২০
ভুবনডাঙা খানিক থমথমে হয়ে আছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যতটা সম্ভব মহিতোষ মাস্টারের বাড়িতে তার দখল পাকাপোক্ত করেছেন। তিনি আসলে দেখতে চাইছেন এই বাড়ি কিংবা জমি নিয়ে অন্য কেউ দাবি জানাতে আসে কী না। এখন পর্যন্ত অবশ্য সেকরম কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে এতে করে তিনি আরো বেশি বিভ্রান্ত বোধ করছেন। এই এত বড় বাড়ি, শানবাঁধানো পুকুর, ফলবতী বৃক্ষ, ফসলের জমি এভাবে ফেলে রেখে কেউ চলে যেতে পারে, এ তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এ কারণেই খানিক আড়ম্বর করেই মহিতোষ মাস্টারের ভিটে দখলে নিয়েছেন তিনি। বাড়ির সামনে এবং জমিতে বড় করে সাইনবোর্ড টানিয়েছেন, ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।
কেউ যদি গোপনে মহিতোষ মাস্টারের কাছ থেকে এসব জমি-জমা কিনে নিয়েও থাকে, তবে তার এতক্ষণে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসার কথা। কিন্তু সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কেউ এলো না। বিষয়টা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে আরো বেশি অস্বস্তি দিতে লাগল। নিজেকে অন্ধকার এক কানাগলিতে আটকে পড়া বিভ্রান্ত পথিক মনে হতে লাগল তার। যেন অদৃশ্য কোনো আতঙ্ক সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরছে।
এই অস্বস্তি কিংবা অস্থিরতা নিয়ে থাকা যায় না। তিনি তাই যেকোনো মূল্যে এর পেছনে লুকিয়ে থাকা আসল ঘটনাটি জানতে চান। জলিল খ, মোতাহার তালুকদার, তৈয়ব আকন সহ আশেপাশের গ্রামের আরো যারা এই মুহূর্তে এইসব জমি কেনার ক্ষমতা বা সাহস রাখেন, তারা কিনে থাকলে প্রকাশ্যেই এসে তার সামনে দাঁড়াতেন। কিন্তু যেহেতু আসেননি, তার মানে বিষয়টা গোলমেলে। বা এর পেছনে অন্য কেউ আছে। অন্য কিছু আছে। কিন্তু কে সে? কী? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অনেক ভেবে দেখেছেন, এমনকি আশরাফ খ কিনলেও লুকোছাপা কিছু করতেন না। তবে এই মুহূর্তে তার নিজের জমি-জমা নিয়েই যা সমস্যা, তাতে তারও এসব ঝামেলায় আসার কথা নয়। সেদিন এছাহাক অবশ্য বলল, একটা কথা বলি ভূঁইয়া সাব?
কী কথা?
আপনি রাগ না হইলে বলব।
আজকাল এছাহাকের কথা বেশির ভাগ সময়ই সহ্য হয় না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। মনে হয় সে বাইরে বাইরে নিজেকে যতটা করিকর্মা প্রমাণের চেষ্টা করে, আসলে ভেতরে ভেতরে ততটাই অকর্মণ্য। বরং অনেক গোছানো কাজেও শেষমুহূর্তে তালগোল পাকাতে ওস্তাদ সে। না হলে মহিতোষ মাস্টার কী করে তাকে এত বড় ফাঁকি দিয়ে গেল? অথচ দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা তার ওপর নজর রাখছে বলে নিশ্চিত করেছিল সে। বিষয়টা নিয়ে খুবই বিরক্ত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। এছাহাক বলল, আমার ধারণা মহিতোষ মাস্টার ভয় খাইয়া গেছিল।
কী খাইছিল? কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।
ভয়।
কী দিয়ে খাইছিল?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কথা যেন বুঝতে পারেনি এমন ভঙ্গিতে তাকাল এছাহাক। তারপর বলল, আপনার কথা বুঝি নাই ভূঁইয়া সাব।
মানুষ কিছু একটা খাইলে তার সঙ্গে তো শালুন-তরকারি কিছু লাগে। লাগে না?
জি।
ভাত খাইলে নুন লাগে। মাছ-মাংস, শাক-সবজি লাগে। তো মহিতোষ মাস্টার যে ভয় খাইছিল, কী দিয়ে খাইছিল? নুন-তরকারি কিছু লাগে নাই? না-কি খালি পানি দিয়ে খাইছিল? মুখ হা করে প্রথমে এক চিমটি ভয় মুখে দিল। তারপর এক ঢোক পানি। ব্যাস, গেলা হয়ে গেল। নাকি?
এছাহাক কথা বলল না। চুপ করে রইল। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল ভূঁইয়া সাহেব তাকে ব্যাঙ্গ করে কথাগুলো বলছেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, মহিতোষ মাস্টাররে তোমার কী মনে হয়?
কী আর মনে হইব? শান্তশিষ্ট মানুষ। এছাহাক সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল।
শান্তশিষ্ট মানুষ যে লেজ বিশিষ্ট হয়, এই কথা জানো?
এছাহাক আবারও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কথা ধরতে পারল না। সে দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে রইল। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, শোনো এছাহাক মিয়া। ময়-মুরুব্বিরা একটা কথা বলে, যেই নদী যত গভীর, সেই নদীর চলার শব্দ তত কম। এই কথা শুনছ?
জি।
এই কথার অর্থ বুঝছ?
এছাহাক বোঝেনি। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, গভীর পানির মাছের কথা শুনছ?
জি। শুনছি।
কী শুনছো?
গভীর পানির মাছ খুব চালাক হয়।
হুম। এই তো বুঝছো। কিন্তু যেটা বোঝো নাই, সেটা শোনো। মহিতোষ মাস্টার গভীর পানির মাছ না। সে হলো গভীর পানি। তার গভীরে যে মাছ থাকে, তারে আমরা চালাক মাছ বলি। তাহলে সে নিজে কী?
এছাহাক এই প্রশ্নের জবাব দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, কী, এখনো বোঝো নাই?
জি বুঝেছি।
তো গভীর পানিতে যে স্রোত থাকে, সেই স্রোত কিন্তু দূর থেকে দেখে বোঝা যায় না। টের পাওয়া যায় না। মনে হয় শান্ত, স্থির পানি। কিন্তু ওই পানির আসল স্রোত বা গভীরতা বুঝতে হলে পানিতে নামতে হয়। তুমি নামছিলা পানিতে?
জি না।
তুমি কী করছিলা? তার মেয়েদের দিকে শকুনের চোখ কইরা তাকাই ছিলা। আর এই ফাঁকে সে যা করার করছে। পাখি উড়াল দিছে। আমরা এখন শূন্য খাঁচা ধরে বসে আছি। আমাদের চাইতে বোকা আর কেউ আছে?
জি না।
রাগে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মাথার তালু ফেটে যাচ্ছে। তিনি অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন। তারপর বললেন, এখন বলো কী বলতে চাইছিলা?
খানিক আগের উদ্যমটুকু আর অবশিষ্ট নেই এছাহাকের মধ্যে। তবে এই মুহূর্তে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে রাগাতেও চায় না সে। এখন নীরব থাকলে বিপদ। সে বলল, মাস্টার সাব হয়তো কোনো কারণে পালাই গেছিল।
কী কারণে?
ভয়ে।
কীসের ভয়?
এই যে আমরা রাত-বিরাতে তার টিনের চালে ঢিল ছুঁড়তাম। তার স্ত্রী মেয়েদের নিয়া আজেবাজে কথা বলতাম। এই কারণে।
তো তাহলে আরো আগে কেন গেল না সে? এইগুলাতো বহুদিন ধরেই করতেছো?
এছাহাকের কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, শোনো এছাহাক। সে আসলে আমাদের সবাইরে বোকা বানিয়েছে। আমরা ভাবছি সে সহজ-সরল, ভীরু একজন মানুষ। সারাক্ষণ আমাদের ভয়ে কাঁপতে থাকে। আসলে ঘটনা উল্টা। সে আসলে এসবের ভান ধরেছিল। ভান ধরে তার জমিজমার কোনো একটা ব্যবস্থা করেছে। বাড়ির দামি জিনিসপত্র সব সরাই ফেলছে। তারপর সময় সুযোগ বুঝে আমাদের বোকা বানাই পালাইছে।
কী ব্যবস্থা করেছে। কারো কাছে যদি সে জমি-জিরাত বেচে যেত, তাহলে সেই লোক এতক্ষণে ছুটে আসত না? কেউ কি কারো পয়সা দিয়ে কেনা জমি অন্যরে এমনি এমনি মাগনা দখল নিতে দেয়?
তোমার কী মনে হয়? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার পাল্টা প্রশ্নে আবারও ঘাবড়ে গেল এছাহাক। সে বলল, না, দেয় না।
তাহলে মহিতোষ মাস্টার কোন যুক্তিতে তার বাপ-দাদার এই পরিমাণ সম্পত্তি আমাদের জন্য বিনা পয়সায় এভাবে ফেলে রেখে যাবে? বলো?
এছাহাক কিছু বলতে গিয়েও কথা খুঁজে পেল না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, আমি কোনো কিছুর কোনো কূল-কিনারা পাইতেছি না এছাহাক। এই ঘটনার পেছনে বড় কোনো ঘটনা আছে। সেই ঘটনা খুঁজে বের করার আগ পর্যন্ত আমার শান্তি নাই। তুমি ওহাব ডাক্তারের বাড়িতে আর গেছিলা?
জি গেছিলাম।
কী বলে সে?
ফরিদ এখনো ফেরে নাই। কোনো খবরও পাঠায় নাই।
সে জানেও না ফরিদ কই গেছে?
না।
তোমার কী মনে হয়, ফরিদ কই গেছে?
এই প্রশ্নের উত্তরও এছাহাকের কাছে নেই। বিষয়টি নিয়ে যে সে ভাবেনি তা নয়। কিন্তু অনেক ভেবেচিন্তেও এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা সে খুঁজে পায়নি। ফরিদ মহিতোষ মাস্টারদের সঙ্গে কেন যাবে? কোথায় যাবে? কিংবা মহিতোষ মাস্টারই বা কেন তাকে সঙ্গে করে নিতে চাইবেন? তিনি নিশ্চয়ই তার মেয়ের সঙ্গে মুসলমান কোনো ছেলের বিয়ে দেবেন না! তাহলে?
এখানে এসেই আটকে যাচ্ছে সকলে। তবে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার দৃঢ় বিশ্বাস এই ব্যাপারে যদি সামান্য কিছুও কেউ জেনে থাকে তবে তিনি ওহাব ডাক্তার। তিনি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই গুহাব ডাক্তারের সঙ্গে মহিতোষ মাস্টারের একটা দহরম মহরম সম্পর্ক চলছিল। রাত-বিরাতে মহিতোষ মাস্টারের বাড়িতে তাকে আর ফরিদকে দেখা যেত। শুধু তা-ই না, রাতে এ বাড়িতে ছিলও ফরিদ। এমনকি পারুকেও ডাক্তারের বাড়িতে দেখা গেছে। এখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে ফরিদও এভাবে উধাও হয়ে গেল, বিষয়টি কোনোভাবেই কাকতালীয় কিছু নয়। এর আড়ালে নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। কিন্তু সেই ঘটনা কী?
তিনি চাইলেই অপেক্ষা করতে পারেন। যেহেতু জমি-জমা, বাড়ি-ঘর তিনি এরই মধ্যে দখল নিয়ে নিয়েছেন, সেহেতু তার তাড়াহুড়ার কিছু নেই। যদি মহিতোষ মাস্টার চুপিচুপিও কারো কাছে এই জমি বিক্রি করে দিয়ে থাকেন, তবে আজ হোক, কাল হোক সে এখানে আসবেই। সমস্যা হচ্ছে, ওই অপেক্ষাটা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সহ্য করতে পারছেন না। সারাক্ষণ এক অজানা আতঙ্ক, তীব্র অস্বস্তি তাকে তাড়া করে ফিরছে। কোনোকিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে আড়াল থেকে কেউ একজন তাকে দেখে হাসছে। তার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছে। বিষয়টা নিতে পারছেন না তিনি। তা ছাড়া এভাবে হাত-পা গুটিয়ে থাকলে শত্রুপক্ষ বরং তাদের পরিকল্পনা মাফিক কাজ করার সুযোগ পাবে। নিশ্চয়ই তাদের কোনো না কোনো পরিকল্পনা আছে। না হলে ঘটনা এমন অস্বাভাবিক রহস্যময় হওয়ার কথা না।
.
আজকাল খুব কমই আড়তে যান তিনি। বেশির ভাগ সময়ই মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির সামনে কিংবা পেছনের ভোলা জমিতে দলবল নিয়ে হাঁটা চলা করেন। কোথায় কী করবেন সেসব নিয়ে পরিকল্পনা করেন। সবচেয়ে ভালো হতো যদি মহিতোষ মাস্টারের ঘরটা ভেঙে সেখানে নতুন একটা পাকা দালান তুলে ফেলা যেত। তাতে তাঁর দখল আরো পাকাপোক্ত হতো। কাজটা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার পিছিয়ে এসেছেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। কারণ একদম নিঃসংশয় না হয়ে। এতবড় কাজ করা ঠিক হবে না। তিনি টের পাচ্ছেন, তার মনে একটা কু ডাক ডাকছে।
তবে যতই তিনি মহিতোষ মাস্টারের বাড়িতে তাঁর দখলদারীত্ব প্রতিষ্ঠা করুন না কেন, গাঁয়ের লোকের কাছে এই জমিতে তাঁর এই হঠাৎ আগমন অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসার মতোই। নেহাৎ তিনি প্রভাবশালী মানুষ বলেই কেউ কিছু বলতে পারছে না। না হলে রাতের আঁধারে মহিতোষ মাস্টারের মতো একজন নিরীহ, নির্বিরোধী মানুষ যেভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে গেলেন, তা কারো কাছেই স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এই নিয়ে ভেতরে ভেতরে সবাই খানিক থম মেরে আছে। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। ফরিদের অনুপস্থিতির সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সংযোগ থাকতে পারে তা তারা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু এই সুযোগটিই নিতে চাইছিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি সেদিন ভোরে বাজারে তার আড়তের সামনে বসা লোকগুলোকে আচমকা বললেন, ওহাব ডাক্তারের। ভাইয়া ফরিদের ঘটনা কী?
কী ঘটনা?
তার সঙ্গে না-কি মহিতোষ মাস্টারের মেয়ে পারুর কী সব ঘটনা ছিল? জানো না কি তোমরা কেউ?
এছাহাক পেছন থেকে বলল, এই ঘটনা তো সবাই-ই জানে। এই কিছুদিন আগেও না-কি সে রাতে সেই বাড়িতে থাকত। তাদের বাজার-সদায় করে দিত। একদিন তো শুনলাম মাঝরাতে না-কি সেই বাড়িতে গিয়ে চিল্লাপাল্লা, দরজা ধাক্কাধাক্কি পর্যন্ত করছে!
কী বলো তুমি? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অবাক হওয়ার ভান করলেন।
হুম। আরো কত কাহিনি যে আছে! বলে পানের পিক ফেলল এছাহাক। তারপর বলল, কাহিনিতো আছেই। নাহলে কি আর যাওয়ার সময় ফরিদরে জামাই বানাইয়া সঙ্গে নিয়া যায় সে? মোসলমানের পোলা শেষ পর্যন্ত না আবার হিন্দুর মাইয়া বিয়া কইরা ধর্ম ত্যাগ করে!
এইটুকু এক কথা! এই কথাই মুহূর্তে গ্রাম হয়ে গেল। ছড়িয়ে পড়ল মানুষের মুখে মুখে। শুধু যে ছড়িয়েই পড়ল, তা-ই নয়। বরং সেই কথার নানা ডাল-পালা ছড়াতে লাগল। ফুল-ফল ধরতে লাগল। শেষ পর্যন্ত কী না এই গাঁয়ে এতবড় এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড! হিন্দুর মেয়ে দিয়ে মুসলমানের ছেলের ধর্মনাশ?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এটিই চাইছিলেন। ওহাব ডাক্তারকে কোনোভাবেই বশে আনতে পারছিলেন না তিনি। তাই চট করে শক্তি প্রয়োগের আগে তার অনুকূলে একটা পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এই ঘটনায় সেটি তৈরি হলো। মানুষ আব্দুল ওহাবের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তাদের ধারণা, বিষয়টা তিনি আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু ইচ্ছে করেই চেপে গিয়েছেন। না হলে ফরিদের নিখোঁজ হওয়ার খবরটা তিনি কেন কাউকে জানাননি? নিশ্চয়ই এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে। সেই কারণটা তারা জানতে চায়।
.
আব্দুল ওহাব অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটেই আছেন। আজকাল আর দোকানেও যান না তিনি। সারাক্ষণ বাড়িতেই থম মেরে বসে থাকেন। ফরিদের ঘটনা শোনার পর থেকে তার স্ত্রী নুরুন্নাহার প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। আছমাও আর ঘর থেকে বের হয় না। পারুর প্রতি ফরিদের আসক্তি কিংবা ভালোবাসা নিয়ে মনে মনে সে কষ্ট পেলেও বাইরে তা কখনো প্রকাশ করেনি। বরং হাসি-ঠাট্টাই করত। কিন্তু সে জানত, ফরিদ আর পারুর ওই সম্পর্ক কোনোদিনও সম্ভব নয়। ফলে ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও ফরিদের হয়তো শেষ পর্যন্ত তাকেই বিয়ে করতে হবে। আর তখন সে তার মনের মতো করে সংসার গুছিয়ে নেবে। সঙ্গে ফরিদকেও। এই আত্মবিশ্বাস তার বরাবরই ছিল। কিন্তু ফরিদ যে এমন কিছু করতে পারে, এটা তার কল্পনার ত্রিসীমানাতেও ছিল না।
ফরিদের উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে যে সামান্য অনিশ্চয়তাটুকুও আব্দুল ওহাবের মধ্যে কাজ করছিল, তা কেটেছে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার তার বাড়িতে আসার পরদিন সন্ধ্যায় ফার্মেসিতে গিয়ে। তালা খুলে দোকানে ঢুকতেই তিনি দেখলেন টেবিল দেরাজ কেমন এলোমেলো। যেন কেউ দুই হাতে সব ঘাটাঘাটি করেছে। কৌতূহলী ডাক্তার দেরাজের কাছটাতে গিয়ে দাঁড়ালেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ল ফরিদের চিরকুটখানা।
সে স্পষ্ট করে লিখেছে–মামা, আমার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি যেখানেই আছি, ভালো আছি। আমার সঙ্গে আছে পারু। ফলে এই জীবনে হয়তো আর কখনোই আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। এ কারণে আমাকে আপনি অকৃতজ্ঞ কিংবা পাষণ্ডও ভাবতে পারেন। আমি তার প্রতিবাদও করছি না। তবে একটা কথা আমি আপনাকে বলতে চাই। মামা নামের যেই শব্দটা আমরা বলি, তা খুবই বিস্ময়কর। এই শব্দে দুজন মা আছেন। দুজন মা মিলে একটি শব্দ মামা। বিষয়টা অদ্ভুত না? আমার ধারণা, আপনি হচ্ছেন এই শব্দের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। সত্যিকার অর্থেই আপনার বুকের ভেতর আমার জন্য দুজন মায়ের সমান ভালোবাসা জমা ছিল। সেই ভালোবাসা আমি নিজ দায়িত্বে নষ্ট করলাম। আমার মতো অভিশপ্ত মানুষ বোধহয় আর এ জগতে নাই।
.
আব্দুল ওহাব চিঠি হাতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলেন। তার মনে হলো তিনি কোনো অনুভূতি টের পাচ্ছেন না। কেবল তার চোখের কোল বেয়ে নেমে আসা দু ফোঁটা উষ্ণ অর স্পর্শ তিনি অনুভব করতে পারছেন। আর কিছুই না।
আব্দুল ওহাব বাড়ি ফিরতে অনেক সময় নিলেন। তার বুকের বাঁ পাশে চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছে। সেই ব্যথা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। এই ছেলেটিকে তিনি নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছেন। কখনো সামান্য অনাদর করেননি। বরং মাঝে মাঝে তাঁর মনে হতো, তিনি বোধহয় আছমার চেয়েও বেশি স্নেহ করেন ফরিদকে। অথচ…।
এরপর আর ভাবতে পারেন না আব্দুল ওহাব। যেন এইটুকু সময়েই তার বয়স বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। তিনি সোজা হয়েও হাঁটতে পারছেন না। বুকটা ভার হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরে গিয়ে এখন কী করবেন তিনি? নুরুন্নাহারকে কী জবাব দেবেন? সারাটা পথ এমন কত কত প্রশ্ন যে তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। তবে এর মধ্যেও একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। পারু ফরিদের সঙ্গে আছে–এই কথার অর্থ কী? পারু আর ফরিদ যদি একসঙ্গেই থাকে তাহলে মহিষেরা কোথায়? আর ফরিদ যদি মহিতোষদের সঙ্গেই থেকে থাকে তবে তার পরবর্তী গন্তব্য কোথায়?
বিষয়টা ভেবেও কোনো সমাধান বের করতে পারলেন না তিনি। বাড়িতে ফিরে কারো সঙ্গে কথাও বললেন না। বেশ কদিন একদম চুপ করে রইলেন। সেদিন সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার অমন হুমকিধমকির পর সারা রাত আর ঘুমাতে পারেননি নুরুন্নাহার। নির্ঘুম রাতজুড়ে অজস্র চিন্তা কিলবিল করেছে তার মাথায়। কোথায় গেছে ফরিদ? কার সঙ্গে গেছে? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যা বলছেন তা কি সত্যি? নুরুন্নাহার তার স্বামীকে চেনেন। তিনি জানেন আব্দুল ওহাব কোনোভাবেই এসবের সঙ্গে যুক্ত নন। তবে কি ফরিদ একা একাই শেষ পর্যন্ত এমন কিছু করেছে যা এখন তাদের সবার জন্যই ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে? তার পর থেকে পারু আর ফরিদকে জড়িয়ে নানা মুখরোচক কথাও তার কানে এসেছে। কিন্তু সেসব তিনি বিশ্বাস করতে চাননি। বরং মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। সমস্যা হচ্ছে এই নিয়ে তার স্বামী আব্দুল ওহাব একদম চুপ। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেন না। আর দিলেও সেসব উত্তর থেকে স্পষ্ট কোনো ধারণাই পাওয়া যায় না।
থমথমে এই বাড়িতে সবচেয়ে যন্ত্রণাকাতর সময় কাটাতে লাগল আছমা। এতদিন মা যখন তাকে ফরিদের যত্ন নিতে বলত। আকারে-ইঙ্গিতে তার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা বাড়িয়ে নিতে বলত। তখন বরং রাজ্যের বিরক্তি দেখাত সে। এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তুমুল বচসাও হয়েছে তার। নুরুন্নাহার দশবার বললেও একবার সে ফরিদের কাছে যেত । নুরুন্নাহার তখন বলতেন, সবাই তো আর রূপে ভজে না। কেউ কেউ গুনেও ভজে। ফরিদ রূপে ভজার ছেলে না। তারে বশ করতে হবে গুণ দিয়া। তোর তো কোনো গুনই নাই। আল্লায় দিছে খালি রূপ।
আছমা মুখ ঝামটা মেরে বলত, আমার কাউরে ভজানোর দরকার নাই মা। আমারে ভজানোর লোকেরই অভাব নাই।
তা থাকব কেন? সবাই তো তোমার পিছে পিছে ছুটবে! ফরিদ কিন্তু আর সব ছেলের মতো না। সে সোনার টুকরা ছেলে। গায়ের সব মেয়ের বাপ-মাই তার দিকে নজর করে তাকাই আছে। কখন কে তারে ছোঁ মেরে বাজপাখির মতো নিয়ে যাবে টেরও পাবা না। তখন কিন্তু কানলেও লাভ হবে না।
এই কথায় বুক কাঁপত আছমার। কিন্তু সেকথা সে মাকে বুঝতে দিত না। আর ফরিদ যে পারুকে পছন্দ করে তখনো তা জানত না সে। যখন জানল, তখন তার এতদিনকার সব শক্ত আবরণ যেন নিমেষেই খসে গেল। সেই রাতে মাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদেছিল সে। মা এত জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু কিছুই বলল না। তবে সেদিনের সেই কষ্টটাকেও ধীরে ধীরে বশে নিয়ে এসেছিল আছমা। সে জানত, ফরিদ আর পারুর এই সম্পর্কের কোনো পরিণতিই নেই। এ কেবলই অসম্ভব এক ভালোলাগা। তারা দুজনও তা জানে। আর জানে বলেই খুব বেশি কাছে যাওয়ার আগে ক্রমশই দূরে সরে আসছিল তারা। ফলে বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া ছেড়ে দিয়েছিল আছমা। আজ হোক কাল হোক ফরিদের সঙ্গে যে তারই বিয়ে হবে, এ বিষয়েও সে নিশ্চিত ছিল। আর বিয়ের পর ফরিদকে কী করে পোষ মানাতে হবে সেসবও ভেবে রেখেছিল সে।
কিন্তু এটা কী হলো? এমন কিছু হতে পারে তা যেন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি সে। ফরিদ কি সত্যি সত্যিই পারুদের সঙ্গে চলে গেছে? সেদিন রাতে নুরুন্নাহার এসে মেয়ের পাশে বসলেন। তারপর মাথায় হাত রেখে বললেন, আমার মন বলছে লোকে যা ভাবছে, আসল ঘটনা তা না।
আছমা মাথা তুলে তাকাল। তবে কথা বলল না। নুরুন্নাহার বললেন, লোকে ভাবছে ফরিদ পারুদের সঙ্গে গেছে। আর এসবের পেছনে তোর বাবার হাত আছে। তুই-ই বল, এগুলা কোনো কথা? তোর বাবা এসব কিছু জানত? বা তার পক্ষে কি এগুলা করা সম্ভব? সে কোন যুক্তিতে এগুলা করবে। তুই-ই বল?
আছমা ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়াল। নুরুন্নাহার বললেন, আমি রহিম ফকিরের কাছে গেছিলাম। সেও বলছে, ফরিদ মহিতোষ মাস্টারের সঙ্গে নাই। সে আছে অন্য কোথাও। এই দেখ, তাবিজও দিছে। এই তাবিজ আগুনে পুড়লে বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করতে থাকবে ফরিদ। বুঝলি?
আছমা কথা বলল না। নুরুন্নাহার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, ফরিদ কোনোভাবেই পারুর জন্য তাদের ছেড়ে কোথাও চলে যেতে পারে না। যাওয়ার যুক্তিও নেই। তা ছাড়া আব্দুল ওহাবও তাকে নিশ্চিত করে এখনো কিছু বলেননি। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার সেই তর্জন-গর্জনের পরও না। মানুষটা কেমন যেন গুটিয়ে গেছেন। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছেন ফরিদের চিন্তায়। তার মানে এই বিষয়ে তিনিও এখনো নিশ্চিত করে কিছু জানেন না। জানলে অবশ্যই তা নুরুন্নাহারকে বলতেন।
.
আব্দুল ওহাব অবশ্য সেদিন চিঠি পাওয়ার পরও কাউকে কিছু বললেন না। নুরুন্নাহার বা আছমাকেও না। বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। অনেক প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে পরের কদিনে যখন পুরো গ্রামবাসীই তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, তখনো তিনি কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। বরং দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে রইলেন।
সমস্যাটা হলো বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরপর। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে আবার আব্দুল ওহাবের বাড়িতে এলেন। এবার আর কোনো রাখঢাক করলেন না। সরাসরিই বললেন, ডাক্তার সাব। বিষয়টা আমি আপনারে ক্লিয়ার করে বলি। মহিতোষ মাস্টার চলে গেছেন। তাঁর জমিজমা সব রেখে গেছেন। এই জমিজমার জন্য উনি আমার কাছ থেকে বায়না বাবদ অর্ধেকেরও বেশি টাকাও নিছেন। বলছিলেন সব কাগজপত্র বুঝাই দেওয়ার সময় পুরো টাকা নেবেন। এখন সমস্যা হচ্ছে, উনি কাউরে কিছু না জানিয়ে রাতের আঁধারে পালাই গেলেন। এইটা কি উনি ঠিক করেছেন?
আব্দুল ওহাব না সূচক মাথা নাড়লেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, তাহলে? এই যে এতগুলা টাকা আমি দিলাম, সেই টাকার কী হবে? হয় জমি, না হয় টাকা? তাইতো?
জি।
তো…। বলে সামান্য থামলেন তিনি। তারপর বললেন, তো ব্যাপার হইছে আপনারে আমি দিন কয়েক সময় দিছিলাম। এরমধ্যে আমার কাজ যা করার আমি করছি। জমি, বাড়ি-ঘরের দখল পাকাপোক্ত করছি। কিছু কাগজপত্রও করার চেষ্টায় আছি। কিন্তু এত ঝামেলা আমার ভালো লাগছে না। আমার বিশ্বাস, আমারে এই সব ঝামেলা থেকে রেহাই দিতে পারেন একমাত্র আপনি। এখন আপনি সেটা করবেন কী না, সেটা আপনার বিবেচনা।
আমি কী করতে পারি?
অনেক কিছুই করতে পারেন। এক, মহিতোষ মাস্টারের ঘটনা আসলে কী, সেইটা খোলসা করে বলতে পারেন। দুই, তার জমিজমার কাগজপত্র যদি আপনার কাছে থেকে থাকে সেগুলো আপসে আমারে দিতে পারেন। তিন, সে যদি চুপেচাপে এই জমি কারো কাছে বেচে থাকে, তার সন্ধান আমারে দিতে পারেন। কথা পরিষ্কার?
পরিষ্কার। কিন্তু ভূঁইয়া সাব, এসবের কিছুই আমি জানি না। কিছু না।
কিছু না?
না।
ফরিদের বিষয়েও না?
না।
কিন্তু লোকজন কথা বলাবলি করছে যে কাল জুমার নামাজ শেষে মসজিদে আপনার বিচার বসবে।
বিচার? আমার? যেন আকাশ থেকে পড়লেন আব্দুল ওহাব। কেন? আমি কী করেছি?
আপনি মহিতোষ মাস্টারের কাছ থেকে সুবিধা নিছেন। আর এই সুবিধা নেওয়ার জন্য ব্যবহার করছেন আপনার ভাগ্নেরে। রাত-দিন তারে আপনি সেই বাড়ির খেদমতে নিয়োজিত করছেন। ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিছেন। দেন নাই?
আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না ভূঁইয়া সাব।
সবই বুঝবেন। কেউ সময়ে বোঝে, কেউ অসময়ে বোঝে। আপনি হলেন অসময়ে বোঝা লোক। শোনেন, বাজারে যে জমিতে আপনার দোকান, সেই জমির মালিক কে?
কে আবার? আমি।
আপনার কাছে ওই জমির দলিল আছে?
এই কথায় আব্দুল ওহাব থমকে গেলেন । তিনি অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন, আছে তো মনে হয়। থাকবে না কেন?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হাসলেন। বললেন, নাই। আপনার কাছে ওই জমির দলিলপত্র কিছু নাই। আপনি ওই জমি যে ভোগ করতেছেন এইটা অবৈধ।
মানে?
মানে আপনি অসহায় দেশত্যাগী হিন্দুদের জমি জবরদখলের মাধ্যমে ভোগ করতেছেন।
এসব কী বলছেন আপনি ভূঁইয়া সাব?
ঠিকই বলছি। আমার কথা মিথ্যা হলে প্রমাণ দেখান। জমির দলিল বের করেন।
এই কথায় যেন খানিক দমে গেলেন ওহাব ডাক্তার। খানিক চুপ থেকে মিনমিন করে বললেন, ওই জমির দলিল আমার কাছে না থাকলেও হস্তান্তরের কাগজ আছে।
কী কাগজ?
জমির মালিক যে তা আমার কাছে হস্তান্তর করবে সেই কাগজ।
আপনার কথা আমি বুঝি নাই। খোলাসা করে বলেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মুখে বাঁকা হাসি।
কথাটা বলতে একটু সময় নিলেন আব্দুল ওহাব। তিনি গলা খাঁকড়ি দিয়ে গলার শ্লেষ্ম পরিষ্কার করলেন। তারপর বললেন, যুদ্ধের সময় যখন মহিতোষ মাস্টারের বড়দা পরিতোষ দেশ ছেড়ে চলে গেলেন, তখন তিনি একদিন এসে আমার হাত-পা জড়াই ধরে বললেন, তার খুব জরুরি কিছু টাকা-পয়সা দরকার। বিনিময়ে উনি ওই বাজারের জমিটুকু আমারে লিখে দেবেন।
তা লিখে দিছিলেন?
জি দিছিলেন।
একেবারে দলিল কইরা?
না।
তাহলে?
দলিল করার আগেই তুমুল গণ্ডগোল লেগে গেল দেশে। আর গণ্ডগোলের সময় এই বেচাবিক্রির কাগজপত্র করারও সুযোগ ছিল না। উনি খুব ভীত লোক ছিলেন। কাউরে কিছু না জানিয়ে একদিন হুট করে চলে গেলেন।
তার মানে আপনার কাছে ওই জমির কোনো কাগজপত্র নাই?
নাই মানে কিছুই যে নাই, তাও না। উনি একটা কাগজে টাকা নেয়ার সময় সই করে নিয়ে গেছিলেন। সেখানে লেখা আছে যে ওই জমির বিনিময়েই উনি টাকাটা নিয়েছেন। কথা ছিল ভূমি অফিস থেকে রেজিস্ট্রি করেই লিখে দেবেন উনি। কিন্তু সেই সময় তো আর হলো না।
কই? কাগজ দেখি?
আব্দুল ওহাব নুরুন্নাহারকে ডেকে কাগজ দেখাতে বললেন। পুরনো ট্রাংক বাক্স ঘেটে সেই কাগজ বের করতে সময় লেগে গেল নুরুন্নাহারের। তবে কাগজখানা তিনি আব্দুল ওহাবের হাতে দিতে পারলেন না। তার আগেই ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বললেন, এই তাহলে সেই বিশাল মূল্যবান। সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তরের দলিল? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মুখে বক্র হাসি। তিনি কাগজখানা উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, ওই জমি এখনো পরিতোষের নামেই রেজিস্ট্রি করা ডাক্তার সাব। আর এই কাগজের ছিটাফোঁটা কোনো মূল্যও নাই। এখন আপনি যে এতবছর ধরে পরিতোষের জমি ভোগদখল করে খাচ্ছেন। এর কারণ কী?
আব্দুল ওহাব বিচলিত ভঙ্গিতে বললেন, কী বলছেন আপনি? আমি ভোগদখল কেন করব? আর মহিতোষ মাস্টার জানতেন না যে ওই জমি তার ভাইয়ের? তিনি সবই জানতেন। কিন্তু কই, তিনিও তো কোনোদিন এই জমি নিয়া আমাকে কিছু বলেন নাই? মাঝখান থেকে আপনি কেন এসব কথা বলছেন?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া শব্দ করে হাসলেন। তারপর বললেন, শোনেন ডাক্তার সাব, একটা কথা বলি। আমি মানুষ ভালো না। এইজন্য সব খোঁজখবরই আমার রাখতে হয়। আপনার এই জমির কাহিনি বহু আগে থেকেই আমি জানি। কিন্তু আপনারে খোঁচাখুঁচি করার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। তাই খোঁচাইও নাই। কিন্তু এখন আপনিই আমারে বাধ্য করতেছেন। বাধ্য করলে কী করব বলেন?
আব্দুল ওহাব বুঝতে পারছেন চারপাশ থেকে ভয়ানক এক বিপদ তার দিকে তেড়ে আসছে। কোনো অপরাধ না করেও ফেঁসে যাচ্ছেন তিনি। এমনিতেই গ্রামসুদ্ধ মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। তারা কেউ কোনো যুক্তির ধার ধারছে না। বরং সকলেই চাইছে এর একটা বিহিত করতে। মুসলমানের ছেলে হয়ে হিন্দুর মেয়ের জন্য তার পরিবারের সঙ্গে দেশত্যাগ করবে ফরিদ, এ কেমন কথা? এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, কাল মসজিদে বিষয়টা উঠবে। সেখানে আমি আপনার দোকানের কথাটাও তুলব। আপনার কাছে কিন্তু আর কোনো প্রমাণ নাই যে পরিতোষরে আপনি জমির বিনিময়ে টাকা দিছিলেন। বলেই হাতের কাগজখানা কুটিকুটি করে ছিঁড়তে লাগলেন তিনি। আব্দুল ওহাব বিস্মিত এবং হতভম্ব চোখে জাহাঙ্গীর ভূইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এছাহাক বলল, টাকা-পয়সা ছাড়া অন্যের জমি দখল করে আপনের লোভ খুব বেড়ে গেছে, তাই না ডাক্তার? সেই লোভেই মহিতোষ মাস্টারের ঘরে ভাইগ্না লেলাই দিছিলেন?
এসব তুমি কী বলছ এছাহাক?
ও ঠিকই বলছে। বললেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনার ভাইগ্না হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়ে দিওয়ানা হয়ে গেল। দেশ ছাড়ল। ধর্ম ছাড়ল। এই দোষ। কার লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আপনার লোভেই তো এমন একটা ঘটনা ঘটল। কাল মসজিদে এই নিয়ে বিচার বসবে। আপনি যে পরিতোষের জমিও জোরদখল। করে ভোগ করছিলেন, সেটাও তখন সবাই জানবে। আপনার ভালো মানুষী চেহারার আড়ালের আসল মুখখানা তখন সবাই দেখতে পাবে।
আব্দুল ওহাব হতভম্ব ভঙ্গিতে বসে রইলেন। পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে যাবে, এটি তিনি জানতেন। কিন্তু সেটি যে এইদিকে মোড় নেবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল যে বাঁকা করতে হয়, এইটাতো পুরনো কথাই। নতুন কথা হইলো ঘির বেয়াম ভাঙার সুযোগ থাকলে এত কষ্ট করে আঙুল দিয়ে কে ঘি ওঠায়? বয়ামইতো ভেঙে ফেলা যায়। আমি আপনারে ভেঙেচুরেই ফেলব ডাক্তার।
২১
আতাহার মওলানা গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রফিকুল। মওলানা থমথমে গলায় বললেন, ঘটনা কি তুই খুলে বল?
ঘটনা কিছু না আব্বা।
কিছু না মানে কী? আমারে তোর কী মনে হয়? আমি দুধের বাচ্চা? তোদের অন্ধভাবে বিশ্বাস করাটা কি আমার অপরাধ?
রফিকুল এই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রফিকুলের মা নাজমা বেগম দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার স্বামী এমনিতে ভালো মানুষ। একটু চুপচাপ, গম্ভীর হলেও কোনো কারণে মন ভালো থাকলে সবার সঙ্গেই গল্পগুজব করেন। কিন্তু গুরুতর কোনো বিষয়ে তার মেজাজ একবার খারাপ হলে সেটি ভয়ংকর। তার ধারণা এ বাড়িতে ভয়ংকর কিছুই ঘটতে যাচ্ছে। কারণ তিনি যা সন্দেহ করছেন, ঘটনা যদি সত্যি সত্যিই তা হয়ে থাকে, তবে এরচেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। সেক্ষেত্রে রফিকুলের শাস্তিও হবে ভয়ংকর। অন্যসময় হলে স্বামীর কথার ওপর তিনি কথা বলতে পারতেন। নানা বিষয়ে তাঁকে বুদ্ধি পরামর্শও দিতে পারতেন। কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতিতে তার সামনে টু শব্দটি অবধি করা যায় না।
এখন বাজে সকাল ৯টা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আতাহার মওলানা বেরিয়ে যাবেন। প্রায়ই তাকে দূর-দূরান্তে সালিস-বৈঠকে যেতে হয়। আজও যেতে হবে। তবে তার আগেই বিষয়টার একটা হেস্তনেস্ত করে যেতে চান তিনি। যদিও হাতে সময় বেশি নেই।
ঘটনা ঘটেছে আজ ভোরে। তিনি নামাজ পড়তে উঠে দেখেন পারুদের ঘরের দরজা খোলা। সম্ভবত পার বাথরুমে গিয়েছিল। সেই খোলা দরজায় চোখ পড়তেই একটা অবাক করা দৃশ্যে তার চোখ আটকে গেল। ঘরের মেঝেতে একটা বিছানা। সেই বিছানায় শুয়ে আছে ফরিদ। দৃশ্যটি খুবই দৃষ্টিকটু। এই প্রচণ্ড শীতের রাতে সে কেন মাটিতে বিছানা করে ঘুমাবে? গত কয়েকদিন ভোরেও তিনি খেয়াল করেছিলেন যে বাইরের ঘরের সোফার কুশনগুলো নেই। চেয়ারগুলো ফাঁকা। তখন অবশ্য ভেবেছিলেন, কেউ হয়তো কোনো কাজে ব্যবহার করেছে বা তুলে রেখেছে। পরে আবার সেগুলো জায়গা মতোই দেখতেন। ফলে এ নিয়ে আর কিছু ভাবেননি। কিন্তু আজ বিষয়টা দেখে তিনি থমকে গেলেন। মুহূর্তের জন্য বিদ্যুৎ চমকের মতো যেন কিছু একটা উঁকি দিয়ে গেল মাথায়। তিনি ওজু করলেন, মসজিদে গেলেন, নামাজ পড়লেন। এই পুরোটা সময় বিষয়টা আর মাথা থেকে তাড়াতে পারলেন না। ফরিদ আর পারু স্বামী-স্ত্রী। তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। ফলে অত ভোরে তাদের ঘরের দরজায় গিয়ে বারবার ডাকতে কেমন অস্বস্তি হতো। এই অস্বস্তি থেকেই পরের কয়েকদিন আর ফরিদকে ভোরবেলা ডাকেননি তিনি। ভেবেছিলেন সে নিজে নিজেই হয়তো উঠবে।
কিন্তু আজকের এই দৃশ্যটা খট করে চোখে লাগল। মনের মধ্যেও একটা স্পষ্ট খচখচানি তৈরি হলো। তাদের তো এভাবে আলাদা বিছানায় থাকার কথা না! তাও এই তীব্র শীতের রাতে। যেখানে মানুষ বিছানায়ই ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে যাচ্ছে, সেখানে কি না একজনকে থাকতে হচ্ছে মেঝেতে! হতে পারে তাদের ঝগড়া হয়েছে। এমন অনেক কারণেই স্বামী-স্ত্রী রাগ করে আলাদা থাকতে পারে। তাই বলে এই সময়ে এই তীব্র শীতের রাতে? তাও আবার পর পর এতদিন? আতাহার মওলানা এখন নিশ্চিত, যে কদিন ভোরে উঠে তিনি সোফা ফাঁকা দেখেছেন, সেই প্রতিদিনই ফরিদ আলাদা ঘুমিয়েছে। তাদের ঘটনা আসলে কী?
পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও ফরিদ আর পারুর কিছু আচরণ তার কাছে প্রথম থেকেই অদ্ভুত ঠেকছিল। বিশেষ করে পারুর। মেয়েটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। তার কথাবার্তাও স্বাভাবিক নয়। এতদিন সেসব এক ধরনের অবচেতন অস্বস্তি অনুভব করালেও সুনির্দিষ্ট কোনো প্রশ্ন তৈরি করেনি। কিন্তু আজ পুরো বিষয়টিই হঠাৎ বড়সড় এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
বিষয়টা নিয়ে তিনি তার স্ত্রী নাজমা বেগমের সঙ্গে কথা বললেন। নাজমা বেগম সব শুনে সঙ্গে সঙ্গেই কোনো জবাব দেননি। বরং অনেক্ষণ থম মেরে বসেছিলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, আমারও মনে হয়েছে বড়সড় কোনো ঝামেলা আছে।
কী ঝামেলা? সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন মওলানা।
মেয়েটার কথাবার্তা আপনি খেয়াল করেননি?
কী কথাবার্তা?
সেদিন খাবার টেবিলে বসে সে কয়েকবার উল্টাপাল্টা কথা বলছিল।
কী উল্টাপাল্টা কথা? বিরক্ত গলায় বললেন আতাহার মওলানা। তার খুব দ্রুত বের হতে হবে। আজ জুমাবার। জুমাবারে প্রায়ই তার বিভিন্ন জায়গায় দাওয়াত থাকে। সালিস ব্যবস্থায় যেতে হয়। আজও আছে। ফলে স্ত্রীর এমন প্রলম্বিত কথাবার্তায় তিনি বিরক্ত বোধ করছেন। তার ধারণা, মেয়েমানুষের এটা একটা বড় সমস্যা। তারা সহজ কথাও সহজে বলতে পারে না। বলবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, হেঁয়ালি করে। তা যত গুরুত্বপূর্ণ কিংবা জরুরি কথাই হোক না কেন!
নাজমা বেগম বললেন, এই মেয়ে সেদিন খাবার টেবিলে বসে হঠাৎই দিলারাকে বৌদি বলে ডাকল। তারপর পানি চাইতে গিয়ে বলল, জল দাও। এমন। আরো কিছু ব্যাপার আছে। বিষয়টা আমার কাছে ঠিক স্বাভাবিক লাগে নাই। তারপর গরুর মাংস খাওয়া নিয়া কী করল আপনার মনে নাই?
নাজমা প্রশ্ন করলেও জবাব দিলেন না আতাহার মওলানা। তাঁর মাথা ঝিমঝিম করছে। কান গরম হয়ে উঠছে। কী ইঙ্গিত করছেন নাজমা? তার নিজেরও এখন মনে হচ্ছে, ভেতরে আসলেই গুরুতর কোনো ব্যাপার রয়েছে। অথচ সেই ব্যাপারটি অনেকাংশেই তাদের সামনে প্রকাশিত ছিল। কিন্তু তাঁরা তাঁদের নির্দোষ দৃষ্টিতে সেসব আলাদা করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। তবে, এখন নাজমার কথা শুনে তার মনে হচ্ছে ঘটনা গুরুতর। সেদিনের নামাজের ঘটনাটাও বললেন। নাজমা বেগম। আতাহার মওলানার হঠাৎ মনে হলো, তিনি ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারছেন না। যদি তাদের সন্দেহই সত্যি হয়ে থাকে, তবে তিনি সমাজে মুখ দেখাবেন কেমন করে? দশজনের কাছে তার একটা আলাদা গ্রহণযোগ্যতা আছে। লোকে তাকে সম্মান ভক্তি করে। সেই তাঁর ঘরেই যদি এমন অধর্ম লালন হয় তাহলে তিনি নিজের কাছেই বা কীভাবে জবাবদিহি করবেন? তাঁর মতো একজন। মানুষের ঘরে এত বড় অন্যায়, এত বড় অধর্মের কাজও হতে পারে? এই পাপ তিনি কী করে মোচন করবেন?
.
সঙ্গে সঙ্গেই রফিকুলকে ডাকলেন তিনি। তারপর আসল ঘটনা জানতে চাইলেন। কিন্তু রফিকুল কিছুতেই কিছু স্বীকার করল না। তার ওই এক কথা, বাবা-মা অযথাই ফরিদ আর পারুকে ভুল বুঝছে। আসল ঘটনা খুবই সাধারণ। পারুরা যেখানে থাকে, তার আশপাশে প্রচুর হিন্দু পরিবারের বসবাস। তার বন্ধুদের মধ্যেও হিন্দু ছেলে-মেয়েদের আধিক্য। তাদের সঙ্গেই সারাক্ষণ থাকতে হয় তাকে, কথা বলতে হয়। ফলে, প্রায়ই তার আচরণে-কথায় হিন্দুয়ানি অনেক চাল-চলন দেখা যায়। এতে অন্যকিছু ভাবার অবকাশ নেই। আতাহার মওলানা বললেন, আমি দগ্রামের সালিস ব্যবস্থা, বিচার-আচার করি। আর আমার ঘরের লোক আমাকে বোকা বানায়?
আব্বা, আপনি ভুল বুঝছেন। বিষয়টা মোটেই তেমন কিছু না। আপনি জুমা শেষ করে আসেন। প্রয়োজনে পারু-ফরিদের সঙ্গে কথা বলেন। আমার বিশ্বাস আপনার ভুল ভাঙবে। সমস্যা হচ্ছে ওরা এ বাড়িতে মেহমান। ওদের সামনে এসব বলা ঠিক হবে কি না?
আতাহার মওলানা আর কথা বাড়ালেন না। তাঁর সালিসে যাওয়ার সময় চলে যাচ্ছে। আজ তাঁকে অনেকটা দূর যেতে হবে। হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে ফিরতে ফিরতে। তিনি ফিরেই বিষয়টির একটা চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন। তবে বিষয়টা এক মুহূর্তের জন্যও মাথা থেকে বের করতে পারলেন না তিনি। বরং একটা বিকট দর্শন বিছার মতো পোকা যেন সারাক্ষণ তার মাথার ভেতর মগজ কামড়ে ধরে বসে রইল।
.
ভুবনডাঙা জামে মসজিদে আজ জুমার নামাজ পড়ানোনার কথা ছিল আতাহার মওলানার। তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারা পরস্পরকে চিনলেও নিজেদের মধ্যে তেমন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কখনোই ছিল না। ফলে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার তরফ থেকে হঠাৎ এমন আমন্ত্রণ পেয়ে আতাহার মওলানা খানিক অবাকই হয়েছিলেন। তিনি বার্তাবাহককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা প্রশ্ন করেছেন। বার্তাবাহক বলেছে, আজাহার ভূঁইয়ার ইচ্ছা তাঁরা দুজন একসঙ্গে এই শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়বেন। এলাকায় ঘটে যাওয়া কিছু অতি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও তিনি কথা বলতে চান মওলানার সঙ্গে। কিছু সালিস-বিচারেরও ব্যাপার আছে। এ ছাড়াও ধর্মীয় দিক থেকে সংবেদনশীল এমন সামাজিক কিছু বিষয়াদি নিয়েও গ্রামবাসী তার মতামত জানতে চায়।
ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু না জানলেও মওলানা সাহেব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। সাধারণত এই ধরনের বিষয়ে নানা দিক থেকেই তাঁর ডাক আসে। তিনি খুশি মনেই সেসব জায়গায় যান। লোকজন তাকে মান্যগণ্য করে। তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। বিষয়টা তিনি উপভোগ যেমন করেন, তেমনি চেষ্টা করেন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে। এ কারণেই কেউ কখনো তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক কোনো আচরণের অভিযোগ আনতে পারেনি। তিনিও মানুষের এই শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটি সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেন।
সমস্যা হচ্ছে, বাড়ি থেকে বের হতে হতে দেরি হয়ে গেল আতাহার মওলানার। পথে সড়ক মেরামতের কাজও চলছিল। ফলে যথাসময়ে ভুবনডাঙা এসে পৌঁছাতে পারলেন না তিনি। নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় কাছাকাছি একটি মসজিদেই নামাজ সেরে নিলেন। ভুবনডাঙায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় আসরের। সময় হয়ে এলো। মুসল্লিরা তখনো কেউ বাড়ি যাননি। তারা বসে আছেন আব্দুল ওহাবের বিচার দেখার জন্য।
কুশল বিনিময়ের পর বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন আতাহার মওলানা। বললেন, এবার বলেন এত জরুরি তলব কেন?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। তিনি ভাবছেন, কতটুকু কী মওলানাকে বলা যায়। তাকে তো আর তার সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য বলা যাবে না। বলতে হবে রাখঢাক রেখে। তাঁর আপাতত উদ্দেশ্য আব্দুল ওহাবকে একঘরে করে দেয়া। তারপর বাকি যা যা করার দরকার তিনি করবেন। একবার একঘরে করে দিতে পারলে আর কেউ এ বিষয়ে বাধা দিতে আসবে না। তিনি তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার দৃঢ় বিশ্বাস, মহিতোষের বিষয়ে যদি সত্যিকার। অর্থেই কেউ কিছু জেনে থাকে, তবে তা আব্দুল ওহাব। এবং ফরিদের সঙ্গেও তার কোনো না কোনো যোগাযোগ অবশ্যই রয়েছে। তিনি চান বিষয়গুলো সম্পর্কে একটা স্পষ্ট, স্বচ্ছ ধারণা পেতে। মহিতোষের জমির আসল ঘটনা আব্দুল ওহাব না জেনে পারেনই না। বরং তিনি অনেকদিন থেকেই এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেই বিশ্বাস জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। বিষয়টা নানাভাবেই স্পষ্টও। ওহাব ডাক্তারের সাহায্য নিয়েই তাকে বোকা বানিয়েছেন মহিতোষ। বিষয়টা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।
তিনি আতাহার মওলানাকে এখানে আনিয়েছেন স্রেফ আজকের বিচারের শোভা বাড়ানোর জন্য। এখানে তার ভূমিকা বলতে গেলে আলংকারিক। তার কোনো মতামত আসলে নেয়া হবে না। সিদ্ধান্ত যা দেবার দেবেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াই। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তগুলো যেন অন্যদের কাছে অগ্রহণযোগ্য বা প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেটি নিশ্চিত করতেই তিনি আতাহার মওলানাকে এনেছেন। নানা কারণেই গাঁয়ের লোকজন তাঁর প্রতি একটু অসন্তুষ্ট। তার ওপর মহিতোষ মাস্টার রাতের আঁধারে ওভাবে পালিয়ে যেতে না যেতেই তিনি যেভাবে তার ভিটা-বাড়ি দখল করে বসে আছেন, তাতেও সবার মধ্যে একটা ফিসফিসানি ছড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় একই সঙ্গে সব কুল রক্ষা করার এটাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পথ। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সেই পথেই হাঁটছেন।
সমস্যা হচ্ছে আব্দুল ওহাব আজ মসজিদে আসেননি। সকাল থেকেই তার শরীর খারাপ করেছে। গায়ে জ্বর। কিন্তু জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সেকথা মানতে নারাজ। তিনি এছাহাককে বললেন আব্দুল ওহাবকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে। এছাহাক বলল, যদি না আসতে চান?
জোর করে নিয়ে আসবা। কোনো ছাড়াছাড়ি নাই।
আতাহার মওলানা ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছেন না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও কিছু খুলে বলছেন না। তিনি প্রশ্নটা আবারও করলেন, ঘটনা কী ভাই সাহেব? এত জরুরি তলব করলেন। কিন্তু আসল ঘটনার তো কিছুই খুলে বলছেন না।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ঘটনা গুরুতর। তবে আপনার এসব নিয়ে ভাবার দরকার নেই। এটা এমন জটিল কোনো সিদ্ধান্ত বা বিচারও না যে এ নিয়ে আপনার মাথা ঘামাতে হবে। সহজ হিসেব। যা বলার আমিই বলব। আপনি কেবল চুপচাপ বসে থাকলেই হবে।
কিন্তু ভূঁইয়া সাহেব, ঘটনা না জানলে আমি বুঝব কী করে যে আমাকে চুপ করে থাকতে হবে, না কথা বলতে হবে?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সতর্ক ভঙ্গিতে বললেন, এক হিন্দু মেয়ের জন্য এ গাঁয়ের এক মুসলমান ছেলে ধর্ম ত্যাগ করছে। আর সেইটাতে ইন্ধন জুগিয়েছে স্বয়ং ছেলের মামা। তাও আবার সেই হিন্দু পরিবারের সম্পত্তির লোভে। এমনকি বহুবছর ধরে তাদের কিছু সম্পত্তি সে ভোগদখলও করছে। এবার তার লোভের দৃষ্টি আরো বাড়ছে। আর কী শুনতে চান বলেন?
আতাহার মওলানা ঘটনা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। এ তো ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু এক কথায় তো এমন গুরুতর ঘটনার সিদ্ধান্ত দেয়া যায় না। এ নিয়ে দু পক্ষের মতামত শোনার ব্যাপার আছে। সাক্ষীদের কথা শুনতে হবে। এমনকি অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনও করতে দিতে হবে। তিনি বললেন, তারা এখন কই? ছেলে আর মেয়ে তারা এখানে হাজির আছে?
না। তারা তো এখানে হাজির নেই।
তাহলে? তাদের ছাড়া বিচার হবে কী করে? কার বিচার হবে?
বিচার হবে ছেলের মামার।
এটা কোনো কথা হলো ভূঁইয়া সাব? বিচার হলে আগে হবে ছেলে আর মেয়ের। বা তাদের কথা শুনতে হবে। তারা কী বলে সেটা জানতে হবে।
তাদের এখন কোথায় পাবেন আপনি?
কেন? তারা এই গাঁয়ের না?
তারা এই গাঁয়েরই। কিন্তু তারা পালাইছে।
খট করে কথাটা কানে লাগল আতাহার মওলানার। তিনি বললেন পালাইছে?
হুম।
কবে?
এই তো দিন দশেক হবে।
ছেলের নাম কী?
ফরিদ।
মেয়ের নাম?
পারু।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কথা শুনে আতাহার মওলানার শরীর বেয়ে ঘাম ছুটতে লাগল। ফরিদ রফিকুলের বন্ধু হলেও তার সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানতেন না তিনি। কারণ তিনি থাকতেন দর্শনা মাদ্রাসায়। মাঝেমধ্যে যে দু-একদিনের জন্য বাড়িতে আসতেন, তখন ছেলে-মেয়েদের সঙ্গেই ঠিক করে কথা বলার সময় হতো না তার। তাদের বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে আর কী জানবেন! ফরিদকে হয়তো আগে দু একবার চোখের দেখা দেখেছেন, কিন্তু তার বাড়ি যে এই গায়ে সেটি তিনি জানতেন না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কথা শুনে তার মাথায় ঝিম ধরে গেল। তিনি বললেন, কী বলছেন আপনি ভূইয়া সাহেব।
মওলানা সাহেবের কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়। বিষয়টা চোখ এড়াল না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। তিনি বললেন, হুম। ঘটনা গুরুতর না?
ঘটনা অবশ্যই গুরুতর। কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর ব্যাপার আছে।
এরচেয়েও গুরুতর ব্যাপার কী? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অবাক চোখে তাকালেন।
এই ছেলে আর মেয়ে তো এখন আমার বাড়িতে।
কী! ঝট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তাঁর আচমকাই মনে হলো, যে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার কানাগলিতে তিনি পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন সেখানে কোনো অলৌকিক উপায় যেন আলোর সন্ধান পেয়েছেন তিনি। পথের দেখা পেয়েছেন। তিনি রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বললেন, মওলানা সাব। আপনি কী বলছেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা আপনার বাড়িতে আসবে কী করে? তাদের তো এতক্ষণে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। আপনি আমাকে ঘটনা খুলে বলেন।
বিভ্রান্ত আতাহার মওলানা তাকে ঘটনা খুলে বললেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যেন নিজের কানকেই নিজে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভাগ্য তাঁকে এমন অভাবিত সহায়তা করতে পারে এটা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। পারু যদি এখনো দেশে থেকে থাকে, তাহলে মহিতোষ মাস্টারও অবশ্যই এই দেশেই আছেন। মেয়েকে এভাবে এখানে একা ফেলে রেখে তার বাবা-মায়ের পক্ষে কিছুতেই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। এখন মহিতোষ মাস্টারের খোঁজ পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো পারুর খোঁজ পাওয়া। একবার পারুকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারলেই আর চিন্তা নেই। কান টানলে যেমন মাথা আপনা আপনিই চলে আসে, তেমনি মহিতোষ মাস্টারও তখন নিজ থেকেই চলে আসবেন।
আতাহার মওলানার কথা শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যতটুকু বুঝলেন, ফরিদ আর পারু পালিয়েছে। তারা এখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। এই-ই সুযোগ তার। এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর তিনি পাবেন না। জাহাঙ্গীর ভূইয়া যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বললেন, ডাক্তার সাব যখন অসুস্থ, তখন বিচার আজকে বাদ থাকুক। উনি সুস্থ হলে তখন আবার দেখা যাবে।
বলেই তিনি মওলানার দিকে তাকালেন। বললেন, এই মুহূর্তে আমাকে আপনার বাড়ি যেতে হবে। এই মুহূর্তে। তাদের আমার দরকার।
আতাহার মওলানা শান্ত কণ্ঠে বললেন, দরকার সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তাদের ক্ষতি হয়, এমন কিছুই করা যাবে না ভূঁইয়া সাব। মানুষ ভুল করে। আবার শুদ্ধও হয়। তারা যদি তাদের ভুল বুঝতে পারে, তাহলে তাদের ক্ষমা করা আমাদের কর্তব্য। এটা নিয়ে দশজনের সঙ্গে বসতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করার ব্যাপার আছে। চট করে বলপ্রয়োগে কিছু করা যাবে না। এমনকি তাদের দুজনের বক্তব্যও আমাদের শোনা উচিত।
হুম। সেজন্যই তো আগে তাদের কাছে যাওয়া উচিত। উচিত না?
হ্যাঁ, তা উচিত। বলে উঠে দাঁড়ালেন আতাহার মওলানা। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার আর এক মুহূর্ত তর সইল না। তিনি বললেন, আপনি বাইরে বের হন। আমি আসতেছি।
তিনি এছাহাককে ডাকতে খবর পাঠালেন। সঙ্গে কিছু ছেলেপুলেরও ব্যবস্থা করতে বললেন। পারুকে কোনোভাবেই হারানো যাবে না। তার এতদিনের যত স্বপ্ন, যত ইচ্ছা, তার সবই এখন নির্ভর করছে পারুর ওপর। যেকোনো মূল্যেই হোক, পারুকে তার চাই-ই চাই। মিনিট দশেকের মাথায় তাকে দেখা গেল দলবল নিয়ে আতাহার মওলানার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে। বাইরে শান্ত ভাব ধরে থাকলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ংকর উত্তেজিত তিনি। একবার, মাত্র একবার তিনি মহিতোষ মাস্টারকে তাঁর সামনে দেখতে চান। যেকোনো মূল্যে তার মুখোমুখি। হতে চান। তা যত সামান্য সময়ের জন্যই হোক না কেন। কিন্তু প্রবল প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তখনো জানেন না যে তার থেকে মাত্র হাত কুড়ি দূরে একটা পুরনো ভগ্নপ্রায় মন্দিরের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন মহিতোষ মাস্টার।
২২
মহিতোষ মাস্টার ভুবনডাঙা পৌঁছেছেন শেষ রাতের অন্ধকারে। তীব্র শীতে তিনি উলের লম্বা কান টুপি পরেছেন। তার ওপরে চাদর। চাদরে তার মুখের প্রায় অর্ধেকটা ঢাকা। মহিতোষ মাস্টারের সঙ্গে তার মেসো অরবিন্দু বাবুও রয়েছেন। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে পায়ের গোড়ালি অবধি লম্বা আলখাল্লার মতো গোল পাঞ্জাবি। মাথায় মোটা কাপড়ের শীত টুপি হলেও তার আকৃতি কিছুটা মুসল্লিদের টুপির মতো। তিনিও যতটুকু সম্ভব নিজেকে চাদর আবৃত করে রেখেছেন। তবে তাঁর মুখ খোলা। স্পষ্টতই পোশাকে-আশাকে একটা সুনির্দিষ্ট পরিচয় প্রকাশের চেষ্টা করছেন অরবিন্দু বাবু।
তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন ভুবনডাঙা জামে মসজিদ থেকে খানিকটা দূরে। এখানে একসময় ঘন জঙ্গল ছিল। তবে কালক্রমে তা বিলীন হয়েছে। ধীরে ধীরে বসতি জমির প্রয়োজন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জায়গাটা এখনো খানিক চুপচাপ। শান্ত, নির্জন। অরবিন্দু বাবু বললেন, এখন কী করবি? সেই ভোর থেকে তো এই জঙ্গলে মশা মারতেছিস। আর কতক্ষণ?
আপনি নিশ্চিত যে ওহাব ডাক্তার বাজারে যান নাই?
এক কথা আর কতবার বলব? আমি তার ফার্মেসির উল্টোদিকের চায়ের দোকানে বসেছিলাম প্রায় ঘণ্টা দুই। কিন্তু তাঁর দোকান খোলার কোনো নাম গন্ধই নাই।
আপনি তাঁর দোকান ঠিকঠাক চিনছেন তো?
চিনব না কেন? বাজারে তো একটাই ওষুধের দোকান। আর কোনো দোকান নাই। সামনে তো সাইনবোর্ড টানানোই আছে।
হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন মহিতোষ। অরবিন্দু বাবুকে এ গাঁয়ের কেউ চেনে না বলে রক্ষে। না হলে তিনি একা একা কিছুই করতে পারতেন না। সমস্যা হচ্ছে, আব্দুল ওহাব ভোরবেলা বাজারে যাননি। এখন তাহলে তাঁর সঙ্গে দেখা করার উপায় কী? উপায় একটা আছে। আর তা হলো সরাসরি তার বাড়িতে চলে যাওয়া। কিন্তু সেটি ঝুঁকিপূর্ণ। যে কারো চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। আরেকটা উপায় হচ্ছে বিকেল অবধি অপেক্ষা করা। তিনি সাধারণত দিনে দুই বেলা দোকানে বসতেন। সকাল আর বিকেল। কিন্তু বিষয়টা অনিশ্চিত মনে হচ্ছে মহিতোষ মাস্টারের কাছে। কারণ অরবিন্দু বাবু যখন চায়ের দোকানে বসেছিলেন, তখন দোকানিকে তিনি ডাক্তারের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। দোকানি বলেছে, ডাক্তারে আছে নানা যন্ত্রণায়। দোকান খোলে কী না তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই।
এই কথাটি অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে মহিতোষ মাস্টারকে। তিনি এখন বুঝতে পারছেন না কী করবেন। এই গাঁয়ে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত তার জন্য ভয়ংকর। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো বিপদ ঘটে যেতে পারে।
সাবধানে পুরো বিষয়টা আবার ভেবে দেখার জন্য তাঁরা দীর্ঘ সময় সেখানেই বসে রইলেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন না। মহিতোষের মনে হলো, তাঁর মাথাও ঠিকঠাক কাজ করছে না। এমনিতেই নানা কারণে তিনি মানসিকভাবে বিচলিত। সবকিছুই যেন তাঁর বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারছেন না তিনি। এর মধ্যে তাঁর স্ত্রী অঞ্জলিও আছেন। পারু এবং মহিতোষকে এই অবস্থায় রেখে তিনি কিছুতেই দেশ ছেড়ে যাবেন না। অনেক চেষ্টা করেও তাকে রাজি করানো যায়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রচণ্ড বিরক্ত মহিতোষ। তিনি টের পাচ্ছেন, মাত্র একদিনেই অরবিন্দু মেসোর ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূরা তাদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠেছে। এমনিতেই অসুস্থ, ঘরে পড়া মাকে নিয়ে তাদের ঝামেলার শেষ নেই। তার ওপর পুরো একটা পরিবার তল্পিতল্পা নিয়ে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। বিষয়টা আসলেই সহ্য করার মতো না। দিন যত যেতে থাকবে, তাদের এই অসহনীয়তা ততই বাড়তে থাকবে। বিষয়টা তিনি আঁচ করতে পারলেও অঞ্জলিকে কিছুতেই কিছু বোঝানো যাচ্ছে না।
মহিতোষ ডান হাতের চাটিতে আরো একটি মশা মারলেন। তারপর অরবিন্দু বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, যা করার আজকেই করতে হবে। কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। বিপদ বাড়বে। তা ছাড়া রাতে আমাদের থাকার মতো কোনো জায়গাও তো এখানে নেই।
অরবিন্দু বাবু গম্ভীর মুখে বললেন, হুম।
মহিতোষ বললেন, এখন ধরেন বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ডাক্তার বাজারে গেলেন না। তখন? তখন ঝামেলা না? তারচেয়ে সবচেয়ে নিশ্চিত উপায় হচ্ছে তার বাড়িতে যাওয়া। বাড়িতে উনি আছেনই।
এই দিন দুপুরে তুই তাঁর বাড়িতে যাবি? লোকজন দেখে ফেললে?
আমি যাব না। যাবেন আপনি।
আমি! যুগপৎ ভীত ও অবাক গলায় বললেন অরবিন্দু বাবু।
আপনাকে যেহেতু এ গাঁয়ে কেউ চেনে না। সেহেতু আপনি গেলে কোনো সমস্যাও নেই। আর আপনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে যাবেন। যেন কোনো রোগী। কোনো উপায় ছিল না বলে সরাসরি ডাক্তারের বাড়িতে চলে এসেছেন। তা ছাড়া, উনি তো বাজারে যাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় অনেক রোগীই নিয়মিত তার বাড়িতে আসে। সুতরাং এটা অস্বাভাবিক কিছু না। স্বাভাবিক ঘটনা।
একটু ইতস্তত করলেও অরাজি হলেন না মেসো। বললেন, তারপর?
তারপর ওনার সঙ্গে কথা বলবেন। আপনার পরিচয় দেবেন।
আমার পরিচয় দিব?
হুম।
উনি কিছু বলবেন না?
আশা করি বলবেন না। উনি মানুষ ভালো। নিশ্চয়ই আমাদের পরিস্থিতিটা উনি বুঝবেন। যদি এতে আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকত, বা ইচ্ছে করে কিছু করতাম আমরা। তাহলে নিশ্চয়ই এত বিপদ মাথায় নিয়ে এভাবে ওনার সঙ্গে দেখা করতে আসতাম না। তাই না?
হু, তা ঠিক। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন অরবিন্দু।
তা ছাড়া এই চিঠিটা আপনি তারে দেবেন। উনি যদি শেষ পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাসই না করেন, তাহলে আপনার কোনো ক্ষতি যেন না হয়। কারণ দোষ যদি কিছু থেকেও থাকে, সেইটা আমার। আপনারতো কোনো দোষ থাকার কথা না। আমি তখন তাঁর বাড়ির আশপাশেই থাকব। শাস্তি কিছু দিতে হলে উনি যেন আমারে দেন। আপনারে যেন কিছু না বলেন। সব এই চিঠিতে বিস্তারিত লেখা আছে।
অরবিন্দু বাবু কিছু বললেন না। তবে মহিতোষের দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। ওহাব মাস্টারের বাড়ির পেছন দিকটা ঘন ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি। শীতকাল বলে জায়গাটা এখন শুকনো খটখটে। চলাচলের যোগ্য। তবে বর্ষাকালে এদিকটায় সাপখোপের যন্ত্রণায় পা রাখা দায়। মহিতোষ সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামনেই একটা পুকুর। পুকুরের দুই ধারে উঁচু ঢিবি। ঢিবি পেরিয়ে খানিক হেঁটে গেলেই গোয়ালঘর। তার পাশেই শুকনো খড় কাঠ-পাতা রাখার জায়গা। মাটির চুলাতে এগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তার পাশেই ওহাব মাস্টারের ঘরের পেছন দিককার বারান্দা। অরবিন্দু বাবুকে ওখানটাতে গিয়ে গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে সামনের উঠানে যেতে হবে। তারপর মূল দরজায় দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে ডাক্তাররে ডাকলেই ভেতর থেকে কেউ না কেউ সাড়া দেবে। কয়েকবার পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার পরও অরবিন্দু বাবু ঠিক নিঃসংশয় হতে পারছিলেন না। তবে তিনি গেলেন।
বাড়িটা আশ্চর্যরকমের শান্ত, চুপচাপ। যেন কোথাও কেউ নেই। এখন এই খাখা দুপুরে কাছেই কোথাও দোয়েল ডাকছে। একটা দুটো শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে গাছ থেকে। সেই শব্দগুলো বড় কানে লাগছে। অরবিন্দু বাবু দুইবার কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর অনুচ্চ স্বরে ডাকলেন, ডাক্তার সাহেব বাড়িতে আছেন? ডাক্তার সাহেব?
ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ এলো না। যেন এই বাড়িতে কেউ নেই। শূন্য, একাকী এক বাড়িতে তিনি শুধু শুধু কাউকে ডেকে যাচ্ছেন। সেই শব্দ আলগোছে প্রায় নিঃশব্দ প্রতিধ্বনির মতো তাঁর নিজের কাছেই ফিরে আসছে। তিনি চকিতে দুইবার এদিক-সেদিক উঁকি দিয়ে দেখলেন। কারো কোনো সাড়া-শব্দ, উপস্থিতি নেই। তবে উঠানে কতগুলো মুরগির ছানা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা টুক টুক করে তাদের ছোট্ট ঠোঁটে খুঁটে খুঁটে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করছে। তার মানে বাড়িতে লোকজন রয়েছে। কিন্তু তারা এমন অদ্ভুত নীরব কেন? অরবিন্দু বাবু কয়েক কদম হেঁটে ঘরের একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর সতর্ক হাতে চাপ দিলেন দরজায়। ভেজানো দরজাটা খুলে গেল। তিনি গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন, ভেতরে কেউ আছেন?
সঙ্গে সঙ্গেই কোনো জবাব এলো না। তবে কারো নড়াচড়ার শব্দ শোনা গেল। তিনি প্রায় দমবন্ধ করে অপেক্ষা করলেন । এই মুহূর্তে আমাকে দেখা গেল। সে খুব উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বলল, কে?
আমাকে আপনে চিনবেন না মা। আপনার বাবা বাড়িতে আছেন? ডাক্তার সাহেব? খুব জরুরি দরকারে আসতে হইল। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন অরবিন্দু বাবু।
আছমা তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঠানের দিকে তাকাল। যেন অরবিন্দু বাবুর কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। যেন সে অন্য কাউকে আশা করছিল। ফলে উঠোনে আর কেউ রয়ে গিয়েছে কী না, তা দেখার চেষ্টা করছে সে। অরবিন্দু বাবু বললেন, ডাক্তার সাহেব তো ঘরেই আছেন। না?
আছমা খানিক দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ভেতরের দিক লক্ষ্য করে বলল, মা, কে জানি আসছে । আব্বার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
অরবিন্দু বাবু ভেবেছিলেন আব্দুল ওহাবের সঙ্গে দেখা করতে হলে তাকে আরো বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আমার মা এসে নিশ্চয়ই অনেক কঠিন। কঠিন প্রশ্ন করবেন। সেসব প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে তাও তিনি মনে মনে ভেবে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ালেন একজন মধ্যবয়স্ক লোক। তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। শরীরেও স্পষ্ট অসুস্থতার লক্ষণ। যেন সোজা হয়েই দাঁড়াতে পারছেন না। তিনি ভাঙা গলায় বললেন, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না?
অরবিন্দু বাবু বিগলিত হাসলেন, আগে একটু ঘরে ঢুকি বসি ভাই সাহেব? অনেক দূর থেকে পায়ে হেঁটে এসেছি।
আব্দুল ওহাব যেন এতক্ষণে লোকটিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন। ধুলোয় ধূসরিত মলিন পা। পোশাকে এখানে-সেখানে ময়লা লেগে আছে। চোখে মুখেও কেমন একটা বিভ্রান্ত, বিচলিত ভাব। তিনি লোকটার প্রতি কৌতূহল বোধ করলেন। নিজের শরীর খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তাকে বসতে বললেন আব্দুল ওহাব। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পরে অরবিন্দু বাবু চট করে কথাটা বললেন, আমার নাম অরবিন্দু। আমি মহিতোষের মেজো মেসো। যশোর থেকে এসেছি।
কথাটা শুনে চট করে মাথায় যেন একটা চক্কর অনুভব করলেন আব্দুল ওহাব। তিনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, আপনি মহিতোষ মাস্টারের মেজো মেসো?
হুম।
আপনি এখানে কেন?
সেটা বলছি। তার আগে আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই।
কী অনুরোধ?
আপনি কি মহিতোষের ওপর কোনো কারণে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন?
আমি তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে থাকব কেন? আপনি শুধু একটা কথা বলেন, আমার ফরিদ কই আছে? সে কি মহিতোষ মাস্টারের সঙ্গে আছে?
এই কথায় অরবিন্দু বাবু চুপ করে গেলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, ফরিদ আর পারু সম্বন্ধে তারা যতটুকু জানেন, তারচেয়ে একবিন্দুও বেশি কিছু জানেন না আব্দুল ওহাব। তার কণ্ঠে স্পষ্ট উৎকণ্ঠা। তবে তাতে মহিতোষের প্রতি আলাদা কোনো প্রতিহিংসা নেই। আব্দুল ওহাব বললেন, আর আপনি এইখানে এলেন কীভাবে? এই জায়গা আপনার জন্য নিরাপদ না। কেউ জানলে খুব খারাপ কিছু ঘটে যাবে। আমি নিজেও আছি মহাবিপদে।
আব্দুল ওহাবের কথা শুনে অরবিন্দু বাবু অন্তত এই ঘরে তার নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে নিঃসংশয় হলেন। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে মহিতোষের লেখা চিঠিখানি ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সেখানে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লেখা আছে। কখন কোথায় গিয়ে তারা কীভাবে আবিষ্কার করলেন যে পারু তাঁদের সঙ্গে নেই। এবং সে ফরিদের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। যদি তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য থাকে তবে আব্দুল ওহাব যেন তা জানান। এবং মহিতোষের প্রতি কোনো ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ পুষে না রাখেন। এই ঘটনায় তিনি নিজেই বরং এখন সর্বহারা, বিপদগ্রস্ত একজন মানুষে পরিণত হয়েছেন।
চিঠিখানা পরপর দুইবার পড়লেন আব্দুল ওহাব। তারপর বললেন, মহিতোষ বাবুও আশপাশেই আছেন?
হুম।
কিন্তু কাজটা আপনারা ঠিক করেন নাই। আপনারা একটা বিপজ্জনক কাজ করেছেন। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমার সাধ্য নেই তা থেকে আপনাদের রক্ষা করি। আমার নিজের সামনেই এখন ফাঁসের দড়ি।
কেন? কী হয়েছে? প্রশ্নটা করলেও থমকে গেলেন অরবিন্দু বাবু। তিনি স্পষ্ট ভয় দেখতে পাচ্ছেন আব্দুল ওহাবের চোখে। হাতের চিঠিটাকে হঠাৎ পায়ের কাছে ফেলে দিলেন তিনি। তারপর পা দিয়ে সাবধানের চেয়ারের পেছন দিকে ঠেলে দিতে থাকলেন। মাটিতে লুটিয়ে থাকা তার লুঙ্গির প্রান্তের ওপারে ঢাকা পড়ে গেল চিঠিটা। বিষয়টা ভারি অবাক করল অরবিন্দু বাবুকে। তিনি হঠাৎ পেছন ফিরে তাকালেন। একজন খর্বাকায় লম্বা টিনটিনে মানুষ উঠোন পেরিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। তার চোখে মুখে প্রবল ঔদ্ধত্য ও হিংস্রতা। সে দরজায় দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলল, কী হইলো ডাক্তার সাব? আপনে না-কি অসুস্থ? মসজিদে নামাজে যাইতে পারলেন না! আর এইখানে বসে কার সঙ্গে খোশগল্প করতেছেন?
আব্দুল ওহাব জবাব দিলেন না। তিনি এছাহাকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। এছাহাক বলল, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেন। আপনারে এখনই যাইতে হবে। থানা শহর থেকে আতাহার মওলানা আসছে। আর গ্রামের লোকজনও সব অপেক্ষা করতেছে। ওঠেন ওঠেন। রেডি হন।
সে চট করে অরবিন্দু বাবুর দিকে তাকাল। তারপর কপাল কুঁচকে বলল, আপনে কে মুরুব্বি? আপনারে তো চিনলাম না!
আব্দুল ওহাব এস্ত ভঙ্গিতে বললেন, ওনারে তুমি চিনবানা এছাহাক। উনি উত্তরপাড়ার মৃধা বাড়ির আত্মীয়। ওনার নাতি অসুস্থ। ওই জন্য প্রেসক্রিপশন নিতে আসছে।
ওওহ! বললেও তার গলা থেকে প্রশ্নটা যেন পুরোপুরি দূর হলো না। খানিকটা সন্দিগ্ধ চোখেই সে অরবিন্দু বাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, তাড়াতাড়ি রেডি হন ডাক্তার। সময় নষ্ট করনের মতো আর সময় নাই।
আব্দুল ওহাব নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেই বললেন, তা ভাই সাহেব ওই ওষুধগুলা খাওয়াই দিয়েন। দিনে দুই বেলা। সকালে আর রাতে। ঠিক আছে? এরপরও যদি ঠিক না হয়, তাইলে আমার কাছে নিয়ে আইসেন। আজ তাহলে যান, হ্যাঁ?
অরবিন্দু বাবু ডাক্তারের আচরণে যারপরনাই মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছেন। প্রবল কৃতজ্ঞতাও বোধ করছেন। তিনি বললেন, আপনি এখন কোথায় যাবেন?
এইতো একটু বাইরে।
এছাহাক অবশ্য আব্দুল ওহাবের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল, তার বিচার আছে। লোকজন সব অপেক্ষা করতেছে।
এই মুহূর্তে নুরুন্নাহারকে দেখা গেল দরজায়। তিনি স্পষ্ট শক্ত গলায় বললেন, সে এখন কোথাও যাবে না। কীসের বিচার তার? সে কী কোনো অপরাধ করছে? অপরাধ করলে যারা করছে, তাগো গিয়া খুঁইজা বাইর করো তোমরা। যাও ফরিদরে গিয়া খুঁইজা বাইর করো। সেই মুরোদ তো নাই। আসছে দুর্বলের ওপর অত্যাচার করতে। না?
নুরুন্নাহারের কণ্ঠে ঝঝ। তাঁর চোখে মুখে বেপরোয়া ভঙ্গি। বিষয়টা লক্ষ্য করে খানিক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল এছাহাক। সে বলল, অপরাধ তার না কার, সেইটার জন্যই তো বিচার। সবাই মিলে ঠিক করবে তার দোষ আছে কী নাই?
কারো ঠিক করা লাগবে না। আর তার শরীরও ভালো না। সে এখন যাইব না।
এছাহাক রুষ্ট হলো এবার। সে কঠিন গলায় বলল, সে যাই না। তার ঘাড় যাইব। এমনে এমনে আপসে গেলে ভালো। না হলে জোর করে নেওয়ার ব্যবস্থা হবে।
কী! যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন নুরুন্নাহার। তিনি আচমকা তার পেছনে আড়াল করে রাখা হাতখানা বের করলেন। সেই হাতে একটা মাছ কাটার বঁটি। তিনি সেই বঁটিখানা সামনে বাড়িয়ে ধরে শীতল গলায় বললেন, দেখি, কোন বাপের বেটার সাহস তার গায় হাত দেয়। আয়, আর এক পা সামনে আয়।
এছাহাক পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেছে। আর যাই হোক, নুরুন্নাহারের কাছ থেকে এমন আচরণ সে আশা করেনি। তাঁকে সে সারাজীবন চুপচাপ, শান্ত, নিরীহ একজন গৃহবধূ হিসেবেই দেখেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনিও যে এমন ফণা ধরা সাপ তা কে জানত। স্তম্ভিত এছাহাক কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে পেছন থেকে ডাকল খলিল। খলিল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার আড়তে কাজ করে। সে বলল, এছাহাক ভাই আপনেরে ভূঁইয়া সাবে ডাকে।
এছাহাক বিরক্ত গলায় বলল, এত ডাকাডাকির কী আছে? দেখোস না, আমি এইখানে একটা কাজে আসছি? ডাক্তাররে নিয়া যাইতে হবে। কিন্তু তার বউ ঝামেলা করতেছে।
ভাই ডাক্তাররে নিতে হইব না। আসল ঘটনা ঘইটা গেছে।
আসল ঘটনা? এছাহাক পেছন ফিরে তাকাল। আসল কী ঘটনা?
ফরিদ আর পারুর খোঁজ পাওয়া গেছে।
কী কস তুই? কই?
আতাহার মওলানার বাড়িতে। ভূঁইয়া সাব এখন সেই বাড়িতে যাইতেছেন। আপনে তাড়াতাড়ি আসেন। এক্ষুণি যাইতে বলছে…।
এছাহাক আর একটা কথাও বলল না। সে লাফ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল বড় রাস্তার দিকে। আব্দুল ওহাব, নুরুন্নাহার ও অরবিন্দু বাবুর তিনজোড়া ভীত, বিস্মিত, কৌতূহলী চোখ তার সেই ছুটে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি সত্যিই ফরিদ আর পারুর খোঁজ পাওয়া গেছে?
.
ভগ্নপ্রায় মন্দিরটার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন মহিতোষ মাস্টার ও অরবিন্দু বাবু। দূরে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে দলবল নিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। তারা এখন থানা শহরে আতাহার মওলানার বাড়িতে যাবে। পারুর খোঁজ পাওয়া গেছে শুনে মহিতোষের কেমন অনুভূতি হয়েছে তিনি তা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছেন না। প্রথমে চট করে মনে হয়েছিল বহুদিন পর আবার বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছেন। একটা শান্ত শীতল ফুরফুরে হাওয়া যেন বুকের এপাশ থেকে ওপাশে বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও তাকে জেঁকে ধরল নানা শঙ্কা। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কাছে এ এক অভাবিত সুযোগ। তিনি যেকোনো মূল্যে এই সুযোগ কাজে লাগাবেন। তার চূড়ান্তভাবে হেরে যাওয়া খেলায় আবার নতুন করে পুনরুজ্জীবন ঘটবে। অরবিন্দু বাবু পুরো ঘটনাই সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। শুনে মহিতোষ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছেন। তিনি এখন কী করবেন তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না।
অরবিন্দু বাবু বললেন, তুই মওলানার বাড়ি চিনিস?
মহিতোষ ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ালেন। অরবিন্দু বাবু বললেন, থানা শহরে কোনোভাবে পৌঁছাতে পারলেই চিনে নেওয়া যাবে। উনি পরিচিত মানুষ। কেউ না কেউ চিনবেই।
কিন্তু সেটা তো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার আগে পৌঁছাতে হবে। তাই না? তার পরে পৌঁছালে তো লাভ নাই।
তাহলে আমরা এখানে দাঁড়াই আছি কেন?
মহিতোষ বিড়বিড় করে বললেন, কারণ তারা এর মধ্যেই রওনা করে দিয়েছে। আমরা তাদের আগে আর পৌঁছাতে পারব না।
অরবিন্দু বাবু মহিতোষের দৃষ্টি লক্ষ করে তাকালেন। আট-দশ জনের একটা ছোট দল দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। তাদের সামনে রয়েছেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। অরবিন্দু বাবু শঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, এখন? এখন তাহলে কী করবি?
মহিতোষ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, জানি না।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াদের দলটা দ্রুত গতিতে তাদের অতিক্রম করে গেল। মহিতোষ এটুকু সময়েও তার মুখভঙ্গিটা স্পষ্ট পড়ে নিতে পারলেন। চোখ দুটি যেন আগুনের পিণ্ডের মতো গনগন করে জ্বলছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। হাঁটার সময়ই শরীরের দুই পাশে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। শান্ত সফেদ চেহারার আড়ালে যে খুনি চেহারাটা তিনি লুকিয়ে রাখেন তা যেন মুহূর্তেই উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
অরবিন্দু বাবু অসহায় চোখে তাকিয়ে বললেন, এখন? পারুর সামনে তো ভয়াবহ বিপদ।
মহিতোষ কথা বললেন না। তার সামনে সত্যি সত্যিই এই মুহূর্তে আর কোনো পথ নেই। একটা কাজ অবশ্য তিনি করতে পারেন, সেটি হচ্ছে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে পারেন। হয়তো এই একটি মাত্র উপায়েই তাঁকে এই যাত্রা থেকে নিরস্ত করতে পারে। সমস্যা হচ্ছে এতেও পারুর বিপদ কমবে না। বরং বাড়বে। কারণ ফরিদ আর পারুর ঘটনাটি এখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। সবাই জেনে যাবে। সুতরাং পারুকে যদি আগেভাগে সাবধান করা না যায়, কিংবা আতাহার মওলানার বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা না যায়, তাহলে সে সত্যি সত্যিই ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে গিয়ে পড়বে। সমস্যা হচ্ছে তাকে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায়ই তার জানা নেই।
অরবিন্দু বাবু বললেন, থানা শহরে যাওয়ার আর কোনো পথ নাই? শর্টকাট, যেটা দিয়ে তাদের চোখ এড়িয়ে আগেভাগেই চলে যাওয়া যাবে?
নাহ, নাই…। কথাটা বলতে বলতেই থমকে গেলেন মহিতোষ। তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, একটা পথ অবশ্য আছে। কিন্তু সেটা আমরা পারব কী না জানি না। আর বিপদ তো আছেই।
কী পথ?
ভুবনডাঙা নদীর কারণে এই রাস্তা প্রথমে মাইল তিনেক দক্ষিণে গিয়ে আবার প্রায় অর্ধেক পথ উত্তরে গেছে। এখন আমরা যদি আড়াআড়ি নদী পাড় হতে পারি। তাহলে প্রায় কয়েক মাইল পথ এগিয়ে থাকব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেখান দিয়ে পাড় হতে হবে সেখান কোনো নৌকা নাই। আর নৌকা থাকলেও ওঠা যাবে না। লোকজন আমাকে চিনে ফেলবে।
অরবিন্দু মেসো বৃদ্ধ মানুষ। যদিও দেখতে এখনো শক্ত-সামর্থ। তারপরও তিনি এরপর যে কথাটি বললেন, সেটির জন্য মহিতোষ প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বললেন, এই শীতে তো নদীতে হাঁটুজল। আমরা হেঁটে পাড় হতে পারব না?
কথাটা মন্দ বলেননি অরবিন্দু বাবু। কিন্তু এতক্ষণ যেন বিষয়টা মাথায়ই আসেনি মহিতোষের। তিনি বললেন, কিন্তু এ বিকেলে নদীর জল কেমন ঠাণ্ডা তাতো জানেন। আপনি এই বয়সে পারবেন পাড়ি দিতে?
মেসো হাসলেন, ঢের পারব। তুই চল।
মহিতোষরা নদী পাড় হলেন কোনোরকম বিড়ম্বনা ছাড়াই। এদিকটাতে নদীর জল সবচেয়ে কম। নিচের বালি অবধি দেখা যায়। দু-এক জায়গায় অবশ্য মাঝে মধ্যেই একটু খাদের মতো ছিল। তাতে কয়েকবার তাদের হাঁটুর ওপর অবধি গোটানো প্যান্ট ভিজে গেল। তবে তা নিয়ে দুজনের কারোই কোনো আক্ষেপ রইল না। বরং এত সহজে নদী পাড় হতে পেরে তারা অত্যন্ত আনন্দিত। যদিও এই আনন্দের পূর্ণতা আনতে হলে বাকি কাজটুকু ঠিকঠাক সারতে হবে। মহিতোষ আর অরবিন্দু বাবু সেই কাজটুকু করতে রুদ্ধশ্বাসে ছুটলেন।
২৩
রফিকুল ঘটনা শুনল তার মায়ের কাছে। বাবা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই যেন বুকে আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ল সে। বল, আব্বা কখন আসবে?
বলল তো দেরি হবে। দূরে গেছে।
দূরে কই?
ভূবনডাঙা।
ভূবনডাঙা?
হম।
শুনেই ধক করে উঠল রফিকুলের বুক। সে বলল, কী জন্য গেছে?
জানি না। তবে কোনো ঝামেলা-টামেলাই হবে। গাঁও গ্রামের ব্যাপার কত কিছুই তো ঘটে। নাজমা বেগম ভেবেছিলেন ছেলের সঙ্গে ফরিদ আর পারুকে নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু রফিকুল আর তাকে সেই সুযোগ দিল না। সে ছুটে এলো ফরিদের কাছে। তারপর বলল, সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
কী সর্বনাশ?
আব্বা আর মা পারুর বিষয়ে সন্দেহ করতেছে। সে না-কি কয়েকবার দিলারা ভাবিরে বৌদি বলে ডাকছে। পানিরে জল বলছে। আরো নানা কাহিনি। এর মধ্যে আব্বা গেছে ভুবনডাঙা কী এক সালিসে। বলে গেছে বাড়ি এসে তোদের নিয়া বসবে। একবার চিন্তা করত অবস্থা?
কই গেছে? ভুবনডাঙা?
হুম। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া নামে একজন তারে দাওয়াত দিয়া নিয়ে গেছে। জুমার নামাজের পর কী কী সব বিচার-আচার হবে।
ফরিদের মনে হলো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল। এই মুহূর্তে আর কিছুই আসছে না তার মাথায়। কী করবে সে?
ঘটনা দিলারাকে খুলে বলা হলো। সে বুদ্ধিমতি মেয়ে। কিন্তু তারপরও দিশেহারার মতো হয়ে গেল সে। বলল, রফিকুল, তুমি একবার ভাবো তো, আব্বা সব জেনেশুনে বাড়ি আসছে। তারপর কী হবে?
রফিকুল কথা বলল না। দিলারা বলল, এই বাড়িতে আজ কেয়ামত হয়ে যাবে। যদি উনি ঘুণাক্ষরেও জানেন যে আমিও এইসবের সঙ্গে যুক্ত। তাহলে এই বাড়িতে আজই আমার ভাত শেষ। তোমার ভাই কালই আমারে তালাক দেবে। ঘটনা কিছু বুঝতে পারছো?
উন্মত্ত সমুদ্রে প্রবল ঝড়ে পড়া জাহাজের মতো অবস্থা ফরিদের। দিলারার কথা ভেবেও এখন অপরাধবোধ হচ্ছে তার। কিন্তু কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। দিলারা বলল, আমি কিছু জানি না। এইসবের কিছু জানি না আমি। তুমি এদের এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বের করো। আর একটা মুহূর্তও না।
রফিকুল ফ্যালফ্যাল করে দিলারার দিকে তাকিয়ে রইল। দিলারা বল, তোমার কারণে আজ আমার এই বিপদ। তোমরা আমার সঙ্গেও মিথ্যা বলছো। আর এখন আবার আসছো আমার কাছে সাহায্য চাইতে? আমার উচিত তোমাদের এখন দরজা বন্ধ করে আটকিয়ে রাখা।
রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছে দিলারা, শুধু এই একটা কাজ করলেই এখন আমি নিজেরে বাঁচাতে পারব। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। শুধু ওইটা হলেই আব্বা বুঝবেন যে এইসবের কিছুই আমি জানতাম না।
ফরিদ দিলারার অবস্থাটা বুঝতে পারছে। তারপরও সে আশা করেছিল দিলারা হয়তো কোনো না কোনো একটা উপায় খুঁজে বের করবে। কিন্তু এখন দিলারার এমন অগ্নিমূর্তি দেখে পুরোপুরি অসহায় বোধ করছে সে। নিজেকে মনে হচ্ছে ঝড়ে বিধ্বস্ত ডানা ভাঙা এক পাখি। যার চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে অসংখ্য শ্বাপদ। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সে উড়তে পারছে না। বসে আছে মৃত্যুর অপেক্ষায়।
রফিকুল হাত জোড় করে বলল, সব দোষ আমার ভাবি। আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু ওদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলে ডেকে এনে আমরা তো ওদের ধরিয়ে দিতে পারি না? এইটা খুবই অন্যায় একটা কাজ হবে ভাবি। তা ছাড়া পারুর এই দেশে কেউ নাই। ও একা। ওর বাবা-মা চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। একবার ভাবো ওর কী হবে?
আমি এত কিছু ভাবতে পারব না। বেশি ভাবতে গেলেই বিপদ। এইজন্যই সবাই বলে কারো উপকার করতে নাই। উপকারীরে বাঘে খায়। আমি আর কিছুক্ষণ পর বাঘের সামনে পড়ব, তখন আমারে কে রক্ষা করবে? তুমি?
রফিকুল এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। সে ফরিদের দিকে তাকাল। ফরিদের চোখে শূন্যদৃষ্টি। পারুকে আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তবে গত রাত থেকেই তার শরীরটা ভালো নেই। হয়তো সে কারণে ঘরে শুয়ে আছে। তারা কথা বলছে বাইরের ঘরে বসে। রফিকুল শেষ চেষ্টাটা করল। মরিয়া ভঙ্গিতে বলল, ভাবি, তোমার কিছু করতে হবে না, জাস্ট একটা বুদ্ধি…।
সে কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল দিলারা। বলল, আর একটা কথাও না। এই বিষয়ে আর একটা কথাও না। রাতের মধ্যে। আমার ঘর খালি চাই আমি। যা হওয়া যথেষ্ট হয়েছে। আর না…।
বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল সে। রফিক মাথা নিচু করে বসে রইল। সে পড়েছে উভয় সংকটে। ফরিদের জন্য তার খারাপ লাগছে এটা যেমন ঠিক। তেমনি নিজের জন্যও ভয় হচ্ছে তার। বাবা বাড়িতে এলে কী হবে সে জানে না। জানে না ফরিদদের ভাগ্যে কী জুটবে। বিশেষ করে পারুর কথা ভেবে বেশি খারাপ লাগছে তার। মেয়েটা এখন কোথায় যাবে? কী করবে? কী হবে তার?
ফরিদকে ডাকল সে। কিন্তু ফরিদ জবাব দিল না। যেমন বসে ছিল তেমন বসেই রইল। যেন যে ভয়ংকর জটিল পৃথিবীতে সে ইচ্ছে করে ঢুকে পড়েছে, সেই পৃথিবীর আর কোথাও সে নেই।
.
মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। এই নামাজের সময় থাকে খুব অল্পক্ষণ। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অবশ্য সেটা নিয়ে ভাবিত নন। তিনি যতদ্রুত সম্ভব আতাহার মওলানার বাড়িতে পৌঁছাতে চান। কিন্তু বাধ সাধলেন মওলানা নিজেই। তিনি বললেন, তাড়াহুড়ার কিছু নাই। তারা আমার বাড়িতে আছে। আরো বেশ কিছুদিন থাকবে। আপনি এত অস্থির হয়ে যাচ্ছেন কেন, সেটাই বুঝতে পারছি না।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া থতমত খাওয়া ভঙ্গিতে বললেন, না না। অস্থিরতার কিছু নাই। কিন্তু ধরেন আমি গ্রামের মাথা। এখন আমার গায়ে এমন একটা ঘটনা ঘটলে সবাই তো আমারেই দোষারোপ করবে তাই না? করতেছেও।
হুম। তা বুঝলাম। কিন্তু সবকিছুর আগে তো আসল দোষের চিন্তা করতে হবে ভূঁইয়া। আসল বাদ দিয়া নকল নিয়া দৌড়াইলে হবে না।
আসল কী?
নামাজ। মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। আগে চলেন আশপাশে কোথাও নামাজটা পড়ে যাই।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মন তাতে কিছুতেই সায় দিল না। তিনি বললেন, এইখানে আশপাশে তো ভালো মসজিদ নাই। না হয়, আপনার বাড়ি পৌঁছানোর পরেই পড়লাম।
আতাহার মওলানা হাসলেন, নামাজের জন্য ভালো মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ না। নামাজটা গুরুত্বপূর্ণ। এইখানে রেলস্টেশন আছে। স্টেশনে মসজিদ আছে। সেখানে বহু মানুষ নামাজ পড়েন। চলেন সেইখানে নামাজটা সেরে ধীরে-সুস্থে বাড়ি যাই।
অগত্যা রাজি হলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারা মসজিদে নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে আতাহার মওলানা দীর্ঘ মোনাজাত ধরলেন। মোনাজাতের পুরো সময়টাতেই উশখুস উশখুস করতে লাগলেন ভূঁইয়া। কয়েকবার এদিক-সেদিক তাকালেনও। মওলানা অবশ্য মোনাজাত শেষ করেই বের হলেন না। মসজিদে একদল তাবলীগ জামাতের লোক এসেছে। তাদের সঙ্গে খানিক কথাবার্তাও বললেন। নিজ এলাকার মসজিদে আমন্ত্রণ জানালেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত। কিন্তু কিছুই বলতে পারছেন না। এছাহাক অবশ্য এক ফাঁকে বেরিয়ে গেছে। বেশিক্ষণ বিড়ি না খেয়ে সে থাকতে পারে না। স্টেশনের কোনায় ছোট্ট ঝুপড়ি একটা চায়ের দোকান। সেই দোকানের সামনে গিয়ে আরাম করে দাঁড়াল সে। তারপর একটা বিড়ি ধরাল। ঢাকাগামী ট্রেন থামছে স্টেশনে। মাত্র দু-তিন মিনিট থাকে এখানে। ফলে যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। তাদের এলোমেলো ছোটাছুটিতে স্থির হয়ে দাঁড়ানোই দায়। যাত্রী আর হকারদের চিঙ্কারে কানে তালা লাগার দশা। বিরক্ত এছাহাক বিড়িতে শেষ টানটা দিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তার চোখ আটকে গেল সামনে। এ কী দেখছে সে!
.
মহিতোষ মাস্টার যতক্ষণে আতাহার মওলানার বাড়ি খুঁজে পেয়েছেন, ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারপাশে কেমন একটা গুমোট অন্ধকার নেমে আসার অপেক্ষায় ওত পেতে আছে। তিনি এখনো নিশ্চিত নন যে তাদের আগেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারা এখানে এসে পৌঁছে গেছেন কি না। তারপরও কোনোদিকে না তাকিয়ে, কিছু না ভেবেই তিনি আতাহার মওলানার বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। সামান্য বিলম্বও তিনি করতে চাইছেন না। কিন্তু বাড়ি ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন তিনি। নীলের ওপর সাদা পদ্মফুলের মতো ছাপওয়ালা শাড়ি পরা এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির চৌহদ্দির ঠিক মুখেই। তরুণীর চোখে-মুখে রাজ্যের বিষাদ। তিনি তরুণীকে বললেন, মা, আপনি কী এই বাড়ির মেয়ে?
দিলারা দ্বিধামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, আমি এই বাড়ির বউ।
আতাহার মওলানা আপনার শ্বশুর?
জি।
মহিতোষ মাস্টার আচমকা হড়বড় করে বলতে লাগলেন, মা, আমার নাম মহিতোষ মাস্টার। আমি এক হতভাগা পিতা। আমার মেয়ে পারু আপনাদের বাড়িতে আছে। সে ফরিদ নামের আমার এক ছাত্রের সঙ্গে পালিয়ে এসেছে। তার। সামনে ভয়াবহ বিপদ। আমি আপনার কাছে করুণা ভিক্ষা করছি মা। তারে আপনি রক্ষা করেন। আপনারে বিনিময়ে দেওয়ার মতো কিছু আমার নাই। কিন্তু একজন পিতার কাছে তার মেয়েরে আপনি ভিক্ষা দেন মা। তারে বাঁচান। মাগো…। তার সামনে বিপদ মা। মা…।
মহিতোষ মাস্টার হাউমাউ করে কাঁদছেন। কান্নায় তাঁর কথা জড়িয়ে আসছে। তিনি ঠিক মতো দাঁড়িয়েও থাকতে পারছেন না। তার পাশে বয়স্ক একজন মানুষ। মানুষটির চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। দেখে বোঝাই যাচ্ছে বহু পথ, বহু চড়াই উতড়াই পেরিয়ে তারা এখানে এসেছেন। দিলারা মানুষ দুজনকে দেখে ভেতরে ভেতরে কেমন কেঁপে উঠল। তবে তার সেই কম্পন বাইরে প্রকাশ পেল না। আজ কত মাস হয় সে বাড়ি থেকে এসেছে? যখন এসেছিল, তখন তার বাবার চোখেও ঠিক এই আকুতিটাই সে দেখেছিল। অথচ সে কোনো অনিশ্চিত গন্তব্যে উধাও হয়ে যায়নি। এসেছিল তার স্বামীর বাড়ির গন্তব্যে। তারপরও বাবার ওই ব্যাকুল চোখজোড়ার কথা সে মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না। আর এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মুখের এই বাবার চোখজুড়ে যে কান্না, যে আকুতি তা তার মেয়েকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে হারিয়ে ফেলার কান্না। কিন্তু তারপরও ওই দুই পিতার কান্নায় যেন কোনো পার্থক্যই খুঁজে পেল না দিলারা। তার বুকের ভেতরটা কেমন অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় হুহু করে উঠল। সে বাঁ হাতের উল্টোপিঠে তার চোখজোড়া আড়াল করতে করতে বলল, চাচাজি, পারু আর। ফরিদ এই কিছুক্ষণ আগে বের হয়ে গেছে। তারা ছয়টার ট্রেনে ঢাকা যাবে। আপনি দ্রুত যান, ট্রেন স্টেশনে আসার আগেই আপনি পৌঁছাতে পারলে তাদের পেয়েও যেতে পারেন।
মহিতোষ মাস্টার আর একটা কথাও বললেন না। তিনি হাওয়ার বেগে স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছুটলেন। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে রইল দিলারা। খানিক আগে হাতের উল্টোপিঠে যে চোখজোড়া সে আড়াল করতে চেয়েছিল, সেই চোখজোড়া আর আড়াল করল না। হাত সরিয়ে উন্মুক্ত করে দিল। ভিজে যেতে দিল বিরামহীন বর্ষণে।
.
এছাহাক লাফ দিয়ে সামনে এগোতে গিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গেই থমকে দাঁড়াল। এই এত এত মানুষের ভিড়ে সে একা কী করবে? বরং সে যদি এখন জোর করে কাউকে ধরে আনতে যায়, তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। জনগণ বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নাও নিতে পারে। চোর, বদমাশ, পকেটমার মনে করে গলধোলাইও দিয়ে বসতে পারে। তার বরং কয়েকজন লোক দরকার। সমস্যা হচ্ছে তার সঙ্গের লোকগুলো মসজিদের ভেতরে মওলানা সাহেবের বয়ান শুনছে। আগে তাদের ডেকে আনতে হবে। একা একা কিছু করতে গিয়ে যদি আবার কোনো ঝামেলা হয়ে যায়, তখন দোষটা তার ঘাড়েই পড়বে। এমনিতেই ভূঁইয়া সাহেব তার ওপর নানা কারণে খুব বিরক্ত। তার ওপর নতুন করে আর ঝুঁকি নিতে চায় না সে। এছাহাক মসজিদের দিকে ছুটল।
বিরক্ত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তাকে দেখে আরো বিরক্ত হয়ে গেলেন। তিনি কপাল কুঁচকে নিচু গলায় বললেন, সবাই এইখানে, আর তুমি কই গেছিলা? এছাহাক মুখে জবাব দিল না। তবে সে হাত ধরে টেনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে দরজার কাছে নিয়ে এলো। তারপর ফিসফিস করে বলল, পারু আর ফরিদ এইখানে। পারুর পরনে বোরখা। এইজন্য মুথ দেখা যায় নাই। তবে ফরিদরে আমি দেখছি। সে বোরখা পরা পারুর হাত ধইরা যাইতেছে!
কী! মুহূর্তেই যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।
হ্যাঁ। তারা ট্রেনে উঠতেছে। বগি নম্বর গ।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া চিৎকার করে বেলালকে ডাকলেন। আতাহার মওলানাসহ মসজিদের অন্যরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তবে তিনি তা গ্রাহ্য করলেন না। ছুটতে শুরু করলেন স্টেশনের দিকে। কিন্তু যতক্ষণে তিনি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছালেন, ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে ট্রেন। কমতে শুরু করেছে শব্দ। বিস্ময়ে স্তব্ধ জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হঠাৎ আবিষ্কার করলেন এই ভিড়ের মধ্যে দৌড়ে গিয়েও তিন আর ট্রেনটা ধরতে পারবেন না।
.
মহিতোষ মাস্টার যখন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঢুকলেন। তখন সর্বশক্তিতে ছুটে যাচ্ছে। ট্রেন। স্টেশনভর্তি গিজগিজ মানুষ। সেই মানুষের ভিড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। বিভ্রান্ত, বিধ্বস্ত এক মানুষ। নিঃস্ব, সর্বহারা এক পিতা। ট্রেনটা দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে দূরে। দূর থেকে আরো দূরে। সেই দূরত্ব যেন তিনি মাপতে পারছেন তার বুকের ভেতর ফেনিয়ে ওঠা অদ্ভুত যন্ত্রণার জলোচ্ছ্বাসে। তার চোখের সামনে প্রলয়ঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড়ে যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। ক্রমশই অপস্রিয়মাণ ট্রেনটির বিদঘুঁটে শব্দ যেন খুবলে খুবলে তুলে নিচ্ছে তার বুকের রক্তজমাট মাংসপিণ্ড।
২৪
ট্রেনটি এক্সপ্রেস ট্রেন নয়। পথে বহু জায়গায় তাকে থামতে হবে। পান খাওয়া লাল ঠোঁট আর মলিন কাপড়ের অজস্র যাত্রী হাঁস-মুরগি সহযোগে এই ট্রেনে উঠবেন। তাঁরা বসার জায়গা পাবেন কী না তা নিয়ে মোটেও ভাবিত নন। চটের বস্তা কিংবা পুরনো কথা থাকে তাদের সঙ্গে। তারা সেই কাঁথা বিছিয়ে দু পাশের সিটের মাঝখানে যাত্রী চলাচলের যে জায়গা, সেখানে অনায়াসে বসে পড়েন। তার খোশগল্পে মশগুল হয়ে যান। কেউ কেউ নাক ডেকে ঘুমাতেও থাকেন। অন্য যাত্রীরা কেউ যদি তাদের পা-মাথা মাড়িয়ে দিয়ে, কিংবা আপাদমস্তক ডিঙিয়েও পার হয়ে যান, তাতেও তারা কিছু মনে করে না। বরং এই ভেবে প্রশান্তিতে নিদ্রা যান যে খুব ভোরে ঢাকা পৌঁছে তারা তাদের রোজগেরে কাজ ধরতে পারবেন।
পারু আর ফরিদকে অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। ট্রেনে গিজগিজে ভিড়। ফলে চট করে বসার আসন পাওয়ার সুযোগ নেই। পরবর্তী কোনো স্টেশনে যাত্রী নেমে গেলে হয়তো সুযোগ হবে। পারুর শরীরটা খারাপ। সে কিছুক্ষণ একা একাই হাতল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এ ধরনের পরিবেশে অনভ্যস্ত পারু কিছুক্ষণের মধ্যেই কাহিল হতে শুরু করল। এই তীব্র ঠাণ্ডায়ও লোকের ভিড় ও ঘামের গন্ধে শরীর গুলিয়ে ওঠার দশা। তার ওপর মুখঢাকা বোরকায় অনভ্যস্ত পারুর প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল। সে বোরকার মুখটা খানিক খুলে দিল। তারপর ক্লান্ত-ভীত চোখে ফরিদের দিকে তাকাল। ফরিদ ফিসফিস করে বলল, আরেকটু অপেক্ষা করো। এরা সব লোকাল প্যাসেঞ্জার। কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে যাবে। এই ট্রেনে খুব মানুষই ঢাকা পর্যন্ত যায়।
পারু অবশ্য ফরিদের কথায় আশ্বস্ত হলো কী না, বোঝা গেল না। তার কাছে এখন সবকিছুই সহজ-স্বাভাবিক মনে হয়। এই মাঝরাস্তায় কেউ যদি তাদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়, তাতেও সে অবাক হবে না। জীবন যেন তার কাছে এখন। কেবলই এক দুঃস্বপ্ন। এখানে ভয়াল দুর্দশা কিংবা গা-শিউরে ওঠা বিপদ ছাড়া আর কোনো কিছুই যেন প্রাপ্তির নেই। পারু আজকাল আর মনে করতে পারে না তার জীবনে কখনো ভালো কিছু ঘটেছিল কি না। নির্ভেজাল কোনো আনন্দের উপলক্ষ এসেছিল কি না। এ যেন এক অন্তহীন দুঃস্বপ্ন। সে যেন ক্রমশই পড়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর অন্ধকার অতল কোনো গহ্বরে। সেই পতন শেষই হচ্ছে না। অথচ একটা সময় এই জীবনের সবটা জুড়ে কেবলই আলো ঝলমলে সময় ছিল। প্রগাঢ় মায়াময় স্পর্শে বিবশ অনুভব ছিল। রোজকার দিন অজস্র রং নিয়ে ডানা মেলা প্রজাপতির মতো আদুরে হাওয়ায় ভেসে ভেসে উড়ে এসে ছুঁয়ে যেত। সেসব কোথায় হারাল? ওই দিনগুলোকে এখন স্বপ্ন কিংবা কল্পনা মনে হয়। মনে হয়, তার জীবনে অমন কিছু কখনো ঘটেইনি। হয়তো এই ভয়ানক দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে সে নিজে নিজেই ওসব ভাবে। কল্পনার রঙিন এক জগৎ তৈরি করে। তারপর সেখানে গিয়ে পালিয়ে থাকতে চায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কখন ঢুলছিল পারু জানে না। তবে কাঁধের কাছে পুরুষ মানুষের হাতের স্পর্শ পেয়ে সচকিত হয়ে উঠল সে। চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। হাতটা ফরিদের। দেখে যেন খানিক স্বস্তি পেল। চারপাশের এই এত এত মানুষের ভিড়ে এই একটি মাত্র মানুষ তার চেনা, আপন। কেবল এই একটি মাত্র মানুষের ওপরই সে নির্দিধায় নির্ভর করতে পারে। যেন এই ভাবনায়ই নিমিষে নিশ্চিন্ত হলো পারু। তবে তার ওই হঠাৎ সন্ত্রস্ত দৃষ্টি এবং ভীত অভিব্যক্তি দেখে ফরিদ বিব্রত ভঙ্গিতে হাতখানা সরিয়ে নিতে উদ্যত হলো। কিন্তু পারু তার দুলতে থাকা ঘাড়টা আলগোছে ফরিদের হাতের ওপর নামিয়ে আনল।
.
ট্রেন চলছে ঘন্টা দুইয়ের মতো হবে। এর মধ্যে অনেক স্টেশনেই থেমেছে। যাত্রীও উঠেছে ঢের। তবে নামার সংখ্যা কম। ফলে বসার আর সুযোগ হয়নি পারুর। বিষয়টা নিয়ে ফরিদ চিন্তিত। এমনিতেই পারুর শরীর খারাপ। তার ওপর যদি এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়, তাহলে দুর্ভোগের আর অন্ত থাকবে না। সবচেয়ে বড় কথা এটা অসম্ভব এক ব্যাপার। পারুকে অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। পরের স্টেশনেই জায়গা পেয়ে গেল সে। যে একটিমাত্র সিট ফাঁকা হলো, তাতে ঝট করে বসে পড়ল। যাত্রী যাতায়াতের প্রান্তের আসনটিতে বসেছে সে। ফলে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের নড়াচড়ায় বড় অসুবিধা হতে লাগল। বিষয়টা লক্ষ করে খানিক সামনে এগিয়ে দাঁড়াল ফরিদ। তারপর চেষ্টা করতে লাগল নিজের শরীর দিয়ে পারুর বাঁ পাশে একটা দেয়াল তৈরি করতে। যাতে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারে সে। তার চোখ জোড়া আলো থেকে আড়ালে করতে নিজের হাতখানাও আড়াআড়ি ভাঁজ করে রাখল সামনে সিটের পেছনটাতে।
.
পারুর মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে বাথরুমে গিয়ে বমি করতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু এত লোকের ভিড়ে সেটি প্রায় অসম্ভব। সে মাথা তুলে সামান্য তাকাল। ফরিদ দাঁড়িয়ে আছে তার গা-ঘেঁষে। তবে সে চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে দাঁড়াতে। যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের মাথার ওপর দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছে ফরিদ। তবে তার দৃষ্টি শূন্য, উদ্দেশ্যহীন। চোখে-মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। যেন সে মনে মনে চাইছে, এই যাত্রা কখনো শেষ না হোক। শেষ হলেই তো কোথাও না কোথাও যেতে হবে তাদের। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? ওই অচেনা অজানা শহরে ঠিক কার কাছে গিয়ে উঠবে? হঠাৎ মুখ ঘোরাতেই পারুর চোখে চোখ পড়ল ফরিদের। সে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল। যেন অভয় দেয়ার চেষ্টা করল পারুকে। পারু অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। মুখ ফিরিয়ে নিল। তারপর বসে রইল দীর্ঘ সময়। ট্রেন চলছে ঢিমেতালে। এখানে ওখানে থামছে। যাত্রীরা উঠছে, নামছে। তারপর দাঁড়িয়ে থাকছে একইরকম স্থির, অনড় ভঙ্গিতে। তাদের মুখগুলো ক্লান্ত, মলিন। কেমন ছবির মতো লাগছে। কল্পনার বিষণ্ণ এক ছবি। যেন কতগুলো অসহায় মানুষ দীর্ঘসময় ধরে ভয়ংকর কোনো দুঃসংবাদ শোনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
ক্লান্তিতে আর সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছে না পারু। খানিক এদিক সেদিক তাকিয়ে আলগোছে মাথাটা এলিয়ে দিল সিটে। কিন্তু সিটের পেছনের অংশটা এমন বেঢপ খাড়া যে কোনোভাবেই মাথাটাকে স্থির রাখতে পারল না সে। বরং ডানপাশের লোকটার মাথাও ঢলে প্রায় তার কাঁধের ওপর চলে এসেছে। কয়েকবার হাতের ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল পারু। তবে তাতে লাভ বিশেষ হলো না। বিরক্ত পারু যতটা সম্ভব সরে গিয়ে সোজা হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করল। ট্রেনের একনাগাড়ে বয়ে চলা একঘেয়ে শব্দটা তার কানে বাজছে। এমন একটি ট্রেনে করেই তো সে বাবা-মার সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। এখন কোথায় তারা? কী করছে? তারা কি জানে সে কই? সে কী করছে? এই ভাবনায় পারুর বুকটা কেমন অসাড় হয়ে আসতে লাগল। এর বেশি কিছু ভাবতে পারে না সে। বাবা-মা কি সীমানা পেরিয়ে ওপারে চলে গেছেন? নিশ্চয়ই গেছেন। কেন থাকবেন তারা? কার জন্য? কীসের জন্য?
এসব প্রশ্নের উত্তর পারুর কাছে নেই। যতবার ভাবে ততবার তার দমবন্ধ হয়ে আসে। মরে যেতে ইচ্ছে হয়। আচ্ছা মৃত্যুর পরে আর কোনো জন্মে কি সে আবার বাবা-মা, চারু-ঠাকুরমার দেখা পাবে? অন্য কোনো জন্মে? পারুর হঠাৎ কী যে হলো! ওই অত অত মানুষের ভিড়ে, ওই ফরিদের শরীরে তৈরি দেয়ালের আড়ালের অন্ধকারটুকুতে সে নিজের মুখ চেপে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। তার সেই কান্নার জল কেউ দেখল না। কেউ শুনল না সেই কান্নার শব্দ। কিন্তু তারপরও ওই কান্নার ফোঁটা ফোঁটা জলের ভাষায় লেখা হতে থাকল এক জীবনের সকল দুঃখ, শোক, অনুশোচনা আর আক্ষেপের গল্প।
এভাবে কতক্ষণ কাঁদল পারু জানে না। তবে কারো আলতো হাতের ছোঁয়ায় চোখ তুলে তাকাল সে। ফরিদ তাকিয়ে আছে। তার হাত পারুর মাথায়। পারু বিচলিত ভঙ্গিতে ওড়নায় চোখ মোছার চেষ্টা করল। যেন ফরিদকে তার এই গোপন কান্নার অশ্রু দেখাতে চায় না সে। ফরিদ অবশ্য কিছু বললোও না। কেবল পারুর মাথাটা আলগোছে টেনে আনল তার দিকে। পারুও বাধা দিল না। যেন প্রবল ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়তে চাওয়া তার মাথার একটা আশয় হলো। সে ফরিদের কোলের কাছে মাথা চেপে ধরে বসে রইল।
.
কতক্ষণ পর পারুর ঘুম ভাঙল সে জানে না। তবে ট্রেন তখনো চলছে। প্রথমে চোখ মেলে তাকিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারল না কোথায় আছে। ট্রেনের একটানা দুলুনি আর শব্দে তার সম্বিৎ ফিরল। এই কঠিন ও অসুবিধাজনক আসনে তো এমন আরাম করে ঘুমানোর কথা নয়। সে সোজা হয়ে বসল। ফরিদ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই পুরোটা সময় সে দু হাতে তার মাথাটা আগলে রেখেছিল!
পারু মুখ তুলে তাকাল। ফরিদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুলছে। ঢাকার পথে যাত্রী নেমে গিয়ে ট্রেন ফাঁকা হওয়ার কথা থাকলেও আজ তা ঘটেনি। বরং কম্পার্টমেন্টে এখনো পা ফেলার জায়গা নেই। ছেলেটা কী মলিন, কী ক্লান্ত মুখে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথাটা বিদঘুঁটেভাবে হেলে আছে ঘাড়ের ওপর। পেছনের লোকটার সঙ্গে খানিক হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ফরিদকে অস্ফুটে ডাকল পারু, শুনছেন?
ফরিদ চমকে সটান হয়ে দাঁড়াল, বাথরুমে যাবে?
উহু।
তাহলে? খারাপ লাগছে?
উহু। বলে একটু থামল পারু। তারপর বলল, আপনি একটু বসুন।
আমি?
হুম।
ফরিদ অপ্রস্তুত হাসল, আরে নাহ। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। ভালো লাগবে।
আমি ঘুমালাম তো। এবার আপনি একটু ঘুমান। আমি দাঁড়াই?
আরেহ! কী বলছ তুমি? যেন আঁতকে উঠল ফরিদ। বলল, এই লোকের ভিড়ে তুমি দাঁড়াবে?
হুম।
উহু।
কেন?
এমনি।
কী সমস্যা, বলুন?
কোনো সমস্যা না।
তাহলে? তাহলে কিছু না। বলেই উদাস ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিল ফরিদ।
পারু বলল, এভাবে এতটা পথ কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে?
আমি পারি। মৃদু হাসল ফরিদ।
আমিও পারি। আপনি বসুন।
ফরিদ খানিক চুপ করে থেকে বলল, তুমি এখানে দাঁড়ালে আমার ভালো লাগবে না। অস্বস্তি হবে। জায়গাটা তোমার দাঁড়ানোর জন্য ভালো না।
কেন?
উত্তরটা দেওয়ার আগে ফরিদ কী ভাবল। তারপর বলল, ভিড় আর অন্ধকারে পুরুষরা মেয়েদের কাছে অন্যরকম হয়ে যায়। খারাপ ধরনের অন্যরকম।
পারু সামান্য চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু কই? আপনি তো হননি? আপনিও তো পুরুষ মানুষ।
ফরিদ এই কথার জবাব দিল না। সে তাকিয়ে রইল বাইরে। সেখানে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের বুক চিরে ছুটে চলেছে রাতজাগা ক্লান্ত ট্রেন।
.
অরবিন্দু বাবু বললেন, এখন? এখন কী করবি? কথাটা আর্তনাদের মতো শোনাল তার কণ্ঠে। পারুদের ট্রেনটা তখনো চোখের আড়াল হয়নি। ওই যে দূরে তার অপস্রিয়মাণ আলো দেখা যাচ্ছে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রভ, নিস্পৃহ মহিতোষ পঁড়িয়ে রইলেন। বলার মতো কোনো শব্দ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। বুকের ভেতর সীমাহীন শূন্যতার প্রবল এক ঝোড়ো হাওয়া সব ওলটপালট করে দিচ্ছে। অরবিন্দু বাবু তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, মহিতোষ?
মহিতোষ প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমি জানি না। আমি জানি না।
ভগবান সবকিছুই যে কেন এমন করে দিচ্ছেন! বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অরবিন্দু বাবু। তারপর বললেন, তার খেলা বোঝা বড় দায়। এই এতকিছুর পরও তিনি তীরে এসে এভাবে তরী ডোবালেন…।
মহিতোষ ঝটকা মেরে অরবিন্দু বাবুর হাতখানা সরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার মেয়ে আমি খুঁজে বের করবই। যে করেই হোক। তারে ছাড়া আমি ঘরে ফিরে যাব না…।
তাঁর চোখ জোড়া টকটকে লাল। সেখানে জলের অস্তিত্ব নেই। চোয়াল শক্ত। অরবিন্দু বাবু কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তবে মহিতোষের মনের অবস্থাটা তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন। মহিতোষ কিছু একটা বলতে গিয়েও হঠাৎ থমকে গেলেন। তারপর ঝট করে অরবিন্দু বাবুর হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে পিছিয়ে গেলেন খানিকটা। সেখানে মোটা একটা থাম। থামের আড়ালে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন। অরবিন্দু বাবু অবাক কণ্ঠে বললেন, কী হলো?
মহিতোষ গলা নামিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, প্ল্যাটফর্মের ওই পাশে তাকান। ওই যে দেখছেন, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আর তার সঙ্গে এছাহাক।
অরবিন্দু বাবু মুহূর্তেই জায়গায় জমে গেলেন। তাদের বিপরীত দিকে কতগুলো মানুষ বিচলিত ভঙ্গিতে উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে। দুপুরে মন্দিরের আড়াল থেকে দেখা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, এছাহাক এবং সঙ্গের দলটাকেও দেখা যাচ্ছে। চট করে আরো খানিকটা আড়ালে সরে গেলেন মহিতোষ। তারপর বললেন, এখানে আর থাকা যাবে না। এক মুহূর্তও না।
তাঁরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর হুডতোলা রিকশায় চেপে বসলেন। অরবিন্দু বাবু বললেন, এখন?
কী?
কই যাব? কী করব?
আপনি যশোর চলে যাবেন।
মানে?
মানে কী?
আমি যশোর চলে যাব মানে কী? তুই যাবি না?
না।
না মানে? তাহলে তুই কী করবি?
ঢাকা যাব।
ঢাকা! অবাক গলায় বললেন অরবিন্দু বাবু।
হুম।
কী বলছিস তুই?
ঠিকই বলছি। আপনি এখান থেকে সরাসরি যশোর চলে যাবেন। আর আমি যাব ঢাকা। এবং সেটা এখুনি।
অরবিন্দু বাবু মহিতোষের দিকে বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকালেন। তারপর বললেন, তুই কি পাগল হয়ে গেছিস মহিতোষ
কেন?
এই অবস্থায় এখন তুই ঢাকা যাবি? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আর এখন ঢাকা গিয়ে তুই কী করবি? ওই অতবড় শহরে ওদের কোথায় খুঁজবি তুই?
মহিতোষ ম্লান হাসলেন, আমি পাগল হয়ে যাইনি মেসো। আমি পাগল হলে চলবে কেন? বলে খানিক থামলেন তিনি। একটা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস শুয়ে যাচ্ছে শরীর। তিনি চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিতে নিতে বললেন, ওই শহরে ওদের খুঁজে পেতে হলে আজ এখুনি রওয়ানা করতে হবে। পরে গেলে আর পাওয়া যাবে না।
মানে? এখন গিয়ে ওদের তুই কী করে পাবি?
ওরা যে ট্রেনটায় গিয়েছে, সেটা ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে। যদি ওদের আগেই ঢাকা গিয়ে রেলস্টেশনের গেটে পৌঁছে যেতে পারি, তাহলে হয়তো ওদের পেয়ে যাওয়ার একটা ভালো সম্ভাবনা আছে।
কীভাবে? অরবিন্দু বাবুর গলায় বিস্ময়।
ধরেন…। একটু থামলেন মহিতোষ। আমি আগেভাগে স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। ভাগ্য যদি সহায় হয়, হয়তো স্টেশন বা ট্রেন থেকে বের হওয়ার সময় ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যেতেও পারে মেসো। আর এখান থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে বাসে চড়তে পারলে ট্রেনের আগেই ঢাকা পৌঁছে যেতে পারব।
মহিতোষের কথা শুনে চুপ করে রইলেন অরবিন্দু বাবু। বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেলেন না তিনি। তারপর হঠাৎ মহিতোষের মাথাটা তার কাঁধে টেনে নিলেন। এই অসম বয়সী পিতা ও পুত্রের মতো অথচ মধ্য বয়স পার করে ফেলা দুজন মানুষ আচমকা যেন আবিষ্কার করলেন, জগতে প্রিয়তম মানুষকে হারিয়ে ফেলার মতো তীব্র যন্ত্রণা আর নেই। তার শূন্যতা পূরণ করার মতো পূর্ণতা আর কিছুতে নেই।
.
মহিতোষ ঢাকাগামী বাসে উঠলেন রাত এগারোটায়। এর আগে আর কোনো বাস পেলেন না তিনি। অরবিন্দু বাবুকে বিদায় দিতে গিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল তাঁর। কেন যেন মনে হলো এই মানুষটার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না। সেই ছেলেবেলা থেকেই দূরে থাকা এই মানুষটা অদৃশ্য এক ছায়া হয়ে ছিলেন। তাকে কখনো সামনে এসে দাঁড়াতে দেখা যেত না। ভুবনডাঙায়ও সেভাবে কখনো এসেছেন বলে মনে পড়ে না মহিতোষের। হয়তো কালেভদ্রে এসে থাকবেন, তবে তা তাঁর স্মৃতিতে তেমন উজ্জ্বল নয়। কিন্তু সেই মানুষটাই কারণে-অকারণে সবার অনিবার্য প্রয়োজন হয়ে উঠতেন। এই যে আজ কিছুক্ষণ আগে ওই বৃদ্ধ মানুষটা তাঁকে আলিঙ্গন করে বাড়ির পথ ধরলেন তার আগ অবধিও মানুষটার উপস্থিতি তেমন করে অনুভব করেননি মহিতোষ। কিন্তু তিনি দৃষ্টির আড়াল হতেই যেন বুকটা ভার হতে লাগল। শিরদাঁড়াটা নুয়ে পড়তে চাইল। মনে হলো খানিক কুঁজো হয়ে গেছেন।
জগতে এমন কিছু মানুষ থাকে, যাদের উপস্থিতির চেয়ে অনুপস্থিতিই বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। যারা পাশে থাকলে তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না, আলাদা করে দৃষ্টি কাড়ে না, কিন্তু চোখের আড়াল হলেই সবকিছু কেমন কাফকা লাগে। মনে হয় কী যেন কী নেই। চারপাশটা হঠাৎ করেই বিরান মরুভূমি মনে হয়। অথচ রোজ চোখের সামনে সেঁটে থাকা সেই মানুষটাকেই হয়তো খানিক আলাদা করে দেখার ফুরসৎ মেলে না। অরবিন্দু বাবু ঠিক তেমনই একজন মানুষ। থাকার চেয়েও থাকাতেই যিনি সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।
.
সুনসান রাস্তায় বাসটা যেন খুব ধীরে চলছে। মহিতোষের মাঝে মাঝে মনে হলো তিনি যদি বাসটাকে আরো দ্রুত চালিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। যদি ভোরের আগেই পৌঁছে যেতে পারতেন ঢাকায়। কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। তাছাড়া রাত বাড়তেই ঘন কুয়াশা যেন দুর্ভেদ্য দেয়াল হয়ে উঠল চোখের সামনে। সেই দেয়াল ভেদ করে এগিয়ে যাওয়া সহজ নয়। ফলে যাত্রীদের অনুরোধে আরো সতর্ক হয়ে গেলেন চালক। বাসের গতি মন্থর থেকে মন্থরতর হতে লাগল। কেবল মহিতোষের বুকের ভেতর বিভত্স এক অস্থিরতা বাড়তে লাগল দ্রুত গতিতে। সেই গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলেন না তিনি নিজেও। হিম-শীতল জানালার কাচে গাল ঠেকিয়ে বসে রইলেন নির্ঘুম। শরীরটা যেন ভেঙে পড়ছে প্রবল ক্লান্তিতে। মুদে আসছে চোখের পাতা। খানিক ঘুমিয়ে নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ঘুম তো আর চোখের পাতায় থাকে না। ফলে চোখ বন্ধ করেও জেগে রইলেন মহিতোষ। নৈশ প্রহরীর মতো উত্তর্ণ হয়ে রইলেন প্রতিটি মুহূর্ত। যেন তিনি ঘুমিয়ে পড়লেই বাসটি আচমকা থেমে যাবে। কিংবা পথ ভুল করে চলে যাবে অন্য কোথাও।
অঞ্জলিকে একখানা চিঠি লিখে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই চিঠি কতটা কাজে লাগবে তা জানেন না মহিতোষ। তিনি চান, অঞ্জলি ওপারে চলে যাক। খানিক হলেও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত হোক তার আর চারুর। কারণ তিনি যে অনিশ্চিত যাত্রায় পথে নেমেছেন, তাতে ভাগ্য সাহায্য খুব দরকার। কিন্তু এই যে দুর্ভোগের জীবন। দুর্বিপাকের ঘূর্ণিচক্র। এ থেকে কি আদৌ মুক্তি আছে তার? মহিতোষ জানেন না।
রাত তখন কত কে জানে! আচমকাই ব্রেক কষলেন চালক। তীব্র ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠল বাসের যাত্রীরা। দু-একজন কাঁচা ঘুম ভেঙে চালককে গালমন্দও করল। কিন্তু জানালার বাইরে তাকাতেই ভুল ভাঙল তাদের। দোষটা চালকের নয়। বাইরে নিরেট দেয়ালের মতো সাদা কুয়াশা। এক হাত দূরের জিনিসও দেখার উপায় নেই। মহিতোষ মনে মনে ভড়কে গেলেও জায়গা ছেড়ে উঠলেন না। যেন অবচেতনেই ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পিত করে দিলেন। তবে বাস কন্ডাক্টরের চিৎকার-চেঁচামেচিতে দু-একজন যাত্রী নেমে গিয়ে বাইরের ঘটনা দেখে এলো। একটা কুকুর চাপা পড়েছে গাড়ির নিচে। তার থেঁতলে যাওয়া শরীর থেকে তখন তাজা রক্ত ঝরছে। দৃশ্যটা দেখে গা শিউরে উঠল অনেকেরই। কুকুরটির জায়গায় যদি কোনো মানুষ থাকত! যেন মানুষের চেয়ে কুকুরের মৃত্যু খুব গৌণ কিছু। কথাটা ভাবলেন মহিতোষ। মানুষ ঠিক কী কী কারণে আর সকল প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ? তার জন্ম কিংবা মৃত্যু কেন আর সব প্রাণীর জন্ম ও মৃত্যুর চেয়ে আলাদা? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজে পেলেন না। হয়তো পেতেও চাইলেন না।
বৃদ্ধ একজন যাত্রী শান্ত গলায় বললেন, ড্রাইভার সাব, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। বেঁচে থাকলে আমরা ঢাকায় যেতেই পারব। কিন্তু এই অবস্থায় আগেভাগে ঢাকা পৌঁছাতে গিয়ে বড়সড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তখন কী হবে?
দু-একজন যাত্রী খানিক দোনোমননা করলেও বেশির ভাগই তাকে সমর্থন দিলেন। ফলে কুয়াশা খানিক ফিকে হয়ে আসা অবধি যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত হলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মহিতোষের মনে হলো, তিনি আর কখনোই পারুর দেখা পাবেন না। এই জীবনে ও-ই তার সঙ্গে পারুর শেষ দেখা।
.
মহিতোষ বাস থেকে নামলেন। তীব্র ঠাণ্ডায় তার হাড় অবধি কেপে যাচ্ছে। খানিক সামনে গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর হঠাৎই আবিষ্কার করলেন, এ যেন অন্য এক জগৎ। তাঁর চেনা পরিচিত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন বিভ্রমে পরিপূর্ণ এক জগৎ। চারদিকে ঘন কুয়াশা। সেই কুয়াশার ভেতর নিজেকে হঠাৎ অস্তিত্বহীন বায়বীয় এক সত্তা বলে মনে হতে লাগল তার। এই যে চোখের সামনে কঠিন দেয়ালের মতো স্পষ্ট দৃশ্যমান কুয়াশা, অথচ হাত বাড়াতেই তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। মহিতোষের নিজেকেও তেমন মনে হতে লাগল। যেন তার এই অবয়ব, এই দৃশ্যমান শরীর, এসবও ছোঁয়া যাবে না। ধরতে গেলেই মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়। তিনি কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন জানেন না। কেবল জানেন প্রচণ্ড শীতে জমে যাচ্ছিলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে এলো। বাসের কন্ডাক্টর বোধহয়। টর্চের আলো ফেলে তাঁকে ডাকলেন। মহিতোষ এগিয়ে গেলেন। বাসে উঠতেই খানিক আরাম লাগতে লাগল তার। চাদর দিয়ে সারা শরীর মুড়ে নিয়ে জবুথবু হয়ে বসলেন তিনি। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে গেলেন টেরও পেলেন না।
.
তার ঘুম ভাঙল ভোরে। বাসের কন্ডাক্টর ডাকতেই উঠে বসলেন তিনি। তবে ঠিকঠাক বসতে পারলেন না। মাথাটা আচমকা চক্কর দিয়ে উঠল। কন্ডাক্টর বলল, চইলা আসছি। নামেন। মহিতোষ এদিক-সেদিক তাকালেন। বাইরে মেঘলা আকাশ। কেমন বিষণ্ণ আলোর দিন। এখন কটা বাজে? তিনি বললেন, বাস অনেকক্ষণ হয় চলে এসেছে?
নাহ। এই তো… মাত্রই থামল।
ওহ। মহিতোষ আশ্বস্ত হলেন। তাহলে ঘুমে ভাঙতে দেরি হয়নি তাঁর। তিনি বাস থেকে নামলেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছাতে মিনিট তিরিশেক সময় লাগল তার। তারপর হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন পারু আর ফরিদকে। কিন্তু অসংখ্য মানুষে পরিপূর্ণ বিশাল এই স্টেশনে দুজন মানুষকে কী করে খুঁজে পাবেন তিনি! তারচেয়েও বড় কথা, যে ট্রেনে তাদের আসার কথা, সেই ট্রেনটি অনেক আগেই এসে পৌঁছে গেছে।
মহিতোষ আচমকা একটা অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করলেন। কেমন অদ্ভুত এক শূন্যতা বোধ তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। একটা বিবশ, বিবর্ণ, ভোঁতা অনুভূতি। যেন ওই কুয়াশাচ্ছন্ন রাত থেকেই তিনি জেনে গিয়েছিলেন, এখানে এসে পারুদের আর পাওয়া যাবে না। এই অসংখ্য মানুষে পরিপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম তাঁর কাছে হয়ে রইবে শূন্য, বিরান।
মহিতোষ দাঁড়িয়ে রইলেন। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে তাঁর। বাস থেকে নামতে গিয়েও মনে হয়েছে মাথাটা ঘুরছে। কিন্তু পারুদের চিন্তায় আচ্ছন্ন মহিতোষ তখন অতকিছু গ্রাহ্য করেননি। কিন্তু এখন এই কোলাহলপূর্ণ স্টেশনে দাঁড়িয়ে খুব অসুস্থ লাগতে লাগল তার। মনে হলো কোথাও একটু বসা দরকার। একটু গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা দরকার। তিনি হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘ স্টেশনের শেষ প্রান্তে চলে এলেন। সেখানে সিমেন্টের মোটা থামের চার পাশ ঘিরে চওড়া বসার জায়গা। এইদিকটা খানিক নির্জন। লোকজন তেমন নেই। মহিতোষ সেখানে বসে পড়লেন। কিন্তু জ্বরে কাঁপতে থাকা তার শরীরটা তাকে খুব বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখতে পারল না। মহিতোষ তখনো বুঝতে পারলেন না, কী ভয়াবহ জ্বরে আক্রান্ত তিনি। একটা ঘোরের ভেতর সিমেন্টের বাঁধানো সেই বেঞ্চিতে শুয়ে পড়লেন তিনি। তারপর জ্ঞান হারালেন।