১. ফাতনার দিকে চোখ রেখে

ফাতনার দিকে চোখ রেখে নিজের বয়সের হিসাব কষছি। কোনও মানে হয়? নিজের বয়স কি আমার জানা নেই? বিয়াল্লিশ বছর তিন মাস চলেছে। রুমা চলে গিয়েছে, কত বছর হল?

রুমা অবিশ্যি ওর নাম না। নাম ছিল–ডাক নাম, ওদের বাঙাল ভাষায় খুকি। ওর মাকে খুকি’ বলে। ডাকতেও শুনেছি। আমাদের ঘটিদের ঘরে হলে খুকিই খুকু হয়ে যায়। সব ঘটিদের ঘরেই না, কারণ খুকু নামটা এখন ফ্যাশানে দাঁড়িয়েছে। খুকু নামটা ঘটি বাঙালের ব্যাপার না, শুনলে এক দিকে যেমন আদুরে মনে হয়, অন্য দিকে তেমনি স্মার্ট। আমার ঠাকমা তো, তাঁর বড় মেয়ে–মানে, আমার বড় পিসিকে খুকি বলেই ডাকতেন। ঘটি হলেই যে খুকিকে খুকু ডাকে, তার কোনও মানে নেই। তবে। খুকিকে কুকি’ বলে ডাকা, একেবারে বাঙাল ছাপ মারা। আমিও ওকে খুকু বলেই ডাকতাম। আসলে। ওর ভাল নাম ছিল জ্যোছনা। ঠিক ঠিক উচ্চারণ করলে জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না মজুমদার। ঢাকা জেলার বদ্যি। প্রথম যখন ওদের মজুমদার পদবি শুনেছিলাম, তখন ধরেই নিয়েছিলাম, ওরা ব্রাহ্মণ। ধরে নেবার আরও একটা কারণ, ওর বাবার গলায় পৈতা দেখেছিলাম। আমি তো মস্ত পণ্ডিত। দাশগুপ্ত, সেনগুপ্ত, বড় জোর গুপ্ত বা সেন শুনলেই বদ্যি মনে করতাম। পরে তো শুনেছি, সেন কায়স্থও হয়। আর বদ্যি? রায়, চৌধুরি, শর্মা, মজুমদার, তরফদার, তোপদার, এমনকী মল্লিকও নাকি বদ্যি হতে পারে। আর আমার ধারণা ছিল, ও সব ব্রাহ্মণদেরই পদবি হতে পারে। পদবি নয়, নবাবি খেতাব।

এ সবের কোনও ধারণাই আমার ছিল না। থাকবে কী করে? নামকাওয়াস্তে, কোনও রকমে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিলাম। কী করে পাশ করেছিলাম, নিজের বলা দূরের কথা, খোদ সরস্বতী ঠাকরুনও বলতে পারবেন না। আসলে ওটুকুও হবার কথা ছিল না। বাছুর যেমন গাইদের বাটে মুখ রেখে বেড়ায়, আমি তেমনি আমার দাদামশাইয়ের কোঁচার খুঁট পাকিয়ে মুখে দিয়ে বেড়াতাম। সত্যি সত্যি দাদামশাইয়ের কোঁচার খুঁট পাকিয়ে মুখে দিতাম। অবিশ্যি সাদাসিধে ব্রাহ্মণ মানুষটির আট হাত ধুতির কোঁচা কখনওই মাটিতে লুটাত না, ধুলাও লাগত না।

আমি আমাদের এ বাড়িতে মানুষ হইনি। মানুষ বলতে, সাবালক হওয়া। আজকাল অবিশ্যি সাবালক বলতে অন্য রকম বোঝায়। বয়স হলেই সাবালক বোঝায় না। সাবালকের মতো জ্ঞান বুদ্ধি থাকা দরকার। এ সব হালে বুঝতে শিখেছি, সেই হিসাবে আমাকে সাবালক বলা যাবে কিনা জানি না। কারণ, আমাকে বাড়িতে সবসময়েই শুনতে হয়, আমার আর বোধবুদ্ধি কোনও কালে হবে না।

কথাটা এক এক সময়ে আমি নিজেও বিশ্বাস করি। কেননা, আমার নিজের এই বিয়াল্লিশ বছর তিন মাসের জীবনটাই তার প্রমাণ। নিজের ভাগ্যকে দোষ দেব, না কি বাবা মাকে দোষ দেব, অথবা সমাজকে দোষ দেব, ভেবে পাইনা। আমি যে একটি নিরেট অপদার্থ, এটা প্রায় সব দিক থেকেই প্রমাণ। হতে বসেছে। বাবার রাগ, বন্ধুদের হাসাহাসি, আর যাদের মন একটু নরম, আমাকে তাদের দয়ার চোখে দেখা। এ সবই আমি বুঝতে পারি। অপদার্থ হলে এ সব বোঝা যায় কি না, জানি না। যদিও নিজের সম্পর্কে ঠিক কোনও ধারণা নেই, তবু কোনও কোনও ব্যাপারে, আমি আবার এটাও বুঝতে পারি, আমি যথেষ্ট সেয়ানা, চালাক, ধূর্ত।

যাই হোক, এক এক সময় মনে হয়, আমাদের বাড়িতে মানুষ হলে, আমার জীবনটা হয়তো এ রকম হত না। বাবাও সে কথা মাঝে মধ্যে ঠেস মেরে বলেন, যা, বসিরহাটে দাদুর কাপড়ের খুঁট চোষ গিয়ে।

বাবা অবিশ্যি খুব খারাপ ভাবে কথাটা বলেন। যে কেউ শুনলেই, কথাটার কদৰ্থ বুঝতে পারে। কোনও বাবার কি ছেলেকে এ রকম কথা বলা উচিত? আমি যতই খারাপ ব্যবহার করি, বাবাকে যতই জ্বালাতন করি, বা হ্যাঁ, এক এক সময় অপমানও করি, তা বলে দাদুর খুঁট চোষ গিয়ে বলার মানেটা কী?

তবে হ্যাঁ, বসিরহাটের দাদুকে নিয়ে খোঁটা দেবার মধ্যে, বাবার কথায় হয়তো অনেকটা সত্যি আছে। বসিরহাট মানে, বাবার শ্বশুরবাড়ি, আমার মামার বাড়ি। আমার মা আর তাঁর এক দাদা ছাড়া দাদামশাইয়ের কোনও সন্তান ছিলনা। আমি ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি, মামা বরাবর বসিরহাট ছাড়া। বিয়ে করে সেই যে মামা এলাহাবাদে গিয়ে ঘরজামাই হয়েছিলেন, তারপর থেকে তিনি এ দেশে আসাই ছেড়ে দিয়েছেন। বোধ হয় নিজের বোনের বিয়ের সময় মানে, আমার মায়ের বিয়ের সময় এক বার এসেছিলেন, তারপরে আমার বছর দশেক বয়সের মধ্যে বার চারেক। আমার দশ বছর বয়সের পর তো আর মনেই করতে পারি না, মামাবাবুটিকে আর কখনও দেখেছি কি না। সেই যাকে বলে প্রবাসী বাঙালি, আমার মামাও তাই হয়ে গিয়েছিলেন। মামা যদি বসিরহাটের বাড়িতে থাকতেন, থেকে বিয়ে করনে, গুচ্ছের ছেলেমেয়ে হত তাহলে আমাকেআর দাদুর আট হাত ধুতির কেচার খুট মুখে গুঁজে বেড়াতে হত না। আমি যে দাদু দিদিমার বিশেষ আদুরে গোপাল নাতিটি ছিলাম, তার কারণ একটাই। দাদু দিদিমা,বুড়োবুড়ির সংসারে আর কেউ ছিলনা। অবিশ্যি আমার নিজের আর জ্যাঠতুতো ভাইবোন না থাকলে, আমাকে কি দাদামশাইয়ের কাছে থাকতে দেওয়া হত? ছিল বলেই দাদামশাই আমাকে পেয়েছিলেন।

হ্যাঁ, একে পাওয়া ছাড়া আর কী বলে। আর দাদামশাইয়ের পাওয়াটাকে আমি চুটিয়ে ভোগ করেছি। যখন যা চাই, এক বার মুখ খুললেই হল। হাত পাবার দরকার ছিল না। তবে সত্যি বলছি, এই যে পুকুরের উঁচু পাড়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে, ছিপ ফেলে বসে আছি, আশেপাশেনানা গাছপালা, এতক্ষণ এ সবেরই গন্ধ পাচ্ছিলাম। দাদামশাইয়ের কথা মনে হতেই তার গায়ের গন্ধ আমার নাকে লাগছে। তার ধুতির কোঁচার গন্ধও এখন আমার নাকে। দাদুর গায়ের গন্ধ, কাপড়ের গন্ধ, সবই আমার ভাল লাগত। এত ভাল লাগত, মাই চোষার মতোই আমি দাদুর কোঁচার শেষটা গুটিয়ে মুখে পুরে চুষতাম। এমনকী রাস্তা দিয়ে চলতে গেলেও। দাদুই হেসে, দ্যাখো, আমার বোকা নাতির কাণ্ড দ্যাখো’ বলে কোঁচার পাকানো ডগাটা আমার মুখ থেকে খুলে দিতেন, আর রাস্তার আশেপাশের লোকের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে হাসতেন।

এখনও বেশ মনে করতে পারি, দাদুর যজমানদের বাড়িতে পাওয়া জ্যালজেলে থানের কোঁচা চোষা, আমার নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এমন নেশা, এঁড়ে লাগা ছেলে যেন মায়ের মাই ছিঁড়েখুঁড়ে চিবিয়ে চুষতে চায়, প্রায় সেইরকম। একটাসস্তান পেট থেকে বেরোতেনা বেরোতেই মায়ের পেটে আর একটি এলে বাচ্চাদের এঁড়ে লাগা বলে। আসলে, মায়ের বুকে তখন দুধ থাকেনা, আর কেমন করে যে একটা শিও বুঝতে পারে, তার আর একা ভাগীদার মায়ের পেটে এসে গিয়েছে, অমনি তার প্রাণ হিংসায় জ্বলতে থাকে–এত হিংসা যে, হিংসার বশেই তার শরীর নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, হাত-পাগুলো রোগা আর লিকলিকে হয়ে যায়, চোখে রাগ আর দৃণা। আমার মনে হয়, মায়ের বুকের দুধ পেলে বোধ হয় এরকম হয়না। পায়নাবলেই রেগে ক্ষেপে যায়, আর বাচ্চাদেরকী সাইকোলজি জানিনা, ঠিক বুঝতে পারে, মায়ের পেটে কেউ এসেছে। মায়ের প্রব হওয়ার পরে তো কথাই নেই। আমার জ্যাঠতুতো বউদির বেলায় দেখেছি। দুটো বাচ্চাকে সামলানো যে মায়েরও কী কষ্ট, বউদির বেলায় দেখেছি। অবিশ্যি বড়টিকেই বেশি সামলে রাখতে হয়, কারণ মায়ের বুকের দুধের পুরোটুকুতেই তার দাবি। আর ছোট ভাইটিকে সুযোগ পেলেই আঁচড়ে কামড়িয়ে এমন হাল করত, যেন পরম শত্রুটাকে শেষ করতে পারলেই বাঁচে।

হিংসা ব্যাপারটার দেখছি, কোনও বয়স নেই। পেট থেকে পড়েই হিংসা। হিংসা মাকে নিয়ে, বউকে নিয়ে, বন্ধুকে নিয়ে, জমি পুকুর নিয়ে কীসেতে নেই। যাক গিয়ে, আমার অবিশ্যি ছেলেবেলায় এঁড়ে লাগেনি, আর আমার পরে যে বোন জন্মেছিল তাকে নিয়ে আমার কোনও হিংসাও ছিল না। মায়ের কাছেই শুনেছি। তবু কেন দাদুর সেই জ্যালজেলে থানের কোঁচা মুঠো পাকিয়ে চুষতাম? নেশা করার মতোই চুষতাম। বয়স তোতখন ছয়েরকম। এমন না, যে সবেমাত্র মায়ের কোল ছেড়ে গিয়েছিলাম। এখন ভাবলে অবিশ্যি হাসি পায়। এক রকমের বাচ্চাদের যেমন দেখা যায় বুড়ো আঙুল চোষে। বেশ বড় হয়েও চোষে। আমারও সেই রকম ছিল।

আমি বুঝতে পারতাম, কোঁচা চোষা ব্যাপারটা দাদুর খারাপ লাগত না। তিনি যেন একটু মাতৃসুলভ ভাবেই কোঁচাটা অনেক সময় ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলে, কিন্তু ঠিক ছাড়িয়ে নিতেন না। তবে রাস্তাঘাটে একটু অস্বস্তিতে পড়তেন। কেউ কেউ ঠাট্টাও করত, ভট্টাচার্যিমশায়ের নাতিটি দেখছি দাদামশায়ের বড্ড ন্যাওটা।.তা অবিশ্যিই ছিলাম। রাস্তায় বেরোলে খাবারের দোকানের সামনে দিয়ে কোনও দিনই খালি হাতে যাওয়া হত না। দোকানদার নিজেই ডেকে আমার হাতে খাবার তুলে দিত। সব্রাহ্মণ আর খাঁটি ভক্তিমান পণ্ডিত হিসাবে দাদুর বিশেষ সম্মান ছিল। নেহাত পুজুরি বামুন বলতে যেমনটি বোঝায়, তা না। এমন ছিল না,দাদু দশটা বাড়িতে পুজো করে বেড়াতেন। কিংবা যে কোনও পূজাপাটের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজো করতেন। নিজেদের বড়লোক যজমান বাড়িতে,বছরে একটাই দুর্গা পূজা করতে দেখেছি। বিয়ে শ্রাদ্ধ করাতেন বিশেষ বিশেষ বাড়িতে। তা ছাড়া দীক্ষা দিতেন। গরিব যজমান খুব কমই ছিল। থাকলে পাকা বড় একতলা বাড়ি, বাগান র, চাষের জমি, এ ব থাকত না। এমনকী, একটা ছোটখাটো ইটের ভাটাও ছিল। লোক দিয়ে সেটা চালাতেন।

ছেলেবেলা থেকেই আমি শুনে এসেছি দাদামশাইয়ের সব সম্পত্তি আমিই পাব। ছেলেবেলায় সম্পত্তির বিষয় তেমন ধারণা ছিল না। কিন্তু কথাটা সলে মনে একটা বেশ আনন্দ হত। দিদিমা লেখাপড়ার জন্য একটু চাপ দিতেন। দাদু বলতেন, সময়ে সব হবে। ছেলেমানুষ, নিজের মতন থাকুক, বেশি জোরাজুরি করার দরকার নেই।..দাদুর সে সব কথা আমার বেশ ভাল লাগত। ইস্কুলে যেতাম বটে, পড়াশোনায় আমার কোনও দিনই তেমন মন ছিল না। অথচ এমন না যে, বসিরহাটে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল বা আমি খেলাধুলায় মেতে থাকতাম। বরং ময়দার ডেলা পাকিয়ে, ছোট ছিপ নিয়ে, পুকুরে পুঁটি মাছ ধরতাম। আম জাম জামরুলের সময় গাছে গাছে থাকতাম। আশেপাশের বাড়ির যেকটা ছেলে আসত, নিতান্ত মরজি হলে তাদের সঙ্গে খেলা করতাম। সবথেকে দাদুর সঙ্গই আমার ভাল লাগত। তাঁর সঙ্গে ইছামতীর এপারে ওপারে যজমানদের বাড়ি যেতাম। কখনও কখনও, এমনকী কলকাতা বা আরও দক্ষিণে সুন্দরবনের হাতায়। আবাদেও দাদুর বাবা-ঠাকুরদার যজমান ছিল।

আমার দাদুর মনে মনে আশা ছিল, তাঁর বংশের যজমানদের আমিই হব কুলগুরু। কথাটা দাদু এক একসময় বললেও, এ সব তো ভাই পরে তোকেই করতে হবে।’…আমার নটা কেমন বেঁকে বসত। মুখে কিছু বলতামনা। কিন্তু যজমানিকরার কথা ভাবলেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যেত। কেন? আমাকে তো কেউ কিছু শিখিয়ে দেয়নি। যজমানের বাড়ি গেলে আদর যত্ন তো পাওয়া যেতই তার সঙ্গে কাপড় খাবার নগদ টাকাকড়ি, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা মোটেই খারাপ ছিল না। কিন্তু আমার মেজাজ বিগড়ে যেত। মনে মনে বললাম, আমার দ্বারা ও সব হবেনা।

ক্লাস এইটে পড়ার সময় দিদিমা হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন। হাতে পায়ে বেশ শক্তই ছিলেন। একটু বেশি মোটা ছিলেন, আর প্রায়ই মাথা ঘুরত। মাথা-ঘোরা রোগ ছাড়া দিদিমার আর কোনও রোগ দেখিনি। এখন ভাবলে মনে হয়, দিদিমাটি নিতান্তই বেরসিক ছিলেন। সেই মাথা ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ একদিন চিত্তির উলটেছিলেন। আমাকেও বসিরহাট ছাড়তে হয়েছিল। কারণ, দাদুকে কে দেখবে তারই ঠিক নেই, তার ওপরে আবার আমি।

আমার এখনও অবাক লাগে, একটি বুড়ি মারা যেতেই একটি বুড়ো মানুষেরও দুর্গতির অন্ত ছিলনা। কেন এমন হবে? এটা তো অবিচার। আমার মাকে দেখে একবারও মনে হয়নি তাঁর বাবার জন্য কোনও দুশ্চিন্তা আছে। দিদিমা মারা যাবার পরে বাবা মা গিয়েছিলেন। বাই আশা করেছিল, মামা এক বার নিশ্চয় আসবেন। দিদিমার মৃত্যু সংবাদের জবাবে এলাহাবাদ থেকে মামার ছেলে চিঠি লিখে জানিয়েছিল মামা নাকি একেবারেই অসুখে শয্যাগত। অতএব দাদুর নাতিরা এলাহাবাদের প্রয়াগেই শ্রদ্ধশান্তি মিটিয়ে নেবে।

সেই সময় বাবাকে একবার বলতে শুনেছিলাম, কত সম্পত্তি পেলে, নিজের বাপঠাকুরদারসম্পত্তি লোকে ছেড়ে দিতে পারে।..অর্থাৎ আমার ঘরজামাই মামা এতই সম্পত্তি পেয়েছিলেন বাপঠাকুরদার সম্পত্তির জন্য তাঁর ছেলেদেরও মাথাব্যথা ছিলনা, সেই জন্যই তারা আসেনি। বাবা আরও বলেছিলেন, আর যদি দেখা যেত আমার সম্বন্ধীবাবুর শ্বশুরের সম্পত্তি ঢু ঢু। তা হলে অসুখ-বিসুখ সব ভাল হয়ে যেত, ছুটে আবার তর সইত না। যাক, দুটোর কপালেই দেখছি সব নাচছে।

দুদে হল আমার ডাক নাম। দুদে বলতে জাঁহাবাজই তো বোঝায়। আমার নাম যে কেন দুদে রাখা হয়েছিল, আমি জানিনা। শুনেছি, ঠাকমা আমাকেদুদেবলে ডাকতেন। কথায় বলে, ভীষণ দুদে ছেলে। ঠাকমাই বা আমাকে দুদে বলে ডাকতেন কেন? আমি কি খুব জ্বালানে ছেলে ছিলাম? অবিশ্যি আমি কোনও দিনই সে কথা বাড়ির কারোকে জিজ্ঞেস করিনি, কারণ আমার মনে আগে এ রকম প্রশ্নই জাগেনি। হতে পারে, ওটাই আমার আদরের নাম ছিল।

যাই হোক, বাবার কথা শুনে মা বলেছিলেন, মা মরেছে, বাবা তো মরেনি। আগে থেকে এত গাওনা গেয়ো না। বাবা মরলে নিশ্চয়ই দাদা, নয়তো তার ছেলেরা সম্পত্তির ভাগ নিতে আসবে।

অবিশ্যি শেষপর্যন্ত কারও কথাই মেলেনি। আমাকে যে যাই ভাবুক, হ্যাঁ, এই বেলা এগারোটায় পুকুরের উঁচু পাড়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে মাছ ধরতে বসেছি, যা আমার বয়সের কোনও লোকেরই কথা না বা গোটা গ্রামটা ঘুরে এলেও দেখা যাবে কেউ তা করছে না, তবু আমি একটা ব্যাপার খুব ভাল ভাবেই বুঝেছি, জীবনের বেশির ভাগ ভাবনা চিন্তাগুলো এক রকমের পাগলা ঘোড়ার মতো।

হ্যাঁ, আমি নিজের মনটাকেই শালা বলে বলছি, প্রায় কোনও ভাবনা চিন্তাগুলোই ঠিক ঠিক মেলে না, সব পাগলা ঘোড়ার মতো চমকিয়ে দিয়ে এলোমেলো নানা দিকে ছুটতে থাকে। যেন সারি সারি সাজানো ঘোড়াগুলোর গায়ে আচমকা কারোর চাবুকের ঝাপটা লেগে যায়। তখন হয় বোকার মতো। তাকিয়ে থাকতে হয়, নয়তো ক্ষেপে উঠতে হয়। এ দুয়ের বাইরে ছাড়া কোনও উপায় নেই। আমার জীবনে এটা অনেক বার অনেক রকমে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।

.

ইসসস্! দারুণ চমকিয়ে উঠেছিলাম। আসলে মাছও খায়নি ফাতনাও ডোবেনি। ফানা থেকে কয়েক হাত দূরেই একটা মাছরাঙা পাখি ঝপ করে জলে পড়ে ডুব দিয়েছে। আর আমি দাদুর ভাবনায় এত মশগুল, ছিপ ধরে টান দিয়ে ফেলেছি। এ রকমই হয়।

অথচ ফাতনা একটু একটু নড়ছিল, সে দিকে আমার খেয়াল ছিল। জানতাম, রুই কাতলা মোটেই আসেনি, মিরগেল মাছের বাঁদরামি হচ্ছে। মিরগেল মাছগুলোই ওই রকম, ঘুঘু দ্য গ্রেট। বঁড়শিতে গাঁথা টোপের আশপাশ দিয়ে যাবে আসবে, কখনও ঠোকরাবে, কখনও বা ল্যাজের একটু আলতো ঝাপটা মেরে যাবে। সহজে টোপ গিলবে না। তবে হ্যাঁ, বাছাধন এক বার গিললে সব বাদরামি বেরিয়ে যাবে।

হুঁ, হাসিটা আমি ঠিকই শুনেছি। একটু আগেই বোসদের বাড়ির চার-পাঁচজন মেয়ে বউরা ঘাটে এসে চান করে গিয়েছে। জানে, আমি মাছ ধরতে বসেছি, চোখেও দেখেছে। কেউ সাঁতার কাটেনি, জলে বেশি তোলপাড়ও করেনি। তা হলে আমার মাছ ধরার অসুবিধা হত। তবে ওরা আমার সম্পর্কে যে ফিসফিস গুজগুজ করেছে, হেসেছে, তা জানি। বিশেষ করে বোসদের মেজো বউটা একটু দেখিয়ে শুনিয়ে মশকরা করে, আসলে আমাকে খোঁচা দেবার জন্যই। যদিও আমার সঙ্গে কথা বলে না। ওর ধারণা ও রূপসী আর আমাকে ভাবে উপোসি ছারপোকা। এরপরে একটা কথাই বলতে হয়। বলতে চাই না, মনে মনে গুমরে লাভ কী?

ওরা চলে যাবার পর বাসুদেব ঘোষাল ঘাটে নেমেছিল, কোলে ছিল ছেলে। জিজ্ঞেস করেছিল, চার করেছ, না এমনিই বসেছ।

বিরক্তি লাগে এ সব কথার জবাব দিতে। নেই কাজ তো খই ভাজ; বাপ ঠাকুরদার পুকুর, মনে হল, পিঁপড়ের ডিম জোগাড় করে টোপ বানিয়ে ছিপ ফেলে বসেছি। এখন চার করে বসবার কী দরকার? চার করতে সময় লাগে। পয়সাও লাগে, মেজাজও দরকার। কোনওটাই আমার নেই। নেহাত জবাব। দিতে হয়, দিয়েছিলাম, না।

বাসুদেবের ছেলেটা বাবার কোমর জড়িয়ে ধরে খুব জোরে জোরে জলে পা দাপাচ্ছিল। কেঁজে বলেছিলাম, কী হল? ছেলেকে এখন সাঁতার শেখাতে এনেছ নাকি?

ছেলেমানুষের কথা আর বলল কেন। বাসুদেব ছেলের পা দুটো চেপে ধরে ধমক দিয়েছিল, এই ছোঁড়া, পা দাপাসনি। দেখছিস না, দুদে কাকা মাছ ধরছে? মাছ পালিয়ে যাবে না?

খচ্চর! মনে মনে না বলে পারিনি। আসলে বাসুদেব ঘোষাল আমাকে চিপটেন কাটছিল। নিশ্চয় মনে মনে আমাকে গালাগালও দিয়েছিল। আমাকে কে কী বলে গালাগাল দেয় আমি সবই জানি। কিন্তু এ পুকুরে চান করতে আসতে হলে, শুনিয়ে গালাগাল দেওয়া চলবে না। গোটা পাড়ার লোকেরই আমাদের এ পুকুরটা খুব পছন্দ। নিজেদের বলে বলছি না, পুকুরটার জল সত্যি খুব ভাল। ঠাকুরদার আমল থেকেই এই পুকুরে কাপড় কাঁচা বাসন মাজা গোরু-মোষ চান করানো বারণ ছিল। বারণ এখনও আছে। কিন্তু বাসন মাজাটা লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘটেই। কে আর সারা দিন পাহারা দিচ্ছে। এক সময়ে, যখন এখানে মিউনিসিপ্যালিটি হয়নি, জল কল হয়নি, এখনকার মতো টিউবওয়েল হয়নি, তখন গোটা পাড়ার লোকেরা এই পুকুরের জল খেত, এই জলে রান্না করত। দেখলেই শুধু বোঝা যায় না, মুখে দিলেও জলের মিষ্টি স্বাদটি পাওয়া যায়।

হাসিটা শুনেও আমি ঘাটের দিকে তাকালাম না। বড় রাস্তা থেকে ভেসে আসা শুয়োরের মরণ চিৎকারের মতো গর্জন শুনেই বুঝতে পারছি, সাড়ে এগারোটার আপ-এর বাস যাচ্ছে। আজ কাল বাস আর লরির হর্নের একই আওয়াজ, আর সত্যি, লাল টকটকে আগুনে পোড়া শিক শুয়োরের পাছায় গুঁজে যাবার সময় যেমন চিৎকার করে ঠিক সেই রকম। আমি ছিপটা যেভাবে টেনেছিলাম তাতে টোপ খসে যাবারই কথা। গিয়েছেও। ডান পাশে রাখা টোপের ঠোঙাটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেলাই ভেঁয়ো পিঁপড়ে এসে জড়ো হয়েছে। এই কালো বড় বড় পিঁপড়েগুলো খায় না, এমন জিনিস নেই। এমনি মরা গোরু ছাগলের গায়ে তো ওঠেই। মানুষের শরীরের মাংস পেলেও ছাড়ে না। আমি টোপের ঠোঙাটা তুলে কয়েকটা টোকা মারলাম। পিঁপড়েগুলো খসে পড়ল। ভিতরে হাত ঢুকিয়ে পিঁপড়ের ডিমের টোপ বের করে বঁড়শিতে গাঁথতে গাঁথতে ঘাটের দিকে তাকালাম। যা ভেবেছিলাম–যাকে ভেবেছিলাম, ঠিক সে-ই। অনাথদার বউ, জ্ঞাতি সম্পর্কে আমার বউদি। সঙ্গে নিয়ে এসেছে পাশের বাড়ির নিতাই বিশ্বাসের আইবুড়ো মেয়ে মিনতিকে। বউদির বয়স কম করে তিরিশ-বত্রিশ, আর মিনতির বয়স বিশ বাইশের বেশি না। অনাথদার বয়সই বা আমার থেকে কত বেশি? বছর খানেক হবে। জ্ঞাতি ভাই না হলে হয়তো নাম ধরেই ডাকতাম।

আমি মুখ ফিরিয়ে ঘাটের দিকে তাকাতেই বউদির সঙ্গে চোখাচোখি হল। মিনতি তখন গলা নামিয়ে বউদিকে কিছু বলছিল। বউদিকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে ও তাড়াতাড়ি এক বার আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখে নিল। বউদি বলল, মাছরাঙাটা সব ভণ্ডুল করে দিল।

বউদির কথা শেষ হবার আগেই মাছরাঙাটা পুকুরের দক্ষিণ দিকে ভেসে উঠল। মনে হল, ওর শিকার ফসকেছে। মিনিট খানেক জলে ভেসে এদিক ওদিক তাকিয়ে উড়ে চলে গেল পুবের বাঁশঝাড়ে। আমি একটু হেসে মাথা ঝাঁকালাম। মুখে কিছু বললাম না। আমি জানি মাছরাঙাটার জলে ঝাঁপ আর আমার চমকিয়ে উঠে ছিপ টানা দেখে বউদি মজা পেয়েছিল। মজা পেয়ে হেসে উঠেছিল, আর এখন যে বলল, মাছরাঙাটাই সব ভণ্ডুল করে দিল’, সেটা আসলে আমাকে একটু খোঁচা মারা। যেন মাছরাঙাটা জলে ঝাঁপ না দিলে, আমার ছিপে মাছ ধরা পড়ত। মানুষের এ রকম বোকার মতো ভুল দেখলে সকলেরই হাসি পায়। আমি দেখলে, আমারও পেত।

এ তো সামান্য, আনমনে থাকার জন্য ভুলের একটা ঘটনা। না হয়, একটু টোপ নষ্ট হয়েছে। ভারী। শরীরের মানুষ পা পিছলে পড়ে হাড় ভেঙেছে, কিংবা কেউ কারোকে ধরে পেটাচ্ছে, সে সব দেখেও মানুষকে হেসে কুটিপাটি হতে দেখেছি। এই তো কয়েক দিন আগেই, আমাদের রেল ইস্টিশনে, একটা নতুন বউকে কয়েকটা ষণ্ডা মার্কা লোক ছিনিয়ে নামিয়ে নিয়ে গেল। বেচারি স্বামী বিয়ে করে, নতুন বউ নিয়ে ক্যানিং যাচ্ছিল। সঙ্গে কিছু আত্মীয়-স্বজনও ছিল। নতুন বউটার গায়ে এমন কিছু গহনাগাঁটিও ছিল না। এমন কিছু কেন, বোধ হয় হাতের চুড়িগুলো বড় জোর তামার ওপরে সোনা দিয়ে ল্যাপা ছিল। গলার হার ছিল কি না, মনে পড়ে না। নাকে একটা নাকচাবি ছিল। কলকাতা থেকে একই কামরায়। ফেরবার সময় ওইটুকুই আমার চোখে পড়েছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, নতুন বরটি ক্যানিং-এর জেলে বা মাঝি শ্রেণীর হবে। বড়লোক ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, সে রকম কিছুই না। বউটির বয়স আঠারো কুড়ি হবে। মাজা মাজা গায়ের রং, চেহারাটি ভালই। সহজেই নজরে পড়ে, কিংবা ওটা আমারই দোষ, মাঝে মাঝেই বউটির দিকে আমার চোখ পড়ছিল, ভাল লাগছিল, অনেক কথাই মনে পড়ছিল। খারাপ কিছু না, কিন্তু স্বামীটাকে মনে মনে একটু হিংসা হচ্ছিল। কতক্ষণের আর ব্যাপার। গোটা সাতেক ইস্টিশান-শিয়ালদহের সাউথ থেকে। আমরা এতগুলো প্যাসেঞ্জার, তার মধ্যেই ভোজবাজির মতো, ষণ্ডামাকা লোকগুলো হঠাৎ কোথা থেকে এল, আর বউটাকে পাঁজাকোলা করে নামিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমরা সবাই হই-চই করে উঠেছিলাম, তবে এমন সাহস ছিল না, সন্ধ্যাবেলার কোলআঁধারে লোকগুলোকে বাধা দিই। নতুন বর আর তার আত্মীয়স্বজনরাও নেমে পড়েছিল, কিন্তু ব্রটি যেই কেঁদে উঠেছিল, আমার বউ নিয়ে চলে গেল গো’ অমনি সকলের কী হাসি৷ অবিশ্যি বরটির ছেলেমানুষের মতোকান্না শুনে, আমিও হেসে ফেলেছিলাম। আমি নেহাত নির্লজ্জ, তাই হেসেছিলাম। মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখেও লোকে হাসে৷ এরকম হাজারটা নজির আমি দিতে পারি। আসলে, আমরা বোধ হয় জানি না, কখন কী কারণে হেসে উঠি। অথচ আমাদেরই কথায় আছে: দুটে পোড়ে, গোবর হাসে/এমনি দিন বারি আসে..ভগবান জানেন, কার মাথায় কথাটা এসেছিল। তবে এটা নিশ্চয়, মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে, লোকের হেসে ওঠা থেকেই, এ রকম কথা কারোর মাথায় এসেছিল।

মিনতিও নিশ্চয় বউদির সঙ্গে হেসে উঠেছিল। কিন্তু শব্দ করে হাসেনি। সে সাহস ওর নেই। জানে, আমি টের পেলে, আমার বাজখাই গলায় গাঁক করে উঠব। পাড়ার বেশির ভাগ লোকেরই ধারণা, বিশেষ করে মেয়েদের, আমি যেমন গোঁয়ার, তেমনি লোকও মোটেই সুবিধার না। চিরকাল অবিশ্যি এ রকম ধারণা ছিল না। সত্যি বলতে কী, আমি আজকাল যে রকম বদরাগী হয়ে উঠেছি, আগে সেরকম ছিলাম না। হাঁকডাক করার অভ্যাস আমার রাবরই ছিল, কিন্তু তা খারাপ মেজাজের হাঁকডাক না। আমার এই প্রায় ছ ফুট লম্বা, ফরসা চেহারাটাকে দশাসই বলা চলে। অবিশ্যি তেমন একটা মোটা নাদুসনুদুস হয়ে যাইনি। আগের মতো ছিপছিপে তো নেই বটেই, অথচ এটা আমি বেশ ভালই বুঝি, মোটাসোটা ঘাড়ে গদানে চেহারা না হলেও, এখন আমার চেহারার মধ্যে একটা বিচ্ছিরি ছাপ পড়েছে। আমার নিজের সেই রকম ধারণা। মা তবু বলে, তুই কি রাত্রে ঘুমোস না? চোখের চারপাশে যেন মাকড়সার ঝুল পড়েছে। হাতে পায়ের নখগুলো কাটবার কথা মনে থাকে না? চান করার সময় হাত পা ঘষিসনা নাকি? যেন গায়ে ছ্যাতলা পড়ছে। সিগারেটের ধোঁয়ায়, আর পানের ছোপে দাঁতগুলোর কী ছিরি করেছিস।..

মা মায়ের মতোই বলে। কিন্তু আমার বাবার ভাষায়, আমার চেহারাটা নাকি দিনকে দিন লম্পটের মতো হয়ে উঠছে। তা তো বলবেই। কেন যে বলে তাও জানি। জানি, আর মনে মনে হাসি। বলুক। বাবার তো ধারণা,আমি পাকা ধানে মই দিচ্ছি। মাকে তো নিজেরজীবন থেকে কবেইসরিয়ে দিয়েছে। মনেপ্রাণে এখনও অনেকআকাঙ্ক্ষা, সে গোরারও তেমন লক্ষণ নেই। বলতে গেলে,সারাটা জীবনই যা খুশি তাই করে এসেছে, এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। তার জন্য কোনও লজ্জা বা অনুশোচনা নেই। আর আমাকে বলে চরিত্রহীন, লম্পট। এর পরে আমার কেন বলতে ইচ্ছা করবে না, নিজেকে দিয়েই আমার বিচার হচ্ছে।

এই যে আমি এখন জাঙিয়ার ওপরে খাটো হাফ প্যান্টটা পরে আছি, বাবার চোখে এটাই হচ্ছে আমার ইতরামি আর নোংরামির লক্ষণ। তার ওপরে বুকে খামচা খামচা চুল নিয়ে খালি গা। বুকের কিছু কিছু চুলে আবার পাকও ধরেছে। অথচ আমার চুল তেমন পাকেনি। কানের কাছে জুলপিতে অথবা কপালের সামনে, মাথার এদিকে ওদিকে দু-চারটে সাদা চুল চোখে পড়ে। যাই হোক, নাভির নীচে খাটো হাফ প্যান্ট পরা আমার চেহারাটিই বাবার চোখেকদর্য কুৎসিত। আসলে আমি লম্পট আর নোরা বলেই নাকি এরকম ভাবে কলের সামনে ঘুরতে পারি।

সকলের সামনে মানে কী? আমি এরকম ভাবে বাড়ির বাইরে কখনও যাই না। আগে অবিশ্যি বাড়িতেও এরকম থাকতাম না। একটা পায়জামা অন্তত পরতাম। তখন বাড়ির চেহারা এ রকম ছিল না। এখন আমার ও সব সভ্যতা-ভব্যতার কথা মনে আসে না। লজ্জাই বা কাকে কব? বাবাকে? মাকে? হ্যাঁ, অবিশ্যি বোনেদের সামনেও অনেক সময় এ রকম নাভির নীচে খাটো প্যান্ট পরে ঘোরাফেরা করি। এদের মোটেই সেটা পছন্দ না। কিন্তু ওরা দুজন মানে, আমার দু বোন,কদিনই বা আর এ বাড়িতে এসে থাকছে? দুজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তা, ওদের সামনেই বা লজ্জার কী আছে। ওরা আমার বোন তো বটে। বাইরের মেয়ে তো না।

এহ এই খানেই আমার বাবার গোলমাল! যাকে বলে পৈতা পুড়িয়ে বামুন,বাবা এখন তাই হয়েছে। আসলে,যদিও জারে বিচারেআমরা চাটুয্যে ব্রাহ্মণইবটে, কিন্তু সারা জীবন নিজেরজীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, বিস্তর টাকা পয়সা উড়িয়ে পুড়িয়ে, গোটা কলকাতায় অনেক কাঁপতেনি করে এখন বাড়িতে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের কারখানা খুলে বসেছে। রকমারি, সুন্দর সুন্দর ব্যাগ তৈরি হচ্ছে বাইরের বৈঠকখানা ঘরে, আর কাজের লোক সবই হচ্ছে দশ থেকে পঁচিশ বছরের মেয়ে। অবিশ্যি আমাকে মানতেইহবে, লোকটিরবুদ্ধিরঅভাব নেই। আর এইবয়সে, পরিশ্রম আর উৎসাহেরও অভাব নেই। এটা আমাকে মানতেই হবে। তা না হলে যে মানুষ জীবনের অনেকগুলো বছরে বেশকয়েক লাখ টাকা উড়িয়েছে, কাজের নামে,(আমার মতে) ফুর্তি করে বেড়িয়েছে, যার ঘড়ি আংটি–যেমন তেমন আংটি না, রীতিমতো হিরে মুক্তো বসানো, কয়েক সেট সোনা আর জড়োয়ার বোতাম, পোশাক আসাকের জেল্লাদার বাবুগিরির তো কথাই নেই, সেই লোক নিজের হাতে প্লাস্টিকের বুড়ি আর ব্যাগ বুনতে শিখেছে, ডজনখানেক মেয়েকে শিখিয়েছে, এবং কারবারটি, বলতে নেই, বেশ ফলাও করেই চালাচ্ছে।

আমি মুখে অবিশ্যি কিছু বলি না, কিন্তু সত্যি, গালে হাত দিয়ে, অবাক হয়ে কখনও কখনও ভাবি, বাবার মতো একটি লোকের পক্ষে এমনটা সম্ভব হল কী করে? জানি, সবই খুইয়েছে। তবু ঠিক উঠে দাঁড়িয়েছে। এক সময়ে ভাবতাম, বাবা নিশ্চয় আমার কাছে হাত পাতবে। সে তো দূরের কথা, এখন আমাকেই হাত পাতবার কথা ভাবতে হয়। যদিও আজ পর্যন্ত হাত পাতিনি। কিন্তু সব খুইয়ে এই ষাটের ওপর বয়সে, একটা লোকের মাথায় এমন বুদ্ধি আসে কী করে, আর এত কাজই বা করে কী করে? এখনও বলতে গেলে রোজ কলকাতায় যায়, প্লাস্টিকের ফিতে দড়ি আনতে, আবার কাঁধে করে তৈরি মাল কলকাতায় নিয়ে যায়।

মুখে আমি কিছু বলিনা, বা মরে গেলেও বলবনা, কিন্তু ভাবা যায় না। সত্যি কথা বলতে কী, বুড়ো মনুষটিকে আমার হিংসে হয়। সেই যে বলছিলাম, হিংসার কেনও বয়স নেই, তার কোনও কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না, এমন বস্তুও নেই। আসলে আমার হিসার আরও কারণ আছে। ওই এক ডজন মেয়ে। এটা আমার একার কথা না, মাও জানে, পাড়ার লোকেরাও জানে, ব্রিলোন চাটুয্যের চরিত্রটি কেমন। লোকটার বয়স তো আমার থেকে কমনা?হাজার হোক আমার বাবা, আমার জন্মদাতা, অথচ মেয়েদের সঙ্গে এমনভাবে মেলামেশা করে, কারোরই কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। আর মেয়েগুলোর চরিত্রের রহস্যও আমি বুঝি না, ওই বুড়ো লোকটির ওপর ওদের এত দরদ কীসের? এত সাজগোজ করে এসে কাজের মধ্যেই এত হাসি কথাবার্তা কীসের? কারো কারোকে নিয়ে তো এক সময়ে দরজা বন্ধও হয়ে যেত। রাত্রেও কেউ কেউ ঘরে থেকে গিয়েছে, টের পেয়েছি। এর পরেও বাবার পিছনে আমি লেগে থাকবনা,এটা কেউ ভাবতে পারে? অনেক কাণ্ডই আমি ঘটিয়েছি, যাকে বলে কেলেঙ্কারি, চিরজীবনই ঘটবে।

যাই হোক, সে সব অনেক ঘটনা। আমার এই খালি গায়ে খাটো হাফ প্যান্ট পরে বাড়িতে ঘুরে বেড়ানোয়, বাবা মহাশয়ের আপত্তির কারণ হল, তার কারখানার মেয়েরা। বেশির ভাগই অবিবাহিতা মেয়ে, দু-একজন বিবাহিতাও আছে। কয়েকজন দেখতে বেশ ভালই। চোখে লাগার মতো শরীর আর স্বাস্থ। কারও কারও চোখ মুখ রীতিমতো সুন্দর। আমাদের অঞ্চলেরই আশেপাশের মেয়ে সব। দু-চারজন কলোনর মেয়ে, বাদবাকি এ দেশেরই গরিব ঘরের মেয়ে বা গরিব বলব, না, উঞ্ছ বুব, আমি বুঝতে পারি না, কারণ সব মেয়েগুলো যে ভাল না তা আমি নির্ঘাত জানি।

ভালই হোক আর মন্দই হোক, আমার বাবার সঙ্গে ওদের যে কী রকম সম্পর্ক, তা আমি বুঝতে পারি। আর এই মেয়েদের নাকি ইজ্জতে লাগে, লজ্জা করে, আমার খালি গায়ে খাটো হাফ প্যান্ট পরা দেখলে। কত বছর আগের সেই ঘটনা? খুকু কবে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে?

যাক গিয়ে, সে হিসেব পরে হবে। আমি প্রথম প্রথম কিছু খেয়ালই করিনি। ওদিকে, আমাকে নিয়ে যে কত কথা আর ব্যাখ্যা হয়ে গিয়েছে, কিছুই জানতে পারিনি। আসলে আমি যে মেয়েদের দেখাবার জন্যই ও রকম একটা অসভ্যের মতো ঘুরে বেড়াই মানে, আমি আসলে একটা বদমাইশ লম্পট ছাড়া কিছুই না, এটা বাবা আর তার কারখানার মেয়েরা ভেবেই রেখেছিল, আর সে কথা নিয়ে ধিকি ধিকি আগুনও জ্বলছিল। তারপরেই একদিন বোম বার্স্ট করেছিল।

ব্যাপারটা আগে জানলে আমি তৈরি থাকতে পারতাম। কিন্তু বাবার সঙ্গে আমার কথা ছিল না। মা’র সঙ্গে বাবার তেমন কথাবার্তা ছিল না, নিতান্ত যেটুকু না বললে নয়, সে রকম কথা হত। আমাকে কিছু বলতে হলে, বাবা তা মাকে শুনিয়ে দিত। অথচ আমার খাটো হাফ প্যান্ট পরার ব্যাপারটা বাবা মাকে না বলে আমাকেই একদিন মুখোমুখি বলে উঠেছিল, এই, শোন, তুই কী ভেবেছিস!

আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম, কারণ ভাবতেই পারিনি, বাবা আমার সঙ্গে কথা বলতে পারে। কথাটা শোনামাত্রই আমার ভিতরে একটা অদ্ভুত ঝংকার দিয়ে উঠেছিল, তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছিল, কথাটা খুব সোজাভাবে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি, নিশ্চয়ই একটা খারাপ কিছু ঘটবে। দেখেছিলাম, বাবার বড় বড় চোখ দুটো যেন রাগে জ্বলছে। বাবা তো আসলে দেখতে খুবই সুপুরুষ। হতে পারে রংটা আমার থেকে কালো, কিন্তু নাক চোখ মুখের তুলনা হয় না। আমি মায়ের মতো দেখতে হয়েছি, আর মায়ের মতো। দেখতে হলে, ছেলেরা নাকিদুর, নিকুচি করেছে! ও পচা প্রবাদটা এখন পুরনো কাসুন্দির মতো গন্ধ ছাড়ে। যাই হোক, ছাদ ঢাকা, থামওয়ালা চওড়া আর বিরাট লম্বা দালানে আমি সবে দোতলা থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা বাইরের ঘরের–অর্থাৎ তার কারখানা ঘরের ভিতরের দরজা থেকে। এগিয়ে এসে আমাকে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি দেখেছিলাম, ঘরের ভিতর থেকে মেয়েরা উঁকি দিয়ে দেখছে। আমি অবাক হলেও, এমনকী মনে মনে একটু ভড়কিয়ে গেলেও, খানিকটা চোটের সঙ্গেই বলেছিলাম, কেন, কীসের কী ভাবব?

এই যে, এইভাবে আধন্যাংটো হয়ে সকলের চোখের সামনে অসভ্যের মতন ঘঘারাফেরা, এ সবের মানে কী? বাবা হাত তুলে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখিয়ে বলেছিল।

আমার মাথায় ঝাঁ করে রক্ত উঠে গিয়েছিল, বাবার থেকে অনেক বেশি গলা চড়িয়ে জবাব দিয়েছিলাম, মুখ সামলে কথা বলো, অসভ্য টসভ্য বোলো না। আধন্যাংটো মানেটা কী? আমি জাঙিয়ার ওপরে শর্ট পরেছি, একে কি আধন্যাংটো বলে?

হ্যাঁ, একে আধন্যাংটোই বলে। বাবাও গলা চড়িয়েছিল, তুই যদি ভদ্র হতিস, আর লজ্জাশরমের মাথা না খেতিস, তা হলে এভাবে মেয়েদের সামনে ঘোরাফেরা করতিস না। মনে রাখিস, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।

সেই মুহূর্তে আমার চোখ এক বার চলে গিয়েছিল বাইরের ঘরের দিকে, আমার মাথার রক্তটা আরও চড়ে উঠেছিল, বলেছিলাম, মেয়েদের সামনে মানে তো তোমার ওই সব মেয়েদের? তাই বড় গায়ে লেগেছে, না? তোমরা খুব সভ্য, আর আমি এই পোশাকে অসভ্য।

ও সব বাজে কথা শুনতে চাই না। বাবা ধমক দিয়ে চড়া গলায় বলেছিল, আমি দেখে যাচ্ছিলাম, কিছু বলিনি। আজ বলে দিলাম, এ বাড়িতে থাকতে হলে, এ রকমভাবে চলবে না। ভদ্রভাবে থাকতে হবে।

আমি সমানে সমানেই বলেছিলাম, তোমাকেও আমি বলে রাখছি, এ বাড়িতে আমার যেভাবে খুশি চলাফেরা করব, তোমার ওইসব মেয়েমানুষদের জন্য আমার কিছু যায় আসে না।

এক থাপ্পড় মেরে তোর চোয়াল ভেঙে দেব রাসকেল।বাবা দু পা এগিয়ে, হাত তুলে থাপ্পড় মারার ভঙ্গি করেছিল, ভদ্রলোকের মতন কথা বলতে হয় বল, নইলে বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে।

আমিও কিছু কম যাইনি, দু পা এগিয়ে, বুক ফুলিয়ে বলেছিলাম, মারো, মেরে দ্যাখো দিকিনি এক বার, কত জোর আছে তোমার কবজিতে দেখি।

আমার কথা শেষ হবার আগেই, মা এসে আমার হাত টেনে ধরেছিল, এই দুদে, করছিস কী? চলে আয়, সরে আয় এদিকে।

আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, কেন সরে আসব? আমি কী দোষ করেছি? আমাকে বলছে আধন্যাংটো, অসভ্য, অভদ্র, বলছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। কার বাড়ি এটা? ঠাকুরদার উইল কি আমি দেখিনি? এ বাড়িতে কি আমার স্বত্ব নেই? এই প্যান্ট পরেছি বলে, ওঁর কারখানার মেয়েদের মানে। লেগেছে। নিকুচি করেছে মেয়েমানুষের, তবু যদি কিছু না জানতাম।

আমি বলছি, তোর যতই স্বত্ব থাক, এ বাড়িতে থাকতে হলে, এরকমভাবে তোর চলাফেরা করা চলবে না। বাবাও চিৎকার করে উঠেছিল, আসলে মেয়েদের সামনে তুই ইচ্ছে করেই ও রকম নোংরা চেহারা নিয়ে বেড়াস। আমি তোকে চিনি।

আমি জবাব দিয়েছিলাম, বেশ করি, আরও করব। এর পরে ন্যাংটো হয়ে ঘুরব।

মা আমাকে টেনে কয়েক পা পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, আহ্, দুদে, একটু চুপ কর। দেখছিস না, বাইরের রাস্তায় লোক জমে গেছে?

আমি বাগানের দিকে, বাড়ির বাইরে যাবার বড় দরজার দিকে এক বার তাকিয়ে দেখেছিলাম, পাড়ারই কিছু চেনা লোকজন রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। আর সেই ভিড় কাটিয়ে যাবার জন্য সাইকেল রিকশাওয়ালারা কয়েকজন একসঙ্গে প্যাক প্যাক করছিল। বাবা চিৎকার করে বলেছিল হ্যাঁ, তোর মতন লম্পট তো ন্যাংটো হয়েই ঘুরবে! তবে মনে রাখিস, বুনো ওলের বাঘা তেঁতুলও আছে। বলতে বলতে বাবা পিছন ফিরে প্রায় ছুটেই বাইরের ঘরে ঢুকে গিয়েছিল।

আমি লম্পট, আর তুমি নিজে কী, সেটা এক বার ভেবে দেখো’ আমিও চিৎকার করে বলেছিলাম, কোন ওলের কোন তেঁতুল, তা আমারও জানা আছে।’ বলে আমি বাগানের সামনের বারান্দা দিয়ে, বাইরের দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম। দরজায় গিয়ে পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই, সরু পিচের রাস্তাটা সাফ হয়ে গিয়েছিল। আমি দরজাটা জোর শব্দে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সেটা কত দিন আগের ঘটনা? খুকু কত বছর আগে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে?