উপক্রমণিকা (প্রথম পরিচ্ছেদ)
জাতি ও দেশবাচক বঙ্গনামের উৎপত্তি
বঙ্গ জাতি হইতে দেশবাচক বঙ্গ নামের উৎপত্তি। বঙ্গ জাতি তথা বঙ্গ শব্দের প্রাচীনতম উল্লেখ রহিয়াছে ঐতরেয় আরণ্যক সেখানে বলা হইয়াছে যে, তিনটি জাতি নষ্ট হইয়া গিয়াছিল, এবং এই তিন জাতি হইতেছে পক্ষী, অর্থাৎ পক্ষিসদৃশ যাযাবর (মতান্তরে পক্ষীর ন্যায় অব্যক্তভাষী, অথবা পক্ষীর “টোটেম” অর্থাৎ আদিপুরুষরূপে কল্পিত পক্ষিবিশেষের চিহ্নধারী)—বঙ্গ, বগধ এবং চেরপাদ।
প্রজা হ তিস্রঃ অত্যায়মীয়ুরিতি যা বৈ তা ইমাঃ প্রজা স্তিস্রঃ অত্যায়মায়ং স্তানীমানি বয়াংসি বঙ্গা বগধাশ্চেরপাদাঃ। ২-১-২-৫।
ক্রমশ পূর্ব্বদিকে হটিতে হটিতে এই যাযাবর বঙ্গ জাতি এখন যে স্থানকে পূর্ব্ববঙ্গ বলা হয় তথায় বাস করিতে থাকে, তাহা হইতেই পূর্ব্ববঙ্গের প্রাচীন নাম হয় বঙ্গ। বর্ত্তমান কালে এই নাম সমগ্র বাঙ্গালাদেশ বুঝাইতে প্রযুক্ত হয়, কিন্তু কিছুকাল পূর্ব্বেও শুধু পূর্ব্ববঙ্গ বুঝাইতেই বঙ্গ শব্দের চল ছিল। মেয়েলী ছড়ায় বলে—“তুমি যাও বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে।” ১৮৬০ সালের দিকে মধুসূদন লিখিয়াছিলেন—“অলীক কুনাট্যরঙ্গে মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে।”
রাঢ় ও সুহ্ম জাতির নাম হইতে পশ্চিমবঙ্গের নাম হয় রাঢ় ও সুহ্ম দেশ। রাঢ় ও সুহ্ম (প্রাকৃতে “সুব্ত”) দেশের সর্ব্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জৈনদিগের আয়ারঙ্গ-সুত্ত বা আচারাঙ্গ-সূত্রে। ইহাতে এই দেশের শয়ন, আসন, ভোজন ও আচরণের নিন্দা করা হইয়াছে। ইহা হইতে আরও জানিতে পারি যে, জৈন শ্রমণদিগের প্রতি রাঢ়-সুহ্মের লোকেরা মোটেই প্রসন্ন ছিল না।
অহ দুচ্চর-লাঢং অচারী বজ্জভূমিং চ সুব্তভূমিং চ।
পন্তং সেজ্জং সেবিংসু আসণগাইং যেব পন্তাইং।।
লাঢেহিং তস্সুবসগ্গা বহবে—জাণবয়া লূসিংসু।
অহ লুক্খদেহিএ ভত্তে কুক্কুরা তত্থু হিংসিংসু নিবইংসু।।
অল্পে জণে নিবারেই লূসণএ সুণএ ডসমাণে।
ছচ্ছুক কারেন্তি আহন্তুং সমণং কুক্কুরা ডসন্তু ত্তি।।
এলিক্খএ জণে ভুজ্জো রহবে বজ্জভূমিং ফরুসাসী।
লটিঠং গহায় নালীয়ং সমণা তত্থ এব বিহরিংসু।।
এবং প তত্থ বিহরন্তা পুট্ঠ-পুব্বা অহেসি সুণএহিং।
সংলুঞ্চমাণা সুণএহিং—দুচ্চরগাণি তত্থ লাঢেহিং।। ৯-৩-২—৬।।
বঙ্গ, রাঢ় ও সুহ্ম জাতি আর্য্যেতর ছিল বলিয়াই মনে হয়; অন্ততপক্ষে ইহারা যে আর্য্য ছিল, এমন কোন প্রমাণ নাই।
বাঙ্গালাদেশে আর্য্যদিগের উপনিবেশ প্রথম স্থাপিত হয় বরেন্দ্র ভূমিতে এবং রাঢ়ের কোন কোন অঞ্চলে, বিশেষ করিয়া ভাগীরথী ও দামোদরের তীরভূমিতে। বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্র ভূমির প্রাচীন নাম পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্দ্ধন। এই স্থানের অধিবাসী (?) পুণ্ড্রদিগের উল্লেখ ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (৭-১৮) পাওয়া যাইতেছে। এখানে অন্ধ্র, পুলিন্দ, শবর প্রভৃতি ব্রাত্য বা অন্ত্যজ দস্যুভূমিষ্ঠ জাতিদিগের মধ্যে পুণ্ড্রগণের নাম করা হইয়াছে।
এখনও পুঁড় বা পুঁড়ো নামে জাতি এই ব্রাত্য পুণ্ড্রদিগের স্মৃতি জাগাইয়া রাখিয়াছে। বোধ হয় এই পুণ্ড্রজাতি আখের চাষে বিশেষ দক্ষ ছিল, এবং ইহাদের নাম হইতেই আখের নাম হইয়াছে পুঁড় এবং এক জাতীয় দেশী আখের নাম পুড়ী। অথবা এমনও হইতে পারে যে “পুণ্ড্র” ইক্ষুর প্রতিশব্দ ছিল, পরে যাহারা আখের চাষ করিত তাহারা পুণ্ড্র নামে পরিচিত হয়। বরেন্দ্র ভূমির নামান্তর গৌড়। ইহা যদি গুড় শব্দজাত হয় তাহা হইলে এখানেও আখ-চাষের ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে; কিন্তু শব্দটি বোধ হয় গোণ্ড-জাতির নামের প্রাচীন রূপ হইতে আসিয়াছে। পাণিনি তাঁহার ব্যাকরণের একটু সূত্রে এই গৌড় দেশস্থিত গৌড়পুরের উল্লেখ করিয়াছেন বলিয়া অনেকে অনুমান করেন—“অরিষ্টগৌড়পূর্ব্বে চ” (৬-২০-১০০)—অর্থাৎ অরিষ্ট ও গৌড় শব্দকে পূর্ব্বপদ করিয়া পুব শব্দের সমাস হইলে পূর্ব্বপদ অন্ত্যোদাত্ত হইবে। কিন্তু এই গৌড়পুর যে পূর্ব্বভারতে অবস্থিত ছিল না, তাহা ইহার অব্যবহিত পূর্ব্ববর্ত্তী সূত্র হইতে যানা যাইতেছে—“পুরে প্রাচাম্”, অর্থাৎ প্রাচ্যদেশে (অথবা, প্রাচ্যদেশীয় বৈয়াকরণদিগের মতে) পুর শব্দ পরে রাখিয়া সমাস করিলে পূর্ব্বপদ অন্ত্যোদাত্ত হইবে। “অরিষ্টগৌড়পূর্ব্বে চ” সূত্রটি “পুরে প্রাচাম” সূত্রের অপবাদ। সুতরাং এই গৌড়পুর পূর্ব্বদেশে অবস্থিত ছিল না নিশ্চয়ই। আরও একটি কথা, যখন স্বরের ব্যবস্থা রহিয়াছে তখন গৌড়পুর বৈদিক যুগের নগর ধরিতে হইবে, এবং এই স্থানের সহিত উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের আয্যেরা বিশেষ পরিচিত ছিলেন তাহাও স্বীকার করিতে হইবে। তাহা হইলে স্থানকে পূর্ব্বভারতে টানিয়া আনা সঙ্গত হয় না।
গৌড় শব্দ সাধারণতঃ বরেন্দ্রভূমিকে বুঝাইলেও অনেক সময় রাঢ় ও সুহ্ম ভূমির সহিত বরেন্দ্রভূমিকে অর্থাৎ পূর্ব্ববঙ্গ বাদ দিয়া সমগ্র বাঙ্গালাদেশকে বুঝাইত।