১০. একদম চিৎকার করবে না

অধ্যায় ১০

“একদম চিৎকার করবে না,” উমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো বাস্টার্ড। “আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না…যদি আমার কথামতো কাজ করো । বুঝতে পেরেছো?”

কোনো রকম মাথা নেড়ে বলতে পারলো উমা। শক্ত করে এক হাতে তার মুখ চেপে রাখা হয়েছে। অন্য হাতে তার গলায় ধরে রেখেছে ধারালো চাকুটা! এই চাকুটা দিয়েই লেডি গিয়াসকে হত্যা করা হয়েছে।

“আমি পুলিশের লোক…তোমার কোনো ভয় নেই।” মিথ্যেটা বললো এই আশায় মেয়েটা যেনো উল্টাপাল্টা কিছু করে না বসে। বাস্টার্ড জানে, চোখের সামনে খুন হতে দেখেছে, হয়তো প্রাণভয়ে মরিয়া হয়ে মেয়েটা কিছু করে বসতে পারে। পুলিশের লোক জানলে আশ্বস্ত হবে।

“আমরা সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জুর দলকে খুঁজছি…তুমি আমাদেরকে সাহায্য করলে আমরা তোমাকে জেলে ঢোকাবো না।” একটু থেমে বাস্টার্ড গলা থেকে চাকুটা সরিয়ে নিলো। “তুমি কোন লাইনের মেয়ে সেটা আমরা জানি…তোমাকে পুলিশ কিছু করবে না যদি আমার কথামতো কাজ করো…ঠিক আছে?”

মেয়েটা আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো। বোঝা যাচ্ছে পুলিশের লোক শুনে অনেকটাই আশ্বস্ত হয়েছে সে।

এবার আস্তে করে মেয়েটার মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো বাস্টার্ড । মেয়েটা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো।

“তোমার নাম কি?”

ফ্যালফ্যাল করে বাস্টার্ডের দিকে চেয়ে রইলো উমা। “আমার নাম?…আ-আমি…উমা।” একটু তোতলালো।

“আসল নামটা বলল।” এবার মেয়েটার মুখোমুখি সে। দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার মতো আচরণ করছে।

“এটাই আমার আসল নাম।”

“তাহলে সুবর্ণা কি তোমার ভুয়া নাম?”

মেয়েটা অবাক হলো। বুঝতে পারলো না এ নামটা কিভাবে জানতে পারলো পুলিশের এই লোকটি। দ্রুত এতোসব ঘটনা ঘটে গেছে যে বেমালুম ভুলে গেছে লেডি গিয়াস বাথরুমের দরজা খোলার তাগাদা দেবার সময় তার এই নামটা ধরে ডেকেছিলো।

“ওটা আমার আসল নাম না,” মাথা নীচু করে বললো উমা ।

“কতোদিন ধরে এই লাইনে আছো?”

চুপ মেরে রইলো সে। তারপর আস্তে করে বললো, “আজকেই প্রথম।”

বাস্টার্ড জানে কর্লগার্ল-বেশ্যারা খদ্দেরদের কাছে এরকমই কথা বলে। বেশি দিন হয় নি; এই তো কিছুদিন আগে এই লাইনে এসেছি। সেই সাথে বয়সটাও অনেক কমিয়ে বলে তারা। এতে করে খদ্দেররা মনে করে মেয়েটা অনেকটাই ফ্রেশ! নিজেদেরকে খদ্দেরদের কাছে আরো লোভনীয় করে তোলার জন্য এই কৌশল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাস্টার্ড তো কোনো খদ্দের নয়, তার কাছে এমন মিথ্যে বলার দরকার কী।

“আজকেই এই লাইনে এসেছো?…ভালো।” মুচকি হেসে আবার বললো সে, “বাড়ি কোথায়?”

‘মানিকগঞ্জ।”

“সেটা না…ঢাকায় কোথায় থাকো?”

“রামপুরায়।”

“লেডি গিয়াসের সাথে পরিচয় হলো কিভাবে?”

দু’চোখ মুছে ঢোক গিলে বললো উমা, “মিনা আপার মাধ্যমে।”

মিনা আপা? বাস্টার্ডের মনে পড়ে গেলো, লেডি গিয়াসের মোবাইল ফোনের ফোনবুকে এই নামটা দেখেছে। এখানে ঢুকে লেডি গিয়াস তাকে একটা ফোনও করেছে।

“এই মিনা আপাটা কে?”

মুখ তুলে তাকালো মেয়েটি। “উনার কাছে অনেকগুলো মেয়ে আছে…একটা বিউটি পালার চালায় মহিলা…আমি উনার পালারেই কাজ করতাম।”

“মিনা আপা কোথায় থাকে?”

“শান্তি নগর।”

বাস্টার্ড একটু ভেবে মাথা দোলালো। “আমরা এখন এখান থেকে চলে যাবো…তুমি কি বাসায় যাবে?” মাথা নেড়ে সায় দিলো মেয়েটি। “তাহলে তোমাকে আমি রামপুরায় নামিয়ে দেবো। ঠিক আছে?”

আবারো নিঃশব্দে সায় দিলো উমা।

ঘর থেকে বের হতেই দেখতে পেলো ৩০৪-এর দরজা ফাঁক করে মাঝবয়সী এক লোক ঔৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে । চোখোচোখি হতেই লোকটা দরজা বন্ধ করে দিলো ।

নিজের রুমে ফিরে এসে হ্যান্ড লাগেজটা নিয়ে মেয়েটাকেসহ লিফটের কাছে চলে গেলো বাস্টার্ড। লিফটের জন্যে যখন অপেক্ষা করছে তখন আবারো ৩০৪ নাম্বার রুমের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো দরজাটা আলতো করে খুলে মাঝবসয়ী লোকটা কৌতূহলভরা চোখে তাকে দেখছে।

বাস্টার্ড স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। ৩০৪-এর নোকটার বাড়তি আগ্রহ তার কাছে ভালো লাগছে না। যাইহোক এখান থেকে জলদি সটকে পড়তে হবে। লিফটের দরজা খুলে গেলে ঢুকে পড়লো মেয়েটাকে নিয়ে।

উমা নামের মেয়েটি তার সব কথা বিশ্বাস করেছে। পুলিশের লোক মনে করে বাধ্য আচরণ করছে সে। লিফটটা সোজা গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামলো ।

“লেডি গিয়াস যে গাড়িতে করে তোমাকে নিয়ে এসেছে সেই গাড়িটা কোথায় পার্ক করেছে?” জানতে চাইলো বাস্টার্ড।

“লিফটের কাছেই…লাল রঙের একটা গাড়ি,” উমা সরলভাবেই জবাব দিলো।

লিফট থেকে বের হয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পেলো কয়েক গজ দূরে ডান দিকে একটা লাল গাড়ি পার্ক করা আছে। গাড়িটার দিকে ইশারা করে মেয়েটাকে বললো সে, “এটা?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো উমা।

চাবি দিয়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে মেয়েটাকে ভেতরে ঢুকতে বললে । মেয়েটা গড়িতে উঠতেই বাস্টার্ড পেছনের বুটটা খুলে দেখতে পেলো বড়সড় একটা গলফব্যাগ। চেইনটা টেনে খুলতেই পাঁচশ’-হাজার টাকার বান্ডিলগুলো দেখতে পেলো । বুটটা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো সে।

“তুমি সিটে শুইয়ে পড়ো…তোমাকে যেনো গার্ড দেখতে না পায়, বুঝেছো?”

কথাটা শুনে উমা একটু ভয় পেয়ে গেলেও কথামতো কাজ করলো।

গেটের দাড়োয়ান আর গার্ডদের এখান থেকে দেখা যায় না, কিন্তু বাস্টার্ড জানে রো থেকে গাড়িটা বের করে গেটের দিকে এগোলেই তাদের দেখা যাবে; তারাও তাকে দেখতে পাবে।

তাই হলো। কিছুটা দূরে থাকতেই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দাড়োয়ান অবাক হয়ে তার গাড়িটার দিকে চেয়ে রইলো। হাত উঁচিয়ে গাড়িটা থামানোর ইশারা করে লোকটা গাড়ির কাছে এগিয়ে এলো হনহন করে।

জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো বাস্টার্ড ।

“কই যাইতাছেন?…কতো নাম্বারের গেস্ট?”

“৩০৬-এর । এই তো, একটু আগে ফ্যামিলি নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে এসেছি…চিনতে পারেন নি?”

দাড়োয়ান ভুরু কুচকে তার দিকে চেয়ে রইলো। “চেকআউট করতাছেন?”

বাস্টার্ড জানে চেকআউটের কথা বললে হোটেলের রিসিপ্ট দেখতে চাইবে।

“এয়ারপোর্টে…একটা লাগেজ ফেলে এসেছি…আমার বউটা একেবারে বেখেয়ালি…এর আগেও কয়েক বার এয়ারপোর্টে লাগেজ হারিয়েছে। এখন না গেলে আর পাবো না।”

দাড়োয়ান তার কথায় বিশ্বাস করলো। “ইশ…একটা ঝামেলার মইদ্যে পইড়া গেছেন তাইলে।”

“আর বলবেন না, মেয়ে মানুষকে কোনো দায়িত্ব দিলে এমনই হয়…এরা রান্নাঘরেই ভালো।”

“ঠিক কইছেন,” মুচকি হেসে দাড়োয়ান চলে গেলো গেটের কাছে।

গেট খুলে দিতেই বেরিয়ে গেলো লাল রঙের গাড়িটা।

বাস্টার্ড রিয়ারভিউ মিররে দেখতে পেলো পেছনের সিটে উঠে বসেছে উমা। তার চোখেমুখে জিজ্ঞাসু।

“আপনি না পুলিশের লোক…দাড়োয়ানকে তাহলে মিথ্যে বললেন কেন?”

রাস্তার উপর চোখ রেখেই বললো সে, “আমি সাদা পোশাকে আছি। ওরা যদি জানে পুলিশ ওদের হোটেলে আছে তাহলে সমস্যা হবে।”

মনে হলো আবারো মেয়েটা তার কথায় বিশ্বাস করেছে।

কিছু দূর গিয়ে একটা নির্জন জায়গায় গাড়িটা থামানোর পরিকল্পনা করছে। বাস্টার্ড । তারপর মেয়েটাকে…

মোবাইল ফোনের রিং বাজতে শুরু করলো গাড়ির ভেতর। তার কাছে এখন চার-চারটা ফোন। কোনটা বাজছে কে জানে। গভীর রাত হওয়াতে রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে পকেট হাতরে রিং হওয়া ফোনটা বের করে ডিসপ্লে’র দিকে তাকালো।

মিনা আপা!

রিয়ারভিউ মিররে চোখ রাখতেই মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো তার। “কোনো কথা বোলো না…ফোনটা রিসিভ করছি।”

গাড়িটা রাস্তার বাম দিকে নিয়ে গিয়ে হ্যান্ড ব্রেক ব্যবহার করে থামিয়ে ফেললো।

“ছেরিটা কি এখনও গাইগুই করতাছে?” কর্কশ কন্ঠে এক মহিলা বললো-মিনা আপা।

“না।” ছোট্ট ক’র বললো বাস্টার্ড । মহিলা সম্ভবত প্রচুর ড্রিঙ্ক করেছে। কথাবার্তায় সেটার আভাস পাওয়া যাচ্ছে ।

“ভালা।” একটু থেমে আসল প্রসঙ্গে চলে এলো মিনা আপা। “শোনো গিয়াস…রঞ্জু আমারে ফোন দিছিলো একটু আগে…তুমি ঢাকায় আইসা মাইয়া। মানুষ নিয়া মওজ করতাছো কিনা জিগাইছে আমারে…কয়, গিয়াস তো আবার মাইয়া মানুষ ছাড়া থাকবার পারে না…আমি কইছি, না, তুমি কাজকামে ব্যস্ত আছো…বুঝলা?”

“হুম।”

“তুমি যে আমার কাছ থেইকা ঐ মাইয়াটারে নিয়া গেছে এইটা যেন রঞ্জু জানবার না পারে…বুঝছো তো?”

“হুম।”

“ছেরিটারে কিন্তু সকাল সকাল ছাইড়া দিও…এই লাইনে আইজকাই প্রথম নামছে…একটু ভালা ব্যবহার কইরো।”

“হুম।”

“আরে, খালি দেখি হু হু মারাইতাছো…মাল টানছো নি?”

এক মাতাল আরেকজনের মাতলামির খবর জানতে চাচ্ছে।

“হুম…একটু।”

“ঠিক আছে, রাখি…ঐ ছেরিটারে আবার এইসব জিনিস খাওয়াইতে যাইও …বমিটমি কইরা দিবো।”

“আচ্ছা।”

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো বাস্টার্ড। লেডি গিয়াসের কাছ থেকে যে কোনো তথ্য বের করার সুযোগ পায় নি তা নিয়ে এতোক্ষণ ধরে একটা আক্ষেপ ছিলো তার মধ্যে। রঞ্জুর সবচাইতে কাছের লোককে পেয়েও কিছু জানতে না পারাটা মোটেই ঠিক হয় নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্ল্যাক রঞ্জুর আরো কাছের একজনের হদিশ পেয়ে গেছে সে।

মিনা আপা!

মহিলা সাধারণ কোনো বেশ্যার দালাল নয় । খুব সম্ভব, রঞ্জুর সাথে এই মিনা আপার ঘনিষ্ঠ কোনো যোগাযোগ আছে।

পেছনে ফিরে উমার দিকে তাকালো সে। “মিনা আপার বাসাটা তো তুমি চেনো, তাই না?”

“হুম।”

হাত ঘড়িটা দেখলো। রাত দশটা। লেডি গিয়াসের খুন হবার খবরটা জানাজানি হবার আগেই মিনা আপার ওখানে যাওয়া দরকার।

আধ ঘণ্টা পর লাল রঙের গাড়িটা শান্তি নগরের একটি বহুতল ভবনের সামনে এসে থামলো । এই ভবনের চার তলায় থাকে মিনা আপা।

পিস্তলে গুলি ভরে নিলো বাস্টার্ড তারপর লেডি গিয়াসের মোবাইল ফোনটা উমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। মিনা আপার নাম্বারটা ডায়ালে দিয়ে রেখেছে। কি বলতে হবে পথে আসতে আসতেই শিখিয়ে দিয়েছে বাস্টার্ড । ফোনটা কানের কাছে ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো উমা।

অনেকবার রিং হবার পর কলটা রিসিভ করা হলো ।

“আবার কী হইছে?” মিনা আপা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো।

“আপা…আমি উমা।”

“তুমি?…হইছে কি?” মহিলা খুব অবাক হয়েছে।

“একটা সমস্যা হয়েছে, আপা। আমি এখন আপনার বিল্ডিংয়ের নীচে আছি। একটু উপরে আসতে হবে।”

“নীচে আছো? কি হইছে?…বুঝলাম না।”

“আপা, গিয়াস ভাই আমাকে আপনার বাড়ির নীচে নামিয়ে দিতে এসেছে। উনার নাকি জরুরি একটা ফোন এসেছে…”।

“কয় কি?..কাম শেষ?” একটু চুপ থেকে আবার বললো, “নাকি প্রথম দিনেই একটা ভেজাল কইরা ফালাইছো?…খাড়াও, আমি দাড়োয়ানরে কইতাছি।”

লাইনটা কেটে গেলো। বাস্টার্ড জানে মিনা আপা এখন চার তলার উপর থেকে হয়তো নীচে পার্কিং করা গাড়িটা দেখবে, তাই গাড়ি থেকে বের হলো না। এই গাড়িটা মহিলা চেনে। এটাই যথেষ্ট।

পাঁচ মিনিট পর রোগাপটকা এক দাড়োয়ান অ্যাপার্টমেন্টের মেইন গেটটা খুলে দিলো। বাস্টার্ড উমাকে আগে নেমে দেখতে বললো মিনা আপা বেলকনি থেকে তাদের দিকে চেয়ে আছে কিনা।

উমা গাড়ি থেকে বের হয়ে উপরে তাকিয়ে দেখলো মিনা আপাকে দেখা যাচ্ছে না। বাস্টার্ডকে সে জানালো কথাটা। আস্তে করে গাড়ি থেকে নেমে উমাকে নিয়ে সে ঢুকে পড়লো ভবনের ভেতর। গাড়িটা বাইরেই রেখে গেলো।

চার-পাঁচ মিনিট পর মিনা আপার ফ্ল্যাটে কলিংবেলটা বেজে উঠলে মহিলা বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই বাস্টার্ড ঢুকে পড়লো ভেতরে । মহিলা কিছু বলার আগেই তার দিকে পিস্তল তাক করে ধরলো সে।

“কোনো কথা বলবেন না!”

উমাকে ভেতরে আসতে বলে দরজাটা বন্ধ করে দিলো ।

“ভেতরে আর কে কে আছে?”

মিনা আপা কিছুই বুঝতে পারছে না। অবাক হয়ে চেয়ে রইলো শুধু। ‘অ্যাই,” উমার উদ্দেশে বললো। “এই লোকটা কে?”

“খালা, পুলিশের লোক,” উমা কাচুমাচু হয়ে বললো।

“কি??”

“একদম চুপ। কোনো রকম হাউকাউ করবেন না।” বাস্টার্ড মহিলাকে তাড়া দিলো ভেতরের ঘরে যাবার জন্য ।

তারা সবাই বসলো ড্রইংরুমের সোফায় ।

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…আপনি কি পুলিশের লোক?” মিনা আপা নামের মহিলা আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বললো ।

“তারচেয়েও বড় কিছু, মুচকি হেসে বললো বাস্টার্ড ।

“এসবি? এনএসআই?…ডিজিএফআই?”

“বাহ, আপনি তো দেখছি সব এজেন্সির নামই জানেন। ভালো।”

“অ্যাই উমা, ঘটনা কী, কিছুই তো বুঝতাছি না?” মহিলা উমাকে বললো।

“আপা, হোটেল থেকে পুলিশ গিয়াস ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে…তারপর আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে,” বাস্টার্ডের শেখানো মিথ্যে কথাগুলো বেশ গুছিয়ে বলে গেলো উমা ।

লেডি গিয়াস পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে শুনে মহিলা ভড়কে গেলো । “আমার কাছে কি চান, আপনারা?”

“আপনি যে ব্ল্যাক রঞ্জুর অনেক ঘনিষ্ঠ একজন সেটা আমরা জানি,” একটু থেমে মহিলার প্রতিক্রিয়া দেখে নিলো সে। “আপনাদের পুরো নেটওয়ার্কটাই আমরা ধরে ফেলেছি। পুরনো ঢাকা থেকে সুলতান…উত্তরার পিং সিটি থেকে লেডি গিয়াস…আর এখানে আপনাকে…এখন শুধু বাকি আছে রঞ্জু।”

মাথায় হাত দিয়ে মিনা আপা মেঝের দিকে চেয়ে রইলো। “হায় আল্লাহ!”

“আপনি যদি পুলিশকে সব তথ্য না দেন তাহলে পুলিশ আপনাকে এনকাউন্টারে দিয়ে দেবে,” খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো বাস্টার্ড।

মুখ তুলে তাকালো মহিলা । চোখেমুখে তার ভয়।

“রঞ্জু এখন কোথায় আছে?” পিস্তলটা মহিলার দিকে তাক করে বললো সে। “আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। কোনো রকম চালাকি করবেন না।”

“কোলকাতায়,” ছোট্ট করে বললো মিনা আপা।

“কোলকাতার কোথায়?”

মহিলা নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কিন্তু যখন দেখলো বাস্টার্ড তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তখন বললো, “সল্টলেকে।”

“বাড়ির নাম্বারটা বলেন,” তাড়া দিলো সে।

আবারো মাথায় দু’হাত রেখে চূড়ান্ত পরাজয়ের ভঙ্গি করলো মহিলা।

“নাম্বারটা বলেন?” ধমকের সুরে বললো সে।

“এফ ব্লক, চার নাম্বার রোড, বারো নাম্বার বাড়ি।”

“রঞ্জুর সাথে আর কে কে আছে ওখানে?”

“গিয়াস থাকে…সে তো এখন ঢাকায়…ইসহাক, শাহজাহান আর দিপুও থাকে।”

তথ্যগুলো কতোটুকু সত্য সেটা যাচাই করা যায় কিভাবে ভাবতে লাগলো বাস্টার্ড । একটু ভেবে বললো, “আপনার কথা সত্যি কিনা বুঝবো কিভাবে?”

মহিলা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার দিকে। “আপনি তো ভুল তথ্যও দিতে পারেন…তাই না?”

একটু ভেবে মহিলা বললো, “আমার কাছে ঠিকানাটা লেখা আছে…চাইলে আপনে দেখতে পারেন।”

ভালো প্রস্তাব, মনে মনে বললো বাস্টার্ড । কিছুক্ষণ আগেও এই মহিলা জানতো না অস্ত্রের মুখে তাকে বাধ্য করবে ব্ল্যাক রঞ্জুর ঠিকানা জানার জন্য । সুতরাং রঞ্জুর ঠিকানা হিসেবে যা বললো সেটা যদি আগে থেকে কোথাও লেখা থাকে তাহলে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্যই হবে।

“কোথায় লেখা আছে?”

“আমার কাছে একটা ডায়রি আছে…ওইটাতে লেখা আছে।” কথাটা বলেই মহিলা ড্রইংরুমের এক কোণে একটা ওয়ার্ডরোবের দিকে ইঙ্গিত করলো ।

“ডায়রিটা নিয়ে আসুন,” আদেশ করলো সে।

“আমি যা বলছি সত্য বলছি, বিশ্বাস করেন…”

বাস্টার্ড পিস্তলটা নেড়ে মহিলাকে ডায়রি নিয়ে আসতে বললো।

ভীতসন্ত্রস্ত পায়ে উঠে গিয়ে ড্রয়ার খুলে ডায়রিটা খুঁজতে লাগলো মিনা আপা। “এইখানেই তো ছিলো…গেলো কই!” বিড়বিড় করে বলতে লাগলো মহিলা।

বাস্টার্ড তার পাশে বসা উমার দিকে তাকালো। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে সোফায়। এই মেয়েটাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেছে সে। বুঝতে পারছে নিরীহ একটা মেয়ে কিন্তু তার নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবলে এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে…।

হঠাৎ চোখের কোণে কিছু একটা দেখতে পেয়ে বাস্টার্ড ফিরে তাকাতেই গুলির শব্দে কান ফেটে যাবার জোগার হলো।

মিনা আপা ড্রয়ার থেকে একটা পিস্তল বের করেই গুলি করেছে। বাস্টার্ড সোফার উপর হুমরি খেয়ে পড়লো । মহিলা আরেকটা গুলি করার আগেই ক্ষিপ্রগতিতে গুলি চালালো সে। তার গুলির কোনো শব্দ হলো না। শুধু ফুট’ করে ভোতা একটি শব্দ। মিনা আপা দু’পা পিছিয়ে গেলেও বুঝতে পারলো না। দ্বিতীয় গুলিটা ঠিকই চালিয়ে বসলো, তবে সেটা লক্ষ্যচ্যুত হয়ে বিঁধলো সোফার নরম গদিতে।

বাস্টার্ড কিছুই বুঝতে পারলো না প্রথমে। স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়ায় আরেকটা গুলি চালালো মহিলাকে লক্ষ্য করে ।

টলতে টলতে মিনা আপা পড়ে গেলো মেঝেতে। বাস্টার্ডের দুটো গুলিই লেগেছে তার দেহে । প্রথমটা তলপেটে লাগলেও টের পায় নি, তবে দ্বিতীয়টার আঘাত বুঝতে পেরেছে মহিলা, সেই গুলিটা লেগেছে তার বুকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মহিলার রক্তে মেঝেটা ভিজে গেলো ।

বাস্টার্ড বুঝতে পারলো তার শরীরেও একটা গুলি লেগেছে।

বুলেট প্রুফ ভেস্ট ভেদ করে ফেলেছে!

অসম্ভব!

বাম কাঁধে চিনচিন করে ব্যাথা করছে। পাশ ফিরে দেখলো উমা আতঙ্ক ভরা চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। তার গলার দিকে।

ডান হাতে কাঁধটা ধরেই বুঝতে পারলো রক্তে ভিজে গেছে শার্ট । বুলেটপ্রুফ ভেস্ট ভেদ করে কিভাবে গুলি লাগলো বুঝতে পারছে না। একটু পরই বুঝতে পারলো। তার ভেস্টটা স্লিভলেস, গলা ভি আকৃতির। গলার কাছে ঐটুকু ফাঁক দিয়েই গুলিটা ঢুকে পড়েছে তার কাঁধে।

ভাগ্য ভালো গুলিটা তার গলায় কিংবা মাথায় লাগে নি। অন্য দিকে কপাল খারাপ, কারণ গুলিটা ঐটুকু ফাঁক গলেই ঢুকে পড়েছে!

বরফের মতো জমে আছে উমা। চোখের সামনে গোলাগুলি আর বীভৎস হত্যাকাণ্ড!

বাস্টার্ড বুঝতে পারছে না আঘাত কতোটা মারাত্মক। ডান হাতে ক্ষতস্থানটা চেপে রাখলো। রক্তপাত হচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে চেপে ধরলো সেখানটা। কিছুক্ষণের জন্য মাথাটা কাজ করলো না।

এদিকে গোলাগুলির শব্দে আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বেরিয়ে আসছে। তাদের শব্দ শুনতে পেলো। পাশের ঘর থেকে চাপা ফিসফিসানিও শোনা যাচ্ছে। উমা বলেছে এখানে ছয়-সাতজন মেয়ে থাকে। ঐ মেয়েগুলোই আছে ওখানে। এতোক্ষণে নিশ্চয় অ্যাপার্টমেন্টের বাইরেও লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। এক্ষুণি তাকে এখান থেকে বের হতে হবে।

ওয়ার্ডরোবের কাছে ছুটে গেলো সে। একটা সূতির শাড়ি বের করে সেটা ছিঁড়ে ফেললো। সে একা একা ব্যান্ডেজ করতে পারবে না। ডান হাতে পিস্তলটা উঁচিয়ে মেয়েটাকে কাছে ডাকলো ।

“শক্ত করে বেঁধে দাও!” শার্টের বোতাম খুলে ক্ষতস্থানটা দেখিয়ে বললো বাস্টার্ড ।

মেয়েটা কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো । খুব একটা ভালো হলো না, তবে আপাতত কাজ হবে। নিজের শার্টটা খুলে দলা পাকিয়ে ফেললো। ওয়ার্ডরোব থেকে খুঁজে দেখলো কোনো শার্ট আছে কিনা। আছে। বেশ কয়েকটাই আছে। বেছে নেয়ার সময় নেই। একটা শার্ট পরে নিলো দ্রুত। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না।

রক্তাক্ত শার্টটা দলা পাকিয়ে মেয়েটার ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিলো, তারপর দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলো তারা। আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে দুয়েক জন বের হয়ে এলেও বাস্টার্ডের হতে পিস্তল দেখে নিজেদের ঘরে আবার ঢুকে পড়লো তড়িঘড়ি করে ।

গেটের দাড়োয়ানও গুলির শব্দ শুনেছে, গেটটা আগলে রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে । বাস্টার্ডকে পিস্তল হাতে আসতে দেখে বুঝতে পারলো না কী করবে। লোকটার দিকে তাকিয়ে পিস্তল নেড়ে ইশারা করলো সরে যাবার জন্যে। মূল গেটটা বন্ধ থাকলেও ছোটো গেটটা খোলাই ছিলো, সেটা দিয়ে বের হয়ে দ্রুত লাল রঙের গাড়িতে উঠে বসলো তারা। রাস্তায় কিছু লোক জমে গেছে। তারা ফ্ল্যাটের দিকে চেয়ে আছে। দু’জন নারী-পুরুষকে বের হতে দেখে উৎসুক চোখে চেয়ে রইলো কেবল ।

গাড়িটা যখন চলতে শুরু করলো তখনই নীরবতা ভাঙলো উমা। “আপনার ডাক্তার দেখানো দরকার, তার কণ্ঠস্বর ভয়ার্ত ।

রাস্তার দিকে চোখ রেখেই সে বললো, “চিন্তার কিছু নেই…মনে হয় না সিরিয়াস।”

কিন্তু সে টের পাচ্ছে বাম হাতটা অবশ হয়ে আসছে । রক্তপাত বন্ধ হয় নি। শার্টের ভেতর চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে এখনও। কিছু একটা করা দরকার ।

গাড়িটা এখন শাহবাগের দিকে যাচ্ছে। ওখানে অনেক ওষুধের দোকান আছে! কিন্তু এতো রাতে কি খোলা থাকবে?

থাকবে। পিজি হাসপাতালের কারণে ওষুধের দোকানগুলোর মধ্যে কয়েকটি দোকান সারারাত খোলা থাকে। ওখানকার ওষুধের দোকানগুলো নিজেরাই পালাক্রমে রাতের সময় ভোলা রাখে ইমার্জেন্সি রোগিদের জন্য।

খুব বেশি ভাবলো না । ভাবার মতো সময় তার হাতে নেই। দ্রুত গাড়িটা নিয়ে ছুটে গেলো শাহবাগের মোড়ে ।

ওষুধের দোকানগুলো রাস্তার ওপর পারে । অনেকটা পথ এগিয়ে ইউ-টার্ন করে আসতে হবে। দরকার নেই। দোকানগুলোর ঠিক বিপরীতে, রাস্তার ওপারেই গাড়িটা থামালো সে । উমাকে কিছু টাকা দিয়ে বললো কটন আর ব্যান্ডেজ কিনে নিয়ে আসার জন্য।

“কোনো রকম চালাকি করবে না!” মেয়েটাকে সাবধান করে দিলো । “ভেবো না আমি আহত হয়ে গেছি বলে কিছু করতে পারবো না। উল্টাপাল্টা কিছু করলেই গুলি করে মেরে ফেলবো। বুঝেছো?” ধমকের সুরে বললো শেষ কথাটা।

দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিলো উমা। গাড়ি থেকে নেমে ভীরু ভীরু পায়ে রাস্তাটা পার হয়ে ওষুধের দোকানগুলোর দিকে এগোলো মেয়েটা। গাড়ি থেকে বাস্টার্ড তাকে চোখে চোখে রাখছে। একটা দোকানে ঢুকলো উমা। সে টের পেলো তার কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। এখনও যথেষ্ট শীত আছে ঘাম হবার কথা নয়, গড়িটাতেও এসি আছে, তাহলে?

একটু পরই নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গেলো তার। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। অস্থির হয়ে উঠলো সে। মেয়েটা আসছে না কেন?

নিঃশ্বাস আরো দ্রুত হয়ে গেছে। মেয়েটা সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছে? কিন্তু তাকে তো দোকান থেকে বের হতে দেখে নি। পরক্ষণেই একটা ভাবনা আসতে নড়েচড়ে উঠলো।

মেয়েটা ওষুধের দোকানে ঢুকে ফোন করছে না তো!

কতোক্ষণ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পারছে না। আন্দাজ করলো পাঁচ মিনিটের বেশিই হবে । এতোক্ষণ তো লাগার কথা নয়। কাঁধের যে অবস্থা তাতে করে গাড়ি থেকে নেমে দোকানে ঢু মারবে সে উপায়ও নেই। মেয়েটা হয়তো বুঝতে পেরেছে এটা। এই সুযোগে কেটে পড়তে চাইছে। কিন্তু দোকান থেকে মেয়েটাকে বের হতে দেখে নি । পিস্তলটা কোমরে গুঁজে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সে।

বাম হাতটা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে যাচ্ছে, টের পেলো বাস্টার্ড। দৃষ্টিও মাঝেমাঝে ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ। মেয়েটা তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছে।

রাস্তাটা পার হতে বেগ পেলো সে। পা দুটোও এখন টলতে শুরু করেছে । অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে । মেয়েটা যদি লোকজনকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে!

যে দোকানে মেয়েটা ঢুকেছে সেটা অনেক বড়, তবে সামনে থেকে নয়। লম্বায়। দোকানের সামনে যে প্যাসেজওয়েটা চলে গেছে সেটার বড়বড় পিলারগুলোর কারণে দোকানের ভেতরটা রাস্তার ওপার থেকে দেখা যায় নি। এখন দোকানের সামনে আসতেই দেখতে পেলো মেয়েটা ভেতরের শেষপ্রান্তে কাউন্টারের সামনে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটা হাত কানের কাছে!

দৃশ্যটা দেখেই রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো। যা ভেবেছিলো তাই । মেয়েটা ফোন করছে!

.

অধ্যায় ১১

লন্ডন থেকে দুদিন আগে এসেছে, এখনও অফিশিয়ালি জয়েন করে নি কিন্তু ক্রাইমসিনে চলে আসতে হয়েছে জেফরি বেগকে।

উত্তরার হোটেল পিং সিটিতে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে কিছুক্ষণ আগে । ঠিক করে বলতে গেলে রাত দশটার দিকে। খুনি হোটেল থেকে কৌশলে বেরিয়ে যেতেই পাশের রুমের গেস্টের সন্দেহ হয়। লোকটা সেনাবাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তা, ইঞ্জিনিয়ার কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলো। অকালে অবসর নিয়ে বিদেশে চলে যায় । আজই দেশে এসেছে সপরিবারে, ঢাকায় একদিন থেকে চলে যাবে গ্রামের বাড়িতে।

এই সাবেক মিলিটারি অফিসারই প্রথম টের পায় পাশের রুমে ভয়ানক কিছু হচ্ছে। খুনিকে দেখেছে সে। এক মেয়ে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ৩০৬ নাম্বারে চলে যায়, তারপর সোজা লিফটের কাছে। কর্নেল সাহেব আর দেরি করে নি, সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজারকে জানিয়ে দেয় ৩০৩-এ কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু ম্যানেজার নীচের পার্কিংএরিয়ায় খবরটা দেয়ার আগেই খুনি সটকে পড়ে।

কর্নেল সাহেব পুলিশকে জানিয়েছে ম্যানেজার লোকটা নাকি পুলিশ ডাকতে চায় নি। খুনের ঘটনা গোপন করতে চেয়েছিলো। তার নিজের হোটেলের একজন গেস্ট খুন হলো অথচ লোকটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছিলো।

খুবই সন্দেহজনক ।

কর্নেলের চাপাচাপিতেই বাধ্য হয়ে পুলিশ ডেকেছে ম্যানেজার। পুলিশ কর্নেল সাহেবের কথায় বিশ্বাস করে হোটেল ম্যানেজারকে তাৎক্ষণিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়েছে লোকটার আচরণ আসলেই সন্দেহজনক । হোটেলের রেজিস্ট্রি’তে ৩০৩ নাম্বার রুমে কোনো গেস্ট আছে বলে উল্লেখ নেই। আজব। নিহতের সম্পর্কে কোনো কিছুই পুলিশ জানতে পারে নি সেজন্যে। এই একটা অপরাধেই ম্যানেজারকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়। নিজেকে বাঁচানোর জন্য ম্যানেজার যা বলেছে তার সবই গেছে তার বিরুদ্ধে।

মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে উঠেছে, নামটাম লেখার সময় পায় নি! একটু পরেই সব ফর্মালিটিজ সেরে ফেলতো।

আচ্ছা! পুলিশকে এতো বোকা ভাবে লোকটা!

নিহতের সাথে এক মেয়ে ছিলো, সে কে?

না। কোনো মেয়ে ছিলো না।

বেচারা পুলিশের সামনে একেবারে নাকাল হয়ে যায় যখন তার কর্মচারিরা জানায় নিহতের সাথে সত্যি এক মেয়ে ছিলো।

এতো উল্টাপাল্টা কথা বলার পর তাকে সন্দেহের বাইরে রাখার কি কোনো উপায় থাকে? উত্তরার থানার পুলিশ লোকটাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।

সব কিছু বিবেচনা করে পুলিশ মনে করেছে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টকে ডেকে পাঠানো দরকার। তারা সন্দেহ করছে এটার পেছনে আন্তর্জাতিক স্মাগলিং চক্রের হাত থাকতে পারে; এয়ারপোর্টের কাছে একটি হোটেলে খুন, ক্রাইম সিনেও অনেক আলামত আছে, সুতরাং তারা আর দেরি করে নি।

এখানে এসেছে দশ-পনেরো মিনিটের বেশি হবে না, এখন রুম নাম্বার ৩০৩-এ দাঁড়িয়ে আছে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। তার সামনেই, বিছানার পাশে বাথরুমের দরজার কাছে মুখ থুবরে পড়ে আছে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের এক যুবক।

লোকটার বাম পায়ে একটা গুলি করা হয়েছে, আর পেছন থেকে ধারালো কিছু দিয়ে বীভৎসভাবে স্টেইব করার আলামত স্পষ্ট চোখে পড়ছে। সম্ভবত মৃত্যু হয়েছে সেই আঘাতেই। তবে অবাক করার ব্যাপার হলো, হোটেলের সবাই বলছে তারা কোনো গুলির শব্দ শোনে নি। ম্যানেজার কিংবা কর্মচারিরা না হয় মিথ্যে বলতে পারে কিন্তু আশেপাশের রুমগুলোর গেস্টরাও এ কথা বলেছে পুলিশকে, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সাহেব, যে কিনা পুরো ঘটনা ভালোভাবে ফলো করেছে। লোকটা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলো, গোলাগুলির ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা আছে। জোর দিয়ে বলেছে কোনো রকম গুলির শব্দ হয় নি, শুধু ধস্তাধস্তি আর ভাঙচুরের শব্দ ছাড়া। জেফরি এখানে আসার আগে উত্তরা থানার পুলিশ এই তথ্যগুলো জানতে পেরেছে।

জেফরির কাছে একটু খটকা লাগলো।

খুনির কাছে অত্যাধুনিক পিস্তল ছিলো সেটা নিশ্চিত-সম্ভবত সাইলেন্সর লাগানো-তাহলে চাকু দিয়ে বীভৎসভাবে হত্যা করার দরকার পড়লো কেন? ঘরের ভেতর কমপক্ষে সাতটি গুলির স্পট পাওয়া গেছে এখন পর্যন্ত । বোঝাই যাচ্ছে নিহত ব্যক্তির সাথে খুনির ধস্তাধস্তি হয়েছে। নিহতের পায়ে একটিসহ মোট আটটি গুলি হলো অথচ কেউ তার আওয়াজ শুনতে পেলো না?

পিস্তলের গুলি ফুরিয়ে গেছিলো? হতে পারে।

মোট ৮টি গুলির সবগুলোর খোসাই ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে। এভিডেন্স হিসেবে জব্দ করা হয়েছে সেগুলো। জেফরির জন্যে একটা সুযোগ এসে গেছে বলা যায়। এই গুলির খোসা থেকেই সে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে সম্ভাব্য ঘাতককে।

ব্যাপারটা কদিন আগেও অসম্ভব মনে হতো, তবে এখন শুধু সম্ভবই নয়, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো বিশ্বনন্দিত সংস্থাও স্বীকৃতি দিয়েছে। দ্রুত এই পদ্ধতিটা সারা বিশ্বের পুলিশ এবং তদন্তকারী সংস্থার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে, সেই সাথে তার নাম!

হ্যাঁ। তার নাম-জেফরি। অবশ্য কাজটার কৃতিত্ব তার একার নয়। আরেকজন অংশীদার আছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর সুলিভান অ্যাবারডিন বেক।

গত বছর নেট-চ্যাটিংয়ে জেফরি বেগ একটা ধারণা শেয়ার করেছিলো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এই ইন্সপেক্টরের সাথে । ব্যাপারটা একেবারেই টেকনিক্যাল । বিভিন্ন ধরণের খুন খারাবির ঘটনায় পুলিশ গুলির খোসা উদ্ধার করে থাকে। এইসব গুলির খোসা আদালতে প্রমাণ হিসেবে জব্দ করা হয়ে আসছে দীর্ঘকাল থেকে। কিন্তু এ থেকে যে অসাধারণ একটি জিনিস পাওয়া যেতে পারে সেটা জেফরির আগে কেউ বুঝতে পারে নি।

গুলির খোসাগুলো থেকে আরো বাড়তি কিছু তথ্য বের করার একটি পদ্ধতি বের করেছে হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ।

জনপ্রিয় লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে সে বাস্টার্ড নামের এক ভয়ঙ্কর আর স্মার্ট খুনির খোঁজ পায়। নিখুঁতভাবে, কোনো প্রমাণ না রেখে কাজ করে সেই খুনি । জেফরি তার কর্মজীবনে এরকম ঠাণ্ডা মাথার খুনি এর আগে আর দেখে নি। তো জায়েদ রেহমানের কেসটা তার নিজের জন্যে একটা ব্যর্থতা ছিলো, কারণ শেষ পর্যন্ত সে প্রমাণ করতে পারে নি খুনটা বাস্টার্ড করেছে, আর এই খুনের জন্যে খুনিকে নিযুক্ত করেছিলো বিশিষ্ট শিল্পপতি সি ই এ সিদ্দিকী।

জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে তার সফলতা বলতে সে উদঘাটন করতে পেরেছিলো খুনটা কে করিয়েছে, কাকে দিয়ে করিয়েছে এবং কেন করিয়েছে। আর ব্যর্থতা বলতে দোষী কাউকেই সে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করতে পারে নি। বাস্টার্ড নামের খুনি তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলে ব্যাপারটা তার ব্যক্তিগত অনুশোচনায় পরিণত হয়। তবে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয় সে।

কিছু দিন পর হুট করেই একটা বিষয় তার মাথায় আসে : তার নিজের ঘরে খুনির সাথে যখন তার ধস্তাধস্তি হয় তখন খুনির পিস্তল থেকে একটা গুলি বের হয়েছিলো। সেই গুলির খোসা এভিডেন্স হিসেবে সংরক্ষিত আছে তার ডিপার্টমেন্টে। সেই গুলির খোসা, মানে বুলেটের খোসাটায় কি খুনির আঙুলের ছাপ আছে না? আছে তো!

সাধারণত অস্ত্রধারী ব্যক্তি নিজের হাতেই পিস্তল-রিভলবারে গুলি ভরে থাকে-শতকরা হিসেবে প্রায় নিরানব্বই শতাংশ। গুলি হবার পর গুলির খোসা অস্ত্র থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে। সেই বুলেটের খোসায় অস্ত্রধারী লোকের আঙুলের ছাপ থেকে যায়।

যেহেতু গুলি ভরার ক্ষেত্রে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ব্যবহার হয়ে থাকে সে কারণে গুলির খোসার গায়ে আঙুলের ছাপ থাকবেই।

ব্যস, কাজে নেমে পড়ে জেফরি বেগ। ফিঙ্গারপ্রিন্ট টিমের সাহায্যে এরকম একটি গুলির খোসা থেকে আঙুলের ছাপ বের করার চেষ্টা করতে থাকে সে। কিন্তু কাজটা খুব সহজ নয়, তারপরও চেষ্টা করতে থাকে। এমন সময় ইন্টারনেটে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর বেকের সাথে এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করার পর সেও আগ্রহী হয়ে ওঠে। শুরু হয় বিশ্বের দু’প্রান্তে দু’জন মানুষের প্রচেষ্টা। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ইন্সপেক্টর বেক এমন একটি কেমিক্যাল বানাতে সক্ষম হয় যার সাহায্যে বুলেটের খোসা থেকে আঙুলের ছাপ বের করা সম্ভব হয়। বেক এটাকে আরো একধাপ উন্নত করে, ফলে দশ বছরের পুরনো বুলেটের খোসা থেকেও আঙুলের ছাপ পুণরুদ্ধার করা সম্ভব হয়।

এরফলে এখন অনেক পুরনো আর অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নতুন করে করা সম্ভব। ব্যাপারটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড অবহিত হলে তারা আর দেরি করে নি। জেফরি বেগ এবং ইন্সপেক্টর সুলিভান বেককে বিশেষ সম্মাননা দবার সিদ্ধান্ত নেয়। গুলির খোসা থেকে ক্রিমিনালের আঙুলের ছাপ বের করার এই পদ্ধতির নামকরণ করেছে তারা জেফরি-বেক’ টেকনিক। সেই আমন্ত্রণেই জেফরি চলে যায় লন্ডনে। লেখক জায়দে রেহমানের কেসে নিজের যে ব্যর্থতা সেটা যেনো অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছে নতুন এই সাফল্য।

খুব সামান্য একটা ব্যাপার : গুলির খোসা। কিন্তু সেটাতে কতো দরকারি তথ্যই না লুকিয়ে থাকে!

তার কাছে এখন মনে হচ্ছে জেফরি-বেক টেকনিকটা প্রয়োগ করার উপযুক্ত কেস এটি। গুলির খোসাগুলো থেকে প্রিন্ট নেবার ব্যবস্থা করতে হবে। একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো : পিং সিটি হোটেল থেকে পাওয়া বুলেটের কয়েকটি খোসা পাঠিয়ে দেবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সুলিভান বেকের কাছে।

এখন পর্যন্ত জেফরি যেতোটুকু জানতে পেরেছে, ৩০৬ নাম্বার রুমের যে গেস্টকে তারা, সম্ভাব্য খুনি হিসেবে মনে করছে সে অনেক ধূর্ত। ভুয়া নামে হোটেলে উঠেছিলো। তার জাতীয়-পরিচয়পত্রের যে নম্বার রেজিস্ট্রি করা হয়েছে সেটা ডাটাব্যাঙ্কের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়েছে-ভুয়া।

লোকটা সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া গেছে সেটাও কোনো কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে কর্নেল সাহেব যদি সময় দেয় তাহলে প্রফেশনাল আর্টিস্ট দিয়ে খুনির একটা স্কেচ তৈরি করা যেতে পারে।

কেসটা আসলেই প্রহেলিকাময়। শিকার এবং শিকারী, উভয়ের পরিচয়ই অজ্ঞাত। এখন দুজনের পরিচয়ই বের করতে হবে। কাজটা দ্বিগুণ কঠিন হয়ে যাবে তাদের জন্য। তবে ম্যানেজারকে রিমান্ডে নিলে নিহতের পরিচয় জানা যেতে পারে।

আরেকটা ব্যাপার, সম্ভাব্য খুনি নাকি গাড়িতে করে হোটেল থেকে বের হয়ে গেছে, আর সেই গাড়িটা নিহতের-লাল রঙের একটি টয়োটা প্রিন্টার । নাম্বারপ্লেটে ঢাকা-ঘ লেখা ছিলো। এর বেশি বর্ণনা দিতে পারে নি পার্কিং এরিয়ার দাড়োয়ান। সংখ্যাগুলো মনে থাকার কথাও নয়।

যাইহোক, এখন থেকে এ শহরের প্রত্যেকটি লাল রঙের টয়োটা গাড়িই সন্দেহের তালিকায় চলে এসেছে। ট্রাফিক আর টহল পুলিশকে এরইমধ্যে বলে দেয়া হয়েছে। খুব বেশি সময় এখনও পার হয় নি, খুনি হয়তো পথেই কোথাও আছে। কথাটা জানার পর পরই জেফরি তার সহকারী জামানকে দিয়ে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে এটা জানিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে বলে দেয়া হয়, ত্রিশ বছরের কোনো যুবক আর বিশ-বাইশ বছরের কোনো যুবতী গাড়িতে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে যেনো গ্রেফতার করা হয়।

এখানে আর তার কোনো কাজ নেই। মোবাইল এভিডেন্স ভ্যানটা চলে এসেছে, নীচের পাকিং এরিয়ায় রয়েছে সেটা। জেফরি বেগ সেখানে চলে গেলো।

সাবের কামাল বুলেটের খোসাগুলো নিয়ে এরইমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। জেফরিকে ভ্যানে ঢুকতে দেখে চওড়া একটা হাসি দিলো।

“কি অবস্থা?” জানতে চাইলো জেফরি।

“নিহতের আঙুলের ছাপ থেকে প্রিন্ট নিয়েছি, কম্পিউটার আর যন্ত্রপাতিতে ঠাসা একটি ডেস্কে বসে আছে সে।

জেফরি মাথা নেড়ে সায় দিলো।

সাবের কামালের চোখ কম্পিউটার মনিটরে। ইতিমধ্যে প্রিন্টটা স্ক্যান করে ফেলেছে সে। সাবের কামালের পাশে একটা ছোট্ট টুলে বসলো জেফরি।

“এখন কি ম্যাচিং করবে?”

“হুম।”

“স্যার?” জামান ভ্যানের ভোলা দরজার কাছে এসে বললে জেফরি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

“আমরা কি এখন অফিসে ফিরে যাবো?”

“হ্যাঁ।”

জামান চুপচাপ ভ্যানে উঠে এক কোণের একটি কম্পিউটারের সামনে বসে গেলে তাদের ভ্যানটা চলতে শুরু করলো।

সাবের কামাল পেছন ফিরে জামানের উদ্দেশ্যে বললো, “জামান, আপনি ভিকটিমের আঙুলের প্রিন্টটা ডাটা ব্যাঙ্কে খুঁজে দেখেন, আপনার ড্রাইভে দিয়ে দিয়েছি ওটা।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জামান কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ।

তাদের ডাটা ব্যাঙ্কের সার্চ ইঞ্জিনটা আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে কাজ করে এখন। আগে যেখানে কোটি কোটি ফাইল থেকে ম্যাচিং বের করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগতো এখন সেখানে অনেক কম সময় লাগে। তার কারণ তাদের সার্চ-মেথড আপগ্রেড করা হয়েছে। ইংরেজি ছাব্বিশটি বর্ণমালায় বিভক্ত হয়ে একই সাথে ছাব্বিশটি ট্র্যাকে সার্চ প্রসেস কাজ করে। এই হিসেবে তাদের সময় ছাব্বিশ গুন কমে গেছে।

জেফরি বুলেটের খোসা থেকে কী পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে উদগ্রীব হয়ে আছে। কারণ বিদেশের মাটিতে তার উদ্ভাবিত পদ্ধতিটা স্বীকৃতি পেলেও দেশে এখনও কোনো রকম মূল্যায়ণ পায় নি। বরং ডিপার্টমেন্টের হিংসুটে কলিগেরা বাঁকা চোখে দেখছে ব্যাপারটা। ওদের কাছে তার পদ্ধতিটার কার্যকারিতার প্রমাণ করার দরকার আছে।

“ন্যারো ডাউনের অপশনগুলো কি হবে, স্যার?” জানতে চাইলে জামান।

“খুব বেশি অপশন নেই…শুধুমাত্র পুরুষ, আর বয়স চব্বিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে।”

ম্যাচিং হতে সময় লাগবে তাই চেয়ার ঘুরিয়ে জেফরির দিকে ফিরে বললো সাবের কামাল, “কফি খাবেন, স্যার?”

মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। তাদের এভিডেন্স ভ্যানে একটি পকোলেটর আছে-কফি মেশিন। জামান কফি খাবে না সুতরাং দু’কাপ কফি ঢালা হলো। তাদের ভ্যানটা চলছে। এখন শুধু অপেক্ষা।

“কেসটা কি আন্দাজ করতে পারছেন, স্যার?” সাবের কামালের প্রশ্নের জবাবে জেফরি মাথা দুলিয়ে জানালো এ ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই।

“আমার মনে হয় নারকোটিক্স কেস, কফিতে চুমুক দিয়ে সাবের কামাল বললো।

“হতে পারে।”

“এয়ারপোর্টের পাশে…এরকম হোটেলগুলোতেই বিভিন্ন ধরণের স্মাগলাররা উঠে থাকে।”

“গোল্ড স্মাগলারও তো হতে পারে?” বললো জেফরি বেগ।

একটু ভেবে সাবের কামাল বললো, “তা হতে পারে।”

“সঙ্গে একটা মেয়ে ছিলো…ঘটনাটা নারীসংক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও রয়েছে।”

“মেয়েটা নাকি ভিকটিমের সাথে ছিলো?” সাবের কামাল বললো।

“হুম।”

“কর্লগার্ল হবে। আমি নিশ্চিত।”

সাবের কামাল যে এরকম ভাববে সেটা জেফরি জানে। নারী সংক্রান্ত ব্যাপারে তার আগ্রহ অপরিসীম। কফিটা বিস্বাদ লাগছে সেজন্যে আর চুমুক দিচ্ছে না জেফরি । হোটেল ম্যানেজারকে ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, মনে মনে ভাবলো সে। লোকটাকে আসলেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। খুব বেশি রাত হওয়াতে আজ করে নি, আগামী কাল সকালেই সেটা করবে বলে ঠিক করলো । ততোক্ষণ পর্যন্ত বদমাশটা থানার গারদে মশার কামড় খেতে থাক।

“স্যার।”

পাশ থেকে জামানের কণ্ঠটা শোনা গেলো । সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলো তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

জেফরি বেগ তার দিকে ফিরলো । “কিছু পেয়েছো?”

কম্পিউটার মনিটরের দিকে ইঙ্গিত করলো জামান। মনিটরে এক লোকের ছবি দেখা যাচ্ছে। জেফরি দেখতে পেলো নিহত লোকটার ভোটার আইডি কার্ডের সমস্ত ডাটা মনিটরে ভেসে উঠেছে। তার নাম তাহলে মোঃ গিয়াস উদ্দিন,” মাথা দোলাতে দোলাতে বললো সে, “যাক, তাহলে তার পরিচয় বের করা গেছে। উত্তরা থানায় জানিয়ে দিও।”

জামান একটু হতাশ হলো। “স্যার?”

“হুম,” জেফরি বললো।

“একটা জিনিস খেয়াল করেন নি মনে হয়।”

জামানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো এক চিলতে হাসি দেখা যাচ্ছে। অধীনস্থরা যখন পদস্থ কর্মকর্তাদের সামনে নিজের বাহাদুরি দেখায়

তখন এক রকম আনন্দ পায় ।

“স্যার, এই ফাইলটা রেড-ক্যাটাগরির!”

“কি!”

.

অধ্যায় ১২

পেছন থেকে একটা হাত তার কাঁধে পড়তেই উমা চমকে উঠলো। ঘুরেই দেখতে পেলো অজ্ঞাত খুনি ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। যেনো এক্ষুণি খুন করে ফেলবে তাকে।

“কাকে ফোন করছো?” ঝাঁঝের সাথে জানতে চাইলো খুনি।

“আ-আমার…পি-পি-”

তোতলাতে তোতলাতে বলতে গিয়েছিলো মেয়েটা আর বলতে পারলো না। হাত থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে কাউন্টারের উপর রেখে দিলো খুনি। রাগে রীতিমতো কাঁপছে সে।

হাত ধরে টানতে টানতে দোকান থেকে বের করে আনলো মেয়েটাকে। পেছন থেকে দোকানি চেঁচিয়ে উঠলো, “আরে, টাকা না দিয়া কই যান, আপা?”

বাস্টার্ড একটু থেমে মেয়েটাকে টাকা দিয়ে দেবার জন্য ইশারা করলো। কাঁপা কাঁপা হাতে টাকা পরিশোধ করে কটন আর ব্যান্ডেজের প্যাকেটটা কোনোমতে হাতে নিয়ে নিলো মেয়েটি।

ওষুধের দোকানে তিনচারজন কর্মচারী আর দুয়েকজন কাস্টমার অবাক হয়ে দেখলো ক্ষুব্ধ এক যুবক রেগেমেগে এক মেয়েকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। কেউ মেয়েটার সাহায্যে এগিয়ে এলো না। তার কারণ সম্ভবত, মেয়েটা কোনো রকম সাহায্য চায় নি, কিংবা লোকটার চোখেমুখে যে হিংস্রতা ছিলো সেজন্যে।

মেয়েটা কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু খুনে দৃষ্টি হেনে মেয়েটাকে চুপ থাকতে বললো সে। ঝটপট গাড়িতে উঠেই আর দেরি করলো না। রাত অনেক হয়েছে, ফাঁকা হতে শুরু করেছে পথঘাট। হাইস্পিডে গাড়ি ছোটালো বাস্টার্ড।

মেয়েটা এমন ভড়কে গেছে যে বোবা হয়ে আছে। বাস্টার্ড চকিতে দেখে নিয়েছে, ভয়ে কাঁপছে সে। কী দুঃসাহস! চোখের সামনে দু’দুটো খুন হতে দেখেছে তারপরও তার সাথে এরকম কাজ করার সাহস পেলো!

একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। হাত ধুয়ে ফেলবে। জ্বলজ্যান্ত একটি সমস্যা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না। তার শরীরের যে অবস্থা

কিছুক্ষণ পর এই মেয়ে যদি তার সাথে আবারও উল্টাপাল্টা কিছু করে সে কিছুই করতে পারবে না।

লাল রঙের গাড়িটা দশ মিনিট পরই পৌঁছে গেলো নিরিবিলি একটা রাস্তায়। উমা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলো না জায়গাটা কোথায়। অজ্ঞাত খুনিকে যে জিজ্ঞেস করবে সে সাহসও হলো না। কেমন যেনো লাগছে তার। গা ছমছম করছে। এক অজানা ভয় জেঁকে বসেছে তার মধ্যে।

আস্তে করে গাড়ির গতি কমে এলো। রাস্তা থেকে একটু সরে গাড়িটা থামলো একটা লেকের পাশে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাস্টার্ড আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সুনসান। সে জানে রাতের এ সময়ে এই জায়গাটা এমনই থাকার কথা।

“গাড়ি থেকে নামো,” মেয়েটাকে বললো সে।

অবাক হয়ে চেয়ে রইলো উমা। এখানে?”

“হ্যাঁ।” কথাটা বলেই সে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে।

একটু ইতস্তত করে মেয়েটাও গাড়ি থেকে নামলো। তার চোখেমুখে অজ্ঞাত ভীতি। চোখ দুটো ছলছল করছে। তবে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। বলার সাহস পাচ্ছে না হয়তো। সে খেয়াল করেছে লোকটা তার পিস্তল হাতে নিয়ে বের হয়েছে।

শার্টের ভেতরে যে ব্যান্ডেজটা আছে সেটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে তার ক্ষতস্থান দিয়ে এখনও রক্ত পড়ছে। শরীরটা দূর্বল হয়ে গেছে। মাথা ভনভন করছে এখন। আর বেশি দেরি করা যাবে না।

কয়েক গজ দূরে লেকের পাড়ে একটা গাছের নীচে নিয়ে গেলো মেয়েটাকে। একটু দূরে ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম বাতির রহস্যময় হলুদাভ আলোয় মেয়েটার চোখের জল দেখতে পেলো সে।

“আমাকে মারবেন না, ভগবানের দোহাই লাগে!” কাঁদো কাঁদো গলায় বললো উমা।

কোমর থেকে সাইলেন্সর পিস্তলুটা বের করে তাক করলো মেয়েটার কপাল বরাবর।

দুহাত জোর করে মেয়েটা কাঁদছে। আমার অসুস্থ বাবা-মা…তাদেরকে দেখার কেউ নেই। আমাকে প্রাণে মারবেন না…আমি এই লাইনের মেয়ে না। আমি নিরুপায় হয়ে এ পথে এসেছি…বিশ্বাস করুন!”

বাস্টার্ড এসব কথা শুনতে চাচ্ছে না। আঙুল রাখলো ট্রিগারে।

মেয়েটা হাটু গেড়ে বসে পড়লো। এই প্রথম সে বুঝতে পারলো মেয়েটার চোখ দুটো বেশ মায়াবি। সেই চোখের দিকে চেয়ে রইলো বাস্টার্ড। তার মনের একটা অংশ বলছে ট্রিগার টিপে দিতে। নিতান্তই একটা বেশ্যা! খুন করো!

কিন্তু মনের অন্য একটা অংশ বলছে, মেয়েটা নিরীহ! অসহায় এক তরুণী! বিপদে পড়ে এ লাইনে এসেছে। তাকে মেরে তোমার কী লাভ?

এখনও দু’হাত জোর করে রেখেছে। দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে তার। রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেলে সেটার হেডলাইটের আলোয় মেয়েটার চোখের জল যেনো চিকচিক করে উঠলো। ক্ষণিকের জন্যে তার মুখটা এমনভাবে উদ্ভাসিত হলো যে কেঁপে উঠলো বাস্টার্ডের বুক।

তার চোখের দিকে তাকিও না!

ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। বাম হাত দিয়ে চেপে ধরলো কপালটা। চিনচিন করে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। তার মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তার মাও কি এই তরুণীর মতো অসহায় ছিলো?

এক সুতীব্র আবেগ তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেললো মুহূর্তে।

“আমি জানি না আপনি কে…আমাকে আপনি দয়া করেন…আমাকে এভাবে মারবেন না…” মেয়েটা কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে যাচ্ছে।

চুপ করো! এসব কথা বলবে না!

“আমি খুবই অসহায় একটি মেয়ে…!” দু’চোখ বেয়ে যেনো জলপ্রপাত

বইছে মেয়েটির । বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি জানাচ্ছে বার বার।

অসহায়!

না। ও একটা বেশ্যা ।

সেই ছোটোবেলা থেকে বেশ্যাদের ব্যাপারে তার মনে যে কোনো ঘৃণা নেই সে খবর হয়তো কেউ রাখে নি। বরং মনের গভীরে তাদের জন্য এক ধরণের মায়ামমতা কাজ করে।

আমার মাও কি বেশ্যা ছিলো না?

“না!” মুখটা আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করে বললো বাস্টার্ড । থরথর করে কাঁপছে সে। মুহূর্তের মধ্যে এক সুতীব্র আবেগ গ্রাস করে ফেললো তাকে।

দু’হাত জোর করে হাটু গেড়ে বসে থাকা উমা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলো তার দিকে। খুনি লোকটা কাঁদছে!

মা!

তার মায়ের মুখটা সে কখনও দেখে নি। কল্পনায় একটা মুখ সব সময় ভেবে থাকে। সেই মুখটা খুবই মায়াবি আর অসহায়, ঠিক এই মেয়েটার মতো!

“মা!” এবার উচ্চারণ করলেও কথাটা বলার সময় তার গলা ধরে এলো । তার গায়ের সমস্ত রোমকূপ শিহরিত হয়ে গেলো তীব্র এক আবেগে। টের পেলো পা দুটো টলে যাচ্ছে।

“মা!”

কিন্তু উমার কাছে প্রথমে মনে হলো সে বুঝি না বলেছে।

“মা!” কাঁপা কাঁপা গলায় আবারও বললো সে।

বিস্ময়ে চেয়ে রইলো উমা।

বাস্টার্ডের মনে হলো চারপাশটা দুলছে। এরকম অসাড় অনুভূতি এই জীবনে কখনও হয় নি। পিস্তলটা হাত থেকে পড়ে গেলো আলগোছে। ঘাসের জমিনটা সজোরে এসে তার মুখের উপর আঘাত হানলো।

তারপরই সব কিছু অন্ধকার।

.

অধ্যায় ১৩

এভিডেন্স ভ্যানটা এখনও পথে আছে। ভেতরে জেফরির সাথে আছে জামান আর সাবের কামাল। কিছুক্ষণ আগে নিহতের আঙুলের ছাপ ডাটাব্যাঙ্কে ম্যাচিং করতে দিলে যে ফলাফল পাওয়া গেছে সেটা তাদের সবাইকে বিস্মিত করেছে। এই কেসটা যে আরো বেশি মনোযোগের দাবি রাখে সে ব্যাপারে কারো মনে সন্দেহ নেই।

“গিয়াস শীর্ষ সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী!…লেডি গিয়াস নামেই বেশি পরিচিত সে।”

“লেডি গিয়াস,” জামানের কথাটা শুনে আপন মনে বললো জেফরি। ব্ল্যাক রঞ্জুর সন্ত্রাসী কাজকর্মের ব্যাপারে অন্যান্য আইনশৃঙখলা-বাহিনীর মতো হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টও অবগত আছে। অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই প্রথম ব্ল্যাক রঞ্জুর দল সম্পর্কিত কোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব তারা পেলো। আর অবাক করার মতো ব্যাপার হলো সেটা ব্ল্যাক রঞ্জুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ লোকের হত্যাকাণ্ড, তাদের হাতে কারো খুনের নয়।

“স্যার, আমাদের কাছে যে আপডেট আছে তাতে দেখা যাচ্ছে গত দেড় বছর ধরে ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে কোলকাতায় বসবাস করে আসছে লেডি গিয়াস, কম্পিউটারের ক্রিমিনাল ডাটা ব্যাঙ্ক থেকে লেডি গিয়াসের ফাইল বের করে বললো জামান।

“তার মানে দেশে এসেছে বেশি দিন হয় নি?” জেফরি বললো।

“জি, স্যার। এই লেডি গিয়াস এক সময় নাটকা গেসু নামে পরিচিত ছিলো। এটা প্রথম দিককার কথা। খুবই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। অতিরিক্ত নারী লোলুপতার কারণে লেডি গিয়াস নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এটা তার দলের লোকেরাই দিয়েছে। ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে কোলকাতায় থাকে সে। ঢাকায় খুব একটা আসেতো না।”

“এর সম্পর্কে তো দেখি ভালোই তথ্য আছে আমাদের কাছে,” বললো জেফরি।

জামানের ফোনটা বেজে উঠলো এমন সময়।

“হ্যালো…ইনভেস্টিগেটর জামান বলছি…হুম…কোথায়?…আচ্ছা…ঠিক আছে…একটু হোল্ড করেন।”

জেফরি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার সহকারী জামানের দিকে।

“স্যার, ধানমণ্ডির লেকের কাছে পাকিং করা অবস্থায় লাল রঙের একটি টয়োটা গাড়িকে টহল পুলিশ লোকেট করতে পেরেছে! এইমাত্র কন্ট্রোলরুমে টহলদল জানিয়েছে সেটা।”

“এখন কি অবস্থা?”

“তারা ব্যাকআপ টিমের অপেক্ষায় আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো গ্রেফতার করা যাবে।”

জেফরি বেগের সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে গেলো। এখানে এসে লাল রঙের গাড়ির বর্ণনা দিয়ে সবখানে অ্যালার্ট করে দেয়ার সময়ও তার মনে হয়েছিলো এতে করে কাজ হতে পারে । “গুড!” তার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো।

.

চোখ খুলে দেখতে পেলো এক নারীর কোলে মাথা রেখে শুইয়ে আছে সে। পরম মমতায় সেই নারী তার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। মায়াবী মুখের সেই নারী এক দৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। তবে কিছু বলছে না।

স্বপ্ন!

মাকে স্বপ্নে দেখছে । এরকম একটা স্বপ্ন ছোটোবেলায় প্রায়ই দেখতো। যে ঘরে তারা থাকতো তার ঠিক পাশের ঘরটাতেই এক অল্পবয়সী মা নিজের সন্তানকে কোলে করে এভাবে আদর করতো। এই দৃশ্যটা দেখার পর থেকেই স্বপ্নটা দেখতে শুরু করে সে। তার আগে মা সম্পর্কিত যাবতীয় আবেগ সুপ্ত অবস্থায় ছিলো।

“মা” অস্ফুট স্বরে বললো বাস্টার্ড ।

মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে গেলো তার তরুণী মা।

“এখন কেমন লাগছে?” তার মায়ের গলা কতোই না মিষ্টি।

“ভালো।”

আবারো কপালে হাতের পরশ পেলো। হাতটা ভীষণ ঠাণ্ডা। তার কপাল স্পর্শ করতেই ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে।

“আপনার এখন কেমন লাগছে?” মিষ্টি কণ্ঠটা জানতে চাইলো।

বাস্টার্ড চোখ খুলে দেখলো আবার। একটা মায়াবি মুখ । কিন্তু এটা তার মায়ের মুখ নয়। তবে এখনও তার কপালে হাতের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। আবার চোখ বুজে ফেললো। চোখ খোলা থাকলে স্বপ্নটা যদি চলে যায়! কী শান্তি সে পাচ্ছে বোঝাতে পারবে না কাউকে। মনে হচ্ছে স্বর্গের বিছানায় ঘুমাচ্ছে। শান্তি মানে ঘুম। ঘুম মানে শান্তি!

সে ঘুমাতে চায়। তার মায়ের কোলে মাথা রেখে এভাবে ঘুমাতে চায় একশ’ বছর!

ঠিক কততক্ষণ এভাবে শুয়েছিলো বলতে পারবে না। প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো তার। জেগে উঠেই দেখতে পেলো এক জোড়া ভয়ার্ত চোখ তার দিকে চেয়ে আছে। তাকে দুহাতে ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে।

এটা কি স্বপ্ন?

মুখটা চেনা চেনা লাগছে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। সেই চোখে ক্লান্তি আর আতঙ্ক। রাস্তা থেকে একটা গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ আর লোকজনের কথাবাতা কানে যাচ্ছে তার।

বাস্টার্ড চেয়ে দেখলো কতোগুলো অল্পবয়সী ছেলে।

উমা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তাকে ঘিরে থাকা কয়েকজন যুবকের দিকে। প্রত্যেকেই হালফ্যাশনের জামাকাপড় পরা। কারো কারো কানে রিং আছে। একজনের হাতে টাটু আঁকা। আরেকজন এই রাতের বেলায়ও সানগ্লাস পরে আছে। মোট চারজন।

“ওয়াও!” কানে দুল বললো।

“হেই ইউ, ফাঁকার! এখানে কী করছিস?” তুরি বাজিয়ে টাটু আঁকা ছেলেটা তাদের দু’জনকে বললো।

উমা ভয়ে কিছু বলতে পারলো না।

“আপ আপ! কোলে মাথা রেখে দুদু খাচ্ছিস!” দলের মধ্যে সবচাইতে বেটে যে সে বললো পেছন থেকে ঠেলেঠুলে সামনে এসে।

দ্রুত ধাতস্থ হয়ে গেলো বাস্টার্ড। পিস্তলটা? আমার পিস্তলটা কোথায়? উমা আর সে উঠে দাঁড়ালে লম্বা মোন এক পাঙ্ক বাস্টার্ডের কলার টেনে ধরলো। তার মুখ থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ আসছে।

“ওই! ঘটনা কি?”

কিছু বললো না সে।

লাল রঙের গাড়িটার দিকে তাকালো লম্বু। “তোর গাড়িটা তো হেব্বি!”

ফোঁস করে একটা শব্দ হলে উমা আর বাস্টার্ড চমকে উঠলো একসঙ্গে।

বেটে মতো ছেলেটা অ্যারোসলের একটা ক্যান হাতে নিয়ে লাল গাড়িটার গায়ে স্প্রে করে কী যেনো লিখে দিলো।

এম.এস ১৩!

উফ! বাস্টার্ড বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। কুখ্যাত এমএস ১৩-এর কবলে পড়েছে। এরা অভিজাত এলাকার ধনীর দুলাল। হাইব্রিড মাল! নিজেদেরকে এমএস ১৩ নামে অভিহিত করে। তাদের মতো আরো কিছু কুলাঙ্গার আছে। একটু লক্ষ্য করলেই ধানমণ্ডি-লালমাটিয়ার বিভিন্ন বাড়ি-ঘরের দেয়ালে এম.এস ১৩, বি বয়েজ, ৯ এম.এম, ইত্যাদি লেখা দেখা যাবে। এইসব দল স্প্রে করে এটা লিখে রাখে। নিজেদের জানান দেয় আর কি। কিছু দিন আগে পত্রিকায় তাদের নিয়ে লেখালেখি হয়েছিলো। কেউ কেউ এদেরকে গ্যাংস্টার হিসেবে চিহ্নিত করলেও অনেকেই মনে করে এরা আসলে বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলেপেলে। নিতান্তই অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে এরকমভাবে নিজেদেরকে জাহির করে।

তবে বাস্টার্ড জানে এ দুটোর কোনোটাই পুরোপুরি সত্য নয়।

এদের মধ্যে কোনো কোনো দল কিংবা কিছু কিছু সদস্য ভয়ঙ্কর কাজকারবারের সাথেও জড়িত। দামি দামি গাড়ি চুরি করা এদের অন্যতম শখ। এগুলো পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে আমেরিকান শহরগুলোর স্ট্রিট গ্যাং এর কেরিকেচার ছাড়া আর কিছু না। তবে ধীরে ধীরে এরা বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এদের প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। এমন কি ইয়াবাসহ অনেক মাদক ব্যবসাও এরা করে থাকে। ঘনঘন ডি.জে পার্টির অ্যারেঞ্জ করা এদের অন্যতম কাজ।

বানচোতের দল! মনে মনে বললো বাস্টার্ড। কাঁধে গুলি লাগার কথা বেমালুম ভুলে গেলো। ভালো করে চেয়ে দেখলো মোেট চারজন। একজন একেবারে বেটে, শারিরীকভাবে কোনো হুমকি হতে পারবে না সে। অন্য একজন মনে হচ্ছে নেশাগ্রস্ত। বাকি থাকে দু’জন। একজন বাস্টার্ডের চেয়েও এক-দু ইঞ্চি লম্বা হবে। অন্যজন তার চেয়ে কিছুটা খাটো। কি করবে ভেবে নিলো সে। ঠিক এ সময় চারজনের মধ্যে একজন এমন একটা কাজ করলো যাকে বলা যেতে পারে বারুদে আগুন দেয়া!

“ওই খানকির পোলা! মাগি নিয়া ফুর্তি করছিস?” লম্বা মতো ছেলেটা আবারো বাস্টার্ডের কলার ধরে বললো ।

টাট্টূ আঁকা ছেলেটা উমাকে জড়িয়ে ধরলে চিৎকার দিতে শুরু করলো। ভয়ার্ত মেয়েটি।

“ওকে ছেড়ে দাও,” একেবারে শান্ত কণ্ঠে বললো বাস্টার্ড।

“ছেড়ে দেবো!” বাস্টার্ডের কলারটা হ্যাঁচকা টান মেরে বললল লম্বু । “তোর খুব খারাপ লাগছে?” কথাটা বলে সঙ্গিদের দিকে তাকালো সে। তারা সবাই হেসে ফেললো । বিদ্রুপের হাসি।

বেটে ছেলেটা চোখমুখ খিঁচিয়ে বললো, “আমরা সবাই তোর সামনে এই খানকিটাকে রেইপ করবো…তুই চেয়ে চেয়ে দেখবি । বুঝলি, মাদারফাঁকার!”

বাস্টার্ড দেখতে পেলো টাটু আঁকা ছেলেটার হাত থেকে ছোটার জন্য মেয়েটা হাসফাস করছে। লম্বুটা তার গালে কামড় বসাতে উদ্যত।

তার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো মুহূর্তে। ভেতরে ঘুমন্ত কোনো দানব যেনো জেগে উঠলো, শুরু করে দিলো তাণ্ডব।

এক ঝটকায় ডান হাতের তালু দিয়ে লম্বুর নাকে এমনভাবে আঘাত করলো যে ছেলেটা মুহূর্তে ছিটকে পড়ে গেলো, আর উঠতে পারলো না। এই আঘাতটা সে করেছে থুতনীর নীচ থেকে নাকের ফুটো লক্ষ্য করে। কমব্যাট ফাইটিংয়ের সবচাইতে ভয়ঙ্কর স্ট্রাইক। তার নাক কেঁটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। এই ছেলে পাঁচ মিনিটের আগে আর উঠতে পারবে না।

সঙ্গে সঙ্গে টাটু আঁকা ছেলেটি মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তেড়ে আসতেই বাস্টার্ড ডান পা দিয়ে তার জননেন্দ্রিয় বরাবর সজোরে লাথি মেরে বসলো ।

নাক আর বিচি! ছেলেদের সবচাইতে নাজুক জায়গা।

স্বতঃফুর্ত প্রতিক্রিয়ায় মুহূর্তেই বাম পায়ের বুটের খাপ থেকে হান্টার নাইফটা হাতে নিয়েই এগিয়ে গেলো কানে রিং পরা ছেলেটার দিকে। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে নিজের ধরাশায়ী দুই সঙ্গিকে চকিতে দেখেই উল্টো দিকে দৌড় শুরু করলো পাঙ্কটা।

স্প্রে হাতে বাট্ট ছেলেটা হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। বেচারার দু’পা যেনো আঠার সাথে লেগে আছে। বাস্টার্ড ভালো করে চেয়ে দেখলো, ছেলেটা রীতিমতো কাঁপছে এখন। এই সাহস নিয়ে অভিজাত এলাকায় মাস্তানি করা যায় বাস্টার্ডের মতো কারোর মোকাবেলা করা যায় না।

লম্বুটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে এখনও, তবে নিজের বিচি দু’হাতে ধরে হাটু গেড়ে বসে আছে টাটু আঁকা ছেলেটা। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে, জোরে জোরে কোত দিচ্ছে! মুখ দিয়ে শুধু ‘আহ্ করে শব্দ বের হচ্ছে ক্রমাগত।

বেটেটার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো চলে যাবার জন্য। বেচারা যেনো ধরে প্রাণ ফিরে পেলো । স্প্রে ক্যানটা ফেলে মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেলো সে। রইলো বাকি দুই । দুজনেই আপাতত কাবু। এদেরকে নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

হঠাৎ ডান পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো উমার পায়ের কাছে তার পিস্তলটা পড়ে আছে। পিস্তলটা তুলে নিয়ে উমাকেসহ গাড়িতে উঠে বসলো।

“তোমাকে তোমার বাড়িতে নামিয়ে দেবো, চিন্তা কোরো না।”

উমা কিছু বলতে যাবে অমনি তীব্র আলোয় দু’চোখ কুচকে এলো। কিছুই বুঝতে পারলো না। দু’হাতে চোখ ঢেকে বাস্টার্ডের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো তার চোখেমুখে বিস্ময়। ঠিক করে বলতে গেলে ভড়কে যাওয়া বিস্ময়!

“শিট!” অস্ফুটভাবে বাস্টার্ডের মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো কথাটা।

.

অধ্যায় ১৪

ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার সুযোগ পায় নি তার আগেই টহল পুলিশের জিপটা তার গাড়ির সামনে এসে আচমকা ব্রেক করলো। হেডলাইটের তীব্র আলোয় কিছুক্ষণের জন্যে চোখ ঝলসে গেলো তার। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে সটকে পড়ার মতো কোনো উপায় রইলো না। টহল জিপটা প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সামনে।

সাইলেন্সার পিস্তলটা তুলে নিলো হাতে। উমা আতঙ্ক ভরা চোখে একবার তার দিকে আরেকবার সামনের দিকে তাকালো।

বাস্টার্ড অবাক হয়ে দেখলো জিপ থেকে দু’জন কনস্টেবল নেমেই রাইফেল উঁচিয়ে রেখেছে তাদের দিকে তবে কেউই সামনে এগিয়ে আসছে না। একটু পর আরো দু’জন কনস্টেবল জিপ থেকে নেমে যোগ দিলো তাদের সাথে। তারপরই জিপের সামনে থেকে একজন অফিসার নেমে এলো।

“উল্টাপাল্টা কিছু করলেই গুলি করা হবে,” অফিসার চিৎকার করে দৃঢ়ভাবে বললো। “গাড়ি থেকে নেমে আসো…একজন একজন করে…”

এবার ওয়াকিটকিতে কথা বলছে সেই অফিসার। তার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে বাস্টার্ড। তাদেরকে যে আঁটক করা হচ্ছে সে কথা জানিয়ে দিচ্ছে। কন্ট্রোলরুমকে। আরো ব্যাকআপ চাইছে সে।

হঠাৎ বাস্টার্ড দেখতে পেলো তার সামনে অস্ত্র তাক করে থাকা পুলিশগুলো তার গাড়ির পেছনে তাকাচ্ছে বিস্ময় নিয়ে। পেছনে তাকাতেই বুঝতে পারলো বাস্টার্ড।

তার গড়ির পেছন থেকে টাটু আঁকা ছেলেটা নিজের বিচি ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলো লম্বুটাও। নাক চেপে ধরে সেও উঠে দাঁড়ালো। তারা কেউই বুঝতে পারছে না। পুলিশ দেখে তারাও ভড়কে গেছে।

অফিসার চিৎকার করে বললো, “হল্ট! হাত তুলো!”

লম্বুটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো পুলিশের দিকে। এদিকে পুলিশও কিছু বুঝতে পারছে না। এরা কারা?

অফিসার আবার বললো, “তোমরা দুজন হাত তুলে হাটু গেঁড়ে বসো!”

লম্বুটা দু’হাত উপরে তুললো ঠিকই কিন্তু আচমকা বাম দিক দিয়ে দৌড়ে পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো, আর টাটু আঁকা ছেলেটা নিজের সঙ্গিকে অনুসরণ করতে এক সেকেন্ডও দেরি করলো না। ডান দিক দিয়ে সেও দৌড় মারলো। তাদের দেখে এমনিতেই পুলিশগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, এখন দুটোকে দু’দিকে দৌড়াতে দেখে তারাও তাদের পেছনে ছুটলো। সামনে থাকলো শুধু অফিসার। সেও অবাক চোখে চেয়ে আছে পলায়নরত ছেলে দুটোর দিকে। একবার ডানে, একবার বায়ে। চিৎকার করে নিজের কনস্টেবলদেরকে বললো, “গুলি করো খানকিরপোলাগো!”

এই সুযোগ, মনে মনে বললো বাস্টার্ড। সাইলেন্সারটা এক ঝটকায় খুলে ফেলে জানালার কাঁচ দিয়ে হাতটা বের করে পর পর তিন রাউন্ড গুলি চালালো। সবগুলোই পুলিশের জিপ লক্ষ্য করে। এলোপাতারিভাবে নয়, তার টার্গেট হেডলাইট দুটো, সেই সাথে পুলিশকে ভড়কে দেয়া।

হঠাৎ এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে অফিসার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো আত্মরক্ষার্থে । আর যেসব পুলিশ ঐ দুটো ছেলেকে ধাওয়া করার জন্য কিছুটা দূরে চলে গেছে তারা গুলির শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকাতেই বাস্টার্ড আরো তিনটি গুলি করলো তাদের লক্ষ্য করে। একটা গুলি কারোর গায়ে না লাগলেও বাস্টার্ডের উদ্দেশ্য পূরণ হলো। টহল পুলিশের চারজন কনস্টেবল নিজেদের হাতে রাইফেল থাকা সত্ত্বেও ভিমরি খেয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আশেপাশে দৌড়ে শেল্টার নেবার চেষ্টা করলো।

গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়েই সামনের জিপটাকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু জায়গাটা সংকীর্ণ হওয়াতে জিপের গায়ে ভয়ঙ্কর শব্দে আঘাত লাগলো লাল রঙের গাড়িটা। বাস্টার্ড পরোয়া করলো না। গাড়িটার প্রতি তার কোনো মায়া নেই। এটা তার নিজের গাড়ি নয়।

পুলিশের জিপটা ধাক্কা মেরে ভয়ঙ্কর শব্দ করে তার গাড়িটা মেইন রাস্তায় উঠে এলো। বাস্টার্ড জানে গাড়িটা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না । এখান থেকে বের হতে পারছে সেটাই আসল কথা।

গাড়িটা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চললো। এতাক্ষণ পর টের পেলো বাম কাঁধটা আড়ষ্ট বোধ করছে। হাতটও কেমন জানি দূর্বল দুর্বল লাগছে।

একটা গুলি লেগেছে আমার কাঁধে।

ভাগ্য ভালো গুলিটা লেগেছে তার বাম কলার-বোনের ঠিক নীচে। কোনো হাঁড় ভেদ করে নি, বুঝতে পারলো। যদি হাঁড়ে লাগতো তাহলে হাতটা কোনোভাবেই নাড়তে পারতো না। অকেজো হয়ে যেতো।

কিছু দূর যাওয়ার পর লক্ষ্য করলে খ্যাখ্যা করে একটা শব্দ হচ্ছে। বাস্টার্ড জানে সামনের চাকার মাডগার্ডটা দুমরে মুচরে টায়রের সাথে ঘষা লাগছে। কিন্তু দুই-তিন মাইল পর্যন্ত এক গতিতে ছুটে চললো সে। নিরাপদ কোথাও না গিয়ে তার গাড়ি থামবে না ।

দশ মিনিট পর অনেক দূর চলে এলো তাদের গাড়িটা। পুলিশের গাড়িটা তাদের অনুসরণ করে নি, এটা এক ধরণের স্বস্তি হলেও বাস্টার্ড জানে যেকোনো সময় রাস্তায় তাদেরকে আঁটকে দেবে পুলিশ। এই গাড়িটা এখন আর নিরাপদ নয়। দ্রুত এটা পরিত্যাগ করতে হবে।

“আমি আপনার কাঁধে ব্যান্ডেজ করে দিই?” উমার কথাটা শুনে তার দিকে তাকালো সে। কিছু বললো না। বুঝতে পারছে না কী বলবে।

“আমি কিছু দিন নার্সের কাজ করেছি।”

মেয়েটার দিকে তাকালো সে।

“ছেড়ে দিলে কেন?” রাস্তার দিকে চোখ রেখেই বললো বাস্টার্ড ।

“টেম্পোরারি ছিলো, স্থায়ী করার জন্য আন্দোলন করেছিলাম আমরা, তাই…” বলেই একটু থেমে আবার বললো, “গাড়িটা কোথাও থামান, আমি দেখি কী অবস্থা।”

সংসদ ভবনের পাশে তাদের গাড়িটা থামলো। চারপাশ অদ্ভুত নীরবতায় আচ্ছন্ন। গাড়ির ভেতরে বাতি জ্বালাতে বললো উমা । বাতির আলোয় ক্ষতস্থানটি ভালো করে দেখে নিলো সে।

“আপনার তো ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত,” সব দেখে বললো মেয়েটি।

“সেটা এখন সম্ভব নয়,” বিরক্ত হয়েই বললো সে।

“ঠিক আছে, আমি পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। ব্লিডিংটা পুরোপুরি বন্ধ হয় নি…ওটা বন্ধ করতে হবে।”

কাজে নেমে গেলো উমা। প্যাকেট থেকে ব্যান্ডেজ, কটন আর অ্যান্টিসেপটিক বের করে নিলো । কী যেনো মনে পড়তেই গাড়ির ড্যাশবোর্ডে কিছু খুঁজতে লাগলো সে।

“কি খুঁজছো?” জানতে চাইলো বাস্টার্ড ।

“মদের বোতল।” খুঁজতে খুঁজতেই বললো সে।

বাস্টার্ডের দু’চোখ কুচকে গেলো অবিশ্বাসে। “কি!”

তার দিকে তাকিয়ে উমা বললো, “মদে অ্যালকোহল আছে, আপনার ক্ষতে একটু ঢেলে দিলে ব্যাথা কমে আসবে । ইনফেকশনও হবে না।” উমা হাতরাতে হাতরাতে ছোট্ট একটা মদের বোতল পেয়ে গেলো। “এই তো।”

“এখানে মদ আছে সেটা তুমি জানলে কী করে?” বাস্টার্ড অবাক।

তার চোখে চোখ রেখে উমা বললো, “আমি লেডি গিয়াসের সাথে এই গড়িতে করেই এসেছি।”

ও! মনে পড়ে গেলো বাস্টার্ডের।

আগেরবারের মতো বাজেভাবে ব্যান্ডেজ করলো না উমা, এবার বেশ ভালোভাবে কাজটা করতে পারলো। বাস্টার্ড অবাক হয়ে দেখলো তার কাজ। গুলিটা যে তার শরীরের ভেতর নেই সেটা আগেই বুঝেছিলো, উমাও একই কথা বললো।

ক্ষতস্থানে একটু মদ ঢেলে দিতেই কামড়ে ধরলো যেনো, তবে ব্যাথায় একটুও শব্দ করলো না। অবাক হলো উমা । লোকটার কি কোনো অনুভূতি নেই!

উমা তার খুব কাছে এসে ক্ষতস্থান পরিস্কার করতে থাকলে বাস্টার্ড তার চুলের গন্ধটা পেলো। এরকম শারিরীক যন্ত্রণার মধ্যেও গন্ধটা স্বস্তি দিলো তাকে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটার শরীরের ঘ্রাণও পেলো। ভালো লাগার একটি অনুভূতি তৈরি হলো তার মধ্যে। তার মায়ের শরীরের ঘ্রাণও কি এরকম ছিলো?

“আমি কিন্তু পুলিশকে ফোন করি নি।” উমা ক্ষতস্থান পরিস্কার করতে করতে কথাটা বললে বাস্টার্ড চমকে তার দিকে তাকালো। “তাহলে কাকে ফোন করেছো?”

“আমার পিসিকে।”

“কেন?”

“আমার মা আর বাবা দুজনেই অসুস্থ, তাদের খোঁজখবর নিতে।”

বাস্টার্ড কিছু বললো না।

পুরো কাজটা করতে পনেরো-বিশ মিনিট লেগে গেলো। চারপাশে চেয়ে দেখলো রাত অনেক গম্ভীর হয়ে গেছে। এই গাড়িটা নিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। বুঝতে পারছে গাড়িটা পুলিশের কাছে রিপোর্ট হয়ে গেছে । মেয়েটাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিতে চায় সে, কিন্তু ভালো করেই জানে এতো রাতে রামপুরায় যাওয়া ঠিক হবে না, আর এই গাড়িটা নিয়ে গেলে নিঘাত ধরা খাবে । ধীরেসুস্থে ভেবে নিলো সে। মেয়েটাকে জানানো উচিত।

“শোনো, তোমার বাড়িতে এখন যাওয়া যাবে না।” নিষ্পলক চেয়ে রইলো উমা।

“রাস্তায় বের হলেই বিপদ…আজ রাতটা অন্য কোথাও থেকে কাল সকালে তোমার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসবো।”

কিছুই বললো না মেয়েটা। যেনো কিছু বলে লাভ নেই, এরকম একটা ভঙ্গি করলো।

আর দেরি না করে গাড়িটা নিয়ে ছুটে চললো নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যে।

কিছুক্ষণ পরই মোহাম্মদপুরের একটা বন্ধ গ্যারাজের সামনে চলে এলো তাদের গাড়িটা । রাতের এই সময় আশেপাশের সব কিছুই বন্ধ হয়ে গেছে । বাস্টার্ড গাড়িতে বসে থেকেই একটা ফোন করলো। অপর প্রান্তে যে ধরলো। তাকে বাচ্চু নামে ডাকলো সে। জানালো তার গ্যারাজের সামনেই আছে এখন। বাচ্চু নামের লোকটা হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বাস্টার্ড তাকে বেশি কথা না বলে গ্যারাজের দরজা খোলার জন্য বলেই ফোন রেখে দিলো ।

দু’তিন মিনিট পর ঘরঘর শব্দ করে গ্যারাজের বিশাল কাঠের দরজাটা খুলে গেলো।

“বস, হইছে কি?” বাচ্চু নামের লোকটা আসলে বিশ-বাইশ বছরের এক যুবক। চোখেমুখে কৌতূহল নিয়ে সে বাস্টার্ডকে দেখে নিলো। তার শার্টের বাম কাঁধের জায়গায় রক্ত লেগে আছে। তারপরই গাড়িটা দেখলো সে। “গাড়িটা তো ভচকাইয়া গেছে!” আড়চোখে গাড়ির ভেতর বসা উমার দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলো।

বাস্টার্ড গাড়িটা গ্যারাজের ভেতর ঢুকিয়ে বের হয়ে এলো, তবে উমা চুপচাপ বসে রইলো নিজের সিটে।

“একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছি,” ছেলেটার প্রশ্নের জবাব দিয়ে তাকে গ্যারাজের এককোণে নিয়ে গেলো সে। “এই গাড়িটা তোর কাছে রেখে দে, নাম্বারপ্লেট আর কালার বদলে ফেলবি।”

“ঠিক আছে, বুঝছি,” ছেলেটা যেনো সব বুঝে গেছে এমনভাবে মাথা নেড়ে বললো।

“এর বদলে আমাকে কয়েক দিনের জন্য অন্য একটা গাড়ি দিবি।”

বাচ্চু একটু মাথা চুলকাতে লাগলো। “তা দিবার পারুম…কিন্তু একটু কাম আছে। কাইল সকালে ঠিক কইরা দিতে অইবো।”

“তুই খুব সকালে গাড়িটা রেডি করে রাখবি।” তারপর লাল রঙের গাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করে বললো, “এটা অনেক ভালো দামে বেঁচতে পারবি তুই।”

“এইটা কি আমারে দিয়া দিলেন নাকি, বস?” এবার দাঁত বের করে হেসে বললো বাচ্চু।

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। “খুব জলদি এটার চেসিস নাম্বার, কালার আর নাম্বারপ্লেট বদলে ফেলবি…পুলিশের ঝামেলা আছে।”

পুলিশের ঝামেলার কথা শুনে বাচ্চু একুটও চিন্তিত হলো না। কারণ এই শহরের গাড়ি চোরদের নিয়ে তার কাজকারবার, পুলিশকে কিভাবে ফাঁকি দিতে হয় সেটা সে ভালা করেই জানে।

“ওইটা নিয়া আপনে চিন্তা করবেন না, বস্।”

একটু ভেবে বাস্টার্ড বললো, “আরেকটা ব্যাপার…”

“কি?” বাচ্চু আগ্রহভরে চেয়ে রইলো।

“তোর এখানে কি আজ রাতটা থাকা যাবে?”

“যাইবা না কেন…আমার গ্যারাজের পিছনে ঘর আছে না।” দাঁত বের করে হেসে গাড়ির ভেতরে চুপচাপ বসে থাকা উমার দিকে ইঙ্গিত করে বললো, “বস…কেসটা কি?”

“আমার পরিচিত একজন, একটু বিপদে পড়েছে…পরে তোকে সব বলবো। এখন বল, তোর এখানে আর কে কে আছে?”

“আমি আর আমার এক পিচ্চি…রাইতে তো এইখানে আমরাই থাকি।”

“বাকি মেকানিক্সরা?”

“ওরা এগোর বাড়িতে থাকে।”

“ভালো।” কথাটা বলেই বাস্টার্ড একটু ভেবে নিলো। “আমরা গাড়িতেই রাত কাটাতে পারবো…”

“কী যে কন না,” বাচ্চু কপট হতাশা ব্যক্ত করলো। “আমরা দুইজন গ্যারাজে থাকি…আপনে আর আপনের মেহমান পেছনের ঘরে থাকেন।”

দশ মিনিট পর, তারা বসে আছে বাচ্চুর গ্যারাজের পেছনে একটা ছাপড়া ঘরে। আম কাঠের সস্তা খাট আর কিছু সেকেন্ডহ্যান্ড ফার্নিচার। খাবার রাখার জন্যে একটা র‍্যাক। কাপড় রাখার আলনা। আয়না। চৌদ্দ ইঞ্চির একটি টিভি।

থাকার জন্যে মোটেও ভালো জায়গা নয়, তবে আশ্রয় হিসেবে ঠিক আছে। বাস্টার্ড খাটের উপর থেকে একটা কথা আর বালিশ নিয়ে মেঝেতে বিছিয়ে দিলো। উমাকে খাটে শোবার সিগন্যাল এটি।

“আমার সাথে এক ঘরে থাকতে কি তোমার খারাপ লাগবে?” বালিশটা জায়গামতো রেখে জানতে চাইলো সে।

“না।” উমা কথাটা এমনভাবে বললো যার অর্থ বিপরীতও হতে পারে।

“ভালো।” বাস্টার্ড আর কোনো কথা না বলে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। টের পেলো ক্ষতস্থানে তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। শারিরীক যন্ত্রণাকে আমলে নিলো না সে। কাল সকালে এই মেয়েটাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে যাবে তার পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে।

ঘরে আলো নেই, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার কিন্তু তাদের দুজনের কারো চোখেই ঘুম নেই। দু’জনের চোখই খোলা। এভাবে কিছুক্ষণ সময় অতিক্রান্ত হবার পর উমাই প্রথম মুখ খুললো। আস্তে করে বললো সে, “কি হয়েছিলো আপনার?”

তার কী হয়েছিলো! বাস্টার্ড নিজেও ঠিক করে বলতে পারবে না । উমা শুধু শুনতে পেলো বাস্টার্ডের নিঃশ্বাসের শব্দ আরো দ্রুত হয়ে উঠেছে।

“আপনার মায়ের কী হয়েছে?” উমা বললো ।

“আমি কখনও মাকে দেখি নি।” কথাটা তার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো। সে জানে না কেন এ কথাটা বললো । কিছু বলার ইচ্ছে ছিলো না তার। কিন্তু অজ্ঞাত এক শক্তি ভেতর থেকে তাকে দিয়ে কথাটা বলিয়ে নিয়েছে।

“আপনি তখন খুব ছোটো ছিলেন?”

“জানি না।”

অবাক হলো উমা। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে না সে মিথ্যে বলেছে। “আপনি জানেন না?”

দু’চোখ বন্ধ করে ফেললো বাস্টার্ড । “জানি…কিন্তু কখনও তাকে দেখি নি।”

“কেন?”

“আমার মা…” আর বলতে পারলো না সে। গলা ধরে এলো।

“মাকে অনেক ভালোবাসেন?”

কোনো জবাব দিলো না সে।

“এখন আপনার কেমন লাগছে?” জানতে চাইলো উমা।

“ভালো।”

যে মেয়েকে খুন করতে উদ্যত হয়েছিলো সেই মেয়েটি কিনা তার প্রতি এমন মমত্ব দেখাচ্ছে! অদ্ভুত! অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে অচেতন ছিলো, মেয়েটা তাকে ফেলে পালিয়ে যেতে পারতো। তকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারতো। গাড়ির বুটে প্রচুর টাকা আছে, সে কথাও মেয়েটার অজানা নয়।

“তুমি আমাকে ফেলে চলে যেতে পারতে…গেলে না কেন?”

“আপনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন,” বললো উমা ।

“আমি তো আরেকটু হলে তোমাকে খুন করে ফেলতাম।”

মেয়েটা কিছু বললো না।

“আমাকে ছেড়ে চলে গেলে না কেন?”

“জানি না,” আস্তে করে বললো উমা।

মেয়েদের মন বোঝার ক্ষমতা বাস্টার্ডের কোনো কালেই ছিলো না, এখন মনে হচ্ছে কোনো কালেই সেই ক্ষমতা তার হবে না ।

“তোমার নাম কি?”

“উমা।”

“এটাই কি তোমার আসল নাম?”

“উমা রাজবংশী।”

“এ রকম একটা…মানে, এ পথে এলে কেন? এদের সাথে তোমার পরিচয় হলো কিভাবে?”

উমা তার গল্পটা বলতে শুরু করলো।

ছয়-সাত মাস আগে চাকরি স্থায়ী করার জন্য আন্দোলনে নামলে নার্সের চাকরিটা হারায় সে, তারপর মিনা আপা নামের এক মহিলার বিউটিপালারে কাজ নেয়। বিউটিপার্লারের ছদ্মবেশে দীর্ঘদিন ধরে দেহব্যবসা চালিয়ে আসছে মহিলা । সমাজের উঁচুতলায় কর্লগার্ল সাপ্লাই দেয়। অনেক হোমরাচোমরার সাথে মহিলার সম্পর্ক আছে।

দেখতে সুন্দর বলে উমার উপর নজর পড়ে মহিলার। তারপর যখন জানতে পারে অভাব অনটনে বিপর্যস্ত সে তখন সুযোগ বুঝে তাকে এই লাইনে আসার প্রলোভন দেয়। প্রথমে উমা রাজি হয় নি কিন্তু দুর্ঘটনায় পঙ্গু বাবা আর মায়ের সংসারে একমাত্র আয়রোজগার করা মেয়ে কোনোভাবেই বিউটিপার্লারের স্বল্প বেতনে চলতে পারছিলো না। গত সপ্তাহে যখন তার মা বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙলো তখন আর কিছু করার থাকলো না। এ শহরে তাদের আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। যারা ছিলো তাদের বেশিরভাগ চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। আশেপাশের প্রতিবেশীরা ধার দিতে দিতে অতীষ্ঠ হয়ে গেছে, তাদের কাছে যাবার মুখও নেই। সুতরাং মিনা আপার লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর বিএ’তে ভর্তি হয়েছিলো উমা, কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারে নি।

সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো বাস্টার্ড। “তুমি আর এসব কাজ করবে না,” আস্তে করে বললো অবশেষে।

বুঝতে পারলো না উমা । এই লোক এ কথা বলছে কোন অধিকারে? “কেউ শখ করে আসে না,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো সে।

“শখ করে এলে তোমাকে গুলি করে মারতাম।”

অন্ধকারেই উমা তার দিকে চেয়ে রইলো। “আর বাধ্য হয়ে এসেছি বললে কি করবেন?”

“তোমাকে আর ওপথে যেতে দেবো না,” দৃঢ়তার সাথে বললো সে।

অবাক হলো উমা। খুব সহজ কথা কিন্তু কী দৃঢ়তার সাথেই না বলছে! “এভাবে ক’জনকে উদ্ধার করবেন?”

“যে ক’জন আমার সামনে পড়বে।” একদ, নির্বিকার তার কণ্ঠ।

চুপ মেরে রইলো উমা ।

মেয়েটির প্রতি কোন মায়া জন্মে গেছে কিনা বুঝতে পারছে না সে শুধু বুঝতে পারছে মেয়েটার উপর অধিকার জন্মে গেছে। অদ্ভুত। এরকম অভিজ্ঞতা তার কখনও হয় নি।

অনেকক্ষণ চলে গেলো, কেউ কোনো কথা বললো না। অবশেষে বাস্টার্ড বললো, “ব্ল্যাক রঞ্জুর দল তোমাকে ছেড়ে দেবে না। খুব সম্ভবত পুলিশও তোমাকে খুঁজবে। ওদের হাত থেকে বাঁচতে হলে তোমাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে । অন্তত এক মাস গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে।”

“আমি কোথায় যাবো?” অসহায়ের মতো বললো সে। “অসুস্থ বাবা মা…আমার হাতে খুব বেশি টাকা-পয়সাও নেই…”

মেয়েটার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে একটু ভেবে বললো, “একটা ব্যবস্থা করা যাবে…চিন্তা কোরো না।”

উমা চুপ মেরে রইলো। এভাবে আরো কিছুক্ষণ চলে গেলেও কেউ কিছু বললো না। বাস্টার্ড টের পেলো সারা শরীর ঘেমে জ্বর আসছে।

“ওদের সাথে আপনার কি হয়েছে?”

উমার প্রশ্নটা বুঝতে পারলো না। “কাদের সাথে?”

“লেডি গিয়াস, মিনা আপা…”

“তুমি বুঝবে না। বোঝার দরকারও নেই।”

আরো পাঁচ-দশ মিনিট পর প্রচণ্ড জ্বর হয়ে সমস্ত শরীর ঘেমে উঠলো। যেখানটায় গুলি লেগেছে তীব্র ব্যাথা হতে লাগলো সেখানে। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো তার। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলো। সেই ঘোরে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলো সে।

ছোট্ট এক শিশু। মায়ের কোলে শুয়ে আছে। অল্পবয়সী মা শিশুটির কপালে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। গুন গুন করে গান গাইছে মা। ঘুম পাড়ানির গান। শিশুটি ঘুমিয়ে আছে…

…সে টের পাচ্ছে তার কপালে কোমল একটি হাত। এরকম আদর সে জীবনেও পায় নি। তার অনেক ভালো লাগছে। প্রতিটি স্পর্শ তাকে ভালো লাগার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

.

ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পেলো উমা নামের মেয়েটি তার মাথার কাছে বসে আছে। তার কপালে ভেজা পট্টি।

“কি!”

“আপনার অনেক জ্বর হয়েছিলো, সারারাত ঘুমাতে পারেন নি। ছটফট করেছেন।”

বাস্টার্ড মেয়েটার দিকে চেয়ে রইলো। কিছু বলতে পারছে না। খুব দুর্বল দুর্বল লাগছে তার । কাঁধটা যেনো অসাড় হয়ে আছে। ঘাড় নাড়াতে পারছে না, নাড়াতে গেলেই ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে।

চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ভোরের আলো ফুটছে। তাকে উঠতে হবে। অনেক কাজ আছে। এই মেয়েটাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতে হবে ডাক্তারের কাছে। ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে নি কোনো মধ্যবয়সী মহিলা পিস্তলের মুখে ভড়কে না গিয়ে পাল্টা তাকে গুলি করে বসবে। বুঝতে পারলো শুটার সামাদের কথাটাই ঠিক। ব্ল্যাক রঞ্জু আর তার দল খুবই বিপজ্জনক। সুলতানকে সহজে কাবু করে তার মনে হয়েছিলো রঞ্জুর দলের সবাই বুঝি খুব সহজেই বাগে আনা যাবে। আসলে খাটো করে দেখেছিলো ওদেরকে। পরিণামে এখন গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে সে। এই প্রথম গুলিবিদ্ধ হলো । তাও আবার কোনো মহিলার হাতে!

উঠে বসলো সে। উমাকে একুট ঘুমিয়ে নিতে বললো, মেয়েটা যে সারা রাত ঘুমায় নি বুঝতে পারলো। বাস্টার্ড চলে গেলো গ্যারাজে ।

.

খুব বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারলো না উমা। খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে বসলো। গ্যারাজ থেকে আওয়াজটা আসছে। বিছানা থেকে উঠে গ্যারাজের গেট দিয়ে ভেতরে উঁকি মারতেই দেখতে পেলো বাচ্চু নামের ছেলেটার সাথে বাস্টার্ড কথা বলছে। বনেট খোলা সাদা রঙের একটি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা। বুঝতে পারলো লাল রঙের গাড়িটা রেখে এটাই ব্যবহার করবে এখন, গত রাতে এরকম কথাই শুনেছে সে।

বাচ্চুর এনে দেয়া নাস্তা সেরেই তারা রওনা হয়ে গেলো সকাল সাড়ে আটটার দিকে। বাস্টার্ড এখন সাদা রঙের গাড়ি চালাচ্ছে। আগের গাড়িটা থেকে এটা সব দিক থেকেই জৌলুসহীন তবে এই গাড়িটাই তাদের জন্য নিরাপদ।

“রামপুরার কোথায় নামিয়ে দিলে তোমার জন্য সুবিধা হয়?” গাড়ি চালাতে চালাতে জানতে চাইলে বাস্টার্ড।

“বৃজের কাছে নামিয়ে দিলেই হবে।”

বাস্টার্ড আর কিছু না বলে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করলো আবার। তার গাড়িতে খুব বেশি তেল নেই, সুতরাং বৃজের কাছে নামিয়ে দিলেই ভালো হয়, সে জানে বৃজ থেকে একটু সামনেই একটা পেট্রলপাম্প আছে।

রাস্তা ফাঁকা, দ্রুত গতিতে চলছে গাড়িটা। রামপুরা বৃজের কাছে পৌঁছাতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগলো না। বৃজ পেরিয়ে গাড়িটা থামলো রাস্তার বাম দিকে।

এবার পাশে বসা উমার দিকে ফিরলো সে। তার দিকে হাজার টাকার দুটো বান্ডিল বাড়িয়ে দিলো। এটা রাখো।”

উমা যারপরনাই বিস্মিত। কিছুই বুঝতে পারছে না ।

“নাও।” তাড়া দিলো সে । মেয়েটার কোলের উপর বান্ডিল দুটো রেখে দিলো সে। বাচ্চু যখন তাদের জন্য নাস্তা আনতে গিয়েছিলো তখনই গলফ ব্যাগ থেকে টাকাগুলো সরিয়ে রেখেছিলো। “আজকেই অন্য কোথাও চলে যাবে। তোমার বাবা-মা’র চিকিৎসাও করাতে পারবে এ টাকা দিয়ে। দেরি করবে না। ঝামেলায় পড়বে।”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো উমা । “আপনি আমাকে টাকা দিচ্ছেন?”

“হ্যাঁ, দিচ্ছি!” ঝাঁঝের সাথে বললো সে। “কোনো সমস্যা আছে?”

চুপ মেরে রইলো উমা ।

“ব্ল্যাক রঞ্জু খুবই ভয়ঙ্কর লোক। তার দলটা বিশাল। তারা তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজবে…পুলিশও আসতে পারে। আজ নয়তো কাল ওরা আসবেই। যতো জলদি পারো অন্য কোথাও চলে যেও।” একটু থেমে আবার বললো সে, “যদি না যাও তাহলে তোমার তো সমস্যা হবেই, আমারও হবে।”

উমা তার এ কথাটা বুঝতে পারলো না। তার কপালে ভাঁজ পড়লো। “আপনার কী সমস্যা হবে?”

“তুমি বুঝবে না। বোঝার দরকারও নেই।”

তার হাতে দুটো অপশন ছিলো : হয় মেয়েটাকে মেরে ফেলা; নয়তো তাকে ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। প্রথমটা করতে পারে নি। তাই দ্বিতীয় কাজটা করছে।

বাস্টার্ড অধৈর্য হয়ে উঠলো। “বাসায় চলে যাও । যা বললাম তাই করো…সবার ভালো হবে। তোমার নিজের, তোমার মা-বাবার…আর যা দেখেছো, যা বুঝেছো, কাউকে কিছু বলবে না। বললেই সমস্যায় পড়বে।”

উমা টাকাগুলো ভ্যানিটি ব্যাগে রাখতে গিয়ে দেখতে পেলো গতরাতের রক্তাক্ত শার্টটা নেই। তার মানে সে যখণ ঘুমিয়েছিলো তখন ওটা সরিয়ে ফেলেছে লোকটা।

দরজা খুলে বের হয়েই কী যেনো মনে করে ফিরে তাকালো আবার । “আপনার নামটা?”

“আমার কোনো নাম নেই।” কথাটা বলেই এক্সেলেটরে পা রাখলো সে। গাড়িটা দ্রুত চলে গেলো।

বিস্ময়ে চেয়ে রইলো উমা ।

.

অধ্যায় ১৫

হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। গতকাল রাতে উত্তরার পিং সিটিতে খুন হয়েছে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী লেডি গিয়াস। ব্যাপারটার পেছনে যে বড় কোনো ঘটনা জড়িত জেফরি বেগ সেটা তখনই বুঝতে পেরেছিলো। রাতের বেলায়ই সম্ভাব্য খুনিকে পুলিশ ধরেও ফেলেছিলো কিন্তু খুনি চার-পাঁচজন অস্ত্রধারী পুলিশকে কাবু করে পালিয়ে গেছে। খবরটা শোনা মাত্রই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। এটা হলো চূড়ান্ত অযোগ্যতা!

পুলিশ যদি আরেকটু সতর্ক থাকতো তাহলে কতো সহজেই না কেসটা সমাধান করা যেতো! সে তো বলেই দিয়েছিলো, খুনি খুবই ভয়ঙ্কর প্রকৃতির।

খবরটা যখন প্রথম শোনে আনন্দে তার শরীরে শিহরণ বয়ে যায় । কিন্তু সেই আনন্দের স্থায়িত্ব ছিলো মাত্র পাঁচ মিনিট। সারাটা রাত তার ঘুম আসে নি এই ব্যর্থতার কথা ভেবে। মেজাজ এতোটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে সকালে ঘুম থেকে উঠে জগিং করতেও ইচ্ছে করে নি।

খুব সকালে অফিস থেকে ফোন করে তাকে জানানো হয় গতকাল রাতে শান্তি নগরের এক অ্যাপার্টমেন্টে নির্মমভাবে এক মহিলা খুন হয়েছে। আরেকটা খুন! জেফরি বুঝতে পারলো হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের লোকবল বাড়াতে হবে। অবশ্য নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিলো এই বলে যে, কখনও কখনও পর পর কয়েকটি খুন হওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। প্রায়ই এরকম হয়ে থাকে; কিন্তু তখনও বুঝতে পারে নি এই মহিলার হত্যাকাণ্ডের সাথে ব্ল্যাক রঞ্জু এবং লেডি গিয়াসের কানেকশান রয়েছে।

অফিসে এসে দশ মিনিটের মতো থেকেই চলে যায় শান্তি নগরের ঘনটাস্থলে। এভিডেন্স টিম চলে গিয়েছিলো আরো আগে । ঘটনা ঘটেছে রাত এগারোটার দিকে। স্থানীয় পুলিশ জানতে পারে বারোটার পর।

.

মিনা নামের মহিলার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেফরি বেগ। মহিলার হাতে একটা ওয়েম্বলি অ্যান্ড স্কট মডেলের পয়েন্ট থার্টি টু ক্যালিবারের রিভলবার। ওয়ার্ডরোবের পাশে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মহিলা অস্ত্র চালিয়েছে। অবাক হলো সে। দুটো গুলি বিদ্ধ হয়েছে মহিলার পেটে আর বুকে। তবে

মহিলা নিজেও দুটো গুলি করেছে, দুটোই বিদ্ধ হয়েছে সামনের সোফায় । বোঝাই যাচ্ছে তার নিশানা ব্যর্থ হয়েছে। অজ্ঞাত খুনি সেই সুযোগে মহিলাকে শেষ করে দিয়েছে। খুনির নিশানা মহিলার চেয়ে অনেক ভালো। প্রফেশনাল। ঘর থেকে মোবাইল ফোন ছাড়া আর কিছুই খোয়া যায় নি।

আজব!

এটা ডাকাতির ঘটনা নয়। কোনোভাবেই না। পুলিশ খতিয়ে দেখেছে : ঘরের ভেতর প্রচুর টাকা আর স্বর্ণালঙ্কার এখনও অক্ষত আছে। কিছুই সরানো হয় নি। সবচাইতে বড় কথা মহিলার ওখানে ছয়-সাতজন যুবতী মেয়ে থাকে, তাদের মধ্যে দু’জন ঘটনা ঘটার পর পরই পালিয়ে গেছে। বাকি চারজন জানিয়েছে খুনের ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না। পালিয়ে যাওয়া ঐ দুই মেয়েও এসবের সাথে জড়িত নয়। তারা নিতান্তই মানসম্মানের ভয়ে পালিয়েছে।

মানসম্মানের ভয়ে?

জেফরি জানতে পেরেছে মিনা আপা নামের ভদ্রমহিলা বিউটি পার্লারের ব্যবসা করতো, তবে এর আড়ালে দেহব্যবসাই ছিলো তার মূল ব্যবসা। গ্রেফতার হওয়া চার মেয়ে পুলিশকে এ তথ্য দিয়েছে। তবে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারা দিয়েছে : দুটো গুলির শব্দ শুনেছে তারা। গুলির শব্দ শুনেই ভয়ে যার যার রুমের দরজা লক করে দিয়েছিলো।

ঠিক আছে, একজন দেহব্যবসায়ী মহিলা খুন হয়েছে। মোট চারটা গুলি করা হয়েছে অথচ গুলির শব্দ শোনা গেছে মাত্র দুটি!

জেফরি বেগকে পুলিশ নিশ্চিত করেছে, শুধু মেয়েরাই নয়, অ্যাপার্টমেন্টের অন্য বাসিন্দারাও দুটোর বেশি গুলির শব্দ শোনে নি। এমনকি অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে এক পান দোকানিও জানিয়েছে সে দুটো গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছে।

চমঙ্কার!

আবারো সাইলেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে?

অবশ্যই।

সবচাইতে মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেছে অ্যাপার্টমেন্টের কিছু বাসিন্দা আর রাস্তার লোকজনের কাছ থেকে : গুলির পর পরই তারা নাকি এক যুবক আর এক যুবতাঁকে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। যুবকের হাতে পিস্তল ছিলো। পিস্তলটার নল অস্বাভাবিক রকমের বড়।

সাইলেন্সার!

তাহলে কি উত্তরার হোটেলে লেডি গিয়াস আর এই মহিলার খুন একই ব্যক্তির কাজ?

জেফরি নিশ্চিত, দুটো খুন একজনই করেছে। এটা কাকতালীয় হতে পারে না। দুটো খুনের মধ্যে সময়ের ব্যবধানটাও বেশ চোখে পড়ার মতো। উত্তরার পিং সিটি হোটেলে খুন করেই খুনি চলে যায় শান্তি নগরে। হোটেল থেকে সে এক মেয়েকে নিয়ে বের হয়। শান্তি নগরেও সেই মেয়েটি ছিলো তার সাথে।

এই মেয়েটি কে?

মিনা আপা নামের যে মহিলা খুন হয়েছে সে পতিতা-ব্যবসার সাথে জড়িত। তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চারজন মেয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। শান্তি নগর থানার ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক এখানেই আছে, ইন্সপেক্টরকে ডাকলো জেফরি।

“মেয়েগুলো কোথায়?”

“স্যার, পাশের ঘরে আছে। লাশ নিয়ে যাবার পর তাদেরকে থানায় নিয়ে যাবো।”

“আমি তাদের সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

চারটা মেয়ে বসে আছে একটা বিছানার উপর। সবাই ওড়না দিয়ে যতোটা সম্ভব নিজেদের মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। শান্তিনগর থানার ইন্সপেক্টর মেয়েগুলোকে বলে দিয়েছে উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা তাদেরকে কিছু প্রশ্ন করবে, ঠিক ঠিক যেনো উত্তর দেয়া হয়। উল্টাপাল্টা কিছু বললে ভালো হবে না।

“তোমার নাম কি?” চারজনের মধ্যে যে মেয়েটি মাথা উঁচু করে রেখেছে তাকে বললো জেফরি। বাকিরা মাথা কুটে মারা যাচ্ছে যেনো।

“শর্মিলি,” ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো সে।

“তোমার পাশের জন?” শর্মিলি নামের মেয়েটির গা ঘেষে অল্প বয়সী এক মেয়েকে দেখিয়ে বললো জেফরি।

“ওর নাম রোজিনা।”

“আর বাকি দু’জনের?”।

“এর নাম শাবনূর, বিছানার পেছনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা দু’জন মেয়েকে দেখিয়ে বললো । “আর এ হইলো পপি।”

“তোমরা এখানে কতো দিন ধরে আছো?”

“আমি আছি দুই বৎসর ধইরা, জেফরির দিকে চোখ নাচিয়ে বললো শর্মিলি নামের মেয়েটি। রোজিনা এক বৎসর ধইরা…না, আট-নয় মাস অইবো। আর এরা,” পেছনের মেয়ে দুটোকে দেখিয়ে বললো, “তিন-চাইর মাস হইবো।”

“তাহলে তুমি এখানে সবচেয়ে পুরনো?”

“হুম।”

“লেখাপড়া কতো দূর করেছো?”

শর্মিলি নামের মেয়েটি একটু অবাক হলো। এই লোক কি পুলিশের লোক? তার বিশ্বাস হচ্ছে না। পুলিশ কখনও তাদের মতো মেয়েদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না। এই লোক তো দেখি তার পড়াশোনার কথা জানতে চাইছে। “ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ছি…পরীক্ষা দিতে পারি নাই।”

“তাহলে তো পড়াশোনা ভালোই করেছো,” একটু থেমে আবার বললো, “বাকিরাও কি তোমার মতো লেখাপড়া জানে?”

“খালি একজন আমার চায়া বেশি…পপি…ডিগ্রি পাস…রোজিনা মেট্রিক ফেল…আর ওরা কেউই এইট-নাইনের বেশি না।”

“মিনা আপা খুন হবার আগে আরো কয়েকজন ছিলো এখানে, তাই না?” মাথা নেড়ে সায় দিলো শর্মিলি। “তারা কারা?”

“ডলি আর তিনি…পলাইছে।”

“এই ছয়জনই ছিলো?”

“হ।”

“আর কেউ ছিলো না? ঠিক করে বলো?…আমরা একজনকে গ্রেফতার করেছি, সে লেডি গিয়াস নামের একজনের সাথে ছিলো।”

শর্মিলি চুপ মেরে গেলো।

“ঐ মেয়েটি বলেছে সেও এখানেই থাকতো…” টোপ দিলো জেফরি। এখন অপেক্ষা বঁড়শি গেলে কিনা ।

“সে এখানে থাকতো না, মিছা কথা কইছে।”

“তাহলে কোথায় থাকতো?”

“আপনে সুবর্ণার কথা কইতাছেন তো?” মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। “ঐ মাইয়া এই লাইনে নতুন…এখানে সে থাকে না। কাইল গিয়াস ভায়ের সাথে গেছিলো।”

আচ্ছা! তাহলে তুমি গিয়াসকেও চেনো । মুচকি হাসলো জেফরি। “ঐ মেয়েটার আসল নাম কি?”

শর্মিল চেয়ে রইলো জেফরির দিকে।

“আমি জানি তোমাদের কেউই আসল নাম বলো নি…ঐ মেয়েটার আসল নাম বলো।”

“উমা…হিন্দু মাইয়া।”

“কোথায় থাকে?”

“রামপুরায়।”

“তুমি তার বাসা চেনো?”

“না। খালি জানি রামপুরায় থাকে…আপার বিউটি পার্লারে কাম করতো।”

“তাহলে কার কাছ থেকে ঐ মেয়েটার ঠিকানা জানা যাবে?”

“বিউটি পার্লারের ইনচার্জ হাবিব ভাই কইতে পারবো।”

“ভালো,” কথাটা বলেই জেফরি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তি নগর। থানার ইন্সপেক্টরের দিকে ফিরলো। “আপনি বিউটি পালারে গিয়ে ঐ হাবিব লোকটাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যান। আমি আসছি।”

“স্যার?” শর্মিলি জেফরিকে বললো। “আমাগো অ্যারেস্ট কইরা কি হইবো…আমরা তো এইসব খুনখারাবির মইদ্যে নাই। আমাগো ছাইড়া দেন।”

“তোমরা ছাড়া পেয়ে যাবে, কিন্তু তার আগে পুলিশকে সব ধরণের সহযোগীতা করতে হবে, সেটা যদি করো তাহলে তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। লাভই হবে। আমি বলবো তোমাদেরকে ছেড়ে দিতে।”

“কন, স্যার, কি করতে হইবো?”

“তোমার মোবাইল ফোন আছে না?”

শর্মিলি তার কামিজের গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা মোবাইল ফোন বের করলো। নিজের ভরাট স্তনের অনেকটা অংশ যে উন্মোচিত করে ফেলছে সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই।

“এখান থেকে মিনা আপনার ফোন নাম্বারটা বের করে দাও।”

শর্মিলি নামের মেয়েটি বেশ চটপটে। মিনা আপার ফোন নাম্বার বের করে দিলে জেফরি সেটা নোটবুকে টুকে রাখলো।

“লেডি গিয়াসের ব্যাপারে তোমরা কতোটুকু জানো?”

শূর্মিল একটু ঢোক গিললো। “স্যার, হেরা তো মানুষ ভালা না। সন্ত্রাসী। আমরা তেমন কিছু জানি না। আমাগো জানতেও দেয় না। কিছু জিগাইলে ধমক দিতো। মাজেমইদ্যে ইন্ডিয়া থেইকা আইলে এইহানে আসে গিয়াস ভাই।”

“মিনা আপার সাথে তার কি সম্পর্ক?”

“ওরা দেবর-ভাবি।”

অবাক হলো জেফরি । “দেবর-ভাবি?”

“মিনা আপার স্বামীরে সে ভাই বইলা ডাকে।”

“মিনা আপার স্বামী কে?”

“ব্ল্যাক রঞ্জু।”

“কি!”

.

অধ্যায় ১৬

রামপুরা বৃজের কাছে উমাকে নামিয়ে দিয়ে বাস্টার্ড চলে গেলো কাছের একটা পেট্রলপাম্পে। তার গাড়িতে সামান্য তেল আছে। এ দিয়ে খুব বেশি পথ যেতে পারবে না। যে ডাক্তারের কাছে সে যাবে সে থাকে কেরাণীগঞ্জে। অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। গুলির কেস, সুতরাং পরিচিত আর নির্ভরযোগ্য ডাক্তারের কাছেই যেতে হবে।

সকালের এই সময়ে পেট্রলপাম্পে খুব একটা ভীড় নেই। তার সামনে একটা গাড়িতে তেল ভরা হচ্ছে। সেই গাড়ির পেছনে গিয়ে সিরিয়াল নিলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে অয়েল-ট্যাঙ্কটার মুখ খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এই গাড়িটা সিএনজি’তে চলে না। ফলে তার সুবিধাই হয়েছে। আজকাল সিএনজি’র জন্য দীর্ঘ লাইন দিতে হয়, অতো সময় তার হাতে নেই।

এখান থেকে কোথায় যাবে ভেবে নিলো। গাড়ির বুটে এখনও গলফ ব্যাগটা আছে। প্রায় দু’কোটি টাকা! এতোগুলো টাকা দেখে কিছুক্ষণের জন্য তার মনে হয়েছিলো ব্ল্যাক রঞ্জুর পেছনে ছোটার দরকার নেই। এই পরিমাণ টাকা নিয়ে বাকি জীবনটা বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু এটা হবে কাপুরুষের মতো কাজ। বেঈমানি করা তার রক্তে নেই। কন্ট্রাক্টটা ভালোভাবে শেষ করবে সে। এটা এক ধরণের পেশাদারিত্ব। এক ধরণের চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া তার ট্রাস্টিকে সে ছোটো করতে পারবে না । অন্তত তার জন্যে হলেও কাজটা করতে হবে তাকে।

উমা নামের মেয়েটি তার মায়ের কাল্পনিক স্মৃতি উসকে দিয়েছে। হয়তো তার মাও অল্প বয়সে এভাবে এ লাইনে…।

আর ভাবতে পারলো না। মা সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা শুনেছে এ জীবনে, তারপরও তার মনের গহীনে মাকে নিয়ে প্রচণ্ড আবেগ কাজ করে। যদিও সেটা কখনও প্রকাশ হয় নি। প্রকাশ হবার মতো পরিস্থিতি কখনও তার জীবনে আসে নি। অন্তত গতকালের আগে!

“স্যার, কয় লিটার?”

কণ্ঠটা তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো। ব্যারেল হাতে ছেলেটা চেয়ে আছে তার দিকে।

“চল্লিশ।”

খ্যাচ করে তার ঠিক পেছনেই একটা গাড়ি ব্রেক করলে পাশ ফিরে তাকালো সে। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলো তার গায়ের পশম ।

পুলিশ!

.

শান্তি নগর থেকে কাজ শেষে করে বেইলি রোডে অবস্থিত হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে ফিরে এলো জেফরি বেগ । অল্প একটু পথ, তাই হেঁটেই এসেছে।

মিনা আপার বিউটি পার্লারের ইনচার্জ হাবিব মিয়াকে জেরা করে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সে। লোকটা উমা রাজবংশী নামের এক মেয়ের ঠিকানা দিয়েছে। রামপুরা থানার পুলিশ হয়তো এতোক্ষণে মেয়েটাকে গ্রেফতারও করে ফেলেছে।

তবে জেফরি খুব খুশি যে তার হাতে প্রচুর তথ্য আছে এখন। এসব তথ্য জোড়া লাগিয়ে, ঠিকমতো সাজিয়ে নিতে পারলে, একটার সঙ্গে আরেকটার সঠিক কানেকশান খুঁজে বের করতে পারলে এই কেসে অনেক অগ্রগতি হবে।

নিজের রুমে বসে আছে এখন, সামনে বসে আছে তার সহকারী জামান।

“মিনা আপা হলো রঙুর স্ত্রী, আপন মনে বললো জেফরি বেগ। “দ্বিতীয় স্ত্রী।”

“প্রথম স্ত্রীকে ব্ল্যাক রঞ্জু নিজের হাতে খুন করেছে, স্যার। আট বছর আগে,” জামান যোগ করলো। “খবরটা পত্রিকায় এসেছিলো। পুরনো ঢাকার এক নামকরা রেস্তোরাঁর সামনে প্রকাশ্যে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে সে।”

কথাটা শুনে একটু ভেবে জেফরি বললো, “ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী লেডি গিয়াস খুন হলো উত্তরায়, একটি হোটেলে…তার বর্তমান স্ত্রী খুন হলো নিজের অ্যাপার্টমেন্টে…খুনির সাথে এমন এক মেয়ে ছিলো যেকিনা রঞ্জুর স্ত্রীর বিউটি পার্লারে কাজ করতো, গতকালই দেহব্যবসায় নাম লিখিয়েছে। মেয়েটা লেডি গিয়াসের সাথে ছিলো। আবার খুনির সাথেও তাকে দেখা গেছে। অদ্ভুত!”

“স্যার, মেয়েটা কোনো এক পক্ষের হয়ে কাজ করেছে,” জামান নিজের মতামত জানলো। মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। হয়তো রঞ্জুর দলের ভেতর কোনো কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে।”

“হতে পারে।” কথাটা বলেই জেফরি উদাস হয়ে গেলে জামানও চুপ মেরে রইলো । তার বসের চিন্তায় কোনো ছেদ ঘটাতে চাইলো না সে।

“খুনির কাছে লেডি গিয়াস আর রঞ্জুর স্ত্রীর মোবাইল ফোন আছে।” অনেকক্ষণ পর আস্তে করে বললো ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। “আমরা এগুলো দিয়ে ট্র্যাক-ডাউন করতে পারি।”

“আমিও সেটাই ভাবছিলাম, স্যার,” জামান বললো ।

“তবে কাজটা একটু অন্যভাবে করতে হবে।”

“কিভাবে, স্যার?”

“মিনা, মানে রঙুর স্ত্রীর ফোন নাম্বার আমাদের কাছে আছে, আমি নিশ্চিত লেডি গিয়াস ঐ নাম্বারে ফোন করেছিলো। আমি চাই, আগে সেটা বের করতে।”

“তা করা যাবে, স্যার,” জামান আগ্রহী হয়ে উঠলো। “রঞ্জুর স্ত্রীর ফোনটা পোস্ট-পেইড, সুতরাং কললিস্ট সেভ করা থাকবে। ফোন কোম্পানিকে বললেই তারা জানিয়ে দেবে ঐ নাম্বারে গতকাল কোন কোন নাম্বার থেকে ফোন করা হয়েছে। সেইসব নাম্বারগুলো ফোন কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন থেকে চেক করে দেখা যাবে ওগুলো কাদের নাম্বার। সন্দেহজনক নাম্বারটা খুব সহজেই বের করা যাবে মনে হয়।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “তুমি নাম্বারটা নিয়ে কাজ শুরু করে দাও, আর কমিউনিকেশন রুমকে বলো আমি কিছুক্ষণ পর আসছি। সাবের কামাল যেনো রিপোর্ট নিয়ে ওখানে চলে আসে।”

“ঠিক আছে, স্যার।” জামান রুম থেকে চলে গেলো।

.

উমা বাড়িতে ফিরে দেখলো তার জন্য তার শয্যাসায়ী বাবা আর পিসি চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। তার মা এখনও হাসপাতালে। গতকাল বিকেলে শেষ দেখে এসেছিলো, তারপর আর যেতে পারে নি। এরইমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। কতো ঘটনা ঘটেছে তা পুরোপুরি মনেও করতে পারলো না। বলতে গেলে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছে সে।

অজ্ঞাত খুনি তাকে কেন রেহাই দিয়েছে আন্দাজ করতে পেরেছে। জ্বরের ঘোরে লোকটা আবোল তাবোল অনেক কথাই বলেছে। তা থেকে উমা বুঝতে পেরেছে খুনির মা খুব সম্ভবত বেশ্যা ছিলো। হয়তো নিজের মায়ের কথা ভেবে উমাকে এ যাত্রায় শুধু ছেড়েই দেয় নি সেইসাথে দুই লাখ টাকাও দিয়েছে । খুনির এমন বিপরীত আচরণে উমা বিস্মিত হয়েছে তবে তারচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ নিজের প্রাণটা নিয়ে ফিরে আসার জন্য ।

বাবাকে বলে গেছিলো বড় লোকের এক বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে, কনেকে সহ আরো অনেককে সাজাতে হবে। সারা রাত লেগে যাবে। ফিরবে সকালে । তারা যেনো কোনো চিন্তা না করে। বেশ ভালো টাকা দেবে তাই এই বাড়তি কাজটা নিয়েছে। বিউটি পার্লারে কাজ করে বলে তার বাবার কাছে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়েছে, তবে তার বিধবা পিসি-যে কিনা তার বাবাকে দেখাশোনা করে থাকে-তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না।

অজ্ঞাত খুনি তাকে টাকা দিয়ে বলেছে যতো দ্রুত সম্ভব জায়গা বদল করতে, এই ব্যাপারটা নিয়েই সে উদ্বিগ্ন এখন। এই শহরে হুট করে কোথাও ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে দু’লাখ টাকা হাতে থাকাতে মনে হচ্ছে চেষ্টা করলে সেটা সম্ভব হলেও হতে পারে। মায়ের অসুখের জন্য যে টাকার দরকার সেটা নিয়ে আর ভাবনা নেই তবে নতুন একটি চিন্তা যোগ হয়েছে। তাকে দ্রুত। এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। কিন্তু পিসি আর বাবাকে বোঝাবে কিভাবে? কী বলবে তাদেরকে? মিথ্যে কথা বলায় তেমন পারদর্শি নয় সে। মিথ্যে বলতে গেলে ছোটো বাচ্চাদের মতো তোতলাতে থাকে। নিজের কাছে কেমন জানি অপরাধি মনে হয়। তার এই স্বভাবটা সে পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। তার বাবা সারা জীবনে মিথ্যে বলে নি-অন্তত পরিচিত লোকজন আর আত্মীয়স্বজন এইরকমটিই বলে থাকে।

কিন্তু উমা জানে তাকে মিথ্যে বলতে হবে। অনেক মিথ্যে। তা না হলে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে যাবে।

ঠিক করলো স্নান করে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ধীরেসুস্থে পিসিকে কথাটা বলবে । এই ফাঁকে মিথ্যে একটা গল্প সাজিয়ে নিতে পারবে সে।

ঘরে বসে যখন এসব ভাবছে তখন তার পিসি দরজার কাছে এসে বললো, “কিছু খাবি?”

“না । আমি খেয়ে এসেছি।”

“হাসপাতালে যাবি কখন?”

“এই তো পিসি, স্নান করে যাবো।”

“তাহলে স্নান করে নে।” পিসি তাকে তাড়া দিয়ে চলে গেলো নিজের কাজে।

উত্তর রামপুরার এক সরু গলির শেষ মাথায় তাদের বাড়িটা । আজ অনেক দিন ধরে এখানে ভাড়া থাকে। দুটো মাত্র ঘর । কোনোমতে চলে যায়। চারদিকে পাকা দেয়াল মাথার উপরে টিনের ছাদ । এটাই উমাদের ছোট্ট সংসার। এখন যে ঘরে বসে আছে তার ঠিক পাশের ঘরেই তার বাবা থাকে। বিছানায় পড়ে থাকে আর কি। বাথরুম আর রান্নাঘর তিন ভাড়াটে পরিবার মিলে ব্যবহার করে। স্নান করার জন্য বাথরুমের সামনে এসে দেখতে পেলো লোক আছে ভেতরে। বাথরুমের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো। একটু আনমনা হয়ে ভাবতে লাগলো গতরাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটে গেছে।

খুনি লোকটার নাম নেই। তা কি করে হয়! তাকে আসলে বলে নি। বলতে চায় নি। খুনি হলেও লোকটার চোখ দুটো বেশ সুন্দর, তবে রেগে গেলে সেই চোখ দিয়ে যেনো শীতল আগুন বের হয়। উমা সেই আগুন দেখেছে। কী ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় সে খুনখারাবি করতে পারে ভাবাই যায় না! তবে লোকটার প্রতি তার এক ধরণের মায়া জন্মে গেছে। তার প্রতিও লোকটার মায়া জন্মে থাকবে হয়তো। নাকি করুণা? সে জানে না।

তবে আশ্চর্যের বিষয় লোকটার চোখ ছাড়া পুরো চেহারাটা স্মরণ করতে পারছে না এখন। গুলিয়ে ফেলছে । কেমন জানি দেখতে? বার বার শুধু চোখ দুটো ভেসে আসছে। পুরো চেহারাটা নয়।

আজব!

উমা খুব অবাক হলো। এই আগন্তুকের সাথে কাল রাত থেকে একটু আগে পর্যন্ত থেকেছে অথচ তার চেহারাটা মনে করতে পারছে না! বুঝতে পারলো তার মনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তার জন্যেই হয়তো এমনটি হচ্ছে। এটাকে কী বলে? যে চোখের সামনে নেই তাকে দেখা গেলে বলে দৃষ্টিবিভ্রম। কিন্তু একটু আগের দেখা কাউকে স্মরণ করতে না পারাকে কি বলে?

হঠাৎ তার চোখের সামনে লোকটার চেহারা ভেসে উঠলো। এই তো! মনে পড়েছে তার। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো সে আসলে অজ্ঞাত সেই খুনির দিকেই চেয়ে আছে ।

এটা কোনো দৃষ্টিবিভ্রম নয়!

হায় ভগবান!

.

কমিউনিকেশন রুমে বসে আছে ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। সে নিশ্চিত দুটো খুন একজনই করেছে! পেশাদার কেউই হবে। বেশ সতর্ক।

সম্ভবত খুনির কাছে ব্ল্যাক রঞ্জুর স্ত্রী আর লেডি গিয়াসের মোবাইল ফোন আছে। তারা এখন জেনে গেছে রঙুর স্ত্রীর ফোন নাম্বারটা । জামান চেক করে দেখছে সেই নাম্বারে বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় কে কে ফোন করেছিলো। মহিলার নাম্বার থেকে লেডি গিয়াসের নাম্বারটাও জেনে নিতে পারবে তারা। ভাগ্য ভালো থাকলে খুনির অবস্থানও জানা যাবে এভাবে ।

কাজ বেশ দ্রুত গতিতেই এগোচ্ছে। রামপুরা থানার একটি টিম চলে গেছে উমা রাজবংশী নামের সেই মেয়েটিকে গ্রেফতার করার জন্য। এই মেয়েটি খুনির সাথে ছিলো, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। মেয়েটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে। জেফরি আশা করছে খুব জলদি খুনিকে চিহ্নিত করতে পারবে তারা।

দরজা খোলার শব্দ শুনে দেখলো জামান বেশ উৎফুল্ল হয়ে ঘরে ঢুকছে। তার মানে ভালো খবর আছে। আশান্বিত হয়ে উঠলো জেফরি ।

“স্যার, মিনা নামের মহিলার ফোনে বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় সমস্ত ইনকামিং আর আউট গোয়িং কলের লিস্ট পাওয়া গেছে।”

“গুড।”

“মহিলা খুন হবার ঘন্টাখানেক আগে একটি কল করে এই নাম্বারে, জামান কাছে এসে হাতের একটি কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে জেফরিকে দেখালো । “এই নাম্বারটার পজিশন তখন ছিলো উত্তরায়…পিং সিটি হোটেলের কাছের একটি সেল-টাওয়ার…আমি নিশ্চিত, এটাই লেডি গিয়াসের নাম্বার।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। তার চোখ এখন কল-লিস্টের দিকে।

“স্যার, বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় মহিলার ফোনে ইনকামিং কল এসেছে মোট এগারোটি। এরমধ্যে একটা ওভারসিস কল…ইন্ডিয়া থেকে…কোলকাতার একটি নাম্বার। বাকিগুলো পালারের ইনচার্জ, মহিলার ড্রাইভার আর লেডি গিয়াসের।”

“ইন্ডিয়ার কলটা খুব সম্ভবত ব্ল্যাক রঞ্জুর, কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো জেফরি।

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। “পালারের ইনচার্জকে ফোন করা হয়েছে দু’বার,” যোগ করলো জামান।

লেডি গিয়াসের নাম্বার বলে যেটাকে সাসপেক্ট করছে সেটার খোঁজ নিয়েছো?” জানতে চাইলো জেফরি।

‘জি, স্যার।” আরেকটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো জেফরির দিকে। “এই নাম্বার থেকে মোট ছয়টি কল করা হয়েছে। রঞ্জুর স্ত্রীর নম্বারে করা হয়েছে তিন বার। মজার ব্যাপার হলো, খুন করার কিছুক্ষণ আগে…উমমম, সাত মিনিট আগে মহিলাকে ফোন করা হয়। অথচ তখন লেডি গিয়াস খুন হয়ে গেছে।”

“ধরে নাও ওটা খুনিই করেছে,” কাগজ থেকে চোখ তুলে বললো জেফরি বেগ।

“লেডি গিয়াসের ফোনে একটা নাম্বার থেকে দু’বার কল করা হয়েছে…লাল কালি দিয়ে সেটা আন্ডারলাইন করা আছে, স্যার।”

“এই নাম্বারটার পজিশন কোথায় ছিলো জানতে পেরেছো?”

“সবগুলো চেক করে দেখতে হলে কমপক্ষে দু’ঘণ্টা সময় লাগবে। আপনি বললে আমি চেক করে দেখতে পারবো।”

“আচ্ছা, এটা পরে দেখা যাবে…লেডি গিয়াসের ফোন নাম্বারটা কি এখনও ওপেন আছে?”

জেফরি এটা জামানকে বলে নি তারপরেও তার অনুমাণ তার এই সহকারী খুব সম্ভবত সেটা জেনে নিয়েছে। একজন ইনভেস্টিগেটরকে সব কিছু বলে না দিলেও অনেক কিছু নিজ থেকে করতে হয়। জামান ছেলেটার মধ্যে সেই গুন আছে।

“জি, স্যার। লেডি গিয়াসের ফোনটা ওপেন আছে। রঞ্জুর স্ত্রীরটা বন্ধ।”

“ঠিক আছে, লেডি গিয়াসের নাম্বারটার বর্তমান পজিশন বের করো।”

জামান কমিউনিকেশন রুমের প্যানেলের সারি সারি কম্পিউটার আর সুইচবোর্ডের সামনে বসে গেলো। কিছুক্ষণ কিবোর্ডে আঙুল চালিয়ে পেছন ফিরে বললো, “স্যার, ফিশিং করবো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি ।

এই ফিশিং-এর মানে হলো লেডি গিয়াসের নাম্বারটা যে ফোন কোম্পানির এখন সেই কোম্পানির পক্ষ থেকে একটি সার্ভিস মেসেজ পাঠানো হবে। এ কাজ করার অথরিটি তাদের আছে। ফোন কোম্পানিগুলোর সাথে সহযোগীতার মাধ্যমেই এটা করা হয়। প্রতিটি ফোন কোম্পানিই তার গ্রাহকদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে মেসেজ পাঠিয়ে থাকে মাঝেমধ্যে। এরকমই একটি ভুয়া মেসেজ পাঠানো হবে লেডি গিয়াসের নাম্বারে। মেসেজ রিসিভ করার দরকার হবে না। সেন্ট হয়ে গেলেই তাদের স্টেট অব আর্ট জিপিএস মডেমে ধরা পড়বে লেডি গিয়াসের ফোনটি এই মুহূর্তে কোথায় আছে। ফোন কোম্পানির চেয়েও তারা অনেক নিখুঁতভাবে অবস্থান বের করতে পারে। তাদের কম্পিউটারে ঢাকা শহরের ভার্চুয়াল ম্যাপ রয়েছে। একেবারে নিখুঁত একটি ম্যাপ। লক্ষ-লক্ষ হোল্ডিং নাম্বার আর পথঘাটের থ্রি-ডি মানচিত্র। তারা শুধু সবচাইতে কাছের সেল-টাওয়ারই চিহ্নিত করতে পারবে না বরং ফ্রিকোয়েন্সির সূক্ষ্ম তারতম্য অনুসারে সঠিকভাবে জানতে পারবে ঠিক কোথায় ফোনব্যবহারকারী অবস্থান করছে।

তাদের কাছে থাকা অনেকগুলো মেসেজ থেকে একটা মেসেজ পাঠানো হলো : বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস উপলক্ষ্যে একটি জনসচেতনতামূলক বাতা!

এবার প্যানেলের সামনে ছাপান্ন ইঞ্চির এলসিডি মনিটরে ঢাকা শহরের মানচিত্রটা ভেসে উঠলো। পাঁচ সেকেন্ড পরই ডিটেক্ট করা যাবে গ্রাহক-ফোনের অবস্থান।

স্ক্রিনের একপাশে লাল রঙের একটি ছোট্ট আলোক বিন্দু ব্লিপ করলে জামান পেছন ফিরে তাকালো। “স্যার, রামপুরায়!”

.

উমা একেবারে হকচকিয়ে যায়। তার বাড়ির আঙিনায় এসে পড়েছে অজ্ঞাত খুনি! এই লোকটাই কিছুক্ষণ আগে তাকে প্রাণে না মেরে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে দিয়েছিলো। এখন আবার কী মনে করে তার বাড়িতে এসেছে। তাহলে তার পেছন পেছন বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করেছে তাকে?

“আপনি!” অক্ষুটভাবে কথাটা বলতে পেরেছিলো সে।

এমন সময় মোবাইল ফোনের বিপ হলে প্যান্টের পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে বাস্টার্ড। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের কেউ ফোন করবে এই আশায় চালু রেখেছিলো লেডি গিয়াসের ফোনটা । ডিসপ্লের দিকে তাকায় সে।

একটা মেসেজ! ওপেন করে দেখে :

আজ বিশ্ব মাতৃ দুগ্ধ দিবস…

বিরক্ত হয়ে ফোনসেটটা আবার পকেটে রেখে দেয়।

.

“জলদি, এখান থেকে চলে যেতে হবে!” উমাকে তাড়া দিয়ে বলে সে। “পুলিশ আসছে…”

“পুলিশ!?” আৎকে ওঠে উমা।

বাস্টার্ড তার হাতটা ধরে বলে, “চলো।”

উমার মাথা ঘুরতে শুরু করে। “কোথায়?”

“আগে এখান থেকে পালাতে হবে…আসো!” হাত ধরে টান দেয় সে।

“আমার বাবা…পিসি…?”

“পুলিশ তাদেরকে ধরতে আসে নি…তোমাকে ধরতে এসেছে। আসো!”

উমার হাতটা ধরে টেনে তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সাদা রঙের গাড়িটা পার্ক করা ছিলো তাদের বাড়ির গেটের কাছে। গাড়িতে ওঠার আগে বাস্টার্ড চেয়ে দেখে মেইন রোড থেকে পুলিশের একটা জিপ গলিতে ঢুকছে।

আর দেরি করে নি, গাড়িতে উঠেই গলির ভেতরের দিকে ছুটে চলে সে। এই গলিটা ভালো করে চেনে না। এখান থেকে কোথায় যাওয়া যাবে সেটাও বুঝতে পারে না। শুধু জানে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে হবে তাকে।

“এই গলিটা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়, জানো?” উমা তখনও ধাতস্থ হতে পারে নি। মাথা দোলায় সে। জানে না।

বাস্টার্ড চিন্তায় পড়ে যায়। সরু গলি দিয়ে খুব বেশি স্পিডে যেতে পারছিলো না। তবে পুলিশের গাড়িটা তাদের পিছু নেয় নি। ওটার গন্তব্য যে উমাদের বাড়ি সেটা বাস্টার্ড জানতো।

সাপের মতো একেঁবেঁকে অনেকটা পথ পেরোনোর পর মেইন রোডে উঠে আসে তাদের গাড়িটা। হাফ ছেড়ে বাঁচে বাস্টার্ড। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়।

উমা বুঝতে পারে না এই খুনি কিভাবে জানতে পারলো তার বাড়িতে পুলিশ আসছে। লোকটা তো তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছিলো!

রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে চকিতে উমাকে দেখে নেয় বাস্টার্ড। সেও বুঝতে পারে মেয়েটা কি ভাবছে।

“তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি সামনের এক পেট্রলপাম্পে গেছিলাম তেল ভরার জন্য…” সামনের দিকে চেয়ে বলে সে। “ওখানে যখন তেল ভরার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখনই পুলিশের গাড়িটা আসে পেট্রলপাম্পে…ভাগ্য ভালো যে ওদেরও তেল ভরার দরকার পড়েছিলো, তা না হলে যে কী হতো কে জানে!”

“কিন্তু আমার বাড়িতে আসছে সেটা বুঝলেন কী করে?” কাঁদো কাঁদো গলায় জানতে চেয়েছিলো উমা।

“জিপটা আমার গাড়ির পেছনেই ছিলো…পুলিশ অফিসার ওয়াকিটকিতে– কন্ট্রোলরুমের সাথে কথা বলছিলো জোরে জোরে…আমি সব শুনেছি।”

“আমার খোঁজ পেলো কি করে?”

চকিতে তাকায় মেয়েটার দিকে। “সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না!”

“আপনি নিশ্চিত, পুলিশ আমাকে খুঁজছে?” উমা তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলো না ব্যাপারটা।

“হুম। উমা রাজবংশী…উত্তর-রামপুরা…২৭/৩…আমি সেখান থেকেই তোমার বাড়ির ঠিকানাটা জেনেছি।”

কথাটা শুনে উমার চোখের পলক আর পড়ে না।

“সঙ্গে সঙ্গে আর দেরি না করে গড়িটা নিয়ে চলে আসি তোমার বাড়িতে…পুলিশের গাড়ির সিরিয়াল ছিলো আমার পরেই।”

“আমার বাবা, পিসি…তাদেরকে যদি পুলিশ ধরে?” আতঙ্কিত হয়ে জানতে চায় উমা।

গাড়িটা খুব দ্রুত গতিতে চলছে তাই মেয়েটার দিকে না তাকিয়ে বলে, “আমার মনে হয় না তাদেরকে কিছু করবে,” একটু থেমে চকিতে আবারো তাকায় তার দিকে। “হয়তো তোমার কথা জানতে চাইবে…একটু জিজ্ঞাসাবাদ করবে…”

দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে উমা। সে নিজে তো বিপদে পড়েছেই এখন তার বাবা আর পিসিকেও ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে।

.

জেফরি বেগ নিশ্চিত খুনি মেয়েটাসহ মেয়েটার রামপুরার বাড়িতে গেছে। জিপিএস মডেমে ডিটেক্ট করার পর আর দেরি করে নি, জামানকে বলেছে রামপুরায় উমা রাজবংশী নামের মেয়েটির বাড়িতে পুলিশের যে দলটি গেছে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া, তারা যেনো আরো বেশি সতর্ক হয়ে বাড়িটাতে রেড দেয়। ঐ বাড়িতে সম্ভাব্য খুনি আছে!

জামান যখন পুলিশকে কথাটা জানালো তখন তারা উমাদের বাসার খুব কাছেই। কিন্তু জেফরিকে এক রাশ হতাশায় ডুবিয়ে টহলদলটি হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টকে জানায় ঐ বাড়ি থেকে তারা উমা কিংবা খুনি, কাউকেই গ্রেফতার করতে পারে নি । উমার শয্যাসায়ী বাবা আর বৃদ্ধ পিসি জানিয়েছে, গুলশানের এক বড়লোকের বিয়ে বাড়িতে উমা সাজাগোজের কাজে কাল সারারাত বাড়ির বাইরে ছিলো। সকালে, পুলিশ আসার একটু আগে, বাড়িতে আসে সে। স্নান করবার জন্যে বাথরুমেও গিয়েছিলো, কিন্তু তারপর সে কোথায় গেছে তারা কিছুই জানে না।

অদ্ভুত! পুলিশ আসার আগেই মেয়েটা টের পেয়ে গেলো!

উমার পিসি আরো জানিয়েছে, উমার সাথে আর কেউ ছিলো না। সে । একদম একা বাড়িতে ফিরেছিলো।

তাহলে কি লেডি গিয়াসের ফোনটা উমার কাছে?

জেফরির তা মনে হয় নি। কিছুক্ষণ পর পুলিশ জানায় উমাদের প্রতিবেশি এক ভদ্রমহিলা নিজের ঘরের জানালা দিয়ে দেখেছে এক যুবক উমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। কথাটা শোনার পর থেকে জেফরি কোনো হিসেব মেলাতে পারছে না।

ঐ খুনি কিভাবে জানলো, কোত্থেকে জানলো পুলিশ উমার বাড়িতে রেড দিতে যাচ্ছে?

বুঝতে পারলো গোলকধাঁধার মতো জটিল হয়ে উঠছে কেসটা। পুলিশের আগমনের পাঁচ মিনিট আগে খুনি উমাকে নিয়ে তার বাড়ি থেকে সটকে পড়েছে। জেফরি টের পেলো তার মেজাজ বিগড়ে গেছে। জামানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আরেকটা ফিশিং করো!”

জামান বুঝতে পারলো তার বসের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। পেছনে না তাকিয়ে কাজ করতে শুরু করে দিলো সে। এবার পাঠালো বোনাস পাওয়া নিয়ে একটি মেসেজ। গ্রাহক কি করলে কতো বোনাস পাবে, এরজন্যে কি লিখে কতো নাম্বারে মেসেজ পাঠাতে হবে এরকম হাবিজাবি একটি মেসেজ। যেকোনো সেলফোন গ্রাহকের কাছে এটি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। খুনি বুঝতে পারবে না তাকে আসলে ডিটেক্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ছাপান্ন ইঞ্চির এলসিডি স্ক্রিনে এবার যে ব্লিপটা হলো সেটা নির্দেশ করছে ফোনসেটটা এখন মালিবাগে আছে। এতো দ্রুত উত্তর রামপুরা থেকে এখানে চলে এলো কিভাবে!

“স্যার, আমার মনে হয় খুনি গাড়িতে করে” জামান তার কথাটা শেষ করতে পারলো না।

“পুলিশকে ইনফর্ম করো,” চট করে বললো জেফরি। “ওদেরকে বলো, রামপুরা থেকে মালিবাগ পর্যন্ত সব কটি পয়েন্টে যতোগুলো টহল দল আছে সবাইকে জানিয়ে দিতে…” কথাটা বলেই থেমে গেলো সে। বুঝতে পারলে নির্দিষ্ট কোনো গাড়ির বর্ণনা কিংবা কোন ধরণের গাড়িতে করে যাচ্ছে সেটা উল্লেখ না করলে রাস্তাঘাটে টহল পুলিশ কোনোভাবেই গাড়ি থামিয়ে চেক করতে পারবে না।

চেয়ে দেখলো জামান পেছন ফিরে তার দিকে চেয়ে আছে। নিজেকে একটু বোকা বোকা লাগলো। “স্যার-” জামানকে হাত তুলে থামিয়ে দিলো।

“বুঝতে পেরেছি।” কথাটা বলেই গাল চুলকালো।

ঠিক এমন সময় রমিজ লস্কর ঢুকলো কমিউনিকেশন রুমে। জেফরির উদ্দেশ্যে সে বললো, “স্যার, পুরনো ঢাকার নাজিরা বাজারে একটা মার্ডার হয়েছে…এইমাত্র খবর পেলাম।”

জেফরি একটু অবাকই হলো। নাজিরা বাজারে খুন হয়েছে সে কথা বলার জন্য রমিজ লস্কর এভাবে ছুটে আসবে! কোনো খুন হলে সেটা স্থানীয় থানার বিষয়। তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে জানায়। সেখান থেকে উর্ধতন কর্মকর্তারা গুরুত্ব বুঝে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টকে ইনভেস্টিগেশন করতে বলে। রমিজ লস্কর এই খবর পেয়ে এভাবে ছুটে আসবে কেন–এরপরই জবাবটা পেলো সে।

“সুলতান নামের এক বিশ-বাইশ বছরের যুবক।” রমিজ তার কথা শেষ করলো। তার চোখেমুখে উত্তেজনা ।

“এটা কি আমাদেরকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে?” জেফরি জানতে চাইলো ।

“এখনও সেরকম কোনো কিছু বলা হয় নি, স্যার।” রমিজের চোখেমুখে এখনও প্রবল উত্তেজনা।

“তাহলে এই খবরটা আমাদেরকে জানানোর মানে কী?”

“স্যার, এই সুলতান ছেলেটা ব্ল্যাক রঞ্জুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী!”

.

অধ্যায় ১৭

বাস্টার্ডের গাড়িটা শহরের কোন জায়গায় আছে উমা সেটা বলতে পারবে না । বাবা-মা আর পিসির চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে সে। নিজের চেয়েও তাদেরকে নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। বিশাল কোনা ঝামেলায় পড়ে গেছে সে ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার পাশে বসা অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকটাকে নিয়ে তার মধ্যে কোনো ভয়ডর কাজ কছে না এখন।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।

“আমরা এখন কোথায়?” জানতে চাইলো উমা।

“ইকুরিয়ায়।”

উমা কিছুই বুঝতে পারলো না। এ নামের কোনো জায়গার নাম সে । কখনও শোনে নি। চারপাশটা ভালো করে চেয়ে দেখলো ঢাকা শহরের মতো মনে হচ্ছে না। আধা-গ্রাম আধা-শহর। তবে রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।

“বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে, তার চাহনি দেখে বাস্টার্ড বললো। “কেরাণীগঞ্জ।”

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

মেয়েটার দিকে তাকালো সে। “ডাক্তারের কাছে।”

“তারপর আমি কোথায় যাবো?”

“দেখি কী করা যায়।” একটু থেমে আবার বলতে লাগলো, “আমি জানতাম তোমার এরকম কোনো সমস্যা হবে, কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নি।” একটু থেমে আবার বললো, “ভেবেছিলাম রঞ্জুর দল তোমার পেছনে লাগবে, পুলিশও দুয়েক দিনের মধ্যে তোমার খোঁজ করবে কিন্তু এখন তো দেখছি…!”

“আমি এখন কী করবো?” উমার কণ্ঠটা ধরে এলো।

উমার দিকে স্থির চোখে তাকালো সে। “আমার নিজের প্রয়োজনেই তোমাকে এসব থেকে দূরে রাখতে হবে।”

উমা কিছু বললো না।

“আমার এক পরিচিত লোকের কাছে তোমাকে রেখে দিতে পারি, বললো বাস্টার্ড ।

“কিন্তু আমার বাবা আর পিসি? মা তো এখনও হাসপাতালে!” বাস্টার্ড কিছু বললো না । এটা আসলেই একটা সমস্যা। এই সমস্যাটা খুব সহজেই সমাধান করা যেতো কিন্তু সেই সহজ কাজটাই তার জন্যে কঠিন হয়ে গেছে মেয়েটার কারণে। মেয়েটা যদি তার সাথে এমন না করতো, যদি সে বৈরী আচরণ করতো তাহলে নির্দ্বিধায় তাকে খুন করতে পারতো…

“আপনি কি ঝামেলা মনে করলে আমাকেও খুন করবেন?” বাস্টার্ডের দিকে তাকিয়ে উমা বেশ শান্ত কণ্ঠে বললো।

একটু চমকে গেলো বাস্টার্ড । মেয়েটা কি তার মনের কথা পড়ে ফেলেছে! কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “সেটা তো অনেক আগেই করতে পারতাম!”

একটু পর মেয়েটা আরো দৃঢ়ভাবে বললো, “আমি এভাবে পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারবো না।”

চকিতে তার দিকে তাকালো বাস্টার্ড । “টাকাগুলো কোথায়?”

প্রথমে বুঝতে পারলো না সে, তারপরই মনে পড়ে গেলো দু’লাখ টাকার কথা। এই লোকটাই তো তাকে টাকাগুলো দিয়েছিলো! স্নান করার আগে ওয়ার্ডরোবে কাপড়চোপড়ের ভাঁজে বান্ডিল দুটো রেখে দিয়েছিলো সে।

“আমার বাড়িতে।”

আলতো করে মাথা দোলালো বাস্টার্ড । “বাড়িতে তোমার পিসি আর বাবা আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো উমা । “তোমার মা কোন্ হাসপাতালে?”

“হলি ফ্যামিলিতে।”

চিন্তায় পড়ে গেলো সে। মেয়েটার মা যদি হাসপাতালে না থাকতো তাহলে তার বাবা আর পিসিকে রামপুরা থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও রাখা যেতো। মাথাটা কাজ করছে না। কাঁধের ব্যাথাটা তাকে সুস্থিরভাবে চিন্তাও করতে দিচ্ছে না।

“আগে ডাক্তার দেখাই, তারপর এটা নিয়ে ভাবা যাবে।”

.

“সুলতানকেও সাইলেন্সর পিস্তল দিয়ে খুন করা হয়েছে!” নাজিরাবাজারের আহলে হাদিস মসজিদের পাশে আলিমুদ্দীনের বাড়ি থেকে ফিরে এসে নিজের অফিসে বসে কথাটা বললো জেফরি বেগ। “আশেপাশের কেউ গুলির শব্দ শোনে নি।”

“স্যার, এক দিনে ব্ল্যাক রঞ্জুর তিনজন ঘনিষ্ঠ লোককে হত্যা করা হয়েছে,” বললো জামান। বসে আছে জেফরির সামনে। “মনে হয় রঞ্জুর দলের ভেতর বড় রকমের কোনো ফ্র্যাকশন হয়েছে।”

মাথা দোলালো জেফরি। কথাটা মেনে নিতে পারলো না সে। “ব্ল্যাক রঞ্জুর দলে এরকম কিছু ঘটে থাকলে পাল্টাপাল্টি আরো কিছু ঘটনা ঘটতো, তিন তিনটি খুনের পরও রঙুর দলের কোনো তৎপরতা নেই।”

“ঘটনা তো মাত্র শুরু হয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যেই দেখবেন আরো কিছু খুনখারাবির ঘটনা ঘটে গেছে,” জামান বললো।

“তার মানে, আরো কিছু হত্যাকাণ্ড দেখতে হবে আমাদেরকে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান।

“তার আগেই ব্যবস্থা নেয়ার দরকার।”

“স্যার, এরকম গ্যাংয়ের মধ্যে খুনাখুনি নতুন কিছু না। এরা এভাবে খুনাখুনি করে দুর্বল হলে আমাদের সবার জন্যেই ভালো।”

“এক দিক থেকে তোমার কথায় যুক্তি আছে, মানছি। কিন্তু ঘটনা যদি সেরকম কিছু না হয়ে থাকে?…মানে, আমরা তো এখনও জানি না এর পেছনে আসল কারণটা কি।”

জামান মাথা নেড়ে সায় দিলেও কিছু বললো না।

“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?” সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকালো জামান। “রঞ্জুর তিনজন সহযোগী খুন হলো…তিনজনের মোবাইল ফোনই খুনি সাথে করে নিয়ে গেছে। অন্য কিছু না।”

একটু ভেবে জামান বললো, “খুনি হয়তো চায় নি মোবাইল ফোনগুলো পুলিশের হাতে পড়ক। সে হয়তো মোবাইলে ফোন করেছিলো…তার নাম্বার হয়তো সেসব মোবাইলে আছে?”

“হয়তো!” একটু চুপ থেকে জেফরি বললো, “আমার কেন জানি মনে হচ্ছে খুনি একেবারে অজ্ঞাত কেউ…মানে রঞ্জুর দলের লোকজন তাকে চেনে না।”

“এটা কেন মনে হচ্ছে, স্যার?”

“প্ৰথম খুনটা হবার পর খুনি লেডি গিয়াসের রুম থেকে উমা নামের কলগার্লকে সাথে করে হোটেল থেকে বেরিয়ে যায়। কেন? ঐ মেয়েটাকে সাথে করেই সে চলে যায় রঞ্জুর স্ত্রীর অ্যাপার্টমেন্টে। কারণ…খুনি সম্ভবত রঞ্জুর দলের আস্তানা চিনতো না। তাই মেয়েটাকে ব্যবহার করেছে।”

“স্যার, এমনও তো হতে পারে, মেয়েটার সাথে আগে থেকেই খুনির সম্পর্ক ছিলো…মানে খুনির হয়ে কাজ করেছে?” জামান আগ্রহী হয়ে বললো।

‘না। তাই যদি হতো তাহলে মেয়েটাকে নিয়ে রঙুর স্ত্রীর ওখানে যাবার কোনো দরকারই ছিলো না।”

“স্যার, রঞ্জুর স্ত্রীর অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার জন্যে মেয়েটাকে নিয়ে গেছে হয়তো।”

জামানের এ কথাটা জেফরির মনে ধরলো । মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “তা হতে পারে।” একটু থেমে আবার বললো, “ভালো কথা, উমার একটা ছবি আর ফোন নাম্বার জোগার করার কথা বলেছিলাম, করেছো?” জেফরি বললো।

“উমা কোনো ফোন ব্যবহার করে না। ওর বাড়ির কেউও ফোন ব্যবহার করে না, স্যার। ওদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। তবে বিউটি পার্লার থেকে কর্মচারিদের একটা গ্রুপ ছবি জোগার করেছে পুলিশ। সেটা থেকে সিঙ্গেল একটা ছবি তৈরি করা যাবে।”

“গুড,” একটু ভেবে নিলো জেফরি বেগ। “উমাদের ফোন নেই, তাই না?” মাথা নেড়ে আবারো সায় দিলো জামান । “যাদের ফোন নেই তারা কি করে, জামান?”

জামান চট করে বললো, “স্যার, ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে ফোন করে।”

“আর তাদেরকে যদি কেউ ফোন করতে চায়, তখন?”

জামান ভাবতে লাগলো। “উমমম…”

“আশেপাশের কারো ফোন ব্যবহার করে। তাই না?”

“জি, স্যার।”

“তুমি উমার আশেপাশে ওর পরিচিত কয়েক জনের ফোন নাম্বার কৌশলে জোগার করার ব্যবস্থা করো। তারা যেনো বুঝতে না পারে, ঠিক আছে?”

“জি, স্যার।”

“আমি নিশ্চিত, মেয়েটা তার বাড়ির লোকজনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেই।”

“আমারও তাই মনে হচ্ছে, স্যার।”

“আচ্ছা, ভালো কথা, উমার বাড়ির আশেপাশে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন কিছু পেয়েছে?”

“একটা তথ্য পাওয়া গেছে, স্যার। উমার বাড়ির সামনে একটা সাদা রঙের প্রাইভেট কার দেখা গিয়েছিলো পুলিশ আসার কিছুক্ষণ আগে। সম্ভবত ওটাতে করেই তারা দু’জন পালিয়েছে।”

আশান্বিত হয়ে উঠলো জেফরি । “তাহলে তো ট্র্যাকডাউন করার কাজটা আবার করা যায়, নাকি?”

“তা করা যায়, কিন্তু গতকাল রাতে লাল রঙের গাড়ি ব্যবহার করেছিলো খুনি, আজ করছে সাদা রঙের গাড়ি । এখন আবার কী ব্যবহার করছে কে জানে।”

“চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি।”

আবারো একটা ফিশিং করে খুনির অবস্থান জেনে নেয়ার চেষ্টা করলো তারা। জেফরি বেগের চোখ বড় এলসিডি স্ক্রিনে নিবদ্ধ।

ভার্চুয়াল মানচিত্রে কিছু দেখা যাচ্ছে না এখন। ফিশিং করার পরও কোনো রেসপন্স নেই।

“স্যার, মোবাইল বন্ধ করে রাখা আছে হয়তো,” জামান পেছন ফিরে বললো।

“কিংবা নেটওয়ার্কের সমস্যা, যোগ করলো জেফরি ।

এমন সময় ডিপার্টমেন্টের রমিজ লস্কর কমিউনিকেশন রুমে ঢুকলো।

“স্যার, উত্তরার পিং সিটি হোটেলের ম্যানেজারকে নিয়ে আসা হয়েছে, ইন্টেরোগেশন রুমে রাখা হয়েছে তাকে।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জেফরি। “জামান, তুমি : সেলফোন কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগ করে আরো কিছু তথ্য জেনে নাও। কি

জানতে হবে নিশ্চয় বুঝতে পারছো?”

“জি, স্যার।”

আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো জেফরি বেগ।

.

জিলানি ডাক্তারের চেম্বারটা কেরাণীগঞ্জের নারকোল বাগে অবস্থিত। বিশাল পৈতৃক বাড়ির সামনের অংশে তার ওষুধের দোকান। সেই দোকানের পেছনেই ছোটোখাটো একটি ডাক্তারি চেম্বার ছিলো এখন সেটাকে ক্লিনিকে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

জিলানি ডাক্তার নামে পরিচিত হলেও তার কোনো ডাক্তারি ডিগ্রি নেই। বহুকাল আগে, তরুণ জিলানি স্থানীয় ডাক্তার বৈদ্যনাথ আচার্যের অধীনে কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ শুরু করে, একাত্তর সালে পাকবাহিনীর হাতে বৈদ্যনাথ নিহত হলে বেকার হয়ে পড়ে জিলানি। কিন্তু বেশি দিন তাকে ঘরে বসে থাকতে হয় নি। চারদিকে যুদ্ধ। শতশত লোকের মৃত্যু হচ্ছে, আহত হচ্ছে তারচেয়েও বেশি। ডাক্তারের খুব প্রয়োজন অথচ ডাক্তার নেই। বেশিরভাগ ডাক্তার পালিয়ে চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। যারা আছে তারাও ঢাকা শহর ছেড়ে অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে।

এক রাতে স্থানীয় কিছু মুক্তিযোদ্ধা জিলানির বাড়িতে এসে হাজির হয়। তাদের দু’জন সঙ্গি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। গুলি বের করতে হবে। কিন্তু আমি তো ডাক্তার নই। আমার কোনো ডিগ্রি নেই! তার দরকার নেই। গুলি বের করতে পারলেই হবে। ডিগ্রি দেখার সময় নেই। বের করতে পারবেন তো? অবশ্যই পারবো। পিরবো না কেন! কম্পাউন্ডার হিসেবে তো কম কাজ করি নি!

ব্যস, জিলানি কম্পাউন্ডার হয়ে উঠলো জিলানি ডাক্তার। লোকজন তখন থেকেই তাকে ডাক্তার নামে ডাকতে শুরু করে।

বাস্টার্ডের সাথে তার পরিচয় বহু দিনের। লোকটা তার বাবার বন্ধু। এখন বয়স হয়ে গেছে কিন্তু নিয়মিত ওষুধের দোকানে বসে। নিজের এক ছেলেকে মেডিকেলে পড়িয়ে জিলানি ডাক্তার তার ক্লিনিকের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে সেই ছেলের হাতে। তবে ক্লিনিকের ব্যাপারে এখনও জিলানি ডাক্তারই সর্বের্সবা।

বাস্টার্ডের গাড়িটা যখন তার চেম্বারের সামনে এসে থামলো জিলানি ডাক্তার তখন ওষুধের দোকানের সামনে বসে পত্রিকা পড়ছে আর আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

বাইফোকাল লেন্সের চশমার উপর দিয়ে পণ্ডিত মশায়ের দৃষ্টি হেনে দেখলো সাদা রঙের একটি গাড়ি তার দোকানের সামনে এসে থেমেছে। বাস্টার্ডকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে পত্রিকাটা নামিয়ে রাখলো ভদ্রলোক।

“কি ব্যাপার, তুমি…!” অবাক হলো জিলানি ডাক্তার। বাস্টার্ড সচরাচর এখানে আসে না।

গাড়ি থেকে নেমে তার সামনে এসে দাঁড়ালো বাস্টার্ড। “চাচা, একটু ক্লিনিকে আসুন।” বলেই সে ভেতরে যাবার জন্য তাড়া দিলো।

জিলানি ডাক্তার গাড়ির ভেতরে উমাকে দেখিয়ে বললো, “বিয়া করছো নি?”

“না, চাচা। একটা সমস্যায় পড়েছি, একটু ক্লিনিকে আসেন।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জিলানি ডাক্তার । “বাবা, আমার এখানে কিন্তু এম.আর করা হয় না।”

বাস্টার্ড বুঝতে পারলো না। “বুঝলাম না, চাচা?”

কানের কাছে মুখ এনে জিলানি সাহেব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, “গর্ভপাত!”

বুড়োর কথা শুনে হাসি পেলো তার। মাথা দুলিয়ে বললো, “ওসব কিছু না। গুলি লেগেছে, ইনজুরিটা একটু দেখতে হবে।”

আৎকে উঠলো ডাক্তার। “কার লাগছে?”

“আমার।”

ভালো করে বাস্টার্ডের দিকে তাকালো জিলানি ডাক্তার। “তোমার?” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “কোনখানে?”

“চাচা, ভেতরে আসেন…সব বলছি।”

এবার জিলানি ডাক্তারই ভেতরে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। “চলো চলো।” কী মনে করে যেনো একটু থেমে বাইরে গাড়ির দিকে চেয়ে বললো, “মাইয়াটা কি গাড়িতেই থাকবো?”

“হুম।” ।

“ক্লিনিকের সামনে গাড়িতে কোনো যুবতী মাইয়া বইসা থাকলে লোকজন সন্দেহ করবো…ওরে ভেতরে নিয়া আসো।”

“ঠিক আছে, আপনি ক্লিনিকে যান আমি ওকে নিয়ে আসছি।”

.

অধ্যায় ১৮

পিং সিটির ম্যানেজার প্রথম থেকেই উল্টাপাল্টা কথা বলে যাচ্ছে। জেফরি অনেক ধৈর্য নিয়ে শুনে গেলো তার কিসসাকাহিনী । লোকটাকে যখন ইন্টেরোগেশন রুমের চেয়ারে বসানোর পর পলিগ্রাফ সেন্সর ক্যাবল তার শরীরে লাগানো হচ্ছিলো তখন বেশ ভড়কে গেছিলো।

হোটেল রেজিস্ট্রেশনে লেডি গিয়াসের নাম-ধাম কেন লিপিবদ্ধ করা হয় নি তার কারণ হিসেবে পুলিশের কাছে যা বলেছিলো এখন সেখান থেকে সরে এসেছে লোকটা।

“স্যার, মেয়েমানুষ নিয়ে একটু…মানে বুঝতেই তো পারছেন, ফুর্তি করতে এসেছিলো, তাই রেজিস্ট্রশনে নামটাম কিছু লিখি নাই। কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার…বুঝতেই তো পারছেন…আমি স্বীকার করছি এটা অন্যায় হয়েছে কিন্তু বিশ্বাস করেন এর পেছনে আর কোনো কারণ নেই। তাকে আমি চিনতাম না।”

লোকটা যে মিথ্যে বলছে তার জন্যে পলিগ্রাফ টেস্টের রেজাল্ট দেখার দরকার নেই জেফরির। যদিও তার সামনে একটা ল্যাপটপের পর্দায় পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল ভেসে উঠছে প্রতি মুহূর্তে ।

কিছু দিন আগে পলিগ্রাফ মেশিনটা আপগ্রেড করা হয়েছে। এখন আর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করার দরকার পড়ে না। ইন্টেরোগেশন রুমে বসেই তারা জানতে পারে সেটা । মিথ্যে বলার পর পরই কম্পিউটার স্ক্রিনে ফলাফল দেখা যায়।

লেডি গিয়াসকে আপনি চেনেন সেটা তো আমি বলি নি,” টেবিলে একটু আগে দেয়া কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললো জেফরি । “হোটেলগুলোতে অসামাজিক কার্যকলাপ হয় সেটা আমরাও জানি…কিন্তু এটাও জানি সেক্ষেত্রে ভুয়া নাম-ঠিকানা লিখে রাখা হয়। আপনি তো তাও করেন নি।”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ম্যানেজার।

“কতো দিন ধরে এই হোটেলে কাজ করছেন?” জেফরি প্রসঙ্গ পাল্টালো।

“দেড় বছর ধরে।”

“এই হোটেলটা তো দেড় বছর আগেই চালু হয়, তাই না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ম্যানেজার।

“তার মানে শুরু থেকেই আছেন…এর আগে কোথায় কাজ করতেন?”

“এর আগে আমি কোথাও কাজ করতাম না, স্যার।”

লোকটা প্রথম থেকেই ক্ষণে ক্ষণে তাকে স্যার বলছে । থ্রি-স্টার দাবি করে এরকম কোনো হোটেলের ম্যানেজার সরকারী কর্মচারিদের স্যার বলবে না। এটা করে থাকে স্বল্প শিক্ষিত লোকজন। অবশ্য অনেক শিক্ষিত লোকজনও যে করে না তা নয়।

“হোটেলে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই অথচ সরাসরি ম্যানেজার হয়ে গেলেন?”

এবারও কিছু বললো না সে।

“মালিকপক্ষের সাথে খুব খাতির আছে মনে হয়?…আত্মীয়-টাত্মীয় হয় নাকি?”

“জি, স্যার।”

“মালিক কে?”

“মনোয়ার হোসেন।”

“উনার আর কি কি ব্যবসা আছে?”

“রিয়েল এস্টেট…ফিল…রেস্টুরেন্ট…”

“ফিল্ম?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ম্যানেজার।

“ভালো।” আবারো কফিতে চুমুক দিলো সে। “তাহলে আপনার মালিক মনোয়ার হোসেন সাহেব চলচ্চিত্র প্রযোজক?”।

“জি, স্যার।”

“উনি কি প্রযোজক হিসেবে নিজের নাম ব্যবহার করেন?” জেফরি জানে অনেক প্রযোজকই নিজের নামে ব্যবসাটা করে না। পর্দার আড়াল থেকে টাকা বিনিয়োগ করে থাকে।

“জি, স্যার। নিজের নামেই করে।”

“আপনার মালিকের সাথে কি লেডি গিয়াসের কোনো সম্পর্ক আছে?”

“না।”

ল্যাপটপের পর্দায় বিপ হচ্ছে। মিথ্যে।

“আপনি এভো মিথ্যে বলে বাঁচতে পারবেন না,” জেফরি হেসে বললো । “আমি নিশ্চিত, যেভাবে মিথ্যে বলছেন তাতে করে এই খুনের ঘটনায় নির্ঘাত ফেঁসে যাবেন। আদালত মনে করবে আপনি এইসব খুনের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত…নইলে এতো মিথ্যে বলবেন কেন।” একটু থেমে দেখে নিলো লোকটাকে। ভড়কে গেছে মনে হলো। “লেডি গিয়াস কবে হোটেলে উঠেছিলো?”

“চার-পাঁচ দিন আগে,” ঢোক গিলে বললো ম্যানেজার।

“চার-পাঁচ দিন ধরে লোকটা একের পর এক মেয়ে নিয়ে এসে ফুর্তি করে গেছে?”

“না, স্যার।”

“তাহলে?”

“কালকেই প্রথম মেয়ে নিয়ে আসে…”

সত্যি বলছে।

“ভালো।” একটু সামনে ঝুঁকে এলো সে। “তাহলে তিন-চার দিন ধরে সে হোটেলে এমনি এমনিই থেকেছে?”

“জি, স্যার। শুধু কালকেই মেয়ে নিয়ে এসেছে।”

“একটু আগে যে বললেন, মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতে এসেছিলো বলে নামটাম কিছু রেজিস্টার করেন নি?…মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার?”

ম্যানেজার এবার বোবা। বুঝে গেছে মিথ্যে বলতে বলতে ধরা খেয়ে গেছে।

অসন্তোষে দু’পাশে মাথা দোলাতে দোলাতে জেফরি বেগ বললো, “ব্ল্যাক রঞ্জুর সবচাইতে ঘনিষ্ঠ লোক লেডি গিয়াস কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসে আপনার হোটেলে উঠলো, চার-পাঁচ দিন পর সে আপনার হোটেল রুমেই খুন হলো, আর আপনি একবার বলছেন লোকটা মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে এসেছিলো বলে নামটাম কিছু রেজিস্টার করেন নি!” দু’হাত টেবিলের উপর রেখে আবার বলতে লাগলো সে, “আপনি এখনও জানেন না কতো বড় বিপদে পড়ে গেছেন। আগামীকাল পত্রিকায় যখন সব ছাপা হবে তখন বুঝবেন। গতকাল শীর্ষ সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জুর ডান হাত হিসেবে পরিচিত লেডি গিয়াসই শুধু খুন হয় নি, খুন হয়েছে তার দ্বিতীয় স্ত্রী মিনা আর পুরনো ঢাকায় সুলতান নামে রঞ্জুর আরেক সহযোগী ।”

ম্যানেজারের চোখেমুখে বিস্ময়। যেনো কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না।

মাথা দোলালো জেফরি। “বিরাট ঘটনা। বুঝলেন, ম্যানেজার সাহেব?”

নির্বাক।

“আপনার কয় ছেলে কয় মেয়ে?” আবারো অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো সে।

“তিন মেয়ে।”

“ছেলে নেই?”

মাথা দোলোললা ম্যানেজার ।

“তারা কি করে?”

“সবাই পড়াশোনা করে। বড়টা কলেজে, ছোটো দু’জন স্কুলে।”

“আপনাকে তো মেয়েদের কথাও ভাবতে হবে, নাকি?…এখন যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে আদালত তো আপনাকে ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের একজন হোমরাচোমরা মনে করবে। কমপক্ষে সাত-আট বছরের জেল । মেয়েগুলো বিয়ে দিতে অনেক সমস্যা হবে। তাদের লেখাপড়াও অনিশ্চিত হয়ে যাবে।”

“স্যার, আমি এরকম কোনো দলের কেউ না, বিশ্বাস করেন।” ম্যানেজার আকুতি জানলো।

“বুঝলাম আপনি নিতান্তই একজন নিরীহ টাইপের লোক। কিন্তু ওদেরকে বাঁচাতে গিয়ে যে নিজেই বিপদে পড়ে যাচ্ছেন সেটা বুঝতে পারছেন?”

লোকটা ভড়কে গেলো। কিছু বলতে পারলো না।

“আপনি যদি আমার কাছে সব সত্যি না বলেন পুলিশ আপনাকে রিমান্ডে নেবে। তারা রিমান্ডে কি করে সেটা নিশ্চয় জানেন। আর আমার কাছে যদি সব সত্যি বলেন তাহলে আমি আর পুলিশ রিমান্ডের জন্য রিকমেন্ড করবো না।”

“স্যার, লেডি গিয়াস ব্ল্যাক রঞ্জুর লোক, তাই হোটেলের রেজিস্টারে রেকর্ড রাখি নি।”

“গুড।” স্বাভাবিক থাকলো জেফরি । যেনো এটা কোনো আহামরি তথ্য নয়। আপনার মালিক আপনাকে নিশ্চয় বলেছে কোনো রেকর্ড না রাখতে?”

“জি, মানে…জি, স্যার।” একটু তোতলালো লোকটা।

সত্যি ।

“আপনার মালিকের সাথে রঞ্জুর কতো দিনের সম্পর্ক?”

ম্যানেজার তার দিকে চেয়ে রইলো। মিথ্যে বললে এরা ধরে ফেলে, কী এক আজব যন্ত্র দিয়ে এটা করে কে জানে। না। আর মিথ্যে বলে ফেঁসে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।

“আমার মালিকের নাম মনোয়ার হোসেন মঞ্জু।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি। এই নামটা তো কিছুক্ষণ আগেও সে বলেছে। আবার বলার মানে কী? “হ্যাঁ, সেটা তো একটু আগেও বললেন।”

“উনি ব্ল্যাক রঞ্জুর বড় ভাই!”

.

অধ্যায় ১৯

গুলিটা গলার খুব কাছ দিয়ে কাঁধের মাংসপেশী ভেদ করে বের হয়ে গেছে। জিলানী ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বললো আর এক ইঞ্চির মতো এদিক ওদিক হলেই বুলেটটা প্রাণঘাতি হয়ে উঠতো। কাজ করতে করতে এক ফাঁকে ডাক্তার জানতে চাইলো গুলিটা কে করেছে। বাস্টার্ড শুধু জানালো এক পুরনো শত্রুর কাজ এটি।

খুব বেশি কিছু করতে হলো না জিলানি ডাক্তারকে। শুধুমাত্র ড্রেসিং করে ক্ষতস্থানটি টেপ ব্যান্ডেজ করে দিলো, ফলে শার্ট পরে থাকলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই তার কাঁধে ব্যান্ডেজ করা আছে। সব শেষে ডাক্তার একটা ইনজেকশন দিয়ে কিছু ওষুধ দিয়ে দিলো তাকে।

কাজটা করতে আধঘণ্টার বেশি লাগলো না। উমা বসে আছে পাশের একটা ছোট্ট ঘরে। জিলানি ডাক্তার হাত ধুয়ে বাস্টার্ডের কাছে চলে এলো। সে এখন শার্ট পরে উঠে বসেছে।

“মেয়েটা কে?” পিতৃসুলভ অধিকার নিয়ে জানতে চাইলো।

“লম্বা কাহিনী, চাচা।”

“আচ্ছা, বুঝছি। লম্বা কাহিনী বলার মতো সময় তোমার নাই।”

“বলবো, তবে এখন না।”

কাঁধ তুললো জিলানি ডাক্তার। আমার শোনার দরকার নাই।”

প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে পাঁচশ টাকার দুটো নোট বের করলো সে। জিলানি ডাক্তার তার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো। “ভাতিজা, টাকা দিতে হইবো না। রাখো।” তারপর একটু থেমে বললো, “কিছু খাইবা?”

“না, চাচা,” টাকাটা মানিব্যাগে রেখে বললো সে। “এক্ষুণি চলে যেতে হবে।

“তোমরা বাপে আছে কেমন?”

“আগের মতোই।”

“অবস্থা আরো খারাপ হইবো…মাথাটা তো একেবারেই গেছে, না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড।

“ও যদি একটু উইঠা বসতে পারতো তাইলে তোমারে কইতাম, হজ্ব করাইয়া নিয়া আসতে।”

বাস্টার্ড কিছু বলতে যাবে অমনি তার চোখ পড়লো বাম দিকের দেয়ালে থাকা একটি পোস্টারের দিকে। একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। জিলানি ডাক্তার বুঝতে পারলো না পোস্টারের কী দেখছে সে। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে দেখে নিলো বাস্টার্ড।

সর্বনাশ!

তার মাথা দ্রুতই কাজ করতে শুরু করলো।

“চাচা, আমি এখন যাই। আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন, হঠাৎ তড়িঘড়ি করে বললো সে।

“আরে না, তেমন কিছু না। খালি ড্রেসিং করছি। আঘাতটা মারাত্মক হইলে অনেক ভুগতে হইতো। বাঁইচা গেছে।”

উমাকে নিয়ে জিলানি ডাক্তারের ওখান থেকে বের হয়েই গাড়িতে উঠে বসলো। বাস্টার্ডের মধ্যে প্রবল তাড়না দেখে উমা কিছুই বুঝতে পারলো না। সে শুধু দেখলো পকেট থেকে একটি মোবাইল ফোন বের করে বন্ধ করে ফেললো বাস্টার্ড।

ঢাকা মওয়া সড়ক ধরে খুব দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে লাগলো।

“কি হয়েছে?” একটু ভয় পেয়ে বললো উমা।

মাথা দোলালো সে, তেমন কিছু না। কিন্তু ভালো করেই জানে, সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে।

.

অবশেষে পিং সিটির ম্যানেজার তোতা পাখির মতো সব বলে দিয়েছে। বেচারা অনেক চেষ্টা করেছিলো সব তথ্য গোপন রাখার জন্য কিন্তু পারে নি। জেফরির ধারণা লোকটা আদৌ সেরকম জাঁদরেল কেউ না। একবারেই নিরীহ আর গোবেচারা টাইপের একজন।

ব্ল্যাক রঞ্জুই পিং সিটি হোটেলের মালিক, তবে কাগজেকলমে এর মালিকানা দেখানো হয়েছে তার বড় ভাই মনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নামে। লোকটা কয়েক বছর আগেও সামান্য মুদি দোকানি ছিলো। ছোটো ভায়ের কল্যাণে এখন বিরাট ব্যবসায়ী। অপারেশন ক্লিনহার্টের পর ব্ল্যাক রঞ্জু দেশ ছেড়ে কোলকাতায় স্থায়ী হয়। তখন থেকেই মনোয়ার হোসেন মঞ্জু ছোটো ভায়ের হয়ে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আসছে।

ইন্টেরোগেশন রুম থেকে সোজা কমিউনিকেশন রুমে ফিরে এলো জেফরি বেগ। তার সহকারী জামানকে দিয়ে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো থেকে আরো কিছু তথ্য জেনে নিতে পেরেছে সে।

“স্যার,” জামান বললো, “লেডি গিয়াস, রঞ্জুর স্ত্রী আর সুলতানের ফোন নাম্বারগুলো ট্যাপিং করার ব্যবস্থা করেছি।”

“ভালো।”

“যদি ঐ সিমগুলো পাল্টে অন্য কোনো সিমও ব্যবহার করা হয় তাহলেও আমরা জনতে পারবো সেটা। ফোন সেটগুলোর পিননাম্বার পাওয়া গেছে।”

নাম্বারগুলো তো বন্ধ করা ছিলো, এখন দ্যাখো চালু হয়েছে কিনা।”

জামান বসে গেলো কম্পিউটারের সামনে। পাঁচ মিনিট পর ফলাফল পাওয়া গেলো। লেডি গিয়াসের মোবাইল নাম্বারটা ওপেন করা হয়েছিলো একটু আগে। কিছুক্ষণ আগে যে ভুয়া মেসেজটা পাঠানো হয়েছিলো সেটা রিসিভ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে খুনি এখন প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুর ওপারে কেরাণীগঞ্জের ইকুরিয়া নামক একটি এলাকায় রয়েছে। সম্ভবত একটা হাইওয়ের উপর, বিক্রমপুরের দিকে চলে গেছে সেটা। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক। গাড়িতেই আছে হয়তো।

ভার্চুয়াল ম্যাপ বলছে খুনি এখন যেখানে অবস্থান করছে তার ঠিক আধ কিলোমিটার দূরেই ইকুরিয়া থানা অবস্থিত। জেফরি দেরি না করে জামানকে বলে দিলো ঐ থানায় যোগাযোগ করে এক্ষুণি ফোর্স পাঠাতে।

কমিউনিকেশন রুমের কম্পিউটারে বাংলাদেশের সবগুলো থানার ফোন নাম্বার এন্ট্রি করা আছে। থানার নাম ইনপুট করে দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডায়াল হয়ে যায়। কাজটা করতে কয়েক সেকেন্ডর বেশি লাগে নি।

ইকুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলে দেয়া হলো তাদের ফোর্স যেনো হাইওয়ের পাশে পার্ক করে রাখা কিংবা চলতে থাকা সবগুলো প্রাইভেট কার থামিয়ে চেক করে। তারা ত্রিশ বছরের এক যুবক আর এক তরুণীকে খুঁজবে। খুনি ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। পুলিশ যেনো সতর্ক থাকে।

জামান পেছন ফিরে তাকালো জেফরির দিকে।

“কি?”

“স্যার, আরেকবার ফিশিং করি?…তাদের গাড়িটার সর্বশেষ অবস্থান জানা গেলে পুলিশকে গাইড করা যাবে।”

কোনো রকম দেরি না করে জেফরি সায় দিয়ে দ্রুত কিছু নির্দেশনা দিয়ে দিলো। “এবার আনোন নাম্বার থেকে কল করো। কল রিসিভ করলে তুমি লেডি গিয়াসকে চাইবে। খুনির গলা শুনে সন্দেহ করবে…কিছুটা সময় কথা বলে টাইম কিলিং করবে, ঠিক আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জামান কাজে নেমে পড়লো । এমন একটা নাম্বার থেকে কল করবে যেটার নাম্বার রিসিভারের ডিসপ্লেতে উঠবে না । রিসিভার দেখতে পাবে ইংরেজি ‘আনোন’ শব্দটি। ভাববে বিদেশ থেকে কল করা হয়েছে।

দুঃখিত…

মোবাইল ফোনটা বন্ধ!

“স্যার?” জামান কি করবে জানতে চেয়ে বললো।

জেফরি বুঝতে পারছে না, একটু আগেও ফোনটা চালু ছিলো এখন বন্ধ করে রেখেছে। অনেক কিছুই হতে পারে । নেটওয়ার্ক সমস্যা…চলতি গাড়িতে থাকলে অনেক সময় এটা হয়…আবার এমনও হতে পারে গাড়ি চালাচ্ছে বলে ফোন অফ করে রেখেছে। যাইহোক তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলো সে।

“সম্ভবত বৃজ পার হতে পারে, জেফরি বললো। “বৃজটায় ব্যারিকেড দিতে বলল। দুটো বৃজে ব্যারিকেড আর মাওয়াঘাটে যে টহলপুলিশ আছে তাদেরকেও অ্যালার্ট করে দিতে বলে। মাওয়াঘাটের দিকে গেলে সমস্যা নেই, ওখানে ফেরির জন্যে অনেকক্ষণ লাইনে থাকতে হবে…সবার আগে বৃজ দুটো সিকিউর করতে বলল।”

জেফরি জানে গাড়িতে করে খুনি যেখানেই যাক না কেন এই তিনটি জায়গা অতিক্রম করতে হবে। তার ধারণা খুনি প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু পার হবার চেষ্টা করবে। তার সর্বশেষ অবস্থান ঐ সেতুর কাছাকাছি ছিলো।

জামান সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ইকুরিয়া থানার ওসিকে জানিয়ে দিলো নির্দেশনাটি।

“জি, স্যার,” ওসির উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেলো। “আমি এখনই যাচ্ছি।”

জামান দ্রুত বললো, “খুনি এখনও হাইওয়েতেই আছে, আমরা নিশ্চিত।”

“জি, স্যার । আমি নিজে যাচ্ছি ফোর্স নিয়ে!”

.

ইকুরিয়া থানা থেকে ওসি মইনুল ইসলাম একটি পিকআপ ভ্যান আর জিপ নিয়ে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে ঢাকা-মাওয়া সড়ক ধরে। মহাসড়কের যতোগুলো স্থানে টহলপুলিশ আছে সবাইকে সাদা রঙের একটি গাড়ির ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। মহাসড়ক দিয়ে যাবার সময় রাস্তার দু’পাশে কোনো প্রাইভেট কার পার্ক করা অবস্থায় দেখতে পেলো না। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট থেকে তাকে গাইড করা হচ্ছে একটু পর পর। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে তাদের সাথে। ওসি সাহেবও মনে করছে খুনি প্রথম বৃজটার দিকেই যাবে।

একজন মাত্র খুনিকে ধরার জন্য আটজন পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে তার কারণ হোমিসাইড থেকে বলা হয়েছে খুনি ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। তিন তিনটি খুন করে পালাচ্ছে। গতরাতে একদল পুলিশকে অস্ত্রের মুখে নাস্তানাবুদ করে সটকে পড়তে পেরেছে। ঠিক আছে, এবার দেখা যাক খুনি কিভাবে পালায়! মনে মনে বললো ওসি মইনুল ইসলাম।

ওয়াকিটকিটা হাতে নিয়ে দুটো বৃজের উপর যে টহল পুলিশের দল আছে। তাদেরকে একটা অর্ডার জানিয়ে দিলো সঙ্গে সঙ্গে।

“সাদা রঙের সব প্রাইভেট কার আর্টকে দেবে..অস্ত্রধারী এক খুনি আছে…একটু সতর্ক থাকবে। আমরা না আসা পর্যন্ত সাদা রঙের কোনো গাড়িই ছাড়বে না…ওকে?”

ওপাশ থেকে জানানো হলো কোনো সমস্যা নেই, তারা প্রস্তুত আছে।

মহাসড়কের মোড় নিতেই ওসি দেখতে পেলো দূরে বৃজটা দেখা যাচ্ছে। তার ধারণা খুনি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। আগেভাগে বৃজে আসতে পেরে ভালো লাগছে তার। উত্তেজনায় তার রক্ত টগবগ করছে এখন। বহুদিন হলো এরকম কোনো কাজ করে নি। রাস্তাটা ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে বৃজের কাছে চলে গেছে। ওসি সাহেব ড্রাইভারকে তাড়া দিলো গাড়িটা আরো জোরে চালাতে ।

বৃজের ঢালু দিয়ে ওঠার সময় দেখতে পেলো সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার ঠিক ঢালুর উপর, রাস্তার পাশে। বৃজ পার হয় নি। সম্ভবত টহল পুলিশের ব্যারিকেড দেখে পার হবার ঝুঁকি নেয় নি। ঘুরে উল্টো দিকে যে যাবে সে সময়ও পায় নি, তার আগেই দু’দুটো পুলিশের গাড়ি চলে এসেছে বুজের কাছে । মইনুল হোসেন কোমরের হোলস্টার থেকে পিস্তলটা তুলে নিলো । “সবাই অ্যালার্ট হয়ে যাও!…নামার সাথে সাথে সাদা গাড়িটা ঘিরে ফেলতে হবে!”

পুলিশের দু’দুটো গাড়ি সাদা রঙের প্রাইভেট কারের কাছে সশব্দে ব্রেক করে থেমে যেতেই লাফ দিয়ে বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারী পুলিশ নেমে পড়লো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *