১৫
সাকেত থেকে তিন বটু তিন স্থবিকা কাহিনী নিয়ে ফিরলেন। পূর্বাপর শুনে মিগার-পত্নী বললেন, ‘গহপতি যা করবে ভেবে-চিন্তে করো। তোমার উপার্জনকে যে তার নিজের সম্পদের তুলনায় এক কাহনও মনে করে না সেই দাম্ভিকের সঙ্গে কুটুম্বিতা করা কি ভালো?’
মিগার শুষ্ক মুখে বললেন, ‘কিন্তু উপায় কি? পাশার দান যে ফেলা হয়ে গেছে! এখন আর ফিরি কী করে? তবে হ্যাঁ। মিগার অত সহজে ছেড়ে দেবে না, শিক্ষা দিচ্ছি। আগে দেখি মহারাজ কী বলেন!’
‘মহারাজের সঙ্গে এ কুটুম্বিতার কী সম্পর্ক?’
‘বাঃ, মহারাজ স্বয়ং তো এই সেট্ঠিকে মগধ থেকে এনে সাকেতে বসত করালেন।’
‘তাই নাকি? কেন?’
‘সে এক মহা অপমানের কথা!’
‘কী ব্যাপার বলো তো সেট্ঠি!’
‘ব্যাপার কিছুই না। মগধের রাজার তো দিনদিন শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। শ্রীবৃদ্ধি তো শুধু শুধু হয় না! অর্থভাণ্ডার প্রস্তুত থাকা চাই। মগধের শ্রীটি আছ পঞ্চ-মহা সেট্ঠির কোষে। তো রাজার অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছা মনে উদয় হয় কি না! আমাদের ডেকে কার কত সম্পদ গণনা করিয়ে বললেন—সাবত্থিতে তো দেখছি সুদত্ত, মণিভদ্র, প্রতর্দন ও মিগার। তাও সুদত্তর মতো সম্পদশালী আর কেউই নয়। কিন্তু মগধে রয়েছেন পাঁচজন। আমার রাজ্যেই বা সেনিয়র রাজ্যের থেকে অল্প থাকবে কেন? আমরা কত করে বোঝালাম মহারাজ এধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কী লাভ? আমরা কি যুদ্ধবিগ্রহের সময়ে, মহামারী দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির সময়ে আপনাকে ধন দিয়ে সাহায্য করতে পারছি না। তো রাজার এক গোঁ। আরেক জন সেট্ঠিকে মগধ থেকে এনে বসত করাতে হবে।’
‘তোমরা বললে না কেন, ভিনদেশের ধনী এসে আমাদের সমাজে মানাতে পারবে না, একটা অনত্থ হবে।’
‘বলিনি আবার! সে কথাও বলেছিলেন সেট্ঠি মণিভদ্দ। তার উত্তরে পাগলা রাজা কী বললেন জানো? বললেন, আপনারা অনর্থক হিংসুকবৃত্তি করে তাকে বিব্রত না করলে তার অসুবিধে হবে কেন? কোসল আর মগধ পাশাপাশি রাজ্য। দেশের প্রজাগণের মধ্যে, সমাজ-সংস্কারের মধ্যে কি কোনও পার্থক্য আছে? সেখানেও যাগ-যজ্ঞ হয়, এখানেও যাগ-যজ্ঞ হয়। ওখানে মগধরাজ ব্রাহ্মণ কূটদন্ত ও সোনদণ্ডকে প্রভূত ধন দিয়ে সম্মানিত করেছেন। এখানেও আমি ব্রাহ্মণ পোক্খরসাদি ও তারুক্খকে ব্ৰহ্মত্র দিয়েছি। ওখানেও সন্ন্যাসী-শ্ৰমণদের সমাদর, এখানেও তাই। আপনাদের অসুবিধা হবে তা-ই বলুন!’
‘গহপতি সুদত্ত কিছু বললেন না?’
‘তাঁর কি আসে যায় বলো গৃহিণী। তিনি তো নিজের সাম্রাজ্য বাড়িয়েই চলেছেন, বাড়িয়েই চলেছেন। মানুষটি কথাও বলেন অল্প। চতুর তো! বুঝেছেন রাজার ইচ্ছা, অন্যথা হবে না। অমনি মৌন নিলেন। তা সেই যাই হোক। ওখানকার মহাসেঠ্ঠি মেণ্ডকের পুত্র ধনঞ্জয়কে মহারাজ একেবারে জোর করে নিয়ে আসছিলেন। সেট্ঠি পুত্তুর চতুর তো কম নয়! সাবত্থি পর্যন্ত এলোই না। সাকেতে বাস নিল। বাস চুকে গেল। আমাদের কারও আর সে কথা কথা মনে নেই। এই বটুরা যে কন্যা নির্বাচন করতে গিয়ে ওই ধনঞ্জয়ের কন্যার গলাতেই আমার মালাটি পরিয়ে আসবে তা কি আমি স্বপ্নেও ভেবেছি!’
শ্রেষ্ঠী ও শ্রেষ্ঠীপত্নী উভয়েই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রেষ্ঠীর পুত্রের সঙ্গে শ্ৰেষ্ঠীর কন্যার বিবাহ হচ্ছে, এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কিন্তু নিজেদের চেয়েও শতগুণে ধনী যে তার ঘর থেকে বধূ আনলে তো মহা সমস্যার উদয় হবে! সে কি শ্বশুর-শ্বশ্রূকে মান্য করবে।
মহারাজ প্রসেনজিৎ কিন্তু এই সংবাদ শুনে অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘বুঝলেন গহপতি, বৈবাহিক সম্পর্কই হলো সবার সেরা সম্পর্ক। এই যে আমি আর মগধরাজ বিম্বিসার পরস্পর পরস্পরের ভগ্নীকে বিবাহ করেছি, দুটি রাজ্যে কেমন শান্তি বলুন তো? যতই রাজ্যলোভ থাক কেউই তো আর ভগ্নীকে বিধবা করতে চায় না!’ বলে প্রসেনজিৎ হা হা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন, ‘তো গহপতি, আপনার আর ধনঞ্জয়ের কন্যা এবং পুত্র যদি থাকে তো এইরকম বিনিময় করে নিন না কেন? আমার রাজ্যের সম্পদের ভিত্তি আরো দৃঢ় হবে!’
মিগার অপ্রসন্ন মুখে বললেন, ‘আমার কোনও কন্যা নেই।’
রাজা তাঁর অপ্রসন্নতা লক্ষ করলেন না, বললেন, ‘তা না থাক। এতদিনে যে মগধশ্রেষ্ঠীর সঙ্গে শ্রাবস্তীর একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ হতে চলেছে—এ অত্যন্ত সুখের কথা। আমি স্বয়ং যাবো। মহাদেবী মল্লিকাকে নিয়েই যাবো।’
এ কথাতে খুব সংগোপনে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন মিগার। বললেন, ‘তা তো নিশ্চয়ই, আপনার জ্ঞাতি-বন্ধু-পরিজন-সৈন্য-রক্ষী সবই নিশ্চয় যাবে!’
প্রসেনজিৎ চিন্তিত হয়ে বলেন, ‘জ্ঞাতি-বন্ধু? সে তো অনেক? আমি কয়েক জন দেহরক্ষী, নির্দিষ্ট সংখ্যক দাস-দাসী আর মহাদেবী মগধকুমারী ও দেবী মল্লিকাকে নিয়ে যাবার কথা ভাবছিলাম।’
মিগার বলে উঠলেন, ‘না, মহারাজ, আমার পুত্রের আবাহে আপনার অন্তঃপুরিকারা সবাই যাবেন। অন্যান্য রানিরাই বা বাদ থাকবেন কেন? তাঁদের রক্ষার জন্য এবং আপনার মর্যাদারক্ষার জন্য যতজন দাসদাসী, রক্ষী ইত্যাদি লাগে সবাইকেই নিতে হবে।’
প্রসেনজিৎ বললেন, ‘তাহলে গহপতি, আপনি একবার সাকেতের শ্রেষ্ঠীকে জিজ্ঞাসা করে পাঠান। শুধু শুধু তাঁকে বিব্রত করতে আমার ইচ্ছা নেই।’
মিগার সংবাদ পাঠালেন, ‘মহাসেট্ঠি, আপনার কন্যাকে বধূ করে আনতে পারছি বলে নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি। মহারাজ প্রসেনজিৎ আমাকে অতিশয় অনুগ্রহ করেন। কন্যাকে আনতে তিনিও আমার সঙ্গে যেতে চান। কত জন বরযাত্রী গেলে আপনার অসুবিধা হয় না, তা একটু যদি পূর্বাহ্নে জানান।’
অশ্বারোহী দূত দু দিনের মধ্যেই ধনঞ্জয়ের লিপি নিয়ে এলো : ‘মাননীয় শ্রেষ্ঠীবর মিগার, আপনার নিজের পরিবার, জ্ঞাতি, জ্ঞাতক, মাতৃকুল, পিতৃকুল, শ্বশুরকুলে যাঁরা আছেন তাঁরা তো সকলে আসবেনই, মহারাজ পসেনদিও তাঁর যতজন সৈন্য, যতজন রক্ষী লাগবে সবাইকে নিয়ে আমার কন্যার বিবাহোৎসবে আসবেন।’
শেষ পর্যন্ত অবশ্য রমণীদের মধ্যে একমাত্র দেবী মল্লিকা ছাড়া আর কেউই গেলেন না। নারীদের এভাবে বরানুগমন করার প্রথা নেই। সে যত সমারোহের বিবাহই হোক। দেবী মল্লিকার কথা স্বতন্ত্র। মাত্র দু-চার বছর হল রাজা পসেনদি তাঁকে বিবাহ করেছেন। গিয়েছিলেন কোশল সীমান্তে বিদ্রোহ দমন করতে। এই সীমান্তের অঞ্চলগুলিতে মাণ্ডলিক রাজারা অধিকার পেতে পেতে এক সময়ে মনে করতে থাকে তারাই আসল রাজা। ইচ্ছামতো কর বসায়, বিচার করে প্রজাদের প্রাণদণ্ড পর্যন্ত দিতে থাকে, রাজা পসেনদিকে গ্রাহ্যই করে না। কোশল রাজ্য, কাশী যুক্ত হবার পর একটি বৃহৎ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। শাক্য, কোলিয়, কালাম, এরা সকলেই কোশলের পদানত। রাজার রয়েছে সুযোগ্য সেনাপতিদ্বয় বন্ধুলমল্ল ও দীর্ঘচারায়ণ। রাজা নিজে অত্যন্ত বিলাসী হলেও একবার ক্রুদ্ধ হলে যে আর রক্ষা নেই এ কথা এরা ভুলে যায়। পসেনদি স্বয়ং গিয়েছিলেন বিদ্রোহ দমন করতে। ফেরবার পথে একটি অতি শোভন পুষ্পোদ্যানে প্রবেশ করেছিলেন ক্লান্ত হয়ে। ওই পুষ্পোদ্যানের স্বত্ব ছিল যাঁর তিনি একজন সুবিখ্যাত মালাকার। মল্লিকা তাঁরই কন্যা। রাজাকে শ্রান্ত ক্লান্ত দেখে মল্লিকা তাঁর ঘোড়াটির রজ্জু ধরে রাজাকে জল পান করতে দেয়। এবং ক্লান্তিতে অভিভূত হয়ে রাজা ঘুমিয়ে পড়লে, কঠিন ভূমিতে এই রাজপুরুষের কষ্ট হবে মনে করে তাঁর মাথাটি নিজের কোলে তুলে নিয়ে—রাজার ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত অচলভাবে বসে থাকে।—কন্যাটি সুশীলা, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী তো বটেই তার ওপর অতি সুন্দরী। এমন নারী পসেনদির চোখে পড়লে রাজান্তঃপুরে সে যাবে না এমন হতে পারে না। মল্লিকা রাজা জেনে তাঁকে আশ্রয় দেয়নি, কিন্তু ঘুম ভাঙলে পসেনদি তৎক্ষণাৎ নিজের পরিচয় দিলেন এবং মল্লিকার পিতার কাছে গিয়ে কন্যাটির পাণি প্রার্থনা করলেন। এরকম তো কতই হয়! কয়েক মাস পরে এই রমণীর ওপর থেকে রাজার ঝোঁক চলে যায় সে তখন রাজার অসংখ্য অন্তঃপুরিকাদের একজন মাত্র হয়ে যায়। কিন্তু মল্লিকার ভাগ্য তেমন হল না। একেই তো তাঁকে রাজা অগ্রমহিষী করলেন, তারপর মাসের পর মাস শুধু মল্লিকার গৃহেই রাত্রিযাপন করতে লাগলেন। দু’জনের মধ্যে গভীর প্রণয়। এখন রাজা দেবী মল্লিকাকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। তাই তিনিও সঙ্গে যাবেন। পাঁচ শতাধিক সৈন্য, রক্ষী, আরও পাঁচ শতাধিক জ্ঞাতি, বন্ধু, পরিজন নিয়ে রাজার মঙ্গল-হস্তী সহ বহু হস্তী, ঘোড়া, রথ ইত্যাদি নিয়ে মহানন্দে সাকেত অভিমুখে যাত্রা করলেন মিগার শ্রেষ্ঠী। সময়টা বর্ষা। আকাশ প্রায় সর্বক্ষণই মেঘাচ্ছন্ন। যে কোনও মুহূর্তে আকাশ থেকে নেমে আসবে বারিধারা। পথঘাট হবে কর্দমাক্ত। স্কন্ধাবারে বাস করা অশ্বস্তিকর হয়ে উঠবে। তার ওপর বর্ষার সময়ে নানাপ্রকার কীট, সাপ, পতঙ্গ-পিপীলিকায় ছেয়ে যাবে চতুর্দিক। ধনঞ্জয় শ্ৰেষ্ঠী বর্ষা উত্তীর্ণ করে শীতের প্রারম্ভে বিবাহোৎসব করতে চেয়েছিলেন। তখন আকাশ থাকবে পরিষ্কার। বসুন্ধরা শস্যপূর্ণ। কীট-পতঙ্গের উপদ্রব থাকবে না। সর্পেরা ঘুমোতে যাবে। বিবাহের জন্য এই সময়ই প্রশস্ত। তা ছাড়া কন্যার অলঙ্কারাদি প্রস্তুত করতে সময় লাগবে। কিন্তু মিগার মনে মনে ধূর্ত হাসি হেসে ধনঞ্জয়ের এ প্রার্থনা অগ্রাহ্য করে দিয়েছেন। অবশ্যই অতি সাবধান সম্ভ্রমের সঙ্গে। শ্রেষ্ঠী ক্ষেপে না যায়। তিনি বলে পাঠালেন বাগ্-দানের পর আমাদের কুলে বধূকে এতদিন পিতৃগৃহে ফেলে রাখবার নিয়ম নেই। পুন্নবদ্ধনের মাতা তাঁর নির্বাচনের দুই পক্ষকালের মধ্যে শ্বশুরগৃহে এসেছিলেন। অতএব শ্রেষ্ঠিবর আপনি কন্যাকে প্রস্তুত করুন। আর অলঙ্কার বস্ত্রাদির জন্য অত সময় নেওয়ার প্রয়োজন কী! একমাত্র পুত্রের বধূর সম্মানরক্ষার জন্য মিগার যথাসম্ভব অলঙ্কারাদির ব্যবস্থা করেছেন।
এই লিপি পাবার পর সাকেতে সাজ-সাজ রব পড়ে গেছে। পেটিকার পর পেটিকা বস্ত্র আসছে, বারাণসীর নানা রঙের দুকূল, স্বর্ণসূত্ৰী শাটিকা, রূপা এবং সোনার সুতোর ফুল তোলা বসন, বহুপ্রকার কার্পাসিক, ক্ষৌমবস্ত্র, পট্টবস্ত্র, সূক্ষ্ম ঊর্ণার বস্ত্র, সেই সঙ্গে মুক্তা, গজদন্ত, হীরা, পুষ্পরাগ, মরকত, বৈদুর্য, মণি-মাণিক্যের স্তূপ হয়ে গেছে। এই সমস্ত নিয়ে নানা চিত্র করতে ব্যস্ত দেবী সুমনা। সেই সব চিত্র দেখে দেখে সুবণ্ণকারেরা গহনা প্রস্তুত করছে। তন্তুবায়েরা বস্ত্র বয়ন করছে। বিবাহমণ্ডপের সজ্জা কেমন হবে, বিশাখার অনুচরীরাই বা কীভাবে সজ্জিত হবে, সঙ্গে কী নেবে, পুরনারীরা, দাস-দাসীরা তারা কী বস্ত্র এবং অলংকার পরবে…দেবী সুমনার নিশ্বাস ফেলবার অবকাশ নেই।
মিগারের পত্রটি দেখে ধনঞ্জয় খানিকটা বিমূঢ় হয়ে অন্তঃপুরে এলেন।—‘সুমনা, প্রিয়ে দেখো তো মিগার শ্রেষ্ঠীর অবিবেচনা। এই বর্ষাতেই সে বিবাহ দিতে চায়! ছয় সাত শতেরও অধিক সম্মানিত অতিথি আসছেন শ্রাবস্তী থেকে। এদিকে সাকেতের সবাইকে, গ্রামগুলি, ভদ্দিয়, রাজগৃহ সর্বত্রই তো নিমন্ত্রণ পাঠাতে হবে।’
সুমনা বললেন, ‘সে কী! “মহালতা পসাদন” নির্মাণ করতেই তো তিন মাস সময় লাগবে সুবণ্ণকারেরা বলছে। তার আগে তো হবে না!’
ধনঞ্জয় বললেন, ‘বুঝতে পারছি না। মিগার শ্রেষ্ঠী কিংবা রাজা প্রসেনজিৎ কি আমার ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে চান?’
‘কেন? যাঁরা নিজেরাই কন্যাকে বরণ করেছেন, যৌতুকের কথা চিন্তা করেননি।’ সহসা তাঁরা তোমার ক্ষমতার পরীক্ষা করতে চাইবেন কেন?
ধনঞ্জয় অপ্রতিভ মুখে বললেন, ‘একটা কথা অসতর্কভাবে বলে ফেলেছিলাম প্রিয়ে, বুঝতে পারছি না এসব তারই প্রতিক্রিয়া কি না।’
‘কী কথা! সুমনা অবাক হয়ে বললেন।
‘শ্রেষ্ঠীর উপার্জনের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তর শুনে মনে হল ইনি আমার সঙ্গে কোনও তুলনাতেই আসেন না। সে কথাটা ব্রাহ্মণদের সামনেই বলে ফেলেছি।’
সুমনা রাগ করে বললেন, ‘তুমি বড় অবিনয়ী সেট্ঠি। কতবার তোমাকে বলেছি প্রকৃত ধনী যে, সে কখনও দম্ভ দেখায় না। শ্বশুর পিতাকে দেখেছ কখনও সম্পদ নিয়ে গর্ব করতে, অথচ তাঁর তুল্য ধনশালী আর কে আছে ভদ্দিয়তে? তুমি যে অন্তত তিন পুরুষে ধনী সন্তান তোমার আচরণ দেখে কখনও কখনও তা মনে হয় না।’
ধনঞ্জয় প্রকৃতই অপ্রতিভ হয়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী জানো সুমনা, কত বিপজ্জনক বাণিজ্যযাত্রা করে, কত অজপথ, জহ্নুপথ, বেত্ৰপথ, শঙ্কুপথ পার হয়ে নিজের বীর্যে, বুদ্ধিতে ধন অর্জন করেছি। অত ধনী পিতার পুত্র হয়েও তার ওপর নির্ভর করিনি। আজ যে সাকেতের এই শ্ৰী-সমৃদ্ধি তার কিছুই কি ধনঞ্জয় ব্যতীত হত? তাই দম্ভ নয়, একটা প্রসন্নতা, প্রত্যয় সব সময়ে আমার হৃদয় অধিকার করে থাকে। আর সংখ্যা গণনার কথাই যদি বলো, চার শত কোটি যে অশীতিসহস্র কোটির কাছে এক কাহনও নয়, এ তো অঙ্কপাত করলেই বোঝা যাবে। সহজ, সরল, সত্য কথা। তাই….।’
সুমনা বললেন, ‘তাই, যে গৃহে কন্যা দিতে চলেছ, সেই গৃহের গৃহপতির সম্পর্কে এ উক্তি করবে! তার দূতদের সামনে? তোমার কন্যার সুখশান্তি সবই যে নির্ভর করছে তোমার এই আচরণের ওপরে।’
জীবনে এই প্রথম শ্রেষ্ঠীগৃহে দাম্পত্যকলহ লাগল।
ধনঞ্জয় বারবার বলতে চান—তিনি যা সত্য তাই বলেছেন মাত্র। কাউকে অপমান করার জন্য কিছু বলেননি। তা ছাড়া সে সময় তিনি মিগার-পুত্রকে কন্যা দেবার কথা একেবারেই ভাবছিলেন না। সুমনা রাজগৃহ থেকে ফেরবার পর পরিস্থিতির চাপে পড়েই এ বিবাহ স্থির করেছেন।
সুমনা ততই ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘সত্য কথা আর রূঢ় কথার পার্থক্য ধনঞ্জয় কবে বুঝবেন? এর ওপর যে বিসাখার সারা জীবনের সুখশান্তি নির্ভর করছে!’ সুমনা সহসা সংযম হারান না। কিন্তু তাঁর এখনকার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তিনি আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
এই বাদপ্রতিবাদের মধ্যে বিশাখা কক্ষে প্রবেশ করেছিল। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, ‘বিসাখার সুখশান্তি কখনওই এইসব তুচ্ছ কারণের ওপর নির্ভর করবে না মা, তুমি শান্ত হও।’
সুমনা বললেন, ‘কিন্তু মা তুই তো জানিস না, ইচ্ছে করলে শ্বশুর-শ্বশ্রূ যে তোকে কী অসহ্য কষ্ট দিতে পারেন, অপমান করতে পারেন, একবার বিবাহ হয়ে গেলে তোকে আমরা এ সব থেকে বাঁচাব কী করে?’
বিশাখা বলল, ‘ইচ্ছে করলেই শ্বশুর-শ্বশ্রূ বা অন্য কেউই ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা বিশাখাকে কষ্ট দিতে পারেন না মা, অপমান করতেও পারেন না। আমি দেবী সুমনার কন্যা, দেবী পদ্মাবতীর পৌত্রী।’
সে স্বচ্ছন্দ কিন্তু দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মুখের ভাবে কোনও কঠিনতা নেই। কিন্তু রানির মতো এক সহজ মর্যাদাবোধ তাকে ঘিরে। এই বিশাখাকে কেউ কষ্ট দিতে পারে, কেউ এর অমর্যাদা করতে পারে সত্যিই বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সদ্য ষোড়শী এই কন্যা তার পিতৃ-মাতৃকুলের গণ্ডির বাইরে যে বিশাল সংসার আছে তার কতটুকু জানে! শ্বশুরগৃহ হল নৈর্ঋত কোণের মতো, সেখান থেকে আসে যত দুঃখ, যত অনাদর, ভাগ্য মন্দ হলে! বিশাখার ভাগ্য কি ভালো! ভালো হলে রাজ-পরিবারের সঙ্গে কুটুম্বিতা করার ভয়ে এমন বায়ুবেগে হ্রস্ব-দীর্ঘ কোনও চিন্তা না করে একটা বিবাহ স্থির করে ফেলতে হয় কেন? ধনঞ্জয় যা বলছেন তাতে তো সুমনার বুক কাঁপছে।
তিনি সভয়ে বললেন, ‘কিন্তু তুমি যা বলছ তাতে মনে হচ্ছে আমরা বিশাখাকে যে ভাবে লালন-পালন করেছি তাতে ও সেখানে গিয়ে থাকবেই বা কী করে?’
এইবার ধনঞ্জয় হেসে বললেন, ‘বিশাখাকে মিগার শ্রেষ্ঠীর ঘরে থাকতে হবে কেন?’
‘তার অর্থ! কন্যাকে শ্বশুর-গৃহে পাঠাবে না?’
‘পাঠাব না কেন? কিন্তু আমার কন্যা তার নিজের সমস্ত প্রয়োজন, নিত্যকৃত্য এবং বিলাসাদির ব্যয়ের জন্য যত অর্থ লাগবে সবই এখান থেকে নিয়ে যাবে। তার দাস-দাসী, সহচরীরা তাকে ঘিরে থাকবে! কোনও কিছুর জন্যই মিগার শ্রেষ্ঠীর মুখাপেক্ষী হতে হবে না।’
‘তাহলে তো আরও ভালো! কন্যার দুর্ভাগ্যের পথটি একেবারে বাঁধিয়ে দিচ্ছ।
‘কেন? তুমি কি বলতে চাও ধনঞ্জয় তার কন্যাকে যৌতুক দেবে না? দাস-দাসী দেবে না? মহাদেবী কোশলকুমারী যখন রাজা বিম্বিসারের মহিষী হয়ে আসেন, কাশী রাজ্যের একটি বৃহৎ গ্রাম শুধু স্নানের ব্যয়-নির্বাহ করবার জন্যই পেয়েছিলেন, তা জানো?
‘তুমি কি মহারাজ মহাকোশলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছ নাকি?’
‘না, তা নয়।’ ধনঞ্জয় কৌতুকের হাসি হেসে বললেন, ‘কিন্তু আমার কন্যার অন্ন-বস্ত্র-প্রসাধন-দান-ধ্যান-আমোদ-প্রমোদের জন্য আমি যদি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী যৌতুক দিই কার কী বলার থাকতে পারে! আর ধরো যে গাভীগুলি পাঠাবো তাদের দুধ তো শুধু বিশাখা আর তার সহচরী দাস-দাসীরাই পান করে ফুরোতে পারবে না, মিগারও খাবেন, তাঁর ধর্মপত্নীও খাবেন, তাঁদের পরিজনদের ভাগ্যেও কিছু মাত্র অল্প পড়বে না। আর বলদ যে সব যাচ্ছে, সেগুলি দিয়ে তো বিশাখা ভূমি কর্ষণ করবে না!’
‘কী অর্থ এসব কথার?’ দেবী সুমনা বিমূঢ় হয়ে বললেন। তিনি একবার হাস্যমুখী কন্যার দিকে তাকাচ্ছেন, আর একবার তাকাচ্ছেন দুষ্টু হাসিতে ভরা মুখ স্বামীর দিকে।’ ‘বুঝতে যদি না পারো তাহলে বুঝতে হবে অলঙ্কারের রত্ন গণনা করতে করতে আর গহনার রত্নসংস্থানের চিত্র করতে করতে তোমার মস্তিষ্কটি একেবারে সোনা রূপা মণি মুক্তাতেই ঠাসা হয়ে গেছে প্রিয়ে, না হলে…’
বিশাখা হাসতে হাসতে বলল, ‘মা, পিতা বলতে চাইছেন অতিরিক্ত যৌতুক পেয়ে আমার শ্বশুর আহ্লাদিতই হবেন! পিতাকে অহংকারী ভেবে ক্রুদ্ধ হবার কোনও কারণ ঘটবে না।’
সুমনা বললেন, ‘কত গাভী, কত বলদ দেবে শুনি?’
‘যত গাভী যেতে চায়, যত বলদ যেতে চায়।’
‘পশুদের বিসাখা নিজের হাতে যত্ন করে, ওরা বিসাখাকে যত চেনে আর কাউকে তত চেনে না। তা ছাড়া গো-পালকদের মতো বিসাখা তো কখনও ওদের প্রহার করে না। বৎসগুলিকে সরিয়ে রেখে, দুধ দোহন করে নেয় না, সে যায় শুধু ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে, ক্ষতস্থানে প্রলেপ লাগিয়ে দিতে কিংবা মধুমাখা ঘাসের গুচ্ছ খাওয়াতে। ওরা বিসাখাকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসে, ল্যাজ তুলে সব ওর পেছন পেছন চলে যাবে।’
‘তাহলে সুমনা তুমি গাভীগুলিকে সব দিতে চাইছ না। শুনছিস বিশাখা, মায়ের মনে ভয় হয়েছে তাঁর গোয়াল বুঝি শূন্য হয়ে যায়।’
সুমনা রঙ্গরসিকতার ধার দিয়েও গেলেন না, বললেন, ‘যার হৃদয় শূন্য হয়ে যেতে চলেছে তার গোয়ালে গরু থাকলেই বা কী! না থাকলেই বা কী! এ সব অর্থহীন কথা বলো না সেট্ঠি। কিন্তু এত গোধন পাঠালে, সাবত্থি সেট্ঠি তা রাখবেন কোথায়?
‘নতুন নতুন গোশালা নির্মাণ করিয়ে নেবেন, আমি যেমন এই বর্ষায় অতিথিদের রাখবার জন্য নতুন নতুন গৃহ প্রস্তুত করছি।’ ধনঞ্জয়ের চোখ ঝিকমিক করছে।
‘আর তাদের পালন? পালন করবার জন্যেও তো বহু লোক চাই!’
‘চাই-ই তো! তাই-ই অপরিমিত দাস-দাসী পাঠাচ্ছি।’
‘বাঃ, আর সেই সব দাস-দাসীর পালন?’
‘তার জন্য আবার শকটের পর শকট কার্ষাপণ যাবে।’
‘সেগুলি ব্যয় হয়ে গেলে?’
‘ধনঞ্জয় শ্ৰেষ্ঠী ধনকে সন্তানবতী করার উপায় জানে। সাকেত থেকে শ্রাবস্তী মাত্র এক দিনের পথ। ওদের লালন-পালন বিশাখাই করবে।’
‘কিন্তু এত দাস-দাসী, সহচরী ইত্যাদি নিয়ে থাকবার স্থান সঙ্কুলান আছে কি না মিগার সেট্ঠির গৃহে সে সংবাদ নিয়েছো? তার নিজেরও নিশ্চয় অনেক আছে।’
‘তা আছে। এবং এত দাস-দাসীর স্থান হওয়া সত্যিই সমস্যা।’
‘তবে?’
‘বিশাখার জন্য স্বতন্ত্র প্রাসাদের নির্মাণ করিয়ে দিচ্ছি। বারাণসী বর্ধকিরা এখানকার কাজ শেষ করেই শ্রাবস্তী চলে যাবে।’
সুমনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘কিন্তু সেট্ঠি, এতটা কি ভালো করছ? স্বতন্ত্র প্রাসাদে স্বতন্ত্র দাসদাসী নিয়ে স্নুষা থাকবে, এ তো রাজবাড়ি নয়, সেট্ঠি বাড়ি। গহপতির কি। এসব ভালো লাগবে?’
ধনঞ্জয় বললেন, ‘আমরা গিয়ে তাঁর পুত্রকে প্রার্থনা করতে যাইনি সুমনা। তাঁরাই সারা মধ্যদেশ ঘুরে আমার কন্যাটিকে সর্বোত্তম বিবেচনা করে, ঝুপ করে তার গলায় আশীর্বাদী হারটি পরিয়ে দিয়ে গেছেন। দূত ব্রাহ্মণদের কাছে নিশ্চয় শুনেওছেন ধনঞ্জয় তার অতিথিদের কীভাবে রাখে। সুতরাং কন্যাকে কীভাবে রাখে সে কথা বলাই বাহুল্য। এমন ঘর থেকে কন্যা নিয়ে যাচ্ছে, মিগার শ্রেষ্ঠীরই তো উচিত স্বতন্ত্র প্রাসাদ নির্মাণ করিয়ে দেওয়া।’
‘কী করে জানলে করাননি?’
‘ভালো তো! করিয়ে থাকলে ভালোই। অধিক থাকলেই বা ক্ষতি কী? তাঁরটাও থাক, আমারটাও থাক।’
সুমনা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কৃপণং হ দুহিতা।’
‘তার সুখের জন্য সব রকম ব্যবস্থা করছি তবু বলবে দুহিতা কৃপণা? দুঃখিনী?’ ধনঞ্জয় সকাতরে বললেন।
সুমনা বললেন, ‘সেইজন্যেই তো বললাম! এত ধনসম্পদ! এমন পিতা! তবু এই পরম স্নেহের ধন দুহিতাটিকে পর-ঘরে পাঠাতে হয়। তার সুখদুঃখ নির্ভর করে এমন কতকগুলি মানুষের ওপর যাদের এতদিন ধরে সে চেনেইনি। জানেইনি। কী তাদের অভ্যাস, কী তাদের চরিত্র, তারা কী চায়, এইসব জানতে বুঝতেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা তার ব্যয় হয়ে যাবে। বালিকার অপূর্ব সরলতার স্থান নেবে অভিজ্ঞতাপক্ক সংসারবুদ্ধি। কিশোরী হয়ে যাবে বৃদ্ধা। কৃপণা, বড়ই দুঃখিনী এই দুহিতারা।’
সুমনার বিষন্ন মুখ দেখে ধনঞ্জয় কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু সুমনা, তাকে তো জায়াও হতে হবে। সে যদি তোমার মতো সখিসম্মিত জায়া হয়!’
সুমনা বললেন, ‘সে সখিসম্মিত হবে, কিন্তু তার পতিটি যদি সখাসম্মিত না হয়, তোমার মতো!’
মাতা-পিতার বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে বিশাখা মাকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে এসেছিল। তার অনেক কাজ। বারাণসীর নিকটবর্তী বর্ধকিগ্রাম থেকে পাঁচ শতাধিক বর্ধকি এসেছে। সরযূতীরে যেখানে নৌবণিকরা এসে থাকে, বিশ্রাম করে, তারই কাছাকাছি তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। নগরের মধ্যে যে কটি শোভন গৃহ পাওয়া গেছে সেগুলি তো রাজা উগ্রসেনের অনুমতিক্রমে নেওয়া হয়েছেই। তা ছাড়া বেশ কিছু অস্থায়ী বাড়ি প্রস্তুত হবে। এই বর্ধকিরা নিজেদের গ্রামেই গৃহের স্তম্ভ, দ্বার, বাতায়ন, মেঝের জন্য বড় বড় পাটা প্রস্তুত করে আনে। সাকেতের স্থপতিজ্যেষ্ঠক অনুবিন্দ বিশাখার সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের দিয়ে কতকগুলি অস্থায়ী হর্ম্য করাচ্ছেন। কোনটি সপত্নীক মহারাজ প্রসেনজিতের জন্য যাতে তিনি ব্যক্তিগত দাসী ও রক্ষীদের নিয়ে থাকতে পারেন। কোনটি তার শ্বশুর মিগার শ্রেষ্ঠীর জন্য। পুত্র এবং ভ্রাতা ও জ্ঞাতিদের নিয়ে তিনি থাকতে পারবেন। কোনটি তার বন্ধু স্থানীয় মহাশ্রেষ্ঠী সুদত্তর। সৈন্যদের থাকবার জন্য অর্ধক্রোশ দীর্ঘ, অশ্বক্ষুরাকৃতি একটি বাসগৃহ নির্মিত হয়েছে। সঙ্গেই পানীয় জলের জন্য একটি, স্নানের জন্য আরেকটি পুকুর। এই সমস্ত গৃহের সজ্জা কী হবে, পীঠিকাগুলি কেমন, পালংকের কী পরিমাপ, ভোজনপট, ফলকাদি, দীপাধার, পেটিকা বস্ত্রাচ্ছাদন ইত্যাদির পরিকল্পনার ভার বিশাখার। অতিথিশালার সংলগ্ন উদ্যানটিতে শয্যার উপকরণাদি প্রস্তুত হচ্ছে। তুলের আঁশে উদ্যানটিতে যেন কুয়াশা লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। বিশাখার দাসীরা মাঝে মাঝে তত্ত্বাবধান করবার জন্য গিয়ে আপাদমস্তক আঁশ জড়িয়ে এসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রত্যেকটি গৃহের সংলগ্ন রন্ধনশালা রাখা হয়েছে। সেখানে যথেষ্ট সংখ্যক পাচক, দাস-দাসী তৈজসাদি। বরানুগামী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা যা ইচ্ছা খেতে পারবেন। বিশাখা একটি বৃহৎ খাদ্যতালিকা করেছে, প্রত্যেকটি গৃহের জন্য। প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজন, সায়মাশ, মধ্যবর্তী সময়ের জন্য ফল ও পানীয়। পাচকজ্যেষ্ঠ অতিথিদের রুচি বুঝে খাদ্য পাক করবে।
কন্যাপক্ষের নিমন্ত্রিতরা থাকবেন শ্ৰেষ্ঠীগৃহের অতিথিশালায়, বিশাল সপ্তভূমিক বিমানের বহু কক্ষে। সুমনার মহানসে বহুবিধ পিষ্টক, মোদক, অপূপ, শুষ্ক খজ্জ প্রস্তুত হয়ে চলেছে। অপরিমিত দুগ্ধের নবনীত তোলা হচ্ছে, ক্ষীর প্রস্তুত হচ্ছে, ভারে ভারে আসছে, মাংসর জন্য পশু, পাখি। রন্ধনশালার বিভিন্ন ভাগে এসব হচ্ছে। ফোটানো, সিজানো, ভাপানো, পোড়ানো, সাঁতলানো, ভাজার গন্ধে, পাকশালা ম-ম করছে।
নানাপ্রকার শাক—লাউ, কুমড়ো, বার্তাকু, শিম্বি, ঝিঙা, কন্দ, ইত্যাদি কুট্টিতকরণ হচ্ছে। বাটা হচ্ছে নানারকম সুগন্ধি ভোজ্যে দেওয়ার জন্য।
ভদ্দিয় থেকে এসে গেছেন বিশাখার সব জ্যেষ্ঠতাত, খুল্লতাত ও তাঁদের পত্নীরা। সব ভাই ভগ্নী। পিতামহ মেণ্ডকপিতা ধনঞ্জয়ের সঙ্গে গভীর পরামর্শে রত। তাঁর কক্ষ থেকে ধনঞ্জয়কে কেবলই বার হতে দেখা যাচ্ছে। বিশাখার মাতুলগৃহ রাজগৃহ থেকেও ধীরে ধীরে এসে পৌঁছচ্ছেন অনেকে। কিন্তু-আত্মীয় পরিজনের চেয়েও সংখ্যায় বেশি সাকেত এবং তার সন্নিহিত গ্রামগুলির মানুষ। কস্সক গ্রামগুলিই তো আছেই, সেইসঙ্গে আছে কম্মার গ্রাম, কুম্ভকার গ্রাম, কৈবর্ত গ্রাম, তন্তুবায় গ্রাম, নিষাদ গ্রাম, বেণ, রথকার, পুক্কুস, চণ্ডাল—সবাই এই বিবাহোৎসবে কোনও না কোনওভাবে জড়িত, নিযুক্ত। ভোজের নিমন্ত্রণে তাদের কেউই বাদ যায়নি। বর্চ্চকুটিরগুলির মল পরিষ্কার করার জন্যই নিযুক্ত করা হয়েছে শত শত চণ্ডাল। পথগুলি, দেবালয় ও উদ্যানগুলি সব সময় পরিচ্ছন্ন ও জলসিঞ্চিত রাখার জন্য শত শত পুক্কুস, নিষাদেরা মাংসের জোগান দিয়ে যাচ্ছে, বরাহমাংস, গোমাংস, মেষমাংস, হরিণমাংস, তা ছাড়াও হংস, ময়ূর, বর্তক আসছে রাশি রাশি।
আচার্য ক্ষত্ৰপাণির সঙ্গে নিভৃতে বহু আলোচনা করে স্থির হল বর্ষা ঋতুর শেষতম লগ্নে কন্যাদান করা হবে। ইতিমধ্যে বরপক্ষ আসছে আসুক। তাঁদের অভ্যর্থনা, আদর যত্নের যেন কোনও ত্রুটি না হয়। মেণ্ডক বললেন, ‘মহারাজ পসেনদি কি অতদিন অপেক্ষা করতে রাজি হবেন? তাঁর রাজকার্য রয়েছে।’
ধনঞ্জয় হেসে বললেন, ‘মহারাজ পসেনদিকে যতদূর বুঝেছি তিনি অত্যন্ত প্রমোদপ্রিয় এবং ভোগবিলাসী। আসছেন বাবাতা রাজ্ঞী মল্লিকাদেবীর সঙ্গে। রাজ্য দেখবার জন্য তো তাঁর সুযোগ্য সেনাপতিদ্বয় রইলই। সর্বার্থক, অন্যান্য অমাত্যরা, মহিষী মগধদেবী এঁরাও রইলেন। আমার তো মনে হয় কিছুকাল বিলাসে আলস্যে কাটাতে পারলে মহারাজ আর কিছু চাইবেন না।’
মেণ্ডক বললেন, ‘এ কেমন রাজা তোমাদের পুত্র? রাজার তো অমাত্য, মহামাত্র, সেনাপতি এ সব থাকবেই, তাই বলে এতদিন শুধু বিলাস আর ভোজনের লোভে রাজকার্য থেকে অব্যাহতি নিয়ে এখানে থাকবেন এক শ্রেষ্ঠী-কন্যার বিবাহে! আমি এ প্রকার দেখিনি। আমাদের মগধরাজ এরূপ নয়। দেখো, পসেনদির রাজ্য বেশি দিন থাকবে না। রাজ্যসীমা তো বাড়িয়েছেন মহারাজাধিরাজ মহাকোশল। ইনি শুধু ভোগ করছেন। আমাদের মহারাজকে দেখো! রাজকার্যে কী গম্ভীর! প্রজাদের সুখ-সুবিধা দেখেন স্বয়ং। অপরাধীদের বিচারের জন্য বিনিশ্চয়ামাত্যর ওপর নির্ভর করেন না। এমন কি মাণ্ডলিক রাজাদের ওপরও নির্ভর করেন না। এই তো ক’মাস আগে সহস্র সহস্র গ্রামণীদের নিয়ে সভা করলেন। ভদ্দিয়র এক গ্রামভোজকের কাছে শুনলাম প্রত্যেকের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে কথা বলেছেন। অতি মধুর অথচ দৃঢ় তাঁর আচরণ। প্রজারা ক্রমশই সেনিয় বিম্বিসারের ভক্ত হয়ে পড়ছে। মহা মহা সন্ন্যাসী শ্ৰমণরাও কিন্তু তাঁর রাজ্যে শান্তি আছে বলে সেখানেই বসবাস করছেন। রাজগৃহে ঢুকতে পশ্চিম দিকের পাহাড়টির তো নামই হয়ে গেল ঋষিগিরি। এত সন্ন্যাসী সেখানে কুটির নির্মাণ করে সাধনা করছেন।’
ধনঞ্জয় বললেন, ‘দেব-দ্বিজে ভক্তি রাজা পসেনদিরও কিছু অল্প নেই পিতা। তিনি যে ভগবান বুদ্ধের ভক্ত শুনেছি। এদিকে পূরণ কাস্যপও থাকেন ওখানেই। পোক্খরসাদি ও তারুকখ এই দুই ব্রাহ্মণকে তো অতিশয় ভক্তি করেন। তবে এ কথা ঠিক, এ রাজা বড় ইন্দ্রিয়পরায়ণ। তক্ষশিলার স্নাতক, এত বড় বংশে জন্ম, কিন্তু সুন্দরী নারী আর সু-রসাল ভোজ্য পেলে আর কিছু চান না।’
মেণ্ডক বললেন, ‘যাক, রাজচরিত্র নিয়ে আলোচনা করে এখন আর কী লাভ ধনঞ্জয়। তোমার ভাগ্য তোমাকে মহারাজ পসেনদির রাজ্যে এনে ফেলেছে। তবে সাকেত তো শুনছি নাকি কোশলের দ্বিতীয় রাজধানী হয়ে উঠেছে। এ কথা কি সত্য?’
ধনঞ্জয় গর্বভরে বললেন, ‘না পিতা, সাকেত নয়, দক্ষিণ কোশলের রাজধানী কুশাবতী। কিন্তু আপনার পুত্র এখানে এসে বসবাস করবার পর থেকে সাকেতের এতটাই শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে যে লোকে মনে করে সাকেতই বুঝি-বা রাজধানী। লোকের মুখে মুখে চারণদের গানে গানে এ কথা চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়। হয়ত শীঘ্রই সত্যি হয়ে উঠবে।’
মেণ্ডক বললেন, ‘তোমার মতো যশস্বী পুত্র গর্ভে ধারণ করেছেন বলে তোমার জননী দেবী পদ্মাবতী ধন্য। ধন্য আমি, তোমার পিতাও। অন্য পুত্রগুলি আমার সম্পদ রক্ষা করছে ঠিকই। কিন্তু তোমার মতো সাহসী, বীর্যবান, বুদ্ধিমান তারা কেউ নয়। শুনলাম তুমি সমুদ্র বাণিজ্যেও উৎসাহী। যাচ্ছ নাকি?’
‘এখনও স্থির করিনি।’ ধনঞ্জয় সলজ্জে বললেন। আসলে দেবী সুমনা এবং কন্যা বিশাখাকে ছেড়ে অতিশয় বিপজ্জনক কিছু করবার উৎসাহ তিনি অনেক দিন হারিয়ে ফেলেছেন। যা করেছেন সেই প্রথম যৌবনে, মধ্যযৌবনে। এখন এত সম্পদ, এবং সেগুলি বাড়াবার এত কৌশল তিনি গৃহে বসে বসেই বার করতে পারেন মাথা থেকে যে সমুদ্রযাত্রার ঝুঁকি আর নিতে ইচ্ছা করে না।
মেণ্ডক বললেন, ‘সে যাই হোক, রাজা এবং অন্যান্য অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবস্থাদি করেছ তো?’
‘নিশ্চয়ই। লঙ্ঘন-নর্তক আনিয়েছি। আনিয়েছি নট, নটক, কুম্ভধুনিক, ঐন্দ্রজালিক, সোকজ্জায়িক। ঘোড়া এবং হাতির খেলাও দেখানো হবে। পণ্যাঙ্গনাও আনিয়েছি নানাপ্রকার। বেশ্যা, রূপাজীবা ও ভালো ভালো গণিকা। এরা নৃত্যগীতে খুবই কুশলী। সঙ্গে অবশ্যই বংশী, বীণা, মৃদঙ্গ, পটহ বাদকেরা আসবে। অক্ষক্রীড়ার জন্য মণ্ডপ করিয়েছি বিশটি। পিতা, আমাদের ভদ্দিয়র বাড়ির দাসেদের মধ্যে কেউ উচ্চস্তরের ইন্দ্রজাল দেখাক না। পারবে না?
মেণ্ডক বললেন, ‘শল্য আর সুলভকে শিখিয়েছিলাম যত্ন নিয়ে। দু’জনকেই মুক্তি দিয়েছি। তারা এখন কোন দেশে বিচরণ করছে জানি না তো! তুমি যদি আগে জানাতে দূত পাঠিয়ে দেখতে পারতাম। তোমার কন্যার বিবাহোৎসব শুনলে তারা নিশ্চয়ই সব কাজ ফেলে আসত।’
মেণ্ডক মৃদুমৃদু হাসছেন দেখে ধনঞ্জয় বললেন, ‘পিতা আপনি হাসছেন কেন?’
মেণ্ডক বললেন, ‘তোমার কন্যা বালিকা বয়সে আমার কাছে প্রায়ই একটি প্রার্থনা জানান, তাই ভেবে হাসছি।’
‘কী প্রার্থনা, পিতা?’ সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন ধনঞ্জয়।
‘ইন্দ্রজাল। ইন্দ্রজাল শিখতে চেয়েছিল। ভাবছি দুটি-একটি গুপ্তবিদ্যা শ্রাবস্তী যাবার আগে শিখিয়ে দেবো কি না।’ মেণ্ডক ও ধনঞ্জয় দু’জনেই প্রাণ খুলে হাসতে লাগলেন।
১৬
প্রত্যূষ। স্নিগ্ধ আকাশ। স্নিগ্ধ বাতাস। শ্রীমতীর গৃহ থেকে বেরিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছে চণক। কাল মধ্যরাতে খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গেছে। পথগুলি তাই ভিজে। বেশির ভাগ বিপণিই এখনও খোলেনি। পথ ঝাঁট দিতে শুধু বেরিয়ে পড়েছে কিছু পথমার্জক। রাতের প্রহরা সেরে গৃহে ফিরছে নগরদ্বারিকরা, নগররক্ষকরা। সারা রাত আমোদ-প্রমোদে কাটিয়ে কিছু রসিক ব্যক্তিও এখন ঈষৎ লাল চোখে, বিস্রস্ত বেশবাসে পথে বেরিয়ে পড়েছে। কোনও কোনও পানাগারের বোধ হয় বিশেষ অনুমতি নেওয়া আছে। সারা রাতই মনে হয় খোলা থাকে। ওখানে থাকে দ্যূতক্রীড়ারও ব্যবস্থা। একটি দীর্ঘদেহী, অত্যন্ত কৃশকায় রুগ্ণ আকৃতির ব্যক্তি কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বেরিয়ে এলো। দেখেই বোঝা যায় পাশা খেলায় যা-যা পণ রেখেছিল সবগুলিই হেরে গেছে। বোধ হয় সর্বস্বান্ত! এদের তক্ষশিলাতে যেমন দেখা যায়, তেমন রাজগৃহেও দেখা যায়। অসংযমের রূপ সর্বত্র এক। আজ সন্ধ্যাতেই আবার এ ফিরে আসবে, আবার ঋণ নেবে, নিয়ে পণ রেখে খেলবে, হয়ত সামান্য কিছু জিতবে। কিন্তু হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। চণক ঘোড়ার গতি দ্রুততর করল। তার লক্ষ্য গৃধ্রকূট! এরা বলে গিজ্ঝকুট। বড় প্রিয় স্থান চণকের। নির্জন। সহজে ওপরে ওঠা যায়। বৈপুল্ল পর্বত বহু বিস্তৃত এবং উঁচুও খুব। বৈভরে তপোদারামগুলি থাকায় রোগীর ভিড় হয় খুব। ইসিগিলি বা ঋষিগিরিতে কয়েক পা অন্তর অন্তরই সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীদের কুটী। তাই গিজ্ঝকুটই চণকের প্রিয় পর্বতশিখর।
পর্বতমূলে পৌঁছবার পর তার মনে হল ঘোড়াটিকে নিয়েই কি কিছুদূর ওঠা যায় না? ঘুরে ঘুরে ঘোড়া নিয়ে ওপরে ওঠবার পথ অন্বেষণ করছে, এমন সময়ে পেছনে অশ্বক্ষুরধ্বনি শোনা গেল। চকিত হয়ে পেছন ফিরে চণক দেখল একটি অশ্বারোহী সৈনিক। বুকে বর্মজালিকা আঁটা। মাথায় করোটিকা শিরস্ত্রাণ। সযত্ন রক্ষিত দাড়ি এবং দীর্ঘ পাকানো গোঁফ। চণকের কাছাকাছি এসে অশ্বারোহী একটি বড় গাছের সঙ্গে ঘোড়াটিকে বাঁধতে লাগল। বাঁধা শেষ হয়ে গেলে অশ্বারোহী বলল, ‘এ পাহাড়ে অশ্ব নিয়ে আরোহণ করা সমীচীন নয় ভদ্র।’
চমকে ভালো করে তাকাল চণক অশ্বারোহীর দিকে। তারপর নত হয়ে বলল, ‘নমস্কার মহারাজ। একেবারে উষার প্রথম লগ্নেই রাজদর্শন! দিন যাবে ভালো।’
‘তুমি আমার ছদ্মবেশ ভেদ করে ফেললে? এত সহজে?’
‘মাত্র কিছুকাল আগেই আমি গান্ধারের মহামাত্রর কাছে তিরস্কৃত হয়েছি ছদ্মবেশ ভেদ করতে পারিনি বলে। আজ এখানে থাকলে তিনি সুখী হতেন, অধীনস্থ অমাত্যের কিছু উন্নতি হয়েছে দেখে। কিন্তু মহারাজ আপনি বোধ হয় ছদ্মবেশ অন্তত আমার কাছে গোপন করতে চাননি। না-হলে কণ্ঠস্বরের কথা চিন্তা করতেন।’
বিম্বিসার বললেন, ‘আচার্যপুত্র, ছদ্মবেশ তোমার কাছ থেকে গোপন করতে চাইনি এ কথা সত্য। কিন্তু কণ্ঠস্বর সম্পর্কে খুব একটা সতর্কতা আমি কখনওই অবলম্বন করি না। এত শ্মশ্রু-গুম্ফ, মুখ এবং দেহের বর্ণ বদল তার পরেও কণ্ঠস্বর বদলাতে হবে ভাবি না তো!’
চণক নিজের ঘোড়াটিকে বেঁধে ফেলে বলল, ‘কণ্ঠস্বর একটি অব্যর্থ নির্ণয়-চিহ্ন। চরেরা কণ্ঠস্বরের চর্চা অর্থাৎ কথনভঙ্গি এবং স্বর-শ্রবণ দুটোই অবশ্য শিক্ষিতব্য বলে মনে করে।’
‘হবে’, বিম্বিসার বললেন, ‘আমার ছদ্মবেশ গ্রহণের প্রয়োজন অল্পই হয়। যখন হয়, মৃদু স্বরে কথা বলা ছাড়া আর কোনও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়নি এতদিন। আচ্ছা চণকভদ্র, গান্ধার রাজ্যে কি চরশাস্ত্র খুবই উন্নত?’
চণক বলল, ‘হ্যাঁ মহারাজ। গান্ধার রাজ্যে অন্তর্কলহ অত্যন্ত হতাশাজনকভাবে সক্রিয়। কাশ্মীর, মদ্র, ইত্যাদি সন্নিহিত অঞ্চলগুলি থেকে সব সময়ে অতিকুশলী চরেরা যাতায়াত করছে, এতটুকু ফাঁক পেলেই এইসব রাজ্যগুলি আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। মদ্র না হয় ভিন্ন রাজ্য, কিন্তু কাশ্মীর তো গান্ধারের অন্তর্ভুক্তই। তবু এই অবস্থা! ওদিকে অসুর, সুমের, পারস্য দেশ থেকে উপরিশ্যেন পর্বত পেরিয়ে বণিকরা যেমন আসে, তেমন আসে চরেরাও। আমি আগেই বলেছি আপনাকে, পারস্যরাজ কুরুস এদিকে লুব্ধ দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। তাঁর ধারণা এই দেশের মাটিতে সোনার রেণু মিশে আছে। সোনার লোভ বিষম লোভ। এদিকে আবার গান্ধার রাজসভায় অমাত্যদের মধ্যে সবসময়ে একটা ক্রূর প্রতিযোগিতা চলে—এতে অংশ নেন অন্তঃপুরিকারাও। অমাত্য পদ ওখানে একরকম পুরুষানুক্রমিক। রাজার ইচ্ছে থাকলেও নতুন কাউকে গুরত্বপূর্ণ কাজের ভার দিতে পারেন না। … সত্যি কথা বলতে কি রাজার চেয়ে অমাত্যদের ক্ষমতা অধিক। অতএব…’
বিম্বিসার বললেন, ‘চলো আচার্যপুত্র আরও ওপরে যাই। এখানে আমাকে মহারাজ বলে সম্বোধন করা ঠিক হবে না। শুধু ভদ্র বলো।’
কিছুক্ষণ পর চণক বলল, ‘কোনও বিশেষ কাজে বেরিয়েছেন না কি ভদ্র?’
‘না। আজ শুধু মুক্তি। মুক্তির জন্য বেরিয়েছি। আজ সারা দিন ঘুরে বেড়াব। মিশে যাব। রাজগৃহের নাগরিকদের সঙ্গে। এই মাত্র।’
চণক লক্ষ করল দু’জন সামান্যবেশী ব্যক্তি, তার পরে আরও দু’জন অনেক দূর থেকে তাদের অনুসরণ করে আসছে। সে নিশ্চিন্ত হল।
একটি চত্বালের মতো স্থান বেছে বসলেন বিম্বিসার, পাশে বসতে ইঙ্গিত করলেন চণককে। চণক সামান্য নিচে যথাসম্ভব নিকটত্ব রক্ষা করে বসল। বিম্বিসার দুঃখিত মুখে বললেন, ‘রাজাদের কি বয়স্য পাওয়ার অধিকার নেই, চণকভদ্র?’
চণক মৃদু স্বরে বলল, ‘বয়সেও তো আমি আপনার থেকে অনেক ছোট। সামাজিক স্তরভেদ মেনে চলা ভালো মনে করেছিলাম ভদ্র, আর কিছু নয়।’ সে উঠে রাজার পাশে গিয়ে বসল।
রাজা বললেন, ‘তুমি কি গান্ধার দেশের জন্য খুব চিন্তিত?’
‘শুধু গান্ধার নয়, আমি সমগ্র উদীচ্য, মধ্যদেশ, প্রাচীর জন্যও চিন্তিত ভদ্র। গান্ধার হল সীমান্ত। এই সীমান্ত অতিক্রম করে যদি পারস্যরাজ কুরুসই বলুন, কি অসুররাজই বলুন কিংবা সমুদ্রপারের যবনরাই বলুন—একবার এসে পড়ে, এই ছিন্নভিন্ন অগ্রথিত রাজ্যগুলির কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। আমরা যতই ভিন্ন হই, আমাদের ‘আকৃতি, ভাষা, পরিচ্ছদ, ধ্যানধারণা মোটের ওপর একই। সরস্বতী-দৃষদ্বতীর মধ্যবর্তী অঞ্চল আমাদের আদিপীঠ। গঙ্গা-যমুনা, অচিরবতী সরযূতীরে ছড়িয়ে পড়েছি আমরা। কিছু কিছু পার্থক্য এসে গেছে ঠিকই কিন্তু উপরিশ্যেন পর্বতের ওপার থেকে যারা আসবে তাদের ভাষা, পরিধেয়, ভাবনা-ধারণা একেবারেই অন্য। আমার বিচারে আমরা তাদের সঙ্গে আমাদের শস্য, আমাদের খনিজ, আমাদের বিদ্যার আদানপ্রদান করতে পারি, কিন্তু বিজেতা হিসাবে যদি তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিই, তা হলে সমগ্র জম্বুদ্বীপের অধিবাসী তাদের দাস হয়ে যাব। কেউ বাদ যাব না। গান্ধার কাম্বোজ যেমন বাদ যাবে না, তেমনি বাদ যাবে না চেদি-মৎস্য, কুরু-পাঞ্চাল, কাশী-কোশল, অঙ্গ-মগধ, বজ্জি-মল্ল! কেউ না, কেউ না। গান্ধার-কাশ্মীর-মদ্র কুটিল, স্বার্থান্ধ, অমাত্যে পূর্ণ, তারা স্বার্থের বশে অনেকেই হয়ত বিপক্ষে যোগ দেবে। তবে তারাও রক্ষা পাবে না।’
বিম্বিসার মন দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, ‘আচার্য দেবরাতও আমাকে বলেছিলেন চক্রবর্তী রাজা হও। তখন আমি সতের-আঠার বছরের কিশোর মাত্র। কিন্তু তিনি একবার আকাশের দিকে তাকালেন, একবার তাকালেন বহুদূরপ্রসারী দিগন্তরেখার দিকে। বললেন মাঝখানে মেরুপৰ্বত তার চারপাশে অকূল বারিধি। সেখানে চতুষ্পত্র ফুলের একটি পাপড়ির মতো ভাসছে জম্বুদ্বীপ। আরও তিনটি পাপড়ি আছে। মধ্যে মধ্যে সমুদ্র, এই দ্বীপের পেছন দিকে আবারও অথই সমুদ্রের ওদিকে চক্রবাল। উত্তরকুরু দ্বীপে কেউ যেতেও পারে না, সেখান থেকে কারও আসার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু অপর গোদান ও পূর্ববিদেহ থেকে জম্বুদ্বীপে কালক্রমে সাম্রাজ্যপিপাসুরা আসবেই। তার আগে জম্বুদ্বীপকে একত্র হতে হবে। তুমি সেই চক্রবর্তী রাজা হও, যে জম্বুদ্বীপকে রক্ষা করবে। আমার এখনও তাঁর প্রতিটি কথা স্পষ্ট মনে আছে, চণক। এখন চণক তুমি বলো এই জম্বুদ্বীপ কী? এই প্রাচী, মধ্যদেশ ও উদীচী, নাকি উদীচীরও ওদিকে যে বহ্লীক দেশ, বখ্ত্রি আছে—এরাও, এমন কি সুমের বা অসুররাজ্যও। আর বিন্ধ্যপর্বত, বিন্ধ্যই কি এই দ্বীপের দক্ষিণ সীমা?’
চণক বলল, ‘না, বিন্ধ্য কখনও জম্বুদ্বীপের দক্ষিণ সীমা হতে পারে না। হিমবানের মতো বিন্ধ্য দূরতিক্রম্য নয়। বহ্লীক বা বখ্ত্রি দেশ কিন্তু বেদ অনুসরণ করে না কোনদিন, সুতরাং আমাদের বর্তমান অবস্থায় গান্ধার, কম্বোজ, কাশ্মীরের পশ্চিমে যে সব দেশ আছে তাদের সম্পর্কে আমার কোনও আত্মীয়বোধ নেই।’
বিম্বিসার হেসে বললেন, ‘চণক কি খুব গোঁড়া বেদপন্থী না কি? যাগ-যজ্ঞ, সাম গান, ইত্যাদিতে বিশ্বাস করেন? বেদই যদি আমাদের মানদণ্ড হয় তা হলে কিন্তু মধ্যদেশ ক্রমশই অ-বৈদিক হয়ে যাচ্ছে, আরও পূর্বের তো কথাই নেই। এ অঞ্চল তো তা হলে জম্বুদ্বীপ হলো না!’
চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। তবে বেদ-পন্থা বলতে আমি কিন্তু শুধু যাগ-যজ্ঞই বোঝাচ্ছি না। আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর আগে দিই। না। চণক যাগ-যজ্ঞে সেভাবে বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞ করলেই সমৃদ্ধি হবে, সন্তান হবে, দেবতারা তুষ্ট হবেন, পিতৃপুরুষ সুখী হবেন—ঠিক এইভাবে আজকাল বিশ্বাস করতে পারছি না ভদ্র। এ কথা সত্য। কারণ দেখুন, সোমযাগের মতো ব্যয়সাধ্য দীর্ঘ সময়ের যজ্ঞ তিন পুরুষের মধ্যে একবার তো করতেই হয়, কিন্তু, করলে যজমানের ধনক্ষয় ছাড়া বৃদ্ধি নেই। যজ্ঞের প্রত্যক্ষ ফল বলে যদি কিছু লাভ হত, যেমন পুত্র্যেষ্টি যাগের ফলে যদি পুত্র হত তা হলে নিয়োগ-প্রথার প্রয়োজন হত না, ধর্ম-নাটকেরও প্রয়োজন হত না। চিন্তা করুন নিয়োগ প্রথায় স্বামী অথবা শ্বশুরকুলের জ্যেষ্ঠরা নিজেরাই একজন অপর পুরুষকে নিযুক্ত করছেন স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য, আর ধর্ম-নাটক প্রথায় নিয়োগ পর্যন্ত করছেন না, পত্নীকে অথবা পত্নীদের স্বচ্ছন্দ-বিহারের জন্য ছেড়ে দিচ্ছেন। কোন্ প্রকৃতির মানুষের ঔরসে সন্তান জন্মালো তা নিয়ে পর্যন্ত চিন্তা নেই। এই হীন পন্থা না ধরে একটি পুত্র্যেষ্টি যজ্ঞ করলেই তো পারতেন এঁরা। করেন না কেন? বলে চণক থামল, সে মহারাজের কাছ থেকে উত্তর আশা করছে।
কিছুক্ষণ পর সে-কথা বুঝে বিম্বিসার বললেন, ‘ঠিক কথা। অর্থাৎ এঁরা অন্তর থেকে ইষ্টি-যাগে বিশ্বাস করেন না।’
‘তার চেয়েও বড় কথা’, চণক বলল, ‘এই সব পুরুষরা স্বীকার করে নিচ্ছেন তাঁদের পুত্র-উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। পত্নী নির্দোষ। তাঁরা নিজেরাই হীনবীর্য। পুরষের শুক্র, নারীর শোণিত মিললে তবেই তো সন্তান জন্ম হবে, পিতা যদি হীনবীর্য বা বীর্যহীন হন তাহলে?’
বিম্বিসার চমকিত হয়ে বললেন, ‘তোমার যুক্তি তো অব্যর্থ চণক? তা হলে!’
‘হ্যাঁ, ভদ্র, বহু পুরুষই জন্মগত কারণে বা অসংযমের ফলে বীর্যহীন হয়ে থাকে সেইজন্যই তাদের সন্তান হয় না, কিন্তু সে কথা আড়াল করে তারা এবং তাদের সমাজ অক্ষমতার দায় তার পত্নীর ওপর চাপিয়ে দেয়। পরের পর পত্নী ত্যাগ করে, বিবাহ করে একটার পর একটা।’
‘আর দেবতা? শ্রৌত যজ্ঞে যে দেবতাদের আবাহন করা হয়?’
চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার মনে নানা সংশয় ভদ্র, সব কথা ঠিক পরিষ্কারও হয়নি এখনও। বলতে সাহস পাই না।’
‘অভয় দিলে?’
‘অভয় দিলে বলতে পারি দেবতাদের অস্তিত্বে সেভাবে আজকাল যেন বিশ্বাস হয় না। কে বলুন তো এই ইন্দ্র? যিনি গৌরব করে বলছেন আমি সালাবৃক দিয়ে যতি অরুর্মুখদের ভক্ষণ করিয়েছি, যিনি বলছেন মাতৃবধ, পিতৃবধ, ভ্রুণহত্যা ইত্যাদি মহা পাতক করলেও তাঁর ভক্তের মনে কোনও অনুশোচনা বা দুঃখ হবে না! এই অতিরিক্ত সোমপায়ী দেবতাকে তো আমার একজন অত্যাচারী রাজা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। মানুষ রাজার যে দশবিধ কৃত্য আছে দান, শীল, পরিত্যাগ, অক্রোধ, অবিহিংসা, ক্ষান্তি, আর্জব, মার্দব, তপঃ ও অবিরোধন—এগুলির একটাও কি এই দেবতাদের রাজা পালন করেন? মানুষ রাজারা যদি ইন্দ্রের মতো সোমপায়ী, ক্ষমতালিপ্সু, পরদারগামী, ক্রোধী, হিংসক, কুটিল, বিশ্বাসঘাতী হন প্রজারা তো বিদ্রোহী হবে, অমাত্যরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে, তাঁকে অপসৃত করতে চাইবে সর্বস্তরের প্রজা। চাইবে না? বলুন?’
বিম্বিসার হাসলেন, বললেন, ‘অবশ্যই। তবে এ একটা আদর্শ। আদর্শকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে কি আমরা সবাই পারি? পারি না।’
‘আমি আদর্শের কথাই বলছি মহারাজ। দেবতারা তো আদর্শেরও আদর্শ।’
‘মহারাজ নয় ভদ্র। আমি এখন একজন শ্মশ্রুবিলাসী সৈনিক মাত্র।’ বিম্বিসার তাঁর দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন।
‘ও, হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম।’ হেসে চণক বলল, ‘এ ছাড়া অন্যান্য দেবতাদের কথাও ভাবুন। অগ্নি অনলের দেবতা, বরুণ জলের দেবতা, আদিত্য সূর্যের দেবতা, এই অগ্নি বা জল ইচ্ছামতো নষ্ট করে দিতে পারে জনপদের পর জনপদ, আবার আমাদের কাজেও লাগে, অর্থাৎ এরা বস্তু। সূর্য প্রতিদিন উদিত হচ্ছে, অস্ত যাচ্ছে, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাও তাই। এরাও যদি বস্তূপিণ্ড হয় ভদ্র! সুন্দর! অপরূপ সুন্দর! মহাশক্তিধর! কিন্তু নিজেদের ওপর এদের কোনও নিয়ন্ত্রণ আছে কি? আপনি প্রার্থনা করে, তপস্যা করে, যজ্ঞ করে অগ্নিকাণ্ড থামাতে পারবেন? আপনাকে জলের সাহায্য নিতে হবে। বন্যা থামাতে পারবেন? আপনাকে নদীর পাড় উঁচু করতে হবে! অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি থামাতে পারবেন? সূর্যকে রাত্রে এবং চন্দ্রকে দিনের বেলায় উদিত করতে পারবেন? যতই যজ্ঞ করুন!’
বিম্বিসার নিবিষ্ট মনে শুনছিলেন, মুখে মৃদু হাসি, বললেন, ‘তুমি তা হলে যাগ-যজ্ঞে বিশ্বাস কর না, দেবতাদের প্রতিও তোমার আস্থা নেই। এমন কি তাদের অস্তিত্ব নিয়েও তোমার মনে সংশয়! কেমন?’
চণক বলল, ‘আপনি হাসছেন?’
‘হাসছি এই কারণে যে, তোমার কথার সঙ্গে আরও কারও কারও কথার মিল খুঁজে পাচ্ছি। বিশেষত তথাগত বুদ্ধর। তুমি কি তথাগতকে দেখেছো চণকভদ্র? তাঁর দেশনা শুনেছ?’
‘না, সে সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি।’ চণক বলল, তার ভিক্ষু অস্সজির কথা মনে পড়ল, সে জোর করে তাঁর কথা মন থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘যাগ-যজ্ঞে সেভাবে বিশ্বাস না করলেও আমি কিন্তু শ্ৰমণ গৌতমের মতো একেবারে উড়িয়ে দিতে পারি না এগুলো।’
‘বিশ্বাস করো না, অথচ উড়িয়ে দিতেও পারো না? আশর্য!’
‘আশ্চর্য নয় ভদ্র, ভেবে দেখুন যাগ-যজ্ঞ কিন্তু খানিকটা সমাজ-উৎসবের মতো। বড় আকারের সত্র হলে বহুদিন ধরে বহু লোকের সঙ্গে মেলামেশা চলে। ছোটখাটো ইষ্টিযাগ বা পশুযোগ হলেও পরিবারবর্গ, জ্ঞাতিকুটুম্ব এঁরা একত্র হন। কিছু সৎ-চিন্তা করেন। শুচিতা, পবিত্রতা রক্ষা করে চলেন। এর মূল্য নেহাত অল্প নয়। সামাজিক বিধিমাত্রেই তো কৃত্রিম। সমাজের স্থিতির জন্য কতকগুলি কৃত্রিম অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয়। আজ যদি আপনি একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন পুনরভিষেক বা ঐন্দ্রাভিষেকের আয়োজন করেন, তা হলে তা কৃত্রিম একটি সমাজবিধি হলেও গান্ধার, কম্বোজ, কুরু-পাঞ্চাল, অবন্তী, মিথিলা সব স্থান থেকেই তো রাজপুরুষ, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি এবং নানান বৃত্তির মানুষ আসবেন, মনে করুন কুরুরাজ জনমেজয়ের মহাযজ্ঞের কথা। সেই উপলক্ষে পুরাবৃত্ত, রাজবংশগুলির উদ্ভব, এমন কি বিভিন্ন জনপদের উদ্ভব নিয়েও কত জ্ঞান, কত বিদ্যার আদানপ্রদান হয়েছিল। হয়নি? এটাই লাভ। বহুজনের কথা জানা, তাদের মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া, এটাই লাভ।’
‘চণক, তুমি কি আমাকে অশ্বমেধ যজ্ঞের ছল করে জম্বুদ্বীপকে মগধের রাজচ্ছত্রের তলায় আনার পরামর্শ দিচ্ছ?’
চণক একটু আশ্চর্য হল। তারপর হেসে বলল, আপনার তাই মনে হল? কিন্তু এ অতি পুরনো উপায়। এখন সময় বদলে গেছে। সময়ের পদধ্বনি শুনতে পান ভদ্র? সমাজকে বাঁধার জন্য, তার অভ্যাস নির্মাণ করার জন্য যাগ-যজ্ঞ ছোট আকারে থাকে থাকুক। কিন্তু রাজাদের বোধ হয় এখন আর মহাসত্র করবার সময় নেই। চতুর্দিকে রাষ্ট্রগুলি অস্থির হয়ে রয়েছে। নিশ্চিন্তে সামাজিক ক্রিয়াকর্ম করার সময়ই এ নয়। অন্য উপায়ের কথা চিন্তা করতে হবে।’
বিম্বিসার বললেন, ‘তুমি হয়ত জানো, হয়ত জানো না, আমার এক মহিষী বুদ্ধশাসনে প্রবেশ করে আমার কুল উজ্জ্বল করেছেন। তিনি এখন ভিক্ষুণী। আমি নিজেও উপাসক। তথাগত বুদ্ধ, যাঁকে তুমি শ্রমণ গৌতম বলে উল্লেখ করলে তাঁকে আমি আমার দেখা সব মহামানবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। মুখে অবশ্য তা প্রকাশ করি না, আরও অনেক শ্রমণপন্থের তপস্বী আছেন, তাঁদেরও আমি দান করি, তাঁদেরও উপদেশ শুনি। বেদপন্থীদেরও আমার রাজ্যে কোনও অনাদর নেই। কিন্তু পশুযজ্ঞে আমার আর ভেতর থেকে সম্মতি আসে না। ধর্মের নাম করে পশুবধ! নাঃ সে আমি আর পারি না।’
‘আমি আপনাকে পশুমেধ করতে বলছি না মহারাজ।’
‘কিন্তু মনুষ্যমেধ করতে তো বলছ? চক্রবর্তী রাজা হতে হলে তো যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ মানেই নরমেধ? নয়?’
‘তা সত্যি। কিন্তু সেভাবে নরমেধ কি আপনি করেন না? চোর, দস্যু, রাজদ্রোহী, ব্যভিচারিণী, এদের মহাদণ্ড দেওয়া হয় না?’
‘তারা তো অপরাধী? অপরাধের শাস্তি ভোগ করে।’
‘প্রত্যন্ত প্রদেশে যখন বিদ্রোহ দমন করতে যান?’
‘সে-ও তো রাজদ্রোহ!’
‘যদি আপনার রাজ্য আক্রান্ত হয়?’
‘তা হলে শত্রুবধ করব।’
‘শত্রুই হোক, রাজদ্রোহীই হোক, অপরাধীই হোক, সবাই-ই মানুষ। কোনও না কোনও প্রকারে মানুষমেধ আপনি করেই যাচ্ছেন। করতেই হচ্ছে!’
‘শোনো চণক, তুমি যত কুযুক্তিই দেখাও, যত উত্তেজিতই করো, দীর্ঘদিন অঙ্গরাজ্য জয় করবার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত থেকেছি। আবার যুদ্ধের কথা আমি ভাবতে পারছি না।’
চণক হেসে বলল, ‘আপনাকে যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করছি না মহারাজ। খালি পিতার আশীর্বাদ সফল করে রাজ-চক্রবর্তী হতে উদ্বুদ্ধ করছি।’
‘যুদ্ধ না করে, যজ্ঞ না করে কীভাবে সেটা হওয়া সম্ভব, চণক?’
‘সে কথাই অবিরত ভেবে যাচ্ছি। তক্ষশিলা থেকে মগধ আসতে আসতে অবিরত ভেবেছি। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে যুদ্ধ এখন অবান্তর মনে হয়। কিন্তু যুদ্ধ না করেও একটা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের অধিপতি কি হওয়া যায় না? একটু ভাবুন তো মহারাজ! আর কোনও পথ…’
এই সময়ে চণক দেখল মহারাজ হঠাৎ যেন দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে সে দেখল একজন পীতবাস পরা ভিক্ষু, যথেষ্ট দীর্ঘদেহী এবং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, প্রশান্ত মুখ, অত্যন্ত দ্রুত উঠে আসছেন। এত দ্রুত উঠে আসছেন অথচ সেই তাড়াটা যেন তাঁর চলনে বা আকারে ধরা পড়ছে না। মহারাজ অস্ফুটে বললেন, ‘ভগবান তথাগত।’
চণক বলল, ‘মহারাজ, আপনি কিন্তু ছদ্মবেশে আছেন। ভুলে যাবেন না।’
‘না, ভুলব না, কিন্তু তুমি যাও চণক, উনি কার্তিকী পূর্ণিমার পর যে-কোনদিন যে-কোনও দিকে বেরিয়ে পড়বেন। এমন সুযোগ হেলায় হারিও না।’ বিম্বিসার দ্রুত একটি পাথরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন।
গৌতম উঠে এলেন। তারপর চণকের পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ দিকে চলতে লাগলেন। চণক চলল তাঁর পেছন পেছন। কিছুটা যাওয়ার পর সে ডেকে বলল, ‘ভদন্ত, আপনি কি কিছু খুঁজছেন?’
‘আমি কিছু খুঁজছি না ব্রাহ্মণ; আমি পেয়েছি’, সংক্ষেপে বললনে গৌতম, একটু পরে বললেন, ‘আমি একটি নির্দিষ্ট স্থানে যাচ্ছি, গিজ্ঝকুটের ওপর দিকে একটি চাতালের মতো সমতল স্থান আছে, সেখানেই।’
‘আমি সঙ্গে গেলে আপনার অসুবিধে হবে, ভদন্ত?’
‘আমার কিছুতেই সুবিধা বা অসুবিধা হয় না আয়ুষ্মন, তুমি আসতে পারো।’
দীর্ঘ ক্ষিপ্র পদক্ষেপে শ্ৰমণ মুহূর্তের মধ্যে চোখের আড়ালে চলে গেলেন। চণক ভাবল, ইনি যে দেখি, হাঁটার পরীক্ষায় সবাইকে পেছনে ফেলে দিতে পারেন। অদ্ভুত ক্ষিপ্র তো?
অবশেষে তিনটি শিলার মধ্যবর্তী একটি সমতল স্থানে পৌঁছে গৌতম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চণক দেখল পাহাড়ের নানা পাথরের মধ্য দিয়ে দিয়ে একটি বৃদ্ধ এবং একটি তরুণ উঠে আসছে।
তারা পৌঁছতে গৌতম বললেন, ‘কেমন ব্রাহ্মণ, এই স্থানটির কথাই বলছিলেন তো?’
বৃদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই স্থানই বটে সমন, আমার এই পিতৃপোষক সুপুত্র পিতার বড় বাধ্য।’ তিনি তরুণটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, ‘আর কোনও পুত্র আমার দেখাশোনা তো করেই না, কেউ আমার কথায় কানই দিল না। বুঝলে গোতম আমি তো ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি। বৃদ্ধ হয়েছি কখন পুট করে মরে যাব, আর এরা অমনি কোনও অপবিত্র শ্মশানে নিয়ে গিয়ে আমার অগ্নিক্রিয়াটি করবে। এত সম্পদ আমার, অগ্নিহোত্র রক্ষা করে চলেছি শ্রদ্ধায়, চিরকাল প্রত্যেকটি দর্শযাগ, পূর্ণমাস-যাগ করে এসেছি। অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে শত শত গাভী দান করেছি। এত পুণ্য, তা সত্ত্বেও হয়ত এইটুকুর জন্য অক্ষয় স্বর্গ থেকে বঞ্চিত হব।’
গৌতম বললেন, ‘ব্রাহ্মণ, শ্মশান কীভাবে পবিত্র বা অপবিত্র হয় তা আমায় বলুন।’
‘তুমি তো কিছুই মানো না’, ব্রাহ্মণ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘তোমায় কী বোঝাবো? শ্মশান এমনিতেই অতি অপবিত্র স্থান। হীন জাতির লোককে দাহ করলেই সে শ্মশান আরও অপবিত্র হয়ে যায়। এই বৃষলেরা মরেও আমাদের শান্তি দেবে না। আমার পুত্র তো খুঁজে খুঁজে কোনও শ্মশান পেল না নগরে যেখানে কোনও চাঁড়াল, কি নিষাদ, কি পুক্কুস দাহ হয়নি। ওর প্রশ্ন শুনেই তো শবদাহ চাঁড়ালগুলো হা-হা করে হাসে, বলে কি জানো? “অরে ব্রাহ্মণ, এইখানে চিতার ওপর যেমন বাঁশের বাড়ি দিয়ে রাজা-রাজড়ার মাথা ফাটাই, বামুন পুরুতের মাথা ফাটাই, স্থূলোদের বণিকগুলোর মাথা ফাটাই, তেমনি চাঁড়ালদেরও মাথা ফাটাই। তফাত তো কিছু বুঝি না। নিজে মরলেও এই শ্মশানেই পুড়বো, আমার ভাইয়ের পুত হয়ত আমার মাথাখানা ফাটাবে!”
চণকের হাসি পেল, সে দেখল ব্রাহ্মণের তরুণ পুত্রটি অনেক কষ্টে হাসি সংবরণ করে দাঁড়িয়ে আছে।
গৌতম বললেন, ‘আপনিই উপসাঢ় পণ্ডিত না?’
‘হ্যাঁ ইনিই।’ পুত্রটি এবার সসম্ভ্রমে বলল।
‘আপনারা তো অগ্নিকে খুব মানেন। অগ্নি সব শুদ্ধ করে দেন না?’ গৌতম বললেন।
‘তা দেন। কিন্তু পরিবেশটিও তো দেখতে হবে! এমনিতেই তো শ্মশান মানেই নোংরা, এখানে নর-কপাল, ওখানে পায়ের হাড়, সেখানে শৃগালের উচ্ছিষ্ট পড়ে রয়েছে। এরূপ স্থানে দাহ হবার কথা ভাবলেই আমার হৃৎকম্প হয়।’
‘মৃত্যুর পর তো আর হৃদয় কম্পিত হবে না আর্য!’ গৌতম বললেন।
‘রসিকতা ছাড়ো শ্ৰমণ। হীন জাতির শব যেখানে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে আমি কিছুতেই দাহ হবো না। না! না! সে আমাকে শ্মশানশুদ্ধিক বলে হাসাহাসিই করো আর যা-ই করো।’
‘না, না, আমি হাসিনি’, গৌতম বললেন, ‘কিন্তু কোনও জাতি মরেনি, এমন স্থান তো রাজগৃহে কেন, সারা পৃথিবীতে খুঁজে পাবেন না ব্রাহ্মণ উপসাঢ়!’
‘সে আবার কী? এই গিজঝকুটের শিখরেও কোনও বৃষল মরেছে নাকি?’
‘ব্রাহ্মণ আপনি নিজেই এই স্থানে অন্তত চতুর্দশ সহস্রবার ভস্মীভূত হয়েছেন। প্রত্যেকবার আপনি ব্রাহ্মণ বংশজাত ছিলেন না। এ স্থান অনুচ্ছিষ্ট নয়। এ পৃথিবীর আকৃতি কল্পে কল্পে বদলে যায়। এ কল্পে যা তপোভূমি, পরের কল্পে তা আমকশ্মশান, তার পরের কল্পে হয়ত তা বিষ্ঠাক্ষেত্র। ভো ব্রাহ্মণ, পৃথিবীতে এমন কোনও স্থান নেই যা কখনও না-কখনও নর-কপালে আবৃত হয়নি। আর মৃত্যুর পূর্বে সেই সব মৃতদেহ হীন জাতির ছিল কি উচ্চ জাতির ছিল অগ্নি তাদের গ্রাস করার আগে কখনও জিজ্ঞাসা করেনি, শৃগাল, শকুন এরাও জিজ্ঞাসা করে না।’ বলতে বলতে গৌতম আরও উঁচুতে আরোহণ করতে লাগলেন। গম্ভীর স্বরে বলতে লাগলেন, ‘অগ্গোহমস্মি লোকস্স। আমি বুদ্ধ, বহু লক্ষ জন্ম পার হবার পর বুদ্ধ জন্ম পেয়েছি। নৈরঞ্জনা নদীতীরে বুদ্ধত্ব লাভ করেছি বহু তপস্যায়। আমি জানি। আমি দেখতে পাই। তোমাদের আগের শতাধিক জন্ম, যখন হীন জাতি ছিলে, তারও আগের আগের সহস্রাধিক জন্ম, যখন তির্যক্ যোনিতে ছিলে, তারও আগের আগের লক্ষাধিক জন্ম যখন ছিলে পাথর, মাটি, বালির স্তূপ, বালুকণা মাত্র। চৈতন্য ছিল না, মন ছিল, প্রাণ ছিল না। বাতাসে উড়তে, জলে ভেসে যেতে, দারুণ রোদে পুড়তে। এটা শুদ্ধ ওটা শুদ্ধ নয় বলা কারও শোভে না ব্রাহ্মণ। যে বলে সে জানে না। আমি জানি।’
সূর্য সেই সময়ে গৌতমের পেছনে ঠিক তাঁর পায়ের কাছে অবস্থান করছিল। গৈরিক সংঘাটিতে আবৃত দেহের তলার দিকটা দেখাচ্ছিল কৃষ্ণবর্ণ। ছায়ার মতো। ওপর দিকটা দীর্ঘ একটি দীপশিখার মতো জ্বলছিল। তাঁর কথাগুলি যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে চণক এবং অন্য দু’জনের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছিল। উপসাঢ়র তরুণ পুত্রটি গভীর সম্ভ্রম ও ভক্তিতে তাঁর দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে জানু মুড়ে বসে পড়ল, বলল, ‘আপনি মহামানব, আমরা জানি না, বুঝি না। আমাদের সত্য পথে নিয়ে চলুন ভগবন। আমার এই পিতা বহু বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন, কিন্তু আমরা সবাই বুঝতে উনি আসলে মূঢ়, মুর্খ। ওঁর মৃত্যুর সময় হয়ে এলো। আপনি ওঁর চোখের সামনে থেকে অজ্ঞানের তমঃ অপসারিত করুন। শুদ্ধিবায়ুগ্রস্ত বলে ওঁকে পরিত্যাগ করবেন না।’
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণটিও যখন জোড় হাতে বসে পড়েছেন। তাঁর চোখ দুটি বোজা। গালের লোলচর্মের ওপর দিয়ে দরদর করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। গৌতম দাঁড়িয়ে আছেন শিখরে। তাঁর হাত দুটির একটি ওপরে একটি নিচে যেন অভয় দিচ্ছে। তিনি চেয়ে আছেন ওই দুই ব্রাহ্মণের দিকে। কিন্তু চণক বুঝতে পারল উনি এখন ধ্যানস্থ। কনকচাঁপার গুচ্ছের মতো দেখাচ্ছে তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ। কখনও নিষ্কম্প দীপশিখা। এদিকে সূর্য পেছনে লাফ দিয়ে দিয়ে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে কখনও ছায়াময় হয়ে যাচ্ছে গৌতমের জানুদেশ, কখনও কটি, কখনও বক্ষোদেশ, তারপর তাঁর গ্রীবা ছুঁয়ে ঠিক মাথার পেছনে অবস্থান করতে লাগল সূর্য। কিন্তু চণক দেখল গৌতমের মুখটিতে ছায়া পড়েনি। যেন সম্মুখ থেকে অন্য কোনও দীপ্ততর সূর্য তাঁকে উজ্জ্বল রেখেছে। দেখতে দেখতে চণক বুঝতে পারল, এ সূর্য গৌতমের ভেতরের। এবং গেীতমের মধ্য থেকে সেই প্রভা তাঁর আর ব্রাহ্মণদ্বয়ের মধ্যে একটি সেতু রচনা করেছে। সেই সেতু বেয়ে ওই প্রভা গৌতমের শির থেকে প্রবেশ করছে ব্রাহ্মণদের মস্তিষ্কে, হৃদয়ে। সে এই শক্তিস্রোতের বাইরে দাঁড়িয়ে, অথচ পুরো প্রক্রিয়াটি দেখতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে। একটা দুলর্ভ সৌভাগ্য তার হলো আজকে।
দৃশ্যটিকে সামনে রেখে সে পিছু হঠতে লাগল। মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে পথ, তারপর আবার চলছে। কেন যে সে চলে আসছে সে ভাল বুঝতে পারল না। সে কি ভয় পাচ্ছে? যেখানে মহারাজ বিম্বিসারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল, সেখানে এসে আর তাঁকে দেখতে পেল না। সামান্য বেশে যে রক্ষীগুলি আশেপাশে ঘুরছিল তাদেরও না। তার অর্থ মহারাজ চলে গেছেন।
চণক এবার দ্রুত নামতে লাগল। এই তা হলে সেই তথাগত বুদ্ধ। বীরপুরুষের মতো আকৃতি। মুখভাবে একাধারে বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য এবং গভীর ধ্যানমগ্নতা! কী অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয়! কেমন বললেন, “আমিই প্রথম, আমিই এ পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি জেনেছি।” এই উচ্চারণগুলিতে কোনও অহমিকা ছিল না। ঠিক যেন সে বলছে আমি দেবরাতপুত্র কাত্যায়ন চণক। আত্মপরিচয় দিচ্ছে। নিজের গোত্র, পিতৃনাম এবং নিজস্ব নাম জানালে কি তা অহমিকা হয়? হয় না। এ-ও তেমনি। কিন্তু ইনি সেই স্বপ্নমগ্ন ভিক্ষু অস্সজির মতো নন। তিনি যেন মুগ্ধ। পৃথিবীর পরিপার্শ্ব দেখতে পাচ্ছেন না। মগ্ন হয়ে আছেন কী এক উপলব্ধির মধ্যে। গৌতম অন্যধরনের। শ্যেন যেমন দৃঢ় নখে পারাবতকে ধরে, পালাবার পথ রাখে না, ইনিও তেমনি নিজের ব্যক্তিত্ব, নিজের প্রত্যয় দিয়ে ব্রাহ্মণ দুটিকে, তাদের ভ্রমাত্মক ধারণাগুলিকে সবলে ধরলেন। সেগুলির টুটি ছিঁড়ে ফেললেন যুক্তি আর জ্ঞানের তীক্ষ্ণধার নখ দিয়ে। কী ভাবে ক্ষিপ্রগতিতে উঠে আসছিলেন! কীভাবে তার প্রশ্নগুলির উত্তর দিলেন। “আমি কিছু খুঁজছি না। আমি পেয়েছি।” “আমর কিছুতেই সুবিধা বা অসুবিধা হয় না আয়ুষ্মন, তুমি আসতে পারো।” কথাগুলি তার মনের মধ্যে যেন বারবার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল কীভাবে গৌতম গিজ্ঝকুট শিখরে গিয়ে দাঁড়ালেন, যেন মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালেন কোনও মহানট। আকাশ তাঁকে পশ্চাৎপট দিল, সূর্য তাঁকে আলো দিল, বাতাস তাঁর কণ্ঠস্বরকে বেগবান, জোরালো করে তুলল। তারপর তাঁর সেই অভয়মূর্তি! সেই দীপ্ত মুখমণ্ডলী! আচ্ছা উনি কি এই দৃশ্যটির এমন অপূর্ব প্রভাব হবে জেনেই ওভাবে শিখরে উঠে গিয়েছিলেন! স্বস্তি উচ্চারণের ওই অদৃষ্টপূর্ব ভঙ্গি! এটি কি জেনেশুনে আয়ত্ত করা?’
হঠাৎ চণকের মনে হল, আচ্ছা সারা রাজগৃহ এঁর ওপর ক্ষিপ্ত। ইনি স্বামীর স্ত্রী, স্ত্রীর স্বামী, পিতার পুত্র-পুত্রী, পুত্র-পুত্রীর পিতাকে কেড়ে নিচ্ছেন। ইনি এঁর শাসনে, এঁর সঙেঘ নাকি সবাইকে প্রবিষ্ট করাতে ব্যস্ত। সঞ্জয়ের শিষ্যদের কেড়ে নিয়েছেন। বিখ্যাত কাশ্যপভ্রাতাদের এঁর সঙ্ঘভুক্ত করেছেন। কই, চণকের প্রতি তো এঁর কোনও আগ্রহ দেখা গেল না! ওই ব্রাহ্মণ দুটিকে উদ্ধার করবার জন্য গোটা গিজ্ঝকুটটাই একরকম দৌড়ে উঠেছেন, অথচ চণক, উদীচ্য ব্রাহ্মণ, গান্ধার রাজসভার অমাত্য, তাকে সঙঘভুক্ত করার কোনও চেষ্টা তো করলেন না! কেন? মহাবুদ্ধিধর, তক্ষশিলার বহু পুরুষের পণ্ডিতবংশের কুলপ্রদীপ চণক, তার প্রতি শ্রমণ কোনও আগ্রহই দেখালেন না! আশ্চর্য! সত্যিই আশ্চর্য!
রাজ-অতিথিশালার দিকে যেতে যেতে চণকের আরও মনে হল—মহারাজ বিম্বিসারের মধ্যে যেন কী একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে। রাজপ্রাসাদের ভোজনকক্ষে যে মগধরাজের সঙ্গে কথা হয়েছিল, আর যে ছদ্মবেশী মহারাজের সঙ্গে আজ গিজ্ঝকুটে দেখা হল এঁরা ঠিক একই ব্যক্তি নন। সেদিন মহারাজ তাকে আত্মানুসন্ধানী কিংবা ভ্রমণপিপাসু পরিব্রাজক মনে করে হতাশ হয়েছিলেন। তারপর তার পরিকল্পনার কথা শুনে তার পরামর্শ মূল্যবান মনে করেছিলেন। আজ সেই তিনিই অভিযোগ করলেন—চণক তাঁকে যুদ্ধ করে লোকক্ষয় করতে প্ররোচিত করছে। অশ্বমেধ যজ্ঞের ছল করে জম্বুদ্বীপের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পরামর্শ দিচ্ছে। পশুহত্যা করতে পরামর্শ দিচ্ছে।
চণক ভাবল আর এখানে নয়। খুব শীঘ্র বেরিয়ে পড়তে হবে। চণকের যা কাজ, তা চণকেরই কাজ। খুবই অন্যমনস্কভাবে সে অনেকটা পথ পার হয়ে অশ্বশালায় গিয়ে অশ্বরক্ষকদের হাতে চিত্তককে অর্পণ করল। সেই রকম গভীর চিন্তায় আবিষ্ট হয়ে পার হল বাইরের প্রাঙ্গণ, সোপান বেয়ে উঠল, তারপর কক্ষগুলির সামনের অলিন্দ পার হতে লাগল। শ্রীমতীর গৃহে অতি প্রত্যূষে প্রায় ব্রাহ্মমুহূর্তে খুব ভাল করে চন্দন-অগুরু মিশ্রিত জলে সে স্নান করেছে। এখন আর স্নানের প্রয়োজন নেই। কিন্তু হাত পা শরীর মুছে ফেলার প্রয়োজন আছে। এতক্ষণ ক্ষুধাবোধ ছিল না। এখন মনে হচ্ছে কিছু পান করার আশু প্রয়োজন, সঙ্গে কিছু খাদ্যও। মধ্যাহ্নভোজনের সময় কি হল? সে দাসীদের কিছু শুষ্ক ফল এবং মৈরেয় আনতে বলে নিজের ঘরের দিকে গেল।
ঢুকতেই একট পীঠিকায় বসা আগন্তুককে দেখে চমকে উঠল চণক। মহারাজ। তিনি কোনও শীতল পানীয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছেন।
মহারাজের ইঙ্গিতে দ্বার বন্ধ করে বসল চণক। বিম্বিসার বললেন, ‘আজ আমি রাজ-অতিথির অতিথি। আপত্তি আছে?’
চণক বলল, ‘সিন্ধুনীর কখনও কখনও নিজেই নিজের পূজা করতে চায়। আমি মৈরেয় আর কিছু শুষ্ক ফল আনতে বলেছি।’
‘শ্ৰমণ গৌতমকে কী দেখলে চণক?’
‘ইনি একজন অতি বিরল ঋদ্ধিশালী পুরুষ, শুধু দেখাই একটা অভিজ্ঞতা! আমি তো শুনলাম।’
‘ধর্মদেশনা শুনলে?’
‘ধর্মদেশনা? বোধ হয় না। তবে কিছু শুনলাম। মনে হল ইনি যুক্তিবাদী। পুরনো ধারণার মধ্যে যেসব কুসংস্কার প্রবেশ করেছে সে সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করে দিতে চাইছেন। নিঃসন্দেহে মুক্ত মনের মানুষ।’
‘আর কিছু?’
‘মহারাজ, মুক্ত মনের চেয়ে বড় কথা, বড় গুণ আমার কাছে আর কিছু নেই।’
তীক্ষ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বিম্বিসার বললেন, ‘আচার্যপুত্র, তোমার মনে ব্যথা দিয়েছি!’
‘ঠিক তা নয় মহারাজ।’ চণক চিন্তিত স্বরে বলল, ‘কিন্তু আমার মনে সংশয়। আপনিই কি আচার্য দেবরাতের সেই শিষ্য, যাঁর সম্পর্কে আচার্য তাঁর মৃত্যুকালে শেষ ভবিষ্যদ্বাণী করে গেলেন? আপনি কেন চণককে আপনার অর্থধর্মানুশাসক করতে চেয়েছিলেন তা-ও বুঝলাম না। শুনেছিলাম, আপনি খুব ঘন ঘন অমাত্য বদলান। সে কি তাঁদের অক্ষমতার জন্য? না, অপরাধ নেবেন না মহারাজ, আপনারই অব্যবস্থিতচিত্ততার জন্য?’
বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন, পদচারণা করতে করতে বললেন, ‘চণক, কিছুদিন আমি বড় বিভ্রান্ত, বড় অসহায় বোধ করছি। বুঝতে পারছি, আমার কথাবার্তার মধ্যে, ব্যবহারের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে না।’
চণক কোমল গলায় বলল, ‘কিন্তু মহারাজ, যাঁদের কাধে গুরুদায়িত্ব, যাঁরা সাধারণ নন, তাঁরা তো চিরকাল একাই। এই একাকিত্ব কী করে বহন করতে হয় আজ গিজ্ঝকুট শিখরে শ্রমণ গৌতমকে দেখে শিখেছি।’
বহুক্ষণ চুপ করে থেকে বিম্বিসার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘নারী, নারীই যত দুঃখ, যত অশান্তির মূল।’
‘এ কথা বলবেন না মহরাজ’, চণক প্রতিবাদ করে উঠল, ‘নারী আমাদের জন্ম দেয়, নারী আমাদের প্রেমতৃষ্ণা মেটায়, আমাদের সন্তান গর্ভে ধারণ করে, আমাদের গৃহকে গৃহ করে তোলে। নিজেদের প্রবৃত্তিকে সংযত করতে পারি না বলে নারী থেকে আমরা দুঃখ পাই।’
‘হয়ত ঠিকই বলেছ বন্ধু চণক। কিন্তু, প্রিয়া নারী যখন একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে গৃহত্যগ করে চলে যায়? অপমানের জ্বালাকে কৃতার্থন্মন্যর হাসিতে পরিণত করতে হয়? শূন্য বক্ষের হাহাকারকে যখন গোপন করতে হয়, অথচ পারা যায় না?’
চণক মৃদু স্বরে বলল, ‘মহারাজ, পত্নী প্রব্রজ্যা নিলে দুঃখ হয়ত হতে পারে, অপমানের জ্বালা হবে কেন? আমি বুঝি না।’
‘আমিও বুঝিনি, আচার্যপুত্র, কিন্তু হল। যখন তিনি কেশগুচ্ছ ফেলে দিলেন, যে সুগন্ধ, অপরিমিত কেশ কতদিন…কতদিন আমি বক্ষে ধারণ করেছি, যখন তিনি পরিত্যাগ করলেন আমার দেওয়া মহার্ঘ বস্ত্র-অলঙ্কার যা তাঁকে মাত্র কিছুদিন উপহার দিয়েছি, মনে হল যেন আমাকেই ফেলে দিলেন, আমাকেই আবর্জনার মতো পরিত্যাগ করলেন! জ্বালা হল। ভেতরে যেন বৃশ্চিক দংশন অনুভব করছি সর্বক্ষণ। যখন আমার অন্তঃপুরে ছিলেন যথাযোগ্য সমাদর করিনি, করতে পারিনি। রাজার জীবনে অনেক বিধিনিষেধ বন্ধু, অনেক কূটনীতিতে কণ্টকিত, কিন্তু তিনি মানিনী ছিলেন। একটু সমাদর করলেই তাঁর ভেতরের সেই অভিমান ফণা তুলত। না, এসব থাক। আমি প্রলাপ বকছি।’ রাজা চুপ করে গেলেন। চণক অপেক্ষা করে রইল। একটু পরে তিনি আবার বললেন, ‘তুমি প্রশ্ন করছিলে না, কেন তথাগত বুদ্ধকে সামনে দেখেও চলে এলাম? এই জন্য। এই জন্য। তাঁর ঋদ্ধিতে, তাঁর অসামান্য রূপবৈভবে, গুণগ্রাম অনুভব করে মুগ্ধ ছিলাম আমি। এখনও আছি। কিন্তু হৃদয়ের সেই জ্বালা তাঁকে দেখলে এখন বেড়ে যায়। আমি সইতে পারি না। তাই তাঁর দর্শন কিছুদিন এড়িয়ে চলছি। তা ছাড়া, তোমার চোখে দিয়ে তাঁকে দেখবার, তাঁকে পরীক্ষা করবার ইচ্ছে হয়েছিল।’
‘কী দেখলেন মহারাজ?’
‘একটি অন্য মানুষকে যেন দেখলাম। ঠিক ধরতে পারছি না। কিন্তু অন্য মানুষ।’ রাজা একটু থেমে দ্বিধামিশ্রিত স্বরে বললেন, ‘চণক, যে কথা কারুর কাছে প্রকাশ করতে পারিনি, তা আজ তোমার কাছে প্রকাশ পেলো। রাজা ক্ষত্রিয় বটে। রাজ্যরক্ষার ভার তার ওপর। সেটাই তার মুখ্য দায়িত্ব। সত্য। সবই সত্য। কিন্তু রাজা তো মানুষও!’
১৭
‘তা দেখালেন বটে সাকেতের সেট্ঠি। বস্সার তিন তিনটি মাস ধরে কি না দীয়তাং, ভুজ্যতাম্!’
‘যা বলেছিস! তা-বড় তা-বড় অতিথ্রা তো আছেই। রাজা-রাজড়া, অমাচ্চ, পারিষদ, সেনাদল, রক্ষী, গহপতি, বোধ হয় সাকেত- সাবত্থি-ভদ্দিয়র কোনও বড় মানুষকে বাদ রাখেনি।’
‘আর রাজগহ? রাজগহর নাম কল্লি না? রাজগহর বড় বড় আঢ্য ব্যক্তিও তো এসেছিল। অলঙ্কার কী সব! দেখলে চোখ ফেরে না।’
‘কত লোক খেটেছে বল তো? এখনও খেটে যাচ্ছে। এক পাকশালেই তো শত শত মাপক, কুট্টক, পেষক, পাচক, পরিবেশক। অতিথ্দের দেখাশোনার জন্যে গাম থেকে সুপ্রচুর সংখ্যায় ভৃতক-ভৃতিকা নিয়েছে সেট্ঠি। লোকগুলো এই তালে ধন করে নিল বটে! বস্সায় পথ নষ্ট হচ্ছে বলে তো সব্বদা কাঁকর আর বালু ফেলছে, ফেলছে আর পিটিয়ে পিটিয়ে সমান করছে।’
‘বারাণসী বদ্ধকিদের দেখেছিলি? ভেলকি দেখালো যেন। কাঠের থাম আর পাটাগুলো আনছে, কাঠামো আনছে আর যেন ফুস মন্তরে এক-একখানা সুরম্ম হম্ম নিম্মান করে ফেলছে। পথ ঝাঁট দিচ্ছে সব সময়। পথে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে, যেন পথ নয়কো, বড় মানুষের গা!’
‘তা যেমন খেটেছে, তেমনি পেয়েছে সব। ভোজ তো তিন মাস ধরে খেলই। তার ওপর পেল জোড়া জোড়া কাপড়, কাহন, তণ্ডুল, যব, মোদক…’
‘সে না হয় হল, কিন্তু শুনেছিস একশ’ গ্রাম থেকে নাকি সেট্ঠি একশ’ রকম উপহার নিয়েছে! নিদ্দেস ছিল! অনেক গরিবগুরবো গ্রামও তো আছে, তারা তো ভয়ে সারা! কী দেবে!’
‘এ সব মিছে অপ্যশ। সেট্ঠি কি আর চেয়েছে? গামে গামে নেমন্তন্ন গেছে। মোড়লগুলোর তো লোক-দেখানি কিছু করা চাই! অমনি সব নিদ্দেস চলে গেল। ছন্দক চাই, ছন্দক চাই! কনের জন্যে উপহার নিম্মান হবে! আমাদের গ্রাম থেকে তো উৎকৃষ্ট দই এক শকট পাঠানো হয়েছে বাস! তোদের?’
‘শুনলুম উপরত্ন দেওয়া গজদাঁতের কাঁকন! চোখে দেখিনি ভাই।’
‘ভালো। তবে অতশত হিরামণিমাণিক্যের মধ্যে তোদের উপরত্নের গহনা কি সেট্ঠি কন্যা পরবে?’
‘কে জানে! দিতে হয় দেওয়া। সেট্ঠি কন্যা পরবে বলে তো আর দেওয়া হয়নি!’
‘হ্যাঁ রে, রাজামশাইকে দেখেছিলি?’
‘কোন রাজা? আমাদের উগ্গসেন?’
‘না রে! আমাদের কোসলের রাজা পসেনদি? কী মোটকা! এত মেদ যে হাসলে চোখ বুজে যায়।’
‘তুই কোথায় দেখলি? সব সময়ে তো রক্ষী দিয়ে ঘেরা থাকে!’
‘কে বলেছে? ইন্দ্রজালের সভায় বসে ঠাঠা করে হাসছিল। ঠিক আমাদের গামনির মেজ পুতের মতো! মোটকা হোক। মনটা খুব ভালো। হাতে সব সময় পানপাত্তরটি ধরা থাকে।’
‘এই বয়সে তো আবার একটা কচি মেয়েকে বিয়ে করেছে শুনছি!’
‘আহা, তা তো করতেই পারে। রাজার আবার বয়েস!’
‘বাজিকরদের দেখলি?’
‘অদিট্ঠপুব্ব। সত্যি ভাই জাদুর খেলা যা দেখলুম, সারা জীবন আর ভুলতে পারব না। বংশধাবন তো করল বিদ্যুতের মতো। তার পর দড়া বাজিকর তালপাতার ছাতা হাতে কেমন হেলেদুলে দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে গেল? কচি ছেলেটাকে নিয়ে যা লোফালুফি করছিল, আমার তো নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমরা ভাই একটু-আধটু সাপের খেলা, কি বানর খেলা দেখেছি গ্রামে। বংশধাবনও দেখেছি। কিন্তু এর সঙ্গে তার কোনও তুলনাই হয় না।’
‘আর জাদুকর! ওই যে শল্ল আর সুলভ, নাকি এক সময়ে বিসাখার পিতাম’র দাস ছিল। কোথা থেকে খবর পেয়ে চলে এসেছে। মাটিতে বীজ পুঁতল, গাছ হল, পাঁচ রকমের ফল ধরল, সেই ফল কেটে কেটে সব্বাইকে খাওয়ালো—বাব্ রাঃ!’
‘কী করে এ সব করে বল তো?’
‘অলৌকিক ক্ষমতা থাকে। নানা রকম ভূতপ্রেত সব বশে থাকে। জানিস না মেণ্ডক সেট্ঠির ইদ্ধি আছে।
‘তা এরূপ ইদ্ধি তোর আমার হয় না কেন? শল্ল, সুলভ ওরাও তো আমাদের মতোই সাধারণ লোক। ছিল তো ক্রীতদাস! বিসাখার পিতাম’র। আমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থা বই ভালো না। আমরা তো নিজেদের গেহে, নিজেদের বউ-পুত-কন্যা নিয়ে খাচ্ছি, দাচ্ছি, খাটছি, পিটছি। বাপ-মা আরও সব জেঠ্দের উপদেশ পাচ্ছি। আর ওরা?’
‘দ্যাখ, ওরা দাস হলেও কিন্তু বড় ঘরের দাস। বিসাখার পিতাম’র ধনের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই, তা জানিস! এই যে বিসাখার বিয়ে হল! এরকম দশটা বিয়ে এক্ষনি দিতে পারে, গায়ে লাগবে না। ওদের ঘরের দাসরা নিত্য সুগন্ধ চালের অন্ন খায়, কাসিক বস্তর পরে। সেট্ঠিরা লোকও ভালো তো। দাসেদের যত্ন করে, কষ্ট দেয় না।’
‘কী করে জানলি?’
‘শুনেছি। এই তো এই বিয়ের জন্যেই ভদ্দিয় থেকে কত দাস এসেছে। এক-একজনের আকৃতি কী! দেখলে ঠিক বুঝবি কুলপুত্তুর। তো সবাই তো আর সমান অহংকারী নয়, নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল কত কথা— তাইতেই বুঝলাম। শল্ল আর সুলভ, ও জাদুকর দুজন তো ওদের প্রভুর কাছ থেকেই শিখেছে সব।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ রে মেণ্ডক সেট্ঠি নিজে অনেক রকম জানে, বললামই তো ইদ্ধি আছে। এমন কি ওঁর পত্নী দেবী পদুমাবতী পর্যন্ত জানেন অনেক কিছু।’
‘বাব্বাঃ, তা হলে তো দেখছি বড় ঘরের দাস হওয়াও অনেক ভালো।’
‘এটা কি বললি চন্দ, ছি! ছি! কত জন্ম পাপ করলে তবে কেনা-দাস হয়, তা জানিস? সেই শূকর আর বলদের গপ্পোটা জানিস না?’
‘কোনটা? সেই শূকর রোজ ভালো ভালো খেত, আর বলদগুলো পেত না সেইটা?’
‘হ্যাঁ সেইটা। তা ওই শূকরের মতো মোটা-সোটা হয়ে মাংসের জন্য বধ হওয়া ভালো?’
‘দুটো এক হল? সেট্ঠি কি দাসেদের কেটে খায়?’
‘তুই বড় মাথামোটা চন্দ, কেটে খাবে কেন? কিন্তু খাটায় তো? অসাগর খাটায়। তার ওপর প্রভু যখন যা বলবে করতে হবে। তেমন তেমন প্রভু হলে মেরে উচ্ছন্ন করে দেবে।’
‘সবাই তো আর দেয় না। বড় ঘরের দাসেরা ভালোই থাকে। আমাদের কস্সকদের খাটুনি কি অপ্পো? রোদে-জলে, কীটপতং, সপ্প, জোঁক মাথার ওপর দিয়ে সারাটা দিন বয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলায়…’
‘কিন্তু যখন সবুজ সবুজ ধানগাছগুলি লতলতিয়ে ওঠে? যখন শিষ আসে? যখন সন্নবন্ন হয়ে যায় ক্ষেত! হাত পায়ে তেল মালিশ করে কুটিরের সামনের চত্তালে বসে দেখিস, তখন?’
চন্দ হেসে ফেলল, বলল, ‘যাই বলিস ওই জাদুকর দুটোকে দেখে আমার মাথা ঘুরে গেছে। ছিল দাস, প্রভু নিজের বিদ্যে শেখালেন, শিখিয়ে মুক্তি দিয়ে দিলেন, এখন দেশ-বিদেশে জাদু দেখিয়ে কেমন করে খাচ্ছে!’
‘সে দেখ, ওদের ভাগ্যের জোর। নয়তো এত তো সেট্ঠি ছিল, মেণ্ডক সেট্ঠির ঘরেই বা দাস হয়ে যাবে কেন? এত তো দাস ছিল সেট্ঠির, ওরা দুজনেই বা বিদ্যেটা পেল কেন? ওদের আগের জম্মের কোনও পুগ্নফল ছাড়া আর কী?’
পাশ দিয়ে একটি চার ঘোড়ার রথ ছুটে গেল।
‘কে যায়? কে যায় গো?’
সারথি মুখ ফিরিয়ে একবার তাকাল, উত্তর দিল না।
‘গুমোর দেখলি?’
‘দেখলাম।’
হুম হুম করে শিবিকা আসছে। পটিচ্ছন্ন। বস্তর দিয়ে ঢাকা। কিন্তু বস্তর একটু ফাঁক করে কৌতূহলী দৃষ্টিতে চারপাশ দেখছে রমণীরা।
‘কে যায়? কে যায়?’
‘অযোধ্যা সেট্ঠির গেহের পুরাঙ্গনারা।’
আরও একটি রথ আসছে। এ পথ এখন বিশাখার বিবাহের কল্যাণে রথ্যা অর্থাৎ রথ চলবার উপযুক্ত হয়ে গেছে। যেমন প্রশস্ত, তেমনি সমান।
‘কে যায় গো?’
‘রাজগহ যাই।’
গো শকট আসছে, দু’তিনখানা।
‘কে যাচ্ছ গো?’
বলদের পিঠে ছপটি মেরে চালক বলে, ‘গামনি, গামভোজক সব আছে, পরিবারসুদ্ধ।’
‘কোথাকার গামনিরা বল্ তো? আমাদের গামনি তো আমাদের সঙ্গেই এলো। সব্বাই একপ্রকার হলিদ্দায় ছোপানো বস্তর পরে, নতুন উত্তরীয় কাঁধে, গলায় মল্লিকার মালা, পায়ে কাঠ্ঠপাদুকা পরে শনশন করে চলে এলাম। সঙ্গে রমণীদের আনিনি।’
‘কেন? রমণীদের আনলি না কেন?’
‘দুর। ওরা সঙ্গে থাকলে সব আনন্দই মাটি। তার ওপর এতটা পথ, বলবে “শকট করো, মাষক-কাহন কিছু নেই নাকি কস্সকের ঘরে? নেই যদি তো বিবাহের সাধ হয়েছিল কেন?” তারপর দেখ এই যে এখানে এত অলংকার এত সব শাটক, বেশভূষা দেখবে, অন্ততপক্ষে এক যুগ মাথা ঘুরে থাকবে। বলবে, “আমারও অমনি সাত লহর চাই। আচ্ছা সাত না পারো পাঁচ লহর দাও। অমনি কাঁকন, অমনি কেয়ুর”, সব চিত্রের মতো বুঝিয়ে দেবে তোকে। কোথায় মরকত থাকবে, কোথায় হীরক, কোনখানটা সপ্পমুখের মতো হবে, কোনখানটা মকরমুখের মতো হবে। চত্তালে বসে বসে স্বপ্ন দেখবে সব। চেয়ে চেয়ে কাঞ্জিকা পাব না, অন্ন আধসেদ্ধ থাকবে, মচ্ছগুলো হয়ত বিড়ালেই খেয়ে যাবে, গাই দুইবার সময় বয়ে যাবে।’
‘বাব্বাঃ, এতও ভেবেছিস্? তবে তোর দুরদিট্ঠি আছে, বলতেই হবে। রমণীরা এমনিই করে বটে। আমাদের তো গ্রাম থেকেই ঠিক হল রমণীরা যাবে না। বালক বালিকারাও না। কে জানে, কেমন ব্যবহার করবে! বড় ঘরের ব্যাপার! তবে বালক-বালিকাগুলিকে না এনে এখন বড় দুঃখ হচ্ছে রে! এমন খেলা, হাতি ঘোড়ার খেলা, নর্তকের খেলা, এমন জাদু দেখতে পেল না! কাছাকাছি গ্রামের থেকে সব এসেছিল। বালক বালিকাদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থাও করেছিল।’
‘গণিকাদের দেখেছিলি? রাজগহ, সাবত্থি, চম্পা থেকে পর্যন্ত নাকি নেমন্তন্ন পেয়ে নৃত্যগীতকুশলা গণিকারা এসেছিল।’
‘বাব্বাঃ তাদের জন্য তো সুরম্ম হম্ম প্রস্তুত হয়েছে, নৃত্য ও সঙ্গীতের জন্য মণ্ডপ ভেতরে। আমরা যাই সাধ্য কি? ওসব রাজভোগ্যা, ধনীভোগ্যা নগরশোভিনী। ওদের সঙ্গীতাদি শোনবার অধিকারও আমাদের নেই। নানা স্থান থেকে আসা সেট্ঠিপুত্তুর আর ক্ষত্তিয়কুমাররা তো ওখানেই সেঁটে ছিল।
‘কেন, সৈন্যদের বাসগহের কাছে তো অল্প মূল্যের বারবধূও ছিল। যাসনি?’
‘তুই গিয়েছিলি না কি?’
‘গেলাম বইকি। পুরো মূল্য দিয়ে গেলাম, তা মাঝরাতে এক বর্শা ধনুকধারী অশ্বারোহী আসতে আমায় বার করে দিলে।’
‘তা তুই কি ভেবেছিলি মূল্য দিয়ে ওকে সারা রাতের জন্য কিনে নিয়েছিস! চল, চল, পা চালিয়ে চল, মনে দুঃখু করিস না।’
সাকেতের প্রান্তিক গ্রাম থেকে অতিথির স্রোত আসা-যাওয়া করতেই থাকে। করতেই থাকে। যারা কাজ করছে এবং পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত কি বন্ধুস্থানীয় তারা তো যতদিন পারছে, থাকছে। অন্য গ্রামগুলিকে গুচ্ছ করে করে খাইয়েছে শ্ৰেষ্ঠী। সারা দিন জাদুর খেলা দেখো, খাওদাও, ইচ্ছে হলে লক্ষ লক্ষ দীপমালায় শোভিত সাকেত নগরীর সন্ধ্যাশ্রী দেখো। তারপর ফিরে যাও। ভোজনের সময়ে নাতি-উচ্চ মঞ্চের ওপর সর্বালঙ্কারভূষিতা, অপরূপ বেশবাসে সজ্জিতা বিশাখা এসে নত হয়ে দাঁড়ায়, সঙ্গে সুবেশী সহচরীরা। শ্রেষ্ঠা কিংবা তার ভাইদের কেউ নিজে তত্ত্বাবধান করে। গ্রামণীর দেওয়া উপহারটি গ্রহণ করে স্মিতমুখে নমস্কার জানায় বিশাখা। অনেকক্ষণ ধরে উপহারটি হাতে চিত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এমন শ্ৰেষ্ঠীকন্যা কেউ কখনও দেখেনি।
এবং সারাক্ষণ পঞ্চশত সুবর্ণকার, মণিকার মিলে সহস্ৰ নিষ্ক পরিমাণ স্বর্ণ, রজত, মুক্তা, প্রবাল, হক, পদ্মরাগ, পুষ্পরাগ, বৈদুর্য নীলকান্ত মণি ইত্যাদি দিয়ে অনলসভাবে প্রস্তুত করে যায় ‘মহালতাপসাদন’। সে এক অদ্ভুত অলঙ্কার। অন্যান্য অলঙ্কার তো ধনঞ্জয় দিয়েইছেন। কিন্তু ‘মহালতা’ এক অতি বিচিত্র, দুর্লভ গহনা। এই গহনা নমনীয় অথচ এতে কোনও সুতো নেই। সব সুতোই রুপোর। পরলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত দেহটিই এক অভিনব, অদৃষ্টপূর্ব উপায়ে অলঙ্কৃত হবে। পায়ের ওপর সোনার চক্র, জানুদ্বয়ে দুটি, কটিদেশে দুদিকে দুটি, কন্ঠে একটি, দুই বাহুসন্ধিতে দুটি, কানের ওপর দুটি এবং শিরের ওপর একটি। মহালতার উপরার্ধ একটি ময়ূরের মতো, যেন পেখম ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁদিকের পেখমে পাঁচশ, ডানদিকের পেখমে আরও পাঁচশ’ সোনার পালক। ঠোঁট প্রবালের, চোখগুলি মণির, কণ্ঠ এবং পুচ্ছের পালকগুলিও বহু মণিখচিত। পালকের মধ্যশিরা রজতের, অনুরূপভাবে ধারগুলি এবং চরণও রজতের। বিশাখার মাথার ওপরে ঠিকভাবে বসিয়ে দিলে মনে হবে পর্বতশিখরে আনন্দিত ময়ুর নৃত্য করছে। আর সেই সহস্র পালকের মধ্যশিরা থেকে নড়া-চড়া মাত্রই সুমধুর, স্বর্গীয় সঙ্গীত শোনা যাচ্ছে। পেখম-ছড়ানো একটি মণিমাণিক্যখচিত ময়ূরের মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দরী বিশাখা। খুব কাছে এলেই বোঝা যাবে এটি সত্যি ময়ূর নয়।
কেউ বলল নব্বই কোটি ব্যয় হয়েছে স্বর্ণ, রৌপ্য, মণিমাণিক্যে এবং আরও দশ কোটি গেছে গড়াতে। কেউ বলল, অতটা হবে কী? কেউ বলল, এ তো বোধ হয় অল্প করে বলা হল : মণিমাণিক্য, কত নষ্ট হয়েছে কাটাকাটিতে। রুপোর জালি নির্মাণ করতে সোনার চক্রগুলি বসাতেও একি-ওদিক অনেক গেছে, সে সব ধরলে আরও বেশি। বিশাখার গতজন্মের মহাপুণ্য ছিল নিশ্চয়ই, তাই-ই এমন অলঙ্কার পেল! কেউ আবার বলল, অলঙ্কার পেলেই তো হল না, তার উপযুক্ত রূপও থাকতে হবে। ধনী শ্রেষ্ঠী তো আরও আছেন। তাঁদের ঘরে কন্যাও আছে। কিন্তু এই গহনা পরবার জন্য ভাগ্য দুই প্রকার চাই। ধনভাগ্য এবং রূপভাগ্য। এই যে নাতিদীর্ঘ, নাতিখর্ব আকার, ক্ষীণ কটি, পদ্মকোরকের মতো বক্ষের আকার, নাতিব্যাপ্ত নাতিপৃথুল শ্রোণি, সুচিক্কণ কম্বু গ্রীবা, অতুলনীয় আঁখি এবং ওষ্ঠাধর। মহালতা ধারণ করবার জন্য আদর্শ আকৃতি এই। এর চেয়ে ক্ষুদ্রকায় হলে, গহনার ভারে চাপা পড়ে যেত, দীর্ঘকায়, কিংবা স্থূলকায় হলে গহনা সমেত একটা অনৈসর্গিক প্রাণী বলে বোধ হত। কিন্তু এখন ছড়ানো ময়ূর পেখমের মধ্যে, ময়ূরের ঝুঁটিসুদ্ধ মুণ্ডটা মাথায় মুকুটের মতো ধারণ করে, বালার্ক বর্ণের স্বর্ণসূত্রী কাসিক দুকূল পরে বিশাখা দাঁড়িয়ে আছে, সোনার চরণচক্র, কটিচক্র, জানুচক্র, কণ্ঠচক্র শোভা পাচ্ছে। মণিবন্ধে, বাহুতে, কণ্ঠে রত্নের ঝিকিমিকি। এ যেন সকল সৌন্দর্যের সার। মানুষী রূপের পরাকাষ্ঠা।
রথটিও তেমন। রূপা আর হাতির দাঁতের কারুকার্য করা। মাথার ওপরের ছাত থেকে মুক্তার ঝালর নেমেছে। সাতটি দুগ্ধধবল সৈন্ধব অশ্ব বাহন। তার পাশাপাশি আর-একটি রথে চলেছে গহপতিপুও পুন্নবদ্ধন। দিব্যি দেখতে। একটু বেশি সুখুমাল। টানা টানা কালো চোখ, ধনুকের মতো বাঁকা ভুরু। ঠোট দুটি টুকটুকে। সরু গোঁফের রেখা। আকুঞ্চিত কেশদাম। প্রচুর অলঙ্কার পরেছে সেও। শুভ্র পট্টবস্ত্র, চন্দনাবলেপ, যূথীমাল্য, নরম সাদা শশকচর্মের পাদুকা। ঠিক যেন বীরপুরুষ বীরপুরুষ মনে হয় না। বীরপুরুষ হবে কি না সে নিয়েও যেন তার দ্বিধা আছে। গোঁফের প্রান্তগুলি মাঝে মাঝেই সে পাকিয়ে তোলবার চেষ্টা করছে। যথেষ্ট মোম দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও ঠিক প্রার্থিত বক্রতাটা পাওয়া যাচ্ছে না। দেব-গন্ধর্বদের যেসব চিত্র লেখা হয়, হাতে মুরলি অথবা মৃদঙ্গ! অনেকটা যেন সেই প্রকারের পুন্নবদ্ধন। সামনে পেছনে সু-উচ্চ সব পেশল আজানেয় অশ্বের ওপর রাজা পসেনদি, তাঁর রক্ষীরা, পুন্নবদ্ধনের পিতা গহপতি মিগার, গহপতি সুদত্ত কুমার জেত, এবং শ্রাবস্তীর আরও গণ্যমান্য জনেরা। মহারানি মল্লিকার পটিচ্ছন্ন শিবিকাটি তার সোনার দণ্ড ঝলসাতে ঝলসাতে চলে গেল, পাশে পাশে অশ্বের পিঠে নারী রক্ষিণীরা, পেছনে আরও শিবিকায় রানির দাসীরা।
রথের ওপর সুসজ্জিত আসন আছে। বিশাখা নিমেষ কয়েক ভাবল। তারপর সে তার সহচরীকে বলল পিতাকে ডেকে দিতে। ধনঞ্জয় এসে বললেন, ‘কী মা? কী হল?’
বিশাখা চুপিচুপি বলল, ‘পিতা সব দিক থেকে দৃশ্যমান না হলে তোমার এই মহালতার পূর্ণ মহিমা তো বোঝা যাবে না। তুমি রথের পাশের ও পেছনের বস্ত্রাচ্ছাদনও সরিয়ে দাও। আমি কিন্তু শ্রাবস্তীতে রথ ঢুকলেই উঠে দাঁড়াব। দণ্ডায়মান বিশাখাকে মহালতার কেন্দ্রমণিরূপে তারা দেখুক।’
ধনঞ্জয় হেসে বললেন, ‘ঠিক বলেছ মা। কিন্তু এখন নয়। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। একটি রজুতে টান দিলেই আবরণী সরে যাবে।’
সুতরাং সূচীশিল্পীরা এলো, এলো সূত্রধর, কৌশল করে রজ্জু গ্রথিত হল রথের আবরণীতে। সাত ঘোড়ার রথটি চলতে লাগল মধ্যম বেগে।
শঙ্খ বাজছে মুহুর্মুহু। অমঙ্গলাশ্রু লুকিয়ে ফেলছেন সুমনা। এখন আর বিশাখা পেছন ফিরে দেখবে না। নিয়ম নেই।
এবার ধনঞ্জয় যৌতুক দিতে আরম্ভ করলেন।
পাঁচশ’ শকট অর্থ চলে গেছে। পাঁচশ’ শকট স্বর্ণপাত্র। পাঁচশ’ শকট রজতপাত্র, তাম্রপাত্র। পাঁচশ’ শকট দুকূল বস্ত্র, নবনীত, সুগন্ধি চাল, নানা প্রকার সৌগন্ধিক সব পাঁচশ’ শকট করে। লাঙল ইত্যাদি কর্ষণের যন্ত্রপাতিও চলল বহু। রথে শিবিকায় বিশাখার রক্ষী ও অনুচরীরা।
শোভাযাত্রা খানিকটা এগিয়ে যেতে ধনঞ্জয় হঠাৎ হেঁকে বলে উঠলেন, ‘গোষ্ঠের দ্বার খুলে দাও।’ অমনি হেলতে হেলতে দুলতে দুলতে বেরিয়ে এলো শত শত গাভী। শুভ্র মেঘের মতো, ধবল, আবার কুচকুচে কালো, পাটল রঙের কেউবা, চিত্রবর্ণও অনেকে। একে অপরের গা ঘেঁষে গাভীর দল চলতে লাগল বিশাখার রথের পেছন পেছন। কানগুলি খাড়া খাড়া হয়ে উঠেছে। তৈলচিক্কণ শিংগুলিতে মালা জড়ানো, কালো নিরীহ চোখগুলি যেন একই সঙ্গে হাসছে এবং কাঁদছে। হাসছে তাদের প্রিয় মাতা বিশাখার সঙ্গে যেতে পারছে বলে। কাঁদছে এতদিনের গৃহ, গৃহস্বামী, গোচরক্ষেত্র এসব ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে।
এইভাবে ধনঞ্জয় বলদ দিলেন, বাছুর দিলেন। গোষ্ঠের বেষ্টনীটি বন্ধ করে দেবার পরেও বহু বলদ ও গাভী লাফিয়ে সে বেষ্টনী পার হয়ে চলে গেল।
সাকেতের আশেপাশে যে চোদ্দটি গ্রাম তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি, সেখান দিয়ে অবশেষে অনুরাধপুর পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে গেলেন ধনঞ্জয় এবং যেতে যেতে বললেন, ‘এখানে যারা যারা বিশাখার সঙ্গে যেতে চাও, যেতে পারো।’ বলে তিনি একটু এগিয়ে গিয়ে মহারাজ পসেনদি ও গহপতি মিগারকে যথাযথ অভিবাদন করে তাঁদের হাতে কন্যা সমর্পণ করে ফিরে এলেন।
এদিকে মিগার তাঁর ঘোড়া থেকে দেখতে পেলেন এক বিশাল জনতা পায়ে পায়ে ধুলো উড়িয়ে পেছন পেছন আসছে।
‘এরা কারা?’ তিনি সভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘এরা আপনার স্নুষার আজ্ঞা পালন করবার জন্য যাচ্ছে। প্রজাবর্গ।’
‘এত জনকে কে খাওয়াবে? সর্বনাশ! তাড়িয়ে দাও, তাড়িয়ে দাও, মেরে তাড়াও।’ তাঁর কথায় সঙ্গী রাজভটরা লাঠি উঁচিয়ে জনতার দিকে তেড়ে গেল।
বিশাখা উৎকণ্ঠিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী করছেন, কী করছেন পিতা, মারবেন না, মারবেন না।’
তার পিতা তাকে পাঁচশত শকট অর্থ দিয়েছেন, তা ছাড়াও তার নিজেরই সঙ্গে রয়েছে চল্লিশ কোটি সুবর্ণ। তার প্রসাধনের ব্যয়নির্বাহের জন্য। ভাবনা কী?
কিন্তু মিগার শ্রেষ্ঠী তখনও চেঁচাচ্ছেন, ‘কল্যাণি, প্রয়োজন কী এদের? কে এদের খাওয়াবে?’
রাজভটরা মাটির ডেলা ছুঁড়তে লাগল। লাঠি দিয়ে প্রহার করতে লাগল, তাতেও কয়েক জন ফিরল না। তখন মিগার ক্লান্ত হয়ে রাজভটদের বললেন, ‘হয়েছে, হয়েছে, এই ক’জনকে আসতে দাও।’
বিশাখার পতিগৃহ যাত্রার পূর্বাহ্নে ধনঞ্জয় সাকেতের সব শ্রেণীর জ্যেষ্ঠকদের সঙ্গে একটি সভায় বসেছিলেন। তাঁর মনে বড় শঙ্কা। এই মিগার শ্রেষ্ঠীর হাবভাব তাঁর ভালো লাগেনি। বিশাখাকে তাঁরা লালন করেছেন শুধু কন্যার মতো নয়, পুত্রের মতোও! তার বিবেক, তার কর্মক্ষমতা, নানা বিষয়ে তার দক্ষতা, স্বাধীনচিত্ততা—এই সবই গুণ। কিন্তু পরিবেশ-ভেদে এগুলোই তো দোষ হয়ে দেখা দিতে পারে! একটি বনে যদি শুধুই শৃগাল এবং শৃগালেতর প্রাণীই থাকে, সেখানে সহসা সিংহের আবির্ভাব হলে শৃগালেরা কি বলাবলি করবে না—‘দেখ দেখ, এই প্রাণী কী কুৎসিত? এর মাথায় কেমন জটা? মুখ ব্যাদান করলে কী করম তীক্ষ্ণ শুভ্র দন্তরাজি দেখা যায়। থাবাগুলিই বা কী! এক একটি শল্লকীর মতো! চলে কি রকম দেখ, যেন অলস, কোন কাজ নেই! ও কি রে, বিদ্যুদ্বেগে ওটা কী চলে গেল? ওই প্রাণীটাই কী? ওর কি কাজকর্মে কোনও সামঞ্জস্য নেই? কোনও সুষমা নেই!’
সিংহের ডাক শুনলেও তারা বলবে, ‘কী অসভ্যের মতো ডাক! আমাদের কী সুন্দর তীক্ষ্ণ হ্রস্ব ডাক, একজন ডাকলেই সবাই মিলিত হয়ে ডেকে উঠি। আর এ দেখো, ডাকছে তো ভূমি পর্যন্ত কেঁপে উঠছে, বাতাসে থম ধরে যাচ্ছে। কোনও প্রত্যুত্তরই তো এখনও পর্যন্ত আর কেউ দিল না। তা হলে, চল্ কলাকৌশল করে একে তাড়াই, কিংবা মেরে ফেলি।’
ধনঞ্জয়ের কথা শুনে শ্রেণিজ্যেষ্ঠকরা সবাই প্রাণভরে হাসলেন। তারপর একজন বললেন, ‘ধনঞ্জয় ঠিকই বলেছেন।’ অন্যরাও সমর্থন করলেন।
তখন ধনঞ্জয় বিনীতভাবে বললেন, ‘সেরকম কিছু হলে আমার কন্যার রক্ষা ও বিচারের জন্য আমি তা হলে আপনাদের এবং শ্রাবস্তীর গহপতিদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে নির্বাচন করে দিতে বলি?’ সকলেরই মত হল। তখন কোশল রাজের সেনাদলের উপস্থিতিতে তিনি শ্রাবস্তীর চারজন ও সাকেতের চারজন মোট আটজন গহপতিকে বিশাখার কাজকর্মের বিচার করবার দায়িত্ব দিলেন।
সৈন্যশ্রেণী চলতে চলতে বলতে লাগল, ‘রান্নার কাঠের কী আকালটাই না হবে ভেবেছিলাম। বর্ষায় সব তো ভিজে স্যাতসেঁতে হবে। কিন্তু যেই প্রথম অভাব দেখা দিল অমনি গহপতি ভেঙে-পড়া হাতিশাল, ভাঙা কাঠের বাড়িগুলো সব জ্বালানির জন্য দিয়ে দিলেন। আর সমস্যা রইল না।’
রক্ষীরা বলল, ‘আমাদেরও তো হয়েছিল, কাঠের অভাব। গহপতির লোকেরা কী করল জানিস? ভাণ্ডার খুলে যেখানে যত স্থূল, রুক্ষ বস্ত্র ছিল, সেগুলো দিয়ে সলতে পাকিয়ে তৈলে ডুবিয়ে জ্বালানির ব্যবস্থা করে দিল।’
রাজভটরা বলল, ‘আমরাই তা হলে সবচেয়ে মহার্ঘ ইন্ধন পেয়েছি। চন্দন কাঠ দিয়ে রান্না হয়েছে আমাদের।’
একটা হাসির রোল উঠল। অনেকেই বলল, ‘চন্ননের গন্ধঅলা শূকর মাংস কেমন লাগল? সাত্ত্বিক আর তামসিকের এমন মিলনকে কী বলা হবে?’ ‘রাজসিক, রাজসিক!’ বহুজনে বলে উঠল।
‘সত্যিই তিন মাস ধরে এমন রাজভোগ জীবনে কখনও কল্পনা করিনি! প্রথম যখন সাকেতে রাজবাহিনীর সঙ্গে যাবার নির্দেশ এলো মনটা দমে গিয়েছিল, বাড়ি ঘর ছেড়ে যেতে হবে। পুত্ত দুটো খুবই ছোট, তাদের মা কি সব দিক দেখতে পারবে? পিতামাতা অথব্ব হয়ে পড়েছেন, তাঁদের সেবাও তো আছে। তা এসে যা খেলাম, আর যা দেখলাম, এখন ভাবছি আগের জম্মে কী সুকম্ম করেছিলাম যে এমন ভাগ্য হল?’
একজন রাজভট বলল, ‘ভেবেছিলাম সাকেত-সাবত্থির পথে তো চোর আর দস্যুদের উপদ্রব লেগেই আছে। না জানি কত চোর দমন করতে হবে। একটু ভয়ই পেয়েছিলাম, সৈন্যবাহিনী দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। তা এখন তো দেখছি নিরীহ কিছু গ্রামবাসীকে লাঠির প্রহার, তর্জন, আর কর্মগোলক ছুঁড়ে মারা ছাড়া আর তেমন কিছু কাজই করতে হল না।’
শ্রাবস্তীর উপকণ্ঠ পার হয়ে গেল। প্রধান তোরণদ্বারের কাছে আসতেই সরসর করে খুলে গেল রথের আচ্ছাদন। মুক্তার ঝালর দেওয়া রজতছত্রের তলায় বিশাখা দাঁড়িয়ে উঠল। শ্রাবস্তীবাসীরা চোখ ভরে, প্রাণ ভরে দেখতে লাগল, এ ওকে বলতে লাগল, ‘এই তা হলে সেই পঞ্চকল্যাণী বিশাখা! কী অপরূপা। এ যে, সাক্ষাৎ শ্রী! এইই মহালতাপসাদন? এই অলংকার প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি বলেই গহপতি ধনঞ্জয় তিন মাস ধরে মিগার সেট্ঠির সমস্ত জ্ঞাতিবগ্গ, মিত্তবগ্গ, রাজা, রাজসেনা, রাজরক্ষী সব্বাইকে রাজভোগ্য সমাদর করে রেখেছিলেন! তা বাপু স্বীকার করতেই হয় অলংকারের মতো অলংকার। অদিট্ঠপূব্ব।’
‘আরে, অলংকার তো অদৃষ্টপূর্ব। কিন্তু বধূটি? এমন বধূ কোথাও কখনও দেখেছ? এ তো দেখছি সাবত্থির অধিষ্ঠাত্রী দেবী এত দিনে সাবত্থিতে এলেন। কোথায় ছিলে মা এত দিন, সন্তানদের ছেড়ে?’ ভাবাবেগরুদ্ধ কণ্ঠে কেউ কেউ এমনও বলতে লাগল।
বধূর আগমন উপলক্ষে ভারে ভারে উপহার এসে পৌঁছতে লাগল মিগারের ঘরে। পুন্নবর্ধনের মাতা বললেন, ‘একেই তো বৈবাহিকের গৃহ থেকে অপরিমিত যৌতুক এসেছে? কোথায় সেসব রাখবো ভেবে পাচ্ছি না। তার ওপর আবার এই! উৎসবটি যে করব, সে অবসরও তো দিল না সাবত্থির জ্ঞাতিবগ্গ, মিত্তবগ্গ। তার ওপর এত লোকজন, দাসদাসী। আমি বাপু এসবের কিছু জানি না।’
বিশাখা বলল, ‘কেন মা! আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ধনপালী, কহ্ন, ময়ূরী যাও তো অন্যান্যদের সাহায্য নিয়ে নতুন গৃহে সমস্ত যৌতুক গুছিয়ে রাখো।’
তারপর বিশাখা উঠে এসে শ্রাবস্তীবাসীদের পাঠানো উপহারগুলি দেখতে লাগল। শাশুড়ি-মাতাকে বলল, ‘আমি এখুনি এগুলির ব্যবস্থা করছি, আপনি ব্যস্ত হবেন না।’ সে একেকটি উপহার তুলে নেয়, মিগারের ঘরের পুরাঙ্গনাদের কাছে উপহারদাতার পরিচয় জেনে নেয় আর মহার্ঘ বস্ত্র, অলংকার, পট, পেটিকা ইত্যাদির একটি তুলে দিয়ে সঙ্গে ছোট ছোট এক একটি পত্র লেখে, ‘আমার মাতাকে প্রণতি জানাই, আমার ভগ্নীকে ভালোবাসা, আমার ভ্রাতাকে সৌভাগেচ্ছা। আমার পিতাকে পরম শ্রদ্ধায়।’ এইভাবে উপহারদ্রব্যগুলি এক এক ঝুড়ি মোদকের সঙ্গে দাসীদের দিয়ে রথে করে সে পাঠিয়ে দিল। বিতরণ করে দিল। যাঁরা পেলেন তাঁরা দু হাত তুলে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। কারণ বিশাখা পুরাঙ্গনাদের কাছ থেকে এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ শুনে নিয়েছিল। কোনও ধনী বাড়ির কন্যা তার পাঠানো গজদন্তের কঙ্কণ হাতে পরে মুগ্ধ হয়ে নিজের হাতটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে—ঠিক এমনই একটি শুভ্র কাঁকন, সোনার সল্পমুখওয়ালা, এমনটাই আমি মনে মনে চাইছিলাম, বধু বিসাখা কী করে জানল?’
আবার কোনও দরিদ্রঘরের বধূ, সোনার লহর কণ্ঠে পরে বারবার ঘটের জলে নিজের রূপ দেখতে থাকল। এমন লহর তার স্বামী তাকে কোনদিনই দিতে পারেনি। বিসাখা তো দেখি আমার নিজের ভগিনীরও বাড়া।
মৃগচর্মের বৃহৎ স্থবিকা হাতে নিয়ে কোনও গহপতির মুখে হাসি ধরে না। সুবন্ন কহাপণগুলি তিনি এতেই রাখবেন।
গেরুয়ার ওপর লোহিত চিত্র করা কাসিক ক্ষৌম বসনটি হাতে তুলে কোনও গৃহের গৃহিণী ভাবলেন, ‘হিমঋতু এলো বলে, এই বসনে শীত কাটবে ভালো।’
আগাগোড়া রুপো দিয়ে নির্মিত হরিণশিশুটি নিয়ে বালক খেলা করতে গেলে, তার মা ভর্ৎসনা করে বলল, ‘এটি খেলার জন্য নয়, দেখছ না, শিঙের শাখাপ্রশাখাগুলি কী সূক্ষ্ম! এটি সাজিয়ে রাখবার জন্য। তুমি বরং এই কন্দুকটি নাও।’
বালক কেঁদে উঠল, ‘এটা তো মাতুলানী বিসাখা আমাকে দিয়েছে, তুমি কেন কেড়ে নেবে? না, আমি কন্দুক নেব না। হরিণ নিয়েই খেলব।’ তার মা কোনক্রমেই রজত মৃগটি বালকের হাত থেকে উদ্ধার করতে না পেরে অবশেষে রাগ করে চলে যায়। বালকটি তার নানাবিধ খেলনার মধ্যে হরিণটিকে সাজিয়ে রাখে, তাকে দৌড় করায়, আবার সাজিয়ে রাখে। অবশেষে বুকের ওপরে নিয়ে ঘুমিয়ে তেলে ভেজানো তূলের মতো হয়ে যায়।
এইভাবে বিশাখা শ্রাবস্তীসুব্ধ জ্ঞাতি এবং মিত্রদের হৃদয় জয় করে নিল। কিন্তু তার শ্বশ্রূ বললেন, ‘এ কী প্রকারের সুহ্না গো! অত মহার্ঘ উপহারগুলি সব বিলিয়ে দিলে! না হয় ঘরে কিছুদিন স্থানের অকুলানই হত, না হয় কিছু দ্রব্য অতিরিক্তই হত? না হয় আমিই যা হোক বুঝে শুনে করতাম, না হয় সবাইকার সঙ্গে পরামর্শ করে এ কাজ আমিই করতাম, না হয়….।’
বিশাখার কানে কথাগুলি এলো। সে ভাবল, ‘এঁদের তো দেখি মতি স্থির নেই। এই বললেন এত বস্তু কোথায় রাখব, ভেবে পাচ্ছি না। মহাবিরক্ত মনে হল! যত শীঘ্র গৃহ অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় বস্তু থেকে মুক্ত হয়ে যায় ততই তো ভালো। সাকেতবাসীদের কাছ থেকে যা যা পেয়েছি সে সবও তো আমি নিজেই ইচ্ছামতো বিতরণই করে দিয়ে এসেছি। মাতা পিতা তো কিছুই বলেননি! সম্ভ্রান্তদের তো এরূপ আচরণই শোভা পায়! দ্রব্যগুলি তো তারা আমাকেই দিয়েছিল। আমার তাদের দিতে ইচ্ছা হল। ধনীর উপহারটি দরিদ্রকে, দরিদ্রের উপহারটি ধনীকে পাঠিয়ে দিলাম। উপহারের বা যে কোনও বস্তুর ব্যাপারে এই প্রকার সুবণ্টনই তো সবচেয়ে ভালো? তা হলে? শ্বশুরগৃহের পুরাঙ্গনা, পুরুষরা তো আমার পিতার কাছ থেকে অপরিমিত উপঢৌকন পেয়েছেন, আমার সঙ্গে যা যৌতুক এসেছে তাতে এঁদের বেশ ক বৎসরের ভোজন হয়ে যাবে। তা হলে? আমি কি ভুল করেছি? না। আমার বুদ্ধিতে যা ঠিক মনে হয় তাই-ই করব। তা ছাড়া শ্বশ্রূমা তো বলেই দিলেন ‘আমি বাপু এ সবের কিছু জানি না।’ তা সে কি তাঁর মনের কথা নয়? তা যদি হয়, বিসাখার সান্নিধ্যে মনের কথা স্পষ্ট করে বলা তাঁকে শিখতে হবে। এখন এটাই তো আমার গৃহ, প্রথম থেকেই এ গৃহে যদি রাজ্ঞীর মতো থাকতে না পারি তা হলে তো দাসীদের নিচে আমার স্থান হবে! মা দেখছি ঠিকই বলেছিলেন। আসবার সময়ে পিতা কয়েকটি উপদেশ দিয়েছেন। সেগুলোর অর্থ আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি। আমাদের গৃহে এরকম রহস্য করে কথা বলার রীতি আছে। শয়নকক্ষে, নিভৃতে মাও অনেক উপদেশ দিয়েছেন। সেগুলির দেখছি আরও গুরুত্ব। মিগারগৃহে পদার্পণ করতে না-করতেই কাজে লাগছে।
১৮
গৃধ্রকূট শিখরে দাঁড়িয়ে চারিদিকে আঙুল দেখিয়ে বিম্বিসার বললেন—এই যে সম্মুখে প্রসারিত বিশাল রাজ্য, এ আমার চণক। আমি বাহুবলে জয় করেছি। যখন জয় করি তখন আমার কতই বা বয়স হবে! জীবক কোমারভচ্চের চেয়েও অল্পবয়স্ক হবো। পশ্চিমে দেখো, শুধু পাহাড়, আর পাহাড়। ওই পাহাড়ের ওপর ছিল পুরনো গিরিব্রজ। দুর্গ নগরী। সেইখান থেকে সুপ্রাচীন কালে শুনেছি বার্হদ্রথ জরাসন্ধ একসময়ে মগধ শাসন করেছেন ক্রূর কঠিন হাতে। তিনি রাজচক্রবর্তী হতে চেয়েছিলেন, সমগ্র দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। শুনেছি, তিনি নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন করছিলেন। ছিয়াশি জন ক্ষত্রিয় রাজন্যকে বন্দি করেছিলেন। তাঁদেরই রুদ্রদেবের কাছে বলি দেবার অভিপ্রায় ছিল। সে সব ছিল অতি বর্বর যুগ। পূর্ব প্রান্তে চেয়ে দেখো, আমার নতুন রাজগৃহ নগর। এ-ও গিরি দিয়ে ঘেরা, কিন্তু পাহাড়ের ওপরে নয়। মাত্র দুটি সংকীর্ণ পথ দিয়ে এ নগরে প্রবেশ করা যায়। সেও আমি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দিয়েছি। পনেরো ক্রোশ বিস্তৃত। দেড় মানুষ সমান উচ্চ এবং প্রায় তিন মানুষ সমান প্রস্থবিশিষ্ট। তলায় পাষাণ। ওপরে ইষ্টক। পনেরো ক্রোশে, পনেরোটি অট্টালক আছে। তুমি দেখেছ সন্ধ্যায় নগরতেরণ বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি প্রবেশ করতে চাইলেও পারব না। এই নগরী আমার প্রাণ। প্রথমে নাম ছিল কুশাগ্রপুর। তখন বজ্জিদের গণরাজ্য আর কোশলের মধ্যে বহু ছোট ছোট পার্বত্য অঞ্চল ছিল। এক একটি অঞ্চলে এক একজন ভূস্বামী প্রখর হয়ে উঠতেন, অন্যদের বশে আনতেন। আমার পিতা এইভাবেই কয়েকটি পার্বত্য অঞ্চলের স্বামী হয়ে উঠলেন, তিনিই আমাকে প্রথম স্বপ্ন দেখান। কুশাগ্রপুর আগুন লেগে পুড়ে গেল। তখন সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর আমি নতুন নগর গড়ে তুললাম। স্থপতি মহাগোবিন্দ এই নগর আর রাজপ্রাসাদের পরিকল্পনা করলেন। আর শুধু কাঠ নয়, ভিত্তিতে পাষাণ, তার ওপর ইষ্টক গেঁথে প্রস্তুত হয়েছে ওই প্রাসাদ, এবং নগরীর অধিকাংশ হর্ম্য। ভেতরে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। তুমি দেখেছ কত উদ্যান, কত সুশোভন হর্ম্য, কত সরোবর দিয়ে সাজিয়েছি আমি এ নগর। আছে বেণুবন, আছে সিতবন, লঠ্ঠিবন, আছে বিশাল আম্রবন বেশ কতকগুলি, যার মধ্যে সুন্দরতমটি আমি আয়ুষ্মান জীবককে দিয়েছি। বেণুবন দিয়েছি তথাগত বুদ্ধকে।
অঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্তর সঙ্গে পিতার শত্রুতা ছিল। অঙ্গ তখন সমৃদ্ধিশালী রাজ্য, পাশেই এই পার্বত্য অঞ্চলে গোষ্ঠীপতিদের শক্তিশালী হয়ে ওঠা তাঁর মনঃপূত হয়নি। তিনি সৈন্যদল পাঠিয়ে আমার পিতাকে প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করেন, তখন তিনি আমায় সিংহাসনে অভিষিক্ত করলেন বিধিমতো। বললেন, সেনিয় তুমি আর গোষ্ঠীপতি নও, তুমি স্বাধীন রাজা। যাও নিজের রাজ্যসীমা বাড়াও। পিতার স্বপ্ন সফল করতে আমার তরুণ দেহের সমস্ত শক্তি, উৎসাহ, তরুণ মনের সমস্ত বুদ্ধি নিয়ে ব্রহ্মদত্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যুদ্ধ চলেছে। অবশেষে কেউ যা কল্পনাও করতে পারেনি তাই ঘটল। অঙ্গরাজ্যের পতন হল, বিম্বিসার নিজেকে অঙ্গ, মগধের রাজা ঘোষণা করল। তারপর কোশলরাজ মহাকোশল আমাকে জামাতা করলেন, বজ্জিদের সঙ্গে বিবাদ হল, তাতেও জয়ী হলাম, তারাও আমাকে কন্যাদান করল, তারপর যে উদীচী আমার এই ভূমিকে একদিন কীকট দেশ বলে ব্যঙ্গ করেছে, ব্রাত্য বলে বিদ্রুপ করেছে, সেই উদীচী থেকে মদ্ররাজকন্যা মহিষী হয়ে এলেন আমার ঘরে।
‘চণক, এখন আমার রাজ্য তিন শত যোজন বিস্তৃত। আশি সহস্র গ্রাম আছে এ রাজ্যে, আছেন বহু পণ্ডিত, বিদ্বান, তপস্বী, শ্রমণ—এঁদের মধ্যে বেশির ভাগই শ্রমণপন্থের। বেদপন্থী নন। তবে কিছু কিছু বৈদিক ব্রাহ্মণও আছেন, তাঁদেরও আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। উত্তরে কোশল, বৈশালী, পশ্চিমে কৌশাম্বী, অবন্তী আমার বন্ধু-রাজ্য। এঁদের কয়েকজনের সঙ্গেই আমার বৈবাহিক সম্পর্ক। প্রজারঞ্জক বলে আমার সুযশ হয়েছে। মহামাত্র, রাজন্য উপরাজ ও গ্রামণীদের সাহায্যে শাসনকার্যের একটা সুব্যবস্থা করে ফেলতে পেরেছি। এই উত্তরাখণ্ডে আমিই প্রথম যার চতুরঙ্গিণী সেনা আছে, যুদ্ধবিগ্রহের জন্য সবসময়ে প্রস্তুত। কোশলরাজ প্রসেনজিৎ আমার পরামর্শেই বেতনভোগী সৈন্যবাহিনী পোষণ করতে আরম্ভ করেন। এখন তুমি বলো আমি কীভাবে আচার্যের আদেশ পালন করব। পালন করবার কোনও উপায় যদি বারও হয় তা হলেও কি শুধুমাত্র আচার্যের আদেশ বলেই তা অন্ধের মতো পালন করব? না, তার সত্যিই কোনও গভীর প্রয়োজন আছে?’
চণক বলল, ‘মহারাজ তাঁর পূর্বে আপনি আমাকে বলুন আমার সঙ্গে আপনার প্রথম আলাপের সময়ে আচার্যের আশীর্বাদের কথা স্মরণ করে আপনি অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছিলেন কেন?’
বিম্বিসার বললেন, ‘চণক, চক্রবর্তী ত্রিবিধ—চক্রবাল-চক্রবর্তী, দ্বীপ-চক্রবর্তী এবং প্রদেশ-চক্রবর্তী। চক্রবর্তী-রাজার যে সপ্তরত্ন থাকে তার একটি অর্থাৎ চক্র বাদে অন্য সবগুলি অর্থাৎ হস্তী, অশ্ব, মণি, স্ত্রী, গৃহপতি ও পরিনায়ক এ সকলই আমার আছে। আমি তো প্রদেশ-চক্রবর্তী হয়েছিই। শুধু শাস্ত্র বর্ণিত চক্রের সন্ধান এখনও পাইনি। অলৌকিক ঋদ্ধিসম্পন্ন না হলে চক্রের মতো একটি শস্ত্র কীভাবে আমার পুরোভাগে যেতে পারে তাও আমি বুঝতে পারি না বন্ধু। বোঝবার চেষ্টা করি। অন্য অনেকের মতো চক্র ধারণ করে হাস্যাস্পদ হই না। তুমি যখন বললে আচার্যের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হবে, আমি উল্লসিত হলাম, কারণ তিনি তো দেখে যাননি অঙ্গ আমার পদানত হয়েছে, দেখে যাননি এতগুলি রাজ্যের সঙ্গে আমার কূটনৈতিক সম্পর্ক হয়েছে। আমি তো অন্তত প্রদেশ-চক্রবর্তী হয়েছি।’
চণক বলল, ‘না মহারাজ, আমি যখন আপনাকে পূর্বে দক্ষিণে রাজ্যসীমা বাড়াবার ইঙ্গিত দিই তখন আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি কী করে আপনার মনের কথা জানলাম। কী পরিকল্পনার কথা ভেবে আপনি এ কথা বললেন, জানতে আগ্রহ হচ্ছে।’
‘চণক, তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ, দক্ষিণ পূর্বে কী বিশাল বন! দক্ষিণের বন ক্রমে বিন্ধ্যারণ্যের সঙ্গে মিশেছে, পূর্বে কজঙ্গল। অঙ্গ অবধি আমার করায়ত্ত। এখন এই কজঙ্গলের বিশাল বন যদি কেটে কেটে আমি প্রজা বসাই। কে আমাকে নিষেধ করবে?’
‘বন্যরা আছে, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করবে তাদের দুর্গ রক্ষা করতে।’
‘বন্যদের আমি ধর্তব্যের মধ্যে আনি না। তারা কী করবে আমার চতুরঙ্গিণী সেনার সামনে?’
‘মহারাজ কিছুদিন আগে যুদ্ধ উপলক্ষে নরমেধের সম্ভাবনায় শিহরিত হচ্ছিলেন, বন্যরা তা হলে মানুষ নয়? তাদের বধ করতে হলে, মহারাজের বিবেক-বুদ্ধি পীড়িত হবে না?’
‘বন্যরা মানুষ? অবশ্যই হাত পা কান নাক চোখ সবই আছে মানুষের মতো। তারা ইচ্ছামতো মানুষ বধ করে। নরমাংসও খায় শুনেছি।’
‘কে বলতে পারে মহারাজ, আমরাও একদিন অমনি বন্য ছিলাম না? শুনঃশেফকে তো যূপের সঙ্গে বাঁধা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল, তার পিতা অজীগর্ত স্বয়ং তাকে বধ করতে রাজি হয়েছিলেন। রাজা জরাসন্ধের কথাও স্মরণ করুন! সভ্য মানুষ যারা প্রাসাদে, কি কুটিরে বাস করে, ক্ষেত্র কর্ষণ করে, পশুপালন করে খাদ্য সংগ্রহ করে, মন্ত্রী, অমাত্য, পারিষদবর্গ নিয়ে রাজ্য চালনা করে সুষ্ঠুভাবে তারাই যদি নরমেধে উদ্যত হতে পারে, তা হলে যারা বনে বাস করে, আর্যমানুষের কোনও সুবিধাই পায় না, তারা নরমেধ করবে—এতে আশ্চর্যের কী আছে? তাতে তাদের মানুষ নাম থেকেই বা বঞ্চিত করা হবে কেন?’
বিম্বিসার অবাক হয়ে চণকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজ একটা নূতন কথা শোনালে আচার্যপুত্র, বন্যরা মানুষ! যারা যক্ষ, রাক্ষস, তারা? তাদেরও তো হাত-পা ইত্যাদি, সমস্ত মনুষ্যলক্ষণই আছে!’
চণক বলল, ‘এরা, এই বন্যরা যখন ধরা পড়ে, বন্দি হয়ে সভ্য রাজ্যের সীমার মধ্যে আনীত হয়, তখন এদের নিয়ে কী করা হয় মহারাজ?’
‘অতিরিক্ত হিংস্র হলে বধ করা হয়। নইলে ধীরে ধীরে বাধ্য বশংবদ হলে কাজে লাগানো হয়। দাস হয়ে কাজ করে।’
‘আপনার যেসব অ-বন্য দাস আছে তাদের থেকে এই একদা বন্য দাসেদের কাজকর্মের ক্ষমতা বা দক্ষতা বা প্রকৃতি কি অন্য প্রকার?’
‘না তো চণক! অনেক বন্যই দাস হয়ে যোগ দিয়ে পরে খুবই কুশলী ধনুর্গ্রহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার সেনাদলে এরূপ অনেক আছে।’
‘তা হলে! ওই সব অরণ্য তো আপনারও নয় মহারাজ আমারও নয়। যারা দীর্ঘকাল সেখানে বাস করছে তাদেরই। মাতা বসুমতী কারও ক্রীতদাসী নন, তিনি জননী, যেখানে তাঁর যে সন্তান উৎপন্ন হয়েছে তাকে তিনি সেখানেই লালন করছেন।’
‘চণক, তোমার যুক্তি মানলে তো কজঙ্গলের দিকে রাজ্যসীমা বাড়ানোও আমার অনুচিত।’
‘মহারাজ আপনি যুদ্ধ করে জম্বুদ্বীপ জয় করবার সম্ভাবনায় নরমেধ হবে মনে করে অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন, তাই এ সব কথা বললাম। অরণ্য কেটে বসতি করতে গেলে বন্যরা ক্রমশই দূরে আরও দূরে সরে যাবে। সহসা প্রতিরোধ করতে সাহসী হবে না। আমরা যেমন তাদের ঘৃণা করি, ভয় করি, তারাও তেমন আমাদের ঘৃণা করে, ভয় করে।’
‘তা হলে? কী তুমি বলতে চাইছ আচার্যপুত্র?’
‘মহারাজ, প্রথম যখন মগধ অভিমুখে যাত্রা করি, আমার শুধু পিতার মগধ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীই স্মরণে ছিল। বিম্বিসার রাজ-চক্রবর্তী হবে। মগধ আদর্শ চক্রবর্তী-ক্ষেত্র। তখন সত্যি বলতে কি আমার কল্পনায় যুদ্ধই ছিল মুখ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সংশয়ও যে ছিল না এমন নয়। প্রতিদিন যা যা দেখেছি, যে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে প্রতিদিন পাল্টে গেছে চিন্তার ধারা।’
চণক থামল। গিজ্ঝকুট শিরে আবারও অস্তাচলের সেই প্রদীপ্ত মায়া-মুহূর্ত। সেই দিকে তাকিয়ে বিম্বিসার বললেন, ‘বলো, তোমার চিন্তার কথা।’
চণক বলতে লাগল, ‘চিন্তারও আগে কী দেখলাম শুনুন মহারাজ। গ্রামের পর গ্রাম, নগরের পর নগর, জনপদের পর জনপদ, নদীর পর নদী, বনের পরে বন—এই হল বসুন্ধরা। এর ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে জীবনস্রোত। দেখলাম সহজ সাধারণ কর্ষক, পাটনি, কর্মার, সূত্রধর, নলকার, ঘটিকার, তন্তুবায় সব যেযার ছোট্ট সীমার মধ্যে আপন কর্মে আপন সুখ-দুঃখে মগ্ন। তারা জানেও না রাজা, রাজধানী কী প্রকার, শত্রু বলতে কী বোঝায়, কেই বা শত্ৰু, কেই বা মিত্র! আরও দেখলাম, বড় বড় সার্থ নিয়ে চলেছে দেশ থেকে দেশান্তরে সার্থবাহ। বহু শকটে পণ্য। এক স্থান থেকে পণ্য সংগ্রহ করে, আরেক স্থানে দ্বিগুণ, ত্রিগুণ মূল্যে বিক্রয় করে, কখনও কখনও এরা কেনা-বেচার জন্য দীর্ঘদিন এক স্থানে বসে যায়, কিছুদিনের মতো একটি গ্রাম সৃষ্টি হয়ে যায় তাতে। তারপর ঘরে ফেরে—কোষাগার পূর্ণ হয়, বিলাস উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ধনরক্ষা করতে আরও দাস-দাসী, আরও কর্মকর, আরও লেখক গণক, আরও পত্নী, পুত্র প্রয়োজন হয়। মাঝে মাঝে এরা সাড়ম্বরে দান করে। ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের, শ্রমণদের, কদাচ দরিদ্রদের, কিন্তু সর্বক্ষণ বাড়িয়ে চলে নিজের সম্পদ, নিজের প্রয়োজন এবং পরিজন। ক্ষমতা, সত্যিকার ক্ষমতা এদের হাতেই আছে, শুধু অস্ত্র নেই। তাই ক্ষত্রিয় রাজাদের এরা একটা সম্ভম ও আনুগত্য দেখায়, ব্রাহ্মণদেরও ভক্তিশ্রদ্ধা দেখায়। কিন্তু সবটাই নীতি। তারা এই পথ বেছে নিয়েছে সমাজের শিখরে ওঠার জন্য। আরও দেখলাম আছে চোর, দস্যু, এরা উত্তরের বাণিজ্যপথের নানান স্থানে দল বেঁধে অবস্থান করে, সার্থর পণ্য, বা অর্থ কেড়ে নেওয়াই এদের জীবিকা। এরা মনুষ্য সমাজের বাইরে। দেখলাম হীনজাতিসম্ভূত আরও অনেক প্রকার কর্মকরদের, তারা সমাজের প্রান্তে বাস করে—আর দেখলাম যত্রতত্র সংসারবৈরাগী শ্ৰমণ, সন্ন্যাসী। এত সংখ্যাধিক্য এঁদের যে, মানুষের প্রায় দুটি বিভাগ করলেই চলে—সংসারী ও সংসারবিরাগী। এই সুপ্রচুর সংখ্যায় বৈরাগী—ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে—এও এক অদ্ভুত ব্যাপার!
বিম্বিসার বললেন, ‘বন্য? বন্যদের দেখেছ?’
‘দেখেছি মহারাজ, তাদের অত্যন্ত কাছাকাছি বাস করেছি। জেনেছি তারা মানুষই। অপ্রাকৃত প্রাণী নয়।’
‘আর কি দেখলে? বলো চণক।’
‘আর দেখলাম সহসা এই গ্রাম, নগর, জনপদ, নদ-নদী, পাহাড়, পথ, যেখানে যা আছে, যে আছে সমস্ত ওই পশ্চিমাকাশের মতো লাল হয়ে উঠল। প্রথমে শুধু এক খণ্ড রক্তবর্ণের মেঘ। বাকি আকাশ নীল। তারপর সেই লোহিত বর্ণ সারা আকাশময় ছুটোছুটি করতে শুরু করল মহারাজ। বর্শা, তীর, ভল্ল, গদা, চক্র, পাশ, তরোয়াল, পরিঘ ঘুরছে, সহস্র সহস্র অশ্বারোহী সেনা বিশাল এক লৌহিত্য নদে পরিণত করে দিচ্ছে সব। কিন্তু এই কর্মার, তন্তুবায়, কৰ্ষক, এই সার্থ, লেখক গণক, এই শ্রমণ তীর্থিক, সন্ন্যাসী, এই চণ্ডাল, নিষাদ আর সবার ওপরে এদের রক্ষক, শাসক, রাজারা যে যার সংকীর্ণ সীমা, সংকীর্ণ লক্ষ্য নিয়ে এমন মুগ্ধ, সম্মোহিত হয়ে আছেন যে, কেউ নিজের গণ্ডি থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছেন না, পরস্পরের হাত ধরতে পারছেন না। এমন কোনও ক্ষমতা নেই যে, ভেরী-ঘোষণা করে সবাইকে নিজের ছত্রতলে সমবেত করেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছে সবাই, সর্বশ্রেণীর মানুষ। আবার মার খেতে খেতে একে অপরকেও মেরে ফেলছে, আর মানুষের রক্তে, এতদিনের সঞ্চিত বিদ্যার রক্তে, নিহত কৃতির রক্তে ক্রমেই লোহিত আরও লোহিত হয়ে উঠছে এই বসুন্ধরা। আদীপ্ত জম্বুদ্বীপ, হুতাশনে জ্বলছে, তার সমস্ত সম্পদ নিয়ে জ্বলছে। মহারাজ ওই দেখুন জম্বুদ্বীপের সূর্য অস্ত গেল।
মুহূর্তে আবছা, ঈষৎ রক্তাভ ছায়া নেমে এলো গিরিশিরে, প্রসারিত সুন্দরী নগরীর দেহের ওপর, গিরিশিরে উপবিষ্ট দুটি মানুষের ওপর।
বিম্বিসার অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, ‘তারপর?’
চণক বলল, ‘তারও পর? তারও পর থাকে! যদি থাকে মহারাজ, তা হলে তা এই অন্ধকার। এই ছায়াময় ভবিষ্যৎ। ক্রমে নীরন্ধ্র রাত্রি, এবং শ্মশাননৈঃশব্দ্য। আর কিছু নেই।’
অনেকক্ষণ দু’জনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। ক্রমে সন্ধ্যা গাঢ় হল। নিচে নগরীতে দীপালোক দেখা যেতে লাগল বিন্দু বিন্দু। আগ্রাসী অন্ধকারের মধ্যে আলোকবিন্দুগুলি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। শেষ পাখির দল আশপাশ দিয়ে পক্ষবাতে দু’জনকে ব্যতিব্যস্ত করতে করতে উড়ে চলে গেল। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল এতক্ষণ, এখন হাওয়ার বেগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। আকাশময় তারার প্রলাপ। চাঁদ উঠবে বিলম্বে। তাও কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়া চাদ। সে শুধু অন্ধকারকে আরও তীব্র করে তুলবে। অন্ধকার তখন যেন এক ভীষণ কালপুরুষের হাতে ভীষণতর নারাচ। রাত্রির আকাশে পৃথিবী ধ্বংস করার জন্য উদ্যত হয়ে রয়েছে।
চণক মৃদুস্বরে বলল, ‘আপনার সাম্রাজ্যলিপ্সা না থাকতে পারে, আপনি তথাগত বুদ্ধর উপাসক হয়েছেন বলে অহিংসক হতে পারেন, কিন্তু সকলেই তো একরূপ হতে পারে না! পারস্যরাজ কুরুস তো কখনই আপনার মতো শান্তিকামী নন। প্রথম রাজা, পৃথিবীর আদি রাজা সৃষ্টি হয়েছিলেন। সবাইকার সম্মতিক্রমে। তাই তাঁর নাম বা উপাধি মহাসম্মত। এ শুধু একটা ব্যবস্থা। ধনজনপূর্ণ জনপদবাসী অনুভব করেছিল, তাদের উৎপাদনকর্মে ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই লুণ্ঠনকারীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য, সমাজে স্থিতিরক্ষার জন্য একজন যোগ্য মানুষ প্রয়োজন। এই মহাসম্মত ছিলেন তাঁর প্রজাদের নিযুক্ত কর্মকর, তিনি সেটা জানতেন। কিন্তু কালক্রমে রাজারা এসব ভুলে গেলেন। বাহুবল, অস্ত্রবল, আজ্ঞাবল এই তিন প্রকার বলে বলীয়ান হয়ে তাঁরা প্রজাদের মনে করতে লাগলেন তাঁদের ভৃত্য, পৃথিবীকে মনে করতে লাগলেন তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এখন এই প্রমাদ পৃথিবীময় ছড়িয়ে গেছে, দূর করবে কে? কিন্তু এই প্রমাদের বলি কেন আমরা হবো? অথচ এইভাবে বিচ্ছিন্ন, স্ব-স্ব গণ্ডির মধ্যে কূপমণ্ডূক হয়ে থাকলে বলিই আমাদের হতে হবে। ভাবুন, মহারাজ ভাবুন। কীভাবে জম্বুদ্বীপকে একত্র করা যায়!’
দু’জনেই উঠে দাঁড়ালেন। এবার নামতে হবে। নামতে নামতে এক পাক দূরে শিলাতলে অস্সজিকে আজও ধ্যানমগ্ন দেখতে পেলেন দু’জনে। কদিনই দেখা যাচ্ছে। বিম্বিসার সসম্ভ্রমে বললেন, ‘ভিক্ষু অস্সজি শীঘ্রই অর্হত্ত্ব লাভ করবেন। এবারের বর্ষাবাস তথাগত করছেন বেলুবনে। এক সারিপুত্ত ও মোগ্গল্লান ছাড়া প্রধান ভিক্ষুদের প্রায় সকলেই তাঁর কাছাকাছি রয়েছেন। কিন্তু তথাগতর নির্দেশ আছে যে, কোনও ভিক্ষু নির্জনবাস করবার জন্য ইচ্ছা হলে অন্যত্র, বনে, পাহাড়ে, গ্রাম-প্রান্তে থাকতে পারেন। ভিক্ষু অস্সজি দেখছি বেশ কিছুদিন ধরে গিজ্ঝকুটকেই তাঁর সাধনক্ষেত্র স্থির করেছেন। সদ্ধর্মে এনেছেনও ইনি অনেক জনকে।’ সাবধানে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলেন দু’জনে। মহারাজ যে অত্যন্ত চিন্তাক্লিষ্ট সেটা তাঁকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি চণকের কথা ভাবছেন, না অস্সজির অর্হত্ত্ব লাভের কথা ভাবছেন, চণক বুঝতে পারল না।
ঘোড়ার পিঠে চড়ে দুই আরোহী। পাশাপাশি চলেছেন মন্দ্র তালে। বিম্বিসার সহসা বললেন, ‘তা হলে আমাদের জানতে হয়।’
‘কী জানতে হবে মহারাজ? ক্লান্ত স্বরে চণক বলল।
‘জানতে হবে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।’
চণক মুখ ফিরিয়ে তাকাল, বলল, ‘মহারাজ, এতক্ষণে আমার যুক্তিপথ অনুসরণ করছেন।’
‘এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা তো রাজার নিজের পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘তা তো নয়ই।’
‘চরেরা কিন্তু এই সংযোগ স্থাপন করে।’
‘উদ্দেশ্য অন্য, তারা শুধু রাজস্বার্থ দেখে।’
‘অথচ যোগাযোগের জন্য বিশিষ্ট মানুষ প্রয়োজন।’
‘আমি সেই বিশেষ কাজের কথাই বলছিলাম মহারাজ’, চণক বলল, ‘আমি এই দেশ ঘুরে ঘুরে দেখব, যাবো প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যাবো বন্যদের কাছেও, যারা আর্যাবাক্ বলে না।’
‘তুমি আজ যা শোনালে চণক, তাতে মনে হচ্ছে, তোমাকে যেতে হবে মধ্যদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও, এমন কি উত্তরেও, কারণ তাঁরাও তো এভাবে ভাবেন না। এই দেখো না, অবন্তীরাজই তো গান্ধারের সঙ্গে বিবাদ লাগিয়ে বসে রয়েছেন।’
‘মহারাজ আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু উদীচীকে আমি ভালো করে জানি বলেই প্রথমে তাদের কাছে যাবার চিন্তা করিনি। যারা সাধারণ, ধরুন একপ্রকার মুর্খই, যারা এখনও আমাদের কেউ নয়, তাদের কাছেই যাবার কথা, তাদেরই বোঝাবার কথা ভাবি।’
‘কিন্তু চণক কী দিয়ে তাদের বোঝাবে? কোনও একটা সূত্র তো চাই! ভাষা, বর্ণ, অভ্যাস, ধর্ম…’
চণক বলল, ‘আমি চেষ্টা করছি সেই সূত্রটি আবিষ্কার করবার। যতক্ষণ না এদের সঙ্গে মিশছি, যতক্ষণ না দেখছি সেসব প্রত্যন্ত অঞ্চল, ততক্ষণ তো সে সূত্র বার করতে পারব না। তত্ত্বচিন্তা করে তো কোনও লাভ নেই!’
বিম্বিসার বললেন, ‘তুমি তা হলে আর বিলম্ব করতে চাইছ না চণক!’
‘না মহারাজ।’
‘ভালো। ইতিমধ্যে আমি রাজনীতির এই নতুন দিকটির সম্পর্কে আমার মিত্ররাজাদের সঙ্গে কথা বলি!’
‘বলবেন? এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। মহারাজ, হঠাৎ একটা পরিকল্পনা আমার মাথায় আসছে। আপনি একটি রাজসংঘ গঠন করার চেষ্টা করুন না কেন! বহু রাজার সম্মিলিত সংঘ, তাঁদের মধ্যে একজনকে সবাই নেতা বলে মেনে নেবেন, বিশেষত বিপদের সময়ে।’
‘অস্পষ্টভাবে এই রকম কিছুই একটা আমার মস্তিষ্কের মধ্যে ঘুরছিল, বন্ধু। অতি অস্পষ্ট…’
‘আমার প্রসঙ্গ এবং নাম উহ্য রাখবেন মহারাজ।’
‘কেন?’
‘রাজারা সর্বদাই সন্দেহপরায়ণ। কে এক উত্তরদেশীয় ব্রাহ্মণযুবক আপনাকে কী বলেছে, সেইজন্যই আপনি এ চেষ্টা করছেন, জানলে এঁদের হয় মনে গুরুতর সংশয় হবে, নয় এঁরা গুরুত্ব দেবেন না চিন্তাটিকে। উত্তরের সঙ্গে মধ্যদেশের বিশেষত প্রাচী-ঘেষা মধ্যদেশের এক অলিখিত তিক্ত সম্পর্ক আছে সে কথা তো আপনি জানেন।’
‘সেটা আমরা ওঁদের মতো আচারপরায়ণ নই বলে, বৈদিক ধর্মের চেয়ে শ্ৰমণ পন্থগুলিকে গুরুত্ব দিই বলে। কোনও রাজনীতিক কারণে কিন্তু নয়। রাজাদের সবাইকার স্বার্থরক্ষার ওপর যদি ঝোঁক দিই, তা হলে হয়ত শুভ ফল হতে পারে।’
চণক কিছু বলল না। রাজার স্বার্থ রক্ষার ওপর ভিত্তি করে যদি রাজসংঘ হয়, তা কি প্রজাবর্গের আন্তরিক অনুমোদন পাবে! রাজা ক’জন রাজপুরুষই বা ক’জন! বেশির ভাগই তো প্রজা, সাধারণ বর্গ, ইতর জন। তাদের হৃদয় জয় করতে না পারলে..কিন্তু নিজের দ্বিধা চণক প্রকাশ করল না। হতে পারে রাজাদের সংঘভুক্ত করবার প্রয়াস যদি মহারাজ বিম্বিসারের দিক থেকে হতে থাকে, এবং তলার দিক থেকে একই সঙ্গে চলতে থাকে তার প্রয়াস, হয়ত কিছু ফললাভ হবে।
এখন তারা বিস্তৃত রাজমার্গে প্রবেশ করেছে। পরিচ্ছন্ন পথ, মাঝে মাঝে দীপস্তম্ভ। সুন্দর বেশে, প্রসাধিত নরনারী চলাচল করছে। পুরুষের তুলনায় রমণী কিছু অল্প। যারা বেরিয়েছে তাদের মধ্যে অধিকাংশই দাসী জাতীয়। কিন্তু তাদের মধ্যেও অনেকেই বিলক্ষণ সুবেশী, যথেষ্ট সুশ্রী। শিবিকা চলে গেল দু-একটা। একটি চার ঘোড়ার রথ। এটি রাজগৃহ-শ্ৰেষ্ঠীর, কদিনে চেনা হয়ে গেছে চণকের। এই দৃশ্যটির দিকে তাকালে হঠাৎ মনে হয় এমন শান্তি, এমন রম্যতা, এত সুখ আর কোথায় পাওয়া যাবে? চিন্তার কী-ই বা আছে? অনর্থক অশুভ-চিন্তায় কালক্ষেপ করে কাজ কী? তার চেয়ে চলে গেলেই হয় কোনও উচ্চশ্রেণীর পানাগারে। সুসজ্জিত, সদালাপী সম্ভ্রান্তবংশীয় কিছু পানরসিক যুবকের সঙ্গে পানপাত্র হাতে বসে গেলেই হয়। পানাগারিকদের সুন্দরী কন্যা হয়ত পানীয় পরিবেশন করবে স্ফটিকের পাত্রে, সেই সঙ্গে ঢেলে দেবে লাস্য। মাধ্বীর মৃদু উত্তেজনা শিরায় শিরায় বইবে, নানা গম্ভীর এবং তরল বিষয়ে আলোচনা হতে থাকবে, বাদ-প্রতিবাদ, তর্কাতর্কি এসবও হতে পারে। কিংবা যাওয়া যেতে পারে শ্রীমতীর গৃহে! সেখানে যদি নিরবচ্ছিন্ন কয়েক দণ্ড বীণা শোনা যায়, শোনা যায় শ্রীমতীর গান। কিংবা তার সেই কৃষ্ণকায় মৃদঙ্গবাদকটির অদ্ভুত বাদন। শ্ৰীমতী নাচে, কিন্তু মৃদঙ্গবাদকের হাত এবং আঙুলগুলি? তারাও অদ্ভুত ছন্দোময় হয়ে ওঠে। মুখ নিচু করে বাজায় মানুষটি। কিন্তু তার চারদিকে কয়েকটি অদৃশ্য নৃত্যপর আকৃতি আছে মনে হয়। তারা মৃদঙ্গের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কখনও সমবেতভাবে নত হয়ে মাটিতে পা ঠোকে, কখনও চক্রাকারে ঘুরে যায়, কখনও ঊর্ধ্বে নিজেদের উৎক্ষিপ্ত করে। একদিন তার এই অদ্ভুত মনে হওয়ার কথা বোধিকুমারকে বলেছিল চণক।
‘ভদ্র দেখেছেন, এর বাদনের ফলে চারপাশে একটা অদৃশ্য নৃত্য হতে থাকে!’
বোধিকুমার বলে, ‘সুনক্ষত্র তো শাপভ্রষ্ট গন্ধর্ব! ও তেমনভাবে বাজালেই অপ্সরারা নেমে এসে নৃত্য করতে থাকে। তাই-ই এ প্রকার অনুভব হয়।’
চণক অবাক হয়ে বলে, ‘অপ্সরা? গন্ধর্ব? আপনি কি কাব্যরচনা করছেন, না সত্য বলছেন!’
‘সত্যই বলছি’ বোধিকুমার বলে। ‘বাঃ চণকভদ্র আপনি তো অদ্ভুত! কাব্য রচনা করলে এভাবে করব?’
‘কী জানি!’ চণক মৃদু হেসে বলে, ‘কবিরা কখন কল্পলোকের কথা বলছেন, কখন এই মরলোকের কথা বলছেন, বোঝা তো না যাওয়াই সম্ভব!’
বোধিকুমার যেন একটু আহত, ‘কেন, চণকভদ্র, আপনি গন্ধর্বলোক আছে এ কথা মানেন না? স্বর্বেশ্যারা তাদের বাদনের সঙ্গে নাচে এ কথা শোনেননি!’
‘শুনেছি মাঝে মাঝে, ভেবেছি কবি কল্পনা।’ চণক স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মনে হয় সুনক্ষত্র এতই সিদ্ধবাদক যে, তার হাত থেকে উত্থিত শব্দগুলি, নানা জটিল ভঙ্গে-বিভঙ্গে বার হতে থাকে। শব্দপাত নয় তাই, শব্দনাচ। এই শব্দ-নৃত্য একটি ছন্দ ও সুরের নিরবচ্ছিন্ন পশ্চাৎপট নির্মাণ করে দেয়, শ্রীমতীর গান ও নাচ তারই সঙ্গে অতি নিপুণভাবে তাল মেলানো, সুর মেলানো। তাকে অতিরিক্ত কিছু করতে হয় না। সে ওই তালে তাল মিলিয়ে একটি দুটি চরণক্ষেপ করে। নূপুর বেজে ওঠে মৃদু গুঞ্জনে। একটি দুটি মুদ্রা, শব্দ মুদ্রাকে যেন রূপ দেয়। সুনক্ষত্রর মৃদঙ্গবাদনের এই গূঢ় রহস্যের কথা নিশ্চয় জানা আছে শ্রীমতীর। বোধিকুমার ছন্দ ও বাকের চর্চা করলেও তাঁর কাছে, যে কোনও করণেই হোক, এ রহস্য ধরা পড়েনি।
বিম্বিসার বললেন, ‘চণক, কী ভাবছ?’
চণক বলল, ‘সঙ্গীত এবং নৃত্য। এবং সুর এবং ছন্দ।’
বিম্বিসার স্থানকাল ভুলে অট্টহাস্য করে উঠলেন। বললেন ‘যাক, আমার একটা মহাচিন্তা দূর হল।’
‘কী চিন্তা মহারাজ?’ চণক হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি ভাবতাম দেবরাতপুত্র দণ্ডনীতি, রাজকর্তব্য, সসাগরা বসুন্ধরার আরক্ষা, এ ছাড়া আর কোনও বিষয়েই আগ্রহী নয়। মনে মনে আলোচনা করতাম, কীভাবে এই সন্ন্যাসীসুলভ একমুখীনতা, এই বহু বিলম্বিত ব্রহ্মচর্যা ভঙ্গ করা যায়। চণক, কে বলতে পারে হয়ত পরের জন্মে আর এমন সুগঠন, এমন নির্ব্যাধি দেহ, এমন সুসংস্কৃত মন, এমন উচ্চবংশে জন্ম, পৃথিবীকে ভোগ করবার এমন সব সুযোগ আর পাব কি না! হয়ত যে মগধে আজ রাজা হয়ে জন্মেছি, কাল সেই মগধেই পথদস্যু হয়ে জন্মালাম! চণক, তখন হয়ত তুমি আমার মাতৃস্বসাপুত্র আর এক তস্কর। একই সঙ্গে রক্তকরবীর মালা পরে বধ্যভূমিতে যাচ্ছি।…’ বলতে বলতে বিম্বিসার আবার হা-হা করে হেসে উঠলেন।
চণক বলল, ‘তা হলে বলুন, নিজেকে পাপী বলে চিনতে পেরেছেন মহারাজ, পাপী না হলে এমন জন্ম হবে কেন?’
‘আমি তো আর দেব তথাগতর মতো বর্ষাবাস করি না। কত কীটানুকীট প্রতিক্ষণে পদদলিত, অশ্বক্ষুরদলিত করছি, জল পান করছি না ছেঁকে, তাতেও চলে যাচ্ছে কত লক্ষ কীট এই উদরগহ্বরে, তারপরে দেখো, তুমিই উল্লেখ করলে কত শত অপরাধীর প্রাণদণ্ড দিচ্ছি। সেগুলিও তো আমাতেই বর্তাচ্ছে। সুতরাং পাপকে এড়ানোর কোনও উপায়ই আমি দেখতে পাচ্ছি না, বন্ধু। পরজন্ম সম্পর্কে কোনও নিশ্চয়তা নেই।’ বিম্বিসার আবার হাসতে লাগলেন।
চণক মনে মনে আনন্দিত হল। মহারাজের মনের মধ্যে এতদিন বর্ষা থমথম করছিল। গর্জায় না, বর্ষায় না। খালি কালো কালো মেঘে আড়াল থাকে আকাশ-নীল, আটক থাকে বাতাসের স্বচ্ছন্দ সাবলীল বিচরণ।
সে প্রসন্ন মুখে বলল, ‘মহারাজ, আমরা তো আজ অতিথিশালার দিকে যাচ্ছি না! আপনার কি আরও কোথাও যাবার ইচ্ছে রয়েছে?’
বিম্বিসার বললেন, ‘বন্ধু, আমরা কি গো-জাতীয়? যে সন্ধ্যা হলেই নিত্য একই গোষ্ঠে ফিরে যাবো! তুমি যে পরিব্ৰজনে শীঘ্রই বেরোবে, তাতে তো পদে পদে অনিশ্চয়তা, অনামা বিপদ, আজকে সামান্য একটু বিপথে নিয়ে যাচ্ছি বলে উদ্বিগ্ন বোধ করছ কেন? একটু উৎকণ্ঠা সহ্য করো, দেখাই যাক না পথের শেষে কী আছে!’
ক্রমশ জনবিরল হয়ে এলো পথ। একটি সুন্দর কাননের মধ্যে প্রবেশ করলেন দু’জনে। উদ্যানপাল এসে নমস্কার করে স্বাগত জানালো। অদূরে একটি সুরম্য হর্ম্য। সহসা দেখলে চিত্রশালা বলে মনে হয়। উচ্চ ভূমির ওপর কয়েকটি স্তম্ভ। তার ওপরে ছাদ। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ছাদের ওপরে সু-উচ্চ কতকগুলি ছত্র দেখা যাচ্ছে। প্রবেশদ্বারটিতে তক্ষণ করা সর্পমিথুন, মধ্যে মুরলীধারী নারী। সোপানগুলি পাথরের।
বিম্বিসার বললেন, ‘চণক, আমার সর্বশ্রেষ্ঠ আম্রকাননটি দিয়েছি আয়ুষ্মান জীবককে, অপূর্ব সুন্দর বেণুবন আরাম সহ দিয়েছি ভগবান বুদ্ধকে, এই জম্বুবন তোমার।’
‘সে কী মহারাজ! আপনি তো জানেন…।’
‘সবই জানি বন্ধু, কিন্তু তুমি তো রাজগৃহে মাঝে মাঝেই ফিরবে? অতিথিশালায় তোমার বসবাস আমার মনঃপূত হয় না। তুমি জানবে রাজগৃহের এই জম্বুবনে তোমার নিজস্ব গৃহ। সেখানে উদ্যানে মগধের সবচেয়ে মিষ্ট জম্বুফলের গাছ আছে, কিন্তু সে দশ বারোটা। তা ছাড়া যা আছে তা শুধু কুসুম, এ এক কুসুমকুঞ্জ। বারাণসী বর্ধকীদের একটি দল গেল সাকেত-গহপতি, ধনঞ্জয়ের কন্যা বিশাখার বিবাহ উপলক্ষে বাড়ি করতে। আরেকটি দলকে এখানে এনে আমি তোমার জন্য এই গৃহ নির্মাণ করিয়েছি কাননের মধ্যে। তোমার অশ্বশালা, গোশালা, দাস-দাসী সবই আছে। চলো।’
রাজা স্পর্শ করতেই যেন জাদুবলে বন্ধ দুয়ার খুলে গেল, দুদিকে দুটি সুবেশ দাস। ওরা কি পূর্ব থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল! আসনশালায় ঢুকলেন দু’জনে, চারদিকে প্রাচীরের গায়ে মাঝেমাঝেই সুন্দর তক্ষিত মূর্তি, লতা, পদ্ম। সুবাসিত জল ও মালা নিয়ে এলো দাসীরা। রাজা খুললেন তাঁর করোটিকা শিরস্ত্রাণ। পাদুকাগুলি খুলে নিয়ে গেল দাসীরা। তার পরে বড় বড় পাত্র থেকে জল নিয়ে পা ধুইয়ে দিল, অতিশয় নরম মার্জনী বস্ত্র দিয়ে মুছিয়ে দিল পা। খুলে দিল রাজার বক্ষের লৌহজালক। চণকের উত্তরীয়। নতুন, সুরভিত উত্তরীয় গায়ে জড়িয়ে দিল দু’জনের। কপালে পরিয়ে দিল গোরোচনার তিলক। গলায় যূথীর মালা। মণিবন্ধেও জড়িয়ে দিল মালা। শরীর মন স্নিগ্ধ এখন। রাজা তাঁর ছদ্ম শ্মশ্রুগুম্ফের মধ্যে থেকে মৃদু মৃদু হাসছেন।
চণক বলল, ‘মহারাজ, আপনার অতিথিশালায় যত্নের কোনও ত্রুটি তো হত না! এত বাহুল্য আপনি আমার জন্য কেন করলেন! আমি তো এখানে থেকে আপনার রাজধানীর খ্যাতিবৃদ্ধি করবো জীবকভদ্রের মতো। ধর্মদেশনা শুনিয়ে আপনাকে সান্ত্বনা দেওয়া বা অনাগামিমার্গে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও আমার নেই তথাগত বুদ্ধর মতো। আমি তো আর দু-এক দিনের মধ্যেই চলে যাবো। কবে আবার ফিরব, জানি না।’
বিম্বিসার ঈষৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তুমি বলেছিলে, যেখানেই থাকো আমার জন্য বন্ধুত্ব তুমি হৃদয়ে বহন করবে, সে কথা কি এখন ভুলে গেছ চণক!’
‘না মহারাজ।’
‘তা হলে? বন্ধুর সান্নিধ্যে বন্ধুকে বারবার ফিরতেই হয়। যখন বহু দূরে, দেশে দেশান্তরে ভ্রমণ করে ফিরবে, নতুন মানুষ, নতুন জীবনচর্যা, নতুন বন্ধু দেখবে, চণক তখন রাজগৃহের উত্তর-পশ্চিম কোণে এই জম্বুবন, এর কুসুমকুঞ্জ, এই গৃহ যার কোনও দ্বিতীয় এ নগরে নেই, এখানকার পরিচর্যা এ সব তোমার মনে পড়বে। তুমি ঘরে ফেরার তাড়া অনুভব করবে রক্তের মধ্যে। এ উপহার হলেও শুধুই উপহার নয় চণক, এ আমার স্বার্থ।’
চণক কথা বলল না। শুধু একবার তার এই রাজসখার দিকে তাকাল। বয়সের পার্থক্য অনেক, পার্থক্য অবস্থার এবং অবস্থানের, অভিজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার, জীবনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যও যে পুরোপুরি এক, এ কথাও বলা যায় না। এঁর রয়েছে সুযোগ্য সব পুত্র, উপায়কুশল মহামাত্রবর্গ, কত শত অনুগত পারিষদ, রয়েছেন রানিরা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই তাঁর মনোবৃত্ত্যনুসারিণী। সর্বোপরি রয়েছেন চন্দ্রাতপের মত আশ্রয় বিস্তার করে তথাগত বুদ্ধ। তাঁর প্রদর্শিত পথে চলাই এঁর অভিপ্রায়। তা হলে? কাত্যায়ন চণক মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সুদূর তক্ষশিলা থেকে এসে এঁর জীবনের কোন্ শূন্যতাকে পূর্ণ করল, বা পূর্ণ করার আশ্বাস দিল যে চণকের জন্য এঁর আকুতি এত তীব্র! এত গভীর! রাজসুলভ কপটতা, দয়া-দাক্ষিণ্য তো এ নয়! চণকের ভেতর থেকে যেন ক্ষীরতরুর মতো ক্ষীরস্রাব হচ্ছে। ভেতরে কেউ নতজানু হয়ে বসছে এই বন্ধুতার সামনে। কৃতাঞ্জলি। এই অনুভূতি চণক চেনে না।’
ভেতরের খোলা দুয়ারপথে দুটি দাসী প্রবেশ করল। তাদের হাতে রৌপ্য ভৃঙ্গার, হাতে স্ফটিকের পানপাত্র, রৌপ্য থালিতে ভোজ্য। সেগুলি তারা একটি দারুফলকের ওপর রাখল। তারপর চলে গেল। চণকের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মাটিতে। সে এখনও ভাবিত, আবিষ্ট। হঠাৎ মেঝের ওপর সে দেখতে পেলো দুটি মণিময় চরণপত্র ফুটে উঠছে, তাতে অলক্তকের চিত্র, শ্বেত দুকুলের ওপর মনঃশিলাবর্ণের লতাচিত্রকরা বসন চরণ দুটিকে জড়িয়ে ওপরে উঠে গেছে। রুপোর বিস্তৃত জলিকাময় কাঞ্চী, তার ওপর অনুপম এক দেহকাণ্ডের ঊর্ধ্বভাগ, রজতসূত্রী এক শ্বেত উত্তরীয় ঊর্ধ্বাঙ্গে, উত্তরীয়ের মধ্য থেকে মণিমাণিক্যের ঝিকিমিকি বোঝা যায়। মাথার স্বর্ণাভ কৃষ্ণকেশ, উঁচু করে তুলে কবরী বাঁধা। তাইতে পুষ্পমালা। কণ্ঠেও মালা দুলছে। অতি শুভ্র মুখ, পাতলা ঠোঁট দুটি রঞ্জিত, কান থেকে হীরকের দীর্ঘ কর্ণাভরণ দুলছে। বিশাল নীলাভ চোখ দুটিতে কি যেন এক দুর্ভেদ্য রহস্যময় ভাবের দ্যোতনা। জিতসোমা।
দু’জনকে নমস্কার করে জিতসোমা অদূরে পারসিক গালিচায় বসল। মৃদুস্বরে বলল, ‘মহারাজ পানীয় গ্রহণ করুন, আর্য চণক ক্লান্ত হয়ে এসেছেন, দাসী জিতসোমার সেবা গ্রহণ করুন।’
যন্ত্রচালিতের মতো মাংসখণ্ড মুখে তুলল চণক। ভৃঙ্গার থেকে সুরা ঢেলে দিল জিতসোমা। মৎস্য, মিষ্টান্ন, ফল, আরও সুরা ঢেলে দিচ্ছে জিতসোমা।
‘মহারাজ আরেকটু নিন, বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত হয়েছে এই মৃগমাংস। নিন চণকভদ্র।’ আরও সুরা পরিবেশন করছে জিতসোমা।
চণক বলল, ‘না’।
চোখে প্রশ্ন, দু’জনেরই। চণক বলল, ‘আর না।’
মহারাজ পাত্র নিঃশেষ করে এনেছিলেন। বললেন, ‘আমারও আজ এইখানেই ইতি।’
দাসীর হাতে সব পাত্র তুলে দিয়ে চলে গেল জিতসোমা।
বিম্বিসার বললেন, ‘চললাম সখা। তুমি তোমার নিজের গৃহে বিশ্রাম করো। আবার দেখা হবে।’ ঘোড়ায় চড়তে চড়তে মৃদুস্বরে বললেন, ‘এই নারীরত্ন রাজোচ্ছিষ্ট মনে করো না যেন চণক।’ রাজার কশাঘাতে শ্বেত অশ্বটি মূহুর্তে উদ্যানপথে রাজমার্গে প্রবেশ করল, তার পর অনেক দূর চলে গেল।
১৯
সাকেতের সীমানায় তিষ্য ও মন্দ্রার ভোর হল। রাত্রে যখন শেষ যামের ভেরী ঘোষণা হচ্ছে তখন অতি গোপনে গৃহত্যাগ করে তিষ্য। ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর বাড়ি বিবাহোৎসব আরম্ভ হবার বহু পুর্বেই চলে আসবার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু পারেনি। পিতা একটার পর একটা কাজে তাকে নিযুক্ত করছিলেন। কোশলরাজ প্রসেনজিৎকে সংবর্ধনা করবার দায়িত্বও পিতা তারই ওপর দিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা, কোশলরাজও তক্ষশিলার স্নাতক, তিষ্যও তাই। উপরন্তু তিষ্য এখন বেশ কিছুদিন শ্রাবস্তীতে কোশল সেনাপতি বন্ধুলের অন্তেবাসী। সুতরাং সে-ই উপযুক্ততম ব্যক্তি মহারাজকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য। গহপতি ধনঞ্জয়ও তাকে ডেকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন। তার দায়িত্ব পালন করেছে তিষ্য। তার পিতার বিশেষ ইচ্ছা ছিল এই সুযোগে সে মহারাজের আরও নিকটস্থ হয়, পরিচয় গভীর হয়, তাতে পরে কোশলসেনাতে উচ্চপদ পাওয়া এবং রাজার সু-দৃষ্টিতে থেকে ক্রমশই উন্নতি করার পথ খুলে যাবে। কোশলরাজ তাকে ভালোই চিনেছেন। এবং সম্ভবত এর পর শ্রাবস্তীতে গেলে তার সমৃদ্ধি কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু তিষ্য শ্রাবস্তী যেতে চায় না। সে কোশল-সেনাতে উচ্চপদ চায় না। তার শস্ত্রাচার্য বন্ধুল মল্লর ওপর তার একটা আন্তরিক টান আছে। আচার্য তাকে ভালোবাসেন, উৎসাহ দেন। কিন্তু আপাতত সেই টান সে প্রাণপণে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছে। এইভাবে গৃহত্যাগ করা ছাড়া তার অন্য উপায় ছিল না। সাকেতের নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃত হট্টরোল, উৎসবের বাতাবরণ, প্রতিটি হর্ম্য এবং মার্গ দীপ দিয়ে সাজানোর আধিক্য, নারীদের সাজ-সজ্জার উল্লাস, পুরুষদের গর্দভের মতো স্বরে বাগ্বিতণ্ডা, পথে পথে সৈন্যদের ভ্রমণ এবং অশ্লীল উচ্চহাসি, সাপের খেলা, বানর খেলা, লঙঘকদের ‘দেখে যান, দেখে যান, এমনটি আর দেখবেন না,’ মণ্ডপে নর্তকীদের নাচ, আর সর্বোপরি ইতর, আর্য, গ্রামবাসী, নাগরিক সবাইকার, কুৎসিত ভোজনলোলুপতা! অসহ্য! অসহ্য!
‘ভো ব্যবস্থাপক, আজ সৈন্য শিবিরে খাদ্যতালিকা কী? ময়ূরের মাংস আজও হচ্ছে তো? মাধ্বীর ব্যাপারে একটু যেন কৃপণতা করেছিলে, যাই বলো!’
‘আহা, কী খেলাম রে মধু, কী খেলাম, এমন শূলপক্ক শূকরমাংস কোনদিন খাইনি। আমরাও তো মাঝে মাঝে বুনো বরা নিষাদদের থেকে কিনে ঝলসে খাই, তার তো কই এমন সোয়াদ হয় না!’
‘এ শূকর, কত প্রকার ভালো ভালো ভোজ্য খেয়ে মানুষ হয়েছে, তা জানিস?’
‘মানুষ! মানুষ হয়েছে! হাঃ, হাঃ, তবে এক প্রকার নরমাংসই খেলাম বল, আহা মুখে দিতেই, নবনীতে ভেজানো তুলের টুকরোর মতো জিভ দিয়ে পিছলে চলে গেল। কণ্ঠ থেকে আবার তাকে দাঁতের তলায় আনি। কী গন্ধ! কী বর্ণ! কী বা স্বাদ!’
মানুষ যে এত খেতে পারে! নিত্য! এবং প্রতিদিন আরও আরও আশা করতে পারে এভাবে, নিজে না দেখলে, নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না তিষ্য। ধিক। ধিক। শত ধিক এদের। তার যেন এই অবিরাম ভোগের গন্ধে বিবমিষা আসছে।
একবার পেছন ফিরে তাকাল তিষ্য। শেষ রাতের তরলিত অন্ধকারে নগরীর দীপালোক হারিয়ে গেছে। ফুটে উঠছে একটি দুটি প্রাসাদের চূড়া। কে জানে কতকাল আর সাকেতে ফেরা হবে না! কাউকে না জানিয়ে এভাবে আসা হয়ত ঠিক হল না। গৃহের সবাই উৎকণ্ঠিত হবে। হয়ত একটি পত্র লিখে এলে সে ভালো করত। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। তার এখন কোনও ঠিকানা থাকবে না। কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্যও কি থাকবে?
আবার ছুটে চলল তিষ্য। মন্দ্রা বারবার কেন যেন তীব্র ডাক ডেকে উঠে পেছন ফেরবার চেষ্টা করছে! সে কি বুঝতে পেরেছে, তিষ্য নিরুদ্দেশের যাত্রী! কিন্তু সে তো পশু! তার আবার ঘর কী! কোথায় কোন কম্বোজবাসীর জালে ধরা পড়েছিল তার পিতা-মাতা, তারপর অশ্ববণিকের মন্দুরায় প্রতিপালিত হয়েছে। গৃহপোষ্য হয়ে আরণ্যক জীবেরও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কেমন চলে যায় দেখো! সহসা তিষ্যর মনে হল, সে কিন্তু মুক্ত! তার কোনও আকর্ষণ নেই। না গৃহের প্রতি, না আত্মজনের প্রতি, না তার মাতৃভূমি ওই নগরীর প্রতি! কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যের বন্ধনও যেন তার নেই। যা জালিকা হতে পারত, সেই প্রণয়ের এক আঘাতে নির্মূল হয়ে গেছে তার সমস্ত কেতুকাম্যতার, উচ্চাকাঙ্ক্ষার শিকড়। মুক্তপুরুষ বলতে সত্যই যদি কেউ থাকে তো সে তিষ্য। রাজকুমার নয়, সাকেতক নয়, তক্ষশিলক নয়, শুধু একজন পরিচয়হীন, লক্ষ্য সম্বন্ধে উদাসীন মানব, তিষ্য।
দুপুরের কাছাকাছি সময়ে কাশীরাজ্যে প্রবেশ করল তিষ্য। একটি গ্রাম অদূরে রয়েছে মনে হচ্ছে। গ্রামপ্রান্তে চারণভূমি দেখে ঘোড়াটিকে ছেড়ে দিয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ল সে। একটি ছোট্ট জলাশয় রয়েছে। অসমান তার ধারগুলি। লোক, বিশেষত গরু চলাচলের জন্য স্বাভাবিকভাবেই সোপান হয়ে গেছে। অসমান, তবু নামা যায়। অঞ্জলি ভরে জল পান করে, উত্তরীয়ের প্রান্ত ভিজিয়ে সমস্ত শরীর জলসিক্ত করে নিল সে। ছায়াবৃক্ষ বলতে বিশেষ কিছু নেই। গো-পালক বালকগুলি কোথায় বসে? রক্তপত্র বিশিষ্ট একটি ঝোপ রয়েছে। তার পাশে সামান্য ছায়া। তিষ্য সেখানে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল। কদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি। গতকাল তো বিনিদ্রই গেছে। এতটা সময় ঘোড়ার পিঠে প্রায় না থেমে চলে আসা। সব মিলিয়ে চোখ বুজে এলো। বসে বসে ঘুমোতে ঘুমোতে কখন যে সে শুয়েও পড়েছে তিষ্য জানে না।
যখন জেগে উঠল তীব্র ক্ষুধা। উদরে যেন আগুন জ্বলছে। মাথার ওপরে সূর্যের তাপও অনুরূপ। অগ্নিবৎ। সে উঠে বসে চারদিকে তাকাল। গভীর ক্লান্তির পর ঘুমিয়ে উঠলে যেমন হয়, সে সহসা কিছুই চিনতে পারল না। মুক্ত আকাশের তলায় সে শুয়ে আছে কেন? চারদিকে ঘাসে-ছাওয়া ভূমি! কী ব্যাপার? কোথায়? তারপর সব মনে পড়ে গেল। মন্দ্রা! মন্দ্রা কোথায়! সে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। দিগন্ত পর্যন্ত অনায়াসে দৃষ্টি চলে যায়। দু-চারটি মাত্র গরু চরছে। কোনও গোপালক কোথাও চোখে পড়ল না। এবং মন্দ্রা নেই।
মন্দ্রা! মন্দ্রা! ডাক ছেড়ে হেঁকে উঠল তিষ্য। জলাশয়টির কাছে গেল, নেই। চরে বেড়াচ্ছিল মন্দ্রা। প্রথমে প্রাণ ভরে জল পান করে, তারপরে চরে বেড়াচ্ছিল। চারণক্ষেত্রটি ঘাসে একেবারে উপছে পড়ছে। তার মধ্যে মন্দ্রার ক্ষুরের চিহ্ন কিছুটা অবধি অনুসরণ করতে পারল সে, তারপর আরও অনেক যষ্টি বা ওই জাতীয় চিহ্নের সঙ্গে সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। মানুষের পায়ের চিহ্নর মতো কিছুও সে খুঁজে পেল। কিন্তু ভূমিটি মধ্যভাগে বৃষ্টি পড়ে পড়ে কেমন আর্দ্র হয়ে রয়েছে। সেখান থেকে আর বিশেষ কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শুধু তার পা দুটিই কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল। মন্দ্রা তাহলে চুরি গেছে! বাঃ, কোশলরাজ বাঃ, তুমি মাত্র আঠার কি বিশ ক্রোশ দূরে বসে মৈরেয়র পাত্র হাতে হা হা করে হেসে উঠছ, কোনও চাটুকারের অশ্লীল কৌতুকে সুবর্তুল মুখে অত হাসিতেও বিশেষ কুঞ্চন পড়ছে না। এদিকে ফটফটে দিনের বেলায় একজন কুলপুত্রের আজানেয় ঘোড়া চুরি যাচ্ছে! চমৎকার! অতি চমৎকার! আর হবে নাই বা কেন! এই রাজাটি তো সবসময়েই বিলাসে-ব্যসনে-বয়স্যে-বনিতায় মত্ত থাকেন। মাঝে মাঝেই নানান স্থান থেকে সংবাদ আসে গ্রামকে গ্রাম লুঠ করে নিয়ে গেছে দস্যুরা। কিংবা বিদেশি সার্থের সর্বস্ব অপহৃত হয়েছে পথে। বন্ধুলভদ্র স্থূল চর্মের বর্ম পরতে পরতে বলেন, ‘চলো হে তিষ্য, গোটাকতক দস্যু মেরে আসি। এ জন্মে তো আর সত্যিকার যুদ্ধের সাধ পূর্ণ হবার নয়! চোর আর দস্যু মেরে মেরে হাতে দুর্গন্ধ হয়ে গেল।’
মল্লদের গৌরবরবি অস্ত গেছে। কুশিনারা আর পাবায় কয়েকটি মল্লকুল নিজেদের দুর্গে জ্ঞাতিবর্গ নিয়ে থাকেন। মল্লদের সৌভাগ্যসূর্য আর উদিত হবে না বুঝে বন্ধুল বেরিয়ে পড়েছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। বলতেন ‘কোলিয়রা কোশলের পদানত হল, পদানত হল শাক্যরা, কালামরা। লিচ্ছবিরাই এখনও পর্যন্ত তাদের সার্বভৌমত্ব ঠিকঠাক টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। মল্লদের সংঘবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। বুঝলে তিষ্য! তাই যখন পারলাম না, কূপের মধ্যে পড়ে থাকব কেন, নিজেও এলাম, ভ্রাতুস্পুত্র চারায়ণকেও নিয়ে এলাম। অর্থ, মান, যশ কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু এই কি বীরপুরুষের জীবন! কতকাল হয়ে গেল সামান্য কটা প্রত্যন্ত বিদ্রোহ দমন ছাড়া যুদ্ধের সুযোগই পেলাম না। শুধু দস্যু-তস্করের ওপরেই পরীক্ষা করার জন্য কি শস্ত্র-বিদ্যা শিখেছিলাম!’
‘মন্দ্রা! মন্দ্রা!’ ডাকতে ডাকতে গোচারণের সীমানায় এসে পৌঁছল তিষ্য, ক্ষুধাতৃষ্ণায় তখন তার শরীর অবসন্ন, উপরন্তু মন্দ্রা চুরি যাওয়ায় ক্রোধে সর্ব শরীর জ্বলছে। লোকালয়ের মধ্যে আসতে আসতে সূর্য একেবারে মাথার ওপরে চলে গেল। একটি কূপ না? কয়েকটি রমণী না তার পাশে? তিষ্য একরকম ছুটতে ছুটতে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল।
‘তোমরা কেউ একটি ঘোড়াকে এদিকে আসতে দেখেছ?’
‘একটি কালো ঘোড়া তো?’ একজন বলল। ‘ঘোড়া না অশ্বতর?’ আর একটি রমণী বলল। ক্রুদ্ধ তিষ্য বলল, ‘কালো-টালো নয়, সর্বশ্বেত, খদির বর্ণের কয়েকটি সুন্দর দাগ আছে, চিত্রাশ্ব!’
‘এমন কোনও ঘোড়া তো আমরা দেখিনি অজ্জ?’ একটি বর্ষিয়সী মহিলা বলল।
‘এখানে কিছু খাদ্য কিনতে পাওয়া যাবে?’
কথা শুনে রমণীগুলি হেসে আকুল হয়ে গেল। একজন বলল, ‘শুধু শুধু হেসে কুলপুত্তটিকে পীড়া দিচ্ছিস কেন? ক্রোধে কেমন কন্নমূল পজ্জন্ত রাঙা হয়ে গেছে দেখছিস না?’
তখন আর একজন বলল, ‘দলিদ্দ গাম। হাট নেই, বিপণি-আপণি কিছুই তো নেই গো অজ্জমশায়, খজ্জ কিনবে কোথা থেকে?’
তিষ্য বলল, ‘তোমাদের কূপে জল আছে তো? না কি কুপও দলিদ্দ?’
‘দলিদ্দ কুয়ো, দলিদ্দ কুয়ো বলে মেয়েগুলি আবার হাসতে লাগল। তখন আগেকার সেই বর্ষিয়সী রমণী বলল ‘কুয়োয় জল আছে অজ্জ, কিন্তু আমরা বেণ-দের ঘরের ইত্থি, খাবে কি না বুঝে দ্যাখো।’
তিষ্য বিরক্ত হয়ে বলল, ‘একটু সরে যাও, সরো তোমরা।’
মেয়েগুলি সরে বসল, কেউ দাঁড়িয়ে উঠল। কেউ একটু দূরে চলে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।
ডোঙায় করে জল তুলে পান করতে গিয়ে তিষ্য যত না খেল, তার চেয়ে বেশি ভিজে গেল। মেয়েগুলি আশে-পাশে, অদূরে, দাঁড়িয়ে বসে খিলখিল করে হাসছে।
‘কিছু শুষ্ক খাদ্য অন্তত আমার চাই-ই, মূল্য দেবো।’ তাদের হাসাহাসি গায়ে না মেখে তিষ্য বলল।
বর্ষিয়সী রমণী বলল, ‘বললুমই তো হট্ট-ঘট্ট কিছু নেই এ গামে, আমার গেহে যাও তো কিছু খজ্জের চেষ্টা দেখতে পারি।’
‘চলো, যাচ্ছি।’ তিষ্য বলল অটল গাম্ভীর্যের সঙ্গে।
বর্ষিয়সী সঙ্গে সঙ্গে এক কলস জল নিয়ে চলতে আরম্ভ করলো, বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে।’ রমণীগুলি অধিকাংশ কালো, কেউ বা অল্প, কেউ অধিক। তিষ্যর মনে হল, এরা অ-সভ্যও। কিন্তু সে এখন এর পেছন পেছন যাওয়া ছাড়া কি-ই বা আর করতে পারে!
খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট একটি কুটির। আরও কয়েকটি দেখা যাচ্ছে দূরে দূরে। খোঁটার সঙ্গে একটি ছাগলী বাঁধা। পরিষ্কার প্রাঙ্গণের মধ্যে ঢুকে তিষ্য দেখল অজস্র বেতের ঝুড়ি, একটার পর একটা বসিয়ে চুড়ো করা রয়েছে। সে বলল, ‘তোমরা কি এইগুলি প্রস্তুত করো!’
‘হ্যাঁ অজ্জ, কাছেই নদী। প্রচুর বেত জন্মায়। আমাদের পুরুষরা কেটে নিয়ে আসে। আমরা সবাই মিলে বানাই।’
‘বিক্রি করো কোথায়? হাটে?’
‘হা কপাল অজ্জ, হাট কোথায় পাবো? যোজনের পর যোজন গেলে তবে হাট পড়ে। কাঁধে পিঠে করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা পোষায় না। একটিও গো-যান নেই আমাদের গামে। মাঝে মাঝে তিন গাম পেরিয়ে গো-যান নিয়ে আসা হয়, তাতে সবার সব ঝুড়ি-ঝোড়া তুলে নিয়ে অনেক দূরের হাটে যাওয়া হয়। তবে মাঝেমাঝেই আসে বণিকরা, তারাই গো-যান নিয়ে আসে। কিনে নিয়ে যায়। আমরা তাদের থেকে চাল চিনি, যব কিনি, তেল কিনি।’
‘কেন? তোমাদের গ্রামে জমি জায়গা তো প্রচুর? কর্ষণ করো না?’
কস্সনের কাজ তো আমরা জানি না অজ্জ! এই কুটিরের সঙ্গেই যে ভূমি রয়েছে সেখানে কিছু ফল কিছু শাক জন্মায়, বীজ পড়ে আবার জন্মায়, তাই খাই। নদী থেকে মচ্ছ আনি মাঝে মাঝে। এই ছাগল আছে কটা। গরু তো সবার নেই। অনেক মূল্ল বাপু, কে দেবে?’
রমণীটি মাটির পাত্রে শুকনো চিঁড়ে, দুটি শুকনো কলা আর এক ডেলা গুড় নিয়ে এলো। প্রাঙ্গণের এক দিকে মাটির উঁচু বেদীর ওপরেই বসেছিল তিষ্য। খাদ্যগুলি দেখে তার উৎসাহ নিবে গেল। রমণীর হাতে মাটির পাত্র। সে বলল, ‘একটু দুধ দুয়ে এনে দিচ্ছি, তুমি দুধে ভিজিয়ে চিঁড়াগুলো খেয়ে ফেলো।’
চারিদিকে চেয়ে তিষ্য দেখলো, এদের কুটিরে চিঁড়ে কোটা, ধান কোটা ইত্যাদির কোনও ব্যবস্থাই নেই। অর্থাৎ এই চিঁড়েও এদের ঝুড়ির বদলে সংগ্রহ করতে হয়।
ছাগলের দুধে তার গন্ধ লাগে। তবু সদ্য-দোয়া একঘটি দুধ দিয়ে সে খাদ্যগুলি কোন প্রকারে খেয়ে ফেলল। তারপর প্রাঙ্গণের এক পাশে হাতমুখ ধুয়ে এসে, রমণীটি আশেপাশে নেই দেখে, তার পাঁচ তলিকা পাদুকার প্রথমতল খুলে সেখান থেকে পাঁচটি রুপোর কাহন বার করল, রমণী এলে তাকে দিয়ে বলল, ‘নাও, তোমার খজ্জের মূল্য।’
‘না না, তুমি অতিথ্। মূল্য দিতে হবে না।’ রমণীটি পিছিয়ে গেল, তারপর তার হাতে চকচকে রুপোর মুদ্রাগুলি দেখে, একই সঙ্গে লুব্ধ ও সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কি এমন অনেক আছে?’
‘তোমার তাতে প্রয়োজন কী?’ তিষ্য তার কটিবন্ধ ভালো করে আঁটতে আঁটতে বলল।
‘তুমি কি বণিক?’
‘তাতেই বা তোমার প্রয়োজন কী?’
‘বলো না, তুমি কি রাজভট?’
‘যদি বলি হ্যাঁ!’
‘শোনো অজ্জকুমার, তোমার ঘোড়াটি আমাদের গ্রামেরই দু’-তিনজন পুরুষ চুরি করে নিয়ে বারাণসীর দিকে গেছে, যেখানে প্রথম ক্রেতা পাবে, বেচে দেবে। তুমি যদি সময়মতো গিয়ে উপস্থিত হতে পার, উদ্ধার করতে পারবে।’
তিষ্য বলল, ‘এতক্ষণ এ কথা বলোনি কেন? আরও আগে গেলে ধরে ফেলতে পারতাম তাদের। এই জন্যেই বলে অনার্য! একেই বলে হীন জাতি।’
রমণীর কালো মুখ আরও কালো হয়ে গেল, সে হঠাৎ তেড়ে উঠে বলল, ‘তবে দূর হয়ে যা অজ্জ আমার আঙন থেকে। তেষ্টা দেখে জল দিলুম, খিদে দেখে নিজের অন্নভাগ দিলুম, বলে কিনা অনজ্জ! হীন জাতি! ভালো করবো তোদের চিত্ত-ঘোড়া চুরি করব, অনেক মুল্ল পাওয়া যাবে সৈন্ধব ঘোড়াটার, যদি বুদ্ধি করে দুটো চারটে গরু কিনে আনে এরা, তো বেশ হয়!’ সে কুটিরের দরজা শব্দ করে বন্ধ করে দিল।
সূর্য এখন সামান্য পশ্চিমে হেলেছে। দিক-নির্ণয় করে সোজা পুব দিকে হাঁটা দিল তিষ্য। যত দ্রুত পারে। মন্দ্রাকে তার খুঁজে বার করতেই হবে।
সন্ধ্যার পূর্বে সে যেখানে পৌঁছলো মনে হল একটি নিগম গ্রাম। কুটির রয়েছে যথেষ্ট। কিছু লোক চলাচল করছে। সে তাদের জিজ্ঞাসা করে করে হাটে পৌঁছলো। যাকেই পায় জিজ্ঞাসা করে, একটি শ্বেতের ওপর খদির বর্ণ চিত্রাশ্ব কেউ বিক্রি করতে এনেছিল? কিছু জানো? কেউ কিছু বলতে পারল না। হতাশ হয়ে সে একজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘অতিথিশালা আছে এখানে?’
তার আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে লোকটি বলল, ‘বড় গাম। কত বণিকের চলাচল, থাকবে না কেন? তবে আপনি কি সেখানে থাকতে পারবেন? বড় ঘরের পুত্ত মনে হয়!’
তিষ্য বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কোনদিকে অতিথিশালাটা সেটাই বলো না কেন, বড় ঘরের পুত্ত কি কী। ঘরের পুত্ত তাতে তোমার প্রয়োজন কী?’
তার ভ্রূকুটির দিকে তাকিয়ে ঈষৎ ভয় পেয়ে লোকটি অতিথিশালার দিকটি দেখিয়ে দিল।
কিন্তু লোকটি যে ঠিকই বলেছিল, সেটা অতিথিশালার প্রাঙ্গণে পা দেওয়া মাত্র সে বুঝতে পারল। চালগুলোতে ফুটো। মাটির দেয়ালে চিড় ধরেছে। কারা থেকে গেছে ঘরটিতে কে জানে, বড় নোংরা। সে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। অতিথিশালার রক্ষী বলে কেউ নেই। খোলা সব পড়ে আছে। ঘরের বাইরে উঁচু অঙ্গনের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে রইল তিষ্য। মন্দ্রা অত্যন্ত প্রভুভক্ত অশ্বী। কিন্তু সে অতিশয় সুশীলাও। কোনও আরোহীকেই সে ফেলে দেয় না চট করে। মানুষের মধ্যে যেমন মূঢ়ও আছে, চতুরও আছে, পশুদের মধ্যেও তেমনি আছে। মন্দ্রা মূঢ়ের দলে পড়ে। কিন্তু মানুষের যা নেই পশুর সেই সহজাত বোধ আছে। মন্দ্রা যখন বুঝতে পারবে ওই লোকগুলি তার প্রভুর অনুমতি না নিয়েই তাকে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে, তখন! তখন সে কী করবে। তবে তখন হয়ত অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়ে থাকবে। তার পায়ে বাঁধন, মুখে শক্ত রজ্জুর গ্রন্থি। এতক্ষণ না থাকলে সে কতদূর এগিয়ে যেতে পারত! এতটা পথ এক রকম দৌড়ে এসে সে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত বোধ করছে। দুপুরে খাওয়াও তেমন হয়নি। এখন, সাকেতে ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর স্থাপিত অস্থায়ী মহানসগুলির থেকে নিষ্ক্রান্ত সুখাদ্যের গন্ধ যেন তার নাকে প্রবেশ করতে লাগল। আর বমি আসছে না। এখন ওই শূকরমাংস কি ময়ুরমাংস পেলে সে গোগ্রাসে খেয়ে নিত। তিষ্যর মনে হল, পৃথিবীতে কোথাও সমতা নেই। কোথাও খাদ্য উপছে পড়ছে, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। কোথাও কিছু নেই। কোথাও সারা রাত ধরে দীপ জ্বলে আছে, কোথাও রাত্রি নিষ্প্রদীপ, কোথাও বহুজনের হট্টরোল, কোথাও আবার একটি রক্ষী কি একটি দাস কি একটি গ্রামবাসীর পর্যন্ত দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, যার সঙ্গে পরামর্শ করা যায় এই আপৎকালে। এমন তো নয় যে সে ভ্রমণ করেনি! সাকেত থেকে শ্রাবস্তী হয়ে মধুরা, উদুম্বর, ভদ্রঙ্কর হয়ে তক্ষশিলা পর্যন্ত দীর্ঘ পথে সে কত যাতায়াত করেছে। তারপরে সাকেত থেকে শ্রাবস্তী প্রায়ই যাওয়া-আসা করতে হয়েছে। এমন বিপদে সে কখনও পড়েনি। সে উঠে পড়ল। এই গ্রাম সন্ধ্যার আগেই ত্যাগ করে যেতে হবে। এখানে কোনও সাহায্য পাবার আশা নেই।
গ্রাম প্রায় ছাড়িয়ে এসেছে, এমন সময় তিষ্য দেখল বিপরীত দিক থেকে এক প্রব্রাজক আসছেন। হনহন করে এগিয়ে আসছেন। আর একটু কাছাকাছি হতে সে বুঝল ইনি প্রব্রাজক নন, প্রব্রাজিকা। মাথায় কুণ্ডলীকৃত কৃষ্ণ কেশ, নতুন গজিয়েছে বলে মনে হয়। হাতে একটি দণ্ড। হাত তুলে তিষ্যকে থামতে ইঙ্গিত করলেন প্রব্রাজিকা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে পড়ল তিষ্য।
প্ৰব্ৰাজিক রীতিমতো বলিষ্ঠ। মুখের ভাবও খুব দৃপ্ত। ক্লান্তির কোন চিহ্নই চোখেমুখে নেই। প্রব্রাজিকা বললেন, ‘সাকেত আর কত দূর হবে যুবক?’
‘পঁচিশ ছাব্বিশ যোজন হবে।’
‘পেছনে যে গ্রামগুলি ফেলে এসেছ, সেখানে রাত্রে বাস করার উপযুক্ত অতিথিশালা আছে?’
‘আছে, তবে তাতে রক্ষী নেই, অর্গল নেই।’
‘ও, তবে তো ঠিকই শুনেছি।’
‘কী শুনেছেন, আর্যে?’
‘তুমি কোথা থেকে আসছে আয়ুষ্মান?’
‘সাকেত,’ সংক্ষেপে বলল তিষ্য।
‘গন্তব্য?’
‘জানি না।’
তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলেন প্রব্রাজিকা। বললেন, ‘উদ্ভ্রান্ত কেন? কিছু অশুভ ঘটেছে?’
‘আপনার তাতে প্রয়োজন কী?’ তিষ্য বিরক্ত হয়ে বলল।
এই সংসারত্যাগী শ্ৰমণ-শ্রমণাদের দেখলেই ভক্তিতে নত হয়ে পড়বার নিয়ম। তিষ্য এঁদের দেখতে পারে না। প্রকাশ করে না অন্য সময়ে। কিন্তু আজ হা-ক্লান্ত, হতাশ, উদ্বিগ্ন। আজ সে তার ব্যবহার ঠিক রাখতে পারল না। সে এগিয়ে যাচ্ছিল, যষ্টির অগ্রভাগ দিয়ে তার পথ রোধ করলেন প্রব্রাজিকা। বললেন, ‘কিসের এত অহংকার যুবক? রূপের? কুলের? বিত্তের? না শিক্ষার? জানো, যে কোনও মুহূর্তে আমার হাতের এই দণ্ডের মতো কালদণ্ড অশনিসম্পাতে ওই উদ্ধত মস্তক বিদীর্ণ করতে পারে? জানো তোমার আত্মাটি তোমার এই সুছন্দ দেহ থেকে বেরোবার পর অনুভব করবে চুরাশি লক্ষতম জন্মটিও তোমার বৃথাই গেল! কিছুই শেখোনি! অষ্টাদশ বিদ্যা আয়ত্ত করার জন্য তক্ষশিলায় গিয়েছিলে? জন্মের কারণ জানো! মৃত্যু কেন হয়? হতাশা কিসের? প্রণয় মায়া। ফল বিরাগ, কুলশীল ত্যাগ করে পথে পথে ঘোরা—এই মাত্র।’
তিষ্য অপরিসীম বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
প্রব্রাজিকা গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘যাও।’
তিষ্য ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি কে আর্যে! আপনি কি স-ব জানেন?’
‘সব জানি না। যেমন জানি না, কী তোমার নাম, গোত্র? জানতে চাইও না। অকিঞ্চিৎকর তুচ্ছ বস্তু সব। মনে হল বিপন্ন, তাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। প্রব্রাজিকার কোনও কৌতূহল নেই।’
তিষ্য বুঝতে পারল, ইনি সব জানেন। এমন কি প্রব্রাজক, বিশেষত প্রব্রাজিকাদের পুরুষের মতো বেশ বাস, নারীত্ব অস্বীকার করে কুশ্রী সাজবার চেষ্টার জন্য সে যে তাদের দ্বিগুণ অরুচির চোখে দেখে, সে কথাও এঁর অজ্ঞাত নেই।
সে সসম্ভ্রমে বলল, ‘আমার প্রিয় অশ্বীটি ওই দিকের একটি গ্রামে চুরি গেছে।’
‘যাবেই তো। সামান্য অসতর্কতার ফলে জীবন চলে যায়, তায় অশ্ব। ওই গ্রামগুলি সব চৌরগ্রাম।’
‘আপনি জানেন?’
‘জানি।’
‘তবে, এখন বেলা পড়ে আসছে, ওদিকে যাবেন?’
‘ভয় কাকে বলে জানি না যুবক, রাজগৃহের এক পর্বতশিখরে রেখে এসেছি আমার ভয়, লজ্জা, সঙ্কোচ, বাসনা। ফিরে যাও ওই চৌরগ্রামে, একটি যেমন-তেমন অশ্ব কিনে নাও। তারপর দ্রুত বারাণসী চলে যাও, অশ্বচোররা ভালো মূল্য পাবে বলে তোমার অশ্বীটিকে নিয়ে সেখানেই যাচ্ছে। পশুর হাটে গিয়ে নিজের অশ্বটিকে যদি দেখতে পাও, দাবি করবে। নাম ধরে ডাকবে। অশ্বটি সাড়া দেবে। তাহলেই অশ্বটি তোমার, প্রমাণ হয়ে যাবে। বোহারিকের কাছে বিচার প্রার্থনা করবে। কোনও চোর, কোনও দস্যুকে কখনও শুধু শুধু ছেড়ে দেবে না।’
তিষ্য প্রব্রাজিকার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে চলল। অতিথিশালার কাছে গিয়ে ব্রাজিকা হাঁক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ভো গ্রামবাসী, কে কোথায় আছো।’
নিমেষের মধ্যেই অতিথিশালার পেছন থেকে দুটি লোক বেরিয়ে এলো। তাদের হাত জোড় করা। মুখে বিনয়।
‘এই কক্ষে আজ রাতে আমি থাকব। আমাকে একটি সম্মার্জনী এনে দাও।’
লোক দুটি তাড়াতাড়ি বলল, ‘না মাতা, আমরাই সব পরিচ্ছন্ন করে দিচ্ছি।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই অতিথিশালার ঘর পরিষ্কার করে, কোথা থেকে নলপট্টিকা এনে সেখানে বিছিয়ে দিল লোকটি। কলস ভর্তি পানীয় জল নিয়ে এলো। কয়েকজন কিছুক্ষণ পরেই মাটির পাত্রে ফলমূল এবং এক ঘটি দুধ এনে হাত জোড় করে দাঁড়াল। প্রব্রাজিকা বললেন, ‘এগুলি খেয়ে নাও যুবক।’
‘আপনি খাবেন না?’
‘আমি শীতল জল পান করব। সূর্যাস্তের পর আর না খেলেও চলে।’
‘এতটা পথ হেঁটে এসেছেন, কিছুই খাবেন না!’
দেখা গেল লোকগুলি আরও এক ঘটি দুধ এনে রেখেছে।
‘পান করুন মা, দয়া করুন।’
দীপ্ত চোখে তাদের দিকে তাকালেন প্রব্রাজিকা। বললেন, ‘এই যুবককে এখুনি বারাণসী যেতে হবে, একে একটি অশ্ব দিতে পারো? এ মূল্য দেবে।’
‘অশ্ব তো সারা গ্রামে একটিও নেই মা।’
‘তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম এ গ্রামে শুধু অশ্ব পালনই করা হয়। চমৎকার সব আজানেয় চিত্রাশ্ব? হয় না?’
লোকগুলির মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। তিষ্য নিশ্বাস রুদ্ধ করে রয়েছে।
একটি লোক প্রায় কেঁদে ফেলে বলল ‘আমরা কিছু করিনি মা, ভিন গামের লোক, আমাদের কিছু বলতে নিষেধ করে ঘোড়াটি নিয়ে ছুটে চলে গেল।’
‘অশ্বের মূল্য থেকে কিছু ভাগ দেওয়ার কথাও তো বলে গেছে?’
এবার একেবারে কেঁদে ফেলল লোকটি। বাকি লোকগুলিরও একই দশা।
‘কী? বলে গেছে তো?
‘হ্যাঁ মা।’
‘চোর নোস তোরা? চোরের অন্ন-পান আমি গ্রহণ করি না।’
‘আমরা চেষ্টা করছি মা। আপনি তৃষ্ণার্ত। দুধটুকু খান।’
‘আচ্ছা যা, দেখ্।’
লোকগুলি শশব্যস্তে চলে গেল। তিষ্য বলল, ‘আর্যে আমি খাচ্ছি, আমার ক্ষুধায় শরীর অবসন্ন লাগছে।’
‘খাও, খেতেই তো বললাম যুবক।’
‘আপনি?’
বস্ত্রের মধ্য থেকে একটি সুকুমার হাত বেরিয়ে এলো। ঘটিটি এক হাতে ধরে প্রব্রাজিকা অনেকক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে চুমুক দিতে লাগলেন দুধে। তিষ্য এতক্ষণে অবাক হয়ে দেখল ইনি একজন অল্পবয়সী যুবতী। মুণ্ডিত মস্তকে হ্রস্ব কুণ্ডলিত কেশ, অঙ্গ ঢাকা বসন এবং তার নিজের উদ্ভ্রান্ত ও বিরক্ত মনোভাবের জন্য এতক্ষণ সে বুঝতে পারেনি। তার চেয়ে ইনি বয়সে বড় তো ননই, সমবয়সী বা ছোটও হতে পারেন।
সে বলল, ‘আৰ্যে, এরা যদি আমাকে একটি ঘোড়া এনে দিতে পারে, আপনাকে কাল আমি সাকেত নগরীর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব।’
‘আর আজ রাত্রে?’
‘এই অতিথিশালায় তো আরও কক্ষ আছে, থাকব সেখানে।’
খুব সামান্য একটুকরো হাসি প্রব্রাজিকার মুখের ওপর দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
বললেন, ‘কেন?’
‘আপনি নারী, এই চৌরগ্রামে একাকিনী’… দ্বিধা হচ্ছে কেন যেন, তিষ্য থেমে গেল।
‘বাল্যে পিতা, যৌবনে পতি আর বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করে নারীকে, নয়?’
তিষ্য কিছু বলল না।
হঠাৎ হেসে উঠলেন প্রব্রাজিকা। বললেন, ‘কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারে না। চিত্তবৃত্তি তোমাকে যে পথে নিয়ে যাবে সেদিকেই যেতে হবে। মানুষ খোঁটায় বাঁধা ছাগ। গলরজ্জু তাকে যত দূর যেতে দেবে, তত দূরই সে যাবে। সে যখন ভাবছে সে মুক্ত, তখন প্রকৃত পক্ষে পেছনে আসছে। অজপালক, বুঝলে?’ একটু পরে বললেন, ‘প্রব্রাজিকার কোনও রক্ষক প্রয়োজন হয় না, জানো না? নির্গ্রন্থ নাতপুত্র রক্ষা করবেন… কিংবা রক্ষা করবেন না।’
‘আপনার গুরু আপনাকে রক্ষা করবেন, এ বিশ্বাসও আপনার নেই?’
‘আমাকে রক্ষা করাই তো তাঁর একমাত্র কাজ নয়, যুবক!’
‘যদি রক্ষিত না হন, সত্যিই?’
‘কতদূর আর হবে, বড় জোর মৃত্যু! নশ্বর দেহ চতুর্মহাভূতে মিলিয়ে যাবে। ক্ষতি কী? তবে তা হবে না।’
‘হবে না, নিশ্চিত জানেন?’
‘নিশ্চিত জানি।’
‘আপনার ঋদ্ধি আছে, তা বুঝতে পারছি, কিন্তু…’ সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল তিষ্য।
কথা শেষ না হতেই প্রব্রাজিকা বলে উঠলেন, ‘ঋদ্ধি আছে কিনা জানি না যুবক, তবে বুদ্ধি আছে। একবার এক চোর এক কুলকন্যাকে পূজা দেবার ছল করে গিরিশিখরে নিয়ে যায়, কন্যার অঙ্গভরা অলঙ্কার, সেই অলঙ্কারগুলি হস্তগত করে সেই কুলকন্যার প্রাণনাশের অভিসন্ধি ছিল চোরটার। কিন্তু সেই কন্যার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল। সেও প্রণয়ের ছল করে চোরটাকে গিরিশিখর থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। এমনি করে।’ হাতের দণ্ডটিকে দাঁড় করিয়ে তাকে আঙুলের টোকা দিয়ে ফেলে দিলেন প্রব্রাজিকা।
শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল তিষ্যর। প্রব্রাজিকা বললেন, ‘নারীরা সবসময়ে বলহীন, বুদ্ধিহীন হয় না।’
‘সে সাহসিকা নারী কে আর্যে? আপনি চেনেন?’
‘চিনতাম এক সময়ে। রাজগৃহের এক রাজপুরুষের কন্যা।’
‘কী নাম রাজপুরুষের? কন্যারই বা কী নাম?’
‘অনাবশ্যক কৌতূহল প্রকাশ করো কেন যুবক? নামরূপে কী কাজ? ওই বোধহয় তোমার ঘোড়া এলো। যাও।’
লোকগুলি ভয়ে ভয়ে দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঘোড়া পাইনি, একটি অশ্বতর জোগাড় করেছি।’
প্রব্রাজিকা বললেন, ‘মূল্যটা দিয়ে দাও যুবক, তারপর শীঘ্র যাও।’
তিষ্য করজোড়ে নমস্কার করল।
প্রব্রাজিকা বললেন, ‘স্বস্তি, স্বস্তি, জয়তু, জয়তু।’