ষট্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
উপরি উক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর কুমারপুর রেলস্টেশনে মেয়েদের ওয়েটিংরুমে এক অস্পরীতুল্যা বিংশতি বর্ষীয়া যুবতী দুইখানি পত্র হাতে করিয়া স্নিগ্ধ প্রদীপ আলোকে দাঁড়াইয়াছিলেন।
রক্তলোহিত মুখখানি নত করিয়া যুবতী পত্রখানি পড়িয়া দেখিলেন।
যদি পত্র পড়িয়া সেই স্থানে যুবতী মূৰ্ছিতা হইতেন তাহা হইলে বিস্ময়ের কোনো কারণ থাকিতে পারে না।
এই যুবতী আমেনা। ওয়েটিংরুমের খোলা জানালা দিয়া আমেনা একবার মুক্ত সুন্দর নীলাকাশের পানে তাকাইল। চক্ষু এবং ওষ্ঠ তাহার কাপিয়া উঠল।
পত্র দুইখানি এইরূপ :
প্রথম পত্রে লেখা ছিল—”প্রিয়তম আমেনা! তুমি জান, আমি বর্তমানে অত্যন্ত বিপন্ন। খোদার করুণার উপর বিশ্বাস হারাইয়াছি। জানি না তুমি দুঃখিত হইবে কি সুখী হইবে। আমি জানি, তোমার স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগের কথা। স্বামী ছাড়া সংসারে আর তোমার কেউ নাই। নরাধমের মতো তোমা হেন ভাষা-বিনিময়ে আজ আমি নিজকে রক্ষা করিতে ইচ্ছা করিতেছি। আমি বুঝিতেছি, আমি হীন। তত্রাচ আমি ইহা না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না। আমার মতো কাপুরুষ জগতে হয়তো আর কেউ নাই, তবুও আমি ইহা করিতেছি। আমার প্রণয় ও ভালবাসার কথা স্মরণ করিয়া লজ্জায় আমি এতটুকু হইয়া পড়িতেছি।–কত বাধার মুখে রায়হানের মধ্যবর্তিতায় তোমায় পাইয়াছিলাম, তবুও আজ তোমাকে জন্মের মতো পরিত্যাগ করিতে হইতেছে।
“এ কথা প্রকাশ উপযোগী নহে। তাই এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছি। আশা করি তোমার মহত্ত্ব আমার এই হীনতাকে স্বীকার করিয়া লইবে। আমার বিশ্বাস, নারী হইলেও মনুষ্যত্বে তুমি আমার চেয়ে বড়।
“মোকদ্দমায় হয় আমার ফাঁসি, না হয় দ্বীপান্তর হইবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
দারোগা সাহেব বলিয়াছেন, কিছুতেই তিনি আমার মুক্তির জন্য সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইতে পারেন না, তবে যদি আমি আমার রূপবতী ও গুণবতী ভার্ষা দয়া করিয়া তাহার জন্য পরিত্যাগ করি তাহা হইলে ভার্ষা-বিনিময়ে তিনি আমার উদ্ধারকল্পে প্রাণপণে চেষ্টা, করিবেন।
“রায়হান ভাই প্রাণপণে চেষ্টা করিলেও তিনি কী সাহায্য করিয়া উঠিতে পারিবেন বুঝিতেছি না।
“আমি তোমাকে ত্যাগ করিয়া নিজকে বিপদমুক্ত ও নিষ্কন্টক করিতে চাই”।
“রাত্রি ১টার ট্রেনে দারোগা সাহেব এবং একজন বৃদ্ধা আসিবেন। দুইটার সময় যে গাড়ি আসে সেই ট্রেনে তুমি সেই মহিলা ও দারোগা সাহেবসহ গাড়িতে উঠিবা।”
“কথাটা তুমি ভালো করিয়া বুঝিয়াছ কিনা বুঝিতেছি না। শোন, এই দারোগা সাহেব তোমাকে বিবাহ করিয়া প্রাণপণে আমাকে বাঁচাইতে চেষ্টা করিবেন। অবশ্য তোমার সহিত তাঁহার বিবাহ খুব সম্মানের সহিত হইবে। তোমার প্রতি কোনো প্রকার অসম্মান বা অত্যাচার দেখান হইবে না।
“শেষ কথা, তুমি যদি এ প্রস্তাবে অসম্মত হও তাহা হইলে দারোগা সাহেব ভায়ানক ক্রুদ্ধ হইবেন। তাহার অত্যাচার ও অবিচারের সম্মুখে তুমি রমণী–সুতরাং তিষ্টিতে পারিবে না। পুরুষ ইচ্ছা করিলে রমণীর মাথায় কলঙ্ক ও অসম্মান চাপাইয়া দিতে পারে।”
“দারোগা সাহেবের মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিবে না। তিনি তোমাকে খুব শ্রদ্ধার সহিত ভালবাসিবেন। তুমি তাহার আদরের ছোট বৌ হইবে। যত শীঘ্র সম্ভব তোমাকে কলিকাতায় লইয়া বিবাহ করিবেন।”
চক্ষু মুছিতে মুছিতে আমেনা দ্বিতীয় পত্রখানি পড়িয়া দেখিল–সে-খানিতে তাহাকে ত্যাগ করা হইয়াছে।
.
সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আমেনা ভাবিয়া ঠিক পাইল না, সে কি করিবে, কাহার কাছে সে যাইবে? চরণ যেন তাহার শক্তি থাকিলেও শক্তিহীন। সে ইচ্ছা করিল, মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া অন্ধকারে পলায়ন করে, কিন্তু তারপর সে কোথায় যাইয়া দাঁড়াইবে?
তাহার ইচ্ছা হইল একবার সে চিৎকার করিয়া সকলকে ডাকিয়া বলে তাহার উপর কতবড় অত্যাচার হইতে যাইতেছে। কিন্তু হায়! বড় করিয়া কথা বলিতে সে কোনো দিন অভ্যস্ত নয়। মানুষের কাছে নিজের কথা বলিবার দাবি করা তো দূরের কথা, পরপুরুষের সম্মুখে একাকী কেমন করিয়া যাইবে?
তাহার ইচ্ছা হইল যেমন করিয়া পারে সে কিছুতেই এই অসম্মান সহিবে না।
একবার তাহার মন তাহার স্বামীর উপর অত্যন্ত বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। দারোগাকে বিবাহ করিয়া এই কাপুরুষকে পরিত্যাগ করিলে কী ক্ষতি? স্ত্রীর সম্মান রক্ষার জন্য মানুষ প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয় না, আর এই নরাধম স্ত্রীকে কলঙ্কিত করিয়া স্বীয় প্রাণ রক্ষা করিতে ব্যস্ত!
কিন্তু সবই তো শেষ হইয়া গিয়াছিল।
আমেনা স্তব্ধ হইয়া ওয়েঠিংরুমে বসিয়া রহিল। যথাসময়ে একটার ট্রেন আসিল। আমেনার বুকখানি কাঁপিয়া উঠিল।
আবার আমেনার ইচ্ছা হইল, সে দৌড়াইয়া পলায়ন করে, কিন্তু তার কাপুরুষ স্বামী হয়ত যমদূতের মত দরজার কাছে দাঁড়াইয়াছিল। তা ছাড়া রমণীর স্বামী ছাড়া এ জগতে কে আছে? তার স্বামীই যখন তাহাকে পরিত্যাগ করিতেছেন তখন সে একা কোথায় যাইয়া দাঁড়াইবে? পথ চিনিয়া এবং একাকিনী সে বাড়িই-বা যাইবে কেমন করিয়া? সে তো এখন একেবারেই সহায়শূন্যা। দারোগার কাছে–সে যত বড় নরপিশাচই হউক–একটি আশ্রয় তো পাওয় যাইতেছে। আমেনা ভাবিল-কর্তব্য কি তাহা তাহার বাড়িতে যাইয়া ধীরভাবে ঠিক করা যাইবে?। সে আরও ভাবিল–তাহার নিজের পক্ষে ভয়ানক অসম্মানজনক হইলেও তাহার সহিত দারোগা পথের রমণীর ন্যায় ব্যবহার করিতেছেন না। সে আবার ভাবিল, স্বামী যাহাকে পথের মাঝে পরিত্যাগ করে, তার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। সহসা দরজার কাছে একটা আঘাত হইল। আমেনা চাহিয়া দেখিল, একটা প্রৌঢ়া রমণী, হাতে তার কতগুলি ফুল। কক্ষে কাপড় দিয়া বাঁধা একটা পোটলা।
কোনো কথা জিজ্ঞাস না করিয়া প্রৌঢ়া আসিয়া আমেনার পদচুম্বন করিল এবং পোটলা খুলিয়া সুন্দরী রমণী ব্যজনী লইয়া আমেনাকে বাতাস দিতে আরম্ভ করিল।
মুহূর্তকাল ব্যজনী দোলাইয়া রমণী কহিল–“দারোগা সাহেব আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন।” অতঃপর পোটলার ভিতর হইতে উত্তম রসনা-তৃপ্তিকর মিষ্টান্ন বাহির করিয়া কহিল–“কিছু জলযোগ করে গাড়ির জন্য প্রস্তুত হন।”
আমেনা কোনো কথা কহিল না।
রমণী আমেনাকে আবার খাইতে অনুরোধ করিল। তাড়াতাড়ি একটা রৌপ্যের গ্লাসে। বাহির হইতে জল আনিয়া আমেনার হাত ধুইয়া দিল।
বিস্মিত ক্রোধ চাপিয়া রাখিয়া আমেনা মৃদুস্বরে কী কহিতে যাইতেছিল। রমণী সে কথা
শুনিয়া তাহার হাতের উপর খানিক মিষ্টান্ন রাখিয়া আমেনার মুখের কাছে ধরিল।
মুহূর্তের মধ্যে আমেনা কী যেন ভাবিয়া লইল। তাহার পর সে সহজভাবে খাইতে বসিল। আহার শেষ করিয়া মনের ভাব চাপিয়া রাখিয়া আমেনা মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল ”দারোগা সাহেবের বাড়ি কতদূর?”
রমণী কহিল–“এই দুই স্টেশন পর। বেশি নয়।”
গাড়ি আসিলে দ্বিরুক্তি না করিয়া আমেনা ধীর পদবিক্ষেপে গাড়ির ভিতরে যাইয়া উপবেশন করিল।
গাড়িতে উঠিবার পূর্বে অন্ধকারে তাহার চোখ দিযা খানিক জল গড়াইয়া পড়িল, অঞ্চলে তাহা মুছিয়া ফেলিল। তাহার এই দুঃখ ও অসম্মানের কথা একটা লোকের কাছেও সে বলিতে পারে না–সে যে রমণী! কথাগুলি যে লজ্জাজনক!
যথাসময়ে পাল্কি হইতে নামিয়া আমেনা বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, দেউড়ীতে কলা গাছ এবং মঙ্গলঘট রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে। ঘটের মুখে ফুল ও আম পাতা। দুইজন রমণী সেখানে দাঁড়াইয়াছিল। হাতে তাহাদের ফুলের ডালা।
আমেনাকে খুবই সম্ভ্রমের সহিত নামাইিয়া লওয়া হইল। দারোগার মায়ের মতোই একটি স্ত্রীলোক পাল্কির ভিতর আসিয়া আমেনাকে চুম্বন করিলেন।
অতঃপর আর একজন বলিষ্ঠকায়া যুবতী আমেনাকে কোলে তুলিয়া বাড়ির মধ্যে লইয়া গেল এবং সেখানে তাহাকে মুল্যবান একখানা মখমলমণ্ডিত বিছানায় বসান হইল।
আমেনার ইচ্ছা হইতেছিল, সে চিৎকার করিয়া বলে–ওগো, সে কেউ নয়। প্রাণের দায়ে তাহাকে তার স্বামী দারোগাকে উপহার দিয়াছে–সে দারোগার বিবাহিত পত্নী নহে। ছিঃ ছিঃ! কেমন করিয়া সে এমন লজ্জাজনক কথা সকলের কাছে প্রকাশ করিয়া দিবে! সে দারেগার পত্নী নহে, সে কি তবে পথের রমণী–একজন রক্ষিতা?
আমেনা স্তব্ধ হইয়া চুপ করিয়া রহিল। একটা কথাও তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল। কেহ সন্দেহ করিল না। সকলেই জানে, নূতন বধূ কাথা বলেন না।
নববধূর রূপ দেখিয়া সকলেই মুগ্ধ হইলেন।
মোট কথা আমেনার প্রতি খুবই সম্মান প্রদর্শন করা হইতেছিল। বাড়ির ছেলেরা এবং চাকরানীরা আসিয়া আসিয়া আমোনার পদ চুম্বন করিল। পোলাও-কোর্মা প্রস্তুত ও ছাগ। জবেহের ব্যবস্থা হইল। আমেনার সম্মুখে এই ব্যঙ্গ অভিনয় সমস্ত দিন ধরিয়া চলিল।
সন্ধ্যা-রাত্রে দারোগা সাহেব আমেনার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলে আমেনা বিছানা ছাড়িয়া গৃহের পার্শ্বে যাইয়া দাঁড়াইল।
দারোগা মৃদুস্বরে অতি সাবধানে কহিল, “ক্ষমা করিবেন–আপনার কোনো ভয় নাই। আপনি আমার স্ত্রী, এই কথা সকলকে বলিয়াছি, সুতরাং আপনি কাহাকেও অন্য কিছু বলিবেন না। আগামীকল্য আমি কর্মস্থানে চলিয়া যাইব, যথাসময়ে সম্মানের সতি অথচ গোপনে আমি আপনাকে বিবাহ করিব। আপনার কোনো ভয় নাই।”
.
অষ্টত্রিংশ পরিচ্ছেদ
দিল্লী হইতে বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া যখন রায়হান হামিদের বাড়িতে আমেনার সহিত দেখা করিতে গেলেন-তখন হামিদ কাঁদিয়া কহিল–আমেনাকে সে কলিকাতায় বিসর্জন দিয়া আসিয়াছে। সে আমেনাকে লইয়া কলিকাতায় বেড়াইতে গিয়াছিল, ভিড়ের মধ্যে আমেনা কোথায় হারাইয়া গিয়াছে।
গভীর দুঃখে রায়হানের কয়দিন কাটিয়া গেল। হামিদ অনেকবার হাসিয়া রায়হানকে বিধির বিধান মানিয়া লইতে বলিয়া গেল, কিন্তু তবুও রায়হান শান্ত হইতে পারিলেন না।
হামিদ যে দিন এই ভয়ানক সংবাদ রায়হানকে দিয়া গেল সেদিন হইতে পঞ্চম দিনে তিনি একখানা বিয়ারিং পত্র পাইলেন। পত্রে যাহা লেখা ছিল তাহা পড়িয়া রায়হান বজাহতের ন্যায় মাটিতে বসিয়া পড়িলেন।
পত্রখানি এইরূপ :
বীরনগর
প্রিয় ভাইজান,
এই পত্র পাইয়া আপনার মনের অবস্থা কেমন হইবে, তাহা বুঝিতেছি না। আপনারা এবং আমার স্বামী কেমন করিয়া আমার অস্তিত্বকে মুছিয়া ফেলিতে সক্ষম হইয়াছেন বুঝিতেছি না।
এই পত্র আপনি পাইবেন কিনা জানি না। কলিকাতা বেড়াইবার ওছিলায় আমার স্বামী আমাকে বাড়ির বাহির করেন। স্বপ্নেও ভাবি নাই, আমার মাথায় এই বজ্রাঘাত হইবে। কুমারপুর রেলস্টেশনে আমার স্বামী আমাকে হত্যা করি। নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছেন। সঙ্গে একখানি পত্র পাঠাইলাম। পড়িয়া দেখিবেন আমাকে কীভাবে পরিত্যাগ করা হইয়াছে। আমি এখন বীরনগর দারোগার বাড়িতে দারোগার স্ত্রীরূপে আছি। আমার মনের উপর কি ভয়ানক কষ্ট হইতেছে, খোদাই জানেন! বিবাহের পর হইতে আমার যে কত অসম্মানের বোঝা চাপান হইল তাহার ইয়ত্তা নাই। যদি উদ্ধারে আমার অসম্মান আরও বর্ধিত হয়, তবে উদ্ধারে কাজ নাই। নিজের বেদনা লইয়া নিজেই শুকাইয়া মরিব। এই জন্যই কি আমায় লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন?
স্ত্রীলোকের জীবন কি এতই তুচ্ছ? একটা খেলনার যে মূল্য আছে আমার জীবনের তাহাও নাই। গৃহপালিতপশুর জীবন ছাড়া আমার জীবন আর কী?
ভাইজান! কোথায় আপনি? কোথায় আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে উপহাস করুক–আপনিও কি আমায় উপহাস করিবেন? আমাকে রক্ষা করুন। তাহার পর নিজের কাছে স্থান দিয়া আমার সম্মান রক্ষা করুন। কেউ আমাকে চিনিবে না। ইহার পর হয়তো আমার মূল্য এক পয়সাও হইবে না। লজ্জা এবং পৃথিবীর অবহেলা হয়তো আমার পক্ষে অসহনীয় হইয়া উঠিবে। এই পত্র আমি দারোগা সাহেবের ছোট ছেলের সাহায্যে ডাকে দিতে সক্ষম হইয়াছি।”
পত্র পড়িয়া রায়হান দুই হস্তে বুক চাপিয়া ধরিয়া বেদনায় মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার উন্নত হৃদয় অতি প্রিয়তম ছাত্রীকে লইয়া পৃথিবীর এ কী কৌতুকঃ অসহ্য বেদনায় রায়হানের চক্ষুও বক্ষ অশ্রুধারায় ভিজিয়া গেল। কিন্তু বিলম্ব করিলে চলিবে না। হয়তো কাঁদিবার কোনো সময় নাই।
রায়হান অনেকক্ষণ বসিয়া চিত্তকে সংগত করিয়া কী যেন ভাবিয়া লইলেন–তাহার পর তিনি সহসা কাপড় পড়িয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া রেলস্টেশন অভিমুখে যাত্রা করিলেন।
জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের সাহায্যে রায়হান যখন বীরনগর দারোগা বাড়ি হইতে আমেনাকে উদ্ধার করিলেন তখন তাহার আনন্দের সীমা রহিল না।
দারোগার পরিবারবর্গ ব্যাপার কিছু না বুঝিতে পারিয়া অবাক হইয়া রহিল।
.
ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
আসল কথা কেহ জানিল না। জানিল কেবল আমেনার মা। তিনি আঁখি-জলে রায়হানের হাত জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন–“বাবা, তোমাকে দিবার আমার কিছুই নাই?।
তালাক যখন হইয়াই গিয়াছিল তখন রায়হান সাধারণের অবগতির জন্য জেল হইতে হামিদকে কারণ নির্দেশ না করিয়াই আমেনার জন্য নূতন তালাকপত্র পাঠাইয়া দিতে। অনুরোধ করিয়াছিলেন। হামিদ তাহা করিয়াছিল। ফাঁসি তাহার হয় নাই। দারোগার বিনা চেষ্টাতেই তাহার মাত্র ছয় মাসের জেল হইয়াছিল। ভীরু হামিদ কাহারো আশ্বাস না মানিয়াই স্ত্রীকে গোপনে পরিত্যাগ করিয়াছিল।
তখন বর্ষাশেষের একটু একটু শীত। সবে শিশির পড়িতে আরম্ভ হইয়াছে। ডোবার ভিতর শেওলার পাতায় হিমকণাগুলি ঝ ঝক্ করিতেছিল। ডোবার মাঝখানে শুভ্র দুটি মৃণাল-প্রভাতে পুণ্য হৃদয়ের পবিত্রটুকু লইয়া আপন মনে জড়াইয়াছিল।
রায়হান দূর হইতে দেখিলেন, ঊষার শিশিরে খালি পায়ে শুভ্র বসনে আমেনা জলের শান্ত সৌন্দর্যের পানে অনিমেষে তাকাইয়া আছে।
কী জানি কেন রায়হানের বুকখানি সহসা কাপিয়া উঠিল। একটা করুণ আবেগ নিমিষের জন্য তাহার বিশ্বাসকে রুদ্ধ করিয়া গেল।
রায়হান তাড়াতাড়ি দোকান-ঘরে চলিয়া গেলেন।
দরজা খুলিয়া, ডাস্টার দিয়া টেবিলখানা, আলমারিগুলি চেয়ার দুইখানা, বইয়ের তাকটি পরিষ্কার করিয়া ফেলিলেন।
তাহার মনে আজ সহসা যেন কীসের একটা স্পর্শ লাগিয়াছে। একটা বেদনা ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার চিত্তকে অধীর করিয়া তুলিতেছিল।
দরজার কাছে চেয়ারখানি টানিয়া লইয়া রায়হান বাহিরের দিকে চাহিয়া মৃদুস্বরে করুণ বেদনায় বলিয়া উঠিলেন–“আমেনাকে কী করা যায়?”
নিত্য মানুষের মঙ্গল খুঁজিয়া রায়হান যতটুকু আত্মপ্রসাদ লাভ হইত আজ তাহা সামান্যই বোধ হইতেছিল।
আমেনাকে রায়হান আজ কয়েক মাস হইল দারোগার বাড়ি হইতে লইয়া আসিয়াছেন। এই কয়মাস তিনি ভিতরে ভিতরে একটু সুখই অনুভব করিয়া আসিতেছিলেন। আজ কিন্তু সে সুখানুভূতি তাঁহার কাছে যথেষ্ট বলিয়া মনে হইতেছিল না।
রায়হান ভাবিলেন–এই স্নেহময়ী বালিকাটি সংসারের কাছে কী অপরাধ করিয়াছে–যার জন্য তার উপর সংসারের এই শাস্তি? নিজে আমেনার কী উপকার করিয়াছেন? কিসের জন্য আমেনা তাহাকে এত শ্রদ্ধা করে?–সে আমেনাকে জ্ঞান দিয়াছে, এই জন্য? যে জ্ঞানে আমেনার কিছুমাত্র সুখ বাড়ে নাই, সে জ্ঞানের মূল্য কী? সেই পুরোনো বিশ্বাস–“বিধাতা বন্ধুকে দুঃখ দান করেন” এ কথা রায়হান বিশ্বাস করতে রাজি নন। দুঃখকে দূর করাই তাঁর জীবনের আনন্দ। সম্মুখে এই ধূমায়িত সুখ ও আনন্দবাঞ্জিতা আমেনাকে ভালবাসিয়া, রায়হান ভাবিতেছিলেন–তার কাছে সকল সুখই হারাম।
রায়হান আবার ভাবিলেন–“দুইবার তাহাকে বিবাহ দেওয়া হইয়াছে। পাড়ার কেউ কেউ আমেনা সম্বন্ধে একটা অপ্রিয় কথা আলোচনা করিয়া তার ভাঙ্গা মর্যাদাটুকুকে আরও খাট করিয়া ফেলিবে না, তারই বা বিশ্বাস কী?”
আমেনা শান্ত মৌন নিষ্পাপ বালিকা, তার হৃদয়ের মর্যাদা রায়হান ছাড়া আর কে জানে! মানুষ তার বিশ্বাস মানিয়া লইবে কী? অবিশ্বাস ও সন্দেহ আমেনার বুকখানাকে কেমন করিয়া রক্তময় করিবে, রায়হান তাহা বুঝিলেন এবং শিহরিয়া উঠিলেন।
এই বয়সে আমেনার আবার বিবাহ হওয়া দরকার। কিন্তু কোথায়? কে তাহাকে বিবাহ করিবে? তাহাকে সন্দেহ করিবার সুযোগ বিধাতা অনেকখানি মানুষকে দিয়াছিলেন। সে আঘাত আমেনা সহ্য করিতে পারিবে কি? কোন অপদার্থ সৌন্দর্যলোলুপ রূপভিখারি আমেনাকে বিবাহ করিতে আসিতে পারে কিন্তু যেখানে স্বামীর স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা নাই যেখানে স্ত্রী কি তিষ্টিতে পারে?
কোনো হীন দুর্মতি যদি আমেনাকে বিবাহ করিতে আসে তাহা হইলে আমেনা কতখানি ব্যথিত হইবে? আমেনা কেমন করিয়া এই অত্যাচার সহ্য করিবে?
দোকান-ঘর বন্ধ করিয়া রায়হান বাহির হইয়া পড়িলেন।
বৈঠকখানায় বসিয়া করিমার বাপ কোরানের অর্থ পড়িতেছিলেন?! রায়হানকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “বাবা, তোমার শিল্পবিদ্যালয় হতে আমাকে দুইখানি নূতন চেয়ার তৈরি। করে দিও।”
রায়হান সালাম করিয়া কহিলেন–“চাচাজান, আপনারই তো সব।”
বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া রায়হান দেখিলেন, করিমা বারান্দায় বসিয়া কলে জামা সেলাই করিতেছেন।
রায়হান আদাব করিয়া কহিলেন, “খুব কর্মী, এক মুহূর্তও নষ্ট হবার যো নাই।”
করিমা বলিলেন,–“সব চাপ আপনার উপর দিয়ে আমি নিজে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকি, এই আপনার ইচ্ছা?”
রায়হান কুণ্ঠায় কহিলেন–“না, না! সে কথা নয়।” করিমার মা সেখানে বসিয়াছিলেন। রায়হান সালাম করিয়া তাহার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন।
করিমার মা স্নেহমাখা স্বরে রায়হানকে বসিতে বলিলেন। মেয়ে ও রায়হানের পাছে। কথা বলিতে লজ্জা বোধ হয়; তিনি কাজের বাহানায় উঠিয়া গেলেন।
রায়হান বলিলেন–“বুবু, আমেনা তোমার ও আমার স্নেহ ও সহানুভূতি ছাড়া বাঁচবে। এই ব্যথিত বালিকার জন্য তোমার কতখানি বেদনা বোধ হয়, তা আমি জানতে চাই। আমি ইচ্ছা করি, তোমার ও আমার বিশ্বাস এবং ভালবাসায় তার জীবনের বেদনা অনেকটা কমে যাক।”
করিমা দুই ফোঁটা উষ্ণ আঁখিজল আঁচল দিয়া মুছিয়া কহিলেন–“ভাই, আমেনার জন্য প্রাণ আমার চুর্ণ হয়ে গিয়েছে! বল কী করতে পারি?”
রায়হান বলিলেন–“বন্ধুর কথা, বিশ্বাস ও সহানুভূতিতে মানুষের বহু দুঃখ কমে বটে। আমি ইচ্ছা করি, আজ হতে ভালো করে আমরা তার ভার গ্রহণ করি। সব সময়ে তাকে আনন্দ দেই–জীবন তার সরস ও সুখময় হোক।”
করিমা বলিলেন–“নিজের সঙ্গে সঙ্গে রাখবার উপায় নাই, তোমারও একই অবস্থা। অন্তত সকাল বিকালে তার সঙ্গে যেয়ে মিশতে হবে–আমাদের উদ্দেশ্য কী, সে কথা তার এবং সবার কাছে থেকে গোপন থাকবে।”
করিমা হাসিয়া বলিলেন–“আমেনাকে যদি আমাদের বাড়িতে আনি তাতে কী ক্ষতি?”
“না, তা তার পক্ষে খুবই মর্মান্তিক হবে লোকের চোখেও ভালো দেখাবে না।”
করিমা কহিলেন–“তা ঠিক।”
রায়হান কহিলেন–“বুবু, আর একটা কথা–তুমি কারো কাছে আমেনাকে নিয়ে কোনো কথা বলো না। যার যাই ইচ্ছে তাই বলুক, আমেনার হয়ে কারো কাছে কোনো কথা বলবার দরকার নাই।”
করিমা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“আমারও তাই ইচ্ছে।”
রায়হান কহিলেন–“চাচিকে বলে যদি তাকে দিনের বেলায় স্কুলে যোগ দেওয়াতে পারি, তার চেষ্টা করব।”
করিমা বলিলেন–“কাজে মানুষের অনেক দুঃখ-কষ্ট ঘুচে যায়। দিনের বেলায় তাকে যদি সঙ্গে পাই তা হলে খুব ভালোই হয়। আমার বেহারাদের বলে দিলে তারা আমেনাকে আনা-নেওয়া করবে। তাতে বেশি খরচ হবে না।”
রায়হান বলিলেন–“ভালো যুক্তি, এতে তার কোনো আপত্তি থাকতে পারে না।”
.
চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
বড় চৌচালা একখানা ঘর-মেঝে সান বাঁধা।–এই ঘরে মেয়েরা কাজ করেন। পড়িবার একটা স্বতন্ত্র কামরা আছে। বেলা দুইটা হইতে সেইখানে পড়া আরম্ভ হয়। সে সময় অন্য সব কাজ বন্ধ থাকে।
হেডমিস্ট্রেস কিরণবালার বাসা স্কুলঘর হইতে একটু দূরে–স্কুল-কম্পাউন্ডেরই ভিতর। সম্মুখে মিস্ত্রী-শিক্ষকের বাসা। তিনিও পরিবার লইয়া থাকেন, তিনি ব্রাহ্মণ।
কিরণবালার স্বামী, সখাওত হোসেন, মিস্ত্রী এবং রায়হান ছাড়া কারও স্কুলে প্রবেশ অধিকার নাই।
মেয়েদের বোর্ডিং-ঘর, দুই শিক্ষকের দুইবাসা এবং স্কুল ঘেরিয়া প্রাচীর; ভিতরের দিকে প্রাচীরের গায়ে গায়ে ফুল ও লতা-পাতা উপরে লৌহশিক বসান। গেট বন্ধ করিয়া দিলে কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকে না।
প্রস্তুত জিনিসপত্র সবই রায়হান গ্রহণ করেন–তিনিই বিক্রয় করেন। লাভ ছাড়া প্রত্যেক জিনিসে নির্দিষ্ট দাম বসাইয়া হিসাব করিয়া মোট যে মূল্য হয় তাহা শিল্পবিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা দেওয়া হয়। ফলে রায়হানেরও প্রচুর লাভ হইতেছে। স্কুলেরও একটা বাঁধা মাসিক আয় হইয়াছে।
দর্জির কাজ যে সব ছাত্র শিখিয়াছেন তাহাদের মধ্যে সকলের চেয়ে ভালো হইয়াছেন আবুল কাসেম মিঞার পুত্রবধূ। তিনি মাসে এখন চল্লিশ টাকা আয় করিতে পারেন।
রানাঘাটের সেই মেয়েটি মিস্ত্রীর কাজে খুব দক্ষ হইয়া উঠিয়াছেন। লেখাপড়ায়ও তাঁহার বিলক্ষণ আগ্রহ। অবসর সময়ে এবং অনেক রাত্রি পর্যন্ত তিনি লাইব্রেরিতে বসিয়া বই পড়েন। এক ব্রাহ্মণ ডাক্তার চিকিৎসার জন্য আসিয়া তাহাকে দেখিয়া যান। তিনি সম্প্রতি রায়হানের কাছে একখানি আবেগপূর্ণ পত্র লিখিয়াছেন–তিনি তাহাকে বিবাহ করিতে চান।
রায়হান কিংবা করিমাকে দেখিয়া ছাত্রীরা কোনো সঙ্কোচ বোধ করে না। তাহারা যে। কাহারো অনুগ্রহে সেখানে পালিত হইতেছে একথা তাহাদিগকে ভাবিতে হয় না।
আজিজের স্ত্রীর স্বভাব অতি সুন্দর। স্বভাবে সে সকলকে মুগ্ধ করিয়াছে। সকল ছাত্রী। তাহাকে ভালবাসে। সে পুস্তক বাঁধাই এবং সেলাইয়ের কাজ শিখে। বাহির হইতে ব্যবসায়ী দপ্তরী আসিয়া প্রতি শনিবারে বই দিয়া যায় এবং বাঁধা বইগুলি লইয়া যায়। একজন ছাত্রীকে বই বাঁধাই শিখাইতে মাত্র তিন মাস লাগিয়াছিল–সেই ছাত্রীটি এখন সকলকে কাজ শিখাইয়া লইয়াছে।
হিন্দু ছাত্রীরা স্বতন্ত্র খায়, মোসলমান ছাত্রীরাও ভিন্ন খায়।
দিন রাত্রির ব্যস্ততায় কাহারও মনে কোনো কুভাব আসে না। কিরণবালা ছাত্রীদের সহিত পাঁচবার নামাজ পড়েন। প্রাতঃকালে আজিজের স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরিয়া কোরান পাঠ করে।
ফুর্তি ও উল্লাসের জন্য প্রতি বৈকালে হেডমিস্ট্রেস সাহেবা ছাত্রীদিগকে লইয়া পুরুষ ছেলেদের মতো নানাবিধ ক্রীড়া করেন। সখাওত মিঞা এবং মিস্ত্রীকে সে সময় বাহিরে যাইতে হয়।
প্রত্যেক ছাত্রীর নামের পূর্বে মাতা শব্দ যোগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। নাম উচ্চারণ করিবার সময় সঙ্গে সঙ্গে মাতা শব্দটি বলিতে হয়।
কোনো ছাত্রী কোনো অসভ্যতা বা নীচতার পরিচয় দিলে হেডমিস্ট্রেস মিষ্ট কথায় তাহার ত্রুটি বুঝাইয়া দেন। কাহারো সহিত কোনপ্রকার কঠিন ব্যবহার করা হয় না।
ভোগবিলাস অপেক্ষা সংযমের কথাই ছাত্রীদিগকে বেশি বলা হয়। যদিও স্পষ্টভাবে কিছু প্রকাশ করা হয় না, কথায় ও কাজে এমন ব্যবহার করা হয় যাহাতে তাহাদের মন। ভোগ অপেক্ষা সংযমের দিকে বেশি অনুরক্ত হয়। কাহাকেও কঠিনভাবে কিছু বলা হয় না।