মেসের বিছানায় শুয়ে সমস্ত লম্বা শীতের রাত এক-এক দিন বেশ ঘুম হয় তার। এক এক দিন ঘুম তেমন হয় না–বারান্দায় পায়চারি করতে থাকে। ইচ্ছে হয়, পরের দিনই বাড়িতে চলে যাবে সে; সকালবেলাও সেই ইচ্ছে থাকে। কিন্তু বেলা যত বাড়তে থাকে, ততই সেই ইচ্ছের অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারে সে, মেসের জীবনের থোড়-বড়ির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়।
।এক-এক দিন শেষ-রাতে গভীর অন্ধকার ও শীতের ভেতর ঘুমের বিছানা এত ভালো লাগে, জীবনের হৈ-হুটপাট রলরোল এত নিরর্থক মনে হয় যে, ভোরের আলোর কথা মনে করে ভয় করে তার।
মাঝে-মাঝে সে খুব সুন্দর স্বপ্ন দ্যাখে।
বোর্ডিং-এর অনেকগুলো রাত তার বেশ চমৎকার কেটে গেল। একটা জিনিস খুব ভালো লাগে এক জন ছিপছিপে লম্বা সুন্দর যুবক রোজ শেষ-রাতে নানারকম ইংরিজি বাংলা কবিতা আওড়াতে-আওড়াতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়; মাল্যবান আলোড়িত হয়ে ভাবে; এর জীবনে সমারোহ আছে বটে, কিন্তু সেটা ফিচেল জিনিস নয়, সত্যিই গভীর; ওর মতন জীবন পেলে হত।
সকালবেলা কুয়াশার ভেতর দিয়ে এক-একটা কাক মাল্যবানের বারান্দার রেলিং-এর ওপর উড়ে আসে, কুয়াশার এলোমেলো ছেড়া-ছেড়ার ভেতর দিয়ে ডানা মেলে গোলদীঘির দেবদারু নিমগাছের দিকে মিলিয়ে যায়; প্রকৃতির দিঙনির্ণয়ী মন নড়ে ওঠে যেন। কুহক অনুভব করে মাল্যবান। কিন্তু তবুও অতিপ্রাকৃত নয়—কী স্বাভাবিক ভাবে নিবিদ এই আলো পাখি আকাশের ভাষা।
একদিন সকালে একটা কাক মাল্যবানের রেলিং-এর ওপর এসে বসল। কাকটা ঘুরে বসে মাল্যবানের দিকে তাকিয়ে অনেক বার ডাকবার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই গলার ভেতর দিয়ে আওয়াজ বেরোল না পাখিটার। গলায় হিম লেগে স্বর বসে গেছে। আবার যে আওয়াজ ফিরে পাবে পাখিটা হয়তো তা বোঝে না। নিজের গলার আওয়াজ হারিয়ে না জানি কী সে ভাবছে। মাল্যবান তাকে একটা বিস্কুটের টুকরো ছুঁড়ে দিল। কাকটা ঘরের ভেতর ঢুকে বিস্কুটের টুকরো-টাকরা খাচ্ছে, কাগজপত্রের ভেতর খচখচ করে লাফাচ্ছে। মাল্যবানের ঘরে অনেকক্ষণ রইল কাকটা-কয়েক টুকরো বিস্কুট খেল।
হপ্তাখানেক পরে বোর্ডিং-এর বারান্দায় পায়চারি করতে-করতে মাল্যবান দেখল, গাঁটরি-বোঁচকা নিয়ে একজন ভদ্রলোক বোর্ডিং-এর একটা বড় অন্ধকার দুর্গন্ধ কামরায় চুপচাপ বসে আছে। যেমন কামরা, তেমন তার মানুষ—এ-দুজনের দিকে তাকালে জীবনের প্রত্যাশা ভরসা ভুইপটকা হয়ে ফুরিয়ে যায়। মাল্যবান কয়েকদিন দেখল, ভদ্রলোক চুপচাপ বসেই থাকেন শুধু, কারুর সঙ্গে কথা বলেন না, কিছু না। মাঝে-মাঝে চশমা এঁটে এক-আধটা বই তুলে নেন, কিন্তু পড়া যে বেশি দূর এগোয়, তা মনে হয় না।
একদিন ভদ্রলোকটির ঘরের ভেতর ঢুকে মাল্যবান বললে, কেমন আছেন?
নাকের ডগা থেকে চশমাটা কেমন একটা এলোমেলো টুনটুনির ঠ্যাঙের মতো খসিয়ে নিয়ে বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে দুটো চোখ কচলাতে কচলাতে বললেন ভদ্রলোক, আমার শরীর বিশেষ ভালো নেই।
কী হয়েছে?
এই কদিন থেকেই জ্বর—
তা, এ-ঘরে থাকেন কেন—
কোথায় থাকব আর?
পকেট থেকে জড়িবড়ি একটা ন্যাকড়ার নুড়ি বার করে চোখের পিচুটি পরিষ্কার করতে করতে ভদ্রলোকটি বললেন, স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই বাসা ছেড়ে দিয়েছি–
ওঃ!
এই মাস-পাঁচেক হল মারা গেছেন। পঁচিশ-তিরিশ বছর এক নাগাড়ে ঘর-সংসার করেছি। ছেলেপুলে নেই। এখন আর পোডড়া বাড়িতে মন টেকে না। পয়মন্তদের মুখ দেখতে চলে এলুম তাই—আপনাদের পাঁচজনের।
মাল্যবানকে শুধোলেন, আপনার স্ত্রী বেঁচে আছেন তো?
আছেন—আছেন—মাল্যবান কেঁপে-কেঁপে মন্ত্ৰপড়ার মতো করে বললে।
বাপের বাড়ি গেছেন বুঝি? মাল্যবান একটু থতমত খেয়ে বারান্দার রেলিং-এর দিকে, যেখানে কাকগুলো এসে বসত সে-দিকে; কুয়াশার যে শুড়িপথের ভেতর দিয়ে গোলদীঘির নিমগাছে উড়ে যেত তারা সে-দিক পানে, তাকিয়ে রইল।
বাস্তবিক, আমাদের অবস্থা আপনি বুঝবেন না,ভদ্রলোক কঁচাপাকা দাড়ির ওপর হাত রেখে বললেন, কেউ বোঝে না। আমার স্ত্রী একটা শাদা উলের গোলা হাতে করে হাসতে-হাসতে চলে গেলেন—
উলের পেটি?
হ্যাঁ, ভেস্ট বুনছিলেন আমার জন্যে—
ওঃ!
বুনছিলেন আশ্বিন মাসে দেশে শীত পড়বার আগে! গ্যালো শীতে গরম জামার অভাবে খুব কুঁদেছিলুম; না, তত বেশি কুঁদিনি বটে, আমি তো ছেলেমানুষ নই; তবে কোঁ-কোঁ করতুম খুব, সত্যিই ভারি শীতকোঁৎকা হয়ে গেছলুম, টের পেয়েছিলেন উনি। কাজেই এবারে উলের জামা বানিয়ে দিচ্ছিলেন—
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে বলেছিলেন যে তোমাকে দুদিনেই ভেস্ট বুনে দোব; বলে দিনরাত কুরুচ কাঁটা চালিয়ে যেতে লাগলেন। একুনে চারটে হাত, বুঝলেন মশাই, দুহাতে ভেস্ট বোনো, দুহাতে সংসারের ব্যাগার ঠ্যালো; বাটনা কুটনো রান্না, আমার চানের জন্যে গরম জল, আমার বাতকোমরে তেল মালিশ,ধনেশ পাখির তেল, আমার নাম বিপিন ঘোষ
বিপিনবাবু বললেন, সে আর এক হিস্ট্রি, আপনাকে পরে বলব কী করে ধনেশপাখির তেল জোগাড় হল; রাস্তায় যে ফিরি করে, বেড়ায়, সে-জিনিস নয়, খাঁটি মাল, এতেও আমার গিন্নির হাত ছিল—
গিন্নি বটে, বিপিন ঘোষের দিকে তাকাতে-তাকাতেই মাল্যবান তার চোখ দুটোকে হোঁৎ করে কড়িকাঠ ঘুরিয়ে এনে খুব একটা সার্থকতা বোধ করে বললে, এখেনে-সেখেনে পাঁচি খেদি, এর বউ ওর বউ—সব ভঁটো তোতাপুরি তো। আপনি হাড়েমাসে কিষেণভোগটা পেয়েছিলেন, দাদা, আহা-হা, চলে গেলেন!
আপনাদের পাঁচজনের আশীবাদে পেয়েছিলুম, বিপিনবাবুর কঁচা ঘায়ে খোচা লাগলেও নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, চলে গেছেন আপনাদের আশীর্বাদ মাথায় করে—
মাল্যবান অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, এ-কথা বলতে গিয়ে বিপিনবাবু একটুও টসকালেন না, কারখানার থেকে শিরা, গ্রন্থি, হৃৎপিণ্ড তৈরি করে এনেছে যেন লোকটা।
উলের জামা দু দিনেই শেষ করে এনেছিলেন প্রায়—এই এত বড় প্রমাণ-সাইজের ভেস্ট, দেখছেন তো আমার কেমন দশাসই চেহারা–
বিপিন ঘোষ পকেট থেকে এক বাক্স কাঁচি-সিগারেট বার করে মাল্যবানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন, স্যার–
নিজে একটা জ্বালিয়ে নিয়ে বললে, ভেস্ট বোনা শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় আমি তাকে সাত-পাঁচ একটু বিশেষ ঘরোয়া আলাপ—মানে, আমিই তাকে সেদিনকার রাত্তিরটার জন্যে আগের থেকে বায়না দিয়ে রাখছিলাম; কথায়-কথায় ওঁর কেমন বুননের ঘর ভুল হয়ে গেল—সমস্ত জামাটাকে খুলে ফেলতে হল আবার—
আহা!
আবার মরিয়া হয়ে আরম্ভ করলেন। তার ওপর রাতে কিছুটা অত্যাচার হলে সেই বায়নার কাজে; কাজটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল—প্রায় শেষ-রাত অব্দি। রক্তের চাপ বেড়ে গেল খুব। সকালবেলা একটু দেরিতে উঠে রোদে গিয়ে দাঁড়ালেন সেই উল আর কুরুচ কাঁচা নিয়ে। আমি একটা জলচকিতে বসেছিলুম মুখোমুখি। আমার সঙ্গে হেসে-হেসে কথা বলতে-বলতে, ব্যাস, ভিরমি খেয়ে পড়ে গেলেন। তখুনি হয়ে গেল—
বিপিন ঘোষ আর কোনো কথা বললেন না। একটা সিগারেট—দুটো সিগারেট—তিনটে সিগারেট শেষ করলেন তিনি। তারপরে মাল্যবানের দিকে তাকিয়ে নিজের গলার কণ্ঠাটার ওপর হাত রাখলেন বিপিন ঘোষ। চোখ দুটো অনবরত নাচতে লাগল তার। একটা জহরকোট গায়ে এঁটে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলেন তারপর।