১. ব্রুনো বাউয়ের, ইহুদি প্রশ্ন ব্রনশভিগ, ১৮৪৩

১. ব্রুনো বাউয়ের, ইহুদি প্রশ্ন ব্রনশভিগ, ১৮৪৩

জর্মন ইহুদিরা মুক্তি চায়। কি রকম মুক্তি তাদের বাসনা? নাগরিক, রাজনৈতিক মুক্তি।

ব্রুনো বাউয়ের তাদের জবাব দিলেন: জর্মন দেশে কেউই রাজনৈতিকভাবে মুক্ত নয়। আমরা নিজেরাই স্বাধীন নই। আমরা কেমন করে তোমাদের স্বাধীন করবো? ইহুদি হিসেবে তোমরা যদি নিজেদের জন্য কোনো বিশেষ রকমের মুক্তি চাও তবে বলতে হয় যে, তোমরা ইহুদিরা খোদ্‌রজি। জর্মন হিসেবে তোমাদের উচিত জর্মন দেশের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করা। মানুষ হিসেবে উচিত মানবজাতির মুক্তির জন্য কাজ করা। তোমাদের যে বিশেষ রকমের নির্যাতন আর অবমাননা ভোগ করতে হয় তাকে বহাল নিয়মের ব্যতিক্রম নয় বরং তার প্রমাণ হিসেবেই অনুভব করা উচিত I

না কি ইহুদিরা খ্রিষ্টান প্রজাদের সমান মর্যাদা চায়? সে ক্ষেত্রে তারা মেনে নেয় যে, এই খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বৈধ, তার সাধারণ নির্যাতনও বৈধ। যদি সাধারণের জোয়ালই মেনে নেয়া গেল তবে বিশেষ জোয়ালটাতে আপত্তি কেন? জর্মনরা কেন ইহুদিদের মুক্তিতে মাথা ঘামাবে যদি ইহুদিরা জর্মনদের মুক্তি নিয়ে মাথা না ঘামায়?

এই খ্রিষ্টান রাষ্ট্র শুধু বিশেষ সুবিধা বোঝে। এই রাষ্ট্রে ইহুদিদের ইহুদি হয়ে থাকার বিশেষ সুবিধা আছে। ইহুদি হিসেবে তার এমন সব অধিকার আছে, যা খ্রিষ্টানদের নেই। যা তার নেই, খ্রিষ্টানদের আছে, এমন অধিকার সে কেন চাইবে?

খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের কাছে মুক্তি চেয়ে, ইহুদিরা দাবি করছে যে, এই খ্রিষ্টান রাষ্ট্র যেন তার ধর্মীয় পক্ষপাত ত্যাগ করে। এই ইহুদি কি নিজের ধর্মীয় পক্ষপাত ত্যাগ করেছে? তবে কি তার অন্য কাউকে নিজ ধর্ম অস্বীকার করতে বলার অধিকার থাকে?

এই খ্রিষ্টান রাষ্ট্র তার একেবারে স্বভাবেই ইহুদিদের মুক্ত করতে অক্ষম; তবে তার সাথে বাউয়ের যোগ করে দেন যে, একেবারে তার নিজের স্বভাবের কারণেই ইহুদিরা মুক্ত হতে পারে না। যতক্ষণ রাষ্ট্রের খ্রিষ্টানপনা আর ইহুদিদের ইহুদিয়ানা আছে, ততক্ষণ এক পক্ষ পারবে না মুক্তি দিতে অপর পক্ষ পারবে না মুক্তি গ্রহণ করতে।

এই খ্রিষ্টান রাষ্ট্র ইহুদিদের প্রতি খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের বাঁধা পথেই আচরণ করতে পারে। তার মানে বিশেষ সুবিধা দেয়া, অন্য প্রজাদের কাছ হতে ইহুদিদের বিচ্ছিন্নতা অনুমোদন করা। কিন্তু তা করা হবে তাকে সমাজের অন্য সব বিচ্ছিন্ন বলয়ের চাপ অনুভব করিয়ে এবং সেই অনুভব সবচেয়ে নিরেট, কারণ সে দাপুটে ধর্মের ধর্মীয় বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু ইহুদিদেরও রাষ্ট্রের প্রতি আচরণ থাকতে পারে ষোলআনা ইহুদিয়ানা ধরনে—মানে, রাষ্ট্রকে তার কাছে বিজাতীয় কিছু একটা হিসেবে দেখা, তার কাল্পনিক জাতীয়তাকে বাস্তব জাতীয়তার, বিভ্রমাত্মক আইনকে বাস্তব আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানো, নিজেকে মানবজাতি হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাটাকে বৈধ মনে করা, ঐতিহাসিক আন্দোলনে অংশ নেয়া হতে নীতিগতভাবে দূরে থাকা, এমন এক ভবিষ্যতে বিশ্বাস স্থাপন করা, যার সাথে মানবজাতির সাধারণ ভবিষ্যতের কোনো মিল নেই আর নিজেকে ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন সদস্য ও ইহুদি সম্প্রদায়কে নির্বাচিত সম্প্রদায় হিসেবে দেখা।

তাহলে, কোন ভিত্তিতে তোমরা ইহুদিরা মুক্তি চাও? তোমাদের ধর্মের খতিয়ানে? সে তো রাষ্ট্রধর্মের জানের দুশমন। নাগরিক হিসেবে? জর্মন দেশে নাগরিক বলতে কিছু নেই। মানুষ হিসেবে? কিন্তু যাদের কাছে আর্জি জানাচ্ছো তোমরা তো তাদের মতোই মানুষ।

ইহুদি মুক্তির প্রশ্নটিকে বাউয়ের নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন, এই প্রশ্নের বিগত সূত্রায়ন এবং সমাধানের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করে। তিনি সওয়াল করছেন, যাকে মুক্ত করতে হবে সেই ইহুদি আর তাকে মুক্ত করবে যে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র—তাদের স্বভাব কি? জওয়াবটা তিনি দিচ্ছেন ইহুদি ধর্মের পর্যালোচনার মাধ্যমে, ইহুদি আর খ্রিষ্টান ধর্মের মাঝের ধর্মীয় বিরোধিতা বিশ্লেষণ করে, খ্রিষ্টান রাষ্ট্রটির সারসত্ত্বা পরিষ্কার করে দেখিয়ে। আর এসব তিনি করেছেন সাহসের সাথে, মোক্ষম যুক্তি দিয়ে, বাক্য বৈদগ্ধ আর গভীরতার সাথে, লেখার ঢঙ যেমন বাহুল্যবর্জিত তেমন শক্তিশালী আর অর্থপূর্ণ।

তাহলে, বাউয়ের কেমন করে ইহুদি প্রশ্নের সমাধান করেন? ফলাফলটা কী দাঁড়ায়? যে কোনো প্রশ্নের সূত্রায়নই হচ্ছে তার সমাধান। ইহুদি প্রশ্নের পর্যালোচনাই ইহুদি প্রশ্নের উত্তর। অতএব, সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:

অন্যদের মুক্ত করবার আগে অবশ্যই আমাদের নিজেদের মুক্ত করতে হবে।

খ্রিষ্টান আর ইহুদিদের মধ্যে বিরোধিতার সবচেয়ে অনড় আঙ্গিক হচ্ছে ধর্মীয় বিরোধিতা। কোনো বিরোধিতা কেমন করে সুরাহা করা যায়? তাকে অসম্ভব করে তুলে। ধর্মীয় বিরোধিতা কেমন করে অসম্ভব করে তোলা যায়? ধর্ম রদ করে দিয়ে। যখনই ইহুদি আর খ্রিষ্টান চিনে ফেলবে যে তাদের নিজেদের ধর্ম মানব মনের বিকাশের ভিন্ন ভিন্ন ধাপ, ইতিহাসের পরিত্যাগ করা ভিন্ন ভিন্ন সাপের খোলস ছাড়া কিছু নয়, আর সেই সাপ হচ্ছে মানুষ— তখন ইহুদি আর খ্রিষ্টানের সম্পর্ক আর ধর্মীয় না থেকে কেবল পর্যালোচনামূলক, বৈজ্ঞানিক ও মানব সম্পর্ক হয়ে যায়। বিজ্ঞান তখন তাদের ঐক্য গঠন করে। তবে, বিজ্ঞানের মাঝের দ্বন্দ্ব বিজ্ঞানের নিজের দ্বারাই মীমাংসিত হয়।

জর্মন ইহুদিরা বিশেষ করে রাজনৈতিক মুক্তির সাধারণ অনুপস্থিতি আর রাষ্ট্রের খুব জোরদার ছাপ মারা খ্রিষ্টান চরিত্রের মোকাবিলা করেন। যাহোক, বাউয়ের-এর ধারণা মতে, ইহুদি প্রশ্নের একটি সার্বিক বৈশিষ্ট্য আছে, যা কিনা বিশেষ রকম জর্মন অবস্থা হতে স্বাধীন। এ হলো রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্কের, ধর্মীয় পক্ষপাত আর রাজনৈতিক মুক্তির মাঝের দ্বন্দ্বের প্রশ্ন। ইহুদি আর রাষ্ট্র উভয়ের কাছে, ধর্ম হতে মুক্তিকে রাখা হয়েছে এক শর্ত হিসেবে যেখানে একপক্ষ রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হতে চায়, আরেক পক্ষ সেই মুক্তিকে কার্যকর করবে আর নিজেও মুক্ত হবে।

“বেশ’, এ কথা বলা হয়, আর তা ইহুদিরাই বলে, “ইহুদিরা মুক্ত হয়ে উঠবে ইহুদি হিসেবে নয়, ইহুদি বলে নয়, তার এমন চমৎকার, সার্বিকভাবে মানবিক নৈতিকতার নীতি আছে বলে নয় বরং ইহুদিরা পশ্চাৎপসরণ করবে নাগরিকতার আড়ালে। আর নিজে নাগরিক হবে, যদিও সে একজন ইহুদি এবং তাকে ইহুদিই থাকতে হবে। বলতে গেলে সে ইহুদি আছে ইহুদি থাকবে, যদিও সে একজন নাগরিক আর বাস করে সার্বিকভাবে মানব শর্তে, তাই তার ইহুদিয়ানা আর বাঁধাধরা স্বভাব সবসময়ই শেষে তার মানবিক আর রাজনৈতিক দায়ের ওপরে থাকে। সাধারণ নীতিগুলো দমিয়ে রাখলেও পক্ষপাত থেকে যায়। আর যদি থেকে যায়, তবে তা বাকি সবকিছুকে ছাপিয়েও যায়। ‘কেবল পরিশীলিতভাবে, বাহ্যিকভাবে রাষ্ট্রজীবনে ইহুদিরা ইহুদি থাকতে পারবে। তাই, সে যদি ইহুদিই থেকে যেতে চায় তবে নিছক বাহ্যিকতাই সার হয়ে চড়াও হবে। মানে তার রাষ্ট্রজীবন সার এবং নিয়মের নিছক সদৃশ বা তার অস্থায়ী ব্যতিক্রম হবে।” (“The capacity of present day Jews and Christians to become free.” Einundzwanzig Bogen, PP 57)

অপরদিকে, বাউয়ের রাষ্ট্রের কাজটিকে কেমন করে উপস্থাপন করেন তা শোনা যাক।

তিনি বলেন:

‘ইদানীংকালে ফ্রান্স আমাদের (ডেপুটিদের কার্যালয়ের কার্যবিবরণী, ডিসেম্বর ২৬, ১৮৪০) ধারাবাহিকভাবে অন্যসব রাজনৈতিক প্রশ্নের মতো ইহুদি সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্নেও এক মুক্তজীবনের ছবি দেখিয়েছে। তা মুক্ত কিন্তু এর স্বাধীনতা আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, তাই তাকে এক প্রতিভাস বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আর অপরদিকে তা এর ক্রিয়া দ্বারা এর স্বাধীন আইনের সাথে দ্বন্দ্ব করছে।

“ফ্রান্সে সার্বিক মুক্তি এখনো আইন হয়নি, ইহুদি প্রশ্নটিরও এখনো সমাধান হয়নি। কারণ আইনগত স্বাধীনতা, সব নাগরিক যে সমান—তা বাস্তব জীবনে সীমাবদ্ধ। এই আইনগত স্বাধীনতা এখনো ধর্মীয় বিশেষ সুবিধা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও খণ্ডিত। বাস্তব জীবনে স্বাধীনতার এই ঘাটতি আইনের ওপর প্রভাব ফেলে তাকে এমনিতে স্বাধীন নাগরিকদের নির্যাতনকারী আর নির্যাতনভোগী ভাগে বিভক্তি অনুমোদন করে।” (পৃষ্ঠা-৬৫)

তাহলে ফ্রান্সে কোথায় ইহুদি প্রশ্ন সমাধা হবে?

“উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইহুদিরা যদি নিজেকে তার আইন দ্বারা রাষ্ট্র ও সহনাগরিকের প্রতি তার দায়িত্ব পালন হতে বিরত হতে না দেয় তবে সে আর ইহুদি থাকবে না। যেমন স্যাবাথের দিনে ডেপুটিদের কার্যালয়ে যাওয়া, দাফতরিক কাজকর্ম করা। প্রতিটি ধর্মীয় বিশেষ সুবিধা, আর তাই একই সাথে বিশেষ সুবিধাভোগী চার্চের একচ্ছত্রতাও পুরোপুরি রদ করতে হবে। আর যদি কয়েকজন বা অনেকজন এমনকি ব্যাপক সংখ্যাগুরুও তখনো ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব পূরণে নিজেদের বাধ্য বলে মনে করে, তাহলে সেটা তাদের নিখাদ ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে ছেড়ে দিতে হবে।” (পৃষ্ঠা- ৬৬)

“বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ধর্ম না থাকলে ধর্ম বলতেও কিছু থাকে না। ধর্ম হতে ধর্মচ্যুত করবার ক্ষমতাটা নিয়ে নাও, তাহলে তার আর অস্তিত্ব থাকবে না।” (পৃষ্ঠা-৭১)

ঠিক যেমন জনাব মার্টিন দু নর্দ সমস্ত আইনে রবিবারের উল্লেখ করা বাতিল করবার প্রস্তাবটিকে খ্রিষ্টানত্বের অস্তিত্বহীনতার ঘোষণা বলে দেখেছেন। তেমনি করেই, একই অধিকারে (যার ভিত্তিও বেশ শক্ত) ইহুদিদের স্যাবাথের আইন থেকে মুক্ত করবার ঘোষণা হবে ইহুদিবাদ বিলুপ্তির ঘোষণা। (পৃষ্ঠা-৭১)

বাউয়ের তাহলে একদিকে দাবি করছেন যে, নাগরিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ইহুদিকে তার ধর্ম আর সাধারণভাবে মানবজাতির ধর্ম পরিত্যাগ করা উচিত। অপরদিকে তিনি বেশ দৃঢ়ভাবেই ধর্মের, রাজনৈতিকভাবে ধর্মের রদকরণকে সামগ্রিকভাবে খোদ ধর্মেরই রদ বলে বিবেচনা করেন। যে রাষ্ট্র ধর্মকে পূর্বানুমান বলে ধরে নেয় তা এখনো সত্যিকারের বাস্তব রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি।

“ধর্মীয় ধারণা অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা নিতে দিতে পারে। কিন্তু সে কোন রাষ্ট্রের? কোন ধরনের রাষ্ট্রের? (পৃষ্ঠা-৯৭)

এইখানে এসে ইহুদি প্রশ্নের একতরফা সূত্রায়ন পরিষ্কার হয়ে যায়। কে মুক্ত করবে? কাকে মুক্ত করতে হবে?—শুধু এটুকু অনুসন্ধান করাই যথেষ্ট ছিল না। অনুসন্ধান করতে হতো যে, প্রশ্নটা কোন ধরনের মুক্তির? যে রকম মুক্তি দাবি করা হচ্ছে তার একেবারে নিজের স্বভাব হতে কি শর্তাদি বের হয়ে আসে? একমাত্র খোদ রাজনৈতিক মুক্তির সমালোচনাই হতে পারতো ইহুদি প্রশ্নের সিদ্ধান্তমূলক সমালোচনা আর ‘কালের সাধারণ প্রশ্ন’তে এর বাস্তব যোগসাধন।

বাউয়ের যেহেতু এই পর্যায়ে প্রশ্নটিকে তোলেননি, তিনি দ্বন্দ্ব বিরোধের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি এমন সব শর্ত সামনে নিয়ে আসেন, যা খোদ রাজনৈতিক মুক্তির স্বভাবের ভিত্তি হতে আসা নয়। তিনি এমন সব প্রশ্ন তোলেন, যা তার সমস্যার অংশ নয়, আর এমন সব সমস্যার সমাধান করেন যাতে প্রশ্নটির উত্তর আর পাওয়া যায় না। বাউয়ের যখন ইহুদি মুক্তির বিরোধীশক্তির সম্পর্কে বলেন যে: তাদের একমাত্র গলদ হচ্ছে যে তারা খ্রিষ্টান রাষ্ট্রটিকে একমাত্র সত্য রাষ্ট্র বলে মনে করেন এবং ইহুদি ধর্মকে তারা যে সমালোচনায় ফেলেন খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের বেলায় তা প্রয়োগ করেন না,” (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩) তখন আমরা তার নিজের গলদটির মূলে যা দেখতে পাই তা হলো, তিনি শুধু ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’টিকে সমালোচনার তোপে ফেলেন, রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রকে’ নয়, তিনি মানবমুক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক মুক্তির সম্পর্কটি অনুসন্ধান করেন না, আর তাই এমন সব শর্তকে সামনে তুলে ধরেন, যা কেবল সাধারণ মানবমুক্তির সাথে রাজনৈতিক মুক্তির পর্যালোচনাহীন গুলিয়ে ফেলা হিসেবেই আখ্যায়িত করা যেতে পারে। বাউয়ের যদি ইহুদিদের প্রশ্ন করেন: তোমাদের জায়গা থেকে কি তোমরা রাজনৈতিক মুক্তি চাওয়ার অধিকার রাখো? আমরা তাহলে পাল্টা প্রশ্ন করি: রাজনৈতিক মুক্তির জায়গা কি ইহুদিদের ইহুদি ধর্ম আর মানুষকে ধর্ম পরিত্যাগ করবার দাবি করার অধিকার দেয়?

ইহুদিরা যে রাষ্ট্রে বাস করে তার ওপর ভিত্তি করে ইহুদি প্রশ্নটি ভিন্ন এক রূপ পরিগ্রহ করে। জার্মানিতে যেখানে কোনো রাজনৈতিক রাষ্ট্র বা রাষ্ট্ররূপে রাষ্ট্র নেই, ইহুদি প্রশ্নটি এখানে তাই একেবারেই ধর্মতাত্ত্বিক। খ্রিষ্টানত্বকে ভিত্তি হিসেবে নেয়া রাষ্ট্রের সামনে ইহুদিরা নিজেদের ধর্মীয় বিরোধিতায় দেখতে পান। এই রাষ্ট্র ঘোষিতভাবেই ধর্মতাত্ত্বিক। সমালোচনা এখানে ধর্মতত্ত্বের সমালোচনা। তার আবার দু’ধারা – ইহুদি আর খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্বের সমালোচনা। তাই আমরা ধর্মতত্ত্বের বলয়েই ছুটোছুটি করতে থাকি, যতই এর ভেতরে আমরা বিশ্লেষণাত্মক হই না কেন।

সাংবিধানিক রাষ্ট্র ফ্রান্সে ইহুদি প্রশ্নটি সাংবিধানিকতার প্রশ্ন, রাজনৈতিক মুক্তির অপূর্ণাঙ্গতার প্রশ্ন। যেহেতু রাষ্ট্রধর্মের এক সদৃশ এখানে বহাল, যদিও অর্থহীন এবং স্ববিরোধী আকারে, সংখ্যাগুরুর ধর্মে, রাষ্ট্রের সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্ক তাই ধর্মীয়, ধর্মতাত্ত্বিক বিরোধিতার সদৃশে বহাল। কেবল উত্তর আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোতে — অন্তত তার কয়েকটাতে ইহুদি প্রশ্ন তার ধর্মতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বাস্তবিক, ইহজাগতিক প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। কেবল যেখানে রাজনৈতিক রাষ্ট্র তার সর্বাঙ্গীণ পরিণত রূপে বহাল, সেখানেই ইহুদি আর সাধারণভাবে ধার্মিক মানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক এবং ফলত রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নিজেকে তার বিশিষ্ট, নিখাদ চরিত্রে প্রকাশ করতে পারে। রাষ্ট্র যখনই ধর্মের প্রতি ধর্মতাত্ত্বিক আচরণ বন্ধ করে, যখনই সে ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র হিসেবে মানে রাজনৈতিকভাবে আচরণ করে তখনই এই সম্পর্কের সমালোচনা আর ধর্মতাত্ত্বিক সমালোচনা থাকে না। সমালোচনা তখন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সমালোচনা। এইখানে এসে প্রশ্নটি যখন তার ধর্মতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে, বাউয়ের-এর বিশ্লেষণও আর বিশ্লেষণাত্মক থাকে না।

“যুক্তরাষ্ট্রে কোনো রাষ্ট্রধর্ম বা সংখ্যাগুরুর ধর্ম অথবা একতন্ত্রের ওপর অন্য তন্ত্রের প্রাধান্য নেই। রাষ্ট্র সব তন্ত্র থেকে আলাদা থাকে।” (Marie ou l’esclavage aux Etats-Unis, etc., by G. de Beaumont, Paris, 1885, P-214) আদতেই উত্তর আমেরিকার এমন কিছু রাষ্ট্র আছে যেখানে “সংবিধান কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস বা চর্চা রাজনৈতিক অধিকারের শর্ত হিসেবে আরোপ করে না।” (প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৫) তথাপি “যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ বিশ্বাস করে না যে ধর্মহীন মানুষ সৎ হতে পারে।” (প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৪)

বিউমঁ, তকভিল আর হ্যামিলটন সাহেব আমাদের একই সুরে আশ্বস্ত করেন যে, উত্তর আমেরিকা সর্বোৎকৃষ্ট ধার্মিকতার দেশ। যাহোক উত্তর আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো আমাদের জন্য কেবল উদাহরণের কাজ দেয়। প্রশ্নটা হচ্ছে: ধর্মের সঙ্গে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মুক্তির সম্পর্ক কি? আমরা যদি দেখি যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মুক্তির দেশেও ধর্ম শুধু অস্তিত্বমান তাই নয় বরং তাজা আর প্রাণবন্ত সতেজতা দেখায়, তাহলে তা প্রমাণ করে যে, ধর্মের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের নিখুঁত তত্ত্বের সাথে ঠোকাঠুকি লাগায় না। ধর্মের অস্তিত্ব যদি কোনো খুঁত হয়ে থাকে তবে, এই খুঁতের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে কেবল খোদ রাষ্ট্রের স্বভাবের ভেতর। আমরা ধর্মকে আর কারণ হিসেবে বিবেচনা করি না, বিবেচনা করি কেবল ইহজাগতিক সংকীর্ণতার প্রকাশ হিসেবে। তাই মুক্ত স্বাধীন নাগরিকের ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করি তাদের ইহজাগতিক সীমাবদ্ধতা দিয়ে। আমরা বলি না যে, এই ইহজাগতিক বাধা- নিষেধ থেকে ছাড়া পেতে তাদের অবশ্যই ধর্মীয় সংকীর্ণতা অতিক্রম করতে হবে। আমরা বলি যে, ইহজাগতিক বাধা-নিষেধ থেকে একবার ছাড়া পেলেই তারা তাদের ধর্মীয় সংকীর্ণতা অতিক্রম করবে। আমরা ইহজাগতিক প্রশ্নটিকে ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নে পরিণত করি না। ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নকেই ইহজাগতিক করে তুলি। ইতিহাস কুসংস্কারে অনেক ডুবে থেকেছে। আমরা এখন কুসংস্কারকে ইতিহাসে ডুবিয়ে দিচ্ছি। ধর্মের সাথে রাজনৈতিক মুক্তির সম্পর্কের প্রশ্নটা আমাদের জন্য হয়ে যায় রাজনৈতিক মুক্তির সাথে মানবমুক্তির সম্পর্কের প্রশ্ন। রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ধর্মীয় দুর্বলতাকে আমরা ধর্মের সাপেক্ষে এর দুর্বলতা থেকে সরে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ইহজাগতিক আঙ্গিকের সমালোচনা দিয়ে সমালোচনা করি। একটি বিশেষ ধর্মের সাথে (ধরা যাক ইহুদি ধর্ম) রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে আমরা মানব আঙ্গিক দেই, এই দ্বন্দ্বকে রাষ্ট্রের সাথে নির্দিষ্ট ইহজাগতিক উপাদানের দ্বন্দ্বে পরিণত করে; রাষ্ট্র আর সাধারণভাবে ধর্মের দ্বন্দ্বকে পরিণত করে রাষ্ট্রের সাথে এর সাধারণ পূর্বানুমানের দ্বন্দ্বে।

ইহুদি, খ্রিষ্টান আর সাধারণভাবে ধার্মিক মানুষের রাজনৈতিক মুক্তি হলো ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টান কিংবা সাধারণভাবে ধর্ম হতে রাষ্ট্রের মুক্তি। রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্র তার নিজের ধরনে, একেবারে তার চরিত্রের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নিজেকে ধর্ম হতে মুক্ত করে খোদ নিজেকে রাষ্ট্রধর্ম হতে মুক্ত করার মাধ্যমে – মানে, রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মের পক্ষে সাফাই গেয়ে নয়, বরং নিজেকে রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করে। ধর্ম হতে রাজনৈতিক মুক্তি- ফয়সালা পর্যন্ত বয়ে নেয়া কোনো ধর্মীয় মুক্তি নয় আর তা বিরোধ হতেও মুক্ত নয়, কারণ রাজনৈতিক মুক্তি ফয়সলা হয়ে যাওয়া, বিরোধবিহীন অথবা দ্বন্দ্ববিহীন হতে মুক্ত মানবমুক্তির কোনো আঙ্গিক নয়।

রাজনৈতিক মুক্তির সীমা একটা বাস্তবতা হতে সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যায়। আর তা হলো রাষ্ট্র-মানুষকে বাস্তবিকভাবে কোনো বাধা-নিষেধ হতে মুক্ত না করেই নিজেকে তা হতে মুক্ত করতে পারে, মানুষ মুক্তমানব না হলেও রাষ্ট্র মুক্ত রাষ্ট্র হতে পারে। না লিখলেও বাউয়ের যে তা স্বীকার করেন সে কথা বোঝা যায় যখন তিনি রাজনৈতিক মুক্তির নিম্নোক্ত শর্ত তুলে ধরেন:

“সমস্ত ধর্মীয় সুবিধা, আর তাই কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া বিশেষ সুবিধা একেবারে নির্মূল করতে হবে, আর যদি কিছু মানুষ বা অনেকে এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠরাও তখনো ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব পালনে নিজেদের বাধ্য বলে বিশ্বাস করে তবে তা তাদের নিখাদ ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবেই ছেড়ে দেয়া উচিত।” (The Jewish Question, P- 65)

অতএব, সংখ্যাগরিষ্ঠজন ধার্মিক হলেও রাষ্ট্রের পক্ষে নিজেকে ধর্ম হতে মুক্ত করা সম্ভব। আর সংখ্যাগরিষ্ঠজনের ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক হওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়টি থাকে না।

কিন্তু সর্বোপরি, ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র আর বিশেষ করে প্রজাতন্ত্রের (মুক্ত রাষ্ট্র) আচরণ শেষ পর্যন্ত ধর্মের প্রতি মানুষেরই আচরণ, যে মানুষ রাষ্ট্র গঠন করে। এ থেকে পাওয়া গেল যে, মানুষ রাষ্ট্রের মাধ্যমিকতার মধ্য দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে, সে কোনো সীমাবদ্ধতা হতে নিজেকে রাজনৈতিকভাবে মুক্ত করে যখন সে নিজের সাথেই দ্বন্দ্বে পড়ে, সে নিজেকে এই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নিয়ে নিয়ে যায় এক অমূর্ত, সীমিত আর আংশিক পথে। এ থেকে আরো পাওয়া গেল যে, রাজনৈতিকভাবে নিজেকে মুক্ত করে মানুষ ঘুরপথে নিজেকে মুক্ত করে, এক মাধ্যমিক পথে, যদিও তা আবশ্যিক মাধ্যমিকতা। চূড়ান্ত বিচারে পাওয়া গেল যে মানুষ নিজেকে রাষ্ট্রের মাধ্যমে নাস্তিক ঘোষণা করলেও—মানে সে রাষ্ট্রকে নাস্তিক ঘোষণা করলেও তখনো ধর্মের কব্‌জার মধ্যে থেকে যায়, সোজা কথায় তার কারণ হলো, সে নিজেকে কেবল ঘুরপথে, কেবল এক মাধ্যমিকতার মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে। ধর্ম হলো, সোজা কথায় এক মাধ্যমিকতার মধ্য দিয়ে, এক ঘুরপথের স্বীকৃতি। রাষ্ট্র হলো মানুষ আর মানুষের মুক্তির মাঝে মাধ্যমিকতা। যেমন, খ্রিষ্টের মতো মাধ্যমিকতার ওপরে মানুষ তার দৈবিকতার সব বোঝা, সব ধর্মীয় ঝামেলা চালান করে দেয়, ঠিক তেমনি রাষ্ট্র হলো সেই মাধ্যমিকতা যার ওপরে মানুষ তার সব অ-দৈবিক, তার সব মানবিক ঝামেলা চালান করে।

ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের রাজনৈতিক উত্তরণে সাধারণভাবে রাজনৈতিক উত্তরণের সমস্ত খুঁত আর সমস্ত সুবিধা থেকে যায়। যেমন, রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্র ব্যক্তিসম্পত্তি রদ করে, নির্বাচিত হওয়া বা নির্বাচত করবার জন্য যখনই সম্পত্তি যোগ্যতা রদ করা হয় তখনই রাজনৈতিক উপায়ে মানুষ ঘোষণা করে যে, ব্যক্তিসম্পত্তি রহিত হলো। উত্তর আমেরিকার অনেক রাষ্ট্রে এমন ঘটেছে। হ্যামিলটন বেশ সঠিকভাবেই এই বাস্তবতাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করেছেন: “সম্পত্তি মালিক আর লগ্নি ধনদৌলতকে টেক্কা দিয়ে জনসাধারণ একদান জিতে নিয়েছে।” (Man and Manners in America)

সম্পত্তিহীনরা যদি সম্পত্তি মালিকদের আইন প্রণয়নকারী হয় তাহলে ভাবগতভাবে কি ব্যক্তিসম্পত্তি রহিত হয়ে যায় না? ভোট দেয়ার অধিকারের জন্য সম্পত্তি যোগ্যতা হলো ব্যক্তিসম্পত্তিকে স্বীকৃতি দেয়ার শেষ রাজনৈতিক আঙ্গিক। তবে ব্যক্তিসম্পত্তির রাজনৈতিক রদকরণ শুধু ব্যক্তিসম্পত্তি উত্থাতেই ব্যর্থ নয়, তা বরং একে পূর্বানুমান করে। রাষ্ট্র যখন ঘোষণা করে যে জন্ম, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা, পেশা—এসব অ- রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য, যখন তা ঘোষণা করে যে এসব পার্থক্য বিচারে না এনে জাতির প্রতিটি সদস্য জাতীয় সার্বভৌমত্বে সমান অংশীদার, যখন তা জাতির বাস্তব জীবনের সমস্ত উপাদান রাষ্ট্রের জায়গা থেকে বিচার করে— রাষ্ট্র তখন নিজের মতো করে জন্ম, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা, পেশার পার্থক্য বিচার তিরোহিত করে। তবে এও ঠিক যে, রাষ্ট্র ব্যক্তিসম্পত্তি, শিক্ষা, পেশাকে তাদের মতো করেই কাজ করতে দেয়—মানে এগুলোকে ব্যক্তিসম্পত্তি হিসেবে, শিক্ষা হিসেবে, পেশা হিসেবে চলতে দেয় আর তাদের বিশেষ স্বভাবের প্রভাবও খাটাতে দেয়। এসব বাস্তব ভিন্নতা দূর করা তো দূরের কথা, এসবের অস্তিত্ব আগে থেকেই মেনে নেয়াতে কেবল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কায়েম থাকে। এর অস্তিত্বের এসব উপাদানের বিপরীতেই কেবল সে নিজেকে এক রাজনৈতিক রাষ্ট্র বলে অনুভব করতে পারে আর এর সার্বিকতা জাহির করতে পারে। হেগেল তাই রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্ক খুব সঠিকভাবেই সংজ্ঞায়িত করেন:

রাষ্ট্র যাতে করে মনের নৈতিক বাস্তবতা, নিজেকে জানতে থাকা কিছু একটা হিসেবে অস্তিত্বমান হয়, তার জন্য কর্তৃত্ব আর বিশ্বাসের আঙ্গিক থেকে একে তফাৎ করাটা আবশ্যিক। তবে ধর্মতান্ত্রিক দিকটা নিজের মাঝে এসে যতটা তফাত হয় এই বিভাষনের বৈশিষ্ট্য ঠিক ততটাই উঠে আসে। কেবল এই পথেই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপরে রাষ্ট্র তার চিন্তার সার্বিকতা অর্জন করেছে এবং অস্তিত্বমান করেছে। এবং এটাই এর মূল রূপ।” (Hegel’s Philosophy of Right, 1st Edition, P- 346 )

অবশ্যই! কেবল এমনি করেই বিশেষ উপাদানগুলোর ওপরে রাষ্ট্র নিজেকে সার্বিকতা হিসেবে গঠন করে।

নিজের স্বভাব অনুযায়ীই নিখুঁত রাজনৈতিক রাষ্ট্র হলো মানুষের বস্তুগত জীবনের বিরোধিতা হিসেবে তার প্রজাতি জীবন। এই অহংবাদী জীবনের সমস্ত পূর্বশর্ত রাষ্ট্রের বলয়ের বাইরে সিভিল সমাজে বহাল থাকে সিভিল সমাজের গুণাবলী হিসেবে। রাজনৈতিক রাষ্ট্র যেখানে এর সত্যিকারের বিকাশ লাভ করেছে মানুষ সেখানে শুধু চিন্তা, চৈতন্যে নয়, বাস্তবে, জীবনেও দু’মুখো জীবনযাপন করে। এর একটা দৈব জীবন, আরেকটা জাগতিক জীবন। একদিকে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ে কাটানো জীবন, যেখানে সে নিজেকে বিচার করে এক সম্প্রদায় সত্ত্বা হিসেবে। অপরদিকে সিভিল সমাজের জীবন যেখানে সে ক্রিয়া করে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে, অন্য মানুষ তার কাছে সেখানে কার্যসিদ্ধির উপায় মাত্র। নিজেকেও সে নামিয়ে আনে উপায়ের পর্যায়ে, হয়ে যায় বিজাতীয় সব শক্তির ক্রীড়নক। পরকালের সঙ্গে দুনিয়ার সম্পর্ক যতটা মরমী, সিভিল সমাজের সাথে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক ঠিক ততটাই মরমী। রাজনৈতিক রাষ্ট্র সিভিল সমাজের ঠিক তেমনই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে। ধর্ম যেমন সংকীর্ণ দুনিয়াবি জগতের ওপর ছেয়ে থাকে, রাজনৈতিক রাষ্ট্রও তেমনি ছেয়ে থাকে সিভিল সমাজের ওপর। মানে একে সবসময় স্বীকৃতি দেয়, পুনরুদ্ধার করে আর নিজেকে এর আধিপত্যে থাকতে দেয়। সিভিল সমাজে—মানে তার সবচেয়ে অ-পরোক্ষ বাস্তবতায় মানুষ এক জাগতিক সত্ত্বা। এখানে, নিজেকে যেখানে সে বিচার করে এক বাস্তব স্বতন্ত্র হিসেবে, অন্যরাও তাকে তেমন করেই দেখে। যেখানে আসলে সে এক কল্প-প্রপঞ্চ। অপরদিকে রাষ্ট্রে যেখানে সে বিবেচিত এক প্রজাতি সত্ত্বা হিসেবে, মায়াময় সার্বভৌমত্বের এক কাল্পনিক সদস্য হিসেবে, সেখানে সে বাস্তব ব্যক্তিজীবন হতে বঞ্চিত হয়ে পায় এক অবাস্তব সার্বিকতা।

কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারী হিসেবে মানুষ তার নাগরিকত্বের সাথে আর সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে অপর মানুষের সাথে দ্বন্দ্ব খুঁজে পায়। এই দ্বন্দ্ব নিজেকে রাজনৈতিক রাষ্ট্র আর সিভিল সমাজের মাঝের জাগতিক বিভাজনের পর্যায়ে নামিয়ে আনে। বুর্জোয়া হিসেবে মানুষের ‘রাষ্ট্রের মাঝে জীবন’ হলো ‘কেবল আবশ্যিক এবং নিয়মের সদৃশ বা এক সাময়িক ব্যতিক্রম।’ অবশ্যই ইহুদিদের মতো বুর্জোয়ারাও কেবল আলগাভাবেই রাজনৈতিক জীবনের বলয়ে থাকে, ঠিক যেমন নাগরিক কেবল আলগাভাবেই একজন ইহুদি বা বুর্জোয়া থাকে। কিন্তু এই গা বাঁচানো এটা স্বয়ং রাজনৈতিক রাষ্ট্রের গা বাঁচানো। ধার্মিক মানুষ আর নাগরিকের মাঝের ব্যবধান হচ্ছে বণিক এবং নাগরিকের মাঝের, দিনমজুর এবং নাগরিকের মাঝের, ভূমি মালিক এবং নাগরিকের মাঝের, জীবন্ত ব্যক্তি এবং নাগরিকের মাঝের ব্যবধান। ধার্মিক মানুষ রাজনৈতিক মানুষের সাথে যে দ্বন্দ্ব খুঁজে পায় তার সঙ্গে বুর্জোয়ার সাথে নাগরিক এবং সিভিল সমাজের সদস্যের সাথে তার রাজনৈতিক সিংহের খোলসের দ্বন্দ্বের তফাৎ নেই।

ইহুদি প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত নিজেকে যে জাগতিক দ্বন্দ্বে পর্যবসিত করে, রাজনৈতিক রাষ্ট্র এবং তার পূর্বশর্তসমূহের দ্বন্দ্ব (তা সে ব্যক্তিসম্পত্তির ইত্যাদির মতো বস্তুগত উপাদান হোক বা ধর্ম বা সংস্কৃতির মতো মরমী উপাদান হোক), সাধারণ স্বার্থ আর ব্যক্তিস্বার্থের মাঝের বিরোধ, রাজনৈতিক রাষ্ট্র আর সিভিল সমাজের মাঝের ঝামেলা—এসব জাগতিক এন্টিথিসিস বহাল থাকতে দিতে বাউয়ের-এর আপত্তি নেই। অথচ তিনি এসবের ধর্মীয় প্রকাশের বিরুদ্ধে তর্ক চালিয়ে যান।

“মোদ্দা কথায় সিভিল সমাজের ভিত্তিতে যে প্রয়োজনে এই সমাজের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হয় এবং এর প্রয়োজনীয়তার জামিন দেয় (যা এর অস্তিত্বধারা বহমান বিপদের মাঝে প্রকাশ করে) সেই প্রয়োজনে এক অনিশ্চয়তার উপাদান রক্ষিত হয়। সেখান হতে দারিদ্র্য আর সম্পদের, দুর্গতি আর সমৃদ্ধির অনবরত পরিবর্তনশীল এক মিশ্রণ উৎপাদন করে এবং সাধারণভাবে এক পরিবর্তন নিয়ে আসে।” (পৃষ্ঠা-৮)

পুরো ‘সিভিল সমাজ’ (পৃষ্ঠা-৮-৯) অধ্যায়টুকু তুলনা করে দেখুন, যা হেগেলের আইন দর্শনের মূল ছক অনুসারে তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক রাষ্ট্রের বিপরীতে সিভিল সমাজ আবশ্যিক বলে স্বীকৃত হয়েছে কারণ রাজনৈতিক রাষ্ট্র আবশ্যিক বলে স্বীকৃত।

রাজনৈতিক মুক্তি নিঃসন্দেহে এক বিশাল অগ্রবর্তী পদক্ষেপ। সত্য যে, এটা সাধারণভাবে মানবমুক্তির চূড়ান্ত রূপ নয়, তবে তা বহাল জগৎ সম্পর্কের মাঝে মানবমুক্তির চূড়ান্ত রূপ। বলাবাহুল্য, আমরা এখানে বাস্তব, ব্যবহারিক মুক্তির কথা বলছি।

মানুষ ধর্ম হতে রাজনৈতিকভাবে নিজেকে মুক্ত করে জনআইনের বলয় হতে একে নিশ্চিহ্ন করে ব্যক্তি আইনে পরিণত করে। ধর্ম আর রাষ্ট্রের মরম (Spirit) নয় যেখানে মানুষ সম্প্রদায়ের মধ্যে অপর মানুষের সাথে আচরণ করে এক প্রজাতি-সত্ত্বা হিসেবে (যদিও তা সীমিত, নির্দিষ্ট রূপে, আর নির্দিষ্ট বলয়ে)। ধর্ম হয়ে গেছে সিভিল সমাজের, অহংবাদী বলয়ের, প্রত্যেকে সবার বিরুদ্ধে-এই ভাবের মরম। তা আর সম্প্রদায়ের নয় বরং ব্যবধানের সারসত্ত্বা। ধর্ম হয়ে গেছে মানুষের তার সম্প্রদায় হতে, নিজ হতে আর অপর মানুষ হতে বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ। আসলে সে ছিলও তাই। এ কেবল নির্দিষ্ট নষ্টামির, ব্যক্তি হুজুগের এবং আত্ম-বিরোধিতার অমূর্ত ব্রত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তর আমেরিকায় ধর্মের অন্তহীন তরিকায় ভাগ হয়ে যাওয়া একে এমন কি বাহ্যিকভাবেও এক নিখাদ ব্যক্তিগত বিষয়ের রূপ দিয়েছে। বহুমাত্রিক ব্যক্তিস্বার্থের মাঝে তা হাজির হয়েছে এক ধাক্কা হিসেবে এবং চলে গেছে একরকম সম্প্রদায়ের বাইরে। তবে রাজনৈতিক মুক্তির সীমা সম্পর্কে কারুর ধন্দ থাকা ঠিক নয়। মানব জাতির জন-মানুষ আর ব্যক্তি মানুষে বিভাজন, রাষ্ট্র হতে সিভিল সমাজে ধর্মের খসে পড়া—এটা রাজনৈতিক মুক্তির স্তর নয় বরং এর সম্পূর্ণতা সাধন। এই মুক্তি তাই মানুষের বাস্তব ধার্মিকতা রদ করেনি, করতে চায়ওনি।

ইহুদি এবং নাগরিক, প্রোটেস্ট্যান্ট এবং নাগরিক, ধার্মিক মানুষ এবং নাগরিক ইত্যাদিতে মানুষের বিভাজন নাগরিকত্বের বিরুদ্ধে চালিত কোনো ছলনা নয়, রাজনৈতিক মুক্তির কোনো বাধা-নিষেধও নয়। এ হলো খোদ রাজনৈতিক মুক্তি, ধর্ম হতে কারো নিজেকে মুক্ত করার রাজনৈতিক পদ্ধতি। যখন এরকম রাজনৈতিক রাষ্ট্র সিভিল সমাজের মাঝ হতে সহিংসভাবে জন্ম নেয়, যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতাই মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের রূপ—সে সময়ে রাষ্ট্র যতদূর সম্ভব ধর্মের রদ, ধ্বংস পর্যন্ত যেতে পারে এবং অবশ্যই যেতে হবে। কিন্তু এ কাজ সে একইভাবে অতটুকুই করতে পারে ঠিক যেমন ব্যক্তিসম্পত্তি উচ্ছেদ করতে যেয়ে খুব বেশি হলে তা অধিগ্রহণ, প্ৰগতিশীল কর আরোপ পর্যন্ত যায়, ঠিক যেমন যায় প্রাণ উচ্ছেদ করতে গিলোটিন পর্যন্ত। বিশেষ আত্মবিশ্বাসের কালে রাজনৈতিক জীবন তার পূর্ব প্রয়োজনগুলো (সিভিল সমাজ এবং এই সমাজ গঠনকারী উপাদানসমূহ) দাবিয়ে রাখতে চায় এবং চায় নিজেকে দ্বন্দ্ব রহিত, মানুষের বাস্তব প্রজাতি জীবন হিসেবে গড়ে তুলতে। কিন্তু তা সে অর্জন করতে পারে কেবল নিজের জীবনের বাস্তব অবস্থার সাথে সহিংস দ্বন্দ্বে গিয়ে, বিপ্লবকে স্থায়ী ঘোষণা দিয়ে, আর তাই, রাজনৈতিক নাটক আবশ্যিকভাবেই শেষ হয় ধর্ম, ব্যক্তিসম্পত্তি এবং সিভিল সমাজের সমস্ত উপাদানের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, ঠিক যেমন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে শান্তিতে।

আদতে একটি আদর্শ বা নিখুঁত খ্রিষ্টান রাষ্ট্র তথাকথিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের মতো নয় যে কিনা ধর্মকে এর ভিত্তি হিসেবে, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ফলত অন্যান্য ধর্মের প্রতি বিশেষ আচরণ গ্রহণ করে। বরং নিখুঁত খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হলো নাস্তিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র ধর্মকে সিভিল সমাজের অন্যসব উপাদানের সাথে স্থান দেয়। যে রাষ্ট্র এখনো ধর্মতাত্ত্বিক, যে এখনো খ্রিষ্টানত্বকে তার উৎস বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, যার এখনো নিজেকে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করবার সাহস নেই-রাষ্ট্র হিসেবে বাস্তবত সে এখনো মানবিক ভিত্তিগুলোকে (খ্রিষ্টানত্ব যার গায়েবি প্রকাশ) জাগতিক, মানবিক রূপে প্রকাশ করতে সফল হয়নি। তথাকথিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্র সোজা কথায় অ-রাষ্ট্রের বেশি কিছু নয়, যেহেতু ধর্ম হিসেবে খ্রিষ্টানত্ব নয় বরং কেবল খ্রিষ্টান ধর্মের মানবিক প্রেক্ষাপটই বাস্তব মানবিক সৃষ্টিতে এর প্রকাশ খুঁজে পেতে পারে।

তথাকথিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হলো রাষ্ট্রের খ্রিষ্টীয় নেতিকরণ, কোনো মতেই তা খ্রিষ্টানত্বের রাজনৈতিক বাস্তবায়ন নয়। যে রাষ্ট্র এখনো খ্রিষ্টানত্বকে ধর্মীয় রূপে মানে, এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রতি যথার্থ হয় এমন আঙ্গিকে স্বীকার করেন, ধর্মের প্রতি সে রাষ্ট্রের এখনো ধর্মীয় আচরণই আছে—অর্থাৎ এটা ধর্মের মানবিক ভিত্তির সত্যিকারের প্রয়োগ নয়, কারণ তা এখনো এই মানবিক শাঁসটির অবাস্তব, কাল্পনিক রূপটির ওপরই ভর করে আছে। তথাকথিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হলো অসম্পূর্ণ রাষ্ট্র, আর খ্রিষ্টান ধর্ম হলো সেই অসম্পূর্ণতার ঘাটতি পোষণের ফাউ, একে ধুপ ধুনো দিয়ে পবিত্র করা। তাই খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের জন্য ধর্ম আবশ্যিকভাবেই হয়ে পড়ে উদ্দেশ্য হাসিলের এক উপায়; কাজেই এটা এক ভণ্ড রাষ্ট্র। সম্পূর্ণ রাষ্ট্র রাষ্ট্রের সাধারণ স্বভাবহেতু এর ভেতরে থাকা খুঁতের জন্য ধর্মকে পূর্বানুমানসমূহের মাঝে গণ্য করে, নাকি অসম্পূর্ণ রাষ্ট্র খুঁতওয়ালা রাষ্ট্র হিসেবে এর বিশেষ অস্তিত্বের মাঝে থাকা ঘাটতির কারণে ধর্মকে তার ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা দেয়—এই দুটো ধরন এক বড় পার্থক্য তৈরি করে। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ধর্ম হয়ে পড়ে অসম্পূর্ণ রাজনীতি। প্রথমটির ক্ষেত্রে এমনকি নিখুঁত রাজনীতিরও খুঁত ধর্মের মাঝে স্পষ্ট হয়ে যায়। তথাকথিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের খ্রিষ্টান ধর্মের দরকার পড়ে নিজেকে রাষ্ট্র হিসেবে সম্পূর্ণ করতে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, প্রকৃত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সম্পূর্ণতার জন্য ধর্মের দরকার হয় না। বরং তা ধর্মকে উপেক্ষা করতে পারে কারণ এর মাঝে ধর্মের মানবিক ভিত্তি জাগতিক উপায়ে বাস্তবায়িত হয়ে যায়। অপরদিকে তথাকথিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের ধর্মের প্রতি থাকে রাজনৈতিক মনোভাব আর রাজনীতির প্রতি থাকে ধর্মীয় মনোভাব। রাষ্ট্রের আঙ্গিককে নিতান্ত সদৃশে নামিয়ে এনে সে ধর্মকেও নিতান্ত সদৃশে নামিয়ে আনে।

এই দ্বন্দ্বটাকে আরো পরিষ্কার করতে বাউয়ের কেমন করে খ্রিষ্টান রাষ্ট্রকে দেখান তা যাচাই করা যাক। এক্ষেত্রে তিনি খ্রিষ্টীয়-জর্মন রাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ কাজে লাগিয়েছেন। বাউয়ের বলছেন,

“কোনো খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের অসম্ভাব্যতা বা অনস্তিত্ব প্রমাণ করতে ইদানীং প্রায়ই সুসমাচারের বাণীগুলোর উদ্ধৃতি দেয়া হয়। যার সাথে (বর্তমানের) রাষ্ট্র শুধু যে তাল মেলায় না তাই নয়, বরং সম্ভবত তাল মেলাতে সক্ষমই নয়, যদি না সে নিজেকে (রাষ্ট্র হিসেবে) একেবারে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিতে চায়।” “কিন্তু সমস্যাটার সুরাহা এত সহজ নয়। সুসমাচারের বাণীগুলো কি দাবি করে? আত্মসত্তার অতিন্দ্রীয় পরিত্যাগ, প্রত্যাদেশের অধিকর্তার কাছে সমর্পণ, রাষ্ট্রের কাছ হতে ফিরে দাঁড়ানো, জাগতিক শর্তসমূহের বিনাশ। বেশ, খ্রিষ্টীয় রাষ্ট্র এসব দাবি করে এবং সবই অর্জন করে। সে সুসমাচারের মরম সন্নিবেশ করলো, এবার সে যদি এই মরম সুসমাচারের অবিকল পরিভাষায় ফের পয়দা না করে তাহলে তা ঘটে কেবল এই কারণে যে, সে এই মরম প্রকাশ করে রাজনৈতিক আঙ্গিকে। অর্থাৎ সত্য যে, এই আঙ্গিক বর্তমান দুনিয়ার চলতি রাজনৈতিক পদ্ধতি হতে নেয়া, তবে তাদের যে ধর্মীয় পুনর্জন্মের মাঝ দিয়ে যেতে হবে তা নেমে আসে নিতান্ত সদৃশের পর্যায়ে। এ হলো তার নিজেকে বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক আঙ্গিকের ব্যবহার করতে গিয়ে রাষ্ট্রের দিকে পিঠ ফিরে দাঁড়ানো।” (পৃষ্ঠা-৫৫)

বাউয়ের তারপর ব্যাখ্যা করে দেখান যে, খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের জনগণ কেবল অ-জনগণ, যাদের নিজেদের আর কোনো ইচ্ছা বলতে কিছু নেই। তাদের আসল অস্তিত্ব তাদের অধীন করে নেয়া নেতার মাঝে বিরাজমান, যদিও এই নেতা তার উৎস আর স্বভাব অনুযায়ীই তার কাছে বিজাতীয় – মানে, খোদার কাছ হতে পাঠানো, জনগণের পক্ষ হতে অংশগ্রহণ ছাড়াই তাদের ওপর আরোপিত। বাউয়ের ঘোষণা করেন যে, এরকম জনগণের আইন তাদের নিজের সৃষ্টি নয়, তা বরং প্রকৃত প্রত্যাদেশ; এর সর্বোচ্চ প্রধানের জনগণের সাথে, আরো ঠিক করে বললে জনসমষ্টির সাথে মাধ্যমিকতার দরকার। এই জনসমষ্টি আবার নিজেরাও অসংখ্য বিশেষ দলে বিভক্ত যা কিনা আকস্মিকতা দ্বারা নির্ধারিত এবং গঠিত, তাদের স্বার্থ, নির্দিষ্ট আবেগ আর মূল্যবোধ দিয়ে পার্থক্যকৃত এবং যারা সুবিধা হিসেবে নিজেদের একে অপরের কাছ হতে নিঃসঙ্গ করার অনুমতি লাভ করে, ইত্যাদি। (পৃষ্ঠা-৫৬)

যা হোক, বাউয়ের নিজেই বলছেন,

“রাজনীতি যদি ধর্ম ছাড়া কিছু নাই হতে পারে, তবে তার রাজনীতি হওয়া উচিত নয়, ঠিক যেমন দরগার হাঁড়ি-বাসন মাজাকে গেরস্থালি কাজ বলা ঠিক নয়।” (পৃষ্ঠা-১০৮)

তবে খ্রিষ্টীয়-জর্মন রাষ্ট্রে ধর্ম একটা ‘অর্থনৈতিক ব্যাপার’ ঠিক যেমন ‘অর্থনৈতিক ব্যাপার’গুলো এখানে ধর্মের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ। খ্রিষ্টীয়-জর্মন রাষ্ট্রে ধর্মের আধিপত্য হলো আধিপত্যের ধর্ম।

‘সুসমাচারের অক্ষর’গুলো থেকে “সুসমাচারের মরমকে” আলাদা করে ফেলা একটা অধর্মের কাজ। যে রাষ্ট্র সুসমাচারকে রাজনীতির ভাষায় কথা বলায়—অর্থাৎ যে ভাষা ‘পবিত্র আত্মা’র ভাষা হতে ভিন্ন, সে তো অধর্ম করে। তা মানবদৃষ্টিতে না হোক, নিজ ধর্মের দৃষ্টিতে অধর্ম। যে রাষ্ট্র খ্রিষ্টানত্বকে তার চরম বৈশিষ্ট্য বলে মানে, বাইবেলকে বলে নিজের সনদ, তাকে অবশ্যই পবিত্র গ্রন্থের শব্দাবলির মোকাবিলা করতে হবে, কারণ সে গ্রন্থের প্রতিটি শব্দই পবিত্র। এই রাষ্ট্র, সাথে সেইসব মানবিক আবর্জনা যার ওপর সে ভিত্তি করে আছে তা এক যন্ত্রণাদায়ক দ্বন্দ্বে আটকা পড়ে গেছে। এই দ্বন্দ্ব ধর্মীয় চৈতন্যের অবস্থান হতে কিছুতেই সমাধানযোগ্য নয় – যখন সে সুসমাচারের সেই সব বাণীর বরাত নেয় যার সাথে তা “শুধু যে তাল মেলায় না তাই নয় বরং সম্ভবত তাল মেলাতে সক্ষমই নয়, যদি না তা নিজেকে রাষ্ট্র হিসেবে একেবারে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিতে চায়।” কেন সে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিতে চায় না? রাষ্ট্র নিজে নিজের কাছে বা অন্য কারুর কাছে এর উত্তর দিতে পারে না। পোশাকি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র তার নিজের চৈতন্যের কাছে এক হুকুম, যার বাস্তবায়ন অর্জনযোগ্য নয়। রাষ্ট্র তার অস্তিত্বের বাস্তবতা কেবল নিজের কাছে মিথ্যে বলেই বিবৃত করতে পারে। ফলে সে নিজের কাছেই সব সময় হয়ে থাকে এক সন্দেহের, ভরসার অযোগ্য, ঝামেলার বিষয়। অতএব সমালোচনা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত হয় যখন সে জোরের সাথে বাইবেলের ওপর নির্ভর করা রাষ্ট্রকে মানসিক অবিন্যস্ত তার পর্যায়ে বিবেচনা করে – যার মাঝে সে আর জানেই না যে সে কী মায়া না বাস্তবতা। এবং যার মাঝে জাগতিক লক্ষ্যের কলঙ্ক (ধর্ম যার আলখেল্লার কাজ করে) তার ধর্মীয় চৈতন্যের সততার সাথে (যার কাছে ধর্মই জগতের উদ্দেশ্য বলে প্রতীয়মান হয়) এক অসমাধানযোগ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্র নিজের আত্মপীড়নের কাছ হতে বাঁচতে পারে কেবল যদি সে ক্যাথলিক চার্চের পুলিশ এজেন্ট হয়ে যায়। চার্চের সাথে সম্পর্কের নিরিখে (যে চার্চ জাগতিক শক্তিকে তার চাকর বলে ঘোষণা করে) রাষ্ট্র ক্ষমতাহীন, ধর্মীয় মরমের নিয়ম বলে দাবি করা জাগতিক ক্ষমতাও অথর্ব।

তথাকথিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের মাঝে মানুষ নয়, বিচ্ছিন্নতাই মোদ্দা কথা। একমাত্র মানুষ রাজা, যে কিনা গণনার অধিকার রাখে, সেও অপর মানুষ হতে বিশেষভাবে আলাদা আর সর্বোপরি ধার্মিক সত্ত্বা বলে সরাসরি খোদার সাথে, স্বর্গের সাথে গাঁটছড়ায় বাঁধা। একমাত্র সম্পর্ক যা বিরাজমান তা এখনো বিশ্বাস নির্ভর সম্পর্ক। অতএব, ধার্মিক মরম এখনো বাস্তবিক ইহজাগতিক হয়ে ওঠেনি

কিন্তু, তদুপরি ধর্মীয় মরমকে বাস্তবিকভাবে ইহজাগতিক করা যায় না! কারণ সে খোদ নিজের কাছে মানব মনের বিকাশের পর্যায়ে এক অ- জাগতিক স্তর ছাড়া আর কিছু কি? ধর্মীয় মরমকে মানব মনের বিকাশের স্ত র পর্যন্তই কেবল ইহজাগতিক করা যায়। ধর্মীয় প্রকাশ যার বহিরাঙ্গিক তৈরি করে এবং স্থাপিত হয় জাগতিক আঙ্গিকের ভেতরে। ব্যাপারটা ঘটে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। এই রাষ্ট্রের ভিত্তি খ্রিষ্টানত্ব নয়, বরং খ্রিষ্টানত্বের মানবিক ভিত। ধর্ম থেকে যায় এর সদস্যদের আদর্শিক, অজাগতিক চৈতন্য হয়ে, কারণ ধর্ম এই রাষ্ট্রের মাঝে অর্জিত মানবিক বিকাশের স্তরের আদর্শ আঙ্গিক।

রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সদস্যদের ধার্মিক হয়ে থেকে যাওয়ার কারণ ব্যক্তি জীবন আর প্রজাতি জীবনের, সিভিল সমাজের জীবন আর রাজনৈতিক জীবনের মাঝের দ্বৈততা। তারা ধার্মিক কারণ মানুষ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক জীবনকে বিবেচনা করে তাদের বাস্তব স্বাতন্ত্রিকতার বাইরের এলাকা হিসেবে যেন সেটাই তাদের সত্যিকারের জীবন। তারা যেই পরিমাণে ধার্মিক যে পরিমাণে ধর্ম এখানে সিভিল সমাজের মরম যা প্রকাশ করে মানুষ হতে মানুষের বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব। রাজনৈতিক গণতন্ত্র এখানে খ্রিষ্টীয় যদিও এর মাঝে একজন নয়, প্রতিটি মানুষই সার্বভৌম, সর্বোচ্চ সত্ত্বার মর্যাদা পায়, কিন্তু তা থাকে তার অসভ্য, অসামাজিক রূপে, তার দৈব অস্তিত্বে, সে যেমন ঠিক তেমনভাবে, আমাদের সমাজের সমস্ত সংগঠন তাকে যেমনভাবে নষ্ট করে রেখেছে তেমনভাবেই, যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, নিজের কাছেই বিজাতীয় হয়ে গেছে, আর অমানবিক সব উপাদান ও শর্তের হাতে শাসিত হতে হাত বদল হয়ে গেছে সংক্ষেপে, যে মানুষ এখনো সত্যিকারের প্রজাতি সত্ত্বা নয়। কল্পনার সৃষ্টি একটা স্বপ্ন, খ্রিষ্টানত্বের এক স্বীকার্য যে মানুষের সার্বভৌমত্ব (এমন মানুষ সে কিনা বিজাতীয় সত্তা হিসেবে বাস্তব মানুষ হতে ভিন্ন) গণতন্ত্রে তাই হয়ে ওঠে সম্ভব রকম বাস্তব, বহাল অস্তিত্ব ও জাগতিক নীতি।

নিখুঁত গণতন্ত্রে ধর্মীয় এবং ধর্মতাত্ত্বিক চৈতন্য খোদ নিজেই নিজের দৃষ্টিতে অধিকতর ধার্মিক ও ধর্মতাত্ত্বিক। কারণ দৃশ্যত তা এখানে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যহীন, জাগতিক উদ্দেশ্যবিহীন। আরো কারণ এই যে, তা সত্যিকারভাবেই আরেক দুনিয়ার জীবন। খ্রিষ্টানত্ব এখানে তার সার্বিক ধর্মীয় তাৎপর্যের ব্যবহারিক প্রকাশে উন্নীত হয়েছে। তাতে সবচেয়ে বহুমুখী বিশ্ববীক্ষা একে অপরের পাশাপাশি খ্রিষ্টানত্বের রূপে এক কাতারে এসেছে আর সবচেয়ে বড় কথা এখানে কাউকে খ্রিষ্টানত্বে দীক্ষা নিতে হয় না, সাধারণভাবে ধর্ম, যে কোনো ধর্ম হলেই কাজ চলে (বিউমঁদের পূর্ব উদ্ধৃতি খেয়াল করুন)। ধর্মীয় চৈতন্য পরমানন্দ লাভ করে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব আর ধর্মীয় বহুমুখিনতার সম্পদে।

এইভাবে আমরা দেখিয়েছি যে, ধর্ম হতে রাজনৈতিক মুক্তি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ধর্ম হিসেবে না হলেও ধর্মের অস্তিত্ব বহাল রেখে দেয়। কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারী তার নাগরিকত্বের সাথে সম্পর্কের নিরিখে যে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হন তা রাজনৈতিক রাষ্ট্র আর সিভিল সমাজের মাঝের সার্বিক ইহজাগতিক দ্বন্দ্বের কেবল একটি দিক। খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের সম্পূর্ণতা মানে এমন এক রাষ্ট্র যা নিজেকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে এবং এর সদস্যদের ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না। ধর্ম হতে রাষ্ট্রের মুক্তি বাস্তব মানুষের ধর্ম হতে মুক্তি নয়।

অতএব, আমরা বাউয়ের-এর মতো ইহুদিদের বলি না যে: ইহুদিবাদ হতে আমূলভাবে নিজেদের মুক্ত না করলে তোমরা রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হতে পারবে না। আমরা বরং উল্টোভাবে তাদের বলি: যেহেতু সম্পূর্ণভাবে এবং তর্কাতীতভাবে ইহুদিবাদ পরিত্যাগ না করেও তোমরা রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হতে পারো, তাই রাজনৈতিক মুক্তি খোদ নিজে মানব মুক্তি নয়। নিজেদের মানবিকভাবে মুক্ত না করে তোমরা ইহুদিরা যদি রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হতে চাও, এই ভিতু কেতা এবং দ্বন্দ্ব শুধু যে তোমাদের মাঝে আছে এমন নয়, এটা স্বয়ং রাজনৈতিক মুক্তির স্বভাব আর বর্গের মাঝেই অন্তর্নিহিত। যদি দেখ যে তোমরা এই বর্গের হাজতখানায় বন্দি, দেখবে সেখানে বাকি সবাইও আটকা পড়ে আছে। রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ইহুদিদের প্রতি খ্রিষ্টীয় ভঙ্গি গ্রহণ করে রাষ্ট্র যেমন খ্রিষ্টীয় বাণী প্রচারে নামে ঠিক তেমনি ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও যখন ইহুদিরা নাগরিক অধিকার দাবি করে, তখন সে রাজনীতিসম্মত আচরণই করে।

যদি ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও কেউ রাজনৈতিকভাবে মুক্তি আর নাগরিক অধিকার পেতে পারে, তবে কি সে তথাকথিত মানব অধিকার চেয়ে তা পেতে পারে? বাউয়ের তা অস্বীকার করেন।

“প্রশ্নটা হলো একজন ইহুদি হিসেবে কেউ (মানে যে নিজেই স্বীকার করে যে তার সত্যিকারের স্বভাবেরই কারণেই সে অপর মানুষ হতে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য) মানুষের সার্বিক অধিকার পেতে এবং অন্যের সাথে তা ভাগ করতে সক্ষম কি না।”
“খ্রিষ্টান জগতে মানুষের অধিকারের ধারণাটি সবে গেল শতাব্দীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। মানুষের মাঝে তা অন্তর্নিহিত নয়, বরং এখন পর্যন্ত মানুষ যে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছে এটা তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পাওয়া। ফলে মানুষের অধিকার প্রকৃতির কোনো উপহার নয়, অতীত ইতিহাসের কোনো উত্তরাধিকার নয়, বরং তা জন্মের আপতিকতা আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এখনো পর্যন্ত ইতিহাস কর্তৃক তুলে দেয়া সেই সব সুবিধার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পুরস্কার। এসব অধিকার হলো সংস্কৃতির ফল, যে তা অর্জন করেছে আর যার তা পাওনা – কেবল সেই তা অধিকারে রাখতে পারে।”
“ইহুদিরা কি বাস্তবেই তা পেতে পারে? যতক্ষণ পর্যন্ত সে ইহুদি, তাকে ইহুদি করে তোলা ধরাবাঁধা স্বভাবই তার মানব স্বভাব, যে স্বভাব তাকে অন্য মানুষের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারে, তাকে বাধ্যতামূলকভাবে টেক্কা মেরে যাবে, এবং বিচ্ছিন্ন করবে ইহুদি নয় এমন মানুষ হতে। এই বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে সে ঘোষণা করে যে তাকে ইহুদি করে তোলা বিশেষ স্বভাবই তার জন্য সত্য, চূড়ান্ত স্বভাব যার সামনে মানব স্বভাব পালিয়ে বাঁচে।” “একইভাবে, খ্রিষ্টান হিসেবে খ্রিষ্টানও মানব অধিকার অনুমোদন করতে পারে না।” (পৃষ্ঠা-১৯, ২০)

বাউয়েরের মতে, সার্বিক মানব অধিকার পাওয়ার যোগ্য হতে হলে মানুষকে ‘বিশ্বাসের বিশেষ সুবিধা’ ত্যাগ করতে হবে। আপাতত চলুন, আমরা তথাকথিত মানব অধিকার বিষয়টি যাচাই করে দেখি। ঠিক করে বললে, মানব অধিকারের খাঁটি রূপ, যে আঙ্গিকে তা এর আবিষ্কারক উত্তর আমেরিকান আর ফরাসিদের কাছে আছে তাই যাচাই করি। আংশিকভাবে মানুষের এই অধিকারসমূহ হলো রাজনৈতিক অধিকার, যে অধিকার কেবল সম্প্রদায়ে অপরের সাথে চর্চা করা যায়। এসব অধিকারের সারমর্ম হলো সম্প্রদায়ে, বিশেষভাবে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ে, রাষ্ট্রজীবনে অংশগ্রহণ। এগুলো রাজনৈতিক মুক্তি, নাগরিক অধিকারের বর্গের আওতাভুক্ত। আমরা দেখেছি, এগুলো কোনোভাবেই তর্কাতীত নয় এবং সদর্থকভাবে ধর্মের, তাই ইহুদিবাদেরও বিলুপ্তি ঘটানোর পূর্বানুমান দেয় না। তাহলে বাকি রইলো মানব অধিকারের বাকি অংশ – যেখানে নাগরিক অধিকারের সঙ্গে তা ভিন্ন, সেই অংশ পরীক্ষা করে দেখা।

এর মাঝে আছে বিবেকের স্বাধীনতা, পছন্দমতো যে কোনো ধর্মচর্চার অধিকার। বিশ্বাসের সুবিধা প্রকাশিতভাবেই চেনা যায়, হয় মানব অধিকার হিসেবে নয়তো মানব অধিকারের ফলাফল – মানে স্বাধীনতা হিসেবে।

মানব এবং নাগরিক অধিকারের ঘোষণা ১৭৯১, আর্টিকেল ১০ : “কাউকেই তার মতামত, এমনকি ধর্মীয় মতামতের কারণেও বিভক্ত করা যাবে না।” “প্রতিটি মানুষের নিজ অনুসরণকৃত ধর্মাচারণের স্বাধীনতা” ১৭৯১-এর সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে মানব অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করা আছে।
১৭৯৩-এর মানুষের অধিকারের ঘোষণা, আর্টিকেল – ৭ মানুষের অধিকারসমূহের মধ্যে ধর্মের স্বাধীন চর্চাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের চিন্তা ও মতামত প্রকাশ, মিলিত হওয়া এবং ধর্মচর্চার অধিকারের সাথে যুক্ত করে এমনকি এও বলা হচ্ছে “এসব অধিকার ঘোষণার আবশ্যিকতা স্বৈরতন্ত্রের উপস্থিতি কিংবা নিকট অতীতে তার অস্তিত্বের স্মৃতির পূর্বানুমান।” তুলনা করুন ১৭৯৫-এর সংবিধান শিরোনাম ১৪, আর্টিকেল ৩৫৪।
পেনিসিলভেনিয়ার সংবিধান, আর্টিকেল-৯ ও ৩: “প্রতিটি মানুষই প্রকৃতির কাছ হতে সর্বশক্তিমানকে তাদের বিবেকানুসারে আরাধনা করার অনির্দেশযোগ্য অধিকার পেয়েছে। কাউকেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ধর্মের বা ধর্মতন্ত্রের অনুসরণ করতে বা সমর্থন করতে আইনগতভাবে বাধ্য করানো যাবে না। কোনো অবস্থায়-ই মানব কর্তৃত্ব বিবেকের প্রশ্নে এবং অন্তরাত্মার শক্তি নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।”
আর্টিকেল ৫ ও ৬, নিউ হ্যাম্পশায়ার সংবিধান: “এসব স্বাভাবিক অধিকারসমূহের মাঝে কিছু তাদের নিজ গুণেই বিচ্ছিন্ন হবার নয়, কারণ এগুলো প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। বিবেকের অধিকার তার মাঝে একটি।”

মানব অধিকার এবং ধর্মের বেমানান সম্পর্ক মানুষের অধিকার ধারণায় এতই অনুপস্থিত যে, যার যেমন ইচ্ছে ধার্মিক হওয়ার অধিকার এবং পছন্দসই ধর্মচর্চার ধর্মচর্চার অধিকার – মানুষের অধিকারসমূহের মাঝে খোলামেলাভাবে যুক্ত হয়েছে। বিশ্বাসের সুবিধা হচ্ছে মানুষের সার্বজনীন অধিকার।

এসব মানব অধিকার যেমনটা আছে তা নাগরিক অধিকার থেকে আলাদা। নাগরিক থেকে আলাদা এই মানুষটি কে? সিভিল সমাজের সদস্য ছাড়া অন্য কেউ নয়। কেন সিভিল সমাজের সদস্যকে ‘মানুষ’, স্রেফ মানুষ বলা হলো, কেন তার অধিকারকে বলা হলো মানব অধিকার? ব্যাপারটা কেমন করে ব্যাখ্যা করা যায়? ব্যাখ্যা করা যায় রাজনৈতিক মুক্তির প্রকৃতি এবং সিভিল সমাজের সাথে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক থেকে।

সর্বোপরি এই সত্যকে আমরা স্মরণে রাখি যে, মানব অধিকার, নাগরিক অধিকার হতে বিচ্ছিন্ন তথাকথিত মানব অধিকার হলো সোজা কথায় সিভিল সমাজের সদস্যের অধিকার, মানে অহংবাদী, অপর মানুষ আর সম্প্রদায় হতে আলাদা হওয়া মানুষের অধিকার। চলুন শুনি, ১৭৯৩ সালের সবচেয়ে র‍্যাডিক্যাল সংবিধানের এক্ষেত্রে কি বলার আছে:

নাগরিক এবং মানব অধিকারের ঘোষণা আর্টিকেল ২, ‘এসব অধিকার, ইত্যাদি (স্বাভাবিক এবং অনির্দেশযোগ্য অধিকার) হলো: সাম্য, মুক্তি, নিরাপত্তা এবং সম্পত্তি।’

মুক্তি কি?

আর্টিকেল ৬, ‘মুক্তি হলো মানুষের অপরের অধিকার খর্ব না করা যে কোনো কাজ করবার ক্ষমতা’, অথবা ১৭৯১-এর মানুষের অধিকার ঘোষণা অনুসারে: ‘অপরের ক্ষতি করে না এমন যে কোনো কাজ করবার সামর্থ্যই মুক্তি।’

মুক্তি তাহলে অপরের ক্ষতি না করে সবকিছু করবার, সম্পাদন করার অধিকার। অপরের ক্ষতি না করে ব্যক্তির নড়াচড়ার সীমা বেঁধে দেয়া হয় আইন দিয়ে, ঠিক যেমন দুই মাঠের চৌহদ্দি ঠিক করা হয় খুঁটি পুঁতে। মুক্ত মানুষ হচ্ছে এখানে নিজের মাঝে গুটিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন একক মানুষ। বাউয়ের কেন বলেন যে, ইহুদিরা মানব অধিকার অর্জনে সমৰ্থ নয়?

যতক্ষণ সে ইহুদি, তাকে ইহুদি করে তোলা ধরাবাঁধা স্বভাব অবশ্যই ছাপিয়ে যাবে মানুষের স্বভাবকে যা কিনা মানুস হিসেবে তাকে অন্য মানুষের সাথে যুক্ত করে, এবং তাকে আলাদা করে অ-ইহুদিদের থেকে।

কিন্তু মানুষের মুক্তির এই অধিকার তো মানুষের সাথে মানুষের বন্ধনের ভিত্তিতে নয় বরং মানুষ থেকে মানুষে আলাদা হওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এটা হলো সেই আলাদা হওয়ার অধিকার, নিজের মাঝেই নিজে গুটিয়ে যাওয়া ধরাবাঁধা ব্যক্তির অধিকার।

ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানব মুক্তির অধিকার হলো ব্যক্তিসম্পত্তিতে মানুষের অধিকার।

ব্যক্তিসম্পত্তিতে মানব অধিকার কি?

আর্টিকেল ১৬ (১৭৯৩-এর সংবিধান): ‘সম্পত্তির অধিকার হলো প্রতিটি নাগরিকের ইচ্ছা অনুযায়ী তার মালামালের, আয়ের এবং তার কাজ ও শ্রমের ফল ভোগ বা হস্তান্তর।’

ব্যক্তিসম্পত্তিতে মানুষের অধিকার তাহলে কারোর নিজের ইচ্ছায় নিজের সম্পদ, অপর মানুষের তোয়াক্কা না করে এবং সমাজ হতে স্বাধীনভাবে ভোগ বা হস্তান্তরের অধিকার, মানে আত্মস্বার্থের অধিকার। এই ব্যক্তি স্বাধীনতা আর তার প্রয়োগই সিভিল সমাজের ভিত্তি গঠন করে। এটা প্রত্যেক মানুষকে অপর মানুষের মাঝে নিজের স্বাধীনতার বাস্তবায়ন দেখায় না, বরং দেখায় প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু সর্বোপরি তা মানব অধিকারের ঘোষণা দেয় :

‘প্রতিটি নাগরিকের ইচ্ছা অনুযায়ী তার মালামালের আয়ের এবং তার কাজ এবং শ্রমের ভোগ বা হস্তান্তরে’র ঘোষণা দেয়।

বাকি রইলো মানুষের আর দুটি অধিকার: সাম্য ও নিরাপত্তা।

অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখানে ব্যবহার করা সাম্যের মানে উপরে বর্ণিত মুক্তির সাম্য ছাড়া কিছু নয়—মানে, প্রতিটি মানুষ স্ব-সম্পূর্ণ একক হিসেবে সমান মাত্রায় বিবেচিত হবে। ১৭৯৫-এর সংবিধান এই সাম্যের ধারণাকে তার উপরোক্ত তাৎপর্য অনুসারেই সংজ্ঞায়িত করে এভাবে:

আর্টিকেল ৩ (১৭৯৫-এর সংবিধান): “রক্ষা বা শাস্তি প্রদান যাই করুক সবার জন্য আইন সমান—এই হলো সাম্য।”

আর নিরাপত্তা?

আর্টিকেল ৮ (১৭৯৩-এর সংবিধান ) : “সমাজের প্রতিটি সদস্যের ব্যক্তিত্ব, অধিকার ও সম্পত্তি রক্ষার সামর্থ্য বিধান হলো নিরাপত্তা।”

নিরাপত্তা হলো সিভিল সমাজের সর্বোচ্চ সামাজিক ধারণা, মানে পুলিশের ধারণা, যার মাধ্যমে এই ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যায় যে, পুরো সমাজটি টিকে আছে কেবল তার প্রত্যেক সদস্যকে তার ব্যক্তিত্ব, অধিকার ও সম্পত্তি রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য। এই দৃষ্টিতেই হেগেল সিভিল সমাজকে বলেন, ‘অভাব ও যুক্তির রাষ্ট্র।’

নিরাপত্তার ধারণা সিভিল সমাজকে তার অহংবাদের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায় না। বরং নিরাপত্তা হলো তার অহংবাদের নিশ্চয়তা।

তথাকথিত মানব অধিকারের কোনোটিই তাই অহংসর্বস্ব মানুষকে, সিভিল সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষকে, মানে যে মানুষ নিজের মাঝে গুটিয়ে আসা, নিজের ব্যক্তিস্বার্থ এবং ব্যক্তি লোভের গরাদে আটকা পড়া, তার সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি মানুষ তাকে ছাপিয়ে যায় না। মানব অধিকারের সীমায় তাকে প্রজাতি সত্ত্বা হিসেবে চিন্তাই করা যায় না; বরং ব্যক্তির কাছে খোদ প্রজাতি-জীবন ও সমাজ হাজির হয় তার আসল স্বাধীনতার পথে বাধাস্বরূপ বহিস্থ এক কাঠামো হিসেবে। তাদেরকে একত্রে ধরে রাখে একটি মাত্র বন্ধন-প্রাকৃতিক প্রয়োজন, অভাব ও ব্যক্তিস্বার্থ, তাদের সম্পত্তি এবং অহংসর্বস্ব সত্ত্বার সংরক্ষণ।

ব্যাপারটা যথেষ্ট ধাঁধায় ফেলে দেয়ার মতো যে, একটা জনগোষ্ঠী যে নিজের বিভিন্ন অংশের মাঝের সব বাধা ভেঙে চুরমার করে দিতে, রাজনৈতিক এক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করতে সবে নিজেকে মুক্ত করা শুরু করলো, তারাই কিনা খুব পবিত্র ভাব নিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের অন্য সদস্য এবং খোদ সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন অহংসর্বস্ব মানুষের অধিকার (১৭৯১- এর ঘোষণা) ঘোষণা করলো, এবং বাস্তবিকই সেই ঘোষণা আবার পুনরাবৃত্তি করলো এমন সময় যখন জাতি নিজেকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বীরত্ব চাইছে, যখন সিভিল সমাজের সমস্ত স্বার্থ বিসর্জন সময়ের দাবি, যখন সমস্ত অহংবাদিতা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য (মানব অধিকারের ঘোষণা ইত্যাদি, ১৭৯৩)! ব্যাপারটা আরো ধাঁধার মতো লাগে, যখন দেখি যে, রাজনৈতিক মুক্তিদাতারা নাগরিকত্ব এবং রাজনৈতিক সম্প্রদায়কে এই সব তথাকথিত মানব অধিকার লালন-পালনের হাতিয়ারে সীমিত করে ফেলেন, সে কারণে নাগরিকরা ঘোষিত হন অহংসর্বস্ব মানুষের সেবক হিসেবে, যেখানে মানুষের সম্প্রদায়গত সত্ত্বা হিসেবে কাজ করবার বলয় নেমে আসে তার আংশিক সত্ত্বা কাজ করার বলয়ে, ফলে, শেষ পর্যন্ত মানুষ নাগরিক হিসেবে নয় বরং বুর্জোয়া হিসেবে বিবেচিত হয় আবশ্যিক, সত্যিকারের মানুষ বলে।

সমস্ত রাজনৈতিক সংঘের লক্ষ্য হলো স্বাভাবিক এবং অনির্দেশযোগ্য মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করা। (১৭৯১-এর অধিকার ঘোষণা ইত্যাদি, আর্টিকেল ২)

সরকার গঠিত হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক, অনির্দেশযোগ্য অধিকারের ভোগ নিশ্চিত করতে। (ঘোষণা, ১৭৯৩, আর্টিকেল ১)

তাই, এমন কি যখন তার উদ্দীপনায় থাকে যৌবনের সতেজতা, পারিপার্শিকতার শক্তি যখন তাকে চূড়ান্ত মাত্রায় একাগ্র করে তোলে, রাজনৈতিক জীবন নিজেকে ঘোষণা করে নিছক এক উপায় বলে, যার উদ্দেশ্য হলো সিভিল সমাজের জীবন। এ কথা সত্য যে, এর বিপ্লবী চর্চা তার নিজের তত্ত্বের সঙ্গে খোলাখুলি এক দুষ্টু দ্বন্দ্বে লিপ্ত। নিরাপত্তাকে যখন মানুষের একটি অধিকার বলে ঘোষণা করা হচ্ছে তখনই চিঠিপত্রের গোপনীয়তা লঙ্ঘন খোলাখুলিভাবে ঘোষিত হচ্ছে যুগের নিয়ম বলে। যখন মানুষের অধিকারের ফলাফল হিসেবে ‘ছাপাখানার বাধাহীন স্বাধীনতা’

(১৭৯৩-এর সংবিধান, আর্টিকেল ১২২) ব্যক্তি স্বাধীনতা হিসেবে নিশ্চিত করা হচ্ছে, তখনই ছাপাখানার স্বাধীনতা পুরোপুরি ধ্বংস করা হচ্ছে, কারণ “জন-স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়লে ছাপাখানার স্বাধীনতা অনুমোদন করা যায় না।” (Robespierre June; Histoire Perlementaire de la revolution francaise, Buchez এবং Roux রচিত, খণ্ড ২৮, পৃষ্ঠা- ১৫৯)।

অতএব, বলা যায় যে, স্বাধীনতার অধিকার যখনই রাজনৈতিক জীবনের সাথে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয় তখনই তা আর অধিকার থাকে না, অথচ কিনা তত্ত্বে বলা হচ্ছে রাজনৈতিক জীবন সোজা কথায় মানুষের, স্বতন্ত্র মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা, যা তার লক্ষ্য মানে মানুষের এই সব অধিকারের সাথে দ্বন্দ্ব করলেই ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু চৰ্চা নিছক ব্যতিক্রম, তত্ত্বই নিয়ম। এমনকি বিপ্লবী চর্চাকে যদি কেউ সম্পর্কটির সঠিক প্রতিফলন বলে মেনেও নেয় তবু একটা ঝামেলা রয়ে যায়। কেন রাজনৈতিক মুক্তিদাতাদের মাথায় বিষয়টা উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে লক্ষ্যকে উপায় আর উপায়কে লক্ষ্য বলে মনে হয়? তাদের চেতনার এই দৃষ্টিবিভ্রম এখন মনোবৈজ্ঞানিক, তাত্ত্বিক ধাঁধা হলেও, ধাঁধা হয়েই থাকবে।

ধাঁধাটির কিন্তু একটা সিধে সরল সমাধান আছে।

রাজনৈতিক মুক্তি একই কালে পুরনো সমাজের মিলিয়ে যাওয়া, যে সমাজের ওপর মানুষ হতে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র, সার্বভৌমের ক্ষমতা ভর করে থাকে। রাজনৈতিক বিপ্লব হলো সিভিল সমাজের বিপ্লব। পুরাতন সমাজের চরিত্র কি ছিল? এক কথায় বললে — সামন্তবাদ। পুরাতন সিভিল সমাজের চরিত্র ছিল সরাসরি রাজনৈতিক, মানে সিভিল জীবনের উপাদান যেমন সম্পত্তি, পরিবার বা শ্রমের ধরনকে জমিদারী, তালুক বা গিল্ডের আঙ্গিকে রাজনৈতিক জীবনের উপাদানের পর্যায়ে তুলে আনা হয়েছিলো। এই আঙ্গিকে তারা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক যেমন তার রাজনৈতিক সম্পর্ক মানে সমাজের অপর উপাদান হতে তার আলাদা হওয়ার, বর্জনের সম্পর্ককে নির্ধারণ করতো। জাতীয় জীবনের আয়োজন সম্পত্তি বা শ্রমকে সামাজিক উপাদানের পর্যায়ে তুলে আনে নি বরং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা সম্পূর্ণ করেছে এবং সংগঠিত করেছে সমাজের ভেতরে আরো অনেক সমাজ হিসেবে। এইভাবে সিভিল সমাজের জীবনের কাজ ও শর্তাদি তখনো সামন্তঅর্থে হলেও রাজনৈতিকই ছিল, মানে, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র হতে ব্যক্তিকে তারা বাদ দিয়েছিলো এবং গিল্ডের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের বিশেষ সম্পর্ককে জাতির জীবনের সাথে তার সাধারণ সম্পর্কে পরিণত করেছিলো, ঠিক যেমন করে তার বিশেষ সিভিল কাজকর্ম ও পরিস্থিতিকে নিজের সাধারণ কাজকর্ম ও পরিস্থিতিতে বদল করে নিয়েছিলো। এই সংগঠনের ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের ঐক্য, তার সাথে সেই ঐক্যের চৈতন্য, ইচ্ছা এবং ক্রিয়া, রাষ্ট্রের সাধারণ ক্ষমতা একইভাবে অবশ্যম্ভাবীরূপে জনগণ এবং তার কর্মচারিদের হতে বিচ্ছিন্ন কোনো শাসকের বিশেষ কাজ-কারবার বলে মনে হতে বাধ্য।

যে রাজনৈতিক বিপ্লব এই সার্বভৌম ক্ষমতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়কে জনগণের বিষয়ে পরিণত করেছে, যা রাজনৈতিক রাষ্ট্রকে জনগণের ব্যাপার, মানে বাস্তব রাষ্ট্রে পরিণত করেছে, তাকে আবশ্যিকভাবেই সমস্ত জমিদারি, গিল্ড, সংঘ এবং বিশেষ সুবিধা ভেঙে চুরমার করতে হয়েছে, কেননা সেগুলো ছিল সম্প্রদায় হতে মানুষের বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ। এভাবে রাজনৈতিক বিপ্লব সিভিল সমাজের রাজনৈতিক চরিত্র উচ্ছেদ করেছে। সে সিভিল সমাজকে টুকরো করেছে তার সরল অংশে; একদিকে ব্যক্তি, অপরদিকে ঐ সব ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও জীবন উপাদান গঠনকারী বস্তু ও মরমী উপাদান। সে সামন্ত সমাজের কানাগলিতে পথ হাতড়ে বেড়ানো, বিচ্ছিন্ন, খণ্ডিত রাজনৈতিক মরমকে মুক্তি দিয়েছে। সে রাজনৈতিক মরমের ছড়ানো-ছিটানো টুকরোগুলো একত্র করে, সিভিল জীবনের সাথে সেগুলোর তালগোল আলাদা করে একে সম্প্রদায়ের বলয় হিসেবে, সিভিল সমাজের ঐ সব বিশেষ উপাদান হতে আদর্শগতভাবে মুক্ত জাতির সাধারণ ব্যাপার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। কোনো ব্যক্তির জীবনের বিশেষ কাজকর্ম এবং পরিস্থিতিকে নিছক ব্যক্তি বিশেষের তাৎপর্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে সেগুলো আর রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সাধারণ সম্পর্ক গঠনকারীর ভূমিকায় রইলো না। জন-বিষয় অন্যদিকে হয়ে গেল প্রত্যেক ব্যক্তির সাধারণ বিষয়, আর রাজনৈতিক ক্রিয়া হয়ে গেল ব্যক্তির সাধারণ ক্রিয়া।

তবে রাষ্ট্রের এই ভাববাদ নিখুঁত করবার কাজটি একই সাথে ছিল সিভিল সমাজের বস্তুবাদের রূপায়ন। রাজনৈতিক জোয়াল ছুঁড়ে ফেলার মানে একই সাথে সিভিল সমাজের অহংসর্বস্ব মরমকে টেনে রাখে এমন বন্ধনগুলো ছুঁড়ে ফেলা। রাজনৈতিক মুক্তি ছিল একই সাথে সিভিল সমাজের রাজনীতি হতে, এমনকি কোনো সার্বিক আধেয়র নাম-গন্ধ হতে মুক্তি।

সামন্ত সমাজ তার মূল উপাদানে, মানে মানুষে পাল্টে গেল। কিন্তু যে মানুষকে দিয়ে সে তার ভিত্তি গড়লো সে হলো অহংসর্বস্ব মানুষ।

এমনি করে সিভিল সমাজের সদস্য এই মানুষ হলো রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ভিত্তি, এর পূর্বশর্ত। মানব অধিকারের বিবেচনায় রাষ্ট্রের কাছে সে এমন স্বীকৃতিই পেল।

অহংসর্বস্ব মানুষের মুক্তি, এবং মুক্তির এই স্বীকৃতি বরং তার জীবন উপাদান গঠনকারী মরমী ও বস্তু উপাদানের বাধাহীন সঞ্চালনের স্বীকৃতি। তাই, মানুষ ধর্ম হতে মুক্ত হতে পারলো না, পেল ধর্মীয় স্বাধীনতা সে সম্পত্তি হতে মুক্তি পেল না, পেল সম্পত্তির মালিক হওয়ার স্বাধীনতা। পেল না ব্যবসার অহংবাদ হতে মুক্তি, পেল ব্যবসার স্বাধীনতা

রাজনৈতিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং সিভিল সমাজের স্বনির্ভর ব্যক্তিতে অবলোপন (যারা কিনা আইনের মাধ্যমে সম্পৃক্ত, ঠিক যেমন জমিদারী বা গিল্ডে মানুষ ছিল বিশেষ সুবিধা দিয়ে সম্পর্কযুক্ত) অর্জিত হয়েছে এক এবং অনুরূপ ক্রিয়া দিয়ে। সিভিল সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ অনিবার্যভাবে আবির্ভূত হয় অরাজনৈতিক, প্রাকৃতিক মানুষ হিসেবে। মানুষের অধিকার আবির্ভূত হয় প্রাকৃতিক অধিকার হিসেবে। কারণ সচেতন ক্রিয়া কেন্দ্ৰীভূত হয় রাজনৈতিক ক্রিয়ার ওপর। অহংসর্বস্ব মানুষ অবলুপ্ত সমাজের পরোক্ষ ফল, এমন এক পরিণাম যা সোজাসাপ্টা কেবল অস্তিতেই বিরাজমান, এক সমূহ নিশ্চিতি-র বিষয় আর তাই এক প্রাকৃতিক বিষয়। রাজনৈতিক বিপ্লব সিভিল সমাজকে তার গঠনকারী উপাদানে আলাদা করে বের করে আনে ঐ সব উপাদানগুলোকে বিপ্লবীকৃত বা সমালোচনার বিষয় না করেই। এটি সিভিল সমাজ, প্রয়োজনের দুনিয়া, শ্রম, ব্যক্তিস্বার্থ, সিভিল আইনকে তার অস্তিত্বের ভিত্তি বলে গণ্য করে, গণ্য করে এমন এক পূর্বশর্ত হিসেবে যার জমিন আর ঠিকঠাক করবার দরকার নেই। আর তাই তা গৃহীত হয় এর প্রাকৃতিক ভিত্তি হিসেবে। শেষে, সিভিল সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষকে তার সংবেদনশীল, ব্যক্তি এবং সমূহ অস্তিত্বে, নাগরিক হতে সুস্পষ্টভাবে আলাদা মানুষ বলে গণ্য করা হয়। যেখানে কিনা রাজনৈতিক মানুষ কেবল অমূর্ত, কৃত্রিম, এক উপমাবাচক, আইনি ব্যক্তি বলে গণ্য। বাস্তব মানুষ শুধু অহংসর্বস্ব স্বতন্ত্রের আঙ্গিকে আর সত্যিকারের মানুষ কেবল অমূর্ত নাগরিকের আঙ্গিকে স্বীকৃত হয়।

রুশো চমৎকারভাবেই রাজনৈতিক মানুষের এই অমূর্ত ভাব বর্ণনা

করেছেন:

জন-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়ার সাহস যেই দেখাক না কেন, তাকে অবশ্যই অনুভব করতে হবে যে নিজেকে তার মানব স্বভাব বদলে দেয়ার, প্রতিটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিকে যে কিনা নিজেই এক সম্পূর্ণ এবং নিঃসঙ্গ সমগ্র তাকে বৃহৎ সমগ্রের অংশে (এক অর্থে যে সমগ্র হতে সে তার জীবন ও সত্ত্বা গ্রহণ করে) রূপান্তরিত করবার, সামষ্টিক ও নৈতিক/মানসিক অস্তিত্ব দিয়ে কেবল প্রকৃতিপ্রাপ্ত শারীরিক ও স্বাধীন অস্তিত্বকে প্রতিস্থাপিত করবার সামর্থ্যসম্পন্ন বলে ভাবতে হবে। এককথায়, তাকে অবশ্যই মানুষের কাছ হতে তার নিজ ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বিনিময়ে এমন বিজাতীয় ক্ষমতা দিতে হবে যা অপর মানুষের সহযোগিতা ছাড়া প্রয়োগ সম্ভব নয়। (J.J. Rousseau, Du Contrat Social, Book II, 1782, P-82)

সমস্ত মুক্তিই মানব জগত ও মানব সম্পর্কগুলোর খোদ মানুষের মাঝে সংকোচন।

রাজনৈতিক মুক্তি একদিকে সিভিল সমাজের সদস্যতে, অহংসর্বস্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিতে আর অপরদিকে নাগরিকে, আইনি ব্যক্তিতে মানুষের সংকোচন।

বাস্তব, ব্যক্তি মানুষ যখন তার নিজের মাঝে অমূর্ত নাগরিকটিকে আবার দখল করে নিতে পারবে, তার প্রাত্যহিক জীবনে, তার সব কাজে, সব পরিস্থিতিতে ব্যক্তি মানবসত্ত্বা হিসেবে সে যখন প্রজাতি-সত্ত্বা হয়ে উঠতে পারবে, যখন মানুষ তার ‘নিজ ক্ষমতা’ সামাজিক ক্ষমতা হিসেবে চিনে নিতে, সংগঠিত করতে পারবে, আর তাই ফলস্বরূপ রাজনৈতিক ক্ষমতার আকারে আর নিজ হতে সমাজ ক্ষমতাকে আলাদা করবে না, কেবল তখনই মানব মুক্তি সম্পূর্ণ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *