২৩. ফতোয়া

দেশ জুড়ে চলছেই আমার মুণ্ডুপাত। এমন কী অবকাশের বাউণ্ডারি ওয়ালে পোস্টার পড়েছে, আরোগ্য বিতানের দেওয়ালেও। ‘তসলিমা নাম্নী এক কুলটা কুলাঙ্গার, যৌনাচারী পাপাচারী, ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলুন।’ যেন মজার বিষয়। তসলিমাকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে রঙ্গ করা যায়। এতে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বাধা কে দেবে, আমি তো কোনও দল করি না যে আমার দলের লোক গিয়ে ওদের মাথাটা ফাটিয়ে আসবে। এমন সময় খবরটি বেরোয়, প্রকাশ্য জনসভায় সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদের সভাপতি মাওলানা হাবীবুর রহমান আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছেন। মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমার মাথাটি কেটে নিয়ে হাবীবুর রহমানের হাতে যে দেবে, সে পাবে এই টাকা। পঞ্চাশ হাজার টাকা নেহাত কম টাকা নয় বাংলাদেশে। প্রথম মোটেও আমি গা করিনি। প্রতিদিন তো কতই খবর বেরোচ্ছে আমার বিরুদ্ধে। বাংলাবাজার পত্রিকার এই খবর আর এমন কি সত্য! মতিউর রহমান চৌধুরী অনেকদিন থেকে লেগে আছেন আমার পেছনে। খবরটি নিশ্চয়ই তিনি বানিয়ে লিখেছেন। পত্রিকাটি পত্রিকার জায়গায় রেখে নিজের কাজে মন দিই। এর ঘণ্টাখানিক পর পত্রিকাটি নিয়ে আবার খবরটি পড়ি। সিলেটের লোক মতিউর রহমান চৌধুরী, সিলেটের খবরাখবর অন্যান্য সাংবাদিকদের চেয়ে তিনি বেশি জানেন। ফতোয়ার খবরটি তিনি প্রথম পাতায় একটি চারকোনা বাক্সের মধ্যে ছেপেছেন। না, এ কোনও উড়ো খবর নয়, প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবর। হঠাৎ আমার বুকের মধ্যিখানটায় অনুভব করি হিম হিম কিছু। আন্দোলন হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে, মসজিদে প্রতি শুক্রবার আমাকে গালিগালাজ করা হয়, লিফলেট বিতরণ হয়, পোস্টার ছাপা হয়, দেয়ালে সাঁটা হয়, মিছিল মিটিংএ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে, ওয়াজ মাহফিলে, ইসলামি জলসায় আমার চিবিয়ে খাওয়া হচ্ছে, হচ্ছে হোক, সবারই গণতান্ত্রিক অধিকার যাকে খুশি গাল দেওয়া, কিন্তু মাথার মূল্য ধার্য হবে কেন! এ অধিকার কে কাকে দিয়েছে!

আমার ফাঁসির দাবিতে মাওলানা হাবীবুর রহমান সিলেট শহরে অর্ধ দিবস হরতাল ডেকেছেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম, কোথাকার কোন সাহাবা সৈনিক পরিষদের ডাকে হরতাল হবে না। কোনও বড় রাজনৈতিক দল ছাড়া হরতালের ডাক দিলেই তো আর হরতাল হয় না! কিন্তু আমাকে অতিবিস্মিত হতে হয়, যখন খবর বেরোয় যে অতি শান্তিপূর্ণভাবে সিলেট শহরে অর্ধ দিবস হরতাল পালন হয়েছে। শহরে কোনও দোকান পাট খোলেনি, গাড়ির চাকা ঘোরেনি। কী কারণ হরতাল পালনের! কারণ সিলেটের মানুষ আমার ফাঁসি চায়। ফাঁসি যদি সরকার না কার্যকর করে, তাতে ওদের অসুবিধে নেই। মাথার মূল্য ঘোষণা করা আছে। যে কেউ মাথাটি কাটার ব্যবস্থা করতে পারে। ঘরের গা- কাঁপা আঁধারে আমি রুদ্ধশ্বাস বসে থাকি। জানালা দরজার পর্দা টেনে দেওয়া, যেন বাইরে থেকে কেউ আমাকে লক্ষ করে গুলি না ছোঁড়ে। এই ব্যবস্থায় যে কাজ হবে না, তা আহমদ শরীফ বলেন। তিনি আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছেন?’

‘কিছু না, বসে আছি।’

আহমদ শরীফ ধমক লাগালেন, ‘বসে থাকলে হবে? কী কাণ্ড হচ্ছে, টের পাচ্ছেন না! এক্ষুনি পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেন।’

‘পুলিশ পাহারা? কি করে করব?’

‘মতিঝিল থানায় একটি চিঠি লিখে দেন। লেখেন যে আপনার মাথার দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং আপনার জন্য যেন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আমি লোক পাঠাচ্ছি, আমার লোক আপনার চিঠি নিয়ে থানায় দিয়ে আসবে।’

আহমদ শরীফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাত্ত্বিক সাহিত্যিক, ধর্মের কঠোর সমালোচক, তাঁর ফাঁসির দাবিতেও মোল্লারা একসময় পথে নেমেছিল। আহমদ শরীফ জানেন যে মোল্লার দৌড় কেবল মসজিদ পর্যন্ত নয়। তাঁর বাড়িতে যে সাপ্তাহিক আলোচনার আসর বসে ধড়িবাজদের ধর্মের ধড় ধসিয়ে দেবার, ওতে অংশ নিতে আমাকে একবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গিয়েছিলাম। কিছু কিছু বিজ্ঞ বিদগ্ধ মানুষ আছেন, যাঁদের বিরাটত্বের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া পেলে, যাঁদের বিচ্ছ.রিত বিভায় স্নাত হতে পারলে সমস্ত বিভ্রান্তি বিদায় হয়। আহমদ শরীফের মত এমন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির প্রশ্রয় আমাকে প্রসন্ন করে। গজনবী নামের এক লোককে পাঠালেন আহমদ শরীফ। গজনবী আমার নিরাপত্তা চাওয়ার চিঠি মতিঝিল থানায় দিয়ে এলেন। এরপর দুদিন যায়, তিনদিন যায়, সপ্তাহ চলে যায়, থানার লোকেরা মোটেও রা শব্দ করেন না। কোনও নিরাপত্তা রক্ষীর টিকিটি দেখতে পাওয়া যায় না। সকাল বিকাল হাত পা ঠাণ্ডা হচ্ছে। বাড়িতে বলে দিয়েছি কোনও অচেনা কেউ এলে যেন দরজা কেউ না খোলে। নিচে দারোয়ানদেরও বলা আছে ইন্টারকমে যেন কথা বলে নেয় কেউ আমার খোঁজে এলে। এখানকার নিয়মই এই, তারপরও বিশেষ ভাবে সচেতন থাকার জন্যও অনুরোধ করি। কি কারণ এই বাড়তি সতর্কতার তা অবশ্য ভেঙে বলি না। ভাল যে বাড়ি কেনার পর পরই একটি গাড়ি কিনে ফেলেছিলাম, এখন আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা রিক্সায় চড়তে হয় না। চড়ে অনেক ধেয়ে আসা লোকের তারস্বরে চিৎকার শুনেছি।
ওই দেখ দেখ তসলিমা যায়।
মাগীরে দেখ। মাগীরে দেখ।
ওই ধর ধর।
টাইন্যা নামা রিক্সা থেইকা। ধোলাই দে।
নাস্তিক যায় রে নাস্তিক যায়।
ওই খানকি!

এসব অনেক শোনা হয়েছে। আর কত! যে কোনও সময় আমাকে রিক্সা থেকে নামিয়ে শেয়াল শকুনের মত খুবলে খেয়ে ফেলতে দ্বিধা করত না ওরা। গাড়িতে চড়ে কোথায়ই বা আমার যাওয়া চলে! কোনও দোকানে! কোনও মেলায়! কোনও অনুষ্ঠানে! নাটক সিনেমা দেখতে! কোনও পার্কে! কোনও সভায়! না। কোথাও না। কোথাও আমার যাওয়া চলে না। আমি বুঝে ওঠার আগেই আমার চলাচলের সীমানা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠল। আমি বুঝে ওঠার আগেই আমি ঘরবন্দী হলাম। কবিবন্ধুরাও আমাকে কোথাও আর আমন্ত্রণ জানান না। কবিতার অনুষ্ঠান থেকে কবিতা পড়ে এসে জানান অনুষ্ঠান চমৎকার হয়েছে। লেখকদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে, অনুষ্ঠান শেষে জানান কেমন হল, কী হল। শিল্পী সাহিত্যিকদের র‌্যালী হচ্ছে, র‌্যালী থেকে ফিরে এসে জানান কেমন জমজমাট হয়েছে সে র‌্যালি। সকলে ব্যস্ত উচ্ছল উৎসবে, মৌসুমি মেলায়, মঞ্চে। নাটক হচ্ছে, গান হচ্ছে। সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। কেউ একবার দুঃখ করেন না আমার জন্য, আমি যে যেতে পারিনি। আমি যে যেতে পারব না, এটি যেন চিরন্তন সত্য। হঠাৎ যদি কোনওদিন বলে বসি, আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। তখন চমকে ওঠেন বন্ধুরা, বলেন, ‘বল কি বল কি, পাগল নাকি তুমি! বাইরে বের হয়ো না। কখন কি বিপদ হয় বলা যায় না।’ সুতরাং নিরাপদে থাকো। ঘরে বসে থাকো চুপটি করে। লক্ষ্মী মেয়ের মত। আমরা আনন্দ করে বেড়াবো। আমরা হৈ হল্লা করব। তোমার জন্য এসব নয়। নিরাপত্তা তোমার জন্য জরুরি। আনন্দ স্ফূর্তি নয়। উৎসব নয়। ঘরে বসে থাকতে মন খারাপ লাগে? কিন্তু বেঁচে তো আছো। বেঁচে থাকাটা প্রয়োজন। কথা ঠিক বটে। কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকতে কেমন লাগে তা সম্ভবত কেউই অনুমান করতে পারেন না। তবে ওঁরা আসেন আমার বাড়িতে। আমিও যাই মাঝে মাঝে ওঁদের বাড়িতে। বাড়িতে বাড়িতে আমাদের দেখা হয়। ওঁরা যখন আসেন, খানিকটা ভয়ে ভয়েই আসেন, এসবির লোকদের ভয়। আমার বাড়িতে আসা মানে সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হয়ে যাওয়া ওঁদের নাম ঠিকানা। নিচে নিরাপত্তা প্রহরীর ঘরে খাতায় নাম লিখে আসতে হয়, কারা আসছে। সেই খাতা থেকে এসবির লোকেরা প্রতিদিনই নাম টুকে নিচ্ছে। ওঁরা এলে অল্প সল্প গল্প হয়, খাওয়া হয় দাওয়া হয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়, রাত হয়। কিন্তু যা হয় সব ঘরে হয়। বাইরে নয়। বাহির আমার জন্য নয়। খোলা হাওয়া আমার জন্য নয়। মুক্তাঙ্গন আমার জন্য নয়। মৌলবাদিরা জোট বাঁধছে, খবর পাই। মসজিদ মাদ্রাসাগুলোয় ডাক দেওয়া হচ্ছে আন্দোলনের। সভার আয়োজন হচ্ছে। বড় সড় মিছিলের জন্য জল্পনা কল্পনা হচ্ছে। এক বিকেলে বাড়িতে কেউ নেই। ইয়াসমিন মিলন বাইরে, মা ময়মনসিংহে। আমি আর মিনু কেবল আছি। এমন সময় দরজায় শব্দ। দরজায় ছিদ্র দিয়ে দেখি ছ জন টুপিঅলা দাঁড়িয়ে আছে। কি চায় ওরা! মিনুকে বলি, দরজা না খুলে জিজ্ঞেস করতে, কাকে চায়। মিনু চেঁচিয়ে শুধায়, কারে চান?

দরজা খোলেন।

কারে চান কন?

দরজা খোলেন আগে। তারপরে বলি, কারে চাই।

মিনুকে আমি ইঙ্গিতে বলে দিই যেন দরজা না খোলে, যেন বলে দেয় কেউ নেই বাড়িতে। মিনু বলে। কিন্তু চলে যায় না ওরা, থাকে, থেকে দরজায় বিকট শব্দে ওরা লাথি দিতে শুরু করে। কলিং বেল চেপে ধরে রাখে। পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট পার হয়ে যায়, দরজায় লাথি কষা কলিং বেল চেপে রাখা কিছুই থামছে না। আমি কুলকুল করে ঘামছি। ইন্টারকম কাজ করছে না। ফোন ডেড। এই ন তলা থেকে চিৎকার করে কাউকে ডাকলে কেউ শুনবে না। দরজায় যত রকম সিটকিনি আছে কব্জা আছে সব লাগিয়ে মিনুকে নিয়ে আমার লেখার ঘরটিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। ওদিকে সদর দরজাটি ভেঙে ফেলতে চাইছে ওরা। ভেঙে ফেলবে, তারপর যে ঘরে বসে আছি, সে ঘরের দরজাটিও ভেঙে ফেলবে, তারপর! তারপর পাঁচজন আমার হাত পা মাথা চেপে ধরে থাকবে, একজন তার পাঞ্জাবির তল থেকে রামদা বের করে আমার গলাটি কাটবে। আমি দুহাতে গলাটি আড়াল করে রাখি। শরীর শিথিল হতে থাকে। শিথিল হতে হতে নুয়ে পড়তে থাকে, কুঁকড়ে শুয়ে থাকি মেঝেয়ে। মিনু, কালো মিশমিশে হাড়গিলে দাঁতাল মেয়েটি (কাজের মেয়ে + আপন ফুপাতো বোন) আমার মাথার কাছে নিঃশব্দে বসে থাকে। আমরা কেউ কারও শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পাই না। প্রচণ্ড ঘুম পেতে থাকে আমার।

ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ি কলকল করছে। মিলন আর ইয়াসমিন ফিরে এসেছে। মিনু বলল, লোকগুলো আরও অনেকক্ষণ ছিল ওখানে। অনেকক্ষণ কতক্ষণ! আধঘন্টা? একঘন্টা? আমার জানতে ইচ্ছে করে না। মিলনকে পাঠিয়ে দিই দরজার জন্য শক্ত তালা কিনতে। নিচের নিরাপত্তা প্রহরীদের জিজ্ঞেস করি কেন তারা ছটি দাড়িটুপিঅলাকে আমার বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দিল। প্রহরীরা জানিয়ে দেয় ছ জন লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে তা বলেনি তাদের কাছে। দু নম্বর দালানের কোনও এক বাড়িতে যাচ্ছে বলেছে। এর মানে যে কেউই আবদুল জলিল বা মান্নান তরফদারের বাড়িতে যাচ্ছে বলে আমার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াতে পারে। ইন্টারকমে তো নিচ থেকে খবর দিতে হয় আগে, কিন্তু যদি ইন্টারকম কাজ না করে, যেমন অকেজো হয়ে যায় মাঝে মধ্যে! প্রহরীদের বলে দিই, আমার বাড়িতে কেউ যদি আসতে চায়, যদি ইন্টারকম কাজ না করে, তবে প্রহরীদের কেউ যেন আগন্তুককে একা আসতে না দিয়ে সঙ্গে আসে। ‘ওপরে যাবে যে, আমাদের তো এত বাড়তি লোক নাই ম্যাডাম।’ নেতাগোছের এক প্রহরী আমাকে জানিয়ে দেয়।

‘এখনও সময় আছে, তওবা করে খাঁটি মুসলমান হয়ে যা, নয়ত ঘোষণা দিয়ে হিন্দু হয়ে যা। এ দুটোর কোনও একটি না হলে বিপদ হবে।’ চিঠির বাক্সে কেউ ফেলে রেখে গেছে কাগজটি। খোলা কাগজের হুমকি তো আছেই, উড়ো চিঠিও আসছে। ‘ধর্মের বিরুদ্ধে যদি আর একটি কথা লিখিস, তবে সেই দিন থেকে তোর বেঁচে থাকা হারাম হয়ে গেল মনে রাখিস।’ ফোনেও অচেনা কর্কশ কণ্ঠ মাথা ফাটাবো, হাত কেটে দেব, পা ভেঙে দেব, রগ কেটে দেব, রাস্তায় ফেলে গণধর্ষণ করব, মুন্ডু কেটে হাতে ধরিয়ে দেব বলে যাচ্ছে। আমি টের পাচ্ছি খুব কাছে কোথাও ওত পেতে আছে আততায়ী। আমার ঘরবন্দী জীবনে সুখের ঝরনা বইছে। বিপন্ন আমি বিমর্ষ হয়ে বিমূঢ় বসে থাকি। বিক্ষুব্ধ বিক্ষিপ্ত মন। কী করি! কায়সার এলে তার মুখে নয়, তার বগলের কালো ব্যাগটির দিকে চোখ যায়। ব্যাগটি থেকে বের করে নিই কালো পিস্তলটি। হাতে নিলেই গা শিরশির করে। ভেতরের বুলেট খুলে রাখে কায়সার, তারপরও শিরশির যায় না। আত্মরক্ষার জন্য যে কোনও একটি অস্ত্র প্রয়োজন আমার, হাড়ে মজ্জায় টের পাই। অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন, তসলিমার ওপর যেরকম বিপদ আসছে, ওর কাছে একটি পিস্তল থাকা উচিত। যখন পড়েছিলাম লেখাটি, মর্ম বুঝিনি, বরং সঙ্গে সঙ্গেই খারিজ করে দিয়েছিলাম উদ্ভুট্টি প্রস্তাবটি। পিস্তলটি আমি রেখেছি কাউকে শখ করে খুন করার জন্য নয়, নিজেকে রক্ষা করার জন্য। খুন করতে যদি কেউ আসে তবে এটি হাতে থাকলে হয়ত নয় আবার হয়ত বা পার পাওয়া যাবে। কিছু কিছু দুঃসময় মানুষের জীবনে আসে, যখন কিছুরই নিশ্চয়তা থাকে না, হয়ত বার ওপরই ভরসা করতে হয়। কিন্তু যেদিন রাখি পিস্তলটি সেদিনই সন্ধার পর এক সাংবাদিক ফোনে খবর দিল যে মতিঝিল থানা থেকে পুলিশ আসছে আমার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে। কেন তল্লাশি, কিসের তল্লাশি? মা ছটফট করছেন পাগলের মত। ‘এখন কি করবি? কই সরাইবি আপদটারে?’ মা আলমারির কাপড়ের তল থেকে পিস্তলের ব্যাগটি বের করে জায়গা খুঁজছেন লুকোনোর, বড় তোশকের তলে একবার রাখছেন, আবার দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে হাঁড়িপাতিলের ভেতর রাখছেন। আমি করুণ কণ্ঠে বলি, ‘মা, তল্লাশি চালাইলে যেইখানেই রাখো, সেইখান থেইকাই বাইর করব। লুকাইয়া লাভ নাই।’ মনে মনে বলি, এবার বোধহয় ওরা পেয়েই গেল কোনও ছুতো!

সেসময় বিকেলের হাওয়া খাওয়া মেজাজে ডাক্তার রশীদ হেলে দুলে আসেন বাড়িতে। ঘটনা খুলে বলি, যা করার খুব দ্রুত করতে হবে, এক্ষুনি আপদ সরাতে হবে, পুলিশ আসছে। রশীদের কালো মুখটি হাসির ছটা মিলিয়ে দিয়ে আরও কালো হয়ে গেল। রশীদের ঘাড়ে এই আপদ বিদেয় করার ভারটি আমি কোনও রকম ভাবনা চিন্তা না করেই দিয়ে দিই। আসলে দিতে হয় না, নিজেই তিনি দায়িত্বটি নেন। পিস্তলটি এখন কোথায় লুকোবেন? শার্টের তলে, প্যাণ্টের ভেতর? ভাবার জন্য কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন। কী করে নেবেন তিনি এটি! এক একটি মুহূর্ত এক একটি ঘন্টার মত দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত হাতে নিলেন ব্যাগটি, যেন টাকা পয়সা কাগজ পত্তরের ব্যাগ। লুকোলেই মনে হবে লুকিয়েছেন কিছু, তার চেয়ে এই ভাল। হাতে থাকবে আপদ, কেউ আপদ বলে ভাববে না। আমি যেন পুলিশ দেখলেই দরজা না খুলি, তাদের পরিচয়পত্র যেন দেখতে চাই, হাতে কোনও তল্লাশির আদেশ আছে কী না যেন দেখতে চাই উপদেশটি দিয়ে রশীদ বেরিয়ে গেলেন দ্রুত, মিলনকে সঙ্গে নিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে খুব স্বাভাবিক ভাবে মিলনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি মিলনকে নিয়ে রিক্সায় ওঠেন। রিক্সায়, কারণ এসময় গাড়ি নিলে, পথে, আমার গাড়ি বলেই গাড়ি থামাতে পারে পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নামেন রিক্সা থেকে। নেমেই দেখেন হাসপাতালের আঙিনায় প্রচুর পুলিশ আর ছাত্র ডাক্তারের জটলা। এখন পিছু হটবেন, নাকি সামনে যাবেন! রশীদ মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলেন সামনে যাবেন। সামনে হেঁটে যাবার সময়ই এক চেনা ডাক্তার এসে দাঁড়ালেন, জানালেন ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হয়েছে, একজন ছাত্র গুলি খেয়ে মারা গেছে। রশীদের ঘাম কপাল বেয়ে গাল বেয়ে বুকে নামছে। মিলনের দুরু দুরু বুক, জিভ শুকিয়ে কাঠ। ম্যাড়ম্যাড়ে স্বরেও সে যে কিছু বলবে, সে শক্তিও হারিয়েছে। পাঁচ হাত দূরে পুলিশ। ছাত্র মরার খবর দেওয়া ডাক্তারটি রশীদের হাতের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হাতে কি আপনার? মাল নাকি?’ ঘর্মাক্ত রশীদ মুখে জোর জবরদস্তি করে ‘আরে কী যে বলঞ্চ জাতীয় হাসি ফুটিয়ে রোগীর পাশে ডাক্তার যেমন করে হাঁটেন তেমন করে হেঁটে গেলেন। সোজা অপারেশন থিয়েটারে। থিয়েটারের ভেতরের আলমারিতে। সে রাতে আমার বাড়িতে পুলিশ আসেনি। না এলেও যে কোনওদিন আসতে পারে। লাইসেন্সহীন পিস্তলের ঝুঁকি আর নিচ্ছি না। যথাবিহীত আশঙ্কাপূর্বক ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে এটির প্রকৃত মালিক কায়সারকে এটি দিয়ে উদ্ধার হই।

শেষ পর্যন্ত আমার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বসানো হয় বাড়ির দরজায়। মতিঝিল থানায় পুলিশ মোতায়েন করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, আমার শিমুল-তুলো অনুরোধ ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়েছে থানার লোকেরা। জানিয়ে দিয়েছে মতিঝিল থানা আমাকে নিরাপত্তা দেবে না যতক্ষণ না থানায় তারা আদালতের আদেশ পায়। আদালতের আদেশ পেতে হলে একজন উকিলের প্রয়োজন। মানবাধিকারের জন্য দেশের দুজন বড় ব্যারিস্টার আদালতে লড়ছেন, ডক্টর কামাল হোসেন এবং আমীরুল ইসলাম। ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গে সরাসরি আমার আলাপ না থাকলেও তাঁর কন্যা সারা হোসেনের সঙ্গে অতি সম্প্রতি আলাপ হয়েছে। তিনি আমার খোঁজ নিয়েছিলেন তাঁর চেনা দুজন বিদেশী মানবাধিকার কর্মী ঢাকায় এসে আমার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন বলে। সারা হোসেনই আমাদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন মতিঝিলে ডক্টর কামাল হোসেনের আপিসে। সারা নিজে ব্যরিস্টার, অক্সফোর্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে এসে তাঁর বিখ্যাত আইনজ্ঞ বাবার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে সারা। সাদা সাদা সালোয়ার কামিজ পরেন। শরীরে একতিল মেদের চিহ্ন নেই। বাংলায় কথা বলেন, কিন্তু বাংলায় নয়, ইংরেজিতেই যে তিনি কথা বলতে বেশি অভ্যস্ত তা বোঝা যায় যখন তিনি খুব সচেতন ভাবে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে কথা বলেন। যে শব্দগুলো আমরা সচরাচর ইংরেজিতে বলি, তিনি সেসবের বাংলা বলেন, অপ্রচলিত যদিও। জাজকে বিচারক, হাই কোর্টকে উচ্চ আদলত, লোয়ার কোর্টকে নিম্ন আদালত, জাস্টিসকে ন্যায়-পরতা বলেন। আইনের সমস্ত শব্দের যদি বাংলা করতে হয়, তবে অনেক বাংলা শব্দই আমার বিশ্বাস সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব হবে। সারার অনেক বাংলা শব্দই আমার কানে অদ্ভুত ঠেকে। নিজেকে অনেকটা সেই রিক্সাঅলার মত মনে হয়, রিক্সারোহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইলে যে বলেছিল যে সে চেনে না বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়, আরোহী পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর গন্তব্যে থেমে বলেছিল, ‘আরে ইনিভার্সিটি আইবেন, সেইটা তো কইবেন।’ সারাই ফতোয়ার বিরুদ্ধে একটি মামলা নথিবদ্ধ করেন। অবশ্য এতে কাজ হয় না, কারণ আদালত থেকে বলে দেয়, সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে আমাকে সিলেটে যেতে হবে, ঢাকার আদালত এই মামলা নেবে না। মরতে যাবো আমি সিলেটে! শেষ পর্যন্ত সারা হোসেন আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন। আমার অনুপস্থিতিতে আদালত কিছুই করতে রাজি নয়। অগত্যা আমাকে যেতে হল পুরোনো ঢাকায় সারার নিম্ন-আদালতে। ঝুঁকি নিয়েই। সরকারের সামান্যও যদি নীতিবোধের বালাই থাকত, এ সময় সাহাবা সৈনিক পরিষদের বিরুদ্ধে আইন অমান্য করার মামলা ঠুকে দিত। কিন্তু সরকার এ ব্যপারে নীরব, যেন সাহাবা সৈনিক পরিষদ অন্যায় তেমন করেনি। অন্যায় আমিই করেছি, এই ফতোয়া প্রাপ্যই ছিল আমার। আদালতের আঙিনা গিজগিজ করছে লোকে। সকলের চোখ আমার দিকে। কে জানালো এই ভিড়ের লোকদের যে আমি আজ আদালতে যাবো! অদৃশ্য কোনও একটি শক্তি কাজ করছে, আমার চলাচল এই শক্তির নখদর্পণে। ভিড়ের লোকদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব কাজ সেরে নিতে হয়। আদালতে বিচারকের চেয়ারে বসা ম্যাজিস্ট্রেট গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এমন সব কথা লিখলে দেবেই তো ফতোয়া!’ ইচ্ছে তাঁর হয় না তবুও তাঁকে থানায় আদেশ দিতে হয় আমার বাড়িতে পুলিশ পাঠাতে। আদালত থেকে বাড়ি ফিরে পাহারা পুলিশের অপেক্ষা করতে থাকি। পুলিশের কোনও চিহ্ন নেই। অনেকদিন চলে গেল। আদালতের আদেশ পুলিশও যে অমান্য করতে পারে, তা আমার আগে জানা ছিল না, এখন জানা হয়। মতিঝিল থানা থেকে পুলিশ আসে শেষ পর্যন্ত, আসে অক্টোবরের ১৪ তারিখে। আগের দিন আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে লেখা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি কড়া চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বলেই কী! কেবল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নয়, প্রায় সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আমার নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছে। এদিকে ফতোয়ার বিরুদ্ধে দেশের ছত্রিশজন লেখক বুদ্ধিজীবী ফতোয়ার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। ফতোয়ার পক্ষে বিপক্ষে লেখালেখি চলছে। কৃশকায় দুটো পুলিশ আমার বাড়ির দরজার সামনে বসে বসে ঝিমোয়। ঝিমোয়, তবু বাড়ির সকলে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। মা ঝিমোনো পুলিশদের চা বানিয়ে খাওয়ান। বলেন, ‘পুলিশগুলার জন্য মায়া হয়।’ বারান্দায় দুটো চেয়ার পাঠিয়ে দেন ওদের বসার জন্য। এপির ফটোগ্রাফার নাদুস নুদুস পাভেল এসে দাঁড়ানো পুলিশের ছবি তুলে নিয়ে গেল, মজার জিনিস সম্ভবত। আমার কাছে অবশ্য এসবকে মজা বলে মনে হয় না। বরং অস্বস্তি লাগে পুলিশের অমন বসে থাকা দেখে। পড়শিরা বলাবলি করছে পুলিশের উপস্থিতি তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে, যে কোনও সময় না আবার বাড়ি আক্রমণ হয়। ইয়াসমিন এক ক্রুদ্ধ বাসিন্দাকে বলে এল, পুলিশ থাকলে তো বরং নিরাপদ বোধ করার কথা! কিন্তু নিরাপদ কেউ বোধ করে না। দরজার বাইরে পা রাখলেই লক্ষ করি আমার দিকে চেয়ে আছে অনেকগুলো পলক না পড়া চোখ। বাড়িতে নিরাপত্তা, বাড়ির বাইরে টিকটিকি। যেখানেই যাই না কেন, টিকটিকি পিছু নেয়, কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি তা সরকারি খাতায় লেখা হয়ে যায়।

উদ্ভট কিছু হতে চলেছে দেশে। টের পাই। গন্ধ পাই। মৌলবাদী নেতারা, যাদের ক্ষমতা অনেক, সব একজোট হচ্ছেন। বড় রাস্তায়, ছোট রাস্তায়, অলিতে গলিতে মৌলবাদীদের সভা হচ্ছে, বিষয় তসলিমা। নেতারা সাংবাদিক সম্মেলন করছেন, বিষয় তসলিমা। মাঠে ময়দানে সভা। তসলিমার জন্য একটি কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা। নেতারা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে আহবান করছেন তাঁদের ডাকে সাড়া দিতে। মসজিদে মসজিদে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে তসলিমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার। শত সহস্র মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রস্তুত মাঠে নামার জন্য। ঢাল প্রস্তুত। তলোয়ার প্রস্তুত। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়ছে। যেন তসলিমাকে এক্ষুনি একটি শাস্তি না দিলে ইসলামের সর্বনাশ হবে, দেশ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মিলন মাঝে মাঝে জুম্মাহর নামাজ পরতে শান্তিনগর মসজিদে যায়। মসজিদে বিলি করা লিফলেট হাতে বাড়ি ফেরে। কেবল মসজিদেই নয়, রাস্তাঘাটে বিলি হচ্ছে হরেক রকম তসলিমা বিরোধী লিফলেট। একদিন আমার হাতে মিছিলের একটি লিফলেট দিল মিলন। মিছিল হবে। বিশাল মিছিল।
নারায়ে তাকবীর = আল্লাহু আকবার
দ্বীন ইসলামের অবমাননা = মুসলমান সইবে না
রাসুলুল্লাহর অবমাননা = চলবেনা চলবেনা
বি.জে.পির তাবেদার = তসলিমা হুশিয়ার
রুশদীর সহযোগী = তসলিমা সাবধান
কুখ্যাত তসলিমার = বিচার চাই করতে হবে
নাস্তিক, মুর্তাদ বেঈমান = হুশিয়ার সাবধান

পবিত্র কোরআন, দ্বীন ইসলাম এবং মহানবী (সাঃ) এর বিরুদ্ধে জঘন্য কটাক্ষকারী, দেশের অব্যাহত সম্প্রীতি ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, কুখ্যাত মুর্তাদ খোদাদ্রোহী, রাসুলের দুশমন, শয়তান রুশদীর দোসর ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বি,জে,পির দাবার গুটি, নারী সমাজের কুলাঙ্গার

মুর্তাদ নিলর্জ্জ তসলিমা নাসরিনের

০গ্রেফতার ০ কঠোর শাস্তি ০ এবং সব আপত্তিকর লিখনী বাজেয়াপ্তের দাবীতে
বিরাট জনসভা
স্থানঃ বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেইট
আরিখঃ ১৮ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার ৯৩
সময়ঃ বেলা ২ ঘটিকা
ঈমানী চেতনা এবং দেশ, জাতি ও নবী প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মিছিল সহকারে দলে দলে যোগদান করুন।
আবেদনে ঃ
সর্বস্তরের ওলামা ও মাশায়েখগণের পক্ষে
(শাইখুল হাদীস মাওলানা ) আজিজুল হক
(মাওলানা গাজী ) ইসহাক
শায়খুল হাদীস, পটিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম
(মাওলানা মুফতী) আব্দুর রহমান
মহাপরিচালক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার,ঢাকা
(মাওলানা) মুহিউদ্দিন খান
সম্পাদক মাসিক মদীনা, ঢাকা
(মাওলানা কবি) রুহুল আমীন খান
(মাওলানা) আব্দুল গাফফার
মুফাসসিরে কোরআন, ঢাকা
(মাওলানা মুফতী) ওয়াহিদুজ্জামন
মোহাদ্দিস, বড়কাটরা মাদ্রাসা, ঢাকা
(মাওলানা) আব্দুল জব্বার,
মহাসচিব, বেফাকুল মাদারিস, বাংলাদেশ
(মাওলানা) নূর হোসাইন কাসেমী,
মুহতামিম, বারিধারা মাদ্রাসা, ঢাকা
(মাওলানা ক্বারী) ওবায়দুল্লাহ
খতিব, চকবাজার শাহী মসজিদ
(মাওলানা) মুহম্মদ হাবীবুর রহমান
আহবায়ক, বাংলাদেশ ছাহাবা সৈনিক পরিষদ

মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী দাঁড়ালেন, মুস্তফা নূরুউল ইসলাম লিখেছেন, ‘কী এক উদ্ভট দেশে, অতি বৈরী পরিবেশে বসবাস আমাদের, যেখানে কাউকে তার আপন স্বাধীনতায় ভাবতে দেয়া হবে না, স্বপ্ন দেখতে দেয়া হবে না। ধিককার দিই নিজেদেরকেই, এই পাপকাণ্ড অবলীলায় এখন ঘটে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধসম্ভূত আমাদের বাংলাদেশে। নইলে তসলিমা নাসরিন লেখেন, লিখে তাঁর ভাবনার কথা বলেন – কারা সেই বিকল্প হাকিম তাঁর বিরুদ্ধে চরম দণ্ড প্রদানের ফতোয়া জারি করার ধৃষ্ট সাহস যাদের? তসলিমার অপরাধ, তিনি অন্ধকারে, কুসংস্কারের জড়বুদ্ধির পাহাড়কে আঘাত করেছেন। মতলববাজদেরকে আঘাত করেছেন। তাঁর অপরাধ, তিনি নিজের মত করে লেখেন এবং তাঁর বিশ্বাসজাত উপলব্ধিসমূহ সৎমানুষের আন্তরিকতায় খোলামেলা করে বলেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে আমরা একমত নাও হতে পারি। তাই বলে বিংশ শতকের শেষ দশকে পৌঁছে, একটি স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক সিভিল সমাজে বাস করে লেখকের অধিকারকে নিহত হতে দেব, এটা হতে পারে না।

মনে পড়ছে, নজরুলকে একদা কাফের বলা হয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে শূলদণ্ডের ফরমান জারি হয়েছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা আবুল হুসেন আর কাজী আবদুল ওদুদকে দিয়ে একরারনামা সই করিয়ে নেয়া হয়েছিল। আশঙ্কা হয়, তবে কি সেই মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার পূনরুত্থান ঘটছে?

কিন্তু শেষ সত্যটা এই যে, ইতিহাসের চাকা কদাপি পেছনের দিকে ঘোরে না। আমরা তসলিমা নাসরিনের আপন মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে।’

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য, ‘তসলিমাকে নিয়ে যা হচ্ছে, বিষয়টি এখন আর সাহিত্যিক নয়, রাজনৈতিক। এখানে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, আলোচনা হচ্ছে মৌলবাদীদের আক্রমণের বিষয় হিসেবে। মৌলবাদীদের দিক থেকে বিষয়টি রাজনৈতিক। বইয়ের ব্যপারে আগ্রহ তাদের নেই। অথচ তারা এ ধরনের বিষয়ের জন্যই ওৎ পেতে থাকে। পাল্টা বক্তব্য দিয়ে খণ্ডন করে না। এ ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। এটা রাজনৈতিক। যখনই এ মৌলবাদী দলগুলো সুযোগ পায়, তখনই তারা এসব বিষয় নিজেদের দিকে টেনে নেয়। বক্তব্য যে জায়গায় আছে, সেটাকে তুলে নিয়ে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করে। নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। এসব নিয়ে যারা আক্রমণ করছে তারা প্রগতির শত্রু।’ বদরুদ্দীন উমর, বামপন্থী তাত্ত্বিক আমার অধিকাংশ লেখার সঙ্গে একমত নন, তিনিও বললেন যে আমাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলকাও সাম্প্রদায়িক শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা হচ্ছে, তিনি তাঁর ঘোর বিরোধী। ধর্মীয় বর্বরতা প্রতিহত করা দেশের সকল প্রগতিশীল শক্তিরই একটি জরুরী কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন। কে এম সোবহান লিখেছেন, ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার তার মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার। নাগরিক নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব এবং নাগরিকের বিনা বাধায় চলাফেরা করার স্বাধীনতা আছে। নাগরিকের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার দেয়া আছে এই ভষায়, বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না যাতে কোনও ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। যে ভাষায় তসলিমা নাসরিনের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মৌলবাদী ও রক্ষণশীলরা আক্রমণ করেছে তাতে তার সুনাম নিঃসন্দেহে ক্ষুণ্ন হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতাই আইন শৃঙ্খলার অবনতির অন্যতম কারণ। যারা তসলিমার মেধাকে সহ্য করতে পারে না, তিনি এই বয়সে সাহিত্য জগতে যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, সে সম্পর্কে যারা ঈর্ষান্বিত তারাই তার বিরুদ্ধে অশালীন অপপ্রচার চালান। অপব্যাখ্যা দেন তাঁর মতামতের। সে মতামত সম্পর্কে যে অপব্যাখ্যাকারীরা সম্যকভাবে পরিচিত তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তসলিমার প্রতিভার, তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি যাদের কাছে অসহনীয় তারাই তাঁকে হুমকি দেয়, দুর্নাম রটায়।’

ভোরের কাগজে সম্পাদকীয় লেখা হল। ঞ্ছসময় এগিয়ে যাচ্ছে, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এগুচ্ছে না বাংলাদেশের সমাজ। এই সমাজকে সব সময়ই পিছনে টানছে সাম্প্রদায়িক বিভেদ, মৌলবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলতা। একাত্তরে এই মৌলবাদী শক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করেছিল কাফের বলে। এখানো তারা চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মের অপব্যবহার, পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করে যাচ্ছে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে, একের পর এক বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল কর্মী হচ্ছে এদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। এদের সাম্প্রতিকতম টার্ণেট তসলিমা নাসরিন। তসলিমা নাসরিনের লেখা এই ফতোয়াবাজদের উষ্মার কারণ। যে কোনও বই কারও কাছে আপত্তিকর মনে হতে পারে, এক লেখা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, এমন কোনও কথা নেই। তসলিমা নাসরিনের লেখা নিয়েও আছে বিতর্ক, তার লেখার পক্ষে ও বিপক্ষে আছে নানা জোরালো মত। এসব লেখার প্রতিপাদ্য নিয়ে যে কেউ আপত্তি তুলতে পারেন, তবে আপত্তিটা আসা চাই গণতান্ত্রিক উপায়ে, সভ্য পন্থায়। কিন্তু সিলেটের তথাকথিত ছাহাবা সৈনিক পরিষদ দেশের প্রচলিত আইন ও সভ্য রীতির চরম অবমাননা ঘটিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় তসলিমা নাসরিনকে হত্যার আহবান জানিয়েছে। হত্যাকারীকে নগদ ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার দেবার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। সিলেটে তারা তাদের কার্যক্রমের সমর্থনে হরতালও আহবানও করেছিল একদিন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে তারা প্রতিষ্ঠা করতে চায় একখণ্ড মধ্যযুগ। দেশে আইনানুগ সরকার, বিচার ব্যবস্থা, আইনের শাসন প্রচলিত থাকা অবস্থায় কি করে একদল মানুষ একজন লেখককে হত্যার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করতে পারে, তা বোঝা কঠিন।

এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে লণ্ডনভিত্তিক আ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আইনের আশ্রয় চেয়েছেন তসলিমা নাসরিন। আদালত তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশকে। কিন্তু ওই ধর্মব্যবসায়ীরা বন্ধ করেনি তাদের কার্যক্রম। বরং তারা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন সংগঠিত করে চলেছে, তারা নেমেছে আটঘাট বেঁধে। দেশের প্রচলিত আইনের ঘোরতর অবমাননা করে যারা দেশটিকে ঠেলে দিতে চায় নৈরাজ্যের দিকে, তারা কি করে এমন প্রকাশ্যে বিনাবাধায় চালিয়ে যেতে পারে তাদের কার্যক্রম? আমরা প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তেমনি লেখকের লেখার স্বাধীনতাও হওয়া উচিত আমাদের অঙ্গীকার। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র বলতে তাই বোঝায়। আমাদের সংবিধান বাক ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়।”

আজকাল ব্যালেন্স বলে একটি শব্দ খুব চলে পত্রিকা পাড়ায়। বিশেষ করে প্রগতিশীলদের পত্রিকায়। এই সম্পাদাকীয়টির লেজে খানিকটা ব্যালেন্স রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে এভাবে, ঞ্ছকোনও লেখককে হত্যার উস্কানি দেওয়া তাই কিছুতেই সুস্থতার লক্ষণ নয়। ইসলামের মূল নীতিও তাতে লঙ্ঘিত হয়। (হয় কি? ইসলাম কিন্তু বলে হয় না)পাশাপশি লেখকের স্বাধীনতা বলতে যে কেবল যা খুশি লেখার স্বাধীনতা বোঝায় না ( কার খুশি মত লিখতে হবে লেখককে?), তার সঙ্গে আপনা আপনিই যুক্ত হয় এক ধরনের দায়িত্ব ( আমি কি দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি?), তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না কোনও প্রকৃত লেখককে ( আমি তবে প্রকৃত লেখক নই)। কোনও সচেতন লেখক (আমি তবে নিশ্চিতই অসচেতন লেখক) নিশ্চয়ই চাইবেন না, তার লেখা ব্যবহৃত হোক মতলববাজদের রাজনৈতিক স্বার্থে (লেখক যখন লেখেন, তখন কি করে জানবেন তাঁর লেখা মতলাববাজরা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করবে কি না)।”

নিঃসন্দেহে ভাল লেখা। ভাল লেখার আকালে এটিই ভাল লেখা। আকাল বলছি এই জন্য যে, ফতোয়ার পক্ষেই অধিক লেখা ছাপা হচ্ছে। ফতোয়ার বিপক্ষে কোনও যুক্তিবাদীর কলম হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে ওঠে। শামসুর রাহমান দুঃখ করে লেখেন, ঞ্ছবাংলাদেশে বসবাস করব, অথচ প্রায়শই মন খারাপ হবে না, এরকম কথা বলা মুশকিল। মন খারাপ করার মত ঘটনা এখানে হরহামেশা ঘটছে। খবরের কাগজ পড়তে শুরু করলেই মন খারাপ হয়ে যায়। হবেই বা না কেন? সড়ক দুর্ঘটনা, হরতাল পালনকারীদের উপর পুলিশী জুলুম, শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাস, লেখকের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, ফতোয়াবাজদের দৌরাত্মে গ্রামাঞ্চলে নারী নির্যাতন, কোনও কোনও নারীর প্রাণনাশ, চুরি ডাকাতির হিড়িক, মৌলবাদীদের তর্জন গর্জন, মুক্তমতি মানুষের বিড়ম্বনা, এইসব কিছুই যুক্তিবাদী খোলা মনের ব্যক্তিদের ব্যথিত করে, বিষণ্ন করে, কখনো কখনো ক্ষুব্ধ করে। এই ক্ষোভ প্রকাশ করাও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাঁরা মুখ খোলেন, তাঁরাই পড়েন বিপদে। অশিক্ষা যেখানে মুকুট পরে বেড়ায়, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার এবং গোঁড়ামি যেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত, সেখানে যুক্তিবাদী মানুষের কল্কে তো জোটেই না, বরং তাঁরা হয়ে পড়েন পশ্চাৎপদ, কূপমণ্ডুকদের আক্রমণের লক্ষ্য। আরো খারাপ লাগে, যখন দেখি একজন মুক্তমতি লেখক প্রতিক্রিয়াশীলদের, মৌলবাদীদের টার্ণেট হন তখন অধিকাংশ লেখক থাকেন উদাসীন, সেই লেখকের পক্ষে দাঁড়াবার কোনও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না, যেন এটা কোনও ইস্যু নয়। মৌলবাদীদের আক্রোশের ঝড়ে বিপণ্ন লেখকের পক্ষ অবলম্বন করা দূরে থাক, কখনও কখনও তাঁর বিরুদ্ধে বাক্যাবলী খরচ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁরাও আক্রমণ করেন সেই লেখককে। আক্রান্ত লেখকের সব মতের সঙ্গে সবাই একমত হবেন, এটা আশা করা যায় না। কিন্তু মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও একজন লেখকের স্বাধীনতার সপক্ষে লেখককুল কলম না ধরলে কারা ধরবে?”

শামসুর রাহমানের এই আহবানে যে লেখককূল কলম হাতে বসে গেলেন তা নয়। কেউ কেউ বলছেন, আমি ধর্ম নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি করি, আমার পক্ষে দাঁড়াবার কোনও মানে হয় না, কেউ বলছেন, ইচ্ছে করেই ধর্মের সমালোচনা করে আমি মৌলবাদীদের ক্ষেপিয়ে তুলেছি, তাদের হাতে ইস্যু ছিল না, ইস্যু দিয়েছি, তাদের শক্তি ছিল না, শক্তি দিয়েছি, আমার কারণেই দেশে মৌলবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিজেকে বিতর্কিত করে তোলার জন্য আমি এসব করেছি, কেউ বলছেন, নারী স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে আমি সীমা ছাড়িয়ে যাই, আমার পক্ষে মন্তব্য করা তাঁদের উচিত নয়। তারপরও কেউ কেউ কিছু লিখছেন। ওদিকে বিপক্ষে একশটি লেখা ছাপা হচ্ছে, এদিকে পক্ষে একটি। মৌলবাদিরা আঁটঘাট বেঁধে লেগেছে। জেহাদ ঘোষণা করেছে। ক্ষমতাসীনদের সহায়তা পেলে জেহাদে বিস্তর সুবিধে। সুবিধে পেয়ে পেয়েই এগোচ্ছে তারা। তাদের যত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকা আছে, নিজেদের মধ্যে মতের মিল না থাকলেও তারা আমার বিরুদ্ধে প্রতিদিন লিখে যাচ্ছে। মিথ্যে কথা। বানানো কথা। অসভ্য অশ্লীল কথা। উদ্দেশ্য পাঠকের মনে যেন ঘৃণা জন্মায়, যেন এই ঘৃণা গায়ে গতরে বড় হতে থাকে এবং বড় হতে হতে এমন অবস্থায় পৌঁছোয়, যে, পাঠক বলতে বাধ্য হয় যে আমার জন্য একটি মৃত্যুদণ্ড অতীব জরুরি। মৌলবাদী নয়, এমন পাঠকও যেন সেসব মিথ্যে পড়ে আঁতকে ওঠে এবং আমার ফাঁসির দাবি তোলে। অথচ সেই তুলনায় প্রগতিশীল পত্রিকাগুলো, যেসব পত্রিকায় মৌলবাদের বিপক্ষে সচরাচর লেখা হয়, সরব নয়। যেন আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদিদের আন্দোলন একটি বিচ্ছিত ঘটনা, যেন এটি আমার ব্যক্তিগত ব্যপার। এখানে তাদের নাক গলানোর কিছু নেই। বড় রাস্তা বন্ধ করে সভা হচ্ছে মৌলবাদিদের, হাজার হাজার মৌলাবাদী মিছিল করছে, রাস্তায় ট্রাফিক থেমে আছে ঘন্টার পর ঘন্টা, এ তসলিমার ব্যক্তিগত ব্যপার। মৌলবাদিরা তো আমাদের ঘাড়ে কোপ বসাতে আসছে না, আমরা কেন লাফাবো তসলিমার পক্ষে! কিন্তু খুব বড় লেখক যখন প্রতিবাদ করে লেখেন, তখন সেসব লেখা ছাপতে হয় পত্রিকায়, বড় লেখক বলেই ছাপতে হয়, তসলিমার পক্ষে বলে নয়। তবু হঠাৎ হঠাৎ কোথাও কোথাও কোনও বিবেক চেঁচিয়ে ওঠে, দৈনিক সংবাদে শাকিনা হাসীন অনেকটা যাত্রার বিবেকের মত মঞ্চে ঢুকে চিৎকার করে বললেন যে ‘না এটি তসলিমার ব্যক্তিগত ব্যপার নয়, কারণ সারাদেশের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি (চিহ্নিত ও ছদ্ম)- ব্যক্তি, দল ও পত্রপত্রিকা জেহাদে অংশ নিচ্ছে, সুতরাং সকল ক্ষুদ্র স্বার্থ, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সংকীর্ণতা ও পরশ্রীকাতরতার উর্ধে উঠে এই হামলাকে যেন প্রগতিশীল লেখকরা নিজেদের ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি গা বাঁচানোর নীতি অনুসরণ করে চলতে চলতে ভোটের বাক্সের দিকে তাকিয়ে এই যে অন্ধত্বের অভিনয় করে চলেছেন, কিন্তৃ যতই অন্ধ আর বোকা তারা সাজুন না কেন প্রলয়ের তাণ্ডব তাঁরাও যে এড়াতে পারবেন না, তা এখনই বুঝতে হবে।’ এখন যদি না বোঝেন, তবে, শাকিনার আশঙ্কা, অনেক দেরী হয়ে যাবে। না এ বুঝতে কোনও রাজনৈতিক দলের কেউ চাইলেন না। ব্যপারটি অনেকটা আমার ব্যক্তিগতই থেকে গেল। সাধারণত মৌলবাদিদের যে কোনও উত্থানে আওয়ামি লীগ পথে নামে। এখন আওয়ামি লীগ মৌনব্রত পালন করছে। আরে বাবা! আমার পক্ষে কথা না বল, অন্তত ফতোয়ার বিপক্ষে কথা বল। সে কথা বলতেও যদি তসলিমা নামটি উচ্চারণ করতে হয়, তাই করা হচ্ছে না। তসলিমা নামের সঙ্গে নাস্তিকতা জড়িয়ে আছে, এই নামটি উচ্চারণ করলে আওয়ামী লীগের ধর্মের লেবাস যদি খুলে যায়, তাই ভয়। কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড ফরহাদ মারা যাওয়ার পর মহাসমারোহে তাঁর জানাজা পালন হয়েছে, কোরান খতম কুলখানি কিছুরই অভাব ছিল না। বাম দলের সদস্যরা নাস্তিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন সে দীর্ঘদিন। সুতরাং তাঁদের দলের সঙ্গে আমার নামটি যোগ করলে যদি আবার ধর্মহীনতার কালি লাগে তাঁদের গায়েও! তবে তো যুগ পার হয়ে যাবে ওই কালি দূর করতে। সুতরাং কোন নাস্তিককে ফতোয়া দেওয়া হলে সে ফতোয়া নাস্তিক সামলাবে। আমাদের পূর্বনেতারা যেমনই ছিলেন, আমাদের দলকে ধরে বেঁধে আমরা অনেক আগেই আমরা মুসলমানি করিয়েছি, আল্লাহ রসুল মেনে চলি, আমাদের দিকে নজর দিও না। বাকি যে দল আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাসদ, সত্তর দশকে শেখ মুজিবর রহমানের বিরোধিতা করার জন্যই যে দলের জন্ম হয়েছিল। শেষ মুজিবের মৃত্যুর পর দলটির বেঁচে থাকার কোনও অর্থ না থাকলেও বেঁচে আছে, এরকম বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না বলে দলের অনেক নেতাই এ দলে ও দলে এমনকী আওয়ামি লীগেও গিয়ে ভিড়েছেন। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের আট দলীয় জোটে জাসদ, জাসদ ভেঙে বেরিয়ে আসা বাসদও ছিল। বাকি যে দল আছে এর মধ্যে বড় হল জাতীয়তাবাদী দল, সংক্ষেপে বিএনপি। জাতীয়তাবাদী দলে আর মৌলবাদী দলে কোনও ফারাক নেই বললে চলে। বিশেষ করে একানব্বইএর নির্বাচনে জামাতের সাহায্য সহযোগিতায় করুণা কৃপায় বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অল্প যেটুক ফারাক ছিল, সেটিও প্রায় যাচ্ছে যাবে করছে। সংসদে এখন জামাতে ইসলামির আঠারোটি আসন। চল্লিশ লক্ষেরও বেশি ভোট পেয়েছে জামাতে ইসলামি। আমাদের কবি-এরশাদ এখন জেলের ভাত খাচ্ছেন, ছাড়া পেলে তিনিও যে দলবল সহ ভিড়তেন মৌলবাদীর দলে, এ নিশ্চিত। জাতীয় পার্টির কোনও চরিত্র ছিল না, এরশাদের জেল হয়ে যাওয়ার পর পরই জাতীয় পার্টির বড় বড় নেতা আওয়ামি লীগে আর বিএনপিতে ভিড়ে গিয়েই তা প্রমাণ করেছে। দল বদল এ দেশের রাজনীতিতে ডাল ভাতের মত ব্যপার। ধূর, আজ এ দলে সুবিধে হচ্ছে না, ও দলে চলে যাই, ও দলে সুবিধে না হলে আরেক দলে চলে যাবো। নীতি আদর্শের বালাই না থাকলে এই হয়। মৌলবাদীরা তাঁদের নীতি আর আদর্শে অটল, জামাতে ইসলামির কাউকে দেখা যায় না অন্য দলে নাম লেখাতে। আওয়ামি লীগ সবসময় ফাঁক ফোকর খোঁজে ক্ষমতাসীন বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যখন গণআদালত বসিয়ে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছিল, আওয়ামি লীগ উড়ে এসে জুড়ে বসে জনপ্রিয়তা পেতে নির্মূল কমিটির দোসর হয়ে গেল, অথচ লেখকের বিরুদ্ধে জামাতপন্থী মৌলবাদিদের ফতোয়া দেওয়ার অন্যায়টি যখন সরকার দেখেও দেখছে না, দেশব্যাপী মৌলবাদিরা আগ্নেয়গিরির লাভার মত বেরিয়ে আসছে দেখার পরও মুখে যখন কুলুপ এঁটে বসে আছে বিএনপি সরকার, এই আওয়ামি লীগই তখন আশ্চর্য রকম ভাবে নিশ্চুপ। সরকার বিরোধী একটি চরম আন্দোলন শুরু করার জন্য এ ছিল একটি মস্ত বড় সুযোগ কিন্তু এই চমৎকার সুযোগটির দিকে সুযোগ সন্ধানী আওয়ামি লীগ মোটেও হাত বাড়াচ্ছে না। কারণ একটিই। তসলিমা। এদিকে সারাদেশের আলেমরা বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, তাদের মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতি প্রয় চূড়ান্ত। কোনও আলেম ওলামা ইমাম মাওলানা পীর মাশায়েখ কোথাও আর বসে নেই। মুসলিম ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটিও হয়েছে। ধর্মীয় রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক সব দল একত্র হয়ে ইসলামী ঐক্যজোট বানিয়েছে। আর কী চাই! নিজেদের মধ্যে মত পার্থক্য অন্তত এই ইস্যুতে নেই। পাঁচ দশ হাজার লোকের মিছিল হচ্ছে ঢাকা শহরে। রাজপথ দখল করে আছে মৌলবাদিরা। তারপরও যখন কোনও রাজনৈতিক দল মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে না, কোনও দলই, কোনও মানবাধিকার সংগঠন, কোনও লেখক সংগঠন, কোনও নারী সংগঠন পথে নামছে না তখন আমার ক্ষুদে বন্ধু নাহিদ ঝুনু মিতুল, নিপা তসলিমা সপক্ষ গোষ্ঠী নাম দিয়ে একটি গোষ্ঠী দাঁড় করিয়ে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান লেখা একটি ব্যনার হাতে নিয়ে নেমে পড়ে মৌন মিছিলে। মিছিল টিএসসি থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত যায়। তসলিমা সপক্ষ গোষ্ঠী একটি লিফলেটও ছেপেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে প্রগতিশীল বিবেকবান সকল সচেতন মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছে, ‘আসুন দলমত নির্বিশেষে আমরা তসলিমা নাসরিনের পাশে দাঁড়াই। তাঁর পক্ষে সংগঠিত হয়ে সরকারের কাছে দাবি জানাই, তসলিমা নাসরিনসহ নারী ও মানবতার মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে যারা আওয়াজ তুলছে তাদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তাসহ তসলিমা নাসরিনের পূর্ণ নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হোক এবং মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’

সব মিলিয়ে কতজন ছিল সেই মৌন মিছিলে! একশ দেড়শ! বেশির ভাগই মেয়ে। গার্মেণ্টেসএর মেয়েরাও যোগ দিয়েছে। ঝুনু বক্তুতা করতে ভাল জানে, প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে লোক জমিয়ে ফেলে। ঝুনুর সাহস আছে বটে। শার্ট প্যাণ্ট জুতো পরে। ছোট চুল। মেয়ে হয়ে ছেলের পোশাক পরেছে বলে ঝুনুকে অনেক কটুকথা শুনতে হয় রাস্তাঘাটে। ও পরোয়া করে না। মৌন মিছিলের আকর্ষণীয় দিক ছিল, যা শুনেছি, শামীম সিকদার, বিখ্যাত ভাস্কর, টিএসসিএ মোড়ে মিছিলটি দেখে এগিয়ে আসেন এবং নিজে তিনি ব্যানার বহন করেন। বাংলাদেশে শামীম সিকদারের মত সাহসী কোনও মেয়ে আমার জানামতে নেই। আর্ট কলেজের অধ্যাপিকা তিনি। একসময় ওই কলেজের অধ্যাপকগণ শামীম সিকদারের অপসারণের দাবীতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছিলেন। শামীম সিকদার কিন্তু হতাশ হয়ে কেঁদে কেটে আকুল হয়ে পিছু হটেননি। তিনি লড়াই করেছেন এবং সে লড়াইয়ে জিতেছেন। আন্দোলনকারী অধ্যাপকদের সামনে তিনি সশব্দে সদর্পে হেঁটে যান। শামীম সিকদারের বিশাল বিশাল ভাস্কর্য ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যেমন দাঁড়িয়ে আছেন শামীম শিকদার নিজের অবস্থানে। আত্মসম্মানবোধ তাঁর প্রবল। নিজের মর্যাদা এতটুকু ক্ষূণ্ন হতে তিনি দেন না। যেমন দেননি সেই ছোটবেলায়, যখন সাইকেল চালিয়ে ইশকুলে যাচ্ছিলেন, আর তার পরনের ওড়না টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক ছেলে, সেই ছেলেকে ধরে তো পিটিয়েছেনই, আর কোনওদিন ওড়না পরেননি, কামিজ পাজামাও পরেননি, শাড়ি তো জীবনেও পরে দেখেননি। পরেন শার্ট প্যাণ্ট। পায়ে শক্ত জুতো। হাতে প্রয়োজন হলে রিভলভার রাখেন। সেই কিশোরী বয়স থেকেই শামীম সিকদারের কথা যত শুনেছি, শ্রদ্ধায় আমার তত মাথা নত হয়েছে। শামীম সিকদারের মত হতে ইচ্ছে করত আমার, কিন্তু পারিনি। লজ্জা, ভয় আমাকে গ্রাস করে ছিল সবসময়ই। সেই শামীম সিকদার, নির্মলেন্দু গুণ এবং গুণের কিছু সাঙ্গ পাঙ্গ মৌন মিছিল শেষ করে সাকুরায় গেলেন। ওখানে গিয়ে আমাকে ফোনে খবর দিলেন, যেন যাই। শামীম সিকদারের সঙ্গে কখনও আমার সুযোগ হয়নি ঘনিষ্ঠ বসে কথা বলার। তাঁকে দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি যখন তিনি হাতে হাতুড়ি আর ছেনি নিয়ে টিএসসির সড়কদ্বীপে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা নামের বিশাল ভাস্কর্যের কাজ করছিলেন। শামীম সিকদারের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ আমাকে ঠেলে নেয় সাকুরার দিকে। আমি যাচ্ছি, এমন সময় দেখি ছোটদা আমার বাড়ির দিকে আসছেন, তাঁকে তুলে নিই গাড়িতে। সাকুরার পেছনের একটি টেবিল দখল করে বসেছে সবাই। শামীম সিকদারের পরনে শার্ট প্যান্ট, কোমরে শক্ত চামড়ার বেল্ট। পায়ে বুট। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, ‘তোমার পক্ষে তো মিছিল করে আসলাম। খুব ভাল হইছে মিছিল।’ এরপর বিস্তারিত বিবরণ শুনতে হল মিছিলের। শামীম সিকদারের সাহচর্য পেয়ে আমি এমনই উত্তেজিত যে মিছিল তখন আমার কাছে কোনও বিষয় নয়। শামীম আমার কাঁধ চাপড়ে বললেন, ‘ভয় পাবা না। ভয় পাবা না। মোল্লা হারামজাদাগুলা কিμছু করতে পারবে না। অত সোজা নাকি? তুমি ভয় পাইলেই ওরা মাথায় উঠবে। যা লিখতাছ লেইখা যাও। আমরা আছি। কোনও অসুবিধা হইলে আমারে খবর দিবা। দেখি তোমারে কোন শালায় কি করে! পিটাইয়া হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা দিব।’

শামীম তাঁর সিগারেটের প্যাকেট ঠেলে দিলেন আমার দিকে। মেয়েদের সিগারেট খাওয়া যে সমাজে কোনও মানুষ কল্পনাও করতে পারেন না, সেই সমাজে বাস করেই তিনি রাস্তা ঘাটে রেস্তোরাঁ বারে সবখানেই সিগারেট খান। এই একটি মানুষ, কোনওদিন পরোয়া করেননি লোকে কি বলবে তার। আমাকে মদও দেওয়া হয়। মদ খেয়ে অভ্যেস নেই আমার। দুতিন চুমুক খেয়েই দৌড়োতে হয় বমি করতে। বমির কথা চেপে রাখি। আবার না শামীম সিকদার বলে বসেন, ‘আরে মেয়ে, তুমি ওই সামান্য মদও খাইতে পারো না! এর মধ্যেই তিনি বলে বসেছেন, আমি ত ভাবছিলাম তুমি খুব শক্ত মেয়ে, কিন্তু না। তুমি একেবারে হাউজওয়াইফদের মত লজ্জাশীলা। আমি বুঝে পাচ্ছি না, তোমার মত নরম নিরীহ মেয়ের পিছনে মোল্লারা লাগল কেন!’

শাড়ি প্রসঙ্গেও বলেছেন, ‘শাড়ি পরো কেন? শাড়ি একটা পোশাক হইল? শাড়ি পইরা তুমি কি ফাইট করতে পারবা টুপিঅলাদের সাথে? শাড়ি ধইরা কেউ টান দিলেই তো শাড়ি খুইলা পড়ে। শাড়ি ছাড়তে হবে।’

আমি যখন মোল্লাদের মিছিল হবে এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে শামীম সিকদার বলে উঠলেন, ‘তুমি একটা ভীতু। খুব ভীতু মেয়ে তুমি। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা যখন ভাইঙ্গা ফেলতে চাইছিল, আমি একলা গিয়া দাঁড়াইছি টিএসসিতে। কোন বেটা আইবি এইটা ভাঙতে। সাহস থাকে তো আয়! কোনও শালা ধারে কাছে ঘেসার সাহস পায় নাই।’

শামীম সিকদার আমার দিকে ফেরেন। চোখে করুণা।

‘জুডো কারাতে কিছু জানো?’

‘না।’

‘কিছুই শিখো নাই জীবনে!’

‘ওইসব জানলেই কি! আমি তো মাঠে নেমে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করছি না।’

‘বুঝলাম। তোমার যুদ্ধ হইল ত তোমার কলম দিয়া। তারা তো শুধু কলম হাতে নেয় নাই। তারা আরও অনেক কিছু হাতে নিছে। পেশির জোর দেখাইতেছে। পুরুষের জোর দেখাইতাছে। রাস্তাঘাটে ভয়ে তুমি বার হইতে পারো না। এইটা কোনও কথা হইল! আরে দুই তিনটারে যদি ঘুসি দিয়া ফালাইয়া দিতে পারো, টুপি পাঞ্জাবি খুইলা ল্যাংটা কইরা ছাইড়া দিতে পারো, ওরা আর তোমার নাম মুখে নেবে না।’

শামীম সিকদারের মত সাহসী হওয়া আমি জানি আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোনওদিন। সবাই শামীম সিকদার হতে পারে না। শামীম সিকদার বাংলাদেশে একজনই। ভয় ভীতি লজ্জা শরম, পাছে লোকে কিছু বলে এসবের তোয়াককা তিনি কোনওদিনই করেননি। অসম সাহসী মানুষটির পাশে বসার সুযেগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মানি।

খবরের কাগজ, আজকের কাগজ, সমীক্ষণ, ভোরের কাগজ, অনন্যা, যায় যায় দিনে আমার কলাম নিয়মিত ছাপা হচ্ছে। ইস্তফার পর এখন দুহাতে লিখছি। যায় যায় দিন এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক কাগজ। সম্পাদনা করেন শফিক রেহমান। শফিক রেহমান অনেককাল লণ্ডনে ছিলেন, সম্প্রতি দেশে ফিরে পত্রিকা বের করছেন। এরশাদ আমলে একবার তাঁকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এরশাদের পতন ঘটার পর তিনি দেশে এসে দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছেন। যায় যায় দিনে শফিক রেহমানের অনুরোধে কলাম লিখি, কিন্তু লিখে স্বস্তি পাই না। কারণ ধর্ম নিয়ে কোনও বাক্য লিখলে তিনি দিব্যি তা উধাও করে দেন। আজকাল এরকম হচ্ছে প্রায় সব পত্রিকায়। মৌলবাদ নিয়ে লেখো, সে চলবে। কিন্তু ধর্মকে আক্রমণ কোরো না। আগে যেমন ইচ্ছে লিখতে পারতাম পত্রিকায়। কোনও রকম কাটছাট করা হত না। এখন দেখছি লেখার স্বাধীনতা অল্প অল্প করে লোপ পাচ্ছে। কোনওরকম অনুমতি না নিয়ে পত্রিকার সম্পাদকরা আমার লেখা থেকে বাক্য উড়িয়ে দেন, শব্দ ফেলে দেন। লেখাকে কেটে পঙ্গু বানিয়ে তারপর পাঠকের জন্য পরিবেশন করেন। ভোরের কাগজে বেদ বাইবেল ও কোরানের নারী বলে ধারাবাহিক একটি রচনা লিখছিলাম, সেটিও হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল। বন্ধ করার কারণ হল ধর্ম। ধর্ম ছাড়া অন্য যে কোনও বিষয় নিয়ে লিখতে পারি, এতে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। ধর্মের আক্রমণে দেশ ধ্বংস হচ্ছে, কিন্তু ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। আমার লেখা ছাপা হলে নাকি পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়, সে কারণেই লেখার জন্য চাপ অনুরোধ আসে। আমি জানিনা কতটুকু কে বিশ্বাস করে আমি যা লিখি তা, কিন্তু কাটতি বাড়ে বলে এখনও আমাকে বহিস্কার করার সাহস পাচ্ছেন না। একবার রোববার পত্রিকার সম্পাদক সাজু আহমেদ আমার কাছে একটি লেখা চাইলেন, দিলাম, বেশ যত্ন করে ছাপলেন। এরপর আবার লোক পাঠালেন চিঠি দিয়ে, তাঁর আবদার আমি যেন নিয়মিত লিখি তাঁর পত্রিকায়। নিয়মিত আমাকে অনেকগুলো পত্রিকায় লিখতে হয়, তাই আমি সবিনয়ে জানিয়ে দিলাম, আমার সময় হবে না। আশ্চর্য এর কিছুদিন পরই তিনি আমার ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা রোববার বের করলেন। পঈচ্ছদে আমার ছবি, ভেতরে পাতায় পাতায় ছবি। পুরো রোববার জুড়ে যত লেখা আছে, তার প্রতি বাক্যে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা। কুৎসা যে এত নোংরা হতে পারে, অবমাননা যে এত অকরুণ হতে পারে, অসম্মাননা যে এত ভয়ংকর হতে পারে, হিংসা যে এত মারাত্মক হতে পারে, আগে আমার তা জানা ছিল না। ইসহাক খান রুদ্রর সেই বন্ধুটি, লেখাটি লিখেছেন। লেখার বিষয় আমার লেখালেখি নয়, বিষয় আমার যৌনজীবন। এ যাবৎ কত পুরুষের সঙ্গে আমার যৌনসম্পর্ক হয়েছে, কবে কোথায় কিভাবে সেসবের বিস্তারিত বানানো বর্ণনা। রুদ্রর সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার আগেও নাকি ময়মনসিংহে আমার প্রেমিক ছিল, যার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ছিল আমার, ইত্যাদি গল্প। সেই যে কলেজ জীবনে কিছুদিন বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বিভাগটি চালু হওয়ার শুরুতে কিছু বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম, সে কথাও উল্লেখ করেছেন, কারণ আমার বিজ্ঞাপন বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য কিছু অশ্লীল বাক্য তিনি রচনা করবেন। করেছেনও। পাঠক তো আর ষোলো বছর আগের বিচিত্রা খুঁজে দেখতে যাবে না সত্যিই আমি ওরকম বিজ্ঞাপন লিখেছিলাম কি না। ইসহাক খানের মাথায় এত যে কুবুদ্ধি তা লোকটিকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। গোবেচারা ধরনের চেহারা। জীবনে তাঁর স্বপ্ন ছিল গল্পকার হওয়ার, হতে পারেননি। এখন সাজু আহমেদের কল্যাণে গল্পকার হলেন বটে। চরিত্র হননের রগরগে গল্পখানা খুব বিকোলো। রোববারের সেই সংখ্যাটি তিনবার ছাপতে হয়েছে পাঠকের তাগাদায়। আমার ওপর প্রশংসা থাকলেও পত্রিকা চলে, নিন্দা থাকলেও চলে। দু হাজার বিক্রি হত রোববার, দুলক্ষ বিক্রি হয়ে গেল পলকে। সুতরাং প্রশংসার প্রয়োজন কী। নিন্দা দিয়েই ভরে ফেলা হোক না কাগজ! ব্যর্থ গল্পকার ইসহাক খান এই গল্পখানি লিখেই জীবনে প্রথম গল্পকার হিসেবে সাফল্য অর্জন করলেন। জীবন তাঁর সার্থক হল। কচুরিপানার মত অগুনতি পত্রিকা গজিয়েছে দেশে, দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, দ্বিমাসিক, ষৈনমাসিক। কম চলা পত্রিকাগুলো বেশি চলার লোভে তসলিমার গল্প তৈরি করে ছাপে। পঈচ্ছদে পঈচ্ছদে তসলিমার ছবি, ভেতরে কত গল্প কত কাহিনী। আমার সঙ্গে কোনও সাংবাদিকের সাক্ষাৎ ছাড়াই, কোনও বাক্যালাপ ছাড়াই আমার বড় বড় সাক্ষাৎকার ছেপে ছাপা হয়ে যায়। ফতোয়া নিয়েও কত রকম মজা করা হয়। হাবীবুর রহমান নাকি বলেছেন আমাকে বিয়ে করতে চান তিনি। উত্তরে আমি নাকি বলেছি হ্যাঁ আমি রাজি। এদিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা মূল্যের মাথাটি নিয়ে মাথার ঠিক নেই। আর ওদিকে হা হা, ওদিকে হি হি।

মতিউর রহমান চৌধুরির উদ্দেশ্য ছিল আমাকে ঘৃণা করার পরিমাণ কত তীব্র এ দেশে, তা ফতোয়ার ঘটনাটি দিয়ে প্রমাণ করা। কিন্তু বুদ্ধিজীবিরা যখন বিবৃতি দিলেন আইনবিরুদ্ধ ফতোয়ার বিরুদ্ধে, প্রচুর লেখালেখি শুরু হল দেশে এবং বিদেশে, আমার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার ভাল একটি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে আঁচ করে খানিক বিপাকে পড়েই হাবীবুর রহমান যে এরকম কোনও ফতোয়া দেননি অথবা দিলেও তিনি তা তুলে নিয়েছেন বলতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাবীবুর রহমান ফতোয়া তুলে নেওয়ার লোক হবেন কেন! তাঁর ডাকে গোটা সিলেটে অত্যন্ত চমৎকার ধর্মঘট পালন হয়েছে। ফতোয়ার কথাটি আপাতত উহ্য রেখে হাবীবুর রহমান জোর আন্দোলনে নেমেছেন। বিশাল বিশাল জনসভায় গরম গরম বক্তৃতা করছেন। ‘কুখ্যাত তসলিমা নাসরিনের সকল লেখা বাজেয়াপ্ত, তাকে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতেঞ্চ সর্বস্তরের উলামা- মাশায়েখগণের উদ্যোগে ঢাকার সিসিলি রেস্তোরাঁয় একুশে অক্টোবর একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন হয়। সম্মেলনে সাংবাদিকদের উদ্যেশে বলা হল, ঞ্ছতসলিমা নামটি দেখে মনে হয় সে মুসলমান-সন্তান। অথচ, তার আকীদা, বিশ্বাস, মন – মানসিকতা সম্পূর্ণ বিপরীত। সে পবিত্র কোরান, মহানবী (সাঃ) এবং ইসলামী শরিয়তের বিরুদ্ধে জঘন্য কটুক্তি করে খোদাদ্রোহিতায় লিপ্ত রয়েছে। … তসলিমার নির্লজ্জ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ অত্যন্ত আপত্তিকর লেখনির ফলে সমাজে, রাষ্ট্রে, দেশ ও বিদেশে অশ্লীলতা, বেলেল্লাপনা ও নগ্নতা মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ছে। এতে করে দ্বীন ইসলাম ও মহানবী (সাঃ) এর ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। উক্ত মহিলা পবিত্র কোরানের সূরা আলে এমরান, সুরা নিসা, সুরা বাকারা, সুরা হুজরাত, সুরা ওয়াকিয়া, সুরা আররাহমান ইত্যাদি নাম ধরে ধরে আল্লাহর বিধানের প্রতি ব্যঙ্গ করেছে, কটুক্তি করেছে। অনুরূপভাবে মহানবী (সাঃ) এর প্রতি জঘন্য ভাষায় কটাক্ষ করেছে। পবিত্র ধর্ম বিশ্বাসকে সে ভুল বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করেছে। সে আরো উক্তি করেছে, ধর্ম মানুষকে অমানুষ করে। ধর্ম নারীকে অপমানিত ও কুৎসিত করেছে। সে নারী নির্যাতন, নারী পুরুষে বৈষম্য ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কে দায়ী করেছে। ধর্ম বিশ্বাসীগণের প্রতি জঘন্য কটাক্ষ করে লিখেছে, যে সব নারী মহানবী (সাঃ) এর হাদীস মান্য করে আমি তাদের ধিককার না দিয়ে পারি না ইত্যাদি। যৌনাচার, ব্যাভিচার সকল ধর্মেই একটি ঘৃণ্য পাপ, অথচ তসলিমা নারী সমাজকে অবাধ যৌনতা ও ব্যাভিচারের প্রতি উৎসাহ প্রদানের উদ্দেশ্যে লিখেছে, আমার মনে হয় একটি নারী ১০টি পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রেখেও সতী থাকতে পারে। এধরণের লাগামহীন বক্তব্য প্রকাশ এবং সমাজে এগুলি ব্যাপকভাবে প্রচার করার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। একটি কথা সর্বজন বিদিত যে, যদি কোনও ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহি বলে প্রমাণিত হয়, সে যদি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তবে তার একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। ঠিক তেমনিভাবে মুসলমান নামধারী কোনও ব্যক্তি যদি দ্বীন ইসলাম, পবিত্র কোরান এবং মহানবী (সাঃ) এর প্রতি কটাক্ষ করতঃ দুর্নাম রটনা করে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির প্রয়াস চালায় তবে সে ধর্মদ্রোহী, শরিয়তের বিধান মতে তার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড।ঞ্জ সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ সাহাবা সৈনিক সমিতি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করে যে, সিলেটে তারা সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল এবং অর্ধদিবস হরতাল পালনের মাধ্যমে সরকারের কাছে তিন দফা দাবি পেশ করেছে, ঞ্ছ১. অবিলম্বে তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার, ২. তার সকল লেখা বাজেয়াপ্ত এবং ৩. তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান। এ দাবি তওহিদি জনতার প্রাণের দাবি। সরকারকে এ সব ন্যায্য দাবি মানতেই হবে। তসলিমার লজ্জা বইটি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে, অথচ লজ্জার চেয়ে বহুগুণ আপত্তিকর অন্যান্য বইগুলো বাজেয়াপ্ত করে সাহাবা সৈনিক পরিষদের ন্যায্য দাবি যেন মেনে নেওয়া হয়। আর বাংলাদেশে দ্বীন ইসলাম, পবিত্র কোরান এবং মহানবী (সাঃ) এর বিরুদ্ধে কটুক্তি করার জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান চালু করার দাবিতে ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।ঞ্জ হবে কেন, হচ্ছে। আমি ষ্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আন্দোলন কেবল দানা বাঁধছে না, বীভৎস রূপ ধারণ করছে।

মিছিল আসছে। একশ নয়, দুশ নয়, কয়েক হাজার লোকের মিছিল। কাকরাইলের মোড় থেকে মিছিল আসছে শান্তিনগরের দিকে। আমি জানালায় বসে দেখছি বড় বড় অক্ষরে ব্যানারের লেখা, তসলিমার ফাঁসি চাই। এগিয়ে আসছে মিছিল নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর বলতে বলতে। মিছিল আসছে। মা বিড়বিড় করে সুরা পড়ছেন। আমাকে জানালার কাছে দেখে সুরা উবে গেল মুখ থেকে। টেনে আমাকে সরালেন জানালা থেকে। সুরায় খুব কাজ হবে বলে মার বিশ্বাস হয় না, মা দৌড়ে গিয়ে জায়নামাজে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাথা ঠেকিয়ে রাখলেন, যদি মার প্রার্থণা আল্লাহতায়ালার কানে পৌঁছোয়। আল্লাহ তায়ালা এই জনরোষ থেকে আমাকে যেন রক্ষা করেন। মিছিল এসে থামল শান্তিনগরের মোড়ে। মোড়ে কিছু খাকি পোশাকের পুলিশ দাঁড়ানো। পুলিশ বাধা দিচ্ছে এগোতে। মোড় থেকে নারায়ে তকবীরের গর্জনে বাড়ি কেঁপে ওঠে।

এরকম প্রায়ই মিছিল আসে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে শান্তি নগরের দিকে। এরকম প্রায়ই প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি।

মানুষের এই ঢল যদি কখনও আমার ঘরে উঠে আসার সুযোগ পায়! দরজায় বসে থাকা দুটো পুলিশ কি আর রোধ করতে পারবে ঢল! দিন দিন বানের ফুঁসে ওঠা জলের মত এগোচ্ছে মিছিল।

শায়খুল হাদিস বিখ্যাত লোক। তিনি নতুন একটি কমিটি গঠন করেছেন। ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি। দলে দলে মুফতী মাওলানা যোগ দিচ্ছেন এই কমিটিতে। বিশাল ব্যানার নিয়ে বিশাল মিছিল করছে এই দল। বিশেষ করে শুক্রবার জুম্মাহর নামাজের পরই মিছিল শুরু হয়। কেবল মিছিল করেই বসে থাকে না এই দল। জাতীয় সংসদের স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।

মাননীয় স্পীকার
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
সংসদ ভবন
শেরে বাংলা নগর,
ঢাকা

জনাব,
যথাযথ সম্মানপূর্বক নিবেদন এই যে
১. বাংলাদেশের আপামর জনতা গভীর ভাবে ধর্মপ্রাণ এবং এ দেশের সকল সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যপারে অত্যন্ত সচেতন ও যত্নশীল এ সত্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু কতিপয় বিভ্রান্ত মহল জনগণের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানাকে প্রগতিশীলতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন মনে করে জনগণের ধর্মীয় চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের হীন তৎপরতা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ হেন দুষ্কর্মের পিছনে ইসলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সামাজিক সুস্থিতির প্রতি বৈরি মহল সমূহের মদদ ও যোগসাজস রয়েছে তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
২. তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কুখ্যাত লেখিকা ক্রমাগত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কলাম, বই ও উপন্যাস লিখে একাধারে বাংলাদেশের সকল ধর্ম বিশ্বাসীর ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হেনে চলছে। অন্যদিকে অত্যন্ত সুচতুর ও সুপরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারষ্পরিক বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে।
৩. মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যভিত্তিক অসৎ উদেবদশ্য প্রণোদিত উপন্যাস লজ্জা লিখার মাধ্যমে তসলিমা নাসরিন এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সর্বজন স্বীকৃত ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং দেশী বিদেশী কতিপয় সাম্প্রদায়িক মহলকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা পরায়ণতার দিকে উস্কে দিয়েছে। অথচ সরকার শুধুমাত্র লজ্জা উপন্যাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোনরূপ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যদিও তসলিমা নাসরিনের বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে বহু উস্কানিমূলক বক্তব্য রয়েছে যা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। সরকারের এহেন আচরণে দেশপ্রেমিক জনগণ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্থ।
৪. যদিও সাংবিধানিকভাবে এবং দেশের প্রচলিত আইনে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানা এবং তাদের মধ্যে পারষ্পরিক বিদ্বেষ ছড়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু এ ধরনের দেশ ও ধর্মবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান না থাকায় দেশদ্রোহী ও ধর্মবিরোধী মহল সমূহ বেপরোয়া ভাবে অপকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছে এবং সামাজিক সংঘাত ও অস্থিরতার ইন্ধন যোগাচ্ছে।
৫. বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগ মানুষ মুসলমান। লেখিকা তসলিমা নাসরিন তার বিভিন্ন বই ও লেখার মাধ্যমে মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন, নবী(দঃ)এর হাদিস এবং ইসলামী শরিয়তের বিভিন্ন বিধি বিধানের প্রতি অবমাননামূলক কটাক্ষ প্রতিনিয়তই করে চলেছে এবং তার এহেন ধর্মদ্রোহী আচরণের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল সকল ধর্মীয় মহল থেকে জোর প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও সরকার এ ব্যপারে দুর্বল আইনের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে রহস্যজনক ভাবে নিষিক্রয়তার পথই অবলম্বন করে চলেছেন। ফলে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অত্যন্ত যুক্তিসংগত কারণেই বর্তমান আইন কানুন ও সরকারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন।
৬. লেখিকা তসলিমা নাসরিন শুধু ধর্মের উপরেই আঘাত হানছে না, সমাজে প্রচলিত সার্বজনিন মূল্যবোধের বিপরীতে ব্যভিচার, অবাধ যৌন সম্পর্ক, বিবাহপূর্ব এবং বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক জুলুমের ফাঁপানো ফুলানো কল্পকাহিনী প্রচার করে সামাজিক সুস্থিতি বিনষ্টের অপপ্রায়াসেও লিপ্ত রয়েছে। তার লেখা যে পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে পড়ে এবং তা এ দেশের যুব সমাজকে উμছৃঙ্খলতা ও নৈতিক অক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বৈ ত কিছুই নয়।
এমতাবস্থায় আমরা দেশ প্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জোর দাবী জানাচ্ছি যে ১. দেশদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহী মুরতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড সহ কঠোর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন। ২. তসলিমা নাসরিনকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং ৩. তার যাবতীয় আপত্তিকর লেখা বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
(শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক)
আহবায়ক
ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
সাত মসজিদ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা

প্রায় একইরকম চিঠি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও দেওয়া হয়। ‘জনাব, আমরা অত্যন্ত হতাশা ও ক্ষোভের সাথে আপনার সমীপে নিবেদন করছি যে বাংলাদেশের বারো কোটি দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস ও আবেগ অনুভূতিতে আবমাননাসূচক আঘাত হেনে তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কুখ্যাত লেখিকা….।’

লেখকের মাথার মূল্য ধার্য করা হয়েছে বাংলাদেশে। এ খবরটি বিশাল খবর, বিশেষ করে ইওরোপ আমেরিকায়। সালমান রুশদির ঘটনার পর এরকম একটি খবর লুফে নেবে বটে বিদেশের প্রচার মাধ্যম। একজন লেখক তাঁর লেখার কারণে ফতোয়ার শিকার হয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডের দাবি তুলছে মুসলিম মৌলবাদীরা। রাজপথে মিছিল হচ্ছে। এমন সব খবর পড়ে লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশের মানুষ। ইওরোপে আমেরিকার বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে মানবাধিকার কর্র্মী, লেখক সমাজ, নারীবাদী দল। বিভিন্ন বিদেশী সংগঠন থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে, আমাকে যেন নিরাপত্তা দেওয়া হয়, মৌলবাদীদের যেন দমিয়ে রাখা হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় উপ সম্পাদকীয় লেখার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইংরেজিতে দুটো কথা না হয় চলে, তাই বলে লেখা! বলে দিতে নিই আমার পক্ষে অসম্ভব। তখন অসম্ভব কে সম্ভব করার জন্য এপির সাংবাদিক ফরিদ হোসেন এগিয়ে আসেন। এর মধ্যে ফরিদ হোসেন বেশ অনেকবার যাওয়া আসা করেছেন আমার বাড়িতে, বিদেশি পত্রিকা থেকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমার খবরাখবর নেওয়ার জন্য। ফরিদ হোসেন সুশিক্ষিত সাংবাদিক, অত্যন্ত ভদ্র, অমায়িক, আন্তরিক। কেবল সাংবাদিক হিসেবে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন না, দুঃসময়ে বন্ধুর মত পাশে দাঁড়াতেও আসেন। উপসম্পাদকীয়টি আমি বাংলায় লিখি, ফরিদ হোসেন আমার বাংলার ইংরেজি করে দেন। ডাক্তার রশীদ ঢাকা মেডিকেল থেকে সিলেটের মৌলভীবাজারে বদলি হয়ে যাওয়ার পর মাঝে মধ্যে ঢাকায় এলে আমার বাড়িতেই ওঠেন, আমার লেখার ঘরে তাঁর শোবার জায়গা করে দেওয়া হয়। তিনি দাদার মত উপদেশ বর্ষণ করে চলেন, দাদার মত বিদেশী সংগঠন থেকে আসা জরুরি চিঠিপত্রের উত্তর লিখে দেন। আন্তর্জাতিক লেখক সংগঠন পেন থেকে আমার খোঁজ করা হচ্ছে। খোঁজ করছেন মেরেডিথ ট্যাক্স। দিনে দশবার করে ফোন করছেন আমার বাড়িতে। প্রথম ফোন ধরে ইংরেজির আগা মাথা কিছু না বুঝে ফোন রেখে দিই। এরপর মেরেডিথ ট্যাক্সের ফোন এলে অন্য কাউকে ধরতে বলে আমি বাড়িতে নেই অথবা ঘুমোচ্ছি এই জাতীয় কিছু বলে দিতে বলি। মেরেডিথ কোত্থেকে আমার ফোন নম্বর যোগাড় করেছেন, তা সাধ্য নেই জানার। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার উকিল কে সেই খোঁজ নিয়ে ডক্টর কামাল হোসেনের ওপর ফোন ফ্যাক্সের তুফান বইয়ে দেন। পেন এর লেখিকা শাখার সভানেত্রী মেরেডিথ, তাঁর দায়িত্ব পৃথিবীর কোথাও কোনও লেখিকার ওপর কোনওরকম আক্রমণ এলে তাঁকে সাহায্য করা! মেরেডিথ আমাকে আর কী সাহায্য করতে পারেন নিউ ইয়র্কে বসে! সরকারি দপ্তরে যত বিদেশি আবেদন অনুরোধ এসেছে, আমি নিশ্চিত, সবই ময়লা ফেলার ঝুড়িতে চলে গেছে। এসবের দিকে আমাদের পুতুলবিবি মোটেও ফিরে তাকান না। ফোন আসছে ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, কানাডা, ইংলেণ্ড, ভারত নানা দেশ থেকে। আমি কেমন আছি, কী করছি, কী ভাবছি, নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি কি না জানার জন্য। ফোনে আশ মেটে না তাঁদের। উড়ে আসেন দূর দূর দেশ থেকে। প্রথম বিশ্ব হুমড়ি খেয়ে পড়ে তৃতীয় বিশ্বে। টেলিভিশন, রেডিও আর পত্রপত্রিকার সাংবাদিকের ভিড় লেগে গেছে আমার বাড়িতে। বিবিসি থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে গেল। তথ্যচিত্রও বানাচ্ছে বিবিসি। জার্মানির টেলিভশন থেকে লোক এল, কেবল সাক্ষাৎকার নয়, আরও কিছু চাই। পুরো একটি তথ্যচিত্র বানানোর জন্য যা কিছু প্রয়োজন। ফ্রান্স থেকে এল দুঘণ্টার একটি তথ্যচিত্র বানাতে। সেদিন আমার বাড়িতে শিবনারায়ণ রায় ছিলেন, সালমান রুশদির সঙ্গে আমার তুলনার প্রসঙ্গ এলে শিবনারায়ণ দৃঢ় কণ্ঠে বলে দিলেন, ‘সালমান রুশদি আর তসলিমার মধ্যে বিস্তর তফাৎ। সালমান রুশদি সমাজ পরিবর্তনের জন্য কোনও আন্দোলন করছেন না। তসলিমা করছেন।’ তথ্যচিত্রের দলটি এর পর সিলেটের হাবীবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিতে যায়, নিতে যে যাচ্ছে সে কথাটি আমাকে পুরো গোপন করেছে। এমন সতর্কতা। কিন্তু দলটির ছবিসহ ছাপা হয়ে যায় ইনকিলাবে। পুরোনো ঢাকায় নাকি কোনও এক হিন্দু পরিবারের সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছিল ওরা। গোয়েন্দা পুলিশের দল পিছু নিয়েছে ওদের। সরকারের ধারণা বিদেশীরা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তথ্যচিত্র করতে এসেছে। ইনকিলাবের আহবানে সরকার সেই দলের ওপর চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে দলটিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। অতি সতর্কতায় তথ্যচিত্রের ক্যাসেটের একটি কপি ওরা আগে ভাগেই ফরাসি দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছিল প্যারিসে। কত কি যে ঘটে যায় আমার অজান্তে! আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসা কোনও বিদেশীকেই এখন থেকে আর দেশে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বুদ্ধিমান সাংবাদিকরা অন্য কোনও কারণের কথা বলে দেশে ঢুকছে। ফ্রান্সের ল্য-মন্দ পত্রিকা থেকে ক্যাথারিন বেদারিদা এলেন। লিবারেশন পত্রিকার আন্তোয়ান দ্য গুডমার। গুডমারকে খুব ভাল লাগে আমার। ফরাসিদের ইংরেজি বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না, ধীরে ধীরে বলেন ওঁরা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি। আমি তো আপাদমস্তক বাঙালি, ফরাসির তো প্রশ্ন ওঠে না, ভাল করে ইংরেজি না জানা বাঙালি, আমার ইংরেজিও অমন ভাঙা ভাঙা। গুডমারকে নিয়ে একদিন গাড়ি করে ধলেশ্বরী নদীটি দেখিয়ে আনি। গুডমার বললেন, ‘এই যে বাইরে বেরোচ্ছে!, কোনও অসুবিধে হয় যদি!’ আমি বললাম, ‘ঘরে বসে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছে করে বাইরে বেরোতে।’ ফরাসি ফটো এজেন্সি থেকে যখন জিল সসেয়ার এলেন ছবি তুলতে, তাঁর অনুরোধে আমাকে ময়মনসিংহে যেতে হয়। জিলের খুব ইচ্ছে ময়মনসিংহের বাড়িতে যেখানে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে, যে ইশকুলে ছোটবেলায় পড়েছি, সেসবের ছবি নেওয়ার। এই যে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়া, যদিও হেঁটে নয়, রিক্সায় নয়, যদিও রাস্তাঘাটে দোকানপাটে, লোকের ভিড়ে, বাজারে থামা নয়, তারপরও আমার ভাল লাগে বেরোতে। গাড়ির জানালা দিয়ে অন্তত মানুষ দেখা যায়। ঘরের চার দেওয়ালের ভেতর বন্দী থাকতে থাকতে মনে হয় আমার বুঝি কবর হয়ে গেল ওখানেই। মরে তো যাবই একদিন, তাই বলে কি কবরে বসে কবরের দিন গুনতে হবে! শামীম সিকদারের ভয় পাবা না উপদেশটি বারবারই নিজেকে বলি।

ভারতের সানডে ম্যাগাজিন, স্টেটসম্যান থেকে সাংবাদিক আসেন সাক্ষাৎকার নিতে। সারা ভারতেই ফতোয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে সভা হচ্ছে। বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। সচেতন লেখকরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন লিখে। পত্রিকায় সম্পাদকীয় যাচ্ছে। কলকাতায় অন্নদাশংকর রায়ের নেতৃত্বে লেখকরা গিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসে স্মারকলিপি নিয়ে। দূতাবাসের দুয়ার খটাশ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওঁদের মুখের ওপর। কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির আয়োজনে আমার জীবন ও লেখার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সভা হয়। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা অনুষ্ঠানে ছিলেন, অবশ্য বাংলাদেশের কেউ ছিলেন না। অন্নদাশংকর রায় ওখানেও ছিলেন। তাঁর মতে আমি একবিংশ শতকের কন্যা, ভুল করে বিংশ শতকে জন্মেছি। আমি ফ্রান্স বা ইংলেণ্ডের কন্যা, ভুল করে বাংলাদেশে জন্মেছি। আরেকটি কথা বলেছেন, ‘তসলিমা একজন আ্যংরি ইয়ং উওম্যান, মোল্লারা একদল অ্যাংরি ওল্ড ম্যান। এদের মধ্যে মিটমাট অসম্ভব। অনেক কথার মধ্যে আরেকটি কথা, বাংলাদেশের জনমত আমরা এখান থেকে বদলাতে পারব না, সেটা পারবে সেখানকার জননায়ক বুদ্ধিজীবীরা, আমরা তাঁদের সমর্থন করতে পারি শুধু।’

এদিকে পেঙ্গুইন ইণ্ডিয়া থেকে লজ্জার ইংরেজি সংষ্করণ বেরিয়ে গেছে। ফোন আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে, প্রকাশকরা ফোন করছেন। তাঁরা লজ্জা বইটি অনুবাদ করে ছাপতে চান। ফতোয়ার খবরটি বিদেশের প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর ওখানকার মানুষের বদ্ধ ধারণা যেহেতু লেখক আমি, নিশ্চয়ই আমি এমন কোনও আপত্তিকর বই লিখেছি, যেটির কারণে মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে। সালমান রুশদিকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল স্যাটানিক ভার্সেসএর কারণে। আমার ফতোয়াও নিশ্চয়ই কোনও না কোনও বইয়ের কারণেই। লজ্জা বইটি সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সে অনেকদিন হয়ে গেল। কিন্তু সাংবাদিকরা পাকামো করে পাঠকের জানার তৃষ্ণা মেটাতে লজ্জাকে ফতোয়ার কারণ হিসেবে কোথাও কোথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু লজ্জা কি মৌলবাদীদের ক্ষেপে ওঠার মূল কারণ? মোটেও না। ওরা তো ক্ষেপেই ছিল। ক্ষেপে আগুন হয়ে ছিল, সরকারের লজ্জা নিষিদ্ধের ঘি ওদের আগুনে গিয়ে পড়েছে। তাই ফতোয়া। আর ফতোয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কিছু না করার ঘি ওদের আগুন আরও বেশি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই দেশ জুড়ে আন্দোলন। পেঙ্গুইন লজ্জা ছেপেছে, সে চলে। কারণ লজ্জার কাহিনী যদিও সম্পূর্ণ বাংলাদেশের পটভূমিতে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ যেহেতু ঘটে, পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না গল্পটি। কিন্তু জার্মান পাঠক বা ফরাসি পাঠক লজ্জার কী বুঝবে! আমি বিরক্ত কণ্ঠে প্রকাশকদের প্রশ্ন করি, ‘আপনারা কি জানেন লজ্জা বইটি কি নিয়ে?’

‘না, তা জানি না।’

‘এটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের স্থানীয় ব্যপার। প্রচুর তথ্য আছে। আপনাদের পাঠকের এসব পড়তে ভাল লাগবে না। উপন্যাস হিসেবে এটি ভাল কোনও বই নয়।’

‘সে নিয়ে আপনি মোটেও ভাববেন না। অনুগ্রহ করে আমাদের অনুমতি দিন।’

‘আমি এমন কোনও বই এখনও লিখিনি যেটি বিদেশে অনুবাদ হতে পারে। এখানকার সমাজের সমস্যা নিয়ে লিখি। কোনও বই আন্তর্জাতিক মানের নয়। আমি ভাল কোনও বই লিখি আগে, তারপর দেব আপনাদের।’

‘সে না হয় ছাপব, যা লিখবেন ভবিষ্যতে। কিন্তু আমরা লজ্জা ছাপতে চাইছি।’

‘কেন, লজ্জা কেন?’

‘লজ্জা তো বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। লজ্জার জন্যই তো ফতোয়া।’

‘না, লজ্জার জন্য আমাকে ফতোয়া দেওয়া হয়নি। লজ্জা বের হওয়ার আগে থেকেই আন্দোলন করছে মৌলবাদীরা। নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক পরে ফতোয়া দিয়েছে। লজ্জা বের হওয়ার পর ছ মাস চলেছে এখানে। কোনও মৌলবাদী লজ্জা নিষিদ্ধ করার দাবি করেনি।’

‘তবুও আমরা লজ্জাই ছাপতে চাই।’

‘এ বই আপনাদের ওখানে চলবে না।’

‘সে আমরা বুঝব। লজ্জা বইটি ছাপার অনুমতি তো দিন। আমরা অগ্রিম রয়্যালটি দেব।’

রিয়্যালটি কোনও ব্যপার নয়। ব্যপার হচ্ছে পাঠকের আগ্রহ। এখানকার হিন্দু মুসলমানের সমস্যা নিয়ে ওখানে আগ্রহ থাকার কথা নয়।’

‘খুব আগ্রহ আছে। আপনি আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। এসব আমরা দেখব।’

নাছোরবান্দা। ফ্রান্সের এডিশন দ্য ফামের মিশেল ইডেল দিনে তিনবেলা ফোন করেন, ‘তসলিমা আপনি তো নারী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছেন। এখানে আমাদের সংগঠনও দীর্ঘবছর ধরে একই সংগ্রাম করে আসছি। আমরা আপনার জন্য এখানে আন্দোলন করছি। আপনি আমাদের লজ্জা বইটি ছাপার অনুমতি দিন। আমরা কনট্রাক্ট ফরম পাঠাচ্ছি। আপনি সই করে দিন।’

‘দেখুন, লজ্জা বইটি নারী স্বাধীনতার ব্যপার নয়। নারী বিষয়ে আমার কিছু বই আছে। আপনারা দেখুন, ওর মধ্যে একটি ছাপা যায় কি না। যদিও আমি নিশ্চিত নই, বাংলাদেশের মেয়েদের সমস্যাগুলো আদৌ ওখানে..’

‘সে নিয়ে ভাববেন না। আমরা অন্য দেশের মেয়েদের সমস্যা জানতে চাই খুব। কিন্তু ওগুলোও ছাপবো। লজ্জা আগে ছাপবো।’

‘লজ্জা ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে। আগে পড়ে দেখুন ওটি, ছাপার যোগ্য কি না। আমি কিন্তু জানি যে আপনি পড়ার পর ছাপতে রাজি হবেন না।’

‘না বলব! বলছেন কি? আমরা লজ্জা বইটা পাওয়ার জন্য এমন আকুল হয়ে বসে আছি।’

‘কি আছে ওতে বলুন তো?’

‘ওতে ইসলামের সমালোচনা করেছেন। তাই তো মুসলমানরা ক্ষেপেছে।’

আমি তিক্ত গলায় বলি, ‘সম্পূর্ণ ভুল। কোনওরকম ইসলামের সমালোচনা নেই ওতে।’

‘দেখুন তসলিমা, আমরা ধর্ম বিশ্বাস করি না। আমাদের কাছে সব ধর্মই এক রকম। সব ধর্ম দ্বারাই মেয়েরা নির্যাতিত।’

‘সে কথা তো আমিও মনে করি।’

‘আপনি মনে করবেন না যে ইসলামের সমালোচনা বলে আমরা ছাপতে চাইছি বই। একজন নারীবাদী লেখিকা সুদূর বাংলাদেশে কি বই লিখেছে, যার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে, সরকার সেই বই নিষিদ্ধ করেছে। আমরা সেই বই পড়তে চাই। আমাদের পাঠক চাইছে পড়তে।’

‘আবারও বলছি লজ্জার জন্য ফাঁসি চাইছে না কেন। ফাঁসি চাইছে ইসলাম বিষয়ে আমার মন্তব্যের জন্য।’

‘ওই হল। আপনার লেখার জন্য ফাঁসি তো চাইছে দিতে!’

চলছেই। যত চলছে তত আমি অপ্রতিভ বোধ করছি। ফরাসি দুই প্রকাশক, মিশেল ইডেল আর ক্রিশ্চান বেস দুজনই লজ্জা ছাপার জন্য আমার অনুমতি নেবেনই নেবেন। আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে দুজনের মধ্যে। দুজনেই কনট্রাক্ট ফরম পাঠিয়ে দিলেন। মিশেল ইডেল আমাকে দিতে চেয়েছিলেন পাঁচ হাজার ফ্রাঁ অগ্রিম। ক্রিশ্চান বেস বলছেন তিনি তিরিশ হাজার ফ্রাঁ দেবেন। প্রতিদিন ফোন আসে ফ্রান্স থেকে, আমি কণ্ঠ শুনেই পালাই। লজ্জা আমার জন্যই বড় একটি লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী লাভ ফরাসি পাঠকদের এখানের ভোলার গ্রামে বা মানিকগঞ্জের কোনও এক অজপাড়াগাঁয়ে কি ঘটেছে তা জেনে! ক্রিশ্চান বেস হঠাৎ হঠাৎ পালিয়ে যাওয়া আমাকে খপ করে ধরে বলতে থাকেন ‘তসলিমা আপনি লেখক। অনেক প্রকাশক আছে ঝড় ওঠে যে বইটি নিয়ে সে বইটি ছেপে তারা লেখককে বেমালুম ভুলে যায়। কিন্তু আপনাকে আমরা সম্মান করি লেখক হিসেবে। আমরা ভাল লেখকের বই ছাপি, সে বই বিক্রি হোক বা না হোক। হঠাৎ নাম হওয়া কোনও লেখকের একটি বই হুজুগে ছাপা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। পৃথিবীর বড় বড় লেখকের বই ফরাসিতে আমরা ছাপছি। আপনি যে অন্য ফরাসি প্রকাশকের কথা বলছেন, সেই প্রকাশক নারীবাদী বই ছাপে, আপনার লজ্জা তো নারীবাদী বই নয়। তবে কেন তারা ছাপতে চাইছে, চাইছে লজ্জা নিয়ে এখন পত্রিকায় লেখা হচ্ছে বলে।’

আমি বলি, ‘আমি যে ভাল লেখক, তা কি করে জানেন? আপনি তো আমার লেখা পড়েন নি! আসলে সত্যি কথা, আমি কিন্তু ভাল লিখতে পারি না। এ দেশে অনেক লেখক আছেন, আমার চেয়ে হাজার গুণ ভাল। আমি তো ডাক্তারি পড়েছি। বাংলা সাহিত্য আমার বিষয় ছিল না। উপন্যাস কি করে লিখতে হয় এখনও শিখিনি। মূলত দেশের সমস্যা টমস্যা নিয়ে লিখি। মাঝে মাঝে অন্যায় অত্যাচার বৈষম্য ইত্যাদি দেখে খুব রাগ করে লিখি, এই যা।’

ক্রিশ্চান বেস আপন আপন সুরে বলেন, ‘আপনি আপনার লেখাকে এত ছোট করে দেখবেন না। আপনি লিখতে পারেন না বলছেন, না পারলে এত লোক আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপেছে কেন? নিশ্চয় আপনি একটি আঘাত করেছেন। সেই আঘাতটি তো সকলে করতে পারে না। ভাল সাহিত্যের যেমন মূল্য আছে, তেমনি সমাজ পাল্টাবার জন্য খুব আঘাত করে লেখারও মূল্য আছে। আত্মবিশ্বাস রাখুন। আত্মবিশ্বাস থাকলে আপনি আরও ভাল লেখা লিখতে পারবেন। আপনার লেখক পরিচয়টি আপনি না চাইলেও এটিই আপনার পরিচয় এখন। আপনি লিখুন। আমরা প্রকাশকরা কেবল তো জনপ্রিয় আর বিখ্যাত লেখকের লেখা ছাপি না, আমরা লেখককে লেখার, আরও ভাল লেখার উৎসাহ দিই। এটিও আমাদের কাজ। আমরা লেখক তৈরিও করি। সম্ভাবনা যাদের মধ্যে আছে, তাদের আমরা প্রেরণা দিই। আপনার মধ্যে সম্ভাবনা আছে তসলিমা।’

বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। বাংলাদেশের আইনে ফতোয়া নিষিদ্ধ হলেও ইসলামে এটি নিষিদ্ধ নয়। ইসলাম দিয়েই দিয়েছে কিছু কিছু শাস্তির বিধান। অবৈধ সম্পর্কে করবে, পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। অনৈসলামিক কাজ করবে, একশ একটা দুররা মারা হবে। মৌলবাদ জেগে উঠছে। হাওয়া এখন মৌলবাদিদের দিকে বইছে। গ্রামে গ্রামে ফতোয়াবাজ মাওলানাদের ফতোয়ার শিকার হচ্ছে মেয়েরা। সিলেটের ছাতকছড়া গ্রামে নূরজাহান নামের একটি মেয়ে দিতীয়বার বিয়ে করেছিল, যে বিয়ে, মাওলানা মান্নান বলেছেন ইসলামের নীতিবিরুদ্ধ, কারণ নূরজাহানের সঙ্গে তার প্রথম স্বামীর তালাক হয়নি (প্রথম স্বামী তাকে ফেলে চলে গেছে বহু বছর আগে। দ্বিতীয় বিয়ের আগে নূরজাহান নিজে তালাকনামা পাঠিয়েছিল প্রথম স্বামীর ঠিকানায়)। সুতরাং নূরজাহানকে পাথর ছোঁড়া হবে। নূরজাহানের বাড়ির উঠোনে মাওলানারা একটি গর্ত খুঁড়লেন, ওতে নূরজাহানকে দাঁড়াতে হল। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে মাওলানারা পাথর ছুঁড়লেন নূরজাহানের গায়ে। পুরো গ্রাম দাঁড়িয়ে দেখল এই দৃশ্য, কোনও প্রতিবাদ করেনি কেউ। রক্তাক্ত, লান্থিত নূরজাহান গর্ত থেকে উঠে ঘরে গিয়ে লজ্জায় অপমানে বিষ পান করে আত্মহত্যা করে। এর পরপরই আবার আরেকটি ঘটনা, ফরিদপুরের একটি মেয়ে, এই মেয়ের নামও নূরজাহান, ঘরে স্বামী রেখে অন্য লোকের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিল, পরপুরুষের সঙ্গে লীলা খেলা ইসলামে নিষিদ্ধ, সুতরাং মাওলানারা ফতোয়া দিলেন নূরজাহানের বিরুদ্ধে। নূরজাহানের হাত পা বেঁধে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল নুরজাহান। এর পরই সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার কালিকাপুর গ্রামে আরেকটি ঘটনা ঘটে। খালেক মিস্ত্রির ষোল বছরের মেয়ে ফিরোজা নদীতে চিংড়ি মাছের পোনা ধরে তা বিক্রি করে সংসারে সাহায্য করত। এই পোনা ধরতে গিয়েই তার সঙ্গে পরিচয় হয় পাশের বন্দকাটি গ্রামের জেলে হরিপদ মণ্ডলের ছেলে উদয় মণ্ডলের। উদয়ের সঙ্গে ফিরোজার সম্পর্ক গড়ায়। সম্পর্ক গড়ায় বলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরিয়ত অনুযায়ী ফিরোজার বিচার করে। ফিরোজাকে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে একশ একবার ঝাঁটাপেটা করা হয়। ঝাঁটা পেটা শেষ হলে ফিরোজা তার বোনের কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি পৌঁছেই আত্মহত্যা করে। উদয়ের জন্যও শাস্তির ব্যবস্থা হয়। হিন্দু বলেই হয়। গ্রামের সব ফতোয়ার খবর পত্রিকায় ছাপা হয় না। কারণ আটষট্টি হাজার গ্রামের কোন কোণে কোন মেয়েকে ফতোয়ায় মরতে হচ্ছে তা সহজ নয় জানা। হঠাৎ হঠাৎ কোনও ফতোয়া গ্রাম জুড়ে আলোড়ন তুললে হয়ত গোচরে আসে কোনও মফস্বলের সাংবাদিকের। তারপরও দেখতে হবে সেই সাংবাদিক কোন পত্রিকায় খবরটি দেবে। ইনকিলাব গোষ্ঠীর পত্রিকার লোকেরা এ জাতীয় খবর ছেপে ফতোয়াবাজদের ওপর জনগণের রাগ করার কোনও সুযোগ দেবে না। বরং খবর যদি অন্য পত্রিকায় প্রকাশ পায় এবং সমালোচনার ঝড় বয়, তবে ফতোয়াবাজদের পক্ষে এবং সেই সব নিরীহ মেয়েদের বিপক্ষে শক্ত শক্ত যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফতোয়াকে বৈধ করার চেষ্টা করবে। দেশের সর্বাধিক বিক্রিত এবং বিকৃত পত্রিকা ইনকিলাব। একসময় ইত্তেফাকের ছিল সবচেয়ে বেশি বিক্রি, ইত্তেফাককে ছাড়িয়ে মাড়িয়ে গেছে ইনকিলাব। এদিকে আরেকটি ভয়ংকর খবর যখন প্রকাশ পায় যে ব্র্যাক (এনজিও)এর তৈরি একশ বারোটি মেয়েদের ইশকুল মৌলবাদিরা পুড়িয়ে দিয়েছে এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে যে এখন থেকে তাদের ইশকুলে যাওয়া বন্ধ, তখন ইনকিলাব দায়িত্ব নেয় ফতোয়াবাজদের পক্ষে গীত গাওয়ার। এনজিওর ইশকুলগুলো নাকি মেয়েদের খ্রিস্টান বানাবার চেষ্টা করছিল, যেহেতু ব্র্যাক খ্রিস্টানদের দেশ থেকে অর্থসাহায্য পায়। গ্রামের যে মেয়েরা এনজিওতে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধেও ফতোয়া, ঘরের বাইরে বেরোনো চলবে না। যদি মেয়েরা এই ফতোয়া না মানে, তবে তাদের স্বামীদের বাধ্য করা হবে স্ত্রীদের তালাক দেওয়ার জন্য। কেবল ফতোয়াই নয়, সালিশের বর্বরতাও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গ্রামে সালিশ বসার নিয়ম চালু যুগ যুগ ধরে। মসজিদের ইমাম আর গ্রামের মাতব্বরের সালিশে সিরাজগঞ্জের বাদেকুশা গ্রামে পঁয়ত্রিশ জন মেয়েকে সমাজচ্যূত করা হয়েছে। তারা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, এই তাদের অপরাধ। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করা মানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার বিরোধিতা করা। সুতরাং পঁয়ত্রিশ জন মেয়েকে সমাজচ্যূত হয়ে বাকি জীবন বাস করতে হবে। ধর্মের কুঠার মেয়েদের মাথার ওপর, পঁয়ত্রিশ জন মেয়ের এখন আর সমাজে জায়গা নেই। নিঃশব্দে তাদের মেনে নিতে হয়েছে এই সালিশ। ধর্ম এখন মাওলানাদের বাপের সম্পত্তি। আলখাল্লা জোব্বা পরল, মাথায় টুপি লাগাল, নামাজ পড়ে পড়ে কপালে কালো দাগ করে ফেলল, তসবিহর গোটা নাড়ল চাড়ল, ধর্ম তাদের স্থাবর সম্পত্তি হয়ে গেল। ধর্মের ভয় দেখিয়ে তারা এখন পুরো দেশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনও ফতোয়াবাজ মাওলানার বিরুদ্ধে, কোনও সালিশের ইমাম আর মাতববরের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আদালতে কোনও মামলা করা হয় না। তাদের অপকর্মের জন্য কোনও শাস্তির ব্যবস্থা নেই।

এদিকে বড় শহরে জুসমে জুলুসের মিছিল হচ্ছে। ঘটা করে হযরত মোহাম্মদের জন্মদিন পালন হচ্ছে। বিশাল বিশাল টুপিবাহিনীর ট্রাক-মিছিলে পুরো ঢাকা শহর ছেয়ে যায়। সাজ সাজ রব চারদিকে। আর যেদিন হিন্দুদের জন্মাস্টমীর মিছিল বেরোলো, মিছিলে বিএনপির লাঠিয়াল বাহিনী আর যুব কমাণ্ডের লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মেয়েদের শাড়ি খুলে নিয়েছে, কৃষ্ণ সেজেছিল যে শিশুটি, তারও মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। পুলিশ কোনও আক্রমণকারীকে একটি টোকা পর্যন্ত দেয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে শুধু।

যখন দেশজুড়ে মৌলবাদিদের প্রলয়ঙ্করী নৃত্য চলছে, তখন সরকার বিষম বিচক্ষণতা দেখালেন মৌলবাদিদের নেতা গোলাম আযমকে নিরপরাধ প্রমাণের ব্যবস্থা করে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে! ঘাতকের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হচ্ছে প্রকাশ্যে। যে দেশদ্রোহীর নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল, সেই দেশদ্রোহীকে আজ সসন্মানে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। কি জানি, সম্ভবত এই সরকার গোলাম আযম এবং তাঁর ঘাতক সঙ্গীদের, যাদের কারণে লক্ষ লক্ষ বাঙালির ঘর আগুনে পুড়েছে, লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিহত হয়েছে, ধর্ষিতা হয়েছে, অচিরে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেবে। গোলাম আযমকে মুক্তি দেওয়া হয় আর ওদিকে রমনায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণআদালত এর সভা থেকে মাইক ছিঁড়ে নেওয়া হয়, গণসমাবেশে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, মানুষ আহত হয়। এ দেশ যেন আমার নয়, আমাদের নয়, আমরা যারা গর্ব করি রফিক বরকত, সালামকে নিয়ে, যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে প্রাণ দিয়েছিলেন, আমরা যারা গর্ব করি অসংখ্য অগুনতি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে, যাঁরা এ দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এ দেশ হয়ে যাচ্ছে গোলাম আযমের দেশ। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। শহীদ মিনারের পাশের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস, কাজী নজরুলের বাণীগুলো রঙ মেখে নষ্ট করে দিয়েছে স্বাধীনতার শত্রুরা। কালি লেপে দিয়েছে ‘বাংলার হিন্দু বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’র ওপর। আর কত ধ্বংস দেখতে হবে আমাদের! তার চেয়ে অন্ধ হয়ে যাক আমাদের চোখ, আমরা বধির হয়ে যাই!

গ্রামের মেয়েদের ওপর ফতোয়া দেওয়ার প্রতিবাদ করতে মহিলা পরিষদ একটি মিছিল বের করে। প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় বসে যান গ্রামের মহিলারা, হাতে কঞ্চি, কঞ্চির আগায় মহিলা পরিষদের স্লোগান লেখা কাগজ। মহিলা পরিষদের সভায়, কোন কোন মেয়েকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে সবার নাম উল্লেখ করে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেন নেত্রীরা। কেউ কিন্তু একবারও উচ্চারণ করেননি আমার নাম। মহিলা পরিষদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠন, সভানেত্রী হিসেবে সুফিয়া কামালের নাম থাকলেও মূল নেত্রী মালেকা বেগম। মালেকা বেগম নারী বিষয়ে অনেকগুলো বইও লিখেছেন। বহু বছর ধরে তিনি নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং বলা যায় দেশের হাতে গোণা দুইএকজন নারীবাদী নেত্রীর মধ্যে তিনি অন্যতম। একদিন আমার বাড়িতে তিনি পদধূলি দেন। বিস্ময়াভিভূত আমি তাঁকে প্রায় আলিঙ্গণ করতে নিই। পত্রিকায় কলাম লেখা শুরু করার পর মালেকা বেগমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কয়েকবার, বলেছিলেন, ‘খুব ভাল হচ্ছে লেখা, লিখে যাও, লিখে যাও।’ মালেকা বেগমের স্বামী মতিউর রহমান কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা একতার সম্পাদক। একতা থেকে বেরিয়ে এসে এখন অবশ্য ভোরের কাগজএর সম্পাদক হয়েছেন। দুজনই সমাজতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। দুজনের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা প্রবল। প্রবলই ছিল। তবে মাঝে মাঝে প্রবলের শরীরে চমকের ধাককা লেগেছে। আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার পর অতি আনন্দে আনন্দর খবর দিতে যেদিন মালেকা বেগমের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তিনি বক্রহাসি হেসে বলেছেন, ‘সুনীলের সঙ্গে খাতির থাকলে আনন্দ পুরস্কার পাওয়াই যায়, এ তো সবাই জানে!’ তিনি মোটেও পছন্দ করেননি আমার পুরস্কার পাওয়া। আমি যোগ্য নই পুরস্কারের, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার জন্য এই পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন, এই তাঁর বিশ্বাস। বড় একা বোধ করেছি। আনন্দ পুরস্কার এমনই একটি ধারালো কাঁটা, যে কাঁটাটি আমার শুভাকাঙ্খীদের বড় একটি সংখ্যার শরীরকে খোঁচা মেরে প্রায় শূন্যে নামিয়ে দিয়েছে। আমি মাথা নিচু করে মালেকা বেগমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। আরও একদিন অবাক লেগেছিল আমার, আমি বুঝে পাইনি মালেকা বেগম এ কী কাণ্ড করছেন, যখন তিনি তাঁর দলের লোক নিয়ে আদালত প্রাঙ্গনে খুকুর ফাঁসি চাইছিলেন। মুনিরের সঙ্গে খুকুর সম্পর্ক ছিল এবং সে সম্পর্ক ছিল অবৈধ, এ কথা পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর লোকেরা খুকুকে ছি ছি করল, দুয়ো দিল। আর কোথায় খুকুর পক্ষে দাঁড়াবে মহিলা পরিষদ, উল্টো আদালতের দরজায় গিয়ে খুকুর ফাঁসি চাই চিৎকার দিয়ে গলা ভাঙল। মহিলা পরিষদের বিখ্যাত নেত্রীটি এখন আমার বাড়িতে।

‘তোমাকে দেখতে আসলাম, কেমন আছ তুমি?’

আমি মলিন হাসি। আমি কেমন আছি তা নিশ্চয়ই তিনি অনুমান করতে পারেন।

‘তোমার কাছে আসলাম। ভাবলাম দেখে যাই। যে অবস্থা হচ্ছে দেশে, তোমার জন্য খুব চিন্তা হয় আমাদের। মোল্লারা খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।’

‘হ্যাঁ। কি যে হবে দেশের!’

মালেকা বেগম হঠাৎ হেসে ওঠেন, হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি বিস্ময়ে। হাসি থামলে বলেন, ‘তিরিশ বছর ধরে নারী আন্দোলন করছি, আর দেশে বিদেশে নারীবাদী হিসেবে নাম হয় তোমার!’

নাম হওয়ার লজ্জায় আমি মুখ লুকোই। নাম হওয়ার মত অপমানকর ঘটনা যেন জগতে আর কিছু নেই। নাম হওয়াটিকে এই মুহূর্তে গলা টিপে হত্যা করতে পারলে আমার স্বস্তি হত। এ আমারই দোষ। আমার দোষেই আমার নাম লোকে জানে।

মালেকা বেগম খুব বুদ্ধিমতি, বুদ্ধিমতি না হলে আমার মনের কথা জানবেন কী করে! বললেন, ‘না, এতে তো তোমার দোষ নেই। মোল্লারাই তোমার নাম জানাচ্ছে।’

হেসে উঠলেন আবার, বললেন, ‘আসলে মনে মনে ওদের তোমার ধন্যবাদই দেওয়া উচিত।’

আমি আমার অস্বস্তি কাটাতে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই বলতে বলতে, ‘চা খাবেন তো! আমি চায়ের কথা বলে আসি।

চা খাওয়া শেষে তিনি যা বললেন, তা হল, ‘তসলিমা এ সময় তোমাকে আমরা সমর্থন করতে পারব মানে তোমার পক্ষে দাঁড়াতে পারব, তুমি যদি আমাদের সংগঠনে যোগ দাও।’

‘সংগঠনে? মহিলা পরিষদের সদস্য হতে বলছেন?’

‘হ্যাঁ।’

আমি হাঁ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ।

‘মালেকা আপা, আমি মহিলা পরিষদে যোগ না দিলে বুঝি আমাকে যে ফতোয়া দেওয়া হল, এই যে আমার বিরুদ্ধে মোল্লারা আন্দোলন করছে, এর প্রতিবাদ করতে পারেন না! আপনারা মেয়েদের পক্ষে আন্দোলন করছেন, আমি মেয়েদের পক্ষে লিখছি..

‘আসলে তুমি তো একটু কনট্রোভার্সিয়াল!

‘তাতে কি? আমার পক্ষে আপনারা যদি কিছু না বলতে চান বলবেন না, কিন্তু একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করা উচিত!’

মালেকা বেগম একসময় উঠে পড়েন তাঁর দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। আমি যে মহিলা পরিষদের সমর্থন পেতে মহিলা পরিষদে নাম লেখাবো না, তা তিনি একরকম বোঝেন। তারপরও আমাকে ভাবার জন্য সময় দিতে চান। মালেকা বেগমের লেখা বেশ কিছু বই আমি পড়েছি, বই পড়ে একটুও মনে হয়নি কখনও কখনও তিনি আপোস করতে পারেন বা কোথাও কোথাও তিনি নগ্নভাবে যুক্তিহীন হতে পারেন।

ফ্রান্স থেকে রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টিভি আমাকে প্যারিসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল টেলিভিশনে প্রেস ফ্রিডমের ওপর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। প্যারিসের কথা কেবল লোকের মুখে শুনেছি, বইয়ে পড়েছি, কল্পনাও করিনি সত্যিকার প্যারিস যাওয়ার। লোকদের জানিয়ে দিই, আমার বাপু পাসপোর্টই নেই, আমার যাওয়া হবে না। যাওয়া হবে না এরকমই জানি। দেড় বছর হয়ে গেছে, আজও যখন পাসপোর্ট দেওয়া হয়নি আমাকে, কোনওদিনই দেওয়া হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয় আমাকে পাসপোর্ট। ফতোয়ার খবরটি বিদেশে প্রচার হওয়ার পর সবচেয়ে যে বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছে, তা হল আমার পাসপোর্ট ফেরত পাওয়া। আমার নাগরিক অধিকার এবং মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে যখন বিদেশিদের আন্দোলন হচ্ছে, তখন একদিন আমেরিকার দূতাবাস থেকে অ্যান্ড্রু নামের এক অফিসার আমার বাড়ি এলেন। কি করে আমার পাসপোর্ট নিল, কবে নিল, কারা নিল ইত্যাদি খবর টুকে নিয়ে চলে গেলেন। আবারও একদিন এসে পাসপোর্টের কথাই বললেন। এরপর দু সপ্তাহও পার হয়নি, অ্যান্ড্রু আমাকে ফোন করে বললেন, পাসপোর্ট আপিসে গিয়ে আমি যেন আমার পাসপোর্টটি নিয়ে আসি। এমনতরো জাদু আমার আগে দেখা হয়নি। দেড় বছরে যে জিনিসটি আমার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি, সে জিনিসটি কি করে নিমিষে সম্ভব করে ফেলে একটি দূতাবাস! পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে আত্মহারা হই, দেশের বাইরে কোথাও যাওয়ার আনন্দে নয়, আমার নাগরিক অধিকার ফিরে পেয়ে।

ফতোয়ার খবর নিয়ে হুলস্থুল পড়ে গেছে সবখানে। বিদেশের বড় বড় পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে এই ফতোয়া নিয়ে। লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করছেন। বিদেশের নারী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, লেখক সংগঠনের লোকেরা মরিয়া হয়ে উঠেছে আমাকে রক্ষা করতে। এক ফতোয়াই আমার নাম ফাটিয়ে দিল বিশ্বময়। কিন্তু যে ফতোয়ার খবরটি কেউ জানে না সেটি হল আমার মার ওপর ফতোয়া। পীরবাড়ি থেকে দেওয়া ফতোয়া। পীরবাড়ি ছিল মার আশ্রয়। খুব বড় আশ্রয়। দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে পীর বাড়িতে যান মা, আল্লাহ রসুলের কথা শুনে সংসারের দুঃখ কষ্ট খানিকটা ভুলে থাকতে যান। হাসিনার ওপর সংসারের দায়িত্ব অর্পিত হবার পর অবকাশে মা একটি বাড়তি মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হলেন। আমি যখন একা থাকতে শুরু করি ঢাকার শান্তিবাগে, আমার কাছে চলে এসে অবকাশের দুঃখও ভুলতে চাইতেন। আমার কাছেও যে খুব সুখ পেতেন তা নয়। ঢাকা থেকেও প্রায়ই পীরবাড়ির দিকে ধাবিত হতেন। এরপর ভালবাসার জন্ম হওয়ার পর অবকাশে মাস কয় কাটিয়ে ইয়াসমিন যখন ভালবাসাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে, সঙ্গে মা আসেন। কারণ মার ওপরই দায়িত্ব ভালবাসার লালন পালনের। ঢাকায় আসার পর মা দেখলেন বাচ্চার ক্যাঁও ম্যাঁও আমার লেখার অসুবিধে করে, আমার ঘুম নষ্ট করে, তার ওপর থাকার জায়গার অভাব। এসব কারণ তো আছেই, সবচেয়ে বড় যে কারণটির জন্য মা চলে গেলেন ময়মনসিংহে, তা আবারও সেই একই কারণে, খরচ বাঁচাতে। আমার হোক, ইয়াসমিনের হোক খরচ তো কারও না কারও করতেই হবে, বাচ্চা পোষার খরচ তো আর সামান্য কিছু নয়! সুহৃদের জন্মের পর সুহৃদের দায়িত্ব মার ওপর ছিল, লালবাসার জন্মের পরও ভালবাসার দায়িত্ব মার ওপর। মা ভেবেছিলেন, সুহৃদের লালন পালনে বাবা যেভাবে সাহায্য করেছিলেন, খাঁটি দুধের ব্যবস্থা, প্রতিদিন মুরগির বাচ্চার সুপের ব্যবস্থা, ভালবাসার জন্যও বাবা তাই করবেন। অবকাশে মা অত গৌণ নন এখন, সংসারের দায়িত্ব তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেলেও অন্য এক দায়িত্ব তাঁর আছে, নাতনি পালনের দায়িত্ব, সুতরাং সামান্য হলেও মর্যাদা তিনি পাবেন, এটি মা-ই কেবল ভেবেছিলেন। কিন্তু মাকে গৌণই করে রাখা হয়েছে অবকাশে, মাকে বাড়তি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে আগের মত। বাবার কাছে ছেলের ছেলে যত মূল্যবান, মেয়ের মেয়ে তত মূল্যবান নয়। আর সংসারের কষর্নী হাসিনার কাছে তাঁর দুই সন্তান ছাড়া আর কারও কোনও সন্তানই মূল্যবান নয়, বরং চক্ষুশূল। স্বামী আর পুত্রবধূর অত্যাচার মাকে পীরবাড়ি নিয়ে যায় ঘন ঘন।

পীর বেশারাতুল্লাহ মারা যাবার পর তার পুত্র মুসা বনেছিলেন নতুন পীর। কিন্তু বেশিদিন পীর হওয়ার আনন্দ তিনি ভোগ করতে পারেন নি। হৃদপিণ্ডের অসুখে হঠাৎ মারা যান। এরপর পীর বেশারাতুল্লাহর নাতি, ফজলি খালার বড় ছেলে মোহাম্মদ হয়েছে পীর। এই মোহাম্মদই দিয়েছে ফতোয়া। এই ফতোয়া সমর্থন করেছে পীরবাড়ির সবাই। ফতোয়াঃ মা যেন পীরবাড়িতে আর না ঢোকেন।

মার অপরাধ? তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কাফেরকে জন্ম দিয়েছেন এবং এই কাফেরের সঙ্গে মার এখনও মা মেয়ে সম্পর্ক বজায় আছে।

এই মার অপরাধ। হয় আমাকে ত্যাগ করতে হবে, নয়ত পীরবাড়ি ত্যাগ করতে হবে। ফজলিখালাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে মা বলেছেন, ‘ফজলি, আমি আমার নিজের মেয়েরে ত্যাগ করবো কেমনে? একটা কি হয়?’

‘ত্যাগ তোমাকে করতেই হবে বড়বু। তোমার মেয়ে হল কাফের। কাফেরের সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। যদি থাকে, তাহলে তুমিও কাফের।’

‘আমারে কাফের কইলি!’

‘এই দুনিয়ার ছেলে মেয়ে হিচ্ছে মিথ্যে মায়া। তোমাকে তো আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। ছেলে মেয়ের মায়ায় পড়ে তুমি যদি একটা কাফেরকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার কর, তাহলে বলে দিচ্ছি আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না। কোরানে আছে, তাহাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখিবে তো তোমাকে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করিব।’

‘নাসরিন মানুষের অনেক উপকার করে। ও খুব উদার। মেয়েদের ওপর অন্যায় অত্যাচার হয়, এইসবের বিরুদ্ধে লেখে। কত গরিব মেয়েরে ও টাকা পয়সা দিয়া সাহায্য করে। ও কি আল্লাহর ক্ষমা পাইব না?’

ফজলিখালা কঠিন গলায় বলেন, ‘না। কোনও ক্ষমা নাই তাদের। ও দোযখে যাবে। ও আল্লাহ বিশ্বাস করে না। বড়বু, তুমি খুব ভাল করেই জানো নাসরিন কোরান সম্পর্কে বাজে কথা লিখেছে। কোরান নাকি মানুষের লেখা। আমাদের নবীজি নাকি কামুক লোক। আল্লাহর নাকি অস্তিত্ব নাই। আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লা।’

‘দেখ ফজলি, তর দুলাভাই আমারে কোনও টাকা পয়সা দেয় না। ময়মনসিংহ থেইকা কয়দিন পরপরই আমারে দূর দূর কইরা তাড়ায়। এহন নাসরিনের কাছে গিয়া যদি আমি না থাকতে পারি, আমি থাকব কোথায়?’

‘সেইটা আমি কি জানি! সোজা কথা, এই বাড়িতে আসতে চাইলে কোনও কাফেরের মুখ দেখা তোমার জন্য হারাম। আর কাফেরের সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক যদি তুমি রাখতে চাও, তবে এই বাড়ি তোমার জন্য হারাম।’

মা কাঁদেন। মা ফুঁপিয়ে কাঁদেন। হাউমাউ করে কাঁদেন। ফজলিখালা মার কান্নার দিকে ফিরে তাকান না।

মাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় পীরবাড়ি থেকে। বলে দেওয়া হয়, মা যেন কখনও আর পীরবাড়ির ত্রিসীমানায় না ঘেঁসেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *