খুরশীদ মোল্লা গ্রামের ফুড কমিটির সেক্রেটারী। ঈদের দিন ভোর হওয়ার সাথে সাথে তার বৈঠকখানার বাইরে জড় হয় অনেক লোক। কেউ কেউ ভেতরেও আসে।
খুরশীদ মোল্লা একটু দেরীতেই ঘুম ভেঙ্গে তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে চৌকির উপর এসে বসে। তার মুখে বিরক্তির স্পষ্ট আভাস সবার চোখেই ধরা পড়ে। গ্রামের মোড়ল কাজী খলিল বক্শ ও গদু প্রধান চৌকির ওপর সেক্রেটারীর পাশে বসে পড়ে।
খুরশীদ বলে—দেখুন তো কি ঝঞঝাট। ভোর না হতেই বাড়ী মাথায় করে তুলেছে। সব। ঈদের দিন এই উৎপাত কার ভাল লাগে? চিনি এসেছে মাত্র কমণ, আর গ্রামে লোক হচ্ছে দু’হাজার! এক তোলা করেও পড়বে না মাথা পিছু।
কাজী খলিল বক্শ উপস্থিত একজনকে উদ্দেশ করে বলে—কিরে লেদু, চিনি দিয়া কি করবি? তারপর নিজে নিজেই বলে—ভাত জোটে না, চিনি খায়। বাহার ব্যাটা! হেই-যে মাইনষে কইছিল—ঘর নাই, দুয়ার দিয়া হোয়।
লেদু মিয়া টিপ্পনী কাটতে পটু। ভেতরে ভেতরে গরম হয়ে বলে—আমাগ মতন গরীব মাইনষের আবার ঈদ কি? ঈদ অইল আপনে লাইগ্যা, বড়মিয়া সাব। হ্যা-হ্যা-হ্যা।
কাজী মোড়ল প্রাকুটি করে। আস্তে আস্তে সে সেক্রেটারীকে বলে—এ হারামজাদাকে এক কণা চিনিও দিতে পারব না, কইয়া রাখলাম।
গদু প্রধান এতক্ষণে কথা বলে—কি মোল্লার পো, চা অইব নি? তারপর নিজেই হাঁক দেয়—ওরে নসুয়া, চা দিয়া যা দুই কাপ।
রোজ ভোরে খুরশীদ মোল্লার বাড়ীতে তাগাদা দিয়ে চা খাওয়ার অভ্যাস তার। ভুলেও তার একদিন বাদ যায় না। রোজার মাসে মুখ বন্ধ ছিল বলে এক মাস মোল্লা গদু প্রধানের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল। মুখ খোলার সাথে সাথেই তার আগমনে খুরশীদ মোল্লা বিরক্ত হয়। সে খলিল বকশের দিকে চেয়ে বলে—আপনি খাবেন না, কাজীর পো?
—হ, খাইমু। খাইমু না ক্যান? তুমি ত বাজান চিনির রাজা।
খুরশীদ হাঁক দেয়—তিন কাপ—তিন কাপ কারো চা।
খলিল বক্শ বলে—আর যা কর কর—আমার ছয় সের চাই-অই। এইডুক না অইলেই অইব না। তুমি জ্ঞাত আছ, এক পাল পৈষ্যের সংসার আমার।
গদু প্রধান বলে–আমার পাঁচ সের আগে রাইক্যা, তারপর ভাগ কর। পাঁচ সের না পাইলে ফাডাফাডি আছে তোমার লগে।
—কাকে রেখে কাকে দেই? আচ্ছা, দেখা যাবে। এ পাঁয়তারা আর কদ্দিন ভালো লাগে, বলুন! বিনে পয়সার চাকরি! ইচ্ছে হয় ছেড়ে দিই এই মুহূর্তে।
-না না, ছাড়বা ক্যাঁ? তুমি না অইলে–
-ব্যাপার দেখুন না। এই খাটছি, তবু নাম নাই। সবাই বলে চোর।
—কোন শালা কয়? দেইক্যা নেই তার গর্দানে কয়ডা মাথা।
চা আসে। তিনজন তিনটা বাটি নিয়ে চুমুক দেয়। জমিদারের পাইক এসে এক টুকরো কাগজ সামনে ধরে। খুরশীদ মোল্লা পড়ে একটু ব্যস্ত হয়ে বলে—ভবানীবাবু বাড়ী এসেছেন নাকি? আর কে কে এসেছেন?
—না, তিনি একলাই আইছেন! দিন চাইরে থাকবেন। চা খাওনের লাইগ্যা তাই
—আচ্ছা,আচ্ছা, তোমাকে বলতে হবে না আর। মাত্র পাঁচ সের ত? তুমি যাও। আমি নিজেই দিয়ে আসব খন। এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি আসব।
চা শেষ করে খুরশীদ মোল্লা দোয়াত কলম নিয়ে উবু হয়ে বসে। দুই টুকরো কাগজে দু’টো পারমিট লিখে খলিল বক্শ ও গদু প্রধানের হাতে দিয়ে বলে—চার সের করে লিখে দিলাম আপনাদের। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বারদের দিতে হবে আবার।
বাইরের লোক এতক্ষণে উতলা হয়ে গেছে। কেউ কেউ চলেও গেছে এর মধ্যে।
এবার খুরশীদ মোল্লা উঠে তাদের উদ্দেশ করে বলে আমি কি করতে পারি, বল তোমরা। গভরমেন্ট মোটে সাপলাই দেয় না, তার আর হ্যা শোন অল্প কিছু চিনি আছে হাতে। মাথা পিছু এক তোলা করেও পড়বে না। তার চেয়ে বরং এক কাজ করলে হয়, আবার যখন চিনি আসবে, তার সাথে মিলিয়ে ভাগ করে দেওয়া যাবে।
একজন আর একজনকে বলে—চল যাইগা। এই সব না দেওয়ার ছল-চক্কর। এইহানে হতৃতা ধইরা থাকলে জামাত পাওয়া যাইব না।
সব লোক সরতে আরম্ভ করে। খুরশীদ মোল্লা আবার বলে—কি করবে আর। গুড় কিনে নাও গে।
একজন বলে—গুড়ের সের দ্যাড় টাকা। আমরা কি অত পয়সার গুড় কিন্যা খাইতে পারি মিয়া সাব? রেশনের চিনি অইলে তয়—
কথা শেষ না হতেই আর একজন বলে—আপনেরাই ঈদ করেন। আপনে দিন দিছে। খোদায়—ঈদ করতে দিছে।
কথাগুলি কোন রকমে হজম করে খুরশীদ মোল্লা অন্দরে যায়। এক্ষুণি জমিদার বাড়ী যাওয়া তার দরকার।
হাসু এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল। সে এবার বাজারের পথ ধরে।
বাজারের একটা জায়গায় সারি সারি গুড়ের হাড় ও জ্বালা সাজিয়ে দোকানদাররা বসেছে। আজ এদিকে খুব ভিড়। মাছি মৌমাছিও ভিড় করেছে গুড়ের ওপর। কয়েকটা ভিখারী ছেলে গুড় কেনার নামে এ-মাথা থেকে ও-শাথা পর্যন্ত সমস্ত হাড়ার গুড় চেখে বেড়াচ্ছে। এক দোকানীর তাড়া খেয়ে একটি আধ-পাগলা ভিখারি ছেলে বলছে—এমন কর ক্যান? ঈদের দিন এটটু মিড়া মুখ করি, মিয়া ভাই। হি-হি-হি।
দোকানীরা খরিদ্দারের সাথে দর কষাকষি করে, গুড় মেপে দেয় আবার মাঝে মাঝে গামছা নেড়ে মাছি তাড়ায়।
হাসু একটা হাঁড়ি থেকে আঙুল দিয়ে একটু গুড় নিয়ে বলে—একটু কড়া জ্বলের। দ্যাট্টাকা কইরা দিবানি? হে অইলে দ্যাও এক পোয়া।
—উহুঁ। এক টাকা বারো আনার এক আধলাও কম না।
পেছন থেকে একজন হাসুকে টান দেয়। সে হাসুদের প্রতিবেশী কেরামত। সে বলে—মিডাই না কিন্যা চিনি লইয়া যা। এই দ্যাখ আমিও কিনলাম। দুই টাকা কইরা চিনি। মিডাইর তন ভালা বরকত দিব।
—কোন ঠাঁয়?
—লতিফ মোল্লার দোকানে। খুরশীদ মোল্লার ভাই লতিফ মোল্লা। পিছ-দুয়ার দিয়া যা চুপচাপ।
হাসু বলে—ওঃ ড় কুমুডির চিনির এই দশা! হেইত আমরা কই, চিনিগুলা কই যায়?
—আর কইস না। ব্যালাক চালাইয়া ব্যাডা ফুইল্যা গেল।
হাসু একটু চিন্তা করে বলে—থাউকগা, মিডাই কিন্যা লইয়া যাই।
হাসু বাজার নিয়ে বাড়ী আসে।
খেতে বসে হাসু ও মায়মুন। খাওয়ার সময় সুড়ুত সুড়ুত শব্দ হয় ওদের মুখে।
হাসু বলে—শিন্নি পানসা অইয়া গেছে মা, মিডা হয় নাই এক্কেরেই।
জয়গুন বলে—যেমন গুড় তেমন মিড়া। তিন পোয়া চাউল এক পোয়া গুড়। মিডা অইব কেমনে?
—নাইকল দেওনে তবু একটু সোয়াদ আইছে, না মা?
—হ। আলা চাউল অইলে দেখতি কেমুন মজা অইত! সিদ্ধ চাউলে আর কি অইব?
—আরেট্টু দ্যাও, মা।
—উহুঁ, অহন আর না। ঈদগার তন আইয়া খাবি।
—ঈদের দিনও এটটু মনাচ্ছি মতন খাইমু না?
—তোগই পেট আছে, অ্যাঁ?
আর কেঅর নাই? শফিডারে এটটু দিয়া আইতে অইব। ও ঘরে যে কিছুই পাক অয় নাই।
হাসু এবার চুপ করে। মায়মুনের পাতেরটা শেষ হয়ে গেছে। সে আঙুল দিয়ে তখনও চাটছে থালাটা।
জয়গুন বলে—অহন আত ধো। তুই দ্যাখতে আছি বাসন ভাইঙ্গা খাইতে চাস।
মায়মুন লজ্জিত হয়। থালায় পানি ঢেলে সে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে।
জয়গুন হাসুকে বলে—মাচার উপরতন কালা কাপড়ের গাট্টি নে। ওড়ার ভিতরে একটা টুপি আছে। ওড়া তুই নে, আর নতুন কাসুরে দিয়া আয়।
—আমি পারতাম না মা। হাসু বলে।
–ক্যাঁ।
ঐ দিনের চরকি দিতে যাওয়ার বিপদের কথা হাসু মা-কে বলেনি।
সে বলে—আমি ঈদগায় যাইমু, মা। নামাজের ওকত অইয়া গেছে। তুমি আর কেই বে দিয়া
—আর কারে পাডাই? তুই-ই যাওনের কালে এটটু ঘুইর্যা ওইহান অইয়া দিয়া আয়।
হাসু আর গোপন রাখতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সে বলেই ফেলে সেদিনের সব কথা।
জয়গুন অসহায়ের মত তাকায় ছেলের মুখের দিকে। শেষে বলে—আগে কস নাই ক্যাঁ? এত পয়সার টুপিড়া ফ্যালাইয়া দিমু? তোর মাতায়ও লাগব না।
—কানা মামানীরে দিয়া পাড়াইয়া দ্যাও।
কথাটা জয়গুনের পছন্দ হয়। শফির মা বুড়ো মানুষ। সে নিয়ে গেলে করিম বক্শ লজ্জায় কিছু বলবে না হয়তো। রাখতে পারে। তা ছাড়া ঈদের দিন। খুশীর দিনে সে হয়ত রাগ করবে না।
হাসু গাঁটরি খোলে। বাপের কিশতি টুপিটা বের করে মাথায় দেয়। টুপিটা অনেক বড় হয়েছে। কান পর্যন্ত ডুবে যায় টুপির মধ্যে।
জয়গুন হাসুর দিকে এক নজর চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সে আর তাকাতে পারে না।
হাসু গামছাটা কাঁধে ফেলে কোষায় চড়ে। শফির মা এবং শফিও ওঠে কোষায়। হাসকে ঈদগার রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে শফির মা শফিকে নিয়ে করিম বকশের বাড়ীতে যাবে। এখন যাওয়াই ভালো। করিম বক্শ এখন বাড়ীতে নেই। নামাজ পড়তে গিয়েছে নিশ্চয়ই।
শফির মা টুপিটা দিয়ে নিরাপদেই ফিরে আসে।
জয়গুন খুটে খুটে জিজ্ঞেস করে কাসুর কথা।
—টুপিডা ঠিক অইল নি মাতায়?
—হ, টুপিডা মাথায় দেওনে এমন সেদর দেহাইল কাসুরে! কি কইমু তোমারে—যেন একটা পরীর বাচ্চা!
শফির মা আবার বলে—সময় বুইঝা গেছিলাম গো। করিম বকশা বাড়ীতে আছিল না। নামাজ পড়তে গেছিল। ওর বউরে তালিম দিয়া আইছি। টুপি যে তুমি দিছ, তা হে কইব না। হে কইব, হে-ই কিন্যা দিছে।
জয়গুন নিশ্চিন্ত হয়। তার ভয় ছিল করিম বক্শ হয়তো ছেলেটাকে মারতে শুরু করবে।
শফির মা বলে—করিম বকশের বউ মানুষ ভালা, খুব হাসিখুশী। আমারে পিঁড়ি দিল বসবার। নিজেই এই এত বড় একটা আস্ত ধলডোগ পান ঘেঁইচ্যা দিল।
জয়গুন বলে—কাসু কিছু কইল?
—উহুঁ। ও আমার মোখের দিগে চাইয়া আছিল! এক্কেরে এতিমের মতন—যেন বাপ-মা নাই।
–তুমি কোলে নিলা না?
—নিলাম। আমার কোলের তন আর কি নামতে চায়! এক্কেরে বুকের লগে মিশ্যা, আছিল। তারপর কত কোস্তাকুস্তি কইর্যা কান্দাইয়া নামাইয়া থুইয়া আইলাম। কি জানি, করিম বক্শ আইলে আবার কি কাণ্ড কইরা ফালায়।
জয়গুন একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করবার চেষ্টা করে।