ডোন্ট লেট গো – হারল্যান কোবেন
রূপান্তর : সায়েম সোলায়মান
উৎসর্গ :
যারা ধূমপান, মদ্যপান এবং যে-কোনো রকমের নেশাজাতীয় উপাদান থেকে সরে এসে সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপন করছেন, এবং যারা ওসব প্রাণঘাতী জিনিস থেকে দূরে আছেন, তাঁদের সবার প্রতি।
.
কালো আঁটসাট কাপড় পরেছে ডেইজি, শুটার গলা বেশ গভীর। কাউকে দর্শনশাস্ত্র শেখাতে হলে ও-রকম কাপড় যথেষ্ট, আলাদাভাবে শিক্ষকের দরকার হয় না।
বারের শেষপ্রান্তে বসে-থাকা লোকটাকে খেয়াল করল সে। স্ট্রাইপের ধূসর স্যুট পরে আছে লোকটা। তার বয়স অনেকডেইজির বাবা হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে। তারমানে ওই লোকের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করাটা সহজ হবে না। আবার হতেও পারে। বয়স্ক পুরুষমানুষদের, বিশেষ করে সম্প্রতি যাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে অথবা যাদের বিবাহবিচ্ছেদ হতে চলেছে, তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। বউয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে এ-রকম অনেক লোক পরিপাটি হয়ে ওঠে হঠাৎ করেই, প্রমাণ করার চেষ্টা করে তাদের শারীরিক সামর্থ্য ফুরোয়নি এখনও
অলস পায়ে হাঁটছে ডেইজি। টের পাচ্ছে, ওর উক্ত স্তনভাজে আর দুই পায়ে যেন কেঁচোর মতো কিলবিল করছে বারের পুরুষ-খদ্দেরদের দৃষ্টি। বারে শেষপ্রান্তে গিয়ে, বয়স্ক ওই লোকের পাশে একটা টুলে বসে পড়ল সে।
একজন জিপসি তার স্কটিক-বলের দিকে যেভাবে তাকায়, নিজের সামনে-রাখা হুইস্কির গ্লাসে সেভাবে উঁকি দিল লোকটা। অপেক্ষা করছে ডেইজি-হয়তো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে লোকটা। কিন্তু তাকাল না সে। লোকটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ডেইজি।
মানুষটার গালে ধূসর দাড়িগোঁফের জঙ্গল। কাকার নাকটা দেখলে মনে পড়ে যায় হলিউডি স্পেশাল ইফেরে কথা। লম্বা চুলগুলো উসুখুসু, জটা পড়ে গেছে কোথাও কোথাও।
ডেইজি জানে, লোকটার নাম ডেইল মিলার। হুইস্কির গ্লাসটা ধীরেসুস্থে তুলে নিল লোকটা, দুই হাত দিয়ে ধরল। ভাবখানা এমন, হুইস্কির গ্লাস না, আহত কোনো পাখি ধরেছে।
হ্যালো, মাথা ঝাঁকি মেরে চুল সরাল ডেইজি, এটা ওর মুদ্রাদোষ, অথবা বারংবার চর্চার ফল।
ঘাড় ঘুরাল মিলার, তাকিয়ে আছে মেয়েটার চোখের দিকে। অপেক্ষা করছে ডেইজি-ওর গলা বেয়ে লো-কাট জামার বুকে নামবে মিলারের দৃষ্টি, আর দশজন যা দেখে তা দেখবে। পুরুষদের একতরফাভাবে দোষ দিয়ে লাভ নেই, অনেক মহিলাও একই কাজ করে। কিন্তু ডেইজির স্তনভাজের দিকে তাকাল না মিলার, বরং এখনও তাকিয়ে আছে চোখে-চোখে।
হ্যালো, বলল লোকটা, আবার মনোযোগ দিল হুইস্কির গ্লাসে।
একটু থতমত খেয়ে গেল ডেইজি। এ-রকম সাধারণত হয় না। যেসব পুরুষকে বেছে নেয় মেয়েটা, ওর সঙ্গে পরিচয়ের শুরুতেই হ্যাংলামি করে তারা। যেমন, ডেইজি যদি বলে, হ্যালো, যদি একটু হাসে, ওর সঙ্গের লোকটা তৎক্ষণাৎ একটা ড্রিঙ্ক কিনে দিতে চায় ওকে। কিন্তু মিলার লোকটা বোধহয় ফষ্টিনষ্টির মুডে নেই। হুইস্কির গ্লাসে বড় করে একটা চুমুক দিল সে।
ভালো। লোকটা যত মদ খাবে, তত মাতাল হবে। ডেইজির কাজ সহজ হবে।
আমি কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি? ডেইজিকে জিজ্ঞেস করল মিলার।
হোঁৎকা, জবাব দেয়ার আগে ভাবল ডেইজি, কণ্ঠটাও খসখসে। তারপরও সেক্সি।
যেসব পুরুষের সঙ্গে থাকলে নিজেকে নিরাপদ বোধ করে ডেইজি, তাদেরকে পছন্দ করে সে।
তোমার সঙ্গে এখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলে কিছু মনে করবে? বলল ডেইজি, একটুখানি ঝুঁকল সামনের দিকে, আরেকটু উন্মুক্ত করার চেষ্টা করল ওর স্তনভাজ। একটা লোক…
বিরক্ত করছে তোমাকে? এমনভাবে বলল মিলার, শুনে মনে হলো সে যেন রক্ষা করতে চায় ডেইজিকে।
না…না।
এদিকওদিক তাকাচ্ছে মিলার। কোন লোকের কথা বলছ?
নিজের একটা হাত মিলারের হাতের উপর রাখল ডেইজি। উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। আমি শুধু তোমার পাশে একটু বসতে চাই। এখানে নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে আমার।
আবারও ডেইজির চোখের দিকে তাকাল মিলার। অবশ্যই। …একটা ড্রিঙ্ক কিনে দেবো তোমাকে?
ঠিক এটাই চাইছিল এতক্ষণ ডেইজি।
মিশুক প্রকৃতির মেয়ে ডেইজি। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে সে, প্রাণ খুলে কথা বলতে পারে। সে খেয়াল করে দেখেছে, বিবাহিত-অবিবাহিত ডিভোর্সড-পুরুষলোক যেমনই হোক না কেন, ওর সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করে। পুরুষলোক যেমনই হোক না কেন, ডেইজির মতো একটা মেয়ের সঙ্গ পেতে ভালোবাসে।
তবে মিলারের বেলায় একটু সময় লেগে গেল, এই যা।
শুরু হয়ে গেল ওদের কথাবার্তা। মদ গিলছে আর বকবক করছে মিলার। ডেইজির গণনায় যদি ভুল না হয়, পর পর চার গ্লাস হুইস্কি খেল লোকটা।
একহাতে যেমন তালি বাজে না, শুধু একজনকে দিয়ে তেমন আলাপ জমে না। তাই মুখ খুলল ডেইজিও। নিজের জীবনের গল্প শোনাল মিলারকে। বলাবাহুল্য, গল্পটা বানোয়াট। ওই গল্প আগেও অনেককে শুনিয়েছে মেয়েটা নিজের প্রতি তাদের সহমর্মিতা জাগানোর চেষ্টা করেছে।
নিজের জীবনের সত্যি গল্পটা কখনও কাউকে বলে না ডেইজি। ওর সেই গল্প জানে রেক্স, তবে সবটা না।
মিলার হুইস্কি খাচ্ছে। আর ডেইজি খাচ্ছে ভদকা। খাচ্ছে মানে গ্লাস ভর্তি করছে, তারপর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার বাহানায় বাথরুমে যাচ্ছে গ্লাসসহ, সিঙ্কে উপুড় করে দিচ্ছে গ্লাসটা, ফিরে আসছে গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে। দুবার করল সে ওই কাজ।
রেক্সের পক্ষ থেকে মেসেজটা যখন এল ডেইজির মোবাইলে, কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠল সেঃ
R?
মানে, রেডি?
সব ঠিক আছে তো? ডেইজিকে জিজ্ঞেস করল মিলার।
অবশ্যই। আমার এক বন্ধু একটা মেসেজ পাঠিয়েছে।
ফিরতি মেসেজ পাঠিয়ে দিল ডেইজিঃ
Y
অর্থাৎ, ইয়েস।
মিলারের দিকে তাকাল ডেইজি। এ-রকম পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গের পুরুষলোকটাকে নিরালা কোনো জায়গায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয় সে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় লোকটা। কিন্তু মিলারের ক্ষেত্রে নিয়মটা খাটবে কি না, বুঝতে পারছে না ডেইজি। নিজের উপর ওই লোকের আকর্ষণ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে সে, তারপরও…কেন যেন মনে হচ্ছে…কিছু একটা বাকি রয়ে গেছে এখনও।
আমি কি কিছু চাইতে পারি তোমার কাছে বলল ডেইজি।
একটুখানি হাসল মিলার। পরিচয় হওয়ার পর থেকেই কিছু-না-কিছু চাইছ তুমি।
পাল্টা হাসল জেইজিও। তোমার গাড়ি আছে
আছে। কেন?
জবাব দেয়ার আগে বাকের এদিকে সেদিকে তাকিয়ে নিল ডেইজি। আমাকে কি…মানে বাসায় দিয়ে আসতে পারবে? আমার বাসা এখান থেকে বেশি দূরে না।
কোনো সমস্যা নেই। তবে…বুঝতেই পারছ, অনেক মদ খেয়েছি… ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগবে আমার।
লাফিয়ে টুল থেকে নামল ডেইজি, জামার নিচে আন্দোলিত হলো ওর স্তন দুটো। তা হলে খাক, আমি বরং হেঁটেই ফিরবো।
পিঠ সোজা হয়ে গেল মিলারের। দাঁড়াও…কেন?
বাসায় ফিরুতে হবে আমাকে। কিন্তু তুমি যদি ড্রাইভ করতে না পারো…
কে বলেছে আমি ডাইত করতে পারবো না। উঠে দাঁড়াল মিলার। চলো, এখনই বাসায় দিয়ে আসছি তোমাকে?
কোনো সমস্যা থাকলে না হয়..
কোনো সমস্যা নেই, ডেইজি।
কেল্লাফতে!
ডেইজিকে নাম ধরে ডেকেছে মিলার,..তারমানে…
দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা দুজন, এমন সময় রেক্সকে আবার মেসেজ পাঠাল ডেইজিঃ
OOW
অন আওয়ার ওয়ে…রওনা হয়ে গেছি।
অনেকেই হয়তো বলবে, ডেইজি যা কছে এবং করতে যাচ্ছে, তা নির্জলা প্রতারণা। কিন্তু বেক্সের মতে, এই টাকা হালাল। অবশ্য এসব করতে ডেইজির যে খুব খারাপ লাগে, তা-ও না।
বুদ্ধিটা রেক্সের।
এ-রকম অনেক মহিলা আছে, যারা সংসার যাতনায় অতিষ্ঠ, যারা বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে মুক্তি চায় অত্যাচারী-অসহ্য স্বামীর কবল থেকে। কিন্তু নিরেট আভিযোগের অভাবে মামলা ঠুকতে পারছে না আদালতে তাদের জন্য মুক্তির দরজা খুলে দিয়েছে রেক্স আর ডেইজি।
ডেইজির কাজটা তেমন কঠিন কিছু না। উত্তেজক পোশাক পরে সাধারণত বারে হাজির হয় সে, গ্লাসের পর গ্লাস মদ খেতে বাধ্য করে টার্গেটকে, মাতাল বানিয়ে দেয় তাকে। তারপর লোকটাকে বলে, ওর বাসা বেশি দূরে না; লিফট দেয়ার অনুরোধ জানায়। বেশিরভাগ টার্গেট এই অনুরোধ ফেলতে পারে না, পানোন্মত্ত অবস্থায় স্টিয়ারিং ধরে গারি।
তখন খেল শুরু হয় রেজের। সে একজন পুলিশ অফিসার। ডেইজিকে নিয়ে যে জায়গা থেকে রওনা দেয় টার্গেট, তার দুই ব্লক দূরে কোয়াড কার নিয়ে অপেক্ষায় থাকে সে। মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে অ্যারেস্ট করে টার্গেটকে, পরে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পৌঁছিয়ে দেয় ওই লোকের স্ত্রীর কাছে। ব্যস, বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় ক্ষতিপূরুন আদায়সহ জেতার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট।
এদিকে,বারের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় হোঁচট খেল মিলার, এদিকে পার্ক করেছি আমার গাড়ি।
আলগা নুড়িপাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা পার্কিংলটে। বার কয়েক লাথি মেরে কিছু পাথর সরিয়ে দিল মিলার। ডেইজিকে নিয়ে হাজির হলো একটা ধূসর টয়োটা করোলার সামনে। কী-ফবে চাপ দিল মিলার, বুনোহাঁসের ডাকের মতো চাপা-আওয়াজ শোনা গেল দুবার। প্যাসেঞ্জার ডোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মিলার-ওটা খুলে দেবে ডেইজির জন্য।
কিছুটা হলেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। অন্য টার্গেটদের ভাবভঙ্গিতে যেমন লুচ্চামি থাকে, মিলারের আচার-আচরণে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। সাহায্য করার চেষ্টা করছে সে ডেইজিকে, এবং সেটা আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে। একজন খাঁটি ভদ্রলোকের মতো খুলছে প্যাসের ভোর। অনেকদিন কোনো খাঁটি ভদ্রলোকের দেখা পায়নি ডেইজি।
দরজাটা খুলে ধরল মিলার, অনেকটা পিছলে গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল ডেইজি। মেয়েটা ঠিকমতো বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল মিলার, দেখে নিল মেয়েটার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তারপর লাগিয়ে দিল দরজাটা।
তীক্ষ একটা অপরাধবোধ পেয়ে বসল ডেইজিকে।
ওকে অনেকবার বলেছে রেক্স, আইনবিরুদ্ধ বা অনৈতিক কিছু করছে না ওরা। মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো নিষেধ–সবাই জানে। কেউ যদি মেয়েমানুষের লোভে পড়ে কাজটা কর, তা হলে সে-দোষ সম্পূর্ণ তার।
তা ছাড়া, ডেইজিকে বলেছিল রে, তুমি তো আর ওই লোকের মাথায় পিস্তল ধরে তাকে গাড়ি চালাতে বাধ্য করছ না। যৌনতানায় অস্থির হয়ে সে যদি সঙ্গ দিতে চায় তোমাকে, তোমার দোষ কী?
সিটবেল্ট বেঁধে নিল ডেইজি। মিলারও তা-ই করল। ইগনিশন কী-তে মোচড় দিল সে, রিভার্স গিয়ার দিল। আলগা নুড়িপাথরে মচমচ শব্দ তুলল গাড়ির টায়ার। কিছুদূর আসামাত্র ব্রেক চাপল মিলার, বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ডেইজির দিকে। হাসার চেষ্টা করল মেয়েটা, কিন্তু হাসিটা ফুটল না ওর চেহারায়।
কেন যেন মনে হচ্ছে আমার, বলল মিলার, কিছু একটা লুকাচ্ছ তুমি আমার কাছে। কী সেটা?
শীতল একটা শিহরণ টের পেল ডেইজি, কিছু বলল না।
কিছু একটা হয়েছে। তোমার চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছি সেটা।
মিলারের কথা হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল ডেইজি। নতুন করে কিছুই হওয়ার নেই আমার জীবনে। আমার জীবনে যা-যা হয়েছে, বারে বলেছি তোমাকে, ডেইল।
আরও দু-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল মিলার, সময়টা এক ঘণ্টা বলে মনে হলো ডেইজির কাছে। শেষপর্যন্ত গ্যাসপেডালে চাপ দিয়ে গাড়ি আগে বাড়াল লোকটা, আর কিছু বলল না। পার্কিংলট ছাড়িয়ে এল ওরা।
বাঁ দিকে মোড় নাও, কিছুদূর এগোনোর পর বলল ডেইজি, নিজের কণ্ঠের উত্তেজনা টের পাচ্ছে। তারপর হাতের ডানদিকের প্রথম বাক ছাড়িয়ে দ্বিতীয়টাতে ঢুকতে হবে।
চুপ করে আছে মিলার, যেভাবে বলেছে ওকে ডেইজি সেভাবে গাড়ি চালাচ্ছে।
গাড়ির ভিতরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাজে কোনো গন্ধ যাতে টের পাওয়া না-যায় সেজন্য ডিওডোরাইযার ব্যবহার করা হয়েছে।
হাতের ডানদিকের দ্বিতীয় বাঁকে যখন ঢুকল মিলার, দম আপনাআপনি আটকে গেল ডেইজির। এখন যে-কোনো মুহূর্তে দেখা যাবে রেক্সের গাড়ির নীলচে-লাল আলো, শোনা যাবে সাইরেনের প্যা-পোঁ আওয়াজ।
এই সময়টাতে প্রতিবারই ঘাবড়ে যায় ডেইজি। কারণ সে জানে না, টার্গেট ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে এই সময়ে। একবার এক লোক পালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই বুঝতে পারে, পণ্ডশ্রম করছে সে আসলে। কেউ আবার অভিসম্পাত করতে থাকে। বেশিরভাগ টার্গেট ফোঁপাতে থাকে। দু-একজন, একহাতে স্টিয়ারিং ধরে। রেখে অন্য হাতটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল ডেইজির জামার ভিতরে, কিন্তু পুলিশের গাড়ি দেখামাত্র কেঁদে ফেলেছিল স্কুলের বাচ্চাদের মতো।
ডেইল মিলার কী করবে, বুঝতে পারছে না ডেইজি।
নীলচে-লাল আলোটা দেখা গেল হঠাৎ করেই। শোনা গেল স্কোয়াড কারের সাইরেনের আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে মিলারের দিকে তাকাল ডেইজি–লোকটার প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়।
বিহ্বল বা আশ্চর্য–কোনোটাই হয়নি মিলার, অন্তত ও-রকম কোনো আবেগের ছাপ দেখা যাচ্ছে না ওর চেহারায়। বরং…থতমত খেয়ে গেল ডেইজিই…নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে লোকটা, দৃঢ়-সংকল্প মনে হচ্ছে তাকে। ব্লিঙ্কার চালু করে দিল সে, গাড়ির গতি কমিয়ে আনছে আস্তে আস্তে, সুবিধামতো একজায়গায় থামল।
ওর গাড়ির ঠিক পেছনে ব্রেক কষল রেক্স।
সাইরেন থেমে গেছে। নীলচে-লাল আলো জ্বলছে।
ডেইজির দিকে তাকাল মিলার। মেয়েটা ভেবে পাচ্ছে না, এখন ওর চেহারায় ঠিক কোন আবেগটা ফুটিয়ে তোলা উচিত। আশ্চর্য হওয়ার ভান করবে? নাকি মেকি সহমর্মিতা ফুটিয়ে তুলবে? নাকি কী আর করা জাতীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলবে?
তোমার অতীত তা হলে আমাদেরও পিছু নিয়েছে, নাকি? বলল মিলার।
ওর বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু একটা ছিল যে, নিজেকে কেমন নিস্তেজ মনে হলো ডেইজির। জলদি শব্দটা চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল রেক্সের উদ্দেশে, কিন্তু বলল না। সময় নিচ্ছে রেক্স–এসব ক্ষেত্রে সাধারণত কখনোই তাড়াহুড়ো করে না একজন পুলিশ অফিসার।
আঙুলের গাঁট দিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালায় যখন টোকা দিচ্ছে রেক্স, ডেইজির দিকে তখনও তাকিয়ে আছে মিলার। আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরাল লোকটা, জানালার কাঁচ নামাল।
কোনো সমস্যা, অফিসার?
লাইসেন্স আর রেজিস্ট্রেশন, প্লিজ।
ওগুলো রেক্সের হাতে দিল মিলার।
আজ রাতে কি মদ খেয়েছেন আপনি, মিস্টার মিলার?
খেয়েছি…এক রাউন্ড।
রেক্সের প্রশ্নের জবাবে বেশিরভাগ টার্গেট ওই জবাবই দেয়। বেশিরভাগ লোকই মিথ্যা বলে।
গাড়ি থেকে একটু নামবেন?
বাড় ঘুরিয়ে আবারও ডেইজিকে দেখল মিলার। লোকটার সঙ্গে যাতে চোখাচোখি না হয়, সে ব্যাপারে খেয়াল রেখেছে মেয়েটা। খেয়াল রেখেছে, ওকে যাতে কিছুতেই দমিয়ে দিতে না পারে ওই লোকের নির্নিমেষ দৃষ্টি।
স্যর? অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে রে, গাড়ি থেকে নামতে বলেছি আপনাকে…
অবশ্যই, অফিসার।
দরজার হ্যান্ডেল ধরে টান দিল মিলার। গাড়ির ভিতরে একটা আলো জ্বলে উঠল। চোখ বন্ধ করে ফেলল ডেইজি। বিরক্তিতে ঘোঘোত কতে করতে সিট ছাড়ল মিলার। নামল সে, খোলাই রাখল দরজাটা। কিন্তু ওকে, ছাড়িয়ে এগিয়ে এল ব্রেক্স, দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা। জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল, টের পেল ডেইজি।
স্যর, আপনি ভাল কি না, সে-ব্যাপারে একটা টেস্ট চালাতে চাই আপনার উপর।
দরকার নেই।
জী?
সরাসরি ব্ৰিদালাইর ব্যবহার করুন।
আশ্চর্য হলো রে। আড়চোখে একবার তাকাল ডেইজির দিকে। কাঁধ ঝাঁকাল মেয়েটা।
আপনার স্কোয়াড কারে একটা ফিল্ড বিদালাইর আছে না জিজ্ঞেস করুল মিলার।
হ্যাঁ, আছে।
তা হলে আপনার অথবা আমার অথবা ওই সুন্দরী মহিলার সময় নষ্ট করে লাভ কী?
ইতস্তত করছে রেক্স। ঠিক আছে। একটু অপেক্ষা করুন এখানে।
অবশ্যই।
স্কোয়াড কারের দিকে ঘুরল রেক্স
সঙ্গে সঙ্গে তেজবাজির মতে একাপিল দেখা গেল মিলারের হাতে।
রেক্সের মাথার পেছনদিকে পর পর দুবার গুলি করল সে।
রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল রেক্স।
পিস্তলের নল ডেইজির দিকে তাক কবুল মিলার।
ফিরে এসেছে ওরা, ভাবল মেয়েটা, এতগুলো বছর পর ঠিকই খুঁজে বের করেছে আমাকে।
.
০১.
বেসবল ব্যাটটা পায়ের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছি আমি, যাতে ওটা দেখতে না পায় ট্রে।
নাচের ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এল সে। রোদে পুড়িয়ে গায়ের রঙ বাদামি বানিয়েছে সে, স্টাইল করার জন্য কপালের উপর নামিয়ে রেখেছে কিছু চুল, শীত ৰাইসেপে আঁকিয়েছে অর্থহীন উপজাতীয়-ট্যাটু। ওর শারীরিক বর্ণনা আমাকে আগেই জানিয়েছে এলি। আমার দিকে এগিয়ে আসছে যে-লোক, তার সঙ্গে মিলে গেছে সে-বনা।
তারপরও, নিশ্চিত হতে হবে আমাকে।
বললাম, ট্রে?
থমকে গেল লোকটা, কপাল কুঁচকে গেছে। কে তুমি?
তারমানে তুমিই ট্রে, এক কদম আগে বাড়লাম আমি, এখনও লুকিয়ে রেখেছি ব্যাটটা।
ট্রে একজন নকল গ্যাংস্টার। অর্থাৎ, পাড়ার মাস্তান সে, কিন্তু এমন ভাব করে, যেন ভয়ঙ্কর কোনো সন্ত্রাসী।
কী চাও তুমি? জিজ্ঞেস করল সে আমাকে।
আরেক কদম আগে বাড়লাম। কথা বলতে চাই।
কী নিয়ে?
মুহূর্তের মধ্যে নড়ে উঠলাম আমি, একহাত দিয়ে চালালাম ব্যাটটা, বাড়ি মারলাম ট্রের একহাঁটুতে ব্যখায় কিার করে উঠল সে, কিন্তু পড়ে গেল না!
এবার দুহাতে ধরলাম আমি ব্যাটটা, উঁচু করলাম একটা কনুই, আরেক কদম আগে বেড়ে ট্রের একই হাঁটুতে সজোরে বাড়ি মারলাম আবার।
এমনভাবে আছড়ে পড়ল ট্রে যেন আমি গুলি করেছি ওকে। প্লিজ
এবার কুড়াল দিয়ে গাছের গুঁড়ি কাটার কায়দায় ধরলাম ব্যাটটা, একই জায়গায় বাড়ি মারলাম আবার। মরণ-আর্তনাদ জাতীয় চিৎকার ছাড়ল ট্রে। ততক্ষণে আবার ব্যাট তুলে ফেলেছি আমি, ওদিকে দুহাতে হাঁটু চেপে ধরেছে ট্রে-বাঁচানোর চেষ্টা করছে ওটা।
ওর গোড়ালিতে প্রচণ্ড এক বাড়ি মারলাম আমি। এক আঘাতেই আলগা হয়ে গেল ওই জায়গার হাড়।
মচমচ একটা আওয়াজ শোনা গেল দূরে–যেন শুকনো কোনো ডালে পা দিয়ে ফেলেছে বুট-পরিহিত কেউ।
আমার চেহারা দেখোনি তুমি, হিসহিস করে বললাম আমি, সতর্ক করে দিচ্ছি ট্রে-কে। যদি কারও কাছে একটা কথাও বলো, কোনো একদিন আবার হামলা চালাবো তোমার উপর। সেদিন আজকের মতো ছেড়ে দেবো না তোমাকে–জানে মেরে ফেলবো।
ট্রে-কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে এলাম।
তিন ব্লক দূরের একটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম ব্যাটটা। গ্লাভস পরে আছি, তাই আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যাবে না ওটার গায়ে।
অনেক বছর আগে আটলান্টিক সিটির এক নিলাম থেকে কিনেছিলাম ব্যাটটা। কাজেই আমার সঙ্গে ওটার যোগসূত্র স্থাপন সহজ কাজ না…বরং অসম্ভব বলা যায়। এবং ওসব নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিতও না।
যেখানে গাড়ি পার্ক করেছি, ঘুরপথে ফিরে এলাম সেখানে। একটা কালো ব্রুকলিন নেট ক্যাপ আছে আমার মাথায়। নিচু করে রেখেছি মাথা। আশপাশে যদি কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা থাকে, আশা করছি আমাকে চেনা যাবে না ভিডিওফুটেজে।
গাড়িতে উঠে পড়লাম আমি, ইন্টারস্টেট টু এইটির দিকে এগোচ্ছি। এখন প্রথমে যাবো ওয়েস্টব্রিজে।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল এমন সময়।
এলি কল দিয়েছে। রিসিভ করলাম না।
ছোটবেলায় বেসবলের খুব ভক্ত ছিলাম আমি। আমাকে আর আমার যমজ ভাই লিওকে যেদিন প্রথমবার মেজর লিগ বেসবল খেলা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা, সেদিনের কথা আজও মনে আছে। ইয়াঙ্কি স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম আমরা। থার্ড-বেস লাইনের কাছের একটা বক্সে বসেছিলাম। বেসবল গ্লাভস পরে ছিলাম আমি আর লিও, আশা করছিলাম আমাদের দিকে বল উড়ে আসবে অন্তত একবারের জন্য হলেও। কিন্তু সে রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।
মনে আছে, সূর্যের তেজ থেকে চোখ বাঁচাতে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিলেন বাবা। আমাদের দুই ভাইয়ের খুশি দেখে তার চেহারায় ফুটে-ওঠা সেই মুচকি হাসিও মনে আছে আমার। ফ্রেঞ্চ হওয়ার কারণে বেসবল খেলার কিছুই বুঝতেন না তিনি। আমাদের দুই ভাইয়ের মতো তিনিও সেদিন প্রথমবার গিয়েছিলেন খেলা দেখতে। কিন্তু তাতে কী? খেলায় কে জিতল আর কে হারল, তা তার কাছে মুখ্য না; দুই ছেলের খুশিই তার জন্য আসল কথা।
একসময় নিয়ম করে আমরা দুই ভাই খেলা শিখতাম জস নামের একজন কোচের কাছে। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন তিনি। তার নামে নাম রাখা হয়েছে ওয়েস্টব্রিজের একটা বেসবল মাঠের।
ওই মাঠের সামনে থামালাম আমি পুলিশের-গাড়িটা। হ্যাঁ, আমি একজন পুলিশ অফিসার। আজ বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে লিও’র কথা। তবে স্মৃতিকাতর হয়ে থাকলাম না বেশিক্ষণ, ফিরে এলাম বাসায়।
দেখা হয়ে গেল আমার পাশের বাসার দুই প্রতিবেশী ট্যামি আর নেডের সঙ্গে। নর্দমা পরিষ্কার করছে ওরা। আমাকে দেখে হাত নাড়াল দুজনই।
হ্যালো, ন্যাপ, আমাকে বলল নেড।
হ্যালো, নেড, পাল্টা সম্ভাষণ জানালাম আমি। হ্যালো, ট্যামি।
প্রতিবেশীরা আমাকে বন্ধুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। কিন্তু আমি আসলে বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার ভান করি। আমার দৃষ্টিতে, এই শহরের মতো কোনো উপ-নগরে আমি আজব এক প্রাণী। এককথায় যদি বর্ণনা দিই নিজের, আমি সোজাসাপ্টা একজন মানুষ। এখনও বিয়ে করিনি। অনেকে বিয়ে করা ছাড়াই বাবা হয়, আমি তা-ও হইনি। কোনো একটা হেল্থক্লাবে একটা সিগারেট যেমন বিসদৃশ, এই শহরে আমিও তেমন। আমি শুধু আমার মতো নিজের কাজগুলো করে যাচ্ছি উদয়াস্ত। স্বাভাবিক একজন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে পরিণত হয়েছি কারও-কারও জন্য বিরক্তিকর একজন ব্যক্তিতে। তবে, একটা কথা না বললে অন্যায় করা হবে নিজের উপর–যে বা যারা ভরসা করে আমার উপর, তারা ঠকে না।
আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই কারও।
পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন বাবা। তারপর থেকে আমি মোটামুটি একা। তাই আমাদের বাড়িটা পরিপাটিই থাকে।
ব্রডির টিমের খবর কী? জিজ্ঞেস করলাম ট্যামিকে।
চলছে আর কী, বলল ট্যামি। আগামী বুধবার খেলা দেখার জন্য আসছ তো?
দেখি।
ঢুকে পড়লাম বাসার ভিতরে। পুরনো একটা ঘর আছে একদিকে, ওখানে একটা বাঙ্কবেডে একসময় ঘুমাতাম আমি আর লিও। যেদিন মারা গেল সে, তারপর থেকে সযত্নে এড়িয়ে চলছি এই ঘর।
স্মৃতিকাতরতা, কখনও কখনও, অনেক যন্ত্রণার।
লিও’র মৃত্যুর পর, থাকার জন্য একতলার আরেকটা ঘরে চলে যাই আমি। আর বাবা মারা যাওয়ার পর চলে এসেছি উপরতলার মাস্টার বেডরুমে। পুরনো ওই ঘরটাকে একটা হোম-অফিস বানানোর কাজে আমাকে সাহায্য করেছে এলি।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছি দোতলায়, শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বেডরুমের দিকে এগোচ্ছি, এমন সময় বেজে উঠল ডোরবেল। ইউ.পি.এস, অথবা ফেডএক্স থেকে কেউ এসেছে মনে হয়। এখনকার দিনে একমাত্র ওরাই জানান না-দিয়ে হাজির হয়। কাজেই নিচে নামার কোনো প্রয়োজন অনুভব করলাম না।
আবার বেজে উঠল বেল। আশ্চর্য হলাম, কোনোকিছুর অর্ডার করেছিলাম কি না ভাবছি-হয়তো আমার স্বাক্ষরের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সে-রকম কিছুর কথা মনে পড়ল না। ঢুকলাম বেডরুমে, জানালা খুলে তাকালাম নিচে।
পুলিশ।
সাদা পোশাকে এসেছে ওরা, তারপরও চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না আমার।
ওদের একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা।
একটা মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ট্রে-কে পিটিয়ে গুরুতর আহত করার দায়ে ফেঁসে গেছি আমি। কিন্তু পরমুহূর্তে বুঝতে পারলাম, ধারণাটা ঠিক না। যে গাড়িতে করে এসেছে দুই পুলিশ অফিসার, সেটার লাইসেন্স প্লেটে পেনসিলভানিয়ার একটা নম্বর দেখা যাচ্ছে। ট্রে-কে পেটানোর অভিযোগ নিয়ে যদি আমার বাসায় আসত পুলিশ, স্থানীয় লাইসেন্স প্লেট থাকত ওদের গাড়িতে।
খুলে ফেলেছিলাম শার্টটা, ওটা গায়ে দেয়ার মতো সময় নেই এখন, তাই চট করে টেনে নিলাম ধূসর একটা সোয়েটার। আয়নায় একঝলক দেখে নিলাম আমার চেহারাটা। নিজেকে কেমন বেপরোয়া মনে হচ্ছে।
সিঁড়ি বেয়ে নামলাম দ্রুত পায়ে, মোচড় দিলাম ডোরনবে।
কল্পনাও করিনি, যা ঘটতে চলেছে, তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে আমার মৃত ভাইটার।
.
০২.
যেমনটা বলেছি, দুজন পুলিশ অফিসার-একজন পুরুষ, একজন মহিলা।
দুজনের মধ্যে মহিলাটার বয়স বেশি, পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে। পরনে নীল ব্লেযার, জিন্স আর শু। ব্লেযারের আড়ালে ফায়ারআর্ম আছে, ফলে উঁচু হয়ে আছে কোমরের কাছটা।
পুরুষ লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মৃত-পাতার মতো খয়েরি সুট পরে আছে।
যন্ত্রচালিতের মতো হাসলেন মহিলাটা। ডিটেকটিভ ডুমাস?
উচ্চারণটা আসলে হবে দুমা…বিখ্যাত সেই লেখকের মতো। আমি আর লিও জন্মেছি ফ্রান্সের মারসেই-এ। পরে আমেরিকায় চলে আসি আমরা। আট বছর বয়স থেকে আছি এই ওয়েস্টব্রিজ শহরে। আমেরিকানদের কাছ থেকে নিখুঁত ফরাসি উচ্চারণ আশা করা বাতুলতা, তাই ওদের কাছে দুমা থেকে দুমাস হয়ে গেছি আমি।
ভুলটা শুধরে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, কী করতে পারি আপনাদের জন্য?
আমি লেফটেন্যান্ট স্টেইসি রেনল্ডস, বললেন মহিলাটা। ইঙ্গিতে দেখালেন তাঁর সঙ্গীকে। ডিটেকটিভ বেটস।
পরিস্থিতিটা পছন্দ হচ্ছে না আমার। কারণ, আমার সন্দেহ, আমাকে কোনো একটা খারাপ খবর দেয়ার জন্য হাজির হয়েছেন এই দুজন। হয়তো বলবেন, আমার কাছের কেউ মারা গেছে। কে হতে পারে মানুষটা? এলি? কিন্তু সে থাকে এই ওয়েস্টব্রিজেই…অর্থাৎ নিউ জার্সিতে, পেনসিলভানিয়ায় না।
আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল জাতীয় মেকি কথাগুলো উচ্চারণও করলাম না। সরাসরি বললাম, কী সমস্যা?
আমরা আপনার বাসার ভিতরে এলে সমস্যা হবে? বললেন রেনল্ডস, ক্লান্ত একটা হাসি ফুটিয়ে তুলেছেন ঠোঁটের কোনায়। গাড়িতে করে লম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে হয়েছে আমাদেরকে।
তা ছাড়া আমার বাথরুমে যাওয়া দরকার, বলল বেটস।
আমার বাসার ভিতরেও আসবেন আপনারা, দরকার হলে বাথরুমেও যাবেন। কিন্তু তার আগে বলুন গাড়িতে করে লম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হলো কেন আপনাদেরকে।
পেনসিলভানিয়ায় একটা খুন হয়েছে, বললেন রেনল্ডস।
এবং নিহত লোকটা আপনার-আমাদের মতোই একজন পুলিশ অফিসার, যোগ করল বেটস।
অন্য সবকিছু থেকে আমার মনোযোগ যেন সরে গেল।
একজন মানুষ খুন হয়েছে এবং সে একজন পুলিশ। খবরটা জানানোর জন্য আমার বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পেনসিলভানিয়ার দুজন পুলিশ অফিসার।
কে? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
রেক্স ক্যান্টন।
আমার প্রতিক্রিয়া কী হয়, দেখার জন্য আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছেন তারা। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়াই হলো না আমার।.
সার্জেন্ট ক্যান্টনকে চেনেন আপনি? জানতে চাইলেন রেনল্ডস।
চিনতাম। অনেক বছর আগে।
তাঁর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল আপনার?
মনে নেই, স্মৃতি হাতড়ানোর ভান করছি আমি। হাইস্কুলে একসঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলাম আমরা। তারপর আর দেখা হয়েছিল কি না, মনে করতে পারছি না।
তারপর আর দেখা হয়নি?
বললাম তো মনে করতে পারছি না।
অর্থাৎ আপনি নিশ্চিত না ওই ব্যাপারে?
না।
দেখে মনে হচ্ছে, খুনের খবরটা শুনে একটুও বিচলিত হননি আপনি।
হয়েছি…ভিতরে ভিতরে। অল্পতে ভেঙে পড়ার মতো মানুষ না আমি। অনেকেই বলে, আমার মধ্যে নাকি আবেগ বলে কিছু নেই।
বিদ্রূপ করার কোনো দরকার নেই, বলল বেটস। একই দেশের একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করি আমরা, সে-হিসেবে রেক্স আমাদের কলিগ।
সময় নষ্ট করারও কোনো দরকার নেই, বললাম আমি। হাইস্কুলে পড়ার সময় চিনতাম রেক্সকে, তারপর আর দেখা হয়নি আমাদের। ব্যস। সে যে পেনসিলভানিয়ায় থাকত, তা-ও জানতাম না। এমনকী, সে যে পুলিশের চাকরিতে ঢুকেছে, জানা ছিল না সেটাও। …কীভাবে খুন করা হয়েছে ওকে?
গুলি করা হয়েছে।
রেক্স ক্যান্টন। হ্যাঁ, আজ থেকে অনেক বছর আগে ওর সঙ্গে খাতির ছিল আমার। তবে আমার চেয়ে আমার ভাই লিও’র সঙ্গে বেশি খাতির ছিল রেক্সের। স্কুলের ট্যালেন্ট শোর জন্য সাময়িক একটা ব্যান্ড দল গড়েছিল লিও আর ওর কয়েকজন বন্ধু, সে-দলে ড্রাম বাজানোর দায়িত্ব নেয় রেক্স। মনে পড়ে গেল, ওর উপরের পাটির একেবারে সামনের দুই দাঁতের মাঝখানে ফাঁক ছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কী করার আছে আমার? জিজ্ঞেস করলাম।
একটুখানি বেঁকে গেল রেনল্ডসের ঠোঁটের একদিকের কোনা-খুব সম্ভব হাসছেন তিনি। খুনটা কে করেছে, ধারণা করতে পারেন।
কোনো ধারণা নেই আমার।
ঠিক আছে। আপনার বাথরুমটা ব্যবহার করতে দিন আমাকে, নইলে আপনার সদর-দরজাতেই পেশাব করে দিতে হবে আমাকে। আগে পেশাব, পরে কথা।
দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে ভিতরে ঢোকার সুযোগ দিলাম ওই দুজনকে। বাথরুমটা কোন্দিকে আছে বলে দিলাম রেনল্ডসকে, সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিলেন তিনি। অপেক্ষা করছে বেটস, লেফট-রাইট জাতীয় একজাতের নড়াচড়া শুরু হয়ে গেছে তার।
আমার মোবাইল বেজে উঠল। আবার ফোন করেছে এলি। ইগনোর-এ চাপ দিলাম আমি, পরে যোগাযোগ করবো জানিয়ে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম।
পানি পড়ার আওয়াজ আসছে বাথরুম থেকে। রেনল্ডস হাত ধুচ্ছেন সম্ভবত। একদিক দিয়ে বের হলেন তিনি, সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমে ঢুকলেন বেটস। সে বের হওয়ার পর লিভিংরুমে গিয়ে বসলাম আমরা তিনজন।
এই রুমও সাজিয়ে দিয়েছে এলি। কাঠের প্যানেলিং বসিয়েছে, বিশাল স্ক্রীনের একটা টিভিও এনেছে।
এবার বলুন কী বলার আছে আপনাদের।
বেটসের দিকে তাকালেন রেনল্ডস। মাথা ঝাঁকাল বেটস।
আমার দিকে তাকালেন রেনল্ডস। ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেয়েছি আমরা।
কোথায়?
জী?
একটু আগে বললেন, গুলি করে মারা হয়েছে রেক্সকে। সেজন্যই জানতে চেয়েছি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেয়েছেন কোথায়। তবে আগে বলুন কোথায় পাওয়া গেছে রেক্সের লাশ। স্কোয়াড কারের ভিতরে নাকি রাস্তায়?
রাস্তায়।
তা হলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেয়েছেন কোথায়?
কোথায় পেয়েছি সেটা বড় কথা না। ফিঙ্গারপ্রিন্ট কার, সেটাই আসল।
অপেক্ষা করছি আমি।
কিন্তু কিছু বললেন না রেনল্ডস বা বেটস।
কার ফিঙ্গারপ্রিন্ট? জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম।
বলছি। তবে তার আগে বলি, ক্রিমিনাল ডেটাবেইসে সার্চ করেছিলাম আমরা ওই ফিঙ্গারপ্রিন্ট। কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। তারপরও…নিশ্চয়ই জানেন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট অনুযায়ী যে-কাউকে সনাক্ত করার আরও ডেটাবেইস আছে আমাদের।
মাথা ঝাঁকালাম।
খুঁজতে খুঁজতে একটা নমুনার সঙ্গে মিল পাওয়া গেল ওই প্রিন্টের, বলছেন রেনল্ডস। এবং আজ থেকে বছর দশেক আগে ওই নমুনা আপলোড করেছিলেন আপনি নিজে।
বুকের ভিতরে একটা আন্দোলন টের পাচ্ছি আমি। স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি চেহারাটা।
বছর দশেক আগে, বলে চললেন রেনল্ডস, নমুনাটা আপলোড করার। সময়, বলা ভালো মেয়েটার বর্ণনা দেয়ার সময়, তাকে একজন ইন্টারেস্টিং মানুষ বলে উল্লেখ করেছেন আপনি। বছর দশেক আগে, আপনি যখন যোগ দেন পুলিশ ফোর্সে, ওই নমুনা আপলোড করে তার নিচে লিখে দেন, যদি কখনও কারও ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে মিলে যায় ওটা, আপনাকে যেন জানানো হয়।
বড় রকমের একটা মানসিক ধাক্কা খেয়েছি, প্রাণপণে চেষ্টা করছি সেটা সামলে নেয়ার, কিন্তু নিজের চেহারা দেখতে না-পেলেও জানি, সফল হচ্ছি না আমি খুব একটা।
অনেক বছর আগের কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বিদ্যুচ্চমকের মতো।
কত বছর হবে?
পনেরো?
গ্রীষ্মের রাতে চাঁদের আলো মাথায় নিয়ে হেঁটে বেড়াতাম আমি আর ওই মেয়ে। ঘুরে বেড়াতাম বনেজঙ্গলে, পাহাড়ি ঢলে। কখনও আবার কম্বল বিছিয়ে তার উপর শুয়ে থাকতাম পাশাপাশি।
মনে পড়ে গেল বিশেষ এক রাতের কথা। চিৎ হয়ে শুয়ে আছি আমি, হাঁপাচ্ছি, তাকিয়ে আছি রাতের আকাশের দিকে। আমার বুকের উপর মাথা আর আমার পেটের উপর একটা হাত রেখে শুয়ে আছে মেয়েটা। শারীরিক। ভালোবাসার আদানপ্রদান শেষ হয়েছে আমাদের।
কয়েকটা মিনিট চুপ করে থাকার পর কথা বলতে শুরু করলাম আমরা। এবং তখন বুঝতে পারলাম, ওই মেয়ের সঙ্গে আমার কথা কখনও ফুরাবে না। ওর সঙ্গে কথা বলার সময় কখনোই ক্লান্ত হবো না আমি।
তারপর একদিন হারিয়ে গেল লিও।
হারিয়ে গেল মেয়েটাও।
কিন্তু আসলেই কি হারিয়ে গেছে মেয়েটা?
সে যদি হারিয়েই যাবে, আমার সামনে কেন বসে আছেন রেনল্ডস আর বেটস?
ডিটেকটিভ ডুমাস? আবারও ভুল উচ্চারণে আমাকে ডাকলেন রেনল্ডস।
এক লহমায় যেন ফিরে এলাম স্মৃতির গহর থেকে। আপনারা কি বলতে চান, ওই ফিঙ্গারপ্রিন্ট মোরার?
হ্যাঁ।
কিন্তু…আজ থেকে অনেক বছর আগে হারিয়ে গেছে মেয়েটা এবং তারপর কেউ খোঁজ পায়নি ওর।
এতদিনে হয়তো পাওয়া গেছে, বললেন রেনল্ডস। আপনার কাছে কি কোনো ব্যাখ্যা আছে ঘটনাটার?
ওয়ালেট আর বাসার চাবিটা তুলে নিলাম আমি। গাড়িতে করে যেতে যেতে বলবো। চলুন।
.
০৩.
কিন্তু নড়ার কোনো লক্ষণ নেই রেনল্ডস বা বেটসের। দেখে মনে হচ্ছে, সব কথা শুনতে চান তারা লিভিংরুমে বসেই।
চলুন গিয়ে গাড়িতে উঠি আমরা, তাগাদা দিলাম আমি। ঘটনাস্থল দেখা দরকার।
পীড়াপীড়ি করায় আমার পিছু-পিছু বের হলেন তারা দুজন।
ইট-বিছানো ফুটপাত ধরে হাঁটছি আমরা। আজ থেকে বিশ বছর আগে ওই ইটগুলো বিছিয়ে দিয়েছিলেন বাবা।
সামনে আছি আমি। আমার কাছাকাছি থাকার জন্য পা চালাতে হচ্ছে রেনল্ডস আর বেটসকে।
যদি বলি, আপনাকে সঙ্গে নিতে চাই না আমরা? বললেন রেনল্ডস।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, ঘুরলাম। তা হলে আমার পক্ষ থেকে এখনই এবং এখানেই বিদায়। প্রার্থনা করি আপনাদের ফিরতিযাত্রা যেন শুভ হয়।
আমার কথাবার্তা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না বেটসের। যা জানতে এসেছি, তা বলতে আপনাকে বাধ্য করতে পারি আমরা।
তা-ই? ঠিক আছে, দেখি কী করতে পারেন।
বাসার উদ্দেশে পা বাড়ালাম, কিন্তু আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লেন বেটস। আমরা একজন পুলিশ-অফিসারের খুনিকে খুঁজছি।
আমিও।
আমি একজন ভালো ইনভেস্টিগেটর…বাড়িয়ে বলছি না। কিন্তু ঘটনাস্থল না দেখে শুধু অনুমানে কিছু করা বা বলা সম্ভব না আমার পক্ষে। খুনখারাপি আমার কাছে খেলার মতো…এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ভালোমতোই চিনি আমি। এই কেসে হয়তো সাহায্য করতে পারবো পেনসিলভানিয়ার পুলিশকে।
তা ছাড়া…মোরা যদি আসলেই ফিরে এসে থাকে, কেসটা কিছুতেই হাতছাড়া করা উচিত হবে না আমার।
ঘটনাস্থলে যেতে কত সময় লাগতে পারে? জিজ্ঞেস করলাম।
গাড়ি স্পিডে চালালে দুঘণ্টা।
নিমন্ত্রণ জানানোর কায়দায় দুহাত দুদিকে প্রসারিত করলাম। গাড়ির ভিতরে পুরো দুই ঘণ্টা আমাকে একা পাবেন আপনারা। যত খুশি তত প্রশ্ন করতে পারেন।
ভ্রু কুঁচকে ফেলল বেটস।
রেনল্ডস বললেন, ফিরে আসবেন কীভাবে?
আমরা কিন্তু উবার না, মনে করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে তাল মেলাল বেটস।
পেনসিলভানিয়া থেকে এখানে আসার ট্রান্সপোর্টেশন নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে যায়নি?
মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন রেনল্ডস আর বেটস। তারপর ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল বৈটস। রেনল্ডস গিয়ে বসে পড়লেন প্যাসেঞ্জার সিটে। পেছনের সিটে নিজের জন্য জায়গা করে নিলাম আমি। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন করলাম এলিকে।
হ্যাঁ, বলো।
আজ রাতে তোমাকে সময় দিতে পারবো না মনে হয়, এলি।
লাঞ্ছিত এবং অধিকারবঞ্চিত মহিলাদের জন্য একটা আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এলি, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রতি রোববার সেখানে সময় দিই আমি।
কী সমস্যা? জানতে চাইল এলি।
রেক্স ক্যান্টনের কথা মনে আছে?
হাইস্কুলের সেই ছেলেটা? আছে।
স্কুলে আমাদের সঙ্গে পড়ত এলি। আমার ভালো বান্ধবী ছিল সে, এখনও আছে। বন্ধুত্বের বেশি কোনো সম্পর্ক কখনোই ছিল না আমাদের মধ্যে। বিয়ে করেছে সে, দুটো মেয়েও আছে ওর। অদ্ভুত হলেও সত্যি, ওই দুটো মেয়েরই ধর্মপিতা আমি।
পেনসিলভানিয়ার একজন পুলিশ অফিসার ছিল রেক্স, বললাম আমি।
সে-রকম কিছু একটা শুনেছিলাম মনে হয়।
কই, আমাকে তো বলোনি কখনও?
বলার দরকার হয়নি, তাই বলিনি। …কী হয়েছে রেক্সের?
খুন করা হয়েছে ওকে। কেউ একজন গুলি চালিয়েছে ওর উপর।
সাংঘাতিক ব্যাপার তো! শুনে খারাপ লাগল।
এলি যখন বলছে খারাপ লেগেছে ওর কাছে, তারমানে আসলেই খারাপ লেগেছে ওর। সহমর্মিতা আবেগটা ওর ভিতরে আছে বলেই অধিকারবঞ্চিত মহিলাদের জন্য কিছু-একটা করতে পেরেছে।
কিন্তু ওই ব্যাপারে তোমার কী করার আছে? বলল সে।
পরে বলবো।
বিস্তারিত কিছু জানতে চেয়ে সময় নষ্ট করল না এলি। জানে, যদি কিছু বলার থাকে, নিজে থেকেই বলবো আমি।
ঠিক আছে, কোনোকিছু দরকার হলে ফোন কোরো।
ব্রেন্ডার খেয়াল রেখো, বললাম আমি।
ব্রেন্ডা, এলির আশ্রয়কেন্দ্রের একজন আশ্রিতা এবং দুই সন্তানের জননী। ট্রে..মানে যাকে পিটিয়েছি আমি…তার কারণে ব্রেন্ডার জীবনটা একটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
সপ্তাহ দু-এক আগে গভীর এক রাতে কনকাশন আর ভাঙা পাঁজুর নিয়ে এলির আশ্রয়কেন্দ্রে হাজির হয় ব্রেন্ডা। তারপর থেকে ওই কেন্দ্রের বাইরে যেতেও ভয় পাচ্ছে বেচারী। উঠানের মতো একচিলতে খোলা জায়গা আছে আশ্রয়কেন্দ্রের ভিতরে, এমনকী সেখানে যেতেও ভয় পায় সে। কখনও কখনও কাঁপতে থাকে ভয়ে। কখনও কখনও চোখমুখ কুঁচকে ওঠে ওর, কখনও আবার পিছিয়ে যায় অথবা নুইয়ে পড়ে–যেন কেউ মারবে ওকে এখনই।
আজ রাতে এলিকে বলতে চেয়েছিলাম, নিজের বাসায় নির্ভয়ে ফিরে যেতে পারে ব্রেন্ডা। কারণ যে-লোক ব্রেন্ডাকে ইচ্ছামতো পিটিয়েছিল, আগামী কয়েকটা মাস হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না সে। আগামী কয়েকটা মাস আর বিরক্ত করতে পারবে না ট্রে ব্রেন্ডাকে।
কিন্তু বলা হলো না কথাটা।
ব্রেন্ডাকে বোলো, যত জলদি সম্ভব ফিরে আসবো আমি।
বলবো, লাইন কেটে দিল এলি।
.
গাড়ি চলছে। এখনও প্রশ্ন করা শুরু করেননি রেনল্ডস আর বেটস। আমার সামনে বসে আছেন তাঁরা, তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। তাদেরকে নিজের অভিভাবক বলে মনে হচ্ছে আমার।
কেন চুপ করে আছেন তাঁরা? তাদের কি মনে নেই, আমিও একজন পুলিশ অফিসার? নাকি তাঁরা আমাকে আগে নিতে চান ইন্টারোগেশন রুমে, তারপর যা জিজ্ঞেস করার জিজ্ঞেস করতে চান?
চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। একটুখানি যদি ঘুমাতে পারি, লাভ হবে।
আপনার নামের প্রথম অংশটা কি আসলেই নেপোলিয়ন? রেনল্ডসের প্রশ্ন শুনে চোখ খুলতে হলো আমাকে।
হ্যাঁ।
আমার বাবা ঘৃণা করতেন নামটা। কিন্তু আমার মা…চাকরিসূত্রে প্যারিসপ্রবাসী একজন আমেরিকান…ওই নাম রাখতে পীড়াপীড়ি করেছিলেন বাবাকে।
তারমানে আপনার পুরো নাম নেপোলিয়ন ডুমাস?
প্রতিবেশী আর চেনা-জানা লোকেরা আমাকে ন্যাপ বলে ডাকে।
অটোমেটেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমে মোরা ওয়েলসের ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা আপনিই আপলোড করেছিলেন?
হ্যাঁ।
কবে?
দশ বছর আগে। …এসব আগেও আলোচনা করেছি আমরা।
হা, করেছি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?
কেন মানে?
মোরার ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা আপলোড করলেন কেন আপনি?
কারণ সে গায়েব হয়ে যায় হঠাৎ করেই।
কিন্তু তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কখনও হারিয়ে-যাওয়ার রিপোর্ট করা হয়নি পুলিশের কাছে।
কিছু বললাম না।
ন্যাপ?
হাইস্কুলে যখন পড়তাম, আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল মোরা ওয়েলস। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পর একদিন আমাকে মেসেজ পাঠায় সে, আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কোথায় যেন চলে যায়। …অনেক খুঁজেছি ওকে, কিন্তু পাইনি।
বেটসের সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন রেনল্ডস। মোরার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেছিলেন?
হ্যা…ওর মার সঙ্গে কথা বলেছি।
তারপর?
তিনি আমার মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন, মোরা কোথায় আছে না আছে তা নিয়ে যেন মাথা না ঘামাই। আমি যেন নিজের চরকায় তেল দিই।
খটি কথা, বলল বেটস।
লোকটা কি আমাকে উস্কানোর চেষ্টা করছে?
যা-খুশি হোক, টোপ গিলোম না।
তখন আপনার বয়স কত ছিল? জানতে চাইলেন রেনল্ডস।
আঠারো।
তো…মোরাকে অনেক খুঁজলেন আপনি, কোথাও পেলেন না… তারপর?
তারপর একসময় পুলিশে যোগ দিলাম আমি। এ.এফ.আই.এস.-এ আপলোড করে দিলাম মোরার ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা। সে যে হারিয়ে গেছে, তা জানিয়ে একটা রিপোর্ট দাখিল করলাম।
কেন করলেন কাজটা? আপনি কি খুঁজে পাওয়ার আশা করছিলেন মোরাকে? আপনি কি তার সঙ্গে আবার সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছিলেন?
জবাব দিলাম না।
কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার ব্যাপারে খোঁজখবর করেই ওয়েস্টব্রিজে এসেছেন রেনল্ডস আর বেটস। তাঁদের জায়গায় আমি থাকলে তা-ই করতাম।
মোরা ওয়েলসকে নিজের তাগিদেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন আপনি, না? বললেন রেনল্ডস।
হ্যাঁ।
কিন্তু কিছুই জানতে পারেননি তাঁর ব্যাপারে?
না।
গত পনেরো বছর ধরে কোথায় আছেন বা ছিলেন মোরা, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণা আছে আপনার?
চট করে কিছু বললাম না।
হাইওয়েতে উঠে এসেছি আমরা ইতোমধ্যে, পশ্চিমদিকে যাচ্ছি।
ভাবছি আমি। মোরা, আমি, রেক্স আর লিও। চারজনই আমরা একই স্কুলে পড়তাম। চারজনের মধ্যে একজন হারিয়ে গেছে। একজন মারা গেছে। একজনকে খুন করা হয়েছে। বাকি আছি শুধু আমি।
কিছু কি বোঝা যায়? হয়তো যায়, হয়তো যায় না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, রেক্স যে-জায়গায় খুন হলো, সেখানে মোরার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেল কেন? রেক্সের সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল মোরার? নাকি মোরাকে হঠাৎ করেই দেখতে পেয়েছিল রেক্স, চিনতে পেরেছিল?
নাকি…মোরাই খুন করেছে বা করিয়েছে রেক্সকে?
না, বললাম আমি, কোনো ধারণা নেই।
অদ্ভুত, বললেন রেনল্ডস।
কী?
মোরা ওয়েলসের নামে সাম্প্রতিক কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। তার কোন ক্রেডিট কার্ড নেই, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। এমনকী আই.আর,এস, ফাইলিংও নেই।
এবং ওর ব্যাপারে কোথাও কিছু পাওয়াও যাবে না, বললাম আমি। পনেরো বছর আগে হারিয়ে গেছে সে। সময়টা নেহাৎ কম না।
.
০৪.
একটা এয়ারপোর্ট অথবা ট্রেন ডিপোর পাশে যেমন নির্জন রাস্তা দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডটার ঘটনাস্থল ঠিক সে-রকম।
আশপাশে কোথাও কোনো বাড়ি নেই। দূরে একজায়গায় একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক আছে, কিন্তু সেটার অবস্থা খারাপ, তাই ধুকছে। গুদামের মতো দেখতে পরিত্যক্ত কিছু ঘর আছে আরেক জায়গায়।
স্কোয়াড কার থেকে নামলাম আমরা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে যাতে ঢুকতে না-পারে অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ, সেজন্য ব্লক করে দেয়া হয়েছে রাস্তার একটা পাশ, তবে ইচ্ছা করলে গাড়ির স্টিয়ারিং এদিকওদিক করে হাজির হওয়া যায় জায়গামতো।
প্রথম যে-ব্যাপারটা খেয়াল করলাম আমি তা হলো: গাড়িঘোড়ার যাতায়াত খুব কম এই জায়গায়।
রক্তের দাগ এখনও লেগে আছে রাস্তার উপর, পরিষ্কার করা হয়নি। ঠিক যেখানে পড়ে ছিল রেক্সের নিথর শরীরটা, চক দিয়ে সেখানে একটা আউটলাইন আঁকা হয়েছে।
বললাম, আরও কাছে যেতে চাই আমি।
আপনাকে ইনভেস্টিগেটর হিসেবে আনা হয়নি এখানে, বেটসের কণ্ঠ চাঁছাছোলা।
একজন পুলিশ অফিসারের খুনিকে ধরতে চান আপনারা, নাকি চান না?
চাই। কিন্তু যদি বলি, আপনার হারিয়ে-যাওয়া প্রেমিকাই সেই খুনি, বাধা দেবেন না তো?
না, দেবো না…যদি মোরাই করে থাকে খুনটা।
ঠিক আছে, দেখা যাবে। ঘটনার বর্ণনা শুনুন তা হলে। রাত একটা পনেরো মিনিটে ডি.ইউ.আই.-এর জন্য এই জায়গায় একটা টয়োটা করোলাকে থামান রেক্স।
তার আগে রেডিওতে যোগাযোগ করেছিল সে পুলিশ স্টেশনে?
করেছিল।
নিয়ম সেটাই। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কোনো পুলিশ অফিসার যদি কোনো গাড়ি থামাতে চায়, রেডিওতে যোগাযোগ করতে হবে তাকে। ওই গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের নম্বর দেখতে হবে, জানতে হবে গাড়িটা চোরাই কি না। তারপর জানতে হবে গাড়ির মালিকের নাম।
গাড়িটা কার ছিল? জানতে চাইলাম আমি।
কারও না।
মানে?
গাড়িটা ভাড়া করা হয়েছিল।
বিরক্ত হলাম। এই কেসের অনেককিছুতেই বিরক্তি বোধ করছি।
বড় কোনো কোম্পানির?
মানে?
নামিদামি কোনো রেন্টাল কোম্পানি থেকে ভাড়া নেয়া হয়েছিল গাড়িটা?
নামিদামি মানে?
যেমন হার্টয অথবা এভিস?
না।
তা হলে?
কোম্পানিটার নাম স্যাল’স।
আমার ধারণা, ওই কোম্পানি কোনো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি অবস্থিত, যেখানে অ্যাডভান্স রিযারভেশনের দরকার হয় না।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন রেনল্ডস আর বেটস।
আপনি জানলেন কীভাবে? জিজ্ঞেস করলেন বেটস।
পাত্তা দিলাম না প্রশ্নটা, তাকিয়ে আছি রেনল্ডসের দিকে।
ডেইল মিলার নামের পোর্টল্যান্ডের-এক-লোক ভাড়া নিয়েছিল। গাড়িটা, বললেন তিনি।
আইডি-টা কি আসল না ভুয়া?
আবারও মুখ চাওয়াচাওয়ি।
ভুয়া।
হাঁটু বসে পড়লাম চকের সেই দাগের কাছে, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলাম রক্ত। শুকিয়ে গেছে। রেন্টাল কোম্পানির সিসিটিভি রেকর্ড চেক করা হয়েছে?
চেক করা হয়নি, তবে ফুটেজ চাওয়া হয়েছে। ওদের এক ডেস্ক অফিসার জানিয়েছে, ডেইল মিলার বুড়ো এক লোক, বয়স ষাটের ঘরে। সত্তরও হতে পারে।
ভাড়া-করা গাড়িটা পরে কোথায় পাওয়া গেছে?
ফিলাডেলফিয়া এয়ারপোর্ট থেকে আধ মাইল দূরে।
গাড়িতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে কজনের?
শুধু একজনের-মোরা ওয়েলসের।
ডেইল মিলারের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেল না কেন? ডেইল মিলার যদি গাড়ি চালিয়ে থাকে সে-রাতে, অন্তত স্টিয়ারিং-এ ওর আঙুলের-ছাপ থাকার কথা। সে কি গ্লাভস ব্যবহার করছিল?
রেনল্ডস বা বেটস কিছু বললেন না।
দূরের রাস্তায় বাঁক নিল একটা ট্রাক, এগিয়ে আসছে এদিকে। কিছুক্ষণ পর পাশ কাটিয়ে চলে গেল আমাদেরকে। এ-রাস্তায় এই প্রথম কোনো যানবাহন দেখলাম।
রাস্তাটা দেখলাম কিছুক্ষণ, চকে-আঁকা লুটিয়ে-পড়া-মৃতদেহের পজিশন দেখলাম…একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছি। কিছুক্ষণ পর তাকালাম রেনল্ডস আর বেটসের দিকে।
কোনো থিউরি আছে আপনাদের?
গাড়িতে বসে ছিল দুজন লোক, বলতে শুরু করলেন রেনল্ডস। তাদের একজন খুনি…মানে যে গুলি চালিয়েছে রেক্স ক্যান্টনের উপর…অর্থাৎ আমাদের ধারণা অনুযায়ী ডেইল মিলার, অন্যজন আপনার সাবেক প্রেমিকা মোরা। এই রাস্তা দিয়ে গাড়িটা যেতে দেখে সন্দেহ হয় ডিউটিতে-থাকা অফিসার ক্যান্টনের। পিছু ধাওয়া করেন তিনি, থামতে বাধ্য করেন মিলারকে। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক, ঘাবড়ে যায় মিলার…এবং সম্ভবত আপনার সাবেক প্রেমিকাও, গুলি করতে বাধ্য হয় ক্যান্টনকে। তারপর সেই টয়োটা করোলা নিয়ে পালিয়ে যায় লোকটা।
আমার ধারণা গুলি করেছে মিলার, বলল বেটস। খুব সম্ভব গাড়ি থেকে নেমেছিল সে। তারপর যে-কোনো কারণেই হোক, ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেন আপনার সাবেক প্রেমিকা। আর মিলার তখন উঠে বসে প্যাসেঞ্জার সিটে। সে-কারণেই ড্রাইভিং সিট ও প্যাসেঞ্জার সিট-দুজায়গায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে মোরার।
আগেও বলেছি, গাড়িটা ভাড়া নেয়া হয়েছিল ভুয়া অর্থাৎ চুরি-করা একটা আই.ডি, ব্যবহার করে, বললেন রেনল্ডস। কাজেই, সহজেই অনুমান করা যায়, কিছু একটা গোপন করার ছিল ওই তথাকথিত ডেইল মিলারের। আরও অনুমান করা যায়, ক্যান্টন যখন থামায় গাড়িটা, যখন গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করে মিলারকে, তখনই বুঝতে পারে, কোথাও কোনো একটা ঘাপলা আছে। ঘাপলাটা যাতে জানাজানি না হয় সেজন্যই খুন করা হয়েছে ওকে।
মাথা ঝাঁকালাম আমি–এমন ভঙ্গিতে, যেন রেনল্ডস আর বেটসের থিউরি মনে ধরেছে আমার। কিন্তু আমি জানি, ওদের ধারণা ভুল। তবে যেহেতু ওদের থিউরির চেয়ে ভালো কিছু উপস্থাপন করতে পারছি না এই মুহূর্তে, সেহেতু বাকযুদ্ধে না-জড়ানোটাই ভালো। আমাকে এখনও পর ভাবছে ওরা। ওদের জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম হয়তো। কাজেই এখন আমাকে যা করতে হবে তা হলো, কী লুকাচ্ছে ওরা আমার কাছে, অর্থাৎ কী বলছে না আমাকে, তা খুঁজে বের করতে হবে। এবং সেটা করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, সাধু সেজে থাকা।
নিজের সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম ঠোঁটের কোনায়। ড্যাশ ক্যামটা দেখতে পারি?
অস্বস্তি দেখা দিল রেনল্ডস আর বেটসের চেহারায়।
বেটস বলল, তার আগে আপনার কাহিনি বলে শেষ করুন। কেন শুধু শুধু দেরি করিয়ে দিচ্ছেন আমাদের?
মোহিনি সেই হাসিটা হাসার চেষ্টা করলাম আরেকবার। আমার বয়স তখন আঠারো। মোরা ছিল আমার গার্লফ্রেন্ড…
এসব আগেও বলেছেন, বেটসের গলায় ধমকের সুর।
কাজেই যা আগেই শুনেছেন, তা কেন বার বার জানতে চাইছেন? কেন সরাসরি কাজের কথায় আসছেন না? কেন বলছেন না, মোরার মার সঙ্গে ইতোমধ্যে দেখা করেছেন আপনারা? হাইওয়ে ধরে লং ড্রাইভ করে এসেছেন, অথচ পথে কোথাও পেশাব করার সুযোগ পাননি-কথাটা কি মানায়? যদি বলি, ওয়েস্টব্রিজে গিয়ে আগে মোরার মার সঙ্গে দেখা করেছেন আপনারা?
প্রশ্ন করার কথা আমাদের, হিসহিসে গলায় মনে করিয়ে দিল বেটস, আপনার না।
মোরার মা কী বলেছে, দয়া করে বলুন।
হাত তুললেন রেনল্ডস-সেটা আমার উদ্দেশে না, বেটসকে থামানোর জন্য। হ্যাঁ, মোরার মার সঙ্গে দেখা করেছি আমরা, কথা বলেছি। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, অনেক বছর হয়ে গেল মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় না তার, কথা হয় না। এমনকী, কোথায় আছে তাঁর মেয়ে, তা-ও জানেন না তিনি।
মোরার মার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন আপনারা?
মাথা নাড়লেন রেনল্ডস। আমাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি। একজন উকিলের মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের কাছে।
তারমানে…মোরার মা এত জলদি একজন উঁকিও ঠিক করে ফেলেছে?
জিজ্ঞেস করলাম, তার কথা বিশ্বাস করেছেন আপনারা?
আপনার বিশ্বাস হয়েছে? পাল্টা প্রশ্ন করা হলো আমাকে।
না।
বললাম বটে, কিন্তু আমি জানি, আসলে সব কথা বলিনি এখনও রেনল্ডস আর বেটসকে।
আমাকে যখন ছেড়ে দিল মোরা, আবেগের বশবর্তী হয়ে একদিন ঢুকে পড়েছিলাম ওদের বাসায়। বোকার মতো হয়ে গিয়েছিল কাজটা…কিন্তু আবেগ মানেই তো বোকামি। আসলে তখন মাথার ঠিক ছিল না আমার। নিজেকে হারিয়ে-যাওয়া একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল সে-সময়। একে তো হারিয়েছি আপন ভাইকে, আরেকদিক দিয়ে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল মোরা। কাজেই সমাজের দৃষ্টিতে যা অসভ্যতা–অর্থাৎ চুরি করে কারও বাসায় ঢুকে পড়া, তা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে কোনোকিছু চুরি করার উদ্দেশ্য ছিল না আমার।
তা হলে কেন ঢুকেছিলাম মোরাদের বাড়িতে? ব্লু খুঁজতে গিয়েছিলাম কোথায় আছে মোরা, অথবা কোথায় গেছে সে। হয়তো…একটা গোয়েন্দাসত্তা সেই ছোটবেলা থেকে লুকিয়ে ছিল আমার ভিতরে, আগে টের পাইনি কখনও; আঠারো বছর বয়সে নিজের প্রথম গোয়েন্দাগিরিটা করলাম আমি, খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম আমার হারানো-প্রেমকে।
তেমন কিছু জানতে পারিনি সেদিন। তেমন কোনো ক্লু-ও খুঁজে পাইনি। শেষে, যা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, তা-ই করেছিলাম–দুটো জিনিস চুরি করি মোরার বাথরুম থেকে একটা টুথব্রাশ আর একটা আয়না।
তখনও পুলিশের ডিটেকটিভ হওয়ার ইচ্ছা ছিল না আমার। তখনও কোনোদিন কল্পনা করিনি, গোয়েন্দাগিরিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেবো। কিন্তু কোনো কু না পেয়ে, বলা ভালো হতোদ্যম হয়ে, ওই টুথব্রাশ আর আয়না রেখে দিয়েছিলাম নিজের কাছে। পরে যখন ঢুকলাম পুলিশ ফোর্সে, আয়না থেকে জোগাড় করলাম মোরার ফিঙ্গারপ্রিন্ট, আর টুথব্রাশ থেকে ডিএনএ নমুনা। তারপর আপলোড করে দিলাম সেগুলো।
এবং শেষপর্যন্ত ধরা খেয়েছি আমি নিজেই। বলা ভালো, শেষপর্যন্ত ফাঁসিয়ে দিয়েছি আমার এককালের প্রেমিকাকে।
কখনোই হয়তো একজন হোমিসাইড ডিটেক্টিভ হতাম না আমি। অগি স্টাইলস নামের পুলিশের এক ক্যাপ্টেন, আমার সেই সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলেন। বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তারা দুজন একসঙ্গে বসে বিভিন্ন বিষয়ে গল্প করতেন, মদ খেতেন। আমার ভাই লিও খুব পছন্দ করত অগিকে।
মোরার মার কথা বিশ্বাস হলো না কেন আপনার? জিজ্ঞেস করলেন রেনল্ডস।
কারণ আমি তার ফোনলাইন ট্যাব করেছি।
কী! তাজ্জব হয়ে গেছেন বেটস। আপনি আপনার সাবেক প্রেমিকার মার…। ঈশ্বর! ডুমাস, আপনি পুলিশ না চোর?
এমন ভান করলাম যেন শুনিইনি বেটসের প্রশ্নটা। বললাম, মিসেস বেটসের কাছে আজব কিছু ফোনকল আসে। বলা ভালো, আসত।
তার ফোন রেকর্ড চেক করার কোনো ওয়ার্যান্ট আছে আপনার কাছে?
জবাব দিলাম না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি রেনল্ডসের দিকে।
তিনি বললেন, আপনার ধারণা, মোরাই করতেন সেসব ফোনকল?
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালাম।
আপনার সাবেক প্রেমিকা লুকিয়ে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কেন?
আবারও কাঁধ ঝাঁকালাম।
না জানলেও নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো ধারণা আছে আপনার?
আছে। কিন্তু সেটা এখনই বলতে চাই না। তাই প্রসঙ্গ বদল করার জন্য বললাম, ড্যাশ ক্যামটা দেখতে চাই আমি।
কিন্তু আমাদের প্রশ্ন এখনও শেষ হয়নি, বলল বেটস।
ড্যাশ ক্যামটা দেখতে চাই আমি, আবারও বললাম। এই রহস্যের কিনারা করতে আমার খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না।
আবারও অস্বস্তি দেখা দিল রেনল্ডস আর বেটসের চেহারায়, আরও একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন তারা।
আমার দিকে এক কদম আগে বাড়লেন রেনল্ডস। ড্যাশ ক্যাম বলে কিছু নেই আমাদের কাছে।
আশ্চর্য হলাম।
এবং সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন রেনল্ডস আর বেটস।
ড্যাশ ক্যাম মানে হলো, পুলিশের স্কোয়াড কারের ড্যাশবোর্ডে বসানো ভিডিও ক্যামেরা। কোনো পুলিশ অফিসার যখন ডিউটিতে থাকে, বিশেষ করে গাড়ি নিয়ে যখন কোনো অপরাধী বা সন্দেহভাজনকে ধাওয়া করে সে, তখন ওই ক্যামেরা চালু করে দেয়ার নিয়ম আছে।
আসলে… কণ্ঠের অস্বস্তি ঢাকতে পারছেন না রেনল্ডস, ড্যাশ ক্যাম বলে কিছু নেই মানে, ওই ক্যামেরার মাধ্যমে খুনের সময়ে ধারণ করা কোনো ভিডিও নেই।
মানে?
মানে…বিশেষ ওই সময়ে, যে-কোনো কারণেই হোক, বন্ধ করে রাখা হয়েছিল ক্যামেরাটা।
তারমানে…
আস্তে আস্তে মাখা ঝাঁকালেন রেনল্ডস। ছোট্ট একটা মিথ্যা বলেছি আমরা আপনার কাছে। খুনের সময় ডিউটিতে ছিল না ক্যান্টন।
কথাটা হজম করতে একটু সময় লাগল আমার।
এবং আমাদের ধারণা, বলছেন রেনল্ডস, ক্যান্টনই বিশেষ কোনো কারণে বন্ধ করে রেখেছিল ক্যামেরাটা।
কেন?
হয়তো…ডিউটি শেষ করে স্টেশনে ফিরে যাচ্ছিল সে।
স্টেশনের সঙ্গে শেষ কখন যোগাযোগ হয়েছিল ওর?
বারোটা নাগাদ।
এখান থেকে স্টেশন কত দূরে?
তিন মাইল।
তা হলে…আমি কি জানতে পারি…রাত বারোটা থেকে সোয়া একটা পর্যন্ত এখানে কী করছিল সে?
জানি না। সে-রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। তবে একটা কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার: রাত বারোটা থেকে সোয়া একটা পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে এখানেই ছিল ক্যান্টন।
ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, বলল বেটস। কারণ ডে-শিফটে ডিউটি থাকে যাদের, কাজ শেষ করে স্টেশনে গাড়ি জমা দেয়ার নিয়ম আছে তাদের।
এবং তারা ড্যাশ ক্যাম বন্ধ করে দিয়ে কোনো সন্দেহভাজনের পিছুও নেয় না, বললেন রেনল্ডস।
কোথাও কোনো ঘাপলা আছে, মনে মনে বললাম আমি।
বেটসের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। পকেট থেকে সেটা বের করে কল রিসিভ করল সে, একটু দূরে চলে গেল আমাদের থেকে। শুনতে পেলাম কাকে যেন বলছে, কোথায়?
কিছু একটা বলা হলো ও-প্রান্ত থেকে।
লাইন কেটে দিয়ে রেনল্ডসের কাছে ফিরে এল বেটস। এখনই যেতে হবে আমাদেরকে।
.
একটা বাস ডিপোতে নামিয়ে দেয়া হলো আমাকে। খা খা করছে ডিপোটা। যখন বুঝতে পারলাম অপেক্ষা করলেও কারও দেখা পাবো না, তখন ভাবতে লাগলাম, বাতাসে উড়ে এসে কোনো শুষ্ক টাম্বলউইড আমার নিঃসঙ্গতা ঘোচাবে হয়তো। টিকেট কাউন্টারে দেখা যাচ্ছে না কাউকে। টিকেট কাউন্টার বলে কিছু আছে কি না এখানে, সন্দেহ আছে।
গিয়ে উঠে পড়লাম সস্তা দরের একটা মোটেলে। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম আমার-জন্য-বরাদ্দকৃত-ঘরের বিছানায়। তাকিয়ে আছি ছাদের দিকে।
মোরাদের বাসায় আমার হানা দেয়ার খবর ঠিকই পৌঁছেছিল ক্যাপ্টেন অগির কাছে। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আমাদের বাসায় আসেননি তিনি। হয়তো ভেবেছিলেন, বাবা যদি দেখতে পান তাঁর ছেলেকে পুছতাছ করছে পুলিশ, তা হলে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবেন না ব্যাপারটা। তবে একদিন ঠিকই আমার মুখোমুখি হলেন তিনি-সেদিন কী একটা কাজে যেন স্কুলে যাচ্ছিলাম আমি।
তোমাদের বাসায় গিয়ে ঝামেলায় ফেলতে চাইনি তোমাকে, বলেছিলেন তিনি। কিন্তু ওভাবে কারও বাসায় ঢুকে পড়াটা সাংঘাতিক অন্যায়।
কিছু একটা গোপন করছেন মোরার মা, বলেছিলাম আমি।
গোপন করলেই বা কী? তিনি তার সন্তানের ভালো চাইতেন পারেন।
তারমানে তার সঙ্গে কথা হয়েছে আপনার?
তার সঙ্গে আমার কথা হোক বা না-হোক বিশ্বাস করো, তোমার জীবন থেকে মোরার হারিয়ে যাওয়াটাই ভালো। যে স্বেচ্ছায় চলে গেছে, তাকে যেতে দাও।
বিশ্বাস করেছিলাম আমি ক্যাপ্টেন অগিকে, আজও বিশ্বাস করি।
কিন্তু সেদিনও যেতে দিইনি মোরাকে, এখনও দেবো না।
কখনও কখনও, কাউকে কাউকে, যেতে দেয়া যায় না।
কারণ, বিশেষ সেই রাতে, তারাজ্বলা আকাশের নিচে, আমার বুকের উপর মাথা রেখে মোরা বলেছিল, ডোন্ট লেট গো…যেতে দিয়ো না।
আমি কাউকে বলিনি…বলতে পারিনি, আমার জীবন থেকে চলে যেতে চায়নি মোরা। বলতে পারিনি, আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে সে।
কেন বাধ্য হয়েছিল সে, তা জানার সুযোগ এসেছে এত বছর পর।
কী করবো এখন? যোগাযোগ করবো অগির সঙ্গে যোগাযোগ করাটা কি উচিত হবে? নাকি ফোন করবো এলিকে? যা যা ঘটেছে এ-পর্যন্ত, জানাবো ওকে? দরকার আছে কোন?
কেউ একজন টোকা দিচ্ছে আমার রুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে নাকি থাবা দিচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না–বেশ জোরে আসছে আওয়াজটা। নামলাম বিছানা থেকে।
দরজা খুলে দেখি, ইউনিফর্ম পরিহিত দুজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। কপাল কুঁচকে আছে দুজনেরই। দুজনই শ্বেতাঙ্গ, পেশী কিলবিল করছে দুজনের শরীরেই।
আমরা যদি ভিতরে আসি, অসুবিধা হবে আপনার? জানতে চাইল একজন।
ওয়ার্যান্ট আছে আপনাদের কাছে?
না
তা হলে হ্যাঁ।
হ্যাঁ মানে?
মানে আপনারা ভিতরে এলে অসুবিধা হবে আমার।
খারাপ কথা।
দরজা ছেড়ে দাঁড়ালাম, ভিতরে ঢুকে পড়ল দুই পুলিশ।
শুনলাম আপনি নাকি সাহায্য করতে চান আমাদেরকে, বলল ওদের একজন।
রেক্স আমার বন্ধু ছিল।
আবারও টোকা পড়ল দরজায়।
এক পুলিশ গিয়ে খুলে দিল দরজাটা।
স্টেইসি রেনল্ডস এসেছেন। ভিতরে ঢুকলেন তিনি, তাকালেন তার দুই কলিগের দিকে। মাথা নিচু করে ফেলল ওই দুজন।
এখানে কী করছ তোমরা? জিজ্ঞেস করলেন রেনল্ডস।
কিছু না, জবাব দিল একজন পুলিশ।
মানে… সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করল অন্যজন, একটু জিজ্ঞাসাবাদ করার চেষ্টা করছিলাম মিস্টার ডুমাসকে। বোকার মতো হাসল। আমরা আসলে আপনার কাজ সহজ করে দিতে চাই।
বের হও এখান থেকে! হিসহিসে কণ্ঠে বললেন রেনল্ডস। দুজনই!
মাথা নিচু করে চলে গেল দুই পুলিশ।
আমার দিকে তাকালেন রেনল্ডস। চলুন আমার সঙ্গে। কিছু একটা দেখাতে চাই আপনাকে।
.