১৫.
ঠিকানাটা পাওয়ামাত্র বুঝতে পারলাম, জায়গামতে হাজির হয়ে ছোটখাটো একটা ধাক্কা লাগবে আমার মনে। ঘটলও তা-ই। মারিয়া হ্যানসনদের বাড়ির অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছে মোরাদের সেই বাড়ি।
আমরা যখন স্কুলের সিনিয়র ইয়ারে পড়ি, তখন মোরাকে নিয়ে এই বাড়িতে চলে আসেন ওর মা। আমার মনে আছে, সময়টা তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। বাড়ির দুটো ঘর ছেড়ে দিয়ে একটা ভিয়েতনামি পরিবারকে সাবলেট দেন মোরার মা। কিন্তু ওই টাকায় কি সংসার চলে? মোরার মা তাই কয়েকটা পার্টটাইম জব করতেন। আর মদ খেতেন প্রচুর।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালাম হ্যানসন পরিবারের বাড়িটার দিকে। পুরনো একটা বাড়িতে থাকেন তারা। কাঠের কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে হাজির হতে হয় ওই বাড়ির সদর-দরজায়। সিঁড়িতে পা রাখামাত্র মচমচ করে উঠল পুরনো কাঠ।
ডোরবেল বাজালাম। মেকানিকের কভারঅল পরিহিত বিশালদেহী এক লোক দরজা খুলে দিলেন। লোকটার বুকের ডানদিকে স্টেনসাইলের মাধ্যমে জো নামটা লেখা আছে। আমাকে দেখে তিনি খুশি হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।
কে আপনি? জিজ্ঞেস করলেন জো।
আমার ব্যাজটা দেখালাম তাঁকে।
জোর পেছনে দেখা যাচ্ছে এক মহিলাকে। আমার ধারণা, তিনিই সুযান হ্যানসন। আমার ব্যাজটা দেখলেন তিনিও। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার–এখনকার সন্তানদের ব্যাপারে অভিভাবকদের স্বাভাবিক উৎকণ্ঠা।
আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত তুললাম আমি। সব ঠিকই আছে।
তারপরও সন্দেহের ছাপ গেল না জোর চেহারা থেকে। বউকে আড়াল করে দাঁড়ালেন তিনি, চোখ সরু বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী চান?
ব্যাজটা পকেটে ঢোকালাম। এই শহরের কয়েকজন বাসিন্দা হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড নামের এক লোকের বিরুদ্ধে একাধিকবার নালিশ জানিয়েছে। ওই ব্যাপার নিয়েই কাজ করছি আমি। যে বা যারা নালিশ করেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলছি।
দেখলে, জো? যাকে সুযান হ্যানসন বলে মনে করছি, কথাটা বললেন তিনি। স্বামীকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি, দরজার পাল্লা ফাঁক করলেন আরও। ভিতরে আসুন, অফিসার।
সামনের ঘর পার হয়ে কিচেনে গেলাম আমরা। ছোট্ট একটা টেবিল আছে এখানে, একধারের একটা চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন সুযান।
বসলাম।
ফর্মিকা লাগানো আছে কিচেনের মেঝেতে। টেবিলটা গোলাকার, কৃত্রিম কাঠের। চেয়ারগুলো সাদা। কিচেনের দরজার উপর, দেয়ালের গায়ে একটা ঘড়ি আটকানো আছে। ওটার অঙ্ক আর সংখ্যাগুলো লাল রঙের। ফ্যাধুলাস লাস ভেগাস শব্দটা খোদাই-করা অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি ঘড়ির গায়ে।
টোস্টের গুড়ো পড়ে আছে টেবিলের উপর। সুযান ওগুলো একহাত দিয়ে সরিয়ে আরেকহাতের তালুতে নিলেন। তারপর ওগুলো ফেলে দিলেন সিঙ্কে, কল ছেড়ে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেন।
একটা প্যাড আর কলম বের করলাম আমি-ভনিতা আর কী। হ্যাঙ্ক স্ট্রাউডের ব্যাপারটা যে আসলেই তদন্ত করছি, দেখাতে চাইছি। বললাম, হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড কে, জানেন?
আমার মুখোমুখি বসে পড়লেন সুযান। তাঁর পাশে টাওয়ারের মতো দাঁড়িয়ে আছেন জো। লোকটার একটা হাত তাঁর স্ত্রীর কাঁধে। তিনি এখনও সরু চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ভাব দেখলে মনে হয়, তার বউকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছি আমি। অথবা, শুতে এসেছি তার বউয়ের সঙ্গে।
বিকৃত রুচির জঘন্য এক লোক সে, আমার প্রশ্নের জবাবে বললেন সুন। স্কুলের আশপাশে ঘুরঘুর করাটাই ওর কাজ।
আমার ধারণা, লোকটাকে একাধিকবার দেখেছেন আপনি, বললাম আমি।
একাধিকবার মানে? প্রায় প্রতিদিনই তো দেখি। লোলুপ দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এবং সেই মেয়েদের মধ্যে আমার মেয়েটাও আছে…মানে মারিয়ার কথা বলছি। অথচ মেয়েটার বয়স মাত্র চৌদ্দ।
মাথা ঝাঁকালাম আমি, বন্ধুত্বসুলভ একটা হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম চেহারায়। হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড যে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, সেটা নিজচোখে দেখেছেন আপনি?
হ্যাঁ, অবশ্যই। …ভয়ঙ্কর! যা-হোক, আপনি শেষপর্যন্ত এসেছেন, এতদিনে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি আমি। কারণ এতদিনে এই ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। আমার কথা হচ্ছে, এত টাকা খরচ করে এত সুন্দর একটা শহর গড়ে তুলেছি আমরা, এখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা নিরাপদে থাকতে পারবে না কেন?
ঠিক কথা, তাল মেলালাম। নোটপ্যাডে কিছু একটা লিখলাম। মিস্টার স্ট্রাউডকে কি লোলুপ-দৃষ্টিতে-তাকিয়ে-থাকা ছাড়া আর কিছু করতে দেখেছেন?
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন সুযান, কিন্তু তাঁর কাঁধে চেপে বসল জোর হাত। তারমানে, বোঝা গেল, ইশারায় স্ত্রীকে সংযত হতে বলছেন জো।
মুখ তুলে তাকালাম জো’র দিকে! আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন তিনি। খুব সম্ভব বুঝে গেছেন, হ্যাঙ্ক স্ট্রাউডকে খুঁজে বের করার জন্য এসেছি আমি আসলে, ওর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে সেগুলোর তদন্ত করতে আসিনি।
অর্থাৎ, আমার খেল খতম।
অথবা…খেলা বোধহয় শুরু হলো এতক্ষণে।
মিসেস হ্যানসন, বললাম আমি, আপনি ইন্টারনেটে হ্যাঙ্ক স্ট্রাউডের একটা ভিডিও পোস্ট করেছেন। ঠিক না?
জ্বলে উঠল মহিলার দুই চোখ। থাবা চালিয়ে নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে দিলেন জোর হাত আমিই করেছি কাজটা, জানলেন কীভাবে?
জানি। ভয়েস অ্যানালাইসিস প্রযুক্তির মাধ্যমে সনাক্ত করা হয়েছে আপনার কণ্ঠ। ভিডিওটা যে ইন্টারনেট আই.পি. অ্যাড্রেস থেকে পোস্ট করা হয়েছে, সেটাও খুঁজে বের করেছি আমরা। নিশ্চিত হয়েছি, আপনিই ধারণ করেছেন ওই ভিডিও, তারপর ছড়িয়ে দিয়েছেন ইন্টারনেটে।
কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভয়েস অ্যানালাইসিস চালায়নি ওয়েস্টব্রিজ পুলিশ। আই.পি. অ্যাড্রেস বের করার জন্য তদন্তও করেনি।
আমার স্ত্রী যদি করেও থাকে কাজটা, জোর কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ, কী হয়েছে? ও-রকম কাজ যে করা যাবে না, এমন কোনো আইন আছে আমাদের দেশে?
আইন আছে কি নেই তা নিয়ে কথা বলার জন্য আসিনি আমি এখানে। আমি এসেছি আসল ঘটনার তদন্ত করতে। তাকালাম সুযানের দিকে। সরাসরি বলুন…সেদিন কী দেখেছিলেন আপনি?
দেখেছিলাম…লোকটা তার প্যান্ট খুলে ফেলেছিল।
কখন?
কখন মানে? তারিখ জানতে চাইছেন নাকি?
ইচ্ছা হলে বলতে পারেন।
মাসখানেক আগে হবে হয়তো।
স্কুল চলাকালীন সময়ে, নাকি স্কুল ছুটির পর?
স্কুল শুরু হওয়ার আগে। …সকাল পৌনে আটটার দিকে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিই আমি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চলে আসি না, ক্লাস শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করি। কেন করি কাজটা, বোধহয় বুঝতে পারছেন।
কেন?
চৌদ্দ বছরের একটা মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসবেন আপনি, আর তখন ওই স্কুলের আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকবে বিকৃত-রুচির একটা লোক…মেয়েকে চোখে-চোখে না রেখে উপায় আছে? কিছু একটা ঘটে গেলে অপরাধীকে বড়জোর শাস্তি দিতে পারবেন আপনারা, আমার মেয়ে যা হারাবে তা কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল, বলুন তো।
বলেছি। লোকটা তার প্যান্ট খুলে ফেলেছিল।
তখন ওর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আপনার মেয়ে?
হ্যাঁ।
কিন্তু আপনার তোলা ভিডিওতে দেখা গেছে, প্যান্ট পরে আছে হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড।
আমি ভিডিও শুরু করার আগে প্যান্ট তুলে ফেলেছিল সে।
ও আচ্ছা। তারমানে আগে প্যান্ট খুলেছিল সে, তারপর আবার পরেছিল?
হ্যাঁ। আসলে… সুযানের দ্বিধা দেখে মনে হলো, যা বলতে যাচ্ছেন তা মনে মনে বানিয়ে নিচ্ছেন, আমি মোবাইল ফোন হাতে নিয়েছি টের পাওয়ার পর ঘাবড়ে যায় লোকটা, প্যান্ট তুলে ফেলে।
প্যান্ট কতক্ষণ নামিয়ে রেখেছিল সে?
জানি না।
আপনার কী ধারণা? মুখ খুললেন জো। লোকটা কতক্ষণ প্যান্ট নামিয়ে রেখেছিল তা জানার জন্য সঙ্গে করে স্টপওয়াচ নিয়ে গিয়েছিল আমার স্ত্রী?
জবাব দিলাম না।
অনেকক্ষণ নামিয়ে রেখেছিল, বললেন সুযান। জোর দিয়ে বলতে পারি।
তারপর? জানতে চাইলাম আমি।
দ্বিধা ফুটল সুযানের চেহারায়। তারপর মানে?
প্যান্ট তুলল হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড। তারপর কী হলো? নাকি সেখানেই শেষ ঘটনার?
কেন, আপনার কি আরও ঘটনা দরকার? ফোড়ন কাটলেন জো।
যদি বলি, প্যান্টটা হ্যাঙ্কের কোমর থেকে পিছলে নেমে গিয়েছিল? খোঁচা মারার ঢঙে বললাম আমি।
আরও একবার দৃষ্টি নিচু হলো সুযানের, তারপর চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। বুঝতে পারলাম, আবারও মিথ্যা বলতে যাচ্ছেন তিনি। প্যান্টটা নামাল ওই লোক। তারপর চিৎকার করে ডাকল আমার মেয়েকে, ওর…বুঝতেই পারছেন,..জিনিসটা দেখতে বলল।
আপনি মিথ্যা কথা বলছেন, শান্ত গলায় বললাম।
ইংরেজি ও অক্ষরের মতো হয়ে গেল সুযানের মুখটা।
ওদিকে লাল হয়ে গেল জোর চেহারা। আপনি কি আমার স্ত্রীকে মিথ্যুক বলতে চান?
যে মিথ্যা কথা বলে, তাকে পৃথিবীর কোন্ দেশে সত্যবাদী বলে?
আপনার সাহস তো কম না! বললেন সুযান।
একটুখানি হাসলাম। কাউকে তার মুখের উপর মিথ্যুক বলার জন্য খুব বেশি সাহসী হতে হয় না। তা ছাড়া, এখানে আসার আগে আপনাদের মেয়ে মায়িরার সঙ্গে কথা বলেছি আমি।
দেখে মনে হলো রাগ বাড়ল সুযান আর জোর।
কী করেছেন আপনি? চিৎকার করে উঠলেন সুযান।
আপনাদের মেয়ে মারিয়ার সঙ্গে কথা বলেছি। মেয়েটার ভাষ্য অনুযায়ী, আপনি যা বলছেন সে-রকম কোনোকিছুই ঘটেনি।
স্বামী-স্ত্রী দুজনের চেহারাই এখন লাল হয়ে গেছে।
আপনি কাজটা করতে পারেন না! কোন্ কাজ?
আমাদের অনুমতি ছাড়া আমাদের মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না আপনি। আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো আমরা।
ঠিক আছে, আমিও দেখে নেবো কী করতে পারেন আপনারা আমার বিরুদ্ধে। শুনুন, বাজে কথা অনেক হলো, এবার কাজের কথা বলি…হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড সম্বন্ধে সত্যি কথাটা যদি না বলেন আমাকে, এই ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের ব্যবস্থা করবো আমি। এবং আপনাদের দুজনের বিরুদ্ধে ফেডেরাল ইন্টারনেট অ্যাক্ট সেকশন ফোর হানড্রেড এইটিন লজ্জনের অভিযোগ আনবো। দোষী প্রমাণিত হলে এক লক্ষ ডলার জরিমানা গুনতে হবে আপনাদের, অনাদায়ে খাটতে হবে সর্বোচ্চ চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
আমার কথাটা সম্পূর্ণ বানোয়াট। ফেডেরাল ইন্টারনেট অ্যাক্ট বলে কোনোকিছু আছে কি না, সন্দেহ আছে আমার। আসলে স্বামী-স্ত্রীকে ফাঁদে ফেলার জন্য বলেছি কথাটা।
আপনি কি ওই বিকৃত রুচির লোকটার পক্ষ নিচ্ছেন? যেন বিষ ঝরল সুনের কণ্ঠে।
না। আমি কারও পক্ষই নিচ্ছি না। আমি শুধু বলতে চাইছি, এমন একটা ভিডিও আপলোড করা হয়েছে ইন্টারনেটে যার ফলে সাংঘাতিক মানহানি হয়েছে হ্যাঙ্ক স্ট্রাউডের, এবং তারপর থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে লোকটা।
কী?
সহজ কথা বুঝতে পারছেন না, নাকি না-বুঝবার ভান করছেন? …আপনি ওই ভিডিও আপলোড করার পর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না হ্যাঙ্ক স্ট্রাউডকে।
ভালো, সুযানের কণ্ঠে নিখাদ সন্তুষ্টি।
কেন? ভালো কেন?
হয়তো…ভিডিও দেখে লজ্জা বলে কিছু একটা জেগেছে ওই লোকের মনে। ফলে আত্মগোপন করেছে সে।
এবং হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় আপনার যারপরনাই খুশি লাগছে?
খুশি হবো না? আমার জায়গায় আপনি থাকলে কি খুশি হতেন না? পৃথিবীর কোন্ বাবা-মা নিজের বাচ্চার ক্ষতি চাইবে, বলুন তো?
মানলাম। এবার ঠিক করে বলুন, কী ঘটেছিল।
.
সব বললেন সুযান।
তিনি স্বীকার করে নিলেন, হ্যাঙ্কের ব্যাপারে অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি-প্যান্ট খুলে কখনোই নিজের সবকিছু দেখায়নি সে। তবে স্কুলের সামনে প্রায় প্রতিদিনই দাঁড়িয়ে থাকত সে, ফলে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন সুন। হ্যাঙ্কের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে নালিশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শেষে যা করলে ভালো হবে বলে বুঝেছেন, তা-ই করেছেন।
আজ না হোক কাল ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলত ওই লোক, বললেন তিনি। ওটা শুধু ঠেকানোর চেষ্টা করেছি আমি।
খুব ভালো করেছেন, আমার কণ্ঠে অবজ্ঞা।
আর কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম ওই বাড়ি থেকে।
আমার পেছনে সদর-দরজাটা দড়াম করে লাগিয়ে দিলেন জো।
লম্বা কর দম নিলাম। তাকিয়ে আছি সেই বাড়ির দিকে, যেখানে একসময় থাকত মোরা। আমাকে কখনও ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়নি মোরা, তারপরও বাড়িটা চিনে নিয়েছি আমি, এবং একদিন চুরি করে ঢুকেছিও ওই বাড়িতে। লিও আর ডায়ানা মারা যাওয়ার সপ্তাহ দু-এক পর করেছিলাম পাগলামিটা।
মোরাদের বাড়ির সামনে সেই গাছটা আজও দাঁড়িয়ে আছে। স্পষ্ট মনে আছে আমার, ওই গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম আমি অনেকক্ষণ। আমার সামনে দিয়েই ভিয়েতনামি ওই পরিবার বাড়ি থেকে বের হয়। পনেরো মিনিট পর বের হন মোরার মা, তার পরনে ছিল দোমডানো-মোচড়ানো একটা সামার-ড্রেস। কেমন এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি বাস স্টপের দিকে।
তিনি দৃষ্টির আড়াল হওয়ামাত্র বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ি আমি।
কেন করেছিলাম কাজটা, তা বোধহয় বলে না-দিলেও বোঝা যায়। মোরা কোথায় গায়েব হয়েছে, সে-ব্যাপারে ব্লু খুঁজছিলাম। এর আগে একদিন মুখোমুখি হয়েছিলাম ওর মার, কোথায় গেছে সে তা জানার জন্য চাপাচাপি করছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন, প্রাইভেট একটা স্কুলে নাকি ট্রান্সফার করা হয়েছে ওকে। আমি তখন জানতে চেয়েছিলাম, স্কুলটা কোথায়। প্রশ্নটার জবাব দেননি মিসেস ওয়েলস…অর্থাৎ মোরার মা।
বরং বলেছিলেন, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, ন্যাপ। এই শহর ছেড়ে চলে গেছে মোরা, আর কখনও ফিরে আসবে না। তোমারও বোধহয় তা-ই করা উচিত। অন্ততপক্ষে, মোরার ফেরার আশা করাটা উচিত না। সে আর কখনও ফিরবে না।
কিন্তু তার কথা বিশ্বাস হয়নি আমার।
তখন আমার কানের কাছে যেন ফিসফিস করে বলছিল মোরা, যেতে দিয়ো না আমাকে…ডোন্ট লেট গো। কাজেই সুযোগ পাওয়ামাত্র ওদের বাড়িতে হানা দিতে হয় আমাকে। প্রতিটা ড্রয়ার আর প্রতিটা কেবিনেট তছনছ করে ফেলি আমি। তারপর গিয়ে হাজির হই মোরার ঘরে। দেখি, ওর কাপড়চোপড় আর ব্যাকপ্যাক জায়গামতোই আছে। তখন মনে প্রশ্ন জাগে, মোরা কি আদৌ কোনোকিছু গুছিয়ে সঙ্গে-নিয়ে শহর ছেড়েছে?
আমার ভার্সিটি জ্যাকেটটা খুঁজতে শুরু করি তখন।
আমি ছিলাম খেলার পাগল; ওদিকে যে-কদিন আমার সঙ্গে ছিল মোরা, সে ছিল আমার জন্য পাগল। আমার একটা ভার্সিটি জ্যাকেট নিজের কাছে রেখে দেয় সে। ওটা ওর খেয়াল, নাকি আমার প্রতি অন্ধ আবেগ…জানি না।
যা-হোক, জ্যাকেটটা খুঁজতে শুরু করি আমি। ওটা ছিল সবুজ রঙের, হাতা দুটো সাদা। পিঠে আড়াআড়িভাবে দুটো হকি স্টিকের ছবি। আমার নামটাও আছে। আর ক্যাপ্টেন শব্দটা স্টেনসাইল করা আছে জ্যাকেটের সামনের দিকে।
কিন্তু অনেক খুঁজেও পাইনি ওটা।
মোরা কি জ্যাকেটটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল? প্রশ্নটা আজও খোঁচায় আমাকে। তা না হলে ওটা পাওয়া গেল না কেন ওর ঘরে?
মোরাদের বাড়িটা যেদিকে আছে, মুখ ঘুরিয়ে নিলাম সেদিক থেকে। রাস্তা পার হয়ে খুঁজে নিলাম রেইলরোড ট্র্যাক। ওই ট্র্যাক ধরে হাঁটলাম বেশ কিছুদূর। ডাউনিং রোড ছাড়িয়ে হাজির হলাম কডিংটন টেরেসে। এখন যেখানে আছি আমি, সেখানে একটা স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি আছে। পুরনো একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্ল্যান্টও আছে। অবশ্য, এখন একটা পার্টি-স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ওই প্ল্যান্ট।
আমার মনে হচ্ছে, সভ্যতা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। এখানে সেখানে পড়ে আছে বিয়ারের ভাঙা বোতল। আরও খানিকটা হেঁটে হাজির হলাম ওয়েস্টব্রিজ প্রেসবাইটেরিয়ানে।
লিও’র স্মৃতি যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে। নিছক বিনোদনের উদ্দেশ্যে ড্রাগস আর মদ খেত সে। ভাই হিসেবে ওকে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা উচিত ছিল আমার, কিন্তু পারিনি–তখন আমি নিজে কুঁদ হয়ে ছিলাম মেয়েমানুষে। আর কে না জানে, ড্রাগস আর মদের চেয়ে বড় নেশার নাম মেয়েমানুষ। ড্রাগস আর মদের নেশার চিকিৎসা আছে, মেয়েমানুষের নেশার কোনো চিকিৎসা নেই।
তা ছাড়া তখন বিনোদনের জন্য আরও অনেকেই ওই পথে পা বাড়িয়েছিল। যেমন মোরা। যেমন আমাদের আরও অনেক বন্ধু। অন্ধকারাচ্ছন্ন ওই জগৎ হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল আমাকেও, কিন্তু কেন যেন সেদিকে যাওয়া হয়নি আমার শেষপর্যন্ত। হতে পারে, অন্ধকারের চেয়ে আলো বেশি টানে আমাকে।
লম্বা করে দম নিলাম আবারও।
এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেই রাতে এখানে কেন এসেছিল লিও আর ডায়ানা?
কিছু সময়ের জন্য একা হতে চেয়েছিল ওরা? কন্সপাইরেসি ক্লাবের বন্ধুদের থেকে আলাদা হতে চেয়েছিল? নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে সরে যেতে চেয়েছিল ওই মিসাইল ঘাঁটি থেকে?
কেন এখানে এসেছিল ওরা?
রেললাইনের উপর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি আমি, এদিকওদিক তাকাচ্ছি। পনেরো বছরের পুরনো দিনগুলো কোনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনে কি না আমার মনে, সে-অপেক্ষা করছি।
তীক্ষ হুইসেলের শব্দ শোনা গেল একসময়। ওয়েস্টব্রিজ স্টেশনে ঢুকছে একটা ট্রেন। রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। আমার। কিন্তু টের পেলাম, এভাবে সবকিছু শেষ করে দেয়ার মতো মানুষ না আমি। আমার ভিতরে আত্মহত্যা-প্রবণতাটা সেভাবে কাজ করে না। যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন বেঁচে থাকতে চাই।
আমার পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। কাঁপছে রেললাইন। এগুলো নিশ্চয়ই এভাবেই কেঁপেছিল সে-রাতে। সে-কম্পন কি টের পেয়েছিল লিও আর ডায়ানা?
রেললাইনের উপর থেকে সরে গেলাম আমি।
আমার মতো এভাবে কি সরে দাঁড়িয়েছিল ওরা?
ট্রেনটা এখন দেখতে পাচ্ছি আমি। সে-রাতের সেই ঘাতক ট্রেনটাকে কি দেখতে পেয়েছিল লিও আর ডায়ানা? দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পেরেছিল নিশ্চয়ই। অপরিমেয় শক্তি নিয়ে চলে একটা ট্রেন, ও-রকম কিছুর অস্তিত্ব টের না পেয়ে উপায় নেই। আরও কিছুটা সরে দাঁড়ালাম আমি, রেললাইনের সঙ্গে এখন আমার দূরত্ব দশ গজের মতো। তারপরও ট্রেনটা যখন হুশ করে চলে এল, মনে হলো বাতাসের ধাক্কায় উল্টে পড়ে যাবো।
ট্রেনটা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। মনে হচ্ছে, এই যাওয়ার কোনো শেষ নেই। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে আমার চোখে পানি চলে এল একসময়।
শেষপর্যন্ত যখন যাওয়া শেষ হলো ট্রেনটার, এদিকওদিক তাকাতে শুরু করলাম। এত বছর পরও ক্লু খুঁজছি আমি, প্রমাণ খুঁজছি; বুঝবার চেষ্টা করছি কোথাও কোনো গণ্ডগোল রয়ে গেল কি না।
কেমন যেন তাজ্জব লাগছে আমার। আমি জানি, ভয়ঙ্কর একটা জায়গায় আছি–এখানে বীভৎস উপায়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে আমার ভাইকে। কিন্তু বীভৎসতার পাশাপাশি পবিত্র একটা ভাবও বিরাজ করছে আমার মনে। কারণ আমি এখন যেখানে আছি, সেখানে জীবনের শেষ দমটা নিয়েছিল আমার ভাই।
শূন্যতার সেই অনুভূতি আবারও যেন ঘিরে ধরেছে আমাকে। বার বার মনে হচ্ছে, মাত্র আঠারো বছর বয়সে কেন মারা গিয়েছিল আমার ভাই, সে প্রশ্নের জবাব আছে এই স্টেশনে। কিন্তু বার বারই খালি-হাতে ফিরে গেছি আমি। আজও খালি-হাতেই হাঁটা ধরলাম ফিরতি পথের উদ্দেশে।
পকেট থেকে বের করলাম মোবাইল ফোনটা–কোনো এস.এম.এস. এসেছে কি না দেখা দরকার। না, আমাদের সেই পুরনো ক্লাসমেট বেথ ফ্লেচার ওরফে বেথ ল্যাশলির কোনো খবর নেই। ফোন করলাম ওর অফিসে।
রিসিপশনিস্ট আমার পরিচয় পাওয়ামাত্র লাইনটা ট্রান্সফার করে দিল ক্যাসি নামের এক মহিলার কাছে। নিজেকে অফিস ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে তিনি বললেন, এই মুহূর্তে হাসপাতালে নেই ডক্টর ফ্লেচার।
টের পেলাম, দমে যাচ্ছি। ক্যাসি, আমি পুলিশে চাকরি করি। ডক্টর ফ্লেচারের সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি দরকার।
দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না। তিনি যদি এখন থাকতেন হাসপাতালে, অবশ্যই কথা বলতে পারতেন তাঁর সঙ্গে। কিন্তু তিনি নেই। আপনার যদি কিছু বলার থাকে, বলতে পারেন আমাকে তার সঙ্গে দেখা হলে জানিয়ে দেবো।
সে কোথায়?
জানি না।
জানেন না?
না, জানি না। হাসপাতালের ডাক্তাররা কে-কখন-কোথায় থাকে, জানাটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আপনার নাম আর ফোন নম্বর থাকল আমার কাছে। ডক্টর ফ্লেচারকে যদি কোনো মেসেজ দেয়ার থাকে, আমাকে বলতে পারেন।
ঠিক আছে। আপনার হাতের কাছে কাগজ-কলম আছে?
আছে।
তা হলে আমি বলছি, আপনি লিখুন। আমাদের বন্ধু রেক্স ক্যান্টনকে খুন করা হয়েছে। আরেক বন্ধু হ্যাঙ্ক স্ট্রাউডকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মোরা ওয়েলস, মানে আজ থেকে পনেরো বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল আমাদের যে-বান্ধবী, কিছু সময়ের জন্য দেখা গেছে তাকে, তারপর আবার গায়েব হয়ে গেছে সে। পুরো ব্যাপারটা সম্ভবত কন্সপাইরেসি ক্লাবের সঙ্গে জড়িত। …আর হ্যাঁ, বেথ এই মেসেজ পাওয়ামাত্র যেন ফোন করে আমাকে।
ও-প্রান্তে নীরবতা।
কিছুক্ষণ পর ক্যাসি বললেন, কী ওয়েলস বললেন? লরা ওয়েলস নাকি মোরা ওয়েলস?
মোরা। শব্দটা এম দিয়ে।
ঠিক আছে। ডক্টর ফ্লেচারকে এই মেসেজ জানিয়ে দেবো।
লাইন কেটে দিলেন ক্যাসি।
মোবাইল হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। ব্যাপারটা কেন যেন ঠিক পছন্দ হচ্ছে না আমার। কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা গড়বড় আছে।
কেন ও-রকম মনে হচ্ছে?
আমার কি অ্যান আবার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ফোন করা উচিত? ওদের সাহায্য চাওয়া উচিত? ওদেরকে কি বলবো, বেথের বাসা আর অফিসে যাতে নিয়মিত খোঁজ রাখে?
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে শুরু করলাম। সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
লিও আর ডায়ানার ট্রেন-দুর্ঘটনা। রেক্সের হত্যাকাণ্ড, এবং ঘটনাস্থলে মোরার ধূমকেতুর-মতো আবির্ভাব। হ্যাঙ্ক আর ওর ভাইরাল ভিডিও। একাধিকবার যোগাযোগ করার পরও বেথের সন্ধান না-পাওয়া। সবশেষে কন্সপাইরেসি ক্লাব। এসবের মধ্যে যোগসূত্রটা কী? নাকি আসলে কোনো যোগসূত্রই নেই? খামোকা যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করছি আমি?
তারমানে, অগি যা বলেছিলেন তা-ই ঠিক-কন্সপাইরেসি ক্লাবের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো আমার কষ্টকল্পনা?
হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি ওয়েস্টব্রিজ মেমোরিয়াল লাইব্রেরির কাছে। হঠাৎ একটা চিন্তা খেলে গেল আমার মাথায়। দিক বদল করে পা বাড়ালাম লাইব্রেরির উদ্দেশে।
লাল ইট দিয়ে বানানো কিছু স্কুল দেখা যায় মাঝেমধ্যে, লাইব্রেরির সামনের দিকটা দেখতে সে-রকম। প্রথম দেখায় মনে হয়, ওটা কমপক্ষে এক শ বছরের পুরনো। বিল্ডিং-এর বাকিটা আধুনিক আর চকচকে।
যে-কোনো লাইব্রেরিই ভালো লাগে আমার। এখনকার বেশিরভাগ লাইব্রেরিতেই কম্পিউটার সেকশন বলে আলাদা একটা জায়গা থাকে, ভালো লাগে সেটাও। ভালো লাগে হলদেটে হয়ে-আসা যে-কোনো বই। আসলে লাইব্রেরি আমার কাছে গির্জার মতো…অভয়ারণ্যের মতো। জীবনের বাস্তবতা আমাদের কাছ থেকে যা কেড়ে নেয়, লাইব্রেরি তার কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দেয়।
আমি আর লিও যখন ছোট ছিলাম, প্রতি শনিবার সকালে আমাদেরকে এখানে নিয়ে আসতেন বাবা। কোনোরকম দুষ্টুমি না করার কড়া আদেশ দিয়ে চিলড্রেন অথবা ইয়ং-অ্যাডাল্ট সেকশনে বসিয়ে দিতেন তিনি আমাদেরকে। ডজন ডজন বই ঘেঁটে বেড়াতাম আমি। আর লিও খুঁজে বের করত বড়দের কোনো বই, ওটা নিয়ে বসে যেত এককোনার একটা চেয়ারে। একবসায় শেষ করত পুরো বই।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাজির হলাম বেইজমেন্টে। মনে হলো, পুরনো কোনো স্কুলে উপস্থিত হয়েছি যেন। আমার চারপাশে সারি-সারি অ্যালুমিনিয়াম-র্যাকে শুধু বই আর বই। এখনকার পাঠকদের কাছে এসব বইয়ের তেমন কোনো কদর নেই বুঝতে পেরে ওগুলো বেইজমেন্টে পাঠিয়ে দিয়েছে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ।
যারা আসলেই পড়ালেখা করতে চায়, তাদের জন্য এককোনায় কয়েকটা ডেস্ক আছে। দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা কাঠের-ফলক আটকে দেয়া হয়েছে স্ক্রু দিয়ে, বিভিন্ন বিষয়ের নাম লেখা আছে ওসব ফলকের গায়ে। টাউন হিস্টোরি লেখা ফলকটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। ওই ফলকের নিচের র্যাকে যে-কটা বই আছে, সবই ওয়েস্টব্রিজ শহরের পুরনো ইতিহাস নিয়ে লেখা।
একধারের একটা ডেস্কে বসে বই পড়ছিলেন ডক্টর জেফ কফম্যান, আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন। অনেক বছর ধরে চিনি আমি এই ভদ্রলোককে। আদর্শ শিক্ষানুরাগী বলতে যা বোঝায়, তিনি তা ই। বয়স হয়েছে তার, তারপরও বিরাম দেননি বই পড়ায়। দিনের বেশিরভাগ সময়ই পড়ে থাকেন লাইব্রেরিতে।
হঠাৎ মুখ তুলে তাকানোর কারণে তার রিডিংগ্লাসটা পড়ে গেল নাক থেকে। চেইনে বাঁধা ছিল ওটা, তাই বাড়ি খেল তার বুকের সঙ্গে। মোটা একটা কার্ডিগান সোয়েটার পরে আছেন তিনি, বোম আটকে রেখেছেন বুক পর্যন্ত। তার সারা মাথায় টাক, দুই কানের কাছে শুধু কয়েকগাছি খাড়া খাড়া চুল আছে।
হ্যালো, ন্যাপ।
হ্যালো, ডক্টর কফম্যান।
আমি আর লিও বাবার-হাত-ধরে এসেছিলাম ওয়েস্টব্রিজে; তার অনেক আগে এখানকার লাইব্রেরিয়ান এবং টাউন হিস্টোরিয়ান ছিলেন ডক্টর কফম্যান। এগিয়ে গেলাম তার দিকে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম সেই মিসাইল ঘাঁটির ব্যাপারে।
যারা অনেককিছু জানেন, তাঁরা জ্ঞান বিতরণ করার সুযোগ পেলে খুশি হন। তাই আমার কথা শোনামাত্র অদ্ভুত এক দ্যুতি দেখা গেল ডক্টর কফম্যানের দৃষ্টিতে। চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি। বুঝতে পারলাম, যা বলবেন তা গুছিয়ে নিচ্ছেন মনে মনে।
কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে তাকালেন আমার দিকে, তাঁর মুখোমুখি একটা চেয়ার ইশারায়-দেখিয়ে বললেন, বসো।
বসলাম।
খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন তিনি। বলতে শুরু করলেন, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ উত্তর নিউ জার্সির বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করা হয় ওসব মিসাইল ঘাঁটি। তখন শীতল-যুদ্ধ নিয়ে রীতিমতো বাড়াবাড়ি চলছে আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। বিশ্বাস করা না-করা তোমার উপর-সে-সময় আমাদের দেশের স্কুলের বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো, স্কুল চলাকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যদি পারমাণবিক হামলা হয়, তা হলে ডেস্কের নিচে মাথা গুঁজে কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে। যা-হোক, আমাদের এই ওয়েস্টব্রিজে মিসাইল ঘাঁটি গড়ে তোলা হয় উনিশ শ চুয়ান্ন নাগাদ।
ওই কাজে ওয়েস্টব্রিজের মতো শহরগুলো বেছে নেয়ার বিশেষ কোনো কারণ ছিল?
মাথা ঝাঁকালেন কফম্যান। প্রথম কথা, সে-সময় ওসব শহর এখনকার মতো ছিল না, বরং মফস্বল শহরের মতো ছিল। দ্বিতীয়ত, প্রচুর ফার্মল্যান্ড ছিল ওসব শহরে। সোজা কথায়, জঙ্গলে ভরা জায়গার ছড়াছড়ি ছিল। …মূলত ভূমি-থেকে-আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য মিসাইলের গবেষণা এবং উৎপাদনের জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল ওসব ঘাঁটি। অর্থাৎ, একটা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। উদ্দেশ্য ছিল, সম্ভাব্য সোভিয়েত বিমান-হামলা ঠেকানো। টি.ইউ. নাইন্টি ফাইভ…মানে তখনকার দিনের সর্বাধুনিক সোভিয়েত যুদ্ধবিমান…ছিল আমেরিকানদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। রিফুয়েলিং না করে ছহাজার মাইল উড়তে পারত ওই প্লেন।
ও-রকম কটা ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছিল, বলতে পারেন?
নিউ জার্সির কমপক্ষে এক ডজন জায়গায় গড়ে তোলা হয় ওসব মিসাইল ঘাটি। স্যান্ডি হুক নামের একজায়গায় আজও ও-রকম একটা ঘাঁটির ধ্বংসাবশেষ আছে, ইচ্ছা হলে দেখে আসতে পারো। লিভিংস্টোনের ঘাঁটিতে গড়ে তোলা হয়েছে আর্ট গ্যালারি। ফ্র্যাঙ্কলিন লেকস, ইস্ট হ্যাঁনোভার, মরিসটাউন-সহ আরও কয়েক জায়গায় ছিল ও-রকম ঘাঁটি।
মিসাইলগুলো দেখতে কেমন ছিল?
প্রতিটা ঘাটির প্রতিটা মিসাইল লম্বার ত্রিশ ফুট। লঞ্চ-সাইট লুকানো থাকত মাটির নিচে। কোনো বডি-শপে মাটির-নিচ-থেকে যেভাবে বের করে নিয়ে আসা হয় গাড়ি, নিক্ষেপের আগে ঠিক সেভাবে মাটির উপর নিয়ে আসা হতো লঞ্চ-প্যাডগুলোকে। …হয়তো ভাবছ, এত বড় আয়োজন, তারপরও সরকার লোকচক্ষুর আড়ালে রাখল কী করে এই মিসাইল সিস্টেম। আসলে সরকার ওই কাজে ব্যর্থ হয়েছে…অন্তত প্রথমদিকে। কারণ ওসব ঘাঁটি নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা, জল্পনা-কল্পনা আর আলোচনার শেষ ছিল না জনগণের মধ্যে। আমার নিজের কথাই বলি। আমার বয়স তখন সাত…মানে উনিশ শ ষাট সালের কথা বলছি। তখন কাব স্কাউট করি আমি। তো, আমাদের স্কাউট প্যাক একবার এক ট্যুরে গেল ও-রকম এক সাইটে।
আমজনতার এত কৌতূহলের কারণ কী?
সম্ভাব্য সোভিয়েত বিমান-হামলা থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে একটা মিসাইল সিস্টেম-বলা বাহুল্য তোমার রাতের ঘুমটা হবে নিশ্চিন্ত। কিন্তু সবকিছুরই পরিবর্তন আছে। ষাটের দশকের শুরু থেকে জনগণের ওই ধারণাও বদলে যেতে শুরু করে। কারণ তখন ত্রিশ ফুটের অ্যাজাক্স মিসাইলের বদলে আরও লম্বা হারকিউলিস মিসাইল স্থাপন করা হচ্ছিল ঘাঁটিগুলোতে। হারকিউলিসগুলোর একেকটার দৈর্ঘ্য ছিল একচল্লিশ ফুট, গতি প্রতি ঘণ্টায় দুহাজার তিন শ মাইল। আর রেঞ্জ পঁচাত্তর মাইল। প্রশ্ন। করতে পারো, যেখানে খুশি হওয়ার কথা জনগণের, সেখানে তাদের খুশি উবে গেল কেন? উত্তরটা সহজ। প্রতিটা হারকিউলিসের সঙ্গে লাগানো ছিল ডব্লিউ থার্টি ওয়ান নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। সোজা কথায়, প্রতিটা মিসাইল একেকটা আণবিক অস্ত্র।
আণবিক অস্ত্র?
আবারও মাথা ঝাঁকালেন কফম্যান। পারমাণবিক বোমা কী জিনিস, উনিশ শ পঁয়তাল্লিশ সালে দেখেছে সারা পৃথিবী। তোমার বাড়ির কাছে। যদি ওই জিনিস থাকে, আর তুমি যদি হরহামেশাই খবর পেতে থাকো, গতকাল পরিবহনের সময় আরেকটু হলে বিস্ফোরিত হতো কোনো-না কোনো ওয়ারহেড, শান্তি বলে কিছু বাকি থাকবে তোমার জীবনে? …ষাটের দশকের শুরুর দিকে কোনো একটা মিসাইল ঘাঁটিতে ঘটল ওই ঘটনা। ডলি (ভারী জিনিস পরিবহনের জন্য চাকাওয়ালা যে-কাঠামো ব্যবহৃত হয়) ভেঙে গিয়ে একবার এক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড গড়িয়ে পড়ল পাহাড়ি ঢাল বেয়ে। বিস্ফোরিত হয়নি, কিন্তু টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল ওটা, সমানে ধোঁয়া বের হচ্ছিল ভাঙা টুকরোগুলো থেকে। কর্তৃপক্ষ ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল ঘটনাটা। কিন্তু এসব খবর কি গোপন রাখা যায়? বরং গোপন করার চেষ্টা করতে গিয়েই কাজ বেড়েছে–জনগণের মন থেকে আস্থা বিদায় নিয়েছে। যা-হোক, সত্তর দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত চালু ছিল ওই মিসাইল কার্যক্রম। ওয়েস্টব্রিজের ঘটিটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সবগুলোর পরে…উনিশ শ চুয়াত্তর নাগাদ।
চুপ করে আছি আমি।
ততদিনে ভিয়েতনামের ঘটনা দেখা হয়ে গেছে এ-দেশের মানুষদের, বলছেন কফম্যান। সেনাবাহিনির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে দেশবাসী কেউ কম, কেউ বেশি। সরকারও বুঝতে পেরেছে, জনগণের করের টাকায় হাতি পুষে লাভ নেই আসলে–সোভিয়েত বিমান-হামলা নামের জুজুটা কোনোদিনই আক্রমণ করবে না আমেরিকায়। তাই মিসাইল-ঘাঁটি স্থাপনের জন্য যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল একসময়, সেগুলোর বেশিরভাগই বিক্রি করে দেয়া হলো নিলামে। সামনের দিকে ঝুঁকলেন তিনি। হঠাৎ ওসব ঘাঁটির ব্যাপারে এতকিছু জানতে চাইছ কেন?
প্রশ্নটা আরও আগেই করেননি কেন তিনি, ভেবে আশ্চর্য হলাম। বললাম, একটা কেস নিয়ে কাজ করছি…আমার ধারণা ওয়েস্টব্রিজের ঘাঁটির সঙ্গে যোগসূত্র আছে কেসটার।
যদি কিছু মনে না করো…কেসটা কী, জানতে পারি?
অনেক বছর আগের একটা ঘটনা।
তোমার ভাইয়ের মৃত্যুর কথা বলছ?
জবাব দিলাম না।
কখনও কখনও জবাব না-দেয়াটা আমার একটা কৌশল। চুপ করে থেকে আমি আসলে প্রশ্নকারীকে তার নিজের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে ঠেলে দিই। চুপ করে থেকে আমি সত্যি জবাবটা এড়িয়ে যাই…অথবা এড়ানোর চেষ্টা করি।
তোমার বাবার সঙ্গে একসময় বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল আমার, জানো?
মাথা ঝাঁকালাম।
তোমার ভাই লিও-ও অনেককিছু জানতে চেয়েছে আমার কাছে ওসব ঘাঁটির ব্যাপারে।
লিও এসেছিল আপনার কাছে?
হ্যাঁ।
কবে?
দিনক্ষণ কি মুখস্ত করে রাখে কেউ, বলো? তবে…ওসব ঘাঁটির ব্যাপারে জানার জন্য কয়েকবার এসেছিল সে আমার কাছে…মারা যাওয়ার বছরখানেক আগে সম্ভবত। বিশেষ করে ওয়েস্টব্রিজের ঘাটিটা যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করত ওকে। ওর সঙ্গে কখনও কখনও ওর কয়েকজন বন্ধুও আসত।
বন্ধু? পিঠ আপনাআপনি খাড়া হয়ে গেছে আমার। তাদের নাম জানেন?
না। দুঃখিত।
ওদেরকে কী বলেছেন আপনি?
তোমাকে এখন যা-যা বললাম, তা-ই।
কিছু একটা কেঁচোর-মতো কিলবিল করতে শুরু করেছে আমার অবচেতন মনে। সেটা কী, বুঝতে পারছি না।
তোমার বাবাকেও বলেছিলাম আমি কথাটা।
কী বলেছিলেন?
বলেছিলাম, আমার কাছে মাঝেমধ্যে আসে লিও, ওয়েস্টব্রিজের ঘাঁটি নিয়ে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে।
শুনে বাবা কী বলেছিলেন?
তেমন কিছু বলেনি। তবে ওর চেহারা দেখে আমার মনে হয়েছিল, লিও’র কৌতূহল মেটাচ্ছি বলে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ সে। খুশি-খুশি দেখাচ্ছিল ওকে।তোমার ভাইটা বেশ চালাকচতুর আর চৌকস ছিল। তাই তোমার বাবা হয়তো ভেবেছিল, ওই মিসাইল ঘাঁটি সম্বন্ধে লিও’র কৌতূহল হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে…আমি কখনও কল্পনাও করিনি ওই ঘাঁটির সঙ্গে তোমার ভাইয়ের মৃত্যুর যোগসূত্র থাকতে পারে। তুমি আমার কাছে এসেছ, নিজের মুখে বলছ ওই ঘাঁটির সঙ্গে লিও’র মৃত্যুর সম্পর্ক আছে, তারপরও বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা।
তারমানে আমার কথা পাগলামি বলে মনে হচ্ছে আপনার?
না, তা-ও না। আচ্ছা, সত্যিই কি ওই ঘাঁটির সঙ্গে লিও’র মৃত্যুর কোনো যোগাযোগ আছে?
বলছি। তবে তার আগে ওই ঘাটির বাকি কাহিনি জানা দরকার।
ঠিক আছে। …ওয়েস্টব্রিজ ঘাঁটির মিসাইল কর্মসূচী যখন অফিশিয়ালি সমাপ্ত হিসেবে ঘোষিত হলো, তারপর ওই ঘাঁটি এবং সংলগ্ন এলাকা হস্তান্ত র করা হলো ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচারের কাছে।
আর আনঅফিশিয়ালি?
ওই এলাকায় গেছ কখনও?
গেছি।
যখন ছোট ছিলাম, আমরাও যেতাম। কাঁটাতারের বেড়ার একদিকে বেশ বড় একটা ফোকর ছিল, ওখান দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়তাম। স্পষ্ট মনে আছে, একবার আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু ধরা পড়ে যাই ওখানকার গার্ডদের হাতে। কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সেনাবাহিনির গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছিয়ে দেয়া হয় আমাদেরকে। ঘটনা জানতে পেরে খুব রেগে গিয়েছিলেন আমার বাবা, সপ্তাহ তিনেক বন্দি করে রেখেছিলেন আমাকে বাসায়। একটুখানি হাসলেন কফম্যান। তুমি ওই ঘাঁটির কত কাছে গিয়েছিলে?
বেশি না। সাহসে কুলায়নি।
কিছু বুঝতে পেরেছ?
চোখ পিটপিট করলাম। কী বুঝতে পারবো?
ওই এলাকায় যখন মিসাইল ঘাঁটি ছিল, ছেলেছোকরারা তখন হরহামেশাই ঢুকে পড়ত কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে; গার্ডরা দেখেও যেন দেখত না, কাউকে পাকড়াও করত না। অথচ যখন ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচারের কাছে হস্তান্তরিত হলো জায়গাটা, কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হলেঅ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচার এমন কী করছিল ওখানে যে, মিসাইল ঘাঁটির চেয়েও বেশি গোপনীয় আর সুরক্ষিত হয়ে গেল জায়গাটা?
জবাব দিলাম না।
কথাটা কিন্তু ভেবে দেখার মতো, বলছেন কফম্যান। এবং সেটা ভাবতে গিয়েই নতুন জল্পনা-কল্পনা ডানা মেলল অনেকের মনে। বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ল ওয়েস্টব্রিজের বাসিন্দাদের মধ্যে।
কী ধরনের গুজব?
কেউ কেউ বলত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল যেসব প্রতিভাবান নাৎসি বিজ্ঞানী, তাঁদের দু-চারজনকে নাকি জোরপূর্বক নিয়ে আসা হয়েছে ওয়েস্টব্রিজের সেই ঘাঁটিতে, তাদেরকে দিয়ে জোরপূর্বক করিয়ে নেয়া হচ্ছে গোপন কিছু গবেষণা। কেউ আবার বলত, অন্যের মন-নিয়ন্ত্রণের নিত্যনতুন কৌশল উদ্ভাবনের গবেষণা চলছে ওই ঘাঁটিতে। কেউ বলত ইউ.এফ.ও.র কথা। সোজাসুজি বললে, যার মনে যা আসত, সে তা-ই বলত।
আপনি বিশ্বাস করতেন ওসব?
বিশ্বাস করতাম মানে?
অন্যদের মতো আপনিও কি বিশ্বাস করতেন, গোপন কোনোকিছু লুকানো আছে ওই ঘাঁটিতে?
গোপন কোনোকিছু তো একসময় অবশ্যই লুকানো ছিল ওখানে…মানে, নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডযুক্ত মিসাইলের কথা বলছি। কাজেই মিসাইল বিদায় নেয়ার পর তার বদলে অন্যকিছু লুকিয়ে রাখতে অসুবিধা কী সরকারি কর্তৃপক্ষের?
জবাব দিলাম না এবারও।
ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচারের নামে যে-কোনোকিছুর গবেষণা চালাতে কোনো বাধা ছিল না কর্তৃপক্ষের। নাৎসি বিজ্ঞানী অথবা ইউ.এফ.ও.র কথা না-হয় বাদ দিলাম, কিন্তু লেযার, ড্রোন, ওয়েদার মোডিফিকেশন অথবা ইন্টারনেট হ্যাঁকিং–এসব নিয়ে গোপনে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে সমস্যা থাকার কথা না ওদের। তারপরও কথা থেকে যায়। যেসব গবেষণার নাম বললাম, সেগুলো গোপনে চালাতে হলে কি কড়া-পাহারার দরকার হয়?
না, হয় না…মনে মনে বললাম আমি।
উঠে দাঁড়ালেন জন কফম্যান, পায়চারি করতে শুরু করলেন। আমার আবার রিসার্চের বাতিক আছে…অনেক আগে থেকেই ছিল। গার্ডদের হাতে ধরা পড়েছি, বাবার বকা খেয়েছি, বাসায় বন্দি থেকেছি হপ্তার পর হপ্তারোখ চেপে গেল আমার। সিদ্ধান্ত নিলাম, কী চলছে ওই গোপন ঘাঁটিতে, তা জানতেই হবে আমাকে। ততদিনে আরও বড় হয়েছি। রেকর্ড আর আর্কাইভ দেখার জন্য একদিন সোজা চলে গেলাম ওয়াশিংটন ডিসি তে। কিন্তু কাগজপত্রে খাদ্যশস্য আর গবাদিপশু ছাড়া অন্য কোনোকিছুর সঙ্গে জড়িত অবস্থায় পাওয়া গেল না ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচারকে।
এসব কথা লিওকে বলেছিলেন আপনি?
হ্যাঁ, বলেছিলাম। আর শুধু ওকেই না, ওর কয়েকজন বন্ধুকেও বলেছিলাম।
ওর কজন বন্ধুকে বলেছিলেন?
কী?
মানে, লিও’র সঙ্গে কারা আসত আপনার কাছে?
পাঁচ…বেশি হলে ছজন। ঠিক মনে নেই আমার আসলে।
লিও’র কোনো মেয়েবন্ধুও কি আসত? নাকি শুধু ছেলেবন্ধুরা?
জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভাবলেন কফম্যান। যতদূর মনে পড়ে, দুজন মেয়েবন্ধু থাকত লিও’র সঙ্গে। কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারবো না কথাটা। লিও’র মেয়েবন্ধুর সংখ্যাটা একও হতে পারে।
আপনার কি মনে আছে, লিও’র সঙ্গে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ওর বান্ধবীও মারা পড়েছিল?
মাথা ঝাঁকালেন কফম্যান। আছে। মেয়েটার নামও মনে আছে। ডায়ানা স্টাইলস। আমাদের শহরের পুলিশ-ক্যাপ্টেনের মেয়ে।
লিও’র সঙ্গে যে-মেয়ে অথবা যে-দুজন মেয়ে আসত আপনার কাছে, তাদের মধ্যে কি ডায়ানা ছিল?
না।
আশ্চর্য হলাম কথাটা শুনে। লিও’র সঙ্গে ডায়ানা আসত না কফম্যানের কাছে?
বললাম, আর কিছু মনে আছে আপনার?
আর কিছু মানে?
ওই ঘাঁটির সঙ্গে জড়িত এমন কিছু, যা আমার কাজে লাগতে পারে?
বুঝিয়ে বল।
ধরুন আপনার কথাই ঠিক। মানে, সেনাবাহিনি ওই ঘাঁটি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও সরকারি কোনো একটা সংস্থা খুবই গোপন কিছু একটা করছিল ওখানে। এবং এটাও ধরে নিন, আমার ভাই আর তার বন্ধুরা জেনে গিয়েছিল খবরটা, বের করে ফেলেছিল কীসের গবেষণা চালানো হচ্ছে ওই ঘাঁটিতে। তারপর কী হলো, সেটাই জানতে চাইছি।
চুপ করে আছেন কফম্যান।
আপনি আর কী জানতে পেরেছিলেন, ডক্টর কফম্যান?
মাত্র দুটো ব্যাপার, খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন ডক্টর, ফিরে এসে বসে পড়লেন চেয়ারে। এক, ওই ঘাঁটির জনৈক কমান্ডারের নাম। অ্যান্ডি রিভস। যেহেতু ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচারের সদস্য, সেহেতু নামিদামি একজন অ্যাগ্রিকালচার-এক্সপার্ট হওয়ার কথা তার। কিন্তু তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে গিয়ে কিছুটা হলেও চমকে উঠতে হয়েছিল আমাকে।
কেন? কোথাকার কমান্ডার ছিলেন তিনি আসলে? সিআইএর?
সেটা জানতে পারিনি। তবে এই ব্যাপারে আমি এক শ ভাগ নিশ্চিত, তিনি কোনো অ্যাগ্রিকালচার-এক্সপার্ট ছিলেন না।
তার সঙ্গে কখনও কথা বলেছেন আপনি?
চেষ্টা করেছিলাম।
তারপর?
তিনি সোজাসুজি বলে দিয়েছিলেন আমাকে, ওই ঘাঁটিতে একঘেয়ে কৃষি-গবেষণা ছাড়া অন্য কিছু চলছে না।
দুই নম্বর ব্যাপারটা কী?
ওই ঘাঁটির বন্ধ হয়ে যাওয়া।
মানে?
আজ থেকে পনেরো বছর আগে বন্ধ হয়ে যায় ঘাঁটিটা।
জানি। কিন্তু এমন বিশেষ কী…
লিও আর ডায়ানা মারা যাওয়ার ঠিক তিন মাস পর বন্ধ হয়ে যায় রহস্যময় ওই ঘাটি।
.
অনেকটা পথ হেঁটে ফিরতে হবে গাড়ির কাছে, তাই হাঁটতে হাঁটতে ফোন করলাম অগিকে।
কল রিসিভ করতে সময় লাগল না তার।
জেফ কফম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি আমি।
দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেলাম বলে মনে হলো আমার। ভালো, প্রাণের কোনো ছোঁয়া নেই অগির কণ্ঠে।
রহস্যময় ওই ঘাঁটির ব্যাপারে ইন্টারেস্টিং কিছু তথ্য জানিয়েছেন তিনি আমাকে।
ও আচ্ছা।
অ্যান্ডি রিভস নামের কাউকে চেনেন?
চিনতাম।
কীভাবে?
প্রশ্নটা অবান্তর হয়ে গেল না? আজ ত্রিশ বছর হতে চলল আমি এই শহরের পুলিশ-ক্যাপ্টেন।
ওই লোক সম্পর্কে কী জানেন আপনি?
ওই ঘাঁটিতে যখন কৃষি-গবেষণা চলছিল, তখন সেখানকার কমান্ডার ছিল সে।
কথাটা বিশ্বাস করেছিলেন আপনি?
কোন্ কথা?
আসলেই কি কৃষি-গবেষণা চলছিল ওখানে?
হ্যাঁ। মন-নিয়ন্ত্রণের গবেষণার চেয়ে কৃষি-গবেষণার ব্যাপারটা বিশ্বাস করা সহজ।
কফম্যান বলেছেন, একসময় নাকি ওই ঘাঁটিতে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড যুক্ত মিসাইল ছিল।
আমিও তা-ই শুনেছি।
কফম্যান আরও বলেছেন, তথাকথিত কৃষিবিদদের কাছে যখন হস্তান্ত রিত হলো ঘাঁটিটা, তখন নাকি নিরাপত্তার কড়াকাড়ি বেড়ে গিয়েছিল।
কফম্যানকে সম্মান করি আমি, এমন কিছু বলতে চাই না যাতে তাঁর সম্মানহানি হয়। তারপরও বলতে বাধ্য হচ্ছি, বয়স বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার কল্পনাশক্তিও বাড়ছে।
মানে?
শুরুর দিকে ওই ঘাঁটিতে নিরাপত্তার তেমন কোনো কড়াকড়িই ছিল না। ওরা যখন নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড-যুক্ত মিসাইল আনতে শুরু করে, তখন কড়াকড়ি শুরু হয়। সেটা কি স্বাভাবিক না?
হ্যাঁ, স্বাভাবিক। তবে আমি বোধহয় ব্যাপারটা বোঝাতে পারিনি আপনাকে। সেনাবাহিনি যখন তথাকথিত কৃষি-গবেষকদের হাতে ওই ঘাঁটি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, তখনকার কথা বলেছেন কফম্যান।
কেউ যদি নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করে, তা হলে তাকে দায়ী করা চলে? …আমার বাড়িতে মূল্যবান কিছুই নেই, তারপরও আমি যদি হঠাৎ করেই আক্রান্ত হই চোর-ডাকাতের ভয়ে, যদি হঠাৎ করেই আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নিজের বাড়ির নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করি, তুমি কি অনুমান করে নেবে, গোপন কোনোকিছু নিয়ে গবেষণায় মত্ত হয়েছি আমি?
জবাব দিলাম না।
নতুন একটা দল নিজেদের কাজ শুরু করেছিল ওই ঘাঁটিতে। সেনাবাহিনিকে এমনিতেই ভয় পায় সাধারণ লোকে, এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু একদল কৃষি-গবেষক? তোমার মনে রাখা উচিত, ওরা তখন নতুন এসেছে এই এলাকায়। এই জায়গার কোনোকিছুই তাদের পরিচিত না, এমনকী কোনো মানুষও না। কে চোর আর কে ভালো, তা-ও জানে না ওরা। তাই ওরা যদি নিরাপত্তা-বিধানের নামে বাড়াবাড়ি কিছু করে, ওদেরকে কি দোষ দেয়া যায়? কাঁটাতারের বেড়াটা যদি আরও মজবুত করে বানায় ওরা, মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যায়?
অ্যান্ডি রিভসের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি। আপনি কি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?
ভেবেছিলাম মুখের উপর মানা করে দেবেন অগি। কিন্তু বললেন, ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখি।
বরাবরের মতো আমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেন না যে?
কোনো লাভ হবে বলে মনে হয়নি, তাই। চেষ্টা করে দেখো আসলেই বিশেষ কিছু জানতে পারো কি না রহস্যময় ওই ঘাঁটি সম্পর্কে। লাইন কেটে দিলেন অগি।
গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি আমি। আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। স্ক্রীনে এলির নাম দেখা যাচ্ছে।
কল রিসিভ করলাম। হ্যালো?
আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসো। যত জলদি সম্ভব।
এলির কণ্ঠের জরুরি-ভাবটা পছন্দ হলো না আমার। কী সমস্যা?
কোনো সমস্যা না। শুধু যত জলদি সম্ভব চলে এসো এখানে। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
লাইন কেটে দিল এলি।
ঝটপট উঠে পড়লাম গাড়িতে। বের করলাম পোর্টেবল পুলিশ সাইরেন লাইটটা। এটা বলতে গেলে কখনোই ব্যবহার করি না আমি, কিন্তু আজ যেহেতু জরুরি ডাক পড়েছে আমার, সেহেতু ব্যবহার করা যেতে পারে। জিনিসটা কায়দামতো বসিয়ে দিলাম গাড়ির ছাদে। তারপর পা দাবালাম এক্সিলারেটরে।
বারো মিনিটের মধ্যে হাজির হলাম এলির আশ্রয়কেন্দ্রে। গাড়ি থেমে নেমে ঝড়ের গতিতে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। মোড় নিলাম বাঁ দিকে, হল ধরে রীতিমতো ছুট লাগালাম। দূর থেকে দেখতে পেলাম, নিজের অফিসরুমের বাইরে অপেক্ষা করছে এলি। ওর চেহারা নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে, বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে।
গিয়ে দাঁড়ালাম ওর সামনে কী?
কিছু না বলে ইশারায় নিজের অফিসরুম দেখিয়ে দিল এলি।
দরজার হাতলে মোচড় দিলাম আমি, ফাঁক করলাম পাল্লাটা। তাকালাম ভিতরে।
দুজন মহিলা আছে ঘরে।
বাঁ দিকের মহিলাটাকে চিনতে পারছি না। অন্যজনকে চিনতে মাত্র একটা মুহূর্ত লাগল আমার।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁর বয়স বেড়েছে। কিন্তু যতটা বয়স্কা হওয়ার কথা ছিল তাঁর, ততটা হননি। বরং, কেন যেন মনে হলো আমার, গত পনেরোটা বছর বন্ধুর-মতো আচরণ করেছে তার সঙ্গে। যোগব্যায়াম করে সময়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন কি না তিনি, ভাবলাম।
দরজা খুলে যাওয়ায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তিনি, চোখাচোখি হলো আমাদের।
কিছু বললাম না আমি, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওই মহিলার দিকে। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি এলির অফিসরুমের দোরগোড়ায়।
আমি জানতাম, বললেন লিন ওয়েলস, আবার একদিন শুরু হবে সব। এবং এটাও জানতাম, সেই শুরুটা হবে তোমাকে দিয়েই।
তবুও কিছু বললাম না আমি। তীব্র একটা আলোড়ন, বলা ভালো প্রচণ্ড একটা ঝড় যেন শুরু হয়েছে আমার স্মৃতির পৃথিবীতে।
নির্নিমেষ তাকিয়ে আছি আমি মোরার মা’র দিকে।
.
১৭.
সংবিৎ ফিরে পেতে সময় লাগল না আমার। একটা মুহূর্তও নষ্ট না-করে জানতে চাইলাম, মোরা কোথায়?
অন্য যে-মহিলা আছেন মোরার-মার সঙ্গে, তিনি বললেন, দরজাটা লাগিয়ে দাও।
তার চুলের রঙ গাজরের মতো। সে-রঙের সঙ্গে ম্যাচ করে লিপস্টিক মেখেছেন তিনি ঠোঁটে। পরনে ধূসর স্যুট আর বুকের-কাছে-ঝালরওয়ালা শার্ট। ফ্যাশন সম্পর্কে ধারণা বা আগ্রহ কোনোটাই নেই আমার, তারপরও ওই স্যুট আর শার্ট বেশ দামি বলে মনে হচ্ছে।
লাগিয়ে দিলাম দরজাটা। ওটা যখন লাগিয়ে দিচ্ছি, তখন এলির সঙ্গে চোখাচোখি হলো আমার। আমার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল সে।
তাকালাম অচেনা ওই মহিলার দিকে। আপনি কে?
বারনাডেট হ্যাঁমিল্টন। লিনের বান্ধবী।
কেন যেন মনে হলো আমার, বারনাডেট হ্যাঁমিল্টন মোরার-মার বান্ধবীর চেয়েও বেশি কিছু, কিন্তু মাথা ঘামালাম না ওই ব্যাপারে। কী দরকার?
আমার বুকের ভিতরে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে।
তাকালাম মিসেস ওয়েলসের দিকে। আবারও প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম মোরার ব্যাপারে, কিন্তু কেউ একজন যেন আমার ভিতর থেকে আমাকে বলল, আস্তে, এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
মিসেস ওয়েলসকে জিজ্ঞেস করার জন্য কম করে হলেও এক লক্ষ প্রশ্ন জমে আছে আমার মনে। তারপরও তাড়াহুড়ো করলাম না। মনে পড়ে যাচ্ছে, আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছেন তিনি, আমি খুঁজে বের করিনি তাঁকে। বরং তিনিই খুঁজে বের করেছেন আমাকে, এবং সেটা নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে। আমার নাগাল পাওয়ার জন্য এলিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। ফোন করেননি, আমার বাসায় বা অফিসে যাননি। তারমানে তিনি চাইছেন না, তাকে অনুসরণ করার কোনো সুযোগ পাই আমি।
তিনি কি বিশেষ কিছু চাইতে এসেছেন আমার কাছে? এবং সেটা পাওয়ার পর আবার গায়েব হয়ে যাবেন?
কাজেই আমার উচিত, নিজে কথা না বলে তাঁকে কথা বলার সুযোগ দেয়া। চুপ থাকা উচিত আমার।
তাই করবো আমি, সিদ্ধান্ত নিলাম। একইসঙ্গে এই সিদ্ধান্তও নিলাম, মোরা কোথায় আছে তা না-জানা পর্যন্ত এই ঘর থেকে বের হতে দেবো না মিসেস ওয়েলসকে।
পুলিশ দেখা করতে গিয়েছিল আমার সঙ্গে, বললেন তিনি।
কিছু বললাম না।
ওরা বলল, একজন পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নাকি জড়িত থাকতে পারে মোরা।
তবুও কিছু বললাম না। মিসেস ওয়েলস যা বলছেন, সেগুলো আমার জন্য পুরনো কথা।
কথাটা কি সত্যি? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
মাথা ঝাঁকালাম।
আড়চোখে দেখলাম, হাত বাড়িয়ে মিসেস ওয়েলসের একটা হাত স্পর্শ করলেন বারনাডেট।
আমার দিকে তাকিয়ে আছেন মোরার মা। তুমিও কি মনে করো ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে আমার মেয়ে?
পারে…সম্ভবত।
একটু যেন বড় হলো মিসেস ওয়েলসের চোখ। মোরা কাউকে খুন করতে পারে না। ভালোমতোই জানো তুমি কথাটা।
চুপ করে আছি।
আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল যে-পুলিশ অফিসার, তার নাম রেনল্ডস। পেনসিলভানিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। বলল, তদন্তের কাজে তুমি নাকি সাহায্য করছ তাকে।
কথাটা বলা হয়েছে প্রশ্ন করার কায়দায়।
কিছু বললাম না আমি।
এ আমার প্রতিশোধ। আজ থেকে অনেক বছর আগে একদিন উভ্রান্তের মতো মিসেস ওয়েলসের দোরগোড়ায় হাজির হয়েছিলাম আমি। সেদিন তাঁর মেয়ের ব্যাপারে হাজারটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে। আমার বেশিরভাগ প্রশ্নের জবাবে চুপ করে থেকে এবং শেষে কিছু নীতিকথা শুনিয়ে আমাকে বিদায় করে দিয়েছিলেন তিনি। আজ আমার শোধ নেয়ার পালা।
একটা ব্যাপার বুঝলাম না আমি, ন্যাপ। আরেক রাজ্যের একটা হত্যা রহস্যের তদন্ত কেন করবে তুমি?
যাকে খুন করা হয়েছে, তার নাম কি আপনাকে বলেছেন লেফটেন্যান্ট রেনল্ডস? মুখ খুললাম।
মনে হয় না। অথবা বললেও আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, নিহত লোকটা একজন পুলিশ অফিসার।
এবং সেই পুলিশ অফিসারের নাম রেক্স ক্যান্টন। তাকিয়ে ছিলাম মিসেস ওয়েলসের চেহারার দিকে, ভাবের কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলাম না সেখানে। নামটা শুনে কিছু কি মনে পড়ে আপনার?
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন অথবা চিন্তা করার ভান করলেন মোরার মা। না, মনে পড়ে না।
আমাদের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত রেক্স।
ওয়েস্টব্রিজ হাইস্কুলে?
হ্যাঁ।
মিসেস ওয়েলসের চেহারা কেমন ফেকাসে হয়ে গেল।
মোরা কোথায়? জানতে চাইলাম আমি।
জানি না।
এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুললাম আমি নিজের চেহারায়, দেখে মিসেস ওয়েলস স্পষ্ট বুঝতে পারেন, তার কথা বিশ্বাস করিনি।
আমি আসলেই জানি না মোরা কোথায়, বললেন তিনি। আর সেজন্যই এসেছি তোমার কাছে। ভেবেছিলাম, তোমার কাছে এলে সাহায্য পাবো।
মোরাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমার সাহায্য চান আপনি?
হ্যাঁ।
আমার বয়স যখন আঠারো, তারপর থেকে আর দেখা হয়নি ওর সঙ্গে।
এলির ডেস্কে রাখা ফোনটা বাজছে, আমরা তিনজনের কেউই পাত্তা দিচ্ছি না। বারনাডেটের দিকে তাকালাম। মিসেস ওয়েলসের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
বললাম, আপনি যদি চান মোরাকে খুঁজে বের করি আমি, নিজের প্রতিটা হৃৎস্পন্দন টের পাচ্ছি, তা হলে মোরার ব্যাপারে যা-যা জানেন, সব বলতে হবে আমাকে।
নীরবতা।
ঘাড় ঘুরিয়ে বারনাডেটের দিকে তাকালেন লিন ওয়েলস, যেন নিঃশব্দে অনুমতি প্রার্থনা করছেন।
মাথা নাড়লেন বারনাডেট। এই লোক সাহায্য করতে পারবে না আমাদেরকে।
সম্মতি জানানোর কায়দায় মাথা ঝাঁকালেন লিন ওয়েলস। …ভুল করে ফেলেছি।
উঠে দাঁড়ালেন তারা দুজন।
এখানে আসাটা উচিত হয়নি আমাদের, বললেন মোরার মা।
দুজনই হাঁটা ধরলেন দরজার উদ্দেশে।
কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
চলে যাচ্ছি, বললেন লিন ওয়েলস।
না, বললাম আমি।
আমাকে পাত্তা না-দিয়ে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে এগোতে চাইলেন বারনাডেট।
ঝট করে নড়ে উঠলাম আমি, এগোনোর পথ বন্ধ করে দিলাম বারনাডেটের।
সরো, বললেন তিনি।
শুনেও যেন শুনলাম না কথাটা। তাকালাম মোরার মার দিকে। আপনি বুঝতে পারছেন কি না, জানি না। ভীষণ বিপদে পড়েছে আপনার মেয়ে। যদি সাহায্য না করেন আমাকে, যদি আজও মুখ বন্ধ করে রাখেন, চিরতরে ওকে হারাবেন আপনি। কারণ পুলিশের অনুমান, যেখানে খুন করা হয়েছে রেক্সকে, সেখান থেকে অস্ত্রের মুখে কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওকে। হয়তো ইতোমধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে ওকে। অথবা হয়তো বেঁচে আছে, মেরে ফেলা হবে আর দু-একদিনের মধ্যে।
তুমি কিছুই জানো না, বললেন বটে, কিন্তু মোরার মার গলায় জোর নেই।
আবারও আমাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলেন বারনাডেট, হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দরজার হাতলের উদ্দেশে। পাল্লার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দিলাম আমি, নিজের ওজন চাপিয়ে দিয়েছি ওটার উপর।
তুমি কি জোর করে আটকে রাখতে চাও আমাদেরকে এখানে? বললেন বারনাডেট।
হ্যাঁ।
ধোঁকা দিচ্ছি না। আসলেই করবো আমি কাজটা, তারপর যা হওয়ার হবে। গত পনেরোটা বছর ধরে শুধু জবাব খুঁজছি আমি…অথচ ওই সময়ে জীবনটা উপভোগ করার কথা ছিল আমার। আমার সমবয়সী অনেকেই গার্লফ্রেন্ড বদল করেছে একাধিকবার, কেউ একাধিকবার বাবা হয়েছে। কেউ আবার প্রচণ্ড কোনো উচ্চাকাচ্চা নিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা কামাই করছে। অথচ আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, বাচ্চা নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আমার আছে শুধু জবাব-না-পাওয়া কিছু প্রশ্ন। কাজেই যে-মানুষটা সেসব প্রশ্নের জবাব, তাঁকে এত সহজে চলে যেতে দিতে পারি না আমি…কিছুতেই না। একবার যখন সাক্ষাৎ ঘটেছে লিন ওয়েলসের সঙ্গে, তখন যা-যা জানেন তিনি তা না-জানা পর্যন্ত ছাড়ছি না তাঁকে। আমি এখন কোনোকিছুরই পরোয়া করি না। নীতিজ্ঞান অথবা আইনি ব্যাপারগুলো এখন আমার কাছে মূল্যহীন।
কাজেই যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, একচুল নড়লাম না সে-জায়গা ছেড়ে।
ওকে বিশ্বাস কোরো না, মোরার মাকে বললেন বারনাডেট।
পাত্তা দিলাম না তার কথা, তাকিয়ে আছি মিসেস ওয়েলসের দিকে। পনেরো বছর আগের কথা। একরাতে হকি খেলে বাসায় ফিরেছি। আমার বয়স তখন আঠারো, হাইস্কুলের একজন সিনিয়র ছাত্র আমি। আমার যমজ ভাই আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বান্ধবী বলতে আছে শুধু একজন, যাকে নিজের চেয়েও আপন বলে মনে করি। বসে ছিলাম আমাদের বাসার কিচেন-টেবিলে, অপেক্ষা করছি আমার ভাইয়ের জন্য ফিরে আসবে সে, একটা খুশির-খবর জানাবো ওকে। কিন্তু আজও শেষ হয়নি আমার সে অপেক্ষা।
আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছেন লিন ওয়েলস–যেন কিছু একটা খুঁজছেন সেখানে। হঠাৎ টের পেলাম, পানি জমতে শুরু করেছে তার চোখে। বললেন, জানি। ওই রাতের পর থেকে তোমার-আমার দুজনেরই জীবন বদলে গেছে।
লিন…
হাত নেড়ে বারনাডেটকে চুপ করিয়ে দিলেন মোরার মা।
কী ঘটেছিল? জিজ্ঞেস করলাম আমি। কেন পালিয়ে গিয়েছিল মোরা?
জবাবটা তুমি কেন দিচ্ছ না আমাদেরকে? খেঁকিয়ে উঠলেন বারনাডেট।
তার কাঁধে একটা হাত রাখলেন মিসেস ওয়েলস। তুমি না হয় বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।
আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।
ন্যাপের সঙ্গে একা কথা বলা দরকার আমার।
একটুখানি সরে দাঁড়ালাম পাল্লার কাছ থেকে। ওটা যতখানি খুললে বেরিয়ে যেতে অসুবিধা হবে না বারনাডেটের, ঠিক ততখানিই খুললাম। কোনো সুযোগ দিতে চাইছি না মোরার মাকে। আসলে তাকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। বার বার মনে হচ্ছে, সুযোগ পেলেই ছুটে পালাবেন তিনি। ফলে আমার সেই প্রশ্নগুলো নিঃশব্দ আততায়ীর মতো তাড়া করে বেড়াবে আমাকে বাকি জীবন। তাই আড়চোখে তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে, নজর রেখেছি।
ছুট লাগালেন না তিনি।
পাল্লা আর চৌকাঠের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেলেন বারনাডেট। তবে যাওয়ার আগে বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে গেলেন আমার প্রতি।
দরজাটা লাগিয়ে দিলাম।
ঘরে এখন শুধু আমি আর মোরার মা।
চলো, বসি, বললেন তিনি।
.
এলির অফিসডেস্কের একপাশে দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসেছি আমি আর মিসেস ওয়েলস। খেয়াল করলাম, বাঁ হাতে একটা ওয়েডিং ব্যান্ড পরে আছেন তিনি। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ওটা ধরে মোচড়ামোচড়ি করছেন।
মোরার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল কিছুটা জটিল, বললেন তিনি। দোষ আমারই। মদ খাওয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আসলে আমারও তেমন কিছু করার ছিল না এই ব্যাপারে। হতাশ হয়ে পড়েছিলাম খুব। হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসেবে বেছে নিই মদকে, এবং ভুল করি। মোরা তখন টিনেজার, আমার সঙ্গ দরকার ছিল ওর। সংসারে ছিল টাকাপয়সার টানাটানি। দুজায়গায় চাকরি করতে হতো আমাকে। কোহলস-এ করতাম একটা। আরেকটা চাকরি করতাম বেনিগানস-এ, ওয়েইট্রেস হিসেবে। …তোমার কি মনে আছে, জেনসন পেট স্টোরে কিছুদিন পার্টটাইম কাজ করেছে মোরা?
আছে।
চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল কেন সে, জানো?
মাথা ঝাঁকালাম। বলেছিল, কুকুরে নাকি অ্যালার্জি আছে ওর।
মুচকি একটু হাসি দেখা দিল মিসেস ওয়েলসের চেহারায়। কথাটা বানিয়ে বলেছে সে।
বানিয়ে বলেছে?
হু। চাকরি ছেড়ে দেয়ার আসল কারণ হচ্ছে, দোকানের মালিক মাইক জেনসন প্রায়ই হাত দিত মোরার শরীরের এখানে-সেখানে, বিশেষ করে পাছায়।
এত বছর পরও টের পেলাম, শরীরের ভিতরটা গরম হয়ে যাচ্ছে আমার। আপনি সিয়িয়াস?
মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ওয়েলস। কথাটা তোমাকে বলেনি মোরা, কারণ তুমি তখন মাথাগরম টাইপের ছেলে। মোরা ভয় পাচ্ছিল, যদি তোমাকে বলে কথাটা, আর তুমি যদি…। থাক, বাদ দাও। যেখানে আমার মেয়েই নিখোঁজ, আমরা যেখানে জানি না সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, সেখানে ওর গায়ে কে হাত দিল তা ভেবে লাভ কী? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমিও। সে-রাতে কী ঘটেছিল?
সে-রাতে বাড়ি ফিরে আসেনি মোরা।
চুপ করে আছি আমি।
সে যে বাড়ি ফেরেনি, তা কিন্তু চট করে বুঝতে পারিনি আমি। লেট শিফটে কাজ করা শেষে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি ফুর্তি করতে, গিয়ে ঢুকি একটা বারে। গলা পর্যন্ত মদ গেলার পর মাথা আর কাজ করছিল না, তাই বাসায় ফিরতে ফিরতে ভোর চারটা বেজে যায়। আসলে…সে রাতে ঠিক কটার সময় বাসায় ফিরেছিলাম, ঠিক মনে নেই। আমার আসলে কোনোকিছুই ঠিকমতো মনে নেই। …মোরার বেডরুম চেক করেছিলাম কি না, মনে নেই সেটাও। যখন চেকিং করছিলাম, তখন যদি দেখতে না-পেতাম ওকে, তা হলে কী করতাম, তা-ও জানি না। হয়তো ধরে নিতাম, তোমার সঙ্গে তোমার বাসায় রাত কাটাচ্ছে সে, অথবা ম্যানহাটনে গেছে। তোমার সঙ্গে ডেটিং শুরু করার আগে বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই ম্যানহাটনে যেত সে।
জানি।
যা-হোক, পরদিন দুপুরের দিকে ঘুম ভাঙল আমার। দেখলাম, মোরা নেই বাসায়। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিলাম, আমার অনেক আগে ঘুম ভেঙেছে ওর, কোনো কাজে বাইরে কোথাও গেছে। তেমন একটা পাত্তা দিলাম না ব্যাপারটা, চলে গেলাম নিজের কাজে। সেদিন আবার বেনিগানস-এ ডাবল শিফট ছিল আমার। বারটা যখন বন্ধ করে দেয়া হবে, তখন হঠাৎ আমাকে ডাক দিল বারটেন্ডার, বলল কে নাকি ফোন করে আমাকে চাইছে। অদ্ভুত লাগল আমার কাছে। এতদিন হয়ে গেল কাজ করছি ওই বারে, কেউ একটাবারের জন্যও ফোন করেনি, সেদিন হঠাৎ…। লোকজনকে বারের ফোন-নম্বর দিয়েছি দেখে ম্যানেজার বকাঝকা করল আমাকে। মনে আছে, যখন এগিয়ে যাচ্ছি কল রিসিভ করতে, তখন মনে মনে ভাবছি, কাকে দিয়েছিলাম আমি নম্বরটা?
কে ফোন করেছিল? মোরা?
হ্যাঁ।
আমার পকেটে রাখা মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট করছে। কেউ একজন ফোন করেছে। পাত্তা দিলাম না। পাত্তা দেবোও না। আমি এখন মুখোমুখি হয়েছি কিছু ঘাতক প্রশ্নের। বললাম, কী বলল সে?
ওর কণ্ঠ শোনামাত্র ঘাবড়ে গেলাম। কারণ কাজের-সময় আমার সঙ্গে আগে কখনোই যোগাযোগ করেনি সে। তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক আছ? সে বলল, মা, আমি শহর ছেড়ে কিছুদিনের জন্য চলে যাচ্ছি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, বোলো, যা ঘটেছে তা নিয়ে আমি ভীষণ আপসেট। ওই স্কুলও আর ভালো লাগছে না আমার, অন্য কোথাও ভর্তি হতে চাই। আর…পুলিশকে কিছু বোলো না। লম্বা করে দম নিলেন মিসেস ওয়েলস।
আপনি তখন কী বললেন?
কী যেন বলেছিলাম…এখন আর ঠিক মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, আমার কথার জবাব না দিয়েই লাইন কেটে দিয়েছিল মোরা। আমার প্রশ্নটা শুনেছিল কি না সে, তা-ও জানি না। এমনকী তখন এটাও বুঝতে পারছিলাম না, যা ঘটেছে তা নিয়ে আমি ভীষণ আপসেট বলতে কী বুঝিয়েছে। কারণ কী ঘটে গেছে, তা তখনও জানতে পারিনি আমি–লিও আর ডায়ানার দুর্ঘটনার খবরটা তখনও শুনিনি। কাজেই ফোন নামিয়ে রেখে ফিরে গেলাম কাজে। ততক্ষণে আমার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে শুরু করে দিয়েছে দুটো টেবিলের কাস্টোমাররা।
তারপর?
আমার মনে আছে, বারের মুখোমুখি একটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, অর্ডার নিচ্ছিলাম। বারের টিভিটা চলছিল। সাধারণত খেলার কোনো একটা চ্যানেল ছেড়ে রাখা হয় টিভিতে, কিন্তু তখন কে যেন খবরের চ্যানেল ছেড়ে রেখেছিল। স্থানীয় খবর প্রচারের সময় জানানো হয়, মারা গেছে লিও আর ডায়ানা। মাথা নাড়লেন মিসেস ওয়েলস। তবে…তখনও কারও নাম প্রচার করা হয়নি। তাই আমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারিনি, লিও আর ডায়ানাই মারা গেছে। শুধু বলা হচ্ছিল, ওয়েস্টব্রিজ হাইস্কুলের দুজন শিক্ষার্থী ট্রেনের নিচে কাটা পড়েছে। আমার মাথায় তখনও ঘুরছে মোরার কথাটা: যা ঘটেছে তা নিয়ে আমি ভীষণ আপসেট। ভাবলাম, ওই ট্রেন দুর্ঘটনাই বোধহয় মোরার আপসেটের কারণ। ভাবলাম, ঘটনাটা নিজচোখে দেখেছে সে, প্রচণ্ড একটা মানসিক ধাক্কা খেয়েছে, আর সেটা সামাল দিতেই শহর ছেড়ে চলে গেছে কয়েকদিনের জন্য।
কী করলেন তখন?
কিছুই না। কারণ, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না।…জীবনের বাস্তবতা অনেককিছু শিখিয়েছে আমাকে। সেগুলোর মধ্যে একটা হলো: কখনোই তাড়াহুড়ো করতে হয় না। এবং আরেকটা হলো: আবেগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। …আমি বুদ্ধিমতী মহিলা না। আমাকে যদি রোড এ আর রোড বি-এর মধ্যে কোনো একটা বেছে নিতে বলা হয়, আমি আগে বুঝবার চেষ্টা করবো কোন রাস্তাটা কেমন, তারপর বাছাবাছি করবো। কাজেই মোরার সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরও, এবং ট্রেন দুর্ঘটনার খবর দেখার পরও, যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে শেষ করলাম আমার ডিউটি। আমার কাছে তখন আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে আসছে সবকিছু…অন্তত সে রকমই মনে হচ্ছিল। তবে মোরার একটা কথা বুঝতে পারছিলাম না–পুলিশকে কিছু বোলো না। ভাবছিলাম, পুলিশকে কিছু বলবো না কেন? ঠাণ্ডা মাথায় যে ভাবব ব্যাপারটা, সে-উপায়ও ছিল না। কারণ একটানা কাজ করতে হচ্ছিল। যা-হোক, ডিউটি শেষ হওয়ার পর ভাবলাম, বাসায় ফিরে যাই, তারপর না-হয় চিন্তাভাবনা করা যাবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। বেরিয়ে এলাম বারের বাইরে, পার্কিংলটে। ততক্ষণে পুরো খালি হয়ে গেছে ওই জায়গা। শুধু… কথা শেষ না করে থেমে গেলেন মিসেস ওয়েলস, চোখ বন্ধ করলেন। মনে হলো, একটুখানি যেন কেঁপে উঠলেন।
শুধু?
আমার অপেক্ষায় ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন লোক।
লোক?
মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ওয়েলস। চারজন।
মানে পুলিশ?
না…ঠিক পুলিশ না…তবে সরকারি কোনো একটা সংস্থার সদস্য ওরা। আমাকে ব্যাজ দেখিয়েছিল।
আমার পিঠ আপনাআপনি খাড়া হয়ে গেছে। কী চেয়েছিল ওরা। আপনার কাছে?
কিছু প্রশ্নের জবাব।
যেমন?
যেমন মোরা কোথায়।
কল্পনার দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি আমি বেনিগানস-এর সেই পার্কিং লট। ওই বার বন্ধ হয়ে গেছে আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে, ম্যাকারনি গ্রিল নামের একটা চেইন রেস্টুরেন্টের শাখা খোলা হয়েছে সেখানে।
ওই লোকগুলোকে কী বললেন আপনি?
বললাম, মোরা কোথায় তা জানি না আমি।
তারপর?
একটুও অভদ্র আচরণ করেনি আমার সঙ্গে ওই লোকগুলো। যে লোকটাকে ওদের নেতা বলে মনে হচ্ছিল, মানে যে-লোক আমাকে বেশিরভাগ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিল, সে বলল, মোরা নাকি আসলে কোনো ঝামেলায় পড়েনি। বলল, মোরা যদি ফিরে আসে, যদি দেখা দেয়, তা হলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। কথাটা কয়েকবার বলেছে সে, এবং জোর দিয়ে বলেছে।
কিন্তু তখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন আপনি, কারণ বুঝতে পারছিলেন না কী ঘটেছে আসলে?
ঠিক।
তারপর?
তারপর… কথা শেষ করতে পারলেন না মিসেস ওয়েলস, কেঁদে ফেললেন। নিজেকে সামলানোর জন্য একটা হাত দিয়ে আলতো করে চেপে ধরলেন গলা। কীভাবে বলবো, বুঝতে পারছি না।
হাত বাড়িয়ে মিসেস ওয়েলসের একটা হাত ধরলাম আমি, সান্ত্বনা দিলাম। আপনি বলুন। আমি বিশ্বাস করবো আপনার কথা।
মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ওয়েলস, চোখের পানি মুছলেন। বললেন, এক সপ্তাহ পর।
মানে?
মানেটা আমিও আসলে ঠিক জানি না। পার্কিং লটের সেই জিজ্ঞাসাবাদের পরের যে-ঘটনা আমার মনে আছে, তা ওই ঘটনার সপ্তাহখানেক পরের।
বলেন কী!
আবারও মাথা ঝাঁকালেন মোরার মা। মনে আছে, বাড়ির পেছনের দরজায় সমানে কিল মারছিল কে যেন। ঘুমিয়ে ছিলাম আমি, চোখ খুললাম, দেখতে পেলাম শুয়ে আছি নিজের-ঘরে নিজের-খাটে। গেলাম দরজার কাছে, দেখলাম কে এসেছে। আমার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছেন তিনি। দরজায় কিল মারছিলে তুমি, ন্যাপ।
মনে পড়ে গেল ঘটনাটা।
বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ মোরাকে হারিয়ে উদ্ৰান্ত হয়ে গেছি আমি তখন। কীভাবে কী করা যায়, সে-ব্যাপারে কোনো বুদ্ধিই আসছে না। মাথায়। গিয়ে হাজির হলাম মোরাদের বাসায়। লিও মারা যাওয়ার পর থেকে সে লাপাত্তা।
তোমাকে দেখতে পেয়ে, দরজাটা খুলিনি আমি সেদিন, বললেন মিসেস ওয়েলস।
জানি।
দুঃখিত, ন্যাপ।
সমস্যা নেই। কিন্তু…একটা সপ্তাহ কেটে গেল, মাঝখানের কোনো ঘটনাই মনে থাকল না আপনার…কীভাবে সম্ভব সেটা?
কীভাবে সম্ভব, জানি না। কিন্তু যে-কোনোভাবেই হোক, সম্ভব হয়েছে। ঠিক কী ঘটেছিল ওই সাতদিনে, তা জানার জন্য আজও স্মৃতি হাতড়াই আমি। কিন্তু বলতে-গেলে কিছুই মনে করতে পারি না। হতে পারে, সহ্যক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মদ খেয়ে ফেলেছিলাম, ফলে মানসিক ব্ল্যাকআউট ঘটে গেছে আমার, নষ্ট হয়ে গেছে জীবনের বিশেষ একটা সময়ের স্মৃতি। তবে, চারজন অপরিচিত লোকের সেই দলটার কথা, বলা ভালো ওদের নেতার কথা মনে আছে। মনে আছে, চেহারা কেমন যেন পাণ্ডুর ছিল লোকটার। নিচু গলায় কথা বলছিল সে আমার সঙ্গে…মনে হচ্ছিল ফিসফিস করছে যেন। ওই লোকের হাতে বড় বড় নখ ছিল। পুরুষমানুষের হাতে বড় নখ দেখলে গা ঘিনঘিন করে আমার, তখনও করেছিল। ওদেরকে সময় দেয়ার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিল সে। বলল, মোরার যদি কোনো খোঁজ পাই তা হলে যেন যোগাযোগ করি ওদের সঙ্গে। মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠলাম আমি। তারপর…তারপর আর কিছু মনে নেই।
মানে?
গাড়িতে ওঠার পর থেকে শুরু করে আমাদের-বাসার-পেছনের দরজায় তোমার কিল মারার আগপর্যন্ত আর কিছু মনে নেই।
মানে?
আমার ধারণা, পাণ্ডুর চেহারা আর ফিসফিসে কণ্ঠের ওই লোক কিছু একটা করেছিল আমাকে।
কী করেছিল?
আমার ধারণা, আমাকে অজ্ঞান করে ফেলেছিল ওরা। তারপর নিয়ে গিয়েছিল গোপন কোনো জায়গায়। মোরার ব্যাপারে বার বার এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছিল। বিশেষ সেই সাতদিনের স্মৃতি যখন বার বার হাতড়াই আমি, স্বপ্নের মতো কতগুলো ঘটনা মনে পড়ে। ওসব ঘটনা আসলেই ঘটেছিল, নাকি আমার দুঃস্বপ্ন-নিশ্চিত বলতে পারবো না। …আমার কথা কি বুঝতে পারছ?
পারছি।
বিশেষ সেই সাতদিনের স্মৃতি ঘটতে গেলে বার বার মনে হয়, ধোঁয়ার একটা রাজ্যে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্দি করে রাখা হয়েছে আমাকে…আমার চারপাশে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া…আর আমি যেন হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইছি কিছু একটা…কিন্তু ধোয়া ছাড়া অন্যকিছুর নাগাল পাচ্ছি না।
ঠিক আছে। …আমাকে দেখতে পেলেন আপনি আপনাদের বাসার পেছনের-দরজায়, কিন্তু দরজা খুললেন না। তারপর কী হলো?
তারপর মনে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে কাজে চলে গেলাম। ভাবছিলাম, এতদিন যেহেতু যাইনি, সেহেতু নিশ্চয়ই যারপরনাই দুর্ব্যবহার করা হবে আমার সঙ্গে। চাকরি আছে কি না, তা-ও ভাবছিলাম। কিন্তু কোহলস-এ গিয়ে আশ্চর্য হতে হয় আমাকে। ওরা বলল, আমি নাকি ফোন করে আগেই জানিয়েছিলাম, আমার শরীর ভালো না, কয়েকদিন যেতে পারবো না কাজে।
কিন্তু ফোন করে ওসব কথা বলার কোনো ঘটনাই মনে করতে পারেন না আপনি, তা-ই না?
ঠিক…পারি না। একই ঘটনা ঘটল বেনিগানস-এ। ওরাও বলল, আমি নাকি ফোন করে আগেই জানিয়েছি, শরীর ভালো না থাকায় টানা কয়েকদিন কাজে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে।
হেলান দিলাম আমি। মিসেস ওয়েলসের কথাগুলো হজম করার চেষ্টা করছি।
একরকমের মানসিক বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি, বলছেন মিসেস ওয়েলস। বার বার মনে হতো, কেউ ফলো করছে আমাকে। বিশেষ একটা লোকের কথা মনে আছে আমার। মেলে-ধরা খবরের কাগজের আড়ালে নিজের চেহারাটা লুকিয়ে রাখত সে সবসময়, অথচ আমি নিশ্চিত, আমার উপর নজর রাখত আসলে। মনে আছে, তুমি তখন প্রায়ই ঘুরঘুর করতে আমাদের বাড়ির আশপাশে। বার বার ভাবতাম, কী ঘটছে বা ঘটেছে তা মোরার কাছ থেকে জানার আগেই কিছু একটা করা উচিত আমার নিজের। কিন্তু কী করবো, তা-ও বুঝতে পারছিলাম না। তাই ওর কথা যখন জিজ্ঞেস করলে আমাকে, সে যা বলতে বলেছে তা-ই বলে দিলাম–স্কুল পাল্টাতে চাইছে সে, ভর্তি হতে চায় অন্য স্কুলে, এই শহরে আর থাকতে চায় না। এমনকী, যোগাযোগ করলাম ওয়েস্টব্রিজ হাইস্কুলের সঙ্গেও। ওদেরকে জানিয়ে দিলাম, শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমরা, তাই ওখানে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াটা আর সম্ভব না মোরার পক্ষে। ওর রেকর্ডস কোন্ স্কুলে পাঠাতে হবে, তা পরে জানিয়ে দেবো। ওয়েস্টব্রিজ স্কুল কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিল ঘটনাটা। তাই ওরা বিশেষ কিছু জানতে চায়নি।…একটু পানি খাওয়াতে পারো?
উঠলাম আমি, এলির ডেস্ক ঘুরে এগিয়ে গেলাম উইন্ডোসিলের দিকে। এখানে ছোট্ট একটা ফ্রিজ রেখেছে এলি। খুললাম ওটা, একসারিতে সাজিয়ে রাখা পানির-বোতলগুলো থেকে একটা বোতল নিলাম মিসেস ওয়েলসের জন্য।
ভাবছি, এভাবে আমার সঙ্গে দেখা করলেন কেন তিনি? আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য মাধ্যম হিসেবে এলিকে বেছে নিলেন কেন?
পানির বোতলটা দিলাম তার হাতে।
ধন্যবাদ, বললেন তিনি।
ক্যাপ খুললেন তিনি, বোতলে মুখ লাগিয়ে তৃষ্ণার্তের মতো বেশ কয়েক ঢোক পানি খেলেন।
আপনি কি এখনও আগের-মতো মদ খান? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
শেষবার মদ খেয়েছি আজ থেকে তেরো বছর আগে। এবং সেজন্য বারনাডেটের কাছে আমি ঋণী। শারীরিক-মানসিক-আর্থিক–তিনদিক দিয়েই আমার তখন নিঃস্ব অবস্থা। একদিন দেখা হয়ে যায় বারনাডেটের সঙ্গে, আলাপ হয়। তারপর…বুঝতেই পারছ। হতে পারে, মেয়েসঙ্গীদের প্রতি একটা অবদমিত বাসনা আগে থেকেই ছিল আমার মনে। যা-হোক, বছর দু-এক আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেছি আমরা।
এই ব্যাপারে কিছু বলার নেই আমার, বলতে চাই না। তাই মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়ার জন্য বললাম, মোরার সঙ্গে পরে আবার কবে যোগাযোগ হলো আপনার?
আরেক ঢোক পানি খেলেন মিসেস ওয়েলস, বোতলের ক্যাপ আটকালেন। দিন যেতে লাগল। কাটতে লাগল সপ্তাহের পর সপ্তাহ। ফোন বাজলেই লাফিয়ে উঠতাম আমি, দৌড়ে গিয়ে রিসিভ করতাম। কোনো একজনের কাছে সব কথা বলতে ইচ্ছা করছিল খুব, কিন্তু কাকে বলবো? ভীষণ ভয় হচ্ছিল। প্রায় প্রতি রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখতাম। …পুলিশ চীফ, মানে ডায়ানার বাবা একদিন গেলেন আমাদের সেই বাসায়। মোরার ব্যাপারে জানতে চাইছিলেন তিনিও।
কী বললেন তাকে?
অন্যদেরকে যা বলেছি, তা-ই–লিও আর ডায়ানাকে ট্রেনের নিচে কাটা পড়তে দেখেছে সে, সহ্য করতে পারেনি দৃশ্যটা, তাই শহর ছেড়ে চলে গেছে আমার এক খালাতো বোনের কাছে। আরও কিছুদিন থাকবে সেখানে, তারপর স্কুল বদলে ফেলবে।
বুঝলাম। কিন্তু মোরার সঙ্গে পরে আবার কবে দেখা বা কথা হলো আপনার?
মাস তিনেক পর।
ওই তিন মাস কোথায় ছিল মোরা?
জানি না। ওই তিন মাসে ওর সঙ্গে একবারের জন্যও যোগাযোগ হয়নি আমার। কোনো চিঠি লেখেনি সে আমাকে, এমনকী ফোনও করেনি।
আমার মোবাইল ফোন আবার ভাইব্রেট করছে। পাত্তা দিলাম না।
মোরা চালাকচতুর মেয়ে, বলছেন মিসেস ওয়েলস, জানতাম, যেখানেই থাকুক না কেন সে, কিছু একটা করে নিজের পেট চালিয়ে নিতে পারবে। তারপরও টানা তিন মাস যখন কোনো খবর ছিল না ওর, ধরেই নিয়েছিলাম মারা গেছে সে। ধরে নিয়েছিলাম, পাণ্ডুর চেহারা আর ফিসফিসে কণ্ঠের ওই লোক খুঁজে বের করেছে ওকে, তারপর শেষ করে দিয়েছে। ভুগতে শুরু করেছিলাম প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায়। বার বার মনে হচ্ছিল, পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত আমার। কিন্তু গিয়ে কী বলবো? তা ছাড়া, মোরা নিষেধ করেছে কাজটা করতে। আরও বড় কথা, আমাকে কি আদৌ বিশ্বাস করবে পুলিশ? ওরা কি বিশ্বাস করবে, একরাতে নিজের গাড়িতে ওঠার পর থেকে পরের সাতটা দিনের সব ঘটনা মুছে গেছে আমার স্মৃতি থেকে? স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, পুলিশের কাছে যাওয়া মানে মোরাকে সাহায্য করা না, বরং সে যদি বেঁচে থাকে তা হলে ওকে আরও বড় বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া।
অস্থিরতা অনুভব করছি। আমি যা জানতে চাইছি, তা বলছেন না মিসেস ওয়েলস। বললাম, মোরার সঙ্গে পরে কোথায় দেখা হলো আপনার?
র্যামসি-তে, স্টারবাকস নামের একটা রেস্টুরেন্টে। বাথরুমে গিয়েছিলাম, হুট করে ভিতরে ঢুকে পড়ল মেয়েটা।
হুট করে মানে? আপনার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেনি সে আগে? কোথায় দেখা করতে হবে, বলেনি?
না।
হুট করে হাজির হয়ে গেল?
হ্যাঁ।
ঘটনাটা কল্পনা করার চেষ্টা করছি আমি। তারপর?
বলল, সে নাকি বিপদের মধ্যে আছে।
আর?
আর কিছু না।
আর কিছু না?
না।
আপনি কিছু জানতে চাননি ওর কাছে?
চেয়েছিলাম। খামচে ধরেছিলাম ওর একটা হাত, শক্ত করে ধরে রাখতে চাইছিলাম ওকে, বার বার জিজ্ঞেস করছিলাম কী হয়েছে। সব কথা বলার অনুরোধ জানাচ্ছিলাম ওকে বার বার। অতিমাত্রায় মদ খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া-আমার এসব দোষের জন্য বার বার ক্ষমাপ্রার্থনা করছিলাম ওর কাছে। বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে, তারপর একসময় ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেয় আমাকে। বেরিয়ে যায় বাথরুম থেকে, বেরিয়ে যায় ওই রেস্টুরেন্ট থেকে। ওর পিছু নিই আমি। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ামাত্র বুঝতে পারি, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেছে সে। তখন আমি ফিরে যাই রেস্টুরেন্টে, আবার ঢুকি বাথরুমে। যখন বাথরুম থেকে বের হই… কথা শেষ না করে থেমে গেলেন মিসেস ওয়েলস।
তখন দেখেন ওই চারজন লোক হাজির হয়ে গেছে রেস্টুরেন্টে, অপেক্ষা করছে আপনার জন্য?
আশ্চর্য হলেন মোরার মা। তুমি জানলে কীভাবে?
অনুমান করেছি। …আমার অনুমান তা হলে ঠিক?
মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ওয়েলস। আগের চারজনই। একজন কেন যেন হঠাৎ করেই ছুট লাগিয়েছিল রেস্টুরেন্টের পেছনের-দরজার দিকে। ওদেরকে দেখামাত্র তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলাম আমি, গিয়ে উঠলাম গাড়িতে। তারপর… আবারও পানি দেখা দিল তার চোখে।
আবারও একবার হাত বাড়িয়ে মিসেস ওয়েলসের হাতে আলতো চাপ দিলাম আমি।
তারপর আবারও আমার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল জীবনের বিশেষ কয়েকটা দিন, না-বলা কথাটা শেষ করলেন তিনি।
এবার কতদিন? জানতে চাইলাম।
তিন। …মোরা জানত…অন্ততপক্ষে বুঝতে পেরেছিল, আমাকে পাকড়াও করবে ওই লোকগুলো, সে কোথায় আছে তা জানার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবে। …খুব সম্ভব কোনো একজাতের ড্রাগস ব্যবহার করেছিল ওরা আমার উপর।
আর সেজন্যই আপনাকে নিরাপদে রাখতে চেয়েছে মোরা। যে কারণেই সে পালিয়ে গিয়ে থাকুক না কেন, বুঝতে পেরেছিল, কারণটা যদি বলে দেয় আপনাকে, ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে আপনার বেঁচে-থাকাটাও।
ও মাই গড…
তারপর কী হলো?
জানি না।
জানেন না মানে? স্টারবাকসের সেই ঘটনার পর মোরার সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি আপনার?
হয়েছে। গত পনেরো বছরে ওর সঙ্গে মোট ছবার দেখা হয়েছে আমার। প্রতিবারই হুট করে দেখা দিয়ে হুট করে গায়েব হয়ে গেছে সে। আমাকে শুধু জানিয়ে গেছে, সে বেঁচে আছে। …শুধু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য একবার একটা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট চালু করল। কিন্তু কখনও মেইল পাঠায়নি আমাকে, আমিও কিছু পাঠাইনি ওকে। আমাদের যা বলার, তা টাইপ করে ড্রাফট আইটেমে রেখে দিতাম আমরা। একই অ্যাকাউন্ট, এবং সেটার পাসওয়ার্ড জানা আছে আমাদের দুজনেরই-তাই আমাদের যে-কেউ সুবিধামতো সময়ে লগ-ইন করতে পারত ওই অ্যাকাউন্টে, ভ্রাক্ট চেক করলেই জেনে যেত কী বলার আছে অন্যজনের। ভি.পি.এন, ব্যবহার করত সে, তাই বেনামি সেজে থাকতে অসুবিধা হয়নি ওর। এভাবে বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকল আমাদের যোগাযোগ। তারপর একদিন হঠাৎ করেই সে বলল, ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কাজটা।
ড্রাফট ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে কী কথাবার্তা বলতেন আপনারা?
বেঁচে আছে আর ভালো আছে জানানো ছাড়া মোরা কিছুই জানাত না আমাকে। অথচ আমি ওকে জানাতাম আমার প্রায় সবকিছু। মদ ছেড়ে দেয়ার খবর জানিয়েছি আমি ওকে, বারনাডেটের ব্যাপারটা জানিয়েছি। আরেক ঢোক পানি খেলেন মিসেস ওয়েলস। গত পনেরোটা বছর ধরে যোগাযোগ ছিল বটে আমাদের মধ্যে, কিন্তু সে কোথায় আছে আর কী করছে তার কিছুই জানতে পারিনি কখনও।
আবার ভাইব্রেট করছে আমার মোবাইল ফোনটা।
এবার ওটা বের করলাম পকেট থেকে।
অগি ফোন করেছেন।
কল রিসিভ করলাম। হ্যালো?
হ্যাঙ্ককে খুঁজে পাওয়া গেছে।
.
১৭.
হ্যাঙ্কের দশম জন্মদিনের কথা আজও মনে আছে আমার।
রেস্টন ইউনিভার্সিটির একটা সাইন্স ল্যাবরেটরিতে হয়েছিল অনুষ্ঠানটা। মনে আছে, পুরু কাঁচের চশমা আর সাদা ল্যাব-কোট পরিহিত একটা লোক বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট দেখিয়ে দিচ্ছিল আমাদেরকে। মনে আছে, বোরাক্স পাউডার আর এলমারস গ্লু দিয়ে স্নাইম বানিয়েছিলাম আমরা। আরও বানিয়েছিলাম হাই-বাউন্সিং পলিমার বল এবং জায়ান্ট আইস মার্বেল।
পার্টিটা, যতটা ভেবেছিলাম আমি, তারচেয়েও ভালো হয়েছিল। হ্যাঙ্ক বসে ছিল আমাদের সামনেই। বড় বড় হয়ে গিয়েছিল ওর স্বপ্নিল দুই চোখ, সার্বক্ষণিক একটা বোকাটে হাসি লেপ্টে ছিল ওর চেহারায়। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাস শেষে পনেরো মিনিটের ওই পার্টিটা আজও মনে আছে। আমার।
কিন্তু এখন?
এখন আমার সামনে ঝুলছে হ্যাঙ্কের লাশ। গলায় ফাস পেচিয়ে একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে ওর মরদেহ। সম্পূর্ণ নগ্ন সে, পচন ধরেছে শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। এখনও বড় বড় হয়ে আছে ওর স্বপ্নিল দুই চোখ, সার্বক্ষণিক সেই বোকাটে হাসি এখনও যেন লেপ্টে আছে ওর নিষ্প্রাণ চেহারায়। নিথর হ্যাঙ্ক নিঃশব্দে বুঝিয়ে দিচ্ছে, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য নেই ওর মতো মানুষদের জন্য।
তাকিয়ে আছি ওর চেহারার দিকে। কেমন বড় হয়ে গেছে চেহারাটা, কিম্ভুতকিমাকার দেখাচ্ছে। পচন ধরেছে সেখানেও। ওর ঝুলন্ত নগ্ন দেহটা দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন সব হাড় বের করে ফেলেছে ওর শরীর থেকে সুতোয়-বাঁধা পুতুলনাচের পুতুল মনে হচ্ছে ওকে। ওর শরীরের অনেক জায়গায় কাটাকুটির দাগ দেখা যাচ্ছে, ওগুলোর জন্য কোনো ধারালো ব্লেড দায়ী সম্ভবত।
যে-ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে তা হলো: শিশ্ন আর অণ্ডকোষ কেটে ফেলা হয়েছে হ্যাঙ্কের।
যে বা যারাই খুন করে থাকুক হ্যাঙ্ককে, নপুংসক বানিয়ে দিয়েছে ওকে।
আমার সঙ্গে আমার দুজন ঊর্ধ্বতন-কর্মকর্তা আছেন। একপাশে আছেন এসেক্স কাউন্টি প্রসিকিউটর লরেন মিউস-ছোটখাটো কিন্তু তেজী একজন মহিলা। আরেকপাশে আছেন অগি। চুপ করে আছি আমরা তিনজনই, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি হ্যাঙ্কের মরদেহের দিকে।
আমার দিকে ঘুরলেন মিউস। তুমি বোধহয় এই কেসের সঙ্গে জড়িত হতে চেয়েছিলে?
এখন শুধু জড়িত হতে চাই না, বললাম শীতল গলায়, এখন এই কেস আমার।
খুন-হওয়া লোকটাকে চেনো?
অনেক বছর ধরে। একসঙ্গে হাইস্কুলে পড়তাম আমরা।
তারপরও এই কেসের দায়িত্ব দেয়া যাবে না তোমাকে। আপাতত ম্যানিং সামলাবে এই কেস।
আমি এখানে এসে হাজির হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি অগি। যে-কোনো খুনের কেসে আমাদের কাউন্টির নিজস্ব বিচারব্যবস্থা আছে। ওয়েস্টব্রিজ শহরটা…মানে অগির ডিপার্টমেন্ট…শুধু সাপোর্ট দিয়ে যায় সে-কাজে। আর আমার কাজ হচ্ছে পুলিশের একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা; অন্য কথায়, কাউন্টির সঙ্গে ওয়েস্টব্রিজ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের যোগাযোগ রক্ষা করা।
দূরের এক পাহাড়ি ঢলে অপেক্ষা করছে কয়েক ডজন নিউজ-ভ্যান। সেদিকে একবার তাকিয়ে আমার দিকে মুখ ফেরালেন মিউস। মিডিয়ার উপস্থিতি খেয়াল করেছ?
মাথা ঝাঁকালাম।
পঙ্গপালের মতো কেন হাজির হয়েছে ওরা, জানো?
ভাইরাল ভিডিও।
এবার মাথা ঝাঁকালেন মিউস। সতর্কতামূলক একটা অনলাইন ভিডিওর মাধ্যমে একজন সেক্সয়াল প্রিডেটর হিসেবে উপস্থাপন করা হলো একটা লোককে। ইতোমধ্যে ত্রিশ থেকে চল্লিশ লক্ষবার দেখা হয়েছে ভিডিওটা। তারপর, যাকে যৌনশিকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সে লোকের লাশ পাওয়া গেল জঙ্গলের ভিতরে, একটা গাছের ডালের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায়। এবং কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে ওই লোকের যৌনাঙ্গ।
এমন এক বেপরোয়া ভঙ্গিতে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল অ্যালান ম্যানিং যে, ওর ভাব দেখে মনে হলো এখনও দেখতে পায়নি আমাদেরকে। অল্প অল্প দুলছে হ্যাঙ্কের ঝুলন্ত লাশ; সেদিকে এগিয়ে গেল ম্যানিং, কাছ থেকে দেখছে অথবা দেখার ভান করছে লাশটা।
আমি জানি, ম্যানিং খারাপ কোনো গোয়েন্দা না। আবার এ-ও জানি, সে ভালো কোনো গোয়েন্দাও না। এই কেস যদি ওর হাতে সোপর্দ করা হয়, তা হলে অন্তত আমি রহস্য-সমাধানের সব আশা ছেড়ে দেবো।
সিদ্ধান্ত নিলাম, মিউস আমাকে এই কেসের দায়িত্ব দিন বা না-দিন, নিজের কাজ ঠিকই চালিয়ে যাবো আমি।
ঘুরলেন মিউস, হেঁটে এসে দাঁড়ালেন কিছুটা দূরে। তাঁর পিছু নিলাম আমি আর অগি।
মিউস বললেন, ন্যাপ, অগির কাছ থেকে শুনলাম, যে-মহিলা ওই ভিডিও পোস্ট করেছিল ইন্টারনেটে, তুমি নাকি তার সঙ্গে কথা বলেছ?
সুযান হ্যানসন।
কী বলেছে সে?
প্রথমে মিথ্যা কথা বলেছে। পরে স্বীকার করেছে, সেদিন প্যান্ট খুলে নিজের সবকিছু দেখায়নি হ্যাঙ্ক।
তা হলে ওই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিল কেন সে?
তিনি চাননি, হ্যাঙ্কের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ ঘুরঘুর করুক স্কুলের আশপাশে।
তার চাওয়াটা সফল হয়েছে, মাথা নাড়লেন মিউস।
আমি কিছু বললাম না।
মূর্খ একটা মহিলা, বললেন মিউস। চেষ্টা করে দেখি ওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা যায় কি না।
সুযান হ্যানসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা না-আনার ব্যাপারে কিছু করণীয় নেই আমার, তাই চুপ করে থাকলাম এবারও।
ন্যাপ, কী মনে হয় তোমার-সুযান হ্যানসন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত?
না, মনে মনে বললাম আমি। মুখে বললাম, আমার মনে হয় হ্যানসন পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে যদি কাজ শুরু করে ম্যানিং, ভালো হবে।
আবার তাকালাম আমরা হ্যাঙ্কের লাশের দিকে।
লাশটা ঘিরে ধীর পায়ে চক্কর দিচ্ছে ম্যানিং, স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ওর চেহারায়। আমার মনে হলো, টিভি নাটকের জন্য কোনো গোয়েন্দা-চরিত্রে অভিনয় করছে সে। মনে হচ্ছে, শার্লক হোমসের কায়দায় বিশাল কোনো ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করবে এখনই।
অগি বললেন, হ্যাঙ্কের বাবাকে চিনি আমি। এককালে বন্ধুত্ব ছিল। আমাদের মধ্যে।
তা হলে এক কাজ করুন, অগিকে বললেন মিউস, কথা বলুন হ্যাঙ্কের বাবার সঙ্গে। খবরটা জানান তাঁকে। হাজির হয়ে গেছে মিডিয়া, কাজেই যত জলদি করবেন কাজটা তত ভালো।
আমি যদি অগির সঙ্গে যাই, আপত্তি আছে আপনার? বললাম আমি।
জবাব না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন মিউস, বুঝিয়ে দিলেন আপত্তি নেই তার।
হাঁটা ধরলাম আমি আর অগি।
ঘটনাস্থলে এইমাত্র হাজির হয়েছেন ফ্রাঙ্কো ক্যাডেডু-কাউন্টি মেডিকেল একযামিনার এবং একজন ভালোমানুষ। আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মাথা ঝাঁকালেন তিনি। জবাবে মাথা ঝাঁকালাম আমিও।
হাজির হয়ে গেছে ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেটররাও। তাদের সবার পরণে ফুল বডি স্যুট, সার্জিকাল মাস্ক আর গ্লাভস। দ্রুত পায়ে আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে হ্যাঙ্কের লাশের দিকে এগিয়ে গেল ওরা। ওদের দিকে ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করলেন না অগি। চেহারা গম্ভীর হয়ে আছে। তার। কারণ পুত্রের মৃত্যুর খবর জানানোর জন্য একজন পিতার কাছে। যাচ্ছেন তিনি। সন্তান হারানোর অনুভূতি কেমন হতে পারে, তা আজ আরেকবার টের পাচ্ছেন তিনি।
মানেটা বুঝলাম না, বললাম আমি।
সাড়া দিতে দু-এক মুহূর্ত লাগল অগির। কীসের মানে?
হ্যাঙ্কের শরীরের কোনো কোনো জায়গায় পচন ধরে গেছে। কিন্তু…যতটা দুর্গন্ধ লাগার কথা ছিল নাকে, ততটা পাইনি।
অগি হাঁটছেন।
আমার ধারণা, বলছি আমি, নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই খুন করা হয় ওকে।
সেটা জানার জন্য ফ্রাঙ্কোর রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
লাশ খুঁজে পেয়েছে কে?
ডেভিড এলিফ্যান্ট, বললেন অগি। কুকুর নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন তিনি। বাধা ছিল না কুকুরটা, তাই হঠাৎ একছুটে হাজির হয় হ্যাঙ্কের লাশের কাছে, ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। ওটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসেন এলিফ্যান্ট, আর তখনই দেখতে পান লাশটা।
এলিফ্যান্ট কি এই কাজ প্রায়ই করেন?
কোন কাজ?
চামড়ার-দড়ি দিয়ে না-বেঁধেই বেরিয়ে পড়েন কুকুর নিয়ে?
জানি না।
যে-উপত্যকায় পাওয়া গেছে হ্যাঙ্কের লাশ, সেখানে লোকজন যায় না বললেই চলে। কিন্তু জায়গাটা দুর্গম না।
তোমার কথার মানে বুঝতে পারলাম না।
ধরে নিন, আমার কথা ঠিক-অর্থাৎ সপ্তাহ তিনেক আগে মারা গেছে হ্যাঙ্ক।
ধরলাম।
খুন করার পর পরই যদি ওর লাশ ঝুলিয়ে দেয়া হতো গাছের ডালে, আপনার কি মনে হয় না এই বিশ দিনে কারও-না-কারও নজরে পড়ত ওটা? অন্ততপক্ষে দুর্গন্ধ টের পেত কেউ-না-কেউ।
অগি কিছু বললেন না।
অগি?
শুনছি।
কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।
থামলেন অগি, ঘুরে তাকালেন দূরের ক্রাইম-সিনের দিকে। একটা মানুষকে নপুংসক বানিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে গাছের ডালে। কাজেই কোথাও-না-কোথাও কোনো-না-কোনো গড়বড় তো অবশ্যই আছে।
এবং সেই গড়বড়ের সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওর কোনো যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না আমার।
মন্তব্য করলেন না অগি।
আমার এখনও মনে হচ্ছে, সবকিছুর মূলে ওই কন্সপাইরেসি ক্লাব আর সেই পুরনো সামরিক ঘাঁটি। এখনও মনে হচ্ছে, হ্যাঙ্কের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রেক্স, লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর যোগসূত্র আছে।
খেয়াল করলাম, মৃত মেয়ের নাম শোনামাত্র চোখমুখ কুঁচকে উঠল অগির।
অগি? কিছু বলছেন না যে?
ঘুরলেন তিনি, হাঁটা ধরলেন আবার। এই ব্যাপারটা নিয়ে পরে কথা বলবো তোমার সঙ্গে। এখন আমাকে খুবই জঘন্য একটা কাজ করতে হবে–টমকে বলতে হবে, ওর ছেলে মারা গেছে।
.
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন টম স্ট্রাউড। তাঁর নিচের ঠোঁটটা কাঁপছে। দরজা খুলে দেয়ার পর থেকে একটা কথাও বলেননি তিনি…একটা শব্দও না। আসলে দরজা খোলামাত্র আমাদেরকে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কেন এসেছি আমরা–আমার আর অগির চেহারা নিঃশব্দে বলে দিয়েছে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য। চোখমুখ কুঁচকে গেছে তার, দেখে মনে হচ্ছে একের পর এক পাঞ্চ হজম করতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। তাকে সান্ত্বনা জানানোর জন্য এটা-সেটা বলছেন অগি। অগির কথা শুনে পনেরো বছর আগের এক রাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। সে রাতে আমাদের বাসায় একই উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সে-রাতে সান্তনা জানাচ্ছিলেন তিনি আমার বাবাকে। অথবা হয়তো সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
তিনি আর টম স্ট্রাউড এখন বসে আছেন কিচেন-টেবিলের ধারে। আমি দাঁড়িয়ে আছি অগির পেছনে, ফুট দশের দূরে। নিজেকে সাইডবেঞ্চে বসা একজন খেলোয়াড় বলে মনে হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে, যে-কোনো সময় আমাকে ডাকতে পারেন আমার কোচ। তবে মনে মনে প্রার্থনা করছি, সে-ডাক যেন না-আসে আমার। কারণ আমি কাউকে সান্ত্বনা জানাতে পারি না। সান্তনার প্রতিটা বাণী প্রতারণা বলে মনে হয় আমার কাছে। টম স্ট্রাউড কী হারিয়েছেন তা বুঝতে পারছেন শুধু তিনি। এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সান্ত্বনার কথাটাও তার জন্য বুকফাটা আর্তনাদের মতো।
মনে হচ্ছে, পা দুটো কাঁপছে আমার। যেহেতু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, আত্মচিন্তা ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার উপর। জোড়াতালি দিয়ে কোনো একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি বার বার, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছি না নিজেই।
ম্যানিং আর কাউন্টি অফিস মিলে হ্যাঙ্কের মৃত্যুর যে-তদন্ত শুরু করেছে, কোনো সন্দেহ নেই, তাতে প্রথমেই জোর দেবে ওরা ওই ভাইরাল ভিডিওর উপর। সবকিছু খুব সহজ বলে ধরে নেবে ওরা-ভাইরাল ভিডিওটা ভীষণ আন্দোলিত করেছে সচেতন জনসাধারণকে, কেউ-না-কেউ মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত হয়েছে, দেশ ও দশের কথা ভেবে আইন তুলে নিয়েছে নিজের হাতে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, হ্যাঙ্ককে শাস্তি দেয়নি কেউ।
অথবা হয়তো দিয়েছে…কিন্তু সেটার সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওর কোনো যোগসূত্র নেই।
অথবা, হয়তো, ভাইরাল ভিডিওটাই হ্যাঙ্কের বীভৎস মৃত্যুর কারণ।
ধরে নিলাম, আমার ধারণাই ঠিক…মানে, কেউ একে-একে খুন করছে কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যদের। জীবনের পঁয়ত্রিশতম জন্মদিন পালন করার আগেই মারা গেছে ওই ক্লাবের অন্তত চারজন সদস্য। একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর হয়ে কী করে অস্বীকার করি, ওই হত্যাকাণ্ডগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত না?
প্রথমে মারা গেল লিও আর ডায়ানা। তারপর রেক্স। সবশেষে হ্যাঙ্ক। ওদিকে বেথের কোনো খবর নেই। আর মোরা…সে আজও একজন রহস্যময়ী হয়ে আছে আমার জন্য। তবে আমি নিশ্চিত, যে-রাতে মারা গিয়েছিল লিও আর ডায়ানা, সে-রাতে বিশেষ কিছু একটা দেখেছিল সে। এবং দেখেছিল বলেই বুঝতে পেরেছিল, ওকে পালাতে হবে, নইলে বাঁচতে পারবে না। তারপর থেকে আজপর্যন্ত সে পলাতক। অথবা, রেক্সকে খুন করার পর ওকে হয়তো পাকড়াও করেছে তথাকথিত ডেইল মিলার, এবং তারপর…
তারপর কী ঘটেছে তা অনুমান করতে চাইছি না আমি।
যদি ধরে নিই সবকিছুর পেছনে আছে ডেইল মিলার, তা হলে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, পনেরো বছর পর কেন? মানে, আজ থেকে পনেরো বছর আগে লিও আর ডায়ানাকে খুন করল সে, এতদিন কোনো খবর ছিল না তার; পনেরো বছর পর এমন কী হয়েছে যে, খুঁজে খুঁজে বের করছে সে কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যদের, এবং একের-পর-এক হত্যা করছে। তাদেরকে?
আরও ধরে নিলাম, যে-রাতে মারা গেল লিও আর ডায়ানা, সে-রাতে কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যরা এমন কিছু একটা দেখেছিল, যা দেখাটা উচিত হয়নি তাদের। এমন কিছু একটা জেনে গিয়েছিল, যা জানাটা উচিত হয়নি। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমার এই অনুমানের পক্ষে কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারিনি এখনও। পারবো কি না তা-ও বুঝতে পারছি না।
পারি অথবা না-পারি, আপাতত ধরে নিই সে-রাতে বিশেষ কিছু একটা দেখেছিল কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যরা।
তারপর কী করল ওরা? দৌড়ে পালাল? খারাপ লোকগুলো তখন কী করল? ধরে ফেলল লিও আর ডায়ানাকে? তারপর? তারপর ওরা লিও আর। ডায়ানাকে নিয়ে গেল রেইলরোড ট্রাকে? এমনভাবে খুন করল ওদেরকে, যাতে যে-কেউ মনে করে, চলন্ত ট্রেনের নিচে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কাটা পড়েছে ওই দুজন? ঠিক আছে, আপাতত মনে করলাম আমার অনুমান ঠিক। কিন্তু তারপর কী হলো? প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে গেল ক্লাবের বাকি সদস্যরা? মোরার বেলায় কথাটা প্রযোজ্য। কিন্তু রেক্স, হ্যাঙ্ক বা বেথের বেলায় কি আমার অনুমান খাটে?
ওই তিনজন তো কখনও লুকিয়ে থাকেনি? ওরা তো আমার সঙ্গে একই স্কুল থেকে পাস করল। আমার সঙ্গেই গ্র্যাজুয়েশন করল।
খারাপ লোকগুলো হাতে এত সময় পেল, তারপরও শেষ করে দিল না কেন ওই তিনজনকে? মানে, ওদেরকে শেষ করে দেয়ার কাজটা শুরু করতে পনেরো বছর সময় লাগল কেন ওই লোকগুলোর?
আরও কথা আছে। ভাইরাল ভিডিও নিয়ে যখন মাতামাতি চলছে, ঠিক তখনই কেন হত্যা করা হলো হ্যাঙ্ককে?
এতগুলো প্রশ্নের মাঝখানে বিশেষ কিছু কি লুকিয়ে আছে?
বুঝতে পারছি না।
ভাইরাল ভিডিওর ব্যাপারটা ভাবা যাক আবার। ওটার সঙ্গে কি কোনো যোগাযোগ আছে এসব ঘটনার?
মাথা নাড়লাম আমি। কিছু একটা ধরি-ধরি করেও ধরতে পারছি না। কিছু একটা বুঝি-বুঝি করেও বুঝতে পারছি না।
কান্নার আওয়াজে ফিরে এলাম বাস্তবে। কাঁদছেন টম স্ট্রাউড। তাঁর মাথাটা ঝুলে পড়েছে বুকের উপর। বার বার কেঁপে উঠছে দুই কাঁধ। সামনের দিকে ঝুঁকে মিস্টার স্ট্রাউডের একটা হাত ধরলেন অগি। কাজ হলো না। বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ালেন অগি, গিয়ে দাঁড়ালেন মিস্টার স্ট্রাউডের পাশে। এবার তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন মিস্টার স্ট্রাউড।
চোখ বন্ধ করে ফেললেন অগি, বেদনার স্পষ্ট ছাপ দেখতে পাচ্ছি আমি তার চেহারায়। কান্নার আওয়াজ বেড়েছে টম স্ট্রাউডের, মনে হচ্ছে আহাজারি করছেন তিনি।
সময় যাচ্ছে। আমরা কেউ নড়ছি না। আমাদের তিনজনের একজন পাথর হয়ে গেছে শোকে। কাউকে আবার পাথর বানিয়েছে অতীতের কোনো দগদগে ঘা। আর আমি পাথর হয়েছি নিজের করণীয় স্থির করতে না পেরে। আমি পাথর হয়েছি চোখের সামনে সন্তান-হারানো দুজন বাবাকে দেখে।
টম স্ট্রাউডের ফোঁপানি কমে আসছে আস্তে আস্তে। অগিকে ছেড়ে দিলেন তিনি একসময়, সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, খবরটা জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
কোনোরকমে মাথা ঝাঁকালেন অগি।
শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন মিস্টার স্ট্রাউন্ড, পৃথিবীর দুর্বলতম হাসিটা হাসলেন। অগিকে বললেন, এখন তুমি আর আমি সমান সমান।
তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন অগি।
তুমি আর আমি দুজনই সন্তান হারিয়েছি, বলছেন টম স্ট্রাউড। তুমি আর আমি দুজনই এখন জানি, সন্তান হারানোর কষ্ট কী-রকম। যারা সন্তান হারিয়েছে তাদেরকে নিয়ে যদি কোনো ক্লাব গঠন করা হয়, তা হলে আমরা সেই জঘন্যতম ক্লাবের দুজন সদস্য।
চোখমুখ কুঁচকে গেল অগির। মনে হচ্ছে, এবার একের পর এক পাঞ্চ হজম করছেন তিনি।
হ্যাঙ্কের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই ভিডিওর কোনো সম্পর্ক আছে? অগিকে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার স্ট্রাউড।
জবাব দিলেন না অগি।
তাঁর দিকে তাকালাম। আত্মচিন্তায় বিভোর হয়ে গেছেন তিনি।
কাজেই জবাবটা দিতে হলো আমাকেই। কাউন্টি অফিস তদন্ত শুরু করেছে।
হ্যাঙ্ক যদি নিজের সবকিছু দেখিয়েও থাকে, তবুও ওকে এভাবে…
হ্যাঙ্ক কিছুই দেখায়নি।
আমার দিকে তাকিয়ে আছেন মিস্টার স্ট্রাউড।
আসলে একটা মিথ্যা কথা ছড়ানো হয়েছে হ্যাঙ্কের নামে, বললাম আমি। স্কুলের আশপাশে ঘুরঘুর করত হ্যাঙ্ক…এটা পছন্দ হয়নি জনৈকা স্কুলছাত্রীর মার।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল মিস্টার স্ট্রাউডের। তারমানে ওই ভিডিও আসলে বানিয়েছে ওই মহিলা?
হ্যাঁ।
মিস্টার স্ট্রাউডের চেহারা দেখে বুঝতে পারছি, রেগে যাচ্ছেন তিনি। নাম কী ওই মহিলার?
সেটা আপাতত বলা যাচ্ছে না আপনাকে।
ওই মহিলাই কি খুন করেছে হ্যাঙ্ককে?
না…আমার মনে হয় না।
তা হলে কে খুন করেছে আমার ছেলেকে?
দেখুন, তদন্ত মাত্র শুরু হয়েছে। জবাবটা জানতে একটু সময় লাগবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে আপনাকে। আপনি কি কাউকে খবর দিতে চান?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার স্ট্রাউড, আমার ভাইকে।
.
গাড়িতে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম অগির দিকে। একদম চুপ মেরে গেছেন…ব্যাপার কী?
কিছু না।
আপনার মোবাইলে কি আপডেট জানিয়ে এস.এম.এস. পাঠিয়েছে কেউ?
না। গাড়িটা মুখ করে আছে টম স্ট্রাউডের বাসার দিকে, উইন্ডশিল্ড ভেদ করে সেদিকে তাকালেন অগি। আমাকে কী বলেছে টম, শুনেছ?
কী?
যারা সন্তান হারিয়েছে তাদেরকে নিয়ে যদি কোনো ক্লাব গঠন করা হয়, তা হলে আমরা নাকি সেই জঘন্যতম ক্লাবের দুজন সদস্য।
কিছু বললাম না।
আমার কষ্টটা বুঝতে পেরেছে টম।
মুষড়ে পড়েছেন অগি। ফোঁস ফোঁস করছেন তিনি–যেন শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে তার।
কী করবো বা বলবো, বুঝতে পারছি না। চুপ করে থেকে অপেক্ষা করাটাই ভালো মনে হয়।
স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন সকালে ডায়ানাকে ঘুম থেকে ওঠাতাম আমি। নিজের হাতে প্রতি বুধবার চকলেট-চিপ প্যানকেক বানিয়ে দিতাম ওকে। সে যখন ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল, প্রতি শনিবার সকালে ওকে নিয়ে যেতাম আর্মস্ট্রং ডিনারে। কখনও কখনও যেতাম দোকানে, ওর চুলের জন্য কিনতাম পনিটেইল-হোল্ডার অথবা টয়টয়েস-শেল ক্লিপ। চুলের ক্লিপ সংগ্রহ করার বাতিক ছিল আমার মেয়েটার। সে মারা যাওয়ার পর ওর ওই জিনিসগুলো আবর্জনা ভেবে হাজারবার ফেলে দিতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি একবারও। যতবার হাত দিয়েছি ওগুলোতে, ততবার যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে আমার পুরো শরীর। …স্কুলে সপ্তম গ্রেডে থাকতে একবার সাংঘাতিক বাতজ্বর হলো ওর। তখন সেইন্ট বারনাবাস চার্চের একই চেয়ারে টানা আট রাত বসে ছিলাম আমি। ওকে দেখতে যখন হাসপাতালে যেতাম, তাকিয়েই থাকতাম ওর দিকে, আর মনে মনে ঈশ্বরকে বলতাম, তিনি যেন কখনও কোনো ক্ষতি না করেন মেয়েটার, তিনি যেন আমার কাছ থেকে কেড়ে না নেন ওকে।
অগি…হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর হওয়ার ব্যাপারে আমাকে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন যিনি…টপটপ করে পানি পড়ছে তার চোখ দিয়ে।
ফিল্ড হকি খুব পছন্দ করত আমার মেয়েটা, কিন্তু আমি করতাম না, তারপরও ওকে খুশি করার জন্য ওকে নিয়ে হাজির থাকতাম শহরের প্রতিটা ম্যাচে। হাজির থাকতাম প্রতিটা হলিডে কনসার্টে আর ড্যান্স পার্টিতে। হাজির থাকতাম প্রতিটা প্যারেন্টস ডে-তে। যেদিন সে জীবনে প্রথমবারের জন্য ডেটিং করতে যায়, গোপনে পিছু নিয়েছিলাম ওর, কারণ ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। যখন ডেটিং করত, রাত করে বাসায় ফিরত; সে না
ফেরা পর্যন্ত শুতে পারতাম না আমি, ঘুমানো তো পরের কথা। স্পষ্ট মনে আছে আমার, যখন সে হাইস্কুলে ছিল, খুব কঠিন একটা রচনা লেখার কাজে সাহায্য করেছিলাম ওকে। কিন্তু সেই রচনা তোমরা কেউ কখনও পড়তে পারোনি, কারণ ওটা স্কুলে জমা দেয়ার আগেই মারা যায় বেচারী।
আবারও ফোঁস ফোঁস শব্দ করছেন অগি, তাকিয়ে আছেন টম স্ট্রাউডের বাসার দিকে।
অথচ টম বলেছে, যারা সন্তান হারিয়েছে তাদেরকে নিয়ে যদি কোনো ক্লাব গঠন করা হয়, তা হলে আমরা নাকি সেই জঘন্যতম ক্লাবের দুজন সদস্য। …সন্তান হারানোর কষ্ট কী, তা কি সে বোঝে? ডায়ানা ছিল আমার জীবন ও পৃথিবী, ও-দুটো হারানোর কষ্ট কি সে বোঝে? …বোঝার কথা। কারণ জীবনের একটা সময়ে হ্যাঙ্ককে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে। ডায়ানার ব্যাপারে আমি কিন্তু কখনও কল্পনাও করতে পারিনি সে-রকম কিছু।
কথা বলতে বলতে আহাজারি-করার-কায়দায় নিজের বুকে চাপড় মারছেন অগি। একসময় চুপ হয়ে গেলেন হঠাৎ, বন্ধ করে ফেললেন দুই চোখ।
আমার মনের একটা অংশ কিছু বলতে চাইছে অগিকে, সান্ত্বনা জানাতে চাইছে তাঁকে। কিন্তু অন্য অংশটা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমি একজন নীরব দর্শকমাত্র, এবং সন্তান হারানোর কষ্টের কোনো সান্ত্বনা হয় না।
মানুষের কোনো কষ্টেরই কোনো সান্ত্বনা হয় না আসলে।
চোখ খুললেন অগি, আবার তাকালেন মিস্টার স্ট্রাউডের বাসার দিকে। হয়তো…পুরো ব্যাপারটা অন্য কোনোভাবে খতিয়ে দেখা উচিত আমাদের।
অন্য কোনোভাবে? যেমন?
আজ থেকে পনেরো বছর আগে কোথায় ছিল টম স্ট্রাউড?
থমকে গেছি আমি। চুপ করে আছি।
সে বলেছে, সে নাকি পশ্চিমের কোনো এক জায়গায় গিয়েছিল, বলছেন অগি! কী নাকি একটা ব্যবসা শুরু করেছিল।
মিস্টার স্ট্রাউডের বাসার দিকে তাকালাম। তো?
আজ থেকে পনেরো বছর আগে ঘটনার শুরু। আজ থেকে পনেরো বছর আগে ওয়েস্টব্রিজে ফিরে এসেছিল টম স্ট্রাউড। কাজেই, এখান থেকে কোথায় গিয়েছিল সে, কী করেছিল–সে-সবের খোঁজ নেয়া দরকার।
.
১৮.
ফিরে এলাম নিজের বাসায়।
বেথ ল্যাশলির কোনো খবর নেই। ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে। হ্যাঙ্কের মতো বেথের লাশ পাওয়ার খবরও জানতে পারবো নাকি হঠাৎ?
ফোন করলাম অ্যান আর্বার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। কথা হলো কার্ল লেগ নামের একজন গোয়েন্দার সঙ্গে। নিজের পরিচয় দিলাম লোকটাকে।
ঠিক কী চাইছেন আপনি, বলবেন? জিজ্ঞেস করল কার্ল।
বেথ ফ্লেচার নামের একজন কার্ডিয়োলোজিস্টকে খুঁজছি আমি। ওর আরেকটা নাম হচ্ছে বেথ ল্যাশলি। অ্যান আর্বারের ইউনিভার্সিটি অভ মিশিগান মেডিকেল সেন্টারে কাজ করে সে। কয়েকবার যোগাযোগ করেছি ওখানে, কিন্তু ওরা সন্তোষজনক কিছু জানাতে পারেনি আমাকে।
তাকে কেন খুঁজছেন আপনি? তিনি কি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন?
না। আমি শুধু কথা বলতে চাই ওর সঙ্গে।
ঠিক আছে। আমি নিজে যাবো ওই মেডিকেল সেন্টারে।
ধন্যবাদ।
চিন্তা করবেন না। কিছু জানতে পারলে ফোন করবো আপনাকে। আপনার নম্বরটা বলুন।
নম্বরটা জানিয়ে লাইন কেটে দিলাম। এদিকওদিক তাকাচ্ছি।
সুনসান হয়ে গেছে পুরো বাড়ি। এই বাড়িতে যদি কোনো ভূত থেকে থাকে, তা হলে সে-ও ঘুমিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। আসলে আমার একার জন্য বিশাল হয়ে গেছে বাড়িটা।
সিঁড়ি বেয়ে হাজির হলাম দোতলায়। এখানে একদিকে একটা হ্যান্ডেল আছে, টান দিলাম ওটা ধরে। নেমে এল চিলেকুঠুরিতে-ওঠার মইটা। উঠতে লাগলাম ওটা বেয়ে।
শেষ কবে গেছি চিলেকুঠুরিতে, মনে করার চেষ্টা করছি। লিও মারা যাওয়ার পর ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখানে এনে রাখি আমি। আসলে…আমার ঠিক মনে নেই কাজটা আমি একাই করেছিলাম, নাকি বাবাও সাহায্য করেছিলেন।
হুট করে মরে গিয়েছিল আমার ভাইটা। বাবার বেলায় সেটা ঘটেনি। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, পৃথিবীতে তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তিনি তখন নিজের ব্যবহৃত অনেককিছু দান করে দেন। বেশিরভাগ কাপড় বিলিয়ে দেন। আস্তে আস্তে গুছিয়ে ফেলেন নিজের ঘরটা। তারপর একদিন চোখ বন্ধ করেন চিরদিনের জন্য। আসলে তিনি চাননি, তিনি মারা যাওয়ার পর তার জিনিসপত্র গোছাতে কোনো কষ্ট হোক আমার।
চিলেকুঠুরিটা বন্ধ ছিল অনেকদিন, তাই ভিতরে ঢোকামাত্র একটা বাসি গন্ধ বাড়ি মারল নাকে। ভাপসা গরম লাগছে, মনে হচ্ছে দম নিতে পারছি না। বাক্স বা ট্রাঙ্কের ছড়াছড়ি নেই এখানে। যখন ছোট ছিলাম, আমি আর লিও আসতাম এখানে, খেলতাম।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম এককোনার একটা কার্ডবোর্ড-বাক্সের দিকে।
লিও মারা যাওয়ার পর ওর সব খেলার-সামগ্রী ফেলে দিয়েছিলেন বাবা। তিনি আবার অগির মতো না যে, সন্তান হারানোর পরও সন্তানের ব্যবহৃত জিনিস বুকে আঁকড়ে ধরে রাখবেন। তার মানে এ-ই না, আবেগ বলে কিছু ছিল না তার। লিও’র লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তার সারা শরীর তখন কাঁপছিল, কোনো এক অসহ্য আবেগে ভীষণ আন্দোলিত হচ্ছিল বুকটা। কাঁপছিল তার দুই কাঁধ। তীব্র মর্মবেদনায় আহাজারি করছিলেন তিনি; আহত বুনো পশুর আর্তনাদের মতো তাঁর সেই চিৎকার আমার কানে বাজছিল এবং আজও বাজে। তাঁর সেই শোকসন্তপ্ত রূপ দেখে সেদিনও ভয় পেয়েছিলাম আমি। তাঁর সেই শেসন্তপ্ত রূপের কথা মনে পড়লে ভয় পাই আজও।
লিও’র মৃত্যু আমাদের পরিবারের জন্য অনেক বড় একটা ঘটনা, অথচ আশ্চর্য, মার পক্ষ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাইনি আমরা।
বাবা কি যোগাযোগ করেছিলেন মার সঙ্গে? বাবা কি দুর্ঘটনার খবরটা জানিয়েছিলেন মাকে? জানি না। বাবাকে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করিনি ওই ব্যাপারে। তিনিও নিজে থেকে কিছু বলেননি কখনও।
একটা কথা মনে পড়ে গেল।
আগে কখনোই এই বাক্স খুলিনি আমি। এমনকী, এই বাক্সে লিও’র জিনিসপত্র ঢোকানোর কাজটাও করিনি। যেহেতু লিও মারা গেছে, সেহেতু এই বাক্স গোছানোর সময় বাবা জানতেন, ওর পক্ষে আর কোনোদিনই খোলা সম্ভব হবে না এটা। তিনি এ-ও জানতেন, তিনিও আর কোনোদিন খুলবেন না বাক্সটা। তা হলে কার কথা ভেবে এই বাক্সের ভিতরে লিও’র জিনিসপত্র গুছিয়েছিলেন তিনি?
আমার কথা ভেবে।
তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, কোনো একদিন খুলবো আমি এই বাক্স, দেখবো ভিতরে কী আছে।
টেপ দিয়ে ভালোমতো আটকানো আছে বাক্সটা। পকেট থেকে একটা চাবি বের করে ওটা দিয়ে এলোপাতাড়ি পোঁচ মেরে কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে ফেললাম টেপ। জোর খাঁটিয়ে সরালাম কার্ডবোর্ড, উঁকি দিলাম ভিতরে। কী পাবো, অথবা আসলেই কিছু পাবো কি না, জানি না। শুধু জানি, যে-কদিন বেঁচে ছিল আমার ভাই, আমার সঙ্গে একই ঘর ভাগাভাগি করেছে সে।
প্রথমেই চোখে পড়ল একটা ফটোগ্রাফ। এবং ওটা দেখতে পাওয়ামাত্র থমকে গেলাম। আমাদের চারজনের স্থিরচিত্র ওটা–আমি, মোরা, লিও আর ডায়ানা। কখন এবং কোথায় তোলা হয়েছিল এই ফটো, মনে আছে আমার-ডায়ানাদের বাসার ব্যাকইয়ার্ডে, ওর সতেরোতম এবং জীবনের শেষ জন্মদিনে। তখন ছিল অক্টোবর মাস, গরমকাল, রাতের বেলা।
টেনে বের করলাম ফটোটা। তাকিয়ে আছি ওটার দিকে। এই ছবি তোলার সপ্তাহ দু-এক পর মারা যায় লিও আর ডায়ানা।
ছবিতে আমরা চারজনই বসে আছি। আমার কোলে বসেছে মোরা। ডায়ানার পাশে বসে আছে লিও। হাসছে না ডায়ানা। লিওকে দেখাচ্ছে পাথর-কুঁদে-বানানো কোনো মূর্তির মতো। ঘষা কাঁচের মতো কেমন অনুজ্জ্বল আর ঝাপসা দেখাচ্ছে ওর দুই চোখ। ওর চেহারায় কি দুশ্চিন্তার ছাপও আছে? অথচ এসব খেয়াল করিনি আমি তখন। সে-সময় হকি আর মোরায় বুঁদ হয়ে ছিলাম আমি।
নিচে ডোরবেল বেজে উঠল।
ফটোটা জায়গামতো রেখে দিয়ে এগিয়ে গেলাম মইয়ের দিকে। ওটা বেয়ে নামছি, এমন সময় আবার বেজে উঠল বেলটা। সিঁড়ির কাছে হাজির হওয়ার আগে আরও একবার বেল বাজাল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে-থাকা মানুষটা। অস্থির হয়ে উঠেছে সে কোনো কারণে।
আসছি! চেঁচিয়ে জানালাম।
দরজা খোলামাত্র একটু আশ্চর্য হতে হলো।
ডেভিড রেইনিভ…আমার এককালের সহপাঠী। রীতিমতো ঝকঝক করছে ওর বিযনেস স্যুটটা। কিন্তু ছাইবর্ণ হয়ে আছে চেহারা, কুঁচকে আছে ভ্রূ।
হ্যাঙ্কের ঘটনাটা শুনেছি, ভিতরে এসে বসার পর বলল সে। যা শুনেছি, তা কি সত্যি?
দেখো, তদন্ত চলছে, এই অবস্থায় একজন পুলিশ অফিসার হয়ে কিছু বলাটা উচিত হবে না আমার।
শুনলাম ওকে নাকি একটা গাছের ডালের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে? সে কি আত্মহত্যা করেছে, নাকি ওকে খুন করা হয়েছে?
আবারও বলতে চাইলাম, এখন কিছু বলা উচিত না আমার, কিন্তু বললাম না–অদ্ভুত একটা মরিয়া ভাব ফুটে আছে ডেভিডের চেহারায়।
সে আসলে কেন এসেছে আমার কাছে? আসলেই জানতে চায় খুন হয়েছে কি না হ্যাঙ্ক? নাকি…,
খুন করা হয়েছে ওকে, বললাম আমি।
চোখ বন্ধ হয়ে গেল ডেভিডের।
তুমি কি এই ব্যাপারে কিছু জানো? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কিছু বলল না ডেভিড। এখনও চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে।
ডেভিড?
আমি আসলে নিশ্চিত না, বলল সে। তবে আমার মনে হয়, কিছু একটা জানি।
.
১৯.
ডেভিডদের বাড়িটা যেমন বিশাল তেমন বিলাসবহুল। গ্যারেজটা আকারে সাধারণ যে-কোনো কলেজের জিমনেশিয়ামের সমান। ওখানে নেমে পার্শ্বদরজা দিয়ে চলে এলাম বেইজমেন্টে।
যদিও বেইজমেন্ট, তারপরও এখানে একটা থিয়েটার রুম আছে, ওয়াইন সেলার আছে। আসলে এই জায়গাকে বেইজমেন্ট না-বলে লোয়ার লেভেল বললে মানায় বেশি।
আমাকে নিয়ে ছোট একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল ডেভিড, সুইচ টিপে লাইট জালাল।
ঘরের ডানদিকের এককোনায় দেখা যাচ্ছে পুরনো আমলের ফুট চারেক উচ্চতার একটা সিন্দুক। ওটার ডায়ালটা বেশ বড়।
হ্যাঙ্কের কেসের দায়িত্ব তো তোমাকে দেয়া হয়নি, না?
প্রশ্নটা এই নিয়ে তিনবার জিজ্ঞেস করল আমাকে ডেভিড।
না, জবাবে বললাম আমি। কেন, কোনো সমস্যা?
এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকের ডায়ালের উপর ঝুঁকে পড়ল ডেভিড, কম্বিনেশন মেলাচ্ছে। আমার কাছে একটা জিনিস রাখতে দিয়েছিল হ্যাঙ্ক।
কবে?
আট কি নয় বছর আগে। বলেছিল, ওকে যদি কখনও খুন করা হয়, আমি যেন এমন কারও হাতে তুলে দিই জিনিসটা, যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। হ্যাঙ্কের ব্যাপারে তোমাকে ছাড়া আর কাকে বিশ্বাস করবো, বুঝতে পারছি না।
কিছু বললাম না। নিজের হৃৎস্পন্দন টের পাচ্ছি…কেন, জানি না।
আরও বলেছিল, বলছে ডেভিড, আইন-প্রয়োগকারী কোনো সংস্থার সঙ্গে জড়িত কারও হাতে দেয়া যাবে না ওই জিনিস। বলেছিল, যদি খুন করা হয় ওকে, তা হলে যে-লোক ওর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করবে, তার হাতেও দেয়া যাবে না ওটা। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল সে আমার দিকে। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে উপযুক্ত বলে মনে করছি না।
আমি আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে জড়িত।
জানি। কিন্তু আট-নবছর আগের হ্যাঙ্কের সঙ্গে মারা-যাওয়ার-আগের হ্যাঙ্কের অনেক পার্থক্য ছিল। তা ছাড়া যেহেতু সে মারা গেছে, সেহেতু যা গচ্ছিত রেখেছিল আমার কাছে, তা জানাজানি হলে ওর কোনো অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, তুমি আমাদের বন্ধু মানুষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার পরও আমাদের দিকটা দেখবে…অন্তত সে-রকমই আশা করছি।
ঠিক আছে।
হ্যাঙ্ক যা গচ্ছিত রেখেছিল আমার কাছে, আমার মনে হয় সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। বরং, বলা ভালো, অসংলগ্ন ও বিকারগ্রস্ত মনের অধিকারী একটা মানুষের…কী বলবো…শেষ সম্বল। আমি বার বার মানা করেছি ওকে…বলেছি, ওর কোনোকিছু নিজের কাছে গচ্ছিত রাখা সম্ভব না আমার পক্ষে। কিন্তু ওই ব্যাপারে সে ছিল নাছোড়বান্দা। এবং আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল, যদি কখনও খুন করা হয় ওকে, যোগ্য কাউকে ছাড়া অন্য কারও হাতে তুলে দেবো না ওটা। ওর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য নিজের কাছে রেখে দিই জিনিসটা, প্রতিজ্ঞাও করি।
ডায়ালে শেষ একটা মোচড় দিল ডেভিড। মৃদু ক্লিক শব্দ শুনতে পেলাম। হাতলের দিকে হাত বাড়াল সে। কিন্তু মোচড় দিল না ওটাতে, বরং ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। তোমাকে বিশ্বাস করি আমি, ন্যাপ। বিশ্বাস করি, হ্যাঙ্কের ওই জিনিস তোমার হাতে তুলে দিলে আমার কোনো ক্ষতি হবে না।
মাথা ঝাঁকালাম আমি।
সিন্দুকের ডালা খুলল ডেভিড। হাত ঢুকিয়ে দিল ভিতরে। সিন্দুকটা ওর ব্যক্তিগত, ভিতরে যা-যা আছে সবই ব্যক্তিগত, তাই উঁকি দিয়ে তাকালাম না আমি, দেখলাম না কী-কী সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে হ্যাঙ্কের সেই জিনিস বের করল ডেভিড।
একটা ডিভিওক্যাসেট টেপ।
ধাক্কার মতো কিছু একটা টের পেলাম আমি নিজের বুকে। আন্দোলন জেগেছে আমার স্মৃতির পর্দায়।
আমরা যখন হাইস্কুলের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, লিওকে একটা ক্যানোন পি.ভি. ওয়ান ডিজিটাল ক্যামকর্ডার কিনে দিয়েছিলেন বাবা। ওটা পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে গিয়েছিল লিও। বেশ কিছুদিন মেতে ছিল সে ওটা নিয়ে-হাতের সামনে যা পেত সেটারই ভিডিও করত। এতই আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল সে যে, আমাকে একবার বলে, বড় হয়ে চিত্রপরিচালক হবে। যদি তা হতে না-পারে, ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাবে।
ক্যাসেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল ডেভিড। লাল একটা প্রাস্টিকের কেসে আছে ওটা। কেসের গায়ে লেখা আছে: ম্যাক্সেল, সিক্সটি মিনিটস–ঠিক যেমনটা ব্যবহার করত লিও। তারপরও জোর দিয়ে বলার উপায় নেই, এই ক্যাসেট টেপ ব্যবহার করেছে সে। কারণ আজ থেকে পনেরো বছর আগে দারুণ জনপ্রিয় ছিল ম্যাক্সেল ক্যাসেটটেপ। তখন অনেকেই ব্যবহার করত ওসব।
ভিডিওটা দেখেছ? জিজ্ঞেস করলাম ডেভিডকে।
না।
কেন?
আমাকে দেখতে মানা করেছিল হ্যাঙ্ক।
কী আছে এই ক্যাসেটে, কোনো ধারণা আছে?
না। আমি আসলে সৎ থাকার চেষ্টা করেছি হ্যাঙ্কের কাছে। আমাকে বিশ্বাস করে একটা জিনিস রেখেছিল সে আমার কাছে…অমর্যাদা করতে চাইনি ওর বিশ্বাসের।
কিছু বললাম না। তাকিয়ে আছি ক্যাসেটের দিকে।
হয়তো…হ্যাঙ্কের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই এই জিনিসের, বলল ডেভিড। মানে…ওই ভাইরাল ভিডিওটার কথা বলছি। অনেকেই বলাবলি করেছে, সে নাকি প্যান্ট খুলে নিজের সবকিছু দেখিয়ে দিয়েছে।
কথাটা মিথ্যা।
মিথ্যা? কেউ কেন একটা মিথ্যা কথা প্রচার করবে হ্যাঙ্কের মতো একজন মানুষের নামে?
ডেভিড হ্যাঙ্কের বন্ধু, আমারও বন্ধু। অন্তত আমার কাছ থেকে সত্যি কথাটা জানার অধিকার আছে তার। তাই, সুযান হ্যানসনের সঙ্গে যা-যা কথা হয়েছে আমার, সংক্ষেপে বললাম ওকে।
শুনে বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ডেডিভ। বন্ধ করল সিন্দুকের ডালা, ডায়াল ঘুরিয়ে লক করল ওটা।
বললাম, ভিসিআর বা ভিসিপি-জাতীয় কিছু কি আছে তোমার বাসায়?
না।
তা হলে খোঁজ নিয়ে দেখি কোথায় পাওয়া যায় ও-রকম কিছু।
মাথা ঝাঁকাল ডেভিড। একটা মানুষ মারা যাওয়ার পরও তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা উচিত না। কিন্তু…তুমিই বলেছ, খুন করা হয়েছে হ্যাঙ্ককে। …এই ভিডিওতে কোনো ব্লু থাকলেও থাকতে পারে, তাই না?
জবাব দিলাম না।
ভাবছি, ডিজিটালাইজেশনের এ-যুগে ভিসিআর বা ভিসিপি বাতিল মাল। সুতরাং কার সঙ্গে যোগাযোগ করবো?
এমন কে আছে, যে আমাকে কিছুসময়ের জন্য ধার দিতে পারবে একটা ভিসিআর বা ভিসিপি, অথচ লোক জানাজানি হবে না?
.
ফোনে এলি বলল, বেইজমেন্টে পুরনো একটা ক্যানোন ভিডিওক্যামেরা খুঁজে পেয়েছে বব। ওর ধারণা, এখনও সচল আছে ওটা। তবে চার্জ দিতে হবে।
আশ্চর্য হতে গিয়েও হলাম না। এলি আর ওর স্বামী বব এমন মানুষ, যারা কখনও কোনোকিছু ফেলে দেয় না। অথচ বেশিরভাগ মানুষের কাছে বাতিল-মাল জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু না, এবং তাদের জন্য যে-কোনো জঞ্জালের একমাত্র ঠিকানা ডাস্টবিন।
ভিডিওটা শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে, জানি না, বললাম আমি। তবে আমার ধারণা, মিনিট দশেকের বেশি লাগবে না।
তা হলে রাতে খেয়ে যেয়ো আমাদের এখান থেকে।
কথা দিতে পারছি না।
কেন?
ভিডিওতে যদি বিশেষ কিছু থাকে, তা হলে হয়তো…
ঠিক আছে, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে এলি। আর সব খবর ভাল?
দেখা হলে বলবো।
লাইন কেটে দিলাম।
গাড়ি চালাচ্ছে ডেভিড, তাকালাম ওর দিকে।
রাস্তার উপর থেকে চোখ না সরিয়ে সে বলল, তুমি কি জানো, হ্যাঙ্ক মরা-মানুষদের খুব সম্মান করত?
মরা-মানুষদের সম্মান করত? যেমন?
যেমন ওর মা। তোমার ভাই। ডায়ানা।
কীরকম?
লিও আর ডায়ানার ভাগ্যে যা ঘটেছিল, তা দেখে চুরমার হয়ে গিয়েছিল হ্যাঙ্কের মন।
মন চুরমার হয়ে যাওয়া আর মরা-মানুষদের সম্মান করার মধ্যে সম্পর্ক কী?
তুমি কি আসলেই জানো না?
না।
হ্যাঙ্ক যে প্রতিদিন সকালে একই পথ ধরে হাঁটত, জানো?
জানি।
হেঁটে কোথায় যেত সে প্রতিদিন, সেটা জানো?
টের পেলাম, কেউ যেন তার বরফশীতল আঙুলগুলো আমার ঘাড়ে বোলাতে শুরু করেছে হঠাৎ করেই।
রেইলরোড ট্রাকে, আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ডেভিড। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় গিয়ে থামত সে, জানো? ঠিক যেখানে…বুঝতেই পারছ।
আমি যেন একটা ভোঁ-ভোঁ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি কানের কাছে। যখন কথা বললাম, মনে হলো, অনেক দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি নিজের কণ্ঠ। তারমানে, তুমি বলতে চাও, প্রতিদিন সকালে ওই মিলিটারি ঘাঁটির পাশ দিয়ে হাঁটা ধরত হ্যাঙ্ক, আর গিয়ে থামত যেখানে পাওয়া গেছে লিও আর ডায়ানার লাশ?
মাথা ঝাঁকাল ডেভিড। আমি কিন্তু এতদিন জানতাম, কথাটা জানা আছে তোমার।
না, জানা ছিল না।
কোনো কোনোদিন হাঁটতে একটু বেশি সময় লাগত হ্যাঙ্কের। ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে কিছু একটা দেখত সে।
কী দেখত?
জানি না। …কখনও কখনও আরেকটা কাজ করত সে।
কী কাজ?
একরকম জোর করেই উঠে পড়ত আমার গাড়িতে। ওকে নিয়ে ওই মিলিটারি ঘাঁটির কাছে যেতে বাধ্য করত আমাকে। ওর পীড়াপীড়িতে কাজটা না করে পারতাম না আমি।
কী করত সে ওখানে গিয়ে?
কিছু না।
কিছু না?
মানে…ওর কথামতো ওই ঘাঁটি থেকে গাড়ি চালিয়ে সেই রেইলরোড ট্র্যাকে যেতাম আমি। তখন বার বার হাতঘড়ির দিকে তাকাত হ্যাঙ্ক। মনে মনে হিসাব কষত, গাড়িতে করে ওই ঘাঁটি থেকে রেইলরোড ট্র্যাকে যেতে কত সময় লাগে।
কেন করত সে কাজটা?
জানি না। আমাকে কখনও কিছু বলেনি ওই ব্যাপারে। আমিও যেচে পড়ে কিছু জানতে চাইনি। …মনে মনে হিসাব কষার সময় কখনও কখনও বিড়বিড় করে কথা বলত সে নিজের সঙ্গে।
কী বলত?
খেয়াল করে শুনিনি কখনও। অথবা শুনলেও এখন মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে…
কী?
মনে করো কোনো ট্রেন ঢুকছে আমাদের শহরের স্টেশনে এবং সে সময় রেলরোড-ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হ্যাঙ্ক। তিন-চারবার দেখেছি, ওই সময় হাপুস নয়নে কাঁদত সে। আমার ধারণা, লিও আর ডায়ানার কথা ভেবে কাঁদত।
নতুন এই তথ্য হজম করতে সময় লাগছে আমার।
জিজ্ঞেস করলাম, আর কিছু জানো এই ব্যাপারে?
না…মনে পড়ছে না।
এলি আর ববের বাসার সামনে গাড়ি থামাল ডেভিড। ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে পড়লাম।
ডেভিড বলল, হ্যাঙ্কের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের জন্য যদি কোনোকিছু করা দরকার হয়, আমাকে বোলো। আমার পক্ষে যথাসম্ভব চেষ্টা করবো।
ঠিক আছে।
আর…ওই টেপে কী আছে, যদি ইচ্ছা হয়, আমাকে জানিও।
ঠিক আছে।
চলে গেল ডেভিড। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ওর গাড়ির দিকে, তারপর পা বাড়ালাম এলি আর ববের বাসার উদ্দেশে।
ওদের লনের ঘাস এত সুন্দর করে হেঁটে রাখা হয়েছে যে, দেখলে মনে হয় পি.জি.এ. গল্ফ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হবে এখানে। সুদৃশ্য কিছু ফ্লাওয়ার বক্সও আছে।
চাপ দিলাম ডোরবেলে। দরজা খুলে দিল বব, আন্তরিক হাসি আর উষ্ণ করমর্দনের মাধ্যমে বরণ করে নিল আমাকে। একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে চাকরি করে সে।
ভিতরের ঘরে ছিল এলি, আমি এসেছি টের পেয়ে বেরিয়ে এল, কাছে এসে চুমু খেল আমার গালে।
ওয়ার্কশপে রেখেছি ভিডিও ক্যামেরাটা, বলল বব। ঠিকমতো চার্জ নিচ্ছে না ওটা। তবে আমার মনে হয়, যদি ইলেকট্রিক লাইনের সঙ্গে প্লগ লাগিয়ে রেখে কাজ চালানো যায়, তা হলে কোনো অসুবিধা হবে না।
ধন্যবাদ।
আঙ্কেল ন্যাপ! আঙ্কেল ন্যাপ!
চিৎকার করতে করতে আমার দিকে ছুটে আসছে এলি আর ববের দুই মেয়ে লিয়া আর কেলসি। লিয়ার বয়স নয়, কেলসির সাত। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম আমি, আমাকে জড়িয়ে ধরল ওরা।
এই মেয়ে দুটো পাগলের মতো ভালোবাসে আমাকে। আমিও ওদেরকে অনেক আদর করি। মাঝেমধ্যে যখন দেখা হয় ওদের সঙ্গে, তখন আমার মনে হয়, শুধু ওদের জন্য চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি আমার উদ্দেশ্যবিহীন জীবনটা। ওদের জন্য নিজেকে একজন গডফাদার বলে মনে হয় আমার।
ওদের স্কুল কেমন চলছে, জানতে চাইলাম। খুব আগ্রহ নিয়ে জবাব দিল দুজনই। বিভিন্ন বিষয়ে আরও অনেক কথা বলল আমাকে।
হয়েছে, হয়েছে, শেষপর্যন্ত বাগড়া না দিয়ে পারল না এলি, আঙ্কেল ন্যাপকে ছাড়ো এবার। তোমাদের বাবার সঙ্গে ওয়ার্কশপে জরুরি কিছু কাজ আছে ওর।
মার দিকে তাকাল কেলসি। কী কাজ করবে আঙ্কেল ন্যাপ?
আছে কিছু কাজ, জবাব দিল বব।
কী কাজ? এবার জানতে চাইল লিয়া।
নিশ্চয়ই পুলিশের কোনো কাজ? বাঁধভাঙা আগ্রহ কেলসির কণ্ঠে।
আমার দিকে তাকাল লিয়া, কৌতূহলে চকচক করছে চোখ। তুমি কি খারাপ লোকদেরকে ধরবে, আঙ্কেল ন্যাপ?
হাসলাম আমি। না, সে-রকম নাটকীয় কিছু না। ভাবলাম, দেখতে যাচ্ছি আমি ববের ওয়ার্কশপে, সেটা কি আসলেই নাটকীয় কিছু না? একটা ভিডিও টেপ দেখবো।
আমরাও কি দেখতে পারি ওটা? জিজ্ঞেস করল লিয়া।
এলি উদ্ধার করল আমাকে। না, পারো না। যাও, নিজেদের কাজে যাও, আঙ্কেল ন্যাপকেও কাজ করতে দাও।
মাথা নিচু করে চলে গেল লিয়া আর কেলসি। খারাপ লাগল আমার, কিন্তু কিছু করার নেই আপাতত। সিদ্ধান্ত নিলাম, পরে একসময় উপহার নিয়ে আসবো বাচ্চা দুটোর জন্য।
ওয়ার্কশপটা গ্যারেজে। ববের পিছু পিছু সেদিকে এগোলাম আমি। দরজার উপর সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে সে: ববস ওয়ার্কশপ। যন্ত্রপাতি যেটা যেখানে রাখা দরকার, সেটা সেখানেই রেখেছে সে। ঘরের কোথাও কোনো ধুলো নেই, কাঠের গুঁড়ো নেই, অন্য কোনো আবর্জনাও নেই। বব আমার-মতো অগোছালো না।
ওয়ার্কবেঞ্চের উপর রাখা হয়েছে ক্যামেরাটা। ওটা চোখে পড়ামাত্র কেমন যেন হয়ে গেল মনটা, কারণ ওটা ক্যানোন পি.ভি. ওয়ান–যেমনটা ছিল লিওর। ভাবলাম, ওটা কি লিওরই ক্যামেরা? সে মারা যাওয়ার পর ওর অনেক জিনিস বিলিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। হয়তো ওই ক্যামেরা কোনোভাবে এসে পড়েছে এলি আর ববের হাতে। কে জানে?
লিও’র জীবনটা…বলা ভালো লিও’র জীবনের বিশেষ একটা ঘটনা, এবং ওর ব্যবহৃত কিছু জিনিসের সঙ্গে মেলে এমন অনেককিছু ফিরে আসতে শুরু করেছে আমার জীবনে।
আমার অতীত ফিরে আসছে আমার বর্তমানে।
ববের হাতে দিলাম ক্যাসেটটা। ওটা ক্যামেরায় ঢোকাল সে। ক্যামেরাটা উল্টেপাল্টে কী যেন দেখল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রেডি। আপাতত কোনো সমস্যা নেই। শুধু প্লে বাটনটা চাপ দিয়ো। স্ক্রীনে আপনাআপনি চলে আসবে ভিডিও। …আমি কিচেনে থাকবো। তোমার কোনো সাহায্য লাগলে ডাক দিয়ো।
ধন্যবাদ।
ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে গেল বব। যাওয়ার আগে টেনে দিয়ে গেল দরজাটা।
প্লে বাটনে চাপ দিলাম আমি।
ঝিরঝিরে ছবি দেখা যাচ্ছে স্ক্রীনে। অন্ধকার। নিচে, ডানদিকে দেখা যাচ্ছে একটা তারিখ।
তারিখটা লিও মারা যাওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগের।
কাঁপছে স্ক্রীনের ছবি। মনে হচ্ছে, যার হাতে আছে ক্যামেরাটা, সে হাঁটছে। কাঁপুনি বেড়ে গেল আরও। ক্যামেরা যার হাতে আছে, সে মনে হয়। দৌড়াচ্ছে। কী ভিডিও করা হচ্ছে, কোথায় করা হচ্ছে সেটা-কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ অন্ধকার কাটেনি। কিছু একটা শুনতে পেলাম বলে মনে হলো, কিন্তু বুঝতে পারলাম না।
ভলিউম নবটা খুঁজে নিয়ে সাউন্ড বাড়িয়ে দিলাম।
কাঁপুনি কমেছে, কিন্তু স্ক্রীন এখনও অন্ধকার। ব্রাইটনেস বাড়িয়ে দিলাম, তাতে তেমন কোনো লাভ হলো না। বাধ্য হয়ে নিভিয়ে দিলাম। ওয়ার্কশপের লাইট! ভূতুড়ে হয়ে গেল গ্যারেজের ভিতরের পরিবেশ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ক্যামেরার স্ক্রীনের দিকে।
একটা কণ্ঠ শোনা গেল: সব ঠিক আছে, হ্যাঙ্ক?
মনে হলো, হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে আমার।
লিও কথা বলছে।
হ্যাঙ্ক বলল, হ্যাঁ।
অন্য একটা কণ্ঠ শোনা গেল: ক্যামেরা উপরে তাক করো, হ্যাঙ্ক। আকাশের দিকে।
মোরা!
আমার মনে হচ্ছে, বন্ধ-হয়ে-যাওয়া হৃৎপিণ্ডটা যেন বিস্ফোরিত হয়েছে বুকের ভিতরে।
নিজেকে সামলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলাম ওয়ার্কবেঞ্চের একটা কোনা।
আস্তে আস্তে উপরের দিকে তাক করা হচ্ছে ক্যামেরা। দূরে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। এবার মনে হয় চিনতে পারছি জায়গাটা।
রহস্যময় ওই সামরিক ঘাঁটি।
লিও বলল, আওয়াজটা এখনও শুনতে পাচ্ছ তোমরা?
আমি পাচ্ছি। যদিও অনেক আস্তে শোনা যাচ্ছে।
রেক্স!
লিও বলল, ঠিক আছে। চুপচাপ থাকি আমরা সবাই। দেখি কী ঘটে।
দেখো, দেখো! বলল মোরা। ঠিক গত সপ্তাহের মতো!
মাই গড! বলল লিও। তুমি ঠিকই বলেছিলে, মোরা।
অন্য একটা মেয়ে-কণ্ঠ শোনা গেল, কিন্তু কী বলল সে, বোঝা গেল না। ডায়ানা?
নাকি বেথ?
সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। ঠিক করলাম, আবার দেখবো এই ভিডিও। নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করবো আর কে বা কারা ছিল লিও-হ্যাঙ্ক-মোরা রেক্সের সঙ্গে।
বাজপাখির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ক্যামেরার স্ক্রীনের দিকে। কী দেখে এত আশ্চর্য হয়েছে কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যরা, বুঝবার চেষ্টা করছি।
একটা হেলিকপ্টার।
অন্ধকার আকাশের পটভূমিতে দেখে মনে হচ্ছে, উড়ছে না ওটা, ভাসছে যেন।
ঢোক গেলার মতো আওয়াজ পাওয়া গেল।
নিজের অজান্তে ঢোক গিলোম আমিও।
হেলিকপ্টার?
রোটরের আওয়াজ শোনার উদ্দেশ্যে ভলিউম আরও বাড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাজ হলো না-ফুল ভলিউম দিয়ে ফেলেছি ইতোমধ্যে।
সিকরসকি ব্ল্যাক হক, যেন আমার মনের কথাটা বলে দিল হ্যাঙ্ক। স্টিলথ হেলিকপ্টার। আওয়াজ বলতে গেলে করেই না।
বিশ্বাস করতে পারছি না,বলল কে যেন।
খুব সম্ভব বেথ।
ক্যামেরার স্ক্রীনটা, স্বাভাবিকভাবেই, ছোট। ওয়ার্কশপের লাইট নেভানো, তারপরও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কী ঘটছে স্ক্রীনে। তবে ঘটনাটা অনুমান করে নিতে কষ্ট হচ্ছে না আমার।
রহস্যময় ওই সামরিক ঘাঁটির উপর চক্কর দিচ্ছে একটা সিককি ব্ল্যাক হক স্টিলথ হেলিকপ্টার।
আস্তে আস্তে নামছে হেলিকপ্টারটা।
মোরা ফিসফিস করে বলল, চলো কাছে যাই।
আরও কাছে গেলে ওরা দেখে ফেলবে আমাদেরকে,বলল রেক্স।
তো কী হয়েছে? মোরা বেপরোয়া।
আমি জানি না…কথা শেষ না করে থেমে গেল বেথ।
হ্যাঙ্ক, তুমি এসো তো আমার সঙ্গে, কৌতূহল অধৈর্য করে তুলেছে মোরাকে।
আবারও কাঁপতে শুরু করেছে ছবি। তারমানে হাঁটা ধরেছে হ্যাঙ্ক। অনুমান করে নিলাম, ওই ঘাঁটির আরও কাছে যাচ্ছে সে।
হঠাৎ হোঁচট খেল হ্যাঙ্ক। ঘাটির বদলে এখন মাটি দেখা যাচ্ছে…অর্থাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে হ্যাঙ্ক। ওকে সাহায্য করার জন্য একটা হাত এগিয়ে এল,..আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গেল আবার।
সেই জ্যাকেট।
আমার সেই ভার্সিটি জ্যাকেট।
ওটার সাদা রঙের হাতার কথা কখনও ভুলবো না আমি।
ভারসাম্য ফিরে পেয়েছে হ্যাঙ্ক, ক্যামেরা সামলানোর চেষ্টা করছে।
মোরার চেহারাটা দেখা গেল।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল আমার সারা শরীর।
মোরার সারা চেহারায় যেন লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে ওর কালো চুল। উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে ওর চোখ। সেই হাসি…সেই পাগলকরা হাসি…ঝুলে আছে ওর ঠোঁটের এককোনায়। কেমন বুনো আর অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে ওকে।
মোরা… নিজের অজান্তেই বলে বসলাম আমি অস্ফুট কণ্ঠে।
শশশ…চুপ! ক্যামেরার স্পিকারে শোনা গেল লিও’র গলা।
হেলিকপ্টারটা ল্যান্ড করেছে। বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না, তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, রোটর ঘুরছে এখনও। রোটরের আওয়াজ পাচ্ছি না একটুও। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। এখন কী দেখতে পাচ্ছি স্ক্রীনে, তা-ও ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, হেলিকপ্টারের দরজা খুলে গেছে। উজ্জ্বল একটা কমলা আলো দেখা যাচ্ছে। কেউ কি নামছে হেলিকপ্টার থেকে?
সম্ভবত।
আসলে কী দেখলাম আমি? উজ্জ্বল কমলা আলো? নাকি উজ্জ্বল কমলা রঙের কোনো পোশাক?
উজ্জ্বল কমলা পোশাক…ও-রকম তো কয়েদিরা পরে, ঠিক না? বলা ভালো, ও-রকম পোশাক একসময় পরানো হতো আমেরিকার কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যের কয়েদিদের।
কিন্তু…একজন কয়েদি কী করছে একটা সামরিক ঘাঁটিতে?
মাটিতে পড়ে-থাকা আলগা ডালপালার উপর পা পড়ল কার যেন। স্পষ্ট শুনতে পেলাম সে-আওয়াজ।
চট করে নড়ে উঠল হ্যাঙ্ক।
ক্যামেরা ঘুরে গেছে ডানদিকে।
চলো পালাই! চিৎকার করে উঠল রেক্স।
আবার কালো হয়ে গেছে পুরো ক্রীন।
ফাস্ট ফরওয়ার্ড বাটনে চাপ দিলাম আমি। কিন্তু আর কোনো দৃশ্য দেখা গেল না। অর্থাৎ এই ভিডিওটেপে আর কিছু নেই।
এবার রিওয়াইন্ড বাটন চেপে ফিরে এলাম হেলিকপ্টারের দৃশ্যে।
আরও দুবার দেখলাম ভিডিওটা। লিও’র কণ্ঠ আর মোরার চেহারার কারণে কাজটা সহজ হলো না আমার জন্য।
চতুর্থবার যখন দেখছি ভিডিওটা, হঠাৎ একটা কথা মনে হলো আমার।
সে-রাতে কোথায় ছিলাম আমি?
কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্য ছিলাম না আমি। তখন ওই ক্লাব নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও ছিল না আমার। চোরাগোপ্তা কোনো কাজ কখনোই আকর্ষণ করেনি আমাকে, আজও করে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, লিও আর ওর ক্লাবের সদস্যরা স্টিলথ হেলিকপ্টারের মতো অভাবনীয় একটা খবর কীভাবে চেপে রাখল আমার কাছে?
লিও তো ওর সব কথাই বলত আমাকে।
তা হলে?
স্মৃতি হাতড়াচ্ছি। কোথায় ছিলাম আমি সে-রাতে?
লিও মারা গিয়েছিল শুক্রবার রাতে। তারমানে, যেহেতু এই ভিডিও এক সপ্তাহ আগের, সেহেতু কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যরা ওই ঘাঁটির কাছে গিয়েছিল আগের শুক্রবার রাতে। আজ থেকে পনেরো বছর আগে আমাদের ওয়েস্টব্রিজ শহরে শুক্রবারের রাত ছিল হকি-নাইট।
সে-রাতে কাদের বিরুদ্ধে হকি খেলতে গিয়েছিলাম আমি?
মনে পড়ছে না।
আমরা কি খেলায় জিতেছিলাম?
মনে পড়ছে না সেটাও।
খেলা শেষে বাসায় ফিরে কি দেখা হয়েছিল লিও’র সঙ্গে?
নাহ্, কিছুই মনে করতে পারছি না।
চোখের সামনে ভাসছে মোরার চেহারাটা। দেখতে পাচ্ছি ওর সেই পাগল-করা হাসি। তীব্র কৌতূহলে জ্বলজ্বল করছে ওর চোখ।
মনে পড়ে গেল চিলেকুঠুরিতে পাওয়া সেই ফটোগ্রাফের কথা। মনে পড়ে গেল, উদ্বিগ্ন আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল লিওকে। কিন্তু সে-সময় আমি ছিলাম প্রেম আর হকি নিয়ে মশগুল। স্বার্থপর এই আমি সে-সময় ভাইয়ের দিকে তাকানোর মতোও সময় পাইনি। ফলে অকালে মারা পড়ল আমার ভাই।
ইলেকট্রিকের লাইন থেকে প্লাগ খুললাম ক্যামেরার। আমি নিশ্চিত, যদি এই জিনিস আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই, বব মানা করবে না। এমনকী কিছু মনে করবে না।
ভিডিওর ব্যাপারটা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে আমাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, গত পনেরোটা বছর ধরে এই ভিডিও লুকিয়ে রাখল কেন হ্যাঙ্ক?
উত্তরটা তেমন কঠিন নাঃ কিছু একটা আছে এই ভিডিওতে…বিশেষ কিছু একটা। এবং হ্যাঙ্ক চায়নি, সেটা জানাজানি হোক।
অথবা…হতে পারে, আসলে কিছুই নেই এই ভিডিওতে। একটা সামরিক ঘাঁটিতে নামতেই পারে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কোনো হেলিকপ্টার। সেটার দরজা খোলামাত্র উজ্জ্বল কমলা রঙ অথবা উজ্জ্বল কমলা রঙের পোশাক পরিহিত কাউকে দেখা যেতেই পারে। যেহেতু হ্যাঙ্ক…কী বলব…অন্যরকম ছিল, সেহেতু সে হয়তো ভেবেছিল, অভাবনীয় কিছু একটা ভিডিও করে ফেলেছে। মূল্যহীন একটা ভিডিও অমূল্য আর খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ওর কাছে। তাই ভিডিওটা লুকিয়ে রেখেছিল। পরে রাখতে দিয়েছিল ডেভিডকে।
রাস্তার পাগল অনেক সময় রাস্তা থেকে ইট কুড়িয়ে নিয়ে ভাবে, সোনার টুকরো পেয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হ্যাঙ্কের বেলাতেও কি সে-রকম কিছু ঘটেছে?
জানি না। কিন্তু এটা জানি…মানে বুঝতে পারছি, এই ভিডিও এখন আমার একমাত্র সূত্র। রহস্য সমাধানের পথে যদি আগে বাড়তে চাই, এই ভিডিও নিয়ে কাজ করতে হবে আমাকে।
তা হলে এখন কী করবো আমি?
যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে যাবো ভিডিওটা? মিউস বা ম্যানিংকে জানাবো? নাকি ফোন করবো অগিকে?
না, আগে অন্য একটা কাজ করব আমি।
কপি বানাবো এই ভিডিওর। অরিজিনালটা নিরাপদে রাখতে হবে আমাকে।
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, তাই আত্মচিন্তা পেয়ে বসল আমাকে।
পুরনো একটা সামরিক ঘাঁটি। সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল ওটা দীর্ঘদিন, এমনকী ওই এলাকা থেকে সেনাবাহিনি চলে যাওয়ার পরও। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল তথাকথিত অক্ষতিকর কৃষি-গবেষণাকেন্দ্র, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আসলে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিল অন্য কিছু একটা। হয়তো ঠিকমতোই চলছিল সব। তারপর একদিন ওয়েস্টব্রিজ হাইস্কুলের একদল রোমাঞ্চপ্রিয় শিক্ষার্থী গড়ে তুলল একটা ক্লাব। একরাতে ওরা হানা দিল ওই ঘাঁটিতে। দেখে ফেলল বিশেষ কিছু একটা। ওদেরকেও দেখে ফেলল ওই ঘাঁটির লোজন।
তারপর?
চিরতরে চুপ করিয়ে দেয়া হলো লিও আর ডায়ানাকে?
কেন?
একটা কৃষি-গবেষণাকেন্দ্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটা হেলিকপ্টার ল্যান্ড করছে, আর সে-দৃশ্য গোপনে ধারণ করা হচ্ছে ভিডিওক্যামেরায় এটা কি কোনো অপরাধ? যদি অপরাধ হয়েও থাকে, সেটার শাস্তি কি মৃত্যুদণ্ড? তা-ও আবার বিনা-বিচারে?
মিলছে কি?
মনে পড়ে গেল, ডায়ানার কণ্ঠ শুনতে পাইনি আমি ভিডিওটেপে। অন্তত …ডায়ানার কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি কি না, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না। কিন্তু এই ব্যাপারে আমি এক শ ভাগ নিশ্চিত, একই জায়গায় একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে লিও আর ডায়ানার।
আমাকে সবচেয়ে বেশি খোঁচাচ্ছে যে-প্রশ্নটা তা হলো: গোপন ওই ঘটির লোকগুলো যদি লিও আর ডায়ানাকে আসলেই হত্যা করে থাকে, কন্সপাইরেসি ক্লাবের বাকি সদস্যদের ছেড়ে দিল কেন? এবং যদি ছেড়েই দেবে, পনেরো বছর পর খুঁজে খুঁজে বের করে খুন করতে শুরু করল কেন?
সম্ভাব্য উত্তর: কন্সপাইরেসি ক্লাবের সঙ্গে রেক্স, হ্যাঙ্ক আর বেথের সংশ্লিষ্টতার খবর জানত না ওই লোকগুলো পনেরো-বছর-আগে।
ওই লোকগুলো কারা?
আগে এই প্রশ্নের জবাব জানতে হবে আমাকে।
ধরে নিলাম, ওই লোকগুলো প্রাথমিকভাবে শুধু লিও আর ডায়ানার ব্যাপারে জানতে পেরেছিল। হয়তো জানতে পেরেছিল মোরার ব্যাপারেও। যদি তা-ই হয়, তা হলে মোরার হঠাৎ পলায়ন এবং আত্মগোপনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ভিডিওটেপ দেখে বুঝতে পেরেছি, ক্লাবের নেতৃত্ব ছিল লিও আর মোরার কাঁধে। ওই দুজন একটু বেশিই বেপরোয়া ছিল; হয়তো…ওরা এমন কিছু একটা করেছিল যা করার সাহস পায়নি অন্যরা। অথবা, ওরা হয়তো কাজটা বাকিদেরকে না জানিয়ে করেছে। এবং ধরা পড়েছে। মোরা পালাতে সক্ষম হয়েছে, আর লিও…
কিন্তু ডায়ানা? ওকে মরতে হলো কেন? সে কি নিছক পরিস্থিতির শিকার?
রেক্স, হ্যাঙ্ক আর বেথ বেঁচে ছিল…বেথ হয়তো বেঁচে আছে এখনও। ওরা কেউ মোরার মতো লুকায়নি। তা হলে কি ওই তিনজন পনেরো বছর পর নতুন করে কেঁচো খুঁড়তে গিয়েছিল? পুরনো ওই ঘাঁটির সাপটা তাই ছোবল দিছে ওদেরকে একে-একে?
আমাকে জানতে হবে, আজ থেকে পনেরো বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল ওয়েস্টব্রিজে। জানতে হবে, সেই ঘটনার পনেরো বছর পর কী হয়েছে আবার।
আপাতত ওই ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই আমার। এবং আন্দাজে ঢিলও ছুঁড়তে চাইছি না আমি।
তবে অগির-বলা একটা কথা ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে। যে-মানুষটা আমার কাছে সাধারণ কেউ একজন ছিলেন, তাঁকে সন্দেহভাজন বানিয়ে দিয়েছে কথাটা। তার ব্যাপারে খোঁজখবর করার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে।
আজ থেকে পনেরো বছর আগে ওয়েস্টব্রিজে ফিরে এসেছিলেন টম স্ট্রাউড।
পুরনো ওই ঘাঁটি, কন্সপাইরেসি ক্লাব আর টম স্ট্রাউডের মধ্যে কি পারস্পরিক কোনো সম্পর্ক আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে অন্য একটা কাজ করতে হবে আমাকে।
মুখোমুখি হতে হবে এলির।
ওর মাধ্যমে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন মোরার মা-~~ঘটনাটা কাকতালীয় হতে পারে না। এলি কিছু-না-কিছু জানে। ওর সঙ্গে জোরাজুরি করতে চাই না আমি, আবার আমার যা মনে হচ্ছে, তা-ও বাতিল করে দিতে পারছি না।
লম্বা করে দম নিলাম, খুললাম ওয়ার্কশপের দরজাটা।
প্রথমেই শুনতে পেলাম লিয়া আর কেলসির আওয়াজ-হাসাহাসি করছে ওরা। গিয়ে ঢুকলাম কিচেনে। এলি নেই। তবে বব আছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
এলি একটা কাজে একটু বাইরে গেল এইমাত্র। তোমাকে অবশ্যই খেয়ে যেতে বলেছে। ইঙ্গিতে কিচেন-টেবিলটা দেখাল বব। ওই দেখো, তোমার জন্য একটা প্লেটও রেখে গেছে সে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। নিজের গাড়ির দরজা খুলছে এলি।
ক্ষমাপ্রার্থনা করলাম ববের কাছে, কিচেনের দরজা খুলে দৌড় দিলাম। একছুটে হাজির হলাম এলির কাছে।
ততক্ষণে গাড়ির দরজা খুলে ফেলেছিল সে, উঠতে যাচ্ছিল গাড়িতে। আমাকে ওর দিকে ছুটে যেতে দেখে থমকে গেল।
ওর কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জানতে চাইলাম, মোরা কোথায় আছে, জানো?
কাঠের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল এলি। না।
ওর চোখে চোখ রাখলাম আমি। আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য তোমাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন মোরার মা।
হ্যাঁ, করেছেন।
কেন?
কারণটা যা-ই হোক, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, কাউকে কিছু বলবো না।
কার কাছে করেছ প্রতিজ্ঞাটা?
মোরার কাছে।
এবার স্থির হয়ে যাওয়ার পালা আমার। মনে হচ্ছে, বক্সিং খেলছিলাম, প্রতিপক্ষ হঠাৎ একটা নকআউট পাঞ্চ হেঁকেছে আমার নাকেমুখে।
তুমি…মোরার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছ?
কিছু একটা বলতে চাইল এলি, কিন্তু পারল না–বেজে উঠেছে আমার মোবাইল ফোন।
পকেট থেকে বের করলাম ওটা।
অগি ফোন করেছেন।
কল রিসিভ করলাম না। মেজাজ বিগড়ে গেছে।
স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এলির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা মুহূর্তের মধ্যে অন্যরকম হয়ে গেছে। ওর একটামাত্র স্বীকারোক্তি মুহূর্তের মধ্যে যেন অচেনা একজন মানুষে পরিণত করেছে ওকে আমার কাছে।
আমাকে যেতে হবে, ন্যাপ। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে জরুরি একটা ফোন এসেছিল।
তারমানে, আমি যেন শুনতে পাইনি কী বলেছে এলি, এতগুলো বছর আমার কাছে মিথ্যা বলেছ তুমি!
না।
না? মোরার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে তোমার, অথচ তুমি বলেছিলে…
সে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল।
একটা মানুষের জীবনের চেয়ে কি প্রতিজ্ঞা বড়? কোনো একজনের অপেক্ষায়…কতগুলো ঘাতক প্রশ্নের জবাব পাওয়ার অপেক্ষায় আমার জীবন থেকে একে-একে হারিয়ে গেল পনেরোটা বছর; আমার জীবনের চেয়ে তোমার প্রতিজ্ঞা বড়?
জবাব দিল না এলি। তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
তোমাকে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে জানতাম আমি, এলি।
আমি এখনও তোমার বন্ধু। কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে আরেকজনের বিশ্বাস নিশ্চয়ই ভাঙতে পারি না?
আবারও বাজছে আমার মোবাইল ফোন। পাত্তা দিলাম না।
এত বড় একটা কথা আমার কাছ থেকে এতদিন লুকিয়ে রাখতে পারলে কীভাবে, এলি?
আমরা সবাই কিছু-না-কিছু কথা কারও-না-কারও কাছ থেকে সবসময় লুকিয়ে রাখি।
মানে?
তুমিও কি আমার কাছ থেকে অনেককিছু গোপন করোনি?
যেমন?
যেমন…ট্রের ব্যাপারটা?
জবাব দিলাম না।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এলি।
আমি মিথ্যা কথা বলিনি তোমাকে, বললাম আমি।
কিন্তু সত্যি কথাটাও বলেনি।
মন্তব্য করলাম না।
তুমি কি আমাকে বোকা মনে করো, ন্যাপ? তুমি না বললে আমি কি বুঝবো না, কে হাসপাতালে পাঠিয়েছে ট্রেকে?
কোথায় ট্রে, আর কোথায় মোরা! তুমি কীসের সঙ্গে কী তুলনা করছ, এলি?
তুমি তা হলে বুঝতে পারোনি। যেসব মেয়ের উপর অত্যাচার চালানো হয়েছে অথবা হচ্ছে, তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান খুলেছি আমি। যারা অত্যাচার চালিয়েছে অথবা চালাচ্ছে, তাদেরকে পিটুনি দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো আমার প্রতিষ্ঠানের কাজ না। এবং আমি চাইও না সে-রকম কিছু ঘটুক। অথচ সে-রকম একটা কাজ করেছ তুমি, এবং পুরো ঘটনাটা গোপন করেছ আমার কাছে।
কী বলতে চাইছ?
বলতে চাইছি, তুমি একটা অন্যায় করেছ এবং সেটা গোপন করেছ আমার কাছে। আর আমি যা গোপন করেছি তোমার কাছে, সেটা যদি বলে দিতাম, তা হলে অন্যায় হতো।
আবারও বাজছে আমার মোবাইল ফোন।
কল রিসিভ করে কানে ঠেকিয়েছি ফোনটা, সুযোগ পেয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল এলি। বাধা দিতে যাচ্ছিলাম ওকে, কিন্তু চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম, ওদের বাসার সদর-দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বব, তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
কী হয়েছে? চিৎকার করে উঠলাম আমি, আমার রাগ গিয়ে পড়েছে অগির উপর।
শেষপর্যন্ত খুঁজে পেয়েছি অ্যান্ডি রিভসকে, বললেন অগি।
আমার আকস্মিক দাবানল যেন মুহূর্তের মধ্যে স্তিমিত হয়ে গেল।
অ্যান্ডি রিভস। পরিত্যক্ত একটা সামরিক ঘাঁটিতে গড়ে তোলা রহস্যময় এক কৃষি-গবেষণাকেন্দ্রের সাবেক কমান্ডার।
আর? জানতে চাইলাম আমি।
রাস্টি নেইল ট্যাভার্ন।
মানে?
একটা বারের নাম। চেনো?
চিনি। হ্যাকেনস্যাকে অবস্থিত। কেন?
ঘণ্টাখানেক পর সেখানে থাকবে অ্যান্ডি রিভস। ইচ্ছা হলে দেখা করতে পারো ওর সঙ্গে।
.