৩০. ক্যান্সারের ওষুধটার কথা

ত্রিশ

নিজের ওপর মাঝে মাঝে আজকাল বড় রেগে যায় শাশ্বতী। ক্যান্সারের ওষুধটার কথা সে যে কোথায় পড়েছিল, কোন কাগজে, কবে, তা তার কিছুতেই মনে পড়ছে না। অনেক ভেবেছে সে।

একদিন ডাঁই করা পুরনো খবরের কাগজ মেঝেতে নামিয়ে ধুলো ঝেড়ে বহু সময় ধরে খুঁজেছে। মা এসে অবাক, ও কী রে ঠান্ডু, সারা দিন কাগজ গড়ায়, খুলেও দেখিস না, এখন পুরনো কাগজ পেড়ে ঘর নোংরা করে কী দেখছিস?

কী দেখছে তা কি কাউকে বলতে পারে শাশ্বতী? কে বুঝবে! তাই সে রেগে বলে, ঘর ঝেঁটিয়ে দেব। এখন যাও তো।

একদিন কালীনাথকেও জিজ্ঞেস করেছিল শাশ্বতী, দাদা, তোর মনে আছে—একদিন কাগজে বেরিয়েছিল না যে ক্যান্সারের কী একটা ওষুধ বেরিয়েছে!

ক্যান্সারের ওষুধ! কালীনাথ অনেকটা ভাবে। মাথা নেড়ে বলে, কোথায়, নজরে পড়েনি তো! বেরিয়েছে নাকি!

হুঁ। আমি নিজে দেখেছি।

কালীনাথ একটু ভেবে বলে, তা হলে খুঁজে দেখিস তো। কাগজে পেলে বলিস। অফিসে সবাইকে খবরটা দেব। খুব সেনসেশেন্যাল খবর। কেউ বলেনি তো!

শুনে রেগে যায় শাশ্বতী। খবরটা কি কেউ দেখেনি! তবে কি বেরোয়নি ও-রকম খবর? না কি সে উড়ো শুনেছে কোথাও।

খুব সন্দেহ হয় তার। কিন্তু হাল ছাড়ে না।

পাড়ার মহিম ডাক্তারকে শাশ্বতী কাকা বলে ডাকে। তার ডিসপেন্সারিতে সবসময়ে ভিড়। এক দুপুরেই যা একটু ফাঁকা। তখন মহিমকাকু কল-এ বেরোয়, আর মদন কম্পাউন্ডার বসে বসে ঝিমোয়। সেই সময়েই একদিন সেখানে হানা দিল শাশ্বতী, মদনদা, একটা খবর জানেন? ক্যান্সারের ওষুধ কোথায় করে বেরিয়েছে!

মদন বুড়ো মাথা নেড়ে বলে, বেরোল আর কোথায়! তবে বেরোব-বেরোব করছে। দু’চার দশ বছরের মধ্যে বেরিয়ে যাবে।

মদন জানে না, জানলে আর কম্পাউন্ডার হয়! শাশ্বতী তখন মহিম ডাক্তারের টেবিলের ওপর রাজ্যের মেডিকাল জার্নাল বসে বসে ঘাঁটে। সব বুঝতে পারে না, কিন্তু মন দিয়ে প্রাণ দিয়ে খোঁজে, কোথাও ক্যান্সারের সম্বন্ধে কিছু লেখা আছে কি না।

মদন কম্পাউন্ডার জিজ্ঞেস করে, কার ক্যান্সার?

কারও না। এক বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরেছি।

অ। বলে মদন হাই তোলে।

কলেজের লাইব্রেরিতে কোনও ডাক্তারি বই নেই। তবু শাশ্বতী ক্যাটালগ খুঁজে ফিজিওলজির গোটাকয় বই নিল। পড়ে কিছুই বুঝতে পারল না। নিজের বোধবুদ্ধির ওপরও তার ভয়ংকর রাগ হতে লাগল।

হাসপাতালে কদাচিৎ গেছে শাশ্বতী। যেতে ভয় করে। অনেক দিন আগে তার বড়দি লীলাবতী কিছু দিন ছিল মেডিক্যাল কলেজে। তখন, খুব ছোটবেলায় সে দু’-একবার সেখানে গেছে। সে জানে দু’নম্বর বাস মেডিক্যাল কলেজের পাশ দিয়ে যায়। সেই স্মৃতির ওপর নির্ভর করে, খুব সাহস করে একদিন কলেজে বেরিয়ে, কলেজে না গিয়ে সে দু’ নম্বর বাসে চাপল। ভয়ে বুক ঢিবঢিব করছিল তার, তবু যেতেই হবে বলে গেল।

ক্যান্সার ইউনিট খুঁজে পেতে দেরি হল না। ছোটখাটো একটা বাড়ি। লোকজনের ভিড় কম। সে গেটের কাছে একজন বেয়ারাকে বলল, আমি একজন ডাক্তারের সঙ্গে একটু কথা বলব।

লোকটা তাকে একটা ফাঁকা অফিস-ঘরের মতো ঘর দেখিয়ে দেয়।

সেখানে বাচ্চা এক ডাক্তার বসে আছে। রোগা, ফরসা, চোখে চশমা, মিষ্টি মুখখানি। কথা বলতেই বোঝা গেল, একটু তোতলা। সুন্দর ব্যবহার তার। শাশ্বতীকে বসতে বলল।

কার ক্যান্সার?

একজনের। আমার চেনা একজন।

কোথায় হয়েছে?

পেটে?

লোকটা হাসে। বলে, পেটে তো অনেক কিছু আছে। পেটের কোথায়?

শাশ্বতী যত দূর জানে বলল। লোকটা ভেবে বলল, তা হলে গ্যাসট্রিক কারসিনোমা। অপারেশন হয়েছে বললেন?

হয়েছে।

লোকটা ঠোঁট ওলটায়। বলে, লাভ নেই অবশ্য।

শাশ্বতীর ভয়ংকর বুক কেঁপে ওঠে। কান-মুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। সে কাঁপা গলায় বলে, আর ট্রিটমেন্ট নেই?

লোকটা মিষ্টি হেসে বলে, গ্যাসট্রিক কারসিনোমা পাঁচ বছর পর্যন্ত টিকলে আমরা কিওর বলে ধরি। কিন্তু পাঁচ বছরই ম্যাক্সিমাম।

তার পর কী হবে?

কালো কফির রঙের বমি হবে। বাঁ কাঁধের দিকে কতগুলো লাম্প দেখা যাবে। খিদে থাকবে না। বমির সঙ্গে রক্তও থাকতে পারে।

কিন্তু শাশ্বতী সে-সব শুনতে পায় না। না শোনার জন্যই বলে, আমি শুনেছি রে দিলে ভাল হয়ে যায়! আমাকে আপনাদের যন্ত্রপাতিগুলো দেখাবেন?

আসুন। বলে লোকটা মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়ায়। সে নতুন ডাক্তার। এই কচি সুন্দর মেয়েটাকে সে নিজের কৃতিত্ব দেখাতে আপত্তি করে না।

নিঃশব্দ, ঠান্ডা ঘরে প্রকাণ্ড যন্ত্রগুলো ভীত চোখে দেখে শাশ্বতী। এই বিশাল যন্ত্রেও ওইটুকু রোগ ভাল হয় না!

লোকটা তাকে দূর থেকে যন্ত্রের কলাকৌশল বুঝিয়ে দিতে থাকে। শাশ্বতী শোনেও না। কেবল চেয়ে থাকে। বলে, কিন্তু আমি শুনেছিলাম, এর, ওষুধ বেরিয়েছে।

ওষুধ! অনেক ওষুধ বেরিয়েছে। কিন্তু কোনওটাই অমোঘ নয়।

কিন্তু কথাটা মনে রাখে না সে।

মানুষ এতকাল ধরে করেছে কী! কী করেছে তারা! শাশ্বতী ভেবে দেখে, এই একটু ছোট্ট ঘটনার কাছে পৃথিবীর সব আবিষ্কার ব্যর্থ হয়ে আছে! সে মানুষের ওপর বড় রেগে যায়। কেন অকাজের কাজ করে মানুষ! কেন খামোখা প্লেন বানাচ্ছে! রকেট ছুড়ছে! তৈরি করছে বোমা! এ তো ছেলেখেলা শুধু শুধু। তারা সব ছেড়ে দিক। তারা এক্ষুনি বসে যাক সেই অমোঘ ওষুধটা বানাতে। শাশ্বতী তাদের পাঁচ বছর সময় দেবে। না, অত নয়। এক বছর— এক বছরের মধ্যে যদি বানাতে পারে ভাল। নইলে—নইলে—হায়, নইলে অসহায় শাশ্বতী কী শাস্তি দেবে তাদের তা ভেবে পায় না।

তাদের ঝি ইন্দু মাঝে মাঝে ঠাকুরপুকুরের এক তান্ত্রিকের কথা বলত। সে রোগ সারায়, প্রাণবিনিময় করে দেয়। ইন্দুকে একদিন জিজ্ঞেস করল শাশ্বতী, হ্যাঁগো ইন্দুদি, সেই তান্ত্রিক ক্যান্সার সারাতে পারে?

ইন্দু ঘাড় হেলিয়ে বলে, সব। আমার ননদাইয়ের অমন বাতব্যাধি সেরে গেল!

ইন্দুর কাছ থেকে তান্ত্রিকের ঠিকানাটা রেখে দেয় শাশ্বতী।

কয়েক দিনের মধ্যেই এ-রকম অনেক ঠিকানা এসে যায় তার হাতে। সে ভেবে কূল পায় না, কার কাছে যাবে।

মাঝে মাঝে সকালের রোদে বাবা বাগানে আগাছা নিড়োয়, ফুলগাছের গোড়া খুঁড়ে দেয়। তখন বাবার কাছে গিয়ে চুপ করে বসে শাশ্বতী। বাবা কথা বলে না, কিন্তু কদাচিৎ কখনও উদাসীন চোখে তার দিকে একপলক তাকায়।

শাশ্বতী ডাকে, বাবা।

উত্তর নেই।

কী করলে ক্যান্সার সারে?

উত্তর নেই।

কেন মানুষ ওষুধ বের করছে না এক্ষুনি?

মানুষের কাজে বড় হেলাফেলা। শাশ্বতী ভাবে।

ললিতের বাসায় সেই যে গিয়েছিল শাশ্বতী তারপর প্রায় এক মাস কেটে গেছে। প্রায় এক মাস পর একদিন রবিবারের কাগজে একজন কবিরাজের প্রবন্ধ বেরোল। হিমালয়ের গাছগাছড়ার কথা বলতে গিয়ে এক জায়গায় এক দুর্লভ গাছের নাম করে বলেছেন যে, এর থেকে একদিন দুরারোগ্য ক্যান্সারের প্রতিষেধক বেরোতে পারে।

কালীনাথকে লুকিয়ে প্রবন্ধের পাতাটা ভাঁজ করে ব্যাগে ভরল শাশ্বতী। অল্প একটু সাজগোজ করে বন্ধুর বাসায় যাচ্ছে বলে বেরিয়ে পড়ল।

ললিতের ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল খুব লম্বা, ফরসা একজন লোক। গায়ে হাফহাতা পাঞ্জাবি, পরনে খাটো ধুতি।

ললিতবাবু নেই?

আছে। আসুন। লোকটি বড় সুন্দর হাসে। শাশ্বতী লক্ষ করে।

আধশোয়া থেকে উঠে বসল ললিত। দরজাটা আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল রমেন, সে সরে যেতেই শাশ্বতীকে দেখে সে প্রথমে কথা বলতে পারল না। কেমন যেন বুক-কঁপা, কথা-গুলিয়ে-যাওয়া, আবেগসর্বস্ব এক অনুভূতি টের পায় সে।

তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।

এতক্ষণ শাশ্বতী কেবল আসছিল ললিতের কাছে। একটা ব্যগ্র প্রয়োজনের কথাই তার মন জুড়ে ছিল। কিন্তু এখন, ললিতের মুখোমুখি সে হঠাৎ টের পায়, এতটা করার মধ্যে সে সকলের কাছেই ধরা পড়ে গেছে। সবাই বুঝতে পারছে এখন, কেন শাশ্বতী এত দূর এসেছে।

বুঝুকগে। শাশ্বতীর কিছু আর যায় আসে না।

আসুন। ভিতরে আসুন। রমেন ডাকে।

শাশ্বতী ভিতরে এসে তার শুষ্ক, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে একটু হাসে। বলে, কেমন আছেন দেখতে এলাম।

তারপরেই মাথা নিচু করে সে।

শাশ্বতীকে বসিয়ে মাকে ডেকে আনে ললিত রান্নাঘর থেকে।

এতক্ষণ মনে মনে বোধহয় শাশ্বতীকেই প্রার্থনা করছিল মা। গতকাল ওই সন্ন্যাসী ছেলেটা আসার পর থেকেই। ও কোনও তুক করার আগেই যেন শাশ্বতী আসে।

একগাল হেসে কাছে বসে শাশ্বতীকে প্রায় কোলে টেনে নেয় মা। বলে, মুখ শুকিয়ে গেছে যে! রোদে রোদে ঘোরো বুঝি! তারপরেই আর দেরি না করে জিজ্ঞেস করে, তোমরা বাঁড়ুজ্যে না! শাণ্ডিল্য গোত্র তো!

ললিতের কান-মুখ ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। বলে, উঃ মা, কী হচ্ছে!

হায় মা! মায়ের জন্য বড় কষ্ট হয় ললিতের। মিতুর অপমান মনে পড়ে। মনে পড়ে আর কিছুদিন বাদে এই ঘরে কেমন একা হয়ে যাবে মা। মা জানে না, ললিত—তার একমাত্র ললিত থাকবে না। ধমক দিতে ললিতের কষ্ট হয়। চোখ ছলছল করে। মা আর শাশ্বতীর ও-রকম কাছ ঘেঁষে আপনজনের মতো বসে থাকা সে দেখতে পারে না। সে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

শাশ্বতীকে তাদের কাছে না-রেখে রান্নাঘরের দরজায় টেনে নিয়ে গিয়ে বসাল মা। মায়ের মুখে আজ হাসি ধরছে না। এই গরিবের সংসারে লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা কি আসতে রাজি হবে! হয় যদি! আহা, যদি হয়!

শাশ্বতীকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য রমেন আর ললিত একসঙ্গে বেরিয়েছিল।

আনোয়ার শা রোড ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পর ললিত একটু হাঁফিয়ে গেল। বেশ রোদ এখন। সেও আবেগবশত জোরে হেঁটেছে। লক্ষ করে শাশ্বতী বলল, আপনারা ফিরে যান। আমি তো রাস্তা চিনি। যেতে পারব।

রমেন ললিতকে ফিরিয়ে দেয়, তুই চলে যা। আমি এগিয়ে দিয়ে আসি।

ক্লিষ্ট একটু হেসে ললিত দাঁড়িয়ে গেল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ফিরে এল আস্তে আস্তে। এসে শাশ্বতীর রেখে-যাওয়া পত্রিকার প্রবন্ধের পাতাটা খুলল সে। খুলে হাসল।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একসময়ে রমেন হাত ধরে শাশ্বতীকে রাস্তার ধারে সরিয়ে আনল। পিছনে অনেকক্ষণ ধরে হর্ন দিচ্ছিল একটা গাড়ি, শাশ্বতী শুনতে পায়নি। সে একটু লাজুক হাসল। যতক্ষণ ললিত সামনে ছিল ততক্ষণ লোকটাকে ভাল করে লক্ষ করেনি শাশ্বতী। এখন লক্ষ করে দেখল লোকটা একটা থামের মতো বড়। গায়ের ফরসা রং থেকে রোদ ঠিকরে আসছে, সুন্দর চেহারা, কিন্তু পোশাকের কোনও যত্ন নেই। পরনে একটা হাফ-হাতা পাঞ্জাবি আর ধুতি। লোকটা বোধ হয় কখনও খেয়াল করে না যে সে কতখানি সুন্দর। শাশ্বতীর ভাল লাগল যে সে রাস্তার মাঝখান দিয়ে অসাবধানে হাঁটছিল বলে লোকটা তাকে একটুও ধমক দিল না, উপদেশও দিল না। শুধু হাত ধরে সরিয়ে এনে আবার নির্বিকারভাবে হাঁটছে। যেন দরকার হলে আবার হাত ধরে সরিয়ে আনবে, ধমক বা উপদেশ দেবে না।

শাশ্বতী জিজ্ঞেস করল, বললেন না তো আপনি সন্ন্যাসী কি না!

রমেন শান্তভাবে বলল, না।

শাশ্বতী তার দাঁতে ঠোঁট টেপা সুন্দর হাসিটা হাসল। বলল, কিন্তু আপনি সন্ন্যাসী হলে খুব ভাল হত।

কেন?

সন্ন্যাসীদের তো অনেক তুকতাক তন্ত্র-মন্ত্র জানা থাকে। আমি আপনার কাছ থেকে ক্যান্সারের ওসুধ জেনে নিতাম।

রমেন একটু হাসল।

শাশ্বতী চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু যত দূর মনে হয় আমি কাগজে দেখেছি ক্যাসারের ওষুধ বেরিয়েছে। তাই না?

রমেন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, বেরিয়েছে।

শাশ্বতীর মুখ সামান্য উজ্জ্বল দেখাল। বলল, আপনিও দেখেছেন, না?

রমেন একটু চিন্তা করে বলল, দেখেছি বোধ হয়।

বেরিয়েছে। শাশ্বতী হঠাৎ নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি।

রমেন একটুও হাসল না। খুব গম্ভীরভাবে বলল, আমি অবশ্য একটা টোটকা ওষুধের কথা জানি।

কী সেটা?

হাঁটতে হাঁটতে বাস-রাস্তায় এসে গিয়েছিল তারা। রমেন বলল, আর-একদিন বলা যাবে। ওই আপনার বাস-স্টপ।

না, আপনি বলুন। অধৈর্যের স্বরে বলল শাশ্বতী। এদিক ওদিক একটু দেখে নিয়ে বলল, ওইখানে একটা রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে। চলুন, একটু বসি।

রমেন একটু ইতস্তত করে বলল, আমি রেস্টুরেন্টে কিছু খাই না।

আচ্ছা, আমি চা খাব। আপনি বসবেন। চলুন।

সকাল সাড়ে দশটায় রেস্টুরেন্টটা খুব ফাঁকা ছিল না। কয়েকজন ইতর ধরনের ছেলে ছোকরা এদিক ওদিক বসে আছে। কেউ জোরালো শিস দিচ্ছে, তার সঙ্গে টেবিলে আঙুল ঠুকে তবলা বাজানোর শব্দ। দেখেশুনে মুখ শুকোল শাশ্বতীর। বলল, এখানে হবে না। বড় বাজে জায়গা।

সব জায়গাই এ-রকম। আসুন, কোনও ভয় নেই।

ভিতরটা নোংরা অন্ধকার। ছেলেছোকরারা লম্বা একটা টেবিল দখল করে রেখেছে, বাদবাকি রেস্টুরেন্টটা ফাঁকা। এরা আড্ডা দেয় বলেই বোধহয় এখানে তেমন খদ্দের আসে না। যে-দোকানে একবার এ-ধরনের আড্ডা বসে সে-দোকান আস্তে আস্তে মিইয়ে যায়, টিম টিম করে চলে।

ইস, কী অসভ্যের মতো তাকাচ্ছে! ফিস ফিস করে শাশ্বতী বলল।

আপনিও তাকান। ভয় পাবেন না।

যাঃ।

রমেন তার সরল সুন্দর চোখে তাকিয়ে ছিল ছেলেগুলোর দিকে। প্রায় নিস্পলকভাবে।

শাশ্বতী ফিসফিস করে বলল, কী করছেন! ওরা ভীষণ বাজে।

সে-কথায় কান দিল না রমেন। তাকিয়েই রইল। ব্যাপারটা খুব আস্তে আস্তে ঘটতে লাগল। কালোকোলো, রংচঙে জামা প্যান্ট পরা ছেলেগুলো ঘন ঘন তাকাচ্ছিল তাদের দিকে। হাসছিল, গা টেপাটেপি করে নিচু স্বরে কথা বলছিল। তারা কিছুক্ষণ রমেনকে লক্ষ করল, তার চোখের দৃষ্টি ফেরত দিল সমানে সমানে। একজন বলল, মাইরি, আমাদের ভসসো করে ফেলবে। তারপর আস্তে আস্তে ঠান্ডা লড়াইটায় তারা হারতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আর কেউ তাকাচ্ছিল না, নিজেদের আড্ডায় ডুবে গেল।

রমেন শাশ্বতীর দিকে মুখ ফিরিয়ে একটু হাসল। তারপর বলল, চোখের একটা কোনও শক্তি আছে। আপনি যদি কখনও এ-সব ছেলের চোখে সাহস করে চোখ রাখেন তবে দেখবেন এরা সেটা সহ্য করতে পারে না। তবে খুব সরলভাবে তাকাতে হয়, রেগে গিয়েও নয় আবার ভয়ে ভয়েও না।

কিন্তু ওষুধের কথাটা!

রমেন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। সেটাও চোখেরই একটা ব্যাপার। আমাদের পরিবারে একটা পুরনো চোখের অসুখ ছিল। আমার ঠাকুরদার বাবা ছিলেন প্রায় অন্ধ মানুষ। দাদু সেই অসুখটা জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন। যৌবনকাল থেকেই তাঁকে চশমার সঙ্গে আতসকাচ কিংবা দূরবিন ব্যবহার করতে হত। আবার দাদুর দুই ছেলে, আমার বাবা আর জ্যাঠামশাই, আর এক মেয়ে, আমার পিসিমা—এদের বয়স তিরিশ পেরোনোর আগেই চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করল। আর চল্লিশের আগেই সকলের অন্ধ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। সেই সময়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল আমাদের বিরাট বিষয়-সম্পত্তি, বাড়ি, বাগান, খাজনার হিসেব এ-সবের দেখাশোনা নিয়ে। কে এ-সব দেখে? আমার ঠাকুমা বরাবর ভিতর-বাড়িতে থাকতেন, বাইরে বেরোতেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন বাবার চোখ খারাপ হতে শুরু করল তখন ঠাকুমাকে বেরোতে হল। আর, আশ্চর্যের বিষয় যে, ঠাকুমা খুব অল্পদিনেই সব বুঝেসুঝে নিলেন। খুব নিখুঁতভাবে, এমনকী দাদুর চেয়েও ভালভাবে তিনি জমিদারি চালাতেন। আমাদের বিরাট বাড়ি, বাগান-সম্পত্তি, সবকিছুর ওপর তাঁর তীক্ষ্ণ চোখ ছিল। সকলের দেখা তিনি একা দেখতেন। তাই এত তীক্ষ্ণ হয়েছিল তাঁর চোখ যে বাগানের একটা ফুল কেউ তুললে তিনি টের পেতেন, গাছের একটা পাতা পড়ে গেলেও তাঁর চোখ এড়াত না। প্রতিটি প্রজার মুখ তাঁর মনে থাকত। আমাদের বাসায় অজস্র সিন্দুক, আলমারি আর বাক্স প্যাঁটরা ছিল, ঠাকুমা সেগুলোর তালা একবার চাবি ঢুকিয়ে খুলতে, কখনও কোন তালার কোন চাবি তা ভুল করতেন না। এইভাবে সাৱা দিন চোখ ব্যবহার করতে করতে তাঁর চোখ ভয়ংকর তীক্ষ্ণ হয়ে যায়, আর বিষয়সম্পত্তির ওপর তাঁর ভয়ংকর একটা ভালবাসা চলে আসে। এর পর ঠাকুমা যখন মারা যান তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল। তাঁর উদুরি হয়েছিল। তার ওপর গায়ে জল এসেছিল। একটা পা গ্যাংগ্রিন হয়ে পচে গোড়ালির হাড় বেরিয়ে পড়েছিল। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে গেল। কিন্তু ঠাকুমা মরছিলেন না। একদিন দু’দিন করে এক মাস দু’মাস বেঁচে রইলেন। ওই ফোলা পচাগলা শরীরের মধ্যে একমাত্র তাঁর চোখ দুটোই ছিল দেখবার মতো। সেই বড় বড় চোখ, সেই উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একই রকম ছিল, রোগের যন্ত্রণা সেগুলিকে একটুও ছোঁয়নি। কেবল বলতেন, আমি মরে গেলে এত সব কে দেখবে? বোধহয় সেই কারণেই ভীষণ ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি বেঁচে রইলেন আরও সাত-আট মাস। সেই বেঁচে থাকাটা দেখার মতো ছিল। তারপর একদিন দুপুরবেলা আমার জেঠিমা ঠাকুমার শিয়রের দিকের আলমারি খুলে কী যেন বের করতে গেছেন, ঠাকুমা ঘাড় উলটে সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বড়বউ, কী নিচ্ছ? ব্যস ওই অবস্থায় তাঁর প্রাণ বেরিয়ে গেল। আমরা চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি অদ্ভুত দৃশ্য। ঘাড় উলটে ঠাকুমা এত বড় বড় চোখে আলমারিটার দিকে চেয়ে আছেন। একেবারে জীবন্ত মানুষের মতো খোলা চোখ, কেবল হাঁ-করা মুখের মধ্যে এলিয়ে থাকা জিবটা দেখে বোঝা যায়, ঠাকুমা বেঁচে নেই। সেই খোলা চোখ বন্ধ করতে আমাদের বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল। যত বার বুজিয়ে দেওয়া হয় তত বারই আস্তে আস্তে চোখের পাতা খুলে যায়, আর ঠাকুমা তাকিয়ে থাকেন।

আহা। স্বভাবত কোমল মন শাশ্বতীর। তার চোখ ছলছল করে।

ওষুধের কথাটা কী জানেন? ঠাকুমা মরে যাওয়ার পর আমি অনেক ভেবে দেখেছি ঠাকুমার যে মরতে অত সময় লেগেছিল তার একটা কারণ হচ্ছে ওই বিষয়-সম্পত্তির প্রতি ভালবাসা। বিষয়-সম্পত্তির প্রতি বেশি টান ভালবাসা আমরা ভারতীয়েরা পছন্দ করি না, কিন্তু তবু বিষয়-সম্পত্তির মতো খারাপ জিনিসের প্রতি ওই ভালবাসাও ঠাকুমার আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছিল। তা হলে দেখুন, ভাল কিছু সৎ কিছুর প্রতি যদি মানুষের ও-রকম তীব্র ভালবাসা হয়, আর তাকে রক্ষা করার জন্য যদি মানুষ সজাগ হয়ে ওঠে তা হলে তার আয়ু বেড়ে যাবে না? শুধু আয়ু নয়, তার চোখের দৃষ্টি বেড়ে যাবে, বাড়বে শ্রবণক্ষমতা, বেড়ে যাবে স্মৃতিশক্তি কিংবা ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি। তখন আর পাঁচজন যা দেখে না, যা শোনে না তার সব সে দেখতে বা শুনতে পাবে। তাই না?

অনেকখানি ঘাড় হেলাল শাশ্বতী। বলল, ঠিক।

তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, তা হলে আপনি বলছেন, আপনার বন্ধুর অসুখটা সেরে যাবে?

মিটমিট করে একটু হাসল রমেন। বলল, আপনার কী মনে হয়?

গূঢ় প্রশ্ন। শাশ্বতী এর উত্তর জানে না। ললিতের উজ্জ্বল চোখ মুখখানা সে মনশ্চক্ষে দেখতে পায়। মৃত্যুর মুখোমুখি একা একটা লোক। রোগী। শাশ্বতীকে ভালবাসে, কিন্তু সেটাকে স্বীকার করতে চাইবে না, এমন অহংকারী! রমেনের সুন্দর সবল মুখখানার দিকে চেয়ে শাশ্বতীর ঠোঁট একটু কেঁপে ওঠে। রমেনের প্রশ্নটার কোনও উত্তর দেয় না শাশ্বতী, কিন্তু হঠাৎ স্খলিত গলায় বলে, আপনি ওকে বাঁচিয়ে দিন।

এই থামের মতো প্রকাণ্ড লোকটার সামনে কথাটা বলতে একটুও লজ্জা করে না শাশ্বতীর।

রমেন একটা নিশ্বাস ফেলল।

এক কাপ চা সামনে জুড়িয়ে যাচ্ছিল। শাশ্বতী তাতে দু’-একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে উঠে পড়ল। বলল, অনেক বেলা হয়ে গেছে।

রাস্তায় এসে শাশ্বতী বলল, আপনি একটা কথা কাউকে বলবেন না।

কী কথা!

আমি ওকে ভালবাসি।

রমেন মাথা নাড়ল, বলব না।

বাস-স্টপের ভিড় থেকে একটু আলগা দাঁড়াল দু’জন। শাশ্বতী হাত দিয়ে রোদ থেকে চোখ আড়াল করে মাথা উঁচু করে রমেনকে দেখল। তারপর বলল, আপনি বরং ওকে বলবেন।

কী?

শাশ্বতী লাজুক মুখ নামিয়ে বলল, বলবেন যে আমি ওকে ভালবাসি।

তারপর একটু ইতস্তত করে শাশ্বতী বিব্রত মুখে বলল, আমাকে যদি ও ভালবাসে তা হলে হয়তো, আপনি যা বললেন সে-রকম, ওর আয়ু বেড়ে যেতে পারে—

রমেন একটু হেসে মাথা নাড়ল, না। মেয়েদের ভালবাসা তো সোজা। সে-ভালবাসায় লাভ নেই। বরং মেয়েদের প্রতি অত্যধিক ভালবাসা মানুষের মধ্যে মৃত্যুপ্রেম জাগিয়ে দেয়।

সে কী?

রমেন শান্তভাবে বলল, আপনি যে-কোনও প্রেমের কবিতা পড়ে দেখবেন, কিংবা প্রেমের গল্প উপন্যাস, তাতে দেখবেন মৃত্যুর কথা কিছু না কিছু থাকবেই। যারা প্রেম-ট্রেম করে তাদের কথাবার্তা শুনে দেখবেন, তারা দু’-দশটা কথার পরেই একে অন্যকে বলছে, আমি যদি মরে যাই তা হলে তুমি কী করবে? মৃত্যুর চেতনা ছাড়া কিছুতেই প্রেমকে মহৎ করা যায় না। ও-রকম প্রেমে কি আয়ু বাড়ে?

তবে? কাকে?

রমেনের মুখে উত্তরটা এসে গিয়েছিল, কিন্তু সে উচ্চারণ করল না। ‘ঈশ্বর’ শব্দটা উচ্চারণ করার একটা বিশেষ সময় আছে, নইলে তো মানুষের মনে তরঙ্গ তোলে না। বরং শুনে মানুষ হেসে ওঠে, মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু কখনও কখনও এক-একটা বিশেষ সময় যখন মানুষ রেল লাইনের ঢালু জমিতে দাঁড়িয়ে থাকে রেলগাড়ির প্রতীক্ষায়, যখন জলপ্লাবনে ছেলে কোলে আশ্রয় খুঁজে বেড়ায়, কিংবা যখন—| তাই রমেন কথা বলে না। একটু হাসে মাত্র।

শাশ্বতী মুখ তুলে রমেনের উজ্জ্বল চোখ দু’খানা দেখল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আপনার কখনও চোখের অসুখ হয়নি?

না। বলে মাথা নাড়ল রমেন, তারপর একটু চুপ করে থেকে দুষ্টু ছেলের মতো হেসে বলল, কিন্তু একবার আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য…কিন্তু ওই আপনার বাস এসে গেল।

বাসটা সামনে এসে দাঁড়াতেই কিন্তু শাশ্বতী পিছিয়ে গেল। বলল, বড্ড ভিড়।

রমেন একটু চিন্তা করে বলল, তা হলে চলুন রাসবিহারীর মোড় পর্যন্ত আপনাকে হেঁটে এগিয়ে দিয়ে আসি।

শাশ্বতীও তাই চায়। এ লোকটার সেই অন্ধ হয়ে যাওয়ার গল্পটা তাকে শুনতেই হবে। সদ্য চেনা একজন লোককে এতদূর খামোখা হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া যে কেমন বেমানান তা তার মনেও হল না। বলল, বেশ হবে। চলুন। ওখান থেকে আমি যাদবপুর যাওয়ার বাস ফাঁকা পাব।

কিছুক্ষণ তারা নিঃশব্দে হাঁটল। ফুটপাথ নেই বলে রাস্তাটা বিপজ্জনক, অবিরল গাড়ি যাচ্ছে। রাস্তার দিকটায় রমেন, রাস্তার ধার ঘেঁষে শাশ্বতী৷ খানিক দূর হেঁটে শাশ্বতী হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে বলল, এবার সেই গল্পটা বলুন। সেই অন্ধ হয়ে যাওয়ার গল্পটা।

রমেন সামান্য একটু হাসল। বলল, রাস্তা একটু ফাঁকা পাই তারপর—

রেলব্রিজ পেরিয়ে যাওয়ার পর চওড়া সুন্দর রাস্তার ফুটপাথে উঠে এল দু’জন। শাশ্বতী এতক্ষণ কৌতূহল চেপে ছিল, এবার শ্বাস ফেলে বলল, এবার—

রমেন মাথা নেড়ে বলল, আমার ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর একদিন সন্ধেবেলা খেলাধুলো সেরে ফিরছি। আমাদের বাড়ির সামনের দিকটায় বিরাট হলঘরের মতো একটা বৈঠকখানা। সেই বৈঠকখানায় সন্ধের অন্ধকারে দেখি দাদু প্রকাণ্ড পিয়ানোটার পাশে বসে আছেন। হাতের আতসকাচ দিয়ে পিয়ানোর গায়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছেন নিচু হয়ে। আমি তাঁকে টের পেতে না-দিয়ে পা টিপে টিপে বড় ঘরটা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময়ে দাদু খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, কে? আমি দাঁড়িয়ে বললাম, আমি। দাদু একটা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে, যেন আমাকে কোলে নেবেন, এমনভাবে বললেন, রমেন! কাছে এসো তো। কাছে যেতেই উনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমার সামনে বোসো। আমি মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসলাম। দাদু আমার মুখ হাতে তুলে বললেন, দেখি রমেন, তোমার মুখখানা। আমার মুখের ওপর আতসকাচ ধরে দাদু অনেকক্ষণ ধরে আমার মুখ দেখলেন। তখনও ঘরে আলো দিয়ে যায়নি, ঘরটা অন্ধকার। আবছা একটু শেষবেলার আলোয় সেই আতসকাচের ভিতর দিয়ে আমি তাঁর দুটো প্রকাণ্ড চোখ, নাকের ওপর উঁচু হাড়, ঘন ভ্রূ আর কপাল দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হচ্ছিল সেই চোখ জোড়া আমার ভিতরে অনেকখানি দেখে নিচ্ছে। যখন আমার বয়স দশ কি এগারো, তখন আমি আমার প্রথম বয়ঃসন্ধির খারাপ স্বপ্নটি দেখেছি, আর একদিন, দুপুরবেলা অলি নামে একটি মেয়ে চোর-চোর খেলার সময়ে মুকুন্দর ঘানিঘরে অন্ধকারে লুকিয়ে আমাকে একটা চুমু খেয়েছিল, তখন আমার গালে একটি-দু’টি ব্রণ দেখা দিচ্ছে। তাই দাদুর সেই চোখ জোড়ার দিকে চেয়ে মনে হচ্ছিল তিনি আমার সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। আমার বুক কাঁপছিল। কিন্তু দাদু সেদিন আমাকে অন্যরকমভাবে দেখলেন। অনেকণ ধরে দেখে তিনি খুব স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলেন, রমেন, তুমি কি খুব বেশি কিছু চাও? খুব টাকা পয়সা, বড় জমিদারি, অনেক বাড়ি-গাড়ি? সে-প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো তখন আমার বয়স নয়। দাদু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে নিজে থেকেই বললেন, তুমি কখনও খুব বেশি কিছু চেয়ো না। লোকে যেন একদিন তোমাকে ভিখিরির পোশাকেও ঐশ্বর্যবান বলে চিনতে পারে। এই বলে দাদু আতসকাচ সরিয়ে রাখলেন। জলভরা চোখ দু’হাতে মুছে নিয়ে একটু অপ্রস্তুত হাসি হেসে বললেন, চোখ বড় মায়ার সৃষ্টি করে। এই ঘটনার পরদিন দাদু দুপুরবেলা একা একা ছাদে উঠে গেলেন। তারপর আতসকাচের ভিতর দিয়ে ভরদুপুরের সূর্যের দিকে চেয়ে দেখলেন। তার দুটো চোখই একদম নষ্ট হয়ে গেল। এই ঘটনায় আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তার ওপর আমার মা মাঝে মাঝে আমাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন আমি চোখে কীরকম দেখি। আমি ভালই দেখতাম, তবু মা’র সন্দেহ যেত না। জিজ্ঞেস করতেন, ওই যে ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে নৌকোটা যাচ্ছে— বল তো ওটা কী নৌকো; কখনও বা জিজ্ঞেস করতেন, ওই যে ছাদে একটা টিকটিকি— ওটাকে দেখতে পাচ্ছিস? এতে আমার ভয় আরও বেড়ে যেত। তখন আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম যে একদিন আমিও আস্তে আস্তে অন্ধ হয়ে যাব। তাই তখন আমি গোপনে গোপনে একটা কাজ শুরু করলাম। গোপনে আমি চোখ বুজে হাঁটতাম, দিক ঠিক করার চেষ্টা করতাম। যদি কোনও দিন সত্যিই অন্ধ হয়ে যাই তবে যেন হঠাৎ মুশকিলে পড়তে না হয়। এই চেষ্টা আমি এমন প্রাণপণে করতাম, এমন প্রাণের টানে যে হোঁচট খেয়ে পড়লে, কিংবা কোনও কারণে ভয় পেলেও চোখ খুলতাম না। আমার এই কাজের সঙ্গী ছিল উদ্ধব নামে আমাদের এক চাকর। সে আমাকে গাড়ি করে অচেনা জায়গায় নিয়ে যেত, তারপর আমার হাত বেঁধে চোখে রুমাল জড়িয়ে ছেড়ে দিত, তারপর দূরে কোথাও লুকিয়ে থেকে একবার মৃদু একটা শিস দিয়েই চুপ করে যেত। আর আমি সেই শব্দটুকু মনে রেখে দিক নির্ণয় করে ঠিক ওকে খুঁজে বের করতাম। তারপর আস্তে আস্তে আমি এ-খেলায় এত পাকা হয়ে গেলাম যে একা একা আমাদের বাড়ির পাঁচিলের ওপর দিয়ে চোখ বুজে দ্রুত হাঁটতে পারতাম। উদ্ধব আমাদের বাড়ির বাইরের মাঠে দুরে একটা ব্ল্যাকবোর্ডে বৃত্ত এঁকে তার পিছনে দাঁড়িয়ে শিস দিত, আমি এয়ারগান দিয়ে চোখ বুজে সেইখানে ঠিকঠাক গুলি করতাম। এইভাবেই আমার যখন চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স তখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমার আর কোনও ভয় নেই। এবার আমি আমার অন্ধকার দিনগুলোর জন্য প্রস্তুত। সেই সময়েই একদিন ঘটনাটা ঘটল। আমি রোজ খুব ভোরে উঠে ফুটবল নিয়ে দৌড়তে যেতাম মাঠে। বলটা মাটিতে গড়িয়ে দিতাম, তারপর পায়ে পায়ে বল নিয়ে মাঠের চার দিকে চক্কর। অন্ধকার থাকতে আমার দৌড় শুরু হত, মাঠটাকে পাঁচ কি ছ’বার পাক দেওয়ার পর আলো ফুটত। রোজই এ-রকম হত। একদিন খুব ভোরে উঠে দৌড়োতে গেছি, পায়ে বল, দৌড়তে দৌড়তে পাক খাচ্ছি মাঠের চার দিকে, ক্রমে ক্রমে এক দুই করে সাত আট দশ বার মাঠটা ঘুরে এলাম। কিন্তু সেদিন ভোর হচ্ছিল না। অন্ধকার জমাট বেঁধে রইল। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল ছিল না, আমি বিভোর হয়ে দৌড়তাম এবং প্রায়ই সে সময়ে আমার চোখ বন্ধ থাকত। কিন্তু হঠাৎ এক সময়ে আমার পা থেকে বলটা একটু জোরে গড়িয়ে গেল আমার আয়ত্তের বাইরে। আমি থেমে চোখ খুলে বলটাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি চার দিকে নিরেট ঘুটঘুটি অন্ধকার। মাটির দিকে চেয়ে দেখি জমাট অন্ধকার, আকাশের দিকে চেয়ে দেখি চাঁদ তারা কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, চার দিকে চেয়ে দেখি কোনওখানে কোনও আলো নেই, ঝাপসা গাছপালা নেই। কিছু নেই। আমি চোখের কাছে তুলে আমার সাদা হাতটাকে দেখার চেষ্টা করলাম, দেখলাম কিচ্ছু নেই। মনে পড়ল আমি মাঠটাকে অন্তত দশবার পাক দিয়েছি, তবু সেদিন ভোর হয়নি। আমি এক জায়গাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি যে চোখ বুজে হাঁটতে শিখেছিলাম, কিংবা শিখেছিলাম দিকনির্ণয় করার কৌশল সে-সব কিছুই এখন আমার মনে পড়ল না। আমার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল ভয়ে। আমি আর এক পাও এগোবার সাহস পেলাম না, দিকনির্ণয় করতে আমার ভয় হল, যদি ভুল পথে চলে যাই? তাই তখন আমি খুব অসহায়ভাবে আস্তে আস্তে হাঁটু গেড়ে বসলাম। আমার চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল। খুব তুচ্ছ কারণেই তখন আমি কাঁদছিলাম। কখনও হারানো বলটির জন্য, কখনও অলি নামে মেয়েটির জন্য, কখনও বা ঘরে যাওয়ার মেঠো পথটির জন্য। আমি কি আর কখনও কিছুই দেখব না? এতকাল ধরে আমি যা-কিছু দেখেছি, কিংবা যা-কিছু আমার দেখা হয়নি আমি সেই সবকিছুর জন্য কাঁদছিলাম। এইভাবে অলীক, অসম্ভব কয়েকটি মুহূর্ত কেটে গেল। এর আগে আমি কখনও ভগবানকে ডাকিনি, ডাকার দরকার হয়নি বলে। যুদ্ধের সময়ে বন্দুক আর গাড়ি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে বলে দশ- বারো বছর বয়সে বন্দুক চালাতে শিখোছলাম, তেরো বছর বয়সে শিখেছি গাড়ি চালাতে, পনেরো-ষোলো বছর বয়সে শিখে গেছি কী করে চোখ বুজে চলতে হয়। আমি তো সবকিছুর জন্যই নিজের ওপর নির্ভরশীল, তবে ভগবানকে আমার কী দরকার? যে নিজে নিজে চলতে পারে তার ভগবান দিয়ে কী হবে? তাই সেই অদ্ভুত সময়ে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে মাঠের মধ্যে বসে থেকে যখন আমি ভগবানের কথা ভাবতে চেষ্টা করলাম তখন তাঁর কোনও চেহারাই আমার মনে এল না। তবু আমি আকুল হয়ে বললাম, রক্ষা করো, আমাকে রক্ষা করো, আমার চোখ ফিরিয়ে দাও। সেই আকুলতার মধ্যে বোধ হয় একটা কিছু ছিল, আমার মনশ্চক্ষে ভগবানের একটা চেহারা ভেসে উঠল। কেমন জানেন? সেই আতসকাচের ভিতর দিয়ে আমি দাদুর মুখ যে-রকম দেখেছিলাম অনেকটা সেই রকম। সে যেন দাদুর মতোই আমার প্রিয় কেউ, যে আমায় বড় ভালবাসে, সে যেন একটা আতসকাচের ভিতর দিয়ে নিবিড় ভালবাসায় শেষবারের মতো আমার মুখখানা দেখে নিচ্ছে। যেন বলছে, আহা, তুমি কি আমার রমেন! আমার রমেন! দেখি তোমার মুখখানা। অনেকটা দাদুর মতোই তার মুখ। পাহাড় পর্বত সমুদ্র আর গাছগাছালি রয়েছে, সেইখানেই রয়েছে আকাশ। এ-রকম কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেলে শীতের উত্তুরে হাওয়া হু হু করে বয়ে গেল, গাছপালায় চার দিকে সেই বাতাসের শব্দ হল। সেই বাতাসটাই আমার কোলের কাছে গড়িয়ে আনল আমার হারানো বল। আমি দু’ হাতে বুকে তুলে চেপে ধরলাম বলটা। চোখ চেয়ে দেখলাম চার দিকে আলোয় আলো, আর সূর্য উঠছে।

শাশ্বতীর পা কখন থেমে গিয়েছিল। সে মুখ তুলে খাস চেপে জিজ্ঞেস করল, সত্যি?

রমেন ম্লান হাসল আবার। বলল, সত্যি।

আপনি কাউকে এ-গল বললেন না?

আমি দাদুকে এই ঘটনার কথা বলেছিলাম। দাদু তখন ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধ, তাই আমার বিশ্বাস ছিল দাদু সেই ঘটনাটা অবিশ্বাস করবেন না। তাই সেদিন সন্ধেবেলা দাদু তাঁর আহ্নিক সেরে এসে যখন বড় ঘরটায় আরাম-কেদারায় বসেছেন তখন আমি তাঁর পাশে মেঝেতে বসে সকালের ঘটনার কথা বললাম। শুনে দাদু আমার মাথায় নীরবে অনেকক্ষণ হাত বুলিয়ে দিলেন। টের পেলাম তাঁর হাত থরথর করে কাঁপছে। সেজবাতিটা কমিয়ে দেওয়া ছিল, তবু সেই অল্প আলোতেও দেখলাম তাঁর গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আস্তে আস্তে বললেন, ভগবানের কথা ভাবতে গিয়ে তুমি কেন একজন মানুষের কথাই ভাবলে রমেন? ভগবান কি মানুষ? আমি এর উত্তর দিতে পারলাম না। কিন্তু মনে মনে ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো, ভগবান যদি মানুষের মতোই দেখতে হয় তবে আর সে ভগবান কীসের? তবু আমি মুখে বললাম, মানুষ হলেও সে খুব প্রকাণ্ড মানুষ! ওই আকাশ পর্যন্ত তার মাথা, আর তার চোখের মধ্যে যেন পাহাড় সমুদ্র এ-সব রয়েছে! শুনে দাদু হেসে বললেন, মানুষ প্রকাণ্ড হলেই কি ভগবান হয়? প্রকাণ্ডতাই যদি ভগবানের গুণ তবে তুমি আকাশ, কিংবা পাহাড় কিংবা সমুদ্র— কিংবা এ-সব যা-কিছু মিলিয়ে যে প্রকাণ্ড চরাচর তাকে ভগবান ভাবলে না কেন? কিংবা তুমি তো ভাবতে পারতে যে তিনি এ-সবের অতীত একটা শক্তি। দাদুর এই কথা শুনে আমি ভেবে দেখলাম যে তা হয় না। পাহাড় আকাশ কিংবা সমুদ্র কী করে ভগবান হবে? তারা কি আমার কথা শুনতে পেয়েছিল? তাদের কি মন আছে যে আমার কথা বুঝবে? তা ছাড়া আমি তার যে-মুখ দেখেছিলাম তা অনেকটা দাদুর মতোই, যিনি আমাকে খুব ভালবাসেন। আমি সেই কথাই দাদুকে বললাম। তখন দাদু আর হাসলেন না, গম্ভীরভাবে চুপ করে রইলেন। তারপর এক সময়ে বললেন, রমেন, অনেকদিন আগে ভগবান বলেছিলেন যে তিনি বার বার পৃথিবীতে আসবেন। যদি সে-কথা সত্যি হয় তবে এটা ঠিক যে তিনি বার বার পৃথিবীতে আসছেন। হয়তো এখন এ মুহূর্তেও তিনি আছেন পৃথিবীতে। কিন্তু মানুষ সে-কথাটা বিশ্বাস করে না বলেই তাঁকে কখনও খুঁজে দেখে না। কিন্তু তুমি খুঁজে দেখো। তুমি তাঁর কথা মানুষকে বোলো। বোলো যে তুমি তাঁর কাছে যাবে। তা হলে কেউ-না-কেউ একদিন ঠিক তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবে।

রুদ্ধশ্বাসে শাশ্বতী জিজ্ঞেস করল, তারপর? আপনি কি তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন?

রমেন সে-কথার উত্তর দিল না। বলল, কিন্তু আমরা কোথায় এসে পড়েছি দেখছেন?

শাশ্বতী দেখল, রাসবিহারী মোড়। তার মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, আপনার অনেক দেরি করিয়ে দিলাম।

রমেন মৃদুস্বরে বলল, দেরি হয়নি তো?

তারপর শাশ্বতীকে একটা ডবলডেকারে তুলে দিয়ে রমেন ফিরল।

একত্রিশ

আজকাল সঞ্জয়ের গাঢ় একরকমের ঘুম হয় রাতে, কিন্তু তৃপ্তি হয় না। মাঝে মধ্যে উঠে দেখে সাতটা সাড়ে-সাতটা বেজে গেছে। খুব আশ্চর্য হয়ে যায় সে। এ-রকম তো কখনও হত না! ছ’টার মধ্যে তার ঘুম ভাঙবেই। সে নিয়মের অনুশাসন মেনে চলা মানুষ।

বিরক্ত হয়ে সে রিনিকে জিজ্ঞেস করে, সকালে ডেকে দাওনি কেন?

কত ডেকেছি! তুমি কেবল উঁ-উঁ করে এ-পাশ ও-পাশ ফিরলে।

শরীরটা বুড়িয়ে গেছে বোধহয়। পায়ে পায়ে জড়তা আর আলসেমির ভাব। বিছানা ছাড়ার পর কোনও দিনই ঘুমের জড়তা থাকে না তার। কিন্তু আজকাল শরীর পালটাচ্ছে।

অফিসে বেরিয়ে মোড়ের মাথায় পানের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল সঞ্জয়, জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা পাঁচ টাকার নোট ধরে রইল। দোকানদারই দৌড়ে এল এক প্যাকেট সিগারেট হাতে।

গাড়ি আবার ছেড়ে বড় রাস্তায় এসে দেখল বাস-স্টপে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ-চেনা মেয়ে, একসময়ে একই এক্সপ্রেস বাসে অফিসে গেছে। গাড়িটা দিয়ে তাকে প্রায় ঢেকে ফেলল সঞ্জয়। চোখে চোখ পড়তেই হাসল, চলুন, পৌঁছে দিচ্ছি।

মেয়েটি একটু অবাক হয়। এই প্রথম আলাপ। কিন্তু একসময়ে বাসে অফিস-যাওয়ার একঘেয়ে দূরত্বটুকু সঞ্জয় পার হত এই মেয়েটার দিকে চেয়ে থেকে। মেয়েটা প্রথম-প্রথম চোখ সরিয়ে নিত। তারপর মাথা নিচু করে লজ্জার ভান করেছিল কিছুদিন। তারপর একদিন— কবে থেকে যেন— চোখে চোখ রাখতে শুরু করল। চমৎকার সময় কেটে যেত। খেলা-খেলা একটা ব্যাপার—প্রেমের মতোই—অথচ প্রেম নয়—এরকমই একটা ব্যাপার।

বহুদিন হয় সঞ্জয়কে আর খুঁজে পায়নি মেয়েটা। আজ গাড়িসুদ্ধু দেখে খুব অবাক হল। ভদ্রলোক কোনও দিন কথা বলতে সাহস করেনি তার সঙ্গে, কিন্তু এখন গাড়ি হওয়াতেই বোধহয় সাহস বেড়েছে। মেয়েটি ইতস্তত করে বলল, বাসেই যেতে পারব।

দুর! আসুন না।

বাঁ হাতে সামনের দরজাটা খুলে ধরে সঞ্জয়। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসে।

শরৎকালের মতো ঋতু নেই। এমন উজ্জ্বল রোদ! সেই আলোতে মেয়েটি বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে। সুডৌল সুন্দর মুখখানা, নাকে একটা পাথর বসানো নাকছাবি ঝিকিয়ে উঠেছে। ডান হাতে সাদা ব্যাগ, বাঁ হাতে ভাজ করা রোদ-চশমা। ভাগ্যিস চশমাটা পরেনি! অমন সুন্দর চোখ দু’খানা, তাতে ভয়, সংশয় আর ইচ্ছার যে খেলাগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো দেখাই যেত না।

মেয়েটি উঠে এল। গাড়ি ছেড়ে দিল সঞ্জয়।

নিঃশব্দে বসে থাকে মেয়েটি, অস্বস্তি বোধ করে বোধ হয়। সঞ্জয় সেদিকে তাকালই না, আলতো হাতে স্টিয়ারিং ধরে অলস ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে দিচ্ছিল সে। মেয়েটি একপলক তাকে দেখল নিঃশব্দে। এতকাল কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে কত খুঁজেছি!

ট্রাফিক জংশনে লাল আলো দেখে সঞ্জয় গাড়ি থামায়। সিগারেটের প্যাকেট খুলতে খুলতে মেয়েটির দিকে তাকায়। না, মেয়েটির শরীর কিংবা মুখ দেখে না। কেবল সিঁথিটা লক্ষ করে। সিঁদুরের চিহ্ন নেই। লুকোয়নি তো! ঠোঁটে আবছা লিপস্টিক, কপালে টিপ নেই। কিছুই বুঝতে পারে না সঞ্জয়। আজকাল বাঙালি মেয়েরা জনসাধারণকে ফঁকি দিতে শিখেছে! সঞ্জয় জিজ্ঞেস করে, কোথায় আপনার অফিস?

নিউ সেক্রেটারিয়েটের কাছে, ম্যাককারিয়ন।

ঝামেলা। এখন আবার সেই নিউ সেক্রেটারিয়েট পর্যন্ত গিয়ে তারপর পার্ক স্ট্রিটে ঘুরে আসতে হবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। সঞ্জয় ঘড়ি দেখল। এখন মিনিট পনেরো সময় আছে, কিন্তু তাতে হবে না। এখন পর্যন্ত এই অফিসে তার একদিনও দেরি হয়নি! যদি হয়, আজই প্রথম হবে। এই মেয়েটির জন্যই। তা ছাড়া আজ সকাল সাতটায় উঠেছে সে। সময় ছিল না বলে দাঁত ঠিক মতো ব্রাশ করা হয়নি, গালে ক্ষুর পড়েনি ঠিকমতো, হাত দিলে খরখর করছে। অগোছালো হয়ে আছে সে। খামোখা জিজ্ঞেস করল, চাকরি করেন?

হুঁ।

কোন ডিপার্টমেন্ট!

পাবলিসিটি।

তাকে কথা শেষ করতে দেয় না সঞ্জয়। বলে, আমাকে আপনার মনে আছে?

বাজে কথা ছেড়ে চট করে কাজের কথায় চলে আসে।

মেয়েটা লজ্জা পায় বোধ হয়। উত্তর দেয় না।

হাজরার মোড় পেরিয়ে সঞ্জয় গাড়ি ছোটায়। গতি বাড়াতে থাকে। যদি সময়টাকে বাঁচানো যায়!

মেয়েটা বলল, গাড়ি কিনলেন!

ওই একরকম কেনাই।

খুব সুবিধে এখন, না? বাসে যা ভিড় বাড়ছে দিন দিন।

সঞ্জয় মৃদু হাসল। বলল, যখন গাড়ি ছিল না তখন একদিনও লেট হয়নি। আজই প্রথম লেট হবে বোধ হয়।

গাড়ি কি অনেক দিন কিনেছেন? বহু কাল আপনাকে দেখি না তো! বোধ হয় বছর খানেক—

না। গাড়ি তো সদ্য হল। মাঝখানে কিছু দিন ট্যাক্সিতে যেতাম।

মেয়েটা বলে, বেশ গাড়িটা। ছোটখাটো, কোজি—

ঘুরেফিরে গাড়ির প্রসঙ্গ। সঞ্জয়ের বিরক্তি লাগে। আমাকে দেখছ না কেন সেই আগের মতো? তখন একশো জনের চোখের সামনে বিহ্বল হয়ে দেখতে, এখন একা গাড়িতে আমরা দু’জন, তুমি কেবল গাড়িতে মনোযোগ রেখেছ। গাড়িটা কি আমার চেয়েও বেশি।

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করে, কোথায় থাকেন?

পণ্ডিতিয়া। আপনি?

হিন্দুস্থান পার্ক।

মেয়েটা একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে, একা?

সঞ্জয় মিটমিটে ডানের মতো হাসে। মাথা নেড়ে বলে, না, আমার লোকজন আছে।

মেয়েটা ঠিক বুঝতে পারে না লোকজন কথাটার মানে কী। মেয়েটাকে ভাবতে দেয় সঞ্জয়, নিজের থেকে সে বলবে না যে তার রিনি আর পিকলু আছে। মেয়েটা সারা দিন ভেবে যাক। কেন আমি বলব? তোমরা কেন আজকাল সিঁদুর লুকোও। কেন জনসাধারণকে ফাঁকি দাও? এই যে আমি তোমার সাদা সিঁথে দেখেও কিছুতেই সিওর হতে পারছি না, যেমন আজকাল রিনিকে দেখেও বাইরের লোকজন বুঝতে পারে না—এই যন্ত্রণা কেন দাও?

ঘড়ি দেখে সঞ্জয়। মেয়েটাকে গাড়িতে তোলা ভুল হয়েছে। একদম ভুল। চৌরঙ্গি দিয়ে যাচ্ছে গাড়ি, সে এই মাত্র সার্কুলার রোডের ক্রসিং পেরোল। ঘড়িতে আছে আর মাত্র ন’-দশ মিনিট সময়। সে কেন গাড়িতে তুলে নিল মেয়েটাকে! হ্যাঁ, কেন তুলেছিল? কী উদ্দেশ্য তার? বুঝলে অচেনা মহিলা, মেয়েদের আমরা মাত্র একটিই ব্যবহার জানি। মাত্র একটিই। তোমাকে আমার গাড়িতে কেন তুলেছি তা চোখ বুজে একটু ভাবলেই দেখা যায়, দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত দেখা যায়। আমি রোজ ওই বাস-স্টপে গাড়ি থামাব, তুলে নেব তোমাকে। তারপর আস্তে আস্তে…। আমি অতদূর চরিত্রহীন। বুঝলে! কিন্তু একটা সময়ে আমার গোটাকয় জিনিস ছিল— সততা, নিষ্ঠা, কর্মক্ষমতা। আমি শূন্য থেকে বোস অ্যান্ড কোম্পানি তৈরি করেছিলাম। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভিখিরির মতো ঘুরেছি, ঝুলিতে ছিল ওই তিনটে জিনিস। ওই তিনটে জিনিসই আমাকে সব দিয়েছে, তারপর তারা ঝরে গেছে আস্তে আস্তে। শেষটা ছিল কর্মক্ষমতা। কাল পর্যন্তও ছিল সেটা। আজ সকাল সাতটায় ভেঙেছে ঘুম, দেরিতে যাচ্ছি অফিসে, শরীর ছেড়ে দিচ্ছে আলসেমিতে। শেষ গুণটাও ছেড়ে যাচ্ছে আমাকে। আর কী চাই! হুর রে!

এসে গেছি। ম্যাককারিয়নের অফিস এই তো দেখা যাচ্ছে। কাল আবার দেখা হবে কী বলো? জানি তো, একদিন অসময়ে গার্ড নিশান উড়িয়ে গাড়ি ছেড়ে দেবে, প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকবে গাঁটরি, খামোখা ভেবে কী হবে বলো! তার চেয়ে আমাদের ঘন ঘন দেখা করা ভাল।

দুপুরে ফোন করেছিল সঞ্জয় ম্যাককারিয়নের মুখার্জিকে। অনেক কালের চেনা লোক।

আরে মশাই, আপনাদের পাবলিসিটিতে একটা মেয়ে আছে না! নাকে নাকছাবি?

ওঃ, মিস দাশগুপ্ত!

মিস। আর ইউ সিওর যে মেয়েটা মিস?

মুখার্জি হাসে, কী ব্যাপার?

কিছু না। শুধু জানতে চাইছিলাম যে মেয়েটা সত্যিই মিস কি না, আজকাল তো বোঝাই যায় না…

জেনেই বা লাভ কী? মিস হলে সুবিধেটা কোথায়? ওর অনেক ভক্ত।

আমার এক শালা সদ্য বিলেত থেকে ফিরেছে— ইঞ্জিনিয়ার, ভাবছিলাম তার সঙ্গে সম্বন্ধ করলে কেমন হয়! ভক্তের কথা কী যেন বলছিলেন?

মুখার্জি গলার ঠাট্টার ভাবটা পালটে বলে, না, ও কিছু না। মেয়েটা সত্যিই ভাল। কাউকে পাত্তা দেয় না। দেখতে পারেন। আমি পরশু-টরশু আরও খোঁজ নিয়ে জানাব।

পরশু কেন? কাল— কালকেই জানাবেন।

কাল বাংলা বন্ধ্। মনে নেই!

ওঃ হোঃ। ঠিক আছে, তবে পরশুই—

ফোন রেখে দেয় সঞ্জয়।

আর কিছু না, মেয়েটাকে এর পরদিন তার নাম ধরে ডাকবে সঞ্জয়, মুখার্জি আর যা যা জানাবে সব বলে দেবে মেয়েটাকে। ভীষণ অবাক হয়ে যাবে মেয়েটা। খুশি হবে। ভাববে সে কত ইম্পর্ট্যান্ট সঞ্জয়ের কাছে। একটা মেয়েকে নষ্ট করা কত সোজা!

আজ যেন কেমন কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। দুটো লোক পরশু থেকে পেমেন্টের জন্য ঘুর ঘুর করছে। দুই-একটা সইয়ের ব্যাপার। কিন্তু তাও করল না সঞ্জয়। বলল, পরশু নেবেন।

কলমটা চোখের সামনে আড়াআড়ি তুলে ধরে অন্যমনে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। একটা প্রোডাকশন দেখতে যাওয়ার কথা ছিল হাওড়ায়। ওপরওয়ালাকে ইন্টারকম টেলিফোনে বলল, পরশু যাবে। সব পরশুর জন্য ফেলে রাখছিল সঞ্জয়। বহুকাল পর আজ তার দুপুরে একটু ঘুমোতে ইচ্ছে করছে।

নাকে নাকছাবি পরা একখানা মুখ হঠাৎ লক্ষ মানুষের ভিড় থেকে তাকে গেঁথে তুলছে। মেয়েদের মধ্যে একটা কিছু আছে, একটা রহস্যময় কিছু। অন্তর্বাস খোলার পর যা দেখা যায়, বা স্পর্শে টের পাওয়া যায় সেটুকুই সব নয়। হলে কারও জন্যই কারও এত স্পৃহা থাকত না। রিনি কি কিছু কম দিতে পারে? তবু কেন যে মনে হয় রিনির যা পেয়েছে তার অনেক বেশি রিনির আছে— যা তাকে দেয়নি। মাঝে মাঝে দেখা যায় রিনি বাবু হয়ে বসে পিকলুকে কোলে নিয়ে ঝুঁকে ওর মুখ দেখছে, পিকলু হাত পা ছুড়ে প্রবল ঔ-ঔ শব্দ করছে। তখন সমস্ত শরীর জুড়ে যে নম্র এক মা ফুটে ওঠে রিনির—ওটা, ওটুকুই কি মেয়েদের রহস্য? বোধ হয় চিরকাল প্রকৃতির সঙ্গে মেয়েরা গোপন ষড়যন্ত্র করে আসছে, ঠকাচ্ছে পুরুষদের! তাদের যেটুকু দেওয়ার—সেইটুকু, সেই তুচ্ছ শরীরটুকু সামনে ছুড়ে দিয়ে গোপন করছে মূল্যবান কিছু। পুরুষেরাও এর বেশি মেয়েদের বোঝে না। কিন্তু সে কেবল অতৃপ্ত থেকে যায়। যেমন রিনির কাছে না-পেয়ে সঞ্জয় এখন অফিসের কাজ ভুলে নাকছাবি পরা একটা মেয়ের মুখ ভাবে। কিন্তু পাবে কি সঞ্জয়! পাবে না। আরও পাগল-পাগল লাগবে, আরও খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করবে। বারবার অন্তর্বাস ছিঁড়ে ফেলে সেই একই অতৃপ্তি। না হে, এখানে নেই। এইরকম অতৃপ্ত থেকে যায়, মানুষ বলে— আমি ঠিক এ-জিনিস চাইনি, আরও কিছু—আরও কিছু যেন ছিল পাওয়ার। কী সেটা? ধরি ধরি করেও ধরা যায় না। যেমন রমেন। কী দরকার ছিল ওর সন্ন্যাসী হওয়ার? ইরা এমন কী মেয়ে ছিল? কিছু না। তবু বোধ হয় রমেনের মনে হয়েছিল, তাকে ঠকিয়ে কী যেন নিয়ে গেল ইরা, হয়তো তাকে দিল না, অন্য পুরুষকে দিল। এই আক্ষেপ, এই ক্ষোভ পুরুষকে পাগল করে দিতে পারে। রমেন তো পাগলই হয়ে গিয়েছিল। সঞ্জয় কতবার রিনিকে ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করেছে, তোমার স্বরূপ কী? রিনি ঘুমকাতুরে গলায় সাজিয়ে বানিয়ে বলেছে, তুমি। সঞ্জয়ের হাসি পেয়েছে, তুমি আর আমি কি এক!

কে জানে এখন রিনির গিটার শেখার মাস্টার এসেছে কি না! কী করছে এখন রিনি? সঞ্জয়ের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সে-ই গিটারের মাস্টার হয়ে রিনির কাছে যায়, কিংবা পিকলু হয়ে দেখে নেয় রিনির স্বরূপ। কী ভাবে যে দেখা যাবে কে জানে!

নাকছাবি পরা ওই মেয়েটা, ওর কী আছে? ওকে নিয়েই বা কী করবে সঞ্জয়? তবু ওকে ফাঁদে ফেলার অনেক উপায় আছে সঞ্জয়ের হাতে। ম্যাককারিয়নের অবস্থা ভাল না, যে-কোনও সময়ে উঠে যেতে পারে কোম্পানি. ওখানকার কর্মচারীরা কেউ স্বস্তিতে নেই। সঞ্জয় জানে। ওই রন্ধ্রপথে ঢোকা যায়। না, কিছুই করবে না সঞ্জয়, কেবল এই আলসেমিটুকু কাটানোর জন্য, এই একঘেয়ে টাকা-রোজগার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য একটু টিজ করবে—

কিংবা তাই কি? সে কি একটি মেয়েকে নিয়ে আজ খুব বেশি ভাবছে না?

ঘরে একা ছিল সঞ্জয়। হঠাৎ দুটো আঙুল গোল করে জিবের তলায় দিয়ে তীব্র সিটি দিয়ে উঠল। একবার দু’বার তিনবার। শরীরে ঝাঁকি লাগে। মনে ঝাঁকি লাগে। সে গাছের মতো ঝড়ের হাওয়ায় দোলে।

বেয়ারাটা হঠাৎ ফ্লাশ ডোর ঠেলে ঘরে ঢোকে। স্লিপ রেখে দাঁড়ায়। সঞ্জয় দেখে স্লিপের ওপর সুন্দর বাংলা হরফে লেখা— রমেন।

কে রমেন! কোন রমেন!

আর-কিছু মনে পড়ার আগে তার কেবল মনে পড়ে যে রমেন তার কাছে টাকা পায়। দু’ হাজার টাকা।

মনে পড়তেই একটু চমকে ওঠে সঞ্জয়। যেদিন আদিত্যর লাথিটা লেগেছিল তলপেটে সেদিনও তার মৃত্যুর মুখোমুখি চার হাজার টাকার কথা মনে পড়েছিল। আশ্চর্য, আজকাল কেবল এইসব মনে পড়ে তার।

লোকটা ঘরে এলে সে অবাক হয়ে দেখে, সেই ভীষণ সুন্দর চেহারা, যার পাঞ্জায় বাঘের জোর ছিল, হরিণের মতো দৌড়ত একদিন যে ছেলেটা, সে এখন এমন একজন—যার গায়ে ফতুয়া, পরনে ধুতি, মিটিমিটি একটু হাসি লেগে আছে মুখে।

সঞ্জয় উঠে দু’হাত তুলে বলে, প্রজাপালক শ্ৰীমন্মাহারাজ রায় রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ভূপ বাহাদুরের জয় হোক।

রমেন হাসে। শান্ত চোখে চেয়ে থাকে।

সঞ্জয় ঝুঁকে বলে, মরিসনি! তুই মরিসনি তা হলে! দেখছি পৃথিবীতে আমার পাওনাদারদেরই আয়ু সবচেয়ে বেশি! হাসে সঞ্জয়। বলে, হোক। তবু আয় রমেন, আয়…

টেবিলটা ঘুরে গিয়ে সে দু’হাতে রমেনকে জড়িয়ে ধরে। হাসতে গিয়ে চোখে জল এসে যায় একটু। হারানো মানুষ ফিরে এলে পৃথিবীকে ভাল লাগে বড়।

একটু শ্বাস ছেড়ে সঞ্জয় বলে, আর এখানে না। চল কেটে পড়ি। আজ অফিস ভাল লাগছিল না একটুও। চল, রিনিকে দেখবি…পিকলুকে…

তাড়াহুড়ো করে গোটা দুই টেলিফোন করল সঞ্জয়। তারপর রমেনের হাত ধরে টানতে টানতে টপাটপ সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামল। চাবি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল, চালাবি? চালা না!

রমেন স্মিতমুখে মাথা নাড়ে, আমার লাইসেন্স নেই যে!

কী করেছিস?

কোথায় হারিয়ে গেছে। দশ-বারো বছর গাড়ি চালাইনি।

কী জোর গাড়ি চালাত রমেন! হাওয়ায় উড়ত লম্বা চুল, ফরসা কপাল ঢেকে যেত চুলে, আর সুন্দর মুখে টেপা হাসি হেসে মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে সঙ্গীদের দেখত, কে কতটা ভয় পেয়েছে। দেখতে লজ্‌ঝরে ছিল রমেনের গাড়িটা কিন্তু ইঞ্জিনকে রুপোর মতো ঝকঝকে রাখত রমেন। সে-সব গাড়িও আর নেই। সঞ্জয় এই ছোট গাড়িখানা নিয়েই কত ঝামেলায় আছে! রোজ একটা না একটা কিছু বদলাতে হচ্ছে, সারাতে হচ্ছে।

গাড়িটা বেচে দিয়েছিস? সঞ্জয় গাড়ি চালাতে চালাতে বলে।

না। রমেন মৃদুস্বরে বলে, কিছুই বেচিনি। সব পড়ে ছিল। পড়ে থেকে থেকেই বোধহয় ধুলো হয়ে গেছে।

খুব নিস্পৃহ গলা রমেনের। সেই নিস্পৃহতা সঞ্জয়কে আঘাত করে। সে শুনেছে কাশীপুরে রমেনদের বাড়িটা দখল করেছে উদ্বাস্তুরা। এ-সব ভাবলে কেমন বুকের ভিতরটা খামচে ওঠে। কত কষ্ট করে মানুষকে বাড়ি গাড়ি জিনিসপত্র করতে হয়! কত পরিশ্রম, কত ত্যাগস্বীকার, কত ব্যক্তিগত গুণের পরিবর্তে! কেউ সেগুলোকে ধুলোমাটি করে দিয়ে গেছে শুনলে মনটা গুড়গুড় করে। একেই কি সন্ন্যাস বলে? গাড়ি চালাতে চালাতে মুখ ফিরিয়ে একঝলক রমেনের মুখখানা দেখে সঞ্জয়। এই কি সন্ন্যাসী? খেলার মাঝখানে খেলা ছেড়ে চলে গেছে বলেই সন্ন্যাসী! রমেনের মুখে কিছুই দেখে না সঞ্জয়। কেবল দেখে একটু তৃপ্তি, শান্ত ভাব একটু, হয়তো বা একটু উদাসীনতা। তুই কি ঠকে যাসনি রমেন! বিনা কষ্টে সব পেয়েছিলি, আর আমাকে দ্যাখ—কত লাথিগুঁতো খেয়ে কতটুকু করেছি। আর তার জন্য দিয়ে দিয়েছি ঐশ্বর্যের মতো সব ব্যক্তিগত গুণগুলি! এটুকু সুখের জন্য মানুষ কত দেয়! আর তুই অনায়াসে সব পেয়ে ঠকে যাসনি তো রমেন! ঠিক জানিস তো!

হঠাৎ ফিস ফিস করে সঞ্জয় বলল, কী পেলি?

রমেন অন্যমনস্ক মুখ ফিরিয়ে বলল, অ্যাঁ!

কিছু না রে।

চুপচাপ কিছুক্ষণ গাড়ি চালায় সঞ্জয়। তারপর বলে, আমার কাছে কিছুদিন থাকবি রমেন!

কেন রে!

সঞ্জয় ক্লিষ্ট হেসে বলে, তোর কাছে কতগুলো জিনিস শিখে নিতাম।

কী?

চোখ বুজে তোর সেই হাঁটা, কতবার ইচ্ছে হয়েছে ও-রকম হাঁটি। পারিনি। কিংবা প্রজাদের ওপর তোর ওই ইনফ্লুয়েন্স, কী মারাত্মক হিংসে করতুম আমরা! কিংবা তোর সেই আশি-নব্বুই মাইল স্পিড়ে গাড়ি চালানো, তোর দৌড়, তোর সাঁতার—সব শিখে নিতুম। আর শিখতুম, কী করে হঠাৎ সব ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হয়!

রমেন! নামটা শুনে রিনি খুব অবাক হয়। সঞ্জয়ের কাছে সে অনেকবার শুনেছে এই নাম। তবে এই সেই রমেন! বউ পালিয়ে গিয়েছিল বলে যে সন্ন্যাসী হয়ে যায়! এই শান্ত, অসম্ভব সুন্দর, শক্তিমান স্বামীটিকে ছেড়ে কে এমন বউ আছে যে পালিয়ে যায়! বড় বোকা মেয়ে সে। বড় বোকা।

একটু হতভম্বের মতো রমেনকে দেখল রিনি। তারপর সংবিৎ পেয়ে বলল, আমি ওঁর কাছে শুনেছিলাম যে, আপনি আর কোনও দিন ফিরে আসবেন না। কিন্তু আপনার কথা শুনে আমার খুব ইচ্ছে করত আপনাকে দেখতে। মনে মনে চাইতাম, আবার আপনি ফিরে আসুন, আবার ঘরসংসার হোক আপনার—

হো-হো করে সঞ্জয় হাসে, দেখেছিস, দুধকলা দিয়ে সাপ পুষছি। ঘর করছে একজনের, আর ভাবছে আর-একজনের কথা।

রিনি লাল হয়ে ধমক দেয়, তোমার মুখের আটক নেই।

সঞ্জয় পিকলুকে নিয়ে আসে।

এই দ্যাখ পিকলু মহারাজ। ব্যাটা আমাকে মহা অপছন্দ করে। সুযোগ পেলেই গায়ে মুতে দেয়। তারপর বুকে চেপে ধরে সঞ্জয় পিকলুকে বলে, কেন রে বাটা, আমি তোর তুলসীগাছ?

শুনছেন? রিনি রমেনের দিকে চেয়ে অসহায় ভাবে বলে, একটামাত্র ছেলে আমাদের, তাকেও দিনরাত কুকুর বাঁদর বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। অথচ ছেলেটা কী লক্ষ্মী দেখুন, একটুও কাঁদে না!

রমেনের কোলে এসে হৌ-হৌ করতে থাকে পিকলু। রমেন ওকে বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়।

ঘুরে ঘুরে ঘরদোর দেখাল রিনি আর সঞ্জয়। সিঁড়ির দিকটায় দেড়তলায় একখানা একটেরে ঘর রয়েছে আলাদা। সেটা দেখিয়ে সঞ্জয় বলে, ওই ঘরটা ক’দিন আগে ভাড়া নিয়েছিলাম একটা স্টাডি করব বলে। আলমারি-টালমারির অর্ডারও দিয়েছিলাম। পরে একদিন ভেবে দেখলাম, আমি স্টাডি বানিয়েছি শুনলে বন্ধুরা হাসবে। তাই শেষ পর্যন্ত করলাম না। ঘরটা পড়ে আছে। তুই যদি থাকিস খুব আরামে থাকবি। দক্ষিণে জানালা আছে। যতদিন খুশি থাক। যতদিন খুশি। ঘরটা ছেড়ে দিলাম তোকে। থাকবি রমেন?

থাকুন না। রিনি মিনতি করে।

রমেন মৃদু হেসে মুখ নামিয়ে নেয়।

রিনি লুচি ভাজল, প্লেট ভরে সাজিয়ে দিল মিষ্টি, যত্নে তৈরি করে দিল ঘোলের শরবত। রমেন একটুখানি খেল মাত্র। বলল, ভাল খাবার না খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে। এখন এ-সব সহ্য হবে না।

শুনে রিনির চোখ ছলছল করে। বলে, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

রমেন মিটিমিটি হাসে। বলে, একজন ডেকেছিল।

কে?

রমেন হঠাৎ চুপ করে চেয়ে থাকে। তার দৃষ্টি দূরে চলে যায়। অন্যমনে আস্তে আস্তে বলে, সে এমন একজন—এমন একজন—যে পৃথিবীকে খুব ভালবেসেছিল। ভালবেসে গলে গিয়েছিল। গলে গিয়েছিল মানুষের দুঃখ দেখে।

বলতে বলতে একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল সে। তাই থমকে গেল হঠাৎ। এখনও সময় হয়নি। এখনও ঠিক সময় নয়!

সঞ্জয়ের মুখে একটু বিদ্রূপ আর অবিশ্বাসের হাসি ফুটে উঠেছিল মাত্র, সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল রমেন। আর বলল না।

রিনি কিন্তু চনমন করে ওঠে, বলুন না, বলুন না।

রমেন কেবল মিটি মিটি হাসে। প্রসন্নমুখে।

তার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল পিকলু। পিকলুকে নেওয়ার সময়ে রিনি বলল, আপনি ওকে ভাল করে আশীর্বাদ করুন। আমাদের ওই একটিমাত্র। যেন বেঁচে থাকে।

বত্রিশ

পরদিন বাংলা বন্ ধ। বেলা করে উঠে বিভু তার নতুন কেনা টেরিলিনের শার্ট, টেরিকটনের গাঢ় রঙের প্যান্ট, তার ভারী সোলের জুতো জোড়া পরে নিল। এখন তার নাম হয়ে গেছে। কলকাতার গুন্ডা মহলে নাম করে নিচ্ছে বিভু। দুর্গাপুর থেকে ফিরে আসার পর আদিলের চায়ের দোকান থেকে খবরটা ছড়িয়ে গেছে। বিভুর একটা কেস বাড়ল। শরীরটা শক্ত হয়ে যায়, বুক ঠেলে ওঠে। সাফল্যের কেমন এক ধরনের আনন্দ আছে।

রোদ-চশমা পরে একটা টহল দিতেই পাড়ার আনাচকানাচ থেকে একজন দু’জন সঙ্গ নিতে থাকে। তোষামোদকারী। বিভু ডাঁটে হাসে। রাজার মতো হাঁটতে থাকে। কথা ছুড়ে দেয় এদিক ওদিক। বিভু মাস্তান।

আদিল এখন খাতির করে খুব। পর পর দু’বার চা খাওয়াল সবাইকে। সবসুদ্ধ বারো কাপ।

কত রে?

কী একটা হিসেব বলল আদিল, বিভু শুনলই না। পাঁচ টাকার একখানা নোট শূন্যে ছুড়ে দিয়ে বিভু জিজ্ঞেস করল, আজ হরতাল কীসের?

খাদ্য সমস্যা। কমিউনিস্টরা ডেকেছে।

কথাটা ভাল করে কানে গেল না বিভুর। সিগারেট ধরানোর সময়ে হঠাৎ তার মনে হল অনেকদিন হয় তার সঙ্গে হরতাল-টরতালের আর যোগাযোগ নেই। তবু যখন দেখা যায় হরতালের দিন সব অফিস-দোকান বন্ধ, কলকারখানার চাকি চলছে না, রাস্তায় গাড়িঘোড়া নেই তখন কেমন যেন বুক ভরে ওঠে। মিছিল দেখলে চনমন করে শরীর।

পাড়ার হরিশ তার পানের দোকানের একখানা তক্তা খুলে চোরের মতো সিগারেট বেচছে, সেখানে ভিড়। বিভু দলবল নিয়ে গিয়ে তার দোকান ঘিরল।

বন্ধ করে দে।

হরিশ ভয় পেয়ে বলে, বন্ধই তো। কেবল চেনা লোক দেখে দিচ্ছি—

না একদম বন্ধ। শালা দেশের লোক না খেয়ে আছে আর তুমি পয়সা লুটবে!

বিভুর সঙ্গীরা আত্মপ্রত্যয়ের হাসি হাসে।

বিভু টহল মারে পাড়ায়। বড় রাস্তায় ফুটবল খেলা হচ্ছে, গলির মধ্যে ক্রিকেট। ওরা খেলুক ক্ষতি নেই। কিন্তু তেলেভাজার দোকান কেন খোলা? মিষ্টির দোকানের ভিতর থেকে কেন আসছে জিলিপির গন্ধ? বন্ধ, সব বন্ধ করে দে। দেশের মানুষ না খেয়ে আছে—

বিভুর গা গরম হয়ে যায়। বন্ধ, সব বন্ধ আজ।

দুর্গাপুরের লোকটা কোন দলের ছিল কে জানে! অত খবর বিভুকে দেয়নি ওরা। কিন্তু ব্যাপারটায় রাজনীতি আছে, বিভু জানে। টালিগঞ্জের শচে তাকে কাজটা ধরে দিয়েছিল। বলেছিল, তুই-ই যা, নতুন উঠছিস, হাত পাকবে। এখন সে-লোকটার বালবাচ্চা বউ কিংবা মা বাপ কাঁদছে হয়তো। ওরা তো জানে না বিভু আঠা দিয়ে বোমা বাঁধে, আঠা শুকোলে ছোট্ট আর কড়কড়ে হয়ে আসে মারাত্মক জিনিসটা, যত শুকোয় ততই যে-কোনও সময়ে ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়! এমনও হতে পারত যে বিভুর হাতেই ফেটে গেল বোমাটা, তখন কোথায় বিভু? বোমা তো আর কারও পোষা নয় যে, বিভুকে চিনে রাখবে! পরশুদিন গাড়ির সেই লম্বা লোকটা বলেছিল যে তাকে দেখলে নাকি মনে হয় তার কোনও প্রিয়জন মারা গেছে। কথাটা ঘুরিয়ে বলা; আসলে লোকটা বুঝতে পেরেছিল যে, বিভু খুনে। না, দুর্গাপুরের সেই লোকটা বিভুর প্রিয়জন ছিল না, শত্রুও নয়। কোন দলের যে তাও বিভু জানে না। তবু সে লোকটার জন্য তেমন দুঃখও নেই বিভুর। ভারতবর্ষে যদি এতদিনে তেমন কোনও যুদ্ধ হত তবে বিভু যেত সৈন্যের খাতায় নাম লেখাতে। কত অচেনা মানুষ মারা পড়ত তার হাতে। এও অনেকটা সে-রকমই, টাকা খেয়ে মানুষ মারা। তবে আর দুঃখ কীসের। নিজের মতো করে বিভুও একজন সৈন্য। কেবল একটা ব্যাপারেই খটকা লাগে তার। দুটো খুনের বেলাতেই সে সেই কবেকার ছেলেবেলার কেউটে-তাড়া-করা বিকেলের দৃশ্যটা দেখেছে। পিছনে আলের ওপর দাঁড়িয়ে একটা মুসলমান লোক লম্বা লাঠি তুলে তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে, ভাইরে-এ-এ। কে ওই লোকটা? কেন সে দু’-দু’বার বিভুকে সাবধান করেছে?

ভাবতে ভাবতে মাথা কেমন ঘুলিয়ে ওঠে।

মৃদুলার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে বিভু দেখে বাইরের ঘরে মৃদুলার বাবা ইজিচেয়ারে বসে আছে। আজকাল চোখে চোখ পড়লেই কেমন অসহায়ভাবে তাকায় লোকটা, বিড় বিড় করে ঠোঁট নড়ে। যেন বলে, আমাকে মেরো না। ক’দিনেই লোকটা বুড়িয়ে গেছে অনেক। দুশ্চিন্তা। মৃদুলার বিয়ের খবর পেয়ে দু’বার বুড়োটাকে ধরেছিল বিশুরা। বুড়ো ওদের পায়ে ধরেছে। বামুন! হায় ঈশ্বর! ক’দিন সারা রাত ঢিল পড়েছে ওদের বাড়িতে, সদরে ঢেলে দিয়েছে গু, সন্ধেরাত্রে ছোরার ওপর টর্চ ফেলে বাইরে থেকে ছোরা চমকে ভয় দেখিয়েছে। এত কিছুর পর বুড়োটা নিস্তেজ হয়ে গেছে। মৃদুলার ভাই আজকাল খুব ভয়ে ভয়ে রাস্তায় হাঁটে, তাদের মুখোমুখি হলে ভয়ে মুখ সাদা হয়ে যায়। দিনরাত এখন জানালা বন্ধ থাকে ওদের বাসায়। বিয়ের পর মৃদুলা আর আসেনি। ভয়! কিন্তু তাতে লাভ নেই, বিভু একদিন পেয়ে যাবে মৃদুলাকে। খোলা দরজাটার মুখোমুখি কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ায় বিভু। বুড়োটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে—চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না—যেন সম্মোহিত।

বিভু একটু হাসল। তারপর দলবল নিয়ে হাঁটতে লাগল।

বড় রাস্তা দিয়ে জালে ঢাকা কালো একটা পুলিশ-ভ্যান চলে যাচ্ছে। আধখানা ইট তুলে নিয়ে বিভু ছুড়ে মারল, শালা! ঝং করে পিছনের জালে লাগল ইটটা। ভ্যানটা থামল না।

পালা, শালা, পালিয়ে যা। হারামি! এই রাস্তা দিয়ে কোনও গাড়ি চলবে না আজ। সব বন্ধ—সব—।

বিশু কানের কাছে মুখ এনে বলে, খামোকা হুজ্জত করিস না, তোর গন্ধ ছুটে যাবে চারধারে।

হ্যাঁ। বিভু জানে। গন্ধ ছুটবার আগেই তাকে পালাতে হবে। এইখানে বেহালার কোন কোণে বিভু-ফুল ফুটে উঠেছে তা টের পেতে মানুষের দেরি হবে না। ইতিমধ্যেই পাড়ার ভদ্রলোকেরা একবার জয়েন্ট পিটিশনের মুসাবিদা করেছিল বিভুর নামে। তার আগে ওসি-র সঙ্গে পরামর্শ করেছিল ওরা। বিশুরা হুজ্জত করে সেটা রুখেছে। কিন্তু ঠান্ডা থাকাই ভাল বিভুর। খুনের গন্ধ বহু দূর যায়। সারাজীবন গায়ে লেগে থাকে।

কিন্তু মাঝে মাঝে রক্ত গরম হয়ে যায়। ভাঙ শালা, সব ভেঙে ফেল। মাঝে মাঝে ডবল ডেকারে দশ নম্বর বা আটের বি কিংবা দু’নম্বর বাসে যেতে যেতে বড়লোকদের অন্দরমহল চকিতে চোখে পড়ে। কী সুন্দর পরদা ওড়ে হাওয়ায়, কী সব বিছানা, কিংবা কেমন স্বপ্নের মতো আলো জ্বলে, কেমন বাগান! নিউ মার্কেটে ঘুরে বেড়ায় ছোট ব্লাউজ আর আঁচল-খসা শাড়ি পরা আপেলের মতো মেয়েরা। তাদের ঘুম-ঘুম চোখ। যেন এ-দেশের এ-জগতের কেউ নয়। নন্দীদের অ্যালসেশিয়ানটা প্রকাণ্ড গামলায় গম আর মাংসের ঝোল খাচ্ছে চকচক করে। ভুর-ভুর শব্দে চলছে এয়ারকুলার, ঠান্ডা ঘরে অকাতরে ঘুমোয় আগরওয়ালা। ভাঙ শালা, সব ভেঙে ফ্যাল। মার বোমা, উড়ে যাক কলকাতা। লুট করে আন ওই মেয়েদের, ভিখিরিদের ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যা ওই এয়ারকন্ডিশন ঘরের ভিতরে, সামনে সাজিয়ে দে রুটি-মাখন আপেলের টুকরো। ভাঙ শাল, ভেঙে ফ্যাল। মাঝে মাঝে রক্ত গরম হয়ে যায় বিভুর। ফুলের মালায় সাজানো প্রকাণ্ড গাড়িতে যাচ্ছে বর-বউ, বিভুর ইচ্ছে করে লাফিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। গাড়ি আটকে বলে, নামো, নেমে হেঁটে যাও। এইরকম কত কী ইচ্ছে করে বিভুর। ইচ্ছে করে সুভাষ বোস হয়ে পালিয়ে যেতে, ইচ্ছে করে অস্ত্রাগার লুট করতে ইচ্ছে করে ফাঁসির মঞ্চে উঠে গলায় দড়ি পরে ‘বিদায় দে মা’ কিংবা ‘বন্দেমাতরম’ গাইতে গাইতে মরে যেতে। কিন্তু বস্তুত শত্রুর দেখাই পায় না বিভু। ইংরেজ আমলে হিসেবটা সোজা ছিল, হিরো হওয়া কঠিন ছিল না। শত্রুরা ছিল চেনা। কিন্তু এখন কেবল মাথাটা ঘুলিয়ে যায় বিভুর। কে যে শত্রু তা বুঝতেই পারে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বটে একজন-দু’জন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কি একজন-দু’জন নেতা-ফেতাকে শেষ করে আসি। কিন্তু তাতে কী লাভ? দু’-তিনটে দারোগা কি ম্যাজিস্ট্রেট মারলে কেউ তার প্রশংসা করবে না। নেতাকে মারলে নির্ঘাত জনতা তাকে লাথি মেরে শেষ করবে। এখন আর ক্ষুদিরাম হওয়া অত সহজ নয়। সুভাষ বোসও হওয়া যায় না আর। ছেলেবেলায় ‘বন্দেমাতরম’ বলে চেঁচালে কখনও-সখনও পুলিশ তাড়া করত, চনমন করে উঠত আশেপাশের লোকজন। কিন্তু এখন চেঁচালে লোকে ভেড়ার মতো তার দিকে একটু চেয়ে নিজের কাজে চলে যাবে। ঈশ্বরের বিধানে সবসময়েই তো আর শত্রুর গায়ের রং সাদা নয়। সবসময়ে চেনাও যাবে না তাকে যে মুখোমুখি লড়ে যাবে।

তবু বিভুর ভিতরটা খেপে ওঠে। পিচের ওপর আছড়ে ইট ভাঙে সে। মিত্তিরদের প্রকাণ্ড বাড়ির একতলায় বাথরুমে ঘষা কাচের সুন্দর জানালা বিভুর ইট লেগে মড়াত করে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে। ‘কে? কে?’ বলে কারা ছুটে আসে বারান্দায়। বিভু দৌড়ে চলে যায় অলিগলির মধ্যে, দু’ হাত তুলে চেঁচায়, বন্ধ—আজ সব বন্ধ—সব বন্ধ করে দে। একটা ঝাঁপও যেন না খোলে!

রাস্তায় চলন্ত লোকজন দ্রুততর বেগে হেঁটে সরে যায়। বন্ধ হয়ে যায় বাড়িঘরের জানালার পাল্লা।

বিশু হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে তার কানের কাছে মুখ এনে বলে, তুই কি কমিউনিস্ট, না তুই কী? হরতাল তো তাতে তোর কী?

আমি! আমি! ঠিকঠাক জবাব দিতে পারে না বিভু। কিন্তু হঠাৎ ভিতরটা টগবগ করে ফোটে।

হুজ্জত করিস না। তোর এ-সবে মাথা গলানোর কী? তোর পকেটে টাকা আছে, তোর বাবার পয়সার অভাব নেই…

আই। বিভু দাঁড়িয়ে যায়। বাবা! বাবার কথাই মনে ছিল না। তিন-চারটে গোরুর দুধ আর তার সঙ্গে মিল্ক পাউডার, সয়াবিন আর কী-সব যেন মিশিয়ে তৈরি হয় দুধ, ছানা। কী এক অদ্ভুত উপায়ে টালিগঞ্জ খালপাড়ে চলে বাবার মিষ্টির দোকান। মনে পড়তেই ঝিমিয়ে যায় বিভু। এককালে বাবা দেশে নিজের হাতে চাষ করত। এখন অবস্থা ফিরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

যদি বাপকেই মারি ল হলেই কি শহিদ হওয়া যাবে? দূর! তাই কখনও হয়। লোকে থুথু দেবে গায়ে।

না, শত্রু চেনা এখন আর সহজ নয়। সকলেই সকলের শত্রু। মানুষ মারলে এখন আর বাহবা নেই। সেই ভোররাত্রে উঠে ঠান্ডা জলে স্নান করে গীতা পড়তে পড়তে হঠাৎ ফাঁসিতে চলে যাওয়া, জেলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার লোক কাঁদছে, ফিসফিস করে বলছে ‘অমর শহিদ বিভু ঘোষ জিন্দাবাদ’—এ-রকম একটা ছবি স্বপ্নের মতোই থেকে যাবে। অলীক।

তার চেয়ে যদি কখনও যুদ্ধ হয়! বিভু চলে যাবে। তারপর ভয়ংকর লড়াইয়ের শেষে একদিন তার দেহ নির্জন নদীর ধারে পড়ে থাকবে, বুটসুদ্ধ পা দু’খানা অন্তৰ্জলিতে জল ছুঁয়ে আছে, মুখে হাসি—আমি দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছি।

শুনলে হা-হা করে হেসে উঠবে লোকজন।

না, ও-সব কিছু আর হবে না। বিভু আস্তে আস্তে ভাড়াটে হয়ে যাবে। শুধু গোপনে তার অন্তরে এক না-হওয়া শহিদের, বিপ্লবীর, দেশপ্রেমিকের রক্ত ফুট-ফুট করে ফুটে ফুটে ক্রমে শীতল হয়ে আসবে।

মৃদুলার বাড়িটাকে ভরদুপুরেও পোড়া বাড়ির মতো দেখায়। লক্ষ্মী ছেড়ে গেছে যেন।

ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে বিভুর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। কোনও দিন বিভু একটা খুব মহৎ কাজ করে মরে যাবে। তার সেই কীর্তির কথা মৃদুলা যেন জানতে পারে, হে ভগবান! যেন তার জন্য মৃদুলাকে একদিন কাঁদতে হয়।

তেত্রিশ

কাল মাঝরাতে রিনি হঠাৎ ঠেলে তুলেছিল সঞ্জয়কে, শুনছ, আমার বড্ড ভয় করছে।

হুইস্কির গভীর আচ্ছন্নতা থেকে আঠায় লাগানো দু’ চোখের পাতা খুলে সঞ্জয় বলে, কীসের ভয়! স্বপ্ন দেখেছ?

কী যেন উৎকর্ণ হয়ে শুনল রিনি। বলল, ওই শোনো। এত রাতেও রাস্তায় কারা চিৎকার করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাবার চাইছে।

সঞ্জয় কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসে শুনল। এ তার চেনা চিৎকার। ‘মা গো, মা গো’ বলে গলিতে গলিতে, রাস্তায়, বড় রাস্তায় কারা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের গলার ওই অপার্থিব চিৎকার। কলকাতায় আজকাল প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। এর পাতকুড়ুনি। মানুষের রাতের খাওয়ার সময় পার হয়ে গেলে রাস্তায় বেরোয়।

রিনির ভিত সুন্দর মুখখানার দিকে তাকিয়ে ঘুম-চোখেও সঞ্জয়ের হাসি পেল। বলল, এ তো রোজকার ব্যাপার। আজ নতুন করে শোনার কী?

রিনির মাথা নড়ে উঠল। ইয়ারিং ঝলসে ওঠে ম্লান আলোয়। বলল, রোজ শুনি। তুমি তো ঘুমোও, আমার যেন কেমন গায়ে কাঁটা দেয়, ঘুম আসে না। কত মেয়ে-মদ্দ রাত জেগে পথে পথে চিৎকার করে বেড়াচ্ছে। বুকের মধ্যে কেমন করে।

সঞ্জয় হাসে।

রিনি বলে, হেসো না। এর আগে এত বেশি ছিল না। দিনকে দিন বাড়ছে।

ভিখিরিকে ভয় কীসের রিনি? বলে পাশ ফেরার চেষ্টা করে সঞ্জয়।

রিনি আস্তে করে বলে, ওরা সবাই কি ভিখিরি?

না তো কী? গাঁয়ে যখন খরা কি বন্যা হয় তখন দলে দলে চলে আসে শহরে। এবারও হয়তো কিছু একটা হয়েছে কোনও জেলায়। প্রতি বছরই হচ্ছে তো!

কী হয়েছে?

কী জানি! কাগজে লিখছে এবারকার ফলন ভাল নয়।

রিনি শ্বাস ফেলে বলে, কাল দেখলাম আমাদের পায়ের দিকের জানলার শার্সিতে একটা ছায়া। ঘোমটা মাথায় একটা বউ, তার কোলে বাচ্চা ছেলে। এমন চমকে উঠেছিলাম! মনে হল জানালার কাছে গিয়ে দেখব যে, ওখানে কেউ নেই, কেবল ছায়াটাই দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাতেও বোধ হয় কেবল চিৎকারগুলোই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক এ-রকম অদ্ভুত মনে হয় আমার—

তা হলে ভূতই হবে বোধ হয়।

আচ্ছা গো, এই যে দিনরাত জুড়ে দেশময় ভিখিরিরা হাঁটছে তার মানে কি ভিখিরিরা অনেক বেড়ে গেছে?

অনেক।

রিনি একটু চুপ করে থাকে। অন্ধকারে তার ঘন শ্বাসের শব্দ শোনা যায়। বড় ভয় করে গো!

ভয় কীসের?

মনে হয় এরা শিগগিরই দলে ভারী হয়ে যাবে খুব। আর এরা দল বাঁধলে—

সঞ্জয় নিঃসাড়ে হাসল। রিনি একটা আঙুল দিয়ে ওর বুকের ওপর আঁকিবুকি কাটল।

তারপর বলল, দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে না-খাওয়া খিদে-পাওয়া লোক, দিনরাত জুড়ে ঘুরে ঘুরে ডাকছে। আমার বুক কাঁপে। আমি যেন টের পাই, আমাদের এই ছোট্ট একটু ঘর-সংসারের দিকে, আমাদের এক ফোঁটা পিকলুটার দিকে চার দিকের খিদে-পাওয়া মানুষের শাপশাপান্ত ছুটে আসছে। আমার বিধবা ঠাকুমা মা’র সঙ্গে ঝগড়া হলে মাটিতে লাথি মারতে মারতে বলত, তোর অবস্থা যেন আমার মতো হয়— আমার মতো হয়। ঠিক সেই রকম বুঝলে, ঠিক সেই রকম আমি চার দিকে মাটিতে লাথি মারার শব্দ শুনি। আমার বুকের মধ্যে ধুপধুপ শব্দ হয়। কারা যেন আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, তোদের অবস্থা যেন আমাদের মতো হয়—আমাদের মতো হয়— আমাদের মতো হয়। অনেক সময়ে শাপশাপান্ত ভীষণ ফলে যায়, জানো?

শুনতে শুনতে সঞ্জয় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, ও বাচ্চা মেয়ের মতো সঞ্জয়ের বুকের মধ্যে মিশে রইল। আধফোটা গলায় বলল, তুমি এ-সবে বিশ্বাস করো না, না?

সঞ্জয় আস্তে করে বলল, মিছিল দেখেছ রিনি, শুনে দেখো মিছিলের স্লোগানেও কত অভিশাপ থাকে। সব কি ফলছে? ভেবে দেখলে আমাদের সকলেরই মন-ভরা অভিশাপ। কাকে দিতে হবে তা জানি না।

তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিল সঞ্জয়।

আজ সকাল থেকেই আবার গড়িমসি করছিল সঞ্জয়। বেলায় ঘুম ভেঙেছে আজ। তারপর রিনির নরম সাদা বুকের মাঝখানে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে অনেকক্ষণ। চন্দনের গন্ধ পেয়েছে গা থেকে। জিজ্ঞেস করেছে, কাল তোমার গিটারের মাস্টার এসেছিল?

হুঁ।

কী শিখলে?

বাব্বা, আজকাল যে খুব খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে! ব্যাপার কী?

সঞ্জয় অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে করে বলেছে, শেখো, খুব ভাল করে শেখো। আমি জীবনে সিটি দেওয়া ছাড়া আর কিছু শিখিনি। পিকলুকে তুমি গান-বাজনা কিংবা সাহিত্য-ফাহিত্য কিছু একটা শিখিয়ো। ও-রকম একটা কিছু জানা থাকলে মানুষের একটা কিছু থাকে।

পিকলু তখন উপুড় হয়ে প্রাণপণে হামা টানার চেষ্টা করে গর্জন করছিল, চার দিকে উঁচু বালিশের বেড়া পার হতে পারছিল না। রিনি তার গাল টিপে দিয়ে বলল, শোনো পিকু, বাবু কী বলছে। তোমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে।

সঞ্জয় আস্তে বলল, যদি বাঁচে।

ফের!

সঞ্জয় হাসে। ভিখিরির অভিশাপ ফলে যায়, রিনির এ-বিশ্বাসও আছে। না, সিঁদুর লুকিয়ে, সেজেগুজে, গিটার শিখেও রিনি কোথায় যেন থেমে গেছে।

সঞ্জয়ের মন ভাল নেই। কাল রমেনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই মন খারাপ হয়েছিল। আহা, বেচারা রমেন। এখন ওর আর কিছু নেই। চক্রবৎ সুখ-দুঃখ আসে। এ তো জানা কথা। তবু কি তা ভাবতে ভাল লাগে? রমেন যখন গঙ্গার ধারে তার প্রকাণ্ড বাড়িতে বাইরের ঘরে বসে পিয়ানো বাজায়, যখন পুরনো মোটরখানা দাবড়ে চষে বেড়ায় কলকাতা থেকে ডায়মন্ডহারবার, তখন সঞ্জয় সামান্য মোটর মেকানিক, ভূতের মতো খাটে আর পয়সা জমানোর বৃথা চেষ্টা করে। আর গতকাল তার এয়ারকন্ডিশন্ড অফিস ঘরে মুখোমুখি বসেছিল রমেন আর কিছুই নেই। আবার কি কখনও এই অবস্থা পালটে যাবে? উলটো হয়ে যাবে ছবিটা? ঐশ্বর্যবান এক রমেনের পাশাপাশি একই সমাজে বাস করবে ভিখিরি সঞ্জয়! দেখা যাচ্ছে কোনও কিছুরই শেষ পর্যন্ত স্থায়িত্ব নেই। রিনির ওই যে ভয়, ওটাও একদিন সত্যি হতে পারে, জোট বাঁধতে পারে ভিখিরি আর অকিঞ্চন মানুষেরা!

এক-এক সময়ে মনে হয় যখন তার কিছুই ছিল না তখনই সঠিক ঐশ্বর্যবান ছিল সঞ্জয়। তিনটে গুণ ছিল তার। সততা, কর্মক্ষমতা আর নিষ্ঠা। তখন সে কত রাত চটের বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছে। তার কোলের মধ্যে শুয়ে থাকত একটা বেড়াল, মাথার ওপর দিয়ে লাফিয়ে যেত ইঁদুর। কখনও বা ফুটপাথে শুয়ে থেকে সে শুনেছে গায়ের পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে মাতালের পা, ঘুম ভেঙে কখনও দেখেছে রাতের আকাশ থেকে সহস্র চোখে কে একজন তাকে লক্ষ করছে। সুন্দর ছিল সেইসব রহস্যময় অনুভূতি। খোলামেলা মানুষ ছিল সে। সে স্পষ্টই জানত, বুঝতে পারত একদিন তার অবস্থা ফিরবে। যে চায়ের দোকানে সে বয়গিরি করত সেটা উঠে গেছে এখন, তার মালিক মারা গেছে লিভার সিরোসিসে, ছেলেমেয়েগুলো এত দিনে রাস্তায় নেমে গেছে বোধ হয়। হাজরার মোড়ের কাছে সেই মোটর সারাইয়ের কারখানা যেখানে সে ছিল মেকানিক তা সে-রকম হতশ্রী রয়ে গেছে। পরশুদিন সেই কারখানার পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে এল সঞ্জয়, বুড়ো হয়ে গেছে বাদু মিঞা, কালো একটা মোটর গাড়ির বনেট-খোলা ইঞ্জিনের মধ্যে ঝুঁকে গাড়ির মালিকের সঙ্গে দরাদরি করছে বোধ হয়। ইচ্ছে হয়েছিল গাড়িটা একবার থামায়। কিন্তু লজ্জা করেছিল। সে তো সেই ছেলেবেলাতেই জানত যে একদিন সে মোটর দাবড়ে ঘুরে বেড়াবে, বাড়ি করবে বালিগঞ্জে। কেননা তার তিনটে গুণ ছিল, অসম্ভব তিনটে গুণ। যা ওদের নেই। সে গাড়ি থামায়নি।

সত্য বটে, গুণগুলো এখন আর সঞ্জয়ের নেই। তবু সে নিজের চেষ্টাতেই উঠেছে এত দূর। তাই এখন যদি দুম করে একটা কিছু হয়, যদি জোট বাঁধে ভিখিরিরা; যদি বিপ্লব হয়, যদি কোনও দুর্ঘটনায় হঠাৎ পঙ্গু হয়ে যায় সে, যদি মারা যায়, তবে আবার সব চলে যাবে। কেন যাবে? কেন কিছুরই স্থায়িত্ব নেই সংসারে? যদি এখন কেউ এসে তার কাছ থেকে সব কেড়েকুড়ে নিয়ে বলে, আবার গোড়া থেকে শুরু করো দেখি! কেমন পারো শূন্য থেকে তৈরি করতে বাড়ি, ঘর, ফ্রিজিডেয়ার, মোটর গাড়ি! তা হলে কিছুতেই পারবে না সঞ্জয়। কিছুতেই না। কেবল ভয় করে এখন। অকারণে মাঝে মাঝে ভয় করে।

যেমন ভয় করেছিল কাল, রমেনের মুখোমুখি।

কলিং বেলটা টুংটাং করে বেজে উঠলে বিছানা ছেড়ে উঠল সঞ্জয়। দরজা খুলে দেখল পাশের ফ্ল্যাটের মাদ্রাজি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।

লোকটা বাংলায় বলে, আপনার টেলিফোন।

সঞ্জয় এখনও নিজের টেলিফোন পায়নি, অ্যাপ্লাই করেছে অনেক দিন। এই লোকটার টেলিফোনে তার কাজ চালাতে হয়।

টেলিফোন ধরতেই চমকে গেল সঞ্জয়। অজয়ের গলা।

কে! সঞ্জু? শিগগির আয়, মা’র স্ট্রোক।

হঠাৎ হাত-পা হিম হয়ে আসে। গলা ঠিক রাখার চেষ্টা করে বলে, কীসের স্ট্রোক?

জানি না। অবস্থা ভাল না। জ্ঞান নেই। চলে আয়।

কী করে যাব? আজ তো সব বন্ধ!

পুলিশের গাড়ি ধরার চেষ্টা কর, ওরা অনেক সময়ে নেয়। দেরি করিস না।

সঞ্জয় ঘরে ফিরে আসে। তার পা সামান্য কাঁপছে। কিছুক্ষণ অর্থহীনভাবে সে রিনির দিকে চেয়ে রইল।

রিনি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

সঞ্জয় উত্তরে বলল, বালিগঞ্জ থেকে বেলেঘাটা হেঁটে যাওয়া যায়? তোমার কোনও আইডিয়া আছে কতক্ষণ লাগবে?

রিনি উঠে বসে, কী হয়েছে বলো তো!

সঞ্জয় অন্যমনস্কভাবে বলল, যদি পুলিশের গাড়িতে না নেয় তবু রাস্তাটা আমাকে হেঁটেই পেরোতে হবে।

চৌত্রিশ

ডিটেকটিভ বই পড়তে পড়তে একদিন বারান্দায় সকাল দশটার সময়ে ঘাড় কাত করে রায়বাবু বসে আছেন। কোলের ওপর খোলা বই। ছেলের বউ স্নান করাতে নিয়ে যেতে এসে ডাকল, বাবু, উঠুন…

রায়বাবু নড়লেন না। খোলা বইয়ের পাতা ফরফর করে বাতাসে উড়তে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমে গেল রাস্তায়।

খবর পেয়ে ললিত তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছিল, মা পিছন থেকে ডেকে বলল, মড়া ছুঁস না। তোর রোগা শরীর, সবতাতে সর্দারির দরকার কী?

বারোটা নাগাদ খাটলি, ফুল, নতুন কাপড় এসে গেল। শম্ভু, সুবল, আর কয়েকজন ছেলে রাস্তার মাঝখানে খাট সাজিয়ে ফেলল।

মড়া যখন নামানো হচ্ছে তখন মাথাটা ঝুলে লটপট করছে দেখে ভিড় থেকে এগিয়ে রমেন মাথাটা তুলে ধরে। বিশাল চেহারা ছিল রায়বাবুর। কোমরের দিকটা ধরে ঠিক তাল সামলাতে পারছিল না শম্ভু। রমেন ললিতকে ডেকে বলল, মাথাটা ধর তো এসে, আমি কোমরটা ধরি।

ললিতের ভিতরটা তখন কাঁপছ। এইভাবে—একদিন এইভাবে—

সে শূন্যচোখে চেয়ে বলে, ছোঁব?

ধর শিগগির। রমেন ধমক দেয়।

রমেন রায়বাবুর কোমর ধরতেই শম্ভু তাকে চাপা গলায় বলে, দাদা, আপনি খাটে কাঁধ দিলে কিন্তু খাট একদিকে উঠে থাকবে। আপনি যা টল।

সার্জেন্টের চাকরিতে লোকটা একনজরে সিলেক্টড হয়ে যেত। শম্ভু ভেবে দেখল।

চার বছরের নাতিটা ভয় পেয়ে কঁদছে। এ-রকম রাজকীয় সমারোহে সে দাদুকে কখনও দেখেনি। একা ভিড়ের মধ্যে দিশেহারা হয়ে সে মানুষের পায়ের ভিতরে ভিতরে রাস্তা খুঁজছিল। হঠাৎ তাকে আকাশে তুলে নিল কেউ। অবাক হয়ে সে দেখল, একটা লোক সকলের মাথার ওপরে তাকে তুলে ধরেছে। উঁচু থেকে সে তার দাদুর মুখখানা শেষবারের মতো স্পষ্ট দেখতে পেল।

বল হরি—হরি বল।

ললিত নিচু স্বরে বলল, শ্মশানে যাবি?

রমেন বলল, তুইও চল।

বিবর্ণ মুখে ললিত বলে, আমার শরীরটা—

রমেন শক্ত করে তার হাত ধরে, চল।

শ্মশানের বদ্ধ চাতালে বসে আগুনের আঁচ অসহ্য লাগছিল ললিতের। আর ওই গন্ধটা। একটু দূরে শম্ভুরা আড়াল হয়ে সিগারেট টানছে আর ঠাট্টা করছে ডোমদের সঙ্গে, কীরে ক’ বোতল বেঙ্গলি টেনেছিস?

রমেন শান্ত মুখে বসে ছিল। একটা ছোট্ট খাট নিয়ে এসেছে কয়েকজন। বাচ্চা ছেলের মড়া। রমেন ললিতকে ডেকে বলল, ওই দ্যাখ, কলেরার মড়া।

কী করে বুঝলি?

রমেন উত্তর না দিয়ে উঠে গেল। কথাবার্তা বলতে লাগল বাচ্চাটার সঙ্গের লোকজনদের সাথে।

রায়বাবুর চিতাটা ভালই ধরেছে। গুনগুন করছে আঁচ। আগুনের ভিতর থেকে এখনও অমলিন পা দুটো দেখা যায়। পা দুটো দেখছিল ললিত। ফট করে একটা শব্দ হয়ে চিতাটা নড়ল, কাঠের গিঁট ফাটল বোধ হয়। ললিত দেখল রায়বাবুর দু’খানা ফরসা পা, আগুন ছোঁয়নি এখনও, একটু নড়ে উঠল। অনভিজ্ঞ লোক দেখলে চমকে উঠত। ললিত অনভিজ্ঞ নয়, এর আগে সে দু’-চার বার মড়া পুড়িয়েছে। তবু এখন কেমন শরীরে ঘাম ছাড়ে।

ডোমদের একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে তাকে রায়বাবুর চিতাটা দেখিয়ে কিছু একটা বলছে।

কী রে?

ওই পা দুটো। চিতা থেকে পড়ে যাবে। ভারী কাঠ চাপা দিন।

ললিত বুঝল না কী করে পা দুটো চিতা থেকে পড়বে। এখনও চিতার মধ্যেই শোয়ানো রয়েছে পা দুটো।

রায়বাবুর বড় নাতিটা শম্ভুদের দঙ্গলের মধ্যে হাঁটুতে মুখ গুঁজে আছে। সে হঠাৎ মুখ তুলে চেঁচিয়ে উঠল, বাবা।

সবুজ পাতায় ছাওয়া বীথি পথটি দিয়ে ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছে অবনীশ। অফিসে ফোন করে ওকে পাওয়া যায়নি।পি ডব্লিউ ডি-তে কাজ করে, সাইটে গিয়েছিল। অফিসে ফিরে খবর পেয়ে সোজা শ্মশানে এসেছে। এখনও গায়ে অফিসের টিপটপ সাজপোশাক। টেরিলিনের টাই ঝুলছে গলায়। কালোর ওপর একটা লাল ত্রিভুজ। দাঁড়িয়ে টলছিল। এক্ষুণি অবনীশ পড়ে যাবে। ছায়ার মতো রমেনকে দেখা গেল তার পাশে। অবনীশ আর পড়বে না। বুঝতে পেরে নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুজল ললিত।

শুনতে পেল কে যেন চেঁচিয়ে বলছে, পা দুটো দ্যাখ।

ললিত চোখ খুলে দেখে রায়বাবুর পা দুটো দু’খানা কাঠের মতো সোজা, আস্তে আস্তে ওপরে উঠে যাচ্ছে। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে উঠে স্থির হল। যেন ডুবন্ত মানুষের পা, জলের ওপর উঠে আছে। তারপর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ভেঙে আরও ওপরে উঠতে লাগল আস্তে আস্তে।

রমেন দৃশ্যটা আড়াল করে সামনে এসে দাঁড়াল। ডান পা’টা খসে গেল প্রথমে। হাঁটু থেকে পাতা পর্যন্ত অংশটা গড়িয়ে চিতার গা বেয়ে দূরে গিয়ে পড়ল। তখনও ফরসা রং গোড়ালির কড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

বাচ্চা ছেলেটা দৃশ্যটা দেখতে পেল না, অবনীশও না। রমেন তার প্রকাণ্ড চেহারা দিয়ে দৃশ্যটা ঢেকে ফেলল।

ডোমরা বড় একটা গা করে না। কিছু একটু করতে বললেই বোতলের পয়সা চায়। রমেন ললিতকে বলল, তুই একটু আড়াল করে দাঁড়া, আমি পা-টা তুলে দিই। বাচ্চাটা নইলে ভয় পাবে।

ললিত কষ্টে দাঁড়াল। রমেন চিতার ও-পাশে গিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে পা-খানা চিতার মধ্যে গুঁজে দিল, বাঁশ দিয়ে ভেঙে দিল অন্য পা।

মাথা ঘুরে বসে পড়ল ললিত। তারপর টক-তেতো জল বমি করতে লাগল। অনেকক্ষণ কিছু খাওয়া হয়নি। সে ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকল, রমেন!

উঁ। খুব কাছ থেকে উত্তর দিল রমেন।

তুই আমাকে এখানে আনলি কেন?

রমেন উত্তর দিল না।

দিন সাতেক বাদে বিমানের ঘরখানা খালি হয়ে গেল। তার বইগুলো নিয়ে গেল ললিত, আর বাসনপত্রগুলো বস্তায় পুরে মুখ বেঁধে রাখা হল বাড়িওয়ালার ঘরে। অপর্ণার প্রকাণ্ড মোটরগাড়িখানা বটতলায় অপেক্ষা করছিল, লাগেজ বুটের বিশাল ডালাটা খোলা। বিমানের বিছানাপত্র আর বাক্স পাড়ার লোকরাই ধরাধরি করে তুলে দিল গাড়িতে। সুবলকে ভীষণ ব্যস্ত দেখাচ্ছিল। তার মুখ লাল, চোখের পাতা বার বার নেমে আসছে, যত বার অপর্ণার দিকে তাকাচ্ছে সে।

বইয়ের র‍্যাক আর চৌকিটা পড়ে রইল। অপর্ণা বাড়িওয়ালার হাতে বাকি ভাড়ার টাকা দিয়ে বলল, ও-জিনিসগুলো ইচ্ছে করলে পরে যে ভাড়াটিয়া আসবে তারা ব্যবহার করতে পারে। নইলে আপনি যা খুশি করবেন।

বিমানকে মাঝখানে রেখে দু’ধারে বসল ললিত আর রমেন। স্টিয়ারিং হুইল ধরেছে অপর্ণা। গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে সুবল জানালা দিয়ে ঝুঁকে বলল, ললিতদা, দরকার হলে আমি সঙ্গে যেতে পারি।

অপর্ণা দাঁতে ঠোঁট কামড়াল।

ললিত মাথা নেড়ে জানাল, দরকার হবে না।

একটু হতাশা দেখা গেল সুবলের মুখে।

পাড়ার লোক ভিড় করে গাড়ি দেখছে।

দু’জনের মাঝখানে নিথর হয়ে বসে আছে বিমান। সে আজকাল আর কিছুই টের পায় না। আকাশে টইটুম্বুর তার মাথা। দিনরাত আকাশ-ডুব। তাকে খুব রোগা দেখাচ্ছিল। মাথার চুল খুব ছোট করে ছাঁটা। তালুর খানিকটা অংশ চেঁছে ফেলা হয়েছে, সেখানে একটা পুলটিস লাগানো। দুটো কোটরগত চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আগে পাগল হয়ে গেলে শান্ত থাকত বিমান। কিন্তু এবার সে গন্ডগোল করেছে। প্রায়ই লাঠি হাতে লোকজনকে তাড়া করত। রাতে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ত। অচেনা বাড়ির দরজায় নিশুত রাতে গিয়ে কড়া নেড়ে চেঁচাত, টেলিগ্রাম… টেলিগ্রাম… শম্ভুদের জিমনাসিয়ামে গিয়ে প্যারালাল বার-এ উঠবার প্রাণপণ চেষ্টা করত মাঝে মাঝে। একদিন পেশিবহুল একটা ছেলে তাকে বের করে দেয়, তাকে ইট নিয়ে তাড়া করেছিল বিমান, বিপুল চেহারার ছেলেটি ভয়ে ছুটে পালিয়েছিল।

এখন বিমান শান্ত। কোনও অস্থিরতা নেই, কিন্তু কোটরগত দু’খানা জ্বলজ্বলে চোখ মাঝে মাঝে চারপাশে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে চিনতে পারছে না এরা কারা এবং কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

ললিতের মুখ আর ঠোঁট সাদা। বিমানের একখানা হাত কোলে টেনে নিয়ে তার ওপর হাত রেখেছে সে। ঠান্ডা সেই হাত। ঘামছে। সে কোনও একটা সান্ত্বনার কথা বলতে চাইছিল অর্ণাকে। পারছিল না।

গাড়ি চলতেই রমেন বিমানের কানের কাছে মুখ এনে ডাকল, বিমান।

বিমান নড়ল একটু, উত্তর দিল না। রমেন বিমানের উদ্ধত মাথাটা হেলিয়ে দিল সিটের পিছন দিকটায়। অমনি গলার শীর্ণতা ফুটে উঠল বিমানের, দেখা গেল কন্ঠাস্থির ওঠা-নামা। বিমান বার বার তার শুকনো মুখের বাতাস গিলছে। রমেন ওর কপালের ঘাম মুছে দিল হাতের চেটোয়। বিমান স্নান করতে চায় না, খেতে চায় না। রমেনই ওকে সব করাচ্ছে। একা। রমেনের হাতে-গালে ওঁর দাঁত আর নখের দাগ দেখা যায়।

ললিত চোখ ফিরিয়ে নেয়। সে ব্যাপারটা ঠিক চোখে দেখতে পারছিল না। অপর্ণা আর বিমানের কত সুন্দর বোঝাপড়া ছিল! এখন এই সব বিয়োগান্ত দৃশ্য সহ্য করতে পারে না। একটা গভীর শূন্যতার মধ্যে তার মনে পড়ে একদিন— খুব শিগগিরই— তাকে মরে যেতে হবে। বিমানের দিকে তাকিয়ে ওই রোগা মুরগির গলার মতো সরু আর তেলচিটে ময়লা-বসা গলা দেখে তার মনে হয় ও-রকমই একটা রুগ্ণ চেহারা নিয়ে সে মরবে।

তিন দিন আগে আদিত্যর একটা চিঠি এসেছে। সংক্ষিপ্ত চিঠি। লিখেছে— এখানে জানালা খুললেই পাহাড় দেখা যায়। একটা অদ্ভুত উপত্যকা সামনে, ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছে। দেহাতিরা হেঁটে নদী পেরিয়ে হাটে যায়। কলকাতার সব ভুলে যেতে ইচ্ছে করে। উদোম মাঠে দাঁড়িয়ে যখন চারপাশটা খাঁ খাঁ করতে দেখি তখন হঠাৎ নিজেকে খুব মহৎ লাগে, মাইরি বিশ্বাস কর। একটা পিপুল গাছের নীচে চেয়ার টেনে বসে থাকি সারা দুপুর, একবারও সতীর কথা মনে পড়ে না। লোলিটা, সতীকে যদি দেখিস তবে বলিস, আমি যদি বিয়ে করতাম ওকে তবে সারা জীবন সন্দেহ করতাম। এ-রকম অদ্ভুত সম্পর্ক মানুষকে ছোট করে। আমি এখন অনেক দিন এখানে থাকব। সতীকে বলিস আমি ওকে অনেক ট্রাবল দিয়েছি। আর না। সঞ্জয়ের পেটে লাথি মেরেছিলাম, ওটা কি মরেই গেছে? মরলে পৃথিবীর মহৎ উপকার হয়েছে। কিন্তু ঠিক জানি ও মরেনি, অনেক জ্বালাবে। যদি পারিস এইখানে চলে আয়।

চিঠি পড়ে ললিতের ঠোঁট সামান্য কেঁপেছে। গলায় ঠেলা মেরেছে কান্নার ডেলা। শাশ্বতীকে ছেড়ে দিচ্ছে আদিত্য! কিন্তু তাতে কী লাভ?

অলৌকিকভাবে বেঁচে যেতে ইচ্ছে করে।

বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল ললিত। শুনতে পারছিল বিমান গুনগুন করে কথা বলছে। কখনও-সখনও হঠাৎ বিমান লাফিয়ে উঠে দরজা খুলে ছুটে বেরোনোর চেষ্টা করেছে। কখনও চিৎকার করেছে, কিন্তু আবার পরক্ষণেই নিথর হয়ে গেছে। এখন বিমান কী বলছে তা শুনতে পাচ্ছিল না ললিত।

সঞ্জয়ের মা মারা গেছে। গুরুর দশা নিয়েই এসে দু’দিন আড্ডা দিয়ে গেছে। গলায় ধড়া, হাতে কুশাসন, গালে দাড়ি আর একটোকা চুল মাথায়। কী বীভৎস শোকের চেহারা! হিন্দুত্বের ওই আর-এক দোষ। শোকটাকে বিজ্ঞাপনের মতো নিয়ে বেড়ায়। লোকে চমকে ওঠে, মন খারাপ হয়ে যায়। বরং শোকচিহ্নগুলি লুকিয়ে রাখাই ভাল, মানুষের এমনিতেই দিনে কত বার মৃত্যুর কথা মনে পড়ে।

অপর্ণা—রোগা ফরসা মেয়েটা—সুন্দর গাড়ি চালায়। এত বড় গাড়ি কী অনায়াসে চালিয়ে নিচ্ছে! ওর মনের অবস্থা কী তা ললিত বোঝে। তবু ওপরের দাঁতে ঠোঁট কামড়ে মাঝে মাঝে উড়ন্ত চুল চোখের ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে দুটো সহজ হাতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সামনেই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মহামহিম এক ল্যাংটা পাগল, হাতে লাঠি, ললিত চোখ বুজে ফেলে লজ্জায়। গাড়ির গতি ধীর হয়ে যায়। ললিত টের পায় গাড়িটা বেঁকে পাশ কাটিয়ে নিল। পাগলটা রাস্তা ছাড়ল না। পাগল কত বেড়ে গেছে আজকাল। হঠাৎ হঠাৎ খেপে যাচ্ছে মানুষ। বিড়বিড় করছে হঠাৎ। মাঝরাতে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ছে রাস্তায়, গায়ের জামা-কাপড় খুলে ফেলে দিচ্ছে। পাকিস্তান হওয়ার পরই এটা বেড়ে গেছে খুব। গতবারের আগের বার পুজোয় বন্ধুরা সব বেড়াতে গেল বাইরে। ললিত মাকে একা রেখে যেতে পারে না কোথাও। তাই সে রাস্তায় ঘুরে-টুরে সময় কাটাত। সেই সময় একদিন ভবানীপুরের ফুটপাথে প্রচণ্ড ভিড়ের ভিতরে একটা লোকের চোখে চোখ আটকে গেল। লাল আঁজি-আঁজি জ্বলজ্বলে পাগলের চোখ। লোকটা হঠাৎ তার দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে বলল, তুমি। হঠাৎ গুড়গুড় করে উঠেছিল ললিতের বুক। আমি! আমি কী! আমি কী! এক রাস্তা ভিড়ের মধ্যে অচেনা লোকটা তার শীর্ণ হাত তুলে তাকে চিহ্নিত করছে। থরথর করে কাঁপছে তার আঙুল, লক্ষ লোকের মাঝখানে সে ললিতকেই কিছু বলতে চাইছে, তুমি। হঠাৎ ও-রকমভাবে কেউ ‘তুমি’ বলে চেঁচিয়ে উঠলে যে কেউ টলে যায়। নিজেকে আজন্ম পাতি পাতি করে খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, আমি কী করেছি! কী করেছি! ললিতের ঠিক তাই হয়েছিল। সেই পাগলটা কেন তাকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলেছিল, তুমি? হয়তো সে একটা কিছু দেখেছিল যা অন্য কেউ লক্ষ করেনি। সে হয়তো লক্ষ করেছিল ললিতের অসংগতি। হয়তো কোনও ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা। কিংবা হয়তো সৌভাগ্যসূচক কিছু। আলটপকা বড় নাড়া খেয়েছিল ললিত। পরমুহূর্তেই সে স্বাভাবিক হয়ে হেঁটে চলে গিয়েছিল ভিড়ের মধ্যে। আশ্চর্য, সেই ঘটনার পর দু’বছরও কাটেনি, তার ক্যান্সার হল।

কোনও যোগাযোগ নেই, তবু আবছাভাবে মনে হয় যোগাযোগ আছে। পাগলটা হয়তো তাকে সাবধান করেছিল।

বিমান গুনগুন করে কথা বলছে। মুখ ফিরিয়ে ললিত দেখল রমেন নিবিষ্টভাবে বিমানের কথা শোনার চেষ্টা করছে।

কী শুনছিস?

রমেন আস্তে বলল, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

ললিত বিমানের দিকে ঝুঁকে বসল। কথাগুলো ঠিক বোঝা যায় না। অসংলগ্ন। মনে হয় বুঝি বা কোনও কবিতার লাইন।

কতোবার গিয়েছি যে ব্যাবিলনে, স্বপ্নের উদ্যানে…কতোবার গিয়েছি যে…

রমেন হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠে সোজা হয়। তারপর অপর্ণার দিকে মুখ বাড়িয়ে বলে, আপনি পারবেন না। গাড়ি টাল খাচ্ছে, অ্যাকসিডেন্ট হবে।

অপর্ণা মুখ ফেরায়। মুখখানা অল্প লাল, উত্তেজিত। চোখ টলটল করছে। একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ঠিক ব্যালান্স থাকছে না।

গাড়ি থামান।

থামিয়ে?

আমি চালাব।

অপর্ণা একটু থমকে বলে, লাইসেন্স আছে?

রমেন হাসে, ছিল। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। আমি চালিয়ে নিতে পারব।

অপর্ণা জিওলজিক্যাল সার্ভের উলটো দিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সরে বসল। রমেন গিয়ে ধরল হুইল। সামান্য হাঁফাচ্ছিল অপর্ণা। বলল, সার্কুলার রোডের লাল বাতি আমার নজরেই পড়েনি। দিব্যি পার হয়ে এলাম। পুলিশ বোধ হয় নম্বর টুকে নিয়েছে।

ললিত দশ বছর পর গাড়ি চালাতে দেখছে রমেনকে। দশ বছর আগে পুরনো ঝরঝৱে অস্টিন গাড়িটা যখন চালাত রমেন তখন তারা আশেপাশে আর পিছনে বসত। রমেন নিয়ে যেত শহরের বাইরে। কত বার গাড়ি চালানো শেখার চেষ্টা করেছে ললিত, ঠিকমতো পারেনি। একসঙ্গে এতগুলো যন্ত্র সামলাতে হয় যে তাল থাকে না। রমেন বিরক্ত হয়ে বলত, যন্ত্রপাতির মধ্যে তোর মনোযোগ নেই।

হঠাৎ ললিত আর-একটা ব্যাপার লক্ষ করে মনে মনে হেসে উঠল। সামনের সিটে ওরা দু’জন। রমেন—প্রাক্তন জমিদার আর অপর্ণা— কারখানা মালিকের মেয়ে। পিছনে সে স্কুলমাস্টার, আর বিমান—কর্পোরেশনের জমাদারবাবু। ঘটনাচক্রে দুটো শ্রেণী আলাদা আলাদা জোট বেঁধেছে।

দক্ষিণেশ্বরের কাছে মানসিক হাসপাতাল। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা। সামনের দিকে একটু বাগান আছে। ললিত ভিতরে গেল না। গাড়ি থেকে নেমে বাগানের মধ্যে বেড়াতে লাগল। বিমানকে ধরে ধরে নিয়ে গেল রমেন, পিছনে অপর্ণা নত মুখে। দৃশ্যটা এত খারাপ লাগছিল ললিতের! একটু পরে দু’জন লোক এসে গাড়ির লাগেজবুট খুলে বিমানের বাক্স-বিছানা নিয়ে গেল। হাসপাতালে বাক্স-বিছানা রাখতে দেয় কি না কে জানে! হয়তো মানসিক হাসপাতালের ব্যবস্থা আলাদা, নয়তো রমেন আর অপর্ণা বন্দোবস্তটা করিয়ে নিয়েছে। ওগুলো কোথাও রাখার জায়গা ছিল না।

ওদের ফিরে আসতে অনেক সময় লাগল। যখন বারান্দায় তিনটে সিঁড়ি ভেঙে এরা দু’জন, অপর্ণা আর রমেন নেমে আসছিল, তখনই হঠাৎ বিমানের জন্য সত্যিকারের একটা কষ্ট টের পাচ্ছিল ললিত। সেরে উঠতে বিমানের কত দিন লাগবে কে জানে! তত দিনে ললিত কোথায়?

ফেরার সময়েও গাড়ি চালাচ্ছিল রমেন। রমেনের পাশে ললিত। পিছনে অপর্ণা।

এক সময়ে অপর্ণা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ওরা যত্ন নেবে তো?

রমেন মুখ না ফিরিয়ে বলল, নেবে। ওরা আমার অনেক দিনের চেনা লোক।

অপর্ণা দাঁতে রুমাল কাটল। তারপর আচমকা বলল, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

ললিত ভয়ংকর চমকে উঠে ফিরে বলল, সে কী?

অপর্ণা মাথা নুইয়ে চুপ করে রইল একটুক্ষণ, যেন কাঁদবে। কাঁদল না। ম্লান মুখখানা তুলে বলল, বাবা সেদিন আমাকে ডেকে বললেন, অর্পণা, তুমি বুঝতে পারছ না আমার শরীরের অবস্থা। কিন্তু ডাক্তার কাজকর্ম চলাফেরা একদম বারণ করে দিয়েছে। এখন আমার এত সব কে দেখে! আমি ইঙ্গিতটা ধরতে পারলাম। উত্তর দিইনি। কিন্তু বাবা খুব কনসিডারেট, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার যদি পছন্দ মতো কেউ থাকে তো বলো আমি তার সঙ্গেই বিয়ে দেব। কিন্তু তাড়াতাড়ি বিয়ে, উইদিন এ মান্থ। জামাইকে আমার ছেলে হয়ে সব দেখতে হবে।

আপনি কী বললেন?

অপর্ণা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি কিছু বললাম না।

কেন?

ও তো বাবার ছেলে হতে পারত না!

তাতে কী আসে যায়!

অপর্ণা একটু হাসল। তারপর বলল, কী জানি! আমি তো তবু রাজি ছিলাম। কিন্তু ও সেদিন আমাকে বলল, আমি তোমাকে নিয়ে কী করব? তোমাকে খাওয়ানোর সাধ্য আমার নেই। তা ছাড়া আমি বিয়ে করব কেন, আমি কি সুস্থ? আমার সন্তান যে মাথার দোষ নিয়ে জন্মাবে না তার গ্যারান্টি কী? আমার ঠাকুমা পাগল ছিল। আমাদের সমাজ যদি মানুষ সম্পর্কে সচেতন হত তা হলে আইনত আমার মতো মানুষকে বিয়ের অযোগ্য বলে ঘোষণা করে দিত। সমাজ যখন তা করছে না তখন দায়িত্ব আমারই।

ললিত ভীষণ চঞ্চল হয়ে বলল, কিন্তু আপনি তো ইচ্ছে করলে একা থাকতে পারেন!

অপর্ণা আবার নতমুখ হয়ে যায়। সম্ভবত নিজের ত্যাগের অভাবের কথা ভাবে। তারপর বলে, সেটা করা যায় না যে তা নয়। কিন্তু কীসের আশায়! কেন?

কোনও যুক্তিপূর্ণ কথা খুঁজে পায় না ললিত, তবু আবেগ থেকে বলে, একজনের কাছে আপনি বাঁধা আছেন।

আপনাকে তো বলেছি আমি ভীষণ দুর্বল, আর ভিতু। একা আমি অত বড় কারখানা চালাতে পারব না। কর্মচারীদের আমি ভয় পাই। তা ছাড়া ওই যে ছেলেটা আপনাদের পাড়ার, ভীষণ ডেসপারেট, আজও বার বার আমার গা ঘেঁষে দাড়াচ্ছিল, ও-রকম সব ছেলের হাত থেকে কে আমাকে বাঁচাবে?

বড় রেগে গিয়েছিল ললিত। উত্তেজনার মাথায় বলে ফেলল, ভগবান বাঁচাবেন।

বলেই লজ্জা পেল।

খুব অবাক হল অপর্ণা। বলল, ভগবান! আপনি ভগবানের কথা বলছেন?

ইয়াঃ! বলে হেসে ফেলল ললিত। বলল, অত ভয় পেলে কি চলে?

অপর্ণা মাথা নাড়ল, আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম ওর মাথা পুরোপুরি ভাল হওয়া মুশকিল। র‍্যাডিক্যাল কিওর নেই। থাকলে আমি চেষ্টা করতাম। অথচ বিয়েটা বাবার দিক থেকে সত্যিই প্রয়োজন।

ললিত চুপ করে থাকে।

রমেন মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনাকে কোথায় পৌঁছে দেব?

অপর্ণা বলে, পরাশর রোড। ওখানে এক বন্ধুর বাসায় যাব। মাকে বলে এসেছি রাত্রে খাওয়ার নিমন্ত্রণ আছে।

পরাশর রোড়ে একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই কলস্বরা একটি মেয়ে ছুটে এল। অপর্ণা তখন নামছে, তার হাত ধরে ভীষণ উত্তেজিত চাপা গলায় হাসতে হাসতে বলল, মাসিমা একটু আগে ফোনে তোর খোঁজ করছিলেন, ড্রাইভার নিয়ে বেরোসনি বলে চিন্তা। আমি বলেছি তুই আর-এক বন্ধুর বাড়িতে একটু গেছিস, এক্ষুনি এসে পড়বি। ইস, সেই থেকে দরজায় দাঁড়িয়ে আছি।

অপর্ণা মৃদু হেসে রমেনের দিকে ফিরে বলল, গাড়িটা আমার এখন দরকার নেই, আমি তো সেই দু’ ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরব। আপনি বরং ললিতবাবুকে পোঁছে দিয়ে আসতে পারেন। ওঁর তো শরীর খারাপ।

রমেন ললিতকে একটু চোখ টিপল। তারপর অপর্ণাকে বলল, সেই ভাল, চল রে ললিত।

বলে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল রমেন।

গাড়ি ছাড়তেই ললিত বলল, তুই আবার গাড়ির ঝামেলাটা ঘাড়ে নিলি কেন! আবার তো তোকে ফিরতে হবে। বেশ তো দু’জন নির্ঝঞ্ঝাটে কেটে পড়তাম।

রমেন মৃদুস্বরে বলল, গাড়ি চালানোর একটা নেশা আছে। কতকাল চালাই না! আর কী ভাল গাড়ি দেখছিস! বুইকের হাল-মডেল।

ললিত ঝেঁঝে উঠল, দূর।

রমেন একটু চুপ করে থেকে বলল, মেয়েটা বোধ হয় আমাকে কিছু একটা বলতে চায়। হয়তো একা বলবে। তাই গাড়িটা দিল, যাতে আমি ফিরে আসি।

আমার সামনে বলতে দোষ কী ছিল?

রমেন উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে গাড়ি চালাল রমেন। ময়দানের কাছাকাছি এসে পড়ল।

ললিত বলল, খামোখা পেট্রল পোড়াচ্ছিস!

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ছাড়িয়ে গিয়ে নির্জন রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করাল রমেন। আয়, ড্রাইভিং সিটে বোস।

আমি! দূর, আমি ও-সব পারব না। শেখার বয়স চলে গেছে।

আয় না।

দূর, অন্যের গাড়ি, কোথায় চোটফোট লেগে যাবে।

কিন্তু রমেন ছাড়ল না।

ললিত বসল ড্রাইভিং সিটে। অনেকদিন আগে একটু-আধটু শিখেছিল। শিখিয়েছিল রমেন। রমেন তাকে আবার সব বুঝিয়ে দিল। তারপর বলল, চালা।

স্টার্ট দিতেই গাড়ি লাফিয়ে উঠল।

রমেন আস্তে করে বলল, তাড়াহুড়ো নেই। আস্তে চালা।

যন্ত্রপাতিগুলো ধীরে ধীরে অধিকার করে নিচ্ছিল ললিতকে। তীব্র উত্তেজনা বোধ করছিল সে। প্রথমটায় গাড়ি একটু এঁকেবেঁকে যাচ্ছিল, পিছন থেকে সাঁ সাঁ করে গাড়িগুলো তাদের পেরিয়ে যাচ্ছিল। ভয় করছিল ললিতের, যদি ধাক্কা লাগে! রমেন একটা হাতে ধরে রেখেছিল স্টিয়ারিং।

আস্তে আস্তে রোখ আর সাহস বেড়ে যাচ্ছিল ললিতের। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে একটু লালচে মুখে প্রবল মনোযোগের সঙ্গে একাই গাড়িটা চালিয়ে নিচ্ছিল ময়দানের নির্জন রাস্তায় রাস্তায়। পাশে একটু ঘাড় হেলিয়ে চোখ বুজে বসে আছে রমেন, যেন ঘুমোচ্ছে। একবারও সাবধান করছে না ললিতকে।

সাহস বাড়ছিল। উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিল।

চাপা গলায় সে বলল, রমেন!

উঁ।

ওই যে সামনে একটা ছোট গাড়ি যাচ্ছে, দ্যাখ ওটাকে ওভারটেক করছি।

কর দেখি।

ললিত করল। গাড়িটা চালাচ্ছিল একটা মেয়ে। এক ঝলক সে প্রকাণ্ড বুইকটার দিকে ঈর্ষার চোখে তাকাল। ভীষণ একটা আনন্দ পেল ললিত। এই দেখো আমি ললিত, কত বড় আর দামি একখানা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

তারপরেই একটু হতাশা আসে। গাড়িটা তার নয়।

ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ চক্কর দিল ললিত। সমস্ত মনপ্রাণ সঁপে দিয়ে সে গাড়ি চালাচ্ছিল। অখণ্ড মনোযোগে।

বোজা চোখে রমেন একটু হাসল।

রমেন!

উঁ।

এবার ফিরি। তুই চালা এবার। ভিড়ের রাস্তায় আমি তো পারব না।

দূর। ভবানীপুর পর্যন্ত তুই চালা৷ তারপর আমি দেখব।

আশ্চর্য এই, ললিত অনায়াসে ভবানীপুর পর্যন্ত চলে এল। অসুবিধে হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু খুব মনোযোগ দিয়ে সে চালাচ্ছিল। ভুল করছিল না।

এলগিন রোডের কাছে গাড়ি থামিয়ে জায়গা বদল করার সময় রমেন চাপা গলায় বলল, সাবাস।

বাচ্চা ছেলের মতো লাজুক হাসল ললিত। তার কপালে ঘাম। হাত-পা কাঁপছে। অনেক—অনেক দিন বাদে আজ সত্যিকারের একটা আনন্দকে সে টের পাচ্ছিল। একটা ছোট্ট সাফল্যের অনাবিল আনন্দ। আমি সব পারি।

প্রতি দিন লক্ষ লক্ষ লোক গাড়ি চালায় যন্ত্রের মতো নির্ভুলভাবে। তারা হয়তো কোনও দিনই ললিতের এই আনন্দকে টের পায় না। একমাত্র ললিত জানে কেন এই আনন্দ।

রাত সাড়ে আটটায় অপর্ণাকে পৌঁছে দিচ্ছিল রমেন।

সারাক্ষণ তেমন কোনও কথা হল না।

শুধু একবার অপর্ণা প্রবল ক্ষোভের সঙ্গে বলল, এখন লোকে আমাকে খারাপ ভাববে। আমি সারা জীবন একজনকে ভালবাসলাম, কিন্তু বিয়ে করছি আর একজনকে। কিন্তু আমি সত্যিই তা চাই না। জানেন! যদি কেউ একজন আমার ভার নিত, যার টাকা পয়সা কিংবা মেয়েমানুষের জন্য একটুও দুর্বলতা নেই তবে কত ভাল হত। কিন্তু সেরকম বোধহয় কেউ নেই, না?

রমেন উত্তর দিল, আছে। বিমান।

অপর্ণা জিজ্ঞেস করে, আপনি—আপনি আমাকে কী করতে বলেন?

আধো-অন্ধকারে রমেন হঠাৎ অপর্ণার দিকে একপলক তাকাল।

ভীষণ চমকে উঠল অপর্ণা। তার মনে হল এ-লোকটা জানে যে অপর্ণা আসলে সেই ছেলেবেলার বয়ঃসন্ধিতে কবে যেন বিমানকে ভালবেসেছিল। তারপর ভালবেসেছিল সেই স্মৃতিকে। তারপর কখনও সে ভালবেসেছে অকিঞ্চনকে ভালবাসার মধ্যে তার নিজের যে মহং আত্মত্যাগ আছে, তাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কোনওটাই বিমান নয়। যে-বিমান কর্পোরেশনের জমাদারদের বাবু, যে মাঝে মাঝে পাগল হয়ে যায়, তাকে সঠিক কবে ভালবেসেছে অপর্ণা?

এ-লোকটা বোধহয় জানে সব। বুঝতে পারে। তাই সে সারা রাস্তায় আর কথা বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *