০১. হোটেল র‍্যাডিসনের সামনে

কন্ট্রাক্ট – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

বেগ-বাস্টার্ড সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১১

.

উৎসর্গ :

নেমেসিস পড়ার পর যারা আমাকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে, যারা আমাকে উৎসাহ দিয়েছে, যারা বিশ্বাস করে বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের মৌলিক-ধূলার লেখা সম্ভব…

.

মুখবন্ধ

নির্জন করিডোর দিয়ে অ্যাপ্রোন পরা এক লোক ভীরু পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই হাসপাতালে বছর তিনেক ধরে কাজ করছে, এই করিডোর দিয়ে অসংখ্যবার যাওয়া আসা করেছে তারপরও আজ একটু নার্ভাস। নিজের হাটার মধ্যে যে অস্বাভাবিকতা আছে সেটা কোনোভাবেই দূর করতে পারছে না। কাজটা করবার জন্য যখন রাজি হয়েছিলো তখন ভেবেছিলো তেমন একটা কঠিন হবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হাসপাতালের এই সুদীর্ঘ করিডোরটা যেনো শেষ হবার নয়। ডাক্তার হিসেবে এরকম নার্ভাস হওয়া তার সাজে না, কিন্তু এটাও তো ঠিক কাজটা ডাক্তারি বিদ্যার সাথে একদমই খাপ খায় না।

বাম দিকে মোড় নিতেই করিডোরের শেষ মাথায় যে কেবিনটা আছে সেটা দেখতে পেলো। এই হাসপাতালের সবচাইতে সুরক্ষিত কেবিন। কেবিনের সামনে যথারীতি দু’জন কনস্টেবল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। না, পুলিশ নিয়ে তার দুশ্চিন্তা নেই। বরং তাদেরকে দেখে একটু সাহসই পেলো, ওদেরকে ম্যানেজ করা হয়েছে। তার দুশ্চিন্তা অন্য লোকগুলোকে নিয়ে। তাদেরকে অবশ্য দেখতে পাচ্ছে না। আশেপাশে আছে কিনা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নয়। হয়তো ক্যান্টিনে গেছে। বিকেলের এই সময়টাতে তারা কিছুক্ষণের জন্যে ক্যান্টিনে যায়। কয়েক দিনের অবজার্ভেশনে এটা জানতে পেরেছে সে। ঠিক এটাই চেয়েছিলো। ঠিক সময়েই এসেছে তাহলে।

৭ নাম্বার কেবিনের সামনে আসতেই কনস্টেবল দু’জন তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তাদের দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে। ডান দিকের কনস্টেবল গেটের তালা খুলে দিলে একটু থেমে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো ডাক্তার মুহতাসিম বিল্লাহ।

*

মিরাজ শেখ প্রবল উত্তেজনা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে হনহন করে উঠে গেলো। তার সারা শরীরে রক্ত টগবগ করছে। প্রতিবারই এমন হয়। কাজটা করার আগে হাত-পা পর্যন্ত কাঁপতে থাকে। ভয়ে নয়, উত্তেজনায়!

আজকের উত্তেজনাটা আরো বেশি। কোনো শিকারী যদি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর শিকারকে বাগে পেয়ে যায় তাহলে এমনই তো হবে। মিরাজ শেখের ইচ্ছে হলো শিষ বাজাবে, কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না। করিডোরে এসে দু’পাশে তাকালো। এ সময় যেমন থাকার কথা-একেবারে ফাঁকা। এটা হলো ভিআইপিদের জায়গা। যে কেউ ইচ্ছে করলেই এখানে আসতে পারে না, কিন্তু মিরাজ শেখ পারে, কারণ এই হাসপাতালের তৃতীয়শ্রেণী কর্মচারি ইউনিয়নের ছোটোখাটো এক নেতা সে।

বড়সর তালা মারা একটি দরজার সামনে এসে থামলো সে। পকেট থেকে চাবিটা বের করে তালা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে। এটা একটা স্টোররুম। পাঁচ-দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে তাকে। তারপরই অবসান হবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার।

*

কেবিনে ঢুকেই ডাক্তার মুহতাসিম বিল্লাহ দেখতে পেলো ভিআইপি রোগি নিজের বিছানায় শুয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা ভাঁজ করে রেখে পায়ের পাতা দুলিয়ে যাচ্ছে। প্রতীক্ষায় থেকে থেকে অধৈর্য হয়ে গেছে সে।

হালকা করে কাশি দিলো ডাক্তার। ভিআইপি রোগি চমকে উঠলো না। ডাক্তারকে দেখেই বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে এলো। রোগিকে নিঃশব্দে সালাম ঠুকলো মুহতাসিম বিল্লাহ। দু’জন মানুষ কিছুই বললো না। বলার দরকারও নেই। ডাক্তার তার অ্যাপ্রোনের পকেট থেকে ছোট্ট একটা জিনিস বের করে ভিআইপি রোগির হাতে তুলে দিলো। রোগি জিনিসটা হাতে নিয়ে আর দেরি করলো না, ঢুকে পড়লো কেবিনের অ্যাটাচড় বাথরুমে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেলো ডাক্তার। আর দেরি করলো না, বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে।

করিডোর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাবার সময় ডাক্তার মুহতাসিম বিল্লাহ নিজের খুশিটা আর চেপে রাখতে পারলো না। সামান্য একটা কাজ অথচ কতো ভয়ই না সে পেয়েছিলো। যাক, শেষ পর্যন্ত কাজটা ঠিকঠাকমতোই করতে পেরেছে। জীবনে এতো অল্প সময়ে পাঁচ লক্ষ টাকা রোজগার করে নি। হ্যাঁ, পুরো পাঁচ লাখ। আর সেটা অগ্রীম।

ডাক্তার মুহতাসিম বিল্লাহ তার প্রিয় একটা গানের শিষ বাজাতে বাজাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো।

ওদিকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে এইমাত্র ডাক্তারের কাছ থেকে পাওয়া মোবাইল ফোনটা সুইচ টিপে চালু করলো ভিআইপি রোগি। নেটওয়ার্ক পেতেই কন্ট্যাক্ট থেকে একটা নাম্বার ডায়াল করলো সে।

চার-পাঁচবার রিং হবার পর ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ করা হলো।

“ওয়ালাইকুম সালাম…” বললো ভিআইপি রোগি।

*

মিরাজ শেখ স্টোররুমের ভেতর একটা চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছে। ভেতরের মালপত্র সরিয়ে আজ সকালেই বিছানাটা তৈরি করে রেখেছিলো সে। তার হাতে কোনো ঘড়ি নেই, তারপরও অনুমাণ করতে পারলো মাত্র দু’তিন মিনিট অতিক্রম হয়েছে। এই ভবনের পাশে যে বড় বিল্ডিংটা আছে সেখান থেকে কারো আসতে কম করে হলেও পাঁচ-দশ মিনিট তো লাগবেই। নিজেকে প্রবোধ দিলো সে।

হঠাৎ একটা চাপা কণ্ঠস্বর তার কানে এলে কিছুটা চমকে ঘরের ভেতরটা তাকিয়ে দেখলো। কোত্থেকে আসছে? বুঝতে পারলো না। কিন্তু চাপা কণ্ঠস্বরটা খুব কাছ থেকেই যে আসছে সেটা বুঝতে পারলো। আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। বেশ ভারিক্কি গলার একজন মানুষ কথা বলছে। কণ্ঠটা বেশ সতর্ক, জোর করে চেপে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু ভারিক্কি গলার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

মিরাজ শেখ তার বাম দিকের দেয়ালে তাকালো। দেয়ালটা তার থেকে মাত্র দুই ফুট দূরে। আগে এখানে একটা বেসিন ছিলো। বছর দুই আগে এই বাথরুমটাকে স্টোররুম বানানো হয়েছে। বেসিনটা যেখানে ছিলো সেখানে এখনও পানির পাইপের দাগ রয়ে গেছে। মাটি থেকে দেড় ফুট উঁচুতে একটা ফুটো আছে। এখান দিয়ে পানির পাইপ চলে গেছিলো। এতোদিন স্টোররুমে রাখা কার্ডবোর্ড বাক্সের আড়ালে ছিলো ফুটোটা, কিন্তু আজ সকালে কিছু বাক্স সরিয়ে বিছানা তৈরি করার ফলে ফুটোটা দৃষ্টির গোচরে চলে এসেছে। এটার ব্যস দুই ইঞ্চির বেশি হবে না। আওয়াজটা সেখান দিয়েই আসছে। মিরাজ শেখ আস্তে করে ফুটোটায় চোখ রাখলো।

*

৭ নাম্বার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল দু’জন দেখতে পেলো সাদা পোশাকের এক অফিসার তাদের দিকে ছুটে আসছে। কনস্টেবল দু’জন একে অন্যের দিকে তাকালো। শালারা কেমনে টের পায়! ডান দিকের কনস্টেবল জোরে একটা কাশি দিলেও বুঝতে পারলো এতে কোনো লাভ হবে না, কারণ কেবিনের ভেতরে ভিআইপি রোগি এখন বাথরুমের ভেতর আছে।

“ভেতরে কে আছে?” অফিসার জানতে চাইলো কনস্টেবল দু’জনের কাছে।

“কেউ নাই, স্যার…” তাদের মধ্যে একজন জবাব দিলো ।

“আমি শুনলাম ভেতরে নাকি একটু আগে একজন ডাক্তার ঢুকেছিলো?” ভুরু কুচকে জানতে চাইলো সে।

হায় আল্লাহ! এরা কি সব দ্যাখে নাকি!

“ঢুকছিলো, বাইর হয়া গেছে, স্যার,” অন্য একজন কনস্টেবল বললো।

“কোন্ ডাক্তার ঢুকেছিলো?” অফিসারের প্রশ্নটা শুনে কনস্টেবল দু’জন চুপ মেরে রইলো। যদি বলে ডাক্তারকে চেনে না তাহলে দায়িত্বের অবহেলার শাস্তি জুটবে।

“ডাক্তার মুহতাসিম, স্যার।”

সাদা পোশাকের অফিসারকে বেশ সন্দিহান দেখালো। “তালা খোলো।”

সঙ্গে সঙ্গে একজন কনস্টেবল দরজার তালা খুলে দিলে অফিসার কেবিনের ভেতর ঢুকেই দেখতে পেলো ভিআইপি রোগিটি বিছানায় নেই। বাথরুমের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। আস্তে করে বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে কান পাতলো সে। ভেতর থেকে যে কথাবার্তা ভেসে আসছে সেটা পরিস্কার শুনতে পেলো না কিন্তু কেউ একজন যে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না। আর সেই লোকটি হলো ভিআইপি রোগি, যাকে পাহারা দেবার দায়িত্ব নিয়ে তারা কয়েকজন দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা পালাক্রমে এখানে থাকে।

দরজায় সজোরে লাথি মারলো অফিসার। পর পর তিনটি। “দরজা খুলুন! দরজা খুলুন!” চিৎকার করে বললো সে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। অস্থির হয়ে আবারো লাথি মারলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল দুজন কেবিনের ভেতর উঁকি মারতেই অফিসার তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো, “এদিকে আসো…দরজায় লাথি মারো!…জলদি!”

কনস্টেবল দু’জন পর পর কয়েকটা লাথি মারলেও দরজাটা ভাঙলো না। এদিকে সাদা পোশাকের অফিসার ওয়াকিটকিতে খবরটা জানিয়ে দিতে শুরু করলো তার লোকজনকে।

হঠাৎ বাথরুমে ফ্ল্যাশ করার শব্দ শুনে অফিসার চিৎকার করে বললো, “স্যার! কোনো লাভ হবে না…কোনো লাভ হবে না!” এরপর আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। কনস্টেবল দুজনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে রেগেমেগে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারলো দরজায়। দরজাটা তো খুললোই চৌকাঠ পর্যন্ত নড়বড়ে হয়ে গেলো।

অফিসার বাথরুমের ভেতর ঢুকেই দেখতে পেলো ভিআইপি রোগি কমোডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কমোডটা ফ্ল্যাশ করে দেয়া হয়েছে। এখনও সেটা পানি ফ্ল্যাশ করে যাচ্ছে।

“কমোডে ফেলে দিয়েছেন!” বলেই ভিআইপি রোগির কাছে এসে একেবারে তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বললো অফিসার। রোগির নাক আর তার নাকের মধ্যে মাত্র এক ইঞ্চির কম দুরত্ব। “লাভ হবে না…আমরা ঠিকই বের করতে পারবো!”

ভিআইপি রোগি অফিসারের মারমুখি আচরণে মোটেও ভয় পেলো না। মুচকি হেসে বললো, “আমার সাথে আজেবাজে কথা বলবে না।” অফিসারকে অনেকটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে গেলো সে।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর হুরমুর করে ঢুকে পড়লো আরো ছয়-সাতজন লোক। তারা সবাই গোয়েন্দা সংস্থার সাদা পোশাকধারী।

“কি হয়েছে?” গোয়েন্দাদের একজন জানতে চাইলো।

“মোবাইলটা কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিয়েছে,” বাথরুম থেকে বের হতে হতে অফিসার জবাব দিলো।

ভিআইপি রোগি নিজের বিছানায় বসে নির্বিকারভাবে চেয়ে রইলো তাদের সবার দিকে। তার চারপাশে গোয়েন্দার দল।

সাদা পোশাকের অফিসার সবার উদ্দেশ্যে বললো, “গেটটা সিকিউর করো…আর ডাক্তার মুহতাসিম বিল্লাহকে অ্যারেস্ট করো, এক্ষুণি।”

ঘর থেকে তিনজন সাদা পোশাকধারী বেরিয়ে গেলেও বাকিরা থেকে গেলো।

“এই দুই বানচোতকেও অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে হবে,” কনস্টেবল দু’জনকে দেখিয়ে বললো। তাদের চোখেমুখে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। ওদের রিপ্লেসমেন্ট করো…পরে আমি বানচোত দুটোকে দেখবো।”

অফিসার আবারো ঢুকে পড়লো বাথরুমে। যদিও জানে কিছুই পাবে না, তারপরও কী মনে করে ঢুকলো সে নিজেও জানে না। বাথরুমটার চারপাশে চোখ বুলালো। একটা কমোড আর একটা লোপ্যান ছাড়াও মাঝারি সাইজের বেসিন আর শাওয়ার ট্যাপ আছে। বাথরুমটা বেশ বড়। আজকাল এরকম বড় বাথরুম কেউ বানায় না। হাসপাতালটা অবশ্য ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বের হতে যাবে অমনি আবার ফিরে তাকালো। কিছু একটা তার চোখে ধরা পড়েছে।

বেসিনের নীচে দেয়ালে একটা ফুটো!

ফুটোটা বেশ বড়। ব্যস দুই ইঞ্চির কম হবে না। দেখেই বোঝা যায় এক সময় ওখান দিয়ে পানির পাইপ চলে গিয়েছিলো দেয়ালের ওপাশে।

হাটু গেঁড়ে উপুড় হয়ে ফুটোটাতে চোখ রাখতে যাবে অমনি একটা কিছু লক্ষ্য করলো অফিসার।

ফুটো দিয়ে যে মৃদু আলো আসছিলো সেটা যেনো হুট করে মিহঁয়ে গেলো।

দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে। ঘর থেকে বের হতে হতে হাতে তুড়ি বাজিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে সাদা পোশাকধারীদের উদ্দেশ্যে বললো, “দু’জন আমার সাথে আসো…বাকিরা এখানেই থাকো!”

ভিআইপি রোগি এই প্রথম একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, সে বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে দরজার দিকে চেয়ে রইলো। হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সাদা পোশাকের তিনজন লোক।

ব্যাপারটা কী?

অধ্যায় ১

ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজার পনেরো মিনিট আগে হোটেল র‍্যাডিসনের সামনে এসে থামলো এক লোক। রোদে পোড়া গায়ের রঙ। পরনের সবকিছু কালো, শুধু চশমাটা সিলভার রঙের। তার চোখে কোনো সমস্যা নেই, চশমাটা একেবারে ভিন্ন একটি কারণে ব্যবহার করছে।

ইচ্ছে করেই পনেরো মিনিট আগে এসেছে। রাস্তার ওপার থেকে হোটেলটা ভালো করে দেখে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে গেলো সে।

হোটেলের ভেতর পার্কিং এরিয়ায় এসে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো। খুঁজে পেতে তেমন অসুবিধা হলো না। হলুদ রঙের গাড়িটা অন্য সব গাড়ির মাঝে চট করেই চোখে পড়লো। এই রঙের গাড়ি খুব কমই ব্যবহার করা হয়। পকেট থেকে একটা চাবি বের করে গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরেকবার চারপাশটা দেখে নিলো ভালো করে। প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে সিটের উপর থেকে একটা জিনিস বের করলোকটি সুটের জিপারব্যাগ।

দরজা লাগিয়ে হ্যাঁঙ্গারটা একহাতে ধরে ব্যাগটা নিয়ে এগিয়ে গেলো হোটেলের ফ্রন্টডেস্কের দিকে।

“মে আই হেল্প ইউ, স্যার,” ডেস্কের স্মার্ট ক্লার্ক মেয়েটি এগিয়ে এসে জানতে চাইলো ।

ব্যাগটা ডেস্কের উপর রেখে লোকটা বললো, “লেটনাইট পার্টি আছে…দশটার মধ্যে ডেলিভারি দেয়া যাবে তো?”

মুখে কৃত্রিম হাসি এঁটে ক্লার্ক মেয়েটি সুটব্যাগটা নিয়ে নিলো। “অফকোর্স, স্যার। আপনি কি চেকইন করেছেন?”

লোকটা কোনো কথা না বলে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দেখালে ক্লার্ক মেয়েটি কার্ডটা হাতে নিয়ে কম্পিউটারের কাছে চলে গেলো।

চারপাশটা আবারো ভালো করে দেখে নিলো লোকটা। সে নিশ্চিত তাকে দেখে তার পরিচিতজনেরাও চিনতে পারবে না। মাথার চুল একেবারে ছোটো ছোটো। প্রায় ন্যাড়া করে ফেলেছে। চোখে চশমা। কাঁচের রঙ হালকা হলুদ। একটা ফুলহাতা কালো গেঞ্জি আর কালো প্যান্ট পরেছে, বেশভূষা দেখলে মনে হবে সদ্য বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে সে। কথাটা মিথ্যে নয়।

ক্লার্ক মেয়েটি ডেস্কের কাছে ফিরে এসে কার্ডটা ফিরিয়ে দিলো তাকে। “আপনার রুমে কি ডেলিভারি দেয়া হবে..নাকি-”

“রুমে,” চট করে বললো লোকটা।

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

মেয়েটার ধন্যবাদের প্রত্যুত্তর না দিয়ে লোকটা সোজা চলে গেলো লবির দিকে।

এটা হলো দ্বিতীয় তলার লবি। অনেকটা বড়সর বেলকনির মতো। ছয় সাতটা রাউন্ড টেবিল আর কিছু চেয়ার আছে। প্রায় সবটাই দখল করে রেখেছে সাদা চামড়ার বেশ কয়েজন নারী-পুরুষ।

এখান থেকে নীচের লবিটা ভালো করে দেখা যায়। হাতঘড়িটা দেখলো। সাড়ে সাতটা বাজে। লোকটা আস্তে আস্তে অলসভঙ্গিতে এগিয়ে গেলো রেলিংয়ের দিকে। নীচের লবিতে, এককোণের একটা টেবিলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। দুজন লোক বসে আছে। তাদের হাতে ফুটজুস। তবে তাতে চুমুক দিচ্ছে না। চুপচাপ বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না।

ঠিক করলো আরেকটু অপেক্ষা করবে। পেছনে ফিরে দেখতে পেলো একটা রাউন্ড টেবিল খালি হয়েছে এইমাত্র। আস্তে করে সেটাতে গিয়ে বসলো। এখানে বসেও নীচের লবিতে লক্ষ্য রাখা যাবে। তার মনের একটা অংশ প্রশ্ন করছে, এতোটা সতর্কতার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা। কিন্তু সে জানে, সতর্কতা হলো এক ধরণের অভ্যাস-এর ব্যত্যয় ঘটানো ঠিক হবে না।

দশ মিনিট পর উঠে গেলো সে।

*

নীচের লবির এক কোণে বসে আছে দু’জন সুট-টাই পরা কেতাদুরস্ত লোক। একজন ক্লিনশেভ হলেও অন্যজনের বেশ স্টাইলিশ ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। হুট করে দেখলে মনে হবে তাদের মধ্যে কোনো তাড়া নেই। নিতান্তই সময় কাটানোর জন্য এখানে এসেছে, কিন্তু ক্লিনশেভ একটু পর পর আড়চোখে হাতঘড়ি দেখছে। তাদের টেবিলে মোট তিনটি চেয়ার। একটা চেয়ার এখনও খালি।

“সময় হয়ে গেছে না?” ফ্রেঞ্চকাট বললো।

“পনেরো মিনিট লেট,” জবাব দিলো ক্লিনশেভ।

“ফোন করবে?”

মাথা নাড়লো ক্লিনশেভ। “দরকার নেই…মনে হয় এসে পড়েছে!”

ফ্রেঞ্চকাট একটু চমকে আশেপাশে তাকালো। লবির পাশেই একটা সুইমিংপুল আছে, সেটার পাশ দিয়ে এক এগিয়ে লোক আসছে তাদের দিকে। কালো পোশাক পরা।

দুজন লোক নড়েচড়ে বসলো। কালো পোশাক পরা লোকটি কিছু না বলে খালি চেয়ারটায় বসে বললো, “দেরির জন্য সরি।”

সুট-টাই পরা দু’জন ভদ্রলোক পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের প্রত্যাশার সাথে বিরাট ফারাক তৈরি হয়েছে। যার সাথে দেখা করার জন্য এখানে এসেছে তার সম্পর্কে যা শুনেছে আর মনে মনে যে ছবিটা একেছিলো তার সাথে একদমই মিলছে না।

“আপনাদের মধ্যে মি. বারী কে?” কালো পোশাকের লোকটা ফ্রেঞ্চকাটের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো।

“আ-আমি…” কথাটা বলার সময় মি. বারী একটু তোতলালো।

লোকটা এবার ক্লিনশেভের দিকে ফিরলো তবে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। এটার কোনো দরকার নেই। “মি. হাশেম, কাজের কথায় আসা যাক, নাকি?” ক্লিনশেভের উদ্দেশ্যে বললো সে।

“শিওর…” মনে মনে একটু গুছিয়ে নিলো মি. হাশেম। “উমম…প্রথম থেকেই বলি, কেমন?”

কালো পোশাক পরা লোকটা আলতো করে মাথা নাড়লো কেবল।

“এক সপ্তাহ আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জু আমার কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের চাঁদা দাবি করেছে…আপনি হয়তো জানেন সে এখন কোলকাতায় আছে।”

“না, আমি জানি না। আপনি কী করে জানলেন সে কোলকাতায় আছে?” কালো পোশাকের আগন্তুক জিজ্ঞেস করলো।

“ওর ফোন নাম্বার দেখে। তাছাড়া এটা সবাই জানে দীর্ঘদিন থেকেই ও। কোলকাতায় বসে চাদাবাজি করে যাচ্ছে। এর আগেও আমার কাছ থেকে একাধিকবার চাঁদা নিয়েছে…দিন দিন তার ডিমান্ড বেড়ে যাচ্ছে। বলতে পারেন তার মতো একটা রাস্তার লোকের কাছে আমি জিম্মি হয়ে পড়েছি।”

“কতে চেয়েছে?” কালো পোশাকের লোকটা জানতে চাইলো।

“দু’কোটি…” কথাটা বলেই মি. হাশেম চুপ মেরে গেলো। মি. বারীর দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো সে। “আমার মতো একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি তার মতো এক গুণ্ডাবদমাশের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে…এটা মেনে নিতে পারছি না।” পাশে বসা মি, বারী মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“আপনি এখন কি করতে চাচ্ছেন?” কালো পোশাকের লোকটা সরাসরি জিজ্ঞেস করলো মি. হাশেমকে।

গভীর করে দম নিয়ে টাইটার নট আলগা করে নিলো বিশিষ্ট শিল্পপতি ব্যবসায়ী আবুল হাশেম। কালো পোশাক পরা আগন্তুক জানে এই লোক কম করে হলেও হাজার কোটি টাকার মালিক।

“আমি ঐ ব্ল্যাক রঞ্জুর হাত থেকে নিস্তার পেতে চাই।”

কালো পোশাকের লোকটা কিছু বললো না। চেয়ে রইলো নিষ্পলক। আবুল হাশেম খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে।

“তাকে খুন করতে চান?”

আবুল হাশেম যেনো একটু বিব্রত হলো, তারপর বেশ দৃঢ়তার সাথে বললো, “হ্যাঁ।”

কালো পোশাকের আগন্তুক মাথা নড়লো আলতো করে। “মি. হাশেম, আমাকে যেহেতু ডেকেছেন ধরে নিচ্ছি পুলিশ এ ব্যাপারে কিছু জানে না। “

ব্যবসায়ী দু’জন মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“পরিস্থিতিটা এমন যে, পুলিশ চাইলেও কিছু করতে পারবে না,” মন্তব্য করলো মি. হাশেম। “পুলিশের কাছে গেলে কোনো লাভ হবে না।”

আগন্তুক একটু চুপ থেকে আবার বলতে লাগলো, “ব্ল্যাক রঞ্জুকে খুন করতে হলে তার অনেক সহযোগীকেও হত্যা করতে হবে। শুধু তাকে মারা সম্ভব হবে না।”

“তাকে মারার জন্যে যা করার তাই করবেন, আবুল হাশেম বললো। “দু’জন…তিনজন…পাঁচজন…যতোজন লাগে।”

আগন্তুক একটু ভেবে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “রঞ্জুর নাগাল পেতে হলে দেশের বাইরে যেতে হবে।”

“সেজন্যেই আপনাকে ডাকা হয়েছে, এবার মুখ খুললো এতোক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে থাকা মি. বারী। “যতোটুকু জেনেছি, এরকম একটা কাজ আপনিই করতে পারবেন।”

তারা জানে, এই পেশাদার খুনি পাকিস্তানে গিয়ে একটি কিলিং মিশন সফলভাবে শেষ করে আসতে পেরেছে। করাচির মতো এক শহরে, ভয়ঙ্কর সেই মিশনটি ছিলো ধারণার চেয়েও কঠিন-আদতে যা ভাবা হয়েছিলো বাস্তবে দেখা গেছে মওলানা ইউসুফ তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতাবান আর ভয়ঙ্কর। এই গল্পটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এ মুহূর্তে তাদের সামনে যে লোকটি বসে আছে সে-ই পারবে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ব্লাক রঞ্জুকে বিদেশের মাটিতে খুঁজে বের করে খুন করতে।

“কিন্তু এতে একটা ঝুঁকি আছে,” আগন্তুক বললো। সামনে বসা দু’জন ভদ্রলোক সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। “তারা যদি জানতে পারে কাজটা আপনারা করিয়েছেন তাহলে ভবিষ্যতে তাদের কেউ আপনাদের অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে।”

“তারা কিভাবে জানবে?” মি: বারী জিজ্ঞেস করলো।

“অনেকভাবেই জানতে পারে।”

“আপনাকে এমনভাবে কাজটা করতে হবে যাতে মনে হয় এটা অন্য কারোর কাজ।”

“অন্য কারো মানে?”

আবুল হাশেম কিছু বলতে গেলেও মি: বারীর চোখের ইশারায় থেমে গেলো। “সরকারী গোয়েন্দাদের কাজ!”

আগন্তুক একটু অবাক হলো। “বাংলাদেশ কিন্তু ইসরায়েল না, এখানকার গোয়েন্দারা অন্য কোনো দেশে গিয়ে খুনখারাবির মতো অপারেশন করে না।”

“সেটা আপনি জানেন, আমরা জানি…কিন্তু ঐ গুণ্ডাটা জানে না। মনে রাখবেন সে একজন ফেরারি সন্ত্রাসী, তার কাছে এটা স্টাবলিস্ট করা কঠিন। কিছু হবে না।”

“বিশেষ করে আপনি যদি সেভাবে কাজটা করেন,” বললো আবুল হাশেম।

নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলো আগন্তুক । “খুব কঠিন কাজ।”

“কিন্তু অসম্ভব নয়,” মি: বারী বললো।

“আমি সেটা বলি নি,” আগন্তুক নাক চুলকে তাকালো মি: বারীর দিকে। “তার মানে আপনারা আমাকে দিয়ে একটা গণহত্যা করাতে চাচ্ছেন?”

কথাটা শুনে দু’জন ভদ্রলোক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। আবুল হাশেম ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো কালো পোশাকের লোকটার দিকে।

“জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী বললাম আর কি…” কথাটা বলার পরই এই প্রথমবারের মতো লোকটার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখা গেলে আড়ষ্ট হয়ে থাকা দু’জন ভদ্রলোক কিছুটা রিল্যাক্স অনুভব করলো। “এরজন্যে কী পরিমাণ টাকা লাগবে সে সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে?”

“আপনি কতোতে হলে কাজটা করবেন?” মি: বারী প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো।

“টাকা যারা দেবে তাদের কাছ থেকেই অফারটা আসা উচিত।”

মি: বারী আবুল হাশেমের দিকে তাকালো। “এরকম কাজে কতো টাকা লাগতে পারে আমাদের দুজনের কোনো ধারণা নেই।” আবুল হাশেম মাথা দোলালো। আপনি যদি আমাদেরকে একটু আইডিয়া দিতে পারেন ভালো হয়।”

আগন্তুক একটু ভেবে নির্বিকারভাবে বললো, “কোটি টাকার মতো।”

অবাক করার ব্যাপার ভদ্রলোক দু’জন টাকার অঙ্কটা শুনে ভড়কে গেলো না। কিন্তু আগন্তুক দারুণ বিস্মিত হলো। বুঝতে পারলো ভদ্রলোক দু’জন এ ব্যাপারে মরিয়া । হয়তো এরচেয়েও বেশি টাকা খরচ করতে পিছ পা হবে না।– “ঠিক আছে,” আবুল হাশিম বললল। “মনে হচ্ছে টাকা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা হবে না।”

“ভালো,” বললো আগন্তুক।

“আমার মনে হয় কিছু বিষয় আরো খোলাখুলি বলা উচিত,” আবুল হাশেম বললো।

তার দিকে স্থিরচোখে তাকালো আগন্তুক। “বলুন।”

“আমরা জানি কাজটা সহজ নয়, এখানে আরো কিছু বিষয় আছে। সময়টা বিরাট ফ্যাক্টর।”

“কী রকম?”

“আমি চাই আপনি কোলকাতা, দিল্লি কিংবা নেপাল, যেখানেই ব্ল্যাক রঞ্জু থাকুক না কেন, তাকে হত্যা করবেন। আর এই কাজটা করতে হবে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে।”

“দু’সপ্তাহ কেন?” আগন্তুক জানতে চাইলো।

“কয়েক দিন পর যে ইলেকশন হবে তাতে আমি এমপি পদে দাঁড়াচ্ছি । আমার নমিনেশন অনেকটা কনফার্ম । আপনি যদি কাজটা নিতে রাজি হন তাহলে আমি কালই স্টেটসে চলে যাবো সপরিবারে। ফিরে আসবো ঠিক দু’সপ্তাহ পর । নমিনেশন পেপার সাবমিট করা ছাড়াও ইলেকশন ক্যাম্পেইনের ব্যাপারটা তো আছেই।”

এবার বুঝতে পারলো কালো পোশাকের আগন্তুক।

“আমি চাই, এই দুই সপ্তাহের মধ্যেই আপনি কাজটা করে ফেলবেন। দেশে ফিরে আমি নিশ্চিন্তে ইলেকশন ক্যাম্পেইন করতে চাচ্ছি।”

“কাজটা এমনিতেই খুব টাফ, সময় বেঁধে দিলে আরো কঠিন হয়ে যাবে।”

“সেটা আমরাও জানি,” আবুল হাশেম তার সঙ্গির দিকে তাকালো। মি: বারী আবারো মাথা নেড়ে একমত পোষণ করলো তার সাথে। “নিছক কোনো খুনখারাবি হলে টাকার অঙ্কটা দশ লাখের বেশি হতো না। কিন্তু কাজটা সেরকম নয়, আপনিও সেরকম নন।”

আগন্তুক মনে মনে হাসলো। হাশেম সাহেব এমনভাবে কথা বলছে যেনো এই জীবনে অনেক লোককে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করিয়েছেন।

“আর সেজন্যে এই কাজটার জন্য আপনাকে এক কোটি টাকাই দেয়া হবে।”

আগন্তুকের কপালে ভাজ পড়ে গেলো। এক কোটি টাকা চাইতেই রাজি হয়ে গেলো! অদ্ভুত! সে ভেবেছিলো টাকার পরিমাণ কমানোর জন্য চাপাচাপি করা হবে। কিন্তু এই লোক দেখি কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই…।

“যে পরিমাণ টাকা রঞ্জুকে দিতে হবে তার অর্ধেক আমাকে দিয়ে দেবেন!” আগন্তুক গাল চুলকে বলতে লাগলো আবার, এতে করে এক কোটি টাকা যেমন বেচে যাবে সেইসাথে দীর্ঘমেয়াদী লাভও হবে। বার বার চাদা দেবার হাত থেকে বেঁচে যাবেন । গুড বিজনেস।”

“দিস ইজ নট অ্যা বিজনেস ফর আস, আবুল হাশেম বললেন। “ইটস অ্যা ম্যাটার অব লাইফ অ্যান্ড ডেথ। ইন আদার ওয়ার্ডস, ইটস অ্যা ম্যাটার অব অনার অ্যান্ড ডিজঅনার।” একটু থেমে আবার বললেন ভদ্রলোক, “ঐ জানোয়ারটা বলেছে টাকা না দিলে আমার পরিবারের কাউকে খুন করবে…এমন কি আমাকেও!” টেবিল থেকে জুসের গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন মনে হলো।

আগম্ভক বুঝতে পারলো ব্ল্যাক রঞ্জু একজন ধনী লোকের নিরাপত্তাই শুধু বিঘ্নিত করে নি, তার ইগোতেও মারাত্মক আঘাত হেনেছে। এখন লোকটা মরিয়া হয়ে উঠেছে পাল্টা আঘাত হানার জন্য। টাকার পরিমাণ এখানে কোনো ব্যাপার নয় ।

“একটু আগে আপনি ঠাট্টা করে গণহত্যার কথা বলেছিলেন,” মি: বারী একদৃষ্টে চেয়ে বললো। “সত্যি বলতে কি, আপনাকে আসলেই ছোটোখাটো একটা গণহত্যা চালাতে হবে। আর সেটা করতে হবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে…অন্য একটি দেশে গিয়ে।”

“এটা নিছক কোনো খুনের কন্ট্রাক্ট নয়। কুখ্যাত সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জু এবং তার নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার মিশন বলতে পারেন, আবুল হাশেম বললো।

“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এ কাজটাকে সমাজসেবা বলে মনে করছেন।” আগন্তুকের ঠোঁটে আবারো স্মিত হাসি।

“বলতে পারেন, এটা এক ধরণের সমাজসেবাই,” মি: বারী বললো। “কতো লোককে এভাবে জিম্মি করে রেখেছে ওরা তার কোনো হিসেব নেই।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে একটু ভেবে নিলো আগন্তুক। “আমাকে কিছু টাকা অগ্রীম দিতে হবে।”

“দশ লাখ,” শিল্পপতি হাশেম চট করে বললো। “আমরা জানি এ কাজ করতে গেলে ইনিশিয়ালি নগদ কিছু টাকা লাগবে।”

“লেনদেনটা কিভাবে হবে?”

“আমাদের কমন ট্রাস্টির মাধ্যমে,” আবুল হাশেম বললো। “পুরো টাকাটা তার মাধ্যমেই লেনদেন হবে। তাদের দু’পক্ষের মাঝখানে পর্দার আড়ালে আরো একজন আছে, যাকে তারা উভয়েই বিশ্বাস করে, আস্থা রাখে।

মি: বারী যোগ করলো, “কাজটা যদি নেন তাহলে আজ থেকে আপনার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ হবে না। আমাদের ট্রাস্টির সাথে আপনি যোগাযোগ রাখবেন। সে-ই আপনাকে যথাসময়ে টাকা-পয়সা দিয়ে দেবে।”

“আশা করি ট্রাস্টির উপর আপনার অগাধ আস্থা আছে?” আবুল হাশেম কথাটা বলে চেয়ে রইলো আগন্তুকের দিকে।

“সময়টা কি বাড়ানো যায় না?”

আগন্তুকের প্রশ্নে মাথা নেড়ে সায় দিলো আবুল হাশেম । “বড়জোড় দু’তিন দিন, এর বেশি না।”

আগন্তুক চুপ মেরে রইলো।

আবুল হাশেম তার বন্ধুর দিকে তাকালে সে নীরবতা ভাঙলো। “আপনি কি আমাদের সাথে এরকম একটা কন্ট্রাক্ট করতে রাজি আছেন, মি…?” থেমে গেলো আজিজুল বারী। এমন নয় যে আগন্তুকের নামটা সে জানে না, বরং মুখ ফসকে বলে দিচ্ছিলো বলেই ভড়কে গেলো।

“রঞ্জুর লোক আপনাকে শেষ কবে ফোন করেছিলো?”

মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো ভদ্রলোক দু’জন।

“তিন দিন আগে,” ছোট্ট করে বললো আবুল হাশেম।

“আবার কবে ফোন করার কথা?”

“বলেছিলো রবিবারের মধ্যে টাকাটা দিতে হবে। আজ শুক্রবার…কাল পরশু ফোন করতে পারে।”

একটু ভেবে আগন্তুক বললো, “আপনি তো বিদেশ চলে যাচ্ছেন, আপনার যে নাম্বারে রঞ্জু আর তার লোক ফোন করেছিলো সেটা আমাকে দিন।”

“অবশ্যই,” আবুল হাশেম পকেট থেকে দামি একটা ফোন সেট বের করে সেটার সিম খুলে আগুন্তুকের দিকে বাড়িয়ে দিলো। “ওরা দু’জন ফোন দিয়েছিলো। প্রথমে দেশীয় একটা নাম্বার থেকে রঞ্জুর এক লোক…তারপর কোলকাতার নাম্বার থেকে রঞ্জু নিজে।”

আগন্তুক সিমটা হাতে নিয়ে চেয়ে রইলো। “কোন্ দুটো নাম্বারে?”

“ওহ্ সরি…বলতে ভুলে গেছিলাম। ব্ল্যাক রঞ্জু১ এবং ব্ল্যাক রঞ্জু২ নামে সেভ করা আছে।”

“এটা তো আপনার প্রাইভেট নাম্বার…এটার কি কোনো দরকার নেই?”

“না, সমস্যা নেই। এটার সবগুলো কন্ট্যাক্ট সেভ করা আছে আমার ল্যাপটপে । এই নাম্বারটা আমি আর ইউজ করবো না।”

“গুড।” আগন্তুক সিমটা পকেটে রেখে দিলো। “আপনি তাহলে কালকেই চলে যাচ্ছেন?” মাথা নেড়ে সায় দিলো আবুল হাশেম। “আর আপনি?” মি: বারীর দিকে ফিলে বললো সে।

“আমি দেশেই আছি,” গম্ভীর মুখে বললো মি: বারী।

“ওর কোনো সমস্যা নেই,” হাশেম সাহেব বলতে লাগলো। “ও আমার ব্যবসায়ীক পার্টনার হলেও রঞ্জু ওর কাছ থেকে চাঁদা চায় নি।”

“আমার সাথে ওর লেনদেন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে,” মি: বারী উদাস হয়ে বললো।

“মানে?”

“আমার যা ছিলো তা সে নিয়ে নিয়েছে।”

আগন্তুক বুঝতে পারলো না।

“গত বছর ওর একমাত্র সন্তানকে রঞ্জু হত্যা করেছে,” হাশেম সাহেব আস্তে করে বললো। “চাঁদা দিতে অস্বীকার করেছিলো।”

.

অধ্যায় ২

পর দিন সকালে ঘুম থেকে একটু দেরিতে উঠলো বাস্টার্ড। বুঝতে পারলো খুব দ্রুত কাজে নেমে পড়তে হবে। সময় খুব একটা নেই। মাত্র দু’সপ্তাহ। এই কদিনে তাকে দেশের ভেতর ব্ল্যাক রঞ্জুর যেসব কন্ট্যাক্ট আছে সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে, তারপর পাড়ি দিতে হবে দেশের বাইরে।

সমস্যা হলো রঞ্জু এমন এক সন্ত্রাসী যার নাম শুনেছে অসংখ্য মানুষ কিন্তু তাকে স্বচক্ষে দেখেছে হাতে গোনা কয়েকজন। তাছাড়া ঢাকা শহরে রঞ্জুর নেটওয়ার্কটা অনেক বিশাল। প্রায় সবগুলো থানায় তার নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। বাস্টার্ড যতোটুকু জানে, রঞ্জুর নেটওয়ার্কে রয়েছে তিনটি স্তর :

প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় কিছু অল্পবয়সী ছেলেপেলে রয়েছে তার। এরাই তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। নিজেদের এলাকায় কোন্ লোকের ব্যবসা-বাণিজ্যের কি অবস্থা, কতো টাকা দিতে পারবে, পারিবারিক তথ্য, ফোন নাম্বার এইসব জরুরি বিষয় সংগ্রহ করে এই দলটি।

এরপর আছে দ্বিতীয় স্তর। এরা ফোন করে জানায় রঞ্জু তাদের উপর কতো টাকার চাদা ধার্য করেছে । শিকারের সাথে টেলিফোনে এরাই যোগাযোগ রাখে। টাকা সংগ্রহ করা, নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেয়ার কাজও করে এই দলটি।

তৃতীয় স্তরে আছে তার সেনাবাহিনী। অল্পবয়সী ভয়ঙ্কর একদল সন্ত্রাসী। কেউ চাদা দিতে অস্বীকার করলে এরা প্রথমে তার বাসা বাড়ি কিংবা অফিসে বোমা হামলা চালায়, গুলি করে কর্মচারী কিংবা বাড়ির অন্যকোনো লোকজনকে আহত করে। এক ধরণের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে সেই লোক আর পরিবারকে। যারা শেষ পর্যন্ত চাঁদা দিতে অস্বীকার করে তাদেরকে এরাই প্রাণে মেরে ফেলে।

বাস্টার্ড জানে শেষ দলটি নিয়ে তার এখন মাথা ঘামানোর দরকার নেই। এদের পেছনে ছুটে লাভ হবে না। প্রথম দলটিও তার কোনো কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এরা তথ্য সংগ্রহকারী। রঞ্জুর খবর এরা জানবে না।

দ্বিতীয় স্তরটি হলো তার প্রথম টার্গেট। এরাই ফোন করে চাদা দাবি করে। রঞ্জুর সাথে এরাই লিয়াজো রক্ষা করে সব সময়। তার দরকারি তথ্য যদি কেউ দিতে পারে তো এরাই পারবে।

রঞ্জু এবং তার দল সম্পর্কে খুব কমই জানে সে, সেজন্যে শুরু করার জন্য শিল্পপতি আবুল হাশেমের কাছ থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের সিমটা নিয়ে নিয়েছে। এটাই তার বড়শী, এটা দিয়েই সে মাছ ধরবে।

তার আরেকটা সুবিধা হলো রঞ্জু যেখানে থাকে, সেই কোলকাতা শহরটা তার ভালো করেই চেনা। তার ঘনিষ্ঠ এক লোকের ওখানে ভালো সোর্স রয়েছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার ট্রাস্টির সাথে ফোনে যোগাযোগ করে সবকিছু সেটেলড করে নিলো, তারপর চলে গেলো পুরনো ঢাকায়, তার এক পরিচিত লোকের কাছে।

শুটার সামাদ নামে পরিচিত এই লোকই তার সব ধরণের অস্ত্র আর গুলি সরবরাহ করে থাকে। নিজের জন্যে একটা পিস্তল রেখে বাকি সব কিছু এই লোকের কাছ থেকে সে ভাড়ায় নেয়। অবশ্য বিদেশে যাবার আগে সেই পিস্তলটাও এর কাছেই রেখে গেছিলো।

এককালে একটি ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার এই শুটার সামাদের কল্যাণেই ছাত্র নেতা এবং সন্ত্রাসের যুবরাজ হয়ে উঠেছিলো তবে সামাদ ভাই বরাবরই রয়ে যায় পর্দার আড়ালে। তার আরেকটা বড় পরিচয় হলো তিনি একজন ভালো শুটার। যে-ই সেই শুটার নন, একেবারে আন্তর্জাতিক পদক পাওয়া একজন। একটা সময় ভাড়াটে শুটার হিসেবে কাজও করেছেন। তবে সেই পেশায় বেশি দিন ছিলেন না। এখন রীতিমতো অস্ত্রব্যবসায়ী। আন্ডারওয়ার্ল্ডে এমন কেউ নেই তার নাম শোনে নি কিংবা তার কাছ থেকে অস্ত্র-গুলি কেনে না। শুটার সামাদের কাছ থেকে ব্ল্যাক রঞ্জু আর তার দল সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা যাবে কারণ ব্ল্যাক রঞ্জুর উত্থান ঐ এলাকায় ।

পুরনো ঢাকার নবাবপুর রোডের সারি সারি হার্ডওয়্যারের দোকানের এক ফাঁকে সংকীর্ণ এক চোরাগলি দিয়ে উপরে উঠে গেলো সে। বাইরে থেকে দেখলে পুরনো দিনের একটি দোতলা ভবন, কিন্তু বাস্টার্ড জানে, ভেতরে এটা তিন তলা । এই বাড়ি যিনি তৈরি করেছিলেন তিনি কেন এরকম আজব কাজ করেছেন সেটা ভেবে পেলো না সে। কী ধরণের সুবিধা পাবার আশায় তিনি এ কাজ করেছেন সেটাও তার বোধগম্য হলো না, তবে বর্তমানে এর পুরো সুবিধা নিচ্ছে শুটার সামাদ। কম করে হলেও একশ’ বছরের পুরনো এই বাড়িটি কোনো হিন্দু ব্যবসায়ীর বাড়ি ছিলো। এখন হাত ঘুরে চলে এসেছে শুটার সামাদের দখলে।

সংকীর্ণ আর খাড়া সিঁড়ি, তার উপর দিনের বেলায়ও বেশ অন্ধকার। দোতলায় উঠেই একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। পর পর তিনটি টোকা মারলো কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। কিছুক্ষণ পর দরজার উপরে একটা লো-পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠলে বুঝতে পারলো দরজার ওপাশ থেকে তাকে কেউ দেখছে। দরজাটা পুরনো দিনের হলেও একটা পিপহোল আছে। ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো উনিশ-বিশ বছরের এক ছেলে। মুখে বেশ কয়েকটি ক্ষতচিহ্ন। তাকে দেখেই ক্ষতচিহ্নভরা মুখটা হাসিতে ভরে উঠলো।

কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। ছেলেটা তাকে নিয়ে দুটো ঘর পেরিয়ে আরেকটা সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে গেলো তিন তলায়। এটাকে এখানকার সবাই বলে আড়াই তলা!

বেশ বড়সড় একটা ঘর, রীতিমতো বিশাল ডেস্ক আর চেয়ার নিয়ে অফিসের রূপ দেয়া হয়েছে। বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যাবে না এখানে এরকম সাজানো গোছানো অফিস থাকতে পারে। ঘরে সামাদ ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। টেলিফোনে কার সাথে যেনো কথা বলছেন। বাস্টার্ডকে দেখে ইশারা করলেন সামনের একটা চেয়ারে বসার জন্য।

টেলিফোনে কথা শেষ করে বাস্টার্ডের দিকে ফিরলেন।

“আরে, তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না!”

বাস্টার্ড কিছু বললো না ।

“গায়ের রঙ তো একেবারে ময়লা হয়ে গেছে…কোথায় ছিলে এতোদিন?”

“দেশের বাইরে।”

সামাদ ভাই জানতে চাইলেন না কোন্ দেশে। বুঝতে পারলেন বাস্টার্ড এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছে না। “তো কী ব্যাপার..বলো?”

“এই তো, কিছু জিনিস লাগবে।”

দাঁত বের করে শুধু হাসলো শুটার সামাদ। “ফোনে যেটা বললে সেটা কি খুব সিরিয়াস?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড।

“হঠাৎ ব্ল্যাক রঞ্জু সম্পর্কে…” কথাটা বলেই সামাদ ভাই ভুরু কুচকালেন। “তোমার পরিচিত কারো কাছ থেকে চাঁদা চেয়েছে নাকি?”

“না,” আস্তে করে নির্বিকারভাবে বললো সে।

শুটার সামাদ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে একটু ভেবে নিলেন। “আসলে ওর সম্পর্কে আমি যে খুব বেশি জানি তা বলবো না। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় সরকার-সমর্থক কিছু সন্ত্রাসী ছাত্রনেতা আর স্থানীয় সন্ত্রাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর হামলা চালায়, তখন সেই দলে ব্ল্যাক রঞ্জুও ছিলো।” কথাটা বলেই সামাদ ভাই একটু হাসলো।

বাস্টার্ড জানে ঐ দলে সামাদ ভাই নিজেও ছিলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তারা সুবিধা করতে পারে নি। স্বৈরাচারের পতন হলে সবাই দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলো ।

“আমরা দুটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করেছিলাম। অস্ত্র নিয়ে ঢাকা শরে মুভমেন্ট করার সুবিধার্থে আমাদেরকে দুটো কোড দেয়া হয়। আমাদেরটা ছিলো রঙধনু, অন্যটার ছিলো সুগন্ধা। রঞ্জু ছিলো অন্য গ্রুপে। অনেকের মধ্যে দেখেছি কিন্তু এতোদিন পর চেহারা মনে থাকার কথা নয়।”

“পত্রিকায় যে ছবিটা দেয়া হয়?” জানতে চাইলো বাস্টার্ড।

মাথা দোলালো শুটার সামাদ। “মনে হয় না ওটা রঞ্জুর ছবি।” একটু থেমে আবার বললো সামাদ, “যেদিন ডাঃ মিলন নিহত হয় সেদিন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসতে বাধ্য হই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করতো ওটা রঞ্জুর কাজ। তো ডাক্তার নিহত হবার পর আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে আমাদের তুমুল বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়ে হয়। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় ব্ল্যাক রঞ্জু। তার বাম হাতের তালুতে গুলি লাগে। খৃ নট থ্র রাইফেলের গুলি। হাতটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।”

“তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, তার বাম হাতটা বিকৃত?…সেটাই একমাত্র চেনার উপায়?”

“একমাত্র উপায় কিনা জানি না, তবে আমি তাকে সেভাবেই চিনবো। চেহারাটা তো আর মনে নেই।”

বাস্টার্ড জানে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে ব্ল্যাক রঞ্জু সম্পর্কে পুলিশের কাছেও খুব বেশি তথ্য নেই। আছে শুধু খুনখারাবি আর চাঁদাবাজির অভিযোগ। এই সন্ত্রাসী প্রায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে সব সময়। এমনকি মাঝেমধ্যে পত্রিকায় তার যে ছবিটা ছাপা হয় সেটা ছাড়া পুলিশের কাছে রঞ্জুর আর কোনো ছবি। পর্যন্ত নেই। সেটা আদৌ রঙুর ছবি কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।

“ওর শুরুটা হয়েছিলো কোথায়?”

“রঞ্জু ভায়ের ক্যাডার হিসেবে…”

“রঞ্জু ভাই? অবাক হলো বাস্টার্ড ।

মাথা নাড়তে লাগলেন শুটার সামাদ। ব্ল্যাক রঞ্জুকে যে লোক রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলো। এই রঞ্জুর কথা এখন খুব কম লোকেই জানে। গেন্ডারিয়া মিলব্যারাক এলাকায় এক সময় তার খুব দাপট ছিলো। সেটা আশি থেকে শুরু করে নব্বই সাল পর্যন্ত।” একটু থেমে একটা সুইচ টিপে আবার বলতে শুরু করলেন। “দুই রঞ্জু একসাথে ছিলো বলেই তাদেরকে আলাদা করার জন্য এই রঞ্জুকে ব্ল্যাক রঞ্জু বলে ডাকতে শুরু করে লোকজন। তার গায়ের রঙ একেবারে নিগ্রোদের মতোই কালো, বুঝলা।” সামাদ ভাই কথা বন্ধ করে ফেললেন, কারণ ঘরে সেই ছেলেটা এসে হাজির হয়েছে।

“দুই কাপ চা,” সামাদ ভাই কথাটা বলেই আবার বলতে শুরু করলেন। “রঞ্জু ভাই এক সময় আন্ডারওয়ার্ল্ডে হোমরাচোমরা হয়ে উঠেছিলেন। পলিটিশিয়ানদের সাথেও তার বেশ খাতির ছিলো। কিন্তু উঠতি এক পলিটিশিয়ানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে রাগের মাথায় হত্যা করে ফেলেন তিনি। ব্যাপারটা ছিলো মারাত্মক ভুল। ক্ষমতাসীন পলিটিশিয়ানদের খুন করা খুব রিস্কি। তো, পুলিশের কিছু করার ছিলো না, যদিও রঞ্জু ভায়ের সাথে তাদের বেশ খাতির ছিলো। ধরা পড়ে জেলে চলে যান। আর ঠিক এই সুযোগেই ব্ল্যাক রঞ্জুর উত্থান। রঞ্জু ভাই চার বছর জেলে ছিলেন। এই চার বছরে ব্ল্যাক রঞ্জু রীতিমতো আন্ডারওয়ার্ল্ডে একটা জায়গা করে নেয়।”

“কিন্তু তার বস রঞ্জু ভায়ের কি হলো?” বাস্টার্ড জানতে চাইলো ।

“চার বছর পর অন্য দল ক্ষমতায় এলে রঞ্জু ভাই জেল থেকে বের হয়ে আসেন। তখন থেকেই ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এটাও তার জন্য মারাত্মক ভুল ছিলো। জেল থেকে বের হবার মাত্র দু’মাসের মাথায় তিনি খুন হন।”

ছেলেটা চা দিয়ে গেলো।

“এরপর ব্ল্যাক রঞ্জুকে আর কেউ আটকাতে পারে নি। বিশাল একটি বাহিনী গড়ে তোলে সে। এমন নেটওয়ার্ক এর আগে এ দেশে দেখা যায় নি। এখনও বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।”

“এখন সে কোথায় আছে?” বাস্টার্ড জানতে চাইলো চায়ে চুমুক দেবার পর।

“কোলকাতায়।” সামাদ ভাই চায়ের কাপ তুলে নিলেন। “আপনি নিশ্চিত, সে কোলকাতায় আছে?”

“হুমম,” চায়ে চুমুক দিলো সামাদ ভাই।

বাস্টার্ড একটু চুপ থেকে বললো, “দেশে ব্ল্যাক রঞ্জুর সবচাইতে কাছের লোক কে?”

“এটা বলা খুব কঠিন। বিশাল নেটওয়ার্ক…কতো লোক কাজ করে কেউ জানে না। তাদের মধ্যে অনেকেই তার ঘনিষ্ঠ কিন্তু সবচাইতে ঘনিষ্ঠ কে সেটা জানা খুব কঠিন।” ।

“ওর এখানকার কাজ মূলত কে করে?”

“অনেকেই…একেক এলাকায় একেক জন।”

“কিন্তু চাঁদাবাজির টাকাগুলো নিশ্চয় একজনের কাছেই যায়?” বললো বাস্টার্ড।

“হুম…তাই তো হবার কথা,” চায়ে চুমুক দিয়ে সামাদ ভাই বললেন। “টাকাটা একজনের কাছেই যাবে। টাকা-পয়সা নিয়ে বিশ্বাস করা যায় এরকম লোকের সংখ্যা সব সময়ই হাতেগোনা থাকে।”

“ব্ল্যাক রঞ্জুর কোন্ লোক প্রথমে ফোন করে চাঁদা দেয়ার কথাটা জানায়? নিশ্চয় এ কাজটা অনেকে করে না?” বাস্টার্ড জানতে চাইলো।

“আমি যতোটুকু জানি সুলতান নামের একজন এ কাজ করে।”

“সে কোথায় থাকে?”

“ঠিক করে কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে পুরনো ঢাকায়, কেউ বলে নদীর ওপারে, কেরাণীগঞ্জে, আবার কেউ বলে সাভারে। তবে আমার ধারণা সে পুরনো ঢাকায়ই থাকে।”

মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “আমার একটা সাইলেন্সারসহ পিস্তল আর বাড়তি কিছু গুলি লাগবে,” বললো বাস্টার্ড।

“সাইলেন্সারসহ?” সামাদ ভাই একটু অবাক হলেন। “একটাই আছে। আমার কাছে…এখানে তো এ জিনিস কেউ ব্যবহার করে না…আমি রেখেছিলাম অনেকটা শখের বশে।”

পকেট থেকে একটা টাকার বান্ডিল বের করে ডেস্কের উপর রাখলো। “এখানে পঞ্চাশ হাজার আছে।”

বান্ডিলটা হাতে নিয়ে ডেস্কের নীচে একটা ড্রয়ারে রেখে দিলেন সামাদ ভাই।

“ঠিক আছে তো জিনিসটা?”

“আরে কি বলো তুমি!” একটু যেনো কষ্ট পেলেন। “আমি একজন শুটার, ভুলে গেছো! আমার কাছে ওইসব জিনিস সব সময় সচল থাকে।”

মুচকি হাসলো বাস্টার্ড।

“একটু বসো,” বলেই ডেস্ক থেকে উঠে গেলেন শুটার সামাদ। চলে গেলেন পাশের একটা ঘরে । পাঁচ মিনিট পর একটা জুতার বাক্স নিয়ে ফিরে এসে ডেস্কে নিজের চেয়ারে বসলেন। বাক্সটা খুলে একটা সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ পিস্তল আর কালো রঙের মোটা চুরুটের মতো জিনিস বের করলেন।

“স্প্যানিশ মাল,” পিস্তলের মুখে সাইলেন্সারটা লাগাতে লাগাতে বললেন, “শুয়ের্নিকা। ছোটো কিন্তু জিনিস কড়া।” সাইলেন্সারটা লাগিয়ে অস্ত্রটা বাস্টার্ডের দিকে ঠেলে দিলেন।

মনে মনে হাসলো বাস্টার্ড । পাবলো পিকাসো যুদ্ধের বিভীষিকা ফুটিয়ে তোলার জন্য গুয়ের্নিকা নামের একটি বিখ্যাত ছবি এঁকেছিলেন, আর তারই স্বদেশীয় অস্ত্রনির্মাতারা সেই নামে ক্ষুদে একটা মারণাস্ত্র বাজারে বিক্রি করছে।

“সাইলেন্সরটা জামার্নির। বেশ ভালো। থুতু ফেলার মতো শব্দ করে…তার বেশি না,” বললেন সামাদ ভাই।

বাস্টার্ড জিনিসটা হাতে নিয়েই কোমরে গুঁজে রাখলো। কোনো রকম পরীক্ষা করে দেখলো না। এই ব্যাপারটা শুটার সামাদকে বেশ খুশি করলো।

সামাদ ভাই এবার ডেস্কের নীচ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে ঠেলে দিলো বাস্টার্ডের দিকে। এখানে বিশটা আছে। আরো লাগবে?”

“না।” প্যাকেটটা পকেটে রেখে দিলো সে। “তাহলে আমি এখন যাই…পরে আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলবো।”

“ওকে,” শুটার সামাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে স্থির চোখে চেয়ে রইলেন। বাস্টার্ড দরজার সামনে যেতেই পেছন থেকে বললেন, “ব্ল্যাক রঞ্জু খুবই ডেঞ্জারাস লোক।”

বাস্টার্ড ফিরে তাকালো তার দিকে।

“তাকে আন্ডারএস্টিমেট কোরো না।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো সে।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখা হলো সেই ছেলেটির সাথে। তার হাতে একশ’ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলো বাস্টার্ড। এখানে যখনই আসে তাকে টিপস দেয়। ছেলেটা কিছু বললো না, চুপচাপ পকেটে টাকাটা রেখে দিয়ে বাস্টার্ডকে হাত ইশারা করে থামতে বললো। তারপর অন্য পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে ধরিয়ে দিলো তার হাতে। অবাক হলো বাস্টার্ড । তবে কিছু না বলে সোজা বেরিয়ে গেলো।

এই ছেলেটা বোবা। জন্ম থেকে নয় । বছর দুই আগে বোমা বানাতে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় বোবা হয়ে গেছে। তার গলায় তিন-চারটা প্রিন্টার ঢুকে গিয়েছিলো। ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে গেছে সেই আঘাতে । অল্পের জন্য চোখ দুটো বেঁচে গেলেও মুখে এখনও দাগগুলো রয়ে গেছে।

রাস্তায় নেমে চিরকুটটা খুলে দেখে অবাক হলো সে। কাঁচা হাতে অল্প কিছু কথা লেখা :

বংশাল ছোটো মসজিদের পাশে সেন্টু মিয়ার দোকানে যান। আমার কথা বলবেন। রঞ্জুর খবর পাবেন।

মুচকি হাসলো সে। বোবা তাহলে সব শুনেছে আড়িপেতে। ছেলেটাকে খুব স্নেহ করে সে। ছেলেটাও তাকে খুব পছন্দ করে যদিও সেটা প্রকাশ করে না। প্রকাশ করার দরকার পড়ে না। সে জানে ।

একটা রিক্সা নিয়ে সোজা চলে গেলো বংশাল।

জ্যামের মধ্যে বসে আছে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। এটা তার ফোন নয়। গতকাল হাশেম সাহেবের কাছ থেকে নেয়া সিমটা এই হ্যান্ডসেটে ব্যবহার করছে এখন। সতর্ক হয়ে উঠলো সে।

ব্ল্যাক রঞ্জু২! তার মানে রঞ্জুর লোক, সুলতান।

কয়েক বার রিং হবার পর কলটা রিসিভ করলো। রিসিভ করার আগে ইনকামিং কল রেকর্ড করে রাখার অপশনটা চালু করে দিলো সে । নিজ থেকে কিছু বললো না প্রথমে।

ওপাশে যে আছে সেও কিছু বললো না। বুঝতে পারলো কলার তার মতোই বাইরে আছে। যানবাহনের শব্দ আর নয়েজ শোনা যাচ্ছে। আশেপাশে কোনো মসজিদ থেকে আজানের শব্দটাও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। এভাবে কয়েক সেকেন্ড চলে যাবার পর একটা অধৈর্য কণ্ঠ শোনা গেলো।

“কী ভাই, কথা কন না কেন?”

“কে বলছেন?” আস্তে করে বললো সে।

“তার আগে কন আপনি কে?” কর্কশভাবে জানতে চাইলো একটা অল্পবয়সী কণ্ঠ। বাস্টার্ডের ধারণা ছেলেটার বয়স বিশ-বাইশের বেশি হবে না।

“আপনি কার কাছে ফোন করেছেন, নিজের পরিচয় না দিয়ে জানতে চাইলো সে।

“এটা তো হাশেম সাহেবের ফোন, আপনি কে?”

“আমি উনার শ্যালক।” মিথ্যেটা খুব সুন্দর করে বললো।

“উনারে দেন…জরুরি দরকার আছে।”

“উনি অসুস্থ…খুবই অসুস্থ।”

“কি হইছে?”।

“গতকাল রাত থেকে প্রেসার হাই…এখন ঘুমাচ্ছেন। ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেছেন। এখন তো কোনোভাবেই উনাকে ডাকা যাবে না।” একটু বিরতি দিয়ে আবার বললো, “আপনার কোনো দরকার থাকলে আমাকে বলতে পারেন।”

“ঠিক আছে, আমি পরে ফোন করুম। উনারে কইয়েন, সুলতান ফোন দিছিলো। রঞ্জু ভায়ের লোক। জরুরি দরকার আছে।”

“ঠিক” লাইনটা কেটে গেলে চিন্তিত হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে রইলো সে। মিথ্যেটা সুন্দর করেই বলতে পেরেছে, আর ছেলেটাও বিশ্বাস করেছে তার কথা, কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে না। এটা কী করে সম্ভব হলো! মোবাইলের ডিসপ্লে’তে সময়টা দেখে নিলো আবার : ৩: ১১।

এ সময় আজান? আজব!

সে নামাজের সঠিক সময়সূচী জানে না, কিন্তু এটা জানে, এ সময় কোনো আজান দেয়া হয় না। এটা কোনো নামাজের ওয়াক্তও নয়।

তাহলে? ভাবনাটা তার মাথায় খেলতেই রোমাঞ্চ বোধ করলো।

.

অধ্যায় ৩

বংশাল ছোটো মসজিদের পাশে সেন্টু মিয়ার দোকানটা খুঁজে বের করতে তেমন একটা কষ্ট করতে হলো না। সেন্টু মিয়ার মুদি দোকানটা বেশ স্বল্প পরিসরের। জিনিসপত্রে ঠাসা। বোবা ছেলেটার পরিচয় দিতেই সেন্টু মিয়া তাকে ভেতরে এসে বসতে বললো। চারপেয়ে একটা টুলে বসলো বাস্টার্ড। বয়স পঞ্চাশের উপর হলেও লোকটা একেবারে হ্যাংলাপাতলা, দেখতে ছেলে ছোকরাদের মতো। মাথার পাকা চুলে মেহেদির লাল রঙ। মুখে পান। সেটা চিবিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন।

দোকানে একজন কাস্টমার ছিলো, তাকে বিদায় করে দিলো সেন্টু মিয়া।

“কন, কি দরকার?”

“আপনি কি লেখাপড়া জানেন?” জানতে চাইলো সে।

পান চিবোতে চিবোতে সেন্টু মিয়া মাথা নেড়ে সায় দিলো। “অল্প একটু জানি।” ।

বোবা ছেলেটা তাকে যে কাগজ দিয়েছিলো সেটা বাড়িয়ে দিলো লোকটার দিকে।

সেন্টু মিয়া কাগজটা পড়ে একবার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে আবার কাগজের দিকে মনোযোগ দিলো। “হুম।”

“আমি ব্ল্যাক রঞ্জুর ব্যাপারে কিছু জানতে চাইছিলাম,” বললো সে।

সেন্টু মিয়া পান চিবানো বন্ধ করে ভালো করে বাস্টার্ডকে দেখে নিলো আরেকবার। তার মধ্যে একটু দ্বিধা থাকলেও সেটা ঝেড়ে ফেললো কেননা বোবা ছেলেটা যে তাকে পাঠিয়েছে সেটা বুঝতে পারছে।

“হে তো দ্যাশে নাই, হের খবর নিবেন কেমনে?”

“আমি এমন একজনের কথা জানতে চাই যার সাথে ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।” কথাটা বলেই পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে সেন্টু মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

নির্বিকারভাবে টাকাটা হাতে নিয়ে ক্যাশবাক্সে রেখে দিলো সেন্টু মিয়া। “কী জন্য জানতে চাইছেন সেটা কি কওয়া যাইবো?”

মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “আচ্ছা।” পাশে রাখা একটা পাত্রে পিচকিরি ফেললো সে। মুখটা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে আবার বলতে লাগলো, “সুলতান। হের সবচাইতে কাছের লোক হইলো সুলতান।”

“কোথায় থাকে?”

“এইসব পোলাপানের কি ঠিক ঠিকানা আছে,” আশেপাশে একটু সজাগ দৃষ্টি রেখে আবার বলতে লাগলো, “অনেক আস্তানা আছে। আশেপাশেও একটা আস্তানায় থাকে মাজেমইদ্যে।”

বাস্টার্ড বুঝতে পারলো লোকটা ঠিকই বলছে। এর কথায় আস্থা রাখা যায়। কোথায় সেটা?”

“কুন বাড়িতে থাকে সেইটা কইবার পারুম না…বংশাল-নাজিরা বাজার আর আগামসিহ লেনের কোনো বাড়ি অইবো।”

বাস্টার্ড এটা আগেই ধারণা করেছিলো। সুলতান যখন তাকে ফোন করে তখন তার ব্যাকগ্রাউন্ডে আজান শোনা গেছে। এ শহরে এমন কোনো মসজিদ নেই যেখানে বেলা তিনটা দশ মিনিটে আজান দেয়া হয়। তবে সে জানে এটা মোটেও অবাক করা ব্যাপার নয়। বিশেষ করে বংশাল-নাজিরাবাজার আলুবাজার এইসব এলাকার অনেক মসজিদে এমন সময় আজান দেয়া হয় । কারণটা খুবই চমকপ্রদ। এইসব এলাকার লোকজন-ইসলামের অনেকগুলো মাজহাবের একটি-আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের। আহলে হাদিসদের নামাজের ওয়াক্ত অন্যান্য মাজহাবের চেয়ে প্রায় এক ঘণ্টা এগিয়ে থাকে। তাদের নামাজ পড়ার ধরণও একটু ভিন্ন। না বুঝে তাদের মসজিদে যারা ঢুকে পড়ে তারা এটা হাড়ে হাড়ে টের পায়।

“আমি এই সুলতানের সাথে দেখা করতে চাই, সেন্টু মিয়াকে বললো সে।

“এইসব পোলাপান থাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে…ওগো লগে দ্যাখা করা সহজ কাম না।”

পকেট থেকে আরো কিছু টাকা বের করে সেন্টু মিয়ার হাতে দিলো বাস্টার্ড ।

“দুনিয়াতে অবশ্য কোনো কামই সহজ না, একটু কষ্ট করলে সব কামই সহজ হইয়া যায়, ঠিক কইছি না?”

“একদম ঠিক বলেছেন।”

“সুলতানের পাত্তা লাগানো যাইবো…আপনি কাইল আসেন।” টাকাটা পকেটে রেখে বললো সেন্টু মিয়া।

একটু ভেবে বাস্টার্ড বললো, “ঠিক আছে। আরেকটা কথা, আপনি তো এখানেই থাকেন?” সায় দিলো সেন্টু মিয়া। “এখানকার কোন্ মসজিদের আজান কোন রকম সেটা কি শুনে বলতে পারবেন?”

একটু ভেবে সেন্টু মিয়া বললো, “আশেপাশের অইলে পারুম।”

পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সুলতানের সাথে কথাবাতার রেকর্ড করা অংশটা শোনাতে যাবে অমনি দোকানে একজন কাস্টমারের আর্বিভাব ঘটলো। দশ বারো বছরের এক পিচ্চি।

“দুইটা ফাইভ ফাইভ।”

সেন্টু মিয়া বিরক্ত হয়ে বললো, “সিগারেট নাই।”

ছেলেটা ভুরু কুচকে দোকানের র‍্যাকের দিকে চেয়ে বললো, “ঐ তো ফাইভ ফাইভের প্যাকেট!”

“আরে নাটকির পো, কইলাম না সিগারেট নাই । দিকদারি করিস না। যা এহন।”

ছেলেটা গজগজ করতে করতে চলে গেলো।

সেন্টু মিয়া বাস্টার্ডের দিকে ফিরলে সে বললো, “এখানে সুলতানের সাথে আমার কথাবার্তা রেকর্ড করা আছে। ও যখন কথা বলছিলো তখন পেছনে একটা মসজিদ থেকে আজান হচ্ছিলো। আমি নিশ্চিত আহলে হাদিস মসজিদই হবে। আপনি শুনে দেখেন চিনতে পারেন কিনা।” মোবাইলটা সেন্টু মিয়ার হাতে তুলে দিলো সে।

বেশ মনোযোগ দিয়ে মোবাইলের সংলাপ শুনে গেলো সেন্টু মিয়া। তবে তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে কিছুই বোঝা গেলো না। সেন্টু মিয়া মুখ খোলার আগেই আরো কিছু টাকা ধরিয়ে দিলো তার হাতে।

“আপনে দেহি মেশিনের মতো টাকা দিতাছেন…” কথাটা বলেই হেসে ফেললো সে। “মিছা কথা কমু না, আমি ধরবার পারছি। একেক মসজিদের একেক রকম আজান, মাগার যারা এইখানে থাকে তারা ঠিকই কইতে পারবো কোন মসজিদের আজান কি রকম।”

“এটা কোন্ মসজিদের আজান?” নির্বিকারভাবে জানতে চাইলো বাস্টার্ড।

“এইটা নাজিরা বাজার আহলে হাদিস মসজিদের আজান।”

“আপনি কি শিওর?”।

“এক্কেবারে সিউর!”

মুখে হাসি এঁটে বললো, “ঐ মসজিদের মুয়াজ্জিনের মতো ফাটা গলার আজান আর কুন হালায় দিবো!”

বাস্টার্ড হেসে ফেললো।

“জীবনে বহুত আজান হুনছি মাগার এই রকম ফাঁটা বাঁশের আওয়াজ হুনি নাই।”

“সুলতান তাহলে মসজিদের খুব কাছেই থাকে?”

“তাই তো মনে হয়, সেন্টু মিয়া সায় দিয়ে বললো।

“সুলতান কোনো রাস্তা থেকে আমাকে ফোন করে নি। আমি নিশ্চিত, সে কোনো বাসাবাড়ি থেকেই ফোনটা করেছে কিন্তু চারপাশে অনেক নয়েজ ছিলো। হতে পারে কোনো বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দা থেকে ফোনটা করেছে।”

বাস্টার্ডের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে গেলো সেন্টু মিয়া। “ঠিক কইছেন,” সেন্টু মিয়া একটু ঝুঁকে এলো, “আরেকটা আওয়াজ আপনে হয়তো খেয়াল করেন নাই।”

“কোন্ আওয়াজ?” বাস্টার্ড কৌতূহলী হয়ে উঠলো।

বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাতে লাগলো সেন্টু মিয়া। “অবশ্য আপনার বোঝার কথা না। অনেক আওয়াজের মইেদ্যে ওই আওয়াজটাও আছে।”

বাস্টার্ড আর কোনো কথা না বলে আরো কিছু টাকা বের করলো। “কোন্ আওয়াজের কথা বলছেন?”

“দোকানপাটের শাটার আছে না, ঐ শাটার বানানোর অনেক কারখানা আছে ঐ এলাকায়।” বাস্টার্ড টাকাগুলো সেন্টু মিয়ার হাতে তুলে দিলো । “নাজিরাবাজার আহলে হাদিস মসজিদের লগেও একটা শাটারের কারখানা আছে। টিনের উপর কাঠের হাতুড় দিয়া কাম করে কারিগররা…ঠাক ঠাক কইরা আওয়াজ হয়। সব সময় শুনি তো তাই আওয়াজ শুইনা বুইঝা গেছি।”

“তার মানে সুলতান ঐ শাটার কারখানার খুব কাছে কোথাও…?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সেন্টু মিয়া। “আপনের কপাল ভালা। ঐ মসজিদের চাইরপাশে দোকানপাটই বেশি…বাসা-বাড়ি বলতে মাত্র তিনটা বাড়ি।”

“তাহলে সুলতান ঐ তিনটা বাড়ির যেকোনো একটাতে…”

“না, না…কোন্ বাড়ি থেইকা কথা বলছে আমি মনে হয় বুঝবার পারছি।”

সেন্টু মিয়ার কথা শুনে দারুণ অবাক হলো সে। এভোটা আশা করে নি। অন্তত এতো জলদি! “কোন্ বাড়ি?”

“আমার মনে হইতাছে আলিমুদ্দীনের বাড়িই অইবো।”

.

অধ্যায় ৪

সেন্টু মিয়ার কথাই ঠিক, মসজিদের আশেপাশে খুব কমই বাসা বাড়ি আছে। বেশিরভাগই প্রেইন শিটের দোকান আর নানা ধরণের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। শাটারের কারখানাটার পাশেই আলিমুদ্দীনের তিন তলা বাড়িটা।

সেন্টু মিয়া কেন এই বাড়িটার উপর জোর দিয়েছে তার কারণ খুব সহজ : বাকি দুটো বাড়ির একটা একতলার। খুবই ছোটো। সামনে একটা মুদি দোকান। পেছনে দুটো ছোটো ছোটো রুম। সেন্টু মিয়ারই দূর সম্পর্কের এক বিধবা আত্মীয় নিজের ছেলের সাথে ওখানে থাকে।

আরেকটা বাড়ি দোতলা। নীচের তলায় প্লেইনশিটের একটা বড়সড় গোডাউন, আর উপরের তলার থাকে মালিক নিজে। তাকেও সেন্টু মিয়া চেনে। মালিকের তিন মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। আর সুলতানের মতো সন্ত্রাসী ওখানে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। মনে মনে সেন্টু মিয়ার বিচারবুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। লোকটা আসলেই কাজের।

আলিমুদ্দীনের তিন তলা বাড়িটা বেশ বড়। পাশে যতোটা চওড়া তার চেয়ে লম্বায় অনেক বেশি। অনেকটা বড়সড় জাহাজের মতো। এই বাড়িটার মালিক আলিমুদ্দীন নিজে এখানে থাকে না। পরিবার নিয়ে সে থাকে ধানমণ্ডিতে। পুরো বাড়িটাই ভাড়া দেয়া। পুরনো বাড়ির কাঠামোর উপর অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে তৃতীয় তলাটি। পেছনের খালি জায়গাটাও টিনশেডের কতোগুলো ঘর বানিয়ে নিম্ন আয়ের লোকদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। মূল বাড়ির তিনটি তলার মধ্যে উপরের তলায় কারা থাকে সে ব্যাপারে সেন্টু মিয়া কোনো তথ্য দিতে পারে নি। সে বলেছে তার ধারণা ঐ তলাতেই হয়তো সুলতান থাকতে পারে। এটা নিছক অনুমান।

একটা কৌশল ঠিক করে নিলো মনে মনে। আলুিমদ্দীনের বাড়ির সামনে যে একতলা বাড়িটা আছে সেটার গেটের পাশেই আছে একটা মুদি দোকান। এখানকার একমাত্র মুদি দোকান এটি। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের এক লোক বসে আছে। বাস্টার্ড এগিয়ে গেলো সেই দোকানের দিকে।

“কি লাগবো?”

মুদি দোকানি লোকটা জানতে চাইলেও সে কিছু বললো না। লোকটার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

“আমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছি,” কথাটা বলেই খেয়াল করলো দোকানির মধ্যে কোনো পরিবর্তন হলো কিনা। না। লোকটা বুঝতেই পারছে না সে কী বলেছে। “আমি রঞ্জু ভাইয়ের লোক।” হ্যাঁ, এবার কাজ হয়েছে। লোকটা চমকে উঠেছে। কিন্তু সেটা বুঝতে দিতে চাচ্ছে না। “সুলতানের সাথে দেখা করতে এসেছি, কিন্তু তার বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না। ঠিকানাও হারিয়ে ফেলেছি।”

ফোন করেন, দোকানি সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো। “হের নম্বর আপনার কাছে নাই?”

“মোবাইল বন্ধ…কয়েক বার চেষ্টা করেছি।”

মনে হলো দোকানি কিছু ভাবছে। “এখন তো বাসায় নাই…সন্ধ্যার আগে ফিরবোও না।”

“সন্ধ্যার দিকে পাওয়া যাবে?”

“হুম…মনে হয় পাইবেন। সন্ধ্যার একটু পর আসেন।” দোকানি এখনও তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

“তাহলে আমি সন্ধ্যার দিকেই আসি, কি বলেন?”

“আসেন।”

বাস্টার্ড চলে যেতে উদ্যত হবে, কী মনে করে যেনো আবার দোকানির দিকে ফিরে তাকালো। কিন্তু তার বাড়িটা তো চিনি না। সুলতান বলেছিলো আপনার দোকানের পাশেই। কোন বাড়িটা, বলবেন কি?”।

লোকটার চোখেমুখে সন্দেহ আরো প্রকট হলো।

সে কিছু বলার আগেই বাস্টার্ড বললো, “তার ফোন যদি সন্ধ্যার সময়ও বন্ধ থাকে তাহলে তো সমস্যা।”

“সমস্যা হইবো ক্যান…জায়গামতোই তো আয়া পড়ছেন। এই যে, বাম দিকের তিন তলা বাড়িটা আছে না,” হাত নেড়ে বাম দিকে ইশারা করলো সে। “এক্কেবারে উপরের তলায় চইলা যাইবেন।”

হাত বাড়িয়ে দিলো বাস্টার্ড । দোকানি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার সাথে করমর্দন করলো। “আপনার কথা আমি রঞ্জু ভাইকে বলবো। অনেক ধন্যবাদ।

দোকানির মুখে হাসি দেখা গেলো এবার।

“তাহলে আমি সন্ধ্যার সময় আসি,” হাতটা না ছেড়েই বললো বাস্টার্ড। দোকানি মাথা নেড়ে সায় দিলো। কিন্তু সন্ধ্যার সময় সুলতান আসে কি না আসে সেটা জানবো কেমন করে?”

“সন্ধ্যার পর হে আসবোই,” জোর দিয়ে বললো দোকানি।

“আমি তো উঠেছি গুলশানে…এতো দূর থেকে এসে যদি দেখি সে আসে নি…আবার ধরেন ফোনটাও বন্ধ থাকলো, সমস্যা না?” হাতটা এখনও ধরে রেখেছে সে। ট্যাকটাইল কমিউনিকেশন। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাউকে কনভিন্স করার জন্যে নাকি স্পর্শের একটা গুরুত্ব আছে। মুখের কথার চেয়ে শারিরীক স্পর্শসহকারে বললে ভালো ফল পাওয়া যায়। এখন সেটাই করছে সে।

“কথা তো ঠিকই কইছেন,” দোকানি একমত পোষণ করলো।

“আপনার যদি মোবাইল থাকে তাহলে গুলশান থেকেই আপনাকে ফোন করে জেনে নিতাম সুলতান এসেছে কিনা…তাই না?” লোকটা এ কথার সাথেও সায় দিলো। “আমাকে এটুকু উপকার করলে সুলতানও আপনার উপরে খুব খুশি হবে।”

“সমস্যা নাই, আমার ফোন নম্বর লইয়া যান। সন্ধ্যার পর ফোন দিয়েন…” লোকটা তার ফোন নাম্বার বলতে লাগলো।

লোকটার হাত ছেড়ে দিয়ে তার ফোন নাম্বারটা নিজের ফোনে সেভ করে নিলো বাস্টার্ড। ধারণা করেছিলো সুলতানের খোঁজ পেতে কম করে হলেও দুতিন দিন লাগবে । সেরকম প্রস্তুতিও তার ছিলো, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনেক আগেই কাজটা করা যাবে। বেশ ফুরফুরে মেজাজে তিন তলা বাড়িটার চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলো সে। তার হাতে অনেক সময় আছে। এ সময়টা কাজে লাগাতে হবে।

.

অধ্যায় ৫

সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার পরই আলিমুদ্দীনের বাড়ির পাশে মুদি দোকানে বাইশ তেইশ বছরের এক ছেলে ঢুকলে দোকানি নিজের জায়গা থেকে উঠে সম্ভ্রমের সাথে সালাম দিয়ে কী যেনো বলে গেলো। লোকটার কথা শুনে ছেলেটা খুব অবাক হয়ে ভুরু কুচকে রইলো কিছুক্ষণ। তারপরই ছেলেটা দোকান থেকে হনহন করে বের হয়ে আলিমুদ্দীনের বাড়িতে ঢুকে পড়লে দোকানির চোখেমুখে বোকা বোকা ভাব ফুটে উঠলো। এমনকি রাস্তার ওপারে, দোতলার উপর থেকেও সেই চেহারায় কিছুটা ভয় দেখতে পেলো বাস্টার্ড।

বিকেলের পর থেকে এই এলাকা ছেড়ে আর অন্য কোথাও যায় নি সে। এখানকারই এক হোটেলে খাবার খেয়েছে। আর সেটা করতে গিয়ে তার লাভই হয়েছে। এটা খুবই ঘনবসতি এলাকা। তার উপর হোটেল রেস্তোরাঁয় স্থানীয় অধিবাসীদের আড্ডা মারার স্বভাব বেশ পুরনো। একটু কান পাতলে তাদের চড়া গলার কথা স্পষ্ট শোনা যায়। আর এসব গালগল্পের ভীড়ে কখনও কখনও অনেক প্রয়োজনীয় তথ্যও পাওয়া যায় একেবারে বিনা খরচায়। তো বাস্টার্ডেরও কিছু বাড়তি তথ্য জানা হয়ে গেছে ভাত খেতেখেতে। তার পাশের টেবিলেই বসেছিলো দুই মাঝবয়সী লোক। খাওয়ার চেয়ে তারা কথাই বলেছে বেশি।

“কাইল্যা রঞ্জু বলে আমির হোসেনরে কাপড় দিছে?” মাথায় টুপি দেয়া পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরা লোকটি বলছিলো তার সঙ্গিকে।

পেটের ভাত আর মুরগির ঝাল-ফ্রাই মেশাতে মেশাতে প্যান্ট-শার্ট পরা সঙ্গি বলে, “দিছে মাইনে…আমির হোসেনের তো পাতলা পায়খানা শুরু অয়া গেছে।”

“কতো চাইছে এইবার?”

“হুনলাম তো দশ লাখ।”

“আমির হোসেন বলে ঘরে খিড়কি মাইরা বয়া আছে…বাড়ির বাইর অয় না।”

“পরশুগা তো ওর দোকানের এক কর্মচারীরে গুলি করছে…হুনো নাই?”

“হুনছি তো।”

“আমির হোসেন এহন কী করবো?”

“কী আর করবো…ট্যাকা তো দিতেই অইবো…হুনলাম, সুলতানরে ধরছে। একটু কমায়া টমায়া দিবার চাইতাছে।”

“কইত্থেকা যে এই খানকির পোলাটা আয়া আমাগো মহল্লায় হান্দাইছে…শান্তি হারাম কইরা দিছে হালারপুতে।”

“কইথেকা আবার ঢুকবো…বেঈমান তো আমাগো মইদ্যেই আছে। তোমাগো দলের নেতা…যারে মাথায় কইরা নাচো…ওই মাঙ্গের পোলায়ই তো সুলতানরে মহল্লায় ঢুকাইছে।”

“আর তোমাগো দলের নেতা মনে হয় মক্কা শরীফের ইমাম সাব?…ওই হাউয়ার পোলায় সুলতানরে শেল্টার দেয় নাই?”

“আরে রাখো ঐ হালারপুতেগো কথা…সব খানকির পোলা এক রকম।” টুপি পরা লোকটা গজগজ করতে করতে বলে।

“পাবলিকের পোঙ মাইর‍্যা খানকির পোলারা মজমা মারায়…মিলিটারিই ভালা, বুঝছো?..মিলিটারি আইলে ঐ হালারপুতেরা হোগার কাপড় মাথায় উঠাইয়া ইন্দুরের গর্তে গিয়া হান্দায়…”

“হ, তুমি তো কইবা-ই…তোমার মাগিবাজ নেতা তো মিলিটারিই আছিলো।”

“ঐ মাগিবাজটার চায়া এরা কি ভালা নাকি…এরা অইলো ফকিন্নির পুত। খাবলাখাবলি কইরা দেশটারে শ্যাষ কইরা ফাইলাইতাছে।”

কথার মাঝখানে বিরতি দিয়ে দু’এক লোমা ভাত মুখে ঢুকিয়ে আবার কথা বলতে থাকে তারা।

“আমির হোসেনের ভাতিজা জিন্না আছে না…” প্যান্ট-শার্ট বলে। “উই তো সুলতানের উপর মার বিলা…এক সময় তো জিন্নাও কম আছিলো না…পুরানা রংবাজ…জিন্না কইছে, সুলতানরে দেইহা লইবো।”

“বুঝছি, জিন্নার মরণ আইছে…হালার গুলি খায়া মরবার শখ অইছে।”

“আরে মিয়া হুনো…বাপের উপরেও বাপ আছে…কাইল্যা রঞ্জু আর সুলতান যতো বড়ই হউক না…একটা সীসা ঢুকায়া দিলে সব শ্যাষ…কই যাইবো মাস্তানি!”

আবার কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিলে তাদের কথাবার্তায় ছেদ পড়ে কিন্তু একটু পরই সেটা শুরু হয় যথারীতি।

“সুলতাইন্যা আবার একটা মাইয়া লইয়া আইছে…জানো নি?” টুপিওয়ালা বলে ।

“পুরা মহল্লা জানে!”

“মাইয়াটা নাকি হেপারের…জোর কইরা তুইলা আনছে।”

“কও কি!”

“ঘরে তালা মাইরা রাখে।”

“হালার দ্যাশে কি কুনো আইন-আদালত আছে…আলিমুদ্দীনের বাড়ির চাইরটা বাড়ি পরই পুলিশের ফাড়ি!”

“খাও, খাও…এই দ্যাশের কুননা ফিউচার নাই, বুঝলা…নাটকির পোলারাই এই দ্যাশ চালাইবো।”

টুপিওয়ালার এই আক্ষেপের পর তারা দুজনে খাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়। তবে বাস্টার্ড জানে একটু পরই তারা আবার কথায় মশগুল হয়েছিলো। সেটা অবশ্য সে শুনতে পায় নি, খাওয়া শেষ করে হোটেল থেকে বের হয়ে যায় সে।

এখন দাঁড়িয়ে আছে নাজিরা বাজার আহলে হাদিস মসজিদের দোতলার বিশাল একটি জানালার সামনে। তার মাথায় মসজিদে রাখা বেতের টুপি। ফুল প্যান্টের অনেকটা অংশ ভাঁজ করে গোড়ালীর উপর তুলে রেখেছে। আপাতত সে নামাজি। এখান থেকে নীচে আলিমুদ্দীনের বাড়ি আর মুদি দোকানটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে দু’একজন নামাজি তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে, তবে কিছু বলছে না।

হোটেলে দু’জন লোকের কথাবার্তা থেকে কিছু তথ্য জানতে পেরেছে সে।

এখানকার লোকজন ব্ল্যাক রঞ্জুকে কাইল্যা রঞ্জু বলে ডাকে। একেবারে সঠিক অনুবাদ। সুলতান এই মহল্লায় বহিরাগত একজন। স্থানীয় ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের নেতার সমর্থন আছে তার। তবে মহল্লার লোকজন তার প্রতি বৈরী। এটা একটা সুবিধা। সুলতান এক মেয়েকে জোর করে নিজের ঘরে আঁটকে রেখেছে তালা মেরে। তার মানে ঘরে আর কেউ নেই, সেই মেয়েটি ছাড়া।

মসজিদ থেকে দ্রুত নেমে গেলো সে। নীচে নেমেই মসজিদের পাশে একটা গলিতে ঢুকে ফোন করলো মুদি দোকানিকে।

“হ্যালো?”

“গুলশান থেকে বলছিলাম…র ভায়ের লোক…চিনতে পারছেন?”

কোনো সাড়া শব্দ নেই। কয়েক সেকেন্ড পরই লাইনটা কেটে দেয়া হলো।

যা বোঝার বুঝে গেলো সে। এখন আর দেরি করা যাবে না। আলিমুদ্দীনের বাড়ির চারপাশটা তার মনে গেঁথে আছে। সিদ্ধান্ত নিলো সামনে দিয়ে নয়, পেছন দিয়ে ঢুকবে সেই বাড়িতে।

আলিমুদ্দীনের বাড়ির পেছন দিকটা মূল বাড়িটার চেয়ে অনেক বড়। আগে এটা খালি জায়গা ছিলো, বছর দশেক আগে এক সারি টিনশেডের ঘর তুলে ভাড়া দেয়া হয়েছে। দেখতে মেথরপট্টি কিংবা চতুর্থশ্রেণী সরকারী কর্মচারীদের কলোনির মতো। দু’পাশে টিনশেডের ঘরের সারি, মাঝখানে চার-পাঁচ ফুটের সংকীর্ণ একটি গলি। নোংরা। তাকে ঢুকতে দেখে লুঙ্গি পরা হ্যাংলা পাতলা এক লোক চেয়ে আছে। লোকটা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা খাচ্ছিলো। তাকে দেখে জিনিসটা লুকিয়ে ফেলেছে। বুঝতে পারলো, ফেন্সিডিল।

সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সে। বিকেলের দিকে এখানে আরেকবার এসেছিলো। এই কলোনির শেষ মাথায় দশ ইঞ্চির ইট দিয়ে একটা নীচু দেয়াল আলিমুদ্দীনের তিন তলা বাড়ির সাথে পার্টিশান তৈরি করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ছোট্ট একটা দরজা আছে মূল বাড়িতে আসা-যাওয়া করার জন্য। সে দেখেছে দরজাটা সব সময় ভোলাই থাকে।

আরেকটা বাড়তি সুবিধা।

কাউকে কিছু না বলে সোজা চলে গেলো সেই সুবিধার সদ্ব্যবহার করার জন্য।

মূল বাড়িটাও লম্বা, তবে ডান দিকে ছয়-সাত ফুটের প্যাসেজ সোজা চলে গেছে বাড়ির সামনের দরজার দিকে। বাম দিকে পর পর কয়েকটা ঘর, তারপর সিঁড়ি। সিঁড়ির পর আবার দুটো ঘর। ভেতরটা ঘুঁটে ঘুঁটে অন্ধকার। কোনো বাতি জ্বলছে না। নীচের বেশিরভাগ ঘরই তালা মারা। শুধু একটা ঘর থেকে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। সেই ঘরটার পাশেই সিঁড়ি।

সিঁড়ি দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেলো সে। তিন তলার ঘরগুলোর সব দরজাই বন্ধ। তবে তালা দেয়া নেই। নীচে যেটা প্যাসেজ ছিলো তিনতলায় সেটাই বারান্দা কাম-প্যাসেজ। সুলতান সম্ভবত এখান থেকেই তার সাথে ফোনে কথা বলেছিলো। কারণ এখান থেকেই বড় রাস্তাটা দেখা যায়। শাটারের কারখানাটাও এখান থেকে চোখে পড়ে।

কিন্তু কোন্ ঘরে আছে সুলতান?

সবগুলো ঘরে ঢু মেরে মেরে তো সেটা বের করা যাবে না।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো। এটাতে হাশেম সাহেবের সিম আছে। তার দুটো মোবাইলই সাইলেন্স মুড়ে রাখা। ব্ল্যাক রঞ্জু২ নাম্বারে কল করলো সে। মনে মনে আশা করলো সুলতানের মোবাইলটা যেনো তার মতো সাইলেন্স মুডে না থাকে।

একটা মৃদু রিং বাজার শব্দ শোনা গেলো। আওয়াজটা আসছে ডান দিকের তিন নাম্বার ঘর থেকে। ঘরের দরজা বন্ধ । তবে জানালার একটা কপাট খোলা। পর্দার কারণে ভেতরটা দেখা না গেলেও শব্দটা যে ওখান থেকে আসছে সেটা বুঝতে পারলো। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠলো সে।

.

ঘরে ঢুকেছে পাঁচ মিনিটও হয় নি, এরইমধ্যে ফোন! মাত্র জামা কাপড় পাল্টাতে যাচ্ছিলো। একটু আগে পুরো এক বোতল ফেন্সি খেয়ে এসেছে। একটা ঝিমুনি ভাব চলে এসেছে তার মধ্যে। মেজাজটা বিগড়ে গেলো সুলতানের।

তার মেজাজ খারাপের আরো কারণ আছে। বাড়িতে ঢোকার আগেই মুদি দোকানি শামসু বললো ইন্ডিয়া থেকে তার খোঁজে এক লোক এসেছিলো। আজব! তাকে কেন খুঁজবে? রঞ্জু ভায়ের কোনো লোক তাকে ফোন না করে সোজা চলে আসবে এখানে? অসম্ভব! তাকে নাকি ফোন করে পায় নি। একদম মিথ্যে কথা। তার ফোন এক মিনিটের জন্যেও বন্ধ ছিলো না। ঘটনাটা কি? ডিবি? না। সব তো ম্যানেজ করা আছে।

এ কথা ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকেই দেখে লাইজু কাঁদছে। মেজাজ আর ঠিক থাকে কী করে। মেয়েমানুষ এতো কাঁদতে পারে! আজ দু’সপ্তাহ ধরে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। সে ভেবেছিলো দু’একদিন কান্নাকাটি করার পর পাখি পোষ মানবে না। এই মেয়েটা মনে হয় আরো ভোগাবে।

“ঘরে ঢুইক্যা কান্নাকাটি দেখলে আমার মিজাজ খারাপ হয়া যায়…এইটা আর কতো কমু!” রিং বাজার আগে এ কথা বলেছিলো সে। তারপরও লাইজু খাটের এক কোণে গুটিশুটি মেরে কেঁদেই চলছে। আর কিছু না বলে ওয়ার্ডরোব থেকে লুঙ্গি আর গেঞ্জি বের করে যেই না পরতে যাবে অমনি এই বালের ফোনটা বেজে উঠলো!

ডিসপ্লে’র দিকে তাকাতেই অবাক হলো সে। হাশেম সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে লুঙ্গি আর গেঞ্জি বিছানার উপর রেখে দরজার দিকে পা বাড়ালো। এই মেয়ের সামনে এসব কথা বলা ঠিক হবে না। দরজাটা খুলে বাইরে পা বাড়ানোর আগেই ঘটলো ঘটনাটা ।

.

অধ্যায় ৬

ব্ল্যাক রঞ্জুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুলতান তার নিজ ঘরের খাটের উপর এক হাতে নাক চেপে বসে আছে। তার থেকে একটু দূরে বসে আছে আলুথালু চুলের এক মেয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় যোবা হয়ে গেছে মেয়েটি। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে আগন্তুকের দিকে।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে বাস্টার্ড। একটু আগে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ডান হাতে সাইলেন্সর লাগানো একটি পিস্তল। তাক করে রেখেছে বিপর্যস্ত হওয়া সুলতানের দিকে।

ফোন হাতে নিয়ে দরজা খুলতেই দরজার কপাটটা সজোরে সুলতানের মুখে আঘাত করলে কয়েক পা পেছনে ছিটকে পড়ে সে। খাটে বসা মেয়েটি আৎকে উঠেছিলো ঠিকই তবে পিস্তল দেখে সঙ্গে সঙ্গে চুপ মেরে গেছে। বাস্টার্ড জানে আশেপাশের লোকজন কিছু শুনতে পেলেও তারা ধরে নেবে

সুলতান হয়তো মেয়েটাকে নির্যাতন করছে।

দরজার কপাটের আঘাতে সুলতানের নাক ভেঙে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পায় রোদে পোড়া এক সুদর্শন যুবক

তার দিকে একটা সাইলেন্সর পিস্তল তাক করে ঘরে ঢুকছে।

বাম হাতের তর্জনী নিজের ঠোঁটের কাছে এনে ঘরের দু’জন মানুষকে চুপ থাকতে বললো সে।

সুলতান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।

বিছানার উপর একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি পড়ে আছে। সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বাস্টার্ড বললো, “গেঞ্জিটা নাকে চেপে ধরো।”

সুলতান গেঞ্জিটা দলা পাকিয়ে নাকে চেপে ধরলো । রক্তে তার থুতনী আর বুক ভিজে একাকার।

এবার মেয়েটার দিকে ফিরলো সে। “আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। আমি জানি ও তোমাকে জোর করে তুলে এনেছে। ওর হাত থেকে তুমি মুক্তি পাবে, যদি আমার কথামতো কাজ করো।”

মেয়েটা নিষ্পলক চেয়ে রইলো। তবে বাস্টার্ড জানে মেয়েটা তার কথা বিশ্বাস করেছে। তাকে নিয়ে আপাতত চিন্তার কিছু নেই।

“আপনি…কে?” হাফাতে হাফাতে নাক চেপেই বললো সুলতান।

“সব জানতে পারবে…আগে তোমার ব্লিডিং বন্ধ করো।”

পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেলো, কেউ কোনো কথা বললো না ।

“আপনি কি চান?”

“খুব সামান্য একটা জিনিস,” একদৃষ্টিতে সুলতানের দিকে চেয়ে বললো সে। “তবে তুমি যদি এই সামান্য জিনিসের জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনো তাহলে আমার কিছু করার থাকবে না।”

“বুঝলাম না,” রক্তভেজা গেঞ্জিটা দিয়ে নাক-মুখ মুছতে মুছতে বললো সুলতান। নাকের ব্লিডিংটা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ মাথাটা ছাদের দিকে মুখ করে রেখে দিয়েছিলো। বাস্টার্ডও জানে এভাবে নাকের ব্লিডিং দ্রুত বন্ধ হয়।

“একটা কথা তোমাকে পরিস্কার বলতে চাই…এখানে আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। এই অল্প সময়ের মধ্যে তোমাকে সঠিক কাজটা করতে হবে।”

“কাজটা কী?” অনেকটা অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলোরর সহযোগী।

“রঞ্জুর সাথে আমাকে দেখা করতে হবে…আর সেটা কিভাবে সম্ভব তুমি বলে দেবে।”

“আপনি কি ডিবি’র লোক?”

“তারচেয়েও বড় কিছু।”

সুলতানের কপালে ভাজ পড়লো। মনে হলো সুলতান একটু ভয় পেয়ে গেছে। “র ভায়ের সাথে দেখা করবেন কেমনে?”

“আমরা তার সাথে কিভাবে দেখা করবো সেটা নিয়ে তোমার ভাবার দরকার নেই। ইচ্ছে করেই আমরা’ শব্দটা ব্যবহার করলো সে।

“আমি জানি না উনি কোথায়-”

কথাটা শেষ করতে পারলো না সুলতান। তার ঠিক কপাল বরাবর সাইলেন্সারের নলটা ঠেকালো বাস্টার্ড । “আমি আগেই বলেছি, আমার হাতে বেশি সময় নেই। আর এটা তো তুমি চিনেছে, নাকি?” মাথা নেড়ে সায় দিলো সুলতান। “এটা দিয়ে গুলি করলে কোনো শব্দ হবে না।”

“আমি জানি ভায়ে কোলকাতায় আছে…কিন্তু কোন্‌খানে আছে, মানে ঠিক কোন জায়গায় আছে আমি জানি না।” সুলতান ভয়ে ভয়ে বললো।

“তুমি কখনও কোলকাতায় যাও নি?”

মাথা নাড়লো সে। “আমি তো এইখানে কাজ করি…ভাই দ্যাশে আইলে দেখা হয়। কোলকাতায় যাওয়ার দরকার হয় না।”

“তোমার ভাই দেশে আসে?” অবাক হলো বাস্টার্ড।

“দুই-তিন মাস পর পর আসে।”

“কিন্তু যেভাবে হোক তুমি জানো সে কোথায় থাকে, ঠিক না?”

“না…বিশ্বাস করেন, আমি জানি না।”

ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখে নিলো বাস্টার্ড। ওয়ার্ডরোবের পাশে একটা একুশ ইঞ্চির টিভি আছে। মেয়েটার দিকে চেয়ে বললো, “এই বানচোতটা কোন্ চ্যানেল বেশি দেখে?”

কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো মেয়েটা, “…হিন্দি চ্যানেলগুলান।”

“ওইরকম একটা চ্যানেলে টিভিটা ছাড়ো।”

বিছানা থেকে নেমে মেয়েটা কথামতো একটা হিন্দি চ্যানেল ছাড়লো। “সাউন্ডটা বাড়িয়ে দাও।”

টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো মেয়েটি। সখির দল সঙ্গে নিয়ে হিন্দি ছবির এক নায়িকা নাচছে।

বাস্টার্ড দেখতে পেলো বাম দিকে একটা ছোটো দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছে সেটা। “ওই দরজাটা কিসের?”

“বাথরুমের,” জবাব দিলো মেয়েটি।

“তুমি কিছুক্ষণ ওখানে থাকো। আমি বললে বের হবে। ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

সুলতানের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

মেয়েটি বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলে সুলতানকে বললো সে, “এতোদিন ধরে ভায়ের সাথে থাকো অথচ সে কোথায় থাকে কিছুই জানো না …এটা তো বিরাট অন্যায়।” বিছানা থেকে দলা পাকানো লুঙ্গিটা বাম হাতে তুলে নিলো সে, তারপরই আচমকা একটা ভোতা শব্দ হলো। অনেকটা জোরে থুতু ফেলার মতো।

গগনবিদারী চিৎকার দিতেই সুলতানের মুখের ভেতর সেই লুঙ্গি ঠেসে ধরলো। বিছানায় শুইয়ে ফেলে তার মুখটা বাম হাতে চেপে ডান হাতের পিস্তলটা ঠেকালো সুলতানের বাম কানে। তার বুকের উপর চড়ে বসলো সে।

“কোনো রকম শব্দ হলেই তুই মরে যাবি,” ফিসফিস করে বললো বাস্টার্ড ।

ঘোৎঘোৎ শব্দ করতে লাগলো সুলতান। তার নাক দিয়ে আবারো রক্তপাত শুরু হয়ে গেছে। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। তার বাম হাটুর একটু উপরে গুলিটা করা হয়েছে।

“রঞ্জু এখন কোথায় আছে?” বেশ শীতল কণ্ঠে জানতে চাইলো সে। “আবার যদি বলিস কিছু জানিস না…আরেকটা গুলি খরচ করবো।” মুখ থেকে লুঙ্গিটা সরালো।

“ভাই…ভাই…আমি আসলেই জানি না-” হাপাতে হাপাতে বললো সুলতান। সঙ্গে সঙ্গে ডান হাটুর উপর পিস্তলের নলটা ঠেকালো বাস্টার্ড। “কিন্তু যে লোক জানে তার ঠিকানা আমি দিতে পারুম।”

একটু ভাবলো সে। “বল।”

“কোলকাতা থেইকা ভায়ের এক লোক আইছে…লেডি গিয়াস…হোটেল পিং সিটিতে উঠছে…উত্তরায়…সে জানে ভায়ে কোনখানে থাকে। ভায়ের খুব ঘনিষ্ঠ লোক।”

এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো সুলতান।

লেডি গিয়াসের ফোন নাম্বার, হোটেল পিং সিটির ঠিকানা সব জেনে নিলো সুলতানের কাছ থেকে। লুঙ্গি দিয়ে হাটুটা বেধে নিতে বললো তাকে। গলগল করে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে।

“লেডি গিয়াসের সাথে তোর কখন কথা হয়েছে?”

“সকালে।”

“ওকে আবার ফোন কর।”

“ফোন কইরা কী বলুম?” যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে জানতে চাইলো সুলতান।

“স্পিকার টোনে দিয়ে কথা বলবি…জানতে চাইবি তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা…এইসব । একটু চেক করে দেখতে চাচ্ছি তুই সব ঠিকমতো বলেছিস কিনা। কোনো রকম চালাকি করবি না।”

সুলতান তার ফোনটা হাতে নিয়ে লেডি গিয়াসকে ফোন করলো । স্পিকার টোনে থাকার কারণে তাদের কথাবার্তা শুনতে পেলো বাস্টার্ড।

সুলতানের দেয়া তথ্য ঠিকই আছে। লেডি গিয়াস উত্তরার পিং সিটি নামের একটি নতুন হোটেলে উঠেছে।

“ওই মেয়েটাকে কোত্থেকে এনেছিস?” প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো সে।

“কেরাণীগঞ্জ থেইকা।”

“এ জীবনে কটা খুন করেছিস?”

ঢোক গিললো সুলতান। “আমি কোনো খুনখারাবি করি নাই।”

“ভালো। আমি এখান থেকে চলে যাবার পর তুই তো ঐ মেয়েটাকে ছেড়ে দিবি না।”

“না, ভাই…ছাইড়া দিমু…আল্লাহর কসম…ছাইড়া দিমু?”

“এতোদিন ধরে আঁটকে রেখেছিস…এখন আমার এক কথায় ছেড়ে দিতে পারবি?”

“পারুম…বিশ্বাস করেন। আপনে যা কইবেন তাই করুম।”

“ভালো।”

ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো সে।

“চুপচাপ বসে থাক…নড়াচড়া করবি না। আমি মেয়েটাকে বাথরুম থেকে বের করছি…ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে, ভাই,” ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো সুলতান।

বিছানা থেকে উঠে সুলতানের পেছনে চলে এলো সে। মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করলো না ছেলেটা। বাম হাটুর ক্ষতস্থানে লুঙ্গিটা চেপে রেখেছে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে ভয়ে আর যন্ত্রণায়।

জোরে থুতু ফেলার মতো শব্দ হলো আবার। সেইসাথে অস্ফুট এক গোঙানি। বিছানায় ঢলে পড়লো বহু খুনখারাবি করা কুখ্যাত সন্ত্রাসী সুলতান।

মাথার ঠিক পেছনে গুলিটা করা হয়েছে। ঘরের দরজা আর তার পাশের দেয়ালে রক্তের ছিটা লেগে একাকার।

বাস্টার্ড জানে সুলতান কোনো মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে নি।

তাকে সহযোগীতা করার পুরস্কার স্বরূপ এটা এক ধরণের প্রতিদান।

.

অধ্যায় ৭

পুরনো ঢাকা থেকে উত্তরায় যাবার আগে বাস্টার্ড মাঝখানে নিজের বাড়িতে গিয়েছিলো পরবর্তী অভিযানের প্রস্তুতি নিতে। লাইজু নামের এক মেয়েকে মুক্ত করে সুলতানের ঘরে তালা মেরে চলে আসে। একটা ইয়েলো ক্যাবে করে হোটেল পিং সিটিতে যখন পৌঁছালো তখন রাত আটটা বেজে দশ মিনিট।

একেবারে নতুন একটি হোটেল। স্থাপত্য বেশ আধুনিক। ছয় তলার হোটেলটির পুরো গ্রাউন্ড ফ্লোর জুড়ে পার্কিংএরিয়া। হোটেল কর্তৃপক্ষ এটাকে তিন তারার বলে দাবি করলেও বাস্টার্ডের কাছে তা মনে হলো না। তবে বেশ ছিমছাম একটি হোটেল।

৩০৩ নাম্বার রুম

তার মানে তিন তলায়। সে জানে হোটেলগুলো প্রতিটি তলার জন্য শতক সংখ্যা ব্যবহার করে। সেদিক থেকে ৩০৩ মানে তিন তলার তিন নাম্বার রুম। দোতলায় ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে এসে দেখতে পেলো ডেস্কের একমাত্র লোকটি টিভি’তে হিন্দি ছবি দেখছে। লোকজন তেমন একটা নেই। সামনে কতগুলো চেয়ার থাকলেও সেগুলোতে হোটেলের কোনো গেস্টকে দেখা গেলো না।

সব ঘরেই টিভি আছে, সুতরাং সস্তা হোটেলের মতো গেস্টরা ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে বসে টিভি দেখবে না সেটাই তো স্বাভাবিক।

বাস্টার্ডকে এগিয়ে আসতে দেখে লোকটা টিভি থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।

“রুম আছে?”

“জি, স্যার।”

“তিন তলায়?”

“আছে…তবে সিঙ্গেল নাই।” লোকটা চকিতে টিভির দিকে তাকিয়ে বললো। “সিঙ্গেল হবে চার আর পাঁচ তলায়…”

“আমি একটু রুমগুলো দেখতে চাই।”

“সিঙ্গেল?”

মাথা নাড়লো সে।

অনেকটা অনিচ্ছায় চারপাশে তাকিয়ে ইদ্রিস নামের একজনকে ডাকলো লোকটা। হ্যাংলা পাতলা এক তরুণ এসে হাজির হলো ডেস্কের কাছে।

“যা…স্যার্‌রে চার তলার সিঙ্গেল রুম দেখাইয়া আন।”

লিফটের বোতাম টিপতে গেলে ইদ্রিসকে বাধা দিয়ে বললো সিঁড়ি ব্যবহার করবে সে। সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠতেই বাস্টার্ড থেমে ইদ্রিসের দিকে তাকালো। “তিন তলায় ডাবলবেডের রুমগুলো কেমন?”।

“আপনে সিঙ্গেল রুম দেখবেন না?” ছেলেটা সরলভাবে জানতে চাইলো ।

“সিঙ্গেল রুমই দেখবো…কিন্তু আমার এক বন্ধু…কয়েক দিন আগে এখানে থেকে গেছে…সে বলেছে তিন তলার রুমগুলো নাকি ভালো।”

“এই হোটেলের সবগুলা রুমই ভালা,” ইদ্রিস একেবারে যোগ্য কর্মচারির মতোই জবাব দিলো দাঁত বের করে হেসে।

“তা ঠিক,” বাস্টার্ডও হেসে বললো। “কিন্তু ভালোর মধ্যেও ভালো আছে না?”

“তাতো আছেই।”

“তিন তলায় কি কোনো রুম খালি নেই?”

“আছে…তবে ডাবল।”

“রুমটা দেখা যাবে?”

“চলেন।”

ইদ্রিস ৩০৬ নাম্বার রুমের সামনে নিয়ে এলো তাকে। পকেট থেকে চাবি বের করে খোলার আগেই বাস্টার্ড ৩০৩ নাম্বার রুমটা দেখে নিলো।

প্যাসেজের একেবারে শেষ মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললো ৩০৬ রুমটাই তার জন্যে ঠিক হবে । তারপরও বাড়তি সুবিধার জন্য ৩০৩-এর ঠিক বিপরীতে ৩০৪ নাম্বার রুমটা দেখে পেছন থেকে ইদ্রিসের কাঁধে হাত রাখলো।

“কি?”

“৩০৪ খালি আছে?”

ইদ্রিস একটু ভেবে বললো, “ঐটা বুক হইয়া গেছে।”

“এখনও লোক ওঠে নি?”

“না।”

“কখন আসবে?”

“প্লেন নামলেই আইবো।” ইদ্রিস দরজা খুলে ৩০৬ নাম্বারে ঢুকে পড়লো। দরজার পাশে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিলো ছেলেটা। “দ্যাহেন।”

দেখার কিছু নেই তারপরও এমনভাবে দেখতে লাগলো যেনো হোটেলের রুম বাছাই করার ব্যাপারে সে ভীষণ খুঁতখুঁতে। তিন-চার মিনিট সময় নিয়ে। দেখে অবশেষে ইদ্রিসের দিকে ফিরে বললো, “এই রুমটাই ভালো।”

“আপনে কি ফ্যামিলি নিয়া থাকবেন?”

“না।”

“তাইলে খামোখা ডাবল লইয়া কী লাভ?” ইদ্রিস এবার গেস্টবান্ধব আচরণ করছে।

“সিঙ্গেল খাটে আমি ঘুমাতে পারি না…হোটেলগুলোর সিঙ্গেল খাট খুব ছোটো হয়। ডাবলই ভালো হবে।”

“হাত-পা ছড়াইয়া ঘুমান?”

নিঃশব্দে হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। যেনো এই বয়সে এভাবে ঘুমানোটা ছেলেমানুষি কাজ।

“আপনে যেখানে খুশি থাকেন…সমস্যা নাই,” ইদ্রিস বললো। “তাইলে আর উপরের সিঙ্গেল রুম দেখবেন না?”

“না। তার কোনো দরকার নেই।” আর কথা না বাড়িয়ে ইদ্রিসসহ বাস্টার্ড চলে এলো নীচের ফ্রন্ট ডেস্কে।

“সিঙ্গেল রুমে না থাকবেন কইলেন,” কথাটা বলেই রেজিস্ট্রি খাতাটা খুলে ফেললো লোকটা। “পনেরোশ’ টাকা, সাথে ভ্যাট।”

“এতো?” কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বললো বাস্টার্ড ।

“রুমটা তো দেখছেনই…ফিটিংসগুলা সব বিদেশী…তাছাড়া এখানকার কোনো হোটেলে এরকম সিকিউরিটি নাই।”

“তাই নাকি?” আবারো বিস্মিত হলো সে। “কী রকম সিকিউরিটি আছে এখানে?”

“ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি…ফায়ার অ্যালার্ম…তারপর ধরেন-”

“থাক, আর বলতে হবে না।” পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে পনেরোশ’ টাকা রাখলো ডেস্কের উপর।

সাড়ে আটটার আগেই সব ফর্মালিটিজ সেরে ৩০৬ নাম্বারে এসে পড়লো সে। এখন অপেক্ষা করবে, তারপর সুযোগ বুঝে কাজে নেমে পড়বে। বিছানায় শুয়ে টিভি ছেড়ে দিলো।

অ্যানিমেল চ্যানেল। কীটপতঙ্গের শিকার করার দৃশ্য। বিদঘুঁটে সব কীটপতঙ্গ। নিজেদের আহার জোগাচ্ছে। বন্ধ করে দিলো। তার পছন্দ বাঘ সিংহ-নেকড়ে-ঈগল। কীটপতঙ্গ তার ঘেন্না লাগে।

ঘরের বাতি নিভিয়ে চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলো। এই সময়টায় নিজের পরিকল্পনা আরো গুছিয়ে নিতে পারবে। চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। তবে ঘুমালো না।

ন’টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে উঠে বসলো । চেক করে নিলো সাইলেন্সার পিস্তলটা। তার কাছে এখন তিনটা মোবাইল । একটাতে আবুল হাশেমের সিম। অন্যটা সুলতানের । আর তার নিজেরটা তো আছেই। দরজা খুলে আস্তে করে মাথাটা শুধু বের করলো। প্রথমে ডানে, তারপরও বায়ে। কেউ নেই। একেবারে নিরিবিলি পরিবেশ। সম্ভবত হোটেলে গেস্টের সংখ্যা কম। বাইরে এসে দরজাটা বন্ধ করে ৩০৩ নাম্বার রুমের কছে চলে এলো। দরজার নীচ দিয়ে তাকিয়ে দেখলো কোনো আলো জ্বলছে না ।

তার মানে ঘরে কেউ নেই? নাকি লেডি গিয়াস ঘুমিয়ে আছে? তাকে নিশ্চিত হতে হবে।

দরজায় টোকা মারলো সে। পর পর বেশ কয়েকটি।

কোনো সাড়া শব্দ নেই। একটু অপেক্ষা করে আবারো টোকা মারলো। ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলে সে হয়ে যাবে মাতাল এক গেস্ট। তার ঘর কোনটা জানতে চাইবে। মাতলামির অভিনয় করবে। কোনো সমস্যা হবে না । বড়জোর কয়েকটা গালি হজম করতে হবে তাকে।

না । কেউ দরজা খুলে বের হলো না । ৩০৩-এ কেউ নেই। লেডি গিয়াস তাহলে উঠেছে কোথায়?

আরো দুটো সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে গেলো তার। হয়তো রুম ছেড়ে চলে গেছে। কিংবা এখনও রুমে ফিরে আসে নি।

তার হাতে অবশ্য আরেকটা তাস আছে। লেডি গিয়াসের ফোন নাম্বার। সুলতানের নাম্বার থেকে না করে তার নাম্বার থেকে একটা ফোন করলো সে। প্রথমবার এক দফা রিং হবার পরও কেউ ফোন ধরলো না। চিন্তায় পড়ে গেলো বাস্টার্ড । আবার ডায়াল করলো ।

চারবারের বার কলটা রিসিভ করা হলো। বাজখাই গলায় একটা কণ্ঠ বললো, “কে?”

সে কিছু বললো না। লেডি গিয়াস কোথায় আছে বোঝার চেষ্টা করলো।

“কে?…কে, বলছেন?”

“দোস্ত, কেমন আছো?” বেশ আন্তরিকভাবে বললো বাস্টার্ড ।

“কে?” মহাবিরক্ত লেডি গিয়াস ।

“আরে দোস্ত আমি…কালাম।”

“ওই মিয়া কারে ফোন দিছেন?” ঝারি মেরে বললো লেডি গিয়াস।

“তুমি মজনু না?”

“ধুর শালা…রং নাম্বার ।” লেডি গিয়াস লাইন কেটে দিলো।

বাস্টার্ড বুঝতে পারলো লেডি গিয়াস বাইরে আছে । তাহলে কি হোটেল ছেড়ে চলে গেছে? নাকি হোটেলে ফিরে আসছে?

মেজাজ একটু খারাপ হয়ে গেলো। কোনো কিছু না জেনে অপেক্ষা করতে ভালো লাগে না তার। কিন্তু নিশ্চিত হবারও উপায় নেই।

অমনি একটা শব্দ শুনে কৌতূহলী হয়ে জানালার কাছে গেলো । দেখতে পেলো একশ গজ দূরেই রেললাইন দিয়ে একটা আন্তনগর ট্রেন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে কোনো গন্তব্যে।

চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি চলে এলো। ইন্টারকমে রুম সার্ভিসকে চাইলো সে।

“বলেন, স্যার,” লাইনের ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ বললো।

“আমার রুমের পাশ দিয়ে তো ট্রেন যায়…” অভিযোগের সুরে বললো বাস্টার্ড।

“জি, স্যার।” ছেলেটা বুঝতে পারলো না সমস্যাটা কোথায়।

“আরে, ট্রেনের আওয়াজে কি ঘুম আসবে নাকি!”

“স্যার, এটাই শেষ ট্রেন…আর ট্রেন যাবে না। রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন।”

“তুমি বললেই হলো…মাঝরাতে ঢাকার বাইরে থেকে ট্রেন আসবে…তখন বলবে ওটাই শেষ ট্রেন…”

“না, স্যার, বললাম তো আর কোনো ট্রেন পাস করবো না,” ছেলেটা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো তাকে।

“ওপাশের একটা রুমে শিফট করা যায় না?” প্রস্তাব দিলো সে। “ওখান দিয়ে কোনো রেললাইন যায় নি।”

“না, স্যার। সেটা সম্ভব না।”

“কেন, রুম খালি নেই?”

“ওপাশের কোনো রুমই খালি নেই, স্যার।”

“কিন্তু আমার তো মনে হলো ৩০৩ নাম্বারটা খালি আছে?”

“না, স্যার। ওটাতে গেস্ট আছে।”

“তুমি শিওর?”

“জি, স্যার । শিওর।”

“ভালো করে চেক করে দ্যাখো…হয়তো কিছুক্ষণ আগে রুমটা ছেড়ে দিয়েছে…তুমি জানো না।” কথাটা বলেই অপেক্ষা করলো সে। মোক্ষম একটা চাল চেলেছে।

“জি না, স্যার। ওটার গেস্ট এখনও আছে। উনি সন্ধ্যার দিকে বের হয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ফিরে আসবেন। ওটা খালি নেই।”

“ব্যাডলাক!” আক্ষেপে বললো সে।

“স্যার, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, আর কোনো ট্রেন পাস করবে না।”

“তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?”

“জি, স্যার?!” ছেলেটা এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে অবাক হয়ে গেলো।

“বললাম, তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?”

“সিলেট, স্যার।”

“তাহলে তোমার কথায় বিশ্বাস করা যায়। শাহজালালের দেশের লোক, নিশ্চয় মিথ্যে বলবে না। ঠিক আছে, তোমার কথাই বিশ্বাস করলাম।”

“থ্যাঙ্কু, স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যান। আর কোনো ট্রেন পাস করবে না।”

“ওকে।”

ইন্টারকমটা রেখে দিলো সে। এবার ভালো লাগছে। লেডি গিয়াস বাইরে আছে । হোটেলেই ফিরছে। তাকে অপেক্ষা করতে হবে। এখন আর অপেক্ষা করতে খারাপ লাগবে না।

দরজাটা খোলা রেখে অন্ধকার ঘরে বসে রইলো চুপচাপ। ৩০৩ নাম্বার রুমে যে-ই ঢুকুক না কেন তাকে দেখতে পাবে। দশ মিনিট পর এক দম্পতি তার দরজার সামনে দিয়ে চলে গেলো। ৩০৪-এর কেউ? বিদেশ থেকে আসার কথা ছিলো যাদের? তা-ই হবে। বসে রইলো সে।

আরো দশ-পনেরো মিনিট পার হয়ে গেলেও লেডি গিয়াসের কোনো দেখা পেলো না। পুরো হোটেল জুড়ে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। সন্দিহান হয়ে উঠলো সে । লেডি গিয়াস কি তবে সুলতানের মৃত্যুর খবর জেনে গেছে? সটকে পড়েছে কোথাও? কিন্তু কিভাবে জানবে? সুলতানকে ফোন করলে তো সে-ই রিসিভ করতে কলটা। না। কালকের সকালের আগে সেটা জানা সম্ভব না। হয়তো দু’তিন দিনের আগেও ব্যাপরাটা জানা যাবে না। অনেক আস্তানা আছে। সুলতানের। আলিমুদ্দীনের বাড়িটা হলো সেরকমই একটা। ওখানে এক মেয়েকে আঁটকে রেখেছিলো সে। তার দলের লোকজন নিশ্চয় ওখানে ঘনঘন যাতায়াত করে না।

ঠিক এমন সময় সিঁড়ির কাছে লোকজনের আওয়াজ শুনতে পেয়ে সতর্ক হয়ে উঠলো। একজন নয়, বেশ কয়েক জনের শব্দ। অন্ধকারে বসে খোলা দরজার দিকে চেয়ে রইলো। এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা তার দরজার সামনে দিয়ে চলে গেলো। এক-দু’ সেকেন্ড পর এক হোটেল বয় ভারি একটা লাগেজ বয়ে নিয়ে চলে গেলো মহিলার পেছন পেছন । কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো তার। এরা কারা?

একটু পরই পঞ্চাশোর্ধ এক লোক, হাতে একটা ছোট্ট লাগেজ নিয়ে হাফাতে হাফাতে তার দরজাটা অতিক্রম করলো।

চেয়ার থেকে উঠে দরজা দিয়ে মাথাটা বের করে দেখলো সে।

৩০৪-এ ঢুকছে লোকটা।

গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো তার। তাহলে একটু আগে যে দম্পতি এখান দিয়ে চলে গেছে তারা উঠেছে ৩০৩-এ? সে ভেবেছিলো ওরা ৩০৪-এর গেস্ট।

সুলতান তাকে মিথ্যে তথ্য দিয়েছে। বিভ্রান্ত করেছে! তার উচিত ছিলো তথ্যটা আরো ভালো করে যাচাই করে নেয়া। কিন্তু এখন আর সেটা ভেবে লাভ নেই। কী করবে কিছুই মাথায় আসছে না। এক অজানা আশংকা জেঁকে বসলো তার মধ্যে। এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলে বাস্টার্ড চমকে উঠলো । তিনটা ফোন আছে তার কাছে। কোনটা বাজছে?

মাইগড! লেডি গিয়াস?

কলটা রিসিভ করবে কিনা বুঝতে পারছে না। দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে প্রথমেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো। রিং বেজেই চলেছে।

তার মনের একটা অংশ বলছে ফোনটা ধরতে। অন্য একটা অংশ তীব্র বিরোধীতা করছে। বাস্টার্ড বুঝতে পারলো, যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এতোদিন ধরে কাজ করে এসেছে তাতে বিরাট চিড় ধরে গেছে। আর এরজন্যে দায়ি ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। লোকটা তার নাগাল পেয়ে গেছিলো। এই প্রথম তার ছবি চলে গেছে পুলিশের খাতায়। তার মুখটা এখন আর অচেনা নেই। অনেকেই চিনে ফেলেছে। আর তাদের বেশিরভাগই পুলিশের লোকজন।

রিংটা শেষ হতে না হতেই আবার বাজতে শুরু করলো।

অসহ্য!

লেডি গিয়াস হন্যে হয়ে সুলতানকে ফোনে পেতে চাইছে। কলটা রিসিভ করলো সে।

“সুলতান?”

“হুম,” বললো সে।

“শোনো, তুমি কাল দুপুরের দিকে টাকাগুলো পাঠিয়ে দিও। জরুরি…বুঝলা?”

“হুম।”

“আমি আর দুদিন ঢাকায় থাকবো।”

“হুম…”

“আরে, হুম হুম করছো ক্যান! ঘুমাচ্ছো নাকি?”

বাস্টার্ড কিছু বললো না।

“হ্যালো?” তাড়া দিলো লেডি গিয়াস।

কিছু বললো না সে।

“আরে…তুমি দেখি—”

লাইনটা কেটে দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে রাখলো । লেডি গিয়াস মনে মনে সুলতানের গুষ্টি উদ্ধার করুক। তার সাথে আর বেশি কথা চালিয়ে যাওয়া ঠিক হতো না।

বুঝতে পারলো, এক্ষুণি কাজে নেমে পড়তে হবে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। তবে একটা বাড়তি ঝামেলা যোগ হয়েছে। লেডি গিয়াসের সাথে এক মেয়ে আছে।

নিজের ঘর থেকে সন্তর্পনে বের হয়ে এসে ৩০৩ নাম্বার রুমের দরজায় কান পাতলো সে। ভেতরে এখন টিভি চলছে। কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে হাতে তুলে নিলো এবার। ডান হাতে সেটা রেখে বাম হাতে দরজায় টোকা মারলো পর পর দুটো ।

“কে?” ভেতর থেকে বিরক্তির সাথে বললো একটা কণ্ঠ । লেডি গিয়াস।

আবারো টোকা মারলো। পর পর দুটো। এবার আরো বেশি জোরে । যথেষ্ট তাড়া দিয়ে।

“অ্যাই…কে?” মনে হলো তেড়ে আসছে কণ্ঠটা।

প্রস্তুত হয়ে গেলো বাস্টার্ড । দরজার নবটা আলতো করে ধরে রাখলো। টের পেলো নবটা একটু ঘুরে যাচ্ছে। দরজাটা ছয় ইঞ্চির মতো ফাঁক হতেই নবটা শক্ত করে ধরে জোরে একটা ধাক্কা মেরে ডান কাঁধটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। লেডি গিয়াস একটা চিৎকার দিয়েই চুপ মেরে গেলো। তার মুখের কাছে একটা সাইলেন্সার পিস্তল। যতো দ্রুত ভেতরে ঢুকলো ততো দ্রুতই দরজাটা বন্ধ করে দিলো সে।

ডান হাত দিয়ে কপাল ধরে রেখেছে গিয়াস। দরজার পাল্লার আঘাত লেগেছে। আঘাত তেমন গুরুতর নয় । রক্তপাত হচ্ছে না।

ঘরের এ কোণে, বিছানার পাশে আলুথালু চুলের এক মেয়ে বুকের কাছে দলা পাকানো শাড়িটা আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে । পেটিকোট আর ব্লাউজ পরা। শাড়িটা সবেমাত্র খোলা হয়েছে। মেয়েটার সাথে যে জোড়াজুড়ি করা হয়েছে সেটা দেখেই বোঝা গেলো।

তবে এই মেয়েটাকে লেডি গিয়াস জোর করে তুলে আনে নি, যেমনটা করেছিলো সুলতান। এই মেয়েটা স্বেচ্ছায় এসেছে তার সাথে । বাস্টার্ড বুঝতে পারলো।

কলগার্ল।

লেডি গিয়াস নামে লেড়ি হলেও দেখতে বেশ ভীতিকর। মেয়েলীপনার ছিটেফোঁটাও নেই তার মধ্যে। পেশীবহুল আর চেহারার মধ্যে এক ধরণের হিংস্রতা আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য বাস্টার্ড ভাবলো, লেডি গিয়াস নামটার নিশ্চয় অন্য কোনো মানে আছে।

কপালে হাত রেখেই সে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাস্টার্ডের দিকে। তার মধ্যে ভয়ের লেশমাত্র নেই। “তুমি কে আমি জানি না…কিন্তু এখান থেকে বের হতে পারবে না।”

ডান পায়ে লেডি গিয়াসের জননেন্দ্রিয় লক্ষ্য করে একটা লাথি মারলো। বাস্টার্ড, কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় লেডি গিয়াস বাম হাতটা ক্লকওয়াইজ ঘুরিয়ে লাথিটা ব্লক করতে সক্ষম হলো। একটু অবাকই হলো সে। তাকে খাটো করে দেখেছে। নামের আগে লেডি থাকাতে এই সমস্যা হয়েছে বলে মনে করলো।

“মারামারি করতে চাও তো পিস্তলটা রেখে খালি হাতে আসো,” কথাটা বলেই ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা এক করে স্টাইলিশ ভঙ্গিতে বাস্টার্ডকে আহ্বান জানালো সে। বাস্টার্ডের পৌরুষ সত্তা চ্যালেঞ্জটা নেবার জন্য প্রলুব্ধ। হলেও তার যুক্তিবাদী মন তাতে সায় দিলো না।

“আমি এখানে তোমার সাথে মারামারি করতে আসি নি,” নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো সে।

“তাহলে কেন এসেছো?” স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললো গিয়াস।

পিস্তলটা নেড়ে বিছানার দিকে ইশারা করলো বাস্টার্ড। “বসো।”

বিছানার প্রান্তে বসলো গিয়াস। বাস্টার্ড দেখতে পেলো মেয়েটা তার সম্ভ্রম আগলে রাখার চেষ্টা করছে, ভয়ে নাভাস হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। কিছুই বুঝতে পারছে না। যেনো চুলা থেকে জ্বলন্ত কড়াইয়ে গিয়ে পড়েছে সে। মুখের সামনে থেকে খোলা চুলগুলো একটু সরতেই দেখতে পেলো মেয়েটার ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে।

“বাথরুমে গিয়ে শাড়িটা পরে নাও। উল্টাপাল্টা কিছু করবে না।”

মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে পাশের অ্যাটাচড বাথরুমে চলে গেলো।

“তাহলে তুমিই লেডি গিয়াস?”

একেবারে নির্বিকার রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক গিয়াস। তার মধ্যে ভয়ের লেশমাত্র নেই। তার দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। “বুঝতে পারছি, সুলতান বেঈমানি করেছে..” আস্তে করে মুচকি হেসে বললো সে। “তাই তো বলি, আমার ফোন ধরে কথা বললো না, মাঝপথে লাইনটাও কেটে দিলো।”

কথাটা শুনে বাস্টার্ড চুপ মেরে গেলো। এই লোক মনে করছে সুলতান তাকে পাঠিয়েছে। দারুণ।

“যেখানে অনেক টাকা-পয়সা জড়িত সেখানে বেঈমানি হতেই পারে।”

“কিন্তু সুলতান আর তুই এই টাকা হজম করতে পারবি না,” এবার তাকে তুই বলে সম্বোধন করলো গিয়াস। একই রকম নির্বিকার আছে সে।

“সুলতান হয়তো পারবে না…আমি পারবো,” বাস্টার্ডও কথার পিঠে কথা চালিয়ে যেতে লাগলো । “পারবো বলেই তো এখানে এসেছি।”

“তুই কে?” তাচ্ছিল্যের সাথে জানতে চাইলো গিয়াস ।

“বানচোত! ভুলে গেছিস পিস্তল আমার হাতে…তোর হাতে না।”

“টাকা চাস তো? ঠিক আছে, এই নে…” পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করে বাড়িয়ে ধরলো তার দিকে। বাস্টার্ড হাত বাড়িয়ে নিলো না। কিসের টাকা? কিসের চাবি? বোঝার চেষ্টা করলো ব্যাপারটা।

“চাবিগুলো তো দেখছি…কিন্তু সিন্দুকটা কোথায়?” হেসে বললো সে।

“নীচের পার্কিংলটে গাড়িটা আছে।”

“আমি তো গাড়ি চুরি করতে আসি নি…”

“তুই কিসের খোঁজে এসেছিস আমি জানি…টাকাগুলো গাড়ির বুটেই আছে। সব।”

সব!

“কতো?” বাস্টার্ড আরো একটু বাজিয়ে দেখার জন্য বললো।

“বাপের জনমেও তুই অতো টাকা চোখে দেখিস নি…”

“কিন্তু আমার জনমে দেখবো..বুঝলি?” সেও পাল্টা বললো গিয়াসকে।

“দেখবি…কিন্তু ভোগ করার সুযোগ পাবি না।”

মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “তোরা তো আমাকে চিনিস না…কিভাবে আমাকে খুঁজে বের করবি?”

“সুলতানই তোর কথা বলে দেবে…একেবারে তোতাপাখির মতো।”

মুচকি হাসলো সে। তার দিকে ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো লেডি গিয়াস, কিছু না বললেও চোখের পলক ফেললো না ।

একটু চুপ থেকে দৃঢ়ভাবে বললো বাস্টার্ড। “ব্ল্যাক রঞ্জু এখন কোথায় আছে?”

“রঞ্জু!” লেডি গিয়াস যারপরনাই অবাক হলো। বাস্টার্ডকে আপাদমস্তক দেখে নিলো আরেকবার।

“আমার কথা মন দিয়ে শোন। রঞ্জু কোথায় থাকে, কিভাবে তার সাথে আমি দেখা করতে পারবো, সব তোকে বলতে হবে। ভালোয় ভালোয় বলবি নয়তো তোকে দিয়ে বলিয়ে নেবো।” পিস্তলটা গিয়াসের পায়ের দিকে তাক করে বললো শেষ কথাটা।

“রঞ্জু কোথায় থাকে সেটা সবাই জানে।”

“সবাই জানে না…সবাই শুধু আন্দাজ করে, কিন্তু তুই জানিস আসলে সে কোথায় থাকে।”

আবারো ইচ্ছে করে বহুবচন ব্যবহার করলো সে।

“রঞ্জু কোথায় থাকে জেনে কী করবি তোরা?”

“তুই কোনো প্রশ্ন করবি না…যা প্রশ্ন করার আমি করবো।”

“রঞ্জু কোথায় থাকে আমি সেটা জানি না…”

লেডি গিয়াসের কথাটা শুনে হেসে ফেললো বাস্টার্ড । “এ কথাটা আর বলবি না। বুঝলি?”

“আমি যদি কিছু না বলি, কী করবি?” লেডি গিয়াস আক্রমণাত্মক হয়ে বললো।

“তোর দুই হাটুতে গুলি করবো…মনে রাখিস, এটা দিয়ে গুলি করলে তেমন কোনো শব্দ হবে না।”

মাথা দোলালো লেডি গিয়াস। “তোর যা খুশি তাই কর…আমি কিছু বলবো না!”

বাস্টার্ড বেশ অবাক হলেও সেটা বুঝতে দিলো না। তার সামনের লোকটা যে খুনখারাবিতে ওস্তাদ সেটা বুঝতে পারলো। একে ভড়কে না দিলে কোনো কথাই মুখ দিয়ে বের করা যাবে না।

সুলতানের সাথে যা করেছিলো তা-ই করলো লেডি গিয়াসের সাথে । থুতু ফেলার মতো শব্দ হতেই লেডি গিয়াস তার বাম হাটুটা ধরে বিছানার উপর শুয়ে পড়লো।

গগনবিদারি চিৎকারটা বন্ধ করার জন্য লেডি গিয়াসের দিকে ঝুঁকে তার মুখটা বাম হাতে চেপে ধরতেই বাস্টার্ড টের পেলো তার ডান হাতটা খপ্ করে ধরে ফেলেছে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে! একটুও নাড়াতে পারছে না হাতটা। আচমকা এই প্রতিরোধে ভড়কে গেলো সে। বাম হাতে একটা ঘুষি মারলো গিয়াসের মুখে। কিন্তু কাজ হলো না। শক্ত করে তার পিস্তল ধরা হাতটা ধরেই রেখেছে গিয়াস। ধস্তাধস্তি হবার উপক্রম হলো। হাটুতে গুলিবিদ্ধ কারোর কাছ থেকে এরকম মরিয়া প্রতিরোধ সে আশা করে নি।

লেডি গিয়াস যেনো তার হাটুর আঘাতের কথা ভুলে গেছে। ডান হাতে হাটু চেপে রেখেছিলো, সেটা দিয়ে এখন বাস্টার্ডের বাম হাতটাও ধরে ফেললো। শারিরীক দিক থেকে তার চেয়ে একটু এগিয়ে আছে লেডি গিয়াস । সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাস্টার্ডের অস্ত্র ধরা হাতটা এমনভাবে ধরে রেখেছে যে মরে গেলেও এ হাত ছাড়বে না।

ডান হাটু দিয়ে লেডি গিয়াসের গুলিবিদ্ধ হাটুতে একটা আঘাত করলো। বাস্টার্ড জানে সুতীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে, কিন্তু আহত লোকটা সেই যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করতে পারছে বেশ ভালোভাবেই। দাঁত বের করে উন্মাদের মতো হাসলো লেডি গিয়াস। সেই হাসি যেনো ভৌতিক সিনেমার পিশাচের মতো।

“কার সাথে কি করতে এসেছিস…বুঝবি এবার!”

ফ্যাসফ্যাসে গলায় নির্বিকারভাবে কথাটা বললো সে। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে ঝটকা মেরে বাস্টার্ডকে বিছানার উপর ফেলে দিলো । বাস্টার্ডও জানে হাতের অস্ত্রটা বেহাত হয়ে গেলে এই জানোয়ারটার সাথে সুবিধা করতে পারবে না। বিছানার উপরেই ধস্তাধস্তি চলতে লাগলো।

এবার লেডি গিয়াস সুযোগ বুঝে ডান হাতে বাস্টার্ডের চোয়ালে একটা ঘুষি মেরেই দু’হাত দিয়ে অস্ত্র ধরা হাতটা এমনভাবে পেচিয়ে ফেললো যে বাস্টার্ডের আর কোনো উপায় রইলো না ।

অবাক হয়ে সে দেখতে পেলো লেডি গিয়াস দক্ষ কমব্যাট ফাইটারের মতো তার সশস্ত্র হাতটা কিভাবে নিরস্ত্র করে ফেলছে। একটা উন্মাদগ্রস্ত হাসি হেসে বাস্টার্ডের কব্জিটা এমনভাবে মোচড় দিলো যে সেটা ভেঙে যাবার উপক্রম হলো। বুঝতে পারলো এরকম অবস্থায় বড়জোর পাঁচ সেকেন্ড টিকতে পারবে সে। তারপরই অস্ত্রটা তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে যেতে বাধ্য।

অস্ত্রটা হাত থেকে পড়ে যাবার আগে শুধু ভাবতে পারলো লেডি গিয়াসকে খুব বেশি খাটো করে দেখেছিলো সে।

মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে!

.

অধ্যায় ৮

বাথরুমে ঢুকেও শাড়িটা পরতে হিমশিম খেলো উমা। কী ঘটছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।

লেডি গিয়াস নামের যে হারামিটার সাথে এখানে এসেছিলো তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য ছটফট করছিলো সে। নিজেকে বিকিয়ে দেবার কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলো গতকালই। তারপর আজ রাতে প্রথমবার নিজেকে বিকিয়ে দেবার জন্যে লেডি গিয়াস নামের এক হোমরাচোমরার সাথে এখানে আসে। কিন্তু যখনই বুঝতে পারে তার এই দেহটা অচেনা এক পুরুষ ভোগ করবে, তখনই ভয়ে আর ঘেন্নায় কুকড়ে যায় সে। কাজটা কতো কঠিন সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। লেডি গিয়াস ঘরে ঢুকেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হয়, আর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে প্রতিরোধ শুরু করে দেয় সে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বদমাশটা। প্রথমে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করে, তারপর রেগেমেগে চপেটাঘাত, কিলঘুষি মারতে আরম্ভ করে জানোয়ারটা।

এক পর্যায়ে সে মনে করতে শুরু করে ধর্ষিতা হতে যাচ্ছে। জানোয়ারটা তাকে বলাৎকার না করে ছাড়বে না। অনেক অনুনয় বিনয় করেছে, পা ধরে রেহাই পেতে চেয়েছে, কিছুতেই কাজ হয় নি। তাকে চড়থাপ্পর মেরে জোর করে শাড়িটা খুলে ফেলে নারীলোলুপ গিয়াস।

ভেবেছিলো জানোয়ারটার হাত থেকে বুঝি আজ তার নিস্তার নেই। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলো পশুটার হাত থেকে যেনো এ যাত্রায় তাকে বাঁচিয়ে দেন।

ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ে। রেগেমেগে লেড়ি গিয়াস দরজা খুলতেই যার আর্বিভাব হলো প্রথমে তাকে দেবতা জ্ঞান করেছিলো উমা; ভেবেছিলো ভগবান তার প্রার্থনা শুনেছেন, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে সে এক জানোয়ার থেকে আরেক জানোয়ারের কবলে পড়ে গেছে। এই জানোয়ারটার হাতে আবার অস্ত্র আছে । লেডি গিয়াস তার কৌমার্য হরণ করতে ব্যগ্র ছিলো, প্রাণে মেরে ফেলতো না, কিন্তু এই অস্ত্রধারী জানোয়ারের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে খুনখারাবির উদ্দেশেই এখানে এসেছে। বাথরুমের দরজায় খিল দিয়ে রেখেছে সে। মরে গেলেও এ দরজা খুলবে না।

কী কুলক্ষণে যে এ কাজে রাজি হয়েছিলো, এখন নিজেকেই গালি দিচ্ছে বার বার । সে তো এ লাইনের মেয়ে না। এরকম জীবন বেছে নিতে হবে দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি কখনও। কিন্তু নিয়তি তাকে বাধ্য করেছে। কতো মেয়েকেই তো দেখেছে এ লাইনে কাজ করে বেচেবর্তে আছে। সেও বাঁচতে চেয়েছিলো । না। বাঁচাতে চেয়েছিলো…

ধস্তাধস্তির শব্দটা কানে যেতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেলো । দুই জানোয়ার একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য মারামারি করছে! জান্তব গোঙানি শোনা গিয়েছিলো কিছুক্ষণ আগে, তার একটু পরই গা শিউরে ওঠা হাসি। হাসিটা কার ছিলো? উমা ধরতে পারে নি।

এখন শুধু ধস্তাধস্তির শব্দটাই শুনতে পাচ্ছে। ঘরে টিভি চলছে লো ভলিউমে। সেটার আওয়াজ ছাপিয়ে জান্তব শব্দটা রাজত্ব করছে। উমা টের পেলো তার হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে । অজানা আশংকায় হৃদপিণ্ডটা লাফাচ্ছে।

পরনের শাড়িটা কয়েক বার পরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তার দু’হাত কাজ করছে না। ভয়াবহভাবে কাঁপছে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও যেনো হারিয়ে ফেলছে আস্তে আস্তে।

ধস্তাধস্তির শব্দটাও এবার ছাপিয়ে গেলো জিনিসপত্রের ভাঙচুরের আওয়াজে। কাঁচ ভাঙার শব্দ! যেনো কেউ ভারি কিছু দিয়ে ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র ভাঙছে তীব্র আক্রোশে।

উমা খেয়াল করলো জোরে জোরে থুতু ফেলার মতো শব্দ হলো কয়েকটা!

তার হাত-পায়ের কাঁপাকাপি আরো বেড়ে গেলো । ভয়াবহ কিছুর আশংকা করছে সে। দুই জানোয়ারের অস্কুট গোঙানিটাও কানে আসছে এখন। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। বাথরুমের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো এতোক্ষণ । পা দুটো টলে গেলে মেঝেতে বসে পড়লো। এখনও বুকের কাছে দলা পাকানো শাড়িটা দুহাতে আকড়ে আছে। সুতীব্র ভয়ে একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলো সে। কতোক্ষণ সময় পার হয়েছে বলতে পারবে না। দরজার ওপাশ থেকে যে আওয়াজগুলো আসছিলো এখন আর সেগুলো তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। দু’কানে শুধু ভো ভো শব্দ হচ্ছে।

তার এই ঘোরলাগা অনুভূতিটা ভাঙলো বাথরুমের দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দে। দরজায় ঠেস দিয়ে বসে থাকার কারণে মনে হলো তার পিঠেই যেনো আঘাতটা করা হচ্ছে। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো তার। মারামারি থেমে গেছে। দুই জানোয়ারের মধ্যে নির্ঘাত একটা মারা গেছে। তাহলে। কোটা মরেছে? বুঝতে পারলো না। কী করবে এখন? দরজা খুলে দেবে? না। মরে গেলেও দরজা খুলবে না। তাকে যদি মারতেই হয় দরজা ভেঙে মারুক।

দরজায় এবার জোরে জোরে লাথি মারা হলো। অধৈর্য হয়ে উঠেছে জানোয়ারটা! “সুবর্ণী!…দরজা খোলো। জলদি!”

কথাটা কানে যেতেই বুঝতে পারলো লেডি গিয়াস বেঁচে আছে। সুবর্ণা নামটা তার নিজের। সদ্য এই লাইনে পা রাখা মেয়ে সে। তাকে একটা নতুন নাম দেয়া হয়েছে। মিনা আপা আয়েশ করে হুইস্কি খেতে খেতে নামটা দিয়েছে তাকে। এ লাইনে সব মেয়েরই নাকি এরকম ভুয়া নাম থাকে। আজকের জন্যে সে স্রেফ সুবর্ণা!

“দরজা খোলো…আমাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে!” লেডি গিয়াস অধৈর্য কণ্ঠে বললো আবার।

মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিলো উমা। একটু আগে এই রাবনটার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য প্রার্থনা করেছিলো, এখন কিনা তাকেই মনে হচ্ছে রাম!

সে ভেবেছিলো অস্ত্র হাতে যে লোকটা হুরমুর করে রুমে ঢুকেছিলো তার সাথে লেডি গিয়াস পেরে উঠবে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, জানোয়ারটা শুধু নারী লোলুপই নয়, বেশ সাহসীও বটে। সশস্ত্র এক যুবককে ঘায়েল করে ফেলেছে খালি হাতে!

“সুবর্ণা!?…আমি গিয়াস…খোলো!…কোনো ভয় নেই।”

নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে কোনো রকমে মুখ দিয়ে বললো সে, “খুলছি।” গলায় আরেকটু জোর এনে বললো আবার, “শাড়িটা পরে নেই…”

“জলদি পরো…আমাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। ভয় পেও না…ঐ হারামজাদা মরে গেছে।”

এখনও তার হাত কাঁপছে তবে শাড়িটা কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে নিতে পারলো।

দরজা খুলতেই দেখতে পেলো রক্তাক্ত গিয়াস তার সামনে কুজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাম পায়ে হাটুর উপরে একটা কাপড়ের পট্টি বাধা। কোনো রুমালই হবে সেটা। সেখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। ডান ভুরুটা কেটেও রক্তপাত হচ্ছে। ঠোঁটটাও অক্ষত নেই। নাকের একটা ছিদ্র দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, দম ফুরিয়ে হাফাচ্ছে সে।

“ভয়ের কিছু নেই…ঐ শুয়োরের বাচ্চা মরে গেছে!”

লেডি গিয়াসের ডান হাতে আগন্তুকের বড় নলওয়ালা পিস্তলটা।

এ কথা শুনে উমা আশ্বস্ত হবার কথা, ভয়-ডরও কমে আসা উচিত, কিন্তু লেডি গিয়াস একটু উপুড় হয়ে বাম হাটুর ব্যান্ডেজটা চেপে ধরতেই যে দৃশ্যটা দেখতে পেলো সেটা একবারেই ভৌতিক। বরফের মতো জমে গেলো সে।

হায় ভগবান!

.

অধ্যায় ৯

বাথরুমের খোলা দরজার সামনে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে উমা । এইমাত্র তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে লেডি গিয়াস।

বাথরুমের দরজা খুলেই বিধ্বস্ত লেডি গিয়াসকে দেখতে পেয়েছিলো সে, সেইসাথে তার ঠিক পেছনেই দেখতে পেয়েছিলো ঐ জানোয়ারটাকে, সন্তপনে গিয়াসের পেছন থেকে উদয় হয় সে। অথচ লেডি গিয়াস তাকে খুন করার কথা বলছিলো তখন। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি তার হাতে খুন হওয়া মৃতব্যক্তিটি জেগে উঠেছে পেছন থেকে।

ব্যাপারটা যেনো ভৌতিক সিনেমার কোনো দৃশ্য। প্রচণ্ড ভয় থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে না পেতেই এই দৃশ্যটা দেখে উমার হাত-পা মুহূর্তে অবশ হয়ে যায়। মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দই বের হয়ে আসে : হায় ভগবান!

উমার চোখেমুখে ভীতিকর অভিব্যক্তি দেখে আর তার মুখ থেকে অস্ফুটভাবে হায় ভগবান কথাটা বের হতেই লেডি গিয়াস পেছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সে সময় সে পায় নি। প্রচণ্ড জোরে তার ঘাড়ে একটা চাকু বসিয়ে দেয় বাস্টার্ড।

পেশীবহুল লেডি গিয়াস চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে মেঝেতে, তারপরই ঘোৎ করে কয়েকটা শব্দ করেই খিচতে খিচতে লুটিয়ে পড়ে উমার পায়ের কাছে।

উমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় নি। বোবা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।

কয়েক সেকেন্ড লেডি গিয়াস একটু নড়াচড়া করেই অসাড় হয়ে পড়ে রইলো। উমা জানে লেডি গিয়াসের প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে। এবার তার পালা।

জানোয়ারটা এক হাতে বুকের ডান পাশটা ধরে রেখে লেডি গিয়াসের দিকে চেয়ে আছে। নিশ্চিত হতে চাইছে লোকটা মরেছে কিনা।

উমা বুঝতে পারছে এই খুনি জানোয়ারটাও আহত, কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না, গুলি খাওয়ার পরও কিভাবে বেঁচে আছে সে। তার বুকের ডান পাশটা রক্তাক্ত। বাম হাত দিয়ে সেই জায়গাটা ধরে রেখেছে। তবে পা দুটো এখনও টলছে। দেখে মনে হচ্ছে বদ্ধ মাতাল। তবে সে জানে, এই মাতাল একটু আগে বলশালী একজনকে নিজের হাতে খুন করেছে। তা না হলে তাকে এক ধাক্কা মেরে উমা এই ঘর থেকে দৌড়ে পালাতো।

জানোয়ারটা উপুড় হয়ে লেডি গিয়াসের হাত থেকে নিজের পিস্তলটা তুলে নিতেই উমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। তাকে কিছু একটা করতে হবে। কী করবে!

বাস্টার্ড পিস্তলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো মেয়েটা দু’পা পিছিয়ে গেলো। প্রথমে বুঝতে পারলো না। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটার দিকে।

বাথরুমে ঢুকেই ঝট করে দরজা লাগিয়ে দিলো মেয়েটি। বাস্টার্ড কিছুই করতে পারলো না। তার অবস্থাও ভালো নয়। গুলিটা লেগেছে বুকের ডান দিকে, ঠিক ফুসফুস বরাবর। বুলেটটা এফোড় ওফোড় হয়ে বেরিয়ে যাবার কথা, কিন্তু তা হয় নি। গেঁথে আছে তার বুকে। তবে যে শক্তি নিয়ে বুকে আঘাত করেছে তাতেই কাবু হয়ে গেছে সে। মনে হয়েছিলো তোতা ক্রু ড্রাইভার দিয়ে তার বুকে আঘাত করা হয়েছে। এখনও বুকটা ব্যাথা করছে। তার ধারণা পাঁজরের একটা হাঁড় বুঝি ভেঙে গেছে।

লেডি গিয়াসের সাথে তার পেরে ওঠার কথা না। লোকটা বেশ পেশীবহুল । নিয়মিত জিমে যায়। মি: ইউনিভার্স না হলেও মি: বাংলাদেশ হবার যোগ্যতা রাখে । শুধু যে শারিরীক যোগ্যতাই আছে তা নয়, লোকটা কমব্যাট ফাইটিংয়েও বেশ দক্ষ। নিতান্তই সৌভাগ্যের কারণে সে এখন বেঁচে আছে। ধস্তাধস্তি করার সময় তার পিস্তল থেকে প্রায় সবগুলো গুলিই ফায়ার হয়ে যায় শুধুমাত্র একটা বাদে। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় সেগুলো বিদ্ধ হয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ, জানালার পর্দা, বিছানার বালিশ, আর অবশেষে লো ভলিউমে চলতে থাকা টিভি পর্দায়। আর সেই একমাত্র গুলিটাই তার বুকের এমন এক জায়গায় ঠেসে দিয়েছে লেডি গিয়াস যেখানে লেডি গিয়াসেরই রক্ত লেগেছিলো। তার সাথে ধস্তাধস্তির সময় ওটা লাগে। ঐ গুলিটা করার পরই পিস্তলটা নিয়ে তার কপালের মাঝখানে ধরেছিলো সে। বুকে গুলি বিদ্ধ হবার পরও বাস্টার্ড ভড়কে যায় নি কিন্তু পিস্তলটা কপালে ঠেকাতেই তার হাত-পা বরফের মতো জমে গিয়েছিলো। বিকারগ্রস্তের মতো হেসে ট্রিগার টিপে দেয় লেডি গিয়াস ।

সব শেষ!

চোখ দুটো বন্ধ করে শুধু এ কথাটাই ভাবতে পেরেছিলো বাস্টার্ড। কিন্তু পিস্তল থেকে থুতু ফেলার মতো কোনো শব্দ বের না হয়ে শুধু ক্লিক করে একটা আওয়াজ হয় । তারপর আরেকটা ক্লিক!

ক্লিক ক্লিক!

বাস্টার্ড বুঝে যায় পিস্তলে আর গুলি নেই। লেডি গিয়াস উদভ্রান্তের মতো ট্রিগার চেপে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে অসাড় হয়ে পড়ে থাকার ভান করে সে। যেনো লেডি গিয়াস মনে করে এক গুলিই যথেষ্ট। লোকটা তাই ভেবেছে। রেগেমেগে তার পড়ে থাকা দেহে সজোরে একটা লাথি মেরে চলে যায় বাথরুমের দরজার কাছে।

দ্বিতীয় বারের মতো বুলেটপ্রুফ ভেস্টটা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। পুরনো ঢাকা থেকে এখানে আসার আগে যে প্রস্তুতি নিয়েছিলো তারমধ্যে এই ভেস্টটাও ছিলো। খুবই মূল্যবান এই ভেস্ট । সুইডেনের বিয়র্ক অ্যামো কোম্পানির অত্যাধুনিক একটি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট এটি। শুটার সামাদ নিতান্তই শখের বশে জিনিসটা সংগ্রহ করেছিলো এক বছর আগে। তার কাছ থেকে উপযুক্ত দাম দিয়ে কিনে নিয়েছে সে।

এই বুলেটপ্রুফ ভেস্টটা ছাড়াও আরেকটা জিনিসের কাছে সে কৃতজ্ঞ।

একটা হান্টার নাইফ।

জিনিসটা সঙ্গে নিয়ে আসার কোনো ইচ্ছেই তার ছিলো না। কিন্তু পায়ের লেদার বুটটা পরার সময় যখন দেখতে পেলো ডান পায়ের বুটের খাপে ওটা ভরা আছে তখন আর রেখে আসে নি।

লেডি গিয়াসের মতো পাণ্ডার সাথে খালি হাতে পেরে ওঠা অসম্ভব, সুতরাং লোকটা যখন বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে মেয়েটাকে ডাকতে লাগলো, সুযোগ বুঝে বাস্টার্ড আস্তে করে পায়ের বুট থেকে চাকুটা হাতে নিয়ে নেয়। সন্তপনে লেডি গিয়াসের পেছনে চলে গেলেও টের পায় নি, তবে মেয়েটা দরজা খুলেই বুঝতে পারে লেডি গিয়াসের পেছনে সে দাঁড়িয়ে আছে চাকু হাতে। ভাগ্য ভালো ভয়ার্ত মেয়েটি চিৎকার দেয় নি। ক্ষণিকের জন্যে সে বোবা হয়ে গেছিলো। সেই সুযোগে পেছন থেকে পাণ্ডাটাকে এক আঘাতেই শেষ করে দিতে পেরেছে।

দশ মিনিট পর কিছুটা ধাতস্থ হলো সে। লেডি গিয়াসের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে একটা আক্ষেপে মনটা ভরে উঠলো। ব্ল্যাক রঞ্জু সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যই তার কাছ থেকে জানতে পারে নি। ওদিকে লেডি গিয়াস যে কর্লগার্লটাকে নিয়ে এসেছে সে এখন বাথরুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছে। সমস্যা নেই।

লেডি গিয়াসের মোবাইল, মানিব্যাগসহ যাবতীয় জিনিসগুলো একসাথে জড়ো করলো সে। এগুলো তার দরকার হবে। মোবাইলটা চেক করে দেখলো । শেষ কলটা করা হয়েছে পনেরো-বিশ মিনিট আগে। তার মানে সে এ ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ আগে । ফোনটা করা হয়েছে মিনা আপা’ নামের একজনকে । ফোনবুকে খুঁজে দেখলো ব্ল্যাক রঞ্জু নামের কোনো কন্ট্যাক্ট সেভ করা আছে কিনা। এ নামে কেউ নেই। ফোনবুকে মাত্র ছয়টি কন্ট্যাক্ট । তার মধ্যে একটা সুলতানের, আরেকটা মিনা আপার। বাকি চারটা কন্ট্যাক্ট সেভ করা আছে আদ্যক্ষর দিয়ে : জি.পি। এ.ডি । এইচ.এম । পি.কে ।

আজব। এতো কম! আর এগুলোর মানে কী!

পরক্ষণেই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। লেডি গিয়াস ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে কোলকাতায় থাকে । খুব কমই দেশে আসে। এই সিমটা হয়তো দেশে ঢোকার পর কিনেছে। আরো কোনো সিম আছে কিনা খুঁজে দেখলো । না । মানিব্যাগে ছয় হাজার টাকা ছাড়া তেমন কিছু নেই। বিছানার উপর চাবির গোছাটা পড়ে আছে। সেটা তুলে নিলো । গাড়িতে নাকি অনেক টাকা আছে। কিন্তু কোন্ গাড়িতে?

এই হোটেলে ঢোকার সময় পার্কিংএরিয়ায় অনেকগুলো গাড়ি দেখেছে। কিন্তু লেডি গিয়াসের গাড়ি কোনটা সেটা জানবে কেমন করে? এক্ষুণি তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। আর নীচের পাকিংয়ে গিয়ে সবগুলো গাড়ি খুঁজে দেখাও সম্ভব নয়। ওখানে সিকিউরিটি গার্ড আছে। লেডি গিয়াস বেঁচে থাকলে খুব সহজেই জানা যেতো।

খুট করে একটা শব্দ হতেই বুঝতে পারলো বাথরুমের ভেতর থেকে সেটা এসেছে।

বাথরুম! মেয়েটা তো ওখানেই আছে!

ব্যাপারটা চট করেই তার মাথায় এলো।

লেডি গিয়াস এই কর্লগার্লটাকে সাথে করেই নিয়ে এসেছে। তাহলে গাড়িটার কথা মেয়েটা জানে । সে জানে কোন গাড়িটা লেডি গিয়াসের!

.

উমার হাত-পা আবারো অবশ হয়ে গেছে। এক খুনির হাত থেকে বাঁচার আশায় এই বাথরুমে ঢুকে আছে প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট হলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো খুনি তাকে বের হবার জন্য একবারের জন্যেও তাড়া দেয় নি । কোনো সাড়া শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না । ঘরে কোনো মানুষ আছে বলেও মনে হচ্ছে না । উমার মনের একটা অংশ বলছে খুনি তাকে কিছু করবে না। তাকে মেরে তার কী লাভ। সে তো কারো কেননা ক্ষতি করে নি। আবার অন্য একটা অংশ বলছে এই খুনি তাকেও খুন করবে, কোনো প্রমাণ না রাখার জন্যে । তার ভাগ্যে কী আছে বুঝতে পারছে না। মাথাটা একদমই কাজ করছে না এখন।

সজোরে দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে আসতেই নড়েচড়ে উঠলো সে। বাথরুমের দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো। ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

খুনিটা চলে গেছে?

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো উমা। কোনো শব্দ শুনতে পেলো না। গাঢ় নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। ঘরের মধ্যে যে দেয়াল ঘড়িটা আছে সেটার টিকটিক

শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কোনো মানুষের উপস্থিতি টের পচ্ছে না।

খুনি এসেছিলো লেডি গিয়াসকে মারতে, তার কাজ হয়ে গেছে। সুতরাং তার মতো একটা তুচ্ছ মেয়ের পেছনে সময় নষ্ট করার কোনো মনে হয় না। উমা এবার নিশ্চিত, খুনি ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। এতোক্ষণে সম্ভবত গাড়িটা নিয়ে হোটেল ছেড়ে চলেও গেছে সে।

জোরে জোরে বার কয়েক নিঃশ্বাস নিলো, বুকে সাহস সঞ্চয় করে দরজাটা আস্তে করে ফাঁক করলো একটুখানি।

ঘরে কেউ নেই।

লেডি গিয়াসের নিথর দেহটা পড়ে আছে বিছানার পাশে।

উমার বুকের ভেতর থেকে জমে থাকা একদলা নিঃশ্বাস বের হয়ে গেলো । দরজাটা পুরোপুরি খুলে পা রাখলো ঘরের ভেতর। খপ করে তার মুখটা চেপে ধরলো শক্ত একটা হাত। অন্য একটা হাত পেছন থেকে জাপটে ধরলো তাকে।

উমা বুঝতে পারলো পেছন থেকে তাকে সেই খুনি ধরে ফেলেছে। তাকে কৌশলে বাথরুম থেকে বের করে এনেছে লোকটা। এখন আর কিছু করার নেই। কোনো রকম প্রতিরোধ করতে পারলো না সে। হাল ছেড়ে দিলো। জানে, মৃত্যু এখন অবধারিত।

দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। খুব কান্না এলো, কিন্তু খুনি তার মুখটা চেপে ধরে রেখেছে বলে কোনো শব্দ করতে পারলো না।

অসুস্থ মা-বাবার চেহারা ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *