপাতায় তেল দিয়ে মুড়ি পরিবেশন করছিল। মা ছিল রান্নাঘরের মধ্যে। সকাল বোধ হয় তখন প্রায় বেলা সাড়ে দশটা। হঠাৎ বাইরের ঘর থেকে বাবা বেরিয়ে এসেছিল। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ভীষণ ফুসছিল। আমার দিকে তাকিয়েই প্রথম চিৎকার করে উঠেছিল, কী হচ্ছে এ সব অ্যাঁ? এটা বাড়ি, না ভেটেরখানা?

আমরা সবাই সেই আচমকা চিৎকারে চমকিয়ে গিয়েছিলাম। যারা যারা সিগারেট টানছিল, তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলেছিল। আমি সিঁড়ির এক ধাপ ওপরে উঠে বসেছিলাম। বিনতি দৌড়ে রান্নাঘরে মায়ের কাছে চলে গিয়েছিল। দেখেছিলাম, বন্ধুরা বাবার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সব আমার দিকে তাকিয়েছিল। প্রথমটা ভেবেছিলাম, আমিও সমানে চিৎকার করে উঠব। কিন্তু তা না করে, সিঁড়িতে বসেই মুখ বাড়িয়ে বলেছিলাম, কেন, কী হয়েছে?

এর পরে কি বলতে হবে নাকি, কী হয়েছে?’ লুঙ্গির ওপরে, গেঞ্জি পরা বাবার বুকটা যেন ফুলে উঠেছিল, এটা কি বাড়ি,না বাগানবাড়ি?

অপরাধটা আমরা কী করেছিলাম, বুঝতে পারিনি। আসলে পার্টির ছেলেরা ছিল বলেই বাবার রাগ। রাগ তো আমার মনেও পোষা ছিল। তার পিছনে কারণ ছিল হাজারটা। কিন্তু বাগানবাড়ি বলাতেই, আমার রাগটা দপ করে জ্বলে উঠেছিল। বাগানবাড়ি বলার মধ্যে একটা খারাপ অর্থ ছিল, আর বাড়িটাকে যদি কেউ খারাপ করে থাকে, তা বাবাই করেছিল। আমি তবু ঠাণ্ডা ভাবেই বলেছিলাম, ভেটেরখানাও নয়, বাগানবাড়িও নয়। বাড়ি বাড়িই।

এ সব কি তারই প্রমাণ?’ বাবা আঙুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বলেছিল, নিজের মা বোনের সামনে এদের এনে বাড়িতে ফুর্তি করা হচ্ছে, একে কী বলে?

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, কেবল তুমি যা কর তা-ই ভাল, আর সব খারাপ, না? আমরা যা করছি, বেশ করছি। আমার মা বোন কেউ এদের কাছে অচেনা নয়, সবাই পাড়ার ছেলে। কেউ বিলেত থেকে আসেনি।

ও সব কথা আমি শুনতে চাইনে। বাবা হাঁকাড় দিয়ে উঠেছিল, এখুনি এখান থেকে এ সব গুটিয়ে নিতে হবে।’

আমার মাথায় আগুন জ্বলছিল, কিছু গুটিয়ে নেওয়া হবে না। বরং তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, এদের কারও সম্পর্কে আর একটিও বাজে কথা বোলো না। যা করছ নিজের ঘরে গিয়ে করো।

নির্মল বলেছিল, ত্রিলোচনকাকা, রাগ করে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন? কাকিমা আর বিনতিতো আমাদের মা বোন।

তোমার সঙ্গে আমি কোনও কথাই বলতে চাই না। বাবা ধমক দিয়ে বলেছিল, আমার বাড়িতে আমি এ সব পছন্দ করি না, তোমাদের খাবার-দাবার নিয়ে যেখানে খুশি যেতে পারো, যেখানে খুশি গিয়ে চড়ুইভাতি করতে পারো, কিন্তু এ বাড়িতে আমি তোমাদের অ্যালাও করব না।

আমি ঝেঁজে উঠে বলেছিলাম, তুমি অ্যালাও করবার কে? আমি ওদের ডেকে এনেছি, আমরা এখানেই রান্না করব, খাব দাব।

তোমরা তা হলে যাবে না?’ বাবা যেন রুখে উঠে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছিল।

আমি বলেছিলাম, ওদের কেন বলছ? যা বলবার আমাকে বলো। আর তোমাকে যা বলার, তাও আমি বলে দিয়েছি।

আমার কথা শেষ হবার আগেই, পঞ্চানন নামে একটি ছেলে বলে উঠেছিল, ত্রিলোচনকাকা, আপনার প্লাস্টিক ব্যাগের কারখানায়, আমাদের দু-একটা বেকার ছেলেকে কাজ দেবেন?

বাবা কিছু বলে ওঠবার আগেই, কেউ কেউ হেসে উঠেছিল। বাবার বড় বড় চোখ দুটো রক্তপলাশের মতো হয়ে উঠেছিল। চেহারাটা তো সত্যি সুন্দর, সুপুরুষ যাকে বলে। মনে হয়েছিল, চোখের সঙ্গে গোটা মুখ আর শরীরটাই লাল হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, আমার বাড়িতে বসে আমাকে অপমান? একি যুক্তফ্রন্টের জেতার র‍্যালা হচ্ছে?

ছি ছি ত্রিলোচনকাকা, যুক্তফ্রন্টকে এর মধ্যে টানছেন কেন?’ নির্মল বলেছিল, ইলেকশনের সময় আপনিই বরং আমাদের কুৎসা করেছেন। আপনি জুয়াড়ি মাতাল লম্পট, কিছু বলতে বাকি রাখেননি, সব খবরই আমরা পেয়েছি, আমরা কিন্তু আপনার নামে কিছু বলিনি।

বাবা এতই ক্ষেপে গিয়েছিল, নির্মলের মুখের ওপরেই বলেছিল, কেন, মিথ্যে কিছু বলেছি নাকি? তোমরা কি সব ধোয়া তুলসী পাতা?

প্রমাণ করতে পারবেন?’ নির্মল বসে ছিল, উঠে দাঁড়িয়েছিল, কবে কোথায় আমাকে মাতলামি বদমাইশি করতে দেখেছেন, বলুন, আমি এখুনি নাক কান মুলে এখান থেকে বেরিয়ে যাব।

বাবা বলেছিল, তোমাকে দিয়ে তো আর সবার প্রমাণ হবে না। তোমাদের আমি চিনি। তা নইলে, তোমরা এ ভাবে আমার বাড়িতে ঢুকে, অসভ্যতা করতে পারতে না। নির্মল কিছু বলবার আগেই, পঞ্চানন আবার বলেছিল, তবে আমাদের মতন বেকার ছেলেদের কথা মনে রাখবেন দাদা। খালি মেয়েদেরই মনে রাখবেন না।

আবার কেউ কেউ হেসে উঠেছিল। পঞ্চাননের ভালমানুষের মতো বলার মধ্যে এমন একটা ভঙ্গি ছিল, হাসি পাওয়াই স্বাভাবিক। আমি আমার কর্তব্য মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম। নির্মলকে অপমান করা, আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না। বলেছিলাম, শোনো, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাকে যা খুশি বলা চলবে না। নিজের মান বাঁচাতে চাও তো, ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে থাকো।

না, ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকব না, আমি এখুনি থানায় যাব।’ বাবা চিৎকার করে বলে, পিছন ফিরেছিল।

আমি বলেছিলাম, তুমি যেখানে খুশি যেতে পারো, কোনও আপত্তি নেই। এ বাড়িতে কার কতখানি অধিকার, আমিও জানি। আর শুনে যাও, আজ থেকে, তোমার ওইসব মেয়েদের বাড়ির ভেতর ঢোকা চলবে না।

তার মানে?’ বাবা বোঁ করে পাক খেয়ে, আমার দিকে তাকিয়েছিল।

আমি বলেছিলাম, তার মানে, আমি আজ থেকেই নীচের বাথরুম পায়খানায় তালা ঝুলিয়ে দেব। এ বাড়ির ভেতরটা তোমার কারখানার ওইসব মেয়েদের পায়খানা পেচ্ছাব করার জায়গা না। তবে, তোমাকে ঢুকতে দেওয়া হবে।

আমি বাবার মুখ দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম, সে আশা করতে পারেনি, আমি ওই রকম একটা কথা বলব। বাবা আর একটা কথাও বলতে পারেনি, কেবল অসহ্য রাগে, গোটা শরীরটা কাঁপছিল। বড় বড় লাল চোখের আগুনে আমাকে ভস্ম করতে পারলে, তা-ই করত, কিন্তু কিছু না বলে, ঘাড়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাইরের ঘরে ঢুকে জোর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল।

অনাথদা এগিয়ে এসেছিল আমার কাছে। সেও আমাদের সঙ্গেই ছিল। গলা নামিয়ে বলেছিল, এই দুদে, কাকিমা আর বিনতিরান্নাঘরে বসে কাঁদছে।

আমি ফিরতে গিয়ে দেখেছিলাম, সবাই চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে আছে। আমি বলেছিলাম, তোদের আবার কী হল, সবাই হাত গুটিয়ে চুপ করে বসে আছিস কেন?

কেমন যেন সব ছানা কেটে গেল দুদেদা। পঞ্চানন বলেছিল। ও আমার থেকে বয়সে ছোট।

 আমি বলেছিলাম, আরে দূর, ছানাকাটার নিকুচি করেছে। আমরা কি কোনও অন্যায় করেছি?

 তা অবিশ্যি ঠিক, আমরা অন্যায় কিছু করিনি। নির্মল বলেছিল, ত্রিলোচনকাকা মিছিমিছি আমাদের অপমান করে গেলেন।

বলেছিলাম, তার জন্যে আমাকে দোষ দিসনে, দেখলি তো, আমার যা বলার, তাই বলে দিলাম। নে নে, তোরা নিজেদের কাজ কর, বেলা হয়ে যাচ্ছে। খেতে খেতে তিনটে বেজে যাবে।’

দুদে ঠিকই বলেছে। নকুল বলেছিল, ও আমাদের জন্য ফাইট করেছে। ত্রিলোচনকাকার কথা আমরা মানি না। আমরা তো দুদের কাছে এসেছি।

সবাই হইহই করে উঠেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ত্রিলোচনকাকার কথায় গুলি মারো।

আমি রান্নাঘরে গিয়ে দেখেছিলাম, মা পিছনের বাগানের দিকের একটা খোলা জানালার কাছে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার বন্ধুরা যেখানে বসেছিল, রান্নাঘরটা তার থেকে কয়েক হাত দূরে। বিনতি বসেছিল উনোনের কাছে। ওর সামনে হামানদিস্তা। বোধ হয় মাংসের গরমমশলা কুটছিল। ও ভেজা চোখে মুখ নিচু করে বসে ছিল। আমি ঢুকতেই মুখ তুলে দেখেছিল, আর তাড়াতাড়ি আবার মুখটা নামিয়ে নিয়েছিল। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ডেকেছিলাম, মা।

মা তাড়াতাড়ি আঁচল টেনে চোখ মুছেছিল, আমার দিকে তাকায়নি। আমি মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কেন মিছিমিছি কঁদছ? আমার কোনও দোষ আছে, বলো?

তোর দোষ নেই, আমারই দোষ। মা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভেজা ভেজা স্বরে বলেছিল। আমি বলেছিলম, তোমারই বা কী দোষ? আমাদের কারোরই কোনও দোষ নেই। বিনা মেঘে বজ্রপাত, এ যেন তা-ই। তুমিই বলো, বাড়িতে সবাই মিলে বেঁধে খাব, ফাঁকা বাড়ি, থাকার মধ্যে তুমি আর বিনতিরয়েছ। কেউ অচেনা ছেলে নয়। সবাই তোমাদের চেনা পাড়ার ছেলে। তুমি আর বিনতিসঙ্গে থাকবে, তাতেই ওদের আনন্দ। আর বাবা যা মুখে এল, তাই বলে গেল!

ওকে তো চিনিসই। আমার আর এ সব ভাল লাগে না। মা বলেছিল।

আমি রুক্ষ গলায় বলেছিলাম, ওকে তো আমি ভালই চিনি, তা বলে এ বাড়িতে আমি বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এক দিন একটু আনন্দ করতে পারব না? তুমি বলো তো, তোমার কি ভাল লাগেনি?’

ভাল লাগলে কী হবে? ভাল লাগতে দিচ্ছে কে? বিনতিবলে উঠেছিল, এখন আমার মনে হচ্ছে, আগেই বাবার পারমিশন নিয়ে রাখলে হত।

আমি সত্যি বলতে কী খেঁকিয়ে উঠেছিলাম, তুই রাখ দিকিনি। পারমিশন! কীসের পারমিশন, কার পারমিশন। বাড়িতে কয়েকজন বন্ধু সহ নিজেরা বেঁধে খাব, তার জন্য পারমিশন নিতে হবে?

তা নইলে এ সব বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। বিনতি বলেছিল।

আমি বলেছিলাম, হয় হবে। তা বলে, এই সামান্য ব্যাপারে, আমি পারমিশন নিতে পারব না। আর নেবই বা কেন?

মা বলেছিল, কিন্তু এখন যদি সত্যি সত্যি বাড়িতে পুলিশ ডেকে আনে?

আমি হা হা করে হেসে উঠেছিলাম, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে মা? নিজের ও-কে আজও চিনলে না? স্রেফ আওয়াজ, বুঝলে স্রেফ আওয়াজ। এই নিয়ে থানায় গেলে থানার দারোগা ভাববে লোটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পাড়ার মধ্যে এই দিনের বেলা আমরা পিকনিক করছি, পুলিশকে কী নালিশটা করবে? তা ছাড়া এখানে যারা আছে, তাদের নাম শুনলে পুলিশ এমনিতেই আসবে না। থানা পুলিশ এখন এদেরই হাতে।

কিন্তু সেজদা, তুই কি সত্যি সত্যি নীচের বাথরুম পাইখানায় তালা ঝুলিয়ে দিবি?’ বিনতিওর বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল।

আমি সেই সময়ে ওই কথার কোনও জবাব দিতে চাইনি। এড়িয়ে যাবার জন্যই বলেছিলাম, ও কথা নিয়ে এখন ভাববার কী আছে। তোর আর মায়ের তো কোনও ভাবনা নেই। তোরা ওপরেও যেতে পারবি।

বিনতি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। কেন, তাও জানতাম। ও মায়ের মনের কথাটা জানতে চেয়েছিল। মা বিনতির দিকে তাকায়নি, বলেছিল, বারে বারে ওপর নীচ করে মরতে হবে নাকি?

দরকার নেই। আমি বলেছিলাম, চাবি তোমাদের কাছেই থাকবে, তোমরা যখন খুশি নীচের বাথরুমেই যাবে।

বিনতিবলেছিল, আর বাবা?

বাবা, কী?’আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

 বিনতিজিজ্ঞেস করেছিল, বাবার দরকার হলে কি আমাদের কাছ থেকে চাবি চেয়ে নেবে?

তাই নিতে হবে। আমি স্পষ্ট জবাব দিয়েছিলাম।

কিন্তু সেজদা, কাজটা ভাল হবে না। বিনতিবলেছিল, তোর কথা শুনে আমার এখনই ভয় লাগছে।

আমার বোনেদের কাছে আমি সেজদা। জ্যাঠামশাইয়ের দুই ছেলে বড়দা আর মেজদা। আমার কাছেও তারা বড়দা আর মেজদা। আমি প্রথম থেকেই বিনতির কথার জবাব এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। সব কিছুরই একটা সময় আছে। বাড়ির মধ্যে তখন একটা হই-হুঁল্লোড় গল্প হাসি চলছিল। পিকনিকের আয়োজন চলছিল, আর একটু আগেই বাবার সঙ্গে ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল। তবু আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, আমি তিন মাস ধরেই কথাটা ভাবছিলাম। ভেবে দ্যাখ, তোর পড়াশোনার খরচার জন্য ছোট পিসিমা এখনও পঞ্চাশ টাকা করে দেয়। তোর আর মায়ের খরচের জন্য বাবা রোজ মাত্র দুটো করে টাকা দেয়, যেন ভিক্ষে দেবার মতো। ভালই জানিস, আমি ওতে ভাগ বসাই নে। আমারটা আমি যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করি, যা পারি মায়ের হাতে তুলে দিই। এতে কোনও সংসার চলতে পারে? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম, তোর আমার মায়ের মাসে ষাট টাকায় চলতে পারে? বাবার একলার চলে? বাবার কী খরচ হচ্ছে না হচ্ছে, ওখানে কী রান্না হচ্ছে না হচ্ছে, কিছুই আমার চোখ এড়ায় না। রোজ সকালে কারখানার একটা মেয়ের হাত দিয়ে দুটো করে টাকা পাঠাতে লজ্জা। করে না? তাও নিজের বউ মেয়েকে? সর্বস্ব তো খেয়ে বসে আছে, উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই তিন মাস আগে আমি বাবাকে বলেছিলাম, মা আর বিতির জন্য তুমি দৈনিক আর একটা করে টাকা বাড়িয়ে দাও। তার জবাবে আমাকে কী বলেছিল জানিস? বলেছিল, ও সব পো-র নামে পোয়াতি বর্তানো আমি ভালই জানি, আমি আর এক পয়সাও বাড়তি দিতে পারব না। তার মানে আমাকে সোজা শুনিয়ে দিয়েছিল, তোর আর মায়ের নাম করে, আমি আমার জন্য এক টাকা বাড়াতে বলেছিলাম। আরও অনেক কথাই হয়েছিল, সে সব বলে কোনও লাভ নেই। আমি তখন থেকেই ভেবে রেখেছিলাম একটা শিক্ষা না দিলে হবে না। আর ভয়ের কথা বলছিস? তুই আর মা ভয় পেতে পারিস, বাবা তোদের জুজুর ভয় দেখিয়ে রেখেছে। আমার ও সব নেই। আমিও বাবাকে দেখে নেব।

অনেকগুলো কথা বলে, আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী, কথাগুলো বলতে বলতে আমি মায়ের মুখের দিকে মাঝে মাঝে দেখেছিলাম। আসলে মাকে নিয়েই আমার ভাবনা ছিল। মা যে কী ভয়ংকর রকম উলটো-পালটা কাজ করতে পারে, তার প্রমাণ পেয়েছিলাম, এক বছর আগেই। বিশেষ করে বাবার ব্যাপারে। কিন্তু রান্নাঘরে কথা বলার সময় দেখেছিলাম, মা পরিপাটি করে বড় উনোনটা ছুঁটে দিয়ে সাজাচ্ছে। ঠোঁট দুটো টেপা ছিল, কারণ মুখে পান ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, আমি যা করতে চেয়েছিলাম, মায়ের তাতে আপত্তি নেই। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে মায়ের ভুরু কুঁচকে উঠছিল, আর হঠাৎ হঠাৎ নিশ্বাস পড়ছিল। তার কারণ, মা অশান্তির ভয় পাচ্ছিল। সেটা স্বাভাবিক। লোকে শুনলে খুব খারাপ ভাবতে পারে। কিন্তু প্ল্যানটা আমি ঠিকই। নিয়েছিলাম। পাড়ার লোকেরা আর আমার বন্ধুরা খুব মজা পেয়েছিল, তাও জানি। কিন্তু আমাদের পিকনিক মিটে যাবার পরে, বিকাল চারটেয়, আমি নীচের তিনটি বাথরুম আর পায়খানার দরজায় তালা লাগিয়ে মায়ের হাতে চাবি দিয়ে বলেছিলাম, মা, দোহাই, এক বারের জন্য আমার কথা রাখো। একটু শক্ত হও। বাবার দরকার ছাড়া, ওই মেয়েগুলোকে তুমি চাবি দেবে না।

কিন্তু তোর বাবা যদি নিজের নাম করে চাবি নিয়ে মেয়েগুলোকে ঢোকায়? মা জিজ্ঞেস করেছিল।

আমি বলেছিলাম, তখন আমি দেখব।

আর একটা কথা, পিকনিকের দিন বাবা সত্যি বেলা বারোটা নাগাদ থানার সাব-ইন্সপেক্টরকে ডেকে এনেছিল। নির্মল, অনাথদা, পঞ্চানন, নকুল সবাইকে দেখে লোকটা একেবারে থ হয়ে গিয়েছিল। সবাইকেই হেসে হেসে কপালে হাত ঠুকে নমস্কার করে বাবাকে বলেছিল: ছি ছি ছি, এদের সম্পর্কে আপনি গিয়ে বললেন, পাড়ার কতগুলো গুণ্ডা মস্তান আপনার বাড়িতে ঢুকে হই হুল্লোড় করছে? এরা তো সবাই আমাদের চেনা। সবাই ভদ্রলোক, পাটি করেন।

সাব-ইনস্পেক্টর বাইরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। বাবা তাকে বলেছিল, মশাই, আপনিই তো ছ মাস আগে আমাকে বলেছেন, এ পাড়ার মস্তানগুলোকে সব ঠাণ্ডা করতে হবে। এরা ছাড়া আবার পাড়ার মস্তান কোথায়?

সাব-ইন্সপেক্টরের মুখটা বেশ শক্ত হয়ে উঠেছিল, বলেছিল, দেখুন ত্রিলোচনবাবু, এ সব নিয়ে আপনার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাইনে। আমার মনেই পড়ছে না, এদের সম্পর্কে আমি আবার আপনাকে কবে ও সব কথা বলতে গেছি। হতে পারে, এদের অ্যান্টি পার্টির লোকেরা কেউ কিছু বলেছিল। আপনি সেটাই আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন।

আহ্, সত্যি, ত্রিলোচন চট্টোপাধ্যায়ের মুখোনি দেখবার মতো হয়েছিল, মাইরি। আসলে আমি বুঝতে পারছিলাম সাব-ইনস্পেক্টর লোকটা মিথ্যা কথা বলছে। বাবাই বরং সত্যি কথা বলছিল। কিন্তু জলধরা যা-ই বলুন, একে ভেলকিই বলে। রাজনীতির ভেলকি। রাতারাতি পুলিশও ভোল পালটে ফেলেছিল। ওই সাব-ইনস্পেক্টরকে আমি কত দিন একই জিপ গাড়িতে গৌর সেনের সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখেছি। কী অসম্ভব দাপটে লোকটা আমাদের পাড়ার এলাকায় একটা বড় লাঠি নিয়ে লাল চোখ করে ঠ্যাঙাড়ের মতো ঘুরে বেড়াত। সেই লোকইনকুল নির্মলকে দেখে একেবারে ভিন্ন মানুষ হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের রোলটা কি তা হলে এ রকম নাকি, যখন যাহার কাছে থাকি/ তখন তাহার মন। রাখি। অর্থাৎ সেই রূপকথার মতো, গাছ এখন তুমি কার? জবাব যে আমার তলায় বসে, তার।তার মানে, যারা যখন পাওয়ারে, পুলিশ তখন তাদের সেবক।

সাব-ইনস্পেক্টরের কথা শুনে, আমরা সবাই হেসে উঠেছিলাম আর সে আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে প্রায় হাত জোড় করে বলেছিল, কিছু মনে করবেন না, বুঝতেই পারছি আপনারা বন্ধুবান্ধবরা পিকনিক-টিকনিক করছেন।

কে একজন বলে উঠেছিল, আপনিও আমাদের সঙ্গে খেয়ে যান না।

তা হলে তো খুবই ভাল হত। সাব-ইনস্পেক্টর বলেছিল, বড়বাবুকে গিয়ে খবরটা দিতে হবে। কারণ ওঁর সামনেই ত্রিলোচনবাবু গিয়ে এমনভাবে রিপোর্ট করেছেন, তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, ব্যাপার-স্যাপার দেখতে। শুনলে হাসবেন। আচ্ছা, চলি নকুলবাবু নির্মলবাবু। কমলবাবু চলি।

বাইরের লোকেরা আমাকে কমল নামেই ডাকে। স্বর্ণকমলের সংক্ষিপ্ত, কমল। সাব-ইন্সপেক্টর ফিরে দাঁড়াতেই বাবা বলে উঠেছিল, আর বাথরুম পাইখানায় তালা ঝোলাবার কথাটা যে আপনাকে বললাম? তার কী হল?

ও সব মশাই আপনাদের ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার, এখানে এখন আমার কিছু বলার নেই। সাব-ইন্সপেক্টর বলেছিল, আপনি আইন মোতাবেক থানায় ডায়রি করুন, তারপরে তদন্ত করে দেখা যাবে। মুখের কথায় এ সব হয় না। বেশ রুষ্ট স্বরেই কথাগুলো বলতে বলতে, সে বাইরের ঘরের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছিল।

আমার বন্ধুরা আবার সবাই হেসে উঠেছিল। অনেকে অনেক কিছু বলেছিল। আর আমি মনে মনে কেবল খুশি না, রীতিমতো শক্তি পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, একলা আমার না, বাবার ভাবনা চিন্তা আশাগুলোও তা হলে কখনও কখনও আচমকা মার খাওয়া পাগলা ঘোড়ার দলের মতো দৌড়ে কোথায় পিছলে ছুটে চলে যায়।

বিকাল চারটার সময় নীচের বাথরুম পাইখানাগুলোতে চাবি লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কেমন করে যে এমন একটা ব্যাপার আমার মাথায় এসেছিল, জানি না। কিন্তু কাজ দিয়েছিল দারুণ! বাবা বাড়ির ভিতরে আসেনি। পাশেই আমাদের আর একটা বাড়ি ছিল। আমাদের বাড়ি মানে ঠাকুরদার আর এক ভাইয়ের বাড়ি। জ্ঞাতির থেকেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সে বাড়িও খুব ছোটখাটো না। বাবা বাথরুম সারবার জন্য সেই বাড়িতে যেতে আরম্ভ করেছিল। আর তার কারখানার মেয়েরা বাড়ির বাইরে, পুকুরের আশেপাশে, আমাদের অনেকখানি ছড়ানো ছিটানো বাগানে বাদাড়ে যেতে আরম্ভ করেছিল।

আমাদের বাড়ির ভিতরে দক্ষিণের বড় বাগানে বারান্দার নীচেই ছিল একটি টিউবওয়েল। খাবার জন্য সেই টিউবওয়েলের জলই ব্যবহার করা হত। বাইরের ঘর থেকে মেয়েরা সারা দিনই সেই টিউবওয়েল থেকে জল নিত। কিন্তু ওই ঘটনার পরে ওরা বাড়ির ভিতরে আসাই বন্ধ করেছিল, ফলে রাস্তার কল থেকে এদের জল আনতে হত। পাশের বাড়ির এক কাকা আমাকে ডেকে বলেছিল, দুদে, ব্যাপারটা বড় খারাপ দেখাচ্ছে। নদাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে না দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।

পাশের বাড়ির কাকারা সবাই বাবাকে ন’ দাদা বলে ডাকত। এ সব হিসাব-টিসাব আমি ঠিক জানি না। কে ন’দা, কে ফুলদা, কে রাঙাদা, আর কেনই বা, কিছুই ধরতে পারতাম না। বলেছিলাম, আমি তো বাবাকে বাড়ির ভেতর যাওয়া বন্ধ করিনি। বাবার জন্য সবই ভোলা আছে। কেবল ওই মেয়েগুলোকে আমি বাড়ি ঢোকা বন্ধ করেছি। তোমরাই বলো আমি কি অন্যায় করেছি? তোমরা কি চাও ওই মেয়েগুলো বাড়ির ভেতর ঢুকে নিজেদের ইচ্ছেমতো সব ঘর দরজা ব্যবহার করুক?

কাকা চুপ করে ছিল, কোনও জবাব দিতে পারেনি। আমি জানতাম আমাদের আত্মীয় জ্ঞাতিরা কেউই বাবার কার্যকলাপ মেনে নিতে পারেনি। তবু কাকা ঢোক গিলে বলেছিল, কিন্তু ন’দা যে রকম বলে তাতে মনে হয়, সে বাড়িতে ঢুকলে তুই নাকি অপমান করবি। এমনকী মারধোরও নাকি করতে পারিস।

আমি হেসে বলেছিলাম, তোমরা যদি তোমাদের নদার কথা বিশ্বাস কর, তা হলে আমার বলার কিছু নেই। নেহাত আমি বড় হয়েছি, আর চেহারাটাও ছোটখাটো নয়, নইলে বাবা আমাকেই পিটিয়ে আজ বাড়ি থেকে বের করে দিত। তবে জেনে রেখো আমি আগে পা বাড়িয়ে বাবাকে কোনও দিনই অপমান করিনি, করবও না। মায়ের কথা তো আসেই না। তা ছাড়া ওই মেয়েগুলোর জন্য বাবার এত জ্বালাই বা কীসের, ওদের জন্য নিজেও বাড়ির ভেতর আসা বন্ধ করে দিয়েছে? আমার সাফ কথা, ওই মেয়েগুলোকে আমি আর কোনও দিন বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেব না। কাকা আর কিছু বলেনি, কারণ তার আর কিছু বলার ছিল না। অবিশ্যি আমি জানতাম, বাবা নিতান্ত চুপচাপ বসেছিল না। নিশ্চয়ই কোনও মতলব আঁটছিল। কিন্তু আমার সময়টা ভালই যাচ্ছিল। পিকনিকের সাত দিন পরেই আমি নির্মলের ডিপার্টমেন্টেই একটা চাকরি পেয়েছিলাম। তার মানে, আমার আশা ভাবনা চিন্তাগুলো ওই সময়ে শান্ত ঘোড়ার দলের মতো যেন মাথা নামিয়ে সুখে জল খাচ্ছিল। তার সবথেকে বড় আর একটা কারণ, খুকু। নাম যার জ্যোৎস্না। জোড়াদিঘি পাড়ার জ্যোৎস্না। আমি সেই সময়ে আমার সারা প্রাণ মন ভরে, জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হচ্ছিলাম। আর চাকরিটা পাওয়ায়…