করুণাধারায় এসো
[নওলাখা হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার সুজিত মিত্র]
এমন তো হওয়ার কথা নয়, আগে কখনও হয়নি!
সকাল সাড়ে আটটা হবে তখন। রোজকার মতো প্রতিবেশী দম্পতির ফ্ল্যাটের বেল বাজালেন মিস্টার খেতওয়াত। অন্যদিন একবার বাজালেই হয় মিস্টার নওলাখা দরজা খুলে দেন, নয় মিসেস নওলাখা। সকালের চা-বিস্কুট প্রায় রোজই নওলাখা পরিবারের সঙ্গেই খান যুগলকিশোর খেতওয়াত। বছরভর একই রুটিন। এদিন হঠাৎ অন্যথা, টানা বেল বাজিয়ে গেলেও কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন? কী এমন হল? শরীর খারাপ? যদি হয়-ও, একসঙ্গে দু’জনের? নাহ, গোলমাল লাগছে।
সাধারণত পৌনে ন’টা থেকে ন’টার মধ্যে রোজকার গৃহকর্মীরা চলে আসেন নওলাখা-দম্পতির ফ্ল্যাটে। সবার আগে আসেন প্রতিমা। দীর্ঘদিন কাজ করছেন এ বাড়িতে, খুবই বিশ্বাসী। ফ্ল্যাটের একটি ডুপ্লিকেট চাবিও তাঁর কাছে রাখা থাকে, কখনও যদি মালিক-মালকিনের অনুপস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজন হয় ঘর খোলার।
প্রতিমা এলেন, দরজার বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন উদ্বিগ্ন মিস্টার খেতওয়াত। আর এক প্রস্থ বেল বাজানোতেও যখন দরজা খুলল না, ব্যবহার করা হল ডুপ্লিকেট চাবি। ভিতরের দৃশ্য মর্মান্তিক, বীভৎসও বলা চলে। পুলিশে খবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে মিনিটখানেকও লাগল না অন্য আবাসিকদের।
ভবানীপুর থানার ঘটনা, প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে। কেস নম্বর ৫৬৩, তারিখ ২৫/১২ /৯১, ধারা ১২০ বি/ ৩০২/ ৩৯৪ /৩৪ আইপিসি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুন, লুঠ করতে গিয়ে ইচ্ছাকৃত কাউকে আঘাত করা এবং একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনা।
শরৎ বোস রোডের উপর এগারো তলার অভিজাত বহুতল ‘রামেশ্বর অ্যাপার্টমেন্টস’। সেন্ট জনস ডায়াসেশন স্কুলের লাগোয়াই প্রায়। দশতলায় ফ্ল্যাট নম্বর ১০সি-তে থাকতেন নওলাখা-দম্পতি। যাঁদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হল দরজা খোলার পর। প্রশস্ত ফ্ল্যাট, ঢুকেই একটা বড় হলঘর। দুটো বেডরুম, অ্যাটাচড বাথ সহ। একটা গেস্টরুম। রান্নাঘর যেমন থাকে তেমন। হলঘরের একটা দিক ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার হত। আর এক কোণায় ছোট্ট একফালি জায়গায় পার্টিশন করে লাইব্রেরি-কাম-স্টাডিরুম। সম্পন্ন পরিবারে যেমন হয়, ফ্ল্যাট জুড়ে দামি আসবাবপত্র সাজানো-গোছানো পরিপাটি।
গিরিশকুমার নওলাখার (৫৯) নিথর দেহ পড়ে আছে স্টাডিরুমের কার্পেটের উপর। পাজামা-পাঞ্জাবি শরীরে। গলায় একটি দামি শাল দিয়ে ফাঁস দেওয়া। নাকমুখ দিয়ে চুঁইয়ে পড়েছে রক্তবিন্দু। সন্দেহ নেই কোনও, শ্বাসরোধ করে খুন। একজোড়া পুরনো ফুটিফাটা চপ্পল, যা দৃশ্যতই গিরিশবাবুর হতে পারে না, পড়ে আছে মৃতদেহের পাশে। একটু দূরে একটি খালি গ্লাস।
বীণা নওলাখার (৫৫) প্রাণহীন দেহ দুটি বেডরুমের একটিতে, পড়ে আছেন উপুড় হয়ে। প্রায় বিবস্ত্রা, রাতপোশাকটি ছিন্নভিন্ন। চোখেমুখে আঘাতের চিহ্ন, রক্তপাতও হয়েছে একটু। পেটের নীচে একটি বালিশ। গলায় শাড়ি দিয়ে ফাঁস দেওয়ার চেষ্টা করেছে আততায়ী বা আততায়ীরা। শাড়ির একটি প্রান্ত গলায় জড়ানো, অন্যপ্রান্ত বাঁধা সিলিংফ্যানে। মৃতার হাউসকোট ভাসছে লাগোয়া বাথরুমের কমোডে। হলঘরের টেলিফোন এবং ইন্টারকম সংযোগ-বিচ্ছিন্ন, তার কেটে দিয়েছে যে বা যারা ঢুকেছিল।
রামেশ্বর অ্যাপার্টমেন্ট
এক পুত্র এবং এক কন্যা ছিল নওলাখা-দম্পতির। কন্যা থাকেন ইন্দোরের শ্বশুরবাড়িতে। পুত্র নীলেশ আর পুত্রবধূ অনুরাধা ১১ ডিসেম্বর বেড়াতে গিয়েছিলেন উত্তর ভারতে। ফেরার কথা ছিল ২৪ তারিখ। ফোন করে দিনদুয়েক আগে মা-বাবাকে জানিয়েছিলেন, প্লেনের টিকিট না পাওয়ায় ২৬ তারিখ ফিরবেন। সস্ত্রীক নীলেশ যে ঘরটিতে থাকতেন, সেটি অক্ষত, তালাবন্ধ।
বাকি ঘরগুলি অবশ্য অক্ষত ছিল না। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আসবাবপত্র। ভেঙে তছনছ করা হয়েছে গেস্টরুমের কাঠের আলমারিটি। ইতস্তত পড়ে আছে কাঠের টুকরোটাকরা। বেশ কিছু জিনিসপত্র যে লুঠ হয়েছে, অনায়াসে অনুমেয়।
কেসের তারিখটি শুরুতে লিখেছি, খেয়াল করবেন। ২৫/১২/ ৯১। বড়দিনের সকাল। ক্রিসমাস ইভের নিশিযাপন শেষে একটু দেরি করে ঘুম ভাঙছে কলকাতার। রাস্তাঘাটে মানুষজন, গাড়িঘোড়া কম। দেরি আছে ভিক্টোরিয়া-চিড়িয়াখানা-পার্ক স্ট্রিটে-রেস্তোরাঁ-ক্লাবে জনপ্লাবন শুরু হতে।
দম্পতি-হত্যার জেরে শুভদিনের সকাল অশুভ হয়ে দেখা দিল কলকাতা পুলিশের কাছে। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তৎকালীন নগরপাল, খবর পেয়ে দ্রুত এলেন ঘটনাস্থলে। এলেন ডিসি ডিডি (গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান)। ভবানীপুর থানার পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগের হোমিসাইড শাখার অফিসারেরা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন। লালবাজার কন্ট্রোল রুম খবর পাওয়া মাত্র সংশ্লিষ্ট সবাইকে বার্তা দিয়েছে দ্রুত, “couple found murdered in Sarat Bose Road apartment, reach the spot at the earliest.”
কৌতূহলী জনতার লাগামছাড়া ভিড় তখন অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে, সামাল দিতে গলদঘর্ম পুলিশ। জটিল কেসে যা সচরাচর হয় কলকাতা পুলিশে, প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে স্থানীয় থানার পুলিশ। গুরুত্ব বুঝে কখনও রহস্যভেদের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোয়েন্দা বিভাগকে, কখনও থানার অফিসাররাই তদন্ত চালান। নগরপাল অকুস্থলে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিলেন, এই জোড়া খুনের তদন্ত করবে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। হোমিসাইড শাখার তৎকালীন সাব-ইনস্পেকটর সুজিত মিত্র তদন্তকারী অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হলেন।
গিরিশবাবুর দেহের পাশে পড়ে থাকা চপ্পল আর গ্লাস, বীণাদেবীর হাউসকোট, ভাঙা আলমারির কাঠের টুকরো এবং ঘটনাস্থলের ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে-পিছনের আদ্যোপান্ত খানাতল্লাশি করে তৈরি হল বাজেয়াপ্ত সামগ্রীর নথি। পুলিশি পরিভাষায় ‘seizure list’। মোটামুটি ‘ডেভেলপ’ করার যোগ্য হাতের আর পায়ের ছাপ পাওয়া গেল কিছু, বিভিন্ন মাপের। সংগ্রহ করা হল সযত্নে। লুঠ এবং জোড়া খুনে যে একাধিক ব্যক্তি জড়িত, সেই ধারণা বদ্ধমূল হল গোয়েন্দাদের। খুনি কে বা কারা, সে-সূত্র অবশ্য তখন পর্যন্ত অধরাই।
এখানে ‘রামেশ্বর অ্যাপার্টমেন্টস’-এর একটু বিবরণ প্রয়োজন। ১৯এ, শরৎ বোস রোডের বহুতলটি তৈরি করেছিলেন যুগলকিশোর খেতওয়াত সাতের দশকের শেষাশেষি। খেতওয়াত পরিবারের নানাবিধ ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ছিল, তবে গৃহনির্মাণ আর পরিবহণ-ব্যবসাই প্রধান। নিজে সপরিবারে থাকতেন ডুপ্লে ফ্ল্যাটে, দশতলার ১০এ আর এগারোতলার ১১এ মিলিয়ে। একতলায় যুগলকিশোর আর তাঁর ভাই প্রহ্লাদের আলাদা দুটি অফিস ছিল। যথাক্রমে রামেশ্বর ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড এবং ভারত রোডওয়েজ় লিমিটেড। আর ছিল রিসেপশন সেন্টার, কেয়ারটেকারের অফিস এবং একটি কমিউনিটি হল। দুই থেকে দশ, অন্য প্রতিটি তলায় চারটি করে আবাসিক ফ্ল্যাট।
আবাসিকরা সকলেই অর্থবান ছিলেন, সুরক্ষা-সতর্কতায় কার্পণ্য করেননি একটুও। উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা প্রাঙ্গণ, লোহার সূচিমুখ শলাকা পাঁচিল বরাবর। দুটি গেট বাইরে। একটি ঢোকার, অন্যটি বেরনোর। ভিতরেও মজবুত নিরাপত্তা। দুটি সিঁড়ি, একটি আবাসিকরা ব্যবহার করেন, অন্যটি ফ্ল্যাটগুলির স্থায়ী বা অস্থায়ী কাজের লোক, সাফাইকর্মী, ড্রাইভার, দুধওয়ালা, খবরের কাগজ দেওয়ার লোক ইত্যাদি। দুটি স্বয়ংক্রিয় লিফট, সেখানেও একই নিয়ম। আবাসিকদের জন্য একটি, বাকিদের অন্যটি।
সুরক্ষা নিশ্ছিদ্র করতে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আবাসিকরা। National Security and Detective Agency-র উর্দিধারী রক্ষীরা তিন শিফটে পাহারায় থাকতেন চব্বিশ ঘণ্টা। ঢোকা-বেরনোর গেটে তো বটেই, বেসমেন্টের পার্কিং স্পেসে এবং একতলার রিসেপশনে সতর্ক প্রহরা ছিল। ইন্টারকমে রিসেপশনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল প্রতিটি ফ্ল্যাটের।
নিয়ম ছিল, পরিচিত আবাসিক বা কর্মী অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়ি বা লিফটে উঠলে নিরাপত্তারক্ষীরা কোনওরকম বাধা দেবেন না। পরিচিতের সঙ্গে অপরিচিত কেউ থাকলেও নয়। সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ ঢুকলে আটকানো হবে রিসেপশনে। নাম কী, কোন ফ্ল্যাটে যেতে চান, কী প্রয়োজন ইত্যাদি জেনে ইন্টারকমে যোগাযোগ করা হবে সংশ্লিষ্ট ফ্ল্যাটে। সবুজ সংকেত পেলে তবেই লিফট বা সিঁড়িতে ওঠার অনুমতি মিলবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটে ছিল ইয়েল লক, আইহোল আর কলিং বেল।
এত কিছু, তবু খুন হয়ে গেলেন নওলাখা-দম্পতি! আজকের নিরিখে ভাবলে মনে হয়, সবই ছিল, শুধু সিসিটিভি-র ব্যবস্থাটা যদি থাকত! এখন শুধু অভিজাত এলাকায় বা ঝাঁ-চকচকে শপিং মলেই নয়, সিসিটিভি লাগানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ছোট-বড় অসংখ্য আবাসনে ক্যামেরা লাগিয়েছেন নিরাপত্তা-সচেতন শহরবাসী। এতে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে সুবিধে হয় আমাদের, ক্যামেরা আছে আন্দাজ করতে পারলে অবচেতনে একটা ভয়ও কাজ করে দুষ্কৃতীদের। এই সুবিধেটা থাকলে আলোচ্য জোড়া খুনের কিনারা নিশ্চিত সহজতর হত, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হত না গোয়েন্দাদের।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলার পর্বে ঢোকার আগে বলে নেওয়া ভাল, দু’তলা থেকে দশতলা, স্থায়ী গৃহকর্মীদের জন্য কোয়ার্টার ছিল প্রতি ফ্লোরেই। দশতলায় চারটি ফ্ল্যাটে ১০সি-র নওলাখা পরিবার ছাড়া থাকতেন ১০এ-তে খেতওয়াতরা, ১০বি আর ১০ডি-তে যথাক্রমে রাজেশ মেহতা আর দীপক মোঘানির পরিবার। নওলাখাদের তিনজন স্থায়ী কাজের লোক ছিলেন। প্রতিমা, যাঁর কথা শুরুতে বলেছি, মনিকা এবং শম্ভু। তিনজনই নির্দিষ্ট কোয়ার্টারে থাকতেন দশতলাতেই।
ময়নাতদন্ত সাঙ্গ হল বড়দিনের বিকেলেই। শ্বাসরোধ করেই খুন। দম্পতির মৃত্যুর আনুমানিক সময় রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে।
জিজ্ঞাসাবাদ দিয়ে শুরু হল তদন্ত। গিরিশবাবু বা বীণাদেবী, যে-ই দরজা খুলে থাকুন, পরিচিত না হলে নিশ্চয়ই খুলতেন না। আইহোলে দেখেছেন চেনা মুখ, অতএব খুলেছেন। সে বাসিন্দাই হন বা কর্মী, আবাসিকের কারও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী অপরাধের নেপথ্যে। পুলিশি পরিভাষায় যাকে বলে ‘insider job’। ৩৬টি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা, যাঁরা সে-রাত্রে ছিলেন বা ছিলেন না, সমস্ত স্থায়ী-অস্থায়ী গৃহকর্মী, বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাটির লোকজন, জেরা থেকে বাদ গেলেন না কেউ। চলল বড়দিনের রাতভর, তার পরের দিনও লাগাতার। কিন্তু বিধি বাম, শত চেষ্টাতেও ভরসাযোগ্য সূত্র মিলল না। কেউ স্বীকার করলেন না কিছু, এগোনোর মতো খড়কুটোও এল না হাতে। কেউ না কেউ মিথ্যে বা অর্ধসত্য বলছিলেন, এটা আন্দাজ করা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রমাণহীন আন্দাজ খুনের তদন্তে মূল্যহীন।
প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল ঘটনার, অন্ধকারে ঢিল ছোড়াতেই তখনও আটকে আছে তদন্ত। পুলিশি ব্যর্থতা নিয়ে মিডিয়ায় চলতে থাকল কাটাছেঁড়া, যেমনটা হয়ে থাকে। পুলিশ পি সি সরকার নয়, জাদুদণ্ড নেই কোনও রাতারাতি কিনারার, সেটা ভুলে গিয়েই।
বর্তমান সময়ে তদন্তের একটা সুবিধে আছে। প্রযুক্তির সুবিধে, ‘electronic surveillance’ -এর সুবিধে। মোবাইল ফোনের সূত্রে অনেক অপরাধের কিনারা হয়, সকলেই জানেন। দুর্ভাগ্য, ঘটনা ১৯৯১-এর, এদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু যার চার বছর পর।
‘যেটা ছিল না ছিল না, সেটা না পাওয়াই থাক’ ধরে নিয়েই সে-সময়ে এগোতে হত গোয়েন্দাদের। কত যে অপরাধের কিনারা হয়েছে স্রেফ নিবিড় ‘সোর্সওয়ার্ক’ দিয়ে আট আর নয়ের দশকে, তালিকা শেষ করা যাবে না লিখে।
সোর্স বড় বিষম বস্তু পুলিশি দুনিয়ায়। ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারলে নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভ অবধারিত, না পারলে লবডঙ্কা। অপরাধ জগতের খবর কোনও সাধু-সন্ন্যাসী দেবেন না, দেবে অপরাধীরাই, যাদের নিত্য বিচরণ অন্ধকার জগতের অভ্যন্তরে। লালমোহনবাবুকে মনে পড়ছে লিখতে গিয়ে। প্রদোষচন্দ্র মিত্রের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনাকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে মশাই।” সোর্স অবশ্য শুধু ‘কাল্টিভেট’ করলেই হয় না, ‘নার্চার’-ও করতে হয়। সোর্স লালন করাটাও এক বিশেষ শৈলী, সবাই পারেন না। যাঁরা পারেন, রহস্যভেদে তাঁরা এগিয়ে থাকেন। কিছু সতর্কতাও নিতে হয় সোর্স ব্যবহারে। সোর্সের মধ্যেই ভূত যাতে তৈরি না হয়ে যায়, সেটা খেয়াল রাখতে হয়। সোর্স আদৌ খাটাখাটনি করছে কি না, অফিসারের মন রাখতে গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছে কি না, নজরে রাখতে হয় তা-ও। কখনও কখনও সোর্সের পিছনে লাগানো হয় দ্বিতীয় সোর্স!
সত্যিটা স্বীকার করা যাক, গল্পের ফেলুদা-ব্যোমকেশ-এরকুল পোয়ারো-শার্লক হোমসের রহস্যভেদের রোমাঞ্চ-রোম্যান্স বাস্তবের তদন্তে থাকে কদাচিৎ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে আধপোড়া সিগারেটের টুকরো থাকে না, থাকে না বাগানের ঝোপঝাড়ের কাদায় পায়ের ছাপ, থাকে না হুমকি-চিরকুট বা সমগোত্রীয় কিছু। সূত্র কিছুতেই না মিললে ভরসা করতে হয় সোর্সের উপর। কল্পনার গোয়েন্দা গল্প খুবই উপভোগ্য, গোগ্রাসে গেলার মতো। বাস্তবের তদন্ত কিন্তু ভিন্ন, অন্তত নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে। প্রতি পদে উত্তেজনার আঁচ পোহানো নেই, নির্মোহ পরিশ্রম আছে। রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ নেই, আপ্রাণ অধ্যবসায় আছে। আপন মনের মাধুরী নেই, মরিয়া একাগ্রতা আছে। নির্মাণের জগৎ মূলত, সৃষ্টির নয় ততটা।
তদন্তে ফিরি। সোর্স লাগানো হল একাধিক, প্রত্যেকে পোড়খাওয়া। বলে দেওয়া হল দুটো কথা। এক, জোড়া খুন নিয়ে অপরাধ-জগতে কিছু কানাকানি হচ্ছে কি না, খবর চাই। দুই, খোঁজখবর দরকার। অন্ধকার দুনিয়ার হোক বা না-হোক, আশেপাশের মহল্লায় কেউ কি হঠাৎ বেশি টাকা খরচ করছে? জীবনযাত্রায় চোখে পড়ার মতো বদল এসেছে কারও? মোদ্দা কথা, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই। পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন’। এবং দ্রুত পাওয়াও গেল বহুপ্রতীক্ষিত সূত্র। সৌজন্য, তদন্তকারী অফিসারের দুর্ধর্ষ সোর্স নেটওয়ার্ক। খবর এল ২৭ তারিখ গভীর রাত্রে।
পদ্মপুকুরের কাছাকাছি এক ঠেকে মদ-জুয়ার আসর চলছে। যেখানে জাঁকিয়ে বসেছে ‘সোর্স’। এই ঠেকে তার দীর্ঘদিনের যাতায়াত। এসব আড্ডায় মোটামুটি সবাই সবার পরিচিতই হয় সচরাচর। সে-রাতের মোচ্ছবে মধ্যমণি এক অপরিচিত যুবক, জুয়ার বোর্ডে টাকা ওড়াচ্ছে দেদার। নতুন কেনা দামি ইয়াশিকা ইলেকট্রো-৩৫ ক্যামেরা দেখাচ্ছে বাকিদের। কিনে এনেছে বিলিতি মদের বোতল, ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। নেশা চড়তেই জড়ানো গলায় হিন্দি গান, ঘুরেফিরে একটাই বারবার, “তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বানা লে, তকদির বানা লে/ আপনে পে ভরোসা হ্যায় তো ইয়ে দাঁও লাগা লে, লাগা লে দাঁও লাগা লে…”। ১৯৫১-য় মুক্তিপ্রাপ্ত গুরু দত্ত পরিচালিত সুপারহিট ছবি ‘বাজি’-র সেই সুপারহিট গান। শচীন দেববর্মণের সুরে গীতা বালির লিপে গীতা দত্তের সেই আশ্চর্য জাদুকরী কণ্ঠে।
গানে অবশ্য সোর্সের মন ছিল না, রুচিও না। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ততক্ষণে সজাগ, এই চ্যাংড়া-টাইপ ছেলেটা এত টাকা পেল কী করে? আর এক পেগ বানানোর মাঝে নেহাতই হালকা চালে প্রশ্ন ছুড়ে দিল অপরিচিত যুবককে, ‘এখানে নতুন দেখছি, কী কাজ করো গুরু তুমি?’ যুবক ততক্ষণে নিরাপদ রকমের মাতাল, উত্তরও দিল হালকা চালেই, ‘পিয়নের কাজ করি বড়লোকের বাড়ি, ও কাজ আর করব না শালা!’
সোর্স-মারফত খবর পেয়ে সেই রাতেই তোলা হল ‘বড়লোকের বাড়ির পিয়নকে’। অপরাধ-জগতে কথিত আছে, লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্টারোগেশন রুমে ঢুকলে সমস্ত রকম নেশা নিমেষে কেটে যায়। আকণ্ঠ মদ্যপান করে এলেও সংবিৎ ফিরতে সময় লাগে না বিশেষ। নতুন অতিথির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। ‘আদরযত্ন’ করার আগেই স্বীকারোক্তি এল স্বতঃস্ফূর্ত, ‘স্যার, আমি খোকন গিরি, খেতওয়াত সাহেবের অফিসে পিয়নের কাজ করি। খুন আমি একা করিনি। রাজু, কামিনী আর জগদীশও ছিল স্যার।’
—বেশ, পুরোটা বল এবার, কীভাবে করলি, কেন করলি?
উত্তরে খোকনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া মুহূর্তের জন্য বাক্রুদ্ধ করে দিল দুঁদে গোয়েন্দাদেরও,
—লোভে পড়ে করেছি, খুন করার জন্য ম্যাডাম এক লাখ টাকা দেবেন বলেছিলেন।
—ম্যাডাম!! কোন ম্যাডাম?
—বিমলা ম্যাডাম, খেতওয়াত সাহেবের স্ত্রী।
বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে জেরা শুরু হল খোকনকে। জানা গেল, যা ঘটেছিল, যেভাবে ঘটেছিল, যে কারণে ঘটেছিল।
খেতওয়াত পরিবার ও নওলাখা পরিবারের সামাজিক পরিচয় আটের দশকের শুরু থেকেই। নওলাখারা তখন থাকতেন বালিগঞ্জের মুলেন স্ট্রিটে। একসঙ্গে বাইরে খাওয়াদাওয়া, উৎসব-উদ্যাপন, ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল ক্রমশ। বিমলা খেতওয়াত এসব পছন্দ করতেন না। অন্তর্মুখী স্বভাবের মহিলা ছিলেন, একটু রক্ষণশীল মানসিকতারও। পুজো-আর্চা ঘর-সংসারেই বেশি স্বচ্ছন্দ। নওলাখা-দম্পতি আবার জীবনকে পূর্ণ মাত্রায় উপভোগে বিশ্বাসী, ক্লাব-পার্টিতে যাতায়াত নিয়মিত। যুগলকিশোর খেতওয়াতও তা-ই, হইহুল্লোড় তাঁরও মনপসন্দ।
নিয়মিত সামাজিক মেলামেশা চলতে চলতেই যুগলকিশোর আকৃষ্ট হলেন বীণা নওলাখার প্রতি। একতরফা ছিল না আকর্ষণ, বিবাহ-বহিৰ্ভূত প্রণয়ে সম্মতি ছিল বীণারও। দু’জনেই তখন মধ্যচল্লিশ। বালিগঞ্জের বাড়ি বেচে ১৯৮৬-তে রামেশ্বর অ্যাপার্টমেন্টে উঠে এলেন নওলাখারা। প্রণয়িনীকে প্রতিবেশিনী হিসেবে পাওয়ার তাগিদে জলের দরে দশতলার ফ্ল্যাটটি বেচলেন যুগলকিশোর। গিরিশ-বীণা দু’জনেই বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ চাকুরে ছিলেন। স্বচ্ছলতা ছিল, কিন্তু ওই বহুতলে ফ্ল্যাট কেনাটা ছিল সামর্থ্যের বাইরে। গিরিশ নির্বোধ ছিলেন না, কেন সস্তায় ফ্ল্যাট দিচ্ছেন খেতওয়াত সাহেব, বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। সম্ভবত পারিবারিক শান্তির কারণেই সব জেনেও মেনে নিয়েছিলেন, মানিয়েও নিয়েছিলেন।
মেনে নিতে পারেননি বিমলা খেতওয়াত, মানিয়ে নিতেও না। পরকীয়া থেকে স্বামীকে দূরে সরিয়ে আনতে চেষ্টার কসুর করেননি। ঝগড়া করেছেন স্বামীর সঙ্গে, প্রবল অশান্তি হয়েছে দিনের পর দিন, ঘরে ওঝা ডাকিয়ে তন্ত্রমন্ত্রেরও শরণ নিয়েছেন মরিয়া হয়ে। লাভ হয়নি কোনও। যুগলকিশোরের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বেড়েছে মিসেস নওলাখার সঙ্গে। রোজ সকালে নওলাখাদের বাড়িতে চা-বিস্কুট, সন্ধেবেলা তাস-আড্ডা-মদ্যপান, চোখের সামনে দেখতে দেখতে একটা সময় প্রায় অসুস্থই হয়ে পড়েন বিমলা। খেতওয়াতদের একমাত্র পুত্র অনিল চাকুরিজীবী, নিজেকে নিয়ে থাকতেন। মা-বাবার দাম্পত্য অশান্তির ব্যাপারে ছিলেন চূড়ান্ত উদাসীন।
‘নারীচরিত্র দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যা।’ মানসিক অশান্তিতে নিত্যদিন ক্ষতবিক্ষত হতে থাকা বিমলা ঠিক করলেন, পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেবেন নওলাখা-দম্পতিকে। বীণার প্রতি আক্রোশ সহজবোধ্য। গিরিশের উপর তীব্র রাগ পরকীয়াকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি একা অশক্ত মহিলা, কাজটা করবে কে?
বিমলা ডেকে পাঠালেন খোকনকে। খেতওয়াতদের কোম্পানির দীর্ঘদিনের পিয়ন খোকন গিরি। একতলার অফিসে থাকে। প্রায় রোজই আসে ফ্ল্যাটে, খোকনের হাত দিয়ে খামভরতি টাকা বীণার কাছে মাঝেমাঝেই পাঠান যুগলকিশোর। বিমলা প্রস্তাব দিলেন, গিরিশ-বীণাকে খুনের বিনিময়ে এক লক্ষ টাকা দেবেন, চল্লিশ হাজার অগ্রিম। প্রথমে গররাজি ছিল খোকন, সে তো আর পেশাদার খুনি নয় যে ‘সুপারি’ নিয়ে মানুষ মারবে। বিমলা টাকার লোভ দেখাতেই থাকলেন, হাতে ধরিয়ে দিলেন নগদ চল্লিশ হাজার। মাথা ঘুরে গেল খোকনের। সে-সময়ে এক লাখ মানে অনেক টাকা। পিয়নের চাকরি ছেড়ে নিজের ছোটখাটো ব্যবসা চালু করার পক্ষে যথেষ্টেরও বেশি।
খোকন রাজি হয়ে গেল। একা মুশকিল হবে, শুরু করল সঙ্গীসাথি জোটানোর কাজ। কাঁচা টাকার লোভ বড় সাংঘাতিক, জুটেও গেল তিন শাগরেদ। রঞ্জিত রাও ওরফে রাজু, একসময় খেতওয়াতদের গাড়ি চালাত। চাকরি ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন অন্য বেসরকারি সংস্থার গাড়ি চালিয়েছিল। তারপর আবার ফিরে এসে রামেশ্বর অ্যাপার্টমেন্টের-ই ৭ডি-র বাসিন্দা ওমপ্রকাশ ভুয়ানিয়ার ড্রাইভারের চাকরি নিয়েছিল। খোকন-রাজুর সঙ্গে যোগ দিল জগদীশ যাদব, মিস্টার খেতওয়াতের অফিসের সাফাইকর্মী। জগদীশই জোটাল কুকর্মের চতুর্থ শরিককে। কামিনীকুমার রায়, দক্ষিণ কলকাতার একটি গ্যারেজের কর্মী। চুক্তি হল, কাজ শেষ হলে প্রত্যেকে পাবে পঁচিশ হাজার করে। অগ্রিমের টাকা থেকে দশ হাজার করে ভাগ হল। দুটো দামি ইয়াশিকা ক্যামেরা কিনে ফেলল খোকন আর রাজু। কামিনী কিনল দামি সুটকেস।
খুনের ঘটনাপ্রবাহ ছিল এরকম। মনে রাখুন, ক্রিস্টমাস ইভের রাত। গমগম করছে বহুতল-প্রাঙ্গণ। গাড়ির স্রোত সন্ধে থেকেই, ঢুকছে-বেরচ্ছে। কেউ পার্টিতে যাচ্ছেন, কারও আবার বাড়িতেই উৎসবের আয়োজন। অতিথিদের অবিরাম আনাগোনা। কর্মীরাও উঠছেন-নামছেন সর্বক্ষণ। দিনটা ভেবেচিন্তেই বেছে ছিল খোকনরা। নওলাখাদের পুত্র-পুত্রবধূ যে ২৪ নয়, ২৬ তারিখে ফিরবেন, সে-খবর বিমলা আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন খোকনকে।
খোকন, রাজু এবং জগদীশ নিরাপত্তারক্ষীদের বহুদিনের পূর্বপরিচিত কর্মী। অপরিচিত বলতে কামিনী। যাকে সঙ্গে নিয়ে রাজু ন’টা নাগাদ উঠে গেল নিজের সাততলার কোয়ার্টারে, যা বরাদ্দ গৃহকর্মীদের জন্য। নিয়ম অনুযায়ী, রিসেপশনের রক্ষীরা আটকাল না। জগদীশ গেল একটু পরে, যোগ দিল রাজু আর কামিনীর সঙ্গে।
বিমলা খেতওয়াত ঠিক সাড়ে ন’টা নাগাদ বেল বাজালেন নওলাখাদের ফ্ল্যাটে। দরজা খুললেন বীণা নওলাখা। বিমলা বললেন, তাঁর স্বামী বোধহয় সকালে পানপরাগের কৌটোটা ফেলে গিয়েছেন, বাড়িতে খুঁজে পাচ্ছেন না,একটু যদি দেখা যায়। বীণা দেখেশুনে জানালেন, ‘না, এখানে তো নেই।’ ততক্ষণে বিমলার যা দেখার ছিল, দেখা হয়ে গিয়েছে। নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন, বাড়ির গৃহকর্মীরা কেউ নেই। প্রতিমা-মনিকা-শম্ভু কাজ শেষ করে বেরিয়ে গিয়েছে।
খোকন অপেক্ষা করছিল বিমলার নির্দেশমতো, নীচে ইন্টারকমের কাছে। ঠিক দশটায় বিমলার ফোন আসার কথা। যথাসময়ে ফোন এল। বিমলা জানালেন, লাইন ক্লিয়ার, এটাই মোক্ষম সময়। যুগলকিশোর ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পুত্র অনিল বেরিয়েছে পার্টিতে, রাত হবে ফিরতে।
খোকন সিঁড়ি দিয়ে সাততলায় উঠল, ডেকে নিল রাজু-জগদীশ-কামিনীকে। একটি বড় ব্যাগে সঙ্গে ছিল লোহার ব্লেড, শাবল ইত্যাদি। দশটা পাঁচে বেল বাজল নওলাখাদের ১০সি-র ফ্ল্যাটে। গিরিশ নওলাখা আইহোল দিয়ে দেখলেন খোকনকে, বহুদিনের পরিচিত মুখ। খুলে দিলেন দরজা, ঝাঁপিয়ে পড়ল খোকন আর দলবল। প্রতিরোধ ব্যর্থ হল গিরিশের। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছিলেন, শাল ছিল গায়ে। ওই শালই গলায় পেঁচিয়ে খুন করল খোকন।
বেডরুমে ছিলেন বীণা, বেরিয়ে এসে চেষ্টা করলেন টেলিফোনের কাছে যাওয়ার। বৃথা চেষ্টা। ফোনের তার ততক্ষণে কেটে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। বীণাকে যথেষ্ট শারীরিক হেনস্থা করা হল, বেডরুমে পড়ে থাকা একটি শাড়ির প্রান্ত দিয়ে শ্বাসরোধের চেষ্টা হল, অন্য প্রান্ত সিলিংফ্যানে বেঁধে। চেষ্টা বিফল হওয়ায় বালিশ মুখে চেপে কেড়ে নেওয়া হল প্রাণবায়ু। এরপর গেস্ট রুমের আলমারি ভেঙে যথেচ্ছ লুঠপাট এবং সরে পড়া, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে।
খোকন-রাজু-জগদীশ ফিরে গেল নিজেদের কোয়ার্টারে, স্নান করে শুয়ে পড়ল দিব্যি। কামিনীই একমাত্র বহিরাগত, ভোর হওয়ার আগে ব্যাগভরতি লুঠের সামগ্রী সমেত পালাল পাঁচিল টপকে, ঝিমোতে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের এড়িয়ে। ঠিক ছিল, লুঠের মাল পরে ভাগ হবে।
খোকনের জবানবন্দির ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হল বিমলা খেতওয়াতকে। বিমলা অপরাধ স্বীকার করলেন। কয়েকদিনের মধ্যে পুলিশের জালে ধরা পড়ল রাজু আর কামিনী। জগদীশ পালিয়েছিল বিহারের প্রত্যন্ত জেলার বাড়িতে, ধরে আনলেন গোয়েন্দারা। লুঠ করা জিনিস খুনের পরের রাতেই ভাগ করে নিয়েছিল চারমূর্তি। উদ্ধার হল প্রচুর গয়নাগাটি, ঘড়ি, ঘর সাজানোর বহু দামি সামগ্রী। যা শনাক্ত করলেন প্রয়াত নওলাখা-দম্পতির পুত্র ও পুত্রবধূ।
১৯এ, শরৎ বোস রোডের বহুতল বাড়িটির প্রবেশপথ
আশ্চর্যের, ঘটনার পরের দু’দিনও খোকন-রাজু-জগদীশ ওই অ্যাপার্টমেন্টে কাজ করে গিয়েছে নির্বিকার। বিন্দুমাত্র স্নায়ুর চাপ ছাড়াই। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দিয়েছে, চা এনে দিয়েছে তদন্তকারী দলের জন্য। একেই কি বলে ‘ক্রিমিনাল মাইন্ড’?
সুজিত মিত্র, লিখেছি আগেই, তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। পদোন্নতির পর দীর্ঘদিন ওসি হোমিসাইড পদে চাকরি করেছেন সুনামের সঙ্গে। বছরদুয়েক আগে অবসর নিয়েছেন ডিসি স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ হিসেবে। যত্নশীল এবং লড়াকু তদন্ত করেছিলেন।
যত্নের অংশবিশেষ প্রথমে বলে নিই। গড়ফা মেইন রোডের কমল স্টুডিয়ো থেকে খোকন ও রাজু কিনেছিল দুটি ইয়াশিকা ক্যামেরা। সেই স্টুডিয়ো থেকে বাজেয়াপ্ত করা হল সংশ্লিষ্ট ক্যাশমেমো দুটি। কামিনী অগ্রিম থেকে পাওয়া ভাগের টাকায় একটি বড় সুটকেস কিনেছিল ভবানীপুরের দোকান থেকে। সেই ক্যাশমেমোও বাজেয়াপ্ত হল। কামিনী গ্রেফতার হওয়ার পর দেখা গিয়েছিল, ডান পায়ের পাতায় ক্ষতচিহ্ন। পাঁচিল টপকে পালানোর সময় লোহার শলাকায় আঘাত লেগেছিল। পাঁচিলে দাগ ছিল রক্তের। সেই রক্ত যে কামিনীরই, প্রমাণ করতে হল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। ঘটনাস্থলের নানা জায়গা থেকে নেওয়া হাত-পায়ের ছাপ পাঠানো হল ফরেনসিক পরীক্ষায়, মিলে গেল চার আততায়ীর সঙ্গে। আদালতে গোপন জবানবন্দিতে দোষ কবুলও করল খোকন এবং রাজু।
পড়তে যতটা সহজ মনে হল, আদতে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংহত করার কাজটি তার চেয়ে ঢের বেশি কঠিন ছিল। গ্রেফতার-পরবর্তী তদন্ত আসলে মালা গাঁথার মতোই। ঠান্ডা মাথায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একটি একটি করে প্রমাণ ঘটনা-পরম্পরা অনুযায়ী সাজিয়ে তবেই তৈরি হয় এধরনের জটিল মামলার চার্জশিট। মালাটি নিখুঁত গাঁথতে পারলে জাল কেটে বেরনোর রাস্তা থাকে না অভিযুক্তের, আইনের কাছে নতজানু হতে হয় নিরুপায়ভাবে।
তদন্তের প্রেক্ষিতে ‘লড়াকু’ শব্দটি লিখেছি আগের এক অনুচ্ছেদে, সচেতনভাবেই। তিন মাসের মধ্যেই পেশ হল চার্জশিট, শুরু হল বিচারপর্বের লড়াই। অন্যতম অভিযুক্ত রাজু নিজেই ইচ্ছে প্রকাশ করল রাজসাক্ষী হওয়ার। কাজ কিছুটা সহজ হল পুলিশের।
খেতওয়াত পরিবার অত্যন্ত বিত্তশালী ছিলেন। বিমলার জামিনের জন্য রাজ্যের এবং ভিনরাজ্যের প্রথিতযশা আইনজীবীদের লাগানো হয়েছিল। কলকাতা পুলিশের পক্ষে ছিলেন অভিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটর শিশির ঘোষ। অন্যদিকে আইনি দুনিয়ার তারকাদের ছড়াছড়ি। বিচার চলাকালীন তীব্র চাপান-উতোরের সাক্ষী থাকল আদালত।
কিন্তু ওই যে লিখলাম, মালাটি গাঁথা হয়েছিল নিপুণ। ১৯৯৯ সালে আলিপুরের জেলা ও দায়রা আদালত বিমলা খেতওয়াত, খোকন গিরি, কামিনীকুমার রায় এবং জগদীশ যাদবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল। রাজসাক্ষী রাজু আগাগোড়া সহযোগিতা করেছিল। মুক্তি দেওয়া হয় ‘প্রসিকিউশন’-এর আবেদনের ভিত্তিতে।
মামলা গড়ায় হাইকোর্টে। যেখানে রাষ্ট্রের আর-এক প্রস্থ লড়াই এক ডজন নামজাদা আইনজীবীর সঙ্গে। হাইকোর্টও নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখল বিস্তর সওয়াল-জবাবের পর। সেটা ২০০৬ সাল।
পরের ধাপ সুপ্রিম কোর্ট। ততদিনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বিমলা খেতওয়াত। দেহের একটি দিক প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত, আরও নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। স্বাস্থ্যজনিত কারণে বিমলাকে জামিন দেয় সর্বোচ্চ আদালত। একটু সুস্থ হলেই আত্মসমর্পণ করতে হবে ফের, এই শর্তে। বিমলা ফেরেন শরৎ বোস রোডের ফ্ল্যাটে।
সুপ্রিম কোর্টও শেষমেশ হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গেই সহমত হয়। তার আগেই অবশ্য জাগতিক আদালতের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিলেন বিমলা। ২০০৮-এর জুনের এক দুপুরে দশতলার বারান্দা থেকে ঝাঁপ দেন নীচে। মৃত্যু ঘটে মাটি ছোঁয়া মাত্রই। দেহের পাশে ওঁর ক্রাচটি পড়ে ছিল, যেটি সঙ্গে নিয়েই মরণঝাঁপ দিয়েছিলেন।
কেন আত্মহনন? ফের কারাবাসের আতঙ্ক? সামাজিক অসম্মানের গ্লানি, নাকি বিবেকদংশন? নাকি ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’, মুক্তি এভাবেই আসে ‘করুণাধারায়’?