১৫
মহিতোষ ক্লান্ত। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছিল। যতটা সম্ভব সিটের পেছনে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়েও পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ঘুমটা ঠিকঠাক হলো না। কিছুক্ষণ পরপরই ভেঙে যাচ্ছিল। খানিক তন্দ্রার মতো যেটুকু হলো তাতেও ভর করছিল নানা স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে একবার দেখলেন ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেছে। মানুষজন হৈ-হুল্লোড় করে ট্রেন থেকে নামছে। তিনি ছায়ারাণীকে ডাকতে গিয়ে দেখেন তার আগেই ছায়ারাণী ট্রেন থেকে নেমে পড়েছেন। তিনি বাইরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। মহিতোষ তাকাতেই ঝলমল করে হেসে ফেললেন। বললেন, তুই নামবি না? আমরা কিন্তু নেমে গেছি।
মহিতোষ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললেন, এটা কোথায়? আমরা যশোর পৌঁছে গেছি? মেজো মেসো আসছেন?
ছায়ারাণীর হাসি আরো বিস্তৃত হলো। তিনি বললেন, যশোর কেন পৌঁছাব? আমরা বাড়ি আইসা গেছি। তোর এই ঘুমকাতুরে স্বভাব তো আর গেল না। এখন না হয় মায়ের ওপর বসে কাটাই দিলি। কিন্তু বড় হইলে কী করবি?
বড় হলে কী করবে মানে! মহিতোষ অবাক চোখে জানালার বাইরে তাকালেন। ট্রেন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে এই জায়গাটা তার চেনা। ওই যে সামনে জল টইটম্বুর পুকুর। পুকুর ধারে হিজল ফুলের গাছ। ওই যে ঠাকুরঘর। পেছনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে সাদা ধুতি। ধুতির সামনের জায়গাটাতে কী যেন কী লেগে আছে। বাবা চেষ্টা করছেন সেটা মুছতে। কিন্তু পারছেন না। এ কারণে তার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। তিনি ছায়ারাণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পান খাওয়ার অভ্যাস আর গেল না। পিক ফেলবা দেখে শুনে ফেলবা না?
ছায়ারাণী জবাব দিলেন না। তার চোখভর্তি দুষ্টুমি। বাবা বললেন, মহি নামে না কেন? ট্রেন তো এখনই ছাইড়া দেবে। ওরে নামাও।
মহিতোষ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলেন মাকে তরুণী এক মেয়ের মতো লাগছে। বাবাকেও কম বয়সী মনে হচ্ছে। তার নিজের পরনে হাফপ্যান্ট আর ফতুয়া। যেন দশ-বারো বছরের এক ছেলে বসে আছে ট্রেনের সিটে। এই ছেলেটিই কি তাহলে সে? তারা কি তাহলে কোথাও থেকে বাড়ি ফিরেছে? হ্যাঁ, ওই যে তাদের ঘর। ওই যে ঝাকড়া ডালপালার আমগাছটা। গোয়ালঘর, পেছনের ধান। ক্ষেত। ধান ক্ষেতে ভোরের সোনালি আলো পড়ে ঝলমল করছে। চোখ রাখা যাচ্ছে না। মহিতোষের বুকের ভেতর হঠাৎ বেপরোয়া এক পাখি ডানা ঝাঁপটাতে লাগল। আহা! কতদিন পর বাড়ি ফিরল সে? ওই যে নরম মাটি। শান্ত দিঘির জল। ওই যে মজা ডোবা। ডাহুক পাখির ক্লান্ত-শীতল চোখ। ওই যে দূরে উঠান পেরিয়ে জারুল ফুলের গাছ। সে চট করে উঠে দাঁড়াল। এই মুহূর্তে তীব্র চিল্কারে হুইসাল বাজাল ট্রেন। নড়তে শুরু করল ধীরে। মহিতোষ ঝট করে মায়ের দিকে ফিরে তাকাল। কিন্তু মাকে কোথাও দেখতে পেল না সে। তবে বাবা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তার চোখে আতঙ্ক। তিনি চিৎকার করে মহিতোষকে ডাকছেন। ছায়ারাণীকে ডাকছেন। কিন্তু ট্রেন চলে যাচ্ছে। মহিতোষ সর্বশক্তিতে চেষ্টা করছে দরজার দিকে ছুটতে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সে নড়তে পারছে না। তার পা পাথরের মতো ভার হয়ে আছে। বাবার অসহায় চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছে না সে। বাবা কি ছুটতে শুরু করবেন? কোনোভাবে লাফিয়ে ট্রেনে উঠে যেতে পারবেন?
কিন্তু মহিতোষকে অবাক করে দিয়ে বাবা দাঁড়িয়েই রইলেন। স্থির, অনড়। তবে তার চোখে কান্না। সেই কান্না মহিতোষের চোখের আড়াল হলো না। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে। অচেনা কোনো স্টেশনে। কিন্তু তারপরও বাবার ওই কান্না-ক্লান্ত চোখ মহিতোষের চোখের সামনে যেন দেয়ালে সাঁটানো পোস্টারের মতো সেঁটে রইল।
.
মহিতোষ চোখ মেলে তাকালেন। ম্লান হলদে আলোর প্রাণহীন এক কামরা। ঘুমে। ঢুলছে আশপাশের সব যাত্রী। কারো কারো বিরক্তিকর একঘেয়ে নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। তিনি বেশ কিছুক্ষণ স্বপ্নটার কথা ভাবলেন। বাবা তো সত্যি সত্যিই রয়ে গেলেন ভুবনডাঙা। তার দেহভস্ম মিশে আছে ভুবনডাঙা নদীর জলে। তাকে রেখে কোথায় যাচ্ছে তারা?
.
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ছায়ারাণী জানালায় মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন। নিস্পন্দ। তার শ্বাস পড়ছে কী না বোঝা যাচ্ছে না। যেন মৃত এক মানুষ। সাবধানে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মহিতোষ। পাশের কামরায় পারুরা রয়েছে। কী করছে তারা কে জানে! আধো আলোয় পা টিপে টিপে পারুদের কামরার দরজায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। শেষ রাতের বিষণ্ণ অন্ধকারে পাশাপাশি বসে আছে চারু আর অঞ্জলি। অঞ্জলির মুখের ওপর শাড়ির আঁচল। চোখ ঢাকা। মায়ের কাঁধের ওপর হেলে আছে চারু। কিন্তু পারু কই? পারুকে আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মহিতোষ কামরার অন্যপ্রান্তে তাকালেন। একজন নারী যাত্রী উঠে গিয়ে বাথরুমের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে ভেতরে কেউ রয়েছে। পারুই সম্ভবত। মহিতোষ আবার নিজের আসনে ফিরে এলেন। তারপর চুপচাপ বসে রইলেন মায়ের পাশে। ট্রেনের একটানা একঘেয়ে শব্দে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লেন টেরই পেলেন না। তার ঘুম ভাঙল অঞ্জলির ডাকে। ততক্ষণে প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। অঞ্জলি বললেন, পারু কই?
মহিতোষ হঠাৎ ঘুম ভেঙে ধাতস্থ হতে সামান্য সময় নিলেন। তারপর আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললেন, কী হয়েছে?
পারু কই? তাকে তো কোথাও দেখছি না।
মহিতোষ দু হাতে চোখ রগড়াতে রগড়াতে হাই তুললেন, কই আর যাবে? দেখো, বাথরুম টাথরুমে গেছে মনে হয়।
বাথরুমে নাই।
বাথরুমে নাই মানে? গেছে কই? প্রশ্নটা করলেও মহিতোষের গলা নিঃশঙ্ক। তিনি উঠে পরনের ভাঁজ পড়ে যাওয়া জামাটা টেনেটুনে ঠিক করতে লাগলেন। অঞ্জলি চাপা গলায় বললেন, সে কোথাও নাই। আমি সবগুলা বাথরুম দেখছি। পাশের বগিও। কিন্তু কোথাও নাই সে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে…।
কী বলছ? ট্রেন থেকে কই যাবে? মহিতোষ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললেন।
অঞ্জলি হঠাৎ কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আপনি এদিকে আসেন। আমার ভালো ঠেকতেছে না।
মহিতোষ বিরক্ত ভঙ্গিতে খ্রীর দিকে তাকালেন। এখানে ভালো না ঠেকার কী আছে? পারু নিশ্চয়ই আশপাশেই কোথাও আছে। এত বড় চলন্ত ট্রেন থেকে তো সে আর পড়ে যায়নি। তিনি অঞ্জলিকে সঙ্গে নিয়ে দুই বগির সংযোগস্থলের নিরিবিলি জায়গাটাতে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, একটু অপেক্ষা করো। এসে পড়বে। হয়তো এই বাথরুম ব্যস্ত দেখে পাশের কোনো বাথরুমে গেছে।
অঞ্জলি আচমকা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, আমি না দেখেই আগে আপনার কাছে আসি নাই। ঘুম ভেঙে দেখি পারু নাই। ভাবলাম বাথরুম টাথরুমে গেছে বোধহয়। অপেক্ষা করতে লাগলাম। ও এলে আমিও যাব। কিন্তু ও এলোই না। আমারও কেমন জানি ঝিমুনির মতো লেগে আসছিল। কিন্তু অনেক সময় কেটে যাওয়ার পরও যখন সে আর এলো না, তখন নিজেই উঠে গেলাম। কিন্তু পারু কোথাও নাই। আশপাশেও না।
অঞ্জলির চোখে-মুখে অজানা আশঙ্কা। তবে মহিতোষ তাতেও খুব একটা বিচলিত হলেন না। নিশ্চয়ই আশপাশেই কোথাও আছে পারু। তিনি হনহন করে পাশের কম্পার্টমেন্টে হেঁটে গেলেন। তারপর আরো একটিতে। কিন্তু পারু কোথাও নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে। ট্রেন যখন যশোর স্টেশনে থামল, তখন ভোরের আলো ফুটেছে। মেজো মেসোকে প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে। তার পরনে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ওপর শাল। মাথায় উলের টুপি। ভালো শীত পড়েছে এদিকে। প্রায় থেমে যাওয়া ট্রেনের জানালায় ছায়ারাণীকে দেখে তিনি হাত নাড়লেন। মহিতোষকে চিৎকার করে ডাকলেন। কিন্তু তাতেও কারো কোনো বিকার দেখা গেল না। এই শীতেও দরদর করে ঘামছেন মহিতোষ। কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামছে ঘামের স্রোত । অঞ্জলি তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। চারু
তারও পেছনে। ছায়ারাণী বসে আছেন নিশূপ। যেন এই মাত্র প্রিয় কোনো মানুষের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেয়েছেন তারা। কোথায় গেল পারু?
যাত্রীদের হুটোপুটি লেগে গেছে। কে কার আগে নামতে পারবে। এর মধ্যেই ট্রেনে উঠে এলেন অরবিন্দ বাবু। মহিতোষের মেজো মেসো। তিনি মহিতোষকে দেখে বললেন, কী রে, হয়েছেটা কী? এত ডাকছি তোরা কেউ শুনছিস না।
মহিতোষ মেসোকে ঘটনা খুলে বললেন। অরবিন্দু বাবু যেন বেশ খানিকটা সময় নিলেন বুঝতে। তারপর চকিতে একবার আশপাশে দেখে নিয়ে বললেন, এটা কেমন কথা? চলন্ত ট্রেন থেকে পারু যাবে কই?
এই প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। কিন্তু তার কোনো উত্তর নেই। সকলেই বিচলিত, বিভ্রান্ত, বিধ্বস্ত। তবে পারু সত্যি সত্যিই হারিয়ে যেতে পারে, এই সম্ভাবনা যেন মেনে নিতে পারছিলেন না কেউই। সে নিশ্চয়ই আশপাশেই কোথাও আছে। নিশ্চয়ই সবাইকে চমকে দিয়ে আচমকা এসে বলবে, কী খুব ভয় পেয়ে গেছিলে না? দেখলাম, আমাকে না পেয়ে তোমরা কী করো!
কেবল অঞ্জলির মনে তীব্র এক অশনি ছড়িয়ে যেতে লাগল। অরবিন্দ বাবু তড়িঘড়ি করে ট্রেন থেকে নামলেন। সঙ্গে মহিতোষও। স্টেশন মাস্টার অরবিন্দ বাবুর পূর্বপরিচিত। সব শুনে তিনি বললেন, বিষয়টা তো চিন্তার অরবিন্দ বাবু। চলন্ত ট্রেন থেকে মেয়ে যাবে কই?
এই একই প্রশ্ন সবার। কিন্তু উত্তর কারো জানা নেই। স্টেশনের মাইকে পারুর নাম ঘোষণার ব্যবস্থা করলেন অরবিন্দু বাবু। ট্রেনের এত এত মানুষের ভিড়ে পারুকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তারচেয়ে মাইকে ঘোষণা দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আশপাশে থাকলে নিশ্চয়ই সে ঘোষণা শুনে ছুটে আসবে। কিন্তু পারু এলো না। স্টেশন ছেড়ে অন্য নতুন কোনো গন্তব্যে চলে গেল ট্রেন।
গৃহহীন উদ্বাস্তু উদভ্রান্ত ওই মানুষগুলো কেবল ঠায় দাঁড়িয়ে রইল স্টেশনে। যেন আর কোথাও যাওয়ার নেই তাদের। কিচ্ছু করার নেই। নিঃসাড়, নিস্তব্ধ এক শ্মশানের শব্যাত্রী যেন তারা। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম। মানুষের ভিড় কমে এলো। শূন্য, নীরব স্টেশন ক্রমশই খাঁ খাঁ নির্জনতায় ডুবে গেল। আর অনন্ত অসীম বিষাদে ডুবে যেতে থাকল গৃহত্যাগী পলাতক মানুষগুলো। তাদের বুকের ভেতর অবর্ণনীয় যন্ত্রণার উন্মাতাল এক নদী বয়ে যেতে লাগল। দাপিয়ে বেড়াতে লাগল প্রবল শোকের মাতাল হাওয়া। কিন্তু পারুকে কোথাও দেখা গেল না।
.
মহিতোষদের বর্ডার পেরোনোর তারিখ পেছাল। পারুকে ছাড়া কোথায় যাবে তারা? অঞ্জলি পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। চারু লুকিয়ে একা একা কাঁদে। দিদিকে ছাড়া কীভাবে থাকবে সে? কী করে যাবে? কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজে পেল না, পারুর ঠিক কী হয়েছে? এই তিন দিনে মহিতোষ আর অরবিন্দ বাবু যতটা সম্ভব খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করলেন। এমন হয়নি তো যে পারু অন্ধকারে এক বগি থেকে অন্য বগিতে যাওয়ার সময় অসাবধানতাবশত ট্রেন থেকে পড়ে গেছে? বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা? কিন্তু তেমন কোনো খবরও কোথাও পাওয়া গেল না।
দিন দুই বাদে অবশ্য ছায়ারাণী তাঁর দীর্ঘ নীরবতা ভাঙলেন। এমনিতেই শিকড় ওপড়ানো এক মৃতপ্রায় বৃক্ষ তিনি। তার ওপর পারুর এই ঘটনা তাঁকে বিবশ করে দিয়েছে। তিনি চারুকে ডেকে সতর্ক গলায় বললেন, তুই সত্য কইরা বল, ঘটনা কী ঘটছে?
চারু অবাক গলায় বলল, আমি কী করে জানব?
তুই জানবি না তো কে জানবে? এবার খ্যানখ্যানে গলায় ধমকে উঠলেন ছায়ারাণী। সারাদিন দুই বইনে ফুসুরাসুর করস, আর বইনে কই গেছে, কার সঙ্গে গেছে, সেইটা জানস না?
চারু ঠাকুরমার কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। পারুদি কই যাবে? কার কাছে যাবে? ছায়ারাণী বললেন, ওই ফরিদ ছ্যামড়াটার সঙ্গে কি কোনো যোগাযোগ ছিল তার?
এই কথায় চমকে উঠল চারু। এটা তো সে ভাবেনি! পারুদি কি তবে আসলেই ইচ্ছে করে ট্রেন থেকে নেমে গেছে? ফরিদ দাদার সঙ্গে? ঠাকুরমার কথায় মুহূর্তের জন্য হলেও এই সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল চারুর মাথায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভাবনাটা তাড়িয়েও দিল সে। মা, বাবা, ঠাকুরমা, এমনকি তাকে ছেড়ে যে পারু চিরদিনের জন্য অন্য কারো সঙ্গে দূরে চলে যেতে পারে, এ কথা তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, কী বলছ ঠাকুমা? পারুদি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? তাও আবার অন্য কারো সঙ্গে অন্য কারো জন্য? ছায়ারাণী মুখ ঝামটা মেরে শ্লোক কাটলেন,
আপনজনের ঘর ছাড়ে যে,
নাঙয়ের পাতে ভাত বাড়ে যে,
তার প্যাটে রয় ক্ষিদা।
এমন নারী শতেক জন্মেও, হয় না কভু সিধা।
চারু ঠাকুরমার কথা বুঝতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কেবল। ছায়ারাণী দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তোর বাপরে ডাক। এক্ষণ ডাক।
মহিতোষ সব শুনে থম মেরে রইলেন। ছায়ারাণী বললেন, ব্যবস্থা যা করার এখনি করতে হবে।
কী ব্যবস্থা করব?
ফরিদের মামার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা কর।
মা। অসহায় গলায় বললেন মহিতোষ।
কী?
তার সঙ্গে যোগাযোগ করব কীভাবে? একবার চিন্তা কর তো ওই গ্রামে আর এই জন্মে আমি কখনো যেতে পারব? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আমাকে জীবন্ত দাহ করবে না?
মহিতোষের কথা সত্য। বিষয়টা যে ছায়ারাণী জানেন না তা নয়। কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও তাঁর মাথায় আসছে না। মহিতোষ বললেন, তা ছাড়া পারু যদি সত্যি সত্যিই ফরিদের সঙ্গে চলে গিয়ে থাকে। এই নিয়ে ভুবনডাঙায় কী লঙ্কাকাণ্ড বাঁধবে তুমি বুঝতে পারছ?
ছায়ারাণী বুঝতে পারছেন। এমন হলে পারুর ভাগ্যে দুঃখের অন্ত থাকবে না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তাঁর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে কুণ্ঠিত হবে না। যে করেই হোক পারুর জীবনে নরক যন্ত্রণা নামিয়ে আনবে সে। মুসলমানের ছেলের সঙ্গে হিন্দুর মেয়ে ভেগে গেছে, বিষয়টা গ্রামের লোকেরাও ভালো চোখে দেখবে না। তাদের প্রতি যদি কারো সামান্য সহানুভূতিও থেকে থাকে, এই ঘটনায় তারা বরং বিপক্ষে চলে যাবে। তা সে হিন্দু হোক কিংবা মুসলমান। আর এই সুযোগ যে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হেলায় হারাবে না, তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। মহিতোষ ভয়ে ভয়ে বললেন, আমার পারু এমন কিছু করতে পারে মা? আমার বিশ্বাস হয় না। অন্য কিছু হয় নাই তো?
ছায়ারাণী খেঁকিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করলেন। বয়স তো আর কম হয়নি তার। এই জীবনে কম মানুষ দেখেননি। অভিজ্ঞতাও কম হয়নি। তিনি অরবিন্দু বাবুকে ডেকে বললেন, মহি তো আর গায়ে যেতে পারবে না। আপনি কাউরে দিয়ে একটু খোঁজ নিয়া দেখেন পারু ভুবনডাঙা আছে কী না?
অরবিন্দ বাবুকে অবশ্য খোঁজ নিতে যেতে হলো না। তার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো চারু। তার হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট। চিরকুটটা সে তার ব্যাগের পকেটে পেয়েছে। সেখানে লেখা–চারু, আমি তোদের ছেড়ে ফরিদের সঙ্গে চলে যাচ্ছি। কেন যাচিছ জানি না। অনেক ভেবেও এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি। নিজেকে কত ভাবে যে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। জানি না, ভাগ্যে কী আছে। যা-ই থাকুক, মেনে নিব। তোদের খুব ভালোবাসি,–এই কথাটা চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি জানি, আমার এই কথা আর কেউ কখনো বিশ্বাস করবে না। তোদের পৃথিবীতে আমি আজীবন এক অকৃতজ্ঞ, অভিশপ্ত মানুষ হয়েই বেঁচে থাকব। এর থেকে কষ্টের কিছু কি আর আছে? তারপরও কেন আমি এমন করলাম? আমি জানি না। মা-বাবার তো তুই ছাড়া আর কেউ রইল না। তাদের দেখে রাখিস।–পারুদি।
ঘরের উঁচু ছাদ। কেউ সামান্য শব্দ করলেও প্রতিধ্বনির মতো কানে বাজে। সেই ঘরখানা মুহূর্তেই হিমশীতল লাশঘরের মতো জ্জ হয়ে গেল। কারো নিঃশ্বাসের শব্দ অবধিও শোনা গেল না। খোলা জানালা দিয়ে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া হুহু করে বয়ে নিয়ে আসতে থাকল অজানা এক আতঙ্ক। সেই আতঙ্কে বিবশ হয়ে রইল সবগুলো মানুষ। কেউ কারো দিকে তাকাতে অবধি পারল না। যে প্রগাঢ় বোধ আর বন্ধনে তারা এতদিন আবিষ্ট হয়েছিল, তা যেন মুহূর্তেই পলকা আভরণের মতো খসে গিয়ে প্রকাশ করে দিয়েছে ভেতরে লুকানো নিষ্ঠুর, বিভৎস, জরাজীর্ণ এক কঙ্কাল।
১৬
দুপুরের দিকে খানিক রোদ উঠেছে। তবে শীত তাতে কমেনি। বরং একটা ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে থেকে হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। পারু আর ফরিদ রফিকুলদের বাড়ির পেছনে বাঁশের মাচার ওপর বসে আছে। তাদের সামনেই শীতের প্রায় শুকিয়ে আসা পুকুর। দুই ধারে শুকনো ডাল, লতা-পাতা জমে আছে। একটা মাছরাঙা পাখি হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এলো। তারপর টুক করে ছোটো কোনো মাছ তুলে নিল হাঁটুজল থেকে। নিস্তরঙ্গ পুকুরে সামান্য কম্পন তৈরি হলো। পারু সেই কম্পনের দিকে স্থির তাকিয়ে আছে। ফরিদ বলল, একটা কথা বলি?
পারু জবাব দিল না। তাকাল না অবধি। যেন সে পুকুরের জলে ভেসে ওঠা ঢেউগুলো এক এক করে গুনে চলেছে। ফরিদ বলল, তোমার খুব অনুশোচনা হচ্ছে, তাই না?
পারু এবারও জবাব দিল না। যেমন বসে ছিল তেমন বসেই রইল। ফরিদ আলতো করে কোলের ওপর রাখা পারুর হাতখানা ধরল। তারপর বলল, আমারও হচ্ছে।
পারু এবার তাকাল। খুব ধীরে। ম্লান, বিবর্ণ, ভাবলেশহীন এক মানুষ। ফরিদ বলল, আমার জন্য নয়।
তাহলে? কথা বলল পারু।
তোমার জন্য।
পারু আবার চুপ করে রইল। তবে তার দৃষ্টি ফরিদের চোখে। ফরিদ বলল, যতবার আমি তোমার দিকে তাকাই, ততবার নিজেকে অপরাধী লাগে। মনে হয় বাগান থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে এসেছি আমি। আর সেই ফুলটা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে।
পারু ম্লান গলায় বলল, ফুল ছিঁড়ে নিলে বাগানের কি কিছু আসে যায়?
ফরিদ তাকাল, মানে?
মানে বাগান তো আর শুকায় না। সে তো অন্য ফুলগুলো নিয়ে রঙিনই থাকে। তাই না?
ফরিদ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল, হুম।
কিন্তু আমার পরিবার এখন কী করছে? আমার মা? বলে মাথার ওপর আকাশে তাকাল সে। একটা চিল উড়ে যাচ্ছে ধূসর আকাশে। একা, নিঃসঙ্গ। পারু আনমনা ভঙ্গিতে বলল, বাবা, চারু, ঠাকুমা, কী করছে ওরা এখন? ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে যখন ওরা দেখল যে আমি ট্রেনে নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে কী করেছিল ওরা?
পারুর দুই হাত তার শরীরের দু পাশে বাঁশের মাচাটার ওপর শক্ত করে রাখা। শীর্ণ, ফ্যাকাশে আঙুলগুলো যেন অবলম্বন খুঁজে নেয়ার মতো করে আঁকড়ে ধরতে চাইছে কিছু। তার দু চোখের কোলে দু ফোঁটা জল এসে শিশির বিন্দুর মতো জমা হয়ে রইল। কিন্তু শূন্য আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকা পারুর চোখের কোল গড়িয়ে সেই জল দু ফোঁটা ঝরে পড়তে পারল না। ফরিদ কী করবে বুঝতে পারছে না। পারুর এই যন্ত্রণা সে বুঝতে পারে। কিংবা চেষ্টা করে। কিন্তু সে জানে, জগতে এমন কিছু দুঃখ-যন্ত্রণা থাকে যা একা ওই মানুষটা ছাড়া আর কেউ কখনো অনুভব করতে পারে না।
পারু আলগোছে হাতের উল্টো পিঠে তার চোখজোড়া মুছে ফেলল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি খুব খারাপ একটা মানুষ, তাই না?
ফরিদ ডান হাত বাড়িয়ে পারুর কাঁধে রাখল। তারপর টেনে আনার চেষ্টা করল কাছে। কিন্তু তার ওই উষ্ণ, নির্ভার হাতের ভেতর যেন নিথর, নিষ্প্রাণ একটি শরীর। সেখানে কোনো উত্তাপ নেই, স্পন্দন নেই। পারু বলল, আমাকে আপনি খারাপ ভাববেন আমি জানি। তারপরও কথাটা আমি বলতে চাই। বলি?
হুম। ফরিদ শান্ত কণ্ঠে বলল।
এই যে আমি হুট করে এভাবে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। এটা কিন্তু আমি আগে থেকে ভেবে রাখিনি। আমার কখনো মনেও হয়নি যে আমি এমন কিছু করতে পারি। শেষ দিন পর্যন্ত না। কিন্তু ঠিক ওই সন্ধ্যায়, যখন অন্ধকার নেমে আসছিল। যখন মনে হলো এই জীবনে আর কখনো আমি আপনাকে দেখতে পাব না। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ কী যে হলো! মনে হলো আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আর তখন মাথাটা এমন এলোমেলো হয়ে গেল যে…।
পারু কথা শেষ করতে পারল না। তার গলা কাঁপছে। হাত দু খানা আরো শক্ত করে ধরে আছে বাঁশের মাচাটা। তার পা জোড়া মাটি ছুঁয়ে স্থির হতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল, কিন্তু এখন এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমি কাজটা ঝোঁকের মাথায় করেছি। আমি আসলে এটা চাইনি। আমার তখন বাস্তব জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল না। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি। না হলে এমন কেউ কখনো করে? বলেই ফরিদের দিকে তাকাল সে। তারপর বলল, আপনি হলে এমন করতেন? নিজের বাবা, মা, বোন, পরিবার সবাইকে ছেড়ে এভাবে কারো জন্য চলে আসতে পারতেন? আর যদি আসতেনই তখন ওই ফেলে আসা মানুষগুলোর জন্য আপনার কেমন লাগত?
এই প্রশ্নের উত্তর ফরিদের কাছে নেই। সে জানে, পারুর বুকের ভেতর কী চলছে। শেষ কটা দিন কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। কিন্তু কী করবে সে? সে নিজেও কি কম ঝুঁকি নিয়েছে? এক অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছে কিছু না ভেবেই। সেও তো ওই পারুর জন্যই? অন্য কোনো কারণে তো নয়?
পারু বলল, আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে এই একটা মাত্র। উপায় আছে যা আমাকে আমার সব যন্ত্রণা, সব অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
ফরিদ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা বলি পারু?
পারু জবাব দিল না। তবে তাকাল। ফরিদ বলল, তোমার খুব অপরাধবোধ হচ্ছে, তাই না?
পারু ফরিদের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিল। তাকিয়ে রইল নিজের পায়ের দিকে। যেন চূড়ান্ত অনর্থক এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না সে। ফরিদ বলল, মানুষ কখন অপরাধবোধে ভোগে জানো?
পারু জবাব দিল না। ফরিদ বলল, যখন সে বড় ধরনের কোনো অপরাধ করে। ছোটখাটো অপরাধ নিয়ে মানুষ তেমন ভাবে না। সে ভাবে বড়, ভয়ংকর অপরাধ নিয়ে। তোমার কি এখন মনে হচ্ছে না যে তুমি খুব বড়সড় একটা অপরাধ করে ফেলেছো? বিরাট বড় একটা ভুল? সুযোগ থাকলে এই ভুলটি তুমি করতে না? কিংবা শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে?
পারু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। ফরিদ জানে, পারুর এই মানসিক অবস্থায় হয়তো এ ধরনের কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও সে কথাগুলো বলতে চায়। কারণ, পারু যদি সত্যি সত্যিই ভাবে যে সে ভুল করেছে, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার এই অনুভূতি আরো গাঢ়, আরো প্রকট হবে। আর যে সম্পর্কের শুরুটাই হয় এমন ভুলের অনুভব নিয়ে, সেই সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো যায় না। তা হয় পৃথিবীর কঠিনতম সম্পর্ক। যে দুর্গম পথে তারা যাত্রা শুরু করেছে, সেই পথে এমন অনুভব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সত্যিকার অর্থেই দুরূহ।
পারু বলল, যে ভুল শুধরে নেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না, সেটা আসলে কী, আমি জানি না।
যদি থাকে?
কী থাকবে?
ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ?
পারু এই প্রশ্নে আবার ফিরে তাকাল। ফরিদ বলল, তাহলে এই ভুলটা শুধরে নেবে?
পারু এবার ম্লান হাসল। তারপর ফরিদের মুখোমুখি ঘুরে বসে বলল, বাবা বলতেন, মানুষের কথা হচ্ছে তূণ থেকে তীর ছুঁড়ে দেয়ার মতো। একবার ছুঁড়লে আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না। আমি যদি ভুল করে থাকি, সেটাও কিন্তু তেমনই। এই ভুলের কোনো সংসোধন নেই।
যদি থাকে?
কীভাবে?
তুমি চাইলে আমি তোমাকে যশোর পৌঁছে দিতে পারি। তোমাকে না পেয়ে নিশ্চয়ই তোমার বাবা-মা ওপার চলে যায়নি। হয়তো তারা এখনো যশোরেই রয়ে গেছে। আমি তোমাকে সেখানে পৌঁছে দিতে পারি।
ফরিদের এই কথায় পারু চুপ করে রইল। তার হঠাৎ চিৎকার করে কান্না পেতে লাগল। এই কদিনে একবারের জন্যও সে শব্দ করে কাঁদেনি। কেঁদেছে নিঃশব্দে, একা। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তার মনে হলো যে মানুষটার জন্য সে এমন করে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে চলে এসেছে, সেই মানুষটা তাকে হয়তো কখনোই বুঝতে পারবে না। কারো বুকের ভেতর জেগে ওঠা দগদগে ক্ষতে কী করে প্রলেপ লাগাতে হয়, তা বুঝবে না। সে ফ্যাকাশে মুখে হাসল, হ্যাঁ, তাহলে খুব ভালো হয়।
বলেই উঠে দাঁড়াল পারু। তারপর ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে। ফরিদ পেছন থেকে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল। কয়েকবার পারুকে ডাকবে ভেবেও শেষ অবধি নিরস্ত রইল সে। তবে তার বুকের ভেতর অভিমানের একটা সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ণ কাঁটার অস্তিত্ব সে ক্রমশই টের পেতে লাগল। পারু যদি সত্যি সত্যিই ভাবে যে সে ভুল করেছে, এবং সুযোগ পেলে সেই ভুল সে শুধরে নিতে চায়, তাহলে কার জন্য এই দুর্গম, অনিশ্চিত, বিপৎসংকুল পথে সে পা বাড়িয়েছে? কেন?
.
সন্ধ্যায় দিলারার ঘরে এলো ফরিদ। তার সামনে জড়সড় পারু। দুপুরে তাকে অন্যদিনের চেয়ে খানিক সপ্রতিভ, স্বাভাবিক মনে হলেও রাতের এই নিস্তব্ধতায় আবার যেন ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির মতো মনে হচ্ছে। ভীত, সন্ত্রস্ত, সন্ধিগ্ধ। ফরিদ সতর্ক গলায় বলল, আমি জানি তোমার মন খারাপ হবে। কিন্তু তারপরও কিছু বিষয়ে আমাদের কথা বলা দরকার।
পারু ফরিদের কথায় কোনো আগ্রহ দেখাল না। সে বলল, দিলারা বৌদি কোথায়?
ফরিদ চট করে পারুর কাছে সরে এলো। তারপর ঠোঁটে তর্জনি চেপে ফিসফিস করে বলল, চুপ। একদম চুপ। খবরদার!
পারু ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।
ফরিদ বলল, তুমি কি সব ভুলে গেছ?
কী ভুলব?
এ বাড়িতে আমরা কীভাবে আছি? আমাদের কী পরিচয়? তুমি যে দিলারা ভাবিকে বৌদি বলে ডাকছ, এতে কী হবে একবার ভেবে দেখেছ? কেউ যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে যে তুমি মুসলিম নও তাহলে কী হবে? একবার ভাবো তো?
কথাটা একদমই মাথায় ছিল না পারুর। কিছু বলতে গিয়েও আচমকা চুপ হয়ে গেল সে। ফরিদ বলল, আজ ভোরে রফিকুলের বাবা অনেক কিছু বললেন আমাকে। জানি না আমি কী করব। এখন কেউ যদি তোমায় নামাজ পড়তে ডাকে, তাহলে তুমি কী করবে? এটা ভেবেই তো আমার মাথা কাজ করছে না!
সমস্যা এতটা গভীরে যেতে পারে এটা পারুর ধারণা ছিল না। সে বলল, দিলারা বৌদি… বলেই থমকে গেল সে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলল, দিলারা ভাবি আজ আমায় একবার নামাজের কথা বলেছিলেন। মানে সরাসরি বলেননি। আকারে ইঙ্গিতে…।
হুম। গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল ফরিদ। তুমি একটু সাবধানে থেকো। জানি খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কী করব বলো? এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই আমাদের। যে কটা দিন এখানে থাকব, এদের সঙ্গে তাল মিলিয়েই থাকতে হবে। যদি কেউ আসল ঘটনা সামান্যও আঁচ করতে পারে, তবে আর কোনো উপায় থাকবে না। ফরিদের কণ্ঠে একইসঙ্গে ভয় ও অসহায়ত্ব।
পারু কথা বলল না। ফরিদ বলল, এখানে বেশিদিন থাকতেও পারব না আমরা।
তাহলে? ভীত চোখে তাকাল পারু।
সেটাই ভাবতে হবে। বলে থামল ফরিদ। তারপর খানিক সময় নিয়ে যেন নিজেকে গুছিয়ে নিল সে। বলল, তোমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে পারু।
কী?
তুমি কি সত্যি সত্যিই আমার সঙ্গে এই বিপদের পথে পা বাড়াতে চাও? না কি হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় করে ফেলা ভুলটা শুধরে নিতে চাও?
মানে?
এটা যুক্তি-তর্ক কিংবা মান-অভিমানের সময় না পার। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমি যদি সিদ্ধান্ত নেই যে আমি ফিরে যেতে চাই?
তাহলে আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।
তারপর?
তারপর কী?
এই প্রশ্নের উত্তর দিল না পারু। চুপ করে রইল। ফরিদ বলল, কী ভাবছ তুমি?
ভাবছি আমার আসলে যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।
কেন?
সম্পর্ক এমন এক জিনিস, সেখানে একবার অবিশ্বাস তৈরি হলে সেটা আর কখনোই আগের মতো হয় না। তা সে যে সম্পর্কই হোক না কেন!
এ কথা কেন বলছ?
বলছি… কারণ…। বলে সামান্য চুপ করে রইল পারু। হঠাৎ করেই তাকে কেমন অন্যরকম লাগতে লাগল ফরিদের। খানিক অচেনা। বয়সের তুলনায় বড়, পরিপক্ব। আগের সেই চপল, চঞ্চল পারুর বিন্দুমাত্রও যেন অবশিষ্ট নেই। সে স্পষ্ট কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আপনি কি জানেন যে আমি এই জীবনে আর কখনো কোনোদিন আমার বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব না?
বলে সামান্য থামল সে। যেন নিজের বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা জলোচ্ছ্বাসটাকে সংবরণ করল। তারপর বলল, কী করে দাঁড়াব? যে যন্ত্রণায় নিজের দেশ ছেড়ে তারা পালিয়ে যাচ্ছিল, সেই যন্ত্রণা তারা ছাড়া আর কে বুঝবে? কিন্তু কীসের জন্য যাচ্ছিল তারা? আমি আর চারু… আমাদের জন্যই তো? অথচ সেই আমি কী করলাম?
পারু দু হাতে মুখ ঢাকল। ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর আলতো করে কপাল ছোঁয়াল। তারপর বলল, ঠিক ওই দুঃসময়টাতেই তারা হঠাৎ আবিষ্কার করল যে আমার জীবনে তাদের আসলে কোনো জায়গাই নেই। যতই তারা আমাকে ভালোবাসুক, আমার কথা ভাবুক। আমার কাছে তো তারা আসলে গুরুত্বহীন। বরং তাদের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্য কেউ আছে আমার জীবনে। এই কষ্টটা কেমন একবার ভেবে দেখেছেন?
ফরিদ কী জবাব দেবে? সে হারিকেনের জ্বলন্ত অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে রইল। পারু বলল, যে মা-বাবা রাতের পর রাত আমার চিন্তায় ঘুমাতে পারত না, খেতে পারত না। গাছ থেকে একটা পাতা পড়ার শব্দে পর্যন্ত আতঙ্কে কেঁপে উঠত। আমি কই, কী করছি, দেখার জন্য ছুটে আসত। সেই বাবা-মা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, আমার জীবনে তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। সেখানে আছে অন্য কেউ। এই কষ্টের কি কোনো সীমা-পরিসীমা আছে? এখন সেই বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে আমি কী করে দাঁড়াব? কোন মুখে? এই জীবনে আর কখনো ওই মানুষগুলোর সামনে গিয়ে আমি দাঁড়াতে পারব?
পারুর কষ্টটা ফরিদ অনুভব করতে পারছে। কিন্তু তারপরও এটি মেনে নিতে পারছে না যে, পারু যতটা না তাকে ভালোবেসে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে, তারচেয়ে বেশি নিয়েছে ঝোঁকের মাথায়। এবং এখন সেই সিদ্ধান্তটা তার কাছে ভুল মনে হচ্ছে। প্রবল অপরাধবোধে ভুগছে সে।
এমন হলে বাকিটা জীবন তারা একসঙ্গে কী করে কাটাবে? ফরিদ তার নিজের কথাও ভাবল। সে নিজে কী ভাবছে? তার কী একবারও মনে হয়েছে যে এভাবে হুট করে চলে আসাটা তার ঠিক হয়নি? আরো খানিক ভাবনা-চিন্তার দরকার ছিল? কারণ সেও কিন্তু তার জীবনটা পুরোপুরি অনিশ্চিত এবং কঠিন করে ফেলেছে। যদি সে না আসত, যদি পারুকে চলে যেতে বলত, তাহলে কি তার জন্যও সবকিছু আরো বেশি সহজ হয়ে যেত না? নাকি তারও এখন মনে হচ্ছে যে সে ভুল করেছে? পারুকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার যে কথাটা সে এখন বলছে, এটি কি তবে তার অবচেতন মন তাকে দিয়ে বলাচ্ছে? কারণ, মনে মনে সেও একটি নিশ্চিন্ত, নিরাপদ জীবন চায়? সেও কি তবে ঝোঁকের মাথায়ই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল? এখন বাস্তবতার কঠিন ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে সেই ভুলটা শুধরে নিতে চাইছে?
ওই আধো-আলো আধো-অন্ধকারের ঘরটাতে এই প্রশ্নটা যেন ক্রমশই জমাট বাঁধতে লাগল। তা পারুর মনে যেমন, তেমনি ফরিদের মনেও। তারা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে যেন তাকাতে পারল না। তাদের কেবলই মনে হতে লাগল, ওই মানুষটি বোধহয় আমার ভাবনা, আমার শঙ্কাগুলো পড়ে ফেলতে পারল। কিংবা এই দ্বিধা আর সংশয় নিয়ে কী করে তারা এমন বন্ধুর পথে বাকিটা জীবন পারি দেবে, সেই প্রশ্নটি ক্রমশই আরো বড় হতে লাগল।
.
রাতের খাবারের জন্য ডাকতে এলো দিলারা। বাড়িতে আজ ভালো-মন্দ আয়োজন করা হয়েছে। আতাহার মওলানা নদী থেকে তাজা মাছ এনেছেন। ফরিদের আচার-আচরণে তিনি খুবই সন্তুষ্ট। খেতে বসে প্রসঙ্গটাও তুললেন তিনি। রফিকুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মানুষ বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে নানাকিছু শেখে। খারাপও শেখে, ভালোও শেখে। কিন্তু আমার এমনই এক কপাল যে আমার ছেলে খালি খারাপটা শেখে। ভালোর ধারে-কাছ দিয়া নাই।
রফিকুল ভাত খেতে খেতে আড়চোখে একবার বাবার দিকে তাকাল। তবে কিছু বলল না। আতাহার মওলানা বললেন, এই যে ফরিদ, এই শীতের সকালেও ঘুম থেকে উঠে ঠাণ্ডা পানি দিয়া ওজু করে মসজিদে গিয়া নামাজ পড়ল। আর তুই? তোর জন্য আমি নিজে ঘুম থেকে উঠে গরম পানি করি। কিন্তু তোরে একদিনের জন্যও ঘুম থেকে তুলতে পারি না। পারি?
খাবার টেবিলের পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠেছে। সবাই মাথা নিচু করে চুপচাপ ভাত খেতে লাগল। তিনি এবার তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তুমি অসুস্থ। কিন্তু এইজন্য যে ঘরের মেয়েদের খোঁজ খবর ঠিক মতো নিবা না তা কিন্তু হবে না। এই দায়িত্ব তোমার। তোমাকে খোঁজখবর নিতে হবে। এরা ঠিক মতো নামাজ-রোজা করে কী না–তা দেখতে হবে। না হলে এইজন্য তোমারেও কিন্তু আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে। বুঝলা?
নাজমা বেগম বললেন, বুঝছি। এখন সবাই খেতে বসছে। শান্তিমতো খেতে দেন। আর এইখানে ফরিদ আছে, ফরিদের নয়া বউ আছে। এর মধ্যে আপনে কী শুরু করলেন?
আমার শুরু করতে হয় কেন? আতাহার মওলানা দমলেন না। তোমাদের জন্যই তো হয়। আর ফরিদ নতুন বিয়া করছে বলে তো সে তার দায়িত্বে অবহেলা করতেছে না। সে তো ঠিকই ভোরে উঠে মসজিদে গেল। কিন্তু আর সবাই বলে একটু থামলেন তিনি। তারপর পারুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি কিছু মনে করো না নয়া বউ। এখন শুনতে খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু একদিন ঠিকই এই বুড়া চাচার কথা মনে পড়বে। গুরুজনরা যা বলে, ভালোর জন্যই বলে। কিন্তু সময় থাকতে আমরা বুঝি না।
পারু চকিতে একবার কিছু বলতে গিয়েই আবার নিজেকে সামলে নিল। তারপর সতর্ক ভঙ্গিতে বলল, জি চাচা।
তুমি লক্ষ্মী মেয়ে। যে কটা দিন আছো রোকেয়ারেও একটু বুঝাও। এই দিন তত দিন না। তাই না?
ফরিদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল, মাছটা খুব স্বাদ হয়েছে চাচা। কোন নদীর মাছ এটা?
এই কথায় আতাহার মওলানা খুব খুশি হলেন। তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, এগুলা বড় গাছের মাছ। খুব ভোরে না গেলে পাওয়া যায় না। ভাগ্য ভালো আমি পেয়ে গেছিলাম। আইড় মাছটা আরেক টুকরা নাও। খুবই স্বাদ।
ফরিদ চাইছিল দ্রুতই খাবার টেবিল থেকে উঠে যেতে। সে পারুকে নিয়ে চিন্তিত বোধ করছে। কখন কী বলে ফেলে তার ঠিক নেই। খানিক আগে পানি চাইতে গিয়ে জল বলে ফেলেছে সে। কেউ সম্ভবত খেয়াল করেনি। সন্ধ্যায় দিলারাকে একবার বৌদি বলেও সম্বোধন করেছিল। ভাগ্যিস তখন ফরিদ ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিল না। কিন্তু ছোটখাটো এমন অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যেগুলো হুট করেই বদলে ফেলা যায় না। এগুলো তার আজন্ম অভ্যাস। ফলে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে উঠে যাওয়াটাই মঙ্গল মনে করছে ফরিদ। আতাহার মলানার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে বাটি থেকে এক টুকরো মাছ তুলে নিল। তারপর বলল, খুই দ্বাদ হয়েছে চাচা।
মওলানা হাসি হাসি মুখে বললেন, বড় গাঙের আইড়। বউ মাকেও দেও। তোমাদের বয়সেই তো বেশি বেশি খাওয়া দরকার।
পারুর কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। যেন গলার মাঝখানে কিছু একটা আটকে আছে। সেখান দিয়ে কোনোভাবেই খাবারই নামছে না। তবে সে সেসব বলল না। বরং ভাতের থালা বাড়িয়ে মাছের টুকরোটা নিল। আতাহার মওলানা অতি উৎসাহী মানুষের মতো বললেন, সকালে ঠাণ্ডা বাসি তরকারি দিয়ে যখন খাবা, তখন বুঝবা আসল টেস্ট।
রফিকুল তার বাবার আচরণে খুবই অবাক হচ্ছে। তিনি সাধারণত এত কথা কখনো বলেন না। কিন্তু আজ তার এমন কী হয়েছে যে ফরিদের সঙ্গে এত কথা বলছেন? এত আদর-আপ্যায়ন করছেন? তবে নাজমা বেগম ঘটনা বুঝতে পেরেছেন। ভোর বেলা ওই ঠাণ্ডার মধ্যেও ফরিদ যেভাবে ঘুম থেকে উঠে তাঁর সঙ্গে মসজিদে গিয়েছিল, এতে তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছেন। সে কারণেই এমন ঝলমলে লাগছে তাকে। একই সঙ্গে হয়তো রফিকুলকেও একটা প্রচ্ছন্ন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
পারু খুব ধীরে-সুস্থে খাচ্ছে। তার একদমই খিদে নেই। কিন্তু এত এত আয়োজন আর টেবিলভর্তি মানুষ রেখে উঠেও যাওয়া যায় না। ফলে অন্যদের সঙ্গ দেয়ার জন্যই মূলত বসে আছে সে। তবে বিষয়টি নাজমা বেগমের দৃষ্টি এড়াল না। তিনি হঠাৎ রোকেয়াকে লক্ষ করে বললেন, বউমার মনে হয় মাছ তেমন পছন্দ না। এক কাজ কর, ওই গরুর মাংসটা দে তারে। কচি গরুর মাংস। মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গলে যায়। এত নরম…।
এই ভয়টাই এতক্ষণ করছিল ফরিদ। সে টেবিলে বসেই বাটিভর্তি মাংস দেখতে পেয়েছিল। ফলে পারু কিছু বোঝার আগেই বাটিটা আড়ালে সরিয়ে রেখেছিল সে। কিন্তু এখন? এখন কী করবে? পারু কেবল গ্লাস থেকে জল খাচ্ছিল। নাজমা বেগমের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সামান্য হেঁচকির মতো উঠল তার। খানিক জলও ছিটকে গেল। গ্লাসটা নামিয়ে রাখতে রাখতে হতভম্ব ভঙ্গিতে ফরিদের দিকে তাকাল সে। তার চোখে বিভ্রান্ত, বিচলিত দৃষ্টি। ফরিদও তার করণীয় কিছু বুঝতে পারল না।
রোকেয়ার হাতে একটা বাটি। সে সেই বাটিভর্তি মাংস নিয়ে পারুর দিকে এগিয়ে আসছে। পারু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এতটা বছরে এমন কিছু ভুলেও কখনো ভাবেনি সে। অথচ আজ এই মুহূর্তে সেই ঘটনাটিই কী না ঘটছে তার সঙ্গে! ফরিদ আচমকা বলল, রোকেয়া, পারু গরুর মাংস খায় না।
কেন?
একটু এলার্জির সমস্যা আছে। আমতা আমতা করে বলল ফরিদ।
একটু-আধটু খেলে কিছু হয় না। নাজমা বেগম বললেন। তোমাদের এই বয়সেই যদি এত বাছ-বিচার করে খাওয়া শুরু করো। তাহলে আমাদের বয়সে কী করবা?
ডাক্তারের নিষেধ আছে চাচি।
আরেহ, রাখো তোমার ডাক্তার। এবার কথা বলে উঠলেন আতাহার মওলানা। আজ তোমার চাচিজান রান্না করেছে। সে তো আজকাল আর রান্না-বান্না করতে পারে না। খেয়ে দেখো, এই স্বাদ জীবনেও ভুলতে পারবা না। বলে হাসলেন আতাহার মওলানা। একদিন খেলে কিছু হয় না।
রোকেয়া চামচে করে ঝোল-মাংস ঢেলে দিতে লাগল পারুর পাতে। ফরিদ তাকিয়ে রইল অসহায় চোখে। পারুর হাতে ভাত-তরকারির আঠালো উচ্ছিষ্ট লেগে আছে। প্লেটে পড়ে আছে মাখানো ভাত। সেই ভাতের ভেতর ঘন ঝোল সেঁধিয়ে যেতে লাগল। চেপে বসতে লাগল টুকরো মাংসগুলো। ঘ্রাণে যেন কেমন হয়ে উঠল চারপাশটা। পারু তা ধরতে পারল না। তবে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মনে হলো এরপর আর কখনো, কোনোদিনও সে কোনো খাবার মুখে তুলে খেতে পারবে না। তার চোখের সামনে দেয়ালে সাঁটা পোস্টারের মতো সারাজীবন এই ভাত, মাংস, ঝোলের ছবিটি সেঁটে থাকবে। এ থেকে আর কখনো মুক্তি মিলবে না তার। ঝাপসা চোখেই সে দেখল নাজমা বেগমকে। তিনি হাসি হাসি মুখে বলছেন, এটা সিলেটের বিখ্যাত সাতকরা দিয়া রান্ধা গরুর মাংস। এক টুকরা মুখে নিয়া দেখো…।
তিনি হয়তো আরো কিছু বললেন। কিন্তু সেসব পারুর কানে ঢুকল না। তার চারপাশের সবকিছুই কেমন অবাস্তব কল্পনার এক জগৎ বলে মনে হতে লাগল। যেন সে উঠে দাঁড়ালেই এই সব মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়। তারপর মূর্ত হয়ে উঠবে খুব স্বাভাবিক, চেনা অন্য কোনো দৃশ্য। যেখানে এই ভয়াল মুহূর্তের ছবিটা আর থাকবে না। তার অর্ধেক খাওয়া ভাতের প্লেট ভর্তি গরুর মাংসের তরকারি, এটা সে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কানে বাজছে নাজমা বেগম আর আতাহার মওলানার আদুরে দরাজ কণ্ঠ, খাও বউমা, খেয়ে দেখো। খাও…।
বাকি কথাগুলো যেন ক্রমশই মিলিয়ে যেতে লাগল দূরে কোথাও। সত্যি সত্যিই কি তাকে এখন এই প্লেটভর্তি গরুর মাংস খেতে হবে?
১৭
সকাল থেকে আব্দুল ওহাবের শরীরটা খারাপ। তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার গায়ে সামান্য জ্বর। মাথা ভার। চোখ টকটকে লাল। স্ত্রী নুরুন্নাহারকে ডেকে বললেন, ফরিদকে বলো দোকানে যেতে। আমি আজ আর বাজারে যেতে পারব বলে হয় না।
নুরুন্নাহার রান্নাঘরে কিছু করছিলেন। তিনি সেখান থেকেই জবাব দিলেন, ফরিদ তো মনে হয় ঘুম থেকে উঠেই বের হয়ে গেছে। ঘরে তো নাই।
এত সকালে কই গেছে সে? বাজার কী জমে না-কি এত ভোরে?
তা তো জানি না। কিছু খেয়েও যায় নাই।
বিষয়টিতে আব্দুল ওহাব খুবই বিরক্ত হলেন। আজকাল কোনো কিছুতেই মনোযোগ নেই এই ছেলের। কখন কী করে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তিনি উঠে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভোরের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া গা শিরশির করে উঠল। ফরিদের ঘরের দরজা খোলা। রান্নাঘরে সাইকেলটাও নেই। এত ভোরে সে গেল কোথায়? ইদানীং ফরিদকে নিয়ে কারণে-অকারণে চিন্তিত থাকেন তিনি। বিশেষ করে পারুদের বাড়িতে ঘটা সেই রাতের ঘটনার পর থেকে। তবে শেষ কিছুদিন ফরিদ একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। কোনোকিছুতেই যেন কিছু আসে যায় না তার। বিষয়টা নিয়ে আব্দুল ওহাব উদ্বিগ্ন। মা-মরা ছেলে ফরিদ। সেই এতটুকু বয়স থেকেই তাকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছেন তিনি। বিনিময়ে কখনো কোনো প্রাপ্তির আশা করেননি। তবে তার স্ত্রী নুরুন্নাহার চাইছেন ফরিদের সঙ্গে আছমার বিয়ে দিতে। এই চাওয়াটা অযৌক্তিকও নয়। আছমা তাদের একমাত্র সন্তান। ফরিদের সঙ্গে তার বিয়েটা হয়ে গেলে সব দিক থেকেই নিশ্চিত হতে পারবেন তারা। কিন্তু ফরিদ যে ভেতরে ভেতরে এত বড় একটা অলক্ষুণে কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছে তা কে জানত!
দুপুরের দিকে আছমা এসে হঠাৎ বলল, আব্বা, ঘটনা শুনছেন?
আব্দুল ওহাবের শরীর খানিক ভালো লাগছে। তিনি উঠানের এক কোণে আরামদায়ক রোদে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। তিনি ভাবলেশহীন গলায় বলল, কী ঘটনা?
পারুদিরা নাই।
নাই মানে? কই গেছে?
তাতো জানি না। সকাল থেকে তাদের বাড়ি খালি। বাড়িতে কেউ নাই।
আব্দুল ওহাব ঘুরে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, বাড়ি খালি মানে? কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গেছে?
আরিব্বা। ঘরের দরজা-জানালা সব খোলা। কিন্তু তারা কোথাও কেউ নাই।
ঘটনা শুনে চট করে কিছু বুঝতে পারলেন না আব্দুল ওহাব। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ফরিদ কি দোকান থেকে ফিরছে?
না আব্বা। ফরিদ ভাই তো এখনো ফেরে নাই।
অব্দুল ওহাব আর ভাত খেলেন না। তিনি ভাতের প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পড়লেন। তারপর পাঞ্জাবির ওপর চাদরটা পেঁচিয়ে নিতে নিতে বললেন, বাড়িতে একদম কেউ নাই?
না। তবে শুনছি ওই বাড়িতে নাকি অনেক মানুষ ভিড় করেছে। কিন্তু জাহাঙ্গীর চাচা কাউরেই বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না।
আব্দুল ওহাব আর কথা বললেন না। তিনি উদ্বিগ্ন মুখে বাড়ি থেকে বের হলেন। তাঁর মাথায় নানা দুশ্চিন্তা এসে ভর করতে লাগল। মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। সেখানে ছোটখাটো একটা জটলা। উত্সক গ্রামবাসী এসে ভিড় করেছে। তবে তাদের কাউকেই বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিচ্ছে না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার লোকজন। তখন শীতের স্লা বিকেল। চারদিকে একটা বিষণ্ণ, মন খারাপের সুর। গাছপালার ফাঁক-ফোকর গলে কিছু ফালি ফালি নিস্তেজ রোদ এসে পড়েছে উঠানে। সেখানে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বসা। তার চারপাশে আরো কিছু মানুষ। তাদের সামনে পুরনো আমলের একখানা টেবিল। টেবিলের ওপর রাজ্যের কাগজপত্র। ভূমি অফিসের দুজন লোকও দেখা যাচ্ছে। তবে এসব কিছুই আব্দুল ওহাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। তার দৃষ্টি কেড়ে নিল বাড়ির সামনে বড় করে টানানো একটা ঝকঝকে সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা–ক্রয় সূত্রে এই জমির মালিক জাহাঙ্গীর ভূইয়া।
নিচে জমির দাগ ও খতিয়ান নম্বর উল্লেখ করা আছে। আব্দুল ওহাব দীর্ঘ সময় চুপচাপ সেই সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার আচমকা মনে হলো, বড় ধরনের কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছেন তিনি।
.
আব্দুল ওহাব ধীর পায়ে হেঁটে ভুবনডাঙা বাজারে গেলেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার আড়ত বন্ধ। সেখানে লোকজন তেমন নেই। তবে বাজারের আর দোকানগুলো স্বাভাবিক। সেখানে লোকের ভিড়। তারা চা-বিড়ি খাচ্ছে। গল্প-গুজব করছে। তবে এসবের মধ্যেও একটা চাপা উত্তেজনা তিনি ঠিকই টের পেলেন। সবার মুখেই মহিতোষ মাস্টারের ঘটনা। তবে এই ঘটনা নিয়ে তারা কেউই যেন প্রকাশ্যে তাদের মনোভাব প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছে না। এমনকি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার এমন চটজলদি সব দখল করা নিয়েও না। তিনি তার নিজের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দোকান বন্ধ। বাইরে থেকে তালা মারা। তার মানে ফরিদ দোকানে নেই। বিষয়টা তিনি অনুমান করতে পারছিলেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ঘটনার এর পরের অংশ তিনি ঠিক অনুমান করতে পারছেন না। ফরিদ কি তবে আগে থেকেই জানত যে পারুরা চলে যাচ্ছে? কে জানিয়েছে তাকে? পারু?
যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এর পরের ঘটনা কী?
আব্দুল ওহাব আর দোকানে ঢুকলেন না। তিনি বাড়ির পথ ধরলেন। তার শরীরটা আবার খারাপ লাগতে শুরু করেছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে শীতের ক্ষণস্থায়ী বিকেল প্রায় মরে এলো। উঠানের এক পাশে হাঁস-মুরগিকে খাবার দিচ্ছিলেন নুরুন্নাহার। এখুনি সেগুলোকে খোপে ঢোকাতে হবে। আব্দুল ওহাবকে বাড়ি ঢুকতে দেখে তিনি বললেন, ফরিদ তো এখনো আসলো না। দোকানে সারাদিন কী এত কাজ তার? খাওন-দাওনের পর্যন্ত ঠিক নাই।
আব্দুল ওহাব জবাব দিলেন না। নুরুন্নাহার বললেন, আপনে যাওয়ার সময় তো বাটিতে করে তার জন্য একটু খাবারও নিয়া যেতে পারতেন। পারতেন না।
তাঁর গলায় উষ্মা। আব্দুল ওহাব বললেন, মহিতোষ মাস্টারের ঘটনা শুনছো?
নুরুন্নাহার মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, তার ঘটনা আমার শোনার দরকার নাই। যার যার জীবন তার তার। সে লোক ভালো। কিন্তু পোলাপানগুলা তো তার মতো করতে পারে নাই। তার বড় মেয়েটার চরিত্র তো ভালো না।
কেন? কী করেছে পারু? প্রমাদ গুনলেন আব্দুল ওহাব।
আপনার চোখ-কান থাকতেও আপনি অন্ধ। আমি তো আর অন্ধ না। ফরিদের সঙ্গে যে তার বড় মেয়ের একটা হাবভাব ছিল, সেটা আপনি জানেন না?
কী বলো তুমি? আব্দুল ওহাব অবাক হওয়ার ভান করলেন।
হুম। চিন্তা করেন মোসলমানের পোলা, আর হিন্দুর মাইয়া। এইটা কোনো কথা? আস্তাগফিরুল্লাহ। আমার ফরিদ সোনার টুকরা ছেলে। কিন্তু সে নিজে ডেকে নিয়ে তার মাথাটা খেতে চাইছিল।
কে?
কে আবার? মহিতোষ মাস্টার। না হলে ওইরম সোমত্ত দুটা মেয়ে ঘরে থাকতে কেউ এত বড় সেয়ানা পোেলা বাড়িতে নেয়? আমি তো আপনার জন্য কিছু বলতে পারি নাই। কথায় কথায় বলেন আমার মন ছোটো। আমি উল্টাপাল্টা চিন্তা করি। কিন্তু কাজটা কি সে ঠিক করছে? যদি কোনো অঘটন ঘটে যেত?
আব্দুল ওহাব জবাব দিলেন না। নুরুন্নাহার বললেন, কপাল ভালো যে রহিম ফকিরের কাছ থেকে তাবিজ আর পানি পড়া আনছিলাম। সেইটার কারণেই বড় কোনো বিপদ-আপদ হয় নাই। ফরিদও ভালোয় ভালোয় ফিরে আসছে। বালাই মসিবতও দূর হইছে। আপনারে আর এগুলা বলে লাভ কী? আপনার তো কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না! নিজের মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা কি একবারও ভাবছেন?
আব্দুল ওহাব নিজের ঘরে ঢুকে অন্ধকারে চুপচাপ বসে রইলেন। আর কিছুক্ষণ বাদেই নুরুন্নাহার বিচলিত হয়ে উঠবেন। রাতে ফরিদ বাড়ি না ফিরলে হাজারটা প্রশ্ন করবেন। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর আব্দুল ওহাবের কাছে নেই। এমনকি তিনি যা ভাবছেন তাও কাউকে বলতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় কথা তার ভাবনাটাও সম্পূর্ণ নয়। তিনি নিজেও এক অনিশ্চিত গোলকধাঁধায় বন্দি। ফরিদ যদি জানেও যে পারুরা চলে গেছে, তাতে তার কী-ই বা করার থাকবে? সে নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে, দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারবে না! তাহলে? কী করবে সে? নাকি অনর্থকই ভাবছেন তিনি? হয়তো আশপাশে কোথাও গিয়েছে ফরিদ। কোনো বন্ধুবান্ধবের বাড়ি। হয়তো রাত বাড়তেই সে ফিরে আসবে। কিংবা কাল সকালে। কিন্তু এভাবে না বলে তো কখনো কোথাও যায় না সে। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের মনে যে কু-ডাক ডাকছে, তাকে কী করে অস্বীকার করবেন আব্দুল ওহাব?
.
তাকে অবশ্য কিছুই করতে হলো না। সন্ধ্যার খানিক পরপরই তাঁর বাড়ির উঠানে লোকজনের সাড়া পাওয়া গেল। এছাহাক গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগল, ডাক্তার সাব। ও ডাক্তার সাব। বাড়ি আছেননি?
আব্দুল ওহাব ভারি অবাক হলেন। এছাহাক এ সময়ে তার বাড়িতে কেন? তিনি চাদরটা জড়িয়ে ঘর থেকে বের হলেন। উঠানে সাত-আটজনের একটা দল। এলোমেলো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই এছাহাক এগিয়ে এলো। বলল, ভূঁইয়া সাব আসছেন, একটু বসার বন্দোবস্ত করা লাগে যে! ।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে এতক্ষণ চোখে পড়েনি আব্দুল ওহাবের। পেছনের আতা গাছটার গোড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এছাহাকের কথা শেষ হতে না হতেই সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার মুখ থমথমে। তবে সেটি আড়াল করে হাসার চেষ্টা করলেন তিনি। বললেন, তা ডাক্তার সাবে আজ ফার্মেসিতে যান নাই?
আব্দুল ওহাব নিজে ঘর থেকে চেয়ার এনে তাকে বসতে দিলেন। নুরুন্নাহার একটা হারিকেন ঝুলিয়ে দিয়ে গেলেন বারান্দায়। সেই হারিকেনের আলোয় উঠানে একটা গা-ছমছমে ভৌতিক আবহ তৈরি হলো। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। হারিকেনের আবছা আলোয় সেই কুয়াশা যেন ধোয়ার মতো রহস্যময় মিহি আচ্ছাদনে মুড়ে দিতে লাগল চারপাশ। তবে সেসবের চেয়েও নুরুন্নাহারকে বেশি ভীত করে ফেলেছে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার এই অসময় আগমন। এর আগে কখনো তিনি এ বাড়িতে আসেননি। কিন্তু আজ হঠাৎ এভাবে দলবল নিয়ে আসার কারণ কী? বিষয়টি নিয়ে নুরুন্নাহার চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন বোধ করছেন।
আব্দুল ওহাব বললেন, না। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। জ্বর জ্বর লাগছে।
হুম। এবার যা ঠাণ্ডা পড়েছে। তাতে সুস্থ থাকাটা কঠিনই হয়ে যাচ্ছে। বললেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। সমস্যা হচ্ছে এই ঠাণ্ডা তত সহজে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তখন উপায় কী হবে?
কী আর হবে? অসুস্থতা তো আর চিরকালের না।
সেইটা না। ফার্মেসি আর কতদিন বন্ধ রাখবেন? লোকজনের তো ওষুধ-পথ্য দরকার হয়। তাই না?
হুম। তা হয়। একটু সুস্থ হলেই খুলে ফেলব। আব্দুল ওহাব এই মুহূর্তে দোকান খোলার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। ফরিদের কোনো একটা খোঁজখবর পাওয়া পর্যন্ত তিনি স্থির হতে পারবেন না।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, কিন্তু দেরি হলে তো সমস্যা। গতকাল বিকাল থেকেই বলতে গেলে ফার্মেসি বন্ধ। তারপর সন্ধ্যা, রাত। আজ সকাল, দুপুর, বিকাল। এমনকি এখনো। এলাকায় তো আর কোনো ওষুধের দোকানও নাই। এমন হলে চলবে? আপনার ভাইগ্না ফরিদ কই? তার একটা দায়-দায়িত্ব আছে না?
হুম। তাতো আছেই। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন আব্দুল ওহাব। এতক্ষণে সম্ভবত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার এ বাড়িতে আসার কারণ কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন তিনি। তবে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কথা শুনে নুরুন্নাহার রীতিমতো ভড়কে গেলেন। ফরিদ গতকাল থেকে এখন অবধি দোকানে যায়নি! তাহলে কোথায় গেছে সে? কী হয়েছে তার?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অবশেষে প্রশ্নটা করলেন, ফরিদ কই?
ছোট্ট এই প্রশ্নটির কী উত্তর দেবেন আব্দুল ওহাব? এছাহাক বলল, তারও কি জ্বর নাকি? ঘরে ঘুমায়?
নাহ।
তাহলে? কই সে?
বাড়িতে নাই।
বাড়িতে না থাকলে গেছে কই? কাল সন্ধ্যার পর থেকে আর বাজারেও যায় নাই সে। বলল এছাহাক।
তাতো জানি না। সে বলে যায় নাই।
কিন্তু সে যে বলে যায় নাই, কাল সন্ধ্যার পর থেকে যে তার কোনো খোঁজ খবর নাই, এই ঘটনা আপনি কাউরে জানাইছেন? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার গলা খসখসে, কঠিন। আপনাদের দেখে তো মনে হচ্ছে না যে আপনারা কেউ এই নিয়ে চিন্তিত। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। চারদিকে খুনাখুনি, চুরি-ডাকাতি। এর মধ্যে ওই বয়সী একটা ছেলের চব্বিশ ঘণ্টা কোনো খোঁজ নাই। বিষয়টা চিন্তার না?
জি, চিন্তার।
কিন্তু কই? আপনাদের দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আপনারা নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বেগ। যেন ফরিদ কই গেছে সেটা আপনারা জানেন না। আমরা জানি না। গত সন্ধ্যায় আগেই বাড়ি ফিরেছিল সে। তারপর আর খেয়াল করি নাই। শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল। আগেভাগেই ঘুমিয়ে গেছিলাম।
কিন্তু আজ সারাদিন যে তার কোনো খোঁজ নাই?
আব্দুল ওহাব এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানো নুরুন্নাহার ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছেন। তবে সেটি তিনি সবার সামনে প্রকাশ করলেন না। নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ঘটেছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ডাক্তার সাব, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কথা আছে। আশা করছি, কথাগুলো আপনি মন দিয়ে শুনবেন। এবং আমাকে সাহায্য করবেন। আমার মনে পড়ে না, আমি কখনো কোনোদিন আপনার কোনো ক্ষতি করেছি।
আব্দুল ওহাব ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বিগলিত হাসলেন, না না। কী যে বলেন না ভূঁইয়া সাব। ক্ষতি কেন করবেন?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হাতের ইশারায় তার সঙ্গে থাকা লোকগুলোকে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। তারপর আব্দুল ওহাবের আরো কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে গলা নিচু করে বললেন, মহিতোষ মাস্টারের ঘটনা কী?
কী ঘটনা?
সেটাই তো আমি জানতে চাইছি। তার ঘটনা কী? সে এভাবে রাতের অন্ধকারে কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে গেল কেন?
সেটা আমি কী করে বলব ভূঁইয়া সাব? আমি তো এসবের কিছুই জানি না।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, শুধু শুধু ঝামেলা করবেন না ডাক্তার সাব। আপনার সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নাই। কিন্তু আপনি যদি জোর করে শত্রুতা করতে চান, তাহলে আমার কিন্তু কিছু করার থাকবে না।
তার কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন হুমকি। কিন্তু আব্দুল ওহাব কী করবেন? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, উনি যে এভাবে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাবেন, এর সবই তো আপনি জানতেন। জানতেন না?।
আমি? আমি কী করে জানব? আব্দুল ওহাবের কণ্ঠে যুগপৎ বিস্ময় ও হতাশা।
জানেন, জানেন। শুধু জানেনই না, এই যাওয়ার ব্যবস্থাও আপনিই করে দিয়েছেন। আমার কাছে সব তথ্য আছে।
কী বলছেন এসব? আব্দুল ওহাব রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। আমি এর কিছুই জানি না। আজ বিকেলের আগে আগে আছমা আমাকে খবরটা দিল।
আপনি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মুখের হাসি ম্লান হলো না। তিনি ওই শ্লেষাত্মক হাসিটুকু ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখেই বললেন, আমারে আপনার বোকা মনে হয় ডাক্তার সাব?
না না। বোকা কেন মনে হবে?
তাহলে?
তাহলে কী?
তাহলে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন কেন?
আব্দুল ওহাব সত্যি সত্যিই অসহায় বোধ করছেন। তিনি প্রায় নিরুপায় ভঙ্গিতে বললেন, আমি কীভাবে আপনাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলাম? আর এতে আমার লাভই বা কী?
লাভ কী, সেটি এখনো বুঝতে পারছি না। তবে আপনি যে আমারে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন, সেটা আমি প্রমাণ করে দিতে পারব। আপনি প্রমাণ চান?
আব্দুল ওহাব কথা বললেন না। তবে হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, গত বেশ কিছুদিন ধরে মহিতোষ মাস্টারের বাড়িতে আপনার ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। এই কথা সত্য?
ঠিক ঘন ঘন না। তবে হ্যাঁ, ওনার শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছিল। এইজন্য কয়েকবার যেতে হয়েছে।
কথা ঠিক না ডাক্তার সাব। মহিতোষ মাস্টারের তেমন গুরুতর কোনো অসুস্থতা থাকলে সেটা গ্রামের সবারই জানার কথা। কথা না?
হুম।
কিন্তু কই? তার সেরকম কোনো অসুস্থতার কথা কিন্তু কেউ জানে না। মানে একমাত্র আপনি ছাড়া। তা ছাড়া তার সঙ্গে আমার নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হতো। কখনো তো তারে অসুস্থ লাগে নাই। সেও তো বলে নাই।
বিষয়টা আসলে সেরকম…। আব্দুল ওহাব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। বললেন, তার বড় মেয়েরেও আপনার বাড়িতে আসতে দেখা গেছে। শুধু তাই না, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ কেউ বলতেছে, রাত-বিরাতেও না-কি আপনাদের ওই বাড়িতে যাতায়াত ছিল? মামা-ভাইগ্না দুজনেরই? এগুলা কেমন কথা ডাক্তার সাব? তার ঘরে জোয়ান মেয়ে ছেলে আছে। আছে না?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কথা শুনে কান গরম হয়ে এলো আব্দুল ওহাবের। তিনি বললেন, ভূঁইয়া সাব, বিষয়টা অন্যদিকে যাচ্ছে। একরাতে উনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তো তখন ফরিদরে আমি নিজেই বলেছিলাম, তার বাড়ির বাইরের ঘরে বসে থাকতে। যাতে কোনো দরকার লাগলেও বিষয়টা দেখতে পারে।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এবার শব্দ করেই হাসলেন। বললেন, কেন? দুনিয়ায় আর কোনো মানুষ ছিল না? তার বাড়ির আশপাশে কেউ নাই? দুই-চার ঘর হিন্দু বাড়িও তো আছে। আছে না? তা সেই সব বাদ দিয়া এই এতদূর আপনার বাড়ি থেকে কেন তারে সাহায্য করতে যেতে হলো? তাও আবার মামা-ভাইগ্না দুজনরেই? একজনের আবার সারা রাত থাকতে হলো। না-কি দুজনই ছিলেন? বলে অশ্লীল ভঙ্গিতে চোখ নাচালেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। নানা বয়সের মেয়ে-ছেলেই তো ছিল। সেইখানে। নাকি
এবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন আব্দুল ওহাব। তিনি শক্ত গলায় বললেন, এবার একটু অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে ভূঁইয়া সাব। কে কোথায় গেছে, সেজন্য আপনি আমার বাড়িতে এসে, আমার সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলতে পারেন না!
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যেমন বসে ছিলেন, তেমন বসেই রইলেন। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তবে তার ঠোঁটে সেই মৃদু হাসিটুকু এখনো লেগে আছে। তিনি শান্ত। কণ্ঠে বললেন, উত্তেজনা ভালো না ডাক্তার। শরীরের জন্য খারাপ। এই কথা তো আমার চেয়ে আপনারই ভালো জানার কথা। বলে একটু থামলেন তিনি। তারপর শীতল কণ্ঠে বললেন, কাল সন্ধ্যা থেকে ফরিদ নাই। তারে সন্ধ্যার পর সাইকেল কাঁধে করে রেললাইন পার হতে দেখা গেছে। আর কাল রাতেই মহিতোষ মাস্টারও পগার পাড়। ফরিদেরও কোনো খোঁজ নাই। বিষয়টা কি চোখে লাগার মতো না ডাক্তার?
আব্দুল ওহাব এই কথায় থমকে গেলেন। ফরিদ সাইকেল কাঁধে করে রেললাইন পার হয়েছে? বিষয়টা অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। কী এমন কারণ ছিল যে তাকে ওভাবে কোথাও যেতে হয়েছে!
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, শোনেন ডাক্তার। ফরিদ বা আপনি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। এমনকি মহিতোষ মাস্টার বা তার মেয়েরাও না। এদের কারো নিয়েই আমার কোনো আগ্রহ নাই। আমার আগ্রহ তার বাড়ি নিয়া। মহিতোষ মাস্টার ঠিক কী কারণে কাউকে কিছু না জানিয়ে ওভাবে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়ে গেল? সে তার জমি-জমার কোনো বন্দোবস্ত না করে যায় নাই। এতটা বোকা সে না। কিন্তু আমার জানা প্রয়োজন, সেই ব্যবস্থাটা আসলে কী?
খানিক থেমে তিনি বললেন, আমার বিশ্বাস, এই ঘটনা আপনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।
এতক্ষণে আসল ঘটনা বুঝতে পারলেন আব্দুল ওহাব। তিনি ফ্যালফ্যালে চোখে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ডাক্তার সাব, ওই জমি আর বাড়ির জন্য এমন কোনো কাজ নাই, যা আমি করতে পারব না। কথাটা আপনার জানা দরকার। মহিতোষ মাস্টার আমার সঙ্গে একটা খেলা। খেলেছে। সেই খেলায় সে আমারে বোকা বানিয়ে গেছে। আমি তার চাল ধরতে। পারি নাই। কিন্তু সে আসলে কী করেছে? সে আসলে সাপের লেজে পাড়া দিয়া দূরে সরে গেছে। কিন্তু সাপ এখন কী করবে বলেন?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মুখ থেকে মৃদু সেই হাসির রেখা মুছে গেছে। সেখানে ফুটে উঠেছে নিষ্ঠুর, ক্রূর এক মানুষের মুখ। তার চোখে মুখে তীব্র জিঘাংসা। তিনি হিসহিসে কণ্ঠে বললেন, সাপের থলি ভর্তি বিষ। সে কিন্তু এখন আশপাশে যারে পাবে, তারেই ছোবল মারবে। আপনি কিন্তু এখন আমার সবচেয়ে কাছে। কথাটা ভুলে যেয়েন না।
১৮
পারুর চুল ভেজা। তীব্র এই ঠাণ্ডার মধ্যেও তার মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। খাবার টেবিলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সে। রোকেয়া যখন ঝোল-তরকারিসুদ্ধ গরুর মাংসগুলো তার পাতে ঢেলে দিল, ঠিক তখনই শরীরজুড়ে তীব্র এক অস্বস্তি অনুভব করতে লাগল সে। মনে হলো এই এতক্ষণে যা যা খেয়েছে, তার সবই যেন উগড়ে ফেলবে। যে পারিবারিক পরিমণ্ডলে পারু বেড়ে উঠেছে, সেখানে এমন ভয়ংকর ঘটনা দুঃস্বপ্নেও ভাবা অসম্ভব ছিল। স্তম্ভিত পারু তাই ভাতের প্লেটটা সামনে নিয়ে নিথর বসে রইল। নাজমা বেগম ও আতাহার মওলানা তাকে সমস্বরে অনুরোধ করে যাচ্ছিলেন প্লেটের মাংসগুলো অন্তত একবারের জন্য হলেও চেখে দেখতে। তাঁদের এই অনুরোধ মুহূর্তের জন্যও থামছিল না। কথা বলছিল ফরিদও। তবে সে নানাভাবে দিলারাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছিল। পারু এসবের কিছুই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল না। কিংবা কী শুনছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিল না। কেবল কতগুলো একঘেয়ে পুনরাবৃত্তিমূলক বিকৃত শব্দ যেন সমস্বরে তার কানে অবিরাম বেজে যেতে লাগল। সেই শব্দগুলোর একটাকেও সে অন্যটা থেকে আলাদা করতে পারছিল না। নিজেকে তার একটুকরো বোধহীন জড় পদার্থ বলে মনে হচ্ছিল।
বিষয়টা খেয়াল করল দিলারা। সে হঠাৎ উঠে এসে পারুর সামনে দাঁড়াল। তারপর বলল, শরীর খারাপ লাগছে পারু?
পারুর মনে হলো এই একটি মাত্র শব্দই কেবল সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। এ ছাড়া এতক্ষণ আর যত কথা হয়েছে তার সবই যেন বিভৎস ছুরির ফলার মতো তার কানের ভেতরটা ফালিফালি করে চিরে দিয়েছে। সে আলতো করে দিলারার হাত ধরল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, মাথাটা হঠাৎ কেমন করে উঠল। আমি একটু বাথরুমে যাব বৌদি… মাথায় জল ঢালব।
শব্দগুলো খট করে কানে লাগল ফরিদের। সে আড়চোখে একবার চারদিকে দিকে তাকাল। তবে বিষয়টা কেউ খেয়াল করেছে বলে মনে হলো না। সকলেই পারুর অবস্থা নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। হঠাৎ কী হলো মেয়েটার।
বাথরুমে নিয়ে গিয়ে তার মাথায় পানি ঢালল দিলারা। তারপর হাত-মুখ মুছিয়ে ঘরে নিয়ে এলো। ফরিদকে বলল, রাতে বেশি যন্ত্রণা করো না। বেচারির শরীরটা ভালো না।
দিলারা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসল। ফরিদ অবশ্য কথা বলল না। সে চুপচাপ খাটের এক প্রান্তে বসে রইল। আজ প্রথমবারের মতো পারুর সঙ্গে তাকে একই ঘরে একই বিছানায় থাকতে হবে। বিষয়টাতে খানিক অস্বস্তি হলেও সে মেনে নিয়েছে। কিন্তু পার কি মেনে নেবে? সে কি পরিস্থিতি বুঝতে পারছে
দিলারা চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে দিল ফরিদ। পারু যেন এতক্ষণে ঘটনা বুঝতে পারল। সে বলল, দরজা বন্ধ করলেন কেন?
দরজা বন্ধ করব না?
কেন?
ফরিদ পারুর প্রশ্ন বুঝতে পারল না। কিংবা বুঝলেও এই প্রশ্নের উত্তর কী হবে তা ধরতে পারল না। সে বলল, আজ রাতে আমাকে তোমার সঙ্গে থাকতে হবে।
মানে? চমকে ওঠা গলায় বলল পারু।
মানে তোমাকে-আমাকে এখন থেকে এক ঘরে থাকতে হবে।
কী বলছেন আপনি! আপনার মাথা ঠিক আছে? পারু আঁতকে ওঠা গলায় বলল।
আমার মাথা ঠিকই আছে পারু। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপরই তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কিছুটা কঠিন গলায়ই কথাগুলো বলল ফরিদ। খানিক আগে খাবার টেবিলে আবারও অসতর্ক হয়ে গিয়েছিল পারু। এলোমেলো নানা কথা বলেছে সে। বিষয়গুলো নিয়ে খুবই শঙ্কিত ফরিদ। সে এখন আর বুঝতে পারছে না, ঠিক কখন কোন বিষয়টি কী বিপদ ডেকে আনতে পারে!
তবে ফরিদকে হঠাৎ এমন রুষ্ট গলায় কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে গেল পারু। তার প্রায় কান্না পেয়ে গেল। তবে কাঁদল না সে। জীবনটা তার কাছে ক্রমশই ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। এর থেকে যেন আর কখনোই মুক্তি নেই তার। সে স্বেচ্ছায় এই জীবন বেছে নিয়েছে। তবে সামনের অনাগত দিনগুলোর কথা ভেবে আতঙ্কে প্রায় আড়ষ্ট হয়ে রইল সে। পারু সত্যি সত্যিই জানে না, সামনে ঠিক কী অপেক্ষা করছে তার জন্য? কিংবা সে ভাবতেও পারছে না। সারাক্ষণ প্রবল এক অশনিসংকেত এক অজানা আতঙ্ক ক্ষণে ক্ষণে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরছে।
পারুর মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারল ফরিদ। এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোটা ঠিক হয়নি তার। পারুর আরো সময় দরকার। সে একটা ভয়ানক মানসিক দশার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই দশা প্রতি মুহূর্তেই আরো প্রলম্বিত হচ্ছে। একের পর এক বিষাক্ত তীর ছুটে আসছে তার দিকে। ফরিদকে বরং এ সময়ে শান্ত থেকে তাকে আগলে রাখতে হবে। পরিস্থিতি অনুধাবনের সময় দিতে হবে। কিন্তু সে কি তা পারছে না কি অল্পতেই অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে?
ফরিদ ধীরে গিয়ে পারুর সামনে বসল। তারপর নরম গলায় বলল, এখানে তো আমরা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে আছি। তাই না?
পারু জবাব দিল না। ফরিদ বলল, এখন নতুন বিবাহিত দম্পতি কি কোথাও গিয়ে আলাদা ঘরে থাকে?
পারু যে বিষয়টা বোঝে না তা নয়। কিন্তু তারপরও কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছে না সে। ফরিদ বলল, এ নিয়ে এ বাড়িতে কথা উঠবে। সন্দেহ করবে। আর এই মুহূর্তে যদি এই আশ্ৰয়টা আমাদের হারাতে হয়, তাহলে কী হবে একবার ভেবে দেখেছো?
পারু এবারও চুপ করে রইল। ফরিদ বলল, একটা কথা বলি?
জবাব না দিলেও পারু এবার মুখ তুলে তাকাল। ফরিদ বলল, আমাকে তোমার ভয় হয়?
এই প্রশ্নের কী জবাব দেবে পারু? সে জবাব দিলোও না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। ফরিদ বলল, বলো। আমাকে তোমার ভয় হয়?
হ্যাঁ, হয়। পারু মৃদু কণ্ঠে বলল।
হয়! অবাক হলো ফরিদ।
হুম।
কেন?
আপনি যখন ওভাবে রেগে রেগে কথা বলেন, তখন খুব ভয় হয়।
পারুর ওইটুকু কথায় কী ছিল কে জানে! ফরিদের বুকের ভেতর হঠাই যেন রক্ত ছলকে উঠল। সে আলতো করে পারুর গালে হাত রাখল। তার সেই স্পর্শে পারু কি খানিক কেঁপে উঠল? সে কি সত্যি সত্যিই তাকে ভয় পাচ্ছে। বিশ্বাস করতে পারছে না? ফরিদ গুটিয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে বলল, সরি।
পার কথা বলল না। ফরিদ বলল, তুমি আমায় ভয় পেয়ো না। তুমি আমায় ভয় পেলে আমার খুব কষ্ট হবে।
পারু বলল, কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাতে পারব না।
এক বিছানায় ঘুমাতে পারবে না?
না।
তাহলে?
তাহলে কী?
বাকি জীবন আমরা আলাদা বিছানায় ঘুমাব?
পারু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। ফরিদের সঙ্গে সে পালিয়ে এসেছে এ কথা সত্য। ফরিদকে সে ভালোবাসে তাও সত্য। কিন্তু এর পরিণতিতে যে তাদের সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে হবে, এক বিছানায় ঘুমাতে হবে, এই বিষয়গুলো যেন তার ভাবনাতেই ছিল না। তাহলে কী ভেবেছিল সে? এই প্রশ্নের জবাবও পারুর কাছে নেই। আজকাল তার প্রায়ই মনে হয়, এই পুরো বিষয়টাই একটা ঘরের মধ্যে ঘটে গেছে। ফরিদের জন্য তার মন খারাপ লাগত। সারাক্ষণ একটা কষ্ট কষ্ট অনুভব হতো। তাকে একটু দেখার জন্য বুকের ভেতর কেমন হাঁসফাস লাগত। এমনকি ফরিদকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসত তার। ফলে সে যেকোনোভাবেই হোক ফরিদের সঙ্গে থাকতে চাইছিল। কিন্তু তার পরিণতি যে একটা গোটা জীবন, এ যেন সে ঠিকঠাক বুঝতেই পারেনি। কিংবা ওই সান্নিধ্যটুকুর প্রার্থনায় আর সব ভাবনাই যেন আড়ালে অদৃশ্য হয়েই রয়ে গিয়েছিল। তাকে কখনো স্পষ্ট করে দেখতে পায়নি সে। কিংবা দেখার কথা ভাবনায়ও আসেনি।
আজ এই বন্ধ ঘরের আবছা অন্ধকারে সেই ভাবনাগুলো স্পষ্ট ছবির মতো একে একে সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। ফরিদ বলল, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি তোমার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাব না।
পারু মুখ তুলে তাকাল। ফরিদ বলল, তোমার শরীর খারাপ লাগছে। তুমি শুয়ে পড়ো। আমি জেগে থাকছি।
আমার ঘুম পাচ্ছে না। বলল পারু। সারাক্ষণ কেমন ভয় ভয় লাগে। মনে হয় এই বুঝি কেউ কিছু জেনে ফেলল। বুঝে ফেলল। তখন কী হবে?
খুব খারাপ হবে। আর এজন্যই যতটা সম্ভব সাবধান থাকতে হবে আমাদের। তুমি দিলারা ভাবি বা অন্যদের সঙ্গে বেশি কথা বলো না। আর এখন থেকে আমরা যত বেশি সম্ভব একসঙ্গে থাকব। বুঝেছো?
পার মাথা নাড়ল। তার মাথায় সারাক্ষণ অসংখ্য চিন্তা উঁকি দিতে থাকে। এলোমেলো, অগোছালো সব ভাবনা। সেখানে মা, বাবা, চারু, ঠাকুমা থাকে সবচেয়ে বেশি। এই জীবনে আর কখনো তাদের দেখা পাবে না সে?
ফরিদ একটা কম্বল নিয়ে নিচে নেমে গেল। পারু আড়চোখে একবার দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। সে এ কদিনে একটা অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করেছে, ফরিদের জন্য যে প্রবল টান সে এতদিন অনুভব করত, সেই টানটা যেন এই মাত্র দু-তিন দিনেই নেই হয়ে গেছে। বরং মাঝে মাঝে এখন ফরিদকে তার বিরক্ত লাগে। মনে হয়, তার কারণেই এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্তটি তাকে নিতে হয়েছে। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ–নিজের পরিবারটিকে হারাতে হয়েছে। ওই যে মা তাকে যেমন ভালোবাসত, কিংবা বাবা, কিংবা চার, ঠাকুরমা, এমন করে কি কেউ আর কখনো তাকে ভালোবাসতে পারবে? পারুর ধারণা, পারবে না। কিংবা পারলেও সে আর কখনোই তা সেভাবে অনুভব করতে পারবে না। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের ভালোবাসার ধরন এবং অনুভব আলাদা। ফলে একজনের ভালোবাসা কখনো অন্যজনের ভালোবাসার পরিপূরক হতে পারে না। একজন মানুষও কখনো অন্য মানুষের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে না।
পারু কি তবে তার এতদিনকার ওই অভ্যস্ত ভালোবাসাটুকু হারিয়ে ফেলার কারণেই এমন বিচলিত? এ কারণেই কি তবে ফরিদের এমন তীব্র ভালোবাসাও তাকে স্পর্শ করতে পারছে না? পারুর আচমকা মনে হলো, জগতে সবচেয়ে তীব্র কষ্ট হলো প্রিয়তম মানুষের ভালোবাসা হারানোর কষ্ট। এই কষ্টের তুল্য কিছু নেই। সে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর ভালোবাসা চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে। এই যন্ত্রণা তাকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছে। তার আর সব অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। ফলে ফরিদের প্রতিও কোনো মায়া অনুভব করছে না সে। কিংবা করলেও তা ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে। রং বদলে বিভ্রান্ত, দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ফরিদ বাইরের ঘরের সোফা থেকে দু খানা মোটা গদি এনে মেঝেতে বিছিয়ে নিল। তার ভাগ্য প্রসন্ন যে এ ঘরে অতিরিক্ত একখানা কম্বলও আছে। সে সেই কম্বলখানা গায়ে চাপিয়ে শুয়ে পড়ল। তবে রাত বাড়তেই ঠাণ্ডা মেঝে থেকে যেন হাড় কাঁপানো হিম উঠে আসতে লাগল। সেই হিম প্রায় অবশ করে দিতে লাগল তাকে। ফরিদ কয়েকবার ভেবেছিল পারু হয়তো তাকে ডাকবে। হয়তো বলবে তার পাশে গিয়ে শুতে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। বরং খানিক বাদে তাকে চুপচাপ উঠে বসতে হলো। এই ঠাণ্ডায় কোনোভাবেই মেঝেতে ঘুমানো সম্ভব না। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইল। বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে পারু। তার মুখজুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি। অসুস্থ, জরাজীর্ণ লাগছে তাকে। মাত্র কদিনেই ভেতরে-বাইরে কেমন অন্য মানুষ হয়ে গেছে সে। আগের সেই মানুষটা যেন আর নেই। বিষয়টা টের পায় ফরিদ। তবে এ নিয়ে তার আর কোনো অভিযোগ অনুযোগ নেই। বরং সে চায়, পারুর ভেতর ক্রমশই চাপা পড়ে যেতে থাকা সেই আগের মানুষটাকে তুলে আনতে। যে তাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। তার সামান্য অনুপস্থিতিতেও অস্থির হয়ে পড়বে। হয়তো আজ, না হয় কাল, কিংবা পরশু। ওই মানুষটাকে সে ফিরিয়ে আনবেই। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত পারু যে কখন গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে, তা হয়তো সে নিজেই টের পায়নি। হারিকেনের আবছা আলোয়। পারুর ঘুমন্ত ওই মুখখানা দেখে ফরিদের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন করে উঠল।
.
পরের কয়েকটা দিন মোটামুটি ভালোই গেল। ফরিদ চেষ্টা করল সারাক্ষণ পারুর সঙ্গে সঙ্গে থাকতে। এতে অবশ্য একটা লাভও হয়েছে। নতুন করে নিজ থেকে আর কোনো ঝামেলা করেনি পারু। বরং কিছু কিছু বিষয় রপ্ত করে ফেলেছে সে। তবে এর মধ্যেও বড়সড় একটা বিপদ ঘটতে যাচ্ছিল। সেদিন বিকেলে নাজমা বেগম হঠাৎ পাকে ডেকে বললেন, বউমা, আর যা-ই করো, নামাজ-রোজাটা কিন্তু ছাড়া যাবে না। এই দুইটা জিনিস কিন্তু করতেই হবে।
পারু কী বলবে ভেবে পেল না। সে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নাজমা বেগম বললেন, তোমার চাচাজান এই একটা জিনিস ছাড়া আর সবকিছুতেই উদার। কিন্তু এই জিনিসটা কারো মধ্যে না থাকলে তারে সে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। দেখো না এই নিয়ে সারাক্ষণ সবার সঙ্গে কেমন করে? সে কিন্তু তোমারে খুব স্নেহ করে।
জি। পারু মৃদু কণ্ঠে বলল।
যাও মা, রোকেয়া তোমারে ওজুর পানি দিতেছে। ওর সঙ্গে ওজু করে নামাজটা পড়ে নাও। ওই যে ওই ঘরে জায়নামাজ আছে।
পারু কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে এখন সে? সে তো ওজু কিংবা নামাজ, কোনোটিরই কোনো নিয়ম-কানুন জানে না। এখন রোকেয়ার সঙ্গে যদি সে যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে বিষয়টা ধরা পড়ে যাবে। তারপর কী হবে?
প্রবল আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসতে লাগল তার। ফরিদকেও আশপাশে। কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রোকেয়া বলল, ভাবি, আসেন। আপনার ওজুর পানি দেওয়া হয়েছে। পানি ঠাণ্ডা বলে মা বললেন গরম করে দিতে। গরম পানিই দেওয়া হয়েছে।
কী বলবে কিছুই ঠিক করতে পারছে না পারু। তবে এরমধ্যেই ফরিদকে দেখতে পেল সে। সম্ভবত মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ফিরছে। পারু তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে ঘটনা খুলে বলল। শুনে চিন্তায় পড়ে গেল ফরিদও। আগের বিষয়গুলো থেকে কোনো মতে রক্ষা পাওয়া গেলেও এবার আর সে সুযোগ নেই। নামাজের ক্ষেত্রে কোনো অজুহাতই খাটে না।
তবে এই অজুহাতের বিষয়টা ভাবনায় আসতেই একটা বুদ্ধিও হঠাৎ উঁকি দিয়ে গেল মাথায়। পারুতো চাইলেই একটা অজুহাত দেখাতে পারে। তাহলে অন্তত বেশ কয়েকদিনের জন্য তাকে নামাজ পড়তে হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওই অজুহাতের বিষয়টা সে পারুকে বোঝাবে কী করে?
পারু বলল, কী হলো, কথা বলছেন না কেন? এখন কী করব আমি?
ফরিদ খানিক চুপ করে থেকে বলল, একটা কাজ করা যায়।
কী কাজ?
তুমি একটা কারণ দেখাতে পারো।
কী কারণ? মানে… ধর্মে এ বিষয়ে একটা নিয়ম আছে।
কী নিয়ম?
মানে…। বলে থামল ফরিদ। সে জানে, ঋতুকালীন অবস্থায় মেয়েদের নামাজ পড়া নিষেধ। কিন্তু বিষয়টি পারুকে সে কী করে বলবে? অনেক ভেবেও কোনো উপায় বের করতে পারল না।
পারু বলল, রোকেয়া এখুনি আবার চলে আসবে। তার আগেই আপনি আমাকে বলেন। না হলে খুব বড় বিপদ হয়ে যাবে।
ফরিদ বেশ খানিক্ষণ আমতা আমতা করে অবশেষে বলল, মানে… শারীরিক বিশেষ অবস্থার কারণে মেয়েদের জন্য মাসের নির্দিষ্ট একটা সময় নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তুমি ওই কারণটিই রোকেয়াকে বলতে পারো।
কোন কারণ? আপনিতো সেটা স্পষ্ট করে…? হড়বড় করে কথাগুলো বলতে গিয়ে আচমকাই থমকে গেল পারু। যেন এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পেরেছে সে। মেয়েদের জন্য এই নিয়মটি সম্ভবত সকল ধর্মেই আছে। মাও তাকে ওই সময়টিতে পূজা-অর্চনা করতে নিষেধ করতেন। কিন্তু ফরিদ সেই বিষয়টিই তাকে ইঙ্গিত করেছে! এভাবে সরাসরি তার সামনে দাঁড়িয়ে? বিষয়টা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না পারু। ঘটনাটি পুরোপুরি বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র এক লজ্জা তাকে ঘিরে ধরল। প্রবল সংকোচ আর অস্বস্তি ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে দিল তাকে। ফরিদের সামনে আর একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না সে।
.
সেই রাতে ফরিদের সঙ্গে একটি কথাও বলল না পারু। ঘরে ঢুকে একা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইল। শেষ কয়েকদিন নিজের জন্য মেঝেতেই আগের চেয়ে সুবিধাজনক একটা শোয়ার জায়গার ব্যবস্থা করেছে ফরিদ। সে সেখানে শুয়ে কয়েকবার পারুকে ডাকল। তবে পার তাতে সাড়া দিল না। বিকেলের ঘটনায় প্রচণ্ড আড়ষ্ট হয়ে আছে সে। ফরিদ অবশ্য এতে খুব একটা বিচলিত হলো না। বরং সে জানে, আজকের এই ঘটনাটি না হলে তাদের দুজনকেই আরো বড় কোনো বিপদে পড়তে হতো। পারু তার সামনে ওভাবে লজ্জায়, অস্বস্তিতে সংকুচিত হয়ে গেলেও শেষ অবধি রোকেয়াকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলেছে। ফলে পরিস্থিতি এখন সবদিক থেকেই স্বাভাবিক। সমস্যা হচ্ছে কতদিন এখানে থাকবে তারা? এরপর কোথায় যাবে? এই বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই ফরিদের। সে নানা কিছু ভাবছে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এভাবে হুট করে কিছু হয় না। রফিকুল অবশ্য বলেছে, তারা চাইলে আরো বেশ কিছুদিন এ বাড়িতে থাকতে পারে। বাবা ফরিদকে খুব পছন্দ করেছেন। শুনে ফরিদ খুবই আশ্বস্ত বোধ করেছে। তবে তার সেই স্বস্তি বেশিদিন টিকল না। সেদিন দিলারা। এসে হঠাৎ ফরিদকে ডাকল। তারপর আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, তোমাকে একটা কথা বলি ফরিদ?
কী কথা?
বড়সড় কোনো বিপদ হওয়ার আগেই তোমাদের কোনো একটা ব্যবস্থা করা উচিত।
ফরিদের বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধক করে উঠল। সে বলল, কেন ভাবি কী হয়েছে? কী বিপদ?
কী হয়েছে, কী বিপদ সেটা তুমি ভালো করেই জানো।
আমি সত্যিই জানি না ভাবি। আপনি বলেন।
দিলারা এবার শক্ত হলো। সে বলল, তুমি সবাইকে যত বোকা ভাবো, তত বোকা কিন্তু সবাই না। তোমাদের বিষয়টা নিয়ে বাড়িতে কানাঘুষা চলছে।
কী কানাঘুষা?
তোমার আর পারুর বিষয় নিয়ে। কাল রোকেয়া হঠাৎ আমাকে বলল, ভাবি তোমার কি মনে হয় না ফরিদ ভাই আর তার বউর মধ্যে কোনো একটা ঝামেলা আছে।
তারপর? রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় জানতে চাইল ফরিদ।
আমি বললাম কী ঝামেলা? সে বলল, তা জানি না। তবে একটা অস্বাভাবিকতা। পারু ভাবি ঠিক আমাদের মতো না। আলাদা। আমি বললাম কেন? সে বলল, সে মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা অনেক কথা বলে। সেদিন ভাত খেতে বসে তোমাকে হঠাৎ বৌদি বলে ডাকল। তারপর পানি চাইতে গিয়ে জল চাইল । তাছাড়া তার অনেক আচার-আচরণও অন্যরকম।
ফরিদ প্রায় দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। দিলারা বলল, তুমি অনেকবার বলি বলি করেও তোমাদের ঘটনার কিছুই এখন পর্যন্ত আমাকে খুলে বলোনি। সেটাও সমস্যা না। সব মানুষের জীবনেই গোপন কিছু না কিছু থাকে। সেগুলোর সবই যে অন্যকে খুলে বলতে হবে তাও না। কিন্তু জীবনে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার মতো কিছু মানুষও থাকতে হয়। সেই মানুষগুলোকে অবিশ্বাস করলে বিপদ।
ফরিদ কথা বলল না। চুপ করে দিলারার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। দিলারা বলল, বিষয়টা শাশুড়ি আম্মাও খেয়াল করেছেন। পারুর কথাবার্তায় হুটহাট এটা ওটা চলে আসে। সেদিন রাতের মাংসের ব্যাপারটাও। এজন্যই উনি পারুকে নামাজের জন্য ওভাবে জোর করেছিলেন। ইচ্ছে করেই। উনি আসলে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন, পারু কী করে!
ফরিদ মরিয়া হয়ে বলল, আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ভাবি।
এবার শক্ত হলো দিলারা। সে কঠিন গলায় বলল, আমি বুদ্ধিমতী মেয়ে ফরিদ। আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করো না। আর এত কাঁচা অভিনয় দিয়ে এতবড় সত্য লুকানো যায়? বিষয়টা প্রথম দিনেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তোমাদের অবস্থা দেখে তখন আর অন্য কিছু ভাবতে যাইনি। কিন্তু এখন বিষয়টা গুরুতর হয়ে গেছে। তুমি আমার শ্বশুরকে চেনো না। উনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত একগুয়ে। বদমেজাজিও। যদি কোনোভাবে এই ঘটনা উনি জানতে পারেন, তা হলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে যাবে।
ফরিদ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার সারা শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম নামছে। কপালের বাঁ দিকের শিরাটা দপদপ করে কাঁপছে। দিলারা বলল, বড়সড় কোনো বিপদের আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ফরিদ। আব্বা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়ে যান যে এর সঙ্গে আমিও জড়িত। তাহলে আমার কী হবে বুঝতে পারছ? এ বাড়িতে আমি নতুন বউ। ছ মাসও হয়নি বিয়ে হয়েছে। একবার ভাবো তো…।
ফরিদ আচমকা দিলারার হাত ধরে ফেলল। তারপর ভাঙা গলায় বলল, আমাকে আর দুটো মাত্র দিন সময় দিন ভাবি। এরমধ্যে আমি একটা না একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। দুটো মাত্র দিন।
দিলারা আর কথা বলল না। কিছু জিজ্ঞেসও করল না। সে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। ফরিদ দাঁড়িয়ে রইল একা। তার সামনে ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল অনাগত দিন। প্রবল আবেগের আতিশয্যে যে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে, তার পরিণতি আসলে কী? ফরিদ জানে না।
১৯
সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও দেশের সীমানা পেরোনো হয়নি মহিতোষ মাস্টারের পরিবারের । যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে তারা পথে নেমেছিলেন তা যেন আরো বেশি অনিশ্চিত, অনির্ণেয় হয়ে গেল। শোকবিহ্বল, হতবুদ্ধি কতগুলো মানুষ। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর মতো প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেন না। মুখোমুখি হন না। যেন নিজেদের ভেতরে যে অকস্মাৎ উপলব্ধির ডুবোচর জেগে উঠেছে তা কেউ কাউকে দেখাতে চান না। কিন্তু সেই ডুবোচরে আটকে যায় সময়, তার মুহূর্মুহূ আঘাতে অনবরত ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। তাদের আটপৌরে অনুভূতির দীর্ঘাকায় জাহাজ। সেখানে এতোদিনকার মায়া মমতা, স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা সকলই যেন হঠাৎ নিরভারণ হয়ে প্রকাশ করে দিয়েছে এক মেকি অন্তরের অন্দরমহল। জরাজীর্ণ কঙ্কালসার হৃদয়।
চারুর ব্যাগে পাওয়া চিঠিখানা অঞ্জলি লুকিয়ে রেখেছেন। সেখানা আর কাউকেই দেখতে দেননি তিনি। তার এখনো মনে হচ্ছে ওই চিঠি পারু লেখেনি। পারু কখনো তাদের ছেড়ে অন্য কারো জন্য এভাবে চলে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই। তাদের কোথাও না কোথাও ভুল হচ্ছে। হয়তো ওই হাতের লেখাই পারুর নয়। অন্য কেউ জোর করে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। মহিতোষের হঠাৎ অঞ্জলিকে নিয়েও ভয় হতে লাগল। সে সময়ে সময়ে এলোমেলো কথা বলতে থাকে। এই দেশ, দেশের মানুষকে শাপ-শাপান্ত করতে থাকে। ভগবানের কাছে দু হাত তুলে কান্নাকাটি করে। মাঝে একদিন চারু বলেছিল, মা, এই যে তুমি বলছ, পারুদিকে। কেউ জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। সে ইচ্ছে করে যায়নি। যদি তা-ই হবে, তাহলে সে চিঠি লিখে যাবে কেন?
ও চিঠি পারু লেখেনি।
লেখেনি?
না।
তাহলে কে লিখেছে?
অন্য কেউ। পারুকে যে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে সে।
কিন্তু দেখো, এটা পারুদির হাতের লেখা। অন্য কারো নয়। তুমি দেখো?
অঞ্জলি দেখেন না। তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন। চারু বলে, এই হাতের লেখা তুমি চেনো না?
না।
এটা পারুদির হাতের লেখা নয়?
এই প্রশ্নের উত্তর দেন না অঞ্জলি। চুপ করে থাকেন। তার চোখে অদ্ভুত ঘোর লাগা দৃষ্টি। খানিক নীরব থেকে তিনি হঠাৎ বলেন, পারুকে যে তুলে নিয়ে গেছে, সে হয়তো জোর করে তাকে দিয়ে এই চিঠি লিখিয়ে নিয়ে গেছে। এমন হয়। ধর। পারুর গলার কাছে ছুরি চেপে ধরে বলল, আমি যা যা বলেছি, তা তা লেখো। তখন সে কী করবে? বাধ্য হয়ে লিখতে হয়েছে।
তা সেটা কখন লিখল? ওই ট্রেনে? ট্রেনের অত অত মানুষের মধ্যে কেউ অমনটা করল, আর অন্য কেউই তা টের পেল না?
অঞ্জলি এই প্রশ্নেরও উত্তর দেন না। চুপ করে থাকেন। তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যে পারু নিজের ইচ্ছায়, নিজের বুদ্ধিতে তাদের ফেলে অন্য কারো সঙ্গে চলে গেছে। সেই পারু! সেই এতটুকু একদলা মাংসপিণ্ডের মতো পারু! তার এখনো মনে আছে, সেদিন ঝড়-বৃষ্টির রাত। বড় আমগাছটার ডাল ভেঙে পড়ল তাদের টিনের ঘরের চালে। সেখান দিয়ে হুড়মুড় করে বর্ষার জল। ঢুকতে লাগল। এদিকে তার প্রসববেদনা উঠেছে। দাই আসার কথা উত্তরপাড়া। থেকে। কিন্তু এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে সে আসবে কী করে? ঘরে মহিতোষ ছাড়া শক্ত সামর্থ্য পুরুষ মানুষও আর নেই। তিনদিনের জ্বরে প্রায় বেহুশ হয়ে আছেন ছায়ারাণী। এর মধ্যে মহিতোষ একা কী করবেন?
তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন টিনের চাল মেরামত করতে। না হলে ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ঘরের অবস্থা ভুবনডাঙা নদীর মতো জল টইটম্বুর হয়ে যাবে। কিন্তু ওই অন্ধকারে একা একা কী করবেন তিনি? মহিতোষ উভ্রান্ত মানুষের মতো একবার অঞ্জলির কাছে ফিরে আসছেন। আবার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে যাচেচ্ছন ভাঙা চালার। কাছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বানের জলের মতো জল ঢুকছে চালের ভাঙা অংশ। দিয়ে। অনেক চেষ্টা করেও তা আটকাতে পারলেন না মহিতোষ। বরং পেছনের বারান্দা ভাসিয়ে জল ততক্ষণে মূল ঘরে ঢুকে পড়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে টিনের চালের ওপর হেলে পড়া গাছের ওজন আরো বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিমুহূর্তে একটু একটু করে চাপ বাড়ছে ঘরের ওপর। যেকোনো সময় পুরো চালটাই হয়তো ধসে পড়বে। তাহলে দুর্ভোগের আর অন্ত থাকবে না। এই দুর্যোগের রাতে অঞ্জলিকে নিয়ে কোথায় যাবেন মহিতোষ?
.
পারুর জন্ম হলো মাঝরাতের দিকে। ততক্ষণে ঘরের অর্ধেক চাল প্রায় ধসে গেছে। অবিরাম বর্ষণে জল থইথই করছে ঘরের মেঝেতে। যে খাটের ওপর পারুর জন্ম। হলো সেখানেও আশপাশ থেকে ছিটকে আসছে জল। অন্ধকারেই একটা তেরপল খুঁজে সেটি দিয়ে মা আর মেয়েকে ঢেকে দিলেন মহিতোষ। তবে তাতে লাভ বিশেষ হলো না। পুরোপুরি ঢেকে দিলে অঞ্জলির শ্বাসকষ্ট হয়। ফলে তেরপলটা উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো তাকে। অঞ্জলি অবশ্য এতকিছু টের পেলেন না। একটা ঘোরের ভেতর চলে গেলেন। ভোরের আলো ফুটতে যখন চোখ মেলে তাকালেন, তখনো মহিতোষ ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার সারা শরীর ভেজা। বাইরে থেকে উড়ে আসা লতাপাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার মাথা, ঘাড়, গায়ে। চোখজোড়া টকটকে লাল। কিন্তু তিনি তাকিয়ে আছেন পারুর দিকে। পারুর তখন হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করে কাঁদছে। আর তাঁর সেই কান্না দেখে হাসছেন মহিতোষ। তার বিধ্বস্ত, ক্লান্ত চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করছে।
সেই পারু! সেই পারু অমন করে রাতের আঁধারে তাদের ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে চলে যেতে পারে, এটা তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। রোজ রাতে ঘুম থেকে উঠে কতবার যে মেয়েদের দেখতে যেতেন মহিতোষ। কতদিন ঘুমের মধ্যেই লুকিয়ে টুক করে মেয়েদের কপালে চুমু খেতে গিয়ে অঞ্জলির কাছে। ধরা পড়েছেন তিনি। দেখে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে হাসতেন। বলতেন, দেখতে এলাম দুই বোন ঘুমাচ্ছে? নাকি সারাক্ষণ ফুসুরাসুর করছে! পড়াশোনার নাম নাই, সারাক্ষণ শুধু গল্প-আড্ডা। এমন করে কোনো বাবাকে তার মেয়েদের ভালোবাসতে দেখেননি অঞ্জলি। তার যে কত কত স্বপ্ন ছিল এই মেয়েদের নিয়ে। এ কারণেই সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে হম্বিতম্বি করতেন। বাইরে থেকে দেখতে কঠিন, শক্ত সামর্থ্য এই মানুষটা আসলে ভেতরে ভেতরে ছিলেন বর্ষার ভেজা মাটির মতো নরম। সেই বাবাকে ছেড়ে এভাবে চলে গেল পারু? অঞ্জলির এসব কিছুতেই বিশ্বাস হয় না ।
মহিতোষ সেদিন অঞ্জলিকে নিয়ে বসলেন। তারপর দীর্ঘসময় ধরে তাকে পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু অঞ্জলি তার কিছুই বুঝল কী না পরিষ্কার হলো না। তিনি বারবার কেবল একটি কথাই বলতে লাগলেন, আপনি আমার মেয়ে এনে দেন। আমি আর কিছুই চাই না। কিছু না।
মহিতোষ বললেন, যে যেতে চায় নাই তাকে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু যে যেতেই চায়, তাকে কী করে ফিরিয়ে আনব?
আপনি জানেন সে কোথায় আছে?
না, জানি না। কিন্তু চিঠিতে তো সে লিখেই গেছে কোথায় গেছে, কার সঙ্গে গেছে!
অঞ্জলি এবার আর মহিতোষের কথার প্রতিবাদ করলেন না। যেন মনে মনে তিনিও মেনে নিয়েছেন যে পারু স্বেচ্ছায়ই চলে গেছে। তিনি বললেন, আপনি ওর ওপর রাগ রাইখেন না। সে ছোটো মানুষ। ভুল করেছে। এই বয়সের ছেলে মেয়েরা এমন একটু-আধটু ভুল করেই। আপনি তো তারে চেনেন। সে ভেতরে ভেতরে খুবই নরম মনের মানুষ। এই ধরনের মানুষ হঠাৎ হঠাৎ বড় ধরনের ভুল করে ফেলে। কিন্তু সেই ভুল বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। ভুল করার পরপরই তারা বুঝতে পারে। আর তখন তাদের চাইতে দুঃখী মানুষ আর কেউ হয় না। সারাক্ষণ অনুশোচনায় ভোগে। আমি জানি, আমার মেয়ে এতক্ষণে তার ভুল বুঝতে পারছে। আপনি তারে ফিরাই আনার ব্যবস্থা করেন। যেভাবেই পারেন আপনি তারে ফিরাই আনার ব্যবস্থা করেন।
অঞ্জলি কাঁদছেন। কান্নার দমকে তারা শরীর কাঁপছে। মহিতোষ স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমিও সেটাই ভাবছি অঞ্জলি। কিন্তু তারে খুঁজতে আমি কোথায় যাব?
আপনি ভুবনডাঙা যান।
ভুবনডাঙা গেলে কী হবে?
সেখানে পারু আছে। আপনি যদি একবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান, দেখবেন সে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে আপনার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভগবানের দোহাই, আপনি একবার ভুবনডাঙা যান।
মহিতোষ খানিক চুপ করে থেকে বললেন, তোমার মনে হয় সে ভুবনডাঙা গেছে?
সেখানে না গেলে আর কই যাবে সে?
সে দুনিয়ার আর যেখানেই যাক, অন্তত ভুবনডাঙা যাবে না।
যাবে। এ ছাড়া আর যাওয়ার জায়গা কই তার?
মহিতোষ কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর বললেন, ফরিদ যদি তারে নিয়ে ভুবনডাঙা যায়, তাহলে কী হবে তুমি বুঝতে পারছ না?
কী হবে?
পুরা ভুবনডাঙায় ভূমিকম্প হয়ে যাবে। সারা গায়ের মানুষ ক্ষেপে যাবে। হিন্দু-মুসলিম নির্বেশেষে সবাই তাদের ভয়ংকর শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
বলে থামলেন মহিতোষ। তার গলা কাঁপছে। অঞ্জলি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন। পরিস্থিতি যে তিনি বুঝতে পারছেন না তা নয়। কিন্তু ভুবনডাঙা ছাড়া আর কোথায় যাবে তারা? ফরিদের তো ওই এক মামা ছাড়া আর কেউ নেই। পারু যদি সত্যি সত্যিই তার সঙ্গে গিয়ে থাকে, তাহলে সে ওই মামা ছাড়া আর কার কাছে। যাবে?
মহিতোষ বললেন, তা ছাড়া জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কথা একবার চিন্তা করে দেখো তো? সে এখন ফণা তুলে ফুঁসতে থাকা কালসাপ। ফরিদ আর পারু যদি এখন ওই গ্রামে যায়, তাহলে সে কী করবে তোমার কোনো ধারণা আছে?
এই কথায় অঞ্জলির বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এলো। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আসলেই ফুঁসতে থাকা আহত এক বিষধর সাপ। তিনি ফ্যাকাশে কণ্ঠে বললেন, তাহলে?
তাহলে এখন একটাই উপায় আছে।
কী উপায়?
ওহাব ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা। সে নিশ্চয়ই ফরিদের খবরাখবর কিছু জানবে। তার মাধ্যমে যদি কোনো খোঁজ পাওয়া যায়। সমস্যা হচ্ছে…।
মহিতোষের কথার প্রথম অংশ শুনে যেন সম্ভাবনার এক চিলতে আলো দেখতে পেয়েছিলেন অঞ্জলি। কিন্তু শেষের অসমাপ্ত অংশটুকু শুনে সেই আলোটুকু আবার দপ করে নিভে গেল। তিনি ব্যাকুল গলায় বললেন, কী সমস্যা?
মহিতোষ বললেন, সে ভালো মানুষ, এটা আমি জানি। কিন্তু বিষয়টা এত নাজুক…। বুঝতেই তো পারছ, ধর্মের বিষয়ে কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দিতে চায় না। তাঁরাও না, আমরাও না। এখন এই ঘটনায় ওনার মানসিকতা কী, সেটা কিন্তু আগেভাগে বোঝার কোনো উপায় নাই। তা ছাড়া, শুনেছিলাম ডাক্তারের মেয়ের সঙ্গে নাকি ফরিদের বিয়ের কথাবার্তাও চূড়ান্ত ছিল। এখন পারুর কারণে যদি তাদের এতবড় একটা ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে সেই ক্ষতি কি উনি এমনি এমনিই মেনে নেবেন?
এই বিষয়টি মাথায় ছিল না অঞ্জলির। তিনি নিরুপায় ভঙ্গিতে বললেন, তাহলে? তাহলে এখন কী হবে? আমার পারুরে আমি পাব কীভাবে?
কীভাবে পাবে জানি না। তবে এটুকু তো বিশ্বাস করো যে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করব?
অলি মুখ তুলে মহিতোষের দিকে তাকালেন। ভেতরে ভেতরে ভেঙে যাওয়া এই মানুষটা এখনো বাইরে কী শক্ত আদল নিয়েই না দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তার বুকের ভেতর পাড় ভাঙা উন্মত্ত এক নদী যে নিরন্তর ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে তা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। অঞ্জলি বললেন, কী করবেন আপনি?
আমি ভুবনডাঙা যাব।
কী! যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না অঞ্জলি। তার গলায় একটা প্রগাঢ় উচ্ছ্বাস। সেখানে পারুর খোঁজ মিলে যাওয়ার সম্ভাবনার ঝলকানি। কিন্তু পরক্ষণেই স্বামীর চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, কিন্তু কী করে যাবেন আপনি?
কী করে যাব তা এখনো ভাবিনি। ভেবে বের করতে হবে। প্রথমে ওহাব ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করব আমি। তারপর পরবর্তী সিদ্ধান্ত।
কিন্তু উনি যদি আপনার কোনো ক্ষতি করেন?
আশা করি করবেন না। আর সেটা যাতে না করেন সেই ব্যবস্থা করেই যাব।
কী ব্যবস্থা?
এখনো জানি না। তবে এইজন্য তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
আমাকে? অবাক হলেন অঞ্জলি।
হুম।
কী কাজ?
মহিতোষ কথাটা বলতে সময় নিলেন। অঞ্জলি এখন যে মানসিক দশায় আছে, তাতে এই কথা শোনার পর তার প্রতিক্রিয়া কী হবে তা তিনি নিশ্চিত নন। তারপরও কথাটা বললেন মহিতোষ, মা আর চারুকে নিয়ে তুমি ওপার চলে যাবে। বড়দা, দিদি, তোমার দাদা সবাই অপেক্ষা করে আছেন। ভগবান যদি সহায় হোন, আমি শীঘ্রই পারুকে সঙ্গে নিয়ে তোমাদের কাছে ফিরব।
অঞ্জলি এক দৃষ্টিতে মহিতোষের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন কথাটা বুঝতে পারলেন না তিনি। পারুর কোনো খোঁজ না পেয়েই তিনি দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাবেন? আর মহিতোষ রয়ে যাবেন একা? এ কেমন ধারা কথা বলছেন মহিতোষ?
মহিতোষ বললেন, এভাবে তাকানোর কিছু নাই। তুমি কি চাও না আমি পারুকে খুঁজি?
কেন চাইব না?
তো আমি যখন পারুকে খুঁজতে বের হবো, তখন তুমি কী করবে? তোমার তো এখানে করার কিছু নাই। আছে?
অঞ্জলি জবাব দিলেন না। মহিতোষ বললেন, তোমার যেহেতু এখানে কিছু করার নাই, সেহেতু এখানে শুধু শুধু বসে থেকেও তো লাভ নাই। তা ছাড়া
অরবিন্দু মেশোর ঘাড়ের ওপর বসে এতগুলো মানুষ কতদিন থাকব আমরা? তার এই কটা মাত্র ঘর। এরমধ্যে নিজের ছেলের বউ আছে। মেয়ে, মেয়ের জামাই আছে। একবার ভাব? তার ওপর মাসি আর মায়ের শরীরও কিন্তু ভালো না।
তাই বলে আপনাকে এভাবে রেখে আমরা চলে যাব?
হ্যাঁ যাবে। এটা সবার ভালোর জন্য। আমি তো আছি। আমার ওপর তোমার ভরসা নাই?
এই কথায় থমকে গেলেন অঞ্জলি। এই মানুষটার ওপর যদি তাঁর ভরসা না থাকে তবে আর কার ওপর থাকবে তার এই দীর্ঘ জীবনে মুহূর্তের জন্যও কখনো এই মানুষটি তাকে অনিরাপদ অনুভব করতে দেননি। প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদের মুখেও তার বিশাল ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন। নিজের জন্য কখনোই কি ভেবেছেন মহিতোষ? অঞ্জলির মনে পড়ে না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমি আপনাকে রেখে যাব না।
এটা আমাকে রেখে যাওয়া না অঞ্জলি। আমি তো কয়েকটা দিন পরেই চলে আসব। এর মধ্যে আর কোনো ঝামেলা হোক আমি চাই না।
আর কী ঝামেলা হবে?
তা জানি না। কিন্তু তোমরা এইখানে থাকলে সারাক্ষণই আমার দুশ্চিন্তা হবে। পারুকে খুঁজতে আমার কই না কই যাওয়া লাগে, কে জানে! তখন যদি আবার তোমাদের চিন্তা মাথায় থাকে, তাহলে আমার কেমন লাগবে বলো? ওইটা বাড়তি একটা দুশ্চিন্তা না? আর তোমরা যদি দাদা-দিদির কাছে একবার পৌঁছাই যেতে পারো, আমি নিশ্চিন্ত।
মহিতোষ বিষয়টা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। নানা যুক্তি-ব্যখ্যা দিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। অঞ্জলি কিছুতেই পারুকে না পাওয়া অবধি যাবে না। মহিতোষ পরদিন সন্ধ্যায় অরবিন্দু বাবুর সঙ্গে হাঁটতে বের হলেন। তাঁরা রেললাইনের ধারে নির্জন একটা মাঠের পাশে বসলেন। মহিতোষের মুখ থমথমে। অরবিন্দু বাবু বললেন, তুই বোধহয় সিরিয়াস কিছু বলবি?
মহিতোষ খানিক নীরব থেকে বললেন, হুম। আমি খুব সিরিয়াস কিছু কথা বলার জন্যই আপনাকে এইখানে ডেকে আনছি মেসো। কথাগুলো ঘরে বসে বলা যেত না। আবার বলা জরুরিও।
বল। বলে চুপ করে রইলেন অরবিন্দু বাবু। মহিতোষ বললেন, আমি পারুকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত কোথাও যাব না মেসো। তার কণ্ঠ থমথমে। গলা ভার।
কিন্তু তারে খুঁজে বের করবি কীভাবে? পুলিশে জানাবি?
নাহ।
কেন?
অনেক কারণ আছে। বলে একটু থামলেন মহিতোষ। তারপর বললেন, আমি এই সময়ে থানা-পুলিশের ঝামেলায় যেতে চাই না। এখন থানা-পুলিশের ঝামেলায় গেলে তারা আরো বড় ঝামেলা করবে। বিষয়টা তো স্বাভাবিক না। এই হিন্দুর মেয়ে-মুসলমানের ছেলে বিষয়টা আরো জটিল করে ফেলবে। তার ওপর আমি আসছি বাড়ি-ঘর সব বিক্রি করে দিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে। এখন পুলিশের কাছে গেলে তারা তো গ্রামে যাবে। লোকজনের কাছে নানা খোঁজখবর নেবে। তখন আমি এইটা নিয়েও অনেক ঝামেলায় পড়ব।
অরবিন্দু বাবু চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন। মহিতোষ বললেন, আরো ব্যাপার আছে। পারু তো অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে না। সে প্রাপ্তবয়স্কা। আর তাকে কেউ জোর করে ধরেও নিয়ে যায়নি। সে গেছে নিজের ইচ্ছায়। তো পুলিশের কাছে গিয়ে আপনি কী বলবেন? বরং তখন তারা মূল ঘটনা বাদ দিয়ে আশপাশের নানা ঘটনা নিয়ে ঝামেলা করবে।
অরবিন্দু বাবু এবার বিষয়টা পরিষ্কার হলেন। বললেন, হু। তোর কথা ঠিক। কিন্তু এ ছাড়া কীভাবে কী করবি তুই?
সেটা এখনো জানি না। তবে এটা জানি, কাজটা সহজ না। প্রথমে আমাকে যেতে হবে ভুবনডাঙা। আর আমার এখন ভুবনডাঙা যাওয়া মানে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মুখে গিয়ে দাঁড়ানো। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আমাকে পেলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে।
তাহলে?
তারপরও আমাকে যেতে হবে। কারণ ভুবনডাঙা যাওয়া ছাড়া পারুর কোনো খোঁজ পাওয়ার সুযোগ নাই। আমাকে ওহাব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিছু যদি জেনেই থাকেন, তবে সেটা জানবেন তিনি।
কিন্তু তার সঙ্গে কী করে দেখা করবি?
সেটা এখনো ভাবি নাই। ভেবে বের করতে হবে। তবে কাজটা কঠিন এবং বিপজ্জনক। এইজন্য সবার আগে একটা কাজ আপনাকে করতে হবে।
কী কাজ?
অঞ্জলিদের বর্ডার পার করাতে হবে।
মানে? তোকে ছাড়াই?
হুম।
কেন?
অনেকগুলো কারণ আছে। বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মহিতোষ। তারপর বললেন, বাদবাকি কারণ বাদ দিয়ে সবচেয়ে গুরুতর কারণটা বলি।
বল।
আমি যেই কাজটা করতে যাচ্ছি, সেটার ফলাফল আমি জানি না। স্বাভাবিক যুক্তিতে যদি আমি চিন্তা করি, তাহলে পারুকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। কারণ ফরিদ তাকে নিয়ে কোনোদিনও আর ভুবনডাঙা ফিরতে পারবে না। কারো সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারবে না। যদি কোনো কারণে সেটা সে করে, তাহলেই কেবল সামান্য একটা সম্ভাবনা আছে। আমি সেই সম্ভাবনার খোঁজেই যাব। কিন্তু ভুবনডাঙা আমার জন্য এখন মৃত্যুকূপের মতো। এতদিন তাও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আর তার দলবলের কাছে আমি শক্র ছিলাম। কিন্তু পারু আর ফরিদের ঘটনার পর সেখানকার প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই আমরা অপরাধী। একজন মানুষও নাই, যে আমাকে সাহায্য করতে পারে। তারপরও ওই সামান্য সম্ভাবনাটুকুর খোঁজেই আমি যাব। কিন্তু ফরিদ যদি আসলেই কোনো যোগাযোগ না করে। বা ওহাব ডাক্তারকে কিছু না জানায়, তাহলে পারুকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।
আচ্ছা। বলে মহিতোষের দিকে তাকিয়ে রইলেন অরবিন্দু বাবু। তিনি বুঝতে পারছেন মহিতোষের মূল বক্তব্য এখনো বলা হয়নি। মহিতোষ বললেন, সেক্ষেত্রে আমাকে আসলে একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে হবে। অনির্দিষ্টকালের জন্য। গন্তব্যহীন।
মানে পারুর খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত?
মহিতোষ এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তবে বললেন, আর যে বিপদ মাথায় নিয়ে আমি কাজটা করতে যাচ্ছি, তাতে বড়সড় কোনো দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। আর তেমন কিছু যদি ঘটেই যায়। তাহলে অঞ্জলিদের তখন কী হবে? এখানে কার কাছে, কীসের আশায় থাকবে তারা?
এতক্ষণে যেন আসল ঘটনা বুঝতে পারলেন অরবিন্দু বাবু। মহিতোষ খুব স্বাভাবিকভাবে কথাটা বললেও তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি বললেন, তুই
এসব কী বলছিস মহিতোষ?–ঠিকই বলছি। ধরেন, আমার খুব খারাপ কিছু হয়ে গেল, তখন? তখন অঞ্জলি, চারু, মা ওদের কী হবে? এখানে বসে কী করবে ওরা? কোথায় যাবে? তারচেয়ে আমি চাই, তারা আগেভাগেই ওপার চলে যাক। দাদা-দিদির কাছে নিরাপদে থাকুক। যদি আমি ঠিকঠাকভাবে সব ব্যবস্থা করে ফিরে আসতে পারি তো ভালো। আর যদি না পারি, ওরা তো অন্তত নিরাপদে থাকবে।
অরবিন্দু বাবু অন্যরকম এক চোখে মহিতোষের দিকে তাকালেন। একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন সন্তান কী অবলীলায় তার পরিবারের জন্য নিজেকে নিঃশেষে উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। অথচ সে জানেই না পারুকে সে খুঁজে পাবে কী না। তিনি বললেন, কিন্তু তুই যদি পারুর কোনো খোঁজ বের করতে না পারিস?
খুঁজব।
খুঁজবি তাতো বুঝলাম। কিন্তু কতদিন খুঁজবি?
যতদিন না পাব।
কিন্তু সেটা কতদিন?
যতদিন আমি আমার পারে না পাব, ততদিন। মহিতোষের গলা কেমন অন্যরকম শোনাল। যেন তীক্ষ্ণ ধারালো কিছু একটা বিধে আছে তার বুকে। সেটি শব্দগুলোকে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করে তুলছে।
যদি কোনোদিনও না পাস?
তাহলে কোনোদিনও আমি আমার খোঁজা বাদ দেব না।
কোনোদিনও না?
নাহ। আমার পারে না খুঁজে আমি থাকব কী করে মেশো? কথাটা বলতে গিয়ে অকস্মাৎ মহিতোষের গলা কেঁপে উঠল। তার চোখ ভারি হয়ে এলো। তিনি যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন। তারপর ঠিক একই গলায় বললেন, পারুরে ছাড়া আমি কী করে থাকব? তারে না দেখে ঘুমাব কী করে? সে এইটুকু একটা মানুষ ছিল মেসো। এই যে এইটুক। বলে দু হাত প্রসারিত করে দেখালেন তিনি। তারপর ভেজা, গাঢ় গলায় বললেন, আমি তারে রোজ আমার বুকের ওপর। ঘুম পাড়াতাম। সে আমার বুকের ওম ছাড়া ঘুমাতে পারত না। আমি একটু সরে গেলেই চিৎকার করে কাঁদত। জেগে উঠত। আমি ছাড়া কেউ তারে কখনো থামাতে পারে নাই। কেউ না।
প্রবল কান্নায় মহিতোষের গলা যেন বুজে আসতে চাইল। কিন্তু তিনি কাদলেন । নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিতে নিতে বললেন, আমি দেরি করে বাড়ি ফিরলে সে খেত না। আর এখন আমার সেই পারে না দেখা পর্যন্ত আমি ঘুমাব কী করে? খাব কী করে? আমার গলা দিয়ে তো কোনো খাবার নামে না মেসো। একফোঁটা জলও না। মনে হয় বিষ যাচ্ছে বুকের ভেতর। সারাটাক্ষণ পুড়ে পুড়ে যায়। চোখের পাতা পর্যন্ত বন্ধ করতে পারি না। বন্ধ করলেই আমার পারুর মুখ ভাসে। সেই এইটুকু এক পারু। মুখে দাঁত নাই। ফোকলা দাঁতে হাসে। আমাকে উঠানে সাইকেল থেকে নামতে দেখলেই ফিক করে হেসে ফেলত। তারপর সবকিছু ফেলে পাখির মতো উড়ে উড়ে ছুটে আসত। আর মুখে বলত, বাবা, বাবা। আমাল বাবা। আমাল বাবা।
মহিতোষ শার্টের হাতায় চোখ মোছার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত। গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে মিশে থাকত। একমুহূর্তের জন্যও তারে আর সেই বুক থেকে সরানো যেত না। এই যে দেখেন, এইখানে…। মহিতোষ তার জামার বুকের দিকটায় বোতাম খুলে দেখাতে লাগলেন। বললেন, এইখানটায় সে মিশে থাকত। এখনো তার সেই গায়ের ঘ্রাণ, তার সেই স্পর্শ, ওম এইখানে লেগে আছে। আমি আমার সেই পারে না দেখে থাকব কী করে মেসো? কী করে থাকব? সন্ধ্যার আকাশে তখন রাত নেমেছে। দূরে কোথাও ট্রেনের সাইরেন শোনা যাচ্ছে। মাথার ওপর ফিনফিনে কুয়াশার সাদা চাদর। সেই চাদরের ওপার থেকে ম্লান চাঁদের আলো ভেসে ভেসে আসছে। মহিতোষ সেই চাঁদের আলোর নিচে, সেই কুয়াশার চাদরের ভেতর সর্বহারা, নিঃস্ব এক মানুষের মতো কাঁদতে লাগলেন। তার সেই কান্নার জলে যেন গলে গলে ঝরে পড়তে লাগল আরো গাঢ়, আরো গভীর কোনো কুয়াশা। ঝরে পড়তে লাগল জোছনা। তিনি যেন ক্রমশই সেই কুয়াশা ও জোছনায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগলেন।