২০. জিলানি ডাক্তারের ওখান থেকে

অধ্যায় ২০

জিলানি ডাক্তারের ওখান থেকে তাড়াহুড়া করে চলে আসার সঙ্গত কারণ আছে। উমা প্রথমে বুঝতে না পারলেও বাস্টার্ড যখন বৃজের গোড়ায় এসে গাড়িটা পরিত্যাগ করলো তখন আন্দাজ করতে পারলো কিছু একটা ঘটেছে।

বাচ্চুর দেয়া পুরনো মডেলের সাদা গাড়িটার কাগজপত্র পুলিশের হাতে পড়লে কোনো সমস্যা নেই। এই গাড়িটা এমন এক মালিকের নামে রেজিস্ট্রেশন করা আছে যার অস্তিত্ব খুঁজে বের করা পুলিশের পক্ষে কখনও সম্ভব হবে না।

বৃজের গোড়ায় গাড়িটা ফেলেই বুট থেকে গলব্যাগটা নিয়ে নিলো সে। উমা এসব দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে, বাস্টার্ড শুধু বললো পুলিশ তাদের পিছু নিয়েছে। কথাটা শুনে উমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।

বৃজের গোড়ায় সারি সারি সিএনজি পার্ক করে রাখা, এখানে সব সময়ই কিছু না কিছু সিএনজি থাকেই, বাস্টার্ড সেটা জানে। সিএনজি’তে করেই বৃজটা পার হওয়া যাবে, মনে মনে ভাবলো সে।

একটা সিএনজি’র সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো যাবে কিনা। ড্রাইভার লোকটা সিএনজি’র সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা তার কথা শুনে তার দিকে না তাকিয়ে তাকালো পাশে দাঁড়ানো উমার দিকে। বাস্টার্ড আবারো জিজ্ঞেস করলো যাবে কিনা ।

“না । আমার গাড়ি নষ্ট।” এখনও বদমাশটা চেয়ে আছে উমার দিকে। বাস্টার্ড আর দেরি করলো না, পাশের সিএনজিটার কাছে চলে গেলো। এটার ডাইভার এক কথায় রাজি হয়ে গেলে উঠে বসলো তারা দু’জনে। সিএনজিটা বুজের উপর উঠতেই বাস্টার্ড দেখতে পেলো যানবাহনের দীর্ঘ লাইন পড়ে গেছে।

“এতো বড় লাইন কেন, কি হয়েছে?” সিএনজি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো সে।

“বৃজের উপর টহলপুলিশ সব সাদা রঙের প্রাইভেটকার চেক করতাছে…আমাগো চিন্তা নাই। আমাগো ছাইড়া দিবো।”

“কখন থেকে এরকম চেক করছে?”

“কিছুক্ষণ ধইরা।”

সতর্ক হয়ে উঠলো বাস্টার্ড । সাদা রঙের প্রাইভেটকার চেক করা হচ্ছে।

“গাড়ি ঘুরাও!” ড্রাইভারকে বললো সে। অবাক হয়ে পেছন ফিরে তার অস্থির যাত্রির দিকে তাকালো ড্রাইভার।

“কি হইছে?!”

“গাড়িটা ঘুরাও!” বাস্টার্ড তাড়া দিয়ে বললো আবার ।

“কি কন?!”

“গাড়ি ঘুরাও…আমরা সামনেই নেমে যাবো।”

ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো ড্রাইভার। “যাইবেন না?”

“না।” কথাটা বলেই একটা একশ’ টাকার নোট বের করে ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিলো। “ধরো। আমরা যাচ্ছি না। যেখান থেকে উঠেছিলাম সেখানে নামিয়ে দিলেই হবে।”

টাকাটা না নিয়েই ড্রাইভার তার সিএনজি ঘুরিয়ে বৃজ থেকে নামতে শুরু করলো ।

“রাখো! রাখো!” পেছন থেকে টাকাটা ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অস্থিরভাবে বললো সে। “এই নাও।”

টাকাটা হাতে নিয়ে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ড্রাইভার।

পাশে বসা উমাকে দেখিয়ে বললো সে, “আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে বের হয়েছি…মনে হয় আমাদের পেছনে পুলিশ লেগেছে।”

উমা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে। কতো দ্রুত মিথ্যে গল্প বানাতে পারে এই লোক!

মুখ টিপে হেসে ড্রাইভার টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “আচ্ছা, এই ঘটনা। রাখেন, রাখেন । টাকা লাগবো না।”

“ওর বাপ অনেক পাওয়ারফুল লোক।” তড়িঘড়ি করে সিএনজি থেকে নেমে পড়লো সে উমাকে নিয়ে।

“শুনেন,” সিএনজি থেকে নামতেই ড্রাইভার বললো। “বৃজের নীচ দিয়া নদী পার হইয়া যান। ওইটাই সবচাইতে নিরাপদ হইবো।”

মুচকি হাসলো বাস্টার্ড । “অনেক ধন্যবাদ, তোমাকে।”

বাস্টার্ড সিএনজি ড্রাইভারের কথামতোই কাজ করলো। লোকটা ঠিকই বলেছে। বৃজ হলেও নৌকা তো উঠে যায় নি। এখনও প্রচুর নৌকা আছে পারাপারের জন্য।

বৃজের ঢাল থেকে নামার সময় দেখতে পেলো দু’দুটো পুলিশের গাড়ি বৃজের দিকে ছুটে আসছে।

উমাকে নিয়ে দ্রুত চলে গেলো নদীর পারে । অনেকগুলো নৌকা ঘাটে ভেড়ানো আছে। অলস সময় পার করছে মাঝিরা। তাদেরকে দেখেই সবাই নড়েচড়ে উঠে ডাকতে শুরু করে দিলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা একটা নৌকায় উঠে বসলো তারা।

নদী পার হতে সাত-আট মিনিটের বেশি লাগলো না। একেবারে নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেলো।

জিলানি ডাক্তারের ওখানে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস উপলক্ষ্যে ইউনিসেফের পোস্টারটা না দেখলে আজ হয়তো ধরা-ই পড়ে যেতো। পোস্টারটা তার কাছে মোটেই আগ্রহের বিষয় হতো না যদি কিছুক্ষণ আগে তার মোবাইলে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস উপলক্ষ্যে একটি মেসেজ না আসতো। পোস্টারে বড় বড় করে লেখা ছিলো ৭ই আগস্ট। হ্যাঁ, ৭ই আগস্ট হলো বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস। কিন্তু আজ তো ৭ই আগস্ট না! এটা ফ্রেব্রুয়ারি মাস! তাহলে আজকে কেন তাকে মাতৃদুগ্ধ দিবস উপলক্ষ্যে মেসেজ পাঠানো হলো?

তার মাথাটা খুব দ্রুত কাজ করতে শুরু করে। বুঝতে পারে তার কাছে থাকা মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে আসলে তার অবস্থান জেনে নেয়া হয়েছে। এরকম প্রযুক্তি র‍্যাবের কাছে আছে। এখন হয়তো পুলিশের কাছেও চলে এসেছে। নাকি হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট? অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় তাদের কাছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অনেক বেশিই আছে। এ নিয়ে পার্লামেন্টে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি কিছুদিন আগেও সমালোচনা করেছিলো। বিশাল টাকা খরচ করে নাকি শ্বেতহস্তী পালা হচ্ছে।

ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি পুলিশ এতো দ্রুত তার পেছনে লেগে যাবে। এই কারণেই সে উমাকে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে দেয় নি, অথচ তারা ঠিকই জেনে গেলে শেষ পর্যন্ত! মোবাইল ফোনটাই যে এক্ষেত্রে কাজ করেছে বুঝতে পারলো। আগামীকাল যখন পত্রিকায় খুনের সংবাদগুলো ছাপা হবে তখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যাবে। কী অসাধারণ টেকনিকই না ব্যবহার করেছে তারা। পুলিশের কাছে এরকম জিনিস আছে সেটা সে জানতো না। এখন যতো দ্রুত সম্ভব ঢাকা ছাড়তে হবে। দেরি করলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।

.

অধ্যায় ২১

জেফরি বেগের মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না খুনি কিভাবে আগেভাগে জেনে গেলো পুলিশ তাকে ধরার জন্য আঁটঘাঁট বেধে নেমেছে। তারা যেভাবে, যে টেকনিক ব্যবহার করে তাকে ট্র্যাকডাউন করেছে সেটা তো খুনির পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তারপরেও সে জেনে গেছে! গাড়িটা ঠিক বৃজের কাছে পরিত্যাক্ত করে চলে গেছে অন্য কোথাও।

ইকরিয়া থানার ওসি সব জানানোর পর থেকে সে এ নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না।

“স্যার, খুনি লোকটার ব্যাপারে আমার কাছে অন্য রকম একটা থিওরি আছে,” জেফরির সহকারী জামান তার বসকে অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ থাকতে দেখে অবশেষে বললো।

জেফরি শুধু ভুরু কুচকে তাকালো তার সহকারীর দিকে।

“আমার মনে হচ্ছে খুনি লোকটা গোয়েন্দাসংস্থার কেউ হবে…”

“মানে?” জেফরি বুঝতে পারেলো না জামানের কথাটা।

“স্যার, এরকম শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বেলায় সরকারের একটি অলিখিত নিয়ম আছে, আমরা সবাই সেটা জানি। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বিভিন্নভাবে তাদেরকে নির্মূল করার কাজ তো অনেক আগে থেকেই চালু আছে।”

“তুমি কি বলতে চাও, ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা র‍্যাব-পুলিশ কোনো অপারেশন চালাচ্ছে?”

“এটা তো হতেই পারে, স্যার, পারে না?”

“কিন্তু কাজটা তো করেছে একজন মাত্র লোক। একেবারে পেশাদার কোনো খুনির মতো। যাদের কথা বলছে তারা কি এভাবে কাজ করে? না। আমার তা মনে হয় না।”

জামান একটু আশাহত হলো তবে হাল ছেড়ে দিলো না। “কাজটা হয়তো একজনই করছে, তার সাথে আছে আরো অনেকে। তা না হলে এভাবে একটা সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের ভেতর ঢুকে…”

“না, না।” জেফরি তার সহকারীর থিওরিটা বাতিল করে দিলো। “এরকম কিছু বলে মনে হচ্ছে না।”

“তাহলে আমরা যে মোবাইল ফোনের সাহায্যে ট্র্যাকডাউন করি সেটা খুনি জানলো কি করে, স্যার?”

এই প্রশ্নটা জেফরিকেও ভাবাচ্ছে। সে ভালো করেই জানে তাদের কাছে থাকা স্টেট অব দি আর্ট ইকুইপমেন্ট কমপক্ষে আরো দুতিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছেও আছে-র্যাব আর দুটো গোয়েন্দা সংস্থা।

তার সহকারী জামানের কথায় যুক্তি আছে কিন্তু জেফরির মন তাতে সায় দিচ্ছে না। সরকারী কোনো সংস্থা এরকম কাজে নামবে? অসম্ভব। কিন্তু খুনি যেভাবে শেষ মিনিটে সব জেনে গাড়িটা ফেলে পালিয়েছে তাতে করে মনে হচ্ছে সে তাদের ট্র্যাকিং করার খবরটা জেনে গেছে। বুঝতে পারছে খুনিকে ধরার কাজটা এখন কঠিনই হয়ে গেলো। সহকারী জামানের আইডিয়াটা বাতিল করে দিলেও মনে মনে ঠিক করলো একটু খতিয়ে দেখবে আসলেই এরকম কোনো গোপন অপারেশন চালানো হচ্ছে কিনা।

“স্যার, হোটেল পিং সিটির মালিক, রর ভাইকে গ্রেফতার করা হলে কিছু তথ্য পাওয়া যেতো।”

জামানের এই কথাতে সায় দিলো জেফরি। হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে সব জানার পর তারা উত্তরা থানাকে জানিয়ে দিয়েছে। দেখা যাক লোকটাকে গ্রেফতার করতে পারে কিনা। জেফরি অবশ্য মনে করছে এতোক্ষণে রঞ্জুর ভাই গা ঢাকা দিয়েছে।

তবে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয় সে। শেষ একটি অস্ত্র প্রয়োগ করবে এখন। খুনিকে ধরার আরেকটা উপায় আছে। উমা রাজবংশী নামের মেয়েটি। সেই মেয়েটি নিশ্চয় জানে খুনি কে। আর জানে বলেই খুনি তাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেছে। ঐ মেয়েটার অনেক কিছুই এখন তারা জানে। এমনকি মেয়েটার ছবিও তাদের কাছে আছে। বিউটি পার্লারের কর্মচারীদের একটি গ্রুপ ছবি থেকে এটা জোগার করা হয়েছে। সুতরাং তাকে ধরার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

“জামান, উমা নামের মেয়েটির ছবি তৈরি করেছো?”

“জি, স্যার,” জামান বললো। “একটা গ্রুপ ছবি থেকে পোর্ট্রেট করা হয়েছে।”

“ছবিটা কি সাম্প্রতিক সময়ে তোলা?”

“তিন মাস আগের।”

“দ্রুত ছবিটার অনেকগুলো প্রিন্ট করে ফেলো…হুম, এক থেকে দেড়শ’ কপি? কিংবা যতোগুলো দরকার পড়ে।”

জামান একটু অবাক হলো। “এতোগুলো?”

“হুম। সারা শহরে ডিস্ট্রিবিউট করে দিতে হবে। খুব দ্রুত।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

একটু ভেবে বললো জেফরি । “মেয়েটার মা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আছে না?”

“জি, স্যার।”

“ওখানে কি সাদা পোশাকের পুলিশ আছে?”

“আছে।”

“তার বাড়ির আশেপাশে?”

“সেখানেও আছে।”

“গুড।” আবারো একটু ভেবে সহকারীকে বললো সে, “কেরাণীগঞ্জের ইকুরিয়া থানার আশেপাশে, বৃজের দুই পারে মেয়েটার ছবি নিয়ে খোঁজ করতে হবে। এই কাজটা করবে তুমি নিজে। ফিল্ডের কাজ। আরো দু’তিনজনকে সাথে করে নিয়ে যাও। এ ব্যাপারে ইকুরিয়া থানারও সহযোগীতা নিতে পারো । আমি রমিজ লস্করকে বলে দিচ্ছি সবগুলো থানায় মেয়েটার ছবি পাঠিয়ে দিতে।”

“আমি কি এখনই চলে যাবো ওখানে?”

“হ্যাঁ। দেরি কোরো না। ফিল্ড থেকে আশা করি কিছু পাওয়া যাবে।”

জামান সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়লো।

.

বাস্টার্ড বুঝতে পারছে না এই মেয়েটাকে নিয়ে সে কী করবে। এমন নয় যে পুলিশের কাছে ধরা পড়লে এই মেয়ে তার সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। মেয়েটা খুবই নিরীহ। একটা বড়সড় ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেছে। এমন ঝামেলা যা তার জীবনটাকে তছনছ করে দিতে পারে। কিন্তু সে চায় না মেয়েটার কোনো ক্ষতি হোক। কোনোভাবেই চায় না। কালকের রাতের পর থেকে এক ধরণের মায়া জন্মে গেছে মেয়েটার উপর।

আড়চোখে তাকালো উমার দিকে। এখন তারা বসে আছে সিএনজি’তে। জুরাইন রেলগেটে আর্টকে আছে সেটা। রেলক্রসিংয়ে ফটক পড়েছে, এখান দিয়ে একটু পরই রেল যাবে । তাদের গন্তব্য গুলশান। উমা জানে না গুলশানে কেন যাচ্ছে। সিএনজি নেবার সময় সে জানতেও চায় নি গুলশানে কেন যাচ্ছে তারা। মেয়েটার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে।

“আমার মাকে দেখতে যাবো,” আস্তে করে বললো উমা ।

“সেটা সম্ভব না ।” সোজাসুজি বলে দিলো বাস্টার্ড । “ওখানে সাদা পোশাকের পুলিশ আছে।”

চুপ মেরে রইলো উমা।

“তোমার বাড়ির আশেপাশেও পুলিশ আছে।”

“কিন্তু মার সাথে দেখা করাটা জরুরি।”

“এটা পুলিশও জানে…তুমি হাসপাতালে একবারের জন্যে হলেও যাবে।”

“আমি কি এভাবেই পালিয়ে বেড়াবো?” কাঁদো কাঁদো গলায় বললো মেয়েটি।

“না।” জ্যামে আটকা পড়ে বিরক্তি ধরে গেছে তার, তারপরও শান্ত কণ্ঠে বললো, “একটা ব্যবস্থা করবো…খুব জলদিই করবো।”

উমা কিছু বললো না । এই লোকটা যে তাকে খুন করবে না সেটা সে বুঝে গেছে। আরো বুঝে গেছে লোকটা কোনোভাবেই চায় না সে বিপদে পড়ক। পুলিশের কাছে ধরা পড়ুক। কিন্তু তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, আর এইসব প্রশ্নের একটারও উত্তর তার জানা নেই।

এই লোকটা কে। কেন সে ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের লোকজনকে খুন করছে। ব্ল্যাক রঞ্জুর ঠিকানা জানতে চাচ্ছে। অন্য দিকে পুলিশ এতো দ্রুত কিভাবে তাদের অবস্থান জেনে যাচ্ছে। তার পরিবারের লোকজনের অবস্থা কি। তাদেরকে পুলিশ কি করেছে। তাকে ধরতে পারলেই বা পুলিশ কি করবে-কিছুই তার জানা নেই।

ভেতরে ভেতরে সে অস্থির থাকলেও ভয়ে কুকড়ে আছে। পাশে বসা অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকটার দিকে তাকালো। ট্রাফিক জ্যামের দিকে উদাস হয়ে চেয়ে আছে। চেহারাটা একেবারে নিষ্পাপ শিশুর মতো। রেগে না গেলে তাকে কেউ খুনি হিসেবে কল্পনাও করতে পারবে না। নির্দ্বিধায় যে লোকটি মানুষ খুন করতে পারে সে-ই কিনা শিশুর মতো ভেঙে পড়েছিলো কাল রাতে। ইচ্ছে করলে লোকটাকে ফেলে চলে যেতে পারতো সে। কেন যায় নি জানে না।

রেল চলে যাবার পর তাদের সিএনজিটা ছুটতে শুরু করলো আবার ।

.

জামান বুদ্ধি করে গাড়ি নিয়ে আসে নি, সে এসেছে একটা মোটরসাইকেলে করে। তারা দুজন এসেছে। বাইকটা চালাচ্ছে ডিপার্টমেন্টে সদ্য যোগ দেয়া এক জুনিয়র ছেলে-হোমিসাইডে যাদেরকে বলা হয় জুনিয়র ইনভেস্টিগেটর।

ইকুরিয়া থানা থেকে সহযোগীতা পাওয়া যাবে তাই তিনজনের জায়গায় দু’জন এসেছে, ফলে মোটরসাইকেলে করে দ্রুত চলে আসতে পেরেছে প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুতে। এই সেতুর কাছেই সাদা রঙের গাড়িটা পাওয়া গেছে-একটা ভুয়া নাম-পরিচয়ে সেটা রেজিস্ট্রি করা। ডিটেইল চেক না করলে কোনো ট্রাফিক পুলিশ বুঝতে পারবে না গাড়িটার কাগজপত্র আসলে জাল।

ইকুরিয়া থানার দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর আগে থেকেই তাদের জন্য বৃজের গোড়ায় অপেক্ষা করছিলো। সাদা রঙের গাড়িটা এখনও জায়গামতোই আছে। পরে থানায় নেয়া হবে। সেই গাড়ির সামনেই থামলো জামানের মোটরসাইকেলটা ।

থানার ইন্সপেক্টরদের সাথে পরিচয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দ্রুত কাজে নেমে গেলো তারা।

জামান খেয়াল করলো বৃজের গোড়ায় সারি সারি সিএনজি পার্ক করা আছে। দৃশ্যটা দেখেই তার মাথায় চট করে একটা আইডিয়া চলে এলো। খুনি কি তাহলে গাড়িটা এখানে ফেলে রেখে কোনো সিএনজি’তে করে চলে গেছে?

এটার সম্ভাবনা আছে। যদি তা নাও করে থাকে এখানকার কেউ হয়তো মেয়েটাকেসহ খুনিকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেছে। এখান থেকেই তো খুনি সটকে পড়েছে, সুতরাং কাজটা এখান থেকেই শুরু করা যাক।

“একটু আগে এই মেয়েটা এখানে ছিলো, তাকে কি দেখেছেন?” সারি সারি সিএনজি’র মধ্যে থেকে একজন ড্রাইভারকে ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো জামান। ড্রাইভার লোকটা অলস ভঙ্গিতে বসেছিলো, ইকুরিয়া থানার দু’জন পুলিশ দেখে বের হয়ে এলো।

“না, স্যার। আমি তো এইমাত্র আইলাম। আপনে ট্যাগরা সালামরে জিগান…ওই তো অনেকক্ষণ ধইরা এইখানে আছে…ওর সিএনজি নষ্ট হইয়া গেছে। ওই কইতে পারবো।”

ট্যাগরা সালাম নিজের নষ্ট হয়ে যাওয়া সিএনজির পেছনের ঢাকনা খুলে উপুড় হয়ে কী যেনো দেখছে। পুলিশ দেখে সেও সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

“মাইয়াটারে তো চিনা চিনাই লাগতাছে…” ট্যাগরা সালাম ছবিটা দেখে বললো, ছবির দিকে চেয়ে থাকলেও মনে হচ্ছে অন্য দিকে চেয়ে আছে।

“একটু আগে দেখেছেন?” জামান জানতে চাইলো। “ঐ যে সাদা রঙের গাড়িটা আছে না…ওটা থেকে নেমেছে…” অদূরে পার্ক করে রাখা সাদা রঙের গাড়িটা দেখিয়ে বললো সে।

ট্যাগরা সালাম সাদা রঙের গাড়িটার দিকে তাকালো, কিন্তু জামানের কাছে মনে হলো সে রাস্তার অন্য একটা দিকে তাকাচ্ছে। লোকটা ট্যারা। গভীর মনোযাগ দিয়ে ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো আবার ।

“ঐ গাড়ি থেইকা নামছে?” মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। “গাড়ি থাকতে সিএনজি’তে উঠবো ক্যান?”

ট্যাগরা সালামের কথায় জামানের মেজাজ চড়ে গেলো। “সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি বলেন, মেয়েটাকে দেখেছেন কিনা।”

“গাড়ি থেইকা তো নামতে দেখি নাই…” খুব বিচক্ষণতার সাথে জবাব দিলো সে। তার চোখ পাশে দাঁড়ানো পুলিশের দিকে। জামান জানে লোকটা আসলে চেয়ে আছে তার দিকে।

“তাহলে কি থেকে নামতে দেখেছেন?”

“এইটা তো আমি কইবার পারুম না…আমি তো গাড়ির চিন্তায় অস্থির…ভাবতাছিলাম আইজকা জমার খরচ উঠবো কেমনে।”

“তাহলে আপনি দেখেন নি?” অধৈর্য হয়ে জামান বললো।

“আমি তো তা কই নাই।”

নড়েচড়ে উঠলো জামান। “তার মানে দেখেছেন?”

“হেরা তহন আমার কাছে আইয়া কইলো, ভাই যাইবেন নি?…আমি কইলাম, না। আমার গাড়ি তো নষ্ট”।

“এটা কে বললো?” জামান তার কথার মাঝখানে জিজ্ঞেস করলো ।

“মাইয়াটার লগে যে ব্যাটা আছিলো হে…”

“তারপর?”

“তারপর আর কি…আমার পরে যে গাড়িটা আছিলো ঐটার কাছে গেলো…কইলো-”

লোকটার বেশি কথা শোনার মতো ধৈর্য নেই জামানের। “ঐ গাড়িটা কার ছিলো? তাকে কি আপনি চেনেন?”

“চিনুম না ক্যান…কন দেহি কী রকম কথা!” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইকুরিয়া থানার এক সাব-ইন্সপেক্টরকে বললো সালাম। তার দৃষ্টি এখনও বিভ্রান্ত করছে। জামানকে।

“সেই ড্রাইভারটা কে?…তার নাম কি?”

“আমাগো ইউসুফ ভাই…খুব ভালা লোক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, এইখানকার”

জামান ট্যাগরা সালামের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললে, “ইউসুফ ড্রইভার এখন কোথায়?”

“কোথায় আবার! খ্যাপ মারতাছে…হের গাড়ি কি আমার মতোন নষ্ট অইছে নি যে বইয়া বইয়া বাল-” ট্যাগরা সালাম মনে মনে জিভ কাটলো । আরেকটু হলে পুলিশের সামনেই বেফাঁস কথাটা হয়ে যেতো।

“ইউসুফ ড্রাইভার এখানে কখন আসবে?” ট্যাগরা সালামের বেশি কথা শুনে তার মেজাজ বিড়ড়ে গেলেও লোকটার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, সুতরাং মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে শান্ত কণ্ঠে বললো জামান।

“ডাকলেই আইবো…”

“মানে?”

এবার দাঁত বের করে হেসে বললো ট্যাগরা সালাম, “হের লগে মোবাইল আছে তো।”

ট্যাগরা সালামের কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিয়ে ইউসুফ ড্রাইভারকে ফোন করে জানা গেলো লোকটা এখন জিঞ্জিরা বাজারের কাছেই কোথাও আছে। পুলিশের পরিচয় দিলে লোকটা একটু থতমত খেয়ে গেলো। তবে জানালো দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই আসছে।

মাঝবয়সী ইউসুফ ড্রাইভার লোকটা যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সেটা তার কপালের দাগ দেখেই বোঝা গেলো। বেশ ধীরস্থির আর নম্র স্বভাবের। জামান তাকে ছবিটা দেখালো।

“এই মেয়েটা এক যুবকের সাথে ছিলো, একটু আগে আপনার গাড়িতে উঠেছিলো তারা। চিনতে পেরেছেন?”

ইউসুফ ছবির দিকে চেয়ে চুপ মেরে গেলো। অবশেষে বললো, “তাগোরে খুঁজতাছেন ক্যান?”

“আমরা মেয়েটাকে খুঁজছি না, খুঁজছি তার সাথের ছেলেটাকে…”

“ছেলেটা কি করছে?” ভুরু কুচকে জানতে চাইলো ইউসুফ।

“সে কী করেছে সেটা আপনার জানা দরকার নাই, আপনি বলুন তাদেরকে কোথায় নামিয়ে দিয়ে এসেছেন।” জামান একটু ঝাঁঝের সাথেই বললো কথাটা। .

“আমি হেগোরে দেহি নাই,” পাল্টা ঝাঁঝের সাথে বললো ইউসুফ।

জামান বুঝতে পারলো লোকটার সাথে অন্যভাবে কথা বলতে হবে । “ট্যাগরা সালাম নামের একজন বললো এই মেয়েটা আর এক যুবক আপনার গাড়িতে উঠেছিলো…”

ইউসুফ চুপ মেরে রইলো।

“মেয়েটার সাথে যে ছিলো সে খুব ডেঞ্জারাস লোক…আপনি জানেন না সে কী করেছে।”

“জানি, ভালা কইরাই জানি।”

ড্রাইভার ইউসুফের কথা শুনে মারাত্মক ধাক্কা খেলো জামান। “আপনি জানেন সে কি করেছে!”

“প্রেমই তো করছে, খুনখারাবি তো আর করে নাই!”

“কি!?” জামান যারপরনাই বিস্মিত হলো। “আপনি এসব কী বলছেন?”

“কি কইতাছি হেইটা তো আপনেও জানেন…হুনেন, তাগোরে ধইরা লাভ হইবো না…এতোক্ষণে মনে হয় বিয়া কইরা ফালাইছে।”

.

প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, কিছু খাওয়া দরকার। গোসল করে একটু বিশ্রামও নেয়ার দরকার আছে। তার শরীরটা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। গুলির আঘাতে অনেক ব্লিডিং হয়েছে। জ্বর জ্বর লাগছে। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সেটা ভাবার আগে দুটো কাজ করতে হবে তাকে : মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করা আর গলফ ব্যাগে থাকা বিশাল পরিমাণের টাকা নিরাপদ কোথাও রাখা।

তাদের সিএনজিটা থামলো গুলশানের এক গেস্টহাউজের সামনে। দোতলার এই গেস্টহাউজটি এই এলাকার আরো অসংখ্য গেস্টহাউজের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা কারণে ভিন্ন : এর মালিক ক্ষমতাসীন দলের একজন এম.পি। ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে ঢুকে পড়লো সেই গেস্টহাউজে।

মাঝবয়সী এক লোক বসে আছে ফ্রন্টডেস্কে। জায়গাটা একেবারে নিরিবিলি। বাস্টার্ড লোকটাকে বললো তাদের একটা রুম দরকার।

“নাইট স্টে করবেন, স্যার?” জানতে চাইলো লোকটা। বার বার আড়চোখে উমাকে দেখছে।

“না।”

হঠাৎ লোকটা দাঁত বের করে হেসে বাস্টার্ডকে এড়িয়ে ডেস্ক থেকে সরে গেলো। বাস্টার্ড পেছন ফিরে দেখলো এক মাঝবয়সী লোক, সঙ্গে বোরকা পরা এক মহিলাকে নিয়ে ফ্রন্টডেস্কের সামনে এসে তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছে। বোঝা যাচ্ছে লোকটা এখানকার পুরনো এবং নিয়মিত কাস্টমার। ফ্রন্ট ডেস্কের লোকটা বাস্টার্ডের দিকে ফিরে বললো, “একটু ওয়েট করেন, প্লিজ। লোকটা ডেস্কের নীচ থেকে একটা চাবি বের করে মাঝবয়সী লোকটার হাতে তুলে দিলো। “২০৩, স্যার।” কোনো ফর্মালিটিজের ধার ধারলো না।

মাঝবয়সী লোকটা বোরকা পরা মহিলাকে নিয়ে হাসিমুখে চলে গেলো ২০৩ রুমে। বাস্টার্ড বুঝতে পারলো বোরকা পরার কারণ কি-নিজের পরিচিত মুখটা আড়াল করার চেষ্টা।

এবার বাস্টার্ডের দিকে ফিরলো লোকটা। “কী যেনো বলছিলেন?”

“রুম দরকার।” কাটাকাটাভাবে বললো সে।

“নাইট স্টে করবেন?” আবারো একই প্রশ্ন।

“না।”

মুখ টিপে হেসে আড়চোখে উমার দিকে তাকালো লোকটা।

তেমন কোনো ফর্মালিটিজ করতে হলো না। বাস্টার্ড নিজের নাম বললো তওফিক আহমেদ। একটা কাগজে স্বাক্ষর করার পর লোকটা অল্পবয়সী এক ছেলেকে ডেকে তাদেরকে রুমে নিয়ে যেতে বললো। তার রুম নাম্বার ২০৬। তার মানে দোতলায়।

ইচ্ছে করেই বাস্টার্ড গেস্টহাউজে উঠেছে । সে জানে এখানে তেমন কোনো ফর্মালিটি করতে হয় না। যেকোনো একটা নাম বললেই হলো। কেউ কিছু জানতে চাইবে না। হোটেলের চেয়ে অনেক ভালো আর নিরাপদ হলো গেস্ট হাউজ আর সেটা যদি হয় সরকারী দলে কোনো এমপি সাহেবের তাহলে তো কথাই নেই। বাস্টার্ড জানে এখানে ভুলেও পুলিশ আসবে না। সরকারী দল মানে রাজার দল, রাজা-বাদশাদের নিয়ে পুলিশ ঘাটাঘাটি করে না ।

ঘরে ঢুকেই বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো বাস্টার্ড। শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চেয়ে দেখলো উমা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

“তুমি গোসল করে নিতে পারো। আমি একটু বিশ্রাম নিই।”

একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো তাকে।

“যাও, গোসল করে আসো। আমিও গোসল করবো একটু পর। তারপর খেয়ে নিতে হবে। এখানে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বাইরে থেকে আমি নিয়ে আসবো।”

উমা আস্তে করে বিছানার প্রান্তে বসলো। “পিসির সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

বাস্টার্ড উঠে বসলো বিছানায় । “তোমার পিসির কাছে ফোন করলেই পুলিশ জেনে যাবে আমরা কোথায় আছি।”

বিস্মত হলো উমা। পুলিশ কিভাবে জানবে আমরা এখানে আছি?”

“তুমি বুঝবে না। তোমার পিসি’র ফোন নাম্বার পুলিশের কাছে চলে গেছে। ঐ নাম্বারটা খুব সম্ভবত ট্যাপিং করা হচ্ছে। ফোন করলেই তারা বুঝে যাবে,..”

“কিন্তু আমার পিসির কাছে তো কোনো মোবাইল নেই,” বললো উমা।

এবার বাস্টার্ড অবাক হলো। “মোবাইল নেই! তাহলে তুমি তাকে ফোন করবে কিভাবে?”।

“পাশের ঘরে এক ভাড়াটিয়া আছে, তাকে ফোন করে যদি বলি জরুরি দরকার আছে তাহলে পিসিকে ফোনটা দেবে।”

একটু ভাবলো বাস্টার্ড। তার কাছে অনেকগুলো ফোন আছে। সবগুলোই বন্ধ। তবে তার নিজের নাম্বার থেকে সুলতান, লেডি গিয়াস কিংবা মিনা আপার নাম্বারে ফোন করা হয় নি। সেটা ব্যবহার করা যেতে পারে।

“ঠিক আছে, ফোন করতে পারো, তবে ফোনটা করবো আমি…তারপর তোমার পিসির কাছে ফোন দেয়া হলে তুমি কথা বোলো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মেয়েটি। উমার কাছ থেকে নাম্বারটা জেনে ডায়াল করলো বাস্টার্ড । ফোন করে কি বলতে হবে সেটাও বলে দিলো সে।

“আপনি সুলোচনা পিসিকে চাইবেন, বলবেন খুব জরুরি,” বললো উমা ।

“হ্যালো,” একটা নারী কণ্ঠ বললো অপরপ্রান্ত থেকে।

“স্লামালাইকুম…”

“ওয়ালাকুম সালাম…কাকে চাই?”

“আমি একটু সুলোচনা পিসিকে চাইছিলাম…খুব জরুরি…আপনি যদি একটু কষ্ট করে উনাকে দিতেন খুব উপকার হতো।”

“একটু ধরেন।” ওপাশ থেকে কণ্ঠটা বললো।

কিছুক্ষণ পরই সুলোচনা পিসি ফোনটা ধরলে সাথে সাথে উমাকে ফোনটা দিয়ে দিলো সে।

“পিসি, আমি,” উমা ব্যাকুল হয়ে বললো পিসিকে।

“হায় ভগবান! তুই কোথায়? কেমন আছিস? তোর চিন্তায় তো আমরা অস্থির হয়ে আছি…” মহিলা হরবর করে বলে চললো।

“পিসি, শোনো, আমি ভালো আছি।”

“মারে, পুলিশ তোকে খুঁজছে কেন? কী করেছিস তুই?”

“পিসি, আমি কিছু করি নি। তবে বিরাট একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি। সব বলবো,” উমা বাস্টার্ডের দিকে তাকালে বাস্টার্ড মাথা নেড়ে সায় দিলো। “আমি ভালো আছি। খুব জলদি বাসায় ফিরে আসবো। আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। পুলিশ এলে বলবে আমি কোথায় আছি তোমরা জানো না। আমার সাথে তোমাদের কোনো যোগাযোগ হয় নি।”

“এখন কোথায় আছিস?”

“পিসি, সব বলবো। এখন কোনো প্রশ্ন কোরো না…বাবাকে বলবে আমি মায়ের সাথে হাসপাতালে আছি।”

“বাবাকে নিয়ে চিন্তা করিস না…তোর মায়ের অবস্থাও ভালো। আমি একটু আগে গিয়ে দেখা করে এসেছি। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো…বললাম তুই কাজ নিয়ে একটু ব্যস্ত আছিস।”

“ঠিক আছে, পিসি। এখন রাখি, পরে আবার যোগাযোগ করবো।”

“ভগবান তোর মঙ্গল করুক।”

ফোন রেখে বাস্টার্ডের দিকে তাকালো উমা।

“যাও, এবার গোসল করে নাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

.

একটু আগে জামানের কাছ থেকে ফোনে সব জানতে পেরেছে জেফরি। খুনি একটা সিএনজি’তে করে পালাতে চেয়েছিলো কিন্তু বৃজের উপর টহলপুলিশের ব্যারিকেড দেখেই গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায় বৃজের গোড়ায় । ড্রাইভার ইউসুফকে একটা প্রেমকাহিনীর গল্প বলে পটিয়ে ফেলে। বেচারা সহজ সরল ড্রাইভার সেই প্রেমকাহিনী বিশ্বাস করে খুনিকে দ্রুত নিরাপদে পালিয়ে যাবার বুদ্ধিটা দিয়ে দেয়। সিএনজি ড্রাইভার ইউসুফের কাছ থেকে মূল্যবান একটি তথ্য পাওয়া গেছে : খুনির গন্তব্য ছিলো গুলশানে।

ঠিক আছে, তাহলে গুলশানে খুনির একটা ঠিকানা আছে হয়তো। সেখানে একটু নজরদারি করতে হবে। মনে মনে গুছিয়ে নিলো ব্যাপারটা।

ত্রিশ বছরের এক যুবক, সঙ্গে পঁচিশ বছরের এক যুবতী, যুবকের হাতে একটা ব্যাগ আছে। তাদের গন্তব্য ছিলো গুলশানে। কোনো গাড়ি ব্যবহার করছে না। রিক্সা ব্যবহার করতে পারবে না। গুলশানের বেশিরভাগ রোডেই রিক্সা চলে না। তাহলে? সিএনজি কিংবা ট্যাক্সিক্যাব ব্যবহার করবে তারা। গুলশান থানা আর ঐ এলাকার সব ট্রাফিক-পুলিশকে জানিয়ে দিতে হবে।

জামানকে ফিল্ডে পাঠিয়ে যে ভালো ফল পাওয়া গেছে তাতে করে জেফরি ভীষণ খুশি। সে জানে ঘরে বসে যতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক না কেন ফিল্ডের কোনো বিকল্প নেই। মাঠে নামলেই পরিস্কার চিত্র পাওয়া যায়।

একটু আগে হোমিসাইডের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ফারুক আহমেদের রুমে গিয়েছিলো সে। মহাপরিচালক মোটামোটি সন্তুষ্ট। ঘটনা ঘটার পর মাত্র এক দিন অতিক্রান্ত হয়েছে, এতো অল্প সময়ে যতোটুকু অগ্রগতি হয়েছে তাতে তিনি খুশি। জেফরিকে আরো সময় নিয়ে কাজ করতে বলেছেন তিনি। এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তিনটি খুন যদি একই সূত্রে গাঁথা হয়ে থাকে তাহলে হাতে যথেষ্ট সময় আছে। সে যেনো ধীরেসুস্থে তদন্ত করে। সময়ের ব্যাপারে কোনো রকম চাপ নেই।

“স্যার?”

নিজের ডেস্কে বসে আছে জেফরি । মুখ তুলে তাকালো। রমিজ লস্কর দরজা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছে।

“আসো।”

“স্যার, কমিউনিকেশন রুম থেকে এলাম…একটা ফোন ডিটেক্ট করা গেছে।”

নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো জেফরি । “কোন ফোনটা?”

“উমা রাজবংশী নামের মেয়েটার পাশের ঘরে যে ভাড়াটে থাকে তার ফোনটা। আমরা তো তার পাশের ঘরে প্রায় সবার ফোন নাম্বার জোগার করেছিলাম…”।

“কোত্থেকে করেছে?”

“গুলশানের একটা প্রাইভেট প্রোপার্টি থেকে কলটা করা হয়েছে। আমাদের ম্যাপে জায়গাটার তেমন কোনো ডেসক্রিপশন নেই। শুধু দেখা যাচ্ছে প্রাইভেট পোপার্টি।”

গুলশান! একটু আগেই সে এটা ভাবছিলো। “হোল্ডিং নাম্বারটা কতো?”

“৭ নাম্বার রোডের ২৩ নাম্বার বাড়ি, স্যার।”

ঢাকা শহরের ভার্চুয়াল ম্যাপ তৈরি করার সময় যেসব জায়গা আভার কনস্ট্রাকশনে ছিলো সেগুলোকে শুধুমাত্র হোল্ডিং নাম্বার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই জায়গাটা বোধহয় সেরকম কোনো জায়গা হবে। তা না হলে আরো কিছু ডেসক্রিপশন থাকতো ।

নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে জামানকে ফোন করলো জেফরি । রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। মোটরসাইকেলে আছে। রিং হবার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। জেফরি আবারো চেষ্টা করলো। চার বারের বার কলটা রিসিভ করলো জামান।

“জি, স্যার?”

“তোমরা এখন কোথায় আছো?”

“মতিঝিলে, স্যার।”

“শোনো, অফিসে আসার দরকার নেই, তোমরা গুলশান দুই নাম্বারে চলে যাও। সেখানে ৭ নাম্বার রোডের ২৩ নাম্বার হোল্ডিং নাম্বারটায় সম্ভবত খুনি আর মেয়েটা আছে…জায়গাটা খুঁজে বের করে লোকাল থানার সাহায্য নিয়ে রেড দেবে। দ্রুত কাজ করতে হবে, ঠিক আছে?”

“জি, স্যার।”

.

বাস্টার্ড গুলশান দুই নাম্বারের গোলচক্করে এসে একটা রেস্তোরাঁ দেখতে পেলো। এখানে অনেক ফাস্টফুডের আউটলেট থাকলেও ভালোমানের বাংলা খাবারের রেস্তোরাঁর সংখ্যা খুব বেশি নেই। বাস্টার্ডের ইচ্ছে করছে দেশি খাবার খেতে।

দু’জনের জন্য লাঞ্চ নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো কারণ রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। যে গেস্টহাউজে উঠেছে সেখানে রিক্সা যায়ও না, অগত্যা পায়ে হেঁটেই রওনা হলো সে। শরীর যে খুব দুর্বল হয়ে গেছে টের পেলো। রীতিমতো হাফাচ্ছে। এটুকু পথ হাঁটতেই এই অবস্থা!

ঠিক করলো পেট ভরে খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নেবে। কী করবে না করবে সেসব পরে ভাবা যাবে, আগে তার প্রয়োজন বিশ্রামের।

মেইন রোড থেকে ৭ নাম্বার রোডে ঢুকতেই দেখতে পেলো দু’জন মোটরসাইকেল আরোহী ফুটপাতের পাশে বাইক থামিয়ে এক লোককে কী যেনো জিজ্ঞেস করছে। বাস্টার্ডের গা ছমছম করে উঠলো। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো সে। ইচ্ছে করেই মোটরসাইকেল আরোহীদের কাছ দিয়ে এগিয়ে গেলো যেনো তাদের কথাবার্তা শুনতে পায়।

“হাউজ নাম্বার ২৩ কোনো বাসা বাড়ি না?” মোটরসাইকেলে পেছনের সিটে যে বসে আছে সে বললো পথচারীকে।

“না। ওইটা তো গেস্টহাউজ। সামনে গিয়া ডাইনে গেলেই দেখবেন বড় কইরা গেস্টহাউজ লেখা আছে,” লোকটা বললো।

বাস্টার্ড তার হাটা ধীরগতির করে ফেললো। তার হাতে খাবারের প্যাকেট। হঠাৎ থেমে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের কর কথা বলার ভান করলো সে। চলতিপথে ফোন এসে পড়েছে, ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। একজন মানুষ। মোটরসাইকেল আরোহীদের সামনে এসে অন্য দিকে তাকিয়ে কাল্পনিক সংলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

যে লোকটাকে মোটরসাইকেল আরোহীরা থামিয়েছিলো সে চলে গেলো নিজের গন্তব্যে। বাস্টার্ড এখনও ফোনালাপে ব্যস্ত। তবে একেবারে থেমে না থেকে এক পা দু’পা করে এগোতে লাগলো যেনো আরোহীরা সন্দেহ না করে। মাটরসাইকেলটা তাকে অতিক্রম করে সামনে চলে গেলে সেও হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো সঙ্গে সঙ্গে।

গেস্টহাউজের সামনে এসে আবারো মোটরসাইকেলটা থামলো। এবার . আরোহীদের একজন কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলছে। বাস্টার্ড তার কানে ফোনটা ধরে রেখে আস্তে আস্তে মোটরসাইকেলের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুধু অল্প কিছু কথাই শুনতে পেলো, কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট।

“স্যার, এটা একটা গেস্টহাউজ,..জি…স্যার…না, স্যার…থানা থেকে ব্যাকআপ টিম আসার জন্যে বলি নি…আগে জায়গাটা লোকেট করে নিলাম… এক্ষুণি বলছি…ঠিক আছে, স্যার । জি, স্যার…”

হন হন করে হেঁটে গেলো সে। কোমরে পিস্তলটার অস্তিত্ব টের পেলো। এটার হয়তো দরকার হতে পারে। মাইগড! আবারো তারা তার অবস্থানের কথা জেনে গেছে!

কিন্তু কিভাবে?

এসব পরে ভাবা যাবে, এখন দরকার দ্রুত গেস্টহাউজে ঢোকা। সে বুঝে গেছে এই দু’জন মোটরসাইকেল আরোহী পুলিশের ব্যাকআপ টিমের সাহায্য চেয়ে পাঠাবে এক্ষুণি । গুলশান থনায়! হ্যাঁ। এখান থেকে থানাটা কতোক্ষণের পথ?

বুঝতে পারলো খুব বেশি সময় তার হাতে নেই।

বাস্টার্ড টের পেলো তার কপাল বেয়ে ঘাম জমতে শুরু করেছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। জানে, মাথা ঠাণ্ডা না রাখলে বিপদে পড়ে যাবে। মোটরসাইকেল আরোহীদের অতিক্রম করে ঢুকে পড়লো গেস্টহাউজে। দ্রুত ভেবে নিলো কি করবে।

তার রুমের সামনে এসেই মাথায় একটা আইডিয়া চলে এলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ২০৩ রুমটা কোথায়। খুব কাছেই থাকার কথা। এই রো’তেই হবে। হ্যাঁ। ঐ তো, তার রুমের দুটো রুমের পরই।

নিজের রুমের দরজায় পর পর তিন-চারটা টোকা দিলে একটু পরই দরজা খুলে দিলো উমা। সদ্য গোসল করেছে। চুলগুলো এখনও ভেজা । তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে খাবারের প্যাকেটটা কফি টেবিলের উপর রেখে দিলো সে। উমা বুঝতে পারছে তার মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করছে।

“জলদি চলো, আমাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে,” উমাকে তাড়া দিয়ে বললো সে।

“কেন, কি হয়েছে?” ভয় পেয়ে গেলো উমা।

“কোনো প্রশ্ন কোরো না, যা বলছি তাই করো।”

পুলিশ? আৎকে উঠলো মেয়েটা। এখানে!

গলফ ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিলো বাস্টার্ড । “মাথা থেকে তোয়ালেটা খুলে ফেলো। কাপড়চোপড় ঠিক করে নাও…জলদি!”

ঘরের ভেতর একটা বন্ধ জানালার সামনে চলে গেলো বাস্টার্ড। খুব সম্ভবত জানালাগুলো দিয়ে গেস্টহাউজের সামনে যে পার্কিংলনটা আছে সেটা দেখা যায়, তার মানে মেইন গেটটাও দেখা যাবে। জানালার ভারি পর্দা সরিয়ে একটু ফাঁক করতেই তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো।

মোটরসাইকেলটা হুরমুর করে গেস্টহাউজে প্রবেশ করছে, তাদের ঠিক পেছন পেছন পুলিশের একটা জিপ।

ফাঁদে পড়ে গেছে সে!

.

অধ্যায় ২২

গেস্টহাউজে পুলিশের গাড়ি হুরমুর করে ঢুকে পড়তেই চরম নাটকীয় অবস্থার সৃষ্টি হলো। বেশিরভাগ গেস্টের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় নিলো না। তবে গেস্টহাউজের কর্তৃপক্ষ শুধু বিস্মতই হলো না, রেগেমেগে রীতিমতো যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আঁটকে দিলো জামানসহ গুলশান থানা থেকে আগত পুলিশের ছোটোখাটো দলটাকে। হাজার হলেও সরকারী দলের এম.পি সাহেবের গেস্টহাউজ, এভাবে পুলিশের আগমনে তাদের যে অপূরণীয় সুনাম হানি হবে সেটা কি কেউ পুষিয়ে দিতে পারবে, পারবে না। তাদের এখানে সমাজের অনেক উঁচুতলার লোক আসে, কেন আসে? নিরাপদ মনে করে তারা।

ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে দু’পক্ষের তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেলো।

ইতিমধ্যে গেস্টহাউজের ম্যানেজার এম.পি সাহেবকে ফোন করে জানালো, তিনি পুলিশকে রীতিমতো ভর্ৎসনা করতে শুরু করে দিয়েছেন টেলিফোনে। কিন্তু পুলিশ নাছোরবান্দা। একজন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী-খুনি গেস্টহাউজে আছে। ব্যাপারটা এম.পি সাহেবকে বুঝতে হবে। তিনি তো আইনপ্রণেতা। তিনি কি নিজের গেস্টহাউজে একজন খুনিকে আশ্রয় দিতে পারেন? না। ঠিক আছে, এম.পি সাহেব একমত পোষণ করে বললেন। তবে পুলিশের উচিত ছিলো আগেভাগে জানিয়ে আসা, তাহলে অন্তত গেস্টেদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়তো না। কিন্তু পুলিশ যেভাবে তার গেস্টহাউজে প্রবেশ করেছে তাতে করে তার বিরাট রকমের ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়ে গেছে। তাদের বোঝা উচিত ছিলো এটা এম.পি সাহেবের গেস্টহাউজ।

গুলশান থানার সাব-ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে জামান কথা বললো এম.পি সাহেবের সাথে ।

“স্যার, খুনিকে ট্রেস করতে করতে আমরা এখানে এসেছি। আগে থেকে জানার কোনো উপায় ছিলো না। তা না হলে অবশ্যই আপনাকে জানিয়ে আসতাম।”

মনে হলো এম.পি সাহেব কিছুটা নমনীয় হলেন। “না, সেটা ঠিক আছে, কিন্তু-”

জামান কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো, “স্যার, আমরা কোনো গেস্টকেই ডিস্টার্ব করবো না। শুধু যে রুমে খুনি আছে সেই রুমটা তল্লাশী করবো।”

“কিন্তু আপনারা কি করে জানবেন খুনি কোন্ রুমে আছে?” এম.পি সাহেবের সন্দিগ্ধ কণ্ঠ।

“স্যার, আমাদের কাছে খুনির ছবি আছে। আপনার ম্যানেজারকে ছবি দেখালেই বলে দেবে কোন রুমে সে আছে।” ইচ্ছে করেই জামান একটু মিথ্যে বললো। আসলে তার কাছে আছে উমা নামের মেয়েটির ছবি।

এম.পি সাহেব একটু ভেবে বললেন, “ঠিক আছে, আপনি যা বলছেন তা করতে পারেন তবে কোনো গেস্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না। অন্য কারোর রুমে গিয়ে তল্লাশীও চালানো যাবে না। শুধু আমার ম্যানেজার যে রুমের কথা বলবে, মানে যে রুমে আপনার ঐ খুনি আছে, শুধু সেই রুমটা, ঠিক আছে?”

“জি, স্যার। আপনি এ নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না।”

“ঠিক আছে, আমার ম্যানেজারকে দিন।”

জামান গেস্টহাউজের ম্যানেজারের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলো। লোকটা কানের কাছে ফোন নিয়ে শুধু জি জি করে গেলো এক নাগারে। ওপাশ থেকে একগাদা নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে, বুঝতে পারলো জামান।

ফোন রেখে ম্যানেজার জামানের দিকে ফিরলো। “আপনার কাছে নাকি খুনির ছবি আছে? দেখান আমাকে।”

জামান উমার ছবিটা তার হাতে তুলে দিলো। “দু’জন খুনি। একজনের ছবি আমাদের কাছে আছে…”

ম্যানেজার চোখ তুলে তাকালো জামানের দিকে। “মহিলা খুনি?”

“হুম…কিন্তু এই মহিলার সঙ্গে যে পুরুষটা আছে সে খুব বিপজ্জনক।”

মাথা দোলালো ম্যানেজার। “হ্যাঁ, এই মহিলা আর এক লোক কিছুক্ষণ আগেই এখানে উঠেছে।”

“কতো নাম্বার রুমে?” উত্তেজিত হয়ে উঠলো জামান।

“২০৬-এ।”

ম্যানেজারের কাছ থেকে জামান ২০৬-এর স্পেয়ার চাবি নিয়ে নিলো, তারপর গুলশান থানার পুলিশের দলটিকে সাথে নিয়ে ছুটে চললো সেই রুমের দিকে।

পুলিশের দলটি নিঃশব্দে অবস্থান নিয়ে নিলো ২০৬-এর দরজার দু’পাশে। জামান ইতিমধ্যে তার অটোমেটিকটা হাতে তুলে নিয়েছে। বলতে গেলে এই রেইডের নেতৃত্ব দিচ্ছে সে-ই।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মৃদু টোকা দিলো। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। দু’পাশে সশস্ত্র পুলিশদের দিকে একবার তাকালো সে। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জানালো তারা প্রস্তুত আছে।

স্পেয়ার চাবিটা ঢুকালো দরজার কি-হোলে। আস্তে করে ঘুরিয়ে দরজাটা দুই তিন ইঞ্চির মতো ফাঁক করে বুঝতে পারলো ভেতরে কোনো আলো জ্বলছে না। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় রুমের ভেতর ঢুকে পড়লো সে, হাতের অস্ত্রটা দু’হাতে ধরে একেবারে সোজা নাক বরাবর তাক করে রেখেছে।

তার ঠিক পেছনে থাকা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ঘরে ঢুকেই দরজার পাশে সুইচ টিপে দিলে বাতি জ্বলে উঠলো।

কেউ নেই!

রুম নাম্বার ২০৬-এ কেউ নেই!

বাথরুমটা চেক করে দেখা হলো। একদম ফাঁকা।

বিছানার পাশে ছোট্ট কফি টেবিলের উপর দুই প্যাকেট খাবার পড়ে আছে, কিন্তু খাওয়ার লোকগুলো উধাও হয়ে গেছে। একেবারে ভেলকিবাজির মতো . ব্যাপার।

গেলো কোথায়!

.

পুলিশ ঢোকার সাথে সাথেই বাস্টার্ড টের পেয়ে যায় বিরাট এক হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। এটাকে কাজে লাগিয়ে এখান থেকে সটকে পড়তে হবে। ভাগ্য ভালো, বিপদের মুহূর্তে তার মাথাটা বেশ ভালোমতো কাজ করেছে। দেখতে পায় উমা ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

যতোক্ষণ পুলিশ আছে এখান থেকে বের হতে পারবে না। কারণ মেইন গেট দিয়ে কোনোভাবেই কারো চোখে ফাঁকি দিয়ে বের হওয়া সম্ভব নয়। তবে এ ঘরে থাকলে বিপদে পড়ে যাবে। এখান থেকে বের হতে হবে। মাথাটা দ্রুত কাজ করতে শুরু করে তার। গলব্যাগটা হাতে নিয়ে উমাকেসহ বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে। সে জানতো কোথায় যেতে হবে তাকে।

রুম নাম্বার ২০৩-এর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আলতো করে টোকা মারে। প্রথম তিন-চারটি টোকায় কোনো সাড়া পায় নি। তবে যে-ই না ফিসফিসিয়ে বলে, “স্যার, আমি রুমসার্ভিস…দরজা খুলুন…”

সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে একটা ভয়ার্ত কণ্ঠ জানতে চায়, বাইরে নাকি পুলিশ এসেছে?”

“জি, স্যার…আপনার কোনো ভয় নেই। দরজা খুলুন। ম্যানেজার সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন। লোকটা দেরি করাতে আবার তাড়া দেয় সে। “স্যার, দেরি করবেন না, প্লিজ…”

আর দেরি করে নি, ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় মাঝবয়সী লোকটা। বাস্টার্ডকে দেখে ভড়কে যায় সে কিন্তু অস্ত্রের মুখে বোবা হওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারে নি।

উমাকে নিয়ে খুব সহজেই রুম নাম্বার ২০৩-এ ঢুকে পড়ে।

“কোনো চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না,” পিস্তলটা উঁচিয়ে বললো বাস্টার্ড।

মাঝবয়সী লোকটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা পরে আছে। সঙ্গের মহিলা যে খুলে ফেলা শাড়ি তড়িঘড়ি করে আবার পরেছে সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বোরকা পরার কারণে মহিলাকে দেখে চিনতে পারে নি, এখন বুঝলো মহিলা আর কেউ নয়, এক টিভি অভিনেত্রী। ঠিক নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করে না তবে নিয়মিত টিভি নাটকে তাকে দেখা যায়। বাস্টার্ড মহিলার নাম না। জানলেও উমা জানে এই মহিলার নাম রোমেনা চৌধুরি।

“আপনারা কি পুলিশ?” বেশ সন্দিগ্ধ হয়ে জানতে চাইলো লোকটা। বাস্টার্ডের সাথে উমাকে দেখে ভুরু কুচকে রেখেছে।

“চুপ! কোনো কথা বলবেন না। লোকটার মাথা বরাবর পিস্তল তাক করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, “আমি যা বলবো তাই করতে হবে, নইলে দুটোকেই গুলি করবো।”

পিস্তলের মুখে ভয়ে মাথা নেড়ে লোকটা জবাব দিলো, “ভাই, প্লিজ…ওটা সরিয়ে রাখুন। যা বলবেন তাই করবো, কিন্তু ওটা সরিয়ে রাখুন।”

.

ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে আবারো হট্টগোল। জামানের সাথে গেস্টহাউজ ম্যানোরের তকাতর্কি। ম্যানেজারের সাফ কথা, রুম নাম্বার ২০৬-এ খুনি উঠেছিলো, এখন তো তারা সবাই নিজের চোখেই দেখেছে ওখানে কেউ নেই। সম্ভবত খুনি পালিয়েছে। সুতরাং পুলিশের উচিত এখান থেকে চলে যাওয়া। তারা তো এম.পি সাহেবকে এ কথাই দিয়েছিলো, নাকি?

কিন্তু চারদিকে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও তারা কিভাবে পালালো?

আচ্ছা, ভালো প্রশ্ন। ম্যানেজারের মনে পড়ে গেলো একটা কথা। তথাকথিত খুনি গেস্টহাউজে ওঠার কিছুক্ষণ পরই তো বাইরে বেরিয়ে গেছিলো। তাকে তো আর ফিরে আসতে দেখে নি। আসলে বাস্টার্ড যখন খাবারের প্যাকেট নিয়ে ফিরে এসেছিলো তখন ফ্রন্ট ডেস্কে ম্যানেজার লোকটা ছিলো না।

“ঐ লোকটা রুমে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই তো বের হয়ে যায়, তাকে তো আর ফিরে আসতে দেখি নি,” জামানকে বললো ম্যানেজার।

“তাই নাকি,” অবাক হলো জামান। “তাহলে সেটা আমাদের আগে বলেন নি কেন?”

“ঐ সময়ে মনে পড়ে নি, কিন্তু এখন যখন বলছেন লোকটা তার রুমে নেই তখনই মনে পড়ে গেলো!”

জামান কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না। সে নিশ্চিত, এই ম্যানেজার লোকটা তাদেরকে এখানে থেকে ভাগানোর জন্য চালাকি করছে ।

“এমনও তো হতে পারে, খুনি অন্য কোনো রুমে ঢুকে আছে?” বললো জামান।

“অন্য কোনো রুমে ঢুকবে কি করে?…তার কাছে কি সব রুমের চাবি আছে নাকি?”

“আহ, চাবি থাকবে কেন…অন্য কোনো রুমে জোর করেও তো ঢুকে যেতে পারে। মনে রাখবেন তার কাছে পিস্তল আছে।”

ম্যানেজার একটু ঢোক গিললো। “আমার তা মনে হচ্ছে না।”

জামান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো লোকটার দিকে।

“ঐ লোকটা, মানে যাকে আপনারা খুনি বলছেন সে কি আপনাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেখেছে? সে কি জানতো আপনারা এখানে আসবেন?”

জামান কিছু বললো না ।

“আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেনো ঐ লোকটা আপনাদের দেখে “ ফেলেছে, তারপর হুট করে অন্য আরেকটা রুমে ঢুকে পড়েছে। আমি বুঝি না এইসব কেন বলছেন।”

অবাক হলো জামান। “কেন বলছি?”

“এই অজুহাতে আপনি সবগুলো রুম চেক করে দেখতে চাইছেন।” ম্যানেজার দৃঢ়তার সাথে বললো। যেনো জামানের চালাকিটা সে ধরে ফেলেছে।

উফ! মনে মনে বললো জামান। “আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, আপনার গেস্টহাউজে একজন খুনি ঢুকে বসে আছে আর আপনি কিনা রেপুটেশন নিয়ে চিন্তা করছেন। এখানে আপনার কোনো গেস্ট খুন হয়ে গেলে আপনাদের রেপুটেশনের কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছেন?”

ম্যানেজার একটু ভড়কে গেলো।

“এই খুনি গতকাল কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিন তিনটি খুন করেছে?”

ঢোক গিললো ম্যানেজার।

“আরো তিন-চারটা খুন করা তার জন্যে কোনো ব্যাপারই না।”

মনে হলো ম্যানেজার চিন্তায় পড়ে গেছে। “একটু দাঁড়ান। লোকটা এ কথা বলেই তার মনিবের কাছে ফোন করলো ।

“স্যার, পুলিশ তো রুম চেক করে কাউকে পায় নি…এখন বলছে সবগুলো রুম চেক করবে…” ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে কিছুক্ষণ কথা শুনে গেলো তারপর জামানের দিকে বাড়িয়ে দিলো ফোনটা।

“স্লামালেকুম, স্যার…জি, স্যার…না, সেটা তো বলেছিলাম কিন্তু…জি, জি, “ কিছুক্ষণ চুপচাপ কথা শুনে গেলো জামান। “স্যার, তাহলে অন্তত প্রতিটি রুমে আপনার লোক গিয়ে চেক করে আসুক। আমাদেরকে জানাক সব ঠিক আছে?…আমরা না হয় গেলাম না…কি বলেন?”

আবারো কিছুক্ষণ কথা শুনে গেলো।

“না, আমরা ফ্রন্ট ডেস্কের এখানেই থাকবো…জি, স্যার…আপনার ম্যানেজার কিংবা অন্য কেউ গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসবে…জি, জি…স্লামালেকুম, স্যার।”

জামান ফোনটা ম্যানেজারকে দিয়ে দিলে সেও কিছুক্ষণ কথা শুনে ফোনটা রেখে দিলো।

“শুনেন,” জামানকে বললো ম্যানেজার। প্রতি রুমে রুমে লোক পাঠানোর দরকার নেই…বুঝেনই তো, গেস্টরা বিরক্ত হবে। কে কী অবস্থায় আছে কে জানে!” কথাটা বলেই একটু ভুরু নাচিয়ে ইঙ্গিত করলো সে। জামান বুঝতে পারলো লোকটা কি বলতে চাচ্ছে। আমি বলি কি, ইন্টারকমে সবগুলো রুমে খোঁজ নিলেই ভালো হয়। সন্দেহজনক কিছুর আভাস পেলে না হয় চেক করে দেখা যাবে?”

লোকটার কথায় যুক্তি আছে। জামান একটু ভেবে রাজি হয়ে গেলো। ভালো করেই জানে বেশি চাপচাপি করলে এম.পি সাহেব হয়তো পুরোপুরি বিগড়ে যাবে। মন্দের ভালো হিসেবে এটা করা যেতে পারে।

“ঠিক আছে, তাই করুন। কিন্তু একটা শর্ত আছে…”

জামানের দিকে ভুরু কুচকে তাকালো ম্যানেজার। “কি শর্ত?”

“ইন্টারকমে আপনি কথা বলার সময় লাউডস্পিকারে দিয়ে রাখবেন যাতে আমি শুনতে পাই।”

ম্যানেজার একটু ভেবে নিলো। “কিন্তু গেস্টরা যেনো জানতে না পারে আপনারা তাদের কথা শুনছেন, কেউ কোনো শব্দ করবেন না, আমি এক এক করে তাদের সাথে কথা বলবো।”

ম্যানেজার এক এক করে গেস্টদের সাথে ইন্টারকমের মাধ্যমে কথা বলতে আরম্ভ করলো।

“হ্যালো স্যার, একটু ডিস্টার্ব করলাম, কিছু মনে করবেন না…”

“এখানে নাকি পুলিশ এসেছে?” আতঙ্কগ্রস্ত একটি কণ্ঠ জানতে চাইলো ।

“জি, স্যার, এসেছে কিন্তু অন্য একটা কাজে…আপনাদের কোনো সমস্যা নেই।”

“কি কাজে এসেছে?”

‘ওরা এসেছে আমাদের রিকোয়েস্টে…এখানে নাকি ফেরারি এক আসামি উঠেছে, তাকে ধরার জন্য…”

“তাকে কি ধরেছে?”

“না, স্যার, পায় নি।”

“তাহলে ওরা চলে যাচ্ছে না কেন?”

“এখনই চলে যাবে, স্যার। আমি আপনাদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য কল করেছি…আপনারা ঠিক আছেন কিনা…?”

“আমরা ঠিক আছি।”

“কোনো সমস্যা নেই তো, স্যার?”

“না, কোনো সমস্যা নেই।”

কম বেশি এরকম কথোপকথনই চললো বাকি গেস্টদের সাথে ।

সব ঠিক আছে। কোনো গেস্টই সামান্যতম সমস্যার কথা জানালো না। শুধু পুলিশের উপস্থিতি ছাড়া। লাউডস্পিকারে জামানও সব শুনেছে। তার কাছেও কারো কথা শুনে মনে হয় নি অস্ত্রের মুখে খুনি কথা বলিয়ে নিচ্ছে। দুয়েকজন গেস্টের মধ্যে যে নাভাস ভাব ছিলো সেটার কারণ একেবারে ভিন্ন।

মানসম্মানের ভয়!

অগত্যা জামানকে গেস্টহাউজ ছেড়ে চলে আসতেই হলো, কিন্তু তার মনে সংশয় কাটলো না। কিভাবে জাদুর মতো ভেলকি দেখিয়ে খুনি সটকে পড়লো? ম্যানেজার বলেছে তারা আসার দশ-পনেরো মিনিট আগে নাকি খুনি রুম থেকে বের হয়ে গেছিলো, তাকে আর ঢুকতে দেখে নি। তাহলে কি আবারো সে পুলিশের আগমনের কথা আগেভাগে জেনে গেছে?

খুনি তো এর আগেও কয়েকবার এরকম করেছে। সুতরাং এটা তো খুবই সম্ভব। তাহলে কি তার ধরাণাই ঠিক?

এটা আসলে গোয়েন্দা সংস্থার কোনো গোপন অপারেশন।

হয়তো পেশাদার কোনো খুনিকে দিয়ে কাজটা করানো হয়েছে। এখন তাকে রক্ষা করার জন্যে আগেভাগে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে সব কিছু। পদার অন্তরালে একটা সংস্থা সক্রিয়, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। কিন্তু সমস্যা হলো তার বস জেফরি বেগ এরকম কোনো থিওরি’তে বিশ্বাসী নয়।

গেস্টহাউজ থেকে বের হয়েই জেফরিকে ফোন করে জানালো গেস্টহাউজে খুনিকে পায় নি।

“সব রুম চেক করে দেখেছো?” ওপর প্রান্ত থেকে জেফরি জানতে চাইলো ।

“না, স্যার। খুনি যে রুমে উঠেছিলো সেই রুমটা দেখেছি । নেই।”

“সব রুম চেক করে দেখো।”

“স্যার, গেস্টহাউজটা সরকারী দলের এক এম.পি সাহেবের.. খুবই প্রভাবশালী একজন, অনেক কষ্টে সবগুলো রুমে ইন্টারকম দিয়ে গেস্টদের সাথে কথা বলে দেখেছি, কোনো রুমে খুনি আছে বলে মনে হয় না।”

জেফরি একটু ভেবে নিলো। “ঠিক আছে, আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য তোমরা একটা কাজ করো, গেস্টহাউজের আশেপাশে কড়া নজরদারি রাখো…উম, আধঘণ্টার মতো। তারপর যদি সন্দেহজনক কিছু না পাও চলে এসো।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

গুলশান থানার পুলিশের দলটাকে বিদায় করে দিয়ে গেস্টহাউজ থেকে একটু সামনে এসে মোটরসাইকেলে থাকা জুনিয়র ইনভেস্টিগেটর ছেলেটাকে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো জামান। তার ধারণা বরাবরের মতোই খুনি সটকে পড়েছে। তবে নিশ্চিত হতে দোষ কী।

.

বাস্টার্ড পাঁচ মিনিট আগে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে পেয়েছে পুলিশের দল চলে গেছে। তবে তার ধারণা গেটের বাইরে এখনও পুলিশ আছে। এখানে থাকাটা যে নিরাপদ নয় বুঝতে পারছে। এমনও হতে পারে কিছুক্ষণ পর আরো বড় দল নিয়ে পুলিশ রেইড দিতে পারে। তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে কিন্তু বাইরে পুলিশ ওৎ পেতে আছে কিনা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে ।

বিছানার পাশে ইন্টারকমটা তুলে নিয়ে রুম সার্ভিসের সাথে কথা বললো সে। “হ্যালো, রুম সার্ভিস…২০৩ থেকে বলছি।”

“জি, স্যার, বলেন।”

“একটু আগে নাকি পুলিশ এসেছিলো এখানে, তারা কি চলে গেছে?” কণ্ঠে যতোদূর সম্ভব উদ্বিগ্নতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো।

“জি, স্যার, চলে গেছে।”

“ওরা কেন এসেছিলো?”

“একজন গেস্টের ব্যাপারে, স্যার । ঐ গেস্ট নাকি ফেরারি আসামি। তার ছবিও নিয়ে এসেছিলো। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, আপনাদের কারো কোনো সমস্যা-”

ছেলেটাকে কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো, “ছবি নিয়ে এসেছিলো?”

“জি, স্যার । ঐ গেস্টের সাথে যে মহিলা, তার ছবি। মহিলা নাকি ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল।”

“কোন রুমের গেস্ট?”

“২০৬, স্যার।”

“আচ্ছা, আমার দুটো রুমের পর…বুঝতে পেরেছি। ধরতে পেরেছে?”

“না, স্যার। ঐ রুমের দু’জনের কাউকে পায় নি। পুলিশ তো সব রুম চেক করতে চেয়েছিলো কিন্তু ম্যানেজার স্যার দেন নি। এই গেস্টহাউজের মালিক একজন এম.পি, তিনি ফোন করে পুলিশকে এমন প্যাদানি দিয়েছেন যে পুলিশ সুরসুর করে চলে গেছে…যাবার সময় ম্যানেজার স্যারকে বার বার সরি বলে গেছে। গুলশান থানার যে পুলিশগুলো এসেছিলো তাদের সবার পোস্টিং বান্দরবান হয়ে যাবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন।”

“তাই হওয়া উচিত।” বাস্টার্ড কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললো । “আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

“স্যার, নিশ্চিন্তে থাকেন। কোনো সমস্যা নেই।”

ইন্টারকমটা রেখে দিলো সে। মাঝবয়সী লোকটা আর তার সঙ্গের মহিলা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। উমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । বাস্টার্ড বুঝতে পারলো পুলিশ উমার একটা ছবি জোগার করে ফেলেছে। এই মেয়েটার সমস্যা আরো বেড়ে গেলো। একে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা বিপজ্জনক। কিছু একটা করতে হবে । আর সেটা করতে হবে খুব দ্রুত।

মাঝবসয়সী লোকটার দিকে ফিরলো সে। “আমি যা বলবো তা যদি না করেন তো সোজা গুলি করে দেবো। কোনো রকম চালাকি করবেন না।”

“কোনো রকম চালাকি করবো না, বিশ্বাস করুন,” ঢোক গিলে বললো লোকটা ।

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। “তাহলে মনে দিয়ে শুনুন।”

.

প্রায় বিশ মিনিট অতিক্রান্ত হবার পরও গেস্টহাউজের আশেপাশে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলো না জামান। এই বিশ মিনিটে একজন লোকও গেস্টহাউজ থেকে বের হয় নি, কাউকে ঢুকতেও দেখা যায় নি। সব কিছুই স্বাভাবিক আছে শুধু জামানের ভেতর ক্রমবর্ধমান বিরক্তিটা ছাড়া।

জুনিয়র ছেলেটার দিকে তাকালো সে। এই ছেলেটাও বিরক্ত হয়ে উসখুস করছে।

“স্যার, আমরা আর কততক্ষণ এখানে থাকবো?”

“আর একটু, তারপরই চলে যাবো।” জামান মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে আর দশ মিনিট নয়, পাঁচ মিনিট পরই চলে যাবে। এখানে অপেক্ষায় থাকাটা যে নিষ্ফল সেটা বুঝে গেছে।

হঠাৎ গেস্টহাউজ থেকে একটা কালো রঙের প্রাইভেট কার বের হয়ে আসতে দেখলো সে। ভালো করে লক্ষ্য করলো, কোনো যাত্রি নেই। ড্রাইভারের বয়স ত্রিশের মতো। চোখে সানগ্লাস।

জামান সন্দেহজনক কিছু দেখতে পেলো না। গাড়িটা মেইন রোডে নামতেই গেস্টহাউজের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেলো । বাজতে শুরু করলো অ্যালার্ম।

ফায়ার অ্যালার্ম।

গেস্টহাউজে আগুন লেগেছে?

জামান একবার অপসৃয়মান গাড়িটার দিকে আরেকবার গেস্টহাউজের দিকে তাকালো। বুঝতে পারছে না কী করবে। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে একটু দেরি করে ফেললো সে। যেই না গেস্টহাউজের দিকে পা বাড়ালো অমনি মুখোমুখি হলো এক লোকের । লোকটা দৌড়ে বের হয়ে এসে জামানকে দেখেই চিৎকার করে বললো :

“স্যার, খুনি পালিয়েছে…ঐ যে গাড়িতে…!” গেস্টহাউজের কর্মচারী রীতিমতো হাফাচ্ছে।

জামান আর অপেক্ষা করলো না। মোটরসাইকেলের দিকে ছুটে যেতে উদ্যত হবে কিন্তু দেখতে পেলো তার জুনিয়র কলিগ ইতিমধ্যেই বাইকটা নিয়ে তার কাছে এসে পড়েছে। জামান সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো বাইকে।

.

পিস্তলের মুখে মাঝবয়সী লোকটার হাতা-পা-মুখ বেঁধে ফেলার আগে জেনে নেয় তার গাড়িটা কি রঙের, চাবিটাও নিয়ে নেয় পকেট থেকে, সেইসাথে তার সানগ্লাস আর লাইটারটাও। অবশ্য রোমেনা চৌধুরি নামের টিভি অভিনেত্রীকে কিছু করার দরকার পড়ে নি। মাঝবয়সী লোকটার হাত-পা-মুখ বাধার আগে আরেকটা ছোটোখাটো কাজ করেছে সে : মহিলা আর তার সঙ্গিকে বাধ্য করেছে জড়াজড়ি করে একটা ছবি তুলতে। মোবাইল ফোনে ছবিটা তুলে রেখে বাস্টার্ড তাদেরকে ভয় দেখিয়ে বলেছে কোনো রকম চিৎকার চেঁচামেচি করলে এটা পত্রিকায় প্রকাশ করে দেবে।

টিভি অভিনেত্রী রোমেনা চৌধুরির বোরকাটা উমাকে পরিয়ে দেয় সে। তারপর গাড়ির চাবিটা তার হাতে দিয়ে জানালা দিয়ে দেখিয়ে দেয় নীচের পার্কিংলনে কোন গাড়িটায় গিয়ে বসতে হবে।

উমা কথামতোই কাজ করে। বোরকা পরা উমা সোজা নীচে চলে যায় ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে দিয়ে কোনো রকম সন্দেহের উদ্রেক না করেই। তার কারণ মাঝবয়সী ব্যবসায়িকে দিয়ে আরেকটা কাজ করিয়ে নিয়েছিলো : ইন্টারকমে ফোন করে সেই লোক ম্যানেজারকে জানিয়ে দেয় তার সঙ্গের মহিলা গেস্টহাউজ থেকে চলে যাবে, তাকে যেনো কোনো রকম প্রশ্ন করা না হয়।

বাস্টার্ড জানালা দিয়ে দেখতে পায় উমা ঠিক ঠিকই গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে, তারপরই গলব্যাগটা হাতে নিয়ে ২০৩ নাম্বার রুম থেকে বের হয়ে ২০৬ নাম্বার রুমের সামনে দাঁড়ায়। এটার চাবি তার পকেটেই আছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো প্যাসেজওয়ে’তে কেউ নেই। চাবি দিয়ে রুমের দরজা খুলে পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে বিছানার চাদরে আগুন ধরিয়ে সোজা রুম থেকে বের হয়ে গেলো। এই লাইটারটা মাঝবসয়ী লোকটার পকেট থেকে গাড়ির চাবি নেবার সময় নিয়ে নিয়েছিলো।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কোমর থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়ে নেয়, যেনো ফ্রন্ট ডেস্কের কেউ তার গতিরোধ করার চেষ্টা না করে।

ফ্রন্ট ডেস্কে ম্যানেজার ছাড়া আর কেউ ছিলো না। লোকটা মোবাইল ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলছিলো। পিস্তল হাতে তাকে দেখতে পেয়েই ডেস্কের নীচে লুকিয়ে পড়ে ভদ্রলোক।

গাড়ির দরজা আগে থেকেই খুলে রেখেছিলো উমা। গলব্যাগটা পাশের সিটে রেখে উমাকে পেছনের সিটে নীচু হয়ে শুয়ে পড়তে বলে। গাড়ির ইঞ্জিন স্টটি দিতেই গেস্টহাউজের ভেতরে লোকজনের গুঞ্জন আর সেই সাথে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠার শব্দটা তার কানে যায়। গেট দিয়ে যখন বের হবে তখন সেটা ক্রমশ বাড়ছিলো।

গেস্টহাউজ থেকে বের হতেই অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলটা দেখতে পায়। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলো পুলিশ তার পিছু নিলে সোজা গুলি করবে। কিন্তু একটু এগিয়ে যাবার পর রিয়ারভিউ মিররে দেখতে পায় মোটরসাইকেলের লোকটা তার সঙ্গিকে রেখে গেস্টহাউজের দিকে ছুটে যাচ্ছে। মুচকি হেসে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয় বাস্টার্ড । সে ভালো করেই জানে গুলশানের মতো ব্যস্ত এলাকায় মোরটসাইকেলের সাথে কোনো প্রাইভেটকার পাল্লা দিয়ে পারবে না ।

.

অধ্যায় ২৩

এতো কাছে পেয়েও খুনিকে ধরতে না পারার জন্য জামানের প্রতি রুষ্ট হয়ে আছে জেফরি বেগ। পুলিশকে বোকা বানিয়েছে, সেটা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের কারোর চোখে ধুলো দিয়ে এভাবে একজন ভয়ঙ্কর খুনি চলে যাবে সেটা মেনে যায় না।

মাথা নীচু করে বসে আছে তার বিপরীতে, ডেস্কের ওপাশে বসে আছে জেফরি। গুলশান থেকে বিশ মিনিট আগে জামান আর জুনিয়র এক ছেলে ফিরে এসেছে, অবশ্য তারা আসার অনেক আগেই জেফরি এই দুঃসংবাদটি জেনে গেছে ফোনে।

“একজন এম.পি’র গেস্টহাউজ বলে তুমি এভাবে ছাড় দেবে?” অনেকক্ষণ পর কথা বললো জেফরি বেগ।

মাথা তুলে তাকালো জামান। “স্যার, লোকটার সাথে আমি নিজে কথা বলেছি…কিছুতেই সবগুলো রুম চেক করার অনুমতি দেন নি।”

“অনুমতি?” আক্ষেপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “ঐ এম.পি অনুমতি দেবার কে? তুমি কি তার চাকরি করো? নাকি সে তোমার অথরিটি?”

জামান বুঝতে পারছে ভুলটা কোথায় করেছে। এম.পি সাহেবের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেবার দরকারই ছিলো না। পুলিশ নিয়ে জোর করে সবগুলো রুম চেক করে দেখলেই হতো। এম.পি সাহেব আর কী করতো। অভিযোগ করতো। হাউকাউ করতো। কিন্তু কোনোভাবেই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারতো না। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট পুলিশ বিভাগের মতো নয়, এখানকার চাকরিতে বদলী নেই। যে বদলীর ভয়ে পুলিশ কাজ করতে পারে না সে তো তাদের নেই। তারা একেবারেই খাঁটি তদন্তকারী সংস্থা। সরকারী কোনো কোপানল তাদের উপর সরাসরি পড়ে না। সরকারের কেউ তাদের উপর ক্ষেপে গেলেও খুব একটা সমস্যা হয় না।

“আমি তোমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট, জামান।”

জেফরির এ কথা শুনে জামান মাথা নীচু করে রাখলো। আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। নিজের কাজে সে নিজেও অনুতপ্ত। ব্যর্থতা শুধু একটা নয়। খুনিকে ফলো করার বেলায়ও সে বোকার মতো কাজ করেছে। গেস্টহাউজ থেকে গাড়িটা বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার বোঝা উচিত ছিলো। কিন্তু ড্রাইভার ছাড়া গাড়িতে কাউকে না দেখতে পেয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ হয় নি। তবে এটাও তো ঠিক, গেস্টহাউজে অনেক গেস্ট ছিলো, একেবারে নিশ্চিত না হয়ে এভাবে কোনো গাড়ির পেছনে ছোটাও সম্ভব ছিলো না।

“তোমাদের কাছে মোটরসাইকেল ছিলো, তার মানে খুনির চেয়ে তোমরাই এগিয়ে ছিলে,” জেফরি আবার বলতে শুরু করলো। “এটা খুনিও বুঝতে পেরেছে।”

আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। কথা সত্য। কিন্তু খুনি যে এভাবে গাড়ি ফেলে পালাবে সেটা তার মাথায়ই ছিলো না। সে আশা করেছিলো জম্পেশ একটি কার চেজিং হবে। মোটরসাইকেলের সাথে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবে না খুনি। টহলপুলিশ আর ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায় খুব দ্রুত গাড়িটা থামাতে পারবে। কিন্তু খুনি ভাবনার দিক থেকে আরেকটু এগিয়ে ছিলো। গাড়িটা নিয়ে মেইন রোডে যেতেই এমন একটা মোড়ে গাড়িটা পরিত্যাগ করে যে জামান কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি খুনি কোন্ দিকে গেছে।

গুলশান দুই নাম্বারের গোলচক্কর।

জামানের সামনে তিনটি রাস্তা ছিলো, কমপক্ষে তিনটি সম্ভাবনা। এরকম পরিস্থিতিতে কি মাথা ঠিক থাকে। যে কোনো একটা রাস্তাই বেছে নিতে হয়েছে তাকে। অনেক দূর যাবার পরই বুঝতে পারে ভুল রাস্তা বেছে নিয়েছে। খুনি গাড়িটা ফেলে রেখে পায়ে হেঁটে চলে গেছে, কোনো সিএনজি নিয়েছে নাকি কোনো ট্যাক্সিক্যাবে করে গেছে সেটা জানা সম্ভব ছিলো না।

“ঐ মেয়েটা এখনও তার সাথে আছে, অনেকটা আপন মনে বললো জেফরি বেগ।

জামান কিছু বললো না।

“আমি ভেবে পাচ্ছি না মেয়েটার সাথে তার সম্পর্ক কি?”

“স্যার, একেবারেই সাধারণ একটি মেয়ে। তার মা হাসপাতালে, বাবা অসুস্থ, ভাই-বোন কেউ নেই। এক পিসি থাকে তাদের সাথে। আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে যতোটুকু জানা গেছে, তাতে করে তো মনে হচ্ছে না মেয়েটার সাথে এরকম কারোর সম্পর্ক থাকতে পারে।” একনাগারে বলে গেলো জামান।

এটা জেফরির কাছেও মনে হচ্ছে। খুনির সাথে উমা রাজবংশী নামের মেয়েটির কোনো সম্পর্ক খুঁজে বের করতে পারে নি এখনও।

“সিএনজি ড্রাইভার ইউসুফ বলেছে খুনির সাথে একটা ব্যাগ ছিলো; গেস্টহাউজের ম্যানেজারও একই কথা বলেছে,” জেফরি বেগ বললো । “যেখানেই যাচ্ছে, ব্যাগ আর মেয়েটাকে হাত ছাড়া করছে না।”

জামান কৌতূহলী হয়ে তাকালো তার বসের দিকে।

“তার মানে ব্যাগ আর মেয়েটা…এ দুটো জিনিস খুনির কাছে অনেক মূল্য বহন করে। কিন্তু সেটা কি?”

জামানের কাছে মনে হলো তার বসের প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ ।

“গেস্টহাউজ থেকে পালিয়ে যাবার পর খুনি আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করে নি । আমার ধারণা সে আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করবে না।”

“স্যার, আমি আবারো বলছি, আমরা কোনো স্টেপ নেবার আগেই খুনি বুঝে যায়। গেস্টহাউজেও খুনি আগেভাগে টের পেয়ে গেছিলো আমরা রেইড দিতে আসছি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি।

“আমরা যে গেস্টহাউজে রেইড দেব সেটা কেউ জানতো না। তারপরও…”

“তুমি কি এখনও মনে করো এটা আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কোনো গোপন অপারেশন?”

“আমার তো তাই মনে হচ্ছে, স্যার,” একটু কাচুমাচু করে বললো জামান।

“ঠিক আছে, আমি এটা খতিয়ে দেখবো।”

জেফরির এ কথা শুনে জামান আগ্রহী হয়ে উঠলো। “স্যার, আমি নিশ্চিত, আপনি একটু খোঁজখবর নিলে সব জানতে পারবেন।”

“হুম, তাই করবো। এখন সব ভুলে নতুন করে কাজে নেমে পড়ো। আমি চাই না ব্যর্থতার জন্য আফসোস করে করে মাথা কুটে মরো। যা হয়েছে ভুলে যাও । ভুল থেকে শিক্ষা নাও।”

“জি, স্যার।”

“পিং সিটি হোটেলের কর্নেল সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে তাকে একটু সময় দিতে বলো। ভদ্রলোক বেশ কোঅপারেটিভ। এক-দেড় ঘণ্টার সিটিং দিতে হবে। তার বর্ণনা অনুসারে আর্টিস্ট খুনির ইমেজ তৈরি করবে।”

“জি, স্যার।”

জামান উঠে দাঁড়ালো, দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকালো তার বসের দিকে।

“কিছু বলবে?”

“সরি, স্যার।”

“ডোন্ট বি…ফরগেট দিস। উই অল মেক মিসটেক্স।”

.

গেস্টহাউজ থেকে বের হওয়াটা ছিলো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ, সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়ে বাস্টার্ডের আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে এসেছে। যদিও কাঁধের ইনজুরিটা তাকে ভোগাতে শুরু করেছে তারপরও মাথাটা দ্রুত কাজ করছে এখন। সে জানে তার মাথা ঠাণ্ডা থাকলে দ্রুত কাজ করতে পারে।

গেস্টহাউজে যখন পুলিশের দল ঢুকতে দেখলো তখন তার কাছে মনে হয়েছিলো সে একটা ফাঁদে পড়ে গেছে। গোলাগুলি করে অতোগুলো পুলিশের সাথে যে পেরে উঠবে না সেটা জানতো । ঠিক তখনই তার মাথাটা আবার আগের মতো কাজ করতে শুরু করে। এরফলে ভালোয় ভালোয় বের হয়ে আসতে পেরেছে।

গেস্টহাউজ থেকে বের হয়েই গাড়িটা এমন জায়গায় ফেলে সটকে। পড়েছে যে বেচারা পুলিশ বিভ্রান্ত না হয়ে পারে নি । সে ভালো করেই জানে তার পেছনে ছুটে আসা পুলিশের মোটরসাইকেলটা চার রাস্তার মোড়ে এসে ডান-বাম নয়তো সোজা, এই তিন জায়গার মধ্যে যেকোনো একটা জায়গা বেছে নিতে বাধ্য হবে। ঘুণাক্ষরেও তারা ভাববে না এরকম পরিস্থিতিতে গাড়ি ফেলে রেখে কেউ খুব কাছেই লুকিয়ে থাকবে।

পুলিশের লোক দুটোকে বোকা বনে যেতে দেখে তার খুব হাসি পাচ্ছিলো। কোথায় যাবে সে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তারা কম করে হলেও এক মিনিটের মতো সময় নিয়ে নেয়। তারপর ডান-বামে না গিয়ে ছুটে চলে সোজা সামনের দিকে।

গুলশান গোলচক্করে যেখানে গাড়িটা পার্ক করে রাখে তার ঠিক বিপরীতে একটা ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে পড়ে মেয়েটাকে নিয়ে। তারপর কাঁচের ভেতর থেকে বসে বসে তামাশা দেখেছে।

পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারলেও নতুন একটা চিন্তা তার মাথায় ঢুকেছে : উমার ছবি পুলিশের কাছে। এই মেয়েটাকে নিয়ে ঢাকা শহরে ঘোরাঘুরি করা এখন আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। পুলিশের দ্রুত কাজকর্ম দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলো না।

এখন তারা সিএনজি’তে বসে আছে। তার গন্তব্য কলাবাগান। তবে তার আগে মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ট্রাফিক জ্যামে বসে সেটাই ভাবছে বাস্টার্ড। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো মেয়েটা একদম চুপ মেরে আছে। এই মেয়েটা তার কথামতো কাজ করেছে। যেভাবে যেভাবে বলেছে ঠিক সেভাবেই কাজ করেছে। বাস্টার্ড অবশ্য এতোটা আশা করে নি। কিন্তু মেয়েটা জানে না তার ছবি চলে গেছে পুলিশের কাছে। এরকম নিরীহ একটি মেয়ে কতোক্ষণ পুলিশের কাছে ধরার পড়ার হাত থেকে টিকে থাকতে পারবে? কাল পত্রপত্রিকায় ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের উল্লেখযোগ্য দুয়েকজনের খুনখারাবির কথা ছাপা হলে পরিস্থিতি কতোটা জটিল হয়ে উঠতে পারে সেটা সে নিজেও জানে না। তাকে খুব দ্রুত কোলকাতায় চলে যেতে হবে। তবে তার আগে রঙুর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা দরকার। রঞ্জুর স্ত্রী মিনা যে তাকে ভুয়া ঠিকানা দিয়েছে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

জ্যামের মধ্যে আর্টকে থেকেই ভাবনাটা তার মাথায় এলো।

“তোমার ছবি পুলিশের কাছে চলে গেছে,” বললো সে।

মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো।

“এভাবে পথেঘাটে তোমাকে নিয়ে ঘোরাটা নিরাপদ না।”

“আমি এখন কী করবো?” মুখ তুলে তাকালো উমা।

“ইচ্ছে করলে তুমি এই ঝামেলা থেকে বাঁচতে পারবে।”

উমা দেখলো অজ্ঞাত লোকটা একদৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। “বুঝলাম না!” অবাক হয়ে বললো সে।

“কাজটা কঠিন কিন্তু চেষ্টা করলে তুমি করতে পারবে।”

“কী করতে হবে, বলুন,” ব্যাকুল হয়ে বললো উমা।

“তোমাকে পুলিশের কাছে ধরা দিতে হবে।”

.

অধ্যায় ২৪

হোমিসাইডের পরিচালক ফারুক আহমেদ ভুরু কুচকে চেয়ে আছে জেফরি বেগের দিকে। এইমাত্র তাকে যে কথাটা বলা হয়েছে সেটাকে উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ছাড়া আর কিছু বলে মনে হচ্ছে না।

“এরকম উদ্ভট জিনিস তোমার মাথায় এলো কী করে?” পরিচালক অবশেষে বললো।

“স্যার, এটা আমার সহকারী জামানের ধারণা, জেফরি গাল চুলকে বললো।

“তাই তো বলি,” ফারুক আহমেদ যেনো স্বস্তি ফিরে পেলেন। “এরকম উদ্ভট আইডিয়া তোমার মাথায় আসার কথা নয়।”

কিন্তু আমিও মনে করছি তার আইডিয়াটা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো কিছু না। একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে।”

“পারে না,” দু’পাশে মাথা নেড়ে জানালো পরিচালক সাহেব। “এসব উদ্ভট আইডিয়া খতিয়ে দেখার দরকার নেই।”

“কিন্তু ঘটনা যেভাবে এগোচ্ছে তাতে করে এই আইডিয়াটা আরো বেশি বাস্তব বলে মনে হচ্ছে, স্যার।”

“আহ, তুমি বুঝতে পারছে না। এরকম কিছু যে একেবারে অবাস্তব তা নয় তবে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এরকম কোনো গোপন অপারেশন হচ্ছে না।”

জেফরি কিছু বললো না। সেও জানতো এরকম কথা শুনে তার বস কি বলবে। তারপরও পাল্টা যুক্তি দেখালো সে। “স্যার, এরকম অপারেশন তো আগেও হয়েছে, হয়েছে না?”

“যেমন?” ভুরু কুচকে জানতে চাইলো পরিচালক।

“অপারেশন ক্লিনহার্ট।”

দু’পাশে মাথা দোলাতে লাগলো ফারুক সাহেব । “তুমি ভুলে গেছো, ওটা কোনো গোপন অপারেশন ছিলো না…ঘোষণা দিয়ে, ফলাও করে প্রচার করে করা হয়েছিলো।”

“তা ঠিক, তবে এবার হয়তো গোপনে করা হচ্ছে?”

আবারো মাথা নেড়ে আইডিয়াটা বাতিল করে দিলো জেফরির বস। “অ্যাবসার্ড! এরকম কিছু হচ্ছে না সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।”

“স্যার, আপনি এতো জোর দিয়ে বলছেন কিভাবে?”

“তোমাকে খুলে বলতে পারবো না তবে একটা কথা মনে রেখো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্তাদের সাথে আমার সম্পর্ক আছে…এরকম কিছু হলে আমি ঠিকই জানতে পারতাম, মানে আমাকে আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হতো। শুধু জানিয়ে দেয়াই হতো না, নির্দিষ্ট কিছু ইট্রাকশনও দেয়া হতো।”

একটু ভেবে নিলো জেফরি বেগ। “ঠিক আছে, ধরে নিলাম এরকম কিছু হচ্ছে না, তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য কি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা যায় না?”

“যে জিনিসের অস্তিত্বই নেই সেটা কিভাবে খতিয়ে দেখবে?” ফারুক সাহেব পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো।

“স্যার, আমি দেখবো না। আপনি দেখবেন। উপরমহলে কারো সাথে কথা বলে একটু জেনে নেবেন।”

“পাগল,” চেয়ারে হেলান দিলো পরিচালক। “এরকম কিছু যদি আমার অগোচরে তারা করেও থাকে তাহলে কি সেটা আমার কাছে স্বীকার করবে?” কথাটা বলেই হা হা করে হেসে ফেললো ফারুক আহমেদ।

জেফরি বেগ তার বসের দিকে চেয়ে রইলো। তার ঠোঁটে স্মিত হাসি। এই হাসির সাথে ফারুক সাহেব পরিচিত। যখন যুক্তিতর্কে কাউকে ফাঁসিয়ে দেয় তখন তার এই প্রিয়পাত্র এরকমভাবে হাসে। ভদ্রলোক নিজের হাসিটা কোনোমতে দমন করে বিব্রত ভঙ্গি করলো। তবে এখনও বুঝতে পারছে না নিজের কথায় নিজে কিভাবে ফেঁসে গেছে।

“স্যার, আপনাকে না জানিয়ে তো তারা কোনো অপারেশন করবে না, সুতরাং এই আশংকা করার দরকার নেই,” জেফরির ঠোঁটের হাসিটা আরো প্রকট হলো।

ফারুক সাহেব এবার বুঝতে পারলো আসলেই নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে। থুতনীটা চুলকাতে শুরু করলো সে।

“করবে না সেটা তো জোর দিয়ে বলা যায় না, তাই না?”

“জি, স্যার।”

“এইসব অপারেশন পলিটিক্যাল সিদ্ধান্তে করা হয়, তারা যদি ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলে তাহলে তো আর আমাদের জানানো হবে না।”

“তাতো ঠিকই, স্যার।”

“তুমি বলছো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা দরকার?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। “তবে সরাসরি জিজ্ঞেস করবেন না।”

“তাহলে?”

“স্যার, এরকম কোনো অপারেশন যদি সত্যি হয়ে থাকে তার মানে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টও আছে। ব্ল্যাক রঞ্জুর দল সম্পর্কে পর্যাপ্ত ইন্টেল ছাড়া অপারেশন করা হবে না। আপনি জানতে চাইবেন সাম্প্রতিক সময়ে ব্ল্যাক রঞ্জু সম্পর্কিত কোনো ইন্টেল আছে কিনা। থাকলে আমাদের সাথে যেনো শেয়ার করা হয়।”

ফারুক সাহেব একটু ভেবে নিলো। “ওকে, মাই বয়। সেটা করা যাবে। ডোন্ট ওরি।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

“আর কিছু?” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বললো হোমিসাইডের পরিচালক।

“না, স্যার।”

“গুড,” একটু থেমে আবার বললো ফারুক সাহেব। “কফি খাবে?”

“না, স্যার, চা খাবো।”

“আমিও সেটাই ভাবছিলাম…চা-ই ভালো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি, এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো। “স্যার, এক্সকিউজ মি।”

“ প্লিজ।”

জামানের ফোন। জেফরির ভুরু কুচকে গেলো। কলটা রিসিভ করলো সে।

“স্যার?” ওপাশ থেকে জামানের উত্তেজিত কণ্ঠটা শোনা গেলো ।

“বলো।”

“উমা রাজবংশী নামের মেয়েটাকে পুলিশ ধরে ফেলেছে!”

.

বাস্টার্ডের সিএনজিটা যখন কলাবাগানের একটি পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামলো তখন সন্ধ্যা সাতটারও বেশি বেজে গেছে। এই গলির শেষ বাড়ি এটা। ভাড়া মিটিয়ে সোজা ঢুকে পড়লো সেই বাড়িতে।

উপর তলায় একটা ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় একটু থেমে কী যেনো মনে করে দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি মারলো।

ঘরের ভেতর একটা খাটের উপর মরা লাশের মতো এক বৃদ্ধলোক শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ বুড়ো লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে যে-ই না চলে যাবে অমনি শুনতে পেলো একটা কণ্ঠ। “বাবলু?”

ফিরে তাকালো সে। বুড়ো লোকটা তার দিকে চেয়ে আছে। খাটের পাশে এসে বসলো বাস্টার্ড ।”কেমন আছো?”

বুড়োর ঠোঁটে উপহাসের হাসি।

“ওষুধ খেয়েছো?”

“হুম।”

“কিছু বলবে?” বুড়োর হাতটা ধরে বললো সে।

“কোথায় ছিলি?”

“একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম।”

“আজ থাকবি?” স্থির চোখে চেয়ে বললো বুড়ো।

“না। কাজ আছে।”

“আমি মনে হয় আজই মারা যাবো!”

বাস্টার্ড মনে মনে হাসলো। আজ তিন বছর হলো তার বাবা শয্যাশায়ী, এই তিন বছরে অসংখ্যবার এ কথা বলেছে।

“ডাক্তার তো বলেছে তোমার সব ঠিক আছে।”

চোখমুখ বিকৃত করে বুড়ো বললো, “সবই যদি ঠিক থাকে তাহলে আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাগামুতা করি কেন?”

“ঠিক আছে মানে, অন্যসব কিছুর কথা বলেছে। আস্তে আস্তে তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে।”

“ওই শালারা খালি টাকা খায়, ইচ্ছে করে আমাকে ভালো করে না…ভালো করলেই তো ইনকাম বন্ধ হয়ে যাবে। বুঝলি?”

“হ্যাঁ, বুঝছি।”

“একটু উঠে বসতে পারলেই ওই শালাদের গুলি করে মেরে ফেলতাম।”

“ঠিক আছে, আমি যাই। তুমি ঘুমাও”

“আরে সারাক্ষণই তো ঘুমাই…আর কতো ঘুমাবো!” বাস্টার্ড কিছু বললো না।

“বাবা, এসব ছেড়ে দে,” বুড়ো তার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো। অবাক হলো বাস্টার্ড। এই দূর্বল শরীরেও বুড়ো এতো শক্তি রাখে! “বিদেশ চলে যা! আমার জন্য চিন্তা করিস না। আমি ঠিক থাকবো। মজিদ আছে, আমেনা আছে…”।

“ঠিক আছে, যাবো। তুমি এখন ঘুমাও। আমি যাই।”

“সত্যি তুই যাবি?” বুড়ো আশান্বিত হয়ে উঠলো।

“হুম…যাবো।”

“কবে যাবি?”

“এই তো, আর কটা দিন পরই চলে যাবো ।”

“এই কথা তো অনেক দিন ধরেই শুনছি। তুই আসলে যাবি না।”

“না। যাবো। তোমাকে একটু সুস্থ করেই চলে যাবো।”

“আমি আর সুস্থ হবো না।”

“হবে,” বাস্টার্ড মিথ্যে করে বললো।

বুড়ো যেনো রেগে গেলো। “বাল হবে!”

বাস্টার্ড হেসে ফেললো।

“হাসবি না…হাসবি না!” অনেকটা চিৎকার করে বললো বুড়ো ।

“একটা কথা বলি?”

“বল!” চট করে বললো পক্ষাঘাতগ্রস্ত বুড়ো।

“আমার মা কে ছিলো সেটা যদি বলো তাহলে বিদেশ চলে যাবো।” বাস্টার্ড জানে বুড়ো এখন কি বলবে। এ কথা সে অনেক শুনেছে।

“যা আমার সামনে থেকে! এক্ষুণি যা!”

বাস্টার্ড মোটেও অবাক হলো না। আস্তে করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বুড়ো সব সময় দাবি করে তার মা কে ছিলো সেটা সে জানে না তবে বাস্টার্ডের ধারণা বুড়ো জানে, কী এক অজ্ঞাত কারণে সেটা বলে না তার কাছে।

দরজার বাইরে যখন চলে এলো শুনতে পেলো বুড়ো বিড়বিড় করে বলছে : “জানি না! জানি না!”

নিজের ঘরে ঢুকে ভাবতে লাগলো সে। হয়তো লোকজনের কথাই ঠিক। তার মা বেশ্যা ছিলো। সেজন্যে তার বাপ সব সময় এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যায় । হোক তার মা বেশ্যা, তবুও সে মায়ের কথা শুনতে চায়-এটা তার বাপ যদি বুঝতো! একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার বুকের ভেতর থেকে।

জন্মপরিচয়হীন একজন মানুষ সে।

.

অধ্যায় ২৫

১৯৭৪ সালের কোনো একদিন খুইন্যা বাবুল কোত্থেকে ফুটফুটে এক শিশুকে নিয়ে হাজির হলো তার বাড়িতে। বাড়ি বলতে বস্তিতুল্য এক আখড়া। নিম্নআয়ের কয়েকশ’ লোকের ঘুপচি ঘর। যুবক বাবুল বেশ প্রভাবশালী, এই বস্তির মা-বাপদের সাথে তার ওঠাবসা। পেশায় যে একজন ভাড়াটে খুনি সেটা অবশ্য তার প্রতিবেশিদের অনেকেই জানে। তার কাছের লোকজন শিশুটি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে সে এমন খুনে দৃষ্টিতে তাকাতো যে ভয়ে কেউ দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন করার সাহস করতো না। তারপরও একটা কথা বস্তির বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগলো : রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে শিশুটিকে। এই কাহিনীর সূচনা ঘটে বাবুল যখন বাচ্চাটার জন্য একজন দুধ মা নিয়োগ দেয় তখন থেকে। ঐ মহিলার নাম ছিলো পেয়ারির মা। খুইন্যা বাবুল শুধুমাত্র পেয়ারির মাকেই বলেছিলো বাচ্চাটাকে কোত্থেকে পেয়েছে।

“রাস্তায় পইড়্যা আছিলো?” পেয়ারির মা অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবুল বলেছিলো, “হ। কতো মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। কতো মা-বাবা অভাবের চোটে নিজের সন্তান ফেলে চলে যাচ্ছে… সময়টা খুব খারাপ, বুঝলে, পেয়ারির মা।”

পেয়ারির মাও জানে সময়টা কতো খারাপ নইলে কয়েক দিন আগেও যার কাছ থেকে প্রতিবেশিরা টাকা ধার করতো, চাল-ডাল চেয়ে নিতে তাকে কিনা এখন পরের বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর চাকরি নিতে হচ্ছে। তার নিজের ছয় মাসের এক মেয়ে সন্তান আছে-এ নিয়ে পর পর দুটো মেয়ে-তাকেও ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়াতে পারে না। যে ভাতের ফেন ফেলে দিতো, এখন সেটাও হয়ে উঠেছে খাদ্য।

“কুনখানে পইড়া আছিলো?”

পেয়ারির মার এ কথা শুনে বাবুল কিছুটা বিরক্ত হয়। “আহ, তুমি এতো কথা জানতে চাও কেন? এতো কথা শুইনা তোমার কি লাভ।” কথাটা বলেই বাবুল ঘর থেকে চলে যায়।

তো পেয়ারির মা এই গল্পটা তার বিবেচনায় বিশ্বস্ত আরো কয়েকজনের কাছে পাড়ে, সেই বিশ্বস্তরা আবার নিজেদের বিশ্বস্তদের কাছে…এভাবে গল্পটা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত : খুইন্যা বাবুল রাস্তা থেকে এক ফুটফুটে শিশুকে তুলে নিয়ে এসেছে।

মন্দলোকের সংখ্যা কোনো কালেই কম ছিলো না, আর বস্তিতে সে সংখ্যাটা একটু বেশিই থাকে। ফুটফুটে নিরীহ শিশুটির প্রতি সবারই যে মায়ামমতা ছিলো তা বলা যাবে না । কিছু ছোটোলোকি নারী-পুরুষ একান্তে, নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ঠোঁট উল্টে বলতো, “রাস্তা থেইকা যখন পাইছে তাইলে মনে হয় কুনো বেশ্যারই পোলা অইবো । ফালাইয়া দিছে, বুঝলা না?”

এটা বোঝার মতো মানুষের সংখ্যাও কম ছিলো না, তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগলো।

এদিকে বাবুল নিজে খুনি হলেও ছেলেটির প্রতি তার মায়ামমতার কোনো কমতি ছিলো না। বিয়েশাদি না করলেও বাপ হিসেবে কোনো অংশেই কম ছিলো না সে। বস্তিতে থাকার পরও ভালো একটি স্কুলে ছেলেকে পড়তে পাঠায়। এমন স্কুল যেখানে শুধু বড়লোকের ছেলেপুলেরাই পড়াশোনা করে। এ নিয়ে বস্তিতে ইর্ষাকাতরদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বাপকে মুখে কিছু বলতে না পারলেও অবোধ শিশুটিকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে, জাউরা বলে গালি দিতেও ছাড়ে না অনেকে। শিশুটি হয়তো আপনমনে খেলছে, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে, দূর থেকে তখন তাকে দেখিয়ে কোনো মহিলা কিংবা পুরুষ বলে উঠলো, “ঐ যে জাউরা পোলা যায়!”

খুইন্যা বাবলু শিশুটির জন্য সুন্দর একটি নাম রেখেছিলো মসজিদের মওলানা সাহেবকে দিয়ে তবে সেই ভারিক্কি নামটা স্কুলে ভর্তির সময়ই ব্যবহার করা হয়েছিলো, বাবুল নিজে কখনও ঐ নামে ডাকতো না। সে তার নিজের নামের সাথে মিলিয়ে ছেলেটাকে ডাকতো বাবলু বলে।

পেয়ারির মাকে স্থায়ীভাবে রেখে দেয়া হয় ছেলেটার দেখাশোনা করার জন্য। এজন্যে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে বাবুল। ঐ মহিলাই বাবলুর সবকিছু দেখাশোনা করতো। তার খাবার, পোশাক, সব। সত্যি বলতে কি, বাবলু নামের ছেলেটি সারাদিন থাকতে পেয়ারির মার কাছেই, কারণ খুইন্যা বাবুল প্রায়ই রাতে বাড়ি ফিরতো না, কখনও কখনও তিন-চার দিন এক নাগারে তার দেখা পাওয়া যেত না। এ রকম পরিস্থিতিতে ছেলেটার নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা, বখে যাওয়ার কথা কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো ছেলেটা যতো বড় হতে থাকে সবার থেকে আলাদা হতে থাকে। তার আচার আচরণ একেবারেই অন্যরকম। বস্তির কারো সাথে মেলে না । পেয়ারির মা মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে ভাবতো, ছেলেটার রক্ত নিশ্চয় কোনো ভালো বংশেরই হবে।

ছেলেটার বয়স যখন বারো-তেরো তখন একটা ঘটনা ঘটে। তাদের বস্তিতে ওঠে এক আজব লোক। দেখতে অদ্ভুত সেই লোকের গায়ে কোনো পশম নেই। শোনা যায় টাইফেয়েডের কারণে নাকি শরীর থেকে সব লোম ঝরে পড়ে গেছে। চকচকে মাথা, হীন, চোখের পাপড়িহীন, তেলতেলে শরীরের এক আজব প্রাণী। বস্তির সবাই আড়ালে আবডালে সেই লোককে ডাকতে লোম্বাছুট বলে। একাকী ছোট্ট একটি ঘরে থাকতো সেই লোম্বাছুট। খুব বেশি লোকের সাথে তার মেলামেশা ছিলো না। লোকটা যে কী করে, কোথায় যায় সে খবর কেউ রাখতোও না।

একদিন দুপুরবেলা, গ্রীষ্মকালীন ছুটির কারণে বাবলুর স্কুল তখন বন্ধ, সে নিজের ঘরের বাইরে বসে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিলো। বিদেশী ম্যাগাজিন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার কারণে ইংরেজিটা অল্প একটু বুঝতে পারতো সেই বয়স থেকেই। বস্তির পুরনো কাগজের যে ভাঙ্গার আছে সেখান থেকে ম্যাগাজিনটা চেয়ে নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন ধরণের বাইসাইকেলের ছবিতে ভরা সেই ম্যাগাজিনটা গভীর মনোযোগের সাথে পড়ছে সে। চমৎকার চমৎকার সব বাইসাইকেলের রঙ্গিন ছবি। অবাক হয়ে দেখছে আর পড়ছে। ভাবছে এরকম একটি সাইকেল যদি তার থাকতো। তার বাবাকে বললে নিশ্চয় একটা কিনে দেবে। এমন সময় লোম্বাছুট এসে হাজির হয় তার সামনে। কি খোকা, কেমন আছো, কি পড়ছে, এসব দিয়ে শুরু, তারপর বাইসাইকেল সম্পর্কে আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। তার কাছে নাকি ঠিক এ ধরণের একটি বাইসাইকেল আছে। বিস্ময়ে চেয়ে থাকে বাবলু। তাদের বস্তিতে এরকম বাইসাইকেল আছে! হ্যাঁ, তবে এখানকার কোনো ছেলেকে সেটা ব্যবহার করতে দেয় না। এরা হলো বস্তির ছেলেপেলে। এরকম বিদেশী সাইকেলের মূল্য এরা বুঝবে নাকি! কিন্তু বাবলুকে দেখে তার সেরকম মনে হচ্ছে না। বাবলু নিজেও জানে তাকে সবাই আলাদা মনে করে।

সাইকেল নিয়ে বাবলুর সাথে আলাপ জুড়ে দেয় লোকটা। প্রথম প্রথম বাবলু একটু ইতস্তত থাকলেও লোকটার কথা শুনে ভয় চলে যায়। তার কাছে মনে হয়, দেখতে ভয়ঙ্কর হলেও লোকটা আসলে অনেক ভালো।

এক পর্যায়ে জানতে চায় সে সাইকেল চালাতে জানে কি না। না। বাবলু জানে না। জীবনে সে সাইকেলে চড়ে নি। তবে অনেককে দেখেছে। তার খুব চালাতে ইচ্ছে করে। ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই। তার কাছে তো একটা সাইকেল আছেই। এমনি পড়ে আছে সেটা। অনেকদিন ধরে কেউ চালায় নি। তো বাবলুর মতো লক্ষীছেলে চাইলে সেটা তাকে মাঝেমধ্যে ব্যবহার করার জন্য দেয়া যেতেই পারে।

বাবলু দারুণ অবাক হয়। সত্যি! আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে লোকটা জানায় অবশ্যই সত্যি। তবে তার আগে সাইকেল কিভাবে চালাতে হয় সেটা তাকে শিখতে হবে। সে চাইলে তাকে এখনই শেখাতে পারে ।

এখনই! বাবলুর কাছে মনে হলো পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নের মতো। হ্যাঁ, আমি শিখবো।

বাবলু ঐ লোম্বাছুটের সাথে চলে যায় তার ঘরে। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো তার ঘরে কোনো সাইকেলই নেই। জিজ্ঞেস করার জন্য পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে লোকটা দরজা বন্ধ করে দিয়ে পিশাচের মতো হাসছে।

“সাইকেল কোথায়?” বাবলু শুধু এটাই বলতে পেরেছিলো, তারপরই লোকটা পেছন থেকে জাপটে ধরে তার মুখ চেপে ধরে।

ঘরে কোনো খাট ছিলো না, তবে শীতলপাটি পাতা ছিলো। বাবলুকে ওখানে নিয়ে গিয়ে উপুড় করে ফেলে দেয়। পেছন থেকে শক্ত করে ধরে রাখে তাকে আর তার মুখ । দম বন্ধ হয়ে আসে তার। মুহূর্তের বিভীষিকায় হতভম্ব হয়ে পড়ে সে। কিছুই বুঝতে পারে না, শুধু বুঝতে পারে লোকটা তার সাথে খুব খারাপ কিছু করতে চাইছে। চিৎকার দেবার অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু লোকটা শক্ত হাতে তার মুখ চেপে রেখেছে। বাবলু টের পায় লোকটা প্যান্টের জিপার খুলছে একহাতে। নিজের সমস্ত শরীরের ভার ছোট্ট বাবলুর উপর প্রয়োগ করে তাকে আটকে ফেলেছে।

বাবলু বুঝতে পারে ভয়ঙ্কর খারাপ কিছু হচ্ছে তার সাথে। লোকটার। লোমহীন তেলতেলে শরীর লেগে আছে তার শরীরের সাথে, গা শিউরে উঠছে তার । জঘন্য। এক অদ্ভুত আর কুৎসিত প্রাণী তাকে গিলে খেতে চাচ্ছে। এর থেকে বাঁচার কোনো উপায়ই নেই। ঠিক তখনই চোখের সামনে, হাতের নাগালের মধ্যে একটা জিনিস দেখতে পেলো সে। এটা তো প্রতিদিনই সে। ব্যবহার করে!

ওদিকে খুইন্যা বাবুল বাড়ি ফিরে দেখে ঘরে তার ছেলে নেই। এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। এই ছেলে কখনও বাড়ি ছেড়ে বাইরে যায় না। গেলেও পেয়ারির মাকে জানিয়ে খেলতে যায়। সেটাও বাড়ির খুব কাছেই যে মাঠটা আছে সেখানে। বাবুল তড়িঘড়ি করে ছুটে যায় সেই মাঠে। নেই। তার বাবলু নেই। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে ছেলেকে। এমন সময় বাবলুর সমবয়সী এক ছেলের সাথে দেখা হয় তার। সে জানায় একটু আগে লোম্বাছুটের সাথে বাবলুকে দেখেছে তার ঘরে যেতে। কথাটা শুনেই খুইন্যা বাবুলের বুকটা ধক করে ওঠে। দৌড়ে ছুটে যায় লোকটার ঘরের দিকে। ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে গোঙানির মতো আওয়াজ হচ্ছে। মাথায় খুন চেপে যায় তার। এক লাথিতে আমকাঠের দরজাটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যে দৃশ্যটা সে দেখতে পায় সেটা একেবারেই নারকীয় ।

তার বারো-তেরো বছরের নিষ্পাপ ছেলেটি উন্মাদগ্রস্তের মতো একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে লোম্বাছুটকে। লোকটা মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে দু’হাতে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু তার ছেলের শরীরে যেনো অশরীরি শক্তি ভর করেছে। মেঝেতে যে পাটির উপরে লোকটা পড়ে আছে সেটা রক্তে একাকার, একাকার লোকটার সারা মুখ আর বুক। লোকটার এক চোখ এরইমধ্যে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। বাবলুর হাতে মুখেও লেগে আছে সেই রক্ত। সে দেখতে পেলো তার ছেলের হাতের অস্ত্রটা আর কিছু নয়, সামান্য একটা বলপেন।

পেছন থেকে নিজের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বাবুল। আর না, বাবা, আর না!

কান্নায় ভেঙে পড়ে তার নিষ্পাপ ছেলেটা। বাবার উপস্থিতি বুঝতে পেরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। হাত থেকে রক্তাক্ত কলমটা পড়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে থাকা লোম্বাছুটের বুকের উপর থেকে ছেলেকে আস্তে করে তুলে আনে বাবুল। জড়িয়ে ধরে রাখে বেশ কিছুটা সময়। কেউ কিছু বলে না, দু’জনেই জানে কি হয়েছে।

কিছুক্ষণ পরই খুইন্যা বাবুলের সম্বিত ফিরে আসে। ভাঙা দরজাটা কোনো রকম ভিড়িয়ে দিয়ে ঘরের এককোণে ছেলেকে বসিয়ে রেখে কিছু কাজ করে ফেলে দ্রুত। তারপর ছেলেকে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পরই লোম্বাছুটের ঘরটা দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলতে শুরু করে।

সবাই জানলো এক দুর্ঘটনায় লোম্বাছুট মারা গেছে।

কতো সহজেই না একটা খুনকে ধামাচাপা দেয়া সম্ভব! কিশোর বাবলু বুঝতে পারে। এই ঘটনার পর থেকে যে তার জীবনটা বদলে গেলো সে খবর কেউ রাখলো না। নিজের হাতে একটা খুন তাকে অন্য এক মানুষে পরিণত করলো রাতারাতি। তার বাবা নিজে একজন পেশাদার খুনি হলেও সে কখনও চায় নি ছেলেকে এ লাইনে আনতে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, তার ফুটফুটে ছেলেটি তার অজান্তে এবং ঘটনাচক্রে তাই হয়ে উঠতে শুরু করে।

এই ঘটনার পর মাত্র আট মাসের মাথায় আরেকটা খুন করে কিশোর বাবলু।

স্কুলে তার এক সহপাঠি ছিলো, তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু-ইরফান। সেই ইরফান স্কুল শেষে আরবী পড়ার জন্য তাদের বাড়ির কাছে মসজিদের এক হুজুরের কাছে যেতো। একদিন ইরফান জানায় তার সাথে হুজুর খারাপ কাজ করেছে জোর করে । লজ্জায় সে এ কথা কাউকে বলতে পারছে না। সে আর হুজুরের কাছে পড়তে যেতে চায় না কিন্তু তার বাপ-মা তাকে বাধ্য করছে। কথাটা তাদেরকে বলতেও পারছে না। কঠিন এক সমস্যায় পড়েছে ইরফান। বাবলুর কাছে সব খুলে বললে কিশোর বাবলু সহজ একটি সমাধান দিয়ে দেয় বন্ধুকে। চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইরফান কিছুই বুঝতে পারে না। এইটুকু এক পিচ্চি কিভাবে এই সমস্যা সমাধান করে দেবে।

কিছুদিন পর জানা গেলো সেই হুজুর নিজের ঘরে মারা গেছে, সম্ভবত হার্ট অ্যাটাকে। অবশ্য ময়না তদন্ত করলে জানা যেতো লোকটাকে ঘুমের মধ্যে শ্বাসরোধ করা হয়েছে।

ইরফান বুঝতে পারে কাজটা তার বন্ধু বাবলু করেছে কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারে না। সাহস করে একদিন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলে সে শুধু জানায়, হুজুর তার সাথে খারাপ কাজ করেছে তাই মরেছে, কিভাবে মরলো, কে তাকে মারলো এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ।

এসএসসি পরীক্ষার আগে দিয়ে ঘটলো আরেকটা ঘটনা । বাবলুর দুধমা অর্থাৎ পেয়ারির মা একটা সমস্যায় পড়লো। পাড়ার এক উঠতি মাস্তান বাড়ন্ত পেয়ারিকে পথেঘাটে বিরক্ত করে। ইদানিং তার সাহস আরো বেড়ে গেছে। ছেলেটার জ্বালায় অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে তাদের পুরো পরিবার। বাবলু সব শুনে চুপচাপ চলে যায় নিজের বাড়িতে। মনে মনে একটা পরিকল্পনা করে সে। ছেলেটাকে কয়েক দিন ফলো করে জেনে নেয় কখন কোথায় থাকে, কী করে । তারপর এক সন্ধ্যায় তার বাবার পিস্তলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। আগে থেকেই জানতো তার বাবা কোথায় পিস্তলটা লুকিয়ে রাখে।

সন্ধ্যার দিকে ছেলেটা বস্তি থেকে একটু দূরে যে খেলার মাঠ আছে সেখানে গিয়ে ফেন্সিডিল সেবন করে। তারপর কিছুক্ষণ বন্ধুবান্ধবদের সাথে চা-সিগারেট খেয়ে চলে যায় নির্জন এক পথ দিয়ে।

প্রতিদিনকার মতো ছেলেটা সেই পথ দিয়ে যাবার সময় বাবলু তাকে পথরোধ করে। কোনো কথা না বলেই সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে গুলি করে দেয়। গুলি করেই স্বাভাবিক ছন্দে হেঁটে বাড়ি চলে আসে। কোনো দৌড়াদৌড়ি কিংবা পালানোর চেষ্টা করে নি। সে জানে ওরকম কিছু করলেই লোকজন সন্দেহ করতো।

তিন নাম্বার খুনটাও ধামাচাপা পড়ে যায়। সবাই বলাবলি করতে থাকে নিজেদের মধ্যে বখরা নিয়ে ভাগাভাগির জের ধরে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে । আশ্চর্যের বিষয় হলো, পত্রপত্রিকাগুলোও এরকম খবর ছাপে। কিশোর বাবলু বুঝে যায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে, বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করলে অনেক কিছুই করা সম্ভব।

এরপর দীর্ঘ দিন আর কোনো খুনখারাবি করে নি । তারপরই এলো আরেকটি বিপর্যয়। বাবলু তখন সবে কলেজে ঢুকেছে। তার পেশাদার খুনি বাপ এক হত্যা মামলায় ফেসে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যায়। মুহূর্তেই পাল্টে যায় বাবলুর জগতটা। বুঝতে পারে এ পৃথিবীতে তার কেউ নেই। তার যে দুধমা ছিলো, ততোদিনে সেই মহিলাও চলে গেছে অন্য কোথাও। তার ঠিকানা পর্যন্ত জানে না সে। তিন-চার দিন কলেজ পড়ুয়া বাবলু নিজের ঘরে খেয়ে না খেয়ে পার করে দেয়। এরমধ্যে একদিন পুলিশ এসে পুরো ঘরটা তল্লাশী করে গেলেও কিছু পায় না, কারণ বাবলু তার বাবার পিস্তলটা অন্য জায়গায় লুকিয়ে রাখে।

বেঁচে থাকার জন্য যে টাকার দরকার সে টাকা সে কোথায় পাবে? তার বাবার দিক থেকে এমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই যে তাকে দেখভাল করবে। ঘরে যা ছিলো সেটা দিয়ে কোনোমতে তিন-চারদিন পার করার পর যখন দেখলো খাবার বলতে কিছু নেই তখনই একটা সিদ্ধান্ত নিলো সে। তার বাবা ঘরে কিছু না রেখে গেলেও একটা জিনিস রেখে গেছে। অনেক ক্ষমতা সেটার। যার হাতে থাকবে সে হয়ে উঠবে ক্ষমতাশালী।

পিস্তলটা কোমরে গুঁজে ঘুরতে থাকে। কিন্তু কী করবে ভেবে পায় না। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে। রাত হয় আরো গাঢ়। এদিকে খিদের চোটে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে সে। এমন সময় নির্জন এক রাস্তায় দেখতে পায় এক লোক তার গাড়ির বনেট খুলে কী যেনো দেখছে। গাড়িটা বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে মাঝপথে ।

গাড়িওয়ালা। নিশ্চয় অনেক টাকার মালিক। একদম একা নির্জন এক রাস্তায়। এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর পাবে না। বাবলু সোজা লোকটার কাছে গিয়ে পিস্তল ধরে বলে মানিব্যাগটা যেনো তাকে দিয়ে দেয়।

আশ্চর্যের ব্যাপার ভদ্রলোক একটুও চমকায় না। আস্তে করে পেছন ফিরে দেখে নেয় তাকে। শীতল চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বাবলু আবারো তাড়া দেয়, “মানিব্যাগটা দিয়ে দিন, প্লিজ!”

লোকটা নিষ্পলক চেয়ে থাকে। বুঝতে পারে ছেলেটা এ লাইনে নতুন। তার কথাবার্তায় এখনও মার্জিত একটা ভাব আছে। কোনো ছিনতাইকারী এভাবে কথা বলবে না । প্লিজ! মুচকি হেসে লোকটা জানতে চায়, “টাকা দিয়ে তুমি কি করবে, বাবা?”

অবাক হয় বাবলু। লোকটা তার সাথে এমন আচরণ করছে কেন? যেনো টাকা চেয়ে আবদার করেছে তার কাছে। অথচ গুলি ভর্তি একটি অত্যাধুনিক পিস্তল ধরে রেখেছে তার বুক বরাবর। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বাবলু বলে, “আমার কাছে কোনো টাকাপয়সা নেই…খিদে পেয়েছে।”

কথাটা শুনে লোকটা মাথা নেড়ে সায় দেয়, যেনো চট করেই সব বুঝতে পেরেছে। তারপর পুরো মনিব্যাগটা বাড়িয়ে দেবার আগে বলে, “পুরো মানিব্যাগটা চাও নাকি শুধু টাকাগুলো দিয়ে দিলেই চলবে?”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে বাবলু।

লোকটা যেনো তার অবস্থা বুঝতে পেরেছে এমন ভাব করে বলে, “মানিব্যাগে আমার জরুরি কিছু কাগজপত্র আর কার্ড রয়েছে, ওগুলো তোমার কোনো কাজে লাগবে না। তাছাড়া আমার স্বর্গীয় মায়ের একটা ছবিও আছে এখানে।” কথাটা বলে মানিব্যাগের ভেতরে রখা ছবিটা দেখায় তাকে। “তোমাকে টাকাগুলো দিয়ে দিচ্ছি…ঠিক আছে?”

বাবলু কিছুই বলতে পারে নি। লোকটা কেন এমন আচরণ করছে বুঝতে পারে না। মানুষ না ফেরেস্তা? এমনভাবে কথা বলছে কেন?

টাকাগুলো বাড়িয়ে দিলে বাবলু দ্রুত পকেটে ভরে নেয়। চলে যেতে উদ্যত হবে তখন শোনে পেছন থেকে লোকটা শান্তকণ্ঠে তাকে বলছে, “আমি জানি তুমি এ লাইনের ছেলে নও।”

ফিরে তাকায় সে। কিছু বলতে পারে না। তার মনের একটা অংশ বলে দ্রুত চলে যেতে, কিন্তু অন্য একটা অংশ বলে, লোকটা তার কোনো ক্ষতি করবে না।

মাথা নেড়ে নিজের কথাটাকে নিজেই সমর্থন করে লোকটা আবার বলে, “মনে হচ্ছে তুমি লেখাপড়া জানা ছেলে,” তারপর টাকাবিহীন মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। “এটা নাও। আমার বিজনেস কার্ড। যদি দরকার মনে করো তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারো।”

কার্ডটা নেবার কোনো ইচ্ছে ছিলো না তার কিন্তু লোকটার কথায় সম্মোহিত হয়ে কার্ডটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা আবার বলে, “এভাবে পিস্তল হাতে এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। চলে যাও। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নাও। কেউ দেখে ফেললে। সমস্যা হবে।”

সেদিন লোকটার কাছ থেকে যে টাকা পেয়েছিলো তা দিয়ে বেশ ভালোমতো কয়েকটা দিন চলে যায় তার। লোকটার কার্ড তার কাছে থাকলেও তার সাথে দেখা করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু লোকটাই একদিন তার বাড়িতে এসে হাজির হয়। অবাক হয় সে, কি করে তার বাড়ি খুঁজে পেলো এ লোক! বাবলু তার সব কথা বললে লোকটা জানায় তার নাম অমূল্য বাবু। সে যদি চায় তাহলে তার লেখাপড়ার সব দায়িত্ব সে তুলে নেবে নিজের কাঁধে। থাকাখাওয়ারও চিন্তা করতে হবে না।

লোকটার কাছ থেকে এরকম প্রস্তাব পাবার পর আর না করার মতো পরিস্থতি ছিলো না তার পক্ষে। ইতিমধ্যে সে জেনে গেছে তার বাবার কমপক্ষে দশ-বারো বছরের জেল হবে । বেশ ভালোভাবেই ফেঁসে গেছে সে।

তো অকৃতদার অমূল্য বাবুর আশ্রয়ে চলে যায় বাবলু। তার কলেজের হোস্টেলে সিটের ব্যবস্থা করে দেয়া থেকে শুরু করে লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ চালিয়ে যেতে থাকে ভদ্রলোক। বছরে দুয়েক বার মাত্র দেখা হতো তাদের। লোকটা তাকে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতো না। সে যে তাকে সাহায্য করছে সেটাও প্রচার করে বেড়াতো না। অনেকটা নীরবে নিভৃতে চলতে থাকে এ ব্যাপারটি।

কিন্তু বাবলুর কলেজের এক ছাত্রনেতার সাথে ঘটনাচক্রে তার ঝগড়া লেগে গেলে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়ায়। তার সহপাঠীরা মিটমাট করে দিলেও ঐ ছাত্রনেতা সন্তুষ্ট হতে পারে না। একদিন সে দলবল নিয়ে বাবলুর উপর চড়াও হয়। বেদম পিটুনি দিয়ে মারাত্মক আহত করে তাকে। ব্যাপারটা সে তার মেন্টর অমূল্য বাবুকে জানাতে পারতো, সে জানতো অমূল্য বাবু বেশ ক্ষমতাশালী একজন লোক, কিন্তু যে ছেলে কিশোর বয়সেই বেশ কয়েকটি হত্যা করেছে তারপক্ষে এভাবে মার খাওয়াটা হজম করা সম্ভব হয় নি। তার বাবার পিস্তলটাও তার কাছে ছিলো, সুতরাং অপমান আর মার খাওয়ার প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে সে। ঐ ছাত্রনেতাকে কিছু দিনের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করে বাবলু। যদিও কেউ এটা দেখে নি তারপরও সবাই বুঝতে পারে কাজটা করেছে সে-ই। এই ঘটনার পর ফেরারি হয়ে যায় সে। কলেজ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। ছাত্রনেতার মূল দল তখন ক্ষমতায়, ফলে। তার জন্যে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

কয়েক দিন পালিয়ে থাকলেও অবশেষে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। অমূল্য বাবু তখন খবর পেয়ে তাকে জামিনে বের করে আনে কিন্তু খুনখারাবির মতো কাজে জড়িয়ে পড়ার জন্য তীব্র ভৎর্সনা করে তাকে। জানিয়ে দেয়, কোনো খুনির জন্য তার দরজা খোলা থাকবে না।

জামিনে বের হয়ে বাবলু একেবারে একা হয়ে পড়ে। ফিরে যায় তার পুরনো ঠিকানায়। বস্তিতে ফিরে এসে অল্প দিনের মধ্যেই নানা রকম বেআইনী কাজকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ে, কারণ তার কাছে একটা অত্যাধুনিক পিস্তল আছে। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে পেশাদার খুনি। অন্যদের চেয়ে একেবারে আলাদা আর শিক্ষাদীক্ষা থাকার কারণে খুব সহজেই এ পেশায় নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে নিতে পারে। বস্তিতে সে পরিচিত হতে থাকে বাস্টার্ড বাবলু নামে, কারণ আরেকজন বাবলু ছিলো ওখানে, একেবারেই নিরীহগাছের একজন। তাই লোকজন তাকে আলাদা করে চেনানোর জন্য বাস্টার্ড শব্দটি জুড়ে দিতো। কালক্রমে আন্ডারওয়ার্ল্ডে সে শুধুই বাস্টার্ড নামে পরিচত হতে থাকে।

সামান্য সন্ত্রাসী আর চাঁদাবাজির পথে না গিয়ে ব্যয়বহুল পেশাদার কিলারে পরিণত হয়। এভাবে অনেক বছর অতিক্রম হবার পর একদিন পত্রিকা পড়ে জানতে পারে অমূল্য বাবু নামের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে কে বা কারা গুলি করেছে অফিস থেকে বের হবার সময়। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় হাসপাতালে। অমূল্য বাবু গুলিবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যায়। বাবলুকে দেখে খুব খুশি হয় ভদ্রলোক। কিন্তু বাবলু ততোদিনে ভয়ঙ্কর পেশাদার খুনি বাস্টার্ডে পরিণত হয়েছে, সে আর দেরি করে না, আন্ডারওয়ার্ল্ডে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এক ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষ অমূল্য বাবুকে খুন করার জন্য আরেক পেশাদার খুনি মুরগী মিলনকে ভাড়া করেছিলো।

অমূল্য বাবুকে দেখে হাসপাতাল থেকে বের হবার মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা পরই মুরগী মিলন আর ঐ ব্যবসায়ী খুন হয় অজ্ঞাত এক খুনির হাতে। শয্যাশায়ী অমূল্য বাবু বুঝতে পারে কাজটা কে করেছে। বাবলু নামের ছেলেটা যে পেশাদার খুনি হয়ে উঠেছে সেটাও বুঝতে পারে ভদ্রলোক। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর অমূল্য বাবুর সাথে বাস্টার্ডের আবার যোগাযোগ হয়। মঝেমধ্যে ফোন করে খবর-টবর নিতো। তবে নিয়মিত যোগাযোগ কিংবা দেখা সাক্ষাত হতো না।

কিছু দিন আগে সেই অমূল্য বাবু তাকে ফোন করে দেখা করতে বলে। দেখা করার পর লেখক জায়েদ রেহমানের কাজটা দেয়। বাস্টার্ড একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোককে খুন করতে রাজি ছিলো না, কিন্তু সব খুলে বললে, বিশেষ করে ইরাম সিদ্দিকির সাথে জায়েদ রেহমান যা করেছে, সেটা জানার পর বাস্টার্ড রাজি হয়ে যায়। কাজটা করার পর থেকে অমূল্য বাবুর সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় সে, তবে তার আগে আগের বাসা ছেড়ে চলে আসে কলাবাগানের বর্তমান বাড়িটায়। এটার ব্যবস্থা অমূল্য বাবুই করেছে। কাগজপত্রে সে ভাড়াটিয়া হলেও কোনো রকম ভাড়া দেয়ার দরকার পড়ে না।

বছর তিনেক আগে, দীর্ঘ দশ বছর জেল খাটার পর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে বের হয়ে আসে তার বাপ। নিজের বাবাকে দেখাশোনা করার জন্য তারই বাবার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় মজিদকে নিয়োগ দেয় সে। এখন সেই মজিদ তার বউ আর এক উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেকে নিয়ে তাদের সাথেই বসবাস করে।

.

অধ্যায় ২৬

হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মাকে দেখতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছে উমা। অবশ্য ওখানকার সাদা পোশাকের পুলিশ বলেছে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে উমা জানে বেশ কয়েক দিনের জন্যে তাকে জেলেই থাকতে হবে, এরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই সে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যায় ।

তার মা ঘুমিয়ে ছিলো, বিছানার পাশে বসে মায়ের কপালে হাত রেখেছে মাত্র অমনি সাদা পোশাকের দু’জন লোক এসে দাঁড়ায় তার সামনে। কোনো রকম তর্কাতর্কি না করে পুলিশের সাথে নীচে নেমে আসে। তারপর পুলিশের একটা জিপ চলে এলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় থানায়, সেখান থেকে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে।

এই ডিপার্টমেন্টের নাম সে খুব একটা শোনে নি। বুঝতে পারছে ডিবি, সিআইডি’র মতো কিছু হবে। তবে হোমিসাইডে ঢুকে, এর পরিবেশ দেখে তার কাছে মনে হলো কোনো অফিসে এসেছে। পুলিশের পোশাক পরা একটা লোককেও দেখতে পেলো না। সবাই স্বাভাবিক পোশাক পরে আছে।

দশ-পনেরো মিনিট বসিয়ে রেখে তাকে একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। এক মহিলা এসে তার শরীরে কিছু তার লাগিয়ে দিয়ে যাবার পরই ঘরে ঢুকলো সুদর্শন এক তরুণ। প্রথমে তাকে দেখে একটু ভড়কে গেলো সে। দেখতে অনেকটাই সেই অজ্ঞাত খুনির মতো! অমিল যে নেই তা নয়, তবে মিলই বেশি।

“কেমন আছেন?” সেই সুদর্শন তরুণ বেশ আন্তরিকভাবেই তাকে বললো।

“ভালো।”

“পুলিশ আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি তো?”

অবাক হয়ে তাকালো সে। “না।”

“ভালো।” একটু থেমে আবার বললো সে, “আমার নাম জেফরি বেগ, আমি এখানকার একজন ইনভেস্টিগেটর। লেডি গিয়াস, মিনা আপা আর সুলতানের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছি।”

উমা বুঝতে পারলো না এই সুলতানটা আবার কে। লেডি গিয়াস আর মিনা আপার খুনের কথা তো সে জানেই।

“এখন বলুন, খুনি লোকটা কোথায়?” আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিলো জেফরি বেগ।

“আমি কিভাবে জানবো? আমি তো ঐ খুনির হাত থেকে পালিয়ে এসেছি,” আস্তে করে বললো উমা।

জেফরি তার সামনে রাখা ল্যাপটপ থেকে মেয়েটির দিকে তাকালো।

মিথ্যে।

“তার সাথে আপনার পরিচয় কতো দিনের?”

“আমি তাকে চিনি না।”

সত্যি ।

অবাক হলো জেফরি বেগ। “চেনেন না?”

“লেডি গিয়াসকে খুন করার পর আমাকে হোটেল থেকে পিস্তলের মুখে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো সে।”

সত্যি ।

“কেন?”

“মিনা আপার বাড়ি চিনিয়ে দেবার জন্যে।”

সত্যি ।

শুধু বাড়ি চিনিয়ে দেবার জন্যে আপনাকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে গেলো?”

“হ্যাঁ।”

সত্যি ।

“তারপর?”

“তারপর আমাকে একটা লেকের পাড়ে নিয়ে যায় খুন করার জন্য,” ঢোক গিলে বললো উমা ।

জেফরি অবাক হয়ে গেলো, মেয়েটা বেশিরভাগ কথাই সত্যি বলছে। কিন্তু এতে করে খুশি না হয়ে বরং চিন্তায় পড়ে যাচ্ছে। তার কথা যদি মেনে নিতে হয় তাহলে তো গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়ছে সে।

“আপনাকে খুন করতে চেয়েছিলো কেন?”

“আমি কী করে বলবো। মনে হয় এসব খুনখারাবির কোনো সাক্ষী রাখতে চায় নি।”

“কিন্তু আপনাকে খুন করার আগেই পুলিশ এসে পড়ে, তাই না?”

উমা চেয়ে রইলো। তাকে আর কষ্ট করে কথাটা বলতে হলো না ।

“তারপর সেখান থেকে কোথায় গেলেন?”

“অনেক জায়গায়, আমি সেইসব জায়গা চিনি না।”

“পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যাবার পর তো অনেক সময় পেলো খুনি, আপনাকে আর খুন করলো না কেন?”

“আমি অনেক কান্নাকাটি করেছি, হাতে-পায়ে ধরে জীবন ভিক্ষা চেয়েছি…অবশেষে লোকটার বোধহয় আমার উপর মায়া হয়…সেজন্যে আর প্রাণে মারে নি।”

সত্যি!

জেফরি ভেবে পেলো না কী বলবে। “উমমম…খুনি আপনাকে নিয়ে গেস্টহাউজে কেন গেলো?”

“সেটা তো আমি বলতে পারবো না। তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আমার ছিলো না।”

সত্যি। উমা সত্যিই জানতো না বাস্টার্ড কেন গেস্টহাউজে গিয়েছিলো।

“আচ্ছা, একটু থেমে গুছিয়ে নিলো প্রশ্নগুলো। এবার আপনি কিভাবে পালিয়ে এলেন সেটা বলুন।”

“গেস্টহাউজ থেকে পালিয়ে যাবার পর লোকটা আমাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে চেয়েছিলো…পথে ট্রাফিক-জ্যামে সিএনজি আর্টকে থাকে অনেকক্ষণ, লোকটা একটু ঘুমিয়ে পড়াতে আমি আস্তে করে সিএনজি থেকে নেমে পালিয়ে আসি।”

মিথ্যে!

চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো জেফরি বেগ। সর্বনাশ! পলিগ্রাফ মেশিনটা কি নষ্ট হয়ে গেলো নাকি! “ঐ খুনি লোকটা কে সে সম্পর্কে কি আপনার কোনো ধারণাই আছে?”

“না। আমি শুধু আন্দাজ করতে পেরেছি তবে নিশ্চিত নই,” উমা বললো।

কি আন্দাজ করতে পেরেছেন?”

“লোকটা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কেউ হবে।”

“কি!” আরেকটু হলে জেফরি চেয়ার ছেড়ে উঠেই যাচ্ছিলো। “আপনি কিভাবে বুঝলেন?”

“মিনা আপা যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আপনি কি পুলিশের লোক, লোকটা তখন বলেছিলো সে নাকি তারচেয়ে বড় কিছু। ডিবি, এসবি, এনএসআই এরকম কিছু কিনা জানতে চাইলে লোকটা হেসেছিলো…সেজন্যেই আন্দাজ করেছি লোকটা গোয়েন্দা সংস্থারই কেউ হবে।”

জেফরি বেগ উমার দিকে চেয়ে রইলো। সে জানে পলিগ্রাফ মেশিন আন্দাজের বিচার করতে পারে না। সুতরাং মেয়েটি যে আন্দাজ করেছে সেটা সত্যিও হতে পারে মিথ্যেও হতে পারে। তবে সে বুঝতে পারছে না এই মেয়ের কোন্ কথাটাকে সত্যি বলে ধরে নেবে। পলিগ্রাফ টেস্টকে মেনে নিলে পুরো ব্যাপারটাই তালগোল পাকিয়ে যাবে।

“আপনি মিনা আপার খপ্পরে পড়লেন কিভাবে?” প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাধ্য হলো সে।

“অভাবে পড়ে…আমার মা-বাবা দুজনেই অসুস্থ।” মাথা নীচু করে ফেললো উমা।

“খুন করার আগে লেডি গিয়াসকে খুনি কি জিজ্ঞেস করেছিলো? মানে তাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছে?”

“আমি শুধু শুনেছি লোকটা লেডি গিয়াসকে জিজ্ঞেস করছে, ব্ল্যাক রঞ্জু কোলকাতার কোথায় থাকে। তারপর আমাকে বাথরুমে আটকে রাখে। আর কিছু শুনতে পাই নি।”

“শুলির আওয়াজ শোনেন নি?”

“না।”

“কিন্তু গুলি তো হয়েছে?”

“হ্যাঁ, গুলি হয়েছে।”

মেয়েটা তো ঠিকই বলছে। জেফরি খেই হারিয়ে ফেললো। পলিগ্রাফ টেস্ট আর এই মেয়েটা কি আজ যুক্তি করেছে জেফরি বেগের মাথাটা খারাপ করেই ছাড়বে?

“আওয়াজ হয় নি কোনো?”

“না। একটা লম্বা নলওয়ালা পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে।”

সাইলেন্সর।

“লেডি গিয়াসকে কিভাবে খুন করলো সে?”

“তারা মনে হয় অনেকক্ষণ মারামারি করেছে, তারপর বাথরুমের দরজায় নক করে লেডি গিয়াস, আমি দরজা খুলে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। তার নাকমুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে…ঠিক তখনই লোকটা পেছন থেকে চাকু মারে তাকে।”

ওহ্। এই মেয়েটা তো সত্যিই বলছে। তার অনুমাণের সাথেও মিলে যাচ্ছে এর বর্ণনা।

“আর মিনা আপা? তাকে কিভাবে খুন করলো?”

“মিনা আপাকে লোকটা খুন করতে চায় নি, তার কাছ থেকে শুধু জানতে চেয়েছিলো ব্ল্যাক রঞ্জু কোথায় আছে। কিন্তু মিনা আপা ডায়রিতে ঠিকানা লেখা আছে বলে ড্রয়ার থেকে পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে, গুলি খাওয়ার পরই লোকটা তাকে খুন করে ফেলে।”

সত্যি ।

“খুনি গুলি খেয়েছে?” নড়েচড়ে উঠলো জেফরি বেগ।

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

“কাঁধে…তবে তেমন গুরুতর নয়।”

“আপনি কিভাবে জানলেন?”

“আমি তার ক্ষতস্থান ড্রেসিং করে দিয়েছি।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। অস্ত্রের মুখে বাধ্য করেছে।”

“খুনি কোনো ডাক্তারের কাছে যায় নি?”

“গিয়েছিলো কিন্তু জায়গাটা আমি চিনি না।”

“আপনি তো আজ সকালে আপনার বাড়িতে গেছিলেন, খুনি আবার সেখানে গেলো কেন?”

“জানি না। সে আমাকে অস্ত্রের মুখে জোর করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।”

“সে আপনার বাড়ির ঠিকানা জানলে কেমন করে?”

“পুলিশের কাছ থেকে নাকি জেনেছে।”

রীতিমতো ভিমরি খেলো জেফরি। “এটা কে বলেছে?”

“ঐ লোকটাই আমাকে বলেছে…সে নাকি শুনেছে আমার বাড়িতে পুলিশ আসছে।”

মাইগড! জেফরি বেগ বিশ্বাসই করতে পারছে না। জামান তাহলে ঠিকই ধরতে পেরেছিলো!

.

অধ্যায় ২৭

রাত দশটা থেকে পরদিন সকাল নটা পর্যন্ত একটানা এগারো ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকলো বাস্টার্ড । গুলির আঘাতটা তাকে পর্যুদস্ত করতে পারে নি তবে শরীরটাকে অনেক দূর্বল করে ফেলেছে। তার বিশ্রামের প্রয়োজন ছিলো, প্রয়োজন ছিলো এক খণ্ড অবসরের যাতে করে পুরো পরিকল্পনাটা সাজিয়ে নিতে পারে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম যে কাজটি করলো সেটা হলো পত্রিকা পড়া। ঘুমোতে যাবার আগেই মজিদকে বলে রেখেছিলো চার-পাঁচটা পত্রিকা জোগার করে রাখতে। মজিদ হলো এই বাড়ির সব কিছুর হর্তাকর্তা। তার অধীনেই শয্যাসায়ী বাপকে রেখেছে সে। তার বাপ দীর্ঘ দশ বছর জেল খেটে বের হবার পর থেকেই মজিদ এই বাড়িতে আছে। লোকটা তার বাপের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তার স্ত্রী আমেনাও থাকে এখানে। রিপন নামের বিশ বাইশ বছর বয়সী তাদের এক ছেলে আছে, খারাপ ছেলেপুলেদের সাথে মিশে বখে গেছে। নেশা-টেশাও করে। বছরখানেক ধরে সেই ছেলেটা মা-বাপকে ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় থাকে, কি করে কেউ জানে না। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে মার কাছে আসে, দেখা করে আবার চলে যায়।

এই মজিদ আর আমেনা তার বাপ-ছেলের ছোট্ট সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে এখন।

বিছানার পাশেই সাইড টেবিলের উপর পত্রিকাগুলো দেখতে পেলো। বুঝতে পারলো খুব সকালেই মজিদ এগুলো এখানে রেখে গেছে।

একটা পত্রিকা হাতে তুলে নিলো । প্রথম পৃষ্ঠায় মাঝারি আকারে সংবাদটি ছাপা হয়েছে। ভিকটিমের ছবি আর দু’কলামের একটি রিপোর্টিং। লেডি গিয়াসের রক্তাক্ত মুখমণ্ডল। খবরটা পড়ে দেখলো ।

লেডি গিয়াস যে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জুর অন্যতম সহচর সেটা বেশ ফলাও করে বলা হয়েছে। হোটেল পিং সিটির মালিকও নাকি ব্ল্যাক রঞ্জু নিজে, তবে কাগজে-কলমে তার বড় ভাইকে মালিক হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। তার ভাইয়ের নাম মনোয়ার হোসেন মঞ্জু। চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী। বর্তমানে গা ঢাকা দিয়ে আছে। এই তথ্যটা তার কাজে দেবে, মনে মনে ভাবলো সে।

বাস্টার্ডের চোখ আটকে গেলো খবরটার একেবারে শেষ দিকে এসে : বর্তমানে এই কেসটি তদন্ত করছে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট। ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ যে লন্ডন থেকে ফিরে এসে তদন্ত কাজটি করছেন সেটাও বলা আছে।

বাস্টার্ড এবার বুঝতে পারলো কেন এতো দ্রুত তাকে ট্র্যাকডাউন করা সম্ভব হলো। জেফরি বেগ তাহলে ফিরে এসেছে! তার কাছে খবর ছিলো ঐ ইনভেস্টিগেটর লন্ডনে আছে।

আরেকটা তথ্য তার মনোযোগ আকর্ষণ করলো : রিপোর্টার হোমিসাইডের বরাত দিয়ে বলেছে, ব্ল্যাক রঞ্জুর বর্তমান স্ত্রী এবং তার আরেক সহযোগী সুলতানও একই রাতে খুন হয়েছে। হোমিসাইড মনে করছে এই তিনটি খুন একই ব্যক্তি করেছে। খুনের মোটিভও অভিন্ন।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সে। মিনা আপা নামের ঐ মহিলা তাহলে রঞ্জর বর্তমান স্ত্রী?

এটা সে জানতো না। খুব সম্ভবতম উমা নামের মেয়েটিরও অজানা ছিলো। দ্বিতীয় পত্রিকাটি তুলে নিলো এবার।

প্রায় একই রকম খবর আছে তবে প্রথমটির তুলনায় কিছু তথ্য কম। যেমন হোমিসাইডের বরাত দিয়ে কোনো কথা লেখা নেই। হয়তো এই পত্রিকার রিপোর্টার হোমিসাইডের কারো কাছ থেকে কোনো মন্তব্য জোগার করতে পারে নি।

তৃতীয় পত্রিকাটি তুলে নিলো সে।

এরা তিনটি খুনের ঘটনাই আলাদা আলাদাভাবে ছেপেছে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। বর্তমান সরকারের আমলে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে সে কথা বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে। খুনের ঘটনার চেয়ে সরকারের ব্যর্থতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তারা। তবে একটা নতুন তথ্য দিয়েছে পত্রিকাটি : হোটেল পিং সিটির ম্যানেজারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সন্দেহ করছে লোকটা ব্ল্যাক রঞ্জুর দলেরই কেউ হবে। লোকটা নাকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও দিয়েছে পুলিশকে।

চতুর্থ পত্রিকাটিতে মনগড়া তথ্য দিয়ে আজগুবি কাহিনী ছাপা হয়েছে ।

ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই যে এই হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে সে ব্যাপারে তাদের কোনো সংশয় নেই। তারা এ আশংকাও করেছে, খুব শীঘ্রই আরো কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটবে। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের ভেতর বড়সড় ভাঙন শুরু হয়ে গেছে! তিনটি খুনই করা হয়েছে একই সময়ে, নিখুঁত দক্ষতায়, একাধিক লোকের সাহায্যে!

বাস্টার্ড পত্রিকাটা তাচ্ছিল্যভরে রেখে দিলো । টয়লেট পেপার।

উমার ব্যাপারে কোনো খবর নেই দেখে সে অবাক হলো না। তার কারণ মেয়েটা গ্রেফতার হয়েছে রাতে। পত্রিকাগুলো হয়তো আগামীকাল সেই সংবাদ ছাপাবে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো মেয়েটার জন্য সে দুশ্চিন্তা করছে।

মেয়েটা যদি তার কথামতো কাজ করে তাহলে খুব জলদিই সে এইসব ঝামেলা থেকে বেঁচে যেতে পারবে-এরকম একটি ধারণা তার ছিলো কিন্তু এখন হোমিসাইডের জড়িত হবার খবরটা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লো। ঐ মেয়ের পক্ষে কি জেফরি বেগের মতো ইনভেস্টিগেটরকে বোকা বানানো সম্ভব হবে?

জোর করে বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে চলে গেলো। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে নিজের ভেতরে সমস্ত চাপ আর ভার লাঘব করে নেবে। তাকে খুব দ্রুত চলে যেতে হবে কোলকাতায়। তবে এটাও ঠিক, ব্ল্যাক রঞ্জুর অবস্থান। খুঁজে বের করাটা যে সহজ কাজ হবে না সেটা সে জানে। রঞ্জুর স্ত্রী, মিনা নামের ঐ মহিলা তাকে যে ঠিকানাটা বলেছে সেটা নির্ঘাত ভুয়া। এই ভুয়া ঠিকানা নিয়ে কোলকাতায় যাওয়াটা ঠিক হবে না। তার চাই আরো নির্ভুল তথ্য। একেবারে নিশ্চিত ঠিকানা না জেনে কোলকাতায় চলে গেলে কানা গলিতে ঢুকে পড়বে। আবার এখানেও বেশিদিন থাকা ঠিক হবে না। যা করার দ্রুত করতে হবে।

.

অধ্যায় ২৮

জেফরির কাছ থেকে সব শুনে হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ চুপ মেরে গেলো।

“স্যার, উমা মেয়েটি খুনির সাথে দীর্ঘক্ষণ ছিলো…দুটো খুন তার সামনেই করা হয়েছে, মেয়েটার কথা গুরুত্ব দিতে হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মহাপরিচালক। “চিন্তার বিষয়।” কথাটা বলেই আবার চুপ মেরে গেলো জেফরির বস।

“আপনি আর দেরি না করে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখুন,..যদি সত্যি সত্যি এরকম কোনো গোপন অপারেশন চলতে থাকে তাহলে আমাদের সমস্ত পরিশ্রমই বৃথা যাবে। খামোখা আমরা কেন এই ইঁদুর-বেড়াল খেলায় ব্যস্ত থাকবো?”

আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো ফারুক আহমেদ। “কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা…”

“কি কথা, স্যার?” উদগ্রীব হয়ে বললো জেফরি।

“এরকম গোপন অপারেশন যদি হয়ে থাকে তাহলে আমরা সে সম্পর্কে জানবো না সেটা মেনে নেয়া যায় কিন্তু ঘটনা ঘটার পর যখন আমরা তদন্তে নেমেছি তখন তো আমাদেরকে জানানো উচিত, নাকি?…মিছেমিছি আমাদের সময় নষ্ট করার তো কোনো মানে হয় না।”

“স্যার, তারা সেটা কেন করে নি বুঝতে পেরেছি।”

সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকালো হোমিসাইড প্রধান।

“অপারেশনটা এখনও শেষ হয় নি…আর শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা চায় এটা কেউ জেনে যাক। তারা হয়তো ভেবেছিলো তদন্ত কাজটি এতো দ্রুত এগোবে না। এখন যখন দেখছে কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে গেছে তখন অন্য কৌশল নিয়েছে।”

“কি কৌশল?”

“নিজেদের লোকদেরকে আমাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল…তাদেরকে আমাদের নাগালের বাইরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ফারুক আহমেদ। “সব শুনে আমারও তাই মনে হচ্ছে ।”

“স্যার, আপনি দ্রুত জেনে নিন ব্যাপারটা কি। সব কিছু না জেনে এই তদন্ত করাটা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই হবে না । আমি আপাতত তদন্ত কাজ বন্ধ রাখছি। দুয়েক দিনের মধ্যে আপনি জেনে নিন আসলে বিহাইন্ড দ্য সিনে কী হচ্ছে।”

“ওকে, মাইবয়।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারুক সাহেব আবার বললো, “ঐ মেয়েটার কী করবে?”

“কী আর করবো…তাকে কাস্টডিতে রেখে তো কোনো লাভ নেই। ছেড়ে দেবো। তবে বলে দেবো আমাদের না জানিয়ে যেনো ঢাকার বাইরে না যায়। তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হবে। আর্টিস্টের সাথে মেয়েটার একটা সিটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। খুনিকে ও-ই সবচেয়ে বেশি দেখেছে, একেবারে কাছ থেকে।”

“তা ঠিক।” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ফারুক সাহেব। জেফরিও উঠে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গে।

“আপনি কি এখনই বেরুচ্ছেন, স্যার?”

“হ্যাঁ।” ডেস্ক থেকে উঠে এসে জেফরির কাঁধে হাত রেখে দরজার দিকে পা বাড়ালো মহাপরিচালক। “আমি আজকের মধ্যেই ব্যাপারটা জেনে নেবো। তুমি এ নিয়ে চিন্তা কোরো না।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

জেফরির পিঠে আলতো করে চাপড় মেরে নিজের রুম থেকে বের হয়ে গেলো হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ।

.

ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করার সময়টাতেই তার মাথায় আইডিয়াটা আসে। সে ঠিক করে ব্ল্যাক রঞ্জু সম্পর্কে আরো নির্ভরযোগ্য তথ্য জেনে নেবে। এবার যার কাছ থেকে ঠিকানাটা আদায় করে নেবে সেটা তাৎক্ষণিকভাবেই খতিয়ে দেখবে সঠিক কিনা।

গোসলের পরও আরেক দফা বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লো বাস্টার্ড। তবে সারা দিন কোনো কাজ করলো না শুধুমাত্র দু’কোটি টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দেয়া ছাড়া। সবগুলো টাকা একটি একাউন্টে না রেখে মোট চারটি একাউন্টে রাখলো। তার এই চারটি একাউন্ট বিদেশী ব্যাঙ্কের, ফলে খুব সহজেই টাকাগুলো যেকোনো জায়গায় নিরাপদে সরিয়ে ফেলা যাবে।

তার কাছে থাকা প্রায় সবগুলো মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছে। ভালো করেই জানে এগুলো তার অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলবে। তবে কয়েক জায়গা ফোন করার দরকার বলে ব্যাঙ্ক থেকে ফেরার সময় সম্পূর্ণ নতুন একটি ফোনসেট আর সিম কিনে নিলো ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে।

কাজ শেষে ফিরে এলো কলাবাগানের বাড়িতে। আজ রাতটাও এখানে থাকবে তারপর শুরু করবে পরবর্তী কাজ। মাঝেমধ্যেই উমা নামের মেয়েটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। মেয়েটার কী অবস্থা জানতে উদগ্রীব হয়ে আছে কিন্তু ভালো করেই জানে এখন সেটা সম্ভব নয়। মেয়েটাকে আজ কোর্টে চালান দেয়া হয় নি। তার পরিচিত এক আইনজীবিকে বলে রেখেছিলো সে, লোকটাকে কিছুক্ষণ আগে ফোন করলে এ কথা জানা গেছে। তার মানে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের কাস্টডিতে আছে। যাইহোক না কেন, মেয়েটা যা ই বলুক না কেন, তার কোনো সমস্যা হবে না। মনে মনে চাইলো মেয়েটা যেনো সব সত্যি কথাই বলে। নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে মিথ্যে বললে বরং ফেঁসে যাবার সম্ভাবনা আছে। সত্যি বললে কী আর সমস্যা হবে? মেয়েটা খুব কমই জানে। যতোটুকু জানে তা বললে তার কোনো সমস্যা হবে না। মেয়েটাও হয়তো বেঁচে যাবে।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে কলাবাগানের বাড়িতে বসে একটা কাজ করলো সে। সদ্য কেনা অত্যাধুনিক মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট কানেকশান আছে, গুগল-এ ‘হোটেল নিয়ার ঢাকা সার্চ করে উত্তরার পিং সিটি হোটেলের কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা জোগার করে ফেললো। কাজটা এতো সহজে করতে পারলো বলে একটু অবাকই হলো সে।

পিং সিটিতে ফোন করলো বাস্টার্ড।

“হ্যালো, হোটেল পিং সিটি থেকে বলছি,” একটা নারীকণ্ঠ বললো।

“আমি কি আপনাদের ম্যানেজারের সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

“আপনি কে বলছেন?” নারী কণ্ঠটা সন্দিগ্ধ হয়ে জানতে চাইলো।

“আমি উনার ইনকাম ট্যাক্স লইয়ার…আপনি আমাকে চিনবেন না। উনাকে একটু দেয়া যাবে? মোবাইলে অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু সেটা তো বন্ধ।”

“স্যার, উনি তো এখন নেই…”

“আমি শুনেছি উনাকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, কথাটা বিশ্বাস করি নি…আসলেই কি ধরে নিয়ে গেছে?”

একটু দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো মেয়েটাকে। “উমমম…জি, স্যার।”

“সো স্যাড…তাই তো বলি ফোন বন্ধ কেন। আচ্ছা, কেসটা কি, আপনি কিছু জানেন?”

“স্যার, আমাদের হোটেলে একটা খুন হয়েছে তো তাই উনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশ নিয়ে গেছে। আশা করছি আগামীকালই জামিন পেয়ে যাবেন।”

“ভালো কোনো উকিল ধরা হয়েছে তো?”

“জি, স্যার…আমাদের মালিক অনেক বড় উকিল ধরেছেন।”

“ভেরি গুড। তাহলে আপনি নিশ্চিত, কালকের মধ্যেই জামিন পাচ্ছেন?”

“আমাকে সেরকমই বলা হয়েছে।”

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ…আপনার নামটা কি জানতে পারি?”

“জি, স্যার। আমার নাম সাগরিকা।”

“চমৎকার নাম, এ নামে উত্তম কুমারের একটা ছবি আছে, তাই না?”

“জি, স্যার, মেয়েটা হেসে বললো।

“নিশ্চয় আপনার বাবা-মা উত্তম কুমারের ভক্ত ছিলেন?”

“জি, স্যার। আমার মা উত্তম কুমারের অনেক বড় ভক্ত।”

“আমিও তার ভক্ত। কোন্ বাঙালি তার ভক্ত নয়, বলুন?”

“তাতো ঠিকই, স্যার।”

“ঠিক আছে, তাহলে কাল আপনাকে ফোন করে জেনে নেবো ম্যানেজার সাহেব জামিন পেয়েছেন কিনা । খুব জরুরি দরকার, বুঝলেন।”

“নো প্রবলেম, স্যার। আপনি দুপুরের পরে ফোন করলে আশা করি সুখবরটা দিতে পারবো।”

“কিন্তু একটা সমস্যা আছে যে।”

“কি সমস্যা, স্যার?” মেয়েটা বেশ সহযোগীতাপরায়ণ আচরণ করছে এখন।

“আমি তো পরশু চলে যাবো সিঙ্গাপুর…একটু থরো চেকআপ করাতে হবে:..ধরুন ম্যানেজার সাহেব কাল জামিন পেলেন না, তাহলে তো একটা ঝামেলা হয়ে যাবে। আসলে কিছু ডকুমেন্ট তার কাছে দিয়ে না গেলেই নয়। আপনি কি তার বাসার ঠিকানাটা দিতে পারবেন? ইনকেস, কাল যদি উনার জামিন না হয় আমি ডকুমেন্টগুলো উনার বাসায় দিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেলাম…?”

“অবশ্যই দেয়া যাবে, স্যার। আপনি একটু হোন্ড করুন, আমি ঠিকানাটা দিচ্ছি।”

কয়েক সেকেন্ড পরই মেয়েটা আবার লাইনে ফিরে এলো। আমি বলছি আপনি লিখে রাখুন…”

বাস্টার্ড মেয়েটার কাছ থেকে ঠিকানাটা শুনে নিলো, তবে ভান করলো সে লিখে নিচ্ছে।

“ঠিক আছে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো। কাল তাহলে ফোন করে জেনে নেবো?”

“অফকোর্স, স্যার।”

“থ্যাঙ্ক ইউ এগেইন, সাগরিকা।”

পিং সিটির ম্যানেজারের বাড়ির ঠিকানা জেনে গেছে সে। আগামীকাল লোকটা জামিন পেলেই কাজে নেমে পড়বে। এই লোকটাই হবে তার আসল চাবিকাঠি।

বাস্টার্ড ফোনটা বন্ধ করে টিভি ছেড়ে দিলো। আজ রাতটাও বিশ্রাম নেবে। আশা করলো দুদিনের বিশ্রামের পর শরীরটা আবার আগে অবস্থায় ফিরে যাবে। কাঁধের ব্যাখাটাও অনেক কমে এসেছে। এখন শুধু অপেক্ষা ক্ষতটা সারতে কতো দিন লাগে।

.

অধ্যায় ২৯

জেফরি বেগ ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের তিনজনের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত আপাতত বন্ধ রাখার কথা বললেও পরদিন অফিসে এসে সহকারী জামানকে বলে দিলো ঢাকা শহরের সবগুলো থানায় একটা অনুরোধ জানানোর জন্য : বিগত এক মাসে ব্ল্যাক রঞ্জু সংক্রান্ত কোনো কেস, জিডি কিংবা কোনো তথ্য থাকলে তারা যেনো সেটা হোমিসাইডকে জানায়। নিজের বসকে তদন্ত কাজ বন্ধ রাখার কথা বললেও একেবারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার লোক সে নয়। কাজ একটু এগিয়ে রাখলে ক্ষতি কি?

জামান তাকে আরেকটা তথ্য জানিয়ে গেছে : খুনি তার কাছে থাকা। পুরনো মোবাইল ফোনগুলো আর ব্যবহার করছে না। সম্ভবত সে টের পেয়ে গেছে মোবাইল ফোনগুলো তার অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছে। জেফরি আগেই বুঝতে পেরেছিলো এটা। একটা সহজ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে বলে কিছুটা আফসোস তৈরি হলো তার মধ্যে।

পিং সিটির গেস্ট অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সাহেব ফোনে জানিয়েছেন তিনি আগামীকাল সকাল দশটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত সময় দিতে পারবেন। জেফরি সেই মোতাবেক হোমিসাইডের আর্টিস্টকে জানিয়ে রাখলো আগামীকাল সকালে সে যেনো প্রস্তুত থাকে। এই কর্নেলের সাথে সিটিংয়ের পরই উমার কাছ থেকে বর্ণনা শুনে আর্টিস্টকে আরেকটা ছবি আঁকতে হবে। তারপর দুটো ছবি মিলিয়ে তৈরি করা হবে একটি ইমেজ। সে কাজটা অবশ্য কম্পিউটার করবে।

হাতে কোনো কাজ নেই তাই সময়টা ভালো কাটছে না। অফিসের ছোট্ট টিভিটা ছেড়ে দিলো সে। কিছুক্ষণ পরই তার ফোনটা বিপ করে উঠলে দেখতে পেলো একটা ইনকামিং মেসেজ এসেছে।

রেবা ।

মুচকি হেসে মেসেজটা ওপেন করলো সে।

লাভ ইউ! ডু ইউ লাভ মি?

জেফরি যতোক্ষণ অফিসে থাকে রেবা তাকে খুব দরকার না পড়লে ফোন করে না, সে চায় না কাজের সময় জেফরির মনোযোগ বিঘ্নিত হোক। শুধু মাঝেমধ্যে এরকম মেসেজ পাঠিয়ে থাকে। এটা জেফরি বেশ পছন্দ করে।

সেও মেসেজটার রিপ্লাই দিলো :

নো, ম্যাডাম! আই … ইউ!

মেসেজটা পাঠিয়ে হেসে ফেললো সে। এরপর রেবা কি জবাব দেবে সেটা সে জানে।

জায়েদ রেহমানের খুনি বাস্টার্ড আর সি ই এ সিদ্দিকীকে ধরার ব্যর্থতার ভার বেশি দিন তাকে বইতে হয় নি। রেবা যখন তার কাছে চলে এলো তার ঠিক দশ দিন পরই লন্ডন থেকে আমন্ত্রণটা আসে। অল্প দিনের নোটিশে তাকে এক মাসের জন্য চলে যেতে হয় লন্ডনে। আমন্ত্রণটা আসার পর একটা চিন্তা মাথায় ছিলো : রেবাকে কার কাছে রেখে যাবে। সে তো তার বাব-মা’র বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। সেখানে ফিরে যাবার কোনো ইচ্ছে তার নেই।

এ রকম সময়ে এক দিন রেবার বাবা জেফরির সাথে দেখা করে একটা মীমাংসা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু জেফরি খুব একটা পাত্তা দেয় নি ভদ্রলোককে। অনেকটা এড়িয়ে যায়। এরপরই রেবার বাবা তার স্ত্রীকে পাঠায় জেফরির কাছে। মহিলা জেফরি আর রেবাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যা হবার হয়ে গেছে, এখন ভালোয় ভালোয় তাদের বিয়েটা দিতে চায় তারা। তাদের . আর কোনো আপত্তি নেই। মহিলার কান্নাকাটিতে রেবা কিছুটা নরম হয় । সিদ্ধান্ত হয়, জেফরি লন্ডন থেকে ফিরে আসার পরই তাদের বিয়ের দিন ঠিক করা হবে। আর জেফরি যতোদিন লন্ডনে থাকবে রেবা যেনো তার বাবার বাড়িতেই থাকে। জেফরির কাছেও ব্যাপারটা ভালো সমাধান বলে মনে হওয়াতে রেবা আর না করে নি।

এখন সে দেশে ফিরে এসেছে চার-পাঁচ দিন হলো। আশা করা যাচ্ছে সামনের মাসে একটা ভালো দিন দেখে তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে।

রেবার সাথে তার প্রায় প্রতিদিনই অল্প সময়ের জন্যে হলেও দেখা হয় । প্রতিদিন অন্তত এক কাপ চা কিংবা কফি তারা একসাথে বসে খায়, গল্পগুজব করে তারপর রেবাকে তাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে আসে নিজের শূন্য ঘরে।

“আসতে পারি?”

একটা নারী কণ্ঠ শুনে জেফরি চেয়ে দেখলো এডলিন ডি কস্টা তার দরজার সামনে। একা পেলে এই মেয়ে জেফরিকে স্যার সমোধন করে না। এখনও তাই করলো।

“আসুন।”

ঘরের ভেতর ঢুকেই তার সামনের চেয়ারে বসে পড়লো সে।

“কি ব্যাপার বলুন?” জেফরি জানতে চাইলো ।

একটা লেটার বাড়িয়ে দিলো জেফরির দিকে। “আমার কয়েক দিনের ছুটি লাগবে,” জেফরির চোখে চোখ রেখে বললো মেয়েটি।

অবাক হলো সে। “ছুটির দরকার তো আমার কাছে কেন এসেছেন?” হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর হিসেবে জেফরি কোনো প্রশাসনিক কাজকর্ম করে না। জুনিয়রদের ছুটির দরখাস্ত অনুমোদন করার এখতিয়ারও তার নয়। তাহলে এই মেয়ে তার কাছে এসেছে কেন?

“ডিজি স্যার বলেছেন আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিতে, মানে আমাকে আপনার দরকার হবে কিনা সেজন্যে,” একটু থেমে রহস্য করে বললো সে, “আমাকে কি আপনার দরকার?”

মেয়েটার চোখ দুটো কেমন জানি করছে। জেফরি অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। পুরো ঘরটা এডলিনের পারফিউমের গন্ধে মৌ মৌ করছে এখন।

“আমি অনুমতি দেবো?” আরো অবাক হলো সে। “ফারুক স্যার বলেছেন?”

“হ্যাঁ।” এবারও স্যার বললো না।

“কিন্তু আমি তো কারোর ছুটির দরখাস্তে সই করি না…মানে এটা করার এখতিয়ার আমার নেই।”

“সেটা আমিও জানি কিন্তু ডিজি স্যার বললেন আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে তিনি ছুটি মঞ্জুর করবেন।”

একটু ভেবে জেফরি বললো, “ঠিক আছে, দিলাম।” সে চাচ্ছে এই মেয়েটা যতো দ্রুত ঘর থেকে চলে যাক। তার চোখের চাহুনি এখন আরো বেশি অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে।

“তাহলে লেটারের এক কোণে নোট লিখে সই করে দিন,” নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ডেস্কের দিকে ঝুঁকে লেটারটার একটা জায়গা দেখিয়ে বললো এডলিন ডি কস্টা।

জেফরি লেটারটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখলো না, সঙ্গে সঙ্গে একটা নোট লিখে সই করে দিয়ে লেটারটা এডলিনের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

“পড়ে দেখলেন না কেন ছুটি নিচ্ছি?” চোখেমুখে আরো রহস্যময়ী ভাব করে বললো এডলিন।

একটু বিষম খেলো জেফরি। “কেন?”

“আমার এনগেজমেন্ট!” বলেই মুখ টিপে হেসে চলে গেলো দরজার কাছে।

একটু অবাক হলো জেফরি তবে বুঝতে পারলো না এনগেজমেন্টের কথা বলতে গিয়ে এমন রহস্যময় হাসি হাসার কারণটা কি। মেয়েটা কি ঠাট্টা করছে?

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলতে চাইলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো জেফরি। এই মেয়েটার উপস্থিতি তাকে কেমন যেনো বিব্রত করে। এটা হয় মেয়েটার অস্বাভাবিক চাহনির কারণে।

আবারো তার ফোনটা বেজে উঠলে জেফরি কলটা রিসিভ করলো।

“স্যার,” জামানের কণ্ঠটা বললো। “ডিসি প্রসিকিউশন থেকে এইমাত্র জানালো পিং সিটি হোটেলের ম্যানেজার জামিন পেয়ে গেছে।”

“তাই নাকি,” জেফরি অবশ্য অবাক হলো না। যদিও ডিসি প্রসিউঁকিশনকে বলে দেয়া হয়েছিলো লোকটার জামিনের আবেদনের ব্যাপারে যেনো তীব্রভাবে বিরোধীতা করা হয় সরকার পক্ষ থেকে।

“জি, স্যার। ম্যানেজারকে কি ফলো করা হবে? তার পেছনে কি তোক লাগিয়ে দেবো?”

একটু ভেবে নিলো জেফরি। এ মুহূর্তে এটার কোনো দরকার নেই। খামোখা সময় নষ্ট। “না । আপাতত দরকার নেই।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

ফোনটা রেখে দিলো জেফরি বেগ।

.

পিং সিটির ম্যানেজার জামিন পেয়েই সোজা চলে গেলে নিজের বাড়িতে। ভদ্রলোক থাকে উত্তরার ৬ নাম্বার সেক্টরে। জীবনে এই প্রথম পুলিশে ধরা খেয়ে কাস্টডিতে ছিলো, রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে, তাই একটু ভড়কে গেছিলো। অবশ্য তার মলিক মনোয়ার হোসেন সাহেব বেশ জাঁদরেল উকিল নিয়োগ দিয়ে কোর্ট থেকে জামিন করিয়েছে। মালিকের কাছে সে কৃতজ্ঞ, যদিও তার মালিক নিজেও সমস্যায় আছে এখন। গা ঢাকা দিয়ে আছে বেচারা। কোথায় আছে সেটা এমন কি সে নিজেও জানে না। তবে তার মালিক যে খুব জলদিই তার সাথে যোগাযোগ করবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত।

মালিকের অবস্থান না জানা থাকার কারণে ভালোই হয়েছে, যদি জানতো তাহলে নির্ঘাত পুলিশ আর ঐ হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টকে বলে দিতো। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের সাথে দীর্ঘদিন ধরে থাকলেও সে নরম স্বভাবের মানুষ। এটা রঞ্জু নিজেও জানে। একজন বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে তার সুনাম আছে।

বাড়িতে ফিরতেই তার তিন মেয়ে আর বউ একসাথে তাকে জড়িয়ে ধরলো। এক আবেগঘন দৃশ্য। তার চোখে পানি এসে গেলো মুহূর্তে। বুঝতে পারলো তার মেয়েরা তাকে অনেক ভালোবাসে। তার চিন্তায় মেয়ে তিনটি অস্থির হয়েছিলো।

গোসল করে ভাত খেয়ে ঘুম দিলো ম্যানেজার । হোটেল পিং সিটিতে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু বড় মেয়ে আর বউ রীতিমতো ধমক দিয়ে বলেছে, আজ আর যেতে হবে না। এখন তার দরকার বিশ্রাম নেবার। সে আর কথা বাড়ায় নি। বউ আর মেয়েদের শাসন বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছে।

সন্ধ্যার একটু আগে তার বড় মেয়ে তাকে ডেকে তুললে ঘুম ভাঙলো । এক লোক এসেছে তার সাথে দেখা করার জন্য। মঞ্জু ভায়ের লোক!

সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে উঠে বসলো ম্যানেজার । সে জানতো লোক মারফতই তার সাথে যোগাযোগ করা হবে। অপারেশন ক্লিনহার্টের সময়ও এরকম হয়েছিলো, সেই সময়টা ছিলো এখনকার মতোই সংকটপূর্ণ। না । ঠিক এখনকার মতো নয়। তখন স্বয়ং রঙুই বিপদে ছিলো। এখন তো রঞ্জু ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিপদ একটা হয়েছে কিন্তু সবটাই গেছে রঙুর ঘনিষ্ঠ লোকদের উপর দিয়ে।

ড্রইংরুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো মাঝবয়সী এক লোক বসে আছে সোফায়। চিনতে পারলো ম্যানেজার। মঞ্জু ভায়ের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ লোক আবুল কালাম।

“ভাই, কেমন আছেন?” আবুল কালাম নামের লোকটা বললো।

“ভালো,” সোফায় লোকটার পাশে বসে পড়লো সে। “ভায়ের কি খবর?”

“উনি নিরাপদেই আছেন। তবে একটু চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছেন।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ম্যানেজার।

“ভাই আপনার সাথে কথা বলবে। এক্ষুণি আসতে হবে আমার সাথে ।”

“এক্ষুণি?”

আবুল কালাম মাথা নেড়ে সায় দিলো। “ভাই খুব কাছেই আছেন।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি একটু বসেন, আমি জামাকাপড় পাল্টে আসছি”।

“তার দরকার নেই, লোকটা তাকে বিরত করলো। “যেভাবে আছেন সেভাবেই চলে আসুন। বেশিক্ষণ লাগবে না।”

ম্যানেজার আর কিছু বললো না। বউ আর মেয়েদের বলে বের হয়ে গেলো আবুল কালামের সাথে।

বাড়ির সামনে একটা রিক্সা দাঁড় করানো আছে, তাতেই উঠে বসলো তারা। এই রিক্সা দিয়েই আবুল কালাম তার বাড়িতে এসেছে, বুঝতে পারলো ম্যানেজার। আরো বুঝতে পারলো মঞ্জু ভাই খুব কাছেই কোথাও আছে ।

তবে ম্যানেজার যেটা বুঝতে পারলো না, তার বাড়ির খুব কাছেই, একটা মুদি দোকানের সামনে এক লোক গভীর আগ্রহের সাথে তাদেরকে দেখে যাচ্ছে । রিক্সাটা একটু সামনে এগোতেই লোকটা দ্রুত রাস্তায় নেমে পড়লো। একটা খালি রিক্সা পেয়ে গেলে সেটাতে উঠে বসলো সে।

বাস্টার্ড দুপুরের পরেই ফোন করেছিলো পিং সিটি হোটেলে। সাগরিকা নামের মেয়েটি আনন্দের সাথেই তাকে জানায় হোটেল ম্যানেজার জামিন পেয়েছেন, তবে আজ তিনি বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছেন, হোটেলে আসবেন না।

শিকারীর ধৈর্য নিয়ে বিকেল থেকে লোকটার বাড়ির সামনে ওৎ পেতে ছিলো সে। জানতো কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাবে। তাই হতে যাচ্ছে এখন।

ম্যানেজারকে নিয়ে রিক্সাটা চলে গেলো ৪ নাম্বার সেক্টরের একেবারে শেষ মাথায় নিরিবিলি একটি জায়গায়। চারপাশে যতোগুলো বিল্ডিং আছে তার প্রায় সবগুলোই আন্ডার কন্সট্রাকশনে। ম্যানেজারের রিক্সাটা যে অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থামলো সেটাই এই এলাকার একমাত্র ফিনিশড অ্যাপার্টমেন্ট।

কিছুটা দূর থেকেই বাস্টার্ড তার রিক্সা ছেড়ে দিলো। আবারো অপেক্ষা করতে হবে তাকে। অপেক্ষা করতে তার খারাপ লাগে না যদি সে নিশ্চিত থাকে অনিশ্চিত কোনো কিছুর জন্যে সে অপেক্ষা করতে পারে না।

মাত্র বিশ মিনিট পরই পিং সিটি হোটেলের ম্যানেজার সেই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে এলো, সঙ্গে সেই লোকটা, যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। গেটের একটু বাইরে এসে ম্যানেজারের সাথে কিছু কথা বলেই লোকটা চলে গেলো কাছের একটা মুদি দোকানে।

বাস্টার্ড দেখলো ম্যানেজার রিক্সার জন্যে অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করেছে।

মুদি দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে লোকটা যে-ই না। অ্যাপার্টমেন্টের দিকে পা বাড়াবে তার পথরোধ করে দাঁড়ালো সে।

লোকটা একটু চমকে গেলো।

“ভাই, আপনি কি এখানেই থাকেন?” বিনীতভাবে জানতে চাইলো সে।

লোকটা ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো।

“১৭/২ বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?”

যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো লোকটা। “১৭/২?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। বাড়ির নাম্বারটা সে আগে থেকেই দেখে রেখেছে। পাশের বিল্ডিংয়ের এক নিমার্ণ শ্রমিকের কাছ থেকে এটাও জেনে নিয়েছে এই বিল্ডিংটাতে কোনো লোজন থাকে না। এখানে শুধু নাটক আর সিনেমার শুটিং হয়। গতকাল রাতেও শুটিং হয়েছে। এখনও সেখানে ইউনিটের লোকজন আছে। সারাদিনই নাকি এখানে শুটিং হয়।

“কার কাছে যাবেন?”

“শুটিং হচ্ছে যেখানে…” বললো সে।

“কোন্ ফ্লোরে?”

এই অল্প সময়ে যেটুকু তথ্য জোগার করেছে তাতে সে এটা জানে না কোন্ ফ্লোরে শুটিং হচ্ছে।

“পাঁচ নাম্বার ফ্লোর বললো নাকি পাঁচ তলা বললো সেটা তো বলতে পারবো না,” গাল চুলকে বললো সে। এমন একটা চালাকি করেছে ধরা খাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এই লোকটা রঞ্জুর ভায়ের সাথে কোন ফ্লোরে থাকে সেটা সে জানে না। আন্দাজে একটা ফ্লোরের কথা বললে যদি কাকতালীয়ভাবে মিলে যায় তাহলে ধরা খেয়ে যাবে তাই ফ্লোর আর তলার মধ্যে যে কনফিউশন আছে সেটা কাজে লাগালো।

“পাঁচ তলায় তো আমরা থাকি, মনে হয় ছয় তলার কথা বলেছে…ওখানে কাল থেকে শুটিং হচ্ছে।”

“তাহলে তাই হবে…আসলে ফ্লোর আর তলা গুলিয়ে ফেলেছি মনে হয়, বলেই বোকার মতো হাসি দিলো সে।

লোকটা অ্যাপার্টমেন্টের দিকে পা বাড়ালে সেও তার সাথে সাথে এগোলো। “আপনিও তাহলে এই বিল্ডিংয়ে থাকেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো লোকটা।

তারা দুজন একসাথেই অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করলো ফলে গেটের দাড়োয়ান তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না।

লিফটে আর কেউ নেই শুধু তারা দু’জন। লিফটটা চলতে শুরু করলে বাস্টার্ড ঠিক করে ফেললো কি করবে। এই লোক নেমে যাবে পাঁচ তলায়। লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। তার দিকে লক্ষ্যই করছে না। গুনগুন করে একটা সুর আওড়াচ্ছে।

“মঞ্জু ভাই খুব টেনশনে আছে, না?”

লোকটা মনে হলো বৈদ্যুতিক শক খেলো। চমকে তার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো তার বুক বরাবর একটা বড় নলওয়ালা পিস্তল তাক করে রেখেছে আগন্তুক।

“আ-আপনি…কে?” কোনোমতে বলতে পারলো সে।

বাম হাতের তর্জনী মুখের কাছে এনে চুপ থাকতে বললো বাস্টার্ড । “একটু এদিক ওদিক করবি তো মরবি!” ।

লোকটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার দিকে।

চকিতে দেখে নিলো লিফটটা এখন চার তলায় আছে। বাম হাত দিয়ে লোকটার কাঁধ জড়িয়ে ধরলো, যেনো বহুদিনের পুরনো দোস্ত-বন্ধু। লোকটার পেটে অস্ত্রটা ঠেকিয়ে রাখলো সে। “চল।” লিফটটা থেমে গেলো পাঁচ তলায়। দরজা খুলতেই তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাস্টার্ড।

পাঁচ তলার ডান দিকের একটা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো তারা। লোকটা পকেট থেকে চাবি বের করে কিহোলে ঢোকালো। লোকটার কাছে চাবি আছে দেখে খুশি হলো বাস্টার্ড। তাকে আর বাড়তি কাজ করতে হবে না, সোজা ঢুকে যাবে অ্যাপার্টমেন্টে।

তাই হলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো তারা।

.

মনোয়ার হোসেন মঞ্জু খুব আপসেট হয়ে আছে। আজ দু’তিন দিন ধরে আত্মগোপন করে আছে সে। নিরাপদ জায়গাতেই আছে কিন্তু যা ঘটছে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। একটু আগে পিং সিটির ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছে, আগামীকালই যে সে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে সেটা জানিয়ে দিয়েছে তাকে, তার অবর্তমানে কি করতে হবে না হবে সবই বলে দিয়েছে লোকটাকে। খুবই সতর্ক থাকতে হবে। ভয়াবহ এক বিপদ নাজেল হয়েছে। চোখকান ভোলা রাখতে হবে। তার উপর এখন অনেক দায়িত্ব। এই সংকটের সময় একটু শক্তও হতে হবে তাকে। ঘাবড়ে গেলে চলবে না। আগামীকাল সকালে এসে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্রে অগ্রীম সই করে নিয়ে যাবে, কারণ কিছুদিন তাকে দেশের বাইরে থাকতে হবে।

ম্যানেজার লোকটা তাদের খুব পুরনো আর বিশ্বস্ত, তবে সমস্যা একটাই, লোকটা ভীতুর ডিম। তাকে একটু আশ্বস্ত করার দরকার ছিলো। এটা বুঝিয়ে দেবার প্রয়োজন ছিলো যে, এই সমস্যাটা খুব সহজেই কেটে যাবে।

সামনের কফি টেবিল থেকে মদের গ্লাসটা আবার তুলে নিলো। এ নিয়ে কয় পেগ হলো? সেই বিকেল থেকেই তো গিলে যাচ্ছে। রঞ্জুর সাথে ফোন কথা লার পর থেকে পান করেই যাচ্ছে। তার ছোটো ভাইকে একটু আগেই জানানো হয়েছে সব ঘটনা। রঞ্জু তো বিশ্বাসই করতে পারে নি। তার দলের তিন তিনজন ঘনিষ্ঠ লোককে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে খুন করা হয়েছে! কে করেছে?

মঞ্জুরও তো একই প্রশ্ন-কে করেছে?

অবশ্য কিছুক্ষণ পর তার ছোটো ভাই নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছে। মঙুকে সে জিজ্ঞেস করে লেডি গিয়াসের কাছে বিপুল পরিমাণের টাকা ছিলো, সেগুলো কোথায়। মঞ্জু অবশ্য টাকার ব্যাপারে কিছু জানতো না। খুন হবার পর তার হোটেলের ম্যানেজার চেষ্টা করেছিলো পুলিশ যেনো খবরটা না জানে কিন্তু এক হারামজাদা রিটায়ার্ড কনেলের কারণে সেটা আর সম্ভব হয় নি। তারপরও পুলিশ আসার আগে লেডি গিয়াসের ঘর থেকে কিছু কাগজপত্র আর তার পাসপোর্টটা সরিয়ে ফেলে ম্যানেজার। কিন্তু কোনো টাকাপয়সা পাওয়া যায় নি ঘর থেকে। সম্ভবত খুনিই টাকাগুলো নিয়ে সটকে পড়েছে।

সব শুনে রঞ্জু জানায়, সে নিশ্চিত, তার দলের মধ্যে কেউ এ কাজ করেছে। কারণ গিয়াসের কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা থাকার কথাটা জানতো যে দু’জন তারাও খুন হয়েছে। হয়তো সুলতানই বেঈমানি করেছে। অন্য কাউকে নিয়ে লেডি গিয়াসকে খুন করে টাকাগুলো হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সে নিজেও বেঈমানির শিকার হয়। প্রচুর টাকা, সুতরাং এরকমটি হতেই পারে।

কিন্তু মঞ্জু যখন জানালো সুলতানই সবার আগে খুন হয়েছে, তারপর গিয়াস, সবশেষে মিনা তখন ফোনের অপরপ্রান্তে নীরবতা নেমে আসে কিছুক্ষণের জন্য।

“তুমি কালই ঢাকা ছেড়ে আমার এখানে চলে আসো।” অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বলে রঞ্জু।

“কাল? ভিসা নিতেই তো দু’দিন লাগবে?”

“ভিসার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই…তুমি কালই চলে আসো।”

“ভিসা ছাড়া?” অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলো মঞ্জু।

“হ্যাঁ। লিটন নামের একজন তোমাকে নিয়ে বর্ডার ক্রশ করবে। আমি তাকে এখনই বলে দিচ্ছি । সব গোছগাছ করে রেডি হয়ে যাও। আমি চাই না তুমি এখন ঢাকায় থাকো।”

“কোন লিটন?”

“তুমি চিনবে না, আমাদের দলে নতুন যোগ দিয়েছে। তার কাছে তোমার ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি, কাল খুব সকালে তোমার সাথে যোগাযোগ করবে সে। লিটনের জন্য সুগন্ধা আর তোমর জন্য রঙধনু। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।” একটু চুপ থেকে আবার বললো মঞ্জু । “ঘটনাটা কি ধরতে পেরেছিস?”

বড় ভাইয়ের এ কথার কোনো জবাব রঞ্জুর কাছেও নেই। “না। কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি চলে আসো…তারপর দেখা যাবে।”

রঞ্জুর সাথে ফোনে কথা বলার পর থেকেই এক অজানা ভয় জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। তাহলে কি সেও খুনির টার্গেট? এজন্যেই কি রঞ্জু তড়িঘড়ি করে তাকে কোলকাতায় চলে আসতে বলছে?

আরো এক ঢোক মদ পান করলো সে। এই অ্যাপার্টমেন্টটা খুব নিরাপদ। ঘুণাক্ষরেও পুলিশ এটাকে সন্দেহের চোখে দেখবে না। এটা বানানোই হয়েছে নাটক আর সিনেমার শুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেবার উদ্দেশ্যে। চলচ্চিত্র ব্যবসার সাথে জড়িত হবার পরই এই চিন্তাটা তার মাথায় আসে। না। তার মাথায় নয়, তার ছোটো ভায়ের মাথায়। যা কিছুই সে করে ছোটো ভায়ের নিদের্শেই করে।

তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী আবুল কালাম ছাড়া এই ফ্ল্যাটে আর কেউ থাকে না। এ কয় দিনেই হাফিয়ে উঠেছে সে। তো কোলকাতায় চলে যেতে পারলে তার ভালো লাগারই কথা কিন্তু খুশি হতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে রাত কাটতে না কাটতেই একটা বিপদ এসে হাজির হবে। ভয়ঙ্কর এক খুনি পিছু নিয়েছে তাদের। সে হয়তো আজরাইলের মতো হাজির হবে এই গোপন আস্তানায়। এই নিরাপদ জায়গাটার কথা এখন আরো একজন জেনে গেছে-তার হোটেলের ম্যানেজার। যদিও লোকটা তার খুব বিশ্বস্ত কিন্তু তার সাথে এখানে দেখা করাটা ঠিক হয় নি। মনে মনে আফসোস করতে লাগলো

সে। রঞ্জুর দলে যদি কেউ বেঈমানি করে থাকে তাহলে সে নিশ্চয় একা নয় । কে কে জড়িত আছে এই বিশ্বাসঘাতকতায় সেটা তাদের অজানা। লেডি গিয়াসের সাথে নাকি অনেক টাকা ছিলো। এটা সে নিজেও জানতো না। ম্যানেজার কি জানতো? না। মনে হয় না।

মাথাটা দু’পাশে দুলিয়ে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো।

কাউকে যেমন সন্দেহ করতে পারছে না তেমনি ঠিক বিশ্বাস করতেও ভয় হচ্ছে। ভালোয় ভালো আজ রাতটা পার করতে পারলেই বেঁচে যায়। রঙুর বড় ভাই হিসেবে সে নিজেও বড় একটা টার্গেটে পরিণত হয়েছে হয়তো। রঞ্জু সেটা আন্দাজ করতে পেরেই ঢাকা ছাড়তে বলেছে।

ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দ পেলো সে। “কে?…কালাম?”

“জি, ভাই।” কালাম জবাব দিলো দরজার কাছ থেকে।

একটু পরই দেখতে পেলো তার ঘরের দরজার সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ঢুলু ঢুলু চোখে তাকালো তাদের দিকে। কালামের কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক লোক, তার অন্য হাতে একটা পিস্তল। কালামের অভিব্যক্তি বলছে লোকটা মোটেও তার ইয়ার-দোস্ত নয়।

একটা ঢেকুর উঠে এলো বুকের ভেতর থেকে।

আজরাইল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *