১৫
অনেক দিনের অনেক ঘটনা অনেক রকমভাবে দীপঙ্করের ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে, কখনও বা নুতন করে বাঁচিয়ে তুলেছে। যখন হতাশায় অসাড় হয়ে এসেছে দীপঙ্কর, তখন কোথা থেকে যেন কে এসে হঠাৎ সাহস যুগিয়েছে তাকে। কে এসে যেন তার প্রাণে বল যুগিয়েছে। সেসব দিনের প্রতিটি কথা দীপঙ্করের মনে আছে। প্রতিটি ঘটনা দীপঙ্করের মনে গাঁথা আছে। আর সেই কিরণ! কিরণের কথাই ধরা যাক্। কিরণের সঙ্গে কোথায় যেন তার আকাশ পাতাল তফাৎ ছিল। কিরণের কোনও হতাশা ছিল না কোথাও। তার মতো আশাবাদী যদি হতে পারতো দীপঙ্কর! অনেক পাওয়ার আনন্দে দীপঙ্কর যখন অধীর হয়ে উঠেছে, কিরণকে তখন দেখা যেত হতাশার চরম শিখরে দাঁড়িয়েও ও যেন উল্লাসে উন্মাদ হয়ে আছে। তবু অত তফাতের মধ্যেও কোথায় যেন দুজনের মধ্যে ভারি মিল ছিল। একদিন কিরণকে না দেখতে পেলে দীপঙ্করের মনটা যেন কেমন করতো!
এক-এক সময়ে মনে হতো কিরণ যেন তার কাছে সকলের চেয়ে আপন, সকলের চেয়ে প্রিয়। কিরণের জন্যে যেন তার মাকেও সে ছাড়তে পারে। কিরণের জন্যে যেন লক্ষ্মীদিকেও ছাড়তে পারে, কিরণের জন্যে যেন সতীকেও ছাড়তে পারে। কিরণের জন্যে কাকীমা, কাকাবাবু, অঘোরদাদু–সব, সব কিছুকেই যেন ছাড়তে পারে দীপঙ্কর। অথচ কোথায় গেল সেই কিরণ! অথচ কোথায় যে কেমন করে হারিয়ে গেল কিরণ!
কাকাবাবু যেদিন বলেছিলেন সেই কিরণকেই ছাড়তে, কাকাবাবু যেদিন সেই কিরণের সঙ্গেই মিশতে বারণ করেছিলেন, সেদিনকার কষ্ট দীপঙ্কর কাউকে বোঝাতে পারবে না। কেউই বুঝবে না তার সেদিনকার কষ্টের কথাটা।
মা বলতো–কী হলো রে, তোর, শরীর খারাপ?
দীপঙ্কর কিছু বলতো না। মনে হতো কিরণের সঙ্গে মিশতে না পারলে তার যেন বেঁচে থাকাই বৃথা। কলেজ থেকে বেরোবার সময় গেটের সামনে যাবার আগে বুকটা ভয়ে দুর-দুর করতো। যদি কিরণের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! যদি তার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে গেটের সামনে! তখন কী বলে তাকে এড়াবে? কী বলে তাকে মিশতে বারণ করবে?
অনেকদিন গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যেন দীপঙ্করের পা-জোড়া আর চলতে চাইত না। একে একে সব ক্লাসের ছেলেরা চলে যেত বাড়ির দিকে। কলেজের সামনের বাগানের রাস্তা দিয়ে সার সার ছেলের দল আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে যেত। সামনেই ট্রাম-রাস্তা। সামনেই বাসগুলো চলছে হু-হুঁ করে। ওপারে হাজরা পার্কের সবুজ ঘাসগুলোর ওপর গিয়ে বসততা কেউ কেউ। সমস্ত পৃথিবীটা যেন ঘুরতো দীপঙ্করের চোখের সামনে, মনে হতো সবাই আছে, শুধু যেন কিরণই নেই। সব যেমন ছিল, তেমনিই চলছে, শুধু কিরণই যেন নেই। তারপর আস্তে আস্তে চারদিকে অন্ধকার করে আসতো। এক একে গ্যাসের বাতিগুলো জ্বলে উঠতো রাস্তায়। ট্রামের ভেতরে, বাসের মাথায় আলো জ্বলে উঠতো। তখনও এক-একদিন দীপঙ্কর ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতো। যদি কিরণ আসে! যদি কিরণ এসে ফিরে যায়! যদি এসে দীপঙ্করকে না দেখতে পায়!
হঠাৎ মনে হলো যেন কিরণ আসছে। খালি পা, ছেঁড়া ময়লা শার্ট, মাথার চুলগুলোর এলোমেলো হয়ে গেছে। হন হন করে তার দিকে আসছে।
দীপঙ্করের বুকটা দুর-দুর করে উঠলো। কেমন করে কথাটা পাড়বে দীপঙ্কর তাই ভাবতে লাগলো। কাকাবাবু মিশতে বারণ করেছেন কিরণের সঙ্গে। সে কথাটা কেমন করে বলা যায় মুখ ফুটে! দীপঙ্করের জীবনের পথ আলাদা, আর কিরণের আলাদা রাস্তা। কিরণ লাইব্রেরী করুক, কিরণ দেশ স্বাধীন করুক, কিরণ ভজুদার সঙ্গে মিশুক। কিন্তু দীপঙ্করকে বড় হতে হবে। দীপঙ্করের বড় হওয়া মানে চড় চাকরি করা, সংসার করা, মাকে শান্তি দেওয়া, বিশ্রাম দেওয়া। তাকে মানুষ হতে হবে। আর দশজন যেমন স্বাধীন হয়ে বাঁচে, তেমনি স্বাধীন হতে হবে। আপিসে যাবে, চাকরি করবে, মাইনে পাবে, মাইনে এনে মা’র হাতে টাকাগুলো দেবে। তার চেয়ে বড় সুখ আর কী আছে পৃথিবীতে! সত্যিই তো, কাকাবাবু অন্যায় কিছু বলেন নি। কাকাবাবু তো তাকে ভালো পরামর্শই দিয়েছেন। কাকাবাবু, কাকীমা, লক্ষ্মীদি, সতী সবাই তো তার ভালোই চায়। তার ভালোর জন্যেই তো সবাই তাকে কিরণের সঙ্গে মিশতে বারণ করে। কিরণের সঙ্গে মিশে তার কী লাভ হবে! কিরণ কি তার আদর্শ!
কিরণ কাছাকাছি আসতেই দীপঙ্কর গেটের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।
অন্ধকার হয়ে এসেছে বেশ। কিরণ যেন তাকে দেখতে না পায়। কিরণ তাকে দেখতে না পেলেই চলে যাবে! তারপর? তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ি চলে যাবে দীপঙ্কর। বাড়ি গিয়ে পড়তে বসবে। একবার বাড়িতে গিয়ে ঢুকতে পারলে কিরণ আর দীপঙ্করকে ডাকতে সাহস করবে না। কিরণ জানে, কেউ তাকে পছন্দ করে না। কেউ তাকে চায় না। দীপঙ্করের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে লাগলো। মনে হলো একবার ডাকে–কিরণ–
কিন্তু নিজেকে হঠাৎ সামলে নিলে দীপঙ্কর।
দীপঙ্কর দেখলে কিরণ সেই অন্ধকারের মধ্যেই এসে কলেজের গেটের সামনে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখলে একবার তারপর সেইখানে দাঁড়িয়েই চারিদিকে চেয়ে চেয়ে যেন কী ভাবতে লাগলো। যেন মুখখানা শুকিয়ে গিয়েছে তার। হয়তো আজকেও তার খাওয়া হয়নি। আজকেও হয়তো ডাব খেয়ে কাটিয়েছে। শার্টের বুকপকেটের ভেতরে রসিদ বইটা থাকাতে একটু ফুলে উঠেছে পকেটটা। এদিক-ওদিক দেখে কিরণ আবার ফিরলো। হয়তো দীপঙ্করকে না দেখতে পেয়ে ফিরে গেল। হয়তো হাজরার মোড়ে দাঁড়িয়ে আবার পৈতে বেচবে। কিংবা ‘কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী’র চাঁদা আদায় করতে শুরু করবে।
দীপঙ্কর বেরিয়ে এসে ফুটপাথের ওপর দাঁড়াল আবার। একবার ভাবলে ডাকবে কিনা। ডাকলে কী দোষ হবে? ডাকলে তার এমন কিছু সর্বনাশ হবার কথা নয় ৷
দীপঙ্কর সেইখানে দাঁড়িয়েই ডাকলে–কিরণ–
কিরণ শুনতে পেলে না। যেমন যাচ্ছিল–তেমনিই চলতে লাগলো।
দীপঙ্কর আবার ডাকলে–কিরণ–
কিরণ সেবারও শুনতে পেলে না। একবার মনে হলো দরকার নেই ডেকে। না শুনতে পেয়েছে ভালোই হয়েছে। ক’দিন দেখতে না পেলেই ভুলে যাবে। কী হবে ডেকে! যখন মিশবে না দীপঙ্কর তখন কেন আবার তার সঙ্গে যেচে ঘনিষ্ঠতা করা! সত্যিই তো কিরণের পথ আরো দুরূহ, কিরণের জীবন আরো কষ্টের, কিরণের মতো কষ্ট সহ্য করতে পারবে না দীপঙ্কর। কিরণের মতোন ডাব খেয়ে দিনের পর দিন কাটাতে পারবে না।
কিন্তু হঠাৎ সমস্ত বুকটা যেন ব্যথায় টন্ টন্ করে উঠলো। কিরণ না হলে কার সঙ্গে সে মিশবে? কিরণ না হলে কার সঙ্গে সে প্রাণের কথা বলবে?
–কিরণ, কিরণ!
কিরণ তখন অনেক দূরে চলে গেছে। ফুটপাথের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে কিরণ যেন হারিয়ে যায়-যায়।
দীপঙ্কর প্রাণভয়ে ডাকলে–কিরণ, কিরণ–
শেষে দৌড়তে লাগলো দীপঙ্কর। ফুটপাথের লোকের গায়ে ধাক্কা লাগবার অবস্থা। হাত থেকে সিভিক্সের বইটা পড়ে গেল রাস্তায়। চটিটা পা-ফসকে ছিটকে চলে গেল ওপাশে–
দীপঙ্কর আর একবার জোরে ডাকলে–কিরণ, কিরণ রে–
রাস্তার লোকজন তার দিকে চেয়ে দেখলে অবাক হয়ে। হাতে বই, সাবান কাঁচা শার্ট গায়ে একটা ছেলে কাকে লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে। কেউ কেউ সরে গিয়ে পথ করে দিলে।
–ও ভাই, তোমার পেনসিল পড়ে গেল যে পকেট থেকে–
তাড়াতাড়ি পেন্সিলটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার দৌড়তে লাগলো দীপঙ্কর। তোর সঙ্গে মিশতে বারণ করেছে বলেই আমি কথা বলিনি কিরণ। আমি গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলুম, ভাই। তুই আমাকে খুঁজছিলি আমি দেখতে পেয়েছি। তোর সঙ্গে আমি মিশবো কিরণ, তোকে আমি ভালোবাসি ভাই। আমি আর কারোর কথা শুনবো না। মা’র কথা ও শুনবো না, কাকাবাবুর কথাও শুনবো না। সতী, লক্ষ্মীদি–কারো কথাই শুনবো না। তুই আমার প্রাণের বন্ধু কিরণ।
দীপঙ্কর একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লো কিরণের গায়ের ওপর।
দীপঙ্কর কিরণের কাঁধে হাত দিয়ে বললে–তুই আমায় খুঁজছিলিস, কিরণ?
কিরণ মুখ ফেরাল। আর সঙ্গে সঙ্গে মুখখানা দেখে চমকে উঠলো দীপঙ্কর। দীপঙ্কর হাতটা সরিয়ে নিলে কাঁধ থেকে। বললে, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি ভেবেছিলাম…
ছেলেটা ভালো করে দেখলে দীপঙ্করের দিকে। বললে—না–
বলে যেমন চলছিল তেমনিই চলতে লাগলো। দীপঙ্কর নিজেই নিজের ব্যবহারে যেন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এতখানি উত্তেজিত হওয়া তার উচিত হয়নি সত্যি। কিরণ হয়তো তার কথা ভাবছেই না। কিরণ হয়তো অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত আছে। সত্যিই তার অনেক কাজ। অনেক কাজ সে করে বেড়ায়। অনেক ভাবনা আছে তার। তার বাবার অসুখ, তার অবস্থা, তার ভজুদা, তার লাইব্রেরী–কত কাজ তার। কত তার কাজ! দু’দিন দেখা না হলে কী হয়! সে হয়তো জানতেও পারছে না দীপঙ্করের কষ্টের কথা। কিরণকে দেখতে না পেলে দীপঙ্করের যে কত কষ্ট হয়, তা সে ভাবতেও পারছে না। আশ্চর্য!
হাজরা রোডের মোড়ের কাছটাতেই ভিড় বেশি। দোকানে আলো জ্বেলে দিয়েছে। দীপঙ্কর সেই মোড়ের মাথাতেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। অনেক ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন যেন ভালো লাগে। সমস্ত অচেনা লোক। অচেনা লোকের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে দীপঙ্করের খুব ভালো লাগে। কেউ তাকে দেখছে না, কেউ তাকে লক্ষ্যও করছে না। ছি ছি, ছেলেটা কী ভাবলে! ও-ও যেন কিরণের মতো। কিরণের মতই যেন উপোস করে কাটায়। অন্তত চেহারা দেখে তা-ই মনে হয়।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর ভাবতে লাগলো এখন কোথায় যাবে সে। এখন বাড়ি যাওয়াই ভালো। বাড়ি গিয়ে পড়তে বসাই উচিত। পড়তে বসলে সব ভুলে যায়। পড়বার সময় আর কিছু মনে পড়ে না। কিরণের কথাও মনে পড়ে না, লক্ষ্মীদির কথাও মনে পড়ে না। কাকাবাবুদের বাড়ির কথাও মনে পড়ে না।
হঠাৎ মনে হলো যেন ও-ফুটপাথে তাদের কলেজের প্রফেসার চলেছেন। অমলবাবু। হিস্ট্রি পড়ান। অমলবাবুর চেহারাটা দূর থেকে দেখলেও চেনা যায়। সাদা পাঞ্জাবির ওপর একটা চাদর গায়ে। মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। ও-ফুটপাথ দিয়ে হন্ হন্ করে চলেছেন। একহাতে মোটা মোটা বই কয়েকখানা।
রাস্তাটা পার হয়ে সোজা ও-দিকের ফুটপাথে একেবারে মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল।
–স্যার!
অমলবাবু থমকে দাঁড়লেন! দীপঙ্কর হঠাৎ পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকাল।
–কে তুমি?
চশমার কাঁচ দিয়ে বেশ স্নেহাতুর দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন তার দিকে।
দীপঙ্কর বললে–একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল স্যার…
–কী কথা বলো!
দীপঙ্কর বললে–স্যার, সেদিন আপনি সক্রেটিসের কথা পড়িয়েছিলেন ক্লাসে…
–হ্যাঁ, সক্রেটিস্–
দীপঙ্কর বললে–আপনি বলেছিলেন, Socretes the wisest of men–আমি সে সম্বন্ধে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপনাকে–কিছু মনে করবেন না স্যার–
–কী কথা?
দীপঙ্কর একটু দ্বিধা করলে। তারপর বললে– স্যার আপনি বলেছিলেন, To a good man, whether alive or dead, no evil can happen, nor are the Gods indifferent to him– কথাটা কি সত্যি?
অমলবাবু কথাটা শুনে কেমন যেন অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। যেন দীপঙ্করকে আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ রাস্তার মধ্যে একজন ছাত্রের মুখে এই প্রশ্ন শুনে তিনি যেন একটু অবাকই হয়ে গেছেন।
জিজ্ঞেস করলেন–তুমি কোন্ ইয়ারে পড়?
দীপঙ্কর বললে–সেকেন্ড ইয়ার স্যার–আমি কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না– আমাদের স্কুলের হেডমাস্টারমশাইও এই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন চোদ্দ বছর যদি সত্যি কথা বলি তো তারপর যা বলবো সব সত্যি হবে–কথাটা ক’দিন থেকে মাথার মধ্যে খুব ঘুরছে–কথাটা কি সত্যি স্যার?
অমলবাবুর অবাক হওয়া যেন তখনও কাটেনি।
বললেন–তোমার নাম কী?
দীপঙ্কর বললে–দীপঙ্কর সেন।
–কোথায় থাকো?
–উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন। কালীঘাট–
–ম্যাট্রিকে কী রেজাল্ট ছিল তোমার?
দীপঙ্কর বললে–আমি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছিলুম। ভালো রেজাল্ট করতে পারিনি, সব বইও ছিল না আমার। অন্য ছেলেদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পড়তে হয়েছে। আমার বাবা নেই–
অমলবাবু যেন আরো আগ্রহী হয়ে উঠলেন। বললেন–তাহলে তোমার পড়াশোনার খরচ কে দেয়?
–প্রাণমথবাবু। তিনিই মাসে মাসে কলেজের মাইনেটা দেন।
অমলবাবু কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর যেন আস্তে আস্তে চলতে লাগলেন। দীপঙ্কর কী করবে বুঝতে পারলে না। অমলবাবুর সঙ্গে সে-ও পেছন পেছন চলতে লাগলো।
একসময়ে অমলবাবু বললেন–কী নাম বললে তোমার?
–দীপঙ্কর সেন।
তারপর একটু থেমে
দীপঙ্কর বললে–আপনি হয়তো এখন খুব ব্যস্ত আছেন স্যার, আমি তাহলে আসি–
অমলবাবু বললেন–না, দাঁড়াও, তুমি একবার একটা কাজ কোরো, আমার সঙ্গে লাইব্রেরীতে দেখা কোরো–
–কখন স্যার?
–যখন ইচ্ছে–বলে অমলবাবু চলে যাচ্ছিলেন।
দীপঙ্করও চলে যাচ্ছিল।
হঠাৎ অমলবাবু আবার ফিরলেন। বললেন–দেখা কোরো ঠিক–বুঝলে?
দীপঙ্কর বললে–যাবো স্যার–
দীপঙ্কর চলতে গিয়ে থেমে গের। পেছন থেকে অমলবাবুর দিকে আবার চেয়ে দেখলে। অদ্ভুত লোক তো! এতদিন ক্লাসে গিয়েছে, কখনও কোনও প্রফেসারের সঙ্গে কথা বলবার সাহসই হয়নি তার। কিন্তু আজ যে কী হলো, কিরণের কথা ভাবতে ভাবতেই কথাটা তার মনে পড়েছিল। সেদিন লক্ষ্মীদির বাড়িতে প্রথম চা খাওয়ার সূত্রেই কথাটা প্রথম মনে পড়ে। কিরণ চা খায় না। অথচ দীপঙ্করই প্রথম চা খেলে সেদিন। কী যে হলো তখন! লক্ষ্মীদিকে কেন সবাই কষ্ট দেয়? যে ভালোমানুষ তার তো কষ্ট পাওয়ার কথা নয়। মা এত ভালো–মাও তো কাউকে কষ্ট দেয়নি, কারোর কোনও ক্ষতি করেনি মা–তবু মা কেন এত কষ্ট পায়? কেন তাকে মানুষ করবার জন্যে এত খোশামোদ করতে হয় লোককে? আর কিরণ! কিরণও তো ভালো। অত ভালো ছেলে কিরণ–সেই কিরণই বা কেন অত কষ্ট পায়! তবে কি সক্রেটিসের কথা মিথ্যে!
সেই অন্ধকার রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই লক্ষ্মীদির কথা আবার মনে পড়লো। কেন যে লক্ষ্মীদি সেদিন অত রেগে গিয়েছিল কে জানে! সে তো কাউকেই বলেনি কিছু দাতারবাবুকে যে চিঠি দিয়ে আসতো, সে-কথাটা তো সতীকে সে একবারও বলেনি। কাউকেই সে বলবে না কোনও দিন। লক্ষ্মীদির প্রাণের কথা সে প্রাণ গেলেও কাউকে বলবে না। সতী হাজার চেষ্টা করলেও তার মুখ দিয়ে লক্ষ্মীদির কথা বার করতে পারবে না।
মনে আছে সেদিন দুজনে তার হাত ধরে টানাটানি করার পর যখন দীপঙ্কর বাড়ি চলে এসেছিল তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর ভাত খেয়ে কলেজে গিয়েছে, ক্লাসে লেকচার শুনেছে, ছুটির পর রাস্তায় ঘুরেছে, তবু কথাটা মোটে ভুলতে পারেনি দীপঙ্কর। সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসেছে নিজের মনে। কিন্তু তবু মনটা যেন নিজের বশে ছিল না। বার বার যেন সকালবেলার কথাটাই মনে পড়ছিল তার। তারপর রাত হয়েছে। মা ভাত বেড়ে দিয়েছে। ভাত খেতে বসেও যেন কথাটা ভুলতে পারছিল না! লক্ষ্মীদি কেন তাকে সতীর সামনে অমন করে বকলো!
মা বললে–কী ভাবছিস্ রে অত? কী হয়েছে রে তোর?
দীপঙ্কর বললে–আমার ক্ষিদে নেই মা আজকে–
–কেন? ক্ষিদে নেই কেন আবার? অন্য দিন যে ক্ষিদের জন্যে এত খাই-খাই করিস? আজকে কী খেয়েছিস তুই? ওই কিরণটা বুঝি ছাইভস্ম বেগুনি-ফুলুরি খাইয়েছে?
দীপঙ্কর বললে–সত্যি বলছি মা, কিছু খাইনি–কিরণের সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি কতদিন–
সত্যি, একদিন দেখা হয়নি, তাইতেই যেন মনে হয়েছে কতদিন দেখা হয়নি কিরণের সঙ্গে! অথচ কাছেই নেপাল ভট্টাচার্যি লেন–একবার গেলেই হয়! কিন্তু কাকাবাবু কথাটা বলার পর থেকেই যেন কেমন দ্বিধা হচ্ছিল। সত্যিই কি কিরণের সঙ্গে মিশলে তার ক্ষতি হবে! কাকাবাবুরও তো বয়েস হয়েছে অনেক। কাকাবাবুরও তো অনেক জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে। কাকাবাবুও তো মস্ত বড় চাকরি করেন। অনেক টাকা মাইনে পান। কাকাবাবুও তো দীপঙ্করের শুভাকাঙ্খী। কাকাবাবুই বা অমন কথা বলতে যাবেন কেন!
খেয়ে উঠে আঁচাতে গিয়ে তখনও ভাবছিল দীপঙ্কর। উঠোনের কোণে আমড়া গাছটার তলায় হাত ধুতে ধুতে হঠাৎ যেন মনে হলো পেছন থেকে কে ডাকলে–দীপু–
চাপা গলার শব্দ।
দীপঙ্কর ফিরে চেয়ে দেখলে লক্ষ্মীদি। খিড়কির দরজাটা অল্প ফাঁক করে লক্ষ্মীদিই তাকে ডাকছে।
দীপঙ্করের বুকটা আনন্দে যেন ঢপ্ ঢপ্ করে উঠলো। এক দৌড়ে কাছে গেল দীপঙ্কর।
বললে–লক্ষ্মীদি তুমি?
–তুই কিছু মনে করিস নি তো, আমি তোকে বকেছিলুম খুব…
দীপঙ্কর বললে–তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল লক্ষ্মীদি–তুমি আমায় অমন করে
বকলে
–তুই কিছু মনে করিস নি–তোকে বকে আমারও খুব কষ্ট হয়েছে–
দীপঙ্করের যেন কান্না পেতে লাগলো কথাগুলো শুনে। বললে–এখন আর আমার কষ্ট হচ্ছে না, কিন্তু তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, তুমি বকলে তার জন্যে কষ্ট হয়নি, কিন্তু তুমি সতীর সামনে কেন বকলে আমায়?
লক্ষ্মীদি বললে–একটু আস্তে কথা বল্, সতী রয়েছে, টের পাবে—
তারপর গলা নিচু করে বললে–সতীকে তুই কিছু বলিস্ নি তো!
দীপঙ্কর বললে–না লক্ষ্মীদি, আমি কিচ্ছু বলিনি–
-–ও তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
দীপঙ্কর বললে–জিজ্ঞেস করবার আগেই তো তুমি এসে পড়লে–
–ভালোই হয়েছে, একটা কাজ করতে পারবি?
দীপঙ্কর বললে–কী কাজ?
লক্ষ্মীদি বললে–একটা জিনিস দিতে হবে শম্ভুকে–
–কী জিনিস?
লক্ষ্মীদি আঁচলের মধ্যে থেকে একটা জিনিস বার করলে। অন্ধকারে ভালো করে দেখা গেল না। দীপঙ্কর আরো ভালো করে দেখবার চেষ্টা করলে। মনে হলো কাগজে মোড়া কী একটা জিনিস!
–এটা কী লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদি বললে–একটা খেলনা, শম্ভুকে দিয়ে আসতে হবে–
খেলনা! দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। দাতারবাবু খেলনা নিয়ে কি করবে!
দীপঙ্কর বললে–কী খেলনা? দেখবো?
কাগজটা খুলতেই একটা পুতুল বেরিয়ে পড়লো। চমৎকার পুতুল একটা। হাত পা মুখ চোখ সব রয়েছে। গোলগাল মোমের পুতুল যেন।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–এ পুতুল কী হবে লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদি রেগে গেল। বললে–পুতুল নিয়ে যা ইচ্ছে সে করুক, তাতে তোর কী! তুই শুধু শম্ভুর হাতে দিয়ে আসবি–পারবি না?
–আর চিঠি?
লক্ষ্মীদি বললে–চিঠির দরকার নেই। তুই শুধু গিয়ে বলবি এটা লক্ষ্মীদি পাঠিয়ে দিয়েছে–বুঝলি? পারবি তো?
হঠাৎ মনে হলো পেছনের রোয়াকে যেন কার পায়ের শব্দ হলো। লক্ষ্মীদি টপ্ করে পুতুলটা নিয়ে নিজের আঁচলে লুকিয়ে ফেলেছে, তারপর সন্ত্রস্ত হয়ে যেন এদিক-ওদিক চাইলে কিছুক্ষণ। শেষে বললে–তুই যা দীপু, আমি নিজেই দিয়ে আসবো’খন
বলে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে সরে গেল। আর দীপঙ্কর অবাক হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। রাত হয়েছে তখন বেশ। অন্ধকার চারিদিকে। আমড়া গাছের তলায় অন্ধকারটা আরো ঘন হয়ে এসেছে। দীপঙ্কর জলের ঘটিটা নিয়ে সেখানেই কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতন দাঁড়িয়ে রইল। মনে হলো কোথায় যেন সব গোলমাল হয়ে গেল এক নিমেষে। সামান্য একটা পুতুল! সেই পুতুলটাই যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠে সব গোলমাল করে দিলে। কার পুতুল, কে পুতুল খেলা করবে–তাও বুঝতে পারলে না দীপঙ্কর। তারপর আস্তে আস্তে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল সেদিন।
পুতুলটা শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল কিনা তাও জানে না দীপঙ্কর।
পরের দিন লক্ষ্মীদি যখন কলেজে যাচ্ছিল, দীপঙ্কর গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সদর দরজার সামনে। মনে হয়েছিল হয়তো তাকে দেখে লক্ষ্মীদি একবার ডাকবে। কিন্তু না, লক্ষ্মীদি জুতো পায়ে দিয়ে গট্ গট্ করে গিয়ে উঠলো গাড়িতে।
দীপঙ্করের মনে হয়েছিল একবার ডাকবে। কিন্তু ডাকতে গিয়েও গলাটা তার আটকে গিয়েছিল। দরকার নেই ডেকে। হঠাৎ সতী দেখে ফেলবে ভেবে আর ডাকা হয়নি, বাসটা হু হু করে ধুলো উড়িয়ে চলে গিয়েছিল সেদিন আর দীপঙ্কর সেইখানেই কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর এক সময়ে বাড়ি চলে এসেছিল।
১৬
অমলবাবু তখন চলে গেছেন। রাস্তাটা পার হবার জন্যে দীপঙ্কর একবার এদিকে একবার ওদিকে দেখে নিলে। অসংখ্য লোকের ভিড়। কোথায় কত কাজে চলেছে সবাই। কারো দিকে কারো চেয়ে দেখবার ফুরসত নেই। শুধু দীপঙ্করেরই কোনও কাজ নেই। শুধু কলেজ আর বাড়ি। আর কোথাও যাবার জায়গা নেই তার। লক্ষ্মীদির বাড়িতেও যাবার উপায় নেই, কিরণদের বাড়িতেও যাওয়া বারণ। তাহলে আর কোথায় যাবে সে? কেউ নেই তার। তার কেউ নেই। দীপঙ্কর সেই সন্ধ্যেয় অন্ধকারে হাজরা রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে একান্ত অসহায়ের মতো ভাবতে লাগলো–কেউ নেই তার। সত্যিই তার কেউ নেই–
হঠাৎ মুখ ফেরাতেই দীপঙ্কর দেখলে–সেই ছেলেটা। সেই যাকে কিরণ বলে ভুল করেছিল দীপঙ্কর। ছেলেটা যেন পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তাকেই লক্ষ্য করছিল। দীপঙ্করের সেই দিকে চোখ পড়তেই ছেলেটা কাছে এল।
বললে–আপনি কিরণকে চেনেন নাকি?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে–আপনি চেনেন?
ছেলেটি বললে–আমি খুব ভালো করে চিনি, কিরণ আমার বন্ধু–
দীপঙ্কর ভালো করে আবার চেয়ে দেখলে ছেলেটির দিকে। কখনও তো দেখেনি তাকে আগে কোথাও!
বললে–কিরণ তো আমারও বন্ধু, ছোটবেলার বন্ধু–
ছেলেটি জিজ্ঞেস করলে-আপনার নাম তো দীপঙ্কর সেন?
–আপনি জানলেন কী করে?
দীপঙ্কর সত্যিই অবাক হয়ে গেছে এবার। তার নাম জানলো কী করে! ছেলেটি বললে–প্রথমটায় আপনাকে আমি চিনতে পারিনি তখন, তারপর হঠাৎ আমার মনে পড়লো। কিরণ আপনার কথা আমাদের কাছে খুব বলে–
একটু থেমে ছেলেটি আবার বললে–কিরণের সঙ্গে আপনার শেষ দেখা হয়েছে কবে?
দীপঙ্কর মনে করতে চেষ্টা করতে লাগলো। খুব বেশি দিন হয়নি। কিন্তু দীপঙ্করের মনে হলো যেন এক যুগ। যেন বহু যুগ ধরে কিরণের সঙ্গে কথা হয়নি। তার বাড়ির সামনে গিয়েও একদিন কিরণের সঙ্গে দেখা করেনি। কিরণের সঙ্গে দেখা করতেই যেন ভয় করছিল তার।
ছেলেটি বললে–কিরণের মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি, শুনে শুনে আপনাকে একেবারে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল
দীপঙ্কর কী বলবো। শুধু হাসলো একটু।
–কিরণ বলেছিল আপনাকে একদিন নিয়ে যাবে আমাদের ওখানে!
— কোথায়?
ছেলেটি বললে–কিরণ আপনাকে ভজুদার কথা বলেনি?
–হ্যাঁ, খুব বলেছে; আমি বলেছিলাম, একদিন কিরণের সঙ্গে যাবো ভজুদার কাছে–
ছেলেটি বললে–এখন তো ভজুদা নেই কলকাতায়, ভজুদা নেপাল গেছে–
নেপাল! কত দূর নেপাল! দীপঙ্কর কল্পনায় যেন ভজুদাকে দেখবার চেষ্টা করলে। কোথায় নেপাল আর কোথায় কলকাতা! দীপঙ্করের কাছে ভজুদা যেন আরো রহস্যময় হয়ে উঠলো। ছোটবেলায় যখন প্রাণমথবাবু জেলে যেতেন, তখনও এমনি রহস্যময় মনে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু এ জেল নয়–জেলের চেয়েও দূর নেপাল। জেলখানার পাঁচিল ডিঙিয়ে তবে যেন নেপালে যেতে হয়।
–কবে ফিরে আসবেন?
ছেলেটি বললে–তার কোনও ঠিক নেই। কালও আসতে পারে, আবার দু বছর পরেও আসতে পারে–
দীপঙ্কর হতাশ হয়ে গেল। আগেই একদিন কিরণের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে এলে হতো!
ছেলেটি বললে–ভজুদা এলে কিরণকে দিয়ে আপনাকে খবর পাঠাবো দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–কিরণ এখন কোথায়?
ছেলেটি অবাক হয়ে গেল। বললে–আপনি জানেন না? কিরণ তো বাড়িতে শুয়ে আছে, কিরণের খুব অসুখ যে–
অসুখ!
দীপঙ্করের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। কিরণের অসুখ! দীপঙ্কর বললে–কিরণের অসুখ, তা তো জানতাম না আমি–
ছেলেটি বললে–হ্যাঁ, আজ সাত দিন ধরে বিছানায় পড়ে ছটফট করছে–খুব যন্ত্রণা হচ্ছে–কিছুতেই সারছে না
দীপঙ্কর যেন অস্থির হয়ে উঠলো। বললে–তা হলে কী হবে? ওদের যে খুব অভাব! ওদের যে ডাক্তার দেখাবার পয়সা নেই! কী হবে–
যেন পাগলের মতো দীপঙ্কর প্রলাপ বকতে লাগলো।
ছেলেটি বললে–আমি কালকে দেখতে গিয়েছিলাম–আবার যাবো একদিন–
দীপঙ্কর বললে–আমি জানতুম না ওর অসুখ হয়েছে–আমি এখুনি যাচ্ছি–
বলে আর দাঁড়াল না সেখানে। হাজরা রোডের মোড়টা কোনও রকমে পার হয়ে দীপঙ্কর যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে লাগলো। কেউ তাকে বলেনি কিরণের অসুখের কথা। কী আশ্চর্য! দীপঙ্করের মনে হলো যেন সমস্ত পৃথিবী তার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে। সমস্ত সংসার যেন তাকে প্রবঞ্চনা করেছে। কিরণের অসুখের কথা কেউ তাকে জানাল না। কী আশ্চর্য! এত দিন সে বাড়ির কাছে রয়েছে, পাশাপাশি বাড়ি, আর সে-ই জানতে পারলো না। দীপঙ্কর যেন বিশ্বাসই করতে পারলো না কথাটা। কিরণ তার প্রাণের বন্ধু। কিরণ তার মা’র চেয়েও আপনার জন। কিরণ তার লক্ষ্মীদির চেয়েও প্রিয়–সেই কিরণের অসুখের খবর সে অন্য ছেলের কাছে শুনলো। দীপঙ্করের মনে হোল–হোক এ ষড়যন্ত্র, তবু তারই দোষ! তারই তো দোষ!
দীপঙ্কর গলি গিয়ে সোজা রাস্তা বার করে চলতে লাগলো। যেন এতটুকু দেরি হলে আর কিরণকে দেখতে পাবে না সে। যেন এক মিনিট দেরি হলে কিরণকে আর দেখতে পাওয়া যাবে না। যেন দীপঙ্করের জগৎ থেকে কিরণ একেবারে হারিয়ে যাবে–নিঃশেষ হয়ে যাবে!
ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন তখন জমজমাট। বন্ধুর তেলে-ভাজার দোকানে তখন খদ্দেরের ভিড় খুব। কড়া তেল পোড়ার মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে। মধুসূদনের রোয়াকে তখন আবার দুনিকাকা ফতুয়া গায়ে দিয়ে বসেছে। ছোনেদা, পঞ্চাদা, মধুসূদনের বড়দা আবার আসর জমিয়েছে। আবার ফোড়ন কাটছে সকালবেলাকার মতো।
দুনিকাকা বলছে–রেখে দে তোর কংগ্রেস, কংগ্রেসকে খুব চেনা গেছে, বাবা– ছোনেদা বললে–কিন্তু দুনিকা, কংগ্রেস যাহোক তবু কিছু লড়ছে, তা না হলে কে লড়তো শুনি? তুমি, না আমি?
দুনিকাকা তখন ক্ষেপে গেছে। বললে–কংগ্রেসের কথা আর বলিস্ নি ছোনে, তবে হাটে হাঁড়ি ভাঙবো? বলি, চরকার সময় তোদের পাড়ার লীডার চরকা বেচে ক’ হাজার টাকা প্রফিট্ করেছে বলবো? নামটা আর বললুম না
–তুমি কেবল ওইটেই দেখ দুনিকা, আর এই যে হাজার হাজার ছেলে জেল খাটছে, সেটা তো দেখতে পাও না–
দুনিকাকা বলে–দ্যাখ, ওসব অনেক দেখা আছে, ক’জন জেল খাটছে আর ক’জন তাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে সব দুনিকাকার দেখা আছে, শালুক চেনাচ্ছে গোপাল ঠাকুরকে! ছেলেগুলোকে ক্ষেপিয়ে তুলে লীডাররা সব তো লেখাপড়ার দফা-রফা করে দিলে, শেষকালে যখন জেল থেকে বেরিয়ে চাকরির জন্য ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে তখন তোদের লীডাররা খাওয়াতে আসবে? বল্, কী উত্তর দিবি, বল?
আসর বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে তখন।
মাঝে মাঝে এক-একদিন আসর আরো জমজমাট হয়ে ওঠে। গান্ধী, জে এম সেনগুপ্ত, সাইমন কমিশন, নানা ব্যাপার নিয়ে মহা গোলমাল শুরু হয়। রাস্তায় লোক দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ কথার মধ্যে কথা বলে। তখন ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। একদল ইংরেজদের পক্ষে, আর একদল স্বদেশীদের পক্ষে।
একদল বলে–এতদিন খেতে পরতে দিচ্ছে যারা, তাদের সঙ্গে শত্রুতা করা মানেই নেমকহারামি করা–
অন্যদল বলে–কী খেতে পরতে দিচ্ছে শুনি? কী কচুটা খেতে দিচ্ছে? ছ’টাকা মণ চালের দর, আর টাকায় দু’সের দুধ–কী খেতেটা দিচ্ছে শুনি? খুব যে ইংরেজদের হয়ে ওকালতি করছো–
দুনিকাকা বলে ওঠে–তোদের কংগ্রেস রাজা হলে দেখবো কী খেতে দেয়–
–দেবেই তো, সবাই মিলে ইংরেজদের তাড়িয়ে দাও, তখন দেখবে কংগ্রেস চালের মণ এক টাকা করে দেবে, টাকায় চার সের দুধ করে দেবে–
দুনিকাকা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠতো–আর যদি তা না করতে পারে, তখন?
–না পারলে কংগ্রেসকে তাড়িয়ে দিও! এই যে সাইমন কমিশন, এ কি আমাদের ভালো করবে বলতে চাও?
হঠাৎ এই আলোচনার মধ্যে কে যেন দীপঙ্করকে দেখে ফেলেছে।
–এই দীপু, তুই কী শুনছিস রে? যা এখান থেকে–পালা–
দীপঙ্কর বললে–কেন, আমি পালাবো কেন? আমি কি কথা শুনছি আপনাদের? আমি তো কিরণদের বাড়ি যাচ্ছি–
দুনিকাকা বললে–ওই দ্যাখ, ওরা আবার একটা লাইব্রেরী করেছে, পাড়ায় আর টিকতে দেবে না দেখছি, শেষকালে কোনদিন ভাই টেগার্ট সাহেবের খপ্পরে পড়বো–
দীপঙ্কর বললে–না, আমি তো লাইব্রেরীতে যাচ্ছি না, কিরণের অসুখ করেছে তাই দেখতে যাচ্ছি–
বলে সেখানে আর দাঁড়াল না। দীপঙ্করের মনে হলো এরা যেন সবাই এক ধরনের লোক। সারাদিন আপিসে কাজ করে, আর সকালে সন্ধ্যেয় রোয়াকে বসে বসে কেবল আড্ডা দেয়। সেই ছোটবেলা থেকে এই রকম দেখে আসছে। এত দিকে এত কাজ হলো এত দিকে এত কিছু বদলে গেল, এদের আর কোন পরিবর্তন হলো না। মনে হয় যেন আর কোন পরিবর্তন হবেও না। কিরণের মূল্য ওরা বুঝবে না–ওদের বোঝবার সে-ক্ষমতাই নেই,
গলির মুখে ঢোকবার সময় হঠাৎ রাখালের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। রাখাল বোধহয় লাইব্রেরী থেকে বেরোচ্ছে।
দীপঙ্করকে দেখে রাখালও দাঁড়িয়েছে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কিরণকে দেখতে গিয়েছিলি বুঝি? কিরণ কেমন আছে রে?
–কিরণ!
রাখাল কেমন অবাক হয়ে গেল। বললে–কিরণের কী হয়েছে? আমি তো বায়োস্কোপ দেখে আসছি–
দীপঙ্কর রাখালের চেহারার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলে। চণ্ডীবাবুর নাতি, বড়লোক ওরা। সিল্কের শার্ট পরেছে।
রাখাল বললে–খুব ভালো বায়োস্কোপ, বুঝলি দীপু, তুই দেখিস্–
–কী বায়োস্কোপ?
রাখাল বললে–’কৃষ্ণকান্তের উইল’–সেই অমৃতলাল বোসকে দেখেছিস তো, আমাদের ইস্কুলে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনে প্রেসিডেন্ট হয়েছিল সেই অমৃতলাল বোস কৃষ্ণকান্তের পার্ট করেছে ভাই–শেষকালে একটা মেয়েকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে মারলে…
রাখাল আরো অনেক কথা বলে যাচ্ছিল। সমস্ত গল্পটাই হয়তো বলতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু কিছুই দীপঙ্করের কানে যাচ্ছিল না যেন। মনে হল যেন রাখালের তুলনায় দুনিকাকারা অনেক ভালো। তবু তারা ভাবে। দিক আড্ডা, তবু তো দেশের কথা তারা ভাবে। কিন্তু রাখালরা বেশ আছে। কোনও ভাবনা-চিন্তা নেই। অনেক পয়সা ওদের। বাড়িতে দোল, দুর্গাপুজো, একটা না একটা লেগেই আছে। আর সময় পেলেই বায়োস্কোপ দেখে। রসগোল্লা খেয়ে খেয়ে শরীরটাও মোটা করেছে।
দীপঙ্কর বললে–কিরণকে একবার দেখতে যাবি রাখাল?
–কী হয়েছে কিরণের?
দীপঙ্কর বললে–খুব অসুখ করেছে শুনলাম, একবার দেখতে চল্ না–
রাখাল বললে–এখন পারবো না ভাই যেতে, এখন বাড়িতে গিয়ে চান করবো, খুব ঘেমে গেছি–
রাখাল চলে গেল। দীপঙ্কর একলাই গলির মধ্যে ঢুকলো। কিরণের বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে। আহা, বাড়িতে মা ছাড়া তো আর দেখবার কেউ নেই। কে ওষুধ আনবে, কে পৈতে বিক্রী করবে, কে ডাক্তার ডাকবে। ডাক্তারের পয়সাই বা কে দেবে!
অন্ধকার হয়ে আছে জায়গাটা। দূরে, অনেক দূরে গলির মোড়ের তেলের বাতিটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। রাস্তার পাশে নর্দমাটা হাঁ করে রয়েছে। সেটা ডিঙিয়ে কিরণের লাইব্রেরী, লাইব্রেরীটা অন্ধকার। দীপঙ্কর লাইব্রেরীটার পাশ দিয়ে বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে কারো সাড়াশব্দ নেই। আহা, বোধহয় জ্বরের ঘোরে অচৈতন্য হয়ে আছে। জ্বর হলে যে কী কষ্ট তা দীপঙ্কর জানে। দীপঙ্করেরও একবার জ্বর হয়েছিল। কিন্তু, কিরণ যদি মরে যায়? যদি এই অসুখে ভুগে ভুগেই মরে যায়?
ভাবতেই দীপঙ্করের সমস্ত অন্তরাত্মা যেন শিউরে উঠলো। দীপঙ্কর সেইখানে সেই খোলা দরজার সামনে অন্ধকারের দাঁড়িয়েই ডাকলে–কিরণ–
কিন্তু ডাকতে গিয়েও যেন গলার স্বর বেরোল না। বার বার চেষ্টা করেও যেন চিৎকার করে ডাকতে পারলে না দীপঙ্কর। মনে হলে মা তো তাকে কিরণদের বাড়ি যেতে বারণ করেছে! কিরণের বাবার থুথু পড়ে থাকে উঠোনে–সে-সব মাড়ানো তো উচিত নয়। রোগীর থুথু মাড়ালে অসুখ হয়। সত্যিই তো, মা তো অন্যায় বলেনি। মাকে জিজ্ঞেস না করে তো কিরণদের বাড়ি ঢোকা যায় না।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো দীপঙ্কর। একবার মনে হলো দোষ কি যেতে! সে তো আড্ডা দিতে যাচ্ছে না! কিরণের অসুখ করেছে তাই দেখতে যাচ্ছে। অসুখের সময়, বিপদের সময়ে মানুষকে তো মানুষের দেখা উচিত। বিপদেই যদি না দেখলুম তো কবে দেখবো!
কিন্তু পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল। মাকে জিজ্ঞেস করে তবে যাওয়া ভালো। মা তো বারণই করেছে যেতে। মাকে বললে মা কি আর বুঝবে না? মা কি বারণ করবে! মা তো অবুঝ নয়! দীপঙ্কর ফিরলো আবার। মাকে জিজ্ঞেস করে তখন আসবে। কত আর দেরি হবে! যাবে আর আসবে। জিজ্ঞেস করেই চলে আসবে দীপঙ্কর। দীপঙ্করকে দেখলে কিরণও খুব খুশী হবে।
.
দীপঙ্কর গলি পেরিয়ে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের মধ্যে এসে পড়লো। আর এক দণ্ডে উনিশের একের বি-র মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু উঠোন থেকেই দেখলে অন্য দিনের চেয়ে যেন আলোটা একটু বেশি উজ্জ্বল। কেউ যেন এসেছে এ বাড়িতে। তাদের বাড়িতে এমন সময় কে আসবে! এ-সময়ে তো কেউ আসে না।
কিন্তু ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে তক্তপোশটার ওপর পা তুলে বসে আছে সতী। একপাশে বসে আছে বিন্তিদি। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মা যেন কী সব কথা বলছে।
দীপঙ্করকে দেখেও যেন কেউ দেখলে না শুধু সতী তার দিকে একবার চাইলে। মা-ও চেয়ে দেখলে। কিন্তু মাকে দেখে মনে হলো মা যেন কী নিয়ে খুব বিব্ৰত।
দীপঙ্করকে দেখিয়েই মা সতীকে বলতে লাগলো–তুমি তো এতদিন আছো মা, সব তো দেখছো, আমার কীসের ভাবনা বলো, আমার দীপু মানুষ হয়ে গেলেই আমি ঝাড়া হাত পা। কিন্তু ওই হয়েছে আমার শূল–
বলে মা বিন্তিদির দিকে দেখিয়ে দিলে–ওর জন্যই আমি কোথাও যেতে পারি না, কোথাও দু’দণ্ড নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারি না। আমি যদি মরে যাই তো ও-ও আমার পেছু নেবে, এমনি মেয়ের টান্। মুখ ফুটে কিছু বলবেও না, বলতে জানেও না। সংসারে এত লোক থাকতে চিনেছে শুধু আমাকে–আমার সঙ্গে যেন ওর আর জন্মের সম্পর্ক
বলে মা বিন্তিদির মুখের দিকে চেয়ে বললে–দেখ দেখ মেয়ের মুখখানার দিকে একবার চেয়ে দেখ, ও মুখ দেখলে মায়া হয় না? সেই ছোটবেলায় যখন এসেছিলুম দীপুকে কোলে নিয়ে, তখন ওই এতটুকু ছিল, তখন থেকেই ওই! নিজের মায়ের পেটের ভাইরা রয়েছে, দাদামশাই রয়েছে, তারা কেউ আপন হলো না, আমি কোথাকার কে– আমিই হলুম ওর আপন–
সতী জিজ্ঞেস করলে–তা দাদামশাই-এর এত টাকা, দাদামশাই নাতনীর জন্যে কিছু টাকা দেবে না, এ কী রকম?
–ওই কথাটাই বলে কে মা? আমি সেই ঘুরে ঘুরে একটা পাত্র ঠিক করবো, আমিই দেখাবার বন্দোবস্ত করবো, তবে সব হবে! আমি মেয়েমানুষ এ-সব আমার করা কি ভালো দেখায়?
সতী জিজ্ঞেস করলে–ক’জন দেখতে আসবে?
মা বললে–পাত্রের বাবা আর কাকা-আর ঘটকমশাই–তোমাকে কিন্তু থাকতে হবে মা, তুমি এসে একটু গুছিয়ে-টুছিয়ে দিও মা, আমি জল-খাবারের ব্যবস্থা-ট্যবস্থা সব ঠিক করবো–ওকে একটু সাজিয়ে দিও মা তুমি–আমি তো সেকেলে মানুষ–
এতক্ষণে বিন্তিদি কথা বললে। বললে–হ্যাঁ ভাই, আমাকে তুমি সাজিয়ে দিও–নইলে ভালো দেখাবে না–
বড় করুণ সুরে কথাটা বললে বিন্তিদি। কিন্তু শুনে হেসে ফেললে সতী। বললে– কিন্তু আমার সাজানো তোমার পছন্দ হবে তো বিন্তিদি?
মা বললে–দেখলে তো, ও ওই রকম সরল সাদাসিধে–
বিন্তিদি সে-কথায় কান দিলে না। বললে–আমাকে তোমার মতো করে সাজিয়ে দিও ভাই–
সতী হেসে বললে–আমি কী কলকাতার মেয়েদের মতো সাজাতে পারবো?
বিন্তিদি বললে–খুব পারবে। এমন করে সাজাবে যাতে আমাকে ওদের পছন্দ হয়–
সতী আরো হেসে উঠলো। হঠাৎ বিন্তিদির গাল দুটো টিপে দিয়ে বললে– হবে হবে খুব পছন্দ হবে। তোমার মতো চেহারা পছন্দ না-হয়ে পারে নাকি বিন্তিদি?
বিন্তিদি কিন্তু হাসলে না। বললে–সত্যি বলছো ভাই?
সতী বললে–সত্যি বলছি না তো কি মিথ্যে বলছি?
তবু যেন বিন্তিদির বিশ্বাস হলো না। বললে–সত্যি বলো তো, আমি তোমার মতন সুন্দরী?
সতী হেসে বললে–আমি সুন্দরী না ছাই–তুমি আমার চেয়েও সুন্দরী—
বলে সতী খুব জোরে হেসে উঠলো।
মা বললে–দেখলে তো মা, ও মেয়ে ওই রকম, মেয়ের মুখ দেখলে আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে মা–
তারপর মা কত কথা বলতে লাগলো। মার দুঃখের কথা, দীপঙ্করের কথা। সে-সব কথা দীপঙ্করের কাছে নতুন নয়। হাজার হাজার বার শুনেছে সে। হঠাৎ এক ফাঁকে দীপঙ্কর বললে–মা–
মা মুখ ফিরিয়ে বললে–কী? তোমার আবার কী?
দীপঙ্করের কথাটা বলতে যেন একটু সঙ্কোচ হলো। সতীও তার দিকে চাইলে। সতীর সামনে কথাটা বলতে যেমন যেন লজ্জা হচ্ছিল।
সতী বললে–আমার সামনে বলতে বুঝি লজ্জা হচ্ছে তোমার?
মা বললে–না মা, তোমার সামনে বলতে আবার লজ্জা হবে কেন ওর, ওর ওইরকম, একটা কিছু বায়না ওর লেগেই আছে–তোমার কাকাবাবুকে বলে একটা চাকরি করে দাও না মা, আমি একটু নিশ্চিন্ত হই–
সতী বললে–একদিন আপনি চলুন না মাসীমা আমার সঙ্গে–কথাটা আপনিই বলবেন কাকাবাবুকে–
মা বললে–সেদিন তো ও গেল বলতে চাকরির কথা, এসে বললে–বলেনি–ওই মুখচোরা ছেলেকে নিয়ে আমি কী করি বলো তো মা–
সতী বললে–তাই নাকি, তুমি মুখচোরা বুঝি খুব? কিন্তু লক্ষ্মীদির সঙ্গে কথা বলতে তো খুব মুখ খুলে যায় ওর মাসীমা–
মা বললে–পরের বাড়িতে ওর খুব মুখ খোলে! এখুনি কিরণদের বাড়িতে যেতে বলো তো সেখানে গিয়ে কথার খই ফুটবে
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে– মা, কিরণদের বাড়ি একবার যাবো, মা?
দীপঙ্কর মা’র হাতটা ধরলো। বললে–তুমি একবার যেতে বলো না আমাকে, তুমি যেতে না-বললে যে আমি যেতে পারছি না–মানুষের অসুখের সময়ে যদি না দেখি তো কখন দেখবো মা! আমি যাবো আর আসবো মা, তুমি একবারটি বলো যেতে–
মা বললে–তা বলে এখনি যেতে হবে? এই রাত্তিরে? কাল সকালে গেলে হয় না?
–না মা, তার বড্ড অসুখ করেছে, ভীষণ জ্বর,–আমি যাচ্ছি, তুমি বলো—হ্যাঁ–
মা বললে–আচ্ছা যাও–কিন্তু বেশি দেরি করবে না–
–না মা, আমি যাবো আর আসবো–
বলে দীপঙ্কর লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা’র অনুমতি পেয়েছে, আর তার কিছু যেন ভাববার নেই। কতদিন পরে কিরণদের বাড়ি যাবে সে। সেই ছোটবেলায় কতদিন সে গেছে ওদের বাড়ির ভেতরে, কতদিন ওদের পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা খেয়েছে। কতদিন ওর বাবা তাদের অঙ্ক করে দিয়েছে। কতদিন ওর মা মুড়ি খেতে দিয়েছে–কতদিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কিরণ পৈতে বিক্রি করেছে, আর সে পেছনে পেছনে গেছে, কতদিন টালিগঞ্জ পুলের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেলগাড়ি চলা দেখেছে। সেই কিরণের অসুখ করেছে!
বাড়ির বাইরে লেনটার মধ্যে তখন তেলের বাতি জ্বলছে। বাতিটার তলায় যেতেই কে যেন ডাকলে–এই–
দীপঙ্কর দাঁড়াল। পেছন ফিরে দেখলে সতী। সতীও তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।
দীপঙ্কর আবার পেছিয়ে গেল। বললে–তুমি চলে এলে যে?
সতী সে কথায় কান না দিয়ে বললে–কিরণদের বাড়ি কোন্ দিকে?
দীপঙ্কর বললে–কেন? তুমি কিরণকে চেন নাকি?
–না চিনি না, এমনি জিজ্ঞেস করছি। কিরণ বুঝি তোমার ক্লাস-ফ্রেন্ড?
–হ্যাঁ, তুমি আমাদের লাইব্রেরীর মেম্বার হবে? আমরা একটা লাইব্রেরী করেছি, আট আনা করে চাঁদা, দু’খানা করে বই পড়তে পাবে–হবে মেম্বার? কাকাবাবুও মেম্বার হয়েছেন। লক্ষ্মীদি তুমি–তোমরা দু’জনেই মেম্বার হও না–তোমাদের যেতেও হবে না কিছু না, আমিই বই এনে দিয়ে যাবো, ভালো ভালো সব বই আছে লাইব্রেরীতে। এত ভালো বই সব যে, দেখে তুমি চমকে যাবে–
সতী হাসলো। বললে–কিরণ বুঝি তোমার খুব বন্ধু?
–হ্যাঁ, কিন্তু তুমি লাইব্রেরীর মেম্বার হবে কিনা বলো না, মাত্র তো আট আনা করে চাঁদা, আর তোমরা তো খুব বড়লোক–আট আনা চাঁদা দিতে গায়ে লাগবে না
সতী সে-কথার ধার দিয়ে গেল না। বললে–তুমি কিরণকে বেশি ভালোবাসো, না লক্ষ্মীদিকে বেশি ভালোবাসো বলো তো?
দীপঙ্কর বিরক্ত হলো। বললে–ও-সব কথা আমার ভালো লাগে না, তুমি লাইব্রেরীর মেম্বার হবে কিনা তাই বলো–
সতী বললে–তা ও-সব কথা ভালো লাগবে কেন? লক্ষ্মীদির কাজ করতে খুব ভালো লাগে, না?
–না, লক্ষ্মীদির কাজ আমি আর করি না।
–না, করো না! তবে সেদিন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীদির সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল তোমার? আমি শুনিনি বুঝি কিছু?
–কবে? কখন কথা হচ্ছিল?
সতী বললো–মনে নেই? সেদিন রাত নটার সময় খিড়কির ধারে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীদি কী বলছিল তোমাকে? কী কাজ করতে পাঠাচ্ছিল? কোথায় যেতে বলছিল তোমাকে? বলো?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে–কই? কোথাও তো পাঠায়নি আমাকে? কোথায় পাঠাবে আবার?
সতী বললে–মিথ্যে কথা বলো না তুমি! মিথ্যে কথা বললে পাপ হবে–
–আমি মিথ্যে কথা বলি না। যা তা বলো না তুমি!
–তাহলে লক্ষ্মীদি কী বলছিল তোমাকে, বলো?
দীপঙ্কর রেগে গেল। বললে–তোমার কি আর কোনও কাজ নেই? তোমার কি আর কোন ভাবনা নেই? কেবল লক্ষ্মীদি কী করছে দিনরাত তাই ভাবো বুঝি তুমি? তোমার নিজের লেখা-পড়া, নিজের কাজকর্ম কোনো কিছুই নেই কেন তুমি লক্ষ্মীদির পেছনে এত লাগো, শুনি?
সতী যেন প্রথমটা একটু অবাক হয়ে গেল কথাগুলো শুনে।
দীপঙ্কর আবার বলতে লাগলো-লক্ষ্মীদির কোনও দোষ নেই জানো, লক্ষ্মীদি তোমার মতন অত পরের পেছনে লাগে না–লক্ষ্মীদির মতো মেয়ে হয় না–আর তুমি কিনা তাকেই মিছিমিছি কষ্ট দাও এত–
–আমি কষ্ট দিই?–সতী যেন মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেলে কথাটা ভেবে।
–কষ্ট দাও না? কেন তুমি আমাকে সন্দেহ করো? আমি কী করেছি তোমার? আমি কি তোমাদের মতো বড়লোক? আমার বাবা নেই, আমার মা কত কষ্ট করে আমাকে মানুষ করছে দেখতে পাও না? আমি ভিক্ষে করে লেখা-পড়া করছি তাও তুমি দেখতে পাও না? তোমাদের সঙ্গে আমার তুলনা? তোমরা বড়লোক আর আমি গরীব লোক। তোমরা ইচ্ছে করলে সব করতে পারো, আর আমাকে সব কাজের জন্যে পরের ওপর নির্ভর করতে হয়–তোমরা ইচ্ছে করলেই তো আমাকে কিনে নিতে পারো! তুমিই তো একদিন আমাকে কুলী মনে করে ঘাড়ে মোট বইয়েছিলে, তারপর চারটে পয়সাও আমার গায়ে ছুঁড়ে মেরেছিলে–মনে নেই?
সতীর মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কোনও কথা বেরোল না।
দীপঙ্কর আবার বলতে লাগলো–তোমার কাকাবাবু আমাকে কিরণের সঙ্গে মিশতে বারণ করেছেন। কেন, কিরণ কী দোষ করেছে? তার গরীব হওয়া ছাড়া আর তার কী দোষ, শুনি? তার মতো গুণ তোমাদের আছে? তার এক কণা গুণ পেলেও তুমি বর্তে যেতে!
সতী এবার কথা বললে। বললে–কই আমি তো তোমায় মিশতে বারণ করিনি কারো সঙ্গে?
–তুমি বারণ করোনি, কিন্ত কাকাবাবু তো বারণ করেছেন। তুমি আর তোমার কাকাবাবু তো একই। তোমার কাকাবাবু আর তুমি কি আলাদা?
–বা রে, তুমি তো বেশ মজার ছেলে! কাকাবাবুর দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে?
দীপঙ্কর বললে–দেব না? তোমারই তো কাকাবাবু! এখন কিরণকে যদি কথাগুলো বলি তো কীরকম কষ্ট পাবে বলো তো? তুমি ভেবে দেখ না–কষ্ট পাবে না?
–তা তো পাবেই
–তবে? এতদিন আমরা এক সঙ্গে মিশেছি ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে খেলা করেছি, এক ইস্কুলে এক কাসে পড়েছি বরাবর–আর এখন হঠাৎ মেশা বন্ধ করে দেব?
আমার বুঝি কষ্ট হয় না? তার অসুখ করলেও দেখতে যেতে পারবো না?
সতী হাসলো। বললে–তা যাও না, কে তোমায় বারণ করেছে?
দীপঙ্কর বললে–বেশ তো বলছো, তারপর হয়তো তুমিই গিয়ে কাকাবাবুকে বলে দেবে, আর কাকাবাবু রাগ করবেন খুব আমার ওপর, রেগে গিয়ে হয়তো আমাকে চাকরিই দেবেন না–
–না না, আমি বলে দেব না–তুমি যাও, অসুখের সময় মানুষকে দেখা উচিত।
দীপঙ্কর বললে–সত্যি বলছো বলে দেবে না?
–না বলবো না, কথা দিচ্ছি। তা ছাড়া, তুমি কার সঙ্গে মিশছো না-মিশছো তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, কাকাবাবুরও মাথাব্যথা নেই–
দীপঙ্কর কী যেন ভাবলে, বললে–তাহলে আমি যাই?
সতী বললে–যাও না, তোমার যেখানে খুশি তুমি যাবে, তাতে আমরা বাধা দেবার কে?
–আমি যদি রোজ রোজ যাই?
–তাতেও কিছু বলবো না।
–বেশ, তাহলে সেই কথা রইল কিন্তু–তুমি কিচ্ছু বলতে পারবে না কোনওদিন! লক্ষ্মীদির সঙ্গেও আমি যখন তখন মিশবো, লক্ষ্মীদি যেখানে যেতে বলবে সেখানে যাবো–লক্ষ্মীদির সব কাজ করে দেব, তুমি কিন্তু কিছু বলতে পারবে না!
সতী বললে–বা রে, লক্ষ্মীদির কথা তো আমি বলিনি-লক্ষ্মীদির কথা আলাদা–
–কেন লক্ষ্মীদির কথা আলাদা কেন?
–না, লক্ষ্মীদি যেখানে যেতে বলবে সেখানে যেও না, লক্ষ্মীদি যদি কাউকে চিঠি দিয়ে আসতে বলে তাহলেও তুমি দিয়ে এসো না।
–কেন?
সতী বললে–না, এখানে এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সব কথা বলা যায় না। তোমাকে তো সেদিন সব বলেছি। বর্মাতেও লক্ষ্মীদি তোমার মতো একটা ছেলের হাত দিয়ে চিঠি পাঠাতো একজনকে–যাতে কেউ টের না পায়–
দীপঙ্কর কথা শুনে কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। অন্ধকার বাড়িটার ঠিক সদর দরজার ওপর দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। দীপঙ্করের মনে হলো এতদিনে যেন সব ঘটনাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। কিন্তু তবু যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। জিজ্ঞেস করলে–সত্যি বলেছো?
সতী বললে–নিজের দিদির সম্বন্ধে মিথ্যে বলে আমার লাভ? আর নিজের দিদির কথা কখনও পরের কাছে এমন করে বলা যায়?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তারপর কী হলো?
সতী বললে–আমিও তখন সেই একই ইস্কুলে পড়তাম কিনা, একই হোস্টেলে থাকতাম দিদির সঙ্গে–তুমি তো বর্মায় কখনও যাওনি, নইলে সেখানে মেয়েদের ইস্কুল কী-রকম জানতে পারতে। বর্মা তো এখানকার মতো নয়, সেখানকার মেয়েরা স্বাধীন–যে যার সঙ্গে মিশতে পারে
–কিন্তু সে ছেলেটা কে? যার হাত দিয়ে চিঠি পাঠাতো লক্ষ্মীদি?
–সে একটা তোমারই মতো ছেলে, পাশের বাড়িতে থাকতো, বাচ্চা ছেলে, সে কিছু বুঝতো না, লক্ষ্মীদি যা বলতো, তাই-ই সে করতো। তাকে চকোলেট দিত, লজেন্স দিত, দরকার হলে আরো সব জিনিস উপহার দিত–আর তার তো বয়েস কম ছিল তাই সে-ও বুঝতো না কী সর্বনাশ করছে সে দিদির
–কেউ কিছু বলতো না?
সতী বললে–কেউ কী-ই বা বলবে! আর জানতে পারলে তো! আমি থাকতাম একই হোস্টেলে, আমিই বলে জানতে পারিনি! ছেলেটাকে আমিও দেখেছি। আমাদের হোস্টেলে আসতো, লক্ষ্মীদির সঙ্গে কথা বলতো, কিন্তু সে যে তলে তলে ওই কাজ করছে তা আমি কী করে সন্দেহ করবো?
–তলে তলে কী কাজ করতো ছেলেটা?
সতী বললে–লক্ষ্মীদির চিঠি নিয়ে একজনকে দিয়ে আসতো
দীপঙ্করের নিজেকে যেন হঠাৎ বড় অপরাধী মনে হলো। সতীর মুখখানা অন্ধকারের মধ্যেও ভালো করে দেখবার চেষ্টা করলে।
বললে–চিঠিতে কী লেখা থাকতো সব?
সতী বললে–সে-সব তুমি বুঝবে না–ছেলে-মেয়েতে প্রেম হলে যে-সব কথা হয়, সেই সব কথা লেখা থাকতো–
প্রেম! কথাটা যেন সতীর মুখ থেকে অন্যরকম শোনালো।
দীপঙ্কর বললে–তা প্রেম করা মানে তো ভালোবাসা! ভালোবাসলে দোষটা কী?
সতী বললে– সে-সব কথা তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই না–বাবা-মা’র বিনা অনুমতিতে কোনও মেয়ের পক্ষে কোনও পুরুষের কাছে চিঠি লেখা বা কোনও ছেলেকে ভালোবাসা অন্যায়, শুধু অন্যায় নয় পাপ–বিশেষ করে বিয়ের আগে–তা সে সব কথা থাক্–তুমি ও-সব বুঝবে না,
দীপঙ্কর বললে–না আমি বুঝবো, তুমি বল–
সতী বললে–না, এখন তুমি বুঝতে পারবে না–আরো বড় হয়ে বুঝবে
–না, আমি বড় হয়েছি, তুমি বুঝতে পারো আর আমি বুঝবো না? আমি তো তোমার চেয়েও বড়, বল তুমি–
সতী বললে–না, ও-সব কথা তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই না–মেয়েরা বয়েস না হলেও বোঝে–
দীপঙ্কর বললে–তা এত জিনিস বুঝতে পারি আর এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারবো না?
সতী যেন কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। বললে–সামান্য ব্যাপার হলে আমি এত ভাবতুম না–তোমার নিজের দিদির ব্যাপার হলে তুমি একে সামান্য ব্যাপার বলতে না–বলতে কি?
দীপঙ্কর এ-কথার কোনও উত্তর দিলে না।
সতী একটু থেমে বললে–নিজের দিদি বলেই বলছি, দিদি যদি কখনও তোমাকে কোনও চিঠি কাউকে দিয়ে আসতে বলে তুমি যেন দিও না–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু যে-লোকটাকে লক্ষ্মীদি চিঠি দিত সে কে? তার নাম কী?
-–সে একজন বর্মার লোক, মারহাট্টি ছেলে, দিদি তাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল।
–কী নাম তার?
সতী বললে–তার নাম শম্ভু দাতার, বর্মায় ব্যবসা করতো। তার কাছ থেকে দূরে সরাবার জন্যেই বাবা কাকাবাবুর সঙ্গে দিদিকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলে–কিন্তু শুনেছি বর্মা থেকেও সে-ছেলেটা চলে গেছে! হয়তো কলকাতায় এসেছে–কী জানি! তাই তো আমাদের এত ভয়!
দীপঙ্কর বললে–তা তোমরা লক্ষ্মীদিকে বারণ করতে পারো না?
সতী বললে–বারণ করলে কি শোনে কেউ! সেইজন্যেই তো লক্ষ্মীদির পাত্র খোঁজা হচ্ছে, লক্ষ্মীদির বিয়ে হয়ে গেলে বাবাও নিশ্চিন্ত হন, আমিও নিশ্চিন্ত হই–
–লক্ষ্মীদির বিয়ে হয়ে যাবে?
সতী বললে–হ্যাঁ, অনেক পাত্র খোঁজা হচ্ছে–
–কিন্তু লক্ষ্মীদি তো সুন্দর, বিয়ে হচ্ছে না কেন?
–সুন্দরী হলেই কি বিয়ে হয়? তোমার বিন্তিদিও তো সুন্দরী, তা-ও বিয়ে হচ্ছে না কেন?
–বিন্তিদির বিয়ে হচ্ছে না টাকার জন্যে। অঘোরদাদু যে টাকা দেবে না– সতী বললে–কিন্তু যার তার হাতে তো দেওয়া যায় না! আর সেই বর্মা থেকে পাত্র খোঁজাও তো সহজ নয়। আমার বাবা হয়তো এসে পড়বেন একদিন, একটা ভালো পাত্রের খোঁজ পেলেই এসে পড়বেন–
খবরটা শুনে দীপঙ্কর যেন কেমন চুপ করে রইল। লক্ষ্মীদির বিয়ে হয়ে যাবে! লক্ষ্মীদিকে সিঁদুর পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কেমন দেখাবে তাই যেন ভাবতে চেষ্টা করতে লাগলো।
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে–আচ্ছা, তাহলে আমি আসি–অনেক দেরি হয়ে গেল—
সতী বললে–যা বললুম তোমার মনে থাকবে তো?
–থাকবে। বলে দীপঙ্কর চলে যাচ্ছিল–সতী আবার বললে–যদি কোনওদিন কোনও চিঠি কি কোনও জিনিস কাউকে পাঠায় তো আমাকে বলে দিও–বুঝলে?
দীপঙ্কর সে-কথার উত্তর না দিয়ে হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল। বললে–আচ্ছা লক্ষ্মীদির বিয়ে হয়ে গেলে তারপর তোমারও তো একদিন বিয়ে হয়ে যাবে!
সতী হাসলো এবার। বললে–তা একদিন হবে বৈ কি! কেন এ-কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?
দীপঙ্কর বললে–না, এমনি জিজ্ঞেস করছি–
তারপর একটু থেমে বললে–বিয়ে হয়ে গেলে তোমরা তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে? সতী বললে–বিয়ে হলে সবাই-ই শ্বশুরবাড়ি যায়–তার আবার নতুনত্ব কী?
দীপঙ্কর বললে–তা তো বটেই শ্বশুরবাড়ি তো যেতেই হবে! মোট কথা তোমরা চলে গেলে বাড়িটা আবার ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যাবে আর কি। আবার নতুন ভাড়াটে আসবে, আবার দেয়ালের গায়ে ‘টু-লেট’ টাঙিয়ে দেবে অঘোরদাদু, আবার…
সতী বললে–আবার তাদের সঙ্গেও তোমার ভাব হবে! তোমার ভাবনা কী!
–না, আর ভাব করবো না কারো সঙ্গে! কারোর সঙ্গে ভাব করবো না আর!
–কেন? রাগ হলো বুঝি?
দীপঙ্কর বললে–না, এত ভাব করা ভালো নয়–
–কেন? ভাব করা দোষ কী?
দীপঙ্কর বললে–না, চলে যাবার সময় বড় কষ্ট হয়–
সতী আবার হেসে উঠলো। বললে–ওমা, কোথায় বিয়ে তার ঠিক নেই, এরই মধ্যে তোমার কষ্ট হতে আরম্ভ করেছে!
দীপঙ্কর হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলো। বললে– না না আমি তা বলিনি, আমি বলছিলুম যে, আগেও তো অনেক ভাড়াটে এসেছে, তাদের সঙ্গে আমার এত ভাব হয়নি। তোমরা এখানে ছিলে এতদিন, বেশ ভালো লাগতো–
সতী বললে–কাকে ভালো লাগতো? আমাকে, না লক্ষ্মীদিকে?
দীপঙ্কর সতীর মুখের দিকে চেয়ে দেখল। মনে হলো সতী যেন মুখ টিপে হাসছে। বললে–তোমাকে আর আমি এ-সব কথা বলবো না, সব কথাতেই ঠাট্টা–আমি যাই বলে দীপঙ্কর অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। দেখলে সতী তখনও পঁইঠের ওপর দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল দীপঙ্করের। আবার ফিরলো। তখন সতী নিজেদের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে ডাকলে–সতী–
সতীও অবাক হয়ে গিয়েছিল। দীপঙ্করের ডাক শুনে ফিরে দাঁড়িয়ে বাইরে এল।
বললে–কী হলো?
দীপঙ্কর বললে–আসল কথাটাই ভুলে গিয়েছিলাম–আমাদের লাইব্রেরীর মেম্বার হবে তুমি?
সতী এ-কথার জন্যে বোধহয় তেমন তৈরি ছিল না। একটু দেরি হলো তার উত্তর দিতে।
দীপঙ্কর তার আগেই বললে–মাত্র তো আট আনা চাঁদা, আট আনা চাঁদাও দিতে পারবে না? দু’খানা করে বই পাবে পড়তে–
সতী কী যেন ভাবলে। বললে–তা লাইব্রেরীটা তোমার না কিরণের?
দীপঙ্কর বললে–আসলে কিরণেরই লাইব্রেরী, কিরণই বেশি মাথা ঘামায় লাইব্রেরী নিয়ে, ওরই বেশি টান লাইব্রেরীর ওপর, ওই-ই হলো সেক্রেটারি কিনা–
সতী বললে–তাহলে মেম্বার হবো না–
–কেন?
সতী বললে– তোমার নিজের লাইব্রেরী হলে মেম্বার হতুম–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমিও তো আছি, আমিই লাইব্রেরীর প্রেসিডেন্ট—
সতী বললে–তাহলে চাঁদা দেব–
দীপঙ্কর হাসলো। বললে–বারে, বেশ তো কথা তোমার, আমি আর কিরণ কি আলাদা? আমাদের দুজনেরই তো লাইব্রেরী, আমরা দুজনে মিলেই তো গড়েছি ওটাকে–
সতী বললে–ও-সব জানি না, কিরণকে তো আমি চিনি না, আমি শুধু তোমাকে দেখেই চাঁদা দিচ্ছি–আমি তোমাকেই চিনি–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু কিরণ আমার চেয়েও ভালো ছেলে, জানো–অনেক ভালো ছেলে, কিরণের তুলনা হয় না–
-–হোক ভালো, তোমার লাইব্রেরী হলে চাঁদা দেব–একটু দাঁড়াও, আমি পয়সা এনে দিচ্ছি–
দীপঙ্কর বললে–এখনই দেবে?
সতী বললে–তা এখনই দিতে পারি–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু থাক্, এখন না, আমার কাছে এখন রসিদ-বই নেই, কাল রসিদ-বই এনে বরং চাঁদা নিয়ে যাবো’খন্–
সতী বললে–রসিদ পরে দিও’খন, এখন বরং চাঁদাটা নিয়ে যাও—
দীপঙ্কর হাসলো, বললে–কিন্তু যদি চাঁদাটা নিয়ে আমি পালিয়ে যাই?
সতীও হেসে ফেললে এবার। বললে–তোমার মুরোদ বোঝা গেছে, তোমার পালাবার ক্ষমতাই নেই–
–কেন? পালাতে পারি না আমি? তুমি ভাবো কী?
সতী বললে–আমি ঠিকই ভাবি! নইলে চাঁদা চাইবার নাম করে এই এত রাত্তিরে আর পেছন থেকে আমায় ডাকতে না–
কথাটা শুনে দীপঙ্কর সেইখানেই অন্ধকারে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর সতী এক মুহূর্ত দেরি না করে ভেতরে অন্ধকারের মধ্যে তরতর করে মিলিয়ে গেল।
১৭
–কিরণ!
কিরণও অবাক হয়ে গেছে, দীপঙ্করও অবাক হয়ে গেছে। একটা তক্তপোশ। ময়লা লেপ কাঁথা বালিশ তোশকের ভিড়ের মধ্যে কিরণ শুয়ে ছিল। ওষুধের শিশি কয়েকটা মেঝের ওপর রাখা। পাশেই একটা হারিকেন জ্বলছে। দীপঙ্করকে দেখেই কিরণ লাফিয়ে উঠলো। বললে–তুই এসেছিস্ দীপু?
কিরণ জড়িয়ে ধরলে দীপঙ্করকে। বললে–তোর মা বকবে না?
দীপঙ্কর বললে–আমি মাকে বলে এসেছি–
–তাহলে এত রাত করলি কেন? আর একটু আগে আসতে পারলি না? অনেক গল্প করা যেত!
দীপঙ্কর বললে–তুই শো, শুয়ে পড়–তোর কষ্ট হবে–এখন কেমন আছিস? কিরণ হঠাৎ ডাকলে–মা, মা–শুনে যাও–
কিরণের মা দাওয়ায় বসে বসে পৈতে কাটছিল। কিরণের ডাকে ঘরে এল।
কিরণ বললে–এই দেখ মা, দীপঙ্কর এসেছে, আমি বলেছিলুম তোমাকে যে, আর কেউ না আসুক দীপু খবর পেলে নির্ঘাত আসবে! দীপু না এসে পারে না–
কিরণের মা বেশি কথার লোক নয়। বললে–না আসাই তো ভালো, রোগীর বাড়িতে কি আসা উচিত বেশি!
দীপঙ্কর বললে–আমি মাকে বলে এসেছি কিন্তু–মা বলেছে আমাকে আসতে। তা হঠাৎ যে এই সময়ে তোর অসুখ হলো?
কিরণ বললে–অসুখ হওয়া তো ভালো রে–অসুখ হওয়াই তো আমি চাই, বেশ তেতো ওষুধ খেতে পারা যায়, উপোস করা অভ্যেস করা যায়–অসুখ হলে কষ্ট সহ্য করা শেখা যায়–
–সে কি? অসুখ হলে কষ্ট হয় না মানুষের? তুই বলছিস্ কী?
কিরণ হাসলো। বললে–দূর, তুই জানিস্ না, অসুখ না হলে কষ্ট সহ্য করা শিখবো কী করে? উপোস করা শিখবো কী করে?
ততক্ষণে কিরণের মা আবার বাইরে চলে গেছে। কিরণ বললে– আমি ডাক্তারবাবুকে বলেছি মিষ্টি ওষুধ মোটে দেবেন না, কেবল তেতো ওষুধ দেবেন!
–কেন?
কিরণ বললে–জেলখানাতে গিয়ে তো খুব কষ্ট দেবে আমাদের, তাই এখন থেকে কষ্ট সহ্য করা অভ্যেস করে রাখছি–তুইও কর্–এখন কষ্ট সহ্য করা থাকলে তখন আর গায়ে লাগবে না–কাকাবাবু সেদিন ডেকে তোকে কী বললে রে দীপু? খুব খুশী হয়েছে, না রে?
দীপঙ্কর তখন কিছু বলতে পারছে না। তার মনে পড়ে গেল কাকাবাবুর কথাগুলো। কেনম করে কিরণকে বলবে কথাগুলো–কেমন করে বলবে যে, কাকাবাবু কিরণের সঙ্গে মিশতে বারণ করে দিয়েছে দীপঙ্করকে!
কিরণ বললে–তোর কাকাবাবু যে এত ভালো লোক সত্যিই আমি জানতুম না ভাই–কী চমৎকার লোক! তার পরে তুই তো চলে গেলি, আর আমি নাচতে লাগলুম, বুঝলি, সারা রাত নাচতে লাগলুম, কিছু খাইনি, ঘুমোইনি–কেবল নেচেছি–
তারপর একটু থেমে বললে–লেখা-পড়া জানা লোক তো, তাই লাইব্রেরীর কদর বোঝে ওরা,–তা কী বললে রে তোর কাকাবাবু?
দীপঙ্করের মুখে তখন কথা আটকে গেছে।
কিরণ বললে–খুব প্রশংসা করলে বুঝি? বল্ না–
দীপঙ্কর কিরণের মুখের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে।
কিরণ বললে–জানি প্রশংসা করবেই, চেহারা দেখেই আমি লোক চিনতে পারি যে! ‘পথের দাবি’ বইটা এনে কাকাবাবুকেই প্রথম পড়তে দেব–কাকাবাবুকেই প্রথম বলেছি তো বইটার কথা! শুনলি তো কত উৎসাহ দিলে, কত উপদেশ দিলে! এই রকম লোক পাড়ায় আর দু-একটা থাকলে আমার ভাবনা! কী রে কথা বলছিস্ না কেন? বল্, কথা বল্?
তারপর হঠাৎ থেমে কিরণ বললে–হ্যাঁ, ভালো কথা, ওই মেয়ে দুটোকে মেম্বার করেছিস্?
দীপঙ্কর বললে–করেছি, কিন্তু তুই অত কথা বলিস্ নি, তোর অসুখ বেড়ে যাবে ভাই ৷
–করেছিস্? মেম্বার করেছিস্ তুই? দুজনে কত দিলে?
–দুজনে নয়, একজন!
কিরণ বললে–একজন কেন? দুজনে হলো না? ভারি কিপটে আছে তো মেয়েগুলো–
দীপঙ্কর বললে–এখন শুধু ছোট মেয়েটা হয়েছে, ওই যার নাম সতী! পরে বড় মেয়েটাকেও মেম্বার করে নেব–বড় মেয়েটাই বেশি ভালো, জানিস–তার নাম লক্ষ্মীদি! শুনলাম ওই বড় মেয়েটার এবার বিয়ে হয়ে যাবে ভাই–
–তাহলে বিয়ের আগেই মেম্বার করে নে, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে তখন কি আর পাত্তা পাওয়া যাবে? তখন ছেলেমেয়ে হয়ে সে একেবারে অন্যরকম হয়ে যাবে!
দীপঙ্কর ভয় পেয়ে গেল। বললে–বিয়ের পর কি অন্যরকম হয়ে যায়?
কিরণ বললে–তা হবে না? বিয়ের পর কি মনে করেছিস তোর সঙ্গে এইরকম রগড়া-রগড়ি থাকবে? দেখবি চিনতেই পারবে না তোকে। তখন নিজের বর নিয়ে মেতে থাকবে কিনা! তারপর, একবার ছেলেমেয়ে হতে আরম্ভ করলে আর বন্ধ হবে না। তখন ছেলেমেয়ের চ্যা-ভ্যা নিয়ে তোর কথা মনে রাখবার ফুরসুতই পাবে না একেবারে! তখন লাইব্রেরীর খাতা থেকে নাম কাটিয়ে দেবে–
দীপঙ্কর কিছু বলতে পালে না মুখ দিয়ে। লক্ষ্মীদি অন্যরকম হয়ে যাবে? একেবারে অন্যরকম? অন্যরকম হয়ে গেলে চেহারাটা কী-রকম দেখাবে তাই-ই যেন সে কল্পনা করবার চেষ্টা করলে। কিন্তু লক্ষ্মীদি কখনও অন্যরকম হতে পারে? লক্ষ্মীদি যে তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। আর ভালোবেসে বিশ্বাস করে বলেই তো তার কাছে সব কথা বলে।
কিরণ বললে–ভজুদাকে তোর কথা বলেছি, জানিস্–ভজুদা তোকে একদিন নিয়ে যেতে বলেছে–
তারপর একটু থেমে বললে–আমাদের মতো যত ছেলে দলে জোটে ততই ভালো, ভজুদার দলে কত ছেলে যে আছে আমাদের মতো না, তার ঠিক নেই, সব হিমালয়ে তৈরি হচ্ছে বুঝলি, ভজুদা একবার ডাকলেই সব হুড় হুড় করে নিচে নেমে চলে আসবে–
তারপর কিরণ একলাই বলে যেতে লাগলো। ক’টা আর ব্রিটিশ আছে ভারতবর্ষে, সব বাঙালী ছেলেরা যদি একবার রুখে দাঁড়ায়, তখন সব ব্রিটিশরা তো পাঁই পাঁই দৌড় দেবে নিজের দেশে। দেখছিস্ না, যত ভালো-ভালো বাড়ি, ভালো-ভালো গাড়ি, যত ভালো-ভালো জিনিস সব ওরা ভোগ করছে আমাদের ঘাড়ে চড়ে, আর আমরা নিজেদের দেশে ওদের গোলাম হয়ে বাস করছি। এই যে আমার বাবার অসুখ, সারছে না, ওষুধ পাচ্ছে না, এই যে তুই, পরের বাড়িতে তোর মা ভাত রেঁধে তোকে মানুষ করছে, তুই ভিক্ষে করে লেখাপড়া চালাচ্ছিস, এর জন্য দোষী কে বল্ তো? কখনও ভেবেছিস এসব কথা? কেন আমরা খেতে পাই না, আর ওদিকে কেন ওরা আরাম করে ফুর্তি করবে? কেন আমাদের দেশের লোক পুলিস হয়ে ওদের হুকুমে আমাদের মাথায় গুলি ছোঁড়ে? কেন চৌরঙ্গীতে অত পরিষ্কার পরিছন্ন আর কালীঘাটে কেন এত নোংরা নর্দমা? কখনও ভেবেছিস্ এ-সব কথা? কী রে, বলছিস না কেন? বল ভেবেছিস্?
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে–লক্ষ্মীদি কিন্তু তাই বিয়ে হলেও বদ্লাবে না–তুই দেখে নিস–
কিরণ অবাক হয়ে গেছে। দীপঙ্করের মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখে বললে– তুই এখনও ওই কথা ভাবছিস্ নাকি?
দীপঙ্কর বললে–না, লক্ষ্মীদি তো ঠিক সাধারণ মেয়ের মতো নয়!
–সাধারণ মেয়ের মতো নয়?
দীপঙ্কর বললে–তুই তো দেখেছিস্, তুই-ই বল্–লক্ষ্মীদি কি সাধারণ মেয়ের মতো?
কিরণ বললে–সাধারণ মেয়ে নয় তো কী? দুটো কান, একটা নাক–যা সব মেয়ের থাকে তাই-ই, আবার অসাধারণ কী আছে লক্ষ্মীদির মধ্যে?
দীপঙ্কর বললে–না, সব মিলিয়ে একটা লাবণ্য আছে না?
কিরণ বললে–ও বাবা, তুই আবার কবিত্ব করছিস্ যে! তুই দেখছি মুখ দেখে সব ভুলে গেছিস্–
দীপঙ্কর বললে–না ভাই, তুই জানিস না, বড় কষ্ট লক্ষ্মীদির, মনে করে দ্যাখ্ নিজের বাবা, নিজের বোন তারাও দেখতে পারে না লক্ষ্মীদিকে–কত ভীষণ কষ্ট বল্ দিকিন–
কিরণ রেগে গেল এবার। বললে–দেখ, আমার কাছে মেয়েদের গল্প আর করবিনি, মেয়েদের কথা ভাবাও পাপ, মেয়েদের সঙ্গে মেশাও পাপ–ভজুদা বলে, ওই বয়েসে মেয়েদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে ইহকাল পরকাল ঝরঝরে হয়ে যায়
দীপঙ্কর বললে–আমি তো বেশি মেলামেশা করি না ভাই
–হ্যাঁ, ভালো কথাই বলছি, বেশি মেলামেশা করবি না,–ওতে কাজকর্ম সব পণ্ড হয়ে যায়–ওরা কাজ পণ্ড করবার যম–
–না, আমি তো সব কাজকর্ম করি, লেখাপড়াও করি, বাজার করি। আর ওদের বাড়িতে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্যটা কী জানিস্–ওই কাকাবাবুকে ধরে একটা চাকরি যোগাড় করা–
মনে আছে তখন দীপঙ্কর অন্তত সেই কথাটাই বলতো নিজের মনকে। ভালো তার লাগতো ওদের বাড়িতে যেতে, ভালো লাগতো লক্ষ্মীদিকে দেখতে, সতীকে দেখতে কিন্তু আসলে সেটা ছিল গৌণ। আসলে চাকরিই তো তার দরকার ছিল। চাকরি হচ্ছিল না বলেই পড়া, চাকরি হচ্ছিল না বলেই লাইব্রেরী, চাকরি হচ্ছিল না বলেই আর সব কিছু
মনে আছে সকাল হতো আর দীপঙ্করের মনটা ছটফট করতো সমস্তক্ষণ। প্রতিদিনের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চেতনার স্পন্দনের সঙ্গে যেন ওই সতী আর লক্ষ্মীদি জড়িয়ে গিয়েছিল। কেন যে তাকে তারা অমন করে আপন করে নিয়েছিল, কেন যে তাদের জীবনের নাটকের সঙ্গে সেও ঘটনাচক্রে জড়িয়ে গিয়েছিল, কেন যে সে তার জীবনের অতখানি আগ্রহ ওদের জন্যে ব্যয় করতো–কে তার কারণ বলে দেবে। কোথাকার মেয়ে দুজন, কোথাকার কোন বর্মার ভুবনেশ্বর মিত্র, কোথায় তাঁর কাঠের ব্যবসা, কোথায় তাঁর বন্ধু শচীশবাবু–কে তাদের চিনতো যদি তারা উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে এসে বাড়ি ভাড়া না নিত। তাদের তো ভবানীপুরের ভদ্রপাড়ায় থাকবার কথা। তাদের তো বৌবাজারের শ্যামবাজারের বড়লোকদের পাড়ায় থাকবার কথা। কেন, কোন্ দুর্ভেদ্য কারণে তারা এসে থাকতে গেল কালীঘাটের নোংরা ঘিঞ্জি পাড়ায়, থাকতে গেল অঘোর ভট্টাচার্যির বাড়িতে। তারা যদি না আসতো ওখানে তা কী ক্ষতি হতো তাদের? আর তাদের সঙ্গে পরিচয় না হলে দীপঙ্করেরই বা কী ক্ষতি হতো! ক্ষতি! ক্ষতির কথা মনে হলেই দীপঙ্কর কেমন শিউরে উঠতো। সতীর সঙ্গে দেখা হওয়ার ক্ষতি যদি কিছু হয়েই থাকে–লাভ কি কিছুই হয়নি? লাভ কি কিছুই সে পায়নি জীবনে? আজ এতদিন পরে সেই পুরোন দিনের কথাগুলো ভাবতে গিয়ে দীপঙ্করের মনে হলো সেদিনকার সমস্ত ঘটনার মধ্যে কোথায় যেন তার ভাগ্যদেবতার বিরাট একটা ষড়যন্ত্র ছিল। নইলে…
মনে আছে সেই রাত্রেই লক্ষ্মীদি তাকে আবার ডেকেছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক রাত্রে দীপঙ্কর যখন উঠোনের কোণে আমড়া গাছটার তলায় ঘটি নিয়ে মুখ ধুচ্ছে, তখন। কিরণের কাছ থেকে ফিরতে তার রাত হয়ে গিয়েছিল। কিরণের সঙ্গে থাকলে তার সত্যিই সময়ের জ্ঞান থাকতো না।
কতবার দীপঙ্কর বলেছিল–আমি এবার আসি রে–
কিরণ বলেছিল–বোস না, বাড়িতে গিয়ে কী করবি এখন–এখানে আমার সঙ্গে কথা বললে তবু একটা কাজের কাজ হবে–
দীপঙ্কর বললে–তোর সঙ্গে মিশতে তোর সঙ্গে কথা বলতে তো আমার ভালোই লাগে–কত যে ভালো লাগে তা তুই জানিস না–
–তা হলে উঠে যাচ্ছিস কেন?
দীপঙ্করের বলতে যেন কেমন একটু সঙ্কোচ হলো। বললে–সবাই যে বারণ করে ভাই তোর সঙ্গে মিশতে–
–কেন, আমি তোর কী সর্বনাশ করেছি? আমি তোর কী ক্ষতি করেছি? তুই-ই বল?
ক্ষতি! সত্যিই তো। সেদিনও দীপঙ্করের সামনে কিরণ সেই একই প্রশ্ন তুলেছিল। অথচ লাভ-ক্ষতির ব্যাপারে হিসেব-নিকেশ করবার কথা তখন তো মনে আসেনি তার। কিরণ সত্যিই তার কিছু ক্ষতি করেছে কি? ক্ষতির কথা ভাবলেই দীপঙ্করের লাভের কথাটা মনে পড়ে। জীবনে ক্ষতির খতিয়ান কষতে গেলে বার বার তার মনে হয়েছে– সংসারে ক্ষতি বলতে বোধ হয় কিছুই নেই। ক্ষতির দিকটা কে যেন বরাবর লাভের অঙ্ক দিয়ে বিচিত্র উপায়ে পুষিয়ে দিয়েছে। কেমন করে পুষিয়ে দিয়েছে সে-কথা ভাবলেও যেন অবাক হয়ে যেতে হয়–
দীপঙ্কর বলেছিল–তুই যেন কিছু মনে করিস নি ভাই–
কিরণ বলেছিল–দূর, ও-সব মনে করলে আমার চলবে না–ও-রকম মেয়েলিপনা আমার নেই–মিশবি-মিশবি না-মিশবি না-মিশবি, আমার তাতে বয়ে গেল–
কিরণের কথাটা শুনে কেমন যেন মনে সেদিন কষ্ট হয়েছিল দীপঙ্করের। বলেছিল–আমি না মিশলে তোর একটুও কষ্ট হবে না কিরণ? কিচ্ছু কষ্ট হবে না? কিরণ সেই বিছানায় শুয়ে শুয়েই হেসেছিল। বলেছিল–কষ্ট? কষ্ট কেন হবে? আমার কষ্ট-ফষ্ট হয় না ভাই–তুই না মিশলে অনেক লোক আছে মেশবার–কোটি কোটি লোক আছে পৃথিবীতে। পৃথিবীটা কি এত ছোট ভেবেছিস? তুই না মিশলে কীসের কষ্ট? তুই যদি না মিশিস, তুই যদি মরেও যাস্ তাতেও আমার কষ্ট হবে না–
–হবে না? দীপঙ্কর অবাক হয়ে চেয়ে ছিল কিরণের দিকে।
–না, শুধু তুই কেন, আমার বাবা মরে গেলেও কষ্ট হবে না, আমার মা মরে গেলেও কষ্ট হবে না–আমার কারোর অভাবেই কোনও কষ্ট হবে না! আগে হতো কষ্ট! সি আর দাশ মরে যাবার দিন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল, আমার কান্না পেয়েছিল–প্রথম প্রথম ছোটবেলায় বাবার কষ্ট দেখে আমার কান্না পেত, মা’র দুঃখ দেখলে আমার কান্না পেত, খেতে না পেলে আমার কান্না পেত–শেষকালে এখন বুঝতে পেরেছি কান্না মানে মেয়েলিপনা–
–সে কী রে?
–হ্যাঁ, কান্না পাওয়া মানে হেরে যাওয়া। এ-সংসারে যে কাঁদে সে হেরে যায়– দীপঙ্করের মুখ দিয়ে অনেকক্ষণ কোনও কথা বেরোয় নি। কিরণের কথাগুলো শুনে কিরণকে যেন বড় নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল–কিরণ যেন বড় হৃদয়হীন। বড় অকরুণ, বড় নির্মম।
কিরণ বলেছিল–নইলে আমার মতন অবস্থায় পড়লে যে-কোনও লোক গলায় দড়ি দিত, গঙ্গায় ঝাঁপ দিত–রেলের চাকার তলায় মাথা দিত জানিস–কিন্তু অত সহজে হেরে গেলে তো চলবে না, অত সহজে আমি বেটাকে ছাড়ছি না–
–কোন্ বেটাকে?
কিরণ হো হো করে হেসে উঠলো। বললে–এই জীবন বেটাকে! বেটা বড় পাজি নচ্ছার রে
কিরণের হাসির সামনে দীপঙ্কর যেন কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সেই সেদিনই প্রথম দীপঙ্কর জানতে পেরেছিল জীবনের রহস্য। মনে হয়েছিল যেন জীবনটাকে কিছু কিছু বুঝতে পারছে, দেখতে পাচ্ছে, অনুভব করতে পারছে, উপলব্ধি করতে পারছে।
–হ্যাঁ রে, ও বেটা যত দাও তত নেবে, বেটা বড় লোভী, ওর খাঁকতির শেষ নেই, বেটাকে যত খোশামোদ করবি তত বেটার পায়া ভারি হবে! যত দিবি তত বলবে– আরো দাও। যত কাঁদবি তত বলবে-আরো কাঁদো
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমার বড় কষ্ট হয় ভাই, সব তাতে আমি বড় কষ্ট পাই– কাকাবাবু যখন তোর সঙ্গে মিশতে বারণ করলে আমায়, তখন আমার খুব কষ্ট হলো ভাই–এত কষ্ট হলো সে তুই বুঝবি না কিরণ! এখন তোকেই জিজ্ঞেস করছি–আমি কাকাবাবুর কথা শুনবো, না তোর কথা শুনবো!
কিরণ বললে–যা তোর খুশি তাই করবি! আমাকে জিজ্ঞেস করছিস্ কেন? তুই আমার কথা না-শুনলে আমার কিচ্ছু কষ্ট হবে না–বড় জোর লাইব্রেরী উঠিয়ে দেব–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমার নিজের ইচ্ছে ভাই আমি তোর কথা শুনবো–
–তাহলে তাই-ই কর–তাহলে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
–কিন্তু আবার মনে হচ্ছে কাকাবাবুর কথা না শুনলে যদি আমাকে চাকরি না দেয়? জানিস, সবাই আমাকে তোর সঙ্গে মিশতে বারণ করে, আমার মা বারণ করে, কাকাবাবু বারণ করে, কাকীমা বারণ করে, লক্ষ্মীদি বারণ করে, সতী বারণ করে–ভাই, কেউ তোকে দেখতে পারে না–কেন যে দেখতে পারে না বুঝতে পারি না–
–ওঃ, বাঁচা গেল, তোর কথা শুনে আশা হলো এবার!
কিরণ সেই অবস্থাতেই উঠে বসলো বিছানার উপর। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। হাসতে লাগলো পেট ভরে।
বললে–ওঃ, খুব ভালো হলো মাইরি! আর ভয় নেই–
দীপঙ্কর অবাক হয়ে দেখলে কিরণের মুখখানা যেন হঠাৎ বদলে গেল। হঠাৎ যেন বড় সুন্দর দেখাতে লাগলো কিরণকে। যেন সুস্থ হয়ে উঠলো কিরণ এক নিমেষে। বললে–আর ভয় নেই রে দীপু–আর ভয় নেই–কেল্লা মার দিয়া
কিরণের এই হঠাৎ আনন্দে যেন দীপঙ্কর হতবাক হয়ে গেল। কেউ দেখতে পারে না শুনে এমন আনন্দ হবে কিরণের তা তো ভাবেনি দীপঙ্কর। দীপঙ্করের তো ভাবনাই হয়েছিল–কেমন করে কথাটা পাড়বে, কেমন করে কথাটা তুলবে প্রথমে। কিন্তু সব শুনে যে এমন লাফিয়ে উঠবে কিরণ তা তো ভাবেনি দীপঙ্কর।
দীপঙ্কর বললে–কিরণ, কিরণ–কী হলো রে তোর?
কিরণ বললে–আনন্দ হবে না, কী বলছিস্ তুই?
হঠাৎ ডেকে উঠলো—মা—মা—
কেমন যেন কিরণের ব্যবহার দেখে অবাক লাগলো দীপঙ্করের। কিরণের মা তখনও বাইরে দাওয়ার ওপর অন্ধকারে বসে পৈতে কাটছিল। ঘরে এল ডাক শুনে। বললে–কী? কী হলো আবার?
কিরণ বললে–মা, দীপু একটা খুব ভালো খবর এনেছে–শোন মাও কিছু বুঝতে পারলে না। দীপঙ্করও কিরণের কথা কিছু বুঝতে পারলে না।
মা বললে–কী খবর?
বলে দীপঙ্করের মুখের দিকে চাইলে। ছেলের চাকরির খবর? ছেলের টাকা পাওয়ার খবর? পৃথিবীতে টাকার খবর ছাড়া আর কী সুখবর থাকতে পারে। পৃথিবীতে টাকাই তো সব। টাকা থাকলেই তো সব থাকা হয়। টাকা ছাড়া আর কিছু আছে নাকি সংসারে!
–কী খবর বাবা দীপু? কিরণের চাকরির খবর?
কিরণ বললে–শোন না মা দীপু কী বলছে! সবাই নাকি আমাকে ঘেন্না করে, কেউ নাকি আমাকে দেখতে পারে না-ও, এতদিন পরে তবু যা হোক অসুখটা একটু সারলো মা, আর ভাবনা নেই আমার।
মা যেন কেমন হতাশ হলো। দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–শুনলে তো কথা ওর?
দীপঙ্কর কী বলবে কিছুই ভেবে পেলে না। মা বলতে লাগলো–তোমরা দেখ দিকিনি কেমন! তোমার মা’র কপাল ভালো, অনেক পুণ্যি করেছিল তোমার মা, তাই তোমার মতো ছেলে পেয়েছে। কেমন পাশ করলে তুমি, লেখাপড়া করছো, আবার চাকরিও পাবে। আর আমার যে কী কপাল!
বলে মা আবার বাইরে চলে গেল। বোধ হয় তার চোখে জল এসে গিয়েছিল।
কিরণ বললে–মা তো সেকেলে মানুষ, লেখাপড়া জানে না তো, কেবল পৈতে কাটতে পারে–তাই শুনে কেঁদে ফেললে
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু চাকরি তো একটা করতে হবে তোকে? চাকরি না করলে এ সংসার চালাবি কী করে?
কিরণ বললে–এবার ঠিক চালাবো, দেখিস, আর ভয় নেই-যখন কেউ আমায় দেখতে পারে না, যখন সব্বাই আমাকে ঘেন্না করে, তখন চালাতে আর ভয় কীসের রে? প্রাণের টান যখন আর রইল না, চক্ষুলজ্জার বালাইও যখন আর রইল না-তখন আমাকে আর পায় কে রে? আমি তো এখন রাজা, যা খুশি তাই করবো
বলতে বলতে কিরণ যেন উন্মাদ হয়ে উঠলো।
বললে–আর কাকে পরোয়া করি আমি! লজ্জাও রইল না আর, ভয়ও রইল না আর-কেউ আর আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না, আমিও কাউকে নিয়ে মাথা ঘামাবো না। ভালোই হলো-তুইও আমার সঙ্গে আর মিশিস নিতুইও আর আসি নি আমাদের বাড়িতে-তুইও আর আমার সামনে মুখ দেখাস্ নি–ভালোই হলো–ভালো হলো রে দীপু-শুধু একটা কাজ করিস তুই কাজ!
দীপঙ্কর বললে–কী কাজ? বল্ না তুই! আমি এখখুনি করব ভাই-তোর জন্যে আমি সব করবো। বল কী কাজ?
কিরণ বললে–সব করতে হবে না, একটা কাজ করলেই চলবে–সেই দাতারকে মনে আছে? সেই এস এস দাতার? তোদের ভাড়াটেদের মেয়েটার সেই চেনা লোকটা?
দীপঙ্কর চমকে উঠলো। এস এস দাতার। লক্ষ্মীদির শম্বু?
বললো, খুব মনে আছে! কী হলো তার?
–সেই অনেকদিন আগে, পাঁচ টাকার একটা নোট দিয়েছিল, মনে আছে?
দীপঙ্কর বললে–খুব মনে আছে। কেন কী হলো তার? দেখা হয়েছিল নাকি তোর সঙ্গে কিরণ বললে–না ভাই, সেই নোটটা অচল–
–অচল!
দীপঙ্কর যেন আকাশ থেকে পড়লো। অচল নোট দিয়েছে তাদের! অত খাওয়ালে, অত খাতির করলে, অত উপদেশ দিলে তাদের দুজনকে! অত ভালো-ভালো কথা শোনালে! আসলে এমন জোচ্চোর? এমন বদমাইশ লোকটা! কী আশ্চর্য! আশ্চর্য হয়ে গেল দীপঙ্কর। পৃথিবীতে কি কাউকে বিশ্বাস নেই! সেই শম্ভু দাতার! তার জন্যে কতদিন দীপঙ্কর কত কী করেছে, কত বৃষ্টিতে ভিজেছে, কতদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’পা ব্যথা করে ফেলেছে–সেই শম্ভু দাতার ছেলেমানুষ পেয়ে ঠকালে!
দীপঙ্কর বললে–আমি কালকেই লক্ষ্মীদিকে খুব শুনিয়ে দেব ভাই-বলবো তোমার লোকটা ভালো নয়–ওর সঙ্গে তুমি মিশো না লক্ষ্মীদি, লোকটা বদমাইশ–এমন করে ছেলেমানুষ পেয়ে ঠকালে আমাদের–
কিরণ হাসছিল। দীপঙ্কর বললে–তুই হাসছিস, আমার কিন্তু খুব রাগ হচ্ছে ভাই! লক্ষ্মীদিটা কী? ওই রকম লোকের সঙ্গে মেশে লক্ষ্মীদি? ওই জন্যেই অত কষ্ট ওর, ওই জন্যেই তো কেউ দেখতে পারে না লক্ষ্মীদিকে, ওই জন্যে তো লক্ষ্মীদির বাবা ওকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে–দাঁড়া, আমি এখুনি যাচ্ছি, এখুনি গিয়ে বলবো
বলে দীপঙ্কর উঠছিল। কিরণ থামিয়ে দিলে। তখনও হাসছে কিরণ।
দীপঙ্কর বললে–তুই তবু হাসছিস ভাই–কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে খুব–
কিরণ বললে–তার চেয়ে এক কাজ কর, টাকাটা নিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে আয়- মিস্টার দাতার তো ঠিকানা দিয়েছিল আমাদের–
দীপঙ্কর বললে–না, লক্ষ্মীদির কাছেই এখুনি যাবোলশ্লীদিকে গিয়ে কথা শোনাবো, বলবোতোমরা ভেবেছ আমরা গরীব বলে এমন করে ঠকাবে আমাদের? গরীব বলে আমরা মানুষ নই?
তারপর একটু ভেবে বললে–আচ্ছা দে, টাকাটা দে–টাকাটা লক্ষ্মীদিকেই গিয়ে ফিরিয়ে দেব–
বালিশের তলা থেকে কিরণ হাসতে হাসতে নোটটা বার করে দিলে। দীপঙ্কর নোটটা নিয়েই বাইরে চলে এল। অন্ধকার তখন খুব। নেপাল ভট্টাচার্যি লেনটা এখানে একেবারে সরু হয়ে বস্তির মধ্যে গিয়ে মিশেছে। অন্ধকারটা দীপঙ্করের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। ছোটবেলা থেকে এ-বাড়িতে এসে এসে এ-বাড়ির পথঘাট সব চেনা। তবু যেন কেমন ধাক্কা খেল প্রথমটায়।
হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকলে—খোকা–
দীপঙ্কর পেছন ফিরলো। কাউকে স্পষ্ট দেখা যায় না। তবু মনে হলো যেন ঝাপসা সাদা। মতন কে দাঁড়িয়ে আছে সেখানটায়।
দীপঙ্কর বললে–কে?
সাদা চেহারাটা এবার এগিয়ে এল আস্তে আস্তে। বেশ ভারি গলা। অন্ধকারে স্পষ্ট চেনা যায় না। দীপঙ্করও একটু সামনে এগিয়ে গেল। একটু যেন স্পষ্ট হলো চেহারাটা তখন। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা। আন্দাজে মনে হলো লোকটা খুব ফরসা-ভয়ানক ফরসা। পাঞ্জাবি পরেছে, ধুতি পরেছে, চকচকে পাম্পশু পরেছে। দীপঙ্কর সামনে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। তবু চিনতে পারলে না। কে? লোকটা তাকে ডাকছে? না আর কাউকে?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-আমাকে ডাকছেন?
–তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
বেশ ভারি গম্ভীর গলা। ভরাট জমজমাট গলার স্বর। আওয়াজ শুনে দীপঙ্করের সমস্ত অন্তরাত্মা যেন চমকে উঠলো।
বললে–কেন? আপনি কে? লোকটা বললে–কোথায় গিয়েছিলে তুমি এত রাত্রে?
দীপঙ্কর বললে–কিরণ, আমার বন্ধু কিরণদের বাড়িতে-কিরণের খুব অসুখ কিনা তাই একবার দেখতে গিয়েছিলাম তাকে
–তুমি রোজ যাও?
–না, কোনও দিন যাই না, আমাকে সবাই যেতে বারণ করে ওদের বাড়িতে—
লোকটা আবার জিজ্ঞেস করলে তুমি কোথায় থাকো?
কোথায় থাকে দীপঙ্কর, কোথায় পড়ে, কী করে, বাড়ির ঠিকানা, বাড়িতে কে কে আছে, কোথায় দেশ-নানান কথা জিজ্ঞেস করলে লোকটা। কিন্তু কিছুতেই নিজের পরিচয় দিলে না। বিরাট চেহারা লোকটার। লোকটার সামনে দীপঙ্করের নিজেকে যেন বড় ছোট, বড় অকিঞ্চিৎকর মনে হলো। দীপঙ্কর উত্তর দিতে যেন বড় ভয় পেয়ে গেল। এত রাত্রে এখানে এই বস্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত খোঁজখবর নিচ্ছে কেন? এত করে জেরা করছে কেন?
লোকটা কথা বলতে বলতে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের দিকে ফিরে এল। দীপঙ্করও পেছনে পেছনে আসতে লাগলো। একটু যেন ভয়-ভয় করতে লাগলো তার। লোকটা কে? ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের রাস্তার আলোর তলায় আসতেই দীপঙ্কর চেহারাটা দেখে আরো ভয় পেয়ে গেল। কী ফরসা, ধপধপে ফরসা গায়ের রং। যেন ঠিক সাহেবদের মতোন। সাহেবের মতোন। মাথার চুল লাল। আদ্দির পাঞ্জাবি পরেছে, পাঞ্জাবির হাতা গিলে-করা। কোচানো শান্তি পুরে ধুতি। পায়ে পেটেন্ট লেদারের পাম্পশু।
উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়ির সামনেটায় আসতেই দীপঙ্করের যেন সাহস ফিরে এল বুকে। দরকার হলে দীপঙ্কর বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। আর কেউ তাকে ধরতে পারবে না, কেউ তাকে কিছু করতে পারবে না।
দীপঙ্কর বাড়ির দরজার সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো।
আর লোকটা সোজা চলতে লাগলো রাস্তাটা ধরে। রাস্তা ধরে এঁকে বেঁকে যেতে যেতে নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রীটের ওপর পড়তেই আর দেখা গেল না তাকে। দীপঙ্কর খানিক সেই দিকে চেয়ে সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো।
মা বললো রে, এতক্ষণ কিরণদের বাড়িতে বসে কী করছিলি রে? দেখা করেই তো চলে আসতে হয়–
দীপঙ্কর বললে–অসুখ করেছে ওর, আর গিয়েই চলে আসতে পারি আমি?
সেদিন মা আর বেশি কিছু কথা বললে না। বিন্তিদির বিয়ের ব্যাপার নিয়েই বোধহয় ব্যস্ত ছিল। নিজের মনেই যেন অনেক আয়োজন করছে মা। কারা বুঝি কবে দেখতে আসবে। কোথায় তাদের বসাবে, কোথায় তাদের খাওয়াবে, কী তাদের বলবে, কী পরাবে বিন্তিদিকে–এই সব অনেক ভাবনা মা’র। দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির বাড়ির জানলাটার দিকে চেয়ে দেখলে। আলো জ্বলছে লক্ষ্মীদির ঘরে। হয়তো পড়ছে–নিচের ঘরগুলোতেও আলো জ্বলছে। এখনও কেউ ঘুমিয়ে পড়েনি ও-বাড়িতে। আর এত সকাল-সকাল তো ওরা কোনওদিন ঘুমোয়ও না। কাকাবাবু আছে তেতলার ঘরটাতে। এখুনি একবার দৌড়ে ভেতরে গেলে হয়। গিয়ে শুধু বলে আসবে কথাটা। টাকাটাও ফেরত দিয়ে আসবে। দরকার নেই ও-টাকার। ও-টাকাটার ওপরেই যেন ঘেন্না ধরে গেছে দীপঙ্করের। কিন্তু সতী যদি থাকে! সতীর সামনে তো কথাটা বলা যাবে না। লক্ষ্মীদিকে। এখন ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীদিও আছে, সতীও আছে। দুজনেই এক ঘরে থাকে, এক ঘরে পড়ে, এক ঘরে শোয়। এখন যদি দীপঙ্কর গিয়ে হাজির হয়, তো হয়তো আবার সেদিনকার মতো কাণ্ড হবে। দুজনের মধ্যে আবার ঝগড়া বেধে যাবে দীপঙ্করকে নিয়ে। আবার লক্ষ্মীদি তাকে বকুনি দেবে, যা-ইচ্ছে-তাই বলবে, সতীর সামনেই দীপঙ্করকে অন্যায়ভাবে অপমান করে বসবে। তখন আর দীপঙ্করের মুখ থাকবে না কথা বলবার। তখন? তখন কী হবে?
শেষ পর্যন্ত ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে গেল লক্ষ্মীদির সঙ্গে।
খেয়ে উঠে আমড়া গাছতলাটায় আঁচাতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্মীদির গলা শোনা গেল।
–এই শোন।
দীপঙ্কর যেন এই ডাকটাই আশা করছিল এতক্ষণ। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে বললে–লক্ষ্মীদি, আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম-তোমাদের বাড়ির ভেতর তখন থেকে যাবো-যাবো করছিলাম–ভয়ানক দরকার ছিল!
–আমি লক্ষ্মীদি নই, আমি সতী!
যেন আকাশ ভেঙে হঠাৎ সামনে বাজ পড়লো। দীপঙ্করের হাত থেকে জলের ঘটিটা উঠোনের ইঁটের ওপর পড়ে ঝন ঝন করে একটা আওয়াজ হলো।
সতীর চেহারাটা তখন চোখের সামনে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। সতীর মুখটা যেন ভীষণ গম্ভীর। চেহারাটার দিকে চেয়ে দীপঙ্করের ভীষণ ভয় করতে লাগলো। দীপঙ্কর বলতে গেল–আমি ভেবেছিলাম….
সে-কথায় কান না দিয়ে সতী হঠাৎ বললে–লক্ষ্মীদি কোথায় গেছে জানো তুমি?
–লক্ষ্মীদি? লক্ষ্মীদি কোথায় গেছে? বাড়িতে নেই?
দীপঙ্করের চমকে ওঠা যেন তখনও শেষ হয়নি।
সতী বললে–না, সকাল বেলা কলেজে গেছে, এখন রাত দশটা বেজে গেল, এখনও ফেরেনি
দীপঙ্কর চুপ করে রইল। সতী আবার জিজ্ঞেস করলে–কোথায় গেছে তুমি জানো কিছু?
দীপঙ্করের মুখ দিয়ে এতক্ষণে কথা বেরোল। বললে–সত্যি বলছি আমি তো জানি না কিছু–
–তাহলে গেল কোথায় লক্ষ্মীদি? নিশ্চয় তুমি জানো!
দীপঙ্কর বললে–কোথায় গেল তা আমি কী করে জানবো, বা রে–যেখানে যায় আমাকে কি বলে যায়? আমিই বরং লক্ষ্মীদিকে খুঁজছিলাম, লক্ষ্মীদির সঙ্গে দেখা করবো ভাবছিলাম এখন–
সতী যেন কী ভাবতে লাগলো নিজের মনে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে কিন্তু এমন করে তা লক্ষ্মীদি কখনও যায় না, এত রাত তো করে না কখনও।
সতী এবার ভেতরেই চলে যাচ্ছিল। দীপঙ্করই ডাকলো। বললে—শোন–
দীপঙ্কর দরজার ভেতরে এগিয়ে এল এবার। বললে–লক্ষ্মীদি যদি আজ আর না ফেরে তো কী হবে?
সতী বললে–সে তোমায় ভাবতে হবে না—
দীপঙ্কর আবার বললে–আমি একবার খুঁজতে যাবো?
সতী বললে–এত রাত্রে তুমি কোথায় খুঁজতে যাবে?
তাই তো! এত রাত্রে দীপঙ্কর কোথায়ই বা খুঁজতে যাবে! কোথায় গেলে লক্ষ্মীদিকে পাওয়া যাবে! কোথায়ই বা যাওয়া লক্ষ্মীদির পক্ষে সম্ভব!
দীপঙ্কর বললে–লক্ষ্মীদির কলেজে গিয়ে একবার খোঁজ নেব আমি?
সতী বললে–না, কলেজে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল, আজ লক্ষ্মীদি কলেজেই যায়নি।
–কলেজে যায়নি? সে কি? কলেজে যায়নি তো খেয়ে দেয়ে সকাল বেলা কোথায় গেল?
সতী বললে–সে তোমায় অত ভাবতে হবে না দীপু-কাকাবাবু খুঁজতে গেছেন–
বলে সতী ভেতরে চলে গেল। দীপঙ্কর সেখানেই খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়াল। লক্ষ্মীদি কোথায় গেল তাহলে! কোথায় যেতে পারে। কোথায় যাওয়া সম্ভব লক্ষ্মীদির পক্ষে!
১৮
কলেজ যাবার পথে একবার নৃপেনবাবুর বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। মা-ই একবার যেতে বলেছিল। মাঝে মাঝে না মনে করিয়ে দিলে লোকে তো আর সেধে কারোর উপকার করে না। সংসার অত সোজা জায়গা নয়-সংসারের মানুষরাও অত সহজ নয়। বার বার বলতে হবে, বার বার খোশামোদ করতে হবে, বার বার দেখা করতে হবে, তবে যদি কাজ হয়।
নৃপেনবাবু চিনতে পারলেন তবু যা হোক। বললেন–এখন এলে? এখন যে আমার কথা বলবার সময় নেই হে–
দীপঙ্কর বললে–মা-ই আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে বললে কিনা–মা-ই পাঠালে আমাকে
–তাহলে তোমার আর আসবার দরকার নেই, তোমার মাকেই বরং পাঠিয়ে দিও একবার–
দীপঙ্কর চলেই আসছিল। নৃপেনবাবু আবার ডাকলেন। বললেন–ওহে ছোকরা, শুনে যাও–
ছোকরা ডাকটা বরাবর খারাপ লাগে দীপঙ্করের। তবু কাছে এগিয়ে গেল।
নৃপেনবাবু বললেন–তোমার মাকে বোল, এখন তিন-চারটে পোস্ট খালি হয়েছে, দু-চার দিনের মধ্যেই লোক নেওয়া হবে–
দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা তাই বলবো–
নৃপেনবাবু তবু ছাড়লেন না। বললেন–একটু তাড়াতাড়ি করতে বোলো তোমার মাকে–বুঝলে, বাজার তো খারাপ, আর ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না, তা তো জানো–
কথাগুলো ভালো লাগেনি দীপঙ্করের। সামান্য পঁচিশটা টাকা। নৃপেনবাবুর কাছে পঁচিশটা টাকা কী এমন বেশি! কিন্তু মা কোথা থেকে যোগাড় করবে? আর কোথাও করলেও ও-চাকরি করবে না দীপঙ্কর। ও তো ঘুষ!
রাস্তা দিয়ে ট্রাম চলেছে। বাসও চলেছে। নতুন নতুন সব বাস হয়েছে রাস্তায়। কোনওটার নাম উর্বশী’, কোনওটার নাম ‘মেনকা, কোনওটার নাম শকুন্তলা’, সব মেয়েদের নাম। বাসের গায়ের মেয়েদের নাম দিলে কী বেশি ভিড় হয়! বাসগুলো হু-হুঁ করে ট্রামের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আর দীপঙ্কর হাঁ করে চেয়ে থাকে। এদিকে আরো লোকজন বেড়ে গেছে। আগ সন্ধ্যেবেলাটার দিকে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। তারপর ট্রাম লাইন হলো এদিকে। ক্যাওড়াতলার দিক থেকে মস্ত বড় চওড়া রাস্তা বেরোল সোজা। বড় বড় পুকুর বুজিয়ে ফেলা হলো। সেই রাস্তা টিকেপাড়ার মোেড় ছাড়িয়ে হাজি কাশিমের বাজারটা বাঁয়ে রেখে একেবারে সোজা বালিগঞ্জের স্টেশনের দিকে গিয়ে পৌঁছলো। ধানক্ষেত, মাঠ, ধোপাপাড়া, আগুনখাকীর পুকুর, টিপু সুরতানের বাড়ি–সব যেন রাতারাতি অন্য রকম দেখতে হয়ে গেল। অন্য রকম চেহারা! যখন প্রথম প্রথম রাস্তা তৈরি হতো দীপঙ্কর গিয়ে সামনে দাঁড়াত। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো কুলীদের হ্যাঁগো, এখানে কী হবে?
কুলীরা বলতো রাস্তা হবে, রাস্তা দিয়ে ট্রাম চলবে—
দীপঙ্কর বলতো–এদিকটাও শ্যামবাজার হয়ে যাবে নাকি?
এদিকটা শ্যামবাজার, বৌবাজার, শেয়ালদার মতন হলে কেমন দেখাবে সেইটেই যেন কল্পনা করতে চেষ্টা করতো দীপঙ্কর। তখন আর এই পচা পুকুর থাকবে না শেতলাতলার সামনে। তখন আর ভূতের ভয় করবে না। টিপু সুলতানের বাড়িটার সামনে দাঁড়ালে আগে ভয় করতো। বড় বড় অশ্বথগাছের শেকড় সারা বাড়িটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল–ওখানে আলোয় আলো হয়ে যাবে একদিন। আশ্চর্য! কত ভুল ধারণাই ছিল একদিন দীপঙ্করের। একদিন ধারণা ছিল টিপু সুলতান বুঝি ওই বাড়িতেই ছিল এককালে। কিন্তু বড় হয়ে সে-ভুল ভাঙলো। টিপু সুলতান নয়, টিপু সুলতানের ছেলেরা থাকতো এই বাড়িতে। ছেলেবেলায় কত ভুল ধারণাই যে থাকে মানুষের। বড় হয়ে সে-সব কথা ভাবলে হাসি পায়।
কুলীরা বলতো–এখান থেকে সরে যাও বাবু, ধুলো লাগবে গায়ে–
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত কতদিন কত রকমভাবে এইখানে কাটিয়েছে দীপঙ্কর। চোখের সামনে সেই রসা রোড, সেই বালিগঞ্জ, সেই টালিগঞ্জ কী হয়ে গেল–আর যেন চেনা যায় না কিছু।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো-ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটাও ভাঙবে?
তখন দীপঙ্কর ভাবতো ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটাও যদি কুলীরা ভেঙে ফেলে! যদি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটাও এমনি করে এদিককার মতো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়! তখন কোথায় থাকবে দীপঙ্কর? কোথায় যাবে অঘোরদাদু, কোথায় যাবে বিন্তিদি! আর কোথায়ই বা থাকবে ছিটে-ফোঁটা। তখন আর ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন অত সরু থাকবে না। নেপাল ভট্টাচার্যি। লেনটার নর্দমাগুলোও বুজিয়ে দেবে। তখন কিরণরা কোথায় যাবে? কোথায় যাবে। কিরণের বাবা-মা? ওর বাবার যে অসুখ। ওদের যে টাকা-পয়সা নেই–ওরা কোথায় থাকবে?
আর কাকাবাবুরা! ওদের পয়সা আছে, ওরা অন্য বাড়ি ভাড়া নেবে হয়তো। ওদের ভাবনা নেই, ওদের টাকা আছে, ওরা বড়লোক, ওরা উঠে যাবে ভবানীপুরে চাউলপটিতে–অঘোরদাদুর বড়লোক যজমানদের পাড়ায়। কিম্বা বৌবাজারে কিংবা শ্যামবাজারে-ভদ্রলোকদের পাড়ায়। যেখানে রাস্তায় নর্দমা নেই, যেখানে দুর্গন্ধ নেই, নোংরা নেই-যেখানে বড়লোকরা থাকে–
সেদিন রাত্রিবেলা সতীর কাছে খবরটা পাবার পরই দীপঙ্কর যেন কেমন হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল!
মা জিজ্ঞেস করলে–কী রে, এখনও ঘুমোসনি তুই?
দীপঙ্কর বললে–ঘুম আসছে না মা–
মা’র পাশেই বরাবর শোওয়া অভ্যাস। ছোটবেলা থেকে মার কাছেই শুয়ে এসেছে।
মা বললে–তা সারাদিন রোদ্দুরে রোদ্দুরে টো-টো করে ঘুরবি তো ঘুম আসবে কী করে?
দীপঙ্কর বললে–না মা, সেজন্যে নয়–
–তাহলে কী জন্যে ঘুম আসছে না? কলেজ থেকে সোজা বাড়িতে এলেই পারিস, কলেজ থেকে বেরিয়ে কোথায় যাস শুনি? ওই ছোঁড়াটার সঙ্গে বুঝি টো টো করে ঘুরে বেড়াস
দীপঙ্কর বললে–না মা, কিরণের তো অসুখ, আর তোমাকে না বলে তো ওদের বাড়ি যাই-ই না আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেই তো আজ গেলুম
মা চুপ করে গেল। মার খুব বুদ্ধি। মা সব বুঝতে পারে। এমন মা পেয়েছিল দীপঙ্কর তাই আজো টিকে আছে, বড় হচ্ছে, মানুষ হচ্ছে। দীপঙ্কর বললে–জানো মা, কী কাণ্ড হয়েছে?
–কী কাণ্ড রে?
দীপঙ্কর কথাটা কাউকে না বলে যেন থাকতে পারছিল না। এমন করে লক্ষ্মীদি চলে গেল-এমন করে সকলকে ভাবিয়ে তুললে! কথাটা কিছুতেই মন থেকে দূর করতে পারছিল না। কিন্তু অন্য কোনও বিপদ-আপদও তো হতে পারে-রাস্তায় কত কী বিপদ হয়। নতুন বাস হয়েছে সব-‘উর্বশী’, ‘মেনকা’, ‘রম্ভা’–কত রকম নাম সব-রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া বেড়েছে। কত লোক চলতে গিয়ে হঠাৎ চাপা পড়ে যায় গাড়ির তলায়। খুব সাবধানে রাস্তা চলতে হয় আজকাল। হাজরা রোডের মোড়টায় আগে অত ভিড়ই ছিল না। এখন ওখানে বাসগুলো থামে, হুড় হুড় করে লোক নামে, তারপর বাসগুলো এসে থামে ঠিক কালীঘাট ট্রাম ডিপোর সামনে। ওখানেই বাসগুলো এসে থেমে যায়। আর যায় না। সব প্যাসেঞ্জার খালি হয়ে যায় ওখানটায়। এদিকে, ওদিকে, বালিগঞ্জের দিকে যেতে গেলে ওইখানে বাস থেকে নেমে হেঁটে যেতে হয়। গাদা গাদা বাস দাঁড়িয়ে থাকে ওখানে। যদি কোনও বাসের ধাক্কায় মাটিতে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়ে থাকে। তারপর হয়তো কোনও হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে লক্ষ্মীদিকে। হয়তো সেখানেই অজ্ঞান হয়ে রয়েছে এখনও। কিম্বা হয়তো এখন এই রাত্রিবেলা, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, যখন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটাও নিঝুম হয়ে আছে রাস্তার সেই ঘেয়ো কুকুরটাও আর ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে পাড়া মাত করে না–এখন হয়তো লক্ষ্মীদি একলাই শুধু যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
দীপঙ্করের যেন সারা রাত ঘুম আসবে না।
আস্তে আস্তে দীপঙ্কর উঠলো। মা ঘুমোচ্ছে। একটু শব্দ হলেই টের পাবে। ঘরের ভেতরে অঘোরদাদুর সিন্দুকটাও রয়েছে। মার ঘুম খুব সজাগ। আলো জ্বাললে টের পাবে মা। দীপঙ্কর উঠে আস্তে আস্তে দরজা খুললে। আবার আস্তে আস্তে ভেজিয়ে দিলে। কাকাবাবুদের বাড়িতে তখনও আলো জ্বলছে। আশ্চর্য! ওদের বাড়িতে বোধহয় কারো ঘুম আসছে না। কেউ ঘুমোতে পারবে না আজকে। একবার মনে হলো গিয়ে জিজ্ঞেস করে কাউকে। আস্তে আস্তে খিড়কির দরজার দিকে গিয়ে টোকা মারতে পারে। রঘু নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে ওখানে। রঘু শব্দ শুনেই দরজা খুলে দেবে। জিজ্ঞেস করলে হয় লক্ষ্মীদি ফিরেছে রঘু?
ওপরে যে-ঘরে লক্ষ্মীদিরা ঘুমোয়, সে-ঘরটাতেও আলো জ্বলছে। সতীর বোধ হয় ঘুম আসছে না। ঘুম তো আসতেই পারে না। পাশে কাকীমার ঘরটাতেও আলো জ্বালা। এত রাত পর্যন্ত কারোর ঘুম নেই। কিম্বা হয়তো কাকাবাবু এখনও ফেরেনি। এখনও হয়তো কাকাবাবু খুঁজে বেড়াচ্ছেন লক্ষ্মীদিকে!
হঠাৎ যেন একটা কীসের শব্দ হলো। চমকে উঠেছে দীপঙ্কর।
–কে রে? কে রে তুই?
দীপঙ্কর পেছন ফিরতেই দেখলে ফোঁটা। ছিটে এসেছে কিনা কে জানে, কিন্তু ফোঁটা বুঝি ফিরলো এখন। ফোঁটা অন্ধকারে পাঁচিল টপকেছে। পাঁচিল টপকে উঠোনে পড়তেই একটা ঝপাৎ করে শব্দ হয়েছে।
–তুই অন্ধকারে এত রাত্তিরে কী করছিস রে ছোঁড়া?
মুখ দিয়ে যেন মদের গন্ধ বেরোচ্ছে ফোঁটার। কাছে এল, ভালো করে দীপঙ্করের মুখের কাছে মুখ আনলে।
–কী করছিস তুই এত রাত্তিরে?
দীপঙ্কর বললে–ঘুম আসছে না
–ভাত খেইছিস?
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ–
ফোঁটা বললে–বেড়ে আছিস তোরা মাইরি, বেড়ে–পরের ঘাড়ে চড়ে বেড়ে আরাম করে ফুর্তি করছিস? যার ধন তার নয় নেপোয় মারে দই! আমার শালার বাড়ি, আমার ঘর, আর আমিই শালা কেউ না
ফোঁটা চলে যাচ্ছিল। ঘরের ভেতরে ফোঁটার ভাত ঢেকে রেখে দিয়েছে মা। ফোঁটা যাবে ভাত খাবে, তারপর ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর ভোর হতে না হতেই আবার বেরিয়ে পড়বে। এই-ই নিয়ম ওদের। বরাবর ছিটে-ফোঁটাদের নিয়মই এক। দুপুরবেলা গঙ্গায় ডুব দিয়ে নিয়ে বেলা তিনটেয় আবার এসে এক ফাঁকে খেয়ে যাবে।
কিন্তু কী যে হলো, খানিক দূর গিয়েই আবার ফিরলো। ফিরে আবার একেবারে মুখ ঘেঁষে দাঁড়াল।
বললে–চার আনা পয়সা আছে তোর কাছে ভাই?
দীপঙ্কর সরে এল পেছনে। বললে–পয়সা তো নেই–
–ওমনি পয়সা নেই? চাইলেই পয়সা নেই ওমনি!
বলতে বলতে চলে যাচ্ছিল ফোঁটা। কিন্তু আবার কী খেয়াল হলো–আবার ফিরলো।
বললে–একটা বিড়ি দে তো—
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে–বিড়ি আমি কোথায় পাবো?
ফোঁটা এবার নিজেই অবাক হয়ে গেছে। বললে–একটা বিড়িও দিতে পারবি না?
ফোঁটার মুখের দিকে চেয়ে দীপঙ্করের মনে হলো যেন আকাশ থেকে পড়েছে সে। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না কথাটা।
দীপঙ্কর বললে–সত্যি বিড়ি নেই আমার কাছে
–তুই কী রে? আমাদের ঘাড়ে পড়ে খাচ্ছিস, দাচ্ছিস, আরাম করছিস আর সামান্য একটা বিড়ি দিয়েও উপকার করতে পারবি না?
যেন বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি তার। বলতে লাগলো-পয়সা নয়, আধলা নয়, এক পয়সার আটটা বিড়ি-বিড়ি তো লোকে দান-খয়রাতও করে–তুই আমাকে অবাক করলি মাইরি
বলতে বলতে চলে গেল ফোঁটা।
যাবার সময় বলে গেল–আচ্ছা, দেখাচ্ছি, তোকে, টের পাওয়াচ্ছি–
দীপঙ্কর যেন ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি আবার ঘরে ঢুকে পড়লো। দরজা বন্ধ করতে গিয়েই খট করে একটা আওয়াজ হয়েছে আর মা চিৎকার করে উঠেছে-কে? কে?
–আমি মা, আমি!
একটু সামান্য শব্দ হলেই মার ঘুম ভেঙে যায়। মা উঠে পড়লো। বললে–কী করছিলি?
দীপঙ্কর বললে–বাইরে গিয়েছিলুম মা–
–বাইরে গেলি তো আমাকে ডাকলি না কেন? আমি বলেছি না যে, বাড়ির বাইরে গেলে আমাকে ডেকে দিয়ে যাবি?
দীপঙ্কর বললে–আমি কোথাও যাইনি মা, শুধু উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম একটু–
মা বললে–তা এই এত রাত্তিরে আবার উঠোনে গিয়ে দাঁড়ানো কী?
দীপঙ্কর বললে–ঘুম আসছে না–
–ঘুম আসছে না তা উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালে ঘুম আসবে?
মা আবার আলো জাললে। আলো জেলে সিন্দুকের তালাটা দেখলে। তক্তপোশের তলাটা দেখলে। চারদিক থেকে তারপর আবার শুলো। বললে–দেখছিস ঘরে এতগুলো পরের টাকা রয়েছে, এমন করে দরজা হাট করে যেতে আছে? নৃপেনবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলি? তবে কেন?
–গিয়েছিলুম।
–কী বললেন?
দীপঙ্কর বললেন–বললেন তোমার মা’কে পাঠিয়ে দিও, দু-তিনটে চাকরি খালি আছে–আমি কিন্তু মা ও-চাকরি করবো না, তা বলে রাখছি-ঘুষ দিয়ে আমি চাকরি করবো না–
মা যেন একথা শুনতে পেলে না। বললে–দেখি, তোর অঘোরদাদুকে বলে, যদি কুড়িটা টাকা দেন, কুড়িটা টাকা দিলেই হয়ে যাবে, আমার কাছে পাঁচটা টাকা আছে–
আর তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লো দীপঙ্কর হুঁশ ছিল না। মা’র ঘুম আসবার আগেই দীপঙ্কর ঘুমিয়ে পড়েছিল।
.
ভোরবেলা মন্দিরে ফুল দিয়ে এসেই দীপঙ্কর সোজা কাকাবাবুদের বাড়ি গিয়েছিল। সামনেই প্রথমে দেখা হলো রঘুর সঙ্গে। ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলে-রঘু, লক্ষ্মীদি আসেনি?
রঘু বললে–আসেনি।
তাহলে সবাই ভাবছে তো খুব! জিজ্ঞেস করলে–কাকীমা কোথায়?
–ওপরে।
–কাকাবাবু?
–সবাই ওপরে, দোতলায়।
–আর সতী?
–সতী দিদিমণিও ওপরে, সবাই সতী দিদিমণির ঘরে বসে আছে।
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে গেল। কিন্তু উঠতে গিয়েও যেন পা উঠলো না। সত্যিই তো, এখন সবাই ভেবে অস্থির হচ্ছে, এই সময়ে সে গিয়ে বিরক্ত করবে! হয়তো কাকাবাবু অনেক রাত্রে ফিরেছেন। সমস্ত রাত ধরে এখানে সেখানে হাসপাতালে থানায়–সর্বত্র ঘুরে খোঁজ নিয়েছে। হয়তো খোঁজ পায়নি কিম্বা হয়তো খোঁজ পেয়েছে। আস্তে আস্তে ওপরের বারান্দায় গিয়ে উঠলো। উঠে কান পেতে রইল। লক্ষ্মীদির ঘরে যেন কাকাবাবুর গলা শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে কাকীমার। মাঝে মাঝে সতীর কথাও শোনা যাচ্ছে
–এখন তো তোমার বাবাকে টেলিগ্রাম করতে হয়! শেষকালে তিনি বলবেন, তোমরা ছিলে আর সময়মত আমাকে খবর দিতে পারলে না একটা! তখন?
কাকীমার গলা শোনা গেল এবার। কাকীমা বললেন–কিন্তু তিনি রইলেন সাত সমুদুর পারে, তাকে মিছিমিছি বিরক্ত করা কি ভালো হবে?
সতী বললে–বাবার কিন্তু খুব শরীর খারাপ, এ-খবর পেলে তাকে আর বাঁচানো যাবে না কাকাবাবু
কাকীমা বললেন–আর একটা দিন দেখ না–হয়তো এসে যাবে–
সতী বললে–কিন্তু কোথায়ই-বা যেতে পারে? আমি তো সব সময়েই পেছনে পেছনে আছি–যেখানে যেত লক্ষ্মীদি, সেখানেই আমি যেতাম পেছন পেছন–যার সঙ্গেই কথা বলতো, তার সঙ্গেই আমি ভাব করতাম, তার সঙ্গে ভাব করে জেনে নিতাম লক্ষ্মীদি কী বললে–
–তাই-ই কি সব সময়ে সম্ভব? তোমারও তো নিজের কাজকর্ম আছে, নিজের লেখাপড়া আছে, নিজের শরীর আছে, নিজের বিশ্রাম আছে–
–না কাকাবাবু, তবু আমি দিনরাত চোখ রাখতাম! আমি যে জানতাম আগে থেকেই-সেখানেও স্কুলে পড়াবার সময় ওইরকম করতো কিনা। সে একটা ছেলে ছিল, তার হাত দিয়ে লুকিয়ে চিঠি পাঠাতো। শেষকালে আমিই তো ধরলাম একদিন–
কাকাবাবুর গলা শোনা গেল।
তিনি বলছেন–কিন্তু সে-ছেলেটা কোথায় গেল? সেই যে সেই একটা মারহাট্টি ছেলে ছিল সেখানে–কী যেন নাম শুনেছিলাম তার?
–সে তো বর্মায়, সে এখানে কী করে আসবে কাকাবাবু?
কাকীমা বললেন–সে তো ব্যবসা করতো ওখানে-শুনেছিলাম তো খুব বড়লোক! কাঠের ব্যবসা করতো–
সতী আবার বললে–বড়লোক হলে কী হবে কাকাবাবু-স্বজাতি তো নয়–আর তাছাড়া বাবা ওসব পছন্দ করেন না, আপনি তো জানেন। আর আমিও পছন্দ করি না। কাকাবাবু ওসব। আমরা হচ্ছি হিন্দু, হিন্দু মেয়েদের স্বামী জন্মের আগে থেকে ঠিক হয়ে থাকে–হিন্দু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক কী বলল কাকীমা–
কাকীমা বললেন–সে তো বটেই, এখন কী করবে তাই বলো?
কাকাবাবু বোধহয় এতক্ষণ ভাবছিলেন। বললেন–এখানে লক্ষ্মী আর কোথাও যেত? কলেজ কি বাড়ি ছাড়া আর কোনও জায়গায় যেতে চেয়েছে কখনও?
সতীর গলা শোনা গেল এবার। সতী বললে–এখানে তো কোথাও যায়নি, আমি আসার পর বরাবর তো লক্ষ্মীদির সঙ্গেই সব জায়গায় গেছি–আর যাবেই বা কোথায়? এখানে তো আমাদের চেনা-শোনা কেউ নেই।
কাকীমা বললেন–সেদিন যে কোথায় গেলে তোমরা দু’জনে–সেই অনেকদিন আগে একদিন বিকেলবেলা?
–সে তো জয়ন্তীদের বাড়ি, জয়ন্তী পালিত, লক্ষ্মীদির ক্লাসে পড়ে, ব্যারিস্টার মুখার্জি রোডে–তাদের বাড়িতে-চায়ের নেমন্তন্ন করেছিল–সেই তো একদিন মাত্র, তারপর তো আর কোথাও যাইনি–
দীপঙ্কর কান পেতে কথাগুলো শুনতে লাগলো। শুনতে শুনতে তার মনে হলো সে যেন অন্যায় করছে। তার হয়তো এসব শোনা উচিত নয়। ওদের ঘরের ভেতরের কাহিনী সব তার কি শোনা উচিত! সে তো বাইরের লোক, লক্ষ্মীদি তাকে যত ভালোই বাসুক, সতীর সঙ্গে তার যত ভাবই থাক, কাকাবাবু তার যত শুভাকাঙ্খীই হোন–তার তো এসব শোনা উচিত নয়।
দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসছিল, হঠাৎ কাকাবাবুর গলা শোনা গেল।
কাকাবাবু বললেন–আর এই যে অঘোর ভট্টাচার্যির বাড়িতে যারা থাকে–যার মা রান্না করে ওদের বাড়িতে, দীপুবাবু–
কাকীমা বললেন—আমাদের দীপু?
সতী বলল–না কাকাবাবু, আমার প্রথমটা সন্দেহ হয়েছিল তাই–
দীপঙ্করের বুকটা দুর দুর করে উঠলো। তার সম্বন্ধেই কথা হচ্ছে। তাকে নিয়েই আলোচনা করছে এবার ওরা।
সতী বললে–লক্ষ্মীদির চিঠিতে আমি ওর কথা শুনেছিলাম, শুনে প্রথমে আমারও সন্দেহ হয়েছিল–তারপর….
দীপঙ্কর এবার কান খাড়া করে শুনতে লাগলো। চারদিকে একবার দেখে নিলে। কেউ কোথাও দেখতে পাচ্ছে না তো তাকে! হঠাৎ যেন তার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। সতী! সতীই একদিন চারটে পয়সা ছুঁড়ে দিয়েছিল তার দিকে। সতীকেই কত সন্দেহ। করেছে সে! সতী বলতে লাগলো-তারপর দেখলাম, না সে-সব মতলব নেই ওর–
কাকীমা বললেন–ও ছেলেটা ভালোই তো মনে হয়–
সতী আবার বললেও তো সকালে মন্দিরে যায় ফুল দিতে। তারপর নিজের বন্ধুবান্ধব, লাইব্রেরী আর নিজের লেখাপড়া নিয়েই থাকে–
হঠাৎ দীপঙ্করের মনে হলো একতলায় যেন কার পায়ের শব্দ হলো। রঘু হয়তো ওপরে উঠছে। এখন আর পালাবার উপায় নেই। সোজা এগিয়ে গিয়ে একেবারে লক্ষ্মীদির ঘরের সামনে দাঁড়াল।
–এই যে দীপুবাবু, হঠাৎ?
কাকাবাবু সামনেই ছিলেন। কাকীমাও দেখলেন। সতীও দেখলে। সবাই যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছেন একটু মনে হলো।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন-এখন এলে তুমি?
সতী বললেও বোধহয় লক্ষ্মীদিকে খুঁজতে এসেছে। কালকে বলেছি কিনা ওকে—
দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে-লক্ষ্মীদি আসেনি?
মনে হলো সবাই যেন তার দিকেই চেয়ে রয়েছে। কেউ হয়তো উত্তর দিলে, কিন্তু কারো উত্তরই যেন তার কানে গেল না। মনে মনে সবাই যেন তাকে সন্দেহ করছে। সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন বড় অস্বস্তিকর মনে হলো। তারপর কখন যে সে নিচে চলে এসেছে, কখন যে একেবারে সোজা বাড়ি চলে এসেছে, কখন যে খেয়ে দেয়ে কলেজে এসেছে, তার কোনও খেয়ালই ছিল না। কলেজেও যেন কোনও দিকে খেয়াল ছিল না। আবার কখন ছুটি হয়েছে–কখন রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হয়ে ঘুরেছে তারও খেয়াল ছিল না তার। হঠাৎ আবার যেন সম্বিৎ ফিরে পেলে দীপঙ্কর।
হঠাৎ দীপঙ্করের মনে হলো যেন ট্রামের মধ্যে দাতারবাবু বসে আছে। ঠিক দাতারবাবুর মতোন চেহারা। সেই রকম কোটপ্যান্ট, নেকটাই পরা। সেই রকম সিগারেট খাচ্ছে। কিন্তু তবু যেন কেমন সন্দেহ হলো। যেন সেই আগেকার চেহারা আর নেই। দু-একদিন দাড়ি কামানো হয়নি।
–দাতারবাবু, দাতারবাবু?
দাতারবাবু শুনতে পেয়েছে। পেছন ফিরে দেখেই চিনতে পেরেছেন দীপঙ্করকে। চিনতে পেরেই যেন তাড়াতাড়ি ট্রাম থেকে নেমে পড়েছেন। কিন্তু ট্রাম থামতে থামতেও অনেক দূরে গিয়ে তবে থামলো। দাতারবাবু ফিরে এলেন খানিকটা, দীপঙ্করও এগিয়ে গেল।
–দাতারবাবু, আপনি এদিকে?
–তুমি? দীপু না?
দাতারবাবুর কোট-প্যান্ট যেন আর ঠিক আগের মতো নেই। একটু যেন ময়লা ময়লা। আগে যেন অনেক দেখতে ভালো ছিল দাতারবাবু। অনেক ফরসা, অনেক সুন্দর।
দীপঙ্কর বললে–আপনি বুঝি আমার ডাক শুনতে পেয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, আর আমিও তো এখানেই নামতাম, এখানে কাছেই আমার কাজ আছে একটা-তোমাদের লাইব্রেরী কেমন চলছে?
দীপঙ্কর বললে–আপনি সেই চাঁদা দিয়েছিলেন মনে আছে? সেই খিদিরপুরের রাস্তায়? আমাদের অনেক খাওয়ালেন! শেষে পাঁচটা টাকা দিলেন!
দাতারবাবু বললেন–খুব মনে আছে–তা তোমরা তো আর চাঁদা চাইতে গেলে–আমি তোমাদের ঠিকানা দিয়েছিলুম-তোমার সেই বন্ধু, কী যেন তার নাম?
–কিরণ!
–হ্যাঁ, কিরণ কেমন আছে?
দীপঙ্কর বললে–তার খুব জ্বর হয়েছে, জানেন-ওরা খুব গরীব, ভারি ভালো ছেলে ও–
দাতারবাবু বললেন–তা হোক, গরীব হওয়া কি দোষের?
দীপঙ্কর বললে–দোষের নয়! কিন্তু গরীব বলে সবাই ঘেন্না করে আমাদের চাকরির জন্যে যার কাছেই যাই, সবাই কেমন মুখ বেঁকিয়ে কথা বলে–ভালো করে কথাই বলতে চায় না
দাতারবাবু চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন–ও-রকম আঘাত পাওয়া একটু ভালো দীপু, আঘাত না পেলে কি বড় হওয়া যায়?
–কিন্তু মাঝে মাঝে বড় দমে যাই যে
দাতারবাবু বললেন–যত আঘাতই পাও, নিজের কাছে যেন কখনও ছোট হয়ো না দীপু
দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। বললে–নিজের কাছে ছোট হয়ো না মানে?
দাতারবাবু বললেন–টাকার দারিদ্র্য একদিন ঘুচলেও ঘুচতে পারে, কিন্তু মনের দারিদ্র্যের আর ওষুধ নেই দীপুওর কোনও ক্ষমাও নেই, আমি অনেক আঘাত পেয়েছি জীবনে অনেক ভালোবাসাও পেয়েছি, কিন্তু নিজের কাছে নিজেকে কখনও ছোট করিনি
দীপঙ্কর যেন নতুন কথা শুনলে দাতারবাবু মুখ থেকে। অবাক হয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো পাশ থেকে। কী লোক, কত ভালো লোক, অথচ বাইরে থেকে মানুষকে দেখে তো কিছুই বোঝা যায় না। বাইরের চেহারা দেখে মানুষকে বিচার করতে যাওয়ার মতো ভুল বুঝি আর নেই! এত ভালো লোক! দাতারবাবুর তুলনায় দীপঙ্কর কতটুকু, কত সামান্য! তবু তো দেখতে পেয়েই ট্রাম থেকে নেমে পড়েছেন। কত কাজ, কত কাজের মানুষ দাতারবাবু, তবু দীপঙ্করের সঙ্গে কথা বলে তো সময় নষ্ট করছেন। এত ভালো লোক বলেই তো সবাই দাতারবাবুকে এত ভালোবাসে–
দাতারবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন-তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?
দীপঙ্কর বললে–কোথাও যাচ্ছি না, এমনি ঘুরছি—
দাতারবাবুও যেন একটু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–এমনি ঘুরছো? কেন?
দীপঙ্কর বললে ভালো লাগছে না, মাঝে মাঝে আমার এমনি কিছুই ভালো লাগে না–
তারপরে হঠাৎ বললে–আপনি নিশ্চয়ই খবর পেয়েছেন, লক্ষ্মীদি চলে গেছে–
দাতারবাবু চাইলে দীপঙ্করের দিকে কেমন যেন অবাক হয়ে। দীপঙ্করের মনে হলো যেন দাতারবাবু খবরটা বিশ্বাস করছে না। বললে–হ্যাঁ দাতারবাবু, ওদের বাড়িতে খুব ভাবনা-চিন্তা চলেছে, কাকাবাবু সারারাত ধরে কত জায়গায় খুঁজেছে-এখনও পাওয়া যায়নি
দাতারবাবু বললে–তুমিও সেই কথা ভেবে ভেবে ঘুরে বেড়াচ্ছ নাকি?
–হ্যাঁ দাতারবাবু, আমারও কাল থেকে রাত্রে ঘুম হচ্ছে না-লক্ষ্মীদি যে কোথায় গেল! আমাকে খুব ভালোবাসততা লক্ষ্মীদি
একটু থেমে আবার বললে–মনে আছে আপনার, সেই আপনাকে চিঠি দেওয়া? সেই আপনি দাঁড়িয়ে থাকতেন কালীমন্দিরের সামনে, আর আমি চিঠি দিয়ে আসতাম? তখন থেকেই আমাকে ভালোবাসততা!
দাতারবাবু জিজ্ঞেস করলেন-ওরা কী বলছে সবাই, তোমার লক্ষ্মীদির বাড়ির লোকরা?
–কী আবার বলবে? চারদিকে খোঁজাখুঁজি চালাচ্ছে-কাকাবাবু তো মস্ত বড় চাকরি করেন, অনেক জায়গায় জানাশোনা। যেদিন প্রথম বাড়িতে এল না লক্ষ্মীদি, সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করেছেন কাকাবাবু
–কেউ জানে না কোথায় গেছে?
–না, কেউ জানে না দাতারবাবু, আমি আজ সক্কালবেলা লক্ষ্মীদিদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, কাল সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি মোটে
–কে বললে তোমায় খবরটা?
দীপঙ্কর বললে–সতী। ওর ছোট বোন–মেয়েটা ভালো, খুব ভালো, জানেন দাতারবাবু! লক্ষ্মীদির বাবা তো বর্ষায় থাকে, খুব বুড়ো মানুষ, তাঁর স্বাস্থ্য খুব খারাপ, লক্ষ্মীদির এই কাণ্ড যদি তার কানে যায় তা তিনি হার্ট ফেল করবেন
দাতারবাবু যেন কথাটা শুনে কী ভাবতে লাগলেন।
দীপঙ্কর বললে–সতী মেয়েটা বাপকে ভালোবাসে খুব জানেন–অথচ লক্ষ্মীদি বাবার কথা একদম শুনবে না
দাতারবাবু বললেন–তা তুমি এখন বাড়ি যাবে তো?
–বাড়ি যেতে আর ইচ্ছে করছে না দাতারবাবু। লক্ষ্মীদি নেই তো, তাই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে বাড়িটা-কিছু ভালো লাগে না, বাড়িতে থাকতেই ভালো লাগে না। অথচ আগে কলেজ থেকেই বাড়িতে চলে যেতাম, লক্ষ্মীদির কাছে যেতাম। জানেন দাতারবাবু, লক্ষ্মীদি আমায় কত বকেছে, কত মেরেছে, কত চুল ধরে টেনেছে, তবু খুব ভালো লাগতো আমার-তবু লক্ষ্মীদিকে খুব ভালোবাসতুম আমি
–আর ওর ছোট বোন সতী?
দীপঙ্কর বললে–আগে সতীকে আমার মোটে ভালো লাগতো না দাতারবাবু, কিন্তু দুটো বোনই ভালো–আমরা ওদের তুলনায় কত গরীব, ধরুন পরের বাড়িতেই বলতে গেলে মানুষ হয়েছি আমি কিন্তু তবু সতী আসে আমাদের বাড়িতে, আমার মাকে মাসীমা বলে ডাকে–অথচ আমার সঙ্গে কথা না বললেই পারতো! ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা হয়–বলুন?
মনে আছে দাতারবাবুর সঙ্গে সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। যেন প্রথম একজন লোক পেয়েছে সব মনের কথা বলবার, সব প্রাণের কথা শোনাবার। দাতারবাবুর সঙ্গে রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে দীপঙ্করের সেদিন মনে হয়েছিল, এমন সহানুভূতি নিয়ে কেউ বুঝি আগে তার কথা শোনেনি।
দীপঙ্কর বললে–এক-এক সময় কী ভয় হয় জানেন? ভয় হয়–ওঁরা যদি হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে উঠে যায়?
–উঠে যাবে কেন?
দীপঙ্কর বললে–না, চলে হয়তো যাবে না, কিন্তু চলে যেতেও তো পারে। লক্ষ্মীদির জন্যেই তো ওই রকম নোংরা জায়গায় বাড়ি ভাড়া করেছিল–
–কেন?
দীপঙ্কর বললে–তা বুঝি জানেন না? ওই রকম জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল কারণ লক্ষ্মীদি তাহলে আর কারো সঙ্গে মিশতে পারবে না–
–তা আমাকে যে সেই আগে আগে তোমার লক্ষ্মীদি চিঠি পাঠাতে তোমার হাত দিয়ে, সে-কথা আজও কেউ জানতে পারেনি?
দীপঙ্কর বললেনা, কেউ জানতে পারেনি, আমি কাউকেই বলিনি। লক্ষ্মীদি আমাকে বলতে বারণ করে দিয়েছিল যে। বলে দীপঙ্কর দাতারবাবুর দিকে চাইল।
বললে–আমি মা’কেও বলিনি–অথচ মাকে আমি সব কথা বলি, জানেন! কিরণকেও বলিনি, কিরণকেও তো আপনি দেখেছিলেন। কিরণ আমার অত বন্ধু তবু বলিনি। আর সতী? লক্ষ্মীদির ছোট বোন? সে কত চেষ্টা করেছিল জানতে-কত আমার পেছনে-পেছনে লেগে থাকতো, কত আমাকে সন্দেহ করেছে–দিনরাত কেবল আমাকে জেরা করেছে–তবু বলিনি! কেন বলিনি জানেন? লক্ষ্মীদি আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল বলে!
তারপর একটু থেমে বললেওরা যদি আমাদের বাড়ি থেকে চলে যায় তো খুব খারাপ লাগবে!
–কিন্তু চিরকাল তো কেউ থাকে না।
দাতারবাবু যেন সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। বললেন–একদিন নিজের বাপ-মা তারাই চলে যায়–তা এরা তো পর
দীপঙ্কর বললে–পর বটে কিন্তু এতদিন মিশে মিশে প্রায় নিজের লোকের মতো হয়ে গিয়েছিল ওরা, দাতারবাবু–ধরুন ওদের বাড়ি যখন-তখন গিয়েছি, যখন-তখন একেবারে লক্ষ্মীদির ঘরের মধ্যে চলে গিয়েছি, ওদের বিছানায় শুয়েছি, কাকাবাবুর ঘরেও গিয়েছি–কেউ আমাকে কিছু বলেনি—
.
সত্যিই, সেই প্রথম লুকিয়ে লুকিয়ে নাচ দেখবার সময় থেকে, সতীর আসার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত আর কোনও দূরত্ব ছিল না ওদের সঙ্গে। যখন কোথাও যাবার জায়গা ছিল না, তখন দীপঙ্কর সোজা এসেছে লক্ষ্মীদিদের বাড়িতে। কতদিন ওদের বাড়িতেই খেয়েছে–শুধু ঘুমোবার সময়টা বাড়ি চলে গিয়েছে। খুব ঝম্-ঝম্ করে বৃষ্টি পড়েছে, কাকীমা খিচুড়ি রান্না করেছেন–সেদিন দীপঙ্করও একসঙ্গে বসে খেয়েছে। শুধু জানালা দিয়ে চিৎকার করে বলেছে–মা, আমি আজ এখানে খেয়ে নিচ্ছি-বাড়িতে খাবো না। মা’র সঙ্গে সতীও গেছে কালীমন্দিরে পুজো দিতে। সঙ্গে গেছে দীপঙ্কর। কালীমন্দিরের সব পাণ্ডা সব ঠাকুরদের চিনতো দীপঙ্কর। সতী পাণ্ডাদের কাছ থেকে ডালা কিনেছে, গাঁদা ফুলের মালা কিনেছে, কিনে মন্দিরে পুজো দিয়েছে। গলায় আঁচল দিয়ে, পাথরে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছে–
মা বলতো-ভালো ঘর হোক, ভালো বর হোক মা, তোমার–
কী ভক্তিই ছিল সতীর তখন। প্রসাদটা নিয়ে কত ভক্তি করে মাথা উঁচু করে মুখের মধ্যে পুরে দিত। মুখে পুরে দিয়ে হাতের পাতাটা মাথায় ঠেকাতো। দীপঙ্কর অবাক হয়ে যেত দেখে। সেই সতী, সেই কলেজে পড়া মেয়ের ভক্তি দেখে দীপঙ্করেরও কতদিন হাসি পেয়েছে।
সতী বলতো। মাসীমা, দীপু অত হাসছে কেন বলুন তো?
মা বকতো দীপঙ্করকে–কেন হাসিস তুই অত দীপু বল তো?
দীপঙ্কর বলতো–হাসবো না? কলেজে-পড়া মেয়ের অত ভক্তি ভালো?
মা বলতো-হলেই বা কলেজে-পড়া, মেয়েমানুষ মেয়েমানুষই-ঘর সংসার তো করতে হবে, মেয়েমানুষ হয়ে যখন জন্মেছো মা তুমি, তখন স্বামীর ঘর তোমাকে করতেই হবে–
সতী বলতো–আমার বাবাও তাই বলেন মাসীমা-বাবাও পুজো জপ-তপ করেন, তারপর আপিসে যান–
মা আশীর্বাদ করতো সতীকে। বলতো-শিবের মতো স্বামী পাবে মা তুমি, দেখোতোমাকে এবার পুণ্যিপুকুর করা শিখিয়ে দেব
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সতী স্নান করে নিত। লক্ষ্মীদি তখনও ঘুমোচ্ছে। দীপঙ্কর গিয়ে দেখতে লক্ষ্মীদির বিছানার পাশে চায়ের কাপ জুড়িয়ে বরফ হয়ে গেছে, আর লক্ষ্মীদি তখনও মশারির মধ্যে অজ্ঞান।
দীপঙ্কর গিয়ে ডাকতো-ও লক্ষ্মীদি, লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদি আড়ামোড়া ভেঙে উঠতো। বলতো–কী রে, এত সকালে কী করতে?
–তুমি এখনও ঘুমোচ্ছে? এদিকে যে সাতটা বেজে গেছে? দেখ তো তোমার চা বরফ হয়ে গেল
–রঘুকে ডাকতো দীপু, আর এক কাপ চা দিয়ে যাবে!
শুয়ে শুয়েই লক্ষ্মীদি চা খেত। শুয়ে শুয়ে এক কাপ চা খাবার পর তখন যেন চোখের পাতা খোলবার ক্ষমতা হতো। তখন আস্তে আস্তে উঠে বসততা বিছানায়।
দীপঙ্কর বলতো–তুমি এত দেরি পর্যন্ত কী করে ঘুমোতে পারো লক্ষ্মীদি? তোমার ঘুম ভেঙে যায় না?
লক্ষ্মীদি জিজ্ঞেস করতো–সতী কোথায় রে?
দীপঙ্কর বলতো-সতী মা’র সঙ্গে গঙ্গায় গেছে–মন্দিরে পুজো দিয়ে তবে ফিরবে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো–তুমি ঠাকুরদেবতা মানে না লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদি বলতো-দূর, ওসব মিথ্যে ভড়ং-ও করেও যা হয়, ও না-করেও তাই হয়–
–তা ঠাকুর-দেবতাকে নমস্কার তো আমি রোজ করি লক্ষ্মীদি, ঘুম থেকে উঠে রোজ মন্দিরে গিয়ে ফুলও দিয়ে আসি আর প্রণামও করে আসি।
–করে তোর কী হয়?
–তা জানি না, কিন্তু করতে ভালো লাগে।
–সতীটা করে ওই সব। বলে–ওই সব করলে নাকি পুণ্য হয়। পুণ্য হয় না ছাই পাশ হয়!
খানিক পরেই সতী এল। লক্ষ্মীদি বললে–আজকেও আবার বুঝি তুই গঙ্গা নাইতে গিছলি সতী?
সতী বললো—হ্যাঁ–
–ওসব ময়লা জলে নেমে কী লাভ হলো?
সতী বললে–লাভ আবার কী হবে, আমার ইচ্ছে হলো তাই গেলাম–
–তা বাড়িতে জল ছিল না?
–বাড়ির জলে তো রোজই নাই, একদিন না হয় গঙ্গাতেই নাইলাম। গঙ্গায় কি কেউ চান করে না?
লক্ষ্মীদি বলতো–করবে না কেন, তোর মতোন যারা তারাই করে! সতীও রেগে গেল। বললে–বেশ করি করি, তোমাকে তো গঙ্গায় নাইতে বলছি। আমি যদি মনে তৃপ্তি পাই, তাহলে ক্ষতি কী?
–তোকে এসব কে শিখিয়েছে বল তো?
সতী বলতো–কে আবার শেখাবে! এ কি শেখাতে হয় নাকি? মেয়েদের একটু ভক্তি-টক্তি থাকা ভালো তো!
–ছাই ভালো! তোর দেখছি কিচ্ছু হবে না!
সতী বলতোনা-হবে না-হবে, তোমার তো হবে! তুমি নিজের দিকটা সামলাও তো দিদি-আমি কী করি না-করি সে তোমায় দেখতে হবে না
–তোর তো ভারি বাড় হয়েছে সতী! সক্কাল বেলাই ঝগড়া করতে এলি?
সতীও রেগে উঠলো। বললে–বা রে, আমি ঝগড়া করলুম না তুমি করলে?
–আবার আমার মুখের ওপর কথা বলছিস?
সতীও ঝাঁঝিয়ে উঠতো। বলতো–বেশ করবো, বলবো! তুমি যখন-তখন আমার সঙ্গে অমন করো কেন বল তো?
লক্ষ্মীদি বলতো–আমি তোর সঙ্গে করি না তুই আমার সঙ্গে করিস?
সতী হঠাৎ দীপঙ্করের হাতটা ধরলে। বললে–এই তো দীপু এখানে রয়েছে, একেই জিজ্ঞেস করো না কে আগে ঝগড়া করেছে–বলো তো দীপু, তুমিই বলো তো, তুমি তো গোড়া থেকেই দেখছো, আমার দোষ?
দীপঙ্কর মহা মুশকিলে পড়লো। কার পক্ষে সে যে রায় দেবে ঠিক করতে পারলে না।
কিন্তু লক্ষ্মীদিই বাঁচিয়ে দিলে দীপঙ্করকে। বললে–ওকে সাক্ষী মানবো কেন রে? ও কে? ও কি সব জানে?
সতী বললো সব জানে ও-তোমাকে আর জানতে বাকি নেই ওর–
লক্ষ্মীদি বললে–না, ও কিছু জানে না, কিছু জানে না ও–
–জানে সব জানে! তুমি কী রকম মেয়ে তা ও জানে, ওর সে-বুদ্ধি আছে। তুমি কাকে চিঠি দিতে সেখানে, কার সঙ্গে লুকিয়ে মিশতে, কার সঙ্গে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলে….
–সতী!
হঠাৎ যেন লক্ষ্মীদি ফেটে পড়লো একেবারে। মনে হলো যেন এখনি লাফিয়ে উঠবে।
লক্ষ্মীদি বললে–যত বড় মুখ নয় তোর তত বড় কথা! তুই আমার মুখের ওপর কথা বলিস? এত আস্পর্ধা তোর?
সতীও কম যায় না। বললে–সত্যি কথা বলবো তাতে আবার ভয় কী?-ভয় কী শুনি? তুমি দোষ করতে পারো, আর আমার বলতেই দোষ? জানো না তোমার জন্যে বাবার কত কষ্ট? জানো না তুমি বাবার মনে কত কষ্ট দিয়েছ? জানো না সেদিন আমি না থাকলে বাবার কী হতো?
হঠাৎ দীপঙ্করের মনে হলো তার যেন বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়। ও-সব কথা শোনাও যেন অন্যায় তার পক্ষে! দীপঙ্কর ঘর থেকে আস্তে আস্তে সকলের অলক্ষ্যে চলে আসছিল, হঠাৎ সতী ডাকলে–এই দীপু চলে যাচ্ছো কেন, থাকো এখানে, ভয় কী তোমার?
দীপঙ্কর থমকে দাঁড়াল। একবার চেয়ে দেখলে লক্ষ্মীদির দিকে।
লক্ষ্মীদি বললে–কথাগুলো ওর সামনে না বললে বুঝি তোমার মনে শান্তি হচ্ছে না?
সতী বললে–তুমি যে আমার নামে বড় দোষ দিচ্ছিলে–এখন ও বুঝুক যে আমার দোষ না কার দোষ!
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু ও বুঝতে পারলে কি তোর সুখ হবে? ওকে পরের নিন্দে শুনিয়ে লাভ কী তোর শুনি? তাতে তোর ইজ্জত বাড়বে?
–দিদি, ইজ্জতের বড়াই আর কোরো না তুমি! আমাদের বংশের ইজ্জত তুমি ডুবিয়ে দিয়েছ, জানো?
লক্ষ্মীদি বলে উঠলো-তুই আর আমাকে ইজ্জত শেখাতে আসিস নি, বুঝলি! দীপুর সঙ্গে তোর এত ভাব কেন বলবো? দীপুদের বাড়ি তুই কেন এত যা জানি না মনে করেছিস্? দীপুর সঙ্গে তোর কেন এত মাখামাখি বল তো?
সতীর মুখখানায় হঠাৎ যেন কে সিঁদুর মাখিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে। সতীর মুখের দিকে চেয়ে দীপঙ্করের মনে হলো যেন হঠাৎ সে বড় হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছে। হঠাৎ দীপঙ্করের হাতখানা তার হাত থেকে খসে পড়লো। দীপঙ্করের সমস্ত শরীরটা কেমন সিরসির করে কেঁপে উঠলো।
লক্ষ্মীদি তখনও ছাড়বে না। বললে–পরের দোষ দেখবার আগে নিজের দোষটা দেখবার চেষ্টা করিস-বুঝলি সতী! তুই যেমন বাবাকে চিঠি লিখে লিখে আমার বিরুদ্ধে লাগিয়েছিস। আমিও যদি তোর কথা লিখি? আমিও যদি লিখে দিই কাদের বাড়িতে যাস তুই, কার সঙ্গে তোর এত ভাব? তখন কী হবে?
সতী যেন ততক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে।
বললে–দিদি, তুমি এই কথা বলতে পারলে?
–কেন, আমি কি মিথ্যে বলছি? আমার কি চোখ নেই? দীপুর সঙ্গে তোর অত কিসের খাতির?
চমকে উঠলো সতী। বললে–দীপুর সঙ্গে আমার খাতির? তুমি বলছো কী?
–হ্যাঁ সত্যি কথাই বলছি! সবাই দেখতে পায়, সকলের চোখ আছে। তুই ওদের বাড়িতে যাস না? ওদের ঘরে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকিস না? দীপুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গল্প করি না?
দীপঙ্করের মাথা থেকে পা পর্যন্ত থর থর করে কাঁপতে লাগলো। আর দাঁড়াতে পারলো না। সোজা বাইরে চলে এল দীপঙ্কর। একেবারে নিচেয়। কাকীমা দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাসতে লাগলেন দীপঙ্করকে দেখে। বললেন–আবার বুঝি ঝগড়া করছে ওরা?
আর তারপর সেইদিনই অনেক রাত্রে সতী তাকে খবরটা দিয়েছিল।
সকালবেলা যথারীতি কলেজে গিয়েছে দুই বোন। দীপঙ্করও কলেজে গিয়েছে। যেমন করে আর সব দিনগুলো কাটে, তেমনি করেই সে-দিনটাও কেটেছে। সমস্ত দিনটায় অন্যদিনের মতো সকাল হয়েছে আর সন্ধ্যে হয়েছে। সন্ধ্যের পর দীপঙ্কর বাড়ি এসেছে, তারপর কিরণের বাড়ি গেছে, কিরণের সঙ্গে গল্প করেছে, গল্প করতে করতে রাত হয়েছে। তারপর খেয়ে উঠে যেই আমড়াগাছ-তলায় আঁচাতে গেছে হঠাৎ খবরটা দিলে সতী!
খবরটা পাবার পর থেকেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। যেন বাড়ি যেতে আর ইচ্ছে করছে না। যেন সমস্ত বিস্বাদ হয়ে গেছে। এতদিনের জীবন, এতদিনের ভালো-মন্দ, এতদিনের আকাশ, এতদিনের বাতাস, এতদিনের পৃথিবী, সমস্ত যেন বিস্বাদ ঠেকছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ নেই, কিছু নেই।
সকাল বেলা বাজার করতে গিয়ে পচা আলু নিয়ে এসেছিল দীপঙ্কর।
মা তরকারি কুটতে গিয়ে দূর করে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। বললেবাজার করতেও শিখলি না তুই? এই পচা আলুগুলো কে খাবে বল তো?
ভোরবেলা মন্দিরে ফুল দিতে গিয়েও অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল।
ষষ্ঠীর মন্দিরে বুড়ো পাণ্ডা জিজ্ঞেস করলে–ফুল দিলে প্রসাদ নিলে না?
রাত্তিরে খেতে বসে অর্ধেক ভাত ফেলে রেখে উঠে যাচ্ছিল, মা ডাকলে। বললে–ও কী রে, ভাত খেলি না?
কিরণের অসুখ, আর একবার কিরণের কাছে গেলেও হতো। পরের দিনটাও কেমন যেন ভেসে ভেসে বেড়াতে লাগল মনটা। সমস্ত কালীঘাট, সমস্ত শানগর, সমস্ত ভবানীপুরটা হেঁটে হেঁটে বেড়াতে লাগলো দীপঙ্কর। সেই পুরোন দিনগুরোর কথা মনে পড়তে লাগলো। কিরণের সঙ্গে ছোটবেলায় কতদিন মিটিং শুনতে এসেছে হরিশ পার্কে, কতদিন পুলিসের লাঠির ভয়ে পালিয়েছে, কতদিন কিরণের সঙ্গে পৈতে বেচতে গিয়েছে ওদিকে, কতদিন রাস্তায় রাস্তায় ‘দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী’র জন্যে চাঁদা আদায় করে বেড়িয়েছে। দুদিন ধরে ঘুরে ঘুরে পায়ে ব্যথা ধরে গেল। যেখানে বালিগঞ্জের নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে, নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে, ওইদিকে গিয়েও কুলি-মজুরদের কাজ দেখতে লাগলো। কুলিরা চিনতে পেরেছে দীপঙ্করকে। দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বললে তাদের সঙ্গে। কোথায় থাকে তারা, কত করে পয়সা পায় রোজ। তারপর যখন সবাই বাড়ি চলে গেল দীপঙ্করও আবার বাড়ির দিকে এলো। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, সেই নেপাল ভট্টাচার্যি লেন, সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল-স্কুল–আর তারপর সেই উনিশের একের বি বাড়িটা। বাড়িতে ঢুকেই মনে হতো যদি লক্ষ্মীদি ফিরে এসে থাকে। যদি হঠাৎ লক্ষ্মীদি আবার ফিরে এসে থাকে।
মা বললো–হ্যাঁ রে, ওদের বড় মেয়েটা কোথায় গেল হঠাৎ তুই তো বলিস নি কিছু আমাকে!
বিন্তিদি বললে–কোন্ মেয়েটা দিদি?
মা বললে–তুমি এ সব কথায় থেকো না মা,–
বিন্তিদি বললেওরা তো লেখা-পড়া জানা মেয়ে, না দিদি?
দীপঙ্করের মনে হলো যেন সমস্ত দোষটা তারই। লক্ষ্মীদির নিন্দে তারই নিজের নিন্দে। লক্ষ্মীদির লজ্জা যেন তার নিজেরই লজ্জা। লক্ষ্মীদির কলঙ্ক যেন তার নিজের কলঙ্ক। দীপঙ্করের মনে হলো সবাই যেন তাকেই দোষ দিচ্ছে। তারই যেন সব দোষ। তারই যেন সব দায়িত্ব। মা’র মুখের দিকে চাইতেও যেন তার লজ্জা হলো! মা তো জানে না যে দীপঙ্করই রোজ ভোরবেলা গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে একজনকে চিঠি দিয়ে আসতো। মা তো জানে না দীপঙ্করই দায়ী এর জন্যে। আর সতী! সতী প্রথম প্রথম সন্দেহ করতো শুধু। কিন্তু তার সন্দেহ কি একেবারে মিথ্যে! কেন সে চিঠি দিয়ে আসতো দাতারবাবুকে! কেন কাউকে বলে দেয়নি! যদি সময়মত বলে দিত তাহলে হয়ত লক্ষ্মীদি এমনি করে পালাতে পারতো না। সমস্ত বাড়িটা যেন খা খা করছে লক্ষ্মীদির অভাবে। লক্ষ্মীদি নেই, কিন্তু লক্ষ্মীদির অভাব যেন সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।
সেদিনও পড়ছিল দীপঙ্কর। হঠাৎ মনে হলো পাশের ঘরে সতীর গলা শোনা গেল।
মা বলছে-তোমার মা থাকলে আর এমন হতে পারতো না মা—
সতী বললে–তা মা’কে তো আমিও ছোটবেলা থেকে দেখিনি মাসীমা–
–কিন্তু কোথায় গেল, একটা খোঁজ পাওয়া গেল না, তাই বা কী করে হয় মা? তোমার কাকাবাবু একবার পুলিসে খবর দিলে না কেন মা? উড়ে তো যেতে পারে না অত বড় জলজ্যান্ত মেয়ে–
সতী বললে–কাকাবাবু তো সেইদিন থেকেই খুঁজছে
মা বললে তোমার বাবারই অন্যায় মা, অত বড় মেয়ে কেউ ঘরে পুষে রাখে! এই দেখ না মা, বিন্তি আমার কে? কেউ না, কিন্তু ওই সোথ মেয়ের জন্যে ভেবে ভেবে আমার রাত্তিরে ঘুম হয় না–
তারপর আবার মা’র গলা শোনা গেল–ছেলে-মেয়ে বড় হলে বাপ-মায়ের যে কী ভাবনা, সে আমি বুঝি
দীপঙ্কর পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে কান খাড়া করে রইল।
–ওই যে দীপু আমার বড় হচ্ছে আর আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ছে–যতদিন ছোট ছিল ততদিন তেমন কিছু ভাবনা ছিল না–এখন ওর দিকে দেখলে আমার বুকটা ধড়াস্-ধড়াস করে ওঠে
সতী হাসতে লাগলো। বললে–আপনার আবার বড় বেশি বাড়াবাড়ি মাসীমা
–না মা, তুমি বুঝবে না, যখন তুমিও মা হবে তখন বুঝবে! ছেলে-মেয়ে নয়তো শত্রু সব
সতী বললে–দীপু আপনার খুব ভালো ছেলে মাসীমা
–ভালো তো তোমরা বলছে, কিন্তু খারাপ হতেই বা কতক্ষণ! কালীঘাট জায়গা তো ভালো নয়–ছেলে-মেয়ে মানুষ করা যে কী কষ্ট আমিই জানি!
অনেকক্ষণ আর কোনও কথা শোনা গেল না। দীপঙ্কর আস্তে আস্তে উঠলো। উঠে পাশের ঘরে গেল। পেছন ফিরে বসে ছিল মা আর সতী। মা-ই প্রথম দেখতে পেয়েছে। বললে–তুই আবার পড়তে পড়তে উঠে এলি কেন দীপু? পড়া হয়ে গেল?
সতীও পেছন ফিরেছে।
দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–লক্ষ্মীদি বাড়ি ফেরেনি?
মা বললে–তোমার ওসব খবরের দরকার কী শুনি? তোমার নিজের চরকায় কে তেল দেয় তার ঠিক নেই–তুমি এসেছ পরের খবর নিতে! দেখলে তো মা, শুনলে তো? ওর ভাবনা কে ভাবছে তাই বলে ঠিক নেই–যাও এখন পড়গে যাও, ভাত হলে খেতে ডাকবো
দীপঙ্কর আবার নিজের ঘরে এসে বসলো। কিন্তু পড়তে গিয়েও কান পড়ে রইল পাশের ঘরে।
সতী বললে–আমিও যাই মাসীমা–
–আর একটু বোসো না মা, তুমি এলে তবু দুটো গল্প করতে পাই–
সতী বললে–আসতে তো ভালো লাগে মাসীমা, কিন্তু কদিন থেকে কিছু ভালো লাগছে না, কাকাবাবুরও খাওয়া-দাওয়া নেই, কাকাবাবু কাজকর্ম ছেড়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আমারও কলেজ যাওয়া হচ্ছে না–
–সে আর কী করে হবে মা!
সতী বললে–দিদির সঙ্গে দিনরাত ঝগড়া করতুম, কিন্তু তবু তাও ভালো লাগতো মাসীমা! এখন যে কী হয়েছে বাড়িতে একদম ভালো লাগে না।
–বাবাকে খবর দেওয়া হয়েছে তো মা?
সতী বললে–কাকাবাবু তো রোজই বলছেন খবর দিতে, কিন্তু আমিই বলছি একটু সবুর করতে! হয়তো এসে পড়বে দু’একদিনের মধ্যে! মিছিমিছি দু’একদিনের জন্যে বাবার মনে কষ্ট দেওয়া!
মা বললে–এবার এলে বাবাকে বোলো দিদির বিয়ে দিয়ে দিতে–আর তোমারও একটা বিয়ে হয়ে যাওয়া ভালো মা, মেয়ে-মানুষের বেশিদিন আইবুড়ো থাকা ভালো নয়-এই দেখ না, বিন্তির জন্যে আমি কত খোঁজখবর নিচ্ছি-আর যখন তোমাদের দেবার-থোবার ক্ষমতা আছে–
সতী বললে–বাবার যে সময় নেই মাসীমা, নিজের পুজো আছে, ব্যবসা আছে, কখন কী করবেন?
মা বললে–ওমা, তা কাজকর্ম ব্যবসা আছে বলে মেয়েদের বিয়ে আটকে থাকবে? এ-ও তো একটা কাজ।
সতী চলে যাবার অনেকক্ষণ পরেও দীপঙ্কর কিছু পড়তে পারলে না। কিছুই মাথায় ঢুকলো না। কিছুতেই যেন পাড়ায় মন বসছে না আর। কেউ জানে না, কেউ কল্পনাও করতে পারছে না দীপঙ্করের কথাটা। কী করে কল্পনা করবে। কেউ তো জানে না। লক্ষ্মীদির সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে কারো জানবার কথা নয়। কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না! অথচ লক্ষ্মীদি কেন একবার জানিয়ে গেল না দীপঙ্করকে। জানিয়ে গেলেও তো পারতো। জানিয়ে গেলেও তো দীপঙ্কর কাউকে বলতো না। লক্ষ্মীদি বারণ করলে দীপঙ্কর কাউকেই বলতো না। দীপঙ্করকেই বা জানাল না কেন লক্ষ্মীদি। দীপঙ্করের কাছ থেকেই বা লুকোতে গেল কেন কথাটা!
আগের দিনও লক্ষ্মীদির সঙ্গে দেখা হয়েছে দীপঙ্করের। আগের দিনও লক্ষ্মীদি হেসে কথা বলেছে। সতীর সঙ্গে ঝগড়া করেছে। কোনও তফাৎ বুঝতে পারেনি। আগের দিনও যেমন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে, দেরি করে চা খায়, তেমনি দেরি করে চা খেয়েছে। ততক্ষণে সতীর স্নান হয়ে গেছে। যেমন করে রোজ সেজে-গুঁজে কলেজে যায় তেমনি সেজেছে। তারপর বাস এসে গলির সামনে দাঁড়াতেই লক্ষ্মীদি বাসে গিয়ে উঠেছে। কলেজ যাবার আগে কাকীমা রোজই ভাতের সামনে এসে বসে। সতী খায়, লক্ষ্মীদি খায়।
কাকীমা বলো রে আর দুটো ভাত দিতে বলবো! ওমা, উঠলি কেন? খা?
লক্ষ্মীদি বলেছে–আর খেতে পারবো না কাকীমা পেট ভরে গেছে–
কাকীমা বলেছে-শেষকালে তোমার বাবা দেখলে বলবেন আমরা খেতে দিইনি বুঝি–
লক্ষ্মীদি বলেছেনা কাকীমা, আমি বরং এসে খাবো, দেরি হয়ে গেছে এখন–
–তা কার জন্যে দেরি হলো শুনি? আমার তো ভাত তৈরি হয়েছে কখন! কখন থেকে ডাকছি খেতে আয় খেতে আয়–
তখন আর অত কথার উত্তর দেবার সময় নেই লক্ষ্মীদির। সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই দেরি হয়ে যায়। তারপর স্নান করে সাজগোজ করতে করতেই বেলা হয়ে আসে। তখন লক্ষ্মীদির বই গুছোনোর পালা। এ-বইটা পায় তো ও-বইটা পায় না। এ খাতাটা নিতে গিয়ে ও খাতাটা ভুলে যায়। আর সতী! সতীর তখন সব শেষ হয়ে গেছে। সে পুজো সেরেছে, চা খাওয়া সেরেছে। একই সময়ে তার বাস আসে। কিন্তু লক্ষ্মীদির বাস এসে অনেকক্ষণ দাঁড়ায়, অনেকবার হর্ন বাজায়, গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হয়রান হয়ে যায়।
সেদিন সতীর বাস আগে এসেছে। সতী খেয়ে-দেয়ে সেজে-গুঁজে তৈরিই ছিল। বাস আসতেই সতী বেরিয়ে গেছে। যাবার সময় রোজকার মতো বলে গেছে–আমি যাচ্ছি কাকীমা
কাকীমাও রোজকার মতো বলেছে-এসো মা—
তারপর লক্ষ্মীদির পালা। লক্ষ্মীদিও সময়মতো বলেছে–আমি যাচ্ছি কাকীমা—
কাকীমাও বলেছে–এসো মা–
তারপর দরজার কাছে এসে কাকীমা জিজ্ঞেস করেছে–আজ কখন আসবি তুই? ক’টার সময়ে? দেরি হবে?
–না কাকীমা, আজ সকাল-সকাল আসবো, চারটের মধ্যে
বরাবর কলেজ যাবার আগে আর পরে কাকীমার সঙ্গে লক্ষ্মীদির দেখা হয়, কথা হয়। লক্ষ্মীদি আর সতীর জন্যে খাবার তৈরি করা থাকে। যে আগে আসে সে খেয়ে নেয়। তারপর গল্প করো, ছাদে বেড়াও ঝগড়া করো, যা খুশি করো। কেউ কিছু বলতে যাবে না। এমনি করেই এতদিন চলছিল। এমনি করেই এ-বাড়ির রোজকার কাজকর্ম সমাধা হচ্ছিল। কাকাবাবু বাড়ির কর্তা, তিনি কখন আপিসের কাজ করতে বাইরে বেরিয়ে যান, কখন আসেন, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা থাকে না। কিন্তু লক্ষ্মী-সতীর একটা বাঁধা সময় আছে। বাঁধা সময়ে তারা যায় আবার একটা বাঁধা সময়ে তারা আসে। তাদের খাওয়ানো, তাদের খাবার যোগানো নিয়েই বেশির ভাগ ব্যস্ত থাকতে হয় কাকীমাকে। সারা কালীঘাটে যখন সবাই অন্য সব ব্যাপার নিয়ে মত্ত, তখন এ-বাড়িতে কাকীমা সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। তিনটে বাজতে-না-বাজতেই কাকীমা উনুনে আগুন দেবার ব্যবস্থা করেছে, ঠাকুরকে তাগাদা দিয়েছে, রঘুকে তাগাদা দিয়েছে। কলে জল এসে গেছে। এখনি মেয়েরা এসে পড়বে, এখনই খাইখাই করবে। বেশির ভাগ দিন লক্ষ্মীদিই আগে আসে। এসেই ডাকে–কাকীমা–
লক্ষ্মীদি সোজা চলে যায় ঘরে। বইগুলো টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ে চিত হয়ে।
সতীও আসে একটু পরে। দুজনের খাবার আসে। দুজনেই খায়। দু’জনেই গল্প করে। কাকীমা শোনে। গল্প করতে করতে ওদিকে রান্নাঘরে ডাক পড়ে কাকীমার। ঠাকুরের কাছে গিয়ে না দাঁড়ালে চলে না। লক্ষ্মীদি ঝাল খায়, সতী ঝাল খায় না। লক্ষ্মীদি লুচি খাবে, সতী খাবে রুটি। লক্ষ্মীদির সব গরম খাবার চাই, সতীর ঠাণ্ডা হলেও আপত্তি নেই। তারপর দুজনেই পড়তে বসবে। তখন হয়তো এক-একদিন সতী পাশের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। সতী বেশিক্ষণ একলা এক জায়গায় থাকতে পারে না। কথা না বলতে পারলে তার যেন দম আটকে আসে।
বলে-কাকীমা, আমি একটু আসছি ওদের বাড়ি থেকে–
–আবার এখন যাবি? খাবার হয়ে গেছে যে!
সতী বলে–আমি যাবো আর আসবো কাকীমা–একটু গল্প করে আসি–
এমনি করেই চলছিল ও-বাড়িতে। এমনি করেই দৈনন্দিন সংসারের চাকা ঘুরছিল। উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ভাড়াটেদের বাড়িতে। কোথায় কোন্ সুদূর বর্মার কোন এক কোণ থেকে মাসে মাসে মনিঅর্ডার আসতো কাকাবাবুর নামে। ভুবনেশ্বর মিত্র টাকা পাঠাতেন দুই মেয়ের জন্যে। দুই মেয়ের পড়ার খরচ, দুই মেয়ের জামা-কাপড়ের খরচ। শুধু তাই নয়, আরো অনেক রকমের খরচ আছে। কলকাতার একটা অন্ধগলির অন্ধকারের মধ্যে পুরে রেখে দিয়ে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন কলঙ্কের ছোঁয়াচ থেকে তিনি বেঁচে যাবেন। ভেবেছিলেন, মেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পর কলকাতাই হয়তো নিরাপদ হবে। আরো ভেবেছিলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে একদিন দুটি মেয়ের বিয়ে দেবেন। ততদিন হয়তো ক্ষতি হবে ব্যবসার, ততদিন হয়তা লোকসান হবে। কিন্তু লোকসান হলে উপায় কী! কাদের জন্যে পয়সা, কাদের জন্য ব্যবসা, কাদের ভবিষ্যতের জন্যে সঞ্চয়! ভুবনেশ্বর মিত্রের ছেলে নেই, সুতরাং একদিন দুই জামাই-ই মালিক হবে তার ব্যবসার, মালিক হবে তার সমস্ত সঞ্চয়ের। তেমন জামাই দেখে-শুনে ভেবে-চিন্তে করতে হবে। দেখাশোনা কি অত সহজ! দেখাশোনা করার সময় পাওয়াও কি অত সহজ? সেই জন্যেই তো এতদিন লক্ষ্মী-সতীর বিয়ে আটকে আছে। তার জন্যই তো তারা পড়ছে, লেখা-পড়া করছে। পরীক্ষায় পাশ করছে। আর নিরাপদে কলকাতায় আছে। বিশ্বাসযোগ্য অভিভাবকের কাছে রেখে তিনি তাই একটু নিশ্চিন্ত বোধ করছিলেন। কিন্তু কে জানতো এমন হবে! কে জানতো সেখানে সেই উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনেও এই দীপঙ্কর আছে, সেখানেও সে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি দিয়ে আসবে একজনকে। আর লক্ষ্মীদিও একদিন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে।
ক্রমে সতী ফিরে এল কলেজ থেকে। অন্য দিনকার মতো নিজের ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় বদলেছে। অন্য দিনকার মতো কাকীমাও এসেছে কাছে। সতী জিজ্ঞেস করেছে
–লক্ষ্মীদি আসেনি এখনও?
কাকীমা বলেছে-না, এইবার আসবে হয়তো–তুই খেয়ে নে–
খেয়ে নিয়ে সতী খানিকক্ষণের জন্যে মাসীমার সঙ্গে গল্প করতে পাশের বাড়িতে গেছে। ফিরে আসার পরও লক্ষ্মীদি এল না।
তারপর আরো দেরি হলো। আরো অন্ধকার হলো। গলির মোড়ে আরো গাড়ির শব্দ হলো। আরও হর্ন বাজলো। কিন্তু লক্ষ্মীদি এল না। তারপর কাকাবাবুও এল এক সময়ে আপিস থেকে। কাকাবাবুও শুনলে। এমন দেরি তো করে না লক্ষ্মী। কোথায় গেল! কোথায় গেল তাহলে?
এসব কথা দীপঙ্কর পরে শুনেছে। সব শুনেছে সতীর কাছে। ওদের বাড়িতে যখন খোঁজাখুঁজি চলেছে, তখন দীপঙ্কর কিরণদের বাড়িতে। তখন কাকাবাবু বেরিয়ে গেছে খুঁজতে। লক্ষ্মীদির কলেজে গেছে, থানায় গেছে, কত জায়গায় গিয়েছে। তারপর দীপঙ্কর যখন খাওয়া-দাওয়ার পর উঠোনের কোণে আমড়াগাছ-তলায় হাত ধুচ্ছে তখনই প্রথম জানতে পারলে সে।
আর তারপর?
তারপর থেকে যেন কেমন হয়েছে দীপঙ্করের। ওরা হয়তো খাচ্ছে, ওরা হয়তো ঘুমোচ্ছে কিন্তু দীপঙ্করের খাওয়াও নেই, ঘুমও নেই। কলেজে গিয়ে, রাস্তায় ঘুরে যেন আর ক্লান্তি আসে না। অথচ শান্তিও নেই তার।
.
মনে আছে সেদিন অনেকক্ষণ দাতারবাবুর সঙ্গে কথা বলে যেন হাল্কা হয়েছিল মনটা।
দাতারবাবু বলেছিল–এমন করে ঘুরে ঘুরে কী করবে, এবার বাড়ি যাও–
দীপঙ্কর বলেছিল–বাড়িতে যেতে ভালো লাগছে না–কেবল মনে পড়ে লক্ষ্মীদির কথা–
–ভেবে আর কী করবে?
–না ভেবেই বা কী করবো!
দাতারবাবু বলেছিল–তা হোক, ভুলতে চেষ্টা করো–
তারপর কথাটা বলে দাতারবাবু চলেই যাচ্ছিল, হঠাৎ দীপঙ্করের মনে পড়ে গেল। ততক্ষণে দাতারবাবু অনেকদূর চলে গিয়েছে। দীপঙ্কর চীৎকার করে ডাকল–দাতারবাবু, দাতারবাবু–
যেতে যেতে দাতারবাবু পেছন ফিরে তাকাল। দীপঙ্কর কাছে গিয়ে বললে–আসল কথাটাই আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছি–
–কী কথা?
দীপঙ্কর বললে–সেই যে আপনি একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়েছিলেন, আমাদের লাইব্রেরীর চাঁদা? মনে আছে আপনার? সেটা অচল!
–অচল? কই, দেখি?
–আমার কাছে তো নেই, বাড়িতে আছে।
দাতারবাবু বললে–ঠিক আছে, তুমি সেটা আমাকে দেখিও, যদি অচল হয় তো আর একটা বদলে দেব! তুমি আমার আপিসে যেও, ঠিকানা তো তোমার কাছে আছে কেমন?
১৯
সেদিন নৃপেনবাবু কিন্তু খুব ভালো ব্যবহার করলেন। বললেন–তুমি আসো না কেন? মাঝে মাঝে আসবে, মাঝে মাঝে না এলে তোমার কথা মনে থাকবে কেন? হাজার হাজার কাজের মধ্যে সব কথা কি মনে থাকে মানুষের–আপিসে একবার ঢুকলে বিশ্ব সংসার ভুলে যেতে হয়–
তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন-কতদূর লেখাপড়া করেছ?
–আজ্ঞে এইবার বি-এ পরীক্ষা দিয়েছি–
নৃপেনবাবু হাসলেন। বললেন–এই দেখ তোমরা বি-এ পাশ করেছ, অথচ আমরা সেকালের এন্ট্রান্স-তোমাদের ইস্কুল-কলেজে আজকাল লেখা-পড়াই তেমন শেখানো হয় না সেকালের মতো–সেকালে…
হঠাৎ যেন নৃপেনবাবু কেমন দয়ালু হয়ে উঠলেন রাতারাতি। মিষ্টি কথা বলতে লাগলেন। হাসি বেরোল মুখ দিয়ে। বললেন–তা আমাকে দরখাস্ত একখানা দিলে না তো তুমি? অত করে বললুম তোমাকে
দীপঙ্কর বললে–আজ্ঞে, আপনাকে তো দরখাস্ত দিয়েছি–তিনখানা দরখাস্ত দিয়েছি–
নৃপেনবাবু একটু রেগে গেলেন–বললেন–দেখছো কাজের লোক-হাজার কাজের মধ্যে ডুবে থাকি–সব কথা কি আমার মনে থাকে? তা তিনখানাই না হয় দিয়েছ, তা বলে আর একখানা দিতে দোষ কী হে ছোকরা? দোষ কী?
সেদিন সত্যিই নৃপেনবাবু রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন–আমি আর ক’দিন হে ছোকরা, এই তো আসছে মাসে রিটায়ার করছি, তখন? তখন কে তোমাকে চাকরি দেবে শুনি? কে তোমাকে আমার মতো এত করে বলবে?
মনে আছে সত্যিই দীপঙ্কর কেমন যেন অবাক হয়ে গিয়েছিল নৃপেনবাবুর ব্যবহারে। মিছিমিছি নৃপেনবাবুর ওপর খারাপ ধারণা করেছিল দীপঙ্কর। এত ভালো লোক! অথচ দীপঙ্কর ভেবেছিল নৃপেনবাবু বুঝি ঘুষ নিচ্ছেন। পঁচিশ টাকা চেয়েছিলেন বুঝি নিজের জন্যেই। সারা রাস্তাটা দীপঙ্কর ভাবতে ভাবতে এসেছিল। এমন করে সকলের সম্বন্ধে খারাপ ধারণা করাও তো অন্যায়। নিজের ওপরেই ঘেন্না হলো দীপঙ্করের। বড় সহজে দীপঙ্কর একটা মানুষ সম্বন্ধে যত খারাপ ধারণা করে বসে, তেমনি বড় সহজে ভালো ধারণাও করে বসে। ওই যেমন কাকাবাবু! লক্ষ্মীদি আর সতীর কাকাবাবু! কাকাবাবু সম্বন্ধেও কত ভালো ধারণা করেছিল দীপঙ্কর। ভালো আর মন্দ–দুটোর মধ্যে কত তফাত অথচ বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না।
বাড়িতে যেতেই মা বললে–তা এতক্ষণ বলতে হয় তো! বলেছেন সেই সকালবেলা আর তুই এখন বললি?
সত্যিই তো, যতদিন চাকরি আছে নৃপেনবাবুর ততদিনই ক্ষমতা। চাকরি থেকে রিটায়ার করলে সাহেবরা কি আর তার কথা শুনবে! মা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলে। নৃপেনবাবু সন্ধ্যেবেলা আপিস থেকে আসবেন, তার পরেই গিয়ে দেখা করতে হবে। কাপড়টা সাবান দিয়ে ফরসা করতে হবে। যাবার আগে মায়ের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিতে হবে। দেখো মা, চাকরিটা যেন হয় খোকার। অনেক আশার ধন আমার খোকা। অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি আমার দীপুকে। পরের বাড়িতে রান্না করেছি, পরের মুখের খোটা শুনেছি, দোরে দোরে খোশামোদ করে বেড়িয়েছি। কেউ কথা রাখেনি, কেউ মুখ তুলে চায়নি। এবার আমার মুখ রেখো মা তুমি! আমি কারোর কোনও অনিষ্ট করিনি, কারো কোনও অমঙ্গল কামনা করিনি কখনও।
দীপঙ্কর সন্ধ্যেবেলা বাড়িটার দিকে চেয়ে দেখলে। কোথায় গেল সব। কোথায় গেল সবাই। কাকাবাবুদের বাড়িটা যেন খা-খা করছে। অন্ধকার চারিদিক। এমন সময় অন্য দিন আলো জ্বলতো ঘরে ঘরে। সব যেন কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল। সব যেন কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অথচ সকাল বেলা উঠেই মন্দিরে যাওয়া তারপর বাজার থেকে এসেই একবার লক্ষ্মীদির কাছে যাওয়া। আর তারপর সেই দুই বোনের ঝগড়া। হোক ঝগড়া, তবু যেন বড় ভালো লাগতো। মা’রও যেন কিছু ভালো লাগে না। লক্ষ্মীদি না আসুক, সতী একবার করে রোজই আসতো তাদের বাড়িতে, রোজই একবার করে দেখা হতো। একদিন সব শেষ হয়ে গেল। শেষ হয়ে গেল যেন বড় হঠাৎ।
তখন শহরের অনেক কিছু বদলে গেছে। ওদিকে ট্রাম লাইনটা গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়েছে বালিগঞ্জ রেলের স্টেশনে। আর দুপাশে বড় বড় বাড়ি উঠেছে। বাসগুলো
কালীঘাটের ট্রাম ডিপো ছাড়িয়ে আরো অনেক দূরে গিয়ে থামে। আরো অনেক দূর গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু তবু দীপঙ্করের মনে হয় যেন আরো অনেক দূরে গেলে ভালো হতো। যেখানে রাস্তার মোড়ে কিরণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পৈতে বিক্রি করতো, সেখানে তখন আরো ভিড় হয়, আরো লোক ওঠা-নামা করে। কিন্তু তখন আর কিরণ পৈতে বিক্রি করতে যায় না। বিক্রি করার দরকারই হয় না তার। সে-সব দিন কোথায় গেল যে!
আগের দিন বিকেল বেলা বাড়িতে যেতেই দীপঙ্কর কেমন অবাক হয়ে গেল। বাড়িতে লুচি ভাজার গন্ধ বেরুচ্ছে। হঠাৎ লুচি ভাজার গন্ধে অবাক হবারই কথা। ফর্সা কাপড় পরেছে মা। খুব ব্যস্ত। চন্নুনী যে চন্নুনী, সে-ও সাবান কাঁচা কাপড় পরে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে বাটনা বাটছে।
উঠোনের পাশ দিয়ে যাবার সময় দীপঙ্কর দেখলে তাদের ঘরের তক্তপোশের ওপর দু-তিনজন ভদ্রলোক বসে আছে। বেশ বৃদ্ধ লোক সবাই। কাউকেই চিনতে পারলে না দীপঙ্কর। সব অচেনা মুখ। তাড়াতাড়ি সেদিক খেতে এসে রান্নাঘরের দিকে যেতেই নজরে পড়লো-সতীকে। সতী বিন্তিদিকে সাজিয়েছে। বিন্তিদিকে আর চেনাই যাচ্ছে না যেন।
দীপঙ্কর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার দিকে যেন কারো ভ্রূক্ষেপই নেই।
দীপু রান্নাঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেওরা সব কারা, মা?
মা’র সব কাজ বোধহয় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঘটি নিয়ে হাত ধুচ্ছিল।
বললে–আজ এত দেরি করে আসতে হয় তোমার? জানো না, আজকে বিন্তিকে দেখতে আসবে সবাই।
–আমাকে তো তুমি বলোনি, বা রে!
মা’র আর কথা বলা হলো না। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে একজন বুড়ো লোক এলেন একেবারে রান্নাঘরের কাছে। বললেন–দিদি, ওঁরা তো আর থাকতে চাইছেন না–
মা বললে সে কি, আমি যে খাবার-দাবার করলুম এত-যোগাড়-যন্তর করলুম এত, তা কি হয়-না, না, আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন ঘটক মশাই-না খেয়ে গেলে মনে কষ্ট হবে–
ঘটক মশাই বললেন–আমি বলেছি, কিন্তু কিছুতেই শুনছেন না–
–তা হলে আমি গিয়ে বলছি চলুন!
মা তাড়াতাড়ি থান-ধুতিটা ভালো করে গায়ে গুছিয়ে নিলে। রান্নাঘরের দরজাটায় শেকল দিলে। চন্নুনীকে বললে–দেখিস তো মেয়ে, কাকে না খায়–
মা গিয়ে সোজা ঘরের দিকে গেল। ঘটক মশাই বললেন–মেয়ে তো পছন্দ হয়েছে বলেই মনে হলো, কিন্তু …..
মা বললে–মেয়ে পছন্দ হোক আর না-হোক জল-খাবার খেতে আপত্তি কী?
ঘটক মশাই বললন–অনেক দূর থেকে আসছেন ওঁরা, বলছেন ফিরতে রাত হয়ে যাবে–
–তা এ-সব কাজে একটু রাত হবে বৈকি, কলকাতা শহরে আর রাত কী!
বলতে বলতে মা সোজা গিয়ে দাঁড়াল একেবারে ঘরের সামনে। দু’জন ভদ্রলোক বসেছিলেন তক্তপোশের ওপর। মাকে দেখে তারা যেন কেমন একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। মা’র কিন্তু সত্যিই কোনও সঙ্কোচ, কোনও লজ্জা নেই।
মা বললে–ভট্টাচার্যি মশাই বলছিলেন আপনারা নাকি জলযোগ না-করেই চলে যাবেন–তা হবে না, আপনারা এসেছেন যখন এ-বাড়িতে, এ-বাড়িতে কষ্ট করে পায়ের ধুলো দিয়েছেন, তখন খালিমুখে আপনাদের যেতে দেব না–তা সে যত দেরিই হোক
একজন বললেন–জলযোগ আর একদিন করলেই হবে-সম্বন্ধ হোক, তখন জলযোগ করবো বৈকি।
মা বললে–কিন্তু আজ যে আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি আপনাদের জন্যে
আর একজন বললেন–তা হয় না মা, সম্বন্ধ হবার আগে আমাদের কোথাও জলগ্রহণ করবার রীতি নেই
–রীতি না-হয় একদিন ভঙ্গই করলেন–আমি তো বেশি কিছু দিচ্ছি না–সামান্য একটু মিষ্টিমুখ করেই চলে যাবেন–
ঘটক মশাই এতক্ষণে কথা বললেন–ইনিই হচ্ছেন পাত্রীর মাতৃতুল্য–
মা বললে–মা-হারা মেয়ে, আমি মানুষ করেছি আর কি, অঘোর ভট্টাচার্যি মশাই আমার গ্রামের লোক, আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন বাড়িতে, সেই থেকে আমিই মানুষ করেছি বিন্তিকে, যদি সম্বন্ধ করেন তো তখন জানতে পারবেন কেমন সোনার মেয়ে আমার–আমি নিজের মুখে কিছু বলতে চাই না
ঘটক মশাই বললেন–আমিও তাই বলছিলাম এঁদের ভট্টাচার্য মশাই তো সংসারের কিছুই দেখেন না, সন্নিসী মানুষ, এই দীপুর-মাই সংসারের সব, নাতি বলুন, নাতনী বলুন, সবাই এর কাছে মানুষ, ভট্টাচার্যি মশাই কবে বনে চলে যেতেন সব ফেলে টেলে দিয়ে ইনি না থাকলে–এই দেখুন না, আজ তাঁর নাতনীকে আপনারা দেখতে এসেছেন, আর তিনি গেছেন যজমানবাড়ি-ভট্টাচার্যি মশাই না হলে আবার যজমানদের যে একদণ্ড চলবে না কিনা–
একজন জিজ্ঞেস করলেন–তা একটা দিন তিনি বাড়িতে থাকতে পারলেন না?
মা বললে–বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ, আপনারা তাকে না দেখলে বুঝতে পারবেন না–আমার পীড়াপীড়িতেই এই সম্বন্ধ হচ্ছে, তিনি বিবাগী মানুষ, কোনও দিকেই তার খেয়াল নেই–অথচ সংসারে আপন বলতে ওই দুটি নাতি আর এই একটি নাতনীতা নাতি দুজনের কথা ছেড়েই দিন, যা কিছু আছে তার, শেষকালে জামাই-ই পাবে–
–তা আর কেউ-ই নেই অঘোর ভট্টাচার্যি মশাই-এর?
মা বললে–আর কে থাকবে বলুন, আমি এই নাতনীটির বিয়ে হয়ে গেলেই চলে যাব, আমার এই ছেলে, এই ছেলের একটা কিছু হিল্লে হলেই আমিও চলে যাবো, তখন জামাই-ই সব! আর তা ছাড়া বাবাই বা ক’দিন আর, এখনই তো চোখে ভালো দেখতে পান না সেদিন তো পড়ে গিয়ে পা ভেঙে এক কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিলে
মা’র কথাটা তখনও শেষ হয়নি, হঠাৎ পাশে সতী এসে ডাকলে–মাসীমা—
মা পাশ ফিরেই সতীকে দেখে বললে–এই যে, কী মা? তুমি যে?
সতী বললে–বিন্তিদি খুব কাঁদছে মাসীমা, আপনাকে ডাকছে–
এত লোকের মধ্যে হঠাৎ যেন লজ্জায় পড়ে গেল মা। কী যে বলবে বুঝতে পারলে
হঠাৎ। এত আয়োজন, এত উদ্বেগ, সব যেন পণ্ড হয়ে যাবার উপক্রম। কত দিনের কত স্বপ্নের পরিকল্পনা। সকাল থেকে কত আয়োজন করেছে মা একলা। অঘোরদাদুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টাকা আদায় করেছে। বুড়ো কৃপণ মানুষ, সহজে কি টাকা বার করতে চায়। তাই সকালবেলা অঘোরদাদু অত হৈ-চৈ করছিল। তখন কলেজ যাবার তাড়াতাড়িতে কিছু বুঝতে পারেনি দীপঙ্কর। তার মনটাও ভালো ছিল না ক’দিন। লক্ষ্মাদির জন্যে কোথায় যেন সব কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্করের। সেই দাতারবাবুর সঙ্গে কথা হবার পর অনেক কথা মনে পড়েছিল। কিছুই ভালো লাগছিল না। কাকাবাবুদের বাড়িতেও যেন সব বদলে গিয়েছিল সে ক’দিন। যেন সকাল-সকাল আলো নিভে যেত বাড়ির। বাড়িটার দিকে চেয়ে চেয়ে দীপঙ্করের মনে হতো হয়তো লক্ষ্মীদি আবার বাড়িতে এসে গেছে। আবার বাড়ি এসে ঠিক তেমনি করে আবার কলেজ যেতে আরম্ভ করবে বাসে চড়ে। সতী একলাই কলেজ যেত। একদিন দাঁড়িয়ে ছিল দীপঙ্কর সতীর কলেজ যাবার সময়। সেদিন বোধহয় বাস আসতে দেরি করছিল।
দীপঙ্কর ডাকলে-এই শোন—
সতী পেছন ফিরে দেখলে দীপঙ্করকে। বললে–কী?
কিছু বলতে গিয়েও যেন কী বলবে ভেবে পেল না দীপঙ্কর।
–ওমা, কী বলবে বলল না, চুপ করে রইলে কেন?
দীপঙ্কর বললে–তোমার বাবার চিঠি এসেছে?
সতী বললো, কেন?
–তোমার বাবার খুব কষ্ট হয়েছে তো শুনে?
–কী শুনে?
–লক্ষ্মীদির বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার খবর শুনে?
সতী বললে–তোমার দেখছি লক্ষ্মীদির জন্যে আমাদের চেয়েও বেশি ভাবনা!
–কেন? তুমিও তো ভাবো! আর তাছাড়া ভাবা কি অন্যায়?
সতী বললে–বাবাকে এখনও খবর দেওয়াই হয়নি!
–তা হলে এখন আর খবর দিও না, বুঝলে, তিনি বিদেশে থাকেন, খুব কষ্ট পাবেন শুনে হয়তো চলেই আসবেন এখানে। আর দুদিন সবুর করো, না, লক্ষ্মীদি হয়তো তার মধ্যে এসে যাবে আবার
সতী যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল দীপঙ্করের দিকে। বললে–তার মানে? তুমি জানো বুঝি কোথায় গেছে লক্ষ্মীদি?
–না, সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না!
–তুমি নিশ্চয় জানো, বলো না, কোথায় গেছে লক্ষ্মীদি!
দীপঙ্কর বললে–তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো না? আমি জানলে তোমায় বলতাম না? আর লক্ষ্মীদি কি আমায় বলে যাবে?
সতী কী যেন ভাবলে। তারপর বললে–এবার আমিও চলে যাবো—
দীপঙ্কর হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল। বললে–চলে যাবে তুমি? কোথায়?
–লক্ষ্মীদি নেই, আর এখানে থেকে কী হবে। লক্ষ্মীদির জন্যেই তো কলকাতায় থাকা। বাবা শিগগিরই আসবেন লিখেছেন–
দীপঙ্কর বললে–তোমরা চলে গেলে বাড়িটা আবার অন্ধকার হয়ে যাবে–তখন আমরাও চলে যাবো–
–কোথায়?
দীপঙ্কর বললে–তখন অন্য বাড়ি একটা ভাড়া নেব, আর আমারও একটা চাকরি খুঁজছে মা, তখন আর এ-বাড়িতে থাকবো না আর, ততদিন বিভিদিরও একটা বিয়ে হয়ে যাবে–
সতী কিছু কথা বললে না। গলির মোড়ের দিকে চেয়ে দেখলে হয়তো বাসটা এল কিনা তাই দেখলে।
দীপঙ্কর একটু থেমে বললেমা বলছিল তোমারও নাকি বিয়ে হয়ে যাবে–
সতী হাসলো বললে–তা বিয়ে তো হবেই, বিয়ে না হয়ে কি আইবুড়ো থাকবো নাকি চিরকাল–
দীপঙ্কর অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বললে–না তাই বলছি–
তারপর যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জা হলো। বললে তোমার বাস আসতে তো আজ খুব দেরি হচ্ছে দেখছি–
–দেরি হোক না, আমি তো তোমায় আটকে রাখিনি?
দীপঙ্কর বললে–তা হলে আমি যাই, আমার আবার একটা কাজ আছে—
সতী আবার হাসলো। বললে–এতক্ষণ তো কাজের কথাটা মনে পড়েনি–
–না, সত্যিই কাজ আছে, আমি যাই–
দীপঙ্কর চলেই আসছিল। হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল। কাছে এসে বললে তোমার এ-মাসের চাঁদাটা তো দিলে না সতী?
–চাদা, কিসের চাঁদা?
দীপঙ্কর বললে–বাঃ, মনে নেই, আমি সেই তোমার কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে রসিদ দিয়ে গেলাম তোমাকে?
–কিন্তু বই তো একটাও পাইনি!
–তা বই চাইলে না কেন! আমি তো তোমাকে রোজ দুখানা করে বই দিতে পারি–তুমিই তো চাইবে?
সতী বললে–কিন্তু কথা তো সেরকম ছিল না–কথা ছিল তুমি দিয়ে যাবে বই
দীপঙ্কর বললে–আমার না-হয় মনে ছিল না–তা তুমিও তো মনে করিয়ে দিতে পারতে
সতী বললে–আমি লক্ষ্মীদি হলে তখন আর মনে করিয়ে দিতে হতো না–তখন ঠিক মনে পড়তো তোমার–
দীপঙ্কর সতীর মুখের দিকে সোজা চেয়ে দেখলে। বললে–লক্ষ্মীদির কথা আলাদা–
–কেন, লক্ষ্মীদির কথা আলাদা কেন?
–আলাদা হবে না? বলো তো কত কষ্ট দিয়েছ তোমরা লক্ষ্মীদিকে! সবাই মিলে কত কষ্ট দিয়েছ! তোমাদের জন্যেই তো লক্ষ্মীদি চলে গিয়েছে বাড়ি ছেড়ে!
–কীসের কষ্ট?-সতী যেন কিছু বুঝতে পারলে না।
দীপঙ্কর কথাটা এড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। বললে–সে আমি বলববা না তোমাকে-তুমি সব জানতে পারবে–
দীপঙ্কর ঘুরে দাঁড়াতেই সতী দীপঙ্করের হাতটা খপ করে ধরে ফেলেছে। বললে পালাচ্ছো যে বড়? বলতেই হবে কী কষ্ট দিয়েছি আমরা লক্ষ্মীদিকে–বলতেই হবে–
দীপঙ্কর বললে–বারে, হাত ছাড়ো না–
–না, বলল আগে, কী জানো তুমি!
–সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না–আমার শুধু মনে হলো বলেই বললাম সতী তখনও জোর করে ধরে আছে দীপঙ্করের হাতটা। বললে–তোমাকে ছাড়ছি আমি, আমি বরাবর জানতাম, লক্ষ্মীদি তোমাকে সব বলেছে–
–কী বলেছ?
সতী বললে–চল তুমি কাকাবাবুর কাছে, কাকাবাবুর কাছে গিয়ে সব বলতে হবে চল কাকাবাবুর কাছে–
বলে সতী জোর করে দীপঙ্করকে ভেতরের দিকে টানতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–আমি বলছি তো আমি কিছু জানি না, তবু কেন কাকাবাবুর কাছে যাবো–
দীপঙ্কর জোর করে নিজের হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে। সতীর গায়েও জোর কম নেই। সতীও টানতে লাগলো। বললে–আমি কিছুতেই ছাড়বো না–চলো তুমি, যেতেই হবে তোমাকে–
হঠাৎ কাকীমা শুনতে পেয়েছে। কাছে এসে বললে–কীরে, ওকে অমন করে টানছিস কেন রে, কী হলো রে সতী–
–দেখ না কাকীমা, দীপু বলছে লক্ষ্মীদি কীজন্যে চলে গেছে, ও জানে!
কাকীমা যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। বললে–সে কী, তুমি জানো নাকি দীপু?
দীপঙ্কর বলে উঠলো-না কাকীমা, আমি কিছু জানি না, লক্ষ্মীদি চলে যাবার পর থেকে আমারই বলে কষ্ট হচ্ছে–এক-একদিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমারই ঘুম আসে না ভেবে ভেবে-আর তাছাড়া আমি জানলে আমি বলতাম না আপনাদের?
কাকীমা বললে–সত্যিই তো, ও কী করে জানবে? ছাড় ওকে–
সতী তবু ছাড়বে না। বললে–কিন্তু দীপুর মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছে ও জানে সব কাকীমা, সেই জন্যে ঘুরে ফিরে কেবল আমাকে দেখলেই লক্ষ্মীদির কথা বলে
–তা লক্ষ্মীদির কথা বলতেও দোষ? লক্ষ্মীদির জন্যে মন-কেমন করতেও দোষ?
কাকীমা বললে–ছাড় সতী, ওর হাত ছেড়ে দে-দেখ দিকিনি ওর মা শুনলে কী ভাববে
সতী বললে–মাসীমাকে গিয়ে আমি আজই বলে দিচ্ছি–
দীপঙ্কর এবার হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নিলে। বললে–আচ্ছা ঠিক আছে, আমার জিজ্ঞেস করাই দোষ হয়েছে–
কাকীমা কাছে এসে বললে–সত্যিই, বলো না দীপু, তুমি কিছু জানো? দেখছো তো আমরা সবাই কেমন ভাবছি মেয়েটার জন্যে, উনি তো কদিন ধরে চারদিকে খুঁজে খুঁজে হয়রান–দেখছো তো তুমি সব-বলো না, কোথায় গেছে লক্ষ্মী-আমরা কিছু বলবো না তাকে, কেউ জানতে পারবে না, কেউ বকবে না তাকে, তার বাবাকেও কিছু জানাবো না–এখনও জানানোও হয়নি–পাড়ার লোকরাও কেউ কিছু জানে না, যেমন থাকছিল এখানে, তেমনি থাকবে-কিছু বলবে না কেউ
দীপঙ্কর বললে–সত্যি কাকীমা, বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানি না–সতী মিছিমিছি আমাকে সন্দেহ করছে-লক্ষ্মীদির যদি সত্যি কোথাও লুকিয়ে থাকবার মতলব থাকবে তো আমাকে বলে যাবে কেন? কেউ কি বলে কয়ে পালিয়ে যায়?
কাকীমার যেন এবারে সত্যিই বিশ্বাস হলো। সতীর দিকে ফিরে বললেও তো বলেছে ও জানে না, তা হলে কেন ওকে তুই অমন করছিলি, আর আমি তো গোড়া থেকেই বলে আসছি যে, দীপু ওর মধ্যে নেই, দীপু তেমন ছেলেই নয়
তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে কাকীমা বললে–যাও, তুমি বাড়ি যাও–
দীপঙ্কর চলে আসছিল। সতী ডাকলে। বললে–চাদা নেবে না তুমি? চাঁদাটা নিয়ে যাও–
দীপঙ্কর পেছন ফিরলো। বললে–চাঁদা?
–হ্যাঁ, এ মাসের চাঁদাটা না নিয়ে চলে যাচ্ছ যে বড়? রাগ হলো বুঝি?
কাকীমা হাসলো। বললে–তুই আর ক্ষেপাসনি বাপু ওকে–না না তুমি বাড়ি যাও তো এখন দীপু–
দীপঙ্কর চলে যেতে যেতে বললে–যার চাঁদা দেবার ইচ্ছে হবে সে আমাদের বাড়িতে এসে দিয়ে যাবে, আমি আর আসতে পারবো না–
সতী হয়তো একটা কিছু বলতো। কিন্তু হঠাৎ একটা ডাক-পিওন আসছিল বাড়ির দিকে। দীপঙ্কর পিওনের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তাদের বাড়িতে কখনও কোনও চিঠি আসে না। কিন্তু তবু পিওন দেখলেই কেমন আশা হয় একটা। পিওনটা কাছে আসতেই দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–উনিশের একের বি-র কিছু চিঠি আছে?
–আছে—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কার নামে?
–সতী মিত্র—
নামটা শুনেই দীপঙ্কর সতীর দিকে চাইলে! সতীও তখন চিঠিটা নেবার জন্যে সামনে এগিয়ে এসেছে। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়েই খামটার মুখ ছিঁড়ে ফেললে। কিসের চিঠি! কার চিঠি! লক্ষ্মীদির চিঠি নাকি! লক্ষ্মীদি লিখেছে? দীপঙ্কর হুঁ করে চেয়ে রইল সেই দিকে।
কাকীমা জিজ্ঞেস করলে-কার চিঠি রে সতী?
সতী চিঠিটা পড়তে পড়তে বললে—বাবার–
সতীর বাবার চিঠি! সতীর বাবার চিঠি! দীপঙ্করের যেন নড়বার ক্ষমতাও নেই আর। চিঠির মধ্যে কী লেখা আছে না জানলে তার যেন শান্তি হবে না। তবে কী লক্ষ্মীদির কথা সব জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে কী হবে? লক্ষ্মীদির বাবার যে শরীর খারাপ! এ খবর শুনলে কি লক্ষ্মীদির বাবাকে আর বাঁচানো যাবে! কেন জানাতে গেল ওরা! আর দু একদিন অপেক্ষা করলেই পারতো! এমন কি লাভ হলো জানিয়ে! মিছিমিছি বুড়োমানুষকে কষ্ট দেওয়া।
কাকীমা আবার জিজ্ঞেস করলে–কী লিখেছেন রে?
সতী বললে–বাবা কলকাতায় আসছেন।
–কবে?
কিন্তু ততক্ষণে গলির মোড়ে সতীর বাসটা এসে গেছে। সতী তাড়াতাড়ি সেই দিকেই চলে গেল।
কাকীমা আবার জিজ্ঞেস করলে-কবে আসছেন রে সতী?
সে-কথার উত্তর না দিয়ে সতী সোজা গিয়ে বাসে উঠলো, আর সঙ্গে সঙ্গে হর্ন বাজিয়ে বাসটা চলে গিয়েছিল সোজা পুব দিকে-বালিগঞ্জের নতুন রাস্তার দিকে। দীপঙ্করও নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল তারপর।
.
সত্যি, বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল! সতীরা চলে যাবার পর থেকে যেন দীপঙ্করের মন বসততা না কোনও কাজেই। আগে অনেক ভাড়াটেই তো এসেছে অঘোরদাদুর বাড়িতে, কেউ চিরকাল থাকেনি। ভাড়াটেরা কখনও চিরকাল থাকে না। একদিন তারা চলেই যায়। সেই ছোটবেলা থেকে কতবার সে-ঘটনা দেখেছে দীপঙ্কর। সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলের সময় থেকে। তখনও এ-পাড়ার দক্ষিণে রাসবিহারী এভিনিউটা হয়নি। পুকুর আর ডোবা দিয়ে তখন জায়গাটা ভরা ছিল। এদিকে হাজি কাশিমের বাগানটাও একদিন ভেঙে নতুন বাড়ি উঠেছে। শিখদের গুরুদ্বার হয়েছে বড় রাস্তার ওপর। ঠিক পার্কটার পুব গায়ে। সত্যিই তো, কত বড় শহর তৈরি হচ্ছে ওদিকে। নতুন নতুন জমি, নতুন রাস্তা। ওইদিকেই ভাড়াটেরা উঠে যায়। নতুন ভাড়াটেরা ওইদিকেই নতুন বাড়ি খোঁজে। ওদিকে অত ভালো বাড়ি থাকতে এদিকে এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ভেতরে কে আসবে পচে মরতে। ভালোই তো! কিন্তু অমন করে চলে গেল কেন সতীরা। অত ভয়ানক কাণ্ড করে কেন যেতে হলো কাকাবাবুদের! সমস্ত পাড়ার লোক কেন অমন করে ওদের বিরুদ্ধে লাগলো!
তখন সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছে দীপঙ্কর, ইন্টারমিডিয়েট পরী হয়ে গেছে, সমস্ত রাত জেগে পড়তে পড়তে দিন-রাত কোথা দিয়ে কেটেছিল জ্ঞান ছিল না। প্রথমেই কেমন যেন বড় একলা-একলা মনে হলো। যেন কেউ নেই কোথাও দীপঙ্করের। কোনও কাজ নেই তার। মন্দিরে ফুল অবশ্য তখনও দিয়ে আসতে হয়, চন্নুনীর বদলে বাজারও করতে হয়, সংসারের অনেক কাজই করতে হয় দীপঙ্করকে। তবু যেন একলা-একলা সমস্তক্ষণ।
মনে আছে প্রথমদিনই গিয়েছিল বউবাজারে। দাতারবাবুর আপিসে। নম্বর খুঁজে খুঁজে যাওয়া কি সোজা কথা! প্রথমে ধর্মতলায় নেমে ট্রাম বদলে আবার অন্য ট্রামে ওঠা! দুপুরবেলা। রাস্তায় দুপুরবেলা ট্রাম ফাঁকা। একটা লোকও নেই। একজন সামনের দিকে বেঞ্চিতে বসে ছিল, সে লোকটাও নেমে গেল চৌরঙ্গীর কাছে।
ট্রাম গাড়িতে তখন কেবল কন্ডাক্টার আর সে। হুহু করে রাস্তার এক পাশে ঘাসের ওপর দিয়ে ট্রামটা চলেছে ঝড়ের মতো। একমনে অনেক কথা ভাবছিল দীপঙ্কর। কথা যে সত্যিই কী ভাবছিল এতদিন পরে তা আর মনে নেই ঠিক। কিন্তু মনে আছে বড় অন্যমনস্ক ছিল সে। পাঁচটা টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে দাতারবাবুকে। টাকাটা ইচ্ছে করে দেয়নি দাতারবাবু।
কিরণ বলেছিল–ওই পাঁচটা টাকা দিয়ে শরৎ চাটুজ্যের ‘পথের দাবি’ কিনবে–
কিন্তু দাতারবাবুর আপিসটা চিনতে পারলে হয়। কুড়ির-বি বউবাজার স্ট্রীটের দোতলার ওপর আপিস। ও-পাড়ায় অনেক আপিস। আপিসেরই পাড়া ওটা। একলা একলা ট্রামে চড়ে চলতে গিয়ে দীপঙ্করের মনে হলো সে যেন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। অথচ এমনি করে রোজ সকালবেলা তাকে তো একদিন আপিসেই যেতে হবে। আর সকলের মতো ভাত খেয়ে দৌড়তে দৌড়তে ছুটতে হবে। কী আশ্চর্য–সবাই বলবে দীপঙ্কর চাকরি করে। কত টাকা মাইনে পায়? তেত্রিশ টাকা! তা তেত্রিশ টাকাই কি কম নাকি! তারপর ফ্রি-পাশ পাওয়া যাবে। যত ইচ্ছে ঘুরে বেড়াও রেলে চড়ে। সকালবেলা টিফিনের কৌটা নিয়ে আপিসে কোনরকমে যেতে পারলেই হলো। তারপরে কাজ কিছুই নেই। কাজ থাকুক আর না-থাকুক মাস গেলে মাইনেটা ঠিক দিয়ে যাবে। কী আরামের চাকরি। এই পথ দিয়েই আপিসে যেতে হবে। পাড়ার আর সবাই যেমন আপিসে যায় তেমনি করে।
সমস্ত কলকাতাটা যেন বড় ফাঁকা। সত্যিই বড় ফাঁকা দেখাচ্ছে শহরটা। অন্তত ট্রামে যেতে যেতে দীপঙ্করের তাই মনে হয়েছিল সেদিন। সমস্ত দুপুরটা যেন বড় কঠোর বড় রুক্ষ বড় নিষ্ঠুর। এইটেই বুঝি পৃথিবীর আসল রূপ। যে-পৃথিবী রাত্রে শীতল হয়, রাত্রে শান্ত হয়, সে-পৃথিবীর সেই রূপটা যেন সাময়িক। আসলে এই জীবনটার মতো এই দুপুরটাই হলো সব চেয়ে সত্যি। এ-জীবনে শান্তি কি পেয়েছে কখনও দীপঙ্কর? এ-জীবনে সান্ত্বনা কি পেয়েছে। কখনও দীপঙ্কর? যদি পেয়েও থাকে সে কতটুকু? কতটুকু তার পরিধি, কতটুকু তার প্রসার? সমস্ত জীবনটাই যেন তার দুপুর–কলকাতার, এই এখনকার দুপুরের মতো রুক্ষ কঠোর নিষ্ঠুর!
–টিকিট?
দীপঙ্কর যেন চমকে উঠলো! এই এতক্ষণ পরে টিকিট! টিকিট কাটার কথা মনেই ছিল তার। পকেট থেকে পয়সা বার করে কন্ডাক্টারকে দিতেই একটা টিকিট কেটে দিলে সে। দুপুর বেলার টিকিট–তিন পয়সা। সস্তা দাম দুপুরবেলা। বিকেলবেলাই এই টিকিটের দাম পাঁচ পয়সা। গুনে গুনে নগদ দু’আনা এনেছিল দীপঙ্কর। তিন পয়সা গেলে হাতে থাকবে পাঁচ পয়সা। কিন্তু কী যেন সন্দেহ হতেই পকেটে হাত দিয়ে দেখলে। কই, দুটো পয়সা মাত্র আছে যে পকেটে! তাহলে?
হঠাৎ লাফিয়ে উঠলো দীপঙ্কর। বললে–টিকিট আমি একবার কেটেছি মশাই–
–কেটেছেন! কোথায় গেল টিকিট?
কন্ডাকটার হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে। দীপঙ্কর এ-পকেট ও-পকেট হাতড়াতে লাগলো। কোথায় গেল টিকিটটা।
বললে–সত্যি বলছি, আমি টিকিট কেটেছি, আমার মনে পড়লো এখন–
কিন্তু কেটেছি বললে চলবে না, প্রমাণ তো দেখাতে হবে। কোথাও নেই। টিকিট যদি না কেটে থাকে সে তো বাকি পয়সা কোথায় গেল? উড়ে গেল নাকি? সমস্ত ট্রামখানার মধ্যে একলা দীপঙ্কর বসে বসে ঘামতে লাগলো! যদি দাতারবাবুর সঙ্গে না দেখা হয় তো ফিরবে কেমন করে? পয়সা কোথায় তার কাছে? সেকেন্ড ক্লাসে এলেও তো আরো পয়সা লাগবে! ধর্মতলা থেকে লালবাজার পর্যন্ত না-হয় হেঁটেই যাবে তারপর? তারপর ফেরবার সময়? সঙ্গে তো আর বেশি পয়সা নেই তার! কাছে শুধু একটা অচল পাঁচ টাকার নোট। সেটা দাতারবাবুকে ফেরত দিতে হবে। দরকার হলে বাধ্য হয়ে না হয় সেই নোটটাই ভাঙাতে হবে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু যদি দাতারবাবুর সঙ্গে দেখা নাই হয়?
হঠাৎ নজরে পড়লো। ট্রামের মেঝের ওপর তার টিকিটখানা পড়ে আছে। কুড়িয়ে দেখলে দীপঙ্কর।
বললে–এই দেখুন, এই তো আমার টিকিট
কন্ডাকটার হাতে নিয়ে টিকিটটা ভালো করে দেখলে। অনেক পরীক্ষা করে বললে–কিন্তু এখন তো কাটা হয়ে গেছে আপনার টিকিট–
–তাহলে এ-টিকিটটা নিয়ে আমায় পয়সা ফেরত দিন!
–আর ফেরত হবে না, আমি যে টিকিট কেটে ফেলেছি
তাহলে! দীপঙ্কর মহা সমস্যায় পড়লো। বললে–দেখুন, আমার কাছে ফিরে আসবার আর পয়সা নেই–আমাকে বড় বিপদে পড়তে হবে
–তা আমি কী করবো? আমারও তো হেড-আপিসে হিসেব দাখিল করতে হবে–
কী আশ্চর্য! এমনভাবে সবাই ঠকাবে তাকে। অথচ সে তো টিকিট কেটেছে ঠিক ঠিক। কন্ডাক্টার গিয়ে আবার দাঁড়াল দরজার কাছে। হু হু করে চলেছে ট্রামটা। ধর্মতলায় আসতেই দীপঙ্কর নেমে পড়লো। যেন তার ঘেন্না ধরে গেছে ট্রামের ওপর। এতটুকু উপকার করতে পারলো না লোকটা। লোকটা আসলে বদমাইশ। সে তো প্রমাণ পেলে যে সে টিকিট কেটেছে! তাহলে নতুন টিকিটটা ফেরত নিতে কী দোষ! যত সব বদমাইশ লোক রেখেছে ট্রাম কোম্পানী! নিজের মনেই গজগজ করতে লাগলো দীপঙ্কর। কোথা দিয়ে যে বৌবাজারে যেতে হয় সে-রাস্তাটাও যেন ভুলে গেল দীপঙ্কর। সোজা ট্রাম রাস্তা ধরে গেলে আর রাস্তা ভুল হবার কথা নয়। সোজা রাস্তা দিয়ে গিয়ে ঘুরে ডান দিকে গেলেই লালবাজার। লালবাজার পুলিসের থানাটা আছে। তারপর আর খানিকটা গেলেই বৌবাজারের পাড়া। দুপুরে রোদ্দুরে বাড়িগুলোর ছায়ার তলা দিয়ে যেতে যেতে ভয়ানক রাগ হলো লক্ষ্মীদির ওপর। মনে হলো এই যে কিছু সবটুকুর জন্যে যেন লক্ষ্মীদিই দায়ী। লক্ষ্মীদি নেই বলেই তো এত অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে! লক্ষ্মীদির জন্যেই তো এত হয়রানি সকলের কাছে। লক্ষ্মীদির কথা ভাবতে ভাবতে তো পড়ায় ভালো করে মন বসে না তার। লক্ষ্মীদির জন্যেই তো সতী তাকে এমন সন্দেহ করে। লক্ষ্মীদি চলে গেছে বেশ হয়েছে–বেশ হয়েছে। সবাই বেঁচেছে। দীপঙ্করও বেঁচেছে। সতীও বেঁচেছে।
বিন্তিদিকে যেদিন দেখতে এসেছিল সেদিনকার কথাটাও মনে পড়লো।
সতী এসে একেবারে হাজির হয়েছিল ভদ্রলোকদের সামনে।
মা বললে–তুমি একেবারে ওঁদের সামনে এসে হাজির হলে? ওঁরা কী ভাবলেন বলো তো মা–
ভদ্রলোকরা তখন ঘটককে জিজ্ঞেস করছেন–ও মেয়েটি কে?
ঘটক মশাই বললে–ওই ভট্টাচার্যি মশাই-এর ভাড়াটেদের মেয়ে–কলকাতার কলেজে পড়ে–
–ওঁরা কি ব্রাহ্মণ?
–না কায়স্থ।
কথাবার্তা শুনে দীপঙ্করের মনে হলো সতীকে যেন পছন্দ হয়ে গেছে ওঁদের। যেন কায়স্থ না হয়ে ব্রাহ্মণ হলে ওঁরা সতীকেই পছন্দ করতেন। সত্যি সেদিন কী সুন্দর যে দেখাচ্ছিল সতীকে! অথচ সতীই তার নিজের গয়না, নিজের স্নো-পাউডার, নিজের শাড়ি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল বিন্তিদিকে। বেশ করে মনের মতন করে সাজিয়ে দিয়েছিল। বাড়িতে যত কিছু আছে তার সব দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল।
বিন্তিদি বলেছিল–আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ভাই?
সতী বলেছিল–খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, দেখবে ঠিক পছন্দ হবে তোমাকে, দেখে নিও।
মা বলেছিল–তুমি মা তবু যা হোক সাজিয়ে গুছিয়ে দিলে নইলে এত সব শাড়ি গয়না আমি কোথায় পেতাম-এখন ভালোয় ভালোয় পার হয়ে যায় মেয়ে তো বুঝবো ওর ভাগ্যি–
কিন্তু তারপরেই অঘটনটা ঘটলো।
মা বললে–আপনারা একটু বসুন, না-খেয়ে যাবেন না–আমি দেখে আসি—
ঘরের মধ্যে এসে মা বললে–কী মা, কাঁদছো কেন মা?
সতী বললে–এই দেখুন না মাসীমা, আমি যত বোঝাই কিছুতেই থামে না–কেবল কাঁদছে, কেঁদে কেঁদে একেবারে পাউডার-স্নো সব ভাসিয়ে দিলে, আমি এত করে সাজালুম–
মা তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে বিন্তিদির মুখ গাল মুছিয়ে দিলে। একেবারে অঝোরধারে কাঁদছিল বিন্তিদি তখনও।
মা বলতে লাগলো–ছি, আজকের দিনে কাঁদতে নেই, কী হয়েছে বলে তো মা! কী হয়েছে তোমার?
বিন্তিদি বললে–ওরা খাচ্ছেন না কেন? আমায় পছন্দ করেনি?
মা হেসে ফেললে। সতী পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সতীও হাসলে।
দীপঙ্কর বললে–সতীকে ওঁদের খুব পছন্দ হয়েছে, জানো মা–ওঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন সতীরা ব্রাহ্মণ না কায়স্থ–
–তুই থাম্ তো!
বলেই মা সতীকে বললে–তা তুমিই বা ওঁদের সামনে একেবারে যেতে গেলে কেন বলো তো মা? চন্ননীকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেই পারতে
সতী বললে–কিন্তু কী কান্নাকাটি যে করছিল বিন্তিদি-আপনি তো তখন দেখেননি মাসীমা–এখন তো তবু থেমেছে একটু
মা বললেছি মা বিন্তি, ওঁরা কী ভাববেন বলো তো? অমন ছেলেমানুষি করতে আছে?
–তাহলে ওঁরা খাচ্ছেন না কেন?
–খাবেন খাবেন, নিশ্চয়ই খাবেন! সেই কথাই তো ওঁদের বলতে গিয়েছিলাম-তা তুমিই তো গোল বাধালে যত–
তারপরে ভালো করে চোখ মুখ মুছিয়ে দিয়ে মা বললে–তুমি কেঁদো না, তুমি স্থির হয়ে বোসো একটু, বিয়ে কি অত সহজে হয় মা, মেয়েমানুষের বিয়ের অনেক জ্বালা, তারপরে বিয়ে হয়ে গেলে তুমিও নিশ্চিন্তি আমিও নিশ্চিন্তি–
সেদিন শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকেরা সত্যিই খেলেন। রীতি না থাক, নিয়ম না থাক, মা’র পীড়াপীড়িতে কেউ আর না করতে পারলেন না। ব্রাহ্মণের মা-বাপ-মরা মেয়ে, এমনিতেই যত্ন-আত্তি পায়নি, তারপর তারা না খেলে মনে বড় কষ্ট পাবে মেয়ে। বিয়ে না হোক ক্ষতি নেই, সমন্ধ না হলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ব্রাহ্মণের বাড়ি ব্রাহ্মাণ এসেছেন, আর অত দূর থেকে এসেছেন–আর আয়োজন সামান্য যা-কিছু করেছেন তিনি, তাঁরা না খেলে কে খাবে? কেউ তো নেই পাত্রীর! আপনারা দয়া করে নিয়ে গেলে বুঝবেন মেয়ের গুণ! সাত চড়েও কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে। বাড়ি থেকে এক-পা বেরোয় না এমনি মেয়ের স্বভাব। এই যে আজকাল সব মেয়েরা রাস্তায়-ঘাটে বেরোয়, এ-মেয়ে তেমন নয়। ঘরে নিয়ে গেলেই বুঝবেন এ-মেয়ে কত লক্ষ্মী! এই মেয়ের টানেই আমি এখানে পড়ে আছি-নইলে কবে চলে যেতুম….ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা! ভদ্রলোকরা লুচি আর রসগোল্লা খেতে খেতে সব শুনতে লাগলেন। ঘটক মশাইও পেট ভরে খেতে লাগলেন–চেয়ে চেয়ে খেতে লাগলেন সব।
সবাই চলে যাবার পর মা বললে–আজ তুমি ছিলে বলেই সব হলো মা, নইলে কে যে সাজিয়ে গুজিয়ে দিত–
সতী বললে–আমি তাহলে এখন আসি মা….।
–দাঁড়াও, ও দীপু, হারিকেনটা একটু ধর তো সতীকে, রাস্তাটা অন্ধকার—
বাড়ির সামনে অন্ধকার মতন। দীপঙ্কর হারিকেনটা নিয়ে সতীকে রাস্তা দেখিয়ে দিতে এল।
দরজার কাছে এসে বললে–আজ তোমাকেই কিন্তু ওরা বেশি পছন্দ করেছিল, জানো সতী?
সতী বললে–আবার বুঝি তোমার বকুনি খাবার সাধ হয়েছে? মাসীমাকে বলে দেব?
–বা রে, সত্যি কথা বলাও দোষ?
–কিন্তু বিন্তিদি কী মনে করলে বলো তো?
দীপঙ্কর বললে–না, কিন্তু বিন্তিদি তো অত সেজেছিল, তবু ওর চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালো দেখাচ্ছিল—সত্যি–
সতী কিছু বললে না। শুধু বললে—ছি–
–ছি কেন?
সতী বললে, ও-কথা বলতে নেই–
–কেন, বলতে নেই কেন, শুনিই না?
সতী বললে–দেখছ না আমার এখনও বিয়ে হয়নি, বিয়ে না হলে ও-কথা বলতে নেই
–কেন? ও-কথা বললে বিয়ে হয় না বুঝি?
সতী হেসে ফেললে হঠাৎ। বললে–তোমার দেখছি কিচ্ছু বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই–লোকে শুনলে কী ভাববে বলো তো?
–কী ভাববে?
সতী বললে–লোকে ভাববে হয়তো তোমার সঙ্গে আমার অন্য রকম সম্পর্ক!
–কী সম্পর্ক?
সতী হয়তো একটা উত্তর দিত, কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে মা’র গলা শোনা গেল। মা বললে–ও মা, তোমার শাড়ি গয়না-টয়নাগুলো নিয়ে গেলে না মা?
সতী সেখানে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললে–কালকে ও-সব নিয়ে যাবো মাসীমা, আজ থাক
দীপঙ্কর বললে–যাক গে, তোমাকে সুন্দর বলেছি বলে কিছু মনে করলে না তো?
–না, মনে আবার করবো কী? সুন্দর বললে তো সকলেরই ভালো লাগে তবে মুখের ওপর বললে একটু সন্দেহ হয়, এই আর কি
–আর তা ছাড়া আমি তো একলা বলছি না, ও ভদ্রলোকরাও বলছিল যে সতী বললে–ওরা না-হয় অন্য কারণে বলছিল–কিন্তু তুমি কী জন্যে বলছো শুনি?
দীপঙ্কর বললে–সত্যি আমার কোনও স্বার্থ নেই-আমার আবার কিসের স্বার্থ থাকতে পারে, বলো?
–তাই দেখছিলাম বটে, তুমি কেবল আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে ছিলে–
দীপঙ্কর বললে–ভাবছিলাম তোমার বিয়ের বেলায় এত কষ্ট করতে হবে না, যে দেখতে আসবে তারই পছন্দ হয়ে যাবে।
সতী বললে–আমার বিয়ের জন্য তোমার দেখছি ঘুম নেই একেবারে—
দীপঙ্কর লজ্জা পেয়ে গেল। বললে–না না, আমি আর কিছু বলবো না, তুমি যাও—
মাসীমাকে আমি কালকেই বলে দেব সব-যা যা বললে সব বলে দেব, দেখো—
–কী বলবে?
সতী আবার হাসলো। বললে–মাসীমাকে বলবো আপনার ছেলের একটা বিয়ে দিয়ে দিন শিগগির, সুন্দর মেয়ে দেখলেই তার সঙ্গে কেবল ভাব করবার জন্যে ছো ছোঁক করে আপনার ছেলে
–তাহলে আমিও বলতে পারি—
–কী বলতে পারো শুনি?
–আমিও কাকাবাবুকে বলতে পারি আপনার ভাইঝি ভদ্রলোকের ছেলে দেখলেই তাকে চাকর মনে করে–আর চাকর মনে করে তার গায়ে পয়সা ছুঁড়ে দেয়
সতী থমকে দাঁড়াল এবার। একবার চাইলে দীপঙ্করের দিকে। তারপর বললে আচ্ছা ঠিক আছে, আমি এ-কথাটাও বলে দেব মাসীমাকে
–কী কথা বলবে?
–বলবো, আপনার ছেলে কেবল গায়ে পড়ে লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে–
বলে আর দাঁড়ায় নি সতী-একেবারে নিজের বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। দীপঙ্করও আর সেখানে তখন দাঁড়ায়নি। সোজা হারিকেন নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। সেদিন অভ্যাগতদের জন্যে অত যে আনন্দের আয়োজন তার সবটুকু যেন তারপর তার অন্যমনস্কতার মধ্যেই হারিয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মা’র পীড়াপীড়িতে ভদ্রলোকেরা জলযোগ করতে বাধ্য হয়েছিল–বিন্তিদির কান্নাও একটু থেমেছিল। কিন্তু সব আয়োজন–অনুষ্ঠানের মধ্যেও দীপঙ্করের মনে হয়েছিল অনুষ্ঠান যেন শুধু তাকে কেন্দ্র করেই। যেন বিন্তিদির কনে-দেখাটা উপলক্ষ মাত্র–আসলে বিন্তিদির এ-অনুষ্ঠান না হলে সতী তার গয়নাগুলো এমন করে খুলেও দিত না, তার গয়নাগুলো না খুললে সতীকে অমন সুন্দরও দেখাত না। আর তা না হলে দীপঙ্করও অমন করে সতীকে সুন্দর বলবার অবকাশ পেত না।
.
ঘরের জানালাটা খুলে দিতেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে দীপঙ্কর স্পষ্ট দেখতে পেলে লক্ষ্মীদির ঘরের আলোটা জ্বলে উঠলো আর ঘরের মধ্যে যেন সতীর ছায়াটা নড়া-চড়া করতে লাগলো এদিক-ওদিক। আর খানিক পরেই ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিতেই দীপঙ্করের চোখে সব অন্ধকার হয়ে এসেছিল।
কিরণ বলেছিল–বিয়ে হবার পর কি আর তোকে চাঁদা দেবে ওরা–দেখবি তখন সব ভুলে যাবে–মেয়েমানুষরা বিয়ের পর আর কিছু মনে রাখে না–
দীপঙ্করের হঠাৎ মনে হলো যদি কিরণের কথাই সত্যি হয়? তা হতেও পারে। কিরণ তো জানে অনেক। অনেক বেশি বোঝে কিরণ। কিরণের কথা সত্যি হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া মনে রাখলেই বা লাভ কী! মনে না রাখাটাই ভালো। এই আপিস পাড়াতেই একদিন কাজের মধ্যে সমস্তই ভুলে যেতে হবে। আগেকার সেসব দিনের কথাগুলোই কি মনে আছে দীপঙ্করের? সেই লক্ষ্মণ সরকার, সেই নির্মল পালিত, সেই ফটিক, সেই চণ্ডীবাবুদের বাড়ির–কী যেন নামটা। আশ্চর্য এই কদিনের মধ্যে নামটাও আর মনে পড়ছে না। আর শুধু মানুষই বা কেন, জায়গাও কত বদলে গেল। ইতিহাস বদলায় আর ভূগোল বদলাবে না?
— মশাই, দাতারবাবুর আপিসটা এখানে কোথায়? এস. এস. দাতার? শিবশঙ্কু দাতার?
কুড়ির-বি বৌবাজার স্ট্রীট! বৌবাজারের বড় রাস্তার ওপর ঠিক নয়। একটা ছোট গলির ভেতর–দোতলার ওপর উঠতে হয়। ঠিক নম্বরটা দেখে মিলিয়ে নিয়ে এদিক-ওদিক চাইতে লাগলো দীপঙ্কর। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে লোক উঠছে নামছে–তার পাশ ঘেঁষে সোজা যে-যার নিজের কাজে চলে যাচ্ছে। দুপুরবেলার আপিস-পাড়া। এদিকটায় চীনেদের বসতি। অনেক চীনেম্যান ঘোরা-ফেরা করছে আশেপাশে। খড়ম পায়ে, গেঞ্জি গায়ে বাড়ির সামনে সরু গলিতেই ঘর-বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে যেন।
–হ্যাঁ মশাই, দাতারবাবুকা আপিস কাঁহা মালুম হ্যায়?
হুঁ করে সবাই প্রশ্নটাস শোনে। কেউ কেউ আবার তেমন আমলই দেয় না। দীপঙ্কর আসল নম্বরটার সামনে এসেই বার কয়েক দাঁড়াল। সাইনবোর্ডও নেই যে দেখে বুঝতে পারবে! দরজায় তালা বন্ধ। একটা রং-চটা দরজা। আশে-পাশের ঘরে লোকজন রয়েছে, কিন্তু ওই দরজাটাই বন্ধ একেবারে। দীপঙ্কর পাশের ঘরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলে। দু’একজন বাঙালী কাজ করছে।
–হ্যাঁ মশাই, এ আপিসটা কখন খুলবে?
–ও আর খুলবে না, ও বন্ধ হয়ে গেছে
–বন্ধ হয়ে গেছে?
–হ্যাঁ–
দীপঙ্কর যেন হতাশ হয়ে পড়লো। এত কষ্ট করে খুঁজে বার করে এখন তাকে আবার ফিরে যেতে হবে! আর কাছে যে পয়সাও নেই ফিরে যাবার। মাত্র দুটো পয়সা। রয়েছে পকেটে। যেমন করে হোক দাতারবাবুর সঙ্গে যে দেখা করতেই হবে। অচল পাঁচ টাকার নোটটাও বদলে নিতে হবে! কাঠের সিঁড়িটা দিয়ে নেমে নিচে চলে এসেছিল দীপঙ্কর। আবার যদি কাল আসতে হয় তো আবার ক’টা পয়সা খরচ। সেই কালীঘাট থেকে অত দূরে আসা কি সম্ভব! পয়সাই বা দেবে কেন মা? জিজ্ঞেস করলে দীপঙ্কর বলবেই বা কী! দীপঙ্কর আবার উঠলো। আপিসটার খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
বললে–হ্যাঁ মশাই, শুনছেন?
ভদ্রলোক মাথা তুললে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা, দাতারবাবুর বাড়ির ঠিকানাটা বলতে পারেন?
লোকটা এবার মনোযোগ দিয়ে চাইলে তার দিকে। বললে–কেন বলুন তো, কী দরকার তার সঙ্গে?
–এই একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়েছিলেন, সেটা অচল, বদলে নিতে এসেছি—
ভদ্রলোক বললে–সে আর বদল পাবেন না—
–আপনি বলুন না তার ঠিকানাটা, নিশ্চয়ই বদলে দেবেন।
অনেক বোঝনোর পর ঠিকানাটা আন্দাজে বললে ভদ্রলোক। চীনেপাড়ার মধ্যে একটা একতলা বাড়িতে সামনের ঘরে থাকে দাতার বাবু। হলদে রং-এর বাড়ি, আলকাতরা মাখানো দরজা-দেখলেই চেনা যাবে।
–তবে এখন তো পাবেন না তাকে, দেখুন চেষ্টা করে যদি পান, এখন একটু গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছে ক’দিন!
ভদ্রলোকের মন্তব্যটা ভালো লাগলো না দীপঙ্করের। তাড়াতাড়ি আবার নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। সেই চীনেপাড়ার মধ্যে আরো ভেতরে ঢুকতে হলো। আশ্চর্য, এও যেন সেই নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের মতো নোংরা। আসলে ভেতরে ভেতরে সব সমান। ট্রাম রাস্তায় দাঁড়ালে ভাবাই যায় না ভেতরে গলির মধ্যে এত নোংরা জায়গা আছে। হলদে রং-এর একতলা বাড়ি, আলকাতরা মাখানো দরজা। দাতারবাবু এই রকম জায়গায় থাকে? অথচ দাতারবাবুর তো বর্মায় মস্ত বড় ব্যবসা ছিল। লক্ষ্মীদির কাছে শুনেছিল দীপঙ্কর, শুধু লক্ষ্মীদির জন্যেই সে-সব ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় এসেছে। টাকা-কড়ি ব্যবসাবাণিজ্য সমস্ত দাতারবাবুর কাছে তুচ্ছ। লক্ষ্মীদির জন্যে দাতারবাবু সব কিছু ছাড়তে পারে। অথচ সেই লক্ষ্মীদিই দাতারবাবুকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল। কিরণ ঠিকই বলেছে-মেয়েরা সব ভুলতে পারে। মেয়েমানুষরা কিছু মনে রাখে না। দাতারবাবু লক্ষ্মীদির জন্যে অত স্বার্থত্যাগ করেছিল–আর লক্ষ্মীদি চলে যাবার সময় সেই দাতারবাবুর কথা একবার ভাবলেও না। দাতারবাবু সেই জন্যেই সেদিন রাস্তায় বলেছিলেন–ভেবে আর কী করবে? তুমি বাড়ি যাও।
না, আর বেশি ভাববে না দীপঙ্কর। দাতারবাবুও নিশ্চয়ই ভাবেন না। একদিন গরীব অবস্থা থেকে উঠেছেন-গরীব অবস্থা থেকে বড় হয়েছেন, একদিন তারও অবস্থা ছিল দীপঙ্করের মতো, কিরণদের মতো। গরীব হওয়ার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই। গরীব বলে হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। দাতারবাবুরই কথা।
হলদে রং-এর একতলা বাড়ি, আলকাতরা মাখানো দরজা।
দীপঙ্কর সামনে গিয়ে দরজার কড়া নাড়লে।
প্রথমটা কোনও সাড়া এল না। তারপর আবার কড়া নাড়লে। ভেতরে ঝি-চাকর কেউ আছে নিশ্চয়। ভেতর থেকে খিল দেওয়া। যদি চাকর এসে বলে-দাতারবাবু বাড়ি নেই। যদি বলে আসতে রাত্তির হবে। রাত দশটা-এগারোটা হবে! ততক্ষণ কি বসে থাকা সম্ভব? কিন্তু দাতারবাবুর কাছে পয়সা না নিয়ে যে তার বাড়ি ফেরবারও উপায় নেই। দুটো পয়সা মাত্র পকেটে নড়ছে তার। থাকতেই হবে বসে। উপায় কী? রোজ রোজ আর আসা যায় না এদিকে। এদিকে এলেই তিনটে-তিনটে ছ’টা পয়সা খরচ। তারপর বিকেল তিনটের পর তিনটে পয়সায় আর হবে না। তিনটের পর থেকে আবার ট্রামের ভাড়া বেড়ে যায়। চীপ মিড-ডে ফেয়ার চালু ওই বিকেল তিনটে পর্যন্ত।
ভেতর থেকে ঝি-এর গলা পাওয়া গেল।–কৌন হ্যায়?
দীপঙ্কর বললে–এ দফে দরওয়াজা খুলিয়ে না-হাম বহুত দূর সে আতা হ্যায় ভেতর থেকে শব্দ এল–বাবুজী আভি নেহি হ্যায় ঘরমে–
দীপঙ্কর বললে–হাম একঠো চিঠ্ঠি লিখে রাখে গা–এক মিনিটকো ওয়াস্তে খুলিয়ে
দরজা খুললো। খুলতেই দীপঙ্কর দু পা পেছিয়ে এসেছে! লক্ষ্মীদি!
–লক্ষ্মীদি তুমি?
লক্ষ্মীদিও কেমন যেন ভয় পেয়ে পেছিয়ে দাঁড়াল।
–দীপু, তুই?
দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির চেহারা দেখে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এ কী চেহারা হয়েছে লক্ষ্মীদির? এ-কী পোশাক! মাথার সিঁথিতে জ্বল জ্বল করছে সিঁদুর। লক্ষ্মীদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে! কবে হলো! এত ময়লা কাপড় শেমিজ পরে আছে কেন? এ কী ঘর! এই ঘরে থাকে কেমন করে লক্ষ্মীদি! ঘরখানাতে যেন আলো ঢোকে না কোনও দিক দিয়ে! একটা তক্তপোশ পাতা রয়েছে একপাশে। ঘরময় একটা ভ্যাপসা ভিজে গন্ধ।
–তুই হঠাৎ?
দীপঙ্কর কী বলবে! তার যেন কথা হারিয়ে গিয়েছে। এমন করে এই অবস্থায় লক্ষ্মীদির দেখা পাবে তা তো ভাবতে পারেনি দীপঙ্কর, এখানে এই দাতারবাবুর বাড়িতে। যে-দাতারবাবুকে দিনের পর দিন চিঠি দিয়ে এসেছে, যে-দাতারবাবুর সঙ্গে এই সেদিনও তার দেখা হয়েছে রাস্তায়, সেই দাতারবাবুর বাড়িতেই শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীদিকে দেখতে পেলে!
–আমি তো ভেবেছিলাম অন্য কেউ ডাকছে, তাই দরজা খুলতে দেরি করছিলাম।
দীপঙ্করের যেন তখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। এ কি সত্যিই লক্ষ্মীদি, না আর কেউ?
–কী দেখছিস অমন করে তুই!
লক্ষ্মীদি যেন হাসছে তার দিকে চেয়ে।
দীপঙ্কর বললে–লক্ষ্মীদি, তুমি এখেনে, আমি যে তোমায় কত খুঁজেছি, কত ভাবছি তোমার জন্যে রাত্রে ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে যায় তোমার কথা ভেবে, কতদিন রাস্তায় রাস্তায় টো টো করে ঘুরে বেড়িয়েছি তোমাকে ভাবতে ভাবতে–
লক্ষ্মীদি আবার হাসলো। বললে–তুই দেখছি এখনও ছেলেমানুষ আছিস—
লক্ষ্মীদির কথাগুলো যেন কানে গেল না দীপঙ্করের। লক্ষ্মীদিকে এখানে দেখে তার আনন্দ হয়েছে, না দুঃখ হয়েছে তাও যেন সে ঠিক বুঝতে পারলে না। আনন্দও নয়, দুঃখও নয়, যেন একটা বিস্ময় তার সমস্ত চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কিরণের অসুখের সময় তার কথাগুলো শুনেও যেন এত আশ্চর্য হয়নি। প্রথম যেদিন লক্ষ্মীদিকে জানালার ফাঁক দিয়ে নাচতে দেখেছিল, সেদিনও এত আশ্চর্য হয়নি। সতী যেদিন তার গায়ে চারটে পয়সা ছুঁড়ে দিয়েছিল, সেদিনও এত অবাক হয়নি।
লক্ষ্মীদি বললে–আয় বোস এখানে—বোস–
বলে লক্ষ্মীদি দীপঙ্করের হাত ধরে তক্তপোশটার ওপরে বসিয়ে দিলে। দীপঙ্কর ঘরটার চারদিকে চেয়ে দেখলে। এত নোংরা ঘর। এত নোংরা ঘরে থাকে কী করে লক্ষ্মীদি! যে-লক্ষ্মীদি অত ফরসা, যে-লক্ষ্মীদি অত দামী দামী শাড়ি শেমিজ পরে, সেই লক্ষ্মীদি এখানে কী করে থাকে।
–এখানে আমি আছি কী করে জানতে পারলি রে তুই?
দীপঙ্কর বোবার মতন লক্ষ্মীদির দিকে চাইলে। তার চোখ যেন ছলছল করে উঠলো–
–বাড়িতে ওরা কী বলছে রে সবাই? খুব খুঁজছে তো আমাকে?
দীপঙ্কর রেগে গেল। বললে–তুমি হাসছো লক্ষ্মীদি? হাসতে তোমার লজ্জা করে না?
-–কেন রে? হাসবো না কী করবো?
দীপঙ্কর বললে–আর আমি যে ভেবে ভেবে অস্থির হচ্ছি তোমার জন্যে তোমার একবারও তা মনে পড়লো না? আমার পড়াশোনা কিচ্ছু হচ্ছে না তোমার জন্যে, তা জানো? তুমি একটা খবরও দিতে পারলে না আমাকে?
লক্ষ্মীদি এবার কাছে সরে এল। দীপঙ্করের হাতটা ধরে নিজের কোলের ওপর রাখলে। বললে–সত্যিই তুই আমার জন্যে খুব ভাবনায় পড়েছিলি, না? কিন্তু কী করে তুই জানলি আমি এখানে আছি?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–দাতারবাবু কোথায়? তাঁকে খুঁজতেই তো এসেছি—
লক্ষ্মীদি বুঝতে পারলে না কিছু। দীপঙ্করের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
দীপঙ্কর বললে–দাতারবাবু সেই যে পাঁচ টাকার নোটটা দিয়েছিল, সেটা অচল। সেটা বদলাতেই তো এসেছি–কদিন থেকে আসবো আসবো ভাবছি, কিন্তু তোমার জন্যে ভেবে ভেবে কিছুতেই আসতে ইচ্ছে করছিল না–তুমি কী লক্ষ্মীদি? তোমার একটু মায়া হয় না?
লক্ষ্মীদি একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বললে–কিন্তু তুই তো জানিস না, আমি এদিকে কী বিপদে পড়েছি
–-তা তুমি একটা খবর দিলে না কেন আমাকে? আমি খবর পেলেই আসতুম–
–সে তুই কিছু করতে পারবি না রে, তোকে খবর দিয়ে আর কী লাভ হতো?
দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। লক্ষ্মীদি তার হাতটা ধরে যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। ঘরটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে। বেলা বোধ হয় পড়ে এল। বৌবাজারের একতলার ঘর, আলো-হাওয়া ঢোকবার পক্ষে বোধ হয় অনুকূল নয় তেমন। দরজা জানালা যা আছে তাও লক্ষ্মীদি বন্ধ করে দিয়েছে।
–ওরা ভাবছে, আমিও ভাবছি–তোমার জন্যে সবাই ভাবছে লক্ষ্মীদি। কাকাবাবু পুলিসের সব থানাতে গিয়ে খবর নিয়ে এসেছেন, তোমার কলেজেও কেউ কিছু জানে না, তুমি যে কখন কেমন করে কোথায় গেলে কেউই জানে না–সতীও খুব ভাবছে। সতী সেদিন আমাকেই সন্দেহ করছিল, জানো? সতী ভেবেছে আমি জানি তুমি কোথায় আছো? শেষকালে আমার হাত ধরে টানাটানি, তখন কাকীমা এসে ছাড়িয়ে দিলেন–
লক্ষ্মীদি বললে–আমি ভাবতেই পারিনি রে এমন হবে–
–কিন্তু তুমি চলে এলে কেন লক্ষ্মীদি? আগে তো বেশ ছিল, কেউ জানতে পারছিল না, যা বলবার দরকার ছিল আমাকে বললেই আমি দাতারবাবুকে এসে বলে যেতাম। এখন যদি কেউ টের পায় তুমি এখানে আছ?
–তুই বলে দিবি নাকি?
-–না আমি বলবো না! কিন্তু তোমার বাবা তো আসছেন এখানে, এসে যদি তোমাকে খুঁজে বার করেন, তখন কী হবে বলো তো?
–বাবা আসছেন? কী করে জানলি তুই?
–তোমার বাবার চিঠি তো এল, আমি দেখলাম! সতীর নামেই তো চিঠি এল– সতীই তো বললে কাকীমাকে–
লক্ষ্মীদি কি যেন ভাবতে লাগলো নিজের মনে।
দীপঙ্কর বললে–তার চেয়ে এক কাজ কর লক্ষ্মীদি–
–কী কাজ?
–তুমি বাড়ি ফিরে চলো। তোমার বাবা আসার আগেই ফিরে চলো, কেউ কিছু বলবে না। সতী আমাকে বলেছে, কেউ কিছু বলবে না–আর তা ছাড়া পাড়ার কেউ কিছু জানতেও পারেনি এখনও! তুমি যেমন থাকতে তেমনিই থাকবে–ও কথাও কেউ তুলবে না। তাই চলো লক্ষ্মীদি–দাতারবাবুকে একটা চিঠি লিখে রেখে দিয়ে আমার সঙ্গে চলো–
লক্ষ্মীদি কথাগুলো শুনেও কিছু বললে না।
দীপঙ্কর বললে–চলো না, আবার যেমন ছিলে তেমনি হয়ে যাবে, বিয়ে-টিয়ে হয়ে গেলে কে আর জানতে পারবে!
লক্ষ্মীদি বললে–না রে তা আর হয় না–
হঠাৎ লক্ষ্মীদির মাথার দিকে আবার নজর পড়লো।
বললে–তুমি ওই সিঁদুরের কথা বলছো তো? ও তেল দিয়ে ঘষলেই একেবারে সাদা হয়ে যাবে, ও কেউ বুঝতে পারবে না–
–দূর, ও-কথা বলিস নি, ও মুছতে নেই, আমি যে বিয়ে করেছি–
–কাকে?
দীপঙ্করের প্রশ্নটা যেন হঠাৎ নিজেরই কানে, খট করে বাজলো! লক্ষ্মীদির দিকে আবার চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। দেখেই যেন একটু সরে বসলো। মনে হলো লক্ষ্মীদি যেন তাকে হঠাৎ বড় প্রবঞ্চনা করেছে। লক্ষ্মীদিকে হঠাৎ যেন বড় পর মনে হলো দীপঙ্করের। দীপঙ্কর নিজের হাতটা লক্ষ্মীদির কাছ থেকে টেনে নিলে। এক মুহূর্তে লক্ষ্মীদির মুখখানা যেন বড় করুণ মনে হলো। যেন মায়া হয় লক্ষ্মীদিকে দেখে।
বললে–কেন তুমি এমন কাজ করলে লক্ষ্মীদি?
–কী কাজ?
–এই দাতারবাবুকে বিয়ে করা! এটা কি তোমার পক্ষে উচিত হয়েছে? কাউকে একবার জিজ্ঞেসও পর্যন্ত করলে না তুমি, আর একেবারে ঝপ্ করে এমন কাজ করে ফেললে? ভাবো তো, কেউ জানলো না, শুনলো না, কেউ সাক্ষী পর্যন্ত রইল না আর বিয়ে হয়ে গেল? এই দেখ না, বিন্তিদিরও তো বিয়ে হবে, কত লোকজন এসে দেখে যাচ্ছে, তারপর দু পক্ষের পছন্দ হলে তবে বিয়ে হবে–এ তোমার কী রকম বিয়ে বলো তো?
–কিন্তু বিয়ে তো এখন হয়নি, অনেক দিন আগেই হয়ে গেছে–
–অনেক দিন আগে? কই, আমি তো কিছুছু টের পাইনি?
–হ্যাঁ, তুই সেই চিঠি দিয়ে দিয়ে আসতিস, তখনই বিয়ে হয়ে গেছে আমাদের– কালীঘাটে গিয়ে বিয়ে করেছিলুম আমরা, এতদিন কেউ জানতো না–
দীপঙ্কর কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন বিহ্বল হয়ে গেল। লক্ষ্মীদির সব কথাই জানে বলে একটা গর্ব ছিল দীপঙ্করের। আজ সেই গর্বটাও যেন চুরমার হয়ে গেল। নিজের পরাজয়টা যেন খুশি মনে মেনে নিতে পারলে না সে। নিজের ওপরেই তার মায়া হলো শুধু।
অনেকক্ষণ পরে দীপঙ্কর বললে–তাহলে এখন কী করবে?
লক্ষ্মীদি বললে–সেই কথাই তো কদিন থেকে ভাবছি, তোর কথাও ভাবছিলাম, ভাবছিলাম তুই এলে ভালো হয়, তা তুই এসেছিস ভালোই হয়েছে, আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি রে এখানে এসে–
–বিপদ? তোমার বিপদ?
–হ্যাঁ, আমি যে কী করবো বুঝতে পারছি না।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কেন, কী হলো তোমার লক্ষ্মীদি 1
–তুই ভাই আমার একটা উপকার করতে পারবি?
দীপঙ্কর বললে–নিশ্চয় পারবো, তুমি বলো না, কী উপকার করতে হবে?
–তাহলে শোন্–
লক্ষ্মীদি গুছিয়ে বসলো। বললে–আমি যেদিন এখানে এলুম, সেদিনও জানি না যে এখানেই আমাকে থাকতে হবে এবার থেকে। আগের দিন সকাল বেলা শম্ভু চিঠি দিয়েছিল, তার খুব অসুখ করেছে–আমি পরের দিন কলেজে যাবার নাম করে এখানে চলে এলুম। দেখি শম্ভুর খুব জ্বর। জ্বর দেখে ডাক্তার ডাকতে গেলাম, ভাবলাম রোজকার মতো বিকেল বেলা বাড়ি পৌঁছলেই হবে, কিন্তু আমার সঙ্গে টাকা ছিল না–শম্ভুর বাক্সটার ভেতর হাত দিতে দেখলাম, টাকা নেই, ওর জামার পকেটে মনিব্যাগটাও দেখলাম, সেখানে দেখি মাত্র একটা টাকা পড়ে রয়েছে–কী করি…
লক্ষ্মীদির কথা শুনতে শুনতে দীপঙ্কর সেদিন যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে গিয়েছিল। সেই বৌবাজার স্ট্রীটের একতলার ছোট ঘরটার মধ্যে যেন দীপঙ্কর আর লক্ষ্মীদি একেবারে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। লক্ষ্মীদির বিপদ যেন দীপঙ্করেরই বিপদ হয়ে উঠেছিল। এমন করে লক্ষ্মীদি বিপদে পড়েছিল আর দীপঙ্কর একটা খবরও পেলে না!
–তারপর?
তারপর কোথা দিয়ে যে সে-রাতটা কেটেছিল, সে-জ্ঞান ছিল না লক্ষ্মীদির। বিকেল হলো, সন্ধ্যে হলো, রাত হলো। রাত আটটা বাজলো, নটা বাজলো, দশটা বাজলো, এগারোট বাজলো। তারপর এক সময়ে ভোরও হয়ে গেল। সারা রাত লক্ষ্মীদি দাতারবাবুর পাশে জেগে কাটিয়েছে, আর মাথায় জলপটি দিয়েছে। রাত্রে খাওয়া হয়নি। সমস্তমাথাটা টন টন করছে ব্যথায়। তখন আর কোনও কথা ভাববার মতো অবস্থা নেই। ভোরবেলা শম্ভু তখন চোখ চাইলে। বললে, একটু জল দাও। তখন আমার যে কী অবস্থা কী করে বোঝাবো তোকে।
–তা আমাকে একটা খবর দিতে পারলে না তুমি?
লক্ষ্মীদি কী একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বাইরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়লে। দীপঙ্কর উঠছিল। বললে–এই বোধহয় দাতারবাবু এসেছেন–
লক্ষ্মীদি বললে–না, দরজা খুলিসনি–
–কেন? কে দরজা ঠেলছে?
লক্ষ্মীদি বললে– সারাদিন ওই রকম দরজা ঠেলে লোকে–ও তোকে কিছু করতে হবে না–
–কিন্তু দাতারবাবুও তো হতে পারে–
–না শম্ভু নয়, শম্ভু বাড়িতে থাকে না–
–থাকে না?
দীপঙ্কর যেন অবাক হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। দাতারবাবু বাড়িতে থাকে না তো কোথায় থাকে? লক্ষ্মীদি একলা এখানে থাকে নাকি?
লক্ষ্মীদি বললে–একলাই তো থাকি, বড় ভয় করে রে আমার এখানে
–তা তুমি একলাই বা থাকো কেন? দাতারবাবু কোথায় গেল তোমাকে ফেলে। এখানে তোমাকে কে তাহলে দেখাশোনা করে? কে রান্না করে? কী করে চলে তোমার লক্ষ্মীদি?
বাইরে যে-লোকটা কড়া নাড়ছিল, সে বোধ হয় এতক্ষণে হতাশ হয়ে চলে গেল।
দীপঙ্কর বললে– দরজা খুললে না কেন লক্ষ্মীদি? ও কে? ওরা কারা?
–ওরা সব শম্ভুর পাওনাদার–
–পাওনাদার? টাকা পায় দাতারবাবুর কাছে? তা শোধ দিয়ে দিলেই হয়?
লক্ষ্মীদি বললে–সেই জন্যেই তো শম্ভু এখানে থাকে এখানে থাকে না। আপিসটা পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে, কারবার একেবারে খারাপ হয়ে গেছে কিনা, যাদের যাদের টাকা দেবার কথা ছিল তারা সবাই কোর্টে নালিশ করেছে, ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে ওর নামে–বড় মুশকিলে পড়েছি রে, এখানে এসে পড়েছি আমি, এখন এখানে থাকতেও পারি না, চলে যেতেও পারি না–কী করি বল তো তুই?
–তা তুমি আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে চলো না?
–তোর সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাবো? ওরা কী বলবে শেষকালে? যদি বাবাকে জানিয়ে দেয়?
দীপঙ্কর বললে–কাউকে জানায়নি লক্ষ্মীদি, আমি ওদের বলেছিলাম যে, লক্ষ্মীদি নিশ্চয়ই ফিরে আসবে আর তা ছাড়া এখানে তুমি একলা একলা থাকবে কী করে? এখানে আছো কী করে তুমি? কী খাও? কে রাঁধে?
লক্ষ্মীদি বললে–রেঁধে খাই না তো–দুদিন শুধু কেনা খাবার খেয়ে আছি–
–বলো কি তুমি লক্ষ্মীদি! চলো তুমি, এখুনি চলো আমার সঙ্গে, আমি একটা ঘোড়ার গাড়ি ডেকে আনছি–
লক্ষ্মীদি চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–ভাবছো কি এত–ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম দাতারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে, তাই তো তোমার দেখা পেলুম।
–তুই কী করতে এসেছিলি বললি?
দীপঙ্কর বললে–সেই একটা নোট দিয়েছিলেন দাতারবাবু সেটা অচল, একদিন রাস্তায় দেখা হলো, বললেন, এখানে এলে আর একটা নোট দেবেন। তখন তুমি এখেনে চলে এসেছ–
লক্ষ্মীদি বললে–তখন থেকেই তো গোলমাল চলছে, এখানে নতুন ব্যবসা তো ওর, নতুন করে সব করতে হচ্ছিল, কত লোক ওকে ঠকিয়ে নিলে, অথচ বর্মায় ওর অত বড় ব্যবসা ছিল। আমার জন্যেই সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে চলে এসেছে। মানুষটাকে দেখলে আমার নিজেরই কেমন খারাপ লাগে, মনে হয় আমিই ওর সর্বনাশের মূল, আমি না থাকলে ও বোধহয় একরকম করে কাটাতে পারতো–
–কিন্তু তোমাকে এখানে একলা ফেলে রেখে দাতারবাবু থাকেই বা কোথায়?
–কোথায় কোথায় থাকে, হঠাৎ একদিন অনেক রাত্তিরে এসে দরজায় কড়া নাড়ে দিনের বেলা আসতে সাহস হয় না। আমার কাছে একটা পয়সা ছিল না যখন চলে গেল–আমার হাতের চুড়িগুলো একটা একটা করে বেচে এ-কদিন চালিয়েছি–এই দেখ না চারটে চলে গেছে, আর এই কটা আছে মাত্ৰ–
–কিন্তু দেনা শোধ করে দিলেই হয়! কত টাকা দেনা?
লক্ষ্মীদি বললে–সে অনেক টাকা, আমার এই হার কানের দুল সব ওকে দিয়ে দিয়েছি, এখনও অনেক টাকা বাকি আছে, সেই টাকার চেষ্টাতেই তো ঘুরে বেড়াচ্ছে
লক্ষ্মীদির কথাটা শুনে দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ভাবতে লাগলো। বললে–কিন্তু টাকার যোগাড় যদি আর না হয়?
–না হলে আর কী করবো! শেষকালে যা হবার তাই হবে–
–কিন্তু ততদিন তুমি এখানে থাকবে কী করে? হাতের বাকি চুড়িগুলোও যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন কী করবে?
লক্ষ্মীদি চুপ করে রইল। যেন কী করবে তা ভাববার ক্ষমতাও তার নেই।
দীপঙ্কর বললে–এ তোমার কী রকম বুদ্ধি বলো তো লক্ষ্মীদি? তোমার নিজের কথাটা তুমি একবারও ভাববে না? এতে কি দাতারবাবুরই ভালো হবে মনে করো?
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু বাড়িতে আমি কোন্ মুখে আবার যাবো!
–-কেন? তুমি তোমার নিজের বাড়িতে যাবে তাতে কার কী বলবার আছে?
–কিন্তু আমি যে বিয়ে করে ফেলেছি–
–-তা বিয়ে কি কেউ করে না? বিয়ে করেছ বলে কি কাকাবাবু কাকীমা তোমায় তাড়িয়ে দেবেন? তারা তো তোমার জন্যেই ভেবে ভেবে হয়রান। এই যে তুমি এতদিন বাইরে আছ, ওদেরও কি কম কষ্ট হচ্ছে ভাবছো?
লক্ষ্মীদি এ কথার কোনও উত্তর দিলে না।
দীপঙ্কর বললে–তাছাড়া তোমাকে এখানে রেখে আমিই বা কী করে যাই বলো তো? আমারও তো রাত্তিরে গিয়ে ঘুম হবে না। আমিও তো শুয়ে শুয়ে কেবল তোমার কথাই ভাববো–
লক্ষ্মীদি বললে–তার চেয়ে তুই এখানে থাক না–থাকতে পারবি না এখানে?
–আমি?
দীপঙ্কর যেন মুশকিলে পড়লো হঠাৎ, বললে–আমি?
লক্ষ্মীদি বললে–হ্যাঁ, থাক না, যে ক’দিন শম্ভু না আসে সে-কদিন তুই থাক না আমার সঙ্গে। তুই থাকলে আমার তবু একটু ভয় কমবে–চীনেদের ছেলে আছে একটা, সে-ই আমায় খাবার এনে দেয় দোকান থেকে, সে-ই আমার গয়নাগুলো বেচে টাকা এনে দিয়েছে, তুই থাকলে তাকে আর বলতে হয় না-থাকবি?
–কিন্তু–
কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল দীপঙ্কর। এক ঘরে একসঙ্গে লক্ষ্মীদির সঙ্গে থাকা, কেমন যেন লোভ হলো দীপঙ্করের।
লক্ষ্মীদি বললে–এখানে তোর কোনও অসুবিধে হবে না, তুই থাক–তুই থাকলে আমার খুব উপকার হবে রে–
দীপঙ্কর কী বলবে ভেবে পেল না। থাকতে যেন তার লোভও হচ্ছে।–তোর মা’র কথা ভাবছিস বুঝি? তোর মাকে গিয়ে বলতে পারবি না যে লক্ষ্মীদির কাছে শুয়েছিলুম, তোর মা তো আমাকে চেনে
–না লক্ষ্মীদি, তাহলে যে জানাজানি হয়ে যাবে সব, সবাই যে জেনে ফেলবে। আর আমি যে বলেও আসিনি, জামা-কাপড় নিয়ে আসিনি কিছুছু–আমি থাকতে পারব না–তার চেয়ে তুমিই চলো।
–আমি যাবো?
লক্ষ্মীদি যেন নিজের মনেই কী সব ভাবতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–চলো না, তোমাকে এরকম করে একলা ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না যে আমার। সারা রাত এইখানে এইরকম করে একলা পড়ে থাকবে? শেষকালে যদি কোন বিপদ-আপদ হয়?
লক্ষ্মীদি বললে–রাত্রে এক-একদিন খুব হৈ চৈ হয় বাইরে, জানিস, আমি একেবারে ঘুমোতে পারি না–
–তা দাতারবাবু যদি আর না আসে?
লক্ষ্মীদি বললে–না, রে, সে আসবেই। আমাকে নিয়ে কী-রকম বিপদে পড়েছে বল তো? সেও তো আমাকে বলে বাড়ি চলে যেতে, কিন্তু আমিই বা কী করে যাই তাকে এই বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে, বল্?
–কিন্তু তুমি এখানে থেকেই কি তাকে কিছু সাহায্য করতে পারবে?
–তা তো পারবো না জানি, তবু বিপদের সময় তাকে ফেলে যাওয়া কি ভালো?
–তার চেয়ে এক কাজ করো না–
–কী কাজ?
দীপঙ্কর বলে–তার চেয়ে তুমি বাড়ি গিয়ে বরং তোমার বাবাকে বলে টাকাকড়ি যোগাড় করে দাতারবাবুকে পাঠিয়ে দাও–তাতেই তো বেশি সাহায্য করা হবে–
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু আমাকে কি কেউ বিশ্বাস করবে?
-–কেন করবে না, তুমিও তো বাড়ির মেয়ে, নিজের বাবা কি নিজের মেয়েকে ফেলতে পারে?
লক্ষ্মীদি খানিকক্ষণ নিজের মনে কী ভেবে বললে–তা হলে তাই চল্–তোর সঙ্গেই বাড়ি চলে যাই–
দীপঙ্কর লাফিয়ে উঠলো, বললে–যাবে তুমি? তা হলে শিগির চলো, সন্ধ্যে হয়ে আসছে–
–দাঁড়া দু-একটা জিনিস গুছিয়ে নিই, এ কদিন যে কীভাবে কাটিয়েছি এখানে, একটা লোক নেই যে তার সঙ্গে দুটো কথা বলি! কতদিন ঘরটা যেন ঝাঁট দেওয়া হয়নি।
দীপঙ্কর বললে–এখন ও-সব থাক্ না লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি জামা-কাপড়গুলো গুছোতে গুছোতে বললে–এ-সব একেবারে ভূতের বাড়ি হয়েছে জানিস–
-–তা একদিনে কি আর পরিষ্কার হবে এ-সব! এ যেমন আছে থাক্ না!
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু এত নোংরা রেখে যাই কী করে বল্ তো!
–ঝি-টি কেউ নেই তোমার?
লক্ষ্মীদি বললে–একটা চাকর ছিল শম্ভুর, মাইনে দিতে পারেনি বলে সে-ও চলে গেছে কদিন হলো–আর ও তো বাড়ি আসছে না মোটে, এই দেখ না শালপাতার ঠোঙায় করে খাবার এনে দিয়েছিল ছেলেটা সে-গুলোই পড়ে আছে এখানে, বাইরে ফেলতেও ভয় করতো–ভাবতাম যদি কেউ দেখে ফেলে–
–জানো লক্ষ্মীদি ওরা কেউ জানে না যে দাতারবাবু এখানে কলকাতায় এসেছে, সবাই জানে এখনও বুঝি বর্মায় ব্যবসা করছে সে
মনে আছে সেদিন লক্ষ্মীদি অনেক কথাই বলেছিল ওইটুকু সময়ের মধ্যে। কেবল দাতারবাবুর কথাই বলেছিল সারাক্ষণ।
–জানিস আমার জন্যেই ওর এই দুর্ভোগ। নিজের আত্মীয়-স্বজন, নিজের ব্যবসা, নিজের ভবিষ্যৎ সমস্ত জলাঞ্জলি দিয়েছে শম্ভু–আর আমি ওর অসুখের সময়ে এখানে না এসে থাকতে পারি? সেই জন্যেই তো একদিন কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে ফেললাম! ভাবলাম চিরকাল তো আর টাকার কষ্ট থাকবে না ওর, আর টাকার কষ্টটাই কি সংসারে বড়?
দীপঙ্করের কেমন যেন লক্ষ্মীদির কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হলো–টাকাটা সত্যিই বোধ হয় বড় নয়।
-–তুই-ই বল না, মনে সুখ না থাকলে টাকা থেকে কী হবে? এই কদিন এখানে আছি, শম্ভু যদি থাকতো এখানে তো আমার কোন কষ্ট হতো না–
সত্যিই তো, দীপঙ্কর ভাবলে, কষ্টের মধ্যে এত ময়লা শাড়ি পরেও লক্ষ্মীদি যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে।
–শম্ভু থাকতো না বলেই খুব ভয় করতো আমার, আর তা ছাড়া তো আমার আর কোনও ভাবনা ছিল না! এক-একটা করে সোনার গয়না বেচে দিয়েছি আর খেয়েছি। এইবার ভাবছিলাম যখন সব চুড়িগুলো ফুরিয়ে যাবে তখন কী করবো! তা এমন সময় ঠিক তুই এসে পড়লি।
–তা দাতারবাবু একবার খোঁজ নিতেও আসে না তোমার? একবার ভাবছে না কী করে তোমার চলবে?
লক্ষ্মীদি বললে–কী করে আসবে বল! অনেক টাকা দেনা হয়ে গেছে যে? সে টাকাটা যোগাড় করতে না পারলে তো আর আসতে পারছে না! তবু তো মাঝে-মাঝে হঠাৎ এক-একদিন রাত্তিরে লুকিয়ে লুকিয়ে আসে–
দীপঙ্করের সত্যিই ভয় হলো। বললে–কিন্তু সত্যি যদি টাকা যোগাড় না হয়! তা হলে কি পুলিস ধরবে?
লক্ষ্মীদি বললে–তাই তো খুব ভয়ে ভয়ে আছি রে দীপু–কী যে হলো!
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু সত্যিই যদি পুলিসে ধরে ফেলে তখন কী হবে! তুমি তখন কী করবে?
লক্ষ্মীদি জিনিসপত্রগুলো গুছোচ্ছিল, এ কথার উত্তর দিলে না।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তোমার কাছে এখন গাড়িভাড়ার পয়সা আছে তো লক্ষ্মীদি? আমার কাছে কিন্তু ট্রাম ভাড়ারও পয়সা নেই–আর একটা অচল পাঁচ টাকার নোট শুধু আছে–
লক্ষ্মীদি হঠাৎ মুখ ফেরাল, বললে–তোর কাছে টাকা নেই!
দীপঙ্কর বললে–না–
লক্ষ্মীদি কী যেন ভাবলে খানিক।
দীপঙ্কর বললে–আমি কালীঘাটে গিয়ে টাকা নিয়ে আসবো? এই যাবো আর আসবো–এক ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবো, তুমি একটু অপেক্ষা করো
–কার কাছ থেকে নিয়ে আসবি?
–সতীর কাছ থেকে।
–না, দরকার নেই–
দীপঙ্কর বললে–তাহলে মা’র কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসবো? মা’র কাছে দু’এক টাকা থাকে–
–না তারও দরকার নেই, আমার এই দু’গাছা চুড়ি আছে, এইটে বেচে তুই নিয়ে আয়–
লক্ষ্মীদি হাতের চুড়িটা খুলতে গেল। বললে–এইটে নে তুই–শম্ভুর সুদিন এলে আবার আমার চুড়ি হবে–
–তুমি তাহলে খালি হাতে থাকবে?
হঠাৎ বাইরে যেন আবার কে সজোরে কড়া নাড়তে লাগলো। দুজনেই চুপ করে রইল। সমস্ত ঘরটার মধ্যে দীপঙ্কর আর লক্ষ্মীদি যেন আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। লোকটা কড়া নাড়ছে, আর বউবাজারের রাস্তার ট্রামের গুম গুম শব্দ আসছে ভেতরে। লক্ষ্মীদি আরো কাছে সরে এল। দীপঙ্করের মনে হলো যেন ভয় পেয়েছে খুব লক্ষ্মীদি। চারদিকে চাইতে লাগলো ভয়ে ভয়ে। অন্ধকার হয়ে এসেছে ঘরের ভেতর। উত্তর দিকের একটা ফাঁক দিয়ে একটু আগেও আলো আসছিল–সেটাও এখন আর নেই। দীপঙ্করেরও কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। যদি লোকটা দরজা ঠেলে ঠেলে শেষকালে ভেঙে ফেলে দরজাটা! যদি ভেতরে ঢুকে পড়ে!
লক্ষ্মীদি বললে–কিছু না বললেই লোকটা চলে যাবে, রোজই এই রকম হয়—
সত্যিই তাই হলো। খানিকক্ষণ পরে শব্দটা থেমে গেল। বোঝা গেল, লোকটা চলে গেছে।
দীপঙ্কর বললে–না লক্ষ্মীদি, তোমাকে আর এখানে থাকতে দেব না–তুমি চলো এখুনি–
লক্ষ্মীদি কথা বললে না। দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে লক্ষ্মীদির চোখ দুটো কেমন ছলছল করছে।
লক্ষ্মীদি বললে–না রে, তুই-ই বরং যা, আমি এখানেই থাকি, আমার যা হবার হবে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তুমি এখানে থাকবে কী করে? যদি কিছু হয় তোমার?
–কী আমার আবার হবে, কিছুই হবে না আমার–দেখিস্!
–তুমি এ-পাড়া চেনো না লক্ষ্মীদি, এখানে গুণ্ডারা থাকে, এরা তোমায় খুন করে ফেলতে পারে! এ বড় সর্বনেশে জায়গা, এখানে তুমি টিকতে পারবে না, আমি বলে দিচ্ছি
লক্ষ্মীদি বললে–না রে, তুই জানিস না, আমার যাওয়া চলে না, আমার যাওয়া উচিত নয়।
–কেন? গেলে দোষ কী? সতীর ভয়ে যাচ্ছো না?
লক্ষ্মীদি হাসলো। বললে–না রে, সে ভয় নেই, তোর দাতারবাবুর জন্যে! মানুষটা কোথায় কোথায় ঘুরছে, কী করছে, খেতে পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, এ সময়ে আমি নিজের বাড়িতে আরাম করে থাকবো? সে-মানুষটা খেতে পাবে না, আর আমি আরাম করে খাবো?
–কিন্তু দুজনে কষ্ট পাওয়ার চাইতে তো একজনের কষ্ট পাওয়া ভালো! দাতারবাবু বেটা ছেলে, তিনি যা হোক করে চালিয়ে নেবেন, কিন্তু তুমি মেয়েমানুষ এমন কষ্টের মধ্যে থাকতে পারবে কেন?
লক্ষ্মীদি বললে–পারবো, খুব পারবো, সে যদি কষ্ট করতে পারে তো আমিও কষ্ট করতে পারবো–তুই চলে যা দীপু, আমি এখান ছেড়ে কোথাও যাবো না
দীপঙ্কর দ্বিধায় পড়লো। বললে–কিন্তু দাতারবাবুকে যদি শেষ পর্যন্ত পুলিসে ধরে নিয়ে যায়, তখন? তখন কী করবে?
লক্ষ্মীদি বললে–তখনকার কথা তখন ভাববো–
–কিন্তু একবার সর্বনাশ ঘটে গেলে তখন কে তোমাকে বাঁচাতে আসবে বলো তো? কে তোমাকে দেখবে? কে তোমার কষ্ট বুঝবে শুনি? তোমার বাবা রইলেন সেই দূর দেশে, সতীও হয়তো চলে যাবে এখান থেকে–তখন কে তোমায় দেখবে?
লক্ষ্মীদি দীপঙ্করের দিকে চাইলে। বললে–কেন, তুই? তুই আমাকে দেখবি না?
–সেই আমার কথাই তো তুমি শুনছো না। সেই জন্যেই তো আমি তোমাকে বার বার আমার সঙ্গে যেতে বলছি!
লক্ষ্মীদি বললে–কিন্তু তোর দাতারবাবু যদি কখনও আসে? মাঝে মাঝে এক একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে আসে সে। এসে শেষকালে যদি আমাকে না দেখতে পায়? দরজায় তালাবন্ধ দেখে যদি ফিরে যায়?
–কিন্তু যখন তোমার হাতের সোনার চুড়ি ফুরিয়ে যাবে, তখন কী করে থাকবে? কী খাবে শুনি?
–না হয় খাবো না
-–বাঃ, না-খেয়ে লোকে বাঁচতে পারে নাকি?
লক্ষ্মীদি বললে–পারে রে, পারে–তুই বিয়ে কর, বিয়ে করলে বুঝবি, স্বামীর জন্যে স্ত্রী না-খেয়েও থাকতে পারে–
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল লক্ষ্মীদির কথা শুনে। এই ক’দিনের মধ্যেই লক্ষ্মীদি এমন হয়ে গেছে। বললে–কিন্তু এ-ঘর তো তোমাদের ভাড়া নেওয়া, যখন বাড়িওয়ালা এক মাস পরে ভাড়া চাইতে আসবে, তখন? তখন কোত্থেকে ভাড়া দেবে? তখন ভাড়ার টাকা না দিলে যদি ঘর থেকে বার করে দেয়?
লক্ষ্মীদি বললে–তা তো বার করে দেবেই, ভাড়া না দিলে বাড়ির বার করে দেবে না?
–কিন্তু তখন তোমার কী হবে?
লক্ষ্মীদি বললে–আমার মতো যাদের স্বামী বাড়ি ভাড়া দিতে পারে না, তাদের যা হয় আমারও তাই হবে–
–তবু তুমি আমার কথা শুনবে না?
লক্ষ্মীদি বললে–তুই বড় অবুঝ ছেলে দীপু–তোকে তো বার বার বলছি তা হয় না, আমার যাওয়া চলে না!
–তবে আমি চললুম।
–হ্যাঁ–যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমার কথা কিছু যেন বলিসনি, বুঝলি? দীপঙ্কর কোনও উত্তর দিলে না।
দীপঙ্কর চলেই যাচ্ছিল।
লক্ষ্মীদি বললে–মাঝে মাঝে আসিস কিন্তু, বুঝলি? যেন ভুলে যাসনি আমাকে–
তারপর হঠাৎ আবার ডাকলে। বললে–হ্যাঁরে, তোর কাছে ট্রাম ভাড়ার পয়সা আছে তো!
হঠাৎ মনে পড়লো দীপঙ্করের। দরজার কাছে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়লো। বললে–তিনটে পয়সা কম আছে লক্ষ্মীদি, তোমার কাছে হবে?
তারপর একটু পরেই বললে–ঠিক আছে, না-হয় হেঁটেই যাই–
–ওমনি রাগ হয়ে গেল ছেলের, দিচ্ছি পয়সা, নিয়ে যা–
দীপঙ্কর বললে–আমি তোমাকে কালকেই ফেরত দিয়ে যাবো পয়সাটা—
-–সত্যিই দিস্ কিন্তু–বলে হাসলো লক্ষ্মীদি।
–আর তোর সেই পাঁচ টাকার নোটটা দাতারবাবু আর দিতে পারবে না এখন, বড় বিপদে পড়েছে, দেখতেই তো পাচ্ছিস–
–সেজন্যে তুমি ভেবো না, লক্ষ্মীদি! তোমাকে এই জায়গায় ফেলে রেখে যেতেই মনটা কেমন করছে। আমার যদি টাকা থাকতো, আমি যদি চাকরি করতুম, আমি তোমাকে সব টাকা দিয়ে যেতুম
দীপঙ্কর দরজাটা খুলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
লক্ষ্মীদি বললে–সতীকে যেন আমার কথা বলিসনি, জানিস, কাকাবাবু কি কাকীমাকেও বলিসনি–
–না–বলবো না!
রাস্তায় বাইরে তখন অন্ধকার। পাশেই ট্রাম লাইনের ওপর ট্রাম চলার ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। দীপঙ্করের পা যেন আর চলতে চাইছে না। বললে–দরজাটা বন্ধ করে দাও লক্ষ্মীদি, আসি আমি–খুব সাবধানে থাকবে!
লক্ষ্মীদি দরজার ভেতর থেকে বললে–বাবা যদি কলকাতায় আসে তো আমায় খবর দিস্–
-–কেন? তুমি বাবার সঙ্গে দেখা করবে নাকি?
লক্ষ্মীদি বললে–না, আমি দেখা করতে চাইলেও বাবা আমার মুখ দেখবে না, আমি
জানি–
হঠাৎ যেতে গিয়েও দীপঙ্কর আবার মুখ ফেরাল। বললে–আচ্ছা লক্ষ্মীদি–
–কী রে?
–দাতারবাবুর কত টাকা দেনা?
লক্ষ্মীদি বললে–কেন? ও-কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? তুই দিবি? কিন্তু সে যে অনেক টাকা রে, অত টাকা তুই কোত্থেকে যোগাড় করবি?
–শুনিই না কত টাকা?
–সে প্রায় পাঁচ-ছ হাজার টাকা! ছ হাজার টাকা দিলেই আমরা আবার ছাড়া পেয়ে যাবো, আবার তোর দাতারবাবু নতুন করে ব্যবসা আরম্ভ করতে পারবে! আসলে তোর দাতারবাবুরও দোষ নেই, আমার জন্যেই ব্যবসার দিকে পুরো মন দিতে পারেনি আর কি! আর তাছাড়া জানিস তো বাজার খুব খারাপ, তা তুই আর সে-সব জানবি কী করে?
–ছ হাজার টাকা?
দীপঙ্কর যেন নিজের মনেই অঙ্কটা উচ্চারণ করলে।
লক্ষ্মীদি বললে–কী ভাবছিস কী? তুই দিতে পারবি নাকি?
–তাই ভাবছি!
–তোর নিজের চাকরি নেই, তুই দিবি কী করে! দিলে তো উপকার হয়। কিন্তু অত টাকার জন্যে তোকে বলতেও সাহস হয় না। আর যদি দিতে পারতিস, তা হলে এক বছরের মধ্যে টাকাটা শোধ করে দিতে পারতাম–
দীপঙ্কর ভাবতে লাগলো।
–কী ভাবছিস? পারবি দিতে?
দীপঙ্কর বললে–ভাবছি অঘোরদাদুর কথাটা! অঘোরদাদু বলে–কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়, এখন দেখছি কথাটা মিথ্যে নয়–সেই অঘোরদাদুর অনেক টাকা আছে, জানো লক্ষ্মীদি, অনেক টাকা–
–তা অঘোরদাদুকে বলে দেখ না, যদি ধার দেয়?
–ধার দেবে না, বুড়ো খুব কেপ্পন, আমরা যে-ঘরে শুই, সেই ঘরেই একটা সিন্দুক আছে অঘোরদাদুর, তার ভেতর সোনা, মুক্তো, রুপো, গিনি অনেক আছে–লাখ লাখ টাকা আছে–
–টাকা তো অনেক লোকেরই আছে, সে আমাদের দেবে কেন?
দীপঙ্কর বললে–চাইলে কি আর দেবে অঘোরদাদু?
–তা তুই কি সিন্দুক ভাঙবি নাকি?
দীপঙ্কর নিজের মনেই কী ভাবতে লাগলো দু’এক মিনিট, তারপর হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললে–দেখি–
বলে হন্ হন্ করে সোজা ট্রাম-রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। ভালো করে পকেটের পয়সা পাঁচটা গুনে দেখলে দীপঙ্কর। কম পড়লে বউবাজার থেকে সোজা কালীঘাট পর্যন্ত আবার হেঁটেই যেতে হবে। অন্ধকার চারিদিকে। দোকানে দোকানে আপিসের ভেতরে আলো জ্বলে গেছে সব। লালদীঘির জলে আপিসের আলোগুলো এসে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে দীপঙ্কর ডালহৌসী স্কোয়ারটা পেরিয়ে একেবারে ধর্মতলায় গিয়ে ট্রামে উঠবে এইটুকুন বেশ হেঁটে যাওয়া যায়।
হঠাৎ যেন একটা বিকট শব্দে দীপঙ্করের কানে তালা ধরে গেল!
লোকজন যে-যেদিকে পারছে দৌড়তে শুরু করেছে–
দীপঙ্কর হতভম্বের মতো কোন্ দিকে যাবে বুঝতে পারলে না। সমস্ত কলকাতা শহরটা যেন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো হঠাৎ।
দীপঙ্করের মনে আছে সেদিনকার কথাটা স্পষ্ট। বোধ হয় ২৫শে আগস্ট– ১৯৩০ সাল। সামনে দিয়েই কে যেন দৌড়তে লাগলো কার পিছু পিছু। দীপঙ্কর স্পষ্ট দেখতে পেলে সেই লোকটা–সেই ফরসা লোকটা। ধুতি পাঞ্জাবি পাম্পশু পরে ক’দিন আগেই দীপঙ্করকে কত কথা জিজ্ঞেস করেছিল। অন্ধকার নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের ভেতর কিরণদের বাড়ি থেকে বেরোবার মুখেই ধরেছিল। ঠিক যেন সাহেবদের মতো দেখতে। হঠাৎ সেই লোকটাই আজ খাকী কোটপ্যান্ট পরেছে, খাকী পোশাক পরে দৌড়চ্ছে–
চারদিক থেকে হঠাৎ পুলিস, পুলিসের গাড়ি এসে গেল। পুলিসে পুলিসে ছেয়ে গেল জায়গাটা। আর সঙ্গে সঙ্গে আশে-পাশে রাস্তার সমস্ত লোকজনদের লাঠি দিয়ে তাড়া করতে শুরু করেছে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।
দীপঙ্কর এক দৌড়ে বাঁ-দিকের একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়লো।
হঠাৎ কে যেন তার হাতটা ধরে টানলে। মুখ ফিরিয়ে দেখতেই দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেছে।
–কিরণ? তুই?
–শিগগির পালিয়ে আয়-শিগির–
–কী হলো রে ওখানে? বোমা ফাটালে কে?
কিরণ দৌড়তে দৌড়তে বললে–টেগার্ট সাহেবকে খুন করেছি–পালিয়ে আয়
–টেগার্ট সাহেব? পুলিস কমিশনার? ওই খাকী কোটপ্যান্ট পরা? আরে ও তো ধুতি পাঞ্জাবি পরে তোদের বাড়ির সামনে ঘুরছিল সেদিন!
–চুপ কর–
মনে আছে দৌড়তে দৌড়তে দুজনে একেবারে গোলদীঘির কাছে এসে পড়েছিল তখন। দীপঙ্কর তখন হাঁফাচ্ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
কিরণ বললে–তুই এবার বাড়ি যা দীপু, আমি অন্য জায়গায় যাচ্ছি, একটা কাজ আছে আমার–
–কী কাজ?
–পরে সব বলবো, ভজুদা এসেছে–
–ভজুদা!
কিরণ বললে–কাল সন্ধ্যেবেলা বাড়ি থাকিস্, তোকে ভজুদার কাছে নিয়ে যাবো–যা–