২৫.
হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবে পৌঁছে গেছি আমি।
সাইনবোর্ড পড়ে বুঝতে পারছি, মহিলাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে পুরুষ এরোটিক ড্যান্সাররা নাচে এই ক্লাবে। স্ট্রিপ-ক্লাব টার্মটা বোধহয় ব্যবহৃত হয় না আজকাল, তার বদলে এরোটিক ড্যান্স ক্লাব টার্মটা ব্যবহৃত হচ্ছে। আজ রাতের পারফরমারের নাম ডিক শ্যাফটউড। আমার ধারণা, ওটা একটা ছদ্মনাম।
ক্লাবের পার্কিং লটের এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে হলুদ ফোর্ড মাস্ট্যাং টা। পার্কিং লটে গাড়ি রাখার মতো জায়গা নেই, তাই রাস্তার একধারে পার্ক করলাম আমি। এখান থেকে একইসঙ্গে নজর রাখা যাচ্ছে ক্লাব-থেকে-বের হওয়ার-দরজা এবং ওই মাস্ট্যাং–এর উপর। খেয়াল করলাম, দুটো বাস আর বড় কয়েকটা ভ্যান আছে পার্কিং লটে। মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ক্লাবে এসেছে নাকি কোনো মহিলা টু্যর গ্রুপ?
ক্লাবে যেসব মেয়ে বা মহিলা ঢুকছে-বের হচ্ছে, তাদেরকে কিছুক্ষণ লক্ষ করে বুঝতে পারলাম, কোনো মেয়ে বা মহিলাই একা আসে না এই ক্লাবে, একা বেরও হয় না। তাদের সংখ্যাটা সবসময়ই দুই কিংবা তার বেশি। তাদের কারও চেহারা বেশ ভদ্র, কারও চেহারা আবার দুষ্টুমিতে ভরা। কিন্তু তাদের সবার উদ্দেশ্য এক: দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো~-দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে অতৃপ্ত শারীরিক চাহিদা পূরণ।
রাত বাড়ছে। মনোরঞ্জিত হওয়া মহিলারা বিদায় নিচ্ছে দলে দলে। বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরছে কয়েকজন পুরুষ নর্তকও। তাদের বেশিরভাগের পরনে বোম-খোলা ফ্ল্যানেলের-শার্ট। চকচকে কিছু একটা মেখেছিল তারা নাচার আগে। স্ট্রীটলাইটের আলোয় তাই চকচক করছে তাদের বুক।
হাঙ্ক-আ-হা-আ ক্লাবে একজন পিয়ানোবাদকের ভূমিকাটা কী, বুঝতে পারছি না। আমার স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে সংযুক্ত হলাম ইন্টারনেটে। খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আর একটা অ্যাপ। জানা গেল, পিয়ানো ঘিরে চক্কর দেয়া অবস্থায় বিশেষ একজাতের নাচের ব্যবস্থা আছে ক্লাবে।
রাত বারোটার কিছু পরে বের হলেন অ্যান্ডি রিভস। গাড়ি থেকে বের হলাম আমি, হাঁটা ধরলাম মাস্ট্যাং-এর উদ্দেশে। নিজেকে লুকানোর কোনো চেষ্টাই করছি না।
আমাকে দেখে ফেললেন রিভস। আপনি এখানে কী করছেন, ডুমাস?
কেন, এখানে আসাটা কি আমাদের সংবিধানে নিষিদ্ধ?
আমাকে খুঁজে পেলেন কীভাবে?
দ্য আদার পিয়ানোম্যান ফ্যান ক্লাব।
কী চান আমার কাছে?
সত্যি কথাটা।
ভিডিওটেপটা যতক্ষণ পর্যন্ত না ফিরিয়ে দিচ্ছেন আমার কাছে, একটা কথাও বের হবে না আমার মুখ দিয়ে।
এবং আপনার মুখ দিয়ে যদি কোনো কথা বের না হয়, মোবাইল হাতে নিলাম আমি, স্ক্রীনে আঙুল দিয়ে খোঁচাখুঁচি করার ভান করলাম, ভিডিওটা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবো আমি। ওয়াশিংটন পোস্টে চাকরি করে আমার এক বন্ধু, ভিডিওটা পাবে সে সবার আগে।
চুপ করে আছেন রিভস। বিষদৃষ্টি দেখা দিয়েছে তাঁর চোখে।
ঠিক আছে, বললাম আমি। ভিডিওটা যদি ভাইরাল হয় সামাজিত যোগাযোগ মাধ্যমে, আমাকে দোষ দিতে পারবেন না।
দাঁড়ান!
থমকে যাওয়ার ভান করলাম।
আমি যদি ওই ঘাটির ব্যাপারে সত্যি কথাটা বলি আপনাকে, আপনি কি…এসব বাদ দেবেন?
কী বাদ দেবো?
আপনাকে কথা দিতে হবে, ওই ভিডিও ছড়িয়ে দেবেন না ইন্টারনেটে।
ঠিক আছে, কথা দিলাম।
আমার দিকে এক কদম আগে বাড়লেন রিভস। আপনাকে আপনার ভাইয়ের নামে শপথ করতে হবে।
করলাম শপথটা।
কিন্তু ওটাও আমার ভান। আমি জানি, যদি রিভস আর ওর চামচারাই খুন করে থাকে লিওকে, তা হলে ওদের প্রত্যেককে নিজের হাতে শেষ করবো।
ঠিক আছে, বললেন রিভস। চলুন কোথাও গিয়ে বসি, তারপর কথা বলি।
কোনো দরকার নেই। এখানেই ভালো লাগছে আমার।
কথাটা শোনামাত্র সন্দেহ ফুটল রিভসের চোখে, আমার সঙ্গে অন্য কেউ আছে কি না জানার জন্য এদিকওদিক তাকালেন।
এবং তাঁর সেই প্রতিক্রিয়া দেখামাত্র বুঝতে পারলাম, তিনি নিছক একজন কৃষি-গবেষক হতে পারেন না। তিনি আসলেই সরকারি কোনো গোপন সংস্থার সঙ্গে জড়িত…অন্ততপক্ষে জড়িত ছিলেন।
আমার গাড়িতে গিয়ে বসি, চলুন, পকেট থেকে চাবি বের করলেন রিভস।
একথাবায় চাবিটা ছিনিয়ে নিলাম তাঁর হাত থেকে, এগিয়ে গিয়ে খুললাম মাস্ট্যাং-এর ডোরলক। উঠে বসলাম প্যাসেঞ্জার সিটে। দেখলাম, ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন রিভস। ড্রাইভিং সিটে বসলেন তিনি।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি রিভসের দিকে। প্রস্তুত হয়ে আছি যে-কোনো জরুরি মুহূর্তের জন্য।
ওই ঘাঁটি আসলে ডিপার্টমেন্ট-অভ-অ্যাগ্রিকালচারের কোনো স্যাটেলাইট অফিস ছিল না, শুরু করলেন রিভস।
আগেই টের পেয়েছি সেটা।
তা হলে এটাও নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, সেখানে যা…কী বলবো…হচ্ছিল, তা খুবই গোপনীয়?
বুঝেছি।
আজ থেকে পনেরো বছর আগের কথা বলছি আমি। তখন নাইন ইলেভেনের ধাক্কাটা হজম করছে আমেরিকা। সামলাচ্ছে ইরাক যুদ্ধের ধকল। আল কায়েদা তখন বড় একটা মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য।
আচ্ছা।
টেরি ফ্রেমন্ড নামের কারও কথা মনে আছে আপনার?
স্মৃতি ঘাটলাম আমি। আছে। শিকাগো শহরতলির এক পয়সাওয়ালা শ্বেতাঙ্গ ছোকরা। পরে সন্ত্রাসী হয়ে যায় সে। আঙ্কেল স্যাম আল-কায়েদা নাম হয়ে যায় ওর। এফবিআই-এর মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে প্রথম দশজনের মধ্যে ছিল ওর নাম।
এবং এখনও আছে। …পনেরো বছর আগে ফ্রেমন্ড একটা সন্ত্রাসী দল গঠন করে। ওরা আরেকটা নাইন ইলেভেনের চক্রান্ত করছিল।
তো?
ওই ছোকরার শেষপর্যন্ত কী হয়েছিল, মনে আছে?
সে টের পেয়ে গিয়েছিল, এফবিআই লেগেছে ওর পেছনে। আমেরিকা থেকে পালিয়ে কানাডায় চলে যায় সে। তারপর বোধহয় সিরিয়া বা ইরাকে চলে গেছে।
হ্যাঁ। মাথা ঝাঁকালেন রিভস। তারপর, যেন গোপন কোনো কথা বলছেন, এমন ভঙ্গিতে নিচু গলায় বললেন, তবে সেটা অফিশিয়াল কথা। ফ্রেমভের আসলে কী হয়েছিল, জানে না অনেকেই।
কমলা-জাম্পস্যুট পরিহিত সেই লোকের কথা মনে পড়ে গেল আমার। মনে পড়ে গেল গোপন সেই ঘাঁটির কথা মনে পড়ে গেল সেখানকার কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা। মনে পড়ে গেল, সেখানে একরাতে চুপিসারে হাজির হয়েছিল একটা স্টিলথ হেলিকপ্টার।
আপনারা পাকড়াও করেছিলেন ফ্রেমন্ডকে, তা-ই না? বললাম আমি। আপনারা ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই ঘাঁটিতে?
জবাব দিলেন না রিভস।
তারমানে, বললাম আমি, যাকে বলে ব্ল্যাক সাইট, ডিপার্টমেন্টে অভ অ্যাগ্রিকালচারের একটা স্যাটেলাইট অফিসের ছদ্মবেশে ওয়েস্টব্রিজের ওই ঘাঁটি আসলে ছিল তা-ই?
জোরে বলে ফেলেছি কথাটা, কেউ শুনে ফেলল কি না জানার জন্য এদিকওদিক তাকালেন রিভস। যখন বুঝতে পারলেন আমাদের আশপাশে কেউ নেই, আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ও-রকম ব্ল্যাক সাইট আরও অনেক আছে। আফগানিস্তানে আছে, লিথুনিয়াতে আছে। থাইল্যান্ডেও আছে। একেকটা ঘাঁটির একেকটা কোড নেম আছে। যেমন সল্ট পিট, ব্রাইট লাইট, দ্য কোয়ার্ট…ইত্যাদি। ভারত মহাসাগরের বিশেষ একটা দ্বীপে ঘোড়া-চালনা প্রশিক্ষণের একটা স্কুল আছে, ওটার সামনে এমনকী একটা দোকানও আছে; কিন্তু সাধারণ কেউ জানে না, আসলে ওই স্কুলের ভিতরে খুবই গোপনে ও-রকম একটা সাইট পরিচালনা করছে সিআইএ। দম নেয়ার জন্য থামলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, সাধারণ জনগণের ভালোর জন্যই কিন্তু পরিচালনা করা হচ্ছে ওসব সাইট। কারণ, একটু ভেবে দেখুন, বিশ্বের বড় বড় সন্ত্রাসীদের প্রায় সবাই এখন টার্গেট করেছে সাধারণ জনগণকে। ওরা এখন আর কোনো নেতা-নেত্রীর উপর হামলা করে না। ওরা এখন একবারের হামলায় মেরে ফেলে শত শত নিরীহ মানুষকে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যদি লড়াই করতে চাই আমরা, ও-রকম ঘাঁটি পরিচালনা করার কোনো বিকল্প নেই। কারণ কোনো সন্ত্রাসীকে সর্বসমক্ষে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলেই লোকটার আইনি অধিকার নিয়ে কথা উঠবে। কাজেই তাকে যদি লোকচক্ষুর আড়ালে কোথাও জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়, গোপন কোনো জায়গা লাগবেই সরকারি অফিসারদের।
আচ্ছা।
তবে…স্বীকার করতে খারাপ লাগছে, তারপরও বলি, অত বড় বড় সন্ত্রাসীরা তো সহজে মুখ খুলতে চায় না, তাই তাদেরকে টর্চার করার ব্যবস্থাও আছে ওসব ব্ল্যাক সাইটে।
একজাতের শিহরণ অনুভব করছি আমি। মজা লুটতে গিয়ে কীসের ভিডিও করে ফেলেছে কন্সপাইরেসি ক্লাব, টের পাচ্ছি। বললাম, তারমানে…যেসব আমেরিকানকে সন্দেহ হতো আপনাদের, তাদেরকে পাকড়াও করতেন আপনারা, তারপর নিয়ে গিয়ে ওঠাতেন স্টিলথ হেলিকপ্টারে, তারপর…
হ্যাঁ-না কোনোটাই বললেন না রিভস। এমনকী মাথাও ঝাঁকালেন না। শুধু বললেন, ও-রকম কোনো কাজের জন্য ওয়েস্টব্রিজের সেই পরিত্যক্ত সামরিক ঘাঁটির চেয়ে ভালো কোনো জায়গা ছিল? আপনার কী মনে হয়?
জবাব দিলাম না।
যাদেরকে পাকড়াও করা হতো, তাদের পরিণতির ব্যাপারে উপর থেকে নির্দেশ আসত আমাদের কাছে। পাকড়াও-করা লোকগুলোকে আমরা তখন হয় পরপারে পাঠিয়ে দিতাম, নয়তো পাঠাতাম কোনো গোপন কারাগারে।
বুঝলাম। কিন্তু এসবের সঙ্গে আমার ভাইয়ের সম্পর্ক কী? ওর দোষটাই বা কী?
আপনার বুঝতে বার বার ভুল হচ্ছে, ডিটেকটিভ ডুমাস। এসবের সঙ্গে আপনার ভাইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের দৃষ্টিতে তার কোনো দোষও নেই। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে আমরা কোনোভাবেই জড়িত না।
একটুখানি হাসলাম আমি। না, বন্ধু, না। আমি এখন জানি, লিও আর ওর বন্ধুরা মিলে এমন একটা ভিডিও ধারণ করেছে, যেটাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একজন আমেরিকান নাগরিককে আইন-বহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
চেহারা কালো হয়ে গেল রিভসের। আমরা যা করেছি, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য করেছি।
এবং তার ফলে মারা গেছে আমার ভাই।
আমাদের কিছু করার ছিল না ওই ব্যাপারে, এখনও নেই। বিশ্বাস করুন, আপনি আমাকে ওই ভিডিওটেপ দেখানোর আগে ওটার ব্যাপারে কিছুই জানতাম না আমি।
রিভসের চেহারা দেখে বুঝবার চেষ্টা করলাম, মিথ্যা কথা বলছেন কি না তিনি। কিন্তু সে-রকম কিছু বোঝা গেল না। তারমানে হয় মিথ্যা বলছেন না রিভস, নয়তো মিথ্যা বলায় তিনি ওস্তাদ।
তিনি কি আসলেই কিছু জানতেন না ওই ভিডিওর ব্যাপারে? সেটা কীভাবে সম্ভব?
খেলার মতো আর মাত্র একটা কার্ড আছে আমার হাতে, খেলোম সেটা।
ভিডিওর ব্যাপারটা যদি না-ই জানবেন আপনারা, মোরাকে খুঁজছিলেন কেন?
কার কথা বলছেন? দৃষ্টিতে শূন্যতা ফুটিয়ে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন রিভস।
এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, মিথ্যা বলছেন তিনি।
আমি পুলিশের একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর। সন্দেহভাজন অনেক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়েছে আমাকে। লোকে যখন মিথ্যা বলে, তখন তা বুঝতে পারার ট্রেনিং আছে আমার।
মোরার মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন আপনি নিজে, বললাম আমি। তা ছাড়া, আমার ধারণা, আপনারা তাঁকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনাদের সেই ব্ল্যাক সাইটে। জিজ্ঞাসাবাদ করার পর এমন কিছু একটা করেছেন, যার ফলে, যে-কদিন ছিলেন ভদ্রমহিলা সেখানে, সে-কদিনের স্মৃতি মুছে গেছে তাঁর মন থেকে।
আপনি কী বলছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।
মোরার মাকে আপনার ছবি দেখিয়েছি আমি। তিনি নিশ্চিত করে বলেছেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন আপনি।
উইন্ডশিল্ড দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকলেন রিভস, কী যেন ভাবছেন। কিছুক্ষণ পর মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, আপনি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছেন না।
আপনিও বুঝতে পারছেন না, আমাদের মধ্যে মৌখিক চুক্তি হয়েছিল, আপনি যা বলবেন সত্যি বলবেন। এখন আপনি যদি ভেবে থাকেন অর্ধেক বা আংশিক সত্যি বলে পার পেয়ে যাবেন…
গ্লাভ কমপার্টমেন্টটা খুলুন।
কী?
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রিভস। যা বলছি করুন। গ্লাভ কমপার্টমেন্টটা খুলুন।
ঘাড় ঘুরালাম আমি। গ্লাভ কমপার্টমেন্টের বাটনটা খুঁজছি, দৃষ্টি সরে গেছে রিভসের উপর থেকে।
সুযোগটা নিলেন তিনি।
আমার বাঁ দিকের চোয়াল আর কপালের মাঝখানে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মারলেন তিনি।
মাথা ঘুরে উঠল আমার, মনে হলো দাঁত নড়ে গেছে। মনে হলো, স্থবির হয়ে গেছে আমার পুরো চোয়াল আর ঘাড়।
তারপরও টের পেলাম, গ্লাভ কমপার্টমেন্ট খুলে ফেলেছেন রিভস।
আমার মাথা এখনও ঘুরাচ্ছে। এখনও হাজারটা তারা দেখতে পাচ্ছি আমি চোখের সামনে। তারপরও বুঝতে পারছি, কেন গ্লাভ কমপার্টমেন্ট খুলেছেন রিভস।
পিস্তল বা ওই জাতীয় কিছু একটা বের করতে যাচ্ছেন তিনি।
এবং ধাতব কিছু একটা আঁকড়ে ধরেছেন ইতোমধ্যে। কী সেটা, বুঝতে পারছি না…বুঝবার বিশেষ কোনো প্রয়োজনও নেই। যা বুঝবার দরকার ছিল, বোঝা হয়ে গেছে আমার।
দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম তার হাতটা। ফলে আমার দুহাত বন্ধ হয়ে গেল, ওদিকে রিভসের একটা হাত এখনও মুক্ত।
সুযোগটা কাজে লাগালেন তিনি। মুক্ত হাতটা বের করে নিয়ে এলেন গ্লাভ কমপার্টমেন্ট থেকে, ওটা দিয়ে যত-জোরে-সম্ভব একের পর এক ঘুসি মারছেন আমার পাঁজরে। প্রতিটা আঘাত হজম করছি আমি, দাঁতে দাঁত চেপে আছি; মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, প্রতিপক্ষ যত শক্তই হোক, এত সহজে ছেড়ে দেবো না।
যেহেতু আমাকে ঘুসি মারায় ব্যস্ত রিভস, আমি তার যে-হাত আঁকড়ে ধরে আছি সেটার প্রতি তেমন একটা মনোযোগ নেই তার। নিজের দুহাত দিয়ে প্রচণ্ড এক মোচড় দিলাম তাঁর ওই হাতে। ঝাঁকিয়ে উঠলেন তিনি, কাঁধ আর হাতের সংযোগস্থলে ভীষণ ব্যথা পেয়েছেন।
আবার হাত ঢুকিয়ে দিলেন তিনি গ্লাভ কমপার্টমেন্টের ভিতরে। আমি বাধা দেয়ার আগেই ব্যাটন জাতীয় কিছু একটা বের করে আনলেন সেখান থেকে। মুহূর্তের মধ্যে শুনতে পেলাম ইলেকট্রিসির পটপট আওয়াজ।
আমি কিছু করার আগেই আমার এক হাতে ওই ব্যাটন চেপে ধরলেন রিভস।
ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল আমার সারা শরীর, তীব্র একটা ব্যথা যেন ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের প্রতিটা কোষে। এবার স্থবির হয়ে গেছে আমার পুরো দেই।
টের পাচ্ছি, আমার হাতের মাধ্যমে সারা শরীরে সঞ্চালিত হচ্ছে হাই ভোল্টর ইলেকট্রিসিটি।
ইতোমধ্যে একটানে নিজের হাতটা আলগা করে নিয়েছেন রিভস আমার হাত থেকে। টের পেলাম, দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছেন তিনি। ওই ব্যাটনটা…স্টান ব্যাটন অথবা ইলেকট্রিক ক্যাটল প্রড জাতীয় কিছু একটা হবে…ঠেসে ধরলেন আমার গলায়।
মৃগী রোগীর মতো ক্রমাগত ঝাঁকুনি খাচ্ছি আমি, সেটা ছাড়া আর কিছু করতে পারছি না। ইচ্ছা করছে প্রচণ্ড একটা লাথি হাঁকাই রিভসের অণ্ডকোষে, কিন্তু বুঝতে পারছি, ওই ইলেকট্রিক ব্যাটন যতক্ষণ লেগে থাকবে আমার শরীরের সঙ্গে, ততক্ষণ কিছুই করতে পারবো না…স্বেচ্ছায় নাড়াতে পারবো না একটা আঙুলও।
একহাত দিয়ে ব্যাটনটা ধরে রেখেছেন রিভস, খালি হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি গাড়ির ব্যাকসিটের উদ্দেশে। কিছু একটা নিয়ে এলেন সেখান থেকে। কী, দেখতে পেলাম না…লোহার কোনো পাত হতে পারে, আবার বেসবল ব্যাটও হতে পারে। তবে যা-ই নিয়েছেন হাতে, সেটা দিয়ে প্রচণ্ড এক বাড়ি মারলেন আমার মাথায়।
ঝাপসা হয়ে গেল আমার দৃষ্টি।
আবার আমার মাথায় বাড়ি মারলেন রিভস।
আরও ঝাপসা হলো আমার দৃষ্টি।
আবার বাড়ি মারলেন রিভস।
কালো একটা পর্দা নেমে এল আমার চোখের সামনে।
.
২৬.
জ্ঞান ফেরার সময় মনে হলো, চেতনার আজব কোনো নদীতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাঁতার কাটছি যেন।
মনে হলো, কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি–ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটছে, আপ্রাণ চেষ্টা করছি সেটা ঠেকানোর, কিন্তু হাত-পা নাড়াতে পারছি না। আমি যেন দৌড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু কোমর-পর্যন্ত-তুষারে আটকে গেছে আমার দুই পা, শত চেষ্টা করেও ছুটতে পারছি না। নড়তে চাইছি আমি, পালাতে চাইছি, কিন্তু যেন জমে গেছি বরফের মতো। কেউ যেন কফিনের মতো কিছু একটাতে আমাকে ঢুকিয়ে শক্ত করে আটকে দিয়েছে সেটার ডালা।
বার কয়েক পিটপিট করে চোখ খুললাম।
চিৎ হয়ে শুয়ে আছি আমি। প্রথমেই নজরে পড়ল কয়েকটা পাইপ আর ছাদের নগ্ন কড়িকাঠ। তারমানে, অনুমান করলাম, কোনো একটা পুরনো বেইজমেন্টের ছাদ দেখতে পাচ্ছি। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল আমার, আমি না চাইতেও উত্তেজিত হয়ে উঠতে চাইছে আমার ভিতরটা। সামলানোর চেষ্টা করলাম নিজেকে শান্ত থাকতে চাইছি। হঠাৎ করে নড়ে উঠতে চাইছি না।
কোথায় আছি, তা বুঝবার জন্য নাড়াতে চাইলাম ঘাড়টা।
কিন্তু আধ ইঞ্চিও নাড়াতে পারলাম না সেটা।
মনে হচ্ছে, ভাইস-জাতীয় কিছু একটা দিয়ে একজায়গায় শক্ত করে আটকে রাখা হয়েছে আমার খুলি। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দেয়ার চেষ্টা করলাম মাথাটা, কোনো লাভ হলো না, উল্টো তীব্র একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল চাদিতে। উঠে বসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সেটাও পারলাম না–কোনো একজাতের টেবিলের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে আমাকে। শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে আমার দুপা-ও।
একটুও নড়তে পারছি না আমি।
এখন আমি সম্পূর্ণ অসহায়।
ফিসফিসে গলায় আমাকে কী যেন বলল রিভস।
এখন লোকটা আমার একনম্বর শত্রু। এখন আর ওকে সম্মান করার কোনো দরকার নেই। এখন ওকে, সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রথম সুযোগেই খুন করবো।
ভিডিওটেপটা কোথায় আছে, আবারও বলল শয়তানটা, বলতেই হবে আপনাকে, ন্যাপ।
কথা বললে কোনো উপকার হবে না আমার, জানি আমি। কাজেই কিছু না বলে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। একের পর এক চিৎকার করছি। শেষে বাধ্য হয়ে আমার মুখে গোঁজ ঢুকিয়ে দিল শয়তান রিভস।
কোনো লাভ হবে না, বলল সে।
কিছু একটা করছে লোকটা। আর গুনগুন করছে। মাথা নাড়াতে পারছি না, তাই বুঝতে পারছি না কী করছে সে। তবে মনে হলো, কল-জাতীয় কিছু একটা খুলেছে, কোনো একজাতের তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ করছে একটা বালতি।
একসময় বন্ধ হয়ে গেল ওই আওয়াজ। কলটা সম্ভবত বন্ধ করে দিয়েছে রিভস।
ওয়াটারবোর্ডিং নামে একটা ট্রেনিং আছে, বলল লোকটা। নেভি সিল (Navy SEAL) নিজেদের ট্রেইনি অফিসারদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। ওটা। একই কাজ করেছে সিআইএ-ও। কেন, জানেন?
জবাব দিলাম না–আমার মুখের ভিতরে গোঁজ ঢোকানো আছে।
কারণ ট্রেইনি অফিসাররা গড়ে চৌদ্দ সেকেন্ডের বেশি সহ্য করতে পারে না ওই ট্রেনিং। অনেকে আরও আগেই বাবা রে-মা রে করতে থাকে।
আমার কাছে এসে দাঁড়াল রিভস। দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে সে। বুঝতে পারলাম, আমার অসহায়ত্ব উপভোগ করছে শয়তানটা।
যাদেরকে পাকড়াও করতাম আমরা, বলল সে, তাদের একেকজনের সঙ্গে একেক রকমের সাইকোলজিকাল গেম খেলতাম। তবে আজ রাতে ওসব নাটক করার সময় নেই আমার হাতে, ন্যাপ। …আপনি নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন, বিশেষ একজাতের টেবিলের সঙ্গে কষে বেঁধে রাখা হয়েছে আপনাকে। নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, কপালে খারাবি আছে আপনার।
আমার পার দিকে এগিয়ে গেল লোকটা।
দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করতে চাইলাম ওকে, কিন্তু পারলাম না।
আবারও বিদ্রোহ করতে চাইছে আমার ভিতরটা, আবারও একটা আতঙ্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে আমার মধ্যে। শান্ত থাকার চেষ্টা করছি।
কোনো একটা মেশিন বা মোটর চালু হওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। নড়ে উঠল টেবিলটা।
আপনার মাথাটা এখন আস্তে আস্তে নেমে যাবে নিচের দিকে, পা দুটো উঠে যাবে উপরের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পাবেন, দম নিতে পারছেন না আপনি। ব্যাপারটা শুনতে যত ভয়ঙ্কর লাগছে, আসলে কিন্তু তারচেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর।
আবার আমার মাথার কাছে হাজির হলো সে। গোঁজটা বের করে নিল আমার মুখ থেকে।
টেপটা কোথায় আছে তা জানিয়ে দেয়ার মতো সময় এখনও আছে আপনার হাতে।
আমাকে নিয়ে চলুন, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
শব্দ করে হেসে ফেলল রিভস। আপনি কি এতকিছুর পরও বোকা ভাবছেন আমাকে?
টেপটা যে-জায়গায় রেখেছি, দেখিয়ে না দিলে বের করতে পারবেন না।
মিথ্যা কথা। এ-রকম কথা এ-পর্যন্ত অনেকবার শুনেছি আমি, ডিটেক্টিভ ডুমাস। আমি আরও জানি, এখন নতুন নতুন গল্প বানাবেন আপনি। আমার অত্যাচার যত চলবে, আপনার গল্পও তত নতুন হবে। তাই আগেই বলে রাখি, চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। এবং শেষপর্যন্ত হার মানতেই হবে আপনাকে। শেষপর্যন্ত সত্যি কথাটা বলতেই হবে আপনাকে।
এবং আমি এ-ও জানি, টেপটা হাতে পাওয়ামাত্র আমাকে খুন করবে রিভস–যেভাবে সে খুন করেছে আমার ভাইকে, আমার হাইস্কুলের কয়েকজন সহপাঠীকে।
কাজেই যতক্ষণ মুখ না খুলছি আমি, ততক্ষণ বেঁচে থাকার আশা আছে আমার।
আবার আমার সামনে এসে দাঁড়াল রিভস। হাতে ধরা অবস্থায় উঁচু করে একটা টাওয়েল দেখাচ্ছে আমাকে।
রেডি?
আমি হা-না বলার আগেই টাওয়েলটা চেপে ধরল সে আমার নাকেমুখে।
শক্ত করে চেপে ধরেনি রিভস টাওয়েলটা, তারপরও আমার মনে হচ্ছে, দম আটকে আসছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আবার নাড়ানোর চেষ্টা করলাম মাথা। কোনো লাভ হলো না। ফাঁস লেগে যাওয়ার মতো একটা অনুভূতি হচ্ছে বুকের ভিতরে।
শান্ত হও, মনে মনে বললাম নিজেকে।
চেষ্টা করছি শান্ত থাকার। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি কমিয়ে দিয়েছি। প্রস্তুতি নেয়ার চেষ্টা করছি আরও খারাপ কোনো ঘটনার জন্য। বুঝতে পারছি, যে কোনো সময় দম আটকে ফেলতে হবে আমাকে।
মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে যাচ্ছে। কিছুই ঘটছে না।
কান পেতে আছি আমি। যে-কোনোকিছু শোনার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। রিভস মনে হয় নড়ছে না। কিছু করছেও না। শুধু টাওয়েলটা আলতো করে চেপে ধরে আছে আমার চেহারায়।
কেটে গেল আরও কয়েকটা মুহূর্ত? কত সময় অতিবাহিত হয়েছে? ত্রিশ সেকেন্ড? চল্লিশ সেকেন্ড?
রিভস কি আসলে ধোকা দিচ্ছে আমাকে? সে কি কোনো সাইকোলজিকাল গেম খেলছে আমার সঙ্গে?
হঠাৎ করেই ভিজে গেল টাওয়েলটা, হঠাৎ করেই পানির উপস্থিতি টের পেলাম আমার পুরো চেহারায়। টের পাচ্ছি, পুরো টাওয়েল ভিজিয়ে দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে ভিতরে ঢুকে যেতে চাইছে আমার নাসারন্ধ্র দিয়ে।
দম বন্ধ করে ফেললাম আমি।
আবারও আমার নাকেমুখে পানি ঢালছে রিভস।
ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট চেপে রেখেছি আমি, প্রাণপণে চেষ্টা করছি একটুও যেন হাঁ না হয় আমার মুখ। দম আটকে রেখেছি এখনও, পারলে হাত দিয়ে চেপে ধরতাম নাকও। ওই কাজ করার জন্য আকুলিবিকুলি করছে আমার দুই হাত, কিন্তু কিছুতেই করতে পারছি না কাজটা-একটুও আলগা করতে পারছি না হাতের বাঁধন। মাথাটা যেন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নড়তে শুরু করেছে-যেন কেউ একজন জোর করে আমার মাথাটা সরিয়ে দিতে চাইছে কিছুটা দূরে, যাতে আমার নাকে পানি ঢালতে না পারে রিভস। কিন্তু ভাইসের কারণে সেটাও পারছি না।
একসময় পানি ঢুকে গেল আমার নাসারন্ধ্রে।
এবার ভয় পেতে শুরু করেছি আমি। জানি, বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবো না দম। টাওয়েলটা ভেজা-থাকার-কারণে আপনাআপনি চেপে বসেছে নাকের ফুটো আর মুখের সঙ্গে, হাতের সাহায্য ছাড়া ওটা এখন কোনোভাবেই সরিয়ে দেয়া সম্ভব না আমার পক্ষে।
জোরে দম ছাড়ার চেষ্টা করলাম নাক দিয়ে, ইচ্ছা ছিল পানি বের করে দেবো; কিছুটা সফলও হলাম, কিন্তু তারপরই ঘটল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা।
বেশ কিছুক্ষণ দম চেপে রাখার পর তা ছেড়ে দেয়ামাত্র শ্বাস নিতে হবে যে-কোনো মানুষকে, যদি না একটানা দম-আটকে রাখার কোনো চর্চা বা অভ্যাস থাকে তার। কাজেই নাক দিয়ে কিছু পানি বের করামাত্র একটু অক্সিজেন নিতে চাইল আমার ফুসফুস, আর সঙ্গে সঙ্গে পানি ঢুকে গেল আমার নাকেমুখে। এবং সঙ্গে সঙ্গে আপনাআপনি আটকে গেল আমার দম।
টের পাচ্ছি, মরতে চলেছি আমি। একটুখানি বাতাসের জন্য আকুলিবিকুলি করছে আমার ফুসফুস, কিন্তু আমার নাক বা মুখের আশপাশে কোথাও কোনো বাতাস নেই। একেই বোধহয় বলে বন্দির উপর অকথ্য নির্যাতন। এবং এভাবে নির্যাতন করে করে এই কাজে হাত পাকিয়ে ফেলেছে রিভস।
আমার নাক ও মুখের আশপাশে এখন শুধু পানি আর পানি। ইচ্ছাবিরুদ্ধ একটা খিচুনি শুরু হয়ে গেছে আমার সারা শরীরে। মাথাটা নড়ছে একটানা, ভাইসের কারণে অসহ্য একটা যন্ত্রণা টের পাচ্ছি চাঁদিতে। বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার জন্য যেন পাগলপারা হয়ে গেছে দুই হাত। রিভসকে কষে লাথি মারার জন্য তলপেটের কাছে ভাঁজ হয়ে আসতে চাইছে দুই পা।
কিন্তু সবই নিষ্ফল।
আমার মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড শক্তিশালী কেউ একজন আমাকে ঠেসে ধরেছে পানির নিচে। কিন্তু যদি ও-রকম কিছু করা হতো আমার সঙ্গে, তবুও একদিক দিয়ে ভালো হতো–অন্তত হাত-পা ছুঁড়তে পারতাম। এখন তা-ও পারছি না। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ডুবে মরার অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমার এখন।
রীতিমতো পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। কিছু একটা যেন ভেঙেচুরে একাকার করে দিচ্ছে আমার মনটাকে। মনে হচ্ছে, এই অবস্থার অবসান হবে না কোনোদিন। মনে হচ্ছে, এখন শুধু ফুসফুস না, আমার শরীরের প্রতিটা কোষ অক্সিজেন দাবি করছে আমার কাছে। টের পাচ্ছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারাবো আমি। আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নাকমুখ দিয়ে পানি ঢুকে গিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হবে…
ঈশ্বর, মনে মনে বললাম আমি, একটু সাহায্য করো আমাকে, একটু দম নিতে দাও…।
আমি এখন নিজের মৃত্যুকামনা করছি। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না। আমার এখন যে-অনুভূতি হচ্ছে, তা বর্ণনা করা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি এখন এমন একটা জায়গায় চলে গেছি, যা জীবন ও মৃত্যুর ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। অতীন্দ্রিয় কিছু ব্যাপার টের পাচ্ছি।
খুব সম্ভব হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আমার।
শুনতে পেলাম, কে যেন চিৎকার করছে। কে যেন থামাতে বলছে এসব। আমার শরীরের প্রতিটা কোষ যদি অক্সিজেনের দাবি না করত আমার কাছে, জীবন ও মৃত্যুর ঠিক মাঝখানে যদি না থাকতাম আমি, তা হলে হয়তো বলতাম, একটা মেয়ের গলা শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আমি জানি মৃত্যুপূর্ব একটা অতীন্দ্রিয় জগতে আছি এখন, কাজেই কী শুনছি আর আসলে কী ঘটছে সে-ব্যাপারে আমি মোটেও নিশ্চিত না। চোখ বড় বড় করে দেখে নিতে চাইছি আমি জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো, কিন্তু ভেজা টাওয়েলটা আমাকে কিছুই দেখতে দিচ্ছে না। মাথার ভিতরে জ্বলতে-নিভতে শুরু করেছে হাজারটা তারা, চাঁদির সেই যন্ত্রণাময়, অনুভূতি আর টের পাচ্ছি না, শুধু বুঝতে পারছি দপদপ করছে আমার মস্তিষ্ক-যেন কেউ একজন হাতুড়ি দিয়ে বিরতিহীনভাবে আঘাত করছে সেখানে।
অস্পষ্ট কোনো একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারবো না, আসলেই সে-রকম কিছু শুনেছি কি না।
একগাদা আলো যেন হুট করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর।
পাইপ আর নগ্ন কড়িকাঠগুলো দেখতে পাচ্ছি আবার।
আমি আসছি, লিও, মনে মনে বললাম, আসছি আমি, ভাই আমার। হয়তো আবারও কোনো এক ঘরে অনন্তকাল একসঙ্গে থাকবো আমরা।
শুধু আফসোস, মরার আগে শেষবারের মতো দেখতে পেলাম না। ভালোবাসার মানুষটাকে।
আমার হ্যালুসিনেশন আরও বেড়েছে।
অসম্ভব সুন্দর…আমার দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।
মোরা।
.
২৭.
আমার বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। একদিকে কাত হয়ে গেছি আমি।
মুখ হাঁ করে দম নিচ্ছি। এই কাজ করা ছাড়া অন্যকিছু করতে পারছি না–আমার সারা শরীর যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। পানি বেরিয়ে আসছে আমার নাকমুখ দিয়ে। মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর পড়ে আছে রিভস। শয়তানটার মাথা ফেটে গেছে সম্ভবত। জাহান্নামে যাক সে-পরোয়া করি না। এখন আমার সব পরোয়া শুধু বাতাস নিয়ে, অক্সিজেন নিয়ে।
ধাতস্থ হতে এবং শক্তি ফিরে পেতে বেশি সময় লাগল না আমার। স্বাভাবিক কৌতূহলের বশে মুখ তুলে তাকালাম-কে আমার জীবন বাঁচিয়েছে, জানতে চাই। তবে ওয়াটারবোর্ড ট্রিটমেন্টের কারণে আমার মন ও মস্তিষ্কে ছড়িয়ে-পড়া হ্যালুসিনেশনটা বোধহয় কাটেনি এখনও।
কারণ আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি মোরাকে।
পালাতে হবে আমাদেরকে, ফিসফিস করে বলল সে।
যা দেখছি আমি, যা শুনছি, তা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। মোরা? আমি…।
প্লিজ, ন্যাপ, কথা বলার মতো একটা সেকেন্ডও নেই আমাদের হাতে। প্লিজ চলে তাড়াতাড়ি।
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু সহসা পারলাম না কাজটা করতে।
হাঁটতে পারবে? জানতে চাইল মোরা।
মাথা ঝাঁকালাম। আমাকে জড়িয়ে ধরল মোরা, ওকে অবলম্বন বানিয়ে একটু একটু করে হাঁটছি আমি। যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সে আমাকে, যাচ্ছি সেদিকে।
আমার এখনও মনে হচ্ছে, আমি আসলে মরে গেছি; মৃত্যুর পর, যে কোনো কারণেই হোক, আমাকে স্বর্গীয় কোনো অনুভূতি দান করছেন
এদিকওদিক তাকাচ্ছি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কোনো একটা ধ্বংসপ্রায় গুদামে আছি। আমাদের চারপাশে আশ্চর্য নীরবতা।
কটা বাজে? মনে পড়ে গেল, মাঝরাতে দেখা হয়েছিল রিভসের সঙ্গে। তারমানে, মোরার মার মতো কোনো ঘটনা যদি না-ঘটে থাকে আমার সঙ্গে, তা হলে এখন গভীর রাত। অথবা কাকডাকা ভোর।
এদিকে, বলল মোরা।
আমাকে জড়িয়ে ধরে ওই গুদামের বাইরে নিয়ে এল সে।
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। টের পাচ্ছি, প্রয়োজন না থাকার পরও এখনও জোরে-জোরে দম নিচ্ছি, তারমানে আমার আতঙ্ক এখনও কাটেনি পুরোপুরি। এখনও আমার অবচেতন মন ভয় পাচ্ছে, আবার পাকড়াও করা হবে আমাকে, আবারও আমাকে দেয়া হবে ওয়াটারবোর্ড ট্রিটমেন্ট।
হলুদ মাস্ট্যাং–টা দেখা যাচ্ছে রাস্তার একধারে। কিন্তু মোরা…আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে-মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সে আসলেই মোরা…অন্য একটা গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। বাঁ হাতটা আলগা করে নিল সে, জিনসের পকেট থেকে রিমোট বের করে চাপ দিল ওটাতে। টের পেলাম, ওর ডান হাতে একটা পিস্তল আছে।
পিস্তল কোথায় পেল সে? ওটা কি রিভসের?
আমাকে প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে দিয়ে চটজলদি ড্রাইভিং সিটে উঠে। বসল মোরা।
গার্ডেন স্টেট পার্কওয়ে ধরে উড়াল দিল আমাদের গাড়ি।
ভালোমতো তাকালাম মোরার দিকে। আজ যতটা সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে, আমার মনে হয় না, আর কখনও অত সুন্দর লেগেছে।
মোরা?
এখন কিছু জানতে চেয়ো না, প্লিজ।
তারপরও একটা প্রশ্নের জবাব জানতেই হবে আমাকে।
আমার ভাইকে কে খুন করেছে?
ছলছল করে উঠল মোরার দুই চোখ, তারপরই টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
ফিসফিস করে বলল, খুব সম্ভব আমি।
.
২৮.
ওয়েস্টব্রিজে ফিরে এসেছি আমরা। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন মিডল স্কুলের পার্কিং লটে গাড়ি রাখল মোরা।
তোমার ফোনটা দাও, বলল সে।
ওর কথা শুনে আশ্চর্য হলাম। আরও আশ্চর্য হলাম, যখন দেখলাম, মোবাইলটা আমার পকেটেই আছে। বের করলাম ওটা, আমার ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাহায্যে আনলক করলাম, তারপর দিলাম মোরাকে।
স্ক্রীনের উপর যেন নেচে বেড়াচ্ছে ওর কয়েকটা আঙুল।
কী করছ? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
নিশ্চয়ই জানো, ইচ্ছা করলেই ট্রেস করা যায় যে-কোনো স্মার্টফোনকে?
জানি।
একহাতের ভিপিএন অ্যান্টিট্র্যাকার লোড করে দিচ্ছি তোমার ফোনে।
তাতে কী হবে?
যদি কেউ ট্র্যাক করার চেষ্টা করে তোমাকে, সে দেখবে, অন্য কোনো অঙ্গরাজ্যে আছো তুমি, নিউজার্সিতে না।
আরও একদফা আশ্চর্য হওয়ার পালা আমার। মোরা যেমনটা বলছে, সে-রকম কোনো প্রযুক্তি যে আছে, সেটাই জানতাম না।
আমার মোবাইলের স্ক্রীনে নাচানাচি বন্ধ হলো মোরার আঙুলগুলোর। সেটটা ফিরিয়ে দিল সে আমাকে। যে-লোক আরেকটু হলে মেরে ফেলত তোমাকে, সে কি খামোকাই তোমার পকেটে রেখে দিয়েছে মোবাইলটা? কী মনে হয় তোমার?
কিছু মনে হয় না। কারণ এই মুহূর্তে মোরাকে ছাড়া পুরো পৃথিবীটা অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। মনে হচ্ছে, মোরা ছাড়া অন্য কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই।
গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল মোরা। একই কাজ করলাম আমি।
এখানে কী করছি আমরা, মোরা?
আরেকবার দেখতে হবে আমাকে।
আরেকবার কী দেখতে হবে?
জবাব দিল না মোরা, হাঁটতে শুরু করেছে। অবধারিতভাবে ওর পিছু নিলাম আমি। সে এখন আমার কাছে চুম্বকের মতো। আর আমি যেন কোনো ধাতব টুকরো। এখন মোরা যেখানে যাবে, আমাকেও যেতে হবে সেখানে।
আমি যেন ফিরে গেছি পনেরো বছর আগে। তখন তাকিয়ে তাকিয়ে মোরার হাটা খেয়াল করতাম, এখনও করছি। প্যান্থার যেভাবে হাঁটে, সেভাবে হাঁটত মোরা; এখনও একইরকম আছে ওর হাঁটার স্টাইল। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারছি, তারপরও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছি না ওর পিঠ, কোমর আর নিতম্বের উপর থেকে।
আমাদের চারপাশে অন্ধকার। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে দাঁড়াল মোরা, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। বিনা-প্রসঙ্গে হঠাৎ করেই বলল, এই পনেরোটা বছর তোমাকে খুব মিস করেছি।
জবাবে কিছু একটা বলতে চাইলাম আমি, কিন্তু সুযোগ পেলাম না–আবার হাঁটা ধরেছে মোরা।
আমাকে আবেগাপ্লুত হওয়ার সুযোগ দিতে চায় না সে সম্ভবত।
দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, মোরার কাছাকাছি থাকার জন্য পা চালালাম।
মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে ছিল চাঁদটা, এবার বেরিয়ে এল। খেয়াল করলাম, আজ পূর্ণিমা। যেন সাদা আর নিরুত্তাপ একটা মোমবাতি হয়ে আমাদেরকে আলো দিচ্ছে চাঁদ। তারপরও ছায়া ছায়া অন্ধকার রয়ে গেছে আমাদের আশপাশে কোথাও কোথাও।
একটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পরিচিত পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। চুপ করে আছি দুজনই। মোরা কেন চুপ করে আছে, জানি না। আমার চুপ করে থাকার কারণ: আমি অনুভব করার চেষ্টা করছি ওকে। আমি বিশ্বাস করার চেষ্টা করছি, অলৌকিক একটা ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনে যে মানুষটা হারিয়ে গিয়েছিল, যাকে শেষবারের মতো দেখার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম, সে ফিরে এসেছে।
আমাকে কতদিন ধরে ফলো করছ তুমি? শেষপর্যন্ত নীরবতা ভাঙলাম আমি।
দুদিন। …ভিডিওটেপটার ব্যাপারে জানো নিশ্চয়ই।
মোরার শেষের কথাটা যতটা না প্রশ্ন, তারচেয়ে অনেক বেশি একটা উক্তি।
হা, জানি। তুমি জানো?
জানবো না কেন? ওই ভিডিওতে আছি আমি, ন্যাপ।
আমি সেটা বলিনি। আমি বলেছি, তুমি কি জানো ভিডিওটা হ্যাঙ্কের কাছে ছিল? তুমি কি জানো, নিরাপদ কোনো জায়গায় রাখার জন্য ভিডিওটা দিয়েছিল সে ডেভিড রেইনিভের কাছে?
জবাব না দিয়ে মাথা ঝাঁকাল মোরা।
অতি পুরনো কিছু তারকাটার বেড়া দেখতে পাচ্ছি সামনে। রহস্যময় সেই ঘাটির কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা।
ডান দিকে বাঁক নিল মোরা। পাহাড়ি একটা ঢাল অতিক্রম করে থেমে দাঁড়াল একটা গাছের পাশে। তাকিয়ে আছে তারকাঁটার বেড়ার দিকে।
আর আমি তাকিয়ে আছি মোরার চেহারার দিকে। এককথায় যদি বলি, ওকে এখনও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আমার কাছে। আমার অবচেতন মন প্রার্থনা করছে, আজকের রাতটা যেন না ফুরায়। প্রার্থনা করছে, আগামীকালের সকালটা যেন না আসে আমার আর মোরার জীবনে।
কারণ আমি ওকে আর হারাতে চাই না।
আমি ওকে আর যেতে দিতে চাই না।
সে-রাতে ঠিক এখানেই অপেক্ষা করছিলাম আমি, বলতে শুরু করল মোরা। ঠিক এই গাছের পেছনে। বসে ছিলাম এখানে, তাকিয়ে ছিলাম। তারকাঁটার ওই বেড়ার দিকে। আমাকে গাঁজাভর্তি সিগারেট দিয়েছিল তোমার ভাই, আর বাসা থেকে নিয়ে এসেছিলাম মদের একটা বোতল; ওই বোতলে চুমুক দিতে দিতে সিগারেট টানছিলাম।
আর কে ছিল তোমার সঙ্গে?
কেউ না। একা ছিলাম আমি।
কেন, কন্সপাইরেসি ক্লাবের কেউ ছিল না তোমার সঙ্গে?
না। …ক্লাবটার ব্যাপারে জানো তুমি?
যা জানি, তা না-জানার সমান। তাই কাঁধ ঝাঁকালাম।
তারকাঁটা ছাড়িয়ে দূরের ওই পরিত্যক্ত ঘাঁটির দিকে তাকাল মোরা। সে-রাতে আমাদের…মানে ক্লাবের সদস্যদের দেখা করার কথা ছিল না কোথাও। আসলে ওই হেলিকপ্টারটা দেখে, ওটার ভিডিও ধারণ করে সাধ মিটে গিয়েছিল আমাদের, কারণ যে-রাতে ভিডিওটা করা হয়েছিল সে-রাতে আরেকটু হলে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম আমরা সিকিউরিটি গার্ডদের হাতে। যা-হোক, আমরা বুঝতে পারি, যে-ব্যাপারটা আমাদের কাছে ছিল নিছক একটা বিনোদন, সেটা বিপজ্জনক কিছু একটায় রুপান্তরিত হতে পারে।
আচ্ছা।
কথা ছিল, ডায়ানাকে নিয়ে এখানে আসবে লিও, শুধু আমরা তিনজন আড্ডা দেবো এখানে, আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চলবে গাঁজা আর মদ।
আচ্ছা।
বসে পড়ল মোরা। এখন যেভাবে বসেছে সে, আমার ধারণা, সে রাতেও একইভাবে বসেছিল।
বসলাম আমিও।
একচিলতে হাসি দেখা যাচ্ছে মোরার ঠোঁটের কোনায়। তোমার কথা ভাবছিলাম আমি। ভাবছিলাম, এখানে ওভাবে একা-একা বসে বোর হওয়ার চেয়ে তোমার সঙ্গে গেলেই ভালো হতো–তোমার আইস-হকি খেলা দেখতে পারতাম। দেখতে পারতাম, কত নিখুঁত ভঙ্গিতে স্কেটিং করো তুমি, কত নিখুঁত ভঙ্গিতে ধোকা দাও প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের।
কিছু বললাম না আমি।
খানিকটা মাতলামি পেয়ে বসেছিল আমাকে, বলছে মোরা। দুঃসাহসিক কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলার ইচ্ছা কাজ করছিল আমার ভিতরে গাঁজার প্রভাবে। তাকিয়ে ছিলাম ঘাটির দিকে। চারদিকে চুপচাপ…সে রকমই থাকত বেশিরভাগ সময়। হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেলাম।
কী-রকম শব্দ?
জানি না। এত বছর পর ঠিক মনে নেই আমার। তা ছাড়া…আমি তখন কিছুটা হলেও নেশার-ঘোরে। তবে এটা মনে আছে, একদল লোক চেঁচাচ্ছিল। কাছাকাছি কোথাও চালু হলো একটা ইঞ্জিন, সে-শব্দও শুনতে পেয়েছিলাম।
তারপর?
ওই যে বললাম…দুঃসাহসিক কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছিল…ঘটনা কী তা জানার দুর্দমনীয় কৌতূহল পেয়ে বসে আমাকে। যে ঘাঁটির সিকিউরিটি গার্ডদের তাড়া খেয়ে পালিয়েছিলাম আমরা, সে-ঘাঁটির গোপন কিছু একটা জেনে নিয়ে বাহবা কুড়াতে চাইছিলাম ক্লাবের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে। সুতরাং রওনা হলাম কাঁটাতারের বেড়ার উদ্দেশে।
কী দেখতে পেলে?
মাথা নাড়ল মোরা। আমি কিছু দেখতে পাওয়ার আগেই আমাকে দেখে ফেলেছিল ওরা।
ওরা মানে?
ঘাঁটির লোকগুলো। এবং যেইমাত্র আমি টের পেলাম, আমাকে দেখে ফেলেছে ওরা, সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করলাম। আতঙ্কে এবং নেশায় তখন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তাই ঘাঁটি থেকে দূরে চলে যাওয়ার বদলে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লাম ঘাঁটির ভিতরে। তারপর…
কী?
হঠাৎ করেই জ্বলে উঠল কয়েকটা অত্যুজ্জ্বল স্পটলাইট। আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার, ছুটতে ছুটতেই একটা হাত তুললাম চোখের কাছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, কোন্দিকে যাচ্ছিলাম তা-ও বুঝতে পারছিলাম না, তারপরও অন্ধের মতো দৌড়াচ্ছিলাম।
তারপর?
তারপর হঠাৎ করেই গুলি করতে শুরু করল ওরা।
গুলি করতে শুরু করল! তোমাকে?
হ্যাঁ।
তারপর?
বন্দুকবাজ যত দক্ষই হোক, ছুটন্ত কোনো নিশানায় গুলি লাগানো খুব কঠিন কাজ। আমার গায়েও বুলেট বেঁধাতে পারল না ওরা। তবে আমার মনে আছে, একবার একটা বুলেট এসে লেগেছিল আমার মাথার কাছের একটা গাছের গায়ে।
মোরার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। অপেক্ষা করছি ওর বাকি কথার জন্য।
একটা মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম হঠাৎ গাছের আড়ালে আড়ালে ছুটছি আমি তখন, যারা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি বার বার। মাথা নিচু করে রেখেছিলাম, নিজেকে সহজ কোনো টার্গেটে পরিণত করতে চাইছিলাম না আসলে। কিন্তু যখন ওই মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম, থমকে না দাঁড়িয়ে পারলাম না। অনতিদূরে দেখতে পেলাম একটা ছায়ামূর্তি…খুব সম্ভব কোনো পুরুষমানুষের। আবারও গুলি চালানো হলো। মোটা কাণ্ডের একটা গাছের আড়ালে থাকায় বেঁচে গেলাম আমি। আরও একবার চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা। কণ্ঠটা চিনতে পারলাম এবার। ডায়ানা। লিও! চেঁচিয়ে বলছিল সে, লিও, বাঁচাও আমাকে! সাহায্য… সাহায্য শব্দটার পর আর কিছু বলতে পারেনি সে, বলার সুযোগ পায়নি আসলে–গুলির আওয়াজ শুনতে পাই আবারও, সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় ডায়ানার চিৎকার।
পুরো দৃশ্যটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমি। আমার দম যেন আবারও আটকে আসছে।
একটা পুরুষলোকের চিৎকার শুনতে পাই তখন। গুলি থামাতে বলছিল সে। অখণ্ড নীরবতা নেমে আসে। কিছুক্ষণ পর আবারও শোনা যায় একটা চিৎকার, কী হলো এটা! তখন অন্য কেউ চেঁচিয়ে বলে, আরও একটা মেয়ে আছে! ওকে খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের! আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করিনি আমি, ছুট লাগাই আবার। কোন্ দিকে যাচ্ছিলাম জানি না, শুধু জানতাম আমাকে পালাতে হবে…
আমার দিকে তাকাল মোরা। ওর দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে আমার সাহায্য চায় সে।
আমি নড়তে পারছি না। নড়তে পারবে বলে মনেও হচ্ছে না। ওরা গুলি চালিয়ে মেরে ফেলল ওই দুজনকে
জবাব দিল না মোরা।
আর তুমিও স্রেফ পালিয়ে গেলে?
কী?
মানে, তুমি কেন পালিয়ে গিয়েছিলে সেটা বুঝতে পারছি–বাঁচতে চাইছিলে বিপদ থেকে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, যখন নিরাপদ কোনো জায়গায় পৌঁছালে, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে না কেন?
যোগাযোগ করে কী বলতাম?
যা দেখেছ তা-ই-তোমার চোখের সামনে গুলি খেয়ে মরেছে দুজন মানুষ।
আরেকদিকে তাকাল মোরা। হয়তো সেটাই করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি তখন থতমত খেয়ে গেছি। ভীষণ ঘাবড়ে গেছি। আমার অবস্থাটা বুঝবার চেষ্টা করো। আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি। তা ছাড়া তখনও আমি নিশ্চিতভাবে জানি না, গুলি খেয়ে আসলেই মরে গেছে কি না লিও আর ডায়ানা। আরেকটা কথা। আমি যে-লোকের ছায়ামূর্তি দেখেছিলাম সে লিও কি না, জানি না। লিও’র কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পাইনি একবারের জন্যও। শুধু ডায়ানার চিৎকার শুনেছিলাম, এবং সে-চিৎকার থেমে যেতে শুনেছিলাম। কাজেই উত্তেজিত এবং নেশায় আচ্ছন্ন মাথায় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, লুকিয়ে পড়াটাই সবদিক দিয়ে ভালো হবে আমার জন্য।
কোথায় লুকালে?
শহরের পুলের পেছনে পাথরের একটা কুড়েঘর আছে। ওটার কথা মনে আছে তোমার?
মাথা ঝাঁকালাম।
গিয়ে ঢুকলাম পরিত্যক্ত ওই ঘরে, বসে থাকলাম অন্ধকারে। কতক্ষণ বসে ছিলাম ওভাবে, জানি না। ওখান থেকে হোবার্ট অ্যাভিনিউ দেখা যায়। দেখতে পেলাম, বড় বড় কালো কয়েকটা গাড়ি ধীর গতিতে চলে গেল রাস্তা, দিয়ে। অত রাতে রাস্তা বলতে গেলে ফাঁকা ছিল, তাই ধীর গতিতে গাড়ি চালানোর দরকার ছিল না; বুঝে গেলাম, যে বা যারা বসে ছিল ওসব গাড়ির ভিতরে তারা আসলে খুঁজছিল কাউকে…সম্ভবত আমাকেই। একটু একটু করে কমতে শুরু করেছিল আমার আতঙ্ক, ওটা তখন নতুন করে পেয়ে বসল আমাকে।
তারপর?
একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম, তোমাদের বাসায় যাবো।
খবরটা আমার জন্য নতুন। গিয়েছিলে?
হ্যাঁ। কিন্তু রাস্তা পার হয়ে যে-ই এগোতে যাবো তোমাদের সদর দরজার দিকে, দেখতে পেলাম, দুরে এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো গাড়ি, ভিতরে বসে আছে স্যুট-পরিহিত দুজন লোক, তাকিয়ে আছে। তোমাদের বাড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে কেটে পড়লাম আমি।
কিছু বললাম না।
পুলিশে ফোন করার কথা বললে তুমি, ন্যাপ। কিন্তু একটাবার ভেবে দেখো তো, কী বলার ছিল আমার। আমি কি বলতে পারতাম, আমার ধারণা, পুরনো ওই ঘাঁটির লোকগুলো গুলি করে মেরে ফেলেছে এক বা একাধিক মানুষকে? পুলিশ তখন ডিটেইলস জানতে চাইত আমার কাছে। কী বলতাম? বিস্তারিত কী বলার ছিল আমার? …হয়তো নিজের নামটা বলতে হতো আমাকে। হয়তো বলতে হতো, অত রাতে কী করছিলাম আমি ওই ঘাঁটির কাছে। জবাবে আমি কি বলতে পারতাম, গাঁজা আর মদ খাওয়ার জন্য গিয়েছিলাম আমি সেখানে? সত্যি জবাবটা শোনামাত্র আমার সঙ্গে আর একটা কথাও কি বলত পুলিশের অফিসার? তা ছাড়া মনে করো ওরা আমার কথা বিশ্বাস করল, তারপর খোঁজখবর করার জন্য গেল ওই ঘাঁটিতে; ঘাঁটির লোকগুলো কি তাদের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করত? তারা যদি বেমালুম চেপে যেত সব, একজন গাঁজাখোর আর মদ্যপের অভিযোগ কি আমলে নেয়া হতো?
মাথা ঝাঁকালাম আমি। কাজেই পালানো ছাড়া উপায় ছিল না তোমার।
হ্যাঁ।
পালিয়ে কোথায় গেলে? এলির গ্যারেজ-হোমে?
হ্যাঁ। ভাবলাম, দু-একটা দিন থাকি সেখানে, দেখি কী হয়। ভেবেছিলাম, ওই লোকগুলো হয়তো ভুলে যাবে আমার কথা। কিন্তু ওরা ভোললনি। আমাদের বাসার পেছনে বিশাল একটা পাথর আছে, ওটার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ওরা। ভাঙা মন নিয়ে ফিরে গেলাম এলির গ্যারেজ-হোমে, টিভি ছাড়ামাত্র জানতে পারলাম লিও আর ডায়ানার মৃতদেহ পাওয়ার খবর। এলি তখন বাইরে গেছে। মনোযোগ দিয়ে দেখলাম আমি খবরটা। খেয়াল করলাম, খবরে বলা হচ্ছে, চলন্ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গেছে লিও আর ডায়ানা, গুলি খেয়ে মরেনি। বুঝতে পারলাম, ঘাঁটির সেই লোকগুলো কেস সাজিয়ে ফেলেছে নিজেদের মতো করে। বুঝতে পারলাম, আমার কথা বিশ্বাস করবে না কেউ।
আমি করতাম। আমার কাছে এলে না কেন তুমি?
তোমার কাছে যাইনি, কারণ আমার মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম, তোমার কাছে না যাওয়াটাই সবদিক দিয়ে ভালো।
কেন?
কারণ তোমার বয়স তখন আঠারো। তোমার মাথা তখন গরম। আজ,..পনেরো বছর পরও…ভাই-হত্যার বদলা নিতে চাইছ তুমি। এসব কথা পনেরো বছর আগে জানতে পারলে কী করতে? ন্যাপ, আমি তখন তোমার কাছে যাইনি, কারণ আমি চেয়েছিলাম, অন্তত তুমি যাতে বেঁচে থাকো।
চুপ করে আছি আমি। তাকিয়ে আছি মোরার দিকে।
চলো, হঠাৎ কেঁপে উঠল মোরা, কেটে পড়ি এখান থেকে।
.
২৯.
মোরার গাড়ির কাছে ফিরে এসেছি, এমন সময় মনে পড়ে গেল কথাটা।
বললাম, হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবের সামনে এখনও রয়ে গেছে আমার গাড়ি।
অসুবিধা নেই।
মানে?
ওই ক্লাবে ফোন করেছিলাম আমি। গাড়িটার বর্ণনা আর লাইসেন্স প্লেটের নম্বর জানিয়ে বলেছি, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেছি আমি, তাই আমার পক্ষে গাড়ি চালানো সম্ভব না। অনুরোধ করেছি, ওরা যাতে একটু দেখে রাখে গাড়িটা। বলেছি, ওটা নিতে আগামীকাল যাবো আমি সেখানে।
কিছু বললাম না। মোরা আগে যেমন স্মার্ট ছিল, এখনও তা-ই আছে। কীভাবে যেন আগেই ভেবে ফেলে সবকিছু। শুধু যদি সে-রাতে…গাঁজা আর মদ খাওয়ার আগে…ভাবতে পারত কী ঘটতে চলেছে!
এখন আর বাসায় ফিরতে পারবে না তুমি, ন্যাপ।
এখন আর কোথাও ফেরার দরকার নেই আমার, সে-রকম কোনো প্রয়োজনও অনুভব করছি না। এখন আমি সবসময় থাকতে চাই মোরার সঙ্গে। এখন আমি আর একমুহূর্তও কাছছাড়া করতে চাই না ওকে।
ইগনিশন কী-তে মোচড় দিল সে।
কোথায় যাচ্ছি আমরা? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
নিরাপদ একটা জায়গা আছে আমার।
সে-রাতের পর থেকে তুমি তা হলে নিজের জন্য পলাতক জীবন বেছে নিয়েছ?
হ্যাঁ।
একটা প্রশ্নের জবাব দাও। পনেরো বছর পর ওরা কেন আবার হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে? কেন বেছে বেছে খুন করছে কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যদের?
জানি না।
জানো না?
না…আসলেই। তোমার কাছে গোপন করার মতো কিছু নেই আমার।
রেক্সকে যে-রাতে খুন করা হলো, তখন ওর সঙ্গে ছিলে তুমি?
মাথা ঝাঁকাল মোরা। গত তিন-চার বছর একটু…কী বলবো…রিল্যাক্স মুডে ছিলাম আমি। ভেবেছিলাম, আর পালিয়ে বেড়িয়ে লাভ কী? নিশ্চয়ই এত বছর পর সবকিছু ভুলে গেছে ওরা, এবং আমার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো প্রমাণ নেই। ঘাঁটিটাও বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে। আমি কিছু বললে যেমন বিশ্বাস করবে না কেউ, ঠিক তেমন আমার বিরুদ্ধে কিছু বলা হলে সেটাও হবে অবিশ্বাস্য। তা ছাড়া টাকাপয়সাও ফুরিয়ে গিয়েছিল আমার, তাই এমন কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম যে-কাজে পরিশ্রম কম কিন্তু আয় বেশি। নিয়তি তখন রেক্সের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয় আমাকে। ওর মাথাতেও ঘুরঘুর করছিল একটা পরিকল্পনা, কিন্তু বিশ্বাসী পার্টনারের অভাবে এগোতে পারছিল না সে।
মদ্যপ পুরুষলোকদের ফাসানোর পরিকল্পনা, তা-ই তো?
হু। স্বীকার করছি, আমরা দুজনে মিলে যা করেছি তা ভালো হয়নি। আবার একদিক দিয়ে চিন্তা করলে খারাপও হয়নি। নিজে মেয়েমানুষ হওয়ায় টের পেয়েছি, যাদেরকে ফাঁসিয়েছি আমরা, তাদের সঙ্গে ঘর করা আসলেই খুব মুশকিল। ওই ধরনের যে-কোনো লোকের কাছ থেকে মুক্তি চাইবে স্বাধীনচেতা যে-কোনো মেয়ে।
জিম জন্সটনস স্টিক হাউসের পাশে, আইযেনহাওয়ার পার্কওয়েতে গাড়ি থামাল মোরা।
বললাম, যে-রাতে মারা গেল রেক্স, সে-রাতের কিছু সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি আমি।
এবং যে-লোক খুন করেছে রেক্সকে, সে একজন প্রফেশনাল।
তারপরও বেঁচে গেছ তুমি।
হয়তো।
মানে?
মানে এখনও নিজের জীবন নিয়ে সংশয় আছে আমার। এখনও আমার ধারণা, আমাকে খুঁজছে ওরা।
রেক্সকে খুন করার পর তোমাকেও শেষ করে দেয়ার কথা তথাকথিত ডেইল মিলারের। পালালে কীভাবে?
লোকটা গাড়ি থেকে নামল, কিন্তু স্টার্ট বন্ধ করেনি। ইগনিশন কী-তে রয়ে গিয়েছিল ওর চাবি। রেক্সকে অসতর্ক অবস্থায় পেয়ে গুলি করল দুবার। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, ধরা পড়ে গেছি আমি, কিছুক্ষণের মধ্যে মরতে হবে আমাকেও–কারণ আমিই ছিলাম তথাকথিত ডেইল মিলারের আসল টার্গেট। কাজেই রেক্সকে মারার পর যখন আমার দিকে পিস্তল তাক করছে লোকটা, একলাফে গিয়ে বসলাম ড্রাইভিং সিটে, গিয়ার বদল করেই পা দাবালাম এক্সিলারেটরে।
মাথা ঝাঁকালাম আমি, এদিকওদিক তাকালাম। কাছেই একটা ছোট মোটেল দেখা যাচ্ছে। নাম: ইস্ট অরেঞ্জ।
ইঙ্গিতে দেখালাম মোরাকে মোটেলটা। ওটাই কি তোমার সেই নিরাপদ জায়গা?
না। আসলে পুরনো একটা বুদ্ধি কাজে লাগিয়েছি আমি।
পুরনো বুদ্ধি?
ইস্ট অরেঞ্জের সামনে যদি থাকে আমার এই চুরি-করা গাড়ি, এবং যদি পরে তদন্ত হয় এই ব্যাপারে, পুলিশ ভাববে, ওই মোটেলে রাত কাটিয়েছি আমি। কিন্তু আসলে এখন আমি নামতে যাচ্ছি গাড়ি থেকে, রাস্তা ধরে সিকি মাইল হেঁটে হাজির হবো ভাড়া-নেয়া একটা ঘরে। গাড়িটা যেহেতু চুরি-করা, সেহেতু এটা নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই আমার। যদি দরকার হয়, অন্য কোনো গাড়ি চুরি করে নেবো।
তিতা হাসি হাসলাম। রেক্স খুন হওয়ার পর তা হলে আবার জোরেশোরে শুরু হয়েছে তোমার পলাতক জীবন।
হু। ইদানীং প্রতি দুদিন পর পর নিজের লোকেশন বদল করছি আমি।
.
মোরার সেই ঘরে গেলাম আমরা, বিছানায় বসলাম পাশাপাশি।
আরও কিছু কথা বলার আছে তোমাকে, বলল মোরা।
লিও মারা যাওয়ার পর থেকে কোথায়-কীভাবে দিন কাটিয়েছে সে, জানাল আমাকে। একবারও বাধা দিলাম না ওকে, কিছু জানতেও চাইলাম না, চুপ করে থেকে শুধু শুনলাম ওর কথাগুলো।
বর্ণনার অতীত কোনো একরকমের অনুভূতি হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে, অবশ হয়ে আসছে আমার সব স্নায়ু।
মোরার কথা যখন শেষ হলো, ঘড়িতে তখন রাত তিনটা বাজে।
এবার বোধহয় বিশ্রাম নেয়া উচিত আমাদের, বলল সে।
মাথা ঝাঁকালাম আমি।
বাথরুমে গিয়ে ঢুকল মোরা, গোসল করল। টেরি ক্লথের একটা রোব পরে বের হলো বাথরুম থেকে, চুল পেঁচিয়ে রেখেছে টাওয়েল দিয়ে। লাইট নিভিয়ে রেখেছিলাম আমরা, জানালা খুলে সরিয়ে দিয়েছিলাম পর্দা; বাথরুম থেকে যখন বের হলো সে, পূর্ণিমার আলো গিয়ে পড়ল ওর উপর। আরও একবার থমকে গেলাম আমি। এত সুন্দর কোনো দৃশ্য…এত সুন্দর কোনো মেয়ে কখনও দেখেছি কি না, মনে করতে পারলাম না।
বাথরুমে গেলাম আমিও। জামাকাপড় ছেড়ে গোসল সেরে নিলাম। কোমরে একটা টাওয়েল পেঁচিয়ে বের হলাম বাথরুম থেকে।
বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মোরা। তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আর আমি তাকিয়ে আছি মোরার দিকে।
কেউ কিছু বলে দিল আমাদেরকে। আমরা জানি এখন কী করতে হবে আমাদেরকে। এখানে ভনিতার কিছু নেই, প্রণয়প্রার্থনার কিছু নেই। আমাদের দুজনেরই দেহ-মনে পনেরো বছরের প্রেমক্ষুধা।
এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম মোরাকে। পাগলের মত চুমু খাচ্ছি। সে-ও পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে আমাকে, বার বার ওর জিভটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে আমার মুখের ভিতরে। হ্যাঁচকা একটানে আমার টাওয়েল খুলে ফেলল সে। আর আমি খুলে ফেললাম ওর রোব।
সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর ধপাস করে আছড়ে পড়লাম আমরা বিছানায়। আমার বুকের উপর মাথা রাখল মোরা, একটা হাত রেখেছে আমার পেটের উপর। আমরা কেউই কিছু বলছি না। আমি তাকিয়ে আছি ঘরের ছাদের দিকে। আর মোরা তাকিয়ে আছে একদিকের দেয়ালের দিকে।
একসময় চোখ বন্ধ হয়ে গেল আমাদের দুজনেরই।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে ফিসফিস করে বললাম মোরাকে, আর কখনও ছেড়ে যেয়ো না আমাকে…কখনও না।
.