১৫
অশান্ত বালকের মতো দুর্ধর্ষ বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে গান্ধার ভবনে প্রবেশ করলেন চণক। অশ্বরক্ষক এসে দাঁড়াতেই রূঢ় ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তার হাতে সমর্পণ করলেন চিত্তককে। চিত্তক ভূমিতে পা ঠুকে হ্রেষা করছে, প্রভুর এই ব্যবহার তার মনোমত নয়। চণক ভ্রূক্ষেপ করলেন না। দাসদাসীরা ছুটে এলো, কোনক্রমে হাতমুখ ধুয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন।
এ কোন সোমাকে তিনি দেখে এলেন? অবাধ্য দুর্বিনীত। নাগরিক বাকচাতুর্যের আড়ালে হারিয়ে গেছে দেবরাতপুত্ৰী জিতসোমা, তাঁর প্রিয় শিষ্যা, প্রিয়তমা ভগ্নী। শুধু বাকচাতুর্য নয়, ব্যবহারচাতুর্যও বটে! অবাধ্যই কী? না দুর্বোধ্য? ঠিক দুর্বিনীত বলা যায় না, প্রকৃতপক্ষে কেমন অনমনীয়, তার ওপর আর কোনও প্রভাবই নেই যেন চণকের। তিনি কণ্ঠের মধ্যে একটা রুদ্ধ আক্ষেপের শব্দ করতে লাগলেন, যা খানিকটা তর্জন খানিকটা কান্নার মতো শোনালো। যে কাত্যায়ন চণক সমগ্র মগধরাজ্য, অঙ্গরাজ্য ঘুরে ঘুরে জম্বুদ্বীপের রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে এলেন, যিনি প্রত্যন্ত মগধ, সীমান্ত অঙ্গের সামান্য জনের না-বলা আশাহতাশার কাহিনী অত সহজে বুঝে ফেললেন, যিনি বিম্বিসার থেকে আরম্ভ করে মেণ্ডক-ধনঞ্জয় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার প্রভাবী পুরুষকে তাঁর নীতির সম্পর্কে প্রত্যয়ী করতে পারলেন, সামান্য একটি নারীর মুক্তি তিনি কিছুতেই ঘটাতে পারলেন না। হায়, কেন তিনি সোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন? যে কর্মভার নিয়েছেন, যা যা সম্পন্ন করছেন সবার পেছনে আছে অনিবার্যভাবে সোমার প্রেরণা। সে কাছে থাকলে, আরও কত পারতেন! সবচেয়ে বড় কথা সোমার সামনে জীবনের রুদ্ধ দ্বার খুলে যেত, উন্মুক্ত বিরাট কর্মময় জীবন যার মধ্যে নিজের জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারে সে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। সেই সাধ তার উত্তরাধিকার, পেয়েছে পিতার কাছ থেকে, পেয়েছে মাতার কাছ থেকে, চণক স্বয়ং সে সাধকে দিনে দিনে পুষ্ট করেছেন। চণকের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ‘রাজশাস্ত্র’ ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ সোমার জীবন। সোমার হৃদয়। সোমার ভবিষ্যৎ।
অথচ সে শান্ত মুখে প্রদীপের সলতে উসকে দিতে দিতে বলল— ভবিতব্য জেট্ঠ। গণিকার ভবিতব্য নিয়ে জন্মেছি। মাঝে বিদুষী-বিদুষী, পুরুষী-পুরুষী খেলা খেলেছিলাম। আপনি দুঃখ করবেন না, আপনার হাত দিয়েই বিধাতা সোমাকে তার গণিকা ভবিতব্যে ফিরিয়ে দিলেন। আপনি তো উপলক্ষ্য! …আর তা ছাড়া… সোমা সহসা মুখ তুলে তাকাল। তার চোখের মণিতে প্রদীপের প্রতিবিম্ব,— নৃত্য-গীত আমার রক্তে জেট্ঠ। আমি প্রতিনিয়ত নূতন সৃষ্টি করছি। কেউ তার প্রকৃত অর্থ বুঝুক না বুঝুক, এই নৃত্যগীতের ভক্তজন রাজগৃহে বহু। যদি মনোমত শিষ্য-শিষ্যা পাই নূতন ধারার প্রবর্তন করে যাব। একটু থামল সোমা, তারপর ধীরে ধীরে বলল— আমার ভালো লাগছে।
—কী ভালো লাগছে, এই নগরশোভিনী-বৃত্তি?
—নগরশোভিনী তো একটা বৃত্তি নয় জেট্ঠ! মুগ্ধতার বেদীমূলে একটি সমাদরময় বিশেষণের অঞ্জলি!
—কার সমাদর সোমা? সে সমাদরের পেছনে যে রিরংসার কদর্য ইঙ্গিত রয়েছে এ কথা নিশ্চয় দেবী দেবদত্তার কন্যাকে আজ নতুন করে মানে করাতে হবে না!
দেবী দেবদত্তার গরিমাময় ভঙ্গিতেই উঠে দাঁড়াল তাঁর কন্যা। বলল— নৃত্যগীত আমার জননীর উত্তরাধিকার। কে তার কী কদৰ্থ করে তা নিয়ে আর চিন্তা করি না দৈবরাত। আমার বিশ্রামের সময় হল। আপনিও ক্লান্ত। আজ এই পর্যন্ত।
সোনার কাজ করা কাসিক দুকুলের উত্তরীয়টি গা থেকে টেনে খুলে ফেললেন চণক যেন বৃশ্চিক তাঁকে দংশন করছে। খুলে ফেলেও দংশন জ্বালা গেল না। এই বসন এই উত্তরীয় জিতসোমার উপহার। নিশ্চয় তার নিজের উপার্জন! চণক কি গণিকাদের ঘৃণা করেন? কই, না তো! শিশুকাল থেকে তাঁদের সমাজশরীরের একটি আবশ্যিক অঙ্গ বলে দেখে এসেছেন। প্রশ্ন ওঠেনি তখন। মনে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। সমাজোৎসবে দূর থেকে এই অপরূপাদের দেখে বিস্মিত, মুগ্ধ বালক এক ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। বালক তখন জানত না এর পেছনে কত বলাৎকার, প্রবঞ্চনা, অভিসন্ধির ক্লেদ আছে! বড় হয়ে নগরশোভিনীদের ইতিবৃত্ত শুনলেন ধীরে ধীরে, এঁরা যে অলৌকিক স্বর্গের অনন্তযৌবনা চিরসুখী জন নন, জানলেন, ভালো করে কাছ থেকে দেখলেন দেবী দেবদত্তাকে, তারপর থেকে এঁদের জন্য একটা গভীর বেদনাবোধ, সম্ভ্রমমিশ্রিত ব্যথা তাঁর হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। অন্যান্য নানা বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে চালাতে তিনি একটি অবধান দিয়ে এঁদের সমস্যার সমাধানের কথাও চিন্তা করেন। কখনও ঘৃণা করেননি, না হলে শ্রীমতীর কাছে জীবনের অর্থ খুঁজতে যেতেন না। কিন্তু আজ জিতসোমার বৃত্তি, জিতসোমার উপার্জন তাঁর গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে কেন? ভগ্নী বলে? না…! চণক দু হাত দিয়ে মাথাটি ধরে নতমুখে বসে রইলেন বহুক্ষণ।
তাঁর চোখ দুটি ঘরের চারধারে ভ্রমণ করতে লাগল ধীরে ধীরে, চোখের পেছনে দৃষ্টি নেই, মন নেই তাই দেখতে পাচ্ছেন না। অনেকক্ষণ পরে দীপশিখাটি কেঁপে উঠল। চণক দীপের আলো অনুসরণ করে দেখলেন একটি অপরূপ গজদন্তের পীঠিকা। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। শিল্পদ্রব্যটি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করল। কাছে গিয়ে দেখলেন, পীঠিকার ওপর একটি মণিময় থালী, তার ওপর অলংকার—দুষ্প্রাপ্য কালো মুক্তার কণ্ঠী, হীরকখচিত রত্নবলয়, নীলকান্তমণির কর্ণভূষা। সন্দেহ নেই এ সমস্তই জিতসোমার। এবং উপহার। কারো উপহার। সোমা এসব ফেলে গেছে। তিনি আরও দেখলেন সুবর্ণ মুকুর, স্ফটিকের পানপাত্র, রজতের দীপদণ্ড। কারও বা অনেকের উপহার সোমা ফেলে গেছে। কক্ষময় মৃদু, অতিমৃদু নারীগন্ধ পেলেন, নারীসঙ্গবিবর্জিত পুরুষরা যেমন পায়। সেই সৌরভ কক্ষের অপ্রশস্ত শয্যার আচ্ছাদনে, উপাধানে, নাগদন্তে লম্বমান তাঁর বসনগুলিতে। সোমা কি ‘পুষ্পলাবী’ থেকে ‘গান্ধার ভবন’ নিয়মিত আসা-যাওয়া করে? তিনি শ্রান্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন এবং ধীরে ধীরে নির্ভুল বুঝতে পারলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে সোমা তাঁর কক্ষটি ব্যবহার করত, সম্ভবত এখানেই থাকত। বাতাসে কান পাতলে তিনি যেন শুনতে পাচ্ছেন তার মৃদু কণ্ঠ, সে আপনমনে শ্লোক আবৃত্তি করছে, গুনগুন করে গান গাইছে, দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস। এই কক্ষ যেন তার বাতাসে ধরে রেখেছে সোমার কথা, ভাবনা, চিন্তা। কিন্তু তিনি শুধু মৃদু ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন, কথাগুলির মমোৰ্দ্ধার করতে পারছেন না। ভাবনাচিন্তাগুলি বিহঙ্গপক্ষের বাত্যাঘাতের মতো তাঁকে একটু একটু স্পর্শ করে যাচ্ছে মাত্র। তিনি ধরতে চাইলেই সেই স্পর্শভীরু বিহঙ্গগুলি পাখা মেলে উড়ে উড়ে যায়।
নিদ্রা আসতে লাগল। চণক অস্পষ্টভাবে অনুভব করতে লাগলেন: লোলা, সুতনা সেই একসালা গ্রামের বালিকাগুলি, রাজপোতলি গ্রামের সেই মানুষগুলি, বনের মানুষ রগ্গা উদ্দক—এরা অনেক সুবোধ্য। এদের সঙ্গ যেন সদানীরায় স্নানের মতো। কিংবা বিশাল তৃণভূমির মধ্য দিয়ে চমৎকার মৃদুল বাতাসের স্পর্শ গায়ে নিয়ে হাঁটার মতো। শিক্ষা যেমন মানুষের চিত্তবৃত্তি পরিশীলিত করে তেমনি তাকে শেখায় সর্ববিষয়ে দ্বিচারণ, গোপনীয়তা। ক্রমশই যেন তিনি নাগরিক জটিলতার অনুপযুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। স্বপ্নের মধ্যে লোলা তাঁকে কুল্মাষপিণ্ড নিয়ে সাধাসাধি করতে লাগল, উদ্দক হাসি মুখে দেখাতে লাগল সূচীমুখ কাঠের ফলা। তিষ্যকুমার রগ্গাকে নিয়ে একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অশ্বের পিঠে তীরবেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। চণক তাকে রাগত কণ্ঠে ডাকলেন— সোমাকে নিয়ে যাবার কথা, সে কেন রগ্গাকে নিয়ে যায়? ‘বিম্বিসার’…সে বলে গেল ‘বিম্বিসার, বিম্বিসার’…। এবং তারপরই তিনি দেখলেন সোমা লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদছে। কই, কাঁদছে না তো? সর্পিণীর মতো মাথা তুলল, তারপর অদ্ভুত দীপ্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।
জ্বলজ্বলদ্ ধমদ্ধমদ্ বষট্ বষট্— আকাশে বিদ্যুতের রেখার মতো ছুটোছুটি করতে লাগল জিতসোমা। এবং অবশেষে যখন বিধ্যেৎ বলে সূচীসমান তর্জনী যেন তরবারির ফলার মতো সামনে ছুঁড়ে দিল মনে হল সে এই পৃথিবীকেই বিঁধে ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে বুঝি। চণক নিদ্রার মধ্যেই অস্ফুটভাবে হৃদয়ঙ্গম করলেন এই তণ্ডু-তাণ্ডব নৃত্য এক ধরনের বিদ্রোহ, বহুমুখী বিদ্রোহ। শিল্পীর বিদ্রোহ, গণিকার বিদ্রোহ, নারীর বিদ্রোহ। জমছে শক্তি, তেজ, আক্ষেপ, আক্রোশ, প্রাণন শক্তি, মনন শক্তি, পুঞ্জীভূত হচ্ছে, ব্যবহার হচ্ছে না, যেদিন ফেটে বেরোবে মত্ত, করাল জিঘাংসু নগ্নিকার বেশে, কর্মী পুরুষ, ভোগী পুরুষ, যোগী পুরুষ পাংশু মুখে শবের মতো ধরাশায়ী হবে।
নিদ্রা তবু এ যেন নিদ্রা নয়। চেতনার ওপর একটি লঘু আচ্ছন্নতার স্তর পড়েছিল। শরীর নিষ্ক্রিয়। কিন্তু মন তার কাজ করে যাচ্ছে। মন, তার সঙ্গে হৃদয় যুক্ত হয়েছে, যে হৃদয় যুক্তিজাল ছাড়াই বোঝে। বোঝে সোজাসুজি। এ এক ধরনের প্রত্যক্ষ জ্ঞান, চিত্রের রূপ ধরে আসে।
চণক উঠে বসলেন। তাঁর ক্লান্তি দূর হয়নি। এবং স্বপ্নে যা দেখেছেন আধো অন্ধকার কক্ষে তা কতকগুলি ছিন্ন সূত্র কালো মুক্তার মতোই ছড়িয়ে আছে। তাঁর একটা তীব্র ইচ্ছা হল, ইচ্ছা এবং সংকল্প। তিনি যথাসম্ভব দ্রুত বেশবাস করে নিলেন। পেছনের দ্বার দিয়ে গিয়ে অশ্বরক্ষককে জাগালেন। সে চিত্তককে প্রস্তুত করে দিল। তিনি অশ্বরক্ষকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে দিয়ে কুলুপ খুলুপ শব্দ তুলে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। সমস্ত নগরীর গায়ে, পাহাড়ের গায়ে, আকাশের গায়ে রাত্রির অন্ধকার মাখামাখি হয়ে রয়েছে। তারাগুলি দপদপ করে জ্বলছে। কতকগুলি তারা যেন হুড়মুড় করে খসে গেল। উল্কাপাত! যেন একটি ছিন্ন হীরার মালার মতো উল্কাগুলি জম্বুদ্বীপের দিকে ছুটে আসছে। কোন প্রান্তর, কোন রাজ্য, কাকে ধ্বংস করবে ওরা? তিনি কোনও কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না, তবু কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর দ্বিগুণিত সংকল্প নিয়ে সপ্পসৌণ্ডিকপভারের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।
ভুল হয়েছিল। প্রমাদ। প্রকৃত কথা, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তাঁর যেমন কতকগুলি গবেষণা আছে। সমাজনীতি, সমাজে মানুষের বিন্যাস সম্পর্কেও তেমনি কতকগুলি ধারণা আছে। সেগুলি গড়ে উঠেছে বহু ভাবনাচিন্তার পর। গোষ্ঠীবদ্ধতা ব্যাপারটি তাঁর মনোমত নয়। পিতা এবং অন্যান্য ঋষিদের কাছ থেকে শুনেছেন গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের একটি বদভ্যাস হল অন্তর্বিবাহ। ক্রমাগত এই অন্তর্বিবাহের ফল কখনও ভালো হয় না। তক্ষশিলায় ঋষি আত্রেয় পুনর্বসু এ নিয়ে বহু ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। একটি বিদথে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়, তাতে চণক যোগ দিয়েছিলেন। এক সময়ে সহোদর ভাইবোনেরও বিবাহ হয়েছে, কয়েকটি জন নিজেদের উৎপত্তির ইতিহাস এভাবেই নির্দেশ করে। লিচ্ছবিরা, শাক্যরা… এখনও এরা গোষ্ঠীবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে। আর বনেচরদের তো কথাই নেই। সম্ভবত মাতা পিতা ছাড়া আর কোনও সম্পর্কই এদের মধ্যে নিষিদ্ধ নয়। জীবক বৈদ্যর সঙ্গেও তাঁর এ বিষয়ে কথা হয়েছে। জীবকেরও তাই ধারণা। তিনি এবং জীবক উভয়ে আলোচনাকালে বিস্ময় বিনিময় করতেন গৌতমের পরম্পরা নিয়ে। অন্তত তিন পুরুষে এঁরা মাতুলকন্যা বিবাহ করছেন। অথচ গৌতমের মতো প্রতিভা কী করে শাক্যকুলে সম্ভব হল? জীবক বলেন– এরপর থেকে দেখবেন গৌতমের বংশ ক্রমশই বিশেষত্বহীন, সাধারণ হতে আরম্ভ করবে।
চণক হেসে বলেন— গৌতম তো নিজের বংশরক্ষা করতে তেমন উৎসুক নন! ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র যে যেখানে আছে সবাইকারই তো মাথা মুড়িয়ে হাতে ভিক্ষাপাত্র ধরিয়ে দিয়েছেন।
জীবক কিন্তু হাসলেন না। তাঁর মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত কথার উদয় হয়। তিনি বললেন— কে জানে নিজ বংশের সার্বিক অবক্ষয় দেখেই তথাগত এ কাজ করলেন কি না! সত্য সত্যই শাক্যবংশ প্রায় নির্মূল করে দিয়ে এসেছেন তথাগত। তাঁর এ কাজের কোনও ব্যাখ্যা পাই না আমি। অন্যত্র ভক্তদের তিনি ইচ্ছামতো উপাসক বা প্রব্রাজক হতে বলেন, অর্থাৎ নির্বাচনের একটা সুযোগ রাখেন। কিন্তু শাক্যদের উনি ছলে বলে কৌশলে প্রব্রজিত করলেন।
জীবকের বিচারবুদ্ধিকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন চণক। বলেছিলেন— একটা কথা জীবকভদ্র। সঙ্ঘে বিদ্যা বুদ্ধি বিচক্ষণতা এসবের জন্য যাঁরা বিখ্যাত তাঁদের কেউই কিন্তু শাক্য নন। এটা লক্ষ্য করেছেন? শ্ৰমণ আনন্দ তো গৌতমের ছায়া মাত্র। অন্যরা ধ্যানমার্গে হয়ত উন্নতিলাভ করেছেন আমি জানি না, কিন্তু জ্ঞানমার্গ বা বুদ্ধিমার্গে তাঁদের কোনও কৃতির কথা আজও শুনিনি। যতই বলা হোক নির্বাণই বুদ্ধমার্গের লক্ষ্য, আমরা জ্ঞান বুদ্ধি এগুলিকে তো মূল্য দেবোই!
জীবক বললেন— শুধু আমরা কেন? স্বয়ং তথাগতই কি দেন না? তাঁর অগ্রশ্রাবক কারা? মহাপণ্ডিত সারিপুত্ত ও মোগ্গল্লান। অগ্রশ্রাবিকা কাঁরা? দেবী খেমা যিনি রাজগৃহের প্রাসাদেও বিদ্যার জন্য খ্যাত ছিলেন। সম্প্রতি শ্রাবস্তীর উৎপলবর্ণা বলে যে ভিক্ষুণী আরেক অগ্রশ্রাবিকা হয়েছেন, তিনি প্রথামতো উপনয়নের পর পাঁচ বছর বারাণসীতে উপাধ্যায় গঙ্গাধরের কাছে ব্রহ্মচারিণী ছিলেন, পরে শ্রাবস্তীর একজন খ্যাতনাম্নী উপাধ্যায় খুব সম্ভব জ্যোতির্লেখা নাম, এঁর কাছে ত্রিবেদ ও আনুষঙ্গিক সবই শিক্ষা করেছেন। অতি সুন্দরী বলে বিবাহ হতে এর বিলম্ব হচ্ছিল। সেই সুযোগে দেবী জ্যোতির্লেখা নাকি এঁকে পরমবিদুষী করে তোলেন। তা হলে দেখুন। পুত্র রাহুলের ভার তথাগত দিলেন সারিপুত্তকে। কই রাজকুমার নন্দও তো অর্হন হয়েছেন তাঁকে তো দিলেন না!
—আর রাহুল? চণক জিজ্ঞাসা করলেন— রাহুল কি কোনও বিশেষ মানুষ হয়ে উঠছে? না বিনয় পালনের ভারে অবলুপ্ত!
ভাবিত কণ্ঠে জীবক বলেছিলেন— আপনি বুদ্ধমার্গের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন না তাই না দৈবরাত?
চণক সোজাসুজি এ কথার উত্তর দেননি। তিনি বলেন— সাধারণজনের পক্ষে এই মার্গ ভালো জীবকভদ্র। আশ্রয়, অশন-বসনের বাহুল্যও নেই, চিন্তাও নেই, সৎভাবে জীবন যাপনের কতকগুলি নীতি বেঁধে দেওয়া আছে, সেগুলি অনুসরণ করে চলতে পারলে মোটামুটি ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে দিনগুলি কেটে যায়। কিন্তু জীবকভদ্র, আপনারও তো বুদ্ধমার্গের প্রতি তেমন নিষ্ঠা আছে বলে মনে হয় না, যদিও আপনি উপাসক।
—এ কথা বলছেন কেন?
—আপনি যে সাধারণ রোগীর চিকিৎসা করতে চাইছেন না! বা অতি উচ্চ মূল্য চাইছেন চিকিৎসার, সেটা তো ঠিক বুদ্ধের করুণামার্গের উপযোগী হল না!
জীবক হাসতে লাগলেন, বললেন— দৈবরাত আপনার দৃষ্টি দেখছি সব দিকে। ব্যাপারটা কি বলুন তো? জীবক তার পিতৃপরিচয় জানে না, মাতা কে তাও জানে না। রাজানুগ্রহ পেয়েছে রীতিমতো ক্ষমতা দেখিয়ে। প্রথম দিকে তো মহারাজ আমাকে যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখতেন। যা-ই হোক অনেক কৌশল তিনিও করেছেন আমার মন জানতে, আমিও বহু কৌশল করেছি তাঁকে তা জানাতে। এখন এই রাজানুগ্রহ ব্যাপারটা পদ্মপত্রে জলবিন্দুসম। এই আছে এই নেই। যতদিন আছে ভাই করে নিই। আবার শুনতে পাই মহারাজ স্বয়ং আমার পিতা হতেও পারেন, সে ক্ষেত্রে মাথার ওপর একটি খাঁড়া সবসময়ে ঝুলছে বুঝতে পারেন তো? তেমন বুঝলে ধনসম্পদ নিয়ে চম্পট দেবো। অত করুণা করলে জীবকের চলবে না।
চণক হাসলেন কিন্তু বললেন— চম্পট দেবেন? চম্পট কেন? মিথ্যা কারণে অত্যাচার হলে আপনি প্রতিবাদ করবেন না?
জীবক বললেন— ভৈষজ বিদ্যাটি ভালো করে আয়ত্ত করেছি দৈবরাত। সামান্য বুদ্ধি সুদ্ধিও আছে ঘটে, কিন্তু শস্ত্রচর্চা এমন করিনি যে কুমার কুনিয়র সঙ্গে যুঝে পারবো— তা ছাড়া দৈবরাত বৈদ্য শত হলেও একজন মানুষ, তার শারীরিক সাধ্যের একটা সীমা আছে। রাজবৈদ্য বলে রাজ-পরিবারের অমাত্যদের পরিবারের যে যেখানে আছে সবাইকার চিকিৎসা আমাকে করতে হয়। তথাগত এবং সঙ্ঘের চিকিৎসা ভারও আমার। তা হলে? আর সময় কই? বলুন? এর অধিক করতে গেলে জীবকের নিজস্ব সময় বলে কিছু থাকবে না। তার কাজের উৎকর্ষও হয়ত এক প্রকার না থাকতে পারে….।
ভাবনায় ভাবনায় অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছেন চণক। অদূরে রাত্রির কৃষ্ণতার মধ্যে আরও গাঢ় কৃষ্ণিমা সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে সপ্পসৌণ্ডিকপভার। সাপের ফণার মতো পর্বত গাত্র। জিতসোমা অতি বুদ্ধিমতী, বিদুষী হলেও ছিল তাঁর একান্ত অনুগত। এক অহেতুক ভয়ে সংকোচে তিনি তাকে ত্যাগ করে এসেছিলেন। না, ত্যাগ তাকে বলা যায় না। সেই মুহূর্তে তিনি বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল তাঁর সঙ্গ জিতসোমার পক্ষে অশুভ হবে। ভালো করে ভেবে দেখলে মনে হয় তাঁর আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটেছিল। এবং যেহেতু রাষ্ট্রিক কাজে নিজেকে নিবেদন করতে চান সেহেতু ব্যক্তিগত জীবনে জটিলতা পরিহার করতে তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন।
মহারাজ বলছেন জিতসোমা তিষ্যকুমারকে মনস্থির করবার সুযোগ দেয়নি। তিনি জিতসোমার আরক্ষার জন্য সশস্ত্র রক্ষী রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু কুমার কুনিয়কে জিতসোমা নিজেই অনুমতি দিয়েছে গান্ধার ভবনে প্রবেশ করবার। দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক তা নাকি মহারাজ জানেন না। এবং বর্তমানে ‘পুষ্পলাবী’র এই নটীজীবন সোমা নিজেই নির্বাচন করেছে। সন্ধ্যায় নৃত্য-গীতের পর কোনও কোনওদিন কাব্যপাঠ, নানা বিষয়ে আলোচনা ইত্যাদির পর জিতসোমার দ্বার নাকি বন্ধ হয়ে যায়। কারো প্রবেশের অনুমতি থাকে না। ভালো। আজ চণক ভগ্নীর গৃহে যাবেন। এ বার যখন প্রাচীতে যাবেন সোমাকে নিয়ে যাবেন। অতি দুর্গম প্রদেশে যেতে হলে তাকে ভদ্দিয়তে রেখে দেওয়া যায়, চম্পায় মেণ্ডক শ্ৰেষ্ঠীর গৃহে রেখে দেওয়া যায়। একসালা গ্রামে বালিকা লোলার গৃহই বা মন্দ কী? প্রাচুর্যে অভ্যস্ত জিতসোমা। কাকে বলে দরিদ্রতা, কাকে বলে সরল জীবন, নিরাড়ম্বর, নিরুপকরণ, সামান্য আশা আকাঙ্ক্ষার জীবন, দেখুক। রাজশাস্ত্রে এদের কী স্থান হবে? এদের কী গুরুত্ব সে দেবে তিনি জানতে উৎসুক। এক বন্য বালিকাকে স্পর্শ করতে জিতসোমা ঘৃণা বোধ করেছিল …আবার… আবার গৌতম যখন সেই বন্যরমণী…কী যেন নাম হারীতি না? তাকে যখন বশ করলেন সে মুগ্ধ বিস্ময় প্রকাশ করেছিল, গৌতমের নীতির সশ্রদ্ধ সমর্থন করেছিল।
পুষ্পলাবীর কাননে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন চণক, শিশিরসিক্ত মৃত্তিকার ওপর শিক্ষিত চিত্তকের খুরের শব্দ হল না। প্রতি মুহূর্তেই তিনি আশা করছেন রক্ষীদের।
—ও কী? ও কে? চন্দ্রকেতু না? অমাত্য চন্দ্রকেতু?
পেছনের দ্বার দিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে চণকের, তাই তিনি চিনতে পারছেন। এক মুহূর্ত। পরক্ষণেই আর চন্দ্রকেতুকে দেখতে পেলেন না চণক। কিন্তু আরও একটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসছে। একইভাবে। সহসা চণকের কী হয়ে গেল তিনি কটি থেকে ছুরিকা টেনে নিলেন, ক্ষিপ্র হাতে অন্ধকারের বক্ষ ভেদ করে ছুঁড়ে দিলেন। অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুরিকা বিঁধে গেল ছায়ামূর্তির কণ্ঠনালীতে। ঘড়ঘড় মতো একটা মৃদু শব্দ হল, লোকটি সম্ভবত ঝোপঝাড়ের ওপর পড়ল। সংবিত ফিরে এলো চণকের। ওই ছায়ামূর্তি যদি কুমার কুনিয় হয়? যদি হন স্বয়ং মহারাজ?
চণক, কাত্যায়ন, তুমি দিশা হারাচ্ছো। সম্ভবত তোমার চিত্ত তোমার বশে নেই। এইসব অতর্কিত প্রতিক্রিয়া, তড়িৎ-সিদ্ধান্ত, হত্যা, রক্তপাত,— এ সবই তোমার অনেক পেছনে ফেলে আসার কথা ছিল। চণক! চণক!
চকিতে চণক চিত্তকের পিঠ থেকে নেমে ছুটে গেলেন। একটি কামিনীঝোপের ওপর পড়ে আছে লোকটি। কৃষ্ণ বসন পরা, কণ্ঠ থেকে গলগল করে রক্তপাত হয়েছে। না পরিচিত কেউ নয়। একটি অপরিচিত সামান্য মানুষ। মরে গেছে।
পেছনের দ্বারে মৃদু করাঘাত করলেন চণক। সামান্য পরেই জিতসোমা স্বয়ং দরজা খুলে দিল। চোখে নিদ্রার চিহ্নমাত্র নেই। পরিপাটি সাধারণ বেশ। দীর্ঘ বেণী দুলছে। চণককে দেখে তার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠল। চণক আঙুল দিয়ে ঝোপের দিকে দেখালেন।
—ও কী?— এস্ত পায়ে কাননে নেমে এলো সোমা—রুরুকে এ ভাবে মারলে কে?
—আমি।
—আপনি? জেট্ঠ? — জিতসোমা এমনভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সহসা তার চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রু পড়তে লাগল, স্খলিত গলায় সে বলল—রুরু, হতভাগ্য রুরু, রুরু, তুমি বিশ্বস্ত ছিলে, এই কি তোমার অপরাধ?
সে ছুটে ভেতরে চলে গেল। নিমেষের মধ্যে একপাত্র জল নিয়ে ফিরে এলো। তূল ভিজিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে রুরু নামক ব্যক্তির গলায় ঢেলে দিল। লোকটির গলার ভেতরে জল গেল কি না বোঝা গেল না। কিন্তু তার মাথাটি একদিকে হেলে গেল অসহায়ের মতো। জিতসোমা লোকটিকে দু হাতে তুলে ধরল অমানুষিক বলে। কোলে করে নিয়ে দাঁড়াল। পরিশ্রমে তার মুখে বিন্দু বিন্দু স্বেদ ফুটে উঠেছে। চণক দেখলেন তাম্রবর্ণ, খর্বকায়, কৃশ একটি সামান্যদর্শন মানুষ। তিনি বললেন— আমি সাহায্য করছি সোমা তুমি পারবে না।
সোমা প্রাণপণে মাথা নাড়ল— আপনি একে স্পর্শ করবেন না। যা আমার কর্তব্য তা আমাকেই পালন করতে দিন— তার দু চোখ দিয়ে এখন ঝরঝর করে জল পড়ছে।
—এত দূর? এত দূর তোমার অধঃপতন সোমা! ধিক। একটি সামান্য লম্পট! তার জন্য এত! একেবারে ক্রোড়ে তুলে নিয়েছো?
সোমার বক্ষের উত্তরীয় রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। সে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বলল— আপনিও তো একদিন এক নষ্ট-ভ্রষ্ট বন্যবালিকাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন, আসেন নি? মুগ্ধ কাতর নেত্রে চেয়ে থাকতেন তার দিকে দিবসরজনী। তাতে দোষ হয়নি? নাকি সে আপনি দেবরাত পুত্র বলে!
চণকের ক্রোধ আসছে। তিনি রুষ্ট কণ্ঠে বললেন— সে বালিকা নষ্ট-ভ্রষ্ট ছিল না।
—এ ব্যক্তিও লম্পট নয়।
—সকলই তোমার ক্ষমার অযোগ্য মোহ।
—মোহ আপনার, ভ্রম আপনার। আর, কাউকে ক্ষমা করা অথবা না করার দায় সোমা নেয় না।
সোমা উচ্চতম সোপানে দাঁড়িয়েছে এবার। চলে যাবে।
ক্রোধে ক্ষোভে মুখ রক্তবর্ণ করে চণক বললেন— যাও, যাও, সোমা ভিক্ষুণীসংঘে যোগ দাও গিয়ে। স্বাধীনতা কন্দুক নয় যে তাকে হেলায় মলক্ষেত্রে ফেলে দেবে। যাও সোমা যাও যাও…
তিনি আর দাঁড়ালেন না। তীব্রবেগে মুখ ফেরালেন। কয়েকটি ক্ষিপ্র পদক্ষেপে পৌঁছে গেলেন চিত্তকের কাছে। তারপর রাজগৃহের প্রত্যূষ-পথে ধূলার ঘূর্ণাবর্ত ছাড়া কিছু দেখা গেল না।
১৬
কিশোর সোপাক চলেছিল ভিক্ষুণী উপাশ্রয়ের দিকে। হন হন করে। মায়ের সঙ্গে দেখা করবে। দুতিন বছরের মধ্যেই সোপাক অতিশয় প্রজ্ঞাবান হয়ে উঠেছে। সে স্থবির সারিপুত্তর সার্ধবিহারিক। প্রত্যূষে উঠে উপাধ্যায়কে দন্তকাষ্ঠ, মুখ ধোবার জল, ধোয়া চীবর— এসব গুছিয়ে দিয়েছে। উপাধ্যায় এবার ধীরে ধীরে পদচারণা করবেন, তারপর ভিক্ষায় বেরোবেন। সোপাকও বেরোবে ভিক্ষায়। কিন্তু বেরিয়ে প্রথমেই সে যায় ভিক্ষুণী উপাশ্রয়ে মায়ের কাছে। মাকে না দেখে সোপাক থাকতে পারে না। অবশ্য মা এখন এই সময়টা উপাশ্রয়ে থাকেন না।
সোপাক চণ্ডালপুত্র। তিন চার বছর আগে তাকে দেখলে মনে হত একটি শশকশাবক। সর্বদা ভয়ে ভয়ে আছে এই কোনও হিংস্র জন্তু এসে তাকে গ্রাস করে নিল বুঝি বা। সোপাকের অভিজ্ঞতা বলত সংসার এক অরণ্য। হিংস্র, ভয়াল, কিংবা উদাসীন। একমাত্র আশ্রয় মা। অথচ পিতৃব্যপুত্রের জন্মের আগে সে ছিল গৃহের পরম আদরের ধন। সেসব দিনের কথা ক্ষীণভাবে মনে পড়ে সোপাকের। তার হাতে ক্ষীরমণ্ড তুলে দিচ্ছেন পিতৃব্য। নানাপ্রকার খেলনা এনে দিচ্ছেন। সে তখন নিতান্তই শিশু। মা বলতে চান না। কিন্তু দুঃখে দ্বন্দ্বে বড় হয়ে সোপাক যতটা বোঝার তার চেয়ে অধিক বোঝে। তার পিতার মৃত্যুর পর পিতৃব্যের পত্নী হবারই কথা ছিল তার মায়ের। তাদের পরিবারে এ রূপই হয়ে থাকে। হলে কোনও গোল হত না। কিন্তু মা সম্মত হননি। পিতৃব্য বিবাহ করলেন, সেই থেকে পিতৃব্যপত্নী খুল্ল-মা, তাদের বিষচোখে দেখলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর পিতৃব্য গৃহে ফিরলে অভিযোগ আর অভিযোগ। অল্পবয়স থেকেই সোপাক প্রহার খেয়ে আসছে। তর্জন-গর্জন, চপেটাঘাত, মুষ্ট্যাঘাত, কেশের গুচ্ছ ধরে প্রহার। সেদিন মা গেছেন প্রতিবেশী গৃহে মহানসীর কাজে। তাঁকে গৃহের কাজ করা ছাড়াও উপার্জন করে এনে দিতে হয় পিতৃব্যকে। তৈলের ভাঁড় তুলতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে যায়। খুল্ল-মা আর খুল্ল-পিতা তাকে এমন প্রহার করলেন যে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কতক্ষণ পর জ্ঞান এসেছে সে জানে না, কিন্তু জ্ঞান হতে দেখল ঘোর অন্ধকার চারিদিকে, টুপ টুপ করে হিম ঝরছে। অন্ধকারে গোল গোল জ্বলন্ত চক্ষু, ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। আর্তনাদে চক্ষুগুলি সামান্য দূরে সরে গেল, কিন্তু আবার একটু পরে কাছে ঘেঁষে আসতে লাগল। সোপাকের দুর্বল শরীর, প্রহারের ক্ষতগুলিতে যন্ত্রণা হচ্ছে। সে কিছু একটা পিণ্ডজাতীয় বস্তুর সঙ্গে বাঁধা। চেষ্টা করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারল না সে। বস্তুটা কী? কোনও বৃক্ষ বা যষ্টি জাতীয় কিছু তো নয়! বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশ ঘোর কালো। প্রচুর মেঘ সঞ্চয় হয়েছে। সেই বিদ্যুতের আলোয় সোপাক দেখল সে একটি শবদেহের সঙ্গে বাঁধা। আতঙ্কে বালক চিৎকার করে উঠল— ‘মা, মা বাঁচাও। কে কোথায় আছো বাঁচাও…।’
অন্ধকারে কে কোথা থেকে বলে উঠল—‘কে তুমি? কোথায় আছো?’
—আমি সোপাক। একটি মৃতদেহের সঙ্গে বাঁধা আছি।
বিদ্যুতের আলোয় পথ হাতড়ে হাতড়ে এক শ্ৰমণ এসে দাঁড়ালেন। দ্রুত হাতে তার বাঁধন খুলে দিলেন।
—কী ভাবে তুমি এখানে এলে বালক?— স্নেহসিক্ত কণ্ঠ।
সোপাক ফুলে ফুলে কাঁদতে কাঁদতে সব বলল।
—হায় তথাগত, মানুষ এত নিষ্ঠুর!
আর একটি কণ্ঠ বলল— আনন্দ ওকে আমার কোলে দাও।
দুই শ্ৰমণ মিলে তাকে বেলুবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মধ্যরাত্রে তার সর্বাঙ্গ উষ্ণ জলে ধুইয়ে নানা স্থানে অনুলেপন লাগানো হল। পরিষ্কার বস্ত্র পরানো হল। গরম দুধ পান করানো হল। সারা রাত্রি দুজনে তার ব্যথাক্লিষ্ট শরীরে কোমল স্পর্শ বুলিয়ে বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়ালেন। যখন ঘুম ভাঙল চারদিক আলোয় আলো। সে বুঝতে পারল অপূর্ব চন্দনের গন্ধর মধ্যে অতিশয় সুখে সে শুয়ে আছে। এতো সুখ, এতো শান্তি, এতো স্নেহ যেন সে পায়নি কখনও। সেই কক্ষে তখন কেউ ছিল না যেন। অথচ তার কোনও ভয় তো হলই না, একটা নির্ভরতার ভাব, আশ্রয়ের আশ্বাস তাকে ঘিরে রইল। নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে আবার নিদ্রা যেতে যাচ্ছিল সে, একটি গম্ভীর কিন্তু কোমল কণ্ঠ তাকে বলল—এই হল সংসার, সোপাক, এই-ই সংসার, এই-ই সংসার। এখানেই কি ফিরে যেতে চাও?
—না, না, কখনোই না।
—বিলাস, ব্যসনের সুযোগ পাবে না বালক। নিয়ম পালন করতে হবে। তবে বিদ্যা শিক্ষা পাবে।
—মা? আমার মা?
—মাকেও পাবে বচ্চ। সংঘে আসবে কী?
—আসব দেবতা।
—আমি দেবতা নই সোপাক।
—তবে?
—আমি মানুষ।
—আমার মতো?
—তোমারই মতো?
—আমি যে চণ্ডাল!
—তোমার সঙ্গে আমার কোনই পার্থক্য নেই, বালক। শুধু আমি পথ পেয়েছি। তুমি এখনও পাওনি।
সোপাক হন হন করে হাঁটছিল। তার পেছন থেকে এক অশ্বারোহী তীব্র বেগে চলে গেলেন। সোপাক চোখ দুটি ঢেকে ফেলল। ধুলো উড়ছে।
ধূলি। সর্বত্রই শুধু ধূলি, শুধু ভস্ম। সোপাকের অস্তিত্বটি যেন একটি শুক্তির মধ্যে মুক্তার মতো। শুক্তির আশ্রয়ে আছে সে, কিন্তু সেই শুক্তির জোড় সামান্য খোলা। সে টের পায় ঘূর্ণমান ধূসর কল্লোল তাকে ঘিরে। বহু প্রকার মাংসজীবী মৎস্য, জলজন্তু লাঙুল ঝাপটায়। এই রাজগৃহের বাইরে এখনও সে যায়নি। রাজগৃহই তার পৃথিবী। কিন্তু রাজগৃহের পথে বেরোলেই মনে হয়—কেমন অশান্ত, উত্তাল, কেমন হিংস্র এই নগর, যেন দাঁতে নখে তাকে খেতে আসছে। অশ্বগুলি, রথগুলি বুঝি তাকে পিষে ফেলে চলে যাবে। যদি দুইয়ের অধিক তিন ব্যক্তিও কাছাকাছি আসে সোপাক সভয়ে শশক শিশুর মতো পথ ছেড়ে দূরে সরে যায়। এরা যেন সোপাককে দেখতে পাচ্ছে না। যদি তাকে মাড়িয়ে চলে যায়? কিম্বা যদি সহসা হত্যা করে? ধূলি চারদিকে ধূলি উড়ছে। সংসারের ধূলি, মানুষের বিচিত্র কামনা-বাসনার ধূলি। লোভ, রোষ, দম্ভ, ঈর্ষার ধূলি সর্বব্যাপী এক ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের মতো রাজগৃহ নগরকে ঘিরে ঘিরে উৎক্ষিপ্ত করতে চাইছে। ওই যে অশ্বারোহী চলে গেল, কিসের অত বেগ, কোথায় ওকে পৌঁছতে হবে নিমেষের মধ্যে? কিম্বা পালাচ্ছে কী? কোথাও থেকে পালাচ্ছে কী? যেন উন্মত্ত ক্রোধের এক দীর্ঘ পুচ্ছ পথের মধ্যে রেখে গেল। ক্রোধ? কিম্বা…কিম্বা…শোক? উন্মত্ত শোক? দুহাতে মুখ ঢাকে কিশোর সোপাক। এই ধূলির ঝড়ের মধ্যে সে যে একা বেরিয়েছে। কেমন করে পথ পাবে?
মায়ের কাছে বহু কষ্টে পৌঁছল সোপাক। তিনি এই সময়টা ভিক্ষুণী উপাশ্রয় ছেড়ে থাকেন বৈভারগিরির ওপরে একটি কন্দরে। নির্জন সাধনা হয়ত তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু এই নির্জন গিরিগুহায় তিনি প্রাণভরে পুত্রকে আদর করতে পারেন। কেউ দেখবার নেই। কাষায় চীবর পরিহিতা শ্রমণা পুত্রকে বুকে টেনে নেন।
—সোপাক, সোপাক, বচ্চ আমার, কাঁপছিস কেন বাপা?
—মা। নগরীতে বড় ভয়। বুঝি কিছু অমঙ্গল ঘটবে।
—এ তোর কী হল সোপাক। কেন এতো ভয়? এতো বুঝিস কেন? আহা যদি তথাগত তোকে আমার কাছে থাকতে দিতেন! না, না, মা তো তোকে রক্ষা করতে পারেনি। তিনিই তোকে রেখেছেন। তিনি যা বলবেন তাই করবি।
—তাই করি মা। তাই করি। যখন তাঁর সঙ্গে থাকি, বেলুবনেই হোক, সিতবনেই হোক, কোনও ভয় থাকে না তো মা! বাইরে পা দেবামাত্র নগর যেন লুব্ধ পশুর মতো আমাকে তাড়া করে আসে। —সোপাক কেঁদে ফেলে।
—ভগবান তথাগতকে বলিস নি এ কথা?
—না।
—বলবি। বিলম্ব করবি না।
—শোন সোপাক একটু কাঞ্জিক খা। গোধূমের পুরোডাশে ভিজিয়ে।
—কোথায় পেলে মা? সঞ্চয় করছো?
—না, বাপা। গিরিগুহায় থাকি। মোড়ানো মাথা। গায়ে শ্রমণার বস্তর। লোকে মনে ভাবে কত বড় সন্ন্যাসিনী বুঝি। দিয়ে যায়। আজ প্রভাতেই দিয়ে গেছে।
—মা, আমরা একাহারী। সারাদিন ভিক্ষার পর মধ্যদিনে খাই।
—মরে যাই বচ্চ, তুমি বালক, তুমি কখনও এতোক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারো? প্রভাতে যাউ বা কাঁজি খেতে তো নিষেধ নাই।
—কিন্তু মা, পুরোডাশ?
—খাও সোপাক, মায়ের হাতে খেলে তোমার উপাধ্যায় রাগ করবেন না।
—তা হলে তুমিও খাও মা।
দুখিনীর চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। বললেন—আবার আমি কেন বচ্চ! আমি তো আর তোমার মতো বালক নই?
—তা হলে আমিও খাবো না মা—সোপাক উঠে দাঁড়ায়।
—বোস, বোস, কোথায় যাস বচ্চ। ঠিক আছে, আমি খেলে যদি তোর অনাগামি ফল লাভ হয় তো খাচ্ছি।
গিরিগাত্র বেয়ে মাতা পুত্র নেমে আসে।
—কোন দিকে যাবি এখন সোপাক?
—পুব পল্লীতে যাই মা? সোপাক এখন অনেকটা শান্ত।
—তাই এসো বচ্চ। ওদিকে হাট রয়েছে। যা পাবে নিয়ে তাড়াতাড়ি সঙ্গে চলে যেও।
পুব পল্লী থেকে ফেরবার পথে একটি রোরুদ্যমানা রমণী সোপাকের পথ রোধ করল। সোপাকের চোখে ধন্দ। একটু পরে সে বুঝতে পারল এ তার খুল্লমাতা।
—সোপাক, সোপাক, রুরু কোথায় জানো?
—রুরু? রুরু কে?
—ছল করছো? রুরুকে জানো না? রুরু আমার ছোট ভাই।
তখন সোপাকের মনে পড়ল রুরু নামে এক ব্যক্তি অদ্ভুত অদ্ভুত অসময়ে তাদের গৃহে আসত বটে। তার খুল্লমার অতিশয় আদরের ভাই। এলেই গৃহের যাবতীয় সুখাদ্য তার সামনে ধরে দিতেন খুল্লমা।
—রুরু কদিন আমার কাছেই ছিল। সন্ধ্যায় কাজ আছে বলে বেরোলো। আজ দেখো সুয্যি মাঝ আকাশে চড়তে গেল তবু তার দেখা নেই। সে আমাকে নিশ্চয় করে বলেছিল আজ গৃহে আমার কাছে পলান্ন পায়স খাবে…কী সোপাক কথা বলছো না কেন?
সোপক একটা গভীর বিস্ময়ের ঘোরের মধ্যে ছিল। যে রমণী এক বালককে সামান্য কারণে বা অকারণে প্রহার করে মৃতপ্রায় করে ফেলে তাকে আমক শ্মশানে মৃতদেহের সঙ্গে বেঁধে রেখে আসতে পারে, সে-ই আবার আরেক ব্যক্তির ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় এমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদে! কী অদ্ভুত মানুষ! কী অদ্ভুত গতি স্নেহের!
—কথা বলছো না কেন?
—আমি কী করে জানবো? সোপাক শান্ত স্বরে বলে।
—তোমারই অভিশাপ। তোমারই অভিশাপ। সমন হয়েছ। ইদ্ধি হয়েছে। এখন আমাদের ওপর শোধ নিচ্ছো। —ক্রুদ্ধ স্বরে বলল রমণী। তারপর সহসা কেমন যেন ভেঙে সোপাকের পায়ের কাছে পড়ে গেল। গদ গদ কণ্ঠে বলতে লাগল—সমন সোপাক, সমন সোপাক দয়া করো, কোথায় কী বিপদে পড়েছে রুরু আমায় বলে দাও। আমি তোমায় দান দেবো। তার পায়ে মাথা খুঁড়তে লাগল খুল্লমাতা।
সোপাকের চলে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে অথচ সে যেতে পারছে না। তার পা দুটি বন্দী। তার সারা শরীর ঘিরে কেমন ভয়ের ঘোর। প্রত্যূষে রাজপথে যেমনটা সে অনুভব করেছিল। যেন দলে দলে সশস্ত্র মানুষ আসছে। একে অপরের মাথা কেটে নিচ্ছে। রুধির বইছে। পথে পথে রুধিরের স্রোত। সে শুধু অস্ফূটে বলল—বিপদ, বড় বিপদ জননী। রাজসভায় যান, সাহায্য চান।
হাতদুটি খসে গেল সোপাকের পা থেকে। রমণী ছুটে চলে গেল। সোপাকের পিণ্ডপাত্র হাত থেকে পড়ে গেছে। তার বাসিটি কোথায় তাও সে জানে না। উদ্ভ্রান্তের মতো সে বেলুবনে ফিরে এলো।
সন্ধ্যাবেলায় আমক শ্মশানে শবের স্তূপের মধ্যে রুরুর মৃতদেহ পাওয়া গেলে, ধীরে ধীরে নগরে সঙেঘ সর্বত্র রটে গেল চণ্ডাল বালক সোপাকের অলৌকিক ইদ্ধিলাভ হয়েছে। তার উপাধ্যায় আদেশ দিলেন সোপাক এখন ভিক্ষার্থে নগরে বেরোবে না। অন্য ভিক্ষুরা তাঁদের ভিক্ষাভাগ দেবেন তাকে। সে শুধু ধ্যান এবং নিভৃত-শ্রবণে শিক্ষালাভে দিন কাটাবে।
বিম্বিসার বললেন—পথে পথে ঘোষণা করাই। কেউ যদি রুরুর মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু জানে। …আমার রাজ্যে আগে কখনও এমন ঘটেনি সোমা।
সোমা শিউরে উঠে বলল—মহারাজ, চর মাত্রেই বিপজ্জনক জীবিকা নেয়। কখন…কোথায়…কীভাবে…। কী প্রয়োজন? ছেড়ে দিন।
—প্রয়োজন? তোমায় যে বললাম এ রাজ্যে আগে কখনও এমন ঘটেনি সোমা। তোমার কি মনে হয় কুনিয়র লোকেরাই ওকে হত্যা করল?
—কোনও সিদ্ধান্তে আসবেন না মহারাজ। আমার কাছে কর্ম করতে এসে লোকটি নিহত হল, এটাই আমার দুঃখ…লজ্জা…। সোমার মুখ অতি বিষণ্ণ।
প্রথমটা মহারাজ নীরবে ছিলেন। সম্ভবত ইতিকর্তব্য কী ভাবছিলেন। হঠাৎ মুখ তুলে বললেন—তোমার কাছে কর্ম করতে ‘এসে’ লোকটি নিহত হল? কোনও বিশেষ অর্থে বলছো না কি? ও কি নিহত হবার পূর্বে তোমার কাছে এসেছিল।
—ও তো ইদানীং প্রায় প্রতি রাত্রেই আসত…সোমা বিবর্ণ মুখে বলে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন একবার মহারাজ।
সোমা বলল—মহারাজ, যাই হোক, ও বড় মূল্যবান সংবাদ দিয়ে গেছে। এখন আপনার প্রধান কর্তব্যই হবে কুমারকে ছলে বলে চম্পায় পাঠানো। অমাত্য বর্ষকারকে পদচ্যুত করবেন কি না ভাবুন।
—বর্ষকারকে পদচ্যুত করলে আরেকটি মহাশত্রু সৃষ্টি করা ছাড়া কিছুই হবে না সোমা।
—সেইজন্যই ভাবতে বলছি। অন্ততপক্ষে তাকে দূরে রাখুন। অমত্য চন্দ্রকেতু যাতে আপনার কাছে কাছে থাকেন, সেই মতো ব্যবস্থা করতে হবে। অমাত্য সুনীথ সম্পূর্ণভাবে বর্ষকারের অনুবর্তী। স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে কিছু না করলেও তাঁকে বিশ্বাস করা যায় না। আপনার রক্ষীদলকে আরও সুসংবদ্ধ করুন।
অন্যমনস্কের মতো বিম্বিসার বললেন— বন্ধুরা শত্রু হয়ে যাচ্ছে, রক্ষী নিয়ে কী করবো সোমা?
কিন্তু রুরুর মৃত্যু নিয়ে নগরে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা হঠাৎই মরে গেল। ঘটনাটা ঘটেছিল এইভাবে:
সেদিন স্থবির সারিপুত্ত ভিক্ষায় বেরিয়েছিলেন। পূর্বপল্লীর মুখে লোক জমাছিল।
—একটি লোক নিহত হল, তার হন্তা কে বোঝা যাবে না? সকলে ভারী উত্তেজিত।
—শাস্তি হবে না অপরাধীর?
—বাঃ ভালো রাজ্য হয়েছে…
—আগে কখনও এমন হয়নি!
রাজা যদি সমনের পরামর্শে রাজ্য চালান। তো এমন হবে না তো কী?
—কে বলল আগে এমন হয় নি? …গম্ভীর কণ্ঠে সারিপুত্ত বললেন, ফিরে তাকাল সবাই।
অসুরেন্দ্র ভরদ্বাজ এদের দলপতি। সে-ই সবচেয়ে সোচ্চার।
—আপনি বলছেন আগে হয়েছে? —সারিপুত্তকে দেখে অসুরেন্দ্র সসম্ভ্রমে বলল।
—হয়েছে যে এমন অনুমান করতে পারি সমন সোপাকের ঘটনা থেকে।
—সমন সোপাকের ঘটনাটা কী?
সোপাকের পিতৃব্য আর তার পত্নী তাকে প্রহার করে অর্ধমৃত অবস্থায় আমক শ্মশানে শবদেহের সঙ্গে বেঁধে আসে। ঘোর অমাবস্যার রাত্রে। একাদশ বর্ষীয় বালক একটি…আপনারা কি মনে করেন একটি বালককে হত্যার চেষ্টা ঘৃণ্য অপরাধ নয়।
অসুরেন্দ্র শিউরে উঠে বলল— বলেন কী? তারপরে?
—তারপর সমন আনন্দ ও ভগবান তাকে উদ্ধার করেন, সে এবং তার দুঃখিনী মা দুজনেই এখন সঙ্ঘে যোগ দিয়েছেন। …এই রুরু তো শুনতে পাচ্ছি সেই পাষণ্ড পিতৃব্যেরই শ্যালক!
—আপনি কি বলছেন বালক সোপাকের হয়ে কোনও মহাশক্তিই এই প্রতিশোধ নিয়েছেন?
—আমি কিছুই বলছি না ভদ্র, আপনারা বলাবলি করছিলেন এ রাজ্যে আগে কখনও এমন হয় নি…আমি তারই সাধ্যমতো উত্তর দিলাম। …আর ভদ্র এ জন্য রাজাকে দোষ দেওয়া অনুচিত। কোথায় কোন বালকের খুল্লমাতা-পিতা তাকে প্রহার করে মেরে ফেলছে রাজা কী করে জানবেন? যদি না বালকের প্রতিবেশীরা তাঁকে জানায়? রাজ্য-শাসনযন্ত্রের কতকগুলি স্তর থাকে ভদ্র। প্রাথমিক স্তর পরিবারে। তার পরে সমাজ। সমাজ…যদি এই সকল অন্যায়-অবিচারের প্রতি চোখ বুজিয়ে থাকে, শাসন যন্ত্র কী করবে? সেক্ষেত্রে যতগুলি পল্লী ততগুলি চর, এবং উপযুক্ত সংখ্যক রাজভট রাখা প্রয়োজন। আপনার পল্লীতে আপনি গৃহের বালক-বালিকা-নারী-দাসেদের প্রতি কী ব্যবহার করছেন দেখবার জন্য চর ঘুরঘুর করলে আপনার ভালো লাগবে?
অসুরেন্দ্র বললেন— সত্যই ভালো লাগবে না। আপনি ঠিকই বলেছেন সমন।
—প্রতিবেশীর দায়িত্ব আছে, সমাজের দায়িত্ব আছে। শাসনযন্ত্র একা কী করবে? বলতে বলতে স্থবির সারিপুত্ত চলে গেলেন।
রুরুর হত্যা থেকে এখন সমালোচনাটি ঘুরে গেল। সোপাকের প্রতি তার আত্মীয়দের অমানুষিক ব্যবহারের প্রতি এবং অনিবার্যভাবে সোপাকের অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি।
১৭
দেবরাতপুত্র চণক এসব কিছুই জানতেন না! জানবার অবস্থাও তাঁর ছিল না। জীবনে কখনও তিনি এরূপ উত্তেজিত হননি। সে রাত্রে গান্ধারভবনে তিনি আদৌ ফেরেননি। চলে গিয়েছিলেন উত্তরদুয়ার পেরিয়ে নগরীর বাইরে। প্রত্যূষে দুয়ার খোলবামাত্র। নগরপ্রাচীর, নগরপ্রত্যন্ত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম, শস্যক্ষেত্র তারপর ক্রমে ক্রমে পাটুলিগ্রাম। এবং গঙ্গা। পাটুলিতে গঙ্গার ধারে পাথরের সুন্দর বিশ্রামগৃহ। এইখানে বসে জলের দিকে তাকিয়ে চণক স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তিনি সম্পূর্ণ অন্যমনা। নানা ভাবনা ও ভাব তাঁর চিত্তের মধ্য দিয়ে যাওয়া-আসা করছে, কোনটিই স্থিত হচ্ছে না। প্রায় তিন দিন দুই রাত তাঁর এখানেই কেটে গেল। অতিশয় ক্ষুধা বোধ হলে হাটে গিয়ে কোনও সমাশালয় থেকে খেয়ে আসেন। চিত্তককে খাওয়ানো কোনও সমস্যাই নয়। পাটুলি অত্যন্ত সম্পন্ন গ্রাম। অশ্বরক্ষার জন্য মন্দুরাও এখানে আছে। এই বিশ্রামগৃহের অদূরেই আছে একটি ভালো মন্দুরা। চিত্তককে আপাতত সেখানেই সমর্পণ করেছেন তিনি। গঙ্গার বহমান জলধারার দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রহরগুলি কাটছে।
তৃতীয় দিন সকালে সহসা তাঁর অত্যন্ত কাছে বসে কেউ বলল– দৈবরাত, আপনি এখানে!
চমকে মুখ তুলে চণক দেখলেন— অমাত্য বর্ষকার!
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে চণক বললেন— আমিও তো আপনাকে একই প্রশ্ন করতে পারি অমাত্যবর?
—প্রশ্ন করলে উত্তর দেবো ভদ্র। আমি এবং সুনীথ এই স্থানে অর্থাৎ গঙ্গাতীরে একটি দুর্গের উপযুক্ত স্থান দেখে বেড়াচ্ছি। অর্থাৎ সন্ধান করছি।
—দুর্গ? ও—চণক অনুৎসুক স্বরে বললেন।
—আপনি কি মনে করেন না পাটুলি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান? পূর্ব-দক্ষিণের বাণিজ্যদ্বার, শক্তিশালী বজ্জি রাজ্যের ঠিক বিপরীতে এর অবস্থান। গঙ্গা-হিরণ্যবাহর সঙ্গমস্থল। ধনার্থী-রণার্থী-পুণ্যার্থী সবাইকার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম এই অনুপম স্থানটি…নয়?
চণক তখনও নীরব রয়েছেন দেখে বর্ষকার গলায় একপ্রকার আক্ষেপের শব্দ করে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন— হল কি দৈবরাত? আপনিও কি আবার সোতাপত্তি মগ্গে প্রবেশ করলেন নাকি? সর্বনাশ!
চণক হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন, বললেন— কী বলছিলেন অমাত্য?
—বলছিলাম, মহারাজকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না, এই পাটুলিতে দুর্গ রচা প্রয়োজন। উত্তর-পশ্চিম থেকে মগধ আক্রান্ত হলে শত্রুসৈন্য এই স্থানেই অবতরণ করবে। তাদের বাধা দেবার উপযুক্ত ব্যবস্থা এখানেই থাকা উচিত। নয় কী!
চণক চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন— হতে পারে…নিমেষ পরে আর একটু উৎসাহ ও আস্থার সঙ্গে বললেন—ঠিকই। রাজগৃহ পর্যন্ত তাদের যেতে দেওয়া ঠিক নয়…
বর্ষকার নিজের ঊরু চাপড়ে বললেন— ঠিক এই কথাটাই আমি মহারাজকে বোঝাতে পারছি না। উনি সর্বদাই রাজগৃহের প্রাচীর, প্রাকৃতিক সুরক্ষা ইত্যাদির কথা বলে থাকেন। রাজগৃহ যেন মহারাজের প্রথম সন্তান। আর কিছু তার সমকক্ষ হোক তা তিনি চান না। অথচ এরূপ কোনও পক্ষপাত রাজার উপযুক্ত নয়। দৈবরাত, আপনি যদি সময় করে মহারাজকে বোঝান…
চণক জিজ্ঞেস করলেন— মহারাজের সম্মতি ছাড়াই কি আপনারা দুর্গ-স্থল অনুসন্ধান করছেন?
—করছি দৈবরাত, ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সমস্যাটা হল কি জানেন? আমরাও দণ্ডনীতি জানি, বার্তা জানি, তার ব্যবহারিক প্রয়োগ করতে করতে বহু সমস্যা ও তার সমাধান মাথায় আসে। শুধু মহারাজের আজ্ঞাবহ ভৃত্য হয়ে কাল কাটাতে পারি না।
অমাত্য সুনীথ এই সময়ে উত্তেজিত হয়ে কোথা থেকে ছুটে এলেন।
—অমাত্য বর্ষকার, অমাত্য বর্ষকার! দুর্গের উপযুক্ত স্থান আর একটু পশ্চিমে পেয়েছি।
চণককে দেখে তিনি থেমে গেলেন।
—মহামান্য দৈবরাত যে! আপনি এখানে?
চণক উত্তর দিলেন না। একটু হাসলেন শুধু। বর্ষকার ও সুনীথ পরস্পর চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
চণক বললেন— আমার প্রত্যাবর্তনের সময় হলো। নমস্কার অমাত্যগণ।
কিছুদূর গিয়ে তাঁর কী মনে হল, দাঁড়ালেন, সামান্য পথ ফিরে এসে বললেন— আমি কোনও চরকর্ম করতে এখানে আসিনি।
এবার তিনি দ্রুত মন্দুরার দিকে গেলেন, চিত্তককে সংগ্রহ করলেন। কিছুক্ষণ পরেই রাজগৃহ অভিমুখে তাঁর ঘোড়া ছুটল। তিনি বোধিকুমার ও জননী সুমেধার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ভুলে গিয়েছিলেন।
চলতে চলতে তাঁর মনে হল— শ্ৰীমতী? শ্রীমতী কি ফিরেছে? যদি তার সন্তান নির্বিঘ্নে জন্মে থাকে তা হলে এতদিনে তার বেশ কয়েক বৎসর বয়স হয়ে যাবার কথা। তাকে তিনি তক্ষশিলায় পাঠাবেন। রাজার কাছে ওই লম্পটটিকে হত্যা বিষয়ে স্বীকারোক্তি করা ভাল। চন্দ্রকেতু যদি বিদ্ধ হত? তা হলে এতক্ষণে রাজগৃহে কোলাহল পড়ে গেছে। তিনি অনেক চেষ্টায় মনটিকে অন্য চিন্তায় ফেরালেন। দ্রুত পথ অতিক্রম করতে লাগলেন। একটি রথ চলে গেল তাঁর পাশ দিয়ে, রথ স্বহস্তে চালাচ্ছেন একজন বীরপুরুষ, পাশে সূত। ভেতরে বসে একটি শ্রমণ। দৃশ্যটি অদ্ভুত লাগল তাঁর। কে ওই বীরপুরুষ? রূঢ়দর্শন। কিন্তু সম্ভবত বয়সে একেবারেই যুবক। দাম্ভিক, রীতিমতো শক্তিধর… প্রায় রাজগৃহের প্রাকার পর্যন্ত চলে আসার পর চণকের মনে হল— এ নিশ্চয় কুমার কুনিয়।
ভেতরে শ্রমণটি কে? তথাগত? তিনিও তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন। রথটিও চলেছিল আট পা তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে। কাষায় বস্ত্র ও মুণ্ডিত মস্তকের একটা স্মৃতি রয়েছে মাথায়। কিন্তু তথাগত নয়। অন্য কেউ। কে?
গান্ধারভবনে গিয়ে স্নান সাজসজ্জা আহার করে পরিতৃপ্ত হলেন চণক। তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে পুষ্পলাবীতে যেতে। জানেন না, আজ অনুষ্ঠান আছে কি না, কিন্তু শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে প্রস্ফুটিত কুসুমের গান, দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে সেই মহাকালের নৃত্য। কিন্তু গোপনে। কেন কে জানে জিতসোমার মুখোমুখি হতে তাঁর ইচ্ছা হচ্ছে না।
সন্ধ্যার পূর্বেই তিনি রাজপ্রাসাদে মহারাজ বিম্বিসারের দর্শনার্থী হয়ে গেলেন। কূটকক্ষে আহূত হলেন চণক।
—মহারাজ, আপনাকে আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত তো এখনও কিছুই বলা হয়নি— কেমন অস্থির যেন আজ চণক রাজাও যেন কেমন অন্যমনা। বিমর্ষ।
—আমি শোনবার জন্য উৎসুক হয়ে আছি আচার্যপুত্র। বললেন, কিন্তু কেমন নিরুৎসুক।
—শুনুন, দু-তিনটি নতুন জনপদ বসিয়ে এসেছি, বন কেটে। অর্থ দিয়েছেন ভদ্দিয়র শ্রেষ্ঠী মেণ্ডক। আর প্রচার করে এসেছি।
—কী প্রচার করেছ চণক?
—প্রচার করেছি মহারাজ বিম্বিসার প্রজাপালক, উদারহৃদয়। মহারাজ পিতার মতো বৎসল, দেবতার মতো শক্তিধর, কিন্তু তিনি প্রজাদের কাছ থেকে বিপদের সময়ে সৈন্যবলের প্রত্যাশী। তিনি চান প্রতিটি গ্রাম আত্মরক্ষায় সমর্থ হোক।
বিম্বিসার উঠে বসলেন, বললেন— তুমি তোমার উপযুক্ত কাজ করেছ আচার্যপুত্র। তুমি চক্রবর্তী রাজার চক্রস্বরূপ। কিন্তু হায় এ চক্র ধারণ করবার মতো রাজা বুঝি আর নেই!
—এ কথা বলছেন কেন মহারাজ?
—নানান জটিলতায় ক্রমশই জড়িয়ে যাচ্ছে রাজ্যের ভাগ্য, রাজার ভাগ্য…
মহারাজের হতাশাব্যঞ্জক মনোভাবকে প্রশ্রয় দিলেন না চণক। বললেন— ভাল কথা, আমি একটি গর্হিত কাজ করে ফেলেছি। দণ্ডনীতির দিক থেকে গর্হিত, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত নীতির দিক থেকে কাজটি শ্লাঘ্য।
—অর্থাৎ! বিম্বিসার ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন।
—‘পুষ্পলাবী’র নগরশোভিনীর গৃহে রাত্রিচর একটি লম্পটকে আমি হত্যা করেছি।
—তুমি! বিম্বিসার চমকে উঠলেন— সোমা জানে?
—অবশ্যই! মুমূর্ষু প্রণয়ীকে অন্তিম জলগণ্ডুষ তো সে-ই দিল। আপনি বিচার করে আমার যা শাস্তি প্রাপ্য মনে করেন, দিন।
বিম্বিসার গম্ভীর হয়ে বললেন— এ অপরাধের প্রকাশ্য বিচার তো হওয়া সম্ভব নয় দৈবরাত!
—কেন?
—তাতে শুধু তুমি নও, জিতসোমা, মগধের শুভাকাঙ্ক্ষী অমাত্যরা এবং শেষ পর্যন্ত মহারাজ বিম্বিসারও জড়িয়ে পড়বেন।
চণক অনুভব করলেন, তিনি ধীরে ধীরে আবার উত্তেজিত হয়ে উঠছেন।
মহারাজ বললেন— চণক, জিতসোমা আমার অমাত্য, পূর্বেও তোমাকে বলবার চেষ্টা করেছি, বিশ্বাস করনি। আবারও বলছি, নগরশোভিনীর এই আয়োজন, এ তার ছদ্মবেশ। রাত্রে তার কাছে প্রণয়ীরা যায় না। যায় চরেরা। এবং বিম্বিসার-ভক্ত অমাত্যরা। কুনিয়-পন্থী অমাত্যদেরও সে সমান আতিথ্য দেয়, কিন্তু তা শুধুই তার রাজকার্য করতে। যে ব্যক্তিকে তুমি হত্যা করেছ, সেই রুরু একটি সামান্য চর।
চণক বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইলেন।
বিম্বিসার বললেন— জিতসোমা প্রশংসনীয় অমাত্য-কর্ম করেছে চণক। অতি অল্পকালের মধ্যে সে শ্রেষ্ঠী ও অমাত্যদের মধ্যে কারা বিম্বিসারের শত্রু, আবিষ্কার করেছে। আবিষ্কার করেছে, বিম্বিসারের ঘনিষ্ঠতম অমাত্যরাই কুমার কুনিয়র সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছেন। এবং এঁদের প্ররোচিত করছেন একজন শাক্যপুত্রীয় শ্রমণ—দেবী রাহুলমাতার সহোদর— ভগবান তথাগতর নিজের শ্যালক—স্থবির দেবদত্ত। … তাই বলছিলাম, চক্র হল কিন্তু চক্র ধারণ করার মতো রাজা হয়ত আর থাকবে না।
চণক ঘটনার বিবরণে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন। এবার তিনি পাটুলি গ্রামে দুর্গ, বর্ষকার-সুনীথ, এবং রথারোহী কুমার ও শ্রমণের দৃশ্যগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারলেন। সেই সঙ্গে সোমার জল-ভরা চোখ ও দৃপ্ত ভঙ্গি মনে পড়ে তিনি নির্বাক হয়ে রইলেন। ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতায় এমনই বিভ্রান্ত ছিলেন যে মহারাজের শেষ কথাগুলি তাঁর কান এড়িয়ে গেল। তিনি অভিমানহত গলায় বললেন— সোমার সমস্ত ব্যাপারটি আমায় পরিষ্কার করে বলা কি আপনাদের উচিত ছিল না?
—সমস্তটাই গুপ্ত। কেউ জানতে পারলে সর্বনাশ!
—আমার থেকেও গুপ্ত?
—তোমাকে সব খুলে বলতে নিষেধ ছিল দৈবরাত।
কার নিষেধ মহারাজ?
—সোমার।
—এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে একজন নারীর নিষেধের কী মূল্য মহারাজ!
—কিন্তু এই নারী বিদুষী, দণ্ডনীতিতে অভিজ্ঞ। নূতন পথ প্রদর্শন করছে সে, তার মতামতের মূল্য নেই? তুমি তার আচার্য, তুমিও এরূপ বলছো!
—মহারাজ, সোমা বিদুষী, তত্ত্বজ্ঞারূপে আপনার রাজ্যের গোপন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে পথ নির্দেশ করছে। কিন্তু আমাকে জানাতে নিষেধটা সে করেছে অভিমানে। এবং নারী অতিমাত্রায় আবেগতাড়িত ও স্পর্শকাতর বলেই অতিবিদূষী হওয়া সত্ত্বেও তাকে গুরত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করার আগে দুবার ভাবতে হয়। ব্যক্তিসত্তার থেকে নৈর্ব্যক্তিক কর্মীসত্তা স্বতন্ত্র করতে পারে না সে।
—সকল পুরুষই কি তা পারে?
—পারে না মহারাজ। ঠিকই। কিন্তু পারতে হয় এবং বহুকাল ধরে পারতে পারতে এটা পুরুষের অভ্যাস হয়ে গেছে।
—তা হলে তুমি বলছ, সোমাকে অমাত্য নিয়োগ করে আমি ভুল করেছি?
চণক নীরবে দু দিকে মাথা নাড়তে লাগলেন। যেন, তিনি কী বলবেন ঠিক করতে পারছেন না।
—বলো, কিছু বলো বন্ধু! বিচারটা ঠিক করলে কি না ভাবো।
—ভাবছি, ভাবছি মহারাজ… সোমার অহেতুক গোপনীয়তার কারণে একটি নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যাকারী হতে হল। নিহত হল আরেক ব্যক্তি। নিহতর চেয়ে হত্যাকারীর ভাগ্যই কি ভাল?
হত্যাকারীর ভাগ্য নির্ধারণ, আমি রাজা আমি যা হয় করব। তুমি এ নিয়ে অনর্থক চিন্তা না-ই করলে!
—মহারাজ, সে চিন্তার কথা বলছি না। একটি ব্যক্তিকে শুধু শুধু হত্যা করেছি এ কথা ভাবলে নিজেকে কলঙ্কিত লাগে ভয়ানক। চণক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। —
ক্ষত্রিয়দের ওরূপ কত হত্যা করতে হয়! তা ছাড়া বন্ধু তুমি তো জেনেশুনে করোনি! যাই হোক, আমি তোমাকে শাস্তি দেবো, ভেবো না। শুধু প্রকাশ্যে দেওয়া সম্ভব নয়। এইটুকু। আমার আর একটা অনুরোধ, এই দুঃসময়ে তুমি আমার পাশে, রাজগৃহে থাকো।
ক্ষণকাল ভেবে চণক বললেন— স্বীকৃত হলাম।
কিন্তু এর কয়েক দিন পর বোধিকুমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে চণকের স্বাভাবিক স্থৈর্য আবার টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
সকালবেলা রাজগৃহ নগরী রৌদ্রে স্নান করছে। ক্রমশই তপ্ত হয়ে উঠছে পথ। চণক দেখলেন বোধিকুমারের গৃহদ্বার খোলা। সকালে বন্ধ থাকবার কোনও কারণও অবশ্য নেই। কিন্তু মাতা-পুত্র উভয়ে গালে হাত দিয়ে গৃহদ্বারের প্রান্তে বসে আছেন। মুখ যারপরনাই বিষণ্ণ।
চণককে দেখে বিস্ময়ে প্রায় লাফ দিয়ে উঠল বোধিকুমার। আলিঙ্গন করার জন্য এগিয়ে আসছিল। সহসাই সে পিছিয়ে গেল।
—কী ব্যাপার? —চণক হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন—সব কুশল তো?
দেবী সুমেধা বললেন—আজ দশম দিন হল।
‘কিসের দশম দিন?’
প্রথমে.কেউ উত্তর দিল না।
একটু পরে বোধিকুমার বলল— শ্ৰীমতীর মৃত্যুর।
‘শ্রীমতী… মারা গেছে?’ চণক ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন।
সুমেধা বললেন—বচ্চ চণক, মারা গেছে অত্যন্ত দুঃখের কথা, শোকের কথা। কিন্তু তার জন্য শোক করছি না। আজ দশ দিন হয়ে গেল হতভাগিনীর সৎকার হল না।
‘—সে কী? কেন জননী!’
—রাজাদেশে, সমন গৌতমের আদেশে…
—অর্থাৎ?
উত্তরে চণক এই কাহিনী শুনলেন : শ্ৰীমতী সন্তান জন্মের পর দ্বিগুণ রূপ যৌবন নিয়ে রাজগৃহে ফিরে আসে। এবং তার গৃহে নিয়মিত নৃত্য-গীত-সভাও বসাতে থাকে। বোধিকুমার তার নিষ্ক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল, দেবী সুমেধা তাকে সাদরে পুত্রবধূ বলে গ্রহণ করবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু শ্ৰীমতী সবিনয়ে এ সকল প্রত্যাখ্যান করে পূর্ববৎ জীবনযাপন করতে থাকে। বোধিকুমার নিয়মিত তার সভায় যেত। দিন দশ আগে গিয়ে শোনে শ্রীমতীর প্রবল জ্বর এসেছে। বৈদ্য ঔষধ দিয়ে গেছেন। বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। প্রতিদিনই সে শ্ৰীমতীর সংবাদ নিতে যেত, কিন্তু দাসী চন্দা দেখা করতে দিত না। তিনদিন জ্বরভোগের পর মধ্যরাতে শ্রীমতীর যন্ত্রণার অবসান হয়। তার দেহ দাসেরা বয়ে নিয়ে যায় শ্মশানে। চিতা জ্বালাবে, এমন সময় সমন গৌতম তাঁর একটি তরুণ শিষ্যকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন।
—কেমন? এ-ই তো সেই নারী? —সমন শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন।
—হ্যাঁ ভন্তে, এই সেই লাবণ্যকোমল, মধুরা, গীতকুশলা, অপরূপা রমণী যাকে দেখে আমার মনে হয়েছে প্রব্রজ্যা প্রকৃতপক্ষে প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়।
সমন হেসে বললেন—ভালো, সেই মোহন দেহকাণ্ডের আর রইল কী? যা কোমল দেখেছিলে তা এখন কেমন কঠিন দেখো, যা উষ্ণ ভেবেছিলে তা শীতল, গীত স্তব্ধ হয়ে গেছে।
—হোক কঠিন, হোক শীতল, হোক স্তব্ধ, তবু কী সুন্দর, কী মোহময় ভন্তে।
শিষ্যর এই কথায় সমন গৌতম শ্ৰীমতীর সৎকার স্থগিত রাখতে মহারাজকে আদেশ করেন। মহারাজও সে আদেশ ঘোষণা করে দেন।
চণক উঠে পড়লেন। দেবী সুমেধা চোখ তুলে তাকালেন, বোধিকুমারকে চোখের ইঙ্গিত করলেন শুধু।
চণক বেরিয়ে গেলেন চক্ষের নিমেষে। বোধিকুমারের এখন একটি অশ্ব হয়েছে। সে অশ্বকে প্রস্তুত করে যেতে যেতে চণক অদৃশ্য হয়েছেন। সে অনুমানে নির্ভর করে দক্ষিণ শ্মশানে পৌঁছল। এখানেই শ্ৰীমতীর শব রয়েছে।
প্রচুর লোক জমেছে শ্মশানের মুখে। বোধিকুমার দেখল উচ্চমঞ্চে শ্ৰীমতীর শবদেহটি শোয়ানো, কণ্ঠ অবধি একটি শুভ্রবর্ণ, সোনারূপার কাজ করা কার্পাসিক বসন দিয়ে ঢাকা। মঞ্চের সামনে সে গৌতমকে দেখতে পেল, সঙ্গে বেশ কয়েকজন ভিক্ষু। জনপরিধি ঠেলে বোধিকুমার শ্মশানভূমিতে পৌঁছল।
—কেমন বন্ন? এখনও কি তোমার এই রমণীকে বাঞ্ছিত, সুন্দর বলে মনে হচ্ছে? গৌতম বললেন।
শ্ৰীমতীর মুখের ত্বক শুষ্ক। অস্বাস্থ্যকর ভৌতিক এক কৃষ্ণবর্ণ তাতে। ওষ্ঠাধরদ্বয় কেমন যেন ঝুলে পড়েছে, দাঁত দেখা যাচ্ছে। বোধিকুমার আরও এগিয়ে দেখল যেন বিকট এক মুখব্যাদান। সভয়ে চোখ সরিয়ে নিল সে। গৌতম ততক্ষণে তাঁর হাতের দণ্ডটি দিয়ে আচ্ছাদন বস্ত্রটি ধীরে ধীরে সরিয়ে দিচ্ছেন। এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে এক উৎকট গন্ধ।
উপস্থিত সকলে উত্তরীয় দিয়ে নাসা চেপে ধরল।
—আয়ুষ্মান বন্ন, দেখো এই নারীদেহ কী বীভৎস পূতিগন্ধময়, কৃমি-কীটের বাস। দুর্গন্ধময় এই নারীর জন্য তুমি…
সহসা ভিড় ঠেলে প্রবেশ করলেন চণক। দেখলেই বোঝায় যায় তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছেন। তাঁর দেহ ঘর্মসিক্ত। চোখদুটি জ্বলছে।
তিনি চিৎকার করে বললেন—কে, কে এই রমণীর অন্ত্যেষ্টিতে বাধা দেয় দেখি! —তিনি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছেন শ্রমণ গৌতমের দিকে।
—কেউ বাধা দেবে না আয়ুষ্মান, তুমি এর সৎকার করো—গৌতম বললেন।
—এতকাল কে বন্ধ রেখেছিল সৎকার? কার আদেশে এই নারীর এরূপ অসম্মান ঘটল?
—বিশেষ প্রয়োজনে, এই ভিক্ষুকে প্রব্রজ্যায় ফেরাতে অন্ত্যেষ্টি স্থগিত রাখা প্রয়োজন হয়েছিল। অসম্মান তো নয় কাত্যায়ন?
—অসম্মান নয়? একটা সামান্য লম্পটের তথাকথিত ধম্মের নামে একটি স্বকর্মে নিষ্ঠ নারীকে এভাবে দাহ না করে ফেলে রাখা অসম্মান নয়?
—কাকে লম্পট বলছো কাত্যায়ন?
যে ভিক্ষু নারীর দেহকেই নারী বলে মনে করে, যৌবনশোভায় মত্ত হয়, আর মৃতদেহে কৃমি দেখে ঘৃণায় শিহরিত হয় সেই মুর্খ দেহসর্বস্ব ভিক্ষুকে লম্পট ছাড়া কী বলব? আর যিনি এইভাবে স্বসংঘে জনসংখ্যা বাড়ান, তাঁকে কী বলব? কী বলব? বলে দিন শ্রমণ!
—তাঁকে যা ইচ্ছা বলতে পারো আয়ুষ্মান—বুদ্ধর মুখে মৃদু হাসি।
—তাহলে তাঁকে দিগ্ভ্রান্ত, কাণ্ডজ্ঞানশূন্য, দাম্ভিক, বাতুল, উন্মাদ বলি। উন্মাদ শ্রমণ।
আরও কিছু চীবরধারী আশেপাশে ছিলেন, তাঁরা ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলেন, কাকে কী বলছেন? কাকে কী বলছেন? ধিক, ধিক আপনাকে।
গৌতম বললেন— বলতে দাও। যখন কোনও ব্যক্তি কাউকে কিছু দেয় এবং প্রথম ব্যক্তি তা গ্রহণ করে না, তখন দত্ত বস্তুগুলি কী হয়?
ভিক্ষুরা বলে উঠলেন—দাতার কাছে ফিরে যায় ভন্তে।
—ভালো, ওই তিরস্কারগুলি আমি গ্রহণ করিনি। ওগুলি কাত্যায়নের কাছেই ফিরে গেল।
তিনি দৃঢ়পায়ে স্থানত্যাগ করতে উদ্যত হলেন।
চণক বললেন—চলে যাবার আগে শুনে যান শ্রমণ, আপনি বাসনার কণ্ঠরোধ করার নামে প্রণয়কে হত্যা করছেন। দুর্বলতা, ভীরুতা, অসংযম এগুলিকে শক্তি, সাহস ও সংযমে পরিণত করতে সাহায্য করছেন না। শেষ অবধি কতকগুলি নপুংসক সৃষ্টি করে যাচ্ছেন সমাজে। যে সমাজ সুস্থ বাসনার বেগ ধারণ করতে পারে না, স্বাভাবিক বীর্যপাতকে যে বজ্রপাত মনে করতে শেখে, নারীকে কামের উপকরণ বলে ভাবে, এবং ভিক্ষাজীবীকে সম্মান করতে বাধ্য হয় সে সমাজ কীটদষ্ট বটবৃক্ষের মতো আমূল উৎপাটিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি জানেন না, আপনিই সেই শক্তিশালী কীট। বটবৃক্ষরূপী জম্বুদ্বীপের বর্তমান, তার ভবিষ্যৎ শাণিত দন্তে কেটে ছিন্ন ভিন্ন করছেন।
—ক্ষান্ত হও চণক, ক্ষান্ত হও।
বোধিকুমার দেখল একটি দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ যুবক এসে চণককে দুহাতে সংবৃত করছে।
চণক একেবারে অবাক হয়ে দুহাতে ব্যক্তিকে আলিঙ্গন করে ধরলেন—অনঘ। সখা অনঘ, এতকাল পরে? কোথা থেকে?
যুবকটির বীরপুরুষের মতো আকৃতি। কটিবন্ধ থেকে কোষবদ্ধ অসি ঝুলছে। তিনি বললেন, সেসব কথা পরে হবে, এখন এসো এই মৃতদেহের সৎকার করি। আপনারা এখানে যাঁরা আছেন, এই অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে পারেন।
অনেকেই স্থানত্যাগ করল। রয়ে গেল বোধিকুমার স্বয়ং এবং সে বিস্মিত হয়ে দেখল আরও দু’চার জনের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং রাজসচিব বর্ষকার ও সুনীথ এবং কুমার বিমল।
চিতায় অগ্নিসংযোগ করবার পর, আগুন তখন ধুধু করে লেলিহান শিখায় ওপর দিকে উঠছে, বোধিকুমার দেখল কুমার বিমল কৌণ্ডিল্য শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অগ্নিশিখার দিকে।
বর্ষকার বললেন—দৈবরাত ঠিকই বলেছেন। কী বলেন কুমার?
বিমল কোনও উত্তর দিলেন না।
বর্ষকার আবারও বললেন—কিন্তু সমন গৌতম যা-ই করে থাকুন, মহারাজের অনুমতি ছাড়া তো করেননি! প্রকৃতপক্ষে… অর্থাৎ বুঝলেন কুমার, বুঝলেন কবি মহারাজের ওপর এই শ্রমণের প্রভাব… উঁহুঃ বর্ষকার মাথা নাড়তে থাকলেন।
সুনীথ বললেন—অমাত্যবর, রাজনটীদের রক্ষার দায় রাজার, তারাও রাজাকে উপার্জনের অংশ করস্বরূপ দিয়ে থাকে। এখন সে মারা গেলে তার শেষকৃত্য তো রাজাদেশেই সুসম্পন্ন হওয়ার কথা! এটি একটি রাজকৰ্তব্য! এই অনাথার প্রকৃত নাথ তো রাজাই!
বিমল ধীরে ধীরে অতি মৃদুস্বরে বললেন—এই-ই নটীর ভাগ্য। কোন দুর্ভাগিনী মায়ের কোলে জন্ম নিয়েছিল! যখন উৎসবমুখর থাকে সভাগুলি, বহুজনের শংসা, সাধু সাধু রব, মৃদঙ্গের ধ্বনি, বংশীর গীত, নূপুরের নিক্কণ… সকল সৌন্দর্যের যেন আপনভূমি, তখন কি সে ভেবেছিল? ভেবেছিল এরূপ হবে!
কথাগুলি যেন কুমার আত্মগত বলছেন। বোধিকুমার ভিন্ন আর কেউ সম্ভবত শুনতে পায়নি। কুমার মৃদুস্বরে কথাগুলি বলতে বলতে থেমে গেলেন। ওদিকে দুই অমাত্য এবং আরও কয়েকজনের মধ্যে মৃদুস্বরে হলেও প্রবল তর্ক চলছে। চণক বসে আছেন একটি শিলাখণ্ডে, পাশে তাঁর সখা অনঘ।
বিমলকে মাঝে মাঝে শ্ৰীমতীর সঙ্গীতসভায় দেখেছে বোধিকুমার। কিন্তু তিনি কি শ্ৰীমতীর প্রণয়ী ছিলেন? উনি বৈশালীর নগরশ্রী অম্বপালীর পুত্র বলে একটি রটনা আছে রাজগৃহে। মহারাজ বিম্বিসারের ঔরসে। কত দূর সত্য কে জানে!
শবদাহক বলল—আপনারা কি গঙ্গানীর দিয়ে চিতা নেভাবেন? তাহলে এক্ষুনি যাওয়া প্রয়োজন। গঙ্গা থেকে রাজগৃহের দিকে যে নালিকা কাটা হয়েছে তার জল হলেই চলবে।
চণক উঠে দাঁড়ালেন, বললেন—চিত্তক অতি দ্রুত যায়। আমি যাচ্ছি।
কুমার বিমল বললেন—আমার রথটি যাবে আরও দ্রুত। যদি কেউ সঙ্গে আসেন। তিনি বোধিকুমারের দিকে তাকালেন।
বর্ষকার বললেন—সেই ভালো।
চিতা তখন নিভে এসেছে। একটা গরম বাষ্প উঠছে তা থেকে। সেই বাষ্পে দৈবরাত চণকের মুখটি শুষ্ক, শোকার্ত দেখায়। সূর্য ঢলে পড়েছে। বোধিকুমার মৃৎকলসটি চণকের হাতে তুলে দিল।
চিতায় জল ছিটোতে ছিটোতে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন চণক। তারপর শ্মশানের পার্শ্ববর্তী সরোবরে স্নানে নামলেন সবাই।
অমাত্য বর্ষকার একটা ডুব দিয়ে উঠে বললেন—কবি, কুমার কোথায়?
বোধিকুমার তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় স্তব্ধ হয়ে ছিল। এখন যেন স্বরকে তার আবিষ্কার করতে হল। কয়েকবার চেষ্টা করবার পর সে সফল হল। বলল—কুমার গন্তব্যে পৌঁছে আমাকে জল নিয়ে ফিরে যাবার কথা বললেন। বললেন—তিনি আর ফিরবেন না। বৈশালী যাবেন, গঙ্গার অভিমুখে চলে গেলেন কুমার।
—বলেন কী? অমাত্য সুনীথ বললেন।
—হ্যাঁ আশ্চর্য। পথে যেতে যেতে কুমার বলছিলেন—সব তর্ক, সব বাদ প্রতিবাদের ঊর্ধ্বে জেগে আছে অবমাননাময় ক্লিন্ন এই মৃত্যুর সত্য। এই ভবিতব্য যেন তাঁর না হয়। কখনও তাঁর না হয়!
—কার কথা বলছিলেন কুমার? নিজের কথা?
—না। বোধহয় দেবী অম্বপালীর কথা।
সকলে নীরব হয়ে গেলেন।
সিক্ত বসন নিংড়োতে নিংড়োতে চণক চিত্তকের কাছে এসে পৌঁছলেন, অশ্বগুলি সবই একস্থানে রক্ষিত। যে যার অশ্বে উঠবেন এবার।
—চণক বললেন—কবি, আমার পুত্র কোথায়?
—পুত্র তো নয় দৈবরাত, কন্যা।
—কন্যা? চণক থমকে দাঁড়ালেন। একটু পরে বললেন—সে কোথায়?
—কী করবেন জেনে? সে তো আপনার কোনও কাজে লাগবে না!
—এতকাল পরে আমায় এই বুঝলেন কবি! চণক কি শুধু প্রয়োজনের কথাই ভাবে? আর কিছু নেই! তাঁর কণ্ঠস্বর যেন আর্তের।
বোধিকুমার বলল—তা নয় দৈবরাত, প্রয়োজনই শুধু নয়, আপনার যে আছে মহান কর্তব্য, কন্যাটিকে গ্রহণ করবার কথাও তো আপনি বলেননি! পুত্রের কথাই বলেছিলেন, তাই…
—কন্যাটিকে কি আপনি লালন করতে চান? চণকের কণ্ঠ এখন অনেক শান্ত।
—সে সুযোগ শ্রীমতী আমায় দেয়নি দৈবরাত। কন্যাটিকে সে রাজপ্রাসাদে পাঠিয়ে দিয়েছে। মহিষী কোশলকুমারীর প্রাসাদে বড় হচ্ছে সে। চণকভদ্র শ্রীমতী তার পিতৃপরিচয় দেয়নি। আমি আপনার সব কথা তাকে বলেছিলাম, তবুও না। সে আপনাকে কন্যার পিতা বলে স্বীকারও করেনি। ওই কন্যাকে আমি দেখিনি ভদ্র, শুনেছি সে মাতৃমুখী। কোশলদেবী তারও নাম রেখেছেন শ্ৰীমতী।
তখনও অপরাহ্ণ হয়নি। দু’জনেই দেখলেন শ্মশানবৃক্ষগুলির শাখায় শাখায় একে একে শকুন এসে নামছে।
১৮
ক্রমে রাজগৃহে সন্ধ্যা নামে। রাত্রি নামে। রজনীর যামগুলি একে একে পার হতে থাকে। চণকের চোখে কোনদিনই ঘুম আসে না। পাশের শয্যায় সখা অনঘ ঘুমে অচেতন। দীর্ঘ দিন শাক্যপুত্রীয় সংঘে বিনয় পালন করে অনঘ শিখেছে কীভাবে চিত্তকে সংযত, একাগ্র, উদাসীন রাখতে হয়। শাক্য মুনির গুণগ্রামে সে অভিভূত। শুধু স্বীকার করে একটি বিশেষ কর্মভার নিয়ে একদিন সে বেরিয়েছিল। তার স্বদেশের ভাগ্য ছিল তাতে জড়িত। সেই কর্ম ফেলে রেখে শ্রমণসংঘে যোগ দেওয়া তার অনুচিত হয়েছিল। চণকের কাছে বারবার সে অনুতাপ প্রকাশ করেছে। কিন্তু যা শিখেছে, যা জেনেছে তা নিয়ে তার আনন্দের অবধি নেই। তাই শয্যায় শোয়ামাত্র নিদ্রায় সে অভিভূত হয়ে যায়। বাঁদিকে পাশ ফিরে হাতের ওপর মাথা রেখে উপাধান বিনা সে শুয়ে থাকে। প্রশান্ত মুখ, সহসা দেখলে মনে হয় সে চোখ দুটি বন্ধ করে শুয়ে আছে মাত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সুষুপ্ত। চণক পদচারণা করতে করতে ভাবেন আপন চিত্তের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে সমস্ত দ্বন্দ্বের যার অবসান হয়েছে সে-ই একমাত্র এমন নিদ্রায় নিদ্রিত থাকতে পারে। চণক পারছেন না। শুধু আজ বলে নয়, যৌবনোন্মেষের সময় থেকেই অদ্ভুত সব শক্তিশালী চিন্তা, স্বপ্ন, কল্পনা তাঁকে জাগিয়ে রেখেছে। মধ্যরাত্রে সহসা ঘুম ভেঙে যেত কতদিন। কোনও ভাব, কোনও সমস্যা তার সমাধান, একেবারে চিত্রের মতো ভেসে উঠত, মনে হত যেন কেউ তাঁর ভেতরে বসে সমস্যাগুলির সমাধান করছে, চিত্রগুলি লিখছে, ভাবগুলি উদিত করে অঙ্গুলিনির্দেশ করছে। প্রথম যৌবনে মনে হত কেউ, কোনও দেবতা তাঁকে ভর করেছেন। তাঁর ভেতরে বসবাস করছেন। এখন, বহু অভিজ্ঞতার পর তিনি বুঝেছেন না, কোনও দেবতা নয়। তাঁর চিত্তের মধ্যে আরও একটি চিত্ত আছে। সদাসতর্ক। বহিশ্চিত্তের দৃষ্টিতে যা এড়িয়ে যায় এই অন্তশ্চিত্ত তাকেও দেখে, তার ক্ষমতা অসীম, বাড়ালেই বাড়ে। চণকের গভীর, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের মূলে তাঁর এই অন্তশ্চিত্তের প্রতি আস্থা। কিন্তু সম্প্রতি, অতি সম্প্রতি সেই আস্থা টলেছে। তিনি উপলব্ধি করছেন বাইরের ঘটনাবলীকে তাঁর চিত্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না সবসময়ে যতই চেষ্টা করুন, আর দ্বিতীয়ত যেটি আরও ভয়াবহ, তাঁর অন্তশ্চিত্তও ভুল করে। তিনি অস্থিরও হন। আজ যে দ্বন্দ্ব যে সমস্যা তাঁর সামনে তিনি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না কী ভাবে তার সম্মুখীন হবেন।
প্রাসাদ থেকে ভেরীঘোষ ভেসে এলো। শেষ যাম রজনীর। অস্থির চণক দ্রুত পদে গান্ধার ভবনের পেছনের দ্বার খুললেন গিয়ে। অন্ধকারে কয়েকটি ছায়ামূর্তি।
ভেতরে নিঃশব্দে ঢুকে এলো।
গম্ভীর কণ্ঠে একটি মূর্তি বলল-একেবারে অভ্যন্তরে, সোমার কক্ষে নিয়ে চলুন আর্য।
চণকের পেছন পেছন অন্তঃপুরের শেষ কক্ষটিতে পৌঁছলেন সবাই। পরিত্যক্ত কক্ষ। নাগদত্ত থেকে একটি ছেঁড়া-তার বীণা ঝুলছে। শয্যার ওপর চিত্রময় একটি আস্তরণ। রাত্রে শুতে যাবার আগে একটি আচ্ছাদন হর্ম্যতলে বিছিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অতিথিরা তার ওপরে বসলেন, শুধু কর্কশ কণ্ঠ-বিশিষ্ট ব্যক্তি বসলেন গিয়ে একেবারে জিতসোমার শয্যার ওপরে।
চণক একবার কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। অনঘ উঠে এসেছে।
—আসুন আসুন মহামান্য গান্ধার—বলে উঠলেন শয্যায় উপবিষ্ট ব্যক্তি।
চণক দ্রুত গিয়ে দ্বার বন্ধ করে দিলেন।
বর্ষকার বললেন এবার আমাদের আলোচনা আরম্ভ হতে পারে কুমার।
শয্যায় উপবিষ্ট ব্যক্তিই কুমার কুনিয়। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ঈষৎ হেসে বললেন আলোচনার তেমন কিছু তো নেই। মগধ কোনদিন আর সাম্রাজ্য হবে না। মগধের রাজাও সম্রাট, রাজচক্রবর্তী হবেন না। তিনি প্রকৃতপক্ষে ভীরু। উত্তরে শক্তিশালী রাজ্য সব, বিশেষত বৈশালীর কাছে তিনি একপ্রকার পরাজিতই হয়েছেন। লিচ্ছবিরা নানা প্রকার বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা নেন, আমাদের রাজা দেখেও দেখেন না, শ্বশুর কুল তো! কী, আমি কি সত্য বলেছি শ্রেষ্ঠী অহিপারক!
অহিপারক শুধু মাথা নাড়লেন।
বিশদই বলুন না, ভয় কী? বর্ষকার বললেন
বিশদ আর কী বলব দৈবরাত, গান্ধার অনঘ, বৈশালী আর মগধের সীমানায় একটি রত্নখনি আছে। পূর্বে তার উৎপাদন মগধও কিছু পেত। যত দিন যাচ্ছে, সুকৌশলে লিচ্ছবিরা রত্নখনির চারপাশে পাহারা বসাচ্ছে। মাগধ বণিকরা আর সেখানে গতায়াত করতে পারেন না। আমাদের গোষ্ঠী থেকেই এ অভিযোগ এসেছে। শ্রেষ্ঠীবর যোতীয় জানেন।
চণক ধীরে ধীরে বললেন—মহারাজকে জানিয়ে ছিলেন?
—কতবার।
—ফল হয়নি?
—না।
—ভালো, আমাকে কী করতে বলেন? —চণক জিজ্ঞেস করলেন।
কুমার কুনিয় পদচারণা করছিলেন, থেমে গিয়ে বললেন— আপনি কী করবেন তা পরে স্থির হবে দৈবরাত। এখন বলুন তো! সমগ্র জম্বুদ্বীপ জুড়ে এক সাম্রাজ্য, এক রাজচক্রবর্তীর মহৎ কল্পনা নিয়েই কি আপনি আসেননি?
—এসেছিলাম কুমার।
জানবেন, মহারাজের এখন যা মতিগতি তাতে তার আর আশা নেই। এখন বলুন নটী শ্রীমতীর মৃতদেহ দশ দিন যাবৎ সৎকার না করে ফেলে রাখা— এ আপনি সমর্থন করতে পেরেছেন?
—পারিনি— কঠিন মুখ চণকের।
গৌতম বুদ্ধ নামে শাক্য রাজকুমার স্বরাজ্য ছেড়ে এখন সমস্ত রাজ্যের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করবার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। সিংহাসনে বসতে তিনি চান না। কিন্তু হতে চান রাজদণ্ডের নিয়ামক। সত্য কি না?
এই সময়ে অনঘ বলে উঠলেন—আমি তথাগতর ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এরূপ কোনও অভিপ্রায় তাঁর আছে বলে আমার মনে হয়নি। তিনি মহাত্মা।
—তিনি যে মহাত্মা তাতে আমাদের সন্দেহ নেই, বর্ষকার তাড়াতাড়ি বললেন, আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না গান্ধার, কিন্তু মহাত্মারাও সর্বদর্শী হন না, অথচ নিজেদের সর্বদর্শী ভেবে থাকেন। রাজকার্যে অনর্থক বাধার সৃষ্টি করে মগধরাজ্যকে গৌতম বুদ্ধ একটি মহা সঙ্কটে ফেলে দিয়েছেন। রাজগৃহ তো আর তাঁর সঙ্ঘ নয় যে সমগ্র রাজগৃহকে তার রাজা-প্রজা সহ তিনি বিনয় পালন করাবেন!
—তিনি কি তাই করছেন?
—তা ছাড়া কী, গান্ধার? বৈশালীর স্পর্ধা চূর্ণ করবার জন্য মহারাজের যদিও বা একেকবার ইচ্ছা জাগে, ইনি তাঁর কানে মন্ত্র দেন— বৈশালী অপরাজেয়। বৈশালী সংঘবদ্ধ, তাই অপরাজেয়। রাজ্যে যক্ষ-রক্ষের উপদ্রব হলে আগে এদের মুণ্ড কেটে বনপথে বর্শায় গেঁথে রাখা হত, আর এখন? ইনি তাদের রক্ষা করেন। সবচেয়ে ভয়ের কথা মহারাজ শাস্তি দিতে উদ্যত সেই সময়ে সেই উত্তোলিত হাত ইনি ধরে ফেলেন। এতে রাজার মর্যাদা নষ্ট হয়, সাধারণের আস্থা নষ্ট হয়।
চণক ধীর কণ্ঠে বললেন— বন্যদের সঙ্গে গৌতমের নির্দেশে মহারাজ যে নীতি মেনে চলছেন। তাতে উপকার হয়নি কোনও?
—উপকার? ব্যাঘ্রের গুহায় আপনি প্রবেশ করে বসবাস করতে আরম্ভ করলে ব্যাঘ্র আপনাকে ছেড়ে দেবে ভদ্র? সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হল শক্তিপ্রকাশ, রক্তপাত, আস্ফালন এগুলি করতেই হবে দৈবরাত। পৃথিবী মহর্ষিদের তপোবন নয় যে এখানে ‘মা-মা হিংসী’ বললেই সব হিংসা থেমে যাবে। আর তপোবনও যে সংগ্রামের হাত থেকে পুরো মুক্ত নয়, সে কথা আপনি ভালোই জানেন। প্রকৃত কথা সাম্রাজ্য স্থাপন। কেন? কোনও ব্যক্তি বা বংশের শ্রীবৃদ্ধির জন্য কী? না, তা নয়। সাধারণ অস্ত্রহীন মানুষ, উৎপাদক, বণিক, দাস, ভূস্বামী সবাই, সবাই নিরাপদে থাকবে বলে, দেশ সুরক্ষিত হবে বলে— উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু তার জন্য প্রথমে কঠোর হতেই হয়। দৈবরাত আপনারও কি এরূপ মত ছিল না?
চণক একটু ইতস্তত করে প্রশ্নটি সামান্য এড়িয়ে বললেন— মৈত্রীর মধ্য দিয়ে, দান, সহমর্মিতা ও কল্যাণকর্মের মধ্য দিয়েও যে রাজ্যবিস্তার এবং সংহতি হয় না এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু মহামান্য সচিব যে বলছেন কোনও ব্যক্তি বা বংশের শ্রীবৃদ্ধির জন্য সাম্রাজ্য নয়, তিনি কি বলতে পারেন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে ক্রমশই তা ব্যক্তির ও বংশের হয়ে যাবে না?
—তার জন্য মন্ত্রিপরিষদ চাই। —সুনীথ এতক্ষণে বললেন!
—মন্ত্রি-পরিষদের যথেষ্ট ক্ষমতা চাই—বর্ষকার বললেন।
—কী হবে এই সকল কথা আলোচনা করে? রক্ত বসনাবৃত মুখ প্রকাশ করলেন এক বয়স্ক শ্ৰমণ। কক্ষের অন্ধকারতম কোনটিতে এতক্ষণ বসেছিলেন ইনি।
চণক অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর অতিথিরা সকলেই রাজপুরুষ। এই দলে একটি শ্ৰমণ আছেন এ কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তাঁর বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ল কুমার কুনিয়র রথের ভেতরে সেই শ্রমণের কথা। তিনিই কি ইনি?
শ্ৰমণ কৃশকায়, দীর্ঘদেহ, চক্ষুদুটি কোটরাগত। সুগৌর বর্ণ। কুমার কুনিয় সম্ভবত চণকের বিস্ময় লক্ষ্য করেছিলেন। বলে উঠলেন– দৈবরাত, ইনি ভগবান দেবদত্ত, ইনিই প্রকৃত বুদ্ধ।
মহাসচিব বর্ষকার ভিন্ন দিকে তাকিয়ে রইলেন, সুনীথ মাথা নিচু করেছেন। প্রকৃত বুদ্ধ? রজনীর শেষ যামে কয়েকজন রাজপুরুষের সঙ্গে একজন বিদেশীর গৃহে এসেছেন মন্ত্রণা করতে? মন্ত্রণা, না যড়যন্ত্র?
তাঁর চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল শ্রমণ দেবদত্তের কণ্ঠস্বরে।
—গৌতমকে আমি শিশুকাল থেকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। সে অতিশয় ক্ষমতালিপ্সু। রাজা তো অনেকেই হয়। সেও হতে পারত গণরাজ। হয়ত শাক্যরা সবাই তাকে মেনে নিত। কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা আরও অনেক উচ্চে। সে রাজাদের নিয়ন্তা হতে চায়। তার অঙ্গুলিহেলনে চলবে কোশল, বৎস, মধুরা, কুরুদেশ, মগধ—সব, সব। সঙ্ঘের মধ্যে যেভাবে সকলকে দমিত করে রেখেছে, সেইভাবেই সারা জম্বুদ্বীপের রাজপুরুষদের ওপর সে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপাতে চায়।
দেবদত্ত একটু থামলেন, কেউ কোনও কথা বলছে না। তথাগত বুদ্ধের কার্যাবলীর এই জাতীয় একটি ব্যাখ্যাও হতে পারে কেউ সম্ভবত ভাবেনি।
দেবদত্ত চারদিকে একবার তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন— আমি তোমাদের আরও কয়েকটি কথা বলব, ধৈর্য ধরে শোনো। তোমাদের মনে হয়ত আমাদের সম্পর্কেও অনেক প্রশ্ন জাগছে। মনে হতে পারে আমি গৌতমের প্রতি ঈর্ষায় এসব করছি। ঈর্ষা কিন্তু নয়। গৌতমের অহন্তা যে কতদূর সর্বনাশা হতে পারে আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী, জীবন দিয়েও আমি তার কুফল রোধ করব এই আমার প্রতিজ্ঞা। সমগ্র শাক্যকুলকে সে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। কত শত শাক্যরমণী যে মর্মবেদনায় মৃত্যুবরণ করেছে, আরও কত যে উপায়ান্তর না দেখে সংঘে প্রবেশ করেছে এবং আরও কত যে জীবন্মৃত হয়ে রয়েছে তা তোমাদের বোঝাতে পারবো না। এখন যে শাক্যপ্রধান সেই মহানামা তো গৌতমের নাম শুনলে জ্বলে যায়। তাকে শতাধিক অনাথা রমণী প্রতিপালন করতে হচ্ছে।
দেবদত্ত আবার থামলেন, বললেন—ভেবো না, শাক্য-কোলীয়দের হয়ে প্রতিহিংসা সাধন করতে আমি গৌতমের শত্রুতা করছি। শাক্যদের উদাহরণ দিলাম শুধুমাত্র বোঝাতে গৌতমের শক্তি কী রূপ। সে ইচ্ছা করলে এই সমগ্র জম্বুদ্বীপ শুধু তার নিবৃত্তির তত্ত্ব দিয়েই শ্মশান করতে নিতে পারে।
অনঘ বলে উঠলেন— কিন্তু ভন্তে এ কথা কি সত্য নয় যে অন্যান্য শাক্যকুমার যেমন ভগু, কিম্বিল, ভদ্দিয় এঁদের সঙ্গে আপনি স্বেচ্ছায় এসে সংঘের শরণ নিয়েছিলেন।
—নিয়েছিলাম আয়ুষ্মান। গৌতমের প্রভাব কি সামান্য মনে করো? সে সময়ে শাক্য রাজ্যে প্রতি গৃহ থেকে একজন অন্তত প্রব্রজ্যা না নিলে লোকে তাকে নিয়ে উপহাস করত। আমি প্রব্রজ্যা নিই, কঠোর সাধনা করে অর্হত্ত্ব লাভ করি, তারপর জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হল— সব কিছু পরিষ্কার দেখলাম, বুঝলাম।
কী বুঝলেন, আমাদের যদি একটু বলেন ভালো করে… কুনিয় বলল।
—কুমার বুঝলাম সংসার-ত্যাগী সন্ন্যাসী আর গৃহীর পথ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সম্পূর্ণ। সম্পূর্ণ। সন্ন্যাসী কখনও অর্ধগৃহী হবেন না। এই যে সব বিশাল বিশাল বিহার নির্মিত হচ্ছে, সর্বশ্রেণীর মানুষ সে চণ্ডাল হোক, পুক্কুশ হোক, সংঘভুক্ত হচ্ছে, রোগ-ব্যাধির নাম করে তিন তলিকা পাদুকা পরা হচ্ছে, মধু, ঘৃত, পায়স, গৃহস্থের গৃহে অন্নভোগ মৎস্য মাংস সহযোগে, এ সকল কি অর্ধগৃহীত্ব নয়? সন্ন্যাসী হতে চাও পূর্ণ সন্ন্যাসী হও, আর নইলে পূর্ণ গৃহী। গৃহীর সামাজিক দায়িত্ব কি অল্প? প্রকৃতপক্ষে তা সন্ন্যাসীর চেয়ে অনেক অধিক। গৃহীই সমাজকে, পৃথিবীকে রাখে। সেই গৃহীরা যে সন্ন্যাসীর লবণ ও অম্লতৃষ্ণা মেটায়, তাকে প্রয়োজনে রক্ষা করে এই-ই তো অনেক। এর ওপরে এ কানন দাও, ও কানন দাও, বিহার গড়ো, নিমন্ত্রণে আপ্যায়িত করো, এ সকল কি ভালো? আমি একজন অর্হন, জীবন্মুক্ত পুরুষ—আমি বলছি ভালো নয়, এ কখনও কল্যাণকর হতে পারে না।
ঘরটি অর্হন দেবদত্তর কণ্ঠস্বরে গমগম করতে লাগল। কেউ কোনও কথাই বলতে পারলেন না।
অনেকক্ষণ পরে অনঘ বললেন: কিন্তু ভগবন, আপনি এক নতুন দৃষ্টিতে বুদ্ধবাণীর ব্যাখ্যা করলেও ওঁর নিজের দিক থেকে উনি একে বলছেন মঝ্ঝিম পন্থা।
তিক্তস্বরে অর্হন দেবদত্ত বললেন হ্যাঁ। গৃহীর দায়িত্বও পালন করতে হবে না। সন্ন্যাসীর করণীয়ও করতে হবে না। গৃহীর সুখও রইল, সন্ন্যাসীর সুখও রইল। আমি অর্হন দেবদত্ত বিহারে থাকি। তা শীতে উষ্ণ, গ্রীষ্মে শীতল, কেন না শ্রেষ্ঠ স্থপতিরা রাজাদেশে তা প্রস্তুত করেছেন। নামমাত্র ভিক্ষায় বেরোই একেক দিন, গৃহস্থ আমাকে দেখলেই তটস্থ হয়ে তার সেদিনের শ্রেষ্ঠ ব্যঞ্জনাদি তা আমার পাত্রে ঢেলে দেয়, আমি নির্জন বৃক্ষতলে বসে আহার সমাধা করি, অন্য কোনও গৃহস্থ আমাকে নিমন্ত্রণ করে শুধু ষোড়শ ব্যঞ্জন দিয়ে ভোজনই করায় না, উপরন্তু উপহার দেয়। রেশমের কাষায়বস্ত্র অতি সুখস্পর্শ, কোমল কার্পাসিক পাদুকা, উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ ভিক্ষাপাত্র, সম্প্রতি স্বর্ণ-রৌপ্যও দিচ্ছে, সংঘ গ্রহণ করছে। সংঘের কোষাগার প্রস্তুত হচ্ছে। অর্থাৎ কোনও কর্ম না করেই, না সন্তান পালন, না জনক-জননী আদি পূর্বজ, ভার্যা প্রভৃতি প্রতিপালনীয়াগণের, বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতি সুহৃৎ গণের প্রতি কোনও কর্তব্য, রাজাকে কর না দিয়ে, বণিককে পণ্যের অর্থমূল্য, দাসকে আরক্ষা না দিয়েই সর্বপ্রকার গৃহসুখ পাচ্ছি। মঝ্ঝিম পন্থাই বটে।
অর্হন দেবদত্তর তিক্তভাষণে সবাই অনেকক্ষণ চিন্তিত, স্তব্ধ হয়ে রইল।
—শ্ৰমণ গৌতম কোনও কোনও বিচারে ভুল করেন— চণক অবশেষে বললেন— কিন্তু তাঁকে, অর্থাৎ তাঁর কার্যকলাপকে আমি ঠিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা অভিসন্ধিমূলক বলে ভাবতে পারছি না।
—তাহলে উনি বজ্জিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে মহারাজকে বাধা দিচ্ছেন কেন? কুনিয় বলল।
—কেন? আপনার কী মনে হয় কুমার? চণক জি্জ্ঞেস করলেন।
—বজ্জি, মল্ল শাক্য এরা সবাই গণরাজ্য। নিজে শাক্য বলে, গণরাজ্যের সন্তান বলে, শ্রমণ গৌতমের সহানুভূতিও পরিপূর্ণ এদের পক্ষে। বজ্জিরা স্বাধীন, মল্লরা হৃতগৌরব, তবু একপ্রকার স্বাধীনই, শাক্যরা নামেমাত্র কোসলের প্রজা, কার্যত স্বাধীন। উনি চান এই গণরাজ্যগুলি ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠুক, মগধ সাম্রাজ্যর অন্তর্ভুক্ত না হোক। বজ্জিরা যে কোনও দিন মগধ আক্রমণ করতে পারে দৈবরাত, তখন শ্ৰমণ গৌতম মহারাজের কানে মন্ত্র দেবেন, বজ্জিরা সংঘবদ্ধ, তারা অপরাজেয়। মহারাজের মনোবল ভেঙে যাবে। রাজনীতির এইসব কূটকৌশল, শত হলেও আপনি ব্রাহ্মণ, আপনি বোঝেন না।
বর্ষকার হাঁ হাঁ করে উঠলেন— এ কথা বলবেন না কুমার, ব্রাহ্মণরাই চিরকাল রাজসচিবের কাজ করে এসেছে, রাজনীতি ও বার্তা নিয়ে তত্ত্ব রচনা করেছেন যাঁরা, তাঁরাও ব্রাহ্মণ।
কুমার কুনিয় বলল– দৈবরাত যদি আমার কথায় আঘাত পেয়ে থাকেন, আমি মার্জনা চাইছি। তিনি তো আমার পিতৃবন্ধুও। আবার বয়সে তিনি পিতার চেয়ে অনেক ছোট। আমার পিতৃব্য হলেন। তাই না? আমি মগধ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ ভেবে আকুল হয়েছি। ভগবান দেবদত্ত ক্ষত্রিয়, তাই রাজ্যরহস্য জানেন আবার প্রব্রজিত, তাই সন্ন্যাসরহস্যও জানেন। বাইরে থেকে আমরা সন্ন্যাসী দেখেই ভক্তিতে নত হয়ে পড়ি। কিন্তু সন্ন্যাসী হলেই তিনি সকল ভ্রমের উর্ধ্বে, প্রলোভনের উর্ধ্বে হন না, স্বভাবতই সমালোচনাও তাঁকে শুনতে হবে।
চণক বললেন— না। শ্ৰমণ গৌতমের কার্যকলাপের পেছনে কোনও স্বার্থপর অভিসন্ধি আছে, এমন মনে করা ভুল কুমার। নূতন কোনও তত্ত্বকে আমরা সহসা গ্রহণ করতে পারি না। আমাদের সংস্কার তাতে বাধা দেয়। ইনি রাজনীতির ব্যাপারে একটি নূতন তত্ত্ব এনেছেন। মৈত্রী তত্ত্ব শুনতে সহজ, রূপ দিতে সহজ নয়। আবার যতটা কঠিন মনে করছি, ততটা কঠিনও না। শুধু বজ্জি, মল্ল, শাক্য নয় উনি সমগ্র জম্বুদ্বীপকে মৈত্রীবদ্ধ হতে বলছেন। রাজা প্রজা, ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের রাজশক্তি—সবাইকে। হয়ত উনি ঠিক এভাবে বলেননি, কিন্তু ওঁর সার্বিক তত্ত্ব থেকে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক এইটুকুই। পারস্পরিক বিপদ ভুলে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে স্থিত থেকে সংঘবদ্ধ হওয়া।
দেবদত্ত বললেন— আয়ুষ্মান, তোমার সঙ্গে না গতকল্যই তার তুমুল বিবাদ হয়েছিল। নটীর অন্তিম সৎকার বন্ধ করা নিয়ে? তুমি এরূপ গৌতমের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো?
চণক ধীরে ধীরে বললেন— আমি তাত্ত্বিক। তত্ত্বের প্রয়োগও কিছু কিছু করে থাকি। তাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে একদেশদর্শিতা থাকে না। বিবাদ ঘটেছিল, বিবাদের কারণ ছিল বলে, তার অর্থ এই নয় যে….
কুমার বলে উঠল,— আপনি ভগবান দেবদত্তকে অপমান করছেন দৈবরাত! আপনি প্রয়োগকুশল পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু তিনি অর্হন।
চণক একটা দুর্বোধ্য হাসি হাসলেন। তারপরে দেবদত্তের দিকে ফিরে বললেন— আমার উক্তি কি আপনাকে কোনও কোমল স্থানে স্পর্শ করল নাকি ভন্তে!
রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই চলে গেলেন পাঁচ আগন্তুক।
সহসা অনঘর দিকে ফিরে চণক বললেন— সখা অনঘ, তুমি কি জানো, দেবী দেবদত্তার কন্যা জিতসোমা এই নগরীতেই আছে।
অনঘ আশ্চর্য হয়ে বলল— জিতসোমা! এখানে? কী বলছো সখা!
—তুমি গান্ধারী নটী সোমার নাম শোন নি? শোননি এই গান্ধার ভবনে সোমা থাকত এক সময়ে! আজ আমরা যে কক্ষে বসে মন্ত্রণা করলাম, সে কক্ষ জিতসোমার, ওই বীণা, এই শয্যা জিতসোমার।
অনঘ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন— নটী সোমার নাম শুনেছি, শুনেছি গান্ধারভবনে তোমাকে দেখাশোনা করত সেই নটী পূর্বে। কিন্তু এই সোমা সেই জিতসোমা….এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
—অনঘ ক্ষণেক নীরব থেকে আবার মাথা নাড়লেন— না, না। স্বপ্নেও না।
চণক বললেন— এখন তো শুনলে। কী ভাবছো এখন?
—কী বিষয়ে? অনঘ কথা কটি বললেন সম্পূর্ণ অন্যমনে।
চণক বললেন—এ কথা কি সত্য নয় অনঘ যে, এত বৎসর পরে জিতসোমার স্মৃতিই তোমাকে সংঘ ত্যাগ করতে বাধ্য করল?
—হয়ত তাই চণক। হয়ত নয়। তুমি যে অর্থে বলছো, সে অর্থে নয় অন্তত।
—যে অর্থেই হোক অনঘ, তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি জিতসোমাকে মাগধ রাজনীতির এই জটিল আবর্ত থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও।
—রাজনীতির জটিল আবর্ত? কী বলছো চণক, ভালো করে বুঝিয়ে বলো।
—সোমা শুধু রাজনটী নয়, আমি যতদূর জানি, সে কিছু রাজকার্যও করে। ঘটনাচক্র যেদিকে চলেছে তাতে তার সে ভূমিকা আর গোপন থাকবার নয়। আজকে যাঁরা এসেছিলেন, বুঝলাম, তাঁরা কুমার কুনিয়কে সমর্থন করছেন। জিতসোমা, অমাত্য চন্দ্রকেতু এঁরা সমর্থন করছেন মহারাজকে। কুনিয় জিতসোমার প্রতি আসক্ত। তার বিশ্বাস মহারাজই তার প্রণয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী। সোমা বুঝতে পারছে না, রাজ্যলোভ, সেই সঙ্গে প্রণয়—উভয় মিলে কুনিয় অতি ভীষণ হয়ে উঠেছে। সোমা অতিশয় বিপন্ন। অনঘ সখা, দয়া করো। পূর্বকথা ভুলে যাও।
অনঘ মৃদুস্বরে বললেন— চণক, তুমি ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই জিতসোমার কোনও মঙ্গল বা অমঙ্গল করে। তুমি, তুমিই তাকে বাঁচাতে পারো।
চণক অব্যক্ত বেদনার ধ্বনি করে বললেন— তুমি তো জানো অনঘ, সে কীরূপ উগ্ৰ অভিমানী, মর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন। সে আর আমার কথা শুনবে না। তুমি চেষ্টা করো অনঘ। এই ভয়ঙ্কর আবর্তের মধ্যে পড়ে সোমা না শূলবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেয়।
তড়িৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন অনঘ। একটু পরে শান্ত হয়ে বললেন—চণক, চণক, সোমাকে রক্ষা করতে কে তোমাকে বাধা দিচ্ছে! কেনই বা তুমি আমাকে তার রক্ষার ভার দিতে চাইছো সব জেনে শুনে!
—সময়, অনঘ সময়। যখন জিতসোমা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারপর অনেক শুক্লপক্ষ অনেক কৃষ্ণপক্ষ এসেছে, গেছে অনঘ। হিমবন্তের শিখরে শিখরে মেঘরাজি কতবার তুষার হয়ে গলল, সিন্ধু গঙ্গা যমুনা, সদানীরার জল কতবার আমূল পরিবর্তত হয়ে গেছে, সোমা জানে না, সে কত বিপন্ন! অনঘ তুমি একবার অন্তত চেষ্টা করো।
অনঘ নিঃশব্দে অন্যমনার মতো ভোরের কাননের দিকে চলে গেলেন। তাঁর মুখে বেদনার ছবি। চণক কিছুক্ষণ পদচারণা করতে লাগলেন। আজ যে পাঁচ আগন্তুক তাঁদের দুই গান্ধার যুবককে নিজেদের গুপ্ত মন্ত্রণায় স্থান দিল, তার কারণ কী? তিনি প্রকাশ্যভাবে শ্রমণ গৌতমের বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তাঁকে কটু কথা শুনিয়েছেন তাই? এবং অনঘ সংঘত্যাগ করে চলে এসেছে, তাই? এ মূর্খদের একবারও মনে হল না, অনঘর সংঘত্যাগের পশ্চাতে গৌতম বিরাগ ছাড়া অন্য কিছু থাকতে পারে? একবারও মনে হল না, তিনি একটি ব্যাপারে গৌতমের সমালোচনা করেছেন বলেই অন্য ব্যাপারে না-ও করতে পারেন! এই মূর্খতার কারণ কী? ত্বরা। অতিশয় শীঘ্র কুমার একটা বিম্বিসার-বুদ্ধবিরোধী দল গড়তে চাইছে। কুনিয়ই কী? না দেবদত্ত নামে ওই শ্ৰমণ! বর্ষকার, সুনীথ ও শ্রেষ্ঠী অহিপারকের অবস্থান আরও জটিল। তাঁরা যতটা রাজার বিরুদ্ধে তার চেয়েও অধিক তাঁর বর্তমান নীতির বিরুদ্ধে। এবং গৌতমকে তাঁরা শ্রদ্ধা হয়ত করেন, রাজনীতিতে তাঁর হস্তক্ষেপ একেবারেই কল্যাণকর মনে করেন না। ইতিমধ্যে শ্রমণ গৌতম নামে ওই ব্যক্তি রাজনীতি, সমাজনীতি, সংঘনীতি কিছুই গ্রাহ্য করেন না। যা ভালো মনে করেন, তা যতই অদ্ভুত হোক, অপ্রচল হোক করেই ছাড়েন। সেদিন তিনি গৌতমকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়েছিলেন, কী প্রতিক্রিয়া হল তাতে ওঁর! ওগুলি নাকি তিনি গ্রহণ করেননি। অগৃহীত উপহার ওই গালিগুলি নাকি চণকের কাছেই ফিরে এসেছে। বা! বা! বা! অতি অদ্ভুত কৌশল তো! কী তীক্ষ্ণ ধীশক্তি এই শ্রমণের, কী সংযম! কী শক্তি দৈহিক এবং চারিত্রিক।
হঠাৎ চণক যেন চমকে উঠলেন। এই কি সেই
ব্যক্তি নয়, যাঁকে তাঁর পিতা কাত্যায়ন দেবরাত এবং তিনি চণক সারাজীবন ধরে খুঁজে চলেছেন? এই তো সে, যে সমগ্র জম্বুদ্বীপের আরক্ষা ও প্রতিপালনের ভার নিতে পারবে! এই সেই রাজচক্রবর্তী যার ছত্রতলে সব রাজা নিজেদের রাজদণ্ড স্বেচ্ছায় নামিয়ে রাখবে। বিনা সংগ্রামে, বিনা রক্তপাতে। ইনিই তিনি, যাঁর কান্তি দিব্য, ধৈর্য অসীম, বুদ্ধি অসামান্য, ভেদবুদ্ধি নেই, সংস্কার নেই, যে কোনও ঋষিবাক্যকে স্পর্ধা জানাতে পারেন। অসাধারণ ব্যক্তিমায়া। লোভ নেই, জিঘাংসা নেই, জুগুপ্সা নেই, অথচ বীরপুরুষ।
স এষ, সে-ই এই। চণক ছটফট করে উঠলেন। অথচ এক্ষুনি, এই মুহূর্তে তিনি মহারাজ বিম্বিসারের কাছেও যেতে পারেন না। যেতে পারেন না শাক্যমুনির কাছেও। কুমারের চর কি তাঁর ওপর লক্ষ রাখছে না? মন্ত্রভেদ তিনি করবেন না, এমন কথা তাঁর কাছ থেকে এরা নেয়নি, সম্ভবত ভেবেছিল, নটী শ্রীমতীর কারণে তিনি চিরকালের মতো বিম্বিসারবিরোধী হয়ে গেছেন। কিন্তু এখন? সব বিষয়ে তিনি বা তাঁরা যে এদের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না, এতেই এরা সতর্ক হয়ে যাবে। অথচ, অথচ… অনঘ কই? তিনি কাননের কোণে কোণে আনঘকে খুঁজলেন তারপর ফিরে এলেন গৃহে। না, গৃহেও সে নেই। কোথায় গেল অনঘ? এখুনি, এই মুহূর্তে সোমার কাছে যাওয়া বিপজ্জনক। ভীষণ বিপজ্জনক। চণক দীর্ঘ কয়েকটি পদক্ষেপে মন্দুরায় পৌঁছে গেলেন। না, কোনও ঘোড়া নেয়নি অনঘ। তিনি এক লাফে চিত্তকের পিঠে চড়লেন। ভোরবেলা তিনি চিত্তকের পিঠে পাহাড়ের দিকে বেড়াতে যান। চর থাকলে সে দেখুক। সন্দেহের কোনও কারণ ঘটবে না। পথে অবশ্যই অনঘকে পাবেন। পেতেই হবে। কিন্তু চণক অনঘকে কোথাও পেলেন না।
সেইদিনই গভীর রাতে অমাত্য চন্দ্রকেতু সংবাদ নিয়ে এলেন। অনঘ কারারুদ্ধ হয়েছেন। অপরাধ—চক্রান্ত। মগধরাজ্যের বিরুদ্ধে। আর নিয়ে এলেন মহারাজ বিম্বিসারের কাছ থেকে চণকের জন্য দণ্ডাজ্ঞা। নিবার্সন। রুরুবধের জন্যই কী? হে চন্দ্রকেতু, সত্য বলো। সত্য বলো। গোপন করো না কিছু।
গভীর উদ্বেগে চন্দ্রকেতুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন চণক। তার পর মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
১৯
তিন্দুক, আমার একটি কাজ করে দিতে পারবে?
নিশ্চয়, মহামান্ন পাঞ্চাল, আপনি আমাদের যা বলবেন, তা-ই পালন করব।
শাক্য কৰ্ষক ভক্তি ও স্নেহভরে পাঞ্চালের দিকে চায়। এই যুবককে তারা ক দিনেই বড় ভালোবেসে ফেলেছে। বীরপুরুষ কিন্তু দম্ভ নেই। অন্যের জন্য নিজ প্রাণ বিপন্ন করেন। বিনিময়ে কিছু চান না। তুলনায় সাবত্থির রাজকুমারকে তাদের ভালো লাগেনি। সামান্যজনের থেকে দূরত্ব রেখে চলে কুমারটি, কারো দিকেই চায়ই না, যেন শক্কদেব স্বয়ংই বা এলেন। নিয়ে তো নিলি পাঞ্চালের জয় করা হাতিটা। ঈর্ষায় কেমন অস্থির-অস্থির করছিল শেষটা? এ প্রসঙ্গ রাত্রে আগুন ঘিরে বসে তারা শাক্য-কৰ্ষকরা অনেকবার আলোচনা করেছে। পাঞ্চাল মহাপ্রাণ মানুষ। তবু, আঘাত লেগেছিল তাঁর। সেই আঘাতের প্রশম করতে তারা কদিন প্রাণপণ করেছে। সমাদরে ভরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। তাদের যতদূর সাধ্য! তবুও পাঞ্চাল গভীর রাত্রে টিলার ওপর একা বসে থাকতেন। আকাশের অগণিত তারাগুলির দিকে চেয়ে চেয়ে যেন কাকে খুঁজতেন, কোন প্রশ্নের উত্তরও হয়ত খুঁজতেন। তারা দূর থেকে দেখত। কাছে যেতে সাহস হত না।
—একটি পত্র রাজগহে নিয়ে যেতে হবে তিন্দুক, মহারাজ বিম্বিসারকে পৌঁছে দিতে হবে।
—ওরে বাবা, মগধরাজ! রাজা-রাজড়া কখনো যে দেখিনি পাঞ্চাল!
—দেখনি? সত্য বলো। —পাঞ্চাল মৃদু হাসেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি পাঞ্চাল, যাবো। কিন্তু… মহারাজের কাছে পৌঁছবো কী ভাবে?
—অভিজ্ঞান দেবো। অতিশয় সাবধানে রাখবে সেটি।
“সাহেত-গামের আপণটি রইল। বাণিজ্য-বিস্তারে বহু সময় গেল। এবার যাবো ভিন দেশে। ধরুন কপিলা, কোসম। বেসর-গামে এখনই না। বেসর হয়ে ফিরব। পণ্য এতদিনে ভালো বিকোয়। সংবাদের জন্য মন বড় উচাটন।”
শেষ পংক্তিটি ভেতরের একটা তাড়ায় লিখে গেছে, কেটে দেবে কিনা অনেকবার ভেবেছে তিষ্য। কোন সংবাদ, কার সংবাদের জন্য তার চিত্ত ব্যাকুল হয়েছে তা যেন তার নিজের কাছেও স্পষ্ট জানা নেই। মহারাজ কি তার এ ব্যাকুলতাকে বাতুলতা মনে করবেন? …না, না। তিনি নিজেও কোমল চিত্তের মানুষ। বারবার তার প্রমাণ সে পেয়েছে।
তিন্দুক ধূলিধূসর বসনপ্রান্ত দিয়ে তার গাধাটির পিঠ মুছে নিচ্ছে। বেঁধে নিয়েছে চিঁড়ে-গুড়। পাথেয়র জন্য কয়েকটি তাম্ৰ কার্ষাপণ পায় সে, পুরস্কারস্বরূপ পাঁচটি স্বর্ণ কার্ষাপণ।
আনন্দ, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা মুখশ্রীতে। তিন্দুক যায়। গাধার ক্ষুরে খুটটুট শব্দ হতে থাকে।
বিলীয়মান সেই বিন্দুটির দিকে তাকিয়ে থাকে তিষ্য। কতদিন, আর কতদিন এই নির্বাসনে, এ কেমন কাজ যা সমাধা করতে যুগ লেগে যাচ্ছে!
বিপরীত দিকে চায় সে। কপিলবস্তুর পথ। কৌতূহল ছিল। তথাগত বুদ্ধর জন্মভূমি… কেমন তা? কেমন তাঁর গোষ্ঠীর মানুষ? শ্ৰমণ আনন্দর মতো সুঠাম, নিরভিমান? না বিনয়ধর থের উপালির মতো বাক্যব্যয়ী? বকবকবক। হাত পা নেড়ে মাথা ঝেঁকে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন সদাই! থের ভদ্দিয়র মতো সদাপ্রসন্ন সৌম্যদর্শন? না থের রূপনন্দর মতো উদাসীন, মূক, বৈরাগী! বিরূঢ়ক কি তার সূক্ষ্ম ঈর্ষার অসদ্গুণটি মাতৃবংশ থেকে পেল? নাকি জনক প্রসেনজিতই তাকে দিলেন এই দোষ? অথচ বিরূঢ়ককে সর্বাংশে মন্দ বলা যাবে না। রাজার কুমার হলেই কি এতো অসহিষ্ণু হতে হয়? কুমার বিরূঢ়ককে এখনও সে স্নেহই করে, কিন্তু কোশলের রাজা হতে হলে কুমারটিকে আরও উদার হতে হবে। গর্ব ভালো, কিন্তু এই প্রকার অহন্তা সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। আশা-নিরাশা, আশা-নিরাশা… মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে তিষ্যর এই পরম্পর-বিরোধী অভিজ্ঞতা হয়েই যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে।
শাক্যভূমিতে যাওয়া হল না যখন মল্লভূম বা বজ্জিভূমিতেও এ যাত্রা যাওয়া স্থগিত থাকুক। রাজগৃহের যত কাছে যাবে তত তার কর্তব্যের লৌহ শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে। সে জানে। সংবাদের জন্য মন বড় উচাটন। কার সংবাদ? শুধু কি মহারাজ বিম্বিসারের? শুধু কি ক্যাত্যায়ন চণকের? অন্য নামটি নিজের মনের কাছেও উচ্চারণ করতে পারে না তিষ্য।
সুতরাং পাঞ্চাল ঘোড়া ছুটিয়ে দ্যান। —উত্তরপথের দীর্ঘ পুচ্ছ সচল হয়।
—কে যায়? কে যায়?
—সার্থ যায়।
—সার্থবাহ কে?
—অমৃত।
—কোথাকার?
—চম্পার। কোথায় যান ভদ্র?
—আপাতত কুরুদেশে।
—আমাদের গোযানগুলির ভেতরে উৎকৃষ্ট শয্যা আছে, বিশ্রাম নিতে পারেন পথিক। সঙ্গে উৎকৃষ্ট চাল, আসব রয়েছে। রাত্রে গো-মাংস পাক করব, কুক্কুট পাক করব। আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করলে সুখী হবো।
সার্থর পর সার্থ পেছনে ফেলে পাঞ্চাল যান। দেহের ওপর দিয়ে দিন রাত বহে যায়, বহে যায়। রৌদ্র কিরণ, উত্তরের হিমবায়ু। দেহবর্ণ তাম্রাভ হয়ে ছিল, ঘোর তাম্রবর্ণ হয়ে যায়, ত্বক রুক্ষ, কেশগুলি অযত্নে বেড়ে গেছে। অবয়বে রুক্ষতা, রূঢ়তাও কী?
মৃত্তিকার প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায়, জলের বর্ণ নীলাভ, আকাশ দ্যুতিমান, বহতা বাতাস কই? ওই তো! কনকনে বাতাস। পাঞ্চাল তিষ্য কোনও রাজ-আশ্রয়ে অধিক দিন থাকেন না। শুধু মগধরাজের বার্তাটুকু বোঝাতে যা বিলম্ব।
—অহো, রাজ্যে রাজ্যে শান্তির প্রস্তাব নয়?
—হ্যাঁ মহারাজ তাই, কিন্তু অধিকন্তুও কিছু!
—বলি যুদ্ধ-টুদ্ধ তো কিছু নেই!
—নিশ্চিন্ত থাকুন, আপাতত কোনও যুদ্ধ নেই।
—তা মগধরাজ তো ক্রমেই পরাক্রান্ত হয়ে উঠছেন। তিনি তো ইচ্ছে করলেই… সাম্রাজ্য-বিস্তারে আমাদের সাহায্য চান না কি?
—না। শুধুমাত্র জম্বুদ্বীপের শত্রু ঠেকাতে, আন্তঃরাজ্য সমস্যাগুলির সমাধান করতে।
—এ যেন নতুন প্রকার মনে হয়!
—নতুনই, একেবারেই নতুন। আপনারা মর্যাদা দিলেই মর্যাদা পায় এই নূতন তত্ত্ব।
কুরু-রাজ্য পাঞ্চাল রাজ্যের সে সব গৌরবের দিন আর নেই। কিন্তু অহঙ্কার আছে। মধ্যদেশীয় যুবকটির নির্লিপ্ত কিন্তু সবিনয় আচরণে সেই অহঙ্কার চরিতার্থ হয়। বিদ্বেষ মাথা তুলতে পায় না।
অবিনয়ী এবং অহঙ্কারী এখানকার মানুষ জন। বহুদিনের ঐতিহ্য বহন করার অহঙ্কার, বিদ্যার অবিনয়। অতিথিভবনের দাসেরা পর্যন্ত কুতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়।
—মধ্যদেশীয়… মগধ… আচার-বিচার মানে না
—সত্য না কি?
—কিন্তু ভীষণ পরাক্রমী। এখন তো ওদেরই দিন পড়েছে।
নিজেদের মধ্যে জনান্তিকে বলাবলি করে ওরা।
গ্রাহ্য করেন না পাঞ্চাল। উভয়পক্ষীয় রাজাদের সম্মানরক্ষার্থে যতদিন প্রয়োজন তার চেয়ে একদিনও অধিক থাকেন না।
উত্তরপথের একটি শাখা চলে গেছে বৎস-অবন্তীর দিকে। চলেন, চলেন। বামে ঘুরে যান পাঞ্চাল।
—কে যায়?
—সমন যান। সাক্কপুত্তীয় সমন।
—কোথা থেকে আসেন? কোথায় যান?
—আসি কোসাম্বি হতে। যাই সাবত্থির পথে।
—আমরা যাই বেসালি।
—দিকে দিকে যান না কি? কোনও সমবেত লক্ষ্য নাই?
—দিগ-বিদিকে ধম্ম বহে নিয়ে যাওয়াই আমাদের কাজ হে পথিক। তা ছাড়া সন্ধান করি, ভগবান কোথায় যে গেলেন!
—হারিয়ে গেলেন না কি? —তাম্রকের রাশ টেনে ধরে মৃদু কৌতুকে জিজ্ঞাসা করেন পাঞ্চাল।
—আমাদের ত্যাগ করেছেন তথাগত।
অশ্রুমুখী ভিক্ষুরা।
—আমরা কলহ করেছিলাম। বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন।
—ও আপনারা তাহলে কলহও করেন! সংসার-ত্যাগ করে সংঘ আশ্রয় করার প্রয়োজন কি ছিল তবে?
—সত্য, সত্য কথা। আপনি তাঁকে দেখেছেন না কি?
—দেখি নি, দেখে থাকলেও বলব না।
পথের ধুলোয় বিব্রত হয়ে অরণ্যসঙ্কুল স্থানগুলির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন পাঞ্চাল। অবাক কাণ্ড! সত্যই তথাগতকে আবিষ্কার করলেন। একটি শাল বৃক্ষের তলায় তিনি বসে আছেন আর একটি হাতি শুঁড়ে করে জল এনে তাঁর মাথায় ওপর ফেলছে।
অদূরে দাঁড়িয়ে পাঞ্চাল দৃশ্যটি দেখলেন কিছুক্ষণ।
দাঁড়িয়ে উঠে নিজের উত্তরাসঙ্গটি ভালো করে নিংড়ে নিচ্ছেন তথাগত। ঝাড়ছেন শব্দ করে। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ওপর ভর দিয়ে উঁচু শাখে শুকোতে দিলেন বসনটি। অন্য একটি শাখা থেকে সংঘাটি তুলে নিয়ে পরলেন। এবার অন্তরবাসক নিংড়োচ্ছেন। শুকোতে দিলেন।
এক লাফে তাম্রকের পিঠ থেকে নামলেন পাঞ্চাল। শুষ্ক পত্রের মর্মর শব্দ তুলে দৌড়ে গেলেন। বৃক্ষের তলা জলে ভিজে, ধুলোর সঙ্গে মিশে কাদা হয়েছে, নিজের পেটিকা থেকে বসন বার করে পরিষ্কার করে দিলেন স্থানটি।
এই মানুষটির জন্য কিছু করতে ভালো লাগে।
—চিনতে পারছেন ভন্তে?
—পারছি। সাবত্থির। কুমার তিষ্য, নয়? মৃদু হাসছেন তথাগত।
—পলায়ন করেছেন শুনলাম?
—অবশ্যই। দেখো আয়ুষ্মান, ওই মোঘপুরুষগুলিকে যেন আবার আমার সংবাদ দিও না।
—নাঃ, তাই দিই? সংঘ সৃষ্টি করে বড় বিপদেই পড়েছেন তাই না ভন্তে?
প্রসন্ন হাসি হাসলেন তিনি।
—উত্তর দিলেন না তো আমার কথার?
—তুমি পৃথগ্জন, ধম্মে বিশ্বাস করো না, তোমায় উত্তর দেবো কেন?
—কী করে জানলেন ধম্মে বিশ্বাস করি না! কোনদিন তো তিষ্য বলে আহ্বান জানাননি! রাজগৃহে প্রথম সাক্ষাৎ, তারপর কতবার সিতবনে, বেলুবনে, অম্ববনে গেছি। গেছি জেতবনে। কখনও তো ডাক দেননি।
—যারা বলে সমন গোতম শিষ্যসংখ্যা বাড়াবার জন্য মায়ার আশ্রয় পর্যন্ত নেয়, তাদের এ কথা বলল আয়ুষ্মান।
—আজ আমার কাছ হতে ভিক্ষা নিন।
—তাই হোক।
তিষ্য তার সংগ্রহ থেকে শুষ্ক খাদ্য বার করে, তারপর কী মনে করে বলে
—আমি আসছি, লোকালয় কোনদিকে বলতে পারেন?
—ওই তো… আঙুল দেখান তথাগত— ওই দিকে পারিলেয্যক গাম।
গ্রাম থেকে চিঁড়ে, দধি, মিষ্টান্ন সংগ্রহ করে এসে তিষ্য দেখে একটি বৃদ্ধ বানর হাতে কী নিয়ে অবিকল মানুষের ভঙ্গিতে তাঁর সামনে বসে আছে।
—কী ব্যাপার? হাতি-বানর সব পুষছেন নাকি ভন্তে, মানুষ শ্ৰমণদের ওপর রাগ করে! এদেরও ধম্ম বিতরণ করছেন?
—ওরা ধম্মের কতকগুলি মূল কথা জানে। ও আমাকে মধু খাওয়াতে এসেছে। কিন্তু তুমি ভিক্ষা দেবে বলেছ তাই ওকে বসিয়ে রেখেছি।
তথাগত পাত্র এগিয়ে ধরলেন, তিষ্য তার সংগৃহীত খাদ্যগুলি পাত্রের ওপর রাখলে, তথাগত পাত্রটি বানরটির দিকে বাড়ালেন, তড়িৎগতিতে বানর মৌচাক দুহাতে টিপে তাঁর পাত্রের ওপর মধুবর্ষণ করল, তারপর দুতিন লাফে দূরে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পারিলেয্যক হয়ে আরও একদিনের পথ অপরাহ্ণ অবধি চলে পাঞ্চাল কৌশাম্বী পৌঁছান। রাজ অতিথিশালে দিন কাটে। যত্ন, বিলাস, প্রমোদ কিছুর অভাব নেই। শুধু রাজার সঙ্গে দেখা হয় না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে শোনেন রাজা নাকি শোকার্ত।
—কিসের শোক? কী ঘটেছে রাজ্যে?
—রাজ্ঞী সামাবতী আর তাঁর সহচরীরা আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন।
—সর্বনাশ! কী করে আগুন লাগল? নেভানো গেল না? এতো সরোবর…
—আহা দাহ্য পদার্থ অপর্যাপ্ত থাকলে সে আগুন নেভে?
—দাহ্য পদার্থ?
—হ্যাঁ মান্যবর দগ্ধ তৈলের গন্ধে ধ্বংসস্তূপ পরিপূরিত ছিল।
—তাহলে এ তো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়।
—নয়ই তো! কাউকে বলবেন না আমি বলেছি, রানীকে সপরিষদ কেউ হত্যা করেছে। হয়ত বা রাজ-আদেশই… জিভ কাটে অতিথিশালার অধ্যক্ষ।
—ভালো— পাঞ্চাল গম্ভীরভাবে বলেন— তাহলে আবার শোক কিসের?
—বলেন কি মহামান্য মাগধ! শোক করবেন না! দেবী সামাবতী যে গুণের আকর ছিলেন, দীপশিখা হেন স্নিগ্ধোজ্জ্বল মানুষটি। অমন সেবা আর কেউ করলে তো! ঘোষিত শ্ৰেষ্ঠীর পালিত কন্যা ছিলেন তো। বহু ভাগ্য বিপর্যয় দেখেছিলেন জীবনে। বড় ক্ষমাশীলা, করুণার্দ্রা মহিয়সী ছিলেন আহা।
—এতোই যদি গুণ তো!
—আমাদের উদেনরাজ বড় অধৈর্য, লোকের কথায় বড্ডই নৃত্য করে ওঠেন কিনা। অমন রাণী অবিশ্বাসিনী হয়? আপনিই বলুন না পাঞ্চাল…
—আমার কিছু বলবার নেই। কবে মহারাজ সভায় আসছেন? সভায় না আসেন, আমাকে নিভৃত আলাপের সুযোগ দিন।
উদেনরাজার পারিষদ সব যেন বিদূষকের মতো।
—এখন কোনও লাভ হবে না। দুর্ঘটনার পেছনে কারণের অনুসন্ধান চলছে, এখন সাক্ষাতে কোনও লাভ নাই। কোনও লাভ নাই… তাদের এক কথা।
কিন্তু একদিন রাজপ্রাসাদ থেকে ডাক আসে। রাজার নয়, রাণীর। না কি জানতে পেরেছেন মগধদূত দীর্ঘদিন প্রতীক্ষা করছেন।
যাবো কি যাবো না! —তিষ্যকুমার ভাবতে থাকেন। রাজগৃহে দীর্ঘদিন মহারাজের সঙ্গে আহার-বিহার। কিন্তু মহিষীদের সঙ্গে কোনও পরিচয় হয়নি কোনদিন। কোশলমল্লিকা অবশ্য আপন ভগিনীর মতো মধুর ব্যবহার করতেন। শাক্যকন্যা বাসবীও ততটা না হলেও মাঝে মাঝে উৎসব কি ধর্মানুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সাক্ষাৎ হলে জ্যেষ্ঠার মতোই আচরণ করতেন। না, রাজ্ঞীরাও তো মানবী-ই। ডেকেছেন, না যাওয়া তো রাজাজ্ঞার অবাধ্য হওয়ারই মতো। না, যাবো, যাই।
অহো! কী গরিমাময় গ্রীবাভঙ্গি! হাত তো নয় যেন রাজদণ্ড। মাথার মুকুট সু-উচ্চ। অঙ্গবস্ত্র, অলংকার সবই কেমন অতিমানবিক। ইনি নিজেই তো সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে পারেন মনে হয়। করবেনও হয়ত অদূর ভবিষ্যতে। রাজা উদেনের যেরূপ অবস্থা!
—আমি পট্টমহিষী মাগন্দিয়া। কুরুদেশের কন্যা, ব্রাহ্মণ…
নত হয়ে নমস্কার জানান পাঞ্চাল। কুরুকন্যা? তো কী? ব্রাহ্মণ… তাতেই বা হল কী?
—কোশল হতে আসছেন শুনলাম।
—ঠিকই শুনেছেন দেবি…
ভণ্ডটা নাকি ধরা পড়েছে!
—কোন ভণ্ডের কথা বলছেন?
—নির্লজ্জ দাম্ভিকটা এখানেও তো কিছুকাল আগে বসবাস করছিল। তা নাগরিকরা ও প্রকার লোক সহ্য করবে কেন? গালি দিয়েছে অকথ্য। পালিয়েছে। —ওই যে শ্রমণ গৌতম!
—শ্ৰমণ গৌতম? তিনি আর যাই হোন ভণ্ড তো নন? দাম্ভিক তো ননই। কখনো নন।
পাঞ্চালের চোখের সামনে দৃশ্যটি ভেসে ওঠে। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ওপর ভর দিয়ে তিনি— শালশাখায় উত্তরাসঙ্গ শুকোতে দিচ্ছেন।
—এই যে শুনলাম শ্রাবস্তীতে, রাজগৃহে তার নামে প্রবল অভিযোগ উঠছে, কোন রমণীকে না কি সে…
—ও সব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ওই রমণীগুলিই দুষ্ট লোকের কাছ থেকে উৎকোচ খেয়ে…
—থামুন… ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর
চক্ষু তুলে পাঞ্চাল দেখেন এ তো রূপের রূপিনী নয়! যেন বিষের সর্পিণী! কিসের ক্রোধ এতো?
—আমার মতো সুন্দরী দেখেছেন আর?
পাঞ্চাল বোঝেন যাকে গরিমা মনে হয়েছিল তা শুধু দম্ভ।
—সুন্দরীরা কখনও একে অন্যের মতো হন না তো দেবি, প্রত্যেকে স্বতন্ত্র।
—বিদুষী দেখেছেন? ব্যাকরণ, ছন্দ সব কণ্ঠস্থ?
—দেখেছি, শুনেওছি— পরম সন্তোষের সঙ্গে বলে পাঞ্চাল। গান্ধার ভবনের দিনগুলি স্মরণে আসে। চিত্ত কোমলতায় গৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে যায়।
—থামুন— ছিন্ন জ্যার মতো অতর্কিতে উঠে দাঁড়ান রাজ্ঞী
—আপনি আমাকে অপমান করছেন?
—তা যদি বলেন দেবি, আপনিই আমাকে অপমান করছেন। আপনি রাজ্ঞী হতে পারেন, কিন্তু আমি মগধরাজের প্রতিনিধি, তাঁর সম্মান আপাতত আমারই প্রাপ্য। তবে তা যদি না-ও দিতে চান, আপনার বা বৎসরাজ্যের ভৃতক তো আমি কখনোই নই।
পাঞ্চাল উঠে দাঁড়ান।
—তুমি… তুমি তোমাকে বন্দী করবার ব্যবস্থা করছি।
ক্রোধে কাঁদতে থাকেন মাগন্দিয়া।
করুন— বিরস মুখে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন পাঞ্চাল। ভেতরে বহু শব্দ। বহুস্বর। রানীর সখীরা তাঁকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রতিহারী বলে— রাজ্ঞী অতিশয় বিদুষী, রূপ তো দেখলেনই, কেন যে এমন উন্মাদের মতো… শ্ৰমণ গৌতম নাকি ওঁকে প্রত্যাখ্যান করে ছিলেন তাইতেই…
রূপ, বিদ্যা, অর্থ, উচ্চপদ কিছুই তাহলে কিছু না? ভেতরে বাসনার কূটদন্ত যদি কামড় দেয় তো রক্ষা নেই!
বিশৃঙ্খল বৎসরাজ্য ছেড়ে উজ্জয়িনীর দিকে চলে যান পাঞ্চাল। প্রদ্যোৎ মহাসেন মহা সমাদর করেন মগধদূতের।
মহারাজ বিম্বিসার যতদিন, যখন যেভাবে আমাকে সাহায্য করতে বলবেন আমি তা করব। তিনি আমাকে দুরারোগ্য রোগ থেকে বাঁচিয়েছেন। আমার জন্য তিনি ভেবেছেন, আমিও তাঁর জন্য ভাববো। তেমন প্রয়োজন হলে আমার সেনা তাঁকে অনুসরণ করবে।
বৃদ্ধ, কিন্তু মহাবল, ক্রোধী বলে পরিচিত এই নৃপতি এই কথা বললেন। তখন উত্তর-পশ্চিম দিক প্রান্তের দিকে তাকিয়ে তিষ্য কুমারের মনে হল সে তার কাজ সমাধা করতে পেরেছে, প্রায়। অবশিষ্ট রইল সুদূর উত্তর-পশ্চিমের রাজ্যগুলি— মদ্র, সৌবীর, গান্ধার। উচিত সেদিকেই যাওয়া। কিন্তু চিত্ত বড় ক্লান্ত। অবন্তীরাজের কাছে বিদায় নিয়ে সে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। উত্তর পথ পিছু হাঁটতে থাকে।
শ্রাবস্তী পার হয়ে যায় যায়। অদ্ভুত সংবাদ কানে আসে।
রানী বাসবী আর কুমার বিরূঢ়ব নাকি প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। প্রত্যন্ত গ্রামের লোকেরা বলাবলি করছে।
গ্রামের নাম সালবতিকা। পুষ্কর্ণী থেকে স্নান সেরে ফিরছেন দুই গৃহস্থ। বলছেন:
—কোসলরাজের কোনও হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান নেই। পট্টমহিষী বলে কথা, উপযুক্ত পুত্র… বার করে দিলেন?
—না না এ ভালো কথা নয়।
—মহিষী না কি শাক্যরাজার দাসীকন্যা। কোসলবংশে নিজেদের কন্যা দেবে না বলে বঞ্চনা করেছে। কপিলবস্তু হতে জেনে এসেছে। কুমারের বসার আসন না কি সাত ঘড়া দুধ দিয়ে ধুচ্ছিল। দাসীপুত্রের ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়ে গেছে।
—চমকে ওঠে তিষ্য। এক মুহূর্ত ভাবে। তার পর বৈশালীর পথে অশ্বচালনা করে। বিরূঢ়ব যদি সত্য সত্যই রাজকুমার হয়, ভাগ্যবিপর্যয়ে হতাশ্বাস হবে না সে। কিন্তু কোসলরাজের কাণ্ডখানা দেখো!
পসেনদি, উদেন, এঁরা দুজনেই ভারসাম্যহীন মানুষ তাহলে! রাজসত্তা আর ব্যক্তিসত্তার মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানে অক্ষম! বর্তমান জম্বুদ্বীপের দৃজন প্রতাপশালী নরপতি এইভাবে চলছেন! উদেনের পুত্র বোধিকুমার নাকি সুংসুমারগিরিতে একটি বিলাসপ্রাসাদ প্রস্তুত করাচ্ছে। যার তুলনা জম্বুদ্বীপের কোথাও নোই। রাজার কোষটি কী দিয়ে ভরেছে? কিছু সীতা ভূমির ওপর তাঁর অধিকার থাকে ঠিকই, কিন্তু আর সব? সবই তো প্রজাদের রাজস্ব, অপুত্রক প্রজার সম্পত্তি, বণিকের শুষ্ক এইসব। রাজাকে তাঁর প্রাসাদ, যান, অলঙ্কার এ সকল কে দেয়? প্ৰজাই তো! অথচ সেই ধন যথেচ্ছ ব্যয় করে যান প্রত্যেক রাজা, তাঁরা যে প্রকৃত পক্ষে রাজ্যের বৃত্তিভোগী ভৃতক এ চেতনা থাকে না। মগধরাজ এরই মধ্যে একটু ব্যতিক্রমী বই কি!
গণরাজ্যে ধনের বণ্টন কী রূপ দেখা যাক। রাজনীতির খেলাই বা তাঁরা কী ভাবে খেলেন।
কপিলবস্তুর ক্ষুদ্র শাখাপথটি পার হয়ে গেছে। শাক্যরাজ্যে যাবার প্রবৃত্তি হয়নি। সে শুনেছিল রানী বাসবী স্বয়ং তথাগতর ভ্রাতৃকন্যা। কোসল রাজ শাক্যকুলের কন্যা বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। শাক্যদের এতো দূর স্পর্ধা যে বিবাহের জন্য দাসীকন্যা পাঠাল! বলে দিতে পারত। আর এই যে ধনী ব্যক্তিমাত্রেই অজস্র দাসী, নটী রাখবে, তাদের গর্ভে ইচ্ছামতো সন্তান উৎপন্ন করবে এই অপব্যয়ী প্রথাই বা কেন? যশ নামে এক অর্হন আছেন তিনি ছিলেন বারাণসীর এক শ্ৰেষ্ঠীপুত্র। একবার শ্রাবস্তীতে তিষ্যর গৃহে ভিক্ষার্থে আসেন। তিষ্যর বড় কৌতূহল, কখন কী পরিস্থিতিতে এঁরা প্রব্রজ্যা নেন! অর্হন যশকে জিজ্ঞাসা করেছিল। উনি বলেন— ঘৃণায়।
—ঘৃণা?
—একদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে যখন পৃথিবী সবে নিদ্রান্তে জাগছে, অপার্থিব বালার্ককিরণে চতুর্দিক রহস্যভূমি, তখন জেগে উঠে দেখলাম আমি শুয়ে আছি, বিলাস শয্যাটি তছনছ, দু পাশে দুই নারী, মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। প্রভুপুত্রের সেবা করে এতো ক্লান্ত যে তাদের অস্থি পর্যন্ত যেন শিথিল হয়ে গেছে। হর্ম্যতলে কৃমি কীটের মতো কিলবিল করছে আরও অনুরূপ নারী। বিতৃষ্ণা হল।
—কার ওপর, ওই নারীগুলির ওপর না কি?
—ওরাই ঘৃণা জাগায়, মূত্র পুরীষের আধার, অপবিত্র, কুৎসিত… কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম আমি, আমিই ঘৃণ্য, ঘৃণ্য আমার এ জীবনযাপন, তখনই ছুটে চলে গেলাম। ভাগ্যক্রমে ভগবান তথাগতর সন্ধান পাই।
তিষ্য কোনদিন এমন জীবন যাপন করেনি বলেই কি তার জীবনতৃষ্ণা যায় না!