উপন্যাস
১
–নাম?
নামটা দরখাস্তের ওপর লেখা রয়েছে, তবু ভদ্রলোক নাম জিজ্ঞেস করলে।
–দীপঙ্কর সেন।
–কী নাম বললেন?
কেরানীটি যেন একটু বিরক্ত হলো। একবার আপাদ-মস্তক দেখে নিলে।
মুখ ফিরিয়ে পাশের একজনকে বললে–শুনলে হে নামের বাহার, নাম নেই গোত্তর নেই, ট্যামগোপালের নাতি! বাপ-মা আর নাম পেলে না, খুঁজে খুঁজে এমন বিদঘুঁটে নাম রাখে এক-একটা–তা যাকগে বানান কী?
–ডি আই পি-এ…
–থাক, আর বলতে হবে না–বলে খস্ খস্ করে নামটা লিখলে।
বললে–ঠিকানা?
দীপঙ্কর বললে–উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন। পোস্ট কালীঘাট—
লোকটা সব লিখে নিলে। আপিসের কেতা-কানুন সব নিয়ম মাফিক করতে হবে।
-কত বয়স হলো? ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট আছে?
লোকটার নানা বায়নাক্কা। অবশ্য চাকরি হয়েছিল সেদিন। ফরসা জামাকাপড় পরে এসেছিল দীপঙ্কর। প্রথম দিন, একটু ভয়-ভয় করছিল বৈ কি! বিরাট লাল বাড়িখানার চেহারা দেখেই যেমন ভক্তি-শ্রদ্ধা হয়েছিল। ফরম ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। তবু দাঁড়িয়েছিল খানিকক্ষণ। এখন ভাবলে খানিকটা হাসি পায়। একেবারে সবচেয়ে নিচু ধাপের চাকরি। তেত্রিশ টাকা মাইনে। অনেক টাকা! সব খরচা বাদ দিলেও পাঁচ সাত টাকা বাঁচে। বাড়ি-ভাড়াটা লাগে না, এই যা রক্ষে।
-কার লোক আপনি?
এতক্ষণে ভদ্রলোক একটু যেন ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করলে।
-কার লোক আপনি? রবিনসন সাহেবের?
ভদ্রলোক কেমন হেসে উঠেছিল, অমায়িক ভঙ্গিতে।
-আরে বলুন না মশাই, আপনি তো এখন আমাদেরই একজন হয়ে গেলেন, এখন আর বলতে দোষ কী! রবিনসন সাহেব পেছনে রয়েছেন আর তেত্রিশ টাকায় ঢুকলেন? সাহেবকে বলে পঞ্চান্ন টাকায় স্টার্টিংটা করে নিতে পারলেন না?
দীপঙ্কর বলেছিল–না, রবিনসন সাহেবকে আমি চিনি না, নৃপেনবাবুকে চেনেন, নৃপেনবাবু আমায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন–
নৃপেনবাবু! নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের নৃপেনবাবু! নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী। তাঁকে রোজই দেখা যেত রাস্তা দিয়ে আপিস যেতে। শীতের দিনে কালো গলাবন্ধ কোট আর লম্বা ফুল-প্যান্ট পরা। গ্রীষ্মকালে সুতির জামা। হাতে একটা অ্যালুমিনিয়মের টিফিন কৌটো। হন্ হন্ করে হাঁটতেন। সোজা গলি দিয়ে বেরিয়ে হাজরা রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে যেতেন আর দেখতে পাওয়া যেত না। এক একদিন দেখা যেত বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছেন। তখন অনেক রাত হয়ে গেছে।
প্রথমে মা-ই একদিন নিয়ে গিয়েছিল নৃপেনবাবুর কাছে।
নৃপেনবাবু বলেছিলেন–বি-এ পাস করেছ?
দীপঙ্কর সবিনয়ে বলেছিল—হ্যাঁ-––
মা তাড়াতাড়ি বলেছিল–প্রণাম করো, প্রণাম করো ওঁকে–
কথাটা আগেই শিখিয়ে দিয়েছিল মা। কিন্তু মনে ছিল না। দীপঙ্কর পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকাল। নৃপেনবাবুর পা দুটো ছিল একটা তক্তপোশ আর একটা টেবিলের সরু ফাঁকের মধ্যে। সেই তক্তপোশের ওপরে বসেই তিনি একটা গামছা পরে তেল। মাখছিলেন। ডান হাতটা অতি কষ্টে ফাঁকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে তবে পায়ের ধুলো নেওয়া গিয়েছিল।
বললেন–থাক থাক—
তারপর বললেন–এই সেদিন একটা এম-এ পাস ছোকরা আমার কাছে এসেছিল কাজের জন্যে, বুঝলে দীপুর মা, তা বললাম তাকে, এম-এ তো পাস করেছ বাপু কিন্তু তোমার দরখাস্তে যে চারটে ভুল ইংরিজী লিখেছ, বলে ভুল দেখিয়ে দিলাম, দেখে ছোকরা…তা যাক্গে স্বদেশী-টদেশী করো না তো বাপু তুমি?
মা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই খালি পিঠের উপর চড়াৎ চড়াৎ করে তেল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন–রবিনসন সাহেব যদি জানতে পারে তো শেষে আমার নিজের চাকরি নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি পড়ে যাবে–স্বদেশী ভালো জিনিস, তবে গরীব লোকের ও-সব করলে তো পেট ভরবে না হে, স্বদেশী করতে কি আমারই সাধ যায় না? ওসব ওদের পোষায়, ওই আনি বেসান্ট, তিলক, সি-আর-দাশ, মতিলাল নেহরুদের মতো লোকদের পোষায়–ওরা হলো বড়লোকের ছেলে…তা যাকগে, তাহলে ওই কথাই রইল–
বলে তিনি ভেতরের দিকে চলে যাবার উপক্রম করলেন।
মা এগিয়ে গিয়ে বললে—তাহলে—
নৃপেনবাবু বললেন–এনেছ? তা এখন তো আমার আবার তেল—
হাত
মা বললে–তাহলে ভিতরে বৌদিকে দিয়ে আসি–
-না না, আচ্ছা ওইখানেই রাখো-বলে তক্তপোশের ওপরটা দেখিয়ে দিলেন।
দীপঙ্কর দেখলেমা দুটো দশ টাকার আর একটা পাঁচ টাকার নোট তক্তপোশের ওপর রেখে দিলে।
নৃপেনবাবু নোট-কখানা দেখে বললেন–কত? পঁচিশ?
মা বললো আপনি তো পঁচিশ টাকার কথাই বলেছিলেন–
-এই দেখ, পঁচিশ টাকা তো তোমাকে আমি গেল-বছর বলেছিলাম! তা তখন এলে পঁচিশ টাকাতেই হয়ে যেত, এখন যে বেটারা সব আরো স্যায়না হয়ে গিয়েছে। চাপরাশীদের আগে দুটাকা করে দিলে হতো, এখন সব পাঁচ টাকা করে রেট করে দিয়েছে–আমি কী করব?
মা বললে–আমি তো আর টাকা আনিনি দাদা–
নৃপেনবাবু বললেন–এই দেখ, একটা চাকরি খালি ছিল, এখন দিলে হতে পারতো, পরে তো আর ভেকেন্সি হবে না–
-তাহলে কত দিতে হবে?
নৃপেনবাবু বললেন–এই পুরোপুরি এক মাসের মাইনে, তেত্রিশ টাকা।
-তেত্রিশ টাকা!
মা যেন হতাশ হয়ে পড়েছিল সেদিন। সোজাসুজি কাতর-দৃষ্টিতে নৃপেনবাবুর দিকে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ।
নৃপেনবাবু বললেন–তা তুমি কি ভাবছো টাকাটা আমি নিজে নিচ্ছি।
মা বললে–না না তা ভাববো কেন–
নৃপেনবাবু বললেন–না, তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন টাকাটা আমি আমার নিজের পকেটে পুরেছি! তবে তোমাকে হিসেব দিই, দুটো চাপরাশী দশ টাকা, এস্ট্যাবলিশমেন্ট কার্ক পাঁচ টাকা–কত হলো? পনেরো। ডাক্তারকে দিতে হবে দশ, ডাক্তারের চাপরাশীকে তিন, আর কম্পাউন্ডার পাঁচ। কত হলো হিসেব করো–ঠিক তেত্রিশ,–
মা’র মুখ দিয়ে তখনও কোনও কথা বেরোচ্ছে না।
নৃপেনবাবু বলতে লাগলেন–তারপরে আমার ডিপার্টমেন্টের চাপরাশী আছে, বাবুরা আছে, তাদের পান খাওয়ার জন্যেও লাগবে মোটামুটি আরো তিন টাকা, তা সে আমি না-হয় নিজের পকেট থেকেই দিয়ে দেব, তার জন্যে আর তোমায় ভাবতে হবে না–
তারপর তেলের বাটিটা নিয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছিলেন–
মা বললে–তাহলে দাদা, আমি যত শিঘি পারি টাকাটা যোগাড় করে আনবো, আপনি দেখবেন চাকরিটা যেন খালি থাকে–
নৃপেনবাবু হাসলেন। বললেন–সে আর বলতে হবে না, কী কষ্ট করে তুমি ছেলে মানুষ করেছ তা আর জানি না। কিন্তু আমি জানলে কী হবে, সাহেব বেটারা তো বুঝবে না তা–
মা আসবার সময় বললে–তাহলে টাকাটা পুরো করেই আনব দাদা–
-হ্যাঁ এনো, তোমাকে তো হিসেব দিয়ে দিলুম, আর সেইদিন তুমিও দরখাস্ত একখানা এনো ওমনি–
দীপঙ্কর বললে–আনবো মামাবাবু–
চলেই আসছিল দীপঙ্কর। কিন্তু মা ইঙ্গিত করতেই আবার গিয়ে তেল-মাখা পা দুটো ছুঁয়ে মাথায় ঠেকালো।
বাইরে এসে মা খুব রাগ করেছিল।
বলেছিল–এত করে তোকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিলাম, তবু তোর একটু হুঁশ হয় না কেন, বুড়ো মানুষের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে কী এমন অপমান হয়! তাহলে আমি এই চিরকাল এমনি করে পরের বাড়ি ভাত বেঁধে বেড়াই, আর তুমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়িয়ে বেড়াও–
আর শুধু নৃপেনবাবুই নয়। কোথায় কোথায় কত লোককে গিয়ে ধরতো মা। কোথায় কোন পাড়ায় কে পোর্ট কমিশনার্সে কাজ করে, কে রাইটার্স বিল্ডিং-এ কাজ করে, কে ম্যাকিনন্ ম্যাকেঞ্জির আপিসে কাজ করে, কে মার্টিন বার্নের আপিসে, কে আরো কত অসংখ্য জায়গায়। সেই ইস্কুলে পড়ার সময় থেকে এইরকম শুরু হয়েছে। সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলে এইরকম করে ভর্তি হয়েছে, তারপর কালীঘাট হাই ইস্কুলে। মা’র তদ্বির-তদারকে কোথাও মাইনে দিতে হয়নি তাকে। সব জায়গাতেই ফ্রি স্টুডেন্ট। এই প্রথম চাকরির ক্ষেত্রে এসেই সব জায়গা থেকে এক সঙ্গে টাকার কথা উঠলো।
কালীঘাট ইস্কুলে মাত্র এক বছর পড়েছিল। তারপরেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুল। ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলেই বলতে গেলে প্রথম হাতে খড়ি। মা একদিন সেখানেও এমনি করে নিয়ে গিয়েছিল।
হেড-মাস্টার প্রাণমথবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন–কী নাম?
কত আর বয়েস তখন! কাকে বলে স্কুল, কাকে বলে আপিস, কাকে বলে কলেজ, কাকে বলে চাকরি, কাকে বলে ইন্ডিয়া, কাকে বলে বেঙ্গল, কিছুই তখন জানতো না দীপঙ্কর।
মা পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বললে–বলো, নাম বলো তোমার, বলো?
দীপঙ্কর বলেছিল–শ্রীমান দীপঙ্কর সেন–
-বাবার নাম?
দীপঙ্কর বলেছিল–ঈশ্বর হরগোবিন্দ সেন।
–দেশ কোথায়?
দীপঙ্কর বলেছিল–হুগলী জেলার ব্যাঁটরা গ্রামে–
-এখানকার ঠিকানা কী?
দীপঙ্কর বলেছিল–উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, পোস্টাপিস কালীঘাট।
সেই প্রাণমথবাবুর কথা বহুদিন পর্যন্ত মনে পড়তো দীপঙ্করের। বৃদ্ধ, অতি বৃদ্ধ। খদ্দর পরতেন আজীবন। পায়ে একটা শু-জুতো। গোড়ালির দিকটা দুমড়ে চটিজুতোর মতন করে পরতেন। মোটা-সোটা মানুষ, এলোমেলো চুল, আলুথালু পোশাক, পান চিবোতেন দিনরাত।
খুব ছোটবেলায় মনে আছে এক-একদিন ইস্কুল ছুটি হয়ে যেত। কেন ছুটি হতো বোঝা যেত না। সকালবেলা ইস্কুলে যেতেই যতীন দপ্তরী বলতো–আজ ইস্কুল হবে না, আজ ছুটি তোমাদের–
ইস্কুল হতো না বটে কিন্তু একেবারে তখুনি চলে আসাও যেত না।
সে-রকম ছুটি জীবনে অনেক এসেছে দীপঙ্করের কিন্তু তেমন আনন্দ কখনও হয়নি। আর।
যতীন দপ্তরী অনেকগুলো প্যাকাটি এনে দিত সকলের হাতে। সকলে এক-একটা প্যাকাটি নিয়ে দাঁড়াত সার দিয়ে। ড্রিল-মাস্টার রোহিণীবাবু ইস্কুলের বাক্স থেকে অনেকগুলো তিন-রঙা ফ্যাগ বার করে আনতেন। যতীন দপ্তরী সকলের প্যাকাটিতে একটা করে ফ্ল্যাগ পরিয়ে দিয়ে যেত। তারপর সবাই দু-সার হয়ে পাশাপাশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোহিণীবাবু চীৎকার করে বলতেন–সবাই রেডি হয়েছ তো—
সবাই রেডি হতো।
তারপর বজ্র-গম্ভীর গলায় রোহিণীবাবু চীৎকার করতেন—অ্যাটেন–শন্–
সকলেরই পা সোজা, বুক চিতিয়ে দাঁড়াত সবাই–
-রাইট টার্ন!
সবাই ডানদিকে ফিরতো।
-লেফট্ টার্ন।
এমনি অনেকক্ষণ ধরে ড্রিল চলতো ইস্কুলের সামনের উঠোনে। কিন্তু কষ্ট হতো না কারো। সবাই জানতো খানিক পরেই পুলিস আসবে, দারোগা আসবে। আর তার একটু পরেই ছুটি।
সত্যি সত্যিই একটু পরে পুলিস-দারোগা এসে পৌঁছুতো। তারা সবাই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে হেড-মাস্টারের ঘরের দিকে চলে যেত। আর সঙ্গে সঙ্গে রোহিণীবাবু চীৎকার করতেন–কুইক মার্চ–
আর প্রায় দেড়শো ছেলে হাতে ফ্ল্যাগ উঁচু করে পুলিস-দারোগার পেছন-পেছন সোজা গিয়ে দোতলায় উঠতো।
ততক্ষণে যতীন দপ্তরী ফুলের মালা নিয়ে তৈরি।
রোহিণীবাবু চীৎকার করতেন-বন্দে-মাতরম–
সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলের দেড়শো ছেলে একসঙ্গে প্রতিধ্বনি করতো–বন্দে-মাতরম্–
একবার নয়, দুবার নয়, অনেকবার। সমস্ত বাড়িটা গম্ গম্ করে উঠতো। সে যে কী আনন্দ। আর রোহিণীবাবু ফুলের মালাটা প্রাণমথবাবুর গলায় পরিয়ে দিতেন।
তখন হেডমাস্টারও বলতেন—বন্দে-মাতরম্–
দীপঙ্কররাও একসঙ্গে বলতে–বন্দে-মাতরম্।
আর তারপর দারোগাবাবু হেড-মাস্টারকে নিয়ে যেত বাইরে। সেই বন্দে-মাতরমের শব্দে তখনও সমস্ত নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
তখন ছেলেদের ছুটি। ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলটা সেদিনের মতো বন্ধ হয়ে যেত। আর তারপর মাস তিন-চারেকের মধ্যে আর প্রাণমথবাবুকে ইস্কুলে দেখা যেত না।
মা প্রথম-প্রথম অবাক হতো। তখনও হয়তো রান্নাঘরে বসে রান্না করছে। অনেক লোকের রান্না মা’কে একলা করতে হতো।
বলতো–ওমা, তুই ফিরে এলি যে? ইস্কুল হলো না?
দীপঙ্কর বলতো–আজকে শুধু ড্রিল হয়েছে–
-কেন?
দীপঙ্কর বলতো–আজকে ছুটি, আজ প্রাণমথবাবুকে পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে যে–
–কেন, পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে কেন হঠাৎ?
দীপঙ্কর নিজেই জানতো না তার জবাব কী দেবে! নিজেই জানতো না কেন মাঝে মাঝে হেড-মাস্টারকে ধরে নিয়ে যায় পুলিসে, কেন আবার ছেড়ে দেয়। কেন প্যাকাটিতে ফ্ল্যাগ এঁটে মার্চ করে ‘বন্দে-মাতরম’ বলতে হয়। আর হেডমাস্টারকে ধরে নিয়ে গেলে কেনই বা ছুটি হয় অমন করে।
আবার হয়তো একদিন দীপঙ্কর দেখে, প্রাণমথবাবু এসে গেছেন। আবার তিনি তাঁর নিজের ঘরে বসে আপিসের কাজকর্ম করছেন। সেই মোটাসোটা চেহারা, সেই এলোমেলো চুল, সেই আলুথালু পোশাক, সারা গায়ে খদ্দরের জামা-কাপড়। সারা মুখে পান। আর পায়ে সেই গোড়ালি দুমড়ানো শু-জুতো।
ইস্কুল থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি যেতে হতো। বাড়িতে না গেলে মা ভাবতো খুব। তবু যেদিন একটু বেড়াবার ইচ্ছে হতো, একটু ঘুরে ঘরে যেত। নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটটা দিয়ে বেরিয়ে একেবারে উত্তরদিকে পাথরপটি। ওদিকে বাড়ি নয়, কিছুই নয়। তবু অনেক লোক, অনেক ভিড় বড় রাস্তায়। অনেক লোক দেখতে ভালো লাগতো। হঠাৎ দেখতো রিকশা করে বাড়ি ফিরছেন অঘোরদাদু।
দীপঙ্কর হঠাৎ ডাকতো–অঘোরদাদু–
–কে র্যা মুখপোড়া?
–আমি দীপু অঘোরদাদু—
–থামা, থামা না মুখপোড়া রিকশাওয়ালা, মুখপোড়া ছুটছে তো ছুটছেই–থামা না রে–
অঘোরদাদু বাড়িওয়ালা। অঘোর ভট্টাচার্য ও-অঞ্চলের পুরোন বাসিন্দা। বুড়ো থুথুড়ে চেহারা। বয়েস যে কত তা দীপঙ্কর বুঝতে পারতো না। উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িটার মালিক। পাঁজির পাতায় একটা বুড়োর ছবি থাকে। হাতে লাঠি কাঁধে চাদর, আর মাথায় টিকি। পাশে লেখা থাকে দক্ষিণ হস্তে ঐশ্বর্য হৃদয়ে সুখ, বামহস্তে মৃত্যুবৎ, নেত্রদ্বয়ে সুখ, পাদদ্বয়ে পীড়া! কথাগুলোর মানে দীপঙ্কর বুঝতো না কিন্তু ছবিটা দেখলেই কেবল অঘোরদাদুর কথা মনে পড়তো! ঠিক সেইরকম চেহারা অঘোরদাদুর। অঘোরদাদু সারাদিন রিকশায় চড়ে যজমান বাড়ি চষে বেড়াতো। কোথায় চাউলপট্টি রোড, কোথায় গোয়ালটুলি সব জায়গায় যজমান ছিল অঘোরদাদুর। যজমানরা সব বড়লোক। কেউ কেউ দুপায়ে দুটো মোহর রেখে প্রণাম করতো। আবার কেউ কেউ শুধু দুটো টাকা।
বলতো–আরে দেখ মুখপোড়ার কাণ্ড, আগে বাঁ-পায়ে হাত দিলি?তোর মুখপোড়ার কিছু হবে না–
অঘোরদাদুও হুগলী জেলার লোক। এক গ্রামের। কবে একদিন ন’-দশ বছর বয়েসে চৌদ্দটা তামার পয়সা আর এক-কাপড়ে একটা গামছা সম্বল করে বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন, তারপর এই আজ সাত বিঘে জমির ওপর বাড়ি, আর অগাধ টাকার মালিক হয়েছেন। বাড়িটা পুরোন হয়ে গেছে। ইট বালি চুন খসে পড়েছে। ঘর-দোর সারানো হয় না। রাত্রিবেলা চামচিকে ঢোকে এক-একদিন। ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। তারপর আলো নিভোলে কখন ফুড়ুৎ করে বাইরে বেরিয়ে যায়। কখন অঘোরদাদু আসে, কখন বেরিয়ে যায় কারোর জানা নেই। বেলা হয়তো তিনটের সময়েই এসে হাজির। তখন সে এসে চীৎকার করবে–ও মেয়ে, কোথায় গেলে গো-মুখপোড়াগুলো গেল কোথায়–
অঘোরদাদুর কাছে সবাই-ই মুখপোড়া। রিকশাওয়ালাও মুখপোড়া, দীপুর মা-ও মুখপোড়া, দীপুও মুখপোড়া। আর চন্নুনী, অঘোরদাদুর বাড়ি কাজকর্ম করতে চন্নুনী, সেই চন্নুনীও মুখপোড়া। স্ত্রী পুরুষ সবাই মুখপোড়া। আর ছিটে, ফোঁটা, বিন্তি-নীতি নানীরা সবাই-ই মুখপোড়া। যেন সারা পৃথিবীর সব মানুষের মুখগুলো একেবারে পুড়িয়ে দিয়ে ছেড়েছে অঘোরদাদু।
অঘোরদাদুকে কতদিন দেখেছে দীপঙ্কর একলা রাস্তা দিয়ে রিকশা চড়ে চলেছে, মুখে কাকে যেন বিড় বিড় করে মুখপোড়া বলতে বলতে চলেছে। হয়তো ঘুমের মধ্যেও অঘোরদাদু চীৎকার করে উঠতো–মুখপোড়ারা মরে না, মুখপোড়ারা মরলে আমার হাড় জুড়োয়–
দাঁতগুলো সব কবে পড়ে গিয়েছিল অঘোরদাদুর। বাইরের অচেনা লোক হঠাৎ বুঝতে পারতো না কী বলছে বুড়োমানুষ।
এক-একদিন দীপঙ্কর গিয়ে হয়তো অঘোরদাদুকে বলেছে-অঘোরদাদু, তোমাকে এক ভদ্দরলোক খুঁজতে এসেছিল।
অঘোরদাদু চীৎকার করে উঠতো–কে ডেকেছিল? মুখপোড়াটা কে? মুখপোড়ারা বাড়িভাড়া নিতে এসেছিল?
-তা তো জানি না অঘোরদাদু–
-তা জানিস না তো বলতে এসেছিস কেন র্যা মুখপোড়া, মুখপোড়াটা মরেও না, মুখপোড়াটা মরলে আমার হাড় জুড়োয়–
বলে মোটা লাঠিটা নিয়ে তাড়া করে আসতে অঘোরদাদু।
বলতো–বেরো বেরো মুখপোড়া–
আবার আদরও করতো দীপঙ্করকে। একদিন দেখা না হলেই অঘোরদাদু বলতো মুখপোড়াটা গেল কোথায় গোও মেয়ে, বলি মুখপোড়াটা গেল কোথায়?
মা হয়তো তখন রান্না করছে। ভাতের ফ্যান গালতে গালতে বললে কার কথা বলছেন বাবা? দীপু?
অঘোরদাদু বলতো–আবার কোন্ মুখপোড়ার কথা বলবো, সেই ছিঁচকে মুখপোড়াটা–
দীপু খেলে বাড়ি আসতেই মা বলতো–ওরে, তোর অঘোরদাদু একবার ডেকেছিলেন তোকে-দেখ তো–কী বলছিলেন–
দীপঙ্কর উঠোনটা পেরিয়ে সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেত। পশ্চিম-মুখো বারান্দা। মেঝেগুলোর সিমেন্ট উঠে জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়ে গিয়েছে। দেয়ালে চুনকাম হয়নি অনেকদিন। বারান্দা পেরিয়ে দোতলার দক্ষিণদিকে যেতেই বোধহয় অঘোরদাদু পায়ের শব্দ পেয়েছে। পেয়েই একেবারে পে উঠেছে।
লাঠিটা উঁচিয়ে দীপঙ্করের মাথায় ঠকাস করে একটা বাড়ি মেরেছে।
বললে–মুখপোড়া আবার এসেছে, মুখপোড়া আবার চুরি করতে এসেছে, আমার ঘরে সোনা-দানা আছে, না রে মুখপোড়া, আমার ঘরে হীরে-জহরৎ আছে, না রে-বেরো মুখপোড়া বেরো বলছি–বেরিয়ে যা–
আবার একদিন অঘোরদাদু, উঠোনের দিকে এগিয়ে এসে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে বলে–মুখপোড়াটা গেল কোথায় গো, ও মেয়ে, বলি মুখপোড়াটা গেল কোথায়।
মা বলতো–দীপু আর যাবে না আপনার কাছে বাবা, আপনি ওকে লাঠি দিয়ে মেরেছেন–
অঘোরদাদু ফোগলা দাঁতে চীৎকার করে উঠতো–আমি মেরেছি মুখপোড়াকে? বলি আমি আবার কখন মারলুম মুখপোড়াকে?
-হ্যাঁ বাবা, আপনি লাঠি দিয়ে ওর মাথায় মেরেছেন, ওর মাথাটা ফুলে গেছে আমি দেখলাম–
অঘোরদাদু তখন আরো জোরে চীৎকার করে উঠতোতা মুখপোড়া নাম বলে না কেন, নাম বলে না কেন মুখপোড়া, আমি ভেবেছি হয় ছিটে মুখপোড়া নয়তো ফোঁটা মুখপোড়া! মুখপোড়া চোখে কি দেখতে পাই আমি–
ছিটে আর ফোঁটা। অঘোরদাদুর দুই নাতি। ছিটে দিনরাত বিড়ি সিগারেট ফুঁকতো আর তবলা বাজাতে পাড়ায় পাড়ায়। অনেকদিন দীপঙ্কর দেখেছে ইস্কুল থেকে আসার পথে পাথরপটির বড় রাস্তার ধারে বিড়ির দোকানের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুলের তেড়ি দেখছে একমনে মুখে একটা বিড়ি।
ছিটে কখন রাত্রে বাড়ি আসতো ঠিক ছিল না। রাত কখনও একটা কি দুটো বাজতো। দীপঙ্কর তক্তপোশটার ওপর মা’র পাশে শুয়ে রয়েছে, হঠাৎ যেন কেমন একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। তখন চারিদিকে সব নিস্তব্ধ। কালীঘাট বাজারের ঢোল বাজনার শব্দটাও থেমে গেছে তখন।
দীপঙ্কর ডাকতো–মা–
–কী বাবা?
–কীসের শব্দ হলো যেন মা—
–ও কিছু না, তুই ঘুমো!
দীপঙ্কর তবু শান্তি পেত না মনে।
বলতো–একটা শব্দ হলো যে, আমি শুনলুম–
মা বলতো–ও কিচ্ছু না, ছিটে ফিরলো–
কিন্তু ছিটে ফিরলে দরজা খুলে দেবার বালাই ছিল না কারো। যে-যত রাত্রেই আসুক মাকে দরজা খুলে দিতে হতো না। পশ্চিমদিকের জানালার দু-একটা গরাদ ভেঙে রাস্তা করা ছিল। ব্যবস্থা ছিটে আর ফোঁটা দুজনেরই। সেইখান দিয়েই ঢুকে পড়তে ছিটে। আর ফোঁটা যে কখন ঢোকে কিংবা কখন ঢোকে না তার খবর কারো রাখবারই দরকার হতো না।
শুধু অঘোর ভট্টাচার্যি এক-একদিন তুমুল কাণ্ড করে বসতো।
শোনা যেত চীৎকার করছে অঘোরদাদু–-মেরে ফেলবো মুখপোড়াদের নির্ঘাৎ মেরে ফেলবো-বেরো মুখপোড়াবেরো–
খড়ম পায়ে বুড়োমানুষ দোতলার বারান্দার এদিক থেকে ওদিকে ছোটাছুটি করছে। কিন্তু চোখে তো দেখতে পায় না অঘোরদাদু। তাই ছিটের মাথায় মারতে গিয়ে লাঠিটা কখনও পড়ছে দেয়ালে, কখনও মেঝেতে। ছিটে-ফোঁটা ততক্ষণে কোথায় টুপ করে পালিয়ে গেছে, অঘোরদাদু জানতেও পারেনি। কিন্তু তার অনেকক্ষণ পরে পর্যন্ত অদৃশ্য ছিটে-ফোঁটাকে উদ্দেশ করে গালাগালি দিতে শোনা যেত অঘোরদাদুকে।
.
কবে একদিন এই কালীঘাট জঙ্গল ছিল। আস্তে আস্তে কালীমন্দিরকে কেন্দ্র করে একটা বসতি গড়ে উঠেছে এখানে। পুরোহিত এসেছে, যজমান এসেছে, ব্যাপারী এসেছে, ভিখিরি এসেছে। ওই ভূ-কৈলাস, ওই শাঁখারীপাড়া, কাঁসারীপাড়া, মনোহরপুকুর,-সব অঞ্চলগুলো কবে আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে কালীমন্দিরের প্রয়োজনে তা কেউ খেয়াল করেনি। যেমন কলকাতা বেড়েছে, তেমনি এদিকের জঙ্গল ডোবাও ক্রমে ক্রমে সাফ হয়েছে। দোকানী, মুদী, কুমোর, জোলা, সোনার বেনেরা এসেছে–আবার বেশ্যাও এসেছে। দোকানপাট খুলেছে। কারবার ফেঁদেছে। সেই যুগেই বোধ হয় অঘোর ভট্টাচার্যও এসেছিলেন। কোন্ যজমানের সাত বিঘে জমি বাড়ি এখানে পড়ে ছিল, সেটা কুলগুরুকে দিয়ে পরলোকের কাজ পাকা করে যেতে চেয়েছিলেন। তারপর আদালত কাছারি হয়েছে আলিপুরে, উকীলমুহুরী এসে জুটেছে। তাদের উন্নতি হয়েছে যেমন যেমন, অঘোর ভট্টাচার্যিরও তেমন-তেমন উন্নতি হয়েছে। যজমানের মোমাটরগাড়ি হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে অঘোর ভট্টাচার্যিকেও দিয়েছে রিকশা চড়বার পয়সা। অঘোর ভট্টাচার্যির চোখের সামনেই চাউলপটির শেখর চাটুজ্জেদের ধনে-জনে লক্ষ্মীলাভ হয়েছে। লখার মাঠের একাদশী বাড়জ্যেদের অবস্থা ভালো হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অঘোর ভট্টাচার্যির একতলা থেকে দোতলা বাড়ি হয়েছে। কুলগুরুর প্রণামী হিসেবে অঘোর ভট্টাচার্যি পেয়েছে চাল-কলা, পেয়েছে নতুন গামছা, পেয়েছে গরদের জোড়, পেয়েছে কাঁসার থালা-বাটি-ঘড়া, খড়ম, খাট-বিছানা, আর পেয়েছে টাকা আর কখনও কখনও পেয়েছে সোনার মোহর।
এমনি করে যখন লোকজন এসেছে, জম-জমাট হয়েছে শহরতলী, তখন হয়েছে ধর্মদাস মডেল ইস্কুল, কালীঘাট হাই-ইস্কুল, তখন হয়েছে নকুলেশ্বরতলা, শেতলাতলা, সোনার কার্তিক। তখন হয়েছে মধুসূদন, সত্যনারায়ণ, গণেশ, ষষ্ঠী, জগন্নাথের মন্দির। তখন এসেছে প্রাণমথবাবু, রোহিণীবাবু, তখন এসেছেন সি আর দাশ, তখন এসেছেন সুভাষ বোস। তখন জন্মেছে কিরণ, নির্মল পালিত। তখন এখানে এসে পৌঁছেছে দীপুর মা, তখন এসেছে দীপঙ্কর, কালীঘাট হাই-ইস্কুলের ফ্রি স্টুডেন্ট–দীপঙ্কর সেন, রোল নাম্বার এইটিন।
আর তখনই এসেছে লক্ষ্মীদি আর সতী।
কিন্তু লক্ষ্মীদি আর সতীর কথা এখন থাক।
তা ওরা যখন এল তখন দীপঙ্কর আরো বড় হয়ে গেছে। আরো বুঝতে শিখেছে। আরো দেখতে শিখেছে। বুঝেছে গরীব কাদের বলে, কাদের বলে বড়লোক। নিজেদের অসহায় অবস্থার কথাও তখন জানতে পেরেছে সে।
দীপঙ্কর দেখতো তাদের তক্তপোশের পাশে একটা লোহার সিন্দুক বহুদিন থেকে পড়ে আছে। লোহার সিন্দুকটা খোলাও হয় না, নড়ানোও হয় না।
দীপু এক-একদিন জিজ্ঞেস করতো–ও কীসের সিন্দুক মা, ওতে কী আছে? কথাটা মা এড়িয়ে যেত। বলতো–ও আমাদের নয়–
–আমাদের নয় তো কাদের মা?
মা বলতো–ও তোর অঘোরদাদুর–
অঘোরদাদুর সিন্দুক যে তাদের ঘরে কেন থাকে তা দীপু বুঝতে পারতো না। অনেক দিন ধরেই বুঝতে পারেনি। সিন্দুকটা একপাশে পড়ে থাকতো। আর তার ওপর। হাঁড়ি-কড়া থাকতো। আর একটা মস্ত আধমণি লোহার তালা ঝুলতো সামনে। ভেতরে নিশ্চয় কিছু দামী জিনিস থাকতো। নইলে অত বড় তালা কেন!
পড়তে বসে দীপঙ্কর হেলান দিত সিন্দুকের গায়ে। কালো মরচে পড়া গা। কিন্তু কতদিন দেখেছে মা স্নান করে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে সূর্যিপ্রণাম করার পর সিন্দুকটাকেও একবার প্রণাম করেছে। তারপর এক একদিন হয়তো অঘোরদাদু এসে ঢুকতো ঘরের ভেতরে। হাতে একটা নতুন গামছার পুঁটলি। পুঁটলির ভেতরে কী আছে দেখা যেত না। কিন্তু হাতের মুঠোয় একটা মোটা চাবির গোছা ঝুলতো।
অঘোরদাদু বাইরে থেকে ডাকতো-ও মেয়ে, মুখপোড়াগুলো….
–এই যে বাবা-আমাকে ডাকছিলেন?
মা ঘোমটা দিয়ে এগিয়ে যেত বাইরে।
অঘোরদাদু বলতো–মুখপোড়াটা কী করছে রে?
মা বলতো–দীপুর কথা বলছেন? দীপু তো ইস্কুলে গেছে বাবা–
অঘোরদাদু তখন ঘরের ভেতরে ঢুকে বলতো–মুখপোড়াটার লেখাপড়া হবে, তুই দেখে নিস মেয়ে, মুখপোড়াটাকে একটু যত্ন করিস বাছা–মুখপোড়াটা তোর মানুষ হবে, আমার ছিটে-ফোঁটার মতো মুখপোড়া হবে না–
বলতে বলতে সিন্দুকটার কাছে গিয়ে চাবি দিয়ে ভারী তালাটা খুলতো অঘোরদাদু। দীপুর মা তখন কাজের অছিলা করে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অঘোরদাদু আস্তে আস্তে গামছার পুঁটলিটা খুলে একটা একটা করে টাকা সবে ভেতরে রাখতে আরম্ভ করেছে।
হঠাৎ দীপঙ্কর ইস্কুল থেকে এসে বই-খানা রাখতে সোজা ঘরে ঢুকেই অবাক। অঘোরদাদুও জানতে পারেনি। কানেও ভালো শুনতে পায় না, চোখেও ভালো দেখতে পায় না অঘোরদাদু। দীপঙ্কর সিন্দুকটার ভেতরে চোখ দিতেই দেখলে অনেক টাকা, অনেক মোহর, অনেক গয়না ঝক ঝক করছে সেখানে।
দীপঙ্কর বলে উঠলো–এত টাকা অঘোরদাদু!
কথাটা কানে যেতেই অঘোরদাদু লাফিয়ে উঠেছে।
কে রে মুখপোড়া, মুখপোড়া তুই এসেছিস আর জানাসনি মুখপোড়া আমাকে, বেরোবেরো–বলতে বলতে সিন্দুকের ডালাটা তাড়াতাড়ি ঝপাং করে বন্ধ করতে গিয়ে অঘোরদাদুর হাতের ওপর সেটা পড়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার করে উঠেছে।
–গেছি গেছি রে, মুখপোড়াটা কী করলে দ্যাখও মেয়ে, দ্যাখ মুখপোড়ার কাণ্ড–
মা দৌড়ে এসেছে ঘরে। এসেই ডালাটা তুলে ধরেছে। ডালাটা এতক্ষণ চেপ্টে বসেছিল অঘোরদাদাদুর হাতের ওপর। মা দাদুর সেই হাতটার ওপর ঠাণ্ডা জল ঢালতে লাগলো ঘটি-ঘটি।
অঘোরদাদু বললে–আগে মুখপোড়া তালাটা বন্ধ কর না মেয়ে–
তারপর সেই হাতটা ক্রমে ক্রমে ফুলে উঠলো। কদিন অঘোরদাদু আর বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না। কিন্তু সেই দোতলার বারান্দা থেকেই মুখপোড়া বলে সারা পৃথিবীর লোককে গালাগালি দিতে লাগলো। কাউকে রেহাই দিলে না। কেউ রেহাই পেলে না অঘোরদাদুর গালাগালি থেকে। পৃথিবীর যত রিকশাওয়ালা অঘোরদাদুর সঙ্গে পয়সা নিয়ে গণ্ডগোল করেছে, পৃথিবীর যত ভাড়াটে ভাড়া নিয়ে কথার খেলাপ করেছে, পৃথিবীর যত ঝি অঘোরদাদুর বাড়িতে ঝি-এর কাজ করেছে, যত যজমান অঘোরদাদুকে মোহর না দিয়ে টাকা দিয়েছে, সে-কদিন সেই সকলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে লাগলো অঘোরদাদু। সে-কদিন ছিটে, ফোঁটা, বিন্তিদের আর দেখা গেল না বাড়ির চৌ সীমানার মধ্যে। চন্নুনীর মুখেও আর রা নেই। সমস্ত বাড়িটা যেন থম্ থম্ করতে লাগলো সে-কদিন।
দীপঙ্কর সন্ধ্যেবেলা লেখাপড়া করছিল।
মা বললে–মুখ বুজে পড়ো বাবা, তোমার দাদুর শরীর খারাপ দেখছো না–
দীপঙ্কর বললে–অঘোরদাদুর অনেক টাকা, না মা?
মা বললে–পরের টাকার দিকে নজর দিতে নেই দীপু–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু অঘোরদাদু আমাদের ঘরে টাকা রাখে কেন, মা?
মা বললে–এ-ঘরও তো অঘোরদাদুর ঘর, উনি যেখানে খুশি ওঁর টাকা রাখবেন–তাতে আমাদের কী!
দীপঙ্কর বললে–তোমারও টাকা আছে মা? তোমার টাকা তুমি কোথায় রাখো?
মা বললে আমাদের টাকা নেই বাবা, তুমি যখন বড় হবে, চাকরি করবে, তখন তুমিও অনেক টাকা উপায় করবে, ওই রকম সিন্দুক করবে, তখন তোমার টাকা হলেই আমার টাকা হবে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তোমার টাকা নেই কেন?
মা বললে–তুমিই তো আমার টাকা, তুমিই তো আমার সিন্দুক বাবা, তুমি মানুষ হও, আর আমার কিছুই চাই না–
অঘোরদাদুর বাড়িটা সাত বিঘে জমির ওপর। তার মধ্যে উত্তর দিকটার অংশ ভাড়া দেওয়া হতো। বাইরে মাঝে মাঝে একটা সাইনবোর্ড টাঙানো থাকতো। সাইন-বোর্ড এ মোটা মোটা অরে লেখা থাকতো বাটি ভাড়া। সেই বাড়িভাড়ার সাইনবোর্ড দেখে মাঝে মাঝে অনেক ভদ্রলোক এসে খোঁজ করতো। যারা ভাড়া নিত তারা ঠেলাগাড়ি বোঝাই মালপত্র নিয়ে এসে উঠতো একদিন। কেউ থাকতো চার মাস, কেউ বা এক বছর। তারপর আবার একদিন উঠে যেত। বেশির ভাগ ভাড়াটেই উঠে যেত চন্নুনীর গালাগালির ঠেলায়।
হয়তো এঁটো এসে পড়েছে দক্ষিণের উঠোনে। কিংবা হয়তো মাছের কাঁটা কাকে মুখে করে এনে ফেলেছে, আর তারপরই চন্নুনীর গলাবাজি আরম্ভ হয়ে গেল।
সেই উঠোনের ওপর দাঁড়িয়েই কাপড়টা গাছ-কোমর বেঁধে আকাশকে উদ্দেশ করে চন্নুনী ঝগড়া করতে বসলো–
-গতরখাকী, শতেকখোয়ারীরা, চোখে ছানি পড়ক তোদের, তোদের ক্যাওড়াতলায় চিতেয় তুলে দিয়ে আসি লো, মুফরাসে তোদের মুখে আগুন দিক্, গতরখাকীদের গতরে পোকা পড়ক, যে-মাছের কাঁটা বামুনের উঠোনে ফেললি লো, সেই কাঁটা তোদের গলায় ফুটুক, সেই কাঁটা গলায় ফুটে আবাগীরা রক্ত-বমি করু…
এর পর যা বলতে চনী, তা আর কানে শোনা যেত না। সে শুনে কানে আঙুল দিতে হতো। কিন্তু দীপঙ্কর সে-সব কথার মানেও বুঝতো না, সে নিয়ে মাথা ঘামাতো না তখন। কিন্তু ভারি হাসি পেত চন্নুনীর ঝগড়া করার অঙ্গভঙ্গী দেখে। সেই হাত-নাড়া, সেই আকাশের দিকে চোখ তুলে কথা বলা। সেই মাথা নাড়ানো, সেই কাপড় মাঝে মাঝে খুলে কোমরে জড়িয়ে নেওয়া, আঙুল মটকানো, মাটির ওপর দুম দুম করে পা দিয়ে মাড়ানো–সব কিছু।
অথচ আগের দিনই দীপঙ্কর দেখেছে–ভাড়াটেদের ছোট ছেলেটিকে কোলে করে আদর করছে চন্নুনী। সে কী আদরের ঘটা! চুমু খেয়ে গাল ব্যথা করে দিচ্ছে তখন একমনে আদরই করছে চন্নুনী।
–মানিক আমার, আমার ধনুটু, আমার মন্টু, আমার যাদুগোপাল, আমার দুগোপাল, নানটুগোপাল…
কত যে আদর করছে তার আর সীমা নেই। তার অর্ধেক আদরের কেউ মানেই বোঝে না। পান খেয়ে মুখ লাল করে পাড়া মাতিয়ে তখন আদর করছে চন্নুনী।
কিন্তু এই ঝগড়ার পরদিনই আবার দেখা যেত একটা ঠেলা গাড়িতে ভাড়াটেদের খাট আলমারি বাসন-কোসন উঠছে, আর তারপর ঘোড়ার গাড়ির জানালার পাখি বন্ধ করে ভাড়াটেদের বউ-ঝিরাও চলে যাচ্ছে অন্য বাড়িতে।
অঘোরদাদুর তখন পাড়া মাত করে চীৎকার করার পালা।
বলে–মুখপোড়া মাগী, হারামজাদী, মুখপোড়াদের তাড়িয়ে ছাড়লে! দেব মুখপোড়াকে খ্যাঙরা মেরে দূর করে–মুখপোড়া ভাড়াটে তাড়ায়, মুখপোড়া আমারই খাবে আবার আমারই সর্বনাশ করবে–
তখন চন্নুনীর গলা বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ। এত যে গলার ঝাল সেই চন্নুনীও তখন মুখ বুজে উঠোন ঝাঁট দিতে বসে। সব গলার তেজ তার থেমে যায় এক নিমেষে। তখন আবার চন্নুনী যেন অন্য মানুষ।
অঘোরদাদু বলে–এবার যদি আর ঝগড়া করবি মুখপোড়াদের সঙ্গে, তবে তোরই একদিন কি আমারই একদিন–
তখন আবার বাড়ির সামনে রাস্তার দিকে দেয়ালে ‘বাটি ভাড়া’র সাইন বোর্ডটা ঝুলতে থাকে। আবার ভদ্রলোকরা এসে খোঁজ নেয়। আবার অঘোরদাদুর সঙ্গে কথা বলে। আবার একদিন ঠেলাগাড়ি ভর্তি হয়ে খাট, আলমারি, বাসন-কোসন এসে থামে। ঘোড়ার গাড়ির জানালার পাখী বন্ধ করে আবার বাড়ির বৌ-ঝিরা এসে নামবে। আবার রাস্তার ধারের বাটি ভাড়া’র সাইন বোর্ডটা নামিয়ে ফেলা হয়।
যেদিন চন্নুনীর গালাগালি শুরু হতো, সেদিন মা ঘরের জানালা-দরজাগুলো বন্ধ করে দিত। বলতো–ওসব শুনো না তুমি-তুমি তোমার পড়ায় মন দাও–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো–চন্নুনী কার সঙ্গে ঝগড়া করে মা?
মা বলে–ও-সব কথা তোমায় শুনতে হবে না–তোমায় বলেছি না–
–গতরখাগী মানে কি মা?
মা বলে–ছি, ওসব কথা কোনওদিন মুখে উচ্চারণ করবে না, যারা ছোটলোক, লেখাপড়া জানে না, তারাই ওইসব বলে তুমি লেখাপড়া শিখবে, কত বড় হবে, কত মান-সম্মান হবে তোমার, কত টাকা উপায় করবে–
দীপঙ্কর বলতো–হ্যাঁ মা, আমি অঘোরদাদুর মতো টাকা উপায় করবো?
মা বলতো–এখন তোমার ও-সব ভাববার দরকার নেই, তুমি লেখা-পড়া শিখে যাও, ও-সব আপনিই আসবে, তখন তোমারও বাড়ি হবে, তখন আর এই খারাপ জায়গায় থাকতে হবে না তোমাকে–
সত্যিই অনেক আশা ছিল মা’র। অনেক সাধ ছিল। মা’র ধারণা ছিল এই বাড়ি, এই কালীঘাট, এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে পারলেই যেন তার ছেলে মানুষ হতে পারবে। শুধু কোনও রকমে কালীঘাট থেকে চলে যেতে পারলেই যেন সমস্ত পাপ, সমস্ত কলঙ্ক থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। মা ভাবতো যদি একটু ভবানীপুর যাওয়া যেত, যদি আর একটু এগিয়ে বউবাজার কি শ্যামবাজারে যাওয়া যেত! মা ভাবতো সারা পৃথিবীর খারাপ লোকগুলোই বুঝি এই কালীঘাটে এসে বাসা বেঁধেছে। যেন আর কোথাও খারাপ লোক নেই। এখানে যেন সবাই তার দীপুকে বিপথে নিয়ে যাবার জন্যে ব্যগ্র। এই কালীঘাটের মন্দিরে যাবার রাস্তা, ওখানে দলে দলে সন্ধ্যের পর যারা লম্প জ্বালিয়ে বসে থাকে, ওই মন্দিরের আশে-পাশে যারা ঘুরে বেড়ায়, সবাই যেন তার ছেলেকে ছন্নছাড়া করতে উঠে পড়ে লেগেছে। মা তো জানতো না, পৃথিবীর সব পাড়ার সব ছেলেদের এই একই বিপদ। সেখানে ভবানীপুর নেই, সেখানে শ্যামবাজার নেই! মা তো জানতো না, শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সব ছেলেরা দল বেঁধে খারাপ হবে বলে পণ করে বসেছে। কত মা কত ছেলেদের রক্ষা করবে!
নইলে লক্ষ্মীদিদের বাড়ির জানালার ফুটো দিয়ে কেন সেদিন উঁকি দিয়েছিল দীপঙ্কর! কেন সেদিন অনেক রাত্রে বাড়ি আসবার পথে নির্জন শেতলাতলার পাশে ভূত দেখেছিল দীপঙ্কর!
***
সেদিন আবার দীপঙ্কর দেখলে, অঘোরদাদু কালীঘাটের বড় রাস্তা দিয়ে রিশা করে আসছে।
দীপঙ্কর ডাকলে–অঘোরদাদু–
অঘোরদাদু চীৎকার করে উঠলো–কে র্যা মুখপোড়া?
তারপর রিকশাওয়ালাটাকে বললে–থামা না রে মুখপোড়া, দেখছিস না কোন মুখপোড়া ডাকছে-কে র্যা তুই মুখপোড়া? কে?
দীপঙ্কর বললে–আমি অঘোরদাদু, আমি দীপু–
অঘোরদাদু যেন এতক্ষণে দেখতে পেলে।
বললেও মুখপোড়া তুই? আয় উঠে আয়–
তারপর রিকশায় উঠে বসলো দীপঙ্কর। অঘোরদাদুর পায়ের কাছে নতুন গামছার একটা পুঁটলি। ভেতরে দু-একটা পাকা কলা উঁকি মারছে।
অঘোরদাদু বললে–মুখপোড়া নাম বলবি তো তোর, আমি কি চোখে কিছু দেখতে পাই?
দীপঙ্কর বললে–চোখে দেখতে পাও না তো তুমি পূজো করো কেমন করে অঘোরদাদু?
অঘোরদাদু মুখ খিঁচিয়ে উঠলো–দূর মুখপোড়া, পূজো কি করি আমি?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল! পূজো করে না তো কী করে অঘোরদাদু?
অঘোরদাদু বললে–তোর কাছে কি মিথ্যে বলে পাতক হবো রে মুখপোড়া, পূজো আমি করি না–
হঠাৎ অঘোরদাদুর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর! অঘোরদাদু বলছে কী!
অঘোরদাদু বললে–ঠাকুরই আমি দেখতে পাই নে তো পূজো করবো কেমন করে! পূজো আমি করি না–
কথাগুলো যেন কান্নার মতো শোনালো দীপঙ্করের কাছে। কই, অঘোরদাদুর গলার সেই ঝাঁজ কোথায় গেল! তবে কি ঠাকুরপূজোর নাম করে অঘোরদাদু যজমান ঠকায়?
দীপঙ্কর বললে–তাহলে তুমি কী করো?
অঘোরদাদু বললে–কী করি দেখবি তুই? দেখবি?
দীপঙ্কর বললে–দেখবো অঘোরদাদু–
অঘোরদাদু বললে–চল্ মুখপোড়া, তোকে দেখাবো আজ, চল–
রিশাটা গিয়ে দাঁড়ালো উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়ির সামনে। দীপঙ্কর আগে আগে নামলো, তারপর অঘোরদাদু এদিক-ওদিক হাতড়ে নতুন গামছার পুঁটলিটা তুলে নিলে। তারপর একহাতে দীপঙ্করের হাত ধেরে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।
রিকশাওয়ালা পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো–বারুজী, পয়সা?
খিঁচিয়ে উঠলো অঘোরবাবু।
বললে–মর মুখপোড়া–আমি তোর পয়সা নিয়ে বড়লোক হবো নাকি মুখপোড়া– নে মুখপোড়া, নে–
বলে বাড়ির দরজার ভেতরে ঢুকে হাত বাড়িয়ে একটা আনি দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দীপঙ্করও সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকলো। অঘোরদাদু চীৎকার করে বলে উঠলো– চন্নুনী, দরজাটায় খিল দিয়ে দে–
দীপঙ্কর শুনতে পেলে-রিকশাওয়ালাটা বাইরে তুমুল চীৎকার করছে। অঘোরদাদু সেই দুপুরবেলা বেরিয়েছে, তারপর একে একে সব যজমানবাড়ি ঘুরে এই বিকালবেলা ফিরে রিক্শাওয়ালাকে এক-আনি পয়সা ফেলে দিয়েছে। বাড়ির উঠোন দিয়ে ঢুকে ছোট রোয়াক। রোয়াকের ওপর উঠে ডান দিকে সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো অঘোরদাদু। দীপঙ্করও পেছনে পেছনে উঠতে লাগলো।
অঘোরদাদু বললে–আয় মুখপোড়া, আয়—
দীপঙ্কর বললে–অঘোরদাদু, রিশাওয়ালাটা এখনও চেঁচাচ্ছে—
অঘোরদাদু বললে–দূর মুখপোড়া, ও চেঁচাচ্ছে তো তোর কী রে? তোর কী?
তারপর দোতলায় উঠে বারান্দা, বড় বড় ঘর। প্রত্যেকটি ঘর তালা-বন্ধ। তারপরে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে অঘোরদাদু নিজের ঘরের তালাটা খুললে। চাবিটা পৈতেয় আটকে রাখলে।
রেখে দীপঙ্করের দিকে চেয়ে দেখলে একবার।
বললে–বল্ মুখপোড়া, কী বলছিলি বল–বল তুই এবার–
দীপঙ্করের মনে পড়লো।
বললে–বলছিলাম, চোখে তুমি দেখতে পাও না তো পূজো করো কেমন করে?
অঘোরদাদু বললে–মুখপোড়া ঠাকুর কি দেখতে পাই যে পূজো করবো, পূজো আমি করি না মুখপোড়া–
-তাহলে পূজো করো না তো কী করো?
অঘোরদাদু বললে–কী করি তাই তো দেখাতে নিয়ে এলাম মুখপোড়া, দেখবি তুই, দেখবি মুখপোড়া-–ওই দেখ–
বলে দরজার শেকলটা টেনে দরজাটা হাট করে খুলে দিলে অঘোরদাদু আর একটা ভ্যাপসা গন্ধে দীপঙ্করের যেন হাঁপ ধরে উঠলো। ঘরের ভেতরটা প্রথমে কিছু দেখতে পেল না। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠলো সব।
-দেখলি তো মুখপোড়া, দেখলি তো?
দীপঙ্করের চোখের সামনে তখন কেউ যেন আরব্য উপন্যাসের সিং-দরজাটা খুলে দিয়েছে। দীপঙ্কর দেখলে ঘরের মধ্যে যেন তাল তাল সোনা পাহাড় হয়ে আছে। চক্ চক্ করছে, ঝক ঝক করছে। তারপরে আরো স্পষ্ট হলো দেখলে, অনেক ঘড়া, কাঁসার ঘড়া। ঘড়ার ওপরে ঘড়া। শুধু ঘড়াই নয়। ঘড়া, গাড়, থালা, গেলাস, বাটি, পিলসুজ। সব প্রণামীতে পেয়েছে অঘোরদাদু। সব ব্রাহ্মণের দান। কুল-পুরোহিতের দান। একটার ওপর আর একটা চাপানো।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–এত ঘড়া ঘটি কী করবে অঘোরদাদু!
অঘোরদাদু মুখ খিঁচিয়ে উঠলো।
বললে–দূর মুখপোড়া, এত জিনিস নিয়ে লোকে কী করে? আমি বেচবো রে মুখপোড়া–অনেক বেচে ফেলেছি, এগুলোও বেচবো, বেচে অনেক টাকা হবে–
টাকা! দীপঙ্করের মনে পড়লো তাদের ঘরের সিন্দুকটার কথা। সেই সিন্দুকটার ভেতরেও অঘোরদাদুর অনেক টাকা, মোহর দেখেছিল।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–এত টাকা-কড়ি নিয়ে কী হবে তোমার অঘোরদাদু? কী করবে তুমি?
অঘোরদাদু রেগে গেল। রেগে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠলো।
বললে–টাকা-কড়ি দিয়ে কী হয় রে, মুখপোড়া! কী হয়? বড় হলে বুঝবি রে, কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়, সব কেনা যায় কড়ি দিয়ে—সব–
মনে আছে দীপঙ্কর ঘর ছেড়ে চলেই আসছিল।
অঘোরদাদু পেছন থেকে চীৎকার করে উঠলো–কোথায় গেলি রে মুখপোড়া কোথায় গেলি?
দীপঙ্কর আবার ফিরলো।
বললে–এই যে দাদু, আমি–
-প্রসাদ খাবি না? নৈবিদ্যি খাবি না মুখপোড়া?
দীপঙ্কর বললে–খাবো–দাও–
অঘোরদাদু ঘরের এক কোণে অনেক দিনের পুরোন নৈবেদ্যর থালা থেকে একটা সন্দেশ দিয়ে বললে–এই নে–
দীপঙ্কর সন্দেশ নিয়ে আবার চলেই আসছিল। হঠাৎ অঘোরদাদুর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। চোখটা যেন কেমন-কেমন দেখাচ্ছে অঘোরদাদুর। কাঁদছে নাকি! না, চোখ খারাপ হয়েছে!
–খা, মুখপোড়া খা—
***
সে-প্রসাদ সেদিন মুখে দিতে পারেনি দীপঙ্কর। মুখে দিতে গিয়ে চমকে উঠেছিল। তারপর এক দৌড়ে সোজা চলে এসেছিল নিচেয়। মা তখন নিচের রান্নাঘরে রাঁধছিল। মাকে অনেক লোকের রান্না করতে হতো। এই অঘোরদাদু খেত, দুই নাতি ছিটে আর ফোঁটা খেত। আর খেত বিন্তি, অঘোরদাদুর নাতনী। বিন্তি অত বড় বাড়িতে কোথায় কোন্ কোণে যে লুকিয়ে থাকতে দেখা যেত না। কখনও উঠোনে বসে অন্য মেয়েদের মতো রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে চুল শুকোতে দিত না। সমস্ত বাড়িটার ওই পঙ্কিল আবহাওয়ার মধ্যে বিন্তি যেন পদ্মফুল হয়ে সকলের চোখের আড়ালে ফুটে ছিল।
এক একদিন বিন্তিদি রান্নাঘরে আসতো টিপি-টিপি পায়ে।
বলতো–দিদি ভাত হয়েছে?
মা বলতো–খিদে পেয়েছে বুঝি মা?–
বিন্তি বলতো—হ্যাঁ–
মা বলতো–তা পাবেই তো, সকাল থেকে তো কিছু পেটে পড়েনি–কী খেয়েছিলে আজ সকালে?
বিন্তি বলতো–তুমিও তো কিছু খাওনি দিদি–
মা হাসতো। বলতো–আমি বিধবা মানুষ, আমি আবার কী খাবো, মুড়ি চিবোবে দুটো?
বিন্তি বলতো–আমার কাছে তো পয়সা নেই–
-আমার কাছে আছে পয়সা, দিচ্ছি, আনিয়ে দিচ্ছি–
দীপঙ্কর তখন পড়ছিল। মা তাড়াতাড়ি ঘরে এল। মায়ের একটা কাঠের ভাঙা বাক্স থাকতো তাকের ওপর। তার ভেতরে মা’র পয়সা-কড়ি থাকতো। আঁচলের চাবিটা দিয়ে বাক্সটা খুলে
মা বললে–বাবা, মোড়ের দোকান থেকে এক পয়সার মুড়ি এনে দাও তো টপ করে?
দীপঙ্কর বলতো–কে খাবে মা?
মা বলতো–সব কথায় অমন কথা বলতে নেই, যা বলছি করো–
মুড়ির দোকান থেকে মুড়ি এনে দিতেই দেখতো অঘোরদাদুর নাতনী রান্নাঘরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মা মুড়ির ঠোঙাটা বিন্তিকে দিতেই সে বললে–দীপুকে একটু দেব দিদি?
-না, না, ওকে দিতে হবে না, ও পান্তাভাত খেয়েছে একপেট—
দীপঙ্কর বললে–অঘোরদাদুর ঘরে অনেক সন্দেশ আছে, খাবে বিন্তিদি?
বিন্তি অবাক হয়ে গেল। বললে, ও কী করে দেখলে বল তো দিদি?
দীপঙ্কর বললে আমি দেখেছি, অঘোরদাদু আমাকে দেখিয়েছে, অনেক ঘড়া আছে, ঘড়া ঘটি থালা বাটি, সব আছে–অনেক সন্দেশ আছে–দেখ, এই এত সন্দেশ–
বলে হাত দুটো বড় ফাঁক করে দেখাল দীপঙ্কর।
বিন্তি অবাক হয়ে গেল। হেসে বললে–সত্যি, ও দেখেছে তো ঠিক! তুই সন্দেশ খেয়েছিস? দাদু সন্দেশ দিয়েছে তোকে?
মা বললে–তোমার দাদুর কথা আর বোলো না বাছা—
বিন্তি বললে–এত সন্দেশ দাদু কার জন্যে জমাচ্ছে বলো তো দিদি?
দীপঙ্কর বললে–অঘোরদাদু বলেছে ওগুলো বেচে অনেক টাকা-কড়ি হবে–
বিন্তি বললে–তা অত টাকা-কড়ি দিয়েই বা কী হবে শুনি? কী বলো দিদি, টাকা কড়ি তো আর মানুষের সঙ্গে যায় না, বলো–
দীপঙ্কর বললে–কড়ি দিয়ে সব কেনা যায় তা জানো, সব কেনা যায় কড়ি দিয়ে–
বিন্তিও অবাক হয়ে গেল। হেসে বললে–ওমা, কে শেখালে রে ও কথা, কে শেখালে তোকে? দীপু তো দেখছি খুব সেয়ানা হয়ে গেছে দিদি–
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ, কেনা যায়–
এমন সময় হঠাৎ বাইরে অঘোরদাদুর খড়মের আওয়াজ শোনা গেল।কই রে, ও মেয়ে মুখপোড়া কানেও কালা হয়ে গেছে, কোথায় গেলে গো, ও মেয়ে–
বিন্তি অঘোরদাদুকে দেখেই টুপ করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছে।
মা বললে–বাবা, আপনি আপনার ঘরের চাবিটা একবার দেবেন তো, আমি পরিষ্কার করবো, আমি ঝাটা না ধরলে ও ঘর আপনার পরিষ্কার হবে না, কোন্ দিন সারা বাড়িতে পোকা থ থ করবে–
ঘরের চাবির কথা শুনে অঘোরদাদু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।
বললো, ঘরের চবি আমি তোমাদের দিই, আর মুখপোড়া ছিটে-ফোঁটা সব লুঠপাঠ করে নিক, মুখপোড়াদের জ্বালায় আমি বলে পৈতেয় চাবি রেখে শান্তি পাই না– মুখপোড়ারা…
মা বললে–কিন্তু আপনি দীপুকে সন্দেশ দিয়েছিলেন, সে-সন্দেশে যে পোকা থ থক করছে একেবারে–
-পোকা! কেন, পোকা হবে কেন? পোকা অমনি হলেই হলো–
মা বললে–অত সন্দেশ, অত ফল-ফুলুরি কার জন্যে তুলে রাখেন আপনি বাবা? কার ভোগে লাগবে? কে খাবে?
অঘোরদাদু যেন হঠাৎ থমকে গেল। চিরকালের বাক্যবাগীশ অঘোরদাদু যেন হঠাৎ বড় বেকায়দায় পড়ল। এমন সহজ কথাটা তো এমন করে কখনও ভাববার দরকার হয়নি। যজমানরা চিরদিন যা দিয়ে এসেছে, তা তিনি সঞ্চয় করেছেন বলেই তো আজ এই বাড়ি হয়েছে, এই জমি, বাগান, সিন্দুক-ভর্তি টাকা, সব কিছু হয়েছে। সঞ্চয় না করলে তো অঘোরদাদু এতদিন ফতুর হয়ে যেত। আর তার দাঁড়াবার মতো একটা আশ্রয়ও থাকতো না! এই এত সঞ্চয় করেছিল বলেই তো এখনও বুকের বল আছে তার। এই যে এখন চোখে দেখতে পায় না, সবাই ঠকিয়ে নিতে চায় তাকে, টাকা না থাকলে কী হতো? খেত কী? যজমানরা কি আর আগেকার মতোন দেয়! আগেকার মতো ভক্তি কি আছে কারো? কিন্তু মার কথাতে সে-সব কিছুই বললে না। তার কথাতে সেই চিরাচরিত যুক্তি যেন নিরর্থক হয়ে গেল হঠাৎ। হঠাৎ যেন অঘোরদাদু বুঝতে পারলে, সত্যিই তো, কে খাবে! কার জন্যে এসব করছে? এত সঞ্চয় করছে? যজমানকে ফাঁকি দিয়ে, রিকশাওয়ালাকে ফাঁকি দিয়ে, অঘোরদাদু তো দেবতাকেও ফাঁকি দিচ্ছে। অঘোরদাদু দেবতার নৈবেদ্য চুরি করছে কার জন্যে? কী লাভ হচ্ছে তার? কোথায় গেল তার স্ত্রী পুত্র কন্যা! অঘোরদাদু দেবতাকে ফাঁকি দিয়েছে, না দেবতা তাকে ফাঁকি দিয়েছে? কোন্টা সত্যি? সত্যিই তো তার কেউ নেই, এই সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়ে অঘোরদাদু কী পেয়েছে?
দীপঙ্কর এসব কথা তখন ভাবতো না। এত কথা ভাববার বয়স তখন তার নয়। কিন্তু সেদিন অঘোরদাদুকে যেন কেমন অন্যরকম লাগলো। যেন চিরকালের বাঁচাল অঘোরদাদুকে হঠাৎ বোকার মতো দেখলো।
কিন্তু তা কেবল এক মুহূর্তের জন্যে।
তারপরেই হঠাৎ অঘোরদাদু চিৎকার করে উঠলো–পোকা হয়েছে, বেশ হয়েছে–তোদের কী রে মুখপোড়া, আরো পোকা হোক, আরো পোকা থ থ করুক, তবু কাউকে ___ খেতে দেব না! কাকে খেতে দেব শুনি? কে আছে আমার, কাকে পিণ্ডি গেলাবো? ওরা কি মানুষ, ওদের কি মানুষ বলিস তুই?
তারপর খড়ম খট খট করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে আবার ওপরে উঠতে লাগলো।
বললে–আমি পোকাকে খাওয়াবো তবু ওদের দেব না। আমি কালীঘাটে গিয়ে ডালার দোকানে বেচবো, তবু ওদের দেব না–ওরা খেলে আমার কী লাভ রে মুখপোড়া, বেচলে তবু টাকা হবে–এবার আমি ডালার দোকানে বেচে টাকা নেব–
এর অনেকদিন পরে অনেকবার এই কথাগুলো দীপঙ্করের মনে পড়েছে। অঘোরদাদু সরল সাদাসিধে মানুষ, তাই অমন করে সকলের সামনে কথাগুলো বলতো! কিন্তু পৃথিবীর চারদিকে চেয়ে সবাইকে দেখেই কেবল তার অঘোরদাদুর কথাই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে সবাই-ই যেন অঘোরদাদু। কে কবে কাকে খেতে দিয়েছে! সেই মোগল বাদশা থেকে শুরু করে আলিবর্দি খাঁ, আলিবর্দি খা থেকে সিরাজদ্দৌলা, লর্ড ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস, লর্ড কার্জন, তারপর লর্ড ডালহৌসি, লর্ড কারমাইকেল, লর্ড রীডিং, কে কবে কাকে খেতে দিয়েছে। হিন্দুরা কি মুসলমানদের খেতে দিয়েছে? মুসলমানরা কি হিন্দুদের খেতে দিয়েছে? যে যখন সুদিন পেয়েছে, তখনই অঘোরদাদু সেজে বসেছে। দুহাতে ঠাকুরের নৈবেদ্য চুরি করেছে, আর লোহার সিন্দুকে লুকিয়ে রেখেছে। সবাই তাই করেছে, সবাই তা-ই করবে!
কিরণ কিন্তু অনেক জানতো। কিরণও ছিল দীপঙ্করের মতো ফ্রি স্টুডেন্ট। কিন্তু কিরণ অনেক জায়গায় ঘুরতো। সেই ছোট বয়সেই সে একলা-একলা ভবানীপুর, লখার মাঠ, চেতলা, খিদিরপুর, বেহালা পর্যন্ত হেঁটে যেত। কোথাও তার যেতে বাকি ছিল না।
কিরণ বলতো–জানিস, যখন আমাদের দেশে স্বরাজ হবে, তখন সি আর দাশ রাজা হবে আমাদের–
দীপঙ্কর কিছু বুঝতো না, বলতো–স্বরাজ মানে?
কিরণ বলতো–তখন সব আমরা যা খুশি করবো, এই পুলিস-টুলিস থাকবে না, আমরা যা ইচ্ছে করবো, লাটসাহেব-টাহেব কিছু বলবে না আমাদের-লাটসাহেব হবে সি আর দাশ–তখন আমার বাবার অবস্থা ভালো হয়ে যাবে–আমাকে আর ভিক্ষে করতে হবে না–
দীপঙ্কর বলতো–আর, প্রাণমথবাবু?
কিরণ বলতো–প্রাণমথবাবুও অনেকবার জেল খেটেছে, প্রাণমথবাবুও একটা ছোটলাট হবে–দেখে নিস্–
সেদিন কিরণই টেনে নিয়ে গেল হরিশ মুখার্জি রোডের ওপর হরিশ পার্কে। সেখানে মিটিং হবে। বিলিতি কাপড় পোড়ানোনা হবে। অনেক মজা হবে। কিন্তু কিরণের সঙ্গে মিশতে দিতে চাইত না মা।
মা বলতো–তোমাকে বলেছি না, ওর সঙ্গে মিশবে না–
কিরণের বাবার ছিল কী-একটা রোগ। গলার ভেতরে রোগ হয়েছিল। তাই মুখ দিয়ে কথা বেরত না শেষকালের দিকে। নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের গলির ভেতরে একটা বস্তিতে ছিল কিরণের বাড়ি। কাউকে না জানিয়ে দীপঙ্কর গিয়ে এক-একদিন বস্তির ভেতর গিয়ে দাঁড়াত। অঘোরদাদুর বাড়িটাও ছিল পুরোন, কিন্তু রাস্তার ওপর। পাকা বাড়ি। কিন্তু কিরণদের বাড়ি ছিল মাটির। গোলপাতার চাল। কিরণদের উঠোনে ছিল একটা পেয়ারা গাছ। পেয়ারা পাড়তে অনেকদিন দীপঙ্কর ওদের বাড়ি গিয়েছে। দেখতে মাটির দাওয়ার ওপর কিরণের বাবা একটা মাদুর পেতে বসে ঝিমোচ্ছে। তার মুখ দিয়ে কেমন একটা ঘড়-ঘড় শব্দ বেরুচ্ছে। একটা ময়লা ঘেঁড়া কাঁথা পাশে পড়ে আছে। ঠিক শীতকালে চন্নুনী যে-রকম কাঁথা গায়ে দিয়ে কাজ করতো, তেমনি কাঁথা একটা। চারদিকে মাছি উড়ছে। যখন কোনও অঙ্ক কষতে পারতো না দীপঙ্কর, তখন যেত কিরণের বাবার কাছে। কিরণের বাবা কোন্ ইস্কুলের অঙ্কের মাস্টার ছিল। নামজাদা–
অঙ্কের মাস্টার। মুখে-মুখে বড় বড় অঙ্কের উত্তর বলে দিতে পারতো।
কিরণ বাবার কাছে গিয়ে বলতো–বাবা, দীপুকে এই অঙ্কটা করে দাও না, বুঝতে পারছে না ও–
অঙ্কের বইটা আর স্লেটটা এগিয়ে দিত কিরণ বাবার সামনে।
বড় বড় অঙ্ক সব। কালীঘাট ইস্কুলে তখন দুজনেই পড়ছে। এল-সি-এম, জি-সি এম, বুদ্ধির অঙ্ক। তখন আরো শরীর খারাপ হয়েছে কিরণের বাবার। গলাটা আরো ফুলে উঠেছে। হাতের আঙুলগুলো ছোট হয়ে ফুলে উঠেছে। থু-থু করে চারিদিকে উঠোনময় থু-থু ফেলছে। যন্ত্রণাও হচ্ছে হয়তো। যখন যন্ত্রণায় খুব কাতর হয়ে পড়ে, তখন পাশের কাঁথার ওপর ঢলে শুয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দটা আরো জোরে জোরে হয়। তখন কিরণের মা খানিকটা গরম জল এনে দেয় গেলাসে করে। ঢক ঢক্ করে খানিকটা গরম জল খেয়ে নিলে তৃপ্তি হয়। তখন দুহাতে নিজের গলাটার ওপর হাত বুলোয়। কিন্তু কথা বেরোয় না মোটে। দেখতে পায়, শুনতে পায়, খেতে পারে, শুধু কথা বলতে পারে না। কথা না-বলতে পারার যে কী কষ্ট দীপঙ্কর সেই প্রথম দেখেছিল।
মা বার বার বারণ করে দিত–ওই কিরণদের বাড়ি যাও না তো খোকা?
দীপঙ্কর বলতো–না মা, তুমি বলার পর আর যাইনি মা আমি–
-হ্যাঁ, যেও না, রোগীর বাড়িতে যাওয়া খারাপ, যদি দেখ রোগীর থুথু পড়ে আছে, তাও মাড়িও না, থুথু মাড়ালেও রোগ হয়–
কিন্তু কিরণের বাবার কথা ভাবতে দীপঙ্করের খুব ভালো লাগতো। কত অঙ্ক জানে কিরণের বাবা, কত লেখাপড়া জানে। কত জ্ঞানী, কত গুণী, কত শিক্ষিত, মানুষটার দিকে চেয়ে চেয়ে কত দিন হাঁ করে দেখতো। তারাও গরীব, তাদেরও অনেক অভাব, তার মা’রও বেশি টাকা নেই, সামান্য কাঠের বাক্সটার ভেতর দু-চারটে পয়সা বড়জোর থাকে! তবু খাবার জন্যে দীপঙ্করকে ভিক্ষে করতে হয় না কিরণের মতো।
কিরণের কিন্তু সত্যিই কোনও দুঃখ ছিল না।
কিরণ বলতো–দেখবি, আমরা অনেক বড়লোক হয়ে যাবো, বাবার অসুখও ভালো হয়ে যাবে। আমাকেও আর ভিক্ষে করতে হবে না–
কিরণ আরো বলতো–দেখিস তুই, আমার কথা ফলে কি না—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো–কী করে হবে?
কিরণ বলতো–আমি মস্ত বড় চাকরি পাবো, অনেক টাকা মাইনে হবে আমার–
দীপঙ্কর বুঝতে পারতো না তবু। জিজ্ঞেস করতো–লেখাপড়া না শিখেও চাকরি পাবি?
কিরণ বলতো–লেখাপড়া শিখতে হবে, কিন্তু মাইনে লাগবে না ইস্কুলের, স্বদেশী ইস্কুল হবে, সেই ইস্কুলে তখন পড়বো আমরা–
-মাইনে দিতে হবে না কেন?
কিরণ বলতো–স্বরাজ হয়ে গেলে আর মাইনে লাগবে কেন! তুই কিছু জানিস না, তখন ওই চৌরঙ্গীতে, আলীপুরে যে সব সাহেব-মেমদের বাড়ি আছে, ওই সব বাড়িতে আমরা থাকবো, বাড়ি ভাড়া লাগবে না–
প্রাণমথবাবুকে আর পুলিসে ধরে নিয়ে যাবে না?
কিরণ বলতো–আরে, প্রাণমথবাবুই দেখিস তখন একটা ছোটলাট-টাট হবে–এই সব চালাবে। আর ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলের আমরা সব ছেলের একটা করে চাকরি নিয়ে নেব প্রাণমথবাবুকে বলে–
কথাগুলো শুনতে শুনতে সত্যিই সেদিন বিশ্বাস করতো দীপঙ্কর। সকলের সব অভাব সব অভিযোগ সব সমস্যার সমাধান হবে একদিন। একদিন অঘোরদাদুর বাড়ির উত্তর দিকে আবার ভাড়াটে আসবে। ভাড়াটেদের সঙ্গে আর ঝগড়া করবে না চন্নুনী, একদিন মাকেও আর অঘোরদাদুর বাড়িতে রান্না করতে হবে না। মা আবার ফরসা কাপড় পরে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বিশ্রাম করতে পারবে। দীপঙ্কর বিশ্বাস করতো একদিন। চন্নুনীও আবার ভালো হয়ে যাবে। আর অঘোরদাদুও আবার চোখে দেখতে পাবে ভালো। করে। চোখ দিয়ে দেখতে পাবে ঠাকুরকে, আর পূজো করতে পারবে। আর পূজোর নামে ঠাকুরের নৈবেদ্য নিয়ে এসে ঘরের ভেতরে জমিয়ে রাখবে না। সে-প্রসাদে আর পোকাও ধরবে না। তখন ছিটেও আর রাত করে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ি ফিরবে না, ফোঁটাও আর বাইরে রাত কাটাবে না আগেকার মতো। আর বিন্তিদি? বিন্তিদিও উপোস করে থাকবে না সকাল থেকে। বিন্তিদিরও একটা ভালো জায়গায় বিয়ে হবে। সিঁথিতে সিঁদুর পরে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বেনারসীর ঘোমটায় মুখ ঢেকে শ্বশুরবাড়ি যাবে বরের সঙ্গে। আর প্রাণমথবাবু? প্রাণমথবাবু, তো কতবার জেলে গিয়েছে। কত বছর জেল খেটেছে। কত কষ্ট সহ্য করেছে প্রাণমথবাবু, প্রাণমথবাবু হয়তো ছোট লাটসাহেব হবে, আর কিরণরা। ভালো বাড়িতে গিয়ে উঠবে। কিরণের বাবার অসুখ আবার ভালো হয়ে যাবে। গলার যন্ত্রণাটাও কমে যাবে। একেবারে সেরে যাবে। আর কিরণের মা’কেও আর পৈতে কাটতে হবে না। কিরণকেও আর ভিক্ষে করতে হবে না–
ছোটবেলায় দীপঙ্করের অনেক বিশ্বাস ছিল। ছোটবেলায় বিশ্বাস করা সহজ বোধহয়। কিরণের সঙ্গে কতদিন বেড়াতে গিয়েছে কত দূর। কখনও ভবানীপুর, কখনও টালিগঞ্জ, কখনও খিদিরপুর। সেখানেও কত লোক। কত ছেলেমেয়ে সেখানেও রয়েছে দেখেছে। সেখানেও দেখেছে ঠিক ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের মতো গলি আর বাড়িগুলো। সেখানেও ছাদে শাড়ি ঝোলে, সেখানেও কার্তিক মাসে বাড়ির ছাদে বাঁশের মাথায় আকাশপ্রদীপ জ্বলে। সেখানেও সূর্য উঠলে আলো হয়, সন্ধ্যেবেলা সূর্যটা অস্ত গেলে অন্ধকার হয়ে আসে। সেখানেও কলের জল নিয়ে ঝগড়া বেধে যায় রাস্তায়, সেখানেও কালীঘাটের মতো ভিখিরিরা হাত বাড়িয়ে ভিক্ষে করে। টালিগঞ্জের পুলটার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে দেখেছে-কোথায় দূরে কালীঘাট স্টেশনের ওদিক থেকে একটা রেলগাড়ি হুড় হুড় করে সামনে দিয়ে চলে যায়। ভেতরের লোকগুলোও ঠিক কালীঘাটের লোকদের মতো। সেই রকম কোট, চাদর, শার্ট, পাঞ্জাবি পরা। সেই একই রকম দাড়ি কামানো মুখ, একই রকম চাউনি। কোথা থেকে এসেছে সব, কোথায় যাবে আবাগর। পৃথিবীতে কত লোক আছে। এত লোক, এত শব্দ, এত ভিড়, এত নির্জনতা! এত বড় পৃথিবী। এত বড় যে, চোখে দেখা যায় না। টালিগঞ্জের পুলের ওপর থেকে রাসবাড়িটার চূড়োটা দেখা যায়। তারপর আরো দূরে টালিগঞ্জ, আরো দূরে টালিগঞ্জের দক্ষিণেও জায়গাটা কী? কী নাম ওর? তারপর যেখানে আকাশটা গিয়ে মিশেছে মাটির সঙ্গে সেখানে কয়েকটা গাছ, ছাড়া ছাড়া গাছের মাথা, আর কয়েকটা বাড়ি–
টালিগঞ্জের পুল থেকে নেমে কিরণ বলতো–এখানে দাঁড়া একটু দীপু আমি ভিক্ষে করে নিই–
তখনও কয়েকটা পৈতে বিক্রি হয়নি। দীপঙ্কর একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়াত, আর কিরণ সোজা চলে যেত সামনে। অনেক লোক আপিস থেকে তখন আসছে। কিরণ সামনে গিয়ে পৈতেটা বাড়িয়ে ধরতো।
বলতো–ভদ্রলোকরা দয়া করে এক পয়সার পৈতে কিনে নিয়ে যান–ভদ্রলোকরা দয়া করে…
বেশ সুর করে ছড়া-কাটার মতো গলায় কিরণ সেখানে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে। কিরণের চেহারাটা দেখে দয়া হবার মতো। গায়ে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি, আ-একটা হাফপ্যান্ট। মুখটা করুণ করে কিরণ একমনে চেঁচিয়ে যেত। দীপঙ্কর জানতে ওই পৈতে বিক্রির পয়সাতেই ওদের চাল-ডাল-নুন-তেল সব কিনতে হয়। বাড়িভাড়া বাপের ওষুধ কিনতে হয়।
তা এক-একজন পৈতে কেনে। দরকার না থাকলেও অনেকে কেনে। গরীব ছেলেটার ওপর দয়া করে কেনে।
কিন্তু সেদিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল।
এক ভদ্রলোক সোজা একটা দোয়ানি দিয়ে দিলেন কিরণকে।
কিরণ জিজ্ঞেস করলে–কটা পৈতে নেবেন?
ভদ্রলোক বললেন–পৈতে আমি নেব না, আমার পৈতের দরকার নেই, আমি কায়স্থতোমার বাড়ি কোথায়?
কিরণ বললে–নেপাল ভট্টচার্যি লেনে–
-তোমার বাবা কী করে?
কিরণ বললে–আমার বাবার কুষ্ঠ হয়েছে, এই পৈতে বিক্রি করে আমাদের চলে–
ভদ্রলোক আর কিছু না বলে চলে গেলেন। কিরণ বললে–আজকে আর পৈতে বিক্রি করবো না, চল্–
দীপঙ্কর তখন আবার কিরণের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বললে–দেখি, ক’ পয়সা হলো?
কিরণ গুনে দেখলে চার আনা মোট। বললে–এই, আলুর চপ খাবি?
দীপঙ্কর বললে–তোর মা যদি জানতে পারে!
কিরণ বললে–দোয়ানি তো রয়েছে একটা-ওটা দিয়ে খাবো–
তারপর সেই টালিগঞ্জ রোড ধরে সোজা এসে কেওড়াতলার কাছাকাছি একটা জায়গায় কিরণ থামলো।
বললে–এই দোকানটায় রোজ আমি খাই–
কিরণ আলুর চপ কিনলে। গরম গরম ভেজে তুলছে সবে। মুখে যে সেদিন দীপঙ্করের কী অমৃত লেগেছিল সেই চুরি করা পয়সায় কেনা আলুর চপগুলো। জীবনে অনেকবার অনেক কিছু খেয়েছে, কিন্তু সেদিনকার সে আস্বাদ আর যেন কখনও পেলে না। অন্ধকার তখন ভালো করে হয়নি। লোক চলাচল বেড়েছে রাস্তায়। ধুলোয় ধুলো হয়ে গেছে সারা গা। অনেক দূরে দূরে ঘুরে বেড়িয়েছে কিরণের সঙ্গে। কিন্তু আলুর চপগুলো যেন সমস্ত কান্তি ভুলিয়ে দিলে।
কিরণের মুখের দিকে চেয়ে দেখল দীপঙ্কর। কিরণ তখনও ঠোঁট চাটছে।
কিরণ বললে–খুব ভালো আলুর চপ, না?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তুই মাকে গিয়ে আলুর চপ খাওয়ার কথা বলবি?
কিরণ বললে–দূর, কষ্ট তো আছেই, আর ক’টা দিন কষ্ট করে নিই না, তারপর তো ভালো দিন আসছে রে। দেখবি আমি তোকে বলে দিলাম সব কষ্ট চলে যাবে আমাদের, তোকে তো বলেছি–
দীপঙ্কর বললে–কে বলেছে তোকে?
কিরণ বললে–কাউকে বলবি না বল?
দীপঙ্কর বললে–না, কাউকে বলবো না-কে বলেছে বল?
কিরণ বললে–আমাকে এক সাধু বলেছে; জানিস সাধুর কথা মিথ্যে হয় না, সোনার কার্তিকের ঘাটে সাধুটা এখনও আছে, তোকে নিয়ে যাবো একদিন–খুব ভালো সাধু, পয়সা নেয় না–
দীপঙ্কর বললে–আর কী কী বলেছে?
কিরণ বললে–সাধু বলেছে–আমাদের অবস্থা ভালো হয়ে যাবে, আমাদের অনেক টাকা হবে, আমার বাবার অসুখ ভালো হয়ে যাবে–
দীপঙ্কর বললেওষুধ দিয়েছে বুঝি সাধু?
কিরণ বললে–দূর, ওষুধ দেবে কেন। শুধু আমার হাত দেখে বলেছে–
দীপঙ্কর বললে–আমাকে একদিন নিয়ে যাবি ভাই?
কাউকে বলবি না বল। তাহলে তোকে নিয়ে যাবো, একেবারে খাঁটি হিমালয়ের সাধু–
দীপঙ্কর বললে–কবে নিয়ে যাবি?
কিরণ বললে–কালকের ইস্কুলের পর একটু বেড়িয়ে-টেড়িয়ে তারপর সন্ধ্যের পর একসঙ্গে যাবো, সন্ধ্যেবেলা ভিড়টা কম থাকে–
সেই কথাই ঠিক রইল। ছোটবেলার সব ঘটনা। সে-শহরটা বদলে গেছে এতদিনে। সে-মনটাও বদলে গেছে। সেই চোখটাও বদলে গেছে। সেদিন মানুষের পৃথিবীকে যে-চোখে দেখেছিল দীপঙ্কর, সেই চোখটা কবে ক্ষীণ হয়ে এল, কবে তার ওপর আর একটা রং-এর ছোপ পড়লো, কিন্তু সব কথাগুলো এখনো মনে আছে। দীপঙ্করের। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন আস্তে আস্তে মানুষের পায়ে পায়ে আরো বিস্তৃত হয়েছে, ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এর ভেতরে বাইরে অনেক মানুষ এসেছে গেছে, তারপর ক্রমে ক্রমে শহর বেড়েছে দক্ষিণে উত্তরে পূবে পশ্চিমে। তবু সব মনে আছে। যে মানুষগুলো এখন ও-রাস্তায় থাকে তারা দীপঙ্করকে চেনে না। জানে না একদিন ওই রাস্তার ধুলোর সঙ্গে আরো একজনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল, একজন ওই শহরকেই ভালোবেসেছিল। ওই শহরের মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিশ্বাস করেছিল সকলের ভালো হবে। ভেবেছিল সকলের সব রোগ নিরাময় হবে, সকলের দারিদ্র ঘুচবে, সকলের আশ্রয় হবে, সংস্থান হবে। কিরণের মতো সেই সোনার কার্তিকের ঘাটের সাধুর কথাই দীপঙ্কর মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছিল। বিশ্বাস করতে ভালো লেগেছিল। বিশ্বাস করে তৃপ্তি পেয়েছিল। কিন্তু কেন তার বিশ্বাস এমন করে ভাঙলো? কেন এত লোকের এত মহাজনের এত চেষ্টা, এত ত্যাগ, এত সাধনা ব্যর্থ হলো। তার জন্যে কার কাছে। সে জবাবদিহি চাইবে? এই যে সেভেনটিন ডাউন এতকাল পরে এসে পৌঁছুলো। গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর ওপর, এর সব আয়োজন কি তবে মিথ্যে! ইস্কুলের বইতে যাঁদের জীবনী পড়েছে, সেই জর্জ স্টিফেনসন্ কি তবে রেলগাড়ি আবিষ্কার করেছিল এই জন্যে! ব্যাসদেব কি অত মোটা মহাকাব্য লিখেছিল এই উদ্দেশ্যে! গ্যালিলিও কি প্রাণ দিয়েছিল এই কারণে! শাস্ত্র-বাক্য কি তবে মিথ্যে! একদিন এই শহরেই কত লোক পার্কে পার্কে মিটিং করেছে, বিলিতি কাপড় পুড়িয়েছে, জেলে গেছে, তারা যদি আজ কৈফিয়ত চায় হঠা! তারা যদি আবার হঠাৎ বেঁচে ওঠে। বেঁচে উঠে যদি বলে–অয়মহম্ ভোঃ–
চলতে চলতে বাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল। এবার একটু আলাদা থাকতে হবে। নইলে কিরণের সঙ্গে তাকে কেউ দেখে ফেলতে পারে। হয়তো অঘোরদাদু দেখে ফেলবে। কিংবা চন্নুনী। দেখে হয়তো মাকে বলে দেবে। কিরণের সঙ্গে তার দেখা করা নিষেধ। কিরণের ছায়াতেও পাপ। কিরণের বাবার যে কঠিন রোগ। কিরণ অস্পৃশ্য যে!
এবার দীপঙ্কর যাবে ডান দিকে। আর কিরণ বাঁয়ে। বাঁ দিকের গলির ভেতরে কিরণদের বাড়ি। হঠাৎ গলির মুখটার কাছে আসতেই আকাশ-বিদীর্ণ-করা একটা আর্তনাদ যেন দুজনেরই কানে এস বিঁধলো।
চমকে উঠেছে কিরণ। দীপঙ্করও চমকে উঠেছে।
-কী হলো রে?
কথা যেন আর বেরোচ্ছে না কিরণের মুখ দিয়ে! কিরণের যেন বারোধ হয়ে গেছে। দীপঙ্করও অজ্ঞাত এক আতঙ্কে যেন শিউরে উঠতে লাগলো।
কিরণ হঠাৎ বললে–মা কাঁদছে ভাই!
–তোর মা?
কিরণেরই মায়ের কান্না সমস্ত পাড়া কাঁপিয়ে তখন উদ্দাম হয়ে উঠেছে। আর নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রীটের আবহাওয়া যেন সেই আর্তনাদের স্পর্শে হঠাৎ অসাড় হয়ে এল।
কিরণ বললে–আমি যাই ভাই, বাবা বোধহয় মরে গেছে–
তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে মুখ কালো করে বললে–বাবা যদি মরে যায় তো সেই সাধু-বেটাকে আমি দেখে নেব-বলেই কিরণ দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে গেল!
দীপঙ্কর তখনও সেই রাস্তার মোড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার যেন আর নড়বার ক্ষমতাটুকুও নেই। সে যেন হঠাৎ বিকল হয়ে গেছে। সে-ও যদি যেতে পারতো কিরণের বাড়িতে! মৃত্যুকে দেখতে মুখোমুখি। সামনাসামনি দেখে নিত কঠিন বাস্তব মৃত্যুকে! এই সেদিনও সে দেখেছে কিরণের বাবাকে। মাদুরের ওপর সোজা হয়ে বসে ময়লা কাঁথা একটা গায়ে দিয়ে আছে। চোখগুলো ঝাপসা, নিরুদ্দেশ। যেন সমস্ত পৃথিবীর ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত অভিযোগ আকণ্ঠ ঠেলে উঠছে ভেতরে ভেতরে। এবার কে অভিযোগ করবে, কে নির্বাক অভিযোগ করে সেই ঈশ্বরকে বিব্রত করবে!
একবার মনে হলো দীপঙ্করের, সে ছুটে যায় কিরণদের বাড়ি। তাদের বাড়ি হবে, তাদের অবস্থা ফিরে যাবে, তাদের সব অসুখ নিরাময় হয়ে যাবে–সেই সব আশ্বাসের ধূলিসাৎ হওয়াটা একবার নিজের চোখে দেখে আসে সে। অন্তত দীপঙ্কর পাশে গিয়ে দাঁড়ালে কিরণ খানিকটা সান্ত্বনাও পাবে! কিন্তু আবার ভয় হলো–মা যদি জানতে পারে!
সন্ধ্যে হবার উপক্রম হয়েছে। আস্তে আস্তে দীপঙ্কর ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটার দিকে ফিরলো। বিকেলের পর থেকে এ-পাড়াটা জম-জমাট হয়ে ওঠে বেশি করে। ছেলেরা জটলা করে বাড়ির রোয়াকে রোয়াকে। তখন বন্ধুর দোকানে গরম বেগুনী আলুর চপ ভাজা শুরু হয়। তখন এক-একজন করে খদ্দের আসতে শুরু করে। তখন কুলপি বরফওয়ালারা রাস্তা দিয়ে চীৎকার করতে করতে হেঁকে যায়। তখন বাড়িতে বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। তখন উনুনের ধোয়ায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সমস্ত পাড়াটা–
হঠাৎ অঘোরদাদুর বাড়ির সামনে আসতেই দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল।
বাড়িটার সামনে তিনটে গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে। মালপত্র বোঝাই গাড়িগুলো। খাট, আলমারি, চেয়ার-টেবিল, বাসন-কোসন। দীপঙ্করের মনটা আনন্দে দশখানা হয়ে গেল। ভাড়াটে এসেছে অঘোরদাদুর বাড়ি! ভাড়াটে এসেছে আবার। আবার অঘোরদাদুর মুখে হাসি ফুটবে। কিন্তু আবার যদি চন্নুনী গালাগালি শুরু করে উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগেকার মতো!
দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে বাড়িটার ভেতরে ঘরগুলোতে আবার আলো জ্বলছে। লোকজনের সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ভেতরে। ভালোই হলো। এতদিন অন্ধকার অন্ধকার ঠেকতো কেমন। উঠোনের কোণটায় মুখ ধুতে এসে সন্ধ্যেবেলা কেমন ভয়-ভয় করতো। এবার আর ভয় করবে না।
দীপঙ্কর খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে।
ভারি ভারি আয়না, ভারি ভারি খাট আলমারি। এবারকার ভাড়াটেরা খুব বড়লোক। এত ভালো আয়না অঘোরদাদুর নেই। অঘোরদাদুর চেয়েও এদের অনেক টাকা। চারজন মুটে মাথায় করে মাল বয়ে নিয়ে ভেতরে রেখে আসছে।
বাড়িতে আসতেই
মা বললে–কোথায় ছিলি খোকা এতক্ষণ?
দীপঙ্কর বললে–আমাদের বাড়িতে আবার ভাড়াটে এসেছে মা দেখেছ—
মা বললে–তা তো হলো, কিন্তু তুই ছিলি কোথায় এতক্ষণ শুনি?
দীপঙ্কর বললে–এবার খুব বড়লোক ভাড়াটে মা, কী বড় বড় খাট, বড় বড় আয়না আলমারি সব,–অঘোরদাদুর চেয়েও বড়লোক। মা তুমি চন্নুনীকে ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে বারণ করে দিও মা–
সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসেও উঠোনের দিকে চেয়ে দেখলে। দেখলে ও-বাড়িতে আজ আলো জ্বলছে। অনেক লোকের কথাবার্তা কানে আসছে। রান্নার গন্ধ আসছে ও-বাড়ি থেকে। বেশ ভালো হলো! কেমন অন্ধকার দেখাতো এতদিন। এতদিন ও-দিকটায় চাইতে ভয় করতো। এবার আবার ওদের আলো পড়ে উঠোনটা আলো হয়ে থাকবে।
রাত্তির বেলা বিছানায় শুয়ে হঠাৎ একটা শব্দে কেমন চম্কে উঠলো দীপঙ্কর। একটা অদ্ভুত শব্দ। ঝুমুর-ঝুমুর ঝুম, ঝুমঝুম।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলেও কিসের শব্দ মা?
সারাদিন খেটে-খুটে মা তখন চোখ বুজিয়েছে। বললে–কী জানি বাছা কিসের শব্দ!”তুই ঘুমো এখন–
এক সময় মা বোধহয় ঘুমিয়েই পড়লো। কিন্তু তখনও সেই শব্দটা হচ্ছে। যেন কেউ ঘুঙুর পরে নাচছে পাশের বাড়িতে। এত রাত্রে নাচছে কেন? কে নাচছে? ঠিক ভাড়াটেদের বাড়ির একতলার একটা ঘর থেকে শব্দটা আসছে। নাচের তালে তালে রাত্রের আবহাওয়াটা যেন দুলতে লাগলো। মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ইচ্ছে হলো একবার ছুটে দেখে আসে গিয়ে। কিন্তু একলা অন্ধকারে উঠতে ভয় হলো। রাত যেন অনেক হয়েছে–চারিদিকের বাড়িগুলোর আলোও হয়তো নিভে এসেছে।
তারপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত দীপঙ্করের আর ঘুম এল না। সেই ঘুঙুরের শব্দের তরঙ্গে যেন দুলতে লাগলো সে। তারপর ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন এক সময় আরো নিস্তব্ধ হয়ে এল। তখন ঘুঙুরের শব্দটা যেন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। মনে হলো যেন ঠিক তার পাশে সরে এসেছে একেবারে, একেবারে তার বিছানার পাশে। একেবারে তার গা-ঘেঁষে কেউ ঘুঙুর পায়ে দিয়ে নাচছে। আর তার চোখে নিঃশব্দে ঘুম নেমে এল। ঘুমে জড়িয়ে এল দু’চোখ…
হঠাৎ দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ক্যাওড়াতলা শ্মশানের দিক থেকে একটা বিকট চীৎকার একেবারে সব স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার করে দিলে। শিউরে উঠলো দীঙ্কর।
কিরণের বাবাকে বোধহয় এতক্ষণে শশ্মশানে নিয়ে গেল ওরা!
এতক্ষণ সে-কথাটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিল সে! কী আশ্চর্য! দীপঙ্করের মনে হলো কী আশ্চর্য! এতক্ষণ ঘুঙুরের শব্দটা তবে কি ভুল শুনেছে! তবে কি স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ!
২
কতদিন আগেকার কথা। দেখতে দেখতে কতদিন কেটে গেল। অথচ মনে হয় এই যেন সেদিন। এই যেন সেদিন সে চাকরিতে ঢুকলো। নৃপেনবাবুর হাতে তেত্রিশটা টাকা দিয়ে এল মা। তারপর চাকরির চিঠি এল। আর তারপর থেকে দীপঙ্কর সেন একদিন হঠাৎ সেন-সাহেব হয়ে উঠলো। প্রথম প্রথম কেমন অবাক লাগতো। তারপর সহ্য হয়ে এল সব। গা-সওয়া হয়ে এল সমস্ত। সেই তেত্রিশ-টাকা যে কখন কেমন করে তের শো টাকায় গিয়ে উঠলো, সে-ও এক ইতিহাস। ইতিহাসই বৈ কি! মর্মান্তিক ইতিহাস। দীপঙ্করের সঙ্গে সঙ্গে যেন সমস্ত দেশের ইতিহাসটাও বদলে গেল। বদলে গিয়ে নতুন হয়ে গেল। কবে একদিন লক্ষ্মীদি এসেছিল তার জীবনে হঠাৎ সেই লক্ষ্মীদিও চিরস্থায়ী হয়ে গেল তার জীবনে। আর কবে একদিন সতী এসেছিল তার জীবনে, সেই সতীও তার জীবনে একেবারে চিরস্মরণীয় হয়ে গেল!
শুরু হয়েছিল সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে। সে-ইতিহাস শেষ হলো বুঝি এই গড়িয়াহাটার লেবেল-ক্রসিং-এ এসে।
প্রথম দিন সত্যিই দীপঙ্কর কিছুই বুঝতে পারেনি। সেদিন অবাকই হয়ে গিয়েছিল প্রথমে। সেই অঘোরদাদুর ভাড়াটেদের বাড়িতে ঝুম্ ঝুম্ করে ঘুঙুর বাজনার শব্দকে সেদিন তার স্বপ্নই মনে হয়েছিল। সমস্ত রাত যেন সেই স্বপ্নের মধ্যেই কেটেছে। সকালবেলা মা’র ডাকে ঘুম ভাঙলো।
মা ডাকলে–ওঠ, ওঠ, ও দীপু ওঠবেলা হয়ে গেল যে–
দীপঙ্কর চোখ মেলে চাইলে চারিদিকে। সেই তো সেই অঘোরদাদুর উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতেই সে শুয়ে রয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই। বিছানা থেকে উঠেই সোজা উঠোনে এসে দাঁড়াল। তখন চন্নুনীর ঝাঁট দেওয়া হয়ে গিয়েছে। ছিটে-ফোঁটা কখন বাড়িতে এসেছে, কখন ঘুমিয়েছে, কিংবা হয়তো আসেওনি, ঘুমোয়ওনি–তা-ও কেউ জানে না। মা রান্নাঘরে রান্না চাপিয়েছে। দাওয়ার ওপর একটা শিল-নোড়া। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে এক-একবার বাটনা বেটে নিতে হয়, এক-একবার তরকারিও কুটে নিতে হয় বঁটিতে। বিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি। বিরাট একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে পৃথিবীতে। মানুষের জীবনের ঘাটা তখনও ভালো করে শুকোয়নি। যারা যুদ্ধে গিয়েছিল তারা কেউ কেউ ফিরে এসেছে মেসোপোটেমিয়া কিংবা ফ্রান্স থেকে। কেউ কেউ ফেরেনি। যারা ফিরেছে তারা পাড়ার বোয়াকে বসে যুদ্ধের গল্প শোনায়। হাঁ করে শোনে সবাই। কেউ কেউ চাকরি পেয়েছে। পুলিসের চাকরি কিংবা রেলের চাকরি। মোটা-মোটা মাইনের চাকরি দিয়েছে ব্রিটিশ-গভর্নমেন্ট। পাড়ায় তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটে। ভাগ্যিস যুদ্ধে গিয়েছিল! থেমে না গেলে আরো লোক যুদ্ধে যেতে পারতো। তোফা আরাম সেখানে। মাছ মাংস ডিম পাউরুটি রোজ সকাল বিকেলে। আর চা। পেটভরে যত ইচ্ছে চা খাও। কাজের মধ্যে কাজ প্যারেড করা। তা খেতে পেলে আর প্যারেড করতে কী!
বুড়োরা বলতো–আরে বাবা স্বরাজ-স্বরাজ করছিস যে, স্বরাজ হলে খাবি কী? ইংরেজরা যদি চলে যায় তখন কে তোদের দেখবে শুনি? জাপান যদি এক হুড়ো দেয় তো বাপ-বাপ বলে পালাবি তখন, তোদের মুরদ তো দেখা আছে–
নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রীটের মধুসূদনদের রোয়াকে সকালবেলা আড্ডা বসে জোর। সেইখানে বেলা বারোটা পর্যন্ত আড্ডা চলে। একখানা ‘অমৃতবাজার’ কাগজ নিয়ে আলোচনা হয়।
মধুসূদনের বড়দা বলতো–এই দেখুন কাকা সি আর দাশ কী বলছে–
দুনিকাকা বলতো–আরে বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়, বলতে তো আর পয়সা খরচ নেই রে। বাঙালীদের ওই মুখেই সব, কেল্লাফতে করতে সবাই পারে! বারীন ঘোষের মতো বোমা মেরে যদি স্বরাজ হতো তো আর ভাবনা ছিল না-ইংরেজ বেটারা ছিল তাই খেতে পাচ্ছিস তোরা, এই তোকে হ-কথা বলে রাখলুম–
তারপরেই হঠাৎ আলোয়ানটা গা থেকে খসিয়ে তেড়ে-মেড়ে ওঠে।
বলে–আচ্ছা, অত কথা থাক, হঠাৎ যদি ইংরেজ-বাবাজীরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যায় তখন মিলিটারি কোথায় পাবি বল্ আর বন্দুক রাইফেল টোটা এ-সব কোথায় পাবি সেইটে তুই আমাকে আগে বোঝা–
এই আড্ডার সামনে দিয়েই দীপঙ্কর ইস্কুলে যেত। যেতে যেতে চীৎকার শুনে এক একদিন দাঁড়িয়ে পড়তো সেখানে। কথা শুনতো। অনেক কথাই বুঝতে পারতো না। কিন্তু কেমন যেন মজা হতো। বড় বড় সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে বড়রা। একদিন সে-ও বড় হবে। তখন হয়তো বুঝতে পারবে।
শশাঙ্কবাবু সেদিন ক্লাসে আসেননি। শশাঙ্কবাবু বাঙলার মাস্টার। দীপঙ্কর সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসেছিল। প্রথম থেকেই কারো সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ হয়নি।
ফটিক বসেছিল পাশে। দীপঙ্কর ফটিককে বললে–এই জানিস, কিরণের বাবা মারা। গেছে কাল–
ফটিক অবাক হয়ে গেল। বললে–তুই কী করে জানলি?
আর কথা হলো না। হঠাৎ প্রাণমথবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন। আবার বহুদিন পরে ইস্কুলে এসেছেন। সেই এক গাল পান মুখে। এলোমেলো খদ্দরের চাদর গায়ে, উস্কোখুস্কো চুল, আর পায়ে গোড়ালি দোমড়ানো জুতো–
প্রাণমথবাবু ঘরে আসতেই সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পেছনের বেঞ্চে যারা এতক্ষণ গোলমাল করছিল তারাও থেমে গেল।
প্রাণমথবাবু চেয়ারে বসে বললেন–কী পড়া আছে আজ তোমাদের? দীপঙ্কর মনিটার। উঠে দাঁড়িয়ে একটা বই দিলে। বললে–বাঙলা ব্যাকরণ স্যার–
-ব্যাকরণ।
প্রাণমথবাবু বইখানা নিলেন। তারপর একটা দুটো পাতা উল্টে দেখে বইখানা আবার মুড়ে ফেললেন। কী যেন ভাবতে লাগলেন নিজের মনে আর পান চিবোতে লাগলেন। তারপর বললেন–শশাঙ্কবাবুর আজকে শরীর অসুস্থ, তাই আমি এসেছি। ব্যাকরণ তোমরা শশাঙ্কবাবুর কাছেই পোড়ো, আমি তোমাদের আর একটা জিনিস পড়াচ্ছি–
বলে খানিক চুপ করলেন। তারপর বললেন–ব্যাকরণ কাকে বলে? তুমি বলতে পারো? তুমি? তুমি? তুমি?
সামনের ক’জনকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। সবাই হাঁ করে রইল। কেউ বলতে পারলে না।
প্রাণমথবাবুর পড়াবার কায়দাই ছিল আলাদা। যখনই তিনি কথা বলতেন সবাই চুপ করে শুনতো। কত জিনিস জানা যেত। অনেকক্ষণ ধরে তিনি অনেক কথা বলেন। দীপঙ্করের মনে হতো সে যেন গল্প শুনছে। প্রাণমথবাবুর পড়ানোর ধরনটাই ছিল গল্প বলার মতো।
প্রাণমথবাবু আবার বললেন–তোমরা দাঁত মাজো? সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো–হা স্যার।
-তোমরা চুলে তেল মাখো?
-হ্যাঁ স্যার!
-নখ কাটো?
-হ্যাঁ স্যার।
প্রাণমথবাবু বলতে লাগলেন–তাহলে এবার বুঝবে আমি কেন ও-কথা জিজ্ঞেস করেছি। তোমরা ওগুলো কেন করো? ও-গুলো করলে শরীর সুস্থ হয়। তেমনি কতকগুলো নিয়ম আছে যা পালন করলে ভাষাও শুদ্ধ হয়, সেই নিয়মগুলো যে-সব বইতে লেখা থাকে তার নাম ব্যাকরণ–
যেটা এতদিন সকলের কাছে দুর্বোধ্য ছিল, হঠাৎ এতদিনে যেন সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
হঠাৎ আবার এক সময়ে প্রাণমথবাবু জিজ্ঞেস করলেন-তোমরা স্বপ্ন দেখো?
সবাই এক সঙ্গে বললো স্যার—
-আচ্ছা তুমি বল তো, কী স্বপ্ন দেখেছ কাল?
ফটিক খানিক ভেবে বললে–আমি কাল কোনও স্বপ্ন দেখিনি স্যার–
-আচ্ছা তুমি দেখেছ?
এবার মধুসূদনের পালা। মধুসূদন উঠে দাঁড়িয়ে বললে–আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি স্যার–
-তা হোক, শুনি কী রকম খারাপ?
মধুসূদন বললে–আমি স্যার দেখলুম যেন আমি মা-কালীর মন্দিরে গেছি প্রণাম করতে, হঠাৎ মনে হলো মা-কালী জ্যান্ত হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, এগিয়ে এসে–
আমাকে খাড়া দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটতে লাগলেন–
-তারপর?
-তারপর স্যার আমি দেখতে লাগলাম আমার হাত-পাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে সামনে পড়তে লাগলো, আমার ধড়টাও পড়লো। আমার মুণ্ডটাও পড়লো-রক্তে ভেসে গেল সমস্ত মন্দিরটা, আর আমি সেই দিকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম–
-তুমি দেখতে পেলে? তারপর?
-তারপর মা-কালী বললেন–এবার আমার সঙ্গে আয়। আমি মার সঙ্গে চলতে লাগলাম। চলতে চলতে একেবারে সোনার কার্তিকের ঘাটের কাছে চলে গেছি। মাও জলে নামলেন, আর আমি যেই জলে পা দিয়েছি, তখখুনি ঠাণ্ডায় কন্ কন্ করে উঠলো, পাটা, আর আমার ঘুম ভেঙে গেল–
প্রাণমথবাবু বললেন–এরও ব্যাখ্যা আছে। স্বপ্নেরও ব্যাকরণ আছে,তোমরা বড় হয়ে সেই সব বই পড়লে এর ব্যাখ্যা পাবে–
তারপর আঙুল দিয়ে দীপঙ্করের দিকে দেখালেন। বললেন–তুমি!
দীপঙ্কর এতক্ষণে সেই কথাই ভাবছিল। তাকেও যদি জিজ্ঞেস করেন প্রাণমথবাবু!
দীপঙ্কর উঠে দাঁড়াল। বললে–আমি স্যার স্বপ্ন দেখেছি আমাদের পাশের বাড়িতে কারা ভাড়াটে এসেছে নতুন, হঠাৎ মনে হলো কানে একটা অদ্ভুত শব্দ এসে বাজছে–
-কীসের শব্দ?
দীপঙ্কর বললে–ঘুঙুরের শব্দ, মনে হলো যেন কেউ ঘুঙুর পায়ে দিয়ে নাচছে, আমি অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে রইলাম, সমস্তক্ষণ ঘুঙুর বাজতে লাগলো, খুব মিষ্টি শব্দটা, যেন ঘুম পাড়িয়ে দেয়–
-তারপর?
তারপর স্যার আমি আর থাকতে পারলুম না। ঘুঙুরের শব্দটা যেন আমায় টানতে লাগলো, আমি বিছানা ছেড়ে সেই রাত্তির বেলা উঠলুম, উঠে উঠোনটা পার হলুম, পার হয়ে যেদিক থেকে ঘুঙুরের শব্দটা আসছে সেই দিকে গেলাম, তারপর পাশের ভাড়াটেদের বাড়ির একতলায় একটা জানালা আছে, সেই জানালাটা ফাঁক করে চুপি চুপি উঁকি মেরে দেখি কি–
-কী দেখলে?
-দেখলুম স্যার, ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে আর খুব সেজেগুজে একটা ভাল্লুক তালে তালে নাচছে।
-ভাল্লুক?
-হ্যাঁ স্যার, আমি অবাক হয়ে ভাবছি এ ভাল্লুকটা কোত্থেকে এল, এমন সময় হঠাৎ ক্যাওড়াতলার শ্মশানে খুব জোরে একবার হরিবোলের’ চীৎকার হলো, আর আমার ঘুম ভেঙে গেছে–
প্রাণমথবাবু বললেন–এরও একটা ব্যাকরণ আছে, তা থাক, সে তোমরা পরে পড়বে বড় হয়ে, কিন্তু আরও এক রকম স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্নের কথা তোমাদের বলবো আমি আজ। সে-রকম স্বপ্ন তোমরা দেখ না, পৃথিবীর যারা মহাপুরুষ তারাই কেবল সেই সব স্বপ্ন দেখেন। সি আর দাশ, মহাত্মা গান্ধী, বালগঙ্গাধর তিলক, মতিলাল নেহরু হলেন সেই সব মহাপুরুষ। এঁরা সব দেশকে স্বাধীন করবার স্বপ্ন দেখেছেন–বড় হলে এদের লেখাও তোমরা পড়ে দেখো। এদের কারো কারো স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। আবার কারো কারো এখনও হয়নি, কিন্তু এ-স্বপ্ন কখনও মিথ্যে হয় না। এ-স্বপ্ন একদিন ফলবেই। তোমরা বড় হয়ে যখন ইতিহাস পড়বে দেখবে, আমাদের দেশে সেই স্বপ্ন সফল করবার জন্যে কত লোক প্রাণ দিচ্ছে, কত লোক ইংরেজদের জেলে জেল খাটছে। উনিশ শো উনিশ সালের তেরোই এপ্রিল তারিখে জেনারেল ও’ডায়ার পাঞ্জাবে কেমন করে তিনশোজন লোককে গুলি করে মেরেছিল, কেন উনিশ শো একুশ সালে আকালী বিদ্রোহ হয়েছিল, কেন মোপলা-বিদ্রোহ হয়েছিল মালাবারে, তোমরা সব বুঝতে পারবে তখন। আর এই যে আজ আমাদের বড়লাট…।
হঠাৎ দেখা গেল টিপি টিপি পায়ে ঘরে ঢুকছে কিরণ।
কিরণ? আশ্চর্য! কিরণের বাবা মারা গেছে, আর কিরণ কিনা আজ ইস্কুলে এসেছে!
বাইরে ঢং করে ঘণ্টা বাজলো।
প্রাণমথবাবু জিজ্ঞেস করলেন-তোমার এত দেরি যে?
কিরণ দাঁড়িয়ে উঠে বললে–আমার খুব অসুখ হয়েছিল স্যার–
-আচ্ছা বোসো–বলে উঠলেন প্রাণমথবাবু। তারপর দীপঙ্করের হাতে বই ফিরিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
প্রাণমথবাবু চলে যেতেই দীপঙ্কর কিরণের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
বললে–কী রে তোর বাবা মারা যায়নি? আমি যে ফটিককে বলছিলুম তোর কথা–
কিরণ বললে–ভাই মিছিমিছি সাধুটার ওপর রাগ করে অনেক গালাগালি দিয়েছিলুম, আমার বাবা মরেনি রে–
-তবে তোর মা যে কাঁদছিল অমন করে?
কিরণ বললে–বাবা তো কথা বলতে পারে না, নাড়ি-টাড়ি একেবারে অসাড় হয়ে গিয়েছিল বাবার, মা ভাবলে বাবা বুঝি মরে গেছে–শেষে কবিরাজ এসে দেখলে, দেখে বললে বাবা বেঁচে আছে–
তারপর হাত নেড়ে বললে–আরে আমি জানতুম বাবা এখন মরবে না, বাবার অসুখ তো আর কদিন পরেই ভালো হয়ে যাবে, আমাদের অবস্থা খুব ভালো হয়ে যাবে, অনেক টাকা হবে আমাদের–
-কী করে জানলি?
কিরণ বললে–সেই সাধু আমাকে বলেছে যে, খাঁটি সাধু, জানিস একেবারে খাঁটি হিমালয়ের সাধু–
ইস্কুলের ছুটির পর
দীপঙ্কর বললে–আজ সেই সাধুর কাছে যাবি কিরণ?
কিরণ কী যেন ভাবলে। বললে–আজ তো হবে না ভাই, আজ যে পৈতে বিক্রি করতে হবে, একটা পয়সা নেই মা’র হাতে, বাবার ওষুধ কিনতে সব ফুরিয়ে গেল কি না–ঠিক আছে কাল যাবো–
–ঠিক যাবি তো?
কিরণ জিজ্ঞেস করলে–কেন রে, তুই কিসের জন্যে যাবি সাধুর কাছে? তোর কিসের দরকার?
-এই এমনি!
সেদিন দীপঙ্কর এড়িয়েই গিয়েছিল কিরণের প্রশ্নটা। অবশ্য সত্যিই তো, সাধুর কাছে কিসের জন্যেই বা সে যাবে! তবু কিছু জানবার কি ছিল না তার সেদিন? মা’র দুঃখ কবে ঘুচবে! আর কতদিন পরের বাড়ি রান্না করতে হবে মাকে! আরো কত কথাই তো জানবার আছে তার। কবে বিন্তিদির ভালো-ঘরে ভালো-বরে বিয়ে হবে। কবে অঘোরদাদু আবার চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে, তখন দৃষ্টির অভাবে আর ঠাকুরের নৈবেদ্য চুরি করতে হবে না অঘোরদাদুকে। আর আরো একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে সাধুকে। সত্যিই কি টাকা দিয়ে সব কেনা যায়–সব কি কেনা যায় টাকা দিয়ে? সব কিছু?
সেদিন সন্ধ্যেবেলা এক মনে পড়তে বসেছে দীপঙ্কর। মা রান্নাঘরে রান্না করছে। চন্নুনীও এতক্ষণ গলা ফাটিয়ে কার সঙ্গে ঝগড়া করছিল, সে-ও বুঝি ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল এতক্ষণে। সন্ধ্যের পর অঘোরদাদুর আর সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না। তখন নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে কী সব করে। আস্তে আস্তে বাতাসের ধোয়াগুলো কেটে যায়। তখন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটাও যেন একটু ঝিমিয়ে আসে। কুলপি-বরফওয়ালার হাঁক, ঘুগনি দানাওয়ালার চীৎকারও থেমে আসে। তখন একমনে পড়তে পারে দীপঙ্কর মন দিয়ে। ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ মনে হলো যেন কালকের সেই শব্দটা আবার হচ্ছে–সেই ঘুঙুরের শব্দ।
কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল দীপঙ্কর।
প্রাণমথবাবু বলেছিলেন এক-একজনের স্বপ্ন সত্যি হয়! এক-একজনের স্বপ্ন ফলে!
একবার ভাবলে মা’কে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু মা তখনও রান্না করছে রান্নাঘরে। দীপঙ্কর ঘর ছেড়ে বাইরে এল। অঘোরদাদুর উত্তরের দিকের বাড়িটা ভাড়াটেদের। সে বাড়িটার একতলায় সব ঘরে আলো জ্বলছে। আর ঘুঙুরের শব্দটা যেন আসছে একতলারই একটা ঘর থেকে। তবে স্বপ্ন নয় ওটা! সত্যি ঘটনা!
আস্তে আস্তে উঠোনে নেমে এল দীপঙ্কর। তারপর টিপি টিপি পায়ে একেবারে উঠোনের শেষ প্রান্তে গিয়ে হাজির। সেখানে একটা আমড়া গাছ। গাছের তলাটায় বেশ অন্ধকার। সেই অন্ধকারের তলায় দাঁড়ালে আর কেউ দেখতে পাবার কথা নয়।
একতলার ঘরটার ভেতরে শব্দ হচ্ছে! সত্যিই কি ভাল্লুক নাচতে পারে! সত্যিই ভাল্লুক পুষেছে নাকি ওরা!
আস্তে আস্তে দীপঙ্কর কাছে গিয়ে জানালার পাখিটা তুললে। তারপর উঁকি দিয়ে দেখলে ভেতরে।
দীপঙ্কর অবাক হয়ে দেখলে-ভাল্লুক নয়, একটা মেয়ে–
মেয়েটা আঁটসাট করে শাড়ি পরেছে, মাথার খোঁপাটা এঁটে বেঁধে নিয়েছে। দু’পায়ে ঘুঙুর বাঁধা, আর আপন মনে এঁকে বেঁকে হেলে দুলে নাচছে। সামনে একটা আয়না।
দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ধরে দেখতে লাগলো। আপন মনেই আয়নার সামনে নাচছে মেয়েটা। কোনও দিকেই খেয়াল নেই। কখনও হাত দোলাচ্ছে, কখনও মাথা, কখনও পা। হাতের দোলানির সঙ্গে পায়ের তালগুলো মিলিয়ে হঠাৎ থেমে যাচ্ছে, তারপর আবার শুরু করছে। বিন্তিদির মতো বয়েস। তবে বিন্তিদির মতো অত সুন্দর নয়। কিন্তু সেজেছে খুব ভালো। বিন্তিদি এত সাজ-গোজ করে না।
–কে? কে রে?
দীপঙ্কর একেবারে চমকে উঠেছে হঠাৎ। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এপাশে ওপাশে চেয়ে দেখলে। কে যেন কী বললে! কিন্তু কোথাও তো কেউ নেই! এমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল!
মেয়েটা তখনও নাচছে। দীপঙ্কর কিন্তু আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না সেখানে। অন্ধকার আড়াল থেকে বেরিয়ে আমড়া গাছের তলা দিয়ে উঠোন পার হয়ে আবার ঘরে এসে ঢুকলো। তখনও ঝুমঝুম করে ঘুঙুরের শব্দ হচ্ছে ও-বাড়িতে।
৩
পরের দিন সন্ধ্যেবেলাই কিন্তু ধরা পড়ে গেল দীপঙ্কর।
অনেক পথ, অনেক বিপথ অতিক্রম করে আসার পর দীপঙ্করের মনে হয়েছে কেন কিসের প্রয়োজন ছিল এ সমস্তর। দীপঙ্করও তো অন্য আর পাঁচজনের মতো সহজ সাধারণ জীবন কাটাতে পারতো! যেমন অভয়ঙ্কর রামমূর্তি, সোম। ওরা তো চাকরি করছে, চাকরিতে উন্নতি করেছে, বিয়ে করেছে, ওদের সন্তান হয়েছে, সকাল বেলা অফিসে গিয়েছে, সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ফিরে সংসার করেছে, সিনেমা দেখেছে। কোনও অভাব তো নেই ওদের। তবে দীপঙ্করের কেন এমন হলো! সেও চাকরিতে ঢুকেছিল একদিন। পাঁচজনের যা হয় না, তার তাই হয়েছে। অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে চাকরিতে! লোকে বলে সেন-সাহেব। সেন-সাহেব হয়ে কী হয়েছে! সেন-সাহেব হয়েও বার বার তার মনে হয়েছে নিজের ভেতরটাতেও যেন তার নিজের আর শেষ নেই। বাইরের আলো-বাতাসের সঙ্গে বাইরের অন্নজলের সঙ্গে কেন তার যোগ এমন নিবিড় হলো। কেন সেদিন সেই আমড়া গাছতলার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে জানালা ফাঁক করে উঁকি দিয়েছিল? কিসের আকর্ষণ। সেই অত কম বয়েসে তার তো কোনও রকম আকর্ষণ থাকবার কথা নয়!
সত্যি, পরের দিনই সন্ধ্যেবেলা ধরা পড়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর।
সেদিনও কিরণ ইস্কুলে এসেছিল। ইস্কুলের পর দীপঙ্কর বলেছিল–এই সেই সাধুর কাছে আজ যাবি না?
কিরণ বললে–সাধুর কাছে তো সন্ধ্যেবেলা যাবো, বিকেলবেলা চল্ মিটিং শুনে আসি–
-কোথায়?
-হরিশ পার্কে।
হরিশ পার্কে সেদিন ছিল এক বিরাট মিটিং। পুলিসে-পুলিসে ভর্তি জায়গাটা। দীপঙ্করের কেমন ভয় করতে লাগলো প্রথমটা। তবু অনেক লোক জড়ো হয়েছে।
কিরণ এ-সব দিকে রোজ পৈতে বিক্রী করতে আসে। তার কোনও ভয় নেই। বললে–আয়, ভেতরে আয়–
ভেতরে অনেক লোক তখন মাটিতে বসে পড়েছে। কংগ্রেসের মিটিং। দুটো নিচু-নিচু টেবিল। একটা কারবাইড় গ্যাস বাতি। অন্ধকার হলে জ্বালানো হবে। দুজন ভদ্রলোক দুটো চেয়ারে বসে আছে। আধখানা পার্ক জুড়ে লোক জড়ো হয়েছে। পাশেই দু’তিনটে চেয়ার। খবরের কাগজের লোক, পুলিসের রিপোর্টার বসে আছে কাগজ পেন্সিল নিয়ে।
মনে আছে দীপঙ্কর কারোর নাম জানতো না। কে প্রতাপ গুহরায়, কে জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী–কে সুভাষ বোস কিছুই জানতো না।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–সুভাষ বোস কোটা রে?
কিরণ বললে–সুভাষ বোস আসেনি, জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী এসেছে, দেখ না, এমন বক্তৃতা দেবে তুই কেঁদে ফেলবি–লণ্ঠন বায়োস্কোপও হবে–
শুধু বক্তৃতা নয়, সঙ্গে সঙ্গে লণ্ঠন-লেকচার। একটা সাদা পর্দার ওপর ছবি পড়তে লাগলো। ঠিক যেন থামানো বায়স্কোপ। ছবিগুলো নড়ে না। কিন্তু বক্তৃতা দিলে সব বোঝা যায়। কেমন করে ইংরেজদের সোলজাররা এসে ভারতবর্ষ দখল করলো, কেমন করে ইংরেজরা তাঁতীদের আঙুল কেটে দিলে, চর-মাইনরের অত্যাচার, বজবজে শিখদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার। সমস্ত ছবির পর্দায় দেখানো হচ্ছে, আর জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগীর বক্তৃতা চলছে। সে কী বক্তৃতা! সমস্ত লোক চুপ করে শুনছে। একটার পর একটা নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে ভারতবর্ষ অন্যায় করে দখল করেছে ইংরেজরা। ইংরেজরা কত পাজি, কত বদমাইশ, কত অত্যাচারী তারই ছবি একটার পর একটা চলছে।
জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী বললেন–আমরা মানুষ না পশু? আমরা গাছ না পাথর? কী আমরা? আমরা মানুষ নই, জানোয়ারও নই। জানোয়ার হলেও আমরা রুখে দাঁড়াতাম, প্রতিবাদ করতাম, প্রতিশোধ নিতাম। ওরা আমাদের গুলি করেছে, আর আমরা কী করেছি? আপনারা বলুন কী করেছি আমরা!
একজন বললে–আমরা ওদের খোশামোদ করেছি—
জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী বললেন–না, আমরা ইংরেজদের পা চেটেছি—
পাশের একটা লোক বললে–ঠিক ঠিক–
জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগীর বক্তৃতা চললো আবার। তখন আশ্বিন মাস। মাদারীপুরের রাস্তা দিয়ে মিস্টার ক্যাটেল যাচ্ছেন। সাহেব জুট মিলের ম্যানেজার। পাশ দিয়ে একটি কলেজের ছেলে মাথায় ছাতা দিয়ে চলেছে। দেখে সাহেবের নীল রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগলো! কী, এত বড় আস্পর্ধা, সাহেবের সামনে ছাতি মাথায় দিয়ে যাওয়া! কালা নিগর, তার এত সাহস?
সাহেব বললে-–ছাতা বন্ধ করো—
ছেলেটাও অবাক হয়ে গেছে, বললে–কেন, ছাতা বন্ধ করবো কেন?
সাহেব বললে–আমার হুকুম—
ছেলেটি বললে–তুমি কে হে যে তোমার হুকুম?
সাহেব বললে–দেখবে আমি কে? এই দেখ–
বলে ছেলেটিকে ধরে বেদম প্রহার। ছেলেটা আধমরা হয়ে পড়ে রইল সেখানে। সাহেব চলে গেল।
মামলা হলো কোর্টে। বিচার হলো। জজ রায় দিলে–ছেলেটিরই দোষ। সে সাহেবকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। ক্যাটেল সাহেব নির্দোষ! তারপর স্টেপট সাহেব নিজে এলেন তদন্ত করতে। তিনি বিচার করে বললেন–অনন্তমোহন দাস আর তার তিনজন সঙ্গীকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এনে পঁচিশ ঘা করে বেত মারা হবে। বন্ধুগণ, আমরা যদি মানুষ হতুম তো আমাদের পিঠেও সে বেতের দাগ পড়তো! আমরা গাছ-পাথর তাই আমরা সেই ইংরেজদের পা চাটি, আর এরা? এই যারা আমার পাশে বসে ইলিশিয়াম রো’র জন্যে রিপোর্ট লিখছে–এদের আর কী বলবো–
বলে তিনি জুতোসুদ্ধ পা’টা মাটিতে ঠুকলেন।
আর হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, কয়েকজন পুলিস বাইরে কোথায় ছিল তারা দৌড়তে দৌড়তে লাঠি ঘুরিয়ে এল সভার মধ্যে। একটা হৈ চৈ পড়ে গেল। লোকগুলো, যারা শুনছিল এতক্ষণ চুপ করে, তারা দৌড়তে লাগলো–
কিরণ হঠাৎ বললে–পালা দীপু–পালিয়ে চল্ শিগগির–
তারপর কোথায় রইল কিরণ, কোথায় রইল দীপঙ্কর, আর কোথায় রইল হরিশ পার্ক। অন্ধকার ভালো করে হয়নি। কোন্ গলি দিয়ে বেরিয়ে কোথায় এসে পড়লো। একেবারে হাজরা রোড। তারপর একটু এসেই হাজি কাশিমের বাড়িটা। বিরাট বাড়ি। সেইখান দিয়ে বেরিয়ে রামধনির পানের দোকানের পাশ দিয়ে একেবারে হাজি কাশিমের বাজারের কাছে গিয়ে পড়লো। টিপু-সুলতানের বাড়ির মাথায় ছিল একটা বিরাট বটগাছ, সেই বটগাছের তলা দিয়ে একেবারে সোজা আগুনখাকীর পুকুরটা ঘুরে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এর শেতলাতলার কাছে এসে পড়েছে। তখন যেন স্থির হয়ে ভাববার অবস্থা হয়েছে দীপঙ্করের। এদিকে কোনও উত্তেজনা নেই, এখানে এসে ভালো করে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। আশেপাশে সামনে পেছনে কোথাও পুলিস নেই। দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে উঠেছিল। এতক্ষণে যেন দম ফিরে এল! কিরণটা কোথায় গেল! তার সঙ্গে সাধুর কাছে যাবার কথা ছিল। তাও হলো না। আস্তে আস্তে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এর দিকে চলতে লাগলো দীপঙ্কর। বন্ধুর দোকানে তখন তেলেভাজার ভিড় হতে আরম্ভ করেছে সবে। মধুসূদনের বাড়ির রোয়াকে তখনও আড্ডা চলছে–
বাড়ির ভেতরে গিয়ে ডাকলে—মা—
মা তাকে দেখেই বললে–কোথায় ছিলি খোকা এতক্ষণ, আমি ভাবছি বসে বসে–
মা মুড়ি রেখে দিত বিকেলবেলা। সকালে-বিকেলে ছিল মুড়ি বরাদ্দ। কোনও কোনও দিন গ্রীষ্মকালে পান্তাভাত। তারপর আর বেরোনো নয়। সন্ধ্যে হবার পর পড়তে বসা। কিন্তু পড়তে বসেও যেন মন থাকতো অন্যদিকে। কিরণটা কী করছে এতক্ষণ। হয়তো পুলিসের লাঠি খেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। নয়তো হাসপাতালে নিয়ে গেছে তাকে। এমনি অনেক কথা!
মা বলতো–হ্যাঁ রে। বই মুখে দিয়ে কী ভাবছিস বসে বসে?
তারপর আর একটু অন্ধকার হবার সঙ্গে সঙ্গে মা যাবে রান্নাঘরে। সেখানে রান্না চড়াবে। তখন একলা-একলা ঘরের মধ্যে অঘোরদাদুর সিন্দুকটার গায়ে হেলান দিয়ে পড়তে বসবে দীপঙ্কর।
সেদিনও তাই করছিল। হঠাৎ মনে হলো যেন ঝুম ঝুম করে আবার সেই ঘুঙুরের আওয়াজ আরম্ভ হলো। ঠিক আগের দিনের মতো। আশ্চর্য, সে কিনা ভেবেছিল ভাল্লুক! ভাল্লুক কী করে আসবে শহরের মধ্যে! আর ঘুঙুরই বা বাজবে কী করে! ভাল্লুক কি কেউ পোষে? কিন্তু নাচে কেন ওদের মেয়েটা! বিন্তিদি তো নাচে না। আশেপাশের বাড়িতে কেউই তো নাচে না। কত মেয়ে আছে কত লোকের বাড়িতে। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীট, কালীঘাট রোড, টালিগঞ্জ রোড, শানগর, কত লোক আছে, কেউ নাচে না। নিশ্চয় ওরা দীপঙ্করদের থেকে আলাদা। আলাদা ধরনের মানুষ ওরা। এর আগেও তো কত লোক এসেছে, কেউ তো অমন করে নাচেনি। নাচলে নিশ্চয় টের পাওয়া যেত। অত বড় ধাড়ি মেয়ে নাচে কী করে? লজ্জা করে না?
রান্নাঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল দীপঙ্কর। মা তখন খুব ব্যস্ত, উনুনে তরকারির কড়া চাপিয়েছে। চাপিয়ে ভাতের ফ্যান গালছে।
দীপঙ্কর বললে–মা–
মা বিরক্ত হয়ে উঠলো। বললে–লেখাপড়া ছেড়ে এখানে কেন এলি বল তো, লেখাপড়া চুলোয় গেল তোমার-এই তুমি বড় হবে, এই তুমি মানুষ হবে?
আর বলা হলো না। একবার ভেবেছিল মাকে জিজ্ঞেস করবে–ওরা কি আলাদা? ওই যারা নাচছে, ওরা কি আমাদের মতো নয়? আমাদের মতো বাঙালী, আমাদেরই মতন কাপড় পরে, ভাত খায়, অথচ অন্যরকম দেখায় কেন ওদের? ওরা তো পরের বাড়ি ভাত রাধে না, ওদের তো কেউ বকে না?
মনে আছে সেদিন দীপঙ্কর যেন বুঝতে পেরেছিল সমস্ত কালীঘাটের লোক এক জাত, আর ওই ভাড়াটেরা আর-এক জাতের। আকর্ষণটা ঠিক বোধহয় সেইজন্যেই। আশেপাশের লোকরা যারা এপাড়ায় পাড়ায় থাকে, তারা তো অত দামী খাটে শোয় না, অত ভালো আলমারি তাদের নেই। যেন অনেক বড়লোকরা তাদের উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এ ভুল করে ভাড়াটে হয়ে এসেছে। ওদের চাকরটারও কেমন বাবু বাবু চেহারা। চাকরটারও মাথায় বাহারে টেরি। হরিশ মুখার্জি রোডের ওদিকেই যেন ওদের মানাত। ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে নির্মল পালিতরা ওইদিকেই থাকতো। কিন্তু হঠাৎ এরা এত জায়গা থাকতে এই মধ্যবিত্ত পাড়ায় এল কেন। এখানে মানায় কিরণদের, এখানে মানায় দীপঙ্করদের, এখানে মানায় চন্নুনী, মধুসূদন, প্রাণমথবাবুদের। এখানে মানায় অঘোরদাদুদের, ছিটে, ফোঁটা, বিন্তিদিদিদের। বন্ধুর তেলেভাজার দোকান এখানেই মানায়।
মধুসূদনের কাছেই খবর পেয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর।
মধুসূদন বলেছিল প্রথমে। বলেছিল–তোদের বাড়িতে কারা ভাড়া এল রে দীপু? দীপঙ্কর বলেছিল–কই, জানি না তো–
মধুসূদন বলেছিল–হ্যাঁ, রে আমি আসবার সময় দেখে এলুম যে, বড় বড় খাট আলমারি নামছিল তোদের বাড়ির সামনে, আর ফরসা-ফরসা লোক নামছিল ট্যাক্সিগাড়ি থেকে–
একটু থেমে মধুসূদন বলেছিল–লোকগুলো খুব ফরসা, একেবারে মেমসাহেবদের মতো দেখতে–
মধুসূদনের রোয়াকের আড্ডাতেও বেশ আলোচনা হয়েছিল।
দুনিকাকা বলেছিল–কে এল রে অঘোর ভট্টাচার্যির বাড়িতে, নতুন ভাড়াটে বুঝি?
মধুসূদনের বড়দা বলেছিল–এ-পাড়ায় অমন লোক এল-ব্যাপারটা কী–এ যে হংস মধ্যে বক বাবা–
সত্যিই পাড়াময় সাড়া পড়ে গিয়েছিল। এ-পাড়ায় তো এমন ভাড়াটে আসে না কস্মিনকালে। এ-পাড়ার লোকেরা পুঁইশাকের খদ্দের, একটু পেঁয়াজ যদি হলো তো গরমমশলার আর দরকার হয় না এদের। কোনও বাড়িতে ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালে এরা অবাক হয়ে যায়। খোঁজ নেয়, কে এল, কত টাকা মাইনে পায়! এরা পরের পরা ধুতি দেখলে হাত দিয়ে খোল পরীক্ষা করে দেখে, দর জিজ্ঞেস করে। এ কালীঘাট। ভবানীপুরও নয়, শ্যামবাজারও নয়। আদিগঙ্গার পূর্ব কূলের এই জনপদ, বাহান্ন পীঠের আর একটা পীঠস্থান। এখানে তো অমন ভাড়াটে আসার কথা নয়। ওদিকে হরিশ মুখার্জি রোড, ওদিকে ল্যান্সডাউন রোড, আর আরো ওদিকে এলগিন রোড। শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রীট-ও-সব বনেদী পাড়া। ওদিকে অঘোরদাদুর সব বনেদী যজমানরা থাকে। সেই বনেদী লোক এল কিনা উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এ।
আর একবার দীপঙ্কর ডাকলে—মা—
কিন্তু কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলে না দীপঙ্কর। মা তখন ডাল সাঁতলাচ্ছে–
দীপঙ্কর উঠোনটা পার হয়ে শোবার ঘরের দিকে আসছে, হঠাৎ কানে গেল ঝুম ঝুম্ শব্দটা। থম্কে দাঁড়াল দীপঙ্কর। তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকারটার দিকে এগিয়ে গেল। আমড়া গাছটার তলায় গিয়ে ভাবলো খানিকক্ষণ। বড়লোকদের চেহারাই আলাদা! ওরা কেন এল এ-পাড়ায়! ওদের বাড়িতে যদি কোনও ছেলে থাকতে তো বেশ হতো। তার সঙ্গে এক সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তো! কেন এল এ-পাড়ায় ওরা?
হঠাৎ মনে হলো যেন ঘুঙুরের শব্দটা থেমে গেল।
থামলো কেন?
দীপঙ্কর হঠাৎ সেই জানালাটার কাছে গিয়ে পাখিটা ফাঁক করলো একবার, তারপর উঁকি দিয়ে দেখলে ভেতরের দিকে–
–কে রে? কে রে ওখানে?
চম্কে উঠে সরে যেতে গিয়েই একটা লোক তার হাতটা ধরে ফেলেছে। দীপঙ্কর অন্ধকারের মধ্যেই চিনতে পারলে। সেই চাকরটা–
চাকরটা তার হাতটা ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে খিড়কীর দরজাটা দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। দীপঙ্কর হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলো। বললে–আমায় ধরছো কেন? বা রে! আমি কী করেছি?
চাকরটা ভেতরে গিয়েই বললে–চলোচলো, রোজ রোজ দেখা হয় উঁকি মেরে–
দীপঙ্কর বললে–বা রে, আমি বুঝি রোজ দেখি, আমি তো ঘুঙুরের আওয়াজ শুনলাম, তাই–
ভেতরে যেন কার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। কে যেন বললে–রঘু, ধরে এনেছিস? নিয়ে আয় তো ধরে আমার কাছে, নিয়ে আয় তো দেখাচ্ছি আমি ওকে–
ভীষণ ভয় হয়ে গেল দীপঙ্করের। চাকরটা হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে। কিন্তু চাকরটার গায়ে জোর খুব। দু’হাতে তাকে ধরে রেখেছে। বললে–রোজ রোজ উঁকি মেরে দেখা হয়-এই দেখ দিদিমণি যেতে চাইছে না–
ভেতর থেকে দিদিমণি বললে–ধরে নিয়ে আয় আমার কাছে–
চাকরটা দীপঙ্করের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। পেছনটা একফালি উঠোনের মতন। তারপর দু’ ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে রোয়াক। রোয়াকের উপর উঠে সামনেই ঘর। ঘরের ভেতরে আলোর তেজ খুব। খুব দামী একটা পর্দা টাঙানো। দামী দামী পর্দা খাটানো হয়েছে বাড়িতে। চাকরটা ঘরের ভেতরে নিয়ে যেতেই মেয়েটি বললেও এই ই বুঝি! খুব কম বয়েস তো-কোথায় থাকো? কী নাম তোমার?
দীপঙ্করের চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। বললে–আমি কিছু করিনি, আমায় শুধু শুধু ধরে নিয়ে এসেছে–
চোখ তুলে ভালো করে কাছাকাছি থেকে দেখলে দীপঙ্কর। চোখে বোধহয় কাজল পরেছে। তখন জানালার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়নি। নাচবার জন্যে সিল্কের শাড়িটা খুব আঁট করে পরেছে গায়ে। কানে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে দুটো পাথরের দুল।
মেয়েটি কাছে এল আরো। বললে–কী নাম তোমার?
দীপঙ্কর সোজাসুজি মুখ তুলে চাইলে। চেহারাটা দেখে অনুমান করবার চেষ্টা করলে কতখানি শাস্তি তাকে পেতে হবে! কিন্তু চেহারাটার মধ্যে কোথায় যেন একটা রুক্ষতা ছিল। আশ্বাসও পাওয়া যায় না, আবার আতঙ্কও কমে না।
মেয়েটি বললে–বলো, তোমার নাম বলো? শিগগির বলো?
দীপঙ্কর বললে–তুমি যদি আমার মাকে বলে দাও–
মেয়েটি হেসে ফেললে এবার। কী চমৎকার দাঁতগুলো! হাসি দেখে যেন খানিকটা আশ্বস্ত হওয়া গেল।
দীপঙ্কর বলল–আমার মাকে বলে দিলে আমার মা খুব বকবে–আমি আর করবো, আমায় ছেড়ে দাও–
-হ্যাঁ ছেড়ে দিচ্ছি তোমায়, রঘু তুই বাইরে যা তো—
রঘু চাকরটা চলে গেল। এবার শুধু মেয়েটি আর দীপঙ্কর।
মেয়েটি বললে–বলো, তোমার মাকে বলে দেব না, কী নাম তোমার? কোথায় থাকো? কী দেখছিলে উঁকি মেরে?
দীপঙ্কর মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বললে–সত্যি বলছি আমি তোমাকে দেখছিলাম, আর কাউকে দেখিনি–
মেয়েটি খুব জোরে হেসে উঠলো। বললে–আরে পুঁটকে ছোঁড়াটার তো খুব শখ, আমাকে দেখছিলে? আমাকে দেখবার কী আছে, আমি বাঘ না ভাল্লুক–
দীপঙ্কর বললে–আমি স্বপ্ন দেখেছিলুম কিনা–
–স্বপ্ন? কিসের স্বপ্ন? আমায় স্বপ্ন দেখছিলে?
মনে আছে দীপঙ্করের, তার সেদিনকার ব্যবহারের কথা মনে পড়ে সত্যিই পরে অনেকবার হাসি এসেছিল। ছোটবেলায় সত্যিই খুব বোকা ছিল দীপঙ্কর। তাছাড়া সারা কালীঘাটে লক্ষ্মীদির মতন মেয়ে তো তখন দেখেনি। যারা ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের আশে পাশে থাকতো তারা কেউই লক্ষ্মীদির মতন নয়। সব মেয়েরা যেমন করে কাপড় পরে, জামা পরে সে-রকম করে কাপড়-জমা পরতো না লক্ষ্মীদি। কেমন করে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পরতো কাপড়টাকে, দেখতে খুব ভালো লাগতো!
লক্ষ্মীদি বলেছিল–কোথায় বাড়ি তোমাদের?
দীপঙ্কর বলেছিল–এই অঘোরদাদু, এই অঘোরদাদুদের বাড়িতেই আমরা থাকি পরশুদিন স্বপ্ন দেখেছিলুম কে যেন ঘুঙুর পায়ে নাচছে, তারপর উঁকি মেরে দেখলুম, একটা ভালুকের পায়ে ঘুঙুর বাঁধা, আর সে খুব নাচছে–
-তা এত জিনিস থাকতে ভালুকের স্বপ্ন দেখেছিলে কেন তুমি? আমি ভাল্লুক?
বলে লক্ষ্মীদি খুব হাসতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–না। প্রাণমথবাবু বলেছিলেন, বড় হলে বই পড়লে সব বুঝতে পারবো, স্বপ্নের অনেক মানে আছে–
-প্রাণমথবাবু কে?
দীপঙ্কর বললে–আমাদের ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলের হেডমাস্টার–তিনি বলেছেন, যারা বড় বড় লোক, মহাত্মা গান্ধী, সি আর দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাদের স্বপ্ন সত্যি হয়–তাই আমি দেখছিলুম আমার স্বপ্নটা সত্যি ফলে কি না।
তারপর একটু থেমে বললে–আমাকে ছেড়ে দাও, আমি আর কখনো করবো না–
লক্ষ্মীদি বললে–তোমাকে ছাড়ছি না এত সহজে—
তারপর ডাকলে–রঘু–
রঘু আসতেই লক্ষ্মীদি বলেছিল–দেখ তো রঘু, কাকাবাবু এসেছে কি না আপিস থেকে–
কে কাকাবাবু, কী রকম লোক কাকাবাবু! কিছুই তখন জানতো না দীপঙ্কর। কিন্তু তখন মনে হয়েছিল হয়তো কাকাবাবুকে বলে মার খাওয়াবে মেয়েটা। দীপঙ্কর বলেছিল–আমি তোমার পায়ে পড়ছি, আমি আর কখনো করবো না–আমার মা জানতে পারলে বকবে–
কিন্তু রঘু খবর নিয়ে এল-কাকাবাবু বাড়িতে এসেছে। চা খাচ্ছে–
মেয়েটি বললো–চলল, চলো ওপরে চলো—
দীপঙ্কর বললে–আমার মা বকবে—
মেয়েটি বললে–দাঁড়াও তোমার কী করি আমি-দেখাচ্ছি–
বলে টানতে টানতে ভেতরের রোয়াক দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নিয়ে গেল। ওপরের বারান্দাটাও খুব সাজানো। সমস্ত ঘরের সামনে পর্দা ঝুলছে।
মেয়েটি দূর থেকেই ডাকলে–কাকাবাবু—
ভেতর থেকে উত্তর এল–কী হলো লক্ষ্মী–কী হয়েছে?
মেয়েটি বললে–এই দেখুন কাকাবাবু, চোরটাকে ধরে এনেছি–এই দেখুন—
বলতে বলতে মেয়েটি দীপঙ্করকে ধরে নিয়ে গেল ঘরের ভেতরে।
বললে–দেখুন। গায়ে জোর আছে খুব–এই দেখুন–
বলে টেনে হিঁচড়ে একেবারে কাকাবাবুর সামনে হাজির করলে।
দীপঙ্কর দেখলে এক ভদ্রলোক টেবিলে বসে চা খাচ্ছেন। পাশে একটি মহিলাও বসে আছেন।
কাকাবাবু বললেন–ছাড়ো, ছাড়ো, ছেড়ে দাও লক্ষ্মী,আহা, লাগবে যে ওর–
লক্ষ্মীদি ছেড়ে দিয়ে বললে–কী বদমাইশ ছেলে জানেন কাকাবাবু, আমাকে বলে কি না ভাল্লুক–
ভদ্রলোক বললেন–সে কি, তুমি ভাল্লুক বলেছো? লক্ষ্মীকে ভাল্লুক বলেছে?
মহিলাটি বললেন–ওমা, কী হবে, আমি তখনি তোমায় বলেছিলুম এত পাড়া থাকতে এখানে বাড়িভাড়া নিলে–
ভদ্রলোক দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললেন–তুমি ভাল্লুক বলেছো লক্ষ্মীকে?
দীপঙ্কর বললে–আমি ভাল্লুক বলিনি, কখন আমি ভাল্লুক বললুম তোমাকে? বা রে–
ভদ্রলোক বললেন–তাহলে তুমি উঁকি মেরে কী দেখতে?
লক্ষ্মীদি একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো এতক্ষণে। দীপঙ্কর অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে চারিদিকে। কী চমৎকার সাজানো ঘর। আগে যারা ভাড়াটে ছিল, তারা এমন সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে না ঘর!
লক্ষ্মী বললে–আমি কালকেই রঘুকে বলে রেখেছিলাম কাকাবাবু, যে আজকে ঠিক যেন রেডি থাকে–আর যা ভেবেছিলাম-ঠিক আজকে এসেছে।
ভদ্রলোকের মুখখানা দেখে যেন খানিকটা ভরসা হলো দীপঙ্করের। বেশ ভদ্র ভদ্র চেহারা।
ভদ্রলোকের স্ত্রী, তিনিও চা খাচ্ছিলেন। বললেন–আমি তখনি বললাম, এ-পাড়ায় বাড়ি নিও না–তুমি তো শুনলে না–
দীপঙ্কর বললে–আমায় ছেড়ে দিন, আমি আর কখনও করবো না–
ভদ্রলোক বললেন–বা রে, আমরা তোমায় মেরেছি না ধরেছি, যে অমন করছো তুমি? কী নাম তোমার?
দীপঙ্কর বললে–আমার নাম দীপঙ্কর সেন, আমি এই অঘোরদাদুর বাড়িতেই থাকি–
-ও, অঘোর ভট্টাচার্যি মশাই, তিনি তোমার কে হন?
-আমার কেউ হন না, তিনি আমাদের দেশের লোক, আমি আর আমার মাকে থাকতে দিয়েছেন ওঁদের বাড়িতে, আমার জামা-কাপড় দেন, আমাকে খুব ভালোবাসেন–
ভদ্রলোক বললেন–তা ভালো তো, খুব কৃপণ লোক শুনেছিলাম, তা যাহোক, তুমি উঁকি মেরে দেখতে কেন রোজ?
দীপঙ্কর বললে–আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম পরশুদিন, কে যেন আমাদের বাড়ির পাশে খুব নাচছে, ঝুম্ ঝুম্ করে ঘুঙুরের আওয়াজ হচ্ছে খুব, তারপর কালকে ইস্কুলে গিয়ে প্রাণমথবাবু, আমাদের হেডমাস্টার-জিজ্ঞেস করলেন, কে কী স্বপ্ন দেখেছে–আমি বললুম স্বপ্নটা–
-তারপর? থামলে কেন, বলো?
দীপঙ্কর বললে–সে-কথা বললে আপনারা রাগ করবেন–
ভদ্রলোক বললেন না, রাগ করবো কেন, বলো না কী স্বপ্ন দেখেছিলে?
দীপঙ্কর বললে–ঘুঙুরের শব্দ শুনে কেমন যেন খুব ইচ্ছা হলো দেখে আসি কে নাচছে। আমি যেন ঘর থেকে উঠে উঠোন পেরিয়ে আপনারদের বাড়ির কাছে এলাম, এসে দেখি ঘুঙুরের শব্দটা একতলার একটা ঘর থেকে আসছে। মনে হলো উঁকি মেরে দেখি কে নাচছে। তারপর আস্তে আস্তে জানালার পাখিটা ফাঁক করতেই-দেখি–
-বলো? থামলে কেন? কী দেখলে?
দীপঙ্কর বললে–দেখলাম একটা ভাল্লুক–
-ভাল্লুক! ভাল্লুক নাচছে?
বলতে বলতে হেসে ফেললেন ভদ্রলোক হো হো করে। ভদ্রমহিলাটিও হঠাৎ হেসে উঠলেন।
ভদ্রলোক বললেন, বলো কী? লক্ষ্মীকে ভাল্লুক মনে হলো?
ভদ্রমহিলাও হাসতে হাসতে বললেন–ও মা, কী হবে, অমন সুন্দর চেহারা বলে কি না ভাল্লুক–
দীপঙ্কর বললেও তো স্বপ্ন! স্বপ্ন কি সত্যি? স্বপ্ন সত্যি কি না সেইটে দেখবার জন্যেই আজ উঁকি মেরে দেখছিলাম, দেখলাম স্বপ্নটা সত্যি নয়। প্রাণমথবাবু বলেছেন, যারা মহাপুরুষ তাদের স্বপ্নই সত্যি হয়, আমি তো গরীবের ছেলে, আমার স্বপ্ন সত্যি হবে কেন?
ভদ্রলোক বললেন–মন দিয়ে লেখা-পড়া করবে জানো, এবারে ক্লাসে কী হয়েছ?
দীপঙ্কর বললে–আমি স্ট্যান্ড করি প্রত্যেকবার–
বাঃ ভেরি গুড, কে পড়ায় তোমাকে?
দীপঙ্কর বললে আমি নিজে নিজে পড়ি, আর অঙ্কটা বুঝিয়ে দেয় কিরণের বাবা, কিরণের বাবা খুব ভালো অঙ্ক জানে–
–তা তুমি লক্ষ্মীর কাছে অঙ্ক ইংরিজী বুঝে নিতে পারো–জানলে, লক্ষ্মী তোমাকে খুব ভালো ইংরিজী শিখিয়ে দিতে পারবে–লক্ষ্মী খুব ভালো ইংরিজী জানে।
লক্ষ্মীদি বললে–বা রে, আপনি তো কাকাবাবু বেশ, আমার সময় কোথায়, আমার নিজেরই পড়ার সময় হয় না, তারপর সেলাই আছে, নাচ আছে–
কাকাবাবু বললেন–তা হোক মা, গরীব ছেলে। একটু দেখিয়ে দিলেই বা–
দীপঙ্করের যেন হঠাৎ সাহস বেড়ে গেল। বললে–দেশে আগে আমাদের অবস্থা খুব ভালো ছিল, আমার বাবাকে ডাকাতে খুন করে ফেলেছিল, তখন থেকে আমার মা এই কলকাতায় এসে অঘোরদাদুর বাড়িতে ভাত রাধে, অঘোরদাদু না দেখলে আমরা কবে মারাই যেতুম–
ভদ্রলোক বললেন–ঠিক আছে, তুমি আসবে, লক্ষ্মীদি তোমায় পড়া বুঝিয়ে দেবে।
লক্ষ্মীদি বললে–তা হলে আমার নিজের পড়া আর হবে না দেখছি কাকাবাবু–
ভদ্রলোক বললেন–তা সতী তো আসছে কলকাতায়, সতী এলে তো তাকেও তোমাকেই পড়তে হবে–সেই সঙ্গে একেও পড়িয়ে দিও–
দীপঙ্কর বললে–ইংরিজীটাই শক্ত, অঙ্কটা আমি কিরণের বাবার কাছ থেকে জেনে নেব–
ভদ্রলোক বললেন–ইংরিজী অঙ্ক বাঙলা সবই বুঝিয়ে দেবে লক্ষ্মী-লক্ষ্মী খুব ভালো স্টুডেন্ট তা জানো, ও আমাকেও শেখাতে পারেনা লক্ষ্মী? ও এবার দশ টাকা স্কলারশিপ পেয়েছে তোমার বাবা তোমার রেজাল্টের খবর শুনে খুব খুশী জানো লক্ষ্মী, লিখেছেন সতাঁকেও এখানে পাঠিয়ে দেবেন, একসঙ্গে থাকায় দু’বোনেরই লেখাপড়া হবে–
লক্ষ্মীদি বললে–একসঙ্গে লেখা-পড়া যা হবে তা আমিই জানি, সতাঁকে তো আপনি দেখেননি কাকাবাবু–
ভদ্রমহিলা বললে–সতাঁকে খুব ছোটবেলায় দেখেছিলাম মনে আছে, তোর মতোন ফর্সা হয়েছিল, না রে?
লক্ষ্মীদি বললে–সে সতী এখন যা হয়েছে না, এখন আর দেখে চিনতে পারবে না কাকীমা–এর মধ্যেই আমার মতো বড় হয়ে উঠেছে–
হঠাৎ একজন চাকর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।
কাকীমা বললেন–কী ঠাকুর, কী বলছো?
ঠাকুর বললে–খাবার হয়ে গেছে মা-দেব এখন?
কাকীমা বললেন–বলছো কী ঠাকুর, এই সবে চা খেলুম, এখনি খাবো? তুমি দেখছি হাত খালি করতে পারলেই বাঁচো। একটু পরে, তোমায় খবর দেব’খন–
দীপঙ্কর বললে–আমার মা বড় ভাবছে, আমি যাই এবার—
কাকাবাবু বললেন–যাও, রাত হচ্ছে, লেখা-পড়া করোগে–
দীপঙ্করের কী যে হলো-হঠাৎ যেন কৃতজ্ঞতায় তার সমস্ত মনটা ভরে উঠলো। মনে হলো, এত আদর, এত স্নেহ, এত সহানুভূতি যেন সে জীবনে কারো কাছে পায়নি। হঠাৎ সে ভদ্রলোকের পায়ের কাছে নিচু হয়ে হাত দিয়ে পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালো। তারপর কাকীমাকেও প্রণাম করলে একটা।
এতদিন পরে সেই দিনগুলোর কথা ভাবতে কেমন অবাক লাগে। কোনও সম্পর্ক নেই তাঁদের সঙ্গে, কোনও সম্পর্ক ছিলও না কোনও দিন। কোনও দিন তাঁদের দেখেও নি দীপঙ্কর আগে। কিন্তু খুব ভালো লেগেছিল সেদিন। শুধু ভালো লাগা নয়, ও শুধু স্নেহের আশ্রয়ই নয়, একদিন সামান্য একটু ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। যখন পরের দয়ার ওপর নির্ভরতাই ছিল তার জীবনের একমাত্র সম্বল সেই সময়ে কেন যে তিনি অমন আত্মীয়তা পাতিয়েছিলেন কে জানে? তা না হলে কি এত করে জীবনকে দেখতে পেত দীপঙ্কর? এমন করে বুঝতে পারতো সংসারকে! এমন করে জানতে পারতো যে, জীবন শুধু জীবনই নয়, দুঃখ শুধু দুঃখই নয়, আনন্দ শুধু আনন্দই নয়–জীবনেরও একটা অন্য অর্থ আছে, দুঃখেরও একটা অন্য ব্যাখ্যা আছে, আনন্দেরও একটা অন্য উদ্দেশ্য আছে!
আর লক্ষ্মীদি?
সত্যিই তো লক্ষ্মীদি এসেছিল বলেই তো সতী এসেছিল!
আর সতী এসেছিল বলেই দীপঙ্কর বুঝতে পেরেছিল জীবনেরও একটা অন্য অর্থ আছে! দুঃখেরও একটা অন্য ব্যাখ্যা আছে, আনন্দেরও একটা অন্য উদ্দেশ্য আছে!
ঘরটা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল দীপঙ্কর। সত্যিই নতুন ভাড়াটেরা আসার পর দীপঙ্কর দেখতে পেলে সমস্ত বাড়িখানার চেহারাই যেন পালটে গেছে। ভেতরে যে এত পরিবর্তন হয়েছে তা তো বাইরে থেকে ধরা যায় না! অঘোরদাদুর সেই ভাড়াটে বাড়িটার চেহারা রাতারাতি এমন করে বদলে দিয়েছে এরা! ফুলগাছের টব বসিয়েছে জানালার ধারে ধারে। দরজায় দরজায় পর্দা। চেয়ার, টেবিল, কৌচ, সোফা, আলমারি, আয়না–কোনও দিকে ফাঁক নেই কিছু। আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল দীপঙ্কর। মা হয়তো এতক্ষণ ভাবছে। হয়তো খুঁজছে–দীপু কোথায় গেল।
হঠাৎ সিঁড়ির নিচে আসতেই পেছন থেকে কে যেন ডাকলো।
-এই ছেঁড়া শোন—
পেছন দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। সেই মেয়েটি। লক্ষ্মী!
বললে–আমাকে ডাকছো?
মেয়েটি তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একেবারে সামনে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল।
দীপঙ্কর মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। এর চোখে তো এতক্ষণ এ-দৃষ্টি ছিল না।
বললে–কিছু বলবে আমাকে?
মেয়েটি বললে–আর যদি কখনও আমাদের বাড়ি আসিস্ তো তোর ঠ্যাং ভেঙে দেব–
-বা রে, আমি কী করলুম?
হঠাৎ মেয়েটি তার কান ধরলে একেবারে। বললে–আবার তর্ক হচ্ছে?
কানটা খুব জোরে ধরেছিল মেয়েটা।
দীপঙ্কর বললে–আমি তো তর্ক করছি না,–
-ফের তর্ক, তুই আসতে পারবি না আর এ-বাড়িতে এই বলে রাখলুম আমি—
দীপঙ্কর বললে–কাকাবাবু যে আসতে বললেন–
-কাকাবাবু বললেই বা, আমি বলে দিচ্ছি তুই আসবি না—
দীপঙ্কর এতক্ষণে মেয়েটির হাব-ভাব দেখে ভয় পেয়ে গেল।
বললে–আচ্ছা আসবো না–
-হ্যাঁ, আর আসবি না।
বলে এক ঠ্যালা দিলে দীপঙ্করকে আর দীপঙ্কর হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়লো সিঁড়ির তলায়। পড়েই মনে হলো মাথায় যেন খুব লেগেছে। উঠে দাঁড়িয়েই দেখলে মেয়েটি এগিয়ে আসছে তার দিকে আবার।
ভয়ে ভয়ে বললে–আমি আসবো না, আমি কথা দিচ্ছি লক্ষ্মীদি, আমি আর আসবো না।
মেয়েটি হঠাৎ হেসে উঠলো। কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে।
বললে–লেগেছে তোর? খুব লেগেছে রে?
দীপঙ্কর বললে–তুমি আমায় ঠেলে ফেলে দিলে কেন? আমি তোমার কী করেছি যে ঠেলে ফেলবে?
মেয়েটি বললে–এমনি দেখছিলুম তুই ভয় পাস্ কিনা–
দীপঙ্কর বললে–আমি আর আসবো না তোমাদের বাড়িতে, কাকাবাবু বললেও আসবো না, আমাকে ছেড়ে দাও–
মেয়েটি হঠাৎ আদর করে বলতে লাগল–না রে, দেখলুম তুই ভয় পাস্ কিনা, তুই আসবি কিন্তু কাল, বুঝলি, আসবি, ঠিক আসবি–
বলে লক্ষ্মীদি চলে গেল। আর দীপঙ্কর অবাক হয়ে সেইদিকে চেয়েই অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে খিড়কীর দরজা দিয়ে উঠোনে পা দিলে। মাথাটা তখনও তার ব্যথা করছে।
৪
কিরণ বললে–কাল কোথায় গেলি রে তুই তারপর? আমি অনেকক্ষণ খুঁজলুম–
দীপঙ্কর বলেছিল–আমি হাজি কাশিমের বাজারের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলুম, তারপর আগুনখাকীর পুকুরটা ঘুরে টিপু সুলতানের বাড়িটার পাশ দিয়ে শেতলাতলা দিয়ে বাড়ি গিয়েছিলুম–
সত্যি সে-সব দিনকার বালিগঞ্জ এখন আর চেনা যায় না। তখন রাসবিহারী এভিনিউ এর মোড়ের ওপর ছিল হাজি কাশিমের বাজার। তারপর ওই মোড়ের দক্ষিণ পূর্ব কোণে ছিল টিপু সুলতানের পোড়ো বাড়িটা। এখন সার-সার দোকান হয়েছে। দিনরাত গম গম করে ট্রাম আর বাসের শব্দে। কিন্তু তখন? তখন কালীঘাটও এরকম ছিল না বালিগঞ্জও এখনকার মতো ছিল না। টিপু সুলতানের বিরাট বাড়িটা ভূতের বাড়ির মতো, এই এধারের মোড় থেকে ওধারের আগুনখাকীর পুকুর পর্যন্ত খাঁ খাঁ করতো। পোড়ো বাড়িটার মাথায় বিরাট বিরাট বটগাছ গজিয়ে জায়গাটা যেন দিনের বেলায়ও থম্ থম্ করতো। ভয় করতো জায়গাটার কাছে গেলে। হঠাৎ দুপুরবেলা হাওয়া লেগে বটগাছটার পাতাগুলো সি সি করে একরকম শব্দ হতো। আর কখনও কখনও একটা তক্ষক সাপ কটকট করে একটা বিরাট শব্দে ডেকে উঠতো আর ওই সমস্ত পাড়াটা তখন কেমন ভয়াবহ হয়ে উঠতো। মোড়ের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে ছিল টিকেপাড়া। টিকেওয়ালারা রাস্তার ওপরে লম্বা লম্বা কাঠের ওপর টিকে শুকোতে দিত। তার উত্তরে ছিল আশু কলুর সরষের তেলের দোকান। দুপুরবেলা কতদিন তেল কিনতে দিয়েছে মা, আর দীপঙ্কর গিয়ে বসতো ঘানিগাছের ওপর। ঘানিটা ঘুরতো–দু’চোখ ঢাকা গরুটা সেই ঘানিগাছটা নিয়ে দিনরাত ঘুরপাক খেত। কতদিন দু’ ঘণ্টা তিন ঘন্টা বসে বসে ঘুরেছে দীপঙ্কর। সরষের তেল কেনা রয়েছে, সে-কথা তখন আর মনে নেই। তারপর সেই তেল নিয়ে যখন বাড়িতে এসেছে তখন সে কী বকুনি মা’র! আর ওই যে আশু কলুর দোকানের উত্তরে ছিল হাজি কাশিমের বিরাট বাড়িটা, ওই বাড়িটার পেছনে বিরাট একটা বাগান ছিল। অনেকদিন বাগানের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেছে দীপঙ্কর। কত সাপ ছিল বাগানে, কত পাখি! তারা সব কোথায় গেল! যখন বাগানটা ভেঙে সদানন্দ রোড হলো সে-বাগানটা উঠে গেল। কত বাড়ি হলো আশে-পাশে। একেবারে অন্যরকম চেহারা হয়ে গেল পাড়াটার। ওদিকে আরো ওদিকে আগুনখাকীর পুকুর পেরিয়ে দেখা যেত ধানক্ষেত। হাওয়া লেগে ধানের ডগাগুলো দুলতো। আর দীপঙ্করের মনে হতো যেন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন ছেড়ে কতদূরে চলে এসেছে সে। শুধু কি ধানতে? শুধু কি টিপু সুলতানের বাড়ি? শুধু কি টিকেপড়া, শুধু আশু কলুর দোকান? কত বড় জগৎ ছিল তখন দীপঙ্করের! এখন মনে হয়, বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে যেন জগৎটা তার ছোট হয়ে এসেছে। কোথায় গেল সেই আটাশ নম্বরের বাগান? কিরণের সঙ্গে কতদিন গিয়েছে সেই বাগানে। কার বাগান, কে মালিক, কিছুই জানতো না। শুধু জানতো বাগানটার মাঝখানে একটা পুকুর ছিল। আর পুকুরের পাড়ে ছিল একটা জামরুল গাছ। বড় বড় জামরুল হতো গাছটায়। মুখটা সিঁদুরের মতো লাল, আর গুড়ের মতো মিষ্টি। বাগানটার পরেই মহারাজ সূর্যকান্তের বাগান। সে-বাগানে ছিল লিচু গাছ একটা। বড় বড় লিচু, পেকে টস্টস্ করতো। অনেকদিন গাছ উঠে লিচু খেতে খেতে অনেক দূরের দিকে চেয়ে দেখেছে। কোথায় যেন একটা রেলগাড়ির শব্দ হতো–পু-উ-উ-উ-ঝিক্-ঝিক্-ঝিক্ ঝিক্। সেই শব্দটা সেই দুপুরবেলায় যে কী মিষ্টি লাগতো, পাকা জামরুল কি পাকা লিচুর চেয়েও যেন মিষ্টি ছিল সেই শব্দটা। তখন কি জানতো যে একদিন ওই রেল নিয়েই তার দিন কাটবে, ওই রেলেরই একটা লেভেল-ক্রসিং-এ তার জীবনের রেলগাড়িটা এমন হুড়মুড় করে এসে পড়বে, ওই রেলগাড়িই একদিন তার জীবনের সব সমস্যার সমাপ্তি ঘটিয়ে দেবে–
একদিন কালীঘাট ইস্কুলের ইনফ্যান্ট ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল দীপঙ্কর।
সেই-ই প্রথম ইস্কুল। জীবনে সেই-ই প্রথম ইস্কুলে যাওয়া। সেই কমা আর কমলালেবু নিয়ে সে-ইস্কুল থেকে একদিন চলে এসেছিল। বুকে এঁটেছিল ইউনিয়ন জ্যাক্। বহুদিন পর্যন্ত সেই ঘটনার কথাটাই মনে ছিল। সেই লক্ষ্মণচন্দ্র সরকার, সেই চারুচন্দ্র ধর, সেই বিমানচাঁদ মিত্র, সেই কিরণ কুমার চট্টোপাধ্যায়–। সেই নির্মলচন্দ্র পালিত। আর সেই দীপঙ্কর সেন, রোল নাম্বার এইটিন।
সবাই রইল কালীঘাট ইস্কুলে। তারপর নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটে ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুল হলো কিছুদিন পরেই।
মা বললেও ইস্কুলটা বড় দূরে, কাছের ইস্কুলে ভর্তি করে দেব তোকে–
ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলে যেতে দীপঙ্করর বিশেষ খারাপ লাগেনি। কিরণও তার সঙ্গে চলে এল নতুন ইস্কুলে। তবু ভালো যে, লক্ষ্মণচন্দ্র সরকার এল না। সে রইল পুরোন ইস্কুলে। রাস্তায় লক্ষ্মণকে দেখলেই বড় ভয় হতো। কথা নেই বার্তা নেই, লক্ষ্মণ দীপঙ্করকে দেখলেই মাথায় চাটি মারতো।
হয়তো রাস্তা দিয়ে দীপঙ্কর চলেছে, হঠাৎ উল্টোদিক থেকে দেখা গেল লক্ষ্মণ আসছে–
লক্ষ্মণকে এড়াবার জন্যে দীপঙ্কর রাস্তার একপাশ ঘেঁষে সরে গেল। কিন্তু লক্ষ্মণ ততক্ষণে তার দিকেই এগিয়ে এসেছে।
এসেই বললে–কী রে, কোথায় চলেছিস–
বলতে না বলতে তার মাথায় খট করে একটা চাটি মেরে আবার চলতে আরম্ভ করেছে।
এক-একবার কান্না পেত দীপঙ্করের। এত লোক থাকতে তার মাথায় কেন চাটি মারে সে! কী করেছে দীপঙ্কর! কিছুতেই কিছু ভেবে বার করতে পারতো না যে, তার ওপরে কেন লক্ষ্মণের এত রাগ! চোখে জল এসে পড়তো কতবার। অথচ কাঁদবার উপায় নেই। মা যদি জিজ্ঞেস করে কে তাকে মেরেছে, কেন তাকে মেরেছে? কী জবাব দেবে দীপঙ্কর? এক একবার মনে হতো, হয়তো ভালো চুল ছাঁটা হয়নি বলে লক্ষ্মণ মারে, কিংবা ময়লা জামা-কাপড় পরে বলে মারে। কিন্তু না, ভালো চুল ছাঁটা হলেও লক্ষ্মণ মেরেছে, ফরসা জামা-কাপড় পরলেও মেরেছে। পরে ভেবে দেখেছে তাকে চাটি মেরে লক্ষ্মণ সুখ পেত বলেই মারতো, অন্য কোনও অপরাধের জন্যে মারতো না। কিন্তু তারপর স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছে। কলেজ ছেড়ে অফিসে ঢুকেছে। তখনও লক্ষ্মণরা তাকে রেহাই দেয়নি। সারা পৃথিবীতে সেই এক লক্ষ্মণ বহু লক্ষ্মণ হয়ে বহুরূপে যেন ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ্মণদের হাত থেকে যেন মানুষের আর মুক্তি নেই।
সেদিন নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের মোড়ের কাছে আসতেই দীপঙ্কর দেখলে, সামনেই লক্ষ্মণ আসছে। তখন বিকেল হয়ে গেছে। রাস্তায় তখন জল দিচ্ছে নল দিয়ে। লক্ষ্মণকে দেখেই কেমন যেন বুকটা দুড়-দুড় করতে লাগলো দীপঙ্করের। আবার যদি মারে লক্ষ্মণ!
একটু পাশে সরে গেল দীপঙ্কর। কিন্তু লক্ষ্মণের কী যে হলো, সে-ও তার দিকে এগিয়ে এল।
সামনে এসেই লক্ষ্মণ বললে–কী রে, আমাদের ইস্কুল ছেড়ে দিলি কেন? আমার ভয়ে?
দীপঙ্কর কিছু কথা বললে না। ভয়ে ভয়ে একদৃষ্টে লক্ষ্মণের চোখের দিকে চেয়ে রইল।
লক্ষ্মণের আর কোনও দিকে খেয়াল নেই। কথাটা বলেই তার মাথায় একটা চটি মারলে–
রোজ রোজ মার খেতে খেতে দীপঙ্করের যেন কেমন সাহস বেড়ে গিয়েছিল।
বলল–আমায় মারিস কেন রে তুই রোজ? রোজ কেন তুই মারিস আমাকে? আমি তোর কী করেছি বল তো?
হঠাৎ দীপঙ্করের কাছ থেকে এ-রকম প্রতিবাদ যেন আশা করেনি লক্ষ্মণ! একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। বললে–বেশ করবো মারবো, আমার খুশি মারবো–এই তো আবার মারছি, কী করবি তুই?
বলে সত্যিই আবার একটা চাটি মারলে মাথায়। এবার আরো জোরে।
দীপঙ্কর মাথাটা সরিয়ে নিলেও লাগলো খুব। মাথাটা যেন ঝন্ ঝন্ করে উঠলো। বললে–আমি কিছু বলি না বলে, তাই না!
লক্ষ্মণ আরো এগিয়ে এল বুকের কাছে। বললে–খুব যে সাহস হয়েছে তোর দেখছি-বড় সাহস, না–
বলে আবার মারলে মাথায়। চুলের একটা গোছ ধরে জোরে টানলে।
বললে–এক ঘুষি মারবো নাকে, তখন ফুটুনি দেখিয়ে দেব–
-বা রে, আমি কখন ফুটুনি করলাম তোর সঙ্গে? তুই তো আমাকে মারলি প্রথমে! লক্ষ্মণ এবার ফটাফট তার মাথায় ঘুষি মারতে আরম্ভ করেছে–
-ফের, ফের ফুটুনি? ফের ফুটুনি হচ্ছে? ফের?
কথা বলে আর মারে লক্ষ্মণ! মাথা তুলতে দেয় না একেবারে। ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে, পেছনে–মুখের চারদিকে মারতে লাগলো। দীপঙ্করের চোখে তখন সমস্ত সংসার ঝাঁ ঝাঁ করছে। মাথা ঘুরছে বন্ বন্ করে–
মারে আর মুখে বলে–বড় ফুটুনি বেড়েছে তোর, না? দেখাচ্ছি তোর ফুটুনি–
মাথাটা বাঁচাতে গিয়ে দীপঙ্কর একপাশে সরে যাবার চেষ্টা করতেই কী হলো, ধপাস করে রাস্তার ওপর পড়ে গেল আর লক্ষ্মণ তখন আরো সুবিধে পেয়েছে। দীপঙ্করের কানে, মুখে, মাথায় পটাপট কিল চড় ঘুষি মেরে চললে০০। দীপঙ্করের মনে হলো যেন সে আর বাঁচবে না। লক্ষ্মণ যেন মেরে ফেলে তবে তাকে নিস্কৃতি দেবে। সেই লক্ষ্মণের অত্যাচারে সেদিন যদি তার প্রাণ বেরিয়ে যেত তাহলে পৃথিবীর অনেক কিছুই তাকে আর দুটো চোখ দিয়ে দেখতে হতোনা, হয়তো অনেক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকেও সে মুক্তি পেত, অনেক যন্ত্রণার হাত থেকে সে অব্যাহতি পেত হয়তো! কিন্তু তাহলে সতাঁকে যে তার দেখা হতো না। সতাঁকে না দেখলে জীবনের সব কিছুই যে নিরর্থক হতো!
লক্ষ্মণের মার খেতে খেতে যখন দীপঙ্কর প্রায় অসাড় হয়ে পড়েছে, তখন হঠাৎ এক কাণ্ড হলো।
মনে হলো পাশেই যেন কে এসে দাঁড়াল।
দীপঙ্কর কোনও রকমে চোখ তুলে দেখলে সামনেই লক্ষ্মীদি–
ইস্কুলের গাড়ি থেকে নেমে লক্ষ্মীদি গলির ভেতরে আসছিল, আসতেই ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মণের চুলের মুঠি ধরে এক টান দিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে কথা নেই বার্তা নেই এক চড়–
লক্ষ্মণও কেমন যেন ভড়কে গিয়েছিল। চড় খেয়েই মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু লক্ষ্মীদি ছাড়বার পাত্রী নয়, লক্ষ্মণের মাথায় কানে পিঠে দুম-দাম করে কিল বসিয়ে দিচ্ছে–
-এই স্টুপিড, কেন মারছিস রে ওকে? মারছিস কেন তুই?
আবার চড়, আবার ঘুষি! লক্ষ্মীদির গায়ে খুব জোর। লক্ষ্মীদি হাতের বইগুলো রাস্তার ওপর রেখে দিয়ে দুম-দাম করে কিল মারতে লাগলো লক্ষ্মণকে। লক্ষ্মণ পালাতেও পারে না, মারতেও পারে না। হঠাৎ এই আচমকা মার খেয়ে যেন সে দিক-বিদিক্ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দীপঙ্কর তখন উঠে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দূর থেকে দেখতে লাগলো। মনে হলো বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে–এতদিনে ঠিক জব্দ হয়েছে লক্ষ্মণ। যেমন তাকে মারা, তেমনি শিক্ষা হয়েছে–
অনেকক্ষণ মারার পর
লক্ষ্মীদি বললে–আর যদি কখনও মারিস ওকে তো তোর চোখ কানা করে দেব, বেরো, বেরো এখান থেকে–যা–
এতক্ষণে দীপঙ্করের অনেকখানি সাহস ফিরে এল।
লক্ষ্মণ মুখ কাঁচুমাচু করে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উল্টো দিকে সোজা চলে গেল– লক্ষ্মীদিও তখন রাস্তার ওপর থেকে তার নিজের বইগুলো কুড়িয়ে নিয়েছে।
দীপঙ্কর কাছে গিয়ে বললে–আমাকে ও রোজ রোজ মারে লক্ষ্মীদি–রোজ এমনি করে মারে আমায়, আমি কিছু করিনি–শুধু শুধু মারে–।
লক্ষ্মীদির মুখটা যেন গম্ভীর গম্ভীর।
দীপঙ্কর বলতে লাগলো–বেশ করেছ তুমি ওকে মেরেছ লক্ষ্মীদি-আমি কিছু করি ওর–তবু মারে–
লক্ষ্মীদি হঠাৎ দীপঙ্করের কান ধরে মাথায় দুম দুম্ করে মারতে লাগলো।
বললে–স্টুপিড় কোথাকার, রোজ রোজ মারে ও আর তুই মার খাস? তুই ওকে মারতে পারিস না? তোর গায়ে জোর নেই? স্টুপিড় গাধা কোথাকার, বোকার মতন আবার বলছিস্ রোজ রোজ মারে ও-তোকেও মারবো আমি–
বলে লক্ষ্মীদি আবার মারতে লাগলো।
দীপঙ্করের চোখ দিয়ে তখন সত্যি সত্যিই জল পড়ছে গড়িয়ে গড়িয়ে। এতক্ষণ লক্ষ্মণের কাছে মার খেয়ে যায় হয়নি লক্ষ্মীদির হাতে মার খেয়ে তার দ্বিগুণ কষ্ট হলো দীপঙ্করের।
দীপঙ্কর দু’হাতে মাথাটা ঢেকে বলতে লাগলো–আর মেরো না লক্ষ্মীদি-আর করবো না আমি–আর মেরো না–
লক্ষ্মীদির তখন যেন সত্যিই গো চেপে গিয়েছে। আরো জোরে জোরে মারতে লাগলো মাথায়।
বললে–মাথা ভেঙে ফেলে দেব তোর স্টুপিড় কোথাকার-লোকে মেরে যাবে আর তুই বসে বসে কাঁদবি, লজ্জা করে না তোর কাঁদতে–আবার কান্না হচ্ছে ছেলের–
তারপর বাড়ির কাছে আসতেই
লক্ষ্মীদি বললে–যা, বাড়ি যা, আর কখনো কাঁদবি না–বুঝলি, তাহলে বেটাছেলে হয়েছিস কী করতে–
বলে এক ঠেলা দিলে দীপঙ্করকে, আর তারপর লাফাতে লাফাতে লক্ষ্মীদি বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো।
রাত্রিবেলা পড়তে বসে কিছুতেই পড়ায় যেন আর মন বসছিল না দীপঙ্করের। অঘোরদাদুর সিন্দুকটার গায়ে হেলান দিয়ে সামনে হিস্ট্রির বইটা নিয়ে অনেকক্ষণ চোখ চেয়ে থাকবার চেষ্টা করলে দীপঙ্কর। কিন্তু চোখ দুটো যেন ঢুলে আসছে ঘুমের ঘোরে। মনে হলো কেন ওরা এল এ-বাড়িতে? ওই ভাড়াটেরা! খালি মারে তাকে। আগেকার ভাড়াটেরা বেশ ছিল। দীপঙ্করদের দিকে ফিরেও তাকাত না। চন্নুনী তাদের গালাগালি দিত, বেশ করতো। এদেরও গালাগালি দিলে বেশ হতো। এরাও থাকতো না তাহলে, উঠে যেত এ-বাড়ি থেকে। উঠে গেলেই ভালো হয়। ভারি তো নাচে! ও-রকম নাচ দীপঙ্করও নাচতে পারে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধেই ধেই করে নাচতে কে না পারে! স্বপ্নটাই ঠিক হয়েছিল-ভালুকের স্বপ্নটাই ঠিক। ঠিক যেন ভাল্লুক-নাচ। পাথরপটির রাস্তায় অনেক ভাল্লুক-নাচওয়ালা আসে। লোকটা ডুগডুগি বাজায় আর ভাল্লুকটা নাচে। আর চেহারা? চেহারাই বা কী এমন! ভারি তো সুন্দর! বিন্তিদিকে ওর চেয়ে ঢের সুন্দর। দেখতে। বিন্তিদি তোকই তাকে কিছু বলে না। আর লেখাপড়া ও-রকম সবাই করতে পারে। আবার দশ টাকার স্কলারশিপ পেয়েছে! ভালো মেমসাহেবদের ইস্কুলে পড়লে বিন্তিদিও স্কলারশিপ পেত।
কী একটা কাজে মা বুঝি ঘরে এল।
দীপঙ্কর বললে—মা—
মা বললে–কী বলছিস, বল—
দীপঙ্কর বললে–চন্নুনী আজকাল গালাগালি দেয় না কেন?
মা বোধ হয় ব্যস্ত ছিল খুব। বিরক্ত হলো কথাটা শুনে। বললে–যত উদভুটে কথা তোর বাপু, কেন গালাগালি দিতে যাবে কেন! কাকে গালাগালি দেবে?
দীপঙ্কর বললে–এই যে নতুন ভাড়াটেরা এসেছে ওদের গালাগালি দেয় না কেন চন্নুনী? গালাগালি দিলে ওরা বেশ উঠে যায়–
–পারিনে বাপু তোর সঙ্গে ব ব করতে—
বলে মা চলে গেল। দীপঙ্কর আবার হিস্ট্রির বইতে মন দেবার চেষ্টা করলে। কোথাকার কোন্ আলেকজান্ডার কোথাকার কোন্, পুরুকে কোথায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার কথা পড়ে কী লাভ হয় কে জানে! কেউ-ই সেদিন শশাঙ্কবাবুর ক্লাসে পড়া বলতে পারেনি। শশাঙ্কবাবু একটু গম্ভীর গম্ভীর লোক। প্রাণমথবাবুর মতো নয়। প্রাণমথবাবুর ক্লাসটাই সবচেয়ে ভালো লাগতো দীপঙ্করের।
প্রাণমথবাবু ক্লাসে কত রকম গল্প বলেন।
প্রাণমথবাবু সেদিন ক্লাসে এসে জিজ্ঞেস করলেন-আজকে কোন্ জায়গাটায় পড়া আছে বলো তো তোমাদের?
মনিটার দীপঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বললে–আলেকজান্ডার আর পুরু স্যার।
প্রাণমথবাবু বইটা মুড়ে পাশে রেখে দিয়ে বলেছিলেন-বলো তো পুরু কে?
ফটিক বললে–একজন রাজা স্যার—
প্রাণমথবাবু বললেন–বেশ, বেশ, কিন্তু রাজা মানে কী? তুমি বলতে পারো?
কিরণের দিকে আঙুল দেখালেন।
বললেন–তুমি? তুমি? তুমি?
একের পর এক অনেককে জিজ্ঞেস করলেন। কেউ-ই বলতে পারেনি সেদিন। রাজা মানে রাজা! রাজার আবার মানে কী! সবাই সেদিন সেই সহজ কথাটারই উত্তর দিতে পারেনি। সকলেই হাঁ করে চেয়ে ছিল প্রাণমথবাবুর দিকে।
প্রাণমথবাবু বললেন–রাজা কথাটার মানে জানো না বলে তোমাদের লজ্জার কোনও কারণ নেই, রাজা কথাটার মানে অনেকেই জানে না–অনেক রাজাও জানে না তবে শোন–
তারপর কৌটো থেকে একটা পান মুখে দিয়ে বললেন–একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীর রাজাও ছিল না, রাজ্যও ছিল না, দণ্ড ছিল না, দণ্ডদাতাও ছিল না! তার মানে সবাই সবাইকে ভালোবাসতো! সবাই সবাইকে ভালোবাসলে আর শাস্তিদাতা কিংবা শাস্তি কিছুরই দরকার হয় না। কিন্তু এ-রকম অবস্থা বেশিদিন চললো না, আস্তে আস্তে মোহ এল–মানে ধর্ম লোপ হয়ে গেল পৃথিবী থেকে। ধর্ম যায় যায় অবস্থা, দেবতারাও ভয় পেয়ে গেলেন। কেউ আর যাগ-যজ্ঞ করে না–আর যজ্ঞের আহুতি না দিলে দেবতারা খাবেন কি? তখন তারা ছুটলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মাকে গিয়ে তাঁরা বললেন এখন উপায় কী? তখন ব্রহ্মা ঋষিদের বলে একজনকে রাজা তৈরি করে দিলেন–তাঁর নাম হলো পৃথু। সেই পৃথুই হলেন পৃথিবীর রাজা। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর অবতার। তিনি রাজা হবার পর আবার যাগ-যজ্ঞ হতে লাগলো, আবার ধর্ম ফিরে এল। তিনি প্রজা-রঞ্জন করতে পারতেন তাই তাঁর নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল চারিদিকে। সেই ‘রঞ্জন’ কথাটা থেকেই রাজা নামটার সৃষ্টি হলো–
তারপর একটু সোজা হয়ে বসে বললেন–এখন বুঝলে তো যে রাজা কাকে বলে?
সবাই একসঙ্গে বললে–বুঝলাম স্যার–
-কিন্তু সব রাজাই পৃথু রাজার মতো ভালো রাজা হয় না। এমন রাজাও আছে যারা প্রজা-রঞ্জন করে না, প্রজাদের খেতে-পরতে দেয় না–আমাদের দেশের মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছ তোমরা?
সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল প্রাণমথবাবুর দিকে।
কিরণ মাঝখানে হঠাৎ বাধা দিয়ে বললে–স্যার, সি আর দাশ যখন রাজা হবেন তখন ভালো রাজা হবেন?
–সি আর দাশ রাজা হবেন?
প্রাণমথবাবু অবাক হয়ে কিরণের দিকে চাইলেন।
বললেন–কে বললে?
কিরণ বললে–একজন সাধু বলেছে, স্যার,–
-কে সাধু?
-খাঁটি সাধু স্যার, খাঁটি হিমালয়ের সাধু বলেছে দেশ স্বাধীন হলে সি আর দাশ রাজা হবে, আর আমার বাবার অসুখ ভালো হয়ে যাবে, আমাদের দেশের সক্কলের অবস্থা ভালো হবে, আমরা সবাই ভালো-ভালো জিনিস খেতে পাবো, দই, রাবড়ি, সন্দেশ, রাজভোগ–
প্রাণমথবাবু যেন একটু হাসলেন। ক্ষীণ একটু হাসির আভাস ফুটলো মুখে। বললেন–দেশ স্বাধীন হলে যে দেশের লোকের অবস্থা ভালো হবে তা বলতে আর সাধুর দরকার হয় না, যা গে যে-কথা বলছিলাম-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা বই আছে তার নাম ‘রাজা-রানী’, বড় হলে তোমরা পোডড়া সে বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের পৃথিবীর একজন মস্ত বড় কবি, একদিন দেখবে ঘরে ঘরে তাঁর ছবি টাঙানো থাকবে তা সেই তাঁর নামই তোমরা শোননি?
দীপঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলেছিল–আমি রবি ঠাকুরকে দেখেছি স্যার–
-তুমি তাকে দেখেছ? কোথায় দেখলে?
দীপঙ্কর বললে–আমাদের কালীমন্দিরে স্যার–
-কালী-মন্দিরে?
-হ্যাঁ স্যার, মন্দিরে পাঁঠা-বলি বন্ধ করতে–
মনে আছে দীপঙ্কর রোজ ভোর বেলা পাড়ায় পাড়ায় ফুল তুলে মন্দিরে দিয়ে আসতো। কুণ্ডুপুকুরের ধার দিয়ে গিয়ে মা-কালীকে, ভুবনেশ্বরীকে, গণেশকে, আরো যত মন্দির আছে, সব ঠাকুরকে। মা-ও এক-একদিন সঙ্গে থাকতো। মা প্রণাম করতো, দীপঙ্করও মা’র দেখা-দেখি প্রণাম করতো। প্রণাম করে কী লাভ, কী লোকসান হয়েছে মনে নেই, কিন্তু প্রণাম করাটা তখন ছিল অভ্যেস। একদিন মা হঠাৎ বললে–ওই দেখ, ও কে বল তো?
দীপঙ্কর দেখেছিল সাদা দাড়ি ভর্তি মুখ, একজন লোক নাটমন্দির আর মায়ের মন্দিরের মধ্যেকার রাস্তায় প্রতিমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। একটা হাতের ওপর আর একটা হাত বুকের কাছে রাখা। দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে–
-ও কে মা?
কোনও দিকে খেয়াল নেই লোকটার। সঙ্গে দু-চারজন ছেলে-মেয়ে। তারাও চেয়ে দেখছে ঠাকুরের দিকে। কী চমৎকার সব চেহারা, কী চমৎকার সব পোশাক তাদের। যেন পুতুলের মতো গড়ন সব।
মা তখনও সেই দিকে চেয়ে দেখছিল।
-ও কে মা?
মা বললে–ওঁর নাম রবি ঠাকুর–
-রবি ঠাকুর কে মা?
-খুব ভালো ভালো পদ্য লেখেন।
সকালবেলা। মন্দিরে তখন ভিড় নেই। সেদিন আর কেউই হয়তো চিনতে পারেনি রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু মা চিনেছিল ঠিক। মা’র অনেক বুদ্ধি ছিল। বাবা যদি না মারা যেত হঠাৎ তো মা আরো অনেক কিছু জানতে পারতো। মাকে আর অঘোরদাদুর বাড়িতে দিনরাত রান্না করতে হতো না। তা সেদিন মা’র সঙ্গে দীপঙ্করও সেই দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে, হঠাৎ–
-দীপুবাবু!
হঠাৎ নিজের নামটা কানে যেতেই দীপঙ্কর চমকে উঠলো। হিস্ট্রির বইটা রেখে ঘরের বাইরে এসে অবাক। রঘু-লক্ষ্মীদিদের চাকর রঘু!
রঘু বললে–তোমাকে কাকাবাবু ডাকছে দীপুবাবু—
দীপঙ্কর আরো অবাক হয়ে গেল।
বললে–আমাকে? আমাকে কেন ডাকছে?
রঘু বললে–কাকাবাবু এখন আপিস থেকে এল, লক্ষ্মীদিদিমণি আমাকে বললে দীপুবাবুকে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আয়–
দীপঙ্কর কী যেন ভাবলে। তাকে আবার কেন ডাকবে! আবার মারবে নাকি? সে কি দোষ করলো! লক্ষ্মীদিরই তো দোষ! লক্ষ্মীদিই তো তাকে মেরেছে। পর পর দু’দিন মেরেছে, তবু কিছু বলেনি দীপঙ্কর, কিছু বলবেও না কোনদিন। চোদ্দ বছর ধরে দীপঙ্কর কিছু বলবে না কাউকে। চোদ্দ বছর ধরে। চোদ্দ বছরের মধ্যে মাত্র বছরখানেক কেটেছে।
প্রাণমথবাবু বলেছিলেন-চোদ্দ বছর ধরে যদি আগাগোড়া তোমরা সত্যি কথা বলে যাও তো একদিন তোমরা যা বলবে সব সত্যি হবে–সব ফলে যাবে–
মধুসূদন বলেছিল–যদি বলি স্যার আমি রাজা হবো?
প্রাণমথবাবু বলেছিলেন–হবে, রাজাই হবে–তবে চোদ্দ বছর বরাবর সত্যি কথা বলে যাওয়া চাই–একটাও মিথ্যে কথা বলা চলবে না–
কিরণ বলেছিল–স্যার, যদি বলি আমার বাবার অসুখ ভালো হয়ে যাক–
-হ্যাঁ, তাই-ই হবে!
-স্যার যদি বলি আমাদের মস্ত বড় বাড়ি হোক–
-হবে, যা ইচ্ছে করবে, তাই-ই হবে—
সেদিন থেকে কিরণ আর দীপঙ্কর ঠিক করেছিল চোদ্দ বছর ধরে তারা সত্যি কথাই বলে যাবে বরাবর। একদিনের জন্যেও একটা মিথ্যে কথা বলবে না। কিন্তু কিরণ রাখতে পারেনি তার কথা। ভিক্ষের পয়সা চুরি করে অনেকদিন বন্ধুর দোকান থেকে আলুর-চপ বেগুনী কিনে খেয়েছে, বাড়িতে কিছু বলেনি–
রঘু বললে–চল দীপুবাবু–
দীপঙ্কর ভাবছিল মা’কে একবার বলে যাবে নাকি–। উঠোন দিয়ে একবার রান্নাঘরের দিকে মাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলও। কিন্তু দরকার নেই। মা হয়তো আবার–
অনেক কথা জিজ্ঞেস করবে। তার চেয়ে এসেই বলবে সব মাকে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-কী জন্যে ডাকছে তুই জানিস?
রঘু বললে–তা জানি না–
উঠোন পেরিয়ে বাইরের রাস্তা দিয়ে ওদের বাড়িতে ঢোকবার আসল পথ। রঘু আগে আগে চললো। দীপঙ্কর পেছন-পেছন গিয়ে ঢুকলো ভেতরে। ওদের উঠোনের রোয়াকে পা দিয়েই সিঁড়িটা। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই ডান দিকে বসবার ঘর। ঘরের মধ্যে কাকাবাবু বসেছিলেন একদিকে তার পাশেই লক্ষ্মীদি আর উল্টোদিকে কাকীমা।
-এই যে দীপুবাবু, আজকে রাস্তায় কী হয়েছিল তোমার!
দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির দিকে চাইলে একবার লক্ষ্মীদি মুখ টিপে টিপে হাসছে তখন।
-বোস, বোস তুমি আগে ওই চেয়ারটায়। এইবার বলো তো কী হয়েছিল! ঠিক সত্যি কথা বলবে, মিথ্যে বলবে না একটুও–
দীপঙ্কর গম্ভীর হয়ে বললে–আমি মিথ্যে কথা বলি না–এক বছর ধরে আমি সত্যি ছাড়া মিথ্যে বলি না–
-এক বছর ধরে সত্যি কথা বলে আসছো? মিথ্যে কথা মোটেই বলো না?
-না, আরো তেরো বছর ধরে সত্যি কথা বলবো।
কাকাবাবু শুনে যেন কেমন অবাক হয়ে গেলেন। কাকীমাও হেসে তাকালেন কাকাবাবুর দিকে।
বললেন–ওমা, বেশ ছেলে তো!
লক্ষ্মীদি টিটকারী দিলে–একেবারে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির আমাদের–
কাকাবাবু থামিয়ে দিলেন লক্ষ্মীকে। বললেন–তুমি থামো লক্ষ্মী, এখন বলল তো তেরো বছর ধরে কেন সত্যি কথা বলবে?
দীপঙ্কর বললে–আমাদের হেডমাস্টারমশাই বলেছেন যদি চোদ্দ বছর ধরে আগাগোড়া সত্যি কথা কেউ বলে তো তার পরে সে যা বলবে সব সত্যি সত্যি ফলে যাবে–
কথাটা শুনে কাকাবাবু হেসে ফেললেন, কাকীমাও হাসলেন, লক্ষ্মীদিও হেসে ফেললে।
কাকাবাবু বললেন–আর তুমি তাই সত্যি বলে বিশ্বাস করলে?
কত সরল কত সহজ কত স্বাভাবিক যে ছিল তখন দীপঙ্কর! এক-এক সময়ে দীপঙ্করের মনে হয়েছে হয়তো সেই দিনগুলোই ভালো ছিল। যে যা বলেছে, সব বিশ্বাস করেছে! বিশ্বাস করেছে কিরণের বাবার অসুখ একদিন ভালো হয়ে যাবে, বিশ্বাস করেছে কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়, বিশ্বাস করেছে সি আর দাশ একদিন দেশের রাজা হবে, আর বিশ্বাস করেছে চোদ্দ বছর সত্যি কথা বললে মুখের সব কথা ফলে যায়–আর আরো কত কথাই যে বিশ্বাস করেছে দীপঙ্কর! আজ এতদিন পরে মনে হলো সংসারে বিশ্বাস করাই হয়তো ভালো, নইলে বিশ্বাস করে সে কি শেষ পর্যন্ত কিছুই পায়নি? আর বিশ্বাস করেছিল বলেই কি তার সব কিছু হারিয়ে গেল?
দীপঙ্কর বললে–ও আগে আমাদের ইস্কুলে পড়তো—
কাকাবাবু বললেন–রাস্তায় যে-ছেলেটা মারে, ও কে? কেন মারে তোমায়?
–তা জানি না, আমার হাতে যা থাকবে ও কেড়ে নেবে, কিছু না করলেও ও মারবে–
লক্ষ্মীদি বললে–তাই আমি আজ ওকে খুব মেরেছি কাকাবাবু, মুখ বুজে ও মার খাবে কেন? ও মারতে পারে না? ওর গায়ে জোর নেই?
দীপঙ্কর বললে–এখন যত পারে মারুক না, একদিন আমি ওর মারা ঘুচিয়ে দেব কাকাবাবু–
কাকাবাবু বললে–কী করে?
দীপঙ্কর বললে–আমি গরীব বলে এখন ও মারে, আমরা বড়লোক হলে ও আর মারবে না–আমার যখন খুব টাকা-কড়ি হবে তখন আর মারবে না ও–
-কেন?
দীপঙ্কর বললে–অঘোরদাদু বলেছে, টাকা-কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়, সব কেনা যায় টাকা-কড়ি দিয়ে–
কাকীমা বললেন–ছেলের বুদ্ধি তো খুব!
দীপঙ্কর বললেঅঘোরদাদু আমাকে বলেছে যে, টাকা থাকলে আমার যা খুশি কিনতে পারবো, ওই লক্ষ্মণও তখন আমায় খাতির করবে–
কাকাবাবু এতক্ষণ হাসছিলেন। এবার বললেন–সব ভুল দীপুবাবু, অঘোরদাদু তোমাকে ভুল শিখিয়েছে–টাকা থাকলেই সব কিছু কেনা যায় না সংসারে, যখন বড় হবে তখন বুঝবে টাকাটাই সব নয়–
-তবে যে অঘোরদাদু বললে? অঘোরদাদুও তো অনেক বড়—
কাকাবাবু বললেন–বুড়ো হলেই কি সবাই বড় হয়? অনেকে বুড়ো বয়েসেও ছেলেমানুষ থাকে যে! তোমার অঘোরদাদুও হয়তো সেইরকম, চাকরিতে ঢোকবার আগে আমারও সেই ধারণা ছিল জানো–এই ভুবনবাবুরই কথা ধরো না, লক্ষ্মীর বাবা ভুবনবাবু আমায় বলেছিলেন, বর্মার রাস্তায় টো টো করে একদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন, পকেটে একটা পয়সা নেই, জানাশোনা লোক নেই একটা, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন ভাগ্য। ফেরাবার চেষ্টায়–
পরে দীপঙ্কর শুনেছে সে কাহিনী।
সতীই একদিন বলেছিল। হাওড়া জেলার কোন এক অজ গাঁয়ের একটি ছোট ছেলে। নাম ভুবনেশ্বর মিত্র। বাপ-মায়ের একমাত্র ছেলে। টাকার অভাবে লেখা-পড়া হয় না। সারাদিন এর বাগানে ওর পুকুরে দিন কাটায়। তারপর কী খেয়াল হলো, একদিন বাড়ি ছেড়ে পালালো। পালালে যে কোথায় তা কেউ জানে না। হাতে একটা পয়সা নেই! কড়ি নেই! খিদিরপুরে তখন ডক তৈরি হচ্ছে। জাহাজ আর স্টিমারের ভিড় লেগে থাকতো ডকে। সেইখানে বুঝি কোন্ খালাসীর সঙ্গে ভাব করে একেবারে সোজা চলে গিয়েছিল বর্মামুলুকে। মানে মগের মুলুকে।
কাকাবাবু বললেন–আমি যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকলুম নতুন জায়গা, জীবনে কখনও বর্মায় যাইনি, একটা বাঙালীর মুখ দেখতে পাই না, হঠাৎ আলাপ হলো ভুবনেশ্বরবাবুর সঙ্গে,দেখি শহর থেকে সাত মাইল দূরে একটা জঙ্গলের ভেতরে কাঠের গুদাম, বড় বড় করাত-কল, হরদম কাজ হচ্ছে-বর্মি কুলিরা দিন রাত কাজ করছে-ভাবলাম কোনও সাহেব কোম্পানী হবে, সাহেব না হোক পাঞ্জাবী কি মাদ্রাজী টাদ্রাজী হবে–কিন্তু সাইনবোর্ডটা পড়ে অবাক। দেখি মোটা মোটা অরে লেখা রয়েছে–প্রোপ্রাইটার বি মিত্র।
-বাঙালী, এই এতদূরে—
তখন ভুবনেশ্বরবাবুর সঙ্গে পরিচয় নেই। বাঙালী দেখেই আলাপ করবার ইচ্ছে হলো।
আমাকে দেখে তিনিও অবাক। আর তাকে দেখে আমিও অবাক।
ভুবনেশ্বরবাবু বললেন–বিয়ে করে ফেলুন মশাই-এতদূরে দেশ ছেড়ে এসেছেন, বউ নিয়ে আসতে হয়!
আমি বললাম–পনেরো টাকা মাইনে, পাঁচ টাকা ওভারসীজ অ্যালাওএন্স-এই টাকায় সংসার চালাবো কী করে–
ভুবনেশ্বরবাবু বললেন–ওর সঙ্গে ঘুষের টাকাটা জুড়ে দিন, দেখবেন তোফা চলে যাবে–
-তারপর তোমার এই কাকীমাকে নিয়ে গেলুম।
লক্ষ্মী বললে–আমি তখন হয়েছি কাকাবাবু?
কাকাবাবু বললেন–তখন তুমি এই এক-ফুটুকে মেয়ে, আমি তেমায় কোলে নিয়ে বেড়াই–
-আর সতী?
-সতী তখন কোথায়, সতী তো এই সেদিন হলো। বর্ষাকাল, ঝমঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে, আমি আপিসের কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরেছি তখন প্রায় রাত এগারোটা, একটা এনকোয়ারি সারতে সারতেই অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, আলো নিভিয়ে সবে শুয়েছি এমন সময় টেলিফোন। ভাবলাম এত রাত্তিরে আবার কে টেলিফোন করছে। টেলিফোনে কান দিয়েই বুঝতে পারলাম ভুবনেশ্বরবাবু–
বললাম–কী ব্যাপার, হঠাৎ কী হলো দাদা?
ওপাশ থেকে ভুবনেশ্বরবাবু বললেন–তোমাকে খবরটা জানানো ভালো, একটি মেয়ে হয়েছে আমার।
আমি তো লাফিয়ে উঠলুম। বললাম–কখন?
-এই এখন!
বললাম–তা হলে সন্দেশ খাওয়ান দাদা–একেবারে একটা নয় দুটো মেয়ে। ওর নাম সতী রাখুন, বড়র নাম লক্ষ্মী আর ছোটটার নাম সতী থাক, দুজনে মিলে সতীলক্ষ্মী হয়ে থাক্–
কাকীমার দিকে চেয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–হ্যাঁ গো, তোমার মনে আছে সে-সব কথা?
কাকীমা বললেন–মনে নেই আবার? তুমি সেই রাত্তিরে আবার গেলে–
কাকাবাবু বললেন–তা যে-কথা বলছিলাম, চাকরির আগে পর্যন্ত ধারণা ছিল টাকা দিয়ে বুঝি সবই কেনা যায়, কিন্তু সে-ধারণা বদলালো ভুবনেশ্বরবাবুর কাছে গিয়ে তখন সবে তোমার কাকীমাকে নিয়ে গিয়েছি, হঠাৎ প্লেগ হলো আমার, সে কী দারুণ। রোগ, বাড়ির চাকর-বাকর সব পালালো। একটা লোক নেই যে সেবা করে, তোমার কাকীমাও তখন নতুন, কাউকেই চেনে না, আমি তো অচৈতন্য অজ্ঞান অবস্থায় মরো মরো, ভাবলাম সে-যাত্ৰা বুঝি বিদেশে-বিভুঁইয়েই মারা যাবো–
কিন্তু কোথাকার কে ভুবনেশ্বরবাবু, আমার সাতকুলের কেউ নয়, লক্ষপতি লোক, খবর পেয়েই একেবারে দৌড়ে এসেছেন। আর তারপর কোথায় ডাক্তার কোথায় ওষুধ আমাকে কিছু ভাবতেই হলো না, সেই যে তিনি এলেন আমাদের বাড়িতে, আর যতদিন না আমি সেরে উঠলুম ততদিন রইলেন–সেই লক্ষপতি মানুষ নিজের কারবার ফেলে রেখে আমার রোগ নিয়ে পড়লেন! এ কে করে? আমার রোগ সারিয়ে কীসের স্বার্থ তার? কী সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে! আমি তার কে যে আমার জন্যে অত করতে যাবেন? নিজের টাকা সময় লোকজন সব দিয়ে আমাকে যে সারিয়ে তুললেন–এ কেন করলেন?
তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললেন–তাহলেই বোঝ। টাকা দিয়ে অনেক কিছুই হয় সংসারে কিন্তু ভুবনেশ্বরবাবুর সেই সেবা-যত্ন কি টাকা দিয়ে যাচাই করার জিনিস?
লক্ষ্মীদিও কিছু কথা বললো না, কাকীমাও কিছু বললেন না। দীপঙ্করও চুপ করে রইল–
কাকাবাবু বলতে লাগলেন–তা যেমন বাপ, তেমনি মেয়ে–আমি বলেছিলুম ভুবনেশ্বরবাবুকে, হলোই বা মেয়ে, লেখাপড়া শেখালে এই মেয়েরাও আপনার ছেলের চেয়ে বেশি দেখবেন–ভুবনেশ্বরবাবু লিখেছেন, জানো মা, তোমার রেজাল্ট শুনে খুব খুশী, লিখেছেন সতাঁকেও এখানে পাঠিয়ে দেবেন–সেখানে থাকলে লেখা-পড়া ভালো হবে না–
-তা হ্যাঁ, ভালো কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ঠাকুরকে বলে দিও তো, কাল আমি ভোর বেলা বেরোব–
কাকীমা বললেন–কালকে ভোর বেলা কেন?
-চাকরির ব্যাপার, জ্বালিয়ে খাচ্ছে একেবারে, এই দেখ না ছিলাম বর্মায়, বেশ আরামে ছিলাম, সস্তা-গণ্ডার দেশ, হঠাৎ অর্ডার হলো বদলির, আর এতদিনকার জায়গা ছেড়ে চলে আসতে হলো, হুকুম তামিল করার নামই তো চাকরি, তা না হলে আর দাসত্ব কাকে বলে! আবার হয়তো একদিন পাটনায় বদলি করে দেবে, হুকুম হলেই হলো–
দীপঙ্কর উঠে দাঁড়াল।
কাকাবাবু উঠলেন। বললেন–যা বললুম মনে থাকবে তো তোমার দীপুবাবু, লক্ষ্মণ যদি আর কখনও তোমায় মারে, তুমি সহ্য করবে না, তুমিও মারবে, মারের প্রতিকার হচ্ছে মার, এ-সংসারে কান্নার দাম কেউ দেয় না, অভিমানেরও দাম কেউ দেয় না সংসারে–
-কিন্তু ওর গায়ে যে বেশি জোর!
কাকাবাবু বললেন–তাহলে তুমি আমাকে এসে বলে দেবে–
লক্ষ্মী বললে–আর হয়তো মারতে সাহস করবে না কাকাবাবু, আমি খুব মেরেছি ছেলেটাকে–
কাকাবাবু বললেন–বেশ করেছ-এ সংসারে মারই হচ্ছে মারের প্রতিকারও গান্ধী যাই-ই বলুক–
দীপঙ্কর আর বেশিক্ষণ থাকেনি সেদিন। মা হয়তো ভাবছে কোথায় গেল খোকা! কিন্তু কাকাবাবুর কথা শুনে সেদিন যেন সমস্ত গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তাহলে কার কথা ঠিক? অঘোরদাদু না কাকাবাবু! না প্রাণমথবাবুর কথা! না সেই কিরণের কাছে শোনা সোনার কার্তিকের ঘাটের হিমালয়ের সাধুর কথা! কে বেশি সত্যি! একবার মনে হলো কাকাবাবুর কথাই সত্যি। সেদিন টাকা থাকা সত্ত্বেও তো কাকাবাবু প্লেগে মারা যাচ্ছিলেন–কিন্তু ভুবনেশ্বরবাবু কেন তাকে বাঁচিয়ে তুললেন, কেন কীসের লোভে কাকাবাবুকে সারিয়ে তুললেন! কিন্তু আবার মনে হলো টাকা থাকলে তো এতদিনে কিরণের বাবা ভালো হয়ে যেত। কবে আবার সেরে উঠে ইস্কুলে অঙ্কের মাস্টারি করতে পারতো। কিন্তু কাকাবাবুরও তো বয়েস হয়েছে, কাকাবাবুও তো অনেক দেখেছে! তবে কাকাবাবুর দেখা কি ভুল দেখা!
রোজ দেখতো কাকাবুবু কোটপ্যান্ট পরে অফিসে চলে যায়। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন দিয়ে বেরিয়ে সোজা গিয়ে পড়ে একেবারে কুণ্ডুপুকুরের কাছে। সেখান থেকে বাস-ট্রাম ধরে অফিসে চলে যায়। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অনেক লোকই অফিসে যায়–কিন্তু কাকাবাবুর অফিস যাওয়া যেন অন্যরকম। কোন সময়ের ঠিক নেই। এক-একদিন ভোের বেলা বেরিয়ে যায় আর ফেরে সেই অনেক রাত্রে। তখন এ-বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যাওড়াতলার দিক থেকে ‘হরিবোলে’র শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে কানে আসে-আর উঠোনে হাজি কাশিমের বাগানের ওধারে কোত্থেকে যেন শেয়াল ডেকে ওঠে দল বেঁধে। তখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কালীঘাটে, মন্দিরে, পাথরপটিতে, নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটে আর কেউ জেগে থাকে না। অঘোরদাদুও বোধহয় তখন ঘড়া-ঘটি-গাড়র একপাশে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে অচেতন হয়ে যায়। কিন্তু ওদের বাড়িতে—ওই লক্ষ্মীদিদের বাড়িতে তখনও এক-একদিন আলো জ্বলে। তখনও চাকর-ঠাকুরের গলা শোনা যায়। তখন হয়তো কাকাবাবু অফিস থেকে ফেরে! কী রকম অফিস! এত রাত পর্যন্ত কাজ হয় এ-কেমন অফিস! কাকাবাবু কোন্ অফিসে কাজ করে? কী কাজ?
কিন্তু আশ্চর্য, ওরা আসবার পর থেকেই চন্নুনী যেন কেমন শান্ত হয়ে এসেছে। গলাবাজি করে বটে কিন্তু তেমন তেজালো গলাবাজি নয়। ওদের বাড়িতে গিয়ে খুব ভাব করে নিয়েছে বোধহয়। সেদিন দুপুর বেলা গামছা ঢাকা দিয়ে এক কাসি ভাত নিয়ে আসছিল–
উঠোনে এসেই হঠাৎ আরম্ভ হলো–আ মোলো যা, মুখে আগুন তোদের, অবেলায় পেটে দুটো দেব, তা-ও তোদের সয় না লো–
দীপঙ্কর দেখতে পেয়ে বললে–কাকে গালাগালি দিচ্ছ চন্নুনী–?
-এই দেখ না বাছা, নোলা দেখ বেটীদের, গতরখাকীরা গন্ধে গন্ধে উঠে এসেছে–
দীপঙ্কর দেখলে চন্নুনীর পোষা বেড়াল দুটো পায়ে পায়ে মুখ উঁচু করে চলেছে।
দীপঙ্কর বললে–তুমি ওদের গালাগালি দাও না কেন চন্নুনী? ওই নতুন ভাড়াটেদের? ওদের খুব গতরখাকী বলে গালাগালি দিতে পারো না? ওদের বাড়ির মেয়েটা আমায় খুব মারে–
চন্নুনী বলেছিল–আহা, মা-হারা মেয়ে বাপকে ছেড়ে বিদেশে রয়েছে–গালাগালি দেব কোন্ আক্কেলে বাছা? ওদের গালাগালি দিলে আমার ধম্মে সইবে ভেবেছ?
চন্নুনীর কাসিতে গামছায় ঢাকা তখন সরু-চালের ভাত, দু’খানা মাছের দাগা, ডাল তরকারি। চন্নুনী যেন আর সে-চন্নুনী নয়। ওরা যেন চন্নুনীকে কড়ি দিয়ে কিনে নিয়েছে। চন্নুনী যেন ওদের কেনা বাদী হয়ে গেছে। অঘোরদাদুর কথাটা সত্যি! অঘোরদাদুই ঠিক কথা বলেছে! টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। টাকা দিয়ে লক্ষ্মণকেও কেনা যায়। দীপঙ্করের টাকা হলে লক্ষ্মণও আর মারবে না তাকে।
ওপর থেকে নেমে খিড়কির দরজাটার কাছে আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকলে–
-এই, শোন—
চাপা-গলার ডাক। দীপঙ্কর পেছনে চেয়ে দেখে অবাক হয়ে গেল।
লক্ষ্মীদি! জায়গাটা অন্ধকার। আমড়া গাছের তলায় ঠিক খিড়কির দরজাটার গায়ে একেবারে দীপঙ্করের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্মীদি।
লক্ষ্মীদি আরো কাছে সরে এল। একেবারে মুখোমুখি।
বললে–লক্ষ্মী ভাই দীপু, একটা কাজ করবি আমার—
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেছে। এত আদর করে কথা বলছে লক্ষ্মীদি তার সঙ্গে! বললে–কী কাজ?
-এই চিঠিটা একজনকে দিতে পারবি?
লক্ষ্মীদির হাতে একটা খামে মোড়া চিঠি।
দীপঙ্কর বললে–কাকে?
-তুই ঠিক দিবি বল?
-ঠিক দেব, তুমি দিয়ে দেখ–
-কাউকে বলবি না তো?
লক্ষ্মীদি এমন করে কোনও দিন তার সঙ্গে কথা বলেনি। লক্ষ্মীদি যেন ঘেমে উঠেছে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে।
-না, কাউকে বলবো না, তুমি দাও চিঠিটা, দিয়ে দেখ দিই কিনা—
-তাহলে একটা কাজ কর—
বলে লক্ষ্মীদি চিঠিটা তার জামার পকেটে ঢুকিয়ে দিলে।
বললে–কেউ দেখবে না তো? তোর মা দেখতে পাবে না তো?
দীপঙ্কর বললে–আমি লুকিয়ে রাখবো, তোমায় কথা দিচ্ছি কাউকে দেখাব না– কাকে দিতে হবে বলো?
লক্ষ্মীদি গলা নিচু করে বলে–কুণ্ডুপুকুরের ধারে ঠিক মন্দিরের পশ্চিমে যে দরজাটা আছে ওইখানে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে থাকবে–তার হাতে দিবি–
-কিন্তু কী রকম চেহারা?
-দেখবি সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, পায়ে সাদা শু–আর হলুদে কোট, কোটের বাট হোলে একটা গোলাপ ফুল–ঠিক চিনতে পারবি তো?
-কটার সময়?
লক্ষ্মীদি বললে–কাল ঠিক ভোর সাতটার সময়–
দীপঙ্কর বললে–ঠিক আছে, ওই সময়ে তো রোজ আমি ফুল দিতে যাই মন্দিরে, তুমি কিছু ভেবো না, আমি দিয়ে দেবোকিছু বলতে হবে?
লক্ষ্মীদি বললে—না—
কথাটা শুনে চলেই আসছিল। কিন্তু হঠাৎ লক্ষ্মীদি ডাকলে।
বললে–শোন্ এদিকে—
দীপঙ্কর কাছে যেতেই
লক্ষ্মীদি বললে–এই নে, এইগুলো তুই খাস–
অন্ধকারের মধ্যেও দীপঙ্কর দেখতে পেলে একমুঠো চকোলেট। চকোলেটগুলো লক্ষ্মীদি তার হাতে গুঁজে দিলে। খুঁজে দিয়ে লক্ষ্মীদি আবার চলে গেল। দীপঙ্কর খিড়কির দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল। তারপর হাতের মুঠোটা আবার খুলে দেখলে। অনেকগুলো চকোলেট। মনোহারী দোকানে যেমন চকোলেট কাঁচের জারের মধ্যে থাকে সে-রকম নয়। তার চেয়েও ভালো। রাস্তা মোড়া চৌকো চৌকো চকোলেট। একটা মুখে পুরে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু হঠাৎ যেন কী মনে হলো! থাক, পরে খাব!
.
তখনও ভালো করে ভোর হয়নি। মা তার আগেই ডেকে দিয়েছে। দীপঙ্কর মুখে চোখে জল দিয়েই জামাটা গায়ে দিয়ে নিলে। তারপর পকেটে লক্ষ্মীদির চিঠিটা পুরে নিলে। হাজি কাশিমের বাড়ির পাশের বাগানে ফুল তুলতে হবে। বাগানের একটা দিকের পাঁচিল ভাঙা, সেইখান দিয়ে ঢুকে ভেতরে অনেক গাছ। গন্ধরাজ, স্থলপদ্ম, জবা কত রকম ফুল। ফুলের সাজিটা এক-একদিন ফুলে-ফুলে ভরে যায়। সেই ফুল নিয়ে দিয়ে আসতে হবে সবগুলো মন্দিরে। প্রথমে মা’র মন্দির, তারপরে মধুসূদনের মন্দির। তারপর সত্যনারায়ণ, গণেশ, জগন্নাথ, ষষ্ঠী, তারপর সকলের শেষে নকুলেশ্বর আর সোনার কার্তিক। সব মন্দিরেই কিছু কিছু ফুল দিয়ে আসতে হবে। সব পূজারীরাই চেনে দীপঙ্করকে। গেলেই সবাই হাত বাড়ায়। বলেদাও খোকা দাও–এদিকে দাও–
ফুল দিয়ে একটা করে নমস্কার করবে দীপঙ্কর।
মা শিখিয়ে দিয়েছিল। বলবে-ঠাকুর আমার যেন লেখা-পড়া হয়, আমার যেন ভালো হয়, আমার যেন মঙ্গল হয়–
বহুদিন পরে যখন দীপঙ্কর রেলের ডি-টি-আই হয়েছিল তখন গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং-এর গেটম্যান ভূষণ তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সেই কথাই বলেছিল–হুজুর, আপনি আমার মা-বাপ হুজুর, আপনার মঙ্গল হবে হুজুর, ভগবান আপনাকে অনেক দেবে হুজুর।
সেদিন হাসিই পেয়েছিল দীপঙ্করের। অনেকেই তো অনেক কিছু মঙ্গলকামনা করেছে তার। লাইন-ময় লোক তার শুভকামনাই করেছিল। এক ডাকে সবাই তাকে সেন-সাহেব বলে চিনেছিল। সেই বালিগঞ্জ স্টেশনের মজুমদারবাবু। সাউথ কেবিনের করালীবাবু। তারপর কে নয়! অফিসের চাপরাশী দ্বিজপদ পর্যন্ত তাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো, শ্রদ্ধা করতো। দ্বিজপদ দেশ থেকে কোনও ভালো জিনিস আনলে আগে সেন-সাহেবকে দিয়ে তবে খেত। কী হলো তাতে! কী লাভ হলো তাতে তার! আর সেই চকোলেটগুলো! যে-চকোলেটগুলো লক্ষ্মীদি তার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। সেও তো এক-রকমের ঘুষ। ঘুষ দিয়েই লক্ষ্মীদি কিনতে চেয়েছিল দীপঙ্করকে। কড়ি দিয়েই দীপঙ্করের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা-ও কি চাপা ছিল! ও কি চাপা থাকার জিনিস!
-এই–
হঠাৎ পেছন ফিরে দীপঙ্কর অবাক হয়ে গিয়েছিল। সেই অত ভোরেও লক্ষ্মীদি ঘুম থেকে উঠে খিড়কির দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল।
চাপা গলায় বললে–চিঠিটা নিয়েছিস ঠিক? ভুলিসনি?
দীপঙ্কর বললেন, এই দেখ না, পকেটে রয়েছে আমার–
–থাক দেখাতে হবে না। তোর মাকে দেখাসনি তো?
-না—
-ঠিক বলছিস্?
দীপঙ্কর বললে–আমি মিথ্যে বলি না, চোদ্দ বছর মিথ্যে কথা বলবোও না–
লক্ষ্মীদি আবার বললে–তা চেহারাটা মনে আছে তো? সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, সাদা শু, আর হলদে কোট, কোটের বাটন হোলে একটা গোলাপ ফুল–
-মনে আছে–
বলে দীপঙ্কর ফুলের সাজিটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।