৩০
কিন্তু পরের দিন আপিস থেকে ফেরবার পথেও যেন দীপঙ্কর মন থেকে দূর করতে পারলে না ভাবনাটা। দাতারবাবু এত জায়গা থাকতে ওখানেই বা কী করতে গিয়েছিল। ওই ক্যাওড়াতলার শ্মশানের কাছে। অথচ একটা কথারও ভাল করে জবাব দিলে না। চোখগুলো কেমন জ্বলছে। যেন খানিকটা লাল। অন্ধকারে ভাল করে দেখা যায়নি অবশ্য। কিন্তু মনে হলো যেন কোথায় কী একটা গণ্ডগোল হয়েছে।
বউবাজারের সেই রাস্তাটা দিয়েই যেতে হবে।
দীপঙ্কর আপিস থেকে সকাল-সকাল বেরিয়েছিল। মিস্ মাইকেলের ঘরের ভেতরে তার বসবার জায়গা হয়েছে। নতুন চেয়ার নতুন টেবল। নতুন একটা আলমারি। ফাইলগুলো সব একে একে হিসেব করে সেকশন থেকে আনাতে হয়েছিল। রামলিঙ্গমবাবু অনেক দিনের লোক। বহুদিন নিজের দেশ ছেড়েছেন। একেবারে নিখুঁত বাঙলা বলেন। বললেন–সাহেবের পাশের ঘরে কাজ করতে একটু অসুবিধে হবে আপনার–
দীপঙ্কর বলেছিল–তা চাকরি যখন করতে এসেছি, তখন আর উপায় কী?
সত্যিই উপায় ছিল না দীপঙ্করের। চাকরি করতে এলে যখন যেখানে বসতে বলবে, যখন যে-কাজ করতে বলবে, তাই-ই করতে হবে। কিন্তু সেদিনও দীপঙ্কর জানতো না যে, সেই ঘরে বসবার সুযোগ না পেলে হয়ত ঘোষাল সাহেবের নজরেও পড়বার সুযোগ আসতো না। আর অমন করে রবিনসন সাহেবের প্রিয়পাত্রও হওয়া যেত না। রবিনসন সাহেবের মেমসাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতো না।
রবিনসন সাহেব একদিন জিজ্ঞেস করেছিল-সেন, আর ইউ এ বেঙ্গলী?
রবিনসন সাহেবের এ প্রশ্নের জবাব দিতে প্রথমে তার একটু দ্বিধা হয়েছিল। দীপঙ্কর সেন বাঙালী না তো কী?
বলেছিল–ইয়েস স্যার-হোয়াই?
রবিনসন সাহেব বলেছিল–না, মিসেস রবিনসন বলছিল তুমি বাঙ্গালী হতেই পারো না, তুমি নিশ্চয়ই সাউথ-ইন্ডিয়ান–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল-এ-কথা কেন মনে হলো তাঁর স্যার?
রবিনুস সাহেব হেসেছিল খুব। বলেছিল–না, তার মত, বেঙ্গলীজ ককনও ভালো হতে পারে না, অল বেঙ্গলীজ আর টেররিস্টস্-বাঙ্গালীরা কী-রকম করে ইংরেজদের গুলি করে মারছে–দেখছো তো?
এ নিয়ে সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করাও বিপজ্জনক। এ নিয়ে কথা উঠলে অনেক কথা বলতে হয়। সাহেব বলতো-দেখ সেন, তুমি নিশ্চয়ই রিয়েলইজ করবে ইংরেজরা তোমাদের ভালো করেছে, তোমাদের লক্ষ লক্ষ লোককে চাকরি দিয়েছে, রেলওয়ে করেছে, স্টীমশিপ করছে, ফেমিন বন্ধ করেছে–হোয়াট নট–
–কিন্তু স্যার পভার্টি তবু ঘোচেনি কারো!
রবিনসন সাহেব একটু অবাক হতো শুনে। বলতো-কেন, কোনও পভার্টি তো নেই ইন্ডিয়ায়, আমি তো কোনও পুওর পীপ দেখতে পাই না এখানে, আমি যখন চৌরঙ্গীতে যাই, ক্লাবে যাই, সব ওয়েল-ড্রেসড্ পীপল, আমার কথা বিশ্বাস না-হয় তো মিসেস রবিনসনকে জিজ্ঞেস কর, শি ইজ অব্ দি সেম্ ওপিনিয়ন–
সাহেব ছিল সত্যিই পাগলা মানুষ। সাহেব গরীব লোক দেখতে পেত না চৌরঙ্গীতে।
সাহেব বলতো–জানো, আমার চাপরাশী দ্বিজপদ, সে এইটিন রুপিজ পে পায়, জানো সে একজন মনি-লেনডার–ওকথা তুমি আমাকে বোঝাতে পারবে না সেন, পভার্টি নেই ইন্ডিয়ায়–কিন্তু তবু বেঙ্গলীজরা টেররিজম্ করছে! জানো মিস্টার বার্জকে গুলি করে মেরেছে, মিস্টার পেডিকে গুলি করে মেরেছে ওরা, কী হরি! ইনোসেনট পীপলদের খুন করে কী লাভ! তারা তো কোনও অন্যায় করেনি!
সাহেবের এ-সব কথা প্রতিবাদ করবার যোগ্য নয়। তবু সাহেব লোক ভালো। সাহেব একদিন পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিল মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে। জাপান-ট্র্যাফিকের ব্যাপারে রবিন্সন সাহেব নিয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। মিস্টার ঘোষালের নিন্দে দীপঙ্কর শুনে আসছে গোড়া থেকে। সবাই বলতো ঘোষাল সাহেব এক নম্বরের চশমখোর লোক ৷ শুয়োরের বাচ্চা বলে সবাই গালাগালি দিত। তখনও দেখেনি তাকে দীপঙ্কর।
গাঙ্গুলীবাবু বলতো–দেখবেন সেনবাবু, বড় হয়ে গেলে আপনিও যেন ঘোষাল সাহেবের মত হয়ে যাবেন না!
কিন্তু আশ্চর্য! ঘোষাল সাহেব হেসে কথা বললেন দীপঙ্করের সঙ্গে। মিছিমিছি লোকে নিন্দে করতো। বোধহয় বড় হলেই লোকে নিন্দে করে।
সাহেব বললে–কাম-অন্
তারপর একেবারে সোজা মিস্টার ঘোষালের ঘরে। মিস্টার ঘোষাল অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার। হোম-বোর্ড থেকে ডাইরেক্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
–লুক হিয়ার ঘোষাল–
কথা বলতে বলতে রবিন্সন সাহেব গিয়ে ঢুকলো ভেতরে। দীপঙ্কর একটু দ্বিধা করছিল। সাহেব বললে–কাম-ইন, কাম-ইন সেন–
সাহেবের কুকুর জিমিও চলেছে পেছন-পেছন। সে-ও ঘোষাল সাহেবের ঘরে ঢুকলো।
রবিন্সন সাহেব বললে–লুক হিয়ার ঘোষাল, দিস ইজ সেন, আমার জাপান ট্র্যাফিক ক্লার্ক, আমি একে আমার ঘরের ভেতরে এনেছি, তোমার সেকশনের মধ্যে সমস্ত মেস-আপ্ হয়ে আছে–একটা পেপার চাইলে খুঁজে পাওয়া যায় না। রেকর্ড সেকশন থেকে একটা চিঠি সেকশনে এসে পৌঁছত লাগে ফোর্টিন–ডেজ-ক্যান ইউ ইমাজিন?
তারপর দীপঙ্করের দিকে ফিরে সাহেব বললে–টেক ইওর সীট সেন, টেক ইওর সীট–
সাহেব না হয় পাগল, তা বলে দীপঙ্কর তো আর পাগল নয়। দীপঙ্কর তবু চেয়ারে বসলো না। মিস্টার ঘোষাল যেন কটমট্ করে চাইতে লাগলো দীপঙ্করের দিকে।
রবিন্সন সাহেবের কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য নেই। বলতে লাগলো–ইউ নো ঘোষাল, হোয়াই আই হ্যাঁভ্ সিলেকটেড্ সেন? কেন জানো?
ঘোষাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন–কেন?
রবিনসন সাহেব বললে–আমি ভেবেছিলাম হি মাস্ট বি এ সাউথ ইন্ডিয়ান, এখন সেন বলছে, হি ইজ এ বেঙ্গলী-তুমি জানো ঘোষাল বেঙ্গলীজ আর ডেঞ্জারাস পীপল, দে আর অল টেররিস্ট–
ঘোষাল সাহেব বললেন—জানি–
–অ্যানাদার থিং, ইজ দেয়ার এনি পভার্টি ইন ইন্ডিয়া? এখানে পভার্টি আছে? তোমার কী ওপিনিয়ন, ঘোষাল? ইউ মে নো বেটার দ্যান মী! তুমি ইন্ডিয়ান, তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালো করে বলতে পারবে! আমার এই জিমিকে যে দেখা-শোনা করে, তুমি জানো আমি তাকে কত দিই মান্থলি? টেন চিপস–আমি তাকে মাসে দশ টাকা দি–। না ঘোষাল, আমার মনে হয় ইন্ডিয়ায় পভার্টি নেই কোথাও! হয়ত ছিল ব্রিটিশদের আসবার আগে, এখন রেলওয়ে হয়েছে, টেলিগ্রাফস-টেলিফোন হয়েছে, কত লোক প্রোভাইডেড হচ্ছে-এখন পভার্টি কোথায়? আমরা রোটারি কাবে এই নিয়ে ডিসকাস করেছি–
ঘোষাল সাহেব এত কথার মাথা-মুণ্ড কিছুই এতক্ষণ বুঝতে পারছিলেন না। হঠাৎ এ প্রসঙ্গ যে কেন উঠলো, তা-ও তিনি বুঝতে পারলেন না। রবিনসন সাহেবের দিকে যখন চাইছিলেন, তখন হাসি-হাসি মুখ কিন্তু দীপঙ্করের দিকে নজর পড়তেই কেমন গম্ভীর হয়ে উঠছিলেন। কোথায় কে-একজন সামান্য ক্লার্ক-তাকে ঘরের মধ্যে এনে এ কী অবান্তর আলোচনা!
তারপর হঠাৎ রবিনসন সাহেবের কী খেয়াল হলো। বললে–আচ্ছা, ঘোষাল, ওয়ান থিং, তুমি বেঙ্গলী না সাউথ ইন্ডিয়ান?
ঘোষাল সাহেব যেন প্রশ্নটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন। তারপরে বললেন–আই কাম ফ্রম সাউথ ইন্ডিয়া
–নাউ, সী!
রবিনসন সাহেব দীপঙ্করের দিকে ফিরে বললে–এখন দেখ, ঘোষাল ইজ এ সাউথ ইন্ডিয়ান! আমি জানি, সাউথ ইন্ডিয়ানরা ভালো লোক।
তারপর হঠাৎ সামলে নিয়ে আবার বললে–কিন্তু, সেনও ভালো, জানো ঘোষাল, সেন যদিও বেঙ্গলী, তবু লোক ভালো, হি রাইটস্ গুড ড্রাফটস্-তুমি ওর কাজ দেখে স্যাটিসফায়েড় হবে
তারপর দাঁড়িয়ে উঠলো সাহেব। বললে–যাগে যে-কথা বলতে এসেছিলাম, আমাদের রোটারি ক্লাবে এ নিয়ে ডিসকাসন হয়ে গেছে হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক ইজ দেয়ার পভার্টি ইন ইন্ডিয়া? ইন্ডিয়ায় পভার্টি আছে?
ঘোষাল সাহেব বললে কোনও পভার্টি নেই, সবাই হ্যাপি, দে আর অল ভেরি হ্যাপি উইথ দি ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট-কারো কোনও দুঃখ-কষ্ট নেই
–নাউ সী!
রবিনসন সাহেব আবার নিজের ঘরে চলে এল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও এল। দীপঙ্করও চলে এল। হঠাৎ কী নিয়ে কথা উঠতে উঠতে কী-কথা উঠে গেল, আর সাক্ষী মানতে গেল সাহেব ঘোষাল সাহেবকে। আর আশ্চর্য মিস্টার ঘোষাল! মুখের সামনে মিথ্যে কথাটা বললে। বললে–ঘোষাল সাহেব সাউথ ইন্ডিয়ান। বললে–দেশে পভার্টি নেই। দারিদ্র্য নেই। সবাই সুখী, সবাই শান্তিতে আছে। আশ্চর্য, এর নামই কী চাকরি! এর নামই কি চাকরির উন্নতি!
গাঙ্গুলীবাবুর কাছেই শোনা ছিল মিস্টার ঘোষালের ইতিবৃত্ত।
গাঙ্গুলীবাবু বলেছিলেন–ঘোষাল সাহেবের ইতিহাস জানেন? কী করে চাকরি পেলে?
সে অনেক দিনের কথা। কিন্তু সবাই জানে না হেড আপিসে। কোথা থেকে হাজার কয়েক টাকা যোগাড় করে একদিন মিস্টার এন কে ঘোষাল লন্ডন শহরে গিয়ে হাজির। উদ্দেশ্য কিছু একটা হওয়া। মাস কয়েক গেল সিগারেট খাওয়া আর মদ খাওয়া শিখতে। আর ঈস্ট-এন্ডে রাত কাটিয়ে ফুর্তি করতে। পাড়াগাঁয়ের ছেলে হঠাৎ বিলেত গেলে যা হয়। সুট পরা, ইংরিজী বলা আর রাত্রে বাইরে কাটানোটা শিখতেই হাতের টাকা-পয়সা সব শেষ হয়ে গেল। তখন কোথায় যায়? কোথায় খায়? কী উপায়? ফেরবার জাহাজভাড়াই বা কোত্থেকে জোটে? ভিক্ষে করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই তখন। কিম্বা উপোস করে মরা। কয়েকজন ইন্ডিয়ান ছিল তখন লন্ডনে। তাদের কাছে হাত পাতলে ঘোষাল। কেউ দিলে না। শেষে প্রায় মারা যাবার অবস্থা। এমন সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্য ফিরে গেল ঘোষালের। তখন লন্ডনে রেলওয়ে স্ট্রাইক চলছে। তখন ১৯২৬ সাল। সমস্ত স্টাফ স্ট্রাইক করেছে। কেউ কাজ করতে চায় না। সেই সময় ঘোষাল গিয়ে হাজির হলো রেল-কোম্পানীর আপিসে।
তারা জিজ্ঞেস করলে–তুমি কে?
ঘোষাল বললে–আমি মিস্টার এন-কে-ঘোষাল, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট-আমি এখানে ব্যারিস্টারি পড়তে এসেছিলাম, হঠাৎ ইন্ডিয়ায় আমার বাবা মারা যাওয়ায় আমার টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেছে–আমি এখন হেলপলেস, আমি আপনাদের রেলওয়েতে স্ট্রাইক-পিরিয়ডে কাজ করতে চাই
বেশ। তাই হলো। স্ট্রাইক চললো অনেকদিন ধরে। ঘোষাল কাজ করলে প্রাণ দিয়ে জান দিয়ে। তারপর স্ট্রাইক যখন শেষ হয়ে গেল, তখন আবার চাকরি খতম। ঘোষাল আবার গিয়ে দাঁড়াল রেল-কোম্পানীর আপিসে।
তারা বললে–কী চাও–
ঘোষাল বললে–ইন্ডিয়ায় একটা রেলের চাকরি যদি দেন–আমি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট–
গাঙ্গুলীবাবু বলেছিলেন–তারা তখন একবার খুঁজেও দেখলে না, লোকটা সত্যিই গ্র্যাজুয়েট কিনা, স্ট্রাইক-পিরিয়ডে কাজ করেছে, তাইতেই খুশি হয়ে একেবারে অ্যাসিস্টান্ট অফিসার করে পাঠিয়ে দিলে এখানে আমাদের হাড়-মাস জ্বালাবার জন্যে–
যাহোক, ঘোষাল সাহেবের ঘর থেকে চলে আসার পরই চাপরাশী এসে ডাকলে দীপঙ্করকে।
বললে–ঘোষাল সাব সেলাম দিয়া হুজুর
–আমাকে?
দীপঙ্কর একটু অবাক হয়ে গেল। এই তো এখনি ঘোষাল সাহেবের ঘর থেকে এল। এরই মধ্যে আবার কী দরকার পড়লো।
ঘোষাল সাহেবের ঘরে যেতেই চেহারা দেখে কেমন অবাক হয়ে গেল। এ যেন একেবারে অন্য মানুষ! একবারে বদলে গেছে মুখের চেহারা!
–আপনি ক’দ্দিন চাকরি করছেন?
দীপঙ্কর বললে।
–রবিন্সন সাহেবের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা হলো কী করে?
সবই ইংরিজীতে প্রশ্ন। চোস্ত নির্ভুল বিলিতী ইংরিজী! খাস লন্ডন থেকে শেখা নিশ্চয়ই। যেমন উচ্চারণ তেমনি ইনটোনেশন। দীপঙ্কর সোজা হয়ে মিস্টার ঘোষালের চোখের ওপর চোখ রেখে কথাগুলোর উত্তর দিয়েছিল সেদিন। বাইরে পোশাক-পরিচ্ছদ, পরিষ্কার করে কামানো দাড়ি, নিপাট তেড়ি, সব কিছু কিন্তু যেন ছদ্মবেশ বলেই মনে হচ্ছিল। কারণ ভেতরের পশুটা যেন বাইরের ছদ্মবেশের আড়ালে পুরোপুরি ঢাকা পড়তে পারেনি। যেন তার দাঁত আর নখ দেখা গিয়েছিল। যে-লোকটা সাহেবকে তুষ্ট করবার জন্যে অনায়াসে নিজেকে সাউথ ইন্ডিয়ান বলে প্রচার করতে পারে, যে-লোকটা ওপরওয়ালাকে খুশি করবার জন্যে মুখ ফুটে বলতে পারে দেশে দারিদ্র্য নেই-তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার ঘৃণা হচ্ছিল সেদিন।
হঠাৎ ঘোষালের চিৎকারে গমগম্ করে উঠলো কামরা–
–গেট আউট্ গেট আউট, ক্লার্ক ক্লার্কের মতন থাকতে চেষ্টা করবেন, যান–
মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে সে-ই প্রথম সাক্ষাৎ। পরে জীবনে এই মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে তাকে বহুবার সাক্ষাৎ-সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। অদ্ভুত আশ্চর্য চরিত্র এ-মানুষটা। পরে আরেকবার মনে হয়েছিল–এত যে বদনাম তাদের, এত যে নিন্দে এ-সমস্তই বোধহয় এই রকম কয়েকজন লোকের জন্যে। ওই কে-জি-দাশবাবু, নৃপেনবাবু, মিস্টার ঘোষাল, রামলিঙ্গমবাবু–অন্তত এদের হাত থেকেও যে মুক্তি পেয়েছে দীপঙ্কর, এর জন্যেও রবিন্সন সাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। পরে দীপঙ্কর অনেক বড় হয়েছিল, কিন্তু সেদিন মিস্টার রবিনসনকে না পেলে হয়ত তাকে চাকরি ছেড়ে দেবার কথাও বিবেচনা করতে হতো।
সন্ধ্যেবেলা জাপান-ট্র্যাফিকের ফাইলগুলো আস্তে আস্তে গুছিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে উঠলো দীপঙ্কর। বাইরে আপিসের ভেতরে তখনও কয়েকজন কাজ করছে।
মিস মাইকেলও অনেকক্ষণ হলো চলে গেছে। মিস্টার রবিনসনও চলে গেছে। আর কোনও কাজ নেই তখন। আবার এক মিনিট বসলো দীপঙ্কর চুপ করে। সারাদিন ধরে কোনও কিছু ভাববার অবসরই ছিল না। এখন যেন সব ভাবনার পাহাড়গুলো মাথায় চেপে বসলো একসঙ্গে। এখন হয়ত একটা গাড়ি ছুটছে কলকাতার রাস্তা দিয়ে। গাড়িটা সোজা উত্তর দিক দিয়ে গিয়ে পড়লো একেবারে যশোর রোড-এ। তারপর সেই রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে অনেক রাত হবে। অনেক সময় গড়িয়ে যাবে। তারপর আবার একটা গাছের ছায়ার তলায় গিয়ে দাঁড়াবে গাড়িটা। সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটি মানুষ একাত্ম হবে সেখানে। দুটি আনন্দ মূর্তি গ্রহণ করবে একটি বিশ্বাসের স্পর্শে। একজন বলবে তার বিগত জীবনের কথা। আর একজন শুনে হাসবে। বলবে–কোথায় ছিলে তুমি, আর কোথায়ই বা ছিলাম আমি–অথচ দুজনে আজ এক হয়ে গেলাম–
একজন বলবে–কালীঘাটে যখন ছিলাম, তখন একটা বিচিত্র ব্যাপার দেখেছি–
— কী?
–বাড়ির উঠোনে একটা আমড়া গাছ ছিল, সেখানে একটা কাক দিনরাত একলা বসে থাকতো–জানো! পাশের বাড়ির একটা ছেলে ছিল তার বন্ধু। ভাত খেয়ে রোজ ভাত দিত কাকটাকে–
–কেন?
–কত মানুষের কত রকমের নেশা থাকে তো! এ-ও এক রকম নেশা!
–ছেলেটা কে?
–সে এমন কেউ না—
–তার কথা তোমার হঠাৎ মনে পড়লো যে?
–এমনি।
হঠাৎ চাপরাশীটা ঘরে ঢুকলো। বললে–সায়েব চলে গেছে হুজুর–
চাপরাশীটা ভেবেছে, এতক্ষণ বুঝি ঘোষাল সাহেবের জন্যেই বসে ছিল দীপঙ্কর। ঘোষাল সাহেবের জন্যে সে বসে থাকবে কেন! আবার দাঁড়িয়ে উঠলো দীপঙ্কর। সবাই যখন আপিস থেকে চলে যায়, তখনই যেন আপিসটা ভাল লাগে। মনে হয়, আপিসটা যেন আর আপিস নয়। যেন তখনই নিজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে পারা যায়। যেন সে তখন নিঃশব্দে মুখর হয়ে ওঠে নিজের মধ্যে। কিন্তু আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। দীপঙ্কর ঘর থেকে বেরোতেই চাপরাশীটা দরজায় তালা-চাবি লাগিয়ে দিলেন। তারপর গেটের সামনে যেতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগলো মুখে। আকাশে আবার চাঁদ উঠেছে।
তারপর আবার সেই রাস্তা।
এই তো কাছেই বউবাজার। একবার ঘুরে গেলে কী এমন ক্ষতি!
কিন্তু বউবাজারের সেই গলিটার ভেতরে যেতেই দেখলে লক্ষ্মীদির ঘরে আলো জ্বলছে। খোলা জানলা দিয়ে আলো ঠিকরে এসে পড়েছে বাইরের গলিতে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই থমকে যেতে হলো। একদল চীনে পরিবার-কিচির মিচির করছে। ঘরের চেহারা একেবারে বদলে গেছে। অন্তত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে জন কুড়ি একটা ঘরে।
কাকে কী প্রশ্ন করবে, কে উত্তর দেবে বোঝা গেল না। দাতারবাবুরা তাহলে এখান থেকে উঠে গেছে! এই ক’দিনের মধ্যেই এত পরিবর্তন হয়ে গেল? এই কদিন আসতে পারেনি দীপঙ্কর। সেই টাকার কথা বলতে এখানে এসেছিল। তারপর দীপঙ্কর চলে গেল থানায়।
–ইয়েস বাবু, কী চান আপনি?
–দাতারবাবুর ওয়াইফ এখানে থাকতো, তারা কোথায় গেল?
তারা কিছুই বলতে পারলে না। একজন পুরুষ উঠে এল বাইরে। ভাঙা ইংরিজীতে যা বললে তার মানে দাঁড়ায় এই যে, তারা এক মাস হলো এখানে এসেছে। আগে কারা এখানে ছিল, তা জানে না।
–আর কেউ জানে? আর কেউ বলতে পারে?
কে বলতে পারে, তার হদিস তারা বলতে পারলে না। বললে–আশে-পাশে জিজ্ঞেস করে দেখ, যদি কেউ খবর রাখে!
আশে-পাশে কাকেই বা চেনে দীপঙ্কর। এ-পাড়ায় আগে তো কারোর সঙ্গেই কথা বলেনি। কারোর সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় নেই। বেশির ভাগই এখানকার চীন থেকে আমদানি। প্রায় চীনে-পাড়াই বলা যায়। একটা ছেলে ছিল, যে লক্ষ্মীদির খাবার এনে দিত দোকান থেকে। ফাই-ফরমাশ খাটতে লক্ষ্মীদির। তাকেও যদি কোনও রকমে পাওয়া যেত।
–নো বাবু, আমরা জানি না।
হতাশ হয়েই বেরিয়ে আসছিল দীপঙ্কর। মনে পড়লো সেই আপিসটার কথা। যে আপিস থেকে প্রথম দিন লক্ষ্মীদির বাড়ির ঠিকানা পেয়েছিল।
গলির মুখে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ওপরে। দাতারবাবুর আপিসটা আবার খুলেছে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলে। দাতারবাবুর চেয়ারটা দেখা গেল না। দাতারবাবুর সেই বন্ধুর চেয়ারটাও দেখা গেল না।
–আচ্ছা, দাতারবাবুর আপিস এটা! মিস্টার এস এস দাতার? দুজন লোক ভেতরে ছিল। একজন জিজ্ঞেস করলে–আপনি কে? কোথা থেকে আসছেন?
–আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, তিনি আমার বিশেষ চেনা লোক। তিনি কোথায় বলতে পারেন?
ভদ্রলোক বললে–ভেতরে গলির মধ্যে একটা হলদে রং-এর একতলা বাড়ি, সেইখানেই তার ফ্যামিলি থাকে
–সেখানে নেই, আমি এখুনি দেখে এলাম।
–কী দরকার আপনার?
দীপঙ্কর বললে–কোনও দরকার নেই, অনেক দিন দেখা হয়নি, তাই দেখা করতে এলাম, আমি এই কাছেই আপিসে চাকরি করি–
মাফ করবেন, আমরা আর কোনও খবর বলতে পারবো না।
বলে ভদ্রলোক আবার নিজের কাজে মন দিলে। দীপঙ্কর আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বিভ্রান্ত হয়ে। কোথায় গেল লক্ষ্মীদি, কোথায় গেল দাতারবাবু! আবার রাস্তায় এসে দাঁড়াল দীপঙ্কর। সবাই যখন তার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে, তখন এই একটা আশ্রয়স্থলই যে ছিল তার। এই এখানে এলেই যা কিছু একটু আনন্দের খোরাক তার জন্যে মজুত ছিল। এটাও গেল। এটা সত্যিই চলে গেলে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যাবে যে সে! আর কী আছে! আর যেন দীপঙ্করের কিছুই নেই। শুধু বাড়ি আর আপিস, আপিস আর বাড়ি।
আবার হাঁটতে আরম্ভ করলে। হাঁটার মধ্যে একটা আনন্দ আছে যেন। তখন আর নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় না। মনে হয় সে তো চলেছে। গন্তব্যস্থানের উদ্দেশে তার যাত্রা বুঝি শেষ হয়নি। আর পৃথিবীতে এত রাস্তা আছে, এত পথ আছে যে, এক-জীবনে। হেঁটেও তা শেষ করা যায় না। গন্তব্যস্থান থাক আর না-ই থাক, পথ যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ গন্তব্যস্থানও একটা আছে। আর পথের যখন শেষ নেই তখন গন্তব্যস্থানেরও শেষ নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হেঁটে-হেঁটেই একটা জীবন অনায়াসে ফুরিয়ে দেওয়া যায়।
হাঁটতে হাঁটতে কোথায় কতদূর এসে পড়েছিল তারও খেয়াল ছিল না। হঠাৎ ভিড়ের আভাস পেতেই যেন সম্বিৎ ফিরে এল। অনেক লোকের ভিড়। অনেক চিৎকার। একেবারে হুড়মুড় করে ছুটে চলেছে সবাই। ভিড়ের স্রোত বয়ে চলেছে দীপঙ্করের দুপাশ দিয়ে।
একজনকে জিজ্ঞেস করতে খানিকটা বোঝা গেল। রবিঠাকুর লেকচার দিতে এসেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! বহুদিন আগে কালীঘাটের মন্দিরে এসেছিলেন তিনি। মা দেখিয়ে দিয়েছিল। দীপঙ্কর তখন ছোট। কিরণের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় পৈতে বিক্রি করে বেড়ায়, আর দু-এক পয়সা হাতে পেলে বেগুনী, আলুর চপ্ কিনে খায়।
খানিক পরে ব্যাপারটা বোঝা গেল। টাউন হল-এ মিটিং-এর ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু লোকের ভিড়ে জায়গা না-হওয়ায় সবাই মনুমেন্টের তলায় গিয়ে হাজির হচ্ছে। কী ভীষণ ভিড়! জীবনে এত ভিড় কখনও দেখেনি দীপঙ্কর। বহুদিন আগে সি আর দাশ মারা যাবার পরও এত লোক হয়নি। সমস্ত ধর্মতলাটা যেন ভর্তি হয়ে গেছে মানুষের মাথায়। দীপঙ্করও গিয়ে দাঁড়াল এক কোণে।
ক’দিন আগেই হিজলী জেলখানায় দুজন খুন হয়ে গিয়েছিল পুলিসের গুলিতে। সন্তোষ মিত্র আর তারকেশ্বর সেন। হিজলী জেলের ভেতরে তাদের গুলি করে মারা হয়েছে। যেদিন আলিপুরের সেসন জজ মিস্টার গারলিক আই-সি-এস-কে গুলি করে খুন করা হয়েছিল, সেদিন হিজলী জেলের ভেতর তারা আলো দিয়ে সাজিয়েছিল। তারপর আরও কোনও কথা নেই–গুলির ওপর গুলি চললো জেলের ভেতর। কলকাতায় এল তাদের দুজনের মৃতদেহ–মিছিল করে নিয়ে গিয়েছিল কেওড়াতলার শ্মশানে।
দীপঙ্কর দেখতে লাগলো ভিড়ের চেহারা। মা’র পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে সে। তবু সব কানে এল। বিচ্ছিন্ন বিপর্যস্ত দীপঙ্কর দূর থেকে দেখতেই লাগলো শুধু। কিন্তু এ কোন্ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! ছোটবেলাকার সেই চেহারার সঙ্গে তো এ মেলে না!
রবীন্দ্রনাথের দুপাশে দুজন দাঁড়িয়ে। একদিকে সুভাষ বোস, আর একদিকে জে এম সেনগুপ্ত। রবীন্দ্রনাথের নাকের কাছে অক্সিজেন ধরে আছেন।
রবীন্দ্রনাথ বলতে লাগলেন–প্রথমেই বলে রাখা ভাল, আমি রাষ্ট্রনেতা নই, আমার কর্মক্ষেত্র রাষ্ট্রিক আন্দোলনের বাইরে। কর্তৃপক্ষদের কৃত কোনও অন্যায় বা ত্রুটি নিয়ে সেটাকে আমাদের রাষ্ট্রিক খাতায় জমা করতে আমি বিশেষ আনন্দ পাইনে। এই যে হিজলীর গুলিচালনা ব্যাপারটা আজ আমাদের আলোচ্য বিষয়, তার শোচনীয় কাপুরুষতা ও পশুত্ব নিয়ে যা-কিছু আমার বলবার, সে কেবল অপমানিত মনুষ্যত্বের দিকে তাকিয়ে। এত বড় জনসভায় যোগ দেওয়া আমার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। মনের পক্ষে উদ্ভ্রান্তি জনক; কিন্তু যখন ডাক পড়ল, থাকতে পারলাম না। ডাক এল সেই পীড়িতদের কাছ থেকে, রক্ষক নামধারীরা যাদের কণ্ঠস্বরকে নরঘাতন নিষ্ঠুরতার দ্বারা চিরদিনের মত নীরব করে দিয়েছে…
প্রচুর হাততালি উঠলো। খানিকক্ষণ আর কোনও কথাই শোনা গেল না।
আবার অনেক পরে শোনা গেল–যেখানে নির্বিবেচক অপমান ও অপঘাতে পীড়িত হওয়া দেশের লোকের পক্ষে এত সহজ অথচ যেখানে যথোচিত বিচারের ও অন্যায় প্রতিকারের আশা এত বাধাগ্রস্ত, সেখানে প্রজারক্ষার দায়িত্ব যাঁদের উপরে, সেই সব শাসনকর্তার এবং তাঁদেরই আত্মীয় কুটুম্বদের শ্রেয়োবুদ্ধি কলুষিত হবেই এবং সেখানে ভদ্রজাতীয় রাষ্ট্রবিধির ভিত্তি জীর্ণ না হয়ে থাকতে পারে না।
আবার হাততালি পড়তে লাগল। কবি যেন এবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন 1
বলতে লাগলেন–প্রজাকে পীড়ন স্বীকার করে নিতে বাধ্য করা রাজার পক্ষে কঠিন না হতে পারে, কিন্তু বিধিদত্ত অধিকার নিয়ে প্রজার মন যখন স্বয়ং রাজাকে বিচার করে তখন তাকে নিরস্ত্র করতে পারে কোন্ শক্তি?
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ শুনতে লাগল। মনে হল, এ-কথা শোনবার অধিকারও যেন তার মা হরণ করে নিয়েছে। সবটা শোনাও হল না। তাড়াতাড়ি ভিড় থেকে সরে বেরিয়ে এল দীপঙ্কর। আজ এই লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ের মধ্যেও দীপঙ্কর যেন অপাক্তেয় হয়ে রইল। সে যেন অস্পৃশ্য এদের চোখে!
আবার হাঁটা। আবার তাকে হাঁটতে হবে। হাঁটাপথের শেষে যেন দীপঙ্কর তার গন্তব্যস্থানের নির্দেশটুকু পেয়ে যেতে পারে। পেছনে যেন এক মহাসমুদ্রের গর্জন সেদিকে চেয়ে দেখবারও অধিকার তার আর নেই। সমস্ত পৃথিবী থেকে যেন তার নির্বাসন হয়ে গেছে কাল থেকে! সে যেন শুধু জাপান-ট্র্যাফিক-এর কাজ করবার জন্যেই জন্মেছে পৃথিবীতে। সে যেন রবিনসন সাহেব আর ঘোষাল সাহেবের খবরদারি করবার জন্যেই বেঁচে আছে। আপিসের কথাটা মনে পড়তেই যেমন সমস্ত মনটা আবার বিষিয়ে উঠল।
তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে পৌঁছতেই মা এল। আজকে মা’কে যেন অনেক ভাল দেখাচ্ছে। মা যেন সুস্থ হয়েছে আরো। তবু মা’র দিকে দীপঙ্কর সেই আগেকার দৃষ্টি নিয়ে আর যেন চাইতে পারলে না। মা যেন সেই আগেকার মা আর নেই। দীপঙ্করের কাছেও যেন মা তার ছোট হয়ে গেছে। কেন তাকে দিয়ে অমন প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলে; কেন তাকে এমন বিচ্ছিন্ন করে দিলে পৃথিবী থেকে! মা’র ওপর যেমন তার কর্তব্য আছে, সকলের ওপরেই তো আছে! এই চারপাশের পৃথিবীও তো তার আপনার জন!
মা বললে–কী রে, অমন দেখাচ্ছে কেন রে তোকে? খুব খাটুনি গেছে আপিসে?
দীপঙ্কর শুধু বললে–না!
মা বললে–সাহেব বকেছে বুঝি তবে?
দীপঙ্করের কেমন রাগ হয়ে গেল। বললে–তুমি চুপ করো তো মা, সাহেব বকতে যাবে কেন মিছিমিছি?
মা আর কোনও কথা বললে না। দীপঙ্কর বিছানায় গিয়ে গড়িয়ে পড়ল। এ সংসারের কোনও কাজেই লাগবে না যখন সে, তখন তার তো আর কিছুই করবার নেই। সত্যিই তার যেন কিছু করবারই নেই। এবার থেকে সে শুধু সকাল থেকে আপিসে যাবে আর বিকেলবেলা বাড়ি এসে বিছানায় শুয়ে গড়াবে! এই উনিশের একের বি-র অন্ধকার সঙ্কীর্ণ পরিধিতে সে নিশ্বাস গ্রহণ করবে আর নিশ্বাস ত্যাগ করবে!
মা আবার ঘরে ঢুকলো। একটা চিঠি এগিয়ে দিয়ে বললে–এই নাও, তোমার একটা চিঠি এসেছে–
চিঠি! দীপঙ্কর তড়াক করে উঠে বসলো বিছানার ওপর। চিঠি তো তার আসে না বড় একটা চিঠি তো তাকে কেউ লেখবার নেই
দু’হাতে খামটার মুখ ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে দীপঙ্কর রুদ্ধনিশ্বাসে পড়তে লাগলো।
লক্ষ্মীদির চিঠি। লক্ষ্মীদি লিখেছে–
দীপু,
অনেকদিন তুমি আসোনি। আমি এখনও কলকাতায় আছি। তুমি বোধহয় বৌবাজারের ঠিকানায় গিয়ে আমাকে না-পেয়ে ফিরে গেছ। আমি এখন ওপরের ঠিকানায় আছি। তুমি চাকরি করছো বলেছিলে। সেই জন্যেই আমি আর তোমায় বিরক্ত করিনি। অনেকদিন কারোরই কোনও খবর পাই না। যদি সময় করতে পারো তো আমার ওপরের ঠিকানায় একবার এসো। তোমার সঙ্গে দেখা হলে খুশী হবো।
তোমার-লক্ষ্মীদি
মা বললে–কার চিঠি রে দীপু? আপিসের?
দীপঙ্কর তখনও এক মনে পড়ছে। একবার পড়া হয়ে গেছে, তখন আবার পড়ছে।
চন্নুনী ওদিক থেকে চিৎকার করে উঠলো-ও দিদি, এদিকে তোমার ডাল পুড়ে যাচ্ছে যে?
তাড়াতাড়ি মা চলে গেল। এতদিন পরে যেন মা আবার আশা পেয়েছে মনে মনে। এবার আর কোনও ভয় নেই। কোনও আশঙ্কা নেই। দীপুকে এবার সব ছোঁয়া থেকে মুক্ত করতে পেরেছে মা। দীপু মা’র পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে আর কোনওদিন স্বদেশী করবে না। এবার শুধু একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে যাবে মা এখান থেকে। তার আগে বিন্তির একটা বিয়ে দিতে পারলেই সব দায়-দায়িত্ব মিটে যায়।
পাশের বাড়িটা অন্ধকার হয়ে পড়ে আছে। অনেকদিন ভাড়াটে আসে না বলে অঘোর ভট্টাচার্যও কেমন যেন অধৈর্য হয়ে পড়েছে। বাড়ি ভাড়ার সাইনবোর্ডটা ঝুলছে। তবু লোক আসে না। কুড়ি টাকা মাত্র। এই বাড়ির জন্যে কুড়িটা টাকা! কুড়িটা টাকা মাসে মাসে কে গুনতে পারে! কার এত ক্ষমতা! কজন লোক আছে কলকাতায় কুড়ি টাকা ভাড়া দেবে মাসে!
যারা আসে তারা কেউ কেউ বলে–পনেরো টাকা হলে নিতে পারি, কুড়ি টাকা বড় বেশি মশাই।
অঘোর ভট্টাচার্য বলে-তবে পড়ে থাক্ ও মাছ নয় যে পচে গন্ধ বেরোবে হে দীপঙ্করের মা বলে-তা দিন না বাবা পনেরো টাকাতেই ভাড়া দিন না–
অঘোর ভট্টাচার্য রেগে যায়। বলে–কেন দেব? আমার কি টাকা সস্তা? আমার কি টাকার গাছ আছে বাড়িতে, নাড়া দেব আর ঝরে পড়বে মেয়ে,
এ-কথার উত্তর দেওয়া চলে না। তবু মনে হয়, বাড়িটায় লোক এলে যেন ভাল হয়। তারা বেশ ছিল। মেয়েটা আসতো, মাসীমা বলে ডাকতো। বিন্তিকে দেখতে এলে নিজের গয়না দিয়ে সাজিয়ে দিত। কোথায় যে চলে গেল সে-মেয়ে! বাপ বর্মা থেকে এসে হয়ত। নিয়ে গেছে।
–মা!
দীপঙ্কর এসে একেবারে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে। বললে–ভাত হয়েছে নাকি?
–কেন রে? এত সকাল-সকাল ভাত কেন রে? কোথায় যাবি?
–হ্যাঁ।
মা বললে–তা আপিস থেকে খেটেখুটে এই এলি, আবার এখুনি কোথায় যাবি; কেউ ডাকতে এসেছে বুঝি?
দীপঙ্কর বললে–না, কেউ ডাকতে আসেনি–
–কিছু বিশ্বাস নেই। যে-সব বন্ধু জুটেছে, সময় নেই অসময় নেই ডাকলেই হলো! দীপঙ্করের মুখ দিয়ে এর কোনও জবাব বেরোল না। বললে–তুমি ভাত দেবে তো দাও, নইলে না-খেয়েই যাবো, এসে খাবো’খন্।
–কেন রে, কী এমন জরুরী রাজকার্য এসে গেল এখন, যে এখুনি না গেলে নয়! এত রাতে আবার কোথায় বেরোবি!
–তা সব কথা তোমায় বলতে হবে নাকি?
মা যেন ছেলের কথায় একটু অবাক হয়ে গেল। এমন করে তো দীপু কখনও কথা বলে না। এমন সুরে তো আগে কখনও কথা বলেনি মা’র সঙ্গে! মা চেয়ে দেখলে ছেলের মুখের দিকে। কী একটা কথা বলতে গিয়েও যেন মা’র মুখ দিয়ে কথাটা বেরোল না। দীপুর মুখের দিকে চেয়ে মা’র হঠাৎ মনে হলো দীপু যেন এখন বড় হয়ে গেছে! এখন যেন দীপুকে আর আগেকার মত শাসন দিয়ে বেঁধে রাখা যাবে না। দীপুরও একটা নিজস্ব মত বলে জিনিস তৈরি হয়েছে। দীপু এখন সত্যিই সাবালক।
দীপু একেবারে জামা-টামা পরে তৈরি। সত্যি যেন সে বেরোবে বলে তৈরি হয়েই এসেছে। বললে–তাহলে একেবারে ফিরে এসেই খাবো। যদি আমার ফিরতে দেরি হয় তো আবার খাবার ঢাকা দিয়ে রেখো!
মা বললে–কিন্তু এত রাত্তিরে কোথায় যাবি তুই যে ফিরতে দেরি হবে?
–সে অনেক দূরে।
–তা এত রাত্তিরে অনেক দূরে না-গেলেই নয়! আবার বুঝি সেই স্বদেশী দলে মিশছিস্?
দীপঙ্কর এবার সত্যিই একটু রেগে গেল। বললে–মা, কাল তোমার না পা ছুঁয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি স্বদেশী আর করবো না, তবু তোমার বিশ্বাস হলো না?
মা বললে–আমি তোমার ভালোর জন্যেই বলি, নইলে আমার কী? আমি আর ক’দিন! একদিন তোমারও ছেলেপুলে হবে, সেদিন বুঝবে বাবা সন্তান কী জিনিস–
কথাটার দিকে কোনও কান দিলে না দীপঙ্কর। সেই লেখার কথাটা মনে পড়লো। উদ্দেশ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত চক্র ত্যাগ করিব না। পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগিনী, গৃহ, পরিবার কাহারও স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ থাকিব না। নেতার আদেশে চক্রের কাজ বিনা প্রতিবাদে করিয়া যাইব। যদি এই শপথ পালনে অক্ষম হই, তবে পিতা, মাতা, ব্ৰাহ্মণ ও সর্বদেশের দেশ-প্রেমিকদের অভিশাপ যেন আমাকে ভস্ম করিয়া ফেলে।
–দেখিস, যেন বেশি রাত করিস নি! তুই বাড়ি না-এলে আমার ঘুমই আসবে না!
এতদিন সংসারের কাছ থেকে কেবল বাধাই পেয়ে এসেছে দীপঙ্কর। প্রতি পদে পদে বাধা। কোনও কাজই স্বাধীনভাবে করতে দেয়নি মা। ছোটবেলা থেকে শুরু করে চিরকাল কেবল নিষেধ আর বারণ। নিষেধের আর বারণের বেড়াজালে ঘিরে রেখে দিয়েছে তাকে। তাই বোধহয় দীপঙ্কর শান্তি চেয়েও শান্তি পায়নি কোথাও। সংসারের কোথাও একটু আশ্রয় জোটেনি তার। আপিসে রবিন্সন সাহেবের আশ্রয়ের মধ্যে এসেও মিস্টার ঘোষালের দৌরাত্ম্য তাই বোধহয় তাকে বিচলিত করেছে। তাই-ই হয়ত বাইরে কিরণের সঙ্গে মিশে, কিরণের সাহচর্য পেয়ে কিরণকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই বোধহয় সতী তাকে সন্দেহ করে এসেছে। তাই বোধহয় লক্ষ্মীদি এতদিন তাকে দূরে ঠেলে রেখেছে!
সত্যিই অনেক দূর। পকেট থেকে চিঠিটা বার করে আবার ঠিকানাটা দেখে নিলে দীপঙ্কর। একেবারে বালিগঞ্জের শেষ প্রান্তে। গড়িয়াহাটার মোড় পর্যন্ত ট্রাম। তারপর পায়ে হাঁটা। একেবারে সোজা দক্ষিণ দিকে হেঁটে হেঁটে চললো দীপঙ্কর। দু’একটা ছাড়া ছাড়া বাড়ি। একেবারে অন্য চেহারা হয়ে গেছে এ-দিকটা। একটা লে হচ্ছে এদিকে। গাছে গাছে ভর্তি। লম্বা-লম্বা তার-গাছের জঙ্গল। কয়েকটা বাড়ি উঠেছে। এখনও জঙ্গল সাফ হয়নি ভাল করে। রাস্তা দিয়ে মোষের-গাড়ি চলেছে। সার সার। ক্রমে রাস্তার আলো কমে এল। কয়েকটা মুদিখানার দোকান। তারপর বাঁ দিকে জলা-জমি। জলের ওপর কচুরিপানার ভিড়।
চলতে চলতে একেবারে গড়িয়াহাটা-রেলের লেভেল-ক্রসিং-এর ওপর গিয়ে পড়লো। এখানে রেলের লাইনটা উত্তর দিক থেকে বেঁকে এসে সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেছে। গেটটা বন্ধ। বন্ধ লেভেল-ক্রসিংটার সামনে সার-সার মোষের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একটা লাল-আলো জ্বলছে গেটের গায়ে। পাশেই লম্বা নর্দমা। ব্যাং ডাকার শব্দ আসছে কানে। পাশেই হয়েছে একটা বুদ্ধমন্দির। মন্দিরের ভেতর থেকে পুজোর ঘণ্টার শব্দ আসছে ঢং-ঢং–
দীপঙ্কর চিনতে পারলে। ভূষণ দাঁড়িয়ে আছে। ভূষণ মালীর হাতে সবুজ হ্যান্ড সিগন্যাল ল্যাম্প। রেলের গুমটিওয়ালা। গেটম্যান।
মাঝে-মাঝে দু’একবার ভূষণ গেছে হেড়-আপিসে। অনেকদিনের গেটম্যান। কোনও অ্যাসিডেন্ট হলে সাক্ষী দিতে যায় ভূষণ। ঘোষাল সাহেবের কাছে গিয়ে দরবার করে। এদিকে বালিগঞ্জ ওয়েস্ট কেবিনের কেবিনম্যান করালীবাবুও চেনা লোক। আর স্টেশনমাস্টার মজুমদারবাবু আছে বালিগঞ্জ স্টেশনে।
হঠাৎ একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন হুশ হুশ করে চলে গেল। পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো থর থর করে। তারপর গেটটা খুলে গেল।
অন্ধকারের মধ্যেই মোষের গাড়িগুলো সার সার চলতে লাগলো। গলায় ঠুন-টুন ঘণ্টা বাজছে সব।
দীপঙ্করও চলতে লাগলো। এখন ভূষণের সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। ভূষণ দেখলেই সেলাম করবে। রবিনসন সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করবে, ঘোষাল সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করবে। অনেক বাজে কথা ব ব করে বলবে!
দীপঙ্কর গাড়িগুলোর পাশ কাটিয়ে একেবারে লাইনের ওপারে গিয়ে পড়লো। তারপর পকেট থেকে চিঠিটা আবার বার করলে। একটা আলোর তলায় ঠিকানাটা পড়ে নিয়ে আবার চিঠিটা পকেটে রেখে দিলে।
রাস্তার এক ভদ্রলোক বললে–কত নম্বর বললেন?
দীপঙ্কর বললে তিপ্পান্ন–
–ওই দিকে দেখুন, ওই বাড়িটা হলো পঞ্চাশ নম্বর–
এর পর আর খুঁজতে অসুবিধে হয়নি। অন্ধকারের মধ্যে একটা লম্বা তালগাছ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তারই তলায় বাড়িটা। পাশেই একটা মাঠ।
বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই লক্ষ্মীদি নিজে দরজা খুলে দিয়েছিল। অন্ধকারে প্রথমে একটু চিনতে কষ্ট হয়েছিল লক্ষ্মীদির। এই কদিনের মধ্যেই যেন বড় হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। তা ছাড়া প্যান্ট পরা দীপঙ্করকে লক্ষ্মীদি চিনবেই বা কেমন করে?
–তোমার চিঠি এই এখুনি পেলাম লক্ষ্মীদি!
লক্ষ্মীদি বললে–আয় ভেতরে আয়-লক্ষ্মীদি আগে আগে যাচ্ছিল, দীপঙ্কর তার পেছনে। গলিটা অন্ধকার, রাতও অনেক হয়েছে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–এখানে কবে এলে লক্ষ্মীদি? লক্ষ্মীদি যেতে যেতে বললে–প্রায় এক মাস হলো–
তারপর একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল দু’জনে। লক্ষ্মীদি যেন কী ভাবলে এক মুহূর্ত। একবার চেয়ে দেকলে দীপঙ্করের দিকে। একটা অস্পষ্ট আতঙ্ক যেন লক্ষ্মীদির মুখের চেহারায় ভেসে উঠলো। যেন কী বলতে গিয়েও মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না। দীপঙ্কর বড় কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে লক্ষ্মীদির গা ঘেঁষে। লক্ষ্মীদি থকে দাঁড়িয়েছে হয়ত কিছু বলবার জন্যে। কিন্তু কিছুতেই বুঝি বলতে পারছে না–
দীপঙ্কর একবার কী বলতে গেল—লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি বললে–চুপ, আস্তে–
দীপঙ্করের মনে হলো লক্ষ্মীদি যেন এক মহা সমস্যায় পড়েছে। চারিদিকে অন্ধকার। কাছাকাছি কোনও আলো নেই কোথাও। পাশেই উঠোনের ওপর একটা তালগাছ সোজা মাথা উঁচু করে আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। মাটির উঠোন। চারদিকে উঁচু পাঁচিল ঘেরা। পাঁচিলের ওপারে জলা-জায়গা থেকে বোধ হয় ব্যাঙ ডাকছে।
লক্ষ্মীদি গলা নিচু করে বললে–তুই এমন সময় এলি–?
দীপঙ্করও আস্তে আস্তে বললে–তোমার চিঠিটা যে আপিস থেকে এসে তবে পেলুম। তারপর মা বললে খেয়ে বেরোতে, তাই একেবারে খেয়ে বেরোলাম–
তারপর একটু থেমে বললে–তাহলে আমি না-হয় এখন যাই, পরে বেলাবেলি আসবো আবার একদিন–
–না দাঁড়া, তোকে তো আমিই আসতে বলেছিলুম।
–তা হোক, তার জন্যে তুমি ভেবো না, আমি আর একদিন আসবো।
তারপর হঠাৎ মনে পড়লো। বললে–কালকে হঠাৎ দাতারবাবুকে দেখলুম লক্ষ্মীদি, দাতারবাবু কি এখনও লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে? আমি ডাকলুম, উত্তর দিলেন না। কী, হয়েছে কী?
লক্ষ্মীদি সে-কথার উত্তর দিলে না। দীপঙ্করকে বললে–এদিকে আয়–
বলে অন্য একটা গলি দিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেল। এদিকটাও অন্ধকার লক্ষ্মীদি আগে আগে চলেছে। কেমন যেন সমস্ত জিনিসটা রহস্য মনে হলো দীপঙ্করের কাছে। কোথায় সেই বৌবাজারের চীনে পাড়া! আবার কোথায় এই গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং! এদিকটা ঢাকুরিয়া। এত জায়গা থাকতে এখানে এল কেন? সেই লক্ষ্মীদি, কত বড়লোকের মেয়ে! কত তার টাকা-পয়সা ছিল! ভুবনেশ্বরবাবুর কত টাকা! কত বড় জায়গায় বিয়ে হতো তার! সতীর মতই কত বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হতো! সতীর বিয়ের দিনেও যেমন গাড়ির সার দাঁড়িয়ে গিয়েছিল প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে, লক্ষ্মীদির বিয়েতেও তাই হতো। বড় বড় লোক দামী-দামী গাড়ি চড়ে আসতো। রায় বাহাদুর
নলিনী মজুমদার আসতো।
লক্ষ্মীদি একটা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। জানালাটা খোলা। ভেতরদিকে আঙুল দিয়ে দেখালে। বললে–ওই দ্যাখ–
দীপঙ্কর দেখলে। কালকে অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায়নি। ঘরে টিম টিম করে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। একটা তক্তপোশের ওপর শুয়ে রয়েছে দাতারবাবু। বড় অসহায় মুখটা। যেন অনেক যুদ্ধ করে অনেক আঘাত পাবার পর ক্লান্তিতে একটু ঘুমিয়েছে এখন। আবার যেন এখুনি জেগে উঠবে। দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ধরে দেখতে লাগলো। সেই শৌখিন মানুষটা! কোট প্যান্ট টাই পরে ট্যাক্সি চড়ে ভোরবেলা কালীঘাটের মন্দিরে আসতো–শুধু লক্ষ্মীদির একটা চিঠির জন্যে। সিগারেট খেত। কোথায় ভারতবর্ষের কোন্ পশ্চিম প্রান্তের কোন্ জনপদের অধিবাসী। অন্য আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাগ্যান্বেষণে সমুদ্র পেরিয়ে কোন্ সুদূর দেশে গিয়ে পৌঁছেছিল।
সেখানে দাতারবাবু প্রতিপত্তি করেছিল, প্রতিষ্ঠা করেছিল, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের কোন্ ষড়যন্ত্রের ফলে বুঝি লক্ষ্মীদির সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল কোন্ অশুভ মুহূর্তে। তখন অর্থ প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা সব কিছু নিরর্থক মনে হলো তার কাছে। একদিন লক্ষ্মীদির সঙ্গে সঙ্গে দাতারবাবুও চলে এল কলকাতায়। আর তারপর জীবনে নতুন করে যখন আবার প্রতিষ্ঠার স্বর্ণসূত্র আবিষ্কার করেছে, ঠিক সেই সময়ে কিনা এল পরিহাস। পৃথিবীর প্রথম ট্রেড-ডিপ্রেশন। আবার অর্থ গেল, প্রতিষ্ঠা গেল, প্রতিপত্তি গেল। আবার লুকিয়ে লুকিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে বেড়াতে হলো রাস্তায় রাস্তায়। দেনায় দুর্দশায় মাথার চুল পর্যন্ত বিক্রী হয়ে গেল দাতারবাবুর।
লক্ষ্মীদি সরে এল। বললে–আজকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি, মোটে ঘুম নেই চোখে-চেহারা কী হয়েছে দেখেছিস?
দীপঙ্কর বললে–আমি ভেবেছিলুম তোমার সেই ছ’হাজার টাকা যোগাড় করতে পারবো, সতী রাজীও হয়েছিল, কিন্তু সব গোলমাল হয়ে গেল–
তারপর দীপঙ্কর নিজের কথা বললে। কেমন করে কেটেছে এ ক’দিন। কেমন করে পুলিসের লক্-আপের মধ্যে থাকতে হয়েছিল। সতীর বিয়ে হবার দিন কেমন করে সে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তার শ্বশুরবাড়ি, প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে।
লক্ষ্মীদি সব মন দিয়ে শুনলে।
দীপঙ্কর বললে–তা ছাড়া, আরো অনেক সব এমন ঘটনা ঘটে গেল, যার জন্যে তোমার খবরই নিতে পারিনি। আর আপিসের কাজও রয়েছে–
লক্ষ্মীদি বললে–তোরও চেহারা অনেক বদলে গেছে–আর সেই আগেকার ছেলেমানুষটি নেই–
দীপঙ্কর হাসলো কথাটা শুনে। ছোটোবেলাকার কথা লক্ষ্মীদির তাহলে এখনও মনে আছে। সেই চকোলেট ঘুষ দেওয়া, সেই চড় মারা, সেই চা খেতে শেখা প্রথম লক্ষ্মীদির কাছে। লক্ষ্মীদি প্রথম দীপঙ্করকে চা খাইয়েছিল একদিন। সত্যি সেই সব দিনের কথা ভাবলে দীপঙ্কর এখনও হাসে। এখনও হাসি পায় তার। এ ঘটনার অনেকদিন পরে যখন লক্ষ্মীদির কথা মনে পড়তো তখন দীপঙ্করের আরো হাসি পেত। ছোটবেলায় গরীব ছিল বলেই দীপঙ্করের মনে হতো, যখন চাকরি হবে তার, প্রতিষ্ঠা হবে তার, তখন হয়ত কোনও দুঃখ থাকবে না আর। মনে হতো পৃথিবীর যত অর্থবান লোকই বুঝি সুখী। শুধু তারই অর্থ নেই, পরের দানের ওপর নির্ভর করতে হয় বলেই তার এত কষ্ট। কিন্তু লক্ষ্মীদি কেন তার বাবার এত ঐশ্বর্য ছেড়ে এমন করে দাতারবাবুর সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে? যার আছে সে কেন ত্যাগ করে? কিসের সন্ধানে ত্যাগ করে? যখন চাকরিতে আরো উন্নতি হয়েছে দীপঙ্করের, যখন সমস্ত আপিসসুদ্ধ লোক দীপঙ্করকে সম্মান দিয়ে খাতির দিয়ে অভ্যর্থনা করেছে, সেন সাহেবের এক কণা কৃপাদৃষ্টি পাবার জন্যে লালায়িত হয়েছে, তখনও দীপঙ্করের অন্তরের দারিদ্র্যের সন্ধান তারা রাখেনি। তারা দেখেছে সেন সাহেবের পদমর্যাদা, সেন সাহেবের মাইনে, সেন সাহেবের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ! কিন্তু তারা, আপিসের সেই কে-জি-দাশবাবু, সেই রামলিঙ্গমবাবু, গাঙ্গুলীবাবু, তারা কি জানতো, এক মুহূর্তের শান্তির জন্যে তাদের সেন সাহেব তার পদ-মর্যাদা, সম্মান, অর্থ, বিত্ত সমস্ত পদদলিত করতে পারে!
কিন্তু সে-কথা পরে হবে!
লক্ষ্মীদির জীবনেই বা কিসের অভাব ছিল? অর্থ? সে তো লক্ষ্মীদিকে কখনও আকর্ষণ করেনি! লক্ষ্মীদির রূপ ছিল, স্বাস্থ্য ছিল, গুণ ছিল, লেখাপড়া জানা ছিল, সবই ছিল। বাপের স্নেহ, বোনের ভালবাসাও ছিল। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও ছিল। আর ভুবনেশ্বরবাবু কী-ই না করতে পারতেন মেয়ের জন্যে! একদিন ভুবনেশ্বরবাবুর মৃত্যুর পর লক্ষ্মীদিই তো তার অর্ধেক সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হতো। ভুবনেশ্বরবাবু তো মেয়েদের মুখের দিকে চেয়েই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। ভেবেছিলেন বড় হয়ে মেয়েরা বাবার অবিমৃষ্যকারিতায় একদিন মনে মনে অপরাধ নেবে। তখন তিনি কী বলে নিজের কাজের জবাবদিহি করবেন?
বহুদিন পরে দীপঙ্কর একদিন লক্ষ্মীদিকে জিজ্ঞেস করেছিল-এ লোভ তুমি কেমন করে ছাড়লে লক্ষ্মীদি?
তখন লক্ষ্মীদি তার দুর্দশার শেষ সীমান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। রোজ খাবার সংস্থানও জোটে না। শহরের প্রান্তের একেবারে বাইরে ভাঙা-বাড়ির তলায় ময়লা শতছিন্ন কাপড়ে লজ্জা ঢাকতে হয় লক্ষ্মীদিকে। তবুও কখনও কাঁদতে দেখেনি, মুখ ভার করতে দেখেনি। ছেঁড়া-কাপড়টা সেলাই করে পরতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। সে এক চরম দুর্দশার দিন গেছে লক্ষ্মীদির!
–সত্যি বলো না, কেমন করে এত ঐশ্বর্যের লোভ ছাড়তে পারলে তুমি? তোমার অনুতাপ হয় না?
লক্ষ্মীদি বলেছিল–শম্ভুকে যদি তুই ভালো করে চিনতিস তাহলে আর একথা জিজ্ঞেস করতি না।
–কিন্তু দাতারবাবু তোমাকে কী দিয়েছে? শুধু অভাব আর অনটন ছাড়া আর কিছু তোমাকে দিয়েছে কোনওদিন?
লক্ষ্মীদি কথাটা শুনে হেসেছিল সেদিন। বলেছিল–তুই বাইরের লোক, তুই তো সে-কথা বলবিই। আমার বাবা দেখলেও ওই কথা বলতো!
–কিন্তু দাতারবাবু কি সত্যিই তোমায় ভালবাসে?
–ভালো না বাসলে, অত সন্দেহ করে কেন দেখতে পাস না, তোর সঙ্গে মিশি বলেও ওর সন্দেহ—জানিস্–
সে-এক অসহ্য অবস্থা দাতারবাবুর তখন। লক্ষ্মীদির সে-সব দিনকার কথা ভাবলেও আতঙ্ক হয় দীপঙ্করের। লক্ষ্মীদিকে দেখেই দীপঙ্কর-নিজেকে যেন নতুন করে চিনতে পেরেছিল। সমস্ত দুঃখের মধ্যে অবিচল থাকার শিক্ষা লক্ষ্মীদির কাছেই তো পেয়েছিল দীপঙ্কর। আর সতী? সমস্ত সুখের মধ্যেও অশান্তির সর্বগ্রাসী দাহনে জুলার যে সুখ–সে তো সতীর কাছেই জেনেছিল দীপঙ্কর।
কিন্তু সে-সব কথাও পরে হবে।
মনে আছে গড়িয়াহাটে লেভেল-ক্রসিং-এর ধারের সেই লক্ষ্মীদির বাড়িতে সেদিন লক্ষ্মীদির সব ব্যাপার শুনে দীপঙ্কর কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল। তখনও কিন্তু জানতে পারেনি কেমন করে বৌবাজারের চীনে-পাড়ার বাড়িটা থেকে আবার এখানে আসতে হলো, এই জলা-জমির ভাঙা বাড়িতে! হারিকেনের টি-টিমে আলোয় দাতারবাবুর ঘুমন্ত ক্লান্ত বিভ্রান্ত চেহারাটা দেখেই দীপঙ্কর খানিকক্ষণ নির্বাক হয়ে গিয়েছিল শুধু। আগের দিন শ্মশানের বাইরে গঙ্গার ঘাটের ধারে দাতারবাবুর পরিবর্তনটা অন্ধকারে ভালো বোঝা যায়নি। কিন্তু এখন যেন বড় মর্মান্তিক লাগলো দাতারবাবুকে দেখে। কেন এমন হলো?
লক্ষ্মীদি বললে–এদিকে আয়, সব বলছি, অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি এই একটু আগে
দীপঙ্কর বললে–কেন? দাতারবাবু ঘুমোয় না নাকি?
–না, ডাক্তার বলে, ঘুমোলেই ভাল হয়ে যাবে, যত ঘুমোবে তত ভাল। মোটে ঘুম পাড়াতে পারি না! সমস্তদিন-রাত কেবল কী যে ভাবে! ভেবে ভেবে ওইরকম মাথা গরম হয়ে গেছে–পাগলের মতন অবস্থা। আর একটু বাড়লে একেবারে পাগল হয়ে যাবে
–কী ভাবেন এত?
লক্ষ্মীদি বললে–ভাবে আমি আর ওকে ভালবাসি না। সেই যে ওর এক পার্টনার ছিল, যার সঙ্গে ব্যবসা করেছিল তাকে কেবল সন্দেহ করে!
–সে কী?
–হ্যাঁ, সে বেচারী অনেক কষ্টে ছ’হাজার টাকা ধার করে ওর সব দেনা মিটিয়ে দিয়েছে। বৌবাজারের যত বাড়িভাড়া বাকি ছিল সব শোধ করে দিয়েছে, এখন আর বলতে গেলে কোনও দেনাই নেই আমাদের, কিন্তু এই আর এক উপসর্গ এসে জুটেছে।
দীপঙ্কর বললে–কালকে রাত্তিরে তাই আমার যেন কেমন সন্দেহ হলো দাতারবাবুকে দেখে, সেই অত রাত্তিরে শ্মশানে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে আছেন, মনে হলো যেন জলের ভেতর নামছেন। আমি ডাকতেই পালিয়ে গেলেন
লক্ষ্মীদি বললে–সেইজন্যেই তো চোখে-চোখে রাখি কেবল, আত্মহত্যা করতে চায় কেবল
–কিন্তু তুমিই বা একলা সামলাবে কী করে?
–হঠাৎ একটু চোখের আড়াল হলেই বেরিয়ে যায়। কাল যখন বাড়ি এল, তখন অনেক রাত, রাত বোধ হয় একটা। আমারও ভয় হচ্ছিল খুব, কিছুতেই ঘুম আসে না। তারপরে ওই রেলের লেভেল-ক্রসিংটা, ওইটের জন্যেই বেশি ভয় করে
–কেন?
–অনেক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে যে ওখানে। লাইন পার হতে গিয়ে অনেকে ট্রেনের তলায় কাটা পড়েছে। মাথার তো ঠিক নেই, হয়ত কখন অন্যমনস্ক হয়ে রেল-লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটবে, আর ওদিক দিয়ে যেন ট্রেন আসছে তার হয়ত খেয়ালই থাকবে না
দীপঙ্কর বললে–তা এত জায়গা থাকতে এখানেই বা ঘর-ভাড়া নিতে গেলে কেন লক্ষ্মীদি? আর কোথাও ঘর পেলে না?
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু এত সস্তায় তো আর কোথাও বাড়ি পাওয়া যাবে না– মাত্র একখানা ঘর। আরও একখানা ঘর আছে বটে, কিন্তু সেটাকে ঠিক একখানা ঘর বলা চলে না। শুধু দেয়াল আছে চারদিকে। এই পর্যন্ত। সেই ঘরেই লক্ষ্মীদি বসালে দীপঙ্করকে। পাশের ঘরে দাতারবাবু অঘোরে ঘুমোচ্ছে। লক্ষ্মীদি একে-একে সব বলতে লাগলো ঘটনাগুলো।
লক্ষ্মীদি বললে–এইজন্যেই তোকে ডেকে পাঠিয়েছিলুম–
দীপঙ্কর বললে–আমার দ্বারা কী সাহায্য হবে তুমি বলো, তুমি যা বলবে আমি তাই-ই করতে পারি–আমি তো এখন আপিসে চাকরি করছি, আমার মাইনেও বেড়ে গেছে এই ক’দিনে।
লক্ষ্মীদি হঠাৎ বললে–এটা কী রে? তোর মানিব্যাগ?
মানিব্যাগটা কখন প্যান্টের পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল টের পায়নি দীপঙ্কর।
দীপঙ্কর বললে–ওতে মাত্র বারো আনা পয়সা আছে–
তারপর একটু থেমে বললে–তোমার টাকার দরকার থাকে তো বলো লক্ষ্মীদি আমি দিতে পারি টাকা–
লক্ষ্মীদি বললে–না, টাকার আমার দরকার নেই, সব দেয় অনন্ত–
–অনন্ত কে?
লক্ষ্মীদি বললে–শম্ভুর বন্ধু!
–ওই যাকে এত সন্দেহ করে ও–
–কেন, সন্দেহ করে কেন?
লক্ষ্মীদি হেসে বললে–কে জানে? অনন্ত না থাকলে আর কোথায় থাকতুম বল্ তো? অনন্ত না থাকলে আজকে তো ওকে জেলে যেতে হতো! অনন্তকে দোষ দেওয়া সহজ, কিন্তু অনন্ত ছিল বলেই তো আজকে টিকে আছি! সে-বেচারীর সংসারে কেউ নেই, কার জন্যে সে করতে যাবে এত? তার কিসের দায়? আমি তার কেউ-ই না, তবু এত করে কেন?
অনন্তর কথা বলতে বলতে লক্ষ্মীদি যেন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো।
–প্রায় তো বৌবাজার থেকে আমাদের পথে বসবার অবস্থা হয়েছিল! জানিস, কী অবস্থা তখন আমাদের! তখন আমার হাতে একটা পয়সা নেই যে কিছু কিনে খাই। গয়নাগুলো তখন একে একে সব বিক্রি হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা এসে বাড়ি ভাড়ার তাগাদা করে, আর শুধু হাতে ফিরে যায়। কদ্দিন আর শুধু হাতে ফিরে যাবে সে! তারপর, আমি একলা। সবাই কেমন সন্দেহ করতো। মারহাট্টি ভদ্রলোকের বাঙালী বউ, এটাই বা কী রকম! তবু ভাগ্যিস চীনেপাড়ায় ছিলুম তাই রক্ষে! আমি তো ভালো করেই জানতুম কাকাবাবু খুঁজবে আমাকে। আর একবার খবর পেলেই ধরে নিয়ে যাবে। তাই অনেক কষ্ট করেও সব মুখ বুজে সহ্য করতুম–
লক্ষ্মীদি তারপর হঠাৎ বললে–তোর খাওয়া হয়ে গেছে?
দীপঙ্কর বললে–আমি খেয়ে তবে এসেছি–এখুনি বললুম তো–
–আমার এখনও খাওয়া হয়নি। অনন্ত এলে তবে এক সঙ্গে খাবো।
–অনন্তবাবুও কি তোমার এখানে খায় নাকি?
–আমার এখানে খাবে না তো কোথায় খাবে? আমার এখানেই খায়, এখানেই শোয়। আর এখানে ছাড়া তার তো খাবার-থাকবার জায়গা নেই আর! তারও তো কেউ নেই কলকাতায়! তাছাড়া এই বাড়ি-ভাড়া, এই এখানকার সংসার খরচ, এ-সব সে-ই তো চালাচ্ছে–! সেই জন্যেই তো শম্ভুর যত রাগ তার ওপরে–
দীপঙ্কর কথাগুলো শুনছিল। কিছু মন্তব্য করলো না। একদিন শুধু দেখেছিল ভদ্রলোককে সেই বৌবাজারের ঘরে।
–কিন্তু লক্ষ্মীদি—
–কী বল?
দীপঙ্কর বলবে না মনে করেও একবার জিজ্ঞেস করলে-অনন্তবাবু কী করেন?
লক্ষ্মীদি বললে–কোত্থেকে অনেক ধার-টার যোগাড় করে একলা আমাদের এই দেনা-টেনা সব শোধ করে দিয়েছে-এখন সারাদিন ওই খুচরো টুকি-টাকি উপায় করে, অর্ডার সাপ্লাই করে। শম্ভুর ছোটবেলার বন্ধু ও
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–এখানেই এসে খাবে আজ?
–হ্যাঁ, রোজই খায়, এইটেই তো তার বাড়ি।
–তা এখুনি আসবে নাকি?
–এখনও আসতে পারে, এক ঘণ্টা দুঘণ্টা পরেও আসতে পারে। সে এলে এক সঙ্গে দু’জনে খাবো। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হয় কিনা। আজ-কাল ক্যাপিটেল না থাকলে ব্যবসা করা কী যে শক্ত তা জানবি কী করে তুই? অনন্ত বলে, বাজার নাকি ভীষণ খারাপ। ধারে জিনিস দেবার জন্যে তোক খোশামোদ করছে, কিন্তু কিনবে কে। কেনবার লোকই নেই!
–তাহলে আমি উঠি লক্ষ্মীদি, আমাকে তো আবার অনেক দূর যেতে হবে।
–উঠবি কেন? এত তোর তাড়া কিসের? অনন্ত আসুক আগে, অনন্ত এলে তারপর না হয় যাস–আর কী খবর বল, তোদের পাড়ার মাসীমা কেমন আছে, আর সেই মেয়েটা? বিন্তি
কী নাম? তার বিয়ে হয়েছে?
অনেক কথা গড়গড় করে জিজ্ঞেস করলে লক্ষ্মীদি। অনেক খবর নিলে। সতীর কী রকম বিয়ে হলো, নেমন্তন্ন করেছিল কিনা, শ্বশুরবাড়ি কোথায়! অনেক কথা সব!
হঠাৎ দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা লক্ষ্মীদি–
–কী?
–ওকে তুমি এ-বাড়িতে শুতে দাও কেন?
–কাকে?
–ওই অনন্তবাবুকে! হাজার বন্ধু হলেও, এক-বাড়িতে শোয়া কি ভালো! দাতারবাবুর অসুখ, আর অসুখটা তো ওই জন্যেই। ওই অনন্তবাবুর জন্যেই! অনন্তবাবুকে তুমি অন্য বাড়িতে শুতে বলতে পারো না? এখানে খেলে দোষ নেই কিন্তু শোওয়ার দরকারটা কী?
তারপর একটু থেমে বললে–কোথায় শোয় অনন্তবাবু? কোন্ ঘরে?
–এই তক্তপোশের ওপর। এটা তো অনন্তরই ঘর!
–আর তুমি? তুমি কোথায় শোও?
হঠাৎ বাইরে কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো। লক্ষ্মীদি উঠলো। বললে–ওই অনন্ত এসেছে–
লক্ষ্মীদি দরজা খুলতে যাচ্ছিল।
দীপঙ্কর বললে–তাহলে আমিও আসি এখন, অনেক রাত হয়ে গেল–
–না বোস, অনন্তর সঙ্গে দেখা করে যা। অনন্তর সঙ্গে দেখা করবার জন্যেই তো তোকে ডেকে পাঠিয়েছি।
বলে লক্ষ্মীদি গলি দিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতে গেল। রাত অনেক হয়েছে। আর বেশিক্ষণ দেরি করা চলে না। সেদিন দীপঙ্করের মনে হয়েছিল লক্ষ্মীদি যেন বড় অন্যায় করছে। শুধু অন্যায় নয়, অপব্যয় করছে নিজেকে। অথচ লক্ষ্মীদির যা বুদ্ধি, তাতে যেন এমনভাবে এই অবজ্ঞাত জীবন যাপন করা তার পক্ষে অন্যায়। এমন করে এই অন্ধকার শহরের প্রান্তে একলা বিচ্ছিন্ন জীবন যেন লক্ষ্মীদির মানায় না। লক্ষ্মীদি এর চেয়েও কোনও বড়, কোনও মহৎ জীবনের জন্যেই যেন তৈরি হয়েছিল। যা হতে পারতো সে আলাদা কথা, কিন্তু এত দারিদ্র্যের মধ্যেও লক্ষ্মীদি যে মুখের হাসি কী করে অম্লান রাখতে পেরেছে, তাইতেই দীপঙ্কর সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল।
আর সেই অনন্তবাবু? অনন্তরাও ভাবে আর শিবশঙ্কু দাতার–দু’জনেই বহুদিনকার বন্ধু। পরে দীপঙ্কর শুনেছিল–দুজনেই এক হোটেলে থাকতো। এক সঙ্গে ব্যবসা করতো। কোম্পানীর দায়-দায়িত্ব সমস্ত ছিল দাতারবাবুর। কিন্তু শেয়ার দু’জনের সমান সমান। অনন্তরাওয়ের ব্যবসা খুচরো ব্যবসা। খুচরো কারবারের মালিক। অর্ডার সাপ্লাই করে অল্প মূলধন নিয়ে। হঠাৎ পাঁচশো মণ সরষের তেল সাপ্লাই করতে হবে তাতেও আছে, আবার এক টন ছোলা সাপ্লাই করতে হবে ফোর্ট উইলিয়ামে তাতেও আছে। হাতে যা কাজ আসবে তাতেই রাজী। আর দাতারবাবুর ছিল ইস্পোর্ট এক্সপোর্টের কারবার। বহুদিন আগে একদিন কলকাতাকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের বাণিজ্যের চাকা ঘুরতে আরম্ভ করেছিল। একদিন রাজপুতানা থেকে এসেছিল মারোয়াড়িরা, পাঞ্জাব থেকে এসেছিল শিখ, ইংলন্ড থেকে এসেছিল ইংরেজরা, চায়না থেকে সেছিল চীনেম্যান, আর হিন্দুস্তানী, বেহারী, পার্শি, ভোরা মুসলমান। সকলের জন্যে কলকাতার রাজধানীতে নিরঙ্কুশ নিমন্ত্রণের স্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল। বাঙালীরা সরকারী চাকরি করেছে, সওদাগরী আপিসে গোলামী করেছে, হাতের লেখা ভাল করেছে, টাইপ-রাইটিং শিখেছে, স্কুল মাস্টারি করেছে, কিন্তু বড়বাজার অঞ্চলটা রেখে দিয়েছিল ওদের জন্যে ভোলা রাস্তা। সেখানেই একদিন প্রথম এসেছিল অনন্তরাও ভাবে। আর তারপর এসেছিল বর্মা ফেরত দাতারবাবু।
উনিশ শো তিরিশ বত্রিশ তেত্রিশের সেই বাঙলা দেশ। বাঙলা দেশে তখন আগুন নিয়ে খেলা চলেছে। মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন, মদের দোকানে পিকেটিং, বিলিতি কাপড় বয়কট, সাইমন-কমিশন রিপোর্ট, লর্ড আরউইনের ডোমিনিয়ন স্টেটাসের প্রস্তাব আর ওদিকে পৃথিবীজোড়া ট্রেড় ডিপ্রেশন। তিন-রঙা কংগ্রেসের ফ্ল্যাগ তখন সর্বত্র উড়ছে। রাস্তায় রাস্তায় ভলান্টিয়ারদের মিছিল, মিছিলের সঙ্গে বাড়ির মেয়েরা সেই প্রথম যোগ দিলে। বড়বাজারে মারোয়াড়িরা মোটা চাঁদা দেয় কংগ্রেসকে। সেই বড়বাজারেও তখন মালের কেনা বেচা কমে গেছে। অনেকে ফিরে গেছে যোধপুর, জয়পুর, বিকানীরে। যারা যেতে পারেনি, যাদের যাবার জায়গা নেই, তারা তখনও কেউ কেউ টিকে আছে। এই দাতারবাবু আর অন্ত রাও ভাবের মত কয়েকজন।
অনন্তবাবু ঘরে ঢুকলো। আর তার আগে আগে লক্ষ্মীদি।
লক্ষ্মীদি ভেতরে এসে বললে–এই সেই দীপঙ্কর, একে তো দেখেছ তুমি বৌবাজারে?
অনন্তবাবুও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ। অন্তত চেহারা দেখে তাই-ই মনে হলো দীপঙ্করের। দাতারবাবুর সঙ্গে একদিন দেখেছিল বৌবাজারের সেই চীনেপাড়ার বাড়িতে।
–আপনি রেলওয়েতে চাকরি করেন?
দীপঙ্কর বললো—হ্যাঁ–
–ছোট চাকরি না বড় চাকরি?
দীপঙ্কর এ-কথার উত্তর দিলে না। কথাটার মধ্যে কোথায় যেন একটা অবজ্ঞার হুল লুকিয়ে ছিল। লোকটাকে সেই প্রথম দিনেই ভাল লাগেনি দীপঙ্করের। দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–আমি এবার যাই লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদি বললে–সে কি রে? যে-কাজটার জন্যে ডাকা সেইটেই তো হলো না। দীপঙ্কর শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াল। বললে–অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই, তা ছাড়া আমি আসতাম না তোমার কাছে, নেহাত তুমি চিঠি দিয়েছিলে বলেই এসেছিলাম আজ–
–কিন্তু আমার একটা উপকার করবি না?
–উপকার? দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। এখন তো অনন্তবাবুই সব উপকার করছে লক্ষ্মীদির। ছ’হাজার টাকার দেনা শোধ করে দিয়েছে, বাড়িভাড়া সব চুকিয়ে দিয়েছে! এখন আর কী দরকার দীপঙ্করকে!
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। ছোট ঘর, অনন্তবাবু নিজের জামা-টামা ছাড়বে। অত ছোট ঘরে এত লোক ধরে না একসঙ্গে। আর তা ছাড়া লক্ষ্মীদি এই লোকটার সঙ্গে এত মেলা-মেশাই বা করে কেন? দাতারবাবুর এই অসুখ, তার কথা তো কই ভাবছে না এরা!
দীপঙ্কর বাইরে আসতে লক্ষ্মীদিও এল সঙ্গে সঙ্গে।
দীপঙ্কর পেছন ফিরে বললে–এখন আমাকে কী জন্যে ডেকেছিলে বলো!
লক্ষ্মীদি বললে–তুই রাগ করছিস কেন? অনন্তর কথার উত্তর দিলি না যে? কী হয়েছে তোর?
সত্যিই দীপঙ্করের আত্মসম্মানে যেন সেদিন ঘা লেগেছিল। বললে–তুমি কিছু মনে কোরো না লক্ষ্মীদি, আমি যেখানে যার সঙ্গেই মিশতে গেছি, যাকেই প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে গেছি, যারই উপকার করতে গেছি, সেখানেই একটা-না-একটা বাধা এসেছে–একটা গণ্ডগোল হয়েছে। এ আমার ভাগ্যেরই দোষ! নইলে আজ তো আমি তোমার সঙ্গে দেখা করবো বলেই, তোমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কাটাবো বলেই একেবারে মা’কে বলে খাওয়া-দাওয়া সেরে এসেছিলাম–
–তা বোস্ না, গল্প কর না তুই! কে তোকে চলে যেতে বলেছে?
অন্ধকার গলির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল তখন দু’জনে। বড় কাছাকাছি, বড় মুখো মুখি, বড় সামনা-সামনি। লক্ষ্মীদি একেবারে তার সামনে বুকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল।
লক্ষ্মীদি বললে–বুঝেছি, তুই কেন চলে যাচ্ছিস! অনন্ত তোকে যদি কিছু বলেই থাকে, আমি তো আছি, আমি তোর কী করেছি? আমার ওপর তুই রাগ করছিস কেন?
দীপঙ্কর বললে–আগে বলো, ও লোকটা কে? ও-লোকটার সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক?
–হঠাৎ তুই একথা জিজ্ঞেস করছিস যে?
–না, তোমাকে বলতেই হবে, ওই অনন্তবাবুর কিসের স্বার্থ যে তোমাদের এত সাহায্য করে? এত টাকা খরচ করে কেন তোমাদের জন্যে? আর তুমিই বা ওর সঙ্গে এক বাড়িতে থাকো কেন?
লক্ষ্মীদি বললে–না রে, তুই যা ভাবছিস তা নয়! এতদিনেও তুই আমায় চিনলি না?
দীপঙ্কর বললে–এখন বুঝতে পারছি দাতারবাবু কেন পাগল হয়েছে! তোমরাই দুজনে মিলে দাতারবাবুকে পাগল করে তুলেছ, তুমি আর ওই তোমার অনন্তবাবু
লক্ষ্মীদি আরো কাছে সরে এল। বললে–একটু আস্তে কথা বল, লক্ষ্মীটি–অনেক কষ্টে ওকে ঘুম পাড়িয়েছি, আবার জেগে উঠবে। তুই কিছু মনে করিসনি, অনন্তই তোকে ডাকতে বলেছিল।
–আমাকে? অনন্তবাবু আমাকে ডাকতে বলেছিল?
–হ্যাঁ, তুই যদি অনন্তকে একটা কাজ করে দিতে পারিস তোদের রেলে তো আমারও উপকার হয়, শম্ভুরও উপকার হয়।
দীপঙ্কর কিছু উত্তর দেবার আগেই অনন্তবাবু এসে দাঁড়াল।
অনন্তবাবু বললে–কী কথা হচ্ছে তোমাদের?
লক্ষ্মীদি বললে–এই যে দীপুকে নিয়ে যাচ্ছি, চলো–
বলে দীপঙ্করের হাত ধরে টানতে লাগলো। বললে–আয় না, একটুখানি বসে অনন্তর কথাগুলো শুনে যা না, যদি তুই কিছু করতে পারিস আমাদের জন্যে, দেখ না–
দীপঙ্কর অনিচ্ছে সত্ত্বেও আবার ঘরের ভেতরে গেল। লক্ষ্মীদি বসলো, অনন্তবাবু বসলো, দীপঙ্করও বসলো। অনন্তবাবু খুচরো অর্ডার সাপ্লাই করে মাঝে মাঝে রেলওয়েতে। সম্প্রতি একটা তিন হাজার টাকার কাজ ধরবার চেষ্টায় আছে। সেইটের জন্যে অনন্তবাবু চেষ্টা করছে। অনেকদিন ঘোরাঘুরি করেছে অনন্তবাবু, কাজটা পেলে পাঁচশো টাকার মত নেট প্রফিট থাকে–খরচ-খরচা বাদ দিয়ে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে কিসের কাজ? কোন ডিপার্টমেন্ট?
অনন্তবাবু বললে–আপনাদের আপিসে মিস্টার এন-কে-ঘোষালের সঙ্গে আপনার জানাশোনা আছে?
দীপঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেল মিস্টার ঘোষালের নাম শুনে। বললে–কেন? তার সঙ্গে আপনার কী দরকার?
অনন্তবাবু বললে–তিনিই তো যত গণ্ডগোল করছেন–কিসের গণ্ডগোল?
অনন্তবাবু বললে–অনেক টাকা চাইছে! অন্তত তিন শো টাকা চাই-ই তার, অথচ তিন শো টাকা দিলে আমার কী-ই বা থাকবে! আমি দুশো পর্যন্ত দিতে রাজী। আপনার সঙ্গে বেশ জানাশোনা আছে?
দীপঙ্কর বললে–অর্ডারটা স্যাংশন করবে কে?
অনন্তবাবু বললে–রবিনসন সাহেব!
সেদিন সেই অন্ধকার ঢাকুরিয়ার সেই ঘরটাতে বসে দীপঙ্কর যেন বজ্রাহত হয়েছিল অনন্তবাবুর কথা শুনে। বাইরে থেকে যে আপিসে প্রতিদিন সে যাচ্ছে, প্রতিদিন যে আপিসে অ্যাটেন্ডেন্স-রেজিস্ট্রারে সই করে দৈনন্দিন কাজ করে চলেছে, সেখানকার ভেতরের ব্যাপার কোনোদিন তো কানে আসেনি তার। সোজাসুজি কাজ করে যায় কলমের খোঁচায়। নোট লেখে, ড্রাফট পাঠায়, স্টেটমেন্ট তৈরি করে, কিন্তু তার পেছনে যে এত রহস্য তা তো কখনও জানতো না দীপঙ্কর! কোথাকার কোন বোর্ড থেকে টেলিগ্রাম আসে, আসে পাবলিকের কাছ থেকে। হেড-আপিস থেকে অর্ডার গেলে তবে ডিভিশন থেকে সে হুকুমের তামিল হয়। বাইরে থেকে গেটে গুর্খা দারোয়ান, আর যত কিছু এস্টাবলিশমেন্টের আইনের কড়াকড়ি! কিন্তু এতদিন কাজ করছে দীপঙ্কর এ-সব তো জানা ছিল না। স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সে। এত ফুটো সেখানে? এত ফাঁক? এত ফাঁকি?
লক্ষ্মীদি এতক্ষণ সব শুনছিল। বললো রে দীপু, কী বলিস্ তুই? পারবি কিছু করতে? চিনিস তুই মিস্টার ঘোষালকে?
অনন্তবাবু বললে–আমি দুশো টাকা পর্যন্ত দিতে পারি–কিন্তু তিনশো টাকা দিলে আমার কী থাকবে–সেইটে বলুন!
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে–তা রবিনসন সাহেব যখন স্যাংশন করবার মালিক, তখন মিস্টার ঘোষালের কাছে যাবার দরকার কী আপনার?
অনন্তবাবু বললে–মিস্টার ঘোষালই যে রবিনসন সাহেবের ডান হাত–মিস্টার ঘোষালকে যে রবিনসন সাহেব খুব বিশ্বাস করে
দীপঙ্কর বললে–আপনি রবিনসন সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলেন কখনও?
অনন্তবাবু বললেন, আমি একজন এলিস্টেড সাপ্লায়ার ওদের। কন্ট্রোলার অব্ স্টোরসের আপিসে আমি নাম রেজিস্ট্রি করে নিয়েছি, তাতেও কিছু টাকা খরচ হয়েছে। নাম কি সহজে খাতায় ওঠে? নাম ওঠানোই এক হ্যাঁঙ্গাম, তারপর একে খাওয়াও, ওকে খুশী করো, তাকে তোয়াজ করো! এখন বলছে মাল আমি সাপ্লাই করবো বটে কিন্তু ডি টি-এস্ যদি রিজেক্ট করে তো পেমেন্ট হবে না। আসলে এর সঙ্গে ওর সঙ্গে সব জড়ানো ব্যাপার–অর্থাৎ সবাইকে খাওয়াতে হবে। তা আমি দেখা করেছিলাম আপনাদের আপিসে–
–কার সঙ্গে?
অনন্তবাবু বললে–সে-নামটা আমি বলতে পারবো না। বারণ করে দিয়েছে ভদ্রলোক। তার হাত দিয়েই খায় মিস্টার ঘোষাল। তার নাম বললে আমার কাজটাই আটকে যেতে পারে।
দীপঙ্কর বললে–ঠিক আছে, নাম আপনাকে বলতে হবে না। আমি আপনার কাজটা করে দেব। আপনাকে আর মিস্টার ঘোষালের কাছে যেতে হবে না। আর খাওয়াতেও হবে না কাউকে। একটা পয়সাও লাগবে না আপনার। এবার থেকে যত কাজ পাবেন আপনি, সব আমার কাছে নিয়ে যাবেন, আমি নিজে আপনাকে রবিনসন সাহেবকে দিয়ে সব করিয়ে দেব
লক্ষ্মীদি খুশী হলো খুব। বললে–করবি তুই দীপু? করবি ভাই?
দীপঙ্কর বললে–আপনি কাল আমার আপিসে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, আমি থাকবো।
–কোথায় বসেন আপনি?
দীপঙ্কর বললে–ঠিক রবিনসন সাহেবের পাশের ঘরে–যেখানে সাহেবের স্টেনোগ্রাফার বসে, সেই এক ঘরেই–আমি রোজ বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থাকি
লক্ষ্মীদি অনন্তবাবুকে বললে–সেই তো ভালো হলো, তুমি মিস্টার ঘোষালের কাছে। গিয়ে দীপুর কাছে যেও, দীপুই তোমাকে রবিনসন সাহেবের কাছে নিয়ে যাবে
তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–আগে ব্যবসা যে-রকম ছিল তেমন থাকলে কোনও অসুবিধে হতো না আমাদের, বুঝলি! আগে শম্ভু দু’হাতে লাভ করেছে। আমি তো দেখেছি, টাকা খরচ করতো দু’হাতে। আর এখন যে কী হলো, সব ওলোট-পালোট হয়ে গেল হঠাৎ–
মনে আছে সেদিন লক্ষ্মীদির কথাগুলো শুনে ভারি হাসি এসেছিল দীপঙ্করের। লক্ষ্মীদি এই ক’মাসের মধ্যেই এমন গৃহিণী হয়ে উঠেছে, এমন সংসারী হয়ে উঠেছে যে, দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যেন। লক্ষ্মীদির মুখের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। যেন আরো ভারী হয়ে গেছে লক্ষ্মীদি এই ক’দিনের মধ্যেই আগে যেন আরো পাতলা ছিল, আরো হাল্কা। একটা আটপৌরে ব্লাউজের ওপর আরো আটপৌরে একটা শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। দু’হাতে শাঁখা ছাড়া আর কোনও গয়না নেই। গোল-গোল ফরসা হাত দুটো আর আধ-খোলা গলাটা নিরাভরণ। শুধু বাইরের দিকেই নয়, ভেতরে ভেতরেও যেন সেই লক্ষ্মীদি একেবারে আগাগোড়া বদলে গিয়েছে। আগে ঘুম থেকে ওঠার আগে বিছানার পাশে চা না দিলে ঘুমই ভাঙতো না লক্ষ্মীদির। আগে কাকীমা কলেজ থেকে আসার পর খাওয়া নিয়ে সাধাসাধি। সেই মেয়ে কোথায় পড়ে রইল, কোথায় কোন্ প্রান্তে এসে কার সংসার করছে, আশ্চর্য! সত্যিই লক্ষ্মীদি বলেছে ঠিক, কী যে হলো যেন সব ওলোট পালোট হয়ে গেল হঠাৎ!
বাইরে গলির কাছে এসেও যেন দীপঙ্করের চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না।
বললে–আমি তাহলে আসি–
লক্ষ্মীদি বললে–দাঁড়া। তুই অন্ধকারে যেতে পারবি না, আমি দরজা খুলে দিচ্ছি– বাইরে দরজার কাছে এসে দীপঙ্কর পা বাড়িয়েও একু থামলো। বললে–তা হলে আমি আসি লক্ষ্মীদি
লক্ষ্মীদি বললে–আয়–
দীপঙ্কর বললে–এতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলো, আর কিছু কথা জিজ্ঞেস করবে না? আর কারো কথা?
লক্ষ্মীদি অবাক হয়ে গেল একটু। বললে–আর কার কথা জিজ্ঞেস করবো, বল্?
–কারো কথাই তোমার জিজ্ঞেস করবার নেই? এতদিন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে ছিলে, কাকাবাবু, কাকীমা, সতী,–সকলকে ভুলে গেলে একেবারে?
লক্ষ্মীদি বললে–কই, ভুলিনি তো?
–কিন্তু তাদের কথা তো একবারও জিজ্ঞেস করলে না? এমন করে তুমি সকলকে ভুলে যেতে পারলে? কিন্তু তার বদলে তুমি পেলে কী, সত্যি বলো তো? এই তোমার অবস্থা তো আজ নিজের চোখের ওপরেই দেখে গেলাম, এতে তুমি সুখী হয়েছ মনে করো? এই যে যার জন্যে তুমি সব কিছু ছেড়ে চলে এলে, তাকেও কি সুখী করতে পেরেছ তুমি? আর কোথাকার কে একজন, যার সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্ক নেই, সেই তারই দয়ার ওপর নির্ভর করে তোমার ভরণ-পোষণ চালাতে হচ্ছে–এটাও কি খুব গৌরবের মনে করো?
লক্ষ্মীদি কোনও কথার উত্তর দিতে পারলে না।
দীপঙ্কর বললে– সত্যি বলো তো, আবার জিজ্ঞেস করছি, ও-লোকটা তোমার কে? ওর সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক এখন? ও তোমাদের জন্যে এত করে কেন? কিসের স্বার্থে?
লক্ষ্মীদি হঠাৎ যেন নিজেকে সামলে নিয়ে বললে–রাত হয়ে গেল, তোর ফিরতে দেরি হবে–তুই বাড়ি যা–
দীপঙ্কর বললে–যাবো তো আমি নিশ্চয়ই, তোমার এখানে থাকতে আসিনি, কিন্তু আমার কথার জবাব দাও–
লক্ষ্মীদি বললে–তুই জানিস না, অনন্ত না থাকলে আমাদের এই বিপদের সময়ে কী হতো ভাবাই যায় না। ও অনেক করেছে, এখনও করছে। সেই জন্যেই তো বলছি ওর কাজটা তুই যদি পারিস তো করে দেওতে আমারই উপকার–
–তোমারই উপকার হবে বলেই তো করছি, নইলে ওর সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক!
–হ্যাঁ, আমার নিজের উপকার হবে বলেই তোকে আজ চিঠি পাঠিয়েছিলাম। অসুখটা সেরে গেলে আমি শম্ভুকে তাহলে এখান থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবো, তখন কেউ আর থাকবে না আমাদের সঙ্গে,-তখন আর কারো দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে আমাকে–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করল-কিন্তু দাতারবাবুর চিকিৎসা কি করাচ্ছো?
–আমি মেয়েমানুষ কী আর করবো বল, ওই অনন্তই ডাক্তার দেখাচ্ছে–
–ডাক্তার কী বলছে?
–ডাক্তার আর কী বলবে, আমি তো নিজেই বুঝতে পারছি, কেবল সন্দেহ করে, সন্দেহবাতিক এসেছে ভীষণ! আমাকে সন্দেহ করে, অনন্তকে সন্দেহ করে। কেবল ওর মাথায় ঢুকেছে যে আমি বুঝি আর ওকে তেমন করে ভালবাসি না, ওর কেবল সন্দেহ আমি ওকে ছেড়ে পালিয়ে যাবো–
হঠাৎ ভেতরে যেন দাতারবাবুর গলা শোনা গেল। দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব চিৎকার করে বলছে পাশের ঘর থেকে।
লক্ষ্মীদি চম্কে উঠেছে। বললে–ওই দ্যাখ শম্ভুর ঘুম ভেঙে গেছে, আমি যাই—
অনন্তবাবু এসে গেল। বললে–এই দেখ শম্ভু উঠেছে–
তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–তোমার তো রাত হয়ে গেল, অনেক দূরে তো যেতে হবে তোমাকে
লক্ষ্মীদি বলল–তাহলে আবার আসিস তুই দীপু–
–আসবো
তারপর অনন্তবাবুকে বললে–আপনি কিন্তু যাবেন ঠিক, আমি সাহেবকে বলে সব বন্দোবস্ত করে দেব–আপনার একটা টাকাও খরচ হবে না–
বলে অন্ধকারের মধ্যে পা বাড়াল দীপঙ্কর। একেবারে নিশ্চিদ্র অন্ধকার চারিদিকে। নিচু জমি। দুপাশে নর্দমায় কাদা জমে আছে। তাড়াতাড়ি দীপঙ্কর পা চালিয়ে চললো। এখান থেকে অনেকখানি হেঁটে যেতে হবে। তারপর সেই মোড় থেকে ট্রাম। ট্রাম এত রাত্রে হয়ত বন্ধ হয়ে গেছে। আশেপাশে কোথাও ঘড়ি নেই। রাত বোঝবার উপায় নেই। দীপঙ্কর লেভেল-ক্রসিং এর গেটটা পেরিয়ে ওপারে চলে গেল। যদি ট্রাম না থাকে তো সমস্ত রাস্তটা হেঁটেই যেতে হবে। তারপর কাল সকালেই আবার আপিস আছে। আবার সেই জাপান-ট্র্যাফিক, আবার সেই মিস্টার ঘোষাল! কালকেই যেতে বলে দিয়েছে অনন্তবাবুকে। কী আশ্চর্য! নৃপেনবাবু তবু ভাল।
তেত্রিশ টাকায় তার লোভ মিটে যায়–আর এ চায় তিনশো টাকা!
হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে চমকে উঠেছে। মনিব্যাগটা কোথায় গেল! তার পার্স!
তার ভেতরে যে পয়সা আছে। ট্রাম ভাড়া দেবে কী করে? অবশ্য বেশি পয়সা নেই। বোধহয় আনা বারো সব সুদ্ধ। সেই লক্ষ্মীদির ওখানেই পড়ে আছে ঠিক।
তাড়াতাড়ি আবার ফিরলো দীপঙ্কর। এইটুকু রাস্তা যাতায়াতে আরো হয়ত মিনিট পনেরো লাগবে। তা হোক, কিন্তু মানিব্যাগটা না হলে কী করে চলবে। কাল তো আবার আপিসে যেতে হবে সকালবেলাই।
আবার সেই গেটটা পেরোতে হলো। গেটটা তখনও বন্ধ রয়েছে। অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। গুডস্ ট্রেন আসছে বোধ হয়। দোতলা গুমটি গরের ওপরে আলো জ্বলছে। ভূষণ মালী তখন ভেতরে! গেট বন্ধ করে ভেতরে সাউথ কেবিনের সঙ্গে কথা বলছে টেলিফোনে। রাস্তা থেকেও তার গলা শোনা যায়।
–হ্যাল্লো, থ্রি-সেভেনটিন আপ? গেট বন্ধ করেছি হুজুর—
–না না সনাতন নই, আমি ভূষণ! ভূষণ মালী! সেকেন্ড নাইট ডিউটি হুজুর–
সেই ভূষণ! ভূষণের গলা শুনলেই চেনা যায়। পরে রবিনসন সাহেবের সঙ্গে যখন দীপঙ্কর লাইন দেখতে এসেছিল, তখন ওই ভূষণই ছিল ডিউটিতে। বিনয়ের অবতার একেবারে ভূষণ! সেলাম করতে ভূষণের কান্তি নেই। রবিনসন সাহেব খুব ভালবাসতো ভূষণকে।
রবিনসন সাহেব দীপঙ্করকে জিজ্ঞেস করেছিল–ইজ হি এ সাউথ ইন্ডিয়ান সেন?
রবিনসন সাহেবের কী একটা ধারণা হয়েছিল ভালো লোক হলেই সে সাউথ ইন্ডিয়ান হবে। তা না হয়ে পারে না। মিসেস রবিনসনের সঙ্গেও তখন দীপঙ্করের খুব পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। সাহেবের সঙ্গে মেমসাহেবও লাইনে আসতো মাঝে মাঝে। যখন এই লেভেল-ক্রসিং গেট আরো চওড়া হলো তখন প্রায় আসতে হতো এখানে। কখনও সাহেবের গাড়িতে, কখনও ট্রলিতে। সাহেবের কুকুর জিমিও আসতো। সবাই নামতো গাড়ি থেকে। নেমে মাপা হতো, ইনসপেকশন হতো। সেই সময়েই ভূষণ মালী এসে সাহেবের কাছে দাঁড়াতো। আর সিগারেট-মুখে মিসেস রবিনসনের মুখের দিকেও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো।
রবিনসন সাহেব একদিন জিজ্ঞেস করেছিল ভূষণকে–হোয়াট ইজ ইয়োর পে গেটম্যান?
দীপঙ্কর বুঝিয়ে দিয়েছিল ভুষণকে। বলেছিল–সাহেব জিজ্ঞেস করছে, তুমি কত মাইনে পাও?
ভূষণ বলেছিল–হুজুর আঠারো রুপেয়া।
রবিনসন সাহেব তাতেও খুশী হয়নি। জিজ্ঞেস করেছিল–আর ইউ স্যাটিসফায়েড?
দীপঙ্কর তর্জমা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল-সাহেব জিজ্ঞেস করছে, তুমি ওই মাইনেতে খুশী?
ভূষণ বলেছিল–জী হুজুর, খুশী—
সাহেবও তখন উত্তর শুনে খুশী হয়েছিল। বলেছিল–সী, হি ইজ হ্যাপি–
কাউকে অসুখী দেখতে চাইত না রবিনসন সাহেব। সাহেব চাইতো সবাই যেন সন্তুষ্ট মনে, সুস্থ চিত্তে কাজ করে। তবে ভাল করে কাজ চলবে রেলওয়ের।
চলতে চলতে দীপঙ্কর গেটটা পেরিয়ে আবার গিয়ে দাঁড়াল সেই তিপ্পান্ন নম্বর বাড়িটার সামনে। হয়ত লক্ষ্মীদিরা এতক্ষণে সবাই শুয়ে পড়েছে। রাত তো কম হয়নি। আবার তাদের ডেকে ঘুম ভাঙাতে হবে। নর্দমাটা ডিঙিয়ে দীপঙ্কর সদর-দরজাটার কড়া নাড়তেই যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, দরজাটা শুধু ভেজানো ছিল। একটু ঠেলতেই খুলে গেল। বন্ধ করতে হয়ত ভুলে গিয়েছে।
ভেতরে তেমনি অন্ধকার। সরু গলিটার মধ্যে ঢুকতেই দীপঙ্করের কানে গেল দাতারবাবুর সেই চিৎকার। সেই আগেকার মতন চিৎকার করছে। তাহলে এখনও ঘুমোয়নি নিশ্চয়ই। হয়ত দাতারবাবুকে জোর করে খাওয়াচ্ছে, জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করছে। আহা! দীপঙ্করের মন থেকে আহা শব্দটা নিজের অজ্ঞাতেই বেরিয়ে এল। আশ্চর্য লক্ষ্মীদির কপাল! কত সুখ ছেড়ে এই এখানে কী কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে!
হঠাৎ গলির শেষে পৌঁছোতেই দীপঙ্কর চমকে উঠলো।
ভেতর থেকে একটা উদ্দাম হাসির শব্দ কানে এল। এমন করে হাসছে কে? এত রাত্রে? ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে। দীপঙ্কর জানালা দিয়ে ভেতরে চোখ ফেলতেই অবাক হয়ে গেল ৷
ঘরের মেঝের ওপর লক্ষ্মীদি আর অনন্তবাবু মুখোমুখি খেতে বসেছে। আর খেতে খেতে দু’জনে কী একটা কথায় প্রাণ খুলে হাসছে। হাসির দমকে দু’জনেই ফুলে ফুলে উঠেছে। ভারি একটা মজার কথায় যেন হাসি আর চাপতেই পারছে না।
দীপঙ্কর জানালা থেকে মুখটা সরিয়ে নিলে। ও-পাশ থেকে দাতারবাবুর চিৎকার তখনও চলেছে সমান তালে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই। এরা হেসেই চলেছে। দাতারবাবুর এ চিৎকারের মধ্যেও হাসি আসছে এদের!
না, দরকার নেই। হেঁটেই বাড়ি যাবে দীপঙ্কর। যত রাতই হোক, যত দূরই হোক। মানিব্যাগে তার দরকার নেই। বারো আনা পয়সার জন্যে ওদের হাসিতে বাধা দেবার দরকার নেই, বারো আনার ক্ষতি দীপঙ্কর সহ্য করবে। আর কালকেই তো মাইনের তারিখ। মাসের পয়লা।
রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তখনও যেন লক্ষ্মীদির হাসিটা কানে আসতে লাগলো। সেই উদ্দাম, উচ্ছল হাসি। আর দাতারবাবুর সেই বীভৎস চিৎকার। সেই চিৎকার আর পাশের ঘরেই এদের হাসি! একেবারে পাশাপাশি!
৩১
লক্ষ্মীদির জীবনটা কেমন যেন জটিল মনে হয়েছিল সেদিন। মনে হয়েছিল–বোধহয় সব মানুষেরই এমনি হয়। দীপঙ্করও তো কতবার সহজ করতে চেয়েছে জীবনকে। সোজা, সরল, জীবনই তো দীপঙ্কর চেয়েছিল। একটা ঋজু রেখার মত নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। হয়ত সবাই তাই-ই চায়। জীবনকে সহজ করার জন্যেই আয়োজন করে অনেক কিছুর, শেষে আয়োজনটাই ভারি হয়ে ওঠে, আয়োজনটাই জঞ্জাল হয়ে শেষে পীড়া দেয় জীবনকে। যেদিন লক্-আপ্ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, সেই দিনই তো দীপঙ্কর সঙ্কল্প করেছিল–এই শেষ! সেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বিয়ে-বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর তো সেই প্রতিজ্ঞাই করেছিল। বলেছিল–ভালোই হয়েছে, সব বন্ধন ছিন্ন করে সে মুক্তি পেল। সব সম্পর্ক ঘুচিয়ে সে পরিত্রাণ পেল। মার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেও তো সেই সঙ্কল্পের পুনরাবৃত্তি করেছিল। তারপর আর কোনও সংসর্গ তো সে চায়নি। চাকরি করবে আর উনিশের একর বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে এসে সে অজ্ঞাতবাস করবে, এই-ই তো সে ভেবেছিল। কোনও আয়োজনই তো তার ছিল না। কোনও আকর্ষণই তো তার ছিল না। আর। ভেবেছিল সব নিঃশেষ হয়ে গেল তার জীবন থেকে। কিরণের বাবার নশ্বর দেহটা যেমন করে শ্মশানে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, তেমনি করেই দীপঙ্করের জীবন থেকেও সব আকর্ষণ তো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা হলে আবার কেন এত আয়োজন স্তূপীকৃত হলো তার জীবনে, কেন এত জঞ্জাল তার জীবনে জড়ো হলো, কেন এমন করে আবার লক্ষ্মীদিও জড়িয়ে পড়লো তার জীবনে! কেন সতীও আবার তাকে এমন করে মূল ধরে আকর্ষণ করলে!
মনে আছে মিস মাইকেল বলতো–মিস্টার সেন, ইউ আর ভেরি শাই–তুমি এত লাজুক কেন?
মিস মাইকেলের সঙ্গে বেশি দিনের পরিচয় নয়। কিন্তু কিছুদিন পাশাপাশি বসতে বসতেই যেন পুরোপুরি চিনে ফেলেছিল দীপঙ্করকে। মিস মাইকেল বাড়ি থেকে টিফিন আনতো। একটা চ্যাপটা কৌটের মধ্যে কয়েকটা মোটামোটা জেলি-মাখানো স্যান্ডউইচ। তারপর ইলেকট্রিক কেটলিতে একটু চা করে নিত।
প্রথম দিন দীপঙ্করকেও চা খেতে বলেছিল মিস মাইকেল।
দীপঙ্কর বলেছিল–না, আমি চা-ই খাই না মিস মাইকেল–
মেমসাহেব যেন আকাশ থেকে পড়েছিল দীপঙ্করের কথাটা শুনে। বলেছিল, সে কি, তুমি চা খাও না? কখনও চা খাওনি?
দীপঙ্কর বলেছিল–না, আমি কখনও চা খাইনি–
কিন্তু কথাটা বলেই মনে পড়ে গিয়েছিল হঠাৎ-চা তো একবার সে খেয়েছিল। সেই ছোটবেলায়। সেই লক্ষ্মীদির কাছে তাদের লাইব্রেরীর চাঁদা চাইতে গিয়ে একবার চা খেয়েছিল। খুব কিন্তু ভালো লেগেছিল চা খেতে।
মিস মাইকেলের সঙ্গে শেষের দিকে খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। সবরকম গল্প হতো।
মিস মাইকেল বলতো–দ্যাটস ভেরি গুড় সেন, চা না-খাওয়া খুব ভালো–
–কেন? ও-কথা বলছো কেন?
মিস মাইকেল হেসে বলেছিল–ইউ উইল গেট প্লেজার ইন কিসিং-চুমু খেয়ে সুখ পাবে খুব।
কথাটা শুনে দীপঙ্করের কান দুটো খানিকক্ষণের জন্যে গরম হয়ে উঠেছিল। প্রথম দিন যে কী লজ্জা হয়েছিল দীপঙ্করের! আগে কখনও দীপঙ্কর কোনও মহিলার সঙ্গে এক ঘরে এতক্ষণ একসঙ্গে কাটায়নি। মেমসাহেবের বয়েস হয়েছিল-তবু অনেকক্ষণ মিস মাইকেলের দিকে তাকাতেই পারেনি দীপঙ্কর।
সেই দিনই মেমসাহেব বলেছিল–তুমি খুব লাজুক দেখছি তো–
দীপঙ্কর একদিন জিজ্ঞেস করেছিল–তুমি বিয়ে করোনি কেন মিস মাইকেল?
বিয়ে! ভারি কঠিন প্রশ্ন করেছে, ভেবেছিল দীপঙ্কর। মেমসাহেব টাইপিং থামিয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে ছিল দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল-তুমি তো সুন্দরী, তাহলে বিয়ে করলে না কেন?
মেমসাহেব হেসেছিল খুব। বলেছিল–খুব, খুব সুন্দরী ছিলাম আমি, ইন মাই ইয়ং ডেজ–তখন যদি তুমি আমায় দেখতে
–তা হলে? তা হলে বিয়ে করোনি কেন?
মেমসাহেব বলেছিল–সুন্দরী ছিলুম বলেই তো বিয়ে করিনি–
–সে কি! সুন্দরী হলে বিয়ে করবার দরকার নেই?
মেমসাহেব বললে–সে তুমি বুঝবে না সেন, তুমি ছেলেমানুষ!
–কেন–
তারপর মেমসাহেব টাইপ-রাইটার থামিয়ে বলেছিল–তুমি ভিভিয়ান লে’র নাম শুনেছ? দি গ্রেট হলিউড ফিল্ম স্টার! এখন আমেরিকাতে খুব ফেমাস স্টার, সে আর আমি একসঙ্গে এইখানে কাজ করেছি–তুমি হয়ত বললে বিশ্বাস করবে না–তার সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল।
দীপঙ্কর চুপ করে ছিল দেশে মিস মাইকেল বললে–তোমাকে আমি তার চিঠি এনে দেখাবো, তা হলে তো বিশ্বাস হবে?
মিস মাইকেল ভেবেছিল দীপঙ্কর বুঝি তার কথা বিশ্বাস করছে না!
মেমসাহেব বলেছিল–তুমি এখানে যাকে জিজ্ঞেস করবে, সে-ই বলতে পারবে সেন। আমরা দুজনে একসঙ্গে এক-বাড়িতে থাকতাম এক ঘরে শুতুম, একসঙ্গে আপিসে আসতুম–
–তা তুমি তার সঙ্গে হলিউডে চলে গেলে না কেন?
মিস মাইকেল আপিসে আসতো কাঁটায়-কাঁটায় নিয়ম করে। নিখুঁত পরিপাটি পোশাক-পরিচ্ছদ। কোথাও এতটুকু খুঁত ছিল না, আপিসে এসেই মেশিনটা খুলে নোট খাতাটা বার করে বসততা। তারপর পেন্সিলটা ছুরি দিয়ে কেটে কেটে শিষটা ছুঁচলো করে নিত। তারপর যতক্ষণ না রবিন্সন সাহেব ডাকতো, ততক্ষণ গল্প করতো সেন-এর সঙ্গে। তিনবার চা করতো, বার বার ব্যাগ থেকে আয়না বার করে মুখ দেখতে, ঠোঁটে লিপস্টিক বুলিয়ে নিতো, জ্বটা এঁকে নিত। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের মুখখানা দেখতে বার বার। যতদিন আপিসে ছিল, ততদিন সময় পেলেই নিজের গল্প বলেছে। জীবনের কোনও গল্পই বলতে বাকি রাখেনি। দীপঙ্করের ওপর কেমন যেন একটু মায়া পড়ে গিয়েছিল মেমসাহেবের।
মিস মাইকেল একদিন বলেছিল–আমার খুব হেট্রেড ছিল বাঙালীদের ওপর, জানো সেন–আমি বেঙ্গলীদের খুব হেট করতাম–কিন্তু
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো–কেন?
–আই ডোন্ট নো, এই আপিসে আমি কারো সঙ্গে কথা বলি না, তুমি দেখেছো তো-আমি বাবুদের সঙ্গে একটাও কথা বলি না–আই হেট দেম ফ্রম মাই হার্ট–আমি মন থেকে তাদের হেট করি, কিন্তু–
–কিন্তু, কী?
–কিন্তু, তোমাকে দেখবার পর থেকে আমি মাইন্ড চেঞ্জ করেছি, আই হ্যাভ চেঞ্জড় মাই মাইন্ড
দীপঙ্কর হেসে ফেললে। বললে–কেন?
–বিকজ ইউ আর রিয়্যালি গুড–তুমি সত্যিই ভালো। তোমার ভালো হোক্ এই আমি চাই–তোমার জীবনে উন্নতি হলে আমার চেয়ে কেউ খুশী হবে না–মনে রেখো
আশ্চর্য! সংসারে হয়ত এমনি করেই এক-একজনকে অকারণে ভালো লাগে। আবার অকারণে খারাপও লাগে। সংসারে ভাল-লাগা আর খারাপ-লাগার মধ্যে ফাঁকটা বোধহয় খুবই সামান্য। সেইজন্যেই বোধহয় একজনের ভাল লাগার সঙ্গে আর একজনের খারাপ-লাগার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাকে মিস মাইকেলের ভালো লাগার পেছনেও তাই সেদিন কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাকে মিস মাইকেলের ভালো লাগার পেছনেও তাই সেদিন কোনও কারণ খুঁজে পায়নি দীপঙ্কর, দীপঙ্কর বলেছিল–তুমি নিজে ভালো, তাই আমাকেও তোমার ভালো লাগে মিস মাইকেল–
–নো নো সেন, নেভার! তুমি জানো না সেন আমি কী জঘন্য মেয়ে!
হঠাৎ মিস মাইকেলের প্রতিবাদ করবার ভঙ্গী দেখে দীপঙ্কর অবাক হয়ে গিয়েছিল।–আমি তোমাকে আজ বলছি সেন, জীবনে এমন ক্রাইম নেই যা আমি করিনি! আমি যে সারা জীবন কত ক্রাইম করেছি, তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না সেন! লর্ড জেসাসের কাছে যে আমি কত অপরাধী!
বলে হঠাৎ মাথাটা নিচু করে ফেলতো। দীপঙ্কর বুঝতে পারতো মিস মাইকেল কাঁদছে। ব্যাগ থেকে সিল্কের রুমালটা বার করে চোখটা আলতো করে মুছে নিত। তারপর অনেকক্ষণ আর কথা পর্যন্ত বলতে পারতো না। অবাক কাণ্ড!
দীপঙ্করও আশ্চর্য হয়ে যেত মেমসাহেবের কাণ্ডকারখানা দেখে। কত মানুষ, কত বিচিত্র মানুষ যে আছে পৃথিবীতে, তাই দেখেই অবাক হয়ে যেত দীপঙ্কর। কোথাকার কে এক মেমসাহেব, এও তো এই কলকাতা-শহরের মানুষ! এও তো এই কলকাতার হাওয়াতেই দীপঙ্করের মত বড় হয়েছে, নিশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করেছে, একই কলকাতার বুকের ওপর মিস মাইকেলও তো দীপঙ্করের মত বেড়ে উঠেছে! এরও তো একদিন বাবা ছিল, মা ছিল, বন্ধুবান্ধব ছিল, এও তো দীপঙ্করের মত স্কুলে পড়েছে! কিন্তু এই পাউডার আর লিস্টিক্ আর বড়-চুলের আড়ালে আসল মানুষটাকে কে দেখতে পেয়েছে এমন করে? বাইরে থেকে দেখলে কে ভাববে এই মেমসাহেবও আবার কাঁদে! বাইরের এই চেহারা দেখে কে ভাবতে পারবে যে এরও দুঃখ আছে, কষ্ট আছে, অশান্তি আছে!
প্রথম দিকে গাঙ্গুলীবাবু বলেছিল–খুব সাবধান সেনবাবু, মেমসাহেবের সঙ্গে এক ঘরে বসছেন, একটু বুঝে-শুনে চলবেন–বলা তো যায় না!
–কেন? দীপঙ্কর সত্যিই বড় ভাবনায় পড়েছিল কথাটা শুনে।
সারাটা জীবন লোকের কাছে অনাদর আর অবহেলা পেতে অভ্যস্ত দীপঙ্কর। সারা জীবন মা’র কাছ থেকে শুনে এসেছে সে মানুষ নয়, সে অপদার্থ। শুনে এসেছে তার জন্যেই মা’র এত কষ্ট। সে মানুষ হলে মা একটু আরাম পেত। ছোটবেলা লক্ষ্মণ সরকার তাকে মেরেছে, লক্ষ্মীদিও তাকে মেরেছে। সতী তাকে তাচ্ছিল্য করে এসেছে। গাঙ্গুলী বাবুর কথায় দীপঙ্কর তাই ভয় পায়নি তেমন। কষ্ট করতেই জন্মেছে দীপঙ্কর। না-হয় কষ্টই ভোগ করবে আরো। কী আর করতে পারে সে। চাকরি তো সে ছাড়তে পারবে না–
গাঙ্গুলীবাবু বলেছিল–বড় দাম্ভিক প্রকৃতির মানুষ। ইন্ডিয়ানদের বড্ড ঘেন্না করে– আমাদের মানুষ বলেই মনে করে না মশাই। আমাদের যেন গরু ভেড়া মনে করে ও, এমন করে হাঁটে
কিন্তু আশ্চর্য! মিস মাইকেলের ভেতরেও যে একটা সহজ মানুষ লুকিয়ে আছে, সে কথা বোধহয় আপিসের মধ্যে একা দীপঙ্করই জানতে পেরেছিল। কিন্তু মিস মাইকেল বলেছিল–তুমি একদিন আমার ফ্ল্যাটে চলো সেন
–আমি?
–কবে যাবে বলো?
দীপঙ্কর যেন বিশ্বাস করতে পারেনি। এতখানি আগ্রহ মিস মাইকেলের, হঠাৎ যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছেও হয় না।
–আজ যাবে?
দীপঙ্কর বলেছিল–না-না, আজ আমার জামা-কাপড় বড় ময়লা–
–তাতে কী! আমার ফ্ল্যাটে কেউ নেই। আমি শুধু একলা থাকি। আর কেউ নেই আমার সংসারে। সংসারে আমি একেবারে এলোন্ সেন, একেবারে এলোন–
তারপর একটু থেমে বলেছিল–ভিভিয়া যে-খাটে শুতো, সেটা তোমায় দেখাবো, চলো, যে-টেবুলে বসে ড্রেস করতো, সেই টেবলটাও দেখাবো, সমস্ত আমি রেখে দিয়েছি, একটাও নষ্ট করিনি। আমার অ্যালবামটাও তোমায় দেখাবো, দেখবে ভিভিয়ানের চেয়েও আমি কত সুন্দরী ছিলাম, কত বিউটিফুল ছিলাম–আমার নিজের লাভ-লেটার্স আছে ফাইভ হান্ড্রেড থার্টি থ্রি, পাঁচশো তেত্রিশটা লাভ-লেটার্স আছে আমার জানো,আর ভিভিয়ানের ছিল ওনলি থ্রি হানড্রেড-মাত্র তিনশো–উড ইউ বিলিভ–?
দীপঙ্করের দিকে খানিকক্ষণ পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মিস মাইকেল।
তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে–অথচ দেখ, সেই ভিভিয়ান এখন আমেরিকার দি গ্রেট ফেমাস ফিল্ম স্টার, আর আমি? এই রেলওয়েতে র করছি–আর এখন তো…
বলতে বলতে মিস মাইকেলের বুকটা যেন ফাঁকা হয়ে যেত। মিস মাইকেলের দুঃখটা বুঝতে চেষ্টা করতো দীপঙ্কর, কষ্টটা অনুভব করতে চাইতো। কিন্তু তবু যেন পুরোপুরি বুঝতে পারতো না। পাঁচশো তেত্রিশ আর তিনশো লাভ-লেটার্সের তফাৎটাও বুঝতে পারতো না। দীপঙ্করকে তো কেউ-ই লাভ-লেটার্স লেখেনি, তাতে এত দুঃখ কেন মিস মাইকেলের?
বাইরে কে যেন ডাকলে। চাপরাশী এসে ডাকলে দীপঙ্করকে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করল-কে?
–একঠো বাবু!
বোধহয় অনন্ত এসেছে। সেই অনন্তরাও ভাবে। দাতারবাবুর বন্ধু। লোকটাকে ভালো লাগেনি কাল। সত্যিই কীসের আর টান! লক্ষ্মীদির জন্যে অত টান ভালো নয় অনন্তবাবুর। তবু যা হোক, উপকার তো হবে লক্ষ্মীদির! লক্ষ্মীদির এই অভাবের সময় অনন্তবাবুকে উপকার করলে লক্ষ্মীদিরও তো উপকার হবে। রবিন্ সাহেবকে গিয়ে যদি বলে দীপঙ্কর, সাহেব কথাটা এড়াতে পারবে না।
বাইরে গিয়ে দেখলেনা। অনন্তবাবু নয়, অন্য একজন ভদ্রলোক।
–কী চাই আপনার? কে আপনি?
ভদ্রলোক বললে–মিস্টার সেনকে চাই—
–আমিই তো মিস্টার সেন! আসল নামটা কী? পুরো নাম?
–হরিপদ সেন।
দূর! কোথাকার কে হরিপদ সেন! তাকে খুঁজতে এসেছে এখানে।
দীপঙ্কর বললে–সে রেটস আপিসে, সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় চলে যান–
ভদ্রলোক চলে গেল। কী আপদ সব! যে-সে এসে ডাকে! চাপরাশীকে বললেও তো আমাকে নয়, রেটস্ আপিসের হরিপদ সেনকে খুঁজছিল
তারপর বললে–দেখ, একজন আমাকে খুঁজতে আসবে আজকে, ভদ্রলোক বাঙালী নয়, মারাঠী-নাম অনন্তরাও ভাবে–সে ভদ্রলোক এলে আমায় ডেকে দিবি, বুঝলি, খুব জরুরী কাজ, তার জন্যে আমি অপেক্ষা করছি–
রবিনসন সাহেব লাঞ্চ খেতে যায় ঠিক একটার সময়। আসে দুটোর পরে। অনন্ত বাবু যদি আগে আসে তো ভাল, আর তা নয় তো দুটোর পরে! একটা থেকে দুটোর মধ্যে এলে মিছিমিছি বসিয়ে রেখে দিতে হবে। অকারণে অনেক গল্প করতে হবে। অনন্ত বাবুর সঙ্গে গল্প করে লাভটা কী! আপিসে যতক্ষণ হৈ-চৈ হল্লা চলে, তখন ভালো লাগে দীপঙ্করের। তবু মিস মাইকেলের ঘরের ভেতরটা বেশ নিরিবিলি। কোনও শব্দ আসে না কানে। কাজ করতে করতে অনেক কিছু ভাবা যায়। অনেক কথা ভাবার আছে দীপঙ্করের। ভাবনার কি শেষ আছে! দীপঙ্কর ভাবতো জীবন তো আরম্ভ হলো। তারপর? তারপর কী? তারপর কোথায় গিয়ে পৌঁছবে সে? এই আপিসে এই রবিনসন সাহেব, এই মিস্টার ঘোষাল, এই মিস মাইকেল! আজ না-হয় এখানে এসে পৌঁছিয়েছে। সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুল থেকে একদিন যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর কিরণ, লক্ষ্মণ সরকার, প্রাণমথবাবু, রোহিণীবাবু, কাকাবাবু, কাকীমা, লক্ষ্মীদি, সতী, সবাইকে অতিক্রম করে এতদিন পরে না-হয় এখানে এল! কিন্তু তারপর? তারপর কী? এই এখানে এসেই আটকে যাবে নাকি সে? এখানে এসেই থেমে যাবে?
হঠাৎ গাঙ্গুলীবাবু এল ঘরের মধ্যে। দীপঙ্করের পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লো।
বললে–এক মিনিটের জন্যে একটু বিরক্ত করতে এলাম সেনবাবু–
–না, না, বিরক্ত কী, বলুন
হাতে শালপাতা মোড়া একটা জিনিস এগিয়ে দিলে দীপঙ্করের দিকে। বললে–এইটে দিতে এলুম-প্রসাদ, মায়ের প্রসাদ–খান–
দীপঙ্কর ঠোঙাটা খুলে দেখলে। একটা শালপাতার ওপর একটু সিঁদুর লাগানো। দু চারটে গাঁদা ফুলের পাপড়ি আর একটা চিনির ডেলার সন্দেশ।
–এ কিসের প্রসাদ?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–মা-কালীর প্রসাদ, সকালবেলা পুজো দিয়ে এসেছিলাম কিনা, ভাবলাম আপনাকে একটু প্রসাদ দেব, তাই আপিসে এনেছিলাম
–তা হঠাৎ পুজো দিলেন কেন?
–আমার স্ত্রীর আজ পাঁচ বছর ধরে অসুখ চলছিল, সেটা ভালো হয়ে গেছে, তাই।
–পাঁচ বছর ধরে অসুখ? কী অসুখ? আপনি বলেন নি তো?
গাঙ্গুলীবাবু একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন–আপনাকে তো কোনও কথাই বলিনি! আপনি আর আমার কতটুকু জানেন! আমার স্ত্রী আজ পাঁচ বছর ধরে পাগল হয়ে গিয়েছিল।
পাগল! দীপঙ্কর চমকে উঠলো। দাতারবাবুরও তো মাথাটা গোলমাল হয়ে গিয়েছে। গাঙ্গুলীবাবু এতদিন কথাটা বলেনি, নইলে জেনে নিলেই হতো। লক্ষ্মীদিকেও বলা যেত তাহলে। লক্ষ্মীদি এতদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে। দাতারবাবু ভালো হয়ে গেলে আর অনন্ত বাবুর কাছে সাহায্য নিতে হয় না। লক্ষ্মীদি বেঁচে যেত তাহলে।
–কেন পাগল হয়েছিলেন আপনার স্ত্রী?
–সে অনেক কথা। আপনাকে তো বলেছিলাম, একদিন বলবো সব! সময় হলেই বলবো একদিন, এখন উঠি!
বলে গাঙ্গুলীবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে যাবার উপক্রম করলে।
দীপঙ্কর হাতটা ধরে টানলে। বললে–না-না, আপনি এখনি বলুন, আমার এখন হাতে কাজ নেই–আপনি বসুন–বলুন ব্যাপারটা–
গাঙ্গুলীবাবু বাইরে চলে এল। দীপঙ্করও সঙ্গে সঙ্গে চলে এল।
দীপঙ্কর বললে–বলুন, কী হয়েছিল কী?
গাঙ্গুলীবাবুর মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে এল। বললে–এখানে ঠিক বলা যাবে না– বরং আর একদিন বলবো
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমাকে যে আজ শুনতেই হবে–আমারও এক আত্মীয় সম্প্রতি পাগল হবার মত হয়েছে কিনা–
— কে?
–আমার একজন দিদির স্বামী।
গাঙ্গুলীবাবু চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললে–আজ পাঁচ বছর যে কী কষ্টেই ছিলাম সেনবাবু, কী বলবো–পাঁচটা বছর আমার রাতে ঘুম ছিল না, দিনে শান্তি ছিল না। আমি ভগবান মানতাম না, তবু ভগবানকে দিনরাত ডেকেছি। বলেছি–আমার কষ্ট দূর করো ঠাকুর, আমি আর সহ্য করতে পারি না এ-কষ্ট! আপনার সঙ্গে কথা বলেছি, আপিসের কাজ করেছি, বাইরে হেসেছি; কথা বলেছি, কিন্তু মনের মধ্যে কেবল অশান্তির আগুন জ্বলেছে–
দীপঙ্কর বললে–চলুন, কোথাও গিয়ে বসি, বসে বসে শুনি–
–কোথায় আর যাবেন! এ অনেক বড় গল্প, অনেক সময় লাগবে–
–তবু চলুন–
দীপঙ্কর চাপরাশীকে বলে গেল যদি কেউ খোঁজ করতে আসে যেন বসিয়ে রাখে তাকে। গাঙ্গুলীবাবুও কে-জি-দাশবাবুকে বলে এসেছিল।
কী বিচিত্র মানুষ আর কী বিচিত্র মানুষের জীবন! কোথায় মিস মাইকেল, তারও একটা সমস্যা আছে। সে-সমস্যার কতা বলতে বলতে মেমসাহেব কেঁদে ফেলে। আবার এই গাঙ্গুলীবাবু। এরও কত বিচিত্র এক সমস্যা। এরও মুখ-চোখ কান্নায় ভারী হয়ে আসে কথা বলতে বলতে।
সত্যিই, এদের তুলনায় তো দীপঙ্করই সুখী। দীপঙ্করের তো কোনও সমস্যাই নেই বলতে গেলে। শুধু লক্ষ্মীদির সমস্যাটাই এখন একটা পাথরের মত বুকের ওপর ভারী হয়ে চেপে বসেছে। লক্ষ্মীদি সুখী হলেই দীপঙ্করের কোনও সমস্যা থাকে না। দাতারবাবুর অসুখ ভাল হয়ে গেলেই সব সমস্যা মিটে যায় লক্ষ্মীদির। দীপঙ্কর নিশ্চিন্ত হয়।
মনে আছে গাঙ্গুলীবাবুকে নিয়ে দীপঙ্কর সামনের পার্কটাতে গিয়ে বসেছিল। চারিদিকে আপিস। আপিস আর আপিসের কেরানী। সমস্তঅঞ্চলটা যেন গম গম্ করছে আপিসের গন্ধে। সেই আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে দীপঙ্কর একেবারে খোলা আকাশের তলায় গিয়ে বসলো।
গাঙ্গুলীবাবু বললে–আপনি ঠিক বুঝবেন না আমার কথাগুলো সেনবাবু, যে ভুক্তভোগী সে-ই শুধু বুঝতে পারে–
দীপঙ্কর বললে–আপনি বলুন আমি ঠিক বুঝবো–
দীপঙ্কর জানতো সংসারে যে ভুক্তভোগী, সে-ই কেবল দুঃখের কথা বুঝতে পারে। দীপঙ্কর কি ভুক্তভোগী নয়? দীপঙ্কর কি মানুষ দেখেনি? দীপঙ্করও কি জানতো না যে মানুষের বাইরের চেহারা দিয়ে তাকে বিচার করার মত ভুল আর নেই! দীপঙ্কর কি দেখেনি ছিটে-ফোঁটাকে, দেখেনি বিন্তিদিকে, দেখেনি প্রাণমথবাবুকে, দেখেনি কিরণ, ফটিক, রাখাল, নির্মল পালিত, লক্ষ্মণ সরকারকে!
দীপঙ্কর বললে–আমিও অনেক লোক অনেক রকম মানুষ দেখেছি গাঙ্গুলীবাবু, আসলে আমি জিজ্ঞেস করছি অন্য কারণে–জিজ্ঞেস করছি আমার এক দিদির জন্যে
–দিদি? কী-রকম দিদি? আপন?
–না, আপন দিদি নয়। এমন কি দূর-সম্পর্কেরও দিদি নয়। বলতে গেলে কেউ ই নয়। তবু খুব আপন। তার কথা আমি খুব ভাবি। প্রায়ই ভাবি। পৃথিবীতে দুজনের কথা কেবল ভাবি আমি, তাদের মধ্যে এই দিদিই একজন–
গাঙ্গুলীবাবু বললে–আমারও আপনার মত কেউ ছিল না সেনবাবু, বেশ ছিলাম, বাবা-মা ছিল, তারা মারা যাবার পর লেখা-পড়া করতাম, আর শেষকালে এই রেলের আপিসে চাকরি পেয়ে গেলাম একটা বোন ছিল বিয়ে দিতে, তা তারও বিয়ে গিয়েছিলাম টাটানগরে–
–তারপর?
–তারপর একদিন বিয়ে হয়ে গেল হঠাৎ। হঠাৎ মানে আমি তার জন্যে ঠিক তৈরি ছিলাম না মশাই। মস্ত বড়ঘরের মেয়ে। আপনি বর্ধমানের ভট্টাচার্যিদের নাম শুনেছেন? তারা ওখানকার বনেদী ঘর। বহু পুরুষের বাস ওদের ওখানে। মানে ইচ্ছে করলে ওরা কলকাতাতেই একশোখান বাড়ি তৈরি করতে পারতো-এত পয়সা। অনেক মেয়ে বাড়িতে-মানে আমার অনেক শালী। একেবারে পর পর সব মেয়ে জন্মেছে ভাইদের। কিন্তু মেয়েদের বিয়ে হয়েছে সব বড় বড় জায়গায়। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনীয়ার, কেউ উকিল, ব্যারিস্টার, কেউ আবার ব্যবসাদার। একমাত্র আমিই হলাম জামাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। আমারই একমাত্র খারাপ অবস্থা। আমিই একমাত্র কেরানী!
মশাই, সেই গোড়া থেকেই আমার স্ত্রীর কেমন লজ্জা করতো আমার জন্যে। কেবল আমাকে বলতো তোমার বড় চাকরি হয় না? আরো বড় চাকরি? আমার সেজ জামাইবাবুর মত?
তা আমি আর কী উত্তর দেব এর, বলুন? আমি ভাবতাম বুঝি হাসিঠাট্টা করছে। আমার সঙ্গে।
কিন্তু একদিন হঠাৎ বলা-নেই কওয়া-নেই আমার বউ বাড়ি থেকে চলে গেল। একলা চলে গেল মশাই। আমি আপিস থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখি, বউ বাড়ি নেই–। কী হলো? হলো কী, এমন তো হয় না। খোঁজাখুঁজি করলুম অনেক। অনেক জায়গায় গেলুম। আমার তো আর কেউ নেই কলকাতায় যে সেখানে যাবে? পাশের বাড়িতে খোঁজ নিলুম-সেখানেও নেই। শেষে কী সন্দেহ হলো, গেলুম বর্ধমানে, আমার শ্বশুরবাড়িতে। যা ভেবেছি, ঠিক তাই! গিয়ে দেখি বউ গেছে বাপের বাড়িতে
আমার শ্বশুর-শাশুড়ী, তাঁরা সেকেলে লোক। বললেন–একলা-একলা থাক, তাই ওইরকম হয়েছে, আর কিছুদিন সবুর করো বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে
আমার তখন বাড়িতে কেউ নেই, বুঝলেন না? স্ত্রীকে ছেড়ে থাকতে পারবো কেন?
শ্বশুরমশাইকে বললাম-যদি আমার ওখানে পাঠিয়ে দেন তো আমার বড় ভাল হয়, বড় কষ্ট হচ্ছে আমার খাওয়া-দাওয়ার
শাশুড়ী বললেন–তাহলে পটলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তাকে যদি বোঝাতে পারো তো দেখ
আমার স্ত্রীর ডাক নাম পটল। তা যাকগে, বউ ঘরে এল।
বললাম-তুমি হঠাৎ যে না বলে-কয়ে চলে এলে, আমায় কী ভাবনায় ফেলেছিলে বলো তো
বউ বললে আমি আর যাবো না কলকাতায়, আমার লজ্জা করে। আমি বললাম-লজ্জা কিসের? আমার কাছে থাকবে তাতে লজ্জা কী?
তখন থেকেই মাথাটা একটু-একটু খারাপ হচ্ছে, আমরা বুঝতে পারিনি আর কি। বউ সে-কথার উত্তরে বললে–তুমি যে মাইনে কম পাও, তাই আমার লজ্জা করে–
বললাম–মাইনে কম-বেশি পাওয়া কি আমার হাত?
–তা বললে কি জানেন? বললে–সেজ-জামাইবাবু, ন’-জামাইবাবু, ওরা তো বেশি মাইনে পায়–তুমি ওদের মত মাইনে পাও না কেন?
–তা আমি এর কী জবাব দেব বলুন! দীপঙ্কর মন দিয়ে শুনছিল গল্প। বললে–তারপর?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–আপনি তো বিয়ে করেননি। কিন্তু বিয়ে যদি কখনও করেন তো বড়লোকের মেয়েকে কখনো বিয়ে করবেন না মশাই, এই আপনাকে আমি বলে রাখলুম। আমার নিজের কখনও একটা অসুখ করেনি মশাই, কখনও আমার নিজের জন্যে ডাক্তার ডাকতে হয়নি একটা। আমার ওই চা-খাওয়া ছাড়া আর কোনও নেশাই নেই জীবনে, কিন্তু এখন ভাবি, বিয়ে না করলে আমি কত সুখেই থাকতে পারতুম! আরাম করে চাকরি করতুম, আর সিনেমা-থিয়েটার দেখে বেড়াতুম–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে তা আপনার প্রমোশন হয়ই বা না কেন গাঙ্গুলীবাবু? এত বছর চাকরি করছেন আপনি?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–আপনিও ওই কথা বলছেন? প্রমোশন হবে কী করে সেনবাবু? আপনার কথা আলাদা, আপনি ঢুকলেন জার্নাল সেকশনে, তারপর কী করতে গিয়ে কী হয়ে গেল, রবিনসন সাহেব আপনাকে বসিয়ে দিলে নিজের ঘরে, আর আমাদের তো তা নয়, চিরকাল ওই এক চেয়ারে এক ঘরের মধ্যে পচতে হবে–
দীপঙ্কর বললে–তা তারপর?
–তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সেবার তো নিয়ে এলাম বউকে বাড়িতে। শাশুড়ী অনেক বুঝিয়ে টুঝিয়ে মেয়েকে পাঠালে। আমি বউ-এর মন ভোলাবার জন্যে আপিসের কো অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে দেড় হাজার টাকা লোন নিলুম। বউ-এর দামী শাড়ি কিনে দিলাম, ভালো-ভালো গয়না গড়িয়ে দিলাম। সিনেমায় নিয়ে গেলাম, থিয়েটারে নিয়ে গেলাম। মহা খুশী বউ। ভাবলাম বুঝি সেরে গেল। সেইবারেই প্রথম বড় মেয়ে হলো আমার। তারপর একটা ছেলে।
কিন্তু পরের মাস থেকে হাতে মাইনে পেতে লাগলাম কম। আর কুলোতে পারি না, আর চলে না সংসার। বউকেও বলতে পারি না তখন। শেষে একদিন আর চাপা রইল না। একেবারে খোলাখুলি গালাগালি দিতে লাগলো আমাকে।
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে–গালাগালি?
–হ্যাঁ সেনবাবু, আপিসে কাউকেই এ-সব কথা বলিনি, কেউ জানে না। আজ আপনাকেই প্রথম বললাম। তখন আর কি একেবারে উন্মাদ অবস্থা। সে শাড়ি-সায়ারও ঠিক থাকে না। চিৎকার করে গালাগালি–
–কাকে গালাগালি দিতেন?
–আমাকে সেনবাবু, আবার কাকে! আমি মাইনে কম পাই, আমি বউকে শাড়ি গয়না কিনে দিতে পারি না, আমি ইতর, আমি ছোটলোক–শেষকালে কানে আঙুল দিতে হতো। পাড়ার লোক পর্যন্ত সে-চিৎকারে তিষ্ঠোতে পারতো না–এমন চিৎকার! ছেলেমেয়েরা হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠতো মায়ের কাণ্ড দেখে–
গাঙ্গুলীবাবুর গল্প শুনতে শুনতে দীপঙ্কর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কী সাংঘাতিক অবস্থা গাঙ্গুলীবাবুর! অথচ বাইরে থেকে তো কিছুই বোঝা যায় না, কিছু বোঝবারই উপায় নেই। দিনের পর দিন জার্নাল সেকশনে এসেছে নিয়ম করে। নিয়ম করে কে জি-দাশবাবুকে চা দিয়েছে, হেসেছে, রসিকতা করেছে। নৃপেনবাবুর ফেয়ারওয়েলের সময় সবই তো করেছে গাঙ্গুলীবাবু, কিছু তো বোঝা যায়নি বাইরে থেকে!
পার্কের ভেতরে আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে। এতক্ষণে বোধহয় রবিন্সন সাহেবের লাঞ্চ খেয়ে ফেরবার সময় হলো।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তারপর?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–তারপর ডাক্তার দেখাতে লাগলুম। শ্বশুর-শাশুড়ী তাঁরাও এলেন। আমার তো টাকা ছিল না। তাঁদেরই জ্বালা, আমার মত জামাই করে তাঁদেরই পস্তাতে হচ্ছে। ভেবেছিলেন জামাই-এর রেলের চাকরি, উন্নতি হলে প্রচুর উন্নতি হবে, একেবারে মাথায় উঠে যাবে জামাই, আবার যদি তা না-ও হয় তো মেয়ের খাওয়া-পরার কষ্ট হবে না জীবনে–কিন্তু তাঁরা তো জানতেন না যে, আমি জার্নাল সেকশনের এ-বি গ্রেডের ক্লার্ক, জার্নাল সেকশনে একবার নাম লেখালে সেখান থেকে আর মুক্তি নেই।
–যাক, তারপর? কিসে ভালো হলো?
গাঙ্গুলীবাবু কী একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাধা পড়লো। দ্বিজপদ দৌড়তে দৌড়তে একেবারে পার্কের মধ্যে এসে পড়েছে।
–হুজুর, রবিন্সন সাহেব!
–ডেকেছে? এরই মধ্যে এসে গেল সাহেব?
দীপঙ্কর উঠে পড়লো। সাহেব আজকে সকাল-সকাল এসে পড়েছে দেখছি। তাড়াতাড়ি জুতোটা পায়ে গলিয়ে দৌড়লো। গাঙ্গুলীবাবু সঙ্গে সঙ্গে চললো। দীপঙ্কর বললে–শেষটা শোনা হলো না, গাঙ্গুলীবাবু, ছুটির পরে শুনবো কিন্তু–
গাঙ্গুলীবাবু বললে–এখন মশাই আর কোনও গণ্ডগোল নেই, ধন্বন্তরি ওষুধ একেবারে, তাই তো সক্কালবেলা উঠেই কালীবাড়িতে গিয়ে পুজো দিয়ে এলুম–
–তা কী ওষুধে সারলো?
–আরে কত রকম কী করেছি, তার কি ঠিক আছে! পাগলা কালীর বালাও পরিয়েছিলাম, তাতেও কিছু হয়নি। শেষে শ্বশুরমশাই অনেক টাকা খরচ করে কলকাতার বড় বড় ডাক্তার দেখালেন, তাতেও কোনও ফল হয়নি—শেষে–
–শেষে?
তখন একেবারে রবিনসন সাহেবের ঘরের সামনে এসে গেছে দুজনে।
–শেষে হরকালী কবিরাজের মধ্যমনারায়ণ-তৈল আছে এক রকম, তাই মাখিয়ে মাখিয়ে ভালো হলো। এখন আবার নরম্যাল, সব স্বাভাবিক–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-তেলটা কোথায় পাওয়া যায়? কত দাম? আমাকে এক বোতল কিনে দিতে পারেন?
–আপিসের পরে দেখা হবে তো, তখন বলবো’খন আপনাকে, আমাকে ডাকবেন!
.
সাহেবের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলে রবিনসন সাহেবের মুখে হাসি। দীপঙ্কর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও যেন সাহেবের চৈতন্য হলো না। তেমনি দীপঙ্করের দিকে চেয়ে হাসতে লাগলো। একরকম দুর্বোধ্য অব্যক্ত হাসি।
হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে উঠলো সাহেব। নড়ে বসলো।
বললে–আমি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলুম, না?
দীপঙ্কর বললে–ইয়েস স্যার–
–কী জন্যে বলো তো? হোয়াই? রবিনসন সাহেবের এই রকমই অদ্ভুত কাণ্ড! কী বলতে ডেকেছিলেন ভুলে গেছেন! দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–জাপান-ট্রাফিকের পিরিঅডিক্যাল স্টেটমেন্ট স্যার?
–নো, নো, নট্ দ্যাট–
বলে সাহেব ভাবতে লাগলো মাথায় টোকা দিতে দিতে। দীপঙ্কর দাঁড়িয়েই আছে। হঠাৎ জিমির দিকে নজর পড়তেই সাহেব বললে–জানো সেন, জিমি ইজ অ্যান ইনটেলিজেন্ট ডগ, জিমির খুব বুদ্ধি! আজকে কী করেছে জানো?
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো।
সাহেব বললে–আজকে মিসেস ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছে, আর্লি মর্নিং ছ’টার সময় ওঠে রোজ মিসেস–এদিকে জিমির ঠিক খেয়াল আছে, উড ইউ বিলিভ জিমি মিসেসের ঘরের দরজায় গিয়ে নক্ করছে–ধাক্কা দিচ্ছে–
জিমির বুদ্ধি দেখে যে দীপঙ্করও অবাক হয়ে গেছে তা বোঝাবার জন্য দীপঙ্কর জিমির দিকে চেয়ে একটু হাসলো। জিমি বোধহয় বুঝতে পারলে যে তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। মুখটা দীপঙ্করের দিকে তুলে ল্যাজটা একটু নেড়ে দিলে।
সাহেব বললে–ভেরি ইনটেলিজেন্ট, বুঝলে সেন, ইভ মোর ইটেলিজেন্ট দ্যা দীজ অফিস-ক্লার্কস–
সাহেব গড়গড় করে জিমির আরো গুণপনার কথা সবিস্তারে বলতে লাগলো। কবে একদিন ছোট্ট একটুকু বাচ্চা বয়েসে এসেছিল বাড়িতে, তারপর ঘরের ছেলের মত হয়ে গেছে সাহেবের। সাহেব আর মেমসাহেব সারাদিন জিমি-জিমি করেই অস্থির। একদিন শরীর খারাপ হলে, একদিন জিমির অরুচি হলে, সি-এম-ও থেকে হসপিটালের কম্পাউন্ডার পর্যন্ত তটস্থ হয়ে ওঠে। জিমির জন্য কোথায় মাংস, কোথায় সোপ, কোথায় বিকিট সব দিকে নজর দিতে হয় মেমসাহেবকে। জিমি হট ওয়াটার ক্লাবে না জানো, জিমির রেফ্রিজারেটে ওয়াটার চাই। স্টু খাবে, বেকন্ খাবে, হ্যাম, পরিজ সব খাবে কিন্তু রাইস মুখে দেবে না–এমন ডগ দেখেছে তুমি সেন?
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনছিল সব। এই জন্যেই সাহেব তাকে ডেকেছিল নাকি! এই জিমির কথা শোনাতেই ডেকে পাঠিয়েছিল সাহেব চাপরাশী দিয়ে? আশ্চর্য খেয়ালী সাহেব! পরে অনেকবার রবিনসন সাহেবের কথা মনে পড়ায় দীপঙ্করের দীর্ঘনিশ্বাস পড়েছে। হোক ইউরোপীয়ান, হোক ফরেনার, হোক ব্রিটিশ, কিন্তু অমন লোক যে হয় না! ভালো লোক কি নেই ব্রিটিশারদের মধ্যে? আছে বৈ কি। রবিনসন সাহেবই তো তার প্রমাণ। অতখানি বিশ্বাস, অতখানি ভালবাসা আর ক’জনের কাছেই বা পেয়েছে দীপঙ্কর! প্রাণমথবাবু–তা প্রাণমথবাবু তো তার উপকার করেছেন। চ্যারিটি করেছেন। গরীবদের ওপর তার কর্তব্যবোধ থেকে তিনি সাহায্য করেছেন দীপঙ্করকে। কিন্তু রবিনসন সাহেব তো তা নয়। রবিনসন সাহেব তো ইন্ডিয়ার পভার্টি দেখতে পাননি। সাহেব পভার্টি টলারেট করবেন না। জিমির ক্লীনারকে টেন চিপস্ দিতো সাহেব। পৃথিবীতে গরীব কেন থাকবে! সে যত ছোট কাজই করুক, হি মাস্ট বি ফেড়। তাকে খেতে দেওয়া চাই। কুকুরের সেবা করছে বলে সে কি কম খাবে নাকি? তারও কি বাঁচবার অধিকার নেই? দৈত্যকুলে হঠাৎ যেন এক প্রহাদ এসে জুটে গিয়েছিল। যেন পেডি, বার্জ, টেগার্ট, সিমসনদের দলের ভেতর হঠাৎ একজন ডেভিড হেযার ভুল করে ঢুকে পড়েছিল। আর আসবি তো আয় একেবারে এই জায়গায়–এই রেলের আপিসে!
তারপর হঠাৎ যেন সাহেবের আসল কথাটা মনে পড়ে গেছে।
বললে-–হ্যাঁ, যে-কথা বলতে তোমাকে ডেকেছিলুম-তুমি অফিসে কী কাজ করো?
প্রশ্নটা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। বললে–আমি ক্লার্ক স্যার, জাপান-ট্রাফিকের কাজ করি
–আই সী, তা আর ইউ এ গ্র্যাজুয়েট?
–ইয়েস স্যার।
সাহেব খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলে। তারপর বললে–তা তুমি সেফওয়ার্কিং এগজামিনেশনটা দাও না কেন? সেফ-ওয়ার্কিং আর ইয়ার্ড।
দীপঙ্কর বললে–আপনি যদি পারমিশন দেন তা দিয়ে দিতে পারি–
–ইয়েস, ডু ইট আমি ডি-টি-আই নিচ্ছি, ইউ মে বি এ ক্যান্ডিডেট–
কথাটা বলেই জিমির দিকে চাইলে সাহেব আবার। বললে–জানো, হোয়াট অ্যান ইনটেলিজেন্ট ডগ, আমি ওকেই ডি-টি-আই করে দিতুমবার্ট আনফরচুনেটলি জিমি ইজ এ ডগ-দো হি ইজ মোর ইনটেলিজেন্ট দ্যান দোজ অফিস-ক্লার্কস–
কী কথা বলতে বলতে কী কথা বলে ফেললে সাহেব।
দীপঙ্কর বললে–আমি পরীক্ষা দেব স্যার–
–হ্যাঁ, দাও–আই উইল্ হেল্প্ ইউ–
বলে সাহেব নিজের কাজে মন দিতে যাচ্ছিল। দীপঙ্করও চলে আসছিল ঘর থেকে। হঠাৎ কথাটা মনে পড়লো। বললে–স্যার একটা অনুরোধ আছে আপনার কাছে–
–বলো?
দীপঙ্কর বললে–আমার এক আত্মীয়ের ভীষণ বিপদ হয়েছ স্যার, তার হাজব্যান্ড হঠাৎ পাগল হয়ে গেছে, তার জন্যে আমি একটা ফেবার চাই আপনার কাছে। তিনি রেলওয়ের এনলিস্টেড্ কনট্র্যাক্টার, তার একটা কাজ যদি আপনি করে দেন, মাত্র তিন হাজার টাকার কাজ–
সাহেব জিজ্ঞেস করলে–কী কাজ?
দীপঙ্কর যতটুকু জানে সমস্তই বললে। বড় বড় কনট্র্যাক্টার অবশ্য অনেক আছে লিস্টে, কিন্তু ইনি তাদের মত নন্। ছোট ছোট অর্ডার সাপ্লাই-এর কাজ করেন। অত্যন্ত দুরবস্থা এঁদের। বেঙ্গলী নয়। মহারাষ্ট্রীয়ান্। ট্রেড্-ডিপ্রেশনের জন্যে অফিস উঠে গেছে এঁদের। একটা সামান্য ছোট বাড়ি ভাড়া করে কলকাতার বাইরে–ঢাকুরিয়ায় থাকেন। গড়িয়াহাটা লেভেল-ক্রসিং-এর কাছে। আমার নিজের দিদি নেই–কিন্তু এ আমার নিজের দিদির চেয়েও নিজের। ছোটবেলা থেকে এক বাড়িতে–এক সঙ্গে পাশাপাশি বাস করেছি। এর কষ্ট আমার নিজের কষ্ট। এর দুঃখ আমার নিজেরই দুঃখ। আমি নিজে গিয়ে এদের দুঃখ-কষ্ট দেখে এসেছি। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তো এদের আমি টাকা দিয়ে সাহায্য করতাম। ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বলে গেল দীপঙ্কর। সাহেবের দয়া উদ্রেক করবার জন্যে যা কিছু বলা দরকার সব বললে।
সাহেব জিজ্ঞেস করলে–এরা টেন্ডার পাঠিয়েছে?
দীপঙ্কর বললে– সে-সব আমি জানি না–ভদ্রলোক আজকেই আসবেন,–
সাহেব বললে–অল্ রাইট্, আমার কাছে তাকে নিয়ে এসো, আই শ্যাল্ সী টু ইট্। দীপঙ্কর আরো একটু করুণ করে বলতে যাচ্ছিল ব্যাপারটা–
সাহেব বললে–আর বলতে হবে না সেন, আই উইল ডু ইট্ ফর ইউ–
দীপঙ্কর সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে বাইরে চলে এল। বাইরে এসেই একবার দেখলে চারিদিকে। অনন্তবাবু হয়ত এসে অপেক্ষা করছে। ওদিকের করিডোর থেকে এদিকের করিডোরটা একবার ঘুরে দেখে নিলে। কোথাও অনন্তবাবুকে দেখা গেল না। এত দেরি করছে কেন আসতে! তারই তো কাজ। দীপঙ্করের কী? গরজটা তো তারই। কাজটা পেলে অনন্তবাবুরই উপকার। লক্ষ্মীদিরই উপকার। তারই পাঁচশো টাকা অন্তত প্রফিট থাকবে। কাউকে ঘুষ দিতে হবে না। রবিন্সন সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেই শুধু ফর্মের ওপর সই করে দেবে। তাহলেই হয়ে যাবে। আর কারোর কিছু বলবার থাকবে না।
আবার নিজের ঘরের কাছে এসে চাপরাশীকে একবার জিজ্ঞেস করলে।
–হ্যাঁ, রে, কেউ খুঁজতে আসেনি আমাকে?
-–না, হুজুর।
দীপঙ্কর বললে–যদি কেউ এসে আমার খোঁজ করে, আমাকে ডেকে দিবি, বুঝলি? মনে থাকবে তো?
–থাকবে হুজুর।
–হ্যাঁ, ভুলিসনি যেন, খুব জরুরী।
আশ্চর্য বটে! এত করে আসতে বলে এল দীপঙ্কর, আর কি না এল না। সত্যি, কী আক্কেল লোকটার! দীপঙ্কর তত তাদের জন্যেই অত করে বলে এসেছিল। নইলে তার কিসের স্বার্থ? লক্ষ্মীদির জন্যেই দীপঙ্কর নিজে রবিনসন সাহেবের কাছে অনুরোধটা করেছে। আর এত করে বলেও অনন্তবাবু ঠিক সময়ে আসতে পর্যন্ত পারলো না।
আবার ভেতরে গিয়ে ঢুকলো দীপঙ্কর, মিস মাইকেলকে লম্বা নোট দিয়েছে সাহেব। সেইটেই একমনে টাইপ করছে। দীপঙ্কর নিজের ফাইলগুলো আবার নামালো। আবার স্টেটমেন্ট করতে হবে। স্টেটমেন্ট পাঠাবার তারিখ এসে গেল আবার। কাজ করতে করতে দীপঙ্কর আবার বাইরে এল, না, এখনও অনন্তবাবুর দেখা নেই।
চাপরাশীকে আবার জিজ্ঞেস করলে–কী রে, কেউ আসেনি?
–না হুজুর।
আশ্চর্য! লক্ষ্মীদিরই বা কী রকম দায়িত্ব-জ্ঞান? লক্ষ্মীদির ব্যাপারটাই যেন দুর্বোধ্য। অনন্তবাবুর সঙ্গে অত মাখামাখিই বা কেন? হা উপকার করছে ভদ্রলোক, সেইজন্যেই যা একটু কৃতজ্ঞতা। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতাটুকুর জন্যে অত ঘনিষ্ঠতার দরকার কী? অত হাসাহাসি, অত গায়ে গড়িয়ে পড়ার দরকার কী? অথচ পাশের ঘরে দাতারবাবু তখন চিৎকার করছে–উন্মাদের চিৎকার!
হঠাৎ নজরে পড়লো এতক্ষণে অনন্তবাবু আসছে। বাইরের গেট দিয়ে সোজা ভেতরে আসছে তার দিকে। পোশাকটা বদলিয়েছে। একটু ফিটফাট। ফরসা জামা কাপড়। দীপঙ্কর হেসে এগিয়ে গেল অনন্তবাবুর দিকে। শেষপর্যন্ত যে অনন্তবাবু এসেছে এই-ই যথেষ্ট। তা না হলে এত তোড়-জোড় এত চেষ্টা-চরিত্র এত রবিনসন সাহেবকে ধরা সব মাটি হতো।
–অনন্তবাবু! আপনি এত দেরি করে এলেন, আমি অনেকক্ষণ ধরে এখানে অপেক্ষা করে আছি–
অনন্তবাবু হন হন করে আসছিল সোজা। তারপর দীপঙ্করের পাশ দিয়ে ডান দিকে ঘুরে গেল। যেন দীপঙ্করকে দেখতেই পেলে না।
দীপঙ্কর ডাকলে-অনন্তবাবু,-এই যে আমি–
অনন্তবাবু পেছন ফিরে চাইলে একবার দীপঙ্করের দিকে। অনেক কষ্টে যেন চিনতে পারলে। বললেও, আপনি, আমি আসছি–
বলে আর দাঁড়ালো না, একেবারে হন হন করে মিস্টার ঘোষালের ঘরে ঢুকে পড়লো। আর চাপরাশীটাও তেমনি। অনন্তবাবুকে দেখেই একটা সেলাম করলে, তারপর দরজাটা খুলে ফাঁক করে দিলে।
এক নিমেষে যেন একটা ম্যাজিক হয়ে গেল দীপঙ্করের চোখের সামনে। সেই অনন্ত বাবুই তো, না সে ভুল করেছে? না সে অন্য লোককে অনন্তবাবু বলে ভুল করেছে! আশ্চর্য তো! চিনতেই পারলে না দীপঙ্করকে? অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলো দীপঙ্কর। এ কী রকম হলো। যার জন্যে সে এত চেষ্টা করলে, সেই তাকে চিনতে পারলে না! মিস্টার ঘোষালকে এত ভাল করে চিনেও সেখানে তার কাছেই গেল!
সেদিন দীপঙ্কর তার চাকরি-জীবনের প্রথমদিকে সত্যিই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। নিঃস্বার্থ উপকার যে করতে চায়, তার কাছে লোকে না এসে কেন যায় স্বার্থপর অশুভবুদ্ধির লোকের কাছে! যেখানে সহজে কার্যসিদ্ধি হয়, সেখানে যাবার প্রবৃত্তি কেন মানুষের হয় না! দীপঙ্করের কোনও স্বার্থ ছিল না বলেই কি অনন্তবাবু মিস্টার ঘোষালের ঘরে গিয়ে ঢুকলো–যেখানে ঘুষ দিতে হবে, যেখানে অন্যায়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে, সেখানে?
সেইখানেই আরো অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দীপঙ্কর। কাল সেই রাত্রের পর এমন কী ঘটনা ঘটে গেল যার জন্যে আজ অনন্তবাবুর এই বিপরীত আচরণ! দীপঙ্করের সমস্ত অন্তরটা বেদনায় টন টন করে উঠলো। বেদনাটা অনন্তবাবুর এই বিপরীত ব্যবহারের জন্যে ততটা নয়, যতটা আত্মগ্লানিতে। ছোটবেলা থেকে অনেক মানুষের অনেক ব্যবহারের সঙ্গে তার মুখোমুখি ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, অনেক দুর্বোধ্য আচরণের ব্যাখ্যাও মিলেছে কিন্তু এ কী হলো! এমন তো হবার কথা নয়। মনে হলো দীপঙ্করের সততা, দীপঙ্করের নিষ্ঠা, দীপঙ্করের ভালবাসার যেন চরমতম অপমান করলে অনন্তবাবু!
দ্বিজপদ এসে ডাকলে-হুজুর, সাব সেলাম দিয়া–
দীপঙ্কর চাপরাশীকে বললে–একটু দেখিস তো, ওই বাবু ঘোষাল সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কিনা–
রবিনসন সাহেবের ঘরে বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। একটা দুটো প্রশ্নের উত্তর দিয়েই তাড়াতাড়ি আবার বেরিয়ে এসেছে। এসেই চাপরাশীকে জিজ্ঞেস করলে বাবু বেরিয়েছে?
–না হুজুর।
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। অনন্তবাবুর সঙ্গে দেখা করতেই হবে আজ। অন্তত লক্ষ্মীদির জন্যেও দেখা করতে হবে। তাহলে কেন তাকে চিঠি দিয়ে ডাকিয়ে পাঠিয়েছিল লক্ষ্মীদি? কেন তাকে অপমান করা এমন করে? রবিনসন সাহেব যখন জিজ্ঞেস করবে-কই, তোমার রিলেটিভ এল না? তখন কী উত্তর দেবে দীপঙ্কর?
হঠাৎ মিস্টার ঘোষালের দরজাটা খুলে যেতেই দীপঙ্কর তৈরি হয়ে নিলে।
কিন্তু অনন্তবাবুর সঙ্গে মিস্টার ঘোষালও বেরোল বাইরে। দুজনের যেন খুব ভাব। গল্প করতে করতে দু’জনে বেরিয়ে সামনের গেটের দিকে গেল। মিস্টার ঘোষালের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল সামনে। দুজনেই গিয়ে উঠলো তাতে। দীপঙ্কর ডাকতে যাচ্ছিল অনন্ত বাবুকে। কিন্তু তার আগেই গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে।
দীপঙ্কর খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। তারপরে আস্তে আস্তে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো।
মিস মাইকেলের তখন হাত খালি। এক কাপ চা করে খাচ্ছে।
বললে–কী হলো সেন? তোমাকে এত ওরিড় দেখাচ্ছে কেন? হোয়াট হ্যাপেনড?
দীপঙ্কর মুখটা আড়াল করে বললে–না কিছু হয়নি মেমসাহেব বললে–আজ যাবে সেন?
–কোথায়?
দীপঙ্করের কোনও কথা মনে ছিল না। তার মাথাটার ভেতর সব যেন গোলমাল হয়ে গিয়েছে।
মেমসাহেব বললে–আমার ফ্ল্যাটে। আমার অ্যালবামটা দেখাবো তোমায় চলো। অনেক কালেকশন আছে আমার–ভিভিয়ানের ছবিও দেখাবো, সে যে খাটে শুয়ে থাকতো সেটা দেখাবো, সে যে ড্রেসিং টেবলে বসে ড্রেস করতো সেটা দেখাবো চলো
তারপর হঠাৎ দীপঙ্করের মুখের দিকে চেয়ে মেমসাহেব বললে–কি ভাবছো? এনিথিং রং উইথ ইউ?
দীপঙ্কর তখনও ভাবছিল–এ কেমন করে হলো! এ কেমন করে সম্ভব হলো! এমন ব্যবহার কেন করলে অনন্তবাবু! লক্ষ্মীদি আর অনন্তবাবু যে খেতে বসে এত হেসে গড়িয়ে পড়েছে, তার জন্যে তো কিছু বলেনি দীপঙ্কর। দীপঙ্কর সে-সব দেখতে পেয়েছে, তাও তো কেউ জানে না। সে তো চুপি চুপি দেখে আবার চুপি চুপি বেরিয়ে এসেছে। লক্ষ্মীদিও জানতে পারেনি, অনন্তবাবুও জানতে পারেনি। তার মনিব্যাগটা সেখানেই পড়েছিল–তবু পাছে তারা জানতে পারে, পাছে তাদের আনন্দের ব্যাঘাত হয়, তাই সেটা না-নিয়েই সে তো ফিরে এসেছে। সেই অত রাত্রে অত দূর থেকে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন পর্যন্ত হেঁটেই চলে এসেছে।
হঠাৎ গাঙ্গুলীবাবু ঘরে ঢুকলো। বললে–সেনবাবু, যাবেন নাকি?
–কোথায়?
–সে কি, এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? সেই কবিরাজী তেল কিনবেন না? মধ্যমনারায়ণ তেল? সেই পাগলের ওষুধটা!
দীপঙ্করের ঘেন্না হলো কথাটা ভাবতে। বললে–না গাঙ্গুলীবাবু, ও তেল আমার দরকার নেই–
–সে কি, এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? সত্যি বলছি তেলটা ভাল, আমি তো বলছি, যত দিনের পাগলই হোক, একটু মাখালেই সেরে যেত। একেবারে অব্যর্থ ওষুধ, দামটাও বেশি নয়।
দীপঙ্কর বললে–না গাঙ্গুলীবাবু, আমার দরকার নেই, আমি আর কারোর ভালোর জন্যে মাথা ঘামাবো না–যাদের আমি নিজের লোক মনে করে উপকার করবার চেষ্টা করি, তারাই আমাকে পর ভাবে, আপনি যান আজকে, আমার দেরি হবে যেতে–
গাঙ্গুলীবাবু কী ভেবে শেষপর্যন্ত চলে গেল। সত্যিই তো, কেন সে ভাবতে যাবে! লক্ষ্মীদির তো কোনও দুঃখ নেই। তার তো হাসতে বাধে না। দাতারবাবু পাগলই হোক আর যাই হোক, তাতে লক্ষ্মীদির তো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। লক্ষ্মীদি তো অনন্তবাবুর সঙ্গে সুখেই আছে!
খানিক পরে মিস মাইকেল বললে–চলো সেন–
দীপঙ্কর সে কথার উত্তর না দিয়ে বললে–জানো মিস মাইকেল, আমি যেখানেই মিশতে গিয়েছি, যার সঙ্গেই ভাব করতে গেছি, সেখানেই আমাকে বহু বাধা পেতে হয়েছে। আমি স্বার্থ চাইনি, অর্থ চাইনি, শুধু চেয়েছিলাম মিশতে, শুধু চেয়েছিলাম ভালবাসতে-কিন্তু সব জায়গা থেকেই আঘাত পেয়েছি কেবল–কেন এমন হয় বলতে পারো? কেন সংসারের মানুষরা ভালো হয় না? কেন সৎ হয় না, কেন ভালবাসতে জানে না কেউ, বলতে পারো?
মেমসাহেব খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল দীপঙ্করের দিকে। হঠাৎ দীপঙ্করের ভাবান্তর দেখে কেমন আশ্চর্য হয়ে গেল। এতদিন একসঙ্গে কাজ করছে, কিন্তু এর আগে এমন করে তো কথা বলেনি সেন!
বললে–চলো। কেন মানুষ ভাল হয় না আমি তোমায় বলবো, আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেব
মিস মাইকেল তাড়াতাড়ি কাগজপত্র সব গুছিয়ে রাখলে। মেসিনটা বন্ধ করে চাবি দিয়ে দিলে চাপরাশী। চায়ের সাজ-সরঞ্জাম সব গুছিয়ে রেখে আলমারিতে চাবি লাগিয়ে দিলে। রবিনসন সাহেব চলে গেছে।
সব ঠিক করে বেরোতে যাবার বন্দোবস্ত করছে, এমন সময় হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও দুম দুম করে কয়েকবার বিকট আওয়াজ হলো। বন্দুক কিম্বা রিভলভারের শব্দ। অনেক লোকের চিৎকারের শব্দ কানে এল। কাছাকাছি যেন কোথাও গণ্ডগোল শুরু হলো। মিস মাইকেল আর্তনাদ করে উঠেছে।
–সেন, স্টপ, স্ট-ফায়ারিং–ফায়ারিং হচ্ছে, স্টপ–
তাড়াতাড়ি দীপঙ্কর আবার ঘরের ভেতর ঢুকলো। মেমসাহেব বললে–ক্লোজ দি ডোর–ক্লোজ ইটুকুইক
অনেকক্ষণ ধরে যেন অনেক গোলমাল চলতে লাগলো কাছাকাছি। দরজা বন্ধ ঘরের ভেতর মিস মাইকেল আর দীপঙ্কর ঘন হয়ে বসলো। মিস মাইকেল দীপঙ্করের হাত দুটো ধরে রাখলে জোর করে। বললে–বাইরে যেও না, এখানে থাকো-ফায়ারিং হচ্ছে–
হঠাৎ গাঙ্গুলীবাবু আবার দৌড়ে ফিরে এসেছে। তখনও হাঁফাচ্ছে। বললে–সর্বনাশ হয়েছে সেনবাবু, রাইটার্স বিল্ডিং-এ গুলি চলছে
–কেন?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–সমস্ত লোকজন যে-যেদিকে পারছে পালাচ্ছে-পুলিসে পুলিসে ছেয়ে গেছে একেবারে, আমি দৌড়তে দৌড়তে আবার চলে এসেছি–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছে, কিছু শুনলেন?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–কর্নেল সিমসনকে স্বদেশীরা খুন করেছে–জেলখানার আই জি। সাহেব আপিসের ভেতরে বসে ছিল, হঠাৎ স্বদেশীরা ঢুকে একেবারে বুকের ওপর গুলি করেছে–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করল-কারা মেরেছে জানেন? শুনলেন কিছু?
গাঙ্গুলীবাবু বললে–অত শোনবার সময় হলো না, গুলির আওয়াজ পেয়েই আমি তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসেছি মশাই–
অবশ্য পরের দিনই খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। দীপঙ্কর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও কিরণের নামটা পেলে না। কিরণ ধরা পড়বার ছেলে অবশ্য নয়। তবু দীপঙ্কর যেন আশ্বস্ত হলো। সেদিন সমস্ত ডালহৌসী স্কোয়ারটাই যেন একটা আগুনের কুণ্ড হয়ে উঠেছিল। অসংখ্য পুলিস আর পুলিস-সার্জেন্ট, চারিদিকে ঘেরাও করে ফেলেছিল সবাইকে। বহু নির্দোষ লোককেও লালবাজারের থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মিস মাইকেলের মুখটা ভয়ে একেবারে লাল হয়ে উঠেছিল। বয়স কম নয় মেমসাহেবের। লিপস্টিক রুজ আর পাউডারের আড়ালে বয়সটা ঢেকে রাখতো। বললে–আমি কী করে বাড়ি যাবো সেন?
দীপঙ্কর বললে–একটু থামুক, আমি তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো–
সমস্ত ডালহৌসী স্কোয়ারটায় তখন সে কী উত্তেজনা! কখন স্বদেশীরা ঢুকেছিল ভেতরে কেউ জানে না। পাকা নিখুঁত সাহেবী পোশাক-পরা তিনজন ছেলে ঢুকেছে রাইটার্স বিল্ডিং-এর ভেতরে। সবাই ভেবেছে, হয় খাঁটি সাহেব নয় তো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। সিমসন সাহেব তখন ভারি ব্যস্ত-সামনে সেকশনের বড়বাবু ফাইল দেখাতে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ দরজাটা খুলে যেতেই সাহেব বলে উঠেছে-হুঁজু দ্যাট? কে?
সিমসন সাহেবের ঘরে অনুমতি না নিয়ে ঢোকা অপরাধ!
–হু আর ইউ?
কিন্তু কথাটা পুরো বলতেও পারলে না সাহেব। তার আগেই একটা গুলি এসে মুখে লাগলো। আর লেখা হলো না সাহেবের। হাত থেকে কলমটা খসে পড়লো।
বাইরে হোম সেক্রেটারী আলবিয়ন সাহেবের ঘর। আলবিয়ন মারে।
সেখানে গিয়ে একজন জিজ্ঞেস করলে-মারে সাব্ টেবল পর হ্যায়?
উত্তরের জন্যে আর অপেক্ষা করেনি কেউ। ঘরের কাঁচে গুলি ছুঁড়তেই ঘরের দরজা ভেঙে গেল। আওয়াজ পেয়েই পুলিসের ইন্সপেক্টর জেনারেল ক্রেগ সাহেব দৌড়ে এসে গুলি ছুঁড়েছে। অ্যাসিস্ট্যোন্ট ইনপেক্টর জেনারেল জোনস সাহেবও ততক্ষণে বেরিয়ে এসে গুলি ছুঁড়েছে। কিন্তু কারোর গুলিই ঠিক লোকের গায়ে লাগলো না। তারা ততক্ষণে পাসপোর্ট আপিসের দিকে গেছে। সেখানে রিভলবারে গুলি ভর্তি করে নিয়ে বেরিয়ে আসছিল। জুডিসিয়াল সেক্রেটারী মিস্টার নেলসনের ঘরটা পাশেই। নেলসন সাহেব ঘর থেকে উঁকি মারতেই তার গায়ে একটা গুলি এসে লাগলো। একটা বিকট আর্তনাদ উঠলো মিস্টার নেলসনের মুখ দিয়ে।
পাশেই ছিল প্রেন্টিশ সাহেবের ঘর। দৌড়তে দৌড়তে নেলসন সাহেব সেই ঘরে এসে ঢুকলো।
বাইরে রাইটার্স বিল্ডিং-এর করিডোরে তখন গুলি ছোঁড়াছুঁড়ি চলেছে। জোনস নেলসন সাহেবের বডিগার্ড গুলি ছুঁড়ছে স্বদেশীদের লক্ষ্য করে-ওরাও ছুঁড়ছে।
তেতলায় এডুকেশন সেক্রেটারী স্টেপলটন সাহেবের ঘর। স্টেপলটন সাহেব খবর পেয়েই লালবাজারে টেগার্ট সাহেবকে টেলিফোন করে দিলে।
লালবাজার থেকে এসে হাজির হলো শুধু টেগার্ট নয়, গর্ডন সাহেব, বার্ট সাহেব, সবাই। লালবাজারের সমস্ত পুলিস এসে তখন রাইটার্স বিল্ডিং ঘিরে ফেলেছে। আপিস পাড়ার যত লোক মজা দেখতে এসেছিল, সবাইকে অ্যারেস্ট করে নিয়েছে পুলিস।
বার্ট সাহেব তখন সিমসন সাহেবের ঘরে ঢুকলো। দেখলে-চেয়ারে বসে আছে একজন লোক হেলান দিয়ে। আর দুজন টেবিলের নিচে বসে আছে।
খবর পেয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো টেগার্ট সাহেব। যে ছেলেটা চেয়ারে বসে ছিল, তাকে তখন ধরা অবান্তর। সে বোধহয় খানিক আগেই বিষ খেয়েছে। মাথাটা ঝুলছে তখনও কাত হয়ে।
টেগার্ট সাহেব টেবিলের নিচে রিভলবার বাগিয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো–হ্যান্ডস্ আপ–
হাত তোলবার ক্ষমতাই তখন আর তাদের নেই। দুজনেই রিভলবার দিয়ে আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করেছিল-কিন্তু তখন তাদের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছে। দুজনেই তখন ধুঁকছে।
টেগার্ট সাহেব জিজ্ঞেস করলে–কী নাম তোমার?
–দীনেশ গুপ্ত!
–আর তোমার?
–বিনয় বসু।
এই বিনয় বসুকে ধরিয়ে দেবার জন্যেই পুলিস এতদিন দশ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। একেই এতদিন খুঁজে বেড়াচ্ছিল পুলিস।
ততক্ষণে রাইটার্স বিল্ডিং-এর বাইরে পুলিস লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে সবাইকে ভাগগা, ভাগো, শালা লোগ–
কুকুর-বেড়ালের মত তাড়া করে এল পুলিস। তারপর হাসপাতালে বিনয় বসু মারা গেল। আর তারপর কিছুদিন পরে দীনশে গুপ্তেরও ফাঁসি হয়ে গেল একদিন।
কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন তখন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তিনি শোকসভায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিলেন। তিনি বললেন–
“We have read instances in history, where the perpetrators of acts like these in one generation having been punished for them, have been acclaimed as martyrs by the next generation. Therefore let us pay our respect to the courage and devotion shown by this young man in the pursuit of his ideal.”
তা মেমসাহেব সেদিন খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। থর থর করে কাঁপছিল। দীপঙ্কর যখন আপিস থেকে বেরোল, তখন সমস্ত জায়গাটাই বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। পুলিসে ছেয়ে গেছে জায়গাটা। আপিসেও যারা দেরি করে কাজ করে, তারা মাইনের দিন বলে সকাল-সকাল চলে গিয়েছে। দীপঙ্করের নিজের একবার মনে হলো হয়ত কিরণও এর পিছনে আছে। হয়ত শেষপর্যন্ত তাকেও ধরবে পুলিস! এবার ধরলে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না কিরণকে। এবার নিশ্চয়ই ফাঁসি হয়ে যাবে তার! সেই আপিসের ঘরের মধ্যে বসেও দীপঙ্করের নিজেকে আবার বড় ছোট মনে হয়েছিল। কিরণের তুলনায় অনেক ছোট! কিরণের মা, কিরণের বিধবা মার কাছে খবরটা যাবে। এই সেদিন কিরণের বাবা গেছে, এবার কিরণ গেলে মাসীমা আর হয়ত বাঁচবে না। আবার হয়ত দীপঙ্করকেই শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে মাসীকে!
মেমসাহেব বললে–আমার বড় ভয় করছে সেন–
গাঙ্গুলীবাবু আগেই চলে গিয়েছিল। গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রী পাঁচ বছর পরে সেরে উঠেছে। বেশি দেরি করে গাঙ্গুলীবাবু বাড়ি যেতে চায় না। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী নিয়ে এতদিন পরে সুখের সংসার করতে চায় গাঙ্গুলীবাবু। মাইনে কম পায়, তাতে কী ক্ষতি! সত্যিই তো, সুখটাই বড়। শান্তিটাই বড়।
দীপঙ্কর বললে–চলো, আমি তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেব মিস মাইকেল–
কোথায়, কোন্ দিকে মিস মাইকেলের বাড়ি তা জানতো না দীপঙ্কর। মিস মাইকেলই অনেক কষ্টে একটা ট্যাক্সি যোগাড় করে উঠরো। দীপঙ্কর সামনের সীটে বসতে যাচ্ছিল। মেমসাহেব বললে–ওকি, ভেতরে বোস, আমার পাশে–
ট্যাক্সি চলার পর মিস মাইকেল আবার বললে–আমার এখনও ভয় করছে সেন–
–কেন, ভয় করবার কী আছে? আমি তো আছি।
মিস মাইকেল বললে–সব ইউরোপীয়ানদের এইরকম করে খুন করলে, কী হবে শেষকালে?
দীপঙ্কর বললে–তা তুমি তো ইউরোপীয়ান নও, তুমি তো ইন্ডিয়ান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান–তোমার ভয় কী?
কিন্তু সে-কথা কি আর তখন কেউ শুনবে। সেদিন যখন আসবে, তখন ইন্ডিয়ানরা সবাইকে খুন করবে। স্বরাজ এলে ইউরোপীয়ান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, কেউ-ই তখন রেহাই পাবে না। কিরণও একদিন সেই কথাই বলেছিল।
মিস মাইকেল বললে–ভিভিয়ান বেশ আরামে আছে সেন-সে ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, এখন হয়ে গেল ইউরোপীয়ান–
ট্যাক্সির ভেতরে বসে দীপঙ্কর বাইরের রাস্তার দিকে চেয়ে দেখছিল। সব যেন ফাঁকা হয়ে গেছে এদিকটা। এই আপিসপাড়াটা। চৌরঙ্গীতে তখনও লোকজন রয়েছে। জায়গায়-জায়গায় জটলা হচ্ছে। পুলিস দেখলেই দল ভেঙে সরে যাচ্ছে। লক্ষ্মীদির কথাও মনে পড়লো। এত করে দেখা করতে বলে আসার পরও অনন্তবাবু দেখা করলে না। ভালোই হয়েছে। তার কিসের গরজ! লক্ষ্মীদির সুবিধে হোক, অসুবিধে হোক, আর কিছু দেখবার দরকার নেই। শুধু লক্ষ্মীদি নয়, কারোরই সুবিধে-অসুবিধে দেখবার গরজ আর তার নেই।
মিস মাইকেল হঠাৎ বললে–কী ভাবছো সেন?
দীপঙ্কর বললে–কই, কিছু ভাবছি না তো।
–খুব আনমাইন্ডফুল দেখছি যে তোমাকে?
দীপঙ্কর বললে–অন্য কথা ভাবছিলাম মিস মাইকেল–
–তুমি এত ভাবো কেন? সব সময়েই দেখেছি তুমি ভাবো?
দীপঙ্কর বললে–না, দেখ আজ মিস্টার রবিনসনকে বলে একটা কাজের কথা বলেছিলাম। সাহেবও রাজী ছিল। আমার এক রিলেটিভের জন্যে। তাকে বলেছিলুম আমার কাছে আসতে-কোনও ঘুষ দিতে হবে না, আমি তার কাজ করে দেব–
হঠাৎ ট্যাক্সিটা এসে একটা গলির মধ্যে থামলো।
মিস মাইকেল নেমে পড়লো। বললে–এখানেই আমার বাড়ি–
দীপঙ্কর বললে–তা হলে এবার আমি আসি মিস মাইকেল–
মিস মাইকেল হঠাৎ দীপঙ্করের হাতটা ধরে ফেললে–না-না, সে কি, আমার ফ্ল্যাটে এসো, একটুখানির জন্য আসতেই হবে বেশিক্ষণ তোমায় আটকাবো না, আমার ঘরে কেউ নেই। আমি এলোন–
শেষপর্যন্ত জোর করেই টেনে নিয়ে গেল মেমসাহেব। কেন যে তাকে তার ঘরে নিয়ে যাবার এত আকর্ষণ, কে জানে! এ-ও কলকাতার আর-একটা অঙ্গ। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে ছোটবেলায় অনেক জায়গায় বেড়াতে বেরিয়েছে দীপঙ্কর, কিন্তু এমন জায়গায় কখনও আসেনি। ছোট ছোট দোকান চারদিকে। মাংসের দোকান, চায়ের দোকান, দরজির দোকান। চারিদিকেই ভিড়। এত ভিড় যেন কালীঘাটেও নেই। শহরের একেবারে কেন্দ্রেও যে এমন পাড়া আছে তা আগে জানতো না দীপঙ্কর। ছোট ছোট অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের মেয়ে খড়ম পায়ে দিয়ে মগে করে দোকান থেকে চা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। দোকানগুলো সবই মুসলমানদের। লুঙ্গি পরে বেচা-কেনা করছে। মেম সাহেবদের সঙ্গে খুব ভাব। মেমসাহেবরা একলাই দোকানে গিয়ে সওদা করছে। গম্ গম্ করছে সমস্ত পাড়াটা। এই যে একটু আগেই রাইটার্স বিল্ডিং-এ এত বড় কাণ্ড হয়ে গেল, এখানে যেন তার কোনও আভাসই নেই। সহজ স্বাভাবিক জীবন এখানে। শিস দিতে দিতে কেল্লা থেকে টমিরা ঘুরছে। হাতে ছোট ছোট ছড়ি। লাল-লাল মুখ। খাকী পোশাক। বিরাট বিরাট আস্ত গরুর মাংস টাঙানো রয়েছে দোকানের সামনে। রাত্রিবেলাও মাছি এসে বসছে মাংসের গায়ে। টমিগুলো কিছু কিনছে না, কিন্তু খুব চেনা-লোকের মত রাস্তার চারদিকে দেখতে দেখতে চলেছে।
দীপঙ্কর বললে–আমি আর ভেতরে যাবো না আজ, অন্য দিন বরং যাবো–
–কেন? কী হলো তোমার বলো তো?
দীপঙ্কর বললে–মনটা সারাদিন খুব খারাপ হয়ে আছে আজ
–কেন? খারাপ কেন? এস, পাঁচ মিনিটের জন্যে এসো ভেতরে
কাঠের সিঁড়ি। পুরনো বাড়ি। দেয়ালে খড়ি দিয়ে নানারকম ছবি আঁকা। এ-বাড়ির বাসিন্দারাই এঁকে রেখেছে। মস্তবড় একটা মুখ সিগারেট খাচ্ছে। দুটো মুখ পরস্পরকে চুমু খাচ্ছে। এমনি নানারকমের ছবি সব।
মেমসাহেব সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললে–কেন, মন খারাপ কেন তোমার সেন? বস্ কিছু বলেছে?
–না-না, আপিসের কোনও কিছু ব্যাপারই নয়।
–তা হলে?
মেমসাহেব একটু কটাক্ষ করলো দীপঙ্করের দিকে। বললে–এনি লাভ-অ্যাফেয়ার? কোনও ভালোবাসার ব্যাপার?
–না-না, ভালোবাসা-টাসা আমার নেই মেমসাহেব। আমিও তোমার মত এলো
মেমসাহেব চাবি দিয়ে দরজার তালাটা খুললে। ঘরের জানালা-দরজা সব বন্ধ ছিল। একটা যেন কেমন ভিজে গন্ধ ঘরের ভেতর। জানলা খুলে দিতেই বাইরের হাওয়া
একটু ঢুকলো ভেতরে। দীপঙ্কর ঘরের ভেতরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলো।
মেমসাহেব বললে–আমি আগে আপিসের কোনও লোককে ঘরে আনিনি জানো, তুমিই প্রথম এলে
তারপর একটু থেমে বললে–দাঁড়াও তোমার জন্যে চা করি, বেশি দেরি হবে না
দীপঙ্কর বললে–আমি তো চা খাই না তুমি জানো–
–তা হলে কী ক্লাবে তুমি?
–কিচ্ছু খাবো না আমি, শুধু তোমার অ্যালবামটা দেখেই চলে যাবো, আমার মা ভাববে বেশি দেরি হলে।
–তা হলে একটু পডিং খাও
–বলে মেমসাহেব পর্দার আড়ালে গিয়ে কী করতে লাগলো। খুটখাট শব্দ। মাঝে মাঝে টুং-টাং শব্দ হচ্ছে। তারপর স্টোভ জ্বালার শব্দ হলো। ছোট্ট একটুখানি ঘর। কিন্তু পর্দার, আলো, পুরনো ফার্নিচারের বাহুল্যে ঘরটা ভরে আছে। দেয়ালে অনেকগুলো ছবি। দেয়াল-ভর্তি ছবি। অনেক পুরুষ অনেক মেয়ের ছবি। কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন ছেলে আর একজন মেয়ে। কোথাও দুটি মেয়ে দুজনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। ঘরের সিলিং থেকে ঝুলছে রঙিন কাগজের ফানুস–
হঠাৎ পর্দার ভেতর থেকে মমসাহেব বেরিয়ে এল। হাতে এক কাপ চা আর দুটো ডিশে পুডিং–
মেমসাহেব দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–আবার ভাবছো নাকি সেন? দীপঙ্কর ধরা পড়ে গিয়ে হাসলো। বললে–না ভাবছি না, আর ভাববো না–
তারপর হঠাৎ মিস মাইকেলকে যেন বড় ভালো লোক বলে মনে হলো। কেন তাকে মেমসাহেব ডেকে আনলে, এত লোক থাকতে? কই, কেউ তো দীপঙ্করকে এত আগ্রহ করে ডাকে না। শুধু কি নিজের কথা বলবার জন্যে!
মেমসাহেব বললে–ভাবলে লাইফের কূল-কিনারা পাবে না সেন, তার চেয়ে খাও–
দীপঙ্কর বললে–তুমি নিজেই রান্না করো নাকি?
–নিজে রান্না করবো না তো কে করবে? কুক? আমার একলার লাইফ, কুক রেখে কী হবে! আর আমি মাইনে কী পাই, তা তো তুমি জানো! আগে যখন ভিভিয়ান ছিল, তখন একদিন ভিভিয়ান রাঁধতো, একদিন আমি রাঁধতুম
হঠাৎ বাইরে দোতলার ওপর কোথায় যেন খুব নাচ-গান আরম্ভ হলো। মাথার ওপর দুম দুম করে নাচছে কারা!
দীপঙ্কর বললে–কে নাচছে?
–ও কেউ না, ভাড়াটেদের বাড়ির মেয়েরা।
খাবার পর মেমসাহেব অনেকগুলো অ্যালবাম বার করলে। বেশ চামড়ায় বাঁধানো অ্যালবাম। দীপঙ্কর ছবিগুলো দেখতে লাগলো। মিস মাইকেলের কত রকমের ভঙ্গির ছবি সব। জোড়ায় জোড়ায় ছবি। বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে বিভিন্ন ভঙ্গি। কোথাও মিস মাইকেল গাউন পরেছে। কোথাও প্রায় সমস্ত শরীরটাই দেখা যায়, শুধু হয়ত কোমরে একটুখানি কাপড়ের টুকরো লেগে আছে। দীপঙ্কর দেখতে দেখতে একবার চোখ নামিয়ে নিলে। কান মুখ কপাল সব যেন তার ঝা-ঝা করতে লাগলো। এসব ছবি কেন তাকে দেখাচ্ছে মেমসাহেব? ওপরে নাচের সঙ্গে গানও চলছে মনে হলো। দীপঙ্করের মনে হলো এখনি উঠে যায় সে! এ-সব ছবি তাকে দেখানো কী দরকার!
–কেমন সেন? হাউ ডু ইউ লাইক ইট? তোমার পছন্দ হয়?
কী আশ্চর্য! এরা কী! এদের একটু লজ্জাও নেই! একটু দ্বিধা-সঙ্কোচ কিছুই নেই।
–আচ্ছা সেন, আমার ফিগার ভাল না ভিভিয়ানের? সত্যি বল তো? দীপঙ্কর এতণে মুখ তুললে।
বললে–এসব আমাকে দেখাচ্ছ কেন মেমসাহেব? আমি তোমাদের ফিগারের কী বুঝি?
মেমসাহেব হেসে উঠলো। বললে–তুমি কখনও মেয়েদের সঙ্গে মেশোনি? তোমার কোনও লেডী-লাভ নেই?
মনে আছে, সেদিন মিস মাইকেলের ঘরে বসে দীপঙ্কর যেন অন্য এক জগতে চলে গিয়েছিল। যে-মিস মাইকেল আপিসে স্টেনোগ্রাফার, সে যেন এই মেয়ে নয়। মিস মাইকেল মানুষের এই পৃথিবীতে এসে যেন হেরে গিয়েছিল। কবে যাত্রা শুরু করেছিল একদিন আর সকলের সঙ্গে। যৌবন ছিল সেদিন। তার জন্যে দলে দলে ইয়ং ম্যানরা এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। মোটরবাইক নিয়ে আসতো সন্ধ্যেবেলা হলেই ভিড় করতো তারা নিচেয়। শিস দিত নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
মেমসাহেব বললে–আমার তখন তোমার মত বয়েস, জানো সেন–
–সেই জন্যেই কি তুমি আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছ?
মেমসাহেব হাসলো। বললে–না, ডেকেছি, কারণ তুমি তবু বুঝতে পারবে তারপর যখন তুমি বড় হয়ে যাবে, তোমার বয়েস বেড়ে যাবে, তখন তো আর বুঝতে পারবে না
মেমসাহেবের ওপর আর ঘৃণা হলো না দীপঙ্করের। মেমসাহেবের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। সত্যিই দেখলে মায়া হয়। এখন আর কেউ আসে না। এখন আর সেই আগেকার মত নিচে মোটর বাইক নিয়ে এসে কেউ শিস দিয়ে ডাকে না তাকে। এখন যারা আসে, তাদের লক্ষ্য অন্য জায়গায়।
মেমসাহেবের গলাটা করুণ হয়ে উঠলো বড়। বললে–এখন আর কেউ আসে না সেন–অবশ্য আসে এক-একজন মাঝে মাঝে
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কারা?
মেমসাহেব সে-কথার উত্তর দিলে না। বললে–আগে যারা আসতো, তারা আমার জন্যেই আসতো আর ভিভিয়ানের ফিগার তো দেখছো, ভিভিয়ানের সেই জন্যে হিংসে ছিল আমার ওপর। আমি নিজে ভিভিয়ানকে কত ফ্রেন্ড জুটিয়ে দিয়েছি। ভিভিয়ানের জন্যে আমি কতদিন খারাপ করে সেজেছি
তারপর হঠাৎ মেমসাহেব আলমারি খুলে একটা প্যাকেট বার করলে।
বললে–এই দেখ–
বেশ যত্ন করে সিল্কের ফিতে দিয়ে বাঁধা প্যাকেট। দামী জিনিসের মত তুলে রেখে দিয়েছে মেমসাহেব। প্যাকেটটা বার করতেই ভর ভর করে সেন্টের গন্ধে ভরে গেল ঘরটা। আস্তে আস্তে মিস মাইকেল প্যাকেটটা খুললে। নানা রং-এর চিঠি। কতরকম বিচিত্র কাগজ। কত বিচিত্র ছবি আঁকা। কেউ লিখেছে ‘মাই লাভ’, কেউ লিখেছে ‘ডিয়ারেস্ট’, কেউ লিখেছে ‘মাই সুইট’-কত যে বিচিত্র সম্বোধন!
মেমসাহেব বললে–এই চিঠিগুলো সব মাঝে-মাঝে খুলে পড়ি, জানো সেন, রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ি–পড়তে পড়তে আমার পুরনো কথাগুলো সব মনে পড়ে যায় তখন যেন আবার পুরনো দিনে ফিরে যাই আমি–
মেমসাহেবের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। এ-ও একরকম মানুষ তো! কলকাতা শহরে কত লোকের কত রকম সমস্যা–কিন্তু এ-সমস্যার কথা সত্যিই দীপঙ্কর জানতো না। পাঁচশো তেত্রিশটা চিঠি যারা লিখেছিল, তারা কোথায় চলে গেছে, কেউ জানে না হয়ত! এরাই একদিন এই ফ্ল্যাট-বাড়ির তলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে শিস দিয়েছে। কেউ কেউ হয়ত আবার মিস মাইকেলকে মোটরবাইকের পেছনে নিয়ে ঘুরিয়েছে। হোটেলে খাইয়েছে। নেচেছে। তারপর হয়ত অনেক রাত্রে আবার এইখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে। তখন হয়ত মিস মাইকেল নেশায় টলছে!
–এরা সব কোথায় গেল মিস মাইকেল?
মিস মাইকেল বললে–কখন যে সবাই কোন দিকে ছিটকে ছড়িয়ে গেল, তার হিসেব রাখবারও সময় পাইনি সেন, মাঝে-মাঝে এক-একজনের সঙ্গে দেখা হয়। সেদিন আর্থারের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ হগ মার্কেটে, সঙ্গে তার মিসেস রয়েছে, বেবীরা রয়েছে, আমি চিনতে পারলুম, কিন্তু আর্থার আমাকে চিনতেও পারলে না—অথচ–
–অথচ?
মিস মাইকেল বলতে লাগলো–অথচ ওই আর্থারের কত চিঠি আছে এর মধ্যে, ওই আর্থার আর আমি একবার ওর ফ্ল্যাটে সেভেনটি-টু আওয়ার্স একসঙ্গে কাটিয়েছি, একসঙ্গে খেয়েছি, একসঙ্গে জেগেছি, একসঙ্গে ঘুমিয়েছি, একসঙ্গে ড্রিঙ্ক করেছি–
–তুমি ড্রিঙ্ক করো নাকি মিস মাইকেল?
–ড্রিঙ্ক?
মিস মাইকেল খিল খিল করে হেসে উঠলো।–ড্রিঙ্ক করবো না? ড্রিঙ্ক না করলে কবে সুইসাইড করতুম সেন, আমি রোজ ড্রিঙ্ক করি, এই দেখ–
হঠাৎ উঠে গিয়ে মিস মাইকেল তার কাবার্ডটা খুলে একটা বোতল বার করলে। দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–তুমি খাবে?
–না-না–দীপঙ্কর জোরে জোরে হাত নাড়লে।
আর-একটু হলেই মুশকিলে পড়েছিল দীপঙ্কর। হয়ত পীড়াপীড়ি করতে খুব।
তবু মেমসাহেব বললে–খাও না, একটুখানি খাও-দেখবে এ-খেলে তুমি তোমার সব ওরিজ ভুলে যাবে, সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকতে পারবে–খাও না–
অদ্ভুত লাগলো দীপঙ্করের। হেসে বললে–না, না–আমার কোনও ওরিজ নেই মেমসাহেব-আমার কোনও সমস্যাই নেই। যাদের নিয়ে আমার ভাবনা ছিল, তারা সবাই কোথায় চলে গেছে, সবাই ভুলে গেছে আমাকে–আমি আবার একলা হয়ে গেছি–
মেমসাহেব বললে–আমারই কি আগে কোনও ভাবনা ছিল? কোনও ভাবনা ছিল। আমি আর ভিভিয়ান দিনরাত ফুর্তি করেছি, দিনরাত ড্রিঙ্ক করেছি তখন–তখন কি ভিভিয়ান জানতো যে, সে হবে ফিল্ম-স্টার, আর আমি রেলওয়ে আপিসে চিরকাল রট করবো।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-ভিভিয়ান তোমাকে এখনও চিঠি লেখে?
মেমসাহেব বললে–না সেন, এখন সে আমার কথা ভুলেই গেছে, এখন সে রেলওয়ের কথা ভুলেই গেছে–অথচ আমার জন্যেই সে আজ এত ফেমা হতে পারলো, আমি আমার ফ্রেন্ডের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলুম বলেই সে আজ ফি-স্টার
দীপঙ্কর মাথা নিচু করে দু-একখানা চিঠি আবার পড়তে লাগলো। কত ভালবাসার কথা রয়েছে চিঠিগুলোতে সব। কী আগ্রহ সকলের মিস মাইকেলের জন্যে! কত চুমু পাঠিয়ে দিয়েছে, কত প্রেম-নিবেদন। পড়তে পড়তে দীপঙ্করের সত্যিই হাসি পেতে লাগলো। ভালবাসা বুঝি একেই বলে। কাছাকাছি থাকা, তবু দুবেলা চিঠি লেখা। চিঠি না পেলে মন খারাপ হয়ে যাওয়া। আর সেই চিঠিগুলো সিল্কের ফিতে জড়িয়ে যত্ন করে তুলে রাখা।
দোতলার ওপরে নাচ-গান তখনও চলছে।
দীপঙ্কর বললে–এবার উঠি মিস মাইকেল, তোমার অনেক দেরি করে দিলাম
–না, আর একটু বোস।
বলে মিস মাইকেল চিঠিগুলো একে-একে আবার বেঁধে ফেললে ভাল করে। তারপর সেগুলো আলমারির ভেতরে তুলে রাখলে। আশ্চর্য, চিঠিগুলো অত যত্ন করে রেখে দিয়ে কী লাভ হবে মিস মাইকেলের! ওগুলো এখন আর কী কাজে আসবে।
–মেমসাহেব?
বাইরের দরজায় একটু আস্তে টোকা পড়লো। শুনেই মিস মাইকেল উঠলো। বললে–কে? কোন্ হ্যায়?
দরজাটা খুলতেই একটা লুঙ্গি-পরা ছেলে এগিয়ে এল। বললে–মেমসাব-একঠো সাব আয়া–
মিস মাইকেলের মুখখানা যেন কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বললে–তুম্ যাও রহিম-যাও তুমি
রহিম তবু যায় না। দাঁড়িয়ে রইল মেমসাহেবের মুখের দিকে চেয়ে। বললে–সাহেব এসেছে মেমসাহেব, খুব বড় আদমী, খুব বড় গাড়ি নিয়ে এসেছে বিলিতি সাহেব।
মেমসাহেব বললে–তুই আর কোথাও নিয়ে যা সাহেবকে, আমার সময় নেই এখন
তবু রহিম ছাড়ে না। বলে–সব মিসিবাবার ঘরে আদমী আছে মেমসাব, আজ কেউ খালি নেই–
-বেরো এখান থেকে, গেট আউট—
মিস মাইকেল হঠাৎ যেন রেগে আগুন হয়ে গেল। বললে–বলছি আমার সময় নেই, তবু কথা বলছে, বেরিয়ে যা–
এবার রহিমের মুখের ওপরেই দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলে মিস মাইকেল। তারপর আস্তে আস্তে এসে আবার চেয়ারটায় বসলো। দীপঙ্কর দেখলে মেমসাহেবের মুখটা কেমন হয়ে গেছে যেন! হঠাৎ যেন কেউ অপমান করেছে মিস মাইকেলকে। খানিকক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারলো না মেমসাহেব।
দীপঙ্কর বললে–আমি তা হলে উঠি মিস মাইকেল
মিস মাইকেল চোখ তুলে চাইতে পারলে না দীপঙ্করের দিকে। দুই হাত দিয়ে হঠাৎ নিজের মুখখানা ঢেকে ফেললে। তারপর খানিকক্ষণের জন্যে আর মুখই তুলতে পারলো উঁচু করে।
বড় মুশকিলে পড়লো দীপঙ্কর। লজ্জাটা যেন মিস মাইকেলের নয়, দীপঙ্করের। হঠাৎ মেমসাহেবকে না-বলেও যাওয়া যায় না। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল দীপঙ্কর। মিস মাইকেলের দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো।
–মিস মাইকেল–
মেমসাহেব এতক্ষণে মুখ তুললো। এরই মধ্যে চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল হয়ে গেছে। ফুলে উঠেছে অনেক। ভিজে-ভিজে রয়েছে চোখের পাতাগুলো।
–মিস মাইকেল, এবার আমি উঠি?
মিস মাইকেলও দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–তুমি যা দেখলে, তা ভুলে যেও সেন, ফরগেট ইট, প্লিজ–
বলতে বলতে মেমসাহেব আবার মুখ নিচু করে ফেললে। মুখ নিচু করেই বললে–আমাকে ভুল বুঝো না সেন, প্লিজ ভুল বুঝো না–চিরকাল আমি এমন ছিলুম না, এর জন্যে আর কেউ দায়ী নয়, কেউ দায়ী নয়, কেউ দায়ী নয়-দায়ী শুধু ভিভিয়ান, ভিভিয়ান আমাকে পাগল করে দিয়েছে সেন, শি হ্যাঁজ রুইন্ড মাই লাইফ–
বলতে বলতে আর সামলাতে পারলে না মিস মাইকেল। একেবারে দীপঙ্করের সামনেই চোখে রুমাল চাপা দিলে।
তারপর বোধহয় হঠাৎ আবার সম্বিৎ ফিরে এল। চোখ মুখ মুছে বললে–অল রাইট তুমি আজ আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছ বলে ধন্যবাদ-কালকে আবার আপিসে দেখা হবে।
দীপঙ্করের কিছু বলবার ছিল না। বলতে পারলেও না। সমস্ত ঘটনাটা যেন একটা স্বপ্নের মত ঘটে গেল। হয়ত ও-পাড়ার জীবনে এ-ঘটনা নিত্য-নৈমিত্তিক। এখানে এমন ঘটনা রোজকার। তবু সব দেখে যেন নির্বাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। যে-মেমসাহেবকে রোজ আপিসে দেখে, এ যেন সে-মেমসাহেব নয়। কবেকার কোন বন্ধুর ভাগ্যের উন্নতিতে মেমসাহেব যেন মরীয়া হয়ে উঠেছে। একজন যশের শিখরে উঠে গেছে অদৃশ্য এক ভাগ্যের দৌলতে, আর অন্য একজন এখানেই পড়ে আছে তার ভাঙা অদৃষ্টের সমস্ত হাহাকার নিয়ে। এও কি কম ট্র্যাজেডি! তবু দীপঙ্কর এখানে আজ এসেছিল বলেই তো এমন করে জীবনের আর-একটা দিক দেখতে পেলে। সেই কালীঘাট বাজারের পেছনে ছিটে-ফোঁটার যে-জীবন, এখানে এই কলকাতা শহরের একেবারে কেন্দ্রেও যেন সেই জীবনের পুনরাবৃত্তি দেখে গেল দীপঙ্কর। অথচ সেই কালীঘাটের বাজারের জগতে যারা নিঃশব্দে বিচরণ করে তারা মানুষের চোখে ঘৃণ্য বলে ঘোষিত হয়। আর এখানে, এই সভ্য জগতে যারা আসে তারা সম্ভ্রান্ত, তারা চিহ্নিত। তফাৎ শুধু এইটুকুই যে সেখানে যৌবনের বাজি খেলা চলে গোপনে, আর এখানে সশব্দে সগৌরবে, উচ্চ ঘোষণা করে! নির্লজ্জ, সদম্ভ এখানকার কারবার।
কিন্তু তখনও হয়ত দীপঙ্করের দেখবার সামান্য কিছু বাকি ছিল।
বাইরে দরজার কড়াটা আবার নড়ে উঠলো। বেশ সচকিত শব্দ এবার। বেশ উচ্চারিত।
আবার বোধ হয় রহিম এসেছে। অনুনয়ে, বিনয়ে আবার হয়ত মিস মাইকেলকে রাজী করাতে এসেছে।
–কে? কৌন হ্যায়?
চীনে পাড়াতে লক্ষ্মীদিকেও একদিন এমনি করে আগন্তুক সামলাতে হয়েছে। মিস মাইকেলের ঘরে দাঁড়িয়ে সেই দিনকার কথাগুলো মনে পড়লো দীপঙ্করের।
মিস মাইকেল বললে–একটু দাঁড়াও সেন। দেখি কে ডাকছে—
দরজাটা খুলতেই দীপঙ্কর যেন সামনে ভূত দেখলে।
মিস্টার ঘোষাল!
পেছনেও যেন আর একজন কে রয়েছে। অন্ধকারে ভাল করে দেখা গেল না তার মুখটা।
দীপঙ্কর দেখেই মিস্টার ঘোষাল এগিয়ে এল। বললে–হ্যাল্লো, আমি তোমাকে চিনি মনে হচ্ছে–
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠে বললে–আমি দীপঙ্কর সেন, জাপান-ট্র্যাফিক ক্লার্ক–
–হোয়াট ব্রট ইউ হিয়ার? তুমি এখানে কী করতে?
দীপঙ্করকে এর উত্তর দিতে হলো না। মিস মাইকেলই বুঝিয়ে দিলে। রাইটার্স বিল্ডিং-এ গুলি চালানোর জন্য মেমসাহেব নিজেই সেনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। সেন আসতে রাজী হয়নি। বলতে গেলে মেমসাহেবের পীড়াপীড়িতেই সেন এখানে এসেছে স্যার!
–আই সী!
বোধহয় বেশি সময় ছিল না মিস্টার ঘোষালের হাতে। ভারি ব্যস্তত্রস্ত ভাব। যেন একটু আগেই কোথা থেকে ঘুরে এসেছে। সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে। মিস মাইকেলকে হঠাৎ বাইরে ডেকে নিয়ে গেল মিস্টার ঘোষাল। দীপঙ্কর একলা বসে রইল ঘরে। বাইরে নিচু গলায় কী যেন সব কথা হতে লাগলো ওদের।
দীপঙ্কর চুপ করে বসে বসে ঘামতে লাগলো।
এখানে কেন এল মিস্টার ঘোষাল! এত জায়গা থাকতে এই মিস মাইকেলের বাড়িতে! যে-লোক আপিসে এত গম্ভীর হয়ে কথা বলে, সে-ই এখন হেসে কথা বললে দীপঙ্করের সঙ্গে! কী অদ্ভুত লোক! কী আশ্চর্য চরিত্র!
হঠাৎ মিস মাইকেল আবার ঘরে ঢুকেছে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে মিস্টার ঘোষাল চলে গেছে?
–যা।
–এখানে কেন এসেছিল, তোমার কাছে?
মেমসাহেব হাসলো। বললেও এসেছিল গার্লস্ খুঁজতে—
দীপঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেল। বললে–সে কি? গার্লস?
–এখানে, ওপরে নিচে সব ঘরে গার্লস পাওয়া যায় কিনা। আজকে কোথাও কিছু পাচ্ছিল, তাই আমি যোগাড় করে দিয়ে এলাম। মিস্টার ঘোষাল যে ব্যাচিলর বিয়ে করেনি, এই কাছেই ‘প্যালেস্ কোর্টে’ থাকে।
কিছুক্ষণ দীপঙ্করের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না।
তারপর উঠলো। বললে–আমি আসি তাহলে মিস মাইকেল–
–অল রাইট, কালকে আবার দেখা হবে।
তিন-চার তলা উঁচু বাড়ি। মিস মাইকেলের ঘর থেকে বেরিয়েই সিঁড়ি। কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। ওঠবার সময় নজরে পড়েনি দীপঙ্করের। মিস মাইকেলের সঙ্গেই চলে এসেছিল। বাইরে বেরিয়েই কেমন ভয় করতে লাগলো। বিরাট চওড়া কাটের সিঁড়ি। ওপরে নিচে একটাও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সর্বত্র যেন অনেক লোকের ভিড়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সব ঘরের ভেতর থেকে গান বাজনা নাচের শব্দ হচ্ছে। ছোট ছোট সুরের টুকরো, অচেনা গন্ধে সমস্ত জায়গাটা জম-জমাট। একতলার সিঁড়ির পাশের ঘরের পর্দাটা একটু ফাঁক করা ছিল। ভেতরে নজর যেতেই দেখলে একদল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে। ঝলমল করছে, কিলবিল করছে। সিল্ক আর সেন্টের ছড়াছড়ি। এ কোথায় তাকে নিয়ে এসেছে মিস মাইকেল!
হঠাৎ পেছনে দুম্ দুম্ করে অনেকগুলো পায়ের শব্দ হলো। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে যেন কয়েকজন নামছে। দীপঙ্কর সরে গিয়ে দাঁড়াল একটা কোণে।
আর তারপরেই একদল লোক সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একেবারে রাস্তায় গিয়ে পড়লো। দু’জন মেয়ে আর দুজন….
কিন্তু দীপঙ্কর আর একবার ভালো করে চেয়ে দেখলে। মিস্টার ঘোষাল আর অনন্ত বাবু। অনন্তরাও ভাবে! দুজনেই দুটো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ের হাত ধরে হাসতে হাসতে চলেছে।
৩২
রাস্তায় একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। দীপঙ্কর চিনতে পারলে। মিস্টার ঘোষালের গাড়ি। চারজনেই গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসলো। তারপর একটা যান্ত্রিক আর্তনাদ করে গাড়িটা ছেড়ে দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্করের চোখে মুখে এসে ছিটকে পড়লো ট্রেলের ধোয়া আর চারজনের অশ্লীল হাসি।
এ কোন জগতে এসে পড়েছে দীপঙ্কর! এরা কোথাকার জীব! সেই কিরণের সঙ্গে দেখা কলকাতার সঙ্গে এ তো মিলছে না! এ তো অন্য জগৎ। এখানকার স্বরাজ তো তারা চায়নি। ওই যারা বোমা রিভলবার নিয়ে টেগার্ট সাহেবকে খুন করবার চেষ্টা করছে, যারা রাইটার্স বিল্ডিং-এ ঢুকে কর্নেল সিমৃসনকে গুলি করল, যাদের সঙ্গতির জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত মনুমেন্টের তলায় এসে লেকচার দিলেন, তাদের সঙ্গে এদের যোগসূত্র কী? এদের মুক্তির জন্যেই কি ক্ষুদিরামের ফাঁসি হলো! এদের জন্যে ভেবে ভেবেই কি সি আর দাশ জীবন দিলেন নাকি! এদেরই জন্যে গোপীনাথ সাহা, সূর্য সেন, ভগৎ সিং, যতীন দাস আত্মত্যাগ করলে? হঠাৎ সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দীপঙ্করের মনে হলো এখনই কিরণের সঙ্গে দেখা হলে যেন ভাল হতো। কিরণকে বুঝিয়ে দিত– তুই যাদের জন্যে এত কষ্ট করছিস কিরণ, তারা অনন্তরাও ভাবে। স্বরাজে ওদেরই সুবিধে হবে। ওরাই মাথায় চড়ে বসবে তখন, দেখিস!
মাইনের টাকাটা জামার বুক পকেটে রয়েছে।
সেই জনবহুল রাস্তাটার ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো। কালীঘাটের বাজারের যে-সমাজ, সেখানকার অধঃপতনকে তবু যেন ক্ষমা করা যায়। সেখানে অজ্ঞতাকে মূলধন করে তারা জীবনের ফাটকা বাজারে জুয়া খেলতে নেমেছে। তোক তারা পাপী। সে তবু অজ্ঞানতার পাপ। যেদিন কিরণের চাওয়া স্বরাজ আসবে, সেদিন তারা কাড়াকাড়ি করে সামনের সারিতে দাঁড়াবার প্রতিযোগিতায় নামবে না। কিন্তু এই সমাজ? এরাই তো সেদিন ক্ষুদিরামের ফাঁসির পরাকাষ্ঠার প্রশংসা করে লেকচার দেবে! এরাই তো সেদিন দেশ-সেবকের প্রাপ্য ফুলের মালাটা আগে-ভাগে এসে গলায় পরবে!
একটা ট্যাক্সি যাচ্ছিল। দীপঙ্কর ট্যাক্সিটাকে ডেকে উঠে পড়লো। ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞেস করলে-কাহা সাব?
ট্যাক্সিওয়ালা ভেবেছিল হয়ত পার্ক স্ট্রীট, কিংবা ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, কিংবা ওইরকম কোনও রাস্তার নাম করবে বাঙালী সাহেব। কিন্তু দীপঙ্কর বললে—কালীঘাট–
হু হু করে চলতে লাগলো ট্যাক্সিটা। ছোটবেলায় এক-একদিন কিরণ আর দীপঙ্কর দূর থেকে এ-পাড়াটার দিকে চেয়ে দেখেছিল। সেদিন ভারি আপসোস হয়েছিল মনে মনে। ভেবেছিল এদের মধ্যেই বুঝি মানুষের সব সমস্যার সমাধানগুলো লুকিয়ে আছে। মানুষ সুস্থ মনে স্বাভাবিক হলে যা হয়, তা বুঝি এই। বড় বড় বাড়ি, ভাল ভাল পর্দা, ভাল ভাল খাবার, বিলাস, ঐশ্বর্য-এ-ই বুঝি মানুষের কামনার শেষ ধাপ! এখানে পৌঁছতে পারলেই বুঝি আর কিছু চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। চৌরঙ্গীর ওপর দিয়ে যেতে যেতে দীপঙ্কর আবার বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে দেখলে মিস মাইকেলের ঘরের পর্দার মত পর্দা ঝুলছে এখানকার জানলায়। মিস মাইকেলের ঘরের মত বাতি ঝুলছে এখানকার সিলিং-এ। হয়ত এ-বাড়িগুলোর ভেতরে এ বাড়ির মেয়েরা মিস মাইকেলের মত সিল্কের ফিতে দিয়ে লাভ-লেটার্সগুলো বেঁধে যত্ন করে তুলে রাখে। এরাও বোধহয় মিস মাইকেলের মত মুখে রুমাল চাপা দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদে। বাইরে থেকেই শুধু চেনা যায়!
চলতে চলতে ট্যাক্সিটা হাজরা রোড দিয়ে মন্দিরের দিকে ঢুকছিল–
দীপঙ্কর লাফিয়ে উঠলো। বললে–কালীঘাট নয় সর্দারজী, গড়িয়াহাট চলো, গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং
ট্যাক্সি ড্রাইভারটা একটু অবাক হলো। হয়ত ভাবলে বাঙালী সাহেব অপ্রকৃতিস্থ। তা ভাবুক। এখনি লক্ষ্মীদির কাছে গিয়ে একবার দেখা করা ভাল। লক্ষ্মীদিকে তার অনন্তবাবুর কাণ্ডটা বুঝিয়ে বলা দরকার। অন্তত লক্ষ্মীদি বুঝতে পারুক কার ওপর নির্ভর করে আছে। লক্ষ্মীদি! কী রকম চরিত্রের লোক সেই অনন্তবাবু! কী জঘন্য চরিত্রের লোক!
লেভেল-ক্রসিং-এর গেটটা খোলাই ছিল। এখন আর কোনও ট্রেন নেই বোধহয়। ট্যাক্সিটা লাইনের ওপর উঠতেই দীপঙ্কর অন্ধকারে চিনতে পেরেছে। দীপঙ্কর চিৎকার করে উঠলো–রোখো রোখো–
ক্রসিং পেরিয়ে ওপারে গিয়ে ট্যাক্সিটা ব্রেক কষে থেমে গেল।
দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি ভাড়াটা ঢুকিয়ে দিয়েই দৌড়ে কাছে এল। বললে–লক্ষ্মীদি, তুমি এখানে?
লক্ষ্মীদি লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল একা। মুখটা শুকনো। চুল বাঁধেনি আজ। টিপ পরেনি।
–তুমি একলা এখানে কী করছো লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদিও দীপঙ্করের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেছে। বললে–তুই যে হঠাৎ? তোর মনিব্যাগটা নিতে?
–না, সেজন্যে নয়, অন্য একটা কথা ছিল তোমার সঙ্গে। তা তুমি এখানে কেন এখন? এই রাত্তির বেলায়?
লক্ষ্মীদি বললেশম্ভু হঠাৎ কোথায় বেরিয়ে গেছে–জানিস, বড় ভাবনায় পড়েছি- কখন যে বেরিয়ে গেল টেরই পাইনি, তাই খুঁজতে বেরিয়েছি–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু এই এখন তাকে কোথায় খুঁজে পাবে?
লক্ষ্মীদি বললে–তা জানি না, কিন্তু মানুষটা কোথায় গেল তাই ভাবছি। শেষে কিছু ঠিক করতে না পেরে বেরিয়ে পড়লাম–
দীপঙ্কর বললে–চলো চলো কী আশ্চর্য এই সময়ে একলা-একলা এইরকম করে বেরোতে আছে! আমি যদি এখন না আসতুম
লক্ষ্মীদির দৃষ্টিটা যেন চঞ্চল। সেই অন্ধকার লেভেল-ক্রসিং-এর গেটের ওপর দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীদিকে যেন বড় অসহায় দেখাচ্ছিল। সত্যিই তো, দীপঙ্কর যদি এই সময়ে না আসতো লক্ষ্মীদি হয়ত একলাই বেরিয়ে যেত এমনি করে!
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে পড়লো। বললে–কোথায় যাবে তুমি?
লক্ষ্মীদি বললে–চল না, ওই দিকটা দেখে আসি একটু, কত দূরে আর যেতে পারে, এই হয়ত ওইদিকে একটুখানি দূরে গেছে-আয় না তুইও আয় না আমার সঙ্গে, তুই সঙ্গে থাকলে তবু একটু করে খুঁজতে পারবো
–কিন্তু কতক্ষণ বেরিয়েছে?
লক্ষ্মীদি বললে–এই তো আমি রান্না করছিলুম, অতটা খেয়াল ছিল না আমার, হঠাৎ নজরে পড়লো দেখি দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি–তারপর যা ভেবেছি তাই, দেখি ঘর ফাঁকা
লক্ষ্মীদির সঙ্গে দীপঙ্করকেও চলতে হলো। খানিকটা এগিয়েই বুদ্ধমন্দির। সরু সরু গলি রাস্তা। দুপাশে পোড়ো জমি আর আগাছা। তারপরেই লেক। মাঝে-মাঝে এক একটা গ্যাসের আলো জ্বলছে। তাও অনেক দূর-দূর। এ অন্ধকারে তেমন স্পষ্ট কিছুই দেখা যায় না। কোথায় অনেক দূরে একটা লোক অস্পষ্ট ছায়ার মত নড়ছে, দূর থেকে তাকে চেনাই মুশকিল। সেদিন তো কালীঘাটের শ্মশানেই গিয়ে হাজির হয়েছিল। আজও যদি সেখানে যায়? অত দূরে চলে গেলে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে! পাগল মানুষ, তার তো কোন খেয়ালের ঠিক-ঠিকানা নেই। যেখানে খুশি যাবে। হয়ত পুলিসেও ধরতে পারে।
দীপঙ্কর বললে–তোমারই তো অন্যায়, তুমি একটু দেখতে পারো না?
লক্ষ্মীদি কিছু বললে না। শুধু আগে আগে চলতে লাগলো। একটা অনির্দিষ্ট ছায়ার অনুসরণ করে। দীপঙ্করও পেছন-পেছন চলছিল। সারাদিন আপিসের কাজ নিয়ে কেটেছে, তারপর মিস মাইকেলের সঙ্গে তার বাড়িতে গিয়েছিল। সেখান থেকে সোজা বাড়িতে যাওয়ারই তো তার কথা। তা হলে কেন হঠাৎ এখানে চলে এল দীপঙ্কর! কী দরকার ছিল তার এখানে আসার!
–ওই যে, ওই বোধহয় শম্ভু!
লক্ষ্মীদি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল একলাই। সমস্ত লেকটা জনহীন। দীপঙ্করের ভয় করতে লাগলো। এত রাত্রে লক্ষ্মীদির মত মেয়েকে নিয়ে এখানে ঘোরাফেরা কি উচিত! এখানে কত কী কাণ্ড হয়, শুনেছে দীপঙ্কর। রাত গম্ভীর হলেই নানারকম বদ লোক এসে জোটে এখানে।
দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি লক্ষ্মীদির পাশে এগিয়ে গেল। দূরে একটা গ্যাসের নিচে দিয়ে যেন দাতারবাবু আস্তে আস্তে এলোমেলোভাবে চলেছে। লক্ষ্মীদির মুখে কথা নেই। হন হন করে এগিয়ে চলেছে।
কিন্তু সামনে গিয়েই ভুলটা ধরা পড়লো। একজন হিন্দুস্থায়ী খাওয়া-দাওয়ার পর বেড়াতে বেরিয়েছেন।
দীপঙ্কর বললে–দেখলে তো? এ রকম করে কি তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব?
লক্ষ্মীদিও সত্যিই হতাশ হয়ে গিয়েছিল। কোন কথা বললে না।
দীপঙ্কর বললে–চলো, ফেরো, এমনভাবে খুঁজলে পাবে না, বরং থানায় একটা খবর দেওয়া ভালো–
শেষে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দীপঙ্কর লক্ষ্মীদিকে ফিরিয়ে নিয়ে এল।
চারিদিকে বেশ অন্ধকার। আশে-পাশের নর্দমায় তখন ঝি ঝি পোকা ডাকছে। লক্ষ্মীদি তখনও অন্যমনস্ক ছিল। লেক পেরিয়ে সোজা বুদ্ধমন্দিরের পাশ দিয়ে রাস্তা।
লক্ষ্মীদি বললে–জানিস দীপু, আজ বুঝতে পারি, আমার জন্যেই শম্ভুর এই অবস্থা–আমি না থাকলে হয়ত ওর এ-অসুখটা হতো না
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু ও-লোকটাকে তুমি কেন তোমার কাছে থাকতে দাও লক্ষ্মীদি? ও-লোকটা কেন তোমাদের কাছে থাকে? জানো, ও-লোকটা ভাল নয়?
লক্ষ্মীদি এতক্ষণে মুখ তুললো। বললে–কেন?
দীপঙ্কর বললে–তুমি কিছু মনে কোর না, কালকে তুমি চিঠি লিখেছিলে বলেই এসেছিলুম, তুমি বলেছিলে বলেই আমি অনন্তবাবুকে আজকে আপিসে যেতে বলেছিলুম
–তা যায়নি তোর কাছে?
দীপঙ্কর বললে–গিয়েছিল।
লক্ষ্মীদি জিজ্ঞেস করলে–কাজটা পেয়েছে তো?
দীপঙ্কর বললে–তা জানি না। হয়ত পেয়েছে, হয়ত পায়নি। কিন্তু মাঝখান থেকে আমি রবিনসন সাহেবের কাছে লজ্জায় পড়লুম। তোমার কথা ভেবেই আমি সাহেবকে বলে রেখেছিলুম। সাহেবও রাজী ছিল, কিন্তু দেখি অনন্তবাবু আপিসে গিয়ে সোজা মিস্টার ঘোষালের ঘরে ঢুকে গেল–
–সে কি রে?
দীপঙ্কর বললে–বললে তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না। না-দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আশ্চর্য, আমি ডাকলুম অনন্তবাবুকে। আমি নিজের কাজ ফেলে সমস্ত দিন বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনন্তবাবুর জন্যে, অথচ যেন চিনতেই পারলে না, অথচ আমার নিজেরই যেন গরজ, যেন আমার নিজেরই কাজ।
লক্ষ্মীদি বললে–তা অনন্ত তোকে দেখে কী বললে?
–আমি ডাকলুম, আমাকে দেখলে অনন্তবাবু, তবু যেন চিনতেই পারলে না। সোজা মিস্টার ঘোষালের ঘরে ঢুকে গেল। অথচ সাহেবকে আমি বলে রেখেছিলুম। রবিনসন সাহেব আমাকে কথা দিয়েছিল, একটা পয়সা লাগতো না আমার কাছে গেলে–
লক্ষ্মীদি বললে–যাক গে, তুই কিছু মনে করিসনি, নিশ্চয় মিস্টার ঘোষাল কম টাকা নিতে রাজী হয়েছে!
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু হলেই বা কম টাকা, কেন ঘুষ দিতে যাবে? জানো, আমার নিজের চাকরি হয়েছে তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে। সে-কথা আমি এখনও ভুলতে পারি না
লক্ষ্মীদি বললেসংসারে তোর মত লোক তো সবাই নয়, এ দুনিয়াটাই মন্দ, এই মন্দর রাজ্যে মন্দ না-হলে লোকে বাঁচবে কী করে? কী করে টিকে থাকবে মানুষ?
তারপর দীপঙ্করের পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো লক্ষ্মীদি।
বললে–সবাইকে নিজের মতন ভাবিসনি তুই, এ-সংসারে ভালোও আছে, মন্দও আছে–মন্দই বেশি, সবাইকে নিয়েই যখন ঘর করতে হবে, তখন মন খারাপ করলে চলে?
চলতে চলতে লেভেল-ক্রসিংটার কাছে এসে পড়েছিল।
দীপঙ্কর বললে–মন খারাপের কথা বলছো, তোমার ব্যাপার দেখেও তো আমার মন খারাপ হয়।
–আমার ব্যাপার? আমি আবার কি করলুম?
দীপঙ্কর বললে–তুমি ভাবো তো, কতখানি অন্যায় করছো তুমি দাতারবাবুর ওপর?
লক্ষ্মীদি বুঝতে পারলে না কথাটা। হাঁ করে চেয়ে রইল দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর বললে–দোষ কি তোমার একটা? তোমার হাজার দোষ! তুমি সতীকে কষ্ট দিয়েছ, তুমি তোমার বাবাকে কষ্ট দিয়েছ, তুমি দাতারবাবুকেও কষ্ট দিচ্ছ–
লক্ষ্মীদি হাসতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–হেসো না, হাসতে তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। যখন ছোট ছিলাম তখন বুঝতে পারতুম না। তখন ভাবতুম সবাই বুঝি তোমাকেই কষ্ট দেয়, সবাই বুঝি তোমার ওপরেই অত্যাচার করছে, পীড়ন করছে। সেদিন তোমার কষ্টের জন্যেই আমার কষ্ট হয়েছে। সকলের কাছে তোমার কষ্টের কথা বলেছি, এখন দেখছি আমারই ভুল
–কেন, ভুল কেন?
–ভুল নয়? ও-লোকটা তোমার কে? ওর জন্যেই তো দাতারবাবুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে তোমার এত কিসের সম্পর্ক? কেন ওর টাকা নিয়ে তুমি সংসার চালাও?
লক্ষ্মীদি আবার হাসলো। বললে–এই জন্যে তোর এত রাগ?
–আমার কেন রাগ হতে যাবে লক্ষ্মীদি! রাগ আমার হয় না, আমার দুঃখ হয় তোমার জন্যে। তুমি তোমার বাবার টাকা, সুখ, আরাম সব ত্যাগ করে এলে কি এই জন্যে? এই অনন্তবাবুর সঙ্গে এক ঘরে থাকবার জন্যে? জানো,অনন্তবাবু কী জঘন্য চরিত্রের লোক?
লক্ষ্মীদি বললে–তুই সত্যিই রেগে গেছিস দেখছি, চুপ কর তুই–
দীপঙ্কর বললে–চুপ করবো না, তোমাকে আমি সব কথা বলে তবে যাবো, আর এই কথা বলতেই এসেছি এত রাত্রে–নইলে আমি তো বাড়িতেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কথাগুলো তোমাকে বলতে এলাম–ভাবলাম, তুমি হয়ত জানো না, তোমাকে সাবধান করে দেওয়া দরকার
লক্ষ্মীদি বললে–বল, তুই কী বলবি?
দীপঙ্কর বললে–জানো, অনন্তবাবু মদ খায়?
লক্ষ্মীদি হেসে উঠলো শব্দ করে। বললে–খায় তো খায়, তাতে কী?
দীপঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেল লক্ষ্মীদির কথা শুনে। দীপঙ্কর ভেবেছিল কথাটা বলে লক্ষ্মীদিকে চমকে দেবে! অথচ লক্ষ্মীদি এত সহজভাবে নিল কথাটা!
লক্ষ্মীদি বললে–মদ তো খাবার জিনিস, খাবে না?
–তুমি বলছো কি?
লক্ষ্মীদি বললে–তোর বয়েস বাড়লে কী হবে দীপু, তুই দেখছি এখনও সেই ছেলেমানুষ আছিস! তুই হাসালি আমাকে, অনন্ত মদ খায় তুই জানতিস না? মদ তো শম্ভুও খায়। আর তাছাড়া মদ খেলেই নোক খারাপ হয়ে গেল একেবারে?
দীপঙ্করের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। লক্ষ্মীদির মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ হাঁ করে। লক্ষ্মীদি বলছে কী! সেই লক্ষ্মীদি এখন কোথায় এসে নেমেছে! এত অধঃপতন হয়েছে লক্ষ্মীদির!
লক্ষ্মীদি বললে–অনন্ত মদ খায়, এই কথাটা বলতেই তুই এত রাত্তিরে কষ্ট করে আমার কাছে এলি! কেন, তুই বুঝি নিজে মদ খাস না?
দীপঙ্কর বললে–আমি মদ খাবো?
–কেন, খেলে কী হয়েছে? তোর এখনও এইসব গোঁড়ামি রয়েছে? তুই কি এখনও মানুষ হলি না দীপু? আর কবে হবি?
বলে লক্ষ্মীদি সেই রাস্তার ওপরেই বেদম হাসতে লাগলো।
দীপঙ্কর চুপ করে রইল। কোনও কথা বলবার মত প্রবৃত্তিও হলো না তার।
লেভেল-ক্রসিংটার ওপর এসে লক্ষ্মীদি বললে–অনেক রাত হলো, তুই এবার বাড়ি যা, তোর মা হয়ত ভাবছে
দীপঙ্কর বললে–মা তো ভাবছেই, কিন্তু দাতারবাবু যদি আজ রাত্রে আর না ফেরে?
লক্ষ্মীদি বললে–আগেও কয়েকদিন শম্ভু বেরিয়ে গেছে, কিন্তু আবার ফিরে এসেছে–ফিরে আসবে’খন, তুই যা–
দীপঙ্কর বললে–চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি–
লক্ষ্মীদি বললে–আমি নিজেই বাড়ি ফিরে যেতে পারবোতোর ভয় নেই–
দীপঙ্কর বললে–ভয় তোমার জন্যে নয় লক্ষ্মীদি, ভয় আমার নিজের জন্যেই।
–কেন?
দীপঙ্কর বললে–আজ অনন্তবাবুকে এমন জায়গায় দেখলুম, আর এমনভাবে দেখলুম, সে-কথা বললে তুমিও অনন্তবাবুকে বাড়ি থেকে দূর করে দেবে, জানো, এরপরে আর কোনও ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয় অনন্তবাবুকে
লক্ষ্মীদি জিজ্ঞেস করলে কোথায়?
দীপঙ্কর বললে–সে এক জঘন্য জায়গায়! অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ায়–মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে-সঙ্গে দেখলাম দুটো মেয়ে রয়েছে আবার, আমি ওদের দেখে লুকিয়ে পড়লাম–
–অনন্ত কী করতে গিয়েছিল সেখানে?
–তা কী করে জানবো! তবে সেখানে যে-জন্যে সবাই যায়, সেই জন্যেই গিয়েছিল। ছি, ব্যাপারটা দেখবার পর থেকে আমার ঘেন্না হয়ে গেল অনন্তবাবুর ওপর! আর তাই বলতেই তোমার কাছে এলাম।
লক্ষ্মীদি চুপ করে রইল।
দীপঙ্কর বলতে লাগলো–সেই জন্যেই তোমাকে বলতে এলাম, তোমার টাকার দরকার থাকে তুমি আমাকে বলল, আমি তোমাকে মাসে মাসে সংসার খরচের সব টাকা দেব, কিন্তু অনন্তবাবুকে বাড়ি থেকে দূর করে দাও, ও-সব লোককে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়াও উচিত নয়
লক্ষ্মীদি এবারও কোনও জবাব দিলে না।
দীপঙ্কর আবার বলতে লাগলো-তুমি হয়ত ভাবছো আমি অনন্তবাবুর বিরুদ্ধে এত বলছিই বা কেন? তাতে আমার কী স্বার্থ? কিন্তু আমার স্বার্থ ভোমার আর দাতারবাবুর জন্যে
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু আমাকে তো সংসার চালাতে হবে–
দীপঙ্কর বললে–তোমার সংসার আমি চালাবো।
লক্ষ্মীদি বললে–দূর, শুধু তো সংসার চালানো নয়, শম্ভুর চিকিৎসাও আছে, শম্ভুকে ডাক্তার দেখানোর খরচও তো আছে–
দীপঙ্কর বললে–কত টাকা তোমার দরকার বলো? তুমি বলো তোমার কত টাকা দরকার মাসে মাসে?
লক্ষ্মীদি বললে–তাছাড়া আমি তোর টাকাই বা নেব কেন? তোর মা-ই বা কী ভাববে?
দীপঙ্কর বললে–আপিসের মাইনেটা আমি মা’কে দেব, তার বাইরে সকালে সন্ধ্যেয় না হয় আমি টিউশনি করবো তোমার জন্যে।
লক্ষ্মীদি বললে–না সে হয় না।
–কেন হয় না? টাকার জন্যেই যদি তোমার অনন্তবাবুকে এত দরকার, তাহলে আমিই তোমাকে টাকা দিচ্ছি, তোমার সব খরচ আমি দেব, এমন কি দাতারবাবুর চিকিৎসার খরচও আমি দেব। আর তাছাড়া এমন একটা ওষুধ আছে যেটা মাখালে এখনি দাতারবাবু ভাল হয়ে যায়—জানো–
–কী ওষুধ?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমি ওষুধ দিলে সে ওষুধ তো মাখাবে না তোমরা! অনন্ত বাবু যে-রকম লোক সে তো চাইবেই যে দাতারবাবুর অসুখটা না সারুক–
–কী ওষুধ তাই-ই বল না?
দীপঙ্কর বললে–আমাদের আপিসের এক ভদ্রলোকের স্ত্রীর পাঁচ বছর ধরে মাথা খারাপ ছিল, শেষে এই ওষুধটা মাখিয়ে ভাল হয়ে গিয়েছে। শুধু ওষুধ কেন, তোমাদের খাওয়া-পরা, তোমাদের বাড়ি ভাড়া, তোমাদের যাবতীয় খরচ সব আমি দিতে পারি, তার জন্যে তুমি কিছু ভেবো না। আর তাছাড়া আমি শীঘ্রি একটা বড় প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছি–রবিনসন সাহেব আমাকে ডি-টি-আই করে দিচ্ছে–
চলতে চলতে আরো অনেক দূর চলে এসেছিল দুজনে।
দীপঙ্কর বললে–আর বাড়ির কথা বলছো, আমাদের অঘোরদাদুর বাড়িটা তো এখনও খালি পড়ে রয়েছে, সেই যেদিন থেকে কাকাবাবু কাকীমা চলে গেছে, তারপর থেকে আর কোনও ভাড়াটে আসেনি-সেই বাড়িতে গিয়েই তো তুমি উঠতে পারো
–সে তো অনেক ভাড়া?
–ভাড়ার কথা তুমি ভাবছো কেন? ভাড়া তো দেব আমি! আর আমি বললে ও বাড়ির ভাড়া অঘোরদাদু পনেরো টাকাও করে দিতে পারে-অঘোরদাদু আমাকে খুব ভালবাসে! আর অঘোরদাদু যদি নাও থাকে তো ছিটেফোঁটাও আমি ভাড়া নিলে কিছু বলবে না। যত খারাপ ভাবো ওদের আসলে তত খারাপ নয় ওরা–
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু তুই-ই বা কেন অত করতে যাবি আমাদের জন্যে?
দীপঙ্কর বললে–সে-সব কথা তোমার ভাববার দরকার কী? তোমার টাকা পেলেই তো হলো?
লক্ষ্মীদিও যেন রাজী হলো দীপঙ্করের কথায়। কেমন যেন ভাবতে লাগলো কথাটা। সত্যিই তো ওখানে থাকলে দীপঙ্করের কাছে হবে, দীপঙ্কর সময়ে সময়ে দেখতে পারবে। দাতারবাবুর চিকিৎসা করতে সুবিধে হবে।
দীপঙ্কর বললে–তোমাদের কিছু করতেই হবে না, আমি আছি, আমার মা রয়েছে, বিন্তিদি আছে, আর ওটা তোমাদের পুরনো পাড়া, ওই পাড়াতে তুমি এতদিন কাটিয়েছে, তোমার কোনও অসুবিধেই হবে না, তুমি চলো লক্ষ্মীদি। এখানে একলা তুমি থাকতে পারবে না। আমি তো তোমাকে সেদিনই সেই বৌবাজারেই বলেছিলুম চলে আসতে
–আর অনন্ত?
লক্ষ্মীদি যেন অনন্তবাবুর নামটা উচ্চারণ করতেও ভয় পাচ্ছিল। বললে–ওকে কী বলবো?
দীপঙ্কর বললে–তুমি ওকে, এত ভয় করো?
লক্ষ্মীদি বললে–ভয় নয়, কিন্তু এতদিন আমাদের দেখাশোনা করলে, আমাদের এত টাকা দিয়ে উপকার করলে। এখন তাকে কী বলবো?
দীপঙ্কর বললে–বলবে, এতদিন তুমি আমাদের অনেক উপকার করেছ, এর জন্যে তোমার ওপর আমরা কৃতজ্ঞ। আর তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না।
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু তুই তো জানিস না, ওর উপকার জীবনে ভোলবার মত নয়। ও না-থাকলে আমরা উপোস করে মরে যেতাম। আমাদের বিপদের সময়ে ও যা করেছে, কোনও মানুষ তা করে না–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু উপকার যা কিছু করেছে, সে তো ওর নিজেরই স্বার্থে!
–কেন? স্বার্থ কিসের?
লক্ষ্মীদি মুখ তুলে চাইলে দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর বললে–তুমি জানো না, কিসের স্বার্থ?
না জানি না!
দীপঙ্কর বললে–নিজের মনকে এমন করে তুমি চাপা দিতে চেষ্টা কোর না। ওকেই বলে মনকে চোখ ঠারা। কিন্তু যাদের চোখ আছে তাদের তুমি কী বলে বোঝাবে? কী বলে জবাবদিহি করবে?
লক্ষ্মীদি বললে–কিসের জবাবদিহি?
লক্ষ্মীদি তখনও যেন বুঝেও বুঝতে চাইছে না।
দীপঙ্কর বললে–তুমি জানো না, কেন তোমাদের জন্যে অনন্তবাবু এত করে? কিসের লোভে? কিসের লোভে অনন্তবাবুর দরদ তোমার ওপর? তোমার কাছে কি কিছুই পায় না অনন্তবাবু? দাতারবাবুর পাগল হওয়ার পেছনে কি অনন্তবাবুর কোনও হাত নেই? দাতারবাবু যে ব্যবসা করতে গিয়ে এমন করে লোকসান খেয়ে গেল, এর পিছনেও কি অনন্তবাবুর কোনও কারসাজি নেই বলতে চাও?
লক্ষ্মীদি চুপ করে চলতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–তোমাকে দেখতে সুন্দর, তোমার রূপ আছে, আয়নাতে কি সেটাও তুমি দেখতে পাও না? অনন্তবাবু আর কতটুকু দিয়েছে তোমাকে? কতটুকু উপকার করেছে? তোমার রূপের জন্যে এর চেয়েও বেশি উপকার করবার লোকের অভাব নেই কলকাতা শহরে, এটা তুমি বিশ্বাস করো?
লক্ষ্মীদি হঠাৎ মুখ টিপে হেসে ফেললে। দীপঙ্করের দিকে চেয়ে দেখলে একবার। বললেহ্যাঁরে, তোরও বুঝি সেই জন্যে আমার উপকার করার এত আগ্রহ?
দীপঙ্কর বললে–আমার কথা আলাদা–
লক্ষ্মীদি বললে–কেন, আলাদা কেন? তুইও তো পুরুষ মানুষ!
খানিকক্ষণ দীপঙ্করের মুখে আর কোনও কথা বেরোল না। দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির পাশ থেকে একটু সরে এল।
লক্ষ্মীদি হঠাৎ দীপঙ্করের হাতটা ধরে ফেললে।
বললে–লজ্জা করছিস কেন? বল না–
দীপঙ্কর হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু লক্ষ্মীদি খুব শক্ত করে হাতটা ধরে ফেলেছে।
লক্ষ্মীদি বলতে লাগলো–আমার কাছ থেকে তুই হাজার চেষ্টা করলেও পালাতে পারবি না,আয়, বাড়ির ভেতরে আয়–
বাড়ির কাছে গিয়ে লক্ষ্মীদি দরজার তালাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। দীপঙ্করও ঢুকলো।
অন্ধকার ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে লক্ষ্মীদি বললে–বোস, বোস এখানে—
দীপঙ্কর বসলো। বসে বললে–অনেক দেরি হয়ে গেল, বাড়ি যাই আমি–
লক্ষ্মীদি হঠাৎ একেবারে গা ঘেঁষে পাশে বসলো। বললে–কেন, তোর যাবার এত তাড়া কেন? এখন তো কেউ নেই এখানে? শম্ভুও নেই, অনন্তও নেই–
দীপঙ্কর একটু সরে বসতে চেষ্টা করলে। কিন্তু লক্ষ্মীদি তার হাতটা জোরে ধরে রেখেছে।
দীপঙ্কর বললেছি—ছি—
লক্ষ্মীদি দীপঙ্করের চোখে চোখ রেখে হাসতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–তুমি মানুষ না কী, লক্ষ্মীদি–ছি–
লক্ষ্মীদি হাসতে হাসতে বললে মানুষ হলে আজ আমার এই দশা হয়, তুই বুঝতে পারিস না? মানুষ হলে আজ অনন্তর পয়সায় পেট চালাই? মানুষ হলে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে শম্ভুর সঙ্গে পালিয়ে আসি? মানুষ হলে এই অন্ধকারে একলা-একলা রাস্তায় বেরোই? তুই তো আমার চেয়ে ছোট, মানুষ হলে তোকে ঘরে টেনে নিয়ে এসে তোর গা ঘেঁষে গল্প করি? তুই কি আমাকে এখনও মানুষ মনে করিস?
কথাগুলো বলে লক্ষ্মীদি হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
দীপঙ্কর একদৃষ্টে লক্ষ্মীদির দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো। সেই লক্ষ্মীদি আজ কোথায় নেমেছে! এ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে!
দীপঙ্কর বললে–তুমি দেখছি জ্ঞানপাপী লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি বললে–আমি আজ জ্ঞানও বুঝি না, পাপও বুঝি না, বেঁচে থাকবার জন্যে কী করা উচিত সেইটেই শুধু বুঝি
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু এ-রকম করলে আর কতদিন বাঁচবে? তুমিও যে পাগল হয়ে যাবে দাতারবাবুর মত!
লক্ষ্মীদি বললে–পাগল হয়ে গেলে তো বেঁচে যাই। সুখ-দুঃখ কোনও জ্ঞানই থাকে না–শম্ভু তো তাই বেঁচে গেছে। আমার অন্য ভয় করে–
–কী ভয়?
লক্ষ্মীদি বললে–এক এক সময় ওই রেল লাইনটার কাছে গিয়ে দাঁড়াই, যখন ট্রেনগুলো আসে, যখন পায়ের তলায় মাটি থর থর করে কাঁপতে থাকে, মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ি সামনে, মনে হয় সব আপদ চুকে যাক–
দীপঙ্কর বললে–দেখছি তোমারও মাথা খারাপ হতে বাকি নেই আর–
লক্ষ্মীদি বললে–লেভেল-ক্রসিং-এর যে গেটম্যানটা আছে, সে মাঝে মাঝে আমাকে ওখানে একলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায়
–কে? ভূষণ?
–নাম জানি না। সে লোকটা অনেকদিন আমাকে দেখেছে। কীভাবে কে জানে! তোর মত সেও হয়ত ভাবে আমার মাথা খারাপ হয়েছে!
দীপঙ্কর বললে–তাহলে এক কাজ করো লক্ষ্মীদি। তোমার বাবার ঠিকানাটা আমায় দাও-আমি চিঠি লিখে জানিয়ে দেব তাকে। নিজের বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে লজ্জা নেই
লক্ষ্মীদি গম্ভীর হয়ে গেল। বললে–না।
দীপঙ্কর বললে–তুমি ঠিকানা দাও আর না-দাও, আমি তোমার বাবাকে চিঠি লিখে দেবই
লক্ষ্মীদি বললে–আমি সব ছাড়তে পারি দীপু, কিন্তু আমার অহঙ্কার আমি ছাড়তে পারি না, অহঙ্কার ছাড়লে আমি বাঁচবো কী দিয়ে বল? অহঙ্কার সম্বল করেই যে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছি আমি, যেদিন সেটাও থাকবে না, সেদিন কিছুই যে আর নিজের বলে থাকবে না রে আমার–
–কিন্তু কিসের এত অহঙ্কার তোমার শুনি? রূপের?
লক্ষ্মীদি বললে–অহঙ্কারের কি নাম আছে রে? অহঙ্কারের কি উপলক্ষ আছে? অহঙ্কার যার আছে, তার কাছে আর সব যে তুচ্ছ–
–কিন্তু জীবনের চেয়ে কি অহঙ্কারটাই তোমার কাছে বড় হলো লক্ষ্মীদি।
লক্ষ্মীদি বললে–যারা বেঁচে আছে, তারাই তো জীবনকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু আমি তো বেঁচে নেই–আমি তো আর বাঁচতে চাই না
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু যেদিন দাতারবাবুকে আমার হাত দিয়ে চিঠি পাঠাতে, যেদিন দাতারবাবুর অসুখের খবর শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে, সেদিন তো বাঁচতেই চেয়েছিলে?
লক্ষ্মীদি বললেমানুষ তো অনেক কিছুই চায়। কিন্তু কে চাওয়ার মত করে চাইতে পারে?
–কিন্তু চাওয়ার মত করে চাইতে কে তোমায় বারণ করেছিল? কে তোমায় বাধা দিয়েছিল?
লক্ষ্মীদি বললে–ওই যে বললুম, আমার অহঙ্কার!
দীপঙ্কর বললে–তাহলে এতই যদি বোঝ তুমি তো কেন আজ অনন্তবাবুকে এমন করে সহ্য করো? দূর করে দিতে পারো না ও-লোকটাকে? তার সঙ্গে হাসাহাসি করো, হেসে গড়িয়ে পড়ো তার সামনে, এটাও কি ভাল?
–কখন আমি হাসাহাসি করেছি? কখন হেসে গড়িয়ে পড়েছি ব!
দীপঙ্কর বললে–তুমি ভাবছো আমি দেখিনি? আমি নিজের চোখে দেখে তবে বলছি, কাল রাত্রে মনিব্যাগটা ফেরত নিতে এসে দেখি ও-ঘরে দাতারবাবু পাগল অবস্থায় চিৎকার করছে, আর এ ঘরে তুমি আর অনন্তবাবু দু’জনে খেতে খেতে হেসে গড়িয়ে পড়ছো। দাতারবাবুর দিকে তোমাদের ক্ষেপই নেই। একেও যদি তুমি অহঙ্কার বলো তো অহঙ্কারের মানেই আমি জানি না বলতে হবে–
লক্ষ্মীদি এ-কথার কোনও উত্তর দিলে না।
দীপঙ্কর বলতে লাগলো–আমি তোমার কাছে কিসের জন্যে আমি আসি জানি না, হয়তো তোমাকে ভালবাসি বলেই আসি, কিন্তু তুমি আপত্তি করো আর যাই করো, এ আমি কিছুতেই সহ্য করবো না। আমি যদি অনন্তবাবুর এখানে আসা বন্ধ না করতে পারি তো তোমার বাবাকেই আমি চিঠি লিখে সব জানিয়ে দেব।
লক্ষ্মীদি তখন যেন একটু নরম হয়ে এল।
বললে–বেশ তুই যা বলবি, আমি তা-ই করবোবল কী করতে হবে?
দীপঙ্কর বললে–তুমি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে আমাদের বাড়িতে উঠে চলো, বাড়িটা এখনও খালি পড়ে আছে–
–ভাড়া?
দীপঙ্কর বললে–ভাড়ার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না, সে আমি বুঝবো। তাছাড়া। তোমাকে কিছুই ভাবতে হবে না। দাতারবাবুর চিকিৎসা আমিই করবো, তার সমস্ত খরচ আমি দেব
–এত টাকা খরচ করবি তুই আমাদের জন্যে?
দীপঙ্কর বললে–করবো! টাকা না থাকলে আমি ধার করবো আপিসের ব্যাঙ্ক থেকে!
লক্ষ্মীদি বললে–কত দিন খরচ করবি? শেষে তো তোরও সংসার হবে, বউ হবে, ছেলে-মেয়ে হবে-তখন?
–ততদিনে দাতারবাবু ভাল হয়ে উঠবে।
–যদি না হয়?
হঠাৎ বাইরে কড়া নড়ে উঠলো।
দীপঙ্কর বললে–ওই বোধ হয় দাতারবাবু এসেছে–
লক্ষ্মীদি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই অনন্তবাবু এল ভেতরে। লক্ষ্মীদিও আগে আগে এল।
অনন্তবাবুকে দেখে দীপঙ্কর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে। লক্ষ্মীদির দিকে চেয়ে বললে–আমি উঠি তাহলে লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি বললে–যাবি?
–হ্যাঁ যাই।
বলে চোখ ফেরাতেই দেখলে অনন্তবাবু তার দিকেই চেয়ে আছে। অনন্তবাবুর চোখে-মুখে যেন একটা কর্কশ ঔদ্ধত্য। যেন কেমন রূঢ় দৃষ্টি দিয়ে দেখছে তার দিকে। দীপঙ্কর সে-দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ লক্ষ্মীদি কথা বলে মুশকিল করে দিলে
লক্ষ্মীদি অনন্তবাবুকে জিজ্ঞেস করলে–কাজটার কী হলো অনন্ত?
অনন্তবাবু গম্ভীর হয়ে বললে–হয়েছে–
–তুমি নাকি দীপুর কাছে যাওনি? ও তোমার জন্যে সমস্তক্ষণ বসে ছিল, রবিনসন সাহেবকেও বলে রেখেছিল। তা কত টাকা নেবে মিস্টার ঘোষাল?
অনন্তবাবু বললে–সে সব তোমার শুনে দরকার কি? সে নিক না-নিক, তোমার শুনে লাভ কি?
দীপঙ্করের কানে কথাটার খোঁচা এসে লাগলো বড় তীক্ষ্ণ হয়ে। যেন কথাটার লক্ষ্য লক্ষ্মীদি নয়, দীপঙ্কর।
দীপঙ্কর ফিরে দাঁড়িয়ে বললে–কিন্তু আপনিই বলেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আমি তাই রবিনসন সাহেবকে বলেও রেখেছিলাম।
অনন্তবাবু এ-কথার উত্তর না-দিয়ে লক্ষ্মীদিকে বললে–এ কতক্ষণ এসেছে?
লক্ষ্মীদি বললে–অনেকক্ষণ, শম্ভু বেরিয়ে গেছে হঠাৎ, তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, দীপু তখন আসছিল এখানে, পথে দেখা হয়ে গেল।
অনন্তবাবু বললে–এতক্ষণ কি সবই সেই সব কথাই হচ্ছিল?
লক্ষ্মীদি হাসতে হাসতে বললে–দীপুর সঙ্গে আমার যে-কথা বরাবর হয়, সেই সব কথাই হচ্ছিল, কেন, তুমি অত রাগ করছো কেন?
অনন্তবাবু যেন ধমকে উঠলো লক্ষ্মীদিকে। বললে–ওর সঙ্গে তোমার এত কিসের কথা?
এতক্ষণে দীপঙ্কর সামনে এগিয়ে এল। অনন্তবাবুর সামনে আসতেই একটা মদের গন্ধ এল নাকে। মনে হলো অনন্তবাবু যেন এখন প্রকৃতিস্থ নয়। কিন্তু অনন্তবাবুর ঔদ্ধত্যটুকু যেন আর বরদাস্ত করা যায় না। বিশেষ করে লক্ষ্মীদির সঙ্গে এমন করে কথা বলবার সাহস কোথায় পেলে অনন্তবাবু!
অনন্তবাবু বললে–ওকে বারণ করতে পারো না এখানে আসতে? লক্ষ্মীদি যে লক্ষ্মীদি, সে-ও যেন অবাক হয়ে গেল। বললে–তুমি কাকে কী বলছো?
অনন্তবাবু বললো ঠিকই বলছি, ও একটা রেলওয়ে ক্লার্ক, ও কেন আসে এখানে? কিসের লোভে? ও কী চায়?
লক্ষ্মীদি বললে–তুমি ভুল করছো, ও আমার ভাই-এর মত যে, ছোট থেকে ওকে দেখে আসছি আমি–
–সেই জন্যে একলা একলা নিরিবিলিতে বসে তার সঙ্গে তে রাত পর্যন্ত গল্প করতে হবে?
লক্ষ্মীদি বললে–কেন, গল্প করলে দোষ কী?
দীপঙ্কর এতক্ষণে কথা বললে–বললে–চুপ করো লক্ষ্মীদি, অনন্তবাবু মদ খেয়েছে, এখন মাথার ঠিক নেই ওঁর।
–কী? অনন্তবাবু চোখ বড় বড় করে চাইলে দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর বললে–এখন আপনার মাথার ঠিক নেই, আপনি বেশি মাত্রায় মদ খেয়েছেন, নইলে আপনাকে বুঝিয়ে বলতাম–আপনিও বুঝতে পারতেন–আপনি শুয়ে পড়ন তাড়াতাড়ি, নইলে পড়ে যাবেন।
অনন্তবাবু রুখে এল দীপঙ্করের দিকে। বললে–কাকে কী বলতে হয় জানেন না আপনি?
দীপঙ্কর বললে–মাতালের কাছে আমি ভদ্রতা শিখতে রাজী নই!
অনন্তবাবু বললে–করেন তো একটা ক্লার্কের চাকরি, মিস্টার ঘোষাল আমাকে সব বলেছে, তার এত আবার তেজ কেন?
দীপঙ্কর বললে–ক্লার্ক নিশ্চয়ই, কিন্তু আপনার মত অভদ্র নই–
লক্ষ্মীদি বললে–কেন তুমি ওকে অমন করে বলছো?
অনন্তবাবু লক্ষ্মীদির হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললে তোমার ভাইকে আজকে এমন জায়গায় দেখেছি, তারপরেও ওর লজ্জা নেই!
লক্ষ্মীদি বললে–কী বলছো তুমি অনন্ত? কাকে দেখেছো? কোথায়? আর ওর কাছেই বা তুমি গেলে না কেন আজ?
অনন্তবাবু বললে কেন যাবো? ঘুষ দিয়ে যখন কাজ আদায় করবো জুতো মেরে কাজ নেব! অত খোশামোদের ধার ধারবো কেন?
দীপঙ্কর বললে–আমি তো আপনাকে খোশামোদ করতে বলিনি–
–বিনা ঘুষে কাজ নেওয়া মানেই তো খোশামোদ? কেন খোশামোদ করবো? মিস্টার ঘোষালকে ঘুষ দেব, সে আমার পা চাটবে, পোষা কুকুরের মত আমার পা চাটবে–
বলে নিজের একটা পা উঁচু করে বাড়িয়ে দিলে দীপঙ্করের দিকে।
–তাতে পেটও ভরবে, মানও বাঁচবে!
দীপঙ্কর বললে–সেটা আপনি আগে বুঝলে সাহেবের কাছে আমার মুখটা নষ্ট হতো না।
অনন্তবাবু মুখ বেঁকিয়ে বললে–আপনার কি সোনা-বাঁধানো মুখ, যে ক্ষয়ে গেলে লোকসান হবে? করেন তো ক্লার্কের চাকরি
দীপঙ্করের সমস্ত শরীর যেন রি-রি করে উঠলো। তবু অনেক কষ্টে সামলে নিলে।
বললে–লক্ষ্মীদি, তুমি ওঁকে একটু থামতে বলো, নইলে সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছেন
লক্ষ্মীদি দীপঙ্করের সামনে এসে তার হাত দুটো ধরলে। বললে–তুই যা এখন দীপুওর কথায় কান দিসনি–
অনন্তবাবু বললো, বেশি কথা বললে অপমান করে বসোব তখন–চলে যেতে বলো–
লক্ষ্মীদি ঠেলতে ঠেলতে দীপঙ্করকে একেবারে গলির ভেতর নিয়ে এল। ওদের দরজার সামনে এসে দরজাটা খুলে দিলে লক্ষ্মীদি। বললে–তুইও রেগে গেছিস আজ– যা তুই–
দীপঙ্কর বললে–আমার রাগটাই দেখলে তুমি?
লক্ষ্মীদি বললেও তো ওই রকমই-ওর কথা ছেড়ে দে–
দীপঙ্কর বললে–আমার জন্যে তো নয়, কিন্তু এই লোকের সঙ্গেই তো তুমি ঘর করছে, এই লোকের সঙ্গেই তো তোমার খাওয়া-পরার সম্পর্ক, এই লোককে সন্তুষ্ট করেই তো তোমাকে চলতে হচ্ছে! তাই তোমার কথা ভেবেই আমার কষ্ট হচ্ছে–
লক্ষ্মীদি বললে–আমার কথা ছেড়ে দে, আমি তো আর বেঁচে নেই, সেই জন্যে আমার ও-সব গায়ে লাগে না–
–কিন্তু, আমাদের ওখানে তোমার যাওয়ার কী হবে?
লক্ষ্মীদি বললে–আমি তো বলেছি, যাবো–
–তাহলে আমি বাড়িটা ভাড়া নিয়ে নিই? শেষকালে তুমি আপত্তি করবে না তো?
লক্ষ্মীদি বললে–না!
হঠাৎ অনন্তবাবুর গলা শোনা গেল পেছনে। বললে–ফিস্ ফিস্ কী প্রেমালাপ হচ্ছে দু’জনে?
বলতে বলতে একেবারে কাছে এসে গেল অনন্তবাবু।
লক্ষ্মীদি বললে–তা তুমি আবার এলে কেন?
অনন্তবাবু হঠাৎ লক্ষ্মীদিকে জড়িয়ে ধরে মুখের কাছে মুখ এনে বললে–ওর সঙ্গে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তুমি প্রেমালাপ করবে আর আমি বুঝি….
কথাটা আর শেষ হলো না। লোকটার স্পর্ধা দেখে দীপঙ্করের মাথায় যেন খুন চেপে গেল।
বললে–স্কাউন্ড্রেলে–
বলে অনন্তবাবুর মুখটা লক্ষ্য করে প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল। ঘুষিটা অনন্তবাবুর মুখের ওপর গিয়ে যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টলে পড়ে গেল মাটিতে। আর ছটফট করতে লাগলো যন্ত্রণায়।
মুহূর্তের মধ্যে কী যে ঘটে গেল, দীপঙ্করেরও খেয়াল ছিল না।
লক্ষ্মীদিও প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। তারপর অনন্তবাবুর ওই অবস্থা দেখে মাটিতে বসে পড়ে অনন্তবাবুর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে ডাকতে লাগলো–অনন্ত-অনন্ত–
অনন্তবাবু তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার তখন সাড়া দেবার ক্ষমতাটুকুও বোধ হয় আর নেই।
লক্ষ্মীদি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।
বললে–তুই অনন্তকে মারলি?
দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির হঠাৎ এই প্রশ্নে চমকে উঠলো।
বললে–তুমি বলছো কি লক্ষ্মীদি, ও একটা স্কাউলে,–ওকে মেরে ফেলিনি এই ই ওর ভাগ্য! যে তোমার সঙ্গে এইরকম ব্যবহার করতে পারে, তাকে তুমি স্কাউড্রেল ছাড়া আর কী বলবে?
–থাম তুই।
লক্ষ্মীদি একেবারে গর্জন করে উঠেছে। লক্ষ্মীদির চেহারা দেখে দীপঙ্কর ভয় পেয়ে গেল।
–তোর এত বড় আস্পর্ধা? তুই ওকে মারলি কী বলে? আমার সঙ্গে যেমন ব্যবহারই করে থাক সে আমি বুঝবো, তুই কে?
বলেই তখনি আবার মাটিতে বসে পড়ে অনন্তবাবুর মাথাটা ধরে আদর করতে লাগলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলো–অনন্ত অনন্ত–
অনন্তবাবু বোধ হয় তখন অজ্ঞান অচৈতন্য। অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না মুখটা। লক্ষ্মীদি বার বার ডাকতে লাগলো-অনন্ত-অনন্ত–
তারপর সাড়া না পেয়ে আবার উঠে দাঁড়াল লক্ষ্মীদি।
বললে–বল কেন তুই মারলি ওকে? তুই ওকে মারবার কে? আমাকে যদি অপমান করে থাকে সে আমি বুঝবো, তুই কেন মারিস?
একটু থেমে আবার বললে–তোর বড় বড় হয়েছে, না? হেসে কথা বলি বলে তুই একেবারে মাথায় উঠে বসবি? বেরো, বেরিয়ে যা এখান থেকে-তোকে আর আসতে হবে না আমার এখানে, বেরিয়ে যা—বেরো–
লক্ষ্মীদি দীপঙ্করকে ঠেলে একেবারে দরজার বাইরে বার করে দিলে। তারপর দড়াম করে সদর দরজাটায় খিল লাগিয়ে দিয়েছেন। দীপঙ্কর সেই দরজার বাইরে অন্ধকারের মধ্যে খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুধু। তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে চলতে আরম্ভ করলো। দীপঙ্করের মনে হলো এতদিনের সব বিশ্বাস এতদিনের সব আকর্ষণের মূল ধরে যেন লক্ষ্মীদি টান দিলে। যেন সব সম্পর্কের সূত্র নিশ্চিহ্ন করে দীপঙ্করকে একেবারে নিরাশ্রয় করে রাস্তায় ছেড়ে দিলে।
৩৩
রাত্রের শেষ নির্জন ট্রামটা ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের মোড়টা পেরিয়ে গেল, তখনও দীপঙ্কর সেই কথাটাই ভাবছে। তারপর হাজরা রোডের মোড়ে আসতেই চলন্ত ট্রাম থেকে নেমে পড়লো এই তো কাছেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোড। সতীর শ্বশুরবাড়ি। সতীর কাছে তার বাবার ঠিকানাটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ভেতরে ঢুকে একেবারে সতীদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল দীপঙ্কর। বিরাট তেতলা বাড়ি। সামনের খেটে দারোয়ান পাহারা দিচ্ছে।
দীপঙ্কর বাড়িটার গেটের দিকে এগিয়ে গেল। এর মধ্যেই সতী নিশ্চয়ই ঘুমায়নি। এত সকাল-সকাল! ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। নিশ্চয় জেগে আছে এখন। নিশ্চয়ই জেগে আছে।
সতী যদি তাকে না-চিনতে পারে। অনেকদিন পরে এসেছে দীপঙ্কর। অনেক বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। বাড়ির সামনে লোহার রেলিং দেওয়া গেট। ইট-বাঁধানো রাস্তা ভেতরে। বাড়ির সামনে দাঁড়ালে সোজা ভেতরের গ্যারেজটা নজরে পড়ে। গেটের দু’ মাথার ওপর ইলেট্রিকের ডুম-বাতি জ্বলছে–
দীপঙ্কর অনেকক্ষণ সেইখানে এধার-ওধার পায়চারি করতে লাগলো।
ঠিক এই সময়ে বাড়ি ঢোকবার মুখে যদি সতী তাকে দেখতে পায় তো ভাল হয়। তাহলে আর ডাকতে হয় না। একটা চিঠি বা একটা স্লিপে দীপঙ্করের নাম লিখে ভেতরে পাঠালেও চলে। কিন্তু স্লিপ যদি সতী দেখা না করে! যদি উত্তর না দেয়। যদি বলে–এখন সময় নেই! দারোয়ান হয়ত ফিরে এসে বলবে–এখন মোলাকাত্ হবে না!
দীপঙ্করের মনে হলো সে বড় মর্মান্তিক। কেউ চিনতে না পারলে মনে বড় কষ্ট হয়। কিন্তু লক্ষ্মীদির বাবার ঠিকানাটাও যে তার দরকার। লক্ষ্মীদির ব্যাপারটা তাকে আর জানালে যে চলবে না। তাঁকে জানালেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। লক্ষ্মীদি কোথা থেকে কোথা নেমেছে, অনন্তবাবুর পাল্লায় পড়ে কত নিচে নেমে এসেছে! শেষকালে কোথায় কত গভীরে যে নামবে তা-ও বলা যায় না। লক্ষ্মীদির সেই আগেকার রূপ, সেই আগেকার চাল-চলন কথা বলা, সমস্ত যেন বদলে গেছে। লক্ষ্মীদির কথা ভাবতে বড় দুঃখ হয়েছে দীপঙ্করের। ট্রামে বসে সমস্তক্ষণ কেবল লক্ষ্মীদির কথাই ভেবেছে। লক্ষ্মীদিকে উদ্ধার করার আর কী উপায় খোলা আছে! ফাঁকা ট্রামের মধ্যে কেবল দীপঙ্করই একলা। একলা-একলাই কথাগুলো ভেবেছে শুধু। দীপঙ্করকে লক্ষ্মীদি তাড়িয়ে দিয়েছে বলে নয়, লক্ষ্মীদির অধঃপতনের জন্যেই দীপঙ্করের মনে আঘাত লেগেছে। এমন করে চোখের সামনে লক্ষ্মীদি নষ্ট হয়ে যাবে! হয়ত তারপর যখন একদিন সমস্ত জলুস চলে যাবে লক্ষ্মীদির, তখন ওই অনন্তবাবুকে নিয়ে পথে দাঁড়াতে হবে! তখন আর কেউ সাহায্য করবার থাকবে না। তখন হয়ত ওই গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং-এর ওপরই ট্রেনের চাকার তলায় আত্মহত্যা করতে হবে লক্ষ্মীদিকে!
–এখানে কাকে চাই আপনার?
দীপঙ্কর হঠাৎ সামনে চেয়ে দেখলে। এক ভদ্রলোক সামনের রোয়াকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তারই দিকে চেয়ে।
–কাকে খুঁজছেন?
দীপঙ্কর বললে–খুঁজতে এসেছিলাম এই পাশের বাড়িতে–
–ঘোষেদের বাড়ি?
দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ, সনাতন ঘোষ।
তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু এত রাত্তিরে কি ওঁরা জেগে আছেন?
ভদ্রলোক বললেন–জেগে আছেন নিশ্চয়ই। আলো তো জ্বলছে ভেতরে-ডাকুন, ওই সামনে দারোয়ান বসে আছে, ওকে বলুন, ও ডেকে দেবে–
দীপঙ্কর বললে–এতক্ষণ তো সেই কথাই ভাবছি–এখন কি ডাকা ঠিক হবে? বরং কাল দেখা করাই ভালো–
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে গলি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এল। না, আজ থাক। এত রাত্রে বাড়ির বউ-এর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াই তো অন্যায়। দারোয়ানের কাছেও নিজের পরিচয় দিতে হবে দারোয়ান হয়ত তাকে সনাতনবাবুর কাছেই নিয়ে যাবে। সনাতনবাবুর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয়ও দিতে হবে। সনাতনবাবু কী-রকম লোক কে জানে! তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এত রাত্রে কিসের দরকারে দেখা করতে এসেছে তা-ও বলতে হবে। তারপর নানান জেরার পরও যে সতীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তা-ও বলতে হবে। তারপর নানান জেরার পরও যে সতীর সঙ্গে দেখা করতে অনুমতি পাওয়া যাবে, তারও কোনও ঠিক নেই। যদি তিনি জিজ্ঞের করেন–দীপঙ্কর কে, তার স্ত্রীর সঙ্গে কোন সূত্রে পরিচয়? তখন? তখন কী জবাব দেবে সে? পাশাপাশি বাড়িতে থাকার সম্পর্কটাই একমাত্র সূত্র! আর কোন সূত্ৰই তো নেই সতীর সঙ্গে।
দরকার নেই।
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে আবার ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের দিকে হাঁটতে লাগলো। মস্ত বড় বাড়ি। সতীর শ্বশুরবাড়িটা! ভেতরে অনেকখানি জায়গা। অনেক চাকর-বাকর। অনেক গাড়ি, অনেক অর্থের চিহ্ন বাড়িটার সর্বাঙ্গে! সমস্ত পাড়াটার মধ্যে সব বাড়িগুলোর চেয়ে বড়। সকলকে ছাড়িয়ে সকলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আপন আভিজাত্য নিয়ে।
হঠাৎ মনে হলো সতী হয়তো কলকাতায় নেই। হয়ত বর্মায় চলে গেছে বাবার কাছে। বিয়ের পর একবার তো বাবার কাছে যায় মেয়েরা। হয়ত সেখানেই গেছে। সেখানেই আছে। সতী যে-রকম বাবাকে ভালবাসে, বাবাকে ছেড়ে এতদিন থাকতে পারবে কেন? কলকাতায় থাকলে একদিন কি আর আসতো না ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের দিকে। সেই পুলিসে ধরে নিয়ে যাবার পর আর তো দেখা হয়নি দীপঙ্করের সঙ্গে! মেয়েরা কি এত শিঘ্রি সব ভুলে যায়। এত শিঘ্রি সব ভুলে যেতে পারে! কিরণ তো ঠিকই বলেছিল সেদিন–ওদের জন্যে তুই এত ভাবিস দীপু, ওদের বিয়ে হয়ে যাবার পর দেখবি সবাই ভুলে যাবে তোকে!
সত্যি, সেই লক্ষ্মীদিই আজ তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে। যে লক্ষ্মীদিকে এত ভালবাসতো দীপঙ্কর, সেই লক্ষ্মীদি! আর সতী! এখন সেই সতীর শ্বশুরবাড়ির সামনেই দীপঙ্করকে প্রার্থীর মতন ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়!
হঠাৎ দীপঙ্করের আবার মনে হলো–সে বড় একলা! তার কেউ নেই। তার লক্ষ্মীদি নেই, লক্ষ্মীদির সঙ্গে তার যেটুকু সম্পর্ক ছিল, তাও তত লক্ষ্মীদি শেষ করে দিলে। সতীও নেই। কিরণও নেই। সকলের সবাই আছে, তারই শুধু কেউ নেই। এই শহরে, এই কালীঘাটের সমস্ত লোকের সব কিছু আছে, দীপঙ্করই শুধু নিঃসঙ্গ, দীপঙ্করই শুধু একলা। দীপঙ্করেরই যেন কোনও কাজ নেই সংসারে। আজ এর কাছে, কাল ওর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। ছিটেরও একটা নিজস্ব পৃথিবী আছে। ফোঁটারও আছে তার নিজস্ব জগৎ। সেখানকার জগতে ছিটে-ফোঁটা সম্রাট হয়ে আছে, দেবতা হয়ে আছে। তারাও সুখী! গাঙ্গুলীবাবুর স্ত্রীও ভাল হয়ে গেছে। সে-ও সুখী। মেমসাহেবও তার ছবির অ্যালবাম আর প্রেমপত্র নিয়ে নিজস্ব জগতে বাস করছে। কিরণ? কিরণের কি কাজের অভাব আছে? কোথায় পৃথিবীর কোন্ কোণে নিজের কাজ করে চলেছে সে। শুধু দীপঙ্করই আজ পথে পথে নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরছে।
কালীঘাটের বাজারের দিকটা দিয়ে না গিয়ে দীপঙ্কর সোজা পথ ধরলো। গলি দিয়ে ঢুকে সোজা ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে পড়া যাবে। অন্ধকার গলিগুলি সব সরু। দু’পাশের ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলোর ভেতরে গাদাগাদি হয়ে বাস করছে কত পরিবার। কোনও কোনও জানালায় তখনও আলো জ্বলছে। কোনও কোনও বাড়ি তখন অন্ধকার। ঘুমিয়ে পড়েছে ভেতরের মানুষরা। সকলের কাজ আছে, সকলের ঘুম আছে–শুধু দীপঙ্কর যেন এই সংসারে প্রহর গুনতে এসেছে! মা হয়ত এতক্ষণ ভাবছে খুব। হয়ত না-খেয়ে বসে আছে দীপঙ্করের জন্যে! তার দীপু আজকে মাইনে পেয়েছে। মাইনে পেয়ে এত দেরি করা উচিত হয়নি। মাইনের দিনটায় দীপঙ্কর বরাবর সকাল-সকাল বাড়ি ফিরে মা’র হাতে টাকাটা তুলে দেয়। মা টাকাগুলো শুনে নিয়ে মাথায় ঠেকায়। তারপর তার কাঠের বাক্সটায় তুলে রাখে।
দীপঙ্কর পা চালিয়েই চললো। মার কথাটা মনে পড়তেই পায়ের গতি যেন বেড়ে গেল।
নেপাল ভট্টচার্যি স্ট্রীটের কাছেই নেপাল ভট্টাচার্য লেন। কিরণদের বাড়িটার দিকে চাইতেই মনে হলো যেন বড় অন্ধকার। হয়ত কিরণের মা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিরণের বাবা মারা যাবার পর আর যাওয়া হয়নি–
কী যে হলো। হঠাৎ নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের ভেতরে ঢুকলো দীপঙ্কর! কিরণদের বাড়ির সামনে গিয়ে দরজার কড়া নাড়তে লাগলো।
–মাসীমা!
আর একবার কড়া নাড়তে হলো। বেশি জোরে কড়া নাড়তে যেন সাহস হলো না দীপঙ্করের। অন্ধকারের মধ্যেই চারদিকে চেয়ে দেখলে একবার। কিরণদের বাড়ির আশে-পাশে সি-আই-ডি’রা এখনও ঘোরা-ফেরা করে। কোথায় থাকে কিরণ, কেউ জানে না। সারা বাঙালা দেশে, সারা কলকাতায় যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
দীপঙ্কর চারদিকে আর একবার চেয়ে দেখলে। কেউ কোথাও নেই। কিরণের বাবা মারা যাবার পর থেকে ‘সি-আই-ডি’রা আরো বেশি করে চর লাগিয়েছে এখানে।
দীপঙ্কর চলে আসবে ভাবছিল। দরকার নেই। এই অন্ধকারে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকেও হয়ত অকারণ হয়রানি করবে তারা।
কিন্তু হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল।
অন্ধকারের মধ্যেই কিরণের মার চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
দীপঙ্কর বললে–আমি দীপু মাসীমা–
–এসো বাবা, এসো।
দীপঙ্কর বললে–কেমন আছেন মাসীমা?
–তুমি ভেতরে এসো, বলছি।
অন্ধকার উঠান। উঠোনের এক কোণে একটা কুমড়োশাকের মাচা। দাওয়ার ওপর যেখানটায় কিরণের বাবা বুকে বালিশ নিয়ে বসে থাকতো, সেখানটায় গিয়েই যেন দীপঙ্করের বুকটা ঘঁাত করে উঠলো। মনে হলো কিরণের বাবা নেই বটে, কিন্তু সমস্ত বাড়িটার মধ্যে যেন তার অশরীরী ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন মুক্তি পেয়েছে এ-কথাটা বলতে এসেছে, কিন্তু বলতে পারছে না মুখ ফুটে।
–আমি আসতে পারিনি মাসীমা আপিসের নানান কাজে–আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
মাসীমা বললে–অসুবিধে হলেই বা কী করছি বলো বাবা! আমার মরণ হলেই বাঁচি
মাসীমা দাঁড়িয়ে ছিল পাশে।
দীপঙ্কর বললে–অমন কথা বলছেন কেন মাসীমা,–
–কেন বলবো না বাবা, আমার কে আছে বলল, কার মুখ চেয়ে বাঁচবো?
–কেন? কিরণ তো রয়েছে! কিরণের মত ছেলে থাকতে আপনি এ-কথা বলছেন কেন মাসীমা। কিরণ তো আর চিরকাল এমনি করে বাড়ি ছেড়ে থাকবে না–
মাসীমা কিছু উত্তর দিলে না।
দীপঙ্কর পকেটে হাত দিয়ে একটা পাঁচ টাকার নোট বার করলে। বললে–আপনি এই টাকাটা রাখুন মাসীমা, আজকে আমি মাইনে পেয়েছি, মাসে মাসে আমি পাঁচ টাকা করে দেব আপনাকে
কিরণের মা টাকাটা নিলে হাতে করে। বললে–তোমার মাকে জিজ্ঞেস করেছ তো বাবা?
দীপঙ্কর বললে–এ আমার নিজের টাকা মাসীমা, আমি নিজে উপায় করেছি
–তা হোক, তবু তোমার মাথার ওপরে মা তো আছে।
দীপঙ্কর বললে–এখন আমি বড় হয়েছি, এখনও কি সব কাজ মাকে জিজ্ঞেস করে করতে বলেন মাসীমা?
কিরণের মা সে-কথার উত্তর দিলে না। বলতে লাগলোনা বাবা ও-কথা বলো না। ছেলে যে কত কষ্ট করে মানুষ করতে হয় তা যারা মা হয়েছে তারাই জানে। সেই ছেলে বড় হয়ে মাকে না দেখলে মা’র মনে যে কী কষ্ট হয়, তা অন্য লোকে কী করে বুঝবে! আর কাকেই বা বোঝাবো?
বলে মাসীমা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–কিরণের মত ছেলে কি সব মা পায় মাসীমা? আপনি তো সৌভাগ্যবতী মাসীমা!
মাসীমা বললে–আমার মরণ হওয়াই ভাল বাবা, উপযুক্ত ছেলে থাকতে যাকে পরের কাছে হাত পাততে হয় তার মরণ হওয়াই ভাল
–ছি মাসীমা, অমন কথা বলবেন না, ওতে কিরণের অমঙ্গল হবে!
মাসীমা আঁচলে চোখ মুছতে লাগলো আবার।
দীপঙ্কর বললে–আজ আপনি কাঁদছেন মাসীমা, কিন্তু যখন স্বরাজ হবে তখন দেখবেন এই ছেলের জন্যেই আপনার গর্বে বুক ফুলে উঠবে আবার। স্বরাজ হলে তখন কিরণদেরই কত খাতির হবে দেখবেন। আজকের এই সুভাষ বোস, এই জে এম সেনগুপ্ত, বিধান রায় এরাই তখন তো দেশের লাটসাহেব হবে–
মাসীমা বললে–তা হয়ত হবে, কে জানে বাবা, কিন্তু গরীব-দুঃখীদের কষ্ট চিরকালই থাকবে—দেখো–
দীপঙ্কর বললে–না মাসীমা, আপনি জানেন না, এখন যারা স্বদেশী করছে, এখন যারা জেল খাটছে, দেখবেন তখন তাদের কত খাতির হবে। এই জে এম সেনগুপ্ত কি বিধান রায় যদি লাটসাহেব হয় তো দেখবেন আপনাদের কোনও দুঃখ থাকবে না তখন কিরণদেরই খাতির তখন সকলের আগে
মাসীমা সে-কালের মানুষ। কী বুঝলো মাসীমা কে জানে! হয়ত বিশ্বাস করলে কি হয়ত বিশ্বাস করলে না। বিশ্বাস না-হবারই কথা। কে-ই বা তখন বিশ্বাস করতো! বিপিন পাল, যিনি স্বরাজ’ কথাটা প্রথম প্রচলন করলেন তিনিই কি বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন? পুরোপুরি! আর কুমিল্লা জেলার বড় ইস্কুলের হেডমাস্টার শরকুমার বসু? তার স্কুলের দুটি ছেলে একদিন লিফলেট বিলি করছিল। হেক্লাস্টার তাদের নাম ধাম ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়ে দিলেন। তারপর একদিন তিনি রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়েছেন, এমন সময় কে তাঁকে পিস্তলের গুলিতে মেরে ফেললে! আর সেই ময়মনসিং-এর ডি-এস-পি যতীন্দ্রমোহন ঘোষ? বাইরের ঘরে বসে নিজের ছোট ছেলেকে আদর করছেন, এমন সময় কোথা থেকে পাঁচটা ছেলে ঘরে ঢুকে পড়লো। ঢুকে পড়েই তার বুকের ওপর গুলি। গুলির পর গুলি! তারপর রংপুরে পুলিসের ডি আই-জি রায়সাহেব নন্দকুমার বসু। স্বদেশী ছেলেদের ধরতে তাঁর ভারি উৎসাহ। হঠাৎ একদিন চারটে ছেলে তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে তাকে গুলি ছুঁড়ে মারলো। শুধু কি তাই? একটার পর একটা। সাব-ইনস্পেক্টর মধুসূদন ভট্টাচার্য মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে চলেছে। রাস্ত য়ি অনেক ভিড়। হঠাৎ গুলির আওয়াজ। মধুসূদন ভট্টাচার্য রাস্তার ওপরেই ঢলে পড়লো। আর এর সূত্রপাত কি আজকে? সেই একদিন বড়লাটের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সার হারবার্ট রিজনী বক্তৃতা দিলেন!
বর্তমানে আমাদের এক ভীষণ ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দেশের গভর্নমেন্ট উচ্ছেদ করে ব্রিটিশ-শাসন অচল করবার জন্য দেশব্যাপী যুদ্ধ চালানোই এদের উদ্দেশ্য। এদের সঙ্ঘশক্তি যেমন কার্যকরী, তেমনি ব্যাপক। সংখ্যায়ও এরা অনেক। নেতারা গোপনে কাজ করে, আর শিষ্যরা অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ করে। রাজনৈতিক মার্ডার এদের আন্দোলনের উপায়। মাসিনির পথই এদের পথ। এরা দুবার সার এ ফ্রেজারের ট্রেন উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। একবার সকলের সামনে তাকে গুলি করবার চেষ্টাও করেছে। মিস্টার কিংসফোর্ডকে খুন করবার চেষ্টা করেছে দু’বার। তাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া বোমার ঘায়ে দু’জন ইংরেজ মহিলা প্রাণ হারিয়েছে। ইনস্পেক্টার নন্দলাল ব্যানার্জি, আলিপুরের পাবলিক প্রসিকিউটার আশুতোষ বিশ্বাস, সার উইলিয়ম কার্জন-উইলি, মিস্টার জ্যান, আর এই সেদিন ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট শামসুল আলম এই ক’জনকে বেপরোয়াভাবে খুন করা হয়েছে। তিনজন ইনফরমারের মধ্যে দু’জনকে গুলি করে মেরেছে। আর একজনকে ধরতে না পেরে তার ভাইকে তার মা আর বোনের চোখের সামনে খুন করেছে এরা। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট অ্যালেনকেও এরা রেহাই দেয়নি। ভাইসরয়কে লক্ষ্য করে দুটো পিক্রিক অ্যাসিড় বোমা ছোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বোমা ফাটেনি বলে তিনি কোনওরকমে বেঁচে গেছেন। এইসব ঘটনা কয়েকটা খবরের কাগজের প্রচারের ফল। বিদ্রোহের জমি তারাই তৈরি করে দিয়েছে।’
কত দিনকার আগেকার সব ঘটনা! তখন কিরণের সঙ্গে দিনরাত মিশতো, তখনকার দিনের কথা সব। কিরণ বলতো সব গল্পগুলো। আজ সেই কিরণদের বাড়িতে কিরণের বিধবা মাকে দেখে সেই কথাগুলোই মনে পড়তে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–আপনি কেবল নিজের কথাই ভাবছেন মাসীমা, কিন্তু ভাবুন তো সুভাষ বোসের কথা
মাসীমা বললেন–তাদের কথা ছেড়ে দাও বাবা, স্বরাজ হলে যদি কিছু হয় তো তাঁদেরই হবে, তাঁরাই বড় বড় চাকরি পাবেন, তখন আমার গরীব ছেলের কথা কে আর ভাববে বলো?
–ভাববে মাসীমা ভাববে। আমি বলছি ভাববে। তখন এই দিশী লোকরাই তো রাজ্য চালাবে, দিশী লোকেরা তো আর সাহেবদের মত এমন নেমকহারামি করবে না
–কে জানে বাবা! আমার যা কপাল, তাতে কিছুই বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না যে!
খানিক পরেই দীপঙ্কর উঠলো। মাসীমা বললে–তোমার মা হয়ত ভাবছে, তুমি মিছিমিছি এখানে দেরি করলে এতক্ষণ!
দীপঙ্কর বললে–আমি আসবো মাসীমা মাঝে মাঝে–আপনি দরকার হলেই আমাকে ডেকে পাঠাবেন।
মাসীমা বললে–দরকার তো হয়ই মাঝে মাঝে
–কিন্তু আমাকে ডাকেন না কেন? টাকার দরকার হলে আমাকে বলবেন, লজ্জা করবেন না যেন।
–টাকার কথা নয় বাবা। কত রকম যে লোক আসে, কত সব কথা জিজ্ঞেস করে। কিরণ বাড়িতে আসে কি না, কিরণ কোনও চিঠি দেয় কি না–এই সব। আমার বড় ভয় করে বাবা–
তারপর হঠাৎ থেমে বললে–আজকে আবার এক কাণ্ড হয়েছে-এই দেখাচ্ছি তোমাকে–
বলে কিরণের মা ঘরের ভেতর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এল। দীপঙ্করের হাতে দিয়ে বললে–এই দেখ, একজন লোক এসে আজ আবার এইটে রেখে গেছে, বলেছে কিরণ এলে তাকে দিতে–
প্যাকেটের দড়িটা খুলে দীপঙ্কর দেখলে। কয়েকটা বই। মোটা-মোটা ইংরিজী বই সব। বোমা বারুদ গুলি তৈরি করবার বই। একখানা বই–অরবিন্দর ভবানী মন্দির। আর একখানা-বারীন ঘোষের ‘মুক্তি কোন্ পথে’। সঙ্গে একগাদা ছাপানো কাগজ–হ্যান্ডবিল। নিচে লেখা রয়েছে ‘স্বাধীন ভারত সিরিজ’।
দীপঙ্কর হারিকেনের আলোর কাছে এসে হ্যান্ডবিলটা পড়তে লাগলো।
“জার আমাদের বলে থাকেন–ঈশ্বরই আমাকে রাশিয়ার ম্রাট করে পাঠিয়েছেন। তোমরা আমার সিংহাসনকে ঈশ্বরের সিংহাসন মনে করে প্রণাম করবে। আমাকে বিরক্ত করতে তোমরা আমার কাছে এসো না। আমি সব সময়েই তোমাদের কথা ভাবি। আমার কোনও পরামর্শের দরকার নেই-কারণ ঈশ্বর আমাকে পূর্ণ জ্ঞান দিয়েছেন। আমি তোমাদের মধ্যে রয়েছি, এতেই তোমাদের গর্ববোধ করা উচিত–এবং আমার ইচ্ছাকেই আইন বলে মেনে নেওয়া উচিত।
“আমরা জারের এই কথা বিশ্বাস করেছি। তিনি যা বলেছেন তা-ই মেনে নিয়েছি। কিন্তু তার ফল কী হয়েছে? আপিসের ফাইলের পাহাড় গরীবদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। সরকারী কর্মচারীরা সামনে মন্ত্রীদের আর সেক্রেটারিদের পায়ের ধুলো নেয়, আর পেছনে, নির্বিকারভাবে চুরি করে। চুরির প্রাধান্য এত বেড়েছে যে, যে যত বড় চোর সে তত বড় সম্মানিত লোক। আপিসে চাকরি-প্রার্থীদের যোগ্যতা বিচারের কোনও বালাই নেই। আস্তাবলের সহিস হয়েছে প্রেস-সেন্সর। সম্রাটের চাটুকার এক অপদার্থ হয়েছে অ্যাড়মিরাল। আর আমরা রাশিয়ানরা কী করছি? আমরা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছি। বুকফাটা কান্নায় চাষী তার জমাবন্দির আদায়ের টাকা দাখিল করছে। যার সম্পত্তি আছে, সে তো বন্ধক দিচ্ছে। লোকে সরকারী কর্মচারীদের ঘুষের দাবি মেটাচ্ছে বাধ্য হয়ে। সম্রাটের প্রমোদ ভ্রমণের জন্যে লাখ লাখ টাকা নষ্ট হতে দেখছি, কিন্তু তার পরেই নিশ্চিন্তে তাস খেলছি, সিনেমার স্টার কিম্বা গানের আসরের গায়িকাদের সুরের সমালোচনা করছি, শয়তানদের সামনে মাথা নিচু করছি আর যে-সব কাজের নিয়ে পঞ্চমুখ হচ্ছি সেই কাজই নিজেরা করবার জন্যে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছি। এরই মধ্যে যখন কেউ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, দেশের জন্যে সংগ্রাম করতে আরম্ভ করে, আমরা বলি–লোকটা কী আহাম্মক!
“এত সবের মধ্যেও আমাদের একটা সান্ত্বনা ছিল যে বিশ্বের দরবারে রাশিয়া শক্তিশালী দেশ বলে পরিগণিত। ইংরেজরা যখন ফ্রান্সের ষড়যন্ত্রকারী সম্রাট এবং বিশ্বাসঘাতক অস্ট্রিয়ার সাহায্যে পশ্চিম ইওরোপকে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিল তখনও আমরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। বলেছি–জার আমাদের দেশরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন-আমাদের পরোয়া কিসের? নির্ভীক চিত্তে আমরা যুদ্ধে গিয়েছি। কিন্তু রাশিয়ার দর্প চূর্ণ করে আমাদের সে-যুদ্ধে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। হাজারে হাজারে আমরা প্রাণ দিয়েছি।
“হে জার, রাশিয়ার লোক তোমাকে পূর্ণ ক্ষমতা দিয়েছিল, পৃথিবীতে ঈশ্বর বলে তোমাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু, তুমি কী করেছ? সত্যকে তুমি খুন করেছ। রাশিয়া জাগো, মঙ্গল খা’র উত্তরাধিকারীদের দাসত্ব বহুদিন করেছ। আজ অত্যাচারী শাসকের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। জাতির এই দুর্দশার জন্যে তার কাছে কৈফিয়ত দাবি কর। দৃঢ়কণ্ঠে শুনিয়ে দাও সম্রাটের সিংহাসন ঈশ্বরের সিংহাসন নয়। আমরা চিরকাল দাসের জীবন যাপন করবে, তা ঈশ্বরের অভিপ্রায় নয়–ইতি–
নিহিলিস্ট পার্টি–রাশিয়া।”
পড়তে পড়তে দীপঙ্কর অনেকণ ভাবতে লাগলো। খানিক পরে বললে–এসব আপনাকে কে দিয়ে গেল? তাকে আপনি চেনেন?
মাসীমা বললে–না বাবা, আমি চিনি না, কখনও দেখিনি তাকে। তারা বললে কিরণ এলে তাকে দিতে!
দীপঙ্কর বললে–আমাকে দেখিয়েছেন, ভালো করেছেন মাসীমা–এ সি-আই ডি’দের কাজ–একটা দেশলাই আছে?
মাসীমা ঘর থেকে একটা দেশলাই এনে দিলে। বললে–কী করবে বাবা দেশলাই দিয়ে?
–পুড়িয়ে ফেলবো। কিরণকে বিপদে ফেলবার জন্যেই এই কাণ্ড করেছে ওরা– বলে ফস্ করে আগুন জ্বালিয়ে দিলে সমস্ত কাগজগুলোতে। কিরণদের সেই উঠোনের মধ্যে সমস্ত বই কাগজপত্র দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। মার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে দীপঙ্কর-স্বদেশী করবে না জীবনে। তবু যেন কিরণকে বাঁচাতে গিয়ে এটুকু করলে কোনও অপরাধ নেই। অন্ধকার উঠোনের মধ্যে আগুনের শিখাগুলো ল লক্ করে উঠছে। দীপঙ্কর চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। তারপর এক সময়ে আগুনটা নিভে এল। কাগজগুলো গন-গনে লাল হতে হতে ক্রমে কুচকুচে কালো হয়ে গেল। তারপর শুধু ধোঁয়া।
দীপঙ্করের হঠাৎ মনে হলো বাইরে যেন কার পায়ের শব্দ হলো।
–কে?
চমকে উঠেছে দীপঙ্কর। কে ওখানে?
তাড়াতাড়ি উঠোনের দরজাটা খুলে বাইরে এসে কাউকে দেখা গেল না কোথাও। এধার-ওধার সব দিকে দেখলে দীপঙ্কর। তারপর বললে–মাসীমা, আপনি দরজা বন্ধ করে দিন, সাবধানে থাকবেন, আমি যাচ্ছি।
মাসীমা বললে–কে বাবা! কাকে দেখলে!
দীপঙ্কর বললে–না, ও কেউ না। আমি যাচ্ছি
মাসীমা দরজা বন্ধ করে দিলে। আশ্চর্য, কিরণ বাড়ি আসে না, তবু তারও পেছনে ঘঘারাঘুরি করছে পুলিসের লোক! তাকে জড়িয়ে ফেলবার জন্যে নিষিদ্ধ কাগজপত্র রেখে গেছে! রায় বাহাদুর নলিনী মজুমদারের লোক এখনও তার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের কাছে আসতেই একটা শোরগোল কানে এল দীপঙ্করের। ঠিক যেন তাদের বাড়ির ভেতর থেকেই আসছে। এখন এত রাত্রে কী হলো আবার! তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ির সামনে আসতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ছিটে!
ছিটের সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল।
ছিটে ভেতর থেকে দৌড়তে দৌড়তে আসছিল। সামনে দীপঙ্করকে দেখেই থমকে গেল।
বললে–এই যে দীপু, শালা শুয়ার-কা-বাচ্ছার কাণ্ডটা দেখেছিস?
ছিটের মূর্তির দিকে চেয়ে দীপঙ্কর ভয় পেয়ে গেল। ঘেমে নেয়ে উঠেছে। দর দর করে ঘাম ঝরছে সারা শরীরে। হাতে একটা লাঠি। চুলগুলো এলোমেলো। যেন মারমুখো হয়ে কোথায় যাচ্ছে। কার সঙ্গে মারামারি লাগিয়েছে এখন?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছে?
ছিটে বললে–আমি ভালোমানুষ আছি তো আছি, আমি চাকর হয়ে তোমার পা চাটবো, কিন্তু রাগলে আমি কারোর নই! শালা শুয়ার-কি-বাচ্ছা, হারামজাদ্-কি-ভেড়ুয়া, আমার মেয়েমানুষের গায়ে হাত তোলা? আমার গায়ে হাত তুললে আমি কিছু বলবো না, কিন্তু আমার মেয়েমানুষের গায়ে হাত? এত বড় আস্পর্দা শালার! শালা জানে না আমি কে?
দীপঙ্কর কিছুই বুঝতে পারছিল না তখনও। বললে–কী হয়েছে বলো না? হয়েছে কী?
ভেতর থেকে হঠাৎ আর্তনাদ উঠলো। মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ। যেন ভীষণ ঝগড়া চলছে ভেতরে। যেন কে কাকে মেরেছে। অনেক মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ যেন ভীষণ ঝগড়া চলছে ভেতরে। যেন কে কাকে মেরেছে। অনেক মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ একসঙ্গে কানে এল। বাড়িতে এত মেয়েমানুষ কোথা থেকে ঢুকে পড়লো!
ছিটে আর দাঁড়াল না। লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে পাগলের মতন আবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো।
–তোর বাবার খাই আমি শালা? তোর বাবার পরি? শালা আমার মেয়েমানুষের ইজ্জত নষ্ট করবি তুই? বেরিয়ে আয়, বেরিয়ে আয় শালা, দেখি তোর কটা মুণ্ডু!
দীপঙ্করও সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়লো। চন্নুনীর ঘরের সামনে আরো দু’জন মেয়েমানুষ। তারাও চিৎকার করছে গলা ছেড়ে। এরা কারা! এরাই কি লক্কা আর লোটন! বেশ সাজা-গোজা চেহারা। একজনকে তো সেদিন দেখেছিল কালীঘাট বাজারের বস্তিতে। লোটন।
ছিটেকে দেখে ফোঁটা বেরিয়ে এল। তারও হাতে একটা চ্যালা কাঠ। বলছে–আয় চলে আয়, বাপের ব্যাটা হোস তো সামনা-সামনি লড়ে যাবি-চলে আয়
ছিটে বলা নেই কওয়া নেই–হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো ফোঁটার ওপর। আর একটু হলেই একটা রক্তারক্তি কাণ্ড বাধতো। কিন্তু দীপঙ্কর দৌড়ে সামনে গিয়ে দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়েছে। বললে–করছো কী তোমরা, মারামারি করবে নাকি?
কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই ফোঁটার চ্যালা-কাঠটা সোজা একেবারে দীপঙ্করের মাথার ওপর এসে পড়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় দীপঙ্করের মাথাটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল। মনে হলো যেন অনেকগুলো মানুষের আর্ত চিৎকার কানে এল। আর তারপর সে-আওয়াজও যেন আর শোনা গেল না। যেন মা দৌড়ে কাছে এল। যেন অঘোরদাদুর গলাও শোনা গেল একটু। মুখপোড়া বলে যেন কাকে গালাগালি দিচ্ছে। তারপর…
কোথা দিয়ে সব কী যে হয়ে গেল। মাথাটার বেশি লাগেনি তাই রক্ষে। সারাদিন পরিশ্রমের পর একটু লাগতেই দীপঙ্কর পড়ে গিয়েছিল।
৩৪
মনে আছে অঘোরদাদু সেই রাত্রেই নেমে এসেছিল ওপর থেকে। না নামলেই হয়ত ভালো হত। বুড়ো মানুষ। চোখে দেখতে পায় না, কানে শুনতে পায় না। সারাজীবন যজমানদের কাছ থেকে সম্মান শ্রদ্ধা ঐশ্বর্য পেয়ে এসেছে–নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি অর্জন করেছে। হঠাৎ শেষ বয়সে পৌঁছে কিনা দেখলে, যে-ভিতরে ওপর তাঁর সমস্ত কিছুর প্রতিষ্ঠা, সেই ভিতটাই ফাঁকি দিয়ে তৈরি। তার সংসার একদিন নিজের মনের দুর্বলতার সুযোগে আপনিই গড়ে উঠেছিল। অঘোরদাদু এতদিন সেই সংসারের গোড়ায় জল দিয়ে সার দিয়ে জিইয়ে তুলেছিল তাকে। হয়ত কোনও দুর্বল মুহূর্তে আশা করেছিল তাতে ফুল ফুটবে, ফল ফলবে। সেই সংসারের ফুল ভোগ করবে অঘোরদাদু বুড়ো বয়সে। কিন্তু হঠাৎ একদিন অঘোরদাদু টের পেলে, যে-ফল তাতে ফলেছে তা বিষ-ফল। যে-ফুল তাতে ফুটেছে তা কাঁটা-ফুল। তখন থেকেই নেতিবাদী হয়ে গেল অঘোরদাদু। তখন থেকেই বলতে লাগলো-কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়–সব কেনা যায় কড়ি দিয়ে–।
তখন থেকেই অবিশ্বাস করতে শুরু করলে সমস্ত পৃথিবীটাকে। তখন থেকেই অঘোরদাদুর কাছে সমস্ত মানুষ মুখপোড়া হয়ে গেল। নিজের নাতিও মুখপোড়া হয়ে গেল, নিজের নাতনীও মুখপোড়া হয়ে গেল। হয়ত নিজেও মুখপোড়া হয়ে গেল নিজের কাছে।
তখন থেকেই সব স্নেহ, সব মায়া, সব মমতা গিয়ে পড়লো টাকার ওপর। টাকা থাকলে কাকে পরোয়া? টাকা থাকলে কিসের ভয়? তাই টাকাকেই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে শেষপর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিল অঘোরদাদু। ভেবেছিল টাকাই তাকে শেষ জীবনে শান্তি দেবে, সান্ত্বনা দেবে। টাকার কাছে আত্মসমর্পণ করেই অঘোরদাদু নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিল।
তবু টাকা তো কথা বলে না, টাকা তো সজীব পদার্থ নয়, টাকা তো ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে না–তাই দীপঙ্করকে দিয়ে সে-সাধ কিছুটা মেটাতো। তাই একজামিন পাশের খবর শুনে অঘোরদাদু নতুন কাপড় কিনে দিত দীপঙ্করকে। চাকরি হবার খবর শুনে আনন্দ হতো। মাঝে মাঝে ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ পচা বাতাসা কি সন্দেশ উপহার দিত!
কিন্তু এতদিনে বুঝি সেই ভালোবাসা স্নেহমমতাটুকু নিঃশেষ হয়ে গেল দীপঙ্করের জীবন থেকে।
কিরণদের বাড়ির সামনে থেকে ফেরবার সময়ও দীপঙ্কর এ-কথা কল্পনা করতে পারেনি। জ্বর হয়েছিল বুঝি দুপুরবেলা থেকেই। দীপঙ্কর তখন আপিসে। চন্নুনীর ক’দিন থেকেই শরীর খারাপ ছিল। উঠোনের কোণে তার নিজের ঘরটার ভেতর শুয়ে ধুকছিল কদিন ধরে। আজ একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল। দুপুরবেলা গিয়ে ঘরে ঢুকে চন্নুনীর কপালে হাত দিয়ে দেখেছিল-কপাল যেন পুড়ে যাচ্ছে–
মা জিজ্ঞেস করেছিল–কিছু খাবে বাছা? কিছু খেতে ইচ্ছে করছে তোমার?
চন্নুনী বলেছিল–তোমার দীপু কোথায় দিদি?
মা বলেছিল–কেন দীপ কী করবে? দীপ তো আপিসে—
চন্নুনী বলেছিল–আমি আর বাঁচবো না দিদি–
–বালাই ষাট, মরবে কেন তুমি? জ্বরজারি কি হয় না কারো?
তারপর একটু থেমে মা আবার জিজ্ঞেস করেছিল-তোমার মেয়েদের খবর দেব? মেয়েদের ডাকবো?
চন্নুনী ঘাড় নেড়েছিল। যে-মেয়েরা বাজারে গিয়ে উঠেছে তাদের ওপর চন্নুনীর কোনও টান ছিল না কোনও দিন। নিজের কলঙ্কিত জীবনের ছোঁয়াচ থেকে মেয়েদের বাঁচাতে পারেনি বলে চন্নুনীর যে ক্ষোভ ছিল তা বুঝি এতদিন পরে স্পষ্ট করে ধরা গিয়েছিল। সেই জন্যেই বুঝি এতদিন আকাশ-বাতাসকে লক্ষ্য করে তার অশ্রাব্য গালিগালির ঠেলায় কানে আঙুল দিয়ে থেকেছে। তাই বুঝি রোগশয্যায় শুয়েও চন্নুনী মেয়েদের নাম শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো।
বললে–সে মুখপুড়ীদের নাম কোর না দিদি–
মা বলেছিল–তবু তো মেয়ে তোমার বাছা,–নিজের পেটের মেয়ে–
নিজের পেটের মেয়ে বলেই চন্নুনী তাদের গালাগালি দিতে পারতো আগেকার মতন। স্বাস্থ্য ভাল থাকলে আবার আগেকার মত চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে দিত। কিন্তু সে-সব কিছুই করলে না চন্ননী। বিছানার তলায় হাত দিয়ে একটা হার বার করলে। সোনার বিছে হার। হয়ত যৌবনকালে অঘোরদাদুরই দেওয়া।
বললে–এই হারটা তোমার দীপুকে দিও দিদি–
–এ কি, বলছো কী তুমি চন্নুনী?
মা একেবারে যেন সাত হাত পেছিয়ে এসেছে। বললে–তুমি দীপুকে হার দিতে যাবে কেন বাছা! না না, তুমি ভাল হয়ে যাবে দেখো, ঠিক ভাল হয়ে যাবে দেখো, ঠিক ভাল হয়ে যাবে, ও হার তুমি রেখে দাও–
তারপর দুপুরবেলা চন্নুনীকে সাবু বার্লি করে দিয়েছে মা। একদিন চন্নুনীর দাপট ছিল, বয়েস ছিল। একদিন চনী এই সংসারের গৃহিণী ছিল। দীপঙ্করের মা যখন প্রথম বিধবা হয়ে ছেলে কোলে করে এ-বাড়িতে এসেছিল সেদিনের কথাও মনে পড়লো। এই-ই মানুষের পরিণতি। সেদিন চন্নুনীর দাপটে ভাড়াটেরা টিকতে পারতো না। চন্ননীকে সেদিন খোশামোদ করে চলতে হয়েছে সকলকে। অঘোরদাদু সেদিন চন্নুনীর কথায় উঠেছে বসেছে। তারপর আস্তে আস্তে চন্নুনী দিন গেল, দাপট গেল, বয়েস গেল। চোখে ছানি পড়লো। লক্কা আর লোটন তার আগেই হয়েছিল। তাদেরও বয়েস হলো একদিন। তারপর একদিন তারাও চলে গেল বাজারে!
দীপঙ্করের মা কাজ করতে করতে আর একবার গিয়ে দেখে এল ঘরের ভেতরে।
–বলি, এখন কেমন আছো গো চন্নুনী?
তখন আর গলার আওয়াজ বেরোচ্ছে না। কেমন ভয়-ভয় করতে লাগলো মা’র। কপালে হাতটা ঠেকালে। মাথাটা নিচু করে মুখের দিকে চেয়ে দেখলে।
–ও চন্নুনী, চন্নুনী?
এসব খবর বোধহয় কাকের মুখে-মুখে ছড়ায়। বিকেলবেলা কলে জল এসেছে। দীপু আপিস থেকে আসবে সেই ছ’টার সময়। দীপঙ্করের মা’র হাত-পা দুটো যেন অবশ হয়ে আসতে লাগলো। মানুষটার জন্যে কেমন যেন দুঃখ হতে লাগলো। যতই ঝগড়া করুক, যতই খিটখিটে লোক হোক, তবু তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ!
বিন্তি বললে–কী হবে দিদি
মা বললে–তুমি কিছু ভেবো না মা, ভগবানকে ডাকো–
–দাদুকে তুমি খবর দিয়েছ?
মা বললে—দিয়েছি–
অঘোরদাদুর বলে নিজেরই জ্বালা। তাকে নিজেকেই কে দেখে তার ঠিক নেই। তারও যাবার অবস্থা। তাকেও তো দেখা দরকার। একে অঘোরদাদু নিজের জ্বালা নিয়েই অস্থির, তার ওপর চন্নুনীর কথা আর শুনতে ভাল লাগে না।
অঘোরদাদু বললেও বুড়ী মরুক গে, ও মুখপোড়া মরলে আমার হাড় জুড়োয়
তবু দীপঙ্করের মা নিজেই একবার গিয়ে ফণি ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এল। হাতের কাছে ফণি ডাক্তার থাকতে বিনা-চিকিৎসায় মারা যাবে মানুষটা। ডাক্তার এসে চন্ননীকে দেখলে, ওষুধ দিলে। একটা টাকাও দিতে হলো তাকে। তারপর সন্ধ্যে হলো। বড় টিপি-টিপি পায়ে যেন সন্ধ্যে এলো সেদিন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িটাতে! সমস্ত কাজের মধ্যেও কোথায় যেন একটা আতঙ্ক লুকিয়ে ওত পেতে ছিল। দরজায় একটু শব্দ হলেই মা যেন চমকে উঠছিল-ওই আসছে দীপু! যেন দীপু এলেই সব আতঙ্কের অবসান হবে। যেন দীপু এলেই এই অবধারিত মৃত্যু এড়ানো যাবে।
–কে রে? দীপু?
সদর দরজায় খিল দেওয়া ছিল। শব্দ হতেই মা তাড়াতাড়ি হারিকেনটা হাতে নিয়ে দরজাটা খুলতে গেছে।
–তুই এত দেরি করে এলি বাবা? দেখ তো, এদিকে চন্নুনী যায়-যায়!
কিন্তু দরজা খুলতেই দীপুর মা অবাক হয়ে গেছে। চন্নুনীর বড় মেয়ে লক্কা। দরজাটা খুলে মা খানিকটা নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। কখনও চন্নুনীর মেয়েদের সঙ্গে ভাল করে কথা বলেনি। মাজা-ঘষা চেহারা। কানে সোনার মাকড়ি, হাতে কাঁচের চুড়ি। মাথার চুলগুলো আঁট করে খোঁপা বাঁধা। গা ধুয়ে এসেছে বোধহয় এখনি। গা দিয়ে সাবানের গন্ধ বেরোচ্ছে ভুর ভুর করে।
বললে–মা কেমন আছে মাসি? মা’র নাকি অসুখ?
তারপর আর দাঁড়াল না। একেবারে শোক যেন উথলে উঠলো মেয়ের। চোখ ছলছল করতে করতে দৌড়ে গেল চন্নুনীর ঘরের দিকে।
বিন্তি রোয়াকে দাঁড়িয়ে দেখছিল।
মা বললে–তুমি ঘরে যাও মা, ওদের দিকে দেখো না
চন্নুনীর ঘরে গিয়ে ঢুকলো বড় মেয়ে। তারপর এলো ছোট মেয়ে। লোটন। তারও শোক উথলে উঠেছে। মা’কে একটা পয়সা দিয়ে কখনও সাহায্য করেনি মেয়েরা। কখনও একটা ভাল-মন্দ জিনিস হাতে এনে মাকে দিয়ে বলেনি–মা তুমি এটা খাও! সেই মেয়েদেরই কাণ্ড দেখে হাসি এল। এই তো পৃথিবী গো! বাপ বলো, মেয়ে বলো, পুত বলো, কেউ কারো নয়। এখন এসেছে মাকে দেখতে!
হঠাৎ এলো ফোঁটা। সে-ও খবর পেয়েছে। সঙ্গে ফণি ডাক্তার।
দীপুর মা বললে–আমি তো ডাক্তারবাবুকে ডেকেছিলুম, তুমি আবার কেন ডেকে আনতে গেলে
ফোঁটার বড় আটা। বললে–তা হোক দিদি, আমার কর্তব্য আমি করছি, বাঁচা মরা তো ভগবানের হাত
সকালবেলাই ফণি ডাক্তার এসেছিল। আর একবার এল ফোঁটার সঙ্গে। আবার একটা টাকা পেলে। কী দেখলে ডাক্তার কে জানে! নাড়ি ঠিকই আছে। ওষুধ সকালেই দিয়েছিল আবার ওষুধ দিলে। চন্নুনীর তক্তপোশের পাশে বসলো খানিকক্ষণ। লক্কা আর লোটন দু’জনে তক্তপোশের দু’ধারে দাঁড়িয়েছিল।
হঠাৎ ছিটে ঢুকলো আর একজন ডাক্তার নিয়ে। নটে ডাক্তার।
সবাই অবাক হয়ে গেছে।
ফোঁটা বললে–আবার কেন ডাক্তার আনলি দাদা?
ছিটে বললে–বেশ করেছি এনেছি, তুই ভেবেছিস তুই আগে ডাক্তার এনে জিতে যাবি?
–তার মানে?
ফোঁটাও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলো। ফণি ডাক্তার আর নটে ডাক্তার দু’জনে দু’জনের মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেছে। এমন রোগী দেখতে তারা তখনও কোনও বাড়ি যায়নি!
ছিটে বললে–হারামজাদা, মায়ের গয়নার লোভে তুই ডাক্তার এনেছিস, তা আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছিস?
–গয়নার লোভে?
–হ্যাঁ, গয়নার লোভে! দশ ভরি বিছে হারের জন্যে ডাক্তার ডেকে ভারি একেবারে ডিউটি করছিস, তা আমি বুঝি না কিছু?
লোটন গালে হাত দিলে। বললে–ওমা, সে কী কথা গো! কী বলে দেখ! আমরা ডাক্তার ডেকেছি দশ ভরি গয়নার লোভে?
লক্কা বললে–তা না তো কী! আর ছেনালী করিসনি, তোর ছেনালী দেখলে গা জ্বলে যায় মাইরি।
ফোঁটা চেঁচিয়ে উঠলো–খবরদার, মুখ সামলে কথা বলবি—
ছিটেও এগিয়ে গেল–কী, আমার মেয়েমানুষকে শাসাচ্ছিস–?
–তোর মেয়েমানুষকে চুপ করতে বল্ ছিটে, সাবধান করে দিচ্ছি এখনও–
লক্কা হাউ-মাউ করে উঠলো। বললে–ওমা, কোথায় যাবো গো, আমাকে খুন করে ফেলতে আসছে যে গো–
সে এক তুমুল চিৎকার শুরু হলো চন্নুনীর ঘরের ভেতর। ফণি ডাক্তার আর নটে ডাক্তার হাত গুটিয়ে কাণ্ড দেখছে। চন্নুনীর তখন কথা বলবারই অবস্থা নয়। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল উদ্দেশ্যহীনভাবে। আর ওদিকে দুই সহোদর ভাই আর সহোদর বোনে কুৎসিত ঝগড়া আরম্ভ হয়ে গেল।
–বেরো, শালা এখান থেকে, বেরিয়ে যা!
–কেন রে শালা বেরিয়ে যাবো, আমার বাড়ি, আমি আলবৎ বসে থাকবো এখানে, তোর শালার কী রে?
–আবার গালাগালি দিচ্ছিস? খবরদার বলছি, মেরে খুন করে ফেলবো!
–তবে রে, যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা!
লোটন হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো-ওঁগো, মেরে ফেল্লে গো, ওগো মেরে ফেলে
লক্কাও কম যায় না। সেও চেঁচাতে জানে। বললে–ওগো কী সব্বনাশ হলো গো আমাদের।
ফোঁটা হাতের কাছ থেকে একটা চ্যালা কাঠ তুলে নিয়ে তেড়ে এসেছিল ছিটের দিকে।
বললে–দাঁড়া দেখাচ্ছি তোকে, তোর বাপের নাম ভুলিয়ে দেব একেবারে
ফণি ডাক্তার আর নটে ডাক্তার তখন প্রাণের ভয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
লক্কা লোটনের চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরলে। বললে–হারামজাদী, ছেনালী, তোর মতলব আমি বুঝিছি, তোর পেটে এমন বুদ্ধি—
ছিটে হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একেবারে বাইরে বেরিয়ে এল। চিৎকার করতে লাগলো-আমি কালীঘাটের গুণ্ডা, আমাকে চেননি শালা, আমি তোকে খুন করে গঙ্গায় কুচি কুচি করে কুটে ফেলে দেব-তবে আমার নাম ছিটে ভটচায্যি
বলে একেবারে বাইরের সদর দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। যেন শাগরেদদের ডাকতে যাচ্ছিল। আর সেখানেই দীপঙ্করের সঙ্গে দেখা।
দুই ভাই-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা কথা বলতে গিয়েই যত গণ্ডগোল বেধেছিল সেদিন। ফোঁটার চ্যালা-কাঠটা এসে ঠিক মাথার ওপর পড়লো। আর দীপঙ্করের মা বোধহয় দূর থেকে দেখছিল সব। এতণে তার মুখ দিয়েও একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল।
–মা গো।
সেইটুকুই কানে গিয়েছিল নিজের, তারপরে একটু জল মাথায় দিতেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল দীপঙ্করের। ডাক্তার দু’জন ছিল সেখানেই। সেখান থেকে উঠিয়ে সবাই ধরাধরি করে নিয়ে এসেছিল সেদিন। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। খানিকপরেই ওপর থেকে বুড়ো মানুষটা চিৎকার শুনে হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে এসেছে।
–মুখপোড়া, মুখপোড়ারা আবার এসেছে জ্বালাতে। মুখপোড়াদের খ্যাংরা মারি মুখে–কোথায় গেল মুখপোড়ারা? কোন্ চুলোয় গেল তারা!
অন্ধ মানুষ। সেই অন্ধকার রাত্রে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে গালাগালি দিচ্ছে।
–হারামজাদা, আবার এ-বাড়িতে এসেছে, মুখপোড়াদের বের করে দেব বাড়ি থেকে! হারামজাদা মুখপোড়া কোথাকার কোথায় গেল মুখপোড়ারা
নামতে নামতে হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটে গেল। বিরাট ভারি লম্বা-চওড়া দশাসই শরীরটা। আর বুঝি ভার সইতে পারলে না। বোধহয় হোঁচট খেলে অঘোরদাদু। তারপর একেবারে গড়াতে গড়াতে এসে পড়লো উঠোনে। তখনও মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে মুখপোড়া, মুখপোড়াদের…
জীবনের পথ তো অত সহজ, অত সরলগতি নয়। জীবন উপন্যাসও নয়। সে নিজের পথেই চলে। তার একটা বাঁধা নিজস্ব পথও আছে। তার নিয়মকানুনও আছে। জীবনের পথ চলার আইন জীবনেরই নিজস্ব আইন। সেই পথ ধরেই দীপঙ্করের রথ এতদিন চলে এসেছে। সেদিন সেই কথাই বার বার মনে হয়েছিল দীপঙ্করের। পরের দিন সকাল পর্যন্ত অঘোরদাদুর জ্ঞান ফেরেনি মনে আছে। বুড়ো সকালবেলা একবার চোখ খুলেছিল। তা-ও খানিকক্ষণের জন্যে।
দীপঙ্করের মা মুখে একটু জল দিয়েছিল।
মাথাটা নিচু করে জিজ্ঞেস করেছিল–আর একটু জল দেব বাবা?
বুড়ো মানুষটা যতদিন শক্তসমর্থ ছিল, ততদিন কারো টু-শব্দ করবার সাহসটুকু পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু সেইদিন ছিটে-ফোঁটা যেন বাড়িতে এসে গেড়ে বসলো। নিচেয় উঠোনের সামনে ঘরের দাওয়ার ওপর এসে বসে রইল ছিটে-ফোঁটা। সকাল থেকে রান্না-বান্না কিছুই হয়নি। চন্নুনীরও শেষ অবস্থা। অঘোরদাদুরও তাই। একা মা’কেই সব দিক সামলাতে হচ্ছে।
বিন্তি সেই যে ঘরে ঢুকেছে, আর বাইরে বেরোতে সাহস হচ্ছে না তার।
মা নিয়ে আসতেই ছিটে ধরলে-দিদি, চাবিটা কার কাছে?
–কিসের চাবি বাবা?
ছিটে যেন ধমকে উঠলো। বললে–কিসের চাবি জানো না? সিন্দুকের-আবার কিসের?
দীপঙ্করের কানেও কথাটা গেল। অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। এখনও যে অঘোরদাদু মরেনি, এখনও যে বেঁচে আছে বুড়ো মানুষটা। এখনই এরা চাবি চায় সিন্দুকের?
মা বললে–দেখছো তো বাবা, বুড়ো মানুষটার এখন শ্বাস উঠছে–তোমাদের নিজের দাদু হয়ে এই কথা বলতে পারছো?
–তা বুড়ো মরতে এত দেরি করছে কেন?
সমস্ত রাত মা’র যে কী কষ্ট গেছে। রাত্রে খাওয়া হয়নি, ঘুম হয়নি। কোথায় ডাক্তার, কোথায় ওষুধ! কোথায় পথ্য! একটা মানুষ কত দিকে দেখবে। বাড়িটা যেন হাট হয়ে উঠেছে। চন্নুনীর মেয়ে দুটো বাড়ি ছেড়ে নড়তে চায় না।
দীপঙ্কর বলেছিল–মা, ও হার আমার দরকার নেই, তুমি ওদের দিয়ে দাও
মা বললে–কিন্তু চন্নুনী যে হারটা তোর নাম করে দিয়েছিল?
সামান্য একটা হার। হোক দশ-ভরি সোনার হার। তা বলে মানুষের প্রাণের চেয়ে সোনার দামটাই তো আর বেশি নয়! তবু সেই রাত্রে সেই হারই কাটারি দিয়ে কেটে দু’ভাগ করা হলো। সেই হারই অর্ধেকটা নিলে লক্কা, অর্ধেকটা নিলে লোটন। তারপর সারারাত বসে ছিল দুজন। এক একবার মাকে দেখে আর জিজ্ঞেস করে–দিদি, বুড়ো মরেছে?
যত বেলা বাড়তে লাগলো, ততই যেন অধৈর্য হয়ে উঠলো ছিটে-ফোঁটা!
বললে–আটটা বাজতে চললো, এখনও মরলো না বুড়ো?
তারপর কোথা থেকে একে-একে ছিটে-ফোঁটার শাগরেদরা এসে জুটতে লাগলো। তারাও বাড়ির ভেতর এসে বসলো সব উঠোনে। দুটো দল হয়ে গেল বাড়িতে। বসে বসে বিড়ি ফুঁকতে লাগলোলা। দীপঙ্করের ঘরের ভেতরের সিন্দুকটার দিকে উঁকি দিয়ে দেখে গেল বারকয়েক। দীপঙ্কর উঠে গিয়ে অঘোরদাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
আবার ডাক্তার এল। মা জিজ্ঞেস করলে কেমন দেখলে ডাক্তারবাবু?
দীপঙ্করের মনে হলো অঘোরদাদুর সঙ্গে যেন একটা যুগও চলে যেতে বসেছে। যখন সবাই চলে গেছে, তখন একমাত্র অঘোরদাদুই ছিল দীপঙ্করের শেষ বন্ধন। সেটাও বোধহয় চলে গেল। অঘোরদাদুর পাশে দাঁড়িয়ে চোখ দুটো ছলছল করে এল তার। আর কেউ রইল না। কেউই রইল না আর! মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দীপঙ্করের যেন বড় কষ্ট হতে লাগলো। অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো। এই তো শেষ। এই-ই তো শেষ পরিণতি। অঘোরদাদুর সেই তেজ কোথায় গেল! সেই দাপট কোথায় গেল! কার জন্যে এতদিন এত ঐশ্বর্য জমিয়ে এসেছে! কার জন্যে এতদিন টাকাকড়ি গয়নাবাসন সন্দেশ জমিয়ে জমিয়ে পচিয়েছে! কে খাবে এসব? কার ভোগে লাগবে? টাকা দিয়ে কি সব হয়? সব কেনা যায় কড়ি দিয়ে? কোথায় গেল সেই যজমানরা? কার ভরসায় এতদিন ছিল অঘোরদাদু? কোথায় তারা? দীপঙ্কর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো মুখখানার দিকে। কয়েকদিন কামানো হয়নি। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি বেরিয়েছে সারা মুখে। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হয়ে রয়েছে–ভেতরে দাঁত নেই। ফোগলা মুখ। মনে হলো অঘোরদাদু যেন হাসছে। আবার মনে হলো যেন হাসছে না–কাঁদছে। হাসি-কান্না কিছুই বোঝা যায় না। বড় অদ্ভুত করুণ হয়েছে মুখখানা। যেন চোখের পাতা দুটো একটু জড়ানো। যেন ঠোঁটটা একটু চমকে উঠলো কোণের দিকে। কিন্তু না, আর নড়ছে না। দীপঙ্করের মনে হলো একবার জিজ্ঞেস করে এখন কেমন লাগছে অঘোরদাদুর! মরবার আগে মানুষের কী মনে হয়, কেমন অনুভূতি হয় তা যেন অঘোরদাদুর কাছ থেকে জেনে নিলে ভাল হত! খুব কি যন্ত্রণা হয়? খুব কি কষ্ট হয়? মরবার আগে মানুষ কি বুঝতে পারে যে তার জীবনের পালা শেষ হলো? বুঝতে পারে যে এতদিনের পৃথিবীটাকে ফেলে যেতে হচ্ছে?
ডাক্তার উঠে দাঁড়াল এবার।
মা মুখের দিকে চাইলে। একটা আশার কথাও বোধ হয় শুনতে চাইলে।
বললে–কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?
দীপঙ্করও উদ্গ্রীব হয়ে চেয়ে রইল ডাক্তারবাবুর দিকে।
হঠাৎ ছিটে-ফোঁটার দল একেবারে হুড়-মুড় করে উঠে এসেছে। তারা বোধহয় আর অপেক্ষা করতে পারেনি।
ফোঁটা বললে–কী হলো? মরলো?
এ-কথার কে উত্তর দেবে! ছিটে বললে–সারা রাত খাওয়া নেই দাওয়া নেই, শালা বুড়ো তো জ্বালালে খুব–
ফোঁটা আর দাঁড়াল না। অঘোরদাদুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দলের লোকরাও সঙ্গে গেছে। ছিটের দলের লোকরাও পেছপা নয়। ঘরটা খোলা ছিল না। অন্য দিন হলে অঘোরদাদু লাঠি উঁচিয়ে আসতো–মুখপোড়া বলে গালাগালি দিত। আজ আর কেউ বাধা দিলে না। ছিটে-ফোঁটার দল তছনছ করে ফেললে সমস্ত জিনিসপত্র। কোথায় ছিল পচা সন্দেশ, কোথায় ছিল ময়লা কম্বল বালিশ-সব উল্টে-পাল্টে সে এক তাণ্ডব কাণ্ড শুরু করে দিলে।
দীপঙ্কর রেগে হয়ত কিছু বলতে যাচ্ছিল। মানুষটা এখনও মরে নি–এরই মধ্যে লোকটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চায় নাকি! কিন্তু মা ইশারায় বারণ করলে। বললে–তুই কিছু বলিস নি, ওদের জিনিস ওরা যা খুশি করুক
আর তারপর হয়ত চাবির গোছাটা পেয়ে গেল। সেই চাবিটার গোছা নিয়ে হুড়-মুড় করে আবার নিচেয় নেমে গেল সবাই। তারপর গিয়ে ঢুকলো দীপঙ্করের ঘরে। যে-ঘরে সিন্দুকটা ছিল।
দীপঙ্কর ওপর থেকে কাণ্ড দেখে বললে–মা, ওরা যে সব আমাদের ঘরে ঢুকলো–
মা বললে—ঢুকুক–
আর তারপর সিন্দুক ভাঙার পালা। দুম্ দাম্ শব্দ হতে লাগলো হাতুড়ির। তালা খুলতে পারেনি তাই হাতুড়ি শাবল ছেনি যা পেয়েছে তাই দিয়ে ঘা দিচ্ছে। কোথা থেকে যে এত লোক এল, কোথা থেকে যে কী সব হলো, কিছুই যেন কল্পনা করা গেল না। হৈ হৈ শব্দ করে চিৎকার করছে। কী আছে সিন্দুকের মধ্যে কেউ জানে না। অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করেছে তারা। অনেক অপমান গঞ্জনা পেয়ে এসেছে অঘোরদাদুর কাছে। আজ যেন এতদিন পরে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।
দীপঙ্করের সারা বুকটা যেন সির সির করে উঠলো। এ-সংসারের মায়া-দয়া ভালবাসার কি কোনও মূল্য নেই? অঘোরদাদু কি জানতো এমন হবে একদিন? অঘোরদাদু কি কল্পনা করতে পেরেছিল এইসব ঘটনা? অঘোরদাদুর মুখের দিকে আবার চেয়ে দেখল দীপঙ্কর। অঘোরদাদুর মুখে কোনও বিকার নেই যেন। যেন সমস্ত পার্থিব সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। মা পাশে বসে অঘোরদাদুর মুখখানার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। স্থির হয়ে অন্তিম মুহূর্তের জন্যে প্রতীক্ষা করছে।
নিচের উঠোনে লক্কা আর লোটন আবার এসে হাজির হয়েছে। এবার সেজেগুজে এসেছে দুজনে। হারের ভাগাভাগি হয়ে গেছে। এখন আর তেমন ঝগড়া নেই। পান খেয়ে মুখ লাল করেছে।
দীপঙ্কর আবার ডাকলে—মা—
মা চাইলে ছেলের মুখের দিকে মুখ তুলে।
–ওরা যে আমাদের ঘরের সব কিছু নষ্ট করে দিচ্ছে–আমি যাবো?
মা গম্ভীর গলায় বললে—না–
তারপর হঠাৎ যেন নিচে থেকে একটা শোরগোল উঠলো খুব জোরে। সবাই চিৎকার করে উঠলো পাড়া কাঁপিয়ে। আশেপাশের বাড়ির কিছু লোক তখন ঢুকে পড়েছে বাড়ির উঠোনে। আজ এ-বাড়িতে রান্না নেই, খাওয়া নেই। একদিকে উন্মত্ত মানুষের কোলাহল, লুকোন সম্পদের জন্যে হুড়োহুড়ি-যে-সম্পদ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাউকে উপার্জন করতে হয়নি, যে-সম্পদ ঠাকুরের নাম করে দিনের পর দিন সঞ্চয় করেছে, যে-সম্পদ ঈশ্বরকে ঠকিয়ে একজন কৃপণ আহরণ করেছে ভোগের উপকরণ হিসেবে। আর একদিকে মৃত্যু। ধীর স্থির গম্ভীর অবধারিত মৃত্যু। দীপঙ্করের মনে হলো যেন সমস্তপৃথিবীটা একেবারে উলঙ্গ হয়ে উঠলো তার চোখের সামনে। শুধু ছিটে-ফোঁটা নয়। ওই যারা নিচের উঠোনে ভিড় করে আছে, ওরা সব কে-জি-দাশবাবু, ঘোষাল সাহেব, অনন্তরাও ভাবে। এই লক্কা-লোটন–ওদের সঙ্গে মিস মাইকেলেরও যেন কোন পার্থক্য নেই। উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন যেন নয় এটা–এটাই যেন পৃথিবী। দীপঙ্করের দেখা-অদেখা গোটা পৃথিবীটা যেন মূর্তিগ্রহণ করেছে। এখানে! মৃত্যুর ওপর কোনও শ্রদ্ধাও নেই যেন ওদের। ওরা হাসছে, কথা বলছে, পান খাচ্ছে।
ছিটে বিড়ি খাচ্ছিল আর তদারক করছিল। বললে–তালাটাকেই তোরা ভাঙতে পারলি না, সর তোরা, আমি দেখি
বলেই একটা শাবল নিয়ে তালার ভেতর ঢুকিয়ে দিলে।
অঘোরদাদুর তালা। সহজে ভাঙবার মত নয়। তবু চাড় দিতে লাগলো ছিটে।
ফোঁটাও বিড়ি ফুঁকছিল গামছা কাঁধে নিয়ে। বললে–মাল নেই পেটে, গায়ে জোর আসবে কোত্থেকে
কাছেই একজন শাগরেদ হুকুমের অপেক্ষা করছিল। বললে–মাল আনবো দেবতা?
–আন–
বলে ফোঁটা পকেট থেকে টাকা বের করে দিলে। ঘেমে নেয়ে উঠেছে সবাই। অথচ জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে পারছে না কেউ। অনেক দিনের সিন্দুক। অনেক দিনের লোভ এই সিন্দুকটার ওপর। সে কি আজকের কথা! অঘোরদাদুর এতটুকু স্নেহমমতা পায়নি এরা। বয়েস বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে বিষনজরে পড়ে গেছে তার। তারপর থেকে রাস্তায় ঘুরে তবলা বাজিয়ে আর নিতান্ত বুদ্ধির জোরে নিজেদের জায়গা করে নিতে হয়েছে সংসারে। জেলে গেছে, হাজতে গেছে, একবারে সমাজের ডাস্টবিনে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে তাদের। তবু তাদের নিজের জগতে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন কালীঘাটের বস্তিতে কাটিয়েছে, এবার এখানে এসে উঠবে। উঠে অনেক টাকার মালিক হবে। লক্কা-লোটনকে নিয়ে সমাজের মধ্যে বাস করবে। তাই বোতলটা আনতেই ফোঁটা প্রাণভরে মুখের মধ্যে উপুড় করে দিলে।
শাগরেদ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। বললে–একটু পেসাদ দ্যান দেবতা
–দেব, দেব, আগে সিন্দুকটা খোল!
ছিটে দেখতে পেয়েই কাছে সরে এল। বললে–কী রে, একলাই খাবি নাকি?
ফোঁটা বললে–বেশ করবো খাবো, নিজের মেহনতের টাকায় খাচ্ছি-তোর বাপের টাকায় খাচ্ছি না তো
ছিটেও রেগে গেল। বললে–তুই বাপ তুলে কথা বলছিস্?
–বেশ করবো, বাপ তুলবো।
–তবে রে হারামজাদা
বলে ছিটে বোধহয় একটা রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে দিত। কিন্তু হঠাৎ দীপঙ্কর ঘরে ঢুকলো। দীপঙ্করকে ঘরে ঢুকতে দেখে সবাই একটু আলাদা হয়ে বসলো। ছিটেও চাইলে দীপঙ্করের মুখের দিকে। ফোঁটাও চেয়ে দেখলে।
দীপঙ্কর একটু চুপ করে থেকে বললে–অঘোরদাদু মারা গেছে
–মারা গেছে?
সে কী উল্লাস! মারা গেছে! মারা গেছে! সমস্ত লোকগুলো যেন আত্মহারা হয়ে যাবার যোগাড়। ফোঁটা প্রথমে কথাটা বিশ্বাস করেনি। তারপর একটু সম্বিৎ পেয়েই মুখের মধ্যে গড়গড় করে ঢেলে দিলে সবটা। উপুড় করে নিঃশেষ করে ফেললে সমস্ত বোতলটা। তারপর আরো বোতল এল। আরো হুল্লোড় বাড়লো তাদের। আরো তামাশা চলতে লাগলো মৃত্যুর সঙ্গে।
.
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। সমস্ত মনটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল এক নিমেষে। এই এদের এত গোলমাল, এত হল্লা, তার মধ্যেও দীপঙ্করের মনে হলো যেন সব নিস্তব্ধ, সব নিঝুম, সব শূন্য। পাড়ার কয়েকজন মেয়ে, কয়েকজন ছেলে মজা দেখতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। দু’একজন মা’র কাছে গিয়ে বসেছে। বিন্তিও মা’র আঁচল ধরে বসে আছে। মার চোখ দিয়ে শুধু নিঃশব্দে টস টস করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আর অঘোরদাদুর স্তব্ধ দেহটা কাঠ হয়ে পড়ে আছে সামনে। একটু নড়া নেই চড়া নেই, একটা প্রতিবাদও নেই মুখে! মৃত্যুর আগে একটা কথাও বলে যেতে পারেনি অঘোরদাদু। কাউকে প্রাণভরে গালাগালিও দিয়ে যেতে পারেনি। পনেরো ষোল ঘণ্টা অসাড় হয়ে পড়েছিল শুধু চোখ বুজে।
মা শুধু এক ফোঁটা গঙ্গাজল দিয়েছিল মুখে শেষ সময়টায়।
অঘোরদাদু শেষ হয়ে গেল। তবু শেষ হয়ে গেলেই তো সব শেষ হয় না। দীপঙ্কর উঠোনটার ওপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাই ভাবছিল। যা ইচ্ছে নিক ওরা। সিন্দুক ভেঙে সবকিছু ওরা নিয়ে যাক্। দীপঙ্কর কিছু বলবে না। তার কিছু বলবারও নেই। আবার মা’কে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোনও আশ্রয়ের সন্ধান করতে হবে।
সেই ভিড়ের মধ্যেই হঠাৎ কে যেন ডাকলে।
–দীপঙ্করবাবু হ্যায়?
দীপঙ্কর ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে। একেবারে অচেনা মুখ।
–দীপঙ্করবাবু কৌন্?
বেশ খাকি পোশাক পরা হিন্দুস্থায়ী একজন। বাড়ির সদর-দরজা দিয়ে একবারে খানিকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
দীপঙ্কর এগিয়ে গেল সামনে। বললে–কাকে খুঁজছো?
–দীপঙ্করবাবুকে!
–আমিই দীপঙ্করবাবু!
লোকটা বললে–আপনাকে বৌদিদিমণি ডাকছেন বাইরে–
–-কে বৌদিদিমণি?
লোকটা বললে–বাইরের গাড়িতে বসে আছেন–
–বাইরে কোথায়? দীপঙ্কর লোকটার সঙ্গে বাইরে এল। এ-রাস্তায় গাড়ি ঢোকে না। দু’পা হেঁটে গেলেই নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের চওড়া রাস্তা। রাস্তাটার ওপর একটা বিরাট গাড়ি দাঁড়িয়ে। বাদামী রং। দীপঙ্করের কী যেন সন্দেহ হলো। হঠাৎ বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। যেন চেনা মুখ একটা গাড়ির ভেতরে। তাড়াতাড়ি কাছে যেতেই অবাক হয়ে গেছে দীপঙ্কর!
–সতী, তুমি?
বেশ সিঁথির ওপর টক্ করছে সিঁদুর। আরো যেন ফরসা দেখাচ্ছে সতীকে আরো যেন মোটা হয়েছে। আরো যেন সুন্দর হয়েছে।
কিন্তু সতীও দীপঙ্করকে দেখে কম অবাক হয়নি। বললে–ও কি, তোমার মাথায় কী হলো?
দীপঙ্কর বললে–ও কিছু না, কালকে মাথায় চোট লেগেছিল–কিন্তু তুমি হঠাৎ কী মনে করে?
সতী হাসলো। বললে–তোমার সঙ্গেই দেখা করতে এলাম!
–আমার সঙ্গে?
–কেন, আসতে নেই?
বলে সতী আবার হাসলো একটু।
দীপঙ্কর বললে–কাল তো তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি, তোমার শ্বশুর বাড়িতে, প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে। কিন্তু অনেক রাত তখন, তুমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলে–তাই ডাকতে ভয় হলো–
তারপর একটু থেমে বললে–তুমি নামবে না?
সতী বললে–আর নামবো না এখন, কেন এসেছি তোমাকে বলে যাই শোন আসছে সোমবার দিন একবার আমাদের বাড়ি যেতে পারবে? সোমবার সন্ধ্যেবেলা–
দীপঙ্কর বললে–আসছে সোমবার সন্ধ্যেবেলা?
সতী বললো—হ্যাঁ–
দীপঙ্কর বললে–কেন যেতে পারবো না। কিন্তু হঠাৎ কী ব্যাপার?
সতী বললে–তুমি আমার ওখানেই খাবে—
দীপঙ্কর মাথাটা নিচু করে কথা বলছিল। বললে–খাবো?
–হ্যাঁ, যাকে নেমন্তন্ন বলে আর কি, তাই!
দীপঙ্কর বললে–খুব আশ্চর্য তো
সতী বললে–কেন, আশ্চর্য হবার কী আছে? খাওয়াতে নেই? মানুষ তো মানুষকে নেমন্তন্ন করেই
দীপঙ্কর বললে–না, সেজন্যে বলছি না। কাল রাত্তির বেলা আমি তোমার শ্বশুরবাড়ির সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। তোমার সঙ্গে দেখা করবার অনেক চেষ্টা করেছিলুম, অথচ আজ তুমিই এসে গেলে
–তা ডাকলে না কেন? আমি তো ছিলুম বাড়িতে!
দীপঙ্কর বলল–খুব ভয় করতে লাগলো আমার-ভাবলাম বড়লোকের বাড়ি ঢুকবো, শেষে যদি কেউ কিছু বলে!
সতী খুবই হাসলো। কিন্তু প্রতিবাদ করলে না। শুধু বললে–বাবা তো বড়লোক দেখেই আমার বিয়ে দিয়েছেন!
তারপর হঠাৎ সে-প্রসঙ্গ বদলে নিয়ে বললেথাক গে, তুমি তা হলে যেও ঠিক, বুঝেছ?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-তোমাকে বুঝি এখন অনেক লোককে নেমন্তন্ন করতে যেতে হবে?
সতী বললে–অনেক লোককে? কেন? অনেক লোককে নেমন্তন্ন করতে যাবো কেন? শুধু তোমাকেই নেমন্তন্ন করলাম–আর কাউকে বলছি না–
–শুধু আমাকে!
দীপঙ্কর যেন একটু অবাক হয়ে গেল। আর কাউকে নেমন্তন্ন করেনি, শুধু একলা তাকে? দীপঙ্কর সোজা সতীর মুখের দিকে মুখোমুখি চেয়ে দেখলে। সতীর গায়ে অনেক গয়না, সতীর চেহারায় অনেক রূপ, সতীর চোখেও যেন অনেক আত্মীয়তা। এতক্ষণ যেন এসব কিছুই নজরে পড়েনি তার। দীপঙ্কর চোখ ভরে দেখতে লাগলো।
বললে–এত লোক থাকতে বেছে বেছে শুধু একলা আমাকেই যে নেমন্তন্ন করলে?
সতী বললে–করলুমই বা! করতে নেই?
তারপর গলাটা একটু নামিয়ে বললে–যাবে তো?
বড় করুণ শোনালো সতীর গলার স্বরটা।
দীপঙ্কর বললে–তুমি এমনভাবে কথাটা বলছো যেন তোমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে আমি তোমাদেরই উপকার করবো, অথচ তুমি নিজে না এসে তোমাদের চাকরকে দিয়ে ডেকে পাঠালেও আমি যেতাম–জানো
–তাহলে আমি যাই? মনে থাকবে তো? ঠিকানা চিনতে পারবে তো?
কী যে বলে সতী! সতী তো জানে না আপিসে কাজ করতে করতে, রাস্তায় ট্রামে চলতে চলতেও কতবার সতীর কথা ভেবেছে! বাড়ি আসবার পথে কতবার ওই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডটার দিকে চেয়ে দেখেছে।
ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিতে যাচ্ছিল–সতী বললে–মাসীমার সঙ্গে আর দেখা করে গেলাম না, কিছু মনে করেন না যেন, তুমি একটু বুঝিয়ে বোল, বুঝলে?
দীপঙ্কর বললে–দেখা না করেছ ভালোই করেছ, মা’র এখন কথা বলবারই সময় নেই
–কেন? খুব কাজে ব্যস্ত বুঝি?
–না, আমার অঘোরদাদু এখুনি মারা গেল।
–সে কি!
দীপঙ্কর বললো, এই তুমি ডাকবার একটু আগেই মারা গেল। বাড়িতে এখন যে-কাণ্ড চলেছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমার মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে কাল থেকে। আমাকে নিজের নাতির মত ভালবাসতে অঘোরদাদু। নিজের নাতির চেয়ে বেশি ভালবাসতো–তুমি তো সবই জানো! সংসারে আমার মা ছাড়া নিজের বলতে আর তো কেউ রইল না–
–কী হয়েছিল?
দীপঙ্কর বললে–সে অনেক কথা, সব কথা বলবারও আমার সময় নেই, তোমারও শোনবার সময় হবে না এখন। তোমরা চলে যাবার পর অনেক কিছু ঘটে গেছে আমার জীবনে, সব কথা বললেও তুমি বুঝতে পারবে না–
–তা হলে তোমার আর সময় নষ্ট করবো না। আগে বললে তোমার এতক্ষণ সময় নষ্ট করতাম না। আমি চলি তাহলে–
–হ্যাঁ, সে-সব শুনে তোমার কাজ নেই।
–তাহলে সোমবার, মনে থাকে যেন, আমি অপেক্ষা করবো–
সতীর গাড়িটা চলে গেল একটা মৃদু শব্দ করে। কী আশ্চর্য! দীপঙ্করের মনে হলো, এমন আশ্চর্য ঘটনাও ঘটে সংসারে! এই কটা বছর কতবার যার কথা মনে পড়েছে, সেই সতীই এমন করে আসবে আবার তারই খোঁজে, এমনও সংসারে ঘটে তাহলে! অনেক কথাই তো জিজ্ঞেস করার ছিল, অনেক প্রশ্নই তো জমে ছিল দীপঙ্করের মনে। কিন্তু কিছু তো জিজ্ঞেস করা হলো না। তাকে নেমন্তন্ন করে গেল সতী।
–দীপুবাবু, দেবতা আপনাকে ডাকছে!
দীপঙ্কর হঠাৎ পেছন ফিরলো। দেখলে ফোঁটারই এক শাগরেদ। এতক্ষণ পরে রাস্তাটার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চেয়ে দেখলে–সতীর গাড়িটার চিহ্নও নেই কোথাও। তারপর আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। রীতিমত উৎসব শুরু হয়ে গেছে সেখানে। তাদের ঘরের ভেতরে তখনও অনেক ভিড়। ছিটে ফোঁটা সবাই আছে। সিন্দুকটার তালা ভাঙা। ভেতরে জিনিসপত্র সব বার করেছে। রূপোর বাসন, সোনার মোহর, টাকা, পয়সা, আনি, দোয়ানি, নানান জিনিসের স্তূপ। দু’ভাগে চুলচেরা ভাগ হচ্ছে।
ফোঁটা দেখতে পেয়েই বললে–কী করে দীপু? কোথায় গিয়েছিলি? আমি ভাবলাম পালালি বুঝি! ওদিকের খবর কী?
ফোঁটার এক হাতে গ্লাস। ছিটেরও তাই। ঘরের চারদিকে চেয়ে দীপঙ্করের রাগ হয়ে গেল। এই তাদের শোবার ঘর। এইখানেই তার মা শোয়। তার মা’র কাঠের ক্যাশবাক্সটা রয়েছে। এই সিন্দুকের ওপরই মাথা ঠেকিয়ে রোজ মা প্রণাম করে। মার কাছে এই সিন্দুকটাই তো লক্ষ্মী! এরা সমস্ত কিছু নোংরা করে দিয়েছে। সমস্ত অশুচি অপবিত্র করে দিয়েছে।
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে মা’র কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সমস্ত রাত মা অঘোরদাদুর পাশে বসে আছে ঠায়। মিনিটের জন্যে উঠে যায়নি কোথাও। অঘোরদাদু চিত হয়ে শুয়ে আছে। ধীর স্থির মূর্তি। বিন্তিও পাশে বসে আছে মা’র কাছ ঘেঁষে।
দীপঙ্কর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মা মুখ তুলে চাইলে। বললে–আজকে আর আপিসে যেও না তুমি, তোমাকেই তো সব করতে হবে–
দীপঙ্কর বললে–আমি তাহলে সাহবেকে একটা টেলিফোন করে দিয়ে আসি মা
–তাই দাও ৷
কাছেই শ্মশান। ক্যাওড়াতলা শ্মশান থেকে দীপঙ্কর আপিসে টেলিফোন করে দিলে। রবিন্সন সাহেব জিজ্ঞেস করলে–হোয়াটস্ রং উইথ ইউ? কী হয়েছে তোমার?
দীপঙ্কর বললে–আমার গ্র্যান্ড-ফাদার মারা গেছে।
সাহেব বললে–কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তোমার মাদার ছাড়া আর কেউ নেই!
–এ আমার নিজের গ্র্যান্ড-ফাদার নয় স্যার, কিন্তু নিজের গ্র্যান্ড-ফাদারের চেয়েও আপন–আমার আপন-জনের চেয়েও আপন!
সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলে–কবে আপিসে আসতে পারবে?
দীপঙ্কর বললে–সোমবার!
সাহেব জিজ্ঞেস করলে-ডেফিনিটলি সোমবার?
–হ্যাঁ স্যার।
সতীদের বাড়িতে সোমবার সন্ধ্যেবেলা যেতে হবে। সেইদিনই আপিসে যাবে। আপিস থেকে ফেরার সময়।