২. ব্রুনো বাউয়ের, “বর্তমান দিনের ইহুদি এবং খ্রিষ্টানের স্বাধীন হওয়ার সামর্থ্য।” (পৃষ্ঠা-৫৬-৭১)

২. ব্রুনো বাউয়ের, “বর্তমান দিনের ইহুদি এবং খ্রিষ্টানের স্বাধীন হওয়ার সামর্থ্য।” (পৃষ্ঠা-৫৬-৭১)

বাউয়ের এমনি আঙ্গিকে ইহুদি আর খ্রিষ্টান ধর্ম এবং একই সাথে সমালোচনার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে কারবার করেন। সমালোচনার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হলো “মুক্ত হওয়ার সামর্থ্যের সঙ্গে” সম্পর্ক।

এ থেকে ফলাফল যেখানে উপনীত হয়:

মুক্ত হতে গেলে ‘ধর্মকে একেবারে ত্যাগ করবার জন্য খ্রিষ্টানদের কেবল একটা বাধাই টপকাতে হবে, তা হলো তাদের ধর্ম’। ‘অপরদিকে ইহুদিদের কেবল তার ইহুদিয়ানা স্বভাব ছেড়ে আসলেই হবে না, একই সাথে তার ধর্মকে সম্পূর্ণ করবার দিকে তার বিকাশ, যে বিকাশ তার কাছে বিজাতীয় তাও ছেড়ে আসতে হবে।’ (পৃষ্ঠা-৭১ )

এভাবে বাউয়ের ইহুদি মুক্তির সমস্যাটিকে আগাগোড়া ধর্মীয় সমস্যা বানিয়ে ফেলেন। ইহুদি আর খ্রিষ্টানের মাঝে কার নাজাত পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি—এই পুরাতন ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নটিকেই আলোকিত রূপে আবার পেশ করা হলো: তাদের মধ্যে কে মুক্ত হতে বেশি সক্ষম। প্রশ্নটি আর এই নয় যে, ইহুদি কিংবা খ্রিষ্টান ধর্মই কি মানুষকে মুক্তি দেয়? প্রশ্নটি বরং এখন এরকম হয়ে গেল: ইহুদিয়ানা অথবা খ্রিষ্টানত্ব— কোনটির অস্বীকৃতি মানুষকে বেশি মুক্ত করে?

“ইহুদি’রা যদি মুক্ত হতে চায়, তবে তাদের খ্রিষ্টানত্বে বিশ্বাস ঘোষণা করলে চলবে না, ঘোষণা করতে হবে খ্রিষ্টানত্ব এবং সাধারণভাবে ধর্মের অবলোপনে, মানে আলোকায়নে ও সমালোচনায় বিশ্বাস। যার ফল হচ্ছে মুক্ত মানবতার বিশ্বাস।” (পৃষ্ঠা-৭০)

ইহুদিদের জন্য এখনো তা এক বিশ্বাস কবুল করবার বিষয়, কিন্তু তা আর খ্রিষ্টানত্ব কবুল করবার নয়, খ্রিষ্টানত্ব’র অবলোপনে বিশ্বাস।

বাউয়ের ইহুদিদের কাছে খ্রিষ্টান ধর্মের সারসত্ত্বা ছেড়ে আসার দাবি জানান, যে দাবি তার নিজের মতেই ইহুদিবাদের বিকাশ হতে জন্মায়নি।

যেহেতু বাউয়ের তার ইহুদি প্রশ্ন রচনার শেষে ইহুদিবাদকে খ্রিষ্টানত্বের নিছক এক আকাট ধর্মীয় সমালোচনা হিসেবে বুঝেছেন, ফলত তার কাছে শুধু এর ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান, কাজে কাজেই বোঝাই যায়, ইহুদিদের মুক্তির ব্যাপারটিকেও তিনি দার্শনিক-ধর্মতাত্ত্বিক এক কাজ বানিয়ে ছাড়বেন। বাউয়ের মনে করেন, ইহুদিদের অমূর্ত, আদর্শ স্বভাব, তাদের ধর্মই তাদের সমগ্র বৈশিষ্ট্য। তাই তিনি সঠিকভাবেই উপসংহার টানেন যে:

“ইহুদিরা যদি তাদের সংকীর্ণ আইন, সমগ্র ইহুদিবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় তবু তাতে মানবজাতির সামান্য কিছুও পাওয়া হয় না।” (পৃষ্ঠা-৬৫)

একইভাবে ইহুদি আর খ্রিষ্টানদের মাঝের সম্পর্ক যা দাঁড়ায় তা হলো: ইহুদিদের মুক্তিতে খ্রিষ্টানদের একমাত্র স্বার্থ হলো সাধারণ মানবিক এক তাত্ত্বিক স্বার্থ। ইহুদিবাদ এমন এক ব্যাপার, যা খ্রিষ্টানদের ধার্মিক চোখে বালির মতো যন্ত্রণা দেয়। তাদের চোখ আর ধার্মিক না থাকলে ব্যাপারটাও আর ঝামেলাজনক থাকে না। মোদ্দা কথা, ইহুদিদের মুক্তিতে খ্রিষ্টানদের কিছু করবার নেই।

অপরদিকে নিজেদের মুক্ত করবার খাতিরে ইহুদিদের শুধু নিজের কাজটা সারলেই চলবে না। তার সঙ্গে খ্রিষ্টানদের কাজও শেষ করতে হবে (মানে যীশুর জীবন এবং সিনোপেটিক ইতিহাসের পর্যালোচনা, ইত্যাদি)। “এটা তাদের নিজেদেরই মোকাবেলা করতে হবে, তাদের ভাগ্য তাদেরই নির্ধারণ করতে হবে; কিন্তু ইতিহাস নিয়ে তো ছেলেখেলা করা যায় না।” (পৃষ্ঠা ৭১)

আমরা চেষ্টা করছি সমস্যাটির ধর্মতাত্ত্বিক সূত্রায়নটা ভেঙে বের হয়ে আসতে। আমাদের জন্য ইহুদিদের মুক্তি অর্জনের সামর্থ্যের প্রশ্নটা যে প্রশ্নে রূপান্তরিত হয়েছে তা হলো: ইহুদিবাদ নিশ্চিহ্ন করতে হলে কোন বিশেষ সামাজিক উপাদান অতিক্রম করতে হবে? কারণ মুক্তির জন্য আজকের দিনের ইহুদিদের সামর্থ্য হলো আজকের দুনিয়ার মুক্তির সঙ্গে ইহুদিবাদের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক অনিবার্যভাবেই প্রবাহিত হয় আজকের শৃঙ্খলিত দুনিয়ার মাঝে ইহুদিদের নির্দিষ্ট অবস্থান হতে।

বাউয়ের-এর মতো কাঠমোল্লা ইহুদিদের না নিয়ে জাগতিক, প্রতিদিনের ইহুদি নিয়ে আলোচনা চালানো যাক।

ইহুদিদের রহস্য তার ধর্মের মাঝে না খুঁজে বরং বাস্তব ইহুদিদের মাঝে তার ধর্মের রহস্য খোঁজা যাক।

ইহুদিবাদের জাগতিক ভিত্তি কি? ব্যবহারিক প্রয়োজন, আত্মস্বার্থ।

ইহুদিদের জাগতিক ধর্ম কি? ফেরিবাজি। তার জাগতিক ঈশ্বর কে? টাকা।

বেশ! তাহলে ফেরিবাজি আর টাকা হতে মুক্তি, ফলে ব্যবহারিক, বাস্তব ইহুদিবাদ হতে মুক্তিই হবে আমাদের কালের আত্মমুক্তি।

ফেরিবাজি, ফেরিবাজির সম্ভাবনা যে ভিত্তির ওপর টিকে থাকে – সেই ভিত্তি নিশ্চিহ্ন করতে পারে এমন সামাজিক গঠন তৈরি করলে ইহুদি হওয়া অসম্ভব হয়ে যাবে। তার ধর্মীয় চৈতন্য এক অরুচিকর আবরণের মতো সমাজের স্বাস্থ্যকর হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। অন্যদিকে, যদি ইহুদিরা বুঝতে পারে যে তার এই ব্যবহারিক স্বভাব চরিত্র অকাজের, এবং তা নিশ্চিহ্ন করতে সে কাজ করে, তাহলে সে তার আগের বিকাশের ধারা হতে সরে এসে প্রকৃত অর্থে মানব মুক্তির পক্ষে কাজ করবে, মানব আত্ম-বিচ্ছিন্নতার চূড়ান্ত ব্যবহারিক প্রকাশের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবে।

আমরা তাই ইহুদিবাদের মাঝে বর্তমান কালের এক সার্বিক ও সাধারণ সমাজবিরোধী উপাদান চিহ্নিত করি, যে ক্ষতিকর উপাদানকে ঐতিহাসিক বিকাশের মাঝ দিয়ে যেখানে ইহুদিরাও আগ্রহভরে অবদান রেখেছে, তার বর্তমান চূড়ায় নিয়ে আসা হয়েছে, অবশ্যই তা এখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শুরু হওয়া দরকার।

শেষ বিচারে ইহুদিদের মুক্তি হচ্ছে ইহুদিবাদ হতে মানবজাতির মুক্তি। ইহুদিরা ইতোমধ্যেই ইহুদিয়ানা তরিকায় নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছে।

“যে ইহুদিদের ভিয়েনাতে একমাত্র সহ্য করা হয়, তারা গোটা সাম্রাজ্যের ভাগ্য নির্ধারণ করে তার আর্থিক ক্ষমতা দিয়ে। যে ইহুদির হয়তো জার্মানির সবচেয়ে ছোট রাজ্যেও কোনো অধিকার নেই সে ভাগ্য নির্ধারণ করে ইউরোপের। গিল্ড বা কর্পোরেশনগুলো যখন তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে বা তখনও পর্যন্ত সুনজরে দেখে না, তখন শিল্পকারখানার চিতিয়ে রাখা বুক মধ্যযুগীয় সংগঠনগুলোর একগুয়েমিকে পরিহাস করে। (ইহুদি প্রশ্ন, পৃষ্ঠা-১১৪)

ঘটনাটা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ইহুদিরা ইহুদিয়ানা তরিকায় নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছে তা শুধু আর্থিক ক্ষমতা অর্জন করেই নয়, একই সাথে এর কারণ হচ্ছে – তার মাধ্যমে তো বটেই, তার বাইরেও টাকা এখন বিশ্বশক্তি হয়ে গেছে, আর ব্যবহারিক ইহুদির মরম হয়ে গেছে খ্রিষ্টান জনগণের ব্যবহারিক মরম। খ্রিষ্টানরা যতটুকু ইহুদি হয়েছে ইহুদিরাও ততটুকু নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে।

যেমন, কাপ্তান হ্যামিলটন জানান:

“ধর্মভীরু এবং রাজনৈতিকভাবে মুক্ত নিউ ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা যেন সাপের চোখে তাকিয়ে সম্মোহিত হয়ে আছে। যে সাপ তাদের পিষে ফেলছে তার থেকে ছাড়া পেতে তাদের বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই। কুবের তার দেবতা, যাকে সে কেবল তার মুখ দিয়ে নয়, তার দেহ-মনের সর্বশক্তি দিয়ে উপাসনা করে। দুনিয়া তার কাছে স্টক এক্সচেঞ্জ ছাড়া আর কিছু নয়, প্রতিবেশীর চাইতে বেশি ধনী হওয়া ছাড়া দুনিয়াতে তার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। বাণিজ্যের ভূত তাকে এমনভাবে আছর করেছে যে, সে লেনদেন করা ছাড়া বিশ্রাম পায় না। বেড়াতে গেলে সে যেন দোকান, ক্যাশ বাক্স কাঁধে নিয়ে বের হয়, লাভ-মুনাফা ছাড়া তার আর কোনো কথা নেই। যদি সে ক্ষণিকের জন্যও নিজের ব্যবসা থেকে চোখ সরায় তার একমাত্র কারণ অন্যের ব্যবসায় নাক গলানো। (বিউম, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৮৫-১৮৬)

আদতেই উত্তর আমেরিকায় খ্রিষ্টান জগতের ওপর ইহুদিবাদের দাপটের চেহারা এত সোজাসাপ্টা পরিষ্কার, এত স্বাভাবিক যে, খ্রিষ্টীয় মন্ত্রণালয় এবং খোদ সুসমাচারের ওয়াজ নসিহতই হয়ে গেছে বাণিজ্যের বিষয়। দেউলিয়া ব্যবসায়ী গিয়ে চার্চের পুরুত হয়, যেমন সফল পুরুত গিয়ে ঢোকে ব্যবসায়।

“যে সম্মানিত পুরোহিতকে দেখতে পাচ্ছো একেবারে সামনে, তিনি শুরুতে ছিলেন ব্যবসায়ী। তার ব্যবসায় লালবাতি জ্বললো, তিনি হয়ে গেলেন পুরুত। অন্যরা ছিলেন পুরোহিত। কিছু টাকা হাতে জমতেই সব ছেড়ে তিনি ব্যবসা শুরু করলেন। ধর্মীয় মন্ত্রণালয় বহু লোকের কাছেই বেশ ভালো একটা পেশা।” (বিউমঁ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৫-১৮৬)

বাউয়ের দৃষ্টিতে এ এক :

“আজগুবি কায়-কারবার। তত্ত্বে ইহুদিরা রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত, কিন্তু বাস্তবে তার ক্ষমতা বিশাল। বৃহত্তর বলয়ে যে তাকে ব্যক্তি বলে মানে না তার ওপরেই সে রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়। (বাউয়ের, ইহুদি প্রশ্ন, পৃষ্ঠা ১১৪ )

ইহুদিদের ব্যবহারিক রাজনৈতিক ক্ষমতা আর তার রাজনৈতিক অধিকারের দ্বন্দ্ব হলো রাজনীতি আর সাধারণ আর্থিক ক্ষমতার মাঝের দ্বন্দ্ব। যদিও তাত্ত্বিকভাবে রাজনীতি আর্থিক ক্ষমতার চাইতে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু বাস্তবে সে তার দাস।

ইহুদিবাদ শুধু খ্রিষ্টানত্বের পর্যালোচনা আর তার উৎস সম্পর্কে সন্দেহের এক মূর্ত রূপ হিসেবেই তার পাশাপাশি চলেছে এমন নয়। তার আরো কারণ হচ্ছে ব্যবহারিক ইহুদি মরম—মানে ইহুদিবাদ খ্রিষ্টান সমাজেই টিকে থেকেছে, এমন কি সেখানেই তার বিকাশের চূড়ান্ত সীমা স্পর্শ করেছে। সিভিল সমাজের বিচ্ছিন্ন সদস্য যে ইহুদি, সে কেবল সিভিল সমাজের নির্দিষ্ট ইহুদিয়ানারই প্রকাশ।

ইহুদিবাদ ইতিহাসের বিরোধ হিসেবে নয় বরং ইতিহাসকে অবলম্বন করেই টিকে আছে।

সিভিল সমাজ তার নাড়িভুড়ি হতেই বিরামহীনভাবে ইহুদি জন্ম দেয়।

ইহুদি ধর্মের নিজের ভিত্তি কি ছিল? ব্যবহারিক প্রয়োজন, আত্মপরায়ণতা।

ইহুদি একত্ববাদ তাই বাস্তবে বহু প্রয়োজনের বহুত্ববাদ, যে বহুত্ববাদ এমন কি হাতমুখ ধোয়ার জায়গাকেও শরিয়তের বিষয় করে ফেলে। ব্যবহারিক প্রয়োজন, আত্মপরায়ণতা সিভিল সমাজেরই নীতি, আর তা নিখাদভাবে স্পষ্ট হয়ে যায় যখন সিভিল সমাজ সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ব্যবহারিক প্রয়োজন আর আত্ম-স্বার্থের দেবতা হলো টাকা।

টাকা হলো ইসরাইলের হিংসুক ঈশ্বর, সে আর কোনো দেবতাকে সহ্য করে না। টাকা মানুষের আর সব দেবতার জাত নষ্ট করে তাকে বাজারের মাল বানিয়ে ছাড়ে। টাকা হলো সব জিনিসের সার্বিক, স্বপ্রতিষ্ঠিত মূল্য। ফলে সে মানুষ আর প্রকৃতি, উভয় জগতেরই বিশেষ মূল্য লুট করে নিয়েছে। টাকা হলো মানুষের কাজ আর অস্তিত্বের বিচ্ছিন্নকৃত সারসত্ত্বা। এই বিজাতীয় সারসত্ত্বা তাকে শাসন করে, আর সে তারই পূজা করে যায়।

ইহুদিদের দেবতা ইহজাগতিক হয়ে গেছে, বনে গেছে পৃথিবীর ঈশ্বর। বিনিময় বিল হচ্ছে ইহুদিদের সত্যিকারের দেবতা। তার দেবতা এক মায়াবী বিনিময় বিল ছাড়া আর কিছু নয়।

ব্যক্তিসম্পত্তি আর টাকার রাজত্বে প্রকৃতি নিয়ে যে ধারণা দাঁড়িয়েছে তাতে প্রকৃতির অবমাননা আর দুর্গতির শেষ নেই! ইহুদি ধর্মে প্রকৃতি আছে, তবে তা কেবল কল্পনায় বিরাজ করে।

এই জায়গা থেকেই (১৫২৪ সালের একটি পুস্তিকায়) টমাস ম্যুনৎসেরের কাছে অসহ্য বোধ হয়েছিল যে,

“সমস্ত জীবজন্তুও সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, জলের মাছ, আকাশের পাখি, মাটির ওপর গাছ; সমস্ত প্রাণশীল অস্তিত্বকেও অবশ্যই মুক্ত হতে হবে।”

ইহুদি ধর্মে যা অমূর্ত রূপে উপস্থিত (তত্ত্ব, শিল্প, ইতিহাস, মানুষের জন্য মানুষ—এসবের প্রতি বিতৃষ্ণা) তাই টাকাওয়ালা মানুষের বাস্তব, সচেতন অবস্থান, তার গুণ। খোদ প্রজাতি সম্পর্ক, নর-নারীর মাঝের সম্পর্কও বাণিজ্যের বিষয় হয়ে যায়! ফলে নারীও পরিণত হয় বেচা-কেনার সামগ্রীতে।

ইহুদিদের কিম্ভূত জাতীয়তা বেনিয়াদের, সাধারণভাবে টাকাওয়ালাদের জাতীয়তা।

ইহুদিদের ভিত্তিহীন আইন কেবল আত্মস্বার্থে নিজেকে ঘিরে রাখা নিখুঁত কেতাবি আচার-অনুষ্ঠানের, সাধারণভাবে ভিত্তিহীন নৈতিকতা আর অধিকারের ধর্মীয় সঙ মাত্ৰ।

এখানেও মানুষের চূড়ান্ত সম্পর্ক আইনি ব্যাপার মাত্র, আর এই আইনের সাথে তার সম্পর্কের গ্রাহ্যতা আইনগুলো তার নিজ ইচ্ছা আর স্বভাবের সাথে যায় বলে মোটেই তা নয়, বরং এই কারণে যে এগুলো দাপুটে আইন, আর তার বাইরে গেলে প্রতিশোধের শিকার হতে হবে।

বাউয়ের তালমুদে যে ইহুদি যেসুইট’পনা খুঁজে পান, সেই ব্যবহারিক যেসুইট’পনাই আসলে দুনিয়াকে দাবিয়ে রাখা আইনের সাথে খোদ-গরজি দুনিয়ার সম্পর্ক, যেসব আইনকে ধূর্ততার সাথে লঙ্ঘন করাই এই জগতের সবচেয়ে বড় শিল্প।

আদতেই এই আইনি ছকের মাঝে এই দুনিয়ার চলাফেরা মানে ক্রমাগত ঐ আইনকেই বুড়ো আঙ্গুল দেখানো।

ইহুদিবাদ ধর্ম হিসেবে, তাত্ত্বিকভাবে আর বিকাশ লাভ করতে পারেনি, কারণ ব্যবহারিক প্রয়োজনের বিশ্ববীক্ষা সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য, দু’চার ঝাপটাতেই তা শেষ হয়ে যায়।

ব্যবহারিক প্রয়োজনের ধর্ম স্বভাববশেই তত্ত্বে নয়, প্রয়োগে তার পূর্ণতা পায়, এর কারণ সোজা কথায় প্রয়োগই হলো তার আসল সত্য।

ইহুদিবাদ নতুন দুনিয়া সৃষ্টি করতে পারে নি; সে কেবল তার নিজ ক্রিয়াকর্মের চৌহদ্দিতে জগতের নতুন সৃষ্টি এবং শর্তসমূহকেই জড়ো করতে পারতো। কারণ আত্মস্বার্থই যার যুক্তি সেই ব্যবহারিক প্রয়োজন হচ্ছে আসলে পরোক্ষ এক ব্যাপার, সে নিজ পছন্দমতো দিকে নিজেকে বাড়াতে অক্ষম, কিন্তু খোদ সমাজ শর্তের ক্রমাগত বিকাশের দাগ ধরেই তা বাড়তে থাকে। সিভিল সমাজের সম্পূর্ণতার সাথেই ইহুদিবাদ তার শিখরে পৌঁছে, কিন্তু কেবলমাত্র খ্রিষ্টান জগতেই সিভিল সমাজ নিখুঁত হয়েছে। আসলে কেবল খ্রিষ্টানত্বের আধিপত্যেরকালেই (যা সব জাতিগত, স্বভাবগত, নীতিগত এবং তত্ত্বগত শর্তগুলোকে মানুষের কাছে বাহ্যিক করে দেয়) সিভিল সমাজ রাষ্ট্রজীবন হতে পুরোপুরি নিজেকে মুক্ত করে, মানুষের সমস্ত প্রজাতি বন্ধন ছিন্ন করে তার জায়গায় এনেছে অহংবাদ আর স্বার্থপর প্রয়োজনকে এবং মানব জগতকে অবলুপ্ত করেছে একে অপরের সাথে দুশমনের মতো লড়তে থাকা টুকরো মানুষের জগতে।

খ্রিষ্টানত্ব জন্ম নিলো ইহুদিবাদ হতে। সে আবার ইহুদিবাদেই মিলিয়ে গেল।

শুরু থেকে খ্রিষ্টানরা ছিল তত্ত্ব করা ইহুদি, ইহুদিরা তাই ছিল হাতে- কলমের খ্রিষ্টান আর হাতে-কলমের খ্রিষ্টান আর একবার ইহুদি হয়ে গেল। খ্রিষ্টানত্ব বাস্তব ইহুদিবাদ অতিক্রম করেছে কেবল ছায়ায়। সে এতই মহৎ, এতই মরমী যে ব্যবহারিক প্রয়োজনের স্থূলতা বিনাশ করতে গিয়ে সেই প্রয়োজন আসমানে তুলে দেয়া ছাড়া তার করবার কিছু ছিল না।

খ্রিষ্টানত্ব হচ্ছে ইহুদিবাদের মহিমান্বিত চিন্তা, আর ইহুদিবাদ হচ্ছে খ্রিষ্টানত্বের সাধারণ ব্যবহারিক প্রয়োগ, কিন্তু এই প্রয়োগ সার্বিক হয়ে উঠতে পেরেছে কেবলমাত্র তখনই যখন একটি বিকশিত ধর্ম হিসেবে খ্রিষ্টানত্ব প্রকৃতি এবং খোদ নিজের কাছ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে তত্ত্বগতভাবে সম্পন্ন করেছে।

একমাত্র তখনই ইহুদিবাদ সার্বিক আধিপত্য অর্জন করতে পারল, আর পাল্টে ফেললো বিজাতীয়কৃত মানুষ ও প্রকৃতিকে বিজাতীয়যোগ্য, বিক্রয়যোগ্য বিষয়ে, যা কিনা আসলে অহংবাদী প্রয়োজন আর বাজারেরই দাস।

বেচা-বিক্রি হলো বিজাতীয়তার ব্যবহারিক দিক। যেমন মানুষ যতক্ষণ ধর্মের খপ্পরে থাকে, ততক্ষণ সে তার আবশ্যিক স্বভাবকে বিষয়কৃত করতে পারে শুধুমাত্র সেটিকে এক বিজাতীয়, কাল্পনিক সত্ত্বায় পর্যবসিত করে। একইভাবে, অহংবাদী প্রয়োজনের অধীনে থাকলে সে তার কাজ, তার উৎপন্নকে এক বিজাতীয় সত্ত্বার অধীনে এনে, তার ওপর এক বিজাতীয় অস্তিত্বের তাৎপর্য আরোপ করেই কেবল নিজে বাস্তবে সক্রিয় হতে পারে। সেই বিজাতীয় সত্ত্বার নামই টাকা।

তার সর্বাধিক নিখুঁত চর্চায় বেহেশতি আশিষের খ্রিষ্টান অহংবাদ অবশ্যম্ভাবী রূপেই ইহুদিদের বস্তুগত আত্মসর্বস্বতায় পাল্টে যায়, বেহেশতি বাসনা বদলায় দুনিয়াবি অভাবে, বিষয়ীবাদ হয়ে যায় আত্মস্বার্থ। আমরা ইহুদিদের একগুঁয়েমি তার ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করি না, ব্যাখ্যা করি তার ধর্মের মানব ভিত্তি (বাস্তব প্রয়োজন, আত্ম-সর্বস্বতা) দিয়ে।

যেহেতু ইহুদিদের সত্যিকারের স্বভাব সার্বিকভাবে সিভিল সমাজে বাস্ত বায়িত ও ইহজাগতিককৃত হয়েছে, ফলে সিভিল সমাজের পক্ষে তাকে তার ধর্মীয় স্বভাবের অবাস্তবতা বোঝানো সম্ভব নয় যে অবাস্তবতা আসলে কেবল বাস্তব প্রয়োজনেরই ভাবগত দিক। ফলে কেবল তাওরাত আর তালমুদেই নয়, হাল আমলের সমাজেও কোন বিমূর্ততা ছাড়াই একেবারে সর্বোচ্চ মাত্রার অভিজ্ঞতায় আধুনিক ইহুদির যে স্বভাব খুঁজে পাওয়া যায়, তা কেবল ইহুদিদের সংকীর্ণতা হিসেবে নয়, একই সাথে সমাজের ইহুদিয়ানা সংকীর্ণতা হিসেবেও।

একবার সমাজ ইহুদিবাদের প্রয়োগবাদী সারসত্ত্বা বিনাশ করতে সমর্থ হলে (মানে ফেরিবাজি ও তার পূর্বশর্তসমূহ) তখন ইহুদি হয়ে থাকাই হবে অসম্ভব। কারণ তার চৈতন্যের আর কোনো বিষয় থাকবে না, ইহুদিবাদের বিষয়ীগত ভিত্তি, বাস্তব প্রয়োজনগুলো তখন মানবিক হয়ে যাবে, ব্যক্তিক সংবেদনগত অস্তিত্ব এবং তার প্রজাতি-অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব নির্মূল হয়ে যাবে।

ইহুদিদের সামাজিক মুক্তি হলো সমাজের ইহুদিবাদ হতে মুক্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *