সূর্য-দীঘল বাড়ীর ভূত ক্ষেপেছে।
রাতে জয়গুনের ঘরের বেড়া ও চালের ওপর ঢিল পড়তে শুরু করে। হাসু, কাসু ও মায়মুন চিৎকার করে ওঠে, শেষে গলা দিয়ে চিৎকারও বের হয় না। ভয়ে তারা মা-কে জড়িয়ে ধরে।
ওদিকে শফির মা-র চিৎকার শোনা যায়।
পরের দিন ভোরে সে বলে–হেসুম কইছিলাম পাহারা বদলাইতে। অখন দ্যাখ কি দশা অয়! গাছগুলা কাটতে মানা করছিলাম। কোন্ গাছে কি আছিল, কে জানে? ওগ বাসা ভাইঙ্গা দেওনে রাগ অইছে।
পরের রাত্রেও এমনি ঢিল পড়ে। গ্রামে এই নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর কাছ দিয়ে আর কেউ হাঁটে না।
গ্রামের বুড়ো সোনাই কাজী বলে—সূর্য-দীগল বাড়ীর ভূত ক্ষেপছে, আর উফায় নাই। সূর্য-দীগল বাড়ীতে মানুষ উজাইতে পারে না, বুড়া-বুড়ীর কাছে হুনছি। সূর্য-দীগল হাটেরও উন্নতি অয় না। আমার চাউথেই দ্যাখলাম, জলধর কুণ্ডু, কুণ্ডেরচরে হাট মিলানোর লেইগ্য কত টাকা খরচ করল। কত হরিলুট দিল। ব্যাপারীগ মিডাই খাওয়াইল, নট্ট কোম্পানীর যাত্রা গানেও দুই এক আজার টাকা খরচ করছিল। কিন্তু কই? হাট আর মিলাইতে পারল না।
থুথুরে বুড়ী হনুফা বিবি বলে আমার মামু একবার সূর্যুদীগল মৌপোকের বাসা ভাঙছিল। আমার মনে আছে। গাছের তন নামতে না নামতে আঁড়ির তলা ভাইঙ্গা মধু পইড়া গেল। কী তেজ! বাপ্পুসরে!
জয়গুন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রাত্রে শফির মা-র ঘরে আশ্রয় নেয়। ছেলে-মেয়েদের বুকে নিয়ে সারারাত ‘আল্লা আল্লা’ করে।
অমাবস্যার রাত। করিম বক্শ গালে হাত দিয়ে কুপির সামনে বসে ভাবছে। তার মরে চোখে ভাসে—জয়গুনের ঘরে ঢিল পড়ছে দাডুম-দুড়ুম। তার বুকে কাসু ও মায়মুন ভয়ে মিইয়ে গেছে। হাসু পাশে বসে বসে কাঁপছে চোখ বন্ধ করে। জয়গুন আর একা এদের সামলাতে পারছে না। করিম বশের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। তার চোখের অব্যক্ত ভাষায় সে যেন সাহায্য চাইছে তার কাছে।
করিম বক্শ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। তাকের ওপর থেকে চারটে গজাল নিয়ে গামছায় বাঁধে। জোবেদ আলী ফকিরের নির্দেশমত আজ এই অমাবস্যার দুপুর রাতে সূর্য-দীঘল বাড়ীর চার কোণে মন্ত্রসিদ্ধ গজাল ক’টা পুঁতে আসতে হবে তাকে।
সূর্য-দীঘল বাড়ী ঠিক-ঠাক কারে জোবেদ আলী ফকির সেই যে একটি পেতলের কলসী দাবী করেছিল, আজ পর্যন্ত তাকে দেয়া হয় নি সে কলসী। বছর বছর পাহারা বদলাবার কথাও সে বলেছিল। তাতেও কান দেয়নি জয়গুন ও শফির মা। এ জন্যে গোস্বা হয়ে সে করিম বক্শকে জানিয়েছিল—এইবার দেখুক মজাখান। সাত দিনের মধ্যে বেবাক মিস্মার অইয়া যাইব। করিম বক্শ একটা পেতলের কলসী কিনে দিয়ে এবং অনেক হাতে-পায়ে ধরে জোবেদ আলী ফকিরের রাগ মাটি করেছে।
ফকির গজাল কয়টায় ফুঁ-ফাঁ দিয়ে তুকতাক করে করিম বকশের হাতে দিয়ে বলে-পরশু অমাবইস্যা। রাইত দুফরের পর–। চাইর কোণে চাইড্ডা—
–আমার ডর করে যে! একলা যাইতে সাবাসে কুলায় না। করিম বক্শ বলে।
—ডর করে! কও কি?
একটু চিন্তা করে ফকির বলে—আইচ্ছা, হেই দাওয়াইও আছে। করিম বকশের কাঁধে দুই হাত রেখে ফকির টানা সুরে মন্ত্র পড়ে–
খাটো কাপড় উলট বেশে
বাণ মারলাম হেসে হেসে।
সেই বাণে মেদিনী কাঁপে,
জল কাঁপে, থল কাঁপে,
চান কাঁপে, তারা কাঁপে,
পাতালের বাসুকী কাঁপে,
আগে ভাগে ভূত-পেরেতে,
জিন ভাগে শেষে।
কালা বাণে ভূত মারলাম,
পেত্নী বানলাম কেশে।
মন্ত্র পড়ে করিম বক্শের বুকে ও চোখে সাতবার ফুঁ দিয়ে ফকির এবার বলে-ডরের মাজা ভাইঙ্গা দিছি। যাও এইবার, আর ডর নাই। পরশু রাইত দুফরের পর, মনে থাকে যেন। চাইর কোণায় চাইড্ডা–
চারটি গজাল—বাড়ীর চার পাহারাদার। ঠিক-ঠাকে বসিয়ে আসতে পারলে ভূত-পেত্নীর দৌরাত্ম আর থাকবে না।
কুপি নিবিয়ে করিম বক্শ লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরোয়। সে পা ফেলে জোরে, আরো জোরে। কালো রাত্রির জমাট অন্ধকার যেন ভয় পেয়ে তার চলার পথ ছেড়ে দেয়।
ঈশান ও বায়ু কোণে দুটি গজাল পুঁতে সে পশ্চিম দিকে চলে আসে। ঘন অন্ধকার। তার মাঝেও দৃষ্টি চলে করিম বক্শের।- তিনটা ছায়ামূর্তি! ভয়ে তার গায়ের রোম কাটা দিয়ে ওঠে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর তাল গাছের তলায় সে থমকে দাঁড়ায়। কাঁপতে কাঁপতে বসে পরে মাটিতে।
ছায়ামূর্তিগুলো ঢিল ছুঁড়ছে আর তারই দিকে সরে সরে আসছে। করিম বক্শ একটা শব্দহীন চিৎকার করে ওঠে। বার কয়েক টিপটিপ করে যন্ত্রটা যেন বন্ধ হয়ে যায়। একটা মূর্তি আরো কাছে সরে আসে তার। করিম বক্শের গায়ে ধাক্কা লাগে লাগে। এবার করিম বক্শ চিনতে ভুল করে না। হৃদযন্ত্রটা আবার বার দুই ঢিপঢিপ করে চালু হয়ে যায়। হঠাৎ ঘাম দিয়ে তার ভয়ও কেটে যায়। সে দাঁড়ায়। পাশ থেকে খপ করে ছায়ামূর্তির একটা হাত চেপে ধরে- গদু পরধান! তোমার এই কাম!!…!!!
সূর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছের তলায় করিম বক্শের মৃতদেহ টান হয়ে পড়ে আছে। আশ-পাশ গ্রামের লোক ছুটে আসে দেখ্তে। মৃতের শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। সকলেই একমত— সূর্য-দীঘল বাড়ীর ভূত তার গলাটিপে মেরেছে।
যে হিম্মত বুকে বেধে জয়গুন এত দিন সূর্য-দীঘল বাড়ীতে ছিল, তা আজ খান্ খান্ হয়ে যায় এ ঘটনার পরে।
আজ বারবার করিম বকশের কথাই মনে পরে জয়গুনের। বেদনায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দরদর ধারায় পানি ঝরে গাল বেয়ে। আহা বেচারা! জীবনে কাউকে ভালোবাসেনি। কারো ভালোবাসা পায়ও নি সে।
শফির মা আগে আগে গাইরি-বোচকা বাঁধে। জয়গুন জিজ্ঞেস করে—বাড়ী ছাইড়া কই যাইবা?
—আগেত সোনার মানিকগো লইয়া বাইর অ। খোদার এত বড় দুইন্যায় কি আর এট্টু জা’গা পাইতাম না আমরা?
ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে জয়গুন ও শফির মা বেরিয়ে পড়ে। মনে তাদের ভরসা খোদার বিশাল দুনিয়ায় মাথা গুঁজবার একটু ঠাঁই তারা পাবেই।
চলতে চলতে আবার জয়গুন পেছন ফিরে তাকায়। সূর্য-দীঘল বাড়ী! মানুষ বাস করতে পারে না এ বাড়িতে। দু’খানা ঝুপড়ি। রোদ বৃষ্টি ও অন্ধকারে মাথা গুঁজবার নীড়। দিনের শেষে, কাজের শেষে মানুষ পশু-পক্ষী এই নীড়ে ফিরবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
ঐ উঁচু তালগাছ অনেক কালের অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী এটা। তারা এগিয়ে চলে।
বহুদূর হেঁটে শ্রান্ত পা-গুলোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে তারা গাছতলায় বসে। উঁচু তালগাছটা এত দূর থেকেও যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আবার তারা এগিয়ে চলে…….
অসাধারণ একটা উপন্যাস।