২২. ওসমান সাহেবের ঘুমের সময়

২২

বুধবার। সময় রাত দশটা চল্লিশ।

ওসমান সাহেবের ঘুমের সময় হয়ে গিয়েছে। ইদানীং তিনি সিডাকসিন না খেয়ে ঘুমাতে পারেন না। তিনি উঠলেন। একটি সিডাকসিন ট্যাবলেট খেয়ে মাথায় পানি ঢাললেন, হাত-মুখ ধুলেন। বিছানায় যাবার আগে রোজকার অভ্যেসমতো উকি দিলেন ফিরোজের ঘরে। গত তিন দিন তিন রাত ধরে ফিরোজ তার ঘরে আটক। দু’ দিন দু’ রাত সে ছটফট করেছে, জিনিসপত্র ভেঙেছে, খাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ সারাদিন তেমন কিছু করে নি। ভাতটাত কিছুই খায় নি, তবে কোনো রকম চিৎকার এবং হৈচৈ করে নি। এখন সম্ভবত করবে। রাত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার পাগলামি বাড়ে, অস্থিরতা বাড়ে।

ওসমান সাহেব ফিরোজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ অবাক হলেন। ফিরোজ শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। গায়ে একটি শার্ট। চুল আঁচড়িয়েছে। মুখভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ি নেই। শেভ করেছে। এবং সম্ভবত গোসলও করেছে। ওসমান সাহেব নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

‘কেমন আছ ফিরোজ?’

ফিরোজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল এবং সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছ বাবা?’

‘ভালো, ভালো। আমি ভালো, বেশ ভালো।’

ওসমান সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কী অদ্ভুত কান্ড! ফিরোজ কি সুস্থ? নিশ্চয়ই সুস্থ।

‘বাবা, মাকে ডাক। খিদে পেয়েছে, ভাত খাব।’

‘নিশ্চয়ই খাবি, নিশ্চয়ই। কী দিয়ে খাবি?’

‘যা আছে, তাই দিয়ে খাব। স্পেশাল কিছু লাগবে না।’

‘লাগবে না কেন? নিশ্চয়ই লাগবে। দাঁড়া ডাকছি। তোর মাকে ডাকছি। তোর শরীরটা এখন ভালো, তাই না?’

‘হ্যাঁ, ভালো। বাবা, আমার ঘরটা খুব নোংরা হয়ে আছে, একটা ঝাড়ু দিতে বল। তালা খোলার দরকার নেই। জানালা দিয়েই দাও।’

ওসমান সাহেব ঝাড়ু এনে দিলেন এবং ছুটে গেলেন স্ত্রীকে খবর দিতে। ফরিদাকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে এনে দেখেন, ফিরোজ ঘর মোটমুটি পরিষ্কার করে ফেলেছে। কত সহজ এবং স্বাভাবিক তার ব্যবহার! ফরিদার চোখে পানি এসে গেল।

‘মা, ভাত দাও আমাকে। খুব খিদে লেগেছে।‘

‘দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি। এক্ষুণি দিচ্ছি।’

‘জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে দিও না মা। নিজেকে জন্তুর মতো লাগে। মনে হয় আমি চিড়িয়াখানার একটা পশু।’

‘না না, জানালা দিয়ে খাবার দেব না। টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তুই চেয়ার-টেবিলে বসে খাবি।’

‘আর শোন মা, আমার বিছানার চাদর-টাদর বদলে দাও। ধবধবে সাদা চাদর দেবে।’

‘দিচ্ছি রে বাবা, দিচ্ছি।’

আনন্দে ফরিদা বারবার মুখ মুছতে লাগলেন। সব ঠিক হয়ে গেছে। আর কোনো সমস্যা নেই, তাদের দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হয়েছে।

খাবার টেবিলে ভাত সাজিয়ে ওসমান সাহেব ফিরোজের ঘরের চাবি খুললেন। ফিরোজ বেরিয়ে এল। তার হাতে লোহার রড। তার পরনে একটি কালো প্যান্ট, খালি গা। সে থমথমে গলায় বলল, ‘কি, ভয় লাগছে? ভয়ের কিছু নেই। মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। ও আমার চিকিৎসা করবে।’

ওসমান সাহেব একটি কথাও বলতে পারলেন না। ফিরোজ হেঁটে-হেঁটে গেল গেটের কাছে। দারোয়ানকে ঠাণ্ডা গলায় বলল গেট খুলে দিতে। দারোয়ান গেট খুলে দিল।

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমতে শুরু করেছে। রাস্তায় কেন যে স্ট্রীট-লাইট নেই! ফিরোজ লম্বা-লম্বা পা ফেলে অন্ধকারে নেমে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *