২০. কাজের মেয়ে

২০

বুধবার! সময় সাতটা দশ।

সন্ধ্যার ঠিক পরপর মিসির আলি নিউ ইস্কাটন রোডের যে তিনতলা দালানের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তার নাম–’নিকুঞ্জ’। লোকজন বিশাল প্রাসাদ তৈরি করে নাম দেয়–কুটির! এ-রকম বাড়ির নাম কেউ কুটির রাখে?

বাড়ির সামনে ফুটবলের মাঠের মতো বড় লন। লনের ঘাস বড়-বড় হয়ে আছে। লনের চারদিকে একসময় ফুলের বাগান ছিল। এখন নেই। শ্বেতপাথরের একটি শিশুমূর্তি (সম্ভবত ফোয়ারা) আছে মাঝখানে, তাতে শ্যাওলা পড়েছে। চারদিকে অবহেলা ও অযত্নের ছাপ।

মিসির আলির মনে হল–এ বাড়ির মালিক দেশে থাকেন না। চাকরবাকরের হাতে বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে তিনি থাকেন বিদেশে। হঠাৎ-হঠাৎ আসেন, আবার চলে যান। মিসির আলি খানিকটা শঙ্কিত বোধ করলেন। বাড়ির মালিক এস. আকন্দ সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়া খুবই জরুরি। কারণ মিসির আলির ছাত্র শেষ পর্যন্ত ‘ইমা’ নামের একটি মেয়ের খবর পত্রিকায় পেয়েছে। খবরের শিরোনাম–হারিয়ে গেল ইমা। ডল হাতে তিন বছর বয়সী একটি বালিকার ছবি আছে খবরের সঙ্গে।

মেয়েটি তার বাবা-মার সঙ্গে ঢাকা থেকে খুলনা যাচ্ছিল। খুব চঞ্চল মেয়ে। সারাদিন ছোটাছুটি করেছে। স্টীমারে উঠে তার খুব ফূর্তি। এক জন আয়া তার সঙ্গে সঙ্গে। বরিশাল থেকে স্টীমার ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই আয়া দেখল, ইমা নেই। সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে একা-একা নিচে নেমে গেছে? সে ছুটে এল নিচে। সেখানেও ইমা নেই। সে কি রেলিং টপকে নদীতে পড়ে গেছে? আয়া ভয়ে-আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গেল। ইমার বাবা-মা তখনো কিছু জানেন না। তাঁরা টেলিস্কোপিক লেন্স লাগিয়ে দূরের একটি মাছধরা নৌকার ছবি তোলার চেষ্টা করছেন।

এ জাতীয় বাড়িগুলোতে সাধারণত দারোয়ান এবং কুকুর থাকে। কিন্তু এ-বাড়িতে দুটোর কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না। মিসির আলি অনেকটা দ্বিধা নিয়েই গেটের ভেতর ঢুকলেন। কলিং-বেল থাকার কথা, তাও চোখে পড়ছে না। তবে বাড়িতে লোক আছে। আলো জ্বলছে।

আচ্ছা, এ-রকম হওয়া কি সম্ভব যে, এ-বাড়িতে এস. আকন্দ নামের কেউ থাকেন না। এক কালে ছিলেন, এখন নেই। কিংবা খবরের কাগজে যে এস. আকন্দের কথা আছে, ইনি সেই ব্যক্তি নন।

হওয়া অসম্ভব নয়। তবে সাজ্জাদ হোসেন বেশ জোর দিয়েই বলেছেন—এটিই ঠিকানা। খবরের কাগজের কাটিং থেকে ঠিকানা বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সাজ্জাদ হোসেনকে। এটি মনে হচ্ছে তিনি ঠিকই করেছেন।

কলিং-বেল খুঁজে পাওয়া গেল না। মিসির আলি দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজা খুলে গেল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই।

‘কাকে চান?’

‘এটা কি আকন্দ সাহেবের বাড়ি? এস. আকন্দ?’

‘জ্বি।’

‘উনি কি আছেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

‘উনি খুবই ব্যস্ত। আজ রাত দু’টার ফ্লাইটে লণ্ডন চলে যাচ্ছেন। আপনার কী দরকার, বলুন?’

‘আমার খুবই দরকার।’

‘আমাকে বলুন।’

‘আমি তাঁকেই চাই। বেশি সময় লাগবে না। পাঁচ মিনিট সময় নেব।’

‘ঠিক আছে, বসুন, আমি দেখি।’

মিসির আলি সাহেব বসার ঘরে একা-একা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বসে রইলেন। বসার ঘরটি সুন্দর। অসংখ্য দর্শনীয় জিনিসপত্র দিয়ে জবড়জং করা হয় নি। ঘাস রঙের একটা কার্পেট, নিচু-নিচু বসার চেয়ার। দেয়ালে একটিমাত্র পেইনটিংচার-পাঁচ জন গ্রামের ছেলেমেয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতে নেমেছে। অপূর্ব ছবি! ছবিটির জন্যেই বসবার ঘরে একটি মায়া-মায়া ভাব চলে এসেছে। মিসির আলি মনে-মনে ঠিক করলেন, তাঁর কোনো দিন টাকাপয়সা হলে এ-রকম করে একটি ড্রইংরুম সাজাবেন। সে-রকম টাকাপয়সা অবশ্যি তাঁর হবে না। সবার সব জিনিস হয় না।

‘আপনি কি আমার কাছে এসেছেন? আমি সাবির আকন্দ।’

মিসির আলি ভদ্রলোককে দেখলেন। বেশ লম্বা। শ্যামলা গায়ের রঙ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মুখে একটি কঠিন ভাব আছে। তবে চোখ দু’টি বড়-বড়, যা মুখের কঠিন ভাবের সঙ্গে মানাচ্ছে না।

‘আমি আপনাকে কোনো সময় দিতে পারব না। আমি আজ একটায় চলে যাচ্ছি।’

‘আমি আপনার বেশি সময় নেব না। আপনি পত্রিকার এই কাটিংটি একটু দেখুন।’ আকন্দ সাহেব দেখলেন। কাটিংটি ফিরিয়ে দিয়ে মিসির আলির পাশে বসে ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘এটা আপনি আমাকে কেন দেখাচ্ছেন? কিছু-কিছু জিনিস আমি মনে করতে চাই না। এটা হচ্ছে তার একটি।

মিসির আলি বললেন, ‘আমার সঙ্গে একটি মেয়ে থাকে। আমার ধারণা, ও ইমা।’

ভদ্রলোক কোনো কথা বললেন না। তাঁর মুখের একটি পেশিও বদলাল না।

’আপনার এই মেয়ের কি খুব ছোটবেলায় ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ, ইংল্যাণ্ডে। ওর বয়স তখন দু’ বছর।’ তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি আপনার পরিচয়টি জানতে পারি?’

‘পারেন। আমার নাম মিসির আলি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন পার্ট টাইম শিক্ষক।’

আকন্দ সাহেব সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টানতে লাগলেন।

মিসির আলি বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, ঘটনার আকস্মিকতা আপনাকে কনফিউজ করে ফেলেছে এবং এটা যে আপনারই মেয়ে, তা আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।’

ভদ্রলোক কিছু বললেন না।

মিসির আলি বললেন, ‘একবার এই মেয়েটি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং জ্বরের ঘোরে বলতে থাকে–মামি ইট হার্টস, মামি ইট হার্টস–তখনই আমার প্রথম মনে হল —।’

মিসির আলি কথা বন্ধ করে আকন্দ সাহেবের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের মুখ রক্তশূন্য। মনে হচ্ছে এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। তারপর আনন্দ আর যন্ত্রণা একসঙ্গে মেশান গলায় আকন্দ সাহেব থেমে-থেমে বললেন, ‘খুব ছোটবেলায় হার্টের অসুখে কষ্ট পেত, তখন বলত. . . মামি ইট হার্টস।’ ওর নাভিতে একটি কালো জন্মদাগ আছে?’

‘আমি বলতে পারছি না। তবে এই মেয়ে আপনারই মেয়ে কি না, তা বোঝার একমাত্র উপায় হচ্ছে DNA টেস্ট। আপনার এবং এই মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করে সেটা বলে দেয়া সম্ভব। এটা একটা অভ্রান্ত পরীক্ষা।’

‘জানি। তার দরকার হবে না। আমি আমার মেয়েকে দেখলেই চিনতে পারব। আমি কি এখনই যেতে পারি আপনার সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ, পারেন।’

‘আমি আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিতে চাই।’

‘নিশ্চয়ই সঙ্গে নেবেন।’

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন! তাঁর সমস্ত মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। তিনি বললেন, ‘আপনি কী করেন?’ এই প্রশ্ন আগে একবার করা হয়েছে এবং তার জবাবও দেয়া হয়েছে। তবু মিসির আলি দ্বিতীয় বার জবাব দিলেন।

আকন্দ সাহেব কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমার মেয়েটি কী করে আপনার ওখানে?’

মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ‘ও আছে কাজের মেয়ে হিসেবে। ভাতটাত রেঁধে দেয়। বিনিময়ে খেতে পায় এবং থাকতে পায়।

ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন, যেন তিনি মিসির আলির কথা বুঝতে পারছেন না। তিনি ফিসফিস করে নিজের মনেই কয়েক বার বললেন, ‘কাজের মেয়ে! কাজের মেয়ে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *