১.৪ বিদ্যাচর্চ্চা

বিদ্যাচর্চ্চা

আর্য্যাবর্ত্তের ধারার অনুসরণে বাঙ্গালা দেশে বিদ্যা ও জ্ঞান চর্চ্চা যথেষ্টই হইত । অনুশাসনগুলি হইতে জানা যায় যে, গুপ্ত, পাল, এবং সেন ও অন্যান্য নৃপতিরা মধ্যদেশবিনির্গত বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়া বাঙ্গালা দেশে, রাঢে ও গৌড়ে বাস করাইয়াছিলেন। এই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা এদেশে আসিয়াও কিছুকাল যাবৎ বেদচর্চা ভুলেন নাই। তবে বাঙ্গালা দেশ মধ্যদেশ হইতে সুদূর বলিয়া বেদচর্চ্চা এখানে পরিপুষ্টি লাভ করে নাই। বরং চর্চ্চার অভাবে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সংখ্যা দিন দিন কমিয়া আসিতেছিল।

ব্যাকরণশাস্ত্রের চর্চ্চাতে সেকালের বাঙ্গালী মনীষীরা যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখাইয়াছিলেন। উদাহরণ হিসাবে পুরুষোত্তম-দেবের ভাষাবৃত্তি, জিনেদ্রবুদ্ধির ন্যাস ইত্যাদির উল্লেখ করা যাইতে পারে। অভিধান অথবা অভিধানের টিকা রচনায়ও বাঙ্গালীর কৃতিত্ব সামান্য নহে। এ বিষয়ে বন্দ্যঘটীয় সর্ব্বানন্দের নাম সমধিক উল্লেখযোগ্য। সর্ব্বানন্দের বিরচিত অমরকোষের টীকাসর্ব্বস্ব নামক টীকায় প্রায় তিন শতাধিক সংস্কৃত শব্দের বাঙ্গালা প্রতিশব্দ দেওয়া আছে। বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসাবে এই শব্দগুলি যথেষ্ট মূল্যবান।

বৌদ্ধ মহাযান এবং তান্ত্রিক মতের আলোচনা ত হইতই, তাহা ছাড়া সাধারণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যমতের দর্শনাদির আলোচনাতেও যে সেযুগের বাঙ্গালী দার্শনিক পণ্ডিতেরা বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ আছে। ভূরিশ্রেষ্টি (বর্ত্তমানে হওয়া জেলায় ভুরশুট) গ্রামনিবাসী পণ্ডিত ভট্ট শ্রীধর ৯১৩ শকাব্দে অর্থাৎ ৯৯১-৯২ খ্রীষ্টাব্দে ন্যায়কন্দলী নামে বৈশেষিক দর্শনের প্রশস্তপাদ-ভাষ্যের একটি অসাধারণ মূল্যবান টীকা রচনা করেন। ইনি স্বীয় পৃষ্ঠপোষক দক্ষিণরাঢ়ের অধিপতি “গুণরত্নাভরণ কায়স্থকুলতিকল” পাণ্ডুদাসের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। এই পাণ্ডুদাসই বিখ্যাত পাণ্ডুভূমি বিহার প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।

 

ন্যায়কন্দলীতে শ্রীধর নিজেই এই পরিচয় দিয়াছেন—

আসীদ্দক্ষিণরাঢ়ায়াং দ্বিজানাং ভূরিকর্ম্মণাম্‌।
ভূরিসৃষ্টিরিতি গ্রামো ভূরিশ্রেষ্টিজনাশ্রয়ঃ।।
অম্ভোরাশেরিবৈতস্মাদ্‌ বভূব ক্ষিতিচন্দ্রমাঃ।
জগদানন্দনাদ্‌ বন্দ্যো বৃহস্পতিরিব দ্বিজঃ।।
তস্মাদ্‌ বিশুদ্ধগুণরত্নমহাসমুদ্রো বিদ্যালতাসমবলম্বনভূরুহোহভূৎ।
স্বচ্ছেশয়ো বিবিধকীর্ত্তিনদীপ্রবাহপ্রস্পন্দনোত্তমবলো বলদেবনামা।।
তস্যাভূদ্‌ ভূরিযশসো বিশুদ্ধকুলসম্ভবা।
অব্বোকেত্যচ্চিতগুণা গুণিনো গৃহমেধিনী।।
সচ্ছায়ঃ স্থূলফলদো বহুশাখো দ্বিজাশ্রয়ঃ।
তাভ্যাং শ্রীধর ইত্যুচ্চৈরর্থিকল্পদ্রুমোহভবৎ।।
অসৌ বিদ্যাবিদগ্ধানামসূত শ্রবণোচিতাম্‌।
যট্‌পদার্থহিতামেতাং রুচিরাং ন্যাকন্দলীম্‌।।

ইহা হইতে যানা যায় যে, শ্রীধরের পিতা ছিলেন বলদেব, মাতা অব্বোকী (পাঠান্তরে অচ্ছোকা), এবং শ্রীধর ছিলেন কুলপতিসদৃশ আচার্য্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *