৫
ফরিদের বাবা-মা নেই। সে থাকে মামাবাড়ি। তার মামা আব্দুল ওহাবের ওষুধের দোকান আছে। সেখানে সে মাঝেমধ্যে বসে। আজও দুপুরে ভাত খেয়ে সে দোকানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছিল। এই সময়ে তাকে তার মামি নুরুন্নাহার ডাকলেন। বললেন, রাতে আসার সময় আছমার জন্য এক দিস্তা কাগজ আর কলম। নিয়াসিস।
আচ্ছা।
আর আজকাল তো দেখি তোর আর সময়ই হয় না। স্কুল নাই দেখে মেয়েটার পড়াশোনাও বন্ধ। তুই একটু তারে নিয়া বসলেই তো পারিস?
জি, মামি। বসব। বলে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেল ফরিদ। তার মন মেজাজ ভালো না। সারাক্ষণ থম মেরে থাকে সে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারে না। আছমা তার একমাত্র মামাতো বোন। এ বছর তার ক্লাস নাইনে থাকার কথা ছিল। কিন্তু নদীভাঙনে স্কুল ঘরটা বিলীন হয়ে যাওয়ায় আপাতত তার পড়াশোনা যতটুকু হয়, তা বাড়িতেই। বেশির ভাগ সময় ফরিদই তাকে পড়ায়। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে সেটাও আর হয়ে উঠছে না। এই নিয়ে মামি খুব বিরক্ত। বিষয়টা যে ফরিদ বোঝে না তা নয়। সে বরং আরো বেশি কিছুই বোঝে। মামী। যতটা না আছমার পড়াশোনা চায়, তার চেয়ে বেশি চায় ফরিদের সঙ্গে আছমার একটা বোঝাপড়া। ফরিদের বাবা-মা নেই। তার ওপর পড়াশোনা জানা ভালো ছেলে। বিয়ের পর ঘরজামাইও রাখা যাবে। এমন ছেলেকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চান না তিনি। ফরিদের মামার অবশ্য এতে সায় নেই। তিনি বলেন, আছমা আর ফরিদ তো ভাইবোনের মতোই?
নুরুন্নাহার এতে ক্ষিপ্ত হন, ভাই-বোনের মতো। কিন্তু ভাই-বোন তো আর না!
আব্দুল ওহাব নির্বিরোধী, চুপচাপ ধরনের মানুষ। তিনি বউয়ের কথার ওপর আর কথা বলেন না। তবে বিষয়টা টের পাওয়ার পর থেকে ফরিদের খুব হাঁসফাঁস লাগতে থাকে। সেই এতটুকু বয়স থেকে সে আছমাকে দেখে এসেছে। নিজের বোনের মতোই মনে করেছে। কিছুতেই তাকে অন্য কিছু ভাবতে পারবে না সে। তার পরও পারুর বিষয়টা সারাক্ষণই তাকে ভয়ানক যন্ত্রণায় অবশ করে রাখে। এই কথা সে না কাউকে বলতে পারে। না নিজের ভেতর চেপে রাখতে পারে। মাঝে মাঝে মনে হয়, জেনে-শুনে কেন এই ভুলটা সে করতে গেল? গাঁয়ে ভালো লাগার মতো মেয়ের তো অভাব নেই। তাহলে কেন পারুকেই তার ভালোবাসতে হলো? এমন অসম্ভব, অকল্পনীয় একটা সম্পর্কে কেন যেতে হলো তাকে?
এতদিন তাও পারু তার সঙ্গে সময় সুযোগ বুঝে যোগাযোগ করত। কিন্তু এখন তাও বন্ধ। বিষয়টা প্রথম আঁচ করেছিলেন পারুর ঠাকুরমা ছায়ারাণী। তিনি বৃদ্ধ মানুষ। ঠিকঠাক চোখে দেখতে পান না। কানেও সেভাবে শুনতে পান না বলেই জানত ফরিদ। তার ঘরের চৌকির সঙ্গেই পারুর পড়ার টেবিল। সেখানেই তাকে পড়াত ফরিদ। তাদের মধ্যে খুব যে বেশি ভাব-ভালোবাসার কথা-বার্তা হতো, এমন নয়। বরং যতটা সম্ভব সতর্কই থাকত দুজন। কিন্তু এরমধ্যেই ছায়ারাণী কোথা থেকে কী বুঝল কে জানে। তিনি একদিন মহিতোষকে ডেকে বললেন, তোর কি দিন দিন বয়স বাড়ে না কমে?
মহিতোষ এই বয়সেও মাকে জমের মতো ভয় পান। তিনি বললেন, কেন মা কী হয়েছে?
কী আর হইবো? যা হওনের তা-ই হইছে।
তুমি আগে বলো তো। এমন করলে বুঝব কেমনে?
তা বুঝবি কেন? বুঝবি তো ঘটনা ঘইটা গেলে।
কী ঘটনা ঘটবে?
ঘরের মধ্যে ডাঙ্গর মাইয়া আর ডাঙ্গর পোলারে দিয়া বাসরঘর বসাইবি, আর কিছুই ঘটব না? দুই মাইয়ার বাপ হইছোস কী বাতাসে?
মহিতোষ প্রমাদ গুনলেন। অযথা সন্দেহ করার দোষ যে ছায়ারাণীর একেবারেই নেই, তা নয়। তবে বিষয়টা নিয়ে অঞ্জলিও তাঁকে কয়েকবার সাবধান করতে চেয়েছিলেন। তাঁর ইঙ্গিত অবশ্য ভিন্ন ছিল। ফরিদ মুসলমান ছেলে। তাঁরা হিন্দু। ওই বয়সের একটা মুসলমান ছেলেকে এভাবে দিনে-রাতে ঘরে আসতে দেয়ায় অন্যরা না কিছু রটিয়ে বসে। মানুষের উদ্দেশ্য বোঝা বড় দায়। তাছাড়া কারো মুখ তো আর বন্ধ করে রাখা যায় না। এরমধ্যেই আশেপাশে যে কিছু ফিসফিসানি শুরু হয়েছে, সেটাও তিনি টের পেয়েছেন। বিষয়টা নিয়ে ছায়ারাণীর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বললেন মহিতোষ। ছায়ারাণী বললেন, বেশিকিছু তো আর শুনি নাই। তবে তাদের মধ্যে কোনো ঘটনা আছে, এইটা এক শ ভাগ সত্য। আমি পড়াশোনা জানি না, তাই বলতেও পারব না। কিন্তু পারুর টেবিলের দেরাজের মধ্যে এই কাগজগুলাও আমি পাইছি। এইগুলান তারা দুজনে চালাচালি করে।
মহিতোষ মায়ের হাত থেকে টুকরো কাগজগুলো নিলেন। তারপর একটা একটা করে খুলে দেখলেন। প্রথম কাগজটাতেই লেখা–
পারু, আমি যদি কয়েকদিন না আসি, তোমার মন খারাপ হবে?
হাতের লেখাটা ফরিদের। তার নিচেই পারুর হাতের লেখা, না, হবে না। তার নিচে ফরিদ আবার লিখেছে, কেন?
জানি না।
কেন জানো না?
তাও জানি না।
তাহলে আমি আর কখনোই না আসি?
যদি আর কখনো না-ই আসেন, তাহলে এ কদিন কেন এলেন? কখনো না এলেই হতো!
কী হতো তাহলে?
কষ্টটা আর হতো না।
এই যে তুমি বললে, আমি না এলে তোমার মন খারাপ হবে না?
কষ্ট তো হবে।
মন খারাপ আর কষ্ট এক নয়?
নাহ।
তাহলে?
মন খারাপের চেয়ে কষ্ট অনেক তীব্র। আপনি একদিন না এলেও আমার খুব কষ্ট হয়।
.
কথাগুলো পারু লিখেছে! তার হাতের লেখা দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না মহিতোষের। বাকি কাগজগুলো আর খোলারই সাহস পেলেন না তিনি। কখন এত বড় হয়ে গেছে পারু? বিষয়টা কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না তিনি। ফরিদ আর পারু ঘরে বসে বসে এসব কথা একে অন্যকে মুখে বলতে পারত না বলে এভাবে কাগজে-কলমে লিখে লিখে প্রশ্ন-উত্তর করত? একইসঙ্গে আহত ও সন্ত্রস্ত বোধ করতে লাগলেন মহিতোষ। এমনিতেই নানাবিধ চাপে বিধ্বস্ত তিনি। তার ওপর পারুর এমন ঘটনা রীতিমতো এলোমেলো করে দিল তাঁকে। পরদিনই তিনি পারুকে ডাকলেন। ডাকলেন ফরিদকেও। তাকে অবাক করে দিয়ে ফরিদ বলল, সে পারুকে ভালোবাসে। যে করেই হোক পারুকে সে বিয়ে করবেই। ধর্ম নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই!
মহিতোষ পারুকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তবে ফরিদকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। সেই সারাটা রাত আর ঘুমাতে পারলেন না তিনি। পরের কয়েকটা দিনও না। কী এক তীব্র আতঙ্ক তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখল। এমনিতেই নানা কারণে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন তিনি। সেখানে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মতো দু-চার জন দুষ্টু লোকের যন্ত্রণা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিছু বিষয়ও। বিশেষ করে বড় দাদা আর দিদি চলে যাওয়ার পর খুব একা লাগতে লাগল তার। তার ওপর অঞ্জলির বাপের বাড়িও ওপারে। সর্বশেষ ফরিদের ওই কথা তাঁকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে বাধ্য করল।
কিন্তু ফরিদ এখন কী করবে? পারুবিহীন পৃথিবীর কথা ভাবতেই পারে না সে। এই ঘটনার পরও বেশ কিছুদিন লুকিয়ে-চুরিয়ে পারুর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। পারু সাড়াও দিত। গভীর রাতে জানালার বাইরে থেকে শিস দিয়ে পারুকে ডাকত সে। দেয়ালের এপার-ওপার ফিসফিসিয়ে কথা বলত। কিন্তু তারপর হঠাৎই একদিন শুনল, পারুরা সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে!
সেই শুরু। এরপর দিন দিন কেমন বদলে যেতে লাগল পারু। যোগাযোগ একদম বন্ধ করে দিল। ফরিদ জানে, পারু যা করছে, তা-ই হয়তো ঠিক। সে তো আর বাবা-মাকে রেখে একা একা এখানে থেকে যেতে পারবে না। ফরিদও যেতে পারবে না ওপারে। তার ওপর তাদের ধর্ম আলাদা। বিশ্বাস, পরিচয়, ভাবনা আলাদা। এতসব বাধা কী করে ডিঙাবে পারু? না হয় কিশোরী বয়সের কিছু অগভীর আবেগ তাকে আক্রান্ত করেছিল। ফরিদের ভালোবাসায় আচ্ছন্ন করে। ফেলেছিল। কিন্তু দিন যত গিয়েছে, পরিস্থিতি বদলেছে। আর সেই পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে পারুও। সে এখন বুঝতে শিখেছে এই সম্পর্কটা কখনোই সম্ভব নয়। এ এক অবাস্তব, অসম্ভব সম্পর্ক। কিন্তু ফরিদ কেন নিজেকে বোঝাতে পারে না? তার কেন সারাক্ষণ এমন দমবন্ধ লাগে?
সারাটা বিকেল সে দোকানে বসে রইল। লোকজন খুব একটা নেই। হেমন্তের। বিকেল-সন্ধ্যা যেন মৃত্যুর ঘ্রাণের মতো। সবকিছু কেমন প্রাণহীন করে রাখে। না কি ফরিদের একাই এমন মনে হয়? হয়তো ভেতরে ভেতরে ক্রমশই মরে যাচ্ছে। সে। মানুষ আসলে একটা জীবন কী নিয়ে বাঁচে? স্মৃতি আর স্বপ্নই তো? তাহলে সে কী নিয়ে বাঁচবে?
তার এক জীবনের সবটুকু স্মৃতি দখল করে আছে পারু। সেই স্মৃতি এতটাই সজীব যে তার কাছে আর সব কিছু স্নান, ধূসর, ফ্যাকাশে। পারুকে ছাড়া স্বপ্ন দেখার মতো তো আর কিছু নেই তার।
সন্ধ্যা নামতেই দোকান বন্ধ করে উঠে পড়ল ফরিদ। আছমার জন্য কাগজ কলম কিনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। তাকে যেতে হয় পারুদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই। রোজ এখানটাতে এসে তার সাইকেল যেন আপনা আপনিই খানিক ধীর হয়ে যায়। আজও হলো। তবে আজ হলো অন্য কারণে। পারুদের বাড়ির চারপাশজুড়েই ঝোঁপ-ঝাড়। সেখানে রাস্তার ধারে কুপি হাতে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দু-একবার বেল বাজিয়ে সাইকেল থামাল ফরিদ। তারপর বলল, কে ওখানে?
কেরোসিনের কুপির আলোয় এতদূর থেকে মানুষটাকে ঠিক ঠাহর করা গেল না। তার ওপর ফরিদের গলার স্বর শুনে মানুষটা যেন আলোটাকে খানিক আড়াল করে ফেলল। জায়গাটাও ভীষণ অন্ধকার। তবে সেই অন্ধকারেও ফরিদ বুঝতে পারল, ওখানে একজন মাত্র মানুষ দাঁড়িয়ে নেই। সে সতর্ক গলায় বলল, কী হলো? কথা বলছেন না কেন? কে ওখানে?
দাদা, আমি চারুর কণ্ঠটা চিনতে সময় লাগল না ফরিদের। সে চট করে সাইকেল থেকে নেমে গেল। তারপর বলল, চারু, তুই?
হ্যাঁ, দাদা।
তুই এখানে কী করছিস?
মা আর পারুদিও আছে। পারুর কথা শুনে বুকটা কেমন ধক করে উঠল ফরিদের। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হলো যে, কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। সে রাস্তার ওপরই সাইকেলটাকে দাঁড় করাল। তারপর হেঁটে সামান্য ঢাল বেয়ে। নিচে নেমে এলো। এতক্ষণে অঞ্জলিকে চোখে পড়েছে তার। পারুকে না দেখলেও বোঝা যাচ্ছে যে সে মায়ের পেছনেই কোথাও আছে। তবে সেদিকে আর তাকাল না। ফরিদ। সে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, কী হয়েছে কাকিমা? কোনো সমস্যা?
অঞ্জলি কথা বললেন না। তবে চারু বলল, বাবা দুপুরে উত্তরপাড়া গিয়েছিল। কিন্তু এখনো ফেরেনি।
একা গিয়েছিল?
না। সঙ্গে এছাহাক বেপারী ছিল। এতক্ষণে কথা বললেন অঞ্জলি।
কোন এছাহাক বেপারী? ওই যে জমির দালাল?
হুম।
উত্তরপাড়া কোথায় গিয়েছিল?
খাঁ বাড়ি। আশরাফ খাঁয়ের কাছে।
আচ্ছা। বলে কী যেন ভাবল ফরিদ। তারপর বলল, আপনারা চিন্তা করবেন, আমি দেখছি। আমার সঙ্গে সাইকেল আছে। তবে ঘরে যদি কোনো টর্চ লাইট থাকে, তাহলে খুব উপকার হয়। এমনিতে সকাল-বিকাল যাতায়াত আছে বলে বাজার থেকে বাড়ির রাস্তাটা একদম মুখস্ত। ফলে অন্ধকারেও ঠিকঠাক সাইকেল চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু অতদূর পথ তো আর এই অন্ধকারে আলো ছাড়া যেতে পারব না।
অঞ্জলি কিছু বলার আগেই চারু ছুটে গিয়ে ঘর থেকে একটা তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট নিয়ে এলো। ফরিদ লাইটটা হাতে নিয়ে কয়েকবার জ্বালিয়ে দেখল সব ঠিক আছে কি না। এই ফাঁকে অবশ্য আড় চোখে একপলক পারুকেও দেখে নিল সে।
.
মহিতোষের সঙ্গে ফরিদের দেখা হলো উত্তরপাড়া থেকে ভুবনডাঙায় ঢোকার মুখে যে সরু উঁচু রাস্তাটা রয়েছে সেখানে। রাস্তার নিচে ঘাসের ভেতর শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন তিনি। অন্ধকারে পড়ে গিয়ে সম্ভবত পা মচকেছেন। ফরিদকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন মহিতোষ। ফরিদ অবশ্য তেমন কিছু বলল না। সে সাইকেলে করে মহিষকে বাড়ি পৌঁছে দিল। তারপর ফিরে গিয়ে আবার তার। মামাকে নিয়ে এলো। আব্দুল ওহাব দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলে ডাক্তার হিসেবেই পরিচিত। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি না থাকলেও তার হাত-যশ ভালো। তিনি সময়। নিয়ে মহিতোষকে দেখলেন। তারপর বললেন, আপনের প্রেসার তো বেশি। খুব টেনশন করেন না কি? তার ওপর এই শরীরে এতটা পথ হেঁটে গেলেন?
মহিতোষ নিস্তেজ গলায় বললেন, সকাল থেকেই শরীরটা খারাপ লাগছিল। কিন্তু কী করব বলেন? আজ যেতেই হতো উত্তরপাড়া। ফেরার পথে হঠাৎই সব
অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটাও খুব ঘোরাচ্ছিল। তারপর কখন যে কী হলো!
হম। ভাগ্য ভালো যে আরো বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নাই। তবে সেই চান্সও ছিল। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিতেছি, ফরিদ দোকান থেকে এনে দিয়ে যাবে।
মহিতোষ কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। একইসঙ্গে কৃতজ্ঞতা ও ভালো লাগায় তাঁর মন দ্রবীভূত হয়ে উঠল। এই মানুষগুলোও তো তার প্রতিবেশীই। এই একই গাঁয়ের। অথচ তারপরও কিছু ফণা লুকানো কাল কেউটের দংশনের ভয়ে তাকে জড়সড় হয়ে থাকতে হচ্ছে নিজভূমে পরবাসীর মতো।
তবে অস্বস্তিটা বাড়ল আরো খানিক পরে। ফরিদ ওষুধ নিয়ে আসতেই আব্দুল ওহাব বললেন, এক কাজ করেন মাস্টার সাব।
কী? মহিতোষ তাকালেন।
ফরিদ এই রাতটুক আপনের বাড়িতেই থাকুক। ও বাইরের ঘরের ওই চেয়ারে বসে থাকবে। বলা তো যায় না, কখন কী দরকার হয়। আপনার বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে তো কেউ নাই।
মহিতোষ জোর চেষ্টা করলেন বিষয়টা বারণ করতে। কিন্তু আব্দুল ওহাবের একগুয়েমির কাছে তা টিকল না। তিনি একা হেঁটেই বাড়ি ফিরলেন। ফরিদ বসে রইল বাইরের ঘরে। তার সামনে একটা কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। ভেতরের ঘরে মহিতোষ। তার পাশের ঘরে পারু আর চারু। এই এতটা সময়ে একবারের জন্যও পারু তার সামনে আসেনি। এমনকি একটা শব্দ অবধি উচ্চারণ করেনি। ফরিদের হঠাৎ মনে হলো, পারুকে এক পলক দেখার জন্য, তার একটা কথা শোনার জন্য প্রবল তেষ্টায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে।
তবে রাত বাড়তেই তাকে খাবার দিয়ে গেল চারু। তার সঙ্গে টুকটাক কথা হলেও ঘরের আর কেউ এলো না। অস্বস্তিকর এক নীরবতা বয়ে যেতে লাগল আবছা আলো-অন্ধকারে। ভাত খাওয়া শেষে হাত ধুতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ফরিদ। ভেতর ঘরের আলোয় দরজার বাইরে উঠানে কারো লম্বা ছায়া পড়েছে। সে পেছন ফিরে না তাকিয়েও বুঝতে পারল, মানুষটা পারু। কিন্তু সেখানে সে একা নয়। তার সঙ্গে হয়তো তার মা আছেন। কিংবা ঠাকুরমা। চারুও হতে পারে। তারা হয়তো কোনো কাজ করছে। এখন যদি মুহূর্তের জন্যও সে পেছন ফিরে তাকায়, তবে তা চোখে পড়ে যাবে অন্যদেরও। প্রকল দিদৃক্ষা সংবরণ করে খানিক স্থির দাঁড়িয়ে রইল ফরিদ। তারপর আবার চুপচাপ এসে চেয়ারে বসে পড়ল। চারু এসে এঁটো থালা বাসন নিয়ে গেল। রাত বাড়তে থাকল। ফুরিয়ে গেল কুপির কেরোসিনও। ভেতর ঘরের আলোও খানিক স্তিমিত হয়ে এলো। হয়তো ঘুমিয়ে গেল ঘরের মানুষগুলোও। কেবল জেগে রইল ফরিদ। যদি খানিক্ষণের জন্য হলেও ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে দরজা পেরিয়ে ওই ছায়াটুকু আবার ভেসে আসে? যদি এক মুহূর্তের জন্যও দেখতে পায় সে?
পারু না হোক, অন্তত পারুর ছায়াটুকুও যদি এক পলকের জন্য তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
৬
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, কী মনে হইল তোমার?
এছাহাক বলল, খাঁ সাব যেই দাম বলছেন, মনে হয় না মাস্টারে ওই দামে জমি বেচবে। আর ওই দামে বেচলে আমরাই কিনব। সমস্যা তো নাই। নাম মাত্র। মূল্য।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া পিচিক শব্দে পানের পিক ফেললেন। তারপর বললেন, তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি কি দিনদিন বাড়ে, না কমে?
কেন?
যেই জিনিস মানুষ ফাও পায়, সেই জিনিস কি কেউ টাকা দিয়া কেনে?
মাস্টারে মনে হয় না এমনে এমনেই সব ছাড়ব।
কেউই কিছু এমনে এমনে ছাড়ে না। ছাড়তে বাধ্য করতে হয়। ঘরে সেয়ানা দুইটা মাইয়া আছে। বাধ্য করা তো সহজ।
তারা তো বাড়ি থিকাই বাইর হয় না।
ব্যবস্থা করো।
কীভাবে করব?
.
সেই রাতে মহিতোষ মাস্টারের গরু চুরি হয়ে গেল। চুরি হয়ে গেল বলতে রাত দুপুরে হঠাৎ বিকট শব্দে গরু ঘরের বাশের আড়া ভেঙে পড়ল। মহিতোষ হন্তদন্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে এলেন। তার হাতে টর্চ লাইট। তিনি গরু ঘরে আলো ফেলে দেখেন গরু নেই! দিকশূন্য মহিতোষ চিৎকার করতে করতে বড় রাস্তার দিকে ছুটলেন। তার সঙ্গে ছুটলেন অঞ্জলিও। পারু আর চারু তাদের কর্তব্য ঠিক করতে পারল না। তবে এই রাতে বাবা-মাকে ওভাবে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখে তারা দুজনও ঘর থেকে বের হতে উদ্যত হলো। কিন্তু বৃদ্ধ ছায়ারাণী হঠাৎ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, বড় খিলটা দিয়া দুয়ার বন্ধ কর।
পারু আর চারু খুবই অবাক হলো। বাবা-মাকে ওভাবে বাইরে রেখে ঠাকুরমা কী না তাদের এভাবে দরজা বন্ধ করে দিতে বলছে? পারু বলল, কী বলছো ঠাকুমা?
যা বলছি, তাই কর। ছায়ারাণীর কণ্ঠ গম্ভীর।
পারু বলল, তুমি বুঝছো না, মা-বাবা বাইরে।
যেইটা বলছি কর। এবার চিৎকার করলেন ছায়ারাণী। বিস্মিত পারু হতভম্ব হয়ে ঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে রইল। ছায়ারাণীর এমন মূর্তি এর আগে কখনো। দেখেনি সে। ছায়ারাণী বললেন, বাড়ির আশপাশে শিয়াল-কুত্তা জড় হইছে। তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। তারা চায় তোরা দুজন বাইরে যাস।
এতক্ষণে যেন ছায়ারাণীর কথা বুঝতে পারলো পারু। বাবা-মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা হলেও সে বড় খিলটা তুলে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে কান খাড়া করে।
মহিতোষ আর অঞ্জলি অবশ্য কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এলেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তাদের সঙ্গে কালুও। গায়ের রং কালো বলে গাইটার নামই হয়ে গেছে কালু। মহিতোষ গোয়ালঘরে কালুকে বাঁধতে বাঁধতে খানিক গর্বিত স্বরেই বললেন, গাই কেউ নিতে পারে নাই মা। কেবল দড়ি খুলছিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই কালু দিছে লাথি। একজন মনে হয় ছিটকে ওই খুঁটির সঙ্গে পড়ছে। তারপর কালু দিছে ধাওয়া। তার তো বড় শিং। ভয়ে চোরগুলা দিবিদিক পালাইছে। আমরা গিয়ে দেখি রাস্তার ওপর দাঁড়াইয়া কুঁসতেছে।
ছায়ারাণী কথা বললেন না। তিনি গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। পরদিন অবশ্য জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ডাকলেন মহিতোষকে। বললেন, কী খবর মাস্টার? শুনলাম বাড়িতে চোর আসছিল?
জি।
আজকাল অবশ্য গ্রামে গরু চোর বাড়ছে। আসলে মানুষের কী দোষ বলেন? কথায় আছে না, অভাবে স্বভাব নষ্ট?
জি।
তা কী ঠিক করলেন? জমি-জমা কী করবেন?
ভাবছি একটু দেরি করব। ইন্ডিয়া যেতে হলেও তো কাগজপত্রের বিষয় আছে। ওগুলোর জন্য এমনিতেই একটু দেরি হবে।
জাহাঙ্গীর বললেন, আমি না শুনছিলাম কাগজপত্রের কাজ সব শেষ?
আরে নাহ। এগুলো কি এত সহজ না-কি? ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথাটা বললেন মহিতোষ।
তাইলে তো হাতে সময় আছে?
জি আছে। আপনি চিন্তা করবেন না। এছাহাকের সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনিও এর মধ্যে একটু গোছাই নেন। আমিও অপেক্ষা করি।
মহিতোষের এই কথায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে এমন ভয়-ভীতি দেখানোর পর যত দ্রুত সম্ভব তড়িঘড়ি করেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হবেন মহিতোষ। ফলে জমি-জমার একটা ত্বড়িৎ ও সহজ সমাধানও তিনি পেয়ে যাবেন। কিন্তু হঠাৎ করেই মহিতোষের এমন উল্টো গীতে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললেন, খ সাব শুনলাম জমির দাম বলছেন?
তা বলছেন। কিন্তু ওই দামে কি এই জমি বেচা সম্ভব?
এখন বাজার তো ভালো না।
তা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে বাপ-মায়ের এই ভিটা এই দামে ছাড়ব?
মহিতোষের কথার স্বরে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কেমন সন্দেহ হতে লাগল। তিনি এছাহাককে ডেকে বললেন, ঘটনা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। মাস্টার তো বলে অপেক্ষা করবে?
এছাহাক হাসল, আপনে চিন্তা নিয়েন না। এইটা তার একটা কৌশল। আমি সব জানি। ভেতরে ভেতরে সে চইলা যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়া ফেলছে। এখন আপনারে একটু বাজাই দেখতেছে।
এছাহাকের কথায় যেন আশ্বস্ত হতে পারলেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ঠিক তো?
ঠিক।
চুপ কইরা গিয়া আবার খাঁ সাবের কাছে জমি বেইচা দিয়াসবে না তো?
সেইটা আমি দেখব। আপনে চিন্তা নিয়েন না। এক মাসের মধ্যে তার জমির ব্যবস্থা আমি কইরা ফেলব।
.
মহিতোষ যে ভেতরে ভেতরে চলে যাওয়ার সব বন্দোবস্তুই করে ফেলেছেন, এ কথা সত্য। কিন্তু বিষয়টা তিনি ঘুণাক্ষরেও কাউকে বুঝতে দিতে চান না। শেষবারের মতো যেদিন বিদায়ের ট্রেন ধরবেন, তার ঠিক আগ মুহূর্তেও না। ফলে সবকিছুই তাঁকে করতে হচ্ছে সাবধানে, গোপনে। আর এ কারণেই চট করে গরু বিক্রির চেষ্টাও তিনি করেননি। সবার আগে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন জমি বিক্রির বিষয়টা। আশরাফ খাঁ চাইলে সেটা গোপনেই করে ফেলা যাবে। সেক্ষেত্রে গরুর একটা ব্যবস্থা এখন করাই যায়। দিন কয়েক আগের ঘটনা সবার কানেই পৌঁছেছে। আশপাশে কিছু হিন্দু-মুসলিম দরিদ্র পরিবার রয়েছে। তারা সহসা খুব একটা উচ্চবাচ্য না করলেও এই বিষয়ে এলাকার গণ্যমান্য লোকেদের কাছে গেল। তারা। কৃষিনির্ভর জীবনে নিজেদের গবাদি পশুর নিরাপত্তার কথাও বলল। সব শুনে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলে কথা দিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। মহিতোষ অবশ্য আশরাফ খাঁর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে একটা চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলত হবে।
তবে তার আগে তিনি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে বিভ্রান্ত করার জন্য জলিল খা, মোতালেব তালুকদার সহ আশেপাশের কিংবা দূরের আরো বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী লোকের কাছেও গেলেন। বিষয়টা দৃশ্যত এমন যে তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছেন, যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো মহিতোষ চান, এছাহাক বা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এগুলো জানুক। এতে বরং তার সুবিধাই। তারা পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যাবে মহিতোষের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। এ কারণেই দুয়েক জায়াগায় তিনি এছাহাককেও নিয়ে গেলেন। এবং সব জায়গা থেকেই মোটামুটি প্রত্যাখ্যাতই হলেন মহিতোষ। এই মুহূর্তে কেউই সেভাবে জমি কিনতে আগ্রহী নয়। আর হলেও তার মূল্য রীতিমতো অগ্রহণযোগ্য। ফলে মহিতোষের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা সন্দেহ পোষণ করলেও ঠিকঠাক কোনো অনুমান করতে পারল না।
জমিটা বিক্রি করতে পারলেই মহিতোষের আসল কাজ শেষ। ফলে এটি নিয়ে আর বিলম্ব করতে চান না তিনি। সেদিন রাতের ঘটনার মূল উদ্দেশ্য যে গরু চুরি নয়, বরং একটা ভয়ংকর অশনিসংকেত, তা ছায়ারাণীর সঙ্গে কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলেন মহিতোষ। ফলে ভেতরে ভেতরে আরো উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছেন তিনি।
মহিতোষ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন, জমি তিনি আশরাফ খাঁকেই দিবেন। এই লোকটার প্রতি তার সামান্য দুর্বলতা রয়েছে। এর কারণ, আশরাফ খাঁ সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে নানান কথা তিনি শুনেছেন। সেগুলো একজন ভালো মানুষের পরিচায়ক। যদিও বিপদে পড়া এই তার প্রতি ঠিক কতটুকু সদয় আশরাফ খাঁ হবেন, সে ব্যাপারেও মহিতোষ সন্দিহান।
তবে এখন মূল সমস্যা হচ্ছে, দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য তাঁকে উত্তরপাড়া যেতে হবে। কিন্তু এছাহাক যে তার দিকে সারাক্ষণ নজর রাখে, এটা তিনি জানেন। ফলে বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে যতটা সহজ মনে হয়, ততটা সহজ আসলে নয়। দিন কয়েক বাদে অবশ্য মফিজুল গোয়ালার সঙ্গে হঠাৎ বাজারে দেখা হয়ে গেল মহিতোষের। আর সঙ্গে সঙ্গেই বুদ্ধিটাও মাথায় চলে এলো। চাইলে তো মফিজুলের মাধ্যমেই খাঁ সাহেবকে খবরটা দিতে পারেন তিনি। মফিজুল লোক ভালো। মহিতোষের বর্তমান পরিস্থিতিও আঁচ করতে পারে সে। ফলে বিশেষ একটা সহানুভূতিও অনুভব করে। এসব কারণে তাকে বিশ্বাসও করা যায়। আশপাশে একটু চোখ বুলিয়ে মফিজুলের কাছে গেলেন মহিতোষ। তারপর খুব স্বাভাবিক আলাপের ভঙ্গিতেই বললেন, কী খবর মফিজুল? সব ভালো তো?
জে, মাস্টার মশাই। ভালো। আপনের খবর তো মনে হয় ভালো না?
কেন? ভালোই তো আছি।
শুনলাম, বাড়িতে না-কি চোর পড়ছিল?
ওহ। এই কথা? তা চোর তো এখন অনেক বাড়িতেই পড়ে। গায়ে তো আজকাল চুরি-ডাকাতি বেড়ে গেছে।
তা বেড়েছে। নিজের গরু দুইটা নিয়াও চিন্তায় আছি। করি আমি গোয়ালার কাম। কিন্তু গরু মোটে দুইখান। হা হা হা। বলে হাসল মফিজুল। তারপর বলল, আমি তো বাড়ি বাড়ি ঘুরে গৃহস্থের কাছ থেকে দুধ কিনি। তারপর সেই দুধ বাজারে আইনা একটু বেশি দামে বেচি। ওই তে যা লাভ হয়। তবে এখন ভাবতেছি আরেকটা গরু কিনব। কিছু টাকাও জমাইছি।
তা আমরটাই তো কিনতে পারো। আচমকাই কথাটা বললেন মহিতোষ। এমন নয় যে বিষয়টা তিনি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু চট করেই কথাটা মাথায় এসেছে। শুনে অবশ্য মফিজুলও খুবই আগ্রহী হলো। সেই দিনই তাকে গরু দেখাতে বাড়ি নিয়ে এলেন মহিতোষ। কালুকে দেখে মফিজুলেরও খুব পছন্দ হয়ে গেল। সে অভিজ্ঞ মানুষ। এক পলক দেখেই বুঝে ফেলেছে, এই গরুর ঠিকঠাক যত্ন-আত্তি করতে পারলে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। সে গরুর যা দাম বলল, তাতে মহিতোষকেও সন্তুষ্টই মনে হলো। তবে তিনি বললেন, তুমি যেদিন গরু কিনতে আসবা, সেদিন আমি নিজে গিয়ে গরু তোমার বাড়িতে দিয়ে আসব।
আপনে কেন কষ্ট করতে যাবেন?
এই কথার উত্তর দিতে গিয়েও থমকে গেলেন মহিতোষ। তিনি কী করে মফিজুলকে বোঝাবেন যে কেন তিনি কালুকে নিজ হাতে গিয়ে দিয়ে আসবেন? মফিজুল কি জানে, এই বাড়ি, এই ঘর, ওই গাছ, গাছের পাতা, উঠানের কোণে আলস্যে পড়ে থাকা দুপুর রোদের চিরলবিরল ছায়াটুকুর জন্যও তার মন কেমন করে? এই যে গোয়ালঘর, ওই যে খড়ের গাদা, জলের ভাড় আর ওই যে কালু, ওই যে সে মলিন মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, জল ছলছল চোখ, এসব তার কাছে কী, তিনি কীভাবে বোঝাবেন? কাকে বোঝাবেন?
মহিতোষ আর জবাব দিলেন না। তবে আশরাফ খাঁকে খবরটা পৌঁছে দিতে অনুরোধ করলেন। আর বললেন, মফিজুল যেদিন গরু নিতে আসবে, সেদিন যেন সে আশরাফ খাঁর কাছ থেকে জমি বিক্রির চূড়ান্ত দিন-ক্ষণের খবরটা নিয়ে আসে।
মফিজুল পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে গরু কেনার বায়না করল। তারপর বলল, যাই তাইলে মাস্টার মশাই। আমি দিন কয়েকের মধ্যেই টাকা নিয়া গরু নিতে আসব।
মহিতোষ কথা বললেন না। মফিজুল চলে গেলেও নড়লেন না তিনি। দীর্ঘ সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কালুর দিকে। কালু কিছু বুঝেছে কী না কে জানে! তবে সে আর একবারও মহিতোষের দিকে ফিরে তাকাল না। কী যেন এক অব্যক্ত অভিমানে হঠাৎ দাঁড়ানো থেকে আধশোয়া হয়ে বসে পড়ল। তার দুই পায়ের মাঝখানে মুখ খুঁজে পড়ে রইল নিঃসাড়ে।
.
পরের দিনগুলো কাটতে লাগল খুব দ্রুত। মহিতোষ হঠাৎ সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। পারু বা চারু কিছু জিজ্ঞেস করলেও জবাব দেন না। যেন শুনতেই পান না তিনি। সারাক্ষণ বাড়ির এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে বেড়ান। আর আপনমনে কী সব বিড়বিড় করতে থাকেন। পারু অবশ্য বাবাকে ঘাটাতেও চায় না। সে বোঝে বাবার বুকের ভেতর কী চলছে! মাও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি চুপচাপ হয়ে গেছেন ঠাকুরমা। সেদিন খুবই আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল। রাতে ছায়ারাণী হঠাৎ সবাইকে ডাকলেন। তারপর বললেন, আমি আর কয়দিন বাঁচব? না হয় আমি এইখানেই থাইকা যাই। মরলে অন্তত চিতাটা তো এই দেশেই হইব! আরেক দেশের পোড়া ছাই হইয়া লাভ কী? নিজের দেশের ছাই নিজের দেশের জল, হাওয়া, মাটিতেই মিশ্যা যাক।
.
পারুর নিজেরও আজকাল আর কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। চারুর সঙ্গেও না। সে প্রায় সারাটা দিন একা একা পুকুর পাড়ে বসে থাকে। জলের ভেতর নিজের ছায়া দেখে। আর হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, এই যে তার চারপাশে এত এত মানুষ, এত এত দুঃখ, এই সব দুঃখের ভিড়ে সে যে কখন কোন ফাঁকে তার নিজের দুঃখগুলোই হারিয়ে ফেলেছে তা টেরই পায়নি। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত তার। এই চেনা সবকিছু ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে, এটা ভাবলেই কান্না পেয়ে যেত। মনে হতো, বুকের ভেতর একটা কঠিন পাথর চেপে বসে আছে। এই পাথরচাপা কষ্ট থেকে এই জীবনে আর মুক্তি নেই তার। কিন্তু দিন যত গিয়েছে, বাবা-ঠাকুরমাকে যত দেখছে, ততই তার নিজের দুঃখগুলোকে যেন আর দুঃখ মনে হচ্ছে না। বরং তীব্র এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব হচ্ছে। যেন এখান। থেকে পালিয়ে গেলেই সে বাঁচে। যতদ্রুত সম্ভব ভুবনডাঙা হয়ে যশোরের দিকে যে ট্রেনটা যায়, সেই ট্রেনটায় চেপে বসতে চায় পারু। তারপর বেনাপোলের বর্ডার। তারপর পারি দিলেই অন্য এক দেশ। নতুন এক ঠিকানা। আচ্ছা, মানুষ যদি। সীমানা পেরোয়, তাহলে কি তার দুঃখগুলোও সীমানা পেরোয়? না-কি কাঁটাতারে আটকে থাকে? না-কি দুঃখগুলো পাখির মতো, সে দেশ-সীমানা, কাঁটাতার কিছুই বোঝে না! সে কেবল মানুষ বোঝে, মানুষ!
.
মহিতোষ সেদিন রাতে সবাইকে নিয়ে বসলেন। তারপর বললেন, আমরা খুব বেশি জিনিসপত্র নেব না। যা যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। শুধু হাতে করে নিয়ে যাওয়া যায়, এমন কিছু জিনিসপত্রই নিয়ে যাব। সুতরাং সবাই যার যার। মালপত্র গুছিয়ে রেখো।
বাকি সব কিছুই রেখে যাব আমরা? চারু জিজ্ঞেস করল।
বেশি কিছু তো নেইও। সংসারের এই হাঁড়ি-পাতিল, বিছানা পত্র ছাড়া। ঘরের যা যা বিক্রি করা যেত, আমি তা গত বছরখানেক ধরেই একটু একটু করে করেছি। কিছু টাকা-পয়সাও তোর বড় মামার কাছে পাঠিয়ে রেখেছি।
মহিতোষ ভেবেছিলেন অনেক কথা বলবেন। কিন্তু এইটুকুতেই থেমে যেতে হলো তাকে। আঁতিপাতি করেও বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেলেন না তিনি। পাঁচজন মানুষ গোল হয়ে বসে আছে একটি ঘরের কাঁচা মাটির মেঝেতে। তাদের মাঝখানে একখানা কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। সেই কুপির আলোতে পাঁচটি মানুষের আবছায়া মুখ দেখা যাচ্ছে। মুখগুলো চুপচাপ, শান্ত, নির্বিকার। কিংবা অপাঠ্য। জগতে সকল অনুভূতির ভাষা পড়া যায় না। আর যায় না বলেই হয়তো ঘরের দেয়ালজুড়ে এই মানুষগুলোর যে ছায়া পড়েছে, সেই ছায়াগুলোকে মনে হচ্ছে অন্য কোনো মানুষ। অন্য কোনো বিশালাকায় প্রাণী। কিংবা বিভ্রম।
৭
ফরিদ জানে পারুরা চলে যাবে। পারু নিজেই তাকে এ কথা বলেছে। কিন্তু তারপর থেকে আর পারুর সঙ্গে কথা হয়নি তার। মাঝখানে কয়েকবার সে কথা বলার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু লাভ হয়নি। পারু কোনোভাবেই সেই সুযোগটি তাকে দেয়নি। আচ্ছা, মানুষ কেন এমন হয়? এমন মুহূর্তেই আমূল বদলে যায়? তাহলে সে কেন পারে না? তার কেন সারাক্ষণ এমন আকণ্ঠ তেষ্টায় গলা শুকিয়ে থাকে? বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণার স্ফুলিঙ্গ ফুটতে থাকে?
রোজ ভোরে যখন সে বাড়ি থেকে বের হয় কিংবা রাতে বাড়ি ফেরে, এই পুরোটা সময় তার বুক শূন্য হয়ে থাকে। গলা শুকিয়ে আসে। তীব্র দুশ্চিন্তায় প্রায় অসাড় হয়ে থাকা ফরিদ পারুদের বাড়ির দিকে দম বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। ওই বুঝি খানিক প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল। ওই বুঝি একটু আলো। একটা মানুষ। একটা শব্দ। না-কি ওই ঘরখানা এখন শূন্য? ওখানে কোথাও কেউ নেই? পারু নেই? সে চলে গেছে রাতের অন্ধকারে। তাকে কিছু না জানিয়ে। প্রায় মাস ছয়েক আগে তার সঙ্গে যে শেষ কথা হয়েছিল পারুর, সে-ই তাদের শেষ কথা? শেষ দেখা? এ জনমে আর কখনো তাদের দেখা হবে না? কথা হবে না?
এরপর আর ভাবতে পারে না সে। তার শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। মনে হয় এই যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু ঢের সহজ। আচ্ছা, মানুষ কেন মানুষকে এমন করে ভালোবাসে? এমন করে কষ্ট পায়? এমন নিভৃত রাতের একাকী স্তব্ধতায় কাঁদে? আর যদি কাঁদেই, তবে অন্য মানুষটা তা কেন টের পায় না?
.
আজ সন্ধ্যা থেকেই শরীরটা খারাপ ফরিদের। রাতে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে টের পেল, কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। গলার কাছে একটু ঠাণ্ডা কাশিও। সে বিছানা থেকে উঠল। তারপর দিয়াশলাই দিয়ে আলো জ্বালাল। ওষুধের বাক্সটা টেবিলের ওপর। সেটা খুলে জ্বরের কোনো ওষুধ খুঁজছিল। আর তখুনি চিরকুটটা চোখে পড়ল তার। সঙ্গে পারুর এক লাইনের একটা লেখাও।
এই লেখাটার কথা মনে আছে ফরিদের। তখন বর্ষা। হঠাৎ করেই কী কাজে মামার সঙ্গে একদিনের জন্য ঢাকা যেতে হলো তাকে। কিন্তু সেখানে গিয়ে নানা ঝামেলায় আটকে গেলেন আব্দুল ওহাব। সঙ্গে ফরিদও। সব কাজ সেরে তাদের ফিরতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে গেল। তবে ফরিদ এর মধ্যে ঢাকা থেকে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল। পারুদের বাড়িতেও। তারা ফিরল প্রায় বারো দিন পর। সেদিন বিকেলেই পারুদের বাড়িতে গেল সে। কিন্তু পারু তার সামনেই এলো না। চারু একা একা এসে পড়তে বসে গেল। ফরিদ বলল, পারু কই?
দিদির শরীর খারাপ।
কী হয়েছে?
তাতো জানি না, বলেছে শরীর খারাপ।
ফরিদ অবশ্য আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার হঠাৎ মনে হলো, মেয়েদের নানা অসুখ-বিসুখ থাকে, তার সবই চট করে জিজ্ঞেস করতে নেই। এটা অভব্যতা। সে চারুকে পড়িয়ে বাড়ি চলে এলো। কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না। সারাক্ষণ কেমন এক অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করতে লাগল বুকের ভেতর। সমস্যা হচ্ছে, পরদিনও একই ঘটনা ঘটল। তার পরদিনও। চতুর্থদিন বিকেলে পড়াতে গিয়ে দেখে পুকুর ধারে বসে আছে পারু। তার হাতভর্তি কদম ফুল। পরনে সবুজ কলাপাতা রঙের শাড়ি। কিন্তু যথারীতি পড়তে এলো না সে। ফরিদ চারুকে বলল, পারুর কি আজও শরীর খারাপ?
তাতো জানি না।
তাহলে পড়তে আসছে না যে?
দিদি আর পড়বে না।
পড়বে না মানে?
পড়বে না মানে আপনার কাছে পড়তে আর ভালো লাগে না দিদির।
ফরিদ খানিক থমকে গেলেও বলল, এ কথা সে বলেছে?
হুম।
কেন ভালো লাগে না আমার কাছে পড়তে?
তাতো জানি না।
যা জিজ্ঞেস করে আয়।
চারু গেল না। ফরিদ বলল, কী হলো? যা, জিজ্ঞেস করে আয়।
পারুদি বলেছে, আপনি কিছু বললে আমি যেন সেটাও তার কাছে বলতে না যাই।
ফরিদ কিছুই বুঝল না। তবে ফেরার সময় সে চারুর হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা দিদির কাছে দিস। আর বলিস, আমি আর আসব না।
ফরিদ আর গেলও না। প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গেল। যদিও ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার। তারপরও গেল না সে। তবে সাত দিনের দিন সন্ধ্যায় রিংকু এলো তার ফার্মেসিতে। রিংকু পারুদের পাশের বাড়ির নয়-দশ বছরের এক ছেলে। সে এসে বলল, পারুদি এই চিঠিটা দিয়েছে।
ফরিদের বুকটা ধক করে উঠল। পারু তাকে চিঠি লিখেছে! সে হন্তদন্ত হয়ে চিঠিটা হাতে নিল। তারপর যত্ন করে রেখে দিল পকেটে। এই সন্ধ্যাবেলা ভরা ফার্মেসিতে বসে সে এই চিঠি পড়তে পারবে না। পড়বে বাড়ি গিয়ে। রাতে খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গিয়ে সে চিঠিখানা খুলল। মাত্র একটা লাইন সেখানে লেখা–
যে অভিমান বোঝে না, সে আবার কীসের প্রেমিক প্রেমিক হতে হলে অভিমান বুঝতে হয়…।
ফরিদ জানে না পারু তার ওপর কেন অভিমান করেছে! কোনো কারণই সে খুঁজে পেল না। কিন্তু তারপরও তার মনে হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে যুক্তিহীন কারণেও যদি পারু তার ওপর অভিমান করে থাকে, তাতেও তার আপত্তি নেই। সে চায়, পারু বাকিটা জীবন এমন করেই তার ওপর অভিমান করুক। জগতের সবচেয়ে খামখেয়ালি, স্বেচ্ছাচারী, যুক্তিহীন অভিমান। ওই অভিমানটুকু সে ভাঙাতেই চায়। বুঝতেই চায়। সে আসলে সত্যিকারের প্রেমিক হতে চায়।
এক সত্যিকারের আদ্যোপান্ত প্রেমিক।
.
কিন্তু সেই পারু কেন এমন বদলে গেল? ফরিদ জানে, মাধান অযোগ্য এক সমস্যা তাদের দুজনের মাঝখানে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় তাদের জানা নেই। কিন্তু তাই বলে এভাবে কথা বন্ধ করে দিতে হবে? একবারের জন্যও নিজের দুঃখগুলোকে বলা যাবে না, শোনা যাবে না? এমন করে রুদ্ধ করে দিতে হবে বাকি সময়টুকুও?
.
সেবার অবশ্য পারুর অভিমানের কারণ শেষ পর্যন্ত জানতে পেরেছিল ফরিদ। সে যে ঢাকা থেকে বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিল, সেই খবর পারুদের বাড়িতে কেউ পৌঁছায়নি। ফলে প্রায় প্রতিদিনই ফরিদের অপেক্ষায় থাকত সে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি ওই সময়টুকুর জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত। প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হতো যন্ত্রণাময় অপেক্ষার দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী! ফরিদ চিরকুটটা উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর কত বার যে পড়ল, তার ইয়ত্তা নেই। তার কেবল মনে হতে লাগল, ওইটুকু এক কথার ভেতর একটা গোটা জীবন লিখে দিয়েছে পারু।
পরদিন আকাশজুড়ে মেঘ। সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। বিকেলে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পড়াতে গেল ফরিদ। পারু অবশ্য সেদিনও এলো না। তার অভিমান তখনো ভাঙেনি। ফরিদও সেদিন একটা চিরকুট লিখে দিয়ে এলো পারুকে। সেখানে ছোট্ট এক কবিতা। সে লিখল–
পারু,
এই যে আমার হঠাৎ মন খারাপ, এই যে আকাশ মেঘলা হয়ে এলো,
এই যে দুপুর বুকের গহিন থেকে, সন্ধ্যা এনে হঠাৎ এলোমেলো।
এই যে আমার ভাল্লাগে না কিছু, এই যে ভীষণ বিষণ্ণ এক দিন,
একটা তুমুল কোলাহলের জগৎ, হঠাৎ হলো নির্জনতায় লীন।
এই যে বুকে জমছে ভেজা পালক, পাখির মতোন ছটফটানি মন,
এই পৃথিবীর সবটা আকাশ জানে, তুমিবিহীন আমার নির্বাসন।
পারুর অভিমান তাতে ভেঙেছিল। পরদিন পড়ার এক ফাঁকে সে চারুকে হঠাৎ জল আনতে পাঠাল। তারপর আচম্বিতে ফরিদের হাতখানা হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। ফরিদ কিছু বলতে গিয়ে দেখে পারু কাঁদছে। তার চোখের কাজল ধুয়ে যাচ্ছে জলে। সে ফিসফিস করে বলল, কী হয়েছে?
পারু বলল, আমি এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কেন?
জানি না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, আপনার সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হবে না। কোনোদিন না!
ফরিদ এবার পারুর হাতখানা তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আরো শক্ত করে ধরল। তারপর বলল, আমাদের রোজ দেখা হবে পারু। রোজ। একদম জীবনের শেষ দিন অবধি।
সত্যি? পারুর গলায় কান্না, সংশয়।
ফরিদ বলল, সত্যি।
.
সেই পারু চলে যাচ্ছে? সারাজীবনের জন্য? এই জীবনে তার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না?
ফরিদের হঠাৎ কী যে হলো! সে আলনা থেকে জামাটা নিয়ে গায়ে জড়াল। তারপর সেই গভীর রাতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। রান্নাঘরের ভেতর শিকল দিয়ে বাধা থাকে সাইকেলটা। অন্ধকারেই হাতড়েচড়ে সেটা বের করে আনল সে। তারপর হতবুদ্ধ এক মানুষের মতো অন্ধকারে ছুটতে লাগল। যেন তার মাথায় কিছু ভর করেছে। সে এক ঘঘারগ্রস্ত মানুষ। এই ঘোর না কাটানো অবধি তার মুক্তি নেই। সে পারুদের বাড়ির উঠোনে এসে সাইকেল থেকে নামলো। তারপর আমগাছটার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড় করাল সাইকেলটা। তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। কোনো গোপনীয়তা নেই। সে সশব্দে দরজায় আঘাত করল। তারপর শান্ত, স্পষ্ট গলায় ডাকল, পারু। পারু।
ছায়ারাণীর ঘুম ভেঙে গেল। কিংবা তখনো ঘুমাননি তিনি। হয়তো জীবন তার চোখ নিদ্রাহীন করে ফেলেছে। তিনি কর্কশ কণ্ঠে বললেন, কে ওইখানে? কে?
আমি ফরিদ ঠাকুমা। ফরিদ নিঃসঙ্কোচে স্পষ্ট গলায় জবাব দিল ।
এত রাইতে এইখানে কী?
দরজাটা একটু খোলেন। পারুর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
ততক্ষণে মহিতোষ জেগে গেছেন। জেগেছেন অঞ্জলিও । হয়তো আশেপাশের বাড়িতেও কেউ! পারু আর চারু জেগে আছে কী না বোঝা গেল না। তবে তাদের কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। ফরিদ গলা উঁচু করে ডাকল, স্যার, দরজাটা একটু খুলবেন? একটু…।
মহিতোষ এবার কথা বললেন, কী হয়েছে ফরিদ?
কিছু হয় নাই।
তাহলে? এত রাতে এখানে কী?
এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না ফরিদ। সে বলল, দরজাটা একটু খোলেন। একটুখানি। একটা মিনিট।
মহিতোষ বললেন, তুই বাড়ি যা ফরিদ। তোরে তো আমি ভালো মানুষই মনে করতাম। তুইও শেষ পর্যন্ত…?
ফরিদ মহিতোষের কথা শেষ করতে দিল না। সে বলল, আমিও কি? আমি খারাপ মানুষ? হ্যাঁ, আমি খারাপ মানুষই। আমি অনেক খারাপ মানুষ। খারাপ মানুষ না হলে আমার এত কষ্ট হয় কেন? কেন এত কষ্ট হয়? বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। কান্নায় তার কথা জড়িয়ে যেতে লাগল। মহিতোষ কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। ফরিদ বলল, একবারের জন্য দরজাটা একটু খোলেন স্যার। মাত্র একবার। আমি একবার শুধু পারুরে একটু দেখব। এক পলকের জন্য। তারপর চলে যাব। আর কোনোদিন আসব না। ও স্যার, একবার। একবার একটু পারুরে আমায় দেখতে দেন। একবার…। কান্নায় গলা বুজে আসছে ফরিদের। সে দরজার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। আর দু হাতে সজোরে আঘাত করতে লাগল দরজায়। আশেপাশের বাড়ির জানালায় দুয়েকটি উৎসুক মুখ ততক্ষণে উঁকি দিয়েছে। ফরিদ অবশ্য আর চিৎকার করল না। সে চুপচাপ বসে পড়ল উঠোনে। কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিল ফরিদ জানে না! তবে তখন দূরের কোনো মসজিদ থেকে ফজরের প্রথম আজানের ধ্বনি কানে ভেসে আসছে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে বাইরে। দীর্ঘক্ষণ ফরিদের কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। চারপাশটা নিখর-নীরব।
মহিতোষ বেশ কিছুক্ষণ পর সাবধানে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু দরজার ঠিক সামনেই ফরিদকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। শিশির ভেজা কনকনে ঠাণ্ডা মাটির উঠান। সেই উঠানে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে ফরিদ। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। মহিতোষ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছেন না। বেশ খানিক্ষণ পর সতর্ক ভঙ্গিতে ফরিদের গায়ে হাত রাখলেন তিনি। প্রচণ্ড জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। তিনি কয়েকবার ডাকলেন। কিন্তু লাভ হলো না। সাড়া দিল না ফরিদ। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে সে।
সেই ভোরে পায়ে হেঁটে এসে আব্দুল ওহাবকে চুপিচুপি বাড়ি ডেকে নিয়ে এলেন মহিতোষ। আব্দুল ওহাব সব শুনে চুপ করে রইলেন। তারপর মহিতোষকে বললেন, আমার ভাইগ্না আপনার বা আপনার মেয়েদের কোনো ক্ষতি করবে না। এই ওয়াদা আমি আপনার কাছে করে যাচ্ছি। আর আজ রাতে সে যা করছে, এর জন্য আমি আপনার পা ধরে মাফ চাচ্ছি। আপনি আমাকে মাফ করে দিয়েন।
মহিতোষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্দুল ওহাব মহিতোষের পা জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি মাস্টার সাব। আপনি কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা কেউ নিজে না ফেস করলে বুঝতে পারবে না। আমি অথর্ব এক মানুষ, আপনার জন্য কিছু করতে পারছি না। এইজন্য ভেতরে ভেতরে নিজের কাছেই নিজে লজ্জায় কুঁকড়ে থাকি। কিন্তু আজ আমার ফরিদ যা করল, তার কোনো ক্ষমা হয় না। তারপরও আপনি আমার ফরিদরে ক্ষমা করে দেবেন। কারণ, এই ছেলেটা এতিম। এর মা-বাবা নাই। এতিমের অপরাধ একবারের জন্য হলেও ক্ষমা করা যায়। সে আপনার ছাত্র। আপনি তারে কোনো অভিশাপ দেবেন না। আপনি অভিশাপ দিলে তার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
মহিতোষ অনেক কষ্টে তার পায়ের কাছ থেকে আব্দুল ওহাবকে টেনে তুললেন। তারপর বললেন, ভাইজান, আমি বাইরে বাইরে শক্ত থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি ভয়ে, আতঙ্কে কাঁপতে থাকা এক মানুষ। গাছ থেকে একটা পাতা পড়লেও বুক কেঁপে ওঠে। দড়ি দেখলেও সাপ মনে হয়। এইজন্য আমি আজকাল অল্পতেই ভয় পেয়ে যাই। কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু আপনারে আমি বিশ্বাস করি। আমার মেয়েগুলার কোনো ক্ষতি আপনি হতে দিয়েন না।
কথা বলতে বলতে মহিতোষের চোখ ভিজে এলো। আব্দুল ওহাব দু হাতে তার হাত দুখানা জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি থাকতে ইনশাআল্লাহ, আপনার মেয়েদের কোনো ক্ষতি ফরিদ কেন, কেউই করতে পারবে না।
.
অচেতন, জ্বরাগ্রস্ত ফরিদকে নিয়ে যখন আব্দুল ওহাব বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন, তখন মহিতোষের ভেতর ঘরের ছোট্ট একটা খাটে অন্ধকারেও এক জোড়া চোখ স্থির, নিষ্কম্প তাকিয়ে আছে। সেই চোখ জোড়া পারুর। সারাটা রাত সে এক ফোঁটা ঘুমায়নি। একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত করেনি। ওই যে ফরিদ হাউমাউ করে কাঁদল, তার সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্য হলেও দেখা করতে চাইল, দরজার বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা মাটিতে অচেতন হয়ে মৃত মানুষের মতো পড়ে রইল, এই যে এত রাতে এমন। পাগলের মতো এভাবে ছুটে এলো, তার কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করল না। সে যেন নিথর, নিষ্প্রাণ, অনুভূতিহীন এক মানুষ হয়ে মিশে রইল গাঢ় অন্ধকারে।
৮
মফিজুল গরু কিনতে এলো তার সপ্তাহখানেক বাদে। কোমরের সঙ্গে বাঁধা ছোট একখানা চটের ব্যাগ বের করে উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে টাকা গুনতে লাগল সে। মহিতোষ অবশ্য সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। চারু এসে মফিজুলের হাত থেকে টাকাগুলো নিল। পারু দাঁড়িয়ে রইল ঘরের দাওয়ায়। কালু নিজ থেকেই উঠে দাঁড়িয়েছে। যেন শেষ বিদায়ের জন্য প্রস্তুত সে। মফিজুল খুঁটির সঙ্গে বাঁধা দড়িটা খুলল। তারপর বলল, এই গাই আমি নিজের সন্তানের মতো করে পালব। একটুও অযত্ন হইবো না স্যার। আপনি চিন্তা নেবেন না।
মহিতোষ তাও কথা বললেন না। মফিজুল বলল, আপনারে দেখে মনে হচ্ছে শরীর ভালো না। এই শরীরে যাইবেন?
মহিতোষ কথা না বললেও উঠে দাঁড়ালেন। দুয়ারের কাছে পারুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন অঞ্জলি আর ছায়ারাণীও। তাদের চোখ ভাবলেশহীন। মুখের অভিব্যক্তিতে কী আছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। কালো ফুটকিওয়ালা বাছুরটা কালুর। পেছনে দুলকিচালে হাঁটতে লাগল। কালু অবশ্য কোনো তোড়জোড় করল না। সে গোয়ালঘর থেকে বের হয়ে আর একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। তবে বড়। রাস্তায় ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ তীব্র শব্দে হাম্বা ডেকে উঠল। পর পর দুবার। তারপর সবকিছু চুপচাপ। যেন চির বিদায়ের এই মুহূর্তটাকে সাড়ম্বরে ঘোষণা করল সে। কিংবা কিছু বলল। বা বলতে চাইল। কিন্তু সবাক মানুষের সাধ্য কী নির্বাক প্রাণীর অব্যক্ত ওই অনুভূতির ভাষা অনুবাদ করে!
পারু অবশ্য আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। হঠাৎই ঝড়ের বেগে ছুটে গেল সে। একদম রাস্তার মাঝখানে। তারপর দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরল কালুর। তবে কথা বলল না কোনো। কেবল জড়িয়ে ধরে রাখল চুপচাপ। দীর্ঘ সময়। কালুও যেন বুঝল, অসহায় নির্বাক এই মানুষগুলো তাদের বুকের ভেতর যে প্রগাঢ় অনুভব তার জন্য পুষে রেখেছে, তা প্রকাশের ভাষা তাদের জানা নেই। সে একটা ছোট্ট আদুরে মানবশিশুর মতোই চুপচাপ তার মাথাটা পারুর কাঁধের ওপর হেলিয়ে রাখল। চুপচাপ, শান্ত, স্থির। মফিজুলের অকস্মাৎ মনে হলো কালুর গভীর কালো চোখের কোল গড়িয়ে জলের ধারা নেমে আসছে। কিন্তু সে নিশ্চিত না, এই অবলা প্রাণীটি সত্যি সত্যিই কাঁদতে পারে কি না! না কি এ তাদের চোখের দুরারোগ্য কোনো অসুখ?
মফিজুল দু পা হেঁটে এসে পারুর সামনে দাঁড়াল। তারপর বলল, তোমাগো এই গাই আমি নিজের সন্তানের মতো কইরা পালব। একটুও অযত্ন হইতে দেব না। এই কথা আমি দিতেছি।
পারু ফিরে তাকাল। মফিজুলের মুখে নির্ভার হাসি। তার চোখে স্নিগ্ধ মায়াময় দৃষ্টি। মানুষটাকে অবিশ্বাস করতে পারল না পারু। তার হঠাৎ মনে হলো, কালু অন্তত যোগ্য মানুষের হাতেই পড়েছে। এই মানুষটির কাছে সে ভালো থাকবে। যত্নে থাকবে।
মহিতোষ কালুর গলায় বাঁধা দড়ি ধরে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতেই আশরাফ খাঁর বিষয়েও মফিজুলের সঙ্গে কথা হলো তার। জমি বিক্রির একটা চূড়ান্ত তারিখ জানিয়ে পাঠিয়েছেন তিনি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই যেতে হবে মহিতোষকে। মহিতোষ ভেবেছিলেন কালুর সঙ্গে উত্তরপাড়া অবধি যাবেন তিনি। দেখে আসবেন, কোথায়, কীভাবে বাকিটা জীবন থাকবে কালু। কিন্তু শেষ অবধি যেতে পারলেন না। কিছুদূর যেতে না যেতেই হঠাৎ শরীর খারাপ লাগতে লাগল তাঁর। বুকটা কেমন ভার হয়ে এলো। কয়েকবার নিজে নিজেই বুকে হাত বোলালেন তিনি। চোখের সামনের দৃশ্যগুলোও যেন ক্রমশই ঝাপসা, অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। সেদিনের সেই অসুখটা কি আবার ফিরে আসছে? বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে সূক্ষ্ম একটা ব্যথাও তিনি টের পাচ্ছেন।
মহিতোষ বাড়ি ফিরে এলেন ঘণ্টাখানেক বাদে। উত্তরপাড়া অবধি তিনি যেতে পারেননি। তার আগেই ফিরে আসতে হয়েছে। তার সারা শরীর ঘর্মাক্ত। চোখ। টকটকে লাল। তাঁকে দেখে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে ছুটে এলেন অঞ্জলি। বললেন কী হয়েছে আপনার? এমন লাগছে কেন?
মহিতোষ কথা বলতে গিয়েও পারলেন না। তবে ইশারায় বোঝালেন যে তিনি জল খেতে চান। অঞ্জলি দৌড়ে গিয়ে জল নিয়ে এলেন। তবে মহিতোষ তা খেতে পারলেন না। তাঁর হাত কাঁপছে। অঞ্জলি দ্বামীর হাত থেকে গ্লাসটা নেয়ার আগেই সেটা মেঝেতে পড়ে গেল। কাসার গ্লাস থেকে জল ছিটকে পড়ল চারদিকে। মহিতোষ বুক চেপে ধরে বসে পড়লেন বিছানায়। অঞ্জলি চিৎকার করে পারু আর চারুকে ডাকলেন। চারু ঘরে নেই। সে কী এক কাজে পাশের বাড়িতে গেছে। পারু এসে বাবাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। গায়ের ঘামে ভেজা জামাটা খুলে হাওয়া দিতে লাগল। অঞ্জলি গামছা ভিজিয়ে এনে গা মুছে দিলেন। মহিতোষ শান্ত, চুপচাপ শুয়ে রইলেন বিছানায়। সময় যেতে তাঁকে খানিক ধাতস্ত মনে হলো। তবে অঞ্জলি হঠাৎ পারুকে বললেন, তুই একটু ওহাব ডাক্তারের বাড়ি যা তো! তারে একটু এখনই ডেকে আন।
পারু ভারি অবাক হলো। মা তাকে ফরিদদের বাড়িতে যেতে বলছে? তবে কিছু বলল না সে। ওই অবস্থায়ই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো।
.
ফরিদদের বাড়ির উঠানে একটা লম্বা চৌকি পাতা। সেখানে একজন মানুষ বসে আছে। এই দুপুর বেলায়ও তার গায়ে কাঁথা জড়ানো। সে বসে আছে পেছন দিকে ফিরে। তবে দূর থেকে দেখেও মানুষটাকে চিনতে ভুল হলো না পারুর। এই ভর দুপুরেও কাঁথা গায়ে বসে আছে কেন ফরিদ? সে অবশ্য সেদিকে আর ফিরে তাকাল না। চৌকিতে বসা জবুথবু ফরিদকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। সেখানে আছমা দাঁড়িয়ে আছে। ফরিদের জন্য কোনো খাবার তৈরি করছে সে। পারু বলল, ওহাব জ্যাঠা কই আছমা?
পারুকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল আছমা। বলল, পারুদি, তুমি?
হুম। কেন?
তোমারে কত বছর পর দেখলাম বলো তো?
পারু এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে গলা নামিয়ে বলল, ওনার কী হয়েছে?
ফরিদ ভাইর?
হুম।
তুমি কিছুই জানো না?
কী জানব?
তার তো বাঁচা-মরা অবস্থা। আব্বা কয়েকদিন আগে হঠাৎ কই থেকে নিয়ে আসলো। গায়ে জ্বর। সেই জ্বর সারাইতে শহরেও নেয়া লাগল। এখন একটু ভালো। কিন্তু কারো সঙ্গে কোনো কথা বলে না। কিছু খায় না। সারাক্ষণ ওইখানে ওইভাবে বসে থাকে।
কী বলিস?
হুম। বলে একটু-এদিক সেদিক তাকাল আছমা। তারপর বলল, আমার কাছে একটা গোপন খবর আছে।
কী গোপন খবর?
ফরিদ ভাইর যখন জ্বর হলো, সে সারাক্ষণ খালি তোমার কথা বলত। সারাটাক্ষণ। আরো কী সব হাবিজাবি যে বলত জ্বরের ঘোরে। তার বেশির ভাগই বোঝা যায় না।
আমার কথা কেন বলবে?
সেটাই তো কথা। মা শুনে তো খুব রাগারাগি করছে। মায়ের ধারণা ফরিদ ভাই আমারে বিয়া করব। কিন্তু আমার ধারণা অন্য।
পারু আর তার অন্য ধারণা শুনতে চাইল না। সে আমাকে চেনে। খানিক সহজ-সরল চপল মেয়ে সে। অকারণে সারাক্ষণ কথা বলে। পেটে কিছু রাখতে পারে না। তবে সে মানুষ ভালো। পারু চট করে জিজ্ঞেস করল, তোর মা কই?
হাসির কথা শুনবা?
কী?
আব্বায় গেছে বাজারে। ফরিদ ভাইর জন্য ওষুধ আনতে । আর মায় গেছে রহিম ফকিরের বাড়ি পানি পড়া আনতে। আছমা হাসছে।
জল পড়া?
হুম।
কেন?
মায়ের ধারণা ফরিদ ভাইর ওপর কিছুর আছর পড়ছে। তার মন আর ঘরে নাই। আমার ওপরও কোনো আগ্রহ নাই। তার আগ্রহ অন্যদিকে। বলে শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগল আছমা। কিন্তু পারু বুঝতে পারল না সে কী করবে? সে কি আব্দুল ওহাব আসা অবধি অপেক্ষা করবে? না-কি খবরটা দিয়েই চলে যাবে?
আছমার খাবার তৈরি করা হয়ে গেছে। সে একটা বাটিতে খাবার নিয়ে উঠানে ফরিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর চামচে করে খাইয়ে দিতে লাগল। ফরিদকে দেখতে লাগছে ছোট্ট শিশুর মতো। মাত্র এই কদিনেই শুকিয়ে গুটিয়ে গেছে সে। বসে আছে আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, শাড়ি পরা আছমাকে দেখতে অনেক বড় লাগছে। তার ভাবভঙ্গিতেও একটা নারী নারী ব্যাপার ফুটে উঠেছে। বরং ফরিদকে তার কাছে নেহাতই শিশু মনে হচ্ছে। যেন মমতাময়ী কোনো নারী তার রুগ্ন সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে মুহূর্তের জন্য কেমন লাগল পারুর। তবে বিষয়টাকে গ্রাহ্য করল না সে। এসব গুরুত্ব দেয়ার মতো পরিস্থিতি তার নেই। ফরিদ তাকে এখনো দেখেছে কি-না পারু নিশ্চিত নয়। তবে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর আছমাকে অস্ফুটে বলল, জ্যাঠা এলে বলবি, এখুনি যেন আমাদের বাড়িতে যায়। বাবার শরীরটা ভালো না।
পারু দাঁড়িয়ে আছে ফরিদের পেছনে। ফরিদ কি তার গলা শুনতে পেয়েছে? পারুর মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সামান্য কেঁপে উঠেছে সে। খানিক ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর চেষ্টাও করেছে। পারু আর অপেক্ষা করল না। সে ফরিদকে পাশ কাটিয়ে বের হবার রাস্তা ধরল। কিন্তু ওইটুকু সময়েই চোখাচোখি হলো তাদের। ফরিদের স্নান, ফ্যাকাশে চোখজোড়া যেন পলকের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন তার সারা শরীরে একটা অদ্ভুত স্পন্দন তৈরি হলো। তবে সেই স্পন্দন, কম্পন কিংবা উজ্জ্বলতাটুকু মুহূর্তের মধ্যেই আবার স্তিমিত হয়ে গেল। সে নিঃসাড়, নিষ্পলক চোখে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কোনো শব্দ করল না। কথা বলল না। ওঠার চেষ্টা অবধি করল না। তবে তার কালি পড়ে যাওয়া চোখজোড়া গভীর শূন্যতায় আচ্ছাদিত হয়ে রইল। তার ঠোঁটের দুই কোষ গড়িয়ে পড়তে লাগল খাবার। যেন ওই মুহূর্তটুকুর জন্য এই চেনা পৃথিবীর আর সব কিছু ভুলে সে হারিয়ে গেল অন্য অচেনা কোনো ভুবনে।
.
পারু রাস্তায় উঠতেই থমকে গেল। এছাহাক মিয়াকে দেখা যাচ্ছে দূরে জারুল গাছটার কাছে। ওই জায়গাটা খানিক চুপচাপ, নির্জন। লোকটাকে তার কখনোই ভালো মানুষ বলে মনে হয় না। বাবাও সব সময় সাবধান থাকতে বলেন। তাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে যে রাত-বিরাতে টিনের চালে ঢিল পড়ে, মহিতোষের ধারণা তা করে এই এছাহাক। সে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ডান হাত। ফলে তার থেকে যেকোনো অবস্থায় সাবধান থাকা জরুরি। সমস্যা হচ্ছে এই মুহূর্তে এছাহাক মিয়ার সঙ্গে আরো একজন লোক আছে। লোকটাকে আগে কখনো এ গাঁয়ে দেখেনি পারু। শক্ত সামর্থ্য ছোটখাটো গড়নের মানুষটার মাথায় চুল নেই। কেমন কুঁতকুঁতে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পারু সামনে এগুতেই এছাহাক মিয়া বলল, কই গেছিলে পারুল?
ওহাব জ্যাঠাদের বাড়ি।
সেই বাড়িতে কী? ফরিদের খোঁজ-খবর নিতে?
পারু প্রমাদ গুনল। ফরিদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বিশেষ কেউ জানে না। তবে কেউ কেউ হয়তো আগ বাড়িয়ে নানা কিছু ভেবে নিয়েছে। যেহেতু একসময় ফরিদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাদের বাড়িতে। তা ছাড়া কিছু মানুষ থাকেই, নিজেদের জীবন কিংবা ভালো-মন্দের চেয়ে অন্যের জীবন ও ভালো-মন্দের প্রতিই যাদের বেশি আগ্রহ। এছাহাক সেই ধরনের মানুষ। সে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে গাঁয়ে কার ঘরে কী ঘটছে, কে কী করছে তা নিয়ে। পারু বলল, ওহাব জ্যাঠার কাছে দরকার ছিল।
কী দরকার?
বাবার শরীরটা একটু খারাপ।
কী হইছে মাস্টার সাবের?
তেমন কিছু না। একটু মাথা ঘোরাচ্ছিল।
ওহ। বলে ম্যাচের কাঠিতে পান খাওয়া লাল দাঁত খেচতে লাগল এছাহাক। সে এখন পারুর পাশাপাশি ধীর লয়ে হাঁটছে। সঙ্গের লোকটাও। খানিক চুপ থেকে এছাহাক বলল, তা শুধু বাবার খবর নিলেই হবে? পাড়া-প্রতিবেশীর খবরও তো নিতে হবে। ফরিদ ছেলেটা যে অসুস্থ, সে খবর কি আছে?
পারু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। এছাহাক বলল, এত জোরে হাঁটো কেন? তোমার সঙ্গে তো তাল মেলাতে পারি না। তা ছাড়া শহরের মানুষ এত হাঁটতেও পারে না।
পারু এবার সঙ্গের লোকটার দিকে তাকাল। এছাহাক বলল, এনার নাম কামাল হোসেন। ভূঁইয়া সাবের শালা। ঢাকায় থাকেন। গ্রাম দেখতে আসছেন। তোমাকে দেখে বললেন, তুমি নাকি খুব সুন্দর দেখতে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
কামাল হেসে সালাম দিল। পারু অবশ্য জবাব দিল না। তবে ম্লান হেসে মৃদু মাথা নাড়াল সে। কামাল সম্ভবত কিছু বলতে চাইছিল। পারু অবশ্য তার আগেই বলল, এছাহাক কাকা, আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। আব্বার শরীরটা, আসলেই ভালো না।
এত তাড়াহুড়ার কী আছে? এ বাড়িতে তো দেরি হইতেই পারত। পারত না? আর এইটুকুই তো মাত্র পথ।
মা আবার বকাবকি করবে কাকা। আমি যাই। বলেই এস্ত পায়ে হাঁটতে শুরু করল সে। এছাহাককে আর কিছু বলার সুযোগই দিল না। বিষয়টিতে ভারি অবাক ও বিরক্ত হলো এছাহাক। দ্রুত পায়ে হেঁটে পারুর পিছু নিতে চাইছিল সে। কিন্তু তাকে হাত ধরে থামাল কামাল। তার ঠোঁটে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি। এছাহাক ঘুরে তাকাতেই চোখের ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলল সে। তারপর বলল, এত তাড়াহুড়ার তো কিছু নেই। হাতে সময় তো আছে।
কামাল থামলেও কথা বলল না এছাহাক। তবে তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা ওই অদ্ভুত হাসিটুকু চোখ এড়াল না তার।
.
মহিতোষ সুস্থ হয়ে উঠলেন রাতের মধ্যেই। আব্দুল ওহাব তাকে দেখে বললেন, অতিরিক্তি দুশ্চিন্তা, নিদ্রাহীনতা আর অনিয়মের কারণেই নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন তিনি। যদি এখুনি সব নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে বড়সড় দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। মহিতোষ অবশ্য এসব নিয়ে মোটেই ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন তার পরিবার নিয়ে। বিশেষ করে পারু আর চারুকে ঠিকঠাক তার মামাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেই তিনি নিশ্চিন্ত। তার আগে অবশ্য জমি-জমার বিষয়টার একটা সুষ্ঠু সমাধান করে যেতে চান। আশরাফ খাঁ তাঁকে পরের সপ্তাহ সময় দিয়েছেন। ওইদিনই জমির পুরো কাজ সম্পন্ন হবে। তবে জমির দাম শুনে ছায়ারাণী খুবই আহত হলেন। এমনিতেই এই ভিটা, বসতবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার বেদনা তাঁকে অষ্টাঙ্গে অবশ করে রেখেছে। তার ওপর এমন জলের দামে সেসব ছেড়ে দিতে হচ্ছে শুনে তিনি আরো মুষড়ে পড়লেন। মহিতোষ অবশ্য মাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, এ ছাড়া তো আর কোনো উপায় নাই মা। না হলে বিনা পয়সায় সব ছেড়েছুঁড়ে যেতে হতো!
ছায়ারাণী মুখ ঝামটা মেরে বললেন, সে-ও এর চেয়ে ভালো। বলতে পারতাম কতগুলা কুকুর-বেড়ালরে ভিক্ষা দিয়া আসছি। আর ওইভাবে দিলে তো তারা দলিল-পত্তর কইরা পাইত না। সারাজীবন অন্যের জিনিস ভোগদখল কইরা খাইত। এই অভিশাপ তারা এড়াই তো কেমনে? পাপের ফসল ঘরে তুললে তা একদিন না একদিন সাপ হইয়া দংশন করেই। ওই দংশনের চাইতে মারাত্মক কিছু নাই। কিন্তু তুইতো এখন দুইটা পয়সার জন্য তাদের পাপরে পূণ্যি বানাই দিলি।
ছায়ারাণীর কথা সত্য। একথা মহিতোষও জানেন। কিন্তু কী করবেন তিনি? এ ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল তার? আশরাফ খাঁ এই সম্পত্তির যে মূল্য তাঁকে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন, তা অতি নগণ্য। বলতে গেলে সুযোগ পেয়ে যতটা সম্ভব মহিতোষকে ঠকিয়েই নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু মহিতোষের আর কিছু করার নেই! তিনি নিরুপায়। তা ছাড়া যেকোনো উপায়েই হোক, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে তিনি এই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতেই চেয়েছিলেন। অন্তত এই একটিমাত্র কারণে হলেও সব জেনে, বুঝে, শুনেও এভাবে ঠকতে তিনি প্রস্তুত।
তবে তাকে চমকে দিয়ে সেদিন বিকেলে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হঠাৎ বাড়িতে এলেন। তার সঙ্গে এছাহক। মহিতোষের মুখে বেশ কদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রক্তশূন্য চেহারা। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তাকে দেখে বললেন, কী অবস্থা মাস্টার? চেহারায় এতো দুশ্চিন্তার ছাপ কেন? আর দুশ্চিন্তার কিছু নাই। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে!
মহিতোষ হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, আপনি আমার বাড়িতে? এতবড় সৌভাগ্য আমার!
কী যে বলেন না মাস্টার? কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকি বলে আসার সময় হয় না। হলে একই গ্রামে থাকি আমরা, একজন আরেকজনের বাড়িতে আসা-যাওয়া তো রেগুলার ঘটনাই হওয়া উচিত ছিল। আপনিও তো কোনোদিন আমার বাড়িতে আসলেন না?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কথা অবশ্য ঠিক। মহিতোষ অনেক ভেবেও মনে করতে পারলেন না, কখনো ভূঁইয়া বাড়িতে তিনি গিয়েছিলেন কি না! এর কারণও অবশ্য রয়েছে। ধূর্ত এই মানুষটিকে সবসময়ই এড়িয়ে চলতে চাইতেন তিনি। এমনিতেই লোকমুখে তার নানা বদনাম রয়েছে। তার ওপর মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করা শুরু করেছিলেন। এবং অবাক ব্যাপার হচ্ছে, যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই কীভাবে কীভাবে যেন আবার ভোল পাল্টে নতুন লেবাসও ধরে ফেললেন। এবং মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আগের চেয়েও বেশি প্রভাব-প্রতিপত্তি করে ফেললেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার চেয়ে ভয়ংকর সুযোগ-সন্ধানী লোক আর মহিতোষ দেখেননি।
এছাহাক বলল, ভূঁইয়া সাবতো অনেকদিন ধরেই আসতে চাইছিলেন। কিন্তু আড়তের কিছু ঝামেলার জন্য আর আসতে পারেন নাই।
মহিতোষ কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন। তবে কথা বললেন না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা কিছু জিজ্ঞেস করলেন। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিলেন। তারপর বললেন, আপনের বাড়িটা একটু ঘুরে দেখি, কী বলেন?
জি জি বলে বিগলিত হাসলেন মহিতোষ।
এছাহাক বলল, হ্যাঁ। দুইদিন পর তো এই বাড়ি ঘর আপনেরই যত্ন কইরা রাখতে হবে ভূঁইয়া সাব। একটু ঘুরে-টুরে দেখেন, কোনদিকে কী অবস্থা!
তারা ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলেন। তাদের পেছনে মহিতোষ। এছাহাক আর জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অবশ্য মাঝেমধ্যেই এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছেন। মহিতোষ যতটা সম্ভব সেসবের জবাব দিতে চেষ্টা করছেন। বাগানে সুপারিগাছ কতগুলো? বছরে তাতে কী পরিমাণ সুপারি ধরে? আম গাছে মুকুল ধরলে পরিপুষ্ট হওয়ার আগেই ঝরে যায় কী না? কোন কোন গাছের আম বেশি মিষ্টিঃ পুকুরে মাছ আছে কি না? বাড়িতে ফসল উঠলে শুকানোর ব্যবস্থা কী? সামনের চাতালটা বর্ষায় ডুবে যায় কী-না? এমন কত কত প্রশ্ন! যেন এই বাড়ি, ঘর, ভিটে মাটিতে নিজের নামের স্বাক্ষর ছেপে দিতে আর তর সইছে না জাহাঙ্গীরের। তার চোখে ঘোর লাগা দৃষ্টি। আর মাত্র কটা দিন। তারপরই এইসব কিছু তার। কোনো কিছু থেকেই সহজে চোখ সরাতে পারেন না তিনি। যেন সবকিছুতেই আঠার মতো আটকে থাকে।
তবে মহিতোষ কিছু দেখছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। তিনিও ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতোই হেঁটে যাচ্ছেন। একঘেয়ে ক্লান্তিকর কণ্ঠে জবাব দিয়ে যাচ্ছেন সব প্রশ্নের। যদিও সেসব উত্তরে কোনো প্রাণ আছে বলে মনে হয় না। বরং তার চোখজোড়া যেন আর কিছুই দেখতে চায় না। বরং ভুলে যেতে চায় সব। তবে তার ঘরের ভেতর থেকে জানালা, দরজার কিংবা বেড়ার ফাঁক দিয়ে চারু, পারু আর অঞ্জলির বিষণ্ণ চোখগুলো তীব্র যন্ত্রণা নিয়েই দেখতে লাগল তাদের।
.
বাড়ি দেখা শেষে উঠানে এসে বসলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর হঠাৎই বললেন, একটা কথা মনে হয় মাস্টার সাব ভুলে গেছেন?
কী কথা? চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালেন মহিতোষ।
কথা ছিল যে আপনার জমি-জমার দলিল-পর্চা নিয়া একদিন আমার কাছে আসবেন। জিনিস কিনব, তার আগে ভালো করে দেখে-বুঝে নেয়ার তো একটা ব্যাপার আছে। তাই না?
জি জি। আবারও বিগলিত হাসলেন মহিতোষ। বললেন, আসলে আমি ভাবছিলাম, আরো কয়েকদিন পরেই যাব। যেহেতু এখন আর তাড়াহুড়া নাই। আমরা তো এখনই চলে যাচ্ছি না, আরো বেশ কিছুদিন তো আছিই ভূঁইয়া সাব।
তা আছেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কষ্ঠ গম্ভীর। কিন্তু জিনিসপত্রগুলা তো একটু দেখার দরকার আছে। আছে না?
এছাহাক সায় দিল, অবশ্যই আছে। এতো টাকা-পয়সার বিষয়।
তা ছাড়া দলিল-পর্চা দেখাতে তো আর সমস্যা নাই। এমন তো না যে দেখানো মাত্রই জমি আমার হয়ে গেল আর আমি দখল নিতে আসলাম?
না না। তা কেন? মহিতোষ বললেন।
তাহলে সমস্যা কী? আমি তো কবেই আপনারে বললামঃ জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কণ্ঠে হঠাৎ প্রবল উষ্ম প্রকাশ পেল। বিষয়টিতে অবাকই হলেন মহিতোষ। তিনি দুষ্ট লোক, সেটা যেমন ঠিক। তেমনি এটাও ঠিক যে এর আগে কখনো তাঁর সঙ্গে এমন ভঙ্গিতে কথা বলেননি জাহাঙ্গীর।
আসলে বুঝতেই তো পারছেন ভূঁইয়া সাব, নানা ঝামেলা যাচ্ছে। একটার পর একটা বিপদ।
বিপদ-আপদ থাকবেই। এগুলা নিয়াই জীবন। বলে সামান্য থামলেন তিনি। তারপর বললেন, না-কি ভয় পাচ্ছেন যে দলিল-পর্চা দেখার কথা বলে নিয়ে আর ফেরত দেব না?
এই কথা মহিতোষের মাথায় যে একদমই ছিল না, তা নয়। তবে বিষয়টা খুব একটা গুরুত্ব দিয়েও ভাবেননি তিনি। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে হয়তো এমন কোনো উদ্দেশ্যই তার ছিল। বিষয়টা ভাবতেই শিউরে উঠলেন মহিতোষ। বললেন, কী যে বলেন ভূঁইয়া সাব। সেইটা কেন ভাবব? আমার শরীরটা একটু সুস্থ থোক, আমি নিজে সব নিয়ে আপনার কাছে আসব।
দেরি করার কী দরকার? এছাহাক বলল। আজ যখন আসছি। এখনই দেখি?
মহিতোষ কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে আচমকাই তিনি বললেন, দলিল-পর্চাগুলো তো এখন বাড়িতে নাই ভূঁইয়া সাব।
বাড়িতে নাই মানে? জমি আপনার, দলিল-পর্চা কার কাছে থাকবে?
আমার মেজো মেসোর বাড়ি যশোরে। উনি ভূমি অফিসে কাজ করেন। তাই কাগজপত্রগুলা একবার দেখতে নিছিলেন। দরকার পড়ে নাই বলে আর আনাও হয়নি। তাঁর কাছেই রয়ে গেছে।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ভেবেছিলেন দেখতে চাওয়ার নাম করে আজই তিনি দলিল পর্চাগুলো হস্তগত করবেন। আর এ কারণেই এভাবে আটঘাট বেঁধে হঠাৎ এ বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। যাতে কোনোভাবেই এড়ানোর সুযোগ না পান মহিতোষ। কিন্তু তিনি এমনই এক কারণ দেখালেন যে এরপর আর কথা থাকে না। এখন জোর করে তো আর তিনি মহিতোষের ঘর-বাড়ি তল্লাশি করতে পারেন না!
বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তবে ভেতরে ভেতরে যে তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছেন, তা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন মহিতোষ। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল এছাহাক। সে মহিতোষকে বলল, আপনে জমি বেচবেন আর দলিল রাখছেন আরেকজনের কাছে, এইটা কেমন কথা?
আসলে কি এই দলিলের কথা আমার মনেই ছিল না। সেদিন ভূঁইয়া সাব বলার পরই মনে পড়ল। বাড়িতে এসে খুঁজতে গিয়ে দেখি দলিল নাই। তখন মনে পড়ল আসল ঘটনা। তারপর যে সেগুলো আনতে যাব, সেই পরিস্থিতিও নেই। নানা ধরনের ঝামেলায় আটকে গেলাম।
এছাহাক কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, যা করার তাড়াতাড়ি করেন। দু-একদিনের মধ্যেই দলিল আনার ব্যবস্থা করেন মাস্টার। আমার কাগজপত্রগুলা দেখা দরকার। বেশি দেরি কইরেন না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কণ্ঠ গম্ভীর।
মহিতোষ বিগলিত হাসিতে সম্মতি জানালেন। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না তিনি। ঘুরে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। তার আচরণেই বোঝা যাচ্ছে, একইসঙ্গে তিনি প্রচণ্ড হতাশ, বিরক্ত ও ক্রোধান্বিত হয়েছেন।
.
মহিতোষ ঘরে ঢুকতেই অঞ্জলি ছুটে এলেন। তিনি বিচলিত ভঙ্গিতে বললেন, এই লোক তো বদ্ধ উন্মাদ। এরে আমি চিনি। সবাই চেনে। এ ভয়ংকর মানুষ। এর ভাবভঙ্গিও আমার ভালো ঠেকল না।
মহিতোষ গম্ভীর গলায় বললেন, হুম।
আপনি তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করেন। না হলে এই লোক কোনো অঘটন ঘটাই ফেলবে।
মহিতোষ এই কথার কোনো জবাব দিলেন না। তবে তিনি গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলেন।
.
পরের সপ্তাহের এক কাক ডাকা ভোরে মহিতোষ উত্তরপাড়া পৌঁছালেন। পুরোটা সময় তার ভাবনার জগতে কতকিছু যে ঘুরে ফিরে এলো। এ যেন সিনেমার মতো। একের পর এক ভাসতে লাগল চোখের সামনে। কত শত স্মৃতি। কত কত গল্প, ছবি, ভাবনা। আজ তিনি তার বাপ-দাদার ভিটে-মাটি বিক্রি করতে যাচ্ছেন। এই দেশ থেকে তার শিকড় উপড়ে ফেলছেন। এরপর বাকিটা জীবন তিনি কী নিয়ে বাঁচবেন?
মহিতোষ জানেন না। তবে উত্তরপাড়া পৌঁছে তার হঠাৎ মনে হলো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে বঞ্চিত করতে গিয়ে তিনি কি বড়সড় কোনো ভুল করে ফেলেছেন? এই যে আজ একা এতটা পথ পাড়ি দিয়ে তিনি এখানে এসেছেন, এটা কি তিনি ঠিক করেছেন? এখানে তো কেউ নেই তাঁর! একা অসহায় এক মানুষ তিনি। তাঁর সঙ্গে জমির সব কাগজপত্র রয়েছে। এখন কেউ যদি জোর করে তাঁর কাছ থেকে সব জমিগুলো লিখিয়ে নেয়, তাহলেও তো কিছু করার নেই তার। করার নেই আরো ভয়ংকর কিছু ঘটলেও।
একটা তীব্র ভয় কোথা থেকে উড়ে এসে হঠাৎ তাকে জাপটে ধরল। তিনি আশরাফ খাঁর বাড়ির সামনে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। ভেতরে ঢুকলেন না। পেছনে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন পথ। ধূসর, অস্পষ্ট। এই ভোরে সবকিছু কেমন নিঃস্ব, রিক্ত মনে হয়। তাঁর নিজের মতোই। মহিতোষের আচমকা খুব ভয় হতে লাগল। তাঁর মনে হলো, তিনি বিশাল বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন। এ বাড়িতে ঢুকলেই সেই ভুল থেকে আর নিস্তার নেই তার। হাতে এখনো সময় আছে। তিনি চাইলে ভুলটা পুরোপুরি সংঘটিত হওয়ার আগেই ফিরে যেতে পারেন। এখনো এ বাড়ির কেউ তাঁকে দেখতে পায়নি। তার অবশ্যই ফিরে যাওয়া উচিত। একটা গা হিম করা তীব্র অশনিসংকেত যেন বেজে যেতে লাগল তার বুকের ভেতর।
বাড়িতেও কাউকে কিছু বলে আসেননি তিনি। এমনকি মাকেও না। এখন তার কিছু হয়ে গেলে কেউ জানতেও পারবে না। ভীত মহিষে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর পিছু হটতে লাগলেন। এই ঘন কুয়াশায় দু হাত দূরের জিনিসও ঠিকঠাক দেখা যায় না। সুতরাং তিনি যে এখানে এসেছেন, তা কারো দেখার কথাও নয়। ফলে চুপিচুপি ফিরে গেলেও কেউ কিছু বুঝবে না।
.
মসজিদটা পেরিয়ে সাবধানে খোলা রাস্তায় উঠলেন মহিতোষ। তার বুকটা আবার ধড়ফড় করছে। তবে এটা স্বস্তির বিষয় যে তাঁকে কেউ দেখতে পায়নি। এখন ঠিকঠাক বাড়ি অবধি পৌঁছে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু তার ইচ্ছে পূরণ হলো না। কয়েক কদম এগুতেই যেন কুয়াশা ফুঁড়ে উদয় হলেন আশরাফ খাঁ। আজ আর তার হাতে লাঠি নেই। তবে পরনে পা অবধি লম্বা সাদা জামা। মাথায় টুপি। সঙ্গে আরো দুজন লোক। তারা প্রায় সমস্বরে বলে উঠলেন, কী ব্যাপার মাস্টার, এইদিকে আবার কই যান?
মহিতোষ তীব্র ভয় ও বিস্ময়ে প্রায় স্থবির হয়ে গেছেন। তিনি থতমত খাওয়া গলায় বললেন, কোথাও যাচ্ছি না খাঁ সাহেব। মনে হলো একটু বেশি আগেই চলে এসেছি। এইজন্য সময় কাটানোর জন্য একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম।
ওহ। তা ঘরবাড়ি থাকতে রাস্তাঘাটে সময় কাটাবেন কেন? চলেন, বাড়ি চলেন।
মহিতোষ বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। এর আগে কখনো এত অসহায় তাঁর লাগেনি। মনে মনে হাল ছেড়ে দিলেন তিনি। যেন যা হবার হোক। নিজের নিয়তি যেন মেনে নিয়েছেন। চুপচাপ খাঁ সাহেবের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন মহিতোষ। খাঁ সাহেব বললেন, জমির কাগজপত্র সব আনছেন তো?
জি।
দেইখেন, আবার কোনো ফাঁকিঝুঁকি যেন না থাকে।
জি না।
যাওয়ার ডেট ঠিক করছেন?
জি।
জমি বেচার পর কিন্তু আর বেশিদিন থাকতে পারবেন না। জাহাঙ্গীর খুব ঝামেলা করবে।
জি।
যাওয়ার বন্দোবস্ত সব ঠিকঠাক?
জি।
আপনি কি কিছু নিয়া খুব ভয় পাচ্ছেন?
জি না।
সত্য কথা বলেন। ভয় হচ্ছে?
মহিতোষ জবাব দিলেন না। খাঁ সাহেব হঠাৎ হাসলেন। খুবই রহস্যময় হাসি। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, আপনি যে একটা বোকামি করছেন, এইটা তো বুঝতে পারছেন, তাই না?
মহিতোষ কথা বললেন না। তাঁর শরীর কাঁপছে। খাঁ সাহেব তাকে দহলিজ ঘরের বারান্দায় নিয়ে বসালেন। ততক্ষণে সূর্য উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পাতলা হতে শুরু করেছে ঘন কুয়াশা। খাঁ সাহেব আরাম করে গদি আঁটা চেয়ারে বসলেন। মহিতোষ তাঁর সামনে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। খাঁ সাহেব তাঁর সঙ্গের একজনকে বললেন, মাস্টারের কাছ থেকে কাগজপত্রগুলা নে। দেখ সব ঠিক আছে কি না!
মহিতোষ যেন নিজের অজান্তেই ব্যাগটা খানিক শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করলেন। তবে তাতে লাভ হলো না। লোকটা তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। তারপর কাগজপত্র দেখে বলল, সব ঠিকই আছে খ সাব।
ঠিক থাকলেই ভালো। আর ভূমি অফিস থেকে লোক আসার কথা। খোঁজ নে, কতদূর এলো।
লোকটা ছুটে বাইরে চলে গেল। খাঁ সাহেব বললেন, ভুল করে ফেলার পর ভুল টের পেলে তো লাভ নাই মাস্টার। টের পেতে হবে আগে। চোর পালানোর পর বুদ্ধি বাড়লে চলবে?
মহিতোষ অনেক চেষ্টা করেও কথা বলতে পারলেন না। দুজন দশাসই চেহারার পালোয়ানের মতো লোক ঘরে ঢুকল। তাদের দেখে ঢোক গিললেন তিনি। খাঁ সাহেব ফাসফেঁসে গলায় বললেন, এই যে একা একা এতদূর আসছেন, এখন আপনার কোনো ক্ষতি হইলে?
মহিতোষ এবারও কথা বলতে পারলেন না। খাঁ সাহেব বললেন, কী, গলা শুকাই গেছে? পানি খাবেন?
মহিতোষ চুপ। চেষ্টা করেও যেন কোনো শব্দ করতে পারছেন না তিনি। তবে ইশারায় জানালেন পানি খাবেন। তাঁকে পানি এনে দেয়া হলো। তবে সেই পানি তিনি খেতে পারলেন না। বুকে ব্যথা হতে লাগল। সারা শরীর ঘামে ভেসে যাচ্ছে। খাঁ সাহেব হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দশাসই চেহারার লোক দুজনকে লক্ষ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, মাস্টাররে ভেতরে নিয়ে আয়।
মহিতোষের মনে হচ্ছিল তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তিনি বসে থাকতে পারছেন না। সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে। লোক দুজন সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। আড়ষ্ঠ শরীরে অনড় হয়ে বসে রইলেন। লোক দুজন তাঁর দুই বাহু ধরে তাকে দাঁড় করাল। তারপর নিয়ে গেল ভেতরের ঘরে। ঘরটা অন্ধকার। জানালায় ভারী পর্দা লাগনো। তবে এই দিনে বেলায়ও হারিকেন জ্বলছে বলে সেই আলোয় একটা আবছায়া ভাব তৈরি হয়েছে। সেখানে খাঁ সাহেব বসা। মহিতোষকে নিয়ে তার মুখোমুখি বসানো হলো।
মহিতোষ বললেন, আমার কোনো অপরাধ খাঁ সাহেব?
খাঁ সাহেব জবাব দিলেন না। তবে তাঁর মুখ থমথমে, গম্ভীর। মহিতোষ প্রায় কাঁপা গলায় বললেন, আমি কি কোনো ভুল করেছি খাঁ সাহেব?
হুম।
ভুল করলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই। কিন্তু আমার কোনো ক্ষতি করবেন না। তাহলে আমার পরিবারটা শেষ হয়ে যাবে। আপনি বললে আমি আজ রাতেই চলে যাব। আমাকে কোনো টাকা-পয়সাও দিতে হবে না। আমি সবকিছু আপনাকে লিখে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার কোনো ক্ষতি আপনি করবেন না।
মহিতোষ কাঁদতে লাগলেন। খ সাহেব চোখের ইশারায় দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে কিছু বললেন। মহিতোষ বললেন, আমি কাউকে কিছু বলব না খাঁ সাহেব। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন। আমি কাউকে কোনোদিন কিছু বলব না।
খাঁ সাহেব মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, এই ঘটনা ঘটার পরও আপনি কাউকে কিছু না বলে থাকতে পারবেন?
পারব পারব। আমি পারব খাঁ সাহেব। তটস্থ, সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বললেন মহিতোষ। এখান থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সব ভুলে যাব।
পারবেন না মাস্টার।
আমি পারব। ভগবানের দোহাই, আমি পারব। মহিতোষ হাত জোড় করে কাঁদছেন।
কেউই পারবে না। এই ঘটনা কেউ কাউকে না বলে পারে না। নিষ্কম্প, স্থির গলায় বললেন খাঁ সাহেব।
আমি আমার দুই মেয়ের কসম কাটছি… আমি এই কথা কোনোদিন কাউকে বলব না।
মহিতোষ তাঁর কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই আশরাফ খাঁ তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলেন। তাঁর সামনে একটা ভারী চটের ব্যাগ এনে রেখেছে দরজায় দাঁড়ানো লোকটা। মহিতোষ ভীত চোখে ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। খাঁ সাহেব বললেন, এটা খোলেন।
মহিতোষ যুগপৎ সন্দিগ্ধ ও সন্ত্রস্ত চোখে তাকালেন। তাঁর শরীরে যেন বিন্দুমাত্র শক্তিও অবশিষ্ট নেই। মনে সাহস নেই। এই ব্যাগ খুলে কী দেখবেন, কে জানে! তিনি আতঙ্কিত চোখে ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। খাঁ সাহেব এবার ধমকে উঠলেন, ব্যাগ খোলেন। হাতে সময় কম।
মহিতোষ তার ধমকে যেন নড়ে উঠলেন। তিনি কম্পিত হাতে ব্যাগটা খুললেন। তারপর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন ব্যাগের ভেতর। তার পা থেকে মাথা অবধি থরথর করে কাঁপছে! এ তিনি কী দেখছেন? ভীত, বিভ্রান্ত চোখে তিনি খাঁ সাহেবের দিকে তাকালেন। খাঁ সাহেব বললেন, কী হলো? এইভাবে
তাকিয়ে আছেন কেন?
মহিতোষ ফাঁসফেঁসে গলায় বললেন, এগুলো কী? এগুলো কীসের জন্য?
এগুলো টাকা। খাঁ সাহেব শান্ত, স্বাভাবিক গলায় বললেন।
এত টাকা!
হুম।
এত টাকা আমি কখনো একসঙ্গে দেখি নাই।
এই যে আজ দেখলেন।
এই টাকা কীসের?
আপনার জমি বিক্রির।
আমার জমি বিক্রির টাকা?
হুম। গম্ভীর গলায় বললেন খাঁ সাহেব।
এইগুলো সব?
হুম।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বলে থামলেন মহিতোষ। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে ফাঁসফেঁসে কণ্ঠে বললেন, আমি জল খাব।
খাঁ সাহেব চোখের ইশারায় পানি নিয়ে আসতে বললেন। মহিতোষ বললেন, এত টাকা…!
খাঁ সাহেব গম্ভীর, শান্ত গলায় বললেন, আমি কাউরে ঠকাই না। সে বিপদে পড়লেও না। এটাই আপনার জমির ন্যায্য দাম।
খাঁ সাহেব! একই সঙ্গে আর্তনাদ ও অবিশ্বাসের স্বরে বললেন মহিতোষ।
সেদিন আপনার সঙ্গে এছাহাক ছিল বলে আমি তেমন কিছুই বলতে পারি নাই। তার সামনে সব কথা বলা যেত না। কিন্তু আপনার পরিস্থিতি আমি জানি। খোঁজখবরও রাখি।
মহিতোষ কিছুই বুঝতে পারছেন না। খাঁ সাহেবের কথাও না। তাঁর সামনে একটা চটের ব্যাগ ভর্তি টাকা। এই এত এত টাকা সব তার? এই সব তাঁর জমির মূল্য? খাঁ সাহেব এসব কী বলছেন? মহিতোষের একবার মনে হলো তিনি স্বপ্ন দেখছেন। পরক্ষণেই আবার মনে হলো তার বিভ্রম হচ্ছে। তিনি দু হাতে চোখ কচলে তাকালেই হয়তো দেখবেন, এসবই মিথ্যে, কল্পনা। খাঁ সাহেব বললেন, আমার বয়স যাই হোক, নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা, দুশ্চিন্তা আমারে বৃদ্ধ বানাই ফেলছে। তারওপর শরীরেও নানা রোগ-শোকের বাসা। বিভিন্ন ঝই-ঝামেলায়ও থাকি। না হলে আপনারে আমি কিছুতেই দেশ ছেড়ে যেতে দিতাম না। জাহাঙ্গীর লোক খারাপ। এই কথা সবাই জানে। কিন্তু সে খুব ধূর্ত, চালাক মানুষ। দেখলেন না, যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই কেমন ভোল পাল্টাই ফেলল? রাজাকারের লেবাস ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের লোক হয়ে গেল?
জি।
আমি শারীরিকভাবে দুর্বল মানুষ। তার ওপর এইসব ঝামেলায় দিশেহারা। না হলে আপনারে আমি কোথাও যেতে দিতাম না। এই দেশ তো আর কারো একার না। এই দেশ সবার। আমার যেমন, আপনারও তেমন। জাহাঙ্গীররে দিয়া এই দেশটারে আপনি মাপবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন… বলে খানিক থামলেন খাঁ সাহেব। তারপর বললেন, দেশের মানুষ খারাপ হতে পারে, কিন্তু দেশ কখনো খারাপ হয় না। তেমনি ধর্মের মানুষও খারাপ হতে পারে, কিন্তু ধর্ম কখনো খারাপ হয় না।
.
খাঁ সাহেবের গলা ভারী হয়ে উঠেছে। দুই হাত জড় করার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, আমি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মতো মানুষের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাই।
মহিতোষ খপ করে তার হাত দু খানা ধরে ফেললেন। তারপর বললেন, খাঁ সাব, আপনি কি জানেন, আপনি কী করলেন?
খাঁ সাহেব জবাব দিলেন না। মহিতোষ বললেন, আমার বুকের মধ্যে যত ঘা ছিল, যত ব্যথা ছিল, যত যন্ত্রণা ছিল আপনি তার সবকিছুতে মলম লাগিয়ে দিলেন। চির শান্তির মলম। এই জীবনে এর চেয়ে শান্তি আমি আর কখনো পাই নাই। আপনি…।
খাঁ সাহেব তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার জন্য আমি কিছুই করি নাই। আমি শুধু আপনার জমির ন্যায্য বাজার মূল্যটা দিছি। সুযোগ পেয়ে কাউরে ঠকানো তো আর মানুষের কাজ হতে পারে না। পারে?
মহিতোষ জবাব দিলেন না। তিনি অপলক চোখে শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত এই মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। খাঁ সাহেব বললেন, মানুষের স্বাভাবিক আচরণ তো ন্যায্যতাই হওয়া উচিত। বরং অন্যায্যতা হওয়া উচিত অস্বাভাবিক। কিন্তু আমরা এমন আশ্চর্য এক সময়ে বাস করি যে কেউ তার স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করলেও তারে আমরা আলাদা করে প্রশংসা করি। কারণ এইখানে অনিয়মটাই নিয়ম। অন্যায়টাই স্বাভাবিক। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। ন্যায়টা স্বাভাবিক আর অন্যায়টা অস্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল।
মহিতোষ বললেন, খাঁ সাহেব। এই টাকা আমি নিতে পারব না। এত টাকা নিয়া আমি কী করব? তার ওপর নানা বিপদ-আপদতো আছেই।
আপনার চিন্তা করতে হবে না। সব ব্যবস্থা আমি করব। আরেকটা কথা?
কী?
আমি এই জমি কেনার দলিলপত্রের সঙ্গে একটা অছিয়ত নামাও লিখে দেব। তার একটা কপি আপনার কাছে থাকবে। আরেকটা আমার কাছে।
কী অছিয়তনামা?
যদি কোনোদিন আপনের মনে হয় যে আপনি আবার দেশে ফিরে আসবেন। বা আপনের উত্তরাধিকার কেউ। তখন ঠিক এই দামেই এই জমি আপনারা ফেরত পাবেন। তা যতদিন পরেই আসেন না কেন! অছিয়তনামায় এইটা লেখা থাকবে। আমি জীবিত না থাকলেও আমার বংশধররা এইটা পালন করতে বাধ্য থাকবে।
খাঁ সাহেব… এটা আপনি কী করছেন? কী বলছেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না…। মহিতোষের গলা জড়িয়ে এলো। তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না।
তার আগেই আশরাফ খাঁ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমারে কিছু বলতে হবে না। যা বলার উপরওয়ালার কাছে বলেন। একমাত্র উনিই জানেন কার জন্য কে, কখন, কী করে? কেন করে? আমি, আপনি, আমরা সেইসব জানি না। কিন্তু তিনি তার হিসাবের বাইরে কিছু করেন না। কে জানে, এইটাও হয়তো তার কোনো হিসাব। হয়তো আমারে দিয়ে উনিই এইটা করাইছেন। কোনো হিসাব মিটাইছেন। বলে হাসলেন আশরাফ খাঁ।
মহিতোষ তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁর মনে হলো তিনি আর কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি হঠাৎ উঠে এসে আশরাফ খাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর কাঁদতে লাগলেন শিশুর মতো। তার আচমকা মনে হলো, একজনমে এমন একজন মানুষকে এভাবে স্পর্শ করার চাইতে আনন্দ বা পূণ্য আর কিছুতে নেই।
৯
ভুবনডাঙ্গা স্টেশন থেকে রাত দশটায় ট্রেনে উঠতে হবে। ভোর নাগাদ মহিষেরা পৌঁছে যাবেন যশোরে। সেখানে তাঁর মেসোমশাই থাকবেন। তিনি বাকি সব বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। তবে তাঁদের ট্রেনে উঠতে হবে গোপনে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এখনো কিছু টের পাননি বলেই মনে হচ্ছে। যদি ঘুণাক্ষরেও তিনি কিছু টের পান, তাহলে ভয়াবহ পরিণতি হবে মহিতোষ ও তার পরিবারের। এর মধ্যে তিনি দু-একবার এছাহাককে দিয়ে মহিতোষের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছেন।
এছাহাক এসে বলেছে, কী ব্যাপার মাস্টার, দলিল-পর্চাগুলা এখনো আনেন নাই কেন?
আনার জন্য তো আমাকে যেতে হবে, তাই না? মায়ের শরীরটা হঠাৎ ভালো না। এই অবস্থায় তাকে রেখে আমি কীভাবে যাই বলো?
আপনার মেসোরে বলেন নিয়া আসতে।
মেসো ব্যস্ত মানুষ। বয়সও হয়েছে। এর মধ্যে তিনি আসবেন কী করে?
তাহলে আমি যাই? আপনি চিঠি লিখে দেন। আমি গিয়ে নিয়ে আসি?
ধুর। সেটা হয় নাকি? এছাহাকের প্রস্তাবটা উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন মহিতোষ। শোনো, জমি-জমার বিষয় খুব সাম্রতিক। কেউ কাউকে সহসা বিশ্বাস করতে চায় না। তোমার কি মনে হয়, মেসো আমার চিঠি পেলেই সব দিয়ে দেবে? বরং আরো সন্দেহ করবে।
কী সন্দেহ করবে?
এই ধরো, আমাকে দিয়ে জোর করে কেউ চিঠি লেখাল কি না! এমনিতেই তো এলাকার পরিস্থিতি তিনি জানেন।
কী পরিস্থিতি এলাকার? আপনারা কি এইখানে খারাপ আছেন?
না না। খারাপ থাকব কেন? খুব ভালো আছি। তারপরও নিজের আত্মীয় স্বজনতো আর কেউ নেই এখানে, ফলে দূরে যারা আছেন তারা খুব দুশ্চিন্তা করেন।
এছাহাক জানে না কেন, কয়েকবার মহিতোষের সঙ্গে কথা বলার পর তার ভাব-গতিক খুব একটা সুবিধার মনে হলো না। কথাটা সেদিন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে বললও সে। শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, এই জমি নিয়া যদি মহিতোষ মাস্টার উল্টাপাল্টা কিছু করে, আমি তারে ভুবনডাঙ্গা নদীতে ডুবাই মারব। সে আমারে চেনে না।
এছাহাক মিনমিনে স্বরে বলল, না না, উল্টাপাল্টা কী করবে? আমি আছি না? কথাটা বললেও গলায় যেন ঠিক জোর পেল না সে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো ঝামেলা হয়ে গেছে। কিন্তু কথাটা সে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে বলার সাহসও পাচ্ছে না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, তুমি ভালো করে খেয়াল রাখো। আর যেভাবেই পারো দলিল আনার ব্যবস্থা করো। প্রয়োজনে কামালকে নিয়া যাও।
জি, আচ্ছা। বলে গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল এছাহাক। সে আজকাল প্রায় সারাক্ষণই মহিতোষের বাড়ির আশপাশে কাটায়। কড়া নজর রাখে। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে কি না সেটা বুঝতে চেষ্টা করে। তবে তেমন কিছুই চোখে পড়ে না। এমনকি তার জমি কিনতেও কেউ রাজি হয়নি। এছাহাক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, দুভাবেই খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছে। মহিতোষ যাদের যাদের কাছে গিয়েছেন, তাদের সবার খবরই সে জানে। তারা কেউই এই জমি কিনতে রাজি হয়নি। ফলে সেরকম কোনো সম্ভাবনাও সে দেখেনি। এমনকি সবকিছুই খুব স্বাভাবিক। তাহলে এতো অস্থির লাগার কারণটা কী? অনেক ভেবেও বের করতে পারল না এছাহাক। তবে এর মধ্যেও একটা ভালো ঘটনা ঘটল। মহিতোষ সেদিন নিজ থেকেই তাকে ডেকে বললেন, মায়ের শরীরটা একটু ভালোর দিকে।
তাই না-কি? তাইলে যশোর যাবেন?
হ্যাঁ, সেটাই ভাবছি।
কবে? কবে? যেন আর তর সইছে না এছাহাকের।
এখনো ঠিক করি নাই। দেখি দুটা দিন। তা ছাড়া মাও বায়না ধরেছে, তারও–কি খুব যশোর যেতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন মাসিরে দেখে না।
এছাহাক যেন মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে উঠল। সে বলল, আপনি কি পুরো পরিবারসহ যাবেন না কি?
আরে না না। কী যে বলেন। বিগলিত হাসলেন মহিতোষ। এই এত বড় বাড়ি-ঘর খালি রেখে সবাই চলে গেলে হবে?
হুম। সেটাই তো…। এছাহাক সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে বলল।
অঞ্জলি আর বাচ্চারা বাড়িতেই থাকবে।
ওহ। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এছাহাক। বলল, তাইলে তো খুবই ভালো। আপনি যান মাস্টার। এদিকে চিন্তা করবেন না।
হ্যাঁ। এইদিকে কিন্তু একটু খেয়াল-টেয়াল রেখো এছাহাক।
একদম। আপনে কোনো চিন্তা করবেন না।
বহুদিন পর এছাহাক খুব নিশ্চিন্ত আর ফুরফুরে মেজাজে আড়তে ফিরল। কামালকেও ঘটনা জানাতে হবে। এমন সুবর্ণ সুযোগ আর মিলবে না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তাকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার, তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন?
সুখবর আছে।
কী সুখবর?
এছাহাক তাকে সব খুলে বলল। কিন্তু জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তাতেও খুব একটা নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। তিনি খানিক গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তুমি ভালো মতো নজর রাখো। আর কামাল তোমার সঙ্গে থাকতে পারবে না। কী এক জরুরি কাজে তাকে কালই ঢাকায় যেতে হবে।
এই খবরেও মনে মনে খুশি হলো এছাহাক। তার জন্য সবকিছু এখন আরো সহজ। দীর্ঘদিন থেকেই পারুর দিকে তার নজর। মাঝখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল কামাল। কিন্তু জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার শ্যালক বলেই কিছু বলতে পারছিল না সে। ভূঁইয়া সাহেব অবশ্য সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ভেতরে অন্য কোনো ঘটনা আছে।
এছাহাক অন্য কোনো ঘটনা খুঁজে পেল না। বরং আনন্দিত বোধ করতে লাগল। কামাল ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পর থেকে আরো পুলকিত অনুভব করতে লাগল সে। ভেতরে ভেতরে যে এতকিছু ঘটে গেছে তার কিছুই টের পেল না। এমনকি মহিতোষরা যেদিন শেষবারের মতো বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এলো সেদিনও না। সন্ধ্যার ঘন্টাখানেক পর ছায়ারাণীকে নিয়ে বের হলেন মহিতোষ। তার জন্য স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার ভ্যান গাড়ি ঠিক করা হয়েছে। ভ্যানগাড়ি রাস্তায় উঠতেই অন্ধকার কুঁড়ে যেন ভূতের মতো এসে উদয় হলো এছাহাক। সে বলল, যাচ্ছেন তাহলে মাস্টার?
জি।
আপনারা দুজনই?
হুম।
বাড়ির আর সবাই কই?
বাড়িতেই।
ওহ। যেন বিশ্বাস হলো না এছাহাকের।
মহিতোষ বললেন, বাড়ির সবারই খুব মন খারাপ। তারা চেয়েছিল স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু আমিই নিষেধ করলাম। অত রাতে আবার তাদের ফিরতে হবে।
তা ঠিক।
এছাহাক তারপরও যেন নিশ্চিন্ত হতে পারল না। সে চকিতে একবার উঁকি দিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল। সেখানে ঘরের দরজা জানালা হাট করে খোলা। সেই খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর থেকে হারিকেনের আলো এসে পড়েছে বাইরে। উঠানে বাঁশের আড়ায় তখনো শুকাতে দেয়া কাপড় ঝুলছে। সেই কাপড়েও আবছা আলো পড়েছে। দরজার কাছে একটা চেয়ার রাখা। চেয়ারে কেউ বসে আছে। তার দীর্ঘ ছায়া এসে পড়েছে বাইরে। এছাহাক আরো নির্ভার হতে চাইছিল। এই মুহূর্তে ঘরের ভেতর থেকে উঠানে বের হয়ে এলো পারু। তাকে এতদূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারুর সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে সে। এছাহাক এবার পুরোপুরি শংকামুক্ত হলো। তাহলে অন্যরা সবাই বাড়িতেই আছে। মহিতোষ বললেন, এখন কাজ কী তোমার?
কোনো কাজ নাই।
চলো তাহলে আমার সঙ্গে।
কোথায়?
স্টেশনে। মারে নিয়া যাচ্ছি। এইজন্য একটু আগেভাগে বের হলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে কতক্ষণ একা একা বসে থাকা লাগে কে জানে! তোমার সঙ্গে গল্প গুজব করলাম।
এছাহাক বলল, আচ্ছা, চলেন।
প্রায় মিনিট তিরিশেক পথ পাড়ি দিয়ে তারা ভুবনডাঙ্গা স্টেশনে এসে পৌঁছালেন। সেখানে লোকজন তেমন নেই। ছোট্ট স্টেশনটা কঁকা। ট্রেন আসতে তখনো ঢের বাকি। এছাহাকের সঙ্গে স্টেশনে বসে চা খেলেন মহিতোষ। তাকে বিড়ি কিনে খাওয়ালেন। নানা গল্প-গুজব করলেন। মহিতোষ মাস্টার এমনিতে সজ্জন মানুষ। কিন্তু তারপরও এর আগে কখনো তাকে এত আন্তরিক হতে দেখেনি এছাহাক। সে খুবই অবাক হলো। ট্রেন এলো রাত দশটায়। তার ঠিক মিনিট তিরিশেক আগে সুনসান ছোট্ট স্টেশনটা হঠাৎ জনমানুষে ভরে উঠল। যাত্রীদের কোলাহলে গমগম করতে লাগল প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন থামা মাত্র যে যার মতো ছোটাছুটি করে উঠতে লাগল। উঠলেন মহিতোষও। স্টেশন মাস্টার তাঁকে খানিক আলাদা সুবিধা দিয়েছেন। দুজন লোক দিয়ে ছায়ারাণীকে ধীরে-সুস্থে ওঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। মহিতোষ সিটে গিয়ে বসলেন। ছায়ারাণীকেও আলগোছে বসালেন। এছাহাক জানালার কাছে গিয়ে বলল, আমি তাহলে এখন যাই মাস্টার সাবা
হ্যাঁ, হ্যাঁ। যাও।
আপনি কিন্তু বেশি দেরি কইরেন না। ভূঁইয়া সাব একটু অস্থির হয়ে আছেন। বোঝেনই তো?
তুমি টেনশন করো না। আমি যত দ্রুত সম্ভব চলে আসব।
আর কাগজপত্র, দলিল-পর্চা কিন্তু সব হিসাব করে নিয়ে আইসেন। ভুলে আবার কিছু রেখে এসেন না।
তা আসব না।
বোঝেনই তো। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মনে মনে আপনার ওপর একটু গোস্বা। আর সে গোস্বা হলে তো বিপদ। সামলানোর উপায় থাকে না! রাগের মাথায় কখন যে কী করে ফেলে।
তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি সব ঠিকঠাক করব। এছাহাককে নিশ্চিন্ত করেন মহিতোষ। তারপর হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। এছাহাক হ্যান্ডশেক শেষে জানালার কাছ থেকে দূরে সরে এসে ধীরে-সুস্থে একটা বিড়ি ধরায়। তার চোখে-মুখে কেমন চাপা উল্লাস। মহিষ মাস্টারের বাড়িতে আজ কোনো পুরুষ মানুষ নেই। অথচ তার মেয়ে দুটো বাড়িতে! ভেতরে ভেতরে খুব ছটফট লাগছে তার। এখুনি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ট্রেনটা ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে।
.
এছাহাক জানালার কাছ থেকে সরে যেতেই মহিতোষ স্টেশন মাস্টারকে নিচু গলায় জিজ্ঞস করলেন, অঞ্জলিরা ঠিক মতো উঠছে?
হুম, উঠেছে।
কোন বগি?
পাশেরটাই।
খাঁ সাহেবকে আমার প্রণাম দিয়েন।
দেব।
আরেকটা কথা।
জি।
খাঁ সাহেবকে বলবেন, আমি আমার এইটুক জীবনে যত পূণ্য করেছিলাম, তার বিনিময়ে ভগবান আমাকে তাঁর মতো মানুষের দেখা দিয়েছেন। কিন্তু আফসোস, আমার পূণ্যের সংখ্যা কম, পাপের সংখ্যা বেশি। এইজন্য বাকি জীবনে আমি আর তার দেখা পাব না।
স্টেশন মাস্টার কথা বললেন না। মহিতোষ বললেন, তাকে বলবেন, তিনি যেন আমার জন্য প্রার্থনা করেন, যাতে মৃত্যুর আগে একমুহূর্তের জন্য হলেও আমি তাঁর দেখা পাই। কীভাবে পাব সেটা জানি না। কিন্তু এটা আমি চাই।
স্টেশন মাস্টার মৃদু হাসলেন। তবে কথা বললেন না। মহিতোষও না। স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে আগেভাগেই সব ব্যবস্থা করিয়ে রেখেছিলেন আশরাফ খাঁ। এছাহাককে বিভ্রান্ত করতেই মূলত ছায়ারাণীকে নিয়ে সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন মহিতোষ। তারা স্টেশনে পৌঁছানোরও অনেক পরে অঞ্জলি মেয়েদের নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন।
আশরাফ খাঁর নিজের লোকেরা তাদের ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগ মূহূর্তে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে। সাবধানতার জন্যই আলাদা বগিতে উঠেছেন তারা। ট্রেন ছাড়তে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে মহিতোষের চোখের সামনে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ভূবনডাঙা স্টেশন। স্টেশনের লাল ভবন। হলদে আলো। পেছনের বিশাল। বটগাছটা। তার ওপারে নদী। নদীর ওপারে মাঠ। মাঠের ওপারে হরিদাশপুর। কলেজ। তার ওপারে কী? শৈশব, কৈশোর, যৌবন? এক নিমিষেই সব হারিয়ে ফেললেন তিনি? এই জীবনের আর কখনো ফিরে পাবেন না?
মহিতষের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কিন্তু তিনি চোখ মোছেন না। তাঁর। চশমার কাচও ভারী হতে থাকে। পেছনে দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে থাকে অন্ধকার। অন্ধকারের বুকের ভেতর ছুটে যেতে থাকে স্মৃতি। স্মৃতির ভের মন। মনের ভেতর। মায়া। এই মায়া ছেড়ে মানুষ কী করে বাঁচে? শিকড়ের মায়া?
.
অঞ্জলি আঁচলে মুখ চেপে বসে আছেন। তাঁর দুই পাশে বসে আছে চারু আর পারু। তারা কেউ কোনো কথা বলছে না। তাদের সবার চোখই জানালার বাইরে অন্ধকারে। ট্রেনের একটানা শব্দ কেমন অদ্ভুত এক দ্যোতনা তৈরি করে বুকের ভেতর। সুনসান গভীর রাত্রিতে সেই দ্যোতনা বুকের গহিন খুঁড়ে তুলে আনে গোপন অভিমান, দুঃখ। কিন্তু আজ এই অন্ধকার রাত্রিতে, যখন শূন্য ফসলের বিরান মাঠের শরীর চিরে, নিঃসঙ্গ এক নদীর মতো বয়ে চলে একাকী এক ট্রেন, তখন তার বুকের ভেতর কয় জোড়া বিনিদ্র, পলকহীন চোখ কেবল হেমন্তের ঝরে পড়া শিশিরের হিম-শিতল স্পর্শ টের পেতে থাকে। সেই স্পর্শে মৃত্যুর মতো অসীম কোনো শূন্যতায় ক্রমশই লীন হয়ে যেতে থাকে তারা।
.
মহিতোষ একবার এসে পারুদের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। তবে তাতে যে তারা কেউই খুব উৎফুল্ল হয়েছে, এমন নয়। বরং সবাই কেমন চুপচাপ, প্রাণহীন। কেবল পারই উঠে বাবাকে খানিক জড়িয়ে ধরল। যেন এমন করে আর কখনো বাবাকে পায়নি সে। কিংবা পাবেও না। মহিতোষ চলে যেতেই আবার নিজের জায়গায় বসে পড়ল সে। তারপর তাকিয়ে রইল বাইরে। পারু ভেবেছিল, এতদিনের এত এত দুশ্চিন্তা আর বিপদ কাটিয়ে অবশেষে নিঝাটে ট্রেনে উঠতে পেরে সবাই-ই হয়তো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং সবাইকে এখন আরো বেশি ফ্যাকাশে-বিবর্ণ লাগছে। যেন এক গন্তব্যহীন শবযাত্রায় শামিল হয়েছে তারা। ভুবনডাঙায় ফেলে আসা ওই ঘরখানা যেন এখনো চোখের সামনে ভাসছে। সেখানে হয়তো কেরোসিনের কুপিটা এখনো জ্বলছে। রাত যত বাড়বে, ততই হয়তো ফুরিয়ে আসবে হারিকেনের সলতে। নিষ্প্রভ হয়ে আসবে আলো। তারপর সেই আলো নিভে গিয়ে নেমে আসবে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। পরদিন ভোরে ঘরের খোলা। দরজা-জানালা দিয়ে ঢুকবে সূর্যের ঝলমলে আলো। কিন্তু ওই অন্ধকার কি আর কখনো দূর হবে পৃথিবীর আর কোনো আলোর কি সাধ্য আছে, চির আঁধারে নিমজ্জিত গৃহহীন ওই গৃহখানাকে আবার আলোকিত করার?
ট্রেনে বসে থাকা পাণ্ডুর মুখের মানুষগুলোর বুকের ভেতর ওই শূন্য ঘর আর নির্জন বাড়িখানা যেন সবটুকু নৈঃশব্দ্য আর প্রাণহীনতা নিয়ে চিরদিনের জন্য বসত গাড়তে লাগল। এই যে তাদের যাত্রা, এই যাত্রা যেন মৃত্যুর মতোই অনির্ণেয় অথচ অনিবার্য।
তখন রাত ঠিক এগারোটা। পারু হঠাৎ বলল, মা, একটু বাথরুমে যাব।
ক্লান্ত, আনমনা অঞ্জলি ঘুমঘুম চোখে বললেন, যা।
পারু উঠে মাথার ওপরের হাতল ধরে ধীরে ধীরে কম্পার্টমেন্টের শেষ প্রান্তে থাকা বাথরুমের দিকে এগোতে লাগল। যদিও বাথরুমে যাওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। তার উদ্দেশ্য কম্পার্টমেন্টের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পোশাক পরিহিত লোকটা। সম্ভবত ট্রেনের কর্মচারী সে। পারু তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে খুব সাবধানে, সতর্ক ভঙ্গিতে বলল, আচ্ছা, রতনপুর স্টেশনটা আর কতদূর?
আরো দুটা স্টেশন পর। লোকটা জবাব দিল।
আর কতক্ষণ লাগবে যেতে?
এই… ঘন্টাখানেক। ঘড়ি দেখে বলল সে।
পারু আর কথা বলল না। বাথরুমেও গেল না। সে চুপচাপ ফিরে এসে সিটে বসে পড়ল। তারপর মাথা এলিয়ে দিল মায়ের কাঁধে। খানিক দু হাতে জড়িয়ে রাখল। তারপর গলার কাছে নাক নিয়ে আবছা অন্ধকারেই যেন মায়ের গায়ের ঘ্রাণ শুষে নিতে লাগল। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল ঘুমন্ত চারুকেও। দীর্ঘসময় ছুঁয়ে রইল চারুর মাথা, গাল। তারপর আবার দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। তবে তার কান খাড়া হয়ে রইল রতনপুর স্টেশনের জন্য। আর কিছুক্ষণ বাদেই ভয়ংকর একটা কাজ করতে যাচ্ছে সে। তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসী কাজ। অবিমৃশ্যকারীও বটে!
আধো ঘুমে ডুবে থাকা তার মা, প্রবল বিষাদে আক্রান্ত বাবা, অসহনীয় যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন বোন কিংবা ঠাকুরমা, তারা কেউই তখনো জানেন না, কী অবিশ্বাস্য ভয়ংকর এক ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে পারু। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই।