মানুষ বড় শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো
[বেলারানী হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ]
দৃশ্য-১
৩০ জানুয়ারি, ১৯৫৪, ভোর সোয়া পাঁচটা, বড়জোর সাড়ে পাঁচ।
ভোর হয়েছে, সকাল নয়। রাসবিহারী থেকে চেতলার দিকে যেতে ডানহাতে কালীঘাটের বাস্তুহারা বাজার। দোকানপাটের ঝাঁপ খুলতে খুলতে সে আরও অন্তত কয়েক ঘণ্টা। বাজারের সাফাইকর্মীদের বেশির ভাগই অবশ্য উঠে পড়েন দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই। বেলা একটু বাড়লেই মেলা লেগে যাবে লোকের। আগে থেকে সাফসুতরো করে না রাখলে পরে সামলে ওঠা দায়।
এমনই একজন কর্মীর প্রথম চোখে পড়ল কাগজের মোড়কগুলো। তিনটে পাশাপাশি। পড়ে রয়েছে কেওড়াতলা শ্মশানের কাছে একটি শৌচালয়ের পাশে। সে তো কত কিছুই এদিকে-ওদিকে পড়ে থাকে, কিন্তু এ তো অন্যরকম! প্রথম দর্শনেই আঁতকে ওঠার মতো। নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা কাগজের মোড়কগুলোর একটার কিছু অংশ ছিঁড়ে গিয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের লালচে ছোপ কাগজে। ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুটো আঙুল। ডাক্তারবদ্যি হওয়ার প্রয়োজন নেই, এক ঝলকেই বোঝা যায়, আঙুল মনুষ্যদেহের।
আতঙ্কিত চিৎকার-চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হল দ্রুত। খবর গেল টালিগঞ্জ থানায়। অফিসাররা এসে কৌতূহলী ভিড় সরালেন প্রথমে, খোলা হল মোড়ক। একের পর দুই, দুয়ের পর তিন। বেরোল দুটো হাতের টুকরো টুকরো খণ্ড। বাহুমূল থেকে কনুই। কনুই থেকে আঙুল। ছিন্নভিন্ন। কাগজের মোড়কটি দেখা হল খুঁটিয়ে। ২১ নভেম্বরের ‘যুগান্তর’।
দৃশ্য-২
৩০ জানুয়ারি, ১৯৫৪, ভরদুপুর।
সবে খেয়ে উঠেছেন কালীঘাট পার্কের বহুদিনের দারোয়ান। শীতের ঝিমধরা দুপুরে ইতস্তত ঘুরছেন গাছগাছালিতে ঘেরা উদ্যানের এদিক-সেদিক, রোজকার অভ্যাসমতো। ঘুরতে ঘুরতেই চোখ আটকে গেল একটা আমগাছের পিছনে। ঝোপঝাড়-আগাছার জঙ্গলে কী পড়ে আছে ওগুলো? চারটে কাগজের মোড়ক, বাঁধা ওই নারকেল দড়ি দিয়েই। কৌতূহলবশত খুলেই ফেললেন। ভিতরে যা দেখলেন, ঊর্ধ্বশ্বাস ছোটাছুটি করে এরপর শ’খানেক পথচলতি মানুষের ভিড় জুটিয়ে ফেলতে লাগল খুব বেশি হলে মিনিটদুয়েক।
একটি মোড়কে হাঁটু থেকে কাটা দুটি পায়ের অংশ। দ্বিতীয়টিতে নারীশরীরের উপরিভাগ ত্রিখণ্ডিত অবস্থায়। তিন নম্বর মোড়কে ধড় থেকে আলাদা করে দেওয়া মাথা। নাক-কান-ঠোঁট-চুল বিহীন। মুখের চামড়া চেঁছে তুলে নেওয়া হয়েছে। আঘাতের তীব্রতায় চূড়ান্ত বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে মুখাবয়ব। কয়েকগাছি চুল, মাত্র কয়েকগাছিই, লেগে রয়েছে কপালের উপরে।
শেষ মোড়কটিতে মিলল একটি ভ্রূণ। যাতে চোখ বুলোলেই মালুম হয়, পৃথিবীর আলো দেখার আর বেশি দেরি ছিল না। মৃতা সন্তানসম্ভবা ছিলেন, প্রসবমুহূর্ত এসেই গিয়েছিল প্রায়।
ফের থানাপুলিশ। খবর পেয়েই টালিগঞ্জ থানার অফিসাররা ছুটলেন ঊর্ধ্বশ্বাসে, সকালের উদ্ধার হওয়া দেহাংশ নিয়ে ধন্দ তখনও কাটেনি। লালবাজার থেকেও হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দাদের নিয়ে গাড়ি ছুটল। গন্তব্য, লেখা বাহুল্য, কালীঘাট পার্ক।
চারটি মোড়কই দেখা গেল ‘যুগান্তর’-এর। ২১ নভেম্বর, ১৯৫৩, ১০ জানুয়ারি, ১৯৫৪, ২৫ জানুয়ারি ও ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫৪।
পার্কের চিরুনিতল্লাশিতে পাওয়া গেল আরও একটি মোড়ক। রাখা ছিল একটি বালির বস্তার নীচে। যার ভিতর থেকে বেরল দুই ঊরুর টুকরো টুকরো অংশ।
মোড়ার জন্য ব্যবহৃত কাগজ? সেই ‘যুগান্তর’-ই।
দৃশ্য-৩
২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪, মধ্যরাত অতিক্রান্ত।
লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্টারোগেশন রুম। লাগাতার জেরায় ধুঁকছেন মধ্যতিরিশের যুবক। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে সন্ধে নাগাদ, চলছে বিরামহীন। অবলীলায় সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শুরুর কয়েক ঘণ্টায়। এমনটাই হয় জটিল মামলায়, জানি আমরা অভিজ্ঞতায়। জেরার প্রাথমিক পর্বে অভিযুক্ত কিছুতেই স্বীকার করে না অপরাধ। আত্মপক্ষ সমর্থনে যা বলার, যে ভাবে বলার, বলতে দেওয়া হয় সব। তদন্তকারীরা শুনতে থাকেন নিরাবেগ নিস্পৃহতায়, বক্তব্যের অসংগতি লিপিবদ্ধ হতে থাকে নীরবে।
একটা সময়ের পর, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আত্মতুষ্টি যখন অজান্তেই ঘিরে ধরে অভিযুক্তকে, আসল খেলা শুরু হয় ঠিক তখন। প্রশ্নের তাস একটার পর একটা ফেলতে থাকেন গোয়েন্দারা, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় জবানবন্দির অসংগতি, যার ধাক্কায় বেআব্রু হয়ে যায় বয়ানের মিথ্যাচার।
তেমনটাই হল সে-রাতে। প্রশ্নের চক্রব্যূহে ক্রমশ দিকভ্রান্ত হতে থাকলেন যুবক। প্রথম দিকের ‘ভাঙব, তবু মচকাব না’ ভাবটা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি তখন। স্নায়ু যে বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে, জানান দিচ্ছে কপালের স্বেদবিন্দু। ভঙ্গুর হয়ে এসেছে রক্ষণ।
সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ, তৎকালীন ওসি হোমিসাইড, বুঝলেন, কাঙ্ক্ষিত স্বীকারোক্তি আসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। এলও অল্পক্ষণ পরেই। ‘স্যার, আমিই মেরেছি ওকে। কেটে ফেলে দিয়েছি টুকরো টুকরো করে। এ ছাড়া উপায় ছিল না আর!’ বলেই মুখ ঢেকে টেবিলে মাথা গুঁজে দিলেন অভিযুক্ত।
সমরেন্দ্র জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন, ‘নিন, খান। অনেক সময় আছে। ধীরেসুস্থে বাকিটা বলুন।’ রাত তখন পাড়ি দিচ্ছে ভোরের ঠিকানায়। সূর্যের দাপট কিছু পরেই দখল নেবে অন্ধকারের।
বেলারানী দত্ত হত্যা মামলা। টালিগঞ্জ থানা, কেস নম্বর ১১৬, তারিখ ৩১/১/৫৪। খুন এবং প্রমাণ লোপাট, ৩০২/২০১ আইপিসি।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নারীশরীরের দেহাংশ খবরের কাগজে মুড়ে, বিকৃত এতটাই যে শনাক্তকরণ প্রায় অসাধ্য। সাম্প্রতিক অতীতে এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ইন্টারনেটের দৌলতে সেসব মামলার বিবরণও সহজলভ্য। চিত্রায়িতও হয়েছে সিরিয়ালে-সিনেমায়। কিন্তু সেই সদ্য স্বাধীনোত্তর সময়ে এমন কেস কলকাতায় কেন, দেশের অন্যত্র বা বিদেশেও আদৌ হয়েছিল কি না, তথ্য নেই প্রামাণ্য।
ঘটনা প্রচারিত হওয়ার পর শহর কলকাতায় প্রবল চাঞ্চল্য প্রত্যাশিতই ছিল। চাঞ্চল্যের অভিঘাত ক্ষীণতর হয়েছে সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে, কিন্তু বিরলের মধ্যে বিরলতম হিসেবে এই মামলার চিরস্থায়ী স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে অপরাধ-গবেষণার ইতিহাসে।
নারকীয় হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র সময় খরচ করলেন না তৎকালীন নগরপাল। দায়িত্ব পড়ল হোমিসাইড শাখার ওসি ইনস্পেকটর সমরেন্দ্রনাথ ঘোষের উপর, আগে লিখেছি যাঁর কথা।
ময়নাতদন্ত হল ৩১ জানুয়ারি। পচনপ্রক্রিয়া ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে দেহাংশে। খণ্ডিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের একটি একটি করে অশেষ অধ্যবসায়ে জোড়ার চেষ্টা করলেন ডাক্তাররা। সাত-আট ঘণ্টার প্রাণান্তকর পরিশ্রমে পূর্ণবয়স্কা নারীশরীরের রূপ নিল জোড়া লাগানো দেহাবশেষ। দুটি বিশেষত্ব নজরে এল মৃতদেহে। এক, দুটি পায়েরই পাতা অস্বাভাবিক লম্বা। দুই, বাঁ ঊরুর উপর একটি কাটা দাগ।
যিনি পোস্টমর্টেম করলেন, তাঁর বক্তব্য ছিল দ্বিধাহীন। মৃত্যু ঘাড়ের কাছে ধারালো কিছুর আঘাতে, যা “ante mortem and homicidal in nature”। শরীরের বাকি অগুনতি আঘাতচিহ্ন মৃত্যুর পর, “post mortem injuries”।
এ পর্যন্ত তো হল। কিন্তু আসল কাজই তখনও বাকি, মৃতার শনাক্তকরণ। মুখ ক্ষতবিক্ষত, চামড়া বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই আর। কে খুন হলেন, সেটা না জানলে কীভাবে খুন, কে খুনি, এগোনোর রাস্তাই তো একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায় তদন্তের।
শেষ চেষ্টা করা হল। খবর পাঠানো হল চুঁচুড়া-নিবাসী ডাক্তার মুরারীমোহন মুখার্জির কাছে। যিনি তখন কলকাতার কারনানি হাসপাতালে প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান, বিস্তর নামডাক।
ডাক্তার মুখার্জি এলেন, অক্লান্ত শ্রমব্যয় করলেন। মুখের আদল কিছুটা এল বটে, কিন্তু তা চিহ্নিতকরণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। পচনক্রিয়া (Putrefaction) শুরু হয়ে গিয়েছিল দেহাংশে। না হলে প্লাস্টিক সার্জারি ফলদায়ক হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল। ভারতের ইতিহাসে অপরাধ-তদন্তে সম্ভবত এই মামলাতেই প্রথম প্লাস্টিক সার্জারির শরণাপন্ন হওয়া।
কলকাতা পুলিশের তরফে ঘটনার বিশদ প্রচার করা হল। কাগজে মৃতার অবয়বের ছবিও ছাপানো হল, যা তোলা হয়েছিল ময়নাতদন্তের পর। দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পেরোল, সামান্যতম খবরও এল না।
মর্গে খণ্ডিত দেহাংশ জোড়া হয়েছে
নীলরতন সরকার হাসপাতালের মর্গে দেহ রাখা হল প্রায় কুড়ি দিন। এর পর মৃতার কপালে আটকে থাকা কিছু চুল, হাতের-কোমরের-পায়ের-ঊরুর কিছু অস্থিমজ্জা সংরক্ষিত করে অশনাক্ত দেহ পুড়িয়ে ফেলা হল প্রথামাফিক।
শনাক্ত করার জন্য কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি পুলিশ। যেখানে দেহের টুকরোগুলি ফেলা হয়েছিল, তার আশেপাশের অন্তত শ’খানেক বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। শুধু শহরে নয়, রাজ্যের প্রতিটি থানায় বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। কোথাও কোনও মহিলার নামে মিসিং ডায়েরি হয়েছে কি না। সূত্র মেলেনি কোনও।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ। প্রায় মাসখানেক গড়িয়ে গিয়েছে ঘটনার। তদন্তে কণামাত্র অগ্রগতি ব্যতিরেকেই। কিনারাসূত্র আপ্রাণ চেষ্টাতেও অধরা থাকলে শতকরা নব্বই ভাগ তদন্তকারীকে একটা সময় গ্রাস করেই অনিবার্য হতাশা। যা ক্রমাগত অবচেতনে বাজাতে থাকে কাটা রেকর্ড, ‘অনেক হল, এবার হাল ছেড়ে দেওয়া যাক, কত মামলারই তো কিনারা হয় না।’
এমতাবস্থায় হতাশাকে প্লেগবৎ পরিত্যজ্য রাখাটাই সফল তদন্তকারীর কষ্টিপাথর। সমরেন্দ্র হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। ফুটবলের তুলনা টানলে, ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা নয়, ছিলেন আদ্যন্ত জার্মান মনোভাবাপন্ন। হারার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত না হারায় বিশ্বাসী, শিল্পের থেকে বরাবর প্রাধান্য দিতেন শৌর্যকে।
কথায় বলে, ভাগ্য বীরেরই সহায় হয়। আর, তদন্তের অভিজ্ঞতা বলে, ভাগ্য সহায় হয় একমুখী অধ্যবসায়েরও। কৃপাদৃষ্টি দেয় আচম্বিতে, ঘটে যায় অভাবিত সমাপতন।
যেমনটা হল ২৫ ফেব্রুয়ারির রাতে। রাত সাড়ে ন’টা-পৌনে দশটা হবে তখন। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে বাড়ি ফিরছিলেন সমরেন্দ্র। ক্লান্ত, অবসন্ন। ঠান্ডাও লেগেছে একটু, হালকা সর্দিকাশিতে বিব্রত। গাড়ি ছুটছে টালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে রাসবিহারীর দিকে। হঠাৎই খেয়াল হল, একটা কাশির ওষুধ কিনে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। রসা রোডের কাছাকাছি এসে চোখে পড়ল প্রায় পাশাপাশিই দুটো ওষুধের দোকান। একটার ঝাঁপ ফেলছে কর্মচারী, Royal Medical Store। পাশেরটা খোলা, South Calcutta Pharmacy। গাড়ি দাঁড়াল দোকানের সামনে।
দোকানের ছিরিছাঁদ দেখলে ভক্তি হওয়ার কথা নয়। টুলে বসে একজন কর্মচারী, অপরিচ্ছন্ন পোশাক। মুখে জন্মজন্মান্তরের বিরক্তি। দোকানের তাক-আলমারির সিংহভাগই খালি, কিছু ওষুধপত্র সাজানো অবিন্যস্ত। পুলিশের গাড়ি থেকে খদ্দের নামতে দেখে সামান্য নড়েচড়ে বসলেন কর্মচারী।
—কাশির ওষুধ লাগবে একটা।
—দাঁড়ান স্যার, দেখছি।
মিনিটখানেক দেখেশুনে কর্মচারী দেঁতো হেসে যে উত্তর দিলেন, একটু রেগেই গেলেন সমরেন্দ্র।
—স্যার, জ্বর-মাথাব্যথার আছে। কাশির ওষুধ ছিল, স্টক শেষ।
—তা এমন দোকান খুলে রেখেছ কেন? বন্ধ করে দিলেই হয়। মালিক কোথায় তোমার?
—মালিক তো স্যার মাসখানেক হল আসছেন না।
—সে জন্যই এই অবস্থা দোকানের। কী নাম মালিকের? দোকানটা তুলে দিতে বলে দিয়ো।
—স্যার, বীরেন দত্ত। খবর পাঠিয়েছেন, বাইরে আছেন। রোজ সন্ধেবেলা দোকানে বসতেন। এই প্রথম এতদিন ধরে দেখছি না।
পাওয়া গেল না ওষুধ, চালক স্টার্ট দিলেন গাড়িতে। সামান্য এগনোর পরই গাড়ি থামালেন সমরেন্দ্র। দোকানের কর্মচারী কী বলল যেন? মালিক মাসখানেক ধরে আসছেন না? আরও তো বলল, ‘এই প্রথম এত দিন ধরে…’। সমরেন্দ্র ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই’-এর তত্ত্বে ভরসা রাখতেন। মনের খচখচানি দূর করতে চালককে বললেন, যা তো আবার, দোকানটার মালিকের ঠিকানা জেনে আয়।
জানা হল। ৫৫/৪/২ টার্ফ রোড। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের অদূরেই। শরীর বইছিল না, তবু মনে হল সমরেন্দ্রর, একবার ঘুরেই আসি। গেলেন, দেখলেন বীরেন দত্তর ঘর তালাবন্ধ। প্রতিবেশীদের থেকে জানলেন, গত বেশ কয়েক বছর ধরে ওই ঘরেই বীরেন থাকেন স্ত্রী বেলাকে নিয়ে। একটি ছ’ বছরের ছেলেও আছে। জানুয়ারির শেষে সন্তানসম্ভবা বেলা ভরতি হয়েছিলেন শিশুমঙ্গলে, এমনটাই তাঁরা শুনেছিলেন বীরেনের কাছে। ৩০ জানুয়ারির পর বীরেনকে তাঁরা আর দেখেননি, ছেলেকে নিয়ে চলে গিয়েছেন।
কিনারার সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেলে যে-কোনও তদন্তকারী অফিসারের যা হয়, তা-ই হল সমরেন্দ্রর। অ্যাড্রিনালিনের বাড়তি ক্ষরণ শিরা-উপশিরায়। এ অনুভূতি বড় পরিচিত পুলিশের, যাঁরা জটিল মামলার তদন্ত করেছেন, তাঁরা জানেন। লিখে বোঝানোর নয় সবটা।
বেলা দত্ত নামে কোনও সন্তানসম্ভবা যে গত এক মাসে ‘শিশুমঙ্গল’ হাসপাতালে ভরতি হননি, সেটা বার করতে লাগল ঘণ্টাদুয়েক। রহস্য আর পরদানশিন থাকল না |
আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দারা। একটি লোককে খুঁজে বার করতে হবে। নাম জানা আছে। জানা হয়ে গিয়েছে কোথায় কীসের দোকান, বাড়ির ঠিকানা পাওয়া গিয়েছে। প্রতিবেশীরা চেহারার বিবরণ দিয়েছেন। এর পরও সন্দেহভাজনকে পাওয়া যাবে না, হয়? সোর্স লাগানো হল একাধিক। বীরেন দত্তর পারিবারিক এবং ব্যবসায়িক ঠিকুজিকুষ্ঠির খোঁজখবর শুরু করার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই খবর এল। বীরেনের নাকি হরিশ মুখার্জি রোডেও আস্তানা আছে একটা, যাতায়াত নিয়মিত।
নজরদারি চালু হল। ২৭ ফেব্রুয়ারির ভোরে ১০২এ হরিশ মুখার্জি রোডের একটি বাড়ি থেকে চাদর মুড়ি দিয়ে এক ভদ্রলোককে বেরতে দেখা গেল। কেদার বোস লেনের মুখে আটকাল সাদা পোশাকের পুলিশ।
—আপনি কি বীরেন দত্ত?
—হ্যাঁ, কেন?
—বেলা দত্ত কি আপনার স্ত্রী?
—হ্যাঁ… কিন্তু…কেন বলুন তো?
—যা জানতে চাইছি, উত্তর দিন। উনি কোথায়?
—লজ্জার কথা কী আর বলব! বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে প্রেমিকের সঙ্গে।
—গাড়িতে উঠুন, আমরা লালবাজার থেকে আসছি। বাকি কথা ওখানেই হবে।
খুনের গায়ে-কাঁটা-দেওয়া বিবরণে আসার আগে একটু পূর্বকথন জরুরি। বীরেন দত্ত, ডাকনাম বেচু, বয়স ৩৪। বজবজের কাছের একটি গ্রামে কেটেছিল ছেলেবেলা। বাবা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সাব-ইনস্পেকটর। বয়স যখন মাত্র এক, বাবা গত হলেন। তার কয়েক মাসের মধ্যে মা-ও। দুই দিদি, আভা ও কনক। যাঁদের শ্বশুরবাড়ি যথাক্রমে আন্দুল ও কলকাতায়। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কিছুদিন থাকলেন দিদার গ্রামের বাড়িতে। ভরতি হলেন স্কুলে।
বীরেনের দুই খুড়তুতো দাদা নবনী দত্ত ও যতীন্দ্র দত্ত থাকতেন ভবানীপুরের চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। বয়স যখন আট-নয়, দাদারা বীরেনকে নিয়ে এলেন কলকাতায় নিজেদের কাছে। বালক বীরেনকে ভরতি করে দেওয়া হল রামরিক ইনস্টিটিউশনে।
পড়াশোনায় যে বিশেষ মন ছিল বীরেনের, এমন অভিযোগ অতি বড় শুভানুধ্যায়ীর পক্ষেও করা কঠিন ছিল। রেজাল্ট তো খারাপ হচ্ছিলই, উপরন্তু ক্লাস পালিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমা, বিড়ি-সিগারেট-মদ। উচ্ছন্নে যাওয়ার ইঙ্গিত ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছিল। দাদারা একদিন বকাবকি করলেন খুব, চড়-থাপ্পড় খরচ করলেন দরাজহস্তে। ক্লাস এইটের বীরেন রেগেমেগে চলে এলেন আন্দুলে দিদির শ্বশুরবাড়িতে।
বেলারানী দেবী
জামাইবাবুর ওষুধের দোকান ছিল, টুকটাক কাজ শুরু করলেন সেখানে। ১৯৩৪ থেকে ’৪৪, দশ বছর কাটল আন্দুলেই। খুড়তুতো দাদা নবনীর বরাবরই কিঞ্চিৎ দুর্বলতা ছিল ‘বেচু’র প্রতি। নিয়মিত খবর রাখতেন। আন্দুলে গেলেন একদিন খোঁজখবর নিতে, যেমন যেতেন মাঝেমধ্যে। বীরেনকে একটু ছন্নছাড়া দেখলেন, মায়াই হল একরকম। ফের নিয়ে এলেন কলকাতায়। বীরেন তখন বছর চব্বিশের যুবক। বড় জামাইবাবু শ্যালককে ভালবাসতেন খুব। রসা রোডে ‘South Calcutta Pharmacy’ নামে একটি দোকান করেছিলেন কিছুদিন আগে। সেটা লিখে দিলেন বীরেনের নামে।
দাদা নবনীর রমেশ মিত্র রোডের বাড়িতে বসবাস শুরু করলেন বীরেন। নবনীর কন্যা কমলা তখন সতেরোর কিশোরী। ছটফটে, হাসিখুশি, প্রাণবন্ত। খুড়তুতো দাদার মেয়ের প্রেমে পড়লেন বীরেন। কমলাও ভেসে গেলেন কৈশোরের আবেগে। অনুরাগ ছিল উভয় পক্ষেই।
কমলাকে নিয়ে একদিন বাড়ি থেকে পালালেন বীরেন, উঠলেন সদানন্দ রোডের এক ভাড়াবাড়িতে। চেষ্টাও করলেন বারদুয়েক নবনীর বাড়ি গিয়ে বোঝাতে, ফল হল না। তুমুল বাদানুবাদ হল। নবনীর পরিবার এই সম্পর্ককে মানলেন না কিছুতেই। মেয়েরও এই গৃহত্যাগে সম্মতি আছে বুঝে নবনী সম্পর্ক ত্যাগ করলেন কমলার সঙ্গে। পুলিশে অভিযোগ করবেন ভেবেছিলেন প্রথমে। শেষমেশ অবশ্য বিরত থাকলেন সামাজিক মর্যাদাহানির আশঙ্কায়।
সদানন্দ রোডের বাড়িতে সংসার পাতলেন বীরেন, নতুন নামও দিলেন কমলার। ‘বেলারানী’। আইনসিদ্ধ বিয়ের প্রথাগত রীতিনীতি অবশ্য মানলেন না বীরেন, বেলার শত অনুরোধ সত্ত্বেও। সিঁথিতে নাম-কা-ওয়াস্তে সিঁদুর ঠেকিয়ে নিরস্ত করলেন বেলাকে, স্বামী-স্ত্রী পরিচয়েই দিন কাটতে লাগল। পুত্রসন্তানের জন্ম হল বছরদুয়েকের মধ্যে। নাম রাখা হল বথীন্দ্রনাথ দত্ত, আদরের ডাক ‘বোতন’।
সন্তানের জন্মের পর বীরেন-বেলা সদানন্দ রোডের বাড়ি থেকে উঠে এলেন ৫৫/৪/২, টার্ফ রোডে। যত সময় গেল, বীরেন ক্রমে বেলার প্রতি নিরুৎসাহ হয়ে পড়তে লাগলেন। আলাপ হল শ্রীকৃষ্ণ লেনের বাসিন্দা শ্রী সরোজকান্তি বসুর কন্যা মীরার সঙ্গে। ’৪৮-এর মাঝামাঝি রেজিস্ট্রি বিয়ে সেরে ফেললেন। বেলার অস্তিত্ব সম্পূর্ণ গোপন করেই। বীরেনের দিদি-জামাইবাবুরা জানতেন বেলা-কাহিনি, কিন্তু তাঁরাও তীব্র বীতশ্রদ্ধ ছিলেন ওই সম্পর্ক নিয়ে। ভাবলেন, বেলা তো এক অর্থে রক্ষিতাই মাত্র, বিয়ে হলে যদি সম্পর্কে ইতি পড়ে, ভালই। এতে যে কারওরই ভাল হবে না, বেলারই হোক বা মীরার, বা বীরেনেরও, সেটা বিলক্ষণ বুঝেও। ওই যে, স্নেহ বড় বিষম বস্তু!
বিয়ের পরে প্রথম দু’বছর গোয়াবাগানে দিদির শ্বশুরবাড়িতে মীরাকে রাখলেন বীরেন। সেখানেই জন্ম হল এক কন্যাসন্তানের, যে পৃথিবীর মায়া কাটাল ভূমিষ্ঠ হওয়ার দু’দিন পরেই। মীরা সদ্যোজাতা কন্যার মৃত্যুশোকে আচ্ছন্ন ছিলেন কিছুদিন। শোকের প্রাবল্য কিছুটা কমলে বীরেনকে বললেন, বাড়ি খুঁজতে শুরু করো, আলাদা থাকব। বাস্তবিকই, কোন বিবাহিতা মহিলাই বা চান ওভাবে থাকতে ননদের অনুগ্রহে?
নাছোড়বান্দা মীরার জোরাজুরিতে বীরেন ১০২এ হরিশ মুখার্জি রোডের একতলার একটি ছোট ঘর ভাড়া নিলেন। ১৯৫৩-য় জন্ম নিল বীরেন-মীরার শিশুপুত্র।
আশ্চর্য কৌশলী রোজনামচা ছিল বীরেনের! কতই বা দূরত্ব টার্ফ রোড আর হরিশ মুখার্জি রোডের? অথচ, বছরের পর বছর মীরাকে জানতে দেননি বেলার কথা, বেলাকে মীরার! দুপুরের খাওয়া সারতেন টার্ফ রোডে, মীরাকে বলতেন, কাজের ব্যস্ততায় মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিতে হয় ওয়াইএমসিএ–র ক্যান্টিনে। রাতটা সপ্তাহের অধিকাংশ দিন কাটাতেন হরিশ মুখার্জি রোডের ভাড়াবাড়িতে। বেলাকে বুঝিয়েছিলেন, দোকানের ওষুধপত্র কেনার কাজে শহরের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে ঘনঘন।
বিবেকবর্জিত দুশ্চরিত্র ছিলেন বীরেন, ঠিকই। কিন্তু সত্যের স্বার্থে স্বীকার্য, গুণও ছিল কিছু। ছোট থেকেই পাড়ায় যাত্রা-নাটকে অভিনয় করতেন এবং নেহাত মন্দ করতেন না। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয় যাতায়াত ছিল নিয়মিত। সেখানেই আলাপ-পরিচয় প্রযোজক-পরিচালকদের সঙ্গে। একটা-দুটো নয়, অভিনয় করেছিলেন ছ’টি ছবিতে। যার মধ্যে বাঙালির সর্বকালীন মহানায়কের কেরিয়ারের দ্বিতীয় মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘কামনা’-ও ছিল। বাকি ছবিগুলি ‘নারী’, ‘মহাকাল’, ‘শুভদা’, ‘নিষ্কৃতি’ এবং ‘পাপের পথে’।
‘পাপের পথে’ আক্ষরিক অর্থেই পা বাড়ানো অবশ্য ওই স্টুডিয়োপাড়া থেকেই। জুটে গেল কিছু ইয়ারদোস্ত। রেসের মাঠ, জুয়ার ঠেক আর নিষিদ্ধ পল্লির ত্র্যহস্পর্শে দিশা হারালেন। ফার্মাসির কাজকর্মে মন দিতেন না আর। কর্মচারীদের উপর ছেড়ে দিলেন পুরোটাই। ফল, বাণিজ্যলক্ষ্মী বিরূপ হলেন, শুরু হল অর্থসংকট। এমনিতেই দুটো সংসার চালানো যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। কষ্টেসৃষ্টে তবু চলছিল। কিন্তু বীরেন চোখে অন্ধকার দেখলেন, যখন জানলেন, বেলা দ্বিতীয়বারের জন্য সন্তানসম্ভবা।
—এর পর?
—আমি আর পারছিলাম না স্যার। একে ব্যবসায় মন্দা চলছে। অনেক ধারদেনা হয়ে গিয়েছিল। তার উপর বেলা আর মীরাকে মিথ্যে বলে বলে ক্লান্ত। ভয় হত স্যার, যে-কোনও দিন ধরা পড়ে যাব। মীরা তো সন্দেহ করতে শুরু করেইছিল, বেলাও মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করত, রোজ রাত্রে কীসের এত কাজ? যখন শুনলাম, বেলা আবার মা হতে চলেছে, প্রথমেই মাথায় এল, আবার একগাদা খরচের ধাক্কা। ঠিক করলাম, বেলাকে সরিয়ে দেব। আর কোনও উপায় ছিল না স্যার, বিশ্বাস করুন!
বিশ্বাস-অবিশ্বাস পরে। জিজ্ঞাসাবাদের গোড়ার কথা, খুব বেশি বিরাম দিতে নেই স্বীকারোক্তির সময়। গোয়েন্দারা থামতে দিলেনও না। বীরেন বলে চললেন।
—এক চোট রাগারাগি করলাম প্রথমে। বললাম, এ সন্তান আমার নয়, হতে পারে না। আমার রাতে বাইরে থাকার সুযোগ নিয়েছ তুমি। শুনে বেলা প্রথমে কাঁদল, তারপর ঝগড়াঝাঁটি হল খুব।
খুনের পরিকল্পনায় একমাত্র পথের কাঁটা ছিল পুত্র বোতন, বয়স তখন ছয়। কী করা যায়? মীরার কাছে আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদলেন বীরেন। বললেন, এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন পথদুর্ঘটনায়। রেখে গিয়েছেন ছ’বছরের ছেলেকে, যে এখন সর্বার্থেই অনাথ। মীরা রাজি থাকলে হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে রাখতে চান। মীরা আবেগপ্রবণ স্বভাবের ছিলেন, সম্মতি দিলেন এক কথায়।
২৭ জানুয়ারি, ১৯৫৪। বেলা তখন পূর্ণ সন্তানসম্ভবা। ফার্মাসি থেকে বাড়ি ফিরলেন বীরেন। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। বোতন ঘুমোচ্ছে অকাতরে। বেলা রুটি-আলুভাজা সাজিয়ে দিলেন থালায়। বীরেন নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলেন। এবং করেই গালিগালাজ শুরু করলেন বেলাকে, আমি এক পয়সাও খরচ সেই বাচ্চার জন্য করব না, যে আমার নয়। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল বেলার, মেজাজ হারালেন, তোমার কীর্তিকলাপ জানতেও আর বাকি নেই কারও।
বীরেন সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। বেমক্কা মারধর শুরু করলেন। রান্নাঘরে রাখা দা দিয়ে বেলার ঘাড়ে কোপ বসালেন। বেশ কয়েকবার। অবিরাম রক্তক্ষরণ এবং মৃত্যু কিছুক্ষণের মধ্যেই। কাঠের আলমারিতে কাপড়চোপড় ছিল। সেসব বার করে আলমারিতেই ঢুকিয়ে দিলেন মৃতদেহ। ধুয়েমুছে পরিষ্কার করলেন রক্তস্রোত। তার আগে বেলার শরীরে যা গয়নাগাটি ছিল, খুলে নিলেন সব। ছ’জোড়া সোনার চুড়ি, সোনার আংটি, কানের দুল, সব। এবং, এত কিছুর পর, ঘুমিয়ে পড়লেন নিশ্চিন্তে!
খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র
উদ্ধার করা বেলারানীর বালা
টার্ফ রোডের বাড়ির দু’তলায় একাই থাকতেন বেণু নামের এক অবিবাহিতা মহিলা। যাঁর সঙ্গে বেলার ঘনিষ্ঠতা ছিল, যিনি অসম্ভব ভালবাসতেন বোতনকে। বোতন দিনের অনেকটা সময় কাটাত ‘বেণুমাসি’র সঙ্গে। ২৮ তারিখ ভোরে উঠেই পরের ধাপগুলো ছকে নিলেন বীরেন। কীরকম?
—ভোরে উঠে বেণুদিকে ডাকলাম। বললাম, গভীর রাতে বেলাকে ভরতি করাতে হয়েছে শিশুমঙ্গল হাসপাতালে। ডেলিভারি হবে যে-কোনও সময়। বোতনকে এ ক’দিন যদি বেণুদি নিজের কাছে রাখেন, ভাল হয়। বেণুদি সানন্দে রাজি হলেন। বোতন সকালে উঠে জানতে চাইল, মা কোথায়? বললাম, মা হাসপাতালে গিয়েছে, তোমার একটা ভাই বা বোন নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে।
অচিন্তনীয়! বেলার লাশকে আলমারিবন্দি রেখে দিব্যি সকালে দোকানে বেরলেন বীরেন। ভাবতে থাকলেন সারাদিন, লাশ হাপিস করা যায় কীভাবে? লাশই যদি না পায় পুলিশ, কাকেই বা ধরবে, কীভাবেই বা ধরবে? রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ কর্মচারীরা বেরিয়ে গেল, দোকানে জমিয়ে রাখা ‘যুগান্তর’-এর স্তূপ থেকে কয়েকটা বার করে নিলেন বীরেন। রওনা দিলেন টার্ফ রোড। পরের অংশ বীরেনের বয়ানেই পড়ুন, নিস্পৃহ বিবরণ দুঃসাধ্য।
—বেলার বডি বার করলাম আলমারি থেকে। প্রথমে দা দিয়ে মাথাটা কাটলাম। তারপর এক এক করে কান-নাক-চুল-হাত-পা-বুক-পেট, সব। মুখের চামড়া চেঁছে দিলাম। যুগান্তরের পাতা দিয়ে মুড়ে নারকেল দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে দিলাম আলমারিতে। তালাও লাগিয়ে দিলাম। পুরো ঘরটা দু’-তিনবার ধুলাম ফিনাইল দিয়ে। রক্তে থইথই করছিল তো, গন্ধও বেরচ্ছিল খুব।
যে ঘরে বেলারানীকে হত্যা করা হয়েছিল
সে-রাতেও নিশ্চিন্ত নিদ্রা ওই ঘরেই!
২৯ তারিখ যথারীতি দিনভর ফার্মাসিতে। রাত্রে ফিরে বীরেন আলমারি খুলে বার করলেন নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা মোড়কগুলো। রেশন আনার জন্য ব্যবহৃত দুটো বড় ব্যাগে বেলার খণ্ডিত দেহাংশ পুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশা ডাকলেন। কালীঘাট পার্কের কাছে গিয়ে ছেড়ে দিলেন রিকশা। কিছু মোড়ক ফেললেন পার্কে, কিছু হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে কেওড়াতলা শ্মশানের কাছের শৌচালয়ের পাশে। টার্ফ রোডে ফিরে ফের একপ্রস্থ ধোয়ামোছা ফিনাইল দিয়ে, আলমারিতে বালতি বালতি জল ঢেলে মুছে ফেলা রক্তের দাগ।
৩০ জানুয়ারির সকাল। দোকানে বেরনোর সময় বীরেনের দেখা বেণুর সঙ্গে।
—বেলার কী খবর বীরেন? ভাবছিলাম, দেখতে যাব একবার।
—না না বেণুদি, এখন যেয়ো না। আজ রাতে ডেলিভারি হবে হয়তো। প্রেশারটা ওঠানামা করছে। ডাক্তাররা আলাদা কেবিনে রেখেছে। বাড়ি আসবে কয়েকদিনের মধ্যে, তখন তো দেখা হবেই।
উৎসুক প্রতিবেশীদেরও একই কথা বললেন। এবং পরের কয়েকদিন বেলার সমস্ত গয়নাগাটি সরিয়ে ফেললেন হরিশ মুখার্জি রোডে। মীরা জানতে চাওয়ায় বললেন, এক বন্ধু গয়না বন্ধক রেখেছেন। বেলার ব্যবহৃত কাপড়চোপড়–প্রসাধনী ফেলে দিলেন টালি নালায়। বোতনকে দিন দুয়েক পরে নিয়ে গেলেন হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে। অনাথ বন্ধুপুত্রের গল্প তো মীরাকে বলা ছিল আগেই। মীরা, অনুমান করা যায়, নির্ঘাত সন্দেহ করেছিলেন কিছু। বোতন নিশ্চয়ই মীরার সামনে ‘বাবা’ বলেই ডাকত বীরেনকে। ছ’বছরে অনাথ হওয়া বালক চট করে অন্য কাউকে ‘বাবা’ ডাকবে কেন? স্বামীর অপকীর্তি অনুমান করেও মীরা নীরব থেকেছিলেন, সংসাররক্ষার দায়ে?
সাক্ষ্যপ্রমাণ সংহত করা হল নিবিড় যত্নে। পান থেকে চুন খসারও বিলাসিতা ছিল না তদন্তকারী অফিসারের কাছে। হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত হল বেলার গয়না| টার্ফ রোডের বাড়ির আলমারি থেকে উদ্ধার হল দা (weapon of offence), যাতে লেগে ছিল চুল। মেঝেতে জমাট বেঁধে থাকা রক্তের দাগ থেকে সংগৃহিত হল নমুনা (sample blood)। উদ্ধার হল ফিনাইলের বোতল, যাতেও আটকে ছিল চুল। রক্তের নমুনা যে মনুষ্যদেহেরই, প্রমাণ হল ফরেনসিক পরীক্ষায়। মৃতা নারীর সংরক্ষিত চুল আর দত্তদের বাড়িতে দা আর ফিনাইলের বোতলে আটকে থাকা চুল যে একই ব্যক্তির, তা-ও নিশ্চিত হল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। এটি অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল আদালতের বিচারে।
মৃতা যে বেলারানীই, প্রমাণের জন্য বেলার সন্তানসম্ভবা থাকার নথি একান্ত প্রয়োজন ছিল। সেটিও জোগাড় হল। টার্ফ রোডের বাড়ি তল্লাশির সময়ই পাওয়া গিয়েছিল শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের আউটডোরের টিকিট। ১৯৫৩-র ২৪ নভেম্বরের সেই টিকিটে স্পষ্ট লেখা ছিল, স্ত্রীরোগবিশারদের কাছে গিয়েছিলেন বেলা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়।
নিজের ফার্মাসিতে ‘যুগান্তর’ পত্রিকা রাখতেন বীরেন। বিক্রি করতেন না, পুরনো কাগজও জমিয়ে রাখার অভ্যাস ছিল। বাজেয়াপ্ত করা হল সমস্ত কাগজ। এবং ঠিক যেমনটা ভাবা হয়েছিল, সব ছিল কালানুক্রমিক, শুধু কয়েকটি দিন বাদে। সেই দিনগুলি, যে যে দিনের কাগজ দিয়ে মোড়া হয়েছিল বেলারানীর দেহের টুকরো টুকরো অংশ। পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসেবে এর তাৎপর্য ছিল অপরিসীম, মাননীয় আদালতও লিপিবদ্ধ রেখেছিলেন রায়ে।
কালীঘাট পার্কে প্রাপ্ত পা-এর খণ্ডিত অংশ
ময়নাতদন্তের সময় আবিষ্কৃত মৃতার পায়ের পাতার অস্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের কথা উল্লেখ করেছি আগে। বীরেনের গ্রেফতারির পর খবর দেওয়া হল বেলারানীর আত্মীয়-পরিজনদের। যাঁদের সঙ্গে বীরেন-বেলার বিশেষ সম্পর্ক ছিল না পারস্পরিক তিক্ততার কারণে। মৃত্যুর খবরে ছুটে এলেন স্বজনরা। এবং দেখা গেল, বেলার বাবা-কাকা-ভাই-বোনের পায়ের পাতাও মৃতার মতোই একটু বেশি বড়।
ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি, ডিডি) চিঠি লিখলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রথিতযশা অধ্যাপক ড. এস এস সরকারকে। মৃতার পায়ের পাতার ছবি এবং বাবা-কাকাদের পায়ের পাতার ছবি ট্রেসিং (tracing) করে পাঠালেন, জানতে চাওয়া হল, Anthropology-র তত্ত্ববিচারে কি বলা সম্ভব, এঁরা একই বংশোদ্ভূত কি না? গভীর পর্যবেক্ষণের পর ড. সরকার লিখিত মতামত পাঠালেন ইতিবাচক। হ্যাঁ, একই বংশের। প্রমাণের বুনিয়াদ দৃঢ়তর হল।
এত কাঠখড় পোড়ানোর প্রয়োজনই হত না আজকের দিন হলে, DNA পরীক্ষার সুবিধা থাকলে। কিন্তু তখনকার দিনে কোথায় সে সুবিধা? অপরাধ-তদন্তে DNA পরীক্ষার ব্যবহার তো শুরুই হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে। ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ডের Leicester-এ দুটি খুন ও ধর্ষণের মামলায়।
বীরেনের কুকর্মের কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হল কমলা ওরফে বেলারানীর মায়ের সাক্ষ্যে। স্মরণ করুন, সংরক্ষিত ছিল মৃতার ঊরুর অংশবিশেষ। বাঁ ঊরুতে ছিল কাটা দাগ। যা এক ঝলক দেখেই আকুল কান্নায় ভাসলেন কমলা ওরফে বেলার গর্ভধারিণী। বললেন, আট বছর বয়সে পড়ে গিয়ে ঊরুতে গুরুতর চোট পেয়েছিল মেয়ে। এ দাগ সেই দাগ। মা তো, সন্তানকে কে আর তাঁর চেয়ে বেশি চিনবেন?
পেশ করা হল, এতটুকু অতিশয়োক্তি না করেই লিখছি, ‘সোনায় বাঁধানো’ চার্জশিট। যা খুনের মামলার তদন্তকারীদের কাছে আজও শিক্ষণীয় গ্রাহ্য হয়। আলিপুর দায়রা আদালতের বিচারপর্বে অভিযুক্তের আইনজীবী তর্কের তুফান তুললেন। দাবি, মৃতা আদৌ বেলারানী নন। বেলা অজ্ঞাতপরিচয় প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছেন। যে দাবি সর্বৈব মিথ্যায় পর্যবসিত হল ছ’ মাস ধরে চলা সওয়াল-জবাবের চাপানউতোরে। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের নিশ্ছিদ্র বুনন এবং ফরেনসিক পরীক্ষার তথ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণের পর বীরেনকে ফাঁসির সাজা শোনাল আদালত।
তদন্তকারী অফিসারের চিঠি
রায়ে পরিবর্তন হল না হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টেও। প্রাণদণ্ড বহাল থাকল। ১৯৫৬-র ২৮ জানুয়ারির ভোরে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসিকাঠ দেখা দিল নারকীয় অপরাধের কর্মফল রূপে। কালো কাপড়ে ঢাকল মুখ, গলায় আঁট হয়ে বসল দড়ি, পূর্বনির্দিষ্ট সময়ে বীরেন দত্তের পায়ের তলা থেকে সরে গেল পাটাতন।
Criminology বা অপরাধবিজ্ঞানের জনক বলা হয় ইতালীয় সমাজতাত্ত্বিক Cesare Lombroso (১৮৩৫-১৯০৯)-কে। যিনি বিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বকে এক যোগসূত্রে বেঁধে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণে অপরাধীর মনের গহনতম অন্দরে ঢোকার প্রয়াস শুরু করেছিলেন। মূলত সেই আধারেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই বর্তমান সময় পর্যন্ত নিরন্তর জারি রয়েছে অপরাধ-গবেষণা। নিত্যনতুন বিশ্লেষণে অজানা দিগন্তের সন্ধান মিলছে প্রতিনিয়ত।
বেলারানী হত্যা মামলার তত্ত্বতালাশে কেস ডায়েরির হলুদ হয়ে আসা পাতা উলটোতে বসে তবু মনে হয়, কিছু ঘটনা থাকেই, যা গবেষণালব্ধ তথ্যের আজ্ঞাবহ নয়, যা জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যার অতীত। পড়লেন তো। ভাবুন, কোন তত্ত্বের ব্যাখ্যায় ধরা যায় বীরেন দত্ত রচিত নিধননাট্য, সে-যুগে যা পাশবিকতায় কল্পনাতীত এবং নৃশংসতায় নজিরবিহীন?
ত্রিনিদাদের বিশ্ববন্দিত ইতিহাসবিদ C .L. R. James (১৯০১- ৮৯) তাঁর বহুপঠিত বই ‘Beyond a boundary’ (১৯৬৩)-তে লিখেছিলেন, “What do they know of cricket who only cricket know?” যাঁরা শুধু ক্রিকেটই জানেন, তাঁরা আর কতটুকুই বা ক্রিকেট জানেন?
অপরাধীর মনের অন্দরমহলও তা-ই। যতটুকু দেখা যায়, জানা যায়, অদেখা-অজানা থেকে যায় ঢের বেশি। এ এক অন্য পৃথিবী। অন্য ছায়াপথ। যেখানে মনোজগতের আলো-আঁধারি ধোঁয়াশা-কুয়াশা এক বিছানায় শুয়ে থাকে পাশাপাশি।
যেভাবে রচিত হয়েছিল চিন্তাতীত হত্যালীলা, মনে পড়ে যায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই অমর লাইনদুটি। ব্যঞ্জনা বিস্তৃত বহুদূর, তা ছুঁতে চাওয়ার ধৃষ্টতা নেই। তবু, এ মামলার দলিল-দস্তাবেজ নাড়াচাড়ার সময় কী অমোঘ মনে হয় কবির ওই উচ্চারণ—
“পথের হদিশ পথই জানে, মনের কথা মত্ত
মানুষ বড় শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।”