পূর্বাভাস পত্রিকা আপিসে হামলা হয়েছে, রাতের অন্ধকারে এক দল দুর্বৃত্ত আপিসে ঢুকে জিনিসপত্র ভেঙে চুরে সব তছনছ করে গেছে। এর কারণ আমার লেখা। আমার লেখা পছন্দ হচ্ছে না অনেকের। ধর্মীয় মৌলবাদীরা পূর্বাভাস পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। একদিন গিয়ে দেখে আসি আপিসের দুরবস্থা। খুব মন খারাপ হয়ে যায়। এত মন খারাপ হয় যে লেখালেখি ছেড়ে দেবার কথা ভাবি। ডাক্তারি করছি, হাসপাতালে চাকরি করে বাড়তি সময় যা থাকে সে সময়ে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে কাজ করলে দিব্যি সংসার চালিয়ে নিতে পারব। সিদ্ধান্তটি নিয়ে আমি লেখা বন্ধ করে দিই। কিন্তু মোজাম্মেল বাবু তা মানবে না, পূর্বাভাসের জন্য লেখা সে চেয়েই যাচ্ছে। জরুরি তলব করল, দেখা করতে গেলে সেই এক কথা, ‘আপা আপনি লেখা বন্ধ করলে চলবে নাকি? লেখেন। আজকেই একটা লেখা দেন।’
হুমায়ুন আজাদ ফোন করেছেন তখন। তিনিও কলাম লেখেন পূর্বাভাসে। বাবু তাঁকে জানাল যে আমি লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছি। শুনে তিনি কথা বলতে চাইলেন আমার সঙ্গে, আমার সিদ্ধান্ত শুনে বললেন, ‘ লেখা ছাড়বেন না, আপনার লেখা খুব ভাল হচ্ছে। লেখা চালিয়ে যান, কিছু দুষ্ট লোক কি করল কি বলল তা নিয়ে মোটেও ভাববেন না।’
হুমায়ুন আজাদের মত আরও অনেকেই উপদেশ দেন, পত্রিকায় লেখা আবার শুরু করার উপদেশ। কেউ কেউ বলেন, ধর্ম সম্পর্কে অত কড়া কথা না লিখলে কোনও অসুবিধে হবে না।
আমি লিখতে শুরু করি, কারণ না লিখে পারি না বলে। কয়েকদিন না লিখে দেখি ভেতরে কথা জমে জমে পাহাড় হয়ে আছে। হুমায়ুন আজাদ পূর্বাভাসে নতুন ধরণের কলাম লেখা শুরু করেছেন, রাজনীতি সমাজ ইত্যাদি নিয়ে কৌতুক করা হুমায়ুন আজাদ এখন নারী নিয়ে লিখছেন, না, আগে যেমন তিনি নারীর বদনাম গেয়ে প্রবচন রচনা করেছিলেন, তেমন নয়, এবারের লেখা নারীর গুণ গেয়ে। হুমায়ুন আজাদের লেখা আমার তখনও পড়া হয়নি, কিন্তু যেদিন নির্মলেন্দু গুণ আমাকে বললেন ‘হুমায়ুন আজাদ জনপ্রিয় হতে চাইছেন, তাই তোমার লেখা নকল করে তিনিও লিখতে শুরু করেছেন,’ পড়ে ঠিকই দেখি যে যে কথা আমি অনেক আগেই বলেছি, সে কথাগুলোই তিনি লিখছেন নতুন করে, তিনি বহু বই ঘেঁটে উদাহরণ দিচ্ছেন, আমি কোনও বই না ঘেঁটে মনে যা ছিল তাই লিখেছি, এই যা তফাৎ।
বইমেলা শুরু হচ্ছে। এবারের মেলায় আমার কয়েকটি বই প্রকাশ পাচ্ছে। কবিতার বই, কলামের বই, উপন্যাস। ফজলুল আলম আমার কবিতার ইংরেজিতে অনুবাদ করে লাইট আপ অ্যাট মিডনাইট নামের একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন। বইটি কে প্রকাশ করবে? এগিয়ে এলেন বিদ্যাপ্রকাশ। ফজলুল আলমের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার আরমানিটোলার বাড়িতে। ও বাড়িতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে ফরিদুর রেজা সাগর তাঁর লন্ডনপ্রবাসী কাকাকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। সাগরের বহুমুখী প্রতিভা। লেখিকা রাবেয়া খাতুনের গুণধর পুত্র তিনি। তিনি নিজেও সাহিত্যিক। বাচ্চাদের জন্য অনেকগুলো বই লিখেছেন। টেলিভিশনে বাচ্চাদের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ব্যবসাতেও সাফল্য তাঁর অনেক। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। আজকের কাগজ, খবরের কাগজেরও আধখানা মালিক হয়েছেন। এমনিতে সাগরকে সাহিত্যের আড্ডায় মোটেও দেখা যায় না। তিনি থাকেন তাঁর ব্যবসা নিয়ে। স্টেডিয়ামের কাছে খাবার দাবার নামে খুব ভাল একটি রেস্তোরাঁ আছে তাঁর। পাঁচবেলা নামাজ পড়েন সাগর, শান্তিনগরে তাঁর বিরাট আপিসে একটি নামাজের ঘর করে নিয়েছেন। রোজার মাসে তিরিশটা রোজা রাখেন। নিভৃতে লেখেন। নিভৃতে ছাপেন। ব্যস্ত লোক। ব্যস্ত লোকই তাঁর দুলাল কাককুর আবদারে আমার সঙ্গে দেখা করাতে এনেছেন, খুঁজে খুঁজে আরমানিটোলায়। দেশে বেড়াতে এসে ফজলুল আলমের প্রথম কথাই ছিল আমার সঙ্গে পরিচিত হবেন। লন্ডনে বসে কাগজে আমার কলাম পড়েই তাঁর এই আবেগ। একবার আমার সঙ্গে দেখা না করে তিনি যাবেন না। ফজলুল আলম আমুদে লোক। স্পষ্টভাষী, সৎ, কোদালকে যার তার সামনে কোদাল বলতে দ্বিধা করেন না, এতে লোকের মন খারাপ হলে হোক। লোকটি দেখতে বালুর বস্তার মত, কানে কম শোনেন, চেঁচিয়ে কথা বলেন, অল্প কিছুতেই ঠা ঠা করে হাসেন। সাগরের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল, তাঁর বাড়িতে অনেকদিন নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছি, কেবল নেমন্তন্ন খেতে নয়, মন ভাল না থাকলে অনেকদিনই চলে গিয়েছি সাগরের বাড়িতে। সাগর না থাক, সাগরের স্ত্রী আছেন, তাঁর মা আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। সাগরের মা রাবেয়া খাতুন আমাকে ডেকে সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছেন, লেখালেখির প্রসঙ্গ এলে আমি মনের কথাটি বলে দিই সবাইকে যে কি করে লিখতে হয় আমি জানি না, যা লিখি আদৌ কোনও লেখা হয় বলে মনে হয় না, কি করে উপন্যাস লিখতে হয় তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মৃদুভাষী রাবেয়া খাতুন আমাকে বলেছেন খুব কনসেনট্রেশন লাগে। এই জিনিসটিই যে আমার নেই আমি নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করেছি। তাঁর বাবা কি করে তাঁর মাকে ছেড়ে চলে গেছেন, কি করে সংসারটির দৈন্যদশা তিনি ঘুচিয়েছেন, কি করে তিনি একটি নির্যাতিতা মেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে বিয়ে করেছেন, সাগর আমাকে সব কথা খুব বন্ধু মনে করে বলেন। সাগরদের বাড়ির সবাইকে আমার খুব আপন মনে হয়। এই আপন পরিবারটির আপন লোক ফজলুল আলমও আমার খুব আপন হয়ে ওঠেন। ফজলুল আলম নিজে লন্ডনের বাংলা পত্রিকায় লেখালেখি করছেন অনেকদিন থেকে, খবরের কাগজেও লিখেছেন কলাম। আমিই তাঁকে একদিন বলি লেখাগুলো জড়ো করে একটি বই বের করতে। তিনি খুব উৎসাহে লেখা জড়ো করলেন। নাম দিলেন বইয়ের। এবার আমার দায়িত্ব প্রকাশক খোঁজা। আমার তো এক খোকাই আছেন অনুরোধ করার। তিনি, তত নাম নেই লেখক হিসেবে, এমন লোকের বই ছাপবেন কেন! আমার অনুরোধে ঢেঁকিটি গিললেন শেষ অবদি। বইয়ের পঈচ্ছদ আমি নিজে এঁকে দিলাম। ফজলুল আলমের খুশি দেখে কে! তিনি লন্ডনে যাওয়া পিছিয়ে দিলেন অথবা গিয়েও আবার ফিরে এলেন দেশে। এবারের বই মেলায় তাঁর বই থাকছে, তিনি কি না থেকে পারেন!
বই মেলা শুরু হয়ে গেল। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বইমেলা। বইমেলার মাসটি লেখকদের মাস। লেখকেরা সারা বছর এই মাসটির অপেক্ষায় বসে থাকেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে রফিক সালাম বরকত এ মাসে প্রাণ দিয়েছিলেন। এ মাসটি বাংলা ভাষার মাস। বাংলা সাহিত্যের, বাংলা গানের উৎসব। মেলায় সাহিত্যিক বিষয় নিয়ে ধুম আড্ডা হচ্ছে। বিরানব্বই সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার আনন্দও কম নয়। আমার একাধিক বই মেলায় এসেছে, তার ওপর বিক্রি হচ্ছে খুব, মেলাতেই প্রথম মুদ্রণ শেষ, দ্বিতীয় মুদ্রণের জন্য প্রকাশক ছাপাখানায় দৌড়োচ্ছেন। খবর বেরোচ্ছে, ‘হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন আর তসলিমা নাসরিন এই তিনজনের বই বিক্রির শীর্ষ তালিকায়।’ ইমদাদুল হক মিলন অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয় লেখক। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নন্দিত নরকে লিখে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। ওখান থেকে দেশে ফিরে নতুন করে লেখালেখি শুরু করলেন। মাত্র বছর কয় আগেও দেখেছি বুকের ওপর দুহাত আড়াআড়ি রেখে একা একা হাঁটছেন মেলায়। হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে তখনই আলাপ। তাঁকে যেদিন আমি বর্ণনা করেছি তাঁর লেখা আমরা ভাই বোনেরা কি করে পড়তাম বাড়িতে, একজন সশব্দে পড়েছে, বাকিরা শুনেছে —শুনে তিনি খুব আনন্দ পেলেন। বললেন তাঁর বাড়িতেও ওভাবে বই পড়া হত। ময়মনসিংহে মোহনগঞ্জে বড় হয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ, কথা বলায় ময়মনসিংহের টান আছে। এরপর থেকে মেলায় এসে তিনি আমাকে খুঁজে বের করে পুরোনো দিনের গল্প বলতেন। আমাকে ডাকতেন কবি বলে। কবির খবর কি আজ? কবি চলেন চা খাই। গল্প বলতে তিনি এত চমৎকার পারেন যে তার শ্রোতা হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যায়। আমার খুব ভাল লাগত হুমায়ুনের আহমেদের গল্প শুনতে, তিনি খুব চেনা জীবনের গল্প বলেন। নিজের কথাই বলেন, নিজের ভাই বোনের কথা বলেন, পাশের বাড়ির লোকের কথা বলেন, মফস্বলের এইসব মধ্যবিত্ত মানুষের সুখ দুঃখ নিয়ে কথা শুনে মনে হত চোখের সামনে দেখছি তাদের, যেন আমারই আত্মীয় স্বজন তারা। টেলিভিশনে যখন তাঁর নাটক সবে প্রচার হতে শুরু হল তিনি নাটকের রাতে বন্ধু বান্ধবদের ডাকতেন একসঙ্গে বসে নাটক দেখার জন্য। হুমায়ুন আহমেদ তখন আজিমপুরের ছোট একটি অ্যাপার্টমেণ্টে থাকতেন। সেখানে আমি আর নির্মলেন্দু গুণ তাঁর একা নাটকটি দেখেছিলাম। নাটকটি প্রচার হওয়ার আগে হুমায়ুন আহমেদ অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন ঘরময়। তাঁর নাকি এরকমই হয় নাটকের আগে, খুব টেনশন হয়। অতি সাধারণ জীবন যাপন হুমায়ুন আহমেদের। আমেরিকায় অনেক বছর থেকে এসেছেন, তারপরও মনে হয় গ্রাম থেকে মাত্র শহরে এসে উঠেছেন। পাড়ার হিমু ভাইএর মত তিনি, উদাসীন, পড়ুয়া, জমিয়ে গপ্প করা, কারও সাতে নেই পাঁচে নেই, তরতর করে একা একা সিঁড়ি পেরোচ্ছেন। হিমু ভাইএর মত সত্যি সত্যি অনেক সিঁড়ি চোখের সামনে পার হয়ে গেলেন হুমায়ুন আহমেদ। এখন তাঁর সঙ্গে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না আর, কারণ তাঁর জনপ্রিয়তা। টেলিভিশনের নাটক তাঁকে এমন গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা দিয়েছে যে এখন তিনি আর মেলায় একা একা হাঁটার লেখক নন। যতক্ষণ মেলায় থাকেন, ততক্ষণই তিনি অদৃশ্য হয়ে থাকে অটোগ্রাফ শিকারিরা আড়ালে। আমি যখন কলাম লিখছি কাগজে তখন একবার হুমায়ুন আহমেদ আমাকে ডেকে বলেছিলেন যে কলামগুলো পড়লে তাঁর তিন কন্যার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয় তাঁর, মেয়েদের জীবন যে ভয়াবহ রকমের নিরাপত্তাহীন তা তিনি অনুভব করতে পারছেন আগের চেয়ে বেশি করে। হুমায়ুন আহমেদের লেখার আমি শুরু থেকেই ভক্ত। অনেকে বলে তাঁর লেখা কালজয়ী নয়, উপন্যাসগুলো হালকা, চরিত্রগুলো পলকা, যে যাই বলুক আমার মনে হয় তিনি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছেন তাঁর লেখা দিয়ে। এই কাজটি সহজ কাজ নয়। তাঁর তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের চোখ জানে পাঠকরা কি চায়, তিনি পাঠকের চাওয়া মেটাচ্ছেন। যারা কখনও বই পড়েনি বা পড়তে চায়নি, তারা আর কারও বই না পড়লেও তাঁর বই পড়ে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি প্রচুর পাঠক তৈরি করছেন।
বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে প্রতি বিকেলে আমাকে বসার জন্য অনুরোধ করেন খোকা। অন্য প্রকাশকরাও তাদের স্টলে আমাকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও বসার আবদার করেন। কোথাও আমার বসে থাকতে ইচ্ছে করে না দীর্ঘক্ষণ। ইচ্ছে করে মেলায় হাঁটতে, মানুষ দেখতে, লেখক বন্ধুদের সঙ্গে মেলার দোকানে গিয়ে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে। কিন্তু খোকার অনুরোধে আমাকে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয় তাঁর স্টলে। ক্রেতারা বই কিনে সই নিতে চায়, সই দিতে হয় বসে বসে। অনেকে বই হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দাম দেখে চলে যায়, পকেটে পয়সা নেই বলে কিনতে পারে না। ইচ্ছে করে বিনে পয়সায় তাদের দিয়ে দিই বই। কয়েকজনকে এমন দিই, খোকা ‘করছেন কি করছেন কিঞ্চ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলে বলি, ‘এটা আমার সৌজন্য কপির পাওনা বই থেকে দিলাম।’ টাকার সঙ্গে বইএর সম্পর্কটি বড় অস্বস্তিতে ফেলে আমাকে। খোকা বলেন, ‘এত দিলদরিয়া হলে চলবে নাকি! আপনি এখন প্রফেশনাল লেখক।’
‘কি যে বলছেন! আমি ভাই ডাক্তারি করি, সেটা আমার প্রফেশন। লেখা আমার হবি।’ খোকা তা মানেন না। বই বেচেই তিনি সংসার চালান। স্টলে খোকা আছেন বউ, শালি শালা সব নিয়ে। উত্তেজিত ফজলুল আলম বারবার স্টলে এসে খবর নিচ্ছেন তাঁর বই আদৌ কেউ কিনেছে কী না। পরিচিত কাউকে পেলে ধরে ধরে নিজের বই দেখাতে নিয়ে আসছেন। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে এলেন একবার। হুমায়ুন আজাদ লাইট আপ এ্যাট মিডনাইট বইটি উল্টোপাল্টো দেখে বললেন, সেই কবিতাটি নেই, ‘সাত সকালে খড় কুড়োতে গিয়ে আমার ঝুড়ি উপচে গেছে ফুলে!’ ফজলুল আলম বললেন, না নেই।’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘তা থাকবে কেন! ভাল কবিতা থাকবে কেন!’
আমি হেসে বলি, ‘আমার কবিতা বুঝি ভাল!’
আজাদ আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আপনার অনেক কবিতাই আমার ভাল লাগে।’
আমি বলি, ‘তবে যে সেদিন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিলেন, আমি নাকি কবিই নই, আমার কলাম আপনি পড়েন না, কারণ কলামগুলো বালক বালিকারা পড়তে পারে!’ হুমায়ুন আজাদ কোনও উত্তর না দিয়ে বিদেয় নিলেন। হাসিটি তখন তেমন আর বিμছুর মত লেগে ছিল না মুখে। এই হুমায়ুন আজাদই খবরের কাগজে আমার লেখা জনপ্রিয় হওয়ায় ক্ষেপে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন। এই হুমায়ুন আজাদই পূর্বাভাস আপিসে ফোনে আমাকে বলেছেন আমার কলাম তাঁর ভাল লাগে। হুমায়ুন আজাদকে আমার নিতান্তই বালক বলে মনে হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক, অত্যন্ত জ্ঞানী লোক, খুব ভাল লেখেন, তাঁর কবিতা, তাঁর গদ্য অত্যন্ত উন্নতমানের। কিন্তু এত গুণের অধিকারী হয়েও তিনি উদ্ভট উদ্ভট সব কাণ্ড করেন। অনেকে বলে এসব নিতান্তই তাঁর স্টান্টবাজি, লোকের নজরে পড়তে চান, তাই এসব করেন। তিনি গালাগাল দিয়ে বেড়ান সব লেখকদের, কবিদের। কিছু চেলা চামুণ্ডা নিয়ে মেলায় হাঁটেন, চেলারা উঠতে বসতে তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি বেজায় রকম উপভোগ করেন এসব।
ফজলুল আলম লন্ডনি কায়দায় চলা লোক, ঠিক খাপ খাওয়াতে পারেন না এই মেলায়। আমার লেজ হয়ে থাকতে চান, আমি বসলে তিনি বসেন, দাঁড়ালে তিনি দাঁড়ান। আমি যেদিকে যাই, তিনি সেদিকে যান। আমি স্টলে এসে বসব, তিনিও স্টলে এসে বসবেন, আমি চা খেতে যাবো, তিনিও চা খেতে যাবেন। দেখে আমার রাগ হয়, বলি, ‘দুলাল কাককু, আপনি কি একা ঘুরে বেড়াতে পারেন না!’ ফজলুল আলম মন খারাপ করে আমার সঙ্গ ছাড়েন। মেলায় একা একা হাঁটেন অগত্যা। এদিকে তাঁর বইও বিক্রি হচ্ছে না যে মনে একটু সুখ পাবেন। মেলায় কোনও বন্ধু বা চেনা কাউকে খুঁজে পান না যার সঙ্গে কথা বলবেন। আমারও সময় নেই তাঁকে সময় দেওয়ার। কানে কম শোনেন বলে যে কোনও কথার উত্তর চেঁচিয়ে দেন, সেটি আরও বিরক্তিকর। বইমেলা শুরু হওয়ার আগে ফজলুল আলম আমাকে একবার নিয়ে গিয়েছিলেন এনায়েতুল্লাহ খানের বাড়ির পার্টিতে। আমার মোটেও ভাল লাগেনি বাড়িটিতে। কাউকেও আন্তরিক মনে হয়নি। ধনী স্বামীদের সঙ্গে সুন্দরী স্ত্রীরা ভয়াবহ রকম সেজে পার্টিতে এসে মদ খাচ্ছিলেন আর নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন মিসেস শাহাবুদ্দিন মিসেস আলম বলে বলে। কোনও মেয়েকেই দেখিনি যার নিজের কোনও পরিচয় আছে। আমার কাছে অদ্ভুত লাগছিল সবকিছু। টাকা পয়সা, ধন দৌলত, বাড়ি গাড়ি, ইত্যাদি ছাড়া আর কিছু নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল না। জমজমাট পার্টি পেছনে ফেলে বেরিয়ে এসেছিলাম। এরপর ফজলুল আলমের ওপর আমার আরও একবার রাগ হয়েছিল। আমি ময়মনসিংহে যাবো বলে তিনি সাগরের গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন আমাকে নিয়ে কিন্তু এত দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন যে যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। লণ্ডনে যে গতিতে তিনি গাড়ি চালান, একই গতি বাংলাদেশেও দিয়ে বসে আছেন। চিৎকার করেছি, যেন তিনি ধীরে চালান গাড়ি। কিন্তু ধীরে কি করে গাড়ি চালাতে হয় তা তিনি জানেন না, এককালে জানলেও ভুলে গেছেন। তিনি ভ্যাবাচাক্যা খেয়ে যাচ্ছেন, ধাককা ট্রাকের সঙ্গে লাগে, গরু গাড়ির সঙ্গে, রিক্সার সঙ্গে, বাসের সঙ্গে, এমনকী মানুষের সঙ্গেও লাগে লাগে।
সেদিন সতেরোই ফেব্রুয়ারির সন্ধেবেলা। মেলায় একটি চাপা উত্তেজনার গন্ধ পাওয়া যায়। উত্তেজনা কেন, কিসের জন্য, আমার জানা হয় না কিছু। বিশাল একটি ব্যানার নিয়ে একটি মিছিল বিদ্যাপ্রকাশের সামনে দিয়ে পার হয়ে গেল। মেলার মধ্যে ব্যানার নিয়ে মিছিল! এ আবার কেমন! এমন তো দেখিনি আগে কোনওদিন! কি সেই মিছিল কেন সেই মিছিল প্রশ্ন করে কারও কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায় না। হঠাৎ দেখি খোকা টেবিল থেকে আমার বইগুলো দ্রুত তুলে ফেলছেন, বইয়ের তাক থেকে খোকার শালা আমার বই নামিয়ে নিচ্ছেন। তখনই হঠাৎ মুহম্মদ নূরুল হুদা আর রফিক আজাদ আমাকে বের করে নিলেন স্টল থেকে। আমাকে নিয়ে বাংলা একাডেমির মূল দালানের ভেতর ঢুকে গেলেন। একেবারে মহাপরিচালকের ঘরে। ঘটনা কি! ঘটনা যা জানা গেল, তা হল, আমার বিরুদ্ধে মেলায় মিছিল বের হয়েছে। তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটি এই মিছিলটি করছে, যৌন-লেখিকা তসলিমাকে পিষে মারার জন্য এই মিছিল। মেলার বইয়ের স্টলগুলোয় কমিটির লোকেরা হুমকি দিয়ে এসেছে আমার বই যেন না রাখা হয় কোথাও। রাখলে ওরা স্টল ভেঙে ফেলবে নয়তো পুড়িয়ে ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার বই যে স্টলগুলোয় ছিল, সরিয়ে ফেলা হল। আমি স্তম্ভিত বসে থাকি। ঘরে আরও লেখক বসা ছিলেন। ফজলুল আলমও উঠে এসেছিলেন আমার পেছন পেছন। আশঙ্কায় তাঁর মুখ চোখ সব গোল গোল হয়ে আছে। মহাপরিচালকের ঘরে এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। মিছিল কেন হয়েছে, কারা করেছে, মেলার অস্থিরতা কি করে বন্ধ করা যায়। ব্যানারে কী লেখা এই নিয়ে ফিসফিস চলছে লেখকদের মধ্যে। মহাপরিচালক হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন এই মিছিল হচ্ছে? আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি ওদের?’
‘তা তো আমি জানি না কি অভিযোগ।’ আমি বলি।
মহাপরিচালক গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘খুব অশ্লীল কথা লেখা আছে ব্যানারে। কি মনে হয় আপনার, কেন এসব করছে ওরা?’
‘সম্ভবত আমার লেখার কারণে।’
‘লেখে তো অনেকেই। এই যে এখানে যত লেখক আছেন, সকলেই বই লেখেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তো মেলায় মিছিল হয় না। আপনার বিরুদ্ধে হয় কেন?’
ফজলুল আলমের কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠল, ‘হয় কেন মানে? উনি কি করে জানবেন হয় কেন! যারা হওয়ায় তারা জানে, কেন। আর তসলিমা নাসরিনের লেখা সকলে গ্রহণ করতে যাবে কেন! তাঁর লেখা তো আর সবার মত আপোসের লেখা না!’
গুঞ্জন ওঠে লেখকদের মধ্যে। তবে কি তিনি তাঁদের বলছেন আপোস করে লেখেন তাঁরা। গুঞ্জন থামিয়ে মহাপরিচালক ভুরু কুঁচকে চাইলেন আমার দিকে, আমাকে বললেন, ‘মেয়ে হয়ে আপনি পুরুষের মত লিখতে যান কেন? সে কারণেই তো ঝামেলা হচ্ছে।’
আমি ঝটিতে উত্তর দিই, ‘আমি পুরুষের মত লিখব কেন! আমি আমার মত করে লিখি।’ বসে থাকা লেখকরা একটু নড়ে চড়ে বসেন।
‘সবাইকে সব কিছু মানায় না। তা কি বুঝতে পারেন না?’ মহাপরিচালকের ঠোঁটের কোণে একটি হাসি ঝিকমিক করে। লেখকদের নিঃশ্বাসের টানে কিছু ঝিকমিক তাঁদের ঠোঁটের কোণেও আশ্রয় নেয়।
‘আপনার লেখা আমি পড়েছি। কোনও মেয়ে কি আপনি যে ভাষায় লেখেন, সে ভাষায় লেখে?’
আমি চুপ।
‘না, লেখে না।’
মহাপরিচালকের মন্তব্যে লেখকদের মাথাও নড়ে, না লেখে না।
আমার চোয়াল শক্ত হচ্ছে।
‘আপনার লেখা খুব অশ্লীল।’
এবার দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ে বলে, ‘আমার লেখা — কারও কাছে তা অশ্লীল মনে হয়, কারও কাছে মনে হয় না।’
মুহম্মদ নূরুল হুদা বাইরে গিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে আসেন যে মেলার মধ্যে কোনও মিছিল যেন না হয়, এতে মেলার পরিবেশ নষ্ট হয়। কারও যদি কোনও অভিযোগ থেকে থাকে তবে যেন তা মেলা কমিটির সদস্যদের জানানো হয়। শান্ত হতে বলেন তিনি মিছিলের জনতাকে।
আগুন আগুন বলে একটি রব ওঠে মেলায়। ঘরে বসা লোকগুলোর কেউ কেউ জানালার দিকে ছুটে যান ঘটনা দেখতে। বই পোড়ানো হচ্ছে মেলার মাঠে। আমার বই মিছিলের লোকেরা যে যেখানে পেয়েছে মাঠের মাঝখানে জড়ো করে পুড়িয়ে দিয়েছে।
খোকা দাঁড়িয়ে আছেন মহাপরিচালক হারুন উর রশীদের ঘরের বারান্দায়। আমি উঠে যাই খোকার কাছে। খোকা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে আছেন, ঘামছেন তিনি। চোয়াল খোকারও শক্ত হয়ে আছে।
‘কারা এই মিছিল করছে খোকা ভাই? জানেন কিছু?’
খোকা মাথা নাড়লেন। তিনি জানেন না।
মহাপরিচালক মেলাকমিটির সদস্য বাংলা একাডেমির উপপরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে জানালেন, ‘আপনি মেলায় না এলে ভাল হয়।’
‘এ কেমন কথা, কেন আমি আসব না?’
ফজলুল আলম বলে ওঠেন, ‘কেন তিনি আসবেন না? তাঁর কি দোষ?’
‘উনি এলে মেলায় গণ্ডগোল হয়, তাই তিনি আসবেন না।’
জানিয়ে দিলেন, মেলায় যদি আমার ওপর কোনও আক্রমণ হয়, সেই দায়িত্ব মেলা কমিটি নিতে পারবে না। সুতরাং আমার নিরাপত্তার জন্য বইমেলায় আমার না আসাই ভাল। আমার জন্য মেলার পরিবেশ নষ্ট হোক, মেলা পণ্ড হয়ে যাক, তা তাঁরা চান না।
ফজলুল আলম চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘আপনারা মেলা কমিটির লোক, আপনারা তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন।’
ফজলুল আলমের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকান মহাপরিচালক। চোখের ভুরুতে প্রশ্ন, লোকটি কে এখানে চিৎকার করছে! একে তো চিনি না!
কিছু ছেলে আমার বিরুদ্ধে মিছিল করছে বলে আমার মেলায় আসা বন্ধ হবে কেন! অনেকে তো আমার লেখা পছন্দ করে, তারা ..
আমার কোনও যুক্তিই মহাপরিচালক মেনে নেন না। মীমাংসা শেষ অবদি কিছুই হয় না। মহাপরিচালক তাঁর বক্তব্যে স্থির থাকেন। তাঁর পরামর্শ আমার আর মেলায় আসা উচিত নয়। যেহেতু আমি মেয়ে হয়ে পুরুষের মত লিখি, যেহেতু আমি অশ্লীল লেখা লিখি, যেহেতু আমার লেখা আদৌ কোনও ভাল লেখা নয়, সেহেতু আমার বিরুদ্ধে মেলায় মিছিল বের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, আমাকে লোকে পেষণ করতে চাইবে, এও অবাক করা কোনও ব্যপার নয়। সুতরাং আমি যেন মেলা থেকে দূরে থাকি, এ যত না আমার নিরাপত্তার জন্য, তার চেয়ে বেশি মেলার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার জন্য।
পুলিশের ভ্যানে তুলে দিয়ে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মেলা জমজমাট। আমার মেলায় যাওয়া নিষেধ। লেখা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ আমি দেখেছি। গতবারের মেলায় এক দল ছেলে, বয়স উনিশ কুড়ি হবে, হাতে আমার একটি কবিতার বই নিয়ে আমার কাছে এসে বিপরীত খেলা নামের একটি কবিতা দেখিয়ে বলেছিল, ‘আমি দশ টাকায় বিক্রি হতে চাই। আমাকে কেনেন।’ প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি মজা করছে। কিন্তু এরপরই যখন কড়া স্বরে চোখ পাকিয়ে বলল যে এক্ষুনি তাকে কিনতেই হবে আমার। আমি থতমত খেয়ে ঢোক গিলে মৃদু স্বরে বলেছি, ‘এটি কবিতা। সত্যিকার কেনার জন্য নয়।’ বলে কিছুটা পিছনে সরে এসেছি। খোকা লক্ষ করেছেন ব্যপারটি। তিনি স্টল থেকে বেরিয়ে গিয়ে ছেলেদের ডেকে বললেন, ‘বিক্রি হতে চাও ঠিক আছে, বিক্রি হলে কবিতায় আর যে সব শর্ত আছে, তা মানতে পারবে তো! পুরো কবিতা পড়ে তারপর বিক্রি হতে এসো।’
‘আমার এখন দশ পাঁচ টাকায় ছেলে কিনতে ইচ্ছে করে। ছেলে কিনে ছেলেকে তছনছ করে বুকে পিঠে লাথি কষে বলব, যাশশালা। ছেলে কিনে ছেলের কুঞ্চিত অণ্ডকোষে লাথি কষে বলে উঠবো, যাশশালা।.. ‘
কবিতাটি লিখেছিলাম রমনা পার্কের সামনে সন্ধের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা দরিদ্র মেয়েদের ভদ্রলোকরা রিক্সা উঠিয়ে নিচ্ছেন দেখতে দেখতে। কোথায় নিয়ে যায় ওদের! কী করে ওদের নিয়ে! বড় কৌতূহল হয়। একদিন হেঁটে যাচ্ছিল!ম রমনার পাশ দিয়ে, ভাঙা আয়না সামনে নিয়ে তেলহীন শুকনো চুলে চিরুনি আর ধুলো বসা মুখে পাউডার লাগাতে থাকা মেয়েদের সামনে থেমে জিজ্ঞেস করেছি, ‘কেন সাজতাছেন এইখানে বইসা?’
আমার প্রশ্নের দিকে কেউ তাকায় না।
আবারও প্রশ্ন করলে একজন বলে, ‘পেটের ধান্দা করি বইন। পেটের ধান্দা।’
উসকো খুসকো চুল, রোদে পোড়া ত্বক, গালে বাহুতে কাটা দাগ, কারও চোখ ফুলে আছে, কারও কপাল। কপাল ফুলে লাল হয়ে আছে একটি অল্প বয়সী মেয়ে রেলিংএ হেলান দিয়ে উদাস দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করি, ‘কপালে কি হইছে?’
আমার দিকে একবার দৃষ্টি ফেলে সরিয়ে নেয় মেয়েটি। আমি যেন এক উপদ্রব ছাড়া কিছু নই। আমাকে তার প্রয়োজন নেই। কপালে কি হয়েছে তা বলার প্রয়োজন সে বোধ করে না। তবু আমি দাঁড়িয়ে থাকি। লু হাওয়ায় শুকনো চুল উড়ে মুখের ঘামে সেঁটে থাকে। সেই চুলও মেয়েটি সরিয়ে দেয় না। ইচ্ছে করে নিজে হাতে সরিয়ে দিই চুল, ইচ্ছে করে বাড়িতে নিয়ে মেয়েটিকে গোসল করিয়ে ভাল খাইয়ে দাইয়ে বিছানা দিই ঘুমোবার। চোখে ঘুম মেয়েটির। কত রাত বোধহয় ঘুমোয় না। মেয়েটি হঠাৎ বলে, কপালের দোষে কপাল পুড়ে, কপাল ফাটে, কপাল দিয়া রক্ত ঝরে।’
ধ ধু চোখদুটো এবার আমার দিকে ফিরিয়ে বলে, ‘বেডারা মারছে গো, বেডারা মারছে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘মারছে কেন?’
‘মারার শখ হইছে, মারছে।’
‘কত টাকা পান? কত টাকা দেয় তারা?’
‘দশটেকা। পাঁচটেকা। কোনওদিন দুই টেকা। কোনওদিন কোনও টেকা পয়সা দেয় না। লাত্থি দেয়, লাত্থি।’
মেয়েটি তেতো একটি হাসি মুখে নিয়ে সরে যায় আমার সামনে থেকে। বাকি মেয়েগুলোও তাদের প্রসাধনসামগ্রী নিয়ে দ্রুত উধাও। পুলিশ আসছে। পুলিশও তো পুরুষ। পুলিশও কি ভোগ করেনা এদের! করে। না করলেও অন্তত টাকা তো নেয়, এদের দশ পাঁচ টাকা থেকেও ভাগ নিতে দ্বিধা করে না। শর্ত মার দেবে না, জেলে পুরবে না। যে লোকেরা এদের দরদাম করে রিক্সায় উঠিয়ে নেয়, তাদের কি পুলিশ কখনও জেলে পুরতে চেয়েছে! চায়নি। তাদের কি কেউ মন্দ বলে? না, বলে না। নিজেকেই প্রশ্ন করতে করতে নিজেকেই উত্তর দিতে দিতে আমি হাঁটি। বুকের ভেতর কষ্টের পাথর নিয়ে হাঁটি।
বইমেলায় যাওয়া আমার জন্য নিষেধ, এ খবরটি খোকাকে ভীষণ রকম হতাশ করে। তিনি বই-ব্যবসা ভুলে যান, ভুলে যান বই ছাপা, প্রতিদিনকার টাকা পয়সার হিসেব নেওয়ার কাজ। এমনকী বইমেলায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। তিনি দিন রাত ব্যস্ত ‘তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটিঞ্চর নাড়ি নক্ষত্র জানতে। কে এরা, কি করে, কি উদ্দেশ্য এদের, কোনও দল করে কি না, করলে কোন দল ইত্যাদি খবর নেন। কমিটির সভাপতি বিএনপির কর্মী এই খবর পেয়ে খোকা তাঁর খালাতো না কি মামাতো ভাইকে ধরে যেহেতু ভাইটি বিএনপির ছোটখাটো এক নেতা, সভাপতিটির সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতে চান। সমঝোতা কেবল মুখের কথায় হয় না, অর্থকড়ি ঢালতে হয়। খোকার কত টাকা গচ্চা যায় তা আমার জানা হয় না। কিন্তু টাকা খেয়েও যখন প্রতিপক্ষের ক্রোধ কমে না, তখন মুখোমুখি কথা বলার ব্যবস্থা করেন খোকা। প্রতিপক্ষ নেতা বনাম আমি। খোকার মুহুর্মুহু অনুরোধে আমি শেষ পর্যন্ত রাজি হই। খোকা আমাকে পই পই করে বলে দেন যে আমাকে উত্তেজিত হলে চলবে না, সভাপতি যা প্রশ্ন করবে তার উত্তর যেন আমি মাথা ঠাণ্ডা করে দিই। প্রশ্নোত্তরের বৈঠকটি হবে খোকার বাড়িতে। আমার ওপর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের গুরুণ্ডাদেশ দেখে ফজলুল আলমের চোখ মুখ সেই যে গোল হয়ে ছিল, গোল হয়েই আছে। এই গোপন খবরটি শুনে যে আমি যাচ্ছি পেষণ কমিটির নেতার সঙ্গে দেখা করতে, গোঁ ধরলেন তিনিও যাবেন। তাঁর আশঙ্কা আমার ওপর আবার আক্রমণ করার চেষ্টা করবে নেতা। আমার বিপদ দেখলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে বাঁচাবেন। আমি তাঁকে কিছুতেই সঙ্গে নেব না, কিন্তু তিনি যাবেনই। তিনি গেলেন। কিন্তু খোকা রাজি হন না বৈঠকে ফজলুল আলমের উপস্থিতি। নেতা শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, যদি তৃতীয় কারও ঘরে থাকতে হয়, বড় জোর খোকা থাকতে পারেন, কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর খোকাকে দিলে চলবে না, দিতে হবে আমাকে। খোকা ঠাণ্ডা মাথার লোক, তিনি অবস্থা বেগতিক দেখলে সামাল দেবার চেষ্টা করবেন। ফজলুল আলমের গরম মাথাকে তিনি পাশের ঘরে একটি পাখার তলে রেখে দিলেন। এসময় ঠাণ্ডা মাথা দরকার, গরম মাথা যে কোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে, খোকার ধারণা। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমাকে পিষে মারার জন্য দল গঠন করেছে, সেই ছাত্রনেতার মুখোমুখি বসি। নেতা দশাসই চেহারার কিছু নয়। নেতার মুখে মোচ, ব্রণ, ঘৃণা সব স্থির হয়ে আছে। আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়, চোখে আমাকে পিষে মারার তৃষ্ণা থিকথিক করে। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ শোনার পালা আমার। ছেলেটি, কী নাম তার, হাফিজ বা হারুন বা হামিদ বা হাসান কিছু একটা হবে, বলল, ‘আপনি আমাদের মা বোনদের সর্বনাশ করছেন।’
‘কি রকম সর্বনাশ করছি?’
‘কি রকম সর্বনাশ করছেন জানেন না?’
‘আমি তো জানি, আমি মেয়েদের পক্ষে লিখি, আমি তাদের সর্বনাশ করতে যাবো কেন?’
‘তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। সংসার ভেঙে তারা যেন বার হইয়া যায়।’
‘এরকম কথা আমি কোথাও তো বলি নাই।’
‘আপনার বালিকার গোল্লাছুট কবিতায় বলছেন, পৃথিবীর সকল বয়ষ্ক বালিকা দিই গোল্লা থেকে ছুট।’
হামিদ বা হাসান আমার কবিতার বই খুলে কবিতাটি দেখায়।
‘পড়েন, কবিতাটা আবার পড়েন। কী মনে করে এই কবিতা লিখেছেন, বলেন আমাকে।’
কণ্ঠস্বরের হুকুম এবং হুমকি দুটোই কান থেকে প্রাণে এসে বিষমাখা তীরের মত বেঁধে।
‘আমরা বালিকারা যে খেলাটি খেলব বলে পৃথিবীতে বিকেল নামত
সে খেলার নাম গোল্লাছুট
…. আমার আবার ইচ্ছে করে খেলি
এখনো মাঝে মধ্যে আঁকুপাঁকু করে পায়ের আঙুল
ধুলোয় ডুবতে চায় গোপন গোড়ালি
ইচ্ছে করে, যাই
পৃথিবীর সকল বয়ষ্ক বালিকা দিই গোল্লা থেকে ছুট।’
জবানবন্দি। যেন আমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, যাহা বলিব সত্য বলিব বলে আমাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। দিতে হবে, কারণ এই নেতাটি যতই হালকা পাতলা হোক, তাকে দু ঘা মেরে হয়ত বসিয়ে দেওয়া যাবে, তাকে দেখে শক্তিহীন মনে হলেও সে কিন্তু অসীম শক্তি ধারণ করে। সে একটি দল গঠন করার শক্তি রাখে, তারও চেয়ে বড় কথা তার দলবল নিয়ে আমাকে পিষে মারার শক্তি রাখে।
‘সকল বয়ষ্ক বালিকাকে গোল্লা থেকে ছুটে যেতে প্রেরণা দিচ্ছেন। আমাদের মা বোনেরা যেন সংসার ছেড়ে বের হইয়া যায়। আপনি এই সমাজের কত বড় ক্ষতি করছেন, তা জানেন?’
‘এটি গোল্লাছুট খেলা নিয়ে কবিতা। মেয়েরা যারা একসময় গোল্লাছুট খেলত ছোটবেলায়, বড় হয়ে গেলে তারা আর সেই খেলাটা খেলতে পারে না। ভেতরে ইচ্ছ!টা তো থাকে। আমি আমার ইচ্ছ!র কথা বলেছি।’
‘উহুঁ ।’ হাফিজ বা হাবিব মাথা নাড়ে।
‘আপনি এইখানে সকল বয়ষ্ক বালিকার কথা বলছেন। আপনার নিজের কথা কেবল বলেন নাই।’
‘সব মেয়েরই এমন ইচ্ছ! হয়। সবাই তো পেছনে ফেরে, শৈশবে ফিরতে চায়। চায় না কি? চায় তো। আমি যখন নিজের কথা বলি, একই সঙ্গে অনুভব করি যে এ অন্য মেয়েদেরও কথা। এই কবিতায় মেয়েদের ইচ্ছ!র কথা বলেছি….’
‘সব মেয়ের তো এমন ইচ্ছ! করে না..’
‘অনেকের করে।’
‘না অনেকের করে না। বলেন যে আপনার করে।’
আমি ঠিক বুঝে পাই না কি বলব।
হাবিব বা হারুন এবার তীক্ষ্ম চোখে আমার চোখে তাকিয়ে বলে, ‘গোল্লা বলতে তো আপনি স্বামী সন্তাান নিয়ে মেয়েরা যে সংসারটা করছে, তা বোঝাতে চেয়েছেন।’
আড়চোখে খোকাকে দেখি। খোকার চোখে আকুলতা, ‘ একবার আপনাকে আমি নেবই বইমেলায়, আপনি বলুন যে আপনি সংসার বোঝাননি, কেবল খেলাই বুঝিয়েছেন।’ আমি এই আকুলতার সামনে প্রায় বলতে যাওয়া ‘একভাবে ভাবতে গেলে এটি সংসারও হয়, সমাজের নিয়মের যে জাল পাতা মেয়েদের জন্য, সেটিও হয়’ আর বলি না। আমার মুখ খোলার আগেই হাসান বা হাফিজ বলে, ‘অন্য মেয়েদের ইচ্ছ!র কথা কি করে জানেন?’ হাতের কাছে বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলি, ‘সেটা আমার মনে হয়েছে।’
‘কাউকে জিজ্ঞেস করেছিলেন লেখার আগে যে তারা গোল্লা থেকে ছুটতে চায় কি না? নাকি আপনি আপনাকে দিয়ে বিচার করেন সবাইকে?’ নেতার চোখ থেকে কিছু একটা বেরোয়। সেই কিছু একটার ঝাঁঝ আমার মুখটি তুলতে দিচ্ছে না।
বইটি টেবিলে রেখে দিয়ে বলি, ‘না, তা করি না।’
‘আপনার মনে হয়েছে অন্য মেয়েদের ইচ্ছ!টা কী। কিন্তু আপনি সঠিক জানেন না।’
এবার নেতার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আমি বলি, ‘আমার ইচ্ছে, আমার মনে হওয়ার কথা তো আমি লিখব আমার কবিতায়। এটা কি দোষের কিছু?’
‘নিশ্চয়ই দোষের।’
‘কী দোষের?’
খোকা খুব আলতো স্বরে বলেন, ‘লেখা তো লেখকেরা যা ভাল মনে করেন, তাই লেখেন। সবাই তো আর সব লেখকের সব লেখাকে ভাল মনে করে না। তাদের সব বক্তব্যই তো সব পাঠক মেনে নেয় না। তবে আমার মনে হয় উনি বোঝাতে চেয়েছেন গোল্লাছুট খেলার কথা। লেখাটা পড়লে অনেকে ভুল বুঝতে পারে।’
খোকার বক্তব্যে মাথা নেড়ে আমি বলি, ‘হ্যাঁ, অনেকেই ভুল বোঝে। তা ঠিক। যেমন ধরেন ওই বিপরীত খেলা কবিতাটা। ওই কবিতায় কি আমি সত্যিই ছেলে কিনতে চেয়েছি? ওই কবিতাটি ছিল একটি প্রতিবাদ!’
‘এই কথাটাই আপনি ওকে বুঝিয়ে বলেন না কেন! খোকা বলেন আমাকে।’
‘আমি তো বোঝাচ্ছিই। বলতে চাইছি যে এক লেখাকে অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা করে। লেখকের এক রকম ব্যাখ্যা থাকে, পাঠকের হয়ত আরেক রকম।’
ছাত্রনেতাটি আমাকে পিষে মারার জন্য বড় একটি দল বানিয়েছে। হাতের কাছে পেলে পুরো মেলার মানুষ যেন দেখে আমাকে ন্যাংটো করে পায়ের তলায় পিষবে, তেমন কথা ছিল। এই নেতাকে আমি নতুন করে বোঝাবো কী! আমার লেখার কিছুই না বুঝে সে দল বানায়নি। তার আশঙ্কা আমি সমাজটাকে নষ্ট করছি। মা বোনের মাথা বিগড়ে দিচ্ছি। এই বিশ্বাস কেবল এই হাসান বা হামিদের নয়, আরও অনেকের। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারি না, আমার গোল্লাছুটের সরল ব্যাখ্যাটি আদৌ সে মেনে নিয়েছে কী না। খোকার সঙ্গে আবার চোখাচোখি হয়। চোখের এবারের ভাষাটি আমার পক্ষে পড়া সম্ভব হয় না।
নেতা এবার জয় বাংলা কবিতা নিয়ে প্রশ্ন করল। ‘জয় বাংলা কবিতাটা কেন লিখেছেন?
আমার সহজ উত্তর, ‘জয় বাংলায় বিশ্বাস করি বলে।’
‘এই কবিতায় তো আপনি যারা জয় বাংলায় বিশ্বাস করে না, সেই দুর্ভাগাদের মৃত্যু চাইছেন। আমি তো জয় বাংলা মানি না। আপনি আমাকে দুর্ভাগা বলবেন কেন? যারা মানে না, তাদের সম্পর্কে বাজে কথা বলবেন কেন?’
‘আপনি কি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না?’
‘বিশ্বাস করব না কেন? অবশ্যই করি।’
আমার গলার স্বরে সত্যিই ফুটে উঠতে থাকে উত্তেজনা, ‘যদি করেন বিশ্বাস তাহলে জয় বাংলায় বিশ্বাস না করার তো কোনও কারণ নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কী স্লোগান আমরা সবাই দিয়েছিলাম? সবাই বলেছে জয় বাংলা। সবাই জয় বাংলার গান গেয়েছে।’ নেতার ক্রুদ্ধ মুখ থেকে চোখ খোকার দিকে ফিরিয়ে বলি, ‘কী খোকা ভাই, একাত্তরে জয় বাংলা বলেন নাই? একমাত্র রাজাকার আলবদররাই জয় বাংলা বলে নাই। আমি তাদেরই দুর্ভাগা বলছি।’
‘জয় বাংলা আওয়ামি লীগের স্লোগান।’ নেতা কঠিন কণ্ঠে বলে। নাকের পাটা ফুলে উঠছে তার।
‘জয় বাংলা আওয়ামি লীগের হবে কেন? এটা সবার। জয় বাংলা মানে বাংলার বিজয়, জয় বাংলা মানে স্বাধীন বাংলা। মুক্তিযোদ্ধারা, যারা কোনওদিন আওয়ামি লীগ করে নাই, তারা কি জয় বাংলা বলত না সবসময়ই? এই জয় বাংলা বলেই তো তারা প্রেরণা পেত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার।’
খোকা একগাল হেসে বলেন, ‘ওর ওইসময় হয়ত জন্মই হয় নাই। আপনার জন্ম বোধহয় যুদ্ধের পরে। ঠিক না?’
নেতাটির মাথা না বোধক নড়তে নিয়েও নড়ে না।
খোকা আমাকে বলেন, ‘আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন! ওরা তো মুক্তিযুদ্ধে কি হয়েছিল, তা জানে না। জানলেও হয়ত মনে নাই। জয় বাংলা, এটা তো সত্যি যে আওয়ামি লীগ এটাকে নিজেদের স্লোগান করে নিয়েছে। আওয়ামি লীগের তো কোনও রাইট নাই জয় বাংলা..’
আমি মাথা নেড়ে বলি, ‘আওয়ামি লীগ একে নিজের সম্পত্তি মনে করলেই তো হবে না। জয় বাংলা কোনও দলের সম্পত্তি না। আমি তো জয় বাংলা সেই একাত্তর থেকে বলে আসছি। আমি তো কোনওদিন আওয়ামি লীগে নাম লেখাই নাই। আমি তো নিরপেক্ষ মানুষ। রাজনীতি করি না। আওয়ামি লীগের অনেক কিছুই আমার পছন্দ না।’ প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলে তখনও সন্তুষ্ট না হওয়া হাসান বা হাবিব বা হাফিজ বা হামিদের সঙ্গে খোকার আরেক দফা বৈঠক হয়। খোকা না চাইলেও মুখে মধুর হাসি টেনে সব জুলুম সহ্য করছেন কারণ তিনি যে করেই হোক অন্তত একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে আমাকে নিয়ে যেতে চান মেলায়। বইমেলায় বই বিক্রি তাঁর জন্য বড় কোনও বিষয় নয়, আমার মেলায় যাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর কাছে এখন সবকিছুর চাইতে জরুরি। কিন্তু এভাবে কি স্বস্তি মেলে? সারাক্ষণই একটি উৎকণ্ঠা কি পায়ে পায়ে হাঁটে না! পেষণ কমিটির সভাপতি কথা দিয়েছে যে আক্রমণ আপাতত তার দল করছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে আমি যেন খুব সাবধানে লিখি, যদি অশ্লীল লেখা লিখি, যদি মা বোনের ক্ষতি করার জন্য লিখি, যদি সমাজের অনিষ্ট করার জন্য লিখি, তবে পেষণ কমিটির কর্মকাণ্ড অনেকদূর এগোবে। বলেছে দলের একজন, কিন্তু দলের বাকিরা কি এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে যে আপাতত আমার ওপর হামলা করবে না! খোকা আমাকে জানান যে নিয়েছে। কিন্তু তারপরও খোকা জানি না কোত্থেকে কিছু পেশীবহুল লোক যোগাড় করলেন, যাদের কাজ আমাকে মেলায় নিয়ে যাওয়া আর মেলা শেষ হলে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। অচেনা পেশী পরিবেষ্টিত হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মেলায় যাই বটে আমি, আগের সেই স্বতস্ফূর্ত আনন্দ জোটে না কিছুতে তবে খোকার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে থাকে। কোনও লেখক তো এগিয়ে আসেনি কোনও সাহায্য করতে, মেলা কমিটি মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, এ সময় খোকা এই মীমাংসাটি না করলে আমাকে এক ঘোর হতাশার মধ্যে ঘরে বসে থাকতে হত। যে দুটো দিন মেলায় গিয়েছি, বিদ্যাপ্রকাশের স্টলেই বসে ছিলাম। মেলার মাঠে হাঁটাহাঁটি বা চায়ের স্টলে গিয়ে চা খাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হলেও যেতে পারিনি। স্টলেও বেশিক্ষণ বসা হয়নি, ঘণ্টা দুঘণ্টা পর বাড়ি ফিরতে হয়েছে। তবে আমি যে যে করেই হোক গিয়েছি মেলায়, সেটিই ছিল বড় ঘটনা। যদিও আশঙ্কা নামের কুৎসিত একটি জিনিসকে কোনও আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতে পারিনি, যদিও খোকার চোখ সারাক্ষণই অস্থির ছিল উদ্বেগে তবু বিজয়ের প্রশান্তি অল্প হলেও কিছু ছিল তাঁর মনে। ফজলুল আলম উৎকণ্ঠা এবং উচ্ছঅ!স দুটো নিয়েই নিরাপদ একটি দূরত্বে হাঁটাহাঁটি করেন। বইমেলা কমিটির লোকেরা আমাকে ভ্রু কুঁচকে দেখেছেন। জ্বলজ্যান্ত উপদ্রুবটিকে দেখতে তাঁদের ভাল লাগেনি। আমার মত আস্ত একটি সমস্যা মেলায় উপস্থিত হলে কী না কী অঘটন ঘটে কে জানে! মেলায় যদি জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়ে যায়, তবে! তার চেয়ে একা আমাকে কোথাও নিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলে মেলাটা অন্তত বাঁচে। মেলার স্টলগুলোয় আমার বই নেই। বেশির ভাগই ছিনিয়ে নিয়েছে পেষণ কমিটির লোকেরা। বেশির ভাগই পুড়িয়ে দিয়েছে। কোনও কোনও স্টলে বই আছে, সেসব বই লুকিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলের তলায়।
প্রতি বছরের মত বাংলা একাডেমি কবিতা পড়ার অনুষ্ঠান করছে। আগের বছরের অনুষ্ঠানগুলোয় কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, এবার আমি আমন্ত্রিত নই।
আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার, পিষে মারার ষড়যন্ত্র যেমন একদিকে চলছে, অন্যদিকে আবার অনেক পাঠকই একবার আমাকে চোখের দেখা দেখতে মেলায় আসেন। কাছে এসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘আপনাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।’ কেউ বলতে বলতে যে আমার লেখা যেন লেখা নয়, সত্যিকার জীবন, কেঁদে ফেলে। কেউ বলে, ‘যে কথা আমি সবসময় বলতে চেয়েছি, পারিনি, আপনি বলছেন।’ কোনও মা আসেন মেয়ে নিয়ে, মেয়েকে পাঠান আমার পায়ের ধুলো মাথায় নিতে। কেউ কেউ সিলেট চট্টগ্রাম রাজশাহী বগুড়া এসব দূর দূর শহর থেকে ঢাকার বইমেলায় আসেন একটি উদ্দেশ্য নিয়েই, কাছ থেকে যদি সম্ভব না হয়, দূর থেকে হলেও আমাকে একটিবার দেখে স্বপ্ন পুরণ করবেন।
আমার জন্য মানুষের ভালবাসা এবং ঘৃণা দুটোই আমাকে কাঁদায়।