অধ্যায়: ২
সব শালা ডিসপোজেবল বডি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবু রংবাজ কেউ কম নয়। আর-একটু হলেই বুলটন খুনটা করেই ফেলেছিল। তার ভিকটিম একেবারে অন্তিম সময়ে একটা প্যাঁচ মেরে বেরিয়ে গেল। তার ছোট্ট কালার টিভিটা যে নড়বড়ে টেবিলটার ওপর রাখা, তার আড়াল থেকে একবার যেন মুখটা বের করে বাঁ চোখটা টিপে তাকে টন্ট করেও গেল মনে হয়। তবে সেটা চোখের বা মনের ভুলও হতে পারে। খেলার মাঠের যেমন জার্সি আছে তেমনই তাদেরও মার্কামারা জার্সি আছে। হাফ-প্যান্ট, হাফ-হাতা গেঞ্জি আর কোমরে প্যাঁচ দেওয়া গামছা। পায়ে হাওয়াই, পকেটে মোবাইল আর দু’-পাঁচটা টাকা। আজ গ্রিন ভ্যালির কে একজন হারাধন নায়েকের বডি ডেসপ্যাচ করার আছে। আজকাল একটা সুবিধে হল বডি ঘাড়ে করে অত দূর টানতে হয় না। কাচের গাড়ি আছে, খোলা ভ্যান আছে, বডি নামিয়ে তাতে তুলে দাও, তারপর ট্যাক্সিতে ফলো, শ্মশানে ফের নামিয়ে ডোমের জিম্মা করে দাও। হয়ে গেল। বডি তন্দুরে যখন ঝলসাচ্ছে তখন রেস্তরাঁয় বসে মাংস পরোটা সাঁটাও। সব রুটিন।
পোশাকটা পরে নিয়ে কোমরে গামছাটা টাইট করে বেঁধে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চিকুকে আরও একবার খুঁজল বুলটন। শালার মেগা আই কিউ। ইঁদুর মারার বিষ আলুর চপের সঙ্গে মেখে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে রেখেছে, আঠামাখানো কাগজ দিয়ে ধরার চেষ্টা করেছে। পারেনি। হেভি চালাক। দিনের বেলা বড় একটা দেখা যায় না, রাতের বেলা চিক চিক করে চিল্লামিল্লি মাচায়। সেই জন্যই বুলটন নাম দিয়েছে চিকু। এখন এই একটাই আছে। বুলটন বিড়বিড় করে বলল, “তুই তো আর অমর নয়। মরবি, একদিন মরবিই।” আজ কাপড় কাচার মুগুরটা অব্যর্থ হাঁকড়েছিল বুলটন, শালা কী করে পিছলে মারাদোনার মতো বেরিয়ে গেল কে জানে!
বান্টিদা বলেছে, এখন কিছুদিন সোশ্যাল ওয়ার্ক করে যা। তারপর পলিটিকাল কাজে নামবি। বুলটনের অবশ্য পলিটিক্সে যাওয়ার ইচ্ছে হয় না। হেভি কমপিটিশন। তার ড্রিম হল, একটা বেশ ঝিনচাক বার-এ বাউন্সার হবে। ওঃ, বাউন্সারের মতো গ্ল্যামার আর কোথাও নেই। যতবার বার-এ যায় মুগ্ধ হয়ে সে শুধু বাউন্সারদের দেখে, কী পারসোনালিটি, কী ট্যাক্টফুল, কী ঠান্ডা মাথায় বজ্জাত বেহেড ব্যাদড়া কাস্টমারদের সামাল দেয়। বাউন্সার মানে তো আর গুন্ডামি নয়। ঝাড়পিট হলে কাস্টমার ভেগে যাবে, দোকানের বদনাম হবে। তাই মস্তানিটা করতে হয় এত চেপেচুপে যে, পাঁচজনে বুঝতে পারে না।
গ্রিন ভ্যালি হল বান্টিদারই প্রোমোট করা অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। সবাই জানে এখানে সাগরিকা নামে যে ম্যাডাম থাকেন, তিনি হচ্ছেন বান্টিদার দুই নম্বর। একটু বয়স হয়েছে, কিন্তু দেখতে একদম ফিল্ম স্টারের মতো।
কাচে ঢাকা গাড়ি এসে গেছে। সুখেন, রজত আর গুড্ডু গাড়ির কাছেই দাঁড়ানো। তাকে দেখে সুখেন বলে, “বডি তিন তলা থেকে নামাতে হবে, বুঝলি। লিফ্ট খারাপ।”
“হারাধন নায়েক লোকটা কে রে?”
“হিস্টরি মে মিস্ট্রি হ্যায় দোস্ত। দু’মাস আগে বউ আর মেয়ে নিয়ে এসে কমল জানার ফাঁকা ফ্ল্যাটে উঠেছিল। শোনা যাচ্ছে বউটা ওর নয়। ভাগানো। মেয়েটাও। ও সব বান্টিদা বুঝবে। আমাদের কী?”
লম্বু হল মৌনীবাবা। কথাই কয় না, শুধু মিটিমিটি হাসে। এখন অবশ্য মুখে হাসি নেই। ভ্রু কুঁচকে ঘাড় উঁচু করে বিল্ডিংটা দেখছিল। যে-কোনও কারণেই হোক রাজুকে সবাই পছন্দ করে। বুলটন নিজেও। রাজুর দুটো প্লাস পয়েন্ট। হাইট আর পেটাই শরীর। কিন্তু সবাই জানে রাজু, জেন্টল জায়ান্ট রাজু একজন স্লো থিংকার, ওর রিফ্লেক্স কম, কোনও অ্যাগ্রেশন নেই, বলিয়ে- কইয়ে তো নয়ই।
পাশে দাঁড়িয়ে বুলটন বলে, “কী দেখছিস?”
রাজু ঘাড় ঘুরিয়ে বুলটনকে দেখে নিয়ে বলে, “কিছু নয়। এত বড় প্যাঁচা দেখা যায় না।”
“প্যাঁচা? কোথায় প্যাঁচা?”
“ওই তো, তিনতলার ওই ফ্ল্যাটটার বাথরুমের জানালায় বসে আছে।”
বুলটনের চোখ ভাল, তবু প্রথমটায় কিছুই দেখতে পেল না। অনেকক্ষণ ঠাহর করার পর ধূসর রঙের পাখিটাকে দেখতে পেল বটে। দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল বলে বোঝা যাচ্ছিল না।
“ওটা কার ফ্ল্যাট জানিস? প্যাঁচা নাকি খুব পয়া। লোকটার বরাত খুলে গেল হয়তো!”
রাজু একটু হাসল। বলল, “ওটাই কমল জানার ফ্ল্যাট।”
“যাঃ শালা, তা হলে তো উলটো কেস হয়ে গেল! ওটা বাথরুম কী করে বুঝলি? আগে এসেছিস?”
মাথা নেড়ে রাজু বলে, “না তো! অন্য জানালাগুলোর চেয়ে ওই জানালাটা ছোট তো, তাই মনে হল। পাখিটা রেয়ার। এখনও দিনের আলো আছে, অন্ধকার না হলে পাখিটা উড়েও যেতে পারবে না।”
গুড্ডু বান্টিদার খুব ক্লোজ়ড। ফোনটা ওর কাছেই এল। গুড্ডু ফোনটা পকেটে রেখে বলল, “চল, বান্টিদা ডাকছে। মালটা নামাতে হবে। স্ট্রেচারটা নিয়ে নে।”
তিনতলার ফ্ল্যাটে ঢুকতেই বড় ডাইনিং কাম ড্রয়িং। সোফাসেট-টেট আছে, যেমন থাকে। বান্টিদা সিঙ্গল সোফাটায় বসে আছে। মোটা মানুষ, থলথলে হাঁসফাঁস চেহারা, মাথায় ঘেঁস চুল, ঘন ভ্রু। ঘরে আর কেউ নেই।
বান্টিদা হাঁফধরা গলায় বলে, “ওই বাঁ দিকের বেডরুমে আছে।”
ছোটমতো বেডরুমে ডবল খাটে যে লোকটা চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে সেও বেশ মোটাসোটা। পরনে সবুজ চেক লুঙ্গি, গায়ে একটা ময়লা গেঞ্জি। মারা গেলে বাড়ির লোক একটু সাজিয়ে টাজিয়ে দেয়, সেটাই নিয়ম। হারাধনকে কেউ সাজায়নি, সেন্ট মাখায়নি, ফুলটুলও নেই। একা ঘরে পড়ে আছে গাড়লের মতো।
সুখেন চাপা গলায় বলে, “আরে, একটা দিন তো মানুষের একটু ভিআইপি ট্রিটমেন্ট জোটার কথা! হারুবাবুর তো শালা সেটাও জোটেনি দেখছি!”
তারা চটপট বডি নামিয়ে সামনের ঘরে এনে মেঝের ওপর রাখল। গুড্ডুই বান্টিদাকে জিজ্ঞেস করল, “বাড়ির লোক কে যাবে বান্টিদা?”
বুলটন লোকটাকে দেখছিল। ভিড়ের লোক। এত অর্ডিনারি চেহারা যে, একবার দেখলে মনে রাখা মুশকিল। যেমন ভিড়ে দেখা মুখ। একটু মোটা নাক, পুরু ঠোঁট, ছোট-ছোট চোখ, গায়ের রং মাঝারি, হাইট মাঝারি, কিছুই ইমপ্রেস করার মতো ছিল না হারাধন নায়েকের। বয়স পঞ্চাশ- টঞ্চাশ।
অন্য বেডরুমটা থেকে এক ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন, হাতে একগোছা পাঁচশো টাকার নোট। রোগা, ফরসা, লম্বাটে মুখ। বেশ মিষ্টি চেহারা। টাকাগুলো গুড্ডুর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, “কিছু মনে কোরো না, আমার শরীর খুব খারাপ। বাড়িতে আর কেউ নেই যে শ্মশানে যাবে। যা করার তোমরাই করবে। এই টাকাগুলো রাখো, এতেই হয়ে যাবে বোধ হয়!”
বুলটনের আন্দাজ, কমসে কম কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা তো হবেই। টাকাগুলো বোধ হয় গুনে আনেনি, তা হলে পরিমাণটা মুখে বলে দিত। গুড্ডু একবার বান্টিদার মুখের দিকে চাইল আর বান্টিদা মাথা একটু নাড়া দিলেন। গুড্ডু টাকাগুলো হাফ-প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম। কিন্তু মুখাগ্নিটা কে করবে?”
“ওসব রিচুয়ালস আমরা মানি না। জাস্ট ক্রিমেট হিম।”
“ডেথ সার্টিফিকেটটা লাগবে ম্যাডাম।”
বান্টিদা তার বুকপকেট থেকে একখানা ভাঁজ করা কাগজ বের করে গুড্ডুর দিকে বাড়িয়ে বললেন, “এই নে, আমার কাছে আছে। আর শোন, আসার সময় ওটার দশ-বারোটা জ়েরক্স করে আনিস। লাগবে।”
“ঠিক আছে।”
কিছুই ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছিল না বুলটনের। ডেডবডি আনঅ্যাটেন্ডেড পড়ে আছে, নো সাজুগুজু, নো নাথিং, কান্নাকাটি বড় একটা হয় না আজকাল, কিন্তু এরা যেন হারাধনকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। আঠা যে ছিল না তা বোঝাই যাচ্ছে। বেচারা হারাধন! বুলটন হঠাৎ ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে বলেই ফেলল, “একটা সাদা চাদর-টাদর হবে? তা হলে বডি ঢেকে নেওয়া যেত।”
ভদ্রমহিলা একটু যেন অবাক হলেন, “সাদা চাদর?”
এই সময়ে হঠাৎ পিছন থেকে একজন স্বপ্নের মতো মেয়ে বেরিয়ে এল। রোগা, ফরসা, এলোথেলো বব চুল, সাজ নেই, তবু বুলটন এই প্রথম কাউকে দেখল যে রক্তমাংসের তৈরিই নয়। কী মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি, তা বোঝা যাচ্ছে না। দু’খানা বিশাল চোখ ঠিক কালো নয়, একটু নীলচে, চুলের রং মধুর মতো। আর, হেঁটে এল না ভেসে এল তা বোঝাই গেল না। পরনে একটা সাদা, লম্বা ঝুলের পা পর্যন্ত ঢাকা গাউনের মতো কিছু। হাতে একটা সাদা চাদর। সেটা গুড্ডুর দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, “আপনারা প্লিজ় দেরি করবেন না। টেক হিম অ্যাওয়ে,” ভ্রু কোঁচকানো, ঠোঁটে বিরক্তি, একটু হয়তো ঘেন্নাও।
তারা একটু ব্যোমকে গেছে সন্দেহ নেই। গুড্ডু চাদরটা ক্যাচ করে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই যাচ্ছি।”
মেয়েটা ফের বলল, “প্লিজ়!”
তারপর ঠিক চলন্ত একটা মোমবাতির মতোই আবার ভাসন্ত পায়ে ঘরের ভিতরে চলে গেল।
বডি নীচে নামিয়ে কাচের গাড়িতে তুলে দিল তারা।
শেষমুহূর্তে হারাধনের একটা সাদা চাদর অন্তত জুটেছে। ডেডবডি দেখলেই লোকজন উঁকিঝুঁকি দেয়। দিচ্ছিলও। একজন বুড়ো মানুষ জিজ্ঞেসও করল, “কে গেল?”
কেউ জবাব দিচ্ছিল না দেখে বুলটন বলল, “একজন ফালতু লোক দাদু, নন এনটিটি, এই আমাদের মতোই।”
ট্যাক্সিতে উঠলে রাজু সবসময়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে। কারণ, লম্বা বলে ওর লেগরুম বেশি লাগে। পিছনে সুখেন, গুড্ডু আর বুলটন। বুলটন বলল, “মেয়েটাকে দেখলি?”
সুখেন বলে, “হাইফাই।”
গুড্ডু টাকা গুনছিল। বলল, “ওর নাম ইলিনা, লা মার্টে পড়ে।”
বুলটন বলে, “পাড়ায় বা রাস্তাঘাটে দেখিনি তো!”
“গাড়িতে যায় আসে। বাড়ি থেকে বেরোয় না।”
হঠাৎ সামনে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে রাজু বলে, “ডেথ সার্টিফিকেটে কী লিখেছে রে গুড্ডু?”
গুড্ডু বলে, “দেখার সময় পেয়েছি নাকি! দেখে বলছি দাঁড়া!” পকেট থেকে কাগজটা বের করে চোখ বুলিয়ে বলল, “কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ডিউ টু ম্যাসিভ কনভালশন। কে জানে কী! জিজ্ঞেস করলি কেন?”
“এমনি।”
রাজু আর কথা বলল না। গুড্ডু বলল, “থার্টি টু থাউজ়্যান্ড আছে। এত দিল কেন বল তো!”
সুখেন চোখ বড় বড় করে বলে, “বাপ রে! এ তো জ্যাকপট!”
বুলটন বলল, “পরে আবার হিসেব না চায়!”
গুড্ডু বলে, “দূর, ওদের কি টাকার লেখাজোখা আছে নাকি!”
“বড়লোক?”
“তাই তো শুনেছি।”
“বড়লোক তো ভাড়াবাড়িতে আছে কেন! আর লুঙ্গি পরেই-বা শ্মশানে যেতে হচ্ছে কেন?”
“বান্টিদার কাছে শুনেছি বালিগঞ্জ প্লেসে ভদ্রলোকের বাড়ি, আর সেটা রিনোভেট হচ্ছে, তাই এখানে শিফ্ট করেছিল। বান্টিদার অ্যারেঞ্জমেন্টে। বাকিটা নো আইডিয়া।”
কেওড়াতলায় প্যারাফার্নেলিয়া অনেক। দু’ঘণ্টার ওপর লেগে গেল বডি চুলোয় ঢোকাতে। হয়ে গেছে কি না জানতে বান্টিদা বার চারেক ফোন করেছেন গুড্ডুকে। অবশেষে তারা হাঁফ ছেড়ে রেস্তরাঁয় এসে বসল।
বুলটন জিজ্ঞেস করল, “অস্থি-ফস্থি নিতে হবে নাকি?”
গুড্ডু মাথা নেড়ে বলে, “আরে না। ওরা ওসব মানে না তো বললই।”
বুলটন বারবারই মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে। চোখে সেই থেকে লটকে আছে। ইলিনা। মেয়েটাকে রিয়েল বলে ভাবতেই পারছে না। মনে হয় এ মেয়ের শরীরে ঘামের গন্ধ হয় না, ঋতুমতীও হয় না, ছোটবাইরে বড়বাইরেও নেই, পরি-টরি যেমন আর কী। ডাইমেনশনটাই আলাদা। তিন জনের জন্য পরোটা মাংসের অর্ডার দিল গুড্ডু। রাজু শ্মশানে এলে খায় না। পিউরিটান আছে। টাকার হিস্সাও নেবে না। খরচখরচা বাদ দিয়ে ওই টাকাটা তিন ভাগ হবে। গুড্ডু, সুখেন আর সে। তাদের মধ্যে রাজুটাই একটু অন্যরকম। কেমন যেন। মাঝে-মাঝে সে রাজুকে বলে, “তুই কি শালা আমাদের বিবেক নাকি?”
রাজু শুধু হাসে। শালার পেট থেকে কথাই বের করা যায় না।
গুড্ডু একটা ছোট নোটবুকে টাকার হিসেব করছিল। পাইপয়সা অবধি হিসেব করে গুড্ডু, কখনও বন্ধুর সঙ্গে দু’নম্বরি করেনি, মদ খেয়েও না। টাকাপয়সার ব্যাপারে ওকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করা যায়। গুড্ডুর পলিটিকাল অ্যাম্বিশন আছে। ওর একটাই টার্গেট, এমএলএ হওয়া আর বুলটন জানে একদিন এমএলএ ও হবেও।
রাজু আজ একটু আলগোছ, কী যেন ভাবছে। বুলটন ওর পেটে একটা আঙুলের খোঁচা দিয়ে বলল, “কী এত ভাবছিস!”
রাজু মৃদু মৃদু হেসে বলে, “তেমন কিছু নয়, তবে এটা কিন্তু পুলিশ কেস ছিল।”
বুলটন অবাক হয়ে বলে, “কোনটা?”
গুড্ডু তার লেখা, আর সুখেন টেবিলের ওপর তার মৃদু তবলা থামিয়ে তাকাল।
রাজু একটু লজ্জা পেয়ে বলে, “মনে হল, তাই বললাম। হারাধনবাবুর ঠোঁট দুটো আমার নীল লাগছিল, আর মুখে বাবল ফর্ম করেছিল।”
গুড্ডু বলল, “যাঃ! কী যে বলিস! বান্টিদা আছে না! তার ওপর হারাধন বান্টিদার পুরনো বন্ধু। ফাউল প্লে হলে বান্টিদা কি ছেড়ে দেবে?”
“ফাউল প্লে নয়। সুইসাইড হতে পারে।”
সুখেন হঠাৎ বলে, “আমারও কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে একটু ডাউট আছে। ভদ্রমহিলার নাম কী রে গুড্ডু?”
“তামসী নায়েক।”
“নায়েক! ঠিক জানিস নায়েক?”
গুড্ডু মাথা নেড়ে বলে, “আাই অ্যাম নট শিয়োর। পদবি কী লেখে জানি না।”
“তামসী ম্যাডাম আর ইলিনা, বডি তাড়াতাড়ি বের করে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আর হারাধনের ঠোটের নীল রংটা আমারও চোখে পড়েছে।”
গুড্ডু ফের মন দিয়ে হিসেব করছিল। মাথা না তুলেই বলল, “বডি ছাই হয়ে গেছে, এখন আর এসব কথা তুলে লাভ কী? চেপে যা। কথাটা ছড়ালে ইমেজ খারাপ হবে।”
বুলটন জানে, গুড্ডু ইমেজ সম্পর্কে ভীষণ সেনসিটিভ। ভাবী এমএলএ তো!
সুখেনের জগৎটা তবলাময়। বাজায় ভাল। ফাংশনে ডাক পায়। অল্পস্বল্প রোজগারও হচ্ছে আজকাল। মণীশ ঘোষ নামে এক ওস্তাদের কাছে তালিম নেয়। কিন্তু চারদিকে গানবাজনার লোক এত বেড়ে গেছে যে, জায়গা করাই মুশকিল। সুখেন ফের টেবিলে তবলার বোল তুলতে তুলতে বলল, “না, রাজু বলল বলে বললাম। তবে একটা কথা বলি। তামসী ম্যাডাম আর ইলিনার সঙ্গে এই হারাধন লোকটা কিন্তু যায় না। ওরা হেভি অ্যারিস্টোক্র্যাট, আর এ লোকটা অর্ডিনারি। টাকা থাকলেই তো হল না, সরাফৎ ভি কোই চিজ় হ্যায়।”
গুড্ডু নোটবইটা বন্ধ করে পকেটে রেখে বলল, “আমাদের শেয়ার পড়ছে আট হাজার একশো পঞ্চাশ টাকা করে বুঝলি?”
কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। গুড্ডুর হিসেব খুব পাকা।
গরম মাংস আর পরোটা এসে গেল আর বাতাসটা যেন পলকে সুগন্ধী হয়ে উঠল। এরা বানায় খুব ভাল। শ্মশানের রেস্তরাঁর তো কোনও পেডিগ্রি নেই, কাস্টমারও সব প্রলেতারিয়েত। কিন্তু রেসিপিতে অনেককেই টেক্কা দেবে। বুলটন বলল, “এত বেশি টাকা দেওয়াটাও সন্দেহজনক। গুনে-গেঁথে হিসেব করেও দেয়নি, যেন খামছে যা হাতে উঠেছে তাই দিয়ে দিয়েছে। তাড়াহুড়ো করে, যেন বিদায় করতে পারলে বাঁচে। মেয়েটা কী বলল শুনলি না, আপনারা প্লিজ় দেরি করবেন না। টেক হিম অ্যাওয়ে।”
গুড্ডু ভ্রু তুলে বলে, “আরে ভাই, তোরা কি মার্ডার মিস্ট্রি বানিয়ে ফেলবি নাকি? মেয়েটা তো ম্যাডামের আগের পক্ষের আর ম্যাডাম হারাধনবাবুর সঙ্গে লিভ টুগেদার করছিলেন। এরকমই তো হওয়ার কথা, আঠা থাকার তো কথাই নয়।”
রাজু মৃদু গলায় বলল, “দে ওয়্যার নার্ভাস।”
গুড্ডু বলে, “আচমকা ঘটনায় নার্ভাস তো হওয়ারই কথা, তাই না?”
সুখেন বলে, “আমার তো মনে হল, মা আর মেয়ে ডেডবডিটা নিয়ে টেনশনে ছিল। ডিসপোজ় অফ করতে পারলে বাঁচে।”
গুড্ডু বলল, “খামোখা ঘেঁটে লাভ নেই, ডেডবডি সম্পর্কে অনেকেরই রিপালশন থাকে।”
বুলটন হঠাৎ বলে, “ডাক্তারটা কে রে গুড্ডু? পাড়ার কেউ?”
গুড্ডু মাথা নেড়ে বলে, “চিনি না। জে রায়, ব্রড স্ট্রিটে চেম্বার।”
“পাড়ায় তো কত ভাল ডাক্তার আছে, অত দূর থেকে ডাক্তার আনতে হল কেন?”
“প্লিজ়, তোরা গোয়েন্দাগিরিটা একটু বন্ধ করবি? ভুলে যাস না এটাতে বান্টিদাও ইনভলভড। আমাদের বডি খালাস করার দায়িত্ব ছিল, করে দিয়েছি।”
বুলটন বিরক্ত গলায় বলে, “তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন, আমরা তো পুলিশের কাছে যাচ্ছি না। বডি হাওয়া হয়ে গেছে, কাজেই গিয়ে লাভও নেই। আমরা তো নিজেদের মধ্যে ডিসকাশন করছি। তা ছাড়া হারাধন নায়েক আমাদের কে যে, আমরা তার জন্য থানা-পুলিশ করব!”
গুড্ডু নরম হয়ে বলে, “আমিও সেটাই বলছি। ঠিক আছে আমি মানছি যে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। এই রাজুটাই যত নষ্টের গোড়া। তুই ফট করে এক একটা এমন কমেন্ট করে বসিস যে, প্রবলেম হয়ে যায়। হারাধনের ঠোঁট লাল না নীল তা তোর দেখার দরকারটা কী ছিল! আমরা তো আর ইনভেস্টিগেশন করতে আসিনি।”
রাজু মৃদু একটু হাসল। তারপর নির্বিকার গলায় বলল, “চোখে পড়ে গেলে কী করব বল!”
সুখেন বলে, “ঠিক আছে, চল বাড়ি যাই।”
বুলটন কিছু বলল না। বান্টিদার কাছে তারও টিকি বাঁধা। সোনার তরী কমপ্লেক্সে সে যে সিকিওরিটি গার্ডের চাকরিটা পেয়েছে সেটা বান্টিদারই দেওয়া।
ফেরার সময়ে তারা একটু চুপচাপ, ছোটাছুটিতে টায়ার্ডও বটে, তার ওপর পেটে মাংস-পরোটা। ট্যাক্সি থেকে নামবার আগে শুধু রাজু হঠাৎ মৃদু গলায় বলল, “প্যাঁচাটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে উড়ে গেছে।”
রাতে সোনার তরী কমপ্লেক্সে ডিউটি দেওয়ার সময় তারও প্যাঁচাটার কথা মনে পড়ছিল। ধূসর রঙের মস্তবড় পাখি। সে কলকাতার বস্তির ছেলে, পাখি-টাখি আর ক’টাই-বা দেখেছে। পাখিটা ওই ফ্ল্যাটের জানালাতেই এসে বসেছিল কেন, যেই ফ্ল্যাটে আজ একটা লোক মারা গেছে এবং হয়তো সুইসাইড করে! জীবনটা মাঝে-মাঝে খুব মিস্টিরিয়াস বলে মনে হয় কিন্তু! আর ইলিনা মেয়েটা! এমন নয় যে, মেয়েটাকে তার পছন্দ হয়ে গেছে। আসলে মেয়েটাকে তার রক্তমাংসের বলে মনেই হয়নি। যেন রূপকথার বই থেকে নেমে এসেছে।
রাতের ডিউটিটা আরামের। রাত বারোটার মধ্যেই রেসিডেন্টরা ফিরে আসে, গেস্ট আসা কমে যায়। তার কাজ হল গেস্ট এলে খাতায় এন্ট্রি করা, যে ফ্ল্যাটে যেতে চায় সেখানে ফোন করে কনফার্ম করা। এটা নিশ্চয়ই বাউন্সারের মতো থ্রিলিং কাজ নয়। অ্যাডভেঞ্চার নেই। সোনার তরীর সেক্রেটারি সাধনবাবু প্রথম দিনই জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ড্রিংক করো না তো!”
সে সভয়ে বলেছিল, “না স্যার।”
সাধনবাবু কঠিন চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, “প্রমাণ পেলে কিন্তু চাকরি যাবে। আর এই কমপ্লেক্সে অনেক ইয়ং মেয়ে থাকে, তাদের কারও কাছ থেকে যদি তোমার কোনও বেয়াদবির কমপ্লেন আসে, তা হলে শুধু চাকরিই যাবে না, পুলিশেও হ্যান্ডওভার করা হবে।”
সাধন গাঙ্গুলি নিজেই পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ছিলেন, সদ্য রিটায়ার করেছেন। বুলটন ভাল ছেলের মতোই বলেছিল, “পাড়াতে আমার কোনও বদনাম নেই স্যার, খোঁজ নিয়ে দেখবেন।”
একসময়ে ব্যায়াম-ট্যায়াম করত বলে তার চেহারা ভাল। রাজুর মতো অতটা না হলেও সে পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি। বাউন্সার হবে বলেই সে চেহারা বানিয়েছে এবং এখনও মেনটেন করে। সাধনবাবু তার চেহারাটা দেখে খুব খুশি হলেন না বলেই মনে হল। তাকে আগাপাশতলা দেখে নিয়ে বললেন, “জিম করো নাকি?” সে সবিনয়ে বলেছিল, “এখন তো আর সময় পাই না। দুটো টিউশনি করতে হয়, জার্মান ল্যাঙ্গোয়েজ শিখতে যেতে হয়। সপ্তাহে চারদিন জিম করার সময় পাই।”
সাধনবাবু বিস্ময়ে ভ্রুটা ওপরে তুলে বললেন, “এডুকেশন কদ্দুর বলো তো!” বি কম পাশ শুনে ওঁর দুশ্চিন্তা যেন আরও একটু বাড়ল। বললেন, “তাই নাকি?”
বুলটনের একবার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল যে, গ্র্যাজুয়েটরা এখন রিকশাও চালায়। বলেনি, বেয়াদবি হয়ে যেত। মুশকিল হল সাধনবাবু ওল্ড টাইমার, ইয়ং মেয়েদের তার মতো ছেলেদের হাত থেকে বাঁচিয়ে চলায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু মাঝে-মাঝে ছেলেদেরও যে বিপদ হয় সেটা বিশ্বাস করেন না। এই তো সিকিওরিটি গার্ডের চাকরি, কোনও গ্ল্যামার নেই, ভদ্রগোছের বেতনও পায় না, তবু কি ইশারা ইঙ্গিত হয় না?
সিদ্ধার্থ গুহ একজন নামী আর্কিটেক্ট, বি ব্লকে বড় ফ্ল্যাট। তার মেয়ে অবন্তিকার বয়স খুব বেশি হলে চোদ্দো-পনেরো, রোগা, ফচকে এবং ডেয়ারিং। প্রথম দিন থেকেই তাকে আড়ে-আড়ে দেখত। একটু-আধটু হাসত। একদিন সকালে ডিউটি করছিল বুলটন, লাল-সাদা স্কুল-ড্রেস পরা অবন্তিকা তার কাছে এসে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “এই, দ্যাখো না, বইখাতা নিয়ে নিচু হতে পারছি না, আমার ডান পায়ের জুতোর ফিতেটা খুলে গেছে। প্লিজ়, একটু বেঁধে দেবে?”
এটা তার কাজ নয়, কিন্তু সে জানে রিফিউজ করলে মেয়েদের শোধ নেওয়ার অনেক পন্থা আছে। সুতরাং সে লক্ষ্মী ছেলের মতো হাঁটু গেড়ে বসে অবন্তিকার জুতোর ফিতে বেঁধে দিল। মুখে একটা থ্যাঙ্ক ইউ বলল বটে, কিন্তু ঠোঁটের বিচ্ছু হাসিটায় অন্য কিছু ছিল। আর ছুতোনাতারও তো অভাব হয় না। এই যেমন একদিন রোববার হঠাৎ খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে বলল, “এই, দ্যাখো না, আমার ফোনটা ভুল করে ফেলে এসেছি ঘরে। তোমার ফোনটা একটু দেবে? একটা জরুরি কল করতে হবে!”
দিতে হল। ফোনটা নিয়ে মুচকি হেসে পোর্টিকোর দিকে চলে গেল। একটু বাদে এসে ফেরত দিয়ে সেই বিচ্ছু হাসি হেসে থ্যাঙ্ক ইউ দিয়েই ফুড়ুৎ। পাঁচ মিনিট বাদেই তার কল, “অ্যাই, বলো তো আমি কে বলছি!” তারপর থেকে অবন্তিকার যখন-তখন ফোন, “এই শোনো না, একটু বাদে মা বেরিয়ে যাবে, আমি একা। চলে এসো না, দু’জনে অনেক গল্প করা যাবে!” কিংবা, “এই বোকা ছেলে, ছাদে আসবে? আমার তিনজন বন্ধু এসেছে, তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।” এসব কথা জানাজানি হলে সাধনবাবু তার চাকরি খেয়ে দেবেন। তাই ফাঁদে পা দেয়নি বুলটন।
আপার, মিডল বা লোয়ার যে-কোনও ক্লাসেরই হোক, সুন্দর, কুৎসিত বা চলনসই হোক, পাজি, চালাক, বোকা, ভালমানুষ বা যে রকমেরই হোক না কেন, চাইলে একটা মেয়ে জুটেই যায়। আজকাল প্রেম করাটাই সবচেয়ে সোজা কাজ। অলিতে-গলিতে বাসে ট্রেনে রেস্তরাঁয় পুজো প্যান্ডেলে মোবাইলে এত প্রেম যে, ভাইরাল অসুখ বলে মনে হয়। যুবক-যুবতীদের প্রেম ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে! প্রেম ফের ফুরিয়েও যায় প্রজাপতির আয়ুর মতো। বুলটন একসময়ে রোজ গীতা পড়ত, বিবেকানন্দ পড়ত, ব্রহ্মচর্য আর ধ্যান করারও চেষ্টা করেছে। তার মনে হয় মেয়েছেলে জীবনের কোনও টার্গেট হতে পারে না। তাই অনেক অফার থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের এই ব্যাপক সেল-এর বাজারে আজও তার কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই।
ওই মাতাল রাঘববাবু এলেন। গেটম্যান মানস কুণ্ডু গেট খুলে দিল, একটা অ্যাপ ক্যাব ঢুকল ভিতরে। বুলটন ঘড়ি দেখল, রাত দেড়টা। এক-এক দিন রাঘববাবু নিজেই নেমে একটু আঁকাবাঁকা পায়ে এসে লিফট ধরে উঠেও যেতে পারেন। আবার কোনও কোনও দিন পেরে ওঠেন না। মানস গাড়ির ভিতরে উঁকি দিয়ে আজ হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল। বুলটন উঠে গেল গাড়িটার কাছে। আজ ডাউন। কেতড়ে আছেন, হাঁ করা মুখ থেকে লালা ঝরছে, চোখ ওলটানো। বুলটন জাপটে ধরে ছেঁচড়ে নামিয়ে এনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। প্রথমটায় পারছিলেন না, কয়েকবারের চেষ্টায় তার কাঁধে পুরো ওজনটা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালেন। এ সময়ে কিছু অর্গলমুক্ত কথা বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে, তার বেশির ভাগই গালাগাল, কাকে কে জানে। ছ’মাস আগে প্রথম যেদিন রাঘববাবুকে এভাবে তুলতে হয়েছিল চারতলার ফ্ল্যাটে, সেদিনকার কথা সহজে ভোলার নয়। সেদিনও রাঘব গালাগাল দিয়ে যাচ্ছিলেন অস্পষ্ট উচ্চারণে। আর তাঁর চারতলার ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজানোর পর ভিতর থেকেও তেড়ে আসছিল নারীকণ্ঠের অশ্রাব্য গালাগাল, যেমনটা তারা বস্তিতে শুনতে পায়। শুয়োরের বাচ্চা, খানকির ছেলে, বেশ্যার দালাল এবং অমুক ভাতারি, তমুক ভাতারি ইত্যাদি। দরজা খুলে যিনি দরজা জুড়ে দাঁড়ালেন তিনি একটু মোটাসোটা হলেও সুন্দরী এবং অভিজাত চেহারা। বুলটনের দিকে চেয়ে ফুটন্ত গলায় বললেন, “মাতালটাকে ওপরে এনেছ কেন? নীচে নিয়ে গিয়ে নর্দমায় ফেলে দাও।”
খুব ঘাবড়ে গিয়ে বুলটন যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখনই রাঘববাবু হঠাৎ তাকে ছেড়ে উবু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করছিলেন। ভদ্রমহিলা তাঁর পা থেকে একপাটি হাওয়াই চটি খুলে চটাস চটাস করে বেশ কয়েক ঘা বসালেন রাঘবের মাথা আর গালে। সঙ্গে গাটার ল্যাঙ্গোয়েজ। বুলটন ভয় খেয়ে পালিয়ে আসে। পরে জেনেছে রাঘব একটা মাঝারি মানের খবরের কাগজের ফিল্ম ক্রিটিক। গিন্নি বৈশালী বড়লোকের মেয়ে, তার ওপর নিজের বুটিকের ব্যাবসা আছে।
রাঘব যে নিজের পয়সায় মদ খান না এটা সবাই জানে। ফিল্ম ক্রিটিক আর খবরের কাগজের লোককে খাওয়ানোর লোকের অভাব হয় না। আর তাঁর চেনাজানাও অনেক। বুলটন বাউন্সার হতে চায় জেনে বলেছিলেন, “দূর, ওটা আবার কোনও চাকরি নাকি? ওরা তো মাতালদের পকেট থেকে পয়সা সরায়।”
বুলটন দমে গিয়ে বলেছিল, “কিন্তু আমার যে খুব শখ।” তখন রাঘব ভরসা দিয়েছিল, “ঠিক আছে। দেখব। মাঝে-মাঝে মনে করিয়ে দিয়ো।”
আজও রাঘববাবুকে ওপরে নিয়ে গেল বুলটন। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। ম্যাডাম এখনও গালাগাল দেন। তবে কম-বেশি আছে। এক-এক দিন কিছুই বলেন না। ইদানীং একটা অল্পবয়সি কাজের মেয়ে দরজা খুলছে। আজ তার হাতেই জিম্মা করে দিল বুলটন। দিন দুই দেখেছে মেয়েটাকে। মুখটা চেনা-চেনা। কারও সঙ্গে মুখের মিল আছে কি? ঠিক বুঝতে পারেনি বুলটন। রংটা কালোই, মাঝারি হাইট, লকলকে শরীর। রাঘববাবুকে দু’হাতে ধরে যখন ঘরের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে, তখন বুলটন হঠাৎ বলল, “আপনি বুলা মণ্ডল না?”
মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে বড়-বড় চোখে তার দিকে একবার তাকাল, তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি আর কেউ নই।”
বুলটন তাজ্জব। কেউ নই মানেটা কী হল? দু’বছর আগে বুলা মণ্ডলের খুব নাম ছিল। দুশো আর চারশো মিটারে ন্যাশনালে রুপো আর ব্রোঞ্জ জিতেছিল। এত সব জানার কথা নয় বুলটনের। তাদের পাড়ার নেতাজি স্পোর্টিং ক্লাব অ্যানুয়াল ফাংশনে কয়েকজনকে সংবর্ধনা দেয়। একজন উঠতি গায়ক, একজন বুড়ো কমেডিয়ান আর এই বুলা। বুলটনের পাশে ক্লাবের পুরনো মেম্বার প্রাক্তন ফুটবলার তপনদা বসেছিলেন। উনিই বলেছিলেন, দেখিস, এই মেয়েটা একদিন অলিম্পিকে যাবে। ক্লাব থেকে পাঁচ হাজার টাকা সাহায্য দেওয়া হয়েছিল বুলাকে। কৃতজ্ঞতা জানাতে উঠে বুলা একদম সাদামাটা ভাষায় ভণিতা না করে বলেছিল যে, তারা খুব গরিব। বাবা ভ্যান চালাত, এখন অসুস্থ হয়ে ঘরবসা, মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে সামান্য টাকা পায় বলে তাদের কোনওরকমে খাওয়া জোটে, দুটো ছোট বোন আছে যাদের একটার বেশি জামা নেই, বুলার নিজের ভাল রানিং বুট নেই, তার কোনও পুষ্টিকর খাবার জোটে না। রুপো আর ব্রোঞ্জ জেতার পর সে কিছু সাহায্য পেয়েছে বটে, কিন্তু তা বাবার চিকিৎসাতেই খরচ হয়ে গেছে। তার আরও টাকার দরকার, একটা চাকরির দরকার, নইলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কথাগুলো খুব মোচড় দিয়েছিল বুকের মধ্যে। তবে এ হল ঘর ঘরকা কহানি। তারপর বুলা ক্রমে আবছা হয়ে গেছে। কারণ, বুলা খবর হয়ে উঠতে পারেনি। তার স্মৃতিশক্তি চমৎকার, সহজে মানুষের মুখ ভোলে না।
রাঘববাবুর সকালে উঠতে দেরি হয়। রোজ নয়, তবে মাঝে-মাঝে একটু বেলায় উনি বাজার করতে যান। তিনদিন বাদে একদিন ডে ডিউটির সময় বুলটন রাঘববাবুকে বাজারে বেরোতে দেখে সঙ্গ নিল, পাশে-পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
রাঘববাবু মাই ডিয়ার মানুষ, বিশেষ প্রোটোকল মানেন না, তা ছাড়া বুলটনের ওপর একটা কৃতজ্ঞতাও তো আছে। রোজ ছেলেটা ঘাড়ে করে তাঁকে তোলে। তার কাঁধে বন্ধুর মতো হাত রেখে বললেন, “সেই বাউন্সারের চাকরির ব্যাপারটা তো?”
বুলটন বলে, “না স্যার, আমি একটা কথা জানতে চাইছিলাম। আপনার বাড়িতে যে নতুন কাজের মেয়েটা এসেছে ও কি বুলা মণ্ডল?”
রাঘব অবাক হয়ে বলেন, “তুমি কি বুলাকে চেনো?”
“না স্যার, তেমন চেনা নয়। তবে উনি ভাল স্প্রিন্টার ছিলেন বলে শুনেছি। আমাদের ক্লাবে ওকে একবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তখন দেখেছি।”
“শুধু ভাল নয়, শি ওয়াজ জেম অফ আ স্প্রিন্টার। লেগে থাকলে অলিম্পিক বাঁধা ছিল। ন্যাচরাল অ্যাথলিট। কিন্তু ফেঁসে গেল বলে কেরিয়ার বরবাদ।”
“ফেঁসে গেল?”
“অভাবে স্বভাব নষ্ট হে! ওরা তিন বন্ধু ছিল, তিনজনেই স্প্রিন্টার। বাকি দু’জন অবশ্য বুলার ক্লাসের নয়। ওই তিনজনের টিম পরামর্শ করে শপ লিফটিং শুরু করেছিল। ওরা ভেবেছিল ভাল দৌড়োতে পারার সুবিধে নিয়ে চুরি করেই পালাতে পারবে, যদি ধরা পড়ার মতো অবস্থা হয়। তিন-চারটে কেস করেও ফেলেছিল। একটা বড় গয়নার দোকানে লিফট করে, সি সি টিভিতে মুখ আইডেন্টিফায়েড হয়ে যায়। পুলিশ তিনজনকেই তুলে নেয়। জেল থেকে বেরিয়েছে বটে, কিন্তু বদনাম হয়ে গেছে। আমি ফিল্ম ক্রিটিক হওয়ার আগে স্পোর্টসে ছিলাম। তখন থেকেই বুলাকে চিনি। অনেকের কাছে ধরনা দেওয়ার পর আমার কাছে আসে। আমি বাড়িতে নিয়ে এসেছি, বৈশালী বলেছে বুটিকের কাজ শিখিয়ে কাজে লাগিয়ে দেবে।”
“স্যাড স্যার।”
“খুব স্যাড। মাত্র উনিশ-কুড়ি বছর বয়স, সারাটা জীবন সামনে পড়ে আছে।”
রাঘববাবুকে গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে ল্যান্ডিংয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এল বুলটন। বুলা একদম বেরোয় না, দোকান-বাজারেও যায় না। দুপুরের দিকে রাঘব আর বৈশালী একসঙ্গেই বেরিয়ে যান। বুলা ওপরে একাই থাকে। হয়তো কাউকে মুখ দেখাতে চায় না।