১৭. প্রাণধারণের ব্যাপারে খারিজ

মাল্যবান প্রাণধারণের ব্যাপারে কেমন যেন খারিজ হয়ে নিচে নেমে গেল। কিছুই ভালো লাগছিল না তার।

স্ত্রীর গরজের কথা হচ্ছিল এতক্ষণ—মাল্যবান নিজের ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখল, বাস্তবিক, বাড়ির গিন্নির স্পৃহার সম্পূর্ণ অভাবের জন্যেই এই ঘরটা একেবারে হতচ্ছাড়া হয়ে রয়েছে—ওপরের ঘরের পরিপাটির পাশে এ-ঘরটা কেমন থুবড়ি খেয়ে পড়ে আছে।

মনটা তার সেকেন্ডখানেকের জন্যে একটা মোচড় দিয়ে উঠল, কেন সে এমন ঘরে পড়ে থাকবে? সমস্ত ঘরগুলোর ভাড়াই কি সে দেয় না? সমস্ত সংসারটাই তো তার টাকায় চলছে। কিন্তু তবুও–

সে ঘর গোছাতে মন দিল।

কেরোসিন-কাঠের টেবিলগুলো বাইরে বার করে দিল, আলমারিটা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করল, ঝাড় মেরে চারদিকের ঝুল ঝেড়ে নিল, মাকড়সার জলা সাফ করল, অনেক আরশোলা ঝেটিয়ে বার করলে, (ফ্লিট, ডিডিটি হাতের কাছে ছিল না কিছুই), পায়ে পিষে মেরে ফেলল, ধোপার জন্যে অপেক্ষা না করে কাপড়ের উঁই সে নিজে কাচবে ঠিক করে ফেলল, জরুলকাঠের ছোট্ট টেবিলটার ওপর পরিষ্কার খবরের কাগজ পাতল, ভাব বিকেলে একটা কালো জমকালো টেবিলক্লথ কিনে আনবে, একটা ফুলদানী আনবে, কতকগুলো ফুল, দেয়ালে টাঙানোর জন্যে একটি কি-দুটি ছিমছাম ছবি।

তাড়াতাড়ি চান করে খেয়ে অফিসে গেল পরদিন সকালবেলা। অফিস থেকে ফিরে আসবার সময়ে দরকারী জিনিসগুলো কিনে আনল টেবিলের কাপড়, ফুলদানী—

ঘরটাকে ঘণ্টা-দুই ধরে সাজাল সে। বাইরে তাকিয়ে দেখল, রাত বেশ অন্ধকার। এই শীতের ভেতর চান করার চৌবাচ্চাটা এখন কেউ ব্যবহার করতে আসে না। ওখানে গা ঢাকা দিয়ে যদি সে কাপড় কাচতে বসে, তাহলে বড় একটা কেউ টের পাবে না। রাত দশটা পর্যন্ত প্রায় কাপড় কাচা হল।

উৎপলার ঘরে হিমাংশু, শ্রীরঙ্গ ইত্যাদি কয়েকজন এসেছিল; বেহালার গৎ বাজছিল; উৎপলা নিজে গান শোনাচ্ছে—আরো শোনাবে—বেহালা আরো বাজবে—ওরা (কোরাসে) গাইবে;–মাল্যবানের কাছে এ একটা নিস্তারের মতো মনে হল; গান-বাজনা যত রাত অব্দি চলে, ততই তার লাভ-কাপড়গুলো কেচে খাবার আগে সে একটু জিরিয়ে নিতে পারবে।

কেচে, নিংড়ে কাপড়গুলো সে গোটা দুই বালতি ঠেসে রেখে দিয়ে, চান সেরে, টেরি কেটে, বিছানায় এসে শুল। একটা চুরুট দাঁতে আটকে নিয়ে সুশৃঙ্খল সংযমী জীবনের শান্তি ধীরে-ধীরে উপভোগ করছিল। কিন্তু একটা চুরুট—দুটো চুরুট ফুরোল–অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল সে, তবুও খাবারের ডাক পড়ল না। আরো অনেকক্ষণ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতে হল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। মাল্যবান ধড়মড় করে উঠে পড়ল তারপর, বিছানায় কাৎ হয়ে শুয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ, উঠে বসল তারপর, ঠাকুরকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললে, কৈ, এখনও গান চলছে যে—

গান আমাদের বাড়িতে নয়।

তবে?

পাশের বাড়িতে কোথায়—

মাল্যবান একটু কান পেতে শুনে বললে, ও, তাই তো, এ যে কলের গান।

ওপরের ঘর নিথারপাথরের মতো চুপ হয়ে আছে বটে। মাল্যবান সিঁড়ি ভেঙে ওপরে যাচ্ছিল।

ঠাকুর বললে, দিদিমণি আর মা ঘুমিয়েছেন।

তাই নাকি? তুমি তো আজ অনেক রাত অব্দি আছ, ঠাকুর। ব্যাপার কী? ওরা খেল না?

খেয়েছেন?

কখন?

দুটো বাবুর সঙ্গে খেয়ে নিয়েছেন—

মাল্যবান একটু চুপ থেকে বললে, আমার ভাত আছে তো?

তা আছে। আপনাকে এখানে এনে দিই?

বেশি কিছু দিয়ো না। কেমন গা-বমি-বমি করছে—

অল্প কয়েক গ্রাস খেয়ে সে উঠল। ঝি এঁটো নিকিয়ে থাকা বের করে চলে গেল। ঝি, ঠাকুর বাড়ি চলে গেল।

মাল্যবানের কেমন উল্টে বমি আসছিল। সে দরজা বন্ধ করে কতকগুলো কাগজ পেতে অনেকক্ষণ ধরে হড়-হড় করে বমি করল, অনেক বমি।

মাকে মনে পড়ছিল শুধু তার। অবাক হয়ে ভাবছিল এই ঘরেই আছেন তিনি—এই অন্ধকারের ভেতরেই দাঁড়িয়ে আছেন বোধ করি; হয়তো আমার বিছানার পাশে এসে বসেছেন; গায়ে বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন; দিচ্ছেন হয়তো

মাল্যবানের মনে হল : উৎপলাও তো মনুর মামা তো সে; মাল্যবানের মায়ের মতন বড়ও হয়ে উঠবে এক দিন। নিজের মায়ের সঙ্গে এই মাকে মিলিয়ে ফেলে বৃষ্টির ছিপছিপে ছটফটে জল যেমন পুকুরের সমাহিত সঞ্চিত জলের শান্ত স্বরূপের ভেতর মিশে যায়, তেম্নি একটা অব্যাহত মাতৃত্বের সদাত্মাকে চাচ্ছিল যেন সে। তার নিজের মাযে নেই আজ, দশ-বারো বছর আগে নিমতলা ঘাটে যাকে ছাই হয়ে যেতে দেখেছিল মাল্যবান-মাল্যবানের মায়ের অব্যক্ত ইঙ্গিতের মৃত্যু হয়নি তো তবু—ধারণ বহন করবার জন্যে অপর নারী এসেছে এই ঘরে; মা হয়েছে; মনুর মা। মাল্যবান আজ মনুর মার স্বামী ঠিক নয়; মাল্যবানের সেই মৃত মা ও জীবিত উৎপলা—এই দুটি নারীকে একজনের মতন—মায়ের মতন—তার ঘরের ভেতর খুঁজে পাবার জন্যে কেমন অদ্ভুত বিশালাক্ষ অস্বস্তিতে সে চারিদিকে তাকাতে লাগল; —আসুক নিজের মায়ের মূর্তিতে, কিংবা আসুক উৎপলার বেশে-দুজনের ভেতরেই দুজনকে খুঁজে পাবে সে-পাবে এক জন মাকে—মাতৃত্ব : যা একক মাল্যবান পাবে তার কামস্পর্শহীন জায়াঘ্রাণহীন আনন্ত্যকে। মাল্যবান কয়েকবার ডাক ছেড়ে অস্পষ্ট ভাবে ডাকলও—মাকে, ঠাকুরকে, ঝিকে—মনুর মাকে, না, উৎপলাকে, ঠিক বোঝা গেল না।

আস্তে আস্তে কমে গেল—থেমে গেল বমির চাড় মাল্যবানের।

মাল্যবান একটু ভড়কে গিয়ে তাকিয়ে দেখল, উৎপলা এসে দাঁড়িয়েছে।

ঠাকুর বাড়ি চলে যাবার সময়ে আমাকে বলল, তুমি বমি করছ। বমি হল কেন?

কী জানি।

কী খেয়ছিলে?

কিচ্ছু না, শুধু ভাত।

বাজারের খাবার-টাবার?

না তো।

উৎপলা বললে, আর বমি হবে বলে মনে হচ্ছে?

না বোধ হয়।

পেটে ব্যথা আছে?

না, সে-সব কিছু নেই।

আচ্ছা, শোও, শুয়ে পড়। আমি বাতাস করছি।

মাল্যবান খানিকক্ষণ বালিশে মাথা রেখে বাতাস খেয়ে বলল, ভালো লাগছে। এখন।

যে মা হয়েছে, মাল্যবান বললে, সে মানুষের শিয়রে না এসে পারে না। তুমি মনুর মা বটে, আমার স্ত্রী। কিন্তু সময়ের কোনো শেষ নেই তো, সেই সময়ের ভেতর আমাদের বাস; সময়ের হাত এসে এখানে এ-জিনিসটা মুছে দ্যায়—সেখানে সে জিনিসটা জাগিয়ে দ্যায়; মানুষের স্ত্রী তুমি; নিজেও তো মানুষের মা, মানুষ; সময়ের নিরবচ্ছিন্ন বহতার ভেতর তোমার মা-রূপ ফুটে উঠল তো; দেখছি। সময়ের দু-একটা ঘূর্ণিকে কেমন অভিরাম গ্রন্থির বলয়ে নিয়ে এসে গড়ে তুললে, দেখছি তো। এই তো নিচের নেমে এসে হাড়-এলিয়ে শীতের রাতে, সিঁড়ি বেয়ে না এলেও তো পারতে। আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত আশাও করিনি যে, তুমি আসবে। কিন্তু তবুও তো এলে—

উৎপলার বাঁ-হাতের দুচারটে আঙুলের দিকে ঝোক গেল মাল্যবানের। কিন্তু সে-আঙুল কটি বিশেষ কোনো সাড়া দিল না। নিজের ভাবুকতা আন্তরিকতার আত্মম্মন্যতা নিয়ে মাল্যবান এত বেশি তলিয়ে গিয়েছিল যে, স্ত্রীর আঙুল কটির রহস্য ছাঁকবার জন্যে কোনো তাড়া ছিল না তার। রহস্যকে কঠিন আলোর মতো পরিষ্কার করে বুঝে দেখবার শক্তিও সময়পুরুষ তাকে দেয়নি; অনেক বিষয়েই বেচারী অন্ধ অবোধ বলে পোডড়া ঘরের চামচিকের মতো হৰ্ষকম্পাথিত। কিন্তু মাল্যবানের অবকল্পনা আছে, অবপ্রতিভাও; সে-জিনিসটা খুব নিয়ন্ত্রিত নয় যদিও। কাজেই চেতনার একটি সূর্যের বদলে অবচেতনার অন্তহীন নক্ষত্র পেয়েছে সে। পাঁচ ইন্দ্রিয়ের ওপর আরো একটি ইন্দ্রিয় আছে খুব সম্ভব মাল্যবানের। বিজ্ঞানে থাকে বলে চতুর্থ-বিস্তার, সেই চাতুর্যের দেশেও বাস করে। কাজেই মা ও মাতৃত্বের ঐ দিব্য কেন্দ্র তার নজরে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ও-সব শিখরে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না সে, শীগগিরই ধ্বসে ভেঙে পড়ে গেল সে তার ছোট সংস্কারের ছোট সংসারে স্বামী স্ত্রী কামনা লিপ্সা হতাশার ঘূর্ণিফেনার ভেতর।

উৎপলার হাতপাখা আবেগে নড়েনি কখনো; সবেগে নড়ছিল কিছুক্ষণ আগে। এখন ক্রমে-ক্রমেই ঢিলে হয়ে আসছিল।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, একা থাকলে বেশ হত। কেউ-কেউ একা থাকে বটে, যেমন আমাদের হেডমাস্টারমশাই চিরটা কাল কাটিয়ে গেলেন, কিন্তু শেষ বয়েসে তাকে বেগ পেতে হয়েছিল। মেয়েদের দর্শন দিতেন বটে, কিন্তু সাধুপুরুষ, স্ত্রীলোকের দর্শন পাবার জন্যেই ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। লালসা জন্মাল। মেয়েরা ভালো মনে করে সেবা করবার জন্যে হেডমাস্টার মশাইর হাত-পা টিপে দিত রোজ, উনিও ক্রমে-ক্রমে গোপনে সুবিধে পেয়ে তাদের গলা টিপতে আরম্ভ করে দিলেন। গড়াল কেলেঙ্কারি অনেক দূর। বিয়ে হল না তবু ছেলে হল, মেয়ে হল। তবুও সিদ্ধপুরুষ রইলেন। হেডমাস্টারমশাইর চিতের ওপর ও অঞ্চলের সব চেয়ে বড় মঠ। নৌকোর ছইয়ের ওপর বসে কতো মাইল দূরের থেকে সে-মঠ দেখা যায়…

মাল্যবান কথা বলে যাচ্ছিল গভীর বৃষ্টির রাত কিছুক্ষণের জন্যে বাতবর্ষণ হলে পাড়াগাঁর নালায় পুকুরে খালে কল-কল শব্দে চলে যেতে যেতে নিজের সাথে নিজে যেমন কথা বলে চলে জল।

বাতাস করতে-করতে উৎপলার হাত ব্যথা হয়ে উঠল, কিন্তু মাল্যবানের দিক থেকে কোনো নিষেধ নেই। বেশি কথা বলে মাল্যবান বেশি ফেনিয়ে ওঠে, মাঝে-মাঝে গাজায়, নিজেকে নিয়ে নিজেকে উপভোগ করবার দুর্ভোগ ভোগাবার বেশ ক্ষমতা আছে; ধ্বেৎ, ভালো লাগে না আমার, এক-এক সময় অবিশ্যি আমাকেও অবশ করে ফ্যালে—যেমন মনু হবার আগে। কিন্তু ভালো লাগে না আর আজ-কাল পুৎ!

পাখাটা বিছানার পাশে রেখে দিয়ে উৎপলা বললে, বমি তো করলে, কিন্তু এখন ওষুধের ব্যবস্থা কী করা হবে?

সে-জন্যে তোমার কোনো ভাবনা নেই, পলা।

ওষুধ আছে?

না।

তবে?

ওষুধ আমার লাগবে না। কেমন পেটে মোচড় খেল, বমি হয়ে গেল, ব্যস। সে-রকম বেশি কিছু হলে শরীরের আক্ষেপটা এত তাড়াতাড়ি পড়ে যেত না।

বলা যায় না কিছু। ওষুধ নেই। ডাক্তারের ব্যবস্থাই বা কে করবে।

না, না, অসুখ নয় তো, একটু হায়রাণি হয়েছিল, মাল্যবান একটু আলোড়িত হয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করে শেষমেশ শুয়ে থাকতে-থাকতেই বললে, সেরে গেছে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঠিক হয়ে যাবে সব।

এ-বাড়িতে কোনো পুরুষমানুষ নেই, টক বিরস মুখে উৎপলা বললে, অসুখ-বিসুখের সময়ে নানা রকম অসুবিধে। ডাক্তার ডাকে কেরাত জাগে কে।

মাল্যবান স্ত্রীর মুখে খিঁচুনিটাকে ইস্ত্রি করে পালিশ করে দেবার জন্যে খুব স্নিগ্ধ ভাবে বললে, এবার একজন সরকারের মতন রাখব ভাবছি; মনুকেও পড়াবে; প্রাইভেট-মাস্টার বাজার সরকার ঘরের বাইরের দশ রকম ফাইফরমাস—সবই চলবে।

কিন্তু, আজকের রাতে কে জাগে–

বোসো, তুমি খানিকটা সময় বসে যাও; নিজের থেকেই ঘুমিয়ে পড়ব। উৎপলা হাত গুটিয়ে গুম হয়ে বসে রইল।

কেটে গেল খানিকটা সময়। কেউ কোনো কথা বলছে না। কারু কোনো কাজ করতে হবে মনে হচ্ছে। ভালো লাগছে না কারুরই। কেমন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। সময় কেটে গেল আরো।

চুপচাপ যে?

কী করতে হবে?

বাতাস করছিলে তো—

উৎপলা উঠে দাঁড়াল। বাতি জ্বালিয়ে ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে বললে, এ বালতি দুটো ভিজে কাপড়ে ঠেসে রেখেছে কে?

একটা বালতি তুলে সমস্ত কাপড় মেঝের ওপর ঢেলে ফেলে দিয়ে চৌবাচ্চার দিকে চলে গেল।

ওগুলো কাচা কাপড় ছিল, মাটিতে ফেলে দিলে— মাল্যবান তাকিয়ে দেখল ননাংরা কাদায় মাটিতে গড়াচ্ছে, কাপড়গুলো পায়ে মাড়িয়ে-মাড়িয়ে উৎপলা চলে গেছে। চৌবাচ্চার থেকে এক বালতি জল এনে হিসসো করে ছড়িয়ে ছিল উৎপলা; আরো এক বালতি ঢেলে ছড়িয়ে মরিয়া হয়ে তাকিয়ে দেখল, বমি সাফ করতে আরো অন্তত দু বালতি জলের দরকার। উৎপলার লোকায়ত মন, আর যা লোকয়ত নয়, অথচ গভীরতর যা—লোকায়েতকে চালাচ্ছে—এই শীতের দুপুর-রাতে হাত-পায়ের চেয়েও ঢের বেশি টনটন করে উঠল সেসব জিনিস।

শেষ বালতি জল এনে ঘরের ভেতর ঢেলে দিল উৎপলা; তারপরে মাল্যবানের একটা সাবানে-কাচা ভিজে ধুতি নিয়ে জায়গাটা নিকোতে লাগল।

কেন তুমি নিকোচ্ছ তোমার নিজের হাতে, আহা, থাক না! মাল্যবান বললে। আনাড়ি ছেলের হাতে কলাপাতার বাঁশীর মতো কেমন কাহিল ভাবে কেঁপে-কেঁপে চিরে গিয়ে বেজে উঠে মাল্যবান আবার বললে, ঠিক হল না, ঠিক হল না, আমার ধুতিটা তুমি রেখে দাও—আমি নোংরা মুছবার জন্যে তোমাকে জিনিস দিচ্ছি।

কলাপাতার বাঁশী কেঁপে কেঁড়ে গিয়ে বললে, বাঃ, উৎপলা, আমার ধুতিটা লোপাট করলে–এই তো আজ সন্ধ্যেবেলা খিদিরপুরের সাবান দিয়ে কেচেছি।

উৎপলা ঘাড় গুঁজে মেঝে পরিষ্কার করতে-করতে ঘরের কোণের একটা ড্রেনের দিকে সমস্ত বের করে দিচ্ছিল,—হাত দিয়ে নয়, মাল্যবানের ধুতিটা পায়ে খানিকটা জড়িয়ে নিয়ে পা চালিয়ে কাজ করছিল সে; কাজ করে যেতে লাগল কোনো জবাব দিল না। এ-রকম সব কাজ তার করবার কথা নয়, শীতের রাতে তো নয়ই, কিছুতেই করত না সে এ-কাজ। কিন্তু কেমন যেন ভূতে তাড়িয়ে এনেছে তাকে। তাই নিচে নেমে এসেছে সে, এমন একটা বিশ্রী ছোঁয়াছানার কাজ করছে—হোক না পা। দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় যা মেরে পিটিয়েও কেউ করাতে পারত না তাকে দিয়ে। ভূতেই পেয়েছে তাকে, চিমড়ে ভূতে পেয়েছে: স্তম্ভিত হয়ে পা ডলছিল আর ভাবছিল উৎপলা।

উৎপলার (মন্থনদণ্ডের মতো) পায়ে জড়ানোে ধুতিটার কাদা বমি লোকসানির দিকে তাকিয়ে মাল্যবান কী যেন কেমন যেন হয়ে গিয়ে বলতে লাগল, করিম ভাই মিলের সুন্দর ধুতিটা—এই দিন পনেরো আগে কিনেছি—তার তুমি এই অবস্থা করলে—এ তো পরাও যাবে না আর।

কিন্তু ধুতি আরো একটা লাগল উৎপলার—সেটা ক্যালিকো মিলের। মাল্যবানের ভেতরের শাঁসটাই মোচড় দিয়ে উঠল। এক মাসের মাইনের চেয়ে যে-সব লোকের একটা ধুতি বা চাদরকে এক-এক সময়ে ঢের বেশি দামী, দরকারী মনে হয়, মাল্যবান সেই ধরণের মানুষ। কাজেই, অনেক কুণ্ঠা, আক্ষেপ, কাতরতার পরিচয় দিল সে, অনেক ছোট ছেদো কথা বললে; কিন্তু সব সময়েই গলা তার হেমন্তের দুপুরে একটা নিঃসঙ্গ উড়চুঙার মতো মিন-মিন ফির-ফির ঝিন-ঝিন করছিল, কাতর করুণ, ঝঝ নেই, উত্মা নেই।

উৎপলার হাসি পাচ্ছিল—মাঝে-মাঝে দয়া হচ্ছিল তার লোকটার জন্যে, মানুষটাকে খানিকটা নিষ্পেষিত করবার জন্যেই তার ভালো-ভালো দুটো ধুতি দিয়ে নোংরা জায়গাটা সে নিকিয়েছে—এ-কথা মনে করে নির্যাতন করবার শখ এখন তার খানিকটা কমে গেল যেন—কাপড় দুটো লাথিয়ে লাগিয়ে ঘর থেকে বার করে দিল উৎপলা।

যা হবার হয়ে গেছে, মাল্যবান মনে খুব বল, খুব সৎ সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে বললে, এ নিয়ে তুমি মন খারাপ করতে যেয়ো না। যেন কঠিন যত্নে নিয়ন্ত্রিত জীবনের দীনতা ও আত্মশুদ্ধির গহুর থেকে (মনে হচ্ছিল উৎপলার) মাল্যবান কথা বলছে।

কুলুঙ্গির থেকে সাবান নিয়ে উৎপলা হাত কচলাচ্ছিল—হাত পা ঘাড় মুখ ধুয়ে আসবে সে।

কোথায় সরালে কাপড় দুটো? চুরি যাবে না তো?

এ-দিককার দরজা তো বন্ধ; তবে পাশের বাড়ির ঝি-চাকর ছাদের সিড়ি দিয়ে উঠা-নামা করে সারারাত। দেখতে পেলে ওরা নিয়ে যাবে হয়তো।

নিয়ে যাবে?—ঘরের ভেতর রেখে দেবে না তুমি ধুতিগুলো?

কোনো কথা না বলে চৌবাচ্চার থেকে হাত পা ঘাড় মুখ খুব ভালো করে ধুয়ে এল উৎপলা। মাল্যবানের বাক্সের থেকে একটা ধোপাবাড়ির ফেরৎ তোয়ালে বের করে উৎপলা বেশ ভোয়াজ করে রগড়েরগড়ে হাত পা মুখ পিঠ মুছে ফেলতে লাগল। তারপর স্লিপার পায়ে গলিয়ে ওপরে যাবার উদ্যোগ করতে লাগল।

আমর বিছানার পাশে এসে বোসো-না।

না, আমি আর বসব না। এ কি, এ যে স্লিপার পায়ে দিয়েছি। আমার জুতো কোথায় গেল? ইশ, মশা কামড়াচ্ছে। যাক, চলি—উৎপলা বললে।

আচ্ছা, এসো–ঘুমোও গিয়ে।

শেষ রাতের একটা বসন্তবউরি পাখির মতো এক রাশ নক্ষত্র ও অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বার আগে একটু চলকে উঠে হেসে জেগে উঠবার বেঁচে থাকবার ইচ্ছা অনিচ্ছা অতিক্রম করে (মাল্যবানের মনে হল) কে যেন উক্রান্ত হয়ে গেল। সে কি উৎপলা? একটা চুরুট জ্বালিয়ে মাল্যবান নিজেকে বললে, না, সে উৎপলা নয়; উৎপলাতে মাল্যবান যে-জিনিস আরোপ করেছে, সেই অশরীরী আত্মাটা—নেই; ছিল না; এই মুহূর্তেই সরে গেল তবু; ওপরের দিকে ওপরের ঘরে যাবার অছিলায় আরো ওপরে—বড় বাতাসে শীত রাতের ঘুরুনো সিঁড়ির শীর্ষে নক্ষত্রে মিশে গেল কোথায়।

পর-দিন রাতে ওপরের ঘরে মাল্যবান বলছিল উৎপলাকে, তোমার এই খাটটা ঢের বড়।

হ্যাঁ, বাবা দিয়েছিলেন আমাদের বিয়ের সময়ে। বরপক্ষকে ঠকাবার মতলব ছিল তো তাঁর।

আমি তা বলছি না।

উৎপলা ধোপদুরস্ত বিছানার পাট-পাট করে পাতছিল—কোনো কথা না বলে হাতের কাজ করে যেতে লাগল।

আমি ভাবছিলাম, দুজন বাড়ন্ত লোক এ-খাটে বেশ এঁটে যায়।

তা যায়, তাতে কী।

আজ রাতে এখাটে আমি শুলেও তো পারি; পারি না?

তাহলে আমাকে নিচের ঘরের খাটে যেতে হয়।

কেন যাবে? মাল্যবান উৎপলাকে ভেদ করে কোনো শ্রেয়োতর আত্মার দিকে তাকিয়ে যেন বললে, আমার পাশে শুয়ে থাকবে।

যা নয়, তাই। শান্ত দৃঢ়তায় বললে উৎপলা; কৃতী অভিভাবিকার মতো ঠোঁট চেপে, দাঁত চেপে।

তোমার মেজদা আর বৌঠান তো এ-খাটেই শোবে। দু-জন।

তা তারা শুয়ে শান্তি পায়।

মাল্যবান একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললে, আমরা পাব না?

চাইলেই ভোগে লাগে না। উৎপলা মনুকে নয়, মাল্যবানকেই বললে।

তা বটে। মাল্যবান হাতের পানটা মুখে তুলবার ভরসা পেল না আর। সিগারেটটাও না খেয়ে জানালার ভেতর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল—জ্বলন্ত সিগারেটটা

বললে, এ-রকমই যদি হল, তাহলে ফুটপাথে গিয়ে শুয়ে পড়ে থাকলেই পারি।

পরিপাটি বিছানাপাতা শেষ করে উৎপলা বললে, ফুটপাথে তুমি কোনো দিন শোবে না। তবে একদিন শুয়ে দেখলে পার। যাও-না, আজই যাও।

আমি ফুটপাথে শুলে খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠবে তোমার মুখ?

তুমি তো নিজেই বলছ, ফুটপাথে আর ভদ্রলোকের বিছানায় কোনো তফাৎ নেই–

দেখছি তো নেই। কেন নেই? কেন নেই সেটা তুমি আমাকে নিজের বুকের ওপর হাত রেখে বলবে?

বলবার যখন, তখন বলা হবে, উৎপলা বললে, কিন্তু ফুটপাথে শোয়ার কী হল?

যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে শুতে আমরা খুব আপত্তি নেই।

উৎপলা মশারী টাঙিয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে বললে, আপত্তি নেই, ৩াহলে বাধাটা কীসের?

মাল্যবান চকমকি ঠুকে আবার একটা সিগারেট জ্বেলে নিয়ে বলে, যাচ্ছি আমি শুতে—

কোথায়? তোমার নিজের ঘরে?

না–

ফুটপাথে? যাও বললে উৎপলা ঘুমের লতায়-পাতায়-তন্তুতে জড়িয়ে যেতে-যেতে কাছের থেকে দূরে চলে যেতে-যেতে যেন।

এসো, দেখে যাও। দেখবে না?

সে আমার দেখা আছে, বলে পাশ ফিরল; ফিরে শুয়ে লেপটা ভালো করে জড়িয়ে নিতে-না-নিতেই ঘুমিয়ে পড়ল উৎপলা।

নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ শুনে মাল্যবান টের পেল একটা নিবিড় বেড়ালের চেয়েও গভীর আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েমানুষটি—তুলোর গরম আর শীতের ঠাণ্ডা খুব প্রবল ভাবে মিশ খেলেই হল—কেনো পুরুষমানুষের স্পর্শের দরকার নেই, উৎপলার–

মাল্যবান নিচে চলে গেল।

এক ঘুমের পর মাঝরাতের শীতে—গরমে–নিজের বিছানাটা মন্দ লাগছিল না তার। মাল্যবানের মনে হল, মানুষের মন সারাটা দিনরাতের প্রথম দিকটায়ও–বোকা হ্যাংলার মতো চায়—অপেক্ষা করে, সাধনা করে, যেন নিজের কিছু নেই তার, অন্যে .এসে দেবে তাকে, তবে হবে। কিন্তু গভীর রাতে বিছানায় শরীরই তো স্বাদ। শরীরটাই তো সব দেয়। মন কী? মন কে? মন কিছু নয়। বেশ নিবিড় শীতের রাতে চমৎকার শরীরের স্বাদ পাচ্ছিল মাল্যবান।

পুরুষের সঙ্গে সংস্পর্শ ঘুচিয়েছে বটে উৎপলা, কিন্তু তাই বলে শরীরের স্বাদের সঙ্গে নয়। দোতলায় গভীর রাতে তার নিজের বিছানায় আশ্চর্য স্বাদ উপলব্ধি করছিল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *