ভূমিকা (ইহুদি প্রশ্নে)

ভূমিকা (ইহুদি প্রশ্নে)

০১.

‘ইহুদি প্রশ্নে’ মার্কস রচনা করেন ২৫ বছর বয়সে। বয়সটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মার্কসের জীবনের প্রথমদিকের রচনাবলী গতানুগতিক মার্কস চর্চায় বরাবরই ছক বাঁধা পথে এগোনোতে ঝামেলা বাঁধিয়েছে। অর্থনৈতিক ভিতকে মার্কস যে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন তার বদলে এমনকি মার্কস অনুসারীদের অনেকের কাজেকর্মে বুর্জোয়া অর্থে শুধু পণ্য বিনিময়ের স্তরেই এই ধারণাকে সীমাবদ্ধ রাখার ঝোঁক প্রবল। ফলে মার্কসের শিক্ষা বহুলাংশেই যেন অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যা বলে বোধ হয়। এঙ্গেলস নিজে এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। ১৮৯০ সালে জোসেফ ব্লখের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি এ ব্যাপারে আক্ষেপ করে বলেছেন— ‘… মিথষ্ক্রিয়ায় অন্তর্গত অন্যান্য বিষয়ের প্রতি উপযুক্ত গুরুত্ব দেয়ার মতো সময়, জায়গা বা সুযোগ সব সময় আমরা পাইনি।’ প্রতিটি মানুষই তো তার কালের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। ফলে বর্তমান চারপাশের বহু ঝামেলা অনেক মৌলিক প্রশ্নকে আড়াল করে দেয়। কার্ল মার্কসও এর বাইরে ছিলেন না। তবে তাঁর জীবনের প্রথমদিককার রচনাতে যে সার্বিকতা পাওয়া যায় তা আলোচনার বাইরে থেকে যাওয়াতে মানুষ জীবনের বহু মৌলিক প্রশ্ন মার্কস চর্চাকারীদের অনেককে হয় নিশ্চুপ রাখে, এড়িয়ে যেতে বাধ্য করে নয়তো এলোমেলো পথে ঘোরায়। ফলে ইতিহাস বদলের মার্কসের প্রস্তাবনা নিতান্ত অর্থনীতিবাদী রাজনৈতিক বিপ্লবের স্তরে পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এই সমস্যার জন্য আমাদের আলস্যও দায়ী। মার্কসের দেয়া ভুবনদৃষ্টি স্থান, কাল অনুযায়ী বিকশিত করবার দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে যা হচ্ছে তাই হওয়ার কথা।

আসলে মানুষ কোনো কিছু তৈরি করবার আগে তার একটা রূপ তার মাথাতেই থাকে। বহাল বিশ্বব্যবস্থা শব্দ, ধারণার যে বোধ তৈরি করে তাকে নতুন করে বুঝে নেয়া ছাড়া বদলানোর ভাবনা বাতুলতা, ক্রিয়া অর্থহীন। মার্কসের প্রাথমিক রচনাবলী জগতকে ব্যাখ্যা করবার যে নতুন শব্দ বোধ তৈরি করেছে তাকে পাঠ করা এজন্যই অনিবার্য। ‘ইহুদি প্রশ্নে’ সেই অর্থে রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম, ব্যক্তি, মানুষ ও টাকার সম্পর্ক বিচারে যে বিশাল ও নতুন প্রকল্প হাজির করছে তা পুঁজিতন্ত্র বুঝতে পারেনি। পারবেও না, কারণ দুই জগতের দুই ভুবনদৃষ্টি।

এই বিকল্প জগত মাথায় রেখেই মার্কস পাঠ শুরু করা দরকার।

০২.

‘ইহুদি প্রশ্নে’ লেখা হয়েছিল আধা-সামন্ত জর্মন দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাধারণ লড়াইয়ের অংশ হিসেবে। জর্মন দেশের অন্যান্য বাসিন্দাদের মতো ইহুদিদেরকেও একই নাগরিক অধিকার দেয়া হবে কিনা—এই তর্ক সেই লড়াইয়েরই একটা পরিপ্রেক্ষিত ছিল। মার্কস তখন ছিলেন রাইন গেজেট পত্রিকার সম্পাদক। আসলে মার্কসের ইচ্ছা ছিল হার্মেস নামের একজনের খোলাখুলি ইহুদিবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল লেখালেখির জবাব দেবার। হার্মেস বলতেন, ইহুদিদের বিচরণ সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্রের খ্রিষ্টান ভিত অক্ষুণ্ণ রাখার কথা। এমন সময় বামপন্থী হেগেলীয় ঘরানার ব্রুনো বাউয়ের দুটো লেখা নিয়ে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন। লেখা দুটো ছিল ‘ইহুদি প্রশ্ন’ আর ‘বর্তমান কালের ইহুদি আর খ্রিষ্টানদের মুক্ত হওয়ার সামর্থ্য’। মার্কস বাউয়েরের ছদ্ম র‍্যাডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বাহাস করা বেশি জরুরি মনে করলেন।

মার্কস তখন পারি নগরীতে নির্বাসনে, ফরাসি সাম্যবাদীদের ভাবনা- চিন্তার সাথে যোগ গড়ে উঠছে তাঁর। ১৮৪৩ সালের শেষদিকে তিনি ‘হেগেলের আইন দর্শনের পর্যালোচনা’তে প্রলেতারিয়েতকে নতুন সমাজের বাহক বলে নির্দিষ্ট করেন। ১৮৪৪ সালে দেখা হয় এঙ্গেলসের সাথে। এঙ্গেলস তাঁকে সমাজ জীবনের অর্থনৈতিক ভিত বুঝে নিতে সাহায্য করেন। এ বছরই এ সমস্ত বিষয়গুলো গভীরভাবে বুঝে নেয়ার প্রথম চেষ্টা পাওয়া যায় ‘অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া’ রচনাতে। ১৮৪৫ সালের ফয়েরবাখ থিসিসে ডাকাবুকো মার্কস দেখা দেন। ‘ফ্রাঙ্কো-জর্মন বর্ষপঞ্জী’তে ছাপা নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে তর্কগুলো এই উত্তরণ কালের ফসল।

এ সময় বাউয়ের ছিলেন জর্মন দেশে বামপন্থার মুখপাত্র। ইহুদি প্রশ্নে তাঁর আপাত র‍্যাডিক্যাল প্রস্তাবনা আসলে ইহুদিদের অবস্থান প্রশ্নে কিছুই না করবার ছুতোতে গিয়ে শেষ হয়। বাউয়েরের মতে, খ্রিষ্টান রাষ্ট্রে ইহুদিদের রাজনৈতিক মুক্তির ডাক দেয়া অর্থহীন। প্রথমেই দরকার ইহুদি ও খ্রিষ্টান—দুই পক্ষেরই ধর্মীয় বিশ্বাস ও পরিচয় ত্যাগ করো, খাঁটি মুক্তির দিকে এগোনোর স্বার্থে। কারণ খাঁটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় আদর্শের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। খ্রিষ্টানত্ব হচ্ছে শেষ ধর্মীয় আবরণ যার মাঝে মানব মুক্তির সংগ্রাম নিজেকে ঐতিহাসিকভাবে প্রকাশ করেছে। ইহুদিরা খ্রিষ্টান ধর্মের এই বার্তা গ্রহণ করেনি। ফলে তাদের পার হতে হবে দুটো ধাপ। খ্রিষ্টানদের জন্য একটাই যথেষ্ট।

মার্কস তর্ক শুরু করেন ইহুদিদের সাধারণ নাগরিক অধিকার প্রদানের পক্ষে দাঁড়িয়ে। এই অধিকারকে তিনি বলছেন, ‘রাজনৈতিক মুক্তি’, যা কিনা “সামনের দিকে এক বড় পদক্ষেপ।’

তবে তিনি তখনই বুঝে ফেলেছিলেন, রাজনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামই শেষ কথা নয়। নিখুঁত রাজনৈতিক মুক্তি বাস্তব মানব মুক্তি থেকে ঢের দূরে।

এই রচনাতে তিনি পরিষ্কারভাবে বুর্জোয়া সমাজকে সিভিল সমাজ বলে চিহ্নিত করছেন, যে সমাজে নিঃসঙ্গ সত্ত্বাগুলো বাজারে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে বেড়ায়। এই সমাজ বিচ্ছিন্নতার সমাজ। এখানে মানুষেরই হাতে সৃষ্টি টাকা, রাষ্ট্রের ক্ষমতা শাসিত মানুষেরই কাছে বিজাতীয় হয়ে পড়ে। এই সমস্যা রাজনৈতিক গণতন্ত্র আর মানুষের অধিকার অর্জন করে সমাধিত হয় না। এর গোড়া লুকিয়ে আছে বিচ্ছিন্ন, টুকরো নাগরিক সত্ত্বায়, যেখানে কোনো বাস্তব সম্প্রদায় বোধ নেই। তার আরো প্রমাণ তিনি দিচ্ছেন উত্তর আমেরিকার উদাহরণ টেনে, যেখানে ধর্ম কেতাবি কায়দায় রাষ্ট্র হতে আলাদা কিন্তু ধর্মীয় শাখা প্রশাখা অসংখ্য।

বাউয়ের যখন বলেন যে, ইহুদিদের রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম কালক্ষয় ছাড়া কিছু নয়—মার্কস তখন বলেন, “আমরা বাউয়েরের মতো ইহুদিদের বলি না: তোমরা ইহুদিবাদ হতে র‍্যাডিকালভাবে নিজেদের মুক্ত না করলে রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হতে পারবে না। আমরা বরং তাদের বলি: যেহেতু সম্পূর্ণ এবং পুরোপুরি ইহুদিবাদ পরিত্যাগ না করেও তোমরা রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হতে পারো, সেহেতু রাজনৈতিক মুক্তি নিজে মানবিক মুক্তি নয়। তোমরা ইহুদিরা যদি নিজেদের মানবিকভাবে মুক্ত না করে রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হতে চাও, তবে এই অসম্পূর্ণতা আর দ্বন্দ্বের দায় শুধু তোমাদের নয়, তার জন্য রাজনৈতিক মুক্তির সারসত্ত্বা আর ক্যাটাগরির দিকেও তাকাতে হবে।”

০৩.

অন্তত দুটো কারণে মার্কসের আলোচ্য লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত ধর্ম, রাষ্ট্র ও সমাজ বিচারে মার্কসের পর্যালোচনা পদ্ধতি এখানে তরতাজা অবস্থায় পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, যেভাবে মার্কস ইহুদি প্রশ্নটি উপস্থাপন করেন তার ধরন।

এই তর্কে মার্কসের অবস্থান কি? তিনি যেভাবে সমস্যাটা উপস্থাপন করছেন তা দেখলেই অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যায়। বাউয়ের পুরো ব্যাপারটার সামনে রেখেছেন ধর্মকে, তাও ধর্মতাত্ত্বিক ঢঙে। কিন্তু মার্কস এই দৃষ্টিভঙ্গি মেনে থামলেন না। ‘ইহুদিদের ইহুদি ধর্ম আর মানবজাতির ধর্ম ত্যাগ করা উচিত’ এটুকু মার্কসের কাছে অসম্পূর্ণ লেগেছিল। তিনি বললেন, “কে মুক্ত করবে? কাকে মুক্ত করতে হবে?” এটুকু অনুসন্ধান করলেই যথেষ্ট হচ্ছে না। সমালোচনাকে তৃতীয় একটা জায়গা অনুসন্ধান করতে হবে। তা হলো : “প্রশ্নটা কোন ধরনের মুক্তির? দাবি করা মুক্তির খোদ স্বভাবটা হতে কোন সব পরিস্থিতি উদ্ভূত হবে?”

সমস্যাটা তাহলে কে কাকে মুক্ত করবে সেটা নয়। সমস্যাটা হলো মুক্ত করবার চরিত্র কেমন তা।

এদিকে আরেকটা কথা গুরুত্বপূর্ণ। কোন ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষকে নিয়ে বিচারে বসলে ঐ ধর্মের নিখাদ শুদ্ধ রূপ নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। যে রাষ্ট্রে ঐ ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস করে তার ওপর ভিত্তি করে বিষয়টিও ভিন্ন রূপ ধারণ করে। রাষ্ট্র যদি রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন না করে তাহলে প্রশ্নটিও শুধু ধর্মতাত্ত্বিক থেকে যায়। এই রূপান্তর ঘটে যখন “রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্র নিজেকে ধর্ম হতে মুক্ত করে রাষ্ট্র ধর্ম হতে নিজেকে মুক্ত করে।” তবে রাষ্ট্র ধর্ম হতে ছাড় পেয়ে মানুষ কিন্তু ধর্ম হতে ছাড় পায় না।

রাষ্ট্রের বাইরেও কিন্তু ধর্ম থেকে যায়। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতা পায়, ধর্ম হতে মুক্তি পায় না। রাষ্ট্র যদি নিজেই মোল্লা সেজে বসে থাকে তাহলে ঐ অপূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র এই রাজনৈতিক মুক্তি দিতে পারে না। রাজনৈতিক তথা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পক্ষে এই মধ্যবর্তী স্বাধীনতা আনা সম্ভব। এই স্বাধীনতা কেমন? “একদিকে মানুষকে সিভিল সমাজের সদস্যতে, এক আত্মপরায়ণ, স্বনির্ভর স্বতন্ত্রে নামিয়ে আনা আর অপরদিকে তাকে নাগরিক, ফৌজদারি ব্যক্তিতে পর্যবসিত করা।” এই ক্ষেত্রে তার অধিকার তার বাস্তবতার সাথে গণ্ডগোল শুরু করে। যখন একজন দিনমজুর দেখে নির্বাচনের সময় তার আর সবচেয়ে পয়সাওয়ালার ভোটের অধিকার সমান তখন আসলে তাদের মাঝের বাস্তব বৈষম্যগুলো রাষ্ট্র হাওয়া করে দিতে চায়। কার্যকরী বাস্তবতাগুলো এমনি করে রাষ্ট্র আর নাগরিকের সম্পর্ক বিচারে হাওয়া করে দেয়ার সাথে ধর্মীয় রহস্যবাদের মর্মগত কোনো ফারাক নেই।

রাজনৈতিক মুক্তির আদর্শ আদল আসে তার রাষ্ট্র হতে, বস্তুগত রূপের অবস্থা সে গ্রহণ করে সমাজ হতে। একদিকে সে মানুষকে সিভিল সমাজের সদস্য করে ফেলে অন্যদিকে সে তাকে বাধ্য করে নিজের মাঝে গোটানো ব্যক্তি হতে, যে সংকুচিত তার ব্যক্তি স্বার্থে, ব্যক্তি লোভে, যে নিজের সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন। সমাজ এমনি করেই আত্ম-স্বার্থপরায়ণ ইহুদি তৈরি করে।

টাকা ইহুদিদের খোদা হয়ে উঠেছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায় এই ইহুদি খোদা এখন আর শুধু ইহুদিদের খোদা নেই। সে এখন দুনিয়াব্যাপী ঈশ্বরে পরিণত হয়েছে।

লক্ষণীয়, ঐ কালে ইহুদিদের মাঝে হরেক রকম পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়া চলছিল। মার্কস কিন্তু এর কোনোটাকেই জাতীয়তাবাদী দাবি হিসেবে গ্রাহ্য করেননি। অন্যদিকে কিন্তু তিনি আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ডের জাতিসত্তা আন্দোলন, জর্মন ও ইতালীয় জাতীয় ঐক্য সমর্থন করেছেন। ইহুদিবাদকে তিনি বলছেন ‘কিম্ভূত’ জাতীয়তা।

ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নজর করা যায়:

প্রথমত, ধর্মকে তার চারপাশের পরিস্থিতি ও শর্ত দিয়ে বিচার করতে হবে। একই ধর্ম রাষ্ট্র, জাতিভেদে ভিন্ন প্রেক্ষিত হাজির করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ধর্ম যে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার স্তরে শেকড় গেড়েছে সেই রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা এখন স্তর বদল করেছে। সামাজিক স্তর বদলের সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কৃতির বদল সমান তালে ঘটে না। ফলে বর্তমানের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বদলের সাথে এই সাংস্কৃতিক বদল সমান তালে ঘটবে না। প্রক্রিয়াটি হবে আরো জটিল।

বাউয়ের যেখানে ইহুদি সমস্যা শুধু ধর্মের দৃষ্টিকোণ হতে দেখছেন মার্কস তখন বিচারের পাল্লায় নিচ্ছেন দুনিয়াবি যে মানুষেরা ইহুদি নামে পরিচিত তার দিক। তাঁর আলোচনায় ধর্মের ধর্মতাত্ত্বিক প্যাঁচ-পয়জার বাদ যাচ্ছে কিন্তু যে বাস্তব মানুষেরা ঐ তরিকা অনুসরণ করছে তাদের ঐ ধর্ম সংস্কৃতি ভিত্তিক অন্তর্কাঠামো কিন্তু বাস্তব। এই জায়গায় বেহেশত- দোযখের বাস্তবতা বা অবাস্তবতার প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু এই ভাবনার পরিকাঠামো যে জাগতিক, বাস্তব শক্তি হয়ে ওঠে তার সাথে চলমান জগতের সংঘাত বা মিলনের সম্পর্কে অনিবার্যভাবে উপযুক্ত গুরুত্ব দাবি করে। গরিব মুসলমান যখন আরব দেশে পেটের দায়ে গায়ে খাটতে গিয়ে আরেক মুসলমান ভাইয়ের মুখে ‘মিসকিন’ নামে ডাক শুনতে পায়, সেই আবার তার মুসলিম পরিচয়ে বুশের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় কেন? এর উত্তরের একটা অংশ নিশ্চয়ই তার ধর্ম, মানে তার অতীত উপরিকাঠামোতে লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ ধর্ম সংস্কৃতি শুধু স্বীকার-অস্বীকারের প্রশ্ন নয়। এই প্রশ্ন উল্টো বিশ্ববীক্ষাকে তার পায়ের ওপর দাঁড় করানোর। এই উপরিকাঠামোকে বিষয়গত বাস্তবতায় বদলানো নিশ্চয়ই ধর্মের সাপেক্ষে মার্কস অনুসারীদের কাজের অংশ।

০৪.

ইহুদিদের বিদ্যমান সমাজেই সম্পূর্ণ অধিকারের সমর্থন করতে গিয়ে মার্কস রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভেবেছেন। এখানে আলাদা করে একেকটা আংশিক মুক্তি বা অধিকার পাওয়া যেতে পারে কিন্তু বিভিন্ন অংশগুলোর অধিকার সংক্রান্ত সংঘাত থামবে না। এই সংঘাতহীন মুক্তি পাওয়া যাবে “যখন মানুষ তার ‘নিজের ক্ষমতা’ চিনে নেবে, গুছিয়ে নেবে সামাজিক শক্তি হিসেবে, আর তার ফলে সামাজিক ক্ষমতাকে রাজনৈতিক ক্ষমতার আদলে নিজের থেকে আলাদা করবে না।”

রচনাটির অপেক্ষাকৃত ছোট দ্বিতীয় অংশে একই ধরনের বিবেচনা প্রয়োগ করেছেন টাকার ক্ষেত্রে। মার্কস লিখেছেন: “টাকা থেকে মুক্তি… হবে আমাদের কালের আত্মমুক্তি।” হালকাভাবে পাঠ করলে টাকার বিরুদ্ধে এই আক্রমণকে “বাস্তব, দুনিয়াবি” ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রচারণা বলে মনে হতে পারে। মার্কস লিখছেন:

“টাকা এখন বিশ্বশক্তি হয়ে গেছে, আর ব্যবহারিক ইহুদির মরম হয়ে গেছে খ্রিষ্টান জনগণের ব্যবহারিক মরম। খ্রিষ্টানরা যতটুকু ইহুদি হয়েছে ইহুদিরাও ততটুকু নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে।”

এরপরেই টমাস হ্যামিলটনের রচনা হতে উত্তর আমেরিকার ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টানদের টাকা কামাই করবার উন্মত্ত চেষ্টার বর্ণনা আছে। এই অংশটুকু পাঠ করলে বোঝা যায় মার্কসের আক্রমণ ইহুদি জনগণের প্রতি নয় বরং টাকার নেশায় ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের প্রতি। এই ইহুদিয়ানা স্বভাবের নিরাময় খ্রিষ্টান বা নাস্তিক হওয়াতে হবে না। এর জন্য চাই টাকাহীন সমাজ যেখানে ‘টাকা বানানো ইহুদি স্বভাব’ কোনো কাজে আসবে না।

০৫.

মার্কস ইহুদি প্রশ্ন নিয়ে বলতে গিয়ে ইহজাগতিক উদার রাষ্ট্রের করণীয়র প্যাচে নিজেকে আটকে ফেলেননি। সমস্যাটা তাঁর কাছে কোনো আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমস্যা ছিল না। তা হলে ব্যাপারটা একেকজন আলাদা ইহুদির সিভিল সমাজে অধিকারের মরতবা নিয়ে নেবে। তখন পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে মানুষের মুক্তির পুরোনো ঝামেলার ফেরে পড়তে হবে। এখানে প্রতিটি স্বাধীনতাই অন্যসব রকমের স্বাধীনতা হতে বিচ্ছিন্ন। আপনি ব্যবসার স্বাধীনতা পাবেন, তখন মজুরের স্বাধীনতা বলতে থাকবে না খেয়ে মরবার স্বাধীনতা। আপনার নিজের সম্পত্তি থাকবে তবে তার জন্য প্রতি মুহূর্তে অন্যের সম্পত্তির অধিকারকে আপনার বুড়ো আঙুল দেখাতে হবে।

মার্কস খোদ প্রশ্নটাকেই প্রশ্ন করলেন। কোনো ইহজাগতিক ধাঁচের রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিলেই কি ইহুদি প্রশ্নের সমাধান হবে? এমন কোনো রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললেও ধর্মীয় পরিচয়, ধর্মীয় ঠোকাঠুকি কি এই খোদগরজি সমাজে সুরাহা হবে, না কি আরো প্রকট হবে? মার্কস অতএব, একটা সামাজিক সমস্যাকে নিখাদ ধর্মীয় পরিচয়ের সমস্যা হিসেবে দেখার বিপদ নিয়ে আমাদের সাবধান করেন। একই সাথে তিনি উদার সব রকমের অধিকার মানে এক্ষেত্রে ইহুদিদের অধিকারের ধারণা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। এখানে উদার অধিকারের ধারণা অন্যরকম ভেক ধরে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোকে নিতান্ত আলাদা মানুষের টুকরো টুকরো অধিকারে বদলে দেয়।

সমাধান তাহলে লুকিয়ে আছে সমাজ রূপান্তরের মাঝে। ইহজাগতিক উদার রাষ্ট্রের গোলক ধাঁধার রাজনীতি থেকে বের হতে না পারলে এ সত্য বোঝা যাবে না। এখানে বড় একটা শিক্ষা নেয়ার আছে। কোনো দীর্ঘস্থায়ী ঘটনায় যারা নিজেরাই উপাদান তারা এর অংশ হিসেবেই এক ফেরে পড়ে যায়। ঐ ঘটনার বহাল তবিয়তের ধরন-ধারণ তখন বড় জটিল মনে হয়, এর থেকে যাওয়াটাই তার চরিত্র নির্ধারণে সমস্যা করে। ফলে একে স্বতন্ত্র, একক বিষয় বলে মনে হয়। মনে হয় সে যেন নিজেই চলে ফেরে, তার চরিত্রের গড়ন যেন সে নিজেই ঠিক করে। মার্কসের কাছ থেকে শিক্ষা নিলে এই প্যাঁচ-পয়জার থেকে বের হওয়ার সাহস পাওয়া যাবে। সাহস, কারণ তখন সমস্যা তার শুধু নিজে নিজের ভেতর থাকে না। বের হয়ে আসে। তখন দেখা যায়, যারা এক কালে আলখাল্লা পরে আমজনতাকে ভালো-মন্দের নসিহত করতো তারাই এখন গলায় টাই পরে বহুজাতিকের এক্সিকিউটিভ হয়ে সেই কাজ করছে।

এই সাহস শুধু তত্ত্বের দুনিয়াতে পয়দা করলেই হবে না। দেখবেন, আগেও যারা এখানে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাসকে টেনে এনেছেন তারাও ধর্মকে একক বিষয় হিসেবে দেখে তার একতরফা ডিসকোর্সে সীমাবদ্ধ থেকে গেছেন। ফলে বিষয়টাকে মোকাবিলা করতে গেলে এর এখন পর্যন্ত তৈরি করা ইতিহাসকেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এই মোকাবিলা তত্ত্বে ও প্রয়োগে সমানভাবে চালাতে হবে। তখন দরকার হবে ঐতিহাসিক ঘটনা অনাবৃত করবার কাজে নিজেরাই অংশ হওয়া, ইতিহাস খোঁজা, ইতিহাস লেখা—যাতে প্রশ্নটাকেই প্রশ্ন করা যায়। ধর্মকে তাত্ত্বিকভাবে বুঝে নেয়ার কাজটা হতে হবে একে আলাদা অস্তিত্ব হিসেবে দাঁড় করাবার প্রকল্পের বিরুদ্ধে রণকৌশলের অংশ। তবে মনে রাখতে হবে আমাদের কাজের ভিত্তি ও তাত্ত্বিক বুঝ-সমঝের জমিন।

০৬.

মানুষকে মুক্ত না করে রাজনৈতিক মুক্তির দৌড় কতদূর হতে পারে মার্কস বোধ হয় ‘ইহুদি প্রশ্নে’ তার সবচাইতে দুর্দান্ত খতিয়ান দিয়েছেন। হাল আমলের রাষ্ট্রকে উদার, জনকল্যাণমুখী করবার যে তদবির শোনা যায় তার শক্তিশালী পর্যালোচনা একটু নজর করলে মার্কসের একদম তরুণ বয়সের এই রচনায় পাওয়া যাবে। রাজনৈতিক কার্যকলাপের একেবারে গোড়ার গলদগুলো কাটাছেঁড়া করে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণগুলো রপ্ত করলে তা কাজে দেবে।১৮৪৩ সালেই এই লেখার ভাবনাগুলো তাঁর কাল তো বটেই এমনকি আমাদের কালের থেকেও এগিয়ে থাকা। বর্তমানকে নিয়ে ভাবনা মানে এখনই আজকের সময়টাকে তার ইতিহাসসহ ধরতে শেখা। মার্কস তা বুঝতেন।

মার্কসের মতে, আধুনিক রাজনৈতিক মুক্তি একই কালে “পুরাতন সমাজের মৃত্যু, যে সমাজে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে সার্বভৌমদের ক্ষমতা, রাজনৈতিক পদ্ধতি আশ্রয় করে থাকে। রাজনৈতিক বিপ্লব হলো সিভিল সমাজের বিপ্লব।” রাজা-বাদশা, জমিদারদের আমলের সরাসরি রাজনৈতিক চরিত্র ছিল। নাগরিক জীবনের বিভিন্ন উপাদান, যেমন সম্পত্তি, পরিবার, রুজি-রোজগারের ধরন জমিদারি, তালুক-মুলুকের আঙ্গিক গ্রহণ করে চলতো। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে এগুলোই হলো সমাজের উপাদান। এই রূপেই উপাদানগুলো সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এই সম্পর্ক মানে রাজনৈতিক সম্পর্ক, সমাজের অন্যসব উপাদান হতে ব্যক্তির আলাদা হয়ে যাওয়া তার বাইরে থাকার সম্পর্ক। পুঁজিতান্ত্রিক জমানার আগে জীবনযাপনের গঠন সম্পত্তি বা শ্রমকে সমাজ উপাদানের স্তরে রাখতে পারত না। তখন মানুষ সমাজের ভেতরেই সমাজ গড়ে তুলত। বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো “সমাজ” শব্দটি সক্রিয় রাষ্ট্র বহির্ভূত সামাজিক প্রশাসনের কাজ করে।

এই অবস্থায় ব্যক্তি সামগ্রিক অর্থে রাষ্ট্রতে কোনো ভূমিকা রাখত না। জমিদারির সঙ্গে ব্যক্তির জমিদারির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক মোটা দাগে জনগণের জীবনের সাথে সমাজ রাজনীতির সম্পর্ক। অপরদিকে জনগণের নির্দিষ্ট কিছু নাগরিক ক্রিয়া আর তার সাথে সম্পৃক্ত পরিস্থিতি তার সাধারণ ক্রিয়া আর পরিস্থিতিতে রূপান্তরিত হতো। এরকম রাষ্ট্র-সামাজিক সংগঠনের ফলে রাষ্ট্রের চৈতন্য, তার কাজ-কর্ম আর অভিপ্রায়ের যোগফল, তার সার্বিক রাজনৈতিক ক্ষমতাকে মনে হয় শাসক আর তার চাকর-বাকরের এখতিয়ার। জনগণের সাথে তার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হতো না।

এই পর্যায়ে সমাজ জীবনের সংগঠন কেমন? প্রতিটি ব্যক্তিই কোনো দলের অন্তর্ভুক্ত যা তাকে অন্য দলগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে। তার মানে সামাজিকভাবে অধিকারবোধ বিচ্ছিন্ন, খণ্ডিত রূপে থাকা। মানুষ কোনো না কোনো জমিদারির অন্তর্গত, তার চলাচল সীমিত, সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই টুকরো দল মিলেই বৃহত্তর অর্থে সমাজ গঠনকারী, তাদের মাঝের সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতা, খণ্ডরূপগুলো দুরত্ব বাড়িয়েই দিত। সমাজ জীবন এই স্তরে সমাজ-রাষ্ট্রের দিকে অবস্থা প্রতিকারের জন্য ঘুরে দাঁড়াতে পারে না, সমাজ বরং নিজেই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়ে, ব্যক্তির সক্রিয় সত্ত্বাকে রাষ্ট্রের বাইরে রাখতে সমাজের ভেতরের ভাগগুলোকে আরো স্পষ্ট করে।

রাজনৈতিক বিপ্লবের মাঝ দিয়ে তৈরি রাজনৈতিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়াদি সমস্ত জনগণের এখতিয়ারে এসে পড়ে। জমিদারি, গ্রাম সমাজের বিচ্ছিন্নতা অকেজো হয়ে যায়। এগুলোই সম্প্রদায় হতে জনগণের বিচ্ছিন্নতা প্রকাশ করতো। এমনি করে রাজনৈতিক বিপ্লব বহাল রাজনৈতিক সম্পর্ক বিলোপ করে। সমাজ তার সবচাইতে সরল উপাদানে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে থাকে ব্যক্তি অপরদিকে ঐ ব্যক্তির জীবন গঠনকারী উপাদান, থাকে তার প্রয়োজন, ব্যক্তিক, মর্মগত, নাগরিক অধিকার।

মার্কস এখানে বলছেন যে, আত্মপরায়ণ সমাজের রাজনৈতিক চরিত্র বিলোপ করলে সামাজিক সম্পর্কের সমস্ত বিচ্ছিন্নতা, খণ্ডিত চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ফলে ব্যক্তিরা একই রাজনৈতিক জায়গায় সহাবস্থান করে, রাষ্ট্রীয় জীবনেও অংশগ্রহণ করে। এখানে রাষ্ট্রের কাজ-কর্ম আর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয় না। কিন্তু সমাজের খণ্ডিতভাবে মুক্ত হওয়া উপাদানগুলো, মানে ব্যক্তির ক্রিয়া যা জীবনের বিভিন্ন অবিচ্ছেদ্য শর্ত বিচ্ছিন্ন হয়েই চলতে থাকে। এগুলো আর জনগণের সার্বিক অবধানের বিষয় হয়ে উঠে না। সামগ্রিক হয়ে ওঠে ব্যক্তি সর্বস্বতার মামলা, বিশেষের স্বার্থই সেখানে সামগ্রিককে বুড়ো আঙুল দেখায়। মার্কসের মতে, আগের জমানায় নাগরিক আর সমাজ জীবনের রাজনৈতিক টানাপোড়ন বিশেষ আর সার্বিকের অপূর্ণাঙ্গ সম্পর্ক হয়ে পুনর্জন্ম নেয়। রাষ্ট্রের বিষয় প্রতিটি স্বতন্ত্র ব্যক্তির বিষয় হয়ে ওঠে তা ঠিক, তবে জনগণের বিশেষ কাজ-কর্ম আর পরিস্থিতি কোনো সার্বিক রাজনৈতিক পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। মানবিক যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য, মিলেমিশে ভাগ করবার মতো সামাজিকতা এখনো দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়নি। রাজনৈতিক বিপ্লবে সমাজ আর রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের একটা আদর্শিক সমাধান পাওয়া যায়, কিন্তু তা বাস্তব নয়। মার্কস এরপর আরো কৌতূহল উদ্দীপক আলোচনা শুরু করেন। রাষ্ট্রের ভাববাদের পালিশ যত নিখুঁত হয় তা একই সাথে আত্মপরায়ণ সমাজের বস্তুবাদকেও নিখুঁত করে। আগের জমানার রাজনৈতিক জোয়ালটা ছুঁড়ে ফেলা মানে, আত্মস্বার্থপরায়ণ সমাজের মরমকে আটকে রাখা বন্ধনগুলোকেও মুক্ত করে ফেলা। রাজনৈতিক মুক্তি মানে একই সাথে আত্মপরায়ণ সমাজ-রাজনীতি হতে মুক্ত হয়ে যাওয়া। এর মাঝে ব্যক্তির সার্বিকতাকে ধারণ করবার নাম- গন্ধও পাওয়া যায় না। তালুক-মুলুকে আটকা পড়া মানুষ ছিল বিগত সমাজের ভিত্তি। সেই সমাজ তার ভিত্তিতেই মিলিয়ে যায়। মানুষ স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা আলাদা টুকরো সত্ত্বা হয়ে সমগ্র সমাজকে ধারণ করে কিন্তু কোনো সামগ্রিক অস্তিত্ব গঠন করতে পারে না। জমিদারির সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক যেমন কিছু বিশেষ সুবিধা দিয়ে নির্ধারিত হতো বর্তমান সমাজে ঠিক তেমনি ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক আইনি বাধ্যবাধকতা দিয়ে নির্ধারিত। এই সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ অনিবার্যভাবে অরাজনৈতিক জীব।

নিজের তৈরি রাষ্ট্র বা সামাজিক সম্পর্কে সক্রিয় থেকেই মানুষ সমগ্রের সাপেক্ষে নিজেকে জানে। এ কারণে হাল-আমলের সমস্ত মানবিক অধিকারকে মনে প্রাকৃতিক হয়, অরাজনৈতিক। আত্মপরায়ণ মানুষ বিগত সমাজের পরোক্ষ উৎপাদন। রাজনৈতিক বিপ্লব সমাজ গঠনকারী একক ব্যক্তির মাঝে সমগ্র সমাজকে মিলিয়ে দেয়। তাদের বহাল অবস্থাকে আর কোনো পর্যালোচনা করে না। রাজনৈতিক মানে বুর্জোয়া বিপ্লবের চৈতন্যে এটাই শেষ কথা। তখন এক প্রান্তে দাঁড়ায় প্রতিনিয়তকার প্রয়োজনের সাথে যুঝতে থাকা, বাস্তব মানুষ; অন্য প্রান্তে নৈতিক, উপমা দেয়ার মতো, হাওয়াই, কৃত্রিম রাজনৈতিক মানুষ। বাস্তব মানুষের স্বীকৃতি এই সমাজ আত্মপরায়ণ, ধান্দাবাজ ব্যক্তিকেই দেয়, রাষ্ট্রের মাঝে যে ব্যক্তি এক হাওয়াই নাগরিকের বেশি কিছু নয়। ব্যক্তি মানুষ নিজের মাঝেই কয়েদ হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক বিপ্লব রাষ্ট্রের বহাল, অনড় অবস্থার মতোই সমান রকম বাস্তব রূপ নেয়। রাষ্ট্রের রাহসিক, অধিবিদ্যক রূপের মতো রূপ লাভ করে ব্যক্তি মানুষ। তার সংস্কৃতি, শিল্পের একই কানাগলিতে ঘুরে মরা নজরে পড়ে। রাজনৈতিক সার্বিকতায় আপাদমস্তক বদলে যাওয়ার বদলে সে তা বর্জন করে বসে।

আধুনিক রাজনৈতিক রাষ্ট্রে স্বতন্ত্র ব্যক্তির প্রত্যক্ষ, তাৎক্ষণিক স্বার্থই চূড়ান্ত বাস্তবতা। এই শর্ত ধরেই অপর ব্যক্তির সাথে তার সম্পর্ক, পরিচয় নির্ধারিত হয়, যাকে জায়েজ করে রাষ্ট্রের আইন, প্রতিষ্ঠান। মানুষ বেঁচে থাকে বিগত যুগের জীবন্ত স্মৃতি চিহ্ন হয়ে।

আধুনিক রাষ্ট্র আত্মপরায়ণ সমাজের মানুষকে যেমন আছে তেমনভাবেই অপরোক্ষ রূপে বাস্তব আর স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়। ব্যক্তির সামগ্রিকতায় বাস্তব অস্তিত্বের বিপরীতে নাগরিকের হাওয়াই, অবাস্তব রাজনৈতিক জীবনই হয়ে ওঠে বাস্তব জীবন। তার ফলে রাষ্ট্র অবাস্তব, হাওয়াই রূপের নাগরিক জীবনকেই স্বীকৃতি দেয়, তাকেই রক্ষা করে। সমাজের আপাত স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে বুঝতে হলে রাজনৈতিক মুক্তির ভিত্তি হিসেবে, রাজনৈতিক বিপ্লবের ভিত হিসেবে আত্মপরায়ণ সমাজের ব্যক্তিকে এমনি করেও বুঝতে হবে।

রাজনৈতিক দর্শনের জমিনে এই বিশ্লেষণ কার্ল মার্কসের খুব বড় অবদান। “রাজনৈতিক জীবন নিজেকে নিছক এক উপায় বলে ঘোষণা করে, যার লক্ষ্যই হচ্ছে আত্মপরায়ণ সমাজের জীবন। বিপ্লবী চর্চা যে নিজের তত্ত্বের সঙ্গে মারাত্মক দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ এ কথা সত্য … মুক্তির অধিকার যখনই রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে নামে তখনই তা আর অধিকার থাকে না। অথচ তত্ত্বে কিন্তু রাজনৈতিক জীবন সোজাসাপ্টা কথায় স্বতন্ত্র মানুষের নিশ্চয়তা বিধান করে। আর তা যদি তার লক্ষ্যের সাথে, মানে মানুষের এইসব অধিকারের দ্বন্দ্ব করে তাহলে তাকে পরিত্যাগ করা উচিত। কিন্তু চর্চা তো কেবল ব্যতিক্রম আর তত্ত্বই নিয়ম!”

০৭.

রাজনৈতিক রাষ্ট্র মানুষের বস্তুগত জীবনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে। এর একদিকে আত্মপরায়ণ জীবন দাপটের সাথে টিকে থাকে রাষ্ট্রের চৌহদ্দির বাইরে সমাজের ভেতরে। সবাই একে সমাজেরই বৈশিষ্ট্য বলে তার মতো করে চলতে বাধ্য হয়। এই ঠুটো রাষ্ট্র যত নিখুঁত হয় ততই মানুষের সমাজ জীবনে তার প্রভাব কমতে থাকে। কারণ মানুষের সাথে তার সম্পর্ক কেবল কিছু ফৌজদারি সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। তার মাঝে মানুষ চিন্তায়, চৈতন্যে, বাস্তবে দু’মুখো জীবন যাপন করে। একদিকে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের জীবন যেখানে সে নিজেকে দেখে এক সম্প্রদায়গত সত্ত্বা হিসেবে। অপরদিকে আত্মপরায়ণ সমাজ জীবন, যেখানে সে একাকী, যেখানে প্রতিটি অপর মানুষই তার ধান্দা হাসিলের হাতিয়ার, তার স্বার্থের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী। তৃতীয় এই মাধ্যমের মাঝ দিয়ে মানুষকে দেখতে গিয়ে, চিনতে গিয়ে সে এক বিজাতীয় ক্ষমতার দাস হয়ে পড়ে। জীবে জীবে পর্দা হয়ে সে একা হয়ে পড়ে। জগত হয়ে পড়ে অবোধ্য, রহস্যময়। আগের কালের ধর্মীয় রহস্যবাদ আজকে এমনি করে রূপ নিয়েছে সর্বময় কিন্তু যেন অবোধ্য বাজারের ক্ষমতায়।

একদিকে বাজার সমাজ আর অপরদিকে রাজনৈতিক রাষ্ট্র। এই দুইয়ের মাঝের সম্পর্ক ঠিক যেন পরকাল আর ইহকালের সম্পর্কের মতোই মরমী। জাগতিক বাসনা, অতৃপ্ততা, কখনো ক্ষোভকে ধর্ম যেমন ধারণ করে, বাস্তবকে অমূর্ত করে, রাজনৈতিক রাষ্ট্রও তেমন ধান্দাবাজির সমাজ, অতৃপ্ততা, অসাম্যকে ধারণ করে বাস্তব সমস্যাগুলোর হাওয়াই রূপ দিয়ে। সেখানে আইনের চোখে সবাই সমান, যার কোনো বাস্তব প্রয়োগ তার বহাল অসাম্য বজায় রেখে অসম্ভব। সমাজের ভেতর তার ব্যক্তিসত্ত্বা তাকে আত্মপরায়ণতার কাছে বলি দিয়ে নিঃসঙ্গ করে। আর রাষ্ট্রে তার সমন্বিত সত্ত্বা স্বীকৃত, কিন্তু এই সমন্বয় পুরোটাই কাল্পনিক, তার বাস্তব, ব্যক্তি জীবনের সাথে যোগহীন। এই রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় বলয়ের কল্পজীবন বাস্তবেরই মরমী প্রকাশ। অর্থাৎ ধর্মের মূল প্রকল্পের সাথে তার কোনো গঠনগত তফাত নেই।

পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের রাজনৈতিক রাষ্ট্র নিজেকে যত ইহজাগতিক করে ততই সে মর্মগতভাবে নিখাদ ধর্মেরই ভূমিকা পালন করতে নেমে পড়ে।

রাষ্ট্র নিজেকে ব্যবসা হতে আলাদা করে ফেলেছে। তার ফলে ব্যবসা অস্বীকৃত হয়নি বরং রাষ্ট্রের ওপরই খবরদারি করছে। এভাবেই ধর্মের উপরিকাঠামোগত উপাদান নিজেই ধারণ করে রাষ্ট্রকে ইহজাগতিক ঘোষণা করলে ধর্ম অস্বীকৃত হয়ে যায় না। এতে তার মাঝের ঐতিহাসিক, উপরিকাঠামোগত অসমাধিত প্রশ্নগুলো রাষ্ট্রের ওপরই চেপে বসে। বাংলাদেশে তথাকথিত মৌলবাদের কান ফাটানো আওয়াজ আর রাষ্ট্রের মডারেট মুসলিম হওয়ার দাবি এ কথাই তো বলছে।

জাভেদ হুসেন
ঢাকা, ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *