১. পদ্মাবতীকে একটা চুমু

অধ্যায়: ১

পদ্মাবতীকে একটা চুমু খেলেন সত্যচরণ।

এখন সকাল, আটটা বাজতে সাত মিনিট বাকি। আশ্বিন মাস। গত ফাল্গুনে সত্যচরণ সাতাত্তর পেরিয়ে এসেছেন, পদ্মাবতী আগামী মাঘ মাসে একাত্তরে পা দেবেন। গত আষাঢ় মাসে তাঁরা তাঁদের সম্পর্কের পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্ণ করেছেন। তবু এখনও পদ্মাবতীকে চুমু খেলে সত্যচরণের একটা পাপবোধ হয়। পদ্মাবতী অবশ্য কোনও আপত্তি করেন না, সত্যচরণ আরও এগোলেও আপত্তি করতেন না হয়তো। কিন্তু ভিতু সত্যচরণ আরও এগোতে আর সাহস পাননি।

পুবদিকের দেওয়ালে টাঙানো মস্ত এলসিডি টিভিটার ওপরেই অরুণাংশুর বাঁধানো ছবিটা টাঙানো। অল্পবয়সের ছবি। হ্যান্ডসাম, মাথাভর্তি ঘন চুল, উজ্জ্বল বুদ্ধির ঝিলিক দেওয়া চোখ। এগারো বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। বলতে গেলে সত্যচরণের হাতে মাথা রেখে।

পদ্মাবতী এখনও বেশ ছিপছিপে, হাঁটুর ব্যথা আর মার্জিনাল ব্লাডশুগার ছাড়া তেমন কোনও অসুখবিসুখ নেই। পাকা চুলে কলপ করেন বলে, বয়স একটু কম দেখায়। উল বোনার ভীষণ নেশা, ওটাই বলতে গেলে পাসটাইম। এখনও হাতে উল আর কাঁটা। একটু সিরিয়াস মুখ করে নরম গলাতেই বললেন, “এই বয়সে উত্তেজনা ভাল নয় কিন্তু!”

কথাটা ঠিক। চুমুটা খেয়ে সত্যচরণের বুকটা একটু বেশি জোরে ধকধক করছিল। তাঁর হার্ট দুর্বল। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, “আজ সকালটায় কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠেই মনে হল হাতে যেন আর সময় নেই, তাড়াতাড়ি সবকিছু সেরে নিতে হবে। কিন্তু কী সারতে হবে, কেন সেরে ফেলতে হবে সেটা স্পষ্ট নয়। খুব তাড়াতাড়ি তো আজকাল কিছুই করে উঠতে পারি না, জোর করে তাড়াহুড়ো করলে হাঁফিয়েও যাই। তবু আজ সকালের সব কিছু বেশ চটপট সেরে ফেললাম। ভাবলাম, কে জানে আজই মারা-টারা যাব কি না। বয়সটা তো হাইলি আনপ্রেডিক্টেবল। মর্নিং ওয়াক সেরেই তোমার কাছে চলে আসার সেটাও একটা কারণ।”

পদ্মাবতী ভ্রু কুঁচকে বললেন, “গত সপ্তাহেই তোমাকে চেক আপ করার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম না! করিয়েছ?”

“না, হয়ে ওঠেনি। জয়তির হঠাৎ ভাইরাল ফিভার হওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।”

“ওটা অজুহাত। জয়তি তো ফোনে আমাকে বলল, জ্বর নিয়েই প্যারাসিটামল খেয়ে গড়িয়াহাটায় গিয়েছিল পুজোর বাজার করতে। নিজের শরীরকে বড্ড হেলাফেলা করো তুমি। আজই ডাক্তার গুপ্তর কাছে যাও তো! অবাধ্যতা করবে না একদম।”

“ঠিক আছে, যাব। টেনশন কোরো না।”

“ওটা বলা সোজা, টেনশন কোরো না। টেনশন না হয়ে পারে? সব সময়ে হাঁ করে কী আকাশ-পাতাল ভাবো বলো তো যে, এত জরুরি একটা ব্যাপার মনে থাকছে না?”

সত্যচরণ তটস্থ হয়ে বললেন, “আমি একটু অন্যমনস্ক, তা তো জানোই। আর এটা বোধ হয় জেনেটিক। কিন্তু টেনশন করতে বারণ করছি, তার কারণ, আমার তো শরীর খারাপ হয়নি। মনটা একটু পিকিউলিয়ার বিহেভ করছে। সেটা কোনও সিরিয়াস ব্যাপার বলে আমার তো মনে হয় না।”

“তা হলে ভয় পাওয়ানোর মতো কথা বলোই-বা কেন? মারা-টারা যাব কি না, এটা কেমন কথা? শুনলে লোকের চিন্তা হবে না?”

সত্যচরণ মৃদু একটু হাসলেন।

“ওই চোরের মতো হাসি দিয়ে কিন্তু আমাকে ভোলানো যাবে না। আমিই ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিচ্ছি।”

“আরে না। ডাক্তার গুপ্ত বন্ধুমানুষ, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই আমাকে দেখেন।”

“কিন্তু তুমি ঠিক যাবে তো?”

“যাব। তুমি যখন বলেছ ঠিক যাব। তবে এসব কথা তো আর ডাক্তারকে বলা যাবে না যে, সকালে উঠেই আমার হঠাৎ মরার কথা মনে হয়েছে আর তাই ছুটে এসেছি!”

পদ্মাবতী এবার নিজেও হাসলেন। আগে, দশ-বারো বছর আগেও পদ্মাবতী হাসলে মাজনের বিজ্ঞাপন বলে মনে হত, এত ঝকঝকে আর পরিপাটি দাঁতের সারি ছিল তাঁর। এখন সামনের ওপরের পাটির দু’দিকের দুটো আর নীচের পাটির তিনটে দাঁত নেই। ততটা নেই আর হাসির ম্যাজিক, তবু হাসলে সত্যচরণের চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। পদ্মাবতী উলকাঁটা বেতের একটা ছোট্ট চুপড়িতে রেখে বললেন, “আমার তো মনে হয় ডাক্তারকে সব কিছুই জানানো ভাল। ওরকম যে মনে হল তারও নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে।”

সত্যচরণ পদ্মাবতীকে ওঠবার উপক্রম করতে দেখে বলেন, “হঠাৎ উঠছ যে!”

“তোমার জন্য এক কাপ ব্ল্যাক কফি করে নিয়ে আসি। শুনেছি ব্ল্যাক কফি খেলে কনসেনট্রেশন বাড়ে, মনটাও নাকি একটু ঝরঝরে লাগে।”

“ব্ল্যাক কফি নিয়ে অনেক মিথ তৈরি হয়েছে। সব বিশ্বাস করো নাকি? তুমি উঠছ কেন? জয়া তো এসেই পড়বে।”

“জয়া সাড়ে আটটার আগে আসবে না। তারপর ট্রেনের মেজাজ-মর্জিও আছে। আর ব্ল্যাক কফি সবাই তো বানাতে পারে না!”

“আমার তো তাড়া ছিল না।”

“আজ আমারও একটু খেতে ইচ্ছে করছে। বোসো না, ইলেকট্রিক কেটলিতে বানিয়ে নেব, সময় বেশি লাগবে না।”

পদ্মাবতী দাঁড়ালেন। পরনে একটা হাউসকোট, হালকা নীলের ওপর সূর্যমুখীর ছাপ। পদ্মাবতী বেশ লম্বা, তবে ঢ্যাঙা নন। যৌবনের চটকটা আর নেই, কোনওক্রমে যাই-যাই একটু রূপ এখনও চৌকাঠ ডিঙিয়ে যাওয়ার আগে একটু থমকে আছে। কিংবা সেটা সত্যচরণের দেখার ভুলও হতে পারে। পদ্মাবতীকে তিনি কখনও কি নির্মোহ চোখে দেখেছেন? সে দেখা যেন তাঁকে দেখতেও না হয়।

পদ্মাবতীর ফ্ল্যাটটা বড়ই। তিন তলায় তিনটে শোওয়ার ঘর আর এই বিশাল লিভিং রুম। পদ্মাবতীর দিন রাত এই ঘরটাতেই কাটে। ছেলে মন্টু অস্ট্রেলিয়ায়, মেয়ে তটিনী চণ্ডীগড়। পদ্মাবতী একা এবং এই একাকিত্ব তাঁর বিশেষ প্রিয়ও বটে। বলেনও, “আমি একাই সবচেয়ে ভাল থাকি। আমি কাউকে মিস করি না। ছেলেমেয়ে শুনলে দুঃখ পাবে হয়তো, কিন্তু আমি একা হলেই জীবনটাকে বেশি বুঝতে পারি।”

দুটো মাগে করে ব্ল্যাক কফি নিয়ে এলেন পদ্মাবতী। সত্যচরণ যে কালো কফি খুব পছন্দ করেন তা নয়। তবে খেয়েও নেন। উপভোগ করেন না অবশ্য। পদ্মাবতীও কালো কফির ভক্ত নন। তবে বোধ হয় কালো কফির উপকারিতার জন্যই আজ এই আগ্রহটা। দু’জনে ডাইনিং টেবিলের পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে কফি খেতে লাগলেন। পদ্মাবতী সত্যচরণের দিকে চেয়ে একটু স্মিতমুখে বললেন, “বাব্বা, চুমুকের যা শব্দ!”

সত্যচরণ বলেন, “আসলে ভাল লাগানোর চেষ্টা করছি। শব্দটা তারই বিজ্ঞাপন।”

পদ্মাবতী সস্নেহে বলেন, “হ্যাঁ গো, বেশি কড়া হয়ে গেছে নাকি? খুব কষ্ট হলে খেয়ো না।”

“আরে না, ঠিকই আছে। আমার খারাপ লাগছে না। মনে-মনে দুধ-চিনি মিশিয়ে নিচ্ছি।”

“যত বয়স বাড়ছে তত দুষ্টু হয়ে যাচ্ছ কিন্তু।”

আলটপকা সত্যচরণের একটা কথা মনে এল। পদ্মাবতীর ভূতের ভয় নেই। পদ্মাবতী একা এই ফ্ল্যাটে দিব্যি থাকেন। সত্যচরণের আবার ভীষণ ভূতের ভয়। এতটাই যে, কখনও একা ঘরে শুতে পারেন না। নতুন বিয়ের পর ভাড়াবাড়িতে সবে সংসার পেতেছেন। জয়তির একবার দরকার পড়েছিল বাপের বাড়ি যাওয়ার। বোধ হয় এক বন্ধুর বিয়েতে। সত্যচরণ নানাভাবে ফাঁড়া কেটে যাওয়াটা আটকাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু লাভ হয়নি। জয়তি চলে যাওয়ার পর সন্ধের পর বাড়ি ফিরে ঠিক করলেন সাহস করে একাই থেকে দেখবেন। কিন্তু রাত বাড়তেই এমন ভয় চেপে ধরল যে শেষপর্যন্ত রাস্তা থেকে এক বুড়ো ভিখিরিকে পঞ্চাশ টাকা কবুল করে নিয়ে এসে ঘরে শুইয়েছিলেন। সেই ঘটনা চাউর হতে সময় নেয়নি। আজও তাঁর কাপুরুষতার সেই কাহিনি প্রচারিত আছে। তাঁর ছেলেমেয়েরাও জানে।

সত্যচরণের পকেটে মোবাইলটা বাজছে। বাজবারই কথা। তিনি কোথাও বেরোলে জয়তি ঘনঘন ফোন করতে থাকে। ঠিক আছ তো! কত দূরে আছ? ফিরতে কত দেরি হবে? ফোনটা বের করে দেখলেন, জয়তিই।

“বলো।”

“কোথায়?”

“এই তো পদ্মাবতীর ফ্ল্যাটে। কফি খাচ্ছি।”

“আজ এত ভোর-ভোর বেরিয়ে গেছ কেন? যাওয়ার সময়ে বলেও যাওনি!”

“হ্যাঁ, আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছি। তুমি তখন ঘুমোচ্ছিলে।”

“তুমি তো জানো, সকালে উঠে প্রথম তোমার মুখ না দেখলে আমার দিন ভাল যায় না!”

সত্যচরণ একটু দ্রব হয়ে পড়লেন। যদিও কুসংস্কার তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছেও করে। কারও কাছে তাঁর এতটা দাম আছে, এ কি কম কথা? একটু নরম গলায় বললেন, “হ্যাঁ, জানি তো! কিন্তু তোমার ঘুমের সমস্যা আছে বলেই ডাকিনি। দেখলাম নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছ, তাই ডাকতে মায়া হল।”

“রোদ বেশি চড়ার আগেই চলে এসো কিন্তু।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই একটু কথা বলছি, একটু বাদেই ফিরব।”

পদ্মাবতী ফের উলকাঁটা হাতে নিয়েছেন। বুনতে বুনতেই বললেন, “তোমার বউ কিন্তু তোমার জন্য খুব ভাবে। এত ভালবাসা, তবু তোমার গাল ওঠে না কেন?”

কফিটা শেষ করলেন সত্যচরণ, মুখটা তেতো স্বাদে ভরে আছে। জিবের তিক্ততা নিয়েই বললেন, “ওটা ভালবাসা নয়, বাতিক।”

“ভালবাসা তবে কেমন হয় বলো তো, আমি তো জানি না। আমার ছেলে-মেয়ের ধারণা, আমি নাকি ওদের ভালবাসি না, তার কারণ, আমি ওদের কাছে যেতে চাই না। বুঝি না বাবা, ক্যানবেরা বা চণ্ডীগড়ে গিয়েই কেন ভালবাসা দেখাতে হবে! দৌড়ঝাঁপ আমার কোনওদিন ভাল লাগে না বলে আমি তো অরুণের সঙ্গেও কখনও বেড়াতে যাইনি। ফোন হচ্ছে, ভিডিয়ো কল হচ্ছে, তবু টানাটানি করা চাই।”

“কেনই-বা যাও না? সারাক্ষণ ঘরে একা কী আনন্দ পাও তুমি কে জানে!”

“ভালবাসা মানে তো সবসময়ে প্রক্সিমিটি নয়। যে জওয়ান ফ্রন্টে পড়ে আছে, সে কি তার বউকে ভালবাসে না! বেশি প্রক্সিমিটিই বরং ভালবাসাকে ফিকে করে দেয়। এই তোমার যেমন হয়েছে। বউ সবসময়ে কাছে থাকে, খোঁজখবর নেয়, কিছু হলে হামলে পড়ে, আর তাইতেই সে জলভাত হয়ে গেছে।”

সত্যচরণ বিপন্ন মুখে বলেন, “আরে, অতটা কঠোর হোয়ো না পদ্মাবতী, ভালবাসা নেই তা বলছি না। তবে সেটা বুড়ো বয়সে ডেভেলপ করেছে। আর তাতে অনেক বাইবাতিকও এসে জুটেছে।”

“ভালবাসার মধ্যে অনেক কিছু থাকে। ওই বাইবাতিকও। দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, ইনসিকিওরিটি থেকে ওসব আসা স্বাভাবিক। দুনিয়ায় এমন ডাকাবুকো কেউ নেই যে, ভালবাসার পাত্রটির জন্য দুশ্চিন্তায় ভোগে না।”

সত্যচরণ একটু অবাক হয়ে বলেন, “তোমারও বাইবাতিক আছে নাকি? এমনভাবে বলছ, যে মনে হচ্ছে, তোমারও আছে!”

ফিক করে হেসে ফেললেন পদ্মাবতী। মুখে হাসিটা ধরে রেখেই বললেন, “আছে বাপু। তবে সেসব শুনতে চেয়ো না যেন। ছেলেপুলের মা হয়েছি না! তার খাজনা না দিয়ে উপায় কী বলো! অরুণাংশুর জন্য ছিল। আর সত্যিকথা বলতে হলে বলি, তোমার জন্যও আছে।”

ঠিক শিহরন হল না হয়তো, কিন্তু সকালটা আজ হঠাৎ আর-একটু উজ্জ্বল হল যেন সত্যচরণের চোখে। এইসব ছোটখাটো হঠাৎ-পাওয়া পুরস্কারের জন্যই তো আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। যে শ্বাসটা মোচন করলেন সত্যচরণ সেটা দীর্ঘশ্বাসই বটে, তবে তাতে কোনও হাহাকার নেই, বরং স্বস্তি আছে।

অরুণাংশুর ছবির খানিকটা ওপরে একটা দেওয়ালঘড়ি। সেদিকে তাকিয়ে সত্যচরণ বললেন, “তোমার জয়া তো এখনও এল না!”

“আসবে। গাড়ির গোলমালে দেরি হয় মাঝে-মাঝে। না এলেও ক্ষতি নেই। একা মানুষ, চলে যাবে। শুধু ঘরদোর ঝাঁটপাট দিতে পারি না আর বাসনও মাজতে পারি না হাঁটুর জন্য। তা হলেই-বা কী, বাসনের তো অভাব নেই। রান্নাবান্নারও ঝামেলা করতে হবে না, ফ্রিজে যা আছে গরম করে খেয়ে নেওয়া যাবে।”

“জয়া তো শুনেছি তোমার কাছে চব্বিশ ঘণ্টার লোক হিসেবে থাকতে চেয়েছে। রাজি হচ্ছ না কেন?”

“পাগল হয়েছ? বর্ষার সময় একবার ট্রেন বন্ধ হওয়ায় বাধ্য হয়ে থাকতে দিয়েছিলাম। রাতে অস্বস্তিতে আমার ঘুমই হল না।”

“অস্বস্তিটা কেন বলো তো! চুরির ভয়?”

“তাও নয়। মেয়েটা চোর নয় বোধ হয়। তবু অস্বস্তি, একা থাকার ভুতুড়ে অভ্যেস তো!”

“আর ছেলেমেয়েরা এলে?”

“লজ্জার কথা আর কী বলব বলো, সত্যি কথা বলতে গেলে ওরা এলেও অস্বস্তি হয়, তবে কম। আর নাতি-নাতনিরা সব অস্বস্তি কাটিয়ে দেয়। ওদের কখনও আগন্তুক বলে মনেই হয় না।”

“আমার ঠিক উলটো। সঙ্গে জয়তি না থাকলে একা বিছানায় শুতেই পারব না।”

“সে তো জানি। তোমার তো ভূতের ভয়। আমার ভূতের ভয় নেই কেন জানো? আমি নিজেই ভূত হয়ে গেছি বলে। হ্যাঁ গো, বউকে এখনো চুমুটুমু খাও তো?”

সত্যচরণ লাজুক হেসে বলেন, “ওই প্রক্সিমিটি থেকে একটুআধটু ঘনিষ্ঠতা তো হতেই পারে। তবে জয়তিও তোমার মতোই বলে, এই বয়সে উত্তেজনা ভাল নয়।”

ডোরবেলের শব্দ হল। পদ্মাবতী বললেন, “ওই বোধ হয় জয়া এল।”

সত্যচরণ উঠলেন, “বললেন, তোমাকে উঠতে হবে না, আমি জয়াকে দরজা খুলে দিয়ে চলে যাচ্ছি। নইলে জয়তি আবার ফোন করবে।”

পদ্মাবতী ভারী সুন্দর করে হেসে বললেন, “এসো গিয়ে। আর ওসব মরা-টরার কথা মাথা থেকে তাড়াও। বেঁচে না থাকলে কি আমাদের চলে, বলো! একটুখানি তো জীবন, টুকুস-টুকুস করে আরও অনেক বেঁচে থাকো তো! আর আজ কিন্তু সন্ধেবেলা ডাক্তার গুপ্তর কাছে যাবে। মনে থাকবে তো! আমি ফোন করে মনে করিয়ে দেব।”

সত্যচরণ গম্ভীর হয়ে বলেন, “মনে থাকবে, তবে তুমি ফোন করলে মন ভাল হয়ে যাবে।”

জয়া এক দিঘল চেহারার মেয়ে। লকলকে শরীর আর ভারী মিষ্টি মুখখানা। একটু গোলমতো, বড়-বড় চোখ, নাকটা তেমন তীক্ষ্ণ নয় বটে, কিন্তু মুখের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। পরনে দামি সালোয়ার কামিজ, হালকা নীল রঙের ওপর বহুবর্ণ সুতোর জ্যামিতিক নকশা। হাতে দামি স্মার্ট ফোন। সত্যচরণ শুনেছেন জয়া ফেসবুক করে, হোয়াটসঅ্যাপ করে, মেসেজ করে, ই-মেল করতে পারে এবং পদ্মাবতীর ল্যাপটপে সে ভিডিয়ো কলও সেট করে দেয়। আর তার একজন মোটরসাইকেলবাজ বয়ফ্রেন্ডও আছে। সেই প্রেমিকই তাকে রোজ স্টেশন থেকে নিয়ে এসে পদ্মাবতীর বাড়িতে পৌঁছে দেয়, আবার রাতের দিকে স্টেশনেও দিয়ে আসে। প্রেমিকটি চাকরি খুঁজছে এবং ভাড়ার বাসাও। দুটোই পেয়ে গেলে তাদের বিয়ে।

তাঁকে দেখে ভারী খুশির হাসি হাসল জয়া, “মেসোমশাই, কখন এলেন?”

“এই তো একটু আগে।”

“আরে, চলে যাচ্ছেন কেন? চা খাবেন না? এক্ষুনি চা করব তো!”

“না রে, কফি খেয়েছি, আর নয়।”

“কফি কি মাসিমা করল? এ মা, আমার আজ দেরি হয়ে গেছে! একটু বসুন না, আজ আমি ভেজ-মোমো বানাব বলে সব গুছিয়ে রেখে গেছি। মাসিমার তো আজ একাদশী।”

“আজ নয় রে, আর-একদিন হবে। তোর মাসিমা কি একাদশী করে নাকি?”

“ও বাবা, করে না আবার! এবার আপনি অনেকদিন পরে এলেন কিন্তু!”

“হ্যাঁ রে, সবসময়ে সময় করে উঠতে পারি না তো!”

“আপনি এলে মাসিমা খুব খুশি হয়।”

সত্যচরণ একটু হাসলেন। লিফট নিলেন না, একটু একসারসাইজ হবে বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তৃতীয় ধাপটায়। তাই তো! আজ একাদশী! আজ পদ্মাবতীকে চুমু খাওয়াটা কি কোনও না কোনওভাবে একটা অপরাধ হল? একাদশীতে চুমু খাওয়া বারণ কি না এটা তো কাউকে জিজ্ঞেসও করা যাবে না। কিন্তু মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল।

বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে পদ্মাবতীদের হাউজ়িং কমপ্লেক্স। বেশ নিরাপদ। পাহারা-টাহারা আছে, যেমন থাকে। আর ভিতরেই আছে চক্রাকারে হাঁটার পথ। খুব ভোরে আর বিকেলে পদ্মাবতী কয়েকজন সমবয়সির সঙ্গে এখানেই হাঁটাহাঁটি করেন। গল্পগাছা হয়। নিজেকে গুটিয়ে ছোট গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলেছেন পদ্মাবতী। কেন, সে রহস্য ভেদ করা যায়নি।

লেক গার্ডেনস থেকে ঢাকুরিয়া, বেশ অনেকটাই দূর। তাই একবার ভাবলেন রিকশা নেবেন কি না। মনে হল রোদের ততটা তেজ নেই। একটু হালকা মেঘ আছে। হাঁটতে খারাপ লাগবে না। পা বাড়িয়েছেন, এমন সময়ে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল জয়া, “মেসোমশাই, আপনার টুপি! মাসিমা বললেন, ছুটে গিয়ে দিয়ে আয়, নইলে রোদ লাগাবে।”

তাই তো! বড্ড ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে যে! অ্যালঝাইমারসের লক্ষণ নয় তো! একটা থ্যাঙ্ক ইউ বলে সাদা হ্যাটটা মাথায় চাপিয়ে নিলেন।

তাঁর সঙ্গে-সঙ্গেই হাঁটছে একাদশী শব্দটা আর হালকা একটু মনখারাপ। পাপ হয়ে গেল না তো! যারা সাহসী তারা এসব গায়েই মাখে না, আর তারাই জীবনটাকে ডেঁড়েমুশে ভোগ করে। মুশকিল এই তাঁদের মতো আধা মরালিস্টদের। আজ একাদশী এটা না জানলে তাঁরও অবশ্য কিছু হত না। আর পদ্মাবতী একাদশী না করলেও কিছু হত না। মনে হয় তাঁর মাথার মধ্যে একটা মাকড়সা আছে। সে ব্যাটার কোনও কাজ নেই, যখন-তখন যে-কোনও সামান্য ঘটনা নিয়ে মাথার মধ্যে অযথা জটিল জাল বুনতে শুরু করে। আর তার ফলে সত্যচরণ প্রায়ই রাস্তাঘাটে আনমনা হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। বলতে কী, এইমাত্র একটা রিকশা প্রায় তাঁকে একটু ছুঁয়ে চলে গেল।

জয়তি মানেই বড়-বড় চোখ, জয়তি মানেই গোলগাল পুতুল-পুতুল, নরম-সরম, আহ্লাদী মেয়েমানুষ, জয়তি মানেই ভীষণ সধবা, শাঁখা-পলা-নোয়ায় সাজানো লক্ষ্মীবউ, জয়তি মানেই সিঁথি থেকে কপাল থেকে নাকের ডগা অবধি ঝরা সিঁদুর, জয়তি মানেই গয়নার ঝনৎকার, জয়তি মানেই পানে ঠাসা গাল আর রাঙা ঠোঁট, জয়তি মানে আরও অনেক কিছু। ছেলে জিষ্ণু আর মেয়ে সম্বিতা বলে, মা মানেই উনিশ শতক। না, ছেষট্টিতে এসে জয়তি আর ঠিক সেরকমটি নেই। শরীর শুকিয়ে গেছে অনেক, গালের হনু দেখা যায়, মাথার চুলের সেই গোছ আর নেই, চোখে চশমা উঠেছে, তড়বড়ানিও আগের মতো নেই, গতি অনেক মন্থর। গয়না পরা ছেড়েই দিয়েছে, শুধু শাঁখা-নোয়া আর দু’গাছা করে সোনার চুড়ি। নাকে নাকছাবিটা অবশ্য আছে। বউয়ের সোনা ছোঁয়া শ্বাস নাকি তার স্বামীর পক্ষে মঙ্গলকারক। তা হবে। সত্যচরণ এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। ভাবেন, আমি জানিই-বা কতটুকু।

জিষ্ণু আর সম্বিতা দু’জনেই আমেরিকায়। জিষ্ণু শিকাগো, সম্বিতা ফ্লোরিডায়। তিনি আর জয়তি দু’বার চার মাস করে থেকে এসেছেন। সত্যচরণের আমেরিকা খারাপ লাগে না কিন্তু বেশিদিন থাকলে মন পালাই পালাই করে। ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। কিন্তু যার আমেরিকা বেশি অপছন্দ হওয়ার কথা, সেই জয়তি সে দেশটাকে প্রায় ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিল। এমনকী, একথাও প্রায়ই বলত, এখানেই বেশ থেকে যাই না গো! কত সুবিধে বলো তো! পান, খয়ের, পোস্ত, ইলিশ সবই তো পাওয়া যায়!

আর-একটা ছেলে আছে সত্যচরণের। বায়োলজিক্যাল নয় অবশ্য, তবু সে ছেলেই। রজত। রজত সিং। সতেরো-আঠারো বছর আগেও তাঁর একটা অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যাবসা ছিল। মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টস। তাঁর পার্টনার ছিল ধরম সিং। বিহারের, পরে ঝাড়খণ্ডের লোক। সতেরো বছর আগে যখন হঠাৎ স্ট্রোকে বিপত্নীক ধরম মারা যায়, তখন রজতের বয়স ছ’বছর। দেশ-গাঁয়ে খোঁজ করেও ধরমের বাড়ির কারও হদিশ পাওয়া গেল না। কোনও আত্মীয়স্বজনও এল না ধরমের পাওনাগন্ডা বুঝে নিতে। আক্ষরিক অর্থেই তখন রজত এক অনাথ বালক। তাকে অনাথ-আশ্রমে পাঠানোরই তোড়জোড় চলছিল। গড়িয়ায় ধরমের ছোট ভাড়াটে বাসায় এক বেবিসিটারের কাছে ছিল রজত। বাবাকে খুব খুঁজত। কাঁদত। কেউ গেলেই জড়িয়ে ধরে বলত, আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাবে? একদিন তিনি গেলে তাঁকেও জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চলো না! বাবা কেন আসছে না এখনও? সত্যচরণ নিজেও হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন সেদিন। আর সেদিনই মনস্থির করে বাচ্চাটাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। যা হওয়ার হবে, একে তিনি ছেলের মতোই মানুষ করবেন। কাজটা সহজ ছিল না। পুলিশের ঝামেলা ছিল, জয়তি খুশি হয়নি, তবে জিষ্ণু আর সম্বিতা একটা গোপাল গোপাল বাচ্চাকে পেয়ে খুব খুশি। জয়তি আঁশটে মুখ করে বলতে লাগল, “এত গ্যাদড়া বাচ্চা, খাইয়ে দিতে হবে, চান করিয়ে দিতে হবে, দাঁত মাজাতে হবে, হাগলে ছুঁচিয়ে দিতে হবে, কে করবে এত সব? রাতে শোবেই-বা কার কাছে?”

সমস্যা ছিলই। কিন্তু সত্যচরণ ধরমের ছেলেকে ফেলেও দিতে পারেন না। পুরনো বেবিসিটারকে ধরে আনা হল। কিন্তু মেয়েটি রাতে থাকতে রাজি নয়। রাতে তা হলে রজত থাকবে কার কাছে? জয়তি তাকে কিছুতেই নিজেদের বিছানায় অ্যালাউ করবেন না। সম্বিতা বলল, “আমার কাছে থাকুক, তবে রাতে পটি-টটি করলে আমি কিছু করতে পারব না।”

তখন সত্যচরণ বললেন, “কাউকে দরকার নেই। আমি আলাদা বিছানায় ওকে নিয়ে শোব। সবে বাবাকে হারিয়েছে, ওর এখন বাবার দরকার।”

টানা তিন বছর একই ঘরে জয়তি এক বিছানায় আর রজতকে নিয়ে আলাদা বিছানায় সত্যচরণ শুয়েছেন। পটি পরিষ্কার করেছেন, ছুঁচিয়ে দিয়েছেন, দাঁত মাজিয়েছেন, যেমনটা তিনি নিজের ছেলেমেয়ের জন্যও করেননি। বাচ্চাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। নিজের বাবাকে ভুলে সত্যচরণকে আঁকড়ে ধরতে রজতের বেশি সময় লাগেনি। তাই প্রথম তিন মাসের পর বেবিসিটারকেও বিদায় দিয়েছিলেন সত্যচরণ। বলতে গেলে রজত তাঁর হাতেই মানুষ। একটা বাংলা স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। মেধাবী ছাত্র ছিল না সে। তবে পাশ করে যেত। খুব দুষ্টুও ছিল না। একটু ভালমানুষ গোছের। হাসিমুখে সবার ফাইফরমায়েশ খাটত, যেটা সত্যচরণ একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু রজতের হয়ে কিছু বলতে গেলেই ঝামড়ে উঠত জয়তি, “কোন কুটুমটা শুনি যে বসে বসে খাওয়াতে হবে! কাজ করতে কি গতর ক্ষয় হয়ে যাবে নাকি! আমরা কি কাজ করি না?”

রজতের বয়স যখন বছর দশেক, তখন একদিন রাতে ফিরে সত্যচরণ দেখলেন, রজত রান্নাঘরের পাশে বাসন মাজার জায়গায় বসে খুব মন দিয়ে বাসন মাজছে। সত্যচরণ অবাক হয়ে বললেন, “এ কী? ও বাসন মাজছে কেন?”

জয়তি ঠান্ডা গলায় বললেন, “আজ ঝুমা আসেনি, তাই ক’খানা বাসন একটু ধুয়ে দিচ্ছে।”

সত্যচরণ বুঝলেন, রজত এক অবধারিত পরিণামের দিকে চলেছে। কিছুদিনের মধ্যেই ও হয়ে যাবে বাড়ির চাকর। সত্যচরণ কোনও প্রতিবাদ করলেন না। শুধু সোজা গিয়ে রজতের পাশেই বসে পড়লেন। বললেন, “আয়, আজ বাপ-ব্যাটায় মিলে বাসনগুলো মেজে ফেলি।”

রজতের কোনও আপত্তিই শুনলেন না। বললেন, “তুই যদি মাজতে পারিস, তা হলে আমিও পারি।”

জয়তি খুব চেঁচামেচি জুড়েছিলেন সেদিন। জিষ্ণু আর সম্বিতাও এসে বাবাকে টানাটানি করে তোলার চেষ্টা করেছিল, নিজেরাও মাজতে চেয়েছিল, কিন্তু সত্যচরণ নড়েননি। তখনই তাঁর ষাটের ওপর বয়স। পরে জয়তি ছলছলে চোখে এসে বলল, “তুমি আমার এঁটো বাসন ধুয়েছ, আমার তো পাপ হয়ে গেল! এখন কী হবে!”

সত্যচরণ বললেন, “যদি পাপ বলে বুঝে থাকো, তা হলে প্রায়শ্চিত্ত করো। রজতের প্রতি তোমার মনোভাব পালটাও।”

জয়তির তবু খুব একটা পরিবর্তন হল না। আর চাকরের কাজ করাত না বটে, কিন্তু নানাভাবে রজতকে বুঝিয়ে দিত যে, সে এ বাড়ির কেউ নয়। একদিন শুনলেন কাজের মেয়ে ঝুমা রজতের এঁটো বাসন মাজতে চাইছে না। বলেছে, “ওর বাসন আমি মাজব কেন? ওর বাসন তো ওরই মাজবার কথা। এ বাড়িতে আমিও যা ও-ও তা।” সত্যচরণ ঝুমাকে ডেকে পরদিন বললেন, “রজতের বাসন মাজবার জন্য তোকে আরও পঞ্চাশ টাকা বেশি দেব। কথাটা যেন রজত বা জয়তির কানে না যায়!”

ঝুমা আর আপত্তি করেনি।

প্রথমে জিষ্ণু হায়ার স্টাডিজ়ের জন্য, তার তিন বছরের মাথায় এক অতি সুপাত্রের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে সম্বিতাও আমেরিকা চলে গেলে বাড়িটা যেন মূক আর বধির হয়ে গেল হঠাৎ। সারা বাড়ি হাঁ হাঁ করছে। আর যেন কেমন একটু অচেনাও লাগছে বাড়িটাকে। দিনের বেলাটা হত না, কিন্তু রাতের খাবারটা ছেলেমেয়েদের নিয়ে একসঙ্গেই খেতেন সত্যচরণ। এখন শুধু রজত আর তিনি। খাওয়াটা আজকাল খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

ওই খাওয়ার টেবিলেই একদিন হঠাৎ জয়তির মুখ খুব থমথমে। খাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন জয়তি হঠাৎ রজতের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “পবনকুমার সিং তোর কে হয় রে রাজু?”

রাজু অর্থাৎ রজত একটু থতমত খেয়ে অবাক হয়ে বলে, “কে পবনকুমার সিং?”

“সেটা তো তুই বলবি। আজ দুপুরবেলা এসেছিল। লম্বা-চওড়া চেহারা। বলল, সে ধরমের চাচাতো ভাই, তোর চাচা। তুই নাকি তাকে একটা চিঠি লিখেছিস দেশে যাবি বলে! সত্যি নাকি?”

রজতের তখন চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স। হঠাৎ করে বয়সের টানে বেশ লম্বা হয়ে উঠেছে। গোঁফের অস্পষ্ট রেখাও দেখা দিয়েছে সবে। মাথাটা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে খুব ভয় খাওয়া গলায় বলল, “হ্যাঁ।”

“তোর তিন কুলে কেউ আছে বলে তো জানতাম না। হঠাৎ এই চাচাই-বা এল কোথা থেকে?”

রজত ঘাবড়ে গিয়ে জল খেতে গেল। বিষমও খেল। তারপর মাথা নিচু করে খুব ভয়ে-ভয়ে বলে, “এই চাচাজির কথা বাবার মুখে শুনেছিলাম।”

সত্যচরণের মাথাটা গরম হয়ে উঠছিল, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলালেন। এ বাড়িতে রজতের বন্ধন তো একমাত্র তিনি। জয়তি কোনওদিন রজতকে পছন্দ করেনি। সুতরাং ওর যদি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে হয়, তা হলে সেটা অন্যায় বলা যায় না।

জয়তি ঝামড়ে উঠে বলল, “কোথাকার লতায়-পাতায় সম্পর্ক, জানা নেই শোনা নেই, হঠাৎ তাকে চিঠি দিয়ে একেবারে দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থাও করে ফেললি? দেশে তোর কোন জমিদারি আছে রে নিমকহারাম, বেইমান! এতকাল দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষলুম!”

এমনিতে রজতের কোনও ভাবাবেগ দেখা যায় না। কথা খুব কম। কিন্তু এই প্রথম জয়তির কথায় ও প্রথমে হতভম্ব হল, তারপর চোখদুটো হঠাৎ জলে টসটস করতে লাগল। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ নিজেকে সামাল দিল সে। তারপর ধরা গলায় বলল, “কী করব বলো তো মা! আমি তো বুঝতে পারি এ বাড়ি আমার নয়। স্কুলের বন্ধুরা বলে, তুই তো বিহারি, তোকে তো ওরা একদিন তাড়িয়েই দেবে। ঝুমা আমাকে বলে, ও আমার এঁটো বাসন মাজতে ঘেন্না পায়, বাবা বেশি টাকা দেয় বলে মাজে। আমার জন্য তোমারও তো কত অসুবিধে হয় আমি জানি। আমি কী করব বুঝতে না পেরে অনেক দিন আগে আন্দাজে গাঁয়ের ঠিকানায় একটা চিঠি লিখেছিলাম। দেশ ছাড়া আমার তো আর যাওয়ার জায়গা নেই!”

রাগের চোটে হঠাৎ গলা চৌদুনে উঠে গেল জয়তির, “কেন লিখেছিলি রে বদমাশ? আমাকে জব্দ করতে?”

রজত একটু মিনমিন করে বলে, “না মা, তোমাকে জব্দ করব কেন? আমাকে তো একদিন চলেই যেতে হবে!”

জয়তির গলা আরও চড়ে গেল, রাগে ফেটে পড়ে বলল, “কেন চলে যেতে হবে রে, শয়তান! আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, তোকে এ বাড়ি ছেড়ে কেন যেতে হবে! আর বোঝাতে যদি না পারিস তো, আমি তোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আগাপাশতলা বেত দিয়ে পেটাব। আর ইস্কুলে কে তোকে বিহারি বলেছে? তার মুখ ভেঙে দিয়ে আসতে পারিসনি! আর ঝুমা আসুক, ওরই একদিন কি আমারই একদিন!”

সত্যচরণ আর রজত দু’জনেই জয়তির চেঁচামেচিতে হতভম্ব। আচরণটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না কারওই।

জয়তি এবার হঠাৎ সত্যচরণের দিকে চেয়ে ধমকের গলায় বলল, “তোমার গলায় কি ময়দার গোলা আটকে আছে? বাক্যি হরে গেছে কেন? উঠে এসে এই বেয়াদব ছেলেকে থাপ্পড় মারতে পারছ না? ওর এত বড় সাহস যে, গৃহত্যাগ করতে চায়! দেশে যাবে! বুঝলে! দেশে যাবে।! ওর কোন আপনজন সেখানে ঠ্যাং ছড়িয়ে ওর জন্য বসে আছে বলবে আমাকে? ওর কত বড় সাহস, আমার মুখের ওপর বলে দিতে পারল যে, এ বাড়ি ওর নয়!”

সত্যচরণ মৃদু হেসে বললেন, “সেটা তো মিথ্যে নয়।”

“এ বাড়ি ছাড়া ওর আর কোন বাড়ি আছে শুনি! এই তুমিই লাই দিয়ে ওকে মাথায় তুলেছ, কখনও শাসন করোনি, তাই ওর আজ এত সাহস!”

কথাটা মাথায় ঢুকলই না সত্যচরণের। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “আমি আবার কী করলাম!”

“তোমার প্রশ্রয়েই আজ ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলতে পারল!”

এর পর তাঁকে আর রজতকে হতচকিত করে দিয়ে হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল জয়তি। মাঝে-মধ্যে নানা ছোটখাটো কারণে কাঁদে বটে, কিন্তু তার এরকম আলুথালু কান্না সত্যচরণ কখনও দেখেননি। ডাইনিং টেবিলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে ফুলে-ফুলে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে সে যেন কান্নার বান।

রজত সোজা-সরল ছেলে, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সত্যচরণের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে বলে, “মা আমার ওপর খুব রেগে গেছে বাবা!”

সত্যচরণ মৃদু হেসে বললেন, “এখন মায়ের কাছটিতে চুপ করে বসে থাক। নড়িস না।”

রজত বাধ্যের ছেলে। বসে রইল। কান্না একসময়ে থামল। তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ। এক সময়ে জয়তি হঠাৎ রাগের গলায় বলল, “আমার কাছে বসে আছিস কেন? শুতে যা না!”

“তুমি খাবে না?”

“আমার খাওয়া নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই আমার কে?”

এসব কথার জবাব দেওয়ার মতো বুদ্ধি রজতের নেই। সে তেমন চোখা চালাক ছেলেও নয়। খুব বিষণ্ণ গলায় বলল, “আমি তো তোমাকে তাই বললাম মা, আমি তো তোমাদের কেউ হই না! সেজন্যই দেশে চলে যেতে চেয়েছিলাম তো! কিছু দোষ করেছি কি?”

জয়তি ফের ফুঁসে উঠল, “দোষ করিসনি? আবার মুখে-মুখে কথা বলছিস! এইটুকু বয়স থেকে এ বাড়িতে আছিস, তোর মায়াদয়া নেই! দেশের বাড়িতে তোর কে আছে শুনি! আর তোর ওই কাকা, সে কেমন লোক তুই কি জানিস? তোকে নিয়ে গিয়ে যে বিক্রি করে দেবে না তারই-বা ঠিক কি?”

রজত অবাক হয়ে বলে, “বিক্রি করে দেবে? বিক্রি করবে কেন?”

“ফের মুখে-মুখে কথা! কত ছোট ছেলেকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে জানিস?”

“পবনচাচাকে যে আমি চিনি, আমাদের গড়িয়ার বাসায় একবার এসে কয়েকদিন ছিল।”

“এখন কাকা খুব আপনার জন হয়েছে, না! আমরা ভেসে গেছি বুঝি?”

“তা কেন হবে? কিন্তু আমি তা হলে কোথায় যাব?”

জয়তি এবার গনগনে চোখে চেয়ে বললেন, “যাওয়ার নাম করলে আমি তোর ঠ্যাং ভেঙে দেব!”

সোজা-সরল হলেও রজত বোধ হয় একটু-একটু করে বুঝতে পারছিল এটা জয়তির রাগ নয়। রাগ তো ঠিক এরকম হয় না! সে একটু চুপ থেকে বলল, “আমি তা হলে কী করব বলো।”

“কোথাও যেতে পারবি না। আমার কাছে থাকবি।”

রজত একটু গুম হয়ে রইল।

জয়তি ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল, “আমাকে ছুঁয়ে বল। নইলে কিন্তু আমি উপোস করে থাকব।”

রজতের চোখ ছলছল করছিল, বাড়ানো হাতটা দু’হাতে ধরে বলল, “আমি যাব না মা, তুমি এখন খাও।”

সেই ছেলে এখন ছ’ফুটের ওপর লম্বা, মজবুত গড়ন। তেমন চোখা চালাক বা স্মার্ট নয়। ধীরস্থির, ভালমানুষ গোছের। লেখাপড়ায় তেমন ভাল কিছু নয়। পাশ কোর্সে বি কম পাশ করে বসে আছে। তবে সে এখন সত্যচরণ আর জয়তির প্রেশার মাপতে পারে, গ্লুকোমিটারে ব্লাডশুগারের হিসেব নেয়, জয়তির অক্সিজেনে কমা-বাড়ার দিকে খেয়াল রাখে অক্সিমিটারে। রাজু ছাড়া জয়তির এক মুহূর্তও চলে না। বয়সের হিসেব করলে রজত তাঁদের ছেলের বয়সি নয়, নাতির বয়সি। দুনিয়ায় কত রকমের সম্পর্ক যে রচিত হয়ে যায়, যার কোনও মাথামুন্ডু নেই। রজতের পরিচয় দিতে হলে জয়তি এখন নির্দ্বিধায় লোককে বলে, এই তো আমার ছোট ছেলে রাজু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *