৩. জানালার ধারেই একটা কদমগাছ

অধ্যায়: ৩

তার জানালার ধারেই একটা কদমগাছ আছে। এত কাছে যে, দোতলা থেকে হাত বাড়ালেই ডালপালা ছোঁয়া যায়। বর্ষায় যখন ঝেঁপে ফুল ফোটে, তখন মাঝে-মধ্যে এক-আধটা ফুল জানালা গলে ঘরের মধ্যেও উঁকি মারে। একদিন সকালবেলায় ঘুম ভেঙে চোখ মেলতেই নাকের ডগায় একটা সদ্য ফোটা ফুলকে ঝুলে থাকতে দেখে সে অবাক। ফুলটা যেন খুব কৌতূহল নিয়ে ঝুঁকে তাকে দেখছে। সে হেসে ফেলে বলে উঠেছিল, “হেল্লো! গুড মর্নিং!”

বর্ষা চলে গেছে। এখন ফুল নেই। গাছটা আছে, তাই জানালায় দাঁড়ালে রোজ এক সতেজ সবুজের সঙ্গে তার দেখা হয়। কখনও-সখনও একটু-আধটু কথাও হয় তাদের মধ্যে। গাছ আর সে। কত রকমের যে বন্ধু আছে চারদিকে, থই পায় না রাজু। তার তো গাছটাকে খুব বন্ধুর মতোই লাগে। শুনলে লোকে হয়তো পাগল বলবে, কিন্তু ঘরের ইনঅ্যানিমেটদের সঙ্গেও তার একটা বন্ধন আছে। ওরাও তাকে অনুভব করে, তাকে দেখে, শোনে এবং তার কথা ভাবেও। কী করবে সে? তার যে এরকমই সব মনে হয়!

আজ গাছটার দিকে সকালের আলোয় মায়াভরে চেয়ে ছিল রাজু। সামনের বছর গাছটা হয়তো আর থাকবে না। প্রোমোটারের সঙ্গে কথা চলছে, এই দোতলা বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি উঠবে। সেই বাড়িতে তার নামেও একটা ফ্ল্যাট থাকবে। রাজুর এটা ন্যায্য মনে হয়নি। সে প্রবল আপত্তি করেছিল, কিন্তু বাবা আর মা কোনও কথা শুনতে চায়নি। বলেছে, “আমরা যখন থাকব না তখন তুই কোথায় যাবি?” বাবা বলেছিল, “তোকে তো দানখয়রাত করা হচ্ছে না। ধরমের কিছু টাকা তো আমার ব্যাবসায় এখনও খাটছে। এ তোর ন্যায্য পাওনা। তোর দাদা-দিদিও রাজি। তা হলে ফ্যাঁকড়া তুলছিস কেন?”

পাওনাগন্ডা ব্যাপারটা আজও ঠিক বোঝে না রাজু। তার অত বুদ্ধি নেই। সে স্লো থিংকার। সিদ্ধান্তে আসতে তার দেরি হয়, দেরিতে বোঝে বা অনেক সময়ে বুঝতেও পারে না। দুনিয়াটা যিনি রচনা করেছেন তিনি ভগবান-টগবান কেউ হবেন, কিন্তু রাজু আবার নিজের মতো করে তারও নিজের একটা দুনিয়া বানিয়ে নিয়েছে। সেই দুনিয়ায় হয়তো অনেক আজগুবি ব্যাপার আছে। সেই দুনিয়ায় রিয়েলিটির চেয়ে রূপকথা বেশি। জয়ীও সেই কথাই বলে, যারা ট্রুথকে ফেস করতে ভয় পায় তারাই ভারচুয়ালিটিতে পালায়। তাই হবে হয়তো।

জয়ী তার খুব ভাল বন্ধু। এ বাড়ির দুটো বাড়ি পরে ওদের বাড়ি, তারা একসঙ্গেই বড় হয়েছে। তারা বেশ কয়েকজন প্রায় সমবয়সি ছেলেমেয়ে একসঙ্গে খেলা করত। জয়ী তখন আলাদা কেউ ছিল না, অনেকের একজন। যখন তার বয়স বারো-তেরো আর জয়ীর আট বা নয় তখন রেললাইন পেরোতে গিয়ে পা মচকেছিল জয়ীর। জয়ী আদুরে মেয়ে, ভ্যাতকাঁদুনি, ব্যথাবেদনা সইতে পারত না। পা মচকে সে কী কান্না! রাজু জয়ীকে খানিক পাঁজাকোলে, খানিক ঘাড়ে চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। সেই থেকে জয়ী একটু আলাদা হল, একটু বিশেষ। জয়ী বন্ধু ঠিকই, বয়সেও ছোট, কিন্তু বরাবর রাজুর সঙ্গে তার একটা দিদি-দিদি ভাব। শাসন করে, ধমকায়, তাঁবে রাখে। জয়ীর বয়ফ্রেন্ড মনসিজ চৌধুরী, একজন এনার্জি এক্সপার্ট, নিউক্লিয়ার ফলআউটের ওপর পেপার করেছে। সে মাঝে-মাঝে জয়ীকে বলে, “আচ্ছা, রাজু কি তোমার প্রজা, না সাবোর্ডিনেট যে, সবসময়ে ওর সঙ্গে তুমি চোখ পাকিয়ে কথা বলো!”

জয়ী বলে, “তুমি তো জানো না, ওকে দাবড়ি না দিলেই ওর মাথায় ঘুঘুপাখি ডাকতে থাকবে। ভাল করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো, ও কিন্তু এ জগতে নেই, ভাবের কুলুঙ্গিতে উঠে বসে আছে।”

জয়ী অর্থাৎ বিজয়িনী ঘোষ আর মনসিজ চৌধুরী বিয়ে করে বিদেশে চলে যাবে একদিন। খুব বেশি দেরিও নেই তার। তখন একটু একা হয়ে যাবে বটে রাজু। কিন্তু জীবনটা তো এরকমই। অন্তহীন পরিযাণ। শুধু গাছেরই কোথাও যাওয়ার নেই। গেলে ভাল হত। এই কদমগাছটা যেমন, কোথাও যেতে পারবে না বলে বেচারা কাটা পড়বে।

বিকেলে কোথায় যেন যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল জয়ী।

“তোকে একটা কথা বলার ছিল।”

“বল না! আমার বেরোতে দেরি আছে। মনসিজ ছ’টার আগে আসতে পারবে না।”

“কাল একটা ঘটনা ঘটেছে। তোকে না বললে অস্বস্তি হচ্ছে।”

“কী হয়েছে রে?”

চুপ করে সবটা শুনল জয়ী। মুখ গম্ভীর। তারপর বলল, “শোন, এসব কথা যেন কেউ টের না পায়। বান্টি দাস খুব ভাল লোক তো নয়! তোর মুখ খোলাই উচিত হয়নি। বন্ধুদের মধ্যে যদি কেউ বলে দেয়, তা হলে কী হবে বল তো! তুই এত বোকা কেন?”

“আরে, অত ভয় পাচ্ছিস কেন? জাস্ট একটা হান্চ। মার্ডার কেস তো নয়!”

“হতেও তো পারে। আচ্ছা একটা কথা বলবি, তুই তো সবসময়ে ভাবের ঘোরে থাকিস, কিন্তু তবু তোর অবজ়ার্ভেশন এত শার্প হয় কী করে? তোর মনে আছে, আরত্রিকার বিয়ের দিন ছেলেপক্ষের লোকেদের মধ্যে একটা ভারী সুন্দর অল্পবয়সি মেয়েকে দেখে আমি বলেছিলাম, এই মেয়েটার সঙ্গে দাদার বিয়ে হলে দারুণ হবে। তুই তখন ফট করে বললি, মেয়েটা কিন্তু ম্যারেড। আমার বিশ্বাস হয়নি। সিঁদুর-টিদুর কিচ্ছু নেই, এত কম বয়স। তুই বললি, মেয়েটার বাঁ হাতে সোনায় লোহায় প্যাঁচানো নোয়া আছে। কিন্তু সেটা অত গয়নাগাঁটির মধ্যে চোখে পড়ারই নয়। পরে দেখলাম তোর কথাই ঠিক। এটা কী করে হয় বলবি? তুই তো শার্লক হোমস নোস।”

“আমার চোখে পড়ে গেলে কী করব!”

“ইলিনা কেমন দেখতে?”

“ভাল করে তো তাকাইনি। ইন ফ্যাক্ট তখন ডেডবডিটার ওপরেই অ্যাটেনশন ছিল। মনে হল মভ কালারের চুল, চোখদুটো ব্লুইশ, খুব ফরসা।”

“দেখতে সুন্দর?”

“হতে পারে।”

“বয়স কত?”

“স্কুলে পড়ে তো, কত আর হবে, ষোলো-সতেরো।”

“খুব সুন্দর?”

“কী করে বলি! আমি ওসব বুঝি না। তবে নাকের বাঁ পাশে একটা তিল ছিল বলে মনে হচ্ছে।”

“পরনে কী ছিল?”

“ড্রেস? একটা সাদা লং ফ্রক, পায়ে হাওয়াই চটি, হলুদ স্ট্র্যাপের।”

“তোর পছন্দ?”

“দূর, কী যে বলিস!”

“ভাল করে না দেখলে কি এত ডিটেলস বলতে পারতি? এমনকী, নাকের বাঁ দিকের তিলটা অবধি! তুই মেয়েটাকে হাঁ করে দেখেছিস! আর তোর পছন্দও হয়েছে।”

“বাজে বকিস না, আমি অত সহজে ঢলে পড়ি না।”

“কেন পড়িস না রে গাধা? এত রিপালশন ভাল নয়। এখন পর্যন্ত তোর একটাও গার্লফ্রেন্ড হল না। এর পর লোকে সন্দেহ করবে, তুই হোমো।”

“বাজে বকিস না। আমি বেশ আছি।”

“না, তুই মোটেই বেশ নেই। তোর একটা মেয়ে বন্ধু দরকার, না হলে তোকে গাইড করবে কে?”

রাজু অবাক হয়ে বলে, “গাইড! আমার আবার গাইডের কী দরকার পড়ল? তার ওপর আবার মেয়ে গাইড!”

“মেয়েরা প্র্যাকটিক্যাল হয় বলে বলছি।”

“দ্যাখ জয়ী, আগে তুই এত মেয়ে ছিলি না, আজকাল দেখছি খুব মেয়েলি হয়েছিস।”

“আমি তো একটা মেয়েই। আগে কি পুরুষ ছিলাম?”

“তা বলিনি, আগে তুই এত জেন্ডার কনশাস ছিলি না, তাই তোর সঙ্গে আমার বনিবনা হত। এখন হয়েছিস, তাই তোর সঙ্গে আমার বনছে না।”

“যা, তা হলে কাট্টি দিয়ে দে। এখন যা তো, আমি ড্রেস চেঞ্জ করব।”

তাদের এরকমই হয়। নতুন ঘটনা কিছু নয়। আড়ি আর ভাব। আর শেষ অবধি রাজুকেই আপস করতে হয়। বরাবর হয়ে আসছে।

কচুবাটা, নিম-সজনে, সিংড়ি, তড়কা, শিষপালং, রাজমা বা ছানা-ভাপা হলেই রাজুকে ছুটতে হয় পদ্মামাসির বাড়িতে। পৌঁছে দিতে। জয়তির বড় মায়া, আহা রে, মানুষটা একা থাকে, কে-ই বা রেঁধে-বেড়ে খাওয়ায়। আর পদ্মামাসির একটা লাখ টাকার হাসি আছে, রাজু গেলে যে হাসিটা হাসেন। সেটা দেখলে মোহর কুড়িয়ে পাওয়ার মতো একটা আনন্দ হয় রাজুর।

পদ্মামাসির সব কিছু টিপটপ, সাজানো-গোছানো, কোথাও কোনও বেগোছ বা বিশৃঙ্খলা নেই। যেখানকার জিনিস ঠিক সেইখানটাতেই আছে আবহমান। অদ্ভুত।

“আমার কী মনে হয় জানিস, তোকে গ্রে রংটা বেশ মানাবে। হাতেরটা শেষ হলে তোকে একটা সোয়েটার বুনে দেব, এই শীতেই পরতে পারবি।”

রাজু হেসে বলে, “তার আগে কলকাতার জন্য একটু শীতও তো বোনো। এখানে শীত কোথায় যে সোয়েটার চড়াব।”

“ওই দু’-চার দিন তো একটু পড়ে, তখন গায়ে দিবি।”

“তোমার আসলে বোনার নেশা। কাকে দেবে ঠিক করতে পারো না।”

“সে কথা ঠিক। সবজি ফিরি করতে আসে যে ইউসুফ, গতবার ওকেও তো একটা দিয়েছি। এত লজ্জা পেল, হাসিই বন্ধ হয় না। কী করব বল, সময় তো কাটে।”

এ বাড়িতে এলে দুধকফি বাঁধা। শুধুই দুধ এবং বেশ ঘন দুধ, কড়া মিষ্টি। জয়া জানে।

জয়ার মুখটা আজ গম্ভীর। রোজকার মতো মিষ্টি হাসিটা নেই তো আজ! কফিটা হাতে ধরিয়ে দিয়েই চলে গেল। অন্য দিনের মতো বলল না, ভাল তো রাজুদা?

রাজুর অনুসন্ধিৎসা আছে কিন্তু ছোঁকছোঁক করার অভ্যাস নেই। সে কিছু জানতে চাইলেও জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পায়। কফিটা ঠিক চার চুমুক খাওয়ার পর পদ্মামাসি খুব নিচু গলায় বললেন, “রতন তো তোর বন্ধু! তাই না?”

“হ্যাঁ তো! তবে আজকাল দেখা হয় না বড়-একটা। কেন বলো তো!”

“আর বলিস না। সে হঠাৎ করে জয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ করে দিয়েছে। মোটরবাইকে করে স্টেশন থেকে নিয়ে আসত, আবার রাতে পৌঁছেও দিত। এখন নাকি ফোনও বন্ধ। মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করছে। ঝগড়াঝাঁটিও নাকি হয়নি। তিন দিন হয়ে গেল।”

“তুমি চাইলে খোঁজ নিতে পারি। ও লাইনের ও-ধারে থাকে।”

“বাড়িতে নেই। গতকাল জয়া ওর বাড়িতে গিয়েছিল, রতনের মা বলে দিয়েছে, প্রেম করার সময় তো আমাকে বলে করোনি, এখন আমার কাছে এসেছ কেন? খুব ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। ছেলেদের কাছে প্রেম মানে ফুর্তি, মেয়েদের কাছে তো তা নয়। তাদের কাছে অবলম্বন। সংসার হবে, নিরাপত্তা হবে, থিতু হবে, সংসার বাড়বে। কত কষ্ট করে টাকা জমিয়ে বিয়ের জন্য তৈরি হচ্ছিল, একটু একটু করে গয়নাগাঁটিও কিনছিল। ওর বাপটা তো ছুতোর, ভালই রোজগার করে, কিন্তু হাড়কেপ্পন। বলে দিয়েছে, প্রেমের বিয়ে তাতে আবার দানসামগ্রী কীসের? এখন কী যে হবে! একটু দেখিস তো বাবা খোঁজ নিয়ে!”

রাজু হাসল না বটে, তবে হাসি পাচ্ছিল। একটু নিরাসক্ত গলায় বলল, “মাসি, ব্রেক আপ তো এখন জলভাত। তুমি আপসেট হচ্ছ কেন? দু’দিন পরেই দেখবে, জয়া এই সিচুয়েশনে সেট হয়ে গেছে।”

পদ্মাবতী একটু হেসে বলেন, “সে জানি বাছা, তবে কান্নাকাটি দেখলে মনটা উতলা হয় তো! কী করব বল, আমরা তো পুরনো দিনের মানুষ!”

“তুমি কী করে পুরনো দিনের মানুষ হলে? তুমি তো বহাল তবিয়তে এই যুগেই রয়েছ, তোমার চারদিকেই তো কনটেম্পোরারি! তুমিও কনটেম্পোরারি। তা হলে মনটাকে পিছনে ফেলে রাখবে কেন? তুমি তো এই যুগেরও মানুষ!”

“কী জানি বাবা, তুই হয়তো ঠিক কথাই বলছিস, কিন্তু এখন যা সব হচ্ছে তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না যে!”

“কেন পারবে না? প্রেজ়েন্ট টেন্সটাকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছ না বলেই পারছ না। তোমার ঘরজুড়ে বসে আছে পাস্ট টেন্স। বর্তমানটাকে ঢুকতে দাও, অতীতটা পালিয়ে যাবে।”

“ওরে ডাকাত, কী বলছিস, অতীত পালালে বাঁচব কী নিয়ে? পুরনো কথা ভেবেই তো মনটা ভরে থাকে। আর কী সম্বল আছে বল তো!”

“মাসি, আমার তো মনে হয় অতীত মানে ইতিহাস, আর ইতিহাসও কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। এগোয়, বদলে যায়। মানুষ বুড়ো হলে আর এগোতে চায় না, নিজের সময়টাকেও এগোতে দেয় না। কী মুশকিল বলো তো!”

পদ্মাবতী একটু লাজুক হেসে বলেন, “বয়স হলে ওরকমই সব হয় বোধ হয়। তবু তুই একটু দেখিস বাবা! এত ভাব ছিল দুজনের, হঠাৎ করে এমন কী হল কে জানে!”

সাইকেলের মতো এত ভাল জিনিস আর কিছুই নেই। এত সহজ, জটিলতাহীন, ঝামেলাহীন আর কী-ই বা আছে দুনিয়ায়। দুটো চাকাসর্বস্ব, উদোম, ন্যাংটো, গরিব একটা গাড়ি। তবু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। এতে চেপে ইচ্ছে করলে দুনিয়া ঘুরে আসা যায়। রাজুর সঙ্গে তার সাইকেলের খুবই ভাবসাব। দু’জনের বোঝাপড়াও চমৎকার। সেই কবে থেকেই সাইকেল তার শরীরেরই একটা সংযোজন হয়ে আছে। তার মাঝে-মাঝে মনে হয় সাইকেল আর সে অবিভাজ্য। সাইকেলে দুনিয়া না হোক, সারা কলকাতাই ঘুরে বেড়ায় সে।

পার্ক স্ট্রিটের একটা পার্কিং লটে ফি কালেকশনের চাকরি করে রতন। জয়ার হিরো। বেলা সাড়ে এগারোটা, স্ল্যাক টাইম। একটা রোগা গাছের তলায় কৃপণ ছায়ায় মাথা বাঁচিয়ে চারটে থাক করা ইটের ওপর বসে ছিল। হাতে পার্কিং মিটার। তাকে দেখে খুশিয়াল হাসি হেসে বলল, “কোথায় বেরিয়েছিলি? চা খাবি? আয়, এখানে বোস,” বলে সরে একটু জায়গা করে দিল।

সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রেখে একটু কেতরে রতনের পাশে বসল রাজু, “তোর প্রবলেমটা কী? নতুন কাউকে জুটিয়েছিস নাকি?”

“তোকে চুকলি কাটল কে? জয়া?”

“পদ্মামাসি।”

মোড়েই চায়ের গুমটি। রতন বলল, “আয়, আগে চা খাই।”

কী দারুণ চা! লিকার, দুধ আর চিনির এত ঠিকঠাক কম্বিনেশন আর্টের পর্যায়ে পড়ে। এ চা গ্র্যান্ডের বাবাও বানাতে পারবে না। গাছতলার সিংহাসনে ফের এসে বসল দু’জনে। রতন বলল, “খুব লোনলি লাগছে, কেন বল তো!”

“লোনলি?”

“হ্যাঁ। লোকজনের মধ্যে আছি, কথাটথাও হচ্ছে, কিন্তু একা ভাবটা যাচ্ছে না। প্রেম-ভালবাসা হচ্ছে, কিন্তু থ্রিল নেই। জয়া বকবক করে, আমিও জবাব দিই, কিন্তু কোনও ম্যাজিক নেই। কেমন গ্যাদগ্যাদে একটা ব্যাপার, বুঝলি! ঠিক ক্লিয়ার হল না তো! আমার কাছেও ক্লিয়ার নয়। প্রেম কে না করছে বল। সেই মান-অভিমান, সেই রেস্তরাঁবাজি, সেই বিয়ে, বাচ্চা। এক সিনারিও। মনে হল একটু ছুটকারা পাওয়া দরকার।”

“জয়াকে এসব বলেছিস নাকি?”

“ও বুঝবেই না। বলার একটু চেষ্টা করেছিলাম, কান্না জুড়ে দিল। কী হচ্ছে আমার বল তো! পেগলে যাব নাকি?”

“মনে হয় বোরডম।”

“তাই হবে। রোজ সকাল-বিকেল ডিউটি করার মতো প্রেম করতে আর ইচ্ছে করছে না। নতুন কথাও তো কিছু খুঁজে পাই না। এখনই যদি এরকম, তা হলে বিয়ের পর কী হবে বল তো!”

“জয়াকে বলে দিস, ইটস এ ব্রেক আপ।”

“আমার বলাটা ভাল দেখাবে না।”

“ফোনের সিম কার্ড চেঞ্জ করেছিস নাকি?”

“বাধ্য হয়ে। নইলে ফোনেই ঝালাপালা হয়ে যেতাম।”

“এখন তা হলে প্রেম-টেম নেই?”

“আছে।”

“আছে?”

“আগে আমি নন্দীবাবুদের গাড়ি চালাতাম। কড়েয়ায়। এখন সেখানেই আছি। এখন ওদের গাড়ি চালায় গণপত। সে সন্ধের পর চলে যায়। নন্দীবাবুর হার্ট ব্লক। যখন-তখন হসপিটালাইজ়ড করতে হতে পারে। তাই আমাকে মেডিক্যাল ইমার্জেন্সির জন্য রেখেছে। রাতে থাকতে হবে বলে মেজেনাইন ফ্লোরে থাকতে দিয়েছে। বুঝলি! জীবনে টেক্সটের বাইরে রবিঠাকুর পড়িনি। মেজেনাইন ফ্লোরের ঘরটায় একটা বুক-শেলফে অনেক বই আছে। একদিন কী ইচ্ছে হল তাক থেকে একটা বই টেনে পড়তে বসে গেলাম। রবিঠাকুরের বলাকা। মাইরি, কিছুক্ষণ পড়ার পর নেশা ধরে গেল। তারপর একটার পর একটা বই। রবিঠাকুর, জীবনানন্দ আরও অনেকের কবিতা। মাতালের মতো অবস্থা। তারপর নিজেও কিনতে শুরু করি। ওই যে রাস্তার ওপারে বইয়ের দোকানটা দেখছিস, এক বুড়ো পারসির দোকান। আমার কবিতা পড়ার নেশা আছে জেনে বলল, ইংরেজি পড়তে পারো? বললাম, বি এ ক্লাসে তো পড়েছি, একটু-একটু পারি। বুড়ো আমাকে এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড পড়তে দিল। প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধে হত ঠিকই, মোবাইলের ডিকশনারিতে মানে দেখে নিতে হত। কিন্তু নেশার ঝোঁকে সব বাধা টপকে গেলাম। তারপর একদিন ঝোঁকের মাথায় একটা খাতা কিনে নিজেও বসে গেলাম কবিতা লিখতে। সেগুলো কিছু হয় না আমি জানি। আগামী একশো বছরেও আমি কবি হয়ে উঠতে পারব না। কথা তো সেটা নয়, আসল কথা হল আমি আমার মতো করে একটা কিছু ক্রিয়েট তো করছি। ওতেই অদ্ভুত একটা আনন্দ। ছাতামাথা যাই হোক, ছাপার অযোগ্য বা অপাঠ্য যাই হোক, অনর্গল ভিতরের চাপাপড়া কথারা বেরিয়ে তো আসছে।”

একটু চুপ করে থেকে রতন বলে, “তোর অবাক লাগছে তো!”

রাজুর অবাক লাগছিল না। বলল, “না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। এরকম হতেই পারে। কিন্তু বেচারা জয়া কী দোষ করল? তাকে ডিচ করলি কেন?”

“জয়া বিয়ের জন্য পাগল। এমনকী, গয়নাগাটিও কিনে ফেলেছে। আমার বয়স মাত্র তেইশ। বিয়ে একটা সিস্টেম, বিয়ে করলে একটা ফরমুলায় পা দিতে হয়। তেমন রোজগারও নেই। আর আমার এখন একটু স্পেসও দরকার। শুধু জয়াকে খুশি করতে বিয়েটা করতেই-বা যাব কেন বল তো! বোঝালে বুঝতে চায় না।”

“তা হলে তোর ভার্ডিক্ট জয়াকে কিন্তু জানিয়ে দেওয়া উচিত। বেচারার বোধ হয় এখনও এক্সপেক্টেশন আছে।”

“জানাব। এখন জানালে খুব শক লাগবে। ক’দিন যাক, আমার ইমেজটা যখন একটু ফিকে হয়ে যাবে ওর মনে, তখন জানিয়ে দেব।”

“তোর মোটরবাইকটা কোথায়?”

“বেচে দিয়েছি। ভাল অফার ছিল, তাই ঝেড়ে দিলাম। লোন ছিল, সেটাও শোধ করতে হল।”

রাজু একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলে, “ভাল। জয়া গেল, মোটরবাইকও গেল!”

“ভাবছিস কেন, সব আবার হবে, ইন গুড টাইম। টাইমটাই ফ্যাক্টর, বুঝলি! কী মনে হয় জানিস, ভালবাসা-টাসারও একটা সময় আছে। জয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও হয়েছিল ভুল সময়ে। আর কিছু করার ছিল না বলে প্রেম করতাম। ওটা প্রেম নয়, জাস্ট টাইম পাস। প্রেম বলে মনে হত।”

হারাধন নায়েক মারা যাওয়ার তিন দিনের মাথায় লোকটা এল। খয়াটে, খেঁকুড়ে চেহারা, শ্যামলা, ভাঙাচোরা শ্রীহীন লম্বাটে মুখ, মাথায় এক টোকা চুল আর তাতে তেল-সাবান পড়েনি অনেকদিন। চেহারা দেখলে ভক্তিশ্রদ্ধা হওয়ার কথা নয়। তবে চোখ দু’খানা বেশ শান দেওয়া, চোখা চাউনি। গায়ে ঢলঢলে একটা পাঁশুটে রঙের হাওয়াই শার্ট, পরনে কালচে রঙের ঢোলা প্যান্ট। হাতে একটা বাঁশের ডান্ডিওয়ালা ছাতা। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে। বেলা সাড়ে দশটা হবে, কাজের মেয়ে সন্ধ্যা এসে খবর দিল, “তোমার কাছে কে একজন এসেছে, ভিতরে বসতে চাইল না, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

রজত নীচে নেমে এসে লোকটাকে দেখল, না, তার কোনও চেনা লোক নয় তো!

“আমাকে খুঁজছিলেন?”

লোকটা ভারী বিনয়ের সঙ্গে হাতজোড় করে কপালে ঠেকাল। তারপর বলল, “আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল, আপনার সময় হবে কি?”

“কী কথা বলুন?”

“আমার নাম সমর বসু। আমি হারাধন নায়েকের বাল্যবন্ধু।”

“কে হারাধন নায়েক বলুন তো!”

“মনে না থাকা স্বাভাবিক, মনে রাখার মতো লোক তো ছিল না। গ্রিন ভ্যালিতে থাকত, দিন তিনেক হল মারা গেছে। আপনি এবং আপনার বন্ধুরা…”

ঝট করে মনে পড়ে গেল রাজুর। বলল, “ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে পড়েছে। কী বলবেন বলুন। তবে আগেই বলে রাখি হারাধনবাবুর সঙ্গে আমার কিন্তু পরিচয় ছিল না। আমি শুধু ক্রিমেশনে ছিলাম, শ্মশানবন্ধু।”

লোকটা ভারী বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আজ্ঞে আমি তা জানি। তবে ওই বিষয়েই দু’-চারটে কথা ছিল। আপনার যদি এখন সময় না হয়, তা হলে আমি অন্য সময়েও আসতে পারি। আপনার যখন সময় হবে।”

রজত একটু ধাঁধায় পড়ে বলে, “কিন্তু হারাধনবাবুর বিষয়ে আমাকে বলে কি কোনও লাভ আছে?”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না, সেরকম কোনও লাভ নেই বটে, না জানলেও কোনও ক্ষতি নেই। তবু আমার মনে হয়েছিল কথাগুলো কাউকে জানানো দরকার, এই আর কী। আমি কয়েকজনকে বলার চেষ্টা করেছিলাম, তবে আমাকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। কোনওদিনই দেয় না। তা হলে আসি? নমস্কার।”

রজতের মনে হল, এটা বড্ড অভদ্রতা হয়ে যাচ্ছে। লোকটার ব্যবহারে একটা সত্যিকারের নম্রতা আছে, যেমনটা আজকাল দেখা যায় না। সে বলল, “আচ্ছা, আপনি আমার ঘরে আসুন।”

লোকটি ভারী খুশি হল। বলল, “আপনার যখনই শুনতে অনিচ্ছে হবে তখনই বলবেন, আমি বিদেয় হয়ে যাব।”

খুবই সংকোচের সঙ্গে প্রায় চোরের মতো সন্তর্পণে লোকটা তার পিছুপিছু ওপরে এল। পায়ের মলিন চটি জোড়া সিঁড়ির নীচেই খুলে রেখে এসেছে। ঘরে ঢুকল যেন ভিখিরি রাজপ্রাসাদে ঢুকছে। প্লাস্টিকের চেয়ারটায় জড়সড় হয়ে বসে বলল, “এত আপ্যায়ন আজকাল উটকো লোককে কেউ করে না।”

রাজু অবাক হয়ে বলে, “আমি আপ্যায়ন করলাম কোথায়?”

“এই যে ঘরে ডেকে আনলেন এটাই কি বড় কম কথা? ক’জন এটুকুও করে বলুন!”

রাজু হেসে ফেলে বলে, “আচ্ছা এবার বলুন তো কী বলতে চান?”

ছাতাটা দু’পায়ের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে হাতলে দু’হাতের ভর দিয়ে সমর বসু বললেন, “হারাধন যেদিন মারা যায় সেদিন আমি তার কাছেই ছিলাম।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। তারপরও আমি সারাক্ষণ আশপাশেই বিচরণ করেছি। আমার একটা সুবিধে হল আমি মশা-মাছির মতো একজন মানুষ বলে আমাকে লোকে লক্ষই করে না। এই আপনিই যেমন এখন কিছুতেই মনে করতে পারবেন না যে, আমি আপনাদের চারজন শববাহকের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনেছি। এমনকী আমি শ্মশানেও গেছি। বন্ধুদের চাপাচাপিতে আপনাকেই হারাধনের মুখাগ্নি করতে হয়েছিল তাও দেখলাম।”

“হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল লাগেনি। পুরুত আমাকে মন্ত্রও পড়িয়েছে। একটা মিথ্যাচার হয়ে গেল। কে জানে লোকটার নিজেরও হয়তো ছেলে আছে।”

“আছে। দুটো। তবে খবর পেলেও তারা বাপের মুখাগ্নি করত কি না তাতে সন্দেহ আছে। হারাধনের ওপর তাদের খুব রাগ। তাদের কথা থাক। সেদিন আপনারা চারজন রেস্তরাঁয় বসেছিলেন। আমি পাশের টেবিলেই এক কাপ চা নিয়ে বসেছিলাম। আমি শুনলাম আপনি বলছেন, এটা কিন্তু পুলিশ কেস ছিল। মনে আছে?”

রাজু অবাক হয়ে বলে, “কী আশ্চর্য, সত্যিই তো আপনাকে দেখেছি বলে মনেই পড়ছে না।”

“আমাকে অনেকেই দেখে, কিন্তু পরে আর আমাকে কেউই মনে করতে পারে না। আর এই জন্যই আমি ক্রিমিনাল হলে হয়তো খুব সাকসেসফুল হতাম। এই আপনার কথাই ধরুন, আপনার অবজ়ারভেশন সাংঘাতিক ভাল, আপনি তিনতলার জানালায় প্রায় অদৃশ্য একটা প্যাঁচাকেও লক্ষ করেছিলেন, কিন্তু আমাকে লক্ষ করেননি। যাকগে, আসল কথাটা হল, আপনি খুব ভুল বলেননি। ওটা সত্যিই পুলিশ কেস ছিল।”

রাজু ভ্রু তুলে বলল, “তাই নাকি?”

“ওই চারজনের মধ্যে সেদিন আপনাকেই আমার সবচেয়ে বিচক্ষণ আর স্থিতধী মনে হয়েছিল। কারণ, মৃতদেহ দাহ হওয়ার আগে আপনি সন্দেহটা প্রকাশ করেননি। করলে এবং বিশেষ করে বান্টিবাবু টের পেলে মৃতদেহ আটক হতে পারত, অটোপসির দাবিও উঠতে পারত।”

“এটা কি মার্ডার কেস সমরবাবু?”

“আপনার স্নানাহারের সময় হলে বলবেন, আমি চলে যাব।”

“তার দেরি আছে। আপনি বলুন।”

“কিছু লোক জন্মগত রিপালসিভনেস নিয়েই জন্মায়। তারা হয়তো তেমন কিছু খারাপ লোক নয়, তবু লোকে তাকে বিনা কারণেই অপছন্দ করতে থাকে। এই আমি হলাম তার এক পাথুরে দৃষ্টান্ত। মায়েদের ভালবাসা কমপালসিভ তাই তাঁর কথা বাদ দিচ্ছি, কিন্তু আমার বাবা এবং ভাইবোনেরাও আমাকে খুব একটা পছন্দ করত না। আমি যে মানুষের কতটা অপছন্দের লোক, তা টের পেলাম স্কুলে গিয়ে। ক্লাসে আমার সঙ্গে কেউই তেমন গল্পগাছা করত না। ঘনিষ্ঠতা দূরে থাক, সকলে যখন অফ ক্লাসে গল্প-টল্প করত, তখন কাঙালের মতো গিয়ে কাছটিতে বসে থাকতাম। আমার সঙ্গে হয়তো দু’-একটা কথা বলত, তারপরেই নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করত, আমার দিকে আর ফিরেও তাকাত না। কতজনের সঙ্গে কতভাবে ভাব করার চেষ্টা করেছি, ঘুষও দিয়েছি, ফাইফরমায়েশও খেটেছি, লাভ হয়নি। ঠাকুরের কাছে চোখের জল ফেলে প্রার্থনা করেছি, ঠাকুর, কেউ এক-দু’জন তো আমার বন্ধু হোক। হয়নি। বন্ধুহীন ওই বয়সটা আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। খেলাধুলো তেমন পারতাম না, লেখাপড়ায়ও ভাল নই, অন্য কোনও গুণও নেই। একা হওয়াই ভবিতব্য ছিল। এই দুঃসময়ে হঠাৎ ক্লাস সেভেনে হারাধন এসে ভর্তি হল। অন্য স্কুলে ডাব্বা মেরে এসে এই পচা স্কুলে ওপরের ক্লাসে অ্যাডমিশন পেয়ে গিয়েছিল। সে প্রথম দিনই আমার পাশে বসল। আর কী আশ্চর্য, দু’-একদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেল। আমাকে মোটেই হ্যাটা করত না হারাধন। অনেক গল্প করত, স্কুলের পর দু’জনে প্রায়ই একসঙ্গে বেরিয়ে অনেক দূর পাশাপাশি হাঁটতাম। আমার ভয় হত, বুঝি স্বপ্ন দেখছি, এক্ষুনি স্বপ্ন ভেঙে যাবে। সবেধন নীলমণি ওই একটা মাত্র বন্ধু পেয়ে আমি এত আত্মহারা যে, তার জন্য জীবন দিতে পারি। আমার বন্ধুক্ষুধা এতই তীব্র ছিল যে, আমি হারাধনকে পেয়ে তার অনুগতও হয়ে পড়তে থাকি। ঠিকঠাক বন্ধুত্ব হয়তো এরকম নয়, তাতে একটা সমান-সমান ভাব থাকে। কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে আমি যে তার ক্রীতদাস হয়ে যাচ্ছি এটা টের পেয়েও আমার কিছু করার ছিল না। রাজুবাবু, আপনার স্নানাহারের সময় হলে বলবেন, ভদ্রতাবশে আমাকে প্রশ্রয় দেবেন না।”

“আরে না, এখন মাত্র সোয়া এগারোটা, আমি দুটোর আগে খাই না।”

“আমার বাচালতা অপছন্দ হলেও তা জানাতে দ্বিধা করবেন না।”

“আপনি বলুন।”

“আমার ভাগ্য বড়ই ভাল। কারণ, বি এ ক্লাসে পড়ার সময়েই আমি হঠাৎ ডাকঘরে পিয়নের চাকরি পেয়ে যাই, আমার এতবড় সৌভাগ্য আমি কল্পনাও করিনি কখনও। হারাধন আরও দু’বার ফেল মেরে ম্যাট্রিক পাশ করল টেনেমেনে। আমাকে বলল, জানিস তো, লেখাপড়া শিখে উন্নতি করতে গেলে বুড়োবয়স হয়ে যাবে। তাই সে শুরু করল ব্যাবসা। তার বাবার একটা ওষুধের ছোট দোকান ছিল, খুব ভাল চলত না। সে দোকানের ভার নিয়ে এক্সপ্যানশনের জন্য উঠেপড়ে লাগল। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়া তো আছেই, তা ছাড়াও সে চোরাগোপ্তা ড্রাগেরও কারবার শুরু করে। আমি বরাবর তার বশংবদ। তার জন্য হেন কাজ নেই যা আমি পারি না। ড্রাগের কারবারেও সে আমাকে কাজে লাগায়। কারণ, আমি ডাকপিয়ন বলে আমার মুভমেন্ট সন্দেহজনক নয়। আমি তার ড্রাগ খদ্দেরদের কাছে অম্লানবদনে পৌঁছে দিয়েছি। দুনিয়ায় সে আমার একটিমাত্র বন্ধু, তাকে আমি কিছুতেই হারাতে চাইনি। তাকে খুশি করার জন্য নৈতিকতাও আমার চুলোয় গেল। অবশ্য তার ওষুধের কারবার ফুলেফেঁপে ওঠায় সে ড্রাগের কারবার বন্ধ করে দেয়। পুলিশও পিছনে লেগেছিল। আমার ডাকঘরের কাজ শেষ হলে সন্ধের সময় আমি তার ওষুধের দোকানে গিয়ে হিসেবপত্র দেখতাম। পার্টটাইম হিসেবে। হারাধন তার জন্য আমাকে পয়সা দিত। না দিলেও আমি কাজটা করতাম। সে ক্রমশ অর্থবান হচ্ছে দেখে আমি বড় খুশি। তার আহ্লাদী বউ হল কমলিকা, বেশ ভালবাসাও ছিল তাদের মধ্যে। আমার মতো তো নয়।”

“আপনি বিয়ে করেননি?”

“করতে হয়েছে। তবে আমার মতো মানুষকে কোনও মেয়ের পক্ষে যে ভালবাসা সম্ভব নয়, তা আমি জানি। স্ত্রীলোকের প্রত্যঙ্গ ছাড়া আমাকে আমার স্ত্রীর আর কিছুই দেওয়ার ছিল না। আমার মতো লোকের তাইতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তবে হারাধন অল্পে খুশি হওয়ার লোক নয়। তার দোকানের সংখ্যা বাড়ল, টাকা বাড়ল, স্ত্রীলোকের সংখ্যাও বাড়ল। নানারকম মেয়েমানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক হতে লাগল। ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও প্রবল অশান্তি। ছেলেরা বড় হচ্ছে, ব্যাপারটা তারাও বুঝতে পারছে। হারাধন আমাকে অনেক কথাই বলত, তার স্লোগান ছিল, পুরুষমানুষ কি একটা মেয়েমানুষে আটকে থাকতে পারে? তার সব কথাই আমার যুক্তিযুক্ত মনে হত। তার নারী মৃগয়ার ইতিহাস দীর্ঘ। সেটা ঘেঁটে কোনও লাভ নেই। বরং আসল কথায় আসি। আপনি খেয়াল করবেন আপনার স্নানাহারের সময় হল কি না। আমি ঝোঁকের মাথায় কথা বলে যাচ্ছি তো।”

“না, ঠিক আছে। আপনি বলুন।”

“যে আজ্ঞে। নীলাঞ্জন ঘোষ ছিলেন হোটেলিয়ার এবং ট্রাভেল এজেন্ট। ব্যবসায়িক সূত্রেই তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল হারাধনের। তখন নীলাঞ্জনের অনেক টাকা ধার হয়ে গেছে, ব্যাবসায় মন্দা। হারাধনের সঙ্গে তার কী চুক্তি হয়েছিল তা আমি জানি না, ওসব বড়-বড় ব্যাপার আমাকে বলতও না হারাধন। তবে নীলাঞ্জনের ব্যাবসায় টাকা ঢেলেছিল সে। অনেক টাকা। ব্যাবসা বাঁচল বটে, কিন্তু নীলাঞ্জন নয়। ডাক্তার রায় দিয়েছিল অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মৃত্যু। পিছনে কোনও রহস্য থাকলেও থাকতে পারে, আমার জানা নেই। মৃত্যুর পর দেখা গেল ব্যাবসার মালিকানা হাতবদল হয়ে গেছে। তা হারাধনের দখলে। নীলাঞ্জনের বউ-মেয়ের পথে বসার অবস্থা। হারাধন অবশ্য তখন বন্ধুর মতোই তাদের পাশে দাঁড়ায়। নীলাঞ্জনের স্ত্রী তামসী সুন্দরী। হারাধন আমাকে একদিন বলে, সে কমলিকাকে ত্যাগ করে তামসীকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চায়। ঘরে তুমুল অশান্তি শুরু হল। তিতিবিরক্ত হারাধন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল এবং তামসীকে নিয়ে নতুন আস্তানায় ডেরা বাঁধল। হারাধনের কোনও সিদ্ধান্তকেই আমার ভুল বলে মনে হত না। সত্যিই তো, এতকাল বিবাহিত জীবন যাপন করার পর একঘেয়েমি তো আসতেই পারে। আমাদের না হয় উপায় নেই, কিন্তু যার উপায় আছে সে কেন পুরনো বন্ধনে পড়ে থাকতে যাবে! এখন দুনিয়ার ট্রেন্ড তো সেদিকেই। আপনি সময়ের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন, আপনার কাজে বিঘ্ন ঘটলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে।”

“মাত্র পৌনে বারোটা বাজছে। আপনার চিন্তা নেই।”

“আপনার অশেষ অনুগ্রহ। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। গ্রিন ভ্যালিতে নতুন জীবন শুরু হল হারাধনের। বউ আর ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক বিষাক্ত, তবে তার দুই ছেলেই সাবালক, ব্যবসায়িক পার্টনার। সুতরাং ছেলেদের সঙ্গে একটা ফর্মাল যোগাযোগ ছিল মাত্র। আর আমি ছিলাম দুই পরিবারের মধ্যে একটা ক্ষীণ যোগসূত্র। আসলে আমি হারাধনের হয়ে আড়কাঠির কাজ করতাম। কমলিকা আর হারাধনের ডিভোর্সের মামলা চলছে, কমলিকা ডিভোর্স দিতে রাজি নয়, তাই কমলিকাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করানোর ভারও হারাধন আমাকে দিয়েছিল। তাতে অবশ্য কাজ হত না। আমি তেমন কোনও কুশলী, বাকপটু লোক তো নই। আমি প্রায় রোজই গ্রিন ভ্যালিতে যেতাম। তামসী, কেন জানি না আমাকে পছন্দ করতেন। চা এবং সুস্বাদু বিস্কুট খাওয়াতেন। অনেক গল্পও করতেন। কিছুদিন পর আমি লক্ষ করি তামসী একটু গম্ভীর এবং চিন্তিত। মুখে উদ্বেগের ছাপ। সেইটা ক্রমে বাড়তে লাগল। হঠাৎ একদিন বললেন, আপনি মেয়েদের কোনও হস্টেলের খবর দিতে পারেন? আমি বললাম কার জন্য? উনি বললেন, ওঁর মেয়ের ওখানে অসুবিধে হচ্ছে। আমি অপদার্থ হলেও আমি কিছু জিনিসের গন্ধ পাই। কথাটা শোনামাত্র আমি বুঝলাম, ওঁর কিশোরী মেয়েটির প্রতি হারাধনের আগ্রহ জন্মেছে। মেয়েটিকে আপনিও দেখেছেন। আপনার কি মনে হয় না যে, মেয়েটির একটি এথেরিয়েল বিউটি আছে?”

“আমি অত বুঝি না, খুব ভাল করে দেখিওনি। তবে বোধ হয় চেহারাটা একটু অন্যরকম।”

“হ্যাঁ, অন্যরকমই বটে। নিষ্পাপ ভাল মেয়ে। হারাধনের মেয়ের মতোই। কিন্তু আদিম প্যাশনের কাছে পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্ক অনেক সময়ে খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। এই জন্যই অনেক সময়ে বালিকা বা কিশোরীরা তাদের বাবার কাছেও নিরাপদ নয়। খবরের কাগজে এরকম খবর আকছার পাওয়া যায়। আর এ তো রক্তের সম্পর্কও নয়। আমি তামসীকে বললাম, আপনি আমাকে অকপটে বলুন আপনার মেয়ের ঠিক কী ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। কারণ, কিছুদিন ধরেই আপনাকে আমি উদ্বিগ্ন দেখছি। আমাকে দুর্বল অপদার্থ ভেবে উপেক্ষা করবেন না, তা হলে মস্ত ভুল হবে। এ কথায় তামসী ভেঙে পড়লেন, কাঁদলেন এবং বললেন, কিছুদিন যাবৎ হারাধন প্রায়ই রাতে ড্রিংক করে এসে ইলিনাকে তার কাছে পাঠাতে হুকুম করছে। তারপর নিজেই গিয়ে ইলিনার দরজায় নক করছে। ছুটির দিনে ইলিনাকে ভাল রেস্তরাঁয় খাওয়াতে নিয়ে যেতে চাইছে ইত্যাদি। তাঁরা মা আর মেয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কে আছেন এবং নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। তাঁরা দু’জনেই কার্যত পণবন্দি। তাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই, টাকাপয়সা নেই, বলভরসা নেই। শুনে আমার মনে হল, এরকম হওয়া উচিত নয়, এটা ঠিক হচ্ছে না। আমি বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না। এর একটা বিহিত হবে। তবে আমার জানা দরকার হারাধনের কাছ থেকে মুক্তি পেলে আপনার সম্বল কী। তিনি মাথা নেড়ে জানালেন, তাঁর কোনও সম্বল নেই। শুধু তিনি শুনেছেন হারাধনের সঙ্গে তাঁর একটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট আছে আর তাতে নাকি পঞ্চাশ লক্ষ টাকাও আছে, কিন্তু চেকবই বা এটিএম কার্ড হারাধনের কাছে। হারাধন তাঁদের পিছনে দেদার খরচ করে বটে, কিন্তু ভাণ্ডার খুলে দেয় না। আমার অযোগ্যতা সীমাহীন। কিন্তু আমি কিছু কাজ খুব নৈপুণ্যের সঙ্গে করতে পারি। আমি বাড়ি ফিরে গভীর রাত্রি পর্যন্ত জেগে রইলাম। আমাদের সকলের ভিতরেই একটি করে আদালত থাকে, আর বাইরে কিছু করে উঠতে না পারলেও আমাদের অভ্যন্তরীণ আদালতে আমরা নিত্যই নানা অপরাধীর বিচার করে শাস্তির বিধান দিই। সেই রাত্রে আমি জীবনে প্রথম হারাধনকে অপরাধী সাব্যস্ত করলাম। আপনি যে এতক্ষণ ধরে আমার কথা শুনছেন, তাতে আমি আপ্লুত, কিন্তু রজতবাবু, আপনার স্নানাহারের যে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে!”

“না তো, আপনি খুব বেশি সময় নেননি! এখন বারোটা মাত্র।”

“তবে বলি। এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল। পৃথিবীতে সে আমার একমাত্র বন্ধু। তার প্রতি আমার অন্ধ আনুগত্য। কিন্তু মনে হল, এর একটা শেষও থাকা দরকার। আপনি কি দাবা খেলা জানেন?”

“একটু আধটু।”

“দেখবেন, অনেক সময়ে প্রতিপক্ষের একটিমাত্র গুটির স্ট্র্যাটিজিক অবস্থান আপনার পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সেই গুটিটা নড়ে গেলেই আবার আপনি নিরাপদ। হারাধন হল সেই গুটিটা। কঠিন সিদ্ধান্ত। আমি প্রথমেই হারাধনের কারেন্ট অ্যাকাউন্টের চেকবই থেকে একদম পিছনের দিককার একটা পাতা ছিঁড়ে নিলাম। হারাধনের সই আমি চোখ বুজেও হুবহু নকল করতে পারি। দুর্বলদের এইসব নৈপুণ্য থাকেই। একটা বড় অ্যামাউন্টের অঙ্ক বসিয়ে চেকটা তৈরি রাখলাম। তবে জমা দিলাম না। হারাধন নানা অসুখে ভুগত। ডায়াবিটিস, হাই প্রেশার, প্রস্টেট, থাইরয়েড, হাই কোলেস্টেরল, হার্টে ব্লকেজ ইত্যাদি। সে কোন কোন ওষুধ খায়, কখন খায় সব আমার মুখস্থ। সকালের দিকে সে যেসব ওষুধ খেত তার মধ্যে একটা খয়েরি রঙের ক্যাপসুল ছিল। আমি সেই ক্যাপসুলটাই বেছে নিই, দোকান থেকে সেটা তুলে নিতে কোনও কষ্ট নেই। কারণ, আমি তার দোকানেই কাজ করি। ব্লিস্টার স্ট্রিপ। ব্লিস্টারের দিকে শক্ত প্লাস্টিকটা নিপুণ ব্লেডের ছোঁয়ায় কেটে ক্যাপসুলটা বের করে ওষুধটা ফেলে দিয়ে অন্য একটা টক্সিন ভরে ক্যাপসুলটা আবার জুড়ে ব্লিস্টারে ভরে কাটা জায়গাটা কুইক সিল দিয়ে লাগিয়ে হারাধনের ওষুধের টেবিলের স্ট্রিপটার জায়গায় রেখে দিই। তারপর একটু অপেক্ষা। সে কবে ওই ক্যাপসুলটা খাবে তাও আমার হিসেব করা ছিল। সেদিন আমি ছুটি নিয়েই রেখেছিলাম। আমার স্ত্রী আমাকে বিদ্রুপ করে মাঝে-মাঝে বলেন নেংটি ইঁদুর। বাস্তবিক আমি নিজের সঙ্গে নেংটি ইঁদুরের অনেক সাদৃশ্য দেখতে পাই। মাটির কাছাকাছি ইঁদুরের অবস্থান, নানা রন্ধ্র, নানা অলিগলি সে চেনে। আমিও তাই। জয়শীল রায় একজন ভাঙাচোরা মানুষ, বারোমাস মানসিক অবসাদে ডুবে থাকেন, তাঁর বউ তাঁকে ছেড়ে তাঁরই এক বন্ধুর সঙ্গে চলে গেছে, প্র্যাকটিস নেই, ড্রাগের নেশা এবং বাজারে প্রচুর ধার। ডাক্তারি ডিগ্রিটা ছাড়া আর কিছুই নেই তাঁর। আমি মাঝে-মাঝেই তাঁর কাছে যাই। কারণ, ব্যর্থ হেরো মানুষদের আমার বড় আপনজন বলে মনে হয়। তাদের মধ্যে যেন নিজেকেই খুঁজে পাই। ডেথ সার্টিফিকেটটা লেখার জন্য আমি তাঁকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিলাম, যে টাকাটা হারাধন মারা যাওয়ার পর পরই আমি তার অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে আনি অবশ্যই সই জাল করে। এত সব করার পরেও মনে খুঁতখুঁতুনি ছিলই। ধরা পড়ে যাব না তো! ধরা পড়লেও আমার কিছুই হবে না আমি জানি। আমি সন্দেহের অতীত। কিন্তু হয়তো বিপদে পড়বেন তামসী আর তাঁর মেয়ে। আপনি হয়তো জানেন না, কমলিকা আর তার ছেলেরা ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে একটা খুনের অভিযোগ দায়েরও করেছে।”

রজত বিস্ফারিত চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে এই ছোটখাটো খেঁকুরে চেহারার লোকটির দিকে তাকিয়ে ছিল। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! এবার একটা বদ্ধ শ্বাস মোচন করে বলল, “আপনি সত্যি বলছেন!”

লোকটা হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে আমার কথাকে কেউই কখনও গুরুত্ব দেয়নি। আপনি না দিলেও ক্ষতি নেই। পৃথিবীতে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল হারাধন, একমাত্র সেই আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করত না, আমার ওপর টানও ছিল খুব। বলত, শরীরের খেয়াল রাখিস। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস তো? যখন ক্যাপসুলটা হাতে নিয়েছে, বাঁ হাতে জলের গেলাস, তখনও কথা বলছিল আমার সঙ্গে। বলছিল, পুরনো বন্ধুরা কে কোথায় আছে বল তো, অনেকদিন কারও খোঁজ নেওয়া হয়নি। একমাত্র তুই ছাড়া আর কারও সঙ্গেই দেখা হয় না। আমার চোখে জল আসছিল, গলায় কান্নার দলা। একবার মনে হল বলি, ক্যাপসুলটা খাস না, ফেলে দে। বলা হল না। ক্যাপসুলটা গিলে ফেলার পর বলল, তোর মেয়ের তো বিয়ের বয়স হল, না? বিয়ে ঠিক হলে আমাকে বলিস। নেকলেস আর বেনারসিটা আমিই দেব। আমি বললাম, সে তো তুই অনেক আগে থেকেই আমাকে বলে রেখেছিস। হেসে বলল, আজকাল অনেক কথা ভুলে যাই। বয়স হল নাকি রে! আমার কথা আটকে যাচ্ছিল, আমার সামনে তখন এক ভয়ংকর একাকিত্বের করাল ছায়া। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। আমি একটু শুই। তুই দরজাটা টেনে দিয়ে যাস। আমার শোকের সময় ছিল না। অনেক কাজ বাকি, তাই চলে এলাম। দরজাটা চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে।”

রজত চিন্তিত মুখে লোকটার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “সমরবাবু, এসব কথা আমাকে জানানো কি ঠিক হল?”

“তা তো জানি না। কিন্তু এই যে আপনার কাছে সব কবুল করলাম, তাতে আমার মনোভার অনেক কমে গেছে। আপনাকে একজন স্থিতধী, বিবেচক এবং সুস্থির মানুষ বলে আমার মনে হয়। আপনার বয়স খুব কম, তবু আপনাকে অপরিণত বলে মনে হয় না। কমলিকা আর তার ছেলেরা খুনের অভিযোগ করেছে। পুলিশ হয়তো তদন্ত করবে। আপনি শ্মশানবন্ধু ছিলেন, কাজেই আপনাকেও হয়তো জেরা করা হবে। আমি শুধু বলতে চাই তামসী আর ইলিনা নির্দোষ। আপনাকে অনেকক্ষণ বিরক্ত করেছি, মাপ করবেন। এবার আপনি স্নানাহার করুন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *