দ্বিতীয় পর্ব
১
‘আত্মপ্রত্যয়ের অগ্নি, হে সন্তান, প্রথম জ্বলুক তব ঘরে।
জানো না কি রাত্রি এসে ঘিরিতেছে আরো-এক দীর্ঘতর বৃত্তে রোজ
মানুষের জীবনকে।
যে-সব সৌন্দর্য র’চে গিয়েছিলো একদিন মেধাবীরা
আজ এই রজনীর অবরোধে মনে হয়
তাহাদের জ্যোতি যেন বিস্ফোরক বাষ্প হয়ে জ্বলে
সহসা আকাশ পথে দিক্হস্তিদের মতো,—’
জীবনানন্দ দাশ
.
শ্ৰেষ্ঠী সুদত্তর নির্মিত শ্রাবস্তী-রাজগৃহ বা রাজগৃহ-শ্রাবস্তী মহাপথটি কিন্তু কোনও নতুন পথ নয়। গতায়াতরত পথিকরা সবাই জানে এই-ই হল সেই সুপ্রাচীন উত্তর-পথ। কত যুগ ধরে এ পথ রয়েছে, কত শত জনযাত্রা, যুদ্ধযাত্রা, শিক্ষাযাত্রা, বাণিজ্যযাত্রার ধূলি মিশে রয়েছে এই উত্তর-পথে। শ্রাবস্তীতে পৌঁছেই কি এ পথ থেমেছে? থামেনি। চলে গেছে কৌশাম্বী, মধুরা অতিক্রম করে, মরুপ্রান্তর পেরিয়ে তক্ষশিলা অভিমুখে। অঙ্গ মগধের বড় বড় সার্থ এখন এই পথ ধরে সিন্ধু বিতস্তার মধ্যবর্তী সুদূর সৌবীর দেশের রাজধানী রৌরূক এবং আরও বহু পট্টনে যাত্রা করে। ভৃগুকচ্ছর পট্টন, তার সংলগ্ন নীল লবণাম্বুরাশি কেতুকামী গরবী বণিকের চোখে স্বপ্নের ঘোর লাগায়। অনতিবিস্মৃত অতীতে কুরুদেশ থেকে দুই কুরুবীরকে নিয়ে যদুবংশীয় কৃষ্ণ এই পথ ধরেই জরাসন্ধ দমনের জন্য ছদ্মবেশে রাজগৃহের দিকে গিয়েছিলেন। সে-সব কাহিনী সূতরা এখন ছোট বড় যজ্ঞে, সমাজোৎসবে বলে থাকেন। মহাবীর ভীমসেন নাকি দিগ্বিজয়ে বার হয়ে বিদেহ-দশার্ণ হয়ে কোশল রাজ্যে প্রবেশের জন্য এই পথই ধরেছিলেন। শ্ৰেষ্ঠী সুদত্ত ভগবান তথাগতর কথা চিন্তা করেই এই বহু পুরাতন মহাপথের শ্রাবস্তী-রাজগৃহ অংশটি সংস্কার করেছেন। পুরোটাই স্থলপথ। বৈশালীর কাছে একবার মাত্র গঙ্গা-হিরণ্যবাহ সঙ্গম পার হয়ে ওপারে কিছুটা দক্ষিণপূর্বে পাটুলিগ্রামে পৌঁছতে হয়। গ্রাম হলেও যাত্রীদের কাছে তো বটেই, বণিকদের কাছেও এই পাটুলিগ্রামের আবস্থানিক গুরুত্ব যথেষ্ট। পাটলি বা পাটুলিকে তারা ‘পুটভেদন’ বলে থাকেন। অর্থাৎ এখানে এসে পণ্য-বস্তুর পুট বা আচ্ছাদন ভাঙা হয়। সবসুদ্ধ বারোটি বিশ্রামস্থল আছে এই পথে। সুন্দরতমটি বৈশালীর ওপ্রান্তে। চমৎকার গন্ধকুসুমের কুঞ্জ সেখানে। তার মাঝখানে পাথরের বিশ্রামগৃহ। সাত-আটটি বৃহৎ কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষ পরিচ্ছন্ন, বিশ্রামের ব্যবস্থাদিও অতি সুষ্ঠু। শুধু বহু পন্থের শ্রমণ, তীর্থিক, সাধুজনই নয়, যে কোনও পথিক, পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হলে এখানে পাবেন আতিথ্য। পানীয় জল, একটু শুয়ে নেবার জন্য কিলিঞ্জক, ভালো গুড় এবং চিড়ে পাওয়া যাবে বিনামূল্যে, সামান্য মূল্য দিলে অন্ন প্রভৃতিও পাওয়া যায়। অদূরেই মহাবন নামে বিস্তীর্ণ শালবন। তার মধ্যে কূটাগারশালা যা বুদ্ধকে দান করেছেন মহামান্য গোশৃঙ্গি।
সেবার ভয়ানক মহামারী লাগল বৈশালীতে। বৈশালীর যত বড় বড় বিদ্যাবিশারদ সবাই যে-যার মতো করে মহামারী থামাবার উপায় করতে লাগলেন। এক দিকে তখন যজ্ঞধূম উঠছে আকাশে, তার সঙ্গে মন্ত্র মিশে যাচ্ছে, আরেক দিকে বৈশালীর সবচেয়ে প্রতাপশালী শ্ৰমণপন্থ নির্গ্ৰন্থরা বলছেন, এতে কিছু হবে না, চতুর্যাম সংবরের উপদেশ শোনো, পালন করো। অহিংসা, সত্য, অস্তেয় ও অপরিগ্রহ এই হল চারটি যাম, এইগুলিই তোমাদের পাপমুক্ত করবে। নিরুপায় নাগরিকরা যে যা বলছেন শুনছেন, কিন্তু মহামারীর উপশম নেই। সাধারণ নাগরিকরা তো মরছেই, মরছে ধনীরাও, শেষে তীর্থিক, নির্গ্ৰন্থরাও দলে দলে মরতে লাগলেন। তখন গণমুখ্যরা সকলে মিলে নির্গ্রন্থ জ্ঞাতিপুত্র মহাবীরের নিষেধ অগ্রাহ্য করে গৌতম বুদ্ধকে আহ্বান করেছিলেন। মুখে মুখে এখন রটনা হয়ে গেছে গৌতম নাকি ঋদ্ধিবলে আকাশমার্গে বৈশালী এসেছিলেন, এবং তিনি এসে দাঁড়াবামাত্র মহামারী পাংশুবসনে পাংশুমুখে নগরীর পশ্চিম দ্বার দিয়ে পালিয়ে যায়। লোকে এ ভাবেই বলতে ও ভাবতে ভালোবাসে। কিন্তু প্রকৃত কথা, আহ্বানপত্র নিয়ে দূত এলে গৌতম প্রথমেই লিচ্ছবি গণমুখ্যদের জানান—তিনি বেসালির অসামান্য নগর-সৌন্দর্য দেখতে বড় ভালোবাসেন। নগর পরিষ্কৃত, সুস্নাত, সুরভিত হলে, তবেই তিনি গিয়ে উপস্থিত হবেন। মাত্র তিন দিনে সেবার সমগ্র বেসালি পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। আবর্জনা, মৃত ব্যক্তিদের ব্যবহৃত, পরিত্যক্ত বস্তুসমূহ হয় নগরদ্বারের বাইরে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়, নয় তো পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুষ্করিণীগুলি পরিষ্কৃত হয়, লক্ষ লক্ষ থলি উগ্র সুগন্ধি চতুষ্পথে চতুষ্পথে পোড়ানো হতে থাকে। সেই গন্ধে এবং সিক্ত খড়ের ধূমে নগরীর গৃহকোণগুলি থেকে দলে দলে মশক, মক্ষিকা, মূষিক এবং নানা শ্রেণীর কীট ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে আসে, তীর্থিকদের মতো মুখে বসন বেঁধে মূষিক ও কীট বধে সেবার বেরিয়ে পড়ে নগরীর আপামর সাধারণ। বহু তোরণ নির্মিত হয় গৌতমকে অভ্যর্থনার জন্য। তোরণগুলি কুসুম সাজে নিপুণভাবে সজ্জিত। চতুর্থ দিন গভীর রাতে গৌতম গঙ্গা পার হলেন, বৈশালীর তৃতীয় প্রাচীর পেরিয়ে প্রধান তোরণদ্বারের নিচে যখন কয়েকটি ভিক্ষু নিয়ে উপস্থিত হলেন তখন ঊষালগ্ন। দ্বার খুলতেই দেখা গিয়েছিল যেন সাক্ষাৎ আদিত্যই আকাশ থেকে নেমে এসেছেন।
কূটাগারশালায় সেবার অবস্থান করলেন তিনি। মহাবনে বিশাল জনসভা। কিন্তু গৌতম সদ্ধম্মের কথা তো কিছু বললেন না। শুধু বললেন— নীরোগ শরীরই হচ্ছে ধম্মসম্মত জীবনযাত্রার প্রথম শর্ত। বেসালিবাসী তাদের নগরকে যে ভালোবাসা দেখিয়েছে আপৎকালে, অন্য সময়েও যেন তেমনই ভালোবাসা দেখায়। সম্পদগর্বে ভুলে গিয়ে নগরীর শ্রীরক্ষায় যেন তারা শৈথিল্য না করে।
তীর্থিকরা প্রশ্ন তুলেছিলেন— নগরী পরিষ্কৃত করতে যে এত মক্ষী, মশা, কীটাদি হত্যা করা হল এতে গৌতমমতে—নিরয়গামী হতে হবে না?
গৌতম দৃঢ়কণ্ঠে জানান— তথাগত মঝ্ঝিম পন্থায় বিশ্বাসী।
নির্গ্রন্থরা জিজ্ঞাসা করেন— আপৎকালে কি তিনি অহিংসা ত্যাগ করতে বলেন? গৌতম তাতে উত্তর দেন— আয়ুষ্মন, রোহিণী নদীর জল নিয়ে শাক্য ও কোলিয়দের মধ্যে বিবাদ হলে তারা যখন পরস্পরকে হত্যা করতে উদ্যত হয় তথাগত তখন তাদের প্রথম প্রশ্ন করেন— কিসের মূল্য অধিক, জল না ভূমি, তারা বলে ভূমি, তথাগত তাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন— কিসের মূল্য অধিক, ভূমি না ক্ষত্রিয়। তারা বলে ক্ষত্রিয়। তখন তথাগত তাদের তৃতীয় প্রশ্ন করেন তবে তারা অল্পমূল্য জলের জন্য অমূল্য ক্ষত্রিয়ের প্রাণ নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছে কেন? আয়ুষ্মন এতে শাক্য ও কোলিয়রা নিরস্ত হয়।
তখন গণমুখ্য ছেটক চতুর হেসে জিজ্ঞেস করেন— কিন্তু ভন্তে, যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে, সন্ধির প্রস্তাব না মানে? তখন কি অক্কোধ দিয়ে কোধ জয় করতে গিয়ে, সাধুতা দিয়ে অসাধুতা জয় করতে গিয়ে আমরা সমূলে বিনষ্ট হবো? এবং যুদ্ধকালে সচ্চবাদিতাই কি সর্বদা টিকিয়ে রাখা যায়?
গৌতম উত্তর দেন— যথাসাধ্য অষ্টাঙ্গিক মার্গর অনুসরণ করা উপাসকের কর্তব্য। যথাসাধ্য। আপৎকালেও অক্রোধের অনুষ্ঠান করা একমাত্র পব্বজিতর পক্ষেই সম্ভব। সেইজন্যই পব্বজিতের স্থান উপাসকের ঊর্ধ্বে।
সেই থেকে লিচ্ছবিরা গৌতম বুদ্ধর গুণমুগ্ধ। কোনও ব্যাপারেই চরম, অটল, জগদ্দল কোনও নিয়ম.বেঁধে দেন না গৌতম, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করেন। কতকগুলি মৌলিক সততার নীতি মেনে চলো, তারপর সমস্যার সমাধান চাও, গৌতমকে সঙ্গে পাবে। আর হবে না কেন, উনি তো সাক্ককুলের, অর্থাৎ আরেকটি গণরাজ্যেরই কুমার। বজ্জিদের উনি বোঝেন, বজ্জিরাও ওঁকে বোঝে। বৈশালীর লিচ্ছবি-বজ্জিকুল মনে মনে তাদের শাসনতন্ত্র-জনিত কারণে গর্বিত। কোনও রাজার ইচ্ছাধীন নয় তারা, পদানতও নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের সংস্থাগারে শলাকা ব্যবহার করে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। তাদের গণমুখ্যদেরও রাজাই বলে। কিন্তু রাজার সর্বময় কর্তৃক তাদের নেই। মহল্লক বা জ্যেষ্ঠদের পরামর্শ তো তাদের শুনে চলতে হয়ই। গৌতমের বড় মনোমত এই রাজ্যশাসন পদ্ধতি সংঘেও তিনি শলাকা দিয়ে নিবাচনের পথ গ্রহণ করেছেন।
আজ বৈশালীর বিশ্রামাগারে দুই দল তীর্থিক এসে উঠেছেন। এক দল আসছেন শ্রাবস্তী থেকে, অন্য দল রাজগৃহ থেকে শ্রাবস্তী যাচ্ছেন। দুটি দলের কেউই কাউকে চেনেন না। সারা মধ্যদেশ জুড়ে আশি হাজার তীর্থিকের যাতায়াত, বসবাস। কে কাকে চিনছে? যদিও উভয় দলই মানে তীর্থঙ্কর পূরণ কাশ্যপকে।
রাজগৃহ-তীর্থিকরা শ্রাবস্তী যাচ্ছেন শুনে ম্লান মুখে শ্রাবস্তী-তীর্থিকদের মধ্যে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বললেন— সাবত্থিতে গিয়ে আর কিই বা করবে আবুস!
রাজগৃহ-তীর্থিকরা অবাক হয়ে বললেন— সে কি? এখন আচারিয় কাস্সপ সাবত্থিতে রয়েছেন… আমরা তাঁকে দেখবার জন্যই আরও… আমাদের মধ্যে অনেকে তো দেখেনইনি।
বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রাবস্তী-তীর্থিক সখেদে বললেন— আচারিয় কাস্সপ তো আর নেই!
—সে কি?
—হ্যাঁ। উনি অচিরবতীর জলে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তা বৎসরখানেক তো হলই!
—অহো! আমরাও যদি সেইসঙ্গে প্রাণ বিসর্জন দিতে পাত্তাম? —আরেকজন বললেন।
—কেন, এরূপ বলছেন কেন? কী ঘটেছিল, বলুন তো! —রাজগৃহ-তীর্থিকরা জিজ্ঞাসা করলেন— আমরা গিয়েছিলাম চম্পায়। অঙ্গদেশের বহু স্থানে তীর্থিক মত প্রচার করছি গত কয়েক বৎসর। এখন রাজগহতে মাত্র একদিন বিশ্রাম করেই সাবত্থি যাচ্ছিলাম। বিশেষত আচারিয়র সাক্ষাতে আমাদের প্রচা- কর্মের কথা জানাবো বলে। এ সকল কথা তো শুনিনি! আচারিয়র দেহত্যাগ? সে কী!
শ্রাবস্তী তীর্থিক বললেন— দেখো আবুস, আমরা তো তীর্থঙ্কর কাস্সপকেই বুদ্ধ বলে জানতাম! সমন গোতম নামে ওই ব্যক্তি সাবত্থিতে এসে অবধি, লোকে তার কাছে ছুটছে। কয়েক বৎসর ধরে ক্রমেই তার প্রতিপত্তি বাড়ছে। মহারাজ পসেনদি পজ্জন্ত ইদানীং মহাত্মা কাস্সপকে বুদ্ধ বলতে দ্বিধা করছেন। সাবত্থির সবচেয়ে সুন্দর কানন জেতবন গৌতমের হয়ে গেল। এইরূপে সকলই হাতছাড়া হয় দেখে আমরাও আচারিয়র আদেশে মহারাজের কাছে আবেদন কল্লাম, জেতবনের সন্নিকটে আমাদেরও বিহার চাই। প্রথমটা তো মহারাজ কিছুতেই ঘাড় নোয়াচ্ছিলেন না। তারপর লক্ষ মুদ্রা উৎকোচ দিয়ে তাঁকে বশ করা হল।
—মহারাজকে উৎকোচ? একজন রাজগৃহ-তীর্থিক সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
—উৎকোচ বলে কি আর দিয়েছি রে ভাই, রাজার রাজত্বে নির্ভয়ে বাস করি, চমৎকার ভিক্ষাদি পাওয়া যায়, —কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ লক্ষ মুদ্রা উপহার দেওয়া হল যেন।
—নিঃস্ব পব্বজিতর কাছ থেকে উপহার? —রাজগৃহ-তীর্থিকদের বিস্ময় আর কাটতেই চায় না।
—আহা, আমাদের কোসলরাজ ধনসম্পদ বড় ভালোবাসেন যে! এই তো সেদিন কৃপণ সেট্ঠি গুণাঢ্য অপুত্তক মারা গেল। অশীতি লক্ষ মূল্যের সম্পত্তি রাজকোষে জমা পড়ল। আনন্দে মহারাজ রানি কোসলমল্লিকাকে দিয়ে নতুন আরাম প্রতিষ্ঠা করে ফেল্লেন। রাজারা এরূপই হন।
—আমাদের মহারাজ বিম্বিসার এরূপ নন।
—আরে উনি তো সেদিনের রাজা। এখন কিছুকাল রাজবংশ সংযত থাকবে, তারপর দেখো না…।
রাজগৃহ-তীর্থিকরা বিরক্ত হয়ে বললেন— আচ্ছা আচ্ছা বলুন তো দেখি কী হয়েছিল!
—আমরাও বিহার নির্মাণ কত্তে আরম্ভ কল্লাম। কদিন পরেই সাক্কপুত্তীয়রা মহারাজের কানে কী মন্ত্র দিল জানি না, রাজাদেশে নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। আচারিয় তো ক্রোধে কাঁপছেন তখন। মহা গোল। অবশেষে পসেনদির আদেশ হল— মুক্ত প্রান্তরে সমন গোতম আর আচারিয় কাস্সপ পরীক্ষা দিন কে কত বড় ইদ্ধিমান! আমাদের আচারিয় ইদ্ধি দেখাতে গেলেন, কী বলব আবুস, হাত নাড়তে পজ্জন্ত পাল্লেন না। মুখ বন্ধ। যেমন জোড়াসনে বসেছিলেন বসে রইলেন।
—সে কি? এ প্রকার অবস্থা কি করে হল?
—কি করে আবার? সমন গোতম ইদ্ধিবলে আচারিয়কে বেঁধে রেখে দিলেন। প্রমাণ হয়ে গেল তিনিই বড়। আচারিয় কাস্সপ অপমান সইতে পাল্লেন না। যেই না মুক্ত হওয়া বিভল চোখে চারদিকে চাইলেন তারপর দেখ না দেখ নদীর জলে প্রবেশ কল্লেন।
—কেউ বাধা দিল না!
—বাধা দেবে কি? সবাই হতবুদ্ধি। চারদিকে সমন গোতমের নামে এমন জয়ধ্বনি উঠছে যে কিছু শোনাও যাচ্ছে না। আমরা ভেবেছি আচারিয় বুঝি চান করতে নামছেন।
রাজগৃহ-তীর্থিকরা ম্রিয়মাণ দুঃখিত স্বরে বললেন— আশ্চর্য! তারপরে?
—তারপরে আর কি? আমাদের দল ভেঙে তীর্থিকরা সব গোতমের সংঘে যোগ দিতে লাগল। আমরা পুরাতনরা আরও নানা উপায়ে গোতমের যশোহানি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু শেষে আমাদেরই লজ্জিত হতে হল। এখন তাই সাবত্থি ছেড়ে চলে এসেছি।
—বিতাড়িত হয়েছি, সেটাই বলুন না। সতীর্থদের কাছে লুকিয়ে আর কি হবে? একজন শ্রাবস্তী-তীর্থিক সক্ষোভে বললেন।
রাজগৃহ-তীর্থিকরা উত্তরোত্তর বিস্মিত হচ্ছিলেন। কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে একজন, দুজন, শেষে সবাই ওঁদের পীড়াপীড়ি করতে আরম্ভ করলেন। কীভাবে তাঁরা সমন গোতমের যশোহানি করতে চেয়েছিলেন, কেনই বা বিতাড়িত হলেন, বলতে হবে।
অবশেষে একজন শ্রাবস্তী তীর্থিক বললেন— ওই চিঞ্চা!
চিঞ্চা? সে কে?
—তীর্থিকদের উপাসিকা। ভক্তি মান্যি করে। অতিশয় রূপসী। তাকে আমরা সমন গোতমের কাছে নিত্য পাঠাতে লাগলাম। … একটু রাত করে… জেতবন স্থানটি কুঞ্জে কুঞ্জে বৃক্ষে কৃক্ষে অতি মনোহর তো!
—তাতে কি?
শ্রাবস্তী-তীর্থিক ঢোঁক গিলে বললেন— কী আর…! রুপুসী রমণী …মনোহর স্থান… সময় রাত্রি…কী হতে পারে আবুস— গর্ভ হল!
—কার? চিঞ্চার?
—আবার কার? সমন গোতমের যেমন কাণ্ড!
—বলেন কি? তা তারই তো বিতাড়িত হবার কথা!
—কি করে হবে? সভাস্থলে, সর্বসমক্ষে চিঞ্চা যখন উঠে দাঁড়িয়ে সমন গোতমকে দোষারোপ করছে, হঠাৎ চিঞ্চার গর্ভটি খসে গেল।
—গর্ভ খসে গেল? সর্বনাশ! —রাজগৃহ-তীর্থিকরা আর্তনাদ করে উঠলেন।
—তাতেও তো সমন গোতমের বহিষ্কার হওয়া উচিত।
—কী করে হবে? গর্ভটি যে একখণ্ড কাঠে পরিণত হল, দুম করে চিঞ্চার পায়ে পড়ে দাহিন পায়ের আঙুল কটি ঘেঁচে গেল একেবারে। সে কী লাঞ্ছনা! কী ধিক্কার! সাক্কপুত্তীয়রা তো তেড়ে মারতে আসে। সাবত্থির লোকেরাও আমাদের দুষতে লাগল। পসেনদি রেগে আমাদেরই বহিষ্কারের আদেশ দিলেন।
রাজগৃহ-তীর্থিকরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। বললেন—অদ্ভুত ইদ্ধি তো! তা কেউ বুঝি বিশ্বাস করল না গর্ভ কাঠ হয়ে গেছে!
—কি করে বিশ্বাস করবে? চিঞ্চাই তো যাতনায়, ধিক্কারে অস্থির হয়ে বলতে লাগল তীর্থিকরাই তাকে এরূপ অভিনয় করতে বলেছে, উদরে কাষ্ঠপিণ্ড বাঁধতে বলেছে, আরও কত কী!
তখন একজন যুবক রাজগৃহ-তীর্থিক মৃদু হেসে বলল— অহো! এমনই ইদ্ধি যে স্বয়ং চিঞ্চাই বুঝতে পারেনি তার উদরে ভ্রুণ আছে না কাষ্ঠপিণ্ড আছে! অতি চমৎকার!
সে বয়োজ্যেষ্ঠ সঙ্গীদের দিকে চেয়ে বলল—দেখুন আজ আমি একটা স্পষ্ট কথা বলছি। নিতান্ত নবীন বয়সে পিতা মারা গেলেন, পিতার বন্ধু সব প্রতারণা করে নিয়ে নিলেন। মাতা বাণিজ্য, পণ্য, গচ্ছিতকরণ, কুসীদ কিছুই বুঝতেন না। ভগ্ন মনে তিনি মারা গেলেন। এরূপ অবস্থায় আচারিয় কাস্সপ আমাদের উদিত-গামে এসেছিলেন, তাঁর দেশনা শুনে অবাক হয়ে যাই। কিছুতেই নাকি পাপ-পুণ্য হয় না। ভ্রূণ হত্যায়, আত্মীয় বন্ধুকে প্রবঞ্চনা করায়, হত্যা করায় পাপ নেই, আবার দানে, যজ্ঞে, মানুষের উপকারেও পুণ্য নেই। আমার আশা ছিল—পিতামাতা অন্তত পুণ্যবলে স্বর্গে গিয়ে সুখী হয়ছেন, এবং ওই প্রবঞ্চক পিতৃবন্ধু নির্ঘাৎ মৃত্যুর পর অবীচি নরকে গিয়ে যন্ত্রণা ভোগ করবে। আচারিয় কাস্সপের কথা শুনে প্রবল হতাশা এলো, তারই ফলে অক্রিয়বাদী হয়েছি। এবার অঙ্গদেশের ভদ্রঙ্করে এক গান্ধার যুবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপ হয়। তিনি আমাদের তীর্থিক মত শুনে বললেন— ‘আপনাদের মতবাদে বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকলে এই পৃথিবী এবং মনুষ্যসমাজকে টিকে থাকতে হত না। সকলেই ইচ্ছামতো পাপ-কর্মে লিপ্ত হত। কিন্তু তা হয় না, মানুষের মনের মধ্যে সহজাত পাপবোধ আছে। অনার্য জনদের মধ্যে অরণ্যে গিয়ে দেখুন, সহজ নীতিজ্ঞান আছে তাদেরও। তা হলে? যে বস্তুর প্রয়োজন নেই তা সৃষ্টি হল? এবং তারই ফলে সংসার সুষ্ঠুভাবে চলছে? প্রকৃত কথা আপনারা নৈতিক বিশৃঙ্খলার মত প্রচার করছেন। তা ছাড়াও আপনাদের অক্রিয়বাদ আর মস্করী গোশালের ভবিতব্যবাদে কোনও পার্থক্য নেই। আপনারা নিজেরা অনৈতিক জীবন যাপন করবেন করুন। কিন্তু গৃহবাসী, সমাজসেবী মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবেন না। আমি রাজা হলে আপনাদের তীর্থিক-মত নিষিদ্ধ করে দিতাম।’
এখন তীর্থঙ্কর কাস্সপের পরিণাম শুনে, এবং তার চেয়েও বড়, এই সাবত্থি-তীর্থিকদের লোভ, ক্রূরতা, প্রবঞ্চনা ইত্যাদির কথা শুনে বুঝতে পারছি এই পঞ্চদশ বৎসর ঘোর পাপীদের অনুগমন করেছি। তীর্থিক জেট্ঠগণ— সংসার যেমন আছে, তেমনি পাপ-পুণ্যও আছে। মৃত্যুর পর স্বর্গ নরকাদি আছে কি না জানি না। তবে মৃত্যুর পূর্বে যে নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী স্বৰ্গফল, নরকফল লাভ হয় এ তো দেখতেই পাচ্ছি— বলে তীর্থিক যুবক ক্রুদ্ধ কটাক্ষে শ্রাবস্তী-তীর্থিকদের দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল। সে দাঁতে দাঁত ঘষছে।
শ্রাবস্তী-তীর্থিকরা বললেন— অহে, এরা আমাদের প্রহার করবে নাকি? নাসারন্ধ্র কী প্রকার ফুলছে দেখো! স্থান-ত্যাগ করাই মঙ্গল মনে হচ্ছে!
রাজগৃহ-তীর্থিকরা বললেন— হ্যাঁ, প্রহার করলে যখন পাপ নেই তখন এই নরাধমগুলিকে প্রহার করলে তো ভালোই হয়!
শ্রাবস্তী-তীর্থিকরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন—প্রহারের প্রয়োজন কী! আমরা তো চলেই যাচ্ছি।
আর দ্বিরুক্তি না করে তাঁরা সবাই আরাম ত্যাগ করলেন।
লোকগুলি দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যাওয়ার পর যুবক তীর্থিক যশ বলল— রাজপুরুষে উৎকোচ নেয়, এবং ধরা পড়লে শূলে চড়ে শুনেছি। কিন্তু দেশের রাজা ভিক্ষুদের কাছ থেকে উৎকোচ নেয় এমন কথা আমি কোথাও কখনও শুনিনি। ওই পাপ-রাজার দেশে আমি যাবো না। যেতে হয় আপনারা যান।
বয়োজ্যেষ্ঠ তীর্থিক বললেন— কিন্তু যশ, সেখানে সমন গোতম রয়েছেন। তাঁকে দর্শন করবার আকাঙ্ক্ষা জাগছে যে।
—জানি না। তিনি হতে পারেন পূরণ কাস্সপের চেয়ে বড় সাধু, কিংবা বড় প্রতারক। আমি আর এ সবে বিশ্বাস করি না। আমি রাজগৃহে ফিরে যাচ্ছি। দেখি কোন প্রকারে জীবিকার উপায় করতে পারি কি না। গান্ধার যুবা বলেছিল— দেহবল, মনোবল, বুদ্ধিবল পূর্ণভাবে প্রয়োগ করে সমাজের দায়গুলি স্বীকার করে নিয়ে বাঁচাই জীবনের সঠিক ব্যবহার। মৃত্যুর পরে কী হবে না হবে, পুণর্জন্ম হবে কি না, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি অজানা কতকগুলি রহস্য নিয়ে চিন্তা করে এ ভাবে কাল কাটানোর কোনও অর্থ হয় না। প্রকৃত কথা, আমরা কেউই জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারিনি। হতাশ হয়ে, নিরুপায় হয়ে এই তীর্থিক-পথ গ্রহণ করেছি, কেমন কি না?
বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি বললেন— না, তোমার কথা সর্বাংশে সত্য নয় আবুস। আমি তো অন্তত সত্যসত্যই জীবনের কার্য-কারণ জানতে আগ্রহী। আমি ভাবছি সমন গোতমের সঙ্গে দেখা করব। তারপর যা হয় কিছু একটা স্থির করা যাবে।
অধিকাংশই তাকে সমর্থন করলেন। আরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, ভালো চিঁড়ে সুমিষ্ট গুড় ইত্যাদি দিয়ে জলযোগ সেরে তারা সবাই বেরিয়ে পড়লেন। এগারো জনের মধ্যে ন’ জনই শ্রাবন্তীর পথ ধরলেন। অবশিষ্ট দুজন, যশ এবং নন্দিয় স্থির করল রাজগৃহে ফিরে যাবে। এরা দুজনেই এ দলে সর্বকনিষ্ঠ। যশের বয়ক্রম পঁচিশ হবে। নন্দিয় আরও একটু ছোট।
তখনও দুজনে বৈশালী-আরামের দ্বার পার হয়নি, যশ বলল—নন্দিয় তুমি কেন আমার অনুগামী হলে?
নন্দিয়র মুখের ওপর একটি পাতা ভরা লতা এসে পড়েছে। সে লতাটিকে সন্তর্পণে সরাতে সরাতে বলল— ভাই যশ, তোমার কথাগুলি আমার বড় মনের মতো হয়েছে। এ কথা সম্পূর্ণ সত্য— অন্ন আর আশ্রয় বিনা ক্লেশে জুটবে বলেই আমি তীর্থিকদের শরণ নিই। অতি দরিদ্র ছিলাম। তোমার মতোই অনাথ, ধরো। কারও গৃহে ভৃতক হওয়া ছাড়া গতি ছিল না তাই। এখন, তুমি যদি দেহবল, মনোবল, বুদ্ধিবলের ওপর নির্ভর করে জীবন আরম্ভ করতে পারো আমিই বা পারি না কেন?
যশ হাসিমুখে বলল— ভালোই হল। একজন সঙ্গী পাওয়া গেল। তবে নন্দিয়, তোমার যখনই ইচ্ছা হবে, তুমি আমার সঙ্গ ত্যাগ করতে পারো।
নন্দিয় বলল— ভাই যশ, তুমি যতটা নির্ভীক হয়ে গেছ আমি এখনও অতটা হতে পারিনি। একটা কোনও উপায় না হওয়া পর্যন্ত আমাকে সহ্য করো ভাই।
আহা, তোমাকে ত্যাগ করার কোনও বাসনা আমার নেই নন্দিয়। তবে সত্যিই আমি কেমন ভয়হীন হয়ে গেছি। আর দেখো, সহসা এই কুঞ্জ, লতাবিতান, সম্মুখে প্রসারিত ওই পরিষ্কৃত রক্ত মৃত্তিকার পথটি সবই আমার অপূর্ব সুন্দর লাগছে, নূতন লাগছে। বেসালি আগে কখনও দেখিনি। শুনেছি অতি সুন্দর। নন্দিয় বেসালি দেখবে?
নন্দিয় সাগ্রহে সম্মতি দিলে দুজনে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত বৈশালীর পথে পথে ভ্রমণ করে বেড়াতে লাগল। দুজনেই ক্ষুৎপিপাসাকাতর। অথচ দুজনেরই উৎসাহের অন্ত নেই। বৈশালীতে নগরের তিনটি প্রাকার, প্রতি প্রকারের মাঝে এক যোজন ব্যবধান। আছে অট্টালক, কূটাগার। কিন্তু নগরের শুষ্ক চরিত্রকে এরা একেবারে পরিবর্তিত করে ফেলেছে, স্থানে স্থানে বনকে সযত্নে রেখে দিয়ে। সমগ্র জম্বুদ্বীপই বনময়। তাকে বলে মহাবন। সেই মহাবনের অংশবিশেষ তার প্রায় মৌলিক চরিত্র সমেত টিকে আছে মধ্যদেশের নানা স্থানে। বৈশালীর মহাবন সেই মহাবন। বা তার অংশ। তার পাশ দিয়েই চলে গেছে মৃত্তিকাময় পথ সব। প্রাসাদগুলি আত্যুচ্চ নয়। সবগুলিই কাননে ঘেরা।
যশের আজকে যেন মুখে কথার জোয়ার এসেছে। সে বলল— কাস্সপই বলো, পকুধ কচ্চায়নই বলো, আর বেলট্ঠিপুত্তই বলল, কী নতুন কথা বলছেন? একই কথার এপিঠ আর ওপিঠ। আর শুধু ব্রহ্মচর্য পালন করো, নির্বস্ত্র হও, কেশ-দাড়ি মুণ্ডন করো আর কৃচ্ছ্র করো, কৃচ্ছ্র করো, কৃচ্ছ্র করো।
নন্দিয় উত্তেজিত হয়ে বলল— এই যে ধরো এই নগরেই, যারা দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে বাস করছে, এদিকে বেশ আঢ্য ব্যক্তিও বটে আবার বিদ্যা-সিদ্যাও শিখেছে তারা তো দিব্য রয়েছে! জীবনটি বেশ সরস, মাংস-ভক্তর (মাংসের ঝোল) মতো চুকচুক করে খাচ্ছে আর সারা শরীর দিয়ে যেন ঘৃত গড়িয়ে পড়ছে, মুখগুলি প্রসন্ন, হাস্যময়। মৃত্যুর পরে কী জানা যাচ্ছে না, কিন্তু পূর্বে তো জীবন! এক অর্ধ অন্তত এরা ভালোই উপভোগ করল। আর আমরা? পরেও শূন্য, আগেও শূন্য। কিসের আশায়?
যশের কপালে ভ্রূকুটি দেখা দিল, সে সরোষে বলল— কিছু না! এই নৈরাশ্যের পথ আমরা কেন এতদিন অনুসরণ করেছি ভাবলে আমার আক্ষেপ হচ্ছে। ক্রোধ হচ্ছে। তুমি আর বলো না। বরং চলো ক্ষুণ্ণিবৃত্তির উপায় দেখি। এখনও অঙ্গে তীর্থিকের ভেক রয়েছে ভিক্ষা পাবো নিশ্চয়ই!
নন্দিয় বলল— ভেকটির জন্যে আমার লজ্জা হচ্ছে ভাই।
—হোক। প্রতি পদে অত ভালো-মন্দ বিচার করে আর চলব না।
দুজনে হনহন করে চলতে লাগল। কোন গৃহে ভিক্ষা নেবে এ বিষয়ে দুজনের সামান্য মতভেদ দেখা দিল। নন্দিয় পূর্ব অভ্যাসমতো যে গৃহ সামনে পড়ে সেখানেই ভিক্ষা নেওয়ার পক্ষপাতী। যশ কিন্তু একটির পর একটি গৃহ পার হয়ে যেতে লাগল। অবশেষে একটি সুবৃহৎ প্রাসাদের সুন্দর শিখর কাননের গাছগুলির মধ্য থেকে মাথা তুলছে দেখে সে দাঁড়িয়ে গেল। কাননটি ক্ষুদ্র, কিন্তু এত সুন্দর সজ্জিত যে চোখ যেন শান্তি পায়। শুভ্র প্রসাদটি। বৃহৎ দ্বারকোষ্ঠক। মানুষ-জন যাতায়াত করছে।
যশ বলল— দেখছ না এটি ব্যাপার-বাড়ি। ভালো ভালো ব্যঞ্জন রান্না হচ্ছে। আমার এখন উদর-ভরা ঘৃতৌদন ও পক্ষীমাংস খেতে ইচ্ছে করছে। এরা যদি গোটাকতক হাঁস মেরে থাকে তো ভালো হয়।
পেছন থেকে কে বলল— আসুন আসুন, তীর্থিক মহোদয়গণ। আজ হংস, কুক্কুটাদি যথেষ্ট মারা হয়েছে। ঘৃতৌদনও পর্যাপ্ত। সীহর গৃহে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করুন।
দুই যুবক পেছন ফিরে দেখল একজন বলিষ্ঠ সুপুরুষ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সম্ভবত এইমাত্র অশ্বটি অশ্বরক্ষকের হাতে দিয়ে গৃহের দিকে আসছেন।
নন্দিয় মুখ ভারী করে বলল— নিমন্ত্রণ আমরা গ্রহণ করছি গহপতি। অতিশয় ক্ষুধার্ত আমরা। কিন্তু জানবেন, তীর্থিক আমরা নই।
আপাদমস্তক তাদের দেখে নিয়ে সীহ বললেন— নন?… তা হলে?…
যশ বলল— কিছুক্ষণ আগেও ছিলাম। এখন নই। মোহভঙ্গ হয়েছে। আপনি যদি খাদ্যের সঙ্গে বস্ত্রও দান করেন, বড় সুখী হই।
সীহ মৃদু মৃদু হেসে বললেন— আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।
গৃহের ভেতরে ঢুকতেই তিন-চারটি দাস ছুটে এলো, সীহ দুজনকে বললেন— এই দুটি যুবককে উত্তমরূপে স্নান করিয়ে, নূতন বস্ত্র, গন্ধ, মাল্য দিয়ে সুসজ্জিত করে আমার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেবার উপযুক্ত করে নিয়ে এসো।
কয়েকটি দীর্ঘ পদক্ষেপে তিনি গৃহের ভেতরে চলে গেলেন।
যশ মৃদুস্বরে নন্দিয়কে বলল— দেখলে তো, সুনির্বাচিত গৃহে ভিক্ষাৰ্থ আসবার সুফল!
নন্দিয় চতুর্দিকে তাকিয়ে খোদিত কাঠের স্তম্ভ, অলঙ্কৃত তক্ষণে সুন্দর দ্বার ও গবাক্ষের কপাটগুলি, ভিত্তিচিত্র ইত্যাদি দেখতে দেখতে বলল— বাঁচতে হয় তো এমনি। পুরুষের মতো বাঁচা। মানুষের মতো বাঁচা আমরা এতদিন কী করেছি যশ! আমাদের চোখের সামনে কেউ যেন একটি মলিন বস্ত্র ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছিল। কেন বলো তো?
যশ মৃদুস্বরে বলল— দেখো নন্দিয়, আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে— সবটাই ইচ্ছাকৃত। এই ভাবে, দলে দলে মানুষের চোখের সামনে জীবনকে একটি মলিন বস্ত্রখণ্ডের মতো ঝুলিয়ে রাখা… এর পেছনে উদ্দেশ্য আছে।
—উদ্দেশ্য! কাদের?
—ধরো পৃথিবীর ভূমি তো পরিমিত, ধনসম্পদও অসীম অনন্ত নয়। সবাই যদি এই গহপতি সীহর মতো সাড়ম্বরে জীবন ভোগ করতে চায় তো তা হলে? যাতে না চায় তাই-ই অতি-চতুর ব্যক্তিরা ওই তীর্থঙ্করদের মতো ব্যক্তিদের নিযুক্ত করে এই সব মত প্রচার করতে। আর আমরা অনাথ, নিঃস্ব এবং মুর্খের দল তাইতে ভুলে নিরুদ্যম হয়ে জীবনকে জয় করবার বাসনা ত্যাগ করে মৃত্যুর সাধনা করি।
এই সময়ে দাস দুটি বিরক্ত হয়ে তাড়া দিয়ে উঠল—চলুন, চলুন, এখনও বলে কত কাজ! সে সব ফেলে ভিক্ষুকদের চান করাও, বস্তর পরাও, উঁঃ। প্রভুর যেমন সাধ!
যশ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল— অ হে দাস, আমাদের ভিক্ষুক বলবে না। তীর্থিক বলে যদি পরিচয় দিতাম, অবজ্ঞা করতে পারতে? তীর্থিক পথ ত্যাগ করেছি এ কথা অকপটভাবে বলেছি বলেই না তোমার প্রভু জানতে পেরেছেন! দুজন একদা তীর্থিককে অন্ন-বস্ত্র দান করার পুণ্য অর্জন করছেন তোমার প্রভু। অধিক বাক্যব্যয় করো না। ডুণ্ডুভ নির্বিষ হলেও সপ্প বটে, কামড়াতে পারে।
দাস দুটি পরস্পরের দিকে সন্ত্রস্ত হয়ে তাকাল। তারপর নীরবে দুই প্রাক-তীর্থিককে স্নান করিয়ে, নূতন শুক্ল বসন ও উত্তরীয় পরিয়ে, গন্ধ মাল্যাদি দিয়ে সুসজ্জিত করে দিল।
—অহো যশ তোমাকে তো দেখছি সেট্ঠি পুত্তর মতো দেখাচ্ছে, যদিও বড় কৃশ— নন্দিয় চমকৃত হয়ে বলল।
যশ বলল— ও কৃশতাটুকু পক্ষী মাংস খেতে খেতেই চলে যাবে। নন্দিয় ভোমাকে দেখাচ্ছে। একটি সদ্য-স্নাতক ব্রাহ্মণকুমারের মতো!
তাদের এই মত-বিনিময়ে দাস দুটি দাঁত বার করে হাসতে লাগল। তারা সে সব গ্রাহ্যও করল না। আদেশের ভঙ্গিতে আঙুল তুলে বলল— ‘কই, তোমাদের প্রভুর কাছে নিয়ে যাবে না?’
দাস দুটি স্মিতমুখে বলল— আগে বিশ্রাম কক্ষে আপনাদের সুরা পরিবেশন করি। এ গৃহের অতিথি আপ্যায়নের নিয়ম-নীতি পুরো পালতে হবে তো!
নন্দিয় বলল—দাঁড়াও দাঁড়াও, সুরা আমরা পান করি না। কি বললা যশ?
যশ গম্ভীরভাবে বলল— সুরা পান করিয়ে আমাদের মত্ত করবার চেষ্টা করছ না কি? সে সব হবে না। অন্য কোনও পানীয়, যেমন দুগ্ধ দিতে পারো। আর দেখো হে, অধিক ব্যঙ্গবিদ্রুপের চেষ্টা করো না, আপাতত আমরা নিঃস্ব হতে পারি, কিন্তু কারও দাস আমরা এখনও নই।
দাস দুটি ভ্রূকুটি করে বলাবলি করল— কী প্রকার কটুভাষী দেখেছিস? তীত্থিকরা আকারেও রুক্ষ, প্রকারেও রুক্ষ।
ভোজনাগারে বসে গহপতি সীহ জিজ্ঞাসা করলেন— তীর্থিক মত সহসা পরিত্যাগ করলেন কেন? কী যেন একটা কারণ বলছিলেন…’
যশ তখন একটি চমৎকার হাঁসের বুকের মাংস চুষছিল। সেটি নামিয়ে রেখে বলল— তার আগে আপনি বলুন, আপনি কে?
—কেন, গৃহে কারও কাছ থেকে শোনেননি আমার পরিচয়?
—না, জিজ্ঞাসা করিনি। আপনার দাসরা বড় দুর্বিনীত। দাসেরা ওরূপ হয়ে থাকে শাসনের অভাবে। শাসনের অভাব তখনই হয় যখন গৃহের স্বামী-স্বামিনী অতিশয় কর্মব্যস্ত হন বা অতিশয় বিলাসপ্রিয় হন। আপনি এই দুটির একটি অথবা দুটিই, এমন অনুমান করতে পারি।
সীহর মুখ সামান্য রক্তবর্ণ হল, তার পরেই তিনি কৌতুকের স্বরে বললেন— বিলাসপ্রিয় ব্যক্তি ধনসম্পদ ব্যয় করতে পরান্মুখ হয় না। আর হয় না বলেই বহু ভিক্ষাজীবী ব্যক্তির ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে পারে। সহসা কোনও প্রাক তীর্থিকের হংসমাংস খেতে ইচ্ছে হলে সে যে অবিলম্বে তার বাসনা পূরণ করতে পারে, সে তো সীহর এই প্রকৃতির জন্যই!
যশ নির্বিকার মুখে বলল—দেখুন গহপতি, তীর্থিক-পন্থ ত্যাগ করেছি বটে কিন্তু পঞ্চদশ বছর মস্তিষ্ক চালনার যে অভ্যাসটি করেছি তা তো ত্যাগ করার কোনও কারণ দেখি না। সত্য নিরপেক্ষ। কারও নিন্দা বা শংসা করা সত্যাসত্য বিচারকের কাজ নয়। আপনি যে বিরক্ত হলেন তাতে বুঝতে পারছি আপনার বহু চাটুকার আছে, কিন্তু আত্মসংবরণ করে নিলেন দ্রুত। তাতে মনে হচ্ছে আপনি উচ্চপদে রয়েছেন। প্রকৃত শিক্ষিত। স্বভাবজ দুর্বলতাগুলির ঊর্ধ্বে ওঠবার বাসনা ও মনোবল দৃটিই আপনার আছে, আপনি শ্রীমান রয়েইছেন। ভবিষ্যতে আপনার বিপুল শ্রীবৃদ্ধি হবে।
যশ হংসমাংসে মন দিল।
নন্দিয় বলল— কিছু যদি মনে না করেন গহপতি আমি সতীর্থ যশের বিচারের ওপর আমার নিজের বিচারের কথা একটু বলতে চাই।
সীহ কৌতুকস্মিত মুখে বললেন— সুস্বাগত। বলুন আয়ুষ্মন।
নন্দিয় বলল— যেভাবে আপনি ভিক্ষাজীবীদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির কথা বললেন, আমার সতীর্থর হংসমাংসলোলুপতার প্রতি কটাক্ষ করলেন, তাতে এ-ও মনে হচ্ছে আপনি স্বভাবে দাম্ভিক। দান করতে এবং দানের প্রকৃত ফল পেতে হলে যে বিনয়ের, দীনতার প্রয়োজন তা আপনার নেই গহপতি। আপনার এই আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন এ শুধু লোক-দেখানোর জন্যে। এই সব হংসমাংস কুক্কুটমাংস, ময়ূরমাংস এ সকলই সমৃদ্ধির বিজ্ঞাপন। আপনি যদি রাজা হতেন এরূপ বাহুল্য মানিয়ে যেত, তা না হলে এই বিজ্ঞাপন লোকসাধারণের চোখে পড়বে, বহু লোকে আপনাকে ঈর্ষা করবে, অনর্থক শত্রু সৃষ্টি হবে তাতে।
সীহর মুখে নানা প্রকার ভাব খেলা করছিল। কখনও ক্রোধ, কখনও বিস্ময়, কখনও কৌতুক। নন্দিয়র কথা শেষ হলে তিনি বললেন— আমি রাজা নই। কিন্তু সেনাপতি। বেসালির সেনাপতি সীহর নাম রাজগহ সাবত্থির লোকেরাও জানে। সে যাই হোক, আপনারা অল্পবয়স্ক হলেও বুদ্ধিচর্চা, বহু ভ্রমণ ও সৎ-সংসর্গের ফলে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছেন। যেভাবে সীহর চরিত্র-বিশ্লেষণ করলেন তাতে সীহ ক্ষুব্ধ হলেও উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এই প্রকার সত্য-কথন যদি করতে থাকেন, তা হলে বেসালির লোকে আপনাদের লগুড় হাতে তাড়া করবে। বিশেষত এখন আপনারা সাধারণ কর্মহীন যুবা ব্যতীত কিছুই নন তো! বেসালিবাসীদের মর্যাদাজ্ঞান প্রখর… ভালো কথা, তীর্থিক পথ ত্যাগ করলেন কেন, বললেন না তো!
—ও আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার সেনাপতি সীহ। আপনার এত আগ্রহের কারণ দেখছি না। সীহ প্রাচীরগাত্রের দিকে চেয়ে বললেন— প্রকৃতপক্ষে কেন কেউ কোনও পথ ত্যাগ করে অন্য পথ নেয় জানতে আমার বড় আগ্রহ হয়। কেন, কেন নেয় বলুন তো?
নন্দিয় বলল— আপনি সমন গোতমের নাম শুনেছেন?
চমকে উঠলেন সীহ। বললেন— শুনেছি।
—তাঁরই চক্রান্তে আমাদের তীর্থঙ্কর পূরণ কাস্সপ আত্মঘাতী হয়েছেন। তাই…
সীহ বললেন— বাঃ এ তো নূতন আরোপ দেখছি। বহু জনে বহু প্রকার দোষ আরোপ করছে তার ওপর। কিন্তু তাঁকে দেখে থাকলে সেসকল বিশ্বাস করা সম্ভব হয় না। আপনারা কি তাকে দেখেছেন?
—না। তিনি নাকি সাবত্থিতে রয়েছেন। তীর্থিকরা সব তাঁর সঙেঘ প্রবেশ করছেন এমন শুনেছি। আমরা সাবত্থিতে যাচ্ছিলাম। এ সকল ঘটনা শুনে ফিরে, যাচ্ছিলাম। তীর্থিকদের আচরণও আমাদের ভালো লাগে না।
সীহ এখন আর ভোজন করছিলেন না। তাঁর দক্ষিণ হাত পাত্রের ওপর থেমে ছিল। তিনি যেন চিন্তামগ্ন। হঠাৎ মুখ তুলে বললেন—সাবত্থি থেকে ঘুরেই আসুন না। একবার তাঁকে দেখে আসা ভালো। হয়ত তার পথ আপনারা নিতেও পারেন।
যশ বলে উঠল—কার পথ আমরা নেবো তা তো ইতিমধ্যেই স্থির করে ফেলেছি।
—সত্য না কি? কি স্থির করলেন?
—বেসালির সেনাপতি সীহর পথ।
—সীহর পথ?… সীহ অবাক হয়ে বললেন।
নন্দিয় চতুর হাসি হেসে বলল— কোনও তীর্থঙ্করের কথাতেই আর আমরা ভুলছি না। ধন উপার্জন করব, শুক্লবসন পরব। হংসমাংস খাবো।
সীহ হেসে বললেন— ভালো, ভালো। কিন্তু বেসালিতে উগ্গ, ভোগ, কৌরব, ঈক্ষ্ববাক, বজ্জি, জ্ঞাতৃক, লিচ্ছবি এই সকল কুলে না জন্মালে তেমন সুযোগ পাওয়া যায় না। বরং সাবত্থিতে যান। অত বড় দেশের রাজধানী। কত লোক, কত বৃত্তি… আপনাদের কোনও না কোনও উপায় হয়ে যাবেই।
যশ একটু ভেবে নিয়ে বলল— পরামর্শটি তো ভালোই। তা হলে আজ রাত্রিটা এখানে কাটিয়ে কাল প্রত্যূষেই সাবত্থি-যাত্রা করব। কি বলো নন্দিয়?
নন্দিয় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে সীহ গাত্রোত্থান করলেন। বললেন— সীহকে ভুলবেন না যেন। সমন গোতম সম্পর্কে যদি কিছু জানতে পারেন, সীহকে জানাবেন। এই ধরুন, গোতম গোপনে নারীসঙ্গ করেন কি না, মুখে অহিংসার কথা বলে দিব্য মাংসাহার করেন কি না, জাদুবিদ্যা জানেন কি না… সত্য সত্য তার চরিত্র কেমন…
যশ বলল— তা না হয় জানলাম। আপনাকে জানাবো কী করে?
সীহ বললেন— আপনাদের যাত্রার পূর্বে দুই প্রস্থ বসন এবং দুই স্থবিকা কহাপন দেবো। যতদিন উপার্জনের ব্যবস্থা করতে না পারেন, চলে যাবে। সংবাদ সংগ্রহ হলে দুজনের একজন চলে আসবেন। সীহর দ্বার মুক্ত থাকবে।
নন্দিয় ঈষৎ কঠিন গলায় বলল— আমরা পূর্বে কখনও চরকর্ম করিনি। এই কাজ করতে আমার ঘৃণাবোধ হচ্ছে।
সীহ একটু ইতস্তত করে বললেন— আয়ুষ্মন, আমি রাজপুরুষ হলেও কোনও রাষ্ট্রীয় কাজে আপনাদের এই অনুসন্ধান করতে বলছি না। প্রকৃত কথা, গৌতম বুদ্ধ যাঁকে আপনারা সমন গোতম বলছেন তাঁকে দেখবার পর, তাঁর দেশনা শোনবার পর আমি তার প্রতি অতিশয় আকৃষ্ট হয়েছি। এদিকে আবার আমি নিগ্গণ্ঠ নাতপুত্তের উপাসক। ভগবান নাতপুত্ত মহাবীর, জিন, কিন্তু গৌতমের ওপর অতিশয় বিরূপ। তিনি বলেন— গৌতম জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে মানুষকে বশ করেন। তিনি নাকি উদ্দিস্সকত, অর্থাৎ কি না তারই জন্য হত্যা করা পশুমাংস আহার করেন, অথচ প্রকাশ্যে বলে থাকেন জীবহিংসা করো না। এই ব্যাপারে আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছি। আপনারা দীর্ঘদিন তীর্থিকদের মধ্যে থাকায় এই সব সমন সঙেঘর গোপন কথাগুলি সহজেই বুঝতে পারবেন। আপনাদের বুদ্ধিও অত্যন্ত স্বচ্ছ। আমি নিশ্চিত হতে চাই যে আমার চিত্ত অযোগ্য পাত্রের দিকে ধাবিত হয়নি।
সীহর কথাগুলির মধ্যে একটা ব্যাকুলতা লক্ষ করে যশ ও নন্দিয় দৃষ্টিবিনিময় করল।
অবশেষে যশ বলল— আমাদের এই কাজের জন্য কোনও মুল্ল দেবেন না সেনাপতি সীহ। তা হলে আমাদের মনে গ্লানি থাকবে না।
সীহ বললেন— কিন্তু আপনারা উপার্জনের, সংসার-যাত্রার কিছুই জানেন না…
নন্দিয় হাত দিয়ে যেন তার কথাগুলি উড়িয়ে দিল, বলল—জেনে নেবো। আপনি ভাববেন না সেনাপতি।
দুই যুবাকে পাথেয় বলে কিছু নিতে সম্মত করিয়ে, অতিথিগৃহে তাদের পাঠাবার পর সেনাপতি সীহ অন্তঃপুরে গেলেন না। নিজের অস্ত্রাগারে প্রবেশ করলেন। বড় প্রিয় স্থানটি তাঁর। নানা প্রকার অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে উন্মনা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সীহ একটি তীর তুলে নিলেন, সেটিতে আঙুল রেখে তার ধার পরীক্ষা করতে করতে আপন মনেই বললেন—
—কে উদ্দিস্সকত (উদ্দেশ্যকৃত) মাংস আহার করে, কে করে না তাতে সীহর কীই বা এসে গেল। প্রকৃত কথা কেউ প্রতারণা করছে কি না। যখন ভগবান জিনের মাংস খাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল তিনি কেন উপাসক সীহকে বললেন—সীহ সীহ, মেণ্টিক গামের উপাসিকা রেবতীর কাছে যাও। সে আমার জন্য নাকি দুটি কপোত সিদ্ধ করে রেখেছে। তা নিও না, কাল তার গৃহে যে কুক্কুটটি বিলার মেরে ফেলেছে, সেই কুক্কুটের মাংস রেঁধে আমাকে দিতে বলো। — এইভাবে তিনি সীহকে কি বোঝাতে চাইলেন? তিনি মাংস খেলেও উদ্দিস্সকও মাংস খান না—এই তো?
আবার ভগবান জিন নিগ্গণ্ঠদের বলে থাকেন— বহু- অট্ঠিমাংস (বহু অস্থি মাংস), বহু কণ্ঠক মচ্ছ, বিল্ল, উচ্ছুখণ্ড (ইক্ষু খণ্ড), সিংবলি (শাল্মলী) ইত্যাদি ফল যাতে খজ্জের ভাগ অল্প, বর্জ্য পদার্থ অধিক সেরূপ ভিক্ষা বর্জন করবে। যাঁরা জিন হতে চান তাদের আবার গ্রহণ বর্জন কি?
নিগ্গণ্ঠরা বলেন জীব ছয় শ্রেণীর— পৃথ্বীকায়, অপকায়, অগ্নিকায়, বায়ুকায়, বনস্পতিকায় ও এসকায়। কোনও কায়কেই হিংসা করবেন না বলে নিগ্গণ্ঠ সমন দীপ জ্বালান না, শীতল জল পান করেন না, মুখে বস্ত্রখণ্ড বেঁধে রাখেন। অথচ নিগ্গণ্ঠ উপাসক সকল প্রকার জীবকেই হত্যা করেন, কারণ ভূমি কস্সন করবার সময়ে সর্ব কায়ই ধ্বংস হয়ে থাকে। সেই উপাসকের পক্ক অন্ন কি নিগ্গণ্ঠ সমন নির্দ্বিধায় ভিক্ষা নেন না? তবে?
আমি বিভ্রান্ত। বড় বিভ্রান্ত। নিগ্গণ্ঠ উপদেশের মধ্যে আমি কোনও সমঞ্জসতা পাচ্ছি না। ভগবান তথাগত বুদ্ধকে আমার গৃহে নিমন্ত্রণ করব কি করবো না তাতে মহাত্মা মহাবীরের কী? তার উপাসক হয়েছি বলে কি ইচ্ছা-অনিচ্ছা, বিবেকবুদ্ধি মহাত্মার কাছে গচ্ছিত রেখেছি না কি? ভগবান তথাগত, ভগবান তথাগত, এই বুদ্ধি-চকচক বাক্য-বকবক সত্যসন্ধ শুক দুটিকে আকাশে উড়িয়ে দিলাম। শুকমুখে শুভ সংবাদ পাঠাবেন। সীহ বড় অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করছে।
২
শ্রাবস্তী একটি চঞ্চলা বালিকার মতো। কোনও উত্তেজনার ঘটনা ঘটলেই সে দু পাক নেচে নিয়ে দুই হাতে তালি দেয়। লাফ দিয়ে দিয়ে চলে যেন নৃত্যই করছে সব সময়। সমৃদ্ধি এখন এমন স্তরে পৌঁছেছে যে শ্রাবস্তীবাসীরা সদা-সর্বদাই যেন নিশ্চিন্ত। কৌতুক, আমোদ-প্রমোদ এ সবই তাদের উত্তাল করে তোলে। জীবন ধারণের ভাবনা নেই। দেখো দেখো রাজপথে কী ভিড়? বহু জনসমাবেশ। সর্বশ্রেণীর। কী চায় ওরা? সার বেঁধে সব দাঁড়াচ্ছে যে! শুধু সামান্য জনই তো নয়! অভিজাতরাও জ্ঞাতিবর্গ নিয়ে সব স্বতন্ত্র চন্দ্রাতপের তলায় জড়ো হচ্ছেন। আকৃতি দেখলেই বোঝা যায়।
—কী ব্যাপার? ব্যাপারখানা কী? —শ্রাবস্তীতে নব-আগন্তুক দুই বন্ধু যশ ও নন্দিয় কাউকেই জিজ্ঞাসা করে কোনও উত্তর পায় না। সব নিজেদের মধ্যে এমন কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলছে যার বিন্দু-বিসর্গ তারা জানে না।
অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে ‘মিগারমাতা’ আর ‘মত্ত হত্থি’ কথা দুটি উদ্ধার করতে পারল ওরা।
—মিগার কে? মিগারমাতা কে? একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগল ওরা। শেষে একজন বিরক্ত হয়ে বলল— তোমরা কে হে বাপা, মিগারমাতা বিসাখাকে চেনো না! বিদেশি নাকি?
—হ্যাঁ ভাই। ঠিকই ধরেছ। তা এই উৎসবটা কিসের একটু বুঝিয়ে বলবে?
—ওরে বাপা, উৎসব এ নয়, উৎসব নয়! এ যে কী তা আমরা জানি নে। মিগার সেট্ঠির পুত্তবধূ বিসাখা, শ্বশুরের এত প্রিয় যে শ্বশুর তাকে মিগারমাতা বলেন, তা তার যত রূপ, ততই গুণ। সেই বিসাখা নাকি মত্ত হত্থি বশ করতে পারে। এই জনশ্রুতি কানে গেছে আমাদের খ্যাপা রাজার। অমনি নিদ্দেস হয়ে গেল বিসাখাকে প্রকাশ্য রাজপথে হত্থি বশ করে দেখাতে হবে।
—ওই শ্বেতছত্রের তলায়, ওখানে বুঝি রাজা?
—হ্যাঁ। এ আবার জিজ্ঞাসা করতে হয় নাকি! —পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে নন্দিয় ও যশ উৎকোচগ্রাহী পসেনদি রাজাকে দেখবার চেষ্টা করতে লাগল।
—উনি কি সেট্ঠি কিংবা তার সুহ্নার ওপর ক্রুদ্ধ? -নন্দিয় জিজ্ঞেস করল।
—না না। ক্রুদ্ধ হবেন কেন? মিগারমাতা বিশাখাকে উনি যথেষ্ট ভালোবাসেন।
—তা হলে? উনি যদি হাতি বশ করতে না পারেন? মত্ত পশু তো ওঁকে পিষে ফেলবে!
বলতে বলতেই রাজপথের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে তুমুল জয়ধ্বনি উঠতে লাগল। একটি স্বর্ণদণ্ডী শিবিকা থেকে একটি আশ্চর্য যুবতীকে নেমে আসতে দেখল দুই বন্ধু। তার পরনে পুরুষদের মতো কচ্ছ দিয়ে পরা কাঞ্চন বর্ণের বসন, স্নিগ্ধ হরিৎ উত্তরীয়, গাঢ় নীল স্তনপট্ট শক্ত করে বাঁধা। কপালে চন্দনের পত্রলেখা। মাথার কেশগুলি সব চূড়া করা। কানে মুক্তার কর্ণভূষা, কণ্ঠে কুসুমমালা’। যশ বলল—নন্দিয় ইনি কে ভাই! আমার যে এঁর পদচুম্বন করতে ইচ্ছা হচ্ছে…
নন্দিয় বলল—পেছনে দেখো, পেছনে দেখো।
যুবতীর পেছনে নামলেন আরো একজন রমণী। ঘৃত বর্ণের শাটকে ও কুঙ্কুমলেখায় তাঁকে দেখাচ্ছে যেন সাক্ষাৎ গঙ্গা নদী। গঙ্গা আর হিরণ্যবাহর প্রয়াগ বুঝি তবে এখানেই।
‘জয় মিগারমাতা বিসাখার জয়, জয় মিগারমাতা বিসাখার জয়’ —রব উঠল। যশ পাশের লোকটিকে বলল—কোনটি দেবী বিশাখা? ঘৃতবসনাটি? না কাঞ্চনবসনাটি?
লোকটি বলল— কোনটি আবার? কাঞ্চন হরিদ্বসনা সদ্যযুবতী রূপসী বিসাখাকে দেখতে পাচ্ছো না? পেছনে উটি বোধ হয় বিসাখাজননী দেবী সুমনা। সাকেত থেকে এসেছেন শুনছি। আহা এমন জননী না হলে কি আর অমন কন্যা হয়?
দেবী সুমনা পথের পাশে চন্দ্রাতপ দেওয়া একটি স্থানে গিয়ে দাঁড়ালেন। দুজন প্রৌঢ় আসছেন দেখা গেল। তারা গিয়ে দাঁড়ালেন দেবী সুমনার দু পাশে।
—ওই তো মিগার সেট্ঠি— লোকটি বলে উঠল— ওহে বিদেশি দেখো দেখো ওই পক্ককেশটি মিগার। চুলগুলি হতভাগ্যের সবই পেকে গেল। হবে না? কৃপণের কত কহাপণ যে সুহ্নার জন্যে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে! দাহিন পাশে দেখো উনিই নিশ্চয় ধনঞ্জয়। একটু স্থূল বটে। কিন্তু স্থূলোদর নয়। দেখ দেখ…
লোকগুলির কথা শেষ হল না। প্রসেনজিতের ইঙ্গিতে গজচালক কালো মেঘের মতো একটি হাতিকে ছেড়ে দিল। হাতি ধেয়ে আসছে। সে যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না। রক্তবর্ণ চোখের পাশ দিয়ে মদবারি ঝরছে। দর্শকরা ভয়ে সরে দাঁড়াতে লাগল। হঠাৎ শুঁড় তুলে কান-ফাটানো বৃংহণ করল হাতিটি। যশ ও নন্দিয় দেখল বিসাখা মিগারমাতা নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটি বীর বালকের মতো, এবং অতিশয় মধুর অদ্ভুত একটি শিস-ধ্বনি ভেসে আসছে কোথা থেকে। হাতিটি আরও বেগে ধেয়ে আসছে। বিশাখা কী যেন ইঙ্গিত করছে। ও মা, হাতিটি তো থেমে গেল! কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! বিশাখা তার শুঁড়ের সামনে দাঁড়িয়ে যেন কালো মেঘের বুকে বিদ্যুল্লতা, কিংবা হাতিটির মুখের কাছে একটি শ্যামস্নিগ্ধ ছায়াতরু। বিশাখার দক্ষিণ হাত উঠছে এবার। সে হাতিটির শুঁড় স্পর্শ করল, অমনি কী আশ্চর্য! হাতি নতজানু হয়ে বসে পড়ল। তখন বিশাখার আঙুল হাতির শুঁড়ের ওপর, কপালের ওপর যেন পত্রলেখা আঁকছে, অত বড় হাতিটা শিশুর মতো আদর খাচ্ছে।
—জাদুবিদ্যা বটে! অদিট্ঠপুরব— মন্তব্য করল একটি লোক।
ভেরী বাজছে। অর্থাৎ সমবেত জনতা তোমরা চলে যাও এবার। জনতা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যে যার নিজের গৃহে, নিজের কাজে যাবে এবার। যশ ও নন্দিয়ও যাচ্ছে তাদের সঙ্গে সঙ্গে।
—বিশাখা তো কড়ে আঙুল দিয়েই হত্থিটাকে শুইয়ে দিলে!
—একটি কড়ে আঙুলে যদি অত শক্তি ধরে, তা হলে পুরো শরীরটাতে কত বুঝে দেখ।
—একটি যুবতী বধূরও যে ইদ্ধি আছে, তীর্থঙ্কর পূরণ কাস্সপ সেটুকুও দেখাতে পাল্লেন না! ধিক!
দুই বন্ধু উৎত্তৰ্ণ হয়ে শুনছে।
—কী অভিপ্পায়ে জেতবনের সন্নিকটে মঠ তুলছিল বল তো!
—কী আবার? গোল করবে! তথাগত হট্টরোল সইতে পারেন না বলেই তো সেট্ঠি সুদত্ত নগরো পান্তে জেতবন কিনলেন।
—তা ছাড়া তথাগত নিসর্গসৌন্দর্য ভালোবাসেন। উরুবেলা গামের যে জায়গাটিতে উনি বোধিলাভ করেছিলেন সেটি তো স্বর্গোদ্যানের মতো! নিরঞ্জনা নদী বইছে। পদ্মসরোবরে শতাধিক পদ্ম ফুটে আছে, একেকটি এক এক বন্নের, চন্ননগন্ধে চাদ্দিক মো মো। অপ্সরারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যেই নেচে নিচ্ছে। ব্রহ্মা স্বয়ং আকাশ থেকে নৃত্য দেখছেন। ওপর দিকে সাহস করে তাকালেই ব্রহ্মার চোখ দুটি দেখা যায়। অশথ্ গাছের তলায় গৌতম বোধি পেলেন। অমনি সুজাতা নামে এক অপ্সরা তাকে পায়স দিয়ে গেল। খেয়ে গায়ে বল পেলেন গৌতম। তাপরে ন্যগ্রোধবৃক্ষমূলে আবার ধ্যানস্থ হলেন। পাখির কাকলি, গাভীদের মা-মা রব, হরিণগুলি শিং দিয়ে তথাগতের পিঠ চুলকে দিচ্ছে, বাঘগুলি পাহারা দিচ্ছে পাছে মার তার দলবল নিয়ে ঢুকে পড়ে…
নন্দিয় বলল— আপনি কি উরুবেলায় গিয়েছিলেন?
লোকটি একবার ভালো করে তাকে দেখে নিল। কিন্তু গ্রাহ্য করল না, বলে যেতে লাগল—ঝড় এলো, সঙ্গে দারুণ বৃষ্টি, অমনি সরোবর ফুঁড়ে উঠল এক ফণা তোলা মহাসপ্প। সড়সড় করে এসে তথাগতের মাথায় ফণা ধরে দাঁড়ালো। বজ্রের হুংকার, গাছ উপড়ে পড়ছে, পশুপাখি ছুটে পালাচ্ছে—তথাগতর চেতনা নেই। বুঝলেন?
নন্দিয় স্মিতমুখে বলল—বুঝলাম।
—আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, না?
—না না, অবিশ্বাস করব কেন? তবে অপ্সরার নৃত্য, ব্রহ্মার চোখ, মহাসপ্পর ফণা ধরে বৃষ্টি আটকানো, এক সরোবরে বহু বর্ণর পদ্ম সব মিলিয়ে এমনটি আমরা ভাবিনি।
—আমার কথায় বিশ্বাস না হয় চলুন দীঘিতির কাছে। দীঘিতিকে জানেন তো? সেট্ঠি সুদত্তর লেখক। সে কখনও মিছা বলে না।
নন্দিয় যশের দিকে চেয়ে বলল—কী ভাই যশ, নৈরঞ্জনা নদীতীরের যে স্থানটির কথা এঁরা বলছেন, মনে পড়ছে? সরোবরে পদ্ম কী বর্ণের দেখেছিলে?
যশ হেসে বলল—শ্বেতপদ্মই তো, গোড়ার দিকটা রক্তাভ!
—ও আপনারা ওখানে গেছেন? —লোকটি দমে গিয়ে বলল।
যশ নন্দিয়র দিকে তাকিয়ে কী বলছিল, ফিরে আর লোকটিকে দেখতে পেল না। সে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছে।
যশ হেসে বলল—বড় নগরের এই-ই চরিত্র, নন্দিয়। সদাই যেন উৎসব হচ্ছে এমন গোল, বহু জন-সমাবেশ, তিলপ্রমাণ সচ্চকে কল্পনার সাহায্যে তাল করে পরিবেশন করা… এ তো সামান্য—আরও কত প্রতারক-প্রবঞ্চক চারদিকে ঘুরছে… সুন্দরী রমণীদের এখানে প্রকাশ্য রাজপথে রথচালনা করতে দেখবে, রাজা রাজপুরুষরা পথে নেমে সভা করেন। কত প্রকারের শব্দ দেখো! রথের ঘর্ঘর, অশ্বের খট্ট খট্ট, গো-যানের গাভীগুলির গলায় ঘন্টার টুঙ্ক টঙ্ক টুঙ্ক টঙ্ক, ওদিকে ভেরী বাজছে ভোঁ ভো, পটহ বাজছে দমদম। এই যে রমণীটি অদ্ভুত কাণ্ড করল এরূপ অদ্ভুত চমৎকার, এ-ও তুমি বৃহৎ নগরেই দেখতে পাবে। বারাণসীতে আমি অহিতুণ্ডিকা দেখেছি। কেমন স্বচ্ছন্দে সর্প নিয়ে খেলা করে, ঈক্ষনিকা দেখেছি —তোমায় ভালো করে দেখে তোমার ভাগ্য বলে দেবে…। তবে বারাণসীর তুলনায় সাবত্থি সুন্দরতর, যেন আরও ঐশ্বর্যশালী, আড়ম্বর ও মহোল্লাসে পূর্ণ। চলো নন্দিয় এই জনতার সঙ্গে ভেসে যাই। যেখানে ঠেকব সেখানে উঠব।
ওদিকে পাঞ্চাল তিষ্য একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। বন্ধুল চমকে ফিরে তাকিয়ে বললেন— কী ব্যাপার তিষ্য? তুমি কি এতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে ছিলে? তিষ্য গম্ভীর মুখে নীরব রইল।
মহারাজ প্রসেনজিৎ আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি হেসে বললেন —আমিও তো নিশ্বাস বন্ধ করেই ছিলাম বন্ধুল। তুমি বুঝি ভীত হওনি! যদি বিশাখা অকৃতকার্য হত।
বন্ধুল বললেন— সে ক্ষেত্রে তিষ্যকুমার ছিল, দীঘকারায়ণ ছিল, আমি ছিলাম—তিনি হাতের বর্শাটি আস্ফালন করলেন।
—তুমি কি এই বর্শা ছুঁড়তে নাকি?
—অব্যর্থ লক্ষ্যে মহারাজ। —বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বন্ধুল বললেন।
—অর্থাৎ তুমি আমার মঙ্গলহস্তীটিকে মারবার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিলে? কী স্পর্ধা?
—তা মহারাজ আপনি যদি জেদের বশে একটি নাগরিকার প্রাণ নিয়ে খেলা করতে যান, প্রিয় হস্তীটির প্রাণও আপনাকে বন্ধক রাখতে হয় অগত্যা।
প্রসেনজিৎ অকস্মাৎ নিবে গেলেন। বললেন— অন্যায় করেছি, না?
—এ সব ভাবার আর সময় নেই মহারাজ, ওই বিশাখা সপরিজন আসছে। পুরস্কৃত করুন তাকে।
হাতিটির পাশে দুজন গজচালক এসে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই বিশাখা ফিরে গিয়েছিল চন্দ্রাতপের তলায় যেখানে তার জনক, জননী, শ্বশুর, সখীরা সকলে সমবেত হয়েছে।
সে সুমনার বুকে মাথা রেখে মৃদুস্বরে বলল— মা তুমি শিস দিলে কেন? আমার শিক্ষার ওপর নির্ভর করতে পারনি?
তার মাথায় হাত বুলিয়ে, মুখে চুমো খেয়ে সুমনা বললেন—তোমার শিসের সঙ্গে আমার শিস-ধ্বনি মিশে গিয়েছিল মা, কেউ বুঝতে পারেনি।
—সে তো আরও অন্যায় মা। প্রতারণা করা হল না?
সুমনা দৃঢ় স্বরে বললেন— না। ধরো তোমার যশের ভাগ নিতে আমারও ইচ্ছা হয়েছিল।
ধনঞ্জয়ের কপালে ভ্রূকুটি, বললেন— মহারাজের দূত এসেছে, চলো।
সুমনা বললেন—চলো! তারও মুখভাব ইতিমধ্যেই কঠিন হয়ে গেছে। মাঝখানে বিশাখাকে নিয়ে প্রথম পঙক্তিতে ধনঞ্জয়, সুমনা ও মিগার, দ্বিতীয় পঙক্তিতে বিশাখার ঘনিষ্ঠ সখারা এবং তৃতীয় সারিতে তার অনুগত দাস-দাসীরা চলল।
প্রসেনজিৎকে নমস্কার করে দাঁড়াতেই তিনি কণ্ঠ থেকে মণিহার খুলে বিশাখার কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন। হেসে বললেন—সাধু বিশাখা সাধু।
সুমনা ও ধনঞ্জয় নত হয়ে মহারাজকে অভিবাদন করলেন। ধনঞ্জয় বললেন—আমার কন্যাটিকে সাবত্থির রাজপথে জাদুর খেলা দেখাতে হবে এ কথা তো আমাকে পূর্বে বলেননি মহারাজ! তা হলে আমি সাবত্থিতে তার বিবাহ দেওয়া ছেড়ে সাকেতেই আসব কি না ভেবে দেখতাম!
হাসতে হাসতেই বলছেন ধনঞ্জয়, কিন্তু তাঁর ক্রোধ অপ্রকাশ নেই। প্রসেনজিৎ অপ্রতিভতা ঢাকবার চেষ্টা করতে করতে বললেন— আপনি কী করে ভাবলেন বিশাখার প্রাণসংশয় হতে পারে—এই দেখুন না বন্ধুল, আমার প্রধান সেনাপতি, রাজগৃহের রাজপ্রতিনিধি মহামান্য পাঞ্চাল তিষ্য সবাই প্রস্তুত ছিলেন বর্শা, ভল্ল ইত্যাদি নিয়ে।
বন্ধুল বিশাল শরীর মেলে দাঁড়ালেন।
—বন্ধুলের লক্ষ্য অব্যর্থ, তা জানেন? —প্রসেনজিৎ লঘুস্বরে বললেন
—কই পাঞ্চাল তিষ্য কই? তিনিও তো সাকেতক!
সুমনা সাগ্রহে বললেন— তিষ্য কুমার? রাজা উগ্গসেনের পুত্ত নাকি? কই?
তিষ্যকুমার কখন চলে গেছেন কেউ জানে না।
—মা বিশাখা! আজ পট্ট মহাদেবী মল্লিকার গৃহে তোমাদের সবার নিমন্ত্রণ, প্রসেনজিৎ বললেন।
—বিশাখা যদি হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে যেত কে এই নিমন্ত্রণ পেত মহারাজ? ধনঞ্জয়ের ক্ষোভ কিছুতেই যেতে চাইছে না।
বন্ধুল বললেন— মহাসেট্ঠি, বিশাখার বিপদের কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। আপনি শান্ত হোন।
মিগার রাজপুরুষদের এড়িয়ে চলেন। আজ কিন্তু থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন— আপনারা তো নিশ্চল ছিলেন। হত্থিটি যখন ধেয়ে আসছিল তখনই তো দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো! উদ্যোগ নিতে তো কাউকে দেখিনি!
বন্ধুল হেসে বললেন— বাতাসে একটি মন্ত্র ধ্বনিত হচ্ছিল শুনেছিলেন সেট্ঠিবর! সেটি শোনবার পর বুঝলাম আমাদের উদ্যোগের আর প্রয়োজন হবে না। বিশাখা সত্যই ইন্দ্রজাল জানে। বিশাখা যদি সম্মত থাকে, তা হেল আমি তাকে নেত্রী করে একটি নারীসেনা গড়তে পারি।
মিগার অপ্রসন্ন স্বরে বললেন— না, না। আমার সুহ্নার কর্মক্ষেত্র ভিন্ন। সে যুদ্ধবিগ্রহ করবে না।
এই ঘটনার পর অনেকেরই বিশ্বাস হল বিশাখার বিশেষ ঋদ্ধি আছে। অনেকে আবার বলল— বিশাখা বুদ্ধ ধম্ম ও সংঘর উপাসিকা। স্বয়ং তথাগত তাকে সবসময়ে রক্ষা করে চলেছেন। শুধু সেদিন পট্টমহাদেবী মল্লিকার গৃহে ভোজনশালায় বন্ধুল-পত্নী মল্লিকা সুমনাকে বললেন—দেবি, আমার স্বামী বলছিলেন আপনি এবং কন্যা বিশাখা উভয়েই কোনও গুপ্ত হস্তিবিদ্যা জানেন। পূর্বজদের অনেক গোপন বিদ্যাই আজকাল চর্চার অভাবে লুপ্ত হতে বসেছে তো!
সুমনা হেসে বললেন— আপনার স্বামী ঠিকই বলেছেন আয়ুষ্মতি। এই বিদ্যা আটবিকদের। আমি অল্প বয়সে আমার আচার্যা কুশাবতী মল্লর কাছ থেকে শিখেছিলাম। তার কথা হয়ত আপনি স্বামীর কাছ থেকে শুনে থাকবেন। তিনি শিখেছিলেন তাঁর বন্য আচার্যর কাছ থেকে। এই জম্বুদ্বীপের মহাবনে একসময়ে আটবিকরা হস্তীর পিঠে দুর্দম, দুর্নিবার ছিল। বিশাখার পিতা উদ্বিগ্ন হলেও আমি তাই নিশ্চিন্তই ছিলাম। তবে এ কথা মানতেই হবে মহারাজের এরূপ ইচ্ছা হওয়াটা বিপজ্জনক।
বন্ধুল-পত্নী শান্ত গর্বের সঙ্গে বললেন— আমার স্বামী যতদিন আছেন, ভয়ের কারণ নেই। তবে সত্যিই, মহারাজের স্বভাবের শংসা করা যায় না।
প্রকৃত কথা, মহারাজ পসেনদি অতিশয় কৌতূহলী স্বভাবের মানুষ। শ্ৰমণ গৌতম যখন প্রথম শ্রাবস্তীতে আসেন, শ্রেষ্ঠীদের কাছ থেকে তার বৃত্তান্ত শুনে মহারাজ পসেনদিও ছুটে গিয়েছিলেন। জেতবনের সভায় প্রবেশ করেই তাঁর প্রথম কাজ হল হন্তদন্ত হয়ে শ্রমণ গৌতমকে প্রশ্ন করা—ভন্তে, আপনি নাকি বুদ্ধ!
গৌতম নীরবে ছিলেন।
—আপনার বোধিজ্ঞান লাভ হয়ে গেছে?
—বোধিজ্ঞান যাঁর আয়ত্ত হয়েছে তাঁকেই তো বুদ্ধ বলে মহারাজ!
—আপনার শরীর থেকে অবশ্য প্রভা বেরোচ্ছে। কিন্তু তা আপনার তপ্তকাঞ্চন দেহবর্ণের জন্যও মনে হতে পারে। আপনার আকৃতিও সম্ভ্রম উৎপাদক। কিন্তু সাক্করা স্বভাবতই হেমবর্ণ ও সুগঠন। আপনি সম্ভ্রান্ত সাক্কবংশীয়, রূপগরিমা থাকা কিছু অসম্ভব নয়।
গৌতম কিছুই বললেন না। প্রসেনজিৎ তাঁকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।
—আচ্ছা ভন্তে, বড় বড় ব্রাহ্মণরা তো আপনাকে ব্যঙ্গ করেন। সমন গোতম বলেন মাত্র, বুদ্ধ বলেন না।
—গোতম মগ্গ স্বীকৃত হলে যাগযজ্ঞ হবে না, তাদের জীবিকার ক্ষতি হবে মহারাজ!
—তবে তীর্থিকরা! তারা তো যাগযজ্ঞ মানেন না। কিন্তু তীর্থিক-নির্গ্ৰন্থরাও তো আপনাকে মানতে চাইছেন না।
—বুদ্ধ মগ্গ স্বীকৃত হলে, তাঁদেরও ভিক্ষাহানি, শিষ্যহানি, প্রভুত্বহানি হবে মহারাজ।
এতেও নিরস্ত হননি প্রসেনজিৎ। বলেন—কিন্তু আপনি তো তেমন বয়স্থ নন? কত পক্ককেশ, জ্ঞানবৃদ্ধ তীর্থঙ্করকে জিজ্ঞাসা করেছি বোধিলাভ হয়েছে কি না, কাউকে তো বলতে শুনিনি—হ্যাঁ। অথচ আপনি অবলীলায় বলে দিলেন হয়েছে?
—মহারাজ, বিষধর সল্প খুদ্দ হলেই কি তাকে হেলা করেন?
—না ভস্তে।
—কিংবা অগ্গি!
—না না, ক্ষুদ্রকায় অগ্নি যে কখন মহাকায় হয়ে সব গ্রাস করবে কিছু বলা যায় না।
—আর রাজপুত্ত? শিশু হলেই কি তাকে সাধারণ শিশুর মতো দেখা সঙ্গত!
—কখনই না ভন্তে। রাজশিশুকে রাজমর্যাদাই দিতে হয়। নইলে ভবিষ্যতে বিপদ।
—বুদ্ধও সেইরূপ মহারাজ। বয়স দিয়ে তার জ্ঞানের পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
কোনও জনশ্রুতি প্রসেনজিতের কানে গেলেই হল। তিনি অমনি তার পরীক্ষা করে দেখতে ছুটবেন। অলৌকিক, ইন্দ্রজাল এসব বলে কেউ তাঁর কাছ থেকে পার পাবে না।
একদিন নিয়মিত দেশনার পর তথাগত তার গন্ধকুটিতে বিশ্রাম করছেন। প্রসেনজিৎ উপস্থিত হলেন। রক্ষী অনুচর এদের তিনি এমনিই গ্রাহ্য করেন না। এখন তথাগতর কাছে আসছেন, আরোই একা। তিনি এসেছেন সংবাদ পেয়ে গৌতমকে দ্বার মুক্ত করতে হল। গন্ধকুটিটি উৎকৃষ্ট চন্দনকাঠে নির্মিত। মৃদু চন্দনের সুরভিতে মন-প্রাণ স্নিগ্ধ হয়ে যায় একটু বসলে। ভগবান তথাগত সুগন্ধ ভালোবাসেন বলে শ্রেষ্ঠী সুদত্ত এভাবেই তাঁর বিশ্রামকুটি প্রস্তুত করেছেন।
মুখোমুখি বসে আছেন দুজনে। এই কক্ষের মধ্যে, আসন্ন রাত্রির স্তব্ধতায়, প্রদীপের মৃদু আলোয় সহসা মুখে কথা আসে না। কিন্তু প্রসেনজিৎ কয়েক মুহূর্ত পরেই কথা বললেন—ভন্তে আপনি যদি বুদ্ধ হন তা হলে আপনি নিশ্চয়ই ইদ্ধিমান!
গৌতম স্তব্ধ হয়ে রইলেন।
—ভন্তে, কিছুক্ষণ পর প্রসেনজিৎ আবার বললেন— জনশ্রুতি শুনেছি বুদ্ধরা ইচ্ছা করলেই নানাপ্রকার অদ্ভুত প্রদর্শন করতে পারেন।
বুদ্ধ ধীর কণ্ঠে বললেন—অদ্ভুত প্রদর্শন করা জাদুকরের কাজ মহারাজ।
—বুদ্ধরা তো জাদুর রাজা হয়ে থাকেন।
গৌতম বললেন— আপনি অতীতে কজন বুদ্ধ দেখেছেন, মহারাজ?
—একজনও না ভন্তে!
—বর্তমানে?
—‘একজন দেখেছি’— এ কথা বলবেন কিনা ইতস্তত করছেন প্রসেনজিৎ, সহসা সামনে তাকিয়ে দেখলেন বেদী শূন্য। গৌতম নেই। প্রদীপের শিখাটি নিষ্কম্প জ্বলছে।
—এ কী! ধ্যানাসনে বসে ছিলেন ভগবান, কোথায় গেলেন? প্রসেনজিৎ ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন মূল বেদীর বাঁ পাশে শূন্যে বসে আছেন বুদ্ধ, তেমনি জোড়াসন, তেমনি নিমীলনেত্র, স্তিমিতভঙ্গি। ওকি! দক্ষিণ দিকেও তো বুদ্ধ! প্রসেনজিৎ গন্ধকুটির যেদিকেই চান বুদ্ধ তথাগতকে দেখতে পান।
—ভগবন, আপনি কি সহস্রধা হয়েছেন? ভগবন, ভগবন। আপনি কোথায়? কোনটি সত্য সত্য আপনি? —প্রসেনজিৎ যেন জ্বরের ঘোরে শিশুর মতো বলতে লাগলেন। বলতে বলতে এক সময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি।
এই অবস্থাতেই তাঁকে আবিষ্কার করলেন শ্ৰমণ আনন্দ। আনন্দর মৃদু পদশব্দে চকিত হয়ে তাকালেন প্রসেনজিৎ। বললেন—আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম শ্রমণ আনন্দ! ভগবন, আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম?
বুদ্ধ বেদীতে বসে আছেন। উত্তর দিলেন না।
—কী স্বপ্ন দেখেছেন মহারাজ! —আনন্দ জিজ্ঞেস করলেন।
ভগবান তথাগত বুদ্ধকে…
—স্বপ্ন দেখবেন কেন? তথাগত তো আপনার সামনেই উপবিষ্ট?
প্রসেনজিৎ বললেন— না। দেখলাম চতুর্দিকে ভগবান। দাহিনে, বামে, এই গন্ধকুটির সমস্ত প্রাচীর-প্রকোষ্ঠে, ছাদে, শুন্যে সর্বত্র রাশি রাশি ভগবান। বুঝেছি, বুঝেছি…পসেনদির জন্য ভগবান সহস্র হলেন…বলতে বলতে রাজা উঠে দাঁড়ালেন। বিমূঢ় চিন্তামগ্ন অবস্থায় টলতে টলতে বেরিয়ে গেলেন। তথাগতকে অভিনন্দন জানাতে পর্যন্ত মনে রইল না।
আনন্দ বললেন—ভন্তে, আপনি কি সত্য সত্যই মহারাজ পসেনদিকে সহস্রবুদ্ধ দেখালেন? সত্য?
—কী সচ্চ আনন্দ? একমাত্র সচ্চ দুক্খচক্র। আপনার কর্মস্থানটি চিন্তা করো। প্রথমে পূর্বনির্বাসজ্ঞান, —পূর্বজন্মের চিত্রসকল তখন দর্পণের ছায়ার মতো দেখতে পাবে। তারপর চ্যুতোৎপত্তি—জন্ম-মৃত্যুর সকল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে। তারপর আশ্রবক্ষয়—সর্বপ্রকার তণহা থেকে মুক্তি পাবে। তখন, একমাত্র তখনই বোঝা সম্ভব সচ্চ কী!
আনন্দ প্রণত হয়ে বললেন—শুনেছি আপনি স্থবির নন্দকে অপ্সরী দেখিয়েছিলেন। অগ্রশ্রাবিকা ক্ষেমাকে অপ্সরীতুল্য রমণীর তারুণ্য, যৌবন, প্রৌঢ়তা, জরা, মৃত্যু, এ সকল দেখিয়েছিলেন। আজ কি পসেনদিকে সহস্রবুদ্ধ দেখালেন? হে ভন্তে, আপনি আনন্দর সঙ্গে রহস্য করবেন না। একবার বলুন…
বুদ্ধ বললেন— আনন্দ! অপ্সরীই কি তবে তোমার কর্মস্থান? তুমি কি সুন্দরী রমণী দেখবার জন্যই তথাগতর কাছে ঘুরঘুর করছ? তথাগতর শ্রাবিকা ও উপাসিকাদের মধ্যেও বহু সুন্দরী আছেন…
আনন্দ বললেন— আনন্দ এ তিরস্কারের যোগ্য নয় এ কথা তথাগত জানেন। আনন্দ ইদ্ধির কথা জানতে চায়। তথাগত মহারাজ পসেনদিকে ইদ্ধি দেখালেন সহস্ৰধা হয়ে, অথচ ভিক্ষুণী কিসা গোতমী যখন মৃত পুত্ত কোলে নিয়ে তথাগতর কাছে পুত্তর প্রাণভিক্ষা করে কাঁদছিলেন তখন তিনি সেই জননীকে অশোক সর্ষপমুষ্টির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরালেন। —কেন? আনন্দ বোঝে না। কোনটি পক্ষপাত তা-ও আনন্দ জানে না।
বুদ্ধ বললেন— আনন্দ আমি কি তোমাকে কপিলবস্তুতে বলেছিলাম— আনন্দ আনন্দ, আমি তোমাকে নানাপ্রকার ইদ্ধি দেখাবো, অন্যদের যা যা দেখিয়েছি এবং যা যা দেখাবো সে সকলও তোমাকে বলবো, এসো আমার হাত থেকে পিণ্ডপাত্র, চীবর নাও, বলেছিলাম এরূপ?
ম্রিয়মাণ আনন্দ বললেন— না, তা অবশ্য বলেননি ভন্তে।
তখন বুদ্ধ স্নেহনিষিক্ত কণ্ঠে বললেন— সহস্ৰ ইদ্ধি দেখলেও পসেনদি পমুখের বোধিচিত্ত জাগে না। হৃদয়ের ভেতরে যা অভিপ্পায় বাইরেও তাকেই প্রতিফলিত দেখে। অথচ আনন্দপমুখ ইদ্ধি নয়, ইষ্ট নয়, শুধুমাত্র ভিক্ষুবেশী তথাগতকে দর্শন করেই সোতাপন্ন হয়। ইদ্ধির দ্বারা কোনও ফল লাভ হয় না আনন্দ। করুণা ও মৈত্রীভাবনার দ্বারাই পৃথিবীর মনুষ্যবাহিত দুখগুলির নিরসন করা সম্ভব।
৩
যশ ও নন্দিয় ভাসতে ভাসতে যেখানে এসে ঠেকল সেটি অমাত্য শ্রীভদ্রর অতিথিশালা। কোশলরাজ্যের অমাত্যরা কাল, জুহ্ন উগ্র, মৃগধর—এঁরা সকলেই অতিশয় ধনী ও ক্ষমতাশালী। পথে ভ্রমণ করতে করতেই এঁদের কারও কারও নাম শুনেছিল তারা। এ-ও শুনতে পাচ্ছিল, রাজা পসেনদি এঁদের কথায় ওঠেন, বসেন।
একটি কাননের মধ্যে একতলা চূনমের প্রলেপ দেওয়া গৃহটি দেখে ওরা দাঁড়াল।
—মহামাচ্চ সিরিভদ্দর অতিথিশাল—দ্বারিক হেঁকে বলল। লোকটির মাথায় মিশমিশে কালো চুল। পরনে পাংশু বর্ণের বসন। নগ্ন গা। পেশীগুলি ফুলে ফুলে রয়েছে।
—কত দিন থাকতে দেবে এখানে?
—তিন দিবস স্বচ্ছন্দে। সাত দিবস পর্যন্ত চলতে পারে— দ্বারিক অহংকারী কণ্ঠে বলল।
—তারপর?
—অর্ধচন্দ্র। দ্বারিক হাতের ইঙ্গিতে দেখায়।
—কেন হে বাপা! যদি ততদিনেও কোনও কর্মসংস্থান না হয়, কুলপুত্ত যাবে কোথায়?
—কর্মসংস্থান? সাবত্থিতে? দ্বারিকের চোখে ব্যঙ্গ— কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
—বেসালি।
—কোথায় বেসালি আর কোথায় সাবত্থি? লোকটি ওষ্ঠাধরের একটি অদ্ভুত ভঙ্গি করল।
অর্থাৎ বেসালির লোকেরা সাবত্থিকে অবজ্ঞা করে। সাবত্থির লোকেরা বেসালিকে। নিজের নিজের নগর নিয়ে দম্ভের শেষ নেই।
এই সময়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল আরেকটি লোক। এর বক্ষে উপবীত, স্নান করা চুলগুলি কানের দু পাশে লটপট করছে। উত্তরীয় দু পাট করে কাঁধের ওপর ফেলা। বয়স হয়েছে। লোকটি বলল— আহা গর্গ, অতিথিকে ভেতরে আসতেই দাও না। সব ওই সুদত্তর ওখানে চলে যাক তাই চাও নাকি?
দুই বন্ধু হৃষ্ট হয়ে ভেতরে ঢুকল, লোকটি সঙ্গে সঙ্গে চলল, নিজের থেকেই বলল- আমিই এই অতিথিশালার অধ্যক্ষ। তা তোমাদের কী কাজ জানা আছে? মন্ত্র পড়া, মালা গড়া, বিক্রিবাটা, মুল্ল স্থির করা, বাদ্য বাজানো, পেশী দেখানো, জ্যোতিষ-বিদ্যা, সম্মোহন, উল্লম্ফন, তরোয়াল চেনা … কোনটা? ধনুর্গ্রহ যে নয় সে তো দেখেই বুঝতে পারছি।
—ধরুন যদি কোনটাই না জানা থাকে?
—তা হলে তো জেতবনে সাক্কপুত্তীয় সমনদের সঙ্গে গিয়ে জুটতে হয়— লোকটির কণ্ঠস্বরে যেন ক্রোধ।
—সেখানে বুঝি গেলেই কম্ম হয়?
—হয় বলেই তো শুনেছি!
—কম্মটা কী?
—কম্ম আর কী, দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভুক্তাবশেষ ভিক্ষা করা, পরিত্যক্ত ছিন্ন বসন সিলিয়ে পরা, আর লোক পেলেই বলা যাগ-যজ্ঞ কিছু না, ব্রাহ্মণ পুরোহিত সব ভণ্ড। পশুবলি পাপকম্ম।
—তা এ কথা তো তীর্থিকরাও বলে থাকেন! সাক্কপুত্তীয়রা তো একা বলছেন না!
—আহা, তীর্থিকরা নিজেদের মধ্যে আছে। অত খেয়ো না, করো না, বলে বলে বিহার করে না। আর এঁরা এলেন সব সেট্ঠি ভাঙাতে, বড় বড় সেট্ঠিরাই যদি সব বুদ্ধ বুদ্ধ করে পাগল হয়ে গেল তো যাগ-যজ্ঞের ব্যয় দেবে কে? সেট্ঠি সুদত্ত, সেট্ঠি মিগার সব তো ওই বুদ্ধর পক্ষে।
—আপনি কী পুরোহিত? আপনার এত ক্রোধ কেন?
—এ সকল কি ভালো? শিষ্টরা যা যা আচার পালন করেন, আমরাও সেরূপ করলে স্বর্গলাভ করবো, পূর্বোপেতরা জল পাবেন। তা না এ সব কী? মহামাচ্চ সিরিভদ্দ সর্বচতুষ্ক যাগটির ব্যবস্থা করে এনেছিলেন, তা সে সব তো ইনি পণ্ড করে দিলেন।
—কী ব্যাপার? বিশদ বলুন তো!
মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে অধ্যক্ষের উৎসাহ বেড়ে গেল। সে যশ ও নন্দিয়কে একটি কক্ষ খুলে দিয়ে বসতে আজ্ঞা দিল। তারপর নিজেও কিলিঞ্জকের প্রান্তে বসে বলল— মহারাজ পসেনদি তো কুস্বপন দেখলেন! ভীষণ সব শব্দ। একেবারে প্রেতলোক থেকে আসছে। আমার প্রভু বড় বড় জ্যোতিষী দিয়ে গণনা করিয়ে বললেন— মহা বিপদ, শীঘ্র সর্বচতুষ্ক যজ্ঞের আয়োজন করতে হবে। সব কিছু চারটি চারটি করে বলি পড়বে। চারটি ছাগ, চারটি গাভী, চারটি অশ্ব, চারটি কপোত, চারটি ময়ূর—এই ভাবে সবই চারটি চারটি। এত পশু-পাখি সংগ্রহ হয়েছিল যে কী বলব! রাজপ্রাসাদের কাননটি তো অরণ্য বলে মনে হচ্ছিল! নগর মধ্যে বিশাল যজ্ঞস্থল নির্মিত হচ্ছিল, কী সমারোহ! চারদিক থেকে বড় বড় বেদবিৎ পণ্ডিতেরা আসছেন, নিমন্ত্রিত হয়ে আসছেন মহা মহা লোক সব। এমন সময়ে কে কানে মন্ত্র দিল কে জানে, মহারাজ ছুটলেন জেতবন। বুদ্ধ অমনি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে দিলেন। গুরুভোজনের ফলে মহারাজের উদরদেশ গরম হয়ে গেছে। যজ্ঞের নাকি প্রয়োজন নেই। বলি পাপ। পশুগুলিকে সব মুক্ত করে দেওয়া হল।
যশ ও নন্দিয় হাঁ করে শুনছিল।
অধ্যক্ষ বললেন—নগরে ইতরজন সারা বৎসর এই যজ্ঞগুলির দিকে চেয়ে বসে থাকে। কত প্রকারের কাজ, কত ভোজ্য, মাংস নিয়ে তো নয় ছয়। মাংস খেয়ে বাঁচি সব। তা এই দুম্মুখ সব বন্ধ করে দিলে। আচ্ছা আমি চললাম। স্নানাদি করে নিয়ে ভোজনাগারে গেলেই অন্ন পাবে … লোকটি চলে গেল।
ঘরটির এক প্রান্তে একটি মৃৎকলস, তার ওপর জলপাত্র। যে কিলিঞ্জকটিতে ওরা বসে রয়েছে সেটি বড় জীর্ণ। বাতায়ন অনেক উঁচুতে।
দুই বন্ধু সবাগ্রে জল পান করল। যশ হাসতে হাসতে বলল সর্বচতুষ্ক যজ্ঞটি ঘটলে, এতক্ষণে আমরাও তার সুফল কিছু কিছু পাচ্ছি, বলো? এরা অতিথশালায় কি আর মাংস-ভক্ত দেবে?
নন্দিয় বলল—তোমার মতো মাংসলোলুপ তীর্থিক আমি পূর্বে আর দেখিনি যশ।
যশ বলল— সাবধান, আমরা আর তীর্থিক নই।
—কিন্তু যশ আমরা তবে কী? কীভাবে আমাদের পরিচয় স্থির হবে?
—কী বৃত্তি পাওয়া যায় দেখা যাক, তারই ওপর নির্ভর করবে সেটা।
—কিন্তু দেখো যশ, হীনজাতি ছাড়া আর সবার একটি করে উপবীত থাকে। আমাদের কি তা আছে?
যশ বলল— আমার তো একটি উপনয়ন হয়েছিল। উদিত-গামে বণিক গেহে জন্মেছি। পিতার তখন অসুখ। মাতা গুরুগৃহে পাঠাতে চাইছিলেন না। গামে একজন পণ্ডিত-ব্যক্তি ছিলেন। যাগ-যজ্ঞ তিনিই সব করতেন। কয়েকটি ব্রহ্মচারী ছিল, আমিও তাদের দলে প্রবেশ করলাম। তারপর তো পিতা মারা গেলেন, মাতা মারা গেলেন। মহাত্মা কাস্সপের সঙ্গে দেখা হল। উপবীত ফেলে দিয়েছি কবে! তুমি?
নন্দিয় বলল— ভাই যশ! দীর্ঘদিন তীর্থিক ছিলে, তোমার উচ্চ-নীচ সংস্কার গেছে আশা করি, কী! তাই তো!
যশ বলল— হ্যাঁ হ্যাঁ, ও-সকল কত অসার পনেরো বৎসর ভ্রমণ করতে করতে বুঝেছি। কী বলবে, বলো।
নন্দিয় মৃদুস্বরে বলল— রাজগহের নিকটবর্তী নালন্দা গামে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পরিবারে দাস ছিলেন আমার পিতা। সে গেহের অতি বিদ্বান পুত্ত গৃহত্যাগ করতে গৃহিণী মহা বিলাপ করতেন, সর্বক্ষণ আমার পিতাকেই দোষ দিতেন। পিতাই ওই পুত্তকে মানুষ করেছিলেন তো? শেষে পিতা একদিন বিরক্ত হয়ে বললেন— নন্দিয় এই তো অবস্থা, তুইও যা, পালিয়ে যা। কয়েকজন তীর্থিক এসে রয়েছেন। ওই ওঁদের কাছে চলে যা, আমি তখন বালক, কত উৎসাহ নতুন নতুন দেশ দেখব বলে চলে গেলাম। —একটু থেমে নন্দিয় বলল— অর্থাৎ ভাই যশ, আমার উপবীত নাই, জাতি নাই, পরিচয় বলে কিছু নাই। তবু যদি কোনও পরিচয় চাও বলতে হয় আমি দাসপুত্ত। শূদ্রই হবো!
যশ বলল—ভালোই হল, আমরা নিজেরাই ইচ্ছেমতো জাতি স্থির করে নেবো।
নন্দিয় বলল— কিন্তু উপবীত তো চাই! ধারণ করতে মন্ত্র-তন্ত্র?
যশ হা-হা করে হেসে উঠল— মন্ত্র? মন্ত্র-তন্ত্র যে সব মিছে, শুনতে সুন্দর, কিন্তু প্রবঞ্চনার কৌশল এ কথা কি তীর্থিকদের কাছে শেখোনি? শোনো। আমরা হট্টে যাবো, দু গোছা উপবীত কিনব, তারপর এই কক্ষের নিভৃতে বসে নন্দিয়ায় নমঃ যশসে নমঃ বলে পরে ফেলব।
নন্দিয় বলল—তা হলে স্নানে যাবার পূর্বেই কাজটা করতে হয়। চলো। আচ্ছা যশ, আমাদের গোত্র কী হবে?
—পনেরো বৎসর পূর্বে কী গোত্র ছিল আমার? —যশ ভাবতে লাগল—ক্ষণেক দাঁড়াও চিন্তা করে নেই। ভরদ্বাজ, বোধ হয় ভরদ্বাজ, না কি বসিষ্ঠ? এহে একেবারে বিস্মরণ হয়ে গেছে ভাই।
নন্দিয় বলল— এক কাজ করলে হয় না—সেই যে গান্ধার যুবক যার সঙ্গে ভদ্রঙ্করে দেখা হয়েছিল সে নিজেকে কী যেন বলত! দৈব … শৈব … দৈব না শৈব
যশ বলল—না না, কাত্যায়ন বলত বোধ হয়।
—তা হলে কাত্যায়ন নন্দিয়, কাত্যায়ন নন্দিয়। কেমন শোনাচ্ছে যশ?
যশ বলল—চমৎকার! ঠিক যেন সত্যি। কিন্তু ভারদ্বাজ যশ বা বাসিষ্ঠ যশ এগুলি অর্ধসত্য হলেও কেমন মিথ্যে-মিথ্যে শোনাচ্ছে। কী করি বলো তো?
নন্দিয় উৎসাহের সঙ্গে বলল— তুমিও কাত্যায়ন হয়ে যাও না ভাই!
কাত্যায়ন যশ—দিব্য শোনাচ্ছে। … কিন্তু যশ এটা প্রতারণা নয় তো!
যশ একটু চিন্তা করে বলল— এই যে গৌতম, ভরদ্বাজ, বসিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, কশ্যপ ইত্যাদি ঋষিদের নামে আমরা বংশপরিচয় দিই, কত কত কাল পূর্বে এঁরা জীবিত ছিলেন বলো তো? এঁদের বংশধারা এতকাল অবিমিশ্র বয়ে এসেছে এ ধারণা করা কি ঠিক? এঁদের যজমানরাও তো এঁদের নাম নিতেন। তাদের বংশই কি সব অমিশ্র? আমার তো মনে হয় না। দেখো নন্দিয়, তুমি বল তুমি শূদ্র, তুমি দাস অথচ তোমার আকৃতিতে কোনও দাস-লক্ষণই নেই। তুমি অনজ্জদের মতো নতনাসিক নও। বর্ণটিও দিব্য উজ্জ্বল। অথচ আমি দেখো বণিক পুত্ত, এক সময়ে উপনয়নও হয়েছিল, কিন্তু আমি কেমন সিংহভ্রূ, এদিকে তাম্রবর্ণ। আজ আমরা কাত্যায়ন গোত্র অবলম্বন করলে বহু পূর্বে মৃত ওই ঋষির কোনও ক্ষতি হবে না। আর যদি মনে করো এতে ইতিবৃত্তর ক্ষতি হল, তা হলে সে ক্ষতি আমাদের আগেই কারও না কারও দ্বারা সাধিত হয়েছে।
নন্দিয় বলল, কিন্তু আমরা তো স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরূপ করছি!
—স্বার্থসিদ্ধি কেন বলবে? কার্যসিদ্ধি বলো—যশ আপত্তি করে উঠল, তা-ও দেখো কোনও নির্দিষ্ট কার্যসিদ্ধির জন্য আমরা এরূপ করছি না। জীবনটিতে সৌষ্ঠব আনবার জন্য, এই সমাজের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম পালন করবার সদিচ্ছা নিয়েই আমরা এরূপ করছি। না করলে সমাজের বাইরে হয় হীনকর্ম করা, নয় দস্যু চোর এইসব হয়ে থাকতে হয়। তাই নয়!
নন্দিয় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
যশ বলল—যখন তুমি চরকর্মহীন এবং তা করবে না বলে সেনাপতি সীহর কাছে ঘৃণাপ্রকাশ করেছিলে, তখনই আমার মনে হয় তুমি অতিমাত্রায় বিবেকী। শোনো নন্দিয়, এ ভাবে বিচার করে করে জীবনধারণ করা যায় না। বড় বড় ব্যাপারে সত্যাশ্রয়ী হলেই হল, এ সব তুচ্ছ ব্যাপারে চুলচেরা বিশ্লেষণ করো না। আচ্ছা, এ ভাবেও তো ভাবতে পারো, সেই গৌরবর্ণ মহিমময় আকৃতির গান্ধার পণ্ডিত যার গোত্র-নাম কাত্যায়ন সে-ই আমাদের আচার্য। বস্তুত সেই-ই তো আমাদের এই নতুন জীবনযাপনের পাঠ দিয়েছে, সুতরাং তার নাম আমরা নিতেই পারি।
এতক্ষণে নন্দিয়র মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল—অবশ্যই। অবশ্যই। আমরা কাত্যায়ন যশ ও কাত্যায়ন নন্দিয়।
শ্রীভদ্রর অতিথিশালায় তৃতীয় দিন সকালের দিকে দুই বন্ধু একটু বিপদে পড়ে গেল। মহামাচ্চ স্বয়ং অতিথিশালা পরিদর্শন করতে এলেন। অতিশয় তীক্ষ্ণাবয়ব এক বয়স্থ ব্রাহ্মণ এই শ্রীভদ্র বা সিরিভদ্দ। মুখটি দীর্ঘ। তাতে যেন খোদিত রয়েছে দীর্ঘ নাসিকা। কোটরাগত দীপ্ত দীর্ঘ চক্ষু, কপালে তিনটি ভ্রূকুটি রেখা। বাহুর চর্ম কিঞ্চিৎ শিথিল হয়েছে, তাতে সোনার অঙ্গদ। গুচ্ছবদ্ধ শ্বেত উপবীত।
কক্ষগুলি ঘুরে দেখতে দেখতে তিনি অধ্যক্ষকে র্ভৎসনা করছিলেন। এ কক্ষটি পরিষ্কৃত হয়নি কেন? ও কক্ষে কিলিঞ্জক অত জীর্ণ কেন? মৃৎ কলসটি ফেটে কোথায় যেন জল পড়ছে। পাকশালায় অত ধুম। ভোজনশালায় উচ্ছিষ্ট। কুক্কুরাদি পাকশালার পেছনে মহা গোল জুড়েছে।
চকিতে পেছনে ফিরে অধ্যক্ষের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন— এরূপ করলে তো অতিথিরা সব সুদত্তর ওখানে গিয়ে উঠবে!
ক্রুদ্ধ মূর্তি, চোখ ঝলসে উঠছে, অথচ আকৃতি কেমন সৌম্য। দেখে যশ ও নন্দিয় সহসা শিহরিত হল। তারা নিজেদের কক্ষে ছিল। প্রত্যূষে স্নান হয়ে গেছে, একবার কাছাকাছি ঘুরেও এসেছে। এখন, ভোজনের পূর্বে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তাদের কক্ষের সামনেই একটি চত্বাল। সেখানে দাঁড়িয়েই মহামাচ্চ সিরিভদ্র তাঁর ক্রোধ প্রকাশ করছিলেন।
সহসা তাদের দিকে তর্জনী তুলে সিরিভদ্দ বলে উঠলেন—এই অতিথিরা তো দেখছি ব্রাহ্মণ! কী, ব্রাহ্মণ তো!
যশ তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে দিল। প্রকৃত কথা, ভয়ে তার তালু শুকিয়ে গিয়েছিল। সে বহু দেশ ঘুরেছে, বহু মানুষ দেখেছে, উচ্চপদস্থ রাজপুরুষদের, ধনী গৃহপতি, মহা মহা পণ্ডিত—এঁদের সঙ্গে মুখোমুখি কথাবার্তা না বললেও অত্যন্ত কাছ থেকে এঁদের দেখেছে। এই তো কিছুকাল আগেই বেসালির সেনাপতি সীহর সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করে এসেছে। ভয় পায়নি। কিন্তু এই অমাত্যর মধ্যে এমন একটা ভয়াল ব্যক্তিত্ব যার সামনে পড়ে তার মনে হচ্ছিল এক ব্যাঘ্রের সামনে সে যেন শশক।
নন্দিয় কিন্তু নিজেকে স্থির রেখেছিল। সে বলল—কেন, ব্রাহ্মণ হলে কি কর্মের কিছু সুবিধা হতে পারে?
শ্রীভদ্র ক্রূর চোখে তার দিকে তাকালেন, বললেন—কত দূর থেকে আসা হচ্ছে!
—সম্প্রতি বেসালি…
—তার পূর্বে?
—রাজগহ, উরুবেলা, চম্পা…
“>—বহু ভ্রমণে বহু অভিজ্ঞতা হয়, অনেক প্রকার চাতুর্যও আয়ত্ত হয়। আমার কর্মকর হবে?
“>—কী করতে হবে আর্য?
—বিশেষ কিছু না। যখন যেমন বলব। এই নগরীতে ঘুরে-ফিরে বেড়াবে। উত্তম লোকে যা বলে শুনবে, অধমে যা বলে তা-ও শুনবে। তার নির্যাস আমার কাছে নিবেদন করবে। ধরো এই সাত দিবস পর পর। পরিবর্তে প্রতিবার একপ্রস্থ পরিধেয়, দশটি কহাপন পাবে। আমার বাসগৃহের সংলগ্ন সমাশালয় আছে, সেখানেই হোক, এখানেই হোক দ্বিপ্রহরে, সাংয়কালে ভোজন করবে। যাউ, অন্ন, মচ্ছ, মাংস, শাক, অম্বিল, দধি। এখানেই কক্ষ নিযুক্ত করে দিচ্ছি। উত্তম শয্যায় শয়ন করবে, এই অধ্যক্ষকে বলে দিচ্ছি সেবার যেন কোনও ত্রুটি না হয়।
যশ বলল—সম্মত।
—নাম পরিচয় দাও।
নন্দিয় বলল—আমি কাত্যায়ন নন্দিয়, আর উনি কাত্যায়ন যশ।
শ্রীভদ্রর চোখে একটি কুটিল ভাব দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
বললেন—এক গোত্র, সহোদর নাকি?
—তা নয় আর্য, কাত্যায়ন আমাদের আচার্য।
—ভালো ভালো, পিতৃনাম আর ইদানীং কেউ গ্রাহ্য করছে না। আচার্যই সব, জন্মদাতা কেউ নয়…ভালো…বলতে বলতে শ্রীভদ্র চলে গেলেন। নন্দিয় মহাদুঃখিত হয়ে বলল—যশ, যশ সবাই আমাদের চরকর্ম দিতে চায় কেন? আমরা কি পাপকর্মা, নীচাশয়ের মতো দেখতে?
যশও চিন্তিত। কিন্তু সে নন্দিয়কে সান্ত্বনা দিয়ে বলল—না নন্দিয়, এটা তুমি সঠিক বোঝনি। চরকর্ম করতে হলে পাপকর্মার মতো দেখতে হলে চলে না। কারও চোখে পড়বে না এমন সাধারণ আকৃতির হলেই বোধ হয় সুবিধা হয়।
নন্দিয় ভাবিত চিত্তে বলল—তুমি হয়ত ঠিকই অনুমান করেছ যশ। প্রভুগৃহ ত্যাগ করবার পর এত নগরে গামে ঘুরেছি কেউ তো কোনওদিন বলেনি—নন্দিয় তুই এখানে? তোকে নালন্দায় দেখেছি না!…যশ আমরা এই শ্রীবিশালা সাবত্থি নগরে ঘুরব ফিরব, কিন্তু কেউ আমাদের দিকে চেয়েও দেখবে না। দেখলেও পরক্ষণে ভুলে যাবে। যশ, যশ, নাম আমরা সমারোহ করে নিলাম বটে, কিন্তু প্রকৃত কথা আমরা নামহীন, গোত্রহীন, আকৃতিহীন, অবয়বহীন ইতর-জন যারা শত প্রকার কাজ করে কিন্তু কোনও বিশেষ কাজ করে না। যারা মহানগরীর পথের ধূলিতে ধূলিকণা হয়ে বিরাজ করে, কেউ কোনওদিন তাদের মনে রাখে না।
দুজনেই কিছুক্ষণ বিষাদে অভিভূত হয়ে বসে রইল। তারপর যশ নিশ্বাস ফেলে বলল—নন্দিয় ওঠো, এ ভাবে বসে থেকে কোনও লাভ নেই। আমরা মহামাচ্চ সিরিভদ্দর কর্ম গ্রহণ করেছি। যেটুকু দায়িত্ব পেয়েছি, সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করব, আর আর…আমাদের আচার্যের কথা স্মরণ করব।
—আমাদের আচার্য? কে তিনি?
—ভুলে গেলে? যাঁর নাম আমরা নিয়েছি! কাত্যায়ন গান্ধারপুত্র! মনে আছে ভদ্রঙ্করের সেই সন্ধ্যায় তিনি কী বলেছিলেন! কোনও একজন মানুষের সামর্থ্যে এই সংসার এই সমাজ গড়ে ওঠেনি, লক্ষ লক্ষ নামহীন পরিচয়হীন মানুষ মিলে এই সমাজদেহ। প্রত্যেকের কর্মের মূল্য অসামান্য। এই অর্থে যে সামান্য সে-ও অসামান্য। তিনি আরও বলেছিলেন জন্ম যেমন ভবিতব্য, মৃত্যুও তেমনই ভবিতব্য। কিন্তু জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টুকু আমাদের নিজস্ব। তারও মধ্যে অর্ধেক পরিবার ও সমাজের জন্য প্রদত্ত। কিন্তু বাকি অর্ধেকটুকু দিয়ে আমরা যা ইচ্ছা করতে পারি। কোনও বিশেষ কর্ম সম্পাদন করা, বিশেষ মহৎ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য অবিরত চেষ্টা করে যাওয়া এ-ও জীবন, একেই তিনি উৎকৃষ্ট জীবন বলেছিলেন।
—এই উৎকৃষ্ট জীবনের জন্য আমরা সর্বদা উন্মুখ থাকব, কী বলো যশ? নন্দিয় গম্ভীর আগ্রহ ও সঙ্কল্পের সুরে বলল।
উৎকৃষ্ট জীবনের জন্য উৎকৃষ্ট কর্মের সন্ধানে নন্দিয় ও যশ শ্রাবস্তীর নগরে ঘুরে বেড়ায়, উত্তম-অধম ব্যক্তিদের কথা শোনে। গোধূম নামে একটি নতুন শস্য উঠেছে। যবের চেয়েও ভালো খেতে, পুরোড়াশ হয় নরম, বিশাখা মিগারমাতা তার কর্মান্তে গুড়যন্ত্র স্থাপিত করেছে, মগধ থেকে আগত সার্থবাহরা বলছে মগধ, বিশেষত রাজধানী রাজগহ ও সংলগ্ন স্থানগুলির ব্যবস্থা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সকল সংবাদ মহামাচ্চ সিরিভদ্দর কর্ণগোচর করায় তিনি আহ্লাদিত হয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। তাদের নাকি সঠিক সংবাদটি শোনবার কান আছে।
ভালো, অচিরেই ধনসঞ্চয় হবে কিছু দুই বন্ধুর। কিন্তু দুজনের মধ্যে আলোচনা হয়—এ কি উৎকৃষ্ট কর্ম? উৎকৃষ্ট জীবনের কি কোনও সন্ধান পাওয়া যাবে এর দ্বারা? কয়েক দিন শ্রাবস্তীর বিভিন্ন অঞ্চল দেখাশোনার পর তারা সেনাপতি সীহর কথা স্মরণ করে জেতবনে প্রবেশ করল।
তখন বেলা পড়ে আসছে। জেতবন বিহারের সম্ভ্রম- উৎপাদক দ্বারাকোষ্ঠক পেরিয়ে ওরা যাচ্ছে দেশনা-স্থলের দিকে। দেখল সামনে দুজন বয়স্থ পুরুষ যাচ্ছেন, প্রচুর সাজসজ্জা করা। অবলেপ্য ও সুগন্ধি যা মেখেছেন গন্ধটি মিশ্রিত এবং উগ্র লাগছে। দুজনেরই পায়ে কৃষ্ণসার-চর্মের পাদুকা। পুরুষ দুটি অভিজাত সন্দেহ নেই। তাদের মতো ইতরসাধারণ হয় নগ্নপদে থাকে। নয় কাষ্ঠপাদুকা পরে। চর্মপাদুকা পরার বিলাসিতা তো ধনশালী ও বিলাসী ব্যক্তি ছাড়া করা সম্ভব নয়।
একজন পুরুষ আরেক জনকে বললেন—সিরিভদ্দ এবং তার প্রশ্রয়ে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ বেড়ে উঠছে, কোসল রাজ্যটা যেন তাদেরই, সাবত্থি নগরটি যেন তাদের গৃহপ্রাঙ্গণ।
অন্য জন বললেন—সর্বচতুষ্ক যজ্ঞের জন্য নরবলির ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল এ জনশ্রুতি শুনেছেন সেট্ঠি!
—সত্য নাকি? আগে কাউকে বলতে শুনিনি তো!
—আমি সম্প্রতি চরমুখে সংবাদ পেলাম। গোপন সংবাদ। চারটির মধ্যে তিনটিই দরিদ্র বণিককুমার। আর একটি হীনজাতি। কী চায় বলুন তো এরা? ভয় প্রদর্শন করছে, না কী?
—হতে পারে। তবে প্রতদ্দন, ওদের তো রাজানুগ্রহের ধন। রাজা দিলেন তাই পোক্খরসাদি, তারুক্খ এরা বিশাল ধনবান গহপতি হয়ে গেল। মনসাকট এবং নিকটবর্তী গামকটির কস্সনের এক দশমাংশ এখন তারাই সংগ্রহ করছে। অনেক সময়ে বিবাহ বা যজ্ঞ উপলক্ষ্যে অতিরিক্ত করও চাপাচ্ছে। কন্যার বিয়েতে প্রজাদের কোনও মণ্ডলকে ঘৃত-ভার, কাউকে পশু-ভার, কাউকে কাষ্ঠ-ভার বহন করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝলেন তো? আবার শ্রম-ভারও আছে!
প্রথম পুরুষ বললেন—সেটঠি প্রতদ্দন, এরা যে এইভাবে রাজার ক্ষমতা খর্ব করে দিচ্ছে তা কি মহারাজ বোঝেন না?
—বুঝবেন না কেন সেট্ঠিবর, আপনার মনে নেই, মগধ থেকে সেট্ঠি ধনঞ্জয়কে এনে কোসলে বসত করালেন। সে কেন? ক্ষমতার সৌষম্য স্থির রাখতেই তো? সেই ধনঞ্জয়ের কন্যা বিসাখা এখন মিগারের পুত্তবধূ হয়ে শুধু সাবত্থির শ্রীই বাড়িয়েছে তাই-ই নয়, ধনসম্পদও প্রচুর বাড়িয়েছে। বিসাখার সম্ভবত নিজের কর্মান্ত হয়েছে। মিগার বলতে চায় না কিছু। কিন্তু ধনঞ্জয় সেট্ঠির উপার্জিত ধন অনেকটাই বিসাখার মাধ্যমে সাবত্থিতে আসছে। এখন বুঝুন না গহপতি সুনক্ষত্ত, আমাদের ধন উপার্জনের ধন। প্রথম যৌবনে নিজ হাতে বিক্রিবাটা করে উপার্জন করেছি। কত দূরদূরান্ত ভ্রমণ করেছি। এখন মাথার চুল পাকতে সার্থ পাঠাই। আমাদের ধন তো এমনি এমনি আসে না। আমাদের শ্রী কারও দানের ওপর নির্ভর করে নেই। সে কথা এই ব্রাহ্মণেরা বুঝতে চায় না। ঈর্ষায় ওদের গা জ্বলে যায়।
—কিন্তু সেট্ঠি প্রতদ্দন রাজা তো সমানে ওদের তালে তাল দিয়ে যাচ্ছেন।
সেট্ঠি সুনক্ষত্ত আমাদের পসেনদিকে যতটা নির্বোধ ভাবেন, তিনি আদৌ তা নন। ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা তো মহারাজ মহাকোসলেরও আগে থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। আজ পসেনদি তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেন কোন সাহসে! সব তেড়ে উঠবে না? সুকৌশলে উনি সেট্ঠিদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছেন, পুরোপুরি সফল হতে পারছেন না। এখন এই তথাগত বুদ্ধ ব্রাহ্মণবিরোধী। তীর্থিক, নিগ্গণ্ঠরাও তাই, কিন্তু ইনি যেন মৌচাকে লোষ্ট্রাঘাত করেছেন। এঁর লোকপ্রিয়তা, সম্মোহনক্ষমতা এ সব অলৌকিক। পসেনদি কী রূপ কৌশলে এই বুদ্ধকে দিয়ে পূরণ কাস্সপকে সরালেন, দেখলে না? শুনছি বহু ব্রাহ্মণ এঁর খ্যাতি শুনে বিতর্ক করতে এসেছেন। এঁদের নায়ক নাকি আশ্বলায়ন বলে এক মহাপণ্ডিত তরুণ। দেখা যাক আজ কী হয়। আমি বলছি, আমরা যদি রাজার উদ্দেশ্য বুঝে কাজ করি, আমাদের বৃদ্ধি ছাড়া ক্ষতি নেই।
শ্রেষ্ঠী দুজন মন্থর পদে চলছিলেন, মাঝে মাঝে উত্তেজনায় একটু থেমে গিয়ে কথা বলছিলেন। নন্দিয়, যশ ছাড়াও বহু লোক পাশ দিয়ে চলে গেল। তাঁরা শুধু স্বরটি মৃদু করা ছাড়া আর কিছুই করলেন না।
প্রতর্দন সুনক্ষত্রকে বললেন—এই তথাগত বুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ইনি কুশল কর্ম অকুশল কর্ম ব্যাখা করেন। যাগ-যজ্ঞাদি অকুশল কর্ম বলে পরিত্যাজ্য বলে দিয়েছেন! এখন আমাদের ধন-উপার্জনের উপায়গুলিকে কুশল কর্ম বলে চিহ্নিত করলেই আমরা নিশ্চিন্ত হই। সুদও কী ভাবে দান বাড়িয়ে দিয়েছে দেখেন না? মিগার যে মিগার সেই কৃপণও হাত খুলেছে। চলো দেখি পণ্ডিত আখলায়ন কী বলেন!
তাঁরা দ্রুত চলে গেলেন। নন্দিয়দের লক্ষই করলেন না। দেশনা-স্থলে পৌঁছে তারা এই শ্রেষ্ঠীদ্বয়ের পেছনে স্থান করে বসল।
প্রচুর জনসমাবেশ হয়েছে। যেন নিস্তরঙ্গ জলধি। মৃদু, অতিশয় মৃদু একটি গুঞ্জনধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সম্মুখের দিকে অম্ববৃক্ষে বুদ্ধের আসনটিকে মাঝখানে রেখে এক দিকে শ্ৰমণরা বসেছেন, আর এক দিকে শ্ৰমণারা এবং গৃহস্থ রমণীরা।
কেউ জিজ্ঞেস করল—তথাগত সাবত্থিতে রয়েছেন কতদিন?
—আজ রয়েছেন, কালই হয়ত চলে যাবেন। এ তো আর বস্সাবাস নয়। প্রত্যূষে হয়ত ভিক্ষার জন্য বেরোলেন আর ফিরলেন না।
দ্যাখ দ্যাখ ওই যে অগগ্সাবিকা খেমা আসছেন। রাজা বিম্বিসারের মহিষী ছিলেন।
যশ ও নন্দিয় উৎকর্ণ হয়ে উঠল। লোকগুলির তর্জনী অনুসরণ করে দেখল একজন দীর্ঘকায়া গৌরাঙ্গী শ্ৰমণা ধীর পদক্ষেপে আসছেন। বুদ্ধাসনের ডান দিকে গিয়ে ইনি বসলেন।
নন্দিয় বলল—দ্যাখো যশ, পুরুষ কি নারী বোঝা যায় না, কী সৌম্য সুন্দরী ইনি। অনেকটা আমাদের সেই কাত্যায়ন গান্ধারের মতো যেন গঠনসৌষ্ঠব।
পাশে একটি লোক বলল—শ্ৰমণাদের সুন্দরী সুন্দরী এরূপ বলে লোভ প্রকাশ করতে হয় না। এঁরা সবাইকার কু-দৃষ্টির অতীত। সংসার ত্যাগিনী!
নন্দিয় বলল—বাঃ, কু-দৃষ্টির কী দেখলেন আপনি! ধিক। সৌন্দর্য দেখলে প্রশংসা করব না! আপনারা সাবত্থিবাসীরা বুঝি নারীদের কু দৃষ্টি ছাড়া দ্যাখেন না!
লোকটি উত্তেজিত হয়ে কী বলতে যাচ্ছিল, তারও পাশে বসা লোকটি বলে উঠল—অ হে শঙ্খ, ইনি কে? পেছনে আসছেন?
—আরে উনিই তো ভদ্দা কুণ্ডলকেশা, কেশগুলি দেখে বুঝছ না, কেমন পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে! ইনি তো প্রথমে নিগ্গণ্ঠ ছিলেন। স্থবির সারিপুত্তর কাছে তর্কে পরাজিত হয়ে বুদ্ধসংঘে যোগ দিয়েছেন। স্থবির সারিপুত্তর কাছেই উপসম্পদা পেয়েছেন।
নন্দিয় ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল, সারিপুত্ত! সারিপুত্ত! যশ, এই সারিপুত্তই তো আমার প্রভুপুত্ত। এঁরই মায়ের নাম রূপসারি! যিনি আমার পিতাকে তিরস্কার করতেন। আচ্ছা ভাই, ও ভাই বলুন না আর্য সারিপুত্ত কোথায়?
—ধৈর্য ধরুন। দেখতে পাবেন। উনি তো আছেন শুনছি। আর্য সারিপুত্ত এরূপ বলবেন না, বলুন স্থবির সারিপুত্ত।
ভেতর থেকে কয়েকজন শ্ৰমণ ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে লাগলেন। লোকটি বলল—ওই দেখুন সুমুখে একজন উনিও ভগবান তথাগতর এক অগ্গসাবক মোগ্গল্লান—পেছনে আসছেন স্থবির সারিপুত্ত।
নন্দিয় ভালো করে দেখে নিরাশ হয়ে বলল—কত শিশুকালে দেখেছি। একেবারেই চিনতে পারছি না যশ।
পাশের লোকটি বিজ্ঞের মতো বলল—উনি তো সংঘে গিয়ে নবজন্ম নিয়েছেন। এখন কি আর পুরাতন চিহ্ন কিছু অবশিষ্ট আছে যে তাই দিয়ে চিনবেন?
—তা ঠিক—নন্দিয় নীরব হয়ে গেল। সেই সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল সেই বিশাল সভা। হঠাৎ।
নন্দিয় দেখল তপ্তকাঞ্চনবর্ণ এক পুরুষসিংহ ডান দিক থেকে প্রবেশ করছেন। অঙ্গের কাষায় বসন তাঁকে অগ্নিশিখার মতো ঘিরে আছে। শুধু মুণ্ডিত মস্তকটি এবং বাহু দুটি দেখা যাচ্ছে। তাঁর পেছনে আরও একজন শ্রমণ। এঁর থেকে যেন অল্পবয়সী।
যশ মৃদুস্বরে বলল—দেখো নন্দিয়, ইনি একই সঙ্গে কেমন দৃপ্ত এবং নম্র!
নন্দিয় হাঁ করে দেখছিল, বলল শুধু, দৃপ্ত ও নম্র নয়, কী সুন্দর যশ। কী জ্যোতিষ্মান! যশ যশ আমার মনে হচ্ছে ইনি জন্মে জন্মে আমার পিতা ছিলেন। সেই নালন্দা গামের দাস পিতা নয়, অদাস, চিরমুক্ত, চির প্রেমময়। যশ, কী অলৌকিক জ্যোতিঃসমুদ্র! দেখতে পাচ্ছো না? এইখানেই তো সেই উৎকৃষ্ট জীবন যার সন্ধানে এতদিন ঘুরছিলাম।
যশ যতই তাকে থামাতে চেষ্টা করে নন্দিয় ততই আরও উত্তেজিত, অভিভূত হয়ে যায়। বলে—হে তথাগত, পিতঃ, ভগবন্ শরণাগতকে গ্রহণ করো প্রভু…
পাশে বসা লোকগুলি যশের দিকে চেয়ে বলল—আপনি ভাববেন না ভদ্দ, তথাগতকে প্রথম দেখলে অনেকেরই মধ্যে এ প্রকার ভাবসঞ্চার হয়। পূর্বজন্মের সুকৃতি আর কি। একে বলে সোতাপন্ন হওয়া, অর্থাৎ কি না সদ্ধম্মের প্রবাহের মধ্যে পড়া। আপনার ভাই একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবেন।
অতঃপর বুদ্ধ উপবিষ্ট হলেন। যশ দেখল অত দূর থেকেও উনি তাদের দিকে চেয়ে রয়েছেন। সে পাশের লোকটিকে বলল—উনি তো এদিকেই দেখছেন। আমার এই সখার অবস্থার কথা ওঁকে নিবেদন করব না কি?
লোকটি হেসে বলল—এখানে যারা উপস্থিত রয়েছে সবারই মনে হচ্ছে উনি তারই দিকে চেয়ে রয়েছেন। তথাগতর ইদ্ধি এ প্রকারই। তবে উনি ইদ্ধির কথা স্বীকার করতে চান না। বলেন তোমাদের ভেতরের অভিপ্পায়কেই বাইরে দেখো। আপনাদের কথা এখন নিবেদন করার প্রয়োজন নেই। সভার শেষে সময় পাবেন।
—সব্বে জীবা সুখিত্তা হন্তু—দক্ষিণ পাণি মেলে ধরে আশীর্বাদ করলেন তথাগত। বৃক্ষে ঘেরা মনোরম স্থানটি। শীতল বাতাস বইছে। যশ উত্তরীয়টি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বসল। বাসন্তী বাতাস, শরীর শিউরে উঠছে। নন্দিয় যশের কাঁধে মাথা রেখে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তথাগত বুদ্ধর দিকে।
সম্মুখের দিকে একটু সামান্য কোলাহল, একটু যেন ঠেলাঠেলি, তারপর এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—হে গৌতম, আজ আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে শতাধিক ব্রাহ্মণ সমবেত হয়েছি। আমাদের আপনাকে কিছু বলবার আছে। আমাদের মুখপাত্র আয়ুষ্মন আশ্বলায়নই তা বলবে। সম্মত আছেন তো?
বুদ্ধ মৌন রইলেন।
একটি যুবক উঠে দাঁড়াল। বলল—হে শ্ৰমণ, আমি সম্প্রতি বেদে পারদর্শী হয়েছি, পরিব্রাজক ধর্মও অধ্যয়ন করেছি, তৎসত্ত্বেও জানি আপনি ধার্মিক ব্যক্তি, আপনার সঙ্গে বিচার করা দুরূহ কর্ম। তবু এঁদের আগ্রহে আজ সেই দুরূহ কর্মই করতে এসেছি। এখন বলুন ব্রাহ্মণদের যে ধারণা তাঁরা শুক্ল, অন্যরা কৃষ্ণ, ব্রাহ্মণই মোক্ষলাভ করেন, ব্রাহ্মণ ব্রহ্মদেবের মুখ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তারাই তাঁর উত্তরাধিকারী অন্যরা নয়—এ কি সত্য নয়? যদি না হয়, কেন নয়?
যশের অদূরে উপবিষ্ট শ্রেষ্ঠিদ্বয় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে উৎসাহভরে কী যেন বললেন। যশ শুনতে পেল না। তারপর বুদ্ধর গম্ভীর মধুর কণ্ঠস্বরে সভাস্থল পরিপূরিত হল।
—হে আশ্বলায়ন, ব্রাহ্মণকন্যারা যে তাঁদের গর্ভে সন্তান ধারণ করেন, তাদের প্রসব করেন, তৎপরে স্তন্যদান করে বড় করেন—এ কথা কি সত্য?
—সত্যই তো! মিথ্যা হবে কেন, শ্রমণ!
—ওই ব্রাহ্মণ সন্তানের পিতা তো ব্রাহ্মণ কন্যার স্বামী কোনও ব্যক্তি!
—নিশ্চয়ই।
—তবে তো ব্রাহ্মণ অন্যান্য বর্ণের মতোই পিতৃ ঔরসে, মাতৃগর্ভে জন্ম লাভ করে, প্রসূত হয়, লালিতপালিত হয়। সে ব্ৰহ্মদেবের সন্তানই বা হয় কী করে? আর অন্যান্য বর্ণের থেকে ভিন্নই বা হয় কী ভাবে?
—আপনি যাই বলুন না কেন ব্রাহ্মণ সদাই মুক্ত এবং ব্রহ্মদেবের উত্তরাধিকারী এ বিষয়ে পূর্ণ বিশ্বাস ব্রাহ্মণদের আছে। তারাই পূর্ণ আর্য।
বুদ্ধ ঈষৎ হেসে বললেন— আয়ুষ্মন তুমি কি যোন, কাম্বোজ প্রভৃতি সীমান্ত দেশের কথা কিছু জানো? সেখানে আর্য ও দাস দুটি বর্ণ বাস করে, কখনও আর্য দাস হয়, কখনও দাস আৰ্য হয়, এখানে তো কোনও বর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হল না। হল কী?
—সে আপনি যাই বলুন শ্রমণ, ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ বর্ণ।
—আচ্ছা আয়ুষ্মন, তোমার কি মনে হয় ব্রাহ্মণ চৌর্য, ব্যভিচার, প্রতারণা, দ্বেষ ইত্যাদি করলে তার পাপ হয় না?
—না শ্ৰমণ, এ রূপ করলে ব্রাহ্মণেরও পাপ হবে।
—আচ্ছা তবে অন্য বর্ণের লোক যদি সদাচার, দান, ধ্যান, মৈত্রীভাবনায় জীবন কাটায়, তার কি পুণ্য হবে না?
—তা কেন শ্রমণ, নিশ্চয়ই পুণ্য হবে।
—তবে ব্রাহ্মণ স্বতন্ত্র কিসে? অন্য বর্ণের মতোই জন্মায়, অন্য বর্ণের মতোই পাপ বা পুণ্য সঞ্চয় করে। অন্য বর্ণের মতোই মৃত্যুমুখে পতিতও হয়, তাই নয়?
—ব্রাহ্মণরা কিন্তু নিজেদের শ্রেষ্ঠ এবং অন্যদের হীন মনে করে।
বুদ্ধ বললেন— তবে আশ্বলায়ন তোমার কি মনে হয় ব্রাহ্মণরা চন্দনাদি কাষ্ঠ দিয়ে অগ্নি জ্বালালে এবং অন্যান্য বর্ণেরা এরণ্ড কাষ্ঠ দিয়ে অগ্নি জ্বালালে, ব্রাহ্মণদের অগ্নি অধিক উজ্জ্বল হবে?
—না, তা-ও না।
—তবে, ক্ষত্রিয় পুত্র যদি ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিবাহ করে বা ব্রাহ্মণ যদি অন্য বর্ণের কন্যা বিবাহ করে তাদের সন্তান পিতামাতার মতো না হয়ে একটি কিম্ভূতকিমাকার জীববিশেষ হয় কী?
—না, তা-ও না শ্রমণ।
—কিন্তু একটি অশ্ব ও একটি গর্দভ মিলিত হলে একটি নূতন প্রকার প্রাণী জন্ম নেয়, তাই তো?
—হ্যাঁ, তা অশ্বও নয়, গর্দভও নয়, অশ্বতর।
অর্থাৎ জন্তুর ক্ষেত্রে নূতন প্রাণী হচ্ছে, মাতা-পিতা ভিন্ন জাতি বলে, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে একই প্রকার প্রাণী জন্মাচ্ছে, মাতা-পিতা একই প্রকার বলে। —ঠিক কি না?
আশ্বলায়ন নীরব রইলেন।
বুদ্ধ বললেন— হে আশ্বলায়ন এবার বলো দুই ব্রাহ্মণ-ভ্রাতার মধ্যে যদি একজন পণ্ডিত হয় অপরজন মূর্খ, লোকে কাকে সমাজকার্যে আমন্ত্রণ জানাবে?
—অবশ্যই পণ্ডিতকে।
—আচ্ছা, যদি একজন বিদ্বান কিন্তু দুঃশীল ও অপরজন বিদ্বান নয় কিন্তু সুশীল, তা হলে তোমার বিচারে কাকে নিমন্ত্রণ জানাবে?
—হে গৌতম, যে ব্যক্তি সচ্চরিত্র তাকেই…
—হে আশ্বলায়ন, তুমি প্রথমে জাতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলে, তার পরে বেদাভ্যাসকে, এখন গুরুত্ব দিচ্ছ সচ্চরিত্রকে। অর্থাৎ আমি চাতুর্বর্ণ্যে যে সংস্কার করতে চাই, চরিত্র ও শীলের ওপর গুরুত্ব দিতে চাই, তুমি তা মেনে নিয়েছ। আয়ুষ্মন, তুমি যে প্রশ্ন নিয়ে আমার কাছে এসেছ সেই একই প্রশ্ন তারুক্খ ও পোকখর সাদির শিষ্যগণও আমার কাছে করেছিল, ব্রাহ্মণ এসুকারিও করেছিল, ভবিষ্যতে আরও অনেকে করবে। সবার প্রতি আমার একই উত্তর। জন্মের কারণে কেউ শ্রেষ্ঠ হয় না, যে শ্রদ্ধা, শীল, বিদ্যা, ত্যাগ ও প্রজ্ঞার অনুশীলন করে, যে কুলেই জন্মাক না সে মানুষের মধ্যে উচ্চতম বর্ণ দাবি করতে পারে।
যস্স কায়েন বাচায়
মনসা নত্থি দুক্কতম।
সম্ভূতং তীহি থানেহি
তমহং ব্রুমি ব্রাহ্মণম্।।
আশ্বলায়ন নামে যুবাটি বহুক্ষণ মাথা নত করে নীরবে বসে রইল। তার পরে উঠে গিয়ে বুদ্ধের চরণতলে মাথা রাখল। এমনভাবে যেন সে আর কখনও উঠবে না।
নন্দিয়কে নিয়ে ফিরে আসতে আসতে যশ বলল— কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!
নন্দিয় বলল— সত্যই আজকের অভিজ্ঞতা আশ্চর্য, অবিস্মরণীয়।
যশ বলল— আজকের অভিজ্ঞতা অতি সুন্দর, কিন্তু আমি আশ্চর্য বলছি অন্য একটি ব্যাপারকে।
—কী ব্যাপার যশ?
—তোমার কি মনে নেই নন্দিয়, কাত্যায়ন গান্ধার আমাদের এই সকল কথাই কিন্তু বলেছিলেন। কায়, মন ও বাক্যে দুষ্কৃত না করার অভ্যাস করা প্রয়োজন। তিনি অবশ্য আরও বলেন কায় ও বাক্যে সংযত হওয়া সর্বপ্রথম কাজ। কিন্তু দুষ্কৃতীদের সম্মুখীন হলে যদি কায় ও বাক্যের প্রহার করতে হয়, নিজে অনুত্তেজিত হয়ে তা করবে। এ বিষয়ে তথাগত কিছু বললেন না তো!
—মুখে না বললেও কাজে দেখান। পূরণ কাসস্পকে জনসমক্ষে অপ্রতিভ করা কি একপ্রকার প্রহার নয়? আর চিঞ্চা তো শুনেছি নারী বলে পার পায়নি, শ্ৰমণরা তীর্থিকদের তো বটেই তাকেও কিছু উত্তম-মধ্যম দিয়ে ছিলেন— নন্দিয় বলল।
—উৎকৃষ্ট জীবনের জন্য কোনও সঙেঘ যোগ দেবার প্রয়োজন নেই নন্দিয়। আমার মনে হয়, আমরা উৎকৃষ্ট জীবনের সন্ধান পেয়ে গেছি। অনেক আগেই। যশ যেন বহু দূরের দিকে চেয়ে বলল।
৪
বিশাখা, তোমার এই নবীন বয়স, সুকুমার শরীর…তুমি নিত্য জেতবনে কিসের সন্ধানে যাচ্ছ আদরিণী কন্যা আমার!
কেন পিতা, জেতবনে যাত্রীদের মধ্যে তো নবীন-প্রবীণের প্রশ্ন নেই। সুদত্ত-কন্যা চুল্লসুভদ্দা, প্রতর্দন-সুহ্না সুপ্পিয়া, সাবত্থির শ্রেষ্ঠসুন্দরী উপ্পলবন্না—এঁরাও তো যান। আপনি ভদ্দা কুন্ডলকেশাকে দেখেছেন? রাজগহের সেই সাহসিকা সুন্দরী যিনি দস্যু স্বামীকে গিজ্ঝকুট থেকে ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। তিনি তো এখন ভিক্ষুণী ভদ্দা। মুখমণ্ডলের দীপ্তি দেখলে বিস্মিত হতে হয়।
ধনঞ্জয়ের মুখের ওপর একটি ছায়া, তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন— তুমিও কি প্রব্রজিত হতে চাও বিশাখা! তাঁর স্বর ভালো করে ফুটছে না, এত ভয়!
বিশাখা হেসে বলল—কিন্তু এখন বড় বড় সেট্ঠিকুলে অনেকেই মনে করছেন কন্যাদের পব্বজ্জা নেওয়া ভাল। কুল উজ্জ্বল হয়। মহারাজ পসেনদির কনিষ্ঠা ভগ্নী দেবী সুমনা ও মহারানি দেবী মল্লিকাও তো…
—দেবী মল্লিকা কি মগধ মহিষী খেমার মতো…
—না পিতা, দেবী মল্লিকা মহারাজ পসেনদির অত্যন্ত প্রিয়া মহিষী, তিনি পব্বজ্জা নেবেন না। তবে আমি দেখেছি তিনি অত্যন্ত ভক্তিমতী। তথাগত বুদ্ধ ছাড়া আর কিছু যেন জানেন না। আর কোশল সেনাপতি বন্ধুলের পত্নী মল্লিকার সঙ্গে সেদিন আলাপিত হলেন তো!
সুমনা বললেন—এই প্রথম, এমন একটি সখী পেলাম বিশাখা, যাকে মনের কথা বলতে পারি।
ধনঞ্জয় হেসে বললেন— কেন প্রিয়ে, মনের কথা কি ইদানীং আমাকে বলতে পারছ না?
—তুমি কি সখী? সুমনা কৌতুক ভ্রূভঙ্গি করে বললেন।
বিশাখা বলল—মা, বন্ধুল পত্নী মল্লিকার নির্বন্ধেই হয়ত রাজ্ঞী মল্লিকা পব্বজ্জা নিচ্ছেন না, একেক সময় মহারাজের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে উনি নাকি স্থিরই করে ফেলেন যে সংসার-ত্যাগ করবেন।
—মহারাজ দেবী মল্লিকার সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করেন?
—হ্যাঁ পিতা, উনি মালাকারের কন্যা বলে মহারাজ যখন-তখনই বলেন রাজ্ঞীপদ পেয়ে দেবী মল্লিকার মাথা ঘুরে গেছে। দেবীর অপরাধ—তিনি মহারাজের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ন্ত্রণ করতে যান, সুপরামর্শ দিতে যান। তবে, রানির প্রতি এইপ্রকার ব্যবহারের জন্য মহারাজ তথাগত বুদ্ধের কাছে তিরস্কৃত হয়েছেন।
—ও তথাগত বুঝি গৃহ-বিবাদ, দাম্পত্য-কলহ এসব ব্যাপারেও উপদেশ দেন!
—হ্যাঁ মা, সেটাই তো ওঁর বিশেষত্ব। কত লোককে যে উনি সৎপরামর্শ দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন! উপাসকরা ওঁকে পিতা-মাতার চেয়েও বেশি মানে এই কারণে। আর শুধু তথাগত নয় মা, শ্রমণদের অনেকেই নানা সাংসারিক ব্যাপারে গৃহীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ধনঞ্জয় বললেন— হ্যাঁ, শ্ৰমণ আনন্দ নাকি সেট্ঠি সুদত্তর বাড়ির চোর ধরে দিয়েছেন।
—চোর নয়, চুরির দ্রব্য—বিশাখা মৃদু কণ্ঠে বলল।
সুমনা বললেন—আমি শুনিনি। সেটা কী ব্যাপার?
ধনঞ্জয় বললেন—বহুমূল্য রত্নহার চুরি গিয়েছিল, শ্ৰমণ আনন্দ সেদিন সেট্ঠির গৃহে নিমন্ত্রণ গিয়েছিলেন। বিশৃঙ্খলা, উৎকণ্ঠা, হট্টগোল শুনে জিজ্ঞেস করেন এবং জানতে পারেন। বলেন—আপনারা দ্রব্যটি চান, না চোরকে চান! সুদত্ত-পত্নী বলেছিলেন— চোরটিকেও চাই, কেননা এত বড়, এত জটিল শাখাপ্রশাখাময় পরিবারে কার কোথায় স্বভাব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জানা প্রয়োজন। আনন্দ বলেন—রত্নহার তিনি উদ্ধার করে দিতে পারবেন, কিন্তু চোর ধরার দায়িত্ব নিতে পারবেন না। সেট্ঠি সম্মত হলে তিনি একটি বৃহৎ মৃৎভাণ্ড কর্দমে পরিপূর্ণ করে তার পাশ দিয়ে একটি স্থূল আবরণী টাঙিয়ে দিতে বলেন। সারাদিন ধরে পরিবারের যে যেখানে আছে দাস থেকে আরম্ভ করে অতিথি-অভ্যাগত, শ্ৰমণরা, স্বয়ং গহপতি, তাঁর পত্নীরা সবাইকে ওই আবরণীর ওপাশ দিয়ে ঘুরে আসতে হবে, নইলে কেউ গৃহ থেকে বেরোতে পারবেন না।
—পাওয়া গেল রত্নহার? সুমনা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
—অবশ্যই! সেই মৃৎ-ভাণ্ডের কর্দমের মধ্যে!
সুমনা সখেদে বললেন— সেট্ঠি, এই আনন্দপমুখ সমনরা আমাকে বড় ভাবাচ্ছেন। এঁরা এত বুদ্ধি, এত ধৈর্য কোথা থেকে পেলেন?
ধনঞ্জয় বললেন—প্রিয়ে তুমি ভুলে যাচ্ছ, এঁরা শাক্যকুলের রাজপুত্র। শাসনপদ্ধতির নানা শাখার বিষয়ে এঁদের সহজাত প্রতিভা আছে।
—তাই-ই তো বলছি, কত কাজে লাগতে পারতেন এঁরা স্ব-কুলের মানুষের, সবাই মিলে পব্বজ্জা নিয়ে শাক্যদের তো ভাসিয়ে দিলেনই, সাধারণভাবে মনুষ্যসমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এঁদের মতো পিতা হলেই তো বীর, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ সন্তান হবে। তা না সব সংসার-ত্যাগ করলেন। দুক্খ, দুক্খ, দুক্খ! এ যেন সেই কবে ব্যাধি হবে বলে আগে থেকেই রোগশয্যায় শুয়ে থাকা!
বিশাখা বলল—কিন্তু মা, শুধু আর্যসত্যগুলিই তো নয়! তথাগত যে অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপদেশ দেন সাধারণ মানুষকে, সেইটুকু সারাজীবন ধরে পালন করে গেলেই তো একটি পাপহীন, নির্দোষ, চমৎকার সমাজ, দেশ গড়ে উঠতে পারে। সেটা কি মস্ত বড় কথা নয়? শরীরকে কষ্ট দিতে হবে না, যে যেমনভাবে যেখানে অবস্থিত সেখানে থেকেই জীবনধারণ করবে, শুধু জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিটি পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
সুমনা বললেন—তুই কি মনে করিস অষ্টশীল অতি সহজ ব্যাপার? সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, এমনকি সম্যক আজীব কি সহজ?
—না মা সহজ নয়। কিন্তু গৃহস্থদের জন্য তথাগত আরও সহজ নির্দেশিকা দিয়েছেন—পঞ্চশীল। প্রাণিবধ না করা, পরদ্ৰব্য না হরণ করা, ব্যভিচার না করা, মিথ্যা না বলা, সুরাপান না করা— এ-ও কি অতিশয় কঠিন?
ধনঞ্জয় বললেন—প্রাণিবধ না করলে তো আমাদের অশন বন্ধ হয়ে যায় মা। নির্গ্রন্থরা যে বলেন চারিদিকে অণুপ্রমাণ প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে, জলে, স্থলে, বৃক্ষে সর্বত্র— তারা তো অবিরাম বধ হচ্ছেই!
বিশাখা বলল—পিতা, তথাগতর সব ব্যাপারেই মঝ্ঝিম পন্থা। উনি অনর্থক প্রাণীবধ অর্থাৎ মৃগয়া, যাগ-যজ্ঞাদিতে বলি এইগুলিই বারণ করেন। প্রয়োজনে মৎস্য মাংসাদি তো উনি নিজেও খান। শ্ৰমণদেরও খেতে বারণ করেন না। তবে ওঁকে নিমন্ত্রণ করে পশুহত্যা করা ওঁর মনোমত নয়।
—সুরাপান না করলেই বা চলবে কিভাবে বিসাখা! অতিরিক্ত পান করলে কুফল হতে পারে কিন্তু এই এতো মানুষ, শারীরিক পরিশ্রম করে বাঁচে। উত্তেজক, বলকারক সুরা না হলে তারা কাজ করতে পারবে না, উচ্চশ্রেণীর নরনারীরও এটি একটি নিত্যব্যবহার্য পানীয়।
—পিতা আপনি অতিরিক্ত পান করেন না বলেই সুরার সপক্ষে কথা বলতে পারছেন। সাবত্থিতে কিছুকাল থেকে দেখুন, বুঝতে পারবেন সুরায় নিষেধ কেন। আর ব্যভিচার, প্রবঞ্চনা, মিথ্যাচরণ এগুলি যে সমাজদেহে ঘৃণ্য রোগের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এগুলিকে যে নির্মূল করা প্রয়োজন এ বিষয়ে কি আপনার সন্দেহ আছে?
—না তা নেই, ধনঞ্জয় বললেন, তবে কি জানো মা, ব্যভিচার প্রবঞ্চনা মিথ্যাচরণ সভ্যতার উষাকাল থেকেই বোধহয় চলছে। যতই দূর করবার চেষ্টা করা হোক, ঠিক কোনখান দিয়ে বেরিয়ে এসে এরা আবার সাড়ম্বরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করে।
—কিন্তু পিতা, পরিপূর্ণ সভ্য সমাজের দিকেই তো আমাদের গতি হওয়া উচিত। এবং সেই সভ্য সমাজ তো ওই সকল পাপ-অভ্যাস দূর করার চেষ্টা থেকেই জন্মাবে। ধীরে ধীরে, একদিনে নয়।
ধনঞ্জয় বললেন—সে কথা ঠিক। মহত্তম সত্যগুলি বোধহয় জীবনের সরলতম সত্য বিসাখা। বুঝতে অসুবিধা হয় না। শুধু কার্যে পরিণত করার পক্ষে এত প্রলোভন, এত বাধা! কিন্তু বিসাখা, তুমি তো বুদ্ধবাণী ভালোই হৃদয়ঙ্গম করেছ, প্রচারকার্যও দিব্য করছ এবং তা তোমার নীল দুকূল এবং মহালতাপসাদন পরেই সম্ভব হচ্ছে। তবে কেন…
বিশাখা মৃদু-মৃদু হেসে বলল—পিতা, আমি কি একবারও বলেছি পব্বজ্জা নেব?
—কিন্তু কন্যা, সংসারই বা করছ কই! জামাতা শুনছি বহু দেশ বাণিজ্য-যাত্রা করে ফিরে আবার কর্মান্তে চলে গেছে। মা, আমাদের বিবাহের পর আমরা দুজনে কত আনন্দ করেছি, তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিও। তোমার জীবনে সেরূপ আনন্দ…ধনঞ্জয় অপ্রতিভ মুখে থেমে গেলেন।
সুমনা কন্যার পাশেই বসেছিলেন। বিশাখার দ্বিতল গৃহের উপরিতলে সুদৃশ্য কাষ্ঠকুট্টিম। তার ওপর চিত্রবিচিত্র আচ্ছাদন দিয়ে প্রস্তুত একটি অনতিকোমল শয্যা, উপাধান ইতস্তত ছড়ানো আছে। মৃৎ-আধারে মৃদু সুগন্ধি পুড়ছে। সময়টা সকাল। সুমনা কন্যার মাথাটি নিজের বুকের ওপর টেনে নিলেন, বললেন— আমাকে বলবে না মা!
বিশাখা অনেকক্ষণ নীরবে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে রইল। তারপর মুখটি ঈষৎ তুলে বলল—মা, তুমি তো জানো শ্বশুরগৃহে সকলে আমায় ভালোবাসেন, মান্য করেন, আমি এই গৃহ-পরিচালনার সমস্ত কাজ আমার শ্বশ্রূমাতার সঙ্গে একত্রে করে থাকি। শ্বশুর আমাকে এত স্নেহ করেন যে, আমি বিব্রত হয়ে পড়ি। যা চাই তা-ই দিতে তিনি প্রস্তুত। মা, তুমি এ-ও জানো যৌবনকাল কর্মের সময়, সেট্ঠি-পুত্ত দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বণিকের উপযুক্ত কর্ম করছেন, মা তুমি আমার মুখ দেখো—আমি আনন্দে আছি।
সুমনা অনুভব করলেন, বলতে বলতে বিশাখার সারা শরীর যেন রোমাঞ্চিত হল, মুখে অদ্ভুত বিভল হাসি। কন্যাকে এমন মুগ্ধা অবস্থায় তিনি কখনও দেখেননি। একটা সময় ছিল যখন তিনি বিশাখার একমাত্র সখী ছিলেন। তার অন্তরের কথা তিনি ছাড়া তেমন কেউ জানত না। সযত্নে নির্মাণ করেছেন তিনি বিশাখা-প্রতিমা। তার বিবাহের পর দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট পেয়েছেন তাঁর স্নেহপুত্তলি বুঝি অপাত্রে পড়ল, বিশাখার গুণগুলি বুঝি সব দোষ হয়ে দেখা দিল। এই ভয়ের সমর্থন পেয়েছিলেন যখন বিশাখার বিচারের জন্য সাকেত থেকে গহপতিরা গেলেন। সুমনা প্রস্তুত ছিলেন কন্যার মোক্ষক্রিয়ার জন্য। ভয় পেয়েছিলেন, এরপর কন্যা কী করবে? তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে কিছুই করানো যাবে না। যদি বলে আর বিবাহ করব না! যদি বলে প্রব্রজ্যা নেব, তো সেসব সঙ্কল্প থেকে তাকে টলানো কঠিন। কিন্তু বিশাখা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাবত্থিতে, শ্বশুরকুলে, সে দিব্য ধনুর্বাণ বা মল্লবিদ্যার অনুশীলনও করছে পূর্বের মতো। মুখটি এতো সুখী। শুধু এই সুখের মধ্যে পুণ্যবর্ধন কতটা আছে, এমন কি আছে কিনা, তা বুঝতেই পারছেন না সুমনা।
মাকে নীরব দেখে বিশাখা বলল—মা, সকলের সুখই কি একপ্রকার হবে? হয় না মা, তা হয় না।
ধনঞ্জয় বললেন—বুঝতে পারছি বিশাখা, তোমার আনন্দ সৎ-কর্মের, সৎ-সঙ্কল্পের আনন্দ। তা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে জেতবনে। কিন্তু একজন গৃহী নারীর যাবতীয় আনন্দ সন্ন্যাসী-বিহারে— এ বড় ভয়ের কথা বিশাখা। তাছাড়া আর অধিকদিন সন্তান না হলে যদি পুণ্যবর্ধন পুনর্বার বিবাহ করতে চায়!
সুমনা দেখলেন বিশাখার মুখে সহসা যেন আলো জ্বলে উঠল। কেন তিনি বুঝতে পারলেন না।
বিশাখা ধীরে ধীরে বলল— মিগার-পুত্ত দ্বিতীয় বিবাহই করুন, তৃতীয় বিবাহই করুন, মিগার মাতা বিসাখাই থাকবে।
বিশাখা গৃহকর্মে চলে গেলে ধনঞ্জয় বললেন— প্রিয়ে, আমরা একটি বালিকাকে সাবত্থি পাঠিয়েছিলাম। সে বুদ্ধিমতী হলেও সরলা ছিল। এই পরিশীলনদুষ্ট নগরী তাকে কি সম্পূর্ণ জীর্ণ করে ফেলল? মিগার কেমন লোক? সে কি আমার কন্যার কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধির প্রাচুর্য দেখে তাকে নিজ বাণিজ্যকর্মে, গৃহপরিচালনা কর্মে পুরোপুরি যুক্ত করে দিয়েছে? বিশাখা কি এই কর্ম ও ক্ষমতার মোহে জীবনের সরল সুখশান্তিগুলি আর চিনতে পারছে না? সুমনা, মিগারের মধ্যে কোনও জটিল চরিত্র-বিকার নেই তো?
সুমনা শিউরে উঠে বললেন— বন্ধ কর এ প্রসঙ্গ, বন্ধ কর সেট্ঠি। আমার বুকের মধ্যেটা কেমন শূন্য লাগছে। কিছু নেই কোথাও, সেট্ঠি, আমি কোনও অবলম্বন পাচ্ছি না। আমার কন্যা কোথায়? সেট্ঠি, আমি জানতাম না আমার ধর্ম-কর্ম, প্রাণ-মন সব কিছুই আমি কন্যাকে সমর্পণ করে বসেছিলাম। সে যদি আমার বোধের অতীত হয়ে যায়, তবে সুমনার জীবনের কেন্দ্রটি শূন্য হয়ে যাবে।
সুমনার মুখচোখের অবর্ণনীয় বিষাদের দিকে তাকিয়ে ধনঞ্জয় আশ্চর্য হয়ে গেলেন, তিনি সুমনাকে আলিঙ্গন করে গাঢ় কণ্ঠে বললেন—প্রিয়ে, আর কিছু আর কেউ কি নেই তোমার জীবনে? আর কোথাও নিজেকে ন্যস্ত করতে পারছ না? আর এত নিরাশই বা হচ্ছ কেন? ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো প্রিয়ে।
সুমনা উঠে গিয়ে গবাক্ষের সামনে দাঁড়ালেন, দুজনেই গবাক্ষপথে দেখছেন বিশাখার কাননের সৌন্দর্য। অদূরে বৃক্ষগুলির মাঝে মাঝে শ্রাবস্তীর পথরেখা দেখা যায়। সামান্য কিছু লোক চলাচল হচ্ছে। সুমনা বললেন—সেট্ঠি, আমি যতদূর বুঝি—আমার জীবনে বিসাখা শুধু কন্যা নয়, সে একটি তত্ত্ব।
ধনঞ্জয় পরিবেশ লঘু করবার জন্য পত্নীর মুখ চুম্বন করলেন, তারপর হেসে বললেন, কন্যার পরিবর্তে পাতিকে নিয়ে পরীক্ষা করলে পারতে প্রিয়ে। তোমার তত্ত্ব তোমারই থাকত।
দুঃখের হাসি হেসে সুমনা বললেন—জীবনে যা কিছু সবলে ধরতে গেছি, অনেক চিন্তায় ভালোবাসায় রূপ দিতে গেছি তা সবই আমার আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। তোমায় নিয়ে তেমন কিছু করতে গেলে তুমিও হয়ত তাই যেতে সেট্ঠি!
ধনঞ্জয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর প্রিয়া পত্নীর দিকে তাকালেন। ইদানীং তাঁর মনে হয়, তিনি এই ক্ষুরধারবুদ্ধিশালিনী ব্যক্তিত্বময়ী ক্ষত্রিয়কন্যার যোগ্য নন। যৌবনে যখন দুঃসাহসিক বাণিজ্যযাত্রায় যেতেন সে-সব দিনগুলিতে নিজের পৌরুষ যেন দেহের কোষে কোষে অনুভব করতেন। তখন সুমনার পাশে দাঁড়াতে তাঁর দ্বিধা হত না। কিন্তু এখন? ধনসম্পদ যেন তাঁর সেই পৌরুষকে কেমন শিথিল করে দিয়েছে। অথচ ধন এমন ক্ষমতা দান করে যে, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ সবার ওপরে কর্তৃত্ব করবার যোগ্যতা জন্মায়। তাঁর পিতা মেণ্ডক বলেন, এমন দিন আসছে-যখন বণিকই হবে শ্রেষ্ঠ বর্ণ। ধনঞ্জয়ের মতে অবশ্য ক্ষত্রিয়রা নিঃসংশয়ে শ্রেষ্ঠ বর্ণ। বাহুবলে পৃথিবী জয় করে, রাজ্যশাসন করে, অপরাধীর শাস্তিবিধান করে, এদিকে শাণিত বুদ্ধি, বিদ্যার গরিমা কী! সেনিয়কে দেখলে এক সময়ে তাঁর ঈর্ষা হত, আর ইদানীং আর এক দম্পতিকে দেখে তিনি মোহিত হয়ে গেছেন। বন্ধুল মল্ল ও তাঁর পত্নী মল্লিকা। বন্ধুল বীরপুরুষ বটে। শার্দূলগতি ওই ক্ষত্রিয় তাঁরই বয়সী হবেন। সুমনার পতি হওয়া উচিত ছিল ওই বন্ধুলের মতো কারুর। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ধনঞ্জয়। আর বিশাখা?
সুমনা মুখ তুলে তাকালেন। ধনঞ্জয়কে তিনি কখনও এত বিমর্ষ দেখেননি। হৃদয়ের ভেতরটা বেদনায় কেমন যেন করে উঠল। তিনি চেষ্টা করে হেসে বললেন— চলো সেট্ঠি, আমরা সাকেতে ফিরে যাই। এখানে ভালো লাগছে না।
—কেন মা, কোথায় যাবে? —বিশাখা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তাঁরা বুঝতে পারেননি। —মা! বিশাখা সুমনার অত্যন্ত সন্নিকটে এসে চোখ দুটি তাঁর দিকে তুলে ধরল। নীল চোখের তারা, নীলাভ বাকি অংশটুকুও।
সুমনার গাঢ় কৃষ্ণ অক্ষিতারা দুটি সেই সুনীল নয়নের ওপর স্থির হয়ে রইল। সুমনা যেন সেই চোখ দুটির ভেতরে অশ্রু দেখতে পেলেন। গভীর উৎকণ্ঠায় বললেন—কী হয়েছে বিসাখা?
—কিছু তো হয়নি মা! মিগারপুত্ত কর্মান্ত থেকে ফিরেছেন! এইমাত্র এসে পৌঁছলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিগারগৃহ আনন্দিত কলস্বরে ভরে উঠল। পুরস্ত্রী-পরিজনরা সবাই ধাবিত হচ্ছে, মিগার-গৃহিণী কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিশাখাকে বারবার ডাকছেন। মিগার তাঁর কর্মকক্ষ থেকে কাষ্ঠপাদুকার শব্দ করতে করতে বহিবাটির অলিন্দে এসে দাঁড়ালেন। গণক, লেখক ও অন্যান্য কর্মকররা, ভৃতকরা ছোটাছুটি করছে। দাস ও দাসীরা হাত-পা ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে এলো। সাত ঘোড়ার রথ থেকে স্বর্ণসূত্ৰী উত্তরীয় দুলিয়ে মৃগচর্মের উপানৎ পায়ে পুণ্যবর্ধন নেমে এলো। আগের থেকে যেন আরও একটু পুষ্ট, খানিকটা দৃঢ়পেশী হয়েছে সে। গাত্রবর্ণ তাম্রাভ। সন্দেহ নেই সার্থর সঙ্গে ভ্রমণ করে করে রোদে পুড়তে হয়েছে তাকে অনেক। তার চলাফেরার মধ্যে একটা কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভাব, কর্ম করলে যে ধরনের আত্মপ্রত্যয় আসে আচরণে, সেইরূপ। সে নেমে এসে পিতার এবং ধনঞ্জয়ের পদবন্দনা করল। গৃহাভ্যন্তরে এসে আগেই সুমনার পরে তার মায়ের চরণে প্রণত হল। তার মা তার শির চুম্বন করলেন। পুণ্যবর্ধন সমস্ত পুরস্ত্রী-পরিজনের কুশল সংবাদ নিল। শুধু বিশাখাকে কোথাও দেখা গেল না। তার পরিবর্তে তার পায়ে প্রক্ষালনের জল দিল ময়ূরী। মার্জনী বস্ত্র দিল কহ্না। শীতল পানীয় এনে দিল ধনপালী।
প্রত্যাবৃত্ত পুণ্যবর্ধনকে নিয়ে যখন সবাই কাহিনী শুনতে, আহ্লাদ প্রকাশ করতে মত্ত, তখন সুমনা সবার অলক্ষ্যে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলেন। মিগার-গৃহের ভেতরের কাননটি পেরিয়ে এলেন বিশাখার গৃহে। কোথাও কেউ নেই। সোপানশ্রেণী পার হয়ে দ্বিতলে উঠলেন। সুপ্রশস্ত শয্যাগৃহ বিশাখার, সেখানে সে নেই। তারপরে অলিন্দ, তাঁদের জন্য একটি সুন্দর কক্ষ। তারপর বিশাখার প্রসাধনকক্ষ। সেইখানে গবাক্ষলগ্নশির বিশাখা বসে রয়েছে। সুমনার হাতের স্পর্শে সে মুখ তুলল না, সে শুধু মায়ের হাতটিকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিল।
অনেকক্ষণ পরে অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে বলল— মা, আমি চেষ্টা করব। ধীরে ধীরে কয়েক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রুজল সুমনার হাত ভিজিয়ে দিতে লাগল।
সুমনা উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন— এই জন্যই কি তুমি এতদিন আনন্দে ছিলে? বিসাখা! মা!
বিসাখা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। তারপর বলল— মা, ভয় করো না, বিসাখা পরাজয় স্বীকার করবে না। বিসাখা চিরদিন আনন্দে থাকবে। শুধু, তথাগত আমাকে করুণা করুন। সুমনার বুকে মাথা রেখে সে ধীরে ধীরে মৃদু কণ্ঠে বলল—মা, এমন দিনরাত গেছে যখন সাকেতের জন্য, পিতামাতার জন্য শোকে, হাহাকারে বিসাখার চিত্ত ভরে গেছে। তখন আর্তস্বরে তোমাকে ডেকেছি মা, পিতাকে ডেকেছি। পিতাকে বলো মা, সেই ডাক তথাগত শুনতে পেয়েছেন। ওই জেতবন তাই আমার হৃৎকমল। বিসাখা পব্বজ্জা নিলেও জেতবনের, না নিলেও জেতবনের, সঙেঘ মনপ্রাণ। সমর্পণ করেছি মা।
সুমনা উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন—এখন? এখন তবে কী করবে, বিশাখা!
—এই সমস্ত কঠিন পরীক্ষা যদি উত্তীর্ণ হতে পারি তবেই নিজেকে দেবী সুমনার কন্যা বলে পরিচয় দিতে পারব মা। চিন্তা করো না। আমি কৃতসঙ্কল্প। এই নির্জনে শুধু শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছিলাম।
রাত্রি ক্রমেই গভীর হচ্ছে। শ্রাবস্তী নসরীর বিচিত্র কোলাহল ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। আলোগুলি নিভে যাচ্ছে। শুধু চলছে সুরভিত মনোরম কক্ষে শয়নপ্রদীপ।
পুণ্যবর্ধন পদচারণা করছে। তার পদক্ষেপগুলি এখন দৃঢ়, প্রত্যয়ব্যঞ্জক। কিন্তু নিজের বক্ষের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। তিন বছর পরে সে গৃহে ফিরল। যথেষ্ট ধনোপার্জন করেছে। কুরুদেশ থেকে সে গোধূমের বীজ এনে নিজেদের কর্মান্তে রোপণ করেছিল। স্বর্ণবর্ণের শস্য হয়েছে। ভৃগুকচ্ছের পট্টন থেকে সে এনেছে যাবনিক স্বর্ণমুদ্রা। কোণবিশিষ্ট নয় সুগোল। কয়েকটি এনেছে সোনার হারে গেঁথে বিশাখার জন্য। কিন্তু বিশাখা কোথায়? ভোজনের সময়ে মা এবং শ্বশ্রূমাতা উপস্থিত ছিলেন। বিশাখা নাকি সঙেঘ গিয়েছিল। মিগার এবং তাঁর গৃহিণী, সবিস্তারে শোনালেন তথাগত বুদ্ধের কাছে তাঁদের উপাসকত্ব নেওয়ার কাহিনী। সঙেঘর প্রসঙ্গ নিতান্ত আনমনে শুনেছে পুণ্যবর্ধন। কোনও গুরুত্ব দেয়নি। একপক্ষে এসব ভালোই। পুরস্ত্রীদের মনোযোগ সৎপ্রসঙ্গে আকৃষ্ট করে রাখে। বিক্ষিপ্ত হয়ে দেয় না। মা বিশাখার প্রশংসা করছিলেন সারাক্ষণ। সে যে কত পুণ্যবতী, কর্মিষ্ঠা সে সবের বিবরণও তাকে শুনতে হল। এ সকলই তার প্রজ্বলন্ত বাসনায় ইন্ধনস্বরূপ। না। পুণ্যবর্ধন আর ভুল করবে না। সে প্রতীচ্যের ধীমান পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করে এসেছে। তেমনি আচরণ করবে। কিন্তু বিশাখা কোথায়?
নিশা প্রায় মধ্যযাম। পুণ্যবর্ধনের কক্ষের প্রদীপ সহসা বাতাসের ফুৎকারে নিবে গেল। দ্বার বন্ধ হওয়ার শব্দ হল। পুণ্যবর্ধন ডাকল—বিসাখা!
—বলুন প্রভু।
আশ্চর্য হয়ে আবার দীপ জ্বালল পুণ্যবর্ধন, কাকে সাড়া দিচ্ছে তার পত্নী? বিশাখা শয্যাপ্রান্তে বসে আছে। বদ্ধাঞ্জলি। চোখ দুটি আধবোজা।
—বিসাখা, কাকে নমস্কার করছ প্রিয়ে, আমি কি তোমার নমস্কারের যোগ্য?
—যিনি যোগ্য তিনি গ্রহণ করুন!
—বিসাখা, এই কয় বৎসর যা চাও আমি তাই করেছি। বলতে বলতে পুণ্যবর্ধন বিশাখার গলায় হারটি পরিয়ে দেয়।
—সুখী হলাম। আপনার কল্যাণ হোক।
—প্রশ্ন করলে না তো কী কী করেছি?
—বলুন শুনছি।
—ধন উপার্জন করেছি। প্রভূত। বাণিজ্যকর্ম শিখেছি ভাল করে। বহু দেশ দেখলাম—গান্ধার, কাশ্মীর অবধি। আর…আর বিসাখা গণিকাগৃহে যাইনি একবারও।
—ভাল করেছেন। তথাগতর পঞ্চ নিষেধের অন্যতম হল ব্যভিচার।
—কে এই তথাগত? পঞ্চনিষেধ কী?
—তথাগত কে ধীরে ধীরে জানতে পারবেন। তিনি মহামানব, আপনার আমার মতো সাধারণ গৃহীকে সুন্দর জীবনযাপন করবার জন্য পঞ্চশীল পালন করতে বলেন — ব্যভিচার নয়, পরদ্রব্য হরণ নয়, মিথ্যাভাষণ নয়, জীবহিংসা নয় ও সুরাপান নয়।
পুণ্যবর্ধন বলল—মুল্ল না দিয়ে কোনও বস্তুই গ্রহণ করিনি বিশাখা। মিথ্যাভাষণও করিনি, কিন্তু সুরা থেকে সবসময়ে বিরত থাকতে পারিনি। আর মৎস্য-মাংসাদি ভক্ষণকে যদি জীবহিংসা বলো, তা করেছি।
—ধীরে ধীরে হবে। একেবারেই কি প্রকৃষ্ট শীল পালন সম্ভব! আপনি তো অনেকটাই করেছেন।
এই স্নেহবচনের কোমলতায় আর্দ্র হয়ে, প্রণয়ে বাসনায় বিহ্বল হয়ে পুণ্যবর্ধন পত্নীকে গাঢ় আলিঙ্গন করল। তার উত্তরীয়ের বাতাসে প্রদীপ নিবে গেল।
—করুণা কর, করুণা কর হে তথাগত, এ তনুমনপ্রাণ সেই তাঁকে সমর্পণ করেছি প্রভু। এই চিদাকাশে তিনি স্বর্ণপলাশের মতো জ্বলছেন। সেই পলাশের ছায়ায় সারাজীবন বদ্ধাঞ্জলি হয়ে বসে থাকব, কিছু চাইব না, শুধু সেই প্রভা আমাকে ঘিরে থাকবে, তাহলেই সব পারব। যত কঠিনই হোক, যত উৎকট হোক সব সইতে পারব। সব।
অন্ধকারে কোথাও যেন আলো জ্বলল। প্রদীপের শিখা নয়। উল্কার দাউ দাউ আগুন নয়। কোথাও কোনও দুর্লক্ষ্য দীপবর্তিকা। শুধু যার চিত্ত দেখতে চায় সে দেখতে পায়। সেই আলোর রেখা ধরে এগিয়ে আসতে লাগলেন রক্তকাষায়মণ্ডিত এক কাঞ্চনদেহ শ্ৰমণ। চোখে স্নিগ্ধ প্রেমের দ্যুতি। তিনি শূন্যপথে কক্ষের ঊর্ধ্ব থেকে নিচে নামলেন যেন সামান্য পাহাড়ের ঢাল অতিক্রম করছেন। কাষ্ঠকুট্টিমে তাঁর নগ্ন দুই সুন্দর চরণের শব্দ বাজছে না। আসছেন, আসছেন তিনি আসছেন। তার ওষ্ঠ পীড়ন করছে মিগারপুত্ত তিন বছরের সঞ্চিত কামনায়, স্তনবৃন্ত বুঝি ছিঁড়ে গেল তার নিষ্ঠুর পিপাসায়। নীবিবন্ধ খুলে যায়। উর্দ্ধারণি মন্থনে অধো-অরণিতে আগুন জ্বলে, বিশাখা অলৌকিক আনন্দে কাষায় বাহুতে মাথা রাখে, আবিষ্ট চোখে শুধু আলোকসম্ভব এক দৃষ্টিপাত তরঙ্গের পর তরঙ্গ আসে। রোমাঞ্চের পর রোমাঞ্চে, বর্ণনার অতীত হর্ষের সমুদ্রে সে আশিরবক্ষযোনি স্নান করে ডুবে যায়, শুধু চৈতন্যটুকু ভাসতে থাকে।
এইভাবেই বিশাখার পর পর যমজ এবং একক সন্তান হয়— হর্ষ এবং মিত্র, তারপর সিরিমা ও সুমেধা, তারপর লৌহিত্য, পিঙ্গলা, তারপর রোহণ ও সবিতর, তারপর অনোমা, বিশ্বম্ভর। কিন্তু দশটি সন্তানের জন্ম দেবার পরও বিশাখার কুক্ষিদেশ শিথিল হয় না, শ্রোণি অতি বিস্তৃত হয় না, কটি থাকে নির্মেদ, মুখশ্রী প্রফুল্ল, সরল কিশোরশ্রীমণ্ডিত। এবং মিগার গৃহিণীসহ গৃহের যতেক পুরস্ত্রী গৌরব করতে থাকেন। —সে কি, তোমরা জানতে না আমাদের সুহ্না যে বয়ঃ কল্যাণী। আমৃত্যু বিশাখা এইপ্রকারই থাকবে। পুন্ন বদ্ধন ধরে বসেছিল যে পঞ্চকল্যাণী কন্যা না হলে বিবাহ করবে না। তাই তো সন্ধান করে করে আসমুদ্র হিমাচল জম্বুদ্বীপ ছেনে ছেনে এমন রত্ন আনা হয়েছে।
—আসমুদ্র হিমাচল? সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলিতেও যাওয়া হয়েছিল নাকি?
—না তা হয়নি অবশ্য।
—তবে হিমাচল?
—তাও হয়নি। কেন যেতে হবে? এই সাকেতেই পাওয়া গেল কি না!
তবে এসব অনেক পরের কথা।