দশ
লোকটা কষ্টেসৃষ্টে উঠে স্টোভ থেকে চায়ের কেটলি নামিয়ে বলল, আমি আকাশের কথা ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।
নিপুণ হাতে চা তৈরি করল লোকটি। কেটলি থেকে যখন লিকার ঢালছিল তখন সেই লিকারটাকে একদম কালো আর থকথকে ঘন দেখাচ্ছিল। খুব কড়া লিকারের চা। রক্তবর্ণ সেই চা কাপে নিয়ে আবার এঁকেবেঁকে বিছানায় এসে বসল। বলল, আকাশের কথা ভাবতে ভাবতে, কিন্তু দেখো, বরাবর আমার চারপাশের পৃথিবীর বা সমাজ-সংসারের ভাবনার চেয়ে আকাশের ভাবনাই আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল। বিভোর হয়ে ভাবতুম। ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা, লোকের মধ্যে আকাশের ভাবনা ঢুকিয়ে দিতে পারলে, আকাশ-বিভোর করে দিতে পারলে পৃথিবীতে পাপটাপ অনেক কমে যাবে, দুঃখ-কষ্ট, বিরহ-মৃত্যু অনেকটাই সহনীয় হয়ে যাবে তখন। মানুষ খানিকটা বিবাগী উদাসী হয়ে যাবে। অবশ্য তারও একটা বিপদ ছিল। মানুষ তখন আর তেমন চাষেবাসে মনোযোগী হবে না, ঠিকমতো কলকারখানা চালাবে না, প্রজনন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তাতেও পৃথিবীর খুব একটা ক্ষতি হত না। হত কি? হিসেব করলে দেখা যায়, আমরা পৃথিবীতে প্রয়োজনের চেয়ে ঢের বেশি জিনিস উৎপাদন করি। বেশি উৎপাদন করি বলেই বেশি লুকিয়ে রাখি, বেশি সঞ্চয় করি। তাতে বেশি অভাব দেখা দেয়। কী বলো? তা ছাড়া আকাশ-চিন্তায় মানুষের কামভাব কমে যায় অনেক। তাতে মানুষ কমই জন্মাবে পৃথিবীতে, লোকসংখ্যা কমে যাবে ঢের। সচ্ছলতা দেখা দেবে। না?
চায়ে চুমুক দিয়ে সেই গরম কড়া চায়ের তীব্র স্বাদে লোকটা মুখ বিকৃত করল। তারপর বলল, এইভাবে আকাশ-চিন্তায় আমি পাগল হয়ে গেলাম। আকাশটা একটু একটু করে আমার মধ্যে ঢুকছিল। কিন্তু আমার মাথা একটা সসীম বস্তু। তার নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং বেধ রয়েছে, তার ভাবনা-চিন্তার রয়েছে একটা সীমা। তার মধ্যে অসীম আকাশটা ঢুকবে কী করে? তবু রোজই আমি টের পেতাম অনবরত আমার মাথার মধ্যে বিশাল, প্রকাণ্ড অনন্ত আকাশ ঢুকছে তো ঢুকছেই। আমার মাথার ভিতরটা টইটম্বুর হয়ে গেল, তারপর ফাটো ফাটো হল। ব্যথায় আমি একা একা চিৎকার করতাম। সেই সময়ে আমাকে ইউনিভার্সিটি থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। আমার মা-বাবার ধারণা হয়েছিল যে, দর্শন পড়তে পড়তেই আমার ও-রকম অবস্থা। আমি তিন-চার মাস বাসায় বসে রইলাম। আমার বাবা ছিল জজ-কোর্টের উকিল, কিন্তু তাঁর পসার ছিল না। সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে কাছারিতে যেত, জামিন বা এফিডেবিটের ছোটখাটো কাজ থেকে পয়সা পেত। সংসার চলত না। বি এ ক্লাসের মাঝামাঝি থেকে রমেন আমার পড়ার খরচ না দিলে আমার পড়া কবে বন্ধ হয়ে যেত। তিন-চার মাস পর আমার পাগলামি সেরে গেলে বাবা আর আমাকে পড়তে দিল না। খুব ধরা-করা করে কর্পোরেশনে আমাকে একটা কেরানির কাজে বহাল করে দিল। ধাঙ্গড়-জমাদারদের হাজিরা নেওয়ার কাজ। তারপর বাবা বুড়ো হয়ে, অসুখে ভুগে মারা গেল। তার এক বছর বাদে উদুরিতে মারা গেল না। আমার ছোট বোনটা একজনকে ভালবেসে বিয়ে করল। আমার দাদা চলে গেল চাকরি নিয়ে জার্মানিতে। আমাকে একা পেয়ে সাবেকি বাসা থেকে উচ্ছেদ করে দিল বাড়িওয়ালা। আমি মামলায় হাজির হইনি বলে একতরফা ডিক্রি পেয়ে সে কোর্টের পেয়াদা এনে আমার মালপত্র, বই, বিছানা ফুটপাথে বের করে দিল সকালবেলায়। আমি সারা দিন পাড়াপড়শিদের ভিড়ের মধ্যে ফুটপাথে আমার বাক্সের ওপর বসে রইলাম। আমার অনেক জিনিস চুরি হয়ে গেল। আমি কাউকেই বলতে পারলাম না যে, ‘আমাকে একটু সাহায্য করুন’ কিংবা ‘আমাকে একটু আশ্রয় দিন।’ ভাগ্যক্রমে কর্পোরেশনের একটা দয়ালু জমাদার আমাকে দেখতে পায়। সে হাজিরা-খাতায় টিপসই দিয়ে সারা দিন নিজের ধান্ধায় ঘুরত। আমি তাকে কিছুই বলতাম না এমনিতেই, তার ওপর সে রোজ আমাকে বাঁধা রেট-এ দশ পয়সা করে ঘুষ দিত মুখ বন্ধ রাখার জন্য। সেই লোকটাই অবশেষে আমাকে এইখানে নিয়ে আসে। সেই থেকে আমি এই ঘরে আছি।
হঠাৎ আচমকা ললিত প্রশ্ন করল, তুমি ঘুষ নাও?
লোকটা মাথা নাড়ল, নিই। আপত্তি করতে আমার লজ্জা করে। ওরা, ওই ধাঙ্গড়-জমাদাররা খুব আদর করে খুব ভালবাসার সঙ্গে পয়সাটা দেয়। আমি খুব অসহায় বোধ করি, ফিরিয়ে দিতে পারি না। তা ছাড়া যদি ফিরিয়ে দিই তবে ওদের দিয়ে আমাকে কাজ করিয়ে নিতে হবে। যদি তা করি তবে ওরা রেগে যাবে, ছুতোনাতা ধরে হাঙ্গামা করবে, আমাকে চাকরিতে থাকতে দেবে না। সেই হাঙ্গামা সহ্য করার মতো জোর আমার নেই। বুঝলে! আমি যদি সৎ হই, তবে আমার কর্তব্যপরায়ণ এবং সাহসীও হওয়া দরকার। নইলে দুর্বল সৎকে দিয়ে সমাজের কোনও উপকার নেই। সৎ হওয়া সোজা। আমি রোজ সকালে জমাদারদের দেওয়া পয়সা ফিরিয়ে দিতে পারি, কিন্তু কিছুতেই তাদের দিয়ে কাজ করাতে পারি না। আমি ঘুষ না-নিলেও শহর নোংরা থাকবে। নয় কি? কেননা আমি কর্তব্যপরায়ণ বা সাহসী নই। ঠিক বলছি না?
ললিত হাসল। বলল, বলে যাও।
লোকটা একটু চুপ করে রইল। কপালে ব্যান্ডেজের তলা দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে একটু চুলকে নিল। তারপর যন্ত্রণায় মুখ একটু বিকৃত করে বলল, আমার সবচেয়ে প্রিয় বই হচ্ছে কবিতা আর দর্শনের। এই সমস্ত দামি বইগুলো আমার ঘুষের পয়সায় কেনা। ওদের পয়সা না নিলে আমি কী করে এই বইগুলো কিনতাম! অ্যাঁ! ওই সব বইগুলোর মধ্যে এক-একটা আশ্চর্য জগৎ, একটা কবিতার মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের ছায়া, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে ওই বইগুলি। আমি সৎ হলে কিংবা ধাঙ্গড়-জমাদাররা কাজে ফাঁকি না দিলে এই আনন্দ আমি কোথায় পেতাম! তা ছাড়া দেখো, ওই ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারটা আমি প্রচলন করিনি। ওই চাকরির ওটাই নিয়ম ছিল, আমি কেবল ওই নিয়মটার মধ্যে গিয়ে পড়েছিলাম। আমি নিয়ম পালটানোর খুব পক্ষপাতী নই। যদি নিয়ম পালটাতেই হয় তবে সমস্ত দেশটার সব নিয়ম এক আঘাতে, একবারে পালটে ফেলাই ভাল। আমি যদি আমার দুর্বল ক্ষমতা নিয়ে ছোট্ট একটা নিয়মকে পালটানোর চেষ্টা করি তা হলে গোলমাল হবে খুব, আমার বিপদ ঘটবে। প্রকাণ্ড একটা পুরনো মেশিনে তুমি যদি একটা নতুন ধরনের পার্টস লাগানোর চেষ্টা করো তা হলে পুরো মেশিনটাই চেঁচাবে, আর্তনাদ করবে, নতুন পার্টসটাকে কিছুতেই থাকতে দেবে না। তাই আমি একটা বিরাট রহস্যময় মেশিনের কোনও অংশই পালটানোর চেষ্টা করিনি। তার নিয়ম মতোই তাকে চলতে দিয়েছি। আমি ধাঙ্গড়-জমাদারদের চটাইনি, বরং তাদের নিয়ম মতো খুশি রেখেছি। ফলে দেখো, তাদের পয়সায় আমি ইচ্ছেমতো বই কিনেছি, তাদেরই দয়ায় ফুটপাথ থেকে এমন সুন্দর একটা ঘরে আশ্রয় পেয়েছি।
‘সুন্দর ঘর’ কথাটা শুনে ললিত মুখ লুকিয়ে একটু হাসল।
চা শেষ করে কাপটা বিছানার ওপরেই রেখে উঁচু বালিশে আধশোয়া হয়ে লোকটা বলতে লাগল, দেখো, একটা নিয়ম পালটানোর চেষ্টা করতে গিয়েই আজ আমার এই অবস্থা। আমি অনেক দিন ধরেই জানি যে, আমি দুর্বল মানুষ, আমি কথা বলতে পারি না। সারা জীবনে আমার প্রতি যত অন্যায় ব্যবহার করা হয়েছে, আমাকে যত অপমান করা হয়েছে সবই আমি সহ্য করেছি। কেননা আমার স্বভাব অনুযায়ী সেটাই ঠিক নিয়ম। এবং এই নিয়ম অনুযায়ী চললে আমার কোনও বিপদ নেই। অথচ কয়েক দিন আগে এক বার অল্পক্ষণের জন্য আমি আমার স্বভাবের, এই নিয়ম পালটে ফেলেছিলাম। ঘটনাটা অবশ্য খুবই ছোট এবং সাধারণ একটা ঘটনা। সেদিন অনেক রাত্রে আমি নাইট শোতে একটা সিনেমা দেখে ফিরছিলাম…
ললিত একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, তুমি সিনেমা দেখো?
লোকটা ঘাড় নাড়ল, দেখি। বই পড়তে পড়তে বা চিন্তা করতে করতে আমার মাথা ভার হয়ে যায়। তাই আমি সিনেমা হল কিংবা খেলার মাঠে চলে যাই। আমি কখনও সিরিয়াস ছবি-টবি দেখি না, আমি দেখি বেলেল্লা হিন্দি ছবি, যাতে প্রচুর হুল্লোড় আছে, যার মধ্যে দুঃখ-টুঃখ বড় একটা নেই। ওইসব ছবি আমার মাথাকে খুব সজীব করে দেয়।
ললিত হাসল, ঠিক আছে। তারপর বলো।
হ্যাঁ, তারপর সেদিন অনেক রাতে আমি ফিরছিলাম। ভিড়ের বাসে আমি উঠতে পারিনি। ভবানীপুর থেকে টালিগঞ্জ খুব একটা দুর নয় বলে আমি হাঁটা-পথেই চলে আসছিলাম। রেল-ব্রিজ পেরিয়ে কিছু দূর আসতেই কে যেন পিছন থেকে বলল, “ও মশাই, শুনুন! ফিরে দেখি ল্যাম্প-পোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে দু’জন লোক। সাধারণ বাঙালির মতোই তাদের চেহারা। শ্যামলাই বোধহয় গায়ের রং, রোগা-টোগা, না-লম্বা-না-বেঁটে। পরনে ধুতি আর শার্ট। আমি ফিরে তাকাতেই বলল, ‘আপনার কাছে দশ কি পাঁচ পয়সার কয়েন হবে? আমরা দুই বন্ধু একটা বাজি ফেলেছি, কিন্তু ‘টস’ করার মতো খুচরো পয়সা আমাদের কাছে নেই।’ লোকটা ভারী ভদ্রলোকের মতো হেসে বলল। খুব শান্ত আর ধীরস্থির তার হাবভাব। আমি কথা না বলে পকেট থেকে একটা আধুলি পেয়ে তার হাতে দিলাম। লোকটা খুব আপ্যায়িত হয়ে বলল, ‘বাঃ, এতেই হবে। বলে আমার সামনে দাঁড়িয়েই ‘টস’ করল। বাঁই করে পয়সা আঙুলের টোকায় শূন্যে উড়িয়ে দু’হাতের চেটোয় চেপে ধরল। তারপর ‘টসে’র ফলাফল দেখে আমার হাতে আধুলিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ। আমি চলে আসছি, তখন আবার সেই লোকটা পিছু ডাকল, ‘দাদা, শুনুন।’ আমি দাঁড়ালাম। আবার বিনয়ের হাসি হেসে বলল, ‘আমাদের ‘টস’-এর রেজাল্টটা জেনে গেলেন না? আমার এই বন্ধুর ভাগে পড়েছে আপনার হাতঘড়িটা, আর আমার ভাগে আপনার ম্যানিব্যাগ। ও দুটো দিয়ে আপনি চলে যান।’ দেখলাম লোকটার বন্ধু একটা মাঝারি লম্বা ছুরি বের করে খুব মনোযোগের সঙ্গে নিজের আঙুলের নখ কাটছে। আমাকে লক্ষই করছে না। দু’জনেরই ভাবভঙ্গি শান্ত, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, আর বেশ গা-ছেড়ে-দেওয়া, হাসিখুশি। তারা আমাকে একটুও ভয় দেখানোর চেষ্টা করেনি, চাপা গলায় কথা বলেনি। আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। তখন বড়জোর রাত বারোটা বেজে দশ কি পনেরো মিনিট। কলকাতায় ওটা তখনও রাতই নয়। আমাদের চারদিকেই তখনও কিছু লোকজন চলাচল করছে, রাস্তায় জ্বলছে আলো, অল্প দূরেই একটা মাংসের দোকান ধোলাই হচ্ছে, ঝাঁটা আর জলের শব্দ আমার কানে আসছিল, ফুটপাথে শোয়া লোকগুলো তখনও ঘুমিয়ে পড়েনি সবাই। এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা আমাকে প্রকাশ্যে লুট করছিল। আমার স্বভাবের নিয়ম অনুযায়ী তখন কী করা স্বাভাবিক ছিল, বলো তো! স্বাভাবিক ছিল চুপচাপ তাদের হাতে আমার পুরনো বাবার আমলের ঘড়ি আর অল্প কয়েকটা টাকাওলা মানিব্যাগটা ছেড়ে দেওয়া। সেটাই ঠিক স্বাভাবিক হত। আমার চেয়ে ঢের সাহসী লোকও ঠিক তাই করত। কিন্তু সেই মুহূর্তে, অল্প কিছুক্ষণের জন্য আমি আমার স্বভাবের নিয়ম পালটে ফেললাম। আমি দিলাম না।
দিলে না?
লোকটা মাথা নাড়ল, না। তারা যদি আমাকে ভয় দেখাত, কিংবা যদি আচমকা আমার সামনে দাঁড়িয়ে সব কেড়েকুড়ে নিত, তা হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের সব দিয়ে দিতাম। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা অনেক সময় নিয়েছিল, রসিকতা করে আমারই পয়সা দিয়ে ‘টস’ করল, তারা আমাকে দেখাল তাদের আত্মবিশ্বাস কত প্রবল, কত সহজে ঠান্ডা মাথায় তারা দুঃসাহসিক সব কাজ করতে পারে। আর সেটা লক্ষ করেই আমার স্বভাবের নিয়মটা বোধ হয় হঠাৎ পালটে গেল। এ-রকম মাঝে মাঝে হয় যে, খুব সাধারণ দুর্বল মানুষও কোনও দুঃসাহসিক কাজ দেখলে অনুরূপ কাজ করতে উৎসাহ বোধ করে। আমার বিশ্বাস, খুব সাধু সৎ প্রকৃতির কোনও লোকও যদি চোখের সামনে একটা দুঃসাহসিক খুন, ডাকাতি কিংবা গুন্ডামি দেখে তবে তার মনের গভীরে কোথাও-না-কোথাও ওইরকম একটা কিছু করার ইচ্ছে জেগে উঠবে। এটা মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা। কিন্তু সাধারণ মানুষের ইচ্ছে হলেও তারা সব করে না। তারা বিবেকানন্দের জীবনী পড়ে, বড় খেলোয়াড়ের খেলা দেখে, বড় গুড়ার গুন্ডামির খবর শোনে, বলাৎকার বা ধর্ষণের খবর পড়ে পত্রিকায়। তবু অধিকাংশ মানুষই মহাপুরুষ কিংবা খেলোয়াড়, গুন্ডা কিংবা ধর্ষণকারী হয় না। কিন্তু তাদের মনের মধ্যে সব ইচ্ছাই পাশাপাশি থেকে যায়। কিন্তু তারা স্বভাবের নিয়ম বড় একটা ভাঙে না, সাধারণ নিরীহ জীবন যাপন করে যায়। তারা যে মহাপুরুষের মতো ত্যাগী জ্ঞানী মানবপ্রেমিক হয় না, খেলোয়াড়ের মতো কুশলী হয় না, অসৎ গুন্ডার মতো নৃশংস হয় না, কিংবা ধর্ষণ বা বলাৎকারের গুপ্ত উত্তেজনা উপভোগ করে না। তার কারণ, তারা জানে যে, ও-রকম কিছু হতে গেলে বা করতে গেলে প্রকৃতি এবং নিয়তি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। আমাকে সেই রাত্রে যারা ছিনতাই করছিল তাদের দুঃসাহস এবং আত্মপ্রত্যয় দেখে অনুরূপ দুঃসাহস এবং আত্মপ্রত্যয় দেখানোর ইচ্ছেটা হয়তো স্বাভাবিক হত। কিন্তু আমি তাদের হাতে আমার মানিব্যাগ বা ঘড়ি দিলাম না। আমি তাদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য তাদের পিছনে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে বললাম, পুলিশের গাড়ি! তারা চমকে পিছু ফিরে চাইল। আমি দৌড় দিলাম। আর দৌড়োতে দৌড়োতে আমি একটা তীব্র উত্তেজনা এবং আনন্দ বোধ করছিলাম। ও-রকম আনন্দ আর উত্তেজনা আমি কখনও বোধ করিনি, আমার দর্শন কিংবা কবিতার বইয়ে এতকাল ধরে আমি যা আনন্দ পেয়েছি, এ আনন্দ তার চেয়ে অনেক বেশি। আমার মনে হল জীবনে এই প্রথম আমি একটা কিছু করছি, একটা অসাধারণ কিছু। আমি একদম দৌড়োতে জানি না, কখনও দৌড়েইনি, খানিকটা ছুটেই আমার হাঁফ ধরে গেল, তবু আমি দাঁতে ঠোঁট চেপে হাসছিলাম, এবং নিজের এই ব্যবহারে আমি অবাকও হচ্ছিলাম খুব। সেই লোক দুটো বোধ হয় আমাকে চিনত। তাদের ধারণা ছিল আমাকে লুট করা খুবই সহজ ব্যাপার হবে, তাই তারা লুটের আগে আমার সঙ্গে রসিকতা করেছিল। কিন্তু আমি তাদের ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছি দেখেই তারা হয়তো খুব রেগে গেল। সেটাও খুবই স্বাভাবিক। যার ওপর আধিপত্য করা সহজ, তুমি যদি দেখো যে, সে তোমার বশ মানছে না, তবে তুমি রেগে যাবে না? কাজেই স্বাভাবিক কারণেই তারা রেগে গেল। কারণ, আমি পোকামাকড়ের মতো তুচ্ছ একটা লোক তাদের সঙ্গে টক্কর দিয়েছি। তাদের প্রেস্টিজে লেগেছিল। কিন্তু তারা সোজাসুজি আমার পিছু নিল না। সম্ভবত তারা আমার ঘর চিনত। কারণ, আমি খানিকটা ছুটে, খানিকটা জোরে হেঁটে যখন ঘরের দরজায় পৌঁছলাম তখন দেখি আমার দরজার বাইরে দু’ধারে তারা দুজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। শান্তভাবে। বোধ হয় তারা কোনও শর্টকাট রাস্তায় এসেছিল, যা আমি জানি না। তাদের একজনের হাতে একটা সাইকেলের চেন, অন্যজনের হাতে লোহার উকো। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, আমার আর দৌড়োবার ক্ষমতা ছিল না। তারা দু’জন চটপটে পায়ে এসে আমার দু’দিকে দাঁড়াল, ধরে নিয়ে গিয়ে বলল, দরজা খোলো। আমি তালা খুলে ভিতরে ঢুকতে তারাও ঢুকল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তখনও স্বভাবের নিয়মে আমি তাদের ভয় পাচ্ছিলাম না। আমি তখনও তীব্র আনন্দ এবং উত্তেজনা বোধ করছিলাম। তারা দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপরেই ফাইট শুরু হয়ে গেল। আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়ে তারা ভুল করেছিল। কারণ, আমি শান্তভাবে মার খেলাম না, ঘড়ি আর মানিব্যাগও ছাড়লাম না। আমি একজনকে বই ছুড়ে মেরেছিলাম। মাটিতে পড়ে গিয়ে একজনের গোড়ালি কামড়ে দিয়েছিলাম। সারাক্ষণ আমি লড়াই করার চেষ্টা করেছিলাম বলে তারা আমাকে বেশি মেরেছিল। ওদিকে হইচই শুনে লোকজন উঠে পড়ছিল বোধ হয়, তারা অল্প সময়ে যত দূর সম্ভব আমাকে মেরে পালিয়ে গেল।
লোকটা হাসল। ফাটা ঠোঁট দিয়ে টস করে রক্তের ফোঁটা পড়ল সাদা তোয়ালেটার ওপর। তারপর লোকটা বালিশের তলা থেকে একটা কালো মানিব্যাগ আর পুরনো আমলের বড় গোল একটা হাতঘড়ি বের করে ললিতকে দেখাল, এই সেই ঘড়ি আর মানিব্যাগ। একেবারেই এলেবেলে জিনিস। পুরনো পচা ঘড়ি, ছেঁড়া মানিব্যাগে বোধ হয় গোটা তিন-চার টাকা ছিল। এর জনেই আমি এত লড়াই দিয়েছি ভেবে আমি এখন আশ্চর্য হই।
লোকটা মানিব্যাগ আর হাতঘড়িটা দু’হাতে চেপে ধরে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সযত্নে আবার বালিশের তলায় ঢুকিয়ে রেখে বলল, এই হচ্ছে ব্যাপার। খুবই সামান্য তুচ্ছ একটা ঘটনা।
লোকটা ভ্রূ কুঁচকে ভেবে বলল, দেখো, ঘটনাটা যতটা সামান্য মনে হচ্ছে, বাস্তবিক সেটা ততটা সামান্য নয়। লোক দুটো আমাকে মারবার সময়ে বলেছিল, শালা, শুয়োরের বাচ্চা, বেজন্মা, তোমার জিয়োগ্রাফি পালটে দেব। কিন্তু কার্যত আমার জিয়োগ্রাফির বদলে তারা আমার ফিলজফি পালটে দিয়ে গেছে।
লোকটা চুপ করল। ললিত কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রকম?
লোকটা তার চোখে চোখ রেখে বলল, আমি এখন আর তেমন নিরীহ শান্ত লাজুক মানুষটি নই। এই ঘরে মাঝে মাঝে একটা সাদা বেড়াল আসে, আমার চায়ের দুধ ডেকচি উলটে খেয়ে যায়। দেখতে পেলে আমি তাড়িয়ে দিই, কিন্তু আর কিছু করি না। কিন্তু পরশুদিন দুপুরবেলা বেড়ালটা আমার ঘরে ঢুকে ডেকচি খোলবার চেষ্টা করতেই আমি লাফিয়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে ওর লেজটা চেপে ধরলাম। ও পালাবার ফিকিরে জানালায় লাফিয়ে উঠেছিল, কিন্তু লেজটা আমি হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম। বেড়ালটা আমাকে ফ্যাঁস করে আঁচড়ে দিল, হাতে দাঁত বসাল, আমি ওকে তবু ছাড়লাম না, তুলে এক আছাড় দিলাম মেঝেয়। ব্যাটা ঝিম ধরে অনেকক্ষণ পড়ে থেকে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল। আর আসেনি। ও যখন আমাকে আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছিল তখনও আমি ঠিক ও-রকম একটা উত্তেজনা আর আনন্দ টের পাচ্ছিলাম। তা ছাড়া দেখো, আগে আমি যে-কোনও লোকের কাছেই চট করে বশ মেনে নিতাম, কারও সঙ্গেই কখনও গোঁয়ারতুমি করিনি। কিন্তু তোমার পাড়ার ছেলেরা এসে যখন আমার মার খাওয়ার ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল তখন আমি তাদের স্পষ্ট কিছুই বললাম না। তারা আমাকে ব্যাপারটা খোলসা করে বলার জন্য অনেক ভয় দেখিয়েছে, আবার অভয়ও দিয়েছে, বলেছে আমার হয়ে তারা শোধ নেবে। এ-সব ছেলেদের আমি চিরকালই ভয় পাই, কারণ বরাবর রাস্তায় ছেলেরা আমাকে খ্যাপায়, টিটকিরি দেয়। কিন্তু এবার আমি আমার জেদ বজায় রাখলাম, তাদের কিছুই বললাম না। তারা বলল, আমার কাছে প্রায়ই একটা মেয়ে আসে বইখাতা নিয়ে, এ-ব্যাপারটার সঙ্গে সেই মেয়েটার কোনও যোগাযোগ আছে কি না। আমি তাদের কোনও উত্তর দিলাম না। যদিও জানি যে, পাড়ার ছেলেরা সেই মেয়েটার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে একটা কেচ্ছা রটিয়ে দিতে পারে।
মেয়েটা কে? ললিত নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।
সেটা আর-একদিন বলা যাবে। বলে ক্লান্তিতে লোকটা চোখ বুজল। বলল, আমি অনেকক্ষণ কথা বলেছি। আমার মাথার মধ্যে কুয়াশা জমছে।
ললিত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি তোমার কাছে পরে আসব। আজ তুমি ঘুমোও।
লোকটা হেসে বলল, আমার হিরো।
বলে চোখ বুজল।
ললিত দরজার কাছ থেকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি খাও কোথায়?
লোকটা চোখ খুলে তাকে দেখল। বলল, নিজে রান্না করি।
ললিত বলল, এখন কে তোমাকে রান্না করে দেয়?
লোকটা মাথা নাড়ে, কেউ না। পাড়ার একটা বাচ্চা-টাচ্চাকে ধরে পাউরুটি নিয়ে দুধ বা চা দিয়ে খেয়ে নিই। কখনও কষ্টেসৃষ্টে সেদ্ধভাত করে নিই।
ললিতের দয়া হচ্ছিল। বলল, কিছু মনে কোরো না, কয়েক দিন আমার বাসায় খাও। আমি তোমার খাবার পাঠিয়ে দেব।
দেবে?
লোকটার চোখমুখ হঠাৎ খুব উজ্জ্বল দেখাল। মাথা নেড়ে বলল, তুমি আমাকে নিমন্ত্রণ করছ?
করছি। ললিত হাসল।
লোকটা খুশি হয়ে বলে, আমি বহুকাল নিমন্ত্রণ খাইনি। ভাল খাবার কাকে বলে জানিই না। তুমি পাঠিয়ে দিয়ে। একটু ভাল হলে আমি নিজেই যাব তোমাদের বাসায়, মাঝে মাঝে খেয়ে আসব।
লোকটা চুপচাপ একটু ললিতের মুখখানা দেখল। বলল, তোমার মা খুব ভাল রাঁধেন, না? আমার খুব পোস্তর বড়া, কচুর শাক আর লাউঘণ্ট খেতে ইচ্ছে করে, তোমার মাকে এ-কথা বোলো।
ললিত হেসে ঘাড় নাড়ল। বলবে। তারপর বলল, তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠো।
লোকটা হাসে, আমি অনেক দিন ধরে তো ভালই ছিলাম। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ভাল থাকাটা ভীষণ একঘেয়ে।
ললিত কথাটা ঠিক বুঝল না। বাইরে বেরিয়ে ফাঁকা রাস্তাঘাট দেখে আর দূরে কুকুরের ডাক শুনে ললিত বুঝল রাত অনেক হয়েছে। হাতে ঘড়ি ছিল না, আন্দাজ করল, বারোটার কাছাকাছি।
মিত্রদের বাড়ির সামনে অশ্বথ গাছটার তলায় গাঢ় ছায়া জমে আছে। সেই ছায়ার মধ্যে পা দিয়ে আপন মনে বিষগ্ন একটু হাসল ললিত। পাড়ার বুড়িদের মধ্যমণি বলে মাকে সে মাঝে মাঝে বলে, হিরোবুড়ি। কিন্তু সে যে কখনও হিরো ছিল কারও, তা ললিত টের পায়নি। সত্য বটে কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে সে ইউনিয়ন করেছে, ভোটে নেমেছে, বক্তৃতা করেছে, কলেজের ফাংশনে হয়তো কথা বলেছে, কলকাতার মেয়র কিংবা বিখ্যাত কোনও সুন্দরী গায়িকার সঙ্গে। কিন্তু সে-সব স্পষ্ট মনে নেই তার, সে-সব নিয়ে গৌরব করার মতোও কিছু ছিল না। অথচ সেইসব কলেজি হইচই ছেলেমানুষির মধ্যেও সে ছিল একটি দুঃখী ছেলের হিরো। তার শরীর একটা অচেনা আনলে শিউরে উঠল।
অথচ ভেবে দেখল বিমান রক্ষিতের চোখে তাকে যা দেখিয়েছিল তা আসলে সত্য ছিল না। ললিতেরও ছিল নানা দুর্বলতা, ক্ষোভ, লজ্জা। বিমান জানে না, লাজুক ললিত মিতু নামে একটি মেয়ের সঙ্গে দুর্বলতাবশত কোনও দিন কথাই বলতে পারেনি। একবার ছাত্র আন্দোলনের সময়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে বিকেলের দিকে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। গলিঘুঁজি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল ললিত, ওয়েলেসলি স্ট্রিটে একজন সার্জেন্ট তার কনুই চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল সে কোথায় যাচ্ছে। ললিত কেবল বোকার মতো বলেছিল, বাড়ি। সার্জেন্টটা তার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করায় সে এত ঘাবড়ে গিয়েছিল যে কিছুতেই তার বাড়িটা কোথায় তা মনে করতে পারেনি। অনির্দিষ্টভাবে হাত তুলে বোধহয় ময়দানের দিকটা দেখিয়েই সে বলেছিল, ওই দিকে। তার অবস্থা দেখে করুণা করেই সার্জেন্টটা সেদিন ছেড়ে দিয়েছিল তাকে। বলেছিল, সাবধানে যাবেন, নিজের বাড়িটা ভুল করবেন না। সেই ঘটনার লজ্জা এখন খুব ক্ষীণ হয়ে এলেও ললিতের মনের মধ্যে রয়ে গেছে। কিছুই ভোলেনি ললিত। কিছু দিন আগে, বোধ হয় বছরখানেক হবে, সে একবার পিসিমার সঙ্গে তাদের এক দূর সম্পর্কের বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল পিসিমার বাড়ির জন্য সরকারি ঋণের তদবির করতে। সেখানে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, ড্রইং রুমে ছোট্ট মদের ‘বার’, শেকলে ঝোলানো ঝাড়লণ্ঠনের মতো মস্ত কাচের বাতিদান দেখেছিল ললিত, আর দেখেছিল একটি মেয়েকে, যার গায়ের রং নতুন তামার পয়সার মতো উজ্জ্বল এবং আলো বিকিরণকারী, সে কৌতূহলী চোখে অনেকক্ষণ দেখেছিল ললিতকে। সেই আত্মীয় ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন সে কী করে। প্রশ্নটা শুনে ললিত খুব দুর্বল আর অসহায় বোধ করেছিল। তার চোখের সামনে তখন ওই বিপুল সাদা শ্বেতপাথরের সিঁড়ি। অদ্ভুত বাতিদান, ছোট্ট মদের ‘বার’-এর কাচগুলি ঝিকমিকিয়ে উঠছে, আর ওই সুন্দরী কিশোরীর কৌতুহলী চোখের মাঝখানে বোকার মতো বসে থেকে তার মুখে আনতে খুবই লজ্জা করছিল যে সে মাস্টারির চাকরি করে, আড়াইশো টাকারও কম বেতন পায়। এতকাল ধরে বড়লোকদের সম্পর্কে তার যে আক্রোশ আর ঘেন্না ছিল তা কোথায় উবে গিয়েছিল তখন! প্রকাণ্ড সোফায় বসে সেই বিপুল ঘরখানাকে চারিদিকে টের পেয়ে তার মনে তীব্র ভয় আর আত্মগ্লানি দেখা দিয়েছিল। নিজের হতশ্রী এবং দারিদ্র্যকে সে কখনও আর এমনভাবে টের পায়নি। তার ইচ্ছে হয়েছিল তখনই উঠে পালিয়ে চলে যায়। সম্ভবত পিসিমাও ভেবেছিল যে অত বড়লোকের কাছে তার মাস্টারির চাকরিটার কথা বলা উচিত হবে না। তাই কৌশলে পিসিমা তার হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ও এখন এম এ পাশ করে রিসার্চ করছে। আশ্চর্য এই যে, পিসিমার উত্তর শুনে এক রকমের স্বস্তি পেয়েছিল সে।
এ-সবের কিছু বিমান জানে না। কিন্তু ললিত জানে যে সে হিরো নয়। কোনওকালে ছিলও না। বিমান একটা ভুল ছবি টাঙিয়ে রেখেছিল চোখের সামনে। ভাবতে ভাবতে ললিত শ্বাসকষ্টের মতো একটা বুক চেপে-ধরা দুঃখকে টের পাচ্ছিল। এইরকম ছোটখাটো ভুলের ওপর, মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা নড়বড়ে সে। ভুল ললিতকেই চিনছে সবাই। সেও নিরীক্ষণ করছে এক ভুল নিজেকে। এখন একবার মৃত্যুর আগে সঠিক ললিতকে তার চিনে নেওয়া দরকার।
একা ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে তার চটির ক্ষীণ দুর্বল শব্দ শুনতে পাচ্ছিল, সুস্থ সবল মানুষের পায়ের শব্দ যেমন হয়, তারটা তেমন নয়। এত মৃদু শব্দ যে মনে হয়, আর কয়েক পা গেলেই শব্দটা মিলিয়ে যাবে।
ঘরে এসে ললিত দেখল, মা মেঝেয় শতরঞ্জি পেতে হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে তখনও। চেয়ারে বসতে গিয়ে সে লক্ষ করল বাবার ছবির আড়াল থেকে টিকটিকিটা মুখ বাড়িয়ে তাকে দেখছে। ললিত ম্লান হেসে মৃদু স্বরে বলল, কার জন্য জেগে আছ, টিকটিকি-মা? কোনজন বাড়ি ফেরেনি তোমার—ছেলে, না কর্তা?
চেয়ার টানার শব্দে মা ঘুম ভেঙে বলল, কে রে! ললিত!
হুঁ।
কোথায় যে যাস! বলে মা উঠে বসল, অরুণ এসেছিল।
কে অরুণ!
ওমা! অরুণ তোর পিসির ছেলে। কাল একবার ওদের বাসায় যাস, যদি পারিস। বার বার যেতে বলে গেছে।
আচ্ছা।
শোয়ার ঘরেই মা ভাতের হাঁড়ি-টাড়ি এনে রেখেছে। এখন উঠে ভাত বাড়তে বসে বলল, ক’টা বাজে দেখ তো?
ললিত ঘড়ি দেখে বলল, পৌনে বারোটা।
ইস! কত রাত হয়েছে…
খাওয়ার পর রোজই মায়ে-পোয়ে একটু গল্প হয়।
খাওয়ার পর ললিত অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। মা তখন নিজের বিছানায় অন্ধকারে বসে আঙুলে চুলের জট ছাড়াচ্ছে। বলল, আত্মীয়-স্বজনদের একটু খোঁজখবর করিস। নইলে আমি মরে যাওয়ার পর কেউ তোকে চিনবেই না। দেখলেও ভাববে, কে না কে!
ললিত হেসে বলল, কে কোথায় থাকে মা!
মা বলল, কেন, কাঁচড়াপাড়ায় তোর ফুলমাসি থাকে, রাঙাকাকা থাকে মাজদিয়া, ইছাপুরে সোনাভাই, হাবড়ায় থাকে নসু ঠাকুরপো…
জটিল সব সম্পর্ক। অচেনা সব মানুষ। শুনতে শুনতে ললিত ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত বারোটাতেও তুলসী আর সঞ্জয়ের ছাড়াছাড়ি হয়নি। ললিতের বাসা থেকে গাড়ি ছাড়ল সঞ্জয়। চলল, সোজা এসপ্ল্যানেডের দিকে। তখন আটটা বেজে গেছে।
তুলসী বলল, কোথায় যাচ্ছিস! আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যা।
সঞ্জয় হাসল, দুনিয়াটাই তো বাসা রে। সেই বাসাটা দেখে নে।
তারপর সোজা গাড়ি চালিয়ে এসে থামল এসপ্ল্যানেডের একটা নিরিবিলি, শান্ত বার-এর সামনে। দরজা খুলে বলল, নাম শালা।
তুলসী ইতস্তত করে বলল, গোলমাল হয়ে যাবে মাইরি।
কেন, বউ গন্ধ পাবে? বলে হাসল সঞ্জয়, বেশি সাধুগিরি দেখাবি তো বউ হাওয়া হয়ে যাবে, দেখিস। রমেনটার তাই হয়েছিল।
তুলসী অস্বস্তিতে হাসল। তারপর নামল। বলল, অনেককাল অভ্যাস নেই।
ইস! শালা যেন কত খেয়েছে!
রাত দশটায় যখন বার-এর মদ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল তখন তুলসী অনেকটা মাতাল। সঞ্জয় বলল, আর খাবি তুলসী?
তুলসী মাথা নাড়ল, খাবে। তার দু’চোখ দিয়ে তখন অঝোরে জল পড়ছে। কাঁদছিল সে।
সঞ্জয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল। এখানে বন্ধ হয়ে গেছে। সাকী কিংবা গ্র্যান্ডে যাই।
গ্র্যান্ড। মৃদু আলো, বাজনা, ছড়ানো প্রকান্ড রেস্টুরেন্ট। দেখে হু হু করে উঠল তুলসীর বুক। কে বলবে বাংলাদেশ এটা! কে বলবে! কে বলবে যে সে সেই তুলসী যে মফস্সলের মাস্টার, স্টেশন থেকে মাইলটাক আলপথ তাকে ধুতি হাঁটুর ওপর তুলে হাঁটতে হয়। সেখানকার স্কুলে আদ্যিকালের বুড়ো বি এ, বি এস সি আধামূর্খ গ্রাম্য একদল লোকের সঙ্গে কাজ করতে হয়! সেখানে মাঠে-ঘাটে বিষধর সাপ, জলেজঙ্গলে রহস্যময় পোকামাকড়। না, এটা মোটে বাংলাদেশই নয়। এই তো নিউ-ইয়র্ক! ইজ নট ইট? সে আপন মনে হাসল। ইট ইজ লন্ডন পারহ্যাপস? হ্যাঁ, লন্ডন। বসন্তকাল।
চেয়ারে বসে সে সঞ্জয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে আবার কেঁদে ফেলল, মাইরি, ললিতটার জন্য কষ্ট হচ্ছে।
সঞ্জয় তার কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল, স্টেডি!
চারধারে একবার বোকা চোখে চেয়ে দেখল তুলসী, তারপর বলল, আমার লাইফ-এ মাইরি কী আছে বল তো! অ্যাঁ!
তারপর আবার কাঁদতে লাগল। চেয়ে দেখল তার অদুরে বসে আছে চারজন জাহাজি লোক, হাতে উল্কি, মুখে সমুদ্রের জলবায়ুর কর্কশ ছাপ। তাদের চওড়া কাঁধ, চওড়া কবজি, তারা বিদেশি ভাষায় কথা বলছে। কিছু দিনের মধ্যেই তাদের জাহাজ ছেড়ে যাবে, দূর থেকে কত দূরে চলে যাবে তারা। তখনও আমি হাঁটুর ওপর ধুতি তুলে…আলপথে! তুলসী কাঁদতে থাকে। মদ খায়। কাঁদে।
কী হচ্ছে? সঞ্জয় ধমক দেয়।
আমার লাইফ-এ কী আছে বল তো? অ্যাঁ!
বউ! তোর বউ আছে। সঞ্জয় সান্ত্বনা দেয়।
তুলসী দেখে জলপাই রঙের সুট পরা একটা বিদেশি লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। কোন দেশি লোক ও? স্পেন? অ্যাঁ! ইয়েস, স্পেন। বুলফাইট। ও লোকটা বুলফাইটার। একজন নিগ্রোর মুখ নজরে পড়ে তুলসীর। লোকটার মোটা ঠোঁট উলটে দিল— ঝকঝকে ধারালো দাঁত দেখা যায়। বক্সার! হ্যাঁ, লোকটা বক্সার। ক্যাসিয়াস ক্লে! না, প্যাটারসন?
নিউ ইয়র্ক! দিস ইজ নিউ ইয়র্ক। তুলসী বিড় বিড় করে।
হঠাৎ সে শুনতে পেল ‘কঁ কঁ’ করে কর্ক খোলার একটা শব্দ। সে চমকে উঠল। শব্দটা সে কোথায় শুনেছে! শব্দটা চেনা। খুব চেনা। আবার সেই ‘কঁ কঁ’ শব্দটা শুনল তুলসী। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর নিচু হয়ে টেবিলের তলাটা দেখল।
কী খুঁজছিস? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করে।
সাপটাকে।
সাপ?
হ্যাঁ, মাইরি এখানেই আছে। শালা ব্যাঙ ধরেছে।
চারদিকে আর-একবার তাকিয়ে তারপর সতর্কভাবে উঠে দাঁড়ায় তুলসী। হাত উঁচু করে সবাইকে সাবধান করে দেয়। স্টপ! অল স্টপ! দেয়ার ইজ এ স্নেক হিয়ার…
সঞ্জয় তার হাত টেনে বসিয়ে দেয়।
তুলসী নীরবে কাঁদতে থাকে।
রাত সাড়ে বারোটায় যখন বাসায় ফিরল তুলসী তখন সিঁড়ির দরজায় ভিড় করে দাদা বউদি মৃদুলা দাঁড়িয়ে আছে। তুলসী ভ্যাবলা চোখে তাকিয়ে দেখল। অসহায়ভাবে। বউদি এগিয়ে এসে ধরল তাকে। মৃদুলা মুখ ফিরিয়ে নিল, দাদা আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেল।
ডু ইউ হেট মি? সে মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করল। তারপর বুঝদারের মতো হাসল সে, ইউ হেট মি। আই নো!
বউদি ঘরে পৌঁছে দিল তাকে। মৃদুলাকেও ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে দরজা টেনে বাইরে থেকে বলল, দরজাটা বন্ধ করে দাও।
মৃদুলা দরজা বন্ধ করতেই খুব হাসল তুলসী। তারপর হঠাৎ বলল, আমার একটা কথা রাখবে?
মৃদুলা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, কী?
তুলসী বলে, মনে করো এটা একটা রাস্তা, তুমি একটা অচেনা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছ, আর আমি একটা রকবাজ মাস্তান ছেলে। তুমি হাঁটো…হেঁটে যাও…যেন আমাকে চেনো না…হাঁটো…
ভয় পেয়ে কয়েক পা হাঁটে মৃদুলা। তুলসী মুখের মধ্যে আঙুল পুরে তীব্র সিটি বাজিয়ে দেয়। চমকে ওঠে মৃদুলা। তুলসী হাসে, মাইরি, আমি কখনও রকবাজি করিনি, মাস্তানি করিনি। সঞ্জয়ের কাছে সিটি দেওয়া শিখেছিলাম, কোনও কাজে লাগেনি। লাইফে আমি একটা মেয়েকেও টিজ করতে পারিনি…বিশ্বাস করো…
তুলসীর চোখে জল এসে যায়। তারপর বলে, এবার তুমি একটা অচেনা মেয়ে—তোমাকে আমি সিটি দিয়েছি…তুমি দাঁড়িয়ে পড়ো—ঘুরে এসে আমাকে একটা চড় মারো, কিংবা চটিজুতো…কিছু একটা করো…বিট মি…আমাকে ছেড়ে দিয়ো না…আমি রকবাজ মাস্তান নোংরা, মাইরি মৃদুল, আমাকে ছেড়ে দিয়ো না…
তুলসী কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।
শোয়ার আগে সঞ্জয় বুকে-পিঠে পাউডার ছড়াচ্ছিল। আয়নায় গলা উঁচু করে কী একটু গলার কাছে আঙুল দিয়ে টিপে দেখল সে। তারপর রিনির দিকে ফিরে বলল, গলায় একটা লাম্প টের পাচ্ছি যেন!
কীসের লাম্প?
সঞ্জয় ঠোঁট ওলটায়, কী জানি!
তারপর আবার জায়গাটাকে টিপে দেখে। মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে যায়। লাইট নিবিয়ে বিছানায় আসতে আসতে বলে, বড় ভয় করে বুঝেছ! এখন কাজকর্ম সদ্য জমিয়ে তুলেছি…
তাতে কী হল?
কিছু না। সঞ্জয় একটু হাসে, মাঝে মাঝে হঠাৎ বড় ভয় করে আজকাল। ক্যান্সার-ফ্যান্সার যদি হয়…
দূর! অলক্ষুণে কথা!
রিনি তাকে আলতো জড়িয়ে ধরে।
তখন বহু দূরের একটা গ্রামে জাতীয় সড়কের পাশে একটা সাপের মৃতদেহকে ঘিরে পরিশ্রমী সঞ্চয়ী পিঁপড়েদের ভিড়। ললিতের বাবার ছবির পিছনে গর্ভযন্ত্রণায় অস্থির একটা টিকটিকি ডেকে উঠল।
এগারো
ললিতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দু’জনে অনেকক্ষণ চুপচাপ হেঁটেছিল। আদিত্য আর শাশ্বতী। বড় রাস্তার কাছে এসে আদিত্য হঠাৎ আপন মনে হেসে বলল, এই হচ্ছে ললিত, বুঝলে সতী, এই হচ্ছে ললিত!
শাশ্বতী বুঝল, আদিত্য কোনও গভীর ভাবনার মধ্যে আছে। হয়তো কলেজ-জীবনের স্মৃতি কিংবা অন্য অনেক তুচ্ছ সুন্দর সব ঘটনার কথা। ‘এই হচ্ছে ললিত’ এই কথাটা দিয়ে শাশ্বতীকে কিছুই বোঝাতে চায়নি আদিত্য, সে নিজের মনেই ললিতের ছবি দেখছে, আর মনের সেই ছবিটাকেই দেখাতে চাইছে শাশ্বতীকে। শাশ্বতী লক্ষ করল, আদিত্যর চোখ অন্যমনস্ক। ট্রামলাইন পেরোবার আগে হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে ফিরে দাঁড়াল, আমার সিগারেট!
বিপজ্জনক রাস্তার মাঝখান থেকে শাশ্বতী তার জামার হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনল। হাসল আদিত্য।
রাস্তা পেরিয়ে আদিত্য বলল, আমার সিগারেটের প্যাকেটটা বোধ হয় চায়ের দোকানেই ফেলে এসেছি। নিয়ে আসব? তুমি একটু দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসি…
শাশ্বতী ভ্ৰূ কোঁচকায়, ক’টা সিগারেট ছিল প্যাকেটে?
গোটা চার-পাঁচ হবে বোধ হয়।
দূর! ওর জন্য এতটা রাস্তা যাবে! বরং এক প্যাকেট কিনে নাও।
নেব?
নাও।
আদিত্য সিগারেট কিনতে গেল কয়েক পা দূরের দোকানটায়। শাশ্বতী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল আদিত্য দোকানের আয়নায় মুখ দেখছে। চোখের কোল টেনে ধরে দেখল চোখের রং, গালের একটা ব্রণ টিপল একটু, মুখটা সামান্য বেঁকিয়ে বোধ হয় নিজেকে ভেঙাল, ধৈর্যশীল দোকানদারটি ততক্ষণ সিগারেটের প্যাকেটটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে রইল। আদিত্য হাসল একটু, তারপর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে হাত নেড়ে কী কথা বলতে লাগল দোকানির সঙ্গে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে প্যাকেট খুলল, সিগারেট বের করে দড়ির আগুনে ধরিয়ে নিল। এবং এতক্ষণ সময় সে একবারও শাশ্বতীর দিকে ফিরে তাকাল না। যেন তার সঙ্গে যে শাশ্বতী আছে এ কথা সে ভুলেই গেছে। শাশ্বতীর মনে হয় এখন যদি সে চুপে চুপে ট্রামে উঠে সরে পড়ে তা হলেও আদিত্য হয়তো ব্যাপারটা ঠিক খেয়াল করবে না। অন্যমনস্কভাবে এসে পরের ট্রামে উঠে কোথাও চলে যাবে। অনেকক্ষণ পরে হয়তো খেয়াল হবে তার যে শাশ্বতী তার সঙ্গে ছিল। তখন যে-অবস্থায় থাক লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠে ট্রাম বাস বা ট্যাক্সি ধরে শাশ্বতীর খোঁজ নিতে ছুটবে। একদিন তারা দু’জনে সিনেমা ‘হল’ থেকে দুপুরের শো দেখে বেরিয়ে ভিড়ের মধ্যে আলাদা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ভিড়ের মধ্যেও লম্বা আদিত্যকে দেখতে পাচ্ছিল শাশ্বতী। আদিত্য এক বারও মুখ ফিরিয়ে তাকে খুঁজল না। সোজা এগিয়ে গেল রাস্তায়, ভিড়ের জন্য আস্তে যাচ্ছিল একটা বাস, সোজা তার পাদানিতে উঠে গেল। ব্যাপারটা কী হল বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল শাশ্বতীর। তারপর সারা বিকেল আর সন্ধে শাশ্বতীর কেবল কান্না পেয়েছিল বারবার। রাত আটটা নাগাদ তাদের বাড়িতে এসে আদিত্য হাজির। খুব অনুতপ্ত তার চোখমুখ। তাকে আড়ালে ডেকে বলল, ছিঃ ছিঃ…আমার কী যে হয়েছিল…ইস…মাইরি, আমি একটা পাগল! আসলে..বুঝলে সতী, ছবিটা ছিল ভীষণ অ্যাবজরবিং, আমি ওই ছবিটার কথা ভাবতে ভাবতেই কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম…মাইরি দেখো, ভুলের জন্য হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে রেখেছি…পানিশমেন্ট…আর ভুল হবে না। শাশ্বতী দেখেছিল আদিত্যর বাঁ হাতে উলটো পিঠে সদ্য-পড়া একটা ফোস্কা, তখনও চারধারটার চামড়া লালচে হয়ে আছে। আদিত্যর অনুতাপে কোনও ভান ছিল না, শাশ্বতী জানে। এখন তার কেবল এইটুকুই মনে হয় যে, সে এমন একটা লোককে আঁচলে বাঁধছে যে-লোকটা খানিকটা পাগল-খ্যাপা, খানিকটা উদাসীন, যার মধ্যে ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ভালবাসার বোধ অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। এখন একটু দূর থেকে আদিত্যকে দেখছিল শাশ্বতী। লম্বা ঢ্যাঙা রোগা ফরসা একটা লোক এলোমেলো এক ঝাঁকড়া চুল মাথায়, শার্টের ভাঁজ ঠিক নেই— দেখলেই বোঝা যায় বড় অস্থির স্বভাবের লোক। অত্যধিক কথা বলে আদিত্য, কথা বলার সময়ে তার চোখ নাচে, মুখের চামড়া কাঁপে, হাত-পা নড়ে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না যে, বাগবাজারে সাত-আট কিংবা দশ পুরুষের প্রকাণ্ড একখানা দেড় বিঘার বাড়িতে সে থাকে— যেখানে শ্বেতপাথরের মেঝে, আর ঝাড়লণ্ঠন রয়েছে। আদিত্যর মুখেই শুনেছে শাশ্বতী যে, যদিও বাড়িটা শরিকে শরিকে কিছুটা ভাগ হয়ে গেছে, তবু আদিত্যরা এখনও দুটো মহল নিয়ে থাকে, যে-মহলে এখনও চোরা গুপ্ত-কুঠুরি আছে। আর আছে মাটির নীচে ঘর, সে-ঘরের কোনওটায় থাকে নগদ টাকা আর গয়না, কোনওটায় বেলেমাটির প্রকাণ্ড জালায় রাখা হয় গ্রীষ্মকালের ঠান্ডা জল, কোনও কোনও ঘর আছে যা এক সময়ে ছিল এ-মহলের ও-মহলের মধ্যে সুড়ঙ্গ-পথ। ভাবলেই ভয় করে শাশ্বতীর। ওই বাড়ির মধ্যে যদি কোনও দিন তাকে বউ হয়ে যেতে হয় (যদিও শাশ্বতীর সন্দেহ আছে, তাকে কোনও দিন আদিত্যর মা-বাবা বাড়ির বউ হিসেবে নেবে কি না!) তা হলে কত রকমের ভয়-ভাবনার মধ্যে গিয়ে পড়বে সে! সে সে-বাড়ির আচার-ব্যবহার-সহবত জানে না, সঠিক ভাষা কিংবা সভ্যতা জানে না, ওখানে চোরা গুপ্ত সব কুঠুরির মধ্যে প্রাচীন প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়ায়, কাঁকড়াবছে লুকিয়ে থাকে, রাত্রিবেলা ডেকে ওঠে তক্ষক, সেখানে শ্যাওলা-ধরা ছাদের ফাটল দিয়ে গজিয়ে উঠছে অশ্বত্থ গাছ। কত দূরে কোন অচেনা রাজ্যে চলে যেতে হবে তাকে। যদিও বাইরে থেকে অনেকটা জমিদারের মতোই দেখায় আদিত্যদের, কিন্তু আসলে তারা জমিদার নয়। কোনওকালে ছিলও না। তাদের বংশ বেনের। চিরকাল তারা ব্যবসা করেই এসেছে। কখনও বা তাদের ব্যবসা লোহার, কখনও তেজারতির। তাদের প্রজা নেই, গ্রামে সম্পত্তি নেই। আদিত্যদের ধারণা জমিদারদের তুলনায় তারা অনেক সৎ, অনেক কম অহংকারী। আমরা কখনও প্রজার রক্ত শুষে খাইনি, বুঝেছ, সতী! আদিত্য বলে, মানুষের মাথায় পা রেখে চলিনি আমরা, প্রজার সেলাম নিইনি। আমার বাবা চিরকাল খদ্দেরদের ‘বাবু’ বলে ডেকেছে। অমুকবাবু-তমুকবাবু নয়, শুধু ‘বাবু’। উঁচুদরের খদ্দেরকে বলেছে ‘হুজুর’। বলতে বলতে হাসে আদিত্য, আমরা বিনয়ী লোক। আর রমেনটা ছিল জমিদার। পূর্ব বাংলায় কোথায় কোন ময়মনসিংহে জমিদারি ছিল ব্যাটার, চিরকাল সেই জমিদারির দাপট খাটিয়ে গেছে। পাটিশানের পরে কলকাতাতেও দেখেছি ওর সব আগেকার প্রজাদের। একবার বাসে ওকে দেখে একটা বেশ ভদ্র চেহারার লোক তাড়াহুড়ো করে সিট ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, বসুন, ছোটবাবু, বসুন। বলেই সিটটা হাত দিয়ে একটু ঝেড়েও দিল। অথচ তখন আর লোকটা রমেনদের প্রজা নয়, রমেনও নয় আর জমিদার। তবু তখনও প্রজা-জমিদার স্বত্বের সম্পর্কটা রয়ে গেছে। না, আমরা ও-রকম নই, মানুষের আত্মা আমরা কিনে নিইনি। আমরা লাভ করেছি, এই পর্যন্ত, ব্যস! শাশ্বতী ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি তোমার বাবার খদ্দেরদের কী বলে ডাকো? বাবু? আদিত্য লজ্জা পেয়ে ঠোঁট উলটেছে, দূর! তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কই নেই। শাশ্বতী হাসে, লুকোচ্ছ কেন? বলো না! আদিত্য হাসে, বললে তুমি আর আমাকে ভালবাসবে না। বাঙালি মেয়েরা ভীষণ অহংকারী। তবু শেষ পর্যন্ত আদিত্য কিছুই লুকোতে পারে না, বলে দেয়। লাজুক হেসে বলেছে, ছেলেবেলায় আমিও খদ্দেরদের ‘বাবু’ বলে ডাকতুম। ব্যাপারটা যে অস্বাভাবিক তা বুঝতে পারতুম না। কলেজে ললিত রমেনদের পাল্লায় পড়ে আমার প্রথম লজ্জা হল। যখন আমি আমাদের খদ্দের দেখলে সম্মান করি, ‘বাবু’ ডাকি, তখন ও-দিকে রামেনকে দেখে বাসের সিট ছেড়ে দেয় ওর প্রজা। দেখেশুনে ঠিক করলুম আমি ব্যবসায় আর নেই। চাকরি করব। দেখো, তাই করছি। এখন আর বাবার খদ্দেরদের আমি চিনিই না। শাশ্বতী হাসে, এ মাঃ, তুমি কাউকে কোনও দিন ‘বাবু’ ডেকেছ ভাবতেই পারি না। আদিত্য মাথা নাড়ে, এখন আমি দুটোই অপছন্দ করি। কেউ আমাকে ‘বাবু’ ডাকুক, সেটাও। কাউকে আমি বাবু’ ডাকি, সেটাও। স্বার্থই মানুষকে ও-রকম ডাকায়। স্বার্থই মানুষকে ছোট কিংবা বড় করে দেখায়। নইলে দেখো রমেন আর আমি একবয়সি, একই ক্লাসে পড়তুম, তবু অনেক দিন পর্যন্ত রমেনকে আমার হিংসে হয়েছে। অথচ হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। রমেনটা চমৎকার দৌড়োত, ভাল ফুটবল খেলত, গান গাইত, লম্বা চওড়া চেহারা ছিল, নায়কের মতো মুখশ্রী। সে-সব কিছুই আমার ছিল না। তবু কখনও ওর খেলাধুলো, গান বা চেহারার জন্য ওকে হিংসে হয়নি। কিন্তু যখনই মনে পড়ত বাসে একজন রীতিমতো ভদ্রলোক ওকে ‘ছোটবাবু’ বলে ডেকে সিট ছেড়ে দিয়েছিল, তখনই আমার বংশানুক্রমিক একটা স্বার্থে ঘা লাগত। আমি ব্যাপারটা সহ্য করতে পারতুম না। সবসময়ে রমেনের সঙ্গে নিজের তুলনা করে দেখতুম কে বড়, কে ছোট। তাই রমেনের বন্ধু হতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। ললিত বা তুলসীর কোনও কমপ্লেক্স ছিল না, ওদের সময় লাগেনি। রমেন মাঝে মাঝে ওদের ঢাউস পুরনো মোটর গাড়িটা নিয়ে কলেজে আসত, আমরা চার-পাঁচজন সেই গাড়িতে চড়ে বেড়াতে যেতাম। গঙ্গার ধার দিয়েই সাধারণত গাড়ি নিয়ে যেত রমেন। অনেক দূর গিয়ে নির্জন কোনও জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বলত, নাম। তারপর জামা-কাপড় খুলে আন্ডারওয়্যার পরে জলে ঝাঁপ দিত, চেঁচিয়ে ডাকত আমাদের, আয়রে। কেউ কেউ নামত জলে, আমি সাঁতার জানতাম না বলে নামিনি। রমেন একদিন জোর করে ধরে নামাল। ডায়মন্ডহারবারের কাছে উথাল পাথাল গঙ্গা, সেইখানে স্রোতের মুখে আমাকে টেনে নিয়ে গেল দূরে। আমি ওর কোমর জড়িয়ে ধরে ভয়ে চেঁচাচ্ছিলাম, ও মুখ ঘুরিয়ে বলল, চেঁচাস না, শালা। লোকে আমাকে সন্দেহ করবে। এখন তুই-আমি মিলেমিশে এক হয়ে গেছি, তুই ডুবলে আমিও ডুবব, ভয় নেই। বুঝলে সতী, রমেনটা কিছু ভেবেটেবে ও-কথা বলেনি। কিন্তু হঠাৎ আমার চেঁচানি বন্ধ হয়ে গেল। কেমন যেন সাহস পেয়ে গেলাম। আমি ডুবলে রমেন ও ডুববে— এই কথাটা বলার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা হঠাৎ ভীষণ একটা আনন্দ দিয়েছিল আমাকে। চারধারে বিপুল জলস্রোত, আমি সাঁতার জানি না, রমেন—একমাত্র রমেন ছাড়া তখন আর আমার কোনও অবলম্বনই নেই। ঠিক সে সময়ে ওই কথা কোনও ভরসার কথা নয়, তব আমি ভরসা পেলাম। মনের ভয় কেটে গেল। ও না-ভেবেই বলেছিল, তুই-আমি মিলেমিশে এক হয়ে গেছি। জলের মধ্যে আমি ওর কোমর ধরে ছিলাম বলেই বোধ হয় ও এই কথা বলেছিল। কিন্তু কথাটা যত বার পরে ভেবে দেখেছি তত বারই মনে হয়েছে ওই রমেন শাল মস্ত জ্ঞানীর মতো বলেছিল কথাটা। জলে হোক, ডাঙায় হোক, সুখে হোক, দুঃখে হোক, কোথাও-না-কোথাও একবার না একবার আমাদের মিলেমিশে এক হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা তা হচ্ছি না। বুঝলে সতী, তারপর থেকেই আমি মনে মনে ছোট-বড়র ভাবটা আস্তে আস্তে তুলে ফেলার চেষ্টা করছি। ইচ্ছে করেই আমি বাবার ব্যবসাতে নামিনি, বাবা কত রাগারাগি করেছে। এতদিন কোন ঘুন-ধরা বনেদি পরিবারের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু আমি তা করিনি। আদিত্যর এ-সব কথার মধ্যে খানিকটা সত্য ছিল, খানিকটা ছিলও না। শাশ্বতী জানে, আদিত্য সুখী ছেলে। আদরে মানুষ। সে এখনও তেমন কষ্টসহিষ্ণু নয়, কোনও দিন নিজে হাতে বাজারও করেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও নিজেদের ব্যবসা নিয়ে তার একটু অহংকার আছে, আর এখনও সে তার সেই বন্ধু রমেনকে একটু হলেও হিংসে করে। বাড়ি ছেড়ে এসে আদিত্য তাকে বিয়ে করবে, এটা ভাবতেও শাশ্বতীর ভাল লাগে না।
একটু দূর থেকে আদিত্যকে দেখছিল শাশ্বতী। অনেকক্ষণ দেখল। তারপর হঠাৎ একটু শ্বাস ছেড়ে আপন মনে বলল, পাগল!
সিগারেট ধরিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াতেই শাশ্বতী আদিত্যকে জিজ্ঞেস করল, দোকানদারের সঙ্গে কী অত কথা বলছিলে?
আদিত্য হাসল, সে অনেক কথা। প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম, এখান দিয়ে চার নম্বর বাস কতক্ষণ পর পর যায়। তারপর ওর কাচ্চা-বাচ্চা, কারবার, দেশ-গাঁওয়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। খুব খাতির করল…
শাশ্বতী রাগ করে, আর আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম ঠায় এতক্ষণ! তুমি এক বার ফিরেও তাকালে না!
আদিত্য চুপচাপ সিগারেট টেনে গেল, তারপর অনেক ভেবেচিন্তে বলল, আমার মন ভাল নেই, তাই অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করছিলাম।
শাশ্বতী চুপ করে অন্য দিকে চেয়ে থাকে।
আদিত্য হঠাৎ হাসে, ললিতকে কেমন দেখলে?
শাশ্বতী বলল, কেমন মানে?
আদিত্য ধীর চোখে অনেকক্ষণ শাশ্বতীকে দেখে, তারপর বলে, তোমার কি মনে হয় ও ব্যাটা টিকে যাবে?
শাশ্বতী ভ্রূ কোঁচকায়, ও-সব কী কথা! আমি কী করে জানব?
আদিত্য বলে, তোমার মেলোমশাইয়ের চেহারা অসুখের পর কীরকম হয়েছিল? খুব সুন্দর?
শাশ্বতী ইতস্তত করে, অত মনে নেই।
আদিত্য মাথা নাড়ে, আজ ললিতের যে-চেহারাটা আমি দেখলাম সেটা ওর আসল চেহারাই নয়। ও দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে। অনেক ব্রাইট। কিন্তু আমি বলছি সতী, এটা ওর চেহারাই নয়। অমন ঝলমলে চোখ ছিল না ওর। আসলে এটাই ওর শেষ চেহারা।
শাশ্বতী ধমক দেয়, ট্রাম আসছে। সরে এসো।
আদিত্য শাশ্বতীর দিকে তাকায়। বলে, লোকে মরে যাওয়ার আগে সুন্দর হয়।
শাশ্বতী বলে, সবাই হয় না।
আদিত্য একটু চিন্তা করে, সবাই হয় না, কিন্তু কেউ কেউ তো হয়। ধরো যারা পাপ-টাপ খুব একটা করেনি, যারা মোটামুটি সৎ পবিত্র জীবন যাপন করেছে, তাদের হয়তো ভগবান শেষ কয়েকটা দিন সুখের করে দেন। তখন ব্যাধি থাকে না, চেহারা সুন্দর হয়ে ওঠে, চোখ উজ্জ্বল হয়, পৃথিবীর ওপর আরও মায়া হতে থাকে। আর ঠিক এই অবস্থাতেই তারা হঠাৎ চলে যায়।
একটু চুপ করে থাকে আদিত্য, তারপর হঠাৎ বলে, মাইরি সতী, ললিতটা বরাবরই কেমন একটু পবিত্র ছিল। খুব পরোপকারী আর তেজি। তাই ওর চেহারার এই উজ্জ্বলতাটা ভাল নয়।
রাস্তায় ধুলো উড়ছে খুব। চারপাশে ভিড়। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে শাশ্বতী একটু পিছিয়ে দাঁড়ায়, তারপর বলে, ট্রামে উঠবে না?
দাঁড়াও, সিগারেটটা শেষ করে নিই। অবশেষে ওরা উঠল একটা ভিড়ের ট্রামে। শাশ্বতী মেয়েদের সিটে বসবার জায়গা পেল। আদিত্য দাঁড়িয়ে রইল।
শাশ্বতী দেখল, আদিত্যকে খুব অন্যমনস্ক লেখাচ্ছে। একগাদা লোকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্য, তার চোখে চোখ পড়তেই একটু ম্লান হাসল। তারপর দীর্ঘ শরীরটা অল্প একটু নুইয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগল। হয়তো বন্ধু ললিতের জন্য ওর মন খারাপ। কিংবা হয়তো এখন নিজের পরিবারের গোঁড়ামি, এবং শাশ্বতীকে বিয়ে করার অনিশ্চয়তার কথা ভেবে এর মন ভাল নয়। কে বলবে কোনটা ঠিক? কিন্তু শাশ্বতী জানে আদিত্যর মন একটা গানে ঢাল জায়গা, সেখানে জল দাঁড়ায় না। মাঝে মাঝে কেবল সুখ দুঃখ বিষতা কিংবা তীব্র কোনও অনুভূতি প্লাবনের মতো এলে চলে যায়। আদিত্য কখনও কখনও তাকে ভীষণ ভালবাসে, কখনও কখনও তার কথা ভুলে যায়। শাশ্বতীর ভয় করে।
শাশ্বতী তার এই বয়সের মধ্যে খুব বেশি পুরুষ দেখেনি। তাদের পরিবারে এক ধরনের অনুশাসন ছিল। বরাবর বাইরের ঘরে পরুষমানুষ এলে তারা ভিতরের ঘরে থেকেছে। রাস্তায় কখনও কারও সঙ্গে কথা বলেনি। হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা সিনেমায় যায়নি অভিভাবক ছাড়া। উপহার নেয়নি অনাত্মীয় পুরুষের কাছ থেকে। বাইরে থেকে ফিরতে সন্ধে হলে বরাবর তাদের কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। এই রকম অনুশাসনের মধ্যে থেকেও তার দিদি লীলাবতীর জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কী ভাবে তা হয়েছিল তা শাশ্বতী জানে না। শুধু জানে, একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে লীলাবতীকে কয়েকজন শয়তান লোক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। সারা রাত তারা লীলাবতীকে ব্যবহার করে খুব ভোরে ক্যালকাটা ফুটবল মাঠের বেড়ার কাছে ফেলে রেখে যায়, পৌষের শীত আর ঘাসের শিশিরের মধ্যে। লীলাবতীর জ্ঞান ছিল না, যখন তাকে কুড়িয়ে আনা হয়। তার তখন গা-ভরা জ্বর। মাস দেড়েক নিউমোনিয়া আর এক ধরনের আচ্ছন্নতার অসুখে ভুগে উঠবার পর সে যখন মাস দেড়েকের গর্ভবতী তখন সমীর সান্যাল নামে একজন উদার পুরুষ তাকে সব জেনে বিয়ে করে নিয়ে যায়। তাদের পরিবারে সেই প্রথম রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে হল, এবং সেই বিয়েতে কোনও নিমন্ত্রণও হয়নি। বরাবর রেজিষ্ট্রি বিয়ের বিরোধী তার বাবা সেই বিয়েতে সাক্ষী দিয়েছিল, আর সাক্ষী দিয়েছিল তার দাদা কালীনাথ। তারপর গত আট-দশ বছর আর লীলাবতীর কোনও খবর রাখে না তারা। সমীর সান্যাল বা লীলাবতী তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তাদের বিপদে ফেলেনি। কোথায় কীভাবে আছে তারা কে জানে! কিন্তু সেই ঘটনার পর থেকেই তাদের পরিবারের অনুশাসন অনেকটা ঢিলে হয়ে গেল। লীলাবতীর বিয়ে হয়ে গেলে বাবা এক দিন খুব গম্ভীরভাবে তাদের উঠোনে একটা গর্ত খুঁড়তে লাগল। প্রকাণ্ড গর্ত। তার ওপর লতাপাতা বাঁখারি দিয়ে একটা ছাউনি দিল। তারপর এক দিন তার মধ্যে ঢুকে জামা-কাপড় ছেড়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে বসে রইল। পাড়ার লোকেরা ভিড় করে এল সেই দৃশ্য দেখতে। বাবা তার সেই গুহার মধ্যে বসে লোকের সঙ্গে কথা বলত, নানা প্রশ্নের উত্তর দিত। বলত, দেখো, উদ্ভিদ জগৎ কত নির্বিকার, দেখো প্রকৃতির মধ্যে কোনও সমাজ নেই। আমি এইরকম নির্বিকার হতে চাই। কখনও বলত, দেখো, আমার ব্রহ্মতালু ভেদ করে একটা আমলকী গাছ গজিয়ে উঠবে। আমি ওইভাবেই আবার জন্ম নেব। তখন শাশ্বতীর বয়স আট কি নয়। বাবার সেই গুহার সামনে লজ্জায় কেউ যেতে পারত না বলে মা মাঝে মাঝে তাকে পাঠাত সেই গর্তের মুখ পাহারা দিতে। এক্কাদোক্কা কিংবা গুটি-খেলা ফেলে শাশ্বতী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত সেই গুহার সামনে। কেউ উঁকি মারতে এলে দু’হাত ছড়িয়ে পথ আটকাত, যাবেন না। যদি কেউ প্রশ্ন করত কেন? অমনি ফিক করে হেসে ফেলত সে, বাবা যে ন্যাংটো!
সেই সময়ে তার গুহাবাসী বাবার সম্পর্কে কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক রটনা করেছিল যে, তিনি তন্ত্রসিদ্ধ মহাপুরুষ, তাঁর মুখের কথা বিফলে যায় না। অনেকে আসত রেসের ঘোড়ার নম্বর বা লটারির টিকিটের ফলাফল জানতে। কিছু কিছু হয়তো বা মিলেও গিয়েছিল। তাই বাবাকে নিয়ে তখন বেশ হইচই চলছে পাড়ায়। অন্য দিকে ভেঙে যাচ্ছে তাদের পরিবার। তখন তার মা তাদের দুই ভাই আর দুই বোনকে নিয়ে দিশেহারা পাগল-পাগল। বি-এ পড়া ছেড়ে কষ্টেসৃষ্টে চাকরিতে ঢুকল কালীনাথ। বাবার আমল থেকে তারা চলে এল দাদার আমলে। অনেক গরিব হয়ে গেল তারা। হই চই করা আমোদপ্রিয় তার দাদা কালীনাথ, যাকে কোনও দিন সঠিক দাদার সম্মান দেয়নি শাশ্বতী, সেই কালীনাথ মাত্র বাইশ বছর বয়সেই হয়ে গেল তাদের অভিভাবক। চোখে রোল্ডগোল্ড ফ্রেমের চশমা, মুখখানা গম্ভীর, সারাদিন চাকরি আর টিউশানি আর রাতের কলেজে বি এ পড়তে পড়তে কালীনাথ হঠাৎ বুড়ো হয়ে গেল। তখন থেকেই কালীনাথ না-ছোড় একটা অম্বলের অসুখেও ভুগে আসছে। বাবা তার গুহায় বাস করল প্রায় বছরখানেক। তারপর সমতলে উঠে এল। বুজিয়ে দেওয়া হল সেই গর্ত! বাবা জামা-কাপড় পরতে লাগল। তবু, বাবা কোনও দিন আর পুরোপুরি ভাল হয়নি। চার-পাঁচ-ছয় মাস একরকম ভালই থাকে, তারপর আবার পাগলামি দেখা দেয়।
যদিও তাদের পরিবারটি ছিল নিরীহ শান্ত ভালমানুষদের পরিবার, তবু লীলাবতীর ঘটনার পর থেকেই তাদের পরিবারের অখ্যাতি রটে যায়। এই অখ্যাতি প্রবল সমস্যা হয়ে দেখা দেয় শাশ্বতীর মেজদি হৈমন্তীর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সময়। যত বার হৈমন্তীর সম্বন্ধ এনেছে কালীনাথ তত বারই পাত্রপক্ষের কাছে বেনামা চিঠি গেছে, নয়তো কেউ-না-কেউ তাদের লীলাবতীর ঘটনার কথা জানিয়ে দিয়েছে, আরও জানিয়ে দিয়েছে যে, হৈমন্ত্রীর বাবা পাগল। পাত্রপক্ষ পিছিয়ে গেছে। ক্রমে বোঝা যাচ্ছিল যে, সম্বন্ধ করে স্বাভাবিকভাবে হৈমন্তীর বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অন্তত যত দিন লোকে লীলাবতীর কথা একেবারে ভুলে না যায়। তাই দাদা এবং মা ভেবেছিল, যদি কেউ পছন্দ করে বা ভালবেসে বিয়ে করে, একমাত্র তবেই হৈমন্তীর বিয়ে সম্ভব। কাজেই তাদের পরিবারে মেয়েদের ওপর যে দীর্ঘকাল একটা অনুশাসন ছিল সেটা হঠাৎ আলগা হয়ে গেল। দাদা তার বন্ধুদের নিয়ে আসত বাসায়, আলাপ করিয়ে দিত হৈমন্তীর সঙ্গে, মোটামুটি ভাল ছেলে দেখে হৈমন্তীর প্রাইভেট পড়ানোর কাজে বহাল করা হল কয়েক বার, কলকাতার বাইরে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও বেড়াতে পাঠানো হল তাকে। হৈমন্তীর চেহারা ভাল ছিল না। সামনের দাঁত উঁচু, রং খুব কালো। প্রথম প্রথম স্বজাতি ব্রাহ্মণ ছেলেই জোগাড় করার চেষ্টা করছিল কালীনাথ। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে অন্য জাতেও হাত বাড়িয়েছিল। হৈমন্তীকে উপলক্ষ করেই তাই একদিন সহকর্মী আদিত্যকে বাসায় নিয়ে এল কালীনাথ। তাকে পরোটা আর অমলেট খাওয়াল। সে চলে গেলে মাকে ডেকে বলল, জাত-ফাত আর দেখো না। এ বিরাট বড়লোকের ছেলে। খুব সৎ। তা ছাড়া ওদের টাইটেলটাও খুব গোলমেলে— ওরা রায়। ব্রাহ্মণ না কি অন্য কিছু তা চট করে বোঝাও যাবে না। মা কোনও উত্তর দেয়নি, অসহায়ভাবে চুপ করে ছিল।
এ-কথা ঠিক যে, তাদের পরিবারে যখন এ-সব ঘাটছিল তখন তাকে, শাশ্বতীকে, কেউ লক্ষই করেনি। তার ওপর কোনও শাসন ছিল না। তবু শাশ্বতী ধরা দিল নিজের স্বভাবে।
নদীর কাছাকাছি ঘাস-ঢাকা মাটিতে যেমন একটা ভেজা ভাব থাকে তেমনই এক ভেজা-ভাব আছে তার শরীরে। অথচ তার শরীরের অনুভূতিগুলি খুব প্রখর। ছেলেবেলা থেকেই যদি কেউ তাকে আচমকা ছোঁয়, কিংবা গায়ে হাত দেয়, অমনি আপনা থেকেই তার শরীর কেঁপে ওঠে, গায়ে কাঁটা দেয়। শাশ্বতী জানে যে, তার শরীরে একটা শুদ্ধতা কিংবা পবিত্রতার ভাব রয়েছে, যেটা কোনও দিন নষ্ট করতে তার খুব কষ্ট হবে। তার তিনটে ডাক নাম আছে, মলু, ঠান্ডু আর সতী। গায়ের রং ময়লা বলে এক সময়ে বাবা তার নাম রেখেছিল মলিনা। সেই থেকে মলু। স্বভাবে ঠান্ডা বলে তার মা তাকে ডাকে ঠান্ডু। আর সকলে ডাকে, সতী। তার শরীর কিংবা স্বভাবের সঙ্গে তিনটে নামেরই কিছু মিল রয়েছে। সে স্বভাবে ঠান্ডা, লাজুক। যে-কোনও স্পর্শেই তার শরীর কেঁপে ওঠে। সম্ভবত সে-কারণেই, স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও সে পুরুষদের কাছাকাছি গেছে খুব কম। তার উপযুক্ত পুরুষ কে বা কেমন, এ-সব ভাবনা চিন্তা সে খুব কমই করেছে। কারণ সে বরাবর তার শরীর ও মনের ওই সহজাত পবিত্রতা বা শুদ্ধতাটুকুকে ভালবেসেছে, সে-শুদ্ধতা কোনও পুরুষের কাছে নষ্ট করতে তার খুব কষ্ট হবে। পাড়ার বখাটে ছেলেরা তার ওই পবিত্রতার ভাব লক্ষ করেই বোধ হয় সে হেঁটে গেলে ‘সিস্টার নিবেদিতা! সিস্টার নিবেদিতা!’ বলে চেঁচায়।
তার এই পবিত্রতার ভাবটুকু প্রথম নষ্ট করার চেষ্টা করে বোকা অভিজিৎ। তার প্রাইভেট টিউটর। অঙ্কে কাঁচা ছিল বলে স্কুল-ফাইন্যাল পরীক্ষার আগে কালীনাথ তার জন্য বি এস সি অভিজিৎকে ঠিক করে দিয়েছিল। অভিজিৎ অঙ্কে তুখোড় ছিল, আর সব বিষয়ে বোকা। কিছুদিন পড়ানোর পরই সে শাশ্বতীর প্রেমে পড়ে গেল। সপ্তাহে তিন দিন তার পড়ানোর কথা, লজ্জার মাথা খেয়ে সে আসত চারদিন কি পাঁচদিন। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত, তুমি দুপুরে ঘুমোও, না? তারপর দুঃখের ভান করে বলত, একজন সারা দিন রোদে রোদে ঘোরে, খেটে মরে, আর একজন ঘুমোয়! কখনও বা অঙ্ক না-মিললে সে শাশ্বতীকে মার দেওয়ার ভান করত, কানের লতি আলগোছে ধরে মাথায় ঠুস করে একটু থাপ্পড়। কখনও বা হঠাৎ চোখ ঘোলা করে বলত, দেখো তো আমার জ্বর হয়েছে কি না! কাল সারা বিকেল বৃষ্টিতে ভিজলাম! এ-সব বোকামির ফলে শাশ্বতীর ভালবাসা বেড়েছিল। অভিজিতের প্রতি নয়, তার নিজের শুদ্ধতার প্রতি। কারণ অভিজিৎ-এর কাছাকাছি সে তার শুদ্ধতাকে সবচেয়ে বেশি টের পেত।
তারপর অনেককাল আর পুরুষ ছিল না তার জীবনে। তার মেজদি হৈমন্তীকে উপলক্ষ করে যে-সব পুরুষ আসত তাদের কৌতূহলভরে দেখত শাশ্বতী। এদের মধ্যে কোন জন তার মেজদিকে পছন্দ করবে? ওই রকম কৌতূহল নিয়েই সে আদিত্যকে দেখেছিল। দূর থেকে, খুব বিষন্ন মুখে পরোটা আর অমলেট খাচ্ছিল আদিত্য। মাকে বলল, মাসিমা, আমার মন ভাল নেই। বাবার সঙ্গে ঝগড়া চলছে চার-পাঁচদিন ধরে। প্রথম দেখে আর কথা শুনে শাশ্বতী বুঝেছিল, আদিতা খুব সরল, তার মনে কথা থাকে না। আদিত্যকে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। হৈমন্তী তার সঙ্গে অনেক কথা বলল, কিন্তু আদিত্য হৈমন্তীর সাজগোজ লক্ষ করল না, চোখে তেমন করে চোখ রাখল না। তারপরও সে অনেকবার গেছে শাশ্বতীদের বাড়িতে, কিন্তু কোনও দিনই সে বোধ হয় বুঝতে পারেনি কেন কালীনাথ তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। হয়তো আজও জানে না। তবে আদিত্য মিশুক ছিল, কথা বলত খুব। মাঝে মাঝে যেত তাদের বাড়ি, সবাইকে হাসিয়ে আসত কিছুক্ষণ। কখনও সে তার কৃপণ বাবার গল্প বলত, কখনও নকল করে দেখাত কীভাবে কালীনাথ অফিসে তার পেটের রোগের গল্প করে। বলার ভঙ্গিতে কত দিন তাদের সঙ্গে মা’ও হেসে গড়িয়ে পড়েছে। আদিত্য চলে যাওয়ার সময় তারা দুই বোন বারান্দায় বেরিয়ে আসত, চেঁচিয়ে বলত, আবার আসবেন। একদিন এই ‘আবার আসবেন’ শুনে আদিত্য থমকে দাঁড়িয়ে ইশারায় তাকে ডাকল। কাছে গেলে গলা নামিয়ে বলল, এসে কোনও লাভ আছে? যদি ভরসা দাও তবেই আসি। খামোকা এসে লাভ কী? যদিও পুরুষমানুষ খুব বেশি দেখেনি শাশ্বতী, তবু আদিত্যর কথাটা সে একপলকেই বুঝেছিল। তারপরেই একদিন আদিত্য একা তার সঙ্গে দেখা করল কলেজের সামনে, রাস্তায়…হৈমন্তীর আপত্তির কিছু ছিল না। একদিন বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে সে গুনগুন করে আদিত্যর ব্যাপারটা বলে দিল হৈমন্তীকে। হৈমন্তী একটুও আপত্তি করল না, অনেক পুরুষ দেখে সে তখন খানিকটা হকচকিয়ে আছে। কোনজন যে তাকে নেবে তা বুঝতে পারছিল না। কাজেই বিশেষ কারও ওপর তার পক্ষপাত থাকার কথা নয়।
এই আদিত্য। কখনও তাকে ছোঁয় না, খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে কাছে আসার চেষ্টা করে না, মাঝে মাঝে তার কথা ভুলে যায়। মন্দ লাগে না শাশ্বতীর। সে এই প্রথম পুরুষ দেখছে বোকা অভিজিতের পর। মাঝে মাঝে তার শরীরের সেই অমোঘ পবিত্রতাটুকুর কথা ভেবে তার মন খারাপ হয়ে যায়। আসলে বয়স। বয়সের দোষ। পাড়ার ছেলেরা তাকে ‘সিস্টার নিবেদিতা’ বলে ভেঙায়। কিন্তু সত্যিই তো আর সে সে-রকম কেউ নয়! শাশ্বতীদের কি নিবেদিতা হলে চলে! তাই সে সুন্দর পবিত্রতার কথা আজকাল ভুলে যায় শাশ্বতী। ট্রাম-বাসের ভিড়ে লোকজন গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, শাশ্বতী আর তেমন শিউরে ওঠে না। সে অনেকটাই ভুলে গেছে। ভুলে যাবে।
শাশ্বতী লক্ষ করল, রাসবিহারীর মোড়ের কাছে এসে গেছে তাদের ট্রাম, তবু বে-খেয়ালে অন্য মনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্য। সে দাঁড়িয়ে আদিত্যকে বলল, নামবে না?
নামব। বলে হাসল আদিত্য।
নেমে বলল, কোন দিকে যাওয়া যায়?
আমি বাড়ি যাব। শাশ্বতী বলে।
বাড়িতে কে আছে তোমার?
কে নেই?
যে-ই থাক, আমি তো নেই!
আদিত্য হাত উঁচু করল একটা ট্যাক্সিকে। সেটা থামল না। ‘শালা…’ গাল দিল আদিত্য।
ট্যাক্সির কী দরকার! পয়সা কামড়াচ্ছে? শাশ্বতী বলে।
এখন বাসে-ট্রামে ভিড়।
চলো হেঁটে যাই। কোথায় যাবে?
লেক।
এইটুকু তো মোটে!
আদিত্য মাথা নাড়ে, দূর! অনেকটা রাস্তা।
দ্বিতীয় খালি ট্যাক্সিটা ধরল আদিত্য। পাশাপাশি বসে সিগারেট ধরাল। বলল, ললিতকে কেমন দেখলে?
তুমি এতক্ষণ ললিতের কথা ভাবছিলে?
আদিত্য হাসে, মাইরি সতী, ললিতটাকে আমি বড় ভালবাসতুম। বলে আদিত্য কী একটু চিন্তা করে, বলে, কিন্তু কীরকম ওর চেহারাটা দেখাল বলো তো আজ? ঠিক যেন ভগবানের বাচ্চা। ডিরেক্ট ভগবানের। তুমি লক্ষ করোনি?
আমি কি ভদ্রলোককে আগে আর দেখেছি নাকি?
আজ কেমন দেখলে?
ভগবানের বাচ্চা কেমন হয় জানি না তো!
ঠিক! আদিত্য হাসে, ওটা একমাত্র আমিই জানি।
তারপর চুপ করে থাকে।
কাছাকাছি কেউ সিগারেট খেলে গন্ধে শাশ্বতীর গা গুলোয়।
শাশ্বতী বলল, একটু সরে বসো। বাইরের দিকে মুখ করো।
আদিত্য ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকায়, আমার চেহারাটা কেমন? জিরাফের মতো?
এতক্ষণে শাশ্বতা হাসল। বলল, গায়ে মাংস লাগলে তোমাকে খারাপ দেখাবে না।
এখন দেখায়?
শাশ্বতী হাসে, কী জানি! চেহারা দেখি নাকি!
কী দেখো তবে?
চেহারা ছাড়াও অনেক কিছু থাকে।
দূর! আর কী দেখার আছে? মেয়েরা ছেলেদের আর কী দেখে? চেহারা কিংবা টাকা-পয়সা ছাড়া?
শাশ্বতী কপাল তোলে, দেখে না?
না। মাথা নাড়ে আদিত্য, বরং পুরুষরা দেখে। আজ আমি ললিতের চেহারায় যা দেখলুম, তুমি তা দেখোনি।
শাশ্বতী রেগে যায়। ঝেঁঝে ওঠে, থাকগে। আমার দেখার দরকার নেই।
আদিত্য হাসতে থাকে। তারপর আচমকা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো গলা নিচু করে বলে, তুমি দেখোনি। কিন্তু আমি দেখেছি। তোমাকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে।
শাশ্বতী কোনও উত্তর দেয় না। কিন্তু চমকে ওঠে। তার শরীর ঠিক আগের মতো এক অসহনীয় স্পর্শকাতরতায় কেঁপে যায়। কিন্তু ততক্ষণ ললিতের কথা তার সঠিক মনে ছিল না। কিন্তু চমকে উঠেই তার মনে পড়ল মুখখানা। তীক্ষ্ণ মুখ, চোখের দৃষ্টি গভীর মায়া-মমতায় জড়ানো। হয়তো আদিত্য ঠিকই বলেছে, মৃত্যুর আগে মানুষ সুন্দর হয়। ললিতকে আগে কখনও দেখেনি শাশ্বতী। কিন্তু এখন মনে পড়ল, মানুষটাকে সে সুন্দর দেখেছিল। কিন্তু এও ঠিক যে চেহারার সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায় ললিতের তা নেই। বরং বিষঘ্নতা আছে, আর আছে খুব দূরের কোনও চিন্তা। কাছেপিঠের লোকজন বা স্থানকে লোকটা ভাল করে দেখে না। আদিত্যর ও-পাশে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে কথা বলছিল ললিত। কয়টাই বা কথা। আদিত্যর শরীরের আড়ালে মুখখানা খুব ভাল করে দেখেওনি শাশ্বতী। তবু এখন মনে পড়ল সে-মুখে সাধু-সন্তের মতো কোনও সৌন্দর্য ছিল। শাশ্বতী চমকে উঠল। কিন্তু ভেবে দেখল, আদিত্য দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কথা বলছে। শাশ্বতীকে অত অল্প সময়ে ললিত কতটুকু দেখেছে? শাশ্বতী জানে যে তার চেহারায় হঠাৎ দেখে পছন্দ হওয়ার মতো কিছু নেই।
কথাটা শুনে সে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আদিত্যর মুখের দিকে চেয়ে রইল।
আদিত্য তখনও হাসছিল, বলল, তুমি যখন বলছিলে যে তোমার বাড়ি মাইকেল মধুসূদনের বাড়ির কাছেই ছিল, যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষতীরে তখন হঠাৎ ওর মুখ-চোখ কেমন হয়ে যাচ্ছিল। বিহ্বল …হ্যাঁ, বিহ্বল কথাটাই ঠিক খাটে।
শাশ্বতী চুপ করে চেয়ে রইল।
খাপছাড়াভাবে আদিত্য বলল, ও শালা কবি।
একটু চুপ করে থেকে মাথা নাড়ল আদিত্য, শালা মরে যাবে।
আদিত্য ঝুঁকে শাশ্বতীর একখানা হাত ধরার চেষ্টা করে। তারপর আবার হাত টেনে নিয়ে শাশ্বতীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পিট পিট করে বলে, মাইরি, সতী, তুমি রাগ করলে না তো! আমি যা দেখেছি তাই বলছি। অন্যায় হল?
শাশ্বতী আস্তে মাথা নাড়ে, তুমি ভুল দেখেছ।
সিগারেটের ধোঁয়া গলায় রেখে আদিতা অস্পষ্ট স্বরে বলল, ললিতকে আমি চিনি। আমরা যখন একসময়ে মেয়েছেলে নিয়ে আলোচনা করতুম, কার কীরকম মেয়ে পছন্দ, তখন প্রায়ই ললিত শ্যামলা রঙের মেয়ের কথা বলত। বলত, বাঙালি মেয়ের খুব ফরসা সাহেবি রং ওর পছন্দ নয়। আর বলত, সে মেয়ের সুন্দর চোখ আর অনেক চুল থাকবে।
আদিত্য মিটমিট করে শাশ্বতীর দিকে তাকায়, তোমার সঙ্গে মিলে যায়।
শাশ্বতীর বুক কাঁপে হঠাৎ। কেমন ভয় করে ওঠে। বলে, কী সব যা-তা বলছ!
সামান্য বিস্বাদ মুখ করে আদিত্য, মৃদু গলায় বলে, যা-তা কেন? এর মধ্যে তো কোনও দোষ নেই। তুমি যখন বলছিলে ‘আপনি ভাল হয়ে যাবেন’ তখন ওর মুখ-চোখ ঝলমল করে উঠল।
দূর!
আদিত্য হাসে, অন্যমনস্কভাবে বলে, দোষ কী সতী? ওর যা চেহারা দেখলাম আজকে—একটা টপ চেহারা—এই চেহারা নিয়ে বেশি দিন টেকে না কেউ। ওর দিন শেষ। তোমাকে দেখে ও যদি আনন্দ পেয়ে থাকে, তাতে দোষ কী? বরং আমি তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব…
ট্যাক্সিটা থামিয়ে হঠাৎ মুখ ফেরায় ট্যাক্সিওয়ালা। সে মুখটায় বসন্তের দাগ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে কালো রোদ চশমা— রুক্ষ মুখখানা ফিরিয়ে বলল, কোথায় যাব?
সোজা। বলল আদিত্য। ট্যাক্সিওয়ালা সামান্য হাসে, সোজা আর কোথায়? রেল লাইনের ও-পাশে ট্যাক্সি যাবে না।
শাশ্বতী দেখল কথায় কথায় তারা বালিগঞ্জ স্টেশনে এসে পৌঁছে গেছে। তাদের যাওয়ার কথা লেকের দিকে, গড়িয়াহাটা হয়ে। গড়িয়াহাটা কখন পেরিয়ে গেছে!
আদিত্য ঠান্ডা গলায় ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, সোজাই যাব, রেললাইনের ও-পাশে। চলুন।
শাশ্বতী আদিত্যকে খানিকটা চেনে। ওই যে ট্যাক্সিওয়ালা বলল যে রেল লাইনের ও-পাশে যাবে না, তাইতেই জেদ চেপে গেছে আদিত্যর। কাজ থাক বা না-থাক সে এখন রেললাইনের ও-পাশেই যাবে।
শাশ্বতী মৃদু ধমক দিল আদিত্যকে, কী হচ্ছে?
তারপর ট্যাক্সিওয়ালার রূঢ় মুখখানার দিকে চেয়ে নরম গলায় বলল, আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। গড়িয়াহাটায় আমরা ট্যাক্সি ছেড়ে দেব।
আদিত্য হঠাৎ বিড়বিড় করে ওঠে, না। গেলে তুমি গড়িয়াহাটায় যাও। আমি সোজা যাব।
কেন?
এমনিই।
ট্যাক্সিওয়ালা শাশ্বতীর দিকেই চেয়ে ছিল। শাশ্বতীর মুখ-চোখ ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল অপমানে।
ট্যাক্সিওয়ালা বলল, আপনারা ঠিক করে নিন কোথায় যাবেন। আমি গড়িয়াহাটায় পৌঁছে দিতে পারি, কিন্তু রেললাইনের ও-পারে যাব না।
কেন? আমি পয়সা দেব না? আদিত্য চেঁচিয়ে বলে।
দিলেই কী! ট্যাক্সিওয়ালা ঝেঁকে ওঠে, ও-পাশে ঘিঞ্জি রাস্তা, ভিড়, রাস্তা খারাপ, আমাদের ঝামেলা পোয়াতে হয়। গাড়িতে চোট হয়ে গেলে সে পয়সা আপনি দেবেন?
চেঁচামেচি শুনে দু’-একজন লোক ট্যাক্সির জানালায় উঁকি মারে। অসহায়ভাবে চেয়ে থাকে শাশ্বতী। তার ভয় করে। অভিমানে ঠোঁট কাঁপে তার। চোখে জল আসি-আসি করে। টলমলে চোখে সে দেখতে পায়, আদিত্য সামনের সিটের গায়ে থাপ্পড় মেরে বলছে, যেতে হবে, যেতে হবে। আর ট্যাক্সিওয়ালা মাথা নেড়ে বলছে, আমি যাব না। যা খুশি করুন।
যা কখনও করে না শাশ্বতী, তাই করল হঠাৎ। ঝুঁকে আদিত্যর উগ্র হাতখানা ধরল। শরীর কেঁপে উঠল তার, উত্তেজনার মধ্যেও। কাঁপা গলায় বলল, কী করছ তুমি? গাড়ি ঘোরাতে বলো।
আদিত্য একটুক্ষণ চুপ করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর শান্তভাবে ট্যাক্সিওয়ালার দিকে চেয়ে হেসে বলে, ঠিক আছে, গাড়ি ঘুরিয়ে নিন।
ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়।
গড়িয়াহাটায় ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে লেকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আদিত্য হঠাৎ বলল, সতী, তুমি অত ভিতু কেন? ও শালাকে আমি ঠিক নিয়ে যেতুম রেললাইনের ও-পাশে কসবায়, কিংবা যেখানে খুশি।
তখনও শাশ্বতীর বুকে চাপ বেঁধে কণ্ঠরোধ করে আছে একটা অসহায় কান্নার ভাব। সে নাক টেনে স্খলিত গলায় বলল, সেটা খুব বাহাদুরি হত, না?
আদিত্য হাসে, বাহাদুরি নয়। কিন্তু ও যাবে না কেন?
অসুবিধে আছে বলেই যাবে না।
আবার চিড়বিড়িয়ে ওঠে আদিত্য, অসুবিধে ঘোড়ার ডিম।
রাগে লাল হয়ে যায় আদিত্যর ফরসা মুখ। শাশ্বতী লক্ষ করে। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটে তারা। একসময়ে হঠাৎ আবার হেসে ওঠে আদিত্য। বলে, বিপদে পড়লে তোমাকে খুব অদ্ভুত দেখায়। আজ দেখলাম।
শাশ্বতী উত্তর দেয় না।
আদিত্য আপন মনে বলে, খুব প্যাশনেট। কিন্তু এমনিতেই তুমি ভীষণ ঠান্ডা। তোমার উত্তেজনা নেই। না?
শাশ্বতী উত্তর দেয় না। কিন্তু তার সামান্য লজ্জা করে।
আদিত্য বলল, আজ আমি মানুষজনকে কেমন উলটোপালটা দেখছি। ললিতকে কেমন দেখলাম। হঠাৎ তোমাকেও! তোমার এত প্যাশন কোনও দিন দেখিনি!
অনেকক্ষণ ধরেই আদিত্য কী একটা কথা তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে চাইছে, শাশ্বতী বুঝতে পারছে না। ললিতের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর থেকেই আদিত্য অন্য এক রকমের ব্যবহার করছে তার সঙ্গে। অকারণ ঝগড়া করল ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে, তাকে বোঝাবার চেষ্টা করল ললিতের তাকে খুব পছন্দ, বারবার জিজ্ঞেস করল ললিতকে সে কেমন দেখল। আদিত্যর সঙ্গে তার সম্পর্কটা মাত্র ছ’-সাত মাসের পুরনো। এই অল্প সময়ে সে আদিত্যকে খানিকটা চিনেছে, খানিকটা চেনেওনি। আজ, এখন আদিত্যকে তার খুব অচেনা লাগছিল। তার রহস্যময় কথাবার্তা ভালও লাগছিল না তার। আদিত্য আবার ঘুরে ফিরে ললিতের কথা উল্লেখ করায় সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রাস্তায় ভিড়। অন্ধের মতো এলোপাথাড়ি হাঁটছে লোকজন, গায়ে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। তবু ফুটপাথের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে শাশ্বতী বলল, তুমি কী বলতে চাও, স্পষ্ট করে বলো।
আদিত্য থতমত খেয়ে যায়। বলে, কী স্পষ্ট করে বলব?
তুমি একটা কিছু বলতে চাইছ, আমি বুঝতে পারছি না।
দূর! বলে হাসল আদিত্য। তারপর বলল, চলো।
হাঁটতে হাঁটতে আবার হাসিঠাট্টার ছলে আদিত্য বলে, দেখো, সতী, দেখো বিবেকানন্দের মূর্তি আর ওই দেখো রামকৃষ্ণ মিশন। ওই বাড়িটার ভিতরে কখনও গেছ তুমি? গেলে তোমার মনে হবে ঠিক আমেরিকার কোনও বড়লোকের বাড়িতে ঢুকেছ…
শাশ্বতী আদিত্যর মুখ একপলক দেখে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল।
আদিত্য কিছুক্ষণ আবোল-তাবোল বকে গেল। তারপর হঠাৎ ওপর দিকে হাত ছুড়ে বলল, দূর ছাই! তুমি এত চালাক কেন?
শাশ্বতী আদিত্যর মুখ একপলক দেখে নিল। আদিত্য ভ্রূ কুঁচকে আছে।
লেকের পারে ঘাস-জমিতে বসে আদিত্য বলল, ঠিক সতী, আমি তোমাকে একটা কিছু বলতে চাইছি।
কী সেটা? মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে শাশ্বতী।
ললিতকে তুমি কেমন দেখলে?
সেই পুরনো প্রশ্ন? এ পর্যন্ত কয়েক বার জিজ্ঞেস করল আদিত্য।
শাশ্বতী অবাক হয়। বলে, আবার সেই এক কথা?
আদিত্য লজ্জা পেয়ে মুখ নামায়। শাশ্বতী দেখে আস্তে আস্তে ওর মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে।
মুখ নিচু করেই আদিত্য বলল, সতী, আমি ভীষণ হিংসুক। ছেলেবেলা থেকেই। আমি ব্যবসাদারের ছেলে, আমার মনে এতটুকুও মহত্ত্ব নেই।
শাশ্বতী সঠিক বুঝল না। তবু বলল, কী-সব বলছ?
স্নান হাসে আদিত্য। তারপর বলে, সতী, আমাদের পরিবারে কোনও কালচার নেই, বাপ-দাদাদের মধ্যে আমিই প্রথম গ্র্যাজুয়েট। জোর করে পড়েছিলুম, নইলে ম্যাট্রিক ক্লাসের আগেই আমার ব্যবসাতে নেমে পড়ার
তাতে কী?
তাতে অনেক কিছু সতী। কিছুতেই আমার নিজেকে তোমার সমান বলে মনে হয় না। ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কেবল মনে হয়, তোমার মধ্যে বংশানুক্রমিক একটা কিছু আছে যা আমি ধরতে পারছি না! তোমার সঙ্গে আমার জাত মেলে না।
শাশ্বতী স্তম্ভিতভাবে আদিত্যর ম্লান মুখ দেখে। তারপর আকুল হয়ে বলে, ছিঃ। এ-সব কী কথা? জাত আবার কেউ মানে নাকি আজকাল?
আদিত্য মাথা নাড়ে, সে-জাত নয়। কিন্তু মানুষের স্বভাব অনুযায়ী তো এক-একটা জাত থাকে। সেই জাত মিলছে না।
শাশ্বতী গম্ভীর হয়ে বলে, হঠাৎ একথা কেন?
কমপ্লেকস। আদিত্য উত্তর দেয়। একটু চুপ করে থেকে বলে, তুমি আর ললিত চায়ের দোকানে আমার দু’পাশে বসে ছিলে। খুব অল্পই কথা হয়েছে তোমাদের। যা কথা বলার আমিই বললুম, হাসিঠাট্টা করলুম। কিন্তু তোমরা দু’জনে আমার দু’পাশে বসতেই আমার মনে হয়েছিল তোমরা দু’জন এক জাতের। আমি তোমাদের সমান নই। আর তক্ষুনি আমার মনে হচ্ছিল, তোমরা, তুমি আর ললিত, পরস্পর নিঃশব্দে কথা বলছ। সে-কথা চোখ-মুখের কোনও ইঙ্গিতে নয়। সেটা হচ্ছিল আরও রহস্যময় সাংকেতিক কোনও সূত্রে, যা আমি বুঝতেই পারলুম না। সেটা বোঝার সাধ্যই আমার নেই, আমার জাত একদম আলাদা। অথচ তোমাদের মধ্যে তেমন কোনও কথাবার্তাই হয়নি, এমনকী তোমরা কেউ কাউকে খুব ভাল করে দেখোওনি। একবার তুমি কেবল ব্যাকুল হয়ে বলেছিলে, দেখবেন, আপনি ভাল হয়ে যাবেন, আর-একবার ললিত তোমার বাড়ি যশোরে শুনে আগ্রহ দেখিয়েছিল। ব্যস, এইটুকু। তবু আমার মনে হচ্ছিল, আমাকে মাঝখানে রেখে অনেক কথা নিঃশব্দে চালাচালি হয়ে গেল তোমাদের। আমি স্বার্থপর, ব্যবসাদারের বাচ্চা, ফালতু পার্টি, মাঝখানে বোকার মতো বসে রইলুম। সে-সব কথা ধরতেই পারলাম না। আমার সেই সূক্ষ্ম অনুভুতিই নেই। যা ললিতের আছে। তোমারও আছে। কিন্তু আমার নেই।
শাশ্বতীর গলা আটকে ছিল। কথা বলতে পারছিল না সে। আদিত্যর লাল আভার লাজুক মুখখানা গভীর তৃষ্ণা এবং বিতৃষ্ণায় দেখতে দেখতে তার চোখে জল এসে গেল। কিন্তু চোখের জল টের পেল না সে।
খুব কষ্টের সঙ্গে সে বলল, ও-রকম কিছুই হয়নি।
জানি। আদিত্য নরম সুরে বলল, কিন্তু আমার সন্দেহ হয়েছিল।
সিগারেট ধরায় আদিত্য। তারপর বলে, ললিতকে আজ অসম্ভব সুন্দর দেখেছিলাম আমি। তোমাকে সে কথা বারবার বললাম, কিন্তু তুমি স্পষ্ট স্বীকার করলে না। আমার সন্দেহ বেড়ে গেল। মনে হল, তুমিও ওর ওই অসম্ভব সুন্দর চেহারাটা ঠিকই দেখেছ, কিন্তু মুখে বলছ না। বলছ না কারণ সেটা তোমার গোপন কথা। তোমরা একে অন্যকে বুঝেছ, কিন্তু আমাকে সেটা বুঝতে দিতে চাও না।
শাশ্বতী কিছু বলতে চেষ্টা করে। পারে না।
আমি একটা ছোটলোক। আদিত্য বলে, আমি হিংসুক। কিন্তু সত্যি বলো সতী, ললিতকে তুমি কেমন দেখলে?
শাশ্বতী শিউরে ওঠে।
আদিত্য! হায় আদিত্য! আদিত্য এতক্ষণ ধরে না খুঁচিয়ে তুললে ললিতের মুখ শাশ্বতীর মনেই পড়ত না। আকুল হয়ে মাথা নিচু করে কাঁদে শাশ্বতী।
আদিত্যর গলা ভারী হয়ে এসেছিল। সে আস্তে আস্তে বলল, আমি ভীষণ নোংরামি করছি সতী। তবু তুমি বলো ললিতকে তুমি কেমন দেখলে আজ?
বলতে বলতে একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দেয় আদিত্য, আমাকে ছুঁয়ে বলো, সতী!
শাশ্বতী মুখ তুলল। তার দিকে বাড়ানো আদিত্যর হাতখানা দেখেই হঠাৎ শিউরে উঠল তার শরীর। তার সেই জন্মগত এক অদ্ভুত পবিত্রতা ও শুদ্ধতার দিকে বাড়ানো পুরুষের হাত। একটু থমকে যায় শাশ্বতী।
তারপর হঠাৎ আদিত্যর হাতখানা আকুল হয়ে চেপে ধরে দু’হাতে। শরীর ভয়ংকর কেঁপে ওঠে তার, চমকে ওঠে মন। দুরদুর করে কাঁপে পায়ের তলার মাটি।…ঠিক, এ-কথা ঠিক… ললিতকে সে সুন্দর দেখেছিল…সন্ত যোগীর মতো সুন্দর…
তবু শাশ্বতী ফিসফিস করে বলে, ললিতকে আমি একটুও সুন্দর দেখিনি। বিশ্বাস করো।
বারো
সে মিথ্যে কথা বলেছিল।
ভোর রাত্রে পাতলা ঘুমের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করছিল শাশ্বতী। দেখল, ভীষণ অন্ধকারের ভিতর মেঠো পথ দিয়ে লণ্ঠন হাতে একটা লোক চলে যাচ্ছে। লোকটার শরীর দেখা যায় না, কেবল লণ্ঠনের ম্লান আলো তার রোগা, ধুলো মাখা, চলন্ত পা দু’খানার ওপর পড়েছে। লণ্ঠনের আলোয় রহস্যময়, ভৌতিক সব ছায়া নেচে যাচ্ছে। একই স্বপ্ন, দৃশ্য বারবার। যত বার চোখে একটু ঘুম আসে শাশ্বতীর, তত বার সেই মেঠো পথ দেখে, লণ্ঠনের আলোয় চলে যাচ্ছে দু’খানা পা। চমকে তার ঘুম ভেঙে গেল অনেক বার।
যত বার ঘুম ভাঙে শাশ্বতীর, তত বারই চোখ খুলে সে দেখে অন্ধকার ঘরে আবছা মশারির চাল দেখা যাচ্ছে। ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে সে জোর করে চোখ বুজে ফেলে, শ্বাস বন্ধ করে থাকে অনেকক্ষণ। দিনের বেলা এই ঘরটা তার খুব চেনা, কিন্তু নিশুতি রাত্রে এই চেনা ঘরটা আর তাদের থাকে না। প্রেতাত্মাদের হাতে চলে যায়। মাঝরাতে হয়তো বা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে চোর, কিংবা ধর্মনষ্টকারী পুরুষেরা। তাই কোনও দিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে শাশ্বতী পরিষ্কার টের পায়, তাদের ঘরে এবং ঘরের বাইরে সর্বত্র একটা অপার্থিব অচেনা পরিবেশ। নিঃশব্দে কারা যেন ফাঁদ পাতছে, ভয় দেখানোর ষড়যন্ত্র করছে। তাই নিঃসাড়ে শুয়ে থাকে শাশ্বতী, নিশ্বাসেরও শব্দ করে না, বুকের হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করতে থাকে বলে অস্বস্তি বোধ করে। নিজেকে জড়সড় করে কাঠ হয়ে শুয়ে থেকে সে তখন কারও জেগে থাকার একটু শব্দ শোনার জন্যে অপেক্ষা করে। কারও একটি গলাখাঁকারি, কিংবা কোনও বাড়ির দরজা খোলার শব্দ, কিংবা যদি কেউ রাস্তা দিয়ে জুতো মশমশিয়ে হেঁটে যায়, এ-রকম যে-কোনও খুব তুচ্ছ একটু শব্দের জন্য সে কান খাড়া করে থাকে। কেউ জেগে আছে টের পেলে নিশ্চিন্ত হয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রথম বার স্বপ্নটা দেখে শাশ্বতী তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। ঘুম ভেঙে মাঝরাতের সেই ভয় হয়েছিল তার। হৈমন্তীর কাছাকাছি একটু সরে গিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে রইল সে। একসঙ্গেই শোয় তারা, কিন্তু শাশ্বতী পারতপক্ষে কখনও হৈমন্তীকে ছোঁয় না। কেননা তার শরীর কাঁপে, শিরশির করে। তা ছাড়া হৈমন্তীর শরীরের একটা বিশ্রী ঘামার দোষ আছে। শীত-গ্রীষ্মে সবসময়েই ও ঘেমে তুকতুকে হয়ে থাকে। ছুঁতে একটু ঘেন্না করে শাশ্বতীর। আজও প্রথম বার শাশ্বতী ছোঁয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় বার আবার সে একই স্বপ্ন দেখল, লণ্ঠনের আলোয় মেঠো পথে দু’খানা পা হেঁটে যাচ্ছে। এবার, ভীষণ চমকে উঠল শাশ্বতী। একই স্বপ্ন দু’বার কেউ দেখে নাকি? ঘুম ভেঙে তার ভীষণ অবাক লাগল। দু’হাত মুঠো করে, দাঁত চেপে, চোখ বন্ধ করে সে হৈমন্তীর খুব কাছাকাছি সরে গেল। মাঝরাতের যে-পৃথিবী সেটা তাদের নয়, মাঝরাতের পৃথিবী চলে যায় চোর কিংবা অসৎ মানুষ, অশরীরী আর স্বপ্নের রহস্যময়তার হাতে। শাশ্বতীর বালিশ গরম হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পাশ ফিরে শুতে তার সাহস হল না। সে আস্তে আস্তে হৈমন্তীকে ঠেলা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু হৈমন্তীর ঘুম খুব গাঢ়। সে একটু বোকাসোকা ভালমানুষ, বুদ্ধি বেশি নেই বলেই বোধ হয় হৈমন্তী অত নিঃসাড়ে ঘুমোতে পারে। হৈমন্তী জাগল না। শাশ্বতী অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকল। তারপর সে ক্ষীণ, খুব ক্ষীণ একটু গানের রেশ শুনতে পেল। অনেক দূরে, তাদের কলোনির বাইরে কিংবা যাদবপুর থেকেও দূরে কোথাও একটা মাইক বাজছে। সম্ভবত রাতজাগা কোনও অনুষ্ঠান। খুবই ক্ষীণ সেই শব্দ, মশা ওড়ার শব্দের চেয়েও মৃদু। তবু অনেকটা স্বস্তি বোধ করে শাশ্বতী ঘুমিয়ে পড়ে। আবার একই স্বপ্ন দেখে সে। আবার ঘুম ভেঙে যায়। ভয় পায় সে। তারপর বহু চেষ্টায় মাইকের সেই আন্দাজি শব্দটা শুনবার চেষ্টা করে। তারপর ঘুমোয়।
ভোর রাত্রে পাতলা ঘুমের মধ্যে সে আবার সেই মেঠো পথ, লণ্ঠন আর রোগা দু’খানা পা দেখতে পেল। হঠাৎ তীব্র ভয়ে চমকে উঠল তার বুক। ছটফট করতে করতে শাশ্বতী হঠাৎ জেগে উঠেই টের পেল তার নিজের গলায় একটা অদ্ভুত গোঙানির শব্দ হচ্ছিল এতক্ষণ। সে সজাগ হয়ে সেই গোঙানির শেষ একটু শব্দ শুনতে পেল। ভীষণ অবাক হয়ে চোখ খুলে রইল শাশ্বতী। তার শরীর অবশ, চোখ-মুখে একটা পোড়া-পোড়া জ্বালার ভাব, তালু বুক শুকিয়ে আছে তেষ্টায়। সে টের পেল বাইরে অন্ধকার পাতলা হয়ে এসেছে, ঘরের টিনের বেড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাইরের একটা ফিকে সাদাটে ভাব চোখে পড়ে। টিনের চালের ওপর হয় শুকনো পাতা, নয়তো শিশিরের ফোঁটা পড়ার টুপ-টাপ শব্দ হয়। ভোর হয়ে আসছে, এখন পৃথিবী থেকে সরে যাচ্ছে অশরীরী প্রেতাত্মা কিংবা স্বপ্নের মানুষেরা। এখন আর ভয়ের কিছু নেই। তবু শাশ্বতীর বুকে তীব্র একটা ভয় বাঘের থাবার মতো বসে রইল। একই স্বপ্ন কেউ এত বার দেখে!
এ-স্বপ্নটার ভয়েই আর ঘুমোতে ইচ্ছে করল না তার। স্বপ্নটা এই ঘরের আনাচে-কানাচে অপেক্ষা করে ওত পেতে আছে। সে ঘুমোলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে আসবে। শাশ্বতী আস্তে আস্তে উঠে বসল। হৈমন্তীকে আর-একবার জাগানোর জন্য সে হাত বাড়িয়েছিল, হঠাৎ সেই শিরশির শীতভাবে তার শরীর কেঁপে ওঠে। আর হঠাৎ মনে পড়ে যায়, গত কাল, গত কাল বিকেলে সে একটা মিথ্যে কথা বলেছিল। আদিত্যকে, তার গা ছুঁয়ে।
ভোর রাত্রির শান্ত নিস্তব্ধতার মধ্যে স্থির হয়ে একটু বসে রইল শাশ্বতী। হৈমন্তীর শরীরের দিকে বাড়ানো হাতখানা টেনে আনল। তারপর দু’হাত কোলের ওপর রেখে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে চোখ বুজল। কথাটা সত্য ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, কথাটা সে ইচ্ছে করে বলেনি। কাল বিকেলে হঠাৎ আদিত্য পাগল না হলে ললিতের মুখ তার মনেই পড়ত না। পড়লেও সে আস্তে আস্তে ক্রমশ ভুলে যেত সে ললিতকে কেমন দেখেছিল। কিন্তু আদিত্য ভুলতে দিল না, মনে পড়িয়ে দিল। আসলে মুখোমুখি ললিতকে সে কেমন দেখেছিল কে জানে! কিন্তু পরে যখন আদিত্য তাকে নানা কথার মার দিয়ে আস্তে আস্তে একটা কোণে ঠেলে নিয়ে গেল, যখন বারবার জিজ্ঞেস করল সে কেমন দেখেছিল ললিতকে, তখন, হঠাৎ তখনই শাশ্বতীর মনে হয়েছিল যে, সে ললিতকে সুন্দর দেখেছে— সন্ত-যোগীর মতো সুন্দর— অপার্থিব সেই রূপ। আশ্চর্য, আদিত্য তাকে খোঁচা না দিলে এ-কথাটা তার মনে পড়ত না! আর যখনই এই অতি সত্য কথাটা তার মনে এসেছে, ঠিক তখনই সে আদিত্যর গা ছুঁয়ে বলেছে যে, সে ললিতকে একটুও সুন্দর দেখেনি।
মিথ্যে কথা। সে মিথ্যে কথা বলেছিল।
কেউ ছুঁলে শরীর কেঁপে ওঠার যে বিশ্রী একটা অনুভূতি শাশ্বতীর ছিল এত কাল, সেটা আজকাল কমে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। আদিত্যর সঙ্গে মিশবার পরে সেটা আরও কমে গিয়েছিল। শাশ্বতী বুঝতে পারছিল, এবার তাকে শরীর দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কাল সন্ধেবেলায় যখন আদিত্য তাকে যাদবপুরের বাসে তুলে দিচ্ছে, তখন সেই এক-চাপ ভিড়ের বাসে ওঠার সময় অচেনা লোকজনের শরীরে লেগে ভয়ংকর শিউরে উঠছিল তার শরীর। সে টের পাচ্ছিল তার প্রতিটি রোমকূপে খর বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। আবার আগেকার মতোই স্পর্শকাতর হয়ে যাচ্ছে সে। সারাটা সন্ধে তার চোখ-মুখ ভেজা-ভেজা ছিল, বুকে ঠান্ডা-বসার মতো একটা কান্নার ভাব ভার হয়ে ছিল। সন্ধেবেলা সে বাড়িতে ফিরে কয়েক বার বই খুলে অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করেছে, না পেরে হাজরাদের বড় মেয়ে শিবানীর সঙ্গে রাস্তায় পায়চারি করে গল্প করেছে অনেকক্ষণ, রাত্রে ভাল করে খেতে পারেনি, যদিও তার প্রিয় সোরা-মাছ রান্না হয়েছিল কাল, তারপর শোয়ার সময় রোজ যা করে শাশ্বতী, বালিশে আঙুল দিয়ে ঠাকুরদেবতার নাম লেখা, সেটা লিখতেও ভুলে গিয়েছিল।
সেই কারণেই সে কি দুঃস্বপ্ন দেখেছে! একই স্বপ্ন দেখেছে বারবার।
না। বোধ হয় তা নয়। ঠাকুরদেবতার নাম লিখেও অনেক বার ভয়ের স্বপ্ন দেখেছে শাশ্বতী। তা ছাড়া, এ-স্বপ্ন বোধহয় ভয়ের স্বপ্ন ছিল না। মেঠো পথে লণ্ঠন হাতে একটা লোক চলে যাচ্ছে, তার শরীর দেখা যায় না। কে লোকটা! কোথায়ই বা যাচ্ছে। কিছুই বোঝা যায় না। গ্রাম-দেশ কখনও দেখেনি শাশ্বতী। তবু তার স্বপ্নে কোথা থেকে এল ওই মেঠো পথ! না, স্বপ্নটা ভয়ের ছিল না। বরং রহস্যময়। বারবার না দেখলে এই স্বপ্ন তার মনেও থাকত না। তবে সে কেন বারবার দেখেছিল?
শাশ্বতী স্থির হয়ে বসে চেয়ে রইল। তার স্পর্শকাতর শরীরে শিউরোনো রোমকূপ, গায়ে জ্বরজ্বর ভাব, তালু-গলা শুকিয়ে আছে তেষ্টায়, চোখ জ্বলছে, পেট ডাকছে কলকল করে, তার রাতের খাবার হজম হয়নি। তবু শারীরিক অনুভূতিগুলো সে সঠিক টের পাচ্ছিল না। তার মনে পড়ছিল যে, গতকাল সে আদিত্যকে ছুঁয়ে একটা ভীষণ মিথ্যে কথা বলেছিল, আর সারা রাত ধরে সে একটা অচেনা-অজানা লোকের দু’খানা পা স্বপ্নে দেখেছে। মনে মনে কোনওটার সঙ্গে কোনওটাই তার মিলছিল না। কেবল মনে হয়, তার মনের গভীরে কোথাও এক অতি রহস্যময় সূত্রে সেই মিথ্যে কথাটার সঙ্গে স্বপ্নে-দেখা লোকটার একটা সম্পর্ক রয়ে গেছে।
নিজেকে সামলাতে পারছিল না শাশ্বতী। খুব অস্থির লাগছিল তার। ঘরের মধ্যে ভোর রাত্রির এক অদ্ভুত আলো-আঁধারি। মশারির সাদা গায়ে অস্পষ্ট সব ছায়া। বাইরে কখনও কখনও ভোরের কাক ডাকছে। এখনও তেমন আলো ফোটেনি বলে পাখিরা বাসা ছাড়েনি। নানা অস্পষ্ট চিন্তা, স্মৃতি, স্বপ্ন তার মাথার মধ্যে ঘুলিয়ে উঠছিল। অকারণ। আর, একটা ভয়।
সকালের দিকেই ঘুম শাশ্বতীর প্রিয়। কিন্তু ভয়ে সে ঘুমোতে পারল না। চুপচাপ বসে রইল। অনেকক্ষণ। তারপর পাশের ঘরের দরজায় ছিটকিনি আর আড়কাঠ খোলার শব্দ শুনল সে। মা।
এত সকালে সে কোনও দিন ওঠে না। আজ উঠে বাইরে এসে ভোরবেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সে। এখন শরৎকাল, সকালের দিকে সামান্য কুয়াশা হয়। একটু শীত করে। উঠোনজোড়া বাগান ভিজে আছে, সতেজ দেখাচ্ছে গাছপালা। ঝাঁকড়া জামরুল গাছটার পেশি-ফোলানো পুরুষ চেহারা, তার প্রকাণ্ড গা বেয়ে নেমেছে শিশিরের জল। অল্প কুয়াশার একটু আবছা তার ওপরে ডালপালা। রাস্তার ও-পাশে বাড়িগুলো দিনের বেলা রোদে যেমন দেখায় তেমন দেখাচ্ছে না এখন। পাতলা কুয়াশায় ডুবে যেন জলের তলাকার দৃশ্যের মতো দেখায়। কুয়াশার মধ্যে ছায়ার মতো ওড়াউড়ি করছে কাক।
শাশ্বতী দেখে উঠোনের এক ধারে বসে মা তোলা-উনুনের ছাই বের করছে। মা’র পরেই ঘুম থেকে ওঠে হৈমন্তী। মা তাকে না দেখেই হৈমন্তী বলে ভুল করে বলে, হৈম, সতীটার গায়ে চাপা আছে কি না দেখে আয়। আজকাল শীত পড়ে।
শাশ্বতী হাসে, উত্তর দেয় না। উঠোনে নামতেই ঠান্ডা মাটির শীত শরীর বেয়ে ওঠে। শিউরে ওঠে শরীর। মায়ের বুকের পাশ দিয়ে হাত বাড়িয়ে উনুনের ছাই তুলে আঙুলে দাঁত মাজতে মাজতে শাশ্বতী তাদের বাগানটার কাছে চলে আসে। একটুক্ষণ গাছপালা দেখে।
হঠাৎ এতক্ষণ পর মা বলে ওঠে, ও মা! তুই?
শাশ্বতী মুখ ফিরিয়ে হাসে, উঠে পড়লাম।
এত সকালে! পেট গরম হয়নি তো? রাতে ঘুমিয়েছিস?
শাশ্বতী মাথা নাড়ে, না, কিছু না। এমনিই উঠলাম।
আর কথা হয় না। মা একমনে ঘুঁটে ভাঙে। শাশ্বতী দাঁত মাজতে মাজতে বেড়ায়। বারান্দার ওপর বেড়া দেওয়া একটা খুপরি। কালীনাথ ওটাতে থাকে। জানালার বেড়ার ঝাঁপটা তোলা। সেখান দিয়ে একবার উঁকি মেরে শাশ্বতী দেখল, কিছুই দেখা যায় না। কেবল মশারিটা। আজ অফিসে কালীনাথের সঙ্গে আদিত্যর দেখা হবে। আদিত্য কালীনাথকে কিছু বলবে কি? বলার মতো কিছুই ঘটেনি। তবু হয়তো আদিত্য বলবে, শাশ্বতীকে নিয়ে ললিতের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার কী রকম সব অনুভূতি হয়েছিল। আদিত্য সবাইকে সব কথা বলে দেয়।
অনেকক্ষণ ধরে দাঁত মাজছিল সে, বে-খেয়ালে। মা বারান্দা ঝাঁট দিতে দিতে ঝাঁটাটা বারান্দার কোণে আছড়ে বলল, দাঁতগুলো ক্ষয় করে ফেলবি।
শাশ্বতীর খেয়াল হল সে অনেকক্ষণ দাঁত মাজছে। তাদের বাড়ির পিছন দিকে পুকুর। যাওয়ার রাস্তাটা জুড়ে গত বর্ষায় ঘন হয়ে উঠেছে কচুকন, যাওয়া-আসার সময়ে গায়ে লাগে। একটা পাতা গায়ে লাগতেই টপ করে এক ফোঁটা শিশিরের জল তার হাত বেয়ে নেমে যায়। শিরশির করে ওঠে শরীর। কাঁটা দেয়। আর জন্মে তুমি শজারু ছিলে, সতী নিজেকেই সেকথা বলে আর হাসে।
পিছনে পুকুর পর্যন্ত তাদের বাড়ির সীমানা। অনেকটা জায়গা। আটচল্লিশ সালের গোড়ায় এসে বাবা এ-জায়গাটার দখল নিয়েছিল। তখন বাবা ছিল বিষয়ী লোক। কোন জমিটা সরেস, কোনটা নীরেস তা সঠিক বুঝত। বাবা পুকুরের গা ঘেঁষে, দু’পাশে রাস্তা হওয়ার সম্ভাবনা আছে দেখে তবেই দখল করেছিল জায়গা। সাত-আট কাঠা জমি। বুক-সমান উঁচু ঘেরাপাঁচিলে ঘিরে নিয়েছিল জমি। তখন রিফিউজি কলোনিতে জমির কাড়াকাড়ি চলছে, কে কোথায় বসে ঠিক নেই। বাবা ঠিক বসেছিল। এখনও এই কলোনিতে তাদের বাড়িটাই সবচেয়ে সুন্দর জায়গায়। তাদের জমিতে ছ’টা নারকেল গাছ, পিছনে পুকুর, সামনে বাগান, দু’পাশে রাস্তা। যখন এই বাড়িটার জন্ম হচ্ছে তখনই জন্মেছিল শাশ্বতী, এই বাড়িতেই। বাড়ির পিছনে এই কচুবনের মধ্যেই গোয়ালঘরের মতো একটা আঁতুড়ঘর, তার জন্মের তিন-চার মাস আগে থেকেই তুলে রেখেছিল তার বিষয় এবং সতর্ক বাবা। জন্মের আট-নয় বছর পরেও ঘরটা দেখেছে শাশ্বতী, সেই ঘরটা তখন সত্যিই গোয়ালঘর। তার ছোট ভাই বাচ্চু জন্মায় শাশ্বতীর জন্মের প্রায় দশ বছর পর। মা-বাবার সেই বয়সে সন্তান হওয়াটা বেমানান। বাচ্চু হঠাৎ হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চু হওয়ার সময়ে আর আঁতুড়ঘর তৈরি হয়নি, সে হয়েছিল শোয়ার ঘরেই। কারণ, তখন আর ঠাকুমা বেঁচে নেই, বাবা-মায়েরও নেই দেশগাঁয়ের সেই শুচিবাই। তারা অনেক পালটে গিয়েছিল। এখন আর সেই গোয়ালঘরটা নেই, গোরুটা মরে গেছে কবে। গাছগাছালি কেটে তৈরি হয়েছিল ঘরটা, আবার সব গাছগাছালিতে ঢেকে গেছে। যেমন উঠোনে যাবার সেই গুহার মতো গর্তটার জায়গায় আবার তকতক করছে উঠোন।
মুখ ধুয়ে পুকুর থেকে উঠে আসবার সময়ে শাশ্বতী ঘাটের পথটুকু দেখল। স্বপ্নের সেই মেঠো পথের সঙ্গে এই পথটুকুর কোনও মিল নেই। সে-পথটা, সেই লণ্ঠনের আলোয় যতটুকু দেখেছিল শাশ্বতী, দিগন্তজোড়া মাঠের ভিতর দিয়ে গেছে। সেটা অনেক দূরের পথ। আশ্চর্য, কোথা থেকে কোথায় যে যাচ্ছিল লোকটা। তার মুখ দেখেনি শাশ্বতী। যদি দেখত, তবে কি চিনতে পারত শাশ্বতী! সে কি চেনা লোক?
স্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই সুন্দর ভোরবেলায় আবার তার মন ভারী হয়ে গেল।
উঠোনে ঢুকবার মুখে শাশ্বতী দেখল সামনেই একটা বাধা। বাচ্চু ঘুমচোখে উঠে এসে বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে পথ জুড়ে পেচ্ছাব করছে।
শাশ্বতী বলল, অ্যাই!
ঘুম-জড়ানো বোকা চোখে বাচ্চু অবাক হয়ে চেয়ে আছে। ওর হাঁ-করা মুখ দিয়ে ভাপ বেরোচ্ছে। ওর বয়সের কথা কেউ খেয়ালই করে না। সকলের অনেক পরে জন্মেছে বলে সকলেই ওকে শিশুর মতোই দেখে। আদরে আদরে ও শিশুই রয়ে গেছে এখনও। খুব কচি মুখচোখ, বোধবুদ্ধি তেমন ফোটেনি।
শাশ্বতী দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। তারপর হেসে বলল, এই বাচ্চু, দাঁড়া, দেখাচ্ছি! এই ধরলাম….
সে হাত বাড়াতেই বাচ্চু পা মাটিতে ঠুকে চেঁচায়, অ মা!
মা বারান্দা থেকে বলে, ঠান্ডু, ওকে ছেড়ে দে।
শাশ্বতী বলে, তুই ঘাটের রাস্তায় পেচ্ছাব করছিস কেন?
বাচ্চু প্যান্ট নামিয়ে পিছিয়ে গিয়ে হাসে, ইল্লি…
উঠোনে ঢুকতে ঢুকতে শাশ্বতী মনে মনে হিসেব করল। করে অবাক হয়ে দেখল, বাচ্চুর বয়স এখন দশের কাছাকাছি। লীলাবতীর ঘটনা যখন ঘটে তখন বাচ্চু খুব ছোট। সে ঘটনাটা আট কি নয় বছরের পুরনো হয়ে গেল। লীলাবতীর মুখ আর মনেই পড়ে না, বাচ্চু লীলাবতীকে ভাল করে দেখেইনি। বাচ্চু বয়স এখন দশের কাছাকাছি ভেবে একটু অবাক হয় শাশ্বতী। না, আর বাচ্চুর সঙ্গে তার ও-রকম খেলা করা উচিত না।
উঠোনে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে খুরপি। বাবা এখন বাগানে ঢুকবে, তারপর সারা দিন ঘুরে-ফিরে বাগানেই থেকে যাবে। গাছগাছালির কাছাকাছি। এখন গাছপালা ভালবাসে বাবা, যত্নে বাগান করে। কিন্তু একটা সময়ে, বাবা যখন বিষয়ী লোক ছিল তখন বাগানের জায়গায় বাড়ি করে ভাড়া দেওয়ার কথা ভেবেছিল বাবা। কিন্তু রিফিউজির দখল করা জমির ওপর গভর্নমেন্ট ছাদওয়ালা বাড়ি করতে দেয়নি বলে সেটা হয়নি। জমিটায় বাগান করেছিল লীলাবতী— তার হাতের কামিনী আর শিউলি গাছ এখনও রয়ে গেছে। মা’র ঠাকুর পুজোর ফুল দেয়। বাবা তার গর্ত থেকে উঠে আসবার পর মানুষজনের সঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দিল খুব। গাছগাছালির খেলায় মেতে রইল। এখন বাবা গাছেদের সঙ্গে কথা বলে, সারা দিন ঘোরে তাদের কাছাকাছি। বাবার ব্ৰহ্মরন্ধ্র ভেদ করে সেই আমলকী গাছটা শেষ পর্যন্ত আর বেরোয়নি। কিন্তু বাবার সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে খানিকটা বিশ্বাস করে কিছু কৌতুহলী লোক অনেক দিন তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। বাবার মাথা থেকে গাছ বেরোয়নি দেখে হতাশ হয়েছে তারা। কিন্তু শাশ্বতী দেখে, বাবার শরীর গাছ হয়ে না গেলেও তার মধ্যে গাছগাছালির একটা স্বভাব এসে গেছে। নির্বিকার, নিরুত্তাপ, আবেগ নেই এতটুকু। সারা দিন প্রায় বোবা হয়ে থাকে বাবা। অনেকেই হয়তো ভাবে, লীলাবতীর স্মৃতি জুড়িয়ে আছে বলেই বাবা বাগানটা নিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু শাশ্বতী জানে যে, তা নয়। কারও জন্যই আর তেমন কোনও বোধ নেই বাবার। কতকাল ‘মলু’ ডাকটা আর শোনেনি শাশ্বতী! আসলে, বাবা সেই গুহার গর্তে বসে গাছেদের মতোই নির্বিকার হতে চেয়েছিল বোধ হয়। সেই চাওয়াটা পূর্ণ হয়েছে। কেবল মাঝে মাঝে পাগলামি দেখা দেয়। কিছু দিন পর আবার ঠিক হয়ে যায়। বাবা গাছেদের কাছে ফিরে যায়।
একমাত্র বাচ্চুর সঙ্গে ছাড়া বাবা স্বেচ্ছায় কারও সঙ্গেই কথা বলে না। কিন্তু বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে মাঝে মাঝে উত্তর পাওয়া যায়। অদ্ভুত সব উওর। লোকে এখনও বিশ্বাস করে বাবার ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়। হয়তো যায়। বাগানের বেড়ার পাশে পথের ওপর দাঁড়িয়ে এখনও অনেক লোক বাবার সঙ্গে কথা বলে, পরামর্শ চায়। অধিকাংশ সময়েই নীরব থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে বাবা উত্তর দেয়। লোকে বলে, সে-সব উত্তর মিলে যায়। কিন্তু শাশ্বতীরা জানে যে, বাবার কোনও যোগসিদ্ধ নেই, বাবা সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিল। মা’ও তাই জানে। তবু কখনও-সখনও শাশ্বতী লক্ষ করেছে মুশকিলে পড়লে মা বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, সমস্যার কথা বলে জিজ্ঞেস করে, তুমি কী বলো? তাদের লুকিয়ে জিজ্ঞেস করে মা, তবু তারা দেখেছে ব্যাপারটা।
বাবা তার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাবা এখন বাচ্চুর জন্য অপেক্ষা করছে। বাচ্চু মুখ ধুচ্ছে বারান্দার এক কোণে। মুখ ধুয়ে পান্টের দু’পকেটে মুড়ি আর ছোট্ট কাস্তে কিংবা কোদাল হাতে বাচ্চু এসে সমবয়স্ক বন্ধুর মতো বলবে, চলো বাবা। তারপর দু’জনে নিঃশব্দে বাগানে ঢুকে যাবে। সাড়ে সাতটা-আটটায় উঠবে কালীনাথ, তখন মাটিমাখা হাত ধুয়ে বাচ্চু এসে পড়তে বসবে।
বাবার আশেপাশে উঠোনে একটু ঘুরে বেড়াল শাশ্বতী। আঁচলে মুখের জল মুছে নিল। বাবা কি সব প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিতে পারে? শাশ্বতীর বিশ্বাস হয় না। তবু তার ইচ্ছে করে বাবাকে দু’-একটা প্রশ্ন করতে। কী উত্তর দেয় দেখাই যাক না।
কিন্তু করি করি করেও ইতস্তত করে শাশ্বতী। সংকোচ হতে থাকে। হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই দেখে বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে-চোখে কিছুই ছিল না, তবু হঠাৎ তার মনে হল এক্ষুনি তার কী একটা গোপন কথা বাবা জেনে যাবে।
শাশ্বতী বারান্দায় উঠে এল। বাচ্চু তার যন্ত্রপাতি হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মুখোমুখি হতেই তাকে মুখ ভেঙিয়ে দৌড়ে নেমে গেল বাচ্চু। বারান্দা থেকে শাশ্বতী দেখল বাগানের বেড়ার গেট খুলে আগে আগে বাচ্চু, আর তার পিছনে বাবা ঢুকে যাচ্ছে। গেট বন্ধ করার জন্য বাবা একবার পিছু ফিরল। ফিরেই সোজা বারান্দায় তার চোখে চোখ রাখল। শান্ত চোখে বোধহয় সদ্য ওঠা সূর্যের আলোর একটু ঝিলিক দেখা গেল। কিন্তু শাশ্বতীর মনে হল, বাবার চোখ সকৌতুকে হেসে উঠছে। ‘মানুষের দুর্বলতাগুলি আমি জানি।’ বুক কেঁপে উঠল তার। সে মুখ ফিরিয়ে নিল।
বাবা কি সত্যিই কিছু জানে? না কি সব ভুয়ো, ফক্বিকারি? তবু তার ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করতে রাত্রের দেখা স্বপ্নটার কথা, কিংবা আদিত্য আর ললিতের কথা, কিংবা তার নিজেরই কথা। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ভয় করে তার।
ঠিকে ঝি আজ কাজে আসেনি। একটু বেলা পর্যন্ত দেখে মা আর হৈমন্তী এঁটো বাসন কোসন নিয়ে ঘাটে যাচ্ছিল। পড়ার টেবিলে বসে খোলা বইয়ের সামনে জানালা দিয়ে বাইরে অন্যমনে তাকিয়ে ছিল শাশ্বতী। মাকে ঘাটে যেতে দেখে উঠে এসে বাসনগুলো নিয়ে বলল, আমি আর মেজদি সেরে দিচ্ছি, তুমি রান্নায় যাও।
শাশ্বতী পড়াশুনো করে বলে মা কখনও তাকে ঘরের কাজে ডাকে না। হৈমন্তী পড়াশুনোয় ভাল ছিল না, স্কুল ফাইনালের পর আর পড়া হয়নি। হৈমন্তী একটু বোকাও। বাড়ির কাজে সেই থাকে মায়ের সঙ্গে। কাজেই শাশ্বতী আর এগোয় না। কিন্তু আজ তার অন্যমনস্ক এবং কোনও কাজে ব্যস্ত থাকতে ইচ্ছে করছিল।
ঘাটে হৈমন্তীর মুখোমুখি বাসন মাজতে বসে সে হঠাৎ আচমকা জিজ্ঞেস করল, তুই কখনও দুঃস্বপ্ন দেখিস?
হৈমন্তী বলল, দেখি।
কীসের?
অনেক রকম।
ভূতের?
না। আমি দেখি সাপের।
শাশ্বতী ঠোঁট ওলটায়, দূর! সাপের স্বপ্নে জ্ঞাতি বাড়ে। তাতে তোর কী?
হৈমন্তী একটু ভেবে বলে, কী জানি?
আমি কাল একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখেছি।
কী?
একটা লোক লণ্ঠন হাতে হেঁটে যাচ্ছে।
বলতে গিয়ে শাশ্বতী বুঝল, স্বপ্নটা তার কাছে যতখানি ভয়ের, অন্যের কাছে ততটা নয়। তাই সে আর বলল না।
হৈমন্তী হাসল, তোর মাথায় পোকা। একটা লোক লণ্ঠন হাতে হেঁটে যাচ্ছে, তাতে ভয়ের কী?
শাশ্বতী চুপ করে অনেকক্ষণ একটানা বাসন মাজল।
হৈমন্তী জিজ্ঞেস করল, কাল তোরা কোথায় গিয়েছিলি?
শাশ্বতী হৈমন্তীকে আদিত্যর সব খবর দেয়। কোথায় গিয়েছিল, কোন রেস্টুরেন্টে কী খেয়েছিল, কিংবা কোন হল-এ কী সিনেমা দেখেছে— সব। হেমন্তী খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। তাকে উৎসাহ দেয়। খুবই সরল হৈমন্তী। শাশ্বতীর মাঝে মাঝে মনে হয়, হৈমন্তী তার দিদি নয়, ছোট বোন। সরল, বোকা, ভাল মেয়েটা।
শাশ্বতী হেসে বলল, ওর এক বন্ধুর অসুখ, তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
কলেজ পালিয়ে?
হুঁ।
কেমন দেখলি! কী অসুখ?
ক্যানসার।
মেসোমশাইয়ের মতো?
মেসোমশাইয়ের তো শ্বাসনালীতে ছিল। এরটা পেটে।
বাঁচবে?
শাশ্বতী ঠোঁট ওলটায়, কী জানি?
কেমন দেখলি?
চেহারা ভালই। অসুখ বলে মনেই হয় না।
তা হলে বাঁচবে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে হৈমন্তী
শাশ্বতী হাসে। তারপর বলে, লোকটা খুব চালাক। আমি ভদ্রলোককে সাহস দেওয়ার জন্য মেসোমশাইয়ের কথা বললাম, তারপর বললাম, দেখবেন, আপনি ভাল হয়ে যাবেন। উত্তরে একটু ঘুরিয়ে লোকটা বলল, আপনারা তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলুন, আমি যেন দেখে যেতে পারি।
আহা রে। হৈমন্তী বলল, কষ্ট হয়। কত বয়স?
বেশি না। ত্রিশ-বত্রিশ, কিংবা আর-একটু বেশি।
আদিত্যর মতো?
হ্যাঁ।
হৈমন্তী কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে, তারপর খুব মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে, আদিত্য বিয়ের কথা কিছু বলে না?
একটু অন্যমনস্ক ছিল শাশ্বতী, এই কথায় চমকে উঠে হেসে ফেলল। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, বলে। যখন বাই ওঠে তখন বলে, এক্ষুনি চলো রেজিষ্ট্রি করে আনি। আবার কখনও কখনও বিয়ের কথা ভুলে যায়।
তোরা রেজিষ্ট্রি করবি?
করব।
কেন?
শাশ্বতী একটু ভেবে বলল, ওর সঙ্গে আমাদের জাত মেলে না, সামাজিকভাবে করলে মা-বাবা-দাদার নিন্দে হবে।
বলতে বলতে হঠাৎ মনে মনে শিউরে ওঠে শাশ্বতী। গতকাল বিকেলে আদিত্য জাতের কথা বলেছিল। সে জাত আলাদা। অন্য রকমের এক জাতিভেদ। আদিত্য তাকে বুঝিয়েছিল, কিন্তু সে ভাল বোঝেনি। কিন্তু এখন হৈমন্তীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার মনে হল, সে নিজেও অনেক দিন ধরেই জানে যে, আদিত্যর সঙ্গে তার জাত মেলে না।
হৈমন্তী বলল, দাদা তো ওর সঙ্গে আমারও বিয়ে দিতে চেয়েছিল, সামাজিকভাবেই। তোরা রেজিষ্ট্রি করবি কেন?
করলে কী হয়?
হৈমন্তী বিষণ্ণ মুখে বলে,আমাদের বাড়ির দুটো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল, অথচ আলো জ্বলল না, বাজনা বাজল না, আমরা সাজলাম না— দূর, ভাবতে ভাল লাগে না।
শাশ্বতী হাসে, আমার বোধ হয় বউভাত-টউভাত হবে না।
হৈমন্তী মৃদু গলায় বলে, আদিত্যর বাপ-মা রাজি হবে না, না?
শাশ্বতী ঠোঁট ওলটায়, কী জানি! মনে তো হয় না।
হৈমন্তী বড় করে শ্বাস ছাড়ে হঠাৎ! তারপর আচমকা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে, পুরুষমানুষেরা কেমন হয় বল তো!
শাশ্বতী স্থির চোখে একটু হৈমন্তীকে দেখে। তারপর উত্তর না দিয়ে অন্যমনস্ক থাকে একটু। আশ্চর্য যে এই প্রশ্নটা তারও মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরুষমানুষেরা কেমন হয়?
পুকুরের ও-পারে হাজরাদের বাড়ি। ঘাট থেকে শিবানী ডাকল।
সতী!
শাশ্বতী মুখ তুলে হাসল, কী রে!
বাসন মাজছিস! ঝি আসেনি?
না।
কলেজ যাচ্ছিস?
যাব।
আমি যাচ্ছি না।
কেন?
জামাইবাবু এসেছে। আজ ম্যাটিনি শো-তে সিনেমায় যাব।
কী ছবি?
কী যেন…বলে হাসল, শক্ত নাম। ভুলে গেছি। হিন্দি। দেবানন্দ ওয়াহিদা। তুই যাবি? টিকিট আছে।
না রে।
শিবানী হাসল, জানতাম, যাবি না। কলেজের পর কোথায় যাচ্ছিস?
কোথাও না।
ইস। শিবানী হাসল, জানি।
শিবানী ঘাট থেকে উঠে গেল। হৈমন্তী গুনগুন করে শাশ্বতীর কাছে শিবানীর নিন্দে করছিল, বেহায়া, পাড়া-বেড়ানি, আড্ডাবাজ। শাশ্বতী মন দিয়ে শুনল না। কেবল একবার হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বলল, আমাদের কেউ প্রশংসা করে না।
হৈমন্তী চুপ করে গেল।
কথাটা বলেই শাশ্বতীর মনে পড়ল যে, এখনও তাদের পরিবারের নিন্দের কথা আদিত্য জানে না। লীলাবতীর ঘটনা তাকে কেউ বলেনি। জানলে কী করবে আদিত্য? ভেবে পেল না শাশ্বতী। হয়তো হো হো করে হেসে বলবে, দূর। ও কিছু না। কিংবা হয়তো গম্ভীর হয়ে বলবে, একথা এত দিন বলোনি কেন? দুটোর যে-কোনওটাই করতে পারে আদিত্য। তার সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। শাশ্বতীর মনে হয় অনেক আগেই তার আদিত্যকে লীলাবতীর ঘটনাটার কথা বলে দেওয়া উচিত ছিল। অন্য কারও কাছ থেকে শোনার আগে তার কাছ থেকে শুনলেই ভাল হত। কেন বলেনি সে?
সারা সকাল হৈমন্তী আর মা’র সঙ্গে ঘরের কাজ করল শাশ্বতী, মশারি তুলে বিছানা ঝাড়ল, ঘর মুছল, ঠাকুর পুজোর জল আনল পুকুর থেকে। বই নিয়েও বসল একটু। পড়া হল না।
পুরুষমানুষেরা কেমন হয়?
কালীনাথ ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বসে বসে চা খাচ্ছে। তার সামনে মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসেছে বাচ্চু। রান্নাঘরে হৈমন্তী। ঠাকুরঘরে মা। বাবা বাগানে একা।
শাশ্বতী পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠোনে এল। কয়েক পা এদিক-ওদিক হাঁটল। তারপর আস্তে বাগানের গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেল।
ঘন গাছপালার একটা আলাদা জগতের মধ্যে চলে এল সে। ভেরেন্ডাগাছের উঁচু বেড়ার আড়ালে তাদের বাগান। শান্ত। নিস্তব্ধ। ঠান্ডা। হাঁটতে গেলে গাছপালা গায়ে লাগে। সরসর শব্দ হয়। শিউরে ওঠে শাশ্বতীর শরীর। এখানে ততখানি আলো নেই। একটু ঝুপসি আলো-আঁধারি। এর মধ্যে বাবাকে প্রথম দেখতে পেল না শাশ্বতী। অনেকটা বড় তাদের বাগান। সে পায়ে পায়ে গাছপালার ভিতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। বাচ্চুর তৈরি করা নুড়িপাথরের কৃত্রিম পাহাড়, তার পাশ দিয়েই গেছে আঁকাবাঁকা লাল সুরকির ক্ষুদে রাস্তা, রাস্তার মাঝখানে একটা চত্বরে পিচবোর্ডের তৈরি ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাফিক পুলিশটার গায়ে একটা সাদা কাগজ আঠা দিয়ে লাগানো, তাতে লেখা— বাবা ওই দিকে। নিচু হয়ে লেখাটা পড়ে শাশ্বতী হাসে, ট্রাফিক পুলিশটার ডান হাত যে-দিকে দেখিয়ে দিচ্ছে সে দিকে তাকিয়ে সত্যিই বাবাকে দেখল শাশ্বতী। গোলাপের ডাল মাটিতে পুঁতে তার ডগায় গোবরের ঢিবি লাগাচ্ছে বাবা। ট্রাফিক পুলিশটার দিকে তাকিয়ে আবার একটু হাসে শাশ্বতী। এটা বাচ্চুর বুদ্ধি। বাবা যখন যে-দিকে থাকে সে-দিকে ওটাকে ঘুরিয়ে রাখে। কিংবা হয়তো বাবাই ঘুরিয়ে দেয়, বাচ্চুর বাবাকে খুঁজতে সুবিধে হবে বলে।
গত তিন-চার মাস আর বাগানে আসেনি শাশ্বতী। গত বর্ষায় জঙ্গল বেড়ে গেছে। বাবার কাছে না গিয়ে একটু এদিক-ওদিক ঘুরল! বাবা তাকে লক্ষ করল না। তারপর ধীর পায়ে আস্তে সে বাবার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। অনেক—অনেক দিন হয় সে বাবার সঙ্গে কথা বলেনি। তার লজ্জা করছিল।
তারপর ঝুপ করে মাটিতে বসল সে। বলল, বাবা, এই সময়ে কেউ গোলাপের ডাল লাগায়? বর্ষাকালে লাগাতে হয়।
বাবা উত্তর দিল না। কিন্তু খুব ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে শান্ত চোখে তাকে একবার দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল।
শাশ্বতীর বুক ঢিবঢিব করে। বাবা কি বুঝতে পারছে যে সে আসল কথা বলার আগে একটা ভূমিকা করছে?
অনেকক্ষণ পর বাবা হঠাৎ তার প্রশ্নের উত্তর দিল। খুব আস্তে গলায় বলল, লাগানো যায়। একটু বেশি জল দিতে হয়।
একটু সাহস পায় শাশ্বতী। বলে, অনেক আগাছা হয়েছে। পরিষ্কার করো না কেন?
বাবা চুপ করে কাজ করতে থাকে। উত্তর দেয় না।
অস্বস্তিতে মাটিতে একটু পা ঘষে শাশ্বতী। জামরুল গাছটার ডালে ছোট্ট মৌচাক—মৌমাছি উড়ছে। ঘাসের ওপর দিয়ে কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে হলুদ প্রজাপতি। পোকামাকড়ের শব্দ হয়। ঝিঁঝি ডাকে। শান্ত, সুন্দর, ঠান্ডা ছায়ায় ঝিম মেরে আছে বাগানটা। একটু দূর থেকে বাচ্চুর ট্রাফিক পুলিশ তার দিকেই আঙুল উঁচিয়ে আছে।
শাশ্বতী হঠাৎ শান্ত গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা, আমার কী হবে বলো তো! আমার ভবিষ্যৎ কী?
বাবা উত্তর দেয় না। কেবল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে শান্ত চোখে দেখে। চোখ ফিরিয়ে নেয়। শাশ্বতীর বুক কাঁপে। ভয় করে।
কাল রাতে আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। শাশ্বতী বলল।
বাবা কিছু জিজ্ঞেস করল না।
তবু শাশ্বতী জোর করে বলল, একটা লোক লণ্ঠন হাতে মেঠো পথ দিয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। লোকটার মুখ দেখিনি, কিন্তু মনে হয় মুখ দেখলে আমি চিনতে পারতাম। বলে শাশ্বতী থামে, তারপর জিজ্ঞেস করে, লোকটা কে বলো তো!
বাবা উত্তর দেয় না। খুরপির ধার দিয়ে হাতের গোবর চাঁচে। হাতে মাটি মাখতে থাকে। ঘাসের ওপর হাত ঘসে।
শাশ্বতী বাবার দিকে একটু চেয়ে থাকে। তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, কাল আদিত্য আমাকে সন্দেহ করেছিল কেন? আমি ললিতকে সুন্দর দেখেছিলাম কেন? আমি কাল একটা মিথ্যে কথা বলেছিলাম কেন?
কিন্তু তার লজ্জা করল। বাবা সেই আগেকার মতো বাবা আর নেই। গাছের মতোই উদাসীন। ইচ্ছে করলে জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু শাশ্বতী পারল না। তবু অনেকক্ষণ বসে রইল শাশ্বতী। তারপর হঠাৎ সচেতন হয়ে হাসল।
দূর! বাবা সত্যিই কিছু জানে না। বাবা পাগল।
সে একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।
চলে আসছিল শাশ্বতী। হঠাৎ শুনল বাবা খুব মৃদু স্বরে বলল, সাবধানে থেকো। পড়ে যেয়ো না।
সে চমকে ঘুরে দাঁড়াল। বাবা গোলাপ-ডালটার সামনে নিচু হয়ে বসে আছে, মাটির দিকে চোখ। না, শাশ্বতীকে নয়। বোধ হয় গাছটাকে বলছে বাবা। শাশ্বতী লক্ষ করে গোবরের ঢিবির ভারে গাছটা নয়ে পড়েছে মাটির দিকে। হ্যাঁ, গাছটাকেই সাবধান করছে বাবা, সাবধানে থেকো। পড়ে যেয়ো না।
শাশ্বতী মুখ ঘুরিয়ে নিল। সে বাচ্চুর ট্রাফিক পুলিশটাকে পার হল, চলে এল বাগানের গেটটার কাছাকাছি। গেট খুলে বেরিয়ে আসবার সময়ে তার এমনিই মনে হল, বাবা ওই কথা বলেছে শুধু গাছটাকে নয়। শুধু গাছটাকে নয়…
স্নান করতে যাওয়ার সময়ে সে মাথায় তেল ঘষতে ঘষতে হৈমন্তীকে বলল, আজ সিনেমায় যাবি? আমার কলেজ যেতে ইচ্ছে করছে না। যাবি তো বল, দাদার কাছ থেকে টাকা চেয়ে রাখি।
হৈমন্তী হাসল, আমার সঙ্গে তোর ভাল লাগবে? লাগলে যাব।
স্নান করে এসে আবার কী একটু ভাবল শাশ্বতী। আজ কলেজে একবার আদিত্য আসতে পারে। এখন, কালকের পর তাদের একবার দেখা হওয়া দরকার। কালীনাথ বেরিয়ে যাচ্ছে দেখেও শাশ্বতী টাকা চাইল না।
হৈমন্তী জিজ্ঞেস করল, দাদাকে বললি না?
থাক গে, শাশ্বতী বলে, আজ কলেজেই যাই। কাল-পরশু দেখব।
কলেজে যাওয়ার সময়ে চলন্ত বাস থেকে শাশ্বতী একটা পোস্টার দেখল। দেবানন্দের সুন্দর মুখ হাসছে। শিবানীরা আজ সিনেমায় যাচ্ছে। চলন্ত বাস থেকে ছবিটার শক্ত নামটা পড়তে পারল না শাশ্বতী। পেরিয়ে গেল। সিনেমায় গেলেও মন্দ হত না। গেল না বলে হৈমন্তীর মন খারাপ হয়ে গেল বোধ হয়। কিন্তু কলেজে যাওয়াটাই আজ দরকার শাশ্বতীর। আজ কোনও একটা ঘটনা ঘটবে। তার মন বলছে।
তেরো
বস্তুত সেদিন কলেজে কিছুই ঘটল না।
টানা তিনটে পিরিয়ড করল শাশ্বতী, সম্পূর্ণ অন্যমনস্কভাবে। দু’-এক লাইন নোট টুকল খাতায়, বাদবাকি সময় অপটু হাতে কয়েকটা ছবি আঁকল। ছবিগুলো সবই পুরুষমানুষের মুখের। কিন্তু একটা মুখও সুন্দর হল না।
তৃতীয় পিরিয়ড তার ফাঁকা। ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে সে বারান্দা পেরোল আস্তে ধীরে। কমনরুমে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময়ে রাকার সঙ্গে দেখা। রাকার পোশাক সবসময়ে ঝকমকে। সাত দিনে সাত রকমের শাড়ি পরে আসে। মেয়েরা ওকে খ্যাপায় মিস ওয়ার্ডরোব বলে। বাড়ির মোটর গাড়ি ওকে কলেজে পৌঁছে দেয়, নিয়ে যায়। ভারী হাসিখুশি মেয়ে রাকা। কখনও মুখ ভার করে থাকে না। অশ্লীল কথা বলে অনায়াসে সে, ঠিক পুরুষদের মতো।
তাকে দেখে রাকা দু’হাত বাড়িয়ে বলল, আরে গোমড়ামুখী, তোর এখন অফ পিরিয়ড না?
শাশ্বতী মৃদু হাসল, বলল, পর পর দু’পিরিয়ড অফ। তারপর এস. বি-র ক্লাস।
রাকা সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল, তা হলে চল, আমার গাড়িতে একটু ঘুরে আসবি। দাদা গাড়ি নিয়ে এসেছে, একটু রেডিয়ো-স্টেশনে যাব। আজ আমার অডিশন। কী ভয় করছে রে! দ্যাখ বুকে হাত দিয়ে কেমন ধুপধাপ হাতির পা পড়ছে…বলতে বলতে শাশ্বতীর হাত টেনে বুকে চেপে ধরল রাকা, তারপর চোখ গোল করে জিজ্ঞেস করল, টের পাচ্ছিস!
শাশ্বতী কিছু বুঝল না, হাত টেনে নিয়ে বলল, তুই একা যা। আমার ভাল লাগছে না।
রাকা মুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে বলল, একটা বন্ধুও যেতে চাইছে না। সব শালি আমাকে ইগনোর করে। এদিকে আমি যে কী ভীষণ ভয় পাচ্ছি।
শাশ্বতী জানে রাকার ভয়-ডর বলে কিছু নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে ভান করে। এর আগে বোধ হয় তিন-চারবার রেডিয়োতে অডিশন দিয়েছে রাকা। একবারও সুযোগ পায়নি। আসলে ছটফটে বলে কোনও কিছুই মন দিয়ে শেখে না ও। ক’দিন গান গায়, ক’দিন সেতার বা সরোদ শেখে, কিছু দিন নাচের স্কুলে গিয়েছিল, এক বছর নষ্ট করেছে আর্ট কলেজে, মাঝেমধ্যে কবিতাও লিখে ফেলে গাদা গাদা। তারপর আবার রাকা ছটফটে আড্ডাবাজ, আমুদে রাকা হয়ে যায়। কোনও শিল্পকর্মই তার ভিতরে গাম্ভীর্য আনে না। তার বিলিতি রঙের দামি টিউবগুলো পচে নষ্ট হয়, সেতারি সরোদ পড়ে থাকে, কবিতার খাতা হলদে হয়ে যায়, খামোখাই গানের স্কুলে মাসে মাসে মাইনের টাকা জমা পড়ে। আবার ঝোঁক চাপলে পনেরো দিনের মধ্যেই বড় গায়িকা কিংবা সেতারি কিংবা আঁকিয়ে হওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লাগে।
রাকা হঠাৎ মুখে-চোখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার দাদাকে তোর মনে নেই? সেই যে একবার কলেজ ছুটির পর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলুম! তারপর কত দিন দাদা তোর চোখ আর চুলের প্রশংসা করেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছে তোর চুল চোখ অরিজিনাল কি না। আজকালকার মেয়েরা তো চুল চোখ তৈরি করতে পারে। আর আমার দাদাকেও তো তুই দেখেছিস! ও-রকম হ্যান্ডসাম ক’জন আছে? বলে চোখ নাচাল রাকা, শাশ্বতীর হাত ঝপ্ করে টানতে টানতে বলল, জীবনে উন্নতি করতে চাস তো শিগগির চল। আমি যখন ভিতরে অডিশন দেব, তখন তুই আর দাদা দু’জনে দু’জনকে অ্যাডমায়ার করবি। আয়…
ব্যাপারটা যে শাশ্বতী জানে না তা নয়। মাঝেমধ্যে রাকা তার দাদার কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে বলেছে। নিয়ে যেতে চেয়েছে তাদের বাড়িতে। শাশ্বতী যায়নি।
কোথায় যেন দুর্বলতা থাকে। থেকে যায়। মানুষে তা বুঝতে পারে, কিন্তু কিছু করার থাকে না। মাস দুই আগেই বোধ হয়, কলেজ ছুটির পর ওরা একসঙ্গে বেরোচ্ছিল। কলেজের গেটের সামনে একটা সবুজ রঙের হেরাল্ড গাড়ির বাফারে পা তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক সাতাশ-আটাশ বছর বয়সের ভদ্রলোক। ফরসা টকটকে রং, বিশাল কাঁধ, পেশিবহুল দুখানা হাত। নিজের সৌন্দর্য দেখাতে জানেন ভদ্রলোক। পরনে ছিল গ্রে রঙের চাপা একটা দামি প্যান্ট, গায়ে চেক-ওলা একটা স্পোর্টস শার্ট। চোখে চমৎকার একটা সবুজ রোদ-চশমা। রাকা সব বন্ধুকে ডেকে তার দাদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। কয়েক মিনিটের মাত্র পরিচয়। তারপরই তারা ভাইবোনে হেরাল্ড গাড়িটার সামনের সিটে বসে, তাদের দিকে একটু মিষ্টি হেসে, হাত নেড়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। রাকা আর তার দাদার সেই চলে যাওয়ার দৃশ্যটি আজও স্পষ্ট মনে আছে শাশ্বতীর। সেই গাড়ি থেকে হাত নেড়ে হেসে চলে যাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত আভিজাত্যের সৌন্দর্য ছিল। যে-সৌন্দর্য নিজেদের পারিবারিক জীবনে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি শাশ্বতী। সেই সৌন্দর্যটুকু আজও কাঁটার মতো ফুটে আছে মনে। কলেজের বন্ধুদের দেখানোর মতো গাড়ি নেই শাশ্বতীর, নেই অমন সুন্দর চেহারার স্মার্ট একটি দাদাও। যত বার ‘হিংসে করব না’ বলে ভাবে শাশ্বতী তত বারই নিজের কাছে নিজে হেরে যায়।
ওই যে একটু তার প্রশংসা করেছে ভদ্রলোক, যা সে রাকার মুখে শুনল, তাইতেই মনটা একটু ছটফটে চঞ্চল হয়ে গেল তার। এ তার মেয়েমানষি দুর্বলতা, সে জানে। তাই রাকা টেনে নিয়ে গেল, আর সেও ‘যাব না, যাব না’ বলতে বলতে চলে এল কলেজের বাইরে। এবং মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেতে লাগল।
আজ হেরাল্ড গাড়িটা ছিল না। তার বদলে সাদা রঙের একখানা অ্যাম্বাসাডার মার্ক টু দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কটা গাড়ি আছে কে জানে। আজ রাকার দাদা বাইরে দাঁড়িয়ে নেই। স্টিয়ারিং হুইলে হাত দু’খানা অলসভাবে ফেলে রেখে, মাথা পিছনে হেলিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। রোদ-চশমায় ঢাকা চোখ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় মার্কিন টুরিস্ট।
তাকে দেখেই বোধ হয় টুক করে দরজা খুলে নামলেন ভদ্রলোক। রাকা কিছু বলার আগেই ঈষৎ হেসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করলেন, চিনতে পারছেন?
লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল শাশ্বতী। ঘাড় নাড়ল সম্মতির। হ্যাঁ, সে চিনতে পারছে।
রাকা কলকল করছিল ইতিমধ্যেই, ওকে ধরে নিয়ে এলাম দাদাভাই, একা যেতে আমার একটুও ভাল লাগে না। তা ছাড়া দেখি ওর লাক-এ এবার হয় কি না!
খুব খুশি হল রাকার দাদা, বলল, আরে, আসুন আসুন। আপনি গেলে তো কথাই নেই। আবার আমরা ভাইবোনে গাড়িতে করেই পৌঁছে দেব আপনাকে। আসুন…
কেন যেন শাশ্বতী বুঝতে পারছিল যে, তার যাওয়া উচিত নয়। তার মন চাইছিল না। তবু, সে বড় দুর্বল। কখনও কখনও প্রতিরোধের সমস্ত শক্তি চলে যায় তার। যে যা খুশি করিয়ে নিতে পারে তাকে দিয়ে। মিনমিন করে সে কী একটু আপত্তি করল বটে। কিন্তু রাকার কলকলানি আর তার দাদার ভরাট গলার হাসিতে সেটুকু চাপা পড়ে গেল।
রাকার দাদাকে বেশ ছেলেমানুষের মতো দেখতে। ‘ছেলেটা’ বললেই মানায়, ‘ভদ্রলোক’ বলে উল্লেখ করতে বাধো বাধো লাগে। সামনের সিটে তারা তিন জন বসল। মাঝখানে রাকা। জানালার পাশে শাশ্বতী— লাজুক, নতমুখে।
গলায় আঁচল জড়িয়ে রাকা বলল, বাব্বাঃ, হাওয়া লাগাব না।সে-বার গানের মাঝখানে গলা ফেঁসে গিয়েছিল।
তার দাদা হাসল। ভারী সুন্দর চিকমিকে দাঁত দেখা গেল তার, যেন শ্বেতপাথরে তৈরি। বলল, তোর কোনও দিন হবে না। তোর ধৈর্য নেই। তারপর শাশ্বতীর উদ্দেশে বলল, জানেন, রাকার একদল গানের মাস্টারমশাই বাড়িতে আসেন, ওস্তাদ মানুষ, খুব নামডাক, সেই ভদ্রলোককে বসিয়ে রেখে ও বত্রিশ বার জল খেতে বাড়ির ভিতরে যায়, আর গিয়ে আমাদের সঙ্গে রাজ্যের ইয়ার্কি দিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করে আসে, ওস্তাদজি হাঁ করে বসে থাকেন।
যাঃ! বলে হেসে লুটিয়ে পড়ল রাকা, বলল, কী করব, তেষ্টা পায় কেন? মাইরি, গানের সময় আমার যত তেষ্টা, মাথা চুলকোনো, পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরা— কেমন যে করে!
গাড়িটা যখন বাঁক নিচ্ছে বড় রাস্তায় ওঠার সময়ে ঠিক তখনই আদিত্যকে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে আসতে দেখল শাশ্বতী। হাওয়ায় রুক্ষ চুল উড়ছে, শ্রীহীন মুখখানা ধুলোটে আর কেমন তেলতেল করছে শিরা-ওঠা প্রকাণ্ড কপালখানা। জামা-কাপড়ের ভাজ নেই। উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে তাকে। বড়লোকের গাড়িতে একটি সুন্দর পুরুষমানুষের কাছাকাছি বসে চলে যেতে যেতে দৃশ্যটাকে খুব করুণ লাগল শাশ্বতীর। সে একটু চমকে উঠেছিল প্রথমটায়। সামলে নিল। আদিত্য লম্বা লম্বা পা ফেলে যাচ্ছে তারই কলেজের দিকে। গিয়ে বেচারা হতাশ হবে। কিন্তু শাশ্বতী আর ফিরে তাকাল না। কী একটা জিজ্ঞেস করছিল রাকার দাদা। অন্যমনস্ক শাশ্বতী শুনতে পায়নি। এবার ঝুঁকে বলল, উঁ! সে কিছুতেই বলতে পারল না, বলতে তার ইচ্ছে করল না যে, গাড়ি থামান। ওই চলেছে আমার প্রেমিক, আমারই খোঁজে। আমি ওর কাছে যাব। এই সুন্দর মানুষটির কাছে ওই শ্রীহীন জিরাফের মতো লোকটাকে প্রেমিক বলে পরিচয় দিতে তার লজ্জা করল।
শাশ্বতী ঠিকই দেখেছিল। সত্যিই আজ বড় কুশ্রী দেখাচ্ছিল আদিত্যকে। চলন্ত গাড়ি থেকে একপলকে শাশ্বতী তবু ভাল করে দেখেনি। দেখলে দেখতে পেত, একদিনের মধ্যেই কণ্ঠার হাড় উঁচু হয়ে গেছে তার, গাল বসে গেছে, চোখ গেছে কোটরে, দাড়ি কামানো হয়নি, স্নান হয়নি, ভাত খাওয়া হয়নি তার কাল রাত থেকে।
কাল বিকেলে শাশ্বতীর সঙ্গে সে যে অদ্ভুত ব্যবহার করেছিল সেই থেকেই মেজাজ ঠিক ছিল না। সন্ধেবেলা সে তাদের দুর্গের মতো বাড়িটিতে ফিরে প্রথম মহল পার হয়ে দ্বিতীয় মহলের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার বারান্দায় উঠেই একটা দেড়শো বছরের পুরনো দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল। যে-দৃশ্যটা ধনতান্ত্রিকতার নিখুঁত একটি ছবি। চিক-দেওয়া বারান্দায় পাথরের মেঝেতে পাতা ছোট্ট গালিচার আসনে চওড়া পাড়ের শাড়ি পরা মা বসে ভারী জাঁতিতে সুপুরি কাটছে। কোলের কাছে নানা রকমের খোপওয়ালা পানের বাটা, প্রতিটি খোপে রয়েছে নানান মশলা। মা’র হাতে ঝকমক করছে ভারী সোনার গয়না, পিঠের আঁচল চাবির ভারে ঝুলে আছে। আধো-ঘোমটায় ঢাকা মায়ের ঢলঢলে সুখী বোকা মুখখানা। মায়ের হাঁটুর কাছে বাবার চটিপরা পা নড়ছে। বাবা বসে আছে কাঠের জালিকাজ করা সিংহাসনের মতো দেখতে প্রকাণ্ড গদিওলা চেয়ারে, সামনে পাথরের টেবিল। টেবিলের ওপর রুপোর রেকাবে কাটা ফল, রুপোর গ্লাসে জল। পিছনে চাকর দাঁড়িয়ে খুব বড় হাতপাখায় বাতাস করছে।
দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ আগাপাশতলা জ্বলে গেল আদিত্যর। একসময়ে কলেজ-জীবনে ললিত তাকে রাজনীতি শিখিয়েছিল। সেগুলো কোনও দিনই ভাল বোঝেনি আদিত্য। কিন্তু তার ফলে নিজেদের অবস্থার প্রতি একটা বিদ্বেষ গজিয়েছিল তার। তার ওপর রমেনকে দেখে সে শিখেছিল নিজেকে ঘেন্না করতে। সেইসব বিদ্বেষ ঘৃণা মনের কোন অন্ধকার জল ঘোলা করে তলানি থেকে উঠে এল।
সে ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় ছাড়ল নিঃশব্দে। তারপর শুয়ে রইল বিছানায়, অন্ধকার ঘরে। সে এই পরিবারে, এই বাড়িতে জন্মেছিল বলে নিজেকে ধিক্কার দিল অনেক। বিকেলে যা ঘটেছিল তার সবটুকু বিষ উঠে এল তার গলায়। সে বুঝতে পারল, এ-বাড়ির ছেলে হয়ে লেখাপড়া শিখতে যাওয়া তার উচিত হয়নি, ঠিক হয়নি শাশ্বতীর সঙ্গে প্রেম করতে যাওয়া। তার জাত আলাদা। শাশ্বতীকে নয়, আসলে তার সন্দেহ নিজেকেই । প্রতি মুহুর্তেই ভয়, শাশ্বতীর সঙ্গে বুঝি তারে মানায় না। সবসময়ে সন্দেহ, ললিত যেন তাকে কোথায় হারিয়ে দিয়ে রেখেছে, কিংবা রমেন বুঝি জন্ম থেকেই মহাপুরুষ, যার নাগাল তার সাধ্যাতীত। এইসব সন্দেহ তাকে কুরে কুরে খায়।
শুয়ে থেকে সে এই বিষজ্বালা টের পাচ্ছিল। গলার কাছে, জিভে দাঁতে উঠে আসছে বিষ। এক্ষুনি ঢালতে হবে কোথাও। নইলে সে রাগে, বিদ্বেষে, ঘৃণায় নীল হয়ে যাবে বুঝি।
ঠিক সেই সময়েই অন্ধকার ঘরে এল মা। চুড়ি বালার ঝন শব্দ করে ঠান্ডা হাতখানা কপালে রেখে বলল, খোকা, তোর শরীরটা ভাল নেই! শরবত খেলি না যে!
অমনি ফণা তুলল আদিত্য। ছিটকে উঠে বলল, চলে যাও, চলে যাও, আমাকে ছুঁয়ো না। তোমার গায়ে বন্দকি সোনার গয়না…
তার চিৎকার শুনে বাবা বারান্দা থেকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
ফুঁসে উঠল আদিত্য। উপর্যুপরি ছোবল মারতে লাগল চারদিকে। অন্ধের মতো। কী বলেছিল তা আর আজ খেয়াল নেই তার। বোধ হয় বলেছিল, আপনি কেন লেখাপড়া শেখেননি!…কেন কোনও দিন মূল্য দেননি মানুষকে?…কেন আত্মসম্মান ভাসিয়ে খদ্দেরদের ‘বাবু’ বলে ডাকেন এখনও?…কেন আপনার জন্য বন্ধুদের কাছে আমার মুখ দেখাতে লজ্জা করবে?…
সে-সব উলটোপালটা কথার কোনও মানেও হয় না। কিন্তু তাতে অপমানের বিষটা ঠিকই ঢালতে পেরেছিল আদিত্য। তার বাবা কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইলেন তার দিকে। ফলটল তখনও খাওয়া হয়নি।
তারপর তুমুল কাণ্ড হয়েছিল অনেক। চেঁচামেচি, কান্না, শরিকির অংশ থেকে জ্ঞাতিরাও চলে এসেছিল। বাবা চটি খুলেছিলেন মারতে। বহুকাল তিনি তাঁর এই শিক্ষিত ছেলেটিকে সমীহ করে চলেছেন। কিন্তু কাল রাতে আর পারেননি।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য চটিটা ব্যবহৃত হয়নি। বাবা বলেছিলেন, তোমার সবকিছু বদহজম হয়েছে। লেখাপড়াটড়া সব। তুমি রোগগ্রস্ত, কিন্তু সেটা টের পাচ্ছো না। এখনই দূর হও এ-বাড়ি থেকে।
কাল সারা রাত আদিত্যর কেটেছে ফাঁকা আস্তাবলে। মশা আর পোকার উপদ্রবে, আর নিজস্ব হলাহলে জেগে থেকেছে সারা রাত। মাইনের টাকা মাসের দশ তারিখের মধ্যে ফুরিয়ে যায় তার। এরপর থেকে মা দেয় হাতখরচ, মাসে প্রায় তিন-চারশো টাকা। কাল পকেটেও কিছু ছিল না। গড়িয়াহাটা থেকে ট্যাক্সিতে ফিরেছিল, ফলে অবশিষ্ট ছিল দু’-তিন টাকার মতো। নইলে গতকাল রাতেই সে বেরিয়ে পড়ত। পকেটে টাকা না থাকলে সে এখনও কোথাও যেতে ভরসা পায় না।
সকালে মা এসে চুপি চুপি পাঁচশো টাকা দিয়েছে তার হাতে, বলেছে, কোথাও গিয়ে দু’-দশদিন থেকে আয়। বাবুর রাগ কমলে আবার ফিরে আসিস। বড় রেগে আছে বাবু। আমি তোর সুটকেস-টুটকেস লুকিয়ে গুছিয়ে এনে দিচ্ছি। তুই বরং নিমতেঘোলায় তোর মেজোমামার কাছে গিয়ে থেকে আয় ক’দিন। কাছেই তো…
সুটকেস আর পাঁচশো টাকা নিয়ে সকালে বেরিয়েছে আদিত্য। সুটকেসটা রেখে এসেছে এক বন্ধুর মেসে, কলেজ স্ট্রিটে। তারপর সারা দিন ঘুরছে। কলকাতা শহরটাকে এমন ধূসর মরুভূমির মতো তার আর কখনও লাগেনি। নিজেকে মনে হয়নি এমন অসহায়। আসলে, দিনের শেষে নিরাপদ আশ্রয় বাগবাজারের সেই দুর্গের মতো বাড়িখানায় আর ফিরে যেতে পারবে না, অবচেতন মনে এই চিন্তাই তাকে ভীষণ ভিতু আর অস্থির করে তুলছে। এখন কোথায় যাবে সে, কীভাবে থাকবে? সে কি পারবে নিজস্ব চাকর ছাড়া? সে কি পারবে নিজস্ব আলাদা ঘর, রোজ চাদর বদলানো বিছানা, শোওয়ার আগে এক গ্লাস দুধ ছাড়া? সে কোনও দিন চেয়ে খায় না। মা নিজে বসে তার খিদে বুঝে খাওয়ায়। নতুন জায়গায় সে কী করে চেয়ে খাবে? তা ছাড়া এক ওই বাড়ির লোকজন আর দাসদাসীরাই সহ্য করে তার উগ্র মেজাজ, তাকে তারা বোঝে, আর কেউ বুঝবে কি? নিজের সম্বন্ধে এইসব অনিশ্চয়তা তাকে আরও অস্থির করে তুলেছিল সকাল থেকে। বন্ধুর নোংরা মেসে সে এক গ্রাসও ভাত খেতে পারেনি। কলাইকরা থালা দেখে বমি উলটে এসেছিল।
আজ অফিস করেনি আদিত্য। কেবল ঘুরেছে আর ঘুরেছে। কয়েকটা বাসারও খোঁজ করেছে সে। পায়নি। কলকাতায় বোধহয় কেউ আর ঘর ভাড়া দিচ্ছে না।
দুপুরের পর শাশ্বতীর অফ-পিরিয়ডটা কখন তা তার মনে ছিল। শাশ্বতীর রুটিন তার মুখস্থ। সেই সময়েই সে এসেছিল শাশ্বতীর কাছে। পেল না। কলেজের দারোয়ান বলল, একটু আগেই শাশ্বতী চলে গেছে। এক দিদিমণির গাড়িতে।
খুব ধীরে ধীরে বড় রাস্তার মোড়ে এসে আদিত্য একটা সিগারেট ধরাল। ক্লান্ত লাগছিল খুব। গাড়িতে কোথায় গেল শাশ্বতী? এখন তাকে কাছে পেলে হয়তো একটু ভাল লাগত আদিত্যর।
আশ্চর্য এই যে, কোনওকালে কোনও অনিশ্চয়তাকে বোধ করেনি সে। বরাবর জানত সে যাই হোক, যাই করুক, তার পিছনে দুর্গের মতো বিশাল আশ্রয়টি আছে। স্বার্থপর লোভী লোকটি তার বাবা, তবু বটগাছের মতো তিনি আছেন মাথার ওপর। এখন সে তার পিছনে সেই দুর্গ আর গাছটিকে অনুভব করতে পারছিল না। শরতের বেলা পড়ে আসছে দ্রুত। একটু পরেই রাত নামারে কলকাতায়। অসহায় আদিত্য একা কোথায় যাবে!
সে ললিতের কথা একটু ভেবে দেখল। বন্ধুদের মধ্যে ললিত একমাত্র লোক যার কাছে যে-কোনও অবস্থাতেই যাওয়া যায়। গেলে দু’হাত বাড়িয়ে ‘আয়’ বলে টেনে নেবে ললিত। যাবে তার কাছে!
পরমুহুর্তেই সে আপন মনে মাথা নাড়ল। তা হয় না। কাল যা ঘটে গেছে তার পিছনের কারণ আসলে ললিতই। ললিতকে নিয়েই গণ্ডগোলটা লেগেছিল। শাশ্বতীর সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য তেতো হয়ে গেল সম্পর্ক, তারপর বাড়ির ওই ব্যাপার। সবকিছুর জন্যই ললিতকে দায়ী করা চলে। সেই কলেজ জীবনে কেন ললিত তাকে শেখাতে গিয়েছিল সাম্যবাদ! যদি না শেখাত তবে আজ সংস্কারবশতই সে তার লোভী স্বার্থপর বাবাকে একরকম করে মানিয়ে নিতে পারত। কেন বিষ ঢুকিয়েছিল ললিত?
ক্রমে অন্ধকার হয়ে এল। গড়িয়াহাট ছেড়ে অনেক দুরে একা একা ভবঘুরের মতো হাঁটল আদিত্য। হিজিবিজি চিন্তা, অনিশ্চয়তা আর ভয়ের উলটোপালটা স্রোত তার মাথার ভিতরে ঘূর্ণিঝড় তুলছে।
অবশেষে রাত আটটা নাগাদ সে হাল ছেড়ে দিল। এসপ্ল্যানেডের একটা দোকান থেকে ফোন করল বাড়িতে, বাবাকে।
বাবার স্বর ভেসে এল, সেই পুরনো চেনা সতর্ক ভারী গলাটি, হ্যালো।
আমি আদিত্য বলছি।
একটু চুপ ওধারে। তারপর, কী চাও?
আদিত্য চোখ বুজল ক্লান্তিতে, শ্বাস ফেলে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন।
বাবার গলা হঠাৎ খুব নরম শোনাল, সারা দিন তুমি কোথায় ছিলে? আমি আজ তোমার জন্যই দুশ্চিন্তা করেছি কেবল। রাতে শুয়েছিলে কোথায়?
আদিত্য সে-সব কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমাকে ফিরে আসতে দিন।
এসো, খুব তাড়াতাড়ি চলে এসো। এসে খাও, বিশ্রাম করো। আমাদের সকলেরই ভুল হয়, তাতে লজ্জার কিছু নেই। …কোথায় আছ— কোথা থেকে টেলিফোন করছ বলো, গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
না, আমিই যাচ্ছি।
ট্যাক্সি নিয়ে এসো। টাকা না থাকলে চিন্তার কিছু নেই। আমি গেটের কাছে দাঁড়াচ্ছি, তুমি এলে ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে দেব। চলে এসো।
কথা শেষ হয়ে গেল। তবু টেলিফোন ছাড়ল না আদিত্য। ধরে রইল। ও-পাশে ধরে রইল বাবাও। কয়েক সেকেন্ড। তারা পরস্পরের ক্লান্ত শাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনল কেবল। তারপরই আদিত্য রেখে দিল টেলিফোন।
বাইরে এসে ট্যাক্সি ধরল।
ওদিকে শাশ্বতী আজ একটা নতুন ধরনের বিকেল কাটাল।
রাকাদের গাড়িটায় ওঠার পর থেকেই সে একটা মৃদু উত্তেজনা বোধ করছিল। সে উত্তেজনাটা বেড়ে গেল যখন রাকা তাদের দু’জনকে রেখে ঢুকে গেল রেডিয়ো স্টেশনে।
তখন কিছুক্ষণ লজ্জায় মুখ নত করে রইল শাশ্বতী। রাকার দাদা চুপ করে একটুক্ষণ চেয়ে রইল অন্য দিকে।
তারপর প্রথম কথা বলল রাকার দাদা, এখানেই গাড়িতে চুপচাপ বসে থাকবেন, না কি কোথাও গিয়ে একটু চা খাবেন? রাকার আসতে বেশ দেরি হবে।
শাশ্বতী একটু চুপ করে থেকে বলল, ফিফ্থ পিরিয়ডে আমার একটা ক্লাস ছিল। ভাবছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে ক্লাসটা করব।
রাকার দাদা কবজির ঘড়ি দেখে বলল, ক’টায় ক্লাস?
শাশ্বতী সময়টা বলতেই রাকার দাদা মাথা নেড়ে বলল, তা হলে মোটে আধ ঘণ্টা সময় হাতে আছে। অবশ্য আপনাকে দশ মিনিটেই পৌঁছে দিতে পারি… কিন্তু, খুব ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস কি?
শাশ্বতী একটু ইতস্তত করে বলল না, তেমন কিছু নয়।
তবে চলুন, কোথাও একটু বসি।
শাশ্বতী নতমুখে লাজুক একটু হাসি হাসল কেবল।
রাকার দাদা সুমন্ত এক মিনিটও দেরি না করে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি।
এটা কেমন যে শাশ্বতীর এখন বেশ ভাল লাগছে! কেন লাগছে? সে নিজের মনে খুঁজে দেখল, কিন্তু কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পেল না। না কি কেবল বাধা নিয়মের বাইরে যাওয়ার মধ্যেই এক আনন্দ আছে। এ কি অবৈধ? অবৈধ কেন হবে! সে তো আর আদিত্যর কাছে বাঁধা নয়! না কি বাঁধা! কোনও এক অদৃশ্য বন্ধন রয়ে গেছে! আদিত্যর ক্লান্ত মুখখানা চোখে এক পলকে জন্য ভেসে উঠল তার। বহু দুর থেকে এসেছিল মানুষটা, তারই খোঁজে। সে অবহেলায় চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
সুমন্ত জিজ্ঞেস করল, গঙ্গার ধারে একটা সুন্দর চা খাওয়ার জায়গা আছে, নির্জন এখন। যাবেন?
শাশ্বতী ঘাড় নাড়ল। যাবে।
সকাল থেকেই তার মন বলছে, আজ একটা কিছু ঘটবে। সেটাই ঘটতে যাচ্ছে কি? ঘটুক, কোনও ক্ষতি নেই। আজ জীবনে এই প্রথম তার গা ভাসাতে ইচ্ছে করছে। গঙ্গার ধার ধরে যাচ্ছে গাড়ি। হাওয়ায় শাশ্বতীর আলগা বেণি থেকে কিছু চুল খুলে উড়ছে। আঁচল উড়ছে। চোখ বন্ধ করল শাশ্বতী। একটু বুঝি শরীর তলিয়ে দিল পিছন দিকে।
ওদিকে ভিড় করে জেটিতে বেঁধেছে জাহাজ। দুপুরের আকাশে তাদের ক্ষণস্থায়ী মাস্তুল দেখা যায়। গঙ্গার জলের ভাপ মুখে এসে লাগে। নৌকো স্থির হয়ে আছে মাঝ গাঙে, দুলছে বয়া। গঙ্গার ঘাট দেখলেই দূরকে মনে পড়ে। মনে পড়ে, বিদায়। প্রবল স্রোত আর তার ওপরে আকাশের দিগন্ত-প্রসার। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দুর দুরান্ত এসে তছনছ করে দিয়ে যায় মানুষকে। নোঙর তুলে ফেলবার সাধ জাগে মনে।
রেস্টুরেন্টে, প্রায় গঙ্গার জলের ওপর মুখোমুখি দুই চেয়ারে বসে তারা চুপ করে গঙ্গা দেখল অনেকক্ষণ। কথা বলল না।
এ-সব জায়গায় শাশ্বতীকে কেউ কখনও আনেনি। আদিত্য বড় ঘরমুখো। তার সামনে বিপুল বিস্তার আর দূর আর দূরান্তের কথা ভাবতে ভাবতে একসময়ে শাশ্বতীর সাধ হল, সে একজন নোঙরছাড়া ভবঘুরে পুরুষের সঙ্গে একদিন এইখানে আসবে। তারপর এখান থেকেই সংসার ত্যাগ করবে তারা। আর ফিরবে না।
কয়েক মুহূর্ত পর চটকা ভাঙে শাশ্বতীর। সে টের পায় যে সে এক প্রায় অচেনা পুরুষের সঙ্গে একা একটা অচেনা জায়গায় বসে আছে।
সুমন্ত কফি আর স্যান্ডউইচ আনাল। অন্য পুরুষের সামনে খেতে বড় লজ্জা করে শাশ্বতীর। কিন্তু তার স্বভাব অনুযায়ী সে তো আজ চলছে না। তাই গঙ্গার দিকে মুখ ফিরিয়ে সেই সুস্বাদু স্যান্ডউইচ খেতে ভালই লাগল তার।
সুমন্ত প্রথমে কলেজ ইত্যাদির কথা জিজ্ঞেস করল, নিজের কলেজ-জীবনের কথা বলল কিছু কিছু। জিজ্ঞেস করল, শাশ্বতী রাজনীতি করে কি না। তারপর আচমকা ভীষণ ব্যক্তিগত প্রশ্ন করল সে, আপনি কি কারও সাথে এনগেজ্ড?
কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগল শাশ্বতীর। হু হু করে বাতাস বইল অনেক, ছল ছল শব্দ করল জল, দূরে বাজল জাহাজের ভোঁ। সমস্ত হাতে নুনের কৌটো নিয়ে খেলা করতে করতে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল।
প্রশ্নটা বড় দেরিতে বুঝল শাশ্বতী। বুঝে উত্তর দিতে পারল না। মাথা নত করে রইল। রক্তের ঝাপটা লাগল মুখে।
অবশেষে সুমন্ত মাথা নিচু করে বলল, প্রশ্নটা করা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু আমার একটা সৎ উদ্দেশ্য ছিল।
সেটা কী শাশ্বতী জানতে চাইল না। অনুমান করল মাত্র।
সুমন্ত খুব লাজুক নয়। সরাসরি অনেক কথা বলতে পারে। বলল, রাকাকে আমি মাসখানেক আগে বলে রেখেছিলাম আপনার কাছ থেকে যেন কয়েকটা কথা জেনে নেয়। তার মধ্যে এই প্রশ্নটা একটা। রাকা অবশ্য আমাকে বলেছিল যে আপনি এনগেজ্ড নন, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ও না-জেনে কথাটা বলেছে। বলে হাসল সুমন্ত, রাকা বড্ড কম সিরিয়াস। কোনও ব্যাপাবেই গুরুত্ব দেয় না।
শাশ্বতী হঠাৎ, ধরা গলায় কোনওক্রমে বলল, আমি এনগেজ্ড এ-কথা তো বলিনি।
নন? ভীষণভাবে শরীর ঝাকিয়ে সোজা হয় সুমন্ত।
এখন কী বলবে শাশ্বতী? সে নিজেও যে বুঝতে পারছে না সত্যিই সে কারও সঙ্গে আবদ্ধ কি না!
সুমন্ত খুব সুন্দর করে হাসল। খুশির হাসি। তারপর ভরাট আত্মবিশ্বাসের গলায় বলল, তা হলে একদিন আমার প্রস্তাব যাবে আপনার কাছে। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, অবশ্য আরও কিছু জানার থেকে গেল। আপনারও, আমারও। কিন্তু প্লিজ, দয়া করে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবেন না। যদি কিছু জানার থাকে এক্ষুনি জেনে নিন।
কিন্তু শরীর ঝিমঝিম করল শাশ্বতীর। মৃদু মদের নেশার মতো অবশ হয়ে গেল তার হাত-পা। চুপ করে বসে রইল সে। কথা বলল না।
একটু পরেই ঘড়ি দেখে সুমন্ত বলে, চলুন, যাওয়া যাক।
তারপর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগল। রাকাকে রেডিয়ো স্টেশন থেকে তুলে নিল সুমন্ত। তারপর তারা গেল খুব বড় একটা রেস্টুরেন্টে। অদ্ভুত খাবার খেল সব। অজস্র কথা বলল রাকা। সুমন্ত হাসল খুব। আর সারাক্ষণ ঝিম ঝিম করল শাশ্বতীর শরীরের ভিতরটা।
সুমন্ত হয়তো কোনও ফাঁকে, হয়তো রেডিয়ো স্টেশনেই যখন রাকাকে আনতে লবি পর্যন্ত গিয়েছিল তখনই, কিছু বলে থাকবে। তাই রাকা এক ফাঁকে শাশ্বতীর কানে কানে বলল, তুই আমার কত নম্বর বউদি জানিস তো! তিন নম্বর! এই দাদা সেজো। তুই হবি আমার সেজোবউদি।
কথাটা শুনতে মোটেই ভাল লাগল না শাশ্বতীর। কিন্তু সে চুপ করে রইল। ভাল করে আজ কিছু বলতে পারছে না। সে এখনও বুঝতে পারছে না সে খুব সুন্দরী কি না। কোনও দিন কেউ তো বলেনি যে সে খুব সুন্দর! নইলে কাল কেন ও রকম অদ্ভুত সন্দেহ করেছিল আদিত্য? বলেছিল যে তার জাত আলাদা! সকলেরই কেন এত মনোযোগ তার প্রতি? ভাবতে ভাবতে কেবলই ঘোলা হয়ে গেল মাথা।
ঘোর-ঘোর সন্ধেবেলায় বাড়ির কাছেই বড় রাস্তায় তাকে ওরা নামিয়ে দিয়ে গেল। তখন শাশ্বতী সত্যিই টলছে। রাকা গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, শিগগিরই আমরা একদিন আসছি দল বেঁধে কনে দেখতে। তৈরি থাকিস।
কত দ্রুত ঘটনা ঘটে যায়। কিছু করার থাকে না।
রাতে যখন বিছানায় শুয়ে ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ তখন শাশ্বতী অনুভব করল তার বুক ভরতি টলটল করছে ভালবাসা-আত্মসমর্পণ। কিন্তু কে নিতে পারে সেই মহামূল্যবান? আদিত্য না, সুমন্ত না। যারা তাকে চায় তারা কেউ না। যে পুরুষ তাকে যাচ্ঞা করে সে কিছুতেই তার নয়। সে হবে অন্য কেউ। হয়তো সে খুব উদাসীন। হয়তো সে খুব কর্মব্যস্ত একজন।
কিন্তু সে কে যে কে জানে!
আচমকা মনে ভেসে ওঠে কয়েক মিনিটের দেখা মৃত্যুপথযাত্রী একজনের দৃঢ় ধারালো মুখ। সে-মুখ ললিতের। আহা— যে বাঁচবে না। তবু মনে পড়তেই ঘুমের মধ্যেই অন্যমনে মুখ টিপে হাসে শাশ্বতী। হাসিটুকু ঠোঁটে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
চোদ্দো
অপরাহ্নে এক-একদিন উঠোনে একটা অদ্ভুত আলো এসে পড়ে। শালিখের পায়ের মতো হলুদ তার রং। পাঁচিলের ছায়া তুলসীমঞ্চ ছাড়িয়ে অর্ধেক উঠোন পর্যন্ত চলে যায়। পেয়ারা গাছে ফিরে আসে পাখির ঝাঁক। সেই অলৌকিক হলুদ আলো-আঁধারিতে মা কুঁজো হয়ে সড়সড় করে উঠোন ঝাঁট দেয়, বিড়বিড় করে কী যেন কথা বলে নিজের সঙ্গে।
দুপুরের ঘুম থেকে উঠে ললিত উঠোনের সিঁড়িতে বসে অলস দুর্বল শরীর আর ঝিম-ধরা মাথায় উঠোনের সেই অলৌকিক আলো দেখে বোকা-চোখে চেয়ে থাকে। মনে হয়— সে জেগেছে অন্য এক গ্রহের বিকেলে। এ সব চেনা পৃথিবীর দৃশ্য নয়।
ঝাঁট দেওয়া শেষ হলে মা ঘটি থেকে জলছড়া ছিটিয়ে দেয় সারা উঠোন। তুলসীতলায় প্রদীপ দেয়, শাঁখ বাজায়। ঠিক সেই সময়ে দূরে কোথাও বাচ্চা ছেলেদের খেলা ভাঙে, তাদের হাসি-চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। আর তখন, ললিতের চোখের সামনে স্বল্পস্থায়ী হলুদ আলোটি ক্রমে মুছে যায়। কোথা থেকে উঠোনে এসে পড়ে বিষন্ন সব ছায়া আর ছায়া। ভেজা মাটির গন্ধ মন্থর বাতাসে ভারী হয়ে ওঠে। ললিত দরজার কাঠে তার মাথা হেলিয়ে দেয়, হাঁটু মুড়ে বাচ্চা ছেলের মতো বসে থাকে। হয়তো তখন মা তাকে ডেকে বলে, ঘরে যা ললিত, এখন বড় হিম পড়ে। কিন্তু ললিত সে-কথা শুনতেই পায় না। কেননা তখন অপরাহ্ণের নিঃশেষ আলোয়, দীর্ঘ গাঢ় ছায়ার দিকে চেয়ে থেকে সে বহুবরের এক নিস্তব্ধতার কণ্ঠস্বর শোনে। তার সামনে ছোট্ট উঠোনটায় শব্দহীন ভাবে শেষ হয়ে যায় একটি দিন। দিন যায়। ললিতের দিন যায়। মহামূল্যবান এক-একটি দিন।
সন্ধ্যাবেলাতেই মায়ের রান্না শেষ হয়ে যায়। তখন মাঝে মাঝে মায়ে-পোয়ে লুডোর ছক ফেলে বসে। অদ্ভুত নিয়মে তাদের খেলা হয়। তারা কেউ কারও গুটি খায় না। যে আগে ঘরে পৌঁছয় তার জিত। এ তাদের নিজস্ব নিয়ম। কেউ বাধা দেয় না। তাদের ভুল ধরে না। তাই অদ্ভুত নিয়মে চলে খেলা।
কোনও দিন বা গলির সামনে পাড়ার রাস্তায় আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়ায় ললিত। চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হলে দু’দণ্ড কথা বলে। সত্যদাসের মুদির দোকানের সামনে বাঁশের খাটার বাবা বেঞ্চে গিয়ে কোনও-কোনওদিন বসে। রান্না করতে করতে গিন্নিদের মশলা ফুরোয়। তাই তখন পড়া ফেলে বাচ্চা ছেলে কি মেয়েটাই আসে মায়ের জন্য এক পোয় তেল কি দু’ আনার গরমমশলা নিতে। একটু সময় কাটিয়ে যায় ললিত। ছেলেবেলায় কত গেছে পড়া ফেলে মায়ের মশলা আনতে। সত্যদাসের দোকানে বাচ্চাদের ভিড় দেখে ললিত, সবাইকে চিনতে পারে না। মাঝে মাঝে সত্যদাসকে ডেকে বলে, ও মেয়েটা কে বলো তো!
ক্লাবের সামনে জটলা করে শম্ভু-সুবলরা। ললিত পারতপক্ষে সেদিকে যায় না। তাকে দেখলে ওরা এখনও সিগারেট লুকোয়। তাই সত্যদাসের দোকানে বসে রাস্তা দেখে ললিত। কখনও সেই রাস্তা ধরেই হা-ক্লান্ত, বিষণ্ণ, চিন্তিত মুখে কপালে ভাঁজ ফেলে তুলসীকে আসতে দেখা যায়। বড় খুশি হয়ে ওঠে ললিত। সারা দিন সে মানুষের জন্য অপেক্ষা করে। যে-কোনও মানুষ আসুক তার কাছে। তুলসীর সঙ্গে কিন্তু আড্ডা জমে না। তুলসী গিয়ে রাজ্যের গল্প ফেঁদে বসে মায়ের সঙ্গে। বুড়োদের মতো সংসারী কথা বলে।
বাবার বাৎসরিক কাজের দিন ঠিক করতে এক দিন এসেছিলেন মাধব চক্রবর্তী। ললিতকে ডেকে বললেন, পৈতেখানা ফেলে দিয়েছিস, তোরা কী রে?
পৈতেটা ঠিক ফেলে দেয়নি ললিত। কবে যেন বহুকাল আগে পুরনো হয়ে ছিড়ে গিয়েছিল পৈতে, সেটা ছেড়ে ফেলেছিল। তারপর আর পরা হয়নি। ললিত চুপ করে থাকে।
মা খুঁজে-পেতে ঠাকুরের সিংহাসনের তলা থেকে একটা প্যাকেটের পৈতে বের করে বলে, ঠাকুরমশাই, গেরোন্থি দিয়ে রেখে যান। আমি ওকে পরাব।
তখন মাধব চক্রবর্তী ললিতকে গাল দিতে দিতে বসলেন গ্রন্থি দিতে। ললিত সুতো ধরল, মাধব চক্রবর্তী পদ্মাসনে বসে হাঁটুতে সুতোর প্যাঁচ দিতে দিতে হেঁকে বললেন, চণ্ডীখানা পড়িস? তোকে শিখিয়েছিলাম পড়তে!
তারপর আপন মনে হায় হায় করেন মাধব, আচমন ভুলে গেলি, গণ্ডূষ ভুলে গেলি… এরপর গায়ত্রী ভুলবি, গোত্র ভুলবি, কোন ঋষির পুত্র তা ভুলবি, শেষে বাপের নামও মনে পড়বে না…।
অনেকটা পর অবিরল হাসতে পারে ললিত।
মাধব চশমা তুলে তাকান, চণ্ডীখানা পড়িস ললিত। তোকে যে পকেট-চণ্ডীখানা দিয়েছিলাম, আছে সেটা?
ললিত ঘাড় নাড়ে। আছে।
পড়িস। চণ্ডীপাঠে রোগ সারে। আমি চল্লিশ বছর পড়ছি। দ্যাখ, আমার শরীরে রোগ নেই।
ললিতদের দেশের গ্রামে পুরুত ছিলেন মাধব। এখানে কাছাকাছিই থাকেন। এখন আসেন কালেভদ্রে। বাবা বেঁচে থাকতে কিন্তু রোজ সন্ধেবেলা মাধব তার লক্ষ্মীনারায়ণের পুজো সেরে আসতেন ললিতের বাসায় খবরের কাগজ পড়তে। চাদরে ঢাকা দিয়ে রেকারে আনতেন সামান্য প্রসাদ। ললিতের তখন টাইফয়েড চলছে। সারা বিকেল সে তার নলীর মতো ঘাড়খানা উঁচু করে মাধবের জন্য দরজার দিকে চেয়ে থাকত। মাধব এসে হাতে দিতেন আলোচাল-মাখা একটু কলা, একটি বাতাসা, এক টুকরো নারকেল কিংবা আখ। সেই প্রসাদটুকু কতক্ষণ ধরে রেখে রেখে টুক টুক করে পাখির মতো অল্পে অল্পে খেত ললিত, পাছে তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়! সারা দিনে ওইটুকুই মাত্র কুপথ্য সে করতে পারত। প্রসাদ বলে মা কিংবা বাবা আপত্তি করত না। প্রসাদটুকু শেষ করে ললিত চিঁ চিঁ করে দুর্বল গলায় বলত, ঠাকুরমশাই, আপনার খাওয়ার গল্প বলুন। মাধব হাসতেন, তারপর ফেঁদে বসতেন গ্রামের এক কৃপণ বুড়িকে ভজিয়ে কীভাবে দেড় সের সর খেয়েছিলেন সেই গল্প। সেই সূত্রে আরও কত খাওয়ার গল্প এসে পড়ত। শুনতে শুনতে ঢোঁক গিলত লোভী ললিত, শূন্যমুখে স্বাদ পেত সেইসব খাবারের। ‘ভাল হয়ে অনেক-অনেক রকমের খাবার খাব’ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ত সে। মাধবকে কী যে ভাল লাগত তখন!
এই সেই মাধব। কিন্তু মাধব এখনকার ললিতকে কী দিতে পারেন, যা ললিত কৃপণের মতো যত্নে নেবে হাত পেতে! আছে কি মাধবের কাছে কিছু, সেই অলৌকিক স্বাদযুক্ত প্রসাদের মতো? কিছু নেই। তবু ললিত স্নান করে পৈতে পড়ল। পরে নিজেকে শিশুর মতো বোধ করল সে। রুগ্ণ এক শিশু, যা-শিশুর মাধবের কাছে রোজ এক প্রত্যাশা থাকত। ঠিক সেইরকম পৈতে পরে সে এই পৈতেটার কাছ থেকে কিছু একটা প্রত্যাশা করতে লাগল। হয়তো তা আরও কিছুদিনের জীবনীশক্তি, নিরাপত্তা, অভাবমোচন কিংবা এমনকী নারীপ্রেম।
দু’-একদিন এ-রকম শিশু হওয়ার নেশা তাকে পেয়ে বলল। পকেট-চণ্ডীখানা দুপুরে খুলে বসল সে। খুলল শেষের দিকের পাতা, যেখানে চণ্ডীপাঠের ফল দেওয়া আছে। সংকল্প ও পূজা করার পর একবার পাঠ করলে ও বলিদান করলে মানুষ সিদ্ধিলাভ করে।… চৌদ্দবার পাঠ করলে স্ত্রী ও শত্রু নিজের বশ হয়ে থাকে… কুড়িবার আবৃত্তি করে পাঠ করলে মানুষ দুষ্টব্রন বা বিষফোঁড়া থেকে আরোগ্য লাভ করে। তার পর আছে “সংকট উপস্থিত হইলে, দুশ্চিকিৎসা ও ব্যাধিতে, প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হইবার সময়ে, আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক—এই তিন প্রকার উৎপাত উপস্থিত হইলে, অতিপাতক হইলে, যত্নের সহিত একশোবার আবৃত্তি করিয়া পাঠ করিবে। তাহাতে বিপদ নষ্ট হইয়া এই জন্মে মঙ্গল ও পরজন্মে পরমগতি লাভ হয়।”
পড়তে পড়তে কেমন একটা লোভ ঘনিয়ে ওঠে মনের মধ্যে। উত্তেজনা বোধ করে ললিত। আত্মবিস্মৃতের মতো উঠে বসে। অতীতের ললিতকে ভুলে গিয়ে পরিপূর্ণ এক নবজাতক শিশু হয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সে গুনগুন করে পাঠ করতে থাকে, ওঁ নারায়ণায় নমঃ, ওঁ দেব্যৈ নমঃ, ওঁ সরস্বত্যৈ নমঃ, ওঁ ব্যাসায় নমঃ, ওঁ নমশ্চণ্ডিকায়ৈ…
পড়তে পড়তে নিজের চারধারে সেই রোমহর্ষকারী শৈশব টের পায় ললিত। যখন কেবল প্রত্যাশা আছে, আছে প্রসারিত দীর্ঘ আয়ু, নির্ভরতা আছে। যেন বা কোলের ললিতকে শক্ত হাতে বুকে আঁকড়ে আছে মা। আর ভয় নেই।
একবার শিশু হয়ে যেতে পারলে আর ভয় নেই। ভাবতে ভাবতে সারা দুপুর ঘরময় অস্থির পায়চারি করে, সিগারেট ধরায়। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে বাইরের দিকে। আবার ফিরে এসে শ্রীশ্রীচণ্ডী খুলে বসে, বিড় বিড় করে বলে, এতকাল ধরে আমি যা শিখেছি সব ভুলিয়ে দাও। আবার নির্বোধ করে দাও। আবার যেন এইসব বিশ্বাস করতে পারি, ছেলেবেলায় যেমন করতুম।
এখন অনেকটাই সেরে গেছে বিমান। পাড়ার এক চেনা কম্পাউন্ডারকে ধরে ওর ব্যান্ডেজ পালটানোর বন্দোবস্ত করেছিল ললিত। ছ’-সাত দিনের মধ্যেই ব্যান্ডেজের সংখ্যা কমে গেছে অনেক। কেবল মাথার চারধারে একটি পট্টি এখনও আছে। ব্যান্ডেজ খোলার পর বিমানের মুখখানা দেখে খুব আবছাভাবে ললিতের মনে পড়েছে যে, এ-মুখ সে কোথাও দেখেছে। হয়তো কলেজের সিঁড়িতে উঠতে নামতে, কিংবা করিডোরে, পথসভার ভিড়ে, হয়তো রমেনের বাড়ির জমায়েতে। এর চেয়ে বেশি কিছু মনে পড়েনি। কলেজ জীবনে হাজারটা ছেলে ঘিরে থাকত ললিতকে, তাদের সকলের মুখ ভিড়ের মুখের মতো, একই রকমের দেখতে।
বিমানের খাবার দু’বেলাই টিফিন ক্যারিয়ারে করে পৌঁছে দিয়ে আসে ললিত। আজকাল বড় লজ্জা পায় বিমান, বলে, আমি বেশ ভাল আছি। বেঁধে খেতে আর অসুবিধে নেই। আর তোমাদের অন্ন ধ্বংস করার মানে হয় না।
ললিত হাসে, অন্ন ধ্বংস হয় আর কোথায়! তুমি তো এইটুকু খাও।
খাওয়ার পরে বিমান ললিতের টিফিন ক্যারিয়ার নিজেই মেজে দেয়। তারপর তারা কিছুক্ষণ মুখোমুখি বসে। সিগারেট ধরিয়ে গল্প করে।
কোনও দিন বিমান বলে, ললিত, তুমি কলেজে যে রকম বক্তৃতা করতে ঠিক সেরকম আবার শুনতে ইচ্ছে করে। এক দিন শোনাবে একটু?
ছেলেমানুষি দেখে ললিত হাসে। মাথা নেড়ে বলে, সব ভুলে গেছি হে।
কথাটা শুনে বিমান অনেকক্ষণ ভাবে। ভেবে চিন্তে বলে, সে-সব কথা কি তুমি প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে না ললিত? করলে কী করে ভুলে যাবে? তোমার সে-সব বক্তৃতা এমন মারাত্মক নেশা জাগাত আমার মধ্যে যে কত বার ভিতরে ভিতরে ওলট-পালট হয়ে গেছি। কখনও একা ঘরে আমি ঠিক তোমার নকল করে বক্তৃতা করতাম, চোখ বুজে কল্পনা করতুম আমাকে ঘিরে সামনে-পিছনে চারধারে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা মন দিয়ে প্রাণ দিয়ে শুনছে আমার কথা। কথা শোনা শেষ হলেই তারা মারমার করে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তুমি তো জানো যে আমি কারও সঙ্গেই কথা বলতে পারতুম না। কিন্তু সে সময়ে আমি একজন বড়লোকের মেয়েকে পড়াতুম। বাচ্চা মেয়ে, সব কথা ভাল বুঝত না। তাই তাকে আমার লজ্জা ছিল না। তোমার বক্তৃতা শুনে আমার এমন নেশা ধরে গিয়েছিল যে সেই বাচ্চা মেয়েটিকে আমি মাঝে মাঝে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের কথা বলতুম। বলতুম, একদিন সেইসব বঞ্চিত মানুষেরা তাদের সব সম্পত্তি কেড়ে নেবে। তারপর বিচার করবে, দণ্ড দেবে, ধবংস করবে তাদের। ব্যক্তিগত মালিকানা বিলোপের সুফল কী তা সেই মেয়েটি বুঝত না। কিন্তু তবু সে ভারী ভয় পেয়ে যেত। যেমন বাচ্চা মেয়েরা তাদের পুতুল কেউ কেড়ে নেবে শুনলে ভয় পায় ঠিক সেইরকম ভয় পেত। বুকের ফ্রক খামচে ধরে শুকনো মুখে চেয়ে থাকত। তার সেই ভয়টুকু আমি বেশ উপভোগ করতুম। অন্তত ওই একটা জায়গায় আমার বক্তৃতা বেশ সফল হত।
একটু চুপ করে থাকে বিমান, তারপর দুঃখের সঙ্গে বলে, কিন্তু হায়, তুমি সে-সব কথা ভুলেই গেছ!
সত্যিই যে ললিত সুৰ কথা ভুলে গেছে তা নয়। এখনও কথাগুলো মাঝে মাঝে তার ভিতরে ওড়াউড়ি করে। কিন্তু সেসবের আর কোনও দংশন নেই। ললিত তাই সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, কিন্তু সেসব কথা তো এখন আর তুমি বিশ্বাস করো না!
বিমান মাথা নাড়ে, না, করি না।
তবে আবার শুনতে চাও কেন?
এমনিই। তোমাকে আবার আমার ওরকম দেখতে ইচ্ছে করে। তোমার ধারালো মুখখানা উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। শক্ত হয়ে ফুলে উঠছে চোয়াল, পাকানো মুঠি তুলে ধরে শপথ করছ, তোমার শরীর নড়ছে চাবুকের মতো। সেইসব ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতুম আমি। তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলুম বলে তোমার কথাই আমার কথা হয়ে উঠেছিল। আবার তোমাকে সে-রকম দেখলে, হয়তো আবার আমি তোমার সব কথা বিশ্বাস করে ফেলব। তুমি কি সত্যিই ভুলে গেছ?
ললিত মৃদু স্নান হাসে। বলে, ভুলিনি। কিন্তু তোমাকে সে-সব আর বিশ্বাস করাতে চাই না।
কেন চাও না ললিত?
ললিত উত্তর দেয় না।
বিমান আস্তে করে বলে, তবে কি এখন বুঝতে পেরেছ যে তুমি সে-সব কথা ভুল বলতে? তাই আমাকে বলতে চাও না?
ললিত কেবল মৃদু হাসে।
বিমান অনুচ্চস্বরে বলে, একথা ঠিকই যে তুমি ভুল বলতে। মানুষকে সমষ্টিগতভাবে দেখার মধ্যেই একটা বিরাট ভুল আছে। কিন্তু তুমি তাই দেখতে। দ্রুত সমাজ পালটানোর জন্য তুমি চেয়েছিলে বিপ্লব, আর বিপ্লবের জন্য জড়ো করতে চাইছিলে মানুষ। তাই তোমার কাছে সমষ্টিই বড় ছিল। ভিড়কে চিনেছিলে কেবল। বিচ্ছিন্ন মানুষটা ভিড় থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ালেই তুমি আর তাকে চেনোনি। তাই না ললিত? অথচ যে-মানুষটা মিছিলে পতাকা বহন করে যায়, যে তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিয়ে আসে সেই মানুষটাই হয়তো সময়ের চাষ ফেলে রাখে, বুড়ো বাপকে খাটায়, বীজধান খেয়ে ফেলে, অন্যের খেত থেকে ধান চুরি করে। দাঙ্গা করে জেল খেটে আসে, জোর করে কেড়ে নেয় বউয়ের গয়না, তখন তাকে কে দেখেছে ভাল করে? স্বভাববশত এ লোকটাই একদিন হয়তো তার সর্বস্ব হারায়। এ রকম হাজারটা লোক আসে তোমার বিপ্লবে। তাদের মধ্যে ক্ষমতার লোভ থাকে, হিংসা থাকে, থাকে প্রতিশোধস্পৃহা, কাম ও মাৎসর্য। কিন্তু তুমি তার স্বভাব বিচার করো না। তোমার কাছে তার সর্বস্ব-হারানোটাই মহত্তর গুণ, তাই তুমি তাকে সর্বহারা বলে বুকে জড়িয়ে ধরো, বিপ্লবের অংশীদার করে নাও, সিংহাসনে বসাতে চাও তাকে কখনও ভেবেও দেখো না সর্বস্ব যে হারায় সে কী ভীষণ ডিসকোয়ালিফায়েড। কিন্তু মানুষকে সমষ্টিগতভাবে দেখতে শিখেছ বলেই তুমি মনে করো সমাজের ব্যবস্থাই তার সর্বস্ব হারানোর কারণ। সমাজ পালটালেই মানুষ পালটে যাবে। তাই না? তাই তুমি তাকে বিপ্লবে ডাক দাও, তাকে লোভ দেখাও যে তার সব অভাব দূর করে দেবে।
ললিত বাধা দিয়ে বলে, সবাই কি এই রকমের?
না। সবাই এই রকমের নয়। সত্যিকারের নিপীড়িতরাও আসে, আসে মুনাফাখোর বুর্জোয়ার চরও, আসে ব্যক্তিগত লাভের প্রত্যাশী কিছু মানুষ। আমরা রোজ যে-সব নানা ত্রুটিযুক্ত মানুষকে চারধারে দেখছি তারাই। তুমি বিপ্লবের আগে তাদের সংশোধন করে নাও না, নির্বিচারে টেনে নাও বলে। কাজে লাগাও তার শক্তিকে। তোমার সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে এদের স্থূল শক্তি এবং হিংস্রতা। তুমি যথেষ্ট পরিমাণে এ দু’টিকে জাগিয়ে তোলে, ফলে জেগে ওঠে ব্যক্তিগত লোভ এবং প্রতিশোধস্পৃহা, ফলে সে খুব হিংস্রভাবে আক্রমণ করে, সমাজকে চুরমার করে দেয়। কিন্তু বিপ্লবের মাঝপথে সে হঠাৎ থেমে পড়ে, দ্রুত খুঁজতে থাকে মুনাফা, প্রবৃত্তির নানা তৃপ্তি— তার কাছে সেগুলিই বিপ্লবের ফসল। সে বহুকাল ভাল খাবার খায়নি, দুর থেকে ধনীদের জীবনযাত্রা দেখে ও রক জীবনযাত্রার যে লোভ তার বরাবর হয়েছে তা মেটেনি, সে কখনও কর্তৃত্ব করার সুযোগ পায়নি, মানুষকে নিপীড়ন করার মধ্যে যে আনন্দ আছে তা ভোগ করেনি। অথচ এই লোভগুলি তার দুর্জয়ভাবে রয়ে গেছে। তাই তখন তার মধ্যে জেগে ওঠে অমোঘভাবে বুর্জোয়ার শ্রেণীচরিত্র। কিন্তু পুরনো ধরনের বুর্জোয়াদের মতো তার হাতে পুঁজির কর্তৃত্ব থাকে না বলে সে আরম্ভ করে ক্ষমতা দখলের লড়াই। নিজের পালকের পাখি খুঁজে সে তৈরি করে প্রতিক্রিয়াশীল জোট। তখন আবার নতুন লড়াই শুরু হয় এই শ্রেণীর সঙ্গে, কিংবা এ-রকম একাধিক শ্রেণীর সঙ্গে। সে-লড়াইয়েও দু’পক্ষেই থেকে যায় বুর্জোয়া শ্রেণীচরিত্রের লোক, শোধনবাদী এবং প্রতিবিপ্লবী। ফলে লড়াই আর শেষ হয় না। বহুভাগে ভেঙে যায় মানুষের আদর্শ, তৈরি হতে থাকে বহু দল। তখন, যারা মানুষের সত্যিকারের ভাল করতে চায় তারা নতুন করে ‘মানুষ’ কথাটা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। খুঁজতে শুরু করে মানুষের মূল। তারা দেখে সমাজ পালটালেও মানুষের প্রবৃত্তি পালটায় না— সেই দমননীতি, সেই ক্ষমতা দখল, সেই প্রতিবাদের পথ রোধ করা— যা কিনা ছিল বুর্জোয়ার শ্রেণীবৈশিষ্ট্য সেটাই অন্য চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে। তাই মূল থেকে পালটাতে হবে মানুষকে।
বিমান একটুক্ষণ ললিতের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, অবশ্য এখনও তুমি সেকথা ভাবতে শুরু করোনি। কিন্তু মনে হয়, তোমার ভিতরে ক্লান্তি এসেছে। ভিড়ের মুখ তুমি বোধহয় আর দেখতে চাও না। এবার হয়তো তুমি মানুষের মূল খুঁজতে শুরু করবে। আমিও খুঁজছি।
ভীষণ প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে ললিতের। সে জানে এগুলো সব ঠিক কথা নয়। কিন্তু বিমান পাগল বলেই সে এর প্রতিবাদ করে না। চুপচাপ বসে শোনে। মৃদু একটু হাসে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে ফিরে আসে সে। ফেরার পথে প্রকাণ্ড একটা অশ্বথ গাছ আছে, তার তলায় বাঁধানো বেদি। সেইখানে একা চুপ করে বসে ললিত। টিফিন ক্যারিয়ারটা পাশে রেখে একটা সিগারেট ধরায়। এতকাল যে-সব কথার পোকাগুলো নির্বিবাদে এলোমেলো ওড়াউড়ি করত মনে, সেগুলো হঠাৎ দলবদ্ধ দংশন শুরু করে। মানুষকে ডেকে আবার কথা বলতে ইচ্ছে করে তার। জোট বাঁধতে ইচ্ছে করে আবার। সে সামনের শূন্য অন্ধকার জায়গাটার দিকে চেয়ে হঠাৎ মৃদুস্বরে বলে, কমরেডস্, আমি ভুলে গিয়েছিলাম সংগ্রামের কথা। আপনারা আমাকে মাপ করবেন। আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে আবার আমি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ফিরে আসব, ভেঙে দেব প্রতিক্রিয়াশীল জোট, সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে মিলিত করব…
কিন্তু বড় ক্লান্তি লাগে। মাথা উত্তেজিত থাকে বলে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসতে চায় না। বিছানা গরম হয়ে ওঠে শরীরের তাপে। ললিত উঠে বাইরের সিঁড়িতে এসে বসে, সিগারেট খায়। বিড়বিড় করে বলে, শৈশবে ফিরে যাওয়া নয়, আমরা চাই তাড়াতাড়ি যৌবনকে পেতে। আমরা অতিক্রম করতে চাই অর্থনৈতিক শৈশব, রাজনৈতিক চেতনার শৈশব, আমরা চাই সমৃদ্ধির যৌবনকে….
ললিত ভাবে, একদিন সে যাবে অবিনাশের কাছে, গিয়ে বলবে, আমি আবার পার্টিতে আসতে চাই। তুমি ব্যবস্থা করে দাও। হ্যাঁ, কালকেই যাবে, কাল সকালেই। আর সময় নষ্ট করবে না।
কিন্তু সকালবেলা থেকেই অন্য রকম সব ঘটনা ঘটতে থাকে।
চা খেতে খেতে খবরের কাগজ দেখছিল ললিত। অনেককাল দেশের রাজনৈতিক খবরগুলোর কোনও খোঁজ রাখেনি সে। তাই মন দিয়ে পড়ছিল। এমন সময়ে সুবল এসে ডাক দেয়, ললিতদা, একটু কথা আছে। গলিতে আসুন।
গলির মুখে ললিতকে নিয়ে গিয়ে খুব উত্তেজিতভাবে বলল, ললিতদা, সেই মেয়েটাকে আমরা ট্রেস করেছি।
ললিত অবাক হয়ে বলে, কোন মেয়েটা?
সুবলের মুখ হঠাৎ রাঙ্গা হয়ে ওঠে, মাথা নামিয়ে নিয়ে বলে, ওই যে, যে-মেয়েটা আপনার বন্ধু বিমান রক্ষিতের কাছে আসে।
মেয়েটার কথা ভুলেই গিয়েছিল ললিত, বলল, সে মেয়েটা কী করেছে?
সুবল ক্ষীণ হাসে, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, কী আবার করবে! পাড়ার মধ্যে একজন মেয়ে একটা ব্যাচেলারের কাছে আসে, ঘরের দরজা বন্ধ করে কথাবার্তা বলে, পাড়ার বাচ্চাকাচ্চা ছেলেমেয়েরা এ-সব দেখছে…এ তো ঠিক নয়, তাই আমরা একটু খোঁজ-খবর করেছি।
ললিত শুনে একটু লজ্জা পেল। বিমান তার সহপাঠী, বন্ধু। তার কাছে কে এক মেয়ে আসে তা নিয়ে বয়সে ছোট সুবলের সঙ্গে আলোচনা করতে তার ইচ্ছে হল না। শুধু বলল, কী খোঁজ পেলি?
দেখলাম বিরাট বড়লোকের মেয়ে। হিন্দুস্থান পার্কে ওদের বাড়ি। বাড়ির চারধারে কম্পাউন্ড আর বাগান, দু’-তিনটে গাড়ি আছে, কুকুর আছে, ছাদের ওপর পাথরের পরি…
বলতে বলতে সুবল উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সে নিজে হয়তো উত্তেজনা টের পায় না। কিন্তু ললিত পায়। সুবলের চোখ চকচকে হয়ে আসে, কালো মুখটাতে কয়েকটা শিরা জেগে ওঠে আস্তে আস্তে বলে, মেয়েটা লেডি ব্রাবোর্নে পড়ে, গান জানে, ফাংশনে গায়। এ-রকম মেয়ের সঙ্গে ওই লোকটার কী সম্পর্ক? এ-লোকটা কর্পোরেশনের জমাদারদের টিপসই বাবু, গরিবের পয়সা ঘুষ খায়, রোগা হাড়গিলে চেহারা, এর সঙ্গে কি ও মেয়ের সম্পর্ক হওয়া উচিত? আপনার বন্ধু, তাই বেশি কিছু বলতে চাই না ললিতা, কিন্তু আমার মনে হয় লোকটা মেয়েটাকে ব্লাফ দিয়ে ভুলিয়েছে। বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে লাইফের মতো নিশ্চিন্ত, লোকটা সেই তালেই ছিল। কিন্তু বোধ হয় মেয়েটার অন্য কোনও লাভার ব্যাপারটা জেনে গুন্ডা দিয়ে ঠ্যাঙান দিয়েছে লোকটাকে। ও-সব ছিনতাই পাটির গল্প আপনি বিশ্বাস করেন? যারা ছিনতাই করে তারা এমন মরশুটে হাভাতে লোককে ধরবে কেন? ওরা লোক চেনে।
ললিত গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, তোরা এখন কী করতে চাস?
সুবল অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, আপনার বন্ধু, তাকে আর আমরা কী করব? আপনি শুধু ওকে একটু সাবধান করে দেবেন, পাড়ার মধ্যে থেকে যেন এ-সব না করে। ওসব মেয়ের দিকে হাত বাড়ানো কি ওর উচিত? আপনিই বলুন না! ওদিকে মেয়েটাও হয়তো লোকটার হিস্ট্রি জানে না, এ-রকম তো হয় আজকাল, অচেনা লোক গিয়ে নানা রকম ব্লাফ দিয়ে বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে। তাই আমাদেরও উচিত মেয়েটাকে বাঁচানো। আমরা মেয়েটাকে সাবধান করে দেব।
ললিত কোনও উত্তর দেয় না। তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। অন্যমনস্কভাবে ঘরে চলে আসে। বিমানের জন্য নয়, সেই অচেনা মেয়েটার জন্যও নয়, বরং সুবলের জন্যই কেমন যেন চিন্তা হতে থাকে ললিতের। ওর চকচকে চোখ, কথা বলার উগ্র ভঙ্গি, অস্থিরতা—এর মধ্যে কী একটা যেন রয়েছে যা অস্বস্তিকর। বড়লোকের সুন্দর মেয়েটা বিমানের কাছে আসে, এটা কি সইতে পারছে না সুবল? না পারাই অবশ্য স্বাভাবিক। বিমান হাড়গিলে, রোগা, ভিতু, দুর্বল, জীবনে অসফল একজন মানুষ। এ-রকম লোকের কাছে কোনও মূল্যবান কিছু দেখলেই নিতান্ত নিরীহেরও ইচ্ছে করবে ওকে দু’ঘা থাপ্পড় দিয়ে জিনিসটা কেড়েকুড়ে নিতে।
শম্ভু-সুবলরা কি জানে যে, একসময়ে ললিতও বড় বাড়ির মেয়ে মিতুর জন্য পাগল হয়েছিল? মিতুকে বাসায় ডেকে এনে ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি করানোর অক্ষম চেষ্টা করেছিল ললিতের বোকা মা? আর, তারপর থেকে ললিত মুখ তুলে রাস্তায় হাঁটতে পারত না? ওরা কি জানে যে, এখনও মিতু বাপের বাড়িতে এসেছে খবর পেলে ললিত অস্বস্তি বোধ করে? না, শম্ভু-সুবলেরা জানে না। কী করে জানবে! ওরা তখন বাচ্চা ছেলে, হাফপ্যান্ট পরে লাল-নীল রবারের বল নিয়ে রাস্তা আটকে ফুটবল খেলে। জানলে কখনও সুবল ললিতকে এমন নিষ্ঠুরের মতো বলতে পারত না, এ-রকম বাজে লোকটার সঙ্গে কি ও-রকম মেয়ের সম্পর্ক হওয়া উচিত? আপনিই বলুন না!
মিতুর কথা মনে পড়লেই এক নিস্তব্ধ পৃথিবীতে চলে যায় ললিত। যেখানে ললিতের ব্যর্থতাগুলি থরে থরে সাজানো রয়েছে। মিতু তাকে অবহেলা করে গেল, সে হল না সংগ্রামী মানুষের নেতা, হয়ে উঠল না সফল মানুষ। যৌবনের মাঝপথে বেলাশেষের হলুদ আলোটি এসে পড়েছে এখন। দূরবর্তী এক নিস্তব্ধতা আসছে তার দিকে। মূক করে দিয়ে যাবে তাকে। তাই মাঝে মাঝে অস্থিরভাবে মায়ের কাছে চলে আসে ললিত! মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়ে বলে, আমার মাথায় একটু হাত রাখো তো মা। একটু হাত রাখো।
মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, কেন রে?
ললিত বিড় বিড় করে বলতে থাকে, সব ভুলিয়ে দাও তো মা, ভুলিয়ে দাও তো। বুদ্ধি, স্মৃতি, অবিদ্যা, ভুলিয়ে দাও। আবার ছোট ললিত হয়ে কোলে ফিরে যাই…