নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের প্যাকেটগুলো নিয়ে গেল নাইম। খবরের কাগজএর পরিবেশকদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে বই, ওরা বই বিক্রি করার দায়িত্ব নিয়েছে। ঘাড় থেকে মস্ত বোঝা নামার মত বইগুলো নেমে যায় নাইমের হাতে। বই নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে বেশ সুন্দর ছাপা যায়, গুণে মানে বই ফাসকেলাস হতে পারে, কিন্তু ডিস্ট্রিবিউটর নেই তো মরেছো। এই ব্যপারটি আমার হাড়ে হাড়ে বোঝা হয়েছে। ছুট্টি দিয়ে দিই ছুট্টি, বই ছাপার কম্মটি আমি আর নিজে করছি না। মনে মনে জুৎসুই একটি নাকে খতও হয়ে যায়। বইটি, পরে শুনেছি, মেলায় বিক্রি হয়েছিল, মেলায় সময়মত এলে হয়ত আরও বিক্রি হত। শেষদিকে আমলা কবি মোহাম্মদ সাদিক মন্ত্রণালয়ের গোপন একটি খবর জানালো আমাকে , বইটি নাকি নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে ওপর মহলে। অভিযোগ নিয়তি নামের কবিতাটি অশ্লীল। বইটির সবগুলো কবিতাই রুদ্রর সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙছে ভাঙছে সময়ে। নিয়তি কবিতাটিও রুদ্রর এক সময়ের আচরণ নিয়ে।
প্রতিরাতে আমার বিছানায় এসে শোয় এক নপুংশক পুরুষ
চোখে
ঠোঁটে
চিবুকে
উন্মাতাল চুমু খেতে খেতে
দুহাতে মুঠো করে ধরে স্তন।
মুখে পোরে, চোষে।
তষ্ণায় আমার রোমকূপ জেগে ওঠে
এক সমুদ্র জল চায়, কাতরায়।
চুলের অরণ্যে তার অস্থির আঙুল
আঙুলের দাহ
আমাকে আমূল অঙ্গার করে লোফালুফি খেলে
আমার আধেক শরীর তখন
সেই পুরুষের গা গতর ভেঙে চুরে
এক নদী জল চায়, কাতরায়।
শিয়রে পৌষের পূর্ণিমা
রাত জেগে বসে থাকে, তার কোলে মাথা রেখে
আমাকে উত্তপ্ত করে,
আমাকে আগুন করে
নপুংশক বেঘোরে ঘুমোয়।
আমার পুরোটা শরীর তখন তীব্র তৃষ্ণায়
ঘুমন্ত পুরুষটির স্থবির শরীর ছুঁয়ে
এক ফোঁটা জল চায়, কাঁদে।
কবিতাটি রোববার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, তখন সেই রোববার পত্রিকাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, বই নিষিদ্ধ হওয়ার কথা কেন ওঠে! কোন জিনিসটি অশ্লীলতা এবং কোনটি নয় তা বিচারের ভার কার ওপর! আমার তো কবিতাটিকে মোটেও অশ্লীল মনে হয়নি। শাহরিয়ার বলে, তোমার ওই মুখে পোরে, চোষে লাইনটি বাদ দিয়ে দাও। কেন বাদ দেব! কারণ মুখে পোরে চোষে ব্যপারটি অশ্লীল। হা! ছলে বলে কৌশলে যে শাহরিয়ার আমার স্তন মুখে পুরতে, চুষতে, চেয়েছিল, সে আমাকে শ্লীলতা শেখাচ্ছে! কোনও কারণ আমি খুঁজে পাই না লাইনটি বাদ দেবার। তৃষ্ণায় রোমকূপ কাঁপার কারণটি বর্ণনা করতে হলে লাইনটির প্রয়োজন, এরকম মনে হয়েছে। আমার মনে হওয়া অনেক পুরুষ বন্ধুর পছন্দ হয় না, যদিও সে পুরুষেরা যে কোনও রমণীয় রমণীর স্তন মনে মনে মুঠো করে ধরে, মুখে পোরে, চোষে এবং তকেক তকেক থাকে মনে মনের ব্যপারটি কখন কার ওপর সত্যিকার ঘটিয়ে ফেলা যায়। মোজাম্মেল বাবুর কথাই বলি। রূপে গুণে ধনে মানে অনন্য। আমার চেয়ে বয়সে ছোট। আপা ডাকে। কয়েক বছর ধরে প্রেম করছে এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে। কাল বাদে পরশু সেই মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে। সেই বাবুই এক রাতে আমাকে একা পেয়ে উষ্ণ শ্বাস ফেলছিল আমার সারা গায়ে। তাকে আমি আমার নাগাল পেতে দিইনি।
নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের দুধরাজ কবি নিয়েও কথা হয়। দুধরাজ কবিটি হচ্ছে রুদ্র, কানাকানি চলে। যাকে উদ্দেশ্য করেই লিখি না কেন, কবিতা কেমন হল, আদৌ হল কী হল না, সেটিই বড়। শব্দের আড়ালে মানুষ ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে। এ কবিতা কি আমি রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে লিখেছি! যাকে উদ্দেশ্য করেই লিখি না কেন, এটি কবিতা। কবিতার পেছনে কে লুকিয়ে আছে, এটি আমার কাছে আর গবেষণার বিষয় নয়।
তার চে কুকুর পোষা ভাল
ধূর্ত যে শেয়াল, সেও পোষ মানে,
দুধ কলা দিয়ে আদরে আহলাদে এক কবিকে পুষেছি এতকাল,
আমাকে ছোবল মেরে
দেখ সেই কবি আজ কিভাবে পালায়।
এই কবিতার শোধ নিতে গিয়ে রুদ্র নিজে একটি কবিতা লেখে।
তুমি বরং কুকুর পোষো,
প্রভু ভক্ত খুনসুটিতে কাটবে তোমার নিবিড় সময়।
তোর জন্য বিড়ালই ঠিক,
বরং তুমি বিড়াল পোষো
খাঁটি জিনিস চিনতে তোমার ভুল হয়ে যায়,
খুঁজে এবার পেয়েছো ঠিক দিক ঠিকানা।
লক্ষ্মী সোনা, এখন তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো।
শুকরগুলো তোমার সাথে খাপ খেয়ে যায়,
কাদা ঘাটায় দক্ষতা বেশ সমান সমান।
ঘাটাঘাটির ঘনঘটায় তোমাকে খুব তৃপ্ত দেখি,
অুমি বরং ওই পুকুরেই নাইতে নামো,
ঊংক পাবে, জলও পাবে।
চুল ভেজারও তেমন কোনো আশঙ্কা নেই,
ইচ্ছে মত যেমন খুশি নাইতে পারো।
ঘোলা পানির আড়াল পেলে
কে আর পাবে তোমার দেখা!
মাছ শিকারেও নামতে পারো
তুমি বরং ঘোলা পানির মাছ শিকারে
দেখাও তোমার গভীর মেধা।
তুমি তোমার স্বভাব গাছে দাঁড়িয়ে পড়ো,
নিলিঝিলির স্বপ্ন নিয়ে আর কত কাল?
শুধু শুধুই মগজে এক মোহন ব্যাধি
তুমি বরং কুকুর পোষো, বিড়াল পোষো।
কুকুর খুবই প্রভুভক্ত এবং বিড়াল আদরপ্রিয়,
তোমার জন্য এমন সামঞ্জস্য তুমি কোথায় পাবে?
রুদ্রর এই কবিতা পড়ে আমার মন খারাপ হয়। হয় কিন্তু তারপরও আমার জানতে ইচ্ছে হয় রুদ্র কেমন আছে, কি করছে, ভাল আছে তো! এই ইচ্ছেটি যখনই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় যাই, অন্তত একবার হলেও অসীম সাহার ইত্যাদিতে আমাকে নিয়ে যায়। ওখানে নির্মলেন্দু গুণ আর অসীম সাহার সঙ্গে আমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখে। মোংলা থেকে এখনও ফেরেনি অথবা শিমুলকে নিয়ে ব্যস্ত এরকম খবর জোটে। পায়ের অসুখ সেরেছে কি? হাঁটতে পারছে? হাঁটে তবে থেমে থেমে। শুনি আমি, কোনও ক, খ, গ, ঘর পায়ের খবর শোনার মত শুনি। ভেতরে প্রাণ ফেটে যায় জানতে আরও কিছু, আরও অনেক কিছু। রুদ্র কি আমার কথা ভাবে, কিছু বলে! এসব এখন আর জিজ্ঞেস করা মানায় না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলাও মানায় না, দীর্ঘ একটি শ্বাস তাই গোপন করি। বিয়ে ভেঙে গেলে অনেকে পরস্পরের শত্রু হয়ে যায়। আমি রুদ্রর শত্রু হব বা রুদ্র শত্রু হবে আমার, এমন আমি কখনও কল্পনাও করি না। এমন কি যে বন্ধুরা আমি বিয়ে ভাঙা একলা মেয়ে বলে অন্ধকার সুযোগ খুঁজেছে আমার শরীরের দিকে শরীর বাড়াতে, তাদের আমি নিজগুণে ক্ষমা করে দিই, বন্ধুত্ব নষ্ট করে দেওয়ার কথা ভাবি না।
খবরের কাগজে নাইম নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের কিছু বিজ্ঞাপন ছেপে দেয়। একদিন বলে পরিবেশকরা খবর দিচ্ছে, বই বিক্রি হচ্ছে ভাল। এটুকু শুনেই আমি খুশি। নাইমের উদারতা আমাকে এমন বিনয়ী করে তোলে যে বই বিক্রির টাকার কথা তাকে আমি জিজ্ঞেস করি না। নাইমের আরও একটি উদারতা আমাকে চমকিত করে, কলকাতা যাওয়ার আগে তাকে আমি বলিনি যে আমি মিলনের সঙ্গে যাচ্ছি, কিন্তু সে যখন জানতে পারে যে আমি একা যাইনি, মোটেও সে এ নিয়ে তামাশা করেনি।
কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর বইমেলায় আমাকে পেয়ে শাহরিয়ার বেশ ভালমানুষের মত প্রশ্ন করেছে, ‘কেমন কাটালে ভারতে?’
আমিও ভালমানুষের মত উত্তর দিয়েছি, ‘ভালই।’
‘কোথায় কোথায় গেলে?’
‘গিয়েছি অনেক জায়গায়। অতসীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। চমৎকার মেয়ে অতসী।’
এরপরই ভালমানুষের মত আরেকটি প্রশ্ন, ‘এসটর হোটেলে মিলনের সঙ্গে রাতগুলো ভাল কেটেছে তো!’
খানিকটা চমকাই। খবর তাহলে জানা হয়ে গেছে শাহরিয়ারের। খবরটি যে অতসীর কাছ থেকে পেয়েছে, তা বুঝি। কলকাতা যাচ্ছি শুনে শাহরিয়ারই আমাকে অতসীর ঠিকানা দিয়েছিল, বলেছিল যেন দেখা করে বলি যে আমি শাহরিয়ারের বন্ধু। দেখা করেছিলাম, খুব ভাল সময় কেটেছিল অতসীর সঙ্গে, অতসী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো বটেই, বাড়ির আর সবার সঙ্গেও চমৎকার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমার। আমি একা যাইনি, আমার সঙ্গে মিলন গিয়েছে, এ খবরটি শাহরিয়ার অন্য রকম করে বলতে পারতো, কিন্তু তা না করে বোলতার মত এসে হুল ফুটিয়ে দিল। শাহরিয়ার এমনই। নির্বিকার হুল ফুটিয়ে যায়। অথচ নাইম কিন্তু হুল ফোটায় নি, যে কোনও সাধারণ খবর দেওয়ার মত বলেছে যে আমি কলকাতা যাওয়ার পর সে মিলনের বাড়িতে গেছে, মিলনের বউ জানিয়েছে যে মিলন কলকাতা গেছে, তখনই সে ধরে নিয়েছে মিলন আর আমি একসঙ্গে গিয়েছি। দুজন না গিয়ে আমি তো একাও যেতে পারতাম! পারতাম না কি! পারতাম। ভারতের যেখানে যেখানে ঘুরেছি, অনায়াসে সে জায়গাগুলোয় একা ঘোরা যেত। তবে একা ঘুরলে হয়ত ভাল লাগত না। অনেককিছু একা করতে ইচ্ছে হয় না। কোথাও যেতে হলে সঙ্গে একজনকে নেওয়া চাইএর অভ্যেস আমার অনেকদিনের। ইয়াসমিন মাঝে মাঝে রাগ হয়ে বলত, ‘তোমার বান্ধবীর বাসায় যাইতাছ, একলা যাও, সব সময় আমারে নিয়া যাইতে হইব কেন!’ অথবা রুদ্র ময়মনসিংহে এলে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেও ইয়াসমিনকে নিয়ে যেতাম। ইয়াসমিন হাতের কাছে না থাকলে সুহৃদকে। রুদ্র অনেকদিন রাগ করে বলেছে, তুমি একা আসতে পারো না! নিশ্চয়ই পারি, কেন পারবো না! একা কলেজে যাচ্ছি, কলেজ থেকে একা বাড়ি ফিরছি। সবই হচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে কেউ একজন থাকলে ভাল লাগে। আপন কেউ থাকলে ভাল লাগে। সবে মাস পেরোলো কলকাতা থেকে ফিরেছি, হঠাৎ একদিন নাইমের আবদার, ‘চল কলকাতা যাই, সাত দিনের জন্য।’ কেন? কেন তা নাইম বলে না। কেন সে যাবে কলকাতা তা খুব করে যখন জানতে চাই, সে বলে পত্রিকার জন্য কিছু ব্যবসায়িক কাজ আছে তার, তাই সে যাচ্ছে। সে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, আমার যদি কলকাতায় ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হয়, আমি অনায়াসে তা করতে পারি। এমনিতে নাচুনে বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি। নাইমের প্রস্তাবে আমার রাজি হওয়ার আরও একটি কারণ ছিল, ময়মনসিংহের বাড়ি আমার কাছে বড় দুর্বিষহ হয়ে উঠৈছিল। সুহৃদ নেই, ইয়াসমিন নেই। বাড়িটিতে যতক্ষণ থাকি মরার মত শুয়ে থাকি। এক অসহ্য নিঃসঙ্গতা আমাকে ছিঁড়ে খাচ্ছিল, তার পরও যদি ডাক্তারির চাকরিতে সামান্য স্বস্তি থাকত, ওখানেও অলস অবসর জুড়ে রাজ্যির ভাল না লাগা আমাকে ঘিরে ধরে। কলকাতা রওনা হই। তবে যাবার আগে মোটেও ভুলি না সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্য গরুর মাংস নিতে। তিনি গরুর মাংস খেতে চেয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলাম এর পর কখনও এলে নিশ্চয়ই নিয়ে আসব।
কলকাতা পৌঁছে পশ্চিম বঙ্গের তথ্য কেন্দ্রে গিয়ে প্রথমেই সৌমিত্র মিত্রর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে দিকে হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের একটি সরকারি গেস্ট হাউজে দুজনের জন্য দুটি ঘরের ব্যবস্থা করে গাট্টিবোঁচকা যার যার ঘরে রেখে ছোটা শুরু হল নাইমের, সঙ্গে আমি। সিদ্ধার্থ সিংহ নামের একটি ছেলে আমাদের সঙ্গে ছোটে। সিদ্ধার্থ সৌমিত্র মিত্রর আবৃত্তিলোকের সদস্য, সৌমিত্র মিত্রর খাঁটি শিষ্য, সিদ্ধার্থ নিজেও আবৃত্তি করে। সিদ্ধার্থর সঙ্গে নাইমের আলাদা একটি সম্পর্কও আছে, নাইমের খবরের কাগজ পত্রিকাটির সে কলকাতা প্রতিনিধি। লেখকদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে লেখা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো তাঁর দায়িত্ব। কলকাতায় আপাতত সে পথ প্রদর্শক। প্রথমেই মাংস নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি সত্যি সত্যি আমি বাংলাদেশ থেকে গরুর মাংস এনেছি। কোরবানি-ঈদের মাংস। মাংস পেয়ে তিনি বেজায় খুশি, ‘গীতা ও গীতা দেখে যাও, কী এনেছো ও।’ মাংস নিয়ে সারা বাড়ি দৌড়োচ্ছেন তিনি। সেদিনই তিনি তাঁর স্ত্রী গীতাকে বলে বলে অস্থির করে মাংস রান্না করিয়ে ছাড়লেন। প্রথম যখন এসেছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, তখন মহা উৎসাহে নিজে রেঁধে আমাকে বাটিচচ্চড়ি খাইয়েছিলেন, কলকাতা চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্র্যান্ড হোটেলের আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শৈলেশ কুমার বন্দোপাধ্যায় পেয়েছিলেন পুরস্কার। আমি কলকাতা থেকে দিল্লি আগ্রা কাশ্মীর যাবো শুনে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মোটেও খুশি হননি, জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ওখানে কী দেখবে? তার চেয়ে আমার সঙ্গে চল। আমরা টেংরা যাবো, বজবজ যাবো।’
টেংরা আর বজবজের নাম শুনে আমি অবাক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওখানে কী আছে দেখার?’
সুভাষ মুখোপাধ্যায় হেসে বললেন, ‘মানুষ।’ তখন হৈ চৈ করা, বাড়ির সকলের সঙ্গে শিশুতোষ দুষ্টুমিতে মেতে থাকা, সামান্য বাটি চচ্চড়ি আর এক গেলাস রামের জন্য তুমুল হল্লা করা মানুষটিকে আমি সত্যিকার চিনতে পারি। তাঁর দৈনন্দিন দোষ জমে জমে যত উঁচুই হোক না কেন, তাঁকে আড়াল করার সাধ্য কারওরই নেই। সব ভেঙে সব ফুঁড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন বেরিয়ে আসেন, তাঁকে শ্রদ্ধা করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নাইম আমাকে বিষম এক চমক দেয়। আমাকে সে নিয়ে যায় ছ নম্বর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আনন্দবাজার আর দেশ পত্রিকার আপিসে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শংকরলাল ভট্টাচার্যর কাছে নাইম তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য কলাম চাইতে গেল। ফাঁকে আমারও দেখা হল কথা হল নামি দামি লেখকদের সঙ্গে যেন সাক্ষাৎ দেবালয়ে গিয়ে দেবতাদের দেখে এলাম। লেখা পড়ে যাঁকে চিনি, যাঁকে কল্পনায় সাজিয়ে নিই একরকম করে, দেখা হলে সেই কল্পনার মানুষটির সঙ্গে আসল মানুষটিকে মেলানো যায় না কিন্তু ছোটখাটো ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দেওয়া যায় সহজে, শীর্ষেন্দুর কালো স্যান্ডেলের সঙ্গে উৎকট নীল রঙের মোজাটি ক্ষমা করে দিই। মন দিয়ে তাঁর ময়মনসিংহের স্মৃতিচারণ শুনি। ঢাকায় বসে প্রতি সপ্তাহে দেশ পত্রিকাটি আদ্যেপান্ত পড়ি। এই একটি সাহিত্য পত্রিকা যা আমার বিশ্বাস বাংলা সাহিত্যের দ্য বেস্ট সাহিত্য পত্রিকা। আর আমি আজ সেই ঘরে বসে আছি, যেখান থেকে দেশ বেরোয়, তাঁদের সামনে বসে আছি যাঁরা দেশ পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন, দেশে লেখেন এবং তাঁদের সামনে বসে আছি সেই শৈশব থেকে যাঁদের লেখা বই আমি গোগ্রাসে পড়ি, বিশ্বাস হয় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে কাগজপত্রের স্তূপ। তিনি তাঁর ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এমন হাসির গল্প লেখেন, অথচ মানুষটি কিন্তু আদপেই হাসেন না। তাঁকেও নাইম অবলীলায় আবদার করল তার কাগজের জন্য কলাম লেখার। এমন হয়েছে, যে লেখক বা যে কবিকেই নাইম সামনে পায়, কলাম লেখার আবদার করে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্র্তীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঢাকায়, আবার দেখা হল কলকাতায়। তাঁর ঘরেই বসেন গৌরকিশোর ঘোষ, মুগ্ধ হয়ে যাই তাঁর ব্যবহারে, যেন আমাদের সেই কতকাল থেকে চেনেন তিনি। একটি জিনিস লক্ষ করছি, পূর্ব বাংলায় যাঁদের জন্ম, যাঁরা দেশভাগের পর পূর্ব বাংলা ছেড়ে পশ্চিম বাংলায় চলে এসেছেন, তাঁরা পূর্ব বাংলার মানুষ দেখলে বড় আপন মনে করেন, ফেলে আসা জীবনটির দিকে ফিরে তাকান। বলেন কেমন ছিল তাঁর বাড়িটি, বাড়ির পাশের বাগানটি, তাঁর গ্রাম বা শহরটি। জানতে চান ব্রহ্মপুত্র বা মেঘনা এখন দেখতে কেমন। শংকরলাল ভট্টাচার্যের সঙ্গে সানন্দা আপিসে দেখা হল, তিনি আমাদের ছাদে নিয়ে বসিয়ে ইদানীং তিনি কি নিয়ে ভাবছেন কি লিখছেন কি পড়ছেন ইত্যাদি অনেক কথা বললেন। সবখানেই আমি শ্রোতা। এর বেশি কিছু হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সৌমিত্র মিত্র অনেক জায়গায় নিয়ে গেলেন আমাদের। আবৃত্তিশিল্পী দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে নিলেন, তাঁর বাড়িতে দুপুরের খাওয়া হল অনেক রকম মাছ দিয়ে। নাইম দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের কাছেও লেখা চেয়েছে। পারলে সে জ্যোতি বসুর কাছে যায় লেখা চাইতে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতেও নিয়ে গেলেন সৌমিত্র। বৈঠক ঘরে শক্তি বসেছিলেন খালি গায়ে। সেই খালি গায়ের শক্তি আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেন। আমাদের খাওয়ালেন। আমাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আগেই চেনেন, স্ত্রী পুত্র নিয়ে অবকাশে তিনি বেড়াতে গিয়েছেন। শক্তি তাঁর বাড়িটির দোতলায় একটি ছোট ঘর দেখিয়ে বললেন, এর পর এলে আমি যেন ও ঘরটিতে থাকি, ও ঘরটি তিনি আড্ডার জন্য বানাচ্ছেন। উদাসীন হিসেবে শক্তির নাম আছে, কবিতাই তিনি কোথায় লিখে রাখেন খোঁজ পান না আর নাইম কিনা শক্তিকে আবদার করল তাঁর পত্রিকায় কলাম লিখতে! অবশ্য শক্তি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলেন। পরের সপ্তাহেই তিনি লিখে রাখবেন কথা দিলেন।
আরও একটি চমক নাইম আমাকে দিল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে রাতের খাবারের নেমন্তন্নে নিয়ে গিয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঢাকায় দুবার আমার দেখা হয়েছিল। প্রথমবার স্বরশ্রুতির আবৃত্তি উৎসবে। উৎসবের তিনি বিশেষ অতিথি ছিলেন। মোজাম্মেল বাবু, শাহরিয়ার, ইমদাদুল হক মিলন এবং আরও কজনের সঙ্গে আমি যখন ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাঠে আড্ডা দিচ্ছিল!ম, দেখেছি তিনি কাছেই বসে আছেন ভক্তপরিবেষ্টিত। অটোগ্রাফ দিচ্ছেন তরুণ তরুণীদের বাড়িয়ে দেওয়া কাগজে, খাতায়, বইয়ে। আমাদের আড্ডায় হঠাৎ মোজাম্মেল বাবু বলল, ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো সবাইকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন, কেমন হয় আমরা যদি তাঁকে এখন অটোগ্রাফ দিই।’ প্রস্তাবটি মজার, সবাই আমরা হেসে উঠি কিন্তু কার স্পর্ধা আছে সুনীলকে অটোগ্রাফ দেবার! বাবু আমাকে বলে, ‘চলেন আপা সুনীলদাকে অটোগ্রাফ দিয়ে আসি।’ কারও কানের কাছে বেলুন ফাটিয়ে মজা করে মজা দেখার উৎসাহ নিয়ে আমি উঠি। দুজন আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়ালাম, তিনি ভাবছিলেন আমরা অটোগ্রাফ নিতে এসেছি, প্রায় হাত বাড়াচ্ছিলেন আমাদের হাতে কোনও খাতা বা বই থাকলে তা নিতে, এমন সময় বাবু বলল, ‘সুনীলদা, আমরা আপনাকে অটোগ্রাফ দিতে এসেছি।’ শুনে আমি যদিও মুখ আড়াল করতে চাচ্ছি লজ্জায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু মোটেও বিব্রত হননি, বিস্মিত হননি বরং বিনীত হেসে বলেছেন, ‘আমার কাছে যে কাগজ নেই।’ কাগজ সংগ্রহ করা হল এবং সেই কাগজে আমরা দুজন দুটো অটোগ্রাফ দিলাম আর সেই ছেঁড়া কাগজটি বাংলার বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক তাঁর শার্টের বুক পকেটে বেশ যত্ন করে রেখে দিলেন। অটোগ্রাফ দিয়ে আমাদের আড্ডাটিতে ফিরে এলে সকলে ঘিরে ধরল, উৎসুক জানতে কী ঘটেছে। এর পরের দেখাটির সময় খুব সামান্যই কথা হয় দুজনের। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, বুঝি যে মনে নেই আমি যে তাঁকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম। আমি আমার সেই স্পর্ধার কথা আর মুখ ফুটে বলি না। কলকাতায় তাঁর ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনের বাড়িতে বিস্তর পানাহারের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী স্বাতী মিষ্টভাষী সুন্দরী। সৌমিত্র মিত্র তাঁর স্ত্রী মুনমুনকে নিয়ে এসেছিলেন। মুনমুনও বেশ সুন্দরী। খুব অনায়াসে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় আর মুনমুন মিত্র মদ্যপান করলেন। এর আগে আমি কোনওদিন কোনও মেয়েকে মদ্যপান করতে দেখিনি। পান করার ক্ষমতা আমার কোমলে সীমিত বলে একটি লিমকার গ্লাস নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু সকলের ষড়যন্ত্রে দেখি আমার গ্লাসে দুফোঁটা ঝাঁঝালো গন্ধের উপদ্রপ। কয়েক চুমুকের পর আমার মাথা ঘুরে ওঠে। কিন্তু ঘুরে ওঠা মাথায় ভাল লাগার এক রিমিঝিমি শব্দ শুনি যখন গান গাইতে শুরু করলেন সবাই। যে যা পারে গাইছেন, হেঁড়ে গলায়, ধরা গলায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একের পর এক গেয়ে যাচ্ছেন যেন পুরো গীতবিতানই তিনি সে রাতে গেয়ে শেষ করবেন। রাত গড়াতে গড়াতে মধ্যরাতে ঠেকলো। মিলন আমাকে যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে নিয়ে আসতে সংকোচ বোধ করেছে, সেখানে নাইম আমাকে নিয়ে এসে গৌরব বোধ করেছে। কাছ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত বিশাল মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হল, বন্ধুর মত আড্ডা হল। ভাল লাগা আমাকে বড় নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে রাখে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ এরকম বড় কবিদের সঙ্গে দুদিন পর আমার কবিতা পড়ারও আমন্ত্রণ জোটে। সৌমিত্র মিত্রের আবৃত্তিলোক আয়োজিত জুঁই ফুলে সাজানো শিশির মঞ্চে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং আরও আরও কবিদের সঙ্গে এক মঞ্চে সভয়ে সলাজে একটি কবিতা পড়ি। ধন্য হই কি? ধন্য হই। আকাশ ছোঁয়া কিছু কিছু স্বপ্ন থাকে মানুষের আমার স্বপ্ন এতদূর পর্যন্ত পৌঁছোতে কখনও সাহস করেনি।
সিদ্ধার্থ আমাকে বলেছে যে নাইম তাকে আমার কিছু বই পাঠিয়েছে, বইগুলো সে কলেজ স্ট্রিটের প্যাপিরাস বুকস নামের দোকানে রেখেছে। দেশ এ ছোট একটি বিজ্ঞাপন দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছে। প্যাপিরাসে কিছু বিক্রি হল কী না তা আমি নাইম বা সিদ্ধার্থর কাছে কিছু জানতে চাই না। জানতে চাই না লজ্জায়, যদি শুনতে হয় একটি বইও বিক্রি হয়নি। বইটি নিয়ে আমার লজ্জার শেষ নেই, হেলাল হাফিজ বলেছিলেন আমার নাকি অহংকারও আছে। বইটি যখন ছাপা হচ্ছে প্রেসে, হেলাল হাফিজ তাঁর বইয়ের প্রকাশক অনিন্দ্য প্রকাশনীর নাজমুল হককে অনুরোধ করেছিলেন আমার বইটির দায়িত্ব নিতে। প্রচ্ছদশিল্পী খালিদ আহসানও অনুরোধ করেছিলেন নাজমুল হককে। আমি ছিলাম সামনে। নাজমুল হক প্রথম ইতস্তত করছিলেন। পরে অবশ্য নিমরাজি জাতীয় কিছু হলেও আমি সকলকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলাম বইটি আমি অনিন্দ্যকে দেব না, আমি নিজেই ছাপবো। নাজমুল হক চলে গেলে হেলাল হাফিজ আমাকে বলেছিলাম, আমার ওই অহংকারটুকু তাঁর খুব ভাল লেগেছে। যে লোক দ্বিধা করছে বইটি ছাপতে, তাকে আমি কেন দেব বই! এইটুকু অহংকার বা আত্মসম্মানবোধ যদি না থাকে মানুষের, তবে থাকে কী!
নাইমের সাহস দেখে মাঝে মাঝে আমি খুব বিস্মিত হই। বড় বড় লেখক কবিদের কাছে তার নতুন পত্রিকাটির জন্য খুব য়চ্ছন্দে কলাম চাইছে সে। এমনকী পুর্ণেন্দু পষনীর বাড়িতেও সে গেছে লেখা চাইতে। আমার কখনও এই স্পর্ধা হত না জানি। পূর্ণেন্দু পষনীর কথোপকথন আর আমরা আবহমান ধ্বংস ও নির্মাণের সকল শব্দাবলী আমার তখন ঠোঁটস্থ। পূর্ণেন্দু পষনীকে যখন আমি দেখছি চোখের সামনে, মনে মনে আওড়াতে থাকি কোনও এক নন্দিনীর জন্য কোনও এক শুভংকর যে কথা বলেছিল, মানুষ, নন্দিনী/ শুধু মানুষ/ উত্তাল ঝড়ঝাপটায়/কেরোসিন কুপির শিউরে-কাঁপা শিখার নিচে/ দুঃখিত মানুষের মুখগুলো/ তাদের স্যাঁতসেঁতে চামড়ায় শস্য এবং ডিজেলের গন্ধ,/ তাদের ঘামের নুনে/অভ্রের ঝিলিক, তাদের হাতের চেটোয়/কোদাল কুড়োল এবং ইঞ্জিন চাকার ছাপ। এই সব মানুষের মুখের দিকে তাকালেই/ আমার দেখা হয়ে যায়/আকাশ, মেঘ, পর্বত চূড়ার পিছনে সূর্যোদয়/দেখা হয়ে যায় নতুন নতুন বৃক্ষের জন্ম/বৃক্ষকে ঘিরে/জ্বলজ্বলে জনপদের বিকাশ। পূর্ণেন্দী পষনীর কবিতা আমার পছন্দ বলে নাইম সৌমিত্র মিত্রকে ধরে পষনীর সঙ্গে আমার যেন দেখা হয়, তার ব্যবস্থা করেছে। কোথায় নাইম তার ব্যবসার কাজ করবে, তার কিছুই নয়। সে ব্যস্ত আমার অপ্রত্যাশিত কিছু চমৎকার ব্যপার ঘটিয়ে আমাকে খুশি করতে। লক্ষ্য করেছি আমার খুশি দেখলে নাইম খুশি হয়। কিসে আমার ভাল লাগবে, আমার আনন্দ হবে তা নিয়ে সে সারাক্ষণই ভাবছে। পারলে সে আকাশের চাঁদটিও আমার হাতে এনে দেয়। আমার কোনও বন্ধুকেই কখনও এমন নিবেদিত হতে দেখিনি। কেবল বন্ধুই কেন! যাকে আমি ভালবেসেছিলাম পাগলের মত, সেই রুদ্রই কি কোনওদিন ভেবেছে!
আমি মুগ্ধ নয়নে পূর্ণেন্দু পষনীকে দেখছি, কথা বলতে গেলে যদি ভুল কিছু বলে ফেলি, এই ভয়ে কথাই বলছি না কিন্তু, নাইম, দিব্যি, যেন পষনী তার খালাতো ভাই এমন গলগল করে তাও আবার কুমিল্লার উচ্চারণে লেখা চাইছে। যেন লেখা চাইছে কোনও সংববদপত্রের ছাপোষা কলামিস্টের কাছে। এত বড় বড় কবির সঙ্গে নাইমের কোনও ভেবে চিন্তে কথা বলতে হয় না। লেখা চাওয়া তার কাছে কি ভাই লেখাটা এহনও দিতাছেন না যে! যত তাড়াতাড়ি পারেন লেখাটা রেডি কইরা রাইখেন, কালকের মধ্যেই চাই এর মত সহজ। নাইম কারও লেখা পড়েনি, কাউকেই তার বিশাল কিছু মনে হয় না। নাইমের উচ্চাকাংখা প্রচণ্ড। নামী দামী সাহিত্যিককে দিয়ে লেখাতে পারলে তার পত্রিকা ভাল চলবে, সম্পাদক হিসেবে তার নাম হবে, এটিই তার কাছে বড়। কারও সময় আছে কী না কলাম লেখার, কেউ আদৌ কলাম লিখতে চান কী না বাংলাদেশের একটি নতুন কাগজে, তাও জানতে চায় না। সে টাকার কথা বলে, এও জানতে চায় না তার ওই কটি টাকার কারও প্রয়োজন আছে কী না। অবশ্য লিখেছেন অনেকে, সে পূর্ববাংলাকে ভালবাসেন বলেই লিখেছেন, আমার মনে হয় না অন্য কিছুর জন্য।
সৌমিত্র মিত্র একসঙ্গে ঠিক কতগুলো কাজ করেন, তা আমার পক্ষে ধারণা করা শক্ত। যতক্ষণই তাঁকে দেখেছি, তিনি কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত। আবৃত্তি করেন, ওদিকে আবার সরকারি তথ্য অফিসারের চাকরি করেন। কুমুদ মান্না নামের এক ব্যবসায়ী লোককে বলে আমাদের নৌকো চড়াবার ব্যবস্থা করলেন একদিন। রাতের গঙ্গা। গঙ্গা দেখার বড় শখ ছিল আমার। গঙ্গার জল ছলাৎ ছলাৎ করে শব্দ তুলে আমার পা ভিজিয়ে দেয়। আমি ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে গঙ্গার কোনও অমিল দেখতে পাই না। আমি যখন গঙ্গার বিভোর ছিলাম, নাইম গঙ্গার দিকে পেছন ফিরে তার ভাবনার গভীর জলে ডুবে ছিল কী করে আমাকে আরও বেশি বিহ্বল করা দেওয়া যায়, আমাকে আরও বিমুগ্ধ করা যায়!
হঠাৎ নাইম আমাকে এক সকালে বলল, ‘তাড়াতাড়ি রেডি হ। একজায়গায় যাইতে হইব।’কোন জায়গা তার কিছুই বলে না সে। তারপর ইস্টিশনে নিয়ে ট্রেনে ওঠালো, সৌমিত্র মিত্রও যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে, তিনি বললেন যে শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি আমরা। শান্তিনিকেতন! ঝিরঝির শান্তি ঝরতে থাকে হৃদয়ে। আমার আনন্দিত চোখদুটো নাইম দেখল। প্রতিদিনই নাইম আমাকে চমক দিচ্ছে। গোপনে যে সে আয়োজনটি করে রেখেছিল, তার কোনও আভাস পাইনি। শান্তিনিকেতনে পৌঁছে আমার জীবন সার্থক হয়। শান্তিনিকেতনে তখন মিষ্টভাষী মৃদুভাষী কবি শঙ্খ ঘোষ ছিলেন। প্রিয় লেখক, প্রিয় কবিদের সঙ্গে দেখা হলে কী কথা বলব ভাবতে ভাবতেই আমার সময় যায়। বেশির ভাগই বাকরুদ্ধ বসে থাকি। কী এক ঘোরের মধ্যে সারাদিন রবীন্দ্রনাথের বাড়িঘর, ছাতিমতলা, আম্রতলা সব ঘুরে ঘুরে দেখি। যে সব জায়গায় দর্শকের ঢোকা নিষেধ, শান্তিনিকেতনের উপাচার্যের কল্যাণে সে সব জায়গাতেও আমাদের ঢোকার অনুমতি মেলে। রবীন্দ্রনাথের চেয়ারে বসিয়ে নাইম আমার ছবি তুলতে চাইছিল, এত বড় স্পর্ধা আমার হয়নি সেই চেয়ারে বসার, আমি মেঝেয় বসি। সবকিছু আমার যেন কেমন স্বপ্নের মত লাগছিল, রাতে গেস্ট হাউজে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশালতার কথা ভেবে আমার আবেগ উপচে পড়ে। কেঁদে ভাসাই। কোনও কল্পিত ঈশ্বরের পায়ে পড়ে লোকে যেমন কাঁদে, আমার কান্নাও তেমন। তবে এ ঈশ্বর বটে, কল্পিত নয়। না, আমি কোনও পাপ মোচনের অনুরোধ করে কাঁদি না। এ কান্না কোনও সুখের নয়, দুঃখের নয়। এ কান্না রবীন্দ্রনাথকে তীব্র করে অনুভব করার কান্না। আমার কান্নার কোনও কারণ নাইমের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। সে আমার পিঠে হাত রাখে, পিঠের হাতটি একটু একটু করে নিচের দিকে নামে। হাতটি আমার সন্দেহ হয় যে আমার প্যাণ্টের বোতামের দিকে নামতে চাইছিল। আমি দ্রুত সরিয়ে দিই নাইমের হাত। সম্ভবত সে ভেবেছে, আর সব পুরুষের মত, যে, যে মেয়ে কোনও পুরুষ নিয়ে অনেকদিনের জন্য হাওয়া হয়ে যায়, হোটেলে রাত কাটাতে দ্বিধা করে না, তার কাছে নিশ্চয়ই শারীরিক সম্পর্ক নিতান্তই ডালভাত। নাইমকে আমি ভেবেছিলাম সবার থেকে আলাদা। কিন্তু তার হাতটি আমার পিঠ থেকে নিচের দিকে নামছিল বলে ইচ্ছে না হলেও তাকে আমার তাদের কাতারেই ফেলতে হয় যারা মেয়েমানুষের শরীর দেখলে লোভ সংবরণ করতে পারে না। কিন্তু এরকম কি কোনও পুরুষ আছে হাতের কাছে কোনও রমণী পেয়েও কামগন্ধহীন রাত কাটাতে পারে! নেই হয়ত। নাইমের চরিত্রের অন্য দিকগুলো আমার ভাল লাগে বলে আমি ক্ষমা করে দিই তার ওই কুৎসিত হাতটিকে। তাকে একটুও বুঝতে দিই না যে আমি বুঝেছি তার হাত যে নামছিল, নাইমও এমন ভাব করে যে হাতটি সে পিঠেই কেবল রেখেছিল, মোটেও তার হাতটির গন্তব্য অন্য কোথাও ছিল না।
কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর নাইম আমাকে তার পত্রিকায় আমাকে কলাম লেখার আমন্ত্রণ জানায়। এ পর্যন্ত যা কিছু লিখেছি পত্রিকায় তা কবিতা আর গল্প। কোনওদিন কলাম বলে কোনওকিছু লিখিনি। আমি ‘ধুর কলাম কি করে লিখতে হয় আমি জানি না,’ বলে উড়িয়ে দিতে চাইলে সে বলে, ‘তোর যা ইচ্ছে করে তাই লেখ, ঘাবড়ানির কিছু নাই।’ ঘাবড়ানির কিছু নাই হয়ত, কিন্তু আমি ঘাবড়ে যাই। কলাম লেখার অভ্যেস অভিজ্ঞতা না থাকলে কি করে লিখব! নাইম জোর করে, ‘লিখতেই হবে। হক ভাই বইলা দিছে তোরে যেন কলাম লিখতে বলি।’ সৈয়দ হক আমাকে স্নেহ করেন জানি, নিজে তিনি আমার কবিতা পড়ে তাঁর বইয়ের প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশএর মালিক মজিবর রহমান খোকাকে বলেছেন আমার বই ছাপতে। একটি চিঠিও লিখে দিয়েছিলেন যেন সেই চিঠি আর আমার কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে খোকার সঙ্গে দেখা করি। করেছিলাম, খোকা বলেছেন, ‘আমরা তো নতুন কবির কবিতার বই ছাপি না। তবে আপনি যদি টাকা দেন, তাহলে ছাপতে পারি।’ রাগ করে চলে এসেছিলাম। টাকা দিয়ে যদি বই ছাপতে হয় তাহলে নিজেই ছাপতে পারি। খবরের কাগজ পত্রিকাটি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি কাগজ। সাপ্তাহিক পত্রিকার যে চরিত্র বিচিত্রা তৈরি করেছিল, বিচিত্রার পথ অনুসরণ করে সন্ধানী আর রোববার বেরিয়েছে, কিন্তু সব চলতি ধরন ভেঙে নতুন চরিত্রে খবরের কাগজ দেখা দিয়েছে। নিউজপ্রিণ্টে ছাপা। পঈচ্ছত নিউজপ্রিণ্টে। দাম কম। যে কারও কেনার সামর্থ আছে। কোনও কবিতা গল্প নেই, সিনেমার খবর নেই। খবরের মধ্যে এক রাজনীতির খবর। বাকি লেখাগুলো কলাম, রাজনীতি সমাজ সাহিত্য নিয়ে বড় বড় লেখক বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদদের কলাম। যে লেখকরা আগে কোনওদিন কলাম লেখেনি, এই প্রথম তারা খবরের কাগজের জন্য কলাম লেখা শুরু করেছে। এত জনপ্রিয় লেখকদের এক সঙ্গে এক পত্রিকায় জড়ো করা নতুন একটি ঘটনা বটে। পত্রিকা জগতে খবরের কাগজ একটি আন্দোলনের মত।
কিছু কিছু আমন্ত্রণ আছে আশার অতীত। খবরের কাগজে লেখার জন্য এই আমন্ত্রণটি আমি কখনই আশা করিনি। এমন একটি জনপ্রিয় কাগজে কিছু লেখার সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। ভাগ্যের পেছনে মানুষ দৌড়োয়। ভাগ্য আমার দোরগোড়ায় এসে পড়ে থাকে। আমি তাকে মোটে ছুঁয়ে দেখি না। কিন্তু নাইমের উৎসাহ এবং তাগাদা আমাকে কাগজ কলম হাতে নিতে বাধ্য করে। কী লিখব কী লিখব ভাবতে ভাবতে হাত কচলাতে কচলাতে বাহুতে ঘসতে ঘসতে চিহ্নটি চোখে পড়ে। ডান বাহুতে সাদা একটি বৃত্ত, সিগারেটে ত্বক পোড়ার স্মৃতি। ঘটনাটি মনে পড়ে, অনেক বছর আগে একটি রাস্তার ছেলে আমার বাহুতে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরে হা হা করে হাসছিল আনন্দে। যখনই ওই দৃশ্যটি মনে পড়ে আমার, আমি সেই পোড়ার কষ্টটি অনুভব করি। সামনে কাগজ কলম, আর আমি সেই কষ্টটি অনুভব করছি। এই অনুভবটিই আমাকে লেখায় সেদিনের সেই ঘটনাটি। সিনেমা থেকে বেরিয়ে রিক্সায় চড়েছি, রিক্সা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে, তখনই অনুভব করি ডান বাহুতে তীব্র একটি যন্ত্রণা। ‘আধখাওয়া জ্বলন্ত একটি সিগারেট আমার বাহুতে চেপে ধরেছে বারো তেরো বছর বয়সের একটি ছেলে। .. ভাবছিলাম চিৎকার করব, কাউকে ডাকব, বিচার চাইব। কিন্তু কিছুই করিনি। কারণ, লোকেরা ভিড় করে আমাকে দেখবে, আমার যন্ত্রণা, আমার আর্তস্বর, আমার ক্রোধ আমার কান্না দেখবে। সবাই তারা আমাকে উপভোগ করবে। আমার ডান বাহুতে এখনও পোড়া দাগ, আমি সেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনও বহন করে চলেছি। এ আমার সৌভাগ্য যে এখনও কেউ এসিড ছুঁড়ে আমার মুখ পোড়ায়নি, আমার দুচোখ অন্ধ করেনি, আমার সৌভাগ্য যে রাস্তাঘাটে এক পাল পুরুষ আমাকে ধর্ষণ করেনি। আমার সৌভাগ্য যে আমি এখনও বেঁচে আছি। আমার যে অপরাধের কারণে আমি এত সব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি তা হচ্ছে আমি মেয়েমানুষ। আমার শিক্ষা আমার রুচি আমার মেধা আমাকে মানুষ করতে পারেনি, মেয়েমানুষ করেই রেখেছে। এই দেশে মেয়েরা কোনও যোগতা বলেই মানুষে উত্তীর্ণ হতে পারে না।..’ এক টানে লিখে ফেলি। নাইম ময়মনসিংহে আসে লেখা নিতে। লেখাটি দেব কী দেব না তখনও ভাবছি। এও ভয় হচ্ছে নিশ্চয়ই পড়ে ওরা বলে দেবে কিμছু হয়নি। বিষম সংকোচে লেখাটি শেষ পর্যন্ত দিই, তবে দেওয়ার সময় বলি, ‘দেখ, কলাম কি করে লেখে তা তো আমি জানি না। নিজের জীবনের একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি শুধু।’ শক্ত শক্ত শব্দ ব্যবহার করে বলিষ্ঠ কিছু একটা লেখা আমার দ্বারা হবে না বোধহয়। নাইম লেখাটি নিয়ে যায়, তবে আমার একটি সন্দেহ থেকে যায় আদৌ ওটি ছাপা হবে কী না। চমকে দেওয়া নাইমের স্বভাব। লেখাটি যেদিন ছাপা হয় সেদিনই সে ময়মনসিংহে আসে হাতে একটি পত্রিকা নিয়ে। দেখে বিশ্বাস হয় না এত বড় বড় লেখকদের কলামের পাশে আমার কলাম। এরপর প্রতি সপ্তাহেই কলাম লিখতে হয়। কী লিখব কী লিখব এ নিয়ে আর খুব একটা ভাবতে হয় না। লেখা ছাপা হওয়ার পর থেকে আমার লেখা নিয়ে প্রচুর চিঠি আসতে থাকে খবরের কাগজ আপিসে। প্রশংসা করে, নিন্দা করে। তবে প্রশংসাই বেশি। কেউ বলে, বাহ, চমৎকার। কেউ বলে, সাংঘাতিক। কেউ বলে, খুব সত্য কথা। কেউ বলে, মেয়েটি খুব সাহসী। কেউ বলে, কলাম পড়ে আমি কেঁদেছি। কেউ নাক সিঁটকায়, বলে, এসব ওর ব্যক্তিগত ব্যপার। কেউ বলে, পুরুষ বিদ্বেষী। যে পড়ে সে-ই বলে, কিছু না কিছু বলেই।
আমার কলাম নিয়ে কাগজ আপিসে, আপিসের বাইরে প্রেসক্লাবে, সাহিত্যের আড্ডায় নাকি আলোচনার ঝড় বইছে, নাইম জানায়। পাঠক নাকি সাংঘাতিক খাচ্ছে আমার কলাম। কী লিখলে পাঠক খায়, কী লিখলে খায় না তা আমার জানা নেই। পাঠক খাওয়ানোর উদ্দেশ্য আমার নয়। প্রতিটি কলাম লিখতে লিখতে আমি জানি আমার চোখ ভিজে ওঠে জলে। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি বাক্যের প্রতিটি শব্দ আমার কলম থেকে নামে না, হৃদয় থেকে নামে। কষ্ট গুলো বুকের ভেতরে জমা কষ্টের ঝাঁপি খুলে বেরোয়। আমার নিজের দেখা আশপাশ নিয়েই মূলত লিখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ বড় বড় প্রবন্ধের বই লিখেছেন, নতুন একটি প্রবচনের বইও লিখেছেন, মেয়েদের সম্পর্কে তাঁর নিজের অশ্লীল মন্তব্যগুলোর নাম দিয়েছেন প্রবচন। দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মেয়েই পতিতা। এসব বলে তিনি তাঁর পুরুষভক্তদের কাছ থেকে বাহবা পান, নিজেও দেঁতো হাসি হেসে বাহবা উপভোগ করেন। তিনি যত বড় লেখকই হন, তাঁকে ছেড়ে কথা কই না আমি। এমন কি যে সৈয়দ শামসুল হকের যে চরিত্র আমি দেখেছি, সেই চরিত্র সম্পর্কে আমার যে মত, তাও প্রকাশ করি। প্রকাশ করি এইজন্য যে, সাহিত্য জগতের বড় বড় অনেক রুই কাতলার আচরণ যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কোনও বদ পুরুষের আচরণের চেয়ে খুব বেশি পৃথক নয় তা বোঝাতে। যে জগতে আমার বিচরণ, সেই জগতের কথা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করলেও সমাজের সব স্তরের মেয়েদের প্রতি পুরুষের আচরণও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমার ব্যক্তিগত ব্যপার তখন আর আমার ব্যক্তিগত থাকে না, সমষ্টিগত হয়ে যায়। আমি খুব নিজে লক্ষ্য করি না, কিন্তু লোকে বলে আমার ভাষা খুব ধারালো, মেয়েদের নিয়ে অনেকে অনেক কথা ই এ যাবৎ লিখেছে কিন্তু এমন করে কেউ লেখেনি।
নাইম একসময় জানালো আমার লেখা ছাপা হলে পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়। অবাক লাগে। বিশ্বাস হতে চায় না। এমন কাণ্ড কি ঘটে বা ঘটতে পারে! কিন্তু পারে। খবরের কাগজে হুমায়ূন আজাদের কলামটি বেশ জনপ্রিয় ছিল, তাঁর লেখা পড়ে পাঠকরা প্রচুর চিঠি লিখত, সে সব ছাপাও হত। এখন কেন তাঁর কলাম সম্পর্কে চিঠি ছাপা হয় না, তসলিমার লেখা বিষয়ে বেশির ভাগ চিঠি ছাপা হয়, এ নিয়ে হুমায়ুন আজাদ অভিযোগ করলেন, ক্ষেপে আগুন তিনি। পত্রিকার লোকেরা বলে দিয়েছে, তসলিমার বাহিরে অন্তরে কলামের আলোচনা সমালোচনা করেই মানুষ আজকাল বেশি লেখে, আপনি আপিসে নিজে এসে দেখে যেতে পারেন চিঠির স্তূপ। তারপরও নাকি ভীষণ চেঁচামেচি। এত নাম আছে লোকটির, তারপরও নাম চাই। তিনি গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন, এ দেশে সব খারাপ লেখক, এক তিনিই শুধু ভাল। তিনিই একমাত্র কবি। আর যারা কবিতা লেখে, সবাই অকবি। শেষ অবদি এমন হল যে তিনি নিজের লেখার প্রশংসা করে ছদ্মনামে চিঠি পাঠাতে লাগলেন খবরের কাগজের চিঠিপত্র কলামের জন্য। যে লোকটি দিয়ে তিনি কলাম পাঠান কাগজ আপিসে, সেই লোকই সেসব চিঠি বহন করে নিয়ে আসে। হায় কাণ্ড, মহীরূহরা তুচ্ছ তৃণকে ঈর্ষা করছেন!
খবরের কাগজের কলামগুলোর কারণে অনেক অভাবনীয় কিছু ঘটতে লাগল। বিদ্যাপ্রকাশের খোকা আমার বই ছাপার জন্য পাগলের মত খুঁজতে লাগলেন আমাকে। অন্য পত্রিকা থেকে কলাম লেখার আমন্ত্রণ এলো। নাইমের বিশেষ অনুরোধে খবরের কাগজ ছাড়া অন্য কোথাও লেখা থেকে বিরত রইলাম কিন্তু বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বই বের হল। একটি নয়, দুটি। নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে আর আমার কিছু যায় আসে না। যেহেতু নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে সকাল প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে, সেটি প্রথম দিই নি। আমার কিছু যায় আসে নার পাণ্ডুলিপি দেওয়ার পর খোকা আবদার করলেন নির্বাসিত বাহিরে অন্তরেও দিতে হবে। দুটো কবিতার বই ছাপতে না ছাপতেই বিক্রি হয়ে গেল। খোকা ব্যস্ত নতুন মুদ্রণে। নতুন মুদ্রণও শেষ হয়ে আসে কদিনেই। তিনি মুদ্রণ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কোনও কবিতার বই এভাবে বিক্রি হতে বাংলাবাজারের কোনও প্রকাশকই দেখেনি আগে। এমন কি সৈয়দ হকও বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে গিয়ে রাগ দেখিয়ে এসেছেন, কারণ তাঁর বইএর চেয়ে তসলিমার বই ভাল চলছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে সৈয়দ হকের মত বড় লেখক এ নিয়ে রাগ করতে পারেন। তাঁর সঙ্গে আমার কোনও তুলনা হয় না এ তিনি নিজেও জানেন। যে সৈয়দ হক নিজে চিঠি লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন বিদ্যাপ্রকাশের কাছে, তাঁর বরং খুশি হওয়ার কথা আমার বই ভাল চললে। খোকা জানালেন, সৈয়দ হক অখুশি।
খবরের কাগজের সাফল্যের পর নাইমের একটি পরিকল্পনা ছিল একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করার। নাইম যা পরিকল্পনা করে, তা সে যে করেই হোক করে ছাড়ে। ঠিক ঠিকই একদিন সে আজকের কাগজ নাম দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করে ফেলল। ধানমণ্ডিতে কাজী শাহেদ আহমেদর বিশাল বাড়িটির দোতলায় যে ছোট একটি ঘর বরাদ্দ ছিল খবরের কাগজ আপিসের জন্য, সেটি বড় হতে হতে বিশাল হয়ে উঠল। অনেক সাংবাদিক, অনেক টেবিল, অনেক চেয়ার। খবরের কাগজ সাপ্তাহিকীটির মত আজকের কাগজ দৈনিকটিও খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
আমার কবিতার বইদুটো অভাবিত সাফল্য পাচ্ছে। কলামের কারণে খবরের কাগজের বিক্রি বেড়ে গেছে, প্রশংসা করে হাজার হাজার চিঠি আসছে কাগজ আপিসে। এসব যখন ঘটছে, ময়মনসিংহে কিন্তু অবস্থা সম্পূর্ণ অন্যরকম। নাইম প্রায়ই ময়মনসিংহে চলে আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে, বার কয়েক তাকে অবকাশে দেখার পর বাবা বলতে শুরু করেছেন, ‘কে এই ছেলে, কী এত মাখামাখি এর সাথে! বাড়ির সবার মুখে চুনকালি দিয়া বিয়া করছিল নিজের ইচ্ছ! মত। তারপর কি হইল? জামাইয়ের সাথে তো দুইদিনও টিকতে পারে নাই। এহন আবার কোন ব্যাডার সাথে ঘুরাঘুরি করে? মাইনসে তো বেশ্যা কইব এরে। কোনও পুরুষ মানুষ আমার বাসায় যেন না আসে।’ মা বলেছিলেন ‘নাইম নামের ছেলেডা নাকি ওর বন্ধু।’ বাবা দাঁত খিঁচিয়ে বলেছেন, ‘বন্ধু আবার কী! বন্ধু জিনিসটা কি, শুনি? কোনও ছেলের সাথে আমি যেন মিশতে না দেখি। মিশতে হইলে যেন বিয়া কইরা লয়। আমি যদি আমার বাসায় কোনও ব্যাডারে দেখি, ঘাড় ধইরা বাসা থেইকা দুইডারেই বাইর করে দিব।’ অপমান আমাকে কামড়ে খায়। মা বলেন, ‘তর বাপে তরে বিয়া করতে কইছে। বিয়া ছাড়া এই যে মিশছ ব্যাডাইনগর সাথে, ওরাই বা কি কয়! ওরা তো খারাপ কয়।’ এ মার গরম হয়ে বাবার কথাগুলোই চালান করা। নরম হয়ে মা আবার বলেন, ‘তুমি নিজের জীবনের কথা একটু ভাব। নাইম যদি ভাল ছেলে হয়, যদি তোমার ভাল লাগে তারে, তাইলে বিয়ার কথা ভাব। বিয়া তো করতেই হইব। সারাজীবন কি একলা থাকবা?’
নাইম এরপর ফোন করলে বলে দিই হুট করে ময়মনসিংহে যেন সে আর চলে না আসে। এরপর একদিন সে ফোনে বলে যে কাল ভোর ছটার সময় আমি যেন কালো ফটকের বাইরে বেরোই। কেন বেরোবো, কি হবে বেরোলে তার কিছুই সে বলে না। পরদিন ভোরবেলা বেরিয়ে দেখি, নাইম দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। পরদিনও একই জিনিস ঘটে। প্রতিদিন ভোরবেলা সে ভোরের ট্রেনে ঢাকা থেকে চলে আসে ময়মনসিংহে। যেহেতু তার জন্য অবকাশ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, অবকাশের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে এক পলক দেখার আশায় তার এই দাঁড়িয়ে থাকা। অগত্যা আমাকে ভোরে উঠতে হয়, কারও ঘুম ভাঙার আগে আমাকে নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরোতে হয়, (হাতে টুথব্রাশ নিয়ে, বাড়িতে কেউ যদি হঠাৎ জেগে ওঠে ভাব দেখাতে হয় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দাঁত মাজতে যাচ্ছি। এটি উদ্ভট কিছু নয়, পাড়ার লোকেরা অহরহ করে।) খুব আস্তে কেউ যেন শব্দ না পায় এমন করে কালো ফটক খুলে বেরোতে হয়। নাইমের সঙ্গে পাঁচ কি দশ মিনিট রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি, কোনও জরুরি কথা নয়, ওটুকুতেই সে তুষ্ট হয়ে সকালের ট্রেনেই চলে যায় ঢাকায়। এমন পাগল ছেলে আমি আগে দেখিনি। নাইমকে বলেছি, ‘তুই এমন পাগলামি করস কেন? কোনও মানে হয় না এভাবে এত দূর চলে আসার। তোর কষ্ট হয় না জার্নিতে?’
নাইম না বলে, তার নাকি মোটেও কষ্ট হয় না বরং ভোরবেলার ঘুম ঘুম নীরব জগতটি দেখতে তার খুব ভাল লাগে। প্রতি ভোরে আমার বের হওয়া সম্ভব হয় না বাইরে, ঘুমই ভাঙে না অথবা ঘুম ভাঙলেও দেখি বাবা জেগে উঠেছেন। নাইম রাস্তায় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে যায়। নাইমের এই আচরণ আমাকে প্রথম ভাবায়, সে কি আমাকে ভালবাসে! নাকি আমি ছাড়া তার আর কোনও সত্যিকার বন্ধু নেই! যদি সে ভালই বাসে, কোনওদিন তো বলেনি যে সে আমাকে ভালবাসে!
অবকাশ দিন দিন আমার কাছে আরও অসহ্য হয়ে উঠছে। কারও নরম গরম কোনও কথাই আমার ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে এ বাড়ি থেকে চলে যাই কোথাও। কোথাও আমি নিজের মত করে থাকি। ইয়াসমিন চলে যাওয়ার পর বাড়িটিতে আমার আর কেউ নেই যার সঙ্গে আমি দু কথা বলে সময় কাটাতে পারি। বুকের ধন সুহৃদও নেই। বড় ফাঁকা লাগে সবকিছু। বড় হু হু করে বুক। বাড়িটিকে আর বাড়ি বলে মনে হয় না। মার নিজের জগতটি বড় সংকীর্ণ, রান্নাঘর আর পীরবাড়ি, বাবার জগতে এ বাড়ির কারও কোনও স্থান নেই, যদি থাকে কারও, সে দাদার। দাদা আরোগ্য বিতানের দায়িত্ব নেওয়ায় বাবার সঙ্গে দাদার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আরোগ্য বিতানে চুরি হল এক রাতে। দাদা সন্দেহ করলেন শরাফ মামাকে, বাবাও তাই। টুটু মামা একবার দাদার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেন নি, সে নিয়ে দাদা প্রায়ই মামাদের গুষ্ঠি উদ্ধার করেন। মাকে উঠতে বসতে টুটু মামার টাকা নেওয়ার এবং না দেওয়ার কেচ্ছ! শোনান। দাদার অনেক আচরণই বাবার মত। বাবা যেমন নানিবাড়ির কাউকে আপন বলে ভাবেন না, দাদাও তেমন। বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া। হাশেম মামা আকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন। বক্তৃতা ভাল করতে পারেন না বলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ইউনিয়ন পরিষদের ওপরের কোনও ধাপে পা ফেলতে পারেন না। মুখে খই না ফুটলে আর নানারকমের প্রতিশ্রুতি, সে মিথ্যে হোক, না দিতে পারলে কারও ভোট জোটে না। হাশেম মামা তাঁর ভাতের দোকানে বসে থাকেন, দোকানেই বন্ধুদের ডেকে ডেকে রাজনীতির আলাপ করেন। দোকান করে সংসার চালাতে হয় হাশেম মামাকে। একটি ছোট্ট ঘরে বউ আর পাঁচ কন্যা নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন, কন্যাদের সবাইকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। একটি মাত্র ছেলে সুমন, খুনের মামলার আসামী হয়ে আরও কজন সমবয়সী ছেলের সঙ্গে জেল খাটছে। হাশেম মামা ম্যালা টাকা ঢালছেন ছেলে যে নির্দোশ এই প্রমাণ নিয়ে হাই কোর্টে মামলা করার জন্য। কোনও অবৈধ পথে টাকা ঢালতে তিনি চান না, চাইলে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পারতেন অনেক আগেই। মামাদের মধ্যে এক হাশেম মামারই আগ্রহ খুব আমার বই পড়ার। দেখা হলে প্রায়ই তিনি বলেন, ‘কই তোমার বই টই কিছু বাইর হইছে? দেও একটা বই দেও।’ একদিন হাশেম মামা এসে পাঁচশ টাকা ধার নিয়ে গেলেন আমার কাছ থেকে। টাকা চাইতে লজ্জা হচ্ছিল তাঁর, তারপরও উপায় ছিল না। সুমনের মামলার জন্য খরচের কোনও মা বাপ ছিল না। তবু হাশেম মামার আমার কাছ থেকে টাকা নেওয়াটি মার ভাল লাগে নি। মা মুখ কালো করে বসে রইলেন, খবরটি বাবা বা দাদার কানে গেলে মার চৌদ্দ গুষ্ঠির বাপান্ত করে ছাড়বেন। হাশেমমামাকে খুব ভালবাসেন মা, তাঁর নীতির জন্যই ভালবাসেন। নীতির কথা কইতে হাশেমমামা নিজের বাপকে ছেড়ে দেন না। এমন মানুষটিকে কেন আজ ভাগ্নীর কাছে হাত পাততে হয়! না খেয়ে থাকতে হবে, না খেয়ে থাক, তবু যেন হাত না বাড়ায় কারও কাছে। মা যতই গুষ্ঠি নিয়ে ভাল কথা বলতে চান, গুষ্ঠি নিয়ে তাঁর লজ্জাও কম নয়। মা খুব একা, মার জগতটিতে মা ছাড়া আর কেউ নেই। সংসারে যখন কোনও অঘটন ঘটে অথবা ছেলেমেয়েদের কারও কোনও গোপন সংবাদ যদি বাবা আহরণ করতে চান অথবা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চান, তবেই মার ডাক পড়ে। আজকাল মাকে তিনি পই পই করে জিজ্ঞেস করেন আমার গতিবিধি, কী করছি , কী ভাবছি, বাকি জীবনের জন্য কোনও পরিকল্পনা করছি কী না। নাকি এরকম যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবো। এরকম ঢাকা ময়মনসিংহ। এরকম আগল বাঁধনহীন জীবন যাপন। মা আমার পরিকল্পনার কথা পরিস্কার করে বাবাকে কিছু বলতে পারেন না।
বাবা বাড়ি এসে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাকে বলেন, ‘শহরে কারও কাছে মুখ দেখানো যায় না। আজকেও একটা লোক আইসা কইল, আপনার মেয়ে তো ডাক্তার হইছে, তার কি বিয়া টিয়া দিছেন? জামাই কি ডাক্তার নাকি? সে যে একটা বিয়া করছিল, তা অনেকে জানে। ব্যাডা মদারু মাগীবাজ এইসব না জাইন্যা বিয়া করছিল কেন? এহন এই মেয়েরে কেডা বিয়া করব? সব ব্যাডাই এরে লইয়া ঘুইরা বেড়াইব। বিয়া কেউ করব না। মাইনষের সামনে আমি মুখ দেখাইতে পারি না। মাইনষে জিগায়, মেয়ে বিয়ার উপযোগী হইছে তো বিয়া দেন না কেন? মাইনষে খবর জানতে চায়। কী উত্তর দিব মানুষের প্রশ্নের! মুখটা নামাইয়া রাখতে হয়। আমি কি কইরা বলব যে মেয়ে নিজের ইচ্ছ!য় বিয়া করছিল, জামাইরে ছাইড়া দিছে, এহন ব্যাডাইন লইয়া ঘুরে। মানুষে কি খবর রাখে না, ঠিকই রাখে। ছি ছি করে। কোনও ডাক্তার ছেলেরে বিয়া করলে বালা অইলো না অইলে? এতদিনে দুই তিনডা বাইচ্চা কাইচ্চা লইয়া সংসার করতে পারত।’
মা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ পারত। আমার বয়সী মুন্নির বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে, লক্ষ্মী মেয়ের মত সুন্দর সংসার করছে। উদাহরণটি মা দেন। উদাহরণের অভাব নেই। যেদিকে তাকান মা, আমার বয়সী এমনকী আমার বয়সে ছোটোদেরও চমৎকার সংসার হয়েছে দেখেন। কেবল আমারই হয়নি।
ভীষণ উৎপাত শুরু হয় বাড়িতে। উঠতে বসতে আমাকে কথা শুনতে হয়। কেউ ফোন করলে কে ফোন করেছে, কেউ চিঠি লিখলে কে চিঠি লিখেছে, কেউ বাড়ি এলে কে এই লোক, কি সম্পর্ক, সম্পর্ক যদি ভাল হয়, তাহলে কেন এখনো বিয়ে করছি না! সারাজীবন একা কাটাবো, বিয়ে করব না এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলে বাবার কড়া হুকুম, খুব ভাল কথা, বিয়ে না করেও অনেকে মেয়েরো বেঁচে থাকে, তবে ছেলেপিলেদের সঙ্গে মেলামেলা বন্ধ করতে হবে, বান্ধবী থাকতে পারে, তবে কোনও বন্ধু নয়। কেবল হুকুম দিয়েই তিনি শান্ত হন না, জরুরি অবস্থাও জারি করেন, আমার কোনও বন্ধু নামক পদার্থ যদি এ বাড়িতে আসে, তবে তার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবেন আমাকে। ইয়াসমিনকে মেরে বাড়িছাড়া করেছেন, আমাকে তিনি মারেন না। আমার শরীরে না পড়লেও মনে পড়তে থাকে শক্ত শক্ত চাবুকের ঘা। কুঁকড়ে যেতে থাকি যন্ত্রণায়। ইয়াসমিন নেই যে বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ব দুজন রিক্সা করে শহর ঘুরতে, অথবা গানের নাচের কবিতার অনুষ্ঠানে যাবো। একা কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ও চলে যাওয়ার পর সকাল কবিতা পরিষদও একরকম ভাঙা ভাঙা। আমি একটি অপদার্থ, অলক্ষ্মী হিসেবে প্রতিদিন চিহ্নিত হতে থাকি। রুদ্রকে বাড়ির কেউই পছন্দ করেনি, রুদ্রকে ছেড়ে আসায় সকলে প্রথম প্রথম খুশি হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ডিভোর্সী পরিচয়টিই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে ওঠে, আমার স্বামীহীন জীবন কারও কাছে আর তেমন ভাল লাগে না। একটি খাঁচা না হলে যেন আমাকে আর মানাচ্ছে না। খাঁচাহীন নিরীহ জন্তুটিকে খেয়ে ফেলবে যে কেউ, তাই কোনও একটি যেন তেন খাঁচায় আমাকে যে করেই হোক ঢুকতেই হবে। এফসিপিএস এ পড়ার জন্য আমার কোনও আগ্রহ নেই, আমি একটা যাচ্ছেত!ই ভবিষ্যত গড়ে তুলছি আমার, এসব নিয়ে বাবা এত বিরক্ত যে জঘন্যতম নোংরা কথা বলতে তাঁর আর বাঁধে না এখন। আমার মনে হতে থাকে যে স্বামী সংসার না থাকলেও একটি মেয়ে যে ভাল হতে পারে, তা প্রমাণ করার একটিই উপায়, কিছু অর্জন বা বর্জন। কিছু বাড়তি যোগ্যতা। কিছু বাড়তি দক্ষতা। বর্জনের মধ্যে পুস্টিকর আহারাদি বর্জন, সাধ আহলাদ আরাম আয়েস বর্জন, বিধবারা যা করে থাকে। অথবা সন্ন্যাস বরণ। অথবা আত্মহত্যা। অথবা চিতায় ওঠা। অর্জনের মধ্যে অসামান্য সাফল্য লাভ করা কোনও কিছুতে। কোনও কিছুর শীর্ষে ওঠা। সবোগচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া। এফসিপিএস পাশ করা। এফসিপিএস এর আবরণে স্বামীহীনতার গ্লানি আমাকে ঢাকতে হবে। অসাধারণ কোনও যোগ্যতা বা দক্ষতা দেখাতে হবে আমার অস্বাভাবিক জীবনকে সহনীয় করার জন্য। যেন বয়স হলে স্বামী সন্তান না থাকাটা একধরনের পাপ, এই পাপ মোচন করতে হলে আমাকে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে নির্বোধের মত খেটেখুটে বড় একটি ডিগ্রি নিয়ে। স্বামীহীনতা একটি যেন বিশ্রি ঘা, এটিকে ঢেকে রাখতে হলে আমার একটি মূল্যবান রঙিন চাদর চাই। আমি যেমন আছি তেমন থেকে আমার পাপ মোচন করতে পারবো না। গ্লানি দূর করতে পারবো না। কারও ক্ষমার যোগ্য হব না। অন্য কোনও মেয়ের এই বাড়তি যোগ্যতা না থাকলেও চলে, না থাকলে তাদের কেউ মন্দ বলবে না। কিন্তু স্বামীকে ছেড়েছো যখন, তোমার কয়েক ধাপ ওপরে উঠতেই হবে অন্য মেয়েদের চেয়ে। কয়েক ধাপ ওপরে উঠেই অন্য মেয়েদের কাতারে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন করবে। কী জানি, তারপরও কি অর্জন হয়! পঞ্চম শ্রেণী পাশ করা স্বামীর সংসারে গতর খেটে মরা একটি মেয়ের দিকে তো এত করুণ আর এত নিস্করুণ দৃষ্টি নিয়ে কেউ তাকায় না, আমি ডাক্তার হওয়ার পরও কেবল আমার স্বামী নেই বলে আমার দিকে যেভাবে তাকায়!
পরিবার পরিকলল্পনার পরিকল্পনাহীন দপ্তরে যা ইচ্ছে তাই হচ্ছে, ওষুধ চুরি, টাকা চুরি, পুরুষ কর্তাদের আধিপত্য, সুন্দরী কোনও কর্মী দেখলেই হাত বাড়ানো। এসবের বিরুদ্ধে উচ্চয়রে কথা বলতে গিয়ে দেখি আমি একা। আমি হেরে যাচ্ছি। পুরুষ কর্তারা আমাকে হেনস্থা করার জন্য ওত পেতে থাকেন। গ্রামে গঞ্জে ক্যাম্প করে যখন লাইগেশন বা টিউবেকটমি করি, বেশ ভাল লাগে, কোনও একটি কাজের মধ্যে থাকলে সাংসারিক দুঃখ শোকগুলো সরিয়ে রাখা যায় দূরে। ক্যাম্প যদি না না থাকে তবে আপিসে যাও, বসে থাকো, কে কেমন আছে দেখ, কে কী বলে শোনো, মাছি মারো বসে বসে। কোনও একদিন হারুন-উর-রশিদ, বড়কর্তা ওরফে ডিপুটি ডিরেক্টর, যাকে লোকে ডিডি বলে ডাকে, বিকেল পাঁচটায় অনেকটা প্রমোদবিহারে যাওয়ার মত পানে মুখ লাল করে, লাল চশমা পরে দেখতে গেলেন কালিবাড়ির টিনের ঘরটি। টিনের ঘরে মুজিবর রহমান আর আম্বিয়া কপোত কপোতির মত সময় কাটাচ্ছেন। বাকিরা সব বাড়ি চলে গেছেন। সাইদুল ইসলাম নেই। তিনি নেই, তাঁর না থাকার একশ একটা কারণ আছে, কিন্তু আমি নেই কেন! ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দিলেন নালিশ। কেবল একবারই নয়, ঘন ঘন তিনি আমার বিরুদ্ধে নালিশ করছেন। তাঁর আর সইছিল না তাঁর মধুর আহবানকে যে আমি হেলা করেছি সেই অপমান। তিনি তাঁর আকুয়ার আপিসে আমাকে প্রায়ই যেতে বলতেন। আমি গিয়েছিলাম একদিন। তিনি আমাকে তাঁর আপিসে ঘরে বসিয়ে বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি খাবেন, দুধ চা না রং চা?’
‘রং চা।’
‘একটা দুধ, একটা রং।’ বেয়ারার দিকে চোখ। বেয়ারা আদেশ মাথায় নিয়ে চলে গেল।
‘রং চা খান কেন? রং চা খেলে তো গায়ের রং নষ্ট হয়ে যায়। আপনারা মেয়েমানুষ, রং এর কথা তো ভাবতে হবে। হা হা।’ কুমড়োর ওপর বসানো বত্রিশটি শুকনো সীমির বীচি।
‘খেয়ে অভ্যেস বলে খাই। .. রংএর কথা আমি অত ভাবি না।’
‘সুন্দরী মেয়েদের অবশ্য অত কিছু না ভাবলেও চলে। হা হা।’
প্রসঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে ফেরাই, ‘আমাকে যে আসতে বলেছেন, কোনও কাজ আছে স্যার?’
‘কী আর কাজ! ফ্যামিলি প্ল্যানিংএ আবার কোনও কাজ থাকে নাকি.. হা হা হা।’
‘তাহলে যে আসতে বলেছেন, কোনও দরকারে?’
‘বসেন গল্প করি। আমার ওয়াইফ বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় গেছে কয়েকদিনের জন্য। আপনি একদিকে ভালই আছেন। লাইফ এনজয় করতে পারছেন। ফ্যামিলি থাকলে লাইফ এনজয় করা যায় না।’
আমি চোখ নামিয়ে চা খাওয়ায় মন দিই।
‘আপনি কি খুব শাই নাকি!’
‘না তো!’ চোখ ওঠাই।
‘আপনিই যদি শাই হন, তা হইলে আর মেয়েরা কি হবে বলেন।’
আমার চোখ দেয়ালে, দেয়ালের টাঙানো ছবিতে। দূর থেকে ছবির অনেক কিছু চোখে পড়ে না কিন্তু এমন ভাবে তাকিয়ে থাকি যেন ছবির খুঁটিনাটি গুলো আমার এখন না উদ্ধার করলেই নয়।
‘আপনার কথা এইবার কিছু বলেন। আপনি তো দেখছি কথাই বলতে চান না। আপনার জীবন তো খুব ইন্টারেস্টিং জীবন! ঠিক না?’
‘ কই না তো! আমার জীবন খুব সিম্পল..’
‘কী বলেন! আমি তো শুনি মানুষের কাছে, বেশ ইস্টারেস্টিং লাইফ আপনার। আপনি তো অনেকটা ড্যাম কেয়ার। এই ক্যারেকটারটা অবশ্য ভাল। হা হা হা।’ সীমির বীচিগুলো ঝলসে ওঠে।
‘স্যার, ক্যাম্প ট্যাম্প কিছু হবে নাকি শিগরি!’ জানি ক্যাম্প আছে আগামী বুধবারে। তবু জিজ্ঞেস করি।
‘ক্যাম্প? হ্যাঁ তা আছে। নেক্সট ক্যাম্পে আপনি তো আমার গাড়িতেই যেতে পারেন। আপনি চলে আসবেন সকালে। আমার সঙ্গে যাবেন আপনি।’
‘আমার তো যাওয়ার কোনও অসুবিধা নাই..’
‘আপনি তো একদিন ডাক্তার সাইদুলের সাথে তার মোটর সাইকেলে গেলেন.. হা হা হা। মোটর সাইকেলের চেয়ে তো জিপে যাওয়া ভাল। আরামের যাওয়া।’
আমি চুপ করে থাকি।
‘তা বলেন, লাইফএর প্ল্যান কি আপনার?’
‘না, কোনও প্ল্যান নাই।’
‘প্ল্যান নাই! বিয়ে টিয়ে করবেন না?’
‘নাহ!’
‘বলেন কী! এইভাবে ইয়াং বয়সটা নষ্ট করে দিবেন নাকি!’
‘নষ্ট হবে কেন! লেখালেখি করি অবসর সময়ে। এইভাবেই তো ভাল।’
হাসির চোটে কুমড়ো নড়ছে।
‘ও আপনি তো আবার কবি।..ভাবুক মানুষ। হা হা হা’
পরিবার পরিকল্পনার বড়কর্তা আমাকে আরও অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখেন। আরও অনেকক্ষণ অর্থহীন কথাবার্তা বলেন। অর্থহীন হাসেন। আমি যতবারই উঠে আসতে চাই, ততবারই তিনি বসতে বলেন। শেষ পর্যন্ত, জরুরি কাজ আছে বলে আমাকে উঠতে হয়। যখন উঠছি, বলেন, ‘আপনি পরশু বিকালে চলে আসেন। আমি কাজ টাজ সেরে ফ্রি হয়ে থাকব। আমার ওয়াইফ ফিরবে আর সাতদিন পর। সুতরাং কোনও অসুবিধা নাই।’
পরশু বিকেলে কেন, আমি কোনওদিনই আর তাঁর আপিসে যাইনি। তাঁর আর সইছিল না আমার স্পর্ধা। তাঁর আর সইছিল না তাঁর অশোভন আহবানে সাড়া না দেওয়ার জন্য সুন্দরী কর্মীদের আমার ইন্ধন যোগানো। এই ময়মনসিংহ থেকে তিনি আমাকে সরিয়ে দেওয়ার যতরকম ষড়যন্ত্র সম্ভব, করে যাচ্ছেন। বাড়ির বাইরে ডিডির বিরোধিতা, বাড়িতে বাবার —- আমাকে কাবু করতে করতে এমন অবস্থায় ফেলল যে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হতে থাকে।
ইয়াসমিনের ওপর যত অভিমান ছিল, সব অভিমান একদিন ধুয়ে মুছে ওর কাছে যাই, ওকে দেখি আর সেই সচল সজল উচ্ছল উতল দিনগুলোর কথা ভাবি। দিনগুলো কখনও আর ফিরে আসবে না। ইচ্ছে করে ইয়াসমিনকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই কোথাও, কিন্তু শৃঙ্খলে ও নিজেকে এত বেশি জড়িয়েছে, এত বেশি আপোস করে জীবন যাপন করতে চাইছে যে ওকে নিয়ে কোথাও এক পা যাওয়া সম্ভব হয় না। ‘চল ঘুরে আসি, চল আগের মত। চল কথা বলি, হাসি, চল আগের মত।’ আমার এইসব আবদার অনুরোধ এখন আর ওকে স্পর্শ করে না। গৃহবধূ তার গত জীবনের ইতি টেনেছে, এই জীবনটি ওর স্বপ্নের ধারে কাছে না হলেও ও আর বদনাম কামাতে চায় না। এক বোনের সংসারহীন জীবনের বদনামই যথেষ্ট সংসারে। আরেক বোন না হয় প্রায়শ্চিত্যই করল নিজের জীবন দিয়ে। শ্বশুরবাড়ির চৌহদ্দিতে ইয়াসমিন বন্দি। আমি ঘন ঘন ওর শ্বশুর বাড়িতে যাই, তা ও চায়ও না। বুঝি আমাকে নিয়ে ও বাড়িতে মুখরোচক কথা হয়। এ বয়সে সকলে ঘর সংসার করে, সকলের স্বামী থাকে, আমারই নেই, আমি মানুষটি ঠিক স্বাভাবিক নই, এসব। আমার বিয়ে ভেঙে গেছে, আমি পাপী তাপী নষ্ট ভ্রষ্ট মেয়ে, এসব। আমার সঙ্গে লক্ষ্মী গৃহবধূর এত মাখামাখি থাকবেই বা কেন! তাই মাখামাখিতে যায় না ও। ওর মাখামাখি শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে, ওর মন শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন যোগাতে। বাবাকে বলে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের নেমন্তন্ন করায়। মা ভুতের মত রান্না করেন। কদিন পর পরই ইয়াসমিন তার শাশুড়ি, স্বামী, ভাসুর, আর ভাসুরবউদের নিয়ে অবকাশে এসে নেমন্তন্ন খেয়ে যায়। ভারত থেকে আনা জিনিসপত্রগুলো ইয়াসমিনকে দিয়ে দিই, ও খুশি হয়। সোনার গয়নাতেও আকর্ষণ নেই আমার, গয়নাগুলোও দিয়ে দিই, ওর চোখ ঝিকমিক করে আনন্দে।
জানি দুঃসময় ঝাঁক বেঁধে আসে। কিন্তু ঝাঁক বেঁধে আসতে থাকলেও তো সীমা থাকে সব কিছুরই। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া দুঃসময় আমার ওপর ভারী ভারী পাথরের মত পড়তে থাকে। চূড়ান্ত দুঃসময়টি আসে এক সকালে। তিরিশ হাজার টাকা ধার নিয়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা শোধ করেছি, বাকিটা এখনও শোধ করছি না বলে আবদুল করিম তুলকালাম কাণ্ড বাঁধান অবকাশে। আমি তাঁর টাকায় বেড়াতে গিয়েছি ভারতে, আমি একটা বদমাশ মেয়ে মানুষ, আমার মত খারাপ তিনি ইহজীবনে কাউকে দেখেননি ইত্যাদি বলে বাড়ি মাথায় তোলেন। আবদুল করিমের কাছ থেকে ভারত যাওয়ার আগে টাকা ধার নিয়েছিলাম, কিন্তু ফেরত দেওয়ার কথা ছিল প্রতিমাসে মাইনে পেয়ে। তিনি রাজি হয়েছিলেন, আর এখন হুট করে বাকি সবটা টাকাই একবারে চাচ্ছেন। এই আবদুল করিমও কম কৌশল করেননি আমাকে নাগাল পেতে। বুঝতে দিইনি কখনও, যে, আমি বুঝতে পারছি তাঁর কৌশল। ফুল ফুলের চারা দেখাতে আবদুল করিম একদিন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ছোটবাজারের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। সাদা মনে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখি সবুজ পাঞ্জাবি পরা, পকেটে টাকার বাণ্ডিল নিয়ে ঘোরা মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী আর আবদুল করিম বসে আছেন একটি অন্ধকার অন্ধকার ঘরে। ব্যবসায়ীটির অনেক টাকা, আমার টাকা পয়সার দরকার হলে তাঁর কাছে চাইলেই দিয়ে দেবে, এমনকী শোধ না দিলেও চলবে এধরনের কথা যখন আবদুল করিম বলছিলেন, যেন বুঝিনি তিনি কি ইঙ্গিত করছেন, হেসে, চা খেয়ে, সবুজ পাঞ্জাবির সবজি-বাগানের ব্যবসা নিয়ে সাধারণ কিছু আলাপ করে আমার হাসপাতালে যাবার তাড়া আছে এক্ষুনি না গেলেই নয় বলে বেরিয়ে এসেছি। এই আবদুল করিমই অবকাশে এসে আমাকে ডেকে একদিন বলেছেন, ‘ডাক্তার, আমার একটা অসুখ আছে, কী করা যায় বল তো!’ কি অসুখ জানতে চাইলে তিনি গলা চেপে বলেন, তাঁর সেক্সুয়াল ডিজায়ার অত্যন্ত বেশি, দুই বউএর কেউই তাঁকে হ্যাপি করতে পারছে না, তিনি যত বেশি চান, তারা তত বেশি মিইয়ে যায়, তিনি স্টে করেন অনেকক্ষণ, তারা খুব তাড়াতাড়িই ফিনিশ। শুনে, এ যেন হরহামেশা হচ্ছে এমন সহজ রোগ, যেন সর্দি জ্বর, যেন আমাশা, যেন অম্বল— কান নাক চোখ ঠোঁট যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রেখে অত্যন্ত সহজ সুরে, টাক মাথা, উপরি টাকায় পকেট বোঝাই করা, পান-দাঁতে হাসা, হাসিতে ভুঁিড় কাঁপা লোকটির চিকিৎসা করি, চিকিৎসা বলতে উপদেশ ‘এ তো এমন কোনও সমস্যা না, আপনি যৌনরোগবিশেষরি কাছে যান, ওখানে ভাল ট্রিটমেন্ট পাবেন, আমি তো যৌনরোগের বিশেষজ্ঞ না।’
‘কী বল, তুমি ডাক্তার হইছ, তুমি ট্রিটমেন্ট করতে পারবা না কথা হইল!’
‘আপনের যে রোগ করিম ভাই, তার জন্য বিশেষজ্ঞ দরকার।’
‘কী যে বল, তুমি হইলা আপন মানুষ, আত্মীয়। বাইরের ডাক্তারের কাছে এইসব বলা যাবে নাকি!’
‘কেন যাবে না? রোগ তো রোগই।’
‘নাহ, এই রোগ কোনও ডাক্তারে সারাইতে পারবে না।’
‘আমি তো ডাক্তার, আমার কাছে তাইলে বললেন কেন!’
ফ্যাক ফ্যাক করে হাঁসের মত হেসে করিম বললেন, ‘আমার চিকিৎসা কি তা আমি জানি।’
কি চিকিৎসা তা জিজ্ঞেস করি না, তিনি নিজেই বলেন, ‘আমার একটা ইয়ং মেয়ে দরকার।’
আমি বলি, ‘কিরণ আর কুমুদ তো আছে, আপনের দুই মেয়ে। ইয়ং মেয়ে।’
করিম জিভে কামড় দিয়ে বলেন, ‘ওরা তো আমার সন্তাান। বলতাছি আমার নিজের জন্য।’
‘ও তাই বলেন!’
না বোঝার এই ভানটুকু আমার না করলেই নয়। আমি লোকটিকে জুতোপেটা করে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাই না, লোকটি এবাড়ির আত্মীয়। কিন্তু লোকটিকে বুঝতে দিতেও চাই না যে তাঁর কোনও ইঙ্গিত আদৌ আমার বোধগম্য হয়েছে। আমি বুঝেছি তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা যদি তিনি বোঝেন, তবে এটুকুই তাকে যৌনতৃপ্তি দিত হয়ত। ভানটুকু করেছি, কারণ, তাঁকে, যত কুকথাই তিনি বলুন, ভাল মানুষ হিসেবেই বিচার করি, তিনি যে কোনও অশোভন ইঙ্গিত দিতে পারেন তা যে আমি কল্পনাও করতে পারি না, তাও বোঝানো। এটুকু যদি তাঁকে অন্তত আমার সঙ্গে আর কখনও এমন আলাপচারিতায় আগ্রহী না করে, যে আলাপের রস গ্রহণ করার মত যোগ্যতাও আমার নেই।
সেই করিম।
সেই আবদুল করিম।
বাড়ি মাথায় তুলছেন চেঁচিয়ে। আমি খারাপ মেয়ে। আমি তাঁর টাকায় লাঙ নিয়ে ফুর্তি করে এসেছি। আমি মৌজ করে এসেছি, আমোদ করে এসেছি। এইসব খারাপ চরিত্রের মেয়েদের যে কেউ চাইলেই পেতে পারে! ইত্যাদি ইত্যাদি।
মা ধমকে থামান করিমকে। বলেন, ‘বাজে কথা বলতাছো কেন! টাকা ধার নিছে। টাকা দিয়া দিবে। আজ না পারে, কাল দিবে, এইজন্য এইসব কথা বলার তুমি কে?’
করিম থামেন। ওদিকে হাসিনা কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে করিমের প্রতিটি কথা শুনে যাচ্ছিল, কোনও রকম প্রতিবাদ করেনি। করার কোনও কারণ নেই, কারণ তার একধরণের আনন্দই হচ্ছিল কথাগুলো শুনতে। এরকম মোক্ষম সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার সে কোনও মানে দেখে না।
যখন ইয়াসমিন ঘরে ঢোকে মিলনকে নিয়ে, করিম চলে গেছেন। গয়নাগাটি আমার যেখানে যা ছিল বের করে নিয়ে যাই সোনার দোকানে, ইয়াসমিন সঙ্গে যায়। যত দাম সোনার, তার চেয়ে অর্ধেক দাম বলে দোকানী, সেই দামেই দিয়ে দেখি কুড়ি হাজার টাকা হচ্ছে। ইয়াসমিন মিলনের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে দেয়। পঁচিশ হাজার টাকা সেদিনই হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁর ভদ্রলোক বোন জামাইকে যেন দিয়ে আসে। টাকা হাতে পেয়ে হাসিনার মুখে কোনও স্বস্তির ছোঁয়া দেখা যায় না, যেন আমি দীর্ঘদিন এই দেনায় বেঁধে থাকলে তার আনন্দ হত।
আমি পালাই ময়মনসিংহ থেকে। শ্বাস নিতে যাই কোনও শুদ্ধ হাওয়ায়। ঢাকায় গীতার দুর্ব্যবহার যথারীতি চলে। ঢুকতে দেয় তো বসতে দেয় না, বসতে দেয় তো শুতে দেয় না। সুহৃদকে নাগাল থেকে সরিয়ে রাখে। সুখের সময় গীতা হয়ত পিঁড়ি দেয় বসতে, দুঃখের সময় দূর দূর করে তাড়ায়। গীতার যে কত রকম নিয়ম আছে অপদস্থ করার, তা বোঝার সাধ্য থাকে না আমার। নাইমের কাছে যাই ভাঙা মন নিয়ে। হীনতা স্বার্থপরতা আর কুটকচাল এসব তার নেই তো নেই ই, বরং কী করলে আমি খুশি হব, কী করলে আমি তাকে বেশ বুদ্ধিমান মনে করব, কী করলে মনে করব তার কোনও সংকীর্ণতা নেই, কী বললে মনে করব নারী পুরুষে যে কোনও রকম বৈষম্যের সে বিরোধী, প্রগতিশীল রাজনীতিতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, কী বললে তাকে অসাম্প্রদায়িক ভাবব, কী করলে তাকে স্বচ্ছল, স্বচ্ছ, উদার, উচ্ছল, প্রাণবান বলে ভাবব এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হব, তার সবই সে করার বলার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যায়। নাইমের এত চেষ্টার পরও তার প্রতি আমার জন্য কোনও ভালবাসা জন্ম নেয় না। আমার অনাথ অভুক্ত অবাধ অসার শরীরটি নাইমের স্পর্শে স্পর্শে যেদিন জেগে ওঠে, সেদিনও তার জন্য আমার কোনও প্রেম জাগে না। চল বিয়ে করি! নাইম বলে সেই বিকেলেই, যে বিকেলে শরীর জাগে। বাক্যটি এমনভাবে সে বলে যে মনে হয় সে অন্য যে কোনও দিনের মত চল চা খাই, চল মেলায় যাই বা চল ঘুইরা আসি বলছে। বাক্যটি আমাকে মোটেও চমকে দেয় না। নাইমের যে কোনও প্রস্তাবে আমি রাজি হই, যেহেতু আমি জানি যে সে আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু, জানি যে পৃথিবীর আর কেউ চাইলেও সে আমার কোনও অমঙ্গল চায় না। নাইমকে আমার কোনও খাঁচা বলে মনে হয় না। লাঞ্ছনা আর অপমানের পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে নাইম আমার জন্য একরকম মুক্তি।
সেই বিকেলেই ধানমণ্ডির দিকে রিক্সা করে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি ঘরে নাইম থামে, ঘরটির মাথায় ছোট একটি নোটারি পাবলিক লেখা সাইনবোর্ড ঝোলানো। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরটিতে ভূুতের মত একটি লোক বসা ছিল, নাইম জিজ্ঞেস করল বিয়ে করতে হলে কি করতে হয়। দুজনের দুটো সই, আর কিছু টাকা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সইও হল, টাকাও দেওয়া হল। সে রাতে নাইমের ইস্কাটনের বাড়িতে ফিরে দুজনের শোয়া হল, প্রথম শোয়া। শুতে হলে কি সই করে শুতে হয়! সই না করেও তো হয়! সই ব্যপারটিকে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে হয় না। আপিসের কাগজপত্রে সই চাইলেই সই দিয়ে দিই। আমি একটি তুচ্ছ মানুষ, আমার সই এর মূল্যই বা কী! সই হয়। এতে আমার কিছু না হলেও নাইমের হয়। শুতে হলে নাইমের সই করে শোয়ার সংস্কারটির একটি রফা হয়। ঘর ভর্তি বাবা মা ভাই বোন, বোন জামাই, ভাই বউ সবার মধ্যেই নাইম আমাকে নিয়ে পুরোটা রাত না হলেও অর্ধেক রাত কাটায়। এ বাড়িতে নাইমের অধিকার আছে যা কিছু করার। এ বাড়িতে নাইমই হল কর্তা, সে যা করে, তাতে কারও জিভে প্রতিবাদের টুঁ ওঠে না কারণ বাড়ির বাসিন্দাদের খাওয়া পরার সব খরচ নাইমই জোগায়, মন্ত বড় বাড়িটির ভাড়াও। এ বাড়িতে তার বন্ধু বান্ধবীরা অহরহ আসছে, খাচ্ছে, রাত কাটাচ্ছে। এ বাড়িতে এক রাতে আমিও থেকেছি, নাইম তার ঘরটি আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। এবারের থাকা অন্যরকম যদিও, সই করে থাকা, কিন্তু আমার মোটেও অন্যরকম মনে হয় না। যেমন বন্ধু ছিল নাইম, তেমনই থেকে যায়। তেমনই তুই তোকারি।
ময়মনসিংহে পানে লাল হওয়া জিভের, লাল চশমার,পরিবার পরিকল্পনার সুন্দরী কর্মীদের দিকে বাঁকা বাঁকা হাসি হাসা ডিজির আবেদনে কাজ হয়েছে। বদলি চৌদ্দগ্রামে। এক লাথিতে চৌদ্দ পুরুষের নাম ভুলিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আমি যে খুব নিরানন্দে ভুগেছি বদলির আদেশ পেয়ে তা নয়। একরকম চাচ্ছিল!মও অবকাশ থেকে দূরে যেতে, পরিবার পরিকল্পনার অসুস্থ পরিবেশ থেকে, যে অসুস্থতার বিরুদ্ধে কোনও জীবানুনাশক কাজ করে না, চাচ্ছিল!মও সরতে। চৌদ্দগ্রাম চলে যাবো শুনে মা চিৎকার করে কাঁদলেন। কিন্তু যেতে তো হবেই। বদলির চাকরি। চৌদ্দগ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দিয়ে কদিন আসা যাওয়া কুমিল্লায় নাইমদের বাড়িতে থেকে করেছি। ওখানে প্রায়ই চলে যেত নাইম, ভোরে উঠে আবার ঢাকা ফিরত।
আমাকে চমকে দেওয়ার অভ্যেস তখনও যায়নি নাইমের। হঠাৎ একদিন একটি কাগজ হাতে দিল নাইম, আমার বদলির কাগজ। চৌদ্দগ্রাম থেকে দু সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের রক্তব্যাংকে মেডিকেল অফিসার পদে বদলি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি। প্রভাব বুঝি একেই বলে! আমার পক্ষে জীবনে কখনও সম্ভব ছিল না কোনও ভাল জায়গায় বদলি হওয়া, ঢাকা শহরে মোটে দুটো মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। লোকে বলে মামা কাকার জোর না থাকলে এসব জায়গায় পোস্টিং হয় না। আমার মামা কাকারা কেউ ওপরতলায় বাস করেন না। সুতরাং আমার কপালে চৌদ্দগ্রাম, পঞ্চগ্রাম, অষ্টগ্রামই ছিল। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের দৌড় খবরের কাগজ আপিস পর্যন্ত না হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত যে হতে পারে, তা কটি লোক জানে! নাইমের এই চমকটি আগের সব চমককে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এতদসত্বেও তার সঙ্গে সইএর সম্পর্কটিও আমার দুমাসও টেকেনি। নাইমের ইচ্ছে ছিল একদিন ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে, বন্ধু বান্ধব চেনা পরিচিত সবাইকে জানাবে বিয়ের খবর। তার এই ইচ্ছেটি সফল হয় না। একদিন রিক্সা নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে ওই ছোট্ট অন্ধকার ঘরটিতে গিয়ে কিছু টাকা আর একটি সই দিয়ে আসি, এবারের সইটি আগের সইটির উল্টো। সই থাকা না থাকায় কোনও কিছু যায় আসে না। আমি সেই আগের আমি। আমার মনে হয় না কিছু হারিয়েছি বা কিছু পেয়েছি আমি। প্রথমবার এখানে সই করতে এসেও যেমন নিস্পৃহ ছিলাম, এবারও তাই। সই এর গুরুত্ব আমার কাছে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি নয়। বন্ধুত্ব যদি ম্লান হয়ে আসে, সেখানে কোনও সই কোনও সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না।
সইএর ঘটনার পর থেকেই নাইমের সংকীর্ণ, প্রতিশোধপরায়ণ, অনুদার, হিংসুক চেহারাটি ধীরে ধীরে এত প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে যে ভাবতে লজ্জা হয় এই নাইম সেই নাইম, যাকে আমি নিজের সবচেয়ে ভাল বন্ধু বলে মনে করেছিলাম। আমার ওপর কর্তৃত্ব করার স্পৃহা তাকে উন্মাদ করে তুলেছে।
আমি ময়মনসিংহে যেতে চাইলে নাইম বলে এখন যাওয়ার দরকার নাই।
মানে?
মানে হইল এখন যাওয়ার দরকার নাই।
তাইলে কখন যাওয়ার দরকার?
পরে।
পরে কবে?
আমি বলব।
যেদিন নাইম সিদ্ধান্ত নেবে সেদিন আমাকে ময়মনসিংহে যেতে হবে। যেদিন সে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেবে, সেদিন আমাকে বাইরে বেড়াতে যেতে হবে।
সইএর আগে নাইম যেমন সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল আমাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য, সই এর পর সে ব্যস্ত হয়ে যায় তার ইচ্ছের খাঁচায় আমাকে বন্দি করার জন্য। বন্দি হতে না চাইলে নাইম চিৎকার করে, দপদপ করে কাঁপতে থাকে তার কপালের শিরা। সই এর আগে তার যে গাড়িটি আমি মাঝে মধ্যে চালাতাম, সইএর পর কৌশলে সেই গাড়ির চালকের আসনে আমার বসা সে বন্ধ করে দেয়। সইএর আগে প্রতি সপ্তাহে আমার কলাম ছাপার জন্য ভীষণ আগ্রহ ছিল তার, সইএর পর সেই আগ্রহ আর থাকে না। আমি ক্রমশ নাইমের হাতের পুতুল হয়ে উঠি। আমি যদি একটি কলম চাই, নাইম আমাকে দশটি কলম এনে দেবে কিন্তু সে দেবে, আমাকে সংগ্রহ করতে দেবে না। আমার সব ইচ্ছে আকাঙ্খা নাইম মেটাতে চায়, আমাকে সে কিছুই মেটাতে দেয় না। আমাকে সে আমার জন্য অহংকার করতে দেয় না, আমার জন্য অহংকার সে নিজে করতে চায়। আমার সব দায়িত্ব সে নিজে নিতে চায়, যেখানে আমার কোনও ভুমিকা থাকবে না, কেবল তার ভুমিকাই থাকবে। সে যে আমার চেয়ে সবদিক দিয়ে বড়, তা বোঝাতে এমন মরিয়া হয়ে উঠল যে আমার কৃতিত্ব ক্রমে ক্রমে তার কাছে তুচ্ছ বিষয় হয়ে ওঠে, যে কৃতিত্ব নিয়ে তার একসময় গৌরবের সীমা ছিল না। যে নাইম নিজেকে নিয়ে হাস্যরস করত, বলত ‘আমি কিচ্ছু জানি না, আমার কোনও ধারণাই নাই, আমি হইলাম একটা গবেট,’ সেই নাইমই নিজেকে জ্ঞানের আধার, সর্বগুণে গুণান্বিত, সর্ববিদ্যায় পারদর্শী বলতে কোনও দ্বিধা করে না। নিজের মহানুভবতার কথা চোখ ফুলিয়ে, নাক ফুলিয়ে, বুক ফুলিয়ে, পেট ফুলিয়ে অনর্গল বলে যায়। আমার মনে হতে থাকে নাইমের আগের চরিত্রের আদ্যোপান্ত ছিল আমাকে জয় করার জন্য। আসল চেহারাটি মানুষের কোনও না কোনও সময় বেরোয়, মুখোশ একসময় খুলে পড়েই। আমাকে যে করেই হোক সে তার মুঠোয় পেয়েছে। মুঠোর মধ্যে কোনও মেয়েমানুষ এসে গেলে তাকে আর মাথা ছাড়াতে দিতে কোনও পুরুষেরই ইচ্ছে করে না। নাইম তো পুরুষই।
নাইম নিজের বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, প্রায়ই উল্লেখ করে বাবা তার পকিস্তান আমলে সংসদ সদস্য ছিলেন। এ নিয়ে গৌরবের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ তার এই বাবাই কুমিল্লার দেবীদ্বারে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল রাজাকারই নয়, শান্তি কমিটির বড় নেতা ছিলেন। নাইম কখনও তার বাবার অতীতের ভূমিকা নিয়ে গ্লানিতে ভোগে না। একবারও বলে না যে তার বাবা ভুল করেছিলেন। বাবাকে এমনই সে ভালবাসে যে আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই তাঁর রক্তচাপ মাপতে বলে। একবার মেপে দেখেছি রক্তচাপ ঠিক আছে, পরদিনও আবার সে মাপতে বলে। পরদিনও মাপি। তার পর আবারও। আমি অবাক হয়ে বলি, কেন? নাইম বলে, এমনি। এমনি কেন? এমনি এমনি প্রতিদিন কারও রক্তচাপ মাপার তো কোনও অর্থ হয় না। বাবা তার রীতিমত সুস্থ মানুষ, রক্তচাপে কোনও ওঠানামা নেই, কিন্তু তার বাবা বলেই, বাবাকে সে ভালবাসে বলেই আমাকে খামোকা তাঁর রক্তচাপ মাপতে হবে। আমি না বলে দিই, আমি মাপবো না। নাইম রাগে থরথর করে কাঁপে। এমনিতেই তার আঙুল কাঁপে কোনও কারণ ছাড়াই। রেগে গেলে সারা গা কাঁপে। চোখ বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে। নাইম যেমনই হোক, নাইমের পরিবারের সকলে খুব চমৎকার মানুষ। নাইমের মা দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, সুন্দরীর স্বামীটি অসুন্দরের ডিপো। ডিপো হলেও আমি যে কটাদিন নাইমের বাড়িতে ছিলাম আমার সঙ্গে মধুর ব্যবহার করেছেন। কেবল তিনিই নন, বাড়ির সকলেই আমাকে মাথায় তুলে রেখেছে। মাথায় তুললেই কি সুখ হয়!
নাইমের বিনয়ী স্বভাবে অনেকে আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অহংকার তার প্রচণ্ড। নিজেকে নিয়ে যেমন, তার বাবাকে নিয়েও তার অহংকারের শেষ নেই। নাইমের রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। খবরের কাগজের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সে চাকরি করত ইনকিলাব পত্রিকায়। ইনকিলাব পত্রিকাটি একশ ভাগ মৌলবাদিদের পত্রিকা। এর সম্পাদক প্রকাশক মাওলানা মান্নান দেশের নামকরা রাজাকার। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে হামেশা লিখে যাচ্ছে। দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। নাইম এই পত্রিকাার বিরুদ্ধে একটি বাক্য উচ্চারণ করে না। বরং ইনকিলাব পত্রিকাটির মেক আপ গেট আপ, ইনকিলাবের ছাপাখানার অকুণ্ঠ প্রশংসা করে। খবরের কাগজও সে ছাপে ইনকিলাবের ছাপাখানা থেকে। একদিন রাতে আমাকে নিয়ে ইনকিলাবের আধুনিক ছাপাখানা দেখিয়ে আনে। দেশে দুটি পক্ষ, একটি মৌলবাদ, আরেকটি মৌলবাদের বিরুদ্ধ। খবরের কাগজের সম্পাদকের ভূমিকায় এসে মৌলবাদের বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে তার খাতির জমে ওঠে, কিন্তু সে নিজে খুব স্পষ্ট করে কোনও পক্ষ নেয় না। ইনকিলাবের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে সে এক আলোকিত জগতে এসেছে। সাংবাদিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা নাইম খবরের কাগজ আর আজকের কাগজের কোনও সম্পাদকীয় আজ পর্যন্ত লেখেনি, আশেপাশের ডেস্কে বসা পাতি সাংবাদিকদের দিয়ে সম্পাদকীয় লিখিয়ে নেয়। কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতার বা কোনও কবি লেখকের কোনও সাক্ষাৎকারও সে আজ পর্যন্ত নেয়নি। এসবে তার দক্ষতা নেই। তার দক্ষতা বাণিজ্যে। কাজী শাহেদ আহমেদ তাকে পছন্দ করে সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন। বড় বড় লেখকদের জড়ো করে কলাম লিখিয়ে কাগজের বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছে তার ওপর জনপ্রিয়তা জুটিয়েছে। নাইম যদিও লেখালেখির জগতে উড়ে এসে জুড়ে বসা একটি নাম তার পরও তার কৃতিত্বের জন্য সে বাহবা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। এরকম হঠাৎ এসে ঝড় তোলা কম কথা নয়।
নাইমের সঙ্গে ওই শোয়াশোয়ির শুরুতেই ঘটনা বা দুর্ঘটনাটি ঘটে। রুদ্রর সঙ্গে দীর্ঘদিন শুয়েও যে ঘটনাটি ঘটেনি, তা নাইমের সঙ্গে দুদিন শুয়েই ঘটে যায়। পেটে বাচ্চা আসে। সারা শরীরে আশ্চর্য এক পরিবর্তন লক্ষ করি। মনেও। যেন এ আমি অন্য আমি। এ আমাকে আমি চিনি না। নিজের রূপান্তরিত এই অস্তিত্বটি অভাবিত এক শিহরণ সৃষ্টি করে আমার ভেতর। এই রূপটিকে আগে কখনও আমি কল্পনা করিনি। ভয়, লজ্জা, সুখ, স্বপ্ন, সব বিজলির মত চমকাতে থাকে আমার আকাশ জুড়ে। নাইম আমাকে অনেক চমকে দিয়েছে। কিন্তু এবারের চমকটি ভিন্ন। এই চমকটির কোনও তুলনা হয় না।
চল ক্লিনিকে চল।
ক্লিনিকে কেন?
এবরশন করতে চল।
মানে?
মানে কিছু না। এবরশন করতে হইব।
এবরশন করতে হইব কেন?
আরে এহনই আবার বাচ্চা কাচ্চা কি? এইসব পরে চিন্তা করলেই হইব।
আমার কোনও আপত্তি নাইম মানে না। সে আমাকে গুলশানের একটি ক্লিনিকে টেনে নিয়ে গিয়ে আমার গর্ভপাত ঘটায়। আমি জানি কেন ঘটায় সে এটি। তার ধারণা, ভ্রূণের জন্য যে স্পার্মের প্রয়োজন হয়, তা অন্য কোথাও থেকে আমি সংগ্রহ করে এনেছি। নাইমের জন্য আমার মায়া হয়, সন্দেহের মন তার নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করেনি। সন্দেহ এমনই এক ভয়ংকর আগুন, আমি পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকি। আমি কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে কথা বলছি, কে আমাকে জন্মদিনে কি উপহার দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে এসব নিয়ে সন্দেহের চোখ ক্রমশ বাঘের মত হতে থাকে, আমাকে ছিঁড়ে খেতে চায় সে চোখ। মায়া হয় নাইমের জন্য, তার সন্দেহের মন এ কথা তাকে বুঝতে দেয় না যদি কারও সঙ্গে আমার কোনও রকম শারীরিক মানসিক সম্পর্ক থেকে থাকে, তবে তা তার সঙ্গেই, আর কারও সঙ্গে নয়। নাইম ভেবেছে আমি তার সঙ্গে চালাকি করেছি, তাই সে অতি চালাকি করে আমার চালাকির জবাব দিয়েছে। মন ধীরে ধীরে নয়, খুব দ্রুতই ওঠে নাইম থেকে।
একসময় খবরের কাগজ আপিসেও শুরু হয় নাইমের অতি চালাকির বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ। কাজী শাহেদ আহমেদের ব্ল্যাংক চেক এর অপব্যবহার করেছে নাইম। কাজী শাহেদ অর্ধচন্দ্র নয়, পূর্ণচন্দ্র দিয়েই বিদেয় করেন নাইমকে। কাগজের মালিক কাজী শাহেদ নিজে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। যে কাজীর প্রশংসায় নাইমের মুখে খই ফুটত, সেই একই কাজী সম্পর্কে সে বলে বেড়াতে লাগল তাঁর মত বদ লোক দুনিয়ায় আর নেই। কুৎসা ছাড়া আর কিছু তার মুখে ফোটে না। তাকে তার বিশালাসন থেকে নামিয়ে দেবার শোধ সে যে করেই হোক নেবে। নাইমের ঘটে বুদ্ধি কম নয়, এই বুদ্ধির জোরেই সে খবরের কাগজ সাপ্তাহিকীটি জনপ্রিয় করে আজকের কাগজ নামে একটি দৈনিকে হাত দেয়। রাতারাতি আজকের কাগজ দেশের এক নম্বর না হলেও দু নম্বর জনপ্রিয়তার তালিকায় চলে আসে, বুদ্ধি আছে, তবে সেই বুদ্ধির সঙ্গে কিছু কিছু কুবুদ্ধি সব কিছু গোলমাল করে দেয়। নাইম দমে যাওয়ার পাত্র নয়। আজকের কাগজের কাজ ফুরিয়ে গেলে সে যে বিমর্ষ বসে থাকবে তা নয়, দল বল জোগাড় করে ভোরের কাগজ নামে একটি পত্রিকা বের করে। আজকের কাগজে যে লেখকদের দিয়ে লেখাতো, অনেককে সরিয়ে নিয়ে আসে নতুন কাগজে। ভোরের কাগজ জনপ্রিয় হতে থাকে ধীরে ধীরে।
নাইম যখন বুঝতে পারে আমি আর তাকে বিশাল কিছু বলে মনে করছি না, সে উঠে পড়ে লেগে যায় প্রতিশোধ নিতে। তার বিনয় ঝুলে পড়ে মরা ডালের মত, তার ভদ্রতা নম্রতা সৌজন্য সব গ্যাসবেলুনের মত শূন্যে উড়ে যায়, সত্যিকার নাইম তার চোখ রাঙানো, দাঁত দেখানো, গলা ফাটানো নিয়ে প্রকাশিত হয়। তার কোনও আচরণ আমাকে কষ্ট দেবে কি না, ক্ষুব্ধ করবে কি না তা নিয়ে আর সে চিন্তিত নয়। আমার চেনা পরিচিত আত্মীয় বন্ধু যাকেই সে চেনে সবার কাছে গিয়ে সে আমার জন্য সে এই করেছে সেই করেছে আর আমি তার জন্য এই করিনি সেই করিনির লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বুঝিয়ে আসে যে তার মত এত অনুগত, অনবদ্য, অসাধারণ ছেলের সঙ্গে আমি খুব অন্যায় করেছি। আমি অকৃতজ্ঞ। আমি অপয়া। আমি অশালীন। আমি অবিবেচক। আমি অপ্রকৃতিস্থ।
নাইম যখন বুঝতে পারে যে তাকে আমি র্নিদ্বিধায় ত্যাগ করতে পারি, তখন সে জোঁকের মত আমাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। যখন সে টের পায় যে তার সন্দেহের ধারে কাছে আমি আর যেতে চাইছি না, সে ফেটে পড়ে রাগে। যখন সে দেখে তার রাগের আমি মোটেও পরোয়া করছি না, সে আমাকে হেনস্থা করার পরিকল্পনা আঁটে। পরিকল্পনায় নাইম বরাবরই বড় পাকা।
মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে আরমানিটোলায় একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকছি। হঠাৎ একদিন দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। খুলে দেখি নাইম। তার জানার কথা নয় আমার ঠিকানা। কিন্তু বাজপাখির চোখ ঠিক ঠিক চিনে নেয় কোথায় শিকার তার। দরজা সে এমন জোরে ধাককাতে থাকে যে আশেপাশের লোক জমে যায়। অতিষ্ঠ হয়ে বেরিয়ে এসে তাকে জানিয়ে দিই, কিছুতেই আমি তাকে ভেতরে ঢুকতে দেব না। ঢুকতে তাকে দিইনি কারণ আমি চাইনি রুদ্রকে সে একফোঁটা অসম্মান করুক। একসময় নাইম সরে যায় আমার দরজা থেকে, কিছু করার পরিকল্পনা নিয়েই সে সরে। এক, আমাকে এ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা। দুই, সত্যিকার একটি বিয়ে করা।