১৫. কলেজে রাকা শাশ্বতীকে ধরল

পনেরো

পরদিনই কলেজে রাকা শাশ্বতীকে ধরল, আমার দাদাকে কেমন লাগল বল।

উদাসীন গলায় শাশ্বতী বলে, ভালই তো।

দাদা বলেছে তোর সঙ্গে একটা সিরিয়াস কথা আছে ওর। শিগগিরই এক দিন গাড়ি নিয়ে আসবে। আমরা গঙ্গার ঘাটে যাব তোকে নিয়ে। হ্যাঁরে তোদের কী কী কথা হল কাল?

শাশ্বতী কেমন ঠান্ডা বোধ করে নিজেকে। কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।

থার্ড পিরিয়ডে ক্লাস ছিল না। শাশ্বতী কমনরুমের জানালার কাছে বসে খাতায় হিজিবিজি মুখ আঁকছিল, যেমন সে প্রায়ই আঁকে। এমন সময় শিবানী এসে ডাকল, এই।

শাশ্বতী মুখ ফিরিয়ে তাকায়।

শিবানী চোরাহাসি হেসে বলল, তোর তিনি এসে দাঁড়িয়ে আছেন গাছতলায়। শিগগির যা।

শাশ্বতী অবাক হল না। আজ আদিত্য আসবে, এমনটা সে আশা করেছিল। প্রায়ই অফিস থেকে পালিয়ে আসে।

অন্য দিনের মতো চমকে উঠে ছুটল না শাশ্বতী। খুব গড়িমসি করে খাতা বন্ধ করল, দাঁড়িয়ে ঠিকঠাক করল শাড়ি, কপাল থেকে সরাল কয়েক কুচি চুল। বুকের মধ্যে অকারণে একটু ধকধক করছে আজ। হয়তো সে আদিত্যর চোখে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারবে না।

গাছের ছায়ায় আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। গালের দাড়ি পরিষ্কার কামানো, পাটভাঙা ধুতি আর সাদা শার্ট পরনে, চুল আঁচড়ানো। এরকম পরিচ্ছন্ন তাকে বড় একটা দেখা যায় না। যেদিন দাড়ি কামায় সেদিন ময়লা জামা পরে সে, যেদিন পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে সেদিন চুল আঁচড়াতে ভুলে যায়। আজ সবকিছু একসঙ্গে করেছে সে। কাছে গিয়ে এমনকী পাউডারের একটু মৃদু গন্ধও পেল শাশ্বতী।

আদিত্য হাসে না, তার মুখ গম্ভীর। বলে, কাল কোথায় গিয়েছিলে?

একজন বন্ধুর সঙ্গে, রেডিয়ো স্টেশনে। শাশ্বতী চোখ নিচু করে বলে।

শুনলাম একটা গাড়িতে একটি ছেলে আর একটি মেয়ের সঙ্গে গেছ। ছেলেটি কে?

জবাবদিহি চাইবার সুরটা তার ভাল লাগে না, তবু শান্ত গলায় বলে, ও রাকার দাদা সুমন্ত।

খুব জরুরি কাজে গিয়েছিলে?

না। এমনিই, সঙ্গ দিতে।

একটু চুপ করে থাকে আদিত্য। মাথার পাট করা চুল থেকে একটা ঘুরলি আঙুলে পাকায়, তারপর হঠাৎ খুব অদ্ভুত গলায় বলে, কাল তোমার দেখা পেলে আমার একটা সর্বনাশ হত না।

শাশ্বতী চকিত চোখ তুলে আদিত্যকে দেখে। বলে, কী সর্বনাশ?

শ্বাস ফেলে আদিত্য বলে, বলব। এখানে তো বলা যাবে না। চলো কোথাও গিয়ে বসি।

শাশ্বতী ইতস্তত করে বলে, এস-বি’র ক্লাসটা রোজ কামাই হচ্ছে। ক্লাসটা করে যদি—

অধৈর্য হয়ে তাড়া দেয় আদিত্য, আঃ! বলছি জরুরি কথা আছে!

একটু কেঁপে ওঠে শাশ্বতী। আদিত্য এমন ধমকাতে পারে জানত না।

আদিত্য আবার ধমকায়, কী! যাবে?

শাশ্বতী মৃদু স্বরে বলে, চলো।

বালিগঞ্জ স্টেশনে যাওয়ার রাস্তায় বাঁ হাতি একটা রেস্টুরেন্ট আছে তাদের। প্রায়ই এখানে আসে তারা।

আদিত্য বসে অনেকক্ষণ মুখ নিচু করে রইল। শাশ্বতী প্রশ্ন করল না। কিন্তু তার বুকের ভিতরটা ধকধক করছিল ঠিকই।

আদিত্য আস্তে করে বলল, আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি সতী। বাবার ব্যবসায়ে নামব। কাল রাতে সব ঠিক হয়ে গেল।

শাশ্বতী বড় অবাক হয়। এ রকম কথা ছিল না তো! বরং শাশ্বতীর ধারণা ছিল, বাবার ব্যবসাকে ঘেন্না করে বলেই একদিন আদিত্য জোর করে চাকরি নিয়েছিল। তারপর শাশ্বতীর সঙ্গে প্রেম করার সময়েই আদিত্য বুঝতে পেরেছিল যে, কোনও দিনই শাশ্বতীকে তাদের বাড়ির লোক নেবে না। কাজেই, শাশ্বতীকে নিয়ে আলাদা ঘর বাঁধবে আদিত্য। সেইজন্যই চাকরিটা আদিত্যর খুব দরকার। এখন বাবার সঙ্গে ব্যবসায়ে নামলে পরিবার ভেঙে আলাদা হয়ে আসতে পারবে কি আদিত্য? বামুনের মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে মেনে নেবে কি ওর বাবা? না কি অত ভেবে দেখেনি আদিত্য!

শাশ্বতী এতসব প্রশ্ন করল না। একটু ধারালো গলায় বলল, ভালই তো। তোমার বাবাও এই চেয়েছিলেন। তুমিও সুবোধ ছেলের মতো কাজ করছ। এবার বাবার পছন্দমতো একটা বিয়ে করে ফেলো।

আদিত্য হঠাৎ রেগে যায়, এখনও তুমি সবটা শোনোনি। বাবার ব্যবসায়ে নামলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না ভাবছ?

শাশ্বতী আদিত্য চোখে চোখ রাখে। শান্ত গলায় বলে, আমাকে তো তোমাদের পরিবার নেবে না! বিয়ে করলে তোমাকে আলাদা থাকতে হবে। বাবার ব্যবসায়ে তুমি পরিবার ভেঙে আসবে কী করে?

আদিত্য ভীষণ অস্থিরভাবে মাথার চুল টানে, ছটফট করে বলে, সে একটা ব্যবস্থা হবেই। বাবাকে আমি বুঝিয়ে বলব। পায়ে ধরব।

শাশ্বতী হঠাৎ বিদ্রূপে হাসে, বলে, ব্যবসায়ে নামলে তুমি তোমার খদ্দেরদের ‘বাবু’ বলেও ডাকবে তো?

আদিত্য হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলে, ডাকব। তাতে কী? আমার বাপ-ঠাকুরদা ডাকতে পারলে আমি পারব না কেন?

শাশ্বতী হঠাৎ শ্বাস ছেড়ে বলে, তা হলে সত্যিই তোমার সঙ্গে আমার জাত মিলবে না।

শুনে বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেল আদিত্য। কয়েকবার কথা বলবার চেষ্টা করেও চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ পর বিষণ্ণ গলায় বলল, সেইজন্যই তো বলছিলুম কাল আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। কিন্তু কলেজে এসে কাল যদি তোমাকে পেতুম তা হলে ঠিক একটা রাস্তা খুঁজে বার করতুম।

আদিত্য করুণ মুখে বসে থাকে চুপ করে। শাশ্বতীর করুণা হয় একটু। বলে, কী হয়েছিল কাল?

আদিত্য আস্তে আস্তে বলল, পরশুদিন সেই যে একটা ভুতুড়ে কাণ্ড করলুম তোমার সঙ্গে, তারপর থেকেই নিজের ওপর গেলুম ভয়ংকর রেগে। তুমি মাইরি কাঁদছিলে সেদিন বিকেলে! আমি কী সব যা-তা বলেছিলুম তোমাকে! কিন্তু কী করব সতী, নিজেকে যে আমার ভীষণ সন্দেহ। কখনও ভুলতে পারি না আমি এমন এক বেনের ছেলে, যে পয়সার জন্য একদলের পায়ে ধরতে পারে। আবার পয়সা দিয়েই কিনে নেয় আর-এক দলকে। আমাদের গদিতে গিয়ে দেখতে পাবে বাবা ক্রীতদাসের মতো হাতজোড় করে, ‘বাবু’ ডেকে খুশি রাখছে খদ্দেরদের, চালু রাখছে লাভজনক ব্যবসা। আবার বাড়িতে গিয়ে সেই বাবাকেই দেখতে পাবে গম্ভীর হয়ে বসে আছে শ্বেতপাথরের টেবিলের সামনে জমকালো চেয়ারে, সামনে রুপোর রেকাবে দামি ফল, চাকরবাকর বাতাস করছে তাকে, তাকে খুশি করার জন্য ছোটাছুটি করছে দাস-দাসী, বন্ধকি সোনার গয়না পরে তার পায়ের কাছে বসে আছে মা। আমাদের পরিবারে কেউই বেশিদূর লেখাপড়া শেখে না, অক্ষরজ্ঞান হলেই পড়া ছেড়ে ব্যবসায়ে নেমে পড়ে। তারপর ঠিক ওইরকম ভাবেই শেখে আত্মসম্মান ভাসিয়ে, ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে রোজগার করতে, আর ঘরে এসে দেড়শো বছর আগেকার সামন্তের মতো সেই রোজগারের ফল ভোগ করতে। তুমি তো জানো না, আমার বাবার সেই পুরনো দিনের রীতি অনুযায়ী একজন রক্ষিতা আছেন শোভাবাজারের আলাদা বাড়িতে, যাকে আমরা ‘মা’ বলে ডাকি। এইসবই আমাদের পারিবারিক শিক্ষা। আমি এই রকম এক বেনের বাচ্চা। তাই সবসময়ে সন্দেহ হয় আমার মধ্যে কীসের যেন অভাব থেকে গেল। আমি বি এ এম এ পাশ করেও ললিতের মতো হতে পারলুম না, টাকা থাকা সত্ত্বেও হলুম না রমেনের মতো। ওরা ওদের পারিবারিক শিক্ষার গুণেই আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। ঠিক সেই কারণেই, তোমাকে ভালবাসি কিন্তু ভয়ে ভয়ে থাকি, পাছে কোনও দিন তুমি আমার শিক্ষার অভাব ধরে ফেলো। তাই ললিতের কাছে তোমাকে নিয়ে গিয়েই আমি ভয় পেয়েছিলুম তুমি তো জানো না, কী ভীষণ স্মার্ট ছেলে ছিল ললিত! আমার মতো বেনের বাচ্চাকে ও বানিয়েছিল কমিউনিস্ট। শিখিয়েছিল নিজের পরিবারকে ঘেন্না করতে। সেই কারণেই আমি বাবার ব্যবসায়ে যেতে পারিনি কোনও দিন। এ ললিতের জন্যই। কী যে বিষ ঢুকিয়েছিল ও! সেই ভয়ংকর ললিতের কী যে আকর্ষণ তা আমি জানি। তাই বারবার তোমাকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলুম, ললিতকে তুমি কেমন দেখেছিলে।

হঠাৎ শাশ্বতীর বড় ভয় করতে থাকে। ছলাৎ ছল করে তার বুকের ভিতরে লাফিয়ে উঠছে হৃৎপিণ্ড, রক্তের ঝাপটা লাগছে মুখে। এ-সব টের পাচ্ছে না তো আদিত্য?

আদিত্য টের পায় না। সে নিজের কথায় ডুবে থেকেই ম্লান হাসে। বলে, যাকগে সে-সব কথা। সেদিন, অর্থাৎ পরশু, তোমার সঙ্গে ওই কাণ্ড করে যখন বাড়ি ফিরলুম তখন আমার মন-ভৱা বিষ। মনে হচ্ছিল তুমি আমাকে ভালবাসে না। ভালবাসো না, কারণ আমি ললিত বা রমেনের মতো নই, আমি এক আলাদা নিচু জাতের লোক। সেজন্য দায়ী আমার পরিবার। আমার বাবা, মা, আমাদের এই বিশাল দুর্গের মতো বাড়িটা। তাই সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আমি সে-সবকিছুর ওপর রেগে গেলুম। বাবা তখন সদ্য রুপোর রেকারে কাটা ফল-টল নিয়ে জল খেতে বসেছে, পিছনে পাখা-হাতে চাকর, চারদিকে দাসদাসী, সেই অবস্থাতে আমি তার সামনে গিয়ে বললুম, আপনি লেখাপড়া শেখেননি কেন? শুনে লোকটা হাঁ হয়ে গেল। তারপর তুমুল কাও। পরশু রাতেই বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিল। আমি সারা রাত ফাঁকা আস্তাবলে বসে মশা তাড়িয়ে কাল সকালে বেরিয়ে এসেছিলম। ভেবেছিলুম আর ফিরব না। কিন্তু সতী, কালই প্রথম বুঝতে পারলুম আমি বড় দুর্বল অসহায়, এত বড় কলকাতা শহরে আমি একটা যাওয়ার জায়গা ঠিক করতে পারলুম না। বন্ধুর মেসে কলাইকরা থালা দেখে খেতে পারলুম না, ওর বিছানায় শুতে গিয়ে ঘামের দাগ দেখে ঘেন্না হল। বুঝলুম আমি অভ্যাসের দাস হয়ে গেছি। ওই দুর্গের মতো বাড়ির বাইরে সর্বত্র আমি পঙ্গু, অনুপযুক্ত। তোমার কাছে এলুম দুপুরে, তখন স্নান হয়নি, খাওয়া নেই। কিন্তু তোমাকে দেখলেই আমার অনেকটা সাহস ফিরে আসত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তুমি কাল ছিলে না। গড়িয়াহাটায় দাঁড়িয়ে যখন সন্ধে পার হয়ে গেল তখন রাতের কলকাতা বিপুল এক ভয়াবহ অচেনা জায়গা বলে মনে হয়েছিল। আমি ললিত বা তুলসীর কাছে যেতে পারতুম, কিংবা সঞ্জয়ের কাছে, কিন্তু কোথাও যেতে ইচ্ছে করল না। মনে হল ওরা সবাই এক আলাদা জাতের মানুষ, ওরা স্কুল-কলেজের বন্ধু বটে কিন্তু ওদের সঙ্গে আমার জাত মেলে না। ভেবে দেখলুম, আমি বাড়ি ছেড়ে এসে ভুল করেছি। ও-বাড়ির বাইরে আমি এক একঘরে। তাই রাতে আবার লজ্জার মাথা খেয়ে, সম্মান বিসর্জন দিয়ে ফিরে গেলুম বাড়িতে। সবাই বুকে টেনে নিল। মা শিখিয়ে দিল, বাবুর পায়ে ধরে ক্ষমা চা।

চাইলে? শাশ্বতী উগ্র আগ্রহে জিজ্ঞেস করল।

হাসল আদিত্য। বলল, সেই ছেলেবেলার পর থেকে বাবাকে কখনও আর প্রণাম করিনি। ঘেন্না করত। কাল পায়ে ধরলুম। বাবা বুকে টেনে নিল। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে গল্প করল আমার সঙ্গে। বলল, পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কেউ শান্তি পায় না। বলল, পারিবারিক জীবিকার চেয়ে সম্মানজনক আর কিছু নেই। আমি অনেক রাত পর্যন্ত ভাবলুম। অনেক ভাবলুম আমি। দেখলুম, ও-বাড়িতে থাকতে গেলে অন্য রকম এক মানুষ হয়ে, বাইরের মানুষের মতো হয়ে থেকে লাভ নেই। তাতে আমার মনুষ্যত্বের কোনও উন্নতি হবে না, আর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক হবে ক্রমেই বিষাক্ত। তার চেয়ে আমি বরং এখন এই পরিবারেরই একজন হয়ে উঠি। আমার একটু শিক্ষাদীক্ষা আছে, ভাল বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গ পেয়েছি আমি, কাজেই আস্তে আস্তে আমি হয়তো একদিন এই পরিবারে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারব। ব্যবসাকে করে তুলতে পারব সম্মানজনক লেন-দেন। আমার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখবে, নিজেদের সম্মান দিতে শিখবে, মানুষের মূল্য দিতে শিখবে। তারা কেউ বন্ধকি সোনার গয়না পরবে না, একই সঙ্গে দু’দলের সঙ্গে ‘হুজুর’ এবং চাকরের সম্পর্ক বজায় রাখবে না, তারা হবে না টাকায় কেনা মানুষ। এইরকম সব অনেক ভাবলুম আমি। শেষে অনেক রাতে বাবাকে বললুম, আমি ব্যবসায়ে নামব। সতী, আমি এই সর্বনাশটুকু করে ফেলেছি। এখন বলো, আমি ঠিক করেছি কি না!

শাশ্বতী মাথা নিচু করে ছিল। টেবিলের কাচে আঙুল দিয়ে আঁকছিল মানুষের মুখ। কথা বলল না।

অধৈর্য আদিত্য ঝুঁকে তার হাত ধরতে গেল। শাশ্বতী চট করে তুলে নিল হাত। বলল, প্রশ্নটা তো থেকেই যাচ্ছে।

কী প্রশ্ন?

আমি।

একটু চুপ করে থেকে শাশ্বতী বলল, আমাকে নিয়েই আবার তোমাদের পরিবারে গোলমাল দেখা দেবে, বাবার সঙ্গে ঝগড়া হবে তোমার। তাঁরা অসবর্ণ বিয়ে মানবেন কেন?

আদিত্য ছেলেমানুষের মতো বলল, আমি বাবাকে রাজি করাবই।

যদি রাজি না হন?

আদিত্য একবার বলতে যাচ্ছিল, তা হলে আমি চাকরি ছাড়ব না। ব্যবসা ছাড়ব। কিন্তু বলার আগে সে একটু ভাবল। ভাবতে লাগল।

ভাবতে ভাবতে কয়েক দিন কেটে গেল আদিত্যর। আবার তার চুল হয়ে গেল এলোমেলো, রুক্ষ, জামার কলার উলটে থাকে, দাড়ি কামানো হয় না। অন্যমনস্কভাবে অফিসে যায়। চেয়ারে বসে থাকতে পারে না, ঘুরে বেড়ায় এ-টেবিল ও-টেবিল। ক্যান্টিনে গিয়ে চা নিয়ে একা বসে থাকে অনেকক্ষণ। অফিস থেকে বেরিয়ে অনেক দুর হাঁটে। তিন-চারদিন সে শাশ্বতীর সঙ্গে দেখা করল না।

ওদিকে শাশ্বতী মাঝে মাঝে একা তার খাতা খুলে বসে। একটা ধারালো তীক্ষ্ণ নাকবিশিষ্ট মুখ সে কয়েক দিন ধরে আঁকার চেষ্টা করছে। পারছে না।

এ দিন ফাস্ট পিরিয়ড শেষ করে ইকনমিক্সের ক্লাসে যাচ্ছে শাশ্বতী, এমন সময়ে রাকা এসে ধরল, আজ দাদা আসবে। সাড়ে চারটেয় টাইম দিয়েছে। আজ কিন্তু আমি যাব না, তুই একা যাবি। দাদার সিরিয়াস কথা আছে তোর সঙ্গে।

খুব অবাক হল শাশ্বতী। বলল, কে আসবে বললি?

রাকা থমকে যায়, ভ্রূ তুলে বলে, ও মা, দাদাকে ভুলে গেছিস নাকি?

সত্যিই শাশ্বতী ভুলে গিয়েছিল। ওই খুব রূপবান যুবকটিকে তার একদম মনে ছিল না। বোধহয় সুমন্তর রূপের মধ্যে মনে রাখার মতো কিছু নেই। সে কেবল সুন্দরমাত্র কিন্তু তা পথ আটকে ধরে না। তার দিকে একবার তাকিয়ে চলে যাওয়া যায়। তাই শাশ্বতী ভুলে গিয়েছিল।

শাশ্বতী মুখে বলল, ওঃ। কিন্তু আজ আমার বড় কাজ আছে। আজ সময় হবে না।

সে কী! দাদা যে খুব আশা করে আসবে!

শাশ্বতী ইতস্তত করে। সে বড় নরম মেয়ে। সহজ কৌশলগুলো সে প্রয়োগ করতে জানে না। অসহায়ভাবে বলে, কী করব তা হলে?

ও-সব কাজফাজ বাদ দে। একাজটা অনেক জরুরি। আজ খুব সম্ভব দাদা তোর কাছে প্রপোজ করবে।

কেমন অবশ লাগল শাশ্বতীর। খিল ধরে এল হাত-পা।

কমনরুমে এসে সে একা একা ছটফটে মন নিয়ে বসে রইল, ইকনমিক্সের ক্লাসে গেল না। এলোমেলো ভাবনায় ভেসে যেতে লাগল সে। বুক কাঁপতে থাকল, ঘাম দিল শরীরে। এখন সে কী করবে!

দুপুরে যখন টিফিন ক্যারিয়ারটি হাতে নিয়ে বেরোতে যাচ্ছিল ললিত, ঠিক সেইসময়ে আদিত্য গিয়ে হাজির। উদ্‌ভ্রান্তের মতো চেহারা, চোখের দৃষ্টি অস্থির, মুখ শুকিয়ে গেছে।

ললিত বলল, কী রে! অফিস নেই?

আদিত্য দু’হাত বাড়িয়ে ললিতের কাধ ধরে বলল, লোলিটা, আমার কয়েকটা কথা শুনবি? খুব জরুরি কথা!

এমনিতে আদিত্য খুব হাসি-খুশি, আমুদে। তাই ওর রোগা শুকনো গম্ভীর চেহারাটা দেখে ঘাবড়ে গেল ললিত। বলল, আয়, ভিতরে আয়।

আদিত্য ভিতরে এসে প্রথমেই সটান বিছানা নিল। উপুড় হয়ে শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। ললিত ওকে ডাকল না। অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর ওর পাশে বসল। গায়ে হাত দিয়ে ডেকে বলল, এই, কী কথা বলবি যে!

ডাকতে গিয়েই ললিত টের পেল, আদিত্য কাঁদছে। খুব মৃদু শরীর কাঁপছে তার। মুখ ঢেকে রেখেছে। তবু কান্না ললিত চেনে।

সে বিহ্বল বোধ করে বোকার মতো বসে রইল একটুক্ষণ। তারপর আবার ডাকল, কী হয়েছে বলবি তো! এই আদিত্য—

আদিত্য উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ ওইভাবে শুয়ে রইল।

মা ঘরে এসে চোখ কুঁচকে বলল, ওটা কে রে শুয়ে! ললিত, ও কে?

ললিত মাকে ঘর থেকে পাচার করার জন্য উঠতে যাচ্ছিল, সে সময়েই আদিত্য মুখ ফেরাল। ম্লান একটু হেসে বলল, মাসিমা, আমি আদিত্য। একটু চা খাওয়াবেন মাসিমা?

মা হাসে, তোর হয়েছে কী, শুয়ে আছিস যে! দেখে এমন চমকে গিয়েছিলুম। উঠে বোস, আমার উনুনে এখনও আঁচ আছে, চা করে দিচ্ছি।

উঠে শোকতাপা মানুষের মতো হাঁটু জড়ো করে তার ওপর মুখ রেখে বসল আদিত্য। বলল, লোলিটা, সতী আমাকে ভালবাসে না।

শুনে স্তব্ধ হয়ে রইল ললিত। এতক্ষণ তার অবচেতন মন এইটাই প্রত্যাশা করছিল।

একটু সময় নিল ললিত। তারপর বলল, কী করে বুঝলি?

আদিত্য তেমনি বসে থেকে উদাসী গলায় বলে, ওর সঙ্গে আমার জাত মিলছে না।

একটু অবাক হয়ে ললিত বলে, এত দিন প্রেম করে এখন তোর শাশ্বতী জাতের কথা তুলেছে?

না-না। ও বরং উলটোটাই বুঝিয়েছিল। আমিই প্রথম জাতের কথা তুলেছি।

ললিত মৃদুস্বরে বলে, তা হলে তই জাত মানছিস আদিত্য? কেন রে, এত দিন পর হঠাৎ জাতের চিন্তা কেন?

আদিত্য দীন ভঙ্গিতে তার হাঁটুর ভিতরে মাথা গুঁজে দিয়ে বলে, আমি বেনের বাচ্চা, আমি আমার বাপ-দাদাদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট। আমার বংশের কালচারের সঙ্গে ওদের মেলে না। আমাদের জাত আলাদা।

শুনে বড় কষ্ট হল ললিতের। আদিত্যর এই দুর্বল দিকটার কথা ললিত অনেক দিন ধরে জালে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আদিত্যর বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে নিজের পরিবারকে নিয়ে।

ললিত স্নেহের একখানা হাত বাড়িয়ে আদিত্যর মাথায় রাখল। বলল, কী হয়েছে খুলে বল। তোদের কি ঝগড়া হয়েছে?

একটু ভেবে আদিত্য বলল, ঠিক ঝগড়া নয়, তবে অনেকটা ও-রকমই।

কী নিয়ে?

আদিত্য শ্বাস ফেলে বলল, প্রথমে শুরু হয়েছিল তোকে নিয়ে।

আমাকে! ভীষণ অবাক হয় ললিত।

তোকে নিয়েই প্রথম জাতের কথা উঠেছিল। যেদিন তোর কাছে সতীকে নিয়ে আসি সেদিনই আমি লক্ষ করেছিলুম যে তোর সঙ্গে ওর জাত মেলে। আমার সঙ্গে মেলে না।

তার মানে? ললিত ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

ধপ করে আবার শুয়ে পড়ে আদিত্য। বলে, কী জানি, আমি কিছুই গুছিয়ে বলতে পারি না। লোলিটা, তুই রাগ করিস না। আমার মনটা ঠিক নেই। আমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি।

ললিত চুপ করে থাকে।

মা চা দিয়ে গেল। বলল, ভাত খেয়ে বেরিয়েছিস তো?

হ্যাঁ, মাসিমা।

তারপর বসে চায়ে চুমুক দিয়ে, যেন বড় স্বাদ পেয়ে, চোখ বুজল আদিত্য। বলল, কয়েক দিনে অনেক নাটুকে কাণ্ড হয়ে গেছে। আমি চাকরি ছেড়ে বাবার ব্যবসাতে নামছি। তাতেই সতীর সঙ্গে আরও গোলমাল পাকিয়ে গেছে। এবার ও নিজেই বলছে যে, ওর সঙ্গে আমার জাত মিলবে না।

আদিত্য একটু দম ধরে থেকে তারপর বলে, আরও একটা ব্যাপার আছে। মাঝখানে একদিন সতী তার এক বন্ধু আর বন্ধুর দাদার সঙ্গে রেডিয়ো স্টেশনে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল আমি জানি না। সেদিনই কলেজে ওকে খুঁজতে গিয়ে আমি পাইনি। কিন্তু আবছাভাবে আমার পরে মনে পড়েছে, যখন ওর কলেজের কাছে বড় রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে ঢুকছিলুম, তখন উলটো দিক থেকে একটা সাদা রঙের গাড়ি খুব ধীরে ধীরে আমাকে পার হয়ে গেল। তখন আমার মন খুব অস্থির ছিল, স্পষ্ট করে দেখিনি, তবু পরে আমার মনে হয়েছে, গাড়ির সামনের সিটেই ওরা তিন জন ছিল। একটি সুন্দরমতো ছেলে, তার পাশে একটি মেয়ে, আর জানলার ধারে সতী। আমার মনে হয়, সেদিন সতী আমাকে দেখতে পেয়েছিল, কিন্তু ডাকেনি। পরে সতী আমাকে নিজেই বলেছে সেদিন সে কোথায়, কার সঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু বলেনি যে, সেদিন গাড়ি থেকে সে দেখেছিল আমায়।

না-ও দেখতে পারে।

আদিত্য দৃঢ় মুখে মাথা নেড়ে বলে, আমি সিওর। ও আমাকে দেখেছিল। ডাকেনি।

একটু শ্বাস ছেড়ে আদিত্য বলে, আজ একটু আগেই আমি ওর কলেজে গিয়েছিলাম। বকুল গাছটার তলায় আমি রোজ দাঁড়াই ওর জন্য। সেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময়ে শিবানী নামে ওর এক বন্ধু চানাচুর কিনতে এসে আমাকে দেখে একটু হেসে এগিয়ে এল। শিবানী মেয়েটা সতীর বাসার কাছেই থাকে, একটু বেশি কথা বলে আর কী, আমার সঙ্গেও আলাপ আছে। শিবানী নিজেই যেচে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে বলল, ওদের রাকা নামে কে এক বন্ধু আছে, তার দাদার সঙ্গে নাকি বিয়ের কথা চলছে সতীর। সতী রাজিও হয়েছে। রাকা নিজেই বলেছে শিবানীকে। আমার মনে হচ্ছে, এই রাকা আর রাকার দাদাই সেই গাড়িওলা পাটি। শিবানীর কাছে এ-সব শুনে আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। সতীর সঙ্গে দেখা না করেই সোজা চলে এসেছি তোর কাছে।

হঠাৎ ললিতের শরীরের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়। থর থর করে কেঁপে ওঠে সে। রাগে, ঘেন্নায়, আক্রোশে। কেন এমন হবে? কেন এমন হতে থাকবে?

সে হাত বাড়িয়ে আদিত্যর হাত চেপে ধরে বলল, তুই ছাড়বি কেন? ছাড়িস না আদিত্য। হয়তো তোর ভুল হচ্ছে। আর যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে—

আদিত্য ক্লান্তমুখে বলে, তবে কী?

তবে তোকে আজই বিয়ে করতে হবে। রেজিষ্ট্রি।

আদিত্য অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলে, কী বলছিস!

একটা সময়ে ললিতের মাথা যন্ত্রের মতো কাজ করত। যখন ইউনিয়নের গোলমাল, কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দাবি-আদায়ের বৈঠক কিংবা এ-রকমই কোনও কাজের চাপ পড়ত, তখন সংকটের মুখে অন্ধ-কষা যন্ত্রের মতো নির্ভুল কাজ করত তার মাথা। তার মুখে কয়েকটা নিষ্ঠুর লাইন জেগে উঠেছে, চকচক করছে উগ্ৰ চোখ। সে আদিত্যর কথার উত্তর না দিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে তুলল, বলল, ওঠ, এখন অনেক কাজ করতে হবে।

আদিত্য বোকার মতো উঠে দাঁড়িয়ে বলে, কীসের কাজ! তুই কী করতে চাস?

ললিত সংক্ষেপে বলল, আজই রেজিষ্ট্রি। আর দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যে।

আদিত্য আবার বসে পড়ে, দূর! তা হয় না। সতী রাজি হবে না।

হতে হবে।

লাভ কী? ও আমাকে ভালবাসে না।

তোকে সে-কথা বলেছে?

না। কারণ, সতী সেটা নিজেও এখনও জানে না। কয়েক দিনের মধ্যেই ও টের পাবে যে ও আমাকে ভালবাসে না।

এত দিন বাসল কী করে? এটা কি ইয়ার্কি?

আদিত্য অন্যমনস্ক চোখে ললিতকে একটু দেখল। তারপর বলল, না, ইয়ার্কি নয়। ললিত, শোন একটা ছোট গল্প। আমাদের বাড়ির মেয়েদের তো জানিস, গায়ে তাদের রোদ লাগে না। সেই আমাদের বাড়ির মেয়ে, আমার খুড়তুতো বোন মান্তু একবার প্রেমে পড়েছিল কালো ন্যাংলা মতন একটা ছেলের। সে-ছেলেটা আমাদের বাড়িতে খবরের কাগজ দিত। কোনদিন কোন ভোরবেলায় বোধহয় মান্তু দোতলার চিকের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরেছিল, আর সে সময়েই ছেলেটা সাইকেলে বসে খবরের কাগজ ছুড়তে যাচ্ছিল বারান্দায়, সেই সময়েই তারা দু’জন দু’জনকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তারপর রোজ ও রকম দেখা হতে লাগল তাদের। আমরা কিছু জানতুম না। শেষ পর্যন্ত সেই ন্যাংলা ছেলেটার জন্য মান্তু একদিন মাঝরাতে ছাদ থেকে দড়ি ঝুলিয়ে নেমে পালানোর চেষ্টা করেছিল। আমরা ধরে ফেললাম। কাকা তাকে জুতোপেটা করে ঘরে তালা দিয়ে রাখল। ভারী আশ্চর্য হয়েছিলুম আমরা, আমাদের মতো বাবুদের বাড়ির মেয়ে কী করে ও-রকম একটা ছেলেকে পছন্দ করে! কিন্তু এখন বুঝি সেটা পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নয়। সেটা কেবল একটা রহস্য ভেদ করার আগ্রহ। চারদিকে যা-সব প্রেম-ট্রেম দেখি তার অধিকাংশই পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নয়, তার মধ্যে শ্রদ্ধা ভক্তি ভালবাসা নেই, আছে ওই রহস্যভাঙা, আছে রোমহর্ষ। হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই সই। বাঙালি মেয়েরা তো খুব একটা পুরুষমানুষ দেখে না! সতীও তাই। ঘরকুনো, পুরুষ দেখলে উপায়। আমিই ছিলুম ওর প্রথম পুরুষ। আমাকে নিয়েই ওর রহস্য ভেঙেছে। ও কোনও দিন ভালবাসেনি আমাকে। বাসবেই বা কেন। ওর সঙ্গে কি আমার জাত মেলে?

আদিত্য ম্লান হাসে, নিজেকে সেই হকার ছেলেটার মতো লাগছে আমার। সেই ছেলেটা হয়তো পরে রোজ এসে দূর থেকে আমাদের দোতলার বারান্দার দিকে চেয়ে থাকত। দেখত খালি বারান্দা, ভোরের বাতাসে কেবল চিকটা দুলছে।

ললিত থরথর করে কাঁপে। তার শরীর দুর্বল, পা কাঁপে, মাথা টলমল করে। প্রবল রাগে খ্যাপাটে গলায় সে বলে, নতুন বা পুরনো কোনও বর্ণাশ্রম আমি মানি না। আমি সব ভেঙে দিয়ে যাব। ওঠ।

লোলিটা, তুই খেপে গেছিস।

ললিতের দুটো চোয়াল বদ্ধমুষ্টির মতো ফুলে ওঠে। সে কেবল বলে, ওঠ। আর-একটু পরেই তোর রেজিস্ট্রেশন।

আদিত্য মাথা নিচু করে ভাবে।

ললিত তাড়া দেয়, কী হল!

ও রাজি হবে না। দেখিস।

হবে। আমি রাজি করাব।

কাজটা ঠিক হবে না।

না হোক। তবু করতেই হবে।

আস্তে আস্তে ললিতের উদ্ধত, ফণাতোলা চেহারার সামনে আদিত্য নরম হয়ে আসে। ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবে। গম্ভীর দেখায় তাকে। তারপর বলে, সাক্ষী কে হবে?

আমি হব। আর দু’জন জোগাড় করছি।

আর বিয়ের নোটিশ?

আমার চেনা রেজিষ্ট্রার আছে। ওটা ম্যানেজ করে দেব।

হঠাৎ যেন দমকা হাওয়ায় আদিত্যর সব বিষণ্ণতা উড়ে যায়। সে পুরনো দিনের মতো হাসে। বলে, তুই খুব ডেঞ্জারাস।

ললিত সে-কথার উত্তর দেয় না। আপন মনে কী যেন একটু বিড় বিড় করে। হয়তো নিজের ব্যর্থতাগুলির কথা নিজেকে শোনায়। হয়তো প্রতিশোধের কথা নিজেকে মনে করিয়ে দেয়।

বিমানের ঘরের দরজা খোলা ছিল। চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়ে ছিল সে। তাদের পায়ের শব্দে চোখ খুলে উঠে বসল, এসো। আমি সময় গুনছিলাম। খুব খিদে পেয়েছে।

ললিত আদিত্যকে দেখিয়ে বলল, একে চেনো?

একপলক আদিত্যকে দেখেই বিমান বলল, চিনি। আদিত্য রায়। বাগবাজারে তোমাদের বাড়ি, না?

আদিত্য হাসল, তুমি সব মনে রেখেছ!

আমি সবাইকেই মনে রাখি। কিন্তু আমাকে সবাই ভুলে যায়।

আদিত্য মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমি ভুলিনি। ললিতকে জিজ্ঞেস করো, তোমার নাম শুনেই চিনেছি। তারপর আদিত্য বিমানের মুখে মায়ের দাগগুলো লক্ষ করে বলে, ইস্‌, ছিনতাই পার্টির লোকেরা তোমাকে খুব মেরেছে তো?

বিমান মৃদু হাসে।

আদিত্য তেজি গলায় বলে, তুমি তাদের পেটে লাথি মারলে না কেন?

মেরেছি। তৃপ্ত স্বরে বিমান বলে।

মেরেছ! সাবাস! বলে আদিত্য হাসে। বিমানের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে চার দিকে চায়। তার গলায় হাসিঠাট্টার সুর ফিরে আসে। বলে, তুমি মাইরি জ্ঞানী লোক, কত বই তোমার!

মেঝেতে বসে একটা অ্যালুমিনিয়মের থালায় খাচ্ছিল বিমান। কাঙালের মতো বসার ভঙ্গি। তাড়াতাড়ি খাচ্ছে, স্পষ্ট বোঝা যায় ওর খুব খিদে পেয়েছে। ললিত ওকে খানিকটা খাওয়ার সময় দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার শরীর কেমন?

ভাল। অনেক ভাল।

চলাফেরা করতে পারছ?

বিমান মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

একটা কাজ করতে পারবে?

কী?

একটা বিয়ের সাক্ষী দেবে? রেজিষ্ট্রি বিয়ের?

বিয়ে! কার? বিমান অবাক চোখে তাকায়।

আদিত্য একটু হেসে বলে, আমার। মাই ম্যারেজ টু-ডে।

যাবে? ললিত আবার বিমানকে জিজ্ঞেস করে।

বিমান হাসে। ঘাড় নেড়ে বলে, যাব। কখন?

আমরা একটু পরে এসে তোমাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে যাব।

বিমান মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়, বলে, বাঃ। আজ কপাল ভাল। বিকেলে আজ খুব খাওয়া হবে, কী বলে?

হবে। অন্যমনস্কভাবে বলে ললিত, আজ তোমার ঘরেই আমরা ফিস্ট করব। মুরগি কিনে আনব।

বিমান হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে আদিত্যকে বলল, এত সহজে বিয়ে করা যায়, আমি জানতুম না। আমার ধারণা ছিল, বিয়ে করতে অনেক সময় আর বিবেচনা লাগে।

আদিত্য মাথা নিচু করে আস্তে বলল, আমারও লেগেছে।

লেগেছে? বিমান হাসে, তবে তোমার সাক্ষীর জোগাড় নেই কেন? তা ছাড়া, রেজিষ্ট্রি বিয়ে তারাই করে যাদের সামাজিক সম্পর্কে গোলমাল আছে।

আদিত্য ভ্রূ কোঁচকায়, তুমি কি সাক্ষী দিতে ভয় পাচ্ছ?

না, না। সুন্দর কবে হাসে বিমান, কিন্তু আমি যখন বিয়ে করব তার অনেক আগে থেকে আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করব তার জন্য। আমার বিয়ের সময়ে সবকিছু প্রস্তুত থাকবে, এমনকী প্রকৃতিও।

একটু থেমে বিমান বলে, আমি একটি মেয়েকে ভালবেসে, তার জন্য পাগল হয়েই বিয়ে করতে ছুটব না। কারণ, যারা এ-রকম বিয়ে করে তাদের সত্যিকারের বিয়ে হয় না। বিয়ের কারণ ভিন্ন।

আদিত্য সামান্য লাল হয়ে বলে, তুমি কীসের জন্য বিয়ে করবে তা হলে?

বিমান খাওয়া থামিয়ে রেখে বলে, বিয়ে সমাজকে সন্তান দেয়। তাই আমি দেখব কীভাবে আমি সমাজকে সুসন্তান দিতে পারি। ব্যক্তিগত প্রেমের চেয়ে সমাজ অনেক বড়।

তুমি প্রেম মানো না?

বিমান হাসে, প্রেমটা ঠিক বোঝা যায় না। ওটা খুব ধোঁয়াটে ব্যাপার। কখনও আছে, কখনও নেই। কিন্তু প্রেম থাক বা না থাক, বিয়েতে সন্তান আছেই। প্রকৃতি আমাদের প্রেমের ধার ধারে না। সে আমাদের দিয়ে যন্ত্রের মতো তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে নেয়। আমরা যতখানি প্রেমিক, তার চেয়ে ঢের বেশি প্রজনন-যন্ত্র।

চকমকে চোখে হাসে বিমান। আমাদের একটা অ্যালসেশিয়ান মাদি কুকুর ছিল। বাবা সেটাকে বাজে কুকুরদের সঙ্গে মিশতে দিত না। দরকার মতো সেটাকে নিয়ে যাওয়া হত মিত্তিরদের মদ্দা অ্যালসেশিয়ান কুকুরটার কাছে। বছর বছর চমৎকার বাচ্চা হত। তেজি, স্বাস্থ্যবান। একবার সেটা বাজে জাতের কুকুরের সঙ্গে মিশেছিল, সেবারকার বাচ্চাগুলো হয়েছিল কুচ্ছিত, ভিতু, পেটুক। জন্মবিজ্ঞানের নিয়ম রয়েছে। মানুষের ভিতরেও এ-রকম বর্ণের তফাত আছে। কিন্তু মানুষ জন্মবিজ্ঞানের কোনও নিয়ম মানে না। যেমন খুশি বিয়ে করে, সমাজে সব একাকার করে দিতে থাকে।

আদিত্য তর্কের জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল। ললিত তা হতে দিল না। হাত ধরে টেনে আনল রাস্তায়, বলল, এখন ও-সব কথা থাক। আমাদের কাজ আছে অনেক।

ললিত চেঁচিয়ে বিমানকে তৈরি হতে বলে চলে এল।

ফিরে এসে আদিত্য ললিতের মাকে বলল, মাসিমা, মাই ম্যারেজ টু-ডে।

কী বললি? মা জিজ্ঞেস করে।

আদিত্য হাসে। বলছিলুম, আপনি বড় ভালমানুষ।

মা হেসে বলে, পাগল! এবার একটা বিয়ে কর।

ললিত গজগজ করে, তোমার কেবল এক কথা।

আদিত্য হো-হো করে হাসে, সেই কথাই তো বলছিলুম মাসিমা, আপনি ভালমানুষ বলে বুঝতে পারলেন না।

বারোটার মধ্যেই তারা তৈরি হয়ে ট্যাক্সি ডেকে আনল। বেরিয়ে পড়ল তিনজন। আদিত্য একটু সংশয়ের গলায় জিজ্ঞেস করে, প্রথমে কোথায় যাবে?

ললিত ওর কাঁধে হাতের একটু চাপ দিয়ে বলল, আগে তোকে একটু ভদ্র পোশাক পরাই। দাড়িটাও কামিয়ে নে। তারপর দেখা যাবে।

দূর। আদিত্য বলে, এ-পোশাকই ভাল। আমি সাজব না।

কিন্তু অবশেষে সবই করতে হল আদিত্যকে। ধুতি, রেডিমেড সিল্কের পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, রুমাল কেনে হল। দোকানের ট্রায়ালরুমে ঢুকে সেগুলো পরে বেরিয়ে এল আদিত্য। ললিত হেসে বলল, সাবাস!

কিছু ফুল, শাশ্বতীর জন্য একটা শাড়ি কিনতে কিনতে সোয়া দুটো বেজে গেল প্রায়। একটা পেট্রল পাম্পে ট্যাক্সি থামিয়ে সঞ্জয়কে ফোন করল ললিত, অফিসে থাকিস। খুব দরকার। যাচ্ছি।

আড়াইটের পাঁচ মিনিট আগে ট্যাক্সিটা শাশ্বতীর কলেজের সামনে বড় রাস্তায় এসে থামে। আদিত্যকে ঠেলা দিয়ে ললিত বলে, নাম।

পাগল!

নামবি না?

দূর! আমাকে দেখলে হয়তো মুখ ফিরিয়ে নেবে। তুই যা!

ললিত ভ্রূ কুঁচকে বলল, অত মেয়ের ভিড়ে কি চিনতে পারব! মোটে তো একবার দেখা।

বলেই সে মনে মনে একটু চমকে ওঠে। সে কি মিথ্যে কথা বলল না? আসলে শাশ্বতীকে লক্ষ জনের ভিতরেও সে চিনতে পারবে।

আদিত্য মাথা নাড়ে, পারবি। তুই না পারলেও ও পারবে। কলেজের সামনে ওই বকুল গাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়া। ওখানে একটা চানাচুরওয়ালা বসে, সতী ওর রোজকার খদ্দের। একটু পরেই একটা পিরিয়ড শেষ হবে।

ললিত আস্তে আস্তে হেঁটে এসে বুড়ো চানাচুরওয়ালাটার পাশে গাছের ছায়ায় দাঁড়ায়। কিন্তু হঠাৎ বড় অস্বস্তি হতে থাকে তার। কেন যেন বুক কাঁপতে থাকে। কেন যেন দুর্বল লাগে নিজেকে। মনে পড়ে শ্যামলা সুন্দর কোমল একখানা মুখ, মায়াবী চোখে চেয়ে বলছে, দেখবেন, আপনার অসুখ সেরে যাবে।

সেই কথাটাই যেন গুনগুন করে ফিরে আসছিল তার কানে।

হঠাৎ দিকবিদিক জুড়ে প্রবল ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে, যেন পাতাল থেকে উঠে আসে সেই শব্দ, আকাশ থেকে নেমে আসে।

চমকে উঠল ললিত। সিগারেটটা আঙুল থেকে খসে পড়ে গেল।

ষোলো

নিজের এই দুর্বলতা অসহায়ভাবে লক্ষ করল ললিত। আশ্চর্য হয়ে গেল। কোথা থেকে এই দুর্বলতা আসছে? সে তো শাশ্বতীর প্রেমিক নয়! একবার মাত্র কয়েক মিনিট দেখা হয়েছিল তাদের, আর আজ একটু পরেই আদিত্যর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যাবে। বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে এসেছে ললিত, এখন সে আর অল্পবয়সি যুবা নয়, যখন মিতুকে দেখলে কেঁপে উঠত বুক; তখন কাঁপা আঙুল থেকে সিগারেট পড়ে যাওয়াও বিচিত্র ছিল না। এখন কি আর সে-রকম কিছু হয়? সে নিজের অস্থিরতার জন্য, দুর্বলতার জন্য অসহায় বোধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। পায়ের কাছেই জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে ছিল। চটি দিয়ে ঘষে ঘষে সেটার নাড়িভুঁড়ি বের করে ফুটপাথে মিশিয়ে দিল সে। এবড়োখেবড়ো বকুল গাছটার গায়ে জোরে চেপে ধরে রইল হাত।

অনেক দিন আগে তাদের বাসার ছোট্ট উঠোনটায় সে বাবার সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিল একদিন সকালবেলায়। বাবা লুঙ্গি পরে তুলসীগাছের বেদিটাকে স্ট্যাম্প করে ব্যাট করছিল, ললিত করছিল বল। অসমান উঠোনে ডিউজ বলটা লাফিয়ে উঠছিল বারবার, ললিত বাহাদুরির জন্য প্রাণপণ জোরে বল ছুড়ছিল। সেটা কোনও এক সময়ে বাবার পায়ের হাঁটুর নীচে হাড়ে লেগেছিল, ললিত টের পায়নি। খেলার শেষে সে ঘরে এসে দেখল বাবার পায়ে হাড়ের ওপর থ্যাঁতলানো চামড়া ফেটে হাঁ হয়ে ফুলে কালশিটে পড়ে আছে, মা হাঁটুগেড়ে আইওডিন লাগাতে লাগাতে তাকে বলল, দ্যাখ, কী করেছিস! ললিত আশ্চর্য হয়েছিল। অত জোরে বল লাগাতেও বাবা একটুও চেঁচিয়ে ওঠেনি, ‘উঃ আঃ’ করেনি, শান্তভাবে খেলা শেষ করে ঘরে এসেছে, তাকে বুঝতেও দেয়নি। ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু ললিতের মনে ছবিটা আঁকা হয়ে আছে। পরবর্তীকালে যত বার ব্যথাবেদনা পেয়েছে ললিত তত বারই চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে বাবার সেই ঘটনাটুকুর কথা মনে পড়ে গেছে। অমনি ললিত ব্যথার বা ক্ষতের স্থান চেপে ধরে সহ্য করেছে। ক্রমে এইটেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তার। ছেলেবেলা থেকেই। তার বন্ধুরা বলত, ললিতের ব্যথা লাগে না। ললিত জানত সে অনেকের চেয়ে বেশি সহ্য করতে পারে। নিজেকে পরীক্ষা করার জন্য সে অনেক বার সিগারেটের আগুনে তার চামড়া পুড়িয়ে দাঁত টিপে সহ্য করেছে। শরীর থেকে সে শুরু করেছিল, তারপর ক্রমে ক্রমে নিজের চেষ্টায় সে মনের দুঃখগুলিকেও গোপন করতে থাকে। শরীর আর মন তো খুব দূরের সম্পর্ক নয়। সবাই জানে ললিত কাউকে তার দুঃখ দুর্দশার গল্প বলে না, তার নাকি-কান্না নেই। নিজের দুর্বলতাগুলিকে ঢেকে রাখতে জানে ললিত। একমাত্র মিতুর ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু তাতেও ললিতের দোষ ছিল না, মায়ের চোখ তাকে ধরে ফেলেছিল। সেইটে ছাড়া ললিতের দুর্বলতার আর কোনও অখ্যাতি নেই। হাসপাতালে গিয়ে সে যখন প্রথম বুঝতে পারল তার ক্যান্সার হয়েছে, তখন প্রথমটায় ভেঙে পড়েছিল ললিত। কিন্তু তাকে সামলে দিল তুলসীর চোখ। বায়োপসির ফলাফল জানার পর তুলসী তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল। সামলে গেল ললিত, এক ঢোঁকে কান্না গিলে ফেলে হেসেছিল। মনে মনে ঠিক করা ছিল তার, এই শেষ যন্ত্রণাটুক সে শান্তভাবে সহ্য করবে। তার চেনা লোকেরা তাদের জীবনে উদাহরণ করে নেবে ললিতের সহনশীলতা। সে সেই কারণেই প্রাণপণে সহ্য করে যাচ্ছে। সে ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলেনি ‘আমাকে বাঁচান’, সে বন্ধুদের জড়ো করে বলেনি ‘আমার মাকে দেখিস—আমি চললাম’, এমনকী এখনও তার ঈশ্বরে অবিশ্বাস অটল রয়েছে, সেই অবিশ্বাস ভেঙে সে তারকেশ্বর কিংবা কালীঘাটে মানত করতে ছোটেনি। সেদিন শাশ্বতী যখন তার মেসোমশাইয়ের ঘটনা তাকে বলেছিল, তখনও ললিত তাকে ঘুর কথায় বুঝিয়ে দিয়েছিল তার কোনও উদাহরণের দরকার নেই। ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। সে বরং মাঝে মাঝে ভেবে দেখেছে বাঁচার চেয়ে মরাটাই বরং তার বেশি দরকার। যারা তার বিপক্ষে, যারা তার শত্রু, কিংবা যারা তাকে ভালবাসেনি তারা সবাই দেখুক ললিত কত শান্তভাবে মরে যেতে পারে।

তাই এখন এই রহস্যময় দুর্বলতার দেখা পেয়ে বড় অসহায় বোধ করে ললিত। সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এতক্ষণ সে তো ঠিক ছিল। একটু আগে সে আদিত্যকে বিয়ে করতে রাজি করিয়েছে। সব ঠিক আছে। তবে এটা কী? এটা কেন? সে তার হাত থেকে খসে-পড়া সিগারেটটার ছিন্ন-ভিন্ন অংশটা চেয়ে দেখল। তারপর মনে মনে গাল দিল নিজেকে, ইডিয়ট!

ঘণ্টা পড়ার একটুক্ষণের মধ্যেই তার চারপাশের রাস্তা রং-বেরঙের মেয়েতে ছেয়ে গেল। প্রথমটায় একটি দিশেহারা বোধ করল ললিত। কোনও দিকে তাকাতে তার লজ্জা করছিল। সে কেবল আবছা ভাবে দেখতে পাচ্ছিল তার চার পাশে ভিড় করে গুনগুন কথা বলতে বলতে ঘুরছে মেয়েরা। মাঝখানে সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে এর মধ্যে তার আধচেনা, একবার দেখা শাশ্বতী কোন জন।

চারজন মেসে চানাচুরওয়ালার কাছে হেঁটে এল। তাদের মধ্যে একজন আকাশি-নীল শাড়ি পরা। আসতে আসতে ও থেমে গেল হঠাৎ। একটু দূর থেকে ললিতের দিকে চেয়ে বলল, আপনি?

ললিত দেখল, শাশ্বতী।

হঠাৎ খুব নির্জন হয়ে গেল চারপাশের পৃথিবী। যেন একটা কাচের ঘরের মধ্যে তারা দু’জন মাত্র দাঁড়িয়ে আছে।

কয়েক মুহুর্তের জন্য মাত্র। তারপরেই ললিত কাচের ঘর ভেঙে দিল। হাত জোড় করে স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। জরুরি।

ললিত জানল না, সেই মুহূর্তে কী ভীষণ বুক কাঁপল শাশ্বতীর। থর থর করে কেঁপে উঠল তার অস্তিত্ব। মুখে ঝাঁপিয়ে এল রক্তস্রোত। তবু, বাইরে স্বাভাবিকই থাকল সে। যেন আগে থেকেই জানত শাশ্বতী এমনভাবে মাথা নেড়ে বলল, চলুন। তার তিন বন্ধু একটু অবাক চোখে তাদের দেখছিল। শাশ্বতী বন্ধুদের বলল, দাঁড়া আসছি।

একটু দূরে আর একটা গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াল দু’জন। ললিত বেশি ভূমিকা করল না। বলল, আদিত্য সকাল থেকে পাগলামি করছে। ওর সন্দেহ আপনি ওকে আর পছন্দ করেন না।

শাশ্বতী ভ্ৰূ কুঁচকে শুনল। তারপর মুখ নামিয়ে বলল, জানি। ওর মাথায় পোকা ঢুকেছে। কিন্তু আমি কী করব?

ললিত মৃদু বিষণ্ণতার হাসি হাসে, আদিত্যর খ্যাপামি উঠলে অনেক দূর গড়ায়। আর, খুব সামান্য ব্যাপারেই ওর খ্যাপামি দেখা যায়। নইলে ও সত্যিই ভাল মানুষ। খুব ভাল।

ললিতকে নস্যাৎ করে দিয়ে শাশ্বতী ঠান্ডা গলায় বলে, আমি ওকে জানি।

ললিত লজ্জা পায়। তারপর সামলে নিয়ে আস্তে করে বলে, ও আমার সঙ্গে এসেছে। মোড়ে ট্যাক্সিতে বসে আছে। আপনি একটু ওর কাছে চলুন। তারপর আপনাকে আমাদের সঙ্গে একটু এক জায়গায় যেতে হবে। খুব দূরে নয়। সন্ধের আগেই আপনাকে আমরা বাসায় পৌঁছে দেব।

কোথায়?

ট্যাক্সিতে বলব।

শাশ্বতী তার শাড়ির আচল তুলে একটা কোণ দাঁতে চাপে, খুব অন্যমনস্ক দেখায় তাকে। বলে, বলবেন না কেন? কোথায় যাচ্ছি তা আমার জানা দরকার।

ললিত বিপদের গন্ধ পেয়ে যায়। মুখখানাকে করুণ করে তোলার একটু চেষ্টা করে সে। বলে, সঙ্গে আদিত্য থাকবে। আপনার ভয় কী?

শাশ্বতী পরিষ্কারভাবে হাসে, ও অদ্ভুত সব কাণ্ড করে। আমার ভাল লাগে না। ভয় করে।

ললিত মৃদু হাসে, এখন ভয় নেই। ও খুব অনুতপ্ত। আপনার সঙ্গে ভাব করতে চায়।

আড়ি তো হয়নি!

ললিত কপাল তুলে বলে, হয়নি? আশ্চর্য! ও যা বলছিল তাতে মনে হয় ওর সঙ্গে আপনার খুব ঝগড়া হয়ে গেছে।

শাশ্বতী মাথা নেড়ে জানায়, না।

তবে? ললিত জিজ্ঞেস করে।

শাশ্বতী বয়ঃসন্ধির লাজুক মেয়ের মতো হাসে, সেটা একটা ভুতুড়ে কাণ্ড। কোনও মানে নেই।

কী?

আপনাকে বলা যায় না। এটা আমাদের—আমাদের একটা ব্যাপার।

ব্যাপারটা জানতে ললিতের লোভ হচ্ছিল। এখন একটু পরেই শাশ্বতী আদিত্যর গিন্নি হয়ে যাবে, তখন আর গতকাল কী হয়েছিল তা জানার চেষ্টাও করা যাবে না। কিন্তু তার আগেই এই কয়েকটা মুহূর্ত, যতক্ষণ কুমারী আছে শাশ্বতী, যতক্ষণ সে আইনত কারও নয়, ততক্ষণ সেই অল্প একটু সময়ে গতকালের কথা জেনে নিলে হত!

কিন্তু ললিত নিজেকে সংযত করে দিল।

সে শাশ্বতীকে বলল, চলুন প্লিজ।

ট্যাক্সির জানালা দিয়ে জিরাফের মতো গলা বের করে ছিল আদিত্য। তাদের দেখেই ভিতরের আবছায়ায় সরে গেল। ললিত শাশ্বতীকে নিয়ে এসে ট্যাক্সির দরজা খুলে ধরল। বলল, দেখুন, কেমন বর সেজে বসে আছে আদিত্য। সুন্দর দেখাচ্ছে না!

শাশ্বতী বোকার মতো অবুঝ চোখে একবার ললিতের দিকে তাকাল। ট্যাক্সিতে উঠল না, দাঁড়িয়ে রইল।

ললিত তাড়া দিল, উঠুন। তাড়াতাড়ি, লোকে আপনাকে দেখছে। ভাববে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

স্পষ্টই অস্বস্তি বোধ করল শাশ্বতী। ইতস্তত করে তারপর উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঝপ্ করে দরজা বন্ধ করে দেয় ললিত। সামনে ড্রাইভারের পাশে সে আর বিমান পাশাপাশি বসে। নতুন গোল্ডফ্লেকের প্যাকেট কেনা আছে আদিত্যর পকেটে! ললিত ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইটা দে। আর, তোরা কথা বল।

আমি কী বলব! আদিত্য মৃদু গলায় বলে।

ললিত মৃদু হাসে। একপলকে দেখে শাশ্বতী গাড়ির সিটের ওপর রাখা খবরের কাগজে জড়ানো রজনীগন্ধার গুচ্ছ আর লাল-সাদা গোলাপের তোড়া অবাক চোখে দেখছে। সিটের পিছনে শাড়ির মোড়কটা আর আদিত্যের ছাড়া জামা-কাপড় নতুন কেনা পাঞ্জাবি আর ধুতির খালি প্যাকেটে ভরে রাখা। আদিত্যকে ললিত বলল, শাড়িটা ওর হাতে দে। আদিত্য বাঁ হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে শাশ্বতীর দিকে বাড়িতে ধরল। শাশ্বতী চেয়ে রইল, হাত বাড়াল না। আদিত্য ঝুপ করে ওর কোলে ফেলে দিল মোড়কটা।

এইটুকু দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিল ললিত। অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে এখন। শাশ্বতীকে কলেজে পাওয়া না গেলে মুশকিল হত। এখন কাজটা আধাআধি মিটেই গেছে। আর একটু বাকি। কয়েকটা স্বাক্ষর মাত্র। সিগারেট ধরিয়ে সে নিচু গলায় বিমানকে বলল, শরৎকাল, তবু দেখে, এখনও গরম গেল না। নাও, সিগারেট। বলে প্যাকেটটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। আচমকা বিমান বলল, তুমি কি খুব উত্তেজিত?

কেন? অবাক হয়ে ললিত জিজ্ঞেস করে।

ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দাওনি।

ওঃ হো! বলে ললিত আর-একবার মুখ ঘোরায়। আদিত্য বাইরের দিকে চেয়ে আছে, শাশ্বতী কিছুই না বুঝতে পেরে স্তম্ভিতভাবে বসে৷ ললিত মৃদু হেসে বলল, এ হচ্ছে বিমান রক্ষিত আমাদের বহু পুরনো বন্ধু, আর বিমান, এই হচ্ছে শাশ্বতী…

শাশ্বতী এ-সব কথা শুনতেই পেল না। সে প্রবল উত্তেজনা চেপে কষ্টে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

ওর গলার স্বর শুনে মায়া হয়। যেন বাচ্চা মেয়ে ভয় পেয়ে কথা বলছে।

বিমান তার ব্যান্ডেজ-বাঁধা মাথাটা কষ্টে পিছন দিকে একটু ঘোরাল। বলল, কেন, আপনি জানেন না?

শাশ্বতী শ্বাসরোধ করে মাথা নাড়ে, না।

এরা কেউ জানে না, অনেক দিন আগে, শাশ্বতী যখন ছোট, তখন তার দিদি লীলাবতীকে কেউ বা কারা কলেজের রাস্তা থেকে এইরকম ভাবেই হয়তো ট্যাক্সিতে তুলে নিয়েছিল। কোথায় কোন অচেনা জায়গায় যে তারা নিয়ে গিয়েছিল লীলাবতীকে। না, এরা কেউ শাশ্বতীর অচেনা নয়, তার পাশেই বসে আছে আদিত্য, হাত বাড়িয়ে তাকে ছোঁয়া যায়। আদিত্যকে ভালবাসে শাশ্বতী। ভালবাসে। কিন্তু এরা কেউ জানে না যে এখন, এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, এরা তিন জন অচেনা পুরুষ তাকে ভুলিয়ে নিয়ে এসে ট্যাক্সিতে তুলেছে। নিয়ে যাচ্ছে অচেনা এক রহস্যময় জায়গায়। এরা তার ধর্ম কেড়ে নেবে, নষ্ট হয়ে যাবে তার আজন্মের প্রিয় এক পবিত্রতা। একবার তার ইচ্ছে হল ট্যাক্সিওয়ালার কাঁধে টোকা দিয়ে বলে, ভাই ট্যাক্সিওয়ালা, আমি এদের কাউকে চিনি না, এরা আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। পায়ে পড়ি, তুমি গাড়ি ঘোরাও, আমাকে বাসায় পৌঁছে দাও। আমি অবুঝ মেয়ে, এখনও পবিত্র আমি, দয়া করো।

কিন্তু ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে তার হাত-পা। গলায় স্বর ফুটছে না। তার পাশে ফুল, কোলের ওপর কাগজের প্যাকেট থেকে উঁকি মেরে আছে খুব ঝলমলে একখানা শাড়ি। সে এর অর্থ খানিকটা বুঝতে পারল, আর খানিকটা বুঝতে চাইল না।

এরা কেউ জানে না যে, শাশ্বতীর বড় ভয় করছে। রজনীগন্ধার উগ্র গন্ধ গোলাপের সঙ্গে মিশে গিয়ে বাতাস বিষিয়ে গেছে এখন। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। … না, সে এদের কাউকেই চেনে না, কাউকেই না…এরা তিন জন অচেনা পুরুষ, আর সে একজন পবিত্র অবুঝ সরল মেয়ে—এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? শাশ্বতীর বড় ভয় করছে।

বিমান তার মাথার ব্যান্ডেজের তলা দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে মাথা চুলকোয়। ব্যথায় মুখ বিকৃত করে। খুব অন্যমনস্ক দেখায় তাকে। সে হঠাৎ গলা নামিয়ে ললিতকে বলে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না।

কী?

এটা?

কেন?

অনেকক্ষণ গম্ভীরভাবে চিন্তা করে বিমান। তারপর সিগারেট ধরানোর অছিলায় মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলে, মেয়েটা আদিত্যকে ভালবাসে না।

শুনে ট্যাক্সিওয়ালা চকিতে একবার তাদের দিকে তাকায়।

দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকে ললিত। ট্যাক্সি পার্ক সার্কাসের ছ’কোনা চত্বরে এসে হু হু করে ঘুরে গেল বাঁয়ে। ধরল পার্ক স্ট্রিট। সোজা সুন্দর রাস্তা। বড় সুন্দর কতগুলি জায়গা ছিল পৃথিবীতে পার্ক স্ট্রিটের মতো! সুন্দর জায়গা ছিল পৃথিবী! বেঁচে থাকা কী রকম ভাল। পার্ক স্ট্রিট ধরে যেতে হঠাৎ গুমরে মুচড়ে ওঠে মন ললিতের। কত সুন্দর রোমাঞ্চকর সব ঘটনা ঘটতে পারত জীবনে, আরও বহুদিন বেঁচে থাকলে!

ললিত! আদিত্য শুকনো গলায় ডাকে।

ললিত ফিরে দেখে, আদিত্যর মুখ অল্প লাল। কিছু একটা বলার চেষ্টা করে আদিত্য, কিন্তু উত্তেজনায় প্রথম চেষ্টায় সেটা বলতে পারে না। ললিত লক্ষ করে ওর গায়ের নতুন পাঞ্জাবির বুকে এখনও দাম লেখা টিকিটটা লাগানো, এতক্ষণ তারা কেউ লক্ষ করেনি। সে হাত বাড়িয়ে বলে, বুকের টিকিটটা ছিঁড়ে ফ্যাল!

কীসের টিকিট! বলে আদিত্য নিজের বুকের দিকে চেয়ে টিকিটটা দেখে, আরও ঘাবড়ে যায়। এক হাতে টিকিটটা খুঁটে তুলতে চেষ্টা করে সে, তারপর গলা ঝেড়ে আস্তে বলে, ওকে বলে দে।

কী?

আমরা কোথায় যাচ্ছি।

শাশ্বতী স্মৃতিহীন বোকার মতো চেয়ে থাকে। ‘ফিট’-এর পর প্রথম জ্ঞান ফিরলে যেমন মুখ-চোখের ভাব হয়, তেমনি।

ললিত হঠাৎ খুব স্বাভাবিক গলায় শাশ্বতীকে বলে, এত ঘাবড়ে যাওয়ার কী আছে? আপনাদের তো একদিন না একদিন বিয়ে হতই। আজ শুধু আইনের দিকটা সেরে রাখা।

তবু শাশ্বতী বুঝতে পারে না। আইনের দিক! কীসের আইন! কার সঙ্গে তার একদিন না একদিন বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?

আপনারা কথা বলুন। তাড়াতাড়ি কথা বলে নিন। সামনেই আমার এক বন্ধুর অফিস, আমি আর বিমান নেমে যাব। অল্প সময়। তার মধ্যেই আপনারা কথা বলে নিন। ললিত বলল।

কথা! শাশ্বতী ভেবেই পায় না কী কথা, কার সঙ্গে কথা।

আদিত্য যদি তার অচেনা পুরুষ হত তবে শাশ্বতী চেঁচিয়ে বলতে পারত, আমাকে নামিয়ে দাও, পায়ে পড়ি। সে বাইরের লোকজনকে উদ্দেশ করে গলা বাড়িয়ে ডাকতে পারত, এরা আমাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। বাঁচাও। কিন্তু তা তো নয়! তার মনে পড়ে সে হৈমন্তীকে বলেছিল যে একদিন খুব শিগগিরই তারা রেজিষ্ট্রি বিয়ে করবে। কিন্তু ভুল, বড় ভুল বলেছিল শাশ্বতী। কেন ভুল? না, শাশ্বতী তা জানে না। সে কেবল আবছাভাবে এইটুকু জানে যে, সকলেই সকলের জন্য নয়। কেউ কেউ কারও জন্য থেকে যায় এক জন্ম। সকলেই সকলের জন্য নয়। তবু ভুল লোক দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। সামলানোর সময় পাওয়া যায় না। ভুল ঠিকানায় চলে যায় ভালবাসার চিঠি। আর ফেরত আসে না।

এক রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছিল শাশ্বতী। একটা লোক লণ্ঠন হাতে মাঠঘাট ভেঙে খুব দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। তার মুখ দেখা যায় না, কেবল পা দু’খানায় পড়েছে লণ্ঠনের আলো। তবু মনে হয়েছিল সে বড় প্রিয়জন শাশ্বতীর, সে এক উদাসী মানুষ। দূরগামী। আজ জেগে থেকে সে সেই দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করল। যেন, তার একান্ত প্রিয়জন কেউ তাকে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে।

সে একবার উদ্ভ্রান্তের মতো আদিত্যর দিকে তাকায়। সেই লোক, সেই লোক কি আদিত্য? না, স্পষ্টই বোঝা যায় সে আদিত্য নয়। নতুন পাঞ্জাবি-পরা আদিত্য জড়সড় হয়ে বসে আছে। বাইরের দিকে মুখ, সদ্য কামানো গালে আলো চকচক করছে, কানের কাছে সেলুনের সাবানের শুকনো সাদা দাগ। এ স্বপ্নের কোনও মানুষ নয়। আশ্চর্য এই যে, একে, এই নিতান্ত সাদামাটা আদিত্যকে কত ভালবাসার কথা বলেছে শাশ্বতী, সব দিতে চেয়েছে তাকে! কিন্তু ভুল লোক, একেবারে ভুল লোক, আদিত্য তার স্বপ্নের কেউ না। শাশ্বতী ভালবাসে খুব দূরের যাত্রা একজন মানুষকে, যে সঙ্গীহীন একা একা খুব বড় প্রকান্ড এক ধু-ধু মাঠ রাতের অন্ধকারে পার হচ্ছে। চেনা আদিত্যকে এখন আর চেনে না শাশ্বতী। সেই অচেনাকে চেনে। সেই অচেনা কি ওই ললিত! হবেও বা। শাশ্বতী সঠিক জানে না কিছুই।

পার্ক স্ট্রিট। অচেনা জায়গা শাশ্বতীর। ট্যাক্সি হঠাৎ থেমে আসে। চমকে ওঠে সে। ট্যাক্সি বাঁক নেয়। ধীর হয়ে আসে। থেমে যায়।

ললিত মুখ ফিরিয়ে হাসল আপনি এখনও রেগে আছেন! এবার কথা বলুন। ও বেচারা খুব মনমরা হয়ে আছে।

লালিত বিমানকে নিয়ে নেমে গেল। জানালা দিয়ে ঝুঁকে বলল, আমরা মিনিট পনেরোর জন্য যাচ্ছি। আপনারা বোঝাপড়া করে নিন।

শাশ্বতী হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে বলে, আমি নামব।

কেন?

শাশ্বতী উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে থেকে বলল, আমি যাব না।

মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ললিতের। সে নিঃসংকোচ স্থির দৃষ্টিতে শাশ্বতীর অদ্ভুত ফ্যাকাসে মুখখানা দেখে। গোলমালটা কোথায় তা সে এখনও জানে না। কিন্তু জানার দরকারও নেই। অনেক দিন আগে সে ছিল অল্পবয়সি এক অসহায় ছেলে, যখন মিতুর জন্য সে রাস্তায়-ঘাটে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত হাঁ করে। মিতু ফিরেও তাকায়নি। মিতু তাকে গোপনে বড় অবহেলা করে গেছে। এখন আর মিতুর জন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই তার, কেবল সেই তখনকার কমবয়েসি ললিতের জন্য তার এক মায়া আছে। পুরুষের অপমান কিংবা দুঃখ সে বোঝে। বোঝে প্রতিশোধ। মনে মনে কঠিন হয়ে গেল ললিত। আদিত্য নামে এক বন্ধুর জন্য নয়, কেবলমাত্র একজন পুরুষের জন্য একটা কিছু সৎ কাজ তার করে যাওয়া দরকার। একটু আগেও হয়তো শাশ্বতীর জন্য মায়া হচ্ছিল তার। কিন্তু এখন হঠাৎ তার ভিতরে এক আহত পুরুষ বাঘের মতো গর্জন করে উঠল।

মুখে মিষ্টি হাসল ললিত। বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখবেন। কোনও ভাবনা নেই। আমরা আজ রাতে আদিত্যর পয়সায় মুরগি খাব, আপনি কি তা চান না?

কিছুই বুঝতে পারল না শাশ্বতী। পাগলা বোকা চোখে চেয়ে রইল।

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত প্রকাণ্ড একটা হলঘর। তার ভিতরেই পার্টিশান দেওয়া খোপে সঞ্জয়ের অফিস। তারা ঢুকতেই ব্যস্ত সঞ্জয় মুখ তুলে বলল, কী ব্যাপার?

একটা ঝামেলা ঘাড়ে করে এনেছি। তোকে যেতে হবে।

কোথায়? সঞ্জয় সই করতে করতে বলে।

সাক্ষী দিতে। আজ আদিত্যর বিয়ে, ওরা নীচে ট্যাক্সিতে বসে আছে। খুব দ্রুত বলে ললিত। তার হাঁফ ধরে যায়।

জানতাম! সঞ্জয় শ্বাস ফেলে বলে, আমার যে ক’টা বন্ধু আছে, এক শালারও মাথার ঠিক নেই।

ললিত দম ফেলার সময় দেয় না। হাত বাড়িয়ে বলে, টেলিফোন ডিরেক্টরি শিগগির—

তারপর বসে মোটা বইখানা টেনে তাড়াতাড়ি পাতা ওলটাতে থাকে ললিত। আপনমনে বলতে থাকে, ডাক্তার বাগচী… ডাক্তার বাগচী… ম্যারেজ রেজিস্ট্রার…

সঞ্জয়ের উলটো দিকের চেয়ারে কালো মোটামতো একটা লোক বসে ছিল। ললিত তাড়াহুড়োয় তাকে লক্ষ করেনি। সেই লোকটা হঠাৎ ললিতের কানের কাছে মুখ এনে বলল, আমার হাতে একজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আছে। যাবেন?

ললিত চমকে উঠে চেয়ে প্রথমে চিনতে পারে না লোকটাকে, তারপর বলে, আরে! লক্ষ্মীকান্ত!

লক্ষ্মীকান্ত হাসে, ম্যারেজ পার্টির জন্য ভাল ঘরও আছে আমার হাতে। নিরিবিলি। বর বউ রাত কাটাতে পারে স্বচ্ছন্দে। ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে দেব। কম ভাড়া।

ললিত তাকে হাত ধরে টেনে তোলে, চলো, তোমার চেনা রেজিস্ট্রারের কাছে। কিন্তু নোটিস দেওয়া নেই, আর মেয়েটা আপত্তি করতে পারে। কান্নাকাটিও করবে হয়তো, কান দিলে চলবে না। পারবে?

লক্ষ্মীকান্ত মিটমিট করে হেসে বলে, মেয়েরা সহজে রাজি হয় না, এ তো জানা কথা। পারব।

ব্যান্ডেজের তলায় আঙুল চালিয়ে আর-একবার কপাল চুলকোনোর চেষ্টা করছিল বিমান। ললিতের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, তোমাকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে। তোমার হাত কাঁপছে।

ললিত চমকে ওঠে হঠাৎ। ঠিক, তার হাত কাঁপছে। গুরগুর করছে বুকের ভিতরটা। দুপুরে সামান্যই খেয়েছে ললিত, কিন্তু হজম হয়নি। কলকল করে তার পেট ডাকছে। নিজের ব্যস্ততা আর অস্থিরতা লক্ষ করে লজ্জা পায় ললিত। বলে, সময় বেশি নেই। ব্যাপারটা আজকেই করতে হবে।

লক্ষ্মীকান্ত বলে, মোটে সোয়া তিনটে। অনেক সময় আছে। দরকার হলে রাত দশটায় করে দেব।

সঞ্জয় মুখ তুলে বলে, একটু বোস। আমি কাজ ক’টা সেরে নিই। সাক্ষী-ফাক্ষী দিয়ে আর অফিস ফিরব না কেটে পড়ব তোদের সঙ্গে।

ললিত অস্থির মন নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। একবার উঠে জানালার কাছে যায়। ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে অচল হয়ে। ট্যাক্সির জানালার কাচের ওপর ছোট্ট শ্যামলা হাতের আঙুল, কবজি, আর হাতঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। শাশ্বতী। আবার ফিরে আসে ললিত। অস্থির বোধ করে। সময় নেই। আর সত্যিই খুব একটা সময় নেই। তার নিজের সময় ফুরিয়ে আসছে।

চেয়ারের পিছনে মাথা হেলিয়ে সে চুপ করে বসে থাকে। চোখ বোজে। ওরা সত্যিই কথা বলছে কি? কে জানে! সে ওদের পনেরো মিনিট সময় দিয়ে এসেছে। সময় আছে। নিজের হাতঘড়ি দেখে ললিত। এখনও অনেক সময় আছে। সে চোখ বুজে থাকে। শুনতে পায় লক্ষ্মীকান্ত নিজে থেকেই বিমানের সঙ্গে পরিচয় করে নিচ্ছে, খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করছে বিমানের জীবন-বিমা করা আছে কি না! ললিত মৃদু একটু হাসে। কত ধান্ধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লোক। ওইভাবে বেঁচে থাকতে হঠাৎ তার শরীর শিরশির করে ওঠে। বেঁচে থাকা কী রকম ভাল। কত ভাল।

মিনিট কুড়ি বাদে সঞ্জয় উঠল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সঞ্জয় বিমানকে বলল, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো! ললিতের খেয়াল হল অস্থিরতায় সে দু’জনের চেনা করিয়ে দেয়নি। বিমান তার সুন্দর গলায় উত্তর দিল, রমেনের বাড়িতে। রমেন গান গাইত, চোখ বন্ধ করে হাঁটত, চোখ বেঁধে দিলেও বলে দিত ঘরের কে কোনখানে বসে আছে। আমি সেখানে যেতাম। সঞ্জয় বলে, ওঃ হো, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনিই, আপনার নাম বিমান না?

ললিত আর কোনও কথা শুনতে পেল না। সে ওদের চেয়ে কয়েক পা এগিয়ে নামতে লাগল।

শাশ্বতী অবিকল সেইভাবেই বসে ছিল যেভাবে ললিত তাকে দেখে গেছে। যেন গত কুড়ি মিনিটে সে একটুও হাত-পা নাড়েনি। নিশ্বাসও নেয়নি। সঞ্জয় আর লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গে পরিচয় করানোর সময়ে একটুও হাসল না শাশ্বতী। কথা বলল না। হাত দুটো জড়ো করল কেবল। বুকের কাছে তুলে ছেড়ে দিল, হাত দু’খানা কাঠের টুকরোর মতো পড়ে গেল।

বোঝা গেল আদিত্য অনেক সিগারেট খেয়েছে। ট্যাক্সির ভিতরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার।

সঞ্জয়ের গাড়িতে উঠল লক্ষ্মীকান্ত আর বিমান। ট্যাক্সির সামনের সিটে পুরনো জায়গায় বসল ললিত। সঞ্জয়ের সাদা গাড়িটা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল আগে আগে।

ললিত একবার মুখ ফিরিয়ে শাশ্বতীকে বলল, আপনারা কথা বলেননি?

শাশ্বতী বেভুল তাকিয়ে রইল শুধু।

হাসল ললিত, আপনমনে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আর তখন শাশ্বতী দেখছিল এক অচেনা শহরের অদ্ভুত রাস্তাঘাটের ভিতর দিয়ে কয়েকজন ধর্মনষ্টকারী অচেনা পুরুষ তাকে এক রহস্যময় জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। যেমন অনেক বছর আগে নিয়ে গিয়েছিল তার দিদি লীলাবতীকে।

আর তখন সঞ্জয়ের গাড়িতে পিছনের সিট থেকে হাত বাড়িয়ে বিমান সঞ্জয়ের পিঠে টোকা দিল। বলল, ওই মেয়েটা আদিত্যকে ভালবাসে না।

বাসে না? সঞ্জয় বিস্মিত হয়।

না। মাথা নাড়ে বিমান, বিড়বিড় করে বলে, আমি জানি।

তা হলে? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করে।

বিমান একটু ভাবে, তারপর তার ধীর গম্ভীর গলায় বলে, কিন্তু ললিতের ইচ্ছে বিয়েটা হোক।

তারপর একটু ভেবে বলে, কিন্তু আমি জানি, সকলের সঙ্গে সকলের বিয়ে হয় না। বিয়ের একটা নিয়ম আছে। বিয়েটা খুব পবিত্র জিনিস। ভুল বিয়ে দুঃখী, অলস, অকর্মণ্য এবং বিশ্বাসঘাতক মানুষকে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। এবং তার জন্য, ভুল বিয়ে যারা করে তারা সমাজের কাছে দায়ী থাকে। তাদের বিচার হওয়া উচিত।

লক্ষ্মীকান্ত মাথা নেড়ে বলে, ঠিক!

সঞ্জয় মৃদু হাসে। বিমানটা পাগল।

ভিতর থেকে লক্ষ্মীকান্ত বুড়ো ম্যারেজ রেজিস্টারের সঙ্গে তার গোপন কথাবার্তা বলে বেরিয়ে আসে।

পাশাপাশি তিনটে আরামদায়ক বড় সোফার একটিতে আদিত্য আর শাশ্বত খুব ফাঁক হয়ে বসেছে। অনাটাতে ললিত আর সঞ্জয়। তৃতীয়টায় বিমান, তার পাশে লক্ষ্মীকান্ত এসে বসল।

শাশ্বতীর এখনও কোনও সাড়া নেই। সে খুব বিস্মিতভাবে চারধারে চেয়ে দেখছে। আদিত্য মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে আছে।

সঞ্জয় দু’-একবার হাসিঠাট্টা করার চেষ্টা করে চুপ করে ছিল। ললিত হঠাৎ একসময়ে বলল, সব শেষ! বাঃ!

রেজিস্ট্রার তার মোটা চশমার কাচের ভিতর দিয়ে তাদের দিকে চেয়ে দেখল। প্রকাণ্ড খাতা খুলল, বের করল কর্ম। নিঃশব্দে লিখতে লাগল।

নিস্তব্ধ ঘর।

হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে ম্যারেজ-রেজিস্ট্রার তার ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞেস করল, দু’জনের নাম?

ললিত বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলা হল না। মৃদু একটু শব্দ করে খুব আস্তে শাশ্বতী কেঁদে উঠল। অনেকক্ষণ তার সংবিৎ ছিল না। কিন্তু এখন সে হঠাৎ বুঝতে পারছে। তাকে কোথায় কেন এনেছে ওরা।

চমকে সোজা হয়ে বসে আদিত্য। সঞ্জয় উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ললিত চেয়ে থাকে।

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল বিমান। সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের টেবিলের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, ভদ্রমহিলা কাঁদছেন। উনি বিয়ে করতে রাজি নন।

লক্ষ্মীকান্ত শাশ্বতীর সামনে মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে বলতে থাকে, দিদি, আমারও বউ রাজি ছিল না। এই দেখুন, আমার কালো মোটা চেহারা, বিচ্ছিরি। কিন্তু এখন আমার ছ’-ছ’টা বাচ্চা, বউ কত খোঁটা দেয়, তবু আমরা সুখে আছি… দিদি, রাজি হয়ে যান, সব ঠিক হয়ে যাবে…সব ঠিক হয়ে যাবে…

বুড়ো ম্যারেজ-রেজিস্ট্রার তার প্রকাণ্ড খোলা খাতাখানার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে থাকে।

বিমান খোঁড়াতে খোঁড়াতে ললিতের কাছে এসে গলা নিচু করে বলে, আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। রাজি করিয়ে আনব। তোমরা অপেক্ষা করো।

ললিত কথা বলে না। চেয়ে দেখে বিমান খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে যাচ্ছে। পিছনে জড়সড় ভিতু শাশ্বতী।

তারা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু বিমান আর শাশ্বতী ফিরল না।

গভীর ক্লান্তির সঙ্গে ললিতের চোখ বুজে আসে। বদহজমের টক ঢেঁকুরে হঠাৎ তার গলা বুক জ্বলে যায়। মুখে জল আসে। হাসপাতালে ওষুধপত্রের যত গন্ধ পেয়েছিল ললিত, হঠাৎ সেইসব গন্ধ তার নাকে আসতে থাকে। হিক্কার মতো একটা শব্দ করে সে। মুখ চেপে ধরে রাখে। তারপর কোনওক্রমে জিজ্ঞেস করে, বাথরুমটা—বাথরুমটা কোন দিকে?

সতেরো

তাকে নীচে ফুটপাথে নিয়ে এল মাথায় ব্যান্ডেজ-বাঁধা রোগা অচেনা লোকটা। এটা কোন জায়গা ঠিক বুঝতে পারছিল না শাশ্বতী। উলটো দিকে একটা বড় পার্ক। তাতে বিশাল বিশাল পামগাছ, অনেক লোকের ভিড়, যেন কোনও মিটিং হচ্ছে। পার্কটার একটা গেটের ওপর সাইনবোর্ড—বহুবাজার ব্যায়াম সমিতি। এটা কি বউবাজার? কে জানে! শাশ্বতী কলকাতার অনেক অংশই চেনে না।

মাথায় ব্যান্ডেজ-বাঁধা লোকটা খুব উত্তেজিতভাবে গলা নামিয়ে বলল, আপনি পালিয়ে যান।

বড় সুন্দর লোকটার গলা। ভরাট, দানাদার, যেন খুব স্বাস্থ্যবান সুন্দর চেহারার পুরুষের গলা।

কিন্তু কোথায় পালিয়ে যাবে শাশ্বতী? কার কাছ থেকে?

সে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে, এটা কোন জায়গা?

লোকটা তার দিকে চোখ গোল করে তাকায়, জায়গাটা চেনেন না? ওই তো ওয়েলিংটন স্কোয়ার, যেখানে মিটিং হয়। আর এই ধর্মতলা স্ট্রিট।

না, শাশ্বতী চেনে না। সে আঁচলে চোখ দুটো একবার চেপে ধরে।

লোকটা তেমনি উত্তেজিত গলায় বলে, ট্যাক্সি ডেকে দেব? বেশি দেরি করবেন না। ওরা ঠিক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আপনার মন ঘুরিয়ে দেবে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে যান।

হঠাৎ দূর স্মৃতিতে যেন শাশ্বতীর মনে পড়ে আদিত্য নামে একটা লোক, আদিত্য নামে একজন ছিল। শাশ্বতী তাকে বলেছিল ভালবাসবে। কিন্তু বাসা হয়নি, ঠিকমতো বাসা হয়নি। এখন সেই আদিত্য তিনতলার ওপর বসে আছে একটা সোফায়, তার পরনে সদ্য কেনা জামা-কাপড়, মুখে লজ্জার ভাব, হাতে ফুল। কিন্তু এখন আদিত্যকে অনেক দূরে ফেলে এসেছে শাশ্বতী। শাশ্বতী ফিসফিস করে ধরা গলায় বলে, একা একা ট্যাক্সিতে চড়তে আমার ভয় করে। তা ছাড়া আমার কাছে পয়সাও নেই।

আমার কাছেও নেই। বলে হাসল বিমান। তারপর বলল, তা হলে বাসে যান। ওই যে বাস-স্টপ।

শাশ্বতী ব্যাপারটা তখনও সঠিক বুঝতে পারছিল না। অগোছালো ঘরের মতো হয়ে আছে তার মন। সে বিমানের দিকে ভ্রূ কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলে, আমি একা যেতে পারব না। আমার শরীর কেমন করছে!

বিমান ওপরের ব্যালকনিটা দেখছিল। সেখানে সঞ্জয় দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে সিগারেট, খুব অন্যমনস্ক চোখে দূরে দেখছে। বিমান শাশ্বতীকে চোখের ইঙ্গিত করে চাপা গলায় বলল, সরে চলুন। সঞ্জয় দেখতে পাবে।

খানিক দূর ভিড় ঠেলে হাঁটল তারা। নিঃশব্দে। বিমান খোঁড়াতে খোঁড়াতে আগে আগে। শাশ্বতী পিছনে। শাশ্বতী হাঁফিয়ে গেল অল্পেই। ফুটপাথের ধারে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, আমার পা ব্যথা করছে।

বিমান মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে, বসবেন?

শাশ্বতী মাথা নেড়ে জানায়, বসবে।

বিমান বলে, তবে একটু চলুন। কাছেই।

ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে ধীরে হেঁটে তারা চাঁদনির কাছে চলে এল। গলিঘুঁজির মধ্যে একটু ঢুকে একটা চায়ের দোকান। বিমান তাকে নিয়ে সেই খুপরি দোকানে ঢুকে একটা কাঠের সরু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিয়ে গেল। জায়গাটা গুদামঘরের মতো বদ্ধ। কিন্তু নির্জন, নিঃশব্দ। শাশ্বতী বোধহীন চোখে দেখছিল। কোথা থেকে কোথায় এসেছে সে, সঙ্গের এই অদ্ভুত লোকটাই বা আসলে কে কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু শাশ্বতীর আলাদা ইচ্ছে বলে কিছুই নেই এখন। তার একটু ঘুম পাচ্ছে, একটু তেষ্টা পাচ্ছে, খুব ক্লান্ত লাগছে—এই কয়েকটা শারীরিক অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই টের পাচ্ছিল না সে। এখন কেউ একন তাকে চালিয়ে নিয়ে যাক।

একটা ছোট টেবিল, আর দু’খানা চেয়ার তার দু’দিকে ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই ঘরটায়। এক ধারে দড়িতে ঝোলানো ময়লা জামা-কাপড় আর গামছা, মেঝেতে গোটানো কয়েকটা সরু পাতলা বিছানা দেখে মনে হয় এখানে গরিবদুঃখী লোকেরা থাকে, এটা তাদের শোয়ার একটা আস্তানা। ঘরের কোণে বস্তা, তেলের টিন, ঝুড়িভরতি আলু আর আনাজ। দোকানের ভাঁড়ার। বোঝা যায় এ-ঘরটা বাইরের খদ্দেরদের জন্য নয়। ঘরটা নিচু, এক পাশে কেবল একটা জানালা। বিকেলের এক ফালি লাল রোদ এসে শাশ্বতীর পা ছুঁয়ে রইল।

মুখোমুখি বিমান বসল। এইবার শাশ্বতী লক্ষ করে দেখল বিমানকে। বিমানের চোখে-মুখে তীব্র উত্তেজনা জ্বলজ্বল করছে, ঠোঁটে টেপা একটু হাসি, যে-হাসিটা চেপে রাখতে বিমানের কষ্ট হচ্ছে, ওর মুখখানা লাল, টেবিলের ওপর রাখা হাতখানা কাঁপছে। জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে একটু তাকিয়ে থাকে বিমান। তারপর হঠাৎ ঝুঁকে চাপা গলায় বলে, জীবনে এই প্রথম—না, না, এই দ্বিতীয়বার আমি একটা কিছু করলাম, জানেন? একটা ভাল কিছু। আমার ভিতরটা ফেটে যেতে চাইছে।

বলে বিমান আপনমনে আনন্দে বিভোর হয়ে হাসে। ওর সমস্ত শরীর রি-রি করে কাঁপতে থাকে।

যেন ডাকাতদলের হাত থেকে শাশ্বতীকে উদ্ধার করে এনেছে একজন সাহসী গোয়েন্দার মতো, এ-রকমই হয়তো নিজেকে মনে হচ্ছিল বিমানের।

আস্তে আস্তে শাশ্বতীর অবোধ অবুঝ ভাবটা কেটে যেতে থাকে। সে পরম ক্লান্তিতে ঘাড় হেলিয়ে একটু চোখ বুজে থাকে। হঠাৎ তার নাক-মুখ ঝাঁ-ঝাঁ করে ওঠে লজ্জায়, ভয়ে। শিউরে কেঁপে ওঠে সে। হঠাৎ সে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করে, আমি কি সই করেছি?

কোথায়?

ওইসব কাগজে? তখন আমার কিছু ঠিক ছিল না মাথার। কী করেছি মনে নেই।

বিমান ঝকঝকে চোখে হয়ে হাসে। মাথা নেড়ে বলে, না। কিন্তু আপনি খুব কমজোরি, আর-একটু থাকলে ওরা আপনাকে দিয়ে সই করিয়ে নিত।

শাশ্বতী জিঞ্জেস করে, কেন?

বিমান উত্তেজিতভাবে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বেশি উত্তেজনায় তার কথা আটকে যায়। বলে, মানুষ অনেক সময়ে মানুষের ভালটাই ভাবে, কিন্তু করতে গেলে উলটো করে ফেলে।

শাশ্বতী একটা শ্বাস ফেলে চুপ করে থাকে।

সদ্য ঘুম থেকে ওঠা একটা বাচ্চা বয় খালি গায়ে হাই তুলতে তুলতে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। বিমান জিজ্ঞেস করে, কী খাবেন?

কিছু না। শাশ্বতী উত্তর দেয়।

একটু চা?

না। মাথা নাড়ে শাশ্বতী, আমার বমি হয়ে যাবে। আমি শুধু একটু জল খাব।

জল। বিমান উত্তেজিত ভরে ছেলেটাকে বলে, এক গ্লাস জল— শিগগির!

ছেলেটা বোকা চোখে তাকিয়ে থেকে মন্থর পায়ে চলে যায়। বিমান ছেলেটার যাওয়ার ভঙ্গিটা চেয়ে দেখে, তারপর হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে শাশ্বতীকে বলে, কী মজা! ওরা আমাদের কোথাও খুঁজে পাবে না।

বলে আপনমনে একটু হাসে।

শাশ্বতী হাসে না। তার খুব ক্লান্তি আর হতাশা বোধ হয়। সে জানে, আজ হোক কাল হোক আদিত্য তাকে খুঁজে বের করবে। ম্যারেজ-রেজিস্ট্রার আর তিনজন সাক্ষীর সামনে তাকে বোকার মতো বসিয়ে রেখে এসেছে সে। সে আর ফিরে যাবে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে থাকবে আদিত্য। অপমানে লজ্জায় লাল হয়ে উঠবে, চিড়বিড় করবে রাগে। তারপর আজ হোক কাল হোক, হয় বাসায় নয় তো রাস্তায়-ঘাটে কোথাও কিংবা কলেজের সামনে ওত পেতে থেকে শাশ্বতীকে ধরবে আদিত্য। তখন কী হবে শাশ্বতী জানে না। কিন্তু আদিত্য খুঁজে বের করবেই তাকে। করবেই। সহজে ছেড়ে দেবে না। শাশ্বতী জানে।

জল খেয়ে শাশ্বতী বলল, এবার যাব।

চলুন। বলে বিমান উঠে দাঁড়ায়।

শাশ্বতী ইতস্তত করে বলে, চা খেলেন না? এতক্ষণ আমরা এখানে বিনিপয়সায় বসলাম! একটা কিছু খাওয়া উচিত ছিল।

না, না। বিমান বলে, এ আমার অনেক কালের চেনা লোকান। কলেজে পড়ার সময়ে এখানে আমি আর রমেন আসতাম। এই ঘরটা তখন থেকেই আমাদের জন্য আছে। আপনার ওই চেয়ারটায় রমেন বসত। আমরা অনেকক্ষণ এখানে কাটিয়ে যেতাম। আমি এখনও প্রায় আসি।

ও। শাশ্বতী বলে।

কাঠের সরু সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নেমে আসে তারা। বড় রাস্তায় এসে শাশ্বতী বলে, আপনার কথা ওর কাছে কোনও দিন শুনিনি তো! আপনি ওঁদের কীরকম বন্ধু?

বিমান মাথা নাড়ল, আমি ওদের বন্ধু নই। এক সময়ে এক ক্লাসে পড়তাম, মুখ-চেনা ছিল।

শাশ্বতীর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে যে, তা হলে সে এদের দলে জুটল কী করে! লজ্জায় জিজ্ঞেস করল না।

কিন্তু বিমান নিজের থেকেই বলল, আজ হঠাৎ অনেক বছর বাদে আদিত্যর সঙ্গে প্রথম দেখা। ললিত ওকে আমার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আদিত্যকে আজ এত দিন বাদে প্রথম দেখার দিনেই ললিত ওর বিয়েতে সাক্ষী দিতে বলল আমাকে। আসলে আমার মনে হয়, ললিতের ধারণা ছিল, এই গোলমেলে বিয়েতে আমার মতো একটা পাগল-টাগল নিরীহ গোবেচারাকে সাক্ষী দিতে ডাকাই নিরাপদ। সেয়ানা বন্ধুরা সাক্ষী দেওয়ার আগে অনেক প্রশ্ন করবে, সব ব্যাপার জানতে চাইবে, এবং গোলমাল দেখলে পিছিয়ে যাবে।

শাশ্বতী অনেকক্ষণ বাদে এইবার হাসল। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি পাগল?

হ্যাঁ। বিমান গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে, মাঝে মাঝে আমার মাথার গোলমাল হয়।

কেন?

বিমান আঙুল তুলে শাশ্বতীকে আকাশটা দেখিয়ে বলল, আমার মাথায় আকাশ ঢুকে যায়। তখন মাথার মধ্যে খুব যন্ত্রণা হয়। আমি পাগল হয়ে যাই। কিন্তু সবসময় আমার পাগলামি থাকে না।

শাশ্বতীর দিকে চেয়ে একটু বুঝদারের মতো হাসল বিমান। বলল, এখন আমি পাগল নই। আমি জানি মেয়েরা পাগলদের ভয় পায়। কিন্তু আপনার কোনও ভয় নেই। একটু আগেই আমি সুস্থ মানুষের মতো একটা কাজ করেছি, আপনাকে নিয়ে এসেছি ওদের কাছ থেকে। আদিত্য এক পাত্র বিষ খেতে যাচ্ছিল, আমি ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সেটাও আজ বুঝবে না। দেখা হলে ও আমার সঙ্গে ভীষণ ঝগড়া করবে।

শাশ্বতী আবার হাসে। বলে, আমি কি বিষ?

না। মাথা নাড়ে বিমান, এমনিতে আপনি বিষ নন। ঘি আর মধু আলাদা আলাদাভাবে বিষ নয়, কিন্তু মেশালে বিষ। ঠিক সেই রকম। ভালবাসা-টাসা আমি খুব ভাল বুঝি না। কিন্তু এইটুকু বুঝি যেমন তেমন বিয়ে হওয়া ভাল নয়। কিন্তু এখন কি আপনি বাসে উঠবেন? বাসে খুব ভিড়। অফিস ভাঙার সময়।

মন্থরগতিতে বোঝাই বাস-ট্রাম চলেছে। সামনেই চৌরাস্তায় ধীরে ধীরে সৃষ্টি হচ্ছে একটা ট্র্যাফিক-জ্যাম।

শাশ্বতী উদ্বিগ্ন চোখে দেখল। বলল, ওঠা যাবে না।

তা হলে?

শাশ্বতী হাসল, এখন হঠাৎ আমার খিদে পাচ্ছে আবার।

বিমান বলল, তবে চলুন ওই দোকানটায় ফিরে যাই। ওখানে বললে কইলে বাকিতে খাওয়া যাবে। কিন্তু খাবার খুব বাজে। আমি ওখানে আসি কেবল নিরিবিলিতে বসার জন্য, আর পয়সা না থাকলে বাকিতে খাওয়ার জন্য। যাবেন?

না। শাশ্বতী মাথা নাড়ে, ওই গুদাম ঘরে আমার দম আটকে আসছিল। তা ছাড়া ওটা তো আসলে একটা শোয়ার ঘর, পুরুষেরা শোয়। আমার ভাল লাগে না।

বিমান তার বাঁ পকেট থেকে ছেঁড়া পুরনো মানিব্যাগটা বার করে পয়সা হিসেব করে বলল, তিরানব্বই পয়সা আছে মোটে।

শাশ্বতী বলল, আমার কাছে এক টাকার মতো।

বিমান একটু ভেবে বলল, তা হলে কোনও মাদ্রাজি দোকানে চলুন। সস্তায় খাওয়া হবে।

একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সিনেমা হল পেরিয়ে যাচ্ছিল তারা। হলঘরের সামনের ফুটপাথে ঠান্ডা হয়ে আছে। শীতে কেঁপে উঠল শাশ্বতী। তারপর বলল, বড় রাস্তা দিয়ে যেতে ভয় করছে। ওরা যদি গাড়িতে এই রাস্তাতেই ফেরে।

ঠিক। বিমান দাঁড়িয়ে পড়ল।

তারপর বড় রাস্তা ছেড়ে গলিঘুঁজির মধ্যে হাঁটতে লাগল তারা। পৃথিবীময় অচেনা মানুষ, অন্ধের মতো গায়ে ধাক্কা দিয়ে উলটোপালটা হেঁটে যাচ্ছে নাম-পরিচয়হীন মানুষেরা। অচেনা রাস্তাঘাট, চোরাগলি, শাশ্বতী কোনও দিন এই সব জায়গা দেখেনি। এই অচেনা জায়গায় ভিড়ের মধ্যে সে একজন অজানা পুরুষমানুষের সঙ্গে কোথায় কোন রেস্টুরেন্টে চলেছে! কিন্তু তার একটুও ভয় করে না। পথ-চলতি লোকেরা মাথায় ব্যান্ডেজ-বাঁধা বিমান, আর তার সঙ্গে তাকে যেতে দেখে কৌতূহলে তাকাচ্ছে। কিন্তু শাশ্বতীর খুব একটা লজ্জা করে না। বরং তার মন এখন ঝরঝরে পরিষ্কার, বন্ধনহীন। জ্বর সেরে গেলে শরীর যেমন দুর্বল আর শীতল মনে হয়, তেমনি লাগছে তার। একটু হয়তো বা দুর্বল। কিন্তু জ্বর নেই। জ্বর আর একটুও নেই। তার খুব ভাল লাগছে, সে যেন এখন সেই ফ্রক-পরা ঝুঁটি-বাঁধা শাশ্বতী, বাবার সঙ্গে পুজোর জামা কিনতে বেরিয়েছে।

আবার কাঠের সিঁড়ি, আবার দোতলা। তবে এ-রেস্টুরেন্টটা অনেক বড়, আর লোকজনের খুব ভিড়। টেবিলের সামনে লোকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে জায়গা খালি হলে বসবে। সমস্ত ঘরটায় একটা টক গন্ধ, আর বাসনকোসন ধোয়ার খুব শব্দ হচ্ছে।

বিমান নিচু গলায় বলে, ভয় নেই। কম পয়সায় লোকে খায় বলে এত ভিড়। এখানে কেবিন আছে। অনেকক্ষণ বসা যায়।

একটু অপেক্ষা করে কেবিন পাওয়া গেল। দুটো দোসা আনতে বলল বিমান। তারপর শাশ্বতীর দিকে চেয়ে হাসল। বাচ্চা ছেলের মতো অহংকার তার মুখে। শাশ্বতীকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, আপনার কোনও ভয় নেই। আমি এখন পাগল নই। পাগলামি আসার আগেই আমি টের পেয়ে যাই। তখন আমার কাছাকাছি যারা থাকে তাদের সাবধান করে দিই যে, আমি আর কয়েক দিনের মধ্যেই পাগল হয়ে যাব।

শাশ্বতী বাচ্চা মেয়ের মতো একটু হাসে। পরমুহূর্তেই বিষণ্ণ হয়ে গিয়ে বলে, আমার বাবাও মাঝে মাঝে পাগল হয়ে যায়।

পাগল? খুব অবাক হয় বিমান, কী রকম?

শাশ্বতী আস্তে আস্তে বলতে লাগল তার বাবার কথা। বলতে তার ভাল লাগছিল, মন মুক্ত হয়ে যাচ্ছিল তার। সে কখনও চোখের জল মুছল, কখনও হাসল।

বিমানকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। হাত কাঁপছিল তার। প্রথমে কিছুক্ষণ সে কথা বলার চেষ্টা করেও পারল না। তারপর কষ্টে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমরা যারা পাগল তারা কী রকম তা ঠিক বোঝানো যায় না। আমরা সকলেই এক রকমের পাগল নই, বুঝলেন! আমরা যে যার নিজের মতো করে পাগল। না, আমি ভবিষ্যৎ কিছু দেখতে পাই না, কিন্তু যখন আমার মাথায় আকাশ ঢুকতে থাকে আর মাথার যন্ত্রণায় আমি কষ্ট পেয়ে কাতরাই তখন মাঝে মধ্যে আমি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখি। প্রকাণ্ড একটা জায়গা— সেই জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, সুর্য চাঁদ তারা কিছু নেই, সেইখানে বিরাট খোলা জায়গায় হাজার হাজার মানুষ। অন্ধকারে অসম্ভব গোলমাল করে তারা, চিৎকার করে, এর সঙ্গে ওর ঠোকাঠুকি হয়ে যায়। আছড়ে পড়ে মানুষ, আবার উঠে দাঁড়ায়। রাস্তা খুঁজে না পেয়ে হাতড়ে চলে, কোথায় চলেছে জানে না। কখনও তারা চেঁচিয়ে বাবা মা ভাই বন্ধুর নাম ধরে ডাকে, কাঁদে, আবার কখনও কেউ পা মাড়িয়ে দিয়েছে বলে ঝগড়া করে। মারপিট ধস্তাধস্তির শব্দ শোনা যায়। দাঁত ঘষার শব্দ, গালাগালের শব্দ! অন্ধকারের মধ্যে এইসব ঘটতে থাকে। কিন্তু তখন আমার মাথায় আকাশ ঢুকছে বলে যন্ত্রণায় আমি বেশি কিছু বুঝতে পারি না। চোখ খুলে ঘোর অন্ধকার দেখি। আর দেখতে পাই আমার গায়ের ওপর দিয়ে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু তারা আসলে কোথাও যায় না, ঘুরে-ফিরে অন্ধকারে আবার একই জায়গায় ফিরে আসে, তারপর ভুল এবং নিরর্থক পরিশ্রম বুঝতে পেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে! হাঁফায়। ককিয়ে কেঁদে ওঠে। খুব মজার সেই দৃশ্য।

শাশ্বতী আস্তে করে হেসে ওঠে, মুখে রুমাল চাপা দেয়।

বিমান হাসে না। গম্ভীরভাবে বলে, যুদ্ধের সময়ে যখন হাতিবাগানে বোমা পড়ল তখন আমরা কলকাতা ছেড়ে পূর্ব বাংলায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। গোয়ালন্দের স্টিমার পার হয়ে রাত্রিবেলা ট্রেনে ওঠার সময়ে অন্ধকারে ঠিক ওই রকমই একটা ধাক্কাধাকি, গোলমাল আর দিশেহারা অবস্থায় পড়েছিলাম আমরা। মা আমাকে নিয়ে ছেঁচড়ে একটা কামরায় উঠেছিল, আমাদের মেঝেয় ফেলে গায়ের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে উঠেছিল মানুষ, থেঁতলে দিয়ে গিয়েছিল আমাদের। তার ওপর বাবা দাদা আর আমার ছোট বোনটা যে কোথায় গিয়েছিল ছিটকে তা কে জানে! সেই আতঙ্ক আর ভয়, আর সেই অন্ধকার এখনও আমার মধ্যে রয়ে গেছে। এক-একবার মনে হয়েছে আমার পাগলামির সময়ে আমি সেই দৃশ্যটাই দেখি। কিন্তু তারপর ভেবে দেখেছি যে, আসলে তা নয়। গোয়ালন্দের যাত্রীদের একটা উদ্দেশ্য ছিল, তারা ট্রেনে উঠে যে যার নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এই অন্ধকার জায়গায় লোকগুলোর আসলে কোনও উদ্দেশ্য নেই, এরা জানেই না কোথায় গেলে কী হবে, এত হাঁটাচলা, এত পরিশ্রমের অর্থ কী। তাই আমি এর একটা অর্থ করলাম যে, আসলে এই যে মানুষ জন্মাচ্ছে পৃথিবীতে, বেঁচে থাকছে, কাম-ক্রোধ-লোভের হাত ধরে চলেছে, এরা তো আসলে জানে না কেন জন্ম, কেন এই জীবন, মৃত্যুই বা কেন! তাই পৃথিবীতে সবসময়েই রয়েছে এক ঘোর অন্ধকার, কিন্তু মানুষ সেটা বুঝতেই পারে না। তাদেরই মন থেকে অন্ধকার ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে। তাই রেলগাড়ির হ্যান্ডেল ধরে যেতে যেতে ঝুলন্ত মানুষ দেখতে পায় না তার মাথা লক্ষ্য করে ষাট মাইল বেগে ছুটে আসছে ইলেকট্রিকের পোস্ট, দেখতে পায় না রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ কখন ট্রাফিকের লাল বাতি সবুজ হয়ে যায়। বুঝতে পারে না, লম্বা ঘাসের ভিতরে চিকন-শরীর সাপ চলে আসছে কাছাকাছি, তারা কখনও দেখে না চারপাশের জীবাণু-জগৎ, শরীরে উঠে আসছে কষ্টকর রোগ। যতটুকু দেখে মানুষ ততটুকু আসলে কিছু নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু আছে, যা সে দেখতে পায় না। তাই আমার পাগলামির সময়কার ওই দৃশ্যে সূর্য নেই, চাঁদ নেই, তারা নেই। ওই দৃশ্যে আমি এক অদ্ভুত সত্যকে দেখতে পাই, যা আর কেউ দেখে না। ঘোর অন্ধকার একটা পৃথিবীতে জন্মান্ধ মানুষেরা হাঁটছে।

বিমান শাশ্বতীর চোখ দেখে হঠাৎ হেসে বলল, না, না, আমি এখন ঠিক আছি। কোনও ভয় নেই। আপনার বাবা এক রকমের পাগল, আমি আর-এক রকমের। কিন্তু কিছু কিছু পাগল আছে যারা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কিছু দেখতে পায়। হয়তো সেইসব পাগলদের কিছু কিছু অনুভূতি প্রখর হয়ে ওঠে, অন্য অনুভূতিগুলো ম্লান হয়ে যায়।

বিমান উৎসুক চোখে শাশ্বতীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর ছেলেমানুষের মতো সরল হাসি হাসল, এই যে একটু আগে আদিত্য আপনাকে আইনের প্যাঁচে বিয়ে করার চেষ্টা করছিল, ওটাও এক রকমের অন্ধকারে হাঁটা। ও কেবল বোঝে ওর প্রবল ভালবাসা আছে। কিন্তু সেই ভালবাসা কত দূর সাহায্য করে মানুষকে বিয়ে কি কেবল ভালবাসারই একটা ঘটনা? তার আগে-পরে কিছু নেই? ও হঠাৎ আজ দুপুরে এসে দু’-একটা কথাবার্তা বলেই বলল, আমার বিয়েতে সাক্ষী দেবে চলো। মনে মনে আমি চমকে উঠলাম। বিয়ে করা কি এতই সহজ, এত দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। সাক্ষীরও ঠিক নেই, প্রস্তুতি না হঠাৎ বিয়ে! মনে মনে আমি তখনি ঠিক করলাম আমি সাক্ষী নতে রাজি হব। সঙ্গে থাকর ওদের। দরকার যদি হয়, যদি বুঝি জোড় মিলছে না তা হল শেষ সময়ে গোলমাল করে দেব।

বলে বিমান উজ্জ্বল মুখে হাসল, আমি গোলমাল করে দিয়েছি। না? আপনাকে রাজি করানোর অছিলায় বের করে না-আনলে ওরা ঠিক আপনাকে দিয়ে সই করিতে নিত। তাই না?

শাশ্বতী ভীত মুখে চেয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

বিমান শব্দ করে হাসল। তাদের সামনে সদ্য রেখে যাওয়া প্লেটে দোসা ঠান্ডা হতে লাগল। বিমান বলল, বিয়েটা আসলে কী তা আমি আদিত্যকে একটু বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তখন ও ভালবাসায় এত ঠাস-ভরাট যে, ওর মধ্যে কথটা ঠিক ঢুকল না। ওর পক্ষে তখন এটা বোঝা সম্ভবই ছিল না যে, প্রকৃতি আমাদের কাছ থেকে সন্তান চায়, সমাজ চায় প্রকৃত মানুষ। একটা বিয়ে মানেই মানুষের একটা ধারা, আবহমানকালের একটা মনুষ্যস্রোত। তাই না? প্রতিটি স্বামী-স্ত্রীই এ-রকম একটা স্রোতের উৎস। সেই স্রোতটার কথা খেয়াল রাখতে হয়, কেবল ক-এর সঙ্গে খ-এর দেখা হয়ে গেল— তারপর ভালবাসা—গভীর ভালবাসা—বিয়ে—এ-রকমভাবে হয় না। চাষাও জানে কোন জমিতে কী রকম চাষ, সে জানে ভাল জমিতে খারাপ বীজ জ্বলে যায়, ফসল হয় না। কিংবা রুগ্ণ ফসল হয়। আপনি কি চান এ-রকম সন্তান, যে আপনার চেয়েও নিকৃষ্ট স্তরের মানুষ, যে আরও অন্ধ, পৃথিবী যার কাছে আরও ঘোরতর অন্ধকার?

শাশ্বতী লজ্জা পায়। তার মুখে রক্ত ছুটে আসে। চোখ নামিয়ে নেয় সে।

বিমান সামনে ঝুঁকে তার একখানা হাত স্পর্শ করেই হাত সরিয়ে নেয়। বলে, লজ্জা পাবেন না। বরং মনে করে নিন আপনি অবুঝ একটি মেয়ে, আর আমি আপনার বাবার মতোই একজন কেউ। আমি আপনাকে শেখাচ্ছি কীভাবে হাঁটতে হয় অন্ধকারে। দেখুন, আমি চাই আমার সন্তান আমার চেয়ে চক্ষুষ্মান হোক, পৃথিবীর এই অন্ধকার যেন তাকে দিশাহারা না করে। তাই না? কিন্তু একটি মেয়েকে গভীর ভালবেসে বিয়ে করলেই কি সে-রকম সন্তান পাওয়া যাবে? না। কারণ, প্রকৃতির নিয়ম মানুষের ভালবাসার ধার ধারে না। ঠিক বীজ ঠিক জমিতে না পড়লে বীজ জ্বলে যায়। আমরা অকর্মণ্য, বিশ্বাসঘাতক, ভ্যাবলা, অলস, চোর মানুষ নিয়ে আসি পৃথিবীতে। সমাজ টলমল করে। তাই না? ওই দোকানটায় যে বাচ্চা ছেলেটা ছিল তাকে লক্ষ করেছেন? আমি ওকে প্রায়ই লক্ষ করি। মানুষকে আড়াল থেকে লক্ষ করা আমার প্রিয় স্বভাব। ছেলেটাকে দেখি একটা কথা বললে বুঝতে অনেক সময় নেয়, গজের মাঝখানে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে, চুরি করে খায়, মালিক মারলে ঠিক জন্তুর মতো চেঁচায়, আবার পরমুহুর্তেই মারের কথা ভুলে যায়। আমি ওকে দেখেছি ওই ঘরের এক কোণে বসে গায়ের ওপর পড়া একটা টিকটিকিকে ধরে তার শরীর থেকে ল্যাজটাকে খুব অন্যমনস্কভাবে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। তারপর সেই টিকটিকিটাকে হাতে কচলে ডেলা পাকিয়ে ফেলে দিল এক ধারে, হাতের রস রক্ত মাথায় মুছে নিল। কী করছে তা ভাল করে খেয়ালই করল না। আমি কখনও মুরগির মাংস খাইয়েছি, কখনও ক্যাডবেরির চকোলেট, জিজ্ঞেস করেছি, কেমন রে? ও উত্তর দিয়েছে, ভাল। আবার ও যখন পাউরুটির গুঁড়ো আর গুড় দিয়ে জলখাবার খায় তখনও জিজ্ঞেস করেছি, কেমন রে! ঠিক একই রকমভাবে বলেছে, ভাল। খাওয়ার সময়ে ওকে দেখবেন, ও স্বাদ বুঝতে পারে না। খেয়ে যায়। আমি রেগে গিয়ে ওকে বলি, হয় তুই সিদ্ধপুরুষ, নয় তো গোবর। আজ আপনার জন্য জল এনে ও গ্লাসটা ধরে দাঁড়িয়েই ছিল, আপনি হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা না নিলে ও দাঁড়িয়েই থাকত। ওটা টেবিলের ওপর রেখে যে ওর সরে যাওয়া উচিত সেটা ও বোঝেই না। আমি জানি ওর মাথার মধ্যে বোধ নেই, বুদ্ধি নেই, কেবল কুয়াশার মতো একটা ধোঁয়াটে ব্যাপার আছে। এই জীবনের মাথামুন্ডু ও কিছুই বোঝে না, এক অদ্ভুত অচেনা রহস্যময় জগতে ও আন্দাজে আন্দাজে চলেছে। ঘোর অন্ধকার পৃথিবীতে জন্মান্ধ মানুষ। উনুনের ধারে ওর নোংরা বিছানায় বেড়ালের থাবার নীচে ও ঘুমিয়ে থাকে, খিদে পেলে চুরি করে খায়, কখনও সততার অর্থ বোঝে না।

বিমানের মুখ আঠাঘামে চকচক করে। দ্রুত কথা বলে সে হাঁফিয়ে পড়ছে, তবু থামতে চায় না, ঝুঁকে বলে, কোথা থেকে আসছে এইসব অন্ধ মানুষেরা? কোথা থেকে? এরা ভুল বিয়ের মন্দ উৎপাদন নয়?

বিমান আপনমনে একটু হাসে, মাথা নেড়ে বলে, ওর মা-বাবা দূরদর্শী ছিল না। দূরদর্শী হলে তারা তাদের অতীতের বংশধারার দিকে লক্ষ রাখত, ভবিষং সমাজের কথা ভাবত, চট করে বিয়ে করত না। কিন্তু বস্তুত তারাও ছিল অন্ধ মানুষ, ঘোর অন্ধকার পৃথিবীতে আন্দাজে-আন্দাজে তারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে, খিদে পেলে খেয়েছে, তৃপ্ত হয়েছে রতিক্রিয়ায়, কোনওটারই অর্থ বোঝেনি। আমি মাঝে মাঝে কাগজে দেখি রেসের ঘোড়ার বংশগতি ছাপা হয়, যাতে রেসুড়ে মানুষ বুঝতে পারে কোন ঘোড়ার কী জাত। ভাল কুকুর, ভাল গোরুর জন্যও আছে এক রকমের পদ্ধতি। সেখানে শ্রেণীভেদ মানা হয়, ভালবাসা নামে কিছু নেই। কেবল মানুষেরই আছে ভালবাসা, আজ দুপুরে আদিত্যর মুখে-চোখে আমি এইরকম একটা অন্ধ উন্মত্ত ভাব দেখেছি। অন্ধের মতো ও যাচ্ছে, আর একজন অন্ধ ললিত ওকে পথ দেখাচ্ছে।

বিমান একটু চুপ করে থাকে, তারপর দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলে, কারখানায় একটা স্ক্রু তৈরি করতেও কত যত্ন লাগে, কত সতর্কতা। অত যত্নে খুব কম মানুষই উৎপাদিত হয়। তাই না?

শাশ্বতী লাজুক হেসে বলল, আপনি খেয়ে নিন।

বিমান কোমল চোখে শাশ্বতীর দিকে চেয়ে একটু হাসে। তারপর দোসার টুকরো ভেঙে মুখে দেয়। ধীর গলায় বলে, আমরা যারা পাগল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ কখনও-সখনও এমন কিছু দেখি, যা আর কেউ দেখে না। ঠিক বলছি না?

শাশ্বতী মাথা নাড়ে, ঠিক।

গভীর তৃপ্তিতে হাসল বিমান। নিজের মুখটা শাশ্বতীকে দেখিয়ে বলল, কয়েক দিন আগে আমাকে দুটো লোক খুব মেরেছিল। বলতে গেলে সেই মার খাওয়াটাই আমার জীবনের প্রথম সাহসের কাজ। আর, দ্বিতীয় সাহসের কাজ আজকেরটা। এই প্রথম আমি একটা কিছু করতে শুরু করেছি। নিজেকে আমার খুব ভাল লাগছে আজকাল। খুব ভাল।

যখন দোকান থেকে বেরিয়ে এল ওরা তখন সন্ধে হয়ে গেছে। এসপ্ল্যানেডের আকাশে মরা আলো। শাশ্বতীর পাশে পাশে খুঁড়িয়ে কষ্টে হাঁটে বিমান। কৌতূহলী লোকজন তাদের দেখে।

বিমান হঠাৎ নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, ললিতের সঙ্গে আপনার কত দিনের আলাপ?

শুনে শাশ্বতী সামান্য কেঁপে ওঠে। তারপর নিচু গলায় বলে, মাত্র এক দিনের আলাপ।

এক দিনের! সামান্য অবাক হয় বিমান। তারপর মাথা নেড়ে বলে, কিন্তু দেখলাম টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতা ওলটাতে ওর হাত কাঁপছে, দু’আঙুলে সিগারেট ধরে রাখতে পারছে না। খুব অস্থির দেখাচ্ছিল ওকে। আমি ভেবেছিলাম, ও আপনাকে গভীরভাবে চেনে। হয়তো কোনও কারণে আপনার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়।

হঠাৎ থেমে আসে শাশ্বতীর পা। বুক কেঁপে ওঠে। তারপরেই আবার সে স্বাভাবিক হাঁটতে থাকে। কোনও কথা বলে না।

আঠারো

বুড়ো ম্যারেজ-রেজিস্ট্রার দেখিয়ে দেয়, বাথরুম ওই দিকে। ললিত দৌড়ে যায়। বেসিনের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে।

বেসিনের ওপর দেয়ালে আয়না। বমি করার পর মুখ তুলে ললিত দেখে তার জলে ভেজা মুখখানা ফ্যাকাসে। মোটাসোটা লক্ষ্মীকান্তর পাশে তাকে এতটুকুন দেখাচ্ছে। কালো বিশাল হাতখানা দিয়ে তার কপাল ধরে রেখেছে লক্ষ্মীকান্ত, যাতে দুর্বল মাথা টলে না পড়ে যায়। ফরসা কপালের ওপর কালো আঙুল।

এখন একজন আধমরা লোককে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ললিত। এ শরীর আর তার নয়। তার যে শরীর ছিল এটা কখনও আলাদাভাবে টের পায়নি ললিত। এখন সে তার হালকা ছিপছিপে শরীরটাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে অনুভব করে।

লক্ষ্মীকান্ত মায়া-মমতার চোখে তার দিকে তাকায়। ভেজা হাতে কানের পিঠে আর ঘাড় ভিজিয়ে দেয়, এইবার একটু ভাল লাগছে না দাদা, অ্যাঁ?

ভাল। বেশ ভাল।

লক্ষ্মীকান্তর হাত ছাড়িয়ে একা হাঁটার চেষ্টা করে ললিত। পৃথিবী টলে যায়।

বাথরুমের দরজায় সঞ্জয় দাঁড়িয়ে ছিল। ললিত মুখোমুখি হতেই সঞ্জয় হাত বাড়িয়ে বলল, আয়। এখন কেমন লাগছে?

এক হাত থেকে আর এক হাতে চলে গেল শরীর। সঞ্জয় বগলের তলায় কাঁধ দিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে ললিত হঠাৎ লক্ষ করে যে সঞ্জয়ের চেয়ে সে লম্বা। অন্তত ইঞ্চিখানেক। কিন্তু এখন আর তাতে কিছু আসে যায় না। বরং এক ইঞ্চি লম্বা হয়েও তার লজ্জা করছিল। একজন মানুষের পক্ষে যুবাবয়সে এর চেয়ে বেশি আর কী লজ্জার থাকতে পারে যে, সে আর একজনের কাধেঁ ভর দিয়ে হাঁটছে?

সঞ্জয় চাপা গলায় বলে, ব্যাপারটা কীরকম বুঝছিস? মেয়েটা কি কেটেই পড়ল! প্রেস্টিজ-ফ্রেস্টিজ আর…কী ব্যাপার বল তো!

ঘরে ঢুকতেই বুড়ো ম্যারেজ-রেজিষ্ট্রার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে, আপনার কী হয়েছে বলুন তো! আমি ডাক্তার।

ডাক্তার! ঘরে ধারে অথচ ডাক্তারির চিহ্ন নেই। ওষুধের কোনও গন্ধও না। স্টেথস্কোপটাই বা কোথায়! হঠাৎ ললিত দেখতে পেল টেবিলের ওপর জার্নালের স্তূপ। ডাক্তারই হবে।

হয়তো প্র্যাক্টিস বেশি নেই। কিন্তু ললিত কিছুতেই এখন লোকটাকে ম্যারেজ-রেজিষ্ট্রার ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। ধুতির ওপর ঝোলানো শার্ট, ফুলহাতার লিঙ্ক বোতাম, বুকপকেটে ঠাসা কাগজপত্র আর ছোট ডায়েরি। তোবড়ানো শুকনো মুখ, যে-মুখ মনে থাকে না। চশমা জোড়াই যেন লোকটার চোখ, আলাদা চোখ নেই।

ললিত দুর্বল হাতখানা বাড়িয়ে ধরে। লোকটা লাজুক মিনমিনে গলায় বলে, আমি অবশ্য চোখের ডাক্তার, কিন্তু জেনারেল রোগ-টোগ বুঝতে পারি।

চোখ বুজে, ঘাড় হেলিয়ে মন দিয়ে অনেকক্ষণ নাড়ি দেখে জিজ্ঞেস করল, কোনও অসুখবিসুখ আছে? অম্বল-টম্বল?

গ্যাসট্রিক কারসিনোমা।

কী?

ক্যানসার।

একটা শ্বাস ফেলার শব্দ হয়। অতি সম্মানের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার হাতখানা নামিয়ে দেয় লোকটা।

হতাশ লাগে ললিতের।

সাবধানে থাকবেন।

ললিত সোফায় গা ছেড়ে একটু হাসে।

ম্যারেজ-রেজিস্ট্রার লক্ষ্মীকান্তর দিকে ফিরে বলে, কী, তোমার পার্টি কই?

দেখে আসি। লক্ষ্মীকান্ত ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে যায়।

আদিত্য সোফার পিছনে মাথা রেখে দু’ হাতে মুখ ঢেকে আছে। কপাল চকচক করছে ঘামে। মাথার চুল একটু আগে পাট করা ছিল, এখন আবার এলোমেলো।

সঞ্জয় সিগারেট ধরায়। পায়ে পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।

অনেকক্ষণ পর লক্ষ্মীকান্ত ফিরে আসে, নাঃ, ধারে কাছে নেই!

বুড়ো লোকটা গম্ভীর হয়ে ঘড়ি দেখে, এক ঘণ্টা হয়ে গেল।

ললিত দেখছিল, সবুজ দেয়ালে রং চটে গেছে। একটা ভেজা নোনা ধরার গন্ধ। মাথার ওপর দুই ব্লেডের একটা পাখা চলছে, পুরনো আমলের পাখা, কিচকিচ শব্দ হয়। জানালা দরজার সবুজ পরদাগুলো ময়লা বিবর্ণ হয়ে গেছে। পুরনো আমলের ডেস্কে, কুমিরের গায়ের মতো খসখসে সোফার ঢাকনায়, চট বেরিয়ে আসা মেঝের লিনোলিয়ামে—সব জায়গাতেই ধুলো জমে আছে বলে মনে হয়। কিংবা ঘরটা অন্ধকার বলে ও-রকম ধুলোটে দেখায়।

এই ঘরে বিয়ে হয়। বর এসেছে বলে ঠেলাঠেলি পড়ে যায় না, শাঁখ না, উলু না, কিংবা নেই রোমাঞ্চকর চোখে-চোখে শুভদৃষ্টি। তবু বিয়ে হয়। হয়ে যায়। এই ধুলোটে জায়গায়। আধো অন্ধকার কৃত্রিম গোধুলিতে। চোরের মতন। ‘রেজিষ্ট্রিই ভাল’—চিরকাল এই কথা বলে এসেছে ললিত। তবু এখন তার মন সায় দেয় না। একটু আগে শাশ্বতী বসে ছিল এই ঘরে। কেঁদেছিল। হায়, তার কড়ি খেলা হল না, আর একজন কুড়িয়ে দেবে বলে সে মাদুরের ওপর ঘট উপুড় করে ছড়িয়ে দিল না চাল, তাকে সম্প্রদান করল না কেউ, সে নিজে হেঁটে এল। এই ঘরে বড় বেমানান লাগছিল শাশ্বতীকে। যশোরে কপোতাক্ষতীরে ওর দেশ। কলকাতায় জন্মেছিল শাশ্বতী? হবেও বা। তবু বাংলার গভীর হৃদয়ে লুকোনো ছিল ওর মায়াবী গ্রাম, মধুসূদনের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। যশোরের কপোতাক্ষতীরে।

সে কেন আসবে—এখানে রুগি দেখা ঘরে, লজ্জাহীনার মতো সে কেন বলবে, ‘আমরা বিয়ে করতে এসেছি। বিয়ে দাও!’ বাংলাদেশে কে কবে শুনেছে এই কথা? ‘বিয়ে করলাম।’ এই কথা বলে রেস্তরাঁয় খেয়ে বিছানায় চলে যায় বর-বউ? কোনজন শুনি না হাসিবে এই কথা? এখানে হয় না বিয়ে, কিছুতেই হয় না। পালাও শাশ্বতী, আমি একদিন সুন্দর বিয়ে দেব তোমার। ওই কি সাজ? হাতে কলেজ-ফেরত বইখাতা, পরনে সুতির শাড়ি, পায়ে চপ্পল? তমি, কপালে সিঁথিমৌর, হাতে গাছকৌটো নিয়ে সেজে এসো। অনেক দূর থেকে নৌকোয় কারে আসবে তোমার বর। কপোতাক্ষ বেয়ে, গভীর বাংলাদেশে মায়াবী এক গ্রাম জুড়ে বেজে উঠবে শাঁখ, উলুধ্বনি। কড়ি খেলার শব্দ হবে।

লক্ষ্মীকান্ত, আবার ঘুরে আসে, দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, নাঃ।

দেয়ালের গোল ঘড়িটায় পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিট।

ম্যারেজ-রেজিস্ট্রারের চশমা ঝিকিমিকিয়ে ওঠে, সে কী? সব জায়গায় দেখেছিলে? কাছাকাছি রেস্তরাঁয়? পার্কে?

সব। লক্ষ্মীকান্ত হাঁফায়।

সঞ্জয় আদিত্যের কাঁধে হাত রেখে বলে, জেগে থাক।

আদিত্য মুখের ওপর থেকে মুখটাকা হাত সরিয়ে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে একটু চেয়ে রইল সঞ্জয়ের দিকে। তারপর চার দিকে তাকিয়ে কাকে খুঁজল। আবার সঞ্জয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?

ওর বোকা মুখখানার দিকে চেয়ে লোভ সামলাতে পারল না সঞ্জয়, বলল, ঘুমোচ্ছিলি? ঘুমোস না। ঘুমোলে সে এসে যদি ফিরে যায়? জেগে থাক রে, আশা রাখ।

খানিকক্ষণ সঞ্জয়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ ঠাট্টাটা ধরতে পারল আদিত্য। মুহূর্তে লাল, ভীষণ লাল হয়ে যায় আদিত্যর মুখ। চাপা গলায় সে বলল, ওই শালা—ওই ললিতের সব দোষ—আমার প্রেস্টিজ—আমার প্রেস্টিজ—

ললিত অবাক চোখে দেখছিল, আদিত্যর এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে, রোগা ফরসা শরীরে তামার রঙের মতো একটা আভা। তার দিকে চেয়ে কী যেন বলছে আদিত্য! তারপরই লাফিয়ে এগিয়ে এল।

আদিত্যকে এগিয়ে আসতে দেখেও কিছুই ভাল করে বুঝতে পারছিল না ললিত। সে হয়তো তখন খুব তুচ্ছ কোনও কিছু ভাবছিল। তাই সে নিজের গালে আদিত্যর লম্বা আঙুলের চড় মারার চটাস শব্দটা শুনতেই পেল না। নরম সোফার ওপর তার দুর্বল শরীরটা একবার দুলে উঠেই গড়িয়ে পড়ল।

সঞ্জয় দৌড়ে এসে আদিত্যকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, কী হচ্ছে? আদিত্য ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর আচমকা হাঁটু ভেঙে বুকের কাছে পা তুলে সঞ্জয়ের তলপেটে একটা লাথি মারল সে। সঞ্জয় ‘আঃক’ শব্দ করে দু’ ভাঁজ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

লক্ষ্মীকান্ত আদিত্যর হাত ধরে টেনে বলে, কী করেন দাদা, কী করেন? এঃ হেঃ—

উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়ায় আদিত্য। খ্যাপা চোখে চারদিকে চায়। হাওয়ায় উড়ছে ওর রুক্ষ চুল। গায়ের ফরসা রং তামার রঙের মতো হয়ে গেছে।

তারপর কোনও দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যায়। কেউ ওকে আটকায় না।

বুড়ো ম্যারেজ-রেজিস্ট্রারের চশমা থেকে আলো ঠিকরে পড়ে, কী হচ্ছে এ-সব—অ্যাঁ? কী হচ্ছে, লক্ষ্মীকান্ত?

লক্ষ্মীকান্ত ললিতকে ধরে বসায়, খুব লেগেছে, দাদা?

না। ললিত মাথা নাড়ে। উঠে বসে। কষ্টে একটু হাসে ললিত, আমি ঠিক আছি লক্ষ্মীকান্ত।

শরীরে কয়েক বার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠবার চেষ্টা করে, তারপর আস্তে আস্তে দাঁড়ায় সঞ্জয়। কুঁজো হয়ে পেটটা চেপে ধরে ব্যথা-বেদনার ‘ইঃ’ শব্দ করে। তারপর সোফায় বসে একটু হাঁফায়।

আশেপাশে অনেক কুঠুরি-অফিস রয়েছে। সেসব জায়গা থেকে ছুটে এসেছিল কিছু লোক। তারা উত্তেজিতভাবে ঘরের মধ্যে চলাফেরা করছে, জিজ্ঞেস করছে, ‘কী হয়েছে দাদা,’ ‘কী ব্যাপার দাদা।’ তাদের ছায়ার মতো দেখতে পায় ললিত। লক্ষ্মীকান্ত তাদের ঘরের বাইরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টায় দু’ হাত ছড়িয়ে বলছে, ‘কিছু না, কিছু না, মানুষে মানুষে কত রকমের হয়। আপনারা বাইরে চলুন, হাওয়ার রাস্তা দিন।’ এর মধ্যে কোনও মেয়েকে না দেখে হতাশ হয়ে কালো বেঁটে একটা লোক চেঁচিয়ে বলল, ‘বিষহরীটি কোথায়—অ্যাঁ? কাকে নিয়ে গড়াচ্ছে এত দূর? না কি কেবল পুরুষে পুরুষে!’

ললিত চারদিকে দেখে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে। সঞ্জয়ের মুখ লাল, কিন্তু সে ললিতের চোখে চোখে পড়তেই ক্লিষ্ট একটু হাসে। মাথা নেড়ে জানায় যে, সে ঠিক আছে। কিছু হয়নি।

কিছু হয়নি। খুব সাঙ্ঘাতিক কিছুই না! সব ঠিক আছে।

কিছুক্ষণ পর তারা সরু কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছিল। সামনে রেলিঙে হাতের ভর রেখে পেট চেপে কুঁজো হয়ে সঞ্জয়, পিছনে লক্ষ্মীকান্তর কাঁধে শরীরের ভার ছেড়ে ললিত।

সঞ্জয়ের গাড়িতে ললিত সামনের সিটে, সঞ্জয় পাশে বসল। পিছনে লক্ষ্মীকান্ত। সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা ললিতের দিকে বাড়িয়ে দেয় সঞ্জয়। ললিত মাথা তে বলে, থাক।

স্টিয়ারিঙে হাত রেখে একটু ইতস্তত করল সঞ্জয়। তারপর ললিতের দিকে বিব্রত চোখে তাকিয়ে একটু হাসল। কোনও প্রশ্ন করল না সঞ্জয়, কিন্তু ললিত বুঝতে পারে এবার সে ললিতের কাছ থেকে কিছু জানতে চাইছে। কেন এ-রকম হল! কী ব্যাপার!

বুক দুরদুর করে ওঠে ললিতের। সঠিক সেও তো জানে না কী ব্যাপার। জিজ্ঞেস করলে সে কী উত্তর দেবে ওদের?

কিন্তু সঞ্জয় ইচ্ছে করেই কিছু জিজ্ঞেস করল না। হয়তো ললিতের অসহায় মুখখানা দেখে তার মায়া হল একটু। হয়তো সে কিছু একটা আন্দাজ করে নিল। প্রশ্ন করল না। মাথার ওপরের ছোট্ট আয়নাটা ঘুরিয়ে সে নিজের মুখটা একটু দেখল। আপনমনে বলল, শালার এখনও মায়া দয়া আছে, বুঝলি! লাথিটা জোরে মারলে এতক্ষণে আমি হাসপাতালে, কিংবা লাথিটা তলপেটে না হয়ে আর-একটু নীচে লাগলে—মাইরি—

কথাটা শেষ করল না সে। গিয়ার দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল।

ওয়েলেসলি দিয়ে বিকেলের ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে যাচ্ছে সঞ্জয়ের গাড়ি। মন্থর ট্রামের জানালায় উদাসী মানুষদের বিষন্ন মুখ। ধুলোময়লা মাখা কলকাতার রাস্তায় হাঁটছে জীর্ণ মানুষেরা, মুখে রাগ, বিরক্তি, হতাশা, থুথু ফেলে চলে যাচ্ছে, সিনেমা হলের সামনে সঙ্গিনীর জন্য অপেক্ষা করছে একটি ছেলে, তার হাঁটুর কাছে মুখ তুলে একটা বাচ্চা ভিখিরির ছেলে, সে লক্ষ করছে না, ট্রাফিকের পুলিশ হাত বাড়িয়ে কার অদৃশ্য চুলের মুঠি ধরল, হঠাৎ থেমে দুলতে থাকে গাড়ি—

সঞ্জয় তার দিকে তাকিয়ে বলে, শরীর কেমন?

ললিত মাথা নাড়ে, ভাল। বেশ ভাল।

শালা বেজম্মা মেরে গেল। ধরতে পারলে শালাকে…

ললিত চুপ করে থাকে। দুরদুর করে বুক, পাখির মতো।

কিন্তু সঞ্জয় কথা ঘুরিয়ে নিল। চাপা গলায় বলল, অনেক দিন মারধর খাইনি, বুঝলি? পেটে চর্বি জমে গেছে, লাথিটা লাগতেই দম আটকে গেল। মনে হল, মরে যাচ্ছি। আসলে বয়স—বুঝলি! এই বয়সে চোট-ফোট লাগলে ভড়কে যাই…

সরে যাচ্ছে ট্রাফিক-পুলিশের হাত। গিয়ার বদলের শব্দ হয়। সঞ্জয় হাসে, বলে, লাথিটা লেগে দম আটকে যেতেই মনটা হায় হায় করে উঠল। কত কিছু বাকি রয়ে গেল জীবনে, কত রকমভাবে বাঁচা যেত! তখন আমি তাড়াতাড়ি ভেবে দেখছিলাম কোন কাজটা সবচেয়ে জরুরি যেটা আমি বাকি রেখে যাচ্ছি! হঠাৎ মাইরি আমার ভেতর থেকে একটা চ্যাঁচানি বেরিয়ে আসছিল, চার হাজার টাকা—চার হাজার টাকার চেকটা কোথায় গেল!

ললিত অবাক হয়ে বলে, কীসের চার হাজার টাকা?

সঞ্জয় চাপা গলায় বলে, তখন কি আমিই জানি কীসের চার হাজার টাকা! কিন্তু মাটিতে পড়ে ছটফট করতে করতে আমি কেবল ওই চার হাজার টাকার কথা ভাবছি। তখন আমার পিকলুর মুখ মনে পড়েনি, রিনির কথাও না, কেবল ওই চার হাজার টাকার কথা। অথচ বুঝতে পারছি না কীসের টাকা। তারপর আস্তে আস্তে মনে পড়ে গেল। …কী হয়েছিল জানিস?

হঠাৎ গলা খুব নিচু করে সঞ্জয়, প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমার যে ছোট্ট কোম্পানিটা আছে তার একটা বকেয়া পেমেন্টের জন্য পরশুদিন দাদার হাতে একটা চার হাজারি বেয়ারার চেক দিয়েছিলাম। জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের চেক, দাদার আর আমার সই থাকে। আজ বেলা এগারোটা নাগাদ ফোন করে দাদা জানাল যে, পরশুদিন চেকটা দাদার পকেটমার হয়ে গেছে। বুকপকেটে রেখেছিল টের পায়নি। আজ ব্যাঙ্ক খোলার ঘন্টাখানেক পরে টের পেয়ে ছুটে গিয়েছিল ব্যাঙ্কে, কিন্তু চেকটা ক্যাশ হয়ে গেছে। এক ঘণ্টার মধ্যেই। শুনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কে ফোন করলাম। এজেন্ট আমার চেনা লোক, তক্ষুনি ক্যাশ থেকে লোক ডেকে পাঠাল। আমি তাকে চেক-এর নম্বর দিয়ে বললাম যে, যে-লোকটা আজ চেকটা ক্যাশ করেছে তার চেহারাটা মনে আছে কি না। লোকটা স্পষ্ট কিছু বলতে পারল না, কিন্তু আবছাভাবে যা বলল তাতে চেহারাটা একজনের সঙ্গে মিলে যায়। যদি সেই লোকটাই চেক ক্যাশ করে থাকে তবে এটা নিশ্চিত যে, চেকটা দাদার পকেটমার হয়নি— বুঝলি! তা ছাড়া দাদা আবার সব জিনিসই তার মানিব্যাগে রাখে, এমনকী দেশলাইটা পর্যন্ত, তবে চেকটা বুকপকেটে রাখতে গেল কেন? তাই সারা দিন আমি মনে মনে চেকটা ট্রেস করার চেষ্টা করছিলাম, কোথা থেকে কীভাবে কার মারফত গিয়েছিল চেকটা, কীভাবে ধরা যাবে ব্যাপারটা। আর, যখন হঠাৎ আদিত্যর লাথি খেয়ে মরে যাচ্ছি তখন আমার সমস্ত মনপ্রাণ ওই চেকটার জন্য কেঁদে উঠল। কিন্তু বিশ্বাস কর, টাকাটার জন্য নয়, আমার মাসের রোজগার ওর চেয়েও বেশি। কিন্তু তখন মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে চার চারটে হাজার টাকা আমার ঠকা রয়ে গেল, জিত হল না। আমার হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেল একটা অঙ্ক, যার উত্তরটা আমি মনে মনে মিলিয়ে ফেলেছি, অথচ পরীক্ষার শেষ ঘন্টা পড়ে গেল, খাতা টেনে নিচ্ছে গার্ড। চেঁচিয়ে বলছি, আর-একটু সময় দাও, আর-একটু, এই চার হাজার টাকার চেকটা ট্রেস করেই আমি চলে যাব—আর কিছু না—। মাইরি, এখন হাসি পাচ্ছে—শালা, অন্তিম মুহূর্ত এসে গেল, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি, অথচ কোনও ভালবাসার মানুষের কথা মনে পড়ল না? ওই চেকটার মধ্যে এমন কী রস ছিল যে, পিকলুর কথা, রিনির কথা মনে পড়ল না?

পার্ক স্ট্রিটে গাড়ি ঘুরিয়ে থামিয়ে ফেলেছিল সঞ্জয়। বলল, নামবি? একটু সেলিব্রেট করে যাই চল।

কীসের সেলিব্রেট?

আদিত্যর লাথিটার।

ললিত ম্লান হেসে মাথা নাড়ে, না। আমার ও-সব বারণ।

ঠিক তো! ভুলে গিয়েছিলাম। বলে জিভে আফসোসের চুক চুক শব্দ করে সঞ্জয়। গাড়ি ছেড়ে বলে, তা হলে চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আজ একটু লোড করতেই হবে। বডি পড়ে যাচ্ছে মাইরি!

বাসায় এসে ললিত শুনল তুলসী এসে ফিরে গেছে।

ওকে ধরে রাখলে না কেন মা?

অনেকক্ষণ বসে ছিল তো। সিনেমার টিকিট কাটা ছিল বলে চলে গেল। খুব খুশি ছিল আজ, বলল কোথাকার ফুটবল খেলায় ও গোল দিয়েছে।

গোল! কীসের গোল?

কী জানি।

তলপেটটা ফুলে ঢিবি হয়ে আছে। ভারী। যেন ন’ মাসের বাচ্চা রয়েছে পেটে। দাঁতে দাঁতে টিপে হাসল সঞ্জয়।

লক্ষ্মীকান্তকে ছেড়ে দিল রাসবিহারীর মোড়ে।

গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা এক হাতে, অন্য হাতে আবার ছোট আয়নাটা ঘুরিয়ে মুখ দেখে সঞ্জয়, বলে, কী মিস্টার সেন, খুব এক পেট হয়ে গেল তো? বুড়ো বয়সের চোট হে, সারতে সময় লাগবে। চাই কি প্রোস্টেস্ট গ্র্যান্ড পর্যন্ত গড়াতে পারে। সুখে নেই হে তুমি, যতই গাড়ি বাড়ি বউ ছেলে আগলাও, কোথা থেকে যে সংসারের লাথিটা আসবে, টেরই পারে না।

দাঁত চেপে হাসে সঞ্জয়। গাড়ি চালায়। পার্ক স্ট্রিটের দিকে।

সামান্য মাতাল হয়ে ফেরার পথে একজায়গায় গড়িয়াহাটার কাছে অন্ধকারে গাড়ি দাঁড় করায় সঞ্জয়। সিগারেট ধরায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তার ভালবাসার লোকজন বোধ হয় খুব কমই আছে পৃথিবীতে। যখন সে ভাবছিল এই তার শেষ মুহূর্ত—মরে যাচ্ছে সে—তখন তার রিনি কিংবা পিকলুর কথা মনে পড়তে পারত—কিংবা অনীতা—তার অন্ধ বোনটার কথা—হাতড়ে হাতড়ে কাছে এসে চুপ করে পাশ ঘেঁষে বসে থাকে—কিংবা মা—কিংবা যে-কেউ—কিন্তু মনে পড়েনি। কেবল একটা চার হাজারি চেকের কথা মনে পড়েছিল। আশ্চর্য। তবে পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কী? অ্যাঁ? কী? সেটা কি টাকা? একটু শিউরে উঠে মৃদু হাসে সঞ্জয়। ঠিক আছে। তবে তাই হোক। আমেন।

রোজই ভুল হয়ে যায়। এখনও কেনা হয়নি রিনির রোজি ড্রিম আর পিকলুর বিলিতি ফিডার। আজ কিনে নিল সঞ্জয় গড়িয়াহাটার প্রকাণ্ড দোকান থেকে।

বাসায় ফিরে দেখল বাইরের ঘরে গম্ভীর মুখে দাদা অজয় বসে আছে। সামনের টেবিলে খালি চায়ের কাপ, আর কাগজ-চাপার তলায় একটা নতুন চেক।

কী ব্যাপার!

অপরাধী মুখে দাদা বলে, এটা সই করে দে। পেমেন্টটা আটকে আছে।

এই লোকটা—অজয়—তার দাদা এক সময়ে ব্যাঙ্কের পিয়ন ছিল, খাকি পোশাক পরা লোকটা সাহেবদের সেলাম দিয়েছে অনেক। অনেক দিন আগে এ-লোকটাই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল প্রায় অকারণে। সেই থেকে দরিদ্র সঞ্জয় আলাদা হয়ে গেল, এখনও আলাদা রয়েছে তাদের পরিবার। এখন লোকটার চোখে অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের চকচকে চশমা, গায়ে নীল টেরিলিন, গাল কামানো, মাথায় অভিজাত গোলাপি রঙের টাক। তবু ব্যাঙ্কের পিয়ন ছিল, আর তাকে একবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল বলে অজয়কে খাতির করে না সঞ্জয়, তার সামনেই সিগারেট খায়, মদের গন্ধ লুকোতে চেষ্টা করে না।

সঞ্জয় উত্তর দিল না। ধীরেসুস্থে জামা প্যান্ট ছেড়ে বাথরুম ঘুরে ডাইনিং টেবিলে এসে চায়ের সামনে বসল। অনেকটা সময় নিল সে।

তারপর বাইরের ঘরে এসে দেখল অজয় স্থিরভাবে বসে আছে। তাকে দেখে একটু নড়ল।

নিঃশব্দে চেকটা সই করে দিল সঞ্জয়।

একবার ইচ্ছে হল বলে যে, যে-লোকটা চেক ভাঙিয়েছিল তাকে চিনতে পেরেছে ব্যাঙ্কের ক্যাশ-ক্লার্ক। শুনে অজয় চমকে উঠে সাদা মুখে তাকাবে। কিংবা সঞ্জয় ইচ্ছে করলে বলতে পারে, উত্তরপাড়ায় বউদির নামে জমি কিনেছ, আমি কি জানি না?

জানে। সঞ্জয় সব জানে। অজয় বড় বোকার মতো ঠকিয়েছে তাকে। এত বোকার মতো যে হাসি পায়। ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয় না। অজয়কে নিরাপদে চলে যেতে দেয় সে।

তলপেট ভারী হয়ে আছে। কত দূর গড়াবে কে জানে। একদিন আমি সব ছেড়েছুড়ে দেব। বুঝলে রিনি। সব ছেড়েছুড়ে—তারপর সাধু হয়ে যাব রমেনের মতো। না, রমেনের মতো নয়। রমেন সবকিছুর মাঝখান থেকে হঠাৎ খেলা ভেঙে উঠে গিয়েছিল। আমি তত দূর পারব না। আগে কোম্পানিটা ট্রান্সফার করব অনীতার নামে—আহা, অঙ্ক বোনটি—টাকা ছাড়া কে আর ওকে পথ দেখাবে? তোমার আর পিকলুর জন্য ব্যাঙ্কে রাখব কয়েক লাখ টাকা। তারপর—হ্যাঁ, তারপর সাধু হয়ে যাওয়া যায়। তারপর সাধু হওয়া শক্ত নয়।

উনিশ

সঞ্জয় যেদিন জোর করে মদ খাইয়ে দিয়েছিল তাকে, আর সে মাতাল হয়ে রাতে বাসায় ফিরেছিল, তার পরদিন সকালবেলায় ভিতরের বারান্দার এক কোণে দাড়ি কাটার সরঞ্জাম নিয়ে বসে ছিল তুলসী। রান্নার জায়গায় মৃদুলা কৌটো-টৌটো খুলে কী খুঁজছে। তুলসী সন্তর্পণে আয়নাটা একটু ঘুরিয়ে তার ভিতর দিয়ে মৃদুলার দিকে চেয়ে থাকে। কালোজিরে কিংবা সর্ষে খুঁজতে খুঁজতে মৃদুলা একবার হঠাৎ মুখ তুলে তাকায়। আয়নার ভিতর দিয়ে চোখাচোখি হতে মৃদুলা টপ করে চোখ নামিয়ে যে পাতকুয়ার মধ্যে ঝুঁকে পড়ল।

সকাল থেকেই কেউ কথা বলছে না তার সঙ্গে, মৃদুলাও না। বাড়িটা থমথম করছে। অথচ বারান্দায় রান্নার জায়গায় বউদি, ঘর জুড়ে দাদা আর খবরের কাগজ, সব যথারীতি, রোজকার মতোই।

পাশ দিয়েই বউদি বাথরুমে যাচ্ছে, তুলসী তাড়াতাড়ি আয়নার ওপর ঝুঁকে পড়ে।

বারান্দায় যখন বউদি নেই ঠিক সেই সময়েই মৃদুলা চা দিতে এল। তুলসী মৃদুলার একটা হাত খপ করে চেপে ধরে বলে, কাল রাতে কী হয়েছিল বলো।

ছাড়ো। জানি না।

পায়ে পড়ি, বলো।

ছিঃ, তুমি গুরুজন না!

আমি পাষণ্ড, ওই সঞ্জয় হারামজাদার দোষ। কী করেছি বলো।

অনেক কিছু। মাতালরা যা যা করে। আমাকে শিসও দিয়েছ।

মাইরি?

আজ সকালে দাদা বলেছে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া উচিত, নইলে ছেলেমেয়েগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।

আমি চলে যাব।

কোথায়?

কোথাও। বাসা খুঁজছি।

একটু চুপ করে থাকে তুলসী। তারপর বলে, একদিন একটু খেলে কী হয়! সঞ্জয়রা তো রোজ খায়।

তুমি কি সঞ্জয়?

উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না মৃদুলা, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়।

তুলসী দেখে আয়না থেকে বুড়োটে মুখটা চোর-চোখে চেয়ে আছে। হিসেব করলে এই শেষ ভাদ্রে তার মধ্যযৌবন। বয়স তেত্রিশ। কিন্তু বাস্তবিক মধ্যযৌবন বলে কিছু টের পায় না তুলসী। নিজের এই মুখখানা সে গতকাল, পরশু কিংবা দশ-পনেরো বছর আগে যে-রকম দেখেছিল, অবিকল সে-রকম দেখছে। আরও দশ বছর পরেও বোধ হয় একই রকম দেখাবে। এই হচ্ছে তুলসী—তুলসীচন্দন—কেবলমাত্র তুলসী হয়ে ওঠা ছাড়া এর আর কোনও গতি নেই। না, সে সঞ্জয় নয়। তবু ‘তুমি কি সঞ্জয়?’ এ-প্রশ্নটা সারা দিন তার বুকে লেগে রইল।

আবার ঘুরে-ফিরে সুযোগ বুঝে কাছে এল মৃদুলা। ফিসফিস করে বলল, তুমি বরং পলাশপুরেই বাসা নাও।

দূর, ওখানে যা সাপ! কালকেই ক’জনকে কামড়েছে।

লোকে তো আছে!

দূর। সব হিংসুক—বোকা। আর কয়েক দিন দেখো না, কলকাতাতেই একটা কিছু—

মৃদুলা চলে যাচ্ছিল। তুলসী তার হাত টেনে বলে, কাল কোথায় গিয়েছিলাম জানো? গ্র্যান্ড!

হাসে তুলসী। আবার বলে, গ্র্যান্ড!

আবার উত্তেজনাহীনভাবে দিন কেটে যায়। কিছুই ঘটে না।

স্কুলে এসে একদিন তুলসী শুনল আজ খেলা আছে। জবর খেলা। টিচার্স ভারসাস স্টুডেন্টস। টিফিনের মধ্যেই টিম তৈরি হয়ে গেল। শিক্ষকদের ক্যাপ্টেন হরি চক্রবর্তী, এক সময়ে কলকাতায় সেকেন্ড ডিভিশনে কয়েকদিন খেলেছেন, বললেন, তুলসী, তুমি রোগা-টোগা আছ, ছুটতে পারবে—তুমি রাইট আউট। গতবারও রাইট আউট ছিল তুলসী, হাফটাইমের পর লাইনের ধারে নেতিয়ে বসে হাঁফিয়ে যাচ্ছিল। তবু ঠিক আছে। পাঞ্জাবিটা খুলে ধুতিতে মালকোঁচা মেরে গেঞ্জি গায়ে রাইট আউটেই দাঁড়িয়ে গেল সে।

ইচ্ছে করেই ছেলেরা আজ বুট পরে নামেনি। তবু তাদের খালি পাগুলোই লোহার মতো শক্ত। লাল-হলুদ জারসি তাদের গায়ে। যেখানেই যাচ্ছে বল সেখানেই লাল-হলুদের পা। ওদের গোলকিপার হাফিজ, ইলেভেন সায়েন্সের। তার গায়ে হলুদ গেঞ্জি, হাতে বল-ধরা দস্তানা, কপালে নামানো টুপির ঢাকনি, এ-তল্লাটের নাম-করা গোলকিপার। জলে শোল মাছ যেমন নড়ে-চড়ে তেমনি শূন্যে বাতাসের মধ্যে চলে যায় হাফিজ, পিংপং বলের মতো মাটিতে পড়ে লাফায়। হরি চক্রবর্তীর দুটো শট তুলে নিল মা যেমন শোয়ানো শিশুকে তুলে নেয়।

হাফ টাইম পর্যন্ত গোল-লেস।

এতক্ষণ মাঠে কোথাও ছিল না তুলসী। লাইন ধরে সে মাঝে মাঝে এগিয়ে গেছে, পিছিয়ে এসেছে আবার। তার দিকে বাড়ানো পাসগুলি তার কাছে পৌঁছয়নি, চলে গেছে লালহলুদের পায়ে। ওরাই তো সারা বছর খেলে, তাই বলটা ওদের পোষ-মানা, পোষা কুকুরের মতো লজ্জাহীন পায়ে পায়ে ছুটছে। সারা মাঠময় লাল-হলুদ, লাল-হলুদ ঝলকে যাচ্ছে দুপুরের রোদে। ডাঁটো শরীরের ঘাম ঠিকরে দিচ্ছে দুপুরের আলো। হরি চক্রবর্তী চেঁচিয়ে বলে, লাইনের বড় ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তুলসী, কে এসো—পাস পায়ে যাবে না, ঢুকে এসে বল তৈরি করে নাও। তুলসী দেখে কখনও সবুজ ঘাসে, কখনও নীল আকাশের গায়ে সাদা বলখানা। খুব দুরে দুষ্পাপ্য বস্তুর মতো মনে হয়। তুলসী চেষ্টা করে না।

হাফটাইমে ভরপেট কোকোকোলা। তার শরীর হিস হিস করে। আরও ঝিমিয়ে পড়ে তুলসী। শরীরটা জুতের নেই। সেদিনের হুইস্কির ঝোঁক এখনও যেন একটা ঝিমুনির মতো রয়ে গেছে। গতকাল কত দূর মাতলামি করেছিল সে? সে কি শিস দিয়েছিল? আশ্চর্য! মৃদুলাকে শিস দেওয়ার কী আছে! শিস দিত সঞ্জয়, যেখানে মেয়েছেলে দেখত, সেখানেই দুটো আঙুল গোল করে মুখে পুরে দিত, চুঁ-হিঁ-হিঁ করে বেজে উঠত আশ্চর্য শিস। তুলসী শিখেছিল, কিন্তু কোনও দিন দেয়নি। কারণ সে তো সঞ্জয় নয়! …তার পা ছুঁয়ে চলে গেল বলটা ধীরে ধীরে লাইনের ও-পারে। থ্রো-ইন। কী খেলছে! সোজা বল— ধরতে পারলে না! তুলসী লজ্জা পায়। লোকটা বড় সিরিয়াস। ছাত্রদের সঙ্গে খেলা, তবু জান লড়িয়ে দাও। কে না জানে একটা না একটা সময়ে ওরা ঠিক গোল ছেড়ে দেবে! শিক্ষকরা জিতলে কাল ছুটি। ওরা জানে।

ওপর থেকে নেমে আসছে সাদা বলটা। তাকে লক্ষ করে। সুন্দর দেখায় বলটাকে। তুলসী অলসভাবে দেখে। বলটার পিছনে নীল আকাশ, নৌকোর পালের মতো মেঘ।

সে কে ধরবে ওই বলটা? কী স্বার্থ তার? সে তো সঞ্জয় নয়, যে অধ্যবসায়ী সঞ্জয় বউয়ের জন্য গোলাপি স্বপ্ন কিনে নিয়ে যায়, ছেলের জন্য কেনে বিলিতি ফিডার, বিকেলের অবসরে গ্রান্ডে গিয়ে বসে থাকে! কিংবা সে নয় ললিত, যে ললিত হাসপাতালের বিছানায় শোয়া—সাদা রোগা মুখখানায় নীল শিরা জেগে আছে, হাতের নলীতে ঢোকানো গ্লুকোজের ছুঁচ— জানে মরে যাবে, তবু ঠাট্টা করছে, তোর মুখটা গম্ভীর কেন রে তুলসী? তোর ভাবী বউটা কি কুচ্ছিত? মরবে তবু কেমন শান্ত! কিংবা সে নয় রমেন, যে রমেন গাড়ি চালাত, পিয়ানো বাজিয়ে গাইত পূর্ব বাংলার মাঝিদের গান, কিংবা রিলে রেসের শেষ ল্যাপ—এ ব্যাটনের জন্য হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। কী সুন্দর সেইসব ভঙ্গি রমেনের! সে তুলসীই, আর কেউ নয়। সে একফি হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে ভরসন্ধেবেলা তার কাঁদুনে ছেলেকে ‘ও-ও’ করে ঘুম পাড়াবে, বাজারে গিয়ে পাশের লোকজনকে লক্ষ করে বলবে, এই বাজারে বাঁচা যায় না, বললেন, বাঁচা যায় না। তারপর একদিন পৃথিবীর বিশাল তার তাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে। তবে সে কেক ধরবে এই বলটা? কী স্বার্থ তার? আশ্চর্য অভিমানে তুলসী চেয়ে থাকে।

ঝলকে ওঠে লাল-হলুল। সুঠাম চেহারার রঞ্জিত হাঁটুতে বলটা আটকে নেয়। তুলসী দেখে। এম-কম জগত্তারণ বলটা প্রাণপণে বুক দিয়ে আটকায়।

আশ্চর্য এই, বলটা তার কাছেই গড়িয়ে আসে। ধীরে ধীরে, বিনীতভাবে। অপরাধী ছাত্রের মতো এসে সামনে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে।

কী সংবাদ ভগ্নদূত?

তুলসী ছোটে। খুব জোরে নয়। তার পায়ে বল। লাইনের বাইরে থেকে ছেলেরা চেঁচায় স্যার, ম্যান বিহাইন্ড, ম্যান বিহাইন্ড—

এইভাবেই ছুটত রমেন, ইন-আউট ইন-আউট করতে করতে। কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে চলে যেত, তারপর হঠাৎ ঘুরে গুপ করে সেন্টার করত বল। কিংবা চিতাবাঘের মতো ডজ করতে করতে ঢুকে আসত।

সামনেই উড়ছে ছোট্ট লাল নিশান। কর্নার ফ্ল্যাগ। অনেক দূর চলে এসেছে তুলসী। এখনও তার পায়ে বল। কী করবে তা সে বুঝতে পারে না। এ অবস্থায় রমেন হলে কী করত? কালো বেঁটে বোটবেগুনের মতো চেহারা গোপীকান্ত ছুটে আসছে। তার গায়ে আগুনের মতো জ্বলছে লাল-হলুদ জারসি। ফার্স্ট ব্রাকেটের মতো বাঁকা পা দু’খানা। এত বাঁকা যে, পা জোড়া করে রাখলেও বোধ হয় মাঝখান দিয়ে বল গলে যায়।

সেই চেষ্টাই করল তুলসী। গোপীকান্তর দু’ পায়ের ভিতর দিয়ে বলটা গলিয়ে দেবার। হল না। বল ধরে উড়িয়ে দিল গোপীকান্ত। হঠাৎ নিঃস্ব মনে হয় নিজেকে।

কিন্তু এ কেমন যে, সে চিরকাল সেই তুলসী? আজন্ম? আমৃত্যু?

গোল দেওয়ার জন্য সেন্টার লাইনের ও-পাশে চলে গেছে সব লাল-হলুদ খেলোয়াড়। বুড়ো মাস্টারদের নাচিয়ে পায়ে পায়ে টোকা দিচ্ছে বল। গোলের সামনে গিয়েও ফিরে আসছে। এ-পাশে ফাঁকা সবুজ মাঠ, সামনে কেবল পায়চারি করছে একজন ব্যাক। এ-তল্লাটের সেরা গোলকিপার হাফিজ পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, বংশীবাদক কৃষ্ণের মতো পা দু’খানা ক্রস করা, দাঁতে ঘাসের ডাঁটি চিবোয়।

হঠাৎ শূন্যপথে উড়ে আসে বল। ফাঁকা মাঠে।

ঝামেলা! তুলসী অলসভাবে এগোয়। লাল-হলুদ ব্যাক ক্লাস এইট-এর পীযূষ এগিয়ে আসে। হাফিজ ভঙ্গি বদলায়।

ফাঁকা মাঠ। উঠে আসে বল। আশ্চর্য, কাছে এসে প্রণামের মতো মাথা নিচু করে দেয় বলটা। বশংবদের মতো পায়ে পড়ে থেমে যায়। সামনে একা পীযূষ। তার লোহার ডাঙের মতো পা। তুলসী ঘুরে তাকে কাটানোর অক্ষম চেষ্টা করে। পায়ে পা লেগে খটাং শব্দ হয়। তুলসী পড়ে গিয়ে ফের ওঠে। পীযূষ তখনও মাটিতে, উঠছে। বলটা তার পায়ের ওপর দিয়ে লাফিয়ে তুলসীর কাছে চলে আসছে, শিশু যেমন অচেনা লোকের কোল ছেড়ে বাপের কাছে ছুটে আসে।

তুলসীর পায়ে বল টেনে নেয়। ছোটে।

লাইনের বাইরে থেকে ছেলেরা চেচায়, ফাস্ট টাইম স্যার, ফাস্ট টাইম—!

তুলসী দৌড়ায়। আদি অন্তহীন ফাঁকা মাঠ। কেউ নেই। কিন্তু বুকে খিঁচ ধরে ওঠে একটা ব্যথায়। তুলসী হাঁফিয়ে পড়ে। মার-মার করে ছুটে আসছে পায়ের শব্দ, হাতি-ছোটার শব্দের মতো। ম্যান বিহাইন্ড!…সে কেন নয় রমেনের মতো কুশলী? সে নয় অধ্যবসায়ী সঞ্জয়, কিংবা আত্মবিশ্বাসী ললিত। সে তুলসী, কেন সে কেবল তুলসী?

ডান ধার থেকে তুলসী ঢুকতে থাকে। এক দুই করে লাল-হলুদ জার্সি এগিয়ে আসে। তুলসী বল নিয়ে ঘুরে যায়, মানুষের অলিগলি দিয়ে ছুটতে থাকে বুকে খিঁচ-ধরা ব্যথা। সে হাঁফায়। বল তার পায়ে বশংবদ লেগে আছে, গড়িয়ে যাচ্ছে।

ফার্স্ট টাইম স্যার—গোলে মারুন!

কিন্তু কোন দিকে গোল-পোস্ট ও তুলসী উদ্ভ্রান্তের মতো তাকায়। কোন দিকে গোলপোস্ট?… ওই তো তিন, বাঁশের গোলপোস্ট, বার বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে৷ ডান দিকে। একা হাফিজ।

বাঁ পা থেকে ডান পায়ে বল টেনে নেয় তুলসী। হঠাৎ ডান দিকে বেঁকে ছুটে যায়। সে কেন তুলসী? সে কেন চিরকাল সেই তুলসী?

লাল-হলুদ একজন, সামনে এসে ভুঁইফোঁড় দাঁড়িয়ে যায়। পা থেকে খসে যায় বল। লাল-হলুদের পায়ে চলে যায়। ছেলেটা মৃদু হাসে, মন্থর পায়ে এগোয়।…এ-অবস্থায় রমেন হলে কী করতঃ তুলসী ভেবে পায় না। সে দেখতে পায় ছেলেটার পা থেকে বল গড়িয়ে একটু এগিয়ে গেছে। ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছে। খুব নিশ্চিন্ত ভাবভঙ্গি। হঠাৎ রেগে যায় তুলসী। খুব রেগে যায়। সে কাছেই রয়েছে, তার ছেলেটা তেল অত নিশ্চিন্ত? কেন সাবধান হচ্ছে না? অবহেলা!

হঠাৎ হালকা পায়ে ছুটে আসে তুলসী। ছেলেটার পা থেকে তিন-চার হাত দূরে বল গড়িয়ে যাচ্ছে। তুলসী টুক কার বলটা সরিয়ে নেয়। ছেলেটা বোকার মতো চেয়ে থাকে। তাকে সময় দেয় না তুলসী, দিশেহারার মতো বাঁ দিকে ঘুরে এগোয়।

সামনেই গোলপোস্ট। হাফিজ দাঁড়িয়ে, হলুদ গেঞ্জি, চামড়ার দস্তানায় ঢাকা দু’খানা হাত— তৈরি—তার মুখে টুপির ছায়া—অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে ক্রুর চোখ। ফণা তুলে অল্প অল্প দোলে হাফিজ।

হাঁটু ভেঙে আসে। হাফিজের মুখোমুখি হঠাৎ মনে হয়, সে পারবে না। অসম্ভব।

বলে পা লাগার টুম শব্দ হয়। সে মেরেছে কি? হ্যাঁ, মেরেছে।

হাফিজ শূন্যে ভেসে যায়।

হঠাৎ বাতাস ছুটে এসে গায় লাগে।

গো-ও-ও-ও-ল! গো-ও-ও-ও-ল! গো-ও-ও—

মাঠের বাইরে ছেলেরা নাচছে। মাঠের ভিতরে ছুটে আসে ছেলের পাল।

হরি চক্রবর্তী জড়িয়ে ধরে, জগত্তারণ কাঁধে তুলে নেয়।

তুলসীর কাছা খুলে ঝুলতে থাকে।

কাল ছুটি।

বিকেলে দু’খানা সিনেমার টিকিট কাটে তুলসী। তারপর প্রথমেই গেল ললিতের বাসায়। গিয়ে শুনল, আদিত্য আর বিমানকে নিয়ে দুপুরে বেরিয়েছে ললিত। কী একটা ব্যাপার আছে ওদের। বলে গেছে বিকেলে নাকি ওরা মুরগি এনে ফিস্টি করবে। তুলসী তাই ললিতের মা’র সঙ্গে বসে একটু গল্প করল। তারপর এক কাপ চা খেয়ে উঠে পড়ে। বাসায় এসেই মৃদুলাকে তাড়া দেয়, তাড়াতাড়ি শাড়ি-টাড়ি পরে নাও। বুকপকেট থেকে সিনেমার টিকিট দু’খানা উঁচু করে দেখায়।

ও মা! মৃদুলা বলে। তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, মাত্র আমরা দু’জন? বাসার লোকে কী মনে করবে!

করুক গে। তুমি তাড়াতাড়ি করো। সময় নেই।

তুলসীকে খুব উত্তেজিত দেখায়। মাঝে মাঝে সে আপনমনে হাসছে।

সিনেমা হলের উলটো দিকে সুরুচি কেবিন। তুলসী বলল, চলো।

মৃদুলা ইতস্তত করে, দেরি হয়ে যাবে।

দূর। নিউজ রিল আগে শেষ হোক।

কবিরাজি কাটলেট কেটে গরম টুকরোটা মুখে দিয়ে তুলসী চোখ নামায়, কেমন?

মাংস ডিম আর ঘিয়ের স্বাদে মুখ ভরে যায়, মৃদুলা লজ্জায় হাসে, রোজ খেতে ইচ্ছে করে। বাসার রান্নায় এখন রুচি হয় না। ভাতের গন্ধে বমি হয়ে যায়।

রোজ খাওয়াব।

দূর। রোজ কি আসা হবে বাইরে?

কেন! বাসায় নিয়ে যাব!

মৃদুলা চোখ গোল করে, বাসায় এত লোক, সকলের সামনে?

তা কেন? লুকিয়ে নিয়ে যাব, রাতে শোয়ার সময়ে দরজা বন্ধ করে মশারির মধ্যে বসে খাবে!

মৃদুলা হাসে, তা কি হয়?

কেন হবে না? আপৎধর্মে সব হয়। সবাইকে অত খাতির করলে চলে না। দেশের বাড়িতে মাকে দেখেছি মশারির মধ্যে বাবা এনে খওয়াত। তখন ছোট ভাইটা পেটে—যে বাঁচল না। তুমিও খাবে।

মৃদুলার মুখ ঝলমল করে। উত্তেজনায় খাবারের স্বাদ পায় না তুলসী। চোখের সামনে অবিকল দেখতে পায় হাফিজকে—শূন্যে অসহায় হাত বাড়িয়ে ভাসছে। খেলার শেষে হেডমাস্টার বলছে, খুব অ্যাকিউট অ্যাঙ্গেল থেকে মেরেছিলে হে—হেরিয়েলি—ভেরি গুড—। গোলটার কথা ভাবতে ভাবতে আপনমনে শূন্যে তুলসীর পা উঠে যায়। নিজেকে সামলায় তুলসী। মৃদুলা দেখলে হাসবে।

ইন্টারভ্যালে প্যাকেটে পোট্যাটো চিপস ফেরি করছিল সাদা ইউনিফর্ম পরা ট্রে-হাতে একটা লোক। তুলসী হাত বাড়িয়ে বলল, দুটো দেখি।

মৃদলা মৃদু ঠেলা দিয়ে বলল, একটা নাও।

দূর

একটু পরে দাম নিতে ঘরে এল লোকটা। দেড় টাকা। শুনে চমকে উঠল তুলসী। মৃদুলা চোখ গোল করে ফিসফিস করে বলল, ও মা! এইটুকু আলুভাজা। কী গলাকাটা নাম গো!

তুলসী মৃদু হাসে, ঠিক আছে।

একদিন সে সঞ্জয়ের সঙ্গে গ্র্যান্ডে গিয়েছিল। সেই স্মৃতি থেকে সামলে নিল ব্যাপারটা। রোজ তো আর নয়। বরং আর কোনও দিন আগে থেকে দাম না জেনে সে পোট্যাটো চিপস কিনবে না।

বেরিয়ে আসার সময় তুলসী দেখে মৃদুলার চোখ লাল। সে জিজ্ঞেস করল, কেঁদেছিলে?

মৃদুলা ম্লান হেসে বলে, ইস, কী কষ্টের ছবিটা!

তুলসীর হঠাৎ বড় মায়া হয় মৃদুলার জন্য।

লবিতে প্রচণ্ড ভিড়, নাইট শোয়ের লোকেরা ঢোকার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ শিউরে কেঁপে উঠে তুলসীর হাতখানা চেপে ধরল মৃদুলা। বলল, দেখো দেখো, ওই লোকটা—ওই নীল জামা পরা—আমার ঊরুতে চিমটি কেটে পালাচ্ছে। ওকে ধরো—ওই যে—

কই? কোথায়? দিশেহারার মতো বলে তুলসী।

মৃদুলা তাড়া দিয়ে বলে, ওই যে—ও পালিয়ে যাচ্ছে—ছুটে ওকে ধরো।

তুলসী দেখতে পেল লোকটাকে। নীল হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা, লম্বা কালো কালো বিশ্রী চেহারা। কিন্তু দেখেও দেখল না তুলসী। ওকে ধরে কী করবে সে? কী করতে পারে? ওই মস্ত লম্বা লোকটাকে কীভাবে বা ধরবে তুলসী? খুবই অসহায় বোধ করে সে। তবু অনিচ্ছার সঙ্গে এগিয়ে একটু এদিক-ওদিক দেখে ফিরে এসে তুলসী বলে, নাঃ, পালিয়ে গেছে।

অপমানে লজ্জায় মৃদুলার চোখ-ভরা জল, বলল, তোমার চোখের সামনে দিয়ে গেল, তুমি দেখতে পেলে না?

তুলসী দার্শনিকের মতো বলে, যেতে দাও। কত বদমাইশ মতলবাজ লোক রয়েছে পৃথিবীতে! সবাইকেই কি ধরা যায়! কত ধরবে তুমি, অ্যাঁ?

বাস-স্টপে এসে মৃদুলা চোখ মোছে। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, লোকটার মুখটা ঠিক দেখতে পাইনি। কিন্তু ঠিক বিভুর মতো। বিভুরও এই রকম বদমাশের মতো চেহারা। ওই রকম কালো লম্বা। ধরতে পারলে আমি ঠিক চটি খুলে মারতাম।

রাত্রি। তুলসী শুয়ে ছিল। গা হাত পায়ে হাজারটা ফোঁড়া টনটন করে, হাত-পা নাড়তে কষ্ট হয়, দম নিতে বুক ফেটে যায়। মনে হয় খুব জ্বর আসছে।

মৃদুলা নরম হাতে তার হাঁটু টিপে দিতে দিতে বলল, কেন ওইসব খেলতে যাও! হাত-পা ভাঙলে, তখন?

তুলসী মৃদু কাতর ধ্বনি করে। তারপর আস্তে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, ওই লোকটা কি সত্যিই বিভু, তুমি ঠিক দেখেছিলে?

মৃদুলা ঠোঁট ওলটায়, কী জানি! মনে হয়েছিল তো। হনহন করে পালিয়ে গেল, মুখটা দেখা গেল না।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে তুলসী, তারপর ঘুমোবার আগে উদাস গলায় বলে, কলকাতাটা বড্ড নোংরা, বুঝলে? একেবারে নোংরা শহর। সম্মান নিয়ে থাকা যায় না। এই ভিড়ভাট্টা গণ্ডগোলের মধ্যে—দূর, দুর—তার চেয়ে ঢলো পলাশপুরেই চলে যাই। ওখানে খেতখামার করব, বুঝলে? খেতখামার— একটা গোরু পুষব—কাছেই একটা ভেড়ি আছে—টাটকা মাছ—মাস্টারমশাই বলে ওখানকার লোক সম্মান করে খুব—গাঁয়ের মানুষ তো—সরল সোজা—

বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে।

ওদিকে শাশ্বতীকে বাসে তুলে দিয়ে সারা বিকেল বিমান এসপ্ল্যানেডে ঘুরে বেড়িয়েছে। ময়দানের ও-ধারে গড়ের পিছনে দেখেছে আশ্চর্য সূর্যাস্ত। তুলিতে আঁকা গোধূলির ছবি। না, ঠিক গোধূলি নয়, গোরু ছিল না, মানুষের পায়ে পায়ে উড়ছিল ধুলো। ফুচকাওলাকে ঘিরে মানুষের ভিড়, চ্যাপটা মাটির উনুনে ভুট্টা পোড়াচ্ছে দেহাতি মানুষ, মনুমেন্টের তলায় মিটিং। সে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। ট্রাম লাইনের ওপরে তারের জটিলতা, লক্ষ করল সে, কার্জন পার্কে বসে আছে অলস মানুষ।

সুন্দর এক দৃশ্য দেখল সে। প্রাইভেট বাসের হাতল ধরে পড়ো-পড়ো মানুষকে বুকে জড়িয়ে তুলে নিল বিশাল চেহারার পাঞ্জাবি কন্ডাক্টর। একটা বাচ্চা ভিখিরির ছেলেকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিল ট্রাফিক পুলিশ। কৃতজ্ঞতায় তার চোখে জল এসে গেল।

প্রতিটি মানুষকেই ডেকে একটি-দু’টি কথা বলতে ইচ্ছে করে। অচেনা মানুষের কাঁধে হাত রেখে কয়েক পা হাঁটতে সাধ হয়। তার চারদিকে অসহায় জন্মান্ধ সব মানুষ, জানে না কোথা থেকে কীভাবে এসেছে। জিজ্ঞেস করলে বড় জোর বাবার নাম বলতে পারে—তার বেশি কিছু নয়। এইখানে মিটিং করছে কিছু লোক, কী বলছে ওরা? বিমান এগিয়ে শোনে। শিগগিরই ধর্মঘট। বাংলা বন্ধ। ট্রেনের চাকা চলবে না। কারখানায় চাক্কি বন্ধ। অফিস ফাঁকা থাকবে। বড় রাস্তায় ফুটবল খেলা হবে। একদিন ছুটি।

ছোট্ট একটা মিছিল আসছে মিটিঙের দিকে। রোগা ক্রুদ্ধ মানুষেরা হাত তুলে চেঁচাচ্ছে, নিপাত যাক। —নিপাত যাক।

জন্মান্ধ মানুষ। জানে না বিদ্রোহ বিপ্লবের বীজ নষ্ট করে দেয়। শতকরা পঞ্চাশ ভাগ দাবি মিটলেই এরা ঝিমিয়ে পড়বে। রেলের চাকা চলবে। কারখানায় চাক্কি ঘুরবে। অফিসে বশংবদ মানষেরা মাথা নিচু করে ঢুকে যাবে। আজকাল আর তেমন মানুষের জন্ম হয় না, তেমন ল্যাংটা মানুষের, যে পৃথিবী কাঁপায়। যার দাবি-দাওয়া অভিশাপ নেই, যে দিতে আসে।

একটু আগেই সে একটা কাজ করেছে। খুব সাহসের কাজ। নিজেকে তাই খুব সজীব বলে মনে হয় তার। সে লোকের চোখে চোখ রেখে হাসে, তারপর তাদের পেরিয়ে হেঁটে যায়।

ট্রামে উঠে বিমান দেখল পিছন দিককার লম্বা সিটে প্রকাণ্ড চেহারার একটা লোক অনেক জায়গা নিয়ে বসে আছে। তার মুখে মদের গন্ধ, কড়া চোখে চার দিকের রোগা লোকগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। সে একটু সরে বসলে তার পাশে একজন রোগাটোগা লোকের জায়গা হয়ে যায়। কিন্তু কেউ বসতে সাহস করছে না।

চোখে চোখ পড়তেই বিমান একটু হাসে, ভরাট সুন্দর গলায় বলে, একটু সরে বসুন।

লোকটা কেঁপে ওঠে। প্রকাণ্ড লোকটা কুঁকড়ে সরে যায়। বিমান আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বসে। দাঁড়ানো লোকগুলো ঈর্ষার চোখে তার মাথার ব্যান্ডেজ লক্ষ করছে। এরা হয়তো আজ বাসায় ফিরে বউয়ের কাছে বিমানের আশ্চর্য সাহসের গল্প করবে।

শরীরটা ভাল নেই। বড় রাস্তা থেকে বিমান একটা রিকশা নিল। ঘরের সামনে রিকশাটা ছেড়ে দেওয়ার সময়ে দেখল রিকশার গায়ে একটা পোস্টার। মৃদু রাস্তার আলোতে বিমান পড়ল, তাতে লেখা, দিন আনি দিন খাই, বাংলা বন্ধে উপোস যাই।

ওধারে যে মিটিং হচ্ছে, এধারে তারই প্রতিবাদ।

এটা কী? বিমান জিজ্ঞেস করে।

লোকটা কপালের ঘাম মুছে বলে, কী জানি বাবু। একজন লাগিয়ে দিয়েছে, বলেছে ছিঁড়ে ফেললে মাথা নামিয়ে নেবে। কী লেখা আছে ওতে?

লেখা আছে, তুমি দিন আনে দিন খাও, বাংলা বন্ধে তুমি উপোস যাবে।

লোকটা হাসে।

তুমি বাংলা বন্ধ চাও না?

কী জানি। লোকটা উদাস গলায় বলে।

ওর কেবল মনে পড়ে গত বর্ষার কথা। বর্ষাকাল রোজগারের সময়। যখন কলকাতায় রিকশা ছাড়া যানবাহন নেই। আবার এক বছর পর আসবে সেই সময়। তখনই বিপ্লব। মাঝখানে বাবুমানুষেরা যা খুশি করে নিক, কিছু যায় আসে না।

রাতের খাবার নিয়ে এল শম্ভু। সঙ্গে সুবল।

ললিতার শরীর খারাপ। খাবার পাঠিয়ে দিলেন।

টিফিন ক্যারিয়ারটা ফেরত নিয়ে যাবে বলে ওরা বসে রইল। খাটের ওপর পাশাপাশি। মেঝেতে বসে নিঃশব্দে খেয়ে নিচ্ছিল বিমান।

হঠাৎ সুবল বলে, বালিগঞ্জের এ কে দত্তকে আপনি চেনেন?

বিমান মুখ ফেরাল, চিনি।

সুবল বলে, তার মেয়ে অপর্ণা, গান গায়, তাকে?

বিমান মাথা নাড়ে, চিনি, ছেলেবেলা থেকে।

আপনাদের সম্পর্কটা কী?

বিমান হাসে। তারপর তার সুন্দর ভরাট গলায় বলে, অপুর সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ছেলেবেলা থেকে। ওদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি একই গ্রামে, পাশাপাশি। ছেলেবেলায় আমি ভাল ছাত্র ছিলাম। সকলেই আশা করত আমি বড় কেউ একজন হয়ে উঠব। ওরা আমাকে তখন থেকে পছন্দ করে রেখেছিল।

আর, এখন? সুবল প্রশ্ন করে।

বিমান মাথা নাড়ে, এখন আর ওরা আমাকে পছন্দ করে না। কেননা, আমি তেমন কিছু হইনি। ওরা কথা ফেরত নিয়েছে। কিন্তু অপুর বোধবুদ্ধি পাকেনি, সে ছেলেবেলা থেকেই জানে একদিন আমি তার স্বামী হব। আমি তার চিরকালের খেলাঘরের পুতুলের বর। সে আমাকে ছাড়তে পারছে না। এখনও নেশার ঘোরে আমার কাছে চলে আসে। বুদ্ধি পাকলে আর আসবে না। ও এখনও বুঝতে পারছে না যে, আমি কিছু নই।

আর আপনি? আপনার কোনও দুর্বলতা নেই?

না। বিমান মাথা নাড়ে। আস্তে আস্তে বলে, আমি বিশেষ কোনও মেয়ের প্রতি দুর্বল নই। আমার দুর্বলতা সন্তানের প্রতি।

বিমান নিঃশব্দে খায়। তারপর হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলে, আমি অঙ্ক কষে বিয়ে করব। খুব ধীরেসুস্থে, ভেবেচিন্তে। তারপর পৃথিবীতে এমন একজন মানুষের জন্ম দেব, এমন একজন—

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে বিমান, কথা আটকে যায়! সময় নিয়ে সামলে ওঠে। ধীরে ধীরে বলে, এমন একজন, যে ঠিক আমার মতো নয়। সে আমার চেয়ে অনেক লম্বা-চওড়া হবে—অনেক সুপুরুষ—সে আমার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী হবে—চক্ষুষ্মান—সে নিজের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেখতে পাবে। সে জানবে সে কোথা থেকে এল—সে পৃথিবীতে কোনও দাবিদাওয়া নিয়ে আসবে না—সে দিয়ে যেতে আসবে—স্বভাবেই সে হবে ঐশ্বর্যবান। পৃথিবী এ-রকম একজন মানুষের জন্য বসে আছে।

কী করে আনবেন? সুবল জিজ্ঞেস করে।

ঠিক মতো বিয়ে করলে—দেখেশুনে, অঙ্ক কষে—

পারবেন? সুবল আর শম্ভু হাসে।

বিমান মাথা নাড়ে, কে জানে! আমি যদি না পারি তবে আমার ছেলে চেষ্টা করবে, কিংবা তার ছেলে। আমার বংশে এ-রকম চেষ্টা থেকে যাবে। ও-রকম একজন পৃথিবীতে আসতে আমাদের কত জন্ম কেটে যায়!

কার মতো হবে সেই ছেলে? কার্ল মার্ক্স, না স্বামী বিবেকানন্দ? সুবল জিজ্ঞেস করে।

কার্ল মার্ক্স, না স্বামী বিবেকানন্দ? কথাটা বুঝতে পারে না বিমান। কেবল বিড়বিড় করে। হ্যাঁ, কার্ল মার্ক্স, সেই দাড়িওয়ালা স্মিতমুখ সাধুসন্তের মতো লোকটা, যে বলছে যে, সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে, মানুষের সপক্ষে। যে-লোকটা উলটে দিচ্ছে পৃথিবীর দান! অদ্ভুত মনোবল লোকটার। হ্যাঁ, কার্ল মার্ক্সকে চেনে বিমান। কিংবা বিবেকানন্দ! শিকাগো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যে লোকটা কেবল গেরুয়া আলখাল্লা আর পাগড়ি মাথায় কাঠের প্যাকিং বাক্সে বসে রাত কাটাচ্ছে, তবু সোজা দাঁড়িয়ে বলছে, আমি তোমাদের ভ্রাতা, তোমরা আমার প্রিয় ভ্রাতা ও ভগিনী। আমি জীবকে ঈশ্বর বলিয়া জানি। ঈশ্বরলাভই প্রতিটি জীবনের লক্ষ্য।…কিন্তু কার মতো হবে সেই মানুষ, কে জানে? বিমান বিড়বিড় করে, কিন্তু থই পায় না। বস্তুত পৃথিবীর কোনও মানুষের সঙ্গেই তার সেই স্বপ্নের মানুষটির অবিকল মিল নেই।

টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ওরা চলে গেলে বিমান আপনমনে বলল, আজ রাতে আমি গীতা পড়ব। অনেককাল পড়ি না।

সুবল শম্ভুকে বলল, লোকটা বদ্ধ পাগল।

শম্ভু একটু চুপ থেকে বলে, এ কে দত্তকে তুই চিনলি কী করে?

বাড়ি পর্যন্ত গেছি মেয়েটাকে ‘ফলো’ করে। বাড়ির গেটে নামের ট্যাবলেট ছিল। সেই দেখে ফোন করেছিলাম।

কী হল?

ফোন করে বললাম যে, আপনার মেয়ে একজন খুব বাজে লোকের সঙ্গে মিশছে। ও-পাশ থেকে গমগম করে লোকটা জিজ্ঞেস করল, আপনি কে? আমার ফোন নম্বর জানলেন কী করে? বললাম, আমি সুবল মিত্র। বি-কম পাশ! ওই বাজে লোকটা যে পাড়ায় থাকে সেই পাড়াতেই থাকি, ফোন নম্বর পেয়েছি ডিরেক্টরিতে। লোকটা তবু ছাড়ে না, বলল ডিরেক্টরিতে পেলেন তো আমার নাম নিশ্চয়ই জানা ছিল। কোথা থেকে জানলেন? বলতে তো পারি না যে আপনার মেয়েকে ‘ফলো’ করেছিলাম, তাই অনেক কায়দা-কসরত করতে হল। বললাম, আপনি অত বড় ফার্মের মালিক, আপনাকে কে না চেনে? তখন বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। বিমান রক্ষিতকে আমি চিনি। ব্যাপারটা দেখব। বলে ফোন রেখে দিল।

সুবলের বুক জ্বালা করে ওঠে। সে যে বি কম পাশ এ-কথা কেন বলতে গেল? আজকাল কি বি কম পাশের কোনও দাম আছে? খামোকাই সে বলেছে কথাটা, বোকার মতো।

বিমান রক্ষিত বেঁচে গেল। কারণ, অপর্ণা দত্তর সঙ্গে ওর প্রেম নেই। থাকলে? থাকলে—সুবলের গা হাত শিরশির করে ওঠে। কেন থাকবে? ওই বড় বাড়ি, যার চূড়ায় পাথরের পরি, অনেকখানি জমিতে বাগান, সে-বাড়ির মেয়ে কেন প্রেম করবে কর্পোরেশনের জমাদারদের হাজিরাবাবুর সঙ্গে? কেন করবে?

ওদিকে রাতের গাড়িতেই কলকাতা ছেড়ে গেছে আদিত্য। ভোররাত্রে বিহারের এক জংশন স্টেশনে নেমেছে সে। বেশ শীত। অল্প কুয়াশা।

স্টেশনের বাইরে বাঁধানো চত্বরে কয়েকটা টাঙ্গা, রিকশার সারি দাঁড়িয়ে আছে। রাত-জাগা কিংবা ভোরে-ওঠা লোকেরা ছোট দোকান থেকে ভাঁড়ে চা খাচ্ছে।

চারটে বেজে দশ মিনিট। এত ভোরে আদিত্য কখনও ওঠে না। এখনও ঘোর অন্ধকার চারদিকে। কোথায় যাবে ঠিক ছিল না। ট্রেনে এক বুড়ো লোক সঙ্গী ছিল। তার কাছেই জেনেছে যে, এইখানে থাকার মতে একটা ডাকবাংলো আছে।

সে একটা ছোকরা টাঙ্গাওলাকে ডাকবাংলোর কথা বলে জিজ্ঞেস করল, কেতনা লেগা?

দু’ টাকা।

দূর। একটুখানি পথ।

চড়াই উতরাই আছে বাবু। পাহাড়ি জায়গা!

আদিত্য হাসল, আর যদি মাঝপথে টাঙ্গা থামিয়ে গলায় ছুরি দাও!

লোকটা হাসে।

টাঙ্গা দুলতে দুলতে চলে। একটা বিশাল উতরাই ভাঙতে থাকে।

আকাশের গভীর রং থেকে একটা আভা আসে। আদিত্য দেখে ডান দিকে একটা উপত্যকা নেমে গেছে। বাঁ দিকে দূরে পাহাড়। খোলা মাঠ বেয়ে আসছে বহু দূরের গন্ধমাখা বাতাস।

ভোরবেলা জায়গাটা সুন্দর দেখাবে। ভাবে আদিত্য।

এইখানে যদি আশ্রয় পায় তবে একা একা অনেক দিন থাকবে সে। অনেক দিন সে আর লোকালয়ে ফিরে যাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *